অমৃত মজুমদার তার বালীগঞ্জের বাড়িতে ফিরে আসে রাত প্রায় দশটার সময়। বিষণ্ণ, হতাশ, গম্ভীর, পরিশ্রান্ত এবং দিশেহারা অমৃত মজুমদার। ছাত্রদের বসন্ত রায়ের বাণী শোনাবার জন্য পুলিশ-লরিতে ওঠবার সময় তার রীতিমতো কষ্ট হয়েছিল, কিন্তু নামবার সময় কি করে যেন ব্যথা লেগেছিল বাঁ দিকের কুঁচকিতে। বিশেষ কিছু নয় তবু ব্যথা তো। বা হাঁটুর বাতের ব্যথাটাও আছে খানিক খানিক। এসব জিমন্যাস্টিক কি পোষায় তার? কি যেন হয়েছে দেশে। এতকাল রাজনীতি করে এসেও আজ যেন তার বাঁধা লেগে যাচ্ছে, ব্যাপারটা বুঝেই উঠতে পারছে না হঠাৎ কোন দিকে গতি নিচ্ছে রাজনীতি। কোনো হলে বা পার্কে মিটিং কর, বক্তৃতা করবে। সংগ্রামের আহ্বান এলে তখন সগ্রাম করবে। মোটরে গিয়ে মঞ্চে উঠে যা করার করা যায় সে অবস্থায়। তা নয়, রাস্তায় ওরা এমন কাণ্ড বাধিয়ে বসে আছে যে, লরিতে উঠে দাঁড়িয়ে কথা বলতে হয়।
সে কথা শোনে না পর্যন্ত কেউ।
কি হল? সাগ্রহে জিজ্ঞেস করে মিসেস অরুণা মজুমদার, বলবার সুযোগ দিয়েছিল তো তোমাকে?
সব বৃত্তান্ত শুনে অরুণা তার রোগা করা মোটা দেহটি সোফায় এলিয়ে দিয়ে গভীর হতাশার সঙ্গে বলে, তুমি একটা পাগল, তুমি একটা ছাগল। তুমি কোনোদিন কিছু করতে পারবে না।
আমি কি করব? বসন্ত বাবু গেলেন না–
অরুণা ফোঁস করে ওঠে মনের জ্বালায়, বসন্তবাবু যে গেলেন না, সেটা যে তোমার কত বড় সুযোগ একবার খেয়ালও হল না তোমার? একবার মনেও হল না এই সুযোগে একটু চেষ্টা করলে এক রাত্রে তুমি নেতা হয়ে যেতে পার? একেবারে ফাকা ফিল্ড পেলে, কেউ তোমার কম্পিটিটর নেই, আর তুমি কিছু না করেই চলে এলে? তুমি সত্যি পাগল। সত্যি তুমি ছাগল। তোমাকে দিয়ে কিছু হবে না, কোনোদিন কিছু হবে না।
আমার কি করার ছিল?
আমি বলে দেব তোমার কি করার ছিল? কুঁসতে থাকে অরুণা ক্ষোভে দুঃখে, তুমি না দশ বছর পলিটিকস করছ? তুমি না সব জান সব বোঝ, অন্যে তোমার বুদ্ধি ভাঙিয়ে খায়? একবার উঠতে পারলে সারা দেশটাকে মুখের কথায় ওঠাতে বসাতে পার? আমার কাছে যত তোমার লম্বা চওড়া কথা, বন গায়ে শ্যাল রাজা। সবাই ওঁকে দাবিয়ে রাখে তাই উনি উঠতে পারলেন না, নামকরাদের তাবেদার হয়ে রইলেন। নিজের বুদ্ধি নেই ক্ষমতা নেই, অন্যের দোষ।
অমৃতের ফাপর-ফাপর লাগে, দশ বছরের বিফলতা বাতাসকে যেন ভারি করে দিয়েছে মনে হয়। কতভাবে কত চেষ্টা করল, কত চাল কত কৌশল খাটাল, মরিয়া হয়ে কত আশায় জেলে গেল, কিন্তু না হল নাম, না জুটল প্রভাব প্রতিপত্তি, বড় নেতা হওয়ার সৌভাগ্যও হল না এতদিনে। পাণ্ডাদের সঙ্গে মিলতে মিশতে পায়, সাধারণ বৈঠকে যোগ দিয়ে কথা বলতে পায়, সভায় মঞ্চে দাঁড়িয়ে দু-চার মিনিট বলতেও পায় তেমন সভা হলে বেশিক্ষণ। পরদিন খবরের কাগজ কেনে অনেকগুলি, সাগ্রহে সভার বিবরণ পাঠ করে। নিজের নাম খুঁজে পায় না কোথাও। যদি বা পায়, সে শুধু আরো নামের সঙ্গে উল্লেখ মাত্র।
অরুণার সঙ্গে তর্ক বৃথা। কিন্তু কিছু তাকে বলতেই হবে, না বলে উপায় নাই।
কথাটা তুমি বুঝছ না, অমৃত বলে কৈফিয়ত দেওয়ার সুরে, পাণ্ডারা যা ঠিক করলেন তার বিরুদ্ধে কি যাওয়া যায়? আমার নিজের কিছু করতে যাওয়া মানেই ওঁদের বিরোধিতা করা। এঁরা চটে যাবেন না তাতে? আমাকেই যে পাঠালেন বাণী দিয়ে, সেও তো একটা বড় সম্মান। কত বিশ্বাস করেন বল তো আমাকে। এত বড় একটা দায়িত্ব।
এরকম দায়িত্ব পালনের অনুগত ভক্ত না থাকলে কি পাণ্ডাগিরি চলে?
বীণার এই ঘরে ঢাকার মন্তব্য আরো কাহিল করে দেয় অমৃতকে। মায়ের মতোই হয়ে উঠেছে মেয়েটা। স্বামী পায় নি এখনো, বাপের ওপরেই কথার ঝাল ঝাড়ে।
চুপ কর বীণা। যা এ ঘর থেকে। অরুণা ধমক দেয়। বীণা অবশ্য যায় না। সে বুঝতে পারে, মার সঙ্গে বাবার খাঁটি বিবাদ বাধে নি, বাবাকে দিয়ে মা কিছু করিয়ে নিতে চান। লাগাম চাবুক সব তাই মা সম্পূর্ণ নিজের আয়ত্তে রাখতে চান, অন্য কারো এতটুকু হস্তক্ষেপ তার পছন্দ নয়। বীণা তাই একটু তফাতে চুপচাপ বসে পড়ে।
এবার কথার ঝাঁঝ বাদ দিয়ে গম্ভীরভাবে অরুণা বলে স্বামীকে, ওটা কর্মীর দায়িত্ব। তুমি তবে দুঃখ কর কেন? বিশ্বাসী দায়িত্ববান কর্মীর সম্মান তো পাম্। নেতা হবার শখ কেন তবে?
কি জানি।
যাক গে। এবার পলিটিক্স ছেড়ে দাও। কাজ নেই আর তোমার পলিটিক্স করে। ওসব তোমার কাজ নয়। মুখ-হাত ধুয় এস।
কি বলতে চাও তুমি? স্ত্রীকে নরম দেখে অমৃত এবার ক্রুদ্ধ, তোমরা ভাব আমি বোকা, হাবা গোবেচারি ভালোমানুষ, ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানি না। এ বাড়ি করেছে কে? ঠাকুর, চাকর, দারোয়ান নিয়ে শাড়ি গয়না পরে এত যে আরামে আছ তোমরা–
বীণা? অরুণা বলে দৃঢ়স্বরে, তোর এত রাত হল কেন বাড়ি ফিরতে? কোথা গিয়েছিলি?
বীণা জবাব দেয় না। সে জানে এটা আসলে তার বাবার কথার জবাব, বাবাকে ধমক দিয়ে চুপ করানো। নইলে বাড়ি ফিরতে এমন কিছু রাত তার হয় নি যে কারণ জানবার জন্য মা মাথা ঘামাবে। অমৃত একটা চুরুট বার করে ধরায়। অরুণা কি হাল ছাড়ল? বাইরের জগৎ থেকে জীবনকে এবার সে ঘরের সীমায় এনে রাখবে ঠিক করেছে? অথবা আরো কিছু বলার আছে তার?
ঠিক বুঝে উঠতে পারে না বলে অমৃত আবার পুরোনো কথাটাই জিজ্ঞেস করে, আমার কি করার ছিল?
তোমার? তোমার বোঝা উচিত ছিল দশ বছর যে সুযোগ খুঁজছ এ্যাদ্দিনে তা এসেছে। বড়রা কেউ হাজির নেই গুলিগোলার ভয়ে, তুমি যা যা বলবে তুমি যা করবে কেউ তা ভেস্তে দিতে পারবে না। বাণী যখন ওরা মানল না, তোমার উচিত ছিল ঘোষণা করা যে তুমি ওদেরই পক্ষে। জোর গলায় বলা উচিত ছিল, দশ বছর পনের বছর দেশের সেবা করছ, জেল খাটছ, কিন্তু আদর্শের চেয়ে বড় কিছু নেই তোমার। তাই, তুমি দায়িত্ব নিচ্ছ মিটমাটের ব্যবস্থা করার, এজন্য যদি প্রাণ বিসর্জন দিতে হয় তোমাকে–
কিসের মিটমাট? অমৃত বলে আশ্চর্য হয়ে।
তা দিয়ে তোমার কি দরকার? তুমি দায়িত্ব নিতে মিটমাটের মিটমাট হোক বা না হোক তোমার কি এসে যায়? ওদের সঙ্গে কথা বলতে, অফিসারদের সঙ্গে কথা বলতে, এদিক-ওদিক ছুটোছুটি করতে, ব্যস, তোমার কাজ হয়ে গেল। দুদিন পরে দেশের লোকের মনের গতি বুঝে অবস্থা বিবেচনা করে তুমি জোর গলায় বলতে, তুমিই বিপদ ঠেকিয়েছ, তুমিই আন্দোলনটা সফল করেছ, তুমিই চেষ্টা করেছ দাবি আদায়ের।
একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে চুপ করে থাকে অমৃত। আগেও অনেকবার তার মনে হয়েছে, আজো মনে হয়, অরুণাকে সামনাসামনি পলিটিসে নামিয়ে সে যদি পিছনে থাকত, এতদিনে হয়তো প্রবল প্রতিপত্তি আয়ত্ত করা যেত রাজনীতির ক্ষেত্রে। নিজে দেশনেতা না হতে পারলেও অদ্ভুত দেশনেত্রীর স্বামী হওয়া যেত।
এখনো সময় আছে।
অরুণার মৃদু, সংক্ষিপ্ত, সুদৃঢ় ঘোষণায় হৃৎকম্প হয় অমৃতের!
এখুনি তুমি যাও আবার, অরুণা বলে উৎসাহের সঙ্গে, পাণ্ডারা শুয়ে শুয়ে ঘুমোক। গিয়ে পুলিশকে বলবে তুমি মিটমাট করতে এসেছ, সবাইকে বাড়ি ফিরে যাবার আবেদন জানাবে। তাহলে বলবার সুযোগ পাবে। কিন্তু খবরদার বলতে উঠে যেন ওদের শান্তভাবে বাড়ি ফিরে যেতে বোলো না। ওদের বীরত্বের প্রশংসা করে, ওরাই যে দেশের ভবিষ্যৎ, এসব কথা বলে আরম্ভ করবে। তারপর খুব ফলাও করে বলবে ওদের দাবি যাতে মেনে নেওয়া হয় সেজন্য তুমি কত। ছুটোছুটি করেছ। বলবে, ভাই সব, তোমাদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে গুলির সামনে বুক পেতে দেবার। গৌরব আমার জুটল না, কারণ বিদেশী সরকারের গুলি যাতে আমার দেশের ভাইদের বুকে না। লাগতে পারে, সেই চেষ্টা করাই বড় মনে হয়েছিল আমার। তোমাদেরই বাঁচাতে চেয়েছিলাম। আমি। গুলি যখন চলেছে, তোমাদের যখন বাঁচাতে পারি নি, তখন আজ থেকে, এই মুহূর্ত থেকে আমার জীবনপণ ব্ৰত হল দেশকে স্বাধীন করা। তোমরা অনেক বক্তৃতা শুনেছ, আমি ভালো বক্তৃতা দিতে পারি না, কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি ভাই সব, বক্তৃতার দিন আর নেই, এখন আমরা সবাই মিলে–
অরুণা অসহায়ের মতো হঠাৎ থেমে যায়। চল্লিশ কোটি কালো নরনারী তার বক্তৃতা শুনছিল। হঠাৎ সামান্য একটা কারণে, নিজের মুখ থেকে বার করা সবাই মিলে কথাটার প্রতিক্রিয়াগত। সাংঘাতিক আঘাতে সে মরণাপনের মতো কাবু হয়ে যায়। স্বামীর জীবনকে সার্থক করা গেল না। বসে বসে তাকে যদি বক্তৃতা শেখাতে হয় স্বামীকে, এতক্ষণ শেখাবার পর এখন যদি আবার বলে দিতে হয় নিজের কথা সংশোধন করে যে, না, সবাই মিলে এ কথাটা বোলো না, তবে সে কি করতে পারে, সামান্য সে মেয়েমানুষ!
এতক্ষণ পরে বীণা কথা বলে, কি হল মা? তোমার সেই হার্টের ব্যথাটা হয় নি তো?
ডাক্তার বছর দেড়েক আগে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে গিয়েছিলেন অরুণার হার্টের ব্যথাটা আবার। যদি জাগে জীবনের সহজ নিয়ম রীতিনীতি পালন না করার জন্য, তবে জগতের কোনো ডাক্তার এ দায়িত্ব নিতে পারবেন না যে, হার্টফেল করে মিসেস অরুণা মজুমদারের আকস্মিক মৃত্যু ঘটবে না।
আমি ঠিক আছি, অরুণা বলে, যাবে তুমি? যাবে? পারবে এ সুযোগ নিতে? দশ বছর কাঙালের মতো যা চেয়েছ, আজ তা আদায় করে নিতে পারবে? যাবে কিনা বল।
যাচ্ছি যাচ্ছি, অমৃত বলে, এখুনি যাচ্ছি।
বীণা, হালিমকে বল গাড়ি বার করুক—এই দণ্ডে। খেতে বসে থাকলে বলবি পৌঁছে দিয়ে এসে খাবে। যদি না ওঠে, কাল থেকে বরখাস্ত। যাও না তুমি? দশ বছরে মুটিয়েছ বেলুনের মতো, একটা দিন একটু খাট?
যাচ্ছি, যাচ্ছি, এখুনি যাচ্ছি, বলে অমৃত।
হালিম খেতে বসে নি। তার যৌবনান্তের দিনগুলিতেও অনেক সমস্যা। আজ সে অনেক ঘুরেছে গাড়ি নিয়ে এত পেট্রোল বাবু কোথা থেকে যোগাড় করেন তা মাথায় ঢেকে না। বড় বড় লোকের সঙ্গে কারবার বাবুর, বাবুর কথাই বোধহয় আলাদা। অন্যদিন হয়তো রাগ করত। হালিম এত খাটুনির পর আবার এখন গাড়ি বার করবার হুকুম শুনলে, আজ সে কথা কয় না, অমৃতকে নিয়ে অসম্ভব স্পিডে গাড়ি চালিয়ে দেয়।
বাড়িতে বীণা তখন বলছে ব্যাকুলভাবে, মাগো, ওমা, কি হল তোমার? কেন এমন করছ? ওমা, মা–
ডাক্তার বার বার বলেছিল, সাবধান সাবধান। এ কোন মরীচিকার লোভে মা সে কথা ভুলে গেল। নিজের মরণ ডেকে আনবার মায়ের অদ্ভুত পাগলামির কথাই বীণা ভাবে ভাইবোনের সঙ্গে মায়ের মৃতদেহ আগলে বাপের প্রতীক্ষায় বসে থেকে। খাওয়াদাওয়ার প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয়ে এমন নিখুঁত সতর্কতা, মনে এত উদ্বেগ অশান্তি ক্ষোভ জমা করবার কি দরকার ছিল? এত পেয়েও সাধ মিটল না, যশ মান প্রতিপত্তির উগ্র কামনায় পুড়তে পুড়তে মরতে হল শেষে? ক্ৰমে ক্ৰমে যেন পাগল হয়ে উঠেছিল মা তার বাবাকে বড় একজন নেতা করার জন্য। এতই কি প্রচণ্ড নেতৃত্বের মোহ মানুষের যে বাবার জীবনটা তার ভরে ওঠে আত্মগ্লানি আর হতাশায় তবু তিনি থামতে পারেন। না, মাকে তার জীবনটা দিতে হয়। মা যেন তার আত্মহত্যা করেছে মনে হয় বীণার। নিঃশব্দ অঞর ধারা গড়িয়ে পড়তে থাকে বীণার গাল বেয়ে, ভাইবোনদের মতো সে চেঁচিয়ে কাঁদতে পারে না।
এদিকে গাড়ির গতির মতোই দ্রুত হয়ে ওঠে অমৃতের চিন্তার গতি। তাড়াতাড়ি মনে মনে সে আউড়ে নিতে থাকে ওখানে গিয়ে কি বলবে আর কি করবে, কোন কৌশলে কাজ হবে বেশি। অনেক দিন পরে হঠাৎ আজ যেন তার আত্মবিশ্বাস সজীব হয়ে উঠেছে মনে হয়, বেশ খানিকটা সে উত্তেজনা বোধ করে। অরুণা ঠিক কথাই বলেছে এসব সুযোগকে কাজে লাগিয়েই মানুষ জনসাধারণের মনে আসন পাতে, নেতা হয়। নানা সম্ভাবনা উঁকি দিয়ে যেতে থাকে অমৃতের মনে। একটা চিন্তা তাকে বিশেষভাবে উত্তেজিত করে তোলে, লোভ ও ভয়ের আলোড়ন তুলে দেয়। একটা কাজ সে করতে পারে, অতি চমকপ্রদ নাটকীয় একটা কাজ, সাধারণের মনকে যে ধরনের ব্যাপার প্রবলভাবে নাড়া দেয়। আজকের ঘটনা নিয়ে সে আন্দোলন করবে, একথা সে জানাবে। কিন্তু আরো সে এগিয়ে যেতে পারে। সে ঘোষণা করতে পারে যে গুলি চালানোর প্রতিবাদ এবং ওদের দাবির সমর্থনে এখন এই মুহূর্তে সে ওদের সঙ্গে যোগ দিল–তারপর ওদের মধ্যে গিয়ে। পথে বসে পড়তে পারে। পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারে তাকে। তাহলে তো আরো ভালো হয়।
চারিদিকে সাড়া পড়ে যাবে তাকে নিয়ে। কাগজে বড় বড় হরফে তার নাম বেরোবে…
বেরোবে কি? এই বিষয়েই মস্ত খটকা আছে অমৃতের মনে! নিজে নিজে সে এতখানি এগিয়ে গেলে বড়রা চটবেন সন্দেহ নেই। সে আন্দোলন করবে, ওদের হয়ে লড়বে, এইটুকু ঘোষণা করার জন্যই চটবে। ওরা চটলে কোনো বড় কাগজে তার নাম বেরোবে না। সে নিজে কোনো বিবৃতি দিলে তাও ছাপা হবে না। তারপর, সে যদি একেবারে রাজপথে গিয়ে বসে পড়ে ওদের মধ্যে ওদের সঙ্গে যোগ দিয়ে, রাগে হয়তো চোখে অন্ধকার দেখবেন চাইরা। আজকের ঘটনাকে তারা কিভাবে নেবেন, কিভাবে নিতে বাধ্য হবেন, এখন সঠিক অনুমান করে বলা যায় না। কিন্তু বড়দের মনোভাবের খানিকটা ইঙ্গিত আজকেই অমৃত পেয়েছে। এঁরা যতটা সম্ভব উদাসীন থাকতে চান, ঘটনাটিকে বেশি গুরুত্ব দিতে চান না। এই দলাদলির দিনে কোনো একটি বিশেষ দলের বাহাদুরি নেবার চেষ্টা বলে হয়তো ব্যাপারটা উড়িয়ে দেবেন। তাহলেই বিপদ অমৃতের। হয়তো তাকে দল থেকে রিজাইন দিতে হবে। নয়তো আজকের প্রকাশ্য ঘোষণা হজম করে ফেলে সরে দাঁড়িয়ে তলিয়ে যেতে হবে তলে।
কিন্তু কথাটা হল কি অমৃত হিসাব কষে যায় প্রাণপণে মাথা ঠাণ্ডা রাখবার চেষ্টা করে সে বিপদ নয় ঘটল, নেতারা নয় বর্জন করলেন তাকে, অন্যদিকে লাভ হবে নাকি কিছুই? হৈচৈ কি হবে না তাকে নিয়ে? অন্য দলে গিয়ে কি করতে পারবে না কিছু? এতকাল নেতাদের মুখ চেয়ে থেকে তো কিছু হল না, সরে গিয়ে অন্য চেষ্টা করে দেখলে ক্ষতি কি? কিন্তু সে সুযোগ যদি না পায়? যদি ফসকে যায় তার আজকের রাজনৈতিক স্ট্রাটেজি? তখন এদিকও যাবে, ওদিকও যাবে।
নরম ঘোষণাটা জানিয়ে বাড়ি ফিরে গেলে পরিস্থিতি যাই দাঁড়াক সে সামলে নিতে পারবে। কিন্তু গরম ঘোষণা আর চরম কাজটার মতো ফল তাতে হবে না–ওতে একরাত্রেই হয়তো সে বিখ্যাত ও জনপ্রিয় হয়ে যেতে পারে। কি করবে ঠিক করে উঠতে পারে না অমৃত। অরুণা কাছে নেই বলে বড় তার আফসোস হয়। অরুণার সঙ্গে একটু পরামর্শ করতে পেলে একটা সিদ্ধান্ত করে ফেলা যেত!
পাশের রাস্তা দিয়ে মোড়ের কাছাকাছি এসে অমৃতের গাড়ি থামে। ভিড় এখন বিশেষ নেই। অমৃত গাড়ি থেকে নেমে চলতে আরম্ভ করেছে, বোতাম খোলা কোট গায়ে লম্বা একটি যুবক এগিয়ে এসে তার সামনে দাঁড়ায়।
অমৃতবাবু, একটা কথা আছে।
আপনাকে তো–?
আমায় চিনবেন না। আপনার স্ত্রী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, আপনি এখুনি বাড়ি ফিরে যান। আপনার বাড়ি থেকে টেলিফোনে খবর পেয়ে সুব্রত এসেছিল–আপনার মেয়ে টেলিফোন করেছিলেন। আপনাকে জানাতে বলে সুব্রত আপনাদের বাড়ি চলে গেছে।
অসুস্থ হয়ে পড়েছেন? কি হয়েছে? কিন্তু আমি যে এদিকে
অমৃতের অনিচ্ছুক, ইতস্তত ভাব অদ্ভুত লাগে মনমোহনের। তারপর সে ভাবে, তার কথা থেকে অমৃত হয়তো খবরটার গুরুত্ব ধরতে পারে নি। সে বলে, হঠাৎ হার্টের এ্যাটাক হয়েছে। শুনলাম। অবস্থা ভালো নয়। আপনি এখুনি চলে যান।
হার্টের এ্যাটাক অরুণার পক্ষে মারাত্মক হওয়া আশ্চর্য নয়। বাড়ি থেকে বেরোবার সময় তাকে সুস্থ দেখেছিল বটে, কিন্তু হার্টের ব্যাপার হলে দু-চার মিনিটে অবস্থা খারাপ দাঁড়ানো সম্ভব। কিন্তু এদিকের ব্যবস্থা তবে কি করা যায়? চরম সিদ্ধান্তটা আজ তবে বাদ দিতেই হল। তাড়াতাড়ি তার কথাগুলি বলে নিয়ে বাড়িই তাকে ফিরে যেতে হবে। অরুণার অসুখের কথাটাও উল্লেখ করে বলতে পারবে যে, ওদের এ অবস্থায় রেখে ফিরে যেতে তার প্রাণ চাইছে না, কিন্তু স্ত্রীর কঠিন অসুখের জন্য একান্ত নিরুপায় হয়েই–
আমি কিছু বলতে এসেছি আপনাদের। মিনিট দশেক বলেই শেষ করে বাড়ি যাব।
আপনাদের কোনো অ্যানাউন্সমেণ্ট?
ঠিক তা নয়, আমি নিজেই কিছু বলব। দেশজোড়া একটা আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে এ ব্যাপার নিয়ে, আমি বলে দিতে চাই যে, সে আন্দোলন গড়ে তুলতে আমার যতখানি ক্ষমতা আছে। সব আমি কাজে লাগাব।
নিজেকে হঠাৎ বড় শ্ৰান্ত মনে হয় মনমোহনের। অসীম ধৈর্যের সঙ্গে ভাষা ও গলার গুরুত্বপূর্ণতা বজায় রেখে সে বলে, এখন বলা কি ঠিক হবে? কেউ বক্তৃতা শোনার মতো অবস্থায় নেই। কাল মিটিং হবে, সেখানে বলাই ভালো হবে।
আমায় বলতে দেবেন না তাহলে?
বলতে চাইলে বাধা দেব কেন? বলা উচিত কিনা আপনিই বুঝে দেখুন। আমাদের মরাল ঠিক আছে, আপনার বক্তৃতার ফলে বড়জোর কয়েকজনের উত্তেজনা বাড়বে। তার চেয়ে আপনি যদি কাল পাবলিকের কাছে বলেন আপনার কথা, তাতে বেশি কাজ হবে।
বাড়িতে ও গাড়িতে যে উৎসাহ ও উত্তেজনা বেড়ে উঠেছিল, এখন তা অনেকটা ঝিমিয়ে গেছে। চারদিকে চোখ বুলিয়ে অমৃতের কেমন অস্বস্তি বোধ হয়, একটু ভয়ও করে। সশস্ত্র আক্রমণ ও নিরস্ত্র প্রতিরোধের যে সংঘর্ষ হয়ে গেছে তারই আলোয় এখনকার শান্ত পরিস্থিতিকেও অমৃতের অপরিচিত, ধারণাতীত মনে হয়। সে অনুভব করে, তার এতদিনকার অভিজ্ঞতার সঙ্গে খাপ খায় না। আজকের অবস্থা, তার জানাশোনা ধরাবাধা পুরোনো নিয়মে আজকের ঘটনা ঘটে নি। তার পক্ষে এই অবস্থার সঙ্গে এঁটে ওঠা কঠিন হয়তো অসম্ভব।
ফিরে গিয়ে গাড়িতে উঠে বসে নিজেকে অমৃতের মৃত মনে হয়।
হালিম জোরে চালাও।
মাথাটা ঝিমঝিম করে ওঠে অমৃতের, চোখের সামনে কতগুলি তারা ঝিকমিক করে ওঠে।
একটু দূরে দূরেই থাকে অজয়, তফাত থেকে উদাসীনের মতো দ্যাখে।
মনে তার নালিশ নেই, ক্ষোভ জমা হয়ে আছে প্রচুর। তার উনিশ বছরের মনটা অভিমানে জর্জর।
ওরা শোভাযাত্রা করে এসে বাধা পেয়ে এখানে বসেছে রাস্তায়, এই নতুন উত্তেজনায় আরো মজাদার হয়েছে ওদের দল বেঁধে রাস্তায় নেমে মজা করা। বেশ খানিকটা হৈচৈ হবে চারিদিকে এই ব্যাপার নিয়ে। বড় বড় লোকেরা ছুটোছুটি করবে বড় কর্তাদের কাছে, আলাপ-আলোচনা চলবে কিছুক্ষণ; তারপর মিটমাট হবে আপস মীমাংসায়। গর্বে বুক ফুলিয়ে বাড়ি ফিরবে সবাই, আত্মীয়বন্ধু পাড়াপড়শির কাছে, মেসে হোটেলে চায়ের দোকানে, সচকিতা মেয়েটির কাছে, বলে বেড়াবে ওরা কিভাবে সংগ্রাম করেছে–সগ্ৰাম! আট মাস আগে হলে সেও যেমন হয়তো থাকত ওদের মাঝে, বাড়ি গিয়ে মাধুকে শোনাত সগ্রামের কাহিনী, চোখ বড় বড় করে অবাক হয়ে চেয়ে থাকত মাধু!
আজ সে ওদের মধ্যে নেই। সে আর কলেজের ছেলে নয়। হাজার দুঃখদুর্দশার মধ্যেও হাসিখুশি আশা স্বপ্নের ওই নিশ্চিন্ত সুখের জীবন তার ফুরিয়ে গেছে, শোভাযাত্রা করে এসে লাঠি বন্দুকের বাধা মানব না বলে রাস্তায় বসে পড়ার মজা আর তার জন্যে নয়। সে এখন চাকুরে, কেরানি। মাসকারি চল্লিশ টাকা বেতনটাই এখন তার আশা আনন্দ ভবিষ্যৎ হাওড়ার ওই বস্তিঘেঁষা নোংরা পুরোনো ভদ্রপল্লীর ওই টিনের চাল মাটির দেয়াল আর লাল সিমেন্টের মেঝেওয়ালা বাড়িটার অংশটুকুতেই আটকে গেছে জীবন তার চিরদিনের জন্য, এই ঘরে-কাচা আধময়লা জামাকাপড় আর সস্তা হেঁড়া রংচটা আতোয়ানটি তার শুধু বেশভূষা নয়, আগামী পরিচয়ও বটে।
এমনি লোকও বহু জুটেছে ওদের সঙ্গে, পথের রাজপথের সাধারণ পথিক। তার চেনা ওই ছোকরা পর্যন্ত দলে ভিড়েছে, আপিসের সামনে বিড়ির দোকানে যাকে সে বিড়ি বানাতে দেখে। আসছে গত কয়েক মাস। তবু অভিমান নরম হয় না অজয়ের। পথিকেরা ভিড় করেছে মজা। দেখতে, কৌতূহলের বশে। ওদের মধ্যে গিয়ে ভিড়লে তাকেও ওরা ভাববে দলের বাইরের ওই রকম কৌতূহলী পথিক, ওদেরই মতো সেও যে ছিল কলেজের ছাত্র মাত্র কয়েক মাস আগে, এ পরিচয় ঘোষণা করলেও ওরা তাকে আপন ভাবতে পারবে না। সে আর ছাত্র নেই, সে পর হয়ে গেছে। ওদের পাশে গিয়ে দাঁড়াবার দাবি তার নেই।
একটা বিড়ি টানতে ইচ্ছা করে। সঙ্গে নেই, কিনতে হবে।
বন্ধুদের কাছে সিগারেট মিলত, তার সঙ্গে নিজে দু-একটা কিনে চালিয়ে দেওয়া যেত একরকম। একটা সিগারেট তিনবারও রানো যায় নিভিয়ে রেখে রেখে। চাকরি নিয়ে পাঁচটা করে সিগারেট কিনছিল রোজ নিজের রোজগারের পয়সায়, কম দামি সিগারেট, পাঁচটা মোটে দুআনা এক বাণ্ডিল বিড়ির দাম। ছেড়ে দিতে হয়েছে। ট্রাম বাসের কটা পয়সা বাঁচাতে ব্রিজ থেকে যাকে হাঁটতে হয় আপিস পর্যন্ত, সে খাবে সিগারেট। বিড়ি ধরেছিল, ঘেন্নায় তাও ছেড়ে দিয়েছে। সিগারেট টানবার সাধ নিয়ে ক্ষমতার অভাবে টানতে হবে বিড়ি! ধোঁয়া খাওয়াই বন্ধ থাক তার চেয়ে!
মাধু বলেছিল শুনে, লাটসায়েবের মত একটা বাড়িতে থাকতে সাধ যায় না?
না।
মিথ্যে বোলো না!
সাধ আর স্বপ্নের তফাতটা মাধু এখন বোঝ না, এটাই আশ্চর্য! পেট ভরে ভাত খাওয়াও যেন সাধ, পোলাও খাওয়াও তাই। অথচ ওর বোঝা উচিত। দুটো পয়সা রোজগারের উপায় খুঁজে ছটফট করছে।
আঙুলে ধরা সিগারেট থেকে ধোঁয়া উঠছে, টানতেও যেন আলস্য লোকটার। দাঁড়াবার ভঙ্গিটাও আলসেমিতে ঢিল! কি হয় দেখবার জন্য দাঁড়িয়েছে কিন্তু আগ্রহের অভাবটা এমন স্পষ্ট। পাতলা পাঞ্জাবির পকেটে সিগারেটের রঙিন টিনটা দেখা যায়।
বিড়ি এক পয়সার কিনে একটা খেলে দোষ নেই। সাধ মিটিয়ে সিগারেট খাবার ক্ষমতা না। হলে সিগারেট হেবে না প্রতিজ্ঞা করেছে, বিড়ি কখনো খাবে না তা বলে নি নিজেকে। এমন বিশ্রী লাগছে ওদের দূরে থেকে দলভ্ৰষ্ট জাতনষ্ট পতিতের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে! একটা বিড়ি টানলে হয়তো একটু ভালো লাগত।
আজ নিয়ে পাঁচ দিন হল বিড়ি খায় না। বেশ কষ্ট হয়েছে না খেয়ে থাকতে, এখনো কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। খাবার ইচ্ছাটাও যে বেশ জোরালো আছে এখনো, সে তো বোঝাই যাচ্ছে। একটা বিড়ি খেয়ে পাঁচ দিনের লড়াইটা বাতিল করে দেবে। যাগে। কি হয় বিড়ি না খেলে।
বাবু? বাবু, শুনছেন? শিয়ালদহ যামু ক্যামনে?
এ এক আশ্চর্য ব্যাপার, অজয় ভাবে। গা থেকে যত গেঁয়ো মানুষ নতুন শহরে এসে ভ্যাবাঁচাকা খেয়ে যায়, সবাই যেন তারা হাঁ করে থাকে কখন অজয়বাবুর দেখা মিলবে, তাকে জিজ্ঞেস করে হদিস মিলবে পথঘাটের, মুশকিলের আসান হবে। কিছু জানবার থাকলে ভদ্রলোক তাকে এড়িয়ে জিজ্ঞেস করে অন্য লোককে, এরা সকলকে এড়িয়ে জিজ্ঞেস করে তাকে! এমন গেঁয়ো অজ্ঞ চাষা-ভূষোর মতোই কি দেখায় তাকে যে দেশগায়ের আপন লোক ভেবে ওরা ভরসা। পায়? ঘোমটাটানা ছোট্ট একটি কলাবৌ আর মাঝবয়সী একজন স্ত্রীলোকের সঙ্গে পাশের রাস্তায় খানিকটা ভেতরের দিকে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে লোকটি খানিকক্ষণ ধরে এদিক-ওদিক এর-ওর মুখের দিকে চাইছিল, এবার এত লোককে ডিঙিয়ে তার কাছে এসেছে।
একটু ঘুরে যেতে হবে বাপু।
পথ আর উপায় বাতলে দেয় অজয়, লোকটি মাথা চুলকোয়।
এস আমার সঙ্গে।
পাশের রাস্তা ধরে এগিয়ে ওদিকের মোড়ে রিকশা ডেকে ওদের তুলে দিয়ে অজয় নিজেও একটু ইতস্তত করে পথসংশয়ী পথিকের মতো। বাড়ি ফিরবে না ওখানে ফিরবে? সে ওদের নয়, তার পথ নয় ওদের পথ।
ইচ্ছে কিন্তু করছে ফিরে যেতে, ওরা কি করে দেখতে, শেষ পর্যন্ত কি হয় সঙ্গে থেকে জানতে। পরের মতোই না হয় সে দেখবে ওদের কার্যকলাপ, সে তো আর দাবি করছে না যে, মোটে আট মাস আমি ছাপ হারিয়েছি, আমায় তোমাদের মধ্যে ঠাঁই দাও!
গুলির আওয়াজটা তখন সে শুনতে পায়, কানে আসে তুমুল কলরব। সব ভুলে সে ছুটতে আরম্ভ করে, তার সমস্ত ক্ষোভ অভিমান পরিণত হয় একটিমাত্র ব্যাকুল প্রশ্নে, কি হল, কি হল? ভয়াতুর মানুষ ছুটে যায় তার পাশ কাটিয়ে বিপরীত দিকে, সে চেয়েও দেখে না। বরং তার একটা অদ্ভুত আনন্দ হয় যে এদের সংখ্যা বেশি নয়। দু-দশ জন পালাক, সকলে কি করছে দেখতে হবে।
তফাতে দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে দেখতে সে ভুলে যায়, সোজা চলে যায় ওদের কাছে, ওদের মধ্যে।