০৫.
…বাঁয়ে গভীর গিরিখাত, ডাইনে খাড়া পাহাড়। মাঝে এবড়োখেবড়ো সরু পাথুরে রাস্তা। পাকদণ্ডী বেয়ে ঘুরে ঘুরে উঠছিল ভাস্কর। পিঠে হ্যাভারস্যাক, চোখে রোদচশমা, হাতে লাঠি। বোঝাটা বডড ভারী, ভাস্কর নুয়ে নুয়ে পড়েছে। এইমাত্র দেবজিৎ আর সুগত পাশে পাশে ছিল, লম্বা লম্বা পায়ে তারা এগিয়ে গেছে, এখন দৃষ্টিসীমার বাইরে। ভাস্কর চেঁচিয়ে ডাকল তাদের, স্বর ফুটছে না। হঠাৎ কোত্থেকে চাপ চাপ কুয়াশা। পথ আঁধার, হাতড়ে হাতড়ে চলছে ভাস্কর। প্রাণপণে হাঁটার গতি বাড়াতে চাইল, কে যেন পিছন থেকে টেনে টেনে ধরছে। দুম করে কখন রাস্তা শেষ। সামনে এক ঝুলন্ত সেতু, নীচে তার খর ধারা। ভাস্কর টলমল পায়ে সেতু পেরোচ্ছে এবার। দড়ির ব্রিজ দুলছে ভীষণ। ভাস্কর কিছুতেই টাল সামলাতে পারছে না। পড়ে যাচ্ছে ভাস্কর…পড়ে যাচ্ছে…
ওই পতনের ধাক্কাতেই তন্দ্রা ছিঁড়ে খানখান। ভাস্কর ধড়মড়িয়ে উঠে বসল। ঘামছে রীতিমতো। দিনদুপুরে এ কী বিটকেল স্বপ্ন? খবরের কাগজ নিয়ে শুয়ে ছিল, ঘুমিয়েই বা পড়ল কখন?
এমনটা এখন ঘটছে ভাস্করের। নিড্ল বায়োপসির পর থেকেই। একটু গড়াল কি গড়াল না, জড়িয়ে আসছে চোখ। ওমনি কোত্থেকে রাশি রাশি ছবিও হাজির। আগে ভাস্কর খুব একটা স্বপ্নটপ্ন দেখত না, বিছানায় পড়লেই তো নাক ডাকছে। গত দু’দিন ধরে ঘুমটাও কেমন পাতলা পাতলা। সঙ্গে বিচ্ছিরি বিচ্ছিরি দৃশ্য। কখনও বয়লারের সিঁড়ি থেকে পা পিছলে গেল, কখনও জলে ডুবে যাচ্ছে, কখনও বা পাহাড়চূড়া থেকে তাকে ঠেলে ফেলে দিচ্ছে কোনও অজানা হাত…। আশ্চর্য, মনেও থাকছে স্বপ্নগুলো! জেগে ওঠার পরেও কতক্ষণ যে রেশ রয়ে যায়!
ভাস্কর কি ভয় পেয়েছে? তরুণ তাকে যা-খুশি পড়াক, সোহিনী যতই এড়িয়ে যাক, ছুঁচ ফুটিয়ে রস বার করে পরীক্ষা-নিরীক্ষার অর্থ না বোঝার মতো মূর্খ সে নয়। ব্রেনস্পট আর ফুসফুসের আবছায়ার মধ্যে কার্যকারণ সম্পর্ক তো আছেই। এখন বায়োপসির ফলাফল জানা গেলেই ষোলো কলা পূর্ণ হয়। কিন্তু সেই কারণে পেটের ভেতর হাত-পা সেঁধিয়ে যাবে, কিংবা অহরহ দুঃস্বপ্ন দেখবে, ভাস্কর চ্যাটার্জি কি সেই প্রজাতির মানুষ?
তবু কেন যে হঠাৎ হঠাৎ শিরদাঁড়া বেয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে যায়? কী নাম ওই স্রোতের?
ভাস্কর বিছানা ছেড়ে নামল। একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল এক জায়গায়। তারপর বাথরুম ঘুরে এসে পাখা বাড়িয়ে দিল। আবার বসেছে শয্যায়। রিপোর্টটা আজ কে আনবে? তরুণদা? না সোহিনী? অবশ্যই দেখে নেবে কী আছে রিপোর্টে! তারপর এসে নিশ্চয়ই প্রবোধবাক্য! নাকি নিষ্ঠুরের মতো ঘোষণা করবে দণ্ডাজ্ঞা?
ধুস, ফের উলটোপালটা চিন্তা। নাহ্, ভাস্কর বোধহয় ভয়ই পাচ্ছে। বায়োপসি তো এক ধরনের রুটিন পরীক্ষা। মা’র গলব্লাডার অপারেশনের পরেও হয়েছিল। শতকরা সাড়ে নিরানব্বইটা ক্ষেত্রে বায়োপসি রিপোর্ট তো নেগেটিভই আসে, নয় কি?
ভাবনাটাকে পছন্দসই খাতে বইয়ে দিতে পেরে ভাস্কর খানিক চনমনে বোধ করল। দিনভর এই একা একা থাকাটাই বুঝি কাল হয়েছে। যত্ত সব আলফাল ব্যাপার গোল পাকায় মাথায়। অফিস যেতে পারলে লোকজন আর কাজকর্মের মাঝে কুটকুটে পোকামাকড়গুলো মগজের ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে পারত না। উঁহুঁ কিছু একটা করা দরকার।
টিভি দেখবে? পাপানের ‘সিআইডি’ আজকাল ভাস্করকেও বেশ টানছে। কতরকম জীবন, কত বিচিত্র অপরাধের অনুসন্ধান…। স্পোর্টস চ্যানেলও খোলা যায়, কিংবা সিনেমা-টিনেমা…। কিন্তু মা বোধহয় শুয়েছে, আওয়াজে জেগে যেতে পারে।
ফোন লাগাবে বন্ধুদের? কাকে করবে? এই দুপুর-বিকেলে সকলেই তো ব্যস্ত যে যার মতো। তাদের ডেকে ডেকে নিজের সংবাদ প্রচার করার প্রয়োজন আছে কোনও? বরং অফিসে একটা ফোন করা যাক। সপ্তাহ ঘুরে গেল, কারও সঙ্গে যোগাযোগ নেই…।
বালিশের তলা থেকে মোবাইলটা টেনে চেনা নম্বর টিপল ভাস্কর। বেজেছে। ওপারে তুহিনের গলা, আরে চ্যাটার্জি যে? খবর কী? আছ কেমন?
এই তো… না মরে বেঁচে আছি।
বালাই ষাট, মরবে কেন। দেশে কি মরার লোকের অভাব পড়েছে?
তা বটে। টিভি, খবরের কাগজ খুললেই তো শুধু ডেডবডি।
মানুষের প্রাণ খুব সস্তা হয়ে গেছে, বুঝলে।…গেছে তোমার ঘাড়ব্যথাটা?
কই আর। মনে হচ্ছে ওটা আমার চিরদিনের সাথী হয়ে গেল।
তোমার ডাক্তার কী বলছে?
কথা কম, কাজ বেশি। ধরাধ্ধড় শুধু টেস্ট করাচ্ছে।
ওটাই তো ডাক্তারদের কায়দা, ব্রাদার। রোগ ডিটেকশনের জেরে তোমার পকেট ফরসা। নিশ্চয়ই এখনও পায়নি কিছু?
সাতকাহন খুলে বসতে অস্বস্তি হল ভাস্করের। এড়িয়ে যাওয়া ভঙ্গিতে বলল, ওই কী সব যেন…
আমি তোমাকে বলছি চ্যাটার্জি, ওদের ভরসায় থেকো না। ন্যাচারাল হিলিং-এর চেষ্টা করো। ফলো বামদেব।
ভাস্করের বলতে ইচ্ছে হল, সে সুযোগ বোধহয় আমার আর নেই। আমার বিধিই বাম। নিজেকে জোর দিতেই বুঝি শব্দ করে হেসে উঠল, আরে, সে হবেখন। এখন একটু অফিসের গল্প শুনি।
কী জানতে চাও?
নতুন চিফ ইঞ্জিনিয়ার কে হচ্ছে, কিছু শুনলে?
বোধহয় বীরেন গুহ। খোদ জায়গায় নাকি ব্যাটা নৈবেদ্য চড়িয়েছে।
তা হলে তো অজিত বোস কে ঠুকে দেবে। সে তো সিনিয়ার মোস্ট।
এফিশিয়েন্সি সিনিয়রিটির জমানা গেছে ভাই। এখন শুধু জায়গা বুঝে অয়েল মেরে যাও। কেস করে বোসের হবেটা কী? চাকরি তো বাকি মোটে সাত মাস। মামলা উঠতে উঠতে বেলপাতা এসে যাবে।
অফিসের গালগল্পে শরীর যেন টনকো হয়ে ওঠে। ভাস্কর জিজ্ঞেস করল, আর আমাদের বিতনুর কী সমাচার? রিজাইন করল?
আরে ছাড়ো। চাকরিকে লাথি মেরে অ্যাকাডেমিক লাইনে চলে যাওয়া অত সোজা?…তুমি জয়েন করছ কবে?
দেখি। বাড়িতে থেকে নাটবল্টুতে তো মরচে ধরে যাচ্ছে।
তা হলে আর কী। ফিট সার্টিফিকেট বাগিয়ে এবার চলে এসো। তুমি বিহনে তোমার গুঁফো বদ্রি কেমন ঝিম মেরে গেছে।
ঠাট্টাটুকুতে হাসল বটে ভাস্কর, কিন্তু ফোন ছাড়তেই মগজে টকটক টোকা। পিঠ বেয়ে আবার সেই হিমশীতল স্রোত।
ফিট সার্টিফিকেট যে কবে মিলবে? আদৌ মিলবে তো?
ওফ্, ফের ভাস্কর বেলাইনে ঢুকছে! হচ্ছেটা কী এসব? কিছুতেই কি নিজেকে বাগে রাখা যাবে না?
রান্নাঘরে টুংটাং আওয়াজ। বনানী বুঝি উঠল, চা বসাচ্ছে। কাপ-কেটলি-চামচের অতি মৃদু ধ্বনি, সেটুকুই বুঝি নির্জন ফ্ল্যাটে উচ্চকিত শোনায়।
খবরের কাগজখানা নিয়ে লিভিংহলে এল ভাস্কর। সেন্টারটেবিলের তলার তাকে কাগজ রেখে সোফায় বসেছে, বনানী চা নিয়ে হাজির। সঙ্গে বিস্কুটের কৌটো।
ঠোঁট বেঁকিয়ে ভাস্কর বলল, ফের হাতে ওই ডাব্বা? কতবার বলেছি, চায়ের সঙ্গে কিছু চাই না।
শুধ চা খাস না বাবুন। গ্যাস হবে। ছোটখাটো রোগাসোগা বনানীর স্বরে সন্ধেহ ধমক, কড়া কড়া ব্যথার বড়ি পড়ছে, এমনিই তো তোর খালিপেটে থাকা উচিত নয়।
ভাস্কর অপাঙ্গে দেখল মাকে। বুদ্ধি মা’র কম নেই, তবু মাঝে মাঝে এমন আজব কথা বলে! ব্যঙ্গের সুরে বলল, সাড়ে বারোটায় ভাত খেলাম। এখনও চারটে বাজেনি। এর মধ্যে পেট খালি?
হ্যাঁ, তাই। ভাত আর কতটুকুই বা খেয়েছিস!
আমি তো আজকাল ওরকমই খাই মা। বেশি খেলে বমি করে ফেলব।
সেটা এমন কিছু বাহাদুরি নয়। মাত্র ক’টা দিনে কেমন কাহিল হয়ে গেলি, আমি দেখছি না? খেয়ে উঠে আঁচানোর সময়ে টলে গেলি, দেওয়াল ধরে সামলালি… ভাবছিস আমার চোখে পড়েনি?
ঈষৎ অপ্রস্তুত হল ভাস্কর। বাড়িতে আবদ্ধ থেকে শুধু শরীর নয়, মনটাও যেন কমজোরি। তরুণদার নির্দেশমাফিক পথেঘাটে একা একা বেরোনো এখন একদম চলবে না। দিদি তো কালও এসে বরের হয়ে খবরদারি মেরে গেল। নীচে নামার প্রসঙ্গ তুললেই মা-ও এমন হাঁ হাঁ করে ওঠে, সিঁড়িতে পা রাখতে ইচ্ছে করে না।
হাত উলটে ভাস্কর বলল, দিনরাত বন্দি থাকলে উইক তো হবই। আমার বাজার যাওয়াটা পর্যন্ত তোমরা বন্ধ করে দিয়েছ।
তুইই তো বলিস, সকালে মাথাটা থানইট হয়ে থাকে।
ভুল বলেনি মা। উপসর্গটা বেড়েছে। গোটা সকালটাই ভাস্করকে বেশ ঝামেলায় রাখে। ঘরে খানিক হাঁটাচলার পর এই দুপুর থেকে অনেকটা সযুত শরীর। পেনকিলারটাও কাজ করতে বড্ড দেরি করছে এখন!
ভাস্কর খানিক জোর করেই তর্ক জুড়ল, সকালে না হোক, বিকেলে তো বাজার যেতে পারি। এ বেলাতেও মাছ, সবজি, সবই বসে।
ছেলেমানুষের মতো বকিস না। মাথা ঘুরছে…রাস্তায় কোথায় উলটে পড়বি…
এটা তোমাদের বাড়াবাড়ি, মা। মাঝখান থেকে সোহিনীর কাঁধে একগাদা ঝামেলা চাপল। বেচারা জীবনে কখনও বাজার মাড়ায়নি, এখন আলুপটল কিনছে, মাছের সুগন্ধি গলতাটায় ঢুকছে…।
তো কী আছে বাবুন? বরের শরীর খারাপ হলে বউকে তো ওটুকু করতেই হবে।
ভাল, ভাল। এখন রোজ তবে কাটাপোনাই গেলো। সে তো ওই একটি বই মাছ চেনে না। আর ওই ডিপফ্রিজের মুরগি! আমার দু’চক্ষের বিষ। দেখলেই গা গুলোয়।
নাকচোখ বন্ধ রাখ বাবুন। ফেরে পড়লে মানুষকে সবই হজম করতে হয়।
উপদেশটা ভাস্করের মনঃপূত হল না। তবে কিছু আর বললও না। কাপ শেষ করে রাখল সেন্টারটেবিলে। টিভির রিমোট খুঁজছে।
বনানী কাপ-ডিশ নিয়ে উঠে যাচ্ছিল, হঠাৎই ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, হ্যাঁরে, তোর বন্ধু তো এর মধ্যে একদিনও এল না?
কোন বন্ধু?
কে আবার! অনুপম।
খবর পায়নি বোধহয়।
সোহিনী জানায়নি?
ভাস্কর থতমত খেল। প্রশ্নটা যেন তত সরল নয়। সত্তর ছুঁইছুঁই বনানী দেবীর নজর অতি তীক্ষ্ণ। তার উপস্থিতি বিনা এ সংসার মসৃণভাবে চলা সম্ভব ছিল না, জানে ভাস্কর। একমাত্র পাপান ছাড়া এ-বাড়ির কোন ব্যাপারেই বা সোহিনীর আগ্রহ আছে? বনানী সংশক্তি বল হয়ে বেঁধে রেখেছে বলেই না…। সেই বনানী দেবী কিন্তু সোহিনী-অনুপমের বন্ধুত্বে মোটেই প্রীত নয়, ভাস্কর টের পায়। ধরে নিয়েছে এটা মা’র সংকীর্ণতা। দৃষ্টিভঙ্গির দোষ। ছেলের বউ ছেলের বন্ধুর সঙ্গে ড্যাডাং ড্যাডাং সিনেমা-থিয়েটার যাচ্ছে, কোন মা তা খোলামনে মেনে নিতে পারে!
সচেতনভাবেই ভাস্কর দায়সারা জবাব দিল, কী জানি, সোহিনীকে জিজ্ঞেস করতে হবে…। হয়তো বলেনি…হয়তো বলেছে…হয়তো অনুপম ব্যস্ত…হয়তো কলকাতায় নেই…
তাই হবে। বনানী রান্নাঘরের দিকে এগোল, খবর পেলে অনুপম অন্তত ফোন একটা করত। তাই না?
আজকালের মধ্যে হয়তো করবে।
অনুপমের আসাটা কিন্তু ইদানীং কমে গেছে।
তো?
নাহ্…হঠাৎ মনে হল, তাই বললাম।
আশা করা যায় মা’র এই কৌতূহলের সঙ্গে তার অনুদারতার কোনও সম্পর্ক নেই? ভাস্কর রিমোটে টিভি অন করল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দরজায় মুহুর্মুহু বেল। শ্রীমান পাপান ফিরলেন। ঢুকেই স্কুল ব্যাগ ছুড়ল সোফায়। জুতো এক দিকে ছিটকে গেল, মোজা এক দিকে। বাবার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে রিমোট, আমি হাঙ্গামা দেখব।
লক্ষ্মী পাপান, ম্যান-ইউ আর আরসেনালের ভাইটাল ম্যাচ…একটু দেখি।
না। এখন আমার চ্যানেল চলবে।
বেশিক্ষণ অবশ্য হাঙ্গামা পোহাতে হল না। পাপানের এখন চনচনে খিদে, বনানী খাবারের প্লেট টেবিলে রাখতেই উঠে গেল সুড়সুড়। গপাগপ গিলে, ইউনিফর্ম বদলে, ছেলে তুরন্ত হাওয়া।
ভাস্করেরও আর টিভিতে মন বসছিল না। বিকেলের এই সময়টায় রোজ রোজ রঙিন পরদায় দৃষ্টি গেঁথে রাখা কি তার পোষায়! উঠে লিভিংহল সংলগ্ন ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের এই তিন কামরার ফ্ল্যাটটি তেমন বড় নয়। পাপানের ঘর তো বেশ ছোট। কিচেন, বাথরুম, লিভিংহল, নেহাতই বিশেষত্বহীন। শুধু এই অলিন্দটিই ভারী বাহারি। আকারে অর্ধবৃত্ত, যথেষ্ট প্রশস্ত, রেলিং-এ লতাপাতার কাজ…। ফ্ল্যাট কেনায় সোহিনীর আপত্তি ছিল। সে বোধহয় চেয়েছিল বাইপাসের ধারে জমি কিনে ভাস্কর বাড়ি বানাক। যদিও মুখ ফুটে বলেনি কখনও। যাদবপুর অঞ্চলটাও সম্ভবত তার মনোমত নয়। শুধু এই বারান্দাটাই যা সোহিনীর চোখে মোটামুটি চলনসই। শোভাবাজারের গাঙ্গুলি বাড়ির ‘সমস্কৃতিবান’ মেয়ের তারিফ পাওয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটা আত্মপ্রসাদ অনুভব করে ভাস্কর। একটু বুঝি আফশোসও জাগে, চিরকাল ভাড়াবাড়িতে বাস করা তার বাবা ফ্ল্যাটখানা দেখে যেতে পারল না। এমন একখানা ব্যালকনি পেলে বাবা যে কী আহ্লাদিত হত!
বাইরে একটা চমৎকার দিন ফুটে আছে। সূর্য নেমে গেছে অনেকটা, পশ্চিম আকাশে ছোপ লাগছে লালের। আবাসনের গেটে সেপাইয়ের মতো খাড়া কৃষ্ণচূড়া ফুলে ফুলে ছয়লাপ। গাঢ় লাল যেন চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। নরম সোনালি আলোয় হাসছে চরাচর, নীচের চত্বরটায় খেলছে বাচ্চারা, দুটো শালিখ কেব্লের তারে এসে বসল—সব মিলিয়ে ছবিটা ভারী মনোরম।
নির্নিমেষ দেখছিল ভাস্কর। হঠাৎই বুকটা ছ্যাঁৎ। কী পাওয়া যাবে আজ বায়োপসি রিপোর্টে? পৃথিবীটাকে এভাবে তারিয়ে তারিয়ে দেখার দিন কি খতম?
উফ্, ভাবনাটা যেন কুকুরতাড়া করছে। হস্টেলের রাজেশ ত্রিবেদীকে মনে পড়ল সহসা। কোনও ফ্যাসাদে পড়লেই তার বাঁধা লব্জ ছিল, ইতনা সোচতা কিঁউ? যো হোগা সো দেখা যায়েগা। মরনেসে জাদা আউর কেয়া হোগ, হাঁ? ঠিকই তো, ভাস্কর বড়জোর মরে যাবে, তার বেশি আর কী? ঢের তো বাঁচা হল, বিয়াল্লিশ বছর তো কম সময় নয়। যেতেই যদি হয়, বুক ফুলিয়ে চলে যাবে ভাস্কর। অনর্থক ধুকপুকুনিতে সিঁটিয়ে থাকবে কেন?
উঁহুঁ, যুক্তিটায় কোথায় যেন ফাঁক আছে। ভাস্কর একটুও হালকা হল না। বিস্বাদ মুখে দেখছে বাইরেটা। গেটের সামনে রিকশাওয়ালার সঙ্গে তুমুল বচসা বেধেছে এক সওয়ারির। নাকের ডগা দিয়ে তিন-চারটে কাক কর্কশ শব্দ করতে করতে উড়ে গেল। কোত্থেকে ডেলা ডেলা মেঘ এসে হানা দিয়েছে পশ্চিমের আকাশে। রক্তিম আভা মুছে গিয়ে আকাশ পাঁশুটে হঠাৎ।
কী রে, এবার কিছু খাবি তো?
বনানীর গলা পেয়ে ঝপ করে চটে গেল ভাস্কর। উষ্মভরে বলল, ফের আমাকে নিয়ে পড়লে?
আহা, এই সময় তো রোজ কিছু একটা খাস।
আমার ইচ্ছে করছে না। গা জড়াচ্ছে।
নির্ঘাত অম্বল।…ক’টা শুকনো চিড়েভাজা মুখে দে।
কেন বোর করছ? ভাস্কর প্রায় খিচিয়ে উঠল, যাও তো পাশ থেকে। কাটো।
বনানী তবু গেল না। নরম গলায় বলল, বুঝি রে, বুঝি। শরীরে যুত না থাকলে মেজাজও বিগড়ে থাকে। তাই তো বলি, একটু পুষ্টি নে। শুধু ডিমসেদ্ধ করে দিই? নুন-গোলমরিচ দিয়ে খা, জিভে স্বাদ পাবি।
ভাস্কর আর তিষ্ঠোতে পারছিল না। যতক্ষণ সে থাকবে এখানে, মা’র ঘ্যানঘ্যান চলবে। ব্যালকনি ছেড়ে ভাস্কর পলকে শোওয়ার ঘরে। গায়ে হাফ-পাঞ্জাবি চড়াচ্ছে। গলা উচিয়ে বলল, আমি নীচে যাচ্ছি।
ওমা…সে কী…না না…। বনানী পক্ষীমাতার মতো ধেয়ে এসেছে। মিনতির সুরে বলল, অমন করতে নেই বাবুন।
আমাকে কী করতে আছে, কী করতে নেই, তা আমাকেই ঠিক করতে দাও।
নীচে কোথায় টো-টো করবি? আমি সঙ্গে আসব?
প্লিজ মা, একটু শান্তি দাও। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।
গটগটিয়ে বেরোল ভাস্কর। চটি গলিয়ে দরজা খুলছে, বনানী দৌড়ে এসে মোবাইলটা হাতে ধরিয়ে দিল, এটা অন্তত কাছে রাখ। অসোয়াস্তি হলে আমাকে ডাকিস।
ভাস্কর অসন্তুষ্ট মুখে সেলফোনখানা নিল। নামছে সিঁড়ি দিয়ে। দোতলার ল্যান্ডিং-এ সুষমা। ভাস্করকে দেখে তার চোখ গোল গোল, এ কী দাদা, কোথায় যাচ্ছ?
ভাস্কর কষ্ট করে হাসল, কোথাও না। এমনিই।
বেশি এদিক-ওদিক কোরো না। শরীর বুঝে বেরিয়ো।
তপ্ত হতে গিয়েও ভাস্কর হেসে ফেলল। বোঝো দশা! হাতি পাঁকে পড়লে চামচিকেতেও ভজন শোনায়! নীচে পাপান খেলছে, সেও না এবার বাপকে চাট্টি জ্ঞান ঝাড়ে!
ঘেরা কম্পাউন্ডে তিনখানা চারতলা বাড়ি। ইউ শেপের ফাঁকা জায়গাটিতে ক্রিকেট চলছে জোর। ব্যাট করছে পাপান, বাবাকে দেখে একবার হাত তুলল। যাক, ছেলে অন্তত রেহাই দিয়েছে। এক-পা, এক-পা করে ভাস্কর গেটের মুখে এল। চোখের সামনে চলন্ত দুনিয়া। ভেঁপু বাজিয়ে সাইকেলরিকশা ছুটছে, সুঁইসাঁই অটো। গাড়ি, ট্যাক্সিও যায় হুশহাশ। ফুচকার ঝাঁপি ঘিরে একপাল মেয়ে। রোল-চাউমিনের দোকানটায় খানেওয়ালাদের ভিড়। এক জোড়া একই ধাঁচের জিনস-টিশার্ট হেঁটে গেল সামনে দিয়ে। ছেলেটির পনিটেল, মেয়েটি বয়কাট। মেয়েটি একবার তাকিয়ে দেখল ভাস্করকে, আবার যেন দেখলও না। থলি হাতে কুলায় ফিরছে ঠিকে-কাজের মেয়েরা। কী তাদের হাঁটার স্পিড, বাপস্! গাদাখানেক প্যাকেট সাপটে চৈত্রসেলের বাজার সেরে আবাসনে ঢুকল পাপানের এক বন্ধুর মা। যেতে যেতে টুকরো হাসি উপহার দিয়ে গেল ভাস্করকে। দখিনা বাতাস বইছে আচম্বিতে, দেহ যেন জুড়িয়ে আসে।
আহ্, বেঁচে থাকায় বড় সুখ। কেন খামোখা মরবে ভাস্কর? রিপোর্ট আজ ভালই আসবে। নিশ্চয়ই ভাল হবে। হতেই হবে। উইলফোর্স বলে তো একটা ব্যাপার আছে, না কী?
একতলার বান্টি কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে বেরোচ্ছিল, দাঁড়িয়েছে ভাস্করকে দেখে। চোখ পিটপিট করে বলল, আপনি এখানে যে? শুনলাম আপনি বেড- রিডন?
আমি? শয্যাশায়ী?
কাল বউদির সঙ্গে দেখা। আপনার কাছে যাব ভাবছিলাম, শুনলাম আপনি বেডরেস্টে আছেন।
বেডরেস্টকে একেবারে বেড-রিডন বানিয়ে দিলে?
বছর পঁচিশেকের বান্টি এবার যেন লজ্জা পেয়েছে। হেসে বলল, যাক গে। ভাল থাকলেই ভাল। সোহিনী বউদি আপনাকে বলেছেন কিছু?
কী ব্যাপারে বলো তো?
এবার তো আমরা দুর্গাপুজো করছি। আমাদের এই ‘আশাবরী’র সবাই মিলে।
তাই নাকি? গ্র্যান্ড আইডিয়া। গত বছরের আগের বছর আমি তো মিটিং-এ পুজোর কথা পেড়েছিলাম, কেউ তখন গা করল না।
এখন অনেকেই খুব উৎসাহী। আমি, টোটোন, জন, কাবুলরা বসে একটা রাফ এস্টিমেটও বানিয়ে ফেলেছি। ছত্রিশটা ফ্ল্যাট থেকে হাজার টাকা করে চাঁদা মানে ছত্রিশ হাজার। আর যদি ষাট-সত্তর হাজার টাকার স্পন্সরশিপ জোগাড় হয়…
মাত্র লাখ টাকায় দুর্গাপুজো?
না হওয়ার কী আছে? আমাদের তো তেমন জাঁকজমকের প্রয়োজন নেই, আসল তো হল হইচই। পুজোর তিনটে দিন কোনও বাড়িতে হাঁড়ি চড়বে না, দু’বেলাই প্যান্ডেলে খাওয়া-দাওয়া… দু’দিন নিরামিষ, একদিন আমিষ…
আমিষ কবে হবে? নবমীতে?
অত এখনও ফাইনাল হয়নি। সবাই মিলে বসা হোক, আলোচনা হোক…। ভাবছি পয়লা বৈশাখ প্রশান্তকাকুকে একটা মিটিং ডাকতে বলব। নববর্ষের প্রীতি সম্মেলনও হবে, আবার পুজোর ব্যাপারটাও সেদিন…
দুর্গাপুজো তোলা কিন্তু মুখের কথা নয়। খাটাখাটুনির লোক পাবে তো?
আমরা আছি। মেয়েরাও আছে। কতজন বউদি-কাকিমা এখনই লাফালাফি শুরু করেছে, জানেন!
গুড। লাগাও তা হলে।
আপনাকে কিন্তু অ্যাড এনে দিতে হবে দাদা। প্লাস, খাটতেও হবে। আপনাদের এজ গ্রুপে আপনিই সবচেয়ে অ্যাজাইল।।
শুনতে ভালই লাগল ভাস্করের। তবু বলে ফেলল, কিন্তু শরীরের যা হাল হয়েছে…
আহা, তদ্দিন আপনি অসুস্থ থাকবেন নাকি? পুজো তো এখনও বহু দূরে।
শেষ শব্দ দুটো আচমকাই কাঁপিয়ে দিল ভাস্করকে। যদি রোগটা বেধেই থাকে, পুজো অবধি সে এই ধরণীতে আছে তো?
আপনা-আপনি ভাস্করের মুখটা মলিন হয়ে গেল। অস্ফুটে বলল, হুঁ।
পয়লা বৈশাখের গ্যাদারিং-এ নিশ্চয়ই থাকছেন?
দেখি।
সোহিনী বউদি তো খালি কেটে কেটে বেরিয়ে যান। আপনাকে কিন্তু চাইই চাই।
এমন আহ্বান হৃদয়কে দুলিয়ে দেয়। কিন্তু ভাস্করের হাতে কিছু আছে কি? ভাস্কর শুকনো হাসল, থাকলে আছি।
হেঁয়ালিটা বুঝল না বান্টি। অল্প হেসে বিদায় নিয়েছে। আস্তে আস্তে হেঁটে ভাস্কর পাপানদের খেলার জায়গাটায় এল। শুনছে তাদের হল্লাগুল্লা, দেখছে তাদের ছোটাছুটি। ফিল্ডিং-এও পাপানের মহা উৎসাহ, দৌড়ে দৌড়ে কুড়োচ্ছে বল। ছোট্ট হাতে ছুড়ছে অভ্রান্ত নিশানায়। ভাগ্যিস এই জমিটুকু ছেড়েছিল প্রোমোটার, নইলে কোথায় যে খেলত পাপানরা!
পকেটে মোবাইলের ডাকাডাকি। মা অধৈর্য হল নাকি? মাত্র তো আধঘণ্টা-চল্লিশ মিনিট বেরিয়েছে…এত ট্যাকট্যাক করলে চলে!
না, মা নয়। তরুণদা।
পলকে ভাস্করের স্নায়ু টানটান। পিঠে সেই বরফের আচড়।
ঢোক গিলে বলল, কী খবর তরুণদা?
এই তো…কেমন আছ তুমি?
যেমন থাকি। সকালে ডাউন, বিকেলে আপ।
কী করছ এখন?
এই তো…। ভাস্কর সতর্ক হল, জাস্ট টাইম পাস…
শুয়ে আছ?
হ্যাঁ…না…মানে…
বুঝেছি। টিভি খুলে বসেছ।
ঠিক তাও নয়…। ভাস্কর অসহজ বোধ করল। তরুণদা এমন খোঁচায়। কাঁহাতক না, হ্যাঁ, মানে মানে করা যায়! শেষমেশ বলেই দিল, নীচে একটু হাঁটছি।
এটা তো উচিত কাজ হচ্ছে না। কতবার বলছি, তোমার একদম স্ট্রেন নেওয়া চলবে না…। মা তোমাকে অ্যালাও করলেন?
ভাস্কর বুঝে গেল রহস্যটা। মা চুকলি খেয়েছে তরুণদাকে। এবং তরুণ ব্যানার্জি প্যাঁচ কষে কষে ভাস্করকে পেড়ে ফেলছে।
ক্ষুব্ধ স্বরে ভাস্কর বলল, আমার কি দরজার বাইরে পা ফেলার স্বাধীনতাটাও নেই তরুণদা?
ডোন্ট বি সেন্টিমেন্টাল। প্র্যাকটিকাল হও, প্র্যাকটিকাল হও। বোঝার চেষ্টা করো, আমি কী বলছি, কেন বলছি…। যতই যা হোক, তুমি তো পাপান নও!
হুঁ…। ভাস্কর ক্ষণকাল নিঝুম। তারপর সাহস সঞ্চয় করে বলে ফেলল, আমার রিপোর্টটা পেলেন?
হ্যাঁ…না…মানে…। এবার তরুণ আমতা আমতা করছে, এই তো, আনতে যাব।
রিপোর্ট নিয়ে এখানে আসছেন তো?
দেখছি। আগে তো ডক্টর সেনগুপ্তর কাছে নিয়ে যেতে হবে…
ভাস্কর জিজ্ঞেস করতে চাইল, কী বেরোল সেটা জানাবেন তো! শব্দ এল না গলায়। ফাঁসির আদেশ শোনার জন্য এর চেয়ে বেশি উৎসুক হওয়া কি সাজে আসামির!
ও প্রান্তে তরুণও নিশ্চুপ। কয়েক সেকেন্ড, নাকি অনন্তকাল পরে তার গলা শোনা গেল, ছাড়ছি।
ভাস্কর নিথর দাঁড়িয়ে রইল একটুক্ষণ। তারপর চলা শুরু করল, মন্থর পায়ে। হঠাৎই যেন অসম্ভব দুর্বলতা ভর করেছে সমগ্র দেহকাণ্ডে। হাঁটু থেকে পায়ের চেটো পর্যন্ত যেন অবশ। গলা, জিভ, ঠোঁট, সব বুঝি অসাড় হয়ে গেছে।
তবু টেনে টেনে হাঁটছিল ভাস্কর। সিঁড়ি ভাঙছিল। একটা একটা করে। মাত্র তিনতলা যেতে হবে, কিন্তু পথ যেন ফুরোয় না। নিজের বাড়ি তো যাচ্ছে ভাস্কর, সেটাও এত সুদূর!
আদৌ পৌঁছোতে পারবে তো? ভাস্করের সংশয় জাগছিল।
.
০৬.
ডক্টর সেনগুপ্ত হঠাৎ এই অসুখটাই সাসপেক্ট করলেন কেন?
না স্যার। উনি প্রথমে সেভাবে কিছু সন্দেহ করেননি। স্পন্ডিলাইটিসই ভেবেছিলেন। ঘাড়ব্যথা, মাথার যন্ত্রণার জন্য তখন পেনকিলার দেন। প্রবলেমটা রেকার করছে শুনে একটা ব্রেনস্ক্যান করতে বলেন। স্ক্যান রিপোর্ট দেখে উনি তৎক্ষণাৎ চেস্ট এক্স-রে করান, তারপর নিড্ল বায়োপসি। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে। যখন বায়োপসি রিপোর্টও পজিটিভ এল, উনি স্পেশালিস্ট কনসাল্ট করতে বললেন। পাঠালেন আপনার কাছে।
উম্।… রিপোর্টগুলো এনেছেন নিশ্চয়ই?
হ্যাঁ স্যার।
ফুসফুসের শল্যচিকিৎসক ডক্টর সমীর পালকে ফাইলটা বাড়িয়ে দিল তরুণ। কাজে কোনও ত্রুটি নেই তার, নিখুঁত সাজিয়ে রেখেছে রিপোর্টগুলো। পরপর উলটোচ্ছেন ডক্টর পাল। মাঝে মাঝে ভাঁজ পড়ছে কপালে। ভিউ-বক্সের আলো জ্বেলে এক্স-রে আর স্ক্যান প্লেট দুটো বসালেন একে একে। দেখছেন গভীর মনোযোগে।
তরুণের পাশের চেয়ারে সোহিনী। খানিক জড়সড় হয়ে বসে। পরশু তরুণের মুখে ফলাফলটা জানার পর থেকেই মস্তিষ্ক যেন ক্রিয়া করছে না। ভাস্করকে এড়াতেই বুঝি কাল অফিসে পালিয়েছিল, যন্ত্রের মতো কাজ করেছে দিনভর। আজ এই ডাক্তারের চেম্বারেও এল প্রায় রোবটের মতো। তার ভূমিকা এবার ঠিক কী, এখনও যেন ঠাহর হচ্ছে না।
ভিউ-বক্সের বাতি নিভল। ডক্টর সমীর পালের মুখ তাসম্ভব রকমের গম্ভীর। চোখ ঘুরিয়ে একবার সোহিনীকে দেখলেন, একবার তরুণকে। জিজ্ঞাসু দৃষ্টি সোহিনীতে থেমেছে, আপনি কি পেশেন্টের…?
মিসেস। তরুণের ঝটপট উত্তর, আমি ভগ্নীপতি। আই মিন, জামাইবাবু।
ও। সমীর ঠোঁটে ঠোঁট চাপলেন। স্থির চোখে কী যেন ভাবলেন একটুক্ষণ। সামান্য ঝুঁকে ফের সোহিনীকেই প্রশ্ন হেনেছেন, পেশেন্টের কি একটা সিম্পটমই ছিল? নেকপেন অ্যান্ড হেডেক?
সোহিনী অতি কষ্টে মাথা নাড়ল, হ্যাঁ।…আর তো কোনও কমপ্লেন শুনিনি।
তরুণ পাশ থেকে বলল, একটা ভমিটিং টেন্ডেন্সিও ছিল। মাঝে মাঝে মাথাও ঘুরত।।
উপসর্গটা কর্দিন চলছে?
একটু-আধটু তো বেশ কিছুদিন ধরেই ছিল। বেড়েছে এই দিন পনেরো-কুড়ি। তরুণ গলা ঝেড়ে বলল, আমায় যেদিন জানাল, সেদিন তো রীতিমতো কাহিল দশা। সারাদিন নাকি অফিসে কাতরেছে। তখনই আমি ডক্টর সেনগুপ্তর কাছে নিয়ে যাই। তার দু’দিন পরেই স্ক্যান।
ব্যথা কি সারাক্ষণ থাকে?
সেদিন ছিল। অফিসে পেনকিলার খেয়েও তেমন রিলিফ হয়নি, বিকেলের দিকে আবার বেড়েছিল। এখন সকালে বেশি সাফার করে। মাথা প্রচণ্ড ভারী হয়ে থাকে তখন। বেলা বাড়লে অবশ্য অনেকটা ইজি হয়।
হুউম। ইডিমার এফেক্ট।…উনি কি স্মোকার?
সোহিনী তাড়াতাড়ি বলল, না না, একদমই সিগারেট খায় না।
বোধহয় ঠিক বলছ না সোহিনী। এককালে তো খেত। নেশার দাস হয়ে পড়েনি অবশ্য। ছেড়েও দিয়েছিল।
কাশি-টাশি বেশি হয়? আই মিন, কাশি-টাশি হত কী?
তেমন তো দেখিনি। সোহিনী পলক ভাবল, ওই যেমন ঠান্ডা-টান্ডা লেগে সকলের হয়…কমেও যায়…
কাশির সঙ্গে রক্ত পড়েছে কখনও?
না, সেভাবে তো…
একবার পড়ে ছিল। বছর তিনেক আগে। আমি নিজেই ডাক্তারি করে অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্স করিয়েছিলাম। তাতে সেরেও গিয়েছিল।
সোহিনীর কানে খুট করে বাজল কথাটা। ভাস্কর তো তখন তাকে জানায়নি! কেন বলেনি? পাছে সোহিনী চেঁচামেচি করে, তাই? নাকি সোহিনীকে বলার তাগিদই অনুভব করেনি?
ডক্টর পাল এবার তরুণকেই জিজ্ঞেস করছেন, শিরদাঁড়া বা কোমরব্যথা কি ছিল পেশেন্টের?
না স্যার। তরুণের বেশ দৃঢ় জবাব, তা হলে তো আমায় বলত।
আপনার ওপর পেশেন্টের খুব কনফিডেন্স দেখছি!
ঠিক তা নয় স্যার। আমার বিয়ের সময়ে ও কলেজে পড়ে, তখন থেকেই…। আসলে নামে জামাইবাবু হলেও আমি প্রায় দাদার মতো। কিছু হলে আমাকেই প্রথম জানায়।
এই বাক্যগুলোও মোটেই সুখকর লাগল না সোহিনীর। হয়তো সাদা মনেই বলছে তরুণদা, তবু কোথায় যেন একটা খোঁচা লাগে। যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, সোহিনী কখনও ভাস্করের আপন হতে পারেনি।
আশ্চর্য, ভাস্করের এ হেন আচরণে সোহিনী ক্ষুণ্ণ হচ্ছে কেন? সে কি ভাস্করের ব্যাপারে পজেসিভ হয়ে পড়ল হঠাৎ? কিন্তু এমনটা তো হওয়ার কথা নয়! তবে কি সোহিনীর মানে লাগছে?
ডক্টর পাল আবার ভাস্করের ফাইল দেখছেন। কলম চালিয়ে খচাং খচাং গোল গোল দাগ মারলেন কয়েক জায়গায়। চোখ না তুলেই বললেন, রিসেন্ট পাস্টে পেশেন্টের তো কোনও ব্লাড টেস্ট হয়নি দেখছি। সাম্প্রতিক কালে জন্ডিস হয়েছিল কি?
না স্যার। তবে শাশুড়িমা বলছিলেন বেশ কিছুদিন যাবৎ খাওয়াটা কমে গেছে। তরুণের স্বরে এবার ঈষৎ উৎকণ্ঠা, স্যার, কন্ডিশন কেমন বুঝছেন?
খোলাখুলিই বলি। ডক্টর পাল কলমটা একবার ঠুকলেন টেবিলে। তারপর ডাক্তারি পরিভাষাতে বললেন, দিস ইজ আ ক্লাসিক কেস অফ স্কোয়ামাশ সেল কারসিনোমা। উইথ সেরিব্রাল মেটাস্টেসিস।
মানে?
যদিও ক্যান্সারটা ধরেছে রাইট লাঙে, কিন্তু সেটা ব্রেনেও ছড়িয়েছে। আই মিন, ব্রেনে ইডিমা ফর্ম করেছে। ব্রেন মেট্স হয়ে গেছে। বলেই সোহিনীর দিকে ফিরেছেন ডাক্তার, সরি মিসেস চ্যাটার্জি, আপনাকে কোনও আশায় বাণী শোনাতে পারছি না। অ্যাকর্ডিং টু সিটিএফএনএসি, পেশেন্টের কারসিনোমা এখন ফোর্থ স্টেজে। অর্থাৎ যথেষ্ট অ্যাডভান্সড।
ঘোষণাটুকু শেষ হতেই কয়েক পল গভীর নৈশঃব্দ্য। নিস্তব্ধতা এত প্রগাঢ়, নিজের হৃৎপিণ্ডের লাবডুবটাও শুনতে পেল সোহিনী। জোরালো টিউবলাইট জ্বলছে সুসজ্জিত চেম্বারে, তার দ্যুতি যেন নিষ্প্রভ সহসা। এসি মেশিনের তাপমাত্রাও বুঝি ঝুপ করে নেমে গেল অনেকটা। কম্প্রেসারের আওয়াজ কী প্রকট!
তরুণ বিড়বিড় করে বলল, এত বড় একটা রোগ দেহে বাসা বেঁধেছে, অথচ আগে থেকে কিছুই সেভাবে বোঝা গেল না!
ক্যান্সারের তো এটাই নিয়ম। নিঃসাড়ে ঘাতকের মতো হাজির হয়। কখনও ছোটখাটো ইঙ্গিত দেয়, কখনও তাও দেয় না। দিলেও সেটা এত সাধারণ, কারও পক্ষে গুরুত্বটা অনুমান করা সম্ভব নয়। আমরাই ধরতে পারি না। লক্ষণগুলো যখন প্রকাশ পায়, অনেক ক্ষেত্রেই তখন অসুখটা ধরাছোঁয়ার বাইরে।…বাই দা বাই, পেশেন্টের ফ্যামিলিতে কি ক্যান্সারের হিষ্ট্রি আছে?
জানা নেই। আমার শ্বশুরমশাই তো মারা গিয়েছিলেন হার্ট অ্যাটাকে।
দেখেছেন তো, হেরিডিটি ফ্যাক্টরটাও সবসময়ে পাওয়া যায় না!
তা হলে স্যার…আমাদের কি এখন কিছুই করার নেই?
তা তো বলিনি। এবং একজন ডাক্তার হিসেবে কখনই তা বলব না। বিরলকেশ সৌম্যদর্শন মধ্যবয়সি ডাক্তারের মুখে পেশাদারি হাসি, যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আশ। চেষ্টা তো চলবেই। এখনই ট্রিটমেন্ট চালু করতে হবে।
কীভাবে এগোবেন, যদি জানতে পারি…।
ও শিয়োর। ডক্টর পাল ঘুরনচেয়ারে হেলান দিলেন, আমরা চাইব, ম্যালিগন্যান্ট সেলগুলোকে আগে ডেসট্রয় করতে। এবং একই সঙ্গে দেখব, নতুন করে আর যেন ওই ধরনের সেল শরীরে গ্রো না করে।…তার কিছু প্রসিডিওর আছে। সারজিকালি লাম্পগুলোকে রিমুভ করতে পারি। রেডিয়েশন দিয়ে পুড়িয়ে দিতে পারি। কেমোথেরাপি দিয়ে মেরে ফেলতে পারি।
কোনটা করবেন? আই মিন, কোনটা করলে ভাল হয়?
সেটা তো এই মুহুর্তে আমি বলতে পারছি না ভাই। পেশেন্টকে ইমেডিয়েটলি হসপিটালে অ্যাডমিট করে দিন। তারপর অন্কোলজিস্ট, অন্কোসারজেন্টদের বোর্ড উইল ডিসাইড কোন লাইনটা ধরলে ঠিক হবে। তবে তাজ এ থোরাসিক সারজেন আমার মনে হচ্ছে, পেশেন্টের কারসিনোমাটা একটু বেশিই ছড়িয়েছে। লাং থেকে শুধু যে ব্রেনেই পৌঁছেছে তা নয়, ক্যারাইনও অ্যাফেক্টেড। অর্থাৎ বাঁ ফুসফুসকেও ধরে নিয়েছে। …স্টিল, আই উইল নট ডিসাইড এনিথিং নাউ। মেডিকেল বোর্ডের মতামতের জন্য অপেক্ষা করব।
পেশেন্টকে তা হলে কবে…?
কবে নয়। পারলে কালই। প্রচুর টেস্ট ফেস্ট করার আছে। পেশেন্টের কোন ধরনের ট্রিটমেন্ট কতটা নেওয়ার ক্ষমতা, সেটাও তো যাচাই করা দরকার।…সো, উই উইল পুট হিম টু অবজারভেশন ফার্স্ট।
কোথায় ভরতি করব স্যার?
যেখানে আপনাদের ইচ্ছে। তবে আমার মতে সব চেয়ে মডার্ন ইকুইপমেন্ট আছে যেখানে, সেখানে যাওয়াই শ্রেয়। সেদিক দিয়ে ভেনাস উইল বি দ্য বেস্ট। অবশ্য ওখানে খরচাটা একটু বেশি পড়বে…
তরুণ ঝলক সোহিনীকে দেখে নিয়ে বলল, আমরা এখন খরচের কথা ভাবছি না স্যার। টাকার চেয়ে জীবন অনেক বেশি মূল্যবান।
ডক্টর পাল বুঝেছেন সম্মতিটা। নিজের প্যাডে খসখস লিখে দিলেন ভরতির নির্দেশ। কাগজটা নিয়ে তরুণ উঠে পড়ল। সোহিনীও।
চেম্বারের বাইরে এসে তরুণ বলল, তুমি রাখবে এটা?
দিন। সোহিনী যেন কেমন ঘোরে। ফ্যাসফেসে গলায় বলল, ভাস্করকে কি তা হলে কালই…?
দেরি করার তো কোনও প্রয়োজন দেখি না।…তুমি কী বলো?
আপনি যা ভাল বোঝেন…।
সকালেই তবে চলে আসছি। টাইমটা রাতে ফোনে জানিয়ে দেব।
তার আগে হসপিটালে একবার কথা বলতে হবে না?
এখন সেখানেই যাচ্ছি। বন্দোবস্তটা এখনই সেরে আসি।
ও। কাগজটা তা হলে আপনিই রাখুন।
যেন এটা শোনারই অপেক্ষায় ছিল তরুণ। ছোঁ মেরে নিয়েছে কাগজটা। পকেটে রেখে হাঁটতে হাঁটতে পলিক্লিনিকটার বাইরে এল। সামনে চওড়া রাস্তা। ট্রাম-বাস-গাড়ি-ট্যাক্সি-অটোর ঠাসাঠাসি ভিড়, যানবাহনের বিকট নিনাদে চৈত্রসন্ধ্যার পেলবতা উধাও। ফুটপাথে হকারের মেলা, বর্ষশেষের কেনাকাটায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে অগণিত মানুষ, শান্তি মতো দু’পা হাঁটাই দুষ্কর। পেট্রল-ডিজেলের কটু ধোঁয়ায় চোখমুখ জ্বালা জ্বালা করে।
দাঁড়িয়ে পড়ে তরুণ ঘড়ি দেখল একবার। কেজো গলায় বলল, হসপিটাল যাওয়ার আগে তোমার সঙ্গে কয়েকটা কথা স্পষ্টাস্পষ্টি হওয়া দরকার।
বলুন?
আমরা সকলেই তোমার পাশে আছি। সাধ্যমতো করবও। কিন্তু…বুঝতেই পারছ, সামনে বিপুল খরচ?
হুঁ।
বাবুনের তো মেডিক্লেম আছে, তাই না?
হ্যাঁ। মা’র সঙ্গে জয়েন্ট।
ও। তোমাদের দু’জনের তো আলাদা আলাদা। ট্যাক্সের ব্যাপার!
হ্যাঁ। আমি আর পাপান একসঙ্গে।
বাবুনের ইনশিয়োরেন্সের অ্যামাউন্ট কত?
আগে তো দেড় দেড় মোট তিন লাখ ছিল। লাস্ট ইয়ার বাড়িয়েছে কি না আমি ঠিক…
নো প্রবলেম। পলিসি ডকুমেন্টটা বার করে রেখো। কাল লাগবে।…ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, তোমাদের সেভিংসে কেমন আছে?
আমার তো ধরুন…
তোমাদের জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট নেই?
না মানে…করা হয়নি…। সোহিনীর কথা বলতে আর ভাল লাগছিল না। তাদের যে কোনও সঞ্চয়ই যৌথভাবে নেই, জানাটা কি তরুণদার খুব দরকার? এই মুহূর্তে? সোহিনী গলা নিচু রেখেই বলল, টাকার চিন্তাটা আমার ওপর ছেড়ে দিন তরুণদা।
অল রাইট। তবে মনে রেখো, আমরাও আছি। তরুণ যেন অকারণেই তাকাল এদিক-ওদিক। স্বরে একটা ওজন এনে বলল, তোমার সামনে এখন কঠিন সময়, সোহিনী। মাথা কিন্তু ঠিক রাখতে হবে। শক্ত থাকতে হবে, ভেঙে পড়লে চলবে না।
হুঁ।
আর একটা কাজ। রাত্তিরে বাবুনকে ভাল করে একটু বুঝিয়ো। ডাক্তারবাবু যা বললেন, তার আভাস বোধহয় খানিকটা দিয়ে রাখা ভাল। নয় কি?
সোহিনীকেই বলতে হবে? উফ্।
তরুণের কথা ফুরোয়নি। ফের বলল, মাকেও আজ একটু সামলে রেখো। কাল রাত্তিরে উনি ভাস্বতীকে ফোন করেছিলেন, ভাস্বতী একটা এলোমেলো জবাব দিয়েছে। তার থেকে উনি হয়তো কিছু আঁচ করলেও করতে পারেন। সুতরাং বুঝতেই পারছ…মা যদি বাবুনের সামনে কান্নাকাটি শুরু করেন…না না, ওটা মোটেও ডিজায়েরেবল নয়। সেইজন্যই বলছি…
সোহিনীর এবার কানমাথা ভোঁ ভোঁ করছে। উফ্, তরুণদা কি থামতে জানে না?
তরুণ উপদেশ দিয়েই চলেছে। সোহিনীও প্রাণপণে অচল রেখেছে শ্রবণশক্তি। হঠাৎ কানে এল, আমি তা হলে এবার এগোই, কেমন?
ঘাড় হেলাল সোহিনী, আচ্ছা।
তুমি কি এখন সোজা বাড়ি?
ভাস্কর আর বনানীর মুখ এঙ্গে ঝলসে উঠল সোহিনীর চোখে। প্রায় আর্তনাদের সুরে বলল, না না, আমি এখন পণ্ডিতিয়া যাব।
হঠাৎ পণ্ডিতিয়া?
সোহিনী কয়েক সেকেন্ড পর থতমত খাওয়া স্বরে বলল, অনুপমের বাড়ি।
অনুপম? মানে বাবুনের সেই বন্ধু? তরুণ একটু যেন বিস্মিত চোখে দেখল সোহিনীকে। তারপর সহজ গলাতেই বলল, হ্যাঁ যাও। এই সময়ে তো বন্ধুবান্ধবদেরই বেশি কাজে লাগে।
তরুণকে পড়তে চাইল সোহিনী। পারল না।
অন্যমনস্ক মুখে মেজদার বক্তব্য শুনছিল অনুপম। বড়দা তো বটেই, সঙ্গে সেজদা-ফুলদার সম্পর্কেও তার ঝুড়ি ঝুড়ি অভিযোগ। দেবোপমকে বিপদের দিনে সে কতভাবে সাহায্য করেছে… রন্টুকে নাকি অনেক খেটেখুটে একটা চাকরি জোগাড় করে দিয়েছিল, রন্টু অবশ্য চালবাজি মেরে কাজটা খুইয়েছে…ঝন্টু একবার চিটিং কেসে ফেঁসে যাচ্ছিল, শেষ মুহূর্তে নিরুপমের হস্তক্ষেপে নাকি কোনওক্রমে বেঁচে যায়…। এত কিছুর প্রতিদানে নিরুপম মিত্তির নাকি দাদা আর জ্যাঠতুতো ভাইদের কাছ থেকে প্রবঞ্চনা ছাড়া কিছু পায়নি…। এখন প্রোমোটারদের সঙ্গে বসতে চায় নিরুপম, তাতেও সকলে ব্যাগড়া দিচ্ছে! নিরুপম যে ভাইবোনদের কথা মাথায় রেখে লাভজনক ডিল করবে, এটা নাকি তারা মানতে নারাজ।
অনুপমের পাগল পাগল লাগছিল। একটানা এত বকবক! অগত্যা মরিয়া হয়ে বলেই ফেলল, তুমিই বা এত ঝোলাঝুলি করছ কেন মেজদা? যে যা খুশি করুক, তোমার কী? তোমার তো একটা ফ্ল্যাট পেলেই হল।
বুঝছিস না অন্তু, মুখে ওরা যতই ফুটুনি মারুক, আসলে তো বোকার হদ্দ। প্রোমোটার ওদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে, ভুতি চুষে, বিচি ঠেকিয়ে চলে যাবে।
যাক না, তখন বুঝবে…
কিন্তু লসটা তোর আমারও হবে, নয় কি?
জুতসই একটা জবাব খুঁজছিল অনুপম, দরজায় শব্দ। সর্বনাশ, নির্ঘাত বড়দা! এবার দুই ভাইয়ে না শুম্ভ-নিশুম্ভর যুদ্ধ বেধে যায়!
শঙ্কিত মুখে খোলা দরজায় এল অনুপম! সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ ভোল্টের শক। সোহিনী! চোখ শুকনো খটখটে, মুখ কাগজের মতো সাদা।
এই সোহিনীকে অনুপম দেখেনি কখনও। ঠোঁট নড়ল সামান্য, তুমি!
এলাম। আর কার কাছে যাব, বলো?
সোহিনীর স্বর প্রায় কান্নার মতো শোনাল। আজ হোক, কাল হোক, তাকে এই সোহিনীর সম্মুখীন হতে হবে, এ তো অনুপম জানত। তা হলে অমন হতবুদ্ধির মতো দাঁড়িয়ে কেন? অভিনয়? আত্মপ্রতারণা? নাকি পরিস্থিতিকে শুধু আগাম অনুমানটুকুই করতে পারে মানুষ, সত্যি সত্যি সেই পরিস্থিতিতে পড়লে সে কী আচরণ করবে, তা বুঝি সর্বদা তার বশে থাকে না!
অতি কষ্টে অনুপম নিজেকে ধাতস্থ করল। দরজা ছেড়ে বলল, এসো।
কোনও দিকে না তাকিয়ে সোহিনী সোজা শোওয়ার ঘরে। অনুপম এক লহমা ন যযৌ ন তস্হৌ দাঁড়িয়ে। তারপর ফিরল মেজদার কাছে।
নিরুপম দেখেছে সোহিনীকে। নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল, সেই বউটা না?
আমার বন্ধুর স্ত্রী।
এখন হঠাৎ?
ও তো আসে মেজদা। তোমরা তো জানো।
সরাসরি বলে দেওয়ায় নিরুপম বুঝি অপ্রতিভ। থতমত মুখে বলল, তা বটে। তোর বউদির মুখে তো শুনি…
আমার বন্ধু খুব অসুস্থ, মেজদা। এখন ওর সঙ্গে আমার ইম্পর্ট্যান্ট কথা আছে। তুমি এবার এসো।
এমনভাবে তাড়ালে নিরুপমকে তো উঠতেই হয়। যাওয়ার সময়ে একবার টেরিয়ে দেখল শোওয়ার ঘরটা। সেটুকুও নজর এড়াল না অনুপমের, তবে সেভাবে গ্রাহ্য করল না। গ্রাহ্য করার মতো মানসিক স্থিতি এখন তার নেই। একটু বুঝি অধৈর্য হাতে ছিটকিনি তুলল দরজার। ঘরে এসে দেখল, সোহিনী বিছানায় বসে। নখ খুঁটছে। মাথা নামিয়ে।
স্নায়ু নিয়ন্ত্রণে রেখে অনুপম বলল, এত কী ভাবছ, সোহিনী?
চোখ তুলেছে সোহিনী। প্রায় শোনা যায় না এমন স্বরে বলল, নিজের কপালের কথা।
মানে? অনুপম দৃষ্টিতে বিস্ময় ফোটাল, ভাস্করের এক্স-রে-তে কি খারাপ কিছু…?
বায়োপসিও হয়ে গেছে অনুপম। রিপোর্টও পাওয়া গেছে। সোহিনী অস্থির ভাবে মাথা ঝাঁকাল, আমি ভাবতে পারছি না। কিছু ভাবতে পারছি না।
এর পর আর কোনও প্রশ্ন মানায় কী? যে-উত্তরটা সে আগেই বুঝে ফেলেছিল, খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সেটাই সোহিনীকে দিয়ে উচ্চারণ করানো তো নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু অজ্ঞতার ভানই বা কতক্ষণ চালানো যায়?
ঝাপসা স্বরে অনুপম বলল, শান্ত হও সোহিনী। আমি তো আছি।
কোথায় আছ তুমি? একটাও ফোন নেই…রিং করলে হয় বেজে যায়, নয়তো শুনি সুইচ অফ…মিসড কল দেখেও সাড়াশব্দ করছ না…! আমি তো তোমায় পাচ্ছি না অনুপম!
শেষ বাক্যটায় বুঝি কোনও দ্যোতনা ছিল। অন্তত সেভাবেই যেন অনুপমের কানে বাজল। ক’দিন ধরে সে এড়িয়ে থাকতে চেয়েছে সোহিনীকে। পালিয়ে পালিয়ে রয়েছে। যেন লুকিয়ে থাকাটাই আত্মরক্ষার বর্ম। যেন চোখ বুজে রাখলেই বন্ধ থাকবে প্রলয়।
কিন্তু এই মুহূর্তে সোহিনীর আকুলতা অনুপমের সমস্ত প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে দিল। কখন যেন তার হাত দুটো জড়িয়ে ধরেছে সোহিনীকে। প্রায় নিরুচ্চারে অনুপম বলতে লাগল, আমার ভুল হয়ে গেছে সোহিনী। ক্ষমা করে দাও, ক্ষমা করে দাও…
স্পর্শেই বুঝি সান্ত্বনা মেলে। স্পর্শেই বুঝি শীতল হয় জ্বালাপোড়া। অনুপমের বুকে মাথা রেখে সোহিনী কেঁদে ফেলল। কেঁদেই চলেছে।
তীব্র এক অপরাধবোধে বিদীর্ণ হচ্ছিল অনুপম। তার অন্তরের কোনও এক অতুল কুঠরিতে লুকিয়ে থাকা বাসনাটাই সত্যি হল শেষমেশ? সে চেয়েছিল বলেই না ভাস্করকে মারণব্যাধিতে ধরল! এ তোঅন্যায় তাকাঙক্ষা! এ তো পাপ! নাহ্, অনুপমের যুক্তিবাদী মন কিছুতেই নিজেকে বোঝাতে পারছে না, তার ইচ্ছে-অনিচ্ছের সঙ্গে ভাস্করের অসুখের কোনও সম্পর্ক নেই। থাকা সম্ভব নয়।
সোহিনীর কান্না থেমেছে। অনুপমের বাহুবন্ধন ছেড়ে সরে গেল একটু। চোখ মুছছে। মুখ টকটকে লাল। হাঁপাচ্ছে অল্প অল্প। হেঁচকি তুলছে।
অনুপম নরম গলায় বলল, একটু জল খাবে?
সোহিনী নাক টানল, দাও।
বুঝি এই অবকাশটুকুর বড় প্রয়োজন ছিল। জল আনতে গিয়ে অনুপম মনে মনে গুছিয়ে নিল নিজেকে। উঁহুঁ, আর আবেগ নয়, এবার সোহিনীকে সাহস দেওয়ার পালা।
এক চুমুকে সোহিনীর গ্লাস শেষ। অনুপম জিজ্ঞেস করল, আর খাবে?
নাহ্।…খুব তেষ্টা পেয়েছিল।
স্বাভাবিক। অনুপম গ্লাস রাখল টেবিলে। চেয়ার টেনে বসেছে। একটু ঝুঁকে বলল, ডাক্তারের সঙ্গে কথা হয়েছে?
ওখান থেকেই তো আসছি। কাল ভেনাসে ভাস্করের অ্যাডমিশান।
প্রথমে কি রেডিয়েশান দেবে?
জানি না। সোহিনী বড় একটা শ্বাস ফেলল, আমার তো বাড়ি ঢুকতেই আতঙ্ক হচ্ছে। কীভাবে যে ভাস্করকে ফেস করি…।
ভাস্কর কি এখনও জানে না?
আমি তো বলতে পারিনি, তবে মনে হয়…। সোহিনী বিহ্বল স্বরে বলল, পরশু রিপোর্টটা জেনেছি। তারপর থেকে যে কী পরিস্থিতির মধ্যে আছি…! পরশু ফিরে দেখি কেমন ভ্যাবলার মতো বসে আছে ভাস্কর! আমার দিকে ফ্যালফ্যাল তাকাচ্ছিল শুধু। সেই দৃষ্টিতে কোনও প্রশ্ন নেই, কৌতূহল নেই, বরি বাঁচার আর্তিটাও নেই। অ্যাবসোলিউটলি ব্ল্যাঙ্ক লুক।…রাত্তিরেও উঠে ঠায় বসে! কালও ঘুম ভেঙে দেখি একই দৃশ্য! পাছে জেগে গেছি টের পায়, মটকা মেরে পড়ে থাকছি।…ওদিকে ভাস্করের মা সারাক্ষণ এমন করুণ চোখে তাকিয়ে…আমি বাড়িতে তিষ্ঠোতে পারছি না অনুপম। এদিকে পাপানের কথাও মাথায় রাখতে হচ্ছে…
কিছু করার নেই, সোহিনী। রিয়্যালিটির সামনে দাঁড়াতেই হবে।
আছি তো দাঁড়িয়ে। আর কী করব?
ভাস্করকে ওর কন্ডিশনটা ডিটেলে জানিয়ে দাও। মাসিমাকেও। ধোঁয়া ধোঁয়ায় মাথার ওপর চাপ বেশি পড়ে। বরং সরাসরি জানার পর সত্যিটাকে অ্যাকসেপ্ট করা অনেক সহজ হয়।
আমি পারব না।
তা হলে তরুণদাকে বলো…
তরুণদাও তো কেটে কেটে বেড়াচ্ছে। দিদিরও তো আর দর্শন নেই। আমি যে এখন কী করি!
এমন এক ভারী আবহাওয়াতেও অনুপম হেসে ফেলল। শুকনো হাসি। পরক্ষণেই গম্ভীর হয়েছে, এত দুশ্চিন্তা করছ কেন? ভাস্কর তো জানবেই। কাল যখন হসপিটালে যাবে, অসুখটা আর গোপন থাকবে কি?
সেভাবেই জানুক। আমি কোনও বলাবলিতে নেই। রোগ বাধাল ভাস্কর, আর চুরির দায়ে ধরা পড়লাম আমি! সোহিনী হঠাৎই যেন খেপে গেল। গুমগুমে গলায় বলল, এখন তো মনে হচ্ছে, ভাস্কর আগেই জানত। আমার ওপর প্রতিশোধ নিতে ইচ্ছে করে অসুখটা গোপন রেখেছিল।
কী যা তা বকছ!
ঠিকই বলছি। অত মাথার যন্ত্রণা…আগে ভাল করে চেক-আপ করায়নি কেন? কাশির সঙ্গে রক্ত পড়েছে, সেটা পর্যন্ত আমায় বলেনি! এই চেপে যাওয়ার মানেটা কী? তখনই চিকিৎসা হলে হয়তো এমন ক্রিটিকাল স্টেজ অবধি পৌঁছোত না! আসলে ও সচেতনভাবে ভেতরে ভেতরে অসুখটাকে পুষেছে। বাড়তে দিয়েছে। যাতে পরে আচ্ছাসে আমায় টাইট দিতে পারে। ভাস্করকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি। হি ইজ সো মিন, সো ক্রুয়েল…
তো? তার জন্য তুমি নিশ্চয়ই ওর মৃত্যু চাইতে পারো না?
সোহিনী জোর হোঁচট খেয়েছে এবার। পলকে কেউ যেন রক্ত শুষে নিল তার মুখ থেকে। নির্জীব গলায় বলল, আমি কি তাই বলেছি?
তা হলে আর ওসব প্রসঙ্গ তুলো না। বরং ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা স্থির করো। ভাস্করকে এখন মনে বল জোগাতে হবে। তার অসুখটার সঙ্গে যুঝতে হবে।
কিন্তু আমাদের কী হবে অনুপম?
সোহিনীর স্বর হাহাকারের মতো শোনাল। কেঁপে উঠেছে অনুপম। চকিতে স্মরণে এল, শিকাগোয় তার সহকর্মী টমাস মুলবেরিরও একই উপসর্গ ছিল, ধরা পড়ল একই অসুখ। ডাক্তার বলেছিল, চিকিৎসা করালেও এমন সংকটজনক রোগীর আয়ু বড় জোর দু’বছর। সতেরো মাস পর শিকাগোর কবরে শোওয়ানো হয়েছিল টমাসকে।
ঘটনাটার উল্লেখ কি আশ্বস্ত করবে সোহিনীকে? নাহ্, উচিত হবে না, উচিত হবে না।
ঠান্ডা গলায় অনুপম বলল, এখন ওই সব ভাবার সময় নয় সোহিনী। সামনে যে-বিপদটা এসেছে, সেটার সঙ্গে আগে লড়াই করতে হবে। উই মাস্ট ফাইট ইট আউট।
বলছ?
অবশ্যই। মানুষ হিসেবে এটাই তো আমাদের ডিউটি। মন খারাপ কোরো না, আমি তোমার সঙ্গে আছি।
স্বচ্ছ স্বরে বলল অনুপম। বলে যেন ভারমুক্তও হল খানিকটা। পরক্ষণে বুকে পিঁপড়ের কামড়। যুদ্ধ তো লড়বে, কিন্তু কী চায় সে? জয়? না পরাজয়? উত্তরটা খুঁজে পাচ্ছিল না অনুপম।
.
০৭.
বাড়ি ফিরে জুতো-মোজা ছাড়ছিল তরুণ। উদ্বিগ্ন মুখে ভাস্বতী বলল, আজ এত দেরি হল যে?
যা একখানা ঝড় উঠল। ভেনাসের গেটেই তো টানা আধঘণ্টা আটকে।
ওদিকে বুঝি ঝড়বৃষ্টি হয়েছে? কই আমাদের এখানে তো…
আমি কি বানিয়ে বলছি?
ভাস্বতী সামান্য গুটিয়ে গেল। তার কর্মকুশল, বুদ্ধিবোঝাই স্বামীটিকে সে একটু সমীহই করে। চোরা চোখে তরুণের মনমেজাজ আন্দাজ করার চেষ্টা করল। সুবিধের ঠেকছে না। খুবই স্বাভাবিক, ক’দিন ধরে বাবুনের জন্য যা ছোটাছুটি যাচ্ছে মানুষটার! সারাদিন অফিস ঠেঙিয়ে সেই হাসপাতাল, সেখান থেকে এতটা পথ উজিয়ে বাড়ি…কম ধকল পড়ে! বেহালার এই জুবিলি পার্ক থেকে একদিন যাতায়াত করেই তো ভাস্বতী কাহিল। নাহ্, তরুণের সঙ্গে এখন সমঝে-বুঝে কথা বলা উচিত।
তোষামোদের সুরে ভাস্বতী বলল, এদিকেও একটা হাওয়া মতন উঠেছিল। কিছুই অবশ্য হল না শেষ পর্যন্ত।
কালবৈশাখী সর্বত্র একসঙ্গে হয় না। এটাই নিয়ম। বিজ্ঞ রায় দিল তরুণ। বেডরুমে যাচ্ছিল, থেমেছে হঠাৎ। দু’কান চেপে বলল, ওফ্, কী আওয়াজ।
হ্যাঁ, আওয়াজ একটা হচ্ছে বটে। তবে আওয়াজ না বলে নাদ বলাই শ্রেয়। কিংবা ব্রহ্মনাদ। সাউন্ড বক্সে ইংরেজি গান শুনছে রাজা। একতলা বাড়িখানা কাঁপছে থরথর।
অপরাধটা যেন তারই, এমন ভঙ্গিতে ভাস্বতী বলল, হ্যাঁ, বড্ড জোরে বাজায়।
এরপর তো পাড়াপড়শিরা বাঁশ নিয়ে আসবে। কমাতে বলতে পারো না?
বলি তো। শোনে কই!
আশ্চর্য, ছেলের ওপর এটুকু কন্ট্রোল নেই?
বলেই তরুণ সোজা রাজার দরজায়। আঙুল তুলে বলল কী যেন, ওমনি কমে গেছে ভলিউম। গর্বিত চোখে স্ত্রীকে ঝলক দেখল তরুণ, চলে গেছে শয়নকক্ষে।
ভাস্বতী সামান্য গলা ওঠাল, চা খাবে নাকি এখন?
খাব? সাড়ে ন’টা তো বাজে। ঠিক আছে, বানাও।
মাত্র মিনিট পাঁচেক সময়। ভাস্বতী যখন কাপ-ডিশ হাতে ঢুকল, প্যান্টশার্ট বদলে লুঙ্গি গলিয়ে নিয়েছে তরুণ। মুখ-হাত ধোওয়াও সারা, চোখে চশমা এঁটে ব্রিফকেস খুলে বসেছে।
টেবিলে চা রেখে ভাস্বতী বলল, এখন আবার কী কাজ?
বাবুনের পেমেন্ট আমার হাত দিয়ে হচ্ছে কিনা…রিসিটগুলো পর পর সাজিয়ে রাখছি।
টাকা দিতে হচ্ছে কেন? বাবুনের তো ইনশিয়োরেন্স আছে!
ক্যাশলেসের ফক্কিকারিতে যেতে দিলাম না। ওতে ঠকা হয়। পনেরো দিনেই বাবুনের লিমিট ক্রস করে যাবে।
টাকাপয়সার জটিল ব্যাপার-স্যাপার ভাস্বতী বোঝে না তেমন, তাই আর ঘটল না প্রসঙ্গটা। মূল প্রশ্নে চলে গেল, বাবুন আজ আছে কেমন?
একই রকম।
এখনও মনমরা?
সে তো থাকবেই। হাসিখুশি ক্যান্সার পেশেন্ট সিনেমা-টিনেমায় দেখা যায়। বাস্তবে নয়।
না, তা বলিনি। ভাবলাম যদি গোড়ার ধাক্কাটা একটু সামলে উঠে থাকে…
মৃত্যুর হুইসিল শোনার শকটা কি এক-দু’দিনে কাটে?
তরুণের এই ধরনের চাঁছাছোলা বাচনভঙ্গিতে অভ্যস্ত ভাস্বতী। তবু যেন ফুটল কথাটা। ভাই মরণাপন্ন জানে সে। কিন্তু শুনতে কি ভাল লাগে?
বেজার মুখে ভাস্বতী বলল, ডাক্তারবাবু আজ ফাইনাল কিছু জানালেন?
হ্যাঁ। অনেকক্ষণ কথা হল। ওরা প্রথমে রেডিয়েশানে যাচ্ছে। পরশু… মানে সোমবার থেকে চালু হবে।
ও। ক’দিন দেবে?
ছাব্বিশটার কোর্স। উইকে পাঁচ দিন করে।
ভাস্বতী মনে মনে হিসেব করল, তা হলে তো হসপিটালে অনেক দিন থাকতে হবে!
দেড় মাস মতো তো বটেই। তরুণ চায়ে চুমুক দিল। পুঁচকে একখানা স্টেপলার দিয়ে কাগজগুলো গাঁথতে গাঁথতে বলল, রেডিয়েশান শেষ হলেই তো সঙ্গে সঙ্গে ছাড়বে না। আগে শুধু লাঙে রেডিয়েশান দেওয়া হত, এখন ফুসফুস আর মাথা, দু’জায়গাতেই একসঙ্গে চলে। বড় স্ট্রেন যায় পেশেন্টের। সুতরাং আরও কয়েকদিন অবজারভেশনে তো রাখবেই।
ভাস্বতী বসল বিছানায়। তরুণের বর্ণনায় বুকটা কেমন ঢিপঢিপ করছে। ঢোঁক গিলে বলল, হ্যাঁগো, বাবুন ভাল হবে তো?
ঘাড় বেঁকিয়ে ভাস্বতীকে দেখল তরুণ। একটু যেন শ্লেষের সুরে বলল, তুমি তো দেখছি সোহিনীর দাদার মতো কথা বলছ!
কৌশিক আজ এসেছিল?
হ্যাঁ। বউ সমেত।
কী বলছিল?
তার তো হাত-পা ছেড়ে যাওয়ার দশা। কাজের কাজ করার ক্ষমতা নেই, খালি হাবিজাবি প্রশ্ন। রেডিয়েশানে লাঙের লাম্পগুলো পুড়িয়ে দিলে অটোমেটিকালি ব্রেনের ম্যালিগনেন্সি উবে যাবে কিনা, রেডিয়েশান যদি নিখুঁত জায়গায় না পড়ে তা হলে বাবুনের ক্ষতি হবে না তো, মোটামুটি কবে থেকে বাবুন নরমাল লাইফে ফিরবে, এইসব।
আহা, এগুলো তো স্বাভাবিক প্রশ্ন। আপনজনরা তো জানতে চাইবেই।
আমাকে কেন? গো অ্যান্ড আস্ক দা ডক্টর। নিজে জানো। তার বেলায় তো হাঁটু ঠকঠক।
জানোই তো কৌশিক একটু ভালমানুষ ধরনের।
উঁহু, এদের বলে আতাক্যালানে। নিকম্মার গোঁসাই। এই ধরনের ক্যারেক্টার দেখলেই আমার গা কিসকিস করে।
ভাস্বতী বলতে না চেয়েও বলে ফেলল, কিন্তু হেসে হেসে গল্প তো করো।
কারণ আমি ভদ্রলোক। অসভ্যতা আমার স্বভাব নয়। ব্রিফকেস বন্ধ করে উঠল তরুণ, আলমারি খুলে চালান করল অন্দরে। ফের চাবি লাগিয়ে বসেছে জানলার ধারে রাখা আরামচেয়ারটায়। তার প্রিয় আসন। নিলামঘর থেকে জলের দরে কিনেছিল বেতের কুর্সিখানা। হাতলে দু’বাহু ছড়িয়ে বলল, আমি শুধু লোকজনের আক্কেলটা দেখে যাচ্ছি।
আর কার কথা বলছ?
কাকে ছেড়ে কাকে ধরি! এই যেমন…বাবুনের শ্বশুরমশাই। চারদিন হল জামাই হাসপাতালে, অথচ একটিবারের জন্য তিনি মুখ দেখালেন না!
আসবেন হয়তো।
আর কবে আসবেন? জামাই বিছানায় পুরো লেটে গেলে?
আহা, এটা তো মানবে, মেসোমশাইয়ের বয়স হয়েছে। তাঁর নিজেরও শরীরের একটা ভালমন্দ আছে…
সত্তর বছরে মানুষ আজকাল মোটেই বুড়োয় না। আর উনি এমন কিছু অথর্বও বনে যাননি। আমাদের মতো ট্রামে-বাসেও চড়তে হয় না। গাড়িটি চেপে পুট করে শুধু আসা…শোভাবাজার থেকে বাইপাস কতটুকুই বা সময় লাগে! মেরেকেটে বিশ-পঁচিশ মিনিট! চাইলে বাবুনের শাশুড়িকেও আনতে পারেন।
তা ঠিক। তবে কী জানো…আচমকা এত বড় আঘাত…এ তো বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো। সইতেও তো সময় লাগে।
বাজ আমাদের মাথায় পড়েনি? আমাদেরও তা হলে হাসপাতালে না ছুটে ঘরে বসে শোক পালন করা উচিত।
সবাই কি এক ধাঁচের হয় গো? তা ছাড়া তুমি এসব পারো।
আত্মার টান থাকলে সবাই পারে। কেন, কৌশিকের যখন কিডনি স্টোন অপারেশন হল, মেসোমশাইকে আমি নার্সিংহোমে দেখিনি? আসল সত্যি হল, ছেলে আপন, জামাই পর।
ভাস্বতী একদমই মানতে পারল না কথাটা। সোহিনীর বাবা-মাকে সে যত দূর দেখেছে, জামাই সম্পর্কে তাঁরা অত্যন্ত স্নেহশীল। তার ওপর সোহিনী তাঁদের বড় আদরের মেয়ে, তার বিপন্নতায় মাসিমা-মেসোমশাই উদাসীন, ভাবনাটাই তো কষ্টকল্পিত। তবে তরুণ এভাবেই বলতে ভালবাসে, জানে ভাস্বতী। মানুষের ছোটখাটো ত্রুটিবিচ্যুতিগুলোকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখে তরুণ বুঝি খুব সুখ পায়।
চায়ের কাপ তুলে ভাস্বতী চলে যাচ্ছিল, আরামচেয়ার থেকে তরুণের ডাক, আজকের ইংরেজি পেপারটা দিয়ে যাও তো।
আনছি।
সিঙ্কে কাপ-ডিশ নামিয়ে ভাস্বতী বসার ঘরে এল। সেন্টারটেবিলে খুঁজছে দৈনিকটা। বাংলাটা রয়েছে, ইংরেজিখানা কোথায়? নির্ঘাত রাজার কীর্তি, পড়তে গিয়ে নিজের ঘরে ফেলে রেখেছে। হায়ার সেকেন্ডারি দিয়েছে ছেলে, জয়েন্টের পাটও শেষ, রাজার এখন অবসরই অবসর। দেরিতে উঠছে, খবরের কাগজে সিনেমা আর খেলার পাতা গিলছে, যখন তখন আড্ডা, ফোনাফুনি, গান, কম্পিউটার…। দুটো মাস রাজার এখন ভারী সুসময়।
ভাস্বতী ছেলের দরজা ঠেলল, ইংলিশ নিউজপেপারটা কি তোর কাছে?
গান বন্ধ করে রাজা এখন কম্পিউটারে। সলিটেয়ার খেলছে। না তাকিয়ে বলল, দ্যাখো বোধহয় বিছানায়…
ঠিক জায়গায় রাখতে পারিস না? তোর বাবা এত রাগ করে!
সরি মম। আমার ছাঁচটা আলাদা।
সে তো দেখতেই পাচ্ছি। বাবা একা ছুটে মরছে, তোর কোনও বিকার নেই!
ভালমামার ব্যাপারে বলছ?
নয় তো কার! মামা তোকে এত ভালবাসে, অথচ সে কেমন আছে তুই জানতে পর্যন্ত চাস না!
জানার তো কিছু নেই। মনিটর থেকে চোখ সরেছে রাজার, ভাল থাকার তো কথা নয়।
পরশু থেকে রে দেবে। টানা বেশ কিছুদিন।
ওটাই প্রসেস। সৌম্যর বাবাকেও তাই করেছিল, ওর বাবার অবশ্য হয়েছিল গলায়।
হয়েছিল মানে? এখন তিনি নেই?
বহাল তবিয়তে আছেন। অফিস-টফিসও যাচ্ছেন। শুধু ভয়েসটা নষ্ট হয়ে গেছে, এই যা।
ওহ্। ক্যান্সার তা হলে সারে?
কেন সারবে না? আফটার অল অসুখ তো। ঠিকঠাক ট্রিটমেন্ট হলে কিয়োর না হওয়ার তো কারণ নেই। অবশ্য ভালমামার কেসটা একটু জন্ডিস হয়ে গেছে। লেটে ধরা পড়ল তো।
মামার জন্য তোর মন খারাপ হচ্ছে না?
হুম্, কী যে একটা বাধাল! এখন রেডিয়েশান, কেমো…কড়া কড়া পেনফুল ট্রিটমেন্ট…! রাজার ভুরুতে পাতলা ভাঁজ পড়েই মিলিয়ে গেল। উঠে এসে মা’র কাঁধে আলগা চাপড় দিয়ে বলল, কিচ্ছু ভেবো না। মামার হেভি কশ আছে, ঠিক পার হয়ে যাবে। অ্যাডমিশনের দিন তো বলে এসেছি, টেনশান ঝেড়ে ফেলো, দেখবে অসুখ অর্ধেক হাপিস হয়ে গেছে।
হোক না ছেলে ছোট, তবু তার আশাবাদী মানসিকতায় ভাস্বতী বুঝি খানিকটা প্রভাবিত হল। পায়ে পায়ে গিয়ে কাগজটা দিল তরুণকে। তারপর বিছানায় বসে যেন আপন মনেই বলল, এবার থেকে হসপিটালে যখন যাব, খুব চিয়ার আপ করব বাবুনকে।
তরুণ শেয়ারের পাতা খুলেছে। মিউচুয়াল ফান্ডে টাকা রাখে নিয়মিত, দেখছে বাজারের ওঠাপড়া। গ্রাম্ভারি গলায় বলল, বেশ তো, কোরো।
ওর ভেতর একটা পজিটিভ চিন্তা ঢুকিয়ে দেওয়া দরকার। যাতে ফাইটিং ম্পিরিটটা বাড়ে।
উম, এই উপলব্ধিটুকু যদি তোমার ভাইয়ের বউয়ের একটু থাকত!
কেন, সে কী করেছে?
বরকে হাসপাতালে পুরে দিয়েই যেন দায়িত্ব ফিনিশ।
সোহিনী আজ যায়নি? কাল তো ছিল!
ছিল তো আজকেও। সারাক্ষণ। ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করল, যারা আসছে তাদের মিট করছে, কিন্তু বরের ত্রিসীমানায় ঘেঁষছে না!
কাল সোহিনী বলছিল বটে বাবুনের সামনে গেলে তার গা ছমছম করছে। তাই কি…? দু’-এক সেকেন্ড থেমে থেকে ভাস্বতী বলল, সোহিনী আজ একবারও বাবুনের কেবিনে যায়নি?
নিয়মরক্ষেটুকু করেছে। তবে ঢুকে কোথায় একটু পাশে বসবে, মাথায় হাত বুলোবে তা নয়,…দু’মিনিটেই আউট। কাগজ ভাঁজ করে আড়মোড়া ভাঙল তরুণ, জানি না বাবা, এতকাল পাশাপাশি থেকেও বরের ওপর কেন যে এত কম টান!
মা-ও প্রায় একই ধরনের অভিযোগ করে বটে। কিন্তু বাবুনের জন্য কেন সোহিনীর টান থাকবে না? বাবুন যেমন ছেলে…সাদাসিধে, প্রাণবন্ত, মনে কোনও প্যাঁচ নেই, বউয়ের ওপর কখনও জোর খাটায় না…মেয়েরা তো এমন বরই পছন্দ করে। আর সোহিনীও মোটেই বজ্জাত টাইপ নয়। একটু দেমাকি, তবু মোটের ওপর তো সভ্যভব্যই। ভাস্বতীর সঙ্গে হয়তো তেমন সখিত্ব গড়ে ওঠেনি, তবে তাকে যথেষ্ট সম্মান দেয়। আগে তো বাড়িতে কথাই বলত কম, ইদানীং নাকি একটু মুখরা হয়েছে। বাবুনের ওপর নাকি খুব চোটপাট করে আজকাল। মা’র সঙ্গেও ব্যবহার ভাল করে না। তা সোহিনীর মতো একটা উঁটিয়ে চাকরি করা মেয়ে ভাস্বতীর মতো পাপোশ-গৃহবধূ হয়ে থাকবে, এমন আশা করাও তো ভুল। নিজের সংসারে নিজের ভাল লাগা, মন্দ লাগা নিয়ে তর্ক করতে পারবে না?
খানিক উদাস মুখে ভাস্বতী বলল, কাউকে কাউকে দেখে ওরকম মনে হয় গো। তাদের ভেতরে কী চলে, বাইরে প্রকাশ পায় না। পা ছড়িয়ে বসে কাঁদলেই কি বেশি প্রেম দেখানো হয়?
কী জানি! আমি হলাম মোটা বুদ্ধির লোক। গাধার মতো শুধু খাটতে পারি, হৃদয়মনের কারবার, অত বুঝি না। চোখ যা দেখায়, সেটাই সম্বল।
সুক্ষ্ম বিদ্রূপটা হজম করে নিল ভাস্বতী। তরুণের স্বভাব তো সে জানে। মুখে যতই যার নিন্দেমন্দ করুক, লোকের জন্য প্রাণপাত করে তো। তা ছাড়া বাবুনের ভার যে স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলেছে, তার কথার মারপ্যাঁচটুকু না খুঁজে কৃতজ্ঞই তো থাকা উচিত ভাস্বতীর। নয় কি?
ভাস্বতী হেসে বলল, এখন আর একটা যে স্থূল কাজ তোমায় করতে হবে!
কী?
একটু পরিশ্রম করে খেতে চলো।
খাওয়াটাও কি কম খাটুনির! তরুণও হাসছে এবার, তোমার কমলারানির রুটির যা ছিরি, ছিঁড়তে জীবন বেরিয়ে যায়।
আজ তিনি বিকেলে ডুব। রুটি আজ আমার শ্রীহস্তে গড়া। সুধা মিশিয়ে দিয়েছি। তুলতুলে মাখনের মতো লাগবে।
রসিকতাটুকু ছুড়ে ভাস্বতী হাসতে হাসতে রান্নাঘরে। খাবার-দাবার গরম করছে। রসুইঘরটি বেশ বড়সড়, কাজ করতে সুবিধে হয়। তরুণই বুদ্ধি করে এমনটা বানিয়েছে। জুবিলি পার্কে এই সওয়া দু’কাঠা জমিটা সস্তায় কিনে অনেকদিন ফেলে রেখেছিল তরুণ। ঠিকঠাক টাকাপয়সার বন্দোবস্ত করে বছর দুয়েক হল বাড়িখানা তুলেছে। সুষ্ঠু নকশার চমৎকার গৃহ। প্রতিটি ঘর, রান্নাঘর, বাথরুম, বারান্দা, সবেতেই তরুণের বিচক্ষণ পরিকল্পনার ছাপ স্পষ্ট।
টেবিল সাজিয়ে ভাস্বতী রাজাকেও খেতে ডাকল। কানে মোবাইল চেপে এল রাজা, বাবাকে দেখে বন্ধও করল চটপট। চেয়ার টেনে ভাস্বতীকে বলল, আজ কী মেনু, মা?
পাত্রগুলো নিরীক্ষণ করে তরুণই জবাব দিল, মাখন মাখন চাপাটি। নভ্রতন কোর্মা, মানে তোর মা’র পাঁচমেশালি তরকারি। আর গ্রেভি টিক্কা, মানে মাছের ডিমের ডালনা। ডেজার্টও আছে। বোঁদে।
রাজাকে খুব একটা আমোদিত মনে হল না। বেজার মুখে রুটি ছিঁড়ছে। ছেলের পাতে তরকারি দিয়ে ভাস্বতী তরুণকে জিজ্ঞেস করল, বাবুনের অফিসের কেউ এসেছিল আজ?
এক পিস। তুহিন বেরা। খিটকেল লোক। বাবুনের হাল জানার যত উৎসাহ, তার চেয়ে খরচ কী হচ্ছে তাতে বেশি কৌতূহল।
ও হ্যাঁ, জিজ্ঞেসই তো করা হয়নি। ভাস্বতীও খেতে বসেছে, রেডিয়েশানে কীরকম পড়বে?
আমরা প্যাকেজে গেলাম। এক লাখ তিরিশ। ক্যাশলেসে ওটাই পনেরো-বিশ বেড়ে যেত।
ওই টাকায় কী দেবে? শুধু রেডিয়েশান?
বেড চার্জও আছে। প্লাস, স্ট্যান্ডার্ড মেডিসিন। তার বাইরে ওষুধ লাগলে আলাদা পেমেন্ট। সর্বক্ষণ দেখভালের লোক রাখলে তার চার্জও এক্সটা।
তুমি ডিসকাউন্ট করাতে পারো না? তোমার কোম্পানির থ্রু দিয়ে?
হসপিটাল-নার্সিংহোমে চার্জ কমানো যায় নাকি? বাড়তি ওষুধ-টষুধগুলোয় হয়তো খানিকটা ছাড় করাতে পারব। খেতে খেতে চোখ তুলে তাকাল তরুণ, তাও আমার দরাদরির ইচ্ছে ছিল। কিন্তু অনুপম বলল, চার্জটা নাকি খুবই মডারেট। দেখলাম সোহিনীও তাতে সায় দিল…
অনুপম আজও এসেছিল?
ও তো এঁটুলির মতো সোহিনীর সঙ্গে সেঁটে আছে। সোহিনী আরএমও-র রুমে গেল, পিছন পিছন অনুপম! সোহিনী লাউঞ্জে, পাশটিতে অনুপম! শুধু টয়লেটটাতেই যা এন্ট্রি পাচ্ছে না!
যাহ্, তুমি বড্ড আজেবাজে বকো। ছেলেটা কত উৎকণ্ঠা নিয়ে বন্ধুর জন্য হাজির থাকছে!
দ্যাখো, ফ্র্যাঙ্কলি বলছি। ও যে বাবুনের এত ক্লোজ, এটা আমার জানা ছিল না। এবং বাবু অনুপম কতটা বন্ধুঅন্তপ্রাণ, কতটা বন্ধুপত্নীঅন্তপ্রাণ, তা কিন্তু এখনও আমার নিরেট মগজে ঢোকেনি।
ফের বাজে কমেন্ট? আমার ভাল্লাগে না।
আমারও না। বরের কন্ডিশন স্বকর্ণে শুনেও বউ যখন বাড়ি না ছুটে বরের বন্ধুর কাছে দৌড়োয়, আমাদের মতো ইতরজনের চোখে দৃষ্টিকটু তো ঠেকেই।
কী জানি বাবা, এটা কেন দোষের? অনুপম তো সোহিনীরও বন্ধু। বিপদ-আপদে মানুষ তো ফ্যামিলি-ফ্রেন্ডের কাছেই যায়।
সব ঠিক। সব মানি। তাও আমি জাস্ট জানতে চাইছি, ও এখন কার বন্ধু? বাবুনেরও? নাকি শুধুই সোহিনীর?
রাজার দৃষ্টি ঘুরছে ঘনঘন। একবার মাকে দেখছে, একবার বাবাকে। ঘোরতর অস্বচ্ছন্দ বোধ করছিল ভাস্বতী। বাইরের জগতে তরুণ চরম ধোপদুরস্ত, কিন্তু বাড়িতে তার মাত্রাজ্ঞান এত কম! ছেলের সামনে কেউ এধরনের মন্তব্য করে? মামি সম্পর্কে কী ধারণা হচ্ছে রাজার? এরপর হয়তো কোনওদিন পাপানের সামনেও…
ভাস্বতী আর রা কাড়ল না। নিঃশব্দে শেষ করছে আহার। তরুণ আর রাজা উঠে যাওয়ার পর খাবার-দাবার ফ্রিজে তুলল, এঁটো বাসন ভাঁই করল সিঙ্কে। তারপর ড্রয়িংরুমে এসে প্রিয় টিভি সিরিয়ালটা খুলে বসল। মন লাগছে না। তরুণের ইঙ্গিতটা বারবার টোকা দিচ্ছে মস্তিষ্কে। তরুণটা যেন কী! মা’র মতো বয়স্ক শাশুড়ির সন্দেহটা তাও মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু তরুণের মতো এক আধুনিক পুরুষের কি এমনটা সাজে? হ্যাঁ, খচখচানি একটা ভাস্বতীরও আছে। যতই সে ভাবার চেষ্টা করুক, বাবুন আর সোহিনীতে মিলমিশ না হওয়ার কোনও কারণ নেই, বাবুনও ভাল, সোহিনীও খারাপ নয়…তবু দু’জনে দ’খানা আলাদা প্রাণী তো বটে। তাদের সম্পর্কে কতটা চিড়, ভাস্বতী কী করে জানবে? অনুপম-সোহিনীর সম্পর্কটাই বা ঠিক কেমন, তাও তো ভাস্বতীর অজানা। যদি অন্যরকম ঘনিষ্ঠতা থাকেও ভাস্বতীর কী করার আছে? হয়তো অনুপমের মধ্যে এমন কিছু আছে, যা সে বাবুনের কাছে পায়নি! ব্যভিচার, ব্যভিচার করে চেঁচিয়েও তো কোনও লাভ নেই। দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষকে লক্ষ্মণরেখা টেনে পৃথক রাখা যায় কি? আর স্বয়ং বাবুন যখন সম্পর্কটাকে মন্দ চোখে দেখে না, অন্যরা কেন ঘোঁট পাকাবে? সবচেয়ে বড় কথা, বাবুনের এই দুঃসময়ে অনুপম স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে যেটুকু পারছে, করছে। এটাকেও কি বাঁকা চোখে দেখা শোভন?
তবু যেন খুঁতখুঁতুনি একটা থেকেই যায়। তার একমাত্র ভাইটা, মাত্র বিয়াল্লিশ বছর বয়সে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা কষছে, কে জানে হয়তো হেরেই যাবে, অথচ সোহিনী প্রবলভাবে বেঁচে থাকবে, হয়তো ওই অনুপমকে নিয়ে…মনে হলেই কেমন জ্বালা ধরে বুকে। সহস্র যুক্তিও সেই জ্বালা জুড়োতে পারে কই!
ওই জ্বালাই বুঝি ঠেলল ভাস্বতীকে। হাত যেন অজান্তেই তুলল রিসিভার। টিপছে বাপের বাড়ির নম্বর। সোহিনীর সঙ্গে সোজাসুজি কথা হয়ে যাওয়াই ভাল।
বার চারেক রিং বাজার পর ওপারে বনানীর ভয়ার্ত গলা, কে বলছেন? কোত্থেকে বলছেন?
ঝাঁকুনি খেয়ে সমে ফিরতে একটু সময় লাগল ভাস্বতীর। থেমে থেমে বলল, আমি বুলু, মা।
ও।…এত রাতে তুই…?
শুয়ে পড়েছিলে?
আর কী করার আছে? ঠাকুরের কাছে এখন একটাই প্রার্থনা, চিরকালের মতো শুইয়ে দাও।
ধ্যাত, ওসব বলতে নেই।
বলতে কি চাই? বেরিয়ে যায়। ঠাকুর যে আমায় কোন পাপে এই যন্ত্রণাটা দিলেন!
কিছুই শেষ হয়নি মা। যিনি যন্ত্রণা দেন, তিনিই যন্ত্রণা হরণ করেন। বাবনের চিকিৎসা তো শুরু হয়েছে, দ্যাখো না ও এবার…
ভাল হলেই মঙ্গল। বনানীর স্বর কাঁপছে, যদি না হয়, আমার যে শেষ বয়সে কী গতি?
মা, তোমার মেয়ে-জামাই কি মরে গেছে? কক্ষনও আর ও কথা উচ্চারণ করবে না।
ঠিক আছে। বাদ দে। ওপারে বনানী জোরে নাক টানল, কী বলছিলি বল?
এমনিই। দুটো কথা বলতে ইচ্ছে হল। পাপান ঘুমিয়েছে?
বহুক্ষণ।
সোহিনী?
সেও শুয়েছে। ছেলে নিয়ে। কেন, তাকে ডাকব? দরকার?
ক্ষণিক ভাবল ভাস্বতী। ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল, নাহ্, থাক।
.
০৮.
বাহু থেকে কালো ফেট্টিটা খুলে নিল সিস্টার। সরু লম্বাটে বাক্সে ভাঁজ করে রাখছে। খটাস ডালা বন্ধ করে ভাবহীন গলায় বলল, হাঁ করুন।
কলের পুতুলের মতো চোয়াল ফাঁক করল ভাস্কর। তার বিয়াল্লিশ বছরের জীবনে হাসপাতালবাস এই প্রথম। তবে টানা সতেরো দিনে রুটিন প্রক্রিয়াগুলোতে সে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। জানে, এখন তাপমান যন্ত্রটি মুখে গুঁজে দিয়ে বড় জোর তিরিশ সেকেন্ড ঘরের চতুর্দিকে চোখ ঘুরবে সিস্টারের, তারপর থার্মোমিটার সুড়ুৎ টেনে শূন্যে ধরে দেখবে, দু’সেকেন্ডের মধ্যে চালান করবে স্বস্থানে। নাড়ি, রক্তচাপ, আর দেহতাপ মাপার রুটিন কর্মটি সেরে খুটখুট বেরিয়ে যাবে অতঃপর।
সেবিকাদের দ্রুত প্রস্থানে প্রায়শই বাধা সৃষ্টি করে ভাস্কর। কখনও খবরের কাগজখানা চায়, কখনও মোবাইলটা চার্জে বসাতে অনুরোধ করে, কখনও বা বাথরুমে যাওয়ার অছিলায় দাঁড় করিয়ে রাখে। কিংবা নেহাতই গল্প জোড়ে হাবিজাবি। যতটুকু মানুষের সাহচর্য পাওয়া যায় আর কী।
আজও আটকাল লম্বা মতন মেয়েটাকে। জিজ্ঞেস করল, কেমন দেখলেন সিস্টার?
শুভ্রবসনা ঘুরে তাকিয়েছে, কী?
এই যে…মাপজোপ করলেন…
ঠিকই তো আছে।
আমি কিন্তু ঠিক বোধ করছি না। কেমন জ্বর জ্বর লাগছে।
ও কিছু নয়। উইকনেস থেকে ওরকম মনে হয়। আপনার টেম্পারেচার এখন একদম নরমাল।
আর ব্লাড প্রেশার?
যেমন থাকা উচিত, তেমনটিই আছে।
বলছেন?
হ্যাঁ হ্যাঁ। আপনি শুয়ে পড়ুন।
ক’টা বাজে এখন?
মাথার ওপরেই তো ঘড়ি…! দশটা চল্লিশ।
তা হলে তো সকালের ভিজিটার্স টাইম এসে গেল। এখন আবার শোব?
তবে নিউজপেপার পড়ুন।
উলটোনো হয়ে গেছে। বেশিক্ষণ তো পড়া যায় না, মাথা ঝিমঝিম করে।
তা হলে মোবাইলে গান শুনুন।
বলেই সিস্টার কাট। আর কিছু কি জিজ্ঞেস করা যেত মেয়েটিকে? ভাস্কর মনে করতে পারল না। শরীর নিয়ে আরও প্রশ্ন করেই বা কী লাভ? সত্যি তো কেউ বলবে না, বাঁধা গৎ আউড়ে যাবে। প্রথম পাঁচ দিন রেডিয়েশনের পর যখন জ্বরটা এল, তখন তো গোড়ায় এরা চেপে যাচ্ছিল। ভাস্কর নিজে টের পাচ্ছে সর্বাঙ্গে কাঁপুনি, শীত শীত ভাব, হাড়েমজ্জায় ব্যথা, অথচ ডাক্তার-নার্স খোলামনে স্বীকারই করতে চায় না। জানতে চাইলে ফাটা রেকর্ড, ও কিছু না, সামান্য গা ছ্যাঁকছ্যাঁক, ওষুধ পড়েছে, ঠিক হয়ে যাবে…! অথচ টানা তিন দিন রইল জ্বরটা। এই যে এখন সিস্টার বলল ভাস্করের সবই নাকি স্বাভাবিক, এও কি বিশ্বাস্য? নিশ্চয়ই চেপে যাচ্ছে! নিশ্চয়ই চেপে যাচ্ছে!
ভাস্করের এই উপসর্গটা বেড়েছে ইদানীং। আগে হঠাৎ হঠাৎ ভাবত, এখন সর্বদাই মনে হয়, তাকে ঘিরে যে পৃথিবীটা আবর্তিত হচ্ছে, তা শুধুই ছলনায় ভরা। কেউ তাকে সত্যি বলে না, কেউ না। মা যে মা, সেও এসে ভান করে, যেন আজ বাদে কাল ছুটি হয়ে যাবে ভাস্করের! আর তার পরদিনই লাফাতে লাফাতে অফিস ছুটবে ভাস্কর! বিষাক্ত রশ্মি যতই তার মস্তিকে আঘাত হানুক, এখনও তো সে তার বোধবুদ্ধি হারায়নি! প্রতিটি স্তোকবাক্য সে ধরে ফেলছে, এটা কেন বোঝে না কেউ! এখন তো তার বেঁচে থাকার অর্থ শুধু প্রহর গোনা, তার বেশি আর কিছু নয়!
খবরের কাগজটা বালিশের পাশে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও টানল ভাস্কর। ষষ্ঠ পাতায় বড় করে একটি সংবাদ। ক্যান্সারের চিকিৎসায় নতুন আবিষ্কার। পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে কী এক ওষুধ বার করেছে দুই জার্মান গবেষক। ইঁদুরের ওপর প্রয়োগ করে আশ্চর্য সুফল পাওয়া গেছে। ডাক্তাররা আশা করছে মানুষের ক্ষেত্রেও চমকপ্রদ কাজ দেখাবে ওই ওষুধ। যত্ত সব গালগপ্পো! যেন ভাস্করের জন্যই সাজানো! কেন যে এসব মিথ্যে কথাগুলো ছাপায়! ভাস্কর তো জেনেই ফেলেছে, সংবাদপত্র যে দুনিয়াটার কথা বলে, সেটা অস্তিত্বহীন! কিংবা কোনও সুদূর মহাশূন্যে বিরাজমান! শুধু সান্ত্বনা দিতে ওই অলীক জগৎটাকে মেলে ধরা হচ্ছে ভাস্করের সামনে! বোগাস, বোগাস, অল বোগাস!
বাথরুম যেতে হবে। কাগজটা ঠেলে সরিয়ে ভাস্কর বেড থেকে নামল। হাঁটুর জোর কমে গেছে, পা দু’খানা যেন টলমল করে। ডাক্তার বলেছে বাথরুম যাওয়ার সময়ে ভাস্কর যেন সিস্টারদের ডাকে, এখন বেল টিপতে ইচ্ছে করল না। যে-কোনও মুহূর্তেই তো মরে যেতে পারে ভাস্কর, সামান্য মাথা ঘোরার আশঙ্কা তাকে কি মানায়?
সবে ভাস্কর পেচ্ছাপ সেরে ফিরছে, কেবিনে তরুণ। পুরোদস্তুর ফিটফাট, হাতে ব্রিফকেস।
চোখ পাকিয়ে তরুণ বলল, কাউকে না ডেকে বাথরুমে গেছ যে বড়?
নিজের অবাধ্যতায় ভাস্কর ঈষৎ অপ্রস্তুত। চুপচাপ বিছানায় বসেছে।
তরুণ ফের বলল, ছোটখাটো অনিয়মগুলো ভাল নয়, বাবুন। আচমকা কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে সবাইকে তো হায় হায় করতে হবে।
ভাস্কর আলগা হাসল। সেই হাসিতে যতটা কষ্ট, ততটাই যেন ব্যঙ্গ। তরুণের উদ্বেগ উপেক্ষা করেই বলল, আজ সকালে কেন?
এলাম। হাতে খানিকটা সময় ছিল। ওবেলা পেরে উঠব না।
রোজ রোজ হাজিরা দেওয়ারই বা কী দরকার?
শালাটাকে না দেখে থাকতে পারি না যে। তরুণের কণ্ঠে স্বভাববিরুদ্ধ রসিকতা। হাসি হাসি মুখেই বলল, তা ছাড়া শালার বউ শুনলাম আটকে যাচ্ছে …
সোহিনী আজ আসবে না?
আসবে, আসবে। বিকেলে। এখন পাপানের স্কুলে গার্জেনস মিটে গেছে।
খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। অবিশ্বাসের কোনও কারণ নেই। তাও যেন প্রতীতি হল না ভাস্করের। কে জানে, হয়তো নিজের কোনও কাজ সারছে সোহিনী। সকলেই তো কাজের মানুষ, রেসের মাঠের বাতিল ঘোড়া তো নয়! যার জন্য বন্দুকের ট্রিগার অপেক্ষা করছে।
তরুণ টুল টেনে বসেছে। গলা ঝেড়ে বলল, তোমার নামে কিন্তু আজও কমপ্লেন আছে। ব্রেকফাস্ট নাকি পুরোটা খাওনি? ডিমসেদ্ধ ফেলে দিয়েছ?
সেদ্ধ ডিমে আমার গন্ধ লাগছে। ওদের বলুন না, যেন ওমলেট দেয়।
বলব।
আর ওই কাটাপোনার বদলে অন্য কিছু। এনি আদার ফিশ।
ঠিক আছে, তাও বলব। পায়ের পাশ থেকে ব্রিফকেস কোলে তুলল তরুণ। খুলে ছোট্ট একটা টিফিনবক্স বার করেছে। সাইডটেবিলে রেখে বলল, কী আছে জানো?
কী?
ঝিঙেপোস্ত। তোমার দিদির নিজের হাতে বানানো।
দেখে ভাস্করের খুশিই হওয়ার কথা। কিন্তু ভিজে ন্যাতার মতো মিইয়ে রইল মনটা। তাকে আনন্দিত রাখার কেন যে এই মিথ্যে আয়োজন?
ব্রিফকেস বন্ধ করে তরুণ বলল, তোমার দিদি কালও একটা আইটেম পাঠাবে। কী খেতে চাও, বলো?
ভাস্কর ফস করে বলল, বেশ কষা কষা করে রাঁধা মাটন।
তরুণ ঈষৎ থতমত। ঘাড় দুলিয়ে বলল, ওটা তো অ্যালাও করবে না ভাই।
ফাঁসির আসামিকে কিন্তু বিমুখ করতে নেই তরুণদা।
ছি বাবুন, ওভাবে বলতে নেই। তরুণ খাড়া হয়ে বসল, তুমি তো এখন অনেক বেটার। ডাক্তাররা তো তোমার ব্যাপারে যথেষ্ট আশাবাদী। ডক্টর গুহ, আই মিন যিনি রেডিয়েশন থেরাপি কনডাক্ট করছেন, তো বললেন মাত্র দশটা ডোজে মাস্ লক্ষণীয় ভাবে রিডিউস করেছে। যদি তোমার শরীর এভাবে রেসপন্ড করে, তা হলে তো মার দিয়া কেল্লা। ছাব্বিশটার পর লাম্পগুলো প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
কই, ডাক্তার তো আমায় কিছু বলেনি? সকালেও ডক্টর গুহ রাউন্ডে এসেছিলেন, আমি জিজ্ঞাসা করলাম, উনি তো প্রশ্নটা অ্যাভয়েড করে গেলেন?
অসুখের অবস্থা নিয়ে রোগীর সঙ্গে আলোচনার নিয়ম নেই বাবুন। আমরা তো রেগুলার কথা বলছি। খবরাখবর রাখছি।
কতভাবে যে ভাস্করকে ধোঁকা দেবে তরুণদা? ভাস্কর তো বুঝতে পারছে তার জীবনীশক্তি নিঃশেষ। তাও যে কেন সান্ত্বনার ঠেকনা দিয়ে তাকে চাঙ্গা রাখতে চায়?
সামান্য ব্যাঁকা সুরে ভাস্কর বলল, আপনারা আমার জন্য যা করছেন…তুলনা নেই!
এখন তুমি আমাদের মুখ চেয়ে কিছু করো। মন থেকে নেগেটিভ চিন্তাগুলো ঝেঁটিয়ে হঠাও। মন যদি শক্তি না দেয়, শরীর লড়াই করবে কীভাবে, অ্যাঁ?
একই কথা আর কতবার বলবেন, তরুণদা?
হাজার বার। প্রয়োজনে লক্ষ বার। তোমার ট্রিটমেন্টের এটাই তো মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট পার্ট। ভাস্করের ঊরুতে আলতো চাপ দিল তরুণ, আজ আর কাল দুটো দিন তো তোমার রেডিয়েশান থেকে ছুটি। দু’দিন ভাল করে খাও-দাও, তোফা ঘুম লাগাও। তারপর চুটিয়ে আড্ডা মারতে বিকেলে দলবল তো আসছেই।
ভাস্কর ম্রিয়মাণ স্বরে বলল, আপনি তা হলে উঠছেন?
আজকের মতো। কাল ফির মিলেঙ্গে।
আগর কাল তক্ জিন্দা রহুঁ, তো। তরুণ ফের চোখ পাকাচ্ছিল, ভাস্কর করুণ হাসল, দিদিকে থ্যাঙ্কস জানাবেন। ফর ঝিঙেপোত্ত।
ভাই-দিদির মাঝে আমি কেন! হাতে তো মোবাইল আছে…তোমার ফোন পেলে ভাস্বতী খুশি হবে।
এই পরামর্শটিও কি চিকিৎসার অঙ্গ? তরুণ যাওয়ার পর ঘাড় ঝুলিয়ে ভাবছিল ভাস্কর। সবাই এতবার করে তাকে বলছে, তবু সে উদ্দীপিত হতে পারছে না কেন?
ভয়। ভয়। মৃত্যুভয়টা যেন ভাস্করকে পেয়ে বসেছে। প্রথমটায় অসুখটা ছিল তার কাছে এক ঝাঁকুনি দেওয়া আশঙ্কার মতো। হয়তো তাতে একটু মৃত্যবিলাসও মিশে ছিল। কিন্তু এখন সে অহরহ মৃত্যুচিন্তায় আচ্ছন্ন। যে-কোনও সংলাপ, যে-কোনও ঘটনাই সে এখন আসন্ন মৃত্যুর প্রেক্ষিতে বিচার করে। তার বাইরে অন্য কিছু ভাবার ক্ষমতাই আর ভাস্করের নেই। নিজের তৈরি নির্দয় জগৎ সত্যিকারের পৃথিবীটাকেও যেন দূরে ঠেলে দিচ্ছে।
প্যাসেজে ঘড়ঘড় শব্দ। খাবারের ট্রলি। রোজকার মতোই দ্বিপ্রহরিক আহার দিতে এল হাসপাতালের উর্দিধারী দশাসই লোকটা। দাঁত ছড়িয়ে বলল, ওভাবে বসে কেন দাদা? খুব বুঝি খিদে লেগেছে?
নাহ্, এমনিই…।
আজ কিন্তু পুরো ভাতটা খাবেন। রোজ পড়ে থাকছে।
টেরিয়ে খোপ খোপ থালাটি দেখে ওয়াক উঠে এল ভাস্করের। সেই পাতলা পাতলা কাটাপোনার ঝোল। এই মাছ তরুণদা নাকি বদলে দিতে বলবে? হাহ্। কালও সকালে সেই ডিমসেদ্ধই আসবে, দুপুরে একই মাছ, রাতে বিবমিষা উদ্রেককারী চিকেন স্টু। কে যেন বলেছিল, ব্রয়লার নাকি শকুন আর কান্ট্রি-চিকেনের হাইব্রিড! তাই হবে। নইলে এত অখাদ্য হয়!
কেন যে মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে গেল তরুণদা? কত মিথ্যে আর সইবে ভাস্কর? বিরস মুখে ভাস্কর ভাত ভাঙল, কৌটোর পোস্ত ঢেলে নিয়ে মাখছে। এত পছন্দের পদ, দিদি যত্ন করে বানিয়েছে, তবু জিভে যেন স্বাদ লাগে না। এত অরুচি! এত অরুচি!
খুঁটে খুঁটে খানিকটা খেয়ে ছেড়ে দিল ভাস্কর। মুখ-টুখ ধুয়ে চিত হয়েছে বিছানায়। চোখ বুজল।
বোধহয় দশ মিনিটও যায়নি, ভাস্কর উঠে পড়েছে ধড়মড়িয়ে। ওফ্, আবার সেই ছবি। কোনও দুঃস্বপ্ন নয়, ঘোর বাস্তব। হুইলচেয়ারে বসিয়ে তাকে নিয়ে চলেছে লক্কা মার্কা ওয়ার্ডবয়টা…একটা কাচের ঘরে ঢুকিয়ে অপেক্ষা করতে বলল…সামনের দরজা খুলে বেরিয়ে এল লেডের জ্যাকেট পরা এক তরুণ…এবার সে নিয়ে যাচ্ছে ভাস্করকে…একটার পর একটা দরজা, একটার পর একটা দরজা…অবশেষে পুরু দেওয়ালওয়ালা সেই ঘর…যেন মৃত্যুকক্ষ…ছায়া ছায়া চার-পাঁচটা মানুষ ঘুরছে ঘরে…সর্বাঙ্গে সিসের আবরণ, রবারের মুখোশ আঁটা মুখে ডুবুরি গগল্স…অতিকায় এক যন্ত্র…প্রকাণ্ড টেবিলে শোওয়ানো হল ভাস্করকে…কী সব মাপজোপ হল বুকে কপালে…চাপা গোঁওও শব্দে চালু হয়েছে যন্ত্র…অদৃশ্য বিকিরণ ভাস্করকে ভেদ করে গেল…দশ সেকেন্ড…বিশ সেকেন্ড…এক মিনিট…দু’ মিনিট…হালকা একটা তাপ বুকে-কপালে মেখে ভাস্কর ফিরছে এবার…একটার পর একটা দরজা, একটার পর একটা দরজা…
কেন যে ওই ঘরটাকে ভাস্করের মৃত্যুপুরী মনে হয়? অথচ তাকে বাঁচানোর জন্যেই তো…!
নিজের অজান্তেই বুকে হাত চলে গেল ভাস্করের। বোঝার চেষ্টা করছে কোনও তফাত হয়েছে কিনা। উঁহুঁ, হাড়-চামড়া তো একই রকম ঠেকে। কপালেও। একটুখানি জায়গা শুধু শুকনো শুকনো। পোড়া পোড়া মতন। হুঁহ্, এটুকুতেই যদি ভাস্কর প্রাণ ফিরে পেত!
ফোন বাজছে। কে তাকে স্মরণ করে? এই অসময়ে?
পাশেই মোবাইলটা পড়ে। ভাস্কর ঝুঁকে মনিটরে নামটা দেখল। সোহিনী। একটা গরম গরম ভিজে বাতাস বয়ে গেল হৃদয়ে। দুপুরে সোহিনীর ফোন আসে না বলে ভারী খেদ ছিল ভাস্করের, এখন প্রায় রোজই ফোন বাজায় সোহিনী। কিন্তু ভাস্করের তেমন শিহরন জাগে না যেন। তৃষ্ণাটাই বুঝি মরে গেছে।
খুদে দূরভাষ যন্ত্রটি কানে চাপল ভাস্কর। নিষ্প্রাণ স্বর বাজল, বলছি।
আজ আছ কেমন?
প্রশ্নে কি কোনও আকুলতা আছে? যদি থাকেই, তবে এখন কেন? এত দেরি করে?
ভাস্করের স্বর আরও নিস্তেজ শোনাল, যেমন থাকা উচিত।
রাতে আবার জ্বরটর আসেনি তো?
জানি না। নার্সরা তো আমায় কিছু খুলে বলে না।
কাল বিকেলে গা গুলোচ্ছিল…!
ওটা আছে।
ডাক্তারকে বলেছিলে?
বলে কোনও লাভ নেই। খামোখা মুখ নষ্ট।
কয়েক সেকেন্ড আওয়াজ নেই। তারপর ফের সোহিনীর গলা ফিরেছে। বুঝি সামান্য উচ্ছল হয়ে বলল, জানো, একটা সুখবর আছে।
কানে ঠাট্টার মতো লাগল ভাস্করের। নীরসভাবে বলল, শুনছি। বলো।
আজ পাপানের স্কুলে গিয়েছিলাম। ক্লাসটিচার তো পাপানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। পাপান নাকি লাস্ট তিনটে ক্লাস টেস্টে সেকশানে হায়েস্ট মার্কস পেয়েছে।
ভাস্করের মন ভাল করার কী আন্তরিক প্রয়াস! জন্মে কখনও পাপানের পড়াশোনা নিয়ে ভাস্করের সঙ্গে আলোচনা করেছে সোহিনী?
নাহ্, এবার বোধহয় ভাস্করের একটু হরষিত হওয়া উচিত। কিন্তু চিত্ত যে সাড়া দিচ্ছে না, ভাস্কর কী করবে!
অবসন্ন স্বরে ভাস্কর বলল, বাহ্, ভাল। খুব ভাল।
দেখো, এবার পাপান ফার্স্ট টার্মিনালেও এক নম্বরে থাকবে।
তোমার হাতযশ। পাপানের ভাগ্য।
আবার খানিক নৈঃশব্দ্য। আবার সোহিনী বলল, পাপানটা আজ তোমায় দেখবে বলে খুব বায়না করছিল।
ও।
কী করে বোঝাই, হাসপাতালের নিয়মটা যে বিচ্ছিরি! রবিবার ছাড়া বাচ্চাদের অ্যালাও করে না!
তা হলে কাল এনো।
তোমার পাপানকে দেখতে ইচ্ছে করছে না?
দেখেই বা আর কী হবে!
আবার ও প্রান্ত নীরব। আবার সোহিনীর স্বর ফুটল, ছাড়ছি। বিকেলে দেখা হবে।
ফোনখানা মুঠোয় ধরে চুপচাপ বসে রইল ভাস্কর। নিজেকে যেন একটু একটু অপরাধী মনে হচ্ছিল হঠাৎ। কী আতান্তরেই না ফেলে দিয়েছে সোহিনীকে! এক দিকে সংসারের ঝক্কিঝামেলা, এক দিকে নিজের অফিস, আর এক দিকে লক্ষ-মনি বোঝার মতো এই ভাস্কর…বেচারা বুঝি খুব নাকানিচোবানি খাচ্ছে। অথচ বোঝা টানাটা তো পণ্ডশ্রম, যে-কোনও দিন ভাস্কর ফুস করে ডুবে যাবে। মাঝখান থেকে সোহিনীর একগাদা ছুটি নষ্ট, অর্থদণ্ড, শরীরপাত…। রেডিয়েশান চলাকালীন প্রত্যেক দিন হাসপাতালে উপস্থিত থাকতে হচ্ছে, নীচে বোধহয় একাই বসে থাকে, তারপর ছুট ছুট ছুট অফিস, ফের বিকেলে পড়িমরি করে আসা…। গ্রহের কী ফের, এত হ্যাপা এমন একজনের জন্য যাকে হয়তো সোহিনী কোনওদিন পছন্দই করেনি!
নাহ্, ভাস্করের ভাবনায় বোধহয় গলতি হচ্ছে। অন্তরের টান না থাকলে সোহিনী এত করছেই বা কেন? স্রেফ কর্তব্য? উঁহু, বোধহয় একটু-আধটু ভালবাসাও আছে, যা ভাস্কর টের পায়নি। নীরস একটা খোলের ভেতর যা কিনা সযত্নে ঢেকে রেখেছিল সোহিনী।
কিন্তু এখন আর জেনেবুঝে কী লাভ? এই বিদায় লগ্নে?
ভাস্কর ফের শুয়ে পড়ল। শূন্য দৃষ্টি সাদা সিলিং দেখছে। মস্তিষ্ক ক্রমে অবশ। অসাড়। কখন যে তন্দ্রা নামল চোখে। স্বপ্নহীন ঘোরটুকু ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাচ্ছে। আপনা-আপনি খুলে যায় চোখ, আবার কখন যেন বুজে আসে…ঢিমে তেতালায় গড়িয়ে চলে দুপুর…।
বিকেলে তরুণের কথা ফলে গেল। আজ অজস্র দর্শনার্থী। প্রথমে সোহিনী ঢুঁ মারল, তারপর জোড়ায় জোড়ায় আগমন। সোহিনীর বাবা-দাদা, ভাস্বতী আর রাজা, আশাবরী আবাসনের মণ্ডলদা-বউদি, মানিকতলার মাসি, কেওড়াপুকুরের পিসি…। প্রায় একই দরদি বাক্য ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলে সবাই, ভাল হয়ে যাবে, ভাল হয়ে যাবে…! মিথ্যে শুনতে শুনতে ভাস্করের কান পচে যাওয়ার জোগাড়।
সওয়া ছ’টা নাগাদ দেবজিৎ-সুগত জুটি হাজির। অফিসে দু’জনকে একত্রে দেখে একরাশ খোলা হাওয়ার ঝলক পেত ভাস্কর, আজ যেন কোনও অনুভূতিই নেই। মিয়োনো স্বরে বলল, বোসো।
দেবজিৎ হেসে বলল, তুহিনদার মুখে শুনলাম আপনার নাকি চেহারা খারাপ হয়েছে! কই, তেমন তো দেখছি না!
সুগত সায় দিল, হ্যাঁ তো। যথেষ্ট ফ্রেশ। লাস্ট যেদিন ক্যান্টিনে গল্প করছিলেন, সেরকমই তো লাগছে।
এত দুঃখেও ভাস্করের হাসি পেল। মাথা নেড়ে বলল, আনাড়ির মতো মিথ্যে বোলো না। প্লিজ। তোমাদের ওটা আসে না।
দেবজিৎ তবু স্তোক শোনাতে মরিয়া, না না, সত্যিই আপনাকে…
ছাড়ো। অন্য কথা বলো। তোমাদের ট্যুর ফাইনাল হল?
দেবজিৎ অস্বস্তিমাখা চোখে সুগতকে দেখল। সুগত ঢোঁক গিলে বলল, হ্যাঁ, যেতে তো হবে। দলবল সব রেডি।
কবে যেন তোমাদের প্রোগ্রাম?
জুলাইতে তো ঠিক ছিল। অনেকে আপত্তি করছে। বলছে, আর একটু আগে…জুনে নাকি ওখানকার ন্যাচারাল বিউটি আরও বেশি।
ওদিকে খুব রডোডেনড্রন ফোটে, তাই না?
জুনিপারও ফোটে অনেক। ঘাস নাকি নানান কালারের প্রিমুলায় ছেয়ে যায়। অবিকল কার্পেটের মতো দেখায় তখন।
কোথায় যেন এগজ্যাক্টলি যাচ্ছ তোমরা?
ওই যে বলেছিলাম…ইয়ক্সাম হয়ে…। প্রথমে জোংরি পিক, সেখান থেকে গোচা-লা ক্রস করে সোমিতি লেক, তারপর নতুন একটা রাস্তা ধরে, জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পৌঁছব রাঠোংছু।
ছু মানে তো নদী?
হ্যাঁ। নদীটা নাকি খুব সুন্দর। কাছেই একটা ফল্স থেকে বেরিয়েছে।
পাহাড়ি নদীর জলে পা ঠেকালে কেমন যে একটা হয়…! ভাস্কর বিড়বিড় করে বলল, আমার আর যাওয়া হল না।
ধুৎ, তা কেন। এবারের ট্যুরটা মিস করলেন, নেক্সট ইয়ার তো আবার হচ্ছে …।
তখন কাঁধে ঝোলা বেঁধে আপনিও যাবেন। এবারই তো আপনাকে খুব মনে পড়বে।
দেবজিৎরা চলে যেতেই ভাস্করের বুকের খাঁচাটা কেঁপে উঠল থরথর। জীবনের কাছে তো তার লাখ লাখ চাওয়া ছিল না, যা পেয়েছে তাতেই মোটামুটি সন্তুষ্ট থেকেছে। শুধু একটা মাত্র সাধ…তাও অপূর্ণ রেখে ছাড়তে হবে পৃথিবীটাকে! কেন? কেন?
অনুপম এসেছে কেবিনে৷ কাছে বসে বলল, কী রে, চোখমুখ তো ফুলিয়ে ফেলেছিস! খুব ঘুমিয়েছিস নাকি দুপুরে?
বন্ধুর কৃত্রিম অক্সিজেনটুকু গ্রহণ করতে পারল না ভাস্কর। ফ্যালফ্যাল তাকাচ্ছে। আচমকা অনুপমের হাত চেপে ধরে বলল, অ্যাই শোন, আমি কি খুব খারাপ লোক?
অনুপম তরল স্বরে বলল, হঠাৎ এই বিদ্ঘুটে উপলব্ধি?
সবাই বলে, যে যা অন্যায় করে, এ জন্মেই তাকে তার ফল ভোগ করতে হয়।…কিন্তু আমি কী দোষ করেছি বল?
যাহ্, এসব আবার কী চিন্তা!
না রে, নিশ্চয়ই কিছু করেছি। নইলে শাস্তিটা পাচ্ছি কেন?
কী শাস্তি? কীসের শাস্তি?…অসুখের কথা বলছিস? অসুখ-বিসুখ কার না হয়? অনুপম ভাস্করের হাতে হাত রাখল। নরম করে বলল, ডাক্তার দেখে, চিকিৎসা চলে, রোগ সেরেও যায়।
কিন্তু আমি যে মরে যাব। আমার একটা মাত্র আশা ছিল, তাও মিটল না। নো চান্স।
কী আশা?
সে আর জেনে কী করবি? ভাস্করের শ্বাস পড়ল, জানিস, জয়েন্ট পরীক্ষার সময়ে একটা ছেলের সিট পড়েছিল আমার পাশে। শ্যামবাজার, না পাইকপাড়া, কোথায় যেন বাড়ি। তোর মনে আছে নিশ্চয়ই, ফিজিক্সের কোয়েশ্চেন সেবার বেশ কঠিন ছিল? …মরিয়া হয়ে পকেট থেকে টুকলি বার করেছিলাম। জাস্ট লেখা স্টার্ট করেছি, ওমনি ইনভিজিলেটারের চোখ আমার ওপর। টের পেয়েই চোথাটা ঠেলে দিলাম ছেলেটার টেবিলে। ছেলেটা অবাক, হাতে তুলে কাগজটা দেখছে, ব্যস অবিলম্বে কট।…এক্সপেলড হয়ে গেল বেচারা। কত হাতেপায়ে ধরল, এগজাম হলের গার্ডটা শুনলই না।…কে জানে, হয়তো ছেলেটার আর ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াই হয়নি।…তার আশাভঙ্গের প্রতিফল কি পাচ্ছি আমি?
আহ্, ভাস্কর, ওভাবে জগতে কিছু ঘটে না। যার কথা বলছিস, সে হয়তো ব্যাপারটা ভুলেই গেছে। হয়তো অন্য লাইনে শাইন করেছে।
না রে, আমাকে সান্ত্বনা দিস না। আমি ভাল নই, আমি ভাল নই। ভাস্কর হাঁপাচ্ছে মৃদু মৃদু, বছর দশেক আগে আমাদের একটা প্রোজেক্ট চলছিল আরামবাগে। আমি ছিলাম সাইট ইনচার্জ। একটা ইয়ং স্টাফ হাইটেনশন লাইনে কাজ করতে গিয়ে মরে গেল হঠাৎ। নিজেরই অসাবধানতায়। আমাদের অফিস তাকে কম্পেনসেশন দেয়নি। বাড়ির একমাত্র আর্নিং মেম্বার ছিল ছেলেটা। তার মা রোজ অফিসে এসে বসে থাকত। পাছে আমাকে পাকড়াও করে, আমি লুকিয়ে লুকিয়ে বেড়াতাম। শেষে সিকিউরিটিকে বলে মহিলার অফিসে ঢোকাটাই বন্ধ করে দিলাম।…তুই বল, এটা পাপ নয়? ওই মায়ের অভিশাপ আমার লাগেনি?
ওফ্, কী খ্যাপামি শুরু করলি ভাস্কর? শুয়ে পড়, শুয়ে পড়।
প্রায় জোর করেই ভাস্করের মাথা বালিশে নামিয়ে দিল অনুপম। অস্ফুটে বলল, পাপ-পুণ্য কিছুই আমরা বুঝি না রে। ঘটনা নিজের মনেই ঘটে, আমরা শুধু নিমিত্তের ভাগী মাত্র।
না রে, সচেতনভাবেই তো অন্যায় করেছি কতগুলো। ভাস্কর বলেই চলেছে, আমার পড়ার ঘরে একটা নেংটি ইঁদুর আসত। আমি তখন ক্লাস সেভেনে। নাকি এইটে…? অঙ্ক বইয়ের পাতা খেয়ে দিয়েছিল ইঁদুরটা। রেগেমেগে বাজার থেকে বিষ এনে খাবারের সঙ্গে নাড়ু পাকিয়ে রেখে দিয়েছিলাম টেবিলের নীচে। বোকা ইঁদুর তাই খেয়ে পরের দিন অক্কা। চোখ দুটো খুলে মরে পড়ে ছিল। যেন মৃত্যুর পরেও অসহায়ভাবে পৃথিবীকে দেখছে। ওই খুন করাটাই কি আমাকে আজ…?
এবার ভাস্করের ঠোঁটই শুধু নড়ছে, একটি কথাও আর বোধগম্য নয়। অনুপম তাকে ঝাঁকাল, নাহ্, ভাস্কর বুঝি চেতনায় নেই।
সোহিনী ঢুকেছে। সঙ্গে ওষুধের প্যাকেট। ভাস্কর ঝাপসাভাবে দেখতে পেল সোহিনীকে। ঝুঁকে দেখছে তাকেই। ভাস্কর হাত বাড়াতে গেল, পারল না। অবসাদের প্রান্তসীমায় পৌঁছে শুধু ক্ষীণ শুনতে পেল অনুপমের গলা, ডাক্তারকে ডাকো সোহিনী। এক্ষুনি।
.
০৯.
বিপদ যখন আসে, বুঝি দল বেঁধেই আসে। যেন ঘাপটি মেরে কোথাও লুকিয়ে ছিল, একজন দেখা দিতেই অন্যরাও বেরিয়ে পড়ছে ঝুপঝাপ। আর সেই এলোমেলো বিপদের স্রোতে যাকে নাও বাইতে হয়, তার যে কী নাজেহাল দশা!
ভাস্করের টালমাটাল অবস্থা তো চলছেই। আজ এক উপসর্গ, তো কাল আর এক। মানসিক অবসাদের ধাক্কাটা সামলাতেই তো সোহিনীকে প্রায় নাকে দড়ি দিয়ে ছুটতে হল। মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলতে হয়, কাউন্সেলারদের প্রশ্ন করে জানতে হচ্ছে কতটা উন্নতি হল ভাস্করের, রেডিয়েশান রুম থেকে ভাস্করকে বার করার সময়ে তো কাঁটা হয়ে থাকে সোহিনী…। অবসাদ যাও বা কমল, বমি আর মাথা ঘোরা তো লেগেই আছে। তারই মাঝে হঠাৎ একদিন স্কুল থেকে গায়ে ধুম জ্বর নিয়ে ফিরল পাপান। সঙ্গে সঙ্গে তাকে ডাক্তার দেখাও, অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়াও…। ক’দিন ছেলে এমন ঘ্যানঘ্যান করল, তাকে ফেলে দু’দণ্ড নড়া দায়। সকালে রেডিয়েশানের সময়ে তরুণ কিংবা রাজা হাসপাতালের ঝুঁকিটা সামলে নিতে পারে। এক-আধদিন অনুপমও। কিন্তু বিকেলে উপায় নেই, সোহিনীর অদর্শনে ভাস্কর ভারী উতলা হয়ে পড়ে। সুতরাং কোনওক্রমে ছেলেকে বুঝিয়ে শুনিয়ে শাশুড়ির জিম্মায় রেখে ছোটো হাসপাতাল। পাপান যখন মোটামুটি গা ঝাড়া দিয়ে উঠল, সবে স্কুল যাওয়া শুরু করেছে, আবার এক দুঃসংবাদ। সোহিনীর মা উঠোনে আছাড় খেয়ে কোমরে চোট পেয়েছে জোর। এক্স-রে অবশ্য বলছে আঘাত তেমন মারাত্মক নয়, তবু মা এখনও শয্যাশায়ী। তাকে একবার দেখে আসা কি সোহিনীর কর্তব্য নয়? ওদিকে অফিসে আর এক বিপত্তি। সামনের মাসে ট্রান্সফার লিস্ট বেরোচ্ছে। নয় নয় করে একই ব্রাঞ্চে চার বছর হল, সোহিনীর নাম থাকতেই পারে তালিকায়। তেমন দূরে হয়তো পাঠাবে না, তবে ব্যারাকপুর বারুইপুর হলেও তো সোহিনীর প্রাণান্ত।
হাজার গন্ডা চিন্তা মাথায় নিয়ে সোহিনী স্থির করল, আজই শোভাবাজার ঘুরে আসবে। রবিবারটাই সুবিধে, নইলে আর হয়তো ফুরসত পাবে না। ভাস্করকে এবার ছেড়ে দেবে, বাপের বাড়ি যাওয়া তো তখন আরও মুশকিল। ঘরে ফিরে ভাস্কর কী খেল দেখাবে তার ঠিক আছে!
নিজের পরিকল্পনা মতো তাড়াতাড়ি দুপুরের খাওয়া সেরে তৈরি হচ্ছিল সোহিনী। যেই না ভ্যানিটিব্যাগ কাঁধে তুলেছে, অমনি বনানীর প্রবেশ। তার গলা এখন এত নির্জীব, স্টেথো লাগিয়ে শুনতে হয়।
স্তিমিত স্বরে বনানী বলল, কাল তোমায় জানানো হয়নি, বাবুনের একটা। এলআইসি-র চিঠি এসেছে। প্রিমিয়ামের নোটিশ।
সোহিনী তাড়াহুড়ো করে বলল, পেয়েছি। সেন্টারটেবিলে পড়ে ছিল।
এই সপ্তাহেই জমা দেওয়ার ডেট না?
তো? এ মাসের মধ্যে দিলেই তো হল।
তুমি দেবে জমা?
আমার তো দেওয়ার কথা নয়। ওদের নিয়মে আটকাতেও পারে।
তা হলে কী হবে?
দেখি।…ভাস্কর ফিরুক।
আর একটা কথা…।
সোহিনী বিরক্ত হল। সকাল থেকে তো সে বাড়িতে, ঠিক এই সময়ে সব একে একে মনে পড়তে হল? অসন্তোষটুকু প্রকাশ করতেই বুঝি ইচ্ছে করে ঘড়ি দেখল সোহিনী। ঘাড় বেঁকিয়ে বলল, হ্যাঁ…বলুন?
বনানীর মুখ কাঁচুমাচু, আমার পেনশানটা তোলা হয়নি, গত মাসেও বাদ পড়ল…
আমাকে ব্যাঙ্কে যেতে হবে, তাই তো?
না মানে…তরুণ বেচারার যা ছোটাছুটি যাচ্ছে…। বুলুকেও বলতে পারি, কিন্তু ওদের বাড়ি থেকে যা দূর…
কথার ভঙ্গিতে সোহিনীর গা রি রি। জামাই ছুটছে, আর ছেলের বউ বুঝি শুয়ে বসে? বনানী দেবীর পেনশান এখনও সেই অফিস পাড়ায়। মেয়ের বেহালার বাড়ি থেকে যা কিনা বহু দূর! আর যাদবপুর, নিউ বালিগঞ্জ, কিংবা বাইপাস থেকে বুঝি নাকের ডগায়? কখন যাবে সে? কীভাবে যাবে? দেড় মাস ধরে তো অফিস থেকে বিস্তর সুবিধে নিচ্ছে, ক্যাশকাউন্টার থেকে সরিয়ে তাকে লোন সেকশনে দেওয়া হল, যখন খুশি ঢুকছে, বেরোচ্ছে…। এখন শাশুড়ির পেনশান তোলার জন্য ছুটি চাওয়াটাই যা বাকি!
গোমড়া গলায় সোহিনী বলল, কেন যে পাড়ার ব্রাঞ্চে অ্যাকাউন্টটা শিফ্ট করাননি!
আমি তো তাই চেয়েছিলাম। বাবুনই বলল, বাবা যখন ওখানে অ্যাকাউন্ট করে গেছে, থাক না…ওদিকে তো আমি যাই, আমিই নয় ড্র করে আনব…!
হুঁহ্, ভাস্করের আর কী। উনি তো শয্যা নিলেন, অতএব দায়িত্ব এবার সোহিনীর। ভুরুতে মোটা ভাঁজ ফেলে সোহিনী বলল, চেকটা লিখে রাখবেন, রাত্তিরে নিয়ে নেব।
বাঁচালে। হাতে একদম টাকা নেই…। বনানী যেন কিঞ্চিৎ উদ্ভাসিত, একটা কাজ করলে হয় না সোহিনী? যদি অ্যাকাউন্টটা তোমার ব্যাঙ্কে ট্রান্সফার করে নিই…?
ভালই তো। বলতে গিয়েও সোহিনী প্রায় আঁতকে উঠেছে। কী বিপজ্জনক মতলব! বোঝাটা পাকাপাকি ভাবে সোহিনীর ঘাড়ে চাপাতে চায় নাকি? আপাতদৃষ্টিতে অসুবিধের কোনও কারণ নেই, কিন্তু…। এই মহিলার সঙ্গে ভবিষ্যতে সোহিনীর সম্পর্ক থাকবেই, এমন কোনও নিশ্চয়তা আছে কি? বরং উলটোটাই তো সত্যি, যদি না নিয়তি তার সঙ্গে ফের কোনও নিষ্ঠুর রসিকতা করে।
সোহিনী সতর্ক স্বরে বলল, তাতেও লাভ নেই মা। যদি বদলি হয়ে যাই, তা হলেও তো সেই একই প্রবলেম।
তবে পাড়াতেই করি, কী বলো?
হ্যাঁ। সেটাই ভাল।
বেশ। বাবুন ফিরলে বাবুনকে বলছি।
কথাটা ঠং করে কানে বাজল সোহিনীর। মহিলার কি বিশ্বাস, হাসপাতাল থেকে প্রত্যাবর্তন মানে তাঁর পুত্র এখন আরোগ্যের দোরগোড়ায়? নাকি ওটা একটা কথার মাত্রা? নিছক অভ্যেসের বশে বলছেন? বেচারা! এখনও কত ধাক্কা যে কপালে আছে মহিলার!
আর বাক্যব্যয় না করে বনানীকে পাশ কাটিয়ে সোহিনী ড্রয়িংহলে। টিভি দেখছে পাপান। সোফায় বাবু হয়ে বসার ভঙ্গিটি হুবহু ভাস্করের। চোখে লাগে।
ভারী ভারী গলায় সোহিনী বলল, এবার স্নানে যাও পাপান।
পাপানের সেই চিরন্তন জবাব, পাঁচ মিনিট।
আমি বেরোলাম। ঠাম্মাকে কিন্তু একদম জ্বালাবে না।…বিকেলে কখন বার্থডে পার্টিতে যাচ্ছ?
সিক্স পিএম।
তোমার বন্ধুর গিফ্টটা স্টাডিটেবিলে র্যাপ করে রেখেছি, নিয়ো মনে করে।
ইয়াপ্।
ন’টার মধ্যে ফিরবে। আমাকে যেন ওদের ফ্ল্যাটে গিয়ে ডাকতে না হয়।
জবাব নেই। এক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থেকে সোহিনী চটি গলাল। ফ্ল্যাটের দরজা টেনে দ্রুত পায়ে একতলায়। চাতালটায় নামতেই প্রশান্ত শিকদার। ‘আশাবরী’র বাসিন্দাদের দেখভাল কমিটির হর্তাকর্তা। পরনে সাদা পাজামা—পাঞ্জাবি, মাথায় ছাতা, কাঁধে শান্তিনিকেতনি ব্যাগ।
ছাতা বন্ধ করতে করতে প্রশান্ত বলল, চললেন কোথায়? হাসপাতালে?
সোহিনী অল্প চোয়াল ছড়াল। যার অর্থ হ্যাঁও হয়, নাও হয়।
প্রশান্ত অনুচ্চ স্বরে বলল, ভাস্করবাবুর কি এখনও রে চলছে?
আর একটা ডোজ বাকি। কাল শেষ।
এখন আছেন কেমন?
মোটামুটি।
হাঁটাচলা করছেন?
ঘরের মধ্যে। করিডোরেও যায় কখনও-সখনও।
অসুখটা বড্ড উইক করে দেয়। তার সঙ্গে ওই ট্রিটমেন্ট…। আমার পিসতুতো দাদাকে তো দেখেছি…রেডিয়েশানের পর রোজ বমি করত। এখন অবশ্য সে অনেকটাই স্টেডি। পাঁচ-পাঁচটা কেমো নিয়ে ফেলল।
ও।
সিক্সথ কেমো নেক্সট্ মান্থে দেবে। ডাক্তার তো বলছে দাদা বোধহয় এ যাত্রা বেঁচে গেল।
তাই বুঝি?
হ্যাঁ তো। এখন তো ক্যান্সারের সারভাইভাল রেট অনেক বেড়েছে। প্রশান্তর ঠোঁটে আশ্বাসের হাসি, চিন্তা করবেন না ম্যাডাম। ভাস্করবাবুর মতো স্ট্রং অ্যান্ড স্টাউট পার্সন অবশ্যই রোগটাকে ওভারকাম করবেন।
সোহিনী মৃদু স্বরে বলল, চেষ্টা তো করছি।
নববর্ষের দিন মিটিং-এ কত বার যে ভাস্করবাবুর কথা উঠল। যারা জানত না…শুনে তো হায় হায় করছে। সিগারেট, তামাক, জর্দা, কোনও নেশা নেই…এত কম বয়স…তার কিনা এই ব্যাধি? শিয়ার ব্যাড লাক। আমরা মনেপ্রাণে চাই…
অবিকল একই ভাষায় এই ধরনের সহানুভূতি যে কত শুনতে হচ্ছে সোহিনীকে! অফিসের লোকেরা বলছে, আত্মীয়স্বজন বলছে…। বন্ধুদের মধ্যে যারই কানে গেছে, তারই মুখ থেকে উড়ে আসছে করুণামাখা বারতা। একটা দুঃখী দুঃখী ভাব ফুটিয়ে অবিরাম সেই বাণী গেলো যে কী কষ্টকর।
প্রসঙ্গ বদলাতে সোহিনী বলল, সেদিন আপনাদের মিটিং-এ কী হল?
ওই…দুর্গাপুজোর কমিটি তৈরি…। লিফলেট ছাপতে গেছে, এলে পাঠিয়ে দেব। প্রশান্ত ফের স্টিয়ারিং ঘুরিয়েছে, ভাস্করবাবু বাড়ি আসছেন কবে?
বুধ-বৃহস্পতিবারের আগে নয়।
ডাক্তাররা বলেছে কিছু? মানে, কতটা ইম্প্রুভমেন্ট হল…?
বলছে তো কমেছে। রেডিয়েশান শেষ হলে আবার স্ক্যান হবে, তখন ফাইনাল বোঝা যাবে।
ভালই হবে। দেখে নেবেন।…এর পরে তো কেমো?
হুঁ।
উনি ফিরলে একদিন দেখা করে আসব।
প্রশান্তর হাত থেকে মুক্তি পেয়ে যেন বাঁচল সোহিনী। রাস্তায় এসে দু’পা হেঁটেই টের পেল আজ প্রচণ্ড উত্তাপ। বৈশাখ যেন আগুন ছড়াচ্ছে। পৌনে একটা বাজে, পথঘাট প্রায় জনশূন্য, কুকুরগুলো পর্যন্ত ছায়া খুঁজছে। এ বছর একটাই যা কালবৈশাখী হল, তারপর আর মেঘের চিহ্ন নেই আকাশে। মাঝে মাঝে একটা শুকনো বাতাস বইছে। তপ্ত হাওয়ায় যেন জ্বলে যায় চামড়া। এখনও তো জ্যৈষ্ঠ পড়ে, কত যে আরও পুড়বে পৃথিবী! পোড়াবে!
বাসস্টপে পৌঁছোনোর আগেই সোহিনী ঝপ করে একটা ট্যাক্সি ধরে নিল। গাড়ির সিটও যেন জ্বলন্ত অঙ্গার, ছ্যাঁকা লাগছে। ডাইভারকে রবীন্দ্র সরোবর মেট্রো স্টেশন যেতে বলল। এই রৌদ্রদগ্ধ শহরে পাতালপথই এখন
আরামদায়ক।
নির্দেশ দিয়েও বসতে পারছিল না সোহিনী। তাপ শুধু চরাচরে নয়, জ্বালাময়ী তাপ যেন সোহিনীর মনেও। প্রশান্তবাবুর পিসতুতো দাদার সমাচারটাই ফিরে ফিরে আসছে মস্তিষ্কে। পাঁচ-পাঁচটা কেমো নিয়েও এখন যষ্ঠের প্রতীক্ষায়? বেঁচে যাবে লোকটা? কোথায় ক্যান্সার, জিজ্ঞেস করা হল না তো! নিশ্চয়ই ফুসফুসে নয়? কিংবা যেখানেই হোক, নিশ্চয়ই ছড়ায়নি অন্যত্র? ভাস্করের মতো?
নিজের ভাবনায় সোহিনী নিজেই চমকেছে ভীষণ। আশ্চর্য, সে কি এখনও ভাস্করের মৃত্যুকামনা করে চলেছে? যার সঙ্গে বারোটা বছর কাটাল, তার প্রতি কি দয়া মায়া করুণা প্রীতি, কিছুই নেই সোহিনীর? চটপট ভাস্করকে চিতায় তুলে দিয়েই কি তার শান্তি?
কক্ষনও না। কক্ষনও না। ভাস্করকে সারিয়ে তোলার জন্যই তো সোহিনী আপ্রাণ লড়ছে। তার চেষ্টায় কি ফাঁকি আছে কোনও? ডাক্তাররা যা বলছে, প্রতিটি পরামর্শই তো অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে সে। ভাস্করকে প্রফুল্ল রাখতে ফোন করছে যখন-তখন, যতটা সম্ভব উদ্দীপক বাক্য শুনিয়ে তার মনে বাঁচার স্পৃহা জাগাতে চাইছে…তা হলে? তা হলে?
এই তা হলের উত্তরটাই তো পাওয়া বড় কঠিন। মন যে কখন কোন দিকে ধায়, মন নিজেও কি জানে? কোন চাওয়াটা তার সত্যি, কোন চাওয়াটা মিথ্যে, কোন ইচ্ছেটা ঠিক, কোনটাই বা ভুল, মন কি বোঝে সর্বদা?
সোহিনীর অন্যমনস্ক হাত মোবাইল ফোন বার করল। চেনা নম্বরে আঙুল ছোঁয়াতেই ওপারে অনুপমের উৎকণ্ঠিত গলা, কী হল সোহিনী? সব ঠিকঠাক তো?
সোহিনীর একটা শ্বাস পড়ল, বেঠিক মনে হচ্ছে কেন?
তা নয়…। তুমি এ সময়ে ফোন করো না তো!
আজ করলাম। ধরে নাও, হঠাৎ তোমার গলা শুনতে ইচ্ছে হচ্ছিল।
সে কী? কেন?
সব ইচ্ছের কি কারণ থাকে অনুপম? প্রতিটি ইচ্ছের মানে বুঝতে পারলে আমাদের জীবনটা কি অনেক সরল হয়ে যেত না?
অনুপম চুপ। তারপর যেন হালকা স্বরে বলল, হঠাৎ তোমায় হেঁয়ালিতে পেয়ে বসেছে নাকি, সোহিনী?
কী জানি! হবে হয়তো।
অনুপম ফের নিশ্চুপ। আবার গলা বাজল, একটু যেন গভীর, সোহিনী, তোমার কি মন খারাপ?
নাহ্। আমার আবার মন কীসের! সোহিনী গলার বাষ্পটাকে গিলল। তারপর সহজ সুরেই বলল, বিকেলে আসছ তো হাসপাতালে?
শিয়োর।
দেখা হবে। ছাড়ছি।
ফোন ব্যাগে রেখে একটুক্ষণ চোখ বুজে রইল সোহিনী। বড় ক্লান্তি, বড্ড ক্লান্তি। কবে যে একটু বিশ্রাম মিলবে সোহিনীর? কীভাবে যে মিলবে?
মেট্রোরেলে শোভাবাজার পৌঁছোতে বেলা গড়াল। ভূগর্ভ ছেড়ে ওপরে। উঠতেই চেনা রাস্তা, চেনা বাড়িঘর, চেনা চেনা দোকানপাট। পাড়ায় ঢুকে নিজেদের পুরনো আমলের বাড়িটা দেখে বুক দুলে উঠেছে ফের। ওই শরিকি বাড়ি, মোটা মোটা দেওয়াল, উঁচু উঁচু সিলিং, বড় বড় দরজা-জানালা, একটা অদ্ভুত সোঁদা সোঁদা প্রাচীন গন্ধ, বুঝি তার চেতনার অন্তঃস্থলে গেঁথে আছে এখনও। বহিরঙ্গে হয়তো সাদৃশ্য নেই, তবু অনুপমদের বাড়ির সঙ্গে কোথায় যেন একটা মিল! হয়তো বা ওই গন্ধটায়। সাধে কি পণ্ডিতিয়ার বাড়িটা তাকে টানে!
সেই বাড়িও তো নাকি ভাঙা পড়তে চলল। সোহিনীর প্রতিটি ভাল লাগার উৎসই যেন নিয়তি গ্রাস করছে একে একে। হা কপাল!
শোভাবাজারের বাড়ি অবশ্য ভাঙাভাঙির সম্ভাবনায় নেই। এত অজস্র শরিক, তাদের এত ধরনের চাহিদা…। বহু কাল আগে পৃথক হয়েছে সবাই, এখন তো কেউ কারও খোঁজও রাখে না বড় একটা। শুধু বিয়েশাদি, পুজোপার্বণে যা মেলামেশা হয় একটু-আধটু। আর হ্যাঁ, কেউ মরলে জড়ো হয় সকলে।
একতলায় নিজেদের অংশের সদর দরজায় বেল টিপল সোহিনী। পাল্লা খুলে কৌশিক হতচকিত। ঘাবড়ানো গলায় বলল, তুই হঠাৎ? ভরদুপুরে?
কেন? মানা আছে?
ও কী কথা! আয়, আয়, ভেতরে আয়। আসার আগে একটা ফোন তো করবি!
এ বাড়িতে বুঝি আমায় বলেকয়ে আসতে হবে?
দেখো কাণ্ড, কী কথার কী মানে! হেসেই বলল কৌশিক, কপালে তবু উদ্বেগের রেখা, হাসপাতালে সব ঠিকঠাক তো?
ভাস্করের ভালমন্দ নিয়েই এখন উদ্ব্যস্ত সবাই, সোহিনীর খোঁজ আর কে রাখে!
শীর্ণ হেসে সোহিনী বলল, বোকার মতো বলিস না দাদা। হাসপাতালে কিছু ঘটলে আমি কি এখানে আসতে পারতাম?
সোহিনীর সাড়া পেয়ে চৈতালি বেরিয়েছে অন্দর থেকে। সঙ্গে তানিয়াও। ছুট্টে এসে পিসির কোমর জড়িয়ে ধরল তানিয়া, তুমি কদ্দিন পর এলে গো! তোমার মুখটাই তো ভুলে যাচ্ছিলাম।
সাত বছরের তানিয়ার এ হেন পাকা পাকা সংলাপে সোহিনী বেশ মজা পায়। আজ যেন একটু জোর করেই হাসল। ভাইঝির গাল টিপে দিয়ে বলল, এবার দেখে ভাল করে মনে রাখ। আবার কবে আসব তার ঠিক নেই কিন্তু।
কেন গো? পিসাইয়ের অসুখ বলে?
হুম্।
পিসাইটা বড্ড ভুগছে। এবার তো সেরে উঠলেই পারে।
অ্যাই, থাম তো। চৈতালি ধমকে উঠেছে মেয়েকে, পিসিমণিকে একটু হাঁপ জিরোতে দে। কত দূর থেকে তেতেপুড়ে এল…
তানিয়া তবু নাছোড়বান্দা, পাপানদাদা আসেনি কেন?
ওর আজ নেমন্তন্ন। বন্ধুর জন্মদিন।
ভেরি ব্যাড। ছেলেকে নিয়েই মাকে আসতে হয়।
এবার চৈতালিও হাসছে। সোহিনীকে বলল, ইস, মুখটা তো পুড়ে কালো মেরে গেছে। দাঁড়াও, আগে এক গ্লাস জল আনি।
খুকুকে আমপোড়ার শরবত দাও না।
অত তরিজুত আমার সইবে না রে দাদা। আমি এখন রুশি সৈনিক, আমার জলই যথেষ্ট।…বাবা কোথায়?
খাচ্ছিলেন তো। নির্ঘাত তোমার গলা পেয়ে…। চৈতালি চোখে একটা ভঙ্গি করল। স্বর নামিয়ে বলল, যাও, চট করে গিয়ে মুখটা দেখাও।
চওড়া, ঢাকা ভেতরবারান্দাটি এ বাড়ির ডাইনিংহল। প্যাসেজ পেরিয়ে জায়গাটায় এল সোহিনী। খাওয়ার টেবিলে পূর্ণেন্দু সত্যিই হাত গুটিয়ে বসে। চশমা পরা চোখজোড়া মেয়েরই প্রতীক্ষায়।
বাবার পিঠে আলগা হাত রেখে সোহিনী বলল, কী, লাস্ট দিন তো দেখলাম ঘং ঘং কাশছিলে…এখন কেমন?
আমার কথা বাদ দে। আমাদের তো যাওয়ারই বয়স।…তুই কি হাসপাতাল থেকে?
নাহ্। সকালে আজ যাইনি। বাড়ি থেকেই।
খেয়ে বেরোসনি নিশ্চয়ই? …বসে যা।
উঁহু, ভাত খাওয়া হয়ে গেছে। তুমি থেমে কেন, স্টার্ট করো।
অল্প করে খা। চৈতালি আজ মাংসটা খাসা রেঁধেছে।
প্লিজ বাবা… এখন ইচ্ছে করছে না।
ও কী, খুকু? ঘর থেকে হঠাৎই নমিতার গলা উড়ে এল, দুপুরে খাওয়ার সময়ে এসেছ, মুখে দুটো না দিলে গেরস্তর অকল্যাণ হবে না?
মা’র এধরনের বচন সোহিনীর কানসওয়া। বিয়ের পর থেকেই তো এ বাড়িতে সে যতটা মেয়ে, তার চেয়ে বেশি অতিথি!
গলা উঠিয়ে সোহিনী বলল, শুয়ে শুয়ে ডায়ালগ ঝাড়তে হবে না। যাচ্ছি, তোমার মজা দেখাচ্ছি।
কৌশিক বসে গেছে টেবিলে। বলল, তুই সত্যি কিছু মুখে দিবি না?
পরে। শুধু মাংসটা টেস্ট করব।
বলেই সোহিনী সোজা বড় ঘরে। সাবেকি আমলের খাটে আধশোওয়া হয়ে আছে নমিতা, পিঠে দু’খানা গোবদা গোবদা বালিশ।
চোখ নাচিয়ে সোহিনী বলল, বসতে পারছ তা হলে?
একটু একটু। বেশিক্ষণ পারি না। ব্যথাটা চাগাড় দেয়। …পরশু অবধি যা অবস্থা…মনে হচ্ছিল চিরকালের মতো শয্যাশায়ী হয়েই কাটাতে হবে।
সেটাই তোমার উপযুক্ত শাস্তি। হাঁটু নড়ে না, ঠ্যাং চলে না, তবু উঠোনে ঘুরঘুর করছিলে কেন?
ঝি-টা এমন শ্যাওলা জমিয়ে রাখে…! রোজ বাসন মাজছে, একদিনও ভাল করে ঘষে না…
তাই তুমি নেমে ঝাঁটা চালাবে?
না রে। শুধু পা দিয়ে একটু ডলছিলাম। হঠাৎ এমন পিছলে গেলাম…
শুনলে গা-পিত্তি জ্বলে যায়। একবার ভেবে দেখো না, তোমার সঙ্গে আর সকলেরও কত ভোগান্তি।
অত বকছিস কেন? জেনেবুঝে কেউ আপনজনকে ভোগায়?
সোহিনী পলক উদাস। সেও যদি মা’র মতো করে ভাবতে পারত!
নমিতা আপন মনে বলছে, সবই ভাগ্যের লিখন রে খুকু। বিধাতা যাকে যতটা কষ্ট বরাদ্দ করছে, তাকে তো সেটা পেতেই হবে। …এই তো ধর না, তোর বাবা মুঠো মুঠো সিগারেট খায়…দু’-পাঁচ দিন নয়, আজ বোধহয় পঞ্চাশ বছর… হাঁপের টানে ভোগে বটে, তবে বলতে নেই… সাংঘাতিক কিছু তো হয়নি! ওদিকে বেচারা আমার জামাইটা…
ঘুরেফিরে সেই একই প্রসঙ্গ! অসুস্থ মাকে দেখার অছিলায় একটু তাজা বাতাস নিতে এসেছিল সোহিনী, এখানেও বুঝি নিস্তার নেই।
নমিতা আঁচলে চোখ মুছছে। মা’র পাশে আরও দু’-এক মিনিট বসে থেকে উঠে গেল সোহিনী। পা টিপে টিপে পাশের ঘরে এসেছে। এখানে আগে থাকত সোহিনী, এখন ঘরখানা পূর্ণেন্দুর বইপত্র আর গানবাজনার সরঞ্জামে বোঝাই। আছে হারমোনিয়াম, আছে তবলা, পূর্ণেন্দুর সেতার, সোহিনীর তানপুরাটাও। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে যাবে ভেবেছিল, শেষমেশ আর ইচ্ছে করেনি।
শ্লথ পায়ে তানপুরাটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল সোহিনী, আঙুল ছোঁয়াল তারে। বাঁধা নেই, বেসুরো ধ্বনি বাজছে।
লম্বা একটা শ্বাস গড়িয়ে এল সোহিনীর বুক বেয়ে। পণ্ডিত বিশ্বম্ভর চক্রবর্তীর কাছে নাড়া বেঁধেছিল, কত মন দিয়ে শিখেছিল গান, কী ভাল ভাল বন্দিশ দিয়েছিলেন গুরুজি, ভেবেছিল উচ্চাঙ্গ সংগীতেই প্রাণমন সঁপে দেবে… তারপর গুরুজিও মারা গেলেন, বাবার খুব ইচ্ছে ছিল বলে সেও পড়তে চলে গেল বিশ্বভারতীতে… সোহিনীর জীবনটাই বয়ে গেল অন্য খাতে।
একেও কি মা ভাগ্যের লিখন বলবে? নাকি সোহিনীর তেমন জোরদার ইচ্ছে ছিল না বলেই ঘুরে গেল স্রোত? আর একবার কি ফেরা যায়? যদি অনুপম পাশে থাকে…!
চৈতালি ডাকছে। চিন্তাটা ছিঁড়ে গেল। সোহিনী ফিরল খাওয়ার টেবিলে। পূর্ণেন্দুর আহার শেষ, সম্ভবত বৈঠকখানায় গিয়ে সিগারেট ফুঁকছে। কৌশিক আর চৈতালি সোহিনীর অপেক্ষায় বসে।
চৈতালি এক বাটি মাংস বাড়িয়ে দিয়ে বলল, একটুও ভাত নেবে না?
না রে। শুধুই ভাল। …এতটা দিয়েছিস কেন?
খাও না যতটা পারো। বাকিটার জন্য তোমার দাদা তো ওত পেতে রয়েছে।
কৌশিক হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে বলল, মাকে কেমন দেখলি?
ভাঙবে তবু মচকাবে না।
কোমর তো মা’র আসল প্রবলেম নয়। সাত দিনের ফিজিওথেরাপিই কাফি। একটা মেয়েকে ফিট করেছি, কাল সন্ধেবেলা থেকে আসবে। মা’র মেন হচ্ছে হাঁটু। স্পেশালি রাইট নি একেবারেই গেছে।
তা হলে এবার অপারেশনটা করিয়ে নে। দরকার বুঝলে ডাক্তার হাঁটু বদলে দিক।
আমারও সেরকমই প্ল্যান। আগে ভাস্করের ব্যাপারটা মিটুক। একটা টেনশন চলতে চলতে আর একটাতে জড়িয়ে পড়ার দরকার কী।
মিটবে মানে? কী বলতে চায় দাদা? মরে যাবে ভাস্কর? নাকি সুস্থ হয়ে উঠবে? নাকি কিছুই ভেবে বলেনি, এও স্রেফ কথার মাত্রা? একটুকরো মাংস দাঁতে ছিঁড়ল সোহিনী। ভাস্কর মরুক, কি বাঁচুক, তার সঙ্গে মা’র হাঁটু বদলের কী সম্পর্ক? মা তো সোহিনী নয়, যে ভাস্করের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ তার জীবনের গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করবে? তা ছাড়া দাদার আবার টেনশন কীসের? ভাস্করের অসুখে দাদাকে কি কুটোটি নাড়তে হয়েছে? এক গিয়ে মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া?
মুখে অবশ্য কিছু ফুটল না সোহিনীর। দু’-তিন টুকরো মাংস খেয়ে বাটি এগিয়ে দিল দাদাকে। কৌশিক হাত বাড়াল না, ভাবছে কী যেন। হঠাৎ বলল, তোর খরচখরচা কেমন হচ্ছে রে খুকু?
হাসপাতালে ভরতির উনচল্লিশ দিন পরে এই প্রশ্ন? যাক, তবু মনে জেগেছে তো শেষ পর্যন্ত!
ফিকে হেসে সোহিনী বলল, বড় হাসপাতালে যেমন হয়। জলের মতো।
প্যাকেজ নিয়েছিস না?
তার বাইরেও বিস্তর খরচ। এই তো, ডিপ্রেশানের ট্রিটমেন্টেই আঠেরো—বিশ হাজার বেরিয়ে গেল।
তুই ক্যাশলেসে যাসনি কেন?
এই একটা খচখচানি আছে বটে সোহিনীর। দুম করে তরুণদা এমন একটা সিদ্ধান্ত নিল… ! হয়তো পাঁচ-দশ হাজার কম হয়েছে, কিন্তু সবটাই তো সোহিনীর গাঁট থেকে যাচ্ছে আপাতত। সোহিনীর সেভিংস তো প্রায় শূন্য হয়ে এল। ভাস্করকে নিশ্চয়ই এখন চেক সই করতে বলা যায় না! এবার হয়তো একটা-দুটো ফিক্সড ডিপোজিটে হাত দিতে হবে।
সোহিনী আলগাভাবে বলল, ঠিক আছে রে। হয়ে তো যাচ্ছে।
লাগলে আমায় বলিস কিন্তু।
সোহিনী ফের হাসল অল্প। চলে গেছে অন্য গল্পে। তানিয়াকে নিয়ে, পাপানকে নিয়ে, বনানীকে নিয়েও। তার মাঝেই পিসিকে টেনে নিয়ে গেল তানিয়া, দেখাল তার বার্বিডলের নির্ঝঞ্ঝাট সংসার। অবশেষে মাকে আর একবার দেখে যখন বসার ঘরে এল, পূর্ণেন্দু তখন ঢুলুঢুলু চোখে টিভিতে খবর দেখছে।
মেয়ে পাশে বসতেই পূর্ণেন্দু টানটান। বড়ঘড়িটা দেখে বলল, কী রে, তুই এবেলাও হাসপাতাল যাবি না?
যাব। দাদার সঙ্গে বেরোব।
খোকন যাচ্ছে বুঝি?
হুঁ। ড্রাইভারকে তো কল দিল।
তা হলে অত তাড়া নেই। একটু গড়িয়ে নিলে পারতিস।
দুপুরে শোওয়ার অভ্যেস যে আমার নেই বাবা।
তোর কিন্তু একটু রেস্ট দরকার খুকু। বড় স্ট্রেন যাচ্ছে। …এবার টানা ক’দিন ছুটি নে। তুই বিছানায় পড়লে আর দেখতে হবে না।
দেখি। ম্যানেজারকে বলি। অফিসের প্রসঙ্গে রূপকের সিডির কথা মনে পড়েছে সোহিনীর। উঠে ব্যাগটা এনে রাশি রাশি কাগজ হাতড়ে হাতড়ে একেবারে তলা থেকে বার করল সিডিটা। বাবাকে দিয়ে বলল, এটা শুনো তো। আমাদের ব্রাঞ্চের একটা ছেলে গেয়েছে। আমি তো সময় পাচ্ছি না…
ফ্ল্যাপ খুলে পূর্ণেন্দু দেখল সিডিখানা। বলল, বাহ্, ভাল ভাল গান। তুইই রেখে দে না। শুনলে ভাস্করের মন ভাল থাকবে।
ও রবীন্দ্রসংগীত তেমন পছন্দ করে না।
তবে থাক। টেবিলে সিগারেট-লাইটারের পাশে পূর্ণেন্দু সিডিটা রাখল। একটু চিন্তা করে বলল, হ্যাঁরে, ভাস্করের ডিপ্রেশানটা তো আর নেই, তাই না?
ওটা কি পুরোপুরি যায়, বাবা?
হুম্। আসলে কী জানিস খুকু, ক্যান্সার রোগটাই এরকম। যার হয়, একমাত্র সেই বোঝে অ্যাকসেপ্ট করা কত কঠিন। …তবু খেয়াল রাখিস বাড়িতে ফিরলে আবার যেন না বাড়ে।
যেন বাবাকে নয়, সোহিনী নিজেকেই বলল, যথাসাধ্য করছি তো। করছি না?
তা তো বটেই। তোরা সবাই মিলে…। ভাস্করের ওই বন্ধুটাও খুব খাটছে। খুব ভাল ছেলে। এই বয়সে ইউনিভার্সিটির প্রফেসার…এতটুক দেমাক নেই…একটা ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে না শুনে সেদিন গাড়ি নিয়ে পিজি হসপিটালের কাছে দৌড়োল…ভাস্করের বন্ধুভাগ্য ভাল বলতে হবে।
শেষ বাক্যটি সোহিনীর কাছে প্রহসনের মতো ঠেকল। আবার এও মনে হল, পরিস্থিতির একটু এদিক ওদিকে ওই অনুপমই হয়তো বাবার চোখে শয়তান লম্পট হয়ে দাঁড়াত। মানুষ তো একই, দৃষ্টিভঙ্গির ফারাকই তাকে বদলে বদলে দেয়।
বিকেলে চা-টা খেয়ে বেরোতে একটু দেরিই হল সোহিনীদের। পৌঁছোল প্রায় পৌনে ছ’টায়। হাসপাতালে দর্শনার্থীর সংখ্যা অনেক কমে গেছে, আজ প্রায় নেইই। দিদি আর তরুণদা শুধু দুর্গ রক্ষা করছে।
সোহিনী-কৌশিককে একসঙ্গে দেখে তরুণ গাল ছড়িয়ে হাসল, বাহ্, বাহ্, বাপের বাড়ি মেরে এলে বুঝি?
মা’র একটা ছোট অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে, দেখতে গিয়েছিলাম। অজান্তেই সোহিনীর গলায় যেন আত্মরক্ষার সুর। তাড়াতাড়ি ভাস্বতীকে বলল, তোমরা দু’জনেই নীচে কেন দিদি? ওপরে কেউ যাবে না?
এতক্ষণ তো আমি ছিলাম। এইমাত্র অনুপম গেল।
ও। সোহিনী নিজের কাছে রাখা কার্ডখানা বার করে কৌশিককে ধরিয়ে দিল, তুই তা হলে যা দাদা, তারপর নয় আমি…
না না, তুমি আগে যাও। ভাস্বতী তাড়া লাগাল, বাবুন তোমার জন্য অনেকক্ষণ ধরে ছটফট করছে।
কেন?
সে কি আমাকে বলবে?
তরুণ মুচকি মুচকি হাসছে। কৌশিকও। সোহিনী তাড়াতাড়ি সরে লিফটের দরজায় গেল। পাঁচতলায় পৌঁছে কেজো পায়ে কেবিনের দরজায় দাঁড়িয়ে পড়েছে। অনুপম হাত নেড়ে কী যেন বোঝাচ্ছে ভাস্করকে, বিছানায় পা ঝুলিয়ে চোখ কুঁচকে শুনছে ভাস্কর…
আচমকাই দৃষ্টি সোহিনীতে। সঙ্গে সঙ্গে যেন জ্বলে উঠেছে চোখের মণি। শীর্ণ মুখমণ্ডল হঠাৎই উজ্জ্বল।
বিহ্বল গলায় ভাস্কর বলল, এত দেরি… কোথায় ছিলে এতক্ষণ?
সোহিনী নিরুত্তাপ স্বরে বলল, মোবাইলে কল করলেই জানতে পারতে। আমার মোবাইলে পয়সা নেই যে। কল আসছে, যাচ্ছে না।
কালই বলা উচিত ছিল। সোহিনী শান্তভাবে বেডের পাশের টেবিলটায় গেল। রোজকার রিপোর্ট চার্টখানা উলটোতে উলটোতে বলল, আজ রিচার্জ করে দেব।
আচ্ছা শোনো… আমার তো কালই রেডিয়েশান শেষ?
হ্যাঁ।
তা হলে কাল এরা আমায় ছাড়বে না কেন?
অনুপম বলে উঠল, আহা, তোকে বলছি না… আবার এক্স-রে হবে, আবার ব্রেনস্ক্যান… ডাক্তারকে তো দেখতে হবে কতটা সুস্থ হলি।
সেগুলো তো কালও হতে পারে।
সব কিছু তো তোমার ইচ্ছেয় হবে না। সোহিনী রিপোর্ট চার্টটা বন্ধ করল। অনুপম উঠে দাঁড়িয়েছে, তার জায়গায় টুলে বসে বলল, নিয়মকানুন বলেও তো একটা কথা আছে।
কবে তা হলে ছাড়বে?
বুধবার, কিংবা বৃহস্পতিবার…
না না, বৃহস্পতি নয়, বুধবারই। এখানে আমার আর একমুহূর্ত ভাল লাগছে না। বলেই খপ করে সোহিনীর কাঁধ চেপে ধরেছে ভাস্কর, তুমিও কিন্তু বুধবার থেকে ছুটি নেবে। সারাক্ষণ আমার কাছে কাছে থাকবে।
বললেই তো হয় না। ভাস্করের হাতটা নামাতে চাইল সোহিনী, পারল না। বড্ড জোরে চেপেছে। অস্বস্তিভরা গলায় বলল, যদি অফিস ছুটি দেয়, তবেই…
আমি কিছু শুনতে চাই না। ভাস্করের অন্য হাতখানাও খামচে ধরল সোহিনীর কাঁধ। অস্থিরভাবে মাথা ঝাঁকাচ্ছে, কেন বুঝছ না সোহিনী, তোমাকে ছাড়া বাড়িতে আমি একা থাকতে পারব না।
মা তো আছেন।
না। তুমি থাকবে, তুমি।
সোহিনী অসহায়ের মতো অনুপমের দিকে তাকাল। পলকের জন্য মনে হল, এই মুহূর্তে এখানে অনুপমের থাকাটা কি খুবই জরুরি!