০১. সূর্য কতোবার পূর্ব দিকে

মরণজয়ী – নসীম হিজাযী

অনুবাদ: সৈয়দ আবদুল মান্নান

অনুবাদকের কথা

উর্দু সাহিত্যের জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক নসীম হিজাযীর বিখ্যাত ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘আখেরী চটান’-এর বাংলা তরজমা গত বছর শেষ প্রান্তর’ নামে আত্মপ্রকাশ করেছে। বর্তমান গ্রন্থ তার অন্যতম উপন্যাস দাস্তান-ই-মুজাহিদ’ এর বাংলা তরজমা।

১৯৬০ সালের গোড়ার দিকে মূল লেখক যখন পাকিস্তান লেখক সংঘের প্রথম বার্ষিক উৎসব উপলক্ষে ঢাকায় আসেন, তার আগেই শেষ প্রান্তর এর পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করে রেখেছিলাম। মূল লেখক তখন বর্তমান গ্রন্থের তরজমার জন্য আমায় অনুরোধ করেন এবং সেই বছরের প্রথমার্ধের মধ্যেই আমি এ গ্রন্থের তরজমা শেষ করি। এছাড়া লেখকের আরো যে দুখানি উপন্যাস তরজমার ভার আমার উপর ন্যস্ত ছিলো, তার একখানি এখনো অসমাপ্ত রয়েছে। আশা করি, আল্লাহর ফজলে অনতিকালের মধ্যে তার তরজমা কার্য সমাপ্ত হবে।

জাতীয় কল্যাণের উদ্দেশ্য নিয়ে দেশের বিভিন্ন অংশের জনগণের মধ্যে নিবিড় পরিচয় ও সম্প্রীতি সৃষ্টির মাধ্যম হিসাবে বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশিত সাহিত্যের তরজমা অপরিহার্য প্রয়োজন সরকারী-বেসরকারী উভয় মহলেই স্বীকৃতি লাভ করেছে। দীর্ঘকাল ধরে আমি অনুবাদকর্মে আত্মনিয়োগ করেছি এবং ইতিমধ্যে আমার বেশ কয়েকখানি অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। আরো কয়েকটি অনুবাদ গ্রন্থ এখন মুদ্রণ প্রতীক্ষায়।

বর্তমান গ্রন্থ আমাদের তরুণ-মনে দেশ ও ধর্মের জন্য আল্লার পথে জীবনের সর্ব কোরবান করে মৃতুঞ্জয়ী হবার সংকল্প জাগিয়ে তুললেই আমার শ্রমের সার্থকতা।

সৈয়দ আবদুল মান্নান
হক ভিলা লেক সার্কাস,
উত্তর ধানমন্ডি ঢাকা-১০০০।

প্রকাশকের কথা

মরণজয়ী উপন্যাসটি সু-সাহিত্যিক সৈয়দ আবদুল মান্নান অনূদিত দান ই-মুজাহিদ’-এর বাংলা অনুবাদ। প্রখ্যাত উর্দু ঔপন্যাসিক নসীম হিজাযী বাংলাভাষী পাঠক সমাজে অত্যন্ত সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব। তার প্রায় সব উপন্যাসই বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়েছে।

প্রকৃতপক্ষে ইতিহাসকে পাঠক সমাজে উপস্থাপন করার জন্যেই নসীম হিজাযী উপন্যাস রচনা করেছেন। তিনি ইতিহাস দরদী ঔপন্যাসিক। উপন্যাসের বিনোদনের জন্য তিনি ইতিহাসের সত্যকে বিকৃত করেননি। তথাপি একথা নিৰ্বিধায় বলা চলে, উপন্যাসের বিনোদন মোটেও ক্ষুণ্ণ হয়নি।

১৯৬৪ ইং সালে মরণজয়ী উপন্যাসটি বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি লিঃ কর্তক প্রথম প্রকাশিত হয়। ১০ম সংস্করণ প্রকাশিত হয় ২০১৩ সনে। পাঠকের চাহিদা অনুযায়ী বর্তমানে এর ১১তম সংস্করণ প্রকাশিত হলো। বইটি পাঠক সমাজে সমাদৃত হয়েছে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।

এস এম রইসউদ্দিন
পরিচালক (প্রকাশনী)
বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি লিঃ

প্রসঙ্গ কথা

মরণজয়ী উপন্যাসটি নসীম হিজাযী রচিত উর্দু উপন্যাস দাস্তানে মুজাহিদ’-এর বাংলা অনুবাদ। দীর্ঘদিন ধরে এ পুস্তকটি আমাদের অনুবাদ সাহিত্যে এক বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে। ১৯৬৪ সনে বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি লিঃ এর অনুবাদ প্রথম প্রকাশ করে। অল্প সময়ের মধ্যেই এর দ্বিতীয় মুদ্রনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলেও নানাবিধ সীমাবদ্ধতার কারণে দীর্ঘ দুই দশক পর এর দ্বিতীয় মুদ্রণ প্রকাশিত হয়। পাঠক মহলের চাহিদার প্রেক্ষিতে অতঃপর ১৯৮৯-এ এর তৃতীয় সংস্করণ এবং ১৯৯৬ সালে চতুর্থ প্রকাশিত হলে অদ্রুিত তা শেষ হয়ে যায়। অতঃপর ২০০৩ সালে পঞ্চম সংস্করণ প্রকাশিত হয় তাও শেষ হয়ে যায়। এক্ষণে এর ৬ষ্ঠ সংস্করণ মুদ্রণ করে বাংলাভাষী পাঠকবৃন্দের হাতে তুলে দিতে পেরে আমরা আনন্দিত।

বাংলায় অনুদিত নসীম হিজাযীর আরো কয়েকটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে ‘শেষ প্রান্তর’, ‘খুন রাঙা পথ’, ‘ভেঙ্গে গেল তলোয়ার’, মুহাম্মদ ইব্‌ন কাসিম’ইত্যাদি। এক সময় এ অনুবাদ গ্রন্থগুলো বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের মধ্যে নসীম হিজাযী ও তাঁর উপন্যাস সম্পর্কে প্রভূত কৌতূহল ও আগ্রহ সৃষ্টি করেছিল। মরণজয়ী’

এর এবারের প্রকাশনাও পাঠক মহলে সমানভাবে আদৃত হবে সন্দেহ নেই।

পাঠক মহলে ঔপন্যাসিক নসীম হিজাযীকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়ার প্রয়োজন নেই। উপমহাদেশের সার্থক ঐতিহাসিক ঔপন্যাসিকদের মধ্যে সম্ভবতঃ তিনি অন্যতম। জাতীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্যের পটভূমিকায় রচিত তাঁর উপন্যাসগুলো নৈতিক অবক্ষয় প্রতিরোধ, মূল্যবোধ জাগরণে এবং জাতিসত্ত্বার স্বকীয় অনুভূতির উজ্জীবনে ফলপ্রসূ ও সুদূরপ্রসারী অবদান রেখেছে। বস্তুত নসীম হিজাযীর উপন্যাসের ভিন্নরূপ স্বাদ, বৈশিষ্ট এবং স্বতন্ত্র সাহিত্যমূল্যের কথা বিবেচনা করে বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি লিঃ তার সবগুলো উপন্যাস বাংলায় অনুবাদের গ্রন্থসত্ত্ব গ্রহণ করেছিল।

রসজ্ঞ পাঠক মহলের সাগ্রহ সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতায় নসীম হিজাযীর অন্যান্য পুস্তকগুলোসহ প্রকাশনা কার্যক্রম বাস্তবায়নে আমাদের অনুপ্রেরণা জোগাবে বলে আশা করি।

এ.জেড.এম.শামসুল আলম
সভাপতি

আমাদের কথা

সাহিত্য জীবনের প্রতিচ্ছবি, আর ইতিহাস জাতির দর্পণ। দর্পণের আলোতে জাতি আত্মপরিচয়ের সৌভাগ্য ভাল করে ভবিষ্যতের চলার পথের সন্ধান পেতে পারে। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখার মধ্যে উপন্যাস সমাজের যে প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে তা জাতিকে তার নিগূঢ়তর নিবিড়তর পরিচয় লাভে সাহায্য করে। উপন্যাস, সে সামাজিক হোক অথবা ঐতিহাসিক, বৃহত্তর ক্যানভাসে সমাজের তথা সমাজের মানুষদের প্রতিকৃতি অংকন করে। সামাজিক উপন্যাসে যেমন একটি সমাজ কথা কয়ে ওঠে, ঐতিহাসিক উপন্যাসে তেমনি কথা কয়ে ওঠে জাতির ইতিহাস। ইতিহাস পুস্তকে আমরা অতীতের নিরেট ঘটনাবলীর বিবরণ পাই। কিন্তু সেই নিরেট ঘটনাবলী ঘটেছিল ফেলে আসা যে জীবন্ত সমাজে, তার প্রতিচ্ছবি পাই ঐতিহাসিক উপন্যাসে। প্রকৃতপক্ষে ঐতিহাসিক উপন্যাস ইতিহাসকে জীবন্ত প্রাণবন্ত করে তোলে। এ কারণেই ঐতিহাসিক উপন্যাস পাঠকের মনে সৃষ্টি করে এক জীবনদায়িনী প্রেরণা, কারণ অতীতের জীবন্ত গৌরব গাথা হিসাবেই রচিত হয় ঐতিহাসিক উপন্যাস।

সামাজিক উপন্যাস যেমন পাঠককে সমাজ-সচেতন করে তোলে, ঐতিহাসিক উপন্যাস তেমনি পাঠককে করে তোলে ইতিহাস-সচেতন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এর গুরুত্ব অপরিসীম। মুসলিম বিশ্বের সমসাময়িক বিপর্যয়সমূহের কারণ পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, এর মূলে রয়েছে তিনটি বড় কারণ। আদর্শবিমুখতা, বিজ্ঞানবিমুখতা ও ইতিহাসবিমুখতা। বর্তমানে মুসলিম উম্মাহর একটি অংশের মধ্যে আদর্শ-চেতনা নতুন করে দেখা দিলেও বিজ্ঞান মনস্কতা তার অনুসঙ্গী হয়নি। কিন্তু বিজ্ঞানের এ যুগে বিজ্ঞানমনস্কতা ছাড়া কোন জাতিই যে টিকে থাকতে পারবে না, তার প্রমাণ তো পাওয়া যাচ্ছে প্রতিদিনই। একইভাবে বলা যায় মুসলমানদের আদর্শ-চেতনা কখনই ফুলে ফলে সুশোভিত হয়ে উঠতে পারবে না, যদি না তাদের মধ্যে গভীর ইতিহাস-চেতনা সঞ্চারিত হয়। ইতিহাস-চেতনা ছাড়া আমরা যেমন উম্মাহর প্রকৃত শত্রু-মিত্র চিনতে পারি না, তেমনি বুঝতে পারি না, ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে কতভাবে কত কৌশলে কত ছদ্মবেশে জাতির শত্রুরা জাতিকে বিভ্রান্ত করেছে, বিপর্যস্ত করেছে। আদর্শের বীজ শূন্যে উপ্ত হয় না, হয় জমিনে, জমিনের মানুষদের মনে, যাদের থাকে একটা ইতিহাস। আবার আগাছাদের আগ্রাসনে আদর্শের চারাগাছ যখন বিপর্যস্ত হয়, তখনও তাদের অবস্থান থাকে একটা জমিনে, যার একটা ইতিহাস থাকে। ইতিহাস ছাড়া কোন আদর্শেরই বাস্তবায়ন-প্রয়াস কল্পনা করা যায় না। ইসলামেরও নয়। ইতিহাস অধ্যয়ন ছাড়া যারা আদর্শ বাস্তবায়নের চিন্তা করে তাদের প্রয়াস এ কারণেই অন্ধ প্রয়াস হিসাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে বাধ্য।

জাতির ইতিহাস-বিমুখতা কাটিয়ে উঠতে প্রয়োজন ইতিহাস-চেতনা। আর ইতিহাস-বিমুখ জাতির মধ্যে ইতিহাস-মনস্কতা সৃষ্টির ব্যাপারে ঐতিহাসিক উপন্যাস পালন করতে পারে ঐতিহাসিক ভূমিকা। ঔষধ সেবনে অনিচ্ছুক রোগীর জন্য যেমন সুগার-কোটেড ঔষধের অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য, তেমনি ইতিহাস-বিমুখ জাতির মধ্যে ইতিহাস-চেতনা সৃষ্টিতেও ঐতিহাসিক উপন্যাসের গুরুত্ব অপরিসীম। এই নিরিখেই মুসলিম বিশ্বকে বর্তমান প্রেক্ষাপটে ঐতিহাসিক উপন্যাসের ভুমিকা বিচার করতে হবে। কিন্তু এখানেও আমাদের দুর্ভাগ্য, বর্তমান মুসলিম ঐতিহাসিক উপন্যাসিকের সংখ্যা একেবারেই আংগুলে গুনে শেষ করা যায়। বর্তমান মুসলিম বিশ্বের যে স্বল্প সংখ্যক লেখক সাহিত্যের এই গুরুত্বপূর্ণ শাখায় সার্থক কলম সৈনিকের ভূমিকা পালন করছেন নসীম হিজাযী তাদের শীর্ষস্থানীয়। নসীম হিজাযী সেই সব সার্থক সাহিত্যিকদের অন্যতম। যাদের লেখায় মুসলমানদের অতীত শৌর্য-বীর্য, জয়-পরাজয়ের ইতিহাসই শুধু প্রাণবন্ত হয়ে ওঠেনা, পাঠককে ঈমানের বলে বলিয়ান এক উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সৃষ্টির স্বপ্নে উদ্দীপ্ত করে তোলে।

মরণজয়ী’ নসীম হিজাযীর জনপ্রিয় ঐতিহাসিক উপন্যাস সমূহের অন্যতম। মরণ জয়ী’ পঁয়ত্রিশ থেকে পচাত্তর হিজরী পর্যন্ত সময়কালের পটভূমিতে রচিত উপন্যাস। মুসলমানদের উত্থান-পতনের বৈচিত্র্যময় ইতিহাসে এই চল্লিশ বৎসর যে কোন বিচারে ছিল এক ক্রান্তিকাল। এই মুদ্দতকালেই আলমে ইসলামের সীমা একদিকে স্পেন ছাড়িয়ে ফ্রান্সের গিরিনিজ পর্বতমালা, অপরদিকে ভারতবর্ষ পর্যন্ত, একদিকে অফ্রিকার সাহারা মরুভূমি, অপরদিকে মধ্য এশিয়ার তুর্কিস্থান তাতারস্থান পর্যন্ত ষড়যন্ত্রের সুবাদে প্রথমবারে মত রাগ্রস্ত হয়। এ ছিল সেই কাল, যখন মুসলিম বীর মুহাম্মদ বিন কাসিম সিন্ধু জয়ের গৌরব অর্জন করেন, মহাবীর মুসা স্পেন বিজয় করেন, আর মধ্য এশিয়াকে আলমে ইসলামের অন্তর্ভূক্ত করেন কুতায়বা বিন মুসলিম। ভাগ্যের চরম পরিহাস, মুসলিম উম্মাহর চিহ্নিত গোপন দুশমনের পরিকল্পিত চক্রান্তের ফলে এই মুসলিম বীরদের প্রত্যেকেই জিল্লতির পরিণাম বরণে বাধ্য হন। উপন্যাসের সার্থকতার প্রয়োজনে নসীম হিজাযী এ বইয়ে সৃষ্টি করেছেন কিছু কাল্পনিক চরিত্র, কাহিনীর জাল বুনতেও অনিবার্যভাবে কিছুটা কল্পনার আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু এতে ইতিহাসের মূল সত্য কোথাও বিকৃত হয়নি। মরণ জয়ী এমন এক উপন্যাস, যা একবার পড়া শুরু করে শেষ না হওয়া পর্যন্ত পাঠককে থামতে দেয় না। এখানেই উপন্যাসখানির সার্থকতা।

বাংলা সাহিত্যে ইসলামের ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে রচিত ঐতিহাসিক উপন্যাসের সংখ্যা একেবারেই কম। এ ব্যাপারে সার্থক সৃষ্টির প্রশ্নে প্রথমেই নাম ওঠে মীর মোশাররফ হোসেনের বিষাদ সিন্ধুর। কিন্তু বিষাদ সিন্ধু’ চরম ইতিহাস-বিকৃতির দোষে দুষ্ট। বাংলা সাহিত্যে এ ধারার দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি শেখ হাবিবুর রহমান সাহিত্যরত্বের ‘আলমগীর’। এ ধারায় অন্যান্য যারা ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনায় ব্রতী হয়েছেন তাদের মধ্যে সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী, খালেক দাদ চৌধুরী, আবু জাফর শামসুদ্দীন, এম এ হাশেম খান, রাজিয়া মজীদ প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। বাংলা সাহিত্যে মুসলিম ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে অবশ্য ঐতিহাসিক উপন্যাসের তুলনায় ঐতিহাসিক নাটকের সাক্ষাৎ বেশী পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে শাহযাদাৎ হোসেন, আকবর উদ্দীন, ইব্রাহীম খাঁ, আবুল ফজল প্রমুখের সূচিত সৃষ্টি ধারা ব্যাপক সার্থকতা লাভ করেছে আসকার ইবনে শাইখে এসে। উর্দু সাহিত্যে ঐতিহাসিক উপন্যাসে নসীম হিযাজী যে স্থান করে নিয়েছেন, আসকার ইবনে শাইখ বাংলা ঐতিহাসিক নাটকে অনুরূপ স্থান অধিকার করতে যাচ্ছেন বললে মোটেই অতিরিক্ত বলা হয় না। কিন্তু ঐতিহাসিক উপন্যাসের ক্ষেত্রে আমাদের দীনতা নিঃসন্দেহে অনস্বীকার্য।

মরণজয়ী’ সহ নসীম হিজাযীর বিভিন্ন উপন্যাস এবং অন্যান্য বহু গ্রন্থ উর্দু ও ফারসী থেকে বাংলায় অনুবাদের গৌরব যার প্রাপ্য, বাংলা সাহিত্যের সেই নীরব সাধক সৈয়দ আবদুল মান্নান বহুদিন হল আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন জীবন সাগরের পরপারে। আমরা তার রূহের মাগফিরাত কামনা করি।

ইসলামের ইতিহাসের যে প্রেক্ষাপটকে ভিত্তি করে মরণজয়ী’ রচিত, আলমে ইসলামের বর্তমান প্রেক্ষাপটের সঙ্গে তার অদ্ভুত সাদৃশ্য রয়েছে। এ সত্যটি যদি পাঠকেরা উপলব্ধি করতে পারেন, তবেই আমাদের এ প্রয়াস সার্থক হবে।

সব প্রশংসা একমাত্র আল্লাহরই প্রাপ্য।

আবদুল গফুর

.

ইসলামী বিধান কায়েম করার সগ্রামে জীবন কুরবান মুজাহিদীনের উদ্দেশ্যে–আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে, তাদেরকে মৃত বলো না, বরং তারা জীবিত, যদিও তোমরা তা অনুভব করো না। –আল-কোরআন, সূরা ২: ১৫৪

এক

সূর্য কতোবার পূর্ব দিকে উদিত হয়ে পশ্চিম দিগন্তে অস্ত গিয়েছে। চাঁদ তার মাসিক সফর শেষ করেছে হাজারো বার। সিতারার দল লাখো বার রাতের অন্ধকারে দীপ্তি ছড়িয়ে ভোরের আলোয় আত্মগোপন করেছে। মানব-বাগিচায় বারংবার এসেছে বসন্ত, আবার এসেছে শরৎ। জান্নাত থেকে নির্বাসিত মানবতার নতুন বাসভূমি হয়েছে এমন এক সগ্রামক্ষেত্রে, যেখানে প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদান রয়েছে অবিরাম সংগ্রামে লিপ্ত। দুনিয়ায় এসেছে বিপ্লবের বিভিন্ন রূপ। তাহযিব ও তমদুনের হয়েছে নব রূপায়ন। হাজার হাজার কওম অধোগতির নিম্নতম স্তর থেকে উঠে এসে ঝড় ও ঘূর্ণিবায়ুর মতো ছড়িয়ে পড়েছে সারা দুনিয়ার বুকে, কিন্তু প্রাকৃতিক নিয়মে উত্থান পতনের সম্পর্ক এমনি মযবুত যে, তারা কেউ এখানে চিরস্থায়ী হয়ে থাকেনি। যে সব কওম তলোয়ারের ছায়ায় বিজয়-ডংকা বাজিয়ে জেগে উঠেছিলো, তারাই আবার বাদ্য গীতের সুর মুছনায় বিভোর হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। উপরে নীল আসমানকে প্রশ্ন করঃ তার অন্তহীন বিস্তৃত বুকের উপর আঁকা রয়েছে অতীতের কতো যুগযুগান্তরের হাজারো কাহিনী; কতো কওমের উত্থান-পতন সে দেখেছে; সে দেখেছে কতো শক্তিমান বাদশাহকে তাজ ও তখৃত হারিয়ে ফকীরের লেবাস পরতে, দেখেছে কতো ফকীরকে শাহী তাজ পরিধান করতে। হয়তো বারংবার একই কাহিনীর পুনরাবৃত্তি দেখে সে হয়ে আছে নির্বিকার-উদাসীন। কিন্তু আমরা নিশ্চিত বলতে পারি, আরবের মরুচারী যাযাবরদের উত্থান ও পতনের দীর্ঘ কাহিনী আজো তার মনে পড়ে। সে কাহিনী আজকের এ যুগ থেকে কতো স্বতন্ত্র! যদিও কাহিনীর কোনো অংশই কম চিত্তাকর্ষক নয়, তথাপি আমাদের সামনে রয়েছে আজ তার এমন এক উজ্জ্বল, অধ্যায়, যখন পূর্ব-পশ্চিমের উপত্যকাভূমি, পাহাড় ও মরু-প্রান্তর মুসলমানদের বিজয় অশ্বের পদধ্বনিতে মুখর হয়ে উঠেছে, তাদের প্রস্তর বিদীর্ণকারী তলোয়ারের সামনে ইরান ও রুমের সুলতানের মস্তক হয়েছে অবনমিত। এ ছিলো সেই যুগ, যখন তুর্কীস্থান,আন্দালুস ও হিন্দুস্থান মুসলমানদের আহবান জানিয়েছে তাদের বিজয় শক্তির পরীক্ষার জন্য।

বসরার প্রায় বিশ মাইল দূরে একটি উর্বর সবুজে ঢাকা বাগিচার মাঝখানে একটি ছোট্ট বস্তি। তারই একটি সাদাসিধা বাড়ির আঙ্গিনায় একটি মধ্য বয়স্কা নারী সাবেরা আসরের নামায পড়ছেন। আর একদিকে তিনটি বালক-বালিকা খেলাধুলায় ব্যস্ত। দুটি বালক আর একটি বালিকা। বালক দুটির হাতে ছোট্ট ছোট্ট কাঠের ছড়ি। বালিকা নিবিষ্ট মনে দেখছে তাদের কার্যকলাপ। বড় ছেলেটি ছড়ি ঘুরিয়ে ছোট ছেলেটিকে বলছে, দেখো নয়ীম, আমার তলোয়ার!, ছোট ছেলেটি তার ছড়ি দেখিয়ে বললো, আমারো আছে তলোয়ার। এসো, আমরা লড়াই করি।

ণা, তুমি কেঁদে ফেল্‌বে। বড় ছেলেটি বললো।

না, তুমিই কেঁদে ফেলবে’। ছোটটি জওয়াব দিলো।

তাহলে এসো।’ বড়টি বুক ফুলিয়ে বললো।

নিষ্পাপ বালকেরা একে অপরের উপর হামলা শুরু করলো। মেয়েটি পেরেশান হয়ে তামাশা দেখতে লাগলো। মেয়েটির নাম উযরা, ছোট ছেলেটির নাম নয়ীম আর বড়টি আবদুল্লাহ। আব্দুল্লাহ নয়ীম থেকে তিন বছরের বড়। তার ঠোঁটের উপর লেগে আছে এক টুকরা মিষ্টি হাসি, কিন্তু নয়ীমের মুখ দেখে মনে হয়, যেনো সে সত্যি সত্যি লড়াইয়ের ময়দানে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। নয়ীম হামলা করছে, আর আব্দুল্লাহ ধীরভাবে প্রতিরোধ করছে। আচানক নয়ীমের ছড়ি তার বায়ুতে লেগে গেলো। আব্দুল্লাহ্ এবার রাগ করে হামলা করলো। এবার নয়ীমের কজীতে চোট লাগলো, আর তার হাতের ছড়িটা ছিটকে পড়ে গেলো।

আব্দুল্লাহ বললো, “দেখো, এবার কেঁদে ফেলো না’।

‘আমি না, তুমি কেঁদে ফেলবে।

নয়ীম রাগে লাল হয়ে তার কথার জওয়াব দিয়ে যমিন থেকে একটা ঢিল তুলে, নিয়ে মারলো আব্দুল্লাহর মাথায়। তারপর নিজের ছডিটা হাতে তুলে নিয়ে ছুটলো ঘরের দিকে। আব্দুল্লাহ্ মাথায় হাত দিয়ে ছুটলো তার পিছু পিছু। কিন্ত এরই মধ্যে নয়ীম গিয়ে সাবেরার কোলের মধ্যে লুকোবার চেষ্টা করছে।

‘আম্মি! ভাই আমায় মারছে।’ নয়ীম বললো।

আব্দুল্লাহ্ রাগে ঠোঁট কামড়াচ্ছিলো, কিন্তু মাকে দেখে সে চুপ করে গেলো।

মা প্রশ্ন করলেন, আব্দুল্লাহ, ব্যাপার কি! বলো তো!’

সে জওয়াবে বললো, মা! ও আমায় পাথর মেরেছে।’

‘কেন লড়াই করছিলে বেটা!’ নয়ীমের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে সাবেরা বললেন। ‘আমরা তলোয়ার নিয়ে লড়াই করছিলাম। ভাই আমার হাতে ঘা দিয়েছে আমি তার বদলা নিয়েছি।’

তলোয়ার কোথায় পেলে তুমি?’

‘এই দেখুন আমি!’ নয়ীম তার ছড়িটি দেখিয়ে বললেন, এটা কাঠের তৈরি, কিন্ত আমার একটা লোহার তলোয়ার চাই। এনে দেবেন? আমি জিহাদে যাবো।’

বাচ্চা ছেলের মুখে জিহাদের কথা শোনার খুশী সেই মায়েরাই জানতো, যারা তাদের জিগরের টুকরাকে ঘুমপাড়ানি গান শুনিয়ে বলতোঃ

ওগো কাবার প্রভু, যাদু আমার-বাছা আমার
হোক বীর মুজাহিদ,
মানবতার বাগিচায় তোমার বন্ধুর লাগানো তরুমূলে
সিঞ্চন করুক যৌবনের রক্তধারা।’

নয়ীমের মুখে তলোয়ার ও হিজাদের কথা শুনে সাবেরার মুখ খুশীর দীপ্তিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। তাঁর দেহে মনে জাগলো অপূব আনন্দ-শিহরণ। আনন্দের আবেশে তার চোখ বন্ধ হয়ে এলো। অতীত ও বর্তমান মুছে গেলো তার চোখের সামনে থেকে। কল্পনায় তিনি তার নওজোয়ান বেটাকে দেখতে লাগলেন মুজাহিদবেশে খুবসুরত ছোঁড়ায় সওয়ার হয়ে লড়াইয়ের ময়দানে। তাঁর প্রিয় পুত্র দুশমনের সারি ভেদ করে এগিয়ে যাচ্ছে বীর পদভারে। দুশমনের ঘোড়া আর হাতী তার নির্ভীক হামলার সামনে দাঁড়াতে না পেরে আগে আগে সরে যাচ্ছে। তাঁর নওজোয়ান বেটা তাদের অনুসরণ করে ঘোড়া নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে গর্জন মুখর দরিয়ার বুকে। বরাবর সে এসে যাচ্ছে দুশমনের নাগালের ভিতরে। তারপর শেষ পর্যন্ত আঘাতে আঘাতে ক্লান্ত হয়ে কলেমায়ে শাহাদৎ পড়ে নির্বাক হয়ে যাচ্ছে। তার চোখে ভাসছে, যেনো জান্নাতের হুরদল শারাবন তার জাম হাতে দাঁড়িয়ে আছে তার প্রতীক্ষায়। সাবেরা ইন্না লিল্লাহ ওয়া ইন্না ইলায়হি রাজেউন’ পড়ে সিজদায় মাথা নত করে দো’আ করলেনঃ

‘ওগো যমিন-আসমানের মালিক! মুজাহিদের মায়েরা যখন হাযির হবেন তোমার দরবারে, তখন আমি যেনো কারুর পেছনে না থাকি। এই বাচ্চদেরকে তুমি এমন যোগ্যতা দান করো, যেনো তারা পূর্বপুরুষদের গৌরবময় ঐতিহ্য কায়েম রাখতে পারে।’

দোআ শেষ করে সাবেরা উঠে দুই পুত্রকে কোলে টেনে নিলেন।

মানবজীবনে এমন হাজারো ঘটনা ঘটে, যা বুদ্ধির সীমাবদ্ধ ক্ষেত্র ছাড়িয়ে দীলের রাজ্যের অন্তহীন প্রসারের সাথে সম্পর্ক খুঁজে বেড়ায়। দুনিয়ার যে কোনো ঘটনাকে যদি আমরা বুদ্ধির কষ্টিপাথরে যাচাই করি, তাহলে কতো মামুলী ঘটনাও আমাদের কাছে রহস্যময় হয়ে দেখা দেয়। অনুভূতি ও আবেগকে আমরা বুঝতে চেষ্টা করি নিজস্ব অনুভূতি ও আবেগ দিয়ে। তাই তাদের যেসব কার্যকলাপ আমাদের মানসিক আবেগ থেকে উচ্চ পর্যায়ের মনে হয়, তা আমাদের চোখে বিসদৃশ লাগে। আজকালকার মায়েদের কাছে প্রাচীন যুগের বাহাদুর মায়ের আশা-আকাংখা কতো বিস্ময়কর প্রতীয়মান হয়। আপনার জিগরের টুকরাকে আগুন ও খুনের ভিতরে খেলতে দেখার আকাংখা তাদের চোখে কত ভয়ানক। আপন বাচ্চাকে বিড়ালের ভয় দেখিয়ে ঘুম পাড়ায় যে মায়েরা, সিংহের মোকাবিলা করবার স্বপ্ন তারা কি করে দেখবে।

আমাদের কলেজ, হোটেল আর কফিখানার পরিবেশে পালিত হয় যে সব নওজোয়ান, তাদের জ্ঞান ও বুদ্ধি কি করে জানবে পাহাড়ের উচ্চতা ও সমুদ্রের গভীরতা লংঘনকারী মুজাহিদদের দীলের রহস্য? বরাবের সুর-মুৰ্ছনার সাথে সাথে ঝিমিয়ে পড়ে যেসব নাযুক মেযাজ মানুষ, তীর ও নেয়ার মোকাবিলায় এগিয়ে যাওয়া জোয়ানদের কাহিনী তাদের কাছে কতো বিস্ময়কর! নীড়ের আশেপাশে উড়ে বেড়ায় যেসব পাখী, কি করে পরিচিত হবে তারা আকাশচারী ঈগলের উড়ে বেড়ানো সাথে!

*

সাবেরার শৈশব যৌবনের যিন্দেগী কেটেছে এক অতি সাধারণ পরিবেশের ভিতর দিয়ে। তার শিরায় শিরায় বয়ে চলেছে আরবের সেই শাহসওয়ারদের খুন, যাঁরা কুফর ও ইসলামের গোড়ার দিকের লড়াইয়ে দেখিয়েছেন তাদের তলোয়ারের শক্তি। তাঁর দাদা ইয়ারমুকের লড়াই থেকে এসেছিলেন গাজী হয়ে, তারপর শহীদ হয়েছিলেন কাদসিয়ার ময়দানে। ছোটবেলা থেকেই গাজী ও শহীদ শব্দগুলো তাঁর কাছে পরিচিত। আধো আধো বুলি দিয়ে তিনি যখন হরফ উচ্চারণ করবার চেষ্টা করতেন, তখন তার মা তাকে প্রথমে শিখিয়েছেন ‘আব্বা গাজী”,তারপর আরো কিছুকাল পরে শিখিয়েছেন ‘আব্বা শহীদ। এমনি এক পরিবেশে প্রতিপালিত হয়েছিলেন বলেই যৌবনে ও বার্ধক্যে তাঁর কাছ থেকে আশা করা যেতো-এক কর্তব্যনিষ্ঠ মুসলিম নারীর গুণরাজি। ছোট বেলায় তিনি শুনেছেন কতো আরব নারীর শৌর্যের কাহিনী। বিশ বছর বয়সে তার শাদী হয়েছিলো আব্দুর রহমানের সাথে নওজোয়ান স্বামী ছিলেন মুজাহিদের যাবতীয় গুণে গুণান্বিত। বিশ্বস্ত বিবির মুহব্বত তাঁকে ঘরের চার দেওয়ালের ভিতর বেঁধে রাখেনি, হামেশা তাঁকে দিয়েছে জিহাদের অনুপ্রেরণা।

আব্দুর রহমান যখন শেষ বারের মতো জিহাদের ময়দানে রওয়ানা হলেন, আব্দুল্লাহ তখন তিন বছরের শিশু, আর নয়ীমের বয়স তিন মাসেরও কম। আব্দুর রহমান আব্দুল্লাহকে তুলে বুকে চেপে ধরলেন, তারপর নয়ীমকে সাবেরার কোল থেকে নিয়ে আদর করলেন। মুখের উপর বিষণ্ণতার ছাপ সুস্পষ্ট হয়ে উঠছিলো। কিন্তু তখুনি তিনি হাসি টেনে আনবার চেষ্টা করলেন। জীবনসাথীকে লড়াইয়ের ময়দানে যেতে দেখে খানিকক্ষণের জন্য সাবেরার দীলের মধ্যে ঝড় বইতে লাগলো, কিন্তু কষ্টে তিনি চোখের কোনে উছলে-ওঠা অশ্রুধারা সংযত করে রাখলেন।

আব্দুর রহমান বলে উঠলেন, সাবেরা! আমার কাছে ওয়াদা করো, যদি আমি লড়াইয়ের ময়দান থেকে ফিরে না আসি, তাহলে যেনো আমার পুত্রেরা আমার তলোয়ারে জং ধরতে না দেয়।

‘আপনি আশ্বস্ত হোন, সাবেরা জওয়াবে বললেন, বাচ্চারা আমার কারুর পেছেনে পড়ে থাকবে না।’

‘খোদা হাফিজ’ বলে আব্দুর রহমান ঘোড়ার রেকাবে পা রাখলেন। তার বিদায়ের পর সাবেরা সিজদায় মাথা রেখে দো’আ করলেন–ওগো যমিন-আসমানের মালিক! ওঁর কদম মযবুত রেখো।

স্বামী-স্ত্রী যখন চেহারা ও চালচলনে একে অপরের কাছে আকর্ষণের পাত্র হয়ে ওঠে, তখন তাদের মধ্যে মুহব্বতের আবেগপূণ সীমায় পৌঁছা কিছু অস্বাভাবিক নয়। সাবেরা ও আব্দুর রহমানের সম্পর্ক ছিলো বেশক দেহ ও মনের সম্পর্কের মতো। বিদায়-বেলায় তাদের সুকোমল স্পর্শকাতর অন্তরের আবেগ সংবরণ করে রাখা কিছুটা বিস্ময়কর মনে হয়। কিন্তু কোন্ আযীমুশান মকসাদ হাসিল করবার জন্য এইসব লোক দুনিয়ার সকল লোভলালসাকে, সকল-আশা আকাংখাকে কোরবান করতেন? কোন্ সে মকসাদ.তিনশ তের জন সিপাহীর একটি মুষ্টিমেয় দলকে টেনে আনতো হাজার সিপাহীর মোকাবিলা করতে? কোন্ সে আবেগ মুজাহিদ দলের অন্তরে দরিয়া ও সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়বার, উত্তপ্ত অনন্তপ্রসার মরু অতিক্রম করবার আর আকাশচুম্বী পর্বতচুড়ায় পদচিহ্ন এঁকে যাবার শক্তির সঞ্চার করেছিলো?

এক মুজাহিদই দিতে পারে এসব প্রশ্নের জওয়াব।

আব্দুর রহমানের বিদায়ের পর সাত মাস চলে গেছে। একই বন্তির আরো চারজন লোক ছিলো তাঁর সাথী। একদিন আব্দুর রহমানের এক সাথী ফিরে এলো এবং উট থেকে নেমে সারোর ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো। তাকে দেখে বহুলোক তার আশে পাশে জমা হলো। কেউ কেউ জিগগেস করলো আব্দুর রহমানের কথা, কিন্তু সে কোন জওয়াব না দিয়ে সোজা গিয়ে ঢুকলো সাবেরার বাড়ির ভিতরে।

সাবেরা নামাযের জন্য ওযু করছিলেন। তাকে দেখে তিনি উঠে এলেন। লোকটি এগিয়ে এসে কয়েক কদম দূরে দাঁড়িয়ে গেলো।

সাবেরা তাঁর দীলের কম্পন সংযত করে প্রশ্ন করলেন, উনি আসেননি?

উনি শহীদ হয়ে গেছেন।

শহীদ’! সংযমের বাঁধ ভেঙ্গে সাবেরার আঁখিকোণ থেকে গড়িয়ে পড়লো কয়েক ফোঁটা অশ্রু।

লোকটি বললো, ‘শেষ মুহূর্তে যখন তিনি যখমে কাতর, তখন নিজের রক্ত দিয়ে তিনি এ চিঠিখানা লিখে আমার হাতে দিয়েছিলেন।

সাবেরা স্বামীর শেষ চিঠিখানা খুলে পড়লেনঃ সাবেরা, আমার আরযু পুরো হয়েছে। এই মুহূর্তে আমি যিন্দেগীর শেষ শ্বাস গ্রহণ করছি। আমার কানে এসে লাগছে এক অপূর্ব সুর-ঝংকার। আমার রূহ দেহের কয়েদখানা থেকে আযাদ হয়ে সেই সুরের গভীরতায় হারিয়ে যাবার জন্য অধীর হয়ে উঠেছে। যখমে ক্লান্ত হয়ে আমি এক অপূর্ব শান্তির স্পর্শ অনুভব করছি। আমার রূহ এক চিরন্তন আনন্দের সমুদ্রে সঞ্চরমাণ। এখনকার আবাস ছেড়ে আমি এমন এক দুনিয়ায় চলে যাচ্ছি, যার প্রতি কণিকা এ দুনিয়ার তামাম রঙের ছটা আপনার কোলে টেনে নিয়েছে।

আমার মৃত্যুতে অশ্রুপাত করো না। আমার লক্ষ্যবস্তু আমি অর্জন করেছি। আমি তোমার কাছ থেকে দুরে চলে যাচ্ছি, মনে করো না। স্থায়ী সৌভাগ্যের এক কেন্দ্রভূমিতে এসে আবার মিলিত হবো। সেখানে সকাল-সন্ধ্যা নেই, সেখানে বসন্ত ও শরতের তারতম্য নেই। যদিও সে দেশ চাঁদ সিতারার বহু উর্ধে তথাপি মরদে মুজাহিদ সেখনে খুঁজে পায় তার শান্তির নীড়। আব্দুল্লাহ ও নয়ীমকে সেই গন্তব্য দেশের পথের সন্ধান দেওয়া তোমার ফরয। আমি তোমায় অনেক কিছুই লিখতাম, কি আমার রূহ দেহের কয়েদখানা থেকে আযাদ হবার জন্য বেকারার। প্রভুর পদপ্রান্তে পৌঁছবার জন্য অন্তর আমার অধীর। আমি তোমায় আমার তলোয়ার পাঠিয়ে দিচ্ছি। বাচ্চাদের এর কদর ও কীমৎ বুঝিয়ে দিও। আমার কাছে তুমি যেমন ছিলে এক কর্তব্যনিষ্ঠ স্ত্রী, আমার বাচ্চাদের কাছে তুমি হবে তেমনি কর্তব্যনিষ্ঠ মা। মাতৃস্নেহ যেনো তোমার উচ্চাকাংখার পথে প্রতিবন্ধক না হয়। তাদেরকে বলবে মুজাহিদের মৃত্যুর সামনে দুনিয়ার যিন্দেগী অবাস্তব-অর্থহীন।

তোমার স্বামী।

দুই

আব্দুর রহমান শহীদ হবার পর তিন বছর কেটে গেছে। একদিন সাবেরা তাঁর ঘরে সামনে আঙিনায় এক খেজুর গাছের তলায় বসে আব্দুল্লাহকে সবক পড়াচ্ছিলেন। নয়ীম একটা কাঠের ঘোড়া তৈরী করে তাকে ছড়ি নিয়ে এদিক ওদিক তাগিয়ে বেড়াচ্ছিলো। হঠাৎ বাইরে থেকে কে যেন ঘা মারলো তাদের দরযায়। আব্দুল্লাহ জলদী উঠে দরযা খুলে মামুজান বলে আগন্তুকের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়লো।

কে? সাঈদ? সাবেরা ভিতর থেকে আওয়ায দিলেন।

সাঈদ একটি ছোট বালিকার হাত ধরে আঙিনায় প্রবেশ করলেন। সাবেরা ছোট ভাইকে সাদর আহ্বান জানিয়ে মেয়েটিকে আদর করে প্রশ্ন করলেন, এ উযরা তো নয়! এর চেহারা সুরত তো বিলকুল ইয়াসমিনেরই মতো।

হাঁ বোন, এ উয়রা। আমি ওকে আপনার কাছে রেখে যেতে এসেছি। আমার ফারেস যাবার হুকুম হয়েছে। সেখানে খারেজীরা বিদ্রোহ ছড়াবার চেষ্টা করেছে। আমি সেখানে পৌঁছে যেতে চাই খুব শিগগীর। আগে ভেবেছিলাম, উযরাকে আর কারুর সাথে পাঠিয়ে দেবো আপনার কাছে, পরে নিজেই এখান হয়ে যাওয়া ভালো মনে করলাম।

এখান থেকে কখন রওয়ানা হবার ইরাদা করেছো? সাবেরা প্রশ্ন করলেন।

আজ চলে গেলেই ভালো হয়। আজ আমাদের ফউজ বসরায় থাকবে, কাল ভোরে আমরা ওখান থেকে ফারেসের পথে রওয়ানা হবে।

আব্দুল্লাহ্ মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে কথা শুনছিলো। নয়ীম এতক্ষণ কাঠের ঘোড়া নিয়ে খেলছিলো, এবার সেও এসে দাঁড়ালো আব্দুল্লাহ পাশে। সাঈদ নয়ীমকে টেনে নিলেন কোলের মধ্যে। তাকে আদর করে আবার তিনি বোনের সাথে আলাপ করতে লাগলেন। নয়ীম আবার খেলাধুলায় ব্যস্ত হলো, কিন্তু খানিকক্ষণ পর কিছু চিন্তা করে সে আব্দুল্লাহর কাছে এলো এবং উযরার দিকে ভালো করে তাকাতে লাগলো। কি যেনো বলতে চাচ্ছিলো সে, কিন্তু লজ্জা তাকে বাধা দিচ্ছিলো। খানিক্ষণ পর সে সাহস করে উযরাকে বললো, তুমিও ঘোড়া নেবে?

উযরা শরমে সাঈদের পেছনে লুকালো।

যাও বেটী!’ সাঈদ উযরার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, তোমার ভাই-এর সাথে খেলো।

উযরা লাজুক মুখ নিয়ে এগিয়ে গিয়ে নয়ীমের হাত থেকে একটা ছড়ি নিয়ে নিলো। তারা দু’জনে.আঙিনার অপর পাশে গিয়ে নিজ নিজ কাঠের ঘোড়ায় সওয়ার হলো। তাদের মধ্যে ভাব জমতে দেরী হলো না।

নয়মের কার্যকলাপে আব্দুল্লাহ খুশী হতে পারছিলো না। সে বার বার তার দিকে তাকিয়ে দেখছিলো। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে নয়ীম তার নতুন সাথীর সাথে এতটা ভাব জমিয়ে ফেলেছে যে, আব্দুল্লাহ তাদের দিকে তাকিয়ে আবার অপর দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। আব্দুল্লাহ যখন তাকেমুখ ভ্যাংচাতে লাগলো তখন সে আর বরদাশত করতে পারলো না।

দেখুন আম্মিজান, আব্দুল্লাহ আমায় মুখ ভ্যাংচাচ্ছে। মা বললেন, আব্দুল্লাহ ওকে খেলতে দাও।

আব্দুল্লাহ গম্ভীর হয়ে গেলে নয়ীম এবার তাকে মুখ ভ্যাংচাতে শুরু করলো। বিরক্ত হয়ে আব্দুল্লাহ মুখ ফিরিয়ে নিলো অপর দিকে।

*

উযরার কাহিনী সাবেরার কাহিনী থেকে কিছু আলাদা নয়। দুনিয়ায় এসে কিছু বুঝবার মতো বয়স হবার আগেই সে হারিয়ে ফেলেছে পিতা মাতার স্নেহের ছায়া।

উযরার বাপ ছিলেন ফুস্তাতের বিশিষ্ট লোকদের একজন। বিশ বছর বয়সে ইরানী মেয়ে ইয়াসমিনের সাথে হলো তাঁর শাদী। ইয়াসমিনের শাদীর পর প্রথম রাত্রি। প্রিয়তম স্বামীর কোলের কাছে থেকে সে গড়ে তুলছিলো নতুন আশা-আকাংখার নয়া দুনিয়া, কামরার মধ্যে জ্বলছিলো কয়েকটি মোমবাতি। ইয়াসমিন আর যহীরের চোখে ছিলো নেশার ঘোের, কিন্তু যে নেশা ঘুমের নেশা থেকে আলাদা।

ইয়াসমিন, সত্যি সত্যি বলো তো, তুমি খুশী হয়েছে? যহীরের মুখে প্রশ্ন। দুলহিন অনন্ত সুখের আবেশে আধো নিমীলিত চোখ দুটি একবার উপরে তুলে আবার নীচ করলো।

যহীর আবার একই প্রশ্ন করলেন। ইয়াসমিন স্বামীর মুখের দিকে তাকালো। লজ্জা ও আনন্দের গভীর আবেগে আত্মহারা হয়ে এক মুগ্ধকর হাসি টেনে এনে সে হাত রাখলো স্বামীর হাতের উপর। তার এ বাকহীন জওয়াব কতো বেশী অর্থপূর্ণ! এ সেই মুহূর্ত, যখন রহমতের ফেরেশতার কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে আনন্দ-গীতি আর ইয়াসমিনের কম্পিত দীল যহীরের দীলের কম্পনের জওয়াব দিচ্ছে। মুখের কথা যেনো হারিয়ে ফেলেছে তার বাস্তবতা। যহীর আবার এই প্রশ্ন করলেন।

‘আপন দীলকে প্রশ্ন করো’। ইয়াসমিন জওয়াব দিলো।

যহীর বললেন, আমার দীলের মধ্যে তো আজ খুশীর তুফান উদ্বেল হয়ে উঠছে। আমার মনে হয় যেনো আজ সৃষ্টি সব কিছুই আনন্দের সুরে মুখর। আহা! এর ঝংকার যদি চিরন্তন হতো!’

‘আহা! ইয়াসমিনের মুখ থেকে অলক্ষ্যে বেরিয়ে এলো। এক মুহূর্ত আগে তার যে কালো কালো ডাগর চোখ দুটি ছিলো আনন্দ-আবেগে উচ্ছল, ভবিষ্যতের চিন্তায় তা হঠাৎ অশ্রুভারাক্রান্ত হয়ে উঠলো। যহীর প্রিয়তমা পত্নীর চোখে অশ্রু দেখে কেমন যেনো আপন ভোলা হয়ে গেলেন। •

ইয়াসমিন! ইয়াসমিন! কেঁদে ফেললে তুমি? কেন?

ণা। ইয়াসমিন হাসবার চেষ্টা করে জওয়াব দিলো। অশ্রুভেজা হাশি যেনো তার রূপের ছটা বাড়িয়ে দিলো আরো বহুগুণ।

কেন? সত্যি সত্যি তো কাঁদছো তুমি। ইয়াসমিন, কি মনে পড়লো তোমার? তোমার চোখের আঁসু দেখা যে আমার বরদাশতের বাইরে’।

একটা কথা আমার মনে এসেছিলো।’ ইয়াসমিন মুখের উপর হাসির আভা টেনে আনার চেষ্ট করে জওয়ার দিলো।

কি কথা?’ যহীর প্রশ্ন করলেন।

এমন কিছু নয়। হালীমার কথা মনে পড়েছিলো আমার। বেচারীর শাদীর পর এক বছর না যেতেই ওর স্বামী দুনিয়া থেকে বিদায় নিলো।’

যহীর বললেন, এ ধরনের মওতের কথা ভেবে আমি ঘাবড়ে উঠি। বেচারা রোগে বিছানায় পা ঘসে ঘসে জান দিলো। এক মুজাহিদের মওত কতো ভালো! কিন্তু আফসোস, সে সৌভাগ্য ওর হোল না। বেচারার নিজেরও কোনো কসুর ছিলো ণা এতে। ছেলেবেলা থেকেই ও ছিলো নানারকম ব্যাধির শিকার। ওর মওতের কদিন আগে আমি যখন ওর অবস্থা জানতে গেলাম, তখন ও এক অদ্ভুত অবস্থার মধ্যে পড়ে রয়েছে। আমায় ও পাশে ডেকে বসালো। আমার হাতটা হাতের মধ্যে নিয়ে বললো, তুমি খুবই খোশ কিসমৎ। তোমার বায়ু লোহার মত মযবুত। ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে তুমি জংগের ময়দানে দুশমনের তীর ও নেয়ার মোকাবিলা কর, আর আমি এখানে পড়ে পা ঘসে ঘসে মরছি। দুনিয়ায় আমার আসা না আসা সমান। ছোটবেলায় আমার চোখে ছিল মুজাহিদ হবার স্বপ্ন, কিন্তু যৌবনে এসে বিছানা ছেড়ে কয়েক পা চলাও হোল আমার পক্ষে কষ্টকর।’ কথাগুলো বলতে বলতে ওর চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠলো। আমি ওকে কতো সান্তনা দিলাম, কিন্তু ও ছোট ছেলের মতো কাঁদতে লাগলো। জিহাদে যাবার আকাংখা বুকে নিয়েই ও চলে গেছে, কিন্তু ওর দেহের ভিতরে ছিলো এক মুজাহিদের দীল। মওতকে ওর ভয় ছিলো না, কিন্তু এ ধরনের মওত ও চায়নি।’

যহীরের কথা শেষ হলে দু’জনই গভীর চিন্তায় অভিভূত হয়ে পরস্পরের মুখের দিকে তাকাতে লাগলো।

ভোরের আভাস তখন দেখা দিচ্ছে। মুয়াযযিন দুনিয়ার মানুষের গাফলতের ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিয়ে নামাযে শরীক হবার খোদায়ী হুকুম শুনিয়ে দিচ্ছে। তারা দু’জনই সেই হুকুম তামিল করবার জন্য তৈরী হচ্ছে, অমনি কে যেনো দরযায় আঘাত দিলো। যহীর দরযা খুলে দেখলেন, সামনে সাঈদ মাথা থেকে পা পর্যন্ত লৌহ আবরণে ঢেকে ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে রয়েছেন। সাঈদ ঘোড়া থেকে নামলেন এবং যহীর এগিয়ে গিয়ে তার বুকে বুক মিলালেন।

সাঈদ আর যহীর ছেলেবেলা থেকে পরস্পরের দোস্ত তাঁদের। দোস্তি তাঁদেরকে সহোদর ভাইয়ের চাইতেও কাছে টেনে এনেছে। দু’জন লেখা পড়া করেছেন একই জায়গায়। একই জায়গায় তাঁরা যুদ্ধবিদ্যা শিখেছেন, আর কতো ময়দানে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দিখিয়েছেন বায়ুর শক্তি ও তলোয়ারের তেয! সাঈদ যহীরকে হঠাৎ আসার কারণ শুধালেন।

কায়রুনের ওয়ালী আমায় আপনার কাছে পাঠিয়েছেন। সাঈদ বললেন।

সব খবর ভালো তো!’

না। সাঈদ জওয়াব দিলেন, আফ্রিকায় দ্রুতগতিতে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ছে। রুমের লোকেরা জাহেল বার্বার দলকে উত্তেজিত করে আমাদের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। এই বিদ্রোহের আগুন নিভিয়ে দিবার জন্য গড়ে তুলতে হবে নতুন ফউজ। গভর্নর দরবারে খিলাফতে সাহায্যের আবেদন করে বিফল হয়েছেন। নাসারা শক্তি আমাদের কমর্যেরীর সুযোগ নিচ্ছে। অবস্থা আয়ত্বে আনতে না পারলে আমরা চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলবো এ বিশাল ভূখন্ড। গভর্নর তাই আমায় আপনার কাছে পাঠিয়েছেন এই চিঠি নিয়ে।

যহীর চিঠি খুলে পড়লেন। চিঠির মর্ম হচ্ছে : সাঈদ তোমায় আফ্রিকার অবস্থা খুলে বলবে। মুসলমান হিসাবে তোমার ফরযঃ যতো সিপাহী সংগ্রহ করতে পার, তাদেরকে নিয়ে শীগগিরই এখানে পৌঁছবে। খলিফার দরবারেও আমি এক চিঠি পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় আরবের লোকেরা যেমন নানারকম গৃহবিবাদে লিপ্ত রয়েছে, তাতে ওখান থেকে আমার কোনো সাহায্য পাবার উম্মীদ নেই। নিজের তরফ থেকে তুমি চেষ্টা করো।’

যহীর এক নওকরকে ডেকে সাঈদের ঘোড়াটি তার হাওয়ালা করে দিলেন। তারপর তাঁকে নিয়ে গেলেন ঘরের একটি কামরায়। তাঁর চোখ থেকে প্রিয়া মিলনের রাত্রির নেশা ততোক্ষণে কেটে গেছে। অপর কামরায় গিয়ে দেখলেন, ইয়াসমিন আল্লাহর দরগায় সিজদায় পড়ে রয়েছে। তার দীল আনন্দে ভরে উঠলো। ফিরে। সাঈদের কাছে এসে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন সাঈদ আমার শাদী হয়ে গেছে।

মুবারক হোক। কবে?

কাল।’

মুবারক হোক। সাঈদের মুখে হাসি, কিন্তু মুহূর্তে সে হাসি কোথায় উবে গেলো। পুরানো বন্ধুর চোখের উপর তিনি চোখ রাখলেন। তাঁর দৃষ্টি যেনো সুধাচ্ছে, এই যে শাদীর আনন্দ তা তোমায় জিহাদের উৎসাহ থেকে ফিরিয়ে আনবে না তো? যহীরের চোখ জওয়াবে প্রকাশ করছিলো সুদৃঢ় আত্মপ্রত্যয়।

*

দুনিয়ার কম বেশি করে প্রত্যেকটি মানুষের জীবনে অবশ্যি আসে এমন সব মুহূর্ত, যখন সে উচ্চস্তরে পৌঁছবার অথবা মহৎ কার্য করবার সুযোগ পায়, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে লাভ-লোকসানের হিসাব করে আমরা হারিয়ে ফেলি সে মওকা।

সাঈদ প্রশ্ন করলেন, “চিঠি সম্পর্কে আপনি কি চিন্তা করলেন? যহীর হাসতে হাসতে সাঈদের কাঁধে হাত রেখে বললেনঃ এতে আমার চিন্তার কি আছে? চলো।’

‘চলো-কথাটা বাইরে খুবই সহজ। কিন্তু যহীরের মুখে কথাটি শুনে সাঈদের মনে যে খুশী হলো, তা আন্দাজ করা কঠিন। নিজের অলক্ষ্যে তিনি বন্ধুর সাথে আলিংগনাবন্ধ হলেন। যহীরের মুখে আর কোনো কথা নেই। তিনি সাঈদকে সাথে নিয়ে ঘরের বাইরে মসজিদের দিকে চললেন।

ফজরের নামাযের পর যহীর বক্তৃতা করতে উঠলেন। মুজাহিদের কথার প্রভাব বিস্তার করতে না লাগে সুন্দর সুন্দর শব্দ সংযোজন আর না লাগে লম্বা লম্বা প্রতিশ্রুতি। তাঁর সাদাসিধা আবেগপূর্ণ কথা গুলো লোকের দীলের মধ্যে বসে গেলো। বক্তৃতার মধ্যে তিনি উঁচ গলায় বললেনঃ

মুসলমান ভাইগণ! আমাদের স্বার্থ সন্ধান ও গৃহবিবাদ আমাদেরকে কখনো রক্ষা করতে পারবে না। রুম ও ইউনানের যে সালতানাতকে আমরা বহুবার পদলুণ্ঠিত করেছি, আজ এই মুহূর্তে তারা আর একবার আমাদের মোকাবিলা করবার সাহস করছে। তারা ইয়ারমুক ও আজনাদিনের পরাজয় ভুলে গেছে। এসো, আমরা তাদেরকে আর একবার জানিয়ে দেই যে, ইসলামের মর্যাদা হেফাজত করবার জন্য মুসলমান অতীতের মতো আজো তার বুকের খুন তেমনি অকাতরে বিসর্জন দিতে পারে। তারা নানা রকম ষড়যন্ত্র করে আফ্রিকার বাসিন্দাদের জীবন দুর্বিসহ করে তুলেছে। তাদের ধারণা, গৃহবিবাদের ফলে আমরা কমযোর হয়ে পড়েছি। কিন্তু আমি বলতে চাই, যতোক্ষণ একটিমাত্র মুসলমান যিন্দাহ খাকবে, তততক্ষণ আমাদের দিকে ভীতির দৃষ্টিতে তাকাতে হবে তাদেরকে।

মুসলমানগণ! এসো, আবার আমরা তাদেরকে বলে দেই, হযরত উমরের (রাঃ) যামানায় যেমন ছিলো, আজো আমাদের সিনায় রয়েছে সেই একই উদ্যম, বায়ুতে রয়েছে সেই তাকৎ আর তলোয়ারে রয়েছে সেই তে।’

যহীরের বক্তৃতার পর আড়াইশ নওজোয়ান তাঁর সাথী হবার জন্য তৈরী হলো।

*

ইয়াসমিনের যিন্দেগীর সকল আকাংখার কেন্দ্রস্থল স্বামী তার চোখের সামনে থেকে বিদায় নিয়ে চলেছেন ময়দানে জংগের দিকে। তার দীলের আগুন চোখের পথ ধরে বেরিয়ে আসতে চাইছে আঁসুর ধারায়, কিন্তু স্বামীর সামনে নিজকে বুদীল প্রমাণিত করতে বাধা দিচ্ছে তার আত্মসমবোধ। চোখের আঁসু চোখেই চাপা পড়ে যাচ্ছে।

যহীর তাকালেন তাঁর বিবির মুখের দিকে। দুঃখ ও বিষণ্ণতার মূর্ত রূপ দাঁড়িয়ে আছে তার চোখের সামনে। তাঁর দীল বলছে আরো এক লহমা দেরী করতে, আরো কয়েকটি কথা বলতে, কিন্তু সেই দীলেরই আর একটি দাবী-আর একটি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে তাকে।

আচ্ছা ইয়াসমিন, খোদা হাফিয। বলে যহীর লম্বা লম্বা কদম ফেলে দরবার দিকে গেলেন এবং দরযা খুলে বাইরে যাবার উপক্রম করলেন। কি যেনো ভেবে তিনি হঠাৎ থেমে গেলেন আপনা থেকেই। যে ধারণা তিনি কখনো মনের কাছেও আসতে দেননি, তা যেনো বিদ্যুৎগতিতে তার দীল ও মস্তিস্ক আচ্ছন্ন করে ফেললো। দীলের সূক্ষ্ম অনুভূতি তার কমফের আওয়াযে শুধু জানিয়ে দিলো, হয়তো এই-ই তাদের শেষ মোলাকাত। মুহূর্তের মধ্যে এই ধারণা যেনো এক বিপর্যয় সৃষ্টি করে দিলো। যহীরের পা আর এগুতে চাইলো না। ইয়াসমিন কয়েক কদম এগিয়ে এলো। যহীর চোখ বন্ধ করে দু’বাহু প্রসারিত করে দিলেন। ইয়াসমিন কান্না ভারাতুর চোখে আত্মসমর্পণ করলো তার আলীংগনের মধ্যে।

ইয়াসমিন!

‘স্বামী!

যে অশ্রুধারা ইয়াসমিন তার দীলের গভীর তলায় গোপন করবার ব্যর্থ চেষ্টা করছিলো, অলক্ষ্যে তা এবার বাঁধমুক্ত হলো। দুজনেরই দীল তখন কাঁপছে, কিন্তু দীলের সে কাঁপন অতি মৃদু এবং ধীরে ধীরে তা যেনো মৃদুতর হয়ে আসছে। সারা সৃষ্টি যেনো এক অপূর্ব সুর-ঝংকারে মুখর। কিন্তু সে সুরের তান যেনো আগের চাইতে আরো গম্ভীর হয়ে আসছে। মুজাহিদের পরীক্ষার মুহূর্ত সমাগত। প্রেমের অনুভূতি আর কর্তব্যের অনুভূতির সংঘাত। সৃষ্টির সুর-মুৰ্ছনা মৃদুতর হয়ে এসেছে আর সেই মুহূর্তে যহীরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ইয়াসমিন শুধু ইয়াসমিন। সৌন্দর্য ও মনোহারিত্বের প্রতিমূর্তি। বর্ণগন্ধময় দুনিয়া! আর অপর দিকে? দীল ও আত্মার হুকুম। সেই গভীর সুরের জগতে আবার লাগে কাঁপন। মুদৃ সুরঝংকার আবার তীব্রতর হয়ে ওঠে। যহীর তাঁর কম্পিত পা দু’খানি আবার সামলে নেন। হাতের চাপ ঢিলা হয়ে আসে। শেষ পর্যন্ত দুজন আলাদা হয়ে দাঁড়ান সামনাসামনি।

ইয়াসমিন, এ যে কর্তব্যের ডাক। যহীর বললেন।

স্বামী, আমি তা জানি,। ইয়াসমিন জওয়াব দেয়।

‘আমার ফিরে আসা পর্যন্ত হানিফা তোমার খেয়াল রাখবে। তুমি ঘাবড়াবে না তো?

না, আপনি আশ্বস্ত হোন।

ইয়াসমিন, একবার হেসে দেখাও তো আমায়। এমনি মুহূর্তে বাহাদুর নারী কখনো চোখের পানি ফেলে না। তুমি এক মুজাহিদের বিবি’।

স্বামীর হুকুম তামিল করতে গিয়ে ইয়াসমিন হাসলো, কিন্তু সে হাসির সাথে সাথেই দু’টি বড় বড় অশ্রুবিন্দু তার চোখে থেকে গড়িয়ে পড়লো।

স্বামী, আমায় মাফ করুন।’ অশ্রু মুছে ফেলতে ফেলতে সে বললো, আহা! আমিও যদি এক আরব মায়ের কোলে পালিত হতাম!’ কথাটি শেষ করতে করতে সে এক গভীর বেদনদার আবেশে চোখ মুদলো আর একবার সে তার বাহু প্রসারিত করলো যহীরের দিকে। কিন্ত চোখ খুলে সে দেখলো, তার প্রিয়তম স্বামী আর নেই সেখানে।

ইয়াসমিন পালিত হয়েছিলো এক ইরানী মায়ের কোলে। তাই আরব-নারীর তুলনায় নারীসুলভ কোমলতা ও সূক্ষ অনুভূতি ছিলো তার ভিতরে বেশি। যহীর বিদায় নিয়ে চলে যাবার পর তার বে-কারারী সীমা ছাড়িয়ে গেলো। তার চোখে বদলে গেলো দুনিয়ার রূপ। পুরানো পরিচারিকা হানিফা সব রকম চেষ্টা করে তার দীলকে আশ্বস্ত করতে চাইতো। কয়েকমাস পরে ইয়াসমিন বুঝলো, তার দেহের মধ্যে প্রতিপালিত হচ্ছে আর একটি নতুন মানবদেহ। এরই মধ্যে স্বামীর কাছ থেকে কয়েকখানি চিঠিও এসেছে তার কাছে।

হানিফা যহীরকে লিখে জানিয়েছেঃ “তোমার ঘরে এক ছোট্টে মেহমান আসবে শিগগীরই। ফিরে এসে দেখবে, ঘরের রওনক বেড়ে গেছে আনেকখানি। হাঁ, তোমার বিবি দিন কাটাচ্ছে কঠিন মর্মপীড়ার মধ্যে দিয়ে। ছুটি পেলে কয়েকদিনের জন্যে এসে তাকে সান্তনা দিয়ে যেয়ো।

আটমাস পর যহীর লিখলেন, দু’মাসের মধ্যে তিনি ফিরে আসবেন ঘরে। এই চিঠি পেয়ে প্রতীক্ষার জালা ইয়াসমিনের কাছে আগের চাইতেও বেশী অসহনীয় হয়ে উঠলো। দিনের প্রশান্তি আর রাতের নিদ্রা তার জন্য হারাম হয়ে গেলো। দেখতে দেখতে শরীরও পড়লো ভেঙ্গে।

যহীরের ইনতেযারের সাথে সাথে ছোট্ট মেহমানের ইনত্যেরও বেড়ে চললো। শেষ পর্যন্ত ইনতেযারের মেয়াদ শেষ হলো এবং যহীরের ঘরের নির্বাক আবহওয়া একটি শিশুর কলশব্দে কিছুটা প্রাণময় হয়ে উঠলো। এই শিশুই উযরা।

উযরার পয়দায়েশের পর ইয়াসমিনের হুঁশ হলে চোখ খুলেই সে প্রথম প্রশ্ন করলো, উনি এলেন না?

উনিও এসে যাবেন।’ হানিফা সান্তনার ভংগীতে বললো।

‘এতো দেরী হলো? খোদা জানেন, কবে আসবেন তিনি।

*

উযরা পয়দা হবার পর তিন হফতা কেটে গেছে। ইয়াসমিনের স্বাস্থ্য দিনের পর দিন ভেঙ্গে পড়ছে। রাত্রে ঘুমের মধ্যে বারংবার সে যহীরের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে উঠে বসে। কখনো আবার ঘুমের মধ্যে চলতে গিয়ে দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যায়।

হানিফা ঘুমে, জাগরণে, উঠতে, বসতে তাকে সান্তনা দেয়। এছাড়া আর সে কি-ই-বা করতে পারে?

একদিন দুপুর বেলা ইয়াসমিন শুয়ে রয়েছে তার বিছানার উপর। হানিফা তার কাছে এক কুরসীতে বসে উযরাকে আদর করছে। এমন সময় কে যেনো ঘা দিলো দরজার উপর।

‘কে যেনো ডাকছে। ইয়াসমিন নেহায়েত কমোর আওয়াযে বললো।

হানিফা উযরাকে ইয়াসমিনের পাশে শুইয়ে রেখে উঠলো এবং বাইরে গিয়ে দরযা খুলে দিলো। সামনে সাঈদ দাঁড়ানো।

হানিফা অধীর ও পেরেশান হয়ে বললো, সাঈদ, তুমি এসেছো? যহীর কোথায়? সে এলোনা?’

ইয়াসমিনের কামরা যদিও বাইরের দূর থেকে বেশ দূরে, তথাপি হানিফার কথাগুলো তার কানে পৌঁছে গেছে। সাঈদের নাম শুনেই তার কলিজা ধড়ফড় করে উঠলো এবং এক লহমার মধ্যে হাজারো দুর্ভাবনা জাগলো তার মনে। কম্পিত বুকখানি হাতে চেপে ধরে সে উঠলো বিছানা থেকে। কাঁপতে কাঁপতে কামরা থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়ালো হানিফার কাছ থেকে দু’তিন কদম পিছনে। হানিফা দরযায় দাঁড়িয়ে তখনো চেয়ে আছে সাঈদের মুখের পানে, তাই ইয়াসমিনের আগমন সে লক্ষ্য করতে পারেনি। সাঈদ দাঁড়িয়ে রয়েছেন দরার বাইরে। তাই দেখতে পাননি ইয়াসমিনকে।

হানিফা আর একবার প্রশ্ন করলো, কিন্তু সাঈদ নীরব।

সাঈদ! হানিফা বললো, জওয়াব দিচ্ছো না কেন? তবে কি সে–?

সাঈদ গর্দান তুলে হানিফার দিকে তাকালেন। তিনি কিছু বলতে চাইছেন, কিন্তু কথা ফুটছে না তার মুখে। তার বড় বড় খুবসুরত চোখ দুটি অশ্রুভারাক্রান্ত। তার মুখের উপর ফুটে উঠেছে অসাধরণ দুঃখ ও বিষাদের ছাপ।

সাঈদ–কথা বল! হানিফা আবার বললো।

উনি শহীদ হয়ে গেছেন!-আমার আফসোস, আমি যিন্দাহ ফিরে এসেছি।’

কথা বলতে বলতে সাঈদের চোখ থেকে উছলে পড়লো অশ্রুধারা।

সাঈদের মুখের কথা শেষ হতেই হানিফার পিছনে একটা চীৎকার ধ্বনি শোনা গেলো এবং ধপ করে যমিনের উপর কিছু পড়বার আওয়ায এলো। হানিফা ঘাবড়ে গিয়ে পিছনে ফিরলো। সাঈদও হয়রান হয়ে আঙিনায় প্রবেশ করলেন। ইয়াসমিন ততক্ষণে নীচের দিকে মুখ দিয়ে পড়ে রয়েছে।

সাঈদ চলদী করে তাকে তুলে কামরায় নিয়ে শুইয়ে দিলেন বিছানার উপর। তার হুঁশ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চললো। অবশেষে হতাশ হয়ে তিনি ছুটলেন হাকীম ডাকতে। খানিকক্ষণ পর হাকীম নিয়ে ফিরে এসে সাঈদ দেখলেন, মহল্লার বহু নারী জমা হয়েছে ঘরের মধ্যে। হাকীমকে দেখে একজন বললো, এখন আর আপনার কোনো প্রয়োজন নেই। সে চলে গেছে।

সন্ধ্যার কাছাকাছি সময়ে শহরের হাকিম ইয়াসমিনের জানাযা পড়ালেন। যহীরের শাহাদতের খবর রটে গেলো চারদিকে। তার মাগফেরাতের জন্য দোয়া করা হলো। তারপর দোয়া করা হলো যহীর ও ইয়াসমিনের স্মরণচিহ্ন উযরার দীর্ঘজীবন কামনায়।

সাঈদ সেই দিনই উযরাকে এক ধাত্রীর হাতে সমর্পণ করলেন। হানিফাঁকে তিনি বললেন, তুমি যহীরের বাড়িতে থাকতে চাইলে আমি তোমার সব খরচ বহন করতে তৈরী। আর আমার বাড়িতে থাকা পছন্দ করলে আমি তোমার খেদমদ করবো।’

হানিফা বললো, আমি হলবে নিজের ঘরে চলে যেতে চাই। ওখানে আমার এক ভাই রয়েছে। ওখানে মন না বসলে আমি আবার ফিরে আসবো তোমার কাছে। সাঈদ হানিফার সফরের ইনতেযাম করে পাঁচশ দিনার দিয়ে তাকে বিদায় করলেন।

দু’বছর পর সাঈদ উযরাকে ফিরেয়ে এনে নিজেই তাকে পালন করতে লাগলেন। ফারেসে খারেজীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যাবার বেলায় তিনি উযরাকে রেখে গেলেন সাবেরার কাছে।

তিন

লোকালয়ের বাগ-বাগিচার ভিতর দিয়ে বয়ে চলেছে একটি নদী। পোষা জানোয়ারগুলোকে পানি খাওয়ানোর জন্য লোকালয়ের বাসিন্দারা নদীর কিনারে খুদে গেছে একটি ভালাব। নদীর পানিতে ভরে থাকে তালাবটি। তালাবের আশে পাশে দেখা যায় খেজুর গাছের মুগ্ধকর দৃশ্য। লোকালয়ের ছেলেমেয়েরা প্রায় সব সময়েই এসে খেলা করে এখানে।

একদিন আব্দুল্লাহ, নয়ীম ও উযরা সেখানে খেলতে গেলো লোকালয়ের ছেলেমেয়েদের সাথে। আব্দুল্লাহ তার সমবয়সী ছেলেদের সাথে গোসল করতে নামলো তালাকের মধ্যে। নয়ীম আর উযরা দাঁড়িয়ে তালাকের কিনারে। সেখান থেকে তারা বড় ছেলেদের সাঁতার কাটা, লাফ-ঝাঁফ ও দাপাদাপি দেখে খুশীতে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। কোনো ব্যাপারেই নয়ীম তার ভাইয়ের পেছনে পড়ে থাকতে চায় না। সাঁতার কাটতে সে শেখেনি, কিন্তু আব্দুল্লাহকে সাঁতার কাটতে দেখে সে নিজকে সামলে রাখতে পারলো না। উযরার দিকে তাকিয়ে সে বললো, এসো উযরা আমরাও গোসল করিগে।

আম্মিজান রেগে যাবেন। উযরা জওয়াব দিলো।

আব্দুল্লাহর উপর তো তিনি রাগ করেন না। আমাদের উপর কেন রাগ করবেন তাহলে?

উনি তো বড়ো। উনি সাঁতরাতে জানেন। তাই আম্মিজান রাগ করেন না।

‘আমরা গভীর পানির দিকে যাবো না। চলো যাই।’

উঁহু! উযরা মাথা নেড়ে বললো।

‘ডর লাগছে তোমার?

নাতো!

তবে চলো।’

নয়ীম যেমন সব কিছুতে আব্দুল্লাহর অনুসরণ করতে চায়-শুধু তাই নয়, তাকে ছাড়িয়ে যেতে চায়, তেমনি উযরাও নয়ীমের সামনে স্বীকার করতে চায় না তার কমজোরী। নয়ীম হাত বাড়িয়ে দিলে উযরা তার হাত ধরে পানিতে ঝাঁপ দিলো। কিনারের দিকে পানি খুব গভীর নয়, কিন্ত আস্তে আস্তে তারা এগিয়ে চললো গভীর পানির দিকে। আব্দুল্লাহ ছেলেদের সাথে অপর কিনারে খেজুর গাছের একটা গুঁড়ির উপর থেকে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ছিলো। পালা করে আব্দুল্লাহর ন্যর যখন নয়ীম ও উমরার উপর পড়লো, তখন পানি তাদের গর্দান বরাবর উঠেছে। তখনো দু’জন পরস্পরের হাত ধরে রয়েছে। আব্দুল্লাহ ঘাবড়ে গিয়ে চীৎকার জুড়ে দিলো, কিন্তু তার আওয়ায পৌঁছবার আগেই উযরা ও নয়ীম গভীর পানিতে পড়ে হাত-পা ছুঁড়তে লাগলো। আব্দুল্লাহ দ্রুত সাঁতার কেটে তাদের দিকে এগিয়ে এলো। তার আসার আগেই নয়ীমের পা যমিনের নাগাল পেয়েছে। নিন্তু উযরা তখন হাবুডুবু খাচ্ছে। আব্দুল্লাহ নয়ীমকে নিরাপদ দেখে এগিয়ে গেলো উযরার দিকে।

উযরা হাত-পা মারছে তখনো। আব্দুল্লাহ কাছে এলে সে তার গলায় বাহু দিয়ে জড়িয়ে ধরলো। তার বোঝা বয়ে নিয়ে সাঁতার কাটার সাধ্য আব্দুল্লাহর নেই। উযরা তাকে এমন ভীষণভাবে জড়িয়ে ধরেছে যে, সে তার বায়ু নাড়তে পারছে না ঠিকমতো। দুতিন বার সে পানিতে ডুবে ডুবে ভেসে উঠলো আবার। এরই মধ্যে নয়ীম কিনারে চলে গেছে। সে আর সব ছেলেদের সাথে মিলে শুরু করলো ডাক চীৎকার। তখন এক রাখাল উটকে পানি খাওয়াতে এসেছিলো তালাবের দিকে। ছেলেদের ডাক-চীৎকারে সে ছুটে এলো এবং কিনারে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটি দেখেই পানিতে ঝাঁপ দিলো কাপড়-চোপড় সমেত। উযরা ততোক্ষণে বেহুশ হয়ে আব্দুল্লাহকে ছেড়ে দিয়েছে তার বাহুবন্ধন থেকে। সে তখন এক হাতে উযরার মাথার চুল ধরে অপর হাত দিয়ে সাঁতার কাটার চেষ্টা করছে।

রাখার দ্রুতগতিতে গিয়ে উযরাকে ধরে তুললো উপরে। আব্দুল্লাহ উযরার বাহুবন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে সাঁতরে গেলো আস্তে আস্তে কিনারের দিকে। রাখাল উযরাকে পানি থেকে তুলে নিয়ে দ্রুতগতিতে ছুটে চললো সাবেরার ঘরের দিকে।

আব্দুল্লাহ তালাব থেকে উঠে এলে নয়ীম ঝট করে ছুটে গেলো অপর কিনারে। সেখান থেকে সে আব্দুল্লাহর কাপড়গুলো নিয়ে এলো। আব্দুল্লাহ কাপড় পরতে পরতে নয়ীমের পানে তার ক্রদ্ধদৃষ্টি হানলো। নয়ীম আগেই হতভম্ব হয়ে গেছে। ভাইয়ের ক্রোধের উত্তাপ সহ্য করতে না পেরে সে কেঁদে ফেললো হু হু করে। আব্দুল্লাহ নয়ীমকে কাঁদতে দেখেছে খুব কম। নয়ীমের চোখের পানি তার মন গলিয়ে দিলো মোমের মতো। সে বললো, তুমি একটা গাধা হয়ে গেছে। ঘরে চলো।

নয়ীম কান্না জড়ানো কণ্ঠে বললো, আম্মিজান মারবেন। আমি যাবো না।

মারবেন না।’ আব্দুল্লাহ তাকে সান্তনা দিয়ে বললো।

আব্দুল্লাহর সান্তনা-ভরা কথা শুনে নয়ীমের চোখের পানি শুকিয়ে গেলো। সে এবার চললো ভাইয়ের পিছু পিছু।

রাখাল উযরাকে নিয়ে যখন সাবেরার ঘরে পৌঁছলো, তখন সাবেরার পেরেশানীর আর অন্ত নেই। আশেপাশের মেয়েছেলেরাও জমা হয়েছে সেখানে। বহু চেষ্টার পর উযরা’র হুঁশ ফিরে এলো। সাবেরা রাখালকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘এ সব নয়ীমের দুষ্টুমির ফল হবে। উযরাকে ওর সাথে বাইরে পাঠাতে আমি সব সময়ই ভয় করি। পরশুও একটা ছেলের মাথা ফুটো করে দিয়েছে। আচ্ছা, আজ একবার ঘরে এলেই হয়।

রাখাল বললো, এতে নয়ীমের কোন কসুর নেই। সে তো কেবল কিনারে দাঁড়িয়ে ডাক চীৎকার দিচ্ছিলো। তার আওয়ায শুনেই আমি তালাবের কাছে ছুটে এসে দেখি, আপনার বড়ো ছেলে উযরার চুল ধরে টানছে আর সে হাবুডুবু খাচ্ছে।

আব্দুল্লাহ!’ সাবেরা হয়রান হয়ে বললেন, সে তো এমন নয় কখনো? . রাখাল বললো, আজ তো আমিও তার কার্যকলাপ দেখে হয়রান হয়ে গেছি।

আমি সময়মতো না পৌঁছলে নিষ্পাপ মেয়েটি ডুবেই মারা যেতো।

ইতিমধ্যে আব্দুল্লাহ ঘরে পৌঁছলো। নয়ীম তার পিছু পিছু মাথা নীচু করে হাঁটছে। আব্দুল্লাহ সাবেরার মুখোমুখি হলে নয়ীম গিয়ে তার পিছনে গা ঢাকা দিয়ে দাঁড়ালো।

সাবেরা গযবের স্বরে বলে উঠলেন, ‘আব্দুল্লাহ, যাও। আমার চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে যাও। আমার ধারণা ছিলো, বুঝি তোমার কিছুটা বুদ্ধি-শুদ্ধি আছে, কিন্তু আজ তুমি নয়ীমেরও চার কদম ছাড়িয়ে গেছে। উযরাকে সাথে নিয়েছিলে ডুবিয়ে মারবার জন্য?

সারা পথ আব্দুল্লাহ নয়ীমকে বাঁচাবার কৌশল চিন্তা করেছে। এই অপ্রত্যাশিত অভ্যর্থনায় সে হয়রান হয়ে গেলো। সে বুঝলো, নয়ীমের কসুর ত্যর ঘাড়েই চেপে বসেছে। সে পিছন ফিরে তাকালো। ছোট্ট ভাইটির চোখে সে দেখতে পেলো এক আকুল আবেদন। তাকে বাঁচাবার একটিমাত্র উপায় আব্দুল্লাহর সামনে। যে অপরাধ সে করেনি, তাই তাকে মাথা পেতে নিতে হবে। ভেবে সে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। মায়ের ক্রদ্ধ ভর্ৎসনা সে নীরবে হজম করে গেলো।

রাতের বেলা উমরার কাশিসহ জ্বর দেখা দিলো। সাবেরা শিয়রে বসে রয়েছেন। নয়ীমও নেহায়েৎ বিষণ্ণ মুখে তার পাশে বসে। আব্দুল্লাহ ভিতরে ঢুকলো। চুপি চুপি সে গিয়ে দাঁড়ালো সাবেরার পাশে। সাবেরা তার দিকে লক্ষ্য না করে উযরার মাথা টিপে দিচ্ছিলেন। নয়ীম হাত দিয়ে আব্দুল্লাহকে চলে যেতে ইশারা করলো এবং হাত মুঠো করে তাকে বুঝাতে চাইলো যে, এখখুনি তার চলে যাওয়া উচিত, নইলে ফল ভালো হবে না। আব্দুল্লাহ মাথা নেড়ে জওয়াব দিলো যে, সে যাবে না।

নয়ীমকে ইশারা করতে দেখে সাবেরা আব্দুল্লাহর দিকে ন্যর তুললেন। আব্দুল্লাহ মায়ের ক্রদ্ধ দৃষ্টিতে ঘাবড়ে গেলো। সে বললো, উযরা কেমন আছে?

সাবেরা আগে থেকেই রেগে রয়েছেন। এবার আর সামলাতে পারলেন না।–দাঁড়াও বলছি’-বলে তিনি উঠে আব্দুল্লাহর কান ধরে বাইরে নিয়ে গেলেন। আঙ্গিনার একধারে আস্তাবল। সাবেরা আব্দুল্লাহকে সেদিকে নিয়ে গিয়ে বললেন, উযরা কেন এখনো মরেনি, তাই দেখতে গিয়েছিলে বুঝি? রাতটা এখানেই কাটাও। আব্দুল্লাহকে এই হুকুম দিয়ে সাবেরা গিয়ে আবার উ’রার শিয়রে বসলেন।

নয়ীম যখন খানা খেতে বসলো, তখন ভাইয়ের কথা তার মনে পড়ে গেলো। লোকমা তার গলা দিয়ে সরতে চাইলো না। ভয়ে ভয়ে সে মাকে জিগগেস করলো, ‘আম্মিজান! ভাই কোথায়?

আজ সে আস্তাবলেই থাকবে।’

‘আম্মি, তাকে খানা দিয়ে আসবো?’

না। খবরদার, তার কাছে গেলে…।’

নয়ীম কয়েকবার লোকমা তুললো, কিন্তু তার হাত মুখের কাছে দিয়ে থেমে গেলো।

‘খাচ্ছো না?’ সাবেরা প্রশ্ন করলেন।

‘খাচ্ছি আমি।’ নয়ীম জলদী করে একটি লোকমা মুখে দিয়ে জওয়াব দিলো। সাবেরা এশার নামাযের ওযু করতে উঠলেন। ওযু করে ফিরে এসে নয়ীমকে তেমনি বসে থাকতে দেখে বললেন, নয়ীম, তোমার আজ বড়ড দেরী হচ্ছে। এখনো খানা খেলে না?’

নয়ীম জওয়াবে বললো, আমার খাওয়া হয়ে গেছে।

বরতনে তখনো খানা পড়ে রয়েছে। সাবেরা তা তুলে অপর কামরায় রেখে নয়ীমকে ঘুমোতে যেতে বললেন। নয়ীম বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। সাবেরা নামাযে দাঁড়ালে সে চুপি চুপি উঠে নিঃশব্দে পাশের কামরা থেকে খানা তুলে নিয়ে আস্তাবলের দিকে চললো। আব্দুল্লাহ একটি ঘোড়ার মুখের উপর হাত বুলাচ্ছিলো। দর্য দিয়ে চাঁদের রোশনী এসে পড়েছে তার মুখে। নয়ীম খানা তার সামনে রেখে বললো, আম্মিজান নামায পড়ছেন। জলদী খেয়ে নাও।

আব্দুল্লাহ নয়ীমের দিকে তাকিয়ে হেসে বললো, নিয়ে যাও। আমি খাবো না’।

‘কেন? আমার উপর নারায হয়েছে, না?’ অশ্রুসজল চোখে সে বললো।

না নয়ীম, এ আম্মিজানের হুকুম। তুমি যাও।’

‘আমি যাবো না। আমিও থাকবো এখানেই’।

যাও নয়ীম! আম্মিজান তোমায় মারবেন।’

না, আমি যাবো না।’ নয়ীম আব্দুল্লাহকে জড়িয়ে ধরে বললো।

নয়ীমের পীড়াপীড়িতে আব্দুল্লাহ চুপ করে গেলো।

এদিকে সাবেরার নামায শেষ হলো। মাতৃস্নেহ তিনি আর চেপে রাখতে পারছেন না। ওহ্! কী যালেম আমি! নামায শেষ করেই তিনি গেলেন আস্তাবলের দিকে। নয়ীম মাকে আসতে দেখে পালালো না, বরং ছুটে গিয়ে তার পা জড়িয়ে ধরে বলে উঠলো, “আম্মি! ভাইয়ের কোনো কসুর নেই। আমিই ‘উয’রাকে গভীর পানিতে নিয়ে গিয়েছিলাম। ভাই শুধু তাকে বাঁচাবার চেষ্টাই করেছে।’

সাবেরা খানিক্ষণ পেরেশান হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর বললেন, আমারও সেই খেয়ালই ছিলো। আব্দুল্লাহ এদিকে এসো।’ আব্দুল্লাহ উঠে এলে সাবেরা আদর করে কপালে হাত বুলালেন। তারপর তার মাথাটা চেপে ধরলেন বুকের সাথে।

নয়ীমকে আপনি মাফ করুন, আম্মি! আব্দুল্লাহ বললো।

সাবেরা নয়ীমের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বেটা! কেন তুমি আগে দোষ স্বীকার করলে না?

‘আমি কি জানতাম ভাইকে আপনি সাজা দেবেন? নয়ীম জওয়াব দিলো। আচ্ছা, তুমি খানা তুলে নাও।’ নয়ীম খানা তুলে নিলো। তারপর তিনজন গিয়ে প্রবেশ করলেন বড়ো কামরায়। তখনো কারুরই কিছু খাওয়া হয়নি, তাই তিনজন আবার একই জায়গায় খেতে বসলেন।

*

ছেলেমেয়েদের শিক্ষাদীক্ষাই ছিলো সাবেরার যিন্দেগীর সকল আকর্ষণের কেন্দ্র। স্বামীর মৃত্যুর পর নারী জীবনের যে নিঃসংগতা অনুভূত হয়, তা সত্ত্বেও তাঁর জীর্ণ গৃহখানি একটি আড়ম্বরপূর্ণ শহরের চাইতে কম ছিল না।

রাতের বেলা তিনি যখন এশার নামায শেষ করে অবকাশ পেতেন, আব্দুল্লাহ, উযরা আর নয়ীম তখন তার কাছে বসে জানতো গল্প শোনার দাবী। সাবেরা তাদেরকে শোনাতেন কুফর ও ইসলামের গোড়ার দিকের যুদ্ধের কাহিনী, আর শোনাতেন রসূলে বরহক সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লামের যিন্দেগীর কিসসা।

ছেলেমেয়েদের নিরুদ্দেশ জীবন বয়ে চলেছে সাবলীল গতিতে। সাবেরার শিক্ষার গুণে তাদের দীলের মধ্যে সিপাহী সুভল গুণের বিকাশ হচ্ছে দিনের দিন। আব্দুল্লাহ বয়সে যেমন বড়ো, নয়ীম ও উযরার তুলনায় তেমনি সে প্রশান্ত গভীর। তেরো বছর বয়সে সে কুরআন পাক ও আরো কতগুলো ছোটখাটো কিতাব পড়ে শেষ করেছে। নয়ীম যেমন বয়সে ছোট, তেমনি খেলাধুলায় তার উৎসাহ বেশি; তাই পড়াশোনায় সে আব্দুল্লাহর পেছেনে রয়েছে। তার চঞ্চল স্বভাব ও দুর্দান্তপনা তামাম লোকালয়ে মশহুর। উঁচু গাছে চড়াতে সে পারে; তেমনি যেতো দুর্দন্ত ঘোড়াই হোক না তার পিঠে সে সওয়ার হয়ে যায় অনায়াসে। ঘোড়ার নাংগা পিঠে চড়তে গিয়ে কতোবার সে পড়ে গিয়ে চোট পেয়েছে। প্রত্যেকবার সে উঠে এসেছে হাসিমুখে আর আগের চাইতেও বেশী সাহস নিয়ে মোকাবিলা করেছে বিপদের। এগারো বছরে পা দিতেই তামাম লোকালয়ে তার শাহ-সওয়ারী ও তীরন্দাযির আলোচনা শোনা যায়।

একদিন আব্দুল্লাহ সাবেরার সামনে বসে সবক শুনাচ্ছে। নয়ীম তখন তীর ধনুক হাতে নিয়ে বাড়ির ছাদের উপর দাঁড়িয়ে তাকাচ্ছিলো এদিক ওদিক। সাবেরা আওয়ায দিলেন নয়ীম, এসো এদিকে। আজ তুমি সবক শেখোনি কেন?

যাই আম্মি।

সাবেরা আবার আব্দুল্লাহর দিকে মনোযোগ দিলেন। আচানক এক কাক উড়ে এলো সেদিকে। নয়ীম তীরের নিশানা করলো তখখুনি। কাকটি হুমড়ি খেয়ে এসে পড়লো সাবেরার কাছে। সাবেরা ঘাবড়ে গিয়ে তাকালেন উপরদিকে। নয়ীম ধনুক হাতে বিজয়গর্বে হাসছে। সাবেরা মুখের হাসি চাপা দিয়ে বললেন, ‘বহুত নালায়েক হয়েছো তুমি!

‘আম্মি, ভাই আজ বলছিলো, আমি নাকি উড়ে যাওয়া পাখীর উপর নিশানা করতে পারি না।’

ভারী বাহাদুর তো হয়েছে! এবার এসে সবক শোনাও।

চৌদ্দ বছর বয়সে আব্দুল্লাহ দ্বীনী এলেম ও যুদ্ধ বিদ্যা শিখবার মতলবে বসরার এক মকতবে দাখিল হবার জন্য বিদায় নিয়ে গেলো। উযরার দুনিয়ার অর্ধেকটা খুশী আর মায়ের মুহব্বত ভরা দীলের একটা টুকরা সে নিয়ে গেলো সাথে করে। আব্দুল্লাহ আর নয়ীম দু’জনের উপরই ছিল উযরার অন্তহীন মহব্বত কিন্ত দু’জনের মধ্যে কার উপর তার আকর্ষণ বেশি? তার নিষ্পাপ দীলের উপর কে বেশী দাগ কেটেছে? তার চোখ কাকে বারবার দেখাবার জন্য বেকারার, আর কার আওয়ায় তার কানের কাছে গুঞ্জন করে যায় সংগীত সুরের মতো?

প্রকাশ্যে উযরা নিজেও এ প্রশ্নের কোনো ফয়সালা করতে পারেনি। তার কাছে আব্দুল্লাহ ও নয়ীম একই দেহের দুটি ভিন্ন নাম। নয়ীমকে বাদ দিয়ে আব্দুল্লাহ, আব্দুল্লাহকে বাদ দিয়ে নয়ীমের কল্পনাই তার কাছে অসম্ভর। সে কখনো তাঁর দীলের মধ্যে এদের দু’জনকে তুলনা করে দেখাবার চেষ্টা করেনি। দু’জনাই যখন তার কাছে ছিলো, তখন তাদেরকে নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করবার প্রয়োজনই হয়নি কখনো। দু’জনের কেউ যখন হেসেছে, তখন সে তাতে শরীক হয়েছে। তারা গম্ভীর হলে সেও গম্ভীর হয়ে গেছে।

আব্দুল্লাহ বসরায় হলে যাবার পর এসব প্রশ্ন নিয়ে তার চিন্তা করবার মওকা মিললো। সে জানতো, নয়ীমও সেখানে চলে যাবে কিছুকাল পর। কিন্তু নয়ীমের বিচ্ছেদের চিন্তা তার কাছে আব্দুল্লাহর বিচ্ছেদের চাইতে আরো অসহনীয় মনে হতে লাগলো। আব্দুল্লাহ বয়সে বড়, তার প্রশান্ত গাম্ভীর্য উযরার দীলের মধ্যে মুহব্বতের সাথে শ্রদ্ধার সঞ্চারও করেছিলো। নয়ীমের মতো সেও তাকে ভাইচান বলে ডাকতো এবং তাকে বড় মনে করে তার কাছ থেকে দূরে দূরে থাকতো, অবাধে মিশতে পারতো না। নয়ীমের প্রতিও তার শ্রদ্ধার কম ছিল না, কিন্তু তার সাথে আবাধ চলাফেরায় তাদের মধ্যে লজ্জার বাধন ছিলো না। তার দুনিয়ায় আব্দুল্লাহ ছিলো সূর্যের মতো, তার মুগ্ধকর দীপ্তি সত্ত্বেও যেনো তার দিকে তাকানো যায় না চোখ তুলে, তার কাছে, যেতে যেনো ঘাবড়ে যায় মন.। কিন্তু নয়ীমের প্রত্যেকটি কথা যেনো বেরিয়ে আসে তার নিজেরই মুখ থেকে। আব্দুল্লাহ চলে যাবার পর নয়ীমের চালচলনে এলো এক অদ্ভুত পরিবর্তন। আব্দুল্লাহর বিচ্ছেদ নয়ীমের মনে বেশী করে বাজাবে, অথরা সেও একদিন বসরার মাদ্রাসায় দাখিল হবার জন্য অধীর হয়ে রয়েছে, হয়তো এই চিন্তাই তাকে ছেলেবেলার চালচলন থেকে ফিরিয়ে পড়াশোনায় মেনোযোগী করে তুললো। একদিন সে সাবেরাকে শুধালো, আম্মি, আমায় কবে পাঠাবেন বসরায়?

মা জওয়াব দিলেন, বেটা, যতোক্ষণ তুমি গোড়ার দিকের শিক্ষা শেষ না করছে, ততোক্ষণ কি করে পাঠাবো? লোকে বলবে, আব্দুল্লাহর ভাই লেখাপড়া জানে না। ঘোড়ায় চড়া আর তীর চালানো ছাড়া জানে না কিছুই। এসব কথা আমি পছন্দ করি না।

মায়ের কথাগুলো নয়ীমের স্পর্শকাতর দীলের উপর ছুরির মতো লাগলো। আঁসু সংবরণ করে সে বললোঃ আম্মি, কেউ আমায় জাহেল বলতে সাহস করবে না। এই বছরই আমি সবগুলো কিতাব শেষ করবো।’

সাবেরা আদর করে নয়ীমের মাথার হাত রেখে বললেন, তোমার পক্ষে কিছুই মুশকিল হবে না বেটা! মুসিবৎ হচ্ছে, তুমি কিছু করতে চাও না।

নিশ্চয়ই করবো আম্মি! আমার বিরুদ্ধে কোনো নালিশ থাকবে না আপনার।

*

মাহে রমযানের ছুটিতে আব্দুল্লাহ ঘরে ফিরে এলো। তার সারা গায়ে সিপাহীর লেবাস। লোকালয়ের ছেলেমেয়েরা তাকে দেখে হয়রান। তাকে দেখে নয়ীমের খুশীর অন্ত নেই। উযরা তাকে দূর থেকে দেখে মুষড়ে পড়ে লজ্জায়, সাবেরা বারবার চুমো খান তার পেশানীতে। নয়ীম প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে আব্দুল্লাহকে তার মাদ্রাসা সম্পর্কে। আব্দুল্লাহ তাকে বলে, সেখানে লেখাপড়ার চাইতে বেশী সময় লাগানো হয় নানারকম রণ-কৌশল শেখাতে। নেযাহবাযি, তেগ চালানো আর তীরন্দাযী শেখানো হয় তাদের মাদ্রাসায়। তীরন্দাযীর কথা শুনে নেচে ওঠে নীমের দীল। ভাইজান! আমায়ও ওখানে নিয়ে চলুল’। অনুনয়ের স্বরে বলে নয়ীম। এখনো তুমি খুবই ছোট। ওখানকার সব ছেলেই তোমার চাইতে অনেক বড়। আরো কিছুকাল তোমায় অপেক্ষা করতে হবে।’ নয়ীম কতক্ষণ চুপ করে থেকে প্রশ্ন করলো, ভাইজান মাদ্রাসায় আপনি সব ছেলের চাইতে ভালো করছেন না? আব্দুল্লাহ জওয়াব দিলো, না, বসরার একটি ছেলে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী। তার নাম মুহাম্মদ বিন কাসিম। তীরন্দাযী আর নেযাহবাযিতে সে মাদ্রাসার সব ছেলের চাইতেই ভালো। তেগ চালানোয় আমারা দু’জন সমান। কখনো কখনো আমি তোমার কথা তাকে বলেছি। তোমার কথা শুনে সে খুব হাসে।

হাসে?’ নয়ীম উত্তেজিত হয়ে বললো, আমি নিজে গিয়ে তাকে বলে দেবো যে, লোক আমার কথা শুনে হাসবে, তেমনটি আমি নই।

আব্দুল্লাহ নয়ীমের রাগ দেখে তাকে বুকে চেপে ধরে খুশী করবার চেষ্টা করলো।

রাতের বেলায় আব্দুল্লাহ লেবাস বদল করে ঘুমালো। নয়ীম তার কাছে শুয়ে অনেকখানি রাত জেগে কাটালো। ঘুমিয়ে পড়লে সে স্বপ্নে দেখলো, যেনো সে : বসরার মাদ্রাসার ছেলেদের সাথে তীরন্দাষিতে ব্যস্ত। ভোরে সে সবার আগে উঠলো। জলদি করে সে আব্দুল্লাহর উর্দী পরে গিয়ে উযরাকে জাগিয়ে বললো, “দেখো তো উযরা, এ লেবাস আমায় কেমন মানায়?

উযরা উঠে বসলো। নয়ীমের মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখে সে হেসে বললো, এ লেবাস বেশ মানিয়েছে তোমায়।’

উযরা, আমিও ওখানে যাবো আর এই লেবাস পরে আসবো।’

উযরার মুখের উপর কেমন একটা উদাস ভাব ছেয়ে গেলো। তুমি কবে যাবে ওখানে?’ সে প্রশ্ন করলো।

‘উয়রা, আম্মিজানের কাছ থেকে আমি শীগগিরই এজাযত নেবো।’

চার

৩৫ হিজরী থেকে শুরু করে ৭৫ হিজরী সাল পর্যন্ত সে সময়টা কেটে গেছে, তখনকার ইসলামী ইতিহাস এমন সব রক্ত-রাঙা ঘটনায় ভরপুর, যার আলোচনা। করতে গিয়ে বিগত কয়েক শতাব্দীতে বহু অশ্রুপাত করা হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও আফসোস ও অশ্রুপাত ছাড়া তা স্মরণ করা যাবে না। যে তলোয়ার খোদার নামে নিস্কোষিত হয়েছিলো তা চলতে লাগলো তাদেরই গলায়, যারা খোদার নাম নিচ্ছে। মুসলমান যেমন দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়েছে দুনিয়ার দিকে দিকে, তেমনি দ্রুতগতিতে এ বিপদের প্রসার ঘটলো তাদের মধ্যে। আশংকা হতে লাগলো, যেনো তেমনি দ্রুতবেগে দুনিয়ার সব দিক থেকে সংকুচিত হয়ে তারা সীমাবদ্ধ হবে আরব উপদ্বীপে। কুফা ও বসরা হয়েছিলো তখন নানারকম ষড়যন্ত্রের কেন্দ্রভূমি। মুসলামন তাদের প্রারম্ভিক ঐতিহ্য ভুলে গিয়ে জিহাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তখন। তাদের সামনে স্বার্থপরতা ও লোভ চরিতার্থ করবার সংগ্রাম এবং ন্যায়-অন্যায় নির্বিশেষে যে কোনো ব্যাপারে কলহ সৃষ্টি ব্যতীত আর কোন দৃষ্টিভংগী ছিলোনা। তখনকার পরিস্থিতিতে এক লৌহ-কঠিন হস্তের প্রয়োজন ছিলো মসুলমানদের এক কেন্দ্রে ঐক্যবদ্ধ করবার জন্য।

আবর মরুতে হলো এক অগ্নিগিরির উদগীরণ এবং আরব-আযমের ধুমায়মান বিদ্রোহের আগুন সেই অগ্নিগিরির ভয়াবহ শিখার মোকাবিলায় এসে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলো। এই অগ্নিগিরি এক বিরাট ব্যক্তিত্ব হাজ্জাজ বিন ইউসুফ। প্রচন্ড শক্তিমান হাজ্জাজ, বেরহম যালিম হাজ্জাজ। কিন্তু কুদরৎ আরব মরুর অভ্যন্তরীণ যুদ্ধবিগ্রহ খতম করে দিয়ে মুসলমানদের দ্রুতগামী বিজয় অশ্বের গতি পূর্ব ও পশ্চিমের লড়াইয়ের ময়দানের দিকে চালিত করবার মহাকর্তব্য ন্যস্ত করেছিলেন এই মানুষটির উপর।

হাজ্জাজ বিন ইউসুফকে যেমন বলা যায় মুসলমানদের সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু, তেমনি বলা যায় নিকৃষ্ঠতম দুশমন। সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু বলা যায় এই কারণে যে, তিনিই এক শান্তিপূর্ণ আবহওয়া পয়দা করে মুসলিম বিজয় বাহিনীর অগ্রগতির জন্য খুলে দিয়েছিলেন তিনটি যুবরদস্ত রাস্তা। এক পথ দিয়ে মুসলিম ফউজ এগিয়ে গেলো ফারগানা ও কাশগড় পর্যন্ত, দ্বিতীয় পত্র মুসলমানদের সৌভাগ্য অশ্ব পৌঁছে গেলো মারাকেশ, স্পেন ও ফ্রান্সের সীমান্তে এবং তৃতীয় পথ ধরে মুহাম্মদ বিন কাসিমের মুষ্টিমেয় সেনা বাহিনী পৌঁছে সিন্ধুর উপকূল ভূমিতে।

নিকৃষ্টতম দুশমন বলার কারণ, তাঁর যে খুন-পিয়াসী তলোয়ার উন্মুক্ত হতো অনিষ্টকারী ও উচ্ছংখল লোকদের দমিত করবার জন্য, কখনো কখনো তা সীমা ছাড়িয়ে নিষ্পাপ মানুষের গর্দান পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছতো। হাজ্জাজ বিন ইউসুফের হাত যদি মযলুমের খুনে রেঙে না উঠতো, তাহলে ইতিহাসে সে যামানার সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ হিসেবে তার স্বীকৃতি না পাবার কোনো কারণই থাকতো না। তিনি ছিলেন এমন এক ঘূর্ণিবাত্যার মতো, যা কাটা-ঝাড়ের সাথে সাথে ইসলামের শুলশান থেকে অসংখ্য সুরভী ফুল ও সবুজ শাখাও নিয়েছে উড়িয়ে।

হাজ্জাজের শাসনকালে একদিক ছিলো অন্তহীন বিভীষিকাপূর্ণ; আরেকদিকে ছিলো অন্তহীন দীপ্তিতে সমুজ্জ্বত। তিনি ছিলেন এমন এক ঝড়ের মতো যা সবুজ বৃক্ষরাজিকে সমূলে উৎপাটন করে, করে ভূপতিত, কিন্তু তার কোলে লুকানো মেঘরাজি বারিবর্ষণ করে প্রাণময় সবুজ ওফলপুষ্পে শোভিত করে দেয় হাজারো শুস্ক বাগিচাকে।

আবর মরুভূমির গৃহবিবাদের আসান হলো হিজরী ৭৫ সালে। মুসলমান আবার জেগে উঠলো এক হাতে কুরআন ও অপর হাতে তলোয়ার নিয়ে। তখনকার যামানায় হাজ্জাজ বিন ইউসুফের নামের সাথেই উঠতো যায়েদ বিন আমেরের নাম। যায়েদ বিন আমেরের বয়স তখন আশি বছর। ইরানে খসরুর এবং শাম ও ফিলিস্তীনে সিজারের সালতানাত পয়মাল করেছিলো যে শাহসওয়ার বাহিনী, যৌবনে তিনি ছিলেন তাদের সংগী। বার্ধক্যে যখন তার আর তলোয়ার ধরবার ক্ষমতা নেই, তখন ইরানের এক সুবায় তিনি হলেন কাযী। আরবে যখন বিশৃংখলা ছড়িয়ে পড়েছে, তখন ইবনে আমের গিয়ে পৌঁছালেন কুফায়। তিনি তাবলীগ করে সেখানকার অবস্থার পরিবর্তন আনতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু তার আওয়ায হলো নিল।

কুফার লোকদের ঔদাসীন্য লক্ষ্য করে ইবনে আমের গেলেন বসরায়। সেখানকার অবস্থাও কুফা থেকে স্বতন্ত্র ছিলো না। ধনী ও দুস্কৃতিকারীরা তার দিকে আমলও দিলো না। নওজোয়ান ও বুড়োদের দিক থেকে হতাশ হয়ে ইবনে আমের তার তামাম উম্মীদ ন্যস্ত করলেন ছোট্ট ছেলেমেয়েদের উপর। তার সবটুকু চেষ্টা, সবটুকু মনোযোগ তিনি নিয়োগ করলেন তাদের শিক্ষাদীক্ষায়। শহরের বাইরে তিনি কায়েম করলেন একটি মাদ্রাসার বুনিয়াদ। বসরায় শান্তি ফিরে এলে সেখানকার বিশিষ্ট লোকেরাইবনে আমেরকে উৎসাহিত করলেন। মাদ্রাসায় শুধু দ্বীনী কিতাবপত্রই পড়ানো হতো না, তাছাড়া আরো শেখানো হতো যুদ্ধ বিদ্যা। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ তার এ নিঃস্বার্থ খিদমতে মুগ্ধ হয়ে মাদ্রাসার তামাম ব্যয়ভার নিলেন নিজের যিম্মায়। ছাত্রদের রণকৌশল, শাহসওয়ারী প্রভৃতি শিখাবার জন্য উত্তম জাতের ঘোড়া আর নতুন নতুন অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবস্থা হলো এবং ঘোড়ার জন্য তিনি মকতবের কাছেই তৈরী করে দিলেন এক শানদার আস্তাবল।

প্রতি সন্ধ্যায় ছাত্ররা এসে জমা হতো এক প্রশস্ত ময়দানে। সেখানে তাদেরকে ফউজী শিক্ষা দেওয়া হতো হাতে-কলমে। শহরের লোক সন্ধ্যা বেলায় সেই ময়দানের আশেপাশে জমা হয়ে দেখতে ছাত্রদের তেগ চালনা, নেযাহবাযি ও শাহসওয়ারীর নতুন নতুন কায়দা।

মাদ্রাসার সুখ্যাতি শুনে সাঈদ সাবেরাকে চিঠি লিখে পরামর্শ দিলেন আব্দুল্লাহকে সেখানে পাঠাতে। এই নতুন পরিবেশে এসে আব্দুল্লাহর তরী হতে লাগলো দ্রুতগতিতে। তার তরী দেখে তার সহপাঠিদের মনে জাগতো ঈর্ষা। রণকৌশল শিক্ষায়ও সে অধিকার করলো একটি বিশেষ স্থান।

আব্দুল্লাহ বসরায় আসার দু’বছরের মধ্যে পরিচিত হয়ে গেলো সেখানকার ছেলেবুড়ো সবারই কাছে। এই প্রতিভাবান শাগরেদের কৃতিত্ব অজনা ছিলো না ইবনে আমেরের

*

একদিন দুপুর বেলা এক কিশোর ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে ঢুকলো শহরে। আগন্তকের এক হাতে নেযাহ, অপর হাতে ঘোরার লাগাম। কোমরে ঝুলানো একখানা তলোয়ার। গলায় হেমায়েলও পিঠে ঝুলানো তুণীর। ধনুক বাধা রয়েছে ঘোড়ার যিনের পেছন দিকে। তার তলোয়ার দেহের উচ্চতা অনুপাতে অনেকটা বড়। কিশোর ঘোড়ার পিঠে বসে রয়েছে মযবুত হয়ে। প্রত্যেক পথচারী ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে তার দিকে। কেউ তাকে দেখে মৃদু হাসছে, আর কেউ বা হো হো করে। তার সমবয়সী ছেলেরা তামাশা দেখতে জমা হচ্ছে তার আশে পাশে। কিছু সময়ের মধ্যেই তার আগে পিছে এসে জমলো বিস্তর লোক। আগে বরাবর ও পিছু হটবার রাস্তা তারা বন্ধ করে দাঁড়ালো। একটি ছেলে তার দিকে ইশারা করে চীৎকার করে উঠলো বন্ধু’ বলে। আর সবাই তার সাথে চীৎকার করে উঠলো সমস্বরে। অপর একটি বালাক তার দিকে কাঁকর ছুঁড়লো। অমনি আর সব ছেলেরাও শুরু করলো কাঁকর ছুঁড়তে। দলের সরদার ছেলেটি এগিয়ে এসে ছিনিয়ে নিতে চাইলো তার নেই, কিন্তু আগন্তুক নেযাহ ধরে রাখলো মজবুত হাতে। সে ঘোড়ার লাগাম টেনে দ্রুত ঘোড়া চালালো। ঘোড়া ছুটকৃর উপক্রম করলে এদিক-ওদিক ছুটতে লাগলো ছেলেগুলো} আগম্ভক নেহ উদ্যত করে দলের সরদারের পেছনে লাগিয়ে দিলো তার ঘোড়া। তয় পেয়ে সে ছুটে পালালো। আগন্তুক হালকা গতিতে চললো তার পিছু পিছু। বাকী ছেলের ছুটে আসছে পিছু পিছু। মজার কান্ড দেখে কতক বয়স্ক লোকও এসে শামিল হয়েছে ছেলের দলে। আগের ছেলেটির পা একটা কিছুতে লাগলো, অমনি সে পড়ে গেলো উপুড় হয়ে। আগন্তক ঘোড়ার লাগাম টেনে পেছনের ছেলেদের দিকে ফিরে তাকালো এবং কয়েক কদম দূরে দাঁড়িয়ে গেলো। মালিক বিন ইউসুফ নামে একটি মধ্যবয়সী লোক এগিয়ে এলো দলের ভেতর থেকে। লোকটি বেঁটে, সুগঠিত দেহ। মাথায় মস্ত এক আমামা। তাঁর সামনের দাঁতগুলো খানিকটা উঁচু হয়ে বেরিয়ে আছে, যেনো সে হাসছে। সামনে এগিয়ে এসে সে আগন্তুককে প্রশ্ন করলো, কে তুমি?

মুজাহিদ। কিশোর সদর্পে জওয়াব দিলো।

‘বেশ ভালো নাম তে! তুমি বেশ বাহাদুর’।

আমার নাম নয়ীম।’

তাহলে তোমার নাম মুজাহিদ নয়?

না আমার নাম নয়ীম।’

‘তুমি কোথায় যাবে?’

মাকিল প্রশ্ন করলো।

ইবনে আমোরর মকতবে। আমার ভাই ওখানে পড়ে?

তারা এখন আখড়ায়। চলো, আমিও যাচ্ছি ওখানে।

নয়ীম মালিকের সাথে চললো। কয়েকটা ছেলে কিছুদূর সাথে এসে ফিরে গেলো। কতকগুলো ছেলে নয়ীমের পেছনে চললো।

নয়ীম তার সাথীকে শুধালো, আখড়ায় তীরন্দাযীও হয় তো?

হাঁ তুমি তীর চালাতে জানো?’

‘হাঁ। উড়ন্ত পাখীকে ফেলে দিতে পারি আমি।’

মালিক পিছু ফিরে নয়ীমের দিকে তাকালো। নয়ীমের চোখ দুটো তখন খুশিতে জলজল করছে।

আখড়ায় বহুলোক আলাদা আলাদা দলে দাঁড়িয়ে শিক্ষার্থীদের তীরন্দাযী, তেগ চালনা ও নেযাহবাযি দেখছে। মালিক সেখানে পৌঁছে নয়ীমকে বললো, তোমার ভাই এখানেই আছে হয়তো। খেলা শেষ হবার আগে তার দেখা পাবে না তুমি.। আপাততঃ এসব তামাশা দেখতে থাক।

নয়ীম বললো, আমি তীরন্দাযী দেখবো।

মালিক তাকে তীরন্দাদের আখড়ার দিকে নিয়ে গেলো। তামাশা দেখতে যারা দাঁড়িয়েছে, তারা দু’জন গিয়ে তাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে গেলো।

আখড়ার এক কোণে লাগানো রয়েছে একটা কাষ্ঠলক। তার মাঝখানে একটা কালো নিশানা। ছেলেরা পালা করে তার উপর তীর ছুঁড়ছে। তীরন্দাদের কাছ থেকেও শ’খানেক গজ দূরে এই কাঠফলক। নয়ীম বহুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেলা দেখলো। বেশির ভাগ তীর গিয়ে লাগছে কালকে, কিন্তু একজন ছাড়া আর কারুর ভীরই কালো নিশানায় লাগলো না।

নয়ীম মালিককে সুধালো, লোকটি কে? এর নিশানা তো ভারী চমৎকার!’

‘উনি হচ্ছেন হাজ্জাজ বিন ইউসুফের ভাতিজা মুহাম্মদ বিন কাসিম। মালিক জওয়াব দিলো।’

মুহম্মদ বিন কাসিম।

হাঁ, তুমি ওঁকে জানো?

হাঁ, উনি আমার ভাইয়ের দোস্ত। ভাই ওঁর নিশানার বহুত তারিফ করেছেন। কিন্তু এ নিশানায় তো মুশকিল নেই কিছু।’

মুশকিল আবার কোথায়? হয়তো আমিও লাগাতে পারবো এ নিশানা। দেখি, তোমার ধনুকটা দাও তো। হাজ্জাজের ভাতিজা ভাবছেন দুনিয়ায় বুঝি আর তীরন্দাষ নেই।

বলতে বলতে সে নয়ীমের ঘোড়ার যিন থেকে ধনুকটা খুলে নিলো। নয়ীম তৃণীর থেকে একটা তীর দিলো তার হাতে। মালিক এক কদম এগিয়ে গিয়ে নিশানা করলো। লোকগুলো তাকে দেখে হাসতে লাগলো। মালিকের কাঁপা হাতের তীর লক্ষ্যস্থল থেকে কয়েক কদম দূরে মাটিতে গেঁথে রইলো। দর্শকদের তুমুল অট্টহাস্য শোনা গেলো। মালিক লজ্জিত হলো। মুহম্মদ বিন কাসিম হাসতে হাসতে এগিয়ে এসে তীরটি যমিন থেকে তুলে মালিকের হাতে দিয়ে বললেন, আপনি আরেকবার চেষ্ট করুন।

মালিক ততোক্ষণে ঘেমে গেছে। সে মুহম্মদ বিন কাসিমের হাত থেকে তীরটি নিয়ে নয়ীমকে এগিয়ে দিল। এবার দর্শকদের নযর পড়লো নয়ীমের উপর। তারা একে একে নয়ীমের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। মুহম্মদ বিন কাসিম স্বভাবসুলভ হাসিমুখে নয়ীমের কাছে এসে বললেন, আপনিও একবার দেখুন। দর্শকরা হেসে উঠলো!

তার এ বিদ্রূপ ও দর্শকদের হাসি নয়ীমের বরদাশত হলো না। সে ঝট করে তার নেশাহ নীচে গেড়ে রাখলো এবং ধুনকে তীর যোজনা করে ছুঁড়লো। তীর লক্ষ্যস্থলে গিয়ে নিশানার মাঝখানে লেগে গেলো। মুহূর্ত মধ্যে জনতা নির্বাক হয়ে গেলো এবং পরক্ষণেই জেগে উঠলো এক তুমুল আনন্দধ্বনি।

নয়ীম আর একটি তীর বের করলো তুণীর থেকে। তামাম লোক নিজ নিজ জায়গা ছেড়ে তার চারিদিকে জমা হলো। দ্বিতীয় তীরটিও লাগলো ঠিক লক্ষ্যস্থলে। চারদিক থেকে মারহাবা মারহাবা’ ধ্বনি উঠলো। নয়ীম একবার দৃষ্টি হানলো সমবেত জনতার দিকে। সবারই সপ্রশংস দৃষ্টি নিবদ্ধ তার দিকে। মুহম্মদ বিন কাসিম হাসিমুখে এগিয়ে এসে নয়ীমের হাত নিজের হাতের মধ্যে চেপে ধরে বললেন, ‘আপনার নাম কি?

আমায় নয়ীম বলে সবাই জানে।

নয়ীম? নয়ীম বিন…..?”

নয়ীম বিন আব্দুর রহমান।

‘আব্দুল্লাহর ভাই তুমি?

‘জি হাঁ।’

‘এখানে কবে এলে?

এই মাত্র।’

‘আব্দুল্লাহর সাথে দেখা হয়েছে?

‘এখনো হয়নি।’

‘তোমার ভাই হয়তো নেযাহবাযি অথবা তলোয়ার চালোনোর অভ্যাস করছে। তুমি তলোয়ার চালাতে জানো?

‘আমাদের এলাকার একটি লোকের কাছে আমি শিখেছিলাম।

‘তোমার তীরন্দাযী দেখে আমার মনে হয়েছে, তলোয়ার চালাতেও তুমি ভালোই শিখেছো। আজ একটি ছেলের সাথে তোমার মোকাবিলা হবে।’

মোকাবিলার নাম শুনেই নয়ীমের শিরায় যেনো রক্তের গতি দ্রুততর হয়ে উঠলো। সে প্রশ্ন করলো, ছেলেটি কতো বড়ো?

‘তোমার চাইতে খুব বেশী বড়ো নয়। বুঝেসুঝে কাজ করলে জিতে যাওয়া তোমার পক্ষে কষ্টকর হবে না। হাঁ, তোমার তলোয়ারটা খানিকটা ভারী। বৰ্মটাও অনেকটা ঢিলে। আমি এখুনি তার ইনতেম করছি। তুমি ঘোড়া থেকে নেমে এসো।

মুহম্মদ বিন কাসিম একটি লোককে বললেন তার বর্ম, লোহার টুপি ও তলোয়ার নিয়ে আসতে।

*

খানিকক্ষণ পর নয়ীম এক নতুন বর্ম পরিধান করে, হাতে একখানা হালকা তলোয়ার নিয়ে দর্শকদের কাতারে দাঁড়িয়ে আমেরের শাগরেদদের তেগ চালনার কৌশল। তার মাথায় ইউনানী ধরনের টুপি তার মুখ ঢেকে দিয়েছিলো চিবুক পর্যন্ত। তাই যারা তার তীরন্দাযী দেখে তার সাথে এসেছিলো, তার ছাড়া কেউ জানতেই পারেনি যে, সে এক আগমুক।

ইবনে আমের দর্শকদের ভিড় থেকে দূরে ময়দানের মাঝে দাঁড়িয়ে শাগরেদদের হেদায়াত দিচ্ছেন। একটি বালকের মোকাবিলা করবার জন্য পর পর কয়েকটি বালক এসে নামলো ময়দানে কিন্তু কেউ দাঁড়াতে পারলো না তার সামনে। প্রত্যেকটি প্রতিদ্বন্দীকে সে হারিয়ে দিলো কোনো না কোনো রকমে। অবশেষে ইবনে আমের মুহম্মদ বিন কাসিমের দিকে তাকিয়ে, বললেন, মুহম্মদ! তুমি তৈরী হওনি?’ মুহম্মদ বিন কাসিম এগিয়ে এসে ইবনে আমেরকে চাপা গলায় কি যেনো বললেন। ইবনে আমের হাসতে হাসতে নয়ীমের দিকে তাকালেন। আদর করে তার কাঁধে হাত রেখে বললেন, তুমি আব্দুল্লাহর ভাই’?

‘জি হাঁ।’

‘এই ছেলেটির সাথে মোকাবিলা করবে?

‘জি, আমার তেমন বেশি অভ্যাস নেই। তাছাড়া এতে আমার চাইতে বড়োও বটে।’

‘কোনো ক্ষতি নেই তাতে।

কিন্তু আমার ভাই কোথায়?

‘সেও এখানেই আছে। তার সাথে তোমার দেখা করিয়ে দেবো। আগে এর সাথে মোকাবিলা করে দেখাও।

নয়ীম দ্বিধাকুণ্ঠিত পদে ময়দানে নামলো। দর্শকরা এতক্ষণে নীরবতা ভেঙে কথা বলতে শুরু করলো।

দুই তলোয়ারের ঠোকাঠুকি শুরু হলো। ধীরে ধীরে তীব্রতর হয়ে উঠতে লাগলো তলোয়ারের ঝংকার। নয়ীমের প্রতিদ্বন্দ্বী খানিক্ষণ তাকে ছোট বালক মনে করে শুধু ঠেকাতে লাগলো তার হামলা, কিন্তু নয়ীম আচানক পায়তারা বদলে তার উপর প্রচন্ড আক্রমণ করলো। বালকটি তার অপ্রত্যাশিত হামলা ঠেকাতে পারলো না যথাসময়ে। নয়ীমের তলোয়ার তার তলোয়ারের উপর দিয়ে পিছলে গিয়ে লাগলো তার লোহার টুপিতে। দর্শকরা প্রশংসাসূচক ধ্বনি তুললো।

নয়মের প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে ব্যাপার বিলকুল নতুন। রাগে ফুঁসে উঠে সে কয়েকবার আক্রমণ চালালো তীব্রতার সাথে এবং নয়ীমকে পিছন দিকে হটাতে লাগলো। কয়েক কদম হটে যাবার পর নয়ীমের পা কেঁপে গেলে সে চিৎ হয়ে পড়ে গেলো।

নয়মের প্রতিদ্বন্দ্বী বিজয়-গর্বে তলোয়ার নীচু করে তার। উঠে আসার ইনত্যের করতে লাগলো।

নয়ীম রাগে লাল হয়ে উঠে এলো এবং তেগ চালনার যাবতীয় নীতি উপেক্ষা করে অন্তহীন গতি ও বেগ সহকারে হামলা চালালে তার উপর। নয়ীমকে সিপাহী সুলভ রীতির বাইরে যেতে দেখে সে পুরো তাক দিয়ে তলোয়ার ঘুরিয়ে হামলা করলো তার উপর। নয়ীম তার তলোয়ার দিয়ে এই হামলা প্রতিরোধ করবার চেষ্টা করলো, কিন্তু তলোয়ার তার হাত থেকে কয়েক কদম দূরে ছিটকে পড়লো। নয়ীম পেরেশান হয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো। মুহম্মদ বিন কাসিম ও ইবনে আমের হাসিমুখে এগিয়ে এলেন। ইবনে আমের এক হাত শাগরেদের ও অপর হাত নয়ীমের কাঁধে রেখে নয়ীমকে বললেন, ‘এসো, এবার তোমার ভাইয়ের সাথে দেখা করিয়ে দিচ্ছি।’

‘জি হাঁ, ভাই কোথায়?

ইবনে আমের দ্বিতীয় বালকটির লোহার টুপিটা নামাতে নামাতে বললেন, এদিকে তাকাও।

নয়ীম ভাইজান বলে আব্দুল্লাহকে জড়িয়ে ধরলো। আব্দুল্লাহর অন্তহীন পেরেশানী লক্ষ্য করে মুহম্মদ বিন কাসিম নয়ীমের টুপিটাও খুলে ফেলে বললেন, আব্দুল্লাহ! এ নয়ীম। হায়! এ যদি আমার ভাই হতো!

*

ইবনে আমেরের মতো দক্ষ ওসতাদের যত্নে সাবেরার পুত্রদের আত্মিক, দৈহিক ও বুদ্ধিবৃত্তিসংক্রান্ত তরী হতে লাগলো অসাধারণ দ্রুতগতিতে। মকতবে আব্দুল্লাহর নাম ছিলো সবার আগে, কিন্তু আখড়ায় নয়ীমের স্থান ছিলো সবার পুরোভাগে। মুহম্মদ বিন কাসিম কখনো আখড়ায় আসতেন এবং তার কোন কোন যোগ্যতার স্বীকৃতি দিতে হতো নয়ীমকে।

মুহম্মদ বিন কাসিমের তেগ চালনার যোগ্যতা ছিলো সবচাইতে বেশী। নেযাহবাষিতে দু’জনের ছিলো সমান দক্ষতা। নয়ীম শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার ছিলো তীরন্দাযীতে। প্রতিক্ষেত্রে সম্মানের অধিকারী হবার মতো গুণরাজি ছেলেবেলা থেকেই বিকাশ লাভ করেছিলো মুহম্মদ বিন কাসিমের মধ্যে। একটা বড়ো কিছু করবার জন্য তিনি পয়দা হয়েছেন বলে তাঁর তারিফ করতেন ইবনে আমের।

আব্দুল্লাহ ও নয়ীমের সাথে মুহম্মদ বিন কাসিমের দোস্তির সম্পর্ক মযবুত হতে লাগলো ক্রমাগত। বাইরে মুহম্মদ বিন কাসিমের নযরে তারা দুজন ছিলো সমান; কিন্তু নয়ীম যে তার বেশী নিকটতর, এ কথা আব্দুল্লাহ নিজে অনুভব করতো। নয়ীমের মকতবে দাখিল হবার পর আট মাস অতীত হলে মুহম্মদ বিন কাসিম শিক্ষা সমাপ্তি পর ফউজে শামিল হলেন।

মুহম্মদ বিন কাসিম চলে যাবার পর নয়ীমের আর একটি গুণের বিকাশ হতে লাগলো মকতবে। মাদ্রাসার ছেলেরা হফতায় একবার করে কোনো না কোনো বিষয় নিয়ে বির্তক সভা করতো নিয়মিত। বিষয়টি নির্ধারণ করে দিতেন ইবনে আমের নিজে। ভাইয়ের দেখাদেখি নয়ীমও এক বির্তক সভায় শরীক হলো। কিন্তু প্রথম বিতর্কে সে কয়েকটা ভাঙা কথা বলে ঘাবড়ে গেলো এবং সলজ্জভাবে মিম্বর থেকে নেমে এলে ছেলেরা বিদ্রূপ করলে ইবনে আমের সান্তনা দিলেন তাকে, কিন্তু সারাদিন তার বিষণ্ণতা কাটলো না। রাতের বেলা সে বারবার পাশ ফিরতে থাকলো ঘুম হারা চোখে। ভোরে বিছানা ছেড়ে উঠে সে চলে গেলো বাইরে। দুপুর পর্যন্ত এক খেজুর গাছের ছায়ায় বসে সে বারংবার পুনরাবৃত্তি করতে লাগলো তার বক্তৃতা। পরের হকতায় সে আবার গিয়ে হাযির হলো বিতর্ক সভায়। এবর সে এক তেজোময় বক্তৃতা করে অবাক করে দিলো শ্রোতৃবর্গকে। তার দ্বিধাসংকোচ কাটতে লাগলো ক্রমাগত এবং এর পর থেকে সে নিয়মিত শরীক হতে লাগলো প্রত্যেকটি বিতর্কের মজলিসে। বেশির ভাগ বিতর্কে আব্দুল্লাহ ও নয়ীম দু’জনই যোগ দিতো। এক ভাই বিষয়ের সমর্থনে বক্তৃতা করলে অপর ভাই তার বিরোধিতা করতো। শহরের যেসব লোক ছিলো তাদের গুণাগ্রাহী, তারা এবার তাদের বক্তৃতা শুনেও আনন্দ পেতে লাগলো। ইবনে আমের নয়ীমের শিরায় শিরায় কেবল সিপাহীর উষ্ণ রক্তধারাই লক্ষ্য করেননি,বরং তার দীল ও দেমাগে দেখেছেন এক অসামান্য বক্তার উজ্জ্বল প্রতিশ্রুতি। তার এ যোগ্যতার পূর্ণ বিকাশের জন্য তিনি চেষ্টা করতেন যথাসাধ্য। কয়েকটি বক্তৃতার পর সে কেবল মাদ্রাসার শ্রেষ্ঠ বক্তা বলেই স্বকৃতি পেলো না বরং বসরার অলিগলিতে শোনা যেতে লাগলো তার চিত্তাকর্ষক বক্তৃতার তারিফ।

ইবনে আমেরর শাগরেদদের সংখ্যা বেড়ে চললো দিনের পর দিন, কিন্তু তাঁর উচ্চাকাংখার পূর্ণতার পথে অন্তরায় হলো বার্ধক্য ও স্বাস্থ্যহীনতা। বসরার ওয়ালীর কাছে তিনি দরখাস্ত করলেন মাদ্রাসার জন্য একজন অভিজ্ঞ ওসতাদের প্রয়োজন জানিয়ে। সাঈদ তখন সাইপ্রাসের ওয়ালী; বসরার ওয়ালী তার চাইতে যোগ্য আর কোন লোককে খুঁজে পেলেন না এ কাজের জন্য। হজ্জাজ খলীফার দরবারে দরখাস্ত করলে সাঈদকে অবিলম্বে বসরায় পৌঁছবার হুকুম দেওয়া হলো।

এক নতুন ওস্তাদ আসছেন, এ খবর নয়ীম ও আব্দুল্লাহর অজানা ছিলো না, কিন্তু তাদের মামুই যে ওস্তাদ হয়ে আসছেন, তা তারা জানতো না। সাইপ্রাসের এক নওমুসলিম পরিবারের মেয়ের সাথে শাদী হয়েছে সাঈদের। বিবিকে সাথে নিয়ে প্রথমে তিনি গেলেন সাবেরার কাছে। তারপর কয়েকদিন সেখানে থেকে চলে এলেন বসরায়। মকতবে এসে তিনি কাজ শুরু করে দিলেন পূণোদ্যোমে। তার ভাগ্নেরাই তার সেরা ছাত্র জেনে তিনি অন্তহীন আনন্দ অনুভব করলেন।

কয়েক মাস পরে আব্দুল্লাহ ও তার জামা’আতের আরো কয়েকটি নওজোয়ান শিক্ষা সমাপ্ত করলো। তাদের বিদায় উপলক্ষে ইবনে আমের যথারীতি এক বিদায় সভা ডাকলেন। বসরার ওয়ালী হাযির থাকলেন সে জলসায়। বিদায়ী ছাত্রদেরকে দরবারে-খিলাফতের তরফ থেকে বিতরণ করা হলো:ঘোড়া ও অস্ত্রশস্ত্র।

ইবনে আমের তাঁর বিদায় সম্ভাষণে বললেন, নওজোয়ান দল! আজ এক কঠোর বিপদসংকুল দুনিয়ায় পা বাড়াবার সময় এসেছে তোমাদের সামনে। আমি আশা করছি যে, আমার মেহনত ব্যর্থ হয়নি, প্রমাণ করবার জন্য তোমরা প্রত্যেকে চেষ্টা করবে। যে সব কথা তোমাদেরকে বহুবার বলেছি, তা আবার নতুন করে বলবার প্রয়োজন নেই। মাত্র কয়েকটি কথার পুনরাবৃত্তি আমি করাবো। নওজোয়ানরা! যিন্দেগী হচ্ছে এক ধারাবাহিক জিহাদ এবং মুসলমানের যিন্দেগীর পবিত্ৰমত কাজ হচ্ছে তার পরওয়ারদেগারের মুহাব্বতে জান পর্যন্ত বিসর্জন দিতে তৈরী থাকা এবং তোমাদের দীল সেই পবিত্র মনোভাবে পরিপূর্ণ থাকবে। তোমাদের সামনে যেনো দুনিয়া ও আখেরাত দুই-ই থাকে উজ্জ্বল হয়ে। দুনিয়ায় তোমরা সম্মানিত হয়ে শির উঁচু করে চলবে এবং আখেরাতে তোমাদের জন্য জান্নাতের দরযা থাকবে খোলা। মনে রেখো, এই পবিত্র মনোভাব থেকে বঞ্চিত হলে দুনিয়ায় কোনো স্থান থাকবে না তোমাদের এবং আখেরাতও হবে তোমাদের চোখে অন্ধকার। কমযোর তোমাদেরকে এমন করে আকড়ে ধরবে যে, হাত-পা নাড়াবার শক্তিও থাকবে না তোমাদের। কুফরের যেসব শক্তি মুজাহিদের পথে ধূলিকণার মতো উড়ে গেছে, তাই আবার তোমাদের সামনে দেখা দেবে মযবুত পাহাড় হয়ে। দুনিয়ার কূটকৌশলী জাতিসমূহ তোমাদের উপর হবে বিজয়ী এবং তোমাদেরকে বানাবে তাদের গোলাম। এমন সব নির্মম, বিধানের আবর্তে জড়িয়ে পড়বে তোমরা যা থেকে নাজাত পাওয়া হবে অসম্ভব। তখনো তোমরা নিজেকে মুসলমান বলেই দাবী করবে, কিন্তু ইসলাম থেকে তোমরা থাকবে বহুদুর। সত্যের উপর ঈমান এনেও যদি তোমাদের মধ্যে সত্যের জন্যে কোরবানী দেবার আকাংখা পয়দা না হয়, তা হলে বুঝবে যে, তোমাদের ঈমান কমোের। ঈমানের দৃঢ়তার জন্য আগুন ও খুনের দরিয়া অতিক্রম করে চলা অপরিহার্য। মওত যখন তোমাদের চোখে যিন্দেগীর চাইতে প্রিয়তর, তখন বুঝবে যে, তুমি যিন্দাহ-দীল, আর মওতের ভয় যখন তোমার শাহযাদাৎ স্পৃহার উপর হবে বিজয়ী, তখন তোমার অবস্থা হবে এমন এক মুরদার মতো, যে কবরে থেকে হাত-পা ছুঁড়েছে শ্বাস নেবার জন্য।’

ইবনে আমের বক্তৃতার মাঝখানে এক হাতে কুরআন উর্ধ্বে তুলে বললেন; এ আমানত রসূলে মাদানী (সঃ)-এর উপর খোদায়ে কুদুসের তরফ থেকে নাযিল হয়েছে এবং দুনিয়ায় তিনি তার কর্তব্য সমাপন করে এ আমানত আমাদের হাতে সোপর্দ করে গেছেন। হুযুর (সঃ) আপন যিন্দেগীতে প্রমাণ করে গেছেন যে, তলোয়ারের তেষী ও বায়ুর কুওৎ ব্যতীত আমরা এ আমানুতের হেফাযত করতে পারবো না। যে পয়গাম তোমাদের কাছে পৌঁছে গেছে, তোমাদের কর্তব্য হচ্ছে দুনিয়ার প্রতি কোণে পৌঁছে দেয়া।

ইবনে আমের তার বক্তৃতা শেষ করে বসলেন। তারপর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ বিস্তারিতভাবে জিহাদের গুরুত্ব বর্ণনা করে নিজের জেব থেকে একটা চিঠি বের করে বললেন, এ চিঠি মরভের গভর্নরের কাছ থেকে এসেছে। তিনি জৈহুন নদী পার হয়ে তুর্কিস্থানের উপর হামলা করতে চাচ্ছেন। এ চিঠিতে তিনি প্রচুর সংখ্যক ফউজ পাঠাবার দাবী জানিয়েছেন। আপাততঃ কয়েকদিনের মধ্যে আমি বসরা থেকে দু’হাজার সিপাহী পাঠাতে চাচ্ছি। তোমাদের মধ্যে কে এমন আছে যে এই ফউজে শরীক হতে রাযী?

ছাত্রদের সবাই তার কথা শুনে হাত উঁচ করে সম্মতি জানালো।

হাজ্জাজ বললেন, আমি তোমাদের জিহাদী মনোভাবের প্রশংসা করি, কিন্তু যারা শিক্ষা সমাপ্ত করেছে, বর্তমান মুহূর্তে আমি বেবল তাদেরকেই দাওয়াত দেবো। এ ফউজরে নেতৃত্ব আমি এই মাদ্রাসারই একটি যোগ্য শিক্ষার্থীর উপর সোপর্দ করতে চাই। আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহমান সম্পর্কে আমি অনেক কিছুই শুনেছি। তাই তারই উপর সোপর্দ করছি এ কাজের ভার। তোমাদের ভিতর থেকে যে সব নওজোয়ান তার সাথী হতে রাযী, বিশ দিনের মধ্যে তারা নিজ নিজ ঘর থেকে ঘুরে বসরায় এসে পৌঁছবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *