০৫. সাবেরার নিয়মিত কাজ ছিলো

পাঁচ

সাবেরার নিয়মিত কাজ ছিলো, তিনি রোজ ফজরের নামায শেষ করে উযরাকে সামনে বসিয়ে তার মুখ থেকে কুরআন তেলাওয়াত শুনতেন। উযরার মধুর আওয়ায কখনো কখনো আশেপাশের মেয়েদের পর্যন্ত টেনে আনতো সাবেরার ঘরে। এরপর সাবেরা গাঁয়ের কয়েকটি মেয়েকে পড়াতে ব্যস্থ হতেন আর উযরা ঘরের দৈনন্দিন কাজকর্ম সেরে তীরন্দাযীর অভ্যাস করতো। একদিন সূর্যোদয়ের আগে উযরা যথারীতি কুরআন তেলাওয়াত করে উঠে যাচ্ছে, সাবেরা অমনি তার হাত ধরে কাছে বসিয়ে খানিকক্ষণ সস্নেহ দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, উযরা কতোবার আমি ভাবি, তুমি না এলে আমার দিন কতো কষ্টে কাটতো। তুমি আমার নিজের মেয়ে হলেও হয়তো এর চাইতে বেশি স্নেহ আমি তোমায় দিতে পারতাম না।

উযরা, জওয়াব দিলো, আম্মি আপনি না হলে আমি …….। উযরা আর কিছু বলতে পারলো না। তার চোখ দু’টি হয়ে উঠলো অশ্রুসজল।

উযরা!’ সাবেরা ডাকলেন।

‘জি, আম্মি?

সাবেরা আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, অমনি-বাইরের দরা খুলে গেলো। এবং ঘোড়ার লাগাম ছেড়ে দিয়ে আব্দুল্লাহ এসে ঢুকলেন ঘরের মধ্যে। সাবেরা উঠে কয়েক কদম এগিয়ে গেলেন। আব্দুল্লাহ সালাম করলেন। মা ও ছেলে দাঁড়িয়ে রইলেন সামনাসামনি।

পুত্রকে ছেড়ে মায়ের নযর তখন চলে গেছে দূরে-বহু দূরে। বিশ বছর আগে ঠিক এমনি লেবাস পরে এমনি আকৃতি নিয়ে এসে ঘরে ঢুকলেন আব্দুল্লাহর বাপ।

আম্মি!

‘হাঁ বেটা।

আপনাকে আগের চাইতে কমগো মনে হচ্ছে।’

না বেটা। আজতো আমায় কমফের মনে হবার কথা নয়…। দাঁড়াও, আমি তোমার ঘোড়া বেঁধে আসি।…বলে সাবেরা ঘোড়ার বাগ হাতে নিয়ে আদর করে তার গর্দানে হাত বুলাতে লাগলেন।

‘ছাড়ন আম্মি। একি করে হতে পারে?’ মায়ের হাত থেকে ঘোড়ার বাগ ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করতে করতে আব্দুল্লাহ বললেন।

বেটা, তোমার বাপের ঘোড়া তো আমি বাঁধতাম।’ সাবেরা বললেন।

কিন্তু আপনাকে তকলীফ দেওয়া যে আমি গুনাহ মনে করি।’

যিদ করো না বেটা, ছেড়ে দাও।

আব্দুল্লাহ মায়ের কণ্ঠস্বরে অভিভুত হয়ে ঘোড়ার বাগ ছেড়ে দিলেন।

সাবেরা ঘোড়া নিয়ে আস্তাবলের দিকে কয়েক কদম এগিয়ে যেতেই উযরা এসে তাঁর হাত থেকে ঘোড়র বাগ ধরে বললো, “আম্মি। ছাড়ুন। আমি বেঁধে আসি।’

সাবেরা স্নেহ করুণ হাসি-ভরা মুখে উযরার দিকে তাকিয়ে একটুখানি চিন্তা করে ঘোড়ার বাগ ছেড়ে দিলেন তার হাতে।

আব্দুল্লাহ তাঁর ছুটির বিশ দিন কাটিয়ে দিলেন বাড়িতে। বাড়ির অবস্থায় তিনি লক্ষ্য করলেন এক যবরদস্ত পরিবর্তন। উযরা আগেও তাঁর সামনে কিছুটা দ্বিধা সংকোচ নিয়ে চলতো। আর এখন সে যেনো শরমে মরে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে আব্দুল্লাহর ছুটির দিন শেষ হয়ে এলো। অতি আদরের পুত্রের জন্য মায়ের সবচাইতে বড়ো তোহফা ছিলো তার দাদার আমলের একখানি খুবসুরত তলোয়ার।

আব্দুল্লাহ যখন ঘোড়ার সওয়ার হয়েছেন, তখুনি উযরা তার নিজ হাতের তৈরী .একখানা রুমাল সাবেরার হতে দিয়ে সলজ্জভাবে ইশরা করলো আল্লাহর দিকে। রুমাল খুলে আব্দুল্লাহ দেখতে পেলেন, তার মাঝখানে লাল রঙের রেশমী সূতা দিয়ে তোলা রয়েছে কালামে ইলাহীর এই কটি কথাঃ

–অনিষ্ট অবশিষ্ট থাকা পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর।

আব্দুল্লাহ রুমালখানা জেবের মধ্যে রেখে উযরার দিকে তাকালেন এবং পর মুহূর্তেই তার দিক থেকে ন্যর সরিয়ে নিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে এজাযত চাইলেন।

সাবেরা মাতসুলভ কোমল ও নায়ক মনোভাব সংযত করে বললেন, এখন আর তোমায় নসীহতের প্রয়োজন নেই। তোমরা কার আওলাদ, তা ভুলে যেয়ো না–তোমার পূর্বপুরুষ কখনো পেছন ফিরে রক্তাদান করেননি। আমার দুধ আর তাদের নামের উযযত রেখে চলবে।’

আব্দুল্লাহর জিহাদে যোগ দেবার পর এক বছর কেটে গেছে। সাবেরার কাছে। তাঁর দেওয়া কয়েক খানা চিঠিতে প্রকাশ পেয়েছে যে, পুত্র-গর্বে গর্বিতা মাতার প্রত্যাশার চাইতেও বেশি সুনাম তিনি হাসিল করছেন। সাঈদের চিঠিতে এবং বসরা থেকে তাদের এলাকায় যারা আসা-যাওয়া করে তাদের মুখে সাবেরা শোনেন মকতবে নয়ীমের সুনাম-সুখ্যাতির খবর। নয়ীমের এক চিঠিতে সাবেরা জানলেন, তিনি শীগগিরই শিক্ষা শেষ করে ফিরে আসবেন বাড়িতে। একদিন সাবেরা বেড়াতে গেলেন পাশের এক বাড়িতে। উযরা তীর-ধনুক নিয়ে আঙিনায় বসে নানা রকম জিনিসের উপর লক্ষ্যভেদ করছে। একটা কাক হঠাৎ উড়ে এসে বসলো উযরার সামনে এক খেজুর গাছের উপর। কাকটা কেবলমাত্র উপরে উটেছে, অমনি অপরদিক থেকে আর একটি তীর এসে তাকে যখম করে নীচে ফেলে দিলো। উযরা হয়রান হয়ে উঠে এসে কাকের দেহ থেকে তীরটা ছাড়িয়ে নিয়ে তাকাতে লাগলো এদিক-ওদিক। ফটকের কাছে গিয়ে সে বাইরে তাকালো। ঘোড়াসওয়ার ফটকরে বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন হাসিমুখে। উযরার ফরসা চেহারা লজ্জায় ও খুশীতে লাল হয়ে উঠলো। এগিয়ে গিয়ে সে ফটক খুলে দিয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে রইলো। নয়ীম ঘোড়া থেকে নেমে এসে ডুকলেন ভিতরে।

নয়ীম বসরা থেকে বাড়ি এসেছেন অনেক কিছু বলবার আর অনেক কিছু শুনবার আকাংখা নিয়ে, কিন্তু অন্তহীন চেষ্টা সত্ত্বেও তাঁর মুখ থেকে একটির বেশী কথা বেরুলো না। তিনি বললেন, ভালো আছ উযরা?’

উযরা কোনো জওয়াব না দিয়ে মুহূর্তের জন্য চোখ তুলে তাকালো তার দিকে; পরক্ষণেই সে তার চোখ অনবত করলো।

‘ভালো আছি।’

আম্মিজান কোথায়?

তিনি একটি মেয়ের অসুখ দেখতে গিয়েছেন।’

খানিকক্ষণ দুজনই নির্বাক।

‘উযরা, তোমায় আমি হররোজ মনে করেছি।’

উযরা চোখ উপরে তুললো, কিন্তু সিপাহীর লেবাসে সৌন্দর্য ও মহিমার প্রতিমূর্তির দিকে তাকিয়ে প্রাণ ভরে দেখবার সাহস হলো না তার।

‘উয়রা, তুমি আমার উপর নারায় হয়েছে?

উযরা জওয়াবে কিছু বলতে চাচ্ছিলো, কিন্তু নয়ীমের রাজকীয় ঐশ্বর্যের দিকে তাকিয়ে তার বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো।

‘আচ্ছ, আমি আপনার ঘোড়াটা বেঁধে রেখে আসি।’ কথার মোড় ঘুরিয়ে দেবার চেষ্টা করে বললো সে।

না, উযরা! তোমার হাত এসব কাজের জন্য তৈরী হয়নি। নয়ীম এই কথা বলে ঘোড়াটিকে নিয়ে গেলেন আস্তাবলের দিকে।

নয়ীম তিন মাস বাড়িতে থেকে জিহাদে যাবার জন্য বসরার ওয়ালীর হুকুমের ইনতেযার করতে থাকলেন।

ঘরে ফিরে এসে নয়ীমের দিনগুলো খুশীতে কাটবে না, এরূপ প্রত্যাশা তিনি করেননি। যৌবনের প্রথম অনুভূতি উযরা ও তার মাঝখানে সৃষ্টি করে তুলেছে লজ্জার এক দুস্তর ব্যবধান। ছেলেবেলার ফেলে আসা দিনগুলো তার মনে পড়ে, যখন উমরার ছোট্ট হাতখানি নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন লোকালয়ের বাগ-বাগিচায়। সেই হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো আজ তাঁর কাছে স্বপ্ন। কম-বেশী করে উযরারও সেই একই অবস্থা। নয়ীম তার ছেলেবেলার সাথী। কিন্তু তার চোখে তিনি যেনো আজ কত নতুন। কোথায় তার চালচলনে দ্বিধা-সংকোচ কমে আসবে, তা না হয়ে যেনো তা আরো বেড়ে যাচ্ছে। নয়ীম তার দেহ মনকে ঘিরে অনুভব করছেন কারাপ্রাচীরের বন্ধন, তাঁর দীলের উপর চেপে রয়েছে একগুরুতর বোঝ। উযরা তাঁর দীলের তন্ত্রীতে জাগিয়ে তুলেছে মহব্বতের এক ছন্দময় সংগীত সুর তার ছোটবেলা থেকেই। নয়ীম চান, এই মরুদুলালী হুরের সামনে খুলে ধরবেন তার দীলের পর্দা, কিন্ত রাজ্যের লজ্জা এসে যেনো চেপে ধরে তাঁর মুখ। তবু যেনো তারা দু’জনই শুনতে পান পরস্পরের দীলের কম্পন।

নয়ীম ঘরে ফিরবার চার মাস পর আব্দুল্লাহ এলেন ছুটি নিয়ে। সাবেরার ঘরের রওনক দ্বিগুণ বেড়ে গেলো। রাতের খানা খেয়ে নয়ীম ও আব্দুল্লাহ বসলেন মায়ের কাছে। আব্দুল্লাহ তাদেরকে শুনাচ্ছেন তার.ফউজী তৎপরতার কথা, আরো শুনাচ্ছেন র্কিস্থানের অবস্থা। উযরা আব্দুল্লাহর কথা শুনছে খানিকটা দূরে পাঁচিলের আড়ে গড়িয়ে। আলোচনার শেষে আব্দুল্লাহ বললেন; আমি বসরা হয়ে এসেছি।’

‘তোমার মামুর সাথে দেখা হয়েছিলো?’ সাবেরা প্রশ্ন করলেন।

‘জি হাঁ, দেখা হয়েছে। আপনাকে সালাম জানিয়েছেন তিনি। তা ছাড়া একটা চিঠিও দিয়েছেন আমার হাতে।

কেমন চিঠি?

আব্দুল্লাহ জেব থেকে একটা চিঠি বের করে বললেন, ‘পড়ে দেখুন।

‘তুমিই পড়ে শুনাও বেটা।

‘আম্মিজান! চিঠিটা আপনার নামে।’ আব্দুল্লাহ সলজ্জভাবে জওয়াব দিলেন। সাবেরা-চিঠিটা নয়ীমের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, “আচ্ছা বেটা, তুমিই পড়ো।’ নয়ীম চিঠি হাতে নিয়ে উযরার দিকে তাকালেন। উযরা বাতিটা তুলে নিয়ে নয়ীমের পাশে দাঁড়ালো।

চিঠির বিষবস্তুর দিকে নযর ফেলতেই নয়ীমের দীলের উপর এসে লাগলো এক প্রচন্ড ধাক্কা। মাকে তিনি শুনাতে চান, কিন্তু চিঠিটার কথাগুলো যেনো তার মুখে চেপে ধরেছে। তিনি দ্রুত নযর চালালেন চিঠির আগাগোড়া। চিঠির বিষয়বস্তু নয়ীমের কাছে না-করা গুনাহর সাজা পাবার হুকুমনামার চাইতেও ভয়ানক হয়ে দেখা দিলো। তার ভবিষ্যত সম্পর্কে তকদীরের অমোঘ ফয়সালা পড়ে তিনি যেনো কিছুক্ষণের জন্য সম্বিতহারা হয়ে গেলেন। এক অসহনীয় বোঝা যেনো তাকে টেনে নিচ্ছে দ্বিধাবিভক্ত যমিনের অভ্যন্তরে। কিন্তু মুজাহিদের স্বভাবসুলভ হিম্মৎ হলো জয়ী। অন্তহীন চেষ্টায় তিনি মুখের উপর হাসি টেনে এনে বললেন, মামুন জান ভাইয়ের শাদীর কথা লিখেছেন। পড়ন আপনি।

নয়ীম এই কথাটি বলে চিঠিখানি মায়ের হাতে দিলেন। সাবেরা বাতির আলোর দিকে এগিয়ে পড়তে শুরু করলেন, ‘বোন, উযরার ভবিষ্যত সম্পর্কে আমি এখনও কোন ফয়সালা করতে পারিনি। আমার কাছে আব্দুল্লাহ ও নয়ীম–দু’জনই সমান। উযরার মতো শরীফ খান্দানের মেয়ের ভবিষ্যতের যামিন হতে পারে এমন গুণরাজি এদের দু’জনেরই ভিতরে মওজুদ রয়েছে। বয়সের দিক বিবেচনা করে আব্দুল্লাহকেই এ আমানতের বেশী হকদার মনে হয়। তার দু’মাসের ছুটি মিলেছে। আপনি কোনো পছন্দমতো দিন ধার্য করে আমায় খবর দেবেন। দু’দিনের জন্য আমি চলে আসবো।

এ বাচ্চাদের তবিয়ৎ সম্পর্কে আপনিই আমার চাইতে বেশী ওয়াকেফ। এ উযরার ভবিষ্যতের প্রশ্ন, খেয়াল রাখবেন।–সাঈদ।

*

নয়ীমের দীর্ঘদিনের স্বপ্নের পরিণাম হলো তার প্রত্যাশার বাইরে। তার এতদিনের ধারণা, তিনি উযরার জুন্য আর উয়রাও তারই জন্য। কিন্তু মামুর এখানা চিঠি তাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে এক তিক্ত বাস্তবের মুখোমুখি।

উযরা, তার নিষ্পাপ উযরা! এখন সে তার ভাবী হতে চলেছে। দুনিয়া আর তার ভিতরকার সব কিছুই যেনো তার চোখে রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে। তার দীলের মধ্যে থেকে থেকে জেগে উঠছে এক অপূর্ব বেদনার অনুভূতি, কিন্তু নিজেকে তিনি সংযত করে রেখেছেন যথাসাধ্য। দীলের গোপন ব্যথা তিনি প্রকাশ করেননি কারুর কাছে। উযরার অবস্থায়ও কোনো ব্যতিক্রম নেই।

আব্দুল্লাহ ও সাবেরা নয়ীম ও উমরার পেরেশানীর কারণ জানতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু ভাইয়ের প্রতি নয়ীমের ছিলো অপরিসীম শ্রদ্ধা। আর উমরা? সাবেরা, সাঈদ ও আব্দুল্লাহর প্রতি শ্রদ্ধা যেনো তাকে বেঁধে ফেলেছে। তাই দু’জনই রইলেন নির্বাক, কোনো কথাটি বেরুলো না তাদের মুখ থেকে। মনের আগুন মনই পোড়ায়, নেই কোনো দোসর।’

আব্দুল্লাহর আনন্দের দিন যতো ঘনিয়ে এলো নিকটে, ততোই নয়ীম ও উযরার কল্পনার দুনিয়া হয়ে এলো অন্ধকার-তিমিরাচ্ছন্ন। নয়ীমের অশান্ত মনের কাছে ঘরের চার দেওয়ালের ভিতরটা হয়ে এলো জিন্দাখানার মতো। হর রোজ সন্ধ্যায় তিনি ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে বেড়াতে চলে যান দূরে-বহু দূরে। মধ্যরাত্রি পর্যন্ত মরুপথে ঘুরে বেড়াতে থাকেন এদিক-ওদিক।

আব্দুল্লাহর শাদীর আর এক হফতা বাকী। নয়ীম এক রাত্রে লোকালয়ের বাইরে ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে বেড়াচ্ছান। আসমানে ঝিকিমিকি করছে সিতারার দল। চাঁদের মন-ভোলানো দীপ্তিতে ঝকঝক করছে মরুভূমির বাল তরংগ। লোকালয়ে আল্লাহর শাদীর খুশীতে নওজোয়ান মেয়েরা গান গাইছে দফ বাজিয়ে। নয়ীম ঘোড়া থামিয়ে খানিক্ষণ শুনলেন সে সংগীত সুর। তিনি ছাড়া গোটা সৃষ্টিই যেনো আজ আনন্দে মশগুল। ঘোড়া থেকে নেমে তিনি শুয়ে পড়লেন ঠান্ডা বালুর বিছানায়। চাঁদ, সিতারা, ঠান্ড মন-ভোলানো হাওয়া আর এলাকার বাগ-বাগিচা মুগ্ধকর দৃশ্য যেনো তার নিষ্পাপ দুনিয়ায় হারিয়ে যাওয়া প্রশান্তির জন্য তাকে আবার পাগল করে তুললো। আপন মনে তিনি বলতে লাগলেন।

‘আমি ছাড়া সৃষ্টির প্রতি অণু-পরমাণু আনন্দে বিভোর। এই বিপুল প্রসারের মাঝখানে আমার হাহাকারের বাস্তবতা কতটুকু। ওহ! ভাই ও মায়ের খুশী, মামুর খুশী এবং হয়তো উযরার খুশীও আমার বিষণ্ণ ও মর্মাহত করে তুলেছে। কতো স্বার্থপর আমি।…..কিন্তু স্বার্থপরও তো নই আমি। ভাইয়ের জন্যই তো আমি আমার নিজের বশী কোরবান করে দিয়েছি!…… কিন্তু তাও মিথ্যা! আমার দীলের মধ্যে ভাইয়ের জন্য এতটুকু ত্যাগের মনোভাব নেই যে, তার খুশীতে শরীক হয়ে আমি আপনার দুঃখ বেদনা ভুলে যাবো। রাতদিন এমনি করে বাইরে থাকা, কোন কথা না বলা, এমনি বেদনাতুর হয়ে থাকা তার কাছে কি প্রকাশ করেছে…..! আর আমি এমন করবো না। তিনি আমার বিষণ্ণ মুখ আর দেখবেন না!….. কিন্তু তাও তো আমার হাতে নেই কিছু! আমি হয়তো দীলের আকাংখা সংযত করে রাখতে পারি, কিন্তু অনুভূতিকে তো সংযত করতে পারব না। তার চাইতে ভালো, আমি কিছুদিনের জন্য বাইরে চলে যাই। …….হাঁ আমার অবশ্যি চলে যেতে হবে …..এখুনি চলে যাচ্ছি না কেন?…..কিন্তু না, এমনি করে নয়। ভোরের দিকে মায়ের এজাযত নিয়ে তবে যাবো।’

এই সংকল্প নয়ীমের দীলের কিছুটা আশ্বস্ত করলো।

পরের দিন ভোরে ফজরের নামায পড়ে নয়ীম-মায়ের কাছে গিয়ে কয়েকদিনের জন্য বসরা যাবার এজাযত চাইলেন।

বেটা! তোমার ভাইয়ের শাদী! তুমি ওখানে যাবে কি আনতে?

আম্মি! শাদীর একদিন আগেই আমি এসে যাবো।’

না বেটা! শাদী পর্যন্ত তোমায় থাকতেই হবে বাড়িতে।

‘আম্মি! আমায় এজাযত দিন।’

সাবেরা রাগের ভাব দেখিয়ে বললেন, নয়ীম, আমার ধারণা ছিলো তুমি সত্যি সত্যি এক মুজাহিদের বেটা, কিন্তু আমার অনুমান ভুল হয়েছে। আপন ভাইয়ের খুশীতে শরীক হতে তুমি চাও না। নয়ীম, তোমার ও আব্দুল্লাহর মধ্যে ঈর্ষা?

ঈর্ষা? আম্মা, আপনি কি বলছেন? ভাইয়ের প্রতি আমি ঈর্ষা কেন পোষণ করবো? আমি তো চাই, আমার সবটুকু সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য আমি তাকেই নযরানা দেবো।

নয়মের কথাগুলো সাবেরার অন্তর স্পর্শ করলো। খানিকক্ষণ নির্বাক থেকে তিনি বলে উঠলেন ‘বেটা! খোদা করুন, আমার এ ধারণা যেনো মিথ্যাই হয়। কিন্তু তোমার এমনি নীরবতা, অকারণ মরুভূমিতে ঘুরে বেড়ানোর অর্থ আর কি হতে পারে?

‘আম্মি, আমি মাফ চাচ্ছি।’

সাবেরা এগিয়ে এসে নয়ীমকে বুকে চেপে ধরে বললেন, ‘বেটা মুজাহিদের সিনা প্রশস্ত হয়েই থাকে।’

সন্ধ্যা বেলায় নয়ীম আর বাইরে গেলেন না। রাতের খানা খেয়ে বিছানায় পড়ে তিনি বিভোর হয়ে রইলেন গভীর চিন্তায়। তার দীলের মধ্যে আশংকা জাগলো, তার চালচলনে মায়ের মনে যে ধারণা জন্মেছে, আব্দুল্লাহর মনেও যদি তেমনি হয়ে থাকে!

এই চিন্তা তার বাড়ী চলে যাবার ইরাদা আরো মযবুত করে দিলো। ( মধ্য রাত্রে তিনি বিছানা ছেড়ে উঠলেন। তারপর কাপড় বদল করে আস্তাবলে গিয়ে ঘোড়ার উপর যিন বাঁধলেন। ঘোড়া নিয়ে বাইরে যাবার মতলব করতেই তার দীলের মধ্যে জাগলো এক নতুন খেয়াল। ঘোড়া সেখানেই রেখে তিনি আঙিনা পার হয়ে গিয়ে দাঁড়ালেন উযরার বিছানার পাশে।

উষরাও কয়েকদিন ধরে রাত জেগে কাটাচ্ছে নয়ীমের মতো। বিছানায় শুয়ে শুয়ে সে দেখছে নয়ীমের কার্যকলাপ। নয়ীম কাছে এলে তার দীলের মধ্যে জাগলো প্রচন্ড কম্পন। ঘুমের ভান করে সে পড়ে রইলো চোখ বন্ধ করে। নয়ীম বহু সময় দাঁড়িয়ে রইলেন পাথরের মূর্তির মতো। চাঁদের রোশনী এসে পড়েছে উযরার মুখের উপর। মনে হচ্ছে যেনো আসমানের চাঁদ উঁকি মেরে দেখেছে যমিনের চাঁদকে। নয়ীমের দৃষ্টি এমন করে গিয়ে নিবন্ধ হয়েছে উযরার মুখের উপর যে, তিনি খানিকক্ষণের জন্য ভুলে গেছেন চারদিকের বাস্তবকে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বলে উঠলেন; উযরা, তোমার শাদী মোবাবক হোক।

নয়মের কথায় উযরার সারা দেহে কম্পন অনুভুত হলো। তার মনে হলো, যেনো কেউ তাকে গর্তের ভিতরে ফেলে উপর থেকে মাটি চাপা দিচ্ছে। তার দম বন্ধ হয়ে আসছে যেনো। সে চীৎকার করতে চায়, কিন্ত কোন এক অদৃশ্য হাত যেনো তার মুখ চেপে ধরে জোর করে। সে চায় নয়ীমের পায়ে মাথা রেখে শুধাতে, কি তার কসুর? কেন তিনি এ কথা বললেন? কিন্তু কম্পিত দীলের মধ্যেই গুমরে মরে তা। চোখ খুলে সে নয়ীমের দিকে তাকাতেও পারে না।

ঘোড়া বের করবার জন্য নয়ীম আবার চলে গেলেন আস্তাবলের ভেতরে। উষরা বিছানা ছেড়ে উঠলো। ঘর থেকে বেরিয়ে এসে পাঁচিলের পাশে দাঁড়িয়ে রইলো। নয়ীম ঘোড়া নিয়ে বাইরে এলেন। উযরা এগিয়ে এসে দাঁড়ালো নয়ীমের পথরোধ করে।

নয়ীম। কোথায় যাচ্ছো তুমি?

‘উযরা তুমি? তুমি জেগে উঠেছে?

‘কখনই বা আমি ঘুমিয়েছিলাম? দেখো নয়ীম….।

‘উযরার মুখ থেকে আর কোন কথা বেরুলো না। কথা শেষ না করেই সে এগিয়ে গিয়ে নয়ীমের হাত থেকে ঘোড়ার বাগ ধরলো।

উযরা, আমায় বাধা দেবার চেষ্টা করো না। যেতে দাও আমায়।

‘কোথায় যাবে, নয়ীম? বহুকাল পরে উযরা নয়ীমকে নামধরে ডাকছে।

কয়েকদিনের জন্য আমি বসরা যাচ্ছি, উযরা।

কিন্তু এ সময়ে কেন?

উযরা, কেন এ সময়ে যাচ্ছি, জানতে চাচ্ছ? তুমি জানোনা কিছুই?

উযরা সবই জানে। তার দীল ধক ধক করছে। ঠোঁট কাঁপছে। নয়ীমের ঘোড়ার বাগ ছেড়ে অশ্রু ভারাক্রান্ত চোখ দুটি দু’হাতে চেপে ধরলো সে।

নয়ীম বললেন, তুমি হয়তো জানো না উযরা, তোমার অশ্রুর কি দাম আমার কাছে। কিন্তু আমার এখানে থাকা ঠিক হবে না। আমি নিজে এমনি উদাস থেকে তোমাদের পীড়িত করে তুলছি। বসরায় কয়েকদিন থেকে আমার তবিয়ৎ ঠিক হয়ে আসবে। তোমাদের শাদীর দু’একদিন আগেই আমি ফিরে আসার চেষ্ট করবো। উযরা! একটা কথায় আমি খুশী হয়েছি, আর তোমারও খুশী হওয়া উচিত। তোমার স্বামী হবেন যিনি, তিনি আমার চাইতে অনেক বেশী গুণের অধিকারী। আহা! তুমি যদি জানতে, আমার ভাইকে আমি কতো ভালোবাসি! এ অশ্রু তাঁর কাছে যেনো ধরা না পড়ে কোনোদিন।

তুমি সত্যি সত্যি চললে? উযরা প্রশ্ন করলো।

‘আমি চাই না যে, এমনি করে হররোজ আমার সংযমের পরীক্ষা চলতে থাক। “উযরা আমার দিকে অমনি করে চেয়ো না। তুমি যাও।’

উযরা আর একটি কথাও না বলে ফিরে এলো। কয়েক কদম এসে একবার সে ফিরে তাকালো নয়ীমের দিকে। এক পা ঘোড়ার রেকাবে রেখে নয়ীম তখনো তাকিয়ে রয়েছেন তার দিকে। মুখ ফিরিয়ে নিয়ে উযরা দ্রুত পা ফেলে গিয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে কেঁদে ফেললো।

নয়ীম ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে মাত্র কয়েক কদম এগিয়ে গেছেন, অমনি তার পিছন থেকে কে যেনো ছুটে এসে তার ঘোড়ার বাগ ধরলেন। নয়ীম অবাক-বিস্ময়ে দেখলেন, তার সামনে দাঁড়িয়ে আব্দুল্লাহ। ভাই! নয়ীম হয়রান হয়ে বললেন।

নীচে নেমে এসো।’ আব্দুল্লাহ কাঠোর আওয়াযে বললেন।

ভাই, আমি বাইরে যাচ্ছি।’

‘আমি জানি। তুমি নীচে নেমে এসো।

নয়ীম ঘোড়া থেকে নামলেন। আব্দুল্লাহ এক হাতে ঘোড়ার বাগ ও অপর হাতে নয়ীমের বায়ু ধরে ফিরে চললেন। বাড়ির সীমানায় পৌঁছে তিনি বললেন, ঘোড়া আস্তাবলে বেঁধে এসো।

নয়ীমের কিছু বলবার ইচ্ছা ছিলো, কিন্তু আব্দুল্লাহ তাঁর সামনে এমন এক গুরুগম্ভীর প্রভুত্বব্যঞ্জক রূপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন যে, তাঁর হুকুম মেনে চলা ছাড়া আর গত্যন্তর নেই তার। তিনি ঘোড়াটাকে আস্তাবলে রেখে এসে আবার দাঁড়ালেন ভাইয়ের কাছে। উযরা বিছানায় শুয়ে শুয়ে দেখছেন এ অপূর্ব দৃশ্য। আব্দুল্লাহ আবার নয়ীমের বায়ু ধরে তাঁকে নিয়ে চলে গেলেন ঘরের একটি কামরায়।

উযরা কাঁপতে কাঁপতে উটে চুপি চুপি পা ফেলে সেই কামরার কাছে গিয়ে দরযার আড়ালে দাঁড়িয়ে শুনতে লাগলো আব্দুল্লাহ ও নয়ীমের কথাবার্তা।

‘বাতি জ্বালাও।’ আব্দুল্লাহ বললেন। নয়ীম বাতি জ্বালালেন। কামরার মধ্যে একটা বড়ো পশমী কাপড় বিছানো। আব্দুল্লাহ তার উপর বসে নয়ীমকে ইশারা করলেন বসতে!

‘ভাই, আমাকে কি বলতে চান আপনি?

‘কিছু না, বসে পড়।

আমি যাচ্ছিলাম এক জায়গায়।

‘তোমায় আমি যেতে মানা করবো না। বসো। তোমার সাথে একটা জরুরি কাজ আছে আমার।’ নয়ীম পেরেশান হয়ে পড়লেন। আব্দুল্লাহ কাগজ-কলম বের করলেন একটা সিন্দুক থেকে। তারপর শুরু করলেন একটা কিছু লিখতে। লেখা শেষ করে আব্দুল্লাহ নয়ীমের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসি সহকারে বললেন, ‘নয়ীম, তুমি বসরায় চলে যাচ্ছ?”

ভাই, আপনি যে গুপ্তচর, তা আমার জানা ছিলো না। জওয়াবে নয়ীম বললেন।

আমি মাফ চাই, নয়ীম! আমি তোমার নই, উযরার গুপ্তচর। ভাইজান, অত শিগগীর আপনি উযরা সম্পর্কে কোনো রায় কায়েম করবেন না।

এই জওয়াব শুনে আব্দুল্লাহ নয়ীমের মুখের দিকে তাকালেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। নয়ীম ভয় পেয়ে ঘাড় নীচু করলেন। আব্দুল্লাহ আদর করে এক হাতে তাঁর চিবুক স্পর্শ করে মুখখানা উপরে তুলে ধরে বললেন, নয়ীম! আমি তোমার ও উমরার সম্পর্কে কখনো ভূল ধারণা পোষণ করতে পারি না। তুমি আমার চিঠিখানা বসরায় মামুর কাছে নিয়ে যাবে।’

এই বলে আব্দুল্লাহ তাঁর লেখা চিঠিটা এগিয়ে দিলেন নয়ীমের হাতে।

‘ভাইজান এতে কি লিখেছেন আপনি?

‘তুমি নিজে পড়ে দেখো। এতে আমি তোমার সাজার ব্যবস্থা করেছি।’

নয়ীম চিঠিটা পড়লেনঃ

প্রিয় মামুজান! আসোলামু আলাইকুম! যেহেতু উযরার ভবিষ্যত সম্পর্কে আপনার মতই আমিও উদ্বিগ্ন, তাই আমি আমার নিজের চাইতে নয়ীমকে তার ভবিষ্যতের মোহাফিয ও আমানতদার হতে দেখলে আরো বেশি খুশী হবো। আর বেশি কি লিখবো? এ চিঠি কেন লিখছি, তা আপনি বুঝবেন। আশা করি, আপনি আমার কথায় আমল দেবেন। আমার ছুটি শেষ হবার আগেই নয়ীম ও উযরার শাদী হয়ে যাক এই আমার ইচ্ছা। সুবিধা মতো তারিখ আপনি নিজে ধার্য করে দেবেন।

আপনার আব্দুল্লাহ।

চিঠি শেষ করতে করতে নয়ীমের চোখ আঁসুতে ভরে উঠলো। তিনি বললেন, “ভাই আমি এ চিঠি নিয়ে যাবো না। উযরার শাদী আপনার সাথেই হবে। আমায় মাফ করুন ভাই।’

আব্দুল্লাহ বললেন, তুমি কি মনে কর, নিজের খুশীর জন্য আমি আমার ছোট .ভাইয়ের সারা জীবনের খুশী কোরবান হতে দেবো?’

‘আমায় আর শরম দেবেন না আপনি।

‘তোমার জন্য কিছুই করছি না আমি। তোমার চাইতে উযরার খুশীর দিকেই আমার ন্যর বেশী। আগে থেকেই আমি ওকে তোমার জোড়া মনে করেছি। তুমি আমার জন্য যা কিছু করতে চাচ্ছ তাই আমি করছি উযরার জন্য। যাও, ভোর হয়ে এলো। কাল পর্যন্ত অবশ্যি ফিরে আসবে। মামুজান হয়তো তোমার সাথেই চলে আসবেন। চলো।’

ভাই, কি বলছেন আপনি? আমি যাবো না।’

নয়ীম যিদ করো না। উযরাকে খুশি রাখবার দায়িত্ব আমাদের দু’জনেরই।’

ভাই….।

‘চলো। আব্দুল্লাহ মুখের ভাব বদল করে বললেন এবং নয়ীমের বায়ু ধরে কামরা থেকে বাইরে গেলেন।

উযরা তাদেরকে দেখে ছুটে গিয়ে শুয়ে পড়লো বিছানার উপর। নয়ীমকে ইতস্ততঃ করতে দেখে আব্দুল্লাহ নিজে আস্তাবলে গিয়ে নিয়ে এলেন তার ঘোড়া। তারপর দু’ভাই বেরিয়ে গেলেন বাড়ির বাইরে। খানিকক্ষণ পরেই উযরার কানে এলো ঘোড়ার পায়ের আওয়া।

আব্দুল্লাহ ফিরে এসে আল্লাহর দরগায় শোকর গোজারী করবার জন্য দাঁড়িয়ে গেলেন।

ভোরবেলা সাবেরা নয়ীমের বিছানা খালি দেখে আস্তাবলের দিকে গেলেন। আব্দুল্লাহ তখন সেখানে তার ঘোড়ার সামনে চারা দিচ্ছিলেন। সাবেরা নয়ীমের ঘোড়া না দেখে পেরেশান হয়ে দাঁড়ালেন। আব্দুল্লাহ তাঁর মনের ভাব বুঝতে পেরে প্রশ্ন করলেন, আমি! নয়ীমকে তালাশ করছেন আপনি?

হাঁ হাঁ, কোথায় নয়ীম?’

সে একটা জরুরী কাজে গেছে বসরায়। আব্দুল্লাহ জওয়াবে বললেন। তারপর খানিকক্ষণ কি যেন চিন্তা করে মাকে শুধালেন, “আম্মি, নয়ীমের শাদী কবে হবে?

‘তোমার শাদী তো হোক বেটা, তার পালাও আসবে’!

‘আম্মি, আমার ইচ্ছা, ওর শাদী আমার আগেই থোক।

‘বেটা। আমি জানি, সে তোমার কত আদরের। তার সম্পর্কে আমি গাফেল নই। তার জন্য আমি সম্পর্ক তালাশ করছি বই কি। খোদার ইচ্ছায় হয়তো উযরার মতো কোন মেয়ে মিলে যাবে।’

‘আম্মি! উযরা আর নয়ীম তো ছোটবেলা থেকেই পরস্পরের সাথী।

‘হাঁ, বেটা।

আম্মিজান, আমার ইচ্ছা, ওরা চিরকাল এমনি একত্র হয়ে থাক।’

“তোমার মতলব তা হলে…..

‘জি, হা, আমার বড়ো সাধ, উযরার শাদী নয়ীমের সাথেই হোক।’

সাবেরা হয়রান হয়ে আব্দুল্লাহর দিকে তাকালেন এবং স্নেহ আদরে দু’হাত তার মাথার উপর রাখলেন।

ছয়

বসরা শহরে প্রবেশ করেই নয়ীমের দেখা হলো এক সহপাঠীর সাথে। তাঁর নাম তালহা। তাঁর মুখে নয়ীম শুনলেন, জুমাআর নামাযের পর শহরের মসজিদে এক যবর দস্ত জলসা হবে আর তাতে সভাপতিত্ব করবেন ইবনে আমের। মুসলিম বাহিনী সিন্ধুর উপর হামলা করবার সংকল্প করেছে এবং সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব সৌপর্দ করা হয়েছে মুহাম্মদ বিন কাসিমের উপর। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ বসরার লোকদের জিহাদের পথে উদ্বুদ্ধ করবার দায়িত্ব ইবনে আমেরর উপর ন্যস্ত করে নিজে রওয়ানা হয়ে গেছেন কুফার লোকদের ফউজে ভর্তি করবার জন্য। ইবনে আমেরের বক্তৃতা শুনে বসরার লোকদের মধ্যে আশাব্যঞ্জক অবস্থা সৃষ্টি হবে, এরূপ আশা করবার কারণ রয়েছে, কিন্ত জামা’আতের কতগুলো দুষ্ট লোক গোপনে গোপনে বিরোধিতা করছে সিন্ধুর বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণার। তারা জলসায় শরীক হয়ে হয়তো একটা ভয়াবহ পরিস্থতি সৃষ্টি করে তুলবে, অমনি একটা আশংকা দেখা যাচ্ছে।

নয়ীম তালহার সাথে কথা বলতে বলতে গেলেন তার বাড়িতে এবং সেখানে ঘোড়া রেখে দু’জন রওয়ানা হলেন মসজিদের দিকে। মসজিদে সেদিন জনসমাগম হয়েছে বরাবরের চাইতে বেশী।

নামাযের পর ইবনে আমের বক্তৃতা করতে উঠলেন মিম্বরের উপর। তিনি কোনো কথা বলবার আগেই বাইরে থেকে দু’হাজার লোকের একটি দল কোলাহল করতে করতে এসে ঢুকলো মসজিদে। তাদের পরোভাগে একটি মোটাসোটা লোক। পরিধানে তার কালো জুব্বা। মাথায় সাদা পাগড়ী ও গলায় ঝুলছে বহুদামী মোতির হার। তালহা আগন্তুকের দিকে ইশারা করে বললেন, ‘দেখুন, এই যে ইবনে সাদেক এলো। আমার ভয় হচ্ছে, লোকটা নিশ্চয়ই জলসায় কোনো হাংগামা পয়দা করবে।’

ইবনে সাদেক নয়ীমের আসন থেকে কয়েগজ দূরে বসে পড়লো আর তার দলের লোকেরাও এদিক-ওদিক তাকিয়ে বসে পড়লো।

ইবনে আমের তাদের চুপ করে বসবারু ইনত্যের করলেন এবং শেষ পর্যন্ত বক্তৃতা শুরু করলেনঃ

রসূলে খোদার পেথে জীবন উৎসর্গকারী বীরদের সন্তান-সন্ততি! বিগত আশি নব্বই বছর ধরে দুনিয়া ধরে দুনিয়া আমাদের পূর্বপুরুষদের শৌর্য-বীর্যের, ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার এবং পরাক্রম ও শক্তির পরীক্ষা নিয়েছে। সে যামানায় আমরা দুনিয়ার বড় বড় শক্তির মোকাবিলা করেছি। বড় বড় পরাক্রান্ত ও গর্বিত বাদশার মস্তক অবনমিত হয়েছে আমাদের সামনে। আমাদের সৌভাগ্যের কাহিনী শুরু হয়েছে তখন থেকে, যখন কুফরের ঘূর্ণিঝড় রিসালতের দীপশিখার আকর্ষণে ধাবমান পতংগদলকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে এগিয়ে এসেছে মদীনার চার দেয়ালের দিকে; তখন ইসলামের বৃক্ষমূল বুকের খুনে সিঞ্চিত করে উর্বর করে তুলবার মানসে রসূল (সঃ) পথে আত্মদানকারী তিনশো তেরো জন বীর সিপাহী কাফের বাহিনীর তীর, নোহ্ ও তলোয়ারের সামনে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। এই আযীমুশশান বিজয়ের পর তওহীদের ঝান্ডা উঁচু করে আমরা কুফরের অনুধাবন করে ছড়িয়ে পড়েছি দুনিয়ার দিক-দিগন্তরে। বিপুল বিরাট দুনিয়ায় রয়েছে বহু অঞ্চল, যেখানে খোদার আখেরী পয়গাম আজো পৌঁছে নি। আমাদের কর্তব্য, আমাদের প্রভু প্রতিপালকের পয়গাম আমরা দুনিয়ার সকল দেশে পৌঁছে দেবো। আমাদের রসূল (সঃ) যে কানুন বয়ে এনেছেন, তা আমরা জানিয়ে দেবো দুনিয়ার তামাম মানুষকে। তারই বদৌলতে দুনিয়ায় কায়েম হবে শান্তি, আর দুনিয়ায় কমজোর ও শক্তিমান কওমসমূহ মিলিত হয়ে গড়ে তুলবে মানব-সাম্যের এক বিপুল ক্ষেত্র। মযলুম অসহায় মানুষ আবার ফিরে পাবে তাদের হারানো অধিকার। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, আজ পর্যন্ত দুনিয়ার যে কোনো শক্তিই এই আযীমুশশান ও আলমগীর কানুনের মোকাবিলা করতে দাঁড়িয়েছে, তারই ভাগ্যলিপি হয়েছে ধ্বংস।

মুসলমান ভাইরা! আমাদের শৌর্য পরীক্ষার সাহস সিন্ধরাজার কি করে হোল, ভেবে আমি হয়রান হচ্ছি। তিনি কি করে বুঝলেন, যে মুসলমান গৃহবিবাদের ফলে এতটা কমজো হয়ে পড়েছে যে, তারা তাদের মা-বোন ও কন্যাদের অবমাননা নীরবে বরদাশত করে যাবে।’

‘বীর মুজাহিদ দল! তোমাদের শৌর্য পরীক্ষার মুহূর্ত সমাগত। আমার মতলব এ নয় যে, তোমরা দীলের মধ্যে প্রতিহিংসাবৃত্তি নিয়ে জেগে উঠবে। সিন্ধুরাজকে আমরা মাফ করতে পারি, কিন্তু মানব-সাম্যের নিশান-বরদার হয়ে আমরা হিন্দুস্থানের মযলুম কওমসমূহের উপর তার নির্মম স্বেচ্ছাচারী শাসন মেনে নেবো না। রাজা দাহির কয়েকজন মুসলমানকে কয়েদখানায় আটক করে আমাদেরকে দাওয়াত করেছেন সিন্ধুর লাখো মানুষকে তাঁর লৌহকঠিন নিষ্পেষণ থেকে নাজাত দেবার জন্য। মুজাহিদ দল! জেগে ওঠ। বিজয়ভেরী বাজিয়ে তোমরা পৌঁছে যাও হিন্দুস্থানের শেষ সীমানা পর্যন্ত।

ইবনে আমেরের বক্তব্য শেষ হবার আগেই ইবনে সাদেক উঠে দাঁড়িয়ে জোর গলায় বললো :

মুসলমানগণ! আমি ইবনে আমেরকে শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি মনে করি। তার আন্তরিকতা সম্পর্কে আমার কোনো সন্দেহ নেই; কিন্ত আমার আফসোস এমনি উচ্চ চরিত্রের লোকও হাজ্জাজ বিন ইউসুফের মতো ক্ষমতালোভীর হাতের ক্রীড়াণকে পরিণত হয়ে তোমাদের সামনে দুনিয়ার শান্তি বিপর্যস্ত করবার ভয়াবহ মন্ত্রণা পেশ করছেন।’

হাজ্জাজ বিন ইউসুফের অতীত যুলুমের ফলে সবরার বেশীর ভাগ লোকই ছিলো তাঁর বিরোধী। তাঁরা বহুদিন ধরে এমন একটি লোকের সন্ধান করেছিলো, যে তাঁর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কিছু বলবার সাহস রাখে। তারা অবাক বিস্ময়ে ইবনে সাদেকের মুখের দিকে তাকাতে লাগলো।

ইবনে আমের কিছু বলতে চাচ্ছিলেন, কিন্তু ইবনে সাদেকের বুলন্দ আওয়ায় তাঁর ক্ষীণ কণ্ঠেকে ছাপিয়ে উঠলোঃ

‘সমবেত জনগণ! হকমাত তোমাদেরকে রাজ্য ও গণিমতের আকাংখা ছাড়া অপর কোনো উদ্দেশ্যে এই ধরণের বিজয় অভিযানে উদ্বুদ্ধ করছে না; কিন্তু একবার ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে দেখো, অতীতে এমনি রাজ্য ও গণিমতের লোভে কতো জান কোরবান করতে হয়েছে, কতো শিশু এতিম ও কতো নারী বিধরা হয়েছে। আমি নিজের চোখে তুর্কিস্তানের ময়দানে তোমাদের নওজোয়ান ভাই-বেটাদের হাজারো লাশ কবর ও দাফন ছাড়া পড়ে থাকতে দেখেছি। কত যখমীকে দেখেছি তড়পাতে আর মাথা খুঁড়ে মরতে। এই অবমাননাকর দৃশ্য দেখে আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, মুসলমানের খুন এতটা সস্তা নয় যে, তা হাজ্জাজ বিন্ ইউসুফের নামে বিজয় খ্যাতি ছড়াবার জন্য অকাতরে বইয়ে দিতে হবে।’

মুসলমান ভাইরা! জিহাদের বিরোধীতা আমি করছি না। কিন্তু আমি অবশ্য বলবো যে, গোড়ার দিকে আমাদের জিহাদের প্রয়োজন হয়েছিলো; কারণ আমরা ছিলাম কমযোর এবং কাফের শক্তি আমাদেরকে হটিয়ে দেবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলো। এখন আমরা শক্তিমান। কোনো দুশমনের ভয় নেই আমাদের। এখন আমাদেরকে নযর দিতে হবে দুনিয়াকে শান্তির আবাস বানানোরদিকে।’

মুসলমান ভাইরা! হাজ্জাজের রাজ্যলোভ চরিতার্থ করবার জন্য যে, সব যুদ্ধ করা হচ্ছে, তার সাথে জিহাদের লেশমাত্র সম্পর্ক থাকতে পারে না। .. সমবেত জনগণকে ইবনে সাদেকের কথায় প্রভাবিত হতে দেখে ইবনে আমের বুলন্দ আওয়াযে বলেঃ মুসলমান ভাইরা! আমার ধারণা ছিল না যে, আজো আমাদের মধ্যে এমনি অনিষ্টকারী মওজুদ রয়েছে, যে…….!

ইবনে সাদেক ইবনে আমেরের কথা শেষ হতে দিলো না। সে বুলন্দ আওয়াযে বলে উঠলোঃ আমার বলতে শরম বোধ হচ্ছে যে, ইবনে আমেরের মতো সম্মানিত ব্যক্তিও হাজ্জাজ বিন ইউসুফের গুপ্তচরের শামিল।

‘হাজ্জাজের গুপ্তচরকে বাইরে বের করে দাও।’ বলে উঠলো ইবনে সাদেকের এক সাথী।

ইবনে সাদেকের কৌশল সফল হলো। কেউ কেউ হাজ্জাজের গুপ্তচর বলে চীৎকার জুড়লো, কেউ কেউ আবার ইবনে আমেরকে অপমানজনক গালি-গালাজ করতে লাগলো। ইবনে আমেরের এক শাগরেদ, এক ব্যক্তির মুখে শ্রদ্ধেয় ওসতাদের গালমন্দ বরদাশত করতে না পেরে তার মুখের উপর এক চর বসিয়ে দিলো। ফলে মসজিদের রীতিমতো হাংগামা বেধে গেলো। জনগণ পরস্পর ধাক্কাধাক্কি শুরু করে দিলো।

মুহাম্মদ বিন কাসিম এতক্ষণে ভীষণভাবে উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন। তাঁর হাত বারংবার তলোয়ারের কব্জির দিকে যাচ্ছে, কিন্তু তিনি নিজেকে সামলে নিচ্ছেন ওসতাদের ইশারায় আর মসজিদের মর্যাদার খাতিরে।

এমনি এক নাযুক পরিস্থিতিতে নয়ীম জনতার ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেলেন মিম্বরের দিকে। তারপর মিম্বরে উঠে কুরআনে করীম তেলাওয়াত করতে শুরু করলেন বুলন্দ ও শিরীন আওয়াযে। কুরআনের আওয়ায সমবেত জনতার মধ্যে প্রশান্ত ভাব ফিরিয়ে আনলো এবং তারা পরস্পরকে চুপ করবার পরামর্শ দিতে লাগলো। ইবনে সাদেক এসেছে জলসার উদ্দেশ্য ব্যর্থ করে দেবার জন্য। তাই তার ইচ্ছা, আর একবার একটা হাংগামা সৃষ্টি হোক। কিন্ত কুরআন তেলাওয়াতের ফলে আওয়ামের মনোভাব আর নিজের জানের আশংকা বিবেচনা করে সে চুপ করে গেলো। জনতা চুপ করে গেলে নয়ীম শুরু করলেন তাঁর বক্তৃতাঃ

বসরার বদ-কিসৎ লোকেরা! তোমরা খোদার কহরের ভয় করো এবং ভেবে দেখো, তোমরা কোথায় দাঁড়িয়ে কি করছে। আফসোস্! যেসব মজিদ গড়ে তোলার জন্য তোমাদের পূর্বপুরুষরা পেশ করতেন দেহের খুন আর অস্থি, আজ তোমরা সেই মসজিদে ঢুকেও গোলযোগ পয়দা করতে দ্বিধা করছে না।’

নয়মের কথায় মসজিদের ফিরে এসেছে প্রশান্তি। গলার আওয়াটা খানিকটা বিষণ্ণ করে তিনি বলে যানঃ

‘এ সেই জায়গা, যেখানে ঢুকেই তোমাদের পূর্বপুরুষ কেঁপে উঠতেন খোদার ভয়ে। দুনিয়ার সব ব্যাপার পিছনে ফেলে এখানে ঢুকতেন তাঁরা। আমি ভেবে হয়রান হচ্ছি, তোমাদের মনের উপর কি করে পয়দা হলো এমনি এক যবরদস্ত ইনকেলাব! তোমাদের ঈমান এতটা কমফের হয়ে গেছে, তা যেনো আমি ভাবতেও পারি না। খোদা ও রসূলের পথে জান বাজি রাখতেন যে মুজাহিদ দল, তাদেরই আওলাদ তোমরা। কোনোদিন সেই পূর্বপুরুষের কাছে ফিরে গিয়ে মুখ দেখাতে হবে, এ অনুভুতি যতক্ষণ তোমাদের মনে রয়েছে, ততক্ষণ তোমরা এমনি, জঘন্য কার্যকলাপের পথে যেতে পারো না। আমি জানি, তোমাদের মধ্যে এ ধরনের মনোভাব পয়দা করছে অপর কোন লোক।

ইবনে সাদেক চমকে উঠলো। নাযুক পরিস্থিতি লক্ষ্য করে সে শ্রোতাদের মন থেকে নয়ীমের কথার প্রভাব দূর করবার চেষ্ট করলো। সে চীৎকার করে বললোঃ দেখুন, এও হাজ্জাজের গুপ্তচর।একে বের করে দিন।’

এ আরো কিছু বলতে চাইলো, কিন্ত রাগে কাঁপতে কাঁপতে নয়ীম বুলন্দ আওয়াযে বললেনঃ

‘আমি হাজ্জাজের গুপ্তচর, তাই ঠিক, তাই ঠিক, কিন্ত ইসলামের গাদ্দার নই। বসরার বদ-নসীব লোকেরা! তোমরা এই ব্যক্তির যবান থেকে শুনেছো আমাদের জিহাদের প্রয়োজন ছিল তখন, যখন আমরা করযোর ছিলাম; কিন্তু একথা শুনেও তোমাদের দেহের খুন গরম হয়ে ওঠেনি। তোমাদের মধ্যে কেউ একথা ভাবলো না যে, আগের দিনের প্রত্যেকটি মুসলমান শক্তি, ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার দিক দিয়ে এ যামানার সকল মুসলমানের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দাবী করতে পাতেন। তারা কি ছিলেন আর কি করে গেছেন? তাঁদের ভিতরে কি ছিলো, তা তোমাদের জানা নেই? তাঁদের ভিতরে ছিলো সিদ্দীকে আকবরের (রাঃ) আন্তরিকতা, উমর ফারুকের (রাঃ) মহৎ মন, উসমানের (রাঃ) বদান্যতা, আলী মুরতযার (রাঃ) শৌর্য এবং আসমান-যমিনে মালিক আল্লাহর প্রীয়তম পয়গাম্বরের দো’আ। তোমাদের মনে পড়ে, যেদিন কুফর ও ইসলামের পহেলা লড়াইয়ে তেগ ও কাফন নিয়ে তারা তিনশ তেরো জন বেরিয়েছিলেন, সেদিন দীন-দুনিয়ার রহমতের নবী বলেছিলেনঃ আজ পুরো ইসলাম কুরের পূর্ণ শক্তির মোকাবিলা করতে যাচ্ছে। কিন্তু আজ এক নীচ মানুষ তোমাদের মুখের উপর বলছেঃ আমাদের চাইতে তাঁরা ছিলেন কমযোর। নাউযুবিল্লাহ।’

নয়মের কথাগুলো সবারই মনের উপর দাগ কাটলো। একজন আল্লাহ আর’ তীর ধ্বনী করলো, আর সবাই তার সাথে আওয়ায় তুলল। এর পর সবাই ফিরে ফিরে তাকাতে লাগলো ইবনে সাদেকের দিকে। কেউ কেউ চাপা গলায় তার নিন্দাও শুরু করলো। নয়ীম বক্তৃতা করে চললেনঃ

‘আমাদের দোস্ত ও বুযুর্গগণ! খোদার রাহে জান, মাল ও দুনিয়ার তামাম স্বাচ্ছন্দ্য কোরবান করেন যে মুজাহিদ দল, তাঁদের উপর রাজ্য ও মালে-গণিমতের লোভের অপরাধ আরোপ করা না-ইনসাফী। দুনিয়ার লোভ যদি তাদের ভিতরে থাকতো, তাহলে মুষ্টিমেয় সহায় সম্বলহীন মুজাহিদ যে ভাবে কাফেরদের সংখ্যাহীন বাহিনীর সামনে বুক ফুলিলে দাঁড়িয়েছেন, আত্মদানের সে উদ্যম-উৎসাহ তোমরা দেখতে পেতে না। রাজ্য লোভ নিয়ে বেরুলে বিজিত কওম কে তাঁরা দিতে পাতেন না সম অধিকার। আজো আমাদের ভিতরে এমন কেই নেই, যে শাহাদতের পরিবর্তে মালে গণিমতের লোভ নিয়ে যাচ্ছে জিহাদের ময়দানে! মুজাহিদ শাসন-ক্ষমতা চায় না, কিন্তু খোদার রাহে যারা সব কিছু কোরবান করে দিতে তৈরী, সব দিক দিয়ে দুনিয়ায় তাঁদের মাথা উঁচু থাকায় বিস্ময়ের কিছু নেই। সাতানাত মুজাহিদের মহিমারই অংশ।

‘মুসলমান ভাইরা! আমাদের অতীত ইতিহাসের পষ্ঠা যেমন সিদ্দীকে আকবরের ঈমান ও আন্তরিকতার কাহিনীতে পরিপূর্ণ, তেমনি আব্দুল্লাহ বিন উবাইর মুনাফেকির কাহিনী থেকেও তা মুক্ত নয়। সিদ্দীকে আকবরের (রাঃ) পদাংক অনুসরকারীদের সামনে হামেশা যেমন থাকে ইসলামের সংগঠনী দৃষ্টিভংগী, তেমনি আবদুল্লাহ্ বিন্ উবাইর উত্তরাধিকারীরা হামেশা ইসলামের তরীর পথে তুলে দেয়া বাঁধার প্রাচীর; কিন্ত তার ফল কি হয়ে থাকে? আমি আবদুল্লাহ বিন উবাইর এই উত্তরাধিকারীর কাছে জিজ্ঞেস করছি।’

ইবনে সাদেকের অবস্থাটা তখন চারদিক থেকে শিকারীর বেড়াজালের মধ্যে অবরুদ্ধ শিয়ালের মতো। সে তখন ঠিকই বুঝে নিয়েছে যে, কথার যাদুকর এ নওজোয়ান আরো কয়েকটা কথা বললে সমবেত লোকজন সবাই তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। সে এদিক-ওদিক তাকিয়ে হতাশাব্যঞ্জক পরিস্থিতি দেকে পিছন দিকে সরতে লাগলো। একজন বলে উঠলো, মুনাফেক পালাচ্ছে, ধর।’ এক নওজোয়ান ‘ধর ধর’ আওয়ায করে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। সাথীরা তাকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করলো, কিন্ত জনতার ভিড়ে টিকতে পারলো না। কেউ তাকে ধাক্কা মারে আর কেউ বা মারে চড়চাপড়। মুহম্মদ বিন কাসিম ছুটে এসে জনতার হাত থেকে বহু কষ্টে তার জান বাঁচিয়ে দিলেন।

ইবনে সাদেক কোনমতে বিপদমুক্ত হয়ে ছুটে পালালো। কয়েকটি দুর্দান্ত নওজোয়ান শিকার হাত ছাড়া হচ্ছে দেখে ছুটতে চাইলো পিছু পিছু। কিন্ত মুহাম্মদ বিন কাসিম বাধা দিলেন তাদেরকে। ইবনে সাদেকের দলের লোকেরা একে একে বেরিয়ে গেলো মসজিদ থেকে। আবার সবাই চুপ করে নয়ীমের দিকে মনোযোগ দিলে তিনি বলতে লাগলেনঃ

এই দুনিয়ার প্রত্যেক অণু-পরমাণুর অস্তিত্ব বজায় রাখবার জন্য আঘাতের জওয়াবে আঘাত দিতে হচ্ছে। তাই জিহাদ হচ্ছে মুসলমানে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য। দুনিয়াকে শান্তির আবাস করে তুলবার জন্য জরুরী হচ্ছে কুফরের অগ্নিকুন্ড নিভিয়ে দেওয়া।

কুফরের যুলুমের আগুনে জ্বলছে যে অগণিত অসহায় মানুষ, বদর, হোনায়েন, কাদসিয়া, ইয়ারমুক ও আজনাদাইনের যুদ্ধের ময়দানের আমাদের পূর্ব পুরুষদের তীর ধ্বনি ছিলো তাদেরই আর্ত হাহাকারের জওয়াব; আর আজকের দুর্গত মানবতা সিন্ধুর ময়দানে আমাদের তলোয়ারের ঝংকার শুনবার জন্য বেকারার। মুসলমান! তোমাদের কওমের যে মেয়ে রয়েছে সিন্ধরাজের কয়েদখানায় বন্দিনী, তার ফরিয়াদ শুনেছো? আমি তোমাদের সিন্ধু বিজয়ের খোশখবর দিতে চাই।’

মুজাহিদ হচ্ছে আল্লাহর তলোয়ার। যে শির তার সামনে উঁচু হয়ে উঠবে, সে ই হবে ধুলিলুষ্ঠিত। সিন্ধুরাজ তোমাদেরকে দাওয়াত দিয়েছেন তলোয়ারের তীক্ষ্ণধার ও বায়ুর শক্তি পরীক্ষা করতে।’

মুজাহিদ দল! জেগে উঠে প্রমাণ করে দাও যে, এখনো তোমাদের শিরায় আরবের শাহ্ সওয়ারদের রক্তধারা জমে যায়নি। একদিকে খোদাওন্দ করীম তোমাদের জিহাদী মনোভাবের পরীক্ষা নেবেন এবং অপরদিকে দুনিয়া তোমাদের আত্মমর্যদাবোধের পরীক্ষা নিতে যাচ্ছে। তোমরা এ পরীক্ষার জন্য তৈরী?

আমরা সবাই তৈরী, আমরা সবাই তৈরী ‘-এই গগণভেদী আওয়ায তুলে বুড়ো জোয়ান সবাই তরুণ মুজাহিদের ডাকে সাড়া দিলো।

নয়ীম বৃদ্ধ ওস্তাদের দিকে তাকালেন। তাঁর ঠোঁটে মৃদু হাসি আর চোখে আনন্দের আঁসু। ইবনে আমের আবার উঠে সংক্ষিপ্ত বক্তৃতার পর ভর্তির জন্য নাম পেশ করবার জরুরি নির্দেশ দিলে সভা ভাঙলো।

*

রাতের বেলা মুহাম্মদ বিন কাসিমের গৃহে ইবনে আমের, সাঈদ, নয়ীম ও শহরের আরো কতিপয় বিশিষ্ট ব্যক্তি দিনের ঘটনাবলীর আলোচনায় ব্যস্ত। নয়ীমের প্রভাব কেবল বসরার নওজোয়ানদের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়েনি, বরং তার প্রশংসা শোনা যাচ্ছে বয়স্ক লোকদেরও মুখে মুখে। ইবনে আমের তার সুযোগ্য শাগরেদকে ভালো করেই জানতেন। তিনি জানতেন যে, অকুতোভয়ে যে কোনো বিপজ্জনক পরিস্থিতির মোকাবিলা করবার মতো যোগ্যতা তার ভিতরে রয়েছে পুরোমাত্রায়; কিন্ত নয়ীম আজ যা করেছেন, তা তাঁর প্রত্যাশার চাইতেও অনেক বেশি। সাঈদের খুশীরও সীমানা নেই। তিনি বারবার নওজোয়ান ভাগ্নের মুখের দিকে তাকান আর তার মুখ থেকে উৎসারিত হয় তার দীর্ঘজীবন কামনার নেক দোয়া। বক্তৃতার শেষে নয়ীমকে উৎসাহিত করবার জন্য তিনি সবার আগে ফউজে শামিল হবার জন্য নিজের নাম পেশ করেছেন এবং মকতবে তাঁর খেদমতের সবচাইতে জরুরি প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেবার জন্য তৈরী হয়েছেন। ইবনে আমেরের দুর্বল হাতে তলোয়ার ধরার তাকৎ আর নেই, তথাপি তিনি তাঁর সুযোগ্য শাগরেদ মুহাম্মদ বিন কাসিম ও নয়ীমের সাথী হবার ইরাদা জানিয়েছেন। কিন্তু বসরার লোকেরা তাকে বাধা দিয়ে একবাক্যে বলেছে, মাদ্রসায় আপনার প্রয়োজন সবচাইতে বেশি। বসরার লোকেরা সাঈদকেও বাধা দিতে চেয়েছে, কিন্তু মুহাম্মদ বিন কাসিম অগ্রবর্তী দলের নেতৃত্বের জন্য একজন অভিজ্ঞ সালারের প্রয়োজন অনুভব করে তাকে নিয়েছেন সেনা বাহিনীর শামিল করে।

নয়ীম প্রতি মুহূর্তে এক মনযিলের নিকটবর্তী হচ্ছেন, আর এক মনযিল থেকে সরে যাচ্ছেন দূরে-বহুদূরে। তিনি মজলিসে বসে বেপরোয়া হয়ে শুনছেন সব আলোচনা। ইবনে আমের অভ্যাসমতো বর্ণনা করে যাচ্ছেন কুফর ও ইসলামের গোড়ার দিকের সংঘাথের কাহিনী। তিনি আলোচনা করেছেন ইসলামের আযীমুশশান মুজাহিদ খালিদ বিন ওয়ালীদের হামলার বিভিন্ন তরিকা।

কে যেন বাইরে থেকে দরজায় করাঘাত করলো। মুহাম্মদ বিন কাসিমের গোলাম দরজা খুলে দিলো। এক বৃদ্ধ আরব এক হতে একটি পুটলি ও অপর হাতে লাঠি নিয়ে ভিতরে ঢুকলেন। বৃদ্ধের ভুরু পর্যন্ত ভার্ধক্যে সাদা হয়ে গেছে। তার মুখে পুরনো যখমের দাগ। দেখে মনে হয় এককালে তিনি খেলেছেন তলোয়ার-নেযাহ নিয়ে। ইবনে আমের তাকে চিনতে পেরে এগিয়ে এসে মোসাফেহা করলেন। বৃদ্ধ ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন, মকতবে আমি আপনাকে খুঁজে এসেছি। সেখানে শুনলাম আপনি এখানে এসেছেন।

‘আপনি বড়ই তকলীফ করেছেন। বসুন।

বৃদ্ধ ইবনে আমেরের কাছে বসলেন।

ইবনে আমের তাঁকে বললেন, বহুদিন পর আপনার যিয়ারত নসীব হলো। বলুন, কি করে এলেন?

বৃদ্ধ বললেন, ‘আজকের মসজিদের ঘটনা শুনেছি লোকের মুখে। যেনওজোয়ানের হিম্মতের তারিফ করছে বসরার বাচ্চা-বুড়ো সবাই, তাকেই খুঁজে বেড়াচ্ছি আমি। শুনালাম, সে নাকি আব্দুর রহমানের বেটা। আবদুর রহমানের বাপ ছিলেন আমার অতি বড় দোস্ত। ছেলেটির সাথে দেখা হলে আমার তরফ থেকে কয়েকটি জিনিস আপনি তাকে দেবেন।

বৃদ্ধ তাঁর পুটলি খুলে বললেন, ‘পরশু তুর্কীস্তান থেকে খবর পেয়েছি, উবায়দা শহীদ হয়েছে;

‘কোন উবয়দা? আপনার নাতি? ইবনে আমের প্রশ্ন করলেন।

‘হ্যাঁ তাই। আমার ঘরে তার এই তলোয়ার আর বর্ম ফালতু পড়েছিলো। আমার ঘরে এ সব জিনিসের হক আদায় করবার মতো কেউ নেই আর। তাই আমার ইচ্ছা কোন মুজাহিদকে এগুলো ন্যরানা দেবো।’

ইবনে আমের নয়ীমের দিকে তাকালেন। তাঁর মতবল বুঝতে পেরে নয়ীম উঠে গিয়ে বৃদ্ধের কাছে বসতে বসতে বললেন, আপনার গুণগ্রাহিতায় আমি ধন্য। যথাসাধ্য আপনার তোহার সদ্ব্যবহার আমি করবো। আমায় আপনি দোয়া করুন।

মধ্যরাত্রের কাছাকাছি মজলিস শেষ হলে সবাই যার যার ঘরে চলে গেলেন। নয়ীম তাঁর মামুর সাথে যেতে চাইলেন, কিন্তু মুহাম্মদ বিন কাসিম তাঁকে কাছে রাখলেন।

মুহাম্মদ বিন্ কাসিমের অনুরোধে সাঈদ নয়ীমকে সেখানে থাকতে বললেন। ইবনে আমের ও সাঈদকে বিদায় দেবার জন্য নয়ীম ও মুহাম্মদ বিন কাসিম ঘরের বাইরে এলেন এবং কিছু দূর গেলেন তাদের সাথে সাথে। নয়ীমের সাথে তখনও সাঈদের কোনো আলাপ হয়নি বাড়ি ঘর সম্পর্কে। চললে চলতে তিনি প্রশ্ন করলেন, নয়ীম, বাড়ির খবর সব ভাল তো?’

‘জি হ্যাঁ, মামুজান! বড়িতে সবাই ভাল। আম্মিজান…..।’ নয়ীম আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। চিঠিটা বের করবার মতলব করে তিনি হাত ঢুকালেন জেবের মধ্যে, কিন্ত কি যেন চিন্তা করে খালি হাতই জেব থেকে বের করলেন।

হ্যাঁ, বোন কি বলেছিলেন?’ তিনি আপনাকে সালাম জানিয়েছেন মামুজান!

বাকী রাতটা নয়ীম বিছানায় পড়ে এপাশ-ওপাশ করে কাটালেন। ভোর হবার খানিকটা আগে তাঁর চোখে নামলো ঘুমের মায়া। তিনি স্বপ্নে দেখলেন, তিনি যেনো তাঁর এলাকার বাগিচার মুগ্ধকর পরিবেশে মহব্বতের সুরঝংকারের মাঝখানে প্রিয়তমার সান্নিধ্য থেকে দূরে-বহুদূরে সিন্ধুর দিগন্তপ্ৰসারী ময়দানে যুদ্ধের বিভীসিকাময় দৃশ্যের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন।

পরদিন নয়ীম ফউজের একজন সিপাহসালার হিসাবে রওয়ানা হয়ে গেলেন। প্রতি পদক্ষেপে তিনি যেনো তাঁর আর্যর পুরানো লোকালয় ভেঙে দিয়ে চলেছেন আর সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন নতুন আকাংকার দুনিয়া গড়তে গড়তে। সন্ধ্যার খানিক্ষণ আগে তাঁর লশকর চলেছে এক উঁচু টিলার উপর দিয়ে। যে বাগিচার ছায়ায় নয়ীম কত সুখ-শান্তির দিন কাটিয়েছেন তারই দিকে নযর পড়ছে এখান থেকে। এ পথ থেকে দু’ক্রোশ দূরে রয়েছে তাঁর যৌবনের নিষ্পাপ আশার মূর্ত প্রতীক, তাঁর অন্তরের আকাংখিত প্রিয়জন। মন চায় তখখুনি তিনি ঘোড়া ছুটিয়ে চলে যান সেই মরুভূমির হুরের কাছে, তাঁকে দুটো কথা বলেন, দু’টো কথা শুনে আসেন তার কাছ থেকে এই বিদায় মূহূর্তে। কিন্তু, মুজাহিদদের আত্মা এ সূক্ষ্ম অনুভূতির উপর হয় বিজয়ী। জেব থেকে তিনি চিঠিটা বের করেন, পড়েন, আবার তা খুঁজে রাখেন জেবের মধ্যে।

*

বাড়িতে আবদুল্লাহ ও নয়ীমের শেষ কথাবার্তা শুনবার পর উযরার খুশীর অন্ত নেই। তার রূহ্ নে আনন্দের সপ্তম আসমানে উড়ে বেড়াচ্ছে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে সে যেন শুনতে পাচ্ছে আসমানের সিতারাদের নির্বাক সংগীত। সারা রাত জেগে থেকেও যেন তার মুখে ফুটে উঠেছে আগের চাইতে বেশী খুশীর আভাস। হতাশার আগুনে জ্বলে পুড়ে যাবার পর আশাতরু আবার ফুলে ফুলে সবুজ হয়ে উঠেছে।

আবদুল্লাহর উপকারের বোঝা যেনো ভারাক্রান্ত করে তুলেছে উার মন। তার অন্তহীন আনন্দের:ভিতরে ব্যাথা হয়ে বাজে আব্দুল্লাহর উপকারের গোপন লজ্জা। সে ভাবে, আব্দুল্লাহর এ ত্যাগ তো শুধু নয়ীমের জন্যই নয়, তাদের দুজনেরই জন্য। তাঁর মুহব্বত কতো নিঃস্বার্থ! কতোটা ব্যথা তাঁর মনে লেগেছে! আহা! সে যদি এমনি করে ব্যথা না দিয়ে পারতো! আহ! নয়ীমকে যদি সে এতটা মুহব্বত না করতো আর আব্দুল্লাহর দীলে এমনি করে আঘাত না দিতে! কল্পনার এই বেদনাদায়ক অনুভূতি মুহূর্তের মধ্যে চাপা পড়ে যায় তার অন্তর থেকে উৎসারিত আনন্দের সুরঝংকারে।

উযরা ভেবেছে, নয়ীম ফিরে আসবেন সন্ধ্যার আগেই। বড়ো কষ্টে কেটেছে তার ইনতেযারের দিন। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো, কিন্তু নয়ীম ফিরে এলেন না। গোধূলির স্নানিমা যখন রাত্রির অন্ধকারে রুপান্তরিত হতে লাগলো, আসমানের কালো পদায় ঝিকমিক করতে লাগলো অসংখ্য সিতারার মোতি, তখন উযরার অস্থিরতা ক্রমাগত বেড়ে চললো। মধ্যরাত্রি অতীত হয়ে গেলো, দুঃখের রাতকে আশার সান্ত্বনা দিয়ে উযরা পাশ ফিরে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। পরের দিনটি কাটলো আরো অস্থিরতার ভিতর দিয়ে এবং পরের রাতটি হলো যেনো আরো দীর্ঘ।

আবার ভোর কেটে গেলো, সন্ধ্যা হলো, কিন্তু নয়ীম ফিরে এলেন না। সন্ধ্যাবেলা উ ঘর থেকে বেরিয়ে কিছু দূরে এক টিলার উপর গিয়ে নয়ীমের পথ চেয়ে রইলো। বসরার পথে বার বার ধূলো উড়ছে কম বেশি করে। বারবার সে ভাবে, ওই বুঝি নয়ীম এলেন। প্রতিবার হতাশ হয়ে সে চেপে ধরে তার কম্পিত বুক। উট ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে চলে যায় কতো পথিক। দূর থেকে সে দেখে, বুঝি নয়ীম এলেন; কিন্তু কাছে এলেই সে দেখে, সব ভুল। সন্ধ্যার ঠান্ডা হাওয়া বইছে। রাখাল ফিরে যাচ্ছে আপন ঘরে। গাছের উপর কল-গুঞ্জন করে পাখীরা তাদের সমজাতীয় পাখীদেরকে জানাচ্ছে সন্ধ্যার আগমনী পয়গাম। উ ঘরে ফিরে যাবার ইরাদা করেছে, অমনি.পিছন থেকে শুনতে পেলো কার পায়ের আওয়ায। ফিরে দেখলো; আব্দুল্লাহ্ আসছেন। হায়া ও লজ্জায় উযরার চোখ নত হয়ে এলো। আব্দুল্লাহ্ কয়েক কদম এগিয়ে এসে বললেন, উযরা! এবার ঘরে চলো। চিন্তা করো না। নয়ীম শীগগিরই এস পড়বে। বসরার কোনো বড়লোক দোস্ত ওকে আসতে বাধা দিয়েছেন।

উফরা কোনো কথা না বলে চললো ঘরের দিকে। পরদিন বসরা থেকে একটি লোক এলে জানা গেলো, নয়ীম রওয়ানা হয়ে গেছেন সিন্ধুর পথে। খবর পেয়ে সাবেরা, আব্দুল্লাহ ও উযরার মনে জাগলো নানারকম ধারণা। সাবেরা ও আব্দুল্লাহর মনে সন্দেহ হলো, হয়তো নয়ীমের আত্মম্ভরিতা তাঁর মনকে ভাইয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশে বিমুখ করেছে। উর সন্দেহ তাদের থেকে ভিন্ন ধরনের। বসরার বড়ো বড়ো লোক তার দোস্ত, আর তাঁদের কেউ তাকে আসতে বাধা দিয়েছেন, আবদুল্লার এই কথা তাঁর দীলের উপর গভীর রেখাপাত করেছে। বারবার সে মনে মনে বলছে, নয়ীমের দেহ সৌন্দর্য ও বাহাদুরীর খ্যাতি বড়ো বড়ো লোককে তাঁর কাছে টেনে এনেছে। তারা হয়তো তার সাথে সম্পর্ক রাখাটাকেই মনে করে গর্বের বিষয়। সম্ভবতঃ বসরার হাজারো সুন্দরী ও বড়ো ঘরের মেয়ে তার কাছে আত্মনিবেদন করতে লালায়িত। আর আমার মধ্যে এমন গুণই বা কোথায়, যা তাকে ফিরিয়ে রাখবে অপরের প্রতি আকর্ষণ থেকে! যদি তার জিহাদে যেতেই হয়, তবু কেন আমায় বলে গেলেন না? তাঁকে বাঁধা দেবার মতো কে-ই আছে এ বাড়িতে? হয়তো এ এলাকায় তাঁর পেরেশানীর কারণ আমিই ছিলাম না। হয়তো আর কারুর সাথে তিনি পেতেছিলেন মুহব্বতের সম্পর্ক …… কিন্তু না। তা কখনো হতে পারে না। নয়ীম-আমার নয়ীম….. এমন তো নয় কখনো। তিনি তো আমায় ধোকা দিতে পারেন না। আর যদি দেনই, তাহলেই বা তাকে নিন্দা করবার কি অধিকার আছে আমার?

তখনকার যামানায় দেবল ছিলো সিন্ধুর এক মশহুর বন্দর। শহরের চার দেয়ালের উপর সিন্ধুরাজের এতটা ভরসা ছিল যে, ময়দানে নেমে মোকাবিলা না করে তিনি তাঁর বেশুমার ফউজ নিয়ে আশ্রয় নিলেন শহরের ভিতরে। মুহম্মদ বিন্ কাসিম শহর অবরোধ করে মিনজানিকের সাহায্যে প্রস্তর বর্ষণ শুরু করলেন, কিন্তু কয়েকদিনের কঠিন হামলা সত্ত্বেও মুসলিম বাহিনী শহরের দেয়াল ভাঙতে পারলো না। অবশেষে একদিন একটা ভারী পাথর পড়লো এক মশহুর বৌদ্ধ মন্দিরের উপর। মন্দিরের স্বর্ণ-গম্বুজ টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়লো নীচে এবং তার সাথেই চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেলো বুদ্ধের এক প্রাচীন মূর্তি। মূর্তিটি ভেঙে পড়ায় রাজা দাহির অশুভ লক্ষণ মনে করে ঘাবড়ে গেলেন এবং রাতের বেলায় ফউজ সাথে নিয়ে পালিয়ে গেলেন ব্রাহ্মণবাদে।

দেবল বিজয়ের পর মুহম্মদ বিন্ কাসিম এগিয়ে এলেন নীরুনের দিকে। নীরুনের বাসিন্দারা লড়াই না করেই হাতিয়ার সমর্পণ করে দিলো।

নীরুন দখল করবার পর মুহম্মদ বিন্ কাসিম ভরোচ ও সিউস্তানের মশহুর, কেল্লা জয় করলেন। রাজা দাহির ব্রাহ্মণাবাদে পৌঁছে চারদিকে দূত পাঠালেন এবং হিন্দুস্তানের রাজা-মহারাজাদের কাছে সাহায্যের আবেদন করলেন। তার আবেদনে দু’শো হাতী ছাড়া আরো পঞ্চাশ হাজার ঘোড়সওয়ার ও কিছু সংখ্যক পদাতিক সিপাহী এসে জমা হলো তার পাশে। রাজা দাহির বিপুল সেনাসামন্ত সাথে নিয়ে ব্রাহ্মণবাদের বাইরে এসে:সিন্ধুনদের কিনারে এক বিস্তৃত ময়দানে তাঁবু ফেলে মুহম্মদ বিন্ কাসিমের আগমন প্রতীক্ষা করতে লাগলেন।

মুহম্মদ বিন্ কাসিম কিশতির সেতু রচনা করে সিন্ধুনদ পার হলেন। ইসায়ী ৭১৩ সালের ১৯ শে জুন মুহম্মদ বিন কাসিমের ফউজ এসে সন্ধ্যাবেলায় তাঁবু ফেললো রাজার তাঁবু থেকে দুই ক্রোশ দূরে। ভোর বেলা বেজে উঠলো শংখঘন্টা এবং অপরদিকে জেগে উঠলো আল্লাহু আকবর’ তকবরী ধ্বনি এবং দুই লশকর নিজ নিজ দেশের সামরিক রীতি অনুযায়ী সংঘবদ্ধভাবে এগিয়ে চললো পরস্পরের দিকে।

মুহম্মদ বিন কাসিম তার ফউজকে পাঁচশ’ সিপাহীর ছোট ছোট দলে ভাগ করে হুকুম দিলেন সামনে এগিয়ে যেতে। অপরদিকে সিন্ধুর ফউজে সবার আগে দু’শো হাতী এগিয়ে এলো। ভয় পেয়ে মুসলিম বাহিনীর ঘোড়াগুলো পিছু হটে যেতে লাগলো। এ সব দেখে মুহম্মদ বিন কাসিম তাঁর ফউজকে হুকুম দিলেন তীর বর্ষণ করতে। একটি হাতি মুসলিম সিপাহীদের সারি দলিত করে এগিয়ে এলো সামনের দিকে। মুহম্মদ বিন কাসিম তার মোকাবিলা করবার জন্য এগিয়ে যেতে চাইলেন, কিন্তু তার ঘোড়া সেই ভয়ংকর জানোয়ারের কাছেও যেতে চাইলো না ভয়ে। মুহম্মদ বিন কাসিম বাধ্য হয়ে নেমে পড়লেন ঘোড়া থেকে এবং এগিয়ে গিয়ে হাতীর শুড় কেঁটে ফেললেন। নয়ীম ও সাঈদ তাঁর মতোই এগিয়ে গিয়ে কেটে দিলেন আরও দুটি হাতীয় শুঁড়। আহত হাতী উলটো দিকে ঘুরে সিন্ধুর ফউজকেই দলিত করে বেরিয়ে গেলো। বাকী হাতীগুলো তীরবৃষ্টির ভিতর দিয়ে এগুতে পারলো না। তারা যখমী হয়ে সিন্ধুর সিপাহীদের সারি ছিন্নভিন্ন করে চললো। সুযোগ বুঝে মুহম্মদ বিন কাসিম সামনের সারির সিপাহীদের এগিয়ে যেতে হুকুম দিলেন এবং পিছনের দলগুলোকে হুকুম দিলেন তিন দিক থেকে দুশমন ফউজকে ঘিরে ফেলতে। মুসলিম বাহিনীর প্রাণপাত সংগ্রামের ফলে দুশমন ফউজের পা টলে গেল। সাঈদ কয়েকজন দুঃসাহসী যযাদ্ধাকে সাথে নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীদের সারি ভেদ করে গিয়ে পৌঁছলেন দুশমন বাহিনীর মধ্যভাগে। নয়ীমও তাঁর বাহাদুর মামুর পিছনে পড়ে থাকতে রাষী ছিলেন না, তাই তিনি নেই হাতে পথ খোলাসা করে এগিয়ে গেলেন তাঁর কাছে। রাজা দাহির তার রাণীদের মাঝখানে এক হাতীর উপর সোনার আসনে বসে দেখছিলেন যুদ্ধের দৃশ্য। তার আগে কয়েকজন পূজারী একটি মূর্তি মাথায় নিয়ে ভজন গেয়ে চলেছে। সাঈদ বলে উঠলো, “এই মূর্তি হচ্ছে ওদের শেষ অবলম্বন। ওটাকে ভেঙে ফেল।’

নয়ীম এক পূজারীর সিনার উপর তীর মারলেন এবং তখনি সে কলজের উপর হাত চেপে ধরে লুটিয়ে পড়লো যমিনের উপর। দ্বিতীয় তীর গিয়ে লাগলো আর এক পূজারীর উপর। অমনি সে মূর্তিটা ময়দানে ফেলে পিছু হটলো। এই মূর্তিটাই ছিল সত্যি তাদের শেষ আশা। তামাম ফউজে ছড়িয়ে পড়লো বিশৃংখলা। কঠিন আঘাত পেয়েও সাঈদ এগিয়ে চললেন সামনের দিকে। তিনি রাজা দাহিরের হাতীর উপর হামলা করলেন, কিন্ত রাজার রক্ষীর যোদ্ধারা তখন তার চারদিকে জমা হয়ে গেছে। সাঈদ এবার তাদের নাগালের মধ্যে। সাঈদকে দুশমনবেস্টিত দেখে নয়ীম ক্ষুধিত সিংহের মতো হামলা করে ছিন্ন ভিন্ন করে দিলেন দুশমন-বাহিনীকে। সাঈদের সন্ধানে তিনি চারদিকে দৃষ্টি সঞ্চালন করলেন, কিন্তু তাকে খুঁজে পেলেন না। আচানক তাঁর শূন্যপৃষ্ঠ ঘোড়াটিকে তিনি দেখতে পেলেন এদিক-ওদিক ছুটেতে। নয়ীম এবার নীচে পড়ে থাকা লাশগুলোর দিকে তাকালেন। সাঈদ দুশমনদের কতকগুলো লাশের উপর উপুড় হয়ে পড়ে আছেন। নয়ীম ঘোড়া থেকে নেমে হাত দিয়ে তাঁর মামুর মাথাটা উপরে তুলে মামুজান বলে ডাকলেন, কিন্তু তার চোখ আর খুললো না। নয়ীম উন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্ন ইলায়হি রাজেউন’ বলে আবার ঘোড়ার পিঠে চাপলেন। রাজা দাহিরের হাতী তখন তাঁর কাছ থেকে বেশী দূরে নয়। কিন্তু তখনো বিশৃংখল সিপাহীদের এক দল তাঁকে ঘিরে রয়েছে।

নয়ীম আবার ধনুক হাতে নিয়ে তীর বষর্ণ শুরু করলেন রাজার দিকে লক্ষ্য করে একটি তীর গিয়ে লাগলো রাজার সিনার উপর এবং রক্তাক্ত দেহে তিনি ঢলে পড়লেন এক রাণীর কোলের উপর। রাজার হত্যার খবর মশহুর হয়ে গেয়ে সিন্ধুর লশকর ময়দানের ভিতরে অগুণতি লাশ ফেলে পালালো। পরাজিত সিপাহীরা কতক গেলো ব্রাহ্মণবাদে, আর কতক গেলো আরারের দিকে।

এই আযীমুশশান বিজয়ের পর মুসলমানরা যখমীদের শ্রুষা ও শহীদের দাফন কাফনের কাজে ব্যস্ত হলেন; সাঈদের দেহে বিশটিও বেশি যখমের নিশানা দেখা যাচ্ছিলো। তার জেব থেকে ভাইয়ের চিঠিটা বের করে কবরের ভিতর ছুঁড়ে দিলেন।

মুহাম্মদ বিন কাসিম হয়রান হয়ে প্রশ্ন, করলেন কি ওটা?

‘একটা চিঠি। নয়ীম বিষণ্ণ কণ্ঠে বললেন।

‘কিসের চিঠি?’

‘আব্দুল্লাহ আমার কাছে দিয়েছিলেন ওটা। চিঠিটা আমি ওঁর কাছে পৌঁছে দেবার ওয়াদা করে এসেছিলাম। কিন্তু সে ওয়াদা পূরণ করাটা আল্লাহ্র মনযুর ছিলো না।

‘আমি ওটা দেখতে পারি?’ মুহাম্মদ বিন কাসিম সুধালেন।

‘ওর ভিতর, এমন কিছু নেই।’

মুহম্মদ বিন্ কাসিম নত হয়ে কবর থেকে তুলে নিলেন চিঠিখানা। পড়ে তিনি তা ফিরিয়ে দিলেন নয়ীমের হাতে। বললেন, এটা নিজের কাছে রেখে দাও। শহীদের দৃষ্টি থেকে দুনিয়া ও আখেরাতের কোনো কিছুই পুশিদা থাকে না।’

মুহম্মদ বিন কাসিমের কাছে নয়ীমের যিন্দেগীর কোনো রহস্যই পুশিদা ছিলো না। নয়ীমের জন্য আব্দুল্লাহর ত্যাগ ও খোদার রাহে নয়ীমের শানদার কোরবানী তাঁর দীলের মধ্যে তাঁদের দু’ভাইয়ের প্রতি আগের চাইতে আরো গম্ভীর মুহব্বত পয়দা করে দিলো।

রাতের বেলা ঘুমোবার আগে মুহম্মদ বিন কাসিম নয়ীমকে তাঁর তাঁবুতে ডেকে নিয়ে নানারকম কথাবার্তার পর বললেন, এবার আমরা কয়েকদিনের মধ্যে ব্রাহ্মণাবাদ জয় করে যাবো মুলতানের দিকে। ওখানের হয়ত আমাদের আরো বেশি সৈন্যবলের প্রয়োজন হবে। তাই আমার ধারণা। তোমায় আবার বসরায় পাঠাতে হবে। সিপাহী সংগ্রহ করবার জন্য তুমি ওখানে গিয়ে বক্তৃতা করে বেড়াবে। পথে তোমার বাড়ি হয়ে ওদের সবাইকে আশ্বাস দিয়ে যাবে। ওদেরকে আশ্বাস দেবার কথা বলতে গেলে আমি ব্যাপারটিকে জিহাদের চাইতে বেশী গুরুত্ব দিচ্ছি না। নতুন সিপাহী ভর্তি সম্পর্কে আজকের লড়াইয়ে প্রমাণিত হয়ে গেছে যে, সিন্ধুর জন্য আর বেশি ফউজের প্রয়োজন নেই।’

‘কিন্তু আমার ইরাদা শুধু সিন্ধু বিজয়েই সীমাব্ধ নয় হিন্দুস্তান এক বিস্তীর্ণ রাজ্য। তোমায় যেতেই হবে।’

‘একজন সিপহী হিসাবে আপনার হুকুম মেনে চলা আমার ফরয, কিন্তু দোস্ত হিসাবে আমার প্রতি আপনার এ উপকারের প্রয়োজন নেই।

‘কোন উপকার?’ মুহম্মদ বিন্ কাসিম প্রশ্ন করলেন।

‘বসরায় পাঠাবার নাম করে আপনি আমায় বাড়ি ফিরে যাবার মওকা দিচ্ছেন। আমি এটাকেই মনে করছি উপকার।

মুহম্মদ বিন্ কাসিম বললেন, ‘যদি এ উপকারের সাথে আমার অথবা তোমার কর্তব্যের সংঘাত হতো, তাহলে কখনো আমি তোমায় এজাযত দিতাম না; কিন্তু আপাততঃ এখানে তোমার কোন প্রয়োজন নেই। কেননা, ব্রাক্ষনাবাদ জয় করা আমাদের কাছে বাম হাতের খেলার মতো। এরপর এদিক ওদিক কয়েকটি মামুলী রাজ্যের বিদ্রোহ দমন করে আমরা এগিয়ে যাবো মুলতানের দিকে। ততদিনে তুমি স্বচ্ছন্দে ফিরে আসবে আর তোমার সাথে আসবে কমবেশী করে যেসব সিপাহী, তারা আমাদের তাকৎ যথেষ্ট বুদ্ধি করতে পারবে।

আচ্ছা, কবে যেতে হবে আমায়?;

যথাসম্ভব শীগগীর। যখন তোমায় সফরে এজাযত দেয়া হলো তখন কালই রওয়ানা হয়ে যাবে।’

মুহম্মদ বিন্ কাসিমের সাথে আলাপের পর নয়ীম বসে থাকলেন সেখানেই, কিন্তু তার কল্পনা তখন তাঁকে নিয়ে গেছে বহুদূরে সিন্ধুর সরমিন থেকে হাজারো মাইল দুরে।

ভোর বেলা দেখা গেলো, নয়ীম বসরার পথে ফিরে যাবার জন্যে তৈরী হচ্ছেন।

*

সিন্ধুতে মুসলমানদের বিজয় অভিযান স্পর্কে হাজ্জাজ বিন্ ইউসুফকে অবহিত করবার জন্য মুহম্মদ বিন কাসিম সিন্ধু থেকে বসরা পর্যন্ত দশ ক্রোশ দূরে দূরে সিপাহীদের চৌকি বসিয়েছেন। ডাক পাঠাবার জন্য প্রত্যেক চৌকিতে রাখা হয়েছে কতগুলো দ্রুতগামী ঘোড়া।

ভোর বেলায় নয়ীম রওয়ানা হলেন সিন্ধু থেকে বসরার পথে। প্রতি চৌকিতে ঘোড়া বদল করে তিনি দিনের সফরে পথ অতিক্রম করে যাচ্ছেন ঘন্টায়। রাতের বেলা তিনি বিশ্রাম করলেন এক চৌকিতে। ক্লান্তির দরুন তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন অল্প সময়ের মধ্যে। মধ্যরাত্রের দিকে সিন্ধুর দিক থেকে আগত এক সওয়ারের লেবাস দেখে তাকে এক মুসলমান সিপাহী বলেই মনে হলো। চৌকিতে পৌঁছেই সে ঘোড়া থেকে নেমে বলতে লাগলো, আমি বসরায় যাচ্ছি এক অতি জরুরী খবর নিয়ে। আমার জন্য আর একটি ঘোড়া তৈরী করে দাও জলদী।’

সিন্ধুর যে কোন ব্যাপার সম্পর্কে নয়ীমের মনে ছিলো আগ্রহ। তিনি উঠে মশালের আলোয় দেখে নিলেন আগন্তুক লোকটিকে। লোকটি গন্দমী রঙের সুগঠিত দেহ জোয়ান।

তুমি মুহম্মদ বিন কাসিমের পয়গাম নিয়ে যাচ্ছে।

‘জি হ্যাঁ!

‘কি পয়গাম?

কাউকেও তা বলবার এজাযত তো নেই।

‘আমায় চেনো তুমি?

‘জি হ্যাঁ, আপনি আমাদের ফউজের এক সালার। কিন্তু মাফ করবেন, যদিও আপনাকে বলায় কোন ক্ষতি নেই, তথাপি সিপাহসালারের হুকুম। হাজ্জাজ বিন্ ইউসুফ ছাড়া আর কাউকেও দেওয়া যাবে না এ পয়গাম।’

‘আমি তোমার কর্তব্যনিষ্ঠার তারিফ করছি।’ নয়ীম বললেন।

ইতিমধ্যে আর একটি ঘোড়া তৈরী হয়ে গেছে। দেখতে দেখেতে আগাম্ভক তার উপর সওয়ার হয়ে এক নিমেষে মিলিয়ে গেলো রাত্রির অন্ধাকারে।

কয়েকদিন পর নয়ীম তাঁর সফরের তিন-চতুর্থাংশ শেষ করে এক মনোমুগ্ধকর উপত্যকা-ভূমির ভিতর দিয়ে পথ চলছেন। পথের মধ্যে আবার সেই সওয়ার তার নয়রে পড়লো। নয়ীম ভালো করে দেখে চিনতে পারলেন তাকে। লোকটি নয়ীমের কাছে এসে ঘোড়া থামিয়ে বললো, আপনি এসেছেন খুব দ্রুত গতিতে। আমার ধারণা ছিলো, আপনি অনেক খানি পিছনেই পড়ে থাকবেন।

হ্যাঁ, আমি পথের মধ্যে তেমন আরাম করিনি।’

‘আপনিও কি তবে বসরায় যাচ্ছেন?

হ্যাঁ, সেদিন যদি তুমি খানিকক্ষণ ইনতেহার করতে, তাহলে সারাটা পথ। আমরা একত্রে সফর করতে পারতাম।’

‘আমার ধারণা ছিলো, আপনি কিছুটা আরামে সফর করবেন। …….চলুন, ঘোড়া আগে বাড়ান।

‘আমার মনে হয়, এসব রাস্তা তুমি বেশ ভালো করে চেন।

জি হ্যাঁ, এ দেশে আমি বহুদিন কাটিয়েছি।’

চলো, তাহলে তুমিই আগে চলো।

আগন্তক ঘোড়া আগে বাড়িয়ে দ্রুতগতিতে ছুটে চললো। নয়ীম চললো তার পিছু পিছু। খানিকক্ষন পর নয়ীম প্রশ্ন করলেন, “পরের চৌকি দেখা যাচ্ছে না কেন? আমরা পথ ভুলে আসিনিতত?

নয়ীমের সাথী ঘোড়া থামিয়ে পেরেশানির ভাব করে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলো। অবশেষে সে বললো, আমার তো তাই মনে হচ্ছে। আপনার কোন চিন্তা নেই। এই উপত্যকা পার হয়ে গেলেই আমরা ঠিক পথ খুঁজে পাবো।’ বলেই সে আবার ঘোড়া ছুটালো। আরো কয়েক ক্রোশ চলবার পর আগন্তক ঘোড়া থামিয়ে বললো, সম্ভবতঃ আমরা সঠিক পথ থেকে বহুদূরে একদিকে সরে এসেছি। আমার মনে হয়, এ পথ শিরাযের দিকে গেছে। আমাদেরকে এবার বাম দিকে মোড় ঘুরতে হবে। কিন্তু ঘোড়া বড়োই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। এখানে খানিক্ষন আরাম করলেই ভাল হবে। সবুজ শ্যামল গাছ-গাছড়া ভরা এলাকাটি এমন নয়নমুগ্ধকর যে, ক্লান্ত দেহ নিয়ে খানিকক্ষণ বিশ্রাম করার জন্য আগন্তুকের কথায় নয়ীম সায় দিলেন। ঘোড়া দু’টোকে এক ঝরণার পানি পান করিয়ে গাছের সাথে বেঁধে রেখে তারা বসে পড়রেন সবুজ ঘাসের বিছানার উপর।

আগন্তক তার থলে খুলতে খুলতে বললো, আপনার তো ক্ষিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই? আমি পিছনের চৌকিতে পেট পুরে খেয়ে নিয়েছি। সামান্য কিছুটা খানা হয়তো আপনারই জন্য বেঁচে গিয়েছিলো।

আগন্তুকের অনুরোধ, নয়ীম রুটি আর পনীরের কয়েটি টুকরো খেয়ে নিলেন। তারপর ঝরণার পানি পান করে ঘোড়ায় সওয়ার হতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু মস্তিষ্কে তীর ঘূর্ণন অনুভব করে শুয়ে পড়লেন ঘাসের উপর।

আমার মাথা ঘুরছে। তিনি আগন্তুককে লক্ষ্য করে বললেন।

আগন্তুক বললো, “আপনি খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। খানিক্ষণ আরাম করে নিন।’

‘না, দেরী হয়ে যাচ্ছে। আমাদের এখখুনি চলতে হবে।’বলে নয়ীম উঠলেন, কিন্তু কম্পিত পদে খানিকটা চলেই আবার বসে পড়লেন যমিনের উপর।

আগম্ভক তার দিকে তাকিয়ে ভয়ংকর অট্টহাসি করে উঠলো। নয়ীমের দীলের মধ্যে তখখুনি সন্দেহ হলো, লোকটা খানার মধ্যে কোন একটা মাদক দ্রব্য দিয়েছে তাঁকে। অমনি তাঁর মনে অনুভূতি জাগলো, তিনি এক ভয়ানক মুসীবতে গ্রেফতার হতে চলেছেন। তিনি আর একবার উঠতে চেষ্ট করলেন। কিন্তু তাঁর হাত-পা আড়ষ্ট হয়ে এসেছে। তার মস্তিস্কে ছেয়ে এসেছে গভীর নিদ্রার মাদকতা। অর্ধ-অচেতন অবস্থায় তিনি অনুভব করলেন, কয়েকটি লোক তার হাত-পা বাঁধছে। তাদের লৌহকঠিন বন্ধন থেকে মুক্ত হবার জন্য তিনি হাত-পা মারতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু তাঁর সকল চেষ্টা হলো নিল। তখন তিনি প্রায় বেঁহুশ। তিনি সামান্যমাত্ৰ অনুভব করেছিলেন যে, কয়েকটি লোক তাকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে আর কোথায়ও।

পরদিন তখন নয়ীমের হুঁশ হলো, তখন তিনি এক সংকীর্ণ কুঠুরীতে বন্দী। যে, অচেনা লোকটি তাকে প্রতারণা করে সেখানে এনেছে, সে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে হাসছে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে নয়ীম তার দিকে দৃষ্টিক্ষেপ করে প্রশ্ন করলেন, আমায় এখানে আনার পশ্চাতে তোমার কি উদ্দেশ্য? আমি কার কয়েদ খানায় বন্দী?

সময় এলেই এসব প্রশ্নের জওয়াব পাবে। অচেনা লোকটি বাইরে গিয়ে কুঠুরীর দরজা বন্ধ করে দিলো।

কয়েদখানায় নয়ীমের তিন মাস কেটে গেলো। তার অন্তরের হতাশা যেন কয়েদখানার ভয়ানক অন্ধকারকে আরও ভয়াবহ করে তুলেছে। আল্লাহ তার সবরের পরীক্ষা নিচ্ছেন, এইমাত্র তার সান্তনা। প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যায় এক ব্যক্তি এসে কয়েদখানার দেওয়ালের একটি ছোট ছিদ্রপথ দিয়ে খানা পৌঁছে দিয়ে চলে যায়।

নয়ীম কয়েকবার প্রশ্ন করেছেন, ‘আমায় কয়েদ করেছে কে? কি কারণে আমায় কয়েদ করলো?’

কিন্ত কোন প্রশ্নেরই জওয়াব মেলে না। তিন মাস এমনি করে কেটে যাবার পর একদিন ভোরে নয়ীম যখন আল্লার দরগায় সিজদা করে দোয়া করছেন, তখনই কুঠুরীর দরয়া খুলে সেই অচেনা লোকটি কয়েকজন সাথী নিয়ে এসে হাযির হলো। সে নয়ীমকে বললো, উঠে আমাদের সাথে এসো।

কোথায়?’ নয়ীম প্রশ্ন করলেন।

‘একজন তোমায় দেখতে চাচ্ছে। সে জওয়াবে বললো।

নয়ীম নাংগা তলোয়ারের পাহারায় চললেন তাদের সাথে সাথে।

কেল্লার এক সুদৃশ্য কামরায় ইরানী গালিচার উপর কয়েকটি নওজোয়ানের মাঝখানে এক বৃদ্ধ উপবিষ্ট। নয়ীম তাকে দেখেই চিনলেন। লোকটি ইবনে সাদেক।

সাত

ইবনে সাদেকের অতীত যিন্দেগী ক্রমাগত ব্যর্থতার এক দীর্ঘ কাহিনী। সে পয়দা হয়েছিলো জেরুজালেমের এক স্বচ্ছল ইহুদী পরিবারে। বুদ্ধিবৃত্তির বলে ষোল বছর বয়সে তার অসাধাণ দখল জন্মাল আরবী, ফারসী, ইউনানী ও ল্যাতিন ভাষায়। তার বয়স তখন আঠারো তখন সে প্রেমে পড়লো মরিয়ম নামে এক ঈসায়ী মেয়ের। মেয়েকে তার সাথে শাদী দিতে মরিয়মের বাপ-মাকে রাযী করতে গিয়ে সে হয়ে গেলো ঈসায়ী। কিন্তু মরিয়ম কিছুদিন তাঁর মন ভুলিয়ে প্রেমে পড়লো তারই চাচাতো ভাই ইলিয়াসের। তারপর থেকেই সে ঘৃণার চোখে দেখতে লাগলো ইবনে সাদেককে। বহু চেষ্টা করে ইবনে সাদেক শাদীর জন্য রাষী করালো মরিয়মের বাপ মাকে। কিন্তু মরিয়ম একদিন মওকা পেয়ে তার প্রেমিককে নিয়ে ফেরার হয়ে চলে গেলো দামেস্কের পথে। দামেস্কে গিয়ে তাদের শাদী হয়ে গেলো। মরিয়মের প্রেমে ও স্বভাবে মুগ্ধ ইলিয়াসও ইসায়ী মহাব এখতিয়ার করলো।

ইলিয়াস ছিলো এক দক্ষ রাজমিস্ত্রী। দামেস্কে তার প্রচুর আয়-রোযগারের পথ খুলে গেলো। সেখানে বাড়ি তৈরী করে তারা কাটাতে লাগলো তাদের যিন্দেগী। এক বছর পর তাদের ঘরে পয়দা হলো এক শিশু-কন্যা। তার নাম রাখা হলো জোলায়খা।

কঠিন সন্ধানের পর ইবনে সাদেক পেলো তাদের খোঁজ। সেও এসে হাযির হলো দামেস্কে। সেখানে তার মাশুক ও ভাইকে আয়েশ-আরামে যিন্দেগী কাটাতে দেখে তার দীলের মধ্যে জ্বলে উঠলো প্রতিহিংসার অগ্নিশিখা। কয়েকদিন সে ঘুরে বেড়ালো দামেস্কের অলিগলিতে। তাপর ইসলাম কবুল করে সে গিয়ে হাযির হলো দরবারে খিলাফতে। খলিফার কাছে মরিয়মকে দাবী করে সে আবেদন জানালো যে, তাকে ইলিয়াসের ঘর থেকে ছিনিয়ে এনে তার হাতে সপে দেওয়া হোক। দরবারে খিলাফত থেকে হুকুম হলো যে, ইহুদী ও ঈসায়ীরা মুসলমানদের আমানত। তাছাড়া মরিয়ম তার নিজের মর্যী মতো শাদী করেছে, তাই তাকে বাধ্য করা যাবে না। হতাশ ইবনে সাদেক এরপর না রইলো ইহুদী, না ঈসায়ী আর না মুসলমান। চারদিকের হতাশা তার দীলের মধ্যে ধুমায়িত করে তুললো প্রতিহিংসার অগ্নিজ্বালা!

দামেস্কে কিছুদিন ঘুরে ফিরে কাটিয়ে সে চলে গেলো কুফায়। হাজ্জাজ বিন ইউসুফকে সে তার অতীত কাহিনী শুনিয়ে তার কাছে পেশ করলো সাহায্যের আবেদন। হাজ্জাজ চুপ করে শুনলেন তার কাহিনী। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে ইবনে সাদেক সেই সুযোগে তার তারিফ করলো আর দরবারে খিলাফতের নিন্দা করে কয়েকটি কথা বলে ফেললো।

সে বললো, আপনি আমার দীলের কথা শুনতে চাইলে আমি বলবো, ব্যক্তিগত যোগ্যতার দিক দিয়ে আপনি হচ্ছেন খিলাফতের মসনদের সবচাইতে বড়ো হকদার।’ ইবনে সাদেক তার কথা শেষ করবার আগেই হাজ্জাজ এক সিপাহীকে আওয়ায দিয়ে ইবনে সাদেককে ধাক্কা মেরে শহরের বাইরে বের করে দেবার হুকুম জারী করলেন। তারপর ইবনে সাদেককে লক্ষ্য করে বললেন, তোমায় মৃত্যুদন্ড দেওয়াই উচিত ছিলো, কিন্তু মেহমান হয়ে তুমি এখানে এসেছে বলেই তোমায় আমি মাফ করে দিচ্ছি।’

ইবনে সাদেক সন্ধ্যাবেলায় শহর থেকে বেরুলো। রাতটা এক পাদরীর ঝুপড়িতে কাটিয়ে ভোরবেলা এক ভয়ানক চক্রান্ত মাথায় নিয়ে সে ধরলো জেরুজালেমের পথ। জেরুজালেমেও সে থাকতে পালো না বেশী সময়। তার ভাই ও তার মাশুকই নয়, গোটা দুনিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিহিংসার মনোভাব নিয়ে সে ঘুরে বেড়াতে লাগলো দেশ দেশান্তরে। শেষ পর্যন্ত সে গড়ে তুললো দুবৃত্তদের এক ভয়ানক জামাত এবং এক কঠিন ষড়যন্ত্রের সংকল্প নিয়ে তাদেরকে ছড়িয়ে দিলো তামাম দেশে দেশে। সে হলো সেই ছোটখাটো জামাতের আত্মিক ও রাজনৈতিক নেতা। একদিন সে তার চাচাতো ভাইর উপর প্রতিহিংসাবৃত্তি চরিতার্থ করবার মওকা পেয়ে গেলো। তার একমাত্র কন্যা জোলায়খাকে সে চুরি করে নিয়ে গেলো। জোলায়খার বয়স তখন আট বছর। ইবনে সাদেক তাকে নিয়ে পালালো ইরানের দিকে। মাদায়েনে তার জামাতের ইসহাক নামে একটি লোকের হাতে তাকে সোপর্দ করে দিয়ে সে আবার লেগে গেলো তার ধ্বংসাত্মক সংকল্প হাসিল করবার কাজে। দু’মাস পরে তার দলের গোপন কর্মীরা হত্যা করলো ইলিয়াস ও মরিয়মকে। এই নৃশংস হত্যার পরও সে নিরস্ত হলো না। ইবনে সাদেকের বাকী যিন্দেগী তামাম দুনিয়ার জন্য হয়ে উঠলো ভয়াবহ। আলমে ইসলামের রাজনৈতিক আধিপত্য হাসিল করার জন্য সে লিপ্ত হলো হুকুমাতের বিরুদ্ধে কঠোর ষড়যন্ত্রে। খারেজী ও ইসলামের দুশমনদের ভিতর থেকে কতক লোক তাকে পূর্ণ সমর্থন করলো, কিন্তু তখনো তাদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে আর্থিক অসুবিধা। হঠাৎ তার মাথায় এলো এক নতুন ধারণা। সে কয়েক মাসের সফর কয়েক হফতায় শেষ করে গিয়ে হাযির হলো রোমের সীজারের দরবারে।

সীজার যদিও পূর্বদিকে তার হারানো অধিপত্য নতুন করে হাসিল করবার ইচ্ছা করতেন, কিন্তু তার দীল থেকে পূর্বপুরুষদের শোচনীয় পরাজয়ের স্মৃতি তখনো মুছে যায়নি। তিনি খোলাখুলি ইবনে সাদেকের সাথে যোগ দিতে সাহস করলেন না, কিন্তু মুসলমানদের এই নিশ্চিত দুশমনকে উৎসাহিত করাও তিনি জরুরী মনে করলেন। ইবনে সাদেককে তিনি বললেন, “আমি তোমাদের সব দিক দিয়ে সাহায্য করৰাে, কিন্তু যতদিন মুসলমানরা এক হয়ে থাকবে, ততদিন তাদের উপর হামলা করা আমরা অবিবেচনার কাজ বলে মনে করি। তোমরা ফিরে গিয়ে তোমাদের কাজ চালিয়ে যাও। তোমাদের কাজের দিকে আমার নযর থাকবে।’

ইবনে সাদেক সেখানে থেকে ফিরে এলো বহু দামী সোনা, চাঁদি ও জওয়াহেরাত তোহফা নিয়ে। বসূরার এক অজ্ঞাত এলাকায় ঘাটি করে সে শুরু করলো ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ। হাজ্জাজের ভয়ে সে কয়েক বছর তার ধারণা প্রকাশ্যে ঘোষণা করবার সাহসও করলো না। সে তার কার্যকলাপ তার নযর থেকে পুশিদা রেখে পুরোপরি হুঁশিয়ার হয়ে চলতে লাগলো। কয়েক বছরের প্রাণপণ চেষ্টাও মেহনতের ফলে এক হাজার লোক এসে তার দলে বিড়লো। তাদের মধ্যে বেশির ভাগকেই সে খরিদ করলো সোনা চাদির বিনিময়ে। সীজারকে সে তার কার্যকলাপ সম্পর্কে অবহিত রেখে প্রয়োজনমতো তার কাছ থেকে সাহায্য পেতে লাগলো। যখন সে বুঝলো যে, তার জামা’আত বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠেছে এবং কুফা ও বসরার বেশীর ভাগ লোক হাজ্জাজ বিন ইউসুফের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করছে, তখন সে তৈরী হলো তার প্রতিদ্বন্দ্বীর উপর শেষ আঘাত হানবার জন্যে। একদিন তার গুপ্তচর এসে তাকে খবর দিলো যে, সেদিন হাজ্জাজ কুফায় চলে গেছেন এবং ইবনে আমের ফউজ সংগ্রহের জন্য এক বক্তৃতা করবেন। সে আরো জানালো যে, বসরার বেশির ভাগ লোক ফউজে ভর্তি হতে নারায। ইবনে সাদেক চাইলো পরিস্থিতির সুযোগ নিতে এবং প্রথমবার সে তার আড়া থেকে বেরিয়ে এসে বসরার লোকদের আম জলসায় শরীক হবার সাহস করলো। তার মনে আস্থা ছিলো যে, বসরার অসন্তোষ-প্রবণ লোকদের সে তার কথার যাদুতে প্রভাবিত করতে পারবে, কিন্তু তার ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। নয়ীম আচানক বেরিয়ে এসে তার সাজানো কৌশলজাল ছিন্নভিন্ন করে ফেললেন।

ইবনে সাদেক বসরা থেকে পালিয়ে বাঁচলো এবং রমলায় খলিফার ভাই সুলায়মানের কাছে আশ্রয় নিলো। এক হাজারের জামাআত থেকে মাত্র কয়েকটি লোক গেলো তার সাথে।

সুলায়মানকে ওয়ালীআহাদের পদ থেকে বঞ্চিত করবার ব্যাপারে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ছিলেন খলীফার সমর্থক। তাই হাজ্জাজ ও তাঁর সাথীদের সুলায়মান মনে করতেন নিকৃষ্টতম দুশমন! হাজ্জাজের দুশমনদের তিনি গ্রহণ করতেন দোস্ত বলে। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ইবনে সাদেকের চক্রান্তের খবর পেয়েই তার পিছনে লাগিয়ে রেখেছিলেন একদল সিপাহী। রমলায় সুলায়মান তাকে আশ্রয় দিয়েছেন জেনেই তিনি সব অবস্থা জানালেন খলিফাঁকে। দরবারে খিলাফত থেকে সুলায়মানের কাছে হুকুম এলো, তক্ষুণি সাথীদের সহ ইবনে সাদেককে শিকল পরিয়ে পাঠাতে হবে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের কাছে। সুলায়মান ইবনে সাদেককে বন্ধু হিসাবে গ্রহন করেছেন এবং তার জান বাঁচাতে চান, তাই তিনি ইবনে সাদেককে ইসফাহানের দিকে সরিয়ে দিয়ে খলিফার দরবারে লিখে পাঠালেন যে, ইবনে সাদেক রমলা থেকে পালিয়ে গেছে। কয়েকদিন ইসফাহানে ঘুরে ফিরে ইবনে সাদেক ধরলো শীরাযের পথ। শীরায থেকে পঞ্চাশ ক্রোশ দক্ষিণ পূর্বে পাহাড়ের মাঝখানে পুরানো যামানার এক বিরাম কেল্লা। ইবনে সাদেক সেই কেল্লায় গিয়ে ফেললো স্বস্তির নিশ্বাস। তার সকল বিপদের দায়িত্ব নয়ীমের উপর চাপিয়ে সে তাঁকে এক অপমানকর শাস্তি দেবার কৌশল চিন্তা করতে লাগলো।

*

নয়ীম ইবনে সাদেকর সামনে নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। এক সিপাহী তাকে আচানক ধাক্কা মেরে উপুড় করে ফেলে দিয়ে বললো, “বেকুফ! এটা বসরার মসজিদ নয়। এ মুহূর্তে তুমি দাঁড়িয়ে আছ আমাদের আমীরের দরবারে। এখানে অপরাধীর মাথা কেটে ফেলা হয়।

ইবনে সাদেক ক্রোধ প্রকাশ করে বললো, ভারী বেকুফ তুমি। বাহাদুর লোকদের সাথে এমন ব্যবহার করে না কখনো।

এই কথা বলে ইবনে সাদেক আসন ছেড়ে উঠে বায়ুর সাহায্যে তাঁকে দাঁড় করিয়ে দিলো। মেঝের উপর পড়ে নয়ীমের নাক বেয়ে রক্ত ঝরছে তখন। ইবনে সাদেক নিজের রুমাল বের করে তাঁর মুখ মুছিয়ে দিলো।

তারপর তার দিকে বিদ্রূপভরা হাসিমুখে তাকিয়ে বললো, আমি শুনেছি, আপনি নাকি নেহায়েত বেকারার হয়ে আপনার মেযবানের নাম জানতে চেয়েছেন। আফসোস! আপনাকে দীর্ঘ সময় ইনতেযার করতে হয়েছে। আমারও ইচ্ছা ছিলো, খুব জলদী করে আপনার দেখতে হাযির হয়ে যিয়ারত করি, কিন্তু ফুরসত পাইনি। আজ আপনাকে দেখে আমার দীলে কি আনন্দ হয়েছে, তা আমিই জানি। আমি আশা করি, আপনিও পুরানো দোস্তের সাথে মিলিত হয়ে বহুত খুশী হয়ে থাকবেন। বলুন, তবিয়ত কেমন? আপনার মুখের রঙ কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। আমার ধারণা, এই কুঠরীর সংকীর্ণতা ও অন্ধকারে আপনার মতো মুজাহিদের তবিয়ত খুবই পেরেশান হয়ে উঠেছে। কিন্তু আপনি হয়তো জানেন না, এ ছোট-খাটো কেল্লায় কোনো বড়ো কুঠরী নেই। তাই আমার লোকেরা বাধ্য হয়ে ওখানেই রেখেছে আপনাকে। আজ আমি আপনাকে কিছুক্ষণের জন্য এই কারণেই বাইরে আনিয়েছি, যাতে আলো অন্ধকারের পার্থক্য করবার ক্ষমতা আপনি হারিয়ে না ফেলেন। কিন্তু আপনি আমার দিকে এমন করে তাকাচ্ছেন, যেনো আমি আপনার অজানা তোক। আপনি আমায় চিনতে পারছেন না? আপনার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিলো বসরায়। যদিও আমাদের পয়লা মোলাকাত নেহায়েত অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির মধ্যে হয়েছে,তবু সেদিন থেকে আমাদের সম্পর্ক এমন নয় যে, আমরা এত শিগগিরই তা ভুলে যেতে পারি। বড় মুশকিলের ভিতর দিয়ে আমি আপনার সে বক্তৃতার তারিফ জানাবার এ মওকা পেয়েছি এবং আপনার মতো আত্মমর্যাদাবান মুজাহিদকে আব্দুল্লাহ বিন উবাইর উত্তারাধিকারীর সামনে এমনি করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমার মনে জাগছে বহুত রহম। বলুন আপনার সাতে কিরূপ ব্যবহার করা যাবে? •

ইবনে সাদেকের প্রতিটি কথা নয়ীমের দীলের উপর বিধছে তীর ও ছুরির ফলার মতো। তিনি ঠোঁট কামড়ে বললেন, কয়েদ হবার জন্য আমার কোন দুঃখ নেই, কিন্ত তোমার মতো বুদীল ও কমিনার হাতে কয়েদ হয়েছি বলেই আমার যা দুঃখ। এখন তোমার মন যা চায়, তাই করো। কিন্তু মনে রেখো, আমার জিন্দেগী আর মওত দুই-ই তোমার জন্য বিপজ্জনক। এই মুহূর্তে আমার হাত শিকল বাঁধা, কিন্তু মনে রেখো, বন্দীদশা মুজাহিদকে বুদীল বানাতে পারেনা কখখনো!’

ইবনে সাদেক নয়ীমের শক্ত কথাগুলো শুনে বেপরোয়া মনেভাব প্রকাশ করে বললো, তুমি যেমন বাহাদুর, তেমনি বেকুফও। তুমি জানো না যে, এই মুহূর্তে তোমার মাথা রয়েছে এক আজদাহার মুখের মধ্যে। তোমার গ্রাস করা অথবা ছেড়ে দেওয়া নির্ভর করছে তারই মরীর উপর। আমার কয়েদখানা থেকে আযাদ হবার ধারণা দূর করে দাও দীল থেকে। এ কেল্লায় দু’শ সিপাহী প্রতিমূহূর্তে নাংগা তলোয়ার নিয়ে মওজুদ রয়েছে তোমার খোঁজখবর রাখবার জন্য।

এই কথা বলে ইবনে সাদেক হাততালি দিলো। অমনি কেল্লা বিভিন্ন কোণ থেকে বেরিয়ে এলো কতক সিপাহী নাংগা তলোয়ার হাতে। নয়ীমের চোখে তাদের প্রত্যেকেরই মুখ ইনে সাদেকের মতো নির্মম-নিষ্ঠুর।

নয়ীম বললেন, তুমি জানো, আমি বুযদীল নই। তোমরা কাছে আমি কখনও রহমের আবেদন করবো না। তুমি যদি আমার জান নিতে চাও, তার জন্য আমি তৈরী।’

ইবনে সাদেক বললো, তুমি মনে কর, দুনিয়ার সবচাইতে বড় শাস্তি মওত; কিন্ত আমি তোমার কাছে প্রমাণ করে দিতে চাই যে, দুনিয়ায় আরো বহুত শাস্তি রয়েছে, যা মওতের চাইতেও ভয়ানক। এমন শাস্তি আমি তোমায় দিতে পারি, যা, বরদাশত করবার মতো হিম্মৎ তোমার হবে না। তোমার যিন্দেগী আমি এমন তিক্ত করে তুলতে পারি যে, তোমার জীবনের প্রতি মূহূর্তে মওতের চাইতেও অন্ধকার হয়ে দেখা দেবে। কিন্তু আমি তোমার দুশমন নই। তুমি যিন্দা থাক, এই আমি চাই। আমি তোমায় এমন এক যিন্দেগীর পথ বলে দিতে পারি, যা তোমার পরলোকের কল্পনার চাইতেও সুন্দর। যুদ্ধের বিপদ-মুসীবৎকে তুমি বরদাশত করে যাও, কেননা যিন্দেগীর আয়েশ-আরাম তোমার জানা নেই। জীবন উপভোগের স্বাদ পাওনি বলেই এমন আপন-ভোলা তুমি। দুনিয়ায় কয়েক বছরের যিন্দেগী খোদা তোমায় দিয়েছেন দুনিয়ার অসংখ্য নিয়ামত ভোগ করবার জন্য। তার কদর ও কীমৎ তোমার জানা নেই। তুমি বাহাদুর সত্যি, কিন্ত তোমার বাহাদুরী তোমায় কি শিখিয়েছে? তোমায় এমন সব লক্ষ্যের পথে জান দিতে শিখিয়েছে, যার সাথে তোমার ব্যক্তিত্বের কোনো সম্পর্ক নেই। তোমার ধারণা, তুমি খোদার. রাহে কোরবান হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তোমার এ কোরবানীতে খোদার কোন প্রয়োজন নেই। তোমার কোরবানী থেকে যদি কারুর কোনো ফায়দা হাসিল হয় তা হয়ে থাকে খলিফা ও হাজ্জাজের-যারা ঘরে বসে বসে বিজয়ের খ্যাতি হাসিল করে থাকেন। তোমরা আত্মপ্রতারণা করে চলেছো। তোমার যৌবনদীপ্তি, চেহারা ও রূপ দেখে মনে হয় খাক ও খুনের মধ্যে লুটিয়ে পড়বার জন্য তৈরী হয়নি ও দেহ। তোমায় দেখলে মনে হয় এক শাহজাদা। তুমি রক্ত পিপাসু নেকড়ের জীবন যাপন করবে, এটাতো হতে পারে না। শাহাজাদার মতো যিন্দেগীই তোমায় মানায়। তুমি হবে এক সুন্দরী শাহজাদীর চোখের আলো, দীলের শান্তি। তোমার যিন্দেগীকে তুমি করে তুলতে পার এক রঙীন স্বপ্নে মতো সুন্দর মোহময়। তুমি ইচ্ছা করলে কঠিন মাটি, রুক্ষ পাথর আর পাহাড়ের শয্যার পরিবর্তে পেতে পার ফুল শেজ। দুনিয়ার অসংখ্য আয়েশ-আরাম দৌলতের বিনিময়ে খরিদ করা যায়। ইচ্ছা করলে দুনিয়ার ধানভান্ডার তুমি আপনার করে নিতে পার, দুনিয়ার সবচাইতে সুন্দরী নারীকে করে নিতে পার তোমার শয্যাসংগীনী। কিন্ত সে পথ তোমার কাছে অজানা। সুন্দরী নারীর কেশের খোশবুতে মাতাল হয়ে বেঁচে থাকতে তুমি শেখোনি। দুনিয়ার আড়ম্বর দেখনি বলেই আত্মভোলা হয়ে খুশী হচ্ছো তুমি।

নওজোয়ান! তোমার জন্য বহুত কিছু করতে পারি আমি। আহা! তুমি যদি আমার সহকর্মী হতে! আমরা বনু উম্মিয়ার হুকুমাত খতম করে দিয়ে কায়েম করবো এক নয়া বিধান। আমার ইকিন রয়েছে যে, খলিফা ও হাজ্জাজের ক্ষমতা গর্বিত মস্তক ভূতলশায়ী করবার চেষ্টায় আমি কামিয়াব হবো। তোমার হয়তো মনে পড়ে, আমি সেই ইবনে সাদেক, বসরার আম জলসায় তুমি যার মোকাবিলা করেছিলো, কিন্তু আমি তোমায় নিশ্চিত বলে দিচ্ছি যাতে কমযোর তুমি আমায় ভেবেছো, আমি তা নই। এইটুকু জেনে রাখাই তোমার পক্ষে যথেষ্ট হবে যে, আমার পিছনে রোমের সীজারের মতো লোকও মওজুদ রয়েছেন। আরব ও আজমে এক যবরদস্ত ইনকিলাব পদয়া করবার জন্য আমি শুধু সময়ের প্রতীক্ষা করছি। বহুদিন ধরে তোমার মতো কথার যাদুকরের সন্ধান করে ফিরেছি আমি। তোমায় আমি দেখাতে চাই সেই কর্মের ময়দান। সেখানে তুমি খোদার দেওয়া শৌর্য-বীর্য পূর্ণ প্রয়োগ করতে পারবে। তোমার মতো নওজোয়ান মামুলী সিপাহী হিসাবে খুশী হয়ে না থেকে হবে খিলাফতের দাবীদার।’

নয়ীমকে নির্বাক হয়ে থাকতে দেখে ইবনে সাদেক ভাবলো যে, তিনি তার প্রতারণাজালের মধ্যে এসে গেছেন। তাই গলার আওয়াটা খানিকটা নরম করে সে বললো, আমার সাথে যদি তুমি বিশ্বস্ত থাকবার প্রক্রিতি দাও, তাহলে আমি তোমার শিকল এখনই খুলিয়ে দিচ্ছি। বলল, তোমার ইরাদা কি? তোমার সামনে যিন্দেগীর পথ দুটো। বলল, তুমি যিন্দেগীর নিয়ামত পূর্ণরূপে করতে চাও, না এই অন্ধকার কুঠরীতে তোমার যিন্দেগীর বাকী দিনগুলো কাটিয়ে দিতে চাও এমনি করে?

নয়ীম গর্দান উপরে তুললেন। তাঁর মুখে তখন অন্তরের অপরিসীম যাতনার অসাধারণ বহিঃপ্রকাশ দেখা যাচ্ছে। তিনি জোশের সাথে জওয়াব দিলেন, তোমার কথা আমার কাছে যখমী কুত্তার চীৎকারের চাইতে বেশি কোনো অর্থ রাখে না। তুমি জানো না, আমি যার গোলাম, তিনি যমিনের অণু থেকে শুরু করে আসমানের সিতারা পর্যন্তের মালিক হয়েও তিনদিন পেটে পাথর বেঁধে রয়েছেন। তুমি আমায় দৌলতের মোহে প্রলুব্ধ করতে চাও? দুনিয়ার তামাম আরামেরই নাম যিন্দেগী। কিন্তু তলোয়ারের ছায়ায় আযাদীর শ্বাস গ্রহণ করে যে আয়েশ-আরাম পাওয়া যায়, তা তোমার মতো নীচ মানুষের কল্পনারও বহু উর্দ্ধে। আমায় তুমি খোদার রাস্তা থেকে সরিয়ে নিজস্ব জঘন্য উদ্দেশ্য হাসিল করবার সহকর্মী বানাতে চাও। তুমি জিহাদের বিরোধিতা কর, কিন্তু নিজের ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যর জন্য রক্তের নদী বইয়ে দিতে তোমার দ্বিধা নেই। যে সীজারের শক্তির উপর ভরসা তোমার, তার পূর্বপুরুষ কততবার আমাদের তলোয়ারের শক্তি পরীক্ষা করে দেখেছেন। এই মুহূর্তে আমি নিঃসন্দেহে তোমার হাতে রয়েছি, কিন্তু কয়েদ অথবা মৃত্যুর ভয় আমায় অচেতন বিবেকহীন করতে পারবে না কখনো। মুজাহিদদের যোগ্য নয়, এমন কোনো কাজের প্রত্যাশা তুমি করো না আমার কাছে।’

ইবনে সাদেক কিছুটা দমে গিয়ে বললো, কয়েকদিনের মধ্যেই তুমি এমন সব কাজ করতে রাযী হবে, যা দেখে শয়তানও শরম পাবে।’

এই কথা বলে সে তার চারপাশে বসা লোকদের দিকে তাকালো এবং ইসহাক নাম ধরে এক ব্যক্তিকে ডাকলো। যে সুগঠিত দেহ জোয়ান তাকে প্রতারণা করে গ্রেফতার করেছে, আওযায় শুনে সেই লোকটিই এগিয়ে এলো সামনে। নয়ীম প্রথমবার জানলেন যে, লোকটির নাম ইসহাক!

ইবনে সাদেক বললেন, ইসহাক! এর মাথাটা ঠিক করে দাও।’

ইবনে সাদেকের হুকুমে নয়ীমকে আঙিনায় এক খুটির সাথে বাঁধা হলো। লোকটি এগিয়ে গিয়ে নয়ীমের গায়ের জামা ছিঁড়ে ফেললো। তারপর সে এক রক্তপিপাসু নেকড়ের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে কোড়া বর্ষণ করতে লাগলো নয়ীমের উলংগদেহের উপর। নয়ীম কোনো আওয়ায না করে মযবুত পাহাড়ের মত দাঁড়িয়ে কোড়া খেতে লাগলেন। সামনের কামরা থেকে চুপি চুপি কদম ফে েএক বালিকা ধীরে ধীরে এসে দাঁড়ালো ইবনে সাদেকের কাছে। সে কখনো বেকারার হয়ে তাকাঁচ্ছে নয়ীমের দিকে, আবার কখনো অনুনয়-ভরা দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে ইবনে সাদেকের দিকে। তার নাযুকদীল আর বরদাশত করতে পারছে না এ নিষ্ঠুর খেলা। অশ্রুভরা চোখে সে ইবনে সাদেকের দিকে তাকিয়ে বললো, চাচা লোকটি বেঁহুশ হয়ে যাচ্ছে।

হতে-দাও। ও যে সায়ফুল্লাহ। আমি ওর তেযী খতম করে তবে ছাড়বো।

‘চাচা!’

ইবনে সাদেক বিরক্ত হয়ে বললো, “চুপ করো জোলায়খা। এখানে কি চাও? যাও।’

জোলায়খা মাথা নীচু করে ফিরে গেলো। দু’একবার সে ফিরে তাকালো নয়ীমের দিকে। নিজের অক্ষমতা ও অসহায়তা মুখভংগীতে প্রকাশ করে সে অদৃশ্য হয়ে গেলো এক কামরার মধ্যে। আঘাতের তীব্রতায় বেঁহুশ হয়ে নয়ীমের গর্দান যখন ঢিলা হয়ে পড়লো, তখন তাকে আবার ফেলে রাখা হলো কয়েদখানায়।

নয়ীমকে কয়েকবার বাইরে নিয়ে কোড়া মারা হলো। তাতেও যখন তাঁর মনোভারের পরিবর্তন দেখা গেলো না, তখন ইবনে সাদেক হুকুম দিলো যে, কয়েকদিন তাকে ভুখা রাখতে হবে। নানা রকম শারীরিক কষ্ট সহ্য করার পর নয়ীমের ভিতরে পয়দা হলো এক অসাধারণ সহনশক্তি। তিনি ক্ষুধা ও পিপাসায় যখন রাতের বেলায় ঘুমোবার ব্যর্থ চেষ্টা করছেন, তখন কে যেন কুঠরীর ছিদ্রপথ দিয়ে আওয়ায দিয়ে ভিতরে ফেলে দিলো কয়েকটি সেব ও আঙ্গুরফল।

নয়ীম হয়রান হয়ে উঠে ছিদ্রপথ দিয়ে বাইরে উঁকি মেরে দেখলেন। রাতের অন্ধকারে দেখা গেল কে যেন কয়েক কদম দূর গিয়ে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। তার লেবাস ও চলার ধরণ দেখে তিনি আন্দায করলেন, কোনো নারী রাতের অন্ধকারে গা-ঢাকা দিয়ে চলে যাচ্ছে। দরদী মেয়েটিকে চিনে নিতে তার মুশকিল ছিলো না মোটেই। কোড়ার ঘা খেতে গিয়ে কতোবার তিনি দেখেছেন এক যুবতাঁকে তার জন্য বেকারার হতে। তার নিষ্পাপ সুন্দর মুখের উপর যুলুম ও অসহায়তার চিহ্ন অংকিত হয়ে গেছে নয়ীমের দীলের ফলকে। কিন্তু কি তার পরিচয়? এ ভায়ানক জায়গায় কি করে সে এলো? নয়ীম এ সব প্রশ্ন নিয়ে চিন্তা করতে করতে একটি সেব তুলে নিয়ে খেতে লাগলেন।

নয়ীমের জন্য এতটা বেদনা-বোধ যে মেয়েটির, তার নাম জোলায়খা। জীবনের ষোলোটি বছর অন্তহীন মুসীবতের ভিতর দিয়ে কাটিয়েও সে ছিলো দৈহিক সৌন্দর্যের এক পরিপূর্ণ প্রতীক। প্রতিটি মানুষের প্রতি অন্তহীন বিদ্বেষ পোষণ করতে জোলায়খা। ইবনে সাদেকের সাহচর্যে সে কাটিয়েছে তার যিন্দেগীর তিক্ত মুহূর্তগুলো এবং হামেশা মানবতার নিকৃষ্ট রূপই রয়েছে তার চোখের সামনে। তাই প্রত্যেকটি মানুষই তার দৃষ্টিতে ছিলো ইবনে সাদেকের মত ধূর্ত, স্বার্থপর, নিষ্ঠুর কমিনা। শিকল-বাঁধা নয়ীমকে কেল্লায় আনতে দেখে প্রথমে তার মনে হয়েছে, একটি স্বার্থপর মানুষ একদল স্বার্থপর মানুষের কব্যয় এসে গেছে, কিন্ত নয়ীমকে ইবনে সাদেকের সাথী হতে অস্বীকার করতে দেখে তার পুরোনো খেয়াল বদলে গেছে। তার মনের হচ্ছে, যে দুনিয়ায় সে কাটিয়ে দিয়েছে তার যিন্দেগীর বৈচিত্রহীন দিন আর ভয়ানক রাতগুলো, সে দুনিয়ার বাসিন্দা নয় এ নওজোয়ান। তাঁর ঈমান আর তে দেখে সে হয়রান হয়ে গেছে। গোড়ার দিকে সে তাকে মনে করতো মযলুম-কৃপার পাত্র, কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি তাঁর কাছে হয়ে উঠেছেন অন্তহীন শ্রদ্ধার দাবীদার।

বাপ-মায়ে মর্মান্তিক পরিণতির খবর জোলায়খা জানতো না তাদের সাথে মিলিত হবার কামনা জানিয়ে সে হয়ে গেছে হতাশ। তার কাছে দুনিয়া এক অবাস্তব স্বপ্ন আর পরকাল একটি নিছক কল্পনা।

ইবনে সাদেকের নির্মমতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের তুফান বারংবার তার আহত দীলকে তোলপাড় করে প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছে। দরিয়ার বুকে ভাসমান মনযিল হারা মাল্লার মতো ঢেউয়ের আঘাতে মুহ্যমান সে হয়েছে সাঁতরে পার হবার বা ডুবে যাবার সম্ভাবনা সম্পর্কে বেপরোয়া এবং চোখ বন্ধ করে মুসীবতের তুফানের উপর দিয়ে সে ভাসিয়ে দিয়েছে। তার জীবন-তরী কোনো বিপদের পরোয়া না করে। কখনো কখনো চোখ খুলে হাল সামলাবার খেয়াল তার আসে, কিন্তু আবার হতাশা তাকে করে অভিভূত। এই ঘরছাড়া মাল্লাকে উপকূল বা মনযিলের নির্দেশ দেবার মতো দিশারীর ছিলো প্রয়োজন, আর প্রকৃতি সে ভার চাপিয়ে দিয়েছিলো নয়ীমের উপর। নয়ীমের সাথে মামুলী সম্পর্ক জোলায়খার দীলের ঘুমন্ত তুফানকে করে তুললো উত্তাল এবং ইবনে সাদেকের পাঞ্জা থেকে রেহাই পেয়ে নয়ীমের দুনিয়ায় স্বস্তির নিশ্বাস ফেলবার আকাংখা তার দীলকে করে তুললো চঞ্চল।

জোলায়খা প্রতি রাত্রে কোনো না কোনো সময়ে আসে এবং খানাপিনার ব্যবস্থা ছাড়াও নয়ীমের অন্ধকার কুঠরীতে রেখে যায় খানিকটা আশার কিরণ।

চারদিন পর আবার নয়ীমকে হাযির করা হলো ইবনে সাদেকের সামনে। ইবনে সাদেক তার শারীরিক অবস্থায় বিশেষ কোনো পরিবর্তন না দেখে হয়রান হয়ে বললো, ‘তোমার জান বড্ড শক্ত। হয়তো খোদার মনযুর, তুমি যিন্দাহ থাকবে। কিন্তু তুমি নিজ হাতে নিজের মওত খরিদ করছে। আমি এখনো তোমায় চিন্তা করবার মওকা দিচ্ছি। আমার একিন রয়েছে যে, তোমার ভাগ্যের সিতারা খুবই বুলন্দ। কোনো বড় কর্তব্য সাধনের জন্যই পয়দা হয়েছো তুমি। আমি তোমায় সেই উচ্চস্তরে পৌঁছাবার ওয়াদা করছি, যেখানে তোমার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী থাকবে না তামাম ইসলামী দুনিয়ায়। আমি তোমার দিকে প্রসারিত করছি দোস্তির হাত আর এই-ই হচ্ছে শেষ মওকা। এখনো তুমি আমার আন্তরিকতাকে উপেক্ষা করলে পস্তাবে শেষ পর্যন্ত।

নয়ীম বললো, ইতর কুত্তা কোথাকার! আমায় বারংবার কেন বিরক্ত করছো?

‘এ ইতর কত্তার কামড় কখনো সুখের হবে না। তোমায় কামড়ে দেবা জন্য এ ইতর কুত্তার মুখ খুলবার সময় হয়েছে এখন। অপরিণামদর্শী যুবক! একবার চোখ খুলে দেখে নাও, দুনিয়া কতো সুন্দর। চেয়ে দেখো, পাহাড়ের দৃশ্য কতো মুগ্ধকর। যে সক:জিনিস দেখবার ইচ্ছা জাগে, আজই ভাল করে দেখে নাও + দীলের উপর সব কিছুর ছবি ভাল করে এঁকে নাও। কাল সূর্যোদয়ের আগেই উপড়ে ফেলা হবে তোমার চোখ। আর ও কান দুটো দিয়েও আর কিছু শুনতে পাবে না কখনো। যা কিছু দেখতে চাও, আজই দেখে নাও; যা কিছু শুনতে চাও, শুনে নাও।’ বলে সে সিপাহীদের হুকুম দিলো এবং তারা নয়ীমকে খুঁটির সাথে বেঁধে দিলো।

“হ্যাঁ, এবার বলো, চোখের দৃষ্টি থেকে বঞ্চিত হবার আগে কোন জিনিস তুমি দেখতে চাও।’

নয়ীম নীরব রইলেন।

ইবনে সাদেক বললো, তুমি জান,আমার ফয়সালা অটল। আজ সারাদিন তোমার এখানেই কাটিয়ে দেবার ব্যবস্থা হবে। এই সময়টার ফায়দা নিয়ে নাও। যা কিছু আসবে তোমার সামনে, ভালো করে দেখে নাও, আর যে সুর ঝংকার বাজবে তোমার সামনে, প্রাণ ভরে শুনে নাও।’

ইবনে সাদেক হাততালি দিলো। অমনি কয়েকটি লোক সেখানে এসে হাজির হোল বাদ্য বাজনার নানা রকম সরঞ্জাম নিয়ে। ইবনে সাদেকের ইশারায় তারা বসে গেলো একদিকে।

আস্তে আস্তে সুর-ঝংকার বুলন্দ হতে লাগলো। এর পর বহু বিচিত্র বর্ণের লেবাসে সজ্জিত কয়েকটি নারী এককোণ থেকে বেরিয়ে এসে নাচতে শুরু করলো নয়ীমের সামনে। নয়ীমের ন্যর তখন নীচে তার পায়ের দিকে। তার কল্পনা তখন তাঁকে নিয়ে গেছে বহুক্রোশ দূরে এক বস্তির পথে।

মজলিস বসরার পর কয়েক মূহুর্ত চলে গেছে। হঠাৎ কয়েকটি দ্রুতগামী ঘোড়ার পায়ের আওয়াযে মজলিসে হাজির লোকেরা চমকে উঠলো। ইবনে সাদেক উঠে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো; ইসহাক পৌঁছে গেছে বলে খবর দিলো এক হাবশী গোলাম।

ইবনে সাদেক নয়ীমকে লক্ষ্য করে বললো, নওজোয়ান, হয়তো তুমি এখন খুব আনন্দের একটি খবর শুনবে।’

খানিকক্ষণ পর ইসহাক এক তশতরী হাতে নিয়ে ভিতরে ঢুকে সসম্ভ্রমে ইবনে সাদেকের সামনে রাখলো। ইবনে সাদেক উপরের রুমালখানা তুললে নয়ীম দেখলেন, তাতে একটি মানুষের মস্তক।

হয়তো এটি দেখে তুমি খুশী হবে। বলে ইবনে সাদেক এক হাবশীকে ইশারা করলো। হাবশী তশতরী তুলে নয়ীমের কাছে নিয়ে রাখলো যমিনের উপর। তশতরীতে রাখা মস্তকটি চিনতে পেরে নয়ীমের দীলে লাগলো এক প্রচন্ড আঘাত। ইবনে আমেরের মস্তক! শুকিয়ে যাওয়া মুখের উপর তখনো খেলছে এক অপূর্ব হাসির রেখা। নয়ীম অশ্রুসজল চোখ দুটি বন্ধ করলেন। জোলায়খ ইবনে সাদেকের পিছনে দাঁড়িয়ে দেখছে মর্মবিদারক দৃশ্য! ধৈর্য ও মহিমার প্রতিমূর্তি নয়ীমের চোখে অশ্রুধারা দেখে তার কলজে ফেটে যাচ্ছে।

ইবনে সাদেক আসন ছেড়ে উঠলো। ইসহাকের কাছে গিয়ে পিঠ চাপড়ে দিয়ে সে বললো, ইসহাক! এখন আর একটিমাত্র শর্ত বাকী। আমি চাই মুহম্মদ বিন কাসিমের মস্তক এই নওজোয়ানের সাথে দাফন করতে। যদি সে অভিযানে কামিয়াব হয়ে ফিরে আসতে পার তুমি, তাহলে জোলায়খা হবে তোমারই। তাকে তোমার মতো বাহাদুর নওজোয়ানের জীবনসঙ্গিনী করে দিতে আর কোনো বাধা থাকবে না।

বলতে বলতে ইবনে সাদেক ফিরে জোলায়খার দিকে তাকালো। জোলায়খা অশ্রুভরা চোখে চলে গেলো নিজের কামরার দিকে। ইবনে সাদেক নয়ীমের কাছে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলো, আমি জানি, ইবনে কাসিমের প্রতি তোমার অশেষ মুহব্বত। যদি কোনো কারণে তার মস্তক এখানে পৌঁছা পর্যন্ত তুমি যিন্দাহ না থাকতে পার, তা হলে আমি ওয়াদা করছি, তার মস্তক তোমারই সাথে দাফন করা হবে।

ইবনে সাদেকের হুকুম সিপাহীরা নয়ীমকে রেখে গেলো কয়েদখানায়।

*

রাতের বেলা নয়ীম বহুক্ষণ কয়েদখানার চার দেওয়ালে মধ্যে ঘুরতে লাগলেন অস্থির চঞ্চল হয়ে। তার দীল দীর্ঘকালের আত্মিক ও দৈহিক ক্লেশ সহ্যকরে নির্বিকার হয়ে উঠেছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও চোখ ও কান থেকে বঞ্চিত হবার শাস্তির কল্পনা করাটা খুব মামুলী ব্যাপার নয়। প্রতি মুহূর্তে তার মনের চাঞ্চল্য বেড়ে চলেছে। কখনো তার মনে কামনা জাগে, এ রাত্রি কিয়ামতের রাত্রির মতো দীর্ঘ হোক, আবার কখনো তার মুখ থেকে দোআ বেরিয়ে আসে, এখনই ভোর হয়ে প্রতীক্ষার দীর্ঘ রাত্রির অবসান হোক। টহল দিয়ে বেড়াতে বেড়াতে তিনি ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়লেন। খানিকক্ষণ পাশ ফিরবার পর মুজাহিদদের চোখে নামলো ঘুমের মায়া। তিনি স্বপ্নে দেখলেন, ভোর হয়ে এসেছে এবং তাকে কুঠরী থেকে বের করে বেঁধে দেওয়া হয়েছে এক গাছের সাথে। ইবনে সাদেক হাতে খঞ্জর নিয়ে এগিয়ে আসছে। সে তার চোখ দুটি উপড়ে ফেলছে। চারদিক ছেয়ে নেমে আসছে ঘন অন্ধকার। তারপর তা হচ্ছে একটি তরল পদার্থ। শাঁই শাহঁ করছে তার কানের ভিতর। তিনি কিছুই শুনতে পারছেন না। ইবনে সাদেকের সিপাহী তাঁকে সেখান থেকে এনে ফেলে যাচ্ছে কুঠরীর ভিতরে। সেখান থেকে বেরিয়ে যাবার পথ তার নজরে আসছে না। সিপাহী আর একবার এসে তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে কুঠরীর বাইরে; তারপর তাঁকে ফেলে আসছে খানিকটা দূরে। তারপর তিনি অনুভব করছেন, যেনো সহসা খুলে গেলো তার কানের পর্দা। পাখিদের কলকালি আর হাওয়ার শাঁ শাঁ আওয়াজ আসছে তার কানে। উযরা নয়ীম নয়ীম’ বলে ডাকছে তাঁকে। যেদিক থেকে উযরার আওয়াজ আসছে, তিনি উঠে কদম ফেললেন-সেদিকে কিন্তু কয়েক পা চলবার পর পা কাঁপতে কাঁপতে তিনি পড়ে যাচ্ছেন যমিনের উপর। আবার ফিরে আসছে তার চোখের দৃষ্টি। তিনি দেখছেন, উযরা তার সামনে দাঁড়িয়ে। আবার উঠে তিনি উযরা উযরা’ বলে দু’হাত প্রসারিত করে এগিয়ে যাচ্ছেন তার দিকে, কিন্তু কাছে গিয়ে ভালো করে তাকিয়ে দেখে তিনি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। তার স্বপ্নের শেষাংশ বাস্তব সত্য হয়ে উঠেছে, কিন্তু উযরার পরিবর্তে কুঠরীর মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে তারই মতো রূপ ও সৌন্দর্যের আর এক মূর্ত প্রতীক। দেয়ালের ছিদ্রপথ দিয়ে তার মুখে এসে পড়ছে চাঁদের রোশনী। খানিকক্ষণ ভালো করে তাকিয়ে দেখে তিনি চিনলেন সে ছায়া মূর্তিটি জোলায়খা, কিন্তু বহুক্ষণ পেরেশান অবস্থায় দাঁড়িয়ে থেকে তিনি অনুভব করতে লাগলেন যেনো তিনি স্বপ্ন দেখছেন। ধীরে ধীরে তার ধারণা ভুল প্রমাণিত হতে লাগলো। কয়েকবার চোখ মেলে নিজের শরীরে হাতের স্পর্শ অনুভব করতে তার মনে হলো, এ স্বপ্ন নয়-বাস্তব সত্য।

নয়ীম প্রশ্ন করলেন, কে তুমি? তাহলে আমি কি স্বপ্ন দেখছি না?’

জোলায়খা চাপা আওয়াজে জওয়াব দিলো, না, এ স্বপ্ন নয়। কিন্তু আপনি পড়ে গেলেন কেন?

কখন?

‘এইতো এখনই, আমি আপনাকে যখন আওয়াজ দিচ্ছিলাম। আপনি ঘাবড়ে উঠলেন, তারপরই আবার পড়ে গেলেন।’

‘উহ্, আমি এক স্বপ্ন দেখছিলাম। আমি অনুভব করছিলাম, যেনো আমি অন্ধ হয়ে গেছি। উযরা আমায় ডাকছে আর আমি এগিয়ে যাচ্ছি তার দিকে। অমনি একটা কিছুতে ধাক্কা খেয়ে আমি পড়ে গেছি। কিন্তু আপনি এখানে?

জোলায়খায় বললো, আস্তে কথা বলুন। যদিও ওরা সবাই ঘুমিয়ে আছে এখন, তবু কারুর কানে আপনার আওয়াজ গিয়ে পৌঁছলে সব কৌশল ব্যর্থ হয়ে যাবে। নিজের সব যেওর দিয়ে আমি বহু কষ্টে পাহারাদারদের বাধ্য করে এ কুঠরীর দরজা খুলিয়েছি। আমাদের জন্য তারা দুটো ঘোড়া তৈরী করে রেখেছে। তারা কেল্লার দরজা খুলে দেবার ওয়াদা করেছে। আপনি উঠে হুঁশিয়ার হয়ে আমার সাথে চলুন। দু’টো ঘোড়া। কি জন্য?

‘আমি আপানার সাথে যাবো।

‘আমার সাথে?’ নয়ীম হয়রান হয়ে প্রশ্ন করলেন।

হ্যাঁ আপনার সাথে। আমার উম্মীদ, আপনি আমার হেফাযত করবেন। আমার বাপ-মার ঘর দামেস্কে। আপনি সেখানে পৌঁছে দেবেন আমায়।’

এ কেল্লায় কি করে এলেন আপনি?

জোলায়খা বললো, কথার সময় নেই এখন। আমিও আপনারই মতো এক বদনসীব।’

নয়ীম খানিকটা ইতস্তত করে বললেন, এখন আপনার আমার সাথে যাওয়া ঠিক হবে না। আপনি আশ্বস্ত হোন, কয়েকদিনের মধ্যেই আমি আপনাকে মুক্ত করবো এ লোকটির হাত থেকে।’

না, না, খোদার দিকে তাকিয়ে আমায় হতাশ করবেন না। জোলায়খা কেঁদে বললো, আপনার সাথেই যাবো আমি। আপনি চলে যাবার পর যদি ওরা জানতে পারে যে, আপনাকে আযাদ করবার ভিতরে আমার কোনো হাত ছিলো, তা হলে ওরা আমায় কতল না করে ছেড়ে দেবে না। আর তা না জানলেও আপনার চলে যাবার পর আপনার দিক থেকে বিপদের আশংকা করে ওরা কেল্লা ছেড়ে কোথাও অদৃশ্য হয়ে যাবে। তখন আমায় ওরা এমন এক পিঞ্জরে কয়েদ করবে, যেখানে পৌঁছা আপনার পক্ষে সম্ভব হবে না। আপনি জানেন না, এ লোকটি যবরদস্তি করে আমায় শাদী দিতে চাচ্ছে ইসহাকের সাথে এবং সে ওয়াদা করেছে যে, মুহাম্মদ বিন কাসিমকে কতল করে আসতে পারলে আমায় তার হাতে সঁপে দেবে। খোদার ওয়াস্তে আমায় এ যালেম নেকড়ের হাত থেকে বাচাঁন। কথা কটি বলে সে নয়ীমের জামা ধরে হাঁপাতে লাগলো।

‘আপনি ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে চলতে পারবেন?’ নয়ীম প্রশ্ন করলেন। জোলায়খা আশান্বিত হয়ে জওয়াব দিলো, আমি এ যালেমের সাথে ঘোড়ায় চড়ে প্রায় আধা দুনিয়া ঘুরেছি। এখন সময় নষ্ট করবেন না। আপনার তামাম হাতিয়াসহ এক পাহারাদার ঘোড়া নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেল্লার বাইরে।

নয়ীম জোলায়খার হাত ধরে কুঠরীর দরজার দিকে গেলে বাইরের কারুর পায়ের আওয়াজ শোনা গেলো। তিনি থেমে গিয়ে চুপি চুপি বললেন, কে যেনো আসছে এদিকে।

এ কুঠরীর দু’জন পাহাদারকেই আমি কেল্লার দরজার পাঠিয়ে দিয়েছি। এ আর কেউ হবে। এখন কি হবে?

নয়ীম তার মুখে হাত রেখে দেয়ালের দিকে ঠেলে দিলেন। তারপর নিজে দরজার বাইরে উঁকি মেরে দেখতে লাগলেন। পায়ের আওয়াজ যতো নিকটতম হতে লাগলো, তার দীলের স্পন্দন ততো প্রবল হতে লাগলো। এক পাহারাদার দেয়ালের গা ঘেঁসে দরজার কাছে এসে মুহূর্তের জন্যে থমকে দাঁড়ালো। সাথে সাথেই নয়ীম তাকে ঘুষি লাগালেন এবং তার গর্দান নয়ীমের লৌহ কঠিন মুঠোর মধ্যে পিষ্ট হতে লাগলো। নয়ীম কয়েকটা ঝাঁকুনি দিয়ে বেঁহুশ অবস্থায় তাকে কুঠরীর ভিতর ঠেলে ফেললেন এবং জোলায়খার হাত ধরে বাইরে এসে দরজটা বন্ধ করে দিলেন।

কেল্লার দরজায় এক সিপাহী তার নযরে পড়লো। জোলায়খাকে দেখেই সে দরজা খুলে দিলো। আর একটি সিপাহী কেল্লার বাইরে নয়ীমের হাতিয়ার আর ঘোড়া নিয়ে দাঁড়িয়ে। নয়ীম হাতিয়ার বেঁধে জোলায়খাকে এক ঘোড়ায় সওয়ার করে দিয়ে নিজে অপর ঘোড়ায় সওয়ার হলেন। কিন্তু কয়েক কদম চলেই তিনি ফিরে পাহারাদারদের বললেন, তোমরা কি নিশ্চিত জানো যে আমাদের জন্য তোমাদের জান বিপন্ন হবে না?’

পাহারাদার জওয়াব দিলো, আপনি আমাদের চিন্ত করবেন না। ওই যে দেখুন। সে একটি গাছের দিকে ইশারা করে বললো ‘ভোর হবার আগে আমরাও কয়েক ক্রোশ দূরে চলে যাবো। এ নেকড়ের দলে আর আমাদের মন বসছে না।’ নয়ীম দেখলেন, গাছের সাথে আরো দুটি ঘোড়া বাঁধা।

দুর্গম পাহাড়ী পথের সাথে নয়ীমের পরিচয় নেই। সিতারার ঝলকে পথ দেখে তিনি এগিয়ে চলেছেন জোলায়খাকে নিয়ে। ঘন গাছপালার ভিতর দিয়ে কয়েক ক্রোশ চলবার পর তার নযরে পড়লো এক বিস্তীর্ণ ময়দান। কয়েক মাস পর তিনি খোলা হাওয়ায় এসে দেখছেন আসমানের দীপ্তিমান সিতারারাজির দৃশ্য। নির্জণ পথে মাঝে মাঝে শোনা যায় শিয়ালের ডাক। চাঁদের মুগ্ধকর আলোর বন্যা গাছের পাতায় পাতায় দীপ্তিমান জোনাকীর দল, হালকা হালকা ঠান্ডা সুরভী হাওয়া-মোটকথা, সেই রাতের সবকিছুই যেনো নয়ীমের কাছে অসাধারণ আনন্দদায়ক মনে হতে লাগলো। খানিকক্ষণ পরেই ভোরের রোশনী রাত্রির কালো পর্দা ভেদ করে উঁকি মারতে শুরু করলো। আলো-আঁধারে নয়ীমের চোখে দেখা দিলে একদিকে সারি সারি পাহাড় শ্ৰেণী, আর একদিকে ময়দানের আবছা দৃশ্য। তিনি জোলায়খার দিকে তাকালেন। তার রূপ ও আকৃতি সেই অস্পষ্ট দৃশ্যরাজিকে যেনো আরো মোহময় করে তুলেছে। নয়ীমের কাছে সে যেনো প্রকৃতির দৃশ্য পরিক্রমারই একটা অংশ। জোলায়খাও তার সাথীর দিকে তাকিয়ে লজ্জায় গদান নীচু করলো। সে কি করে ইবনে সাদেকের হাতে পড়েছিলো জানুতে চাইলেন নয়ীম। তার জওয়াবে জোলায়খা তার মর্মন্তুদ কাহিনী আদ্যোপান্ত বর্ণনা করলো। বলতে বলতে কয়েকবার সে আপনার অলক্ষ্যে কেঁদে ফেলেছে। নয়ীম বারবার তাকে দিয়েছেন। সান্তনা।

আরো বেশি আলো দেখা দেবার পর তারা ঘোড়ার গতি আরো বাড়িয়ে দিলেন। জোলায়খা ঘোড়ায় চড়ে খুব ভালো চলতে পারে দেখে নয়ীম ছুটে চললেন আরো দ্রুত গতিতে। প্রায় দু’ক্রোশ চলবার পর হঠাৎ নয়ীমের মাথায় এক খেয়াল এলো এবং তিনি ঘোড়া থামালেন। জোলায়খা তার দেখাদেখি থেমে পড়লো। নয়ীম জোলায়খাকে প্রশ্ন করলেন, আপনি কি বিশ্বাস করেন যে, ইসহাক মুহম্মদ বিন কাসিমকে কতল করবার ইরাদা নিয়ে রওয়ানা হয়ে গেছে?

‘হা, সে সন্ধ্যাবেলায় রওয়ানা হয়ে গেছে। জোলায়খা জওয়াব দিলো। তা হলে বেশি দূর যায়নি সে। বলে নয়ীম ঘোড়ার গতি বাঁ দিকে ঘুরিয়ে দিলেন। জোলায়খা কোন প্রশ্ন না করে তার পিছু পিছু ঘোড়া ছুটালো।

সূর্যোদয়ের খানিকক্ষণ পর নয়ীম এসে পৌঁছলেন এক চৌকিতে। পাহাড়ী লোকদের হামলা প্রতিরোধ করবার জন্য সেখানে ছিলো ত্রিশজন সিপাহী। নয়ীম ঘোড়া থেকে নামলেন। এক বুড়ো সিপাহী নয়ীমকে চিনতে পেরে এগিয়ে এসে তাকে কোল দিলো। বুড়ো সিপাহীটি নয়ীমের পাশের বস্তির বাসিন্দা। খুশীর জোশে সে নয়ীমের পেশানীতে হাত বুলিয়ে বললো আলহামদুলিল্লাহ, আপনি নিরাপদে আছেন। এতদিন কোথায় ছিলেন আপনি? আমরা দুনিয়ার প্রতি কোণে খুঁজে বেড়িয়েছি আপনাকে। আপনার ভাইও আপনার খোঁজে গিয়েছিলেন সিন্ধতে। আপনার দোন্ত মুহম্মদ বিন কাসিম আপনার সন্ধানের জন্য পাঁচ হাজার আশরফী পুরস্কার ঘোষণা করেছেন। আমরা সবাই হতাশ হয়ে গিয়েছি। শেষ পর্যন্ত কোথায় ছিলেন আপনি?

নয়ীম জওয়াব দিলেন, এসব প্রশ্নের জওয়াব দিতে বহু সময়ের প্রয়োজন। এখন আমি খুব তাড়া হুড়ায় রয়েছি। আপনি আমায় বলুন, আজ রাত্রে অথবা ভোর বেলায় একটি বলিষ্ঠ দেহ লোক এই পথ দিয়ে গিয়েছে কি?

সিপাহী জওয়াব দিলো, হাঁ, সূর্যোদয়ের খানিকক্ষণ আগে একটি লোক এখন থেকে গেছে। সে বলছিলো দামেস্ক থেকে খলিফাতুল মুসলেমীন এক খাস পয়গাম নিয়ে তাকে পাঠিয়েছেন সিন্ধুর পথে মুহম্মদ বিন কাসিমের কাছে। লোকটি এখান থেকে ঘোড়া বদল করে নিয়েছে।’

‘লোকটি গন্দমী রঙের? নয়ীম প্রশ্ন করলেন।

‘জি হাঁ, সম্ভবতঃ তার রঙ গন্দমী।’ বুড়ো সিপাহী জওয়াব দিলো।

বহুত আচ্ছা।’ নয়ীম বললেন, আপনাদের মধ্যে একজন সোজা উত্তর পূর্বে চলে গিয়ে কয়েক ক্রোশ দূরে পাহাড়ের উপর দেখতে পাবেন গাছ-পালায় ঢাকা এক কেল্লা। যে লোকটি যাবে সে কাছে গিয়ে দেখরে, কেল্লার বাসিন্দারা কেল্লা ছেড়ে চলে গেছে কিনা। আমার বিশ্বাস, তার যাবার আগেই ওরা কেল্লা খালি করে চলে যাবে। কিন্তু আমি জানতে চাই, ওরা কোন দিকে যাচ্ছে। এর জন্য দরকার একটি হুঁশিয়ার লোক।’

আমি যাচ্ছি,বলে এক নওজোয়ান এগিয়ে এলো।

হাঁ, যাও। যদি ওরা আগেই কেল্লা খালি করে গিয়ে থাকে, তাহলে ফিরে এসো, নইলে তাদের গতিবিধির খেয়াল রাখবে। নয়ীম বললেন।

নওজোয়ান ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে ছুটে চললো। নয়ীম বাকী সিপাহীদের ভিতর থেকে বিশজনকে বাছাই করে নিয়ে হুকুম দিলেন, তোমরা সম্মানিত মহিলার সাথে বসরা পর্যন্ত যাবে এবং সেখানে পৌঁছে আমার তরফ থেকে গভর্নরকে বলবে যে, একে ইযযত ও শ্রদ্ধার সাথে দামেস্কে পৌঁছে দিতে হবে। পথের চৌকিগুলো থেকে যত সিপাহী সংগ্রহ করা সম্ভব, তোমাদের সাথে সামিল করে নেবে। সম্ভবত এক ভয়ানক দুশমন এর অনুসরণ করবে। বসরার ওয়ালীকে বলবে, তিনি যেনো এর সাথে কমসে কম একশ সিপাহী রওয়ানা করে দেন। তোমরাও হুঁশিয়ার থাকবে। এর দুশমনদের সাথে মোকাবিলা করবার সম্ভাবনা এলে তোমাদের সব চাইতে ফরয হবে এর জান বাঁচানো। পথে এর তকলীফ না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখবে।’ হুকুম পেয়ে সিপাহী ঘোড়ার যিন লাগাতে ব্যস্ত হলো। নয়ীম ঘোড়া থেকে নেমে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের নামে একটি চিঠি লিখে তাতে তার জন্য জোলায়খার কোরবানীর কথা জানিয়ে তাকে ইযযত ও শ্রদ্ধার সাথে দামেস্কে পৌঁছে দেবার আবেদন জানালেন। চিঠিখানা এক সিপাহীর হাতে দিয়ে তিনি এসে দাঁড়ালেন জোলায়খার কাছে। জোলায়খা তখনো মাথা নীচু করে বসে রয়েছে ঘোড়ার উপর। নয়ীম খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আপনাকে বিষণ্ণ মনে হচ্ছে। কোনো চিন্তা করবেন না। আমি আপনার হেফাজতের পুরো বন্দোবস্ত করে দিয়েছি। পথে কোনো কলফি হবে না আপনার। মনে করেছিলাম, আমিও আপনাদের সাথে বসরা পর্যন্ত যাবো, কিন্তু আমি নিরুপায়।

‘কোথায় যাবেন আপনি’? জোলায়খা বললেন।

আমায় এক দোস্তের জান বাঁচাতে হবে।

আপনি ইসহাকের পিছু ধাওয়া করতে যাচ্ছেন?

‘হাঁ, উম্মীদ রয়েছে, খুব শিগগিরই আমি তাকে ধরে ফেলবো।’

জোলায়খা তার অশ্রুভারাক্রান্ত চোখে দুটি রুমালে ঢেকে বললো, আপনি সতর্ক হয়ে চলবেন।.ও যেমন বাহাদুর তেমনি প্রতারক।

আপনি চিন্তা করবেন না। আপনার সাথীরা তৈরী হয়ে গেছে, আমারও দেরী হয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা খোদা হাফিয। নয়ীম চলবার উপক্রম করেছেন। জোলায়খা অশ্রুভরা চোখে তার দিকে তাকিয়ে বিষণ্ণ আওয়াজের বললেন, আমি একটা কথা আপনাকে জিগগেস করতে চাই।

হাঁ বলুন।

জোলায়খা চেষ্টা করেও বলতে পারে না। তার কালো চোখ থেকে উছলে উঠা অশ্রুর ফোঁটা পড়লো গাল বেয়ে।

বলুন।’ নয়ীম বললেন, আপনি আমায় কি প্রশ্ন করতে চেয়েছিলেন। আমি আপনার চোখের আসুর কদর ও কিম জানি, কিন্তু আপনি আমার নিরুপায় অবস্থার খবর জানেন না।

আমি জানি।’ জোলায়খা চাপা আওয়াজে জওয়াব দিলো।

‘হাঁ, আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে। কি জিগগেস করতে চান, বলুন। জোলায়খা বললো, আমি প্রশ্ন করতে চাই, যখন আমি আপনাকে কয়েদখানায় আওয়ায দিয়েছিলাম, তখন উযরা বলে আপনি উঠে আবার পড়ে গিয়েছিলেন।’

হাঁ আমার মনে আছে।’ নয়ীম জওয়াব দিলেন।

আমি জানতে পারি, সে খোশনসীব কে? জোলায়খা কাঁপা গলায় প্রশ্ন করলো।

‘আপনি ভুল করছেন। সে হয়তো অতোটা খোশনসীব নয়।’

তিনি যিন্দাহ আছেন?

‘সম্ববত।’

‘খোদা করুন, তিনি যেন যিন্দাহ থাকেন। কোথায় তিনি? আমার পথ থেকে বহুত দূর না হলে আমি তাকে দেখে যেতে চাই একবার। আপনি আমার আবেদন কবুল কববেন?

আপনি সত্যি সত্যি সেখানে যেতে চান?

‘আপনি অপছন্দ না করলে আমি খুবই খুশী হবো।’

‘বহুত আচ্ছা। এ সিপাহী আপনাকে আমার ঘরে পৌঁছে দেবে। আমি ফিরে আসা পর্যন্ত আপনি ওখানে থাকবেন। কোনো কারণে দেরী হলে সম্ভবত পথেই এসে আমি মিলবো আপনাদের সাথে।

তিনি আপনার মার কাছেই আছেন কি? আপনাদের কি শাদী হয়েছে?

না’ কিন্ত সে প্রতিপালিত হয়েছে আমাদেরই ঘরে। এই কথা বলে নয়ীম সিপাহীদের লক্ষ্য করে হুকুম দিলেন, যেনো জোলায়খাকে বসরায় পৌঁছে না দিয়ে তার বাড়িতেই পৌঁছে দেওয়া হয়। নয়ীম খোদা হাফিজ বলে চলে যাচ্ছিলেন, কিন্তু জোলায়খার অনুনয় ভরা দৃষ্টি আর একবার তার পথ রোধ করলো। জোলায়খা চোখ নীচু করে ডান হাত দিয়ে একখানা ধনজর নয়ীমের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, আপনার হাতিয়ারের ভিতর থেকে এই খনজর আমি নিজের কাছে রেখেছিলাম কল্যাণ নিদর্শন হিসেবে। হয়তো এর প্রয়োজন হবে আপনার।

যদি ওটাকে আপনি কল্যাণ নিদর্শন বলেই মনে করে থাকেন, তা হলে আমি খুশী হয়েই আপনাকে ওটা পেশ করছি। আপনি ওটা হামেশা কাছে রাখবেন।

‘শোকরিয়া। আমি ওটা হামেশা নিজের কাছে রাখবো। হয়তো কখনো এটা আমার কাজে লাগবে। নয়ীম তখন তার কথায় ততোটা মনোযোগ না দিয়ে ঘোড়ায় সওয়ার হলেন, কিন্ত পরে বহুক্ষণ তার কথাগুলো বাজতে লাগলো তার কানের মধ্যে।

*

জোলায়খাকে এই ছোটখাটো কাফেলার সাথে পাঠিয়ে দিয়ে নয়ীম রওয়ানা হলেন ইসহাকের পিছু ধাওয়া করতে। প্রত্যেকটি চৌকিতে ঘোড়া বদল করে ইসহাকের সন্ধান করতে করতে তিনি ছুটে চললেন অত্যন্ত দ্রুত গতিতে। দুপুর বেলা তার সামনে এক সওয়ার তার নযরে পড়লো! নয়ীম তার ঘোড়ার গতি আরো বাড়িয়ে দিলেন। আগের সওয়ার নয়ীমের দিকে ফিরে তাকিয়ে ঢিলে করে দিলো তার ঘোড়ার বাগ। কিন্তু পিছনের সওয়ারের ঘোড়া অত্যন্ত দ্রুতগতিতে আসছে, দেখে সে কি যেনো ভেবে ঘোড়ার গতি কমিয়ে দিলো। নয়ীম দূর থেকেই ইসহাককে চিনে ফেলেছেন। তিনি লৌহ শিরস্ত্রাণ নীচু করে দিয়ে মুখ ঢেকে নিলেন। নয়ীমকে কাছে আসতে দেখে ইসহাক রাস্তা থেকে কয়েক কদম সরে একদিকে দাঁড়ালো। নয়ীমও তার কছে গিয়েই ঘোড়া থামালেন। উভয় সওয়ার মুহূর্তের জন্য পরস্পরের মুখোমখি হয়ে দাঁড়ালেন নির্বাক হয়ে। শেষ পর্যন্ত ইসহাক প্রশ্ন করলো, আপনি কে? আর কোথায় যাবার ইরাদা করেছেন?

‘সেই একই প্রশ্ন আমিও তোমায় জিগগেস করতে চাচ্ছি। নয়ীম বললেন।

নয়ীমের কণ্ঠস্বরের কঠোরতা এবং আপনির মোকাবেলায় তুমি’ বলতে দেখে ইসহাক পেরেশান হয়ে উঠলেন কিন্তু শিগগিই পেরেশানি সংযত করে বললো, আপনি আমার প্রশ্নের জওয়াব না দিয়ে আর একটি প্রশ্ন করে বসেছেন।

নয়ীম বললেন, ভালো করে তাকাও আমার দিকে। তোমার দুটি প্রশ্নের জবাব মিলে যাবে।’ কথাটি বলেই নয়ীম এক হাত দিয়ে তার মুখের আবরণ খুললেন।

‘তুমি…… নয়ীম?’ ইসহাকের মুখ থেকে অলক্ষ্যে বেরিয়ে এলো।

হাঁ তাই….। নয়ীম তার লৌহ-শিরস্ত্রাণ আবার নীচু করে দিয়ে বললেন। ইসহাক তার ভীতি সংযত করে আচানক ঘোড়ার বাগ টেনে পিছু হটালো। নয়ীমও এক হাতে ঘোড়ার বাগ ও অপর হাতে নেয়াই সামলে নিয়ে তৈরী হয়ে গেছেন ইতিমধ্যে। দুজনই প্রতীক্ষা করছেন পরস্পরের হামলার। আচানক ইসহাক নেযাহ বাড়িয়ে দিয়ে ঘোড়া হাকালো সামনের দিকে। ইসহাকের ঘোড়ার এক লাফে নয়ীম এসে গেছেন তার নাগালের ভিতর, কিন্ত বিজলী চমকের মতো দ্রুতগতিতে তিনি একদিকে ঝুঁকলেন। ইসহাকের নোহ সরে গেলো তার রানে খানিকটা হালকা যখম করে। ইসহাকের ঘোড়া কয়েক কদম আগে চলে গেলো। নয়ীম তখখুনি তার ঘোড়া ঘুরিয়ে তার পিছনে লাগিয়ে দিলেন। ইতিমধ্যে ইসহাক তার ঘোড়াটাকে বৃত্তাকার ঘুরিয়ে এনে আর একবার দাঁড়িয়ে গেলো নয়ীমের সামনে। উভয় সওয়ার একই সংগে নিজ নিজ ঘোড়া হাকিয়ে নেয়াহ সামলাতে সামলাতে এগিয়ে গেলেন পরস্পরের দিকে। নয়ীম আর একবার আত্মরক্ষা করলেন ইসহাকের আক্রমণ থেকে। কিন্তু এবার নয়ীমের নেযাহ ইসহাকের সীনা পার হয়ে চলে গেছে। ইসহাককে খাক ও খুনের মধ্যে তড়পাতে দেখে নয়ীম ফিরে চললেন। পরের চৌকিতে গিয়ে তিনি যোহরের নামায আদায় করলেন। তারপর ঘোডা বদল করে তিনি এক লহমা সময় নষ্ট না করে চললেন গন্তব্য পথে। যে চৌকি থেকে জোলায়খাকে বিদায় দিয়ে তিনি ইসহাকের সন্ধানে বেরিয়েছিলেন, সেখানে পৌঁছে জানলেন যে, ইবনে সাদেক তার দলবল নিয়ে চলে গেছে কেল্লা ছেড়ে। তাদের পিছনে ছুটে বেড়ানো নয়ীমের কাছে মনে হলো নিল। তখনো সন্ধ্যার কিছুটা দেরী। এক সিপাহীর কাছ থেকে কাগজ কলম চেয়ে নিয়ে নয়ীম এক চিঠি লিখলেন মুহম্মদ বিন কাসিমের নামে। সিন্ধু থেকে বিদায় নিয়ে আসার পর ইবনে সাদেকের হাতে গ্রেফতার হওয়ার কাহিনী তিনি সবিস্তারে লিখলেন তার চিঠিতে। তিনি তাকে ইবনে সাদেকের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবহিত হবার জন্য তাগিদ করলেন। তিনি দ্বিতীয় চিঠি লিখলেন হাজ্জাজ বিন ইউসুফের নামে। ইবনে সাদেককে অবিলম্বে গ্রেফতার করবার জরুরী ব্যবস্থা করার তাগিদ দিলেন তাকে। চিঠি দুটো চৌকিওয়ালাদের হাতে সোপর্দ করে দিয়ে নয়ীম তাদেরকে দ্রুত পৌঁছে দেবার নির্দেশ দিয়ে আবার ঘোড়ায় সওয়ার হলেন।

নয়মের মনে আশংখা ছিলো, ইবনে সাদেক হয়তো জোলায়খার অনুসরণ করবে। প্রতি চৌকিতে তিনি ছোট-খাটো কাফেলাটির খবর নিতে নিতে চললেন। তিনি জানতে পেলেন যে, অপর চৌকিগুলোয় সিপাহীর অভাব ছিলো বলেই জোলায়খার সাথে দশজনের বেশি সিপাহী যেতে পারেনি। জোলায়খার হেফাযতের চিন্তা করে তিনি তখখুনি সেই কাফেলায় শামিল হতে চাইলেন এবং দ্রুত থেকে দ্রুততর বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে চললেন। রাত হয়ে গেছে। শুক্লা চতুর্দশীর চাঁদ সারা দৃষ্টির উপর ছড়িয়ে দিয়েছে তার রূপালী আভা.নয়ীম পাহাড়-প্রান্তর অতিক্রম করে এসে পার হয়ে চলেছেন এক মরু অঞ্চল। পথের মধ্যে এক বিচিত্র দৃশ্য দেখে তার দেহের রক্ত জমাট হয়ে এলো। বালুর উপর পড়ে রয়েছে কয়েকটি ঘোড়া ও মানুষের লাশ। তাদের মধ্যে কেউ কেউ তখনো তড়পাচ্ছে। নয়ীম ঘোড়া থেকে দেখলেন, জোলায়খার সাথে যারা এসেছিলো, তাদের কেউ কেউ রয়েছে তাদের মধ্যে। নয়ীমের দীলের মধ্যে সবার আগে জাগলো জোলায়খার চিন্তা। তিনি ঘাবড়ে গিয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলেন। এক যখমী নওজোয়ান পানি চাইলো নয়ীমের কাছে। নয়ীম ঘোড়ার পিঠে বাঁধা মোশক থেকে পানি ধরলেন তার মুখের কাছে। এক হাত দিয়ে তার কম্পিত বুক চেপে ধরে তিনি কিছু জিজ্ঞেস করলেন, এর মধ্যে যখমী নওজোয়ান একদিকে হাতের ইশারা করে বললো, আমাদের আফসোেস, আমাদের ফরয আদায় করতে পারিনি আমরা। আপনার হুকুম মোতাবেক আমরা নিজের জান বাঁচাবার, চেষ্টা না করে শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত ওর জানের হেফাযত করবার জন্য লড়াই করেছি, কিন্তু ওরা ছিলো সংখ্যায় অনেক বিশী। আপনি ওর খবর নিন।

এই কথা বলে সে আবার হাত দিয়ে ইশারা করলো এক দিকে। নয়ীম দ্রুত সেদিকে এগিয়ে গেলেন। কয়েকটি লাশের মাঝখানে জোলায়খাকে দেখে তার দীল কেঁপে উঠলো। কানের ভিতর শাঁই শাঁই আওয়ায হতে লাগলো। যে মুজাহিদ আজ পর্যন্ত অসংখ্যবার নাযুক থেকে নাযুকতার পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছে অকুতোভয়ে, এই মর্মান্তিক দৃশ্য তাকে কাঁপিয়ে তুললো।

‘জোলায়খা!’ জোলায়খা! তুমি…..।

জোলায়খার শ্বাস তখনো কিছুটা বাকী রয়েছে।-”আপনি এসে গেছেন? সে বললো ক্ষীণ আওয়াযে।

নয়ীম এগিয়ে গিয়ে জোলায়খার মাথাটা তুলে ধরে পানি দিলেন তার মুখে। জোলায়খার সিনায় বিদ্ধ হয়ে রয়েছে এক খনজর। নয়ীম কম্পিত হাতে তার হাতল ধরে টেনে বের করতে চাইলেন, কিন্ত জোলায়খা হাতের ইশারায় তাকে মানা করে বললো, ওটা বের করে কোন ফায়দা হবে না। ওর কার্য ও করেছে আর এই শেষ মুহূর্তে আমি আপনার নিশানী থেকে জুদা হতে চাই না।

নয়ীম হয়রান হয়ে বললেন, আমার নিশানী?

জি হাঁ, এ খনজর আপনার। আপনার দেওয়া খনজর আমার কার্যে এসেছে, তাই আমি আপনার শোকরগুযারী করছি। জোলায়খা! জোলায়খা তুমি আত্মহত্যা করলে!!

প্রতিদিনের রূহানী মওতের চাইতে একদিনের জিসমানী মতকে আমি ভাল মনে করেছি। খোদার ওয়াস্তে আপনি আমার উপর নারায় হবেন না। শেষ পর্যন্ত আমি কি-ই বা করতে পারতাম? ভাঙ্গা তকদীরকে জোড়া দেওয়ার সাধ্য ছিলো না আমার, আর এই শেষ হতাশা আমি জিন্দাহ থেকে বরদাশত করতে পারতাম না।’

নয়ীম বললেন, জোলায়খা, আমি অত্যন্ত লজ্জিত কিন্তু উপায় ছিলো না।

জোলায়খা নয়ীমের মুখের উপর প্রীতি ভরা দৃষ্টি হেনে বললো, আপনি আফসোস করবেন না। এই-ই কুদরতের মনযুর, আর কুদরতের কাছে এর চাইতে বেশী প্রত্যাশাও আমি করিনি। শেষ মুহূর্তে আপনি আমার পাশে রয়েছেন, এর চাইতে খোশনসীব আমার কিই বা হতে পারতো।

জোলায়খা এই কথা বলে দুর্বলতা ও বেদনার আতিশয্যে চোখ মুদলো। কম্পিত দীপশিখা বুঝি নিভে গেল, ভয় করে নয়ীম ‘জোলায়খা জোলায়খা’ বলে তাঁর মাথায় ঝাকনি দিলেন। জোলায়খা চোখ খুলে নয়ীমের দিকে তাকালো এবং শুকনো গলায় হাত রেখে পানি চাইলো। নয়ীম পানি দিলেন তার মুখে। খানিকক্ষণ দু’জনই নির্বাক। এই শুব্ধতার মধ্যে নয়ীমের দীলের কম্পন দ্রুততর ও জোলায়খার দীলের স্পন্দন ক্ষীণতর হতে লাগলো। মৃত্যু পথযাত্রীর দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়ে রয়েছে শেষ সংগীর মুখের উপর, আর সংগীর ব্যথাতুর দৃষ্টি গিয়ে পড়েছে তার বুকে নিমজ্জিত খনজরের উপর। শেষ পর্যন্ত জোলায়খা একবার কাতরে উঠে নয়ীমের মনোযোগ আকর্ষণ করে বললো, আপনার ঘরে গিয়ে আমি ওকে দেখতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সে অরযু আমার পুরা হলো না। আপনি গিয়ে ওকে আমার সালাম বলবেন। জোলায়খা আবার চুপ করলো। খানিক্ষন চিন্তা করে জোলায়খা আবার বললো, আমি এখন এক দীর্ঘ সফরের পথে চলেছি। আপনার কাছে একটা প্রশ্ন করবো আমি। যে দুনিয়ায় আমি চলছি, সেখানে আমার পরিচিত কউে থাকবে না। আমার বাপ-মাও হয়তো চিনবেন না আমায়, কেননা যখন এই জালেম চাচা আমায় চুরি করে এনেছে, তখন আমি ছিলাম খুবই ছোট। এ আশা কি আমি করতে পারি যে, সেই দুনিয়ায় আপনি একবার অবশ্যি মিলিত হবেন আমার সাথে। সেখানে এমন একজন লোক তো চাই, যাকে আমি আপনার বলতে পারবো। আপনাকেই আমি মনে করছি আমার আপনার জন। কিন্তু আপনি যতোটা আমার নিকট, ততোটা দূর।

জোলায়খার কথা নয়ীয়মের দীলকে অভিভূত করলো। তার দু’চোখ হয়ে উঠলো অশ্রুভারাক্রান্ত। তিনি বললেন, জোলায়খা যদি তুমি আমায় আপনার করে নিতে চাও, তাহলে তার একই পথ রয়েছে।

জোলায়খার বিষণ্ণ মুখ খুশীতে দীপ্ত হয়ে উঠলো। হতাশার অন্ধকারে বিশীর্ণ ফুলের বুকে আশার আলো এনে দিলো নতুন সজীবতা। বেকারার হয়ে সে বললো, বলুন, কোন সে পথ?

‘জোলায়খা! আমার প্রভুর গোলামী কবুল কর। তাহলে তোমার আমার মাঝখানে কোনো দূরত্ব থাকবে না।’

আমি তৈরী। কিন্ত আপনার প্রভু আমায় গ্রহন করবেন কি?

হাঁ। তিনি বড়ই কৃপাময়!

কিন্তু আমি তো কয়েক লহমার জন্যই মাত্র যিন্দাহ থাকব।’

তার জন্য দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন নেই। জোলায়খা, বল।’

কি বলব?’ বিগলিতা জোলায়খা বললো।

নয়ীম কলেমায়ে শাহযাদাত পড়লেন আর জোলায়খা তার সাথে সাথে তা আবৃত্তি করলো। জোলায়খা আর একবার পানি চাইলো এবং তা পান করে বললো-আমি অনুভব করছি, যেনো আমার দীল থেকে এক বোঝা নেবে গেছে।’

নয়ীম বললেন, এখান থেকে কয়েক ক্রোশ দূর রয়েছে ফৌজী চৌকি। তুমি ঘোড়ায় চড়তে পারলে তোমায় ওখানে নিয়ে যেতে পারতাম। এ অবস্থায় তোমার না ঘোড়ায় উপর বসা সম্ভব নয়, তাই আমায় কিছুক্ষনের জন্য এজাযত দাও। খুব শিগগীরই আমি ওখান থেকে সিপাহী ডেকে আনবো। হয়তো ওরা আশপাশের বস্তি থেকে কোন হাকীম খুঁজে আনাতে পারবে।’

নয়ীম জোলায়খার মাথা যমীনের উপর রেখে উঠছিলেন, কিন্তু কমফের হাত দিয়ে সে নয়ীমের জামা ধরে কেঁদে বললো, “খোদার ওয়াস্তে আপনি কোথাও যাবেন না। ফিরে এসে অপনি যিন্দাহ পাবেন না আমায়। মরবার সময় আমি আপনার কাছ-ছাড়া হতে চাই না।’

নয়ীম জোলায়খার বেদনাতুর কণ্ঠের আবেদন অগ্রাহ্য করতে পারলেন না। তিনি আবার বসে পড়লেন তার পাশে। জোলায়খা আশ্বস্ত হয়ে চোখ বন্ধ করলো। বহুক্ষণ সে পড়ে রইলো নিশ্চল। কখনো কখনো সে চোখ খুলে তাকাচ্ছে নয়ীমের মুখের দিকে। রাতের তৃতীয় প্রহর কেটে গেছে। ভোরের আভা দেখা যাচ্ছে। জোলায়খার দেহের শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে। তার সকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিসার হয়ে এসেছে, আর বহু কষ্টে সে টানছে শ্বাস।

জোলায়খা! নয়ীম বেকারার হয়ে ডাকলেন।

জোলায়খা শেষ বারের মত চোখ খুললো এবং এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘুমিয়ে পড়লো। চিরকালের মত। উন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলায়হি রাজেউন, বলে নয়ীম মাথা নত করলেন। অলক্ষ্যে তার চোখ থেকে নেমে এলো অশ্রুর বন্যা। সে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো জোলায়খার মুখের উপর। জোলায়খার নির্বাক মুখ যেন বলে যাচ্ছেঃ

‘হে পবিত্র আত্মা! তোমার অশ্রুর মূল্য আমি আদায় করে গেলাম। নয়ীম উঠে ঘোড়ায় সওয়ার হলেন এবং নিকটের চৌকিতে পৌঁছে কয়েকজন সিপাহীকে ডেকে আনলেন। আশাপাশের বস্তি থেকেও কতক লোক এসে জমা হলে সেখানে। নয়ীম জানাযার নামায পড়িয়ে জোলায়খা ও তার সংগীদের দাফন করে চললেন তার বাড়ির পথে।

আট

রাতের বেলায় নয়ীম এক বিস্তীর্ণ মরুপ্রান্তর অতিক্রম করে চলেছেন। জোলায়খার মৃত্যুশোক, সফরের ক্লান্তি, আরো নানারকমের পেরেশানির ফলে কেমন যেন উদাস মন নিয়ে তিনি এগিয়ে চলেছেন মনযিলে মকসুদের দিকে। জনহীন প্রান্তরে মাঝে মাঝে শোনা যায় নেকড়ে ও শিয়ালের আওয়ায়। তারপরই আবার নিস্তব্ধ-নিঝুম। খানিকক্ষণ পরে পূর্বদিগন্তে দেখা দিলো শুক্লপক্ষের চাঁদ। অন্ধকার পর্দা গেলো ছিন্ন হয়ে, নিস্প্রভ হয়ে এলো সিতারার দীপ্তি। বাড়তি আলোয় নয়ীমের নযরে পড়তে লাগলো দূরের টিলা পাহাড়, বন-ঝাড় আর গাছপালা। মনযিরে মকসুদের কাছে এসে গেছেন তিনি। তার বস্তির আশপাশের বাগবাগিচার অস্পষ্ট ছবি ভেসে উঠছে তার চোখে। তার রঙিন স্বপ্নের কেন্দ্রভূমি যে বস্তি, যে বস্তির প্রতি ধুলিকণার সাথে রয়েছে তার দীলের সম্পর্ক, সেই বস্তি এখন তার কতো কাছে। দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে দিয়ে তিনি সেখানে পৌঁছে যেতে পারেন, তবু তার কল্পনা বার বার সেখান থেকে তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে বহু ক্রোশ দূরে জোলায়খার শেষ বিরাম ভুমির দিকে। জোলায়খার মওতের মর্মান্তিক দৃশ্য বারংবার ভেসে উঠছে তার দৃষ্টির সামনে। তার শেষ কথাগুলো গুঞ্জন করে যাচ্ছে তার কানে। তিনি খানিকক্ষণের জন্য ভুলে যেতে চান সে মর্মান্তিক কাহিনী, কিন্তু তিনি অনুভব করেন, যেন সারা সৃষ্টি সেই নির্যাতিত নারীর আর্তনাদ ও অশ্রুধারা বেদনাতুর।

নিজের ঘরের হাজারো আশংকা তাকে উতলা করে তুলেছে। তিনি তার যিন্দেগীর আশা আকাঙ্কার কেন্দ্রস্থলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু তার দীলের নওজোয়ানসূলভ উৎসাহ-উদ্যম আর উদ্দীপনার চিহ্ন নেই। অতীত যিন্দেগীতে ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে কখনো তিনি এমনি ঢিলেঢালা হয়ে বসনে নি। চিন্তার ভারে তিনি যেনো পিষ্ট হয়ে যাচ্ছেন।

আচানক বস্তির দিক থেকে একটা আওয়াজ এলো তার কানে। তিনি চমকে উঠে শুনতে লাগলেন সে আওয়াম। বস্তির মেয়েরা দফ বাজিয়ে গান গাইছে। শাদী উপলক্ষে আরব নারীরা যে সাদাসিধা গান গাইতো, এ সেই গান। নয়ীমের দীলের স্পন্দন দ্রুততর হতে লাগলো। তার মন চায়, উড়ে ঘরে চলে যেতে কিন্তু কিছুদূর গিয়েই তার ক্রমবর্ধমান উদ্যম যেনো উবে যায়। তিনি সেই ঘরের চারদেয়ালের কাছে এসে গেলেন, যেখান থেকে ভেসে আসছে গানের আওয়ায। এ যে তারই আপন ঘর। খোলা দরযার সামনে গিয়ে তিনি ঘোড়া থামালেন। কিন্ত কি যেনো মনে করে আর এগুতে পারলেন না তিনি।

আঙিনার ভিতরে মশাল জ্বলছে। বস্তির লোক খানাপিনায় মশগুল। মেয়েরা জমা হয়েছে ছাদের উপর। মেহমানদের সমবেত হবার কারণ তিনি চিন্তা করতে লাগলেন আপন মনে। তার মনে হলো, বুঝি খোদা উযরার কিসমতের ফয়সালা করে ফেলেছেন। মনের উদাস চিন্তা ভাবনা তাকে এমন অভিভূত করলো যে, তার ঘরের জান্নাত আজ তার কাছে মনে হচ্ছে সকল আশা-আকাঙ্খকা সমাধি। নীচে নেবে ঘর থেকে কয়েক কদম দূরে তিনি ঘোড়া বাঁধলেন এক গাছের সাথে। তারপর গা ঢাকা দিয়ে তিনি দাঁড়িয়ে থাকলেন গাছের ছায়ায়।

বস্তির একটি ছেলে ছুটে বেরিয়ে এলো বাইরে। নয়ীম এগিয়ে গিয়ে তার পথ রোধ করে শুধালেন, এখানে কিসের দাওয়াত?

বালক চমকে উঠে নয়ীমের দিকে তাকালো, কিন্তু গাছের ছায়া আর নয়ীমের মুখের অর্ধেকটা লৌহ শিরস্তাণে ঢাকা বলে সে চিনতে পারলো না তাকে। সে জওয়াবে বললো, শাদী হচ্ছে এখানে।

কার শাদী’?

‘আব্দুল্লাহর শাদী হচ্ছে। আপনি বোধ হয় বিদেশী। চলুন, আপনি এ দাওয়াতে শরীক হবেন।’ কথাটি বলেই চলে যাচ্ছিল, কিন্তু নয়ীম বায়ু ধরে তাকে থামালেন। বালক পেরেশান হয়ে বললো, আমায় ছেড়ে দিন। আমি কাযীকে ডাকতে যাচ্ছি।

যদিও নয়ীমের দীল এ প্রশ্নের জওয়াব আগেই দিয়েছে, তবু তার অন্তরের প্রেম ব্যর্থতা ও হতাশার শেষ দৃশ্য চোখের সামনে দেখেও আশা ছাড়লো না। তিনি কম্পিত আওয়াযে প্রশ্ন করলেন, আব্দুল্লাহর শাদী হবে কার সাথে?

উয়রার সাথে। বালক জওয়াব দিলো।

আব্দল্লার মা কেমন আছেন?’ শুকনো গলার উপর হাত রেখে প্রশ্ন করলেন নয়ীম।

‘আবদুল্লার মা? তিনিতো ইন্তেকাল করেছেন তিনচার মাস আগেই। বলেই বালক ছুটে চললো।

নয়ীম গাছটিকে ধরে দাঁড়ালেন। মায়ে শোক তার অন্তর তোলপাড় করে তুললো। তার চোখে নামলো অশ্রুর দরিয়া। খানিকক্ষণ পর সেই বালক কাযীকে নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো। নয়ীমের দীলের মধ্যে দুটি পরস্পর বিরোধী আকাঙ্খ জেগে উঠলো, এখনো তকদীর তার হাতের নাগালের ভিতরে। উযরা তার কাছে থেকে দুরে নয়। তার যিন্দাহ ফিরে আসার খবর জানলে আব্দুল্লাহ তার যিন্দেগীর সর্বস্ব কোরবান করেও তার দীলের ভেঙ্গে পড়া বস্তি আবাদ করে দেবেন মনের খুশীতে। এখনো সময় রয়েছে।

তার বিবেক আবার দ্বিতীয় আওয়ায তুললোঃ এই-ইতো তোমার ত্যাগ ও সবরের পরীক্ষা। উযরার প্রতি তোমার ভাইয়ের মহব্বত তো কম নয়, আর কুদরতের মনযুরও এই যে, উযরা আর আব্দুল্লাহ এক হয়ে থাকবেন। আত্মত্যাগী ভাই তোমার জন্য নিজের খুশীকে কোরবান করতে তৈরী হবেন, কিন্তু তা হবে যুলুম। যদি তুমি আব্দুল্লাহর কাছে সেই কোরবানীর দাবী কর, তাহলে তোমার আত্মা কখনো সন্তোষ লাভ করবে না সিন্ধুর উপকূল পর্যন্ত তোমার সন্ধান করে শেষ পর্যন্ত হতাশ হয়ে তিনি শাদী করছেন উযরাকে। তুমি বাহাদুর, তুমি মুজাহিদ, সংযত হয়ে থাক। উযরার জন্য চিন্তা কর না। সময় ধীরে ধীরে তার দীল থেকে মুছে ফেলবে তোমার স্মৃতির বেদনা। আর এমন কোন গুণ রয়েছে তোমার যা আব্দুল্লাহর ভিতরে নেই?

বিবেকের দ্বিতীয় আওয়াযই নয়ীমের কাছে ভালো লাগলো। তিনি অনুভব করলেন, যেন তার দীল থেকে নেমে যাচ্ছে এক অসহনীয় বোঝা। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে নয়ীমের দুনিয়া বদলে গেলো তার চোখে।

ঘরে যখন আব্দুল্লাহর ও উযরার শাদী পড়ানো হচ্ছে, নয়ীম তখন বাইরে গাছের নীচে সিজদায় মাথা নত করে দোআ করছেন, দীন দুনিয়ার মালিক! এ শাদীতে বরকত দাও। উযরা ও আব্দুল্লাহর সারা জীবন খুশি আনন্দে অতিবাহিত হোক। একে অপরের জন্য তাদের দীল-জান উৎসর্গিত হোক। সত্যিকার জীবন মরনের মালিক! আমার হিসসার তামাম খুশী তুমি ওদেরকে দাও।’

অনেকক্ষণ পর নয়ীম যখন সিজদাহ থেকে মাথা তুললেন মেহমানরা তখন চলে গেছে। মন চাইলো তিনি ছুটে গিয়ে ভাইকে মোবারকবাদ দিয়ে আসেন, কিন্ত আর একটি চিন্তা তাকে বাধা দিলো। তিনি ভাবলেন, ভাই তাকে দেখে খুশী হবেন নিশ্চয়ই, কিন্তু লজ্জাও হয়তো পাবেন। তিনি যে যিন্দহ রয়েছেন তাতে উফরার কাছে প্রকাশ করা চলে না। তার ফিরে আসা সম্পর্কে হতাশ হয়ে উযরা এতদিনে যে সবুর ও স্থিরতা লাভ করেছেন তা যে মুহূর্তের মধ্যে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। তিনি মরে গেছেন, মনে করে যদি তারা শাদী করে থাকনে, তাহলে উযার তামাম যিন্দেগী হবে অশান্তিপূর্ণ। তাকে দেখে তিনি লজ্জায় মরে যাবেন। উযরার পুরানো যখম আবার তা হয়ে উঠবে। তার চাইতে ভালো তিনি তাদের কাছ থেকে দূরে থাকবেন, তার দুর্ভাগ্যে শরীক করবেন না তাদেরকে। তার বিবেক এ চিন্তায় সায় দিলো। মুহূর্ত-মধ্যে মুজাহিদের দীলে জাগলো সুদৃঢ় প্রত্যয়। নয়ীম ফিরে চলবার আগে কয়েক কদম এগিয়ে গেলেন ঘরের দিকে; তারপর বেদনাতুর দৃষ্টি মেরে তাকালেন তার আশা-আকাঙ্খর শেষ সমাধির দিকে। ফিরে চলবার উপক্রম করতেই আঙিনায় কার পায়ের আওয়ায এলো তার কানে। তার মনোযোগ নিজের দিকে নিবদ্ধ হলো। আব্দুল্লাহর ও উযরা কামরা থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়ালেন আঙিনায়। তিনি মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিলেন, কিন্ত আব্দুল্লাহকে লেবাসের বদলে বর্ম পরিহিত ও উযরাকে তার কোমরে তলোয়ার বেঁধে দিতে দেখে তিনি হয়রান হয়ে দাঁড়ালেন দরযার আড়ালে। তখখুনি তিনি বুঝলেন যে, আব্দুল্লাহ জিহাদে যাচ্ছেন। এতে নয়ীমের হয়রান হবার কিছু নেই। এই প্রত্যাশাই তিনি করেছেন ভাইয়ের কাছে।

. আব্দুল্লাহ হাতিয়ার পরিধান করে আস্তাবল থেকে ঘোড়া নিয়ে এসে আবার দাঁড়ালেন উযরার সামনে।

‘উযরা, তুমি দুঃখ পাওনি তো? আব্দুল্লাহ হাসিমুখে তার দিকে চেয়ে প্রশ্ন করলেন।

‘না, আমারও তো মন চায় এমনি করে বর্ম পরে ময়দানে যেতে। উযরা মাথা নেড়ে জওয়াব দিলেন।

‘উযরা, আমি জানি, বাহাদুর তুমি, কিন্তু আজ সারাদিন আমি তোমার দিকে তাকিয়ে দেখেছি। আমি বুঝি, তোমার দীলের উপর আজও এক বোঝা চেপে রয়েছে, যা তুমি আমার কাছে গোপন করতে যাচ্ছে। নয়ীম যে ভুলে যাবার মতো ব্যক্তিত্ব নয়, তা আমার জানা আছে। উযরা! আমরা সবাই আল্লার তরফ থেকে এসেছি আর তারই কাছে ফিরে যাবো আমরা। সে যিন্দাহ থাকলে অবশ্যি ফিরে আসততা। সে আমার কম প্রিয় ছিলো, এমন কথা মনে করো না তুমি। আজও যদি আমার জান কোরবান করে দিয়ে তাকে ফিরিয়ে আনতে পারতাম, তাহলে হাসিমুখে আমি জান বাজি রাখতাম। হায়! তুমি ভাবতে, এ দুনিয়ায় আমিও কত একা? আমার মা ও নয়ীম চলে যাবার পর এ দুনিয়ায় আমার কেউ নেই। আমরা চেষ্টা করলে একে অপরকে খুশী রাখতে পারি।’

‘আমি চেষ্টা করবো। উযরা জওয়াব বললেন।

‘আমায় নিয়ে চিন্তা করো না, কেননা স্পেনে আমায় তেমন কোনো বিপজ্জনক অভিযানে যেতে হবে না। সে দেশ প্রায় বিজিত হয়ে গেছে। কয়েকটি এলাকা বাকী রয়েছে মাত্র। তাদেরও মোকাবিলা করবার তাকৎ নেই। শিগগীরই ফিরে এসে আমি তোমায় নিয়ে যাব সাথে। খুব বেশি হলে আমার ছ’মাস লাগবে।

আব্দুল্লাহ খোদা হাফিয’ বলে ঘোড়ায় সওয়ার হলেন। নয়ীম তাকে বাইরে আসতে দেখে কয়েক কদম দূরে দাঁড়িয়ে গেলেন এক খেজুর কুঞ্জের আড়ালে।

দরযার বাইরে এসে আব্দুল্লাহ উযার দিকে একবার ফিরে তাকিয়ে ঘোড়া হাঁকালেন দূর বিদেশের পথে।

*

ভোরের আলোর আভাস দেখা দিয়েছে। আব্দুল্লাহ ঘোড়া ছুটিয়ে চলেছেন গন্তব্য পথে। পেছন থেকে আর একটি ঘোড়ার পায়ের আওয়ায তার কানে এলো। তিনি ফিরে দেখলেন, এক সওয়ার আরও জোরে ছুটে আসছেন সেই পথে। আব্দুল্লাহ ঘোড়া থামিয়ে পিছনের সওয়ারকে দেখতে লাগলেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। পিছনের সওয়ারের মুখ লৌহ শিরাস্ত্রাণ দিয়ে ঢাকা। আব্দুল্লাহর মনে উদ্বেগ জাগলো। তিনি হাতের ইশারায় থামাতে চাইলেন তাকে। কিন্তু আব্দুল্লাহর ইশারার পরোয়ানা করে তিনি যথারীতি ছুটে চললেন তাকে ছাড়িয়ে। আব্দুল্লাহর উদ্বেগ আরও বেড়ে গেলো। তিনি পিছু পিছু ছোঁড়া ছুটালেন। আব্দল্লাহর তাযাদম ঘোড়া। অপর ব্যক্তিকে শাহসওয়ার মনে হলেও তিনি বেশি দূর এগিয়ে যেতে পারলেন না। তার ঘোড়ার মুখে তখন ফুটে উঠেছে ক্লান্তির চিহ্ন। আব্দুল্লাহ কাছে এসে নেযাহ বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,

তুমি দোন্ত হলে দাঁড়িয়ে যাও, আর দুশমন হলে মোকাবিলা জন্য তৈরী হও।’

দ্বিতীয় সওয়ার ঘোড়া থামালেন।

‘আমায় মাফ করুন। আব্দুল্লাহ বললেন, আমি জানতে চাচ্ছি, আপনি কে? আমার এক ভাই বিলকুল আপনারই মতো ঘোড়ার উপর বসততা আর ঠিক আপনারই মতো ঘোড়ার বাগ ধরতো। তার দেহটিও ছিল ঠিক আপনারই মতো। আমি আপনার নাম জিগগেস করতে পারি? সওয়ার নীরব।

‘আপনি কথা বলতে চান না…..? আমি জিগগেস করছি, আপনার নাম কি……..? আপনি বলবেন না?

সওয়ার এবারও নীরব হয়ে রইলেন।

‘মাফ করবেন, যদি মনোঃকষ্টের কারণে আপনি কথা না বলতে চান, তাহলে কমপক্ষে আপনার চেহারা দেখাতে কোনো আপত্তি থাকা উচিত হবে না। কোনো দেশের গুপ্তচর হলেও আমি আপনাকে না দেখে আজ যেতে দেবো না। এই কথা বলে আব্দুল্লাহ তার ঘোড়া আগন্তুকের ঘোড়ার কাছে নিয়ে গেলেন এবং আচানক নেযার মাথা দিয়ে তার শিরস্ত্রাণ তুলে ফেললেন। আগন্তুকের মুখের দিকে তাকিয়ে আব্দুল্লাহর মুখ থেকে নয়ীম’ বলে এক হালকা চীৎকার ধ্বনি বেরিয়ে এলো। নয়ীমের চোখ দিয়ে বয়ে চলেছে অবিশ্রান্ত অশ্রুধারা।

দু’ভাই ঘোড়া থেকে নেমে পরস্পর আলিংগনাদ্ধ হলেন।

‘ভারী বেওকুফ হয়েছো তুমি।’ আব্দুল্লাহ নয়ীমের পেশানীর উপর হাত বুলিয়ে বললেন, কমবখত! এতটা আত্মাভিমান? আর এ তো আত্মাভিমানও নয়। তোমার কিছুটা বুদ্ধি থাকা উচিত ছিলো আর এও তো ভাবা উচিত ছিল যে তোমার মা তোমার জন্য ইনতেযার করছেন। তোমার ভাই তোমার সন্ধান করে বেরিয়েছে সারা দুনিয়ায় আর উযরাও বস্তির উঁচু টিলায় চড়ে তোমার পথের দিকে তাকিয়ে রয়েছে, কিন্তু কোনো কিছুর পরোয়া করলে না তুমি। খোদা জানেন, কোথায় লুকিয়ে ছিলে এতকাল। এ তুমি কি করলে?

নয়ীম কোন জবাব না দিয়ে ভাইয়ের সামনে নীরবে দাঁড়িয়ে রইলেন। দীলের কথাগুলো ফুটে বেরুচ্ছে তার চোখ দিয়ে। আব্দুল্লাহ তার নীরবতায় অবিভূত হয়ে নয়ীমকে আর একবার বুকে চেপে ধরে বললেন, কথা বলছো না তুমি। আমার উপর তোমার এতটা বিদ্বেষ যে, মুখ ঢেকে চলে যাচ্ছিলে আমার পাশ দিয়ে! কোত্থেকে এসে কোথায় চলে যাচ্ছো তুমি? আমি সিন্ধুতে তোমার খোঁজ করে কোন সন্ধান পাইনি। কেন তুমি ঘরে এলে না?’ নয়ীম এক ঠান্ডা শ্বাস পেলে বললেন, ভাই, আমার ঘরে ফিরে আসা খোদার মনযুর ছিলো না।’

‘কোথায় ছিলে তুমি? আব্দুল্লাহ শুধালেন।

তার প্রশ্নের জওয়াবে নয়ীম তার কাহিনী সংক্ষেপে বর্ণনা করলেন, কেবল বললেন না জোলায়খার কথা। আরো বললেন, যে আগের রাত্রে তিনি ঘরের বাইরে দাঁড়িয়েছিলেন। নয়ীমের কথা শেষ হলে দু’ভাই পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

আব্দুল্লাহ প্রশ্ন করলেন, কয়েদ, থেকে মুক্তি পেয়েও তুমি ঘরে এলে না কেন? নয়ীমের মুখে জওয়াব নেই। নির্বাক হয়ে রইলেন।

‘এখন ঘরে না গিয়ে কোথায় চলেছো?’ আব্দুল্লাহ প্রশ্ন কররেন।

ভাই আমি ইবনে সাদেককে গ্রেফতার করবার জন্য বসরা থেকে কিছু সিপহী আনতে যাচ্ছি।’

আব্দুল্লাহ বললেন, আমি তোমায় একটি কথা জিজ্ঞেস করবো। আশাকরি, তুমি মিথ্যে বলবে না।

জিজ্ঞেস করুন।’

তুমি বল, কয়েদ থেকে মুক্তি পাবার পর কেউ তোমায় বলেছিলো যে, উযরার শাদী হতে চলেছে?

নয়ীম মাথা নেড়ে অস্বীকৃতি জানালেন।

‘এখন তুমি জানতে পেরেছ যে উযরার শাদী আমার সাথে হয়েছে?

‘জি হাঁ! আমি আপনাকে মোবারকবাদ দিচ্ছি? তুমি বস্তি হয়ে এসেছো? আব্দুল্লাহ প্রশ্ন করলেন।

হাঁ।’ নয়ীম জওয়াব দিলেন।

‘ঘরে গিয়েছিলে?

না।’

‘কেন? নয়ীম নির্বাক হয়ে গেলেন।

আব্দুল্লাহ বললেন, ‘আমি জানি, তোমার উপর আমি যুলুম করেছি মনে করে তুমি ঘরে যাওনি।’

‘আপনার ধারণা ভুল। আপনার ও উমরার উপর যুলুম করতে চাইনি বলেই আমি ঘরে ফিরে যাইনি। আনি জানি, আপনি আমার ফিরে আশা সর্ম্পকে হতাশ হয়েছিলেন এবং ভেবেছিলেন যে, উযরা দুনিয়ায় একা আর আপনাকে তার প্রয়োজন। আমি আর একবার ঘরে ফিরে পুরানো যখমগুলো তাযা করে দিয়ে উযরার যিন্দেগী তিক্ত বিস্বাদ করে দিতে চাইনি। প্রকৃতির ইশারা বারংবার আমায় বুঝিয়ে দিয়েছে যে, উযরা আমার জন্য নয়, তকদীর আপনাকেই সে আমানতের মোহাফেয মনোনীত করে নিয়েছে। তকদীরের বিরুদ্ধে লড়াই করতে চাই না আমি। উযরা আপনাকে আর আপনি উযরাকে খুশী রাখতে পারবেন, এই এনি আছে বলেই আমি খুশী হয়েছি। আপনাদের উভয়ের খুশীর চাইতে বড় আর কোন আকাংক্ষা নেই আমার। আপনি আমার ও উমরার একটা উপকার করবেন। উযরার দীলে এ খেয়াল কখনও আসতে দেবেন না যে, আমি যিন্দাহ রয়েছি। আপনার সাথে আমার দেখা হয়েছে, একথা ওকে বলবেন না কোনোদিন।

নয়ীম, আমার কাছে কি গোপন করতে চাও? এতো এমন কোন রহস্য নয়, যা আমি বুঝতে পারি না। তোমার চোখ, তোমার মুখভাব, তোমার চেহারা, তোমার কথা, তোমার কণ্ঠস্বর প্রকাশ করছে যে, তুমি এক জবরদস্ত বোঝার তলায় পিষ্ট হচ্ছো। উযরা শুধু আমার মন রাখবার জন্য এ কোরবাণী করেছে এবং তাও এই খেয়ালে যে, সম্ভবত…..।’

‘সম্ভবতঃ আমি মরে গেছি। নয়ীম আব্দুল্লাহর অসমাপ্ত কথাটি পূরণ করে দিলেন।

ওই, নয়ীম, তুমি আমায় আর শরম দিওনা। আমি তোমায় বহুত তালাশ করেছি, কিন্তু…..

‘খোদার মনযুর এই-ই ছিল।’ নয়ীম আব্দুল্লাহর কথায় বাধা দিয়ে বললেন। নয়ীম! নয়ীম! তুমি কি মনে করছো যে, আমি….।’ আব্দুল্লাহ আর কিছু বলতে পারলেন না। তার চোখ দুটি অশ্রু ভারাক্রান্ত হয়ে উঠলো। তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন। ভাইয়ের সামনে এক বেগুনাই আসামীর মত।

নয়ীম বললেন, ভাই। একটা মামুলী কথার উপর এতটা গুরুত্ব কেন দিচ্ছেন আপনি?

আব্দুল্লাহ জওয়াব দিলেন, হায়! এ যদি সত্যি সত্যি মামুলি কথা হতো। এছিলো আম্মির নির্দেশ যে, উযরাকে যেন একা ছেড়ে না দিই। কিন্তু সে তোমায় আজও ভোলেনি। সে তোমারই। তোমার ও উযরার খুশীর জন্য আমি তাকে তালাক দিয়ে দেবো। তোমাদের দুজনের ভেঙে যাওয়া ঘর আবার আবাদ করে দিয়ে আমি যে কি সন্তোষ লাভ করবো, তা আমিই জানি।’

‘ভাই, খোদার ওয়াস্তে এমন কথা বলবেন না। এমন কিছু বললে আমাদের তিনজনেই যিন্দেগীই হয়ে যাবে তিক্ত-বিস্বাদ, আমার নিজের চোখে আমি ছোট হয়ে যাবো। আমাদের উচিত তকদীরের উপর শোকরগুযারী করা।’

‘কিন্ত আমার বিবেক আমায় কি বলবে? নয়ীম তার মুখের উপর এক আশ্বাসের হাসি টেনে এনে বললেন, আপনার শাদীতে আমার মরমীও শামিল ছিলো।

‘তোমার মরী? তা কি করে?

কাল রাত্রে আমি সেখানেই ছিলাম।

‘কোন সময়ে?

‘আপনার নিকাহ হবার খানিকক্ষণ আগে থেকেই আমি বাড়ির বাইরে থেকে সব অবস্থা জেনেছিলাম।

‘ঘরে কেন এলে না?

নয়ীম নির্বাক হয়ে থাকলেন।

‘এই জন্যে যে, তুমি তোমার স্বার্থপর ভাইয়ের মুখ দেখতে চাওনি।’

না, সে জন্য নয়। আল্লার কসম, সে জন্য নয়, বরং আমি আমার বেগর ভাইয়ের সামনে নিজের স্বার্থপরতা দেখাতে যাওয়া লজ্জাজনক মনে করেছি। আপনারই শেখানো একটি সবক আমার দীলের মধ্যে ছিল আঁকা!

‘আমার সবক’!

আমায় আপনি সবক দিয়েছিলেন যে, যে আকর্ষণ ত্যাগের মনোভাব বর্জিত, তাতে মহব্বত বলা যায় না।’

‘তোমার ভিতরে এ ইনকেলাব কি করে এল, ভেবে আমি হয়রান হচ্ছি। সত্যি করে বলো তো, আর কারুর কল্পনা তোমার দীলে উযরার জায়গা তো দখল করেনি? আমার মনে এ সন্দেহ জাগেনি কখনো, তবু গোড়ার দিকে উযরা আম্মির কাছে এমনি সন্দেহ প্রকাশ করতো। আমার একিন ছিলো যে, জিহাদের এক অসাধারণ মনোভাব তোমায় টেনে নিয়ে গেছে সিন্ধুর পথে। কিন্তু তবু মাঝে মাঝে আমার সন্দেহ জেগেছে যে, তুমি জেনে শুনে হয়তো শাদী এড়িয়ে চলেছে। তোমার ঘরে ফিরে না আসার কারণ যদি তাই হয়, তুব তুমি ভাল করনি।’

নয়ীম নির্বাক। কি জওয়াব দেবেন, তা তিনি জানেন না। তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো ছেলেবেলার একটি ঘটনা। যেদিন তিনি উযরাকে নিয়ে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, সেদিন আব্দুল্লাহ তারই জন্য না-করা অপরাধের বোঝা কাঁধে নিয়ে তাকে বাঁচিয়েছিলেন সাজা থেকে। তিনিও আজ এক না করা অপরাধ স্বীকার করে ভাইয়ের মনে এনে দিতে পারেন সন্তোষ।

নয়ীমের নীরবতায় আব্দুল্লাহর মনের সন্দেহ আরও বদ্ধমূল হলো। তিনি নয়ীমের বায়ু ধরে ঝাঁকানী দিয়ে বললেন, বল নয়ীম।

নয়ীম চমকে উঠে আব্দুল্লাহর মুখের উপর দৃষ্টি নিবন্ধ করে হেসে বললেন, হাঁ ভাই। আমি দীলের মধ্যে আর একজনকে জায়গা দিয়ে ফেলেছি,

আব্দুল্লাহ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘এখন বল, তাকে তুমি শাদী করেছ কিনা?

না।

‘কেন, এর মধ্যে কোন মুশকিল রয়েছে কি?

না।’

শাদী কবে করবে?

শিগগীরই।’

‘ঘরে কবে ফিরে যাবে?

ইবনে সাদেকের গ্রেফতারির পরে।

আচ্ছা, আমি বেশি কিছু জিজ্ঞেস করব না তোমায়। খুব শিগগীরই আমার আন্দলুস পৌঁছে যাবার হুকুম না হলে আমি তোমার শাদী দেখে যেতে পারতাম। ফিরে আসা পর্যন্ত আমি এ প্রত্যাশা করতে পারি যে, তুমি ইবনে সাদেককে গ্রেফতার করার পর ঘরে ফিরে আসবে? ইনশাআল্লাহ দু’ভাই পাশাপাশি হয়ে ঘোড়ায় সওয়ার হলেন। নয়ীম প্রকাশ্যে আব্দুল্লাহকে আশ্বাস দিলেও তার দীল কাঁপছে তখনও। আব্দুল্লাহর উপর্যুপরি প্রশ্নের আঘাতে তিনি ঘাবড়ে উঠেছেন। তামাম রাস্তায় তিনি ভাইয়ের কাছে প্রশ্ন করতে লাগলেন আন্দালুস সম্পর্কে। প্রায় দু’ক্রোশ পথ চলবার পর এক চৌরাস্তায় এসে দু’জনের পথ আলাদা হয়ে গেছে। তার কাছে এসে নয়ীম মোসাফেহার জন্য আব্দুল্লাহর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে এজাযত চাইলেন।

আব্দুল্লাহর হাত নয়ীমের নিজের হাতে নিয়ে শুধালেন, নয়ীম। যা কিছু তুমি আমায় বললে, সব সত্য, না আমার মন রাখবার জন্য বললে এসব কথা?

‘আমার উপর আপনার বিশ্বাস নেই?

‘আমার বিশ্বাস আছে তোমার উপর।

‘আচ্ছা, খোদাহাফিয।’

আব্দুল্লাহ নয়ীমের হাত ছেড়ে দিলেন। নয়ীম মুহূর্তমাত্র বিলম্ব না করে দ্রুত ঘোড়া ছুটালেন। যতক্ষণ না নয়ীমের ঘোড়া তার দৃষ্টির আড়ালে চলে গেলো, ততক্ষণ আব্দুল্লাহ্ নয়ীমের কথাগুলো নিয়ে চিন্তা করতে থাকলেন। নয়ীম তার নরের বাইরে চলে গেলে তিনি হাত তুলে দোআ করলেনঃ ওগো দীন দুনিয়ার মালিক! উযরা আমার জীবন সংগিনী হবে, এই যদি হয় তোমার মনযুর, তা হলে আমার তকদীরের বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই। ওগো মাওলা! নয়ীম যা কিছু বললো, তা যেনো সত্য হয়। আর যদি তা সত্য নাও হয়ে থাকে তুমি তাকে সত্য করে দেখাও। তার প্রেমিকা যেন এমন কেউ হয়, যাকে নিয়ে সে ভুলে যেতে পারে উযরাকে। ওগো রহীম! ওর দীলের ভেঙ্গে পড়া বস্তিকে আবার আবাদ করে দাও। আমার কোনও নেকী যদি তোমার রহমতের হকদার হয়ে থাকে, তা হলে তার বদলায় তুমি নয়ীমকে দান করো দুনিয়া ও আখেরাতের সুখ-শান্তি।’

নয়ীমের বসরায় পৌঁছবার আগেই ইবনে সাদেককে গ্রেফতার করবার চেষ্টা চলছিলো, কিন্তু তার কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। নয়ীম বসরার ওয়ালীর সাথে মোলাকাত করলেন। তাকে নিজের অতীত দিনের কাহিনী শুনিয়ে তিনি আবার সিন্ধুতে ফিরে যাবার ইরাদা জানালেন।

নয়ীম যন্দিাহ ফিরে আসায় বসরার ওয়ালী আনন্দ প্রকাশ করে বললেন, সিন্ধু বিজয়ের জন্য একমাত্র মুহাম্মদ বিন কাসিমই যথেষ্ট। তিনি ঝড়ের মতো রাজা মহারাজাদের পংগপালের মত অগুনতি সেনাদলকে দলিত করে সিন্ধুর সর্বত্র উডডীন করছেন ইসলামী পতাকা। এখন তুর্কিস্তানের বিরাট মুলুক পূর্ণ বিজয়ের জন্য চাই নিপুন যোদ্ধা। কুতায়বা বোখরার উপর হামলা করেছেন, কিন্তু সফল হতে পারেননি। কুফা ও বসরা থেকে প্রচুর ফউজ চলে যাচ্ছে। পরশু এখান থেকে রওয়ান হয়ে গেছে পাঁচশ সিপাহী। চেষ্টা করলে আপনি রাস্তায় তাদের সাথে মিলিত হতে পারবেন। মুহাম্মদ বিন কাসিম নিঃসন্দেহে আপনার দোস্ত, কিন্তু কুতায়বা বিন মুসলিমের মত বাহাদুর সিপাহসালারের গুণগ্রহিতাও মশহুর হয়েছেন সর্বত্র। তিনি কদর করবেন আপনাকে। আমি তার কাছে চিঠি লিখে দিচ্ছি।

নয়ীম বেপরোয়া হয়ে জওয়াব দিলেন, কেউ আমার কদর করবে, সেজন্য তো আমি জিহাদে আসিনি। আমার মকসুদ হচ্ছে খোদার হুকুম মেনে চলা। আমি আজই এখান থেকে রওয়ানা হচ্ছি। আপনি ইবনে সাদেকের খেয়াল রাখবেন। তার অস্তিত্বই দুনিয়ার জন্য বিপজ্জনক।

তা আমি জানি। তাকে খতম করবার আমি সবরকম চেষ্টাই করছি। দরবারে খিলাফত থেকে তার গ্রেফতারীর হুকুম জারী হয়ে গেছে, কিন্তু এখনও আমরা পাইনি তার সন্ধান। তার সম্পর্কে আপনিও হুঁশিয়ার থাকবেন। হতে পারে, সে হয়ত তুর্কিস্তানের দিকেই পালিয়ে গেছে।’

নয়ীম বসরা থেকে বিদায় নিলেন। যিন্দেগীর অগুনতি বিপদের ঝড় বয়ে গেছ তার উপর দিয়ে, কিন্তু মুজাহিদের ঘোড়ার গতি আর আকাংখা আজও রয়েছে অব্যাহত।

নয়

মুহম্মদ বিন কাসিম সিন্ধুর উপর হামলা করবার কিছু আগে কুতায়বা বিন মুসলিম বাহেলী জৈহুন নদী পার হয়ে তুর্কীস্তানের কয়েকটি রাজ্যের উপর হামলা করেন এবং কয়েকটি বিজয়ের পর কতকটা ফউজ ও রসদের অভাবে এবং কতকটা শীতের অতিশয্যে ফিরে আসেন মরভে। গরমের মওসুম এলে তিনি আবার ছোটখাটো ফউজ নিয়ে পার হয়ে যান জৈহুন নদী এবং জয় করেন আরো কয়েকটি এলাকা।

কুতায়বা বিন মুসলিম প্রতি বছর গরমের মওসুমে জয় করে নিতেন তুর্কিস্তানের কোনো কোনো অংশ এবং শীতের মওসুমে ফিরে আসতেন মরভে। হিজরী ৮৭ সালে তিনি বিন্দ নামে তুর্কিস্তানের এক মশহুর শহরের উপর হামলা করলেন। হাজার হাজার তুর্কিস্তানী এসে জমা হলো শহর হেফাযত করতে। ফউজ ও রসদের অভাব সত্তেও কুতায়বা আত্মবিশ্বাস ও সহিষ্ণুতা সহকারে শহর অবরোধ রাখলেন অব্যাহত। দুমাস পর শহরবাসীদের উদ্যম আর রইলো না। শেষ পর্যন্ত তারা হাতিয়ার সমর্পণ করলো।

বিকন্দ জয়ের পর কুতায়বা রীতিমতো তুর্কিস্থান জয়ের জন্য হামলা চালিয়ে যেতে লাগলেন। হিজরী ৮৮ সালে সুনয়েদের এক শক্তিশালী ফউজের সাথে হলো এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। এই যুদ্ধে জয়লাভ করে কুতায়বা তুর্কিস্তানের আরও কয়েকটি রাজ্য জয় করে এসে পৌঁছলেন বোখারার চার দেয়াল পর্যন্ত। শীতের মওসুমে সামরিক সরঞ্জামহীন ফউজ বেশী সময় অবরোধ চালিয়ে যেতে পারলো না। কুতায়বা সেখান থেকে বিফল মনেরথ হয়ে ফিরলেন, কিন্তু হিম্মৎ হারালেন না। কয়েক মাস পরেই তিনি আবার বোখরা অবরোধ করলেন। এই অবরোধ চলবার সময়ে নয়ীম এসে কুতায়বার সাথে যোগ দিয়েছেন বসরার পাঁচশ সওয়ার সাথে নিয়ে। কয়েক দিনেই তিনি হয়েছেন বাহাদুর ও সমরকুশলী সিপাহসালারের অন্তরংগ বন্ধু। বোখারা অবরোধের মাঝখানে কুতায়বার সামনে এলো কঠিন বিপদ।

কেন্দ্র থেকে দূরে এসে পড়াই ছিলো তার অসুবিধার বড় কারণ। এখানে প্রয়োজনের সময়ে ফউজ ও রসদ-সাহায্যে ঠিক সময় মতো পৌঁছা সহজ ছিলো না মোটেই। বোখরার বাদশার সাহায্যের জন্য এসে সমবেত হলো তুর্ক ও অন্যান্য দলের বেসুমার ফউজ। মুসলমান শহরের পাঁচিলের উপর মিনজানিকের সাহায্যে পাথর ছুঁড়ছিলো এবং শেষ হামলার জন্য তারা তৈরী হয়েছিলো। ইতিমধ্যে পেছন থেকে তুর্কদের এক শক্তিশালী ফউজ এসে দেখা দিলো। মুসলিম বাহিনী শহরের খেয়াল ছেড়ে দিয়ে পেছন থেকে আগত ফউজের দিকে মনোযোগ দিল, কিন্তু তারা মযবুত হয়ে দাঁড়াবার আগেই শহরে বাসিন্দারা বেরিয়ে এসে হামলা করলো তাদের উপর। মুসলিম বাহিনী উভয় ফউজের হামলার নাগালের মধ্যে এসে পড়লো। একদিক দিয়ে বাইরের হামলা মাথার উপর এসে গেছে, অপরদিকে শহরের ফউজ করছে তীরবর্ষণ। মুসলিম বাহিনীর মধ্যে দেখা দিলো বিশৃংখলা। মুসলিম সিপাহীরা যখন পিছপা হচ্ছে, তখন আরব নারীরা তাদেরকে বাধা দিয়ে তাদের ভিতরে সঞ্চার করলো নতুন উদ্দীপনা। মুসলমান আবার শুরু করলো জীবনপণ লড়াই, কিন্ত তাদের সৈন্যসংখ্যা নগণ্য। তুর্করা দুদিক দিয়ে ফউজের মাঝখানে এসে মহিলাদের খিমায় পৌঁছে যাবার উপক্রম করছিলো। তখন আরব যোদ্ধারা আর একবার যিন্দাহ করে তুললো তাদের পূর্বপুরুষের শৌর্যবীর্যের ঐতিহ্য। তারা উঠতে উঠতে পড়ছে, আবার পড়তে পড়তে উঠে যাচ্ছে, এমনি করে তারা নতুন করে জাগিয়ে তুলছে কাদসিয়া ও ইয়ারমুকের স্মৃতি। দুশমনে দুরন্ত ঝড়ের উপর জয়ী হবার জন্য কুতায়বা মনে মনে স্থির করলেন এক কৌশল। ফউজের কতক অংশ সরিয়ে নিয়ে অপর দিক দিয়ে শহরে প্রবেশ করতে হবে, অথচ মাঝখানে রয়েছে এক গভীর নদী। শহর হেফাযতের জন্য তা করছে খন্দকের কায়। কুতায়বা যখন এই কৌশল চিন্তা করছেন তখন নয়ীম ঘোড়া ছুটিয়ে এলেন তার কাছে। তিনিও একই পরামর্শ দিলেন।

কুতায়বা বললেন, আমিও এই কৌশলই চিন্তা করছিলাম, কিন্তু কে এ কোরবাণীর জন্য তৈরী হবে?’

আমি যাচ্ছি।,’ নয়ীম বললেন, ‘আমায় কিছু সিপাহী দিন।’

কুতায়বা হাত প্রসারিত করে বললেন, এমন যোদ্ধা কে আছে, যে এই নওজোয়ানের সাথে যেতে রাযী?

প্রশ্ন শুনে ওয়াকি ও হারিম নামে দু’জন তমিমী সরদার হাত প্রসারিত করে দিয়ে সম্মতি জানালো। তাদের সাথে শামিল হলো তাদের জামায়াতের আটশ যোদ্ধা। নয়ীম সেই জীবনপণ যোদ্ধাদের সাথে নিয়ে বিপক্ষ সেনাবাহিনীর সারি ভেদ করে বেরিয়ে গেলেন ময়দানের বাইরে। তারপর একটা লম্বা পথ ঘুরে গিয়ে পৌঁছলেন তারা শহরের উত্তর-পশ্চিম কোণের দিকে। তার ডানে-বায়ে ছিল তমিমী সওয়ারের দল। শহরের পাঁচিল ও তাদের মাঝখানে খন্দকের মত এক নদী। নয়ীম আর তার সাথী তমিমী সরদার নদীর কিনারে দাঁড়ালেন মুহূর্তকালের জন্য। নদীর প্রস্থ ও গভীরতা আন্দাজ করে নিয়ে ঘোড়া থেকে নেমে আল্লাহ আকবর ধ্বনি করে ঝাঁপিয়ে পড়লেন নদীর পানিতে। পাঁচিলের ভিতর দিকে ছিল এক বিরাট গাছ। তার একটা শাখা পাঁচিলের উপর দিয়ে ঝুঁকে পড়েছিল নদীর দিকে। নয়ীম সাঁতার কেটে অপর কিনারায় গিয়ে সেই শাখায় ফাঁস ফেলে গাছ বেয়ে গেলেন পাঁচিলের উপর এবং সেখান থেকে রঙ্গুর সিঁড়ি ছুঁড়ে দিলেন সাথীদের দিকে। ওয়াকি ও হারিম সেই সিঁড়ি বেয়ে পাঁচিলে উঠে ছুঁড়ে দিলো আরও কয়েকটি সিঁড়ি। এমনি করে নদীর অপর কিনার দিয়ে মুজাহিদ বাহিনী পালা করে উঠতে লাগলো পাচিলের উপর। একশ যোদ্ধা এমনি করে পাঁচিলের উপর উঠে গেলো। সহসা অপ্রত্যাশিতভাবে নয়ীমের নযরে পড়লো যে, প্রায় পাঁচশ সিপাহীর একটি দল এগিয়ে আসছে। নয়ীম পঞ্চাশজন সিপাহী সেখানে রেখে বাকী পঞ্চাশজনকে নিয়ে শহরের দিকে নেবে গেলেন এবং এক প্রশস্ত বাজারের মধ্যে পৌঁছে তাদের মোকাবিলা করতে দাঁড়িয়ে গেলেন। কিছুক্ষণের জন্য তারা তাদেরকে বিব্রতকর রাখলেন। এরই মধ্যে তামাম মুসলিম ফউজ পাচিল পার হয়ে শহরে ঢুকে গেছে। তখন আর তুর্ক সিপাহীদের হাতিয়ার সমর্পণ ছাড়া আর কোনো উপায় রইল না। নয়ীম তার কতক সাথীকে শহরে সর্বত্র ইসলামী ঝান্ডা উড়িয়ে দিতে বলে তিনি বাকী সিপাহীদের সাথে নিয়ে গেলেন। শহরের তামাম দর দখল করে নেবার হুকুম দিলেন। শহরের বড়ো দরযার দিকে সেখানে কয়েকজন পাহারাদারকে মৃত্যুর পথে ঠেলে দিয়ে খন্দকের পুল উপরে তুলে দিলেন।

শহর মুসলমানদের দখরে চলে গেছে, সে খবর তুর্ক সেনাবাহিনীর জানা ছিলো। অই তারা বিজয়ের আশা নিয়ে জীবন-পণ লড়াই করে যাচ্ছিলো। নয়ীম মুসলিম মুজাহিদদের হুকুম দিলেন পাঁচিলের উপরে উঠে তুর্কদের উপর তীরবর্ষণ করতে। শহরের দিক থেকে তীরবর্ষণ তুর্কদের মনে হতাশ সৃষ্টি করলো। পিছনে ফিরে তাদের নযরে পড়লো শহরে মুসলমান তীরন্দায ও উড্ডীয়মান ইসলামী ঝান্ডা।

ওদিকে কুতায়বা এ দৃশ্য দেখে কঠিন হামলার হুকুম দিলেন। খানিক্ষণ আগে মুসলমানদের যে অবস্থা ছিলো, এখন তুর্কদের অবস্থা ঠিক তেমনি। পরাজয়ের সময়ে শহরে মযবুত দেওয়ালের ভিতর আশ্রয় ভরসা ছিলো তাদের, কিন্ত সেদিকেও তখন মৃত্যুর ভয়ানক রূপ পড়ছে তাদের নযরে। যারা এগিয়ে গেছে সামনের দিকে, তারা দাঁড়িয়ে আছে মুসমানদের প্রস্তর বিদীর্ণকারী তলোয়ারের মুখোমুখি। যারা পিছন দিকে হটছে, তারা ভয় করছে ভয়াবহ তীরবর্ষণের। জান বাঁচাবার জন্য তারা ছুটতে লাগলো ডানে-বায়ে এবং দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে অগুণতি সৈনিক গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো খন্দকের মধ্যে।

এ মুসীবত শেষ করে দিয়ে মুসলিম বাহিনী মনোযোগ দিলো পিছন থেকে হামলাকারী ফউজের দিকে। প্রথমেই তারা শহর মুসলমানদের দখলে দেখে হিমমৎ হারিয়ে ফেলেছে। মুসলমানদের হামলার তীব্রতা সহ্য করতে না পেরে বেশির ভাগ পালালো ময়দান ছেড়ে এবং আরও অনেকে হাতিয়ার সমর্পণ করে দিলো।

কুতায়বা বিন মুসলিম ময়দান খালি দেখে এগিয়ে গেলেন। শহরে দরযায় পৌঁছে তিনি ঘোড়া থেকে নামলেন এবং আল্লার উদ্দেশ্যে সিজদায় অবনমিত হলেন। নয়ীম ভিতর থেকে খন্দকের পুল পেতে দেবার হুকুম দিলেন এবং ওয়াকি ও হারীমকে সাথে নিয়ে এগিয়ে এলেন বাহাদুর সিপাহসালারের অভ্যর্থনার জন্য। কুতায়বা বিন মুসলিমের সাথে সাথে নয়ীমের নামও হয়ে উঠলো আলোচনার বিষয়বস্তু। তার দীলের পুরানো যখম ধীরে ধীরে মিটে গেলো। তার উচ্চ চিন্তাধারা বিজয়ী হলো স্বাভাবিক কামনার উপর। তখন তলোয়ারের ঝংকার তার কাছে প্রেমের কমনীয় সুর ঝংকারের চাইতেও মুগ্ধকর। ভাই ও উমরার খুশী তার কাছে নিজের খুশীর চাইতেও প্রিয়তর হয়ে দেখা দিলো। তার অন্তরের দোআ তখন বেশী করে তাদেরই জন্য উৎসারিত হতে লাগলো।

কোন অবসর মুহূর্তে তিনি যখন খানিকটা চিন্তা করার সুযোগ পান তখনই তার মনে খেয়াল জাগে, হয়তো ভাই উযরাকে বলে দিয়েছেন যে আমি যিন্দাহ রয়েছি। হয়তো এখন তারা আমার সম্পর্কে আলাপ করছেন। উযরার মনে হয়তো সত্যি সত্যি প্রত্যয় জন্মেছে যে, আমি আর কোন নারীকে অন্তরে স্থান দিয়েছি। দীল দিয়ে সে হয়তো আমায় ঘৃণা করছে। হয়তো সে আমায় ভুলেই গেছে। হাঁ, আমায় ভুলে যাওয়াই ভালো তার পক্ষে।

আন্তরিক দো’আ সাথে শেষ হয় এ সব চিন্তার। তিন বছর এমনি করে কেটে গেলো। কুতায়বার সেনাবাহিনী বিজয় ও সৌভাগ্যের ধ্বজা উড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ছে তুর্কিস্তানের চারদিকে। নয়ীম হয়েছেন অসাধারণ খ্যাতির অধিকারী। দরবারে খিলাফতে এক চিঠি লিখে কুতায়বা নয়ীমের সম্পর্কে জানিয়েছেন, এই নওজোয়ানের বিজয়ে আমি নিজের বিজয়ের চাইতেও বেশী গৌরব বোধ করছি।

*

হিজরী ৯১ সালে তুর্কিস্তানের অনেকগুলো রাজ্যে ধুমায়িত হয়ে উঠলো বিদ্রোহের লেলিহান অগ্নিশিখা। এই আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে দূর থেকে তামাশা দেখছিলো সেই ইবনে সাদেক। নয়ীম মুক্তি পেয়ে যাবার পর প্রাণের ভয় হয়ে উঠেছে ইবনে সাদেকের নিত্যসহচর। সে পালিয়ে এসেছে কেল্লা ছেড়ে। পথে বদনসীব ভাতিজীর সাথে দেখা হলে সে দুবৃত্ত চাচার হাতে কয়েদ হবার চাইতে মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে।

জানের ভয় ইবনে সাদেকে পেয়ে বসেছে। সে তার অনুচরদের সাথে নিয়ে চললো তুর্কিস্তানের দিকে। সেখানে পৌঁছে সে তার বিচ্ছিন্ন দলকে সংহত করতে শুরু করলো এবং কিছুটা শক্তি সঞ্চয় করে তুর্কিস্তানের পরাজিত শাহযাদাদের মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করে এক চুড়ান্ত লড়াইয়ের প্রস্তুতি চালাতে লাগলো।

তুর্কিস্তানের গণ্যমান্য লোকদের মধ্যে একজন ছিলো নাযযাক। ইবনে সাদেক তার সাথে দেখা করে প্রকাশ করলো তার ধারণা। আগে থেকেই নাযযাক বিদ্রোহ ছড়াবার চেষ্টায় লিপ্ত ছিলো। তার প্রয়োজন ছিলো ইবনে সাদেকের মত মন্ত্রনাদাতার। স্বভাবের দিক দিয়ে দু’জন ছিলো অভিন্ন। ন্যযাক চাইতো তুর্কিস্তানের বাদশাহ হতে, আর ইবনে সাদেকের আকাংখা ছিলো শুধু তুর্কিস্তানের নয়, বরং তামাম ইসলামী দুনিয়ার তার নামের খ্যাতি ছড়িয়ে দেওয়া। নযযাক ওয়াদা করলো যে, তুর্কিস্তানের উপর আধিপত্য বিস্তার করতে পারলে সে ইবনে সাদেককে বানাবে তার উযিরে আযম। ইবনে সাদেক তাকে দিলো সাফল্যের আশ্বাস।

তুর্কিস্তানের লোকদের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠতো কুতায়বার নামে। বিদ্রোহের কথা শুনলে তারা ঘাবড়ে যেতো, কিন্ত ইবনে সাদেকের দুষ্ট পরামর্শ তাদের কাছে নিষ্ফল হলো না। যার কাছেই সে যায়, তাকে বলে, তোমাদের রাজ্য তোমাদেরই জন্য। অপর কারুর কোনো অধিকার নেই তার উপর। আকলমন্দ লোক অপরের হুকুমাত মেনে নিতে পারে না। ইবনে সাদেক ও নযকের চেষ্টায় তুর্কিস্তানের বহুসংখ্যক বিশিষ্ট শাহযাদা ও সরদার এসে জমা হলো এক পুরানো কেল্লায়। এই জনসমাবেশে নাযযাক এক লম্বা চওড়া বক্তৃতা করলো। নাযযাকের বক্তৃতার পর চললো দীর্ঘ বিতর্ক। কয়েকজন বৃদ্ধ সরদার মুসলমানদের শান্তিপূর্ণ হুকুমাতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ঝান্ডা তোলার বিরোধিতা করলেন। অবস্থা নাযুক দেখে ইবনে সাদেক কি যেন বললো নায়কের কানে।

নাযযাক তার জায়গা ছেড়ে উঠে বললো, দেশপ্রেমিক জনগণ! আমায় আফসোসের সাথে বলতে হচ্ছে, পূর্বপুরুষের খুন আর আপনাদের মধ্যে অবশিষ্ট নেই। এখন আপনাদের কাছে কিছু বলতে চান আমাদের এক সম্মানিত মেহমান। আপনারা গোলাম বলেই আপনাদের প্রতি তার হামদর্দী। নাযযাক কথাটি বলেই বসে পড়লো। ইবনে সাদেক উঠে বক্তৃতা শুরু করলো। মুসলমানদের খেলাপ যতটা বিদ্বেষ প্রচার তার সাধ্যায়ত্ত, তার সবই সে করলো। তারপর সে বললো, শাসক কওম গোড়ার দিকে শাসিত কওমকে গাফলতের ঘুম পাড়াবার জন্য কঠোর রূপ নিয়ে দেখা দেয়, কিন্ত শাসিত কওম যখন আরামের যিন্দেগীতে অভ্যস্ত হয়, বাহাদুরীর ঐশ্বর্য থেকে বঞ্চিত হয়ে যায়, তখন শাসকরা তাদের কর্মনীতি পরিবর্তন করে ফেলে। ইবনে সাদেক তুর্ক সরদারদের প্রভাবিত হতে দেখে আরও জোর আওয়াযে বললো, মুসলমানদের বর্তমান নরম নীতি দেখে মনে করবেন না যে, তারা হামেশা এমনি থাকবে। শিগগীরই তারা আপনাদের উপর এমন যালেমের রূপ নিয়ে দেখা দেবে যা আপনারা কল্পনাও করতে পাবেন না। আপনারা শুনে হয়রান হবেন যে, কিছুকাল আগে আমিও ছিলাম মুসলমান, কিন্ত আধিপত্য লোভী এই কওম সারা দুনিয়ার আযাদ কওমকে গোলাম বানাবার জন্য এগিয়ে যাচ্ছে দেখে আমি তাদের কওম থেকে আলাদা হয়ে গেছি। আপনারা তাদেরকে আমার চাইতে ভাল করে জানেন না। এরা চায় দৌলত আর শিগরীই দেখবেন যে, তারা এ মুলুকে একটি কানাকড়িও অবশিষ্ট রাখবে না। আর যদি তা না-ও হয়, তাহলে আপনাদের স্ত্রী-কন্যাকে দেখবেন শাম ও আরবের বাজারে বিক্রি হতে। ইবনে সাদেকের কথায় প্রভাবিত হয়ে তামাম সরদার পরস্পরের দিকে তাকাতে লাগলো।

এক বৃদ্ধ সরদার উঠে বললেন, তোমাদের কথায় অনিষ্টের আভাষ পাওয়া যাচ্ছে। আমরা নিজেরাও বেশক মুসলমানদের গোলামীকে খারাপ জানি, কিন্ত দুশমনের সম্পর্কেও মিথ্যা কথায় একিন আনা আমাদের জন্য ঠিক হবে না। মুসলমান শাসিত কওমের ইযযত ও দৌলত হেফাযত করে না, এ এক কল্পিত কাহিনী মাত্র। ইরানে গিয়ে আমি স্বচক্ষে দেখেছি, সেখানকার লোক নিজেদের হুকুমতের চাইতেও বেশী খুশী রয়েছে মুসলমানদের হুকুমাতে। দেশপ্রেমিক জনগণ! নাযযাক ও এই লোকটির কথায় বিভ্রান্ত হয়ে লোহার পাহাড়ের সাথে সংঘর্ষ লাগানোর চেষ্টা করা সংগত হবে না আমাদের পক্ষে। এই নতুন লড়াইয়ে জয়লাভের বিন্দুমাত্র উম্মীদ যদি আমি দেখতে পেতাম, তাহলে সবার আগে আমি নিজেই হাতে নিতাম বিদ্রোহের ঝান্ডা। কিন্তু, আমি জানি আমাদের বাহাদুরী সত্ত্বেও এ কওমের মোকাবিলা করতে আমরা পারবো না। রুম ও ইরানের মতো প্রবল শক্তি যাদের সামনে মস্তক অবনত করেছে, যে কওমের সামনে দরিয়া ও সমুদ্র সংকুচিত হয়ে যায়, আকাশচুম্বী পর্বত যাদের কাছে শির অবনত করে, তাদের উপর বিজয় হাসিল করবার কল্পনাও মনে এনো না তোমরা। আমি মুসলমানদের পক্ষে ওকালতি করছি না। কিন্তু একথা আমায় বলতেই হবে যে, আমাদের অবশিষ্ট শক্তিটুকু লোপ হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না এ বিদ্রোহের পরিণাম। এর ফলে হাজারো বাচ্চা হবে এতীম আর হাজারো নারী হবে বিধবা! কওমের গলায় ছুরি চালিয়ে নাযযাক চায় নিজের সুখ্যাতি। আর এ লোকটি কে আর কি তার মকসুদ, তা আমার জানা নেই।’

ইবনে সাদেক এ আপত্তির জওয়াব আগেই চিন্তা করে রেখেছে। সে আর একবার শ্রোতাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে বক্তৃতা শুরু করলো : বৃদ্ধ সরদারের মোকাবিলায় তার দুষ্ট বুদ্ধি অনেক বেশি। তাছাড়া অভিনয় সে জানে। মুখের উপর এক কৃত্রিম হাসি টেনে এনে সে আপত্তির জওয়াব দিতে লাগলো। তার যুক্তির সামনে বুড়ো সরদারের কথাগুলো লোকের মনে হলো অবাস্তব। বড় বড় সরদার তার যাদুতে ভুললো এবং আযাদী ও বিদ্রোহের আওয়ায তুলে শেষ হলো জলসা।

*

রাতের বেলা কুতায়বা বিন মুসলিমের খিমায় জ্বলছে কয়েকটি মোমবাতি এবং এক কোণে জ্বলছে আগুনের কুণ্ড। কুতায়বা শুকনো ঘাষের গালিচায় বসে একটি নকশা দেখছেন। তাঁর মুখের উপর গভীর উদ্বেগের চিহ্ন সুপরিস্ফুট। নকশা ভাঁজ করে এক পাশে রেখে তিনি উঠে পায়চারী করে গিয়ে দাঁড়ালেন খিমার দরযায় এবং দূরে তাকিয়ে দেখতে লাগলেন বরফপাতের দৃশ্য। অনতিকাল মধ্যে গাছের পেছন থেকে এক সওয়ার এসে হাযির হলেন। কুতায়বা তাকে চিনতে পেরে এগিয়ে গেলেন কয়েক কদম আগে। কুতায়বাকে দেখে সওয়ার ঘোড়া থেকে নামলেন। এক পাহারাদার এসে ধরলো ঘোড়ার বাগ।

কি খবর নিয়ে এলে, নয়ীম?’ কুতায়বা প্রশ্ন করলেন।

নাযযাক এক লাখের বেশী ফউজ সংগ্রহ করেছে। আমাদের শিগগিরই তৈরী হওয়া দরকার।’

কুতায়বা ও নয়ীম কথা বলতে বলতে খিমার ভিতরে দাখিল হলেন। নয়ীম নকশা তুলে কুতায়বাকে দেখাতে দেখাতে বললেন, “এই যে দেখুন! বলখ থেকে প্রায় পঞ্চাশ ক্রোশ উত্তর-পূর্বে নাযযাক তার ফউজ একত্র করেছে। এই জায়গাটির দক্ষিণ দরিয়া আর বাকী তিন দিকে পাহাড় ও নিবিড় বন। বরফপাতের দরুন এ পথ অতি দুর্গম কিন্তু গরমের দিনের প্রতীক্ষা করা আমাদের ঠিক হবে না। তুর্কদের উৎসাহ দিনের পর দিন বেড়ে যাচ্ছে। মসুলমানদের তারা হত্যা করে চলেছে

নির্মম-নিষ্ঠুরভাবে। সমরকন্দেও রয়েছে বিদ্রোহের সম্ভাবনা।

কুতায়বা বললেন, ইরান থেকে যে ফউজ আসবে, তাদের জন্য ইনতেযার করতে হবে আমাদের। তারা পৌঁছ গেলেই আমরা হামলা করবো।’

কুতায়বা ও নয়ীমের আলাপের মধ্যে এক সিপাহী খিমায় এসে বললো, এক তুর্ক সরদার আপনার মোলাকাত প্রার্থী।

তাকে নিয়ে এস।’ কুতায়বা বললেন।

সিপাহী চলে যাবার খানিকক্ষণ পরেই এক বৃদ্ধ সরদার খিমায় দাখিল হলেন। তিনি ছিলেন পুস্তিন ও সামুরের টুপি পরিহিত। তিনি ঝুঁকে পড়ে কুতায়বাকে সালাম করে বললেন, সম্ভবতঃ আপনি আমায় চিনতে পারছেন। আমার নাম নিযক।

‘আমি আপনাকে ভাল করেই চিনি। বসুন।

নিযক কুতায়বার সামনে বসে পড়লেন। কুতায়বা তার আগমনের কারণ জানতে চাইলেন।

নিযক বললেন, আমি আপনাকে বলতে এসেছি, আপনি আমাদের কওমের উপর কঠোর হবেন না।’

কঠোর! কুতায়বা দ্রুকুঞ্চিত করে বললেন, ‘বিদ্রোহিদের সাথে যে আচরণ করা হয়, তাই করা হবে তাদের সাথে। তারা মুসলিম শিশু ও নারীর রক্তপাত করতেও দ্বিধা করছে না।’

কিন্তু ওরা বিদ্রোহী নয়। নিযক গাম্ভীর্যের সাথে জওয়াব দিলেন, ‘ওরা বেঅকুফ। এ বিদ্রোহের পূর্ণ যিম্মাদারী আপনাদেরই এক মুসলমান ভাইয়ের।

আমাদের ভাই? কে সে?

‘ইবনে সাদেক।’ নিযক জওয়াব দিলেন।

নয়ীম এতক্ষণ মোমবাতি আলোয় বসে নকশা দেখছিলেন। ইবনে সাদেকের নাম শুনে তিনি চমকে উঠলেন। ইবনে সাদেক!’ তিনি নিযকের দিকে তাকিয়ে বললেন।

হাঁ, ইবনে সাদেক।

‘সে লোকটি কে?’ কুতায়বা প্রশ্ন করলেন।

নিযক জওয়াবে বললেন, “সে তুর্কিস্তানে এসেছে দু’বছর আগে এবং তার কথার যাদুতে তুর্কিস্তানের সকল গণ্যমান্য লোককে আপনাদের হুকুমাতের খেলাফ বিদ্রোহ করতে প্ররোচিত করেছে। এর বেশি তার সম্পকে আমি কিছু জানি না।’

‘আমি তার সম্পর্কে অনেক কিছুই জানি।’ নয়ীম নকশা ভাঁজ করতে করতে বললেন, “আজকাল কি সে তবে নায়কের সাথে রয়েছে?

না, সে কোকদের কাছে ওজওয়াক নামক স্থানে পাহড়ী লোকদের জমা করে নায়কের জন্য এক ফউজ তৈরী করছে। সম্ভবত সে হুকুমাতে চীনের সাহায্য হাসিল করবারও চেষ্টা করবে।’

নয়ীম কুতায়বার উদ্দেশ্যে বললেন, আমি বহুদিন ধরে এই লোকটির খুঁজে বেড়াচ্ছি। সে যে আমার এত কাছে, তা আমি জানতাম না। আপনি আমায় এজাযত দিন। ওকে অবিলম্বে গ্রেফতার করে আনা নেহায়েত জরুরী।

কিন্তু লোকটি কে তাওতো জানতে হবে আমায়।

‘সে আবু জেহেলের চাইতে বড় ইসলামের দুশমন, আব্দুল্লাহ বিন উবাইর চাইতে বড় মোনাফেক, সাপের চাইতে বেশী ভয়ানক আর শিয়ালে চাইতেও বেশী ধূর্ত। তার তুর্কিস্তানে থাকায় প্রতি মুহূর্তে বিপদের সম্ভাবনা রয়েছে। ওর দিকে আমাদেরকে অবিলম্বে নজর দিতে হবে।’

কিন্তু এই মওসুমে? কোকেন্দের পথে রয়েছে বরফের পাহাড়।

‘তা যাই থাক, আপনি আমায় এজাযত দিন। নয়ীম বললেন, ‘কোকন্দে কোন বিপদের সম্ভাবনা নেই মনে করে সে ওখানে রয়েছে। সম্ভবতঃ সে শীতের মওসুম ওখানে কাটিয়ে গরমের দিনে আর কোনও নিরাপদ জায়গা খুঁজে নেবে।

কবে যেতে চাও তুমি?’

‘এই মুহূর্তে। নয়ীম জওয়াব দিলেন, আমার একটি মুহূর্ত অপচয় করাও ঠিক হবে না।’

‘এ সময়ে বরফপাত হচ্ছে। ভোরে চরে যাবে। এইমাত্র তুমি এক দীর্ঘ সফর থেকে ফিরে এলে। খানিকক্ষণ আরাম কর।

যতক্ষণ এ আপদ যিন্দাহ রয়েছে, ততক্ষণ আরামের অবকাশ নেই আমার। এখন একটি মুহূর্তের অপচয় আমি গুনাহ মনে করি। আমায় এজাযত দিন। কথাটি বলেই নয়ীম উঠে দাঁড়ালেন।

‘আচ্ছা দু’শ সিপাহী তোমার সাথে নিয়ে যাও।’

নিযক হয়রান হয়ে বললেন, আপনি এক কোনন্দে পাঠাচ্ছেন মাত্র দুশ সিপাহী সাথে নিয়ে! পাহাড়ী লোকদের লড়াইর তরিকা আপনি জানেন? বাহাদুরীর দিক দিয়ে দুনিয়ার কোন কওমের চাইতে কম নয় তারা। ওর উচিত বেশ বড় রকমের ফউজ নিয়ে যাওয়া। ইবনে সাদেকের কাছে সব সময় মওজুদ থাকে পাঁচশ সশস্ত্র নওজোয়ান। এখন পর্যন্ত কত ফউজ সে একত্র করেছে তাই বা কে জানে?

নয়ীম বললেন, ‘এক বুযদীল সালার তার সিপাহীদের মধ্যে বাহাদুরীর ঐশ্বর্য পয়দা করতে পারে না। যদি সেই ফউজের সালার ইবনে সাদেক হয়ে থাকে তাহলে এত সিপাহীও দরকার হবে না আমার।’

কুতায়বা মুহূর্তকাল চিন্তা করে নয়ীমকে তিনশ সিপাহী সাথে নিয়ে যাবার হুকুম দিলেন। তারপর তাকে কয়েকটি নির্দেশ দিয়ে বিদায় করে দিলেন।

এক মুহূর্ত পর কুতায়বা ও নিযক খিমার বাইরে দাঁড়িয়ে দেখলেন, নয়ীম এক ক্ষুদ্রাকার ফউজ নিয়ে অতিক্রম করে যাচ্ছেন সামনের এক পাহাড়ী পথ।

‘বহুত বাহাদুর ছেলে। নিযক কুতায়বাকে বললেন।

‘হাঁ, ও এক মুজাহিদের বেটা। কুতায়বা জওয়াব দিলেন।

আপনারা কেন এত বাহাদুর, আমি জিজ্ঞেস করতে পারি? নিক আবার প্রশ্ন করলেন।

কেননা আমরা মওতকে ভয় করি না। মওত আমাদের কাছে নিয়ে আসে এক উষ্ণতর যিন্দেগীর খোশখবর। আল্লার জন্য যিন্দাহ থাকবার আকাংখা ও আল্লারই পথে মৃত্যুবরণ করবার উদ্যম পয়দা করে নেবার পর কোন মানুষেরই মনে অন্যকোনো বড়ো শক্তির ভয় থাকতে পারে না।

‘আপনদের কওমের প্রত্যেক ব্যক্তিই কি এমনি বাহাদুর?

হাঁ, যারা তওহীদ ও রেসালাতের উপর সাচ্চা দীলে ঈমান আনে, তাদের প্রত্যেকেই এমনি।’

*

ইবনে সাদেক কোকন্দের উত্তরে একটি নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় নিয়ে দিন যাপন করছে। এক উপত্যকার চারদিকে উঁচু পাহাড় তার জন্য এক অপরাজেয় প্রাচীরের কাজ করছে। পাহাড়ী এলাকার দুর্দান্ত বাসিন্দারা ছোট ছোট দলে এসে জমা হচ্ছে সেই উপত্যকায়। ইবনে সাদেক এই লোকগুলোকে সোজা পথে কাটিয়ে দিচ্ছে নাযযাকের কাছে। তার গুপ্তচর তাকে এনে দেয় মুসলমাদের প্রতিনিধির খবর। মুসলমান শীতের মওসুম শেষ না হলে লড়াই শুরু করবে না। এই ধারণা নিয়ে আশ্বস্ত ছিলো ইবনে সাদেক। তার আরও বিশ্বাস ছিলো যে, প্রথমতঃ অতদূর থেকে মুসলমান তার চক্রান্তের খবর পাবে না। আর যদি খবর পেয়েও যায়, তথাপি শীতের দিনে এদিকে আসতে পারবে না। যদি শীতের পর তারা এ পথে আসেও তাহলে খোদার দুনিয়া বহু দুর বিস্তৃত।

একদিন এক গুপ্তচরের কাছ থেকে নয়ীমের অগ্রগতির খবর পেয়ে সে খুবই ঘাবড়ে গেল।

তার সাথে কত ফউজ রয়েছে? ইবনে সাদেক খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে নিজেকে সামলে নিয়ে প্রশ্ন করলো।

মাত্র তিনশ সিপাহী।’ গুপ্তচর জওয়াব দিলো।

কুল্পে তিনশ লোক? এক তাতারী নওজোয়ান অট্টহাস্য করে বললো।

ইবনে সাদেক বললো, তুমি হাসছ কেন? এই তিনশ,ফউজ আমার চোখে চীন ও তুর্কিস্তানের তামাম ফউজের চাইতেও বেশি বিপজ্জনক।’

তাতারী বললো, আপনি একিন রাখবেন, ওরা এখানে পৌঁছাবার আগেই আমাদের পাথরের তলায় চাপা পড়ে থাকবে।

নয়ীমের কল্পনা ইবনে সাদেকের কাছে মৃত্যুর চাইতেও ভয়ানক। তার কাছে সাতশর বেশী তাতারী মওজুদ রয়েছে, তথাপি তার মনে বিজয়ের একিন নেই। সে জানে, খোলা ময়দানে মুসলমানের মোকাবিলা করা খুবই বিপজ্জনক। সে তামাম পাহাড়ী রাস্তায় পাহাড়া বসিয়ে নয়ীমে ইনতেজার করতে লাগলো।

নয়ীম ইবনে সাদেকের সন্ধান করতে করতে গিয়ে বেরুলেন কোকন্দের উত্তর পূর্ব দিকে। এখানকার অসমতল যমিনের উপর দিয়ে ঘোড়া এগুতে লাগলো অতি কষ্টে। উঁচু পাহাড়-চুড়ায় ঝলমল করছে জামাট বরফপ্প! নীচের উপত্যকাভূমির কোথাও কোথাও ঘন বন। কিন্তু বরফ পাতের মওসুমে বনের গাছ পালা পত্রহীন। নয়ীম এক উঁচু পাহাড়ের পাশের সংকীর্ণ পথ দিয়ে যাচ্ছেন। অমনি আচানক পাহাড়ের উপর থেকে তাতারীরা শুরু করলো তীরবর্ষণ। কয়েকজন সওয়ার যখমী হয়ে ঘোড়া থেকে পড়ে গেলো এবং ফউজের মধ্যে দেখা দিল বিশৃংখলা। পাঁচটি ঘোড়া সওয়ার সমেত গিয়ে পড়লো এক গভীর খাদের মধ্যে। নয়ীম সিপাহীদের ঘোড়া থেকে নামবার হুকুম দিয়ে পঞ্চাশ জনকে পাহাড় থেকে খানিকটা দূরে একটা নিরাপদ জায়গায় ঘোড়াগুলো নিয়ে যেতে বললেন এবং বাকী আড়াইশ সিপাহী সাথে নিয়ে তিনি পায়দল এগিয়ে চললেন পাহাড়ের উপর। তখনো যথারীতি পাথরবর্ষণ চলছে। মুসলমানরা মাথার উপর ঢাল ধরে পাহাড়ারে চূড়ায় উঠতে উঠতে নয়ীমের ষাটজন সিপাহী পড়ে গেছে পাথরের আঘাত খেয়ে। নয়ীম তার বাকী লোকদের নিয়ে পাহাড় চূড়ায় মযবুত হয়ে দাঁড়িয়ে হামলা করলেন। মুসলমানদের অসাধারণ ধৈর্য দেখে তাতারীদের উৎসাহে ভাটা পড়লো। তারা চারদিক থেকে সরে এসে একত্র হতে লাগলো। ইবনে সাদেক মাঝখানের দাঁড়িয়ে উৎসাহ দিচ্ছে হামলা করতে। তা উপর নয়ীমের নযর পড়তেই তিনি জোশের আতিশয্যে আল্লাহু আকবর আওয়ায করে হাতে তলোয়ার আর অপর হাতে নেযাহ নিয়ে পথ সাফ করে এগিয়ে চললেন। তাতারীরা ক্রমাগত ময়দান ছেড়ে পালাতে লাগলো। ইবনে সাদেক তখন প্রাণের ভয়ে অস্থির। সে তার অবশিষ্ট ফউজকে ফেলে পালালো একদিকে। নয়ীমের চোখ তারই দিকে নিবন্ধ। তাকে পালাতে দেখে নয়ীম তার পিছু ধাওয়া করলেন। ইবনে সাদেক পাহাড় থেকে নেবে গেলো নীচে। প্রয়োজনের সময়ে নিজে বাঁচবার বন্দোবস্ত সে আগেই করে রেখেছিলো। পাহাড়ের নীচে একটি লোক দাঁড়িয়েছিল দুটি ঘোড়া নিয়ে। ইবনে সাদেক ঝট করে এক ঘোড়ায় চেপে ছুটে চললো। তার সাথী কেবলমাত্র রেকাবে পা রেখেছে অমনি নয়ীম নেযাহ মেরে তাকে ফেলে দিল নীচে। তারপর ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে ছুটে চললেন ইবনে সাদেকের পিছু পিছু।

নয়মের ধারণা মোতাবেক ইবনে সাদেক ছিলো শিয়ালের চাইতেও বেশী ধুর্ত। পরাজয় নিশ্চিত দেখলে কি করে নিজের জান বাঁচাতে হবে পুরো ইনতেযাম সে আগেই করে রেখেছে। নয়ীম আর ইবনে সাদেকের মাঝখানে দূরত্ব বড় বেশী নয়। কিন্তু কিছুক্ষণ তার অনুসরণ করার পর নয়ীম বুঝলেন যে, তাদের মাঝখানের দূরত্ব বেড়ে যাচ্ছে ক্রমাগত, আর তার ঘোড়াও ইবনে সাদেকের ঘোড়র তুলনায় অপেক্ষকৃত কম চলতে পারে। তবু নয়ীম তার পিছু ছাড়তে পারলেন না এবং তাকে চোখের আড়াল হতে দিলেন না।

ইবনে সাদেক পাহাড়ী পথ ছেড়ে উপত্যকার দিকে চললো। উপত্যকায় মাঝে মাঝে ঘন গাছপালা। এক জায়গায় ঘনসন্নিবিষ্ট গাছপালার নীচে ইবনে সাদেক কয়েকজন সিপাহী দাঁড় করিয়ে রেখেছে। সে ছুটে পালাতে পালাতে তাদেরকে ইশারা করলো, অমনি তারা গা ঢাকা দিলো গাছের আড়ালে। নয়ীম যখন সেই গাছের পাশ দিয়ে যাচ্ছেন তখন এক তীর এসে লাগলো তার বায়ুতে, কিন্তু তিনি ঘোড়ার গতিবেগ হ্রাস করলেন না।

খানিকক্ষণ পর আর একটি তীর লাগলো তার পিছন দিকে। তারপর আর একটি তীর এসে ঘোড়ার পিঠে পড়তেই ঘোড়া ছুটে চললো আরও দ্রুতগতিতে। নয়ীম তার বায়ু ও পিছন দিক থেকে তীর টেনে বের করলেন কিন্তু ইবনে সাদেকের পিছু ছাড়লেন না। আর ও কিছুদূর চলবার পর একটি তীর এসে লাগলো নয়ীমের কোমরে। আগেই প্রচুর রক্তপাত হয়েছে তার দেহ থেকে। তৃতীয় তীর লাগবার পর তার দেহের শক্তি নিঃশেষ হয়ে আসতে লাগলো, কিন্তু যতক্ষণ জ্ঞান থাকল, ততক্ষণ মুজাহিদের হিম্মৎ থাকলো অটুট। ততক্ষণ তিনি ঘোড়র গতিবেগ কম হতে দিলেন না। গাছের সারি শেষ হয়ে গেল, এবার দেখা দিল প্রশস্ত ময়দান। ইবনে সাদেক অনেকখানি আগে চলে গেছে, কমযোরী নয়ীমের উপর জয়ী হচ্ছে। তার চোখে নেমে আসছে নিবিড় অন্ধকার। তার মাথা ঘুরছে, কানের ভিতরে শ শ করছে। নিরুপায় হয়ে ঘোড়া থেকে নামতেই তিনি বেহুশ হয়ে পড়লেন যমিনের উপর উপুর হয়ে। বেঁহুশ অবস্থায় তার কয়েক মুহূর্ত কাটলো। যখন কিছুটা হুশ ফিরে এল, তখন তার কানে ভেসে এলো কারুর দূরাগত সংগীতের আওয়াম। বহুদিন এমন মধুর আওয়ায নয়ীমের কানে আসেনি। বহুক্ষণ নয়ীম অজ্ঞানের মত পড়ে শুনলেন সে সুরঝংকার। অবশেষে তিনি হিম্মৎ করে মাথা তুললেন। তার কাছেই চরে বেড়াচ্ছে কয়েকটি ভেড়া। যে গান গাইছে তাকে দেখতে চান নয়ীম, কিন্তু দুর্বলতার দরুন আবার তার চোখের সামনে নামলো অন্ধকারের পরদা এবং তিনি নিরুপায় হয়ে মাথা রাখলেন যমিনের উপর। একটি ভেড়া নয়ীমের কাছে এলো এবং নয়ীমের কানের কাছে মুখ নিয়ে তার দেহের ঘ্রাণ নিতে লাগলো। তারপর তার নিজের ভাষায় আওয়ায দিয়ে ডাকলো আর একটি ভেড়াকে। দ্বিতীয় ভেড়াটিও তেমনি আওয়াম করে বাকী ভেড়াগুলোকে খবর দিয়ে এগিয়ে এলো। কিছুক্ষণের মধ্যে অনেকগুলো ভেড়া নয়ীমের আশেপাশে জমা হয়ে কোলাহল শুরু করলো। এক তুর্কিস্তানী তরুণী ছড়ি হাতে ভেড়ার ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চাগুলোকে তাড়িয়ে যথারীতি গান গেয়ে চলেছে। একই জায়গায় এতগুলো ভেড়ার সমাবেশ দেখে সে এগিয়ে এলো। ভেড়াগুলোর মাঝখানে নয়ীমকে রক্তাক্ত পড়ে থাকতে দেখে সে চীৎকার করে উঠলো। তারপর কয়েক কদম দূরে দাঁড়িয়ে আঙুল কামড়াতে লাগলো হতবুদ্ধির মতো।

নয়ীম বেঁহুশ অবস্থার মধ্যে একবার মাথা তুলে দেখলেন, তার সামনে দাঁড়িয়ে তারই দিকে তাকিয়ে রয়েছে প্রকৃতির সৌন্দর্যের পরিপূর্ণ প্রতিচ্ছবি এক পাহাড়ী যুবতীর রূপ নিয়ে। দীর্ঘ আকৃতির সাথে দৈহিক স্বাস্থ্য, নিখুঁত অঙ্গপ্রত্যংগ মিলিত হয়ে তার নিষ্পাপ সৌন্দর্যকে যেনো আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। তার মোটা অমসৃণ কাপড়ের তৈরী লেবাস তার স্বাভাবিক সৌন্দর্যকে ম্লান করেনি। সামুরের একটা টুকরা তার গর্দানে জড়ানো। মাথায় টুপি। সুন্দরী তরুনীর মুখ খানিকটা লম্বা এবং তাতে তার মুখখানাকে যেন গম্ভীর করে দিয়েছে। বড় বড় কালো উজ্জ্বল চোখ, নওবাহারের ফুলের চাইতেও মুগ্ধকর পাতলা নাযুক ঠোঁট, প্রশস্ত ললাট ও মযবুত চিবুক-সবকিছু মিলে তাকে করে তুলেছে অপরূপ। নয়ীম এবার তার দিকে তাকিয়ে দেখলেন উযরার রূপ, আর একবার দেখলেন জোলায়খার প্রতিচ্ছবি। যুবতী নয়ীমের দেহে রক্তের দাগ দেখে খানিকক্ষণ হতভম্ব হয়ে নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকার পর সাহস করে কাছে এগিয়ে বললো, আপনি কি যখমী?

নয়ীম তুর্কিস্তানের থেকে তাতারী জবানের যথেষ্ট জ্ঞান লাভ করেছেন। সুন্দরী তরুণীর প্রশ্নে জওযাব না দিয়ে তিনি উঠে বসতে চাইলেন, কিন্তু পারলেন না, মাথা ঘুরে বেঁহুশ হয়ে পড়ে রইলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *