০৫. সকলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায়

সকলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় এতটুকু আনমনা মনে হয় না অনুরূপাকে, তার কোমল ভীরু হাসিটি বার বার দেখা দেয় মুখে, কিন্তু ক্ষীণ একটা অস্বস্তি তিনি অনুভব করেন। এখনো ফিরল না কেন হেমন্ত? দুটো বাজল বড় ঘড়িটায়। কলেজ থেকে সে সোজা বাড়ি চলে আসে, কোনো কারণে ফিরতে দেরি হবার সম্ভাবনা থাকলে যাবার সময়েই বলে যায়, নয়তো বাড়ি ফিরে এসে আবার বার হয়। আজ তো কলেজও নাকি হয় নি। সরকারি কলেজ হেমন্তের, সেখানে ক্লাস যদিবা হয়েই থাকে পুরোপুরি, অনেক আগেই হেমন্তের ফিরে আসা উচিত ছিল আজ।

আধঘণ্টার মধ্যে তাকে বেরিয়ে যেতে হবে গান শেখাতে। তার আগে কি ফিরবে না হেমন্ত?

দোকান থেকে চা আনিয়ে দেন অভ্যাগতদের, অপরাধীর মতো বলেন, দোকানের চা-ই খেতে হবে, ঘরে চিনি নেই।

তাতে কি হয়েছে।

সবারই এক অবস্থা, বাড়িতে কেউ এলে আমিও দোকান থেকে চা আনিয়ে দিই, কি করব, নিজেদেরই কুলোয় না।

আমি কিন্তু বাড়তি চিনি পাই। এক টাকা সের নেয়, কিন্তু কি করব তাই কিনি, চিনি নইলে তো চলে না। একটা দোকান আছে, তেল আর চিনি দুই-ই পাওয়া যায়। সকলকে দেয় না, দোকানিরও তো ভয় আছে। জানা লোক গেলে দেয়।

আমিও পাই চিনি, মাসের গোড়ায় দু-তিন বার আধসের করে এনে জমিয়ে রাখি, একবারে বেশি দেয় না। এক টাকা সের পান আপনি? আমার কাছে পাঁচসিকে নেয়।

ওরকম তো পাওয়া যায়, অনুরূপা বলেন, আমি আনাই না। কেমন খারাপ লাগে! ব্ল্যাকমার্কেটকে প্রশ্রয় দেওয়া হয় তো ওতে। তাছাড়া বড় ছেলে যদি টের পায়।

অনুরূপা ভাবে, দ্যাখ, ছেলের কথা ভাবতে ভাবতে কি খাপছাড়া কথা বলে ফেললেন। দুটি মুখ ভার হয়ে গেল তাঁর কথায়। খোঁচা দিয়ে ফেলার জন্য মৃদু আফসোসের সঙ্গে আরেকটা খুশির চিন্তাও মনে আসে অনুরূপার। বলেই যখন ফেলেছেন তখন আর উপায় কি, হেমন্ত শুনে মজা পাবে, খুশি হবে। হেমন্ত খেতে বসলে বেশ করে সাজিয়ে বলতে হবে গল্পটা তাকে।

কবে যে অবস্থা একটু ভালো হবে।

সত্যি, যুদ্ধ থামল কবে, ভাবলাম যাক, এবার নিশ্চিন্ত হওয়া যাবে। অবস্থার উন্নতি হল ছাই, দিন দিন আরো যেন খারাপ হচ্ছে! দ্যাওরের চাকরিটা যাবে সামনের মাসে। আবার এসে ঘাড়ে চাপবে সবাইকে নিয়ে। তিন বছর ছিল না, অন্য সময় হলে কিছু পয়সা জমত হাতে, যুদ্ধের বাজারে তাও পারলাম না। উনি গুইগাই করছিলেন, আমি স্পষ্ট কথা লিখিয়ে দিয়েছি, যে দিনকাল, আমরা আর পারব না। পারা কি যায়, আপনারাই বলুন?

আমার তো মেজ সেজ দুটি ছেলেই নোটিশ পেয়েছে। মাথা ঘুরে গেছে ভাই। বড় জন তো একরকম ভিন্নই, দিল্লিতে থাকে, দশখানা চিঠি দিলে একখানারও জবাব দেয় কি দেয় না।

ভয় ও হতাশা উদ্যত হয়েই ছিল ভঁড়ানো কুয়াশার মতো, অতিমন্দ বাতাসের মতো অতিমৃদু এই আলোচনাকে আশ্রয় করে গড়িয়ে আসে ঘরে। অনুরূপা টোক গেলেন। গলাটা শুকনো মনে হয়, খুসখৃস করে। গলায় যদি কিছু হয় তার, গাইবার ক্ষমতা যদি নষ্ট হয়ে যায় কোনো কারণে–হেমন্ত লেখাপড়া শিখে মানুষ হয়ে ওঠার আগে! কত গায়ক-গায়িকার অমন গিয়েছে। গান শেখানোও ঝকমারির কাজ। সকালে দুপুরে সন্ধ্যায় এমন অত্যাচার চলে গলার ওপর। গান শেখানোর কাজ ছেড়ে দেবেন একটা-দুটো বাড়ির? কিন্তু তাহলে কি চলবে তাঁর সংসার, হেমন্তের পড়ার খরচ?

গান শোনাবেন একখানা?

গান? অনুরূপা তাঁর ক্ষীণ কোমল হাসি হাসেন, গান গেয়ে শোনাবার গলা কি আর আছে? গান শিখিয়ে শিখিয়েই গলা গেছে। গাইতে পারি না আর।

একটু ক্ষুণ্ণ হয়ে তারা বিদায় নেয়। অনুরূপা জানেন ওদের মনের ভাব : একটু গাইতে জানলে, একটু নাম হলে, এমনি অহঙ্কারই হয় মানুষের। গলাকে বাড়তি এতটুকু পরিশ্রম করাতে তার যে কত কষ্ট, কত ভয়, ওরা তার কি বুঝবে!

জয়ন্ত বলে, এবার যাব মা খেলতে?

এতক্ষণ যাও নি কেন?

জিজ্ঞাসা করা বৃথা, অনুরূপা জানেন। বাড়িতে লোক এলে এ ছেলে ঘর ছেড়ে নড়তে চায় না, বসে বসে বুড়িদের আলাপ শুনতে পর্যন্ত কি যে ভালো লাগে তের বছরের ছেলের

যাও! দূরে যেও না কিন্তু। শিগগির ফিরবে।

রমাও বাড়ি নেই, শান্তাদের ওখানে গেছে। সন্ধ্যার সময় ফিরে এসে নতুন গানটি সেধে। রাখবে বলেছে। অন্যের মেয়েকে নটা পর্যন্ত গান শিখিয়ে বাড়ি ফিরে তখন অনুরূপা নিজের মেয়ের গান কেমন তৈরি হল শুনতে পাবেন। তবে, গানের পেছনে বেশি সময় রমার না দিলেও চলে। মোটামুটি ও যা শিখবে তাই যথেষ্ট। ওকে খুব ভালো করে শেখালেও গানে ও বিশেষ কিছু করে উঠতে পারবে না, গানের ধাত নয় ও মেয়ের। অনুরূপ একটা নিশ্বাস ফেলেন। খালি বাড়িতে নিজেকে কেমন শ্ৰান্ত, অবসন্ন মনে হয়। সাড়ে ছটা বেজে গেছে কিন্তু গভীর আলস্যে উঠতে ইচ্ছা করছে না আজ। হেমন্ত ফিরে এলে হয়তো আলস্যটা কেটে যেত, জোর মিলত উঠে গিয়ে ছড়া বলার গলা বা সুরজ্ঞান পর্যন্ত নেই যে মেয়ের, নিজের গলার আওয়াজ শুনেই ভাব লেগে যে মেয়ের খেয়াল থাকে না সুর কোথা গেল, তাদের গান শিখিয়ে আসতে!

এই রকম সময়ে, ছেলে বা মেয়ে যখন কাছে থাকে না কেউ, কেমন আর কিসের অজানা সব শঙ্কার ছায়াপাতে হৃদয় মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে অনুরূপার। নিরাপত্তার জন্য নিজেকে একরকম ঘেঁটে ফেলেছেন, সহজ ও সীমাবদ্ধ করে এনেছেন জীবন ও জীবনের পরিধি, যেমন চেয়েছেন। তেমনি দিন চলছে শান্তিতে, ছেলেমেয়েরা মানুষ হয়ে উঠছে মনের মতো। কোথা থেকে তবে এত সংকেত আসে বিপর্যয়ের, বিভ্রাটের, বিপদের? কেন কেঁপে কেঁপে ওঠে অনুরূপার ভীরু বুক? পৃথিবী জোড়া যুদ্ধ তাকে বিচলিত করে নি। সে যুদ্ধের যত ধাক্কা এসে লাগুক তার ঘরে, সে অসুবিধা, শুধু টানাটানি, কষ্ট করার ব্যাপার বোমার ভয়ের দিনগুলিও তাকে এমন সচকিত করে তুলতে পারে নি। মনে হয়েছে ওসব দূরের বিপদ বহু দূরের। তাদের চারটি প্রাণীর ছোট নীড়টিতে ও বিপদের ছোঁয়া লাগবে না। কিন্তু এ বিপদ যেন বাতাসের গুমোটের মতো মাথার ওপরের আকাশে ঘন কালো মেঘের মতো ঘনিয়ে আসছে অনুভব করা যায়। খবরের কাগজ পড়তে গিয়ে মনে হয়, সব খবরের আড়ালে যেন দুরন্ত ক্ষোভ গুমরাচ্ছে মানুষের, পথেঘাটে, লোকের কথা শুনলে মনে হয় সব চিন্তা একদিকে গতি পেয়েছে মানুষের চারিদিকে সভা আর শোভাযাত্রায় সেই চিন্তা ফেটে পড়ছে হাজার কণ্ঠের গৰ্জনে। প্রতি মুহূর্তে ঘরে বাইরে চেতনায় যা ঘা দিচ্ছে, জীবনের খুঁটিনাটি সব কিছুর সঙ্গে যা জড়িয়ে গেছে, তা কি ঠেকিয়ে রাখা যাবে ঘরের নিরাপদ সুখশান্তি অব্যাহত রাখতে চেয়ে?

রমা ফিরে আসে প্রচুর উত্তেজনা নিয়ে।

বেরোও নি তো? বেশ করেছ। ট্রাম বন্ধ হয়ে গেছে। জান মা, ট্রাম চলছে না। ওদিকে খুব হাঙ্গামা চলছে, পুলিশ নাকি গুলি চালিয়েছে–কি ভাবছ মা?

কিছু না। হেমা ফেরে নি এখনো।

ও! দাদার জন্য ভাবছ? রমা হালকা সুরে বলে, দাদা কস্মিনকালে ওসবের মধ্যে যায় না, যাবেও না। কোথায় গেছে, এখুনি এসে পড়বে। দাদার জন্যে ভেব না।

রমার কথা আর কথার সুর আঁচড় কাটে অনুরূপার কানের পর্দায়। রমার গলায় তার দাদার সম্বন্ধে অবজ্ঞার সুর শোনা যাবে, এই বিপদের আশঙ্কাও বুঝি তার ছিল।

না, ভাবনার কি আছে। গানটা ভালো করে শিখবি রমা? কাপড় ছেড়ে আয়।

রমাকে বিপন্ন দেখায়। তার মুখে দারুণ অনিচ্ছা!

আজ থাক গে। গানটান শিখতে আজ ইচ্ছে করছে না মা।

তবে থাক।

জয়ন্ত ফিরে আসে আরো বেশি উত্তেজনা নিয়ে। যত কিছু সে শুনে এসেছে বাইরে থেকে সব অনুরূপাকে শোনায়। তারপর এক মারাত্মক প্রস্তাব করে।

একটু দেখে আসব মা? একটুখানিদূর থেকে একটু দেখেই চলে আসব।

না।

কি হয় গেলে? এসে পড়তে বসব।

আজ পড়তে হবে না। আজ তোর ছুটি। মুখ-হাত ধুয়ে আয়, গল্প বলব একটা।

বানানো গল্প ভালো লাগে না মা।

বানানো গল্প, ভালো লাগে না। এতটুকু ছেলে তার আজ সে রকম গল্প চাই, যা ধরাছোঁয়া দেখাশোনা যায়।

রাত বাড়ে, হেমন্ত আসে না। অনুরূপা উৎকর্ণ হয়ে থাকেন সদরের কড়া নাড়ার শব্দের জন্য। অস্বস্তি তাঁর উদ্বেগে দাঁড়িয়ে গেছে অনেকক্ষণ। রমার মনেও ভাবনা ঢুকেছে।

জয়ন্ত ঘুমিয়ে পড়লে অনুরূপা বলেন, আমি একটু খোঁজ করে আসি রমা।

কোথায় খোঁজ করবে এত রাত্রে?

সীতার কাছে যাই একবার। ওদের বাড়ি টেলিফোনও আছে।

সীতা সবে বাড়ি ফিরেছিল। হেমন্তকে বিদায় দিয়ে নেয়ে খেয়ে নিয়ে সেও বেরিয়ে গিয়েছিল। মনটা নাড়া খেলেও খাওয়ায় অরুচি জন্মানোর শখ তার নেই। তার বেশ খিদে পায় এবং

সে খায়। তারপর আর কিছু খাওয়ার অবসর পায় নি এ পর্যন্ত। খাওয়ার ইচ্ছাটা মরে গেছে। আজকের মতো। চেনা অচেনা প্রিয়জনের আঘাত ও মরণ নাড়া দিয়েছে মনটাকে, সে তো আর ব্যক্তিগত দুঃখের কাব্য নয়। ক্ষোভ ছাড়া কোনো অনুভূতিই তার নেই, যার আগুনে আরো শক্ত ও দৃঢ় হয়ে গেছে তার মন ও প্রতিজ্ঞা।

হেমন্ত? বাড়ি ফেরে নি?

সভায় একবার চোখে পড়েছিল হেমন্তকে। সেখানে তার উপস্থিতিকে বিশেষ মূল্য সে দিতে পারে নি। তার সঙ্গে তর্ক করার উপকরণ সংগ্রহের উদ্দেশ্যেই হয়তো সে সভায় এসে দাঁড়িয়েছে মনে হয়েছিল সীতার। তারপর হেমন্তের কথা আর তার মনে পড়ে নি। আর অবসর হয় নি তার কথা মনে পড়ার, ভালো লাগে নি তার কথা ভাবতে। হেমন্তের সম্বন্ধে আশা-ভরসা কিছু আর রাখা চলে না এ সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া তার পক্ষে কষ্টকর। অন্য দিন জীবনের সাধারণ কাজ ও ঘটনার মধ্যে ভুলতে পারত না, দুঃখ ও ক্ষোভটা নেড়েচেড়ে খাপ খাইয়ে নিতে হত সচেতন প্রচেষ্টায়, আজ নিজের সুখ-দুঃখের কথা মনের কোনায় উঁকি দেবারও অবসর পায় নি। দুঃখ বেদনা হতাশার ওই স্তরটাই যেন তুচ্ছ হয়ে গেছে, দূরে সরে গেছে।

অনুরূপার জন্য সে মমতা বোধ করে না। তার মনে হয়, মাতৃস্নেহের এই বিকৃত অভিব্যক্তির সঙ্গে সহানুভূতি দেখালে অন্যায় করা হবে। অনুরূপার মুখে উদ্বেগের ছাপটা স্পষ্ট দেখতে না পেয়ে সে একটু আশ্চর্য হয়। কিন্তু অত বড় ছেলে সন্ধ্যারাতে বাড়ি ফেরেনি বলে পাগল হয়ে খোঁজ করতে বার হবার মধ্যেই উদ্বেগ প্রকাশ পেয়েছে যথেষ্ট, মুখের ভাব যতই শান্ত থাক। গুলির মুখে ছেলে পাঠিয়ে কত মা বুক বেঁধে প্রতীক্ষা করছে ধৈর্য ধরে, ছেলের বেরিয়ে ফিরতে দেরি হলে এঁর। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। এর জন্যই হয়তো এত বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে হেমন্ত, অতি আহ্লাদী ছেলেরা যা হয়।

কোথায় গেছে, আসবে। সীতা উদাসভাবে বলে।

তোমার সঙ্গে দেখা হয় নি?

ও-বেলা একবার এসেছিল বারটা-একটার সময়।

তার কাছে অনুরূপা খোঁজ নিতে এসেছেন হারানো ছেলের। পৃথিবীতে এত লোক থাকতে তার কাছে! কথাটা এতক্ষণে খেয়াল হয় সীতার। সুখস্বাচ্ছন্দ্যভরা আগামী দিনের জীবনের পরিকল্পনায় তাকেও তবে ওরা মায়ে-ব্যাটায় হিসাবের মধ্যে ধরে রেখেছে? এমন হাসি পায় সীতার। কথাটা মনে করে। অনুরূপা জানেন, মনে মনে অন্তত এই ধারণা পোষণ করেন যে সীতা দুদিন পরে তার ছেলের বৌ হয়ে তার বাড়ি যাবে। ছেলের ভাব দেখে তিনি অনুমান করে নিতে পেরেছেন এই মেয়েটিকে তার পছন্দ হয়েছে, তাই থেকে একেবারে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে বিলম্ব হয়। নি। তার এত ভালো ছেলে, এমন উজ্জ্বল তার ভবিষ্যৎ, সীতার পছন্দ-অপছন্দের প্রশ্নটা মনের মধ্যে ঠাঁইও পায় নি তাঁর।

এবার সীতা বুঝতে পারে অনুরূপার মুখে উদ্বেগের, দুর্ভাবনার চিহ্ন জোরালো হয়ে ফোটে নি কেন। ভাবী বৌয়ের সঙ্গে তিনি ভাবী শাশুড়ির মতো আচরণ করেছেন। ভয়ে-ভাবনায় সীতা কাতর হয়ে পড়বে, তাকে ভড়কে দেওয়া তার উচিত নয়। সীতাকে ভরসা দেবার, তার মনে সাহস জাগিয়ে রাখার দায়িত্ব তারই!

সীতার নির্লিপ্ত ভাব তাই তাকে রীতিমতো ক্ষুণ্ণ করেছে, আঘাতও করেছে।

গম্ভীরমুখে রীতিমতো অনুযোগর সুরে অনুরূপা বলেন—

না জানিয়ে কোনোদিন বাড়ি ফিরতে দেরি করে না সীতা বুঝে উঠতে পারছি না কি হল।

সীতার হাসি পাচ্ছিল কিন্তু হাসির রেখাও তার মুখে ফুটল না। সে নিজেও জানত না মনের এ ভাবটা এত ক্ষণস্থায়ী হবে। ক্ষণিকের একটু আমোদ বোধ করে মনটা তার খারাপ হয়ে যায়, নাড়া খায় গভীরভাবে। হেমন্তের অনেক অন্ধতা, অনেক কুসংস্কার, অনেক দুর্বলতার মানে তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। হেমন্তের দোষ নেই! এমন যার মা, আঁতুড় থেকে আজ এত বয়স পর্যন্ত যার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত এই মা নিয়ন্ত্রণ করে এসেছে, তার হৃদয়-মনের গঠনের ত্রুটির জন্য সে নিজে কতটুকু দায়ী। এটুকু সীতা জানে যে শৈশবে মনের যে গঠন হয় জীবনে তার আর পরিবর্তন হয় না। সজ্ঞান সাধনায় পরবর্তী জীবনে চিন্তা ও অনুভূতির জগতে নতুন ধারা আনা যায় আপসহীন অবিশ্রাম কঠোর সংগ্রামের দ্বারা। নিজের সঙ্গে লড়াই করার মতো কষ্টকর, কঠিন ব্যাপার আর কি আছে জীবনে। বুদ্ধি দিয়ে যদি বা আদর্শ বেছে নেওয়া গেল, কর্তব্য ঠিক করা গেল, সে আদর্শ অনুসরণ করা, সে কর্তব্য পালন করা যেন ঝকমারি হয়ে দাঁড়ায় যদি তা বিরুদ্ধে যায় প্রকৃতির। ইন্টেলেকচুয়ালিজমের ব্যর্থতার কারণও তাই! বুদ্ধির আবিষ্কার, বুদ্ধির সিদ্ধান্ত কাজে লাগানোর চেয়ে অন্ধ অকেজো ভালোলাগা ও পছন্দকে মেনে চলা অনেক সহজ, অনেক মনোরম। বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে তাই অধঃপতন এত বেশি। এত বেশি হতাশা। কথার এত মারপ্যাচ। এত ফাঁকিবাজি। বিশ্বাসের এমন নিদারুণ অভাব।

সীতা বলে, মাসিমা, ছেলে আপনার কচি খোকা নেই!

আমার কথাটা তুমি বুঝলে না সীতা। আমার ভয় হচ্ছে, ও তো হাঙ্গামায় জড়িয়ে পড়ে নি? কিছু হয় নি তো ওর?

সীতা এবার না হেসে পারে না, যদিও সে হাসিতে দুঃখ ও জ্বালাই প্রকাশ পায় বেশি : হেমন্ত কোনো হাঙ্গামার ধারেকাছে যাবে!।

এটা তুমি কি কথা বললে? অনুরূপা বলেন আহত মাতৃগর্বের অভিমানে, ছমাস একবছর আগে বললে নয় কোনো মানে হত। হেমা যে কি ভাবে বদলে যাচ্ছে তুমিও তা লক্ষ কর নি বলতে চাও মা? আমার তো বিশ্বাস হয় না ও-কথা। ওর মধ্যে অদ্ভুত একটা অস্থিরতা এসেছে কিছুদিন থেকে। আমি জানি সেটা কিসের অস্থিরতা, ওর কি হয়েছে। তুমিও দায়ী এর জন্য।

আমি?

তুমি! তুমি দায়ী। তুমি কি বলতে চাও, তুমি টেরও পাও নি হেমা কি ভাবে ছটফট করছে, বদলে যাচ্ছে?

অনুরূপার অনুযোগে সত্যই খটকা লাগে সীতার মনে, মনে পড়ে আজ সে হেমন্তকে সভায় দেখেছিল। হয়তো নিছক খেয়ালের বশে সভায় যায় নি হেমন্ত। হয়তো নতুন চেতনা, নতুন অনুভূতির তাগিদেই সভায় যেতে হয়েছিল তাকে, নবজাগ্ৰত প্ৰশ্ন ও সংশয়গুলির নির্ভুল বাস্তব জবাব খুঁজে পাবার কামনায়। আত্মপ্রীতির জেলখানার প্রাচীরে হয়তো সত্যই চিড় খেয়েছে হেমন্তের। দু দণ্ড দাঁড়িয়ে থেকেই সে যে চলে গিয়েছিল সভা ছেড়ে বিরক্ত হয়ে তাও তো জানা নেই সীতার। শেষ পর্যন্ত চলে হয়তো যেতে পারে নি, শোভাযাত্রায়ও হয়তো যোগ দিয়েছিল। প্রাণ তুচ্ছ করা অভিযানে সে যে অংশগ্রহণ করে নি তাই বা কে জানে!

ভাবতেও এমন অদ্ভুত লাগে সীতার। নিজের মত সমর্থনের জন্য আজই হেমন্ত আরো বেশি রকম ভোঁতা, বেশি রকম সঙ্কীর্ণ হয়ে উঠেছিল, সেটা তবে তার কাছে নিজের দুর্বলতা আড়াল করবার চেষ্টা! ভেতরে লড়াই চলছে বলে, পুরোনো বিশ্বাস ভেঙে পড়েছে বলে, বাইরে এমন অন্ধ একগুঁয়েমির সঙ্গে হার মানার অপমান এড়িয়ে চলতে হবে। তার কাছে কি কোনোদিন নিজের ভুল স্বীকার করবে হেমন্ত? পারবে স্বীকার করতে? নিজের জন্য জয়ের লোভ নেই সীতার। তার কাছে শেষ পর্যন্ত হেমন্ত হার মানল এ সুখ সে চায় না। ভুল বুঝতে পেরে সেটা মেনে নেবার সাহস তার আছে, নতুন সত্যকে চিনতে পারলে সেটাকে গ্রহণ করার ছেলেমানুষি লজ্জা তার নেই, এটুকু জানলেই সে খুশি হবে।

অনুরূপাকে বসিয়ে সীতা নিজেই কয়েক জায়গায় টেলিফোন করে। অনেকক্ষণ চেষ্টার পর সে হাসপাতালে সাড়া পায় শিবনাথের। শিবনাথ আহতদের সম্বন্ধে ব্যবস্থা করছিল।

কার কথা বলছঃ হেমন্ত? শিবনাথ বলে, া হেমন্ত এখানে আছে।

সীতা মনে মনে বলল, সর্বনাশ!

ওর খবর কি?

সামান্য লেগেছে, বিশেষ কিছু নয়। ড্রেস করে দিলেই বাড়ি যেতে পারবে।

হেমন্ত শোভাযাত্রায় ছিল?

ছিল।

গুলি চলবার সময় ছিল?

আগাগোড়া ছিল।

আমার ভারি আশ্চর্য লাগছে।

কেন? আশ্চর্য হবার কি আছে? ওর রক্ত কি গরম নয়?

তর্ক দিয়ে ছাড়া রক্ত গরম করার অত্যন্ত বিরুদ্ধে ছিল। ওকে বলবে তাড়াতাড়ি যেন বাড়ি চলে যায়। ওর মা খুব উতলা হয়ে আছেন।

অনুরূপা প্রায় আর্তকণ্ঠে বলে ওঠেন, না না, ওকথা বলতে বোলা না সীতা! বারণ করে দাও। আমার কথা কিছু বলতে হবে না।

শিবনাথ, ছেড়ে দাও নি তো? শোন, হেমন্তকে ওর মার কথা কিছু বোলো না। শুধু বোলো আমি টেলিফোন করেছিলাম, তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে বলেছি।

হেমন্ত জানুক, সীতা সব জেনেছে, বুঝতে পেরেছে। ওবেলার তর্কটা তাদের বাতিল হয়ে গেছে একেবারে।

অনুরূপা মোহগ্ৰস্তার মতো বসে থাকেন। ছেলে নিরাপদ আছে জানার পর এতক্ষণে তার মুখ থেকে রক্ত সরে যাবার কারণ খানিকটা অনুমান করতে পারে সীতা। দ্বিধা-সংশয়ের দিন পার হয়ে গেছে হেমন্তের। সব রকম হাঙ্গামা থেকে নিজেকে সযত্নে বঁচিয়ে বেঁচে থাকার স্বাৰ্থদুষ্ট হীনতাকে আর সে প্রশ্রয় দিতে পারবে না। সে শুধু মনে মনে এটা স্থির করে নি, একেবারে হাতেনাতে বিদ্রোহ করেছে। সুখের রঙিন স্বপ্ন মুছে যাবার সম্ভাবনায় মুখের চেহারাও তাই বিবর্ণ হয়ে গেছে অনুরূপার।

আপনি অত ভাবছেন কেন মাসিমা?

ভাবব না? তোমার নয় খুশির সীমা নেই, হেমন্ত এবার থেকে লেখাপড়া চুলোয় দিয়ে মিটিং করে বেড়াবে, জেলে যাবে, দেশোদ্ধার করবে। আমার অবস্থাটা বুঝে দেখেছ একবার? আমার কত আশা-ভরসা হেমন্তের ওপর। তুমি যে আমার কি ক্ষতি করলে শুধু ভগবান জানেন।

আমায় শেষে দায়ী করলেন মাসিমা? সীতা বলে আশ্চর্য ও আহত হয়ে, ছেলেমানুষি ভুল করলেন একটা। আমার সঙ্গে মেশার জন্য আপনার ছেলে বদলায় নি। অত বড় গৌরব দাবি করবার অধিকার আমার নেই। হেমন্ত নিজেই বদলেছে, স্বাভাবিক নিয়মে। দেশের এই অবস্থা, এটা বুঝতে পারেন না যে সবকিছুর মধ্যে এদেশের রাজনীতি জড়িয়ে আছে, ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলতে হলে তাকে তালাবদ্ধ করে রাখা দরকার? শত শত আঘাত এসে ওকে সচেতন করে তুলবে, সামলাবেন কি করে? স্বাধীনতার প্রেরণাই ওকে জাগিয়েছে, দেশপ্রেমের আলোই ওকে পথ দেখিয়েছে। আপনার কথা সত্যি, আমি পেরে থাকলে আমিই নিজেকে কৃতার্থ ভাবতাম মাসিমা। কিন্তু তা হয় নি। আমি তো তুচ্ছ, নেতাও কি মানুষকে জাগাতে পারেন? মানুষের মধ্যেই জাগরণ আসে, নেতা শুধু তার প্রতিনিধিত্ব করেন।

সীতা একটু চুপ করে থেকে ধীরে ধীরে বলে, আপনার আফসোসের কারণটাও মাথায় ঢুকছে। না আমার। দেশের জন্য ছেলে দুঃখ পেলে মার কষ্ট হয়, কিন্তু গৌরবও কি হয় না?

তুমি বুঝবে না সীতা, অনুরূপা জ্বালার সঙ্গে বলেন, আমার মতো কষ্ট করে ছেলেকে যদি পড়িয়ে মানুষ করতে হত, তবে বুঝতে লেখাপড়ার ক্ষতি করে ছেলে ভবিষ্যৎ নষ্ট করতে বসলে কেমন লাগে।

আপনি হেমন্তের ওপর অবিচার করছেন মাসিমা। ভুল করছেন।

কেন?

হেমন্ত লেখাপড়ার ক্ষতি করবেই, ভবিষ্যৎ নষ্ট করবেই, এটা আপনি ধরে নিলেন কেন? লেখাপড়ায় ভালো করা ওর কর্তব্য, তাতেই যদি অবহেলা করে, তবে তো ধরে নিতে হবে ওর অধঃপতন হল। দেশের কথা ভাবলে কি লেখাপড়া বাদ দিতে হয় মাসিমা? কোথাও কিছু নেই, জেলেই বা হেমন্ত যাবে কেন শখ করে? জেলে গেলেই কি কাজ হয় দেশের, দরকার থাক বা না থাক? হেমন্তেরও ঠিক এই রকম ধারণা ছিল, পড়লে শুধু পড়তেই হবে চোখ-কান বুজে, আর নয়তো সব ছেড়ে দিয়ে নামতে হবে রাজনীতিতে। মুক্তি সগ্রামে ছাত্রদেরও যে একটা অংশ আছে, সাধারণ অবস্থায় সে অংশ গ্রহণ করা যে পড়াশোনার এতটুকু বিরুদ্ধে যায় না, বরং চরিত্র গঠনে আর মানসিক শক্তির বিকাশে সাহায্যই করে, এই সহজ কথাটা মাথায় আসে না কেন আপনাদের মাসিমা?

তোমাদের মতো মাথা নেই বলে বোধহয়।

মন শান্ত হলে আপনার রাগ কমে যাবে।

আমি না লড়েই হাল ছেড়ে দিয়ে বসে থাকব ভেবেছ বুঝি?

অনুরূপার কথার উগ্রতায় সীতা একটু আশ্চর্য হয়ে যায়, গভীর তীব্র বিদ্বেষে মুখখানা বিকৃত হয়ে গেছে অনুরূপার। নিরুপায়ের অন্ধ আক্ৰোশে তিনি যেন কাকে আঘাত করতে উদ্যত হয়েছেন। হেমন্তকে সুপথে ফিরিয়ে আনার জন্য, তাকে সুমতি দেবার জন্য তিনি কি লড়াই করবেন? ছেলেকে ভালো ছেলে করে রাখতে এতদিন যে লড়াই করে এসেছেন, তার চেয়েও জোরালো লড়াই? কিন্তু সে কথাটা বলতে গিয়েও এত বিদ্বেষ, এত আক্রোশ ফুঠে উঠবে কেন তার। কথায়, মুখের ভঙ্গিতে?

সংশয়ের সঙ্গে সীতা জিজ্ঞেস করে, আপনার কথা বুঝতে পারলাম না মাসিমা। কিসের লড়াই? কি নিয়ে লড়বেন? কার সঙ্গে?

খুকি বুঝিও না সীতা আমায়। পনের বছর হল স্বামীর আশ্রয় হারিয়েছি, সেই থেকে নিজের। পায়ে দাঁড়িয়ে সংসার চালিয়ে এসেছি, ছেলেমেয়ে মানুষ করছি। তুমি আমাকে যত বোকা ভাব অত বোকা আমি নই।

এবার সীতা বুঝতে পারে। জোরে এমন নাড়া খায় তার মনটা! খানিকক্ষণ সে পলকহীন চোখে চেয়ে থাকে অনুরূপার মুখের দিকে! অনুরূপাকে তুচ্ছ না ভাবা সত্যই অসম্ভব মনে হয় তার।

বোকা আপনাকে কখনো ভাবি নি মাসিমা, আজ বোকা মনে হচ্ছে। আমার সঙ্গে লড়বেন বলছেন নাকি? আপনার বুদ্ধি সত্যি লোপ পেয়েছে। আমায় অপমান করুন তার মানে হয়, ও-কথা বলে নিজের ছেলেকে কত বড় অপমান করছেন বুঝতে পারছেন না? ছেলের আপনার নীতি নেই আদর্শ নেই জীবনে, একটা মেয়ের খাতিরে নিজেকে সে চালাচ্ছে? আমায় খুশি করার জন্য আপনার বিরোধিতা করতে যাচ্ছে, তার ব্যবহারের আর কোনো মানে নেই? নিজের ছেলেকে এমন অপদার্থ কি করে ভাবলেন? তাও যদি এতটুকু সত্যি হত কথাটা। আপনার মনের কথা আন্দাজ করলে হেমন্তেরই ঘেন্না ধরে যাবে জীবনে। একটা ভুল ধারণার বশে আমাকে হিংসা করে অশান্তি সৃষ্টি করবেন না মাসিমা। নিজেই জ্বলেপুড়ে মরবেন।

স্পষ্ট রুঢ়তার সঙ্গেই সীতা কথাগুলি বলে যায়, অনুরূপাকে রেয়াৎ করার কোনো প্রয়োজন বোধ করে না। কড়া ভাষায় খোলাখুলি সোজাসুজি না বললে তার কথার মর্ম অনুরূপা গ্রহণ করতে পারবেন কিনা, এ সন্দেহও তার ছিল। স্নেহের বাড়াবাড়ি মাকেও কোথায় নিয়ে যায় ভেবে বড় আক্ষেপ হচ্ছিল সীতার। এই সব মায়েরাই ছেলের বৌ-প্রীতির জ্বালায় পুড়ে মরে, সব দিক দিয়ে গ্রাস করে রাখতে চায় ছেলেকে চিরকাল। স্নেহ যায় চুলোয়, বড় হয়ে থাকে শুধু বিকারটা। মায়ের স্নেহও যদি এমন সর্বনেশে হয়, সে কত বড় অভিশাপ মানুষের! তাও এমন মার, অন্তঃপুরের বন্দি জীবনে অন্ধ মমতা বিলিয়ে যাওয়াই শুধু যার কাজ নয়, একা নিজের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে যে বাইরের জগতের সঙ্গে লড়াই করে আসছে পনের বছর ধরে, বাঁচবার জন্য, ছেলেমেয়ে মানুষ করার জন্য। এমন বাস্তব যার জীবন, মা বলেই কি তার এতটুকু বাস্তববোধ জন্মায় নি ছেলেমেয়েদের বিষয়ে? এই জন্যেই নিজেকে ছোট করে মায়ের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না সন্তানের। তাই কি করতে হবে হেমন্তকে? নইলে যে সমস্যা সৃষ্টি করবেন অনুরূপা, তার সমাধান করা কি সম্ভব হবে হেমন্তের পক্ষে।

কিন্তু অনুরূপা কি সত্যই ওরকম অশান্তি সৃষ্টি করবেন? হেমন্ত পাস করে মোটা মাইনের চাকরি করবে, এ আশা তো ফুরিয়ে যায় নি একেবারে। অনিশ্চিত আশঙ্কাই শুধু পীড়ন করছে। তাকে। শান্ত মনে সব কথা বিবেচনা করে দেখবার পরেও কি ছেলের দিকটা খেয়াল হবে না অনুরূপার, মনে হবে না অত বড় উপযুক্ত ছেলেকে চলাফেরা মতামতের এতটুকু স্বাধীনতা না। দেওয়া পাগলামির শামিল? স্নেহের শিকলে জোর করে হেমন্তকে হয়তো বেঁধে রাখা যাবে কিন্তু ফলটা তার ভালো হবে না মোটেই?

অনুরূপার নিজের মুখে লড়াইয়ের উদ্ভট ঘোষণা শোনার পর এখনো যেন বিশ্বাস হতে চায় না সীতার যে, ব্যাপারটা তিনি সত্য সত্যই ওরকম কুৎসিত করে তুলবার জন্য কোমর বেঁধে উঠেপড়ে লাগতে পারবেন।

অসহায়ের মতোই চুপচাপ বসে ছিলেন অনুরূপা তার ধমকানির মতো কথাগুলি শুনে। তার নীরবতা বা বসে থাকা কোনোটার মানেই ধরতে না পেরে সীতা সংশয়ভরা চোখে তার দিকে তাকায়। নিজের শ্রান্তিও সে আবার অনুভব করে নতুন করে।

তোমার কথা শুনে একটু ভড়কে গেছি মা।

অনুরূপার ক্ষীণ ভীরু কণ্ঠ আশ্চর্য করে দেয় সীতাকে। ভড়কে যাবেন কেন?

অনুরূপ একটু ইতস্তত করে তেমনি শঙ্কিত সুরে অসহায় ভাবে বলেন, আমার ওপর রাগ করে হেমাকে হেঁটে দেবার কথা ভাবছ না তো তুমি? আমি না শেষকালে দায়ী হই।

এ কথায় অন্য সময় হাসি পেত সীতার, এখন এ আবেদনের করুণ দিকটাই তার মনে লাগে। তাকে ছেলের ভবিষ্যৎ বৌ হিসাবে ভাবতে ভাবতে কল্পনাটা অনুরূপার জোরালো বিশ্বাসে দাঁড়িয়ে গেছে যে, হেমন্ত আর সে পরস্পরকে ভালবাসে, সব ঠিক হয়ে আছে তাদের মধ্যে। এ বিষয়ে দ্বিধা-সংশয়ের লেশটুকু নেই অনুরূপার মনে। হেমন্তকে বিগড়ে দেবার জন্য মনে মনে তাকে স্থির নিশ্চিত ভাবে দায়ী করে ক্ষেপে উঠবার কারণ হয়তো তাই।

বিয়ে না হতেই শাশুড়ি-বৌয়ের লড়াই!

একটা ব্ৰতের কথা মনে পড়ে সীতার। ছেলেবেলা মামাবাড়ি গিয়ে মামাতো বোন আর পাড়ার কয়েকটি ছোট মেয়েকে এই ব্ৰত করতে দেখেছিল। যমপুকুরের ব্রত যুগ যুগ ধরে শাশুড়িরা ছেলের বৌদের যত যন্ত্রণা দিয়েছে তারই বিরুদ্ধে কচি কচি মেয়ের ব্রতের বিদ্রোহ! ব্রতের প্রচার কথাটা চমৎকার। বৌ চায় এ ব্রত করতে, শাশুড়ি বলে, না। কাজেই মরে শাশুড়ি নরকে যায়। নরকের কষ্ট সয় না–ছেলের বৌয়ের দয়ায় উদ্ধার পাওয়ার চেয়ে কোনোমতে নরকের কষ্টও অনেক ভালো মনে করে প্রাণপণে সহ্য করতে চেয়েও সয় না। অগত্যা স্বপ্নে ছেলেকে বলে দিতে হয় যে করে হোক বৌকে দিয়ে ব্ৰতটা করিয়ে আমায় উদ্ধার কর। বৌ কম চালাক নয়, বলে, শাশুড়ি নেই এ ব্রত করতে যাব কেন মিছামিছি কষ্ট সয়ে উপোস করে : এক গা গয়না দাও, দুধ ভাত খাওয়াও তবে করব ব্ৰত। ব্ৰত কথায় সে কি ঝাল ঝাড়া শাশুড়ির ওপর, আর তার মধ্যেই শাশুড়ির বৌ নির্যাতনের কি অকাট্য প্রমাণ! শাশুড়ি হল খুইদিয়া দাই।

আলো আলো খুইদিয়া দাই, ধানতলা দিলি না ঠাঁই।

আলো আলো খুইদিয়া দাই, মানতলা দিলি না ঠাঁই।

আলো আলো খুইদিয়া দাই, কলাতলা দিলি না ঠাঁই।

ছেলের সঙ্গে বিয়ের কথা পর্যন্ত হয় নি, তবু যেন অনুরূপা মরে না গিয়ে মোটাসোটা দেহটি নিয়ে জলজ্যান্ত বেঁচে থাকলেও নরক যন্ত্রণারই প্রতিকারে তাকে দিয়ে শাশুড়ি উদ্ধারের ব্ৰত পালন করিয়ে নিতে চান!

একটা কথা ভেবে সীতা স্বস্তি পায়। ছেলের দিকটা অনুরূপা বিবেচনা করবেন। এটা বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তার ভাবেসাবে। যত অন্ধই হোক তার স্নেহ, ওই বিবেচনাটাও তার আছে। ছেলেকে নিজের খুশিমতো চালাতে চেয়ে উনি যে ভাবেই লড়াই করুন, হেমন্তকে অসুখী দেখলে, তার জীবনে অশান্তি এলে, নিজেই তিনি জিদ বিসর্জন দেবেন, সামঞ্জস্য খুঁজবেন। সে যা ভয়। করছিল, অনুরূপার দিক থেকে সে ভয়ের কারণ নেই।

অথবা আছে? কি করে সুনিশ্চিত হবে সীতা, কি করে বিশ্বাস করবে এরকম মা, ছেলে-প্ৰাণ। এরকম মা, ছেলেকে বিব্রত দুঃখিত অসুখী দেখলে নিজের খেয়ালখুশিকে সত্য সত্যই ছাঁটাই করে ছেলের সঙ্গে আপস করবে? বিশেষ করে, যে ছেলের জন্য এতকাল মেয়েমানুষ হয়েও টাকা রোজগার করেছেন এত কষ্টে, এত দুঃখে। একবার যদি খেয়াল হয় যে ছেলে অকৃতজ্ঞ আর কি তখন সহজ বুদ্ধিটি টিকবে, অনুরূপার আপস করার সংযম বজায় থাকবে? কে জানে! ভালোটা আশা করাই ভালো।

অনুরূপার অদ্ভুত কথাই যেন পুরোনো অন্তরঙ্গতা ফিরিয়ে আনে সীতার, সে হাসিমুখে শাসনের সুরে বলে, কি আবোল-তাবোল বকছেন মাসিমা? যেমন আবোল-তাবোল ভাবছেন, কথাও বলছেন তেমনি। মাথা খারাপ হয়ে গেছে আপনার। বাড়ি যান তো। দাঁড়ান, কাউকে সঙ্গে দিই, পৌঁছে দিয়ে আসুক।

থাক্ থাক্। আমি নিজেই যেতে পারব মা।

ভাগ্যি বৌমা বলে বসেন নি, সীতা ভাবে।

তা কি হয় মাসিমা? নকুল গিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসুক।

অনুরূপা উতলা হয়ে পড়ছেন–এ খবরটা হাসপাতালে হেমন্তকে দেবার নামেই ব্যাকুল হয়ে অনুরূপা কেন বাধা দিয়েছিলেন বুঝতে পারলে, অনুরূপা সম্বন্ধে সীতা বোধহয় আরো নিশ্চিন্ত হতে পারত। ছেলে পাছে মনে করে তার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে এ ভয়টা কত জোরালো অনুরূপার মনে, কত সাবধান তিনি এ বিষয়ে, সীতা সেটা টের পেত। অত বড় ছেলে সন্ধ্যারাত্রে বাড়ি না ফিরলে ব্যস্ত হওয়া সঙ্গত হয় না, সীতার মুখে এ কথা শুনেই তিনি ভড়কে গিয়েছিলেন। তিনি উতলা হয়ে উঠেছেন, অস্থির হয়ে ছুটে বেরিয়েছেন খোঁজ নিতে, এ কথা শুনে তাঁর বাড়াবাড়িতে যদি বিরক্ত হয় হেমন্ত। এক দিন একটু দেরি করে বাড়ি ফেরার অধিকারটুকু পর্যন্ত তার নেই ভেবে যদি ক্ষুণ্ণ হয়।

এত ভয়-ভাবনা নিয়েও কিন্তু এক বিষয়ে মনটা শক্ত করে রাখেন অনুরূপ। ছেলেমানুষি করে হেমন্ত নিজের সর্বনাশ করবে, এটা চুপচাপ বরদাস্ত করার কথা তিনি ভাবতেও পারেন না। বাধা তিনি দেবেন, সামলাবার চেষ্টা করবেন, যতটা তার সাধ্যে কুলোয়। সেজন্য যদি রাগ করে হেমন্ত, দুঃখ পায়, বিরক্ত হয়, উপায় কি!

মনের এই লড়াইয়ে ভাবটা আগেও ছিল, এখনো আছে উদ্যত হয়ে, তবে সীতার শাসনটা কাজ দিয়েছে। হেমন্ত ফেরামাত্র লড়াই শুরু করে দেবার ঝেকটা সংযত হয়েছে। এত বড় ছেলেকে বাগাতে হলে যে যুদ্ধটা ধীর স্থির শান্ত সংযতভাবে করতে হবে সীতার মতো, এ বিষয়ে মন সতর্ক হয়ে আছে। তাই, মায়ে-ব্যাটায় সংঘর্ষ বাঁধতে বাঁধতে রাত্রি গভীর হয়ে আসে। রমা ও জয়ন্ত যতক্ষণ জেগে থাকে, অনুরূপা সাধারণভাবে কথা বলে যান, হেমন্তের কাজে তার সমর্থন আছে কি নেই, সেই ইঙ্গিতও আসে না তার কাছ থেকে। হেমন্ত তার অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেয়, রমা ও জয়ন্ত হাঁ করে তার কথাগুলি গিলতে থাকে। অনুরূপাও নীরবে শুনে যান। মায়ের ভাবান্তর লক্ষ করেও হেমন্ত কিন্তু সে বিষয়ে কিছু বলে না। মার দিক থেকে কথা ওঠা পর্যন্ত ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করাই সে ভালো মনে করে। আর চুপচাপ থাকার কোনো কারণ আছে নিশ্চয়। আলোচনা শুরু হবার আগে নিজের মনটাকেই হয়তো গুছিয়ে নিচ্ছেন মা, হৃদয়কে শান্ত ও আয়ত্তাধীনে রাখবার আয়োজন করছেন। তাড়াহুড়ো করে কথা পেড়ে কোনো লাভ হবে না।

জয়ন্ত ঘুমিয়ে পড়ে আগে। পরে রমাও কয়েকবার হাই তুলে বিছানায় গিয়ে আশ্রয় নেয়। খাওয়ার পাট চুকেছিল হেমন্ত বাড়ি ফেরার কিছু পরেই। তখন অনুরূপা কথা পাড়েন।

ঘুম পেয়েছে হেমা?

না মা। কি বলবে বল।

আমাকে বলতে হবে?

হবে না? নইলে তোমার মনের কথা বুঝব কি করে?

নতুন কথা শোনালি আজ। আমার মনের কথা বুঝি না তুই? কপাল আমার!

শুনে হেমন্ত ভয় পেয়ে যায়। বুঝতে পারে, অনুরূপার কাছে আজ সে সহজে রেহাই পাবে না। নইলে তিনি এ সুরে কথা শুরু করতেন না। রাগ দুঃখ অভিমান অনুযোগ অভিযোগ কদাকাটা সবকিছু অস্ত্ৰ সাজিয়ে মা প্রস্তুত হয়ে আছেন। আলোচনা গড়ে তুলে এগিয়ে যাবার ভার মার হাতে ছেড়ে দিলে আর রক্ষা থাকবে না, একেবারে মর্মান্তিক কাণ্ড করে ছাড়বেন তিনি। ভেবেচিন্তে হেমন্ত নিজেই কথা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব গ্রহণ করে।

অনুরূপা কি যেন বলতে যাচ্ছিলেন, বাধা দিয়ে হেমন্ত বলে, শোন, শোন। তুমি রাগ করেছ, মনে কষ্ট পেয়েছ, তোমার ভয় হয়েছে, সব আমি জানি না। তোমার সঙ্গে আমি তর্ক করব না। তর্কও করব না, তোমার কথার অবাধ্যও হব না। তুমি যদি বারণ কর কোনো কাজ করতে, তোমার কথা আমি মেনে চলব। গোড়াতে এ কথাটা স্পষ্ট করে বলে রাখলাম। এবার আসল কথা বলে তোমার মত চাইব। তুমি হাঁ কি না বলে দিও, ব্যস, সেইখানে সব খতম হয়ে যাবে। আমরা আর ও নিয়ে মাথা ঘামাব না।

অনুরূপ একটু বিব্রত বোধ করেন। এ ভাবে কথা চালাবার জন্য তিনি মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি ভাবতেও পারেন নি হেমন্ত এতটুকু লড়াই করবে না, তাকে বুঝিয়ে দলে টানবার চেষ্টা পর্যন্ত বাতিল করে দেবে গোড়াতেই, সোজাসুজি তারই ওপর সব সিদ্ধান্তের দায়িত্ব চাপিয়ে দেবে। পছন্দ হোক, অপছন্দ হোক, চোখ-কান বুজে তাঁর কথা মেনে চলতে সে প্রস্তুত, হেমন্তের এ ঘোষণায় এক দিকে হৃদয় যেমন তার উল্লাসে ভেসে যাবার উপক্রম হয়, অন্য দিকে তেমনি মতামত দেবার দায়িত্বটা যে তার কতদূর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে অনুভব করে দুর্ভাবনারও তাঁর সীমা থাকে না। শুধু মা হিসাবে অন্যায় আবদার করা চলত, যুক্তিতর্ক শূন্যে উড়িয়ে দিলেও দোষ হত না। হেমন্ত যেন সে পথটা তার বন্ধ করেছে। মা বলে তাকে আকাশে তুলেছে বটে, আছাড় খেয়ে পড়বার সম্ভাবনাও সৃষ্টি করে দিয়েছে সেই সঙ্গে।

হেমন্ত শান্ত কণ্ঠে বলে, ঘটনা সব জান। কাল একটা প্রোটেস্ট মিটিং হবে, আমি তাতে যোগ দিতে চাই। মিটিঙের পর আর একটা প্রোসেশনও হয়তো বার হবে, তাতেও আমি থাকতে চাই।

এখন তুমি যা বল।

তুই কি লেখাপড়া করতে চাস না?

কেন? তার মানে কি?

এ সব করে বেড়ালে লেখাপড়া হবে কি করে?

ও! এই কথা। হেমন্ত এবার হাসে, রোজ এসব করে বেড়াব নাকি? এ সব করা মানে তো শুধু এই যে, একটা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছি। ওটুকু না করলে কি মনুষ্যত্ব থাকে? লেখাপড়ার অজুহাতে মনুষ্যত্ব ঘেঁটে ফেলতে পারি না মা, তুমি যাই বল। হাঙ্গামা যে হচ্ছে, সে দোষ আমাদের নয়।

কিন্তু হচ্ছে তো। আজ সামান্য চোট লেগেছে, কাল তো মারা যেতে পারিস। সোজাসুজি মৃত্যুর কথাটা বলে যান অনুরূপা, গলায় আটকায় না, কিন্তু তার মুখ দেখে হেমন্ত বুঝতে পারে যে, কথাটা বলতে কি উগ্র আতঙ্কে মড়মড় করে উঠেছে তার দেহ-মন।

হেমন্ত মৃদুস্বরে বলে, হয়তো সম্ভব। তোমায় মিথ্যে ভরসা দেব না।

তবে?

শোন তবে বলি তোমায়, হেমন্ত যেন দম বন্ধ করে কথা বলে, এই ভাবের ভয়ভাবনার জবাবটা আজ পেয়েছি মা, এত দিন পরে। লেখাপড়ার জন্য কি সব ছাড়া যায়? তোমাকে কিংবা রমাকে যদি একটা গুণ্ডা আক্রমণ করে, আমি যদি স্পষ্ট বুঝতে পারি তোমাদের বাঁচাতে গেলে লাঠির ঘায়ে মাথা ফেটে যাবে, ব্রেনটা খারাপ হয়ে যাবে, জীবনে লেখাপড়া কিছু আর হবে না। আমার তাই ভেবে কি তখন চুপ করে থাকব? কি হবে সে লেখাপড়া দিয়ে আমার। তবে এটাও ঠিক যে, ও হল বিশেষ অবস্থা। অবস্থাবিশেষে লেখাপড়ার কথা ভাবারও মানে হয় না। লেখাপড়া করাই যার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য তাই বলে সাধারণ অবস্থায় লেখাপড়া করব না কেন? তাই তো কাজ আমার।

অনুরূপা গুম খেয়ে থাকেন।

যাগে, হেমন্ত স্বাভাবিক গলায় বলে, বলেছি তো তোমার সঙ্গে তর্ক করব না। তুমি যা বল–হ্যাঁ কিংবা না।

মরতে পারিস জেনেও হা বলতে পারি আমিঃ অনুরূপা আৰ্তকণ্ঠে প্রায় চিৎকার করে ওঠেন।

সেটা কঠিন বটে তোমার পক্ষে বলা, হেমন্ত স্বীকার করে নেয়, এক কাজ কর তবে। হাঁ না কিছুই তুমি বোলো না। আমার ওপরে সব ছেড়ে দাও, আমি যা ভালো বুঝব করব। তাই কর মা।

অনুরূপা নিশ্বাস ফেলেন।–এ আমি আগেই জানতাম হেমা, তোর সঙ্গে পারব না।

এই ভাবে একটা বোঝাপড়ার মধ্যে মা ও ছেলের সংঘর্ষটা বেঁচে রইল। মার অনুমতি মানেই আশীৰ্বাদ। সেটা জুটল না হেমন্তের। তবে নিষেধের অভিশাপ যে এল না, অনুরূপার মতো ভদ্ৰ স্নেহাতুরা মায়ের এ পরিবর্তন কে অস্বীকার করবে? কে বুঝতে পারবে না যে, অনুরূপার পক্ষেই সম্প্ৰতি সন্তানকে আশীর্বাদ দেওয়া সম্ভব হবে, আচ্ছা মরবে যাও, এর চেয়ে মহান মৃত্যু মা হয়ে কি করে কামনা করি তোমার জন্য?

 

হাতটা গেছে? জীবনে আর সারবে না? আমিনার আর্তনাদ যেন চিরে দেয় ঠাণ্ডা মাঝরাত্রি।

একটা হাত তো আছে। রসুল বলে জোর দিয়ে।

তা আছে।

আমিনা আত্মসংবরণ করেন আর্তচিৎকারে ফেটে পড়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে। মাঝরাত্রে এভাবে। হঠাৎ ব্যাণ্ডেজ বাঁধা গলায় ঝুলানো নষ্ট হাত নিয়ে রক্তমাখা জামাকাপড় পরা ছেলে হাজির হলে কোন মা আত্মহারা না হয়ে পারে? তবে নিজেকে সামলাবার ক্ষমতা আমিনার অদ্ভুত। ছেলেটা আজাদির জন্য অনায়াসে মরতে পারে, মরবার জন্য তৈরি হয়ে আছে, টের পাবার পর থেকে আমিনার মনের এই জোরটা হু হু করে বেড়ে গেছে।

আদর খেতে এলাম, আমায় মোটে আদর করছ না মা!

তোর মা হওয়ার যা ঝকমারি, আদর করতে মোটে ইচ্ছে যায় না রসুল।

রসুলের মাথাটা আরো জোরে বুকে চেপে ধরে আমিনা বলেন, হাসপাতালে গেছিস জেনে নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম। জানি তো এমনি ভাবে যাবি একদিন, দুদিন আগে আর পরে। আগে গেলেই বরং চুকে-বুকে যায় সব। লতাকে পুড়তে হয় না চব্বিশ ঘণ্টা মনে মনে, আমাকেও পুড়তে হয় না। চব্বিশ ঘণ্টা তোর কথা ভেবে ভেবে–

মা, জান? ফিসফিস করে রসুল বলে।

তেমনি ফিসফিস করে আমিনা বলেন, কি?

আমায় আটকে দিয়েছিল হাসপাতালে। তোমায় দেখতে কেমন করতে লাগল মনটা। চুপিচুপি পালিয়ে এসেছি।

আঁ? ডাক্তার বলেছিল শুয়ে থাকতে। চুপিচুপি তুই পালিয়ে এসেছিস এই রাতে এক মাইল পথ হেঁটে?

তোমার একটু আদর না পেলে কি এ যন্ত্ৰণা সয়?

রসুল বুঝতে পারে, মা নিঃশব্দে কাঁদছেন। বেশ রক্ত বেরিয়ে যাবার ফলে একদিকে যেমন দুর্বল অশক্ত মনে হচ্ছে শরীরটা, তেমনি আবার কেমন অদ্ভুত রকমের ভেঁাতা অবসন্নতা এসেছে। অনুভূতিতে। আমিনার কান্না যে অগাধ ও অসহনীয় বিষাদে হৃদয় ভরে দেয়, রসুল জানে সেটা সাময়িক ও কৃত্রিম। রক্তক্ষরণের ফলে শুধু এই প্রতিক্রিয়া এসেছে। নইলে এত রাত্রে এসে মাকে কাঁদাতে তার মোটে ভালো লাগত না, এলেও কাদাবার বদলে নিজেই সে হৈচৈ হাঙ্গামায় অস্থির করে ভুলিয়ে রাখত মাকে। কিন্তু আজ এমন দুর্বল হয়ে গেছে মনটা যে মাকে আরো বেশি কাদিয়ে দুঃখটা উপভোগ করতে ইচ্ছে হচ্ছে। ডাক্তার সত্যি বলেছিল যে, রক্তক্ষয়ের কতগুলি অদ্ভুত খাপছাড়া প্রতিক্রিয়া আছে নিজেকে হঠাৎ অতিরিক্ত সবল মনে করে সে যেন বিছানা ছেড়ে উঠবার চেষ্টা না করে। তাই সে করেছে শেষ পর্যন্ত! বেড ছেড়ে উঠে এক মাইল রাস্তা হেঁটে মাকে কঁদাতে এসেছে।

দাঁতে দাঁত ঘষে রসুল মনে মনে বলে, না, বিকারের ঝোঁকে মাকে সে কাঁদাতে আসে নি, ভেবেচিন্তে যা করেছে সে কাজকে ওই সস্তা দুর্বলতায় পরিণত হতে সে দেবে না, রক্ত ক্ষয় হবার জন্য তো নয় শুধু, গ্রেপ্তার হওয়ার জন্যও বটে। হাসপাতালে গ্রেপ্তার না হলে কি তার মাকে এ ভাবে দেখতে আসবার ঝোঁক চাপত! আবার কবে দেখা হয়, মার মনে একটু শান্তি ও শক্তি দেবার চেষ্টা করা তার উচিত, এ সব হিসাব করেই সে এসেছে মাকে দেখতে। মাকে কাঁদয়ে খুশি হয়ে যেতে নয়।

তবে তুমি কাঁদ, আমি যাই।

কাঁদছি কই?

এবার যে কথা বলব শুনে কিন্তু ভেউ-ভেউ করে কাঁদবে।

–ইস্!

না সত্যি। হাঙ্গামার কথা। সেই জন্য তো রাতদুপুরে পালিয়ে পালিয়ে এলাম তোমায় দেখতে।

সুতরাং তখন মনটা শক্ত করতে হল আমিনার। চোখের জল চলে গেল আড়ালে, অন্য সময়ের জন্য। ছেলে যদি মুশকিলে পড়েই থাকে, তাকে এখন সাহস যোগানো দরকার, নিজের দুর্বলতা দিয়ে তাকে কাবু করে আনা সঙ্গত হবে না। রসুলও জানত, তার বিপদের খবর শুনে মার পক্ষে আত্মসংবরণ করা সহজ হবে। হাতে গুলি লেগেই সব শেষ হয় নি, এখনো হাঙ্গামা সঞ্চিত আছে। তার জন্য, এ কথা শুনলেই মার কান্না স্থগিত হয়ে যাবে।

আমাকে গ্রেপ্তার করেছে।

গ্রেপ্তার? কেন?

হাঙ্গামায় ছিলাম বলে।

তোর হাতে গুলি লাগল, তোকেই গ্রেপ্তার করল কি রকম?

ওই তো খাঁটি প্রমাণ যে আমি হাঙ্গামায় ছিলাম। নইলে আহত হব কেন?

–বাঃ, বেশ!

খানিকক্ষণ চুপ করে থাকে রসুল। শরীরটা সত্যই বড় দুর্বল লাগছে। মনে কোনো কষ্ট নেই কিন্তু শান্ত গভীর সেই করুণ বিষাদের ভাবটা কাটছে না।

আনমনা ছেলের চুলের ভেতরে আঙুল দিয়ে আমিনা তার মাথাটা তোকিয়ে দেন ধীরে ধীরে। মনে অসংখ্য প্রশ্ন এসে ভিড় করেছে। তার মধ্যে কয়েকটি মাত্র জিজ্ঞাসা করা যায়, বাকিগুলি চিরকাল অবোধ আকুল মনের প্রশ্ন হয়েই থাকবে।

গ্রেপ্তার করে হাসপাতালে পাঠিয়েছিল?

না, হাসপাতালে গ্রেপ্তার করেছে।

জামিন দিল?

না, জামিন দেয় নি।

তবে?

পালিয়ে এসেছি, তোমার জন্যে। ভোরে আবার ফিরে যেতে হবে।

কেন? ফিরে যাবি কেন?

যাব না? আরো তো কয়েকজন গ্রেপ্তার হয়েছে; তারা কেউ পালায় নি। ফিরে না গেলে লোকে বলবে না তোমার ছেলে গ্রেপ্তার হয়ে একা পালিয়েছে?

তবে এখন ঘুমো, আর কথা নয়।

আমিনাও কিছু কিছু বুঝতে পারেন যে আঘাতের ও রক্তপাতের ফলে এমন কোনো একটা প্রক্রিয়া ঘটে গেছে রসুলের মধ্যে যার ফলে হঠাৎ মাকে কাছে পাবার ঝোঁক জাগায় নিজেকে সামলে রাখতে অনেক চেষ্টা করেছিল কিন্তু পেরে ওঠে নি। শিশুর মতো কেন রসুল এমন পাগল হয়ে উঠল মায়ের জন্য? আর দশটি শান্তশিষ্ট ভালো ছেলের মতো হয়ে না থেকে এইসব বিপজ্জনক আজাদির ব্যাপারে যোগ দিয়ে দুঃখিনী মাকে আরো দুঃখ দিচ্ছে, এ রকম কোনো কাটা কি আছে ওর মনে, তিনি তো কোনোদিন সমালোচনা করেন নি, আফসোস জানান নি। ওরকম নিরীহ গোবেচারা ছেলেই বা কজন আছে দেশে যে, তাদের সঙ্গে তুলনায় দেশের ও দশের জন্য নিজের মাকে কষ্ট দেবার চেতনা ওর লেগেছে। আমিনার তো মনে হয় দেশের সব ছেলেই তার রসুলের মতো অন্য কোনো পথ তাদের নেই। আচ্ছন্ন অভিভূতের মতো রসুল ঘুমিয়ে থাকে, মাঝে মাঝে তার মুখ দিয়ে অস্ফুট কাতর শব্দ বার হয়। আমিনা জেগে বসে চুপ করে চেয়ে থাকেন তার রক্তহীন বিবর্ণ মুখের দিকে। তার অশ্রুহীন দুটি আরক্তিম চোখে শুধু ইঙ্গিত ফুটে থাকে হৃদয় তাঁর কি ভাবে রক্তাক্ত হয়ে আছে।

শেষরাত্রে আবদুল ঘরে ঢোকে।

এবার যেতে হবে রসুল।

হেঁটে ফিরতে পারবে? আমিনা বলেন।

না, হাঁটতে হবে না! গাড়ির ব্যবস্থা করেছি।

আবদুলেরও ঘুম হয় নি, তার চোখ দুটিও টকটকে লাল হয়ে উঠেছে। সে চোখের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে ঘুমন্ত শহরের শেষরাত্রির স্তব্ধতা যেন প্রশ্ন হয়ে ওঠে আমিনার কাছে : তোর কি শুধু একটি ছেলে?

কে নিজের ছেলে কে পরের ছেলে ভাববার ক্ষমতা নিজের ছেলেই তার লোপ পাইয়ে এনেছে ক্রমে ক্রমে। অজানা অচেনা অসংখ্য ছেলে তার রসুলের সঙ্গে হতাহত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে তার বুকের মধ্যে। আর এমন এক বন্ধুকে সঙ্গে এনেছে রসুল, দুদণ্ড যার মুখখানা দেখে মনে হচ্ছে, রসুলের মতোই সে তার চেনা-জানা, নিজের বুকের রক্ত ঢেলে মানুষ করা সন্তান!

 

সুধাই বাইরের দরজা খুলে দেয় প্রতি রাতের মতো। মুখ খুলে ব্যথিত ভসনার দৃষ্টিতে আজ আর তাকায় না অন্য দিনের মতত। পাশে সরে দাঁড়িয়ে পথ ছেড়ে দিয়ে মাথা হেঁট করে থাকে।

অক্ষয় উৎফুল্ল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, ঘুমিয়ে পড়েছে সবাই?

কি জানি। চেঁচামেচি জুড়োনা।

তোমার হল কি?

সুধা জবাব দেয় না। মাথাও সে হেঁট করেই রাখে। অক্ষয় চৌকাঠ পার হয়ে ভেতরে এলে নিঃশব্দে সদর দরজা বন্ধ করে ভেতরে চলে যায়। অক্ষয়ের অনুভূতি হয় দুরকম। তার নেশা করার জন্য সুধা কষ্ট পায় সে জানত, কিন্তু কত তীব্র, কি অসহ্য যে হত সে কষ্ট তা সে শুধু আজকে, এখন, সুধাকে চোখে দেখবার পর, প্রথম পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পেরেছে। আজ অবশ্য সুধার মনে আঘাত লেগেছে চরম, আজকের লজ্জা দুঃখ হতাশার তার সীমা নেই, মনে মনে আজ সে মরে গেছে। আজ অক্ষয় শুধু মদ খেয়ে আসে নি, আর কোনোদিন ও-জিনিস স্পর্শ করবে না এই প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে খেয়ে এসেছে। আজ তার বিশেষ দুঃখ, বিশেষ হতাশা, কিন্তু আগেও কি কম ছিল? অধঃপতন শুরু হয়ে গিয়েছে স্বামীর, দিন দিন বাড়ছে তার নেশা, কোথায় গিয়ে শেষ হবে তা কি ভাবতে পারত সুধা? আগে এতটা অনুমান করতে পারে নি বলে, অনুমান করতে চায়ও নি বলে, অক্ষয়ের সমবেদনা ছিল জলো খেয়াল। হালকা মেঘের মতো সে সমবেদনা খুশিমতো মনে ভেসে আসত, দরকার মতো উপে যেত। পশুত্র মতো কিভাবে সুধাকে সে নির্যাতন করে এসেছে, এতকাল পরে আজ প্রথম পশুর মতো জমজমাট নেশা না করে বাড়ি ফিরে হঠাৎ সেটা অনুভব করে আজ প্রথম আন্তরিক অনুতাপ দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে। তবু তারই মধ্যে সে বুঝতে পারে যে এ অনুতাপের তীব্র মধুর জ্বালা লেগেছে শুধু এইজন্য যে আজ সে মদ খেয়ে আসে নি, আজ তাকে মদ না খেয়ে আসার নেশায় ধরেছে। কাল যদি ওজন মতো, আজ বাদ গেছে বলে খানিকটা বেশি খেয়ে আসে, সুধাকে পশুর মতোই নির্যাতন করবে। তার কালকের কাণ্ডের জন্যই সুধা আজ বেশি রকম ভয়ার্ত হয়ে আছে। কাল বাড়ি ফিরেই সে ফতোয়া দিয়েছিল : ঝুলো মাই, বুড়ি মাগী, শাড়ি সেমিজ পরে কচি বৌ সাজতে লজ্জা করে না? খোল, খোল, শিগগির খোল!

সুধা তা ভুলতে পারে নি। সুধা আজো আশঙ্কা করছে ওই রকম একটা ভয়ঙ্কর মাতলামির। শুধু সেটা কিভাবে আসবে ঠাহর করে উঠতে পারছে না।

প্ৰায়শ্চিত্ত বাকি আছে তার, অনেক প্ৰায়শ্চিত্ত। নিজেকে অনেক দিন ধরে দলে পিষে ছিঁড়ে ধুনে চলতে হবে। নেশা করার দুরন্ত, অবাধ্য দৈহিক মানসিক সর্বাঙ্গীণ সাধ শুধু নয়, সে যে মাতাল হওয়া বরবাদ করেছে এ বিষয়ে বহুকাল ধরে ঘরে বাইরে সকলের অবিশ্বাসের পীড়ন। মাথাটা আজ যেন আশ্চর্য রকম সাফ মনে হয় অক্ষয়ের। জগতের যাবতীয় সমস্যার মর্ম যেন তার আজ মদ খাওয়ার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও না খাওয়ার এবং এ নেশা যে ভাবেই হোক ত্যাগ করার প্রতিজ্ঞার বিদ্রোহে অকস্মাৎ সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে জীবনে–কঠিন, কঠিন এ কাজ।

কিন্তু অন্য এক ভয়ঙ্কর নেশাতে একেবারে সচেতন অচেতন মন নিয়ে মশগুল হওয়ার মজাও টের পেয়েছে অক্ষয়, বাঁচার জন্য বাঁচাবার জন্য গুলির সামনে বুক পেতে দিয়ে মরা। এই প্রথম ও নতুন নেশা এত সাফ করে দিয়েছে তার মাথা যে সে জেনে গিয়েছে মদ হয়তো সে খাবে দু-একবার নিজের দুর্বলতায় কিন্তু সেটা দু-একবারের বেশি আর খাবে না, কারণ ফেনিল গ্লাসে চুমুক দিতে গেলে তার মনে হবে সে জীবন্ত তাজা ছেলের রক্ত খাচ্ছে–গেজানো রক্ত।

এমনিভাবে উদ্ভট প্রক্রিয়া চলে অক্ষয়ের মনের। … তবে পরম মুক্তির, মহান আত্মজয়ের, দুঃস্বপ্নের অবসানের বাস্তব, কাৰ্যগত জীবন্ত অনুভূতিও আজ খুব প্রবল অক্ষয়ের। মিথ্যা ধারণা ভেঙে দিয়ে সুধার মৃত্যু-স্নান মুখে জীবনের জ্যোতি, আশার আলো ফুটিয়ে তোলার কল্পনা তার হৃদয়কে উৎসুক, উফুল্ল করে রেখেছে–প্রথম প্রেমে প্রিয়াকে পাওয়ার সম্ভাবনা আবিষ্কার করে ফেলার মতোই রসালো সে আনন্দ। জামাকাপড় ছাড়তে ছাড়তে সে সুধাকে দেখতে থাকে। খাটে। বসে মেঝেতে চোখ বিধিয়ে রেখেছে সুধা। বিছানায় উঠে কেন সে শুয়ে পড়ছে না দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে, অক্ষয় তা বুঝতে পারে। রাতদুপুরে মাতাল অক্ষয়কে সামলাবার দায়িত্ব সুধা পালন করে এসেছে বরাবর রাতদুপুরে বাড়ি ফিরে সে যাতে নেশার কেঁকে হৈচৈ কেলেঙ্কারি কিছু না করে। অক্ষয় না শুয়ে পড়লে সে শোয় না, অক্ষয় না ঘুমোলে সে ঘুমায় না। আজ সে মরে গেছে। অক্ষয়ের কাণ্ডে, তবু আজো তার সে দায়িত্ব পরিহার করতে সে পারছে না। হৃদয়-মনে কোটি বসন্ত আসে অক্ষয়ের। তার মনে হয়, আজ সে নেশা করার অপরাধ করে নি জানিয়ে কয়েক বছরের পুরোনো বৌকে সে খুশি করবে না, আমি তোমায় ভালবাসি বলে এই আশাহীনা লজ্জিতা অপমানিতা মেয়েটিকে সে আজ পুলকিতা রোমাঞ্চিতা করে তুলবে। আজ তাদের আবার বিয়ে হবে নতুন করে।

মা কি ঘুমিয়ে পড়েছেন সুধা?

কি জানি।

বোসো এখুনি আসছি।

কোথা যাবে? সুধা আর্তনাদ চেপে বলে।

মাকে প্রণাম করে আসি।

বলে অক্ষয় ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। বারান্দার কোণ ঘুরলেই মার শোবার ঘরের দরজা মা আর অক্ষয়ের বোন ললিতা শোয় ও-ঘরে। বারান্দার কোণটা ঘুরবার সময় সুধার দেহটা একেবারে পায়ের ওপর এসে পড়ায় অক্ষয়কে থামতে হয়।

পায়ে পড়ি তোমার, রাতদুপুরে কেলেঙ্কারি কোরো না। মা ঘুমুচ্ছেন।

অক্ষয় বলে, আরে! কি করছ তুমি! এত রাতে ফিরে মাকে প্রণাম করতে যাচ্ছি কেন বুঝতে পারছ না? আজ খেয়ে আসি নি। মা খুশি হবেন শুনে।

ঘুম ভাঙালে মার শরীর খারাপ হয়। কাল সকালে মাকে প্রণাম কোরো।

অক্ষয় আহত হয়, সুধা বিশ্বাস করে নি!

সত্যি খাই নি সুধা।

জানি। কিন্তু মাকে ঘুমাতে দাও। ঘরে চল। চল।

আগে তোমাকে বোঝাতে হবে দেখছি।

ঘরে গিয়া সুধা বলে, এক কাজ কর, কেমন। শুয়ে পড়ি এস। আমারও ঘুম পেয়েছে, দুজনে শুয়ে পড়ি।

খাব না?

খেয়ে আস নি? অন্য দিন তো–! এস তবে, বোলো।

সুধা তাড়াতাড়ি আসন এনে পেতে দেয়… ঘরের কোণে অন্ন-ব্যঞ্জন ঢাকা ছিল, আসন ভাজ। করা ছিল আলনায়! বাড়ি ফিরে কদাচিৎ খায়, কিন্তু আহার্য তার প্রস্তুত হয়ে থাকে প্রতিদিন। খাক বা না খাক!

অক্ষয় ধীরে ধীরে আসনে বসে। সাজিয়ে গুছিয়ে সব ঠিক করে সামনে দেবার পরও সে হাত গুটিয়ে বসে থাকে। সুধার গৃহিণীপনা দেখতে দেখতে চোখে তার পলক পড়ে না। সে আজ সত্যই গন্ধও সেঁকে নি মদের। কিন্তু সুধা জানে সে মাতাল হয়ে এসেছে। জেনেও সুধা হাল ছাড়ে নি, বিশ্বাস হারায় নি, আশা বাদ দেয় নি। মরে তো সুধা তবে যায় নি, আজ সে মদ খেয়ে এসেছে। জেনেও, যা সে ভাবছিল এতক্ষণ। তার প্রতিজ্ঞা-ভঙ্গের আঘাত পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে আঘাত। সামলে নিয়ে সুধা তো আবার আশা করছে। আজ পারে নি, কাল হয়তো পারবে, কিংবা দুদিন-দশ দিন না পেরে ক্ৰমে ক্ৰমে একদিন হয়তো পারবে, ইতিমধ্যেই এই বিশ্বাস সৃষ্টি করে সুধা জীবনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রচনা করছে বাঁচবার অপরাজেয় প্রেরণায়!

মরা সোজা, তাই সে ভেবেছিল আজ যদি সে মদ খায়, সুধা সোজাসুজি মরবে। সে কি জানত জীবনকে এত বেশি শ্রদ্ধা করে সুধা যে, মরা সহজ মনে হলেও বাঁচবার জন্য সে এমনভাবে লড়বে চরম হতাশায় আশা না ছেড়ে, ব্যর্থতার পরম প্রমাণকে শেষ বলে ধরে না নিয়ে? সাধারণ পতিপ্রাণা বৌ বলে সুধাকে জানত অক্ষয়। তাকে অসাধারণ সে ভাবতে পারে না এখনো। কিন্তু জীবনে আজ প্রথম জীবনযুদ্ধে সাধারণ একটি নারীর স্বাভাবিক সংগ্রাম শক্তির স্বরূপ আঁচ করে সে স্তম্ভিত, অভিভূত হয়ে যায়।

বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি তোমার?

হচ্ছে বৈকি, বাঃ! খাও।

সত্যি বলছি, খাই নি আজ। তোমার কাছে কিছু গোপন করব না। খাই নি বটে, কিন্তু তাতে আমার বাহাদুরি নেই। খাব না বলেছিলাম বলে খাই নি, তা সত্যি নয়। খাবার জন্য হোটেলের। দরজা পর্যন্ত গিয়েছিলাম। অন্য দিনের চেয়ে বেশিই হয়তো আজ খেতাম সুধা। কিন্তু এমন ব্যাপার আজ দেখলাম, যাদের মেয়েৰ্শোকা ভাবপ্রবণ ফাজিল ছোকরা বলে জানতাম, তাদের এমন অদ্ভুত মনের জোর দেখলাম, আমি একেবারে থতমত খেয়ে গেলাম সুধা। বুঝলাম যে, আমি যা ভাবি সব ভুল। মদ খেতে হোটেলের দরজা পর্যন্ত গেলাম, কিন্তু তখনো ভাবছি, গুলি খেলে মরতে হবে জেনেও সাধারণ একটা ছেলে যে গুলি খাবার জন্য তৈরি, ওটা কিসের নেশা? মদ না খেয়েও যদি মানুষের ওরকম নেশা হতে পারে, আমি তবে কেন বোকার মতো গাঁটের পয়সা খরচ করে এই সস্তা বিশ্রী নেশা করি! ওই ছেলেগুলোর জন্য আজ খেতে পারলাম না। আমার মনের জোরের জন্য নয়।

বেশ তো, বেশ তো, সুধা বলে শ্ৰান্ত, ক্লান্ত ব্যাহত গলায়, শুনবখন সব কথা কাল। খেয়ে নাও।

অক্ষয় স্তম্ভিত হয়ে থাকে। সুধা এখনো বিশ্বাস করে নি! তার কথা আবোল-তাবোল ঠেকছে। সুধার কাছে। তার কথা শুনে সুধার বিশ্বাস শুধু আরো দৃঢ় হয়েছে যে আজ সে অন্য দিনের চেয়ে। বেশি মদ খেয়েছে, হৈচৈ করার স্তর পার হয়ে উঠে গিয়েছে দার্শনিকতার স্তরে।

মদ খেলে মুখে গন্ধ থাকবেই সুধা।

কেন ভাবছ। গন্ধ কেউ পাবে না। কাল সকালে সেই গার্গল আর–

গন্ধ পাচ্ছ?–অক্ষয় মুখের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে সুধাকে নিশ্বাসের গন্ধ শোকায়! আগেই এ প্রমাণ তার দেওয়া উচিত ছিল সুধাকে। ভাবপ্রবণ, অভিমানী, বিকারগ্রস্ত মন তার, তাই না সে চেয়েছে বড় বড় কথার প্যাচে সুধাকে বিশ্বাস করাতে রাতদুপুরে যে ধরনের কথা বললে অজানা লোকেরও সন্দেহ হবে লোকটা মাতাল।

সত্যি খাও নি তো তুমি!

সত্যি খাই নি।

মুখের চেহারা বদলিয়ে সুধা তার দিকে চেয়ে থাকে। এতক্ষণে বিশ্বাস করেও সে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না তার এত বড় সৌভাগ্য কি করে সম্ভব।

একদিন না খেলে কি হয়?

তা ঠিক।

সহজভাবেই সায় দেয় অক্ষয়। তার অভিমানও হয় না, রাগও হয় না। একদিন প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করলে সুধা সেটা সহ্য করে এই জন্য যে, একদিন প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করা চরম নয়, শেষ পর্যন্ত প্ৰতিজ্ঞাটা আসল কথা। এটা অক্ষয় আজ জেনেছিল খানিক আগে। তাই একদিন আজ সে মদ খায় নি এটা যে অসাধারণ ব্যাপার কিছু নয়, কাল পরশু তরশু যদি না খেয়ে থাকতে পারে তবেই জানা যাবে সে সত্যই সত্যই জয়ী হয়েছে, সুধার এই ইঙ্গিত তাকে ক্ষুণ্ণ করে না। সুধা ঠিক কথাই বলেছে। কেউ ঠিক কথা বললে খুশি না হওয়া বোকামি।

বোকামিকে প্রশ্রয় দিতে আজ রাত্রে অন্তত অক্ষয় একেবারেই রাজি নয়!

মাকে প্রণাম করার ঝেকটাও তার কেটে গেছে। এমন এক জায়গায় উঠে গিয়েছিল তার মনটা সেখানে কোনো মনেরই বাস্তব আশ্রয় নেই, সুধার কল্যাণে সেখান থেকে নেমে এসে সে এখন বুঝতে পারছে সে মদ খেয়ে আসে নি বলে রাতদুপুরে মাকে ঘুম থেকে তুলে প্রণাম করতে গেলে সে পাগলামিকে লোকে চেনা মাতালের মাতলামিই মনে করবে।

অনেক দিন পরে এমন সাদাসিধে সহজ কথা সাদাসিধে সহজভাবে ভাবতে বড় ভালো লাগে তার। যদিও রোগের অস্বস্তি, সবকিছু থেকে বঞ্চিত হবার, সবকিছু ফুরিয়ে যাবার উৎকট অনুভূতি, মনকে খিচে রাখা পুঞ্জ পুঞ্জ অন্ধ আতঙ্ক সে মাথা কপাল খুঁড়লেও আজ রাত্রে এক চুমুক পাওয়া যাবে না, এসব পুরোমাত্রায় বজায় আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *