বেশ অনেক দিন অসুখে ভুগল গফুর। রইসের ঠিক তেরো বছরের মাথায় দুদিনের জ্বরে মারা গেল। কোনো কিছু ভাবার বা বুঝে উঠার অবকাশ ছিল না বুড়ির। অসুস্থ অবস্থায় ভীষণ জ্বালিয়েছে গফুর। কিন্তু মারা যাবার পর কেমন নিথর হয়ে গেল। বুড়ি। একটা লোকের অস্তিত্ব যখন নিঃশেষ হয়ে যায় সে তখন পরিবার পরিজনের সবাইকে অনুভবে গতিশীল করে। সে কারণেই গফুরের প্রতি প্রবল আকর্ষণ না থাকা সত্ত্বেও বুড়ির বুকের ভেতরের সবুজ বন হলুদ হয়ে যায়। লাল গোলাপের পাপড়িগুলো অকালে বাতাস ছাড়াই ঝরে যেতে থাকে। বুড়ি একলাফে বেশ বয়স্ক হয়ে যায়। মাথার চুল সাদায় ভরে ওঠে।
সলীম সংসারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়। ও আরো ধীর স্থির এবং গম্ভীর হয়েছে। সাংসারিক বুদ্ধিও খুব। অল্প কয়দিনেই সব গুছিয়ে ফেলে। জমিজমার হিসেব বোঝে চমৎকার। ধানের গন্ধে ও ছটফট করে। রাতে ঘুমোতে পারে না। ধান মাড়াইয়ের সময় সারারাত বারান্দায় বসে কাটিয়ে দেয়। সলীমের সব কিছু বুড়ির ভাল লাগে। রইস নির্বোধের মত বারান্দায় বসে থাকে। কখনো উড়ে যাওয়া পাখির দিকে তাকিয়ে হাততালি দিয়ে হেসে উঠে। বাঘার গলা জড়িয়ে ধরে। কুকুরটার সঙ্গে ওর ভারি ভাব। কুকুরটাও বেশির ভাগ সময় রইসের সঙ্গে সঙ্গে কাটায়। ওর আদর নেয়। ওর দিকে তাকালে বুড়ির আনন্দ নষ্ট হয়ে যায়। ও এখন বুড়ির সঙ্গে সুপপারি বাগানে যায় না কিংবা শাক তোলে না। বুডিও ডাকে না। বুড়ি আরো একলা হয়ে যায়।
কলীম চড়া গলায় গান গায়। ভাটিয়ালী সুরের আমেজ ওর গলায় অদ্ভুত আসে। বুড়ি মাঝে মাঝে মনোযোগ দিয়ে শোনে। ভাললাগে। বাপের মতো স্বভাব হয়েছে ওর। ভোর রাতে উঠে ডিঙি নিয়ে মাছ ধরতে যায়। ডাকাডাকি করে মাকে ওঠায়। জালটা আর খলুইটা যাবার সময় হাতে বুড়িরই তুলে দিতে হবে। নইলে ও কিছুতেই যাবে না। সন্ধ্যা রাতে বুড়ি জাল, খলুই ওর জন্যে গুছিয়ে রাখে। তাতে হয় না। ও বলে, তুমি আমার হাতে জাল তুলে না দিলে মাছ পাব না। বুড়ি জানে, এটাই কলীমের স্বভাব। ছোট থেকেই ওর ওপর এমনি আবদার করে আসছে। ভোর রাতে উঠতে অবশ্য বুড়ির খারাপ লাগে না। কলীম সুপারি বাগানের আড়াল থেকে চিৎকার করে, মা, মাগো আসি। তারপর লাফিয়ে ডিঙিতে ওঠে। তখন শুরু হয় গান। গান গাইতে গাইতে ও যখন আঁধারে মিলিয়ে যায় তখন অদ্ভুত একটা রেশ জেগে থাকে বুড়ির মনে। ভেসে আসা গানের ক্ষীণ সুর ধরে ও অনুভব করে এমন অনেক ভোর-রাত ওর নিজের স্মৃতির কৌটায় জমা আছে। একটুও নষ্ট হয়নি। একটুও দাগ পড়েনি। তবে গান গাইত না গফুর। বুড়ি সঙ্গে থাকত বলে। কেবল ওর হাতটা ধরে দ্রুত সুপারি বাগান পেরিয়ে যেত। কোন দিন সুপপারি বাগানের মাঝখানে জড়িয়ে ধরে চুমু খেত। বাদুরের পাখা ঝাপটানীতে ভয় পেয়ে গফুরের বুকের সঙ্গে মিশে যেত। বুড়ি কৌটার ঢাকনাটা বন্ধ করে দেয়। ভাবে, ছেলেদের জীবন এবং পারিপার্শ্বিকতায় কোন অসঙ্গতি নেই। সব ঠিক আছে। হাল বাওয়া, ধান বোনা, ধান কাটা, ধান মাড়াই, মাছ ধরা, ডিঙি বাওয়া। শুধু গফুর নেই। আর গফুর নেই বলে বিরাট কোন পরিবর্তন হয়নি। ওদের জীবনে ঝড় ওঠেনি। দারুণ রদবদলে দিকভ্রষ্ট হয়নি কেউ। কেবল একটা ছায়া আর উঠোনে পড়ে না। কাঁধের উপর জাল ফেলে কিশোরী বউয়ের হাত ধরে খালে যায় না। জলের সঙ্গে ভালবাসার খেলা গড়ে তোলে না। অনেক রাতে হাট থেকে ঘরে ফিরে বুড়ির নাম ধরে ডাকাডাকি করে না। এইসব ভেবে বুড়ির বুক যখন চেপে আসে তখন জলিলের কথা ভাবে। জলিলের ভাবনায় বুকের ভেতর অন্যরকম স্রোত অনুভব করে। সে স্রোতে ভেসে যায় পার্থিব যাবতীয় পঙ্কিলতা। জলিল মানেই অলৌকিক ঈশ্বর। বুড়ির নিরবচ্ছিন্ন প্রবহমান আনন্দ। যে আনন্দ ব্যতিক্রমী স্রোতে প্রবাহিত হয়ে ওকে অপার্থিব সুখ দেয় এবং প্রতিদিনের সংসারের বাইরে নিয়ে যায়।
সলীম কলীম না থাকলে বাড়িটা নিঝুম হয়ে থাকে। বুড়ি কখনো আপন মনে বব করে। ও রইস, রইসরে তোকে কি আমি এমন করে চেয়েছিলাম। ওই হাবা ছেলেটা একবারও মা বলে কি ডাকতে পারিস না? তোর কাছ থেকে মা ডাক শোনার জন্যে আমার প্রাণটা ফেটে যায় রে? কত সাধ ছিল মনে, কত সাধ্যি-সাধনা করলাম? বোবা ছেলেটা তোর মুখ দিয়ে কথা ফোটাতে পারলাম না? এমন চুপ হয়ে থাকিস কি করে? মাগো মা? রইসরে ও রইস একবার মুখটা খোল বাবা? আমার সোনার ছেলে বুকের মানিক সাত রাজার ধন? একবার হাঁ কর আমি তোর কাছ থেকে একটু শব্দ শুনি? এই আমি তোর মুখের কাছে কান রাখলাম। বল বাবা বল? একবার বল? মা বলে প্রাণ খুলে ডাক দে? সেই ডাকে মাঠ-ঘাট বন-প্রান্তর আকাশ-বাতাস কেঁপে উঠুক? সেই ডাকে গাঁয়ের সব মানুষগুলো দৌড়ে তোর কাছে ছুটে আসুক? অবাক হয়ে দেখুক তোর শক্তি, তোর ক্ষমতা? প্রমাণ হোক তুইও হাঁক ছাড়তে পারিস। ও রইস, রইসরে তোকে নিয়ে আমি কি করব? তুই কোন্ কাজে লাগবি? হাল বাইতে পারিস না, মাছ মারতে পারিস না, সংসার দেখতে পারিস না। আঃ বুকটা আমার কেমন যে করে। আমি চাই তুই একটা কিংবদন্তি হয়ে যা রইস, রইসরে?
বুড়ি হঠাৎ করে রইসকে আঁকুনী দেয়। খামচে ধরে ওর দুই কাঁধ। রইস ফ্যালফ্যাল করে মা-র দিকে চেয়ে থাকে। তারপর ওর চোখ দিয়ে জল গড়ায়। ও শব্দ করে কাঁদে না। সে অশ্রুর দিকে তাকিয়ে থমকে যায় বুড়ি। রইসের মাথাটা বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে ওঠে।
সংসারের আকর্ষণ বুড়ির শিথিল হয়ে আসে। সাদা চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। সলীম কাছে এসে বসে।
–মা তুমি কি এত ভাব?
–কই রে? বুড়ি হেসে ফেলে।
–হ্যাঁ ভাব। অন্য ঘরের চাচি খালার মত তুমি সংসার কর না। সারাদিন ব্যস্ত থাক না। ঝগড়া কর না। এত চুপচাপ থাক কেন মা?
–আমি ভাবছি তোর বিয়ে দিয়ে বৌ আনব ঘরে। সে এসে সংসার দেখবে। আমার এবার ছুটি।
–হ্যাঁ, তাহলে তো তোমার পোয়াবারো। যেটুকু সংসারে ছিলে তাও থাকবে না। সেটি হবে না।
–আমার তো বয়সও হয়েছে সলীম। তুই মত দিয়ে দে। আমি মেয়ে দেখি। তোরা সারাদিন বাড়ি থাকিস না। ঐ বোবা ছেলেটাকে নিয়ে আমার একলা কি করে যে কাটে সে তোরা কি বুঝবি? তুই না করিস না বাবা?
বুড়ি সলীমের হাত চেপে ধরে। সলীম মুখ নিচু করে থাকে। তারপর মাথা নাড়ে।
–ঠিক আছে দেখ। কিন্তু তোমার মনের মত হওয়া চাই। বৌ দিয়ে তুমি কষ্ট পাবে সে আমার সইবে না।
সলীম মা-র সামনে থেকে পালিয়ে যায়। বুড়ির খুশি লাগে। ইচ্ছে করে পুকুরে ঝাঁপিয়ে কিছুক্ষণ সঁতার কেটে আসতে। ওর ঘরে লোক আসবে। বাড়তি একজন মানুষ। বুড়ি এখন মানুষ চায়। চারদিকে অগণিত থৈ-থৈ মানুষ।
এর মাঝে একদিন নীতা বৈরাগিনী আসে। বুড়িকে দেখে চোখ কুঁচকে তাকায়।
–তোকে দেখে মনে হচ্ছে আমাদের বয়স হয়েছে সই। বুড়ি ম্লান হাসে।
–বেলা তো অনেক হলো। নীতা পা ছড়িয়ে বসে। আজ ও একা।
–তোর মনের মানুষ কৈ সই?
–আসেনি। বলল আমি বেরুতে পারব না। তুই ভিখ মেগে নিয়ে আয়। ও এখন এমনই করে।
–কেন চিড় ধরেছে বুঝি?
–এক রকম তাই। বড় জ্বালায়। ভাল লাগে না। একদিন ছেড়ে ছুড়ে চলে আসব।
বুড়ি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।
–হাঁ করে দেখছিস কি? চাট্টি খেতে দে। যাই। ফিরতে দেরি হলে আবার রেগে। যাবে। এ বুড়ি ভাত আনতে যায়। মনে মনে ভাবে, নীতা যেন একটু বদলে গেছে। ও আর। আগের মত নেই। তখন ও নিজের সঙ্গে কথা বলে, ও বুড়ি তুই কি কম বদলেছিস? তুই তো আর আগের মত নেই। এমনি হয়রে বুড়ি। এমনি হয়। কেউ চিরকাল একরকম থাকে না।
–ও সই কৈ রে ভাত দিবি না?
ও আবার তৎপর হয়। ভাবনায় মগ্ন হয়ে হাত শিথিল হয়ে এসেছিল। ভাতের * সানকি আর জলের গ্লাস নিয়ে আসতেই নীতা খেকিয়ে ওঠে।
–তুই একদম ভারী হয়ে গেছিস। বাব্বা চাট্টি ভাত খাওয়াবি তাও আবার তাগাদা। দিতে হয়। নাহ্ তুই যেন কেমন হয়ে গেছিস সই?
নীতার কলাপাতায় ভাত ঢেলে দিতে দিতে স্নান হাসে বুড়ি। কথা বলে না। নীতা তাড়াহুড়ো করে খায়। বুড়ি এক কোচড় চাল দেয় ওকে।
–বাঁচালি সই। আজ আর দোরে দোরে যেতে হবে না।
নীতা কৃতজ্ঞতার হাসি হাসে। ওর শরীরটা গাছ-গাছালির আড়ালে মিলিয়ে যাবার পরও বারান্দায় খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে থাকে। নীতা একটা দমকা ঘূর্ণির মত আসে। কিছুক্ষণ ধুলো উড়িয়ে সব কিছু এলোমেলো করে আবার চলে যায়। উঠোনে এঁটো কলাপাতা গড়ায়। বুড়ি সেদিকে তাকিয়ে থাকে। না, নীতা আর কিছুই ফেলে যায়নি। অথচ কেন যে মনে হচ্ছে সারা বাড়ি জুড়ে নীতা দবদবিয়ে হাঁটছে। সে শব্দ বুড়িকে অস্থির করে তুলেছে।
দুমাসের মধ্যেই ঘটা করে সলীমের বিয়ে হয়। সলীমের বৌ রমিজা, ছোটখাটো মিষ্টি মেয়ে। হাসি-খুশি। প্রথম দেখাতেই ভাল লাগে। বিয়ের পরদিন বুড়ি ওকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ওদের বাড়ির সীমানা দেখাল।
–বুঝলে বৌমা এখন থেকে এসব তোমার। আমি আর কেউ না। আমাকে চারটে খেতে দিও তাতেই হবে।
রমিজা কথা বলে না। ঘোমটার ফাঁকে উৎসুক চোখ মেলে রাখে।–
-জায়গাটি তোমার মনে ধরেছে বৌমা? রমিজা মাথা নাড়ে।
–পারবে না সামাল দিতে।
–আপনি দেখিয়ে দিলে পারব।
–অমা দেখ মেয়ের বুদ্ধি। আবার আমাকে জড়ানো হচ্ছে। আমি আর নেইগো মেয়ে। এবার আমার ছুটি।
বুড়ি রমিজার থুতনি নেড়ে আদর করে। মাথার ঘোমটা টেনে ফেলে দেয়।
–এত ঘোমটা দিয়ে জড়োসড়ো হয়ে থাকলে সংসার দেখবে কে?
রমিজা লজ্জা পায়। বুড়ি হাসে।
–আমাকে তোমার শরম কীসের বৌমা। আমি তোমার মায়ের মত। কোন অসুবিধা হলে আমাকে বলবে। আমি তো আছি তোমার জন্যে।
দুজনে হাঁটতে হাঁটতে সুপোরি বাগান ছাড়িয়ে পুকুর ঘাটে এসে দাঁড়ায়। সবকিছু রমিজার ভাল লাগে। শ্বশুরবাড়ির অজানা ভীতি ওকে কাবু করে রাখে না। বুড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে ওর বুক দুলে উঠে। বাপের বাড়ির মায়াময় পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এসেও ও উপলব্ধি করল গভীর মমতাময় বুকের ছায়া ওর জন্যে উন্মুক্ত আছে। ওর কোন অভাব নেই।
ঘাটের কাছে দাঁড়িয়ে বুড়ি রমিজাকে বলে, যাও মা দেখ সলীমের কি লাগবে? ও যা পাগল ছেলে। একটু এদিক ওদিক হলে রেগে কাঁই হয়ে যায়।
রমিজা মাথার ওপর ঘোমটা টেনে চলে যায়। বুড়ি কাঠের সিঁড়ি বেয়ে পুকুরের পানির কাছে এসে বসে।
অল্পদিনেই রমিজা সংসারের সব দায়িত্ব তুলে নেয়। চমত্তার গোছানো মেয়ে। বুদ্ধিও রাখে। দেখে শুনে বুড়ি হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। মনে হয় সংসারের বোঝাটা কাঁধের ওপর নিয়ে দীর্ঘদিন একটানা এক সবুজ বনের মধ্য দিয়ে পথ চলেছে। এখন বোঝাটা পথের ধারে নামিয়ে গাছের ছায়ায় ঘুমিয়ে পড়েছে। চারদিকে সোনালী পাতা ঝরে। স্বপ্নের কোকিল প্রশান্তি হয়ে ডাকে। কোন ভীষণ শব্দে সে ঘুম ভাঙ্গে না। কেবল, রইস রয়ে যায় ওর জন্যে। সকাল বেলা ওকে এনে বারান্দায় বসিয়ে রাখে। পুকুর ঘাটে নিয়ে গোসল করায়। খাওয়ায়। বুড়ো বয়সে বুড়ির যেন নতুন করে পুতুল খেলা। ওর মাঝে মাঝে মজা লাগে। শৈশব কৈশোর চোখের সামনে দীপ্ত আলো জ্বেলে হাজির হয়। বুড়ি কখনো তন্ময় হয়ে যায়। আশ্চর্য সুন্দর স্বাস্থ্য হয়েছে রইসের। যে দেখে সে অবাক হয়। বয়সের চাইতে অনেক বড় দেখায়। মুখের দিকে তাকিয়ে কেউ ভাবতে পারে না ছেলেটি বোবা-হাবা-কালা। ছেলেটির কোনো বোধশক্তি নেই। ও এই পৃথিবীর বাইরে বাস করে। মাঝে মাঝে ওর মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে বুড়ি। বুক দুমড়ে মুচড়ে উঠে। সব দুঃখ বোধগুলো একাকার হয়ে বুকের মধ্যে এক বিরাট নদী হয়ে যায়। তখন নদীর বালুচরে হাঁটতে গিয়ে বুড়ি প্রকৃতির কাছে এসে দাঁড়ায়। শৈশবের মত, কৈশোরের মত। ঘর ভাল লাগে না। খাল পাড়ে দাঁড়িয়ে নৌকোর চলে যাওয়া দেখে। শিমুল গাছের নীচে দাঁড়িয়ে স্টেশনের দিকে যাবার রাস্তায় মানুষের যাতায়াত দেখে। এসব দেখতেই ভালো লাগে এখন। মা নেই শাসন করার জন্যে। স্বামী নেই ঘরে ডাকার জন্যে। বুড়ি এখন অবাধ স্বাধীন। ছেলেরা নিজেদের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। রমিজা রান্নাবাড়ি সামলায়। রইস কখনো বুড়ির সামনে থাকে। কখনো থাকে না। ওকে নিয়ে বুড়ির কোন ঝামেলা নেই। বুড়ি মনের সুখে সুপোরি খোঁজে, কোচড় ভর্তি লাল শাক উঠিয়ে আনে। নইলে পুকুর পাড়ে বসে মাছ ধরে। বুড়ির এখন থৈ-থৈ আনন্দ! সময় ভালই কাটে।
রমিজা বুড়িকে ভীষণ ভালবাসে। আদর যত্ন করে। যেন কোন কিছুতে অসুবিধা না হয় সেদিকে খেয়াল রাখে। ছোটবেলা থেকে দেখে আসা এবং শোনা অনেক দজ্জাল শাশুড়ির ধারণা বুড়ি ভেঙে দিয়েছে। বুড়ি যেন অবিকল রমিজার আপন মা। কৃতজ্ঞতাবোধের সঙ্গে সঙ্গে ভালবাসাও রমিজাকে তাড়িত করে।
–আম্মা আপনার যখন যা দরকার হয় আমাকে বলবেন।
রমিজা বুড়ির পায়ে তেল মালিশ করতে করতে কথা বলে! বুড়ি চোখ বুজে আদর উপভোগ করে। মেয়ে নেই বুড়ির। মেয়ে থাকলে এমন হয়। কাছে থাকে, ভাত এগিয়ে দেয়, মাথা আঁচড়ে দেয়, বিছানা ঠিক করে রাখে। এই অভাব বুড়ি রমিজা আসার পর অনুভব করছে। রমিজার কথায় ও মনে মনে হাসে। সব দরকারের কথা কি আর রমিজাকে বলা যায়? ওর যে কত অজস্র ভাবনা তা রমিজার মত ছোট মেয়েকে কি করে বোঝাবে? রমিজা বুড়ির সঙ্গী হতে পারে না। ওর সঙ্গে প্রাণ খুলে কথাও বলা যায় না। তবে ওর আদর বড় ভাল লাগে। মনে হয় জীবনে একটা সুর বেজে ওঠে থেকে থেকে। যে সুরের সঙ্গে ওর কোন পরিচয় ছিল না। তবে বড় ক্ষণিকের সে বোধ। মুহূর্তে আবার কোথায় যেন সব হারিয়ে যায়। আর কিছুই খুঁজে পায় না। রমিজার সাধ্য নেই বুড়ির মনের তল খুঁজে পাওয়ার। দুপুরবেলা বুড়ির পাশে শুয়ে ও অনেক কথা বলে। ওর বাবার কথা, মার কথা, গায়ের কথা। মাঝে মাঝে খাপছাড়া কথা বলে। কথা বলতে বলতে ও তন্ময় হয়ে যায়।
–জানেন আম্মা ছেলেবেলায় কাদার মধ্যে মাছ কুড়োতে আমার খুব ভাল লাগত। আশ্বিন মাসে মাঠ থেকে পানি নেমে গেলে সাদা বকের ঝক নেমে আসতো সে কাদায়। আমরা সব ছেলে-মেয়েরা বকের মত মাছ খুঁজতাম। কি যে মজা হত তখন।
রমিজার কণ্ঠ বদলে যেত আস্তে আস্তে। ও খুব সুন্দর করে বলতে পারত। ওর গল্পে বুড়ি কখনো নিজের স্মৃতি ফিরে পায়। কান পেতে মনোযোগ দিয়ে শোনে। বুড়ির নিজের সঙ্গে মিলে গেলে সে ঘটনা শুনতে খারাপ লাগে না। রমিজার সঙ্গে বুড়িও তাল দেয়। কিন্তু রমিজা অন্য প্রসঙ্গে গেলে বিরক্ত হয়। মেয়েটা কথা একবার আরম্ভ করলে আর থামতে চায় না। পাশ ফিরে শশায়। রমিজা বুঝতে পারে না বুড়ির বিরক্তি। একটানা বলে যেতে থাকে। একসময়ে থামে। বুড়িকে ড্রাকে।
–ও আম্মা, আম্মা?
বুড়ি তখন ঘুমিয়ে পড়েছে।
–আমার কথা শুনলে আম্মার ঘুম পায়।
রমিজা হাই তোলে।
সলীম ওকে বাপের বাড়িতে যেতে দেয় না বলে মন খারাপ করে থাকে প্রায়ই। বুড়ির মনে হয় রমিজাও স্বপ্ন দেখতে ভালবাসে। বাপের বাড়ির স্বপ্ন। ফেলে আসা দিনগুলোর স্বপ্ন। শৈশব-কৈশোরের সেই গা-টা ওর কাছে এখন অচিনপুরী হয়ে গেছে। ইচ্ছে করলেই আর ছুটে যেতে পারে না। হেসে খেলে বেড়াতে পারে না। রমিজা এখন বন্দী জীবনযাপন করছে। সলীম যে কেন ওর সঙ্গে এমন করে তারও হদিস পায় না বুড়ি। ছেলেকে এখন আর বোঝার ক্ষমতা নেই। অনেক বদলে গেছে সলীম। সারাদিন ব্যস্তও থাকে খুব। রাত করে ঘরে ফেরে। ফিরে চারটে খেয়ে সটান ঘুম। কথা বলতে চাইলে বিরক্ত হয়। ওর নাগালই পায় না বুড়ি।
–আম্মা আপনি রাতদিন কি এত ভাবেন?
–কৈ? কিছু ভাবিনা তো?
–উঁহু ভাবেন। আমি টের পাই।
বুড়ি অবাক হয়। রমিজা কি টের পায়? কতটুকু বোঝে ও?
–রইসের জন্যে আপনার মন খারাপ থাকে না আম্মা?
–হ্যাঁ তা থাকে। ছেলেটার যে কি হবে?
–কি আর হবে। আল্লাহ্ আছে। আপনি কিছু ভাববেন না।
রমিজা বিজ্ঞের মত কথা বলে। ও যখন মুরুব্বি সাজে বুড়ির তখন বেশ ভাল লাগে। মেয়েটা একদম সরল। মনটা ভাল। কোন ধরনের কুচিন্তা করে না। বুড়ির মনে হয় ওর চারপাশের মানুষগুলো ঠিক ওরই মত। ওর সঙ্গে ভাঁজে ভাঁজে মিলে যায়। না, ঠিক তা নয়। ধাক্কা কি খায়নি বুড়ি? দেখেনি কি হিংসা, ঝগড়া, রেষারেষি? আসলে এসব বুড়ি ভাবতে চায় না। ভাড়ার ঘরে ঢুকিয়ে তালা দিয়ে রাখে।
তবুও খারাপ লাগে যখন দেখে সলীম রমিজাকে মারে। সলীমের অভিযোগ, ও নাকি কোন কাজের না। বুড়ি ভেবে পায় না কেন? লক্ষ্মী মেয়ে রমিজা। গুছিয়ে সংসারের কাজ করে। ছিমছাম পরিপাটি। কোথাও কোন গলদ নেই। তবুও সলীম ওর ওপর বিরক্ত। অভিযোগের অন্ত নেই। রাত্রিবেলা পাশের ঘর থেকে সলীমের শাসানী এবং ধমকানি কানে আসে বুড়ির। রমিজা যখন গুনগুনিয়ে কাঁদে তখন বুড়ির দম আটকে আসতে চায়। সলীমের আচরণ ওর কাছে বড় অদ্ভুত লাগে। সলীমকে জিজ্ঞেস করতে ওর বাধে। এতদিনে বুড়ির মনে হয় ওর অভিজ্ঞতার বাইরেও অনেক কিছু ঘটে। যে ঘটনাকে বুঝতে যাওয়া বোকামী। বুঝতে না চাইলে যন্ত্রণা। প্রথমদিকে বুড়ি সলীমের আচরণে আপত্তি করেছে। ওর ওপর রাগ করেছে। রাগে কাজ না হওয়ায়। অনুনয়-বিনয় করেছে। কিন্তু কিছুই শোনেনি সলীম। একদিন রেগে গিয়েছিল, তুমি আমার ব্যাপারে বুঝবে না মা। তুমি চুপ থাক। সব ব্যাপারে নাক গলাতে আস কেন?
সলীমের তীব্র ভাষায় থমকে গিয়েছিল বুড়ি। অপমান লেগেছিল। সলীমের মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে নিঃশব্দে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল। দুদিন মন খারাপ ছিল। মনকে অনেক বুঝিয়েছে। ঠিকই বলেছে সলীম। ও বড় হয়েছে ওর ব্যাপারে মাথা ঘামানো একদম উচিত না। কিন্তু রমিজা যখন কাঁদে তখন সইতে পারি না যে! বুড়ি নিজেকে ধমকায়। সইতে হবে। না সয়ে উপায় কি? রমিজাকে নিয়ে যা খুশি করার অধিকার সলীম পেয়েছে।
এখন বুড়ি চুপই থাকে। কিছু বলে না। মাঝে মাঝে রমিজার ক্রটি আবিষ্কারে তৎপর হয়। কেন ও সলীমকে খুশি করতে পারে না? পরক্ষণে নিজেকে আবার শাসন করে। ছিঃ মা হয়ে এমন চিন্তা করা ঠিক নয়। তাছাড়া রমিজাই বা ওকে কি ভাববে? একদিন রাতে ঘর থেকে বের করে দিয়েছিল সলীম। রমিজা কাঁদতে কাঁদতে বুড়ির পাশে এসে শুয়েছিল। বুড়ি ওর সঙ্গে কথা বলেনি। কিন্তু হাত বাড়িয়ে চোখের পানি মুছিয়ে দিয়েছিল শুধু স্পর্শ দিয়ে সান্ত্বনা দিয়েছিল ওকে। শাশুড়ির আদরে বেশি করে কেঁদেছিল রমিজা। তবু বুড়ি জিজ্ঞেস করেনি যে সলীমের সঙ্গে কি হয়েছে। শেষ রাতের দিকে সলীমের মৃদু শাসানীতে ঘুম ভেঙে যায়। দেখে ওকে বিছানা থেকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। বুড়ি সাড়াশব্দ না করে চুপ-চাপ শুয়ে থাকে। তখন বুড়ির মনে হয়েছিল ব্যাপারটা একান্তভাবেই ওদের দুজনের। সেখানে বাইরের কারো কিছু করার নেই। তারপর থেকে ওদের ব্যাপারে আর মাথা ঘামায়নি। সলীম যখন রমিজাকে মারে তখন পুকুর পারে বসে থাকে। নইলে পড়শীর ঘরে চলে যায়। ভীষণ কথা বলে। হাসে, অন্যমনস্ক হওয়ার ভান করে। যদিও মন পড়ে থাকে রমিজার কাছে। সলীম বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে ফিরে আসে। রমিজার মাথা বুকের সঙ্গে চেপে ধরে। রমিজা কোন কথা বলে না। বুড়িও না। এজন্যে মাঝে মাঝে বুড়ি অবাক হয়। রমিজার মুখে কোন অভিযোগ নেই। সলীমের বিরুদ্ধে কিছু বলে না। বড় নীরবে সয়ে থাকে।
এদিক থেকে কলীম অনেক শান্ত, রাগ কম। বুড়ি মনে মনে ভাবল কলীমের একটা বিয়ে দিতে হবে। ওর এখন বিয়ের বয়স হয়েছে। আসলে যত শান্তই হোক বিয়ে দিলে ও নিজেও হয়ত বউকে মারবে। কোন কোন পুরুষ আছে যারা বউর ওপর বীরত্ব দেখাতে ভালবাসে। বাইরে সমকক্ষ পুরুষের সঙ্গে পারে না বলে ঘরে তাদের যত আস্ফালন। অবশ্য কলীম এমন নাও হতে পারে। ও খুবই ভাল ছেলে। কলীমের প্রতি বুড়ির পক্ষপাতিত্ব আছে। মনে মনে কলীমের জন্যে মেয়ে খুঁজতে খুঁজতে ওসমান মৃধার মেয়েটা চোখে পড়ে যায় বুড়ির। কলীমের সঙ্গে বেশ মানাবে।
রাতে খাবার সময় দুভায়ের সামনে কথাটা পাড়ে। সলীম সারাদিন বাড়ি ছিল না। কোথায় কোথায় ঘুরেছে কে জানে। খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়বে। অন্য সময়তো ওকে ধরাই যায় না। দুদণ্ড বসে কথা বলার জো নেই। সংসারের কাজের কথাও শুনতে চায় না। বলতে গেলেই, পরে হবে মা বলে বেরিয়ে যায়। বুড়ির মাঝে মাঝে রাগ হয়। কি এত রাজকাজে ব্যস্ত ও? সলীম খুব তাড়াতাড়ি ভাত খাচ্ছে। বেশিক্ষণ বসে থাকতে চাইছে না। সলীমকে উদ্দেশ্য করে বুড়ি বলে, কলীমের একটা বিয়ে এবার দিতে হয় বাবা? দুভায়ে একসঙ্গে আপত্তি করে।
–এখন না মা?
–কেন? এখন নয় কেন? আমি মরলে হবে?
বুড়ি রেগে যায়। উত্তর দেয় সলীম।
–তুমি আজকাল বড় তাড়াতাড়ি রেগে যাও মা।
–তাতো বলবি। তোরা এখন বড় হয়েছিস না?
–শোন, মাথা ঠাণ্ডা কর। তুমি তো কিছু জান না, দেশের অবস্থা এখন একদম ভাল না।
–ওমা দেশের আবার কি হলো? জ্বর এলো নাকি? বুড়ি হেসে ওঠে। রমিজাও খুকখুক হাসে। রেগে যায় সলীম।
–আঃ মা যা বোঝ না তা নিয়ে হাসাহাসি করো না। আমাদের সামনে একটা কঠিন সময় আসছে। . সলীম ঢক করে পানি খায়। কলীমও মুখ নিচু করে খেয়ে যায়। বুড়ি ভাত নাড়াচাড়া করে। ওদের খাওয়া হলে, ও আর রমিজা খাবে। জিহ্বার শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। অকস্মাৎ পুরো ঘরে নীরবতা নেমে আসে।
সলীম আজকাল গাঁয়ের একজন মাতব্বর গোছের লোক হয়েছে। ও এখন অনেক বোঝে। বেশ গুছিয়ে কথা বলতে পারে। বুড়ির চোখের সামনে দিয়ে ছেলেটা বদলে গেল। বুড়ির ভালই লাগে। পেটের ছেলে না হলে কি হবে সলীম লীমের সঙ্গে ওর একটা আত্মিক যোগ আছে। সে যোগ নাড়ি-ছেঁড়া ছেলের চাইতে কম না। বুড়ির বুকের মধ্যে অহংকার জন্মায়। কাচারীঘরে সারাক্ষণ লোকজন আসা-যাওয়া করে। কখনো জোরে, কখনো ফিসফিসিয়ে কি সব কথাবার্তা বলে ওরা। বুড়ির মনে ভাবনা জোটে। কি হলো দেশটার? কৈ বুড়ির এত বছরের জীবনে হলদী গাঁ-র কিছু হয়েছে। বলে তো মনে পড়ে না। মৌসুমী ফসল বোনা, সময়ে ফসল কাটা। কোন বছর ভরা গোলা, কোন বছর অভাব। কখনো আকাল, দুর্ভিক্ষ। প্রবল খরা কিংবা বন্যা। এর বাইরে তো এ গাঁয়ে বড় রকমের কিছু ঘটেনি। তাছাড়া প্রাকৃতিক কিছু হলে বুড়ি টের পায়। শুধু দৃষ্টিতে নয়, ইন্দ্রিয়েও টের পায়। এ ব্যাপারে ওর জুড়ি নেই।
খেয়ে উঠে সলীম চলে যায়। সেদিকে তাকিয়ে বুড়ির মনে হয় সলীম বেশ একটা পুরুষ হয়েছে। ছেলে-ছোকড়া ভাবটা ওর মধ্যে এখন কম। আর কিছুদিনে সেটাও ঝরে যাবে। কলীম খেয়ে উঠতে যাবে তখন ওকে ধরে বসে বুড়ি।
–হ্যাঁ রে বাবা কি হয়েছে দেশটার? জন্মাবার পর থেকে তো কিছু হতে দেখলাম।
–কোন দিন হয়নি বলে কি এখন হবে না মা?
–তা বলবি তো কি হয়েছে?
–সে মেলা কথা তুমি বুঝবে না মা।
–তোদের মুখে এই এক কথা। বুঝবো না কি? বোঝালেই বুঝবো?
রমিজা পাশ থেকে চট করে বলে, আমাদের বোঝাবে কি আম্মা কলীম ভাই নিজেই জানে না কি হয়েছে।
–হ্যাঁ, জানি না তোমাকে বলেছে। দেখ এবার আমাদের একটা যুদ্ধ করতে হবে। দেশ স্বাধীন করতে হবে।
–ওমা এ আবার কি কথা? স্বাধীন আবার কি রে?
বুড়ি চোখ গোল করে তাকায়। সুযোগটা নেয় কলীম।
–এজন্যে তো বললাম কিছু বুঝবে না।
–যতসব আজগুবি কথা। আসলে একটা কিছু নিয়ে থাকতে না পারলে তোমাদের দুভায়ের ভাল লাগে না। মাগো কত যে তোমরা পার।
রমিজা ফোঁড়ন কেটে থালাবাসন গুছিয়ে রান্নাঘরে চলে যায়। কলীম ওর কথার উত্তর দেয় না। বিড়ি টানবে বলে উঠোনে নামে। একটু পরে ভেসে আসে ওর কণ্ঠের গান। বুড়ি ভাবনায় পড়ে। হাত পা ছড়িয়ে বারান্দায় বসে থাকে। যখন কোন সমস্যায় পড়ে তখন গফুরের কথা বেশি করে মনে হয়। দূরের তারার দিকে তাকিয়ে থাকে। আকাশের বুকে ফুটিফাটা জ্বলে তারারা। বাঁশবনের মাথার অন্ধকার নিবিড় হয়ে ওঠে। যুদ্ধ কি? যুদ্ধ কখনো দেখেনি বুড়ি। গফুরের সঙ্গে বিয়ের কদিন পর শুনেছিল দেশ স্বাধীন হয়েছে। তখন কোন যুদ্ধের কথাবার্তা হয়নি। গাঁয়ের লোক এমন গম্ভীর হয়ে যায়নি। সলীমের মত থমথমে আচরণ করেনি। এখনো স্পষ্ট মনে আছে তখন গাঁয়ের ছেলেরা সবুজের ওপর সাদা রঙের চাঁদতারা মার্কা পতাকা নিয়ে লাফালাফি করছিল। গাছের আগায় বেঁধে দিয়েছিল। মোটকথা একটা দারুণ ধুমধাম হয়েছিল। সবার মনে ফুর্তি ছিল। কিন্তু এখন কেন স্বাধীনতা মানে যুদ্ধ? সলীম কলীম কেন এমন বদলে গেল? কি হল দেশটার? নিশ্চয় সাংঘাতিক কিছু। নইলে বিয়ে পর্যন্ত বন্ধ করে দেবে কেন ওরা।
সূচোল হয়ে ওঠে বুড়ির ভাবনা। খরা বা বন্যার মত এ ঘটনা নয়। পুড়িয়ে বা ভাসিয়ে দিয়ে যায় না প্রকৃতি। এর সঙ্গে মানুষের যোগ আছে। সেজন্যে সলীম কুলীম ভাবনায় পড়ে, তৈরী হয়। প্রস্তুতি নেয়। বুড়ির সামনে সমস্যার নতুন দিগন্ত-দুয়ার খুলে যায়। সেটা ওর মগজে ঘুরপাক খায়। সে আবর্ত ওর ইন্দ্রিয়কে তীক্ষ করে তোলে। কি যেন গন্ধ পায় বাতাসে। ওর মনে হয় পোষা কুকুরটার ঘেউ ঘেউ শব্দও যেন কেমন। একটু অন্যরকম। চিরকালের চিরচেনা নয়। যে কোন সচেতন বুদ্ধিসম্পন্ন লোক তা বুঝতে পারবে। বুড়ি হলদী গাঁয়ে ঘুরে বেড়ায়। অনুভব করে হলদী গাঁয়ে চিরকালীন শান্ত সংযত কর্মপ্রবাহে জোয়ার এসেছে। মুখ বুজে সয়ে যাওয়া, ঘা খেয়ে মাথা নোয়ান মানুষগুলোর কণ্ঠে এখন ভিন্ন সুর। চোয়ালে ভিন্ন আদলের ভঙ্গি।
বুড়ি গরু বাঁধতে এসে রমজান আলীর দিকে তাকিয়ে থমকে যায়।
–রমজান ভাই কৈ যাও?
–বাজারে। মনসুরের দোকানে ট্রানজিস্টারে খবর শুনবো। এবার সাংঘাতিক একটা কিছু হবে সলীমের মা। আমরাও ছাড়ব না।
–কি হবে রমজান ভাই?
–এখন আসি। পরে কথা হবে।
বুড়ি কিছু ভেবে কুলিয়ে উঠতে পারে না। কেন এমন হল দেশটার। বাঘা আজকাল কারণ অকারণে ঘেউ ঘেউ করে। বাঁশবনে শত্রু লক্ষ্য করে দৌড়ে যায়। ফিরে এসে বুড়ির পায়ের কাছে বসে গরগর শব্দ করে। জিহ্বা বের করে লম্বা শ্বাস নেয়। বুড়ি মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
–তোর এত অস্থির লাগে কেন বাঘা? তোর কি হয়েছে? তুই কি কিছু বুঝতে পারিস? ছোটবেলা থেকে কত কিছুই যে বুঝতে চেষ্টা করেছি পারিনি। এখন আমি বুঝতে চাইরে বাঘা। আমার শরীরটা অন্য কথা বলে। আমিও ধরতে পারছিরে বাঘা, এ খরা বা বন্যা নয়। এ অন্য কিছু, একদম অন্যরকম।
–আম্মা যে কি কুকুরের সঙ্গেও কথা বলে।
রমিজার কথায় বুড়ি লজ্জা পায়। সত্যি মাঝে মাঝে আশপাশের সব কিছু একদম ভুলে যায়। তখন মনে হয় নিজের মনটাই বড় সঙ্গী। নিজের সঙ্গে আপন মনে কথা বলাতেও কম সুখ না, খেলাটা জমে ওঠে। তখন আর কিছু খেয়াল করতে পারে না। আসলে বাঘাতে উপলক্ষ মাত্র।
–আম্মা আপনার কি হয়েছে? আপনিও কি ওদের মত হয়ে গেলেন?
রমিজার হাসিতে বুড়ির রাগ হয়। ওর মুখের দিকে তাকায় না। মেয়েটা ভেঁপো হচ্ছে। সব কিছুতে নাক গলাতে আসা! ওর কি দরকার শাশুড়ির দিকে এত খেয়াল করার? বুড়ি রাগের চোটে বাঘার গায়ে এক লাথি দিয়ে ওকে উঠিয়ে দেয়। তারপর রইসকে নিয়ে পুকুরঘাটে চলে যায়।
আজকাল প্রতিদিনই নতুন মনে হয় বুড়ির। সকালের আড়মোড়া ভাঙতে কোন আলস্য নেই। চমৎকার ঝরঝরে লাগে। দরজা খুললেই এক ঝলক সতেজ বাতাস। ফুসফুসের মধ্য দিয়ে ঢুকে এক দৌড়ে পুরো শরীর স্নিগ্ধ করে ফেলে। বুক ভরে শ্বাস টেনে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নেমে হাঁস মুরগির খোয়াড়ের কাছে এসে দাঁড়ায়। একটানে দরজা খুলে দেয়। কলকলিয়ে বেরিয়ে আসে ওরা। গোয়ালে যায়। গরুটার গলায় হাত বোলায়। বাছুরটার গা চাপড়ে দেয়। সব কিছুতে এখন আনন্দ। সারাদিন কেমন করে যে কাটে টের পায় না। বাঁশবনের মাথার ওপর দিয়ে ঝকঝক বালিহাঁস উড়ে যায়। উঠোনে ছায়া পড়ে। অসম্ভব সুন্দর হলুদ গলাটা সকালের রোদের মত লাগে। কোথায় যেন আলগা রঙে ঝরণা বইছে। অথচ ধরতে পারছে না বুড়ি। সে রঙ এবার বন্যা হবে। সে বন্যা নতুন পলিমাটি বয়ে আনবে। উর্বরা শ্যামল মাটিকে ঐশ্বর্যশালী করবে। বুড়ি খালের ধারে যায়। মনে হয় মৃদু-স্রোতের ছোট খালের শরীর বদলে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে পানির রেখা; জলের বুকের কেলি। বদলে যাচ্ছে সবুজ শ্যাওলার মাথা নাড়া, পারের মাটির সখী-খেলা। বদলে যাচ্ছে মাটির গতর। হৃৎপিণ্ডের ধুকধুক শব্দধ্বনি। কেমন যেন উদ্দাম হয়ে উঠতে চাইছে খালের শরীর। চিরকালের চিরচেনা নৌকা বাওয়া, মাছ ধরা খালটা কত দ্রুত পাল্টে গেল। যেন বাক বদলাতে চায়, যেন স্রোতে বিশাল কিছু বয়ে আনতে চায় কিংবা দুকূল ভাসিয়ে সাগরে যেতে চায়। বুড়ি খালের পানিতে হাত ভেজায়, গালে ডলে, চোখে মাখে, মাথায় দেয়। যদি পানি তাকে কোন নতুন কথা বলে দেয়? যদি বলে কেন হলদী গাঁয়ের প্রাণ বদলে যাচ্ছে। কোন অমোঘ শক্তির টানে হলদী গাঁ তার আপন স্বরূপের বাইরে পা বাড়াচ্ছে? কে তাকে এমন সাহসী, বেগবান এবং যৌবনবতী করে তুলল?
বুড়ি স্টেশনের দিকে চলে যাওয়া রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে। ছোটবেলায় কতদিন জলিলের হাত ধরে ঐ রাস্তা দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে স্টেশনে গেছে। ঐ রাস্তার ধুলোমাটি, লজ্জাবতী লতা, ভাঁটফুল, কচুপাতা, লম্বা ঘাস সব কিছুই তো ওর মুখস্থ। কোনটাকে বুড়ি না চেনে? অথচ এখন মনে হয় ঐ রাস্তাটা একদম অচেনা। কোনদিন এই পথে হাঁটেনি। এই পথে হাঁটতে দারুণ সাহস লাগে। ধুলো-ওড়ানো কাঁচা রাস্তাটা রোদের সোহাগে ঝক্ঝক্ করে। কেমন বুক চিতিয়ে হা হা করছে। যেন ডাকছে, এস একবার দেখে যাও। দেখ কোথায় নিয়ে যাই। কত লোক আসা-যাওয়া করছে রাস্তা দিয়ে। কেউ ওর দিকে ফিরেও তাকায় না। সবার পায়ের চলার গতি দুর্বার হয়ে উঠেছে। ঐ মাটির সঙ্গে মানুষগুলোর পায়ের আশ্চর্য মিল। ঐ মাটি ওদের সঙ্গে কি কথা বলে? কি মন্ত্র শিখিয়ে দেয়? ঐ রাস্তা যদি বুড়িকে বলে দিত হলদী গাঁয়ের প্রাণ কেন বদলে যাচ্ছে? এই টগবগিয়ে ওঠা প্রাণটা কে এতদিন ঘুম পাড়িয়ে দীঘির বুকে লুকিয়ে রেখেছিল? ঐ রাস্তা কেন বুড়িকে এখুনি বলে দিচ্ছে না যে হলদী গার। লোকগুলো কোন লক্ষ্যের দিকে যাত্রা শুরু করছে?