০১. অনুপমকে দেখছিল সোহিনী

গহিন হৃদয় – সুচিত্রা ভট্টাচার্য

.

সদ্যপ্রয়াত জেঠিমা
অন্নপূর্ণা দেবীর স্মৃতির উদ্দেশে

.

০১.

দরজা থেকে অনুপমকে দেখছিল সোহিনী। অপলক চোখে। ঈষৎ ঝুঁকে থাকা ওই দেহকাণ্ড, চওড়া কাঁধ, রুপোর কুচি মেশানো একমাথা ঘন চুল, তাকে যেন চুম্বকের মতো টানছিল। খাটে বসে কী যেন লেখালিখি করছে অনুপম, ল্যাপটপে আঙুল চলছে দ্রুত লয়ে। সোহিনী মাত্র কয়েক হাত তফাতে দাঁড়িয়ে, অথচ অনুপম এখনও টেরই পেল না! ওই নিমগ্নতাও কম সম্মোহক নয়। অজান্তেই দুর্বল হয়ে আসে পা, কাঁপন জাগে দেহে।

আশ্চর্য, ভাস্করকে তো সে কত রূপে দেখেছে। ঘরোয়া ভাস্কর, দলের মাঝে ভাস্কর, সুটেড-বুটেড ভাস্কর, কেজো ভাস্কর, নিরাবরণ ভাস্কর…কখনও কি সোহিনীর এ হেন আলোড়ন জেগেছে?

সোহিনী ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলল। কেন এই মানুষটা আগে তার জীবনে আসেনি? কেন সে এতগুলো বছর নষ্ট করল ভাস্করের সংসারে?

একটা মাত্র নিশ্বাসের অভিঘাতেই বুঝি ঘরের ভারসাম্য টলে গেল। অনুপমের হাত থেমেছে, একটু যেন আনমনা সহসা। ল্যাপটপ বন্ধ করল, চশমা খুলে রগড়াচ্ছে দু’চোখ। হাত দু’খানা মাথার পিছনে একত্র করে বার কয়েক চাপ দিল ঘাড়ে। পা টানটান হল, মাথা উঠছে, নামছে, হেলছে ডাইনে বাঁয়ে। দৃশ্য বটে একখানা।

আচমকাই ঘুরে তাকিয়েছে অনুপম। কপালে নরম বিস্ময়, কখন এলে? বেল বাজাওনি তো?

সোহিনী ভ্রূভঙ্গি করল, চাবিটা তা হলে রেখেছি কেন মশাই? একা একা কী করো দেখব বলেই তো?

কী দেখলে?

উঁহু, দেখিনি তো কিছু। বুঝলাম।

কী?

মুনিঋষিদের ধ্যান ভাঙানোটা ঠিক নয়। পাপ হয়।

দারুণ একখানা সার্টিফিকেট দিলে তো! অনুপম ঘুরে বসল। খাটের বাইরে পা ঝুলিয়ে লম্বা শ্বাস টানল। মুচকি হেসে বলল, ধ্যান আমার আগেই ভেঙেছে। কোত্থেকে একটা মিষ্টি গন্ধ নাকে আসছিল, উৎসটা ধরতে পারছিলাম না। কী করে বুঝব, এ তোমারই স্মেল!

শুনতে মজাই লাগল সোহিনীর। অফিস থেকে বেরোনোর মুখে সদ্য কেনা পারফিউমটা ছড়িয়েছিল গায়ে, অটোরিকশায় ঠাসাঠাসিতেও সুবাস যায়নি তা হলে! নাহ্, আড়াই হাজার টাকা খরচটা বৃথা হয়নি।

মুখে অবশ্য খুশিটুকু ফুটতে দিল না সোহিনী। ঠাট্টার সুরে বলল, আমার গন্ধ তা হলে এখনও তুমি চেনো না?

চেনার কোনও শেষ নাই সখি। চিনিতে চিনিতে জীবন যায়।

খুব যে ডায়ালগের বহর!…মনোযোগ দিয়ে কী করছিলে শুনি?

বক্সে একগাদা ই-মেল জমেছিল। চেক করে করে জবাব দিচ্ছিলাম।

তোমার মেয়ের মেল এল?

কই আর। লীনা বোধহয় আমায় ভুলেই গেছে।

তুমি তাকে লিখেছ?

আজকেও একটা পাঠালাম। দেখি কবে মেয়ে রিপ্লাই দেয়। অনুপমের মুখে পলকা ছায়া পড়েও মিলিয়ে গেল। পূর্ণ চোখে দেখছে সোহিনীকে। একটু যেন উৎকণ্ঠা নিয়েই বলল, তোমার মুখচোখ এত কালো দেখাচ্ছে কেন? অফিসে খুব ধকল যাচ্ছে বুঝি?

কিছুই কি অনুপমের দৃষ্টি এড়ায় না? সোহিনীর শ্রান্তি যেন জুড়িয়ে গেল। ভালবাসার জনের কাছে এটুকুই তো আশা করে মানুষ।

রঙ্গ করার সুরে সোহিনী চোখ পাকিয়ে বলল, আমার তো তোমার মতো আরামের জীবন নয় স্যার। গ্যারাজ থেকে এসি গাড়িটি বার করে হুস ইউনিভার্সিটি, একটা-দুটো ক্লাস নিয়ে ব্যাক টু নিজের গুহা…

ফর ইয়োর ইনফর্মেশন, আজ আমার ডে অফ। বিছানা থেকে নামল অনুপম। কাছে এসে সোহিনীর গালে টোকা দিয়ে বলল, সারাদিনই আজ গড়াগড়ি খাচ্ছি।

জানি, জানি। আজ তো তোমার সুখই সুখ। অনুপমের কাঁধে আলগা চাপড় দিল সোহিনী। ভুরু বেঁকিয়ে বলল, আমাদের রীতিমতো খেটে খেতে হয়, বুঝলে।

ব্যাঙ্কের চাকরি তো মোটামুটি আয়েশের কাজ বলেই জানি।

ক্যাশ কাউন্টারে বসতে হলে ওই বাক্যটি মুখ দিয়ে বেরোত না মশাই।

আজকাল কাউন্টার থেকে কেউ টাকা তোলে নাকি? সবাই তো এটিএম-এই…

বুড়োগুলো ব্যাঙ্কেই ভিড় জমায়। যা জ্বালায় না এক-এক জন! কেউ হয়তো বড় নোট নেবে না, কারও আবার ছোট নোটে অরুচি…

উম্, বুঝলাম। অনুপম আরও ঘন হল। সোহিনীর কাঁধে হাত রেখে বলল, বুড়োরা তোমার সব এনার্জি নিংড়ে নিয়েছে। এখন এই আধবুড়োর হাতের এক কাপ গরম কফি দরকার।

অনুপমের স্পর্শে সোহিনীর শরীর ঝনঝন। ব্যাগখানা ছুড়ে দিল বিছানায়। জড়িয়ে ধরেছে অনুপমের গলা। গাঢ় স্বরে বলল, শুধু কফি?

এ প্রশ্নের উত্তর শব্দে হয় না। অনুপমের ঠোঁট নেমে এল সোহিনীতে। দু’জোড়া ওষ্ঠ শুষে নিচ্ছে পরস্পরকে। তীব্র আশ্লেষে অনুপমের বুকে মুখ ঘষল সোহিনী। সর্বাঙ্গে অনুভব করছে পুরুষালি চাপ, রমণীয় হ্লাদে যেন গলে যাচ্ছে হাড়পাঁজরা।

অনুপমই আস্তে আস্তে সরাল নিজেকে। সোহিনীর নাকে নাক ঘষে বলল, শুধু আদর খেলে কি পেট ভরবে?

উম্‌ম্।

স্যান্ডুইচ বানিয়ে দেব?

উম্‌ম্।

উম্‌ম্।

পাগলামি করে না, ছাড়ো। কফির জলটা বসাই।

চটি গলিয়ে অনুপম রান্নাঘরে। সোহিনী স্খলিত পায়ে বিছানায়। বসেও হাঁপাচ্ছে অল্প অল্প। এখনও শরীর জুড়ে কী তাপ! রক্তকণিকারা ছোটাছুটি করছে শিরা উপশিরায়।

উত্তেজনা সংযত করার চেষ্টা করল সোহিনী। ধমকাল নিজেকে। সাঁইত্রিশ বছর বয়স হল, এখন কি আর কচি খুকিদের মতো উদ্দাম প্রেম তাকে মানায়? কিন্তু করবেই বা কী? এই নিরালা…অনুপমের মতো এক মায়াবী পুরুষ…মাথার ঠিক থাকে না যে। নিষিদ্ধ প্রণয়ের রোমাঞ্চ কি পুলকের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়?

বেডকভারখানা কিঞ্চিৎ এলোমেলো হয়ে আছে। সোহিনী শুয়ে পড়ল খাটে। প্রকাণ্ড ইংলিশ খাট, ছত্রি লাগানো, অনুপমের ঠাকুরদার আমলের। শিকাগো থেকে পাকাপাকি চলে এসে বাড়ির একতলার এই পিছন ভাগটা উত্তররাধিকার সূত্রে পেয়েছে অনুপম, সঙ্গে কিছু সাবেকি আসবাব। যেটি যেমন দশায় ছিল, প্রায় তেমনই রেখেছে। ঘরদোরের এই পুরনো চেহারাটাই বুঝি অনুপমের বেশি প্রিয়। সোহিনীরও বেশ লাগে। শুধু অনুপমকে নয়, শুধু অনুপমের শয্যাটিকে নয়, আলোছায়া মাখা অনুপমের বাসস্থানটিকেও সে যেন ভালবেসে ফেলেছে। চোখ বুজে সোহিনী বলে দিতে পারে এ বাড়ির খুঁটিনাটি। কড়িবরগাওয়ালা এই বিশাল কক্ষটির কোথায় কাঠের আলমারি, কোথায় ড্রেসিংটেবিল, কোথায় দেরাজ, নীল কাচের ঢাকনা পরানো বাহারি টেবিল ল্যাম্পটিই বা কোথায়, কিংবা পাশের ঘরের শোকেসে ক’খানা চিনেমাটির পুতুল সাজানো, দেওয়ালে কার কার ছবি ঝুলছে, সোহিনীর সব মুখস্থ। অভিজাত অষ্ট্রিয়ান পিয়ানো, চওড়া প্যাসেজে ল্যাজারাসের খাওয়ার টেবিল, ইটালিয়ান কাচের রঙিন শার্সি, জানলার খড়খড়ি, দরজার খিল, ছোট-বড় পেন্টিং, পিছনের এজমালি জমিটায় আপন খেয়ালে বেড়ে ওঠা কামিনী গাছ—প্রতিটি এখন সোহিনীর অতি চেনা। পাপানকে নিয়ে সে এবার পাকাপাকি চলে আসবে এখানে, ভাবলেই যেন গায়ে কাঁটা দেয়।

দু’হাত বিছানায় ছড়িয়ে দিল সোহিনী। হ্যাঁ, পাপান তার মায়ের কাছেই থাকবে। ভাস্করের মতো ছ্যাবলা, আত্মসুখপরায়ণ লোকের হাতে মোটেই সে ছেলেকে ছাড়বে না। প্রয়োজনে লড়বে আদালতে, দাঁতে দাঁত চেপে।

কিন্তু পাপানের এ বাড়ি ভাল লাগবে তো? আছে তো ফ্ল্যাটের দশ বাই বারো কামরায়। এত বড় বড় ঘর তো পাপানের অপছন্দ হওয়ার কথা নয়। অনুপমের সঙ্গেও তার যথেষ্ট দোস্তি। স্টোরি বুক, গেমস কিনে নিয়ে যায় বলে অনুপম আঙ্কলকে দেখামাত্র চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে পাপানের। তবু তাকে বাবা হিসেবে মেনে নেওয়া…! নয় পুরে দশে পড়বে ছেলে, এখনই অনেক ব্যাপারে তার মতামত তৈরি হয়েছে। সুতরাং…। বোঝাতে হবে, বোঝাতে হবে। তা ছাড়া মাকে ছেড়ে পাপান থাকতেই পারবে না।

এরকম ভাবনায় একধরনের ছটফটানি আছে। সোহিনী ব্যাগ খুলে মোবাইল বার করল। বাড়ির নম্বর টিপছে। কে ধরবে ফোন? ঠাকুমা? না নাতি?

যাক, নাতিরই গলা, হ্যালো?

কী করছ বাবু?

টিভি দেখছি।

নিশ্চয়ই সিআইডি?

একটু আগে খুলেছি মা।

উফ্, সারাক্ষণ ওই এক সিরিয়াল। কখন পড়তে বসা হবে, শুনি?

আর পাঁচ মিনিট।

আমাকে যেন আবার তাড়া লাগাতে না হয়।…বিকেলে আজ কী করলি?

রন্টিদের ফ্ল্যাটে গিয়েছিলাম। স্ক্র্যাব্‌ল্ খেলতে।

তোর ঠাম্মা কোথায়?

বোধহয় ঘরে। পুজো করছে।

সুষমামাসি বিকেলে এসেছিল?

বোধহয়।

কিচ্ছু খবর রাখিস না। বলতে বলতে সোহিনী দেখল অনুপম ট্রে নিয়ে ঢুকছে। ইশারায় মিল্কপটটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, কফিতে দুধ দেবে কিনা। ঘাড় নেড়ে সায় দিল সোহিনী। এক আঙুলে চিনির পরিমাণ দেখিয়ে ফের ছেলেকে বলল, সময় নষ্ট কোরো না কিন্তু। পটাপট হোমওয়ার্ক সেরে ফেলো। আমি গিয়ে চেক করব।

তুমি কখন ফিরছ মা?

ঘণ্টাখানেকের মধ্যে।

একটা চার্ট পেপার কিনে এনো। কাল স্কুলে লাগবে।

এতক্ষণে সেটা মনে পড়ল? ঠিক আছে। ছাড়ছি।

সেলফোন বন্ধ করে সোহিনী অনুযোগের সুরে বলল, পাপানটা মহা বিচ্ছু হয়েছে। পড়তে বসাতে ঘাম ছুটে যায়।

কফি মগে চামচ নাড়ছিল অনুপম। হেসে বলল, সবে তো ক্লাস ফোর, এখনই এত প্রেশার তৈরি করছ কেন?

নইলে ছেলে আরও পেয়ে বসবে। ঠাম্মাকে তো ট্যাঁকে গোঁজে। কাজের কাজ তো তিনি কিছুই করেন না, সারাক্ষণ নাতিকে মাথায় তুলে নাচছেন! আর বাবার তো হুঁশই নেই। তিনি থাকেন নিজের জগতে। …কাউকে না কাউকে তো নজরদারির ভারটা নিতেই হয়।

বটে? অনুপম ট্রে-টা এগিয়ে দিল, নাও, স্টার্ট করো। পেটে কিছু না পড়লে মাথা আরও গরম হবে।

ভারী পরিপাটি ভাবে স্যান্ডুইচ বানিয়েছে অনুপম। পাতলা পাঁউরুটির ধার সযত্নে ছাঁটা, ভেতরে মেয়নিজের আস্তরণ, মাঝখানে পুরু হ্যাম। সোহিনী হাক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরলে ভাস্কর তার সামনে এভাবে খাবার ধরছে…স্বপ্নেও ভাবা যায়? হাহ্, ভাস্করের এসব বোধই নেই। এখানেই অনুপমের সঙ্গে তার বিরাট তফাত। অনুপমের মধ্যে যে-সংবেদনশীলতা আছে, ভাস্করের সেটা তৈরিই হয়নি। সোহিনীর ভাল লাগা, মন্দ লাগা নিয়ে কোনওদিন মাথা ঘামিয়েছে ভাস্কর?

একখানা স্যান্ডুইচ তুলে কামড় বসাল সোহিনী। হঠাৎই হাসছে ফিকফিক।

অনুপম কফিতে চুমুক দিচ্ছিল। ভুরু নাচিয়ে বলল, কী হল?

তোমার মেমবউটা কী বুদ্ধু গো! এমন গৃহকর্মনিপুণ বরকেও ছেড়ে চলে গেল?

ধুৎ, বিদেশে এসব কোনও গুণই নয়। সবাইকে ওখানে কাজ করতে হয়। না পারলে শিখে নেয়।

তুমি কি বলতে চাও, বাইরে-টাইরে থাকলে ভাস্করও শিখত? অসম্ভব। এক গ্লাস জল পর্যন্ত যে ঢেলে খায় না, সে কিনা ঢুকবে রান্নাঘরে! যদি বা দায়ে পড়ে করতেও হত, দেশে ফিরে ওমনি স্বমূর্তি ধরত। গরগর করত মেল ইগোয়।

যাহ্, তুমি কিন্তু ভাস্করের একটু বেশিই নিন্দে করছ। অনুপম চোখ টিপল, আরে বাবা, বাড়ির অ্যাটমসফিয়ারের ওপরও তো অনেক কিছু নির্ভর করে, না কী? মাসিমা মাটির মানুষ, উনি কখনও ছেলেকে দিয়ে…

বন্ধুর হয়ে সাফাই গেয়ো না তো। ওর নেচারটাই ওরকম। তোমার মধ্যে ফিলিংস বলে একটা ব্যাপার আছে, ভাস্করের সেটি এগজিস্টই করে না। এক এক সময়ে তো রীতিমতো নিষ্ঠুর মনে হয়। ভাবতে পারবে না…প্রচণ্ড মাথা ধরেছে, অফিস থেকে ফিরে শুয়ে পড়েছি…বাবু ঢুকে একবার দেখলেন, শুনলেন প্রবলেমটা…তারপরেই উপদেশ, কড়া করে এক কাপ চা বানিয়ে খাও, মাইগ্রেন-টাইগ্রেন পড়পড়িয়ে পালাবে! আর হ্যাঁ, আমার জন্যও এক কাপ বানিয়ো! কফি শেষ করে পোরসেলিনের সুদৃশ্য মগখানা নামাল সোহিনী। ঠোঁটের কোল আলগা মুছে নিয়ে ফের বলল, কত শোনাব! এবার শীতে…জানুয়ারির শেষে যে বিচ্ছিরি ঠান্ডাটা পড়ল…একদিন ভোরবেলা কাজের মেয়েটা কলিংবেল বাজাচ্ছে…বাবুর ঘুম ভেঙে গেছে, আমি তখনও ঘোর নিদ্রায়…আমাকে ঠেলে তুলে বলল, দরজাটা খুলে দিয়ে এসো না…!

ভাস্করটা চিরকালই একটু আয়েশি টাইপ। হস্টেলে তো ওর ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে দিতে হত। অনুপম মিটিমিটি হাসছে, তবে সত্যি বলতে কী, অ্যাভারেজ বাঙালি ছেলেই তো এই গোত্রের।

কথাটা তেমন পছন্দ হল না সোহিনীর। এখন সে ভাস্করকে ত্যাগ করার জোরালো কিছু কারণ খুঁজছে বলেই হয়তো। এবং এই দোষত্রুটিগুলোই তো সেই যুক্তি, যার ওপর ভিত্তি করে তার আশু পদক্ষেপটি নৈতিক বৈধতা পায়। অন্তত তার নিজের কাছে। একটা সম্পর্ক ছেঁড়ার ক্ষেত্রে এর মূল্য নেহাত কম নয়।

ভেতরে ভেতরে সোহিনী যেন তেতেই গেল একটু। গুমগুমে গলায় বলল, আমি কিছু শুনতে চাই না। আমি আর ওকে বরদাস্ত করতে পারছি না, ব্যস।

সেটাই বলো। যাকে সহ্য করতে পারছ না, তার সঙ্গে আর থাকবে না, এটাই তো যথেষ্ট।

এ কথাটাও সোহিনীর যেন হজম হল না। কেন যেন মনে হল, তার যুক্তি অসার প্রমাণ হওয়ায় অনুপমের কাছে সে বুঝি একটু ছোট হয়ে গেল। নাকি নিজের কাছেই?

সোহিনীর খারাপ লাগাটুকু বোধহয় টের পেয়েছে অনুপম। ট্রেখানা মেঝেতে নামিয়ে সোহিনীর গা ঘেঁষে বসল। কপালে ছোট্ট চুমু খেয়ে বলল, আমিও তো কিছু শুনতে চাই না। আমারও তো তোমাকে চাই, ব্যস।

যেন এইটুকুনিরই প্রতীক্ষায় ছিল সোহিনী। নাকের পাটা ফুলে উঠল, গরম হচ্ছে কান, ফের জাগছে শরীর। নিপুণ হাতে সোহিনীকে উন্মোচিত করল অনুপম। কামিজ সালোয়ার ব্রা প্যান্টি সরে গেল বিছানায় প্রান্তে। অনুপমও নগ্ন এখন। শুইয়ে দিয়েছে সোহিনীকে, সর্বাঙ্গ তার ভরিয়ে দিচ্ছে চুমুতে চুমুতে। নারীপুরুষ মাতল আদিম খেলায়।

রমণ শেষে শুয়ে আছে ক্লান্ত অনুপম। সোহিনী উঠে বসল। অনুপমের চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলল, অ্যাই, এবার তো আমায় যেতে হয়।

চোখ বুজে অনুপম বলল, থেকে যেতে পারো না?

আসব গো আসব। এবার একেবারেই চলে আসব।

কবে?

একটু তো সময় লাগবে। সোহিনী নামল বিছানা ছেড়ে। পোশাক পরতে পরতে বলল, আইনি ফ্যাকড়াগুলো আগে কাটিয়ে নিই।

অনুপম পাশ ফিরল। নেশা নেশা চোখে দেখছিল সোহিনীকে। ঈষৎ জড়ানো গলায় বলল, দুটো প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ একসঙ্গে থাকবে…এর মধ্যে আবার আইনকে টানার দরকার কী?

বা রে, পাপান আছে না!

হুম। তা তোমার কোন ল’ইয়ার বন্ধুর সঙ্গে পরামর্শ করবে বলেছিলে…কী হল?

ও নেই। রিলেটিভের বিয়েতে দিল্লি গেছে। নেক্সট উইকে ফিরলেই মিট করব। সম্ভবত জুডিশিয়াল সেপারেশনই সাজেস্ট করবে। বাই মিউচুয়াল কনসেন্ট।

ভাস্কর রাজি হবে?

কী জানি! গড়বড় করলে তো মুশকিল। বেরিয়ে এসে ডিভোর্সের মামলা ঠুকতে হবে তখন। তারও তো প্রচুর হ্যাঙ্গাম। সলিড গ্রাউন্ড লাগবে…

কীসের গ্রাউন্ড? একজন আর একজনের সঙ্গে থাকবে না, এটাই তো সাফিশিয়েন্ট। শুধু এটুকু বলেই তো মারিয়া আমার সঙ্গে কাটান-ছেঁড়ান করে নিল।

এটা আমেরিকা নয় মশাই, দেশটার নাম ভারতবর্ষ। এবং হিন্দু বিবাহ অতি সনাতন প্রতিষ্ঠান। একে ভাঙা অত সহজ নয়।

কথাটা ছুড়ে দিয়ে সোহিনী সোজা বাথরুমে। রান্নাঘর, আর এই লাগোয়া বাথরুমটাই যা এ বাড়িতে আধুনিক। নতুন টাইলস-ফাইলস লাগিয়ে, হাল ফ্যাশানের সরঞ্জামে রীতিমতো ঝাঁ-চকচকে। বেসিনের আয়নায় সোহিনী দেখল নিজেকে। খুব বেশি ধ্বস্ত লাগছে না তো? কেশদাম যথেষ্ট অবিন্যস্ত, আঙুল চালিয়ে ঠিকঠাক করল। মুখে-ঘাড়ে জল ছেটাল অল্প, রডে ঝুলন্ত অনুপমের তোয়ালেতে মুছল চেপে চেপে। বুঝি বা নতুন করে মেখে নিল অনুপমের ঘ্রাণ।

বেরিয়ে দেখল, পাজামা-পাঞ্জাবি চড়িয়ে সিগারেট ধরিয়েছে অনুপম। নেশা নেই, ইচ্ছে হলে খায় দু’-একটা। তামাকের ওই কটু গন্ধটা এ বাড়িতে সোহিনীর উপরি পাওনা। কেমন একটা আবেশ জাগে যেন।

জোরে নাক টেনে সোহিনী ব্যাগ কাঁধে তুলল, আজ তা হলে চলি?

অনুপম কী যেন ভাবছিল। মাথা সামান্য ঝাঁকিয়ে বলল, চলি বলতে নেই। বলো, আসি।

সোহিনী হেসে বলল, বেশ, তাই।

বাড়ির বাইরে পা রেখে অভ্যেস মতো একবার ঊর্ধ্বপানে ঘাড় ঘোরাল সোহিনী। সামনের দিকের দোতলা তিনতলা অনুপমের জেঠতুতো দাদাদের। গ্যারেজ বাদে একতলার বাকিটাও। আর অনুপমের মাথার ওপর তার বড়দা-মেজদার অধিষ্ঠান। সোহিনী এলেই অনেকগুলো মুখ উঁকিঝুঁকি দেয় এদিক ওদিক থেকে। বিশেষত, অনুপমের ফুলবউদির তো অসীম কৌতূহল। দোতলার বারান্দা বেয়ে প্রায় ঝুঁকে ঝুঁকে পড়ে। আজ বাঁচোয়া, বউদিটি অলিন্দে নেই।

ফাল্গুন প্রায় ফুরিয়ে এল। দিনমানে রোদ বেশ চড়া, তবে সন্ধে থেকে চমৎকার হাওয়া দিচ্ছে। শুকনো শুকনো, মিঠে বাতাস। হাঁটতে হাঁটতে সোহিনী বাস স্টপে এল। আটটা বেজে গেছে, ট্যাক্সি ধরে নেবে নাকি? তা কলকাতায় ঠিকঠাক ট্যাক্সি মেলা তো প্রায় ঈশ্বরপ্রাপ্তির সমতুল, শেষমেশ মিনিবাসেই উঠতে হল। কপাল খুব মন্দ নয় আজ, ড্রাইভারের পাশের টানা সিটটায় জায়গাও মিলে গেছে।

সামনের কাচে চোখ রেখে আবার অনুপমকেই ভাবছিল সোহিনী। কী যে হয়েছে তার, ওই একটা মানুষই তাকে দখল করে থাকে সারাক্ষণ। অথচ মাত্র বছর দুয়েক আগেও অনুপমের তেমন কোনও অস্তিত্ব ছিল না তার কাছে। প্রথম দর্শনেও প্রেম-টেম কিছু জাগেনি। ভাস্করের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের বন্ধু, আমেরিকা গিয়ে মেম বিয়ে করে থিতু হয়েছিল, বউয়ের সঙ্গে ছাড়াছাড়ির পর এখন কলকাতায়, মাঝেসাঝে বন্ধুর ফ্ল্যাটে গল্পগুজব করতে আসে—ব্যস, সম্পর্ক তো ছিল এইটুকুই। গত বছরের গোড়ার দিকে অনুপমের মা মারা গেলেন, তখনই বুঝি মানুষটার জন্য একটু একটু মায়া জেগেছিল। শ্রাদ্ধের নেমন্তন্ন করতে এসে চুপ মেরে বসে, কাছা-টাছা নেয়নি তবু চেহারাটা ভারী শুকনো দেখায়, চুল উসকোখুসকো, না কামানো খোঁচা খোঁচা দাড়ি…! দুই দাদা থাকা সত্ত্বেও ফস করে শ্বাস ফেলে বলেছিল, এবার আমি সত্যিই একদম একা হয়ে গেলাম!

বাক্যটা এক অচিন অনুরণন সৃষ্টি করেছিল সোহিনীর বুকে। সেদিনের মায়াই কি দিনে দিনে বদলে গেল ভালবাসায়? সোহিনীর চোখে বোধহয় কোনও আমন্ত্রণের ইঙ্গিত ছিল, এরপর অনুপম যখন-তখন চলে আসত তাদের ফ্ল্যাটে। ভাস্কর নেই তো কী, সোহিনীর সঙ্গে গোটা সন্ধে বকবক করছে। রাতে খেয়েও যায় কোনও কোনও দিন।

তারপর হঠাৎই এক দুপুরে অফিসে হানা। ছুটি হতে তখন ঢের বাকি, ঠায় বসে রইল অনুপম। সোহিনীর সঙ্গে নাকি জরুরি কথা আছে!

নাহ্‌, কথাটা এখনও জমাই রয়েছে। বলার প্রয়োজনই বা কী, যখন এমন এক উজ্জ্বল পুরুষের জন্য সোহিনীও তৃষ্ণার্ত ছিল এতকাল! ভাস্কর এত সাধারণ, এত বেশি ম্যাড়মেড়ে!

আপন মনে হাসল সোহিনী। জীবন যে কখন কোন বাঁকে মোড় নেয়!

বাস থেকে নেমে সামান্য হাঁটা। জোরে পা চালিয়ে সোজা তিনতলার ফ্ল্যাটের দরজায় এসে একটুক্ষণ দাঁড়াল সোহিনী। তারপর বেল বাজাচ্ছে। একবার…দু’বার…তিনবার…! ব্যাপারখানা কী?

অবশেষে সাড়া মিলল। ভাস্কর দরজা খুলেছে। পরনে হাঁটুঝুল শর্টস, ঊর্ধ্বাঙ্গ যথারীতি অনাবৃত। লোমশ বুকে থাবা ঘষতে ঘষতে বলল, আজ এত লেট?

লোকটাকে দেখামাত্র সোহিনীর অন্তরাত্মা খিঁচড়ে গেল। ঢুকে চটি ছেড়ে বলল, কান দুটো কি একেবারেই গেছে?

পাপান খুলবে ভাবছিলাম। ব্যাটা এমন ঝুল দিল…বেরোলই না। ফের সোফায় গিয়ে পজিশন নিয়েছে ভাস্কর। দৃষ্টি দেওয়ালে টাঙানো বড়সড় এলসিডি-তে। রিমোট হাতে নিয়ে বলল, মেজাজ আজ সপ্তমে কেন? ইয়ার এন্ডিং-এর বাম্বু শুরু হয়েছে বুঝি?

সোহিনী অপ্রসন্ন মুখে একবার দেখল টিভিটা। ফুটবল চলছে। গম্ভীর মুখে বলল, পাপান কী করছে? হোমটাস্ক শেষ?

বইখাতা নিয়ে তো বসেছিল। মাঝে শুধু ঘ্যানঘ্যান করছিল, মা এখনও চার্টপেপার নিয়ে এল না…

এমা, সোহিনী তো বেমালুম ভুলে গেছে! আত্মহারা থাকার ফল? নিজের দুর্বলতা ঢাকতেই বুঝি সোহিনী ঝেঁঝে উঠল, তুমি তো বসে আছ, এনে দিলেই পারতে!

ধুস, একবার বাড়িতে বডি ফেলে দিলে আর বেরোতে ইচ্ছে করে! যা থকে যাচ্ছি আজকাল, ওফ।

বাহানার অভাব নেই! সোহিনী কথা না বাড়িয়ে ঘরে গেল। ঘড়ি-টড়ি খুলে ছেলের কামরায় উঁকি দিয়েই চক্ষু স্থির। দ্যাখো কাণ্ড, স্টাডিটেবিলে বই-খাতা-পেনসিল বক্স-ইরেজার ছত্রাকার, ওদিকে পাপান নিজের খাটটিতে চিতপাত! এখন ওই ছেলেকে ঠেলে ঠেলে জাগানো কি সহজ কাজ? কালকের বইটইগুলো গুছিয়ে দিতে হবে স্কুল ব্যাগে, তারপর টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে খেতে বসানো… কম হ্যাপা!

গুমগুমে মুখে সোহিনী ডাইনিং স্পেসে এল। ফ্রিজ খুলে দেখছে কী কী রান্না হয়েছে। মুরগির মাংসর পাত্রখানা রাখল টেবিলে। কাচের বাটিতে খানিকটা তুলে ঢোকাল মাইক্রোওভেনে। কাজের তালে তালে উচ্চগ্রামে গজগজ চলছে, এটা কি একটা বাড়ি? একজন হাত-পা ছড়িয়ে খেলায় মশগুল, আর একজন সিরিয়াল গিলছেন…এদিকে যে ছেলেটা না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল, সেদিকে কারও হুঁশ আছে! সবার মুখের ডগায় সব কিছু জুটে যায় তো…!

তির যথাস্থানে বিঁধেছে। বনানী বেরিয়ে এসেছে নিজের ঘর থেকে। সন্ত্রস্ত স্বরে বলল, অমন রাগারাগি করছ কেন? কী হল?

আপনাদের আক্কেলটা দেখছি। আপনার ছেলে নয় নড়ে বসে না, আপনি তো একটু নজর রাখতে পারেন। নাতিকে নিয়ে এত সোহাগ…ছেলেটা রাতে উপোস করলে আপনার ভাল লাগবে?

পাপান শুয়ে পড়ল নাকি? এমা, ছি ছি।…তুমি জামাকাপড় বদলে নাও, আমি দেখছি।

পাঁজাকোলা করে তুলে আনব? ওদিক থেকে ভাস্করের গলা উড়ে এল, উঠলে মাথায় জল ঢেলে দিচ্ছি।

নিজে যা নিয়ে আছ, থাকো। বাড়াবাড়ি করতে হবে না।

ঝামটা মেরে সোহিনী ফের ঘরে। একটু বসল বিছানায়। দিনকে দিন ভাস্কর যেন আরও বিরক্তিকর হয়ে উঠছে। লোকটার হ্যাহ্যা হিহি, চাষাড়ে বোলচাল, সহ্যসীমার বাইরে ক্রমশ। কবে যে সে ভাস্করের কবল থেকে মুক্তি পাবে?

নাহ্, খোলাখুলি কথা হয়ে যাওয়া দরকার। আজই বলবে? শুনে কী প্রতিক্রিয়া হবে ভাস্করের? হাত-পা ছুড়বে রাগে? ষাঁড়ের মতো চিল্লাবে? এগুলো প্রত্যাশিত, কিন্তু যদি চুপসে যায়? যদি দুম করে কান্নাকাটি জোড়ে? হাতে-পায়ে ধরে বলে, যেয়ো না সোহিনী, আমি নিজেকে শুধরে নেব? তুমি যেমনটি চাও, তেমনটিই হয়ে উঠব?

ভাবনার বিষয়। ওরকম কোনও পরিস্থিতির উদ্ভব হলে তো আর এক বিপদ। সোহিনী অবশ্য ভালমতোই জানে, সাত জন্ম চেষ্টা করলেও ভাস্করের পক্ষে অনুপম হয়ে ওঠা সম্ভব নয়। তা সত্ত্বেও পাপানকে নিয়ে তখনই বেরিয়ে যাওয়া কি কঠিন হয়ে পড়বে না?

ধুৎ, উলটোপালটা চিন্তাকে বড্ড বেশি প্রশ্রয় দিচ্ছে সোহিনী। সিদ্ধান্ত যখন নিয়েছে, চলে সে যাবেই। অনুপমকে তার চাই। চাইই।

নাইটি নিয়ে সোহিনী বাথরুমে ঢুকল। গরম তেমন নেই, তবু গায়ে একটু জল ঢালতে ইচ্ছে করছে। নিজেকে নিরাবরণ করে দেখল খানিকক্ষণ। দেহে তার মেদ জমেনি সেভাবে, যতটুকু আছে তাতে পুরুষের চোখে এখনও সে ঘোরতর আকর্ষণীয়। তার মসৃণ ত্বক, যথেষ্ট আঁটোসাঁটো বুক, কদলীকাণ্ডসদৃশ ঊরু, নয়নের মদিরতা, পাতলা পাতলা ঠোঁট, যে-কোনও তরুণীর চেয়ে কম মোহনীয় নয়। এই শরীরটাকেও কি সেভাবে মর্যাদা দেয় ভাস্কর? দিয়েছে কোনওদিন? নিজের ভোগটুকু সারা, তো ওমনি ভোঁস ভোঁস নাকডাকা শুরু। সোহিনী তৃপ্ত হল কি হল না, ভাবেইনি কখনও। শুধু এই অপরাধেই তো স্বচ্ছন্দে ভাস্করকে পরিত্যাগ করা যায়, নয় কি?

রাতে খেয়েদেয়ে টিভির সামনে বসল সোহিনী। দেখছে না কিছুই, ঘুরছে এ চ্যানেল, ও চ্যানেল। মনে মনে সাজাচ্ছিল, কীভাবে পাড়া যায় কথাটা। আজ কি ভাসিয়ে দেবে আলগাভাবে? তারপর আস্তে আস্তে ভাঙবে? নাকি যা হয় হোক, একবারেই…?

টিভি বন্ধ করে অন্যমনস্ক পায়ে সোহিনী ঘরে এল। লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়েছিল ভাস্কর, খটাস করে জ্বেলেছে বাতি।

সঙ্গে সঙ্গে ভাস্করের গলা, আহ্, আলো ভাল্লাগছে না। ঘাড়ে খুব যন্ত্রণা হচ্ছে।

হঠাৎ? সোহিনী ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল ভাস্করকে, এতক্ষণ তো দিব্যি ছিলে।

কী জানি, খাওয়ার পর থেকেই…

আরও বসে বসে টিভি দ্যাখো!

টিভির জন্য নয়। মনে হচ্ছে সেই স্পন্ডিলাইটিসের ব্যথাটা…

এক্সারসাইজ না করলে তো বাড়বেই।

জ্ঞান মেরো না তো। ভাস্কর কপাল টিপে ধরল, কোনও পেনকিলার আছে কিনা দ্যাখো। মনে হচ্ছে এখনই মরে যাব।

হুঁহ্, আমার কি সেই কপাল হবে! বলতে গিয়েও সামলে নিল সোহিনী। ড্রয়ার খুলে ওষুধের বাক্সটা বার করল বিরস মুখে।

.

০২.

প্রকাণ্ড ড্রয়িংখানা টেবিলে ছড়ানো। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বিদ্যুৎ সরবরাহ পদ্ধতিতে নতুন কিছু সংযোজন ঘটবে, তারই নকশা। বারোটায় চিফ ইঞ্জিনিয়ারের ঘরে মিটিং, পরিকল্পনাটা নিয়ে নিজস্ব মতামত জানাতে হবে তখন।

ঝুঁকে নকশাটা পর্যবেক্ষণ করছিল ভাস্কর, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। হঠাৎই টের পেল ব্যথাটা ফিরে আসছে। ঘাড়ের ওপর দিকটায় সেই বিশ্রী টনটনানি, মাথা জুড়ে সেই অসহ্য ঝিমঝিম।

হচ্ছেটা কী? ব্যথাটা এভাবে জ্বালাচ্ছে কেন? ভাস্কর রীতিমতো বিরক্ত হল। কাল রাতের ওষুধে দিব্যি উবে গিয়েছিল, সুন্দর ঘুম হল…। সকালে অবশ্য বেশ ভার ছিল মাথাটায়। তা এই সিজন চেঞ্জের সময়ে তো এমনটা হয়ই। তা ছাড়া সোহিনীর গরম বেশি, সারারাত ফুলস্পিডে পাখা চলে, পরিণামে প্রভাতী মাথাধরাটা যেন নিত্যনৈমিত্তিক। ওই নিয়েই তো খানিক গড়িমসি করে বাজার গেল ভাস্কর। তারপর থেকে তো মোটামুটি স্বাভাবিক। নিয়মমাফিক স্নান, খাওয়া, সোহিনীর প্রায় পিছন পিছন অফিস বেরোনো… তেমন কোনও সমস্যা তো ছিল না! এখন আবার একটা দরকারি কাজের সময়ে…! কী যে এক মেয়েলি রোগে ধরল, কথায় কথায় মাথাব্যথা!

সোজা হয়ে ঘাড়টাকে এদিক-ওদিক ঘোরাল ভাস্কর। চিড়িক চিড়িক লাগছে ব্রহ্মতালুতে। ওষুধ খেয়ে নেবে? ইস, কেন যে কালকের ট্যাবলেট একটাও সঙ্গে রাখেনি? বদ্‌রিকে দিয়ে অবশ্য আনানো যায়। আধা সরকারি অফিসের গ্রুপ ডি স্টাফরা আজকাল কথাই শোনে না, ভাস্করের কপাল ভাল, তার অধস্তনটি বেশ বাধ্য। বয়স্ক লোক তো, ওপরওয়ালাকে অমান্য করার অভ্যেসটুকু রপ্ত করতে পারেনি।

বেল বাজাতেই বদ্‌রিপ্রসাদ হাজির। খসখস ওষুধের নাম লিখে চিরকুট বাড়িয়ে দিল ভাস্কর, চটপট একপাতা নিয়ে এসো তো।

চোখের খানিক তফাতে রেখে কাগজটা পড়ল বদ্‌রি। চোখ কুঁচকে বলল, ফির মাথাব্যথা?

হুঁ।

এত অ্যালোপ্যাথি দাওয়াই খাবেন না স্যার। কমবে, ফির আসবে, পুরা সারবে না। আমি একটা তেল এনে দেব, সাতদিন মালিশ করবেন। ব্যস, জিন্দেগিভর দর্দ গায়েব।

আপাতত এটা তো আনো। নইলে মাথাটা ফেটেই যাবে।

বদ্‌রি যেতে রগ দুটো টিপে বসে রইল ভাস্কর। যন্ত্রণায় গা গুলোচ্ছে। বমিটমি হবে নাকি? চোরা অম্বল টম্বল ধরেনি তো? সেরকম তেলমশলাদার কিছু তো খায়নি আজ। সকালে তো স্রেফ ডাল, আলুসেদ্ধ, মাছের ঝোল। ক’দিন ধরে আড়মাছ খেতে খুব ইচ্ছে করছিল। সোহিনী নাক সিঁটকোয় বলে আজও কাটাপোনা। সুষমার হাতের ট্যালটেলে মাছের ঝোলে ভাস্কর চ্যাটার্জির অম্লশূল?

নিজেকে অন্যমনস্ক রাখতে ভাস্কর আবার ড্রয়িং-এ চোখ রাখল। নাহ্, সম্ভব নয়, কিছুই ঢুকছে না ঘিলুতে। বদ্‌রি ফিরতেই টপাটপ দু’খানা পেনকিলার গিলে নিল। চোখ বুজে বসে রইল চেয়ারে। মিনিট পনেরো পর আস্তে আস্তে ছাড়ছে মাথা। গা-গুলোনো ভাব কমল যেন। আহ্, ঘাড়ের টনটনানিও অনেক কম। বেশ নির্ভার লাগছে নিজেকে।

আবার বদ্‌রির শরণাপন্ন হল ভাস্কর, এক কাপ চা খাওয়াবে?

ক্যান্টিনে বলে দিয়েছি স্যার। এখনই দিয়ে যাবে।

সত্যি বদ্‌রি, তোমার জবাব নেই। তুমি রিটায়ার করলে আমার যে কী হবে!

ছোটখাটো চেহারার পাকানো গোঁফ বদ্‌রিপ্রসাদ লজ্জা পেয়েছে। ঘাড় নামিয়ে বলল, এখনই তো রিটায়ার হচ্ছি না স্যার। এখনও চার বছর বাকি।

জানে ভাস্কর, তবু হেসে ফেলল। দেখেই মালুম হয় বদ্‌রির বয়স ছেষট্টি-সাতষট্টির কম নয়। বদ্‌রির নাতিরই তো গত বছর বিয়ে হল। চাকরিতে ঢোকার জন্য কত যে জল মিশিয়েছিল বয়সে! কম করে বছর দশেক।

ভাবতে গিয়ে ভাস্কর উদাস সহসা। জল কে না, মেশায়? বদ্‌রির তো শুধু বয়স, ভাস্করদের মতো মানুষদের জীবনটাই তো ভেজালে ভরা। সুখে ভেজাল, দুঃখে ভেজাল, ভালবাসায় ভেজাল, ঘেন্নাতেও ভেজাল। দুনিয়ায় কোথাও কিছু নির্ভেজাল আছে কি?

ভাস্কর আপন মনে মাথা দোলাল। মাত্র দু’খানা ব্যথা নিরোধকের কী গুণ! ভাস্কর চ্যাটার্জিও কিনা দার্শনিক বনে গেল!

চা এসেছে। কাপে চুমুক দিয়ে ভাস্কর ফের কাজে মনোযোগী। স্বচ্ছ মস্তিষ্কে নিরীক্ষণ করছে নকশখানা। গ্রিড লাইন টানায় বেশ কিছু অসংগতি চোখে পড়ছে, পয়েন্টগুলো সংক্ষেপে নোট করল ডায়েরিতে। মিটিং-এ দেখাতে হবে।

মোবাইল বাজছে। বাড়ির ফোন। ভাস্কর সেটটা কানে চাপল, হ্যাঁ, বলো?

ওপারে বনানীর গলা, আজ টিফিন নিয়ে যেতে ভুলে গেছিস রে বাবুন।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। বাক্স তো দেখছি রান্নাঘরে পড়ে।…সুষমারও কী আক্কেল, হাতে ধরিয়ে দিতে পারত।

অফিসের দ্বিপ্রাহরিক জলযোগটি বনানীই বানায় রোজ। ছেলে, ছেলের বউ, আর নাতির। সকালে প্রায় একসঙ্গে তিনজনের বেরোনোর তাড়া, সুষমা হুটোপুটি করে সামাল দিতে পারে না। তাই পছন্দমতো টিফিন তৈরির দায়িত্ব বনানীরই। এবং হাতে হাতে তুলে দেওয়ারও। বেচারা মা নিজের ত্রুটি সুষমার ঘাড়ে চাপাতে চাইছে!

ভাস্কর বেশ মজাই পেল। হেসে বলল, তা আজ কী মিস করলাম শুনি?

পরোটা-আলুচচ্চড়ি ছিল। সঙ্গে সন্দেশ।

এহেহে, গ্রেট লস্। রেখে দাও, গিয়ে খাব।

তুই আজ তা হলে ক্যান্টিনেই চালিয়ে নিস।

হুম।

খাস কিন্তু। ক’দিন ধরেই তো দুর্বল দুর্বল লাগছে বলছিস…খালি পেটে থাকিস না।

ঠিক আছে। আর কিছু বলবে?

ওপ্রান্তে বনানী ক্ষণকাল চুপ। ভাস্কর বুঝে গেল, এখনও মা’র কথা ফুরোয়নি। ঈষৎ তাড়া লাগাল, কী হল ঝেড়ে কাশো।

একটু বেহালায় যাব ভাবছিলাম…

দিদির বাড়ি?

হ্যাঁ রে। ভাবছি ক’টা দিন খুকুর ওখানে কাটিয়ে আসি।

হঠাৎ এ হেন মনোবাসনা? তুমি তো ঘাঁটি ছেড়ে নড়তেই চাও না!

না মানে…খুকু অনেকদিন ধরে বলছে…বনানীর স্বরে ইতস্তত ভাব, চিন্তা করিস না, পাপানের ব্যবস্থা করেছি। সুষমা এখন ক’টা দিন তাড়াতাড়ি আসবে। পাপান স্কুল থেকে ফেরার আগেই। থেকেও যাবে, তোরা কেউ একজন না ফেরা পর্যন্ত।

বটে?…তা সোহিনীকে জানিয়েছ?

ওপ্রান্ত আবার নীরব। জবাবটা বুঝে গেল ভাস্কর। হেসে বলল, অল রাইট। আজই যাচ্ছ?

হ্যাঁ। যদি খেয়ে উঠে রওনা দিই…! তুই একটু ম্যানেজ করে নিস, কেমন?

ফোন ছেড়ে একটুক্ষণ ঠোঁট ছুঁচলো করে বসে রইল ভাস্কর। সোহিনীর ব্যবহারে আহত হয়েই কি মা…? কাল রাতে খুব বিচ্ছিরি ভঙ্গিতে মাকে কথা শোনাচ্ছিল সোহিনী। মা যতই শান্ত হোক, চুপচাপ থাকুক, ভাস্করের মতো মোটাচামড়া তো নয়। সোহিনী যেন কেমন হয়ে গেছে ইদানীং। বড্ড বেশি খিটখিটে। পান থেকে চুন খসলে মেজাজ। অবশ্য বরাবরই তো একটু নাক উঁচু। বিয়ের পর যখন চারু মার্কেটের ভাড়াবাড়িতে এসে উঠল, তখনই বেশ অস্বচ্ছন্দ যেন। ভাস্করদের বাড়ির পরিবেশ, জীবনযাপনের ধারা, এমনকী ভাস্করের বাবা-মাকেও একটু হেলাফেলার চোখে দেখত সোহিনী। যেন শোভাবাজারের গাঙ্গুলি বাড়ির শান্তিনিকেতনে পড়া মেয়ে চ্যাটার্জি-পরিবারের বউ হয়ে সবাইকে ধন্য করে দিয়েছে, এমনই এক হাবভাব। তার ওপর চাকরি করে বলে আলাদা একটা গুমোরও ছিল যেন। মুখে কখনও প্রকাশ করেনি, তবে ঠিকঠাক খেয়াল করলে বোঝা যেত।

ভাস্করকেও কি পছন্দ হয়েছিল সোহিনীর? ধন্দ আছে। হানিমুনটাই তো কেমন কেমন কেটেছিল। তারা দার্জিলিং গেছিল, কত সুন্দর জায়গা, চমৎকার চমৎকার বেড়ানোর স্পট…হোটেল ছেড়ে সোহিনী নড়তেই চায় না! জানলা দিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখাতেই তার নাকি বেশি আনন্দ! তাও টেনে টেনে টাইগার হিল নিয়ে গেছে ভাস্কর, জোর করে ঘুম-সোনাদা ঘুরিয়েছে। খুশি তো হয়ইনি, উলটে হোটেলে ফিরে অনুযোগ, আমরা হানিমুনে এসেছি, না রুটিন ভ্রমণে? এত ভিড়ভাট্টা, লোকে হাঁ করে নতুন কাপল্‌ দেখছে…আমার ভাল্লাগে না। রুচিতে বাধে।

তারপর থেকে তো অভ্যেসই হয়ে গেল খুঁত ধরা। শব্দ করে খাও কেন! খ্যাকখ্যাক হাসো কেন! খকখক কাশো কেন! বিকট আওয়াজ মেরে তুড়ি বাজিয়ে হাই তোলো কেন! অফিস পিকনিকে গিয়ে অমন ভালগার জোক্‌স শোনাচ্ছিলে কেন! আমার কলিগদের সঙ্গে চ্যাংড়ামি মারছিলে কেন! একটু সোবার কালারের জামা পরতে পারো না? আমার জন্য এই ক্যাটকেটে-রং শাড়ি আনলে?

যাক গে যাক, এভাবেই বারোটা বছর কেটে তো গেল। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একটুও অমিল না থাকলে বেঁচে থাকাটাই তো আলুনি হয়ে যায়। সোহিনী যেরকম, থাক না সেরকমই। ভাস্কর থাকুক ভাস্করের মতো। একটাই আফশোস, সোহিনী যদি ভাস্করের মা-বাবা সম্পর্কে একটু বুঝদার হত। নিজে পছন্দ করে সোহিনীকে ছেলের বউ করে এনেছিল বাবা। পুত্রবধ চাকরি-বাকরি ছেড়ে শ্বশুরসেবা করবে, এমন দুরাশা করেনি কখনও। তবু চাইত সোহিনী দু’দণ্ড কাছে বসুক, দু’-চারটে গল্পগাছা করুক…তা পুত্রবধূটি কোনওদিন তাকে পাত্তাই দিল না। সোহিনী আসার পর কতদিনই বা বেঁচে ছিল বাবা? বছর তিনেক। তার মধ্যে অর্ধেক দিন সোহিনী তো বাপের বাড়িতে! আর মা? সে তো ভিতুর ডিম। প্রথম থেকেই বউয়ের সামনে জোড়হস্ত। এই যে এখন বউয়ের ওপর অভিমানে ছুটছে মেয়ের বাড়ি, জোর গলায় সেটি উচ্চারণ করারও সাহস আছে নাকি?

কী ব্যাপার চ্যাটার্জি? তুমিও শেষে অফিসে ঢুলছ, অ্যাঁ?

চমকে সিধে হল ভাস্কর। তুহিন বেরা! বয়সে ভাস্করের চেয়ে সামান্য বড়, তবে পদমর্যাদায় সমান। ডিভিশনাল ইঞ্জিনিয়ার।

মাথা ঝাঁকিয়ে ভাস্কর বলল, না না, চিন্তা করছিলাম।

চিন্তা? তোমার?

বাহ্, আমার বুঝি চিন্তা থাকতে নেই?

কী নিয়ে ভাববে, বলো? টাকা? আস্ত ব্যাঙ্কের ক্যাশিয়ারই তো তোমার ঘরে মজুত।

হা হা, বেড়ে বলেছ তো! সকালে সোহিনীর নিমপাতা খাওয়া মুখখানা পলকের জন্য মনে পড়ল ভাস্করের, পলকে মুছেও ফেলেছে ছবিটা। ভুরু নাচিয়ে বলল, কফি চলবে?

দরকারটা কী! মিটিং-এ তো বার দুই গিলতেই হবে। মুখোমুখি বসল তুহিন, ডিস্ট্রিবিউশনের প্ল্যানটা দেখলে?

মোটামুটি চোখ বুলিয়েছি। বহুত ভুলভাল আছে। ঘাড়টাকে অল্প নাড়িয়ে নিল ভাস্কর। তারপর চোখ টিপে বলল, আচ্ছা, এইসব মিটিং টিটিং করে সত্যিই কি কোনও লাভ হয়?

আজকাল তো এই সিস্টেমই চলছে ব্রাদার। অনেকগুলো মাথা একত্র হয়ে মতামত দিলে সিদ্ধান্ত নাকি অনেক গণতান্ত্রিক হয়। তা ছাড়া নতুন নতুন আইডিয়া তো মেলে।

ঘোড়ার মাথা। আসলে এ হল দায়িত্ব এড়ানোর একটা কৌশল। কিংবা ভুলচুকের দায়টাকে সকলের ঘাড়েই খানিকটা করে চাপিয়ে দেওয়ার ট্যাকটিক্স।

তা কেন, আজ যে মিটিংটা হচ্ছে…

এটার হয়তো প্রয়োজন আছে।…তবে দেখছি তো, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ডিসিশন আগেই নেওয়া থাকে, মিটিং ডেকে শুধু একগাদা লোককে ছুঁইয়ে রাখা হয়। টু সেভ ওন হেড। কিংবা বলতে পারো, গোটা প্রসেসটা লিংগার করার এটা একটা তরিকা।

দিস ইজ ইয়োর ভিউ। অথরিটি মে ডিফার।

অথরিটি দেখিয়ো না। আজকাল যা সব কারণে কর্তারা মিটিং ডাকছে…! যেমন ধরো, আমাদের প্ল্যান্ট ওভারলিং। পাওয়ার সেক্টরের শিশুরাও জানে, এটি একটি রুটিন জব। বছরে একবার প্ল্যান্ট শাট-ডাউন করে বয়লার, কুলিং টাওয়ার, টারবাইন, বাগারা বাগারা থরো চের-আপ করতে হবে। এ ব্যাপারে জিএম অর্ডার ইস্যু করবে, ইঞ্জিনিয়াররা লোকলশকর নিয়ে ফিল্ডে নেমে পড়বে, এই তো নিয়ম। এর মধ্যে এত মিটিং আসে কোত্থেকে? আবার ঘাড়টাকে ওপর-নীচ ডাইনে-বাঁয়ে করল ভাস্কর। খানিকটা বুঝি অজান্তেই। ফের বলল, এরপর দেখব টয়লেট কেন পরিষ্কার নেই, তার জন্য মিটিং! পিছনের আমগাছে কেন বোল এল না…!

তুমি ঘাড়টাকে বারবার ওরকম করছ কেন বলো তো? তুহিনের ভুরুতে ভাঁজ, স্টিফ নেকের প্রবলেম?

বুঝতে পারছি না। তবে ভোগাচ্ছে মাঝে মাঝে। মাথাটাও ঝিনঝিন করছে।

প্রেশার চেক করিয়েছ?

অফিসেই করিয়েছিলাম। মাস দেড়েক আগে। নরমাল।

চোখ? চালশে পড়ার বয়সে একটু প্রবলেম হয় কিন্তু।

না না, আই-সাইট ঠিকই আছে। কাগজ-টাগজ তো এখনও দিব্যি পড়ি।

একসময়ে স্পন্ডিলাইটিস মতন ছিল, বোধহয় ওটাই আবার চাগাড় দিচ্ছে।

খুব বাজে রোগ। নো দাওয়াই। একমাত্র সলিউশন বাবা বামদেব।

ওই দেড়েল সাধুটা? টিভিতে যে নানা কসরত দেখায়?

অত ক্যাসুয়াল রিমার্ক কোরো না চ্যাটার্জি। হি ইজ আ জেম অফ যোগা থেরাপিস্ট। ওঁর নির্দেশ মতো দাঁতে দাঁত ঘষে আমার কনস্টিপেশন সেরে গেল।

অনেকক্ষণ পর, আজ এই প্রথম, ভাস্কর হা হা হেসে উঠল। তার অট্টহাসির সামনে একটু বুঝি মিইয়ে গেছে তুহিন। ক্ষুণ্ণ গলায় বলল, বিশ্বাস হল না তো?

ভাস্কর হাসি থামিয়েছে। দু’হাত তুলে বলল, না, না। বলছ যখন, একটা ট্রাই নেওয়া যাবে। যদি কোনও লিটারেচার থাকে তো এনো, পড়ে দেখব।

কষ্ট করে সকাল সকাল উঠে টিভি খুলো, আপনা-আপনি শিখে যাবে। তুহিন ঘড়ি দেখল, পৌনে বারোটা বাজে, এবার যাবে তো? চিফ ইঞ্জিনিয়ার সাহেব বোধহয় কনফারেন্স রুমে ঢুকে পড়েছেন।

চলো।

প্রায় ঘণ্টা দেড়েক চলল মিটিংটা। ভাস্কর যা ভেবেছিল, তাই ঘটল অবশ্য। অজস্র কথার ফুলঝুরি, বাদানুবাদ, কিন্তু নিট ফল শূন্য। প্রত্যেকের মতামত নথিবদ্ধ করা হয়েছে, এরপর ছোট্ট কমিটি পর্যালোচনা করবে সেগুলো, তারপর নতুন করে সংশোধিত আকারে ফের প্রস্তুত হবে প্ল্যান। আর যুক্তিগুলো গ্রাহ্য না হলে এটাই চলবে। যাই হোক, ব্যাপারটা নিয়ে আবার মিটিং বসছে। মাসখানেক পরে।

সভাকক্ষ থেকে বেরিয়ে ভাস্কর একটা বড় হাই তুলল। তুড়ি মেরে। খিদে পাচ্ছে। কাগজপত্র চেম্বারে রেখে এসেছে ক্যান্টিনে।

কাউন্টারের পাশে, ব্ল্যাকবোর্ডে খাবারের লম্বা ফিরিস্তি। আলগা চোখ বুলিয়ে চিকেন স্টু আর টোস্টের অর্ডার দিল ভাস্কর। শরীরের গতিক সুবিধের নয়, হালকা হালকাই চলুক।

কোণের টেবিলে দেবজিৎ আর সুগত। ভাত খাচ্ছে। ভাস্কর গিয়ে বসল সেখানে, কী খবর? সব ঠিকঠাক?

চলছে একরকম। দেবজিৎ হেসে তাকাল, আপনি আজ ক্যান্টিনে যে বড়?

ফুডের কোয়ালিটি টেস্ট করতে এলাম।

খুব খারাপ হয়ে গেছে ভাস্করদা। মাছের পিস ক্রমশ ছোট হচ্ছে।

সুগত হাত চাটছিল। টুপুস ফোড়ন কাটল, আরে বাবা, ক্যান্টিনওয়ালাকেও তো লাভ করতে হবে, নাকি? অফিস সাবসিডি বাড়াবে না, বাজারদর চড়চড় বাড়ছে…

যা বলেছ। স্টান্ডার্ড সাইজের কইমাছ চারশো টাকা! হাত ছোঁয়ালে ছ্যাঁকা লাগে।

গল্পে মেতে গেল ভাস্কর। প্রশাসনিক বিভাগের এই ছেলে দুটোর সঙ্গে তার জমে বেশ। বছর দশেক আগে স্পোর্টস কোটায় চাকরি পেয়েছিল দু’জনে, তখন থেকে খাতির। অফিসের হয়ে তো খেলতই, ময়দানেও মাঝারি ফুটবল টিমের ফরোয়ার্ড ছিল দেবজিৎ, আর সুগত ডিফেন্ডার। এখন বয়স বেড়েছে, ফুটবলের পাট প্রায় শেষ, দুই মূর্তি এখন অভিযান-টভিযান করে বেড়ায় নিয়মিত।

কথায় কথায় দেবজিৎ বলল, এবার জুলাইতে ট্রেকিং-এ যাচ্ছি ভাস্করদা৷

ভাস্করের টোস্ট-স্টু দিয়ে গেছে। খেতে খেতে ভাস্কর জিজ্ঞেস করল, কোথায়?

সিকিমে। নতুন একটা রুট খুলেছে। ইয়াম থেকে যেতে হয়।

কঠিন জার্নি?

গেলে বুঝব। শুনেছি ওদিকে খুব তুষারঝড়-টড় হয়। সুগত ঢকঢক জল খেল, যাবেন নাকি?

আমি? খেপেছ?

কেন নয়? আপনি তো ট্রেক করেছেন।

ধুস, জন্মের মধ্যে কর্ম, একবার বদরিনাথ থেকে কেদার। খুব একটা ঝুঁকি ছিল না…বয়সটাও তখন কম…জোশের মাথায় বন্ধুদের সঙ্গে চলে গিয়েছি।

ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের বন্ধু?

উঁহুঁ, পুরনো পাড়ার। চারু মার্কেট।

আর একবার জয় মা বলে লড়ে যান না। খুব কাছ থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে পাবেন। হিমালয়ের সেকেন্ড হাইয়েস্ট পিক্।

ভাস্করের মন ঈষৎ দুলে গেল। ওই একবার গিয়ে কী যে হয়েছিল, চোখের সামনে হিমালয় ঘুরত সারাক্ষণ। বরফের মুকুট পরা শিখর, সোনালি রোদে তুষার ঝিকমিক…কী ভীষণ যে ইচ্ছে জেগেছিল পর্বতারোহী হওয়ার! স্বপ্নটা বেশিদিন টেকেনি অবশ্য। তাদের মতো ঘরের ছেলের কী ওই সব শখশৌখিনতা মানায়? বাবা রেলের কেরানি, পিসিদের বিয়ে দিয়ে সেই যে দেনার দায়ে ডুবেছিল তার নাগপাশ থেকে তখনও মুক্ত হতে পারেনি। তার মধ্যেই দিদির বিয়ের ভাবনা করতে হচ্ছে, সঙ্গে ভাস্করের ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার খরচখরচা…। পাশ করে কোনওমতে একটা চাকরিতে যুতে যাওয়া ছাড়া আর কিছু ভাবার কি ভাস্করের অবকাশ ছিল? এখন অবশ্য আর্থিক সমস্যা নেই, তার বিয়াল্লিশ বছরের শরীর যথেষ্ট সক্ষম, চূড়ায় না উঠুক, হিমালয়ের পথে পথে তো ঘোরাই যায়।

কী ভাবছেন ভাস্করদা? বউদি আপত্তি করবেন?

আরে না। ভাস্কর কৌতুক জুড়ল, ক’দিন এই থোবড়াখানা না দেখতে হলে সে বোধহয় হাঁপ ছেড়ে বাঁচে।

তা হলে আর কী, লোটাকম্বল নিয়ে রেডি হয়ে যান। কয়েকটা জিনিসের লিস্ট দিয়ে দেব, সেগুলো শুধু কিনে নেবেন।

আর একটা কাজ কিন্তু করা দরকার। দেবজিৎ বিজ্ঞ স্বরে বলল, হিমালয়ে যাওয়ার আগে মন থেকে পিছুটানগুলো ঝেড়ে ফেলতে হবে। যদি ওই নব-কার্তিকের মতো হন, তা হলেই গুবলেট।

কে নবকার্তিক?

ওই যে দেখুন…। তিন-টারটে টেবিল তফাতে অ্যাকাউন্টসের সজল ভৌমিকের পানে চোখের ইশারা করল দেবজিৎ। বঙ্কিম হেসে বলল, হাটের মাঝেও হুঁশ নেই। অফিসে আসাটাই ওর ফাউল। সর্বক্ষণই তো কানে মোবাইল! গলায় এরকম চেন বাঁধা থাকলে হিমালয়ে এন্ট্রি নেই কিন্তু।

ভাস্কর হো হো হেসে উঠল, আমাকে কি ওইরকম মনে হয়?

না না, আপনি তো বিন্দাস। সুগত খুকখুক হাসছে। সামান্য গলা নামিয়ে বলল, পুরনো বউয়ের সঙ্গে সজলটার এত কী গুজগুজ! ব্যাটা পরকীয়া চালায় না তো?

কে জানে! দেবজিৎ টিপ্পনী জুড়ল, ওর ডিপার্টমেন্টের লোকরা তো বলে এক ম্যারেড মহিলার সঙ্গে নাকি ওর হেভি দোস্তি। দু’জনকে যত্রতত্র দেখা যায়।

ইঙ্গিতটা এবার যেন একটু খারাপই লাগল ভাস্করের। এই কিসিমের পরচর্চা তার বিলকুল না-পসন্দ। কেউ কারওর সঙ্গে ঘুরলেই তাকে সন্দেহ করতে হবে? সোহিনী আর অনুপম তো হুটহাট থিয়েটারে যায়, শীতে দু’জনে সারা রাত মিউজিকাল কনফারেন্স শুনল…ওমনি কি ধরে নিতে হবে দু’জনের ইয়ে চলছে? যত সব উলটোপালটা ধারণা। ভাস্করের আঁতুমার্কা নাটক কিংবা কালোয়াতি গানের আসর গেলার ধৈর্য নেই, তা বলে কি অন্য কারও সঙ্গে সোহিনী যেতে পারবে না? স্বাভাবিক ব্যাপারকে বেঁকিয়ে দেখা মানুষের যে কী বদভ্যাস!

একটা বেদনা অবশ্য ভাস্করের আছে। ইস, অফিসে যদি সোহিনীর ফোন পেত এক-আধটা! কেজো নয়, অকারণ ফোন। তুহিনদের বউরা যেমন করে। ফিরছ কখন, টিফিনে কী খেলে, কী করছ…! তা বিশেষ প্রয়োজন বিনা সোহিনীর স্বর কি কদাচ বাজে মোবাইলে? কে জানে, চাকুরে বউরা হয়তো এরকমই হয়। তা ছাড়া অজস্র কাস্টমার নিয়ে কারবার, বেচারির তেমন ফুরসতই বা কোথায়।

চেটেপুটে স্টুয়ের বাটি শেষ করল ভাস্কর। দুলে দুলে ফিরছে নিজের গলতায়। প্যাসেজ ধরে হাঁটতে হাঁটতে মাথাটা যেন টলে গেল। পেটে গ্যাস-ট্যাস হল নাকি? খেতে তো দিব্যি লাগল, স্টু-টা বাসি ছিল না তো? খুবই সম্ভব। প্রাইভেট কেটারার ক্যান্টিন চালায়, দিনের ঝড়তিপড়তি মাল কি ফেলে দেয় রোজ? টোস্টের সঙ্গে ডিমসেদ্ধ আর কলা নিলেই আজ ঠিক হত।

খুঁতখুঁতুনিটুকু সরাতেই বুঝি দেবজিৎদের প্রস্তাবটা আর একবার স্মরণ করল ভাস্কর। ছুটি তো জমে জমে পচছে, ওদের সঙ্গে একবার গেলে হয়। কতকাল যে পাহাড়ে যাওয়া হয়নি। সোহিনী তো ইদানীং নড়তেই চায় না। আগে যাও বা গেছে, পাহাড় আর নৈব নৈব চ। বড়জোর কোনও সি-সাইট। সেখানেও জলে নেমে হুটোপুটিতে নেই, চুপটি করে বসে থাকবে সমুদ্রের পাড়ে। আহা রে, হিমালয়ের কোনও উপত্যকায় দলবেঁধে তাঁবু খাটিয়ে রয়েছে ভাস্কর, সন্ধেবেলা চলছে আগুন-টাগুন জ্বেলে হুল্লোড়, সকালে ফের চড়াই-উতরাই, রাতে কনকনে বাতাস আর হুইস্কির গ্লাস…!

স্বপ্ন স্বপ্ন ছবিখানা চোখে নিয়ে ভাস্কর এসেছে চেম্বারে। ব্রিফকেস খুলে অ্যান্টাসিডের পাতাটা বার করল। দু’খানা ট্যাবলেট কচর কচর চিবিয়ে গুছিয়ে বসল কম্পিউটারের সামনে। তখনই টের পেল, ব্যথাটা আবার ফিরছে। মহা জ্বালাতন হল তো! যাবে একবার মেডিকেল অফিসারের কাছে? তিনটে বাজে, আর কি সেই মক্কেল অফিসে আছে? তা ছাড়া অমিত ডাক্তারের ওপর কি ভরসা করা যায়? পশার জমাতে পারেনি বলেই না চাকরিটা নিয়েছে! তরুণদাকে একটা ফোন লাগাবে? দিদির বরটি আছে ওষুধ কোম্পানিতে, বহু ডাক্তারের সঙ্গে তার দহরম-মহরম। নিশ্চয়ই একটা কোনও বন্দোবস্ত করতে পারবে তরুণদা। যদি আজই অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে দেখিয়ে নিতে পারে…

নাহ্‌, ব্যথাটা অগ্রাহ্য করা বোধহয় উচিত হচ্ছে না। মোবাইল হাতে তুলল ভাস্কর।

ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরোতে রাতই হল। বাড়ি ঢুকতে ঢুকতে প্রায় পৌনে দশটা। ভাস্কর অন্দরে পা রাখামাত্র বিস্ফোরণ। তীক্ষ্ণ স্বরে ঝাঁঝিয়ে উঠেছে সোহিনী, আমি জানতে চাই, এভাবে আমাকে অপমান করার কী অর্থ?

খানিক আগে একখানা ওষুধ খেয়েছে ভাস্কর। মাথা এখন ঈষৎ ফুরফুরে। হেসেই বলল, হঠাৎ বোম ফাটাচ্ছ কেন ম্যাডাম?

তোমার মা তাঁর মেয়ের বাড়ি গেছেন, খবরটা কাজের লোকের মুখে শুনতে হবে? বাড়ির কাউকে না জানিয়ে উনি যা ইচ্ছে তাই করবেন?

না না, মা আমাকে অফিসে ফোন করেছিল।

ও। তুমি তা হলে জানো? ক্ষণকাল থামল সোহিনী, পরক্ষণে ঝামরে উঠেছে, আমাকে ইনফর্মেশনটা দেওয়ার তুমি প্রয়োজন বোধ করোনি?

ভুল হয়ে গেছে। সরি। এমন এক শিরঃপীড়ার গাড্ডায় পড়েছি…! সারাটা দিন ভোগাচ্ছে। শেষে তো মরিয়া হয়ে…

নো গপ্‌পো। নো ফালতু টক। আই অ্যাম রিয়েলি ডিজ্গাস্টেড।

দেবী তো আজ জোর চটিতং! সুড়ুৎ ঘরে ঢুকে গেল ভাস্কর। শার্ট ছাড়তে ছাড়তে সতর্কভাবে গলা ওঠাল, মা’র একটু কন্যাগৃহে যাওয়ার শখ জাগতে পারে না?

যাক না। আমি কি আপত্তি করেছি?

ভাস্কর বলতে পারত, মা আজকাল পাশের ফ্ল্যাটে গেলেও তোমার গাল ফোলে। আমি স্বচক্ষে দেখেছি। বলার সাহস পেল না। চুপচাপ পোশাক বদলাচ্ছে।

নীরব হয়েও নিস্তার নেই। সোহিনী দরজায় হাজির। কোমরে হাত রেখে বলল, তোমরা দু’জনে মিলে যা করছ, তাকে কিন্তু মেন্টাল টর্চারই বলে।

ওভাবে বলছ কেন? ভাস্কর সোহিনীর কাছে এল। কাঁধে সামান্য চাপ দিয়ে বলল, কুল। কুল। তোমার টেনশানের কারণটা বুঝতে পারছি। পাপান। তা মা তো সেই অ্যারেঞ্জমেন্ট করেই গেছে। সুষমা তো…

থাক। সুষমা আমায় বলেছে। কিন্তু সে যদি একদিন ডুব মারে, কী হবে, অ্যাঁ? সোহিনী ছিটকে সরে গেল, কে তখন অফিস ডুব মেরে বাড়ি সামলাবে?

আমি আছি তো। কথা দিচ্ছি, মা যদ্দিন না আসে, আমি ছুটি নেব। প্রবলেম সল্ভড?

এমন একখানা সমাধানের জন্য সোহিনী বুঝি প্রস্তুত ছিল না। তেরিয়া চোখে দেখছে ভাস্করকে। তারপর সরে গেছে ঘর থেকে।

ভাস্কর বাথরুমে গেল। বেরিয়ে আর অন্য দিনের মতো ড্রয়িংহলে টিভি খুলে বসল না, শুয়ে পড়েছে বিছানায়। ওষুধটায় কাজ হচ্ছে, ঘুম পাচ্ছে অল্প অল্প।

টিউব জ্বলছে ঘরে। আড়াআড়ি হাত চোখে রাখল ভাস্কর। বুক বেয়ে হঠাৎ দীর্ঘশ্বাস গড়িয়ে এসেছে। তার বউটা আগে তাও খানিক নরম-সরম ছিল। যতই ক্ষোভ থাক, মুখে প্রকাশ করত কি? অন্তত এমন রণরঙ্গিনী মূর্তি তো অকল্পনীয় ছিল। মেলে না, সোহিনীর সঙ্গে মেলে না। ইদানীং মেজাজ যেন চড়া তারে বাঁধা সর্বদা। সোহিনীর শরীরটা কি ভাল নেই? ভেতরে ভেতরে যদি কোনও অসুস্থতা থাকে, তা হলে তো স্নায়ুর নিয়ন্ত্রণ হারানো অসম্ভব নয়। নাহ্, কায়দা করে সোহিনীর প্রেশারটা চেক করাতে হবে। মোড়ের সুকুমার কম্পাউন্ডারকে যদি বলে দেয়, সে তো বাড়ি এসেই…

আবার সোহিনীর পদশব্দ। হাত সরাতেই ভাস্কর দেখল সোহিনীর খর চোখ তাকেই নিরীক্ষণ করছে।

ভাস্কর গলা ঝেড়ে বলল, কিছু বলবে?

ঢঙ করে এখন শুলে কেন? ঘড়ির কাঁটাটা দেখেছ? দয়া করে খেয়ে নিয়ে আমায় উদ্ধার করো।

ইচ্ছে করছে না। ভাবছি পেটটাকে আজ রেস্ট দিই।

আগে বলা উচিত ছিল। তোমার খাবারটা গরম করতাম না। সোহিনীর জিভে ফুল্‌কি ছিটল, যেমন মা, তার তেমনই ছেলে! দু’জনে যে কীভাবে আমাকে…!

থামো রে বাবা, থামো। ভাস্কর উঠে বসল, যাচ্ছি।

ডাইনিং টেবিলে যাওয়ার আগে ছেলেকে একবার দেখে এল ভাস্কর। চেয়ার টানতে টানতে বলল, কখন ঘুমোল পাপান?

উত্তর নেই। ক্যাসারোল খুলে রুটি বার করছে সোহিনী।

ভাস্কর ফের বলল, তুমি আসা পর্যন্ত সুষমা ছিল নিশ্চয়ই?

এবারও জবাব নেই সোহিনীর। ভাস্করের প্লেটে পটলের ডালনা দিচ্ছে। হঠাৎই বলে উঠল, আমার কিন্তু সহ্যের সীমা পেরিয়ে গেছে।

এখনও রাগ পড়েনি?

রাগের কথা নয়। আমি আর পারছি না। এবার এই সংসার থেকে চলে যাব।

সর্বনাশ করেছে! ভাস্কর তামাশা জুড়ল, তুমি গেলে এই অভাগার কী হবে ডার্লিং?

আমি কিন্তু সিরিয়াস। আই অ্যাম গোয়িং টু লিভ দিস হাউস। পাপানকে নিয়ে।

ঠিক আছে বাবা, ঠিক আছে। কালই মাকে চলে আসতে বলছি। ভাস্কর রুটি ছিঁড়ল, এবার একটা দরকারি কথা শোনো তো। নইলে পরে আবার বলবে আমি জানাইনি।…আজ একজন ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম। তরুণদাই অ্যারেঞ্জমেন্ট করল। ওষুধ-টষুধ দিয়েছেন ডাক্তারবাবু। সঙ্গে ব্রেনের একটা সিটি স্ক্যানও করাতে বললেন। প্লাস, সাতদিন নো অফিস। বেডরেস্ট।

সোহিনীর আঙুল থেমেছ। ভুরু কুঁচকে তাকাল।

বুঝতেই পারছ, কিস্যু মিলবে না, মাঝখান থেকে চার-পাঁচ হাজার টাকা গচ্চা। বোঝো, মাথাব্যথার কী মহিমা! ভাস্কর এক ঢোক জল খেল, করিয়েই নিই, কী বলো?

সোহিনীর কোনও জবাবও নেই, প্রশ্নও নেই। আবার একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল ভাস্করের। কেন যে পড়ল?

.

০৩.

গাড়ি গ্যারেজে তুলে শাটার টানল অনুপম। ঝুঁকে তালা লাগিয়ে পুরনো একটা হিন্দি গানের কলি ভাঁজতে ভাঁজতে সরু গলিটা দিয়ে ঢুকছিল, সামনে বড়দা।

দেবোপমের পরনে যথারীতি ঢোল্লা পাজামা, বুশশার্ট। গালে যথারীতি এক-দু’দিনের না কামানো দাড়ি। হাতে যথারীতি জ্বলন্ত সিগারেট। প্রশ্নটাও প্রায় রীতিমাফিক, কী রে, ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরছিস?

দাদার সঙ্গে বাক্যালাপ বাড়াতে চায় না অনুপম। ছোট্ট একটা আওয়াজ করল, হুঁ।

আজ এত দেরি যে? সন্ধে অবধি তোর ক্লাস হচ্ছে নাকি?

ডিপার্টমেন্টে কাজ ছিল।

ও। সিগারেটে ভুসভুস টান দিল দেবোপম, এখন ঘরে আছিস তো?

হুঁ।

আমি একবার আসব ভাবছি। তুই একটু ফ্রেশ হয়ে নে…

অনুপম কিছু বলার আগেই বড়দাটি হাওয়া। পাশ কাটিয়ে সোজা বাড়ির বাইরে।

প্রমাদ গুনল অনুপম। বড়দার প্রবেশ মানেই সন্ধেটার বারোটা। গ্যাঁট হয়ে বসলে আর উঠতেই চায় না। প্রথমে খানিক ভ্যাজর ভ্যাজর, তারপর চলে আসবে নিজের লাইনে। আমার দিকটাও একটু ভাব অন্তু! ব্যাঙ্কে কেন ফেলে রাখছিস টাকা, আমার অ্যাডভাইস শোন, কোথাও একটা লাগিয়ে দে! তোরও লাভ, আমারও টু পাইস আসে! ভাইকে কিছুতেই জপাতে না পেরে শেষে ব্রহ্মাস্ত্র ঝাড়বে, শ’চারেক মতো টাকা হবে তোর কাছে? ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে হবে, কম পড়ে যাচ্ছে…! অথবা টেলিফেন বিলের দোহাই, কিংবা ঝিনির কলেজের মাইনে। একেবারে কাঙাল টাইপ। দশ বছরের বড় দাদাটিকে মুখের ওপর কিছু বলতে পারে না অনুপম, মাঝখান থেকে মেজাজটা কষাটে মেরে যায়।

ঘরে এসে অনুপম ঝুম বসে রইল একটুক্ষণ। বড়দাটা কিছুই করে উঠতে পারল না জীবনে। লেখাপড়ায় তেমন খারাপ ছিল না। মাধ্যমিকে স্টার পেয়েছিল। হায়ার সেকেন্ডারিতে ফার্স্ট ডিভিশান। কমার্সে৷ কিন্তু কলেজে ঢুকেই কেমন বিগড়ে গেল। কী যে করত কে জানে? সম্ভবত কুসঙ্গের পরিণাম। অনার্সটাও রাখতে পারল না, টায়েটুয়ে গ্র্যাজুয়েটটি হয়ে মা সরস্বতীকে বিদায়। প্রেম যে একটা করত, তাতে সন্দেহ নেই। বেকার দশাতেই হুট করে তাকে একদিন সিঁদুর-টিদুর পরিয়ে বাড়িতে হাজির। বাবা তো চটে গিয়ে জুতো খুলে এই মারে তো সেই মারে, মা হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসল, তারপর কী অদ্ভুতভাবে মেনেও নিল বউদিকে। ব্যস, আর বড়দাকে পায় কে, দিব্যি পায়ের ওপর পা তুলে কাটাতে লাগল দিন। টুকটাক কোনও চাকরি ধরে হয়তো করল দু’-তিন মাস, তারপর হুট করে অফিস-টফিস ছেড়ে ফের মৌজমস্তিতে কাল কাটাচ্ছে। আবার হয়তো একটা কাজে ঢুকল, আবার ছাড়ল…। মাথার ওপর ডাক্তার বাবা মজুত, তেমন পশার না থাকলেও পাড়ার চেম্বার থেকে তাঁর মোটামুটি একটা রোজগার আছে, অতএব পেটের ভাবনা নেই, ছেলেমেয়ে দুটো কীভাবে মানুষ হবে সে চিন্তাও নেই, থাকো দেদার ফুর্তিতে। আরামে গড়াচ্ছে, চায়ের দোকানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা, ফুটবল-ক্রিকেট দেখতে ছুটছে, পাড়ার পুজো নিয়ে হয়তো মেতে রইল…। বছর আষ্টেক আগে বাবা গত হওয়ার পর অবশ্য খানিক টনক নড়ল। অনুপম তখনও শিকাগোয়। মাকে ডলার টলার পাঠাত, মেজদা পৃথগন্ন হয়ে গেলেও মা’র হাতে কিছু কিছু দেয়, বাবার সঞ্চয়ের ঠেকনাটুকুও ছিল, তবু জীবনবিমা আর মিউচুয়াল ফান্ডের এজেন্সি নিয়ে রোজগার শুরু করল বড়দা। দেশে ফিরে অনুপম মাকে নিয়ে একতলায় নেমে এল, দেবোপম মিত্র পড়ল আরও গাড্ডায়। বাড়িভাড়া হয়তো লাগে না, কিন্তু সংসারের হাঁ তো কম নয়। ছেলেমেয়ের পড়ার খরচই তো রাশি রাশি। জ্যেষ্ঠপুত্রের ওপর চিরকাল মা’র অসীম দুর্বলতা, অনুপমের কাছে এসেও একটা পয়সাকড়ির জোগান মা চালু রেখেছিল, এখন তো সেটিও গন। সুতরাং এই অহরহ হাত পাতা ছাড়া বড়দার আর উপায়ই বা কী!

অনুপমের খারাপ লাগে বউদির জন্য। বিয়ে হয়ে আসা ইস্তক শ্বশুর-শাশুড়ির মন জোগানোর চেষ্টা চালিয়েছে, কিন্তু লাভ হল না। বউদি চিরকালই মা’র চক্ষুশূল। মা’র বদ্ধমূল ধারণা ছিল, তার সোনার চাঁদ ছেলেটি ভিখিরিবাড়ির মেয়েতে মজেই অকর্মা হয়েছে। অবশ্য বউদিরও দোষ আছে। বরকে যে ধমকে-ধামকে কিছু করতে বলবে, সে সাহসই নেই। মা যা অপমান করত বউদিকে, অন্য কোনও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মেয়ে হলে কবেই ছেলেমেয়ে নিয়ে বেরিয়ে যেত। তার বাপের বাড়িরও জোর নেই, বিদ্যেতেও ঢনঢনে, অতএব দাঁতে দাঁত চেপে পড়ে থাকতে হল বেচারাকে। মাথার ওপর একটা ছাদ তো আছে, সেটুকুই বা কে খোয়াতে চায়!

ধুস, পরের সংসার নিয়ে মাথা ঘামিয়ে হবেটা কী? কোনও সমাধান আছে তার হাতে? অনুপম গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়ল। রান্নাঘরে গ্যাস জ্বেলে চায়ের জল চাপিয়েছে। আপন মনে মাথা নাড়ল দু’দিকে। যে নিজের ঘরই টিকিয়ে রাখতে পারে না, অন্যকে নিয়ে ভাবনা কি তার সাজে? তা ছাড়া বড়দা-বউদির সঙ্গে একত্রে সে থাকতে পারবে কি? বরং মেজদা-মেজবউদির মতো হাঁস হয়ে থাকাই তো শ্রেয়। লেখাপড়ায় তেমন চৌকশ না হয়েও ধরে-করে মোটামুটি একটা চাকরি বাগিয়ে ফেলেছে মেজদা। বাবার কথামতো বিয়ের পিঁড়িতে বসেও মোটেই ঠকেনি। স্কুলটিচার বউ, শ্বশুরবাড়ি মোটামুটি পয়সাওয়ালা…। নিজেও মেজদা যথেষ্ট গুছোনো। মোটে একটি সন্তান, খরচ করে মেপে, সঞ্চয়ও মাপা, সন্ধেবেলা হুইস্কিটুকুও খায় নিখুঁত মাপমতন। নিরুপম মিত্তির খাসা আছে।

নাহ্, অতটা স্বার্থপর অনুপম হতে পারবে না। বড়দাকে সাবসিডি তাকে দিয়ে যেতেই হবে। সোহিনীর হয়তো বড়দার এই নিত্যকার খুচখাচ প্রার্থনা ভাল লাগবে না, তার চেয়ে একটা মাসিক বরাদ্দ হাতে ধরিয়ে দিলে কেমন হয়?

জল ফুটছে। টি-পটে চা-পাতা ভিজিয়ে অনুপম বিস্কুটের কৌটো খুলল। ফ্রিজ থেকে মাখন বার করে ঘুরিয়ে নিল মাইক্রোওয়েভ ওভেনে। দুটো বিস্কুটের মাঝে মাখন লাগাচ্ছে। খিদে পাচ্ছে অল্প অল্প, আপাতত চায়ের সঙ্গে বিস্কুটই পেটে যাক।

পেয়ালায় দামি সুগন্ধী চা ঢেলে নিয়ে অনুপম শোওয়ার ঘরে ফিরল। দুধবিহীন, চিনি ছাড়া উষ্ণ পানীয় এখন তাকে খানিক সঞ্জীবিত করবে। ল্যাপটপ খুলে বসল বিছানায়। মেল বক্সে চোখ রেখেই টানটান। লীনা উত্তর দিয়েছে! সংক্ষিপ্ত বৈদ্যুতিন চিঠি। হাই পপ, গেটিং অ্যালং ফাইন। জয়েন্‌ড পিয়ানো ক্লাস লাস্ট উইক। গ্রেট ফিলিং। হোপ ইউ আর ও-কে।

কী মেয়ে, আরও দুটো-চারটে লাইন কি লিখতে ইচ্ছে করে না! জানুয়ারিতে বারো পূর্ণ করল লীনা, এবার যে-কোনও দিন আস্ত এক নারী বনে যাবে। কে জানে হয়তো হয়েও গেছে। অনুপমের আর জানা হল না। ছোট্ট খরগোশের মতো সেই মেয়েটা, পাতলা পাতলা ঠোঁট, কুচকুচে কালো চোখের মণি, তুলতুলে হাত-পা, টুকটুকে ফোলা ফোলা গাল, যার বেড়ে ওঠার প্রতিটি পল তিলে তিলে অনুভব করবে ভেবেছিল অনুপম, সে বুঝি আর কোনও কালেই তাকে দেখা দেবে না। এখন লীনা একশো ভাগ মারিয়ারই মেয়ে। নইলে একবারও কি লিখত না, আই মিস ইউ, পপ!

লিখবেই বা কেন? নিশ্চয়ই জোহান আর মারিয়ার সংসারে দেবলীনা মিত্র নামের মেয়েটা অসুখী নেই! উঁহু দেবলীনা মিত্র নয়, ডেবোলিনা মিট্‌রা। মেয়েটা নিজের নামের মানেই হয়তো কোনওদিন জানবে না। তবু ওই নামটুকু তো বহন করছে, এটাই যা অনুপমের সান্ত্বনা।

শ্বাস গোপন করে মেয়েকে একটা প্রত্যুত্তর লিখল অনুপম। সংক্ষেপেই। মিছিমিছি বেশি মায়া বাড়িয়ে কী লাভ, এবার ক্রমশ বিযুক্ত করতে হবে নিজেকে। মেয়ে যে আর অনুপমের নেই, এ তো খোলামনে মেনে নেওয়াই ভাল। পুরনো সম্পর্কগুলোকে পুরোপুরি ছিঁড়তে না পারলে নতুনে কি স্থিত হওয়া যায়?

মোবাইলে কুককুক ধ্বনি। সোহিনী? টেবিল থেকে সেলফোনখানা তুলে অনুপম সামান্য হতাশ। গলা গম্ভীর করে বলল, হ্যালো?

স্যার, আমি শুভম বলছি। শুভম রায়চৌধুরী। সেকেন্ড ইয়ার।

অনুপমের চট করে মনে পড়ল না ছেলেটাকে। গলা আরও ভারী করে বলল, হ্যাঁ, বলো?

আপনি স্যার আজ নেটওয়ার্ক থিয়োরিটা পড়িয়েছেন…আমি ক্লাসটা করতে পারিনি…

কেন পারোনি?

নেক্সট উইকে যে ইলেকশন, স্যার। দেখেছেন তো এবার কী হাড্ডাহাড্ডি লড়াই…!

এতক্ষণে স্মরণে এল ছেলেটাকে। রোগা, লম্বা, ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল, প্রতিদিন আলাদা আলাদা রঙের টিশার্ট পরে আসে। অতি ফাঁকিবাজ, কামাই করে প্রায়ই, এলেও লেটে ঢোকে ক্লাসে। অনুপম একটু বিরক্তির সঙ্গেই বলল, সারাদিন ইউনিয়ন রুমে বসে ছিলে তো?

থাকতেই হবে স্যার।… তা কোন বইটা ফলো করব…

ক্লাসে আমি রেফারেন্স বুকের নাম দিয়ে এসেছি।

সে তো স্যার তিনটে বই।

হ্যাঁ। তিনটেই পড়তে হবে।

বলছিলাম কী স্যার… এখন তো ক’দিন ব্যস্ত থাকব… যদি একটা নোট মতন দিয়ে দেন… আপনারও সুবিধে, আমাদেরও সুবিধে।

চড়াং করে মাথা গরম হয়ে গেল অনুপমের। কী স্পর্ধা! ইউনিয়নের নেতা বলে মাথা কিনেছে নাকি? রুক্ষ স্বরে অনুপম বলল, শোনো, আমি কীভাবে পড়াব, আমিই স্থির করব। তোমার ক্লাস করতে ইচ্ছে না হয়, কোরো না। ডোন্ট অ্যাডভাইস মি এগেন।

বলেই অনুপম খটাস করে কেটে দিয়েছে লাইন। কপাল টিপে মাথা নাড়ছে দু’দিকে। এখানে পড়ানোর অভিজ্ঞতাটা খুব সুখকর হচ্ছে না। কলকাতা যে রাজনীতির আখড়া, তা সে জানে। স্কুল-কলেজগুলোও যে দলবাজির প্রভাবমুক্ত নয়, তাও। তবু চাকরিটায় যোগ দেওয়ার আগে পর্যন্ত অনুপমের ধারণা ছিল, প্রযুক্তিবিদ্যার পাঠশালাগুলো হয়তো একটু অন্যরকম। হা হতোহস্মি, এসে অবধি দেখছে এখানেও রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিষ। প্রথম ধাক্কাটা খেয়েছিল ডিপার্টমেন্টে। সহকর্মীরা তাকে কেমন সন্দেহের চোখে দেখত। ঠারেঠোরে বুঝতে চাইত, পার্টির কোন কেষ্টবিষ্টুর খুঁটির জোরে সরাসরি প্রফেসর পদে বহাল হল সে! এই শহরে রাজনৈতিক দাক্ষিণ্য ছাড়া উপাচার্য থেকে পিয়ন, কোনও চাকরিই জোটা কঠিন, এ অনুপম জানবে কোত্থেকে! কিছুকাল যেতে তবে না টের পেল, যে পোস্টে সে এসেছে সেখানে সুপারিশ করার মতো দলীয় লোক পাওয়া যায়নি বলেই, এবং অনুপমের যোগ্যতা অনেকখানি বেশি ছিল বলেই, শিকেটা তার ভাগ্যে ছিঁড়েছিল। অ্যাকাডেমিক রেকর্ড, বিদেশের নামী জার্নালে প্রকাশিত অজস্র গবেষণাপত্র, বিদেশে দীর্ঘকাল পড়ানোর অভিজ্ঞতা, সব মিলিয়ে অনুপমের ব্যক্তিগত তথ্যপঞ্জিও যথেষ্ট ওজনদার। নির্বাচকমণ্ডলী তাকে বাতিল করার সুযোগ পায়নি। আর কাজে ঢোকা ইস্তক দেখছে, ছাত্রদের মধ্যে এ-দলে ও-দলে মারপিট লেগেই আছে। ইউনিয়নের দখল পাওয়া যেন সাম্রাজ্য জয়ের শামিল। এতে যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বনেদটা ক্রমে ঝুরঝুরে হয়ে যাচ্ছে, তা নিয়ে কারওই হুঁশ নেই যেন। না ছাত্রছাত্রীদের, না কর্তৃপক্ষের। মরুক গে যাক। একা অনুপম ভেবে কী করবে!

চায়ের কাপ ডাইনিং টেবিলে রেখে আবার একবার ফ্রিজ খুলল অনুপম। রাত্তিরের জন্য খুব একটা কিছু নেই, কালকের রাঁধা ডাল আর মুরগির মাংস পড়ে আছে সামান্য। কলকাতায় ফেরার পর মা রান্না করত প্রথম প্রথম, পরে একটি কাজের মেয়ে। এখন অবশ্য রাঁধুনি টাধুনি নেই। সে নিজেই রাখেনি। এক মহিলা সকালে শুধু ঘরদোর মুছে-টুছে যায়, ব্যস। আহারের মতো একটা সাদাসাপটা ব্যাপারে পরনির্ভর হওয়াটা অনুপমের আঁতে লাগে। আজ রাতে শুকনো কিছু বানিয়ে নেবে? আর মোড়ের দোকান থেকে হাতে গড়া রুটি? নাহ্‌, থাক। আজ ভাত, আলুসেদ্ধ, ডিমসেদ্ধ। ঘি-মাখন খাওয়া ইদানীং বেশিই হচ্ছে, তবু আর একটা দিন নয় অনিয়ম হোক।

সরল সমাধানটা পেয়ে অনুপম ঈষৎ উৎফুল্ল বোধ করল। ইদানীং ভাতটাই তার বেশি মনোমতো হচ্ছে। সে কি এবার পুরোদস্তুর ভেতো বাঙালি বনে যাবে? মন্দ কী…নয় একটু নেয়াপাতি ভুঁড়িই গজাল! সোহিনী শুনলে অবশ্য মোটেই প্রসন্ন হবে না। ভাস্করের ভুঁড়ি দিন দিন ফুলছে, এটাও নাকি বরের প্রতি বীতরাগের অন্যতম কারণ! পাগলি কোথাকার!

দরজায় বেল। পলকের জন্য অনুপমের হৃৎপিণ্ড ছলাৎ। পরমুহূর্তে মনে পড়ল, সোহিনী তো বেল বাজাবে না! তা হলে কি বড়দা…?

বেজার মুখে অনুপম দরজা খুলল। যা ভেবেছে তাই। দেবোপম মিত্তির উপস্থিত।

একগাল হেসে দেবোপম বলল, কী রে, এখনও জামাপ্যান্ট বদলাসনি?

একবারেই চেঞ্জ করব। একটা শাওয়ার নিয়ে।…এসো।

আমি অবশ্য আজকাল রাত্তিরে স্নানটা করতে পারি না। ঠান্ডা লেগে যায়। বলতে বলতে বসার ঘরে গিয়ে সোফায় আসীন হয়েছে দেবোপম। পকেট থেকে সিগারেট-দেশলাই বার করে সেন্টারটেবিলে রাখল। ভাইয়ের মুখটা ঝলক দেখে নিয়ে বলল, এক কাপ চা খাওয়াবি রে? তোর পাতা-চায়ের টেস্টটা দারুণ। তুই বানাসও চমৎকার।

অত সুখ্যাতির প্রয়োজন নেই। করছি।

রান্নাঘরে যাওয়ার আগে অ্যাশট্রেখানা টেবিলে তুলে দিয়ে গেল অনুপম। হাতের সামনে না পেলে ঘরময় সিগারেটের ছাই ফেলে বড়দা। বলতে গেলে হা হা হাসে! আরে বোকা, চতুর্দিক একটু নোংরা না হলে মাইনে দিয়ে ঝি রাখার দরকার কী!

চায়ের সঙ্গে প্লেটে খানিকটা কাজুবাদামও নিল অনুপম। ফিরে দেখল, বড়দা বসে বসে ঢুলছে। একটু মায়াই হল দেখে। রোদ্দুরে খুব ঘোরাঘুরি করে নাকি আজকাল? নাকি সুগার-ফুগার ধরল? মা’র তো ভালই সুগার ছিল, সেই ধাতটাই পেল না তো? অতি রূপবান ছিল এক সময়ে, এখন এই বাহান্নতেই গাল-টাল ভেঙে প্রায় বুড়োমানুষের হাল।

অনুপম সামান্য গলা-খাঁকারি দিল। ওমনি ধড়মড়িয়ে সোজা হয়েছে দেবোপম। মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, একা বসে থাকলেই আমার এই হয়, বুঝলি। চোখটা জড়িয়ে আসে।

স্বাভাবিক। চব্বিশ ঘণ্টা দঙ্গলের মধ্যে থাকা যার স্বভাব…!

আজকাল আড্ডায় আর যাই কই! খপ করে এক মুঠো কাজুবাদাম তুলে নিল দেবোপম। একটা-দুটো মুখে ফেলে বলল, তোর এখন কোনও জরুরি কাজ নেই তো?

অনুপম মুচকি হাসল, যদি থাকে?

তা হলে বেশি সময় নেব না। দেবোপম একটুক্ষণ জুলজুল তাকিয়ে থেকে বলল, একটা বৈষয়িক ব্যাপারে তোর সঙ্গে পরামর্শ করতে এসেছি।

কীরকম?

ঝন্টু আর রন্টু একটা প্রস্তাব দিয়েছে। বলছে, বাড়িটার দশা তো ভাল নয়, আগাপাশতলা মেরামত করতে অনেক খরচ, ছাদেও ফাটল ধরেছে… যদি সবাই মিলে বাড়িটা নিয়ে একটা জয়েন্ট ভেঞ্চারে নেমে পড়ি…

কী ভেঞ্চার? কীসের ভেঞ্চার?

ধর যদি কোনও প্রোমোটারকে দিই! ল্যান্ডটা হবে আমাদের ইনভেস্টমেন্ট, আর বাড়ি ভেঙে নতুন করে বানানোর খরচা দেবে প্রোমোটার। জমি বাড়ি মিলিয়ে আমাদের আছে মোট সাত কাঠা। আর বাড়ির সামনে যা রাস্তা, স্বচ্ছন্দে জি প্লাস ফোর হয়ে যাবে। রন্টু হিসেব করে দেখাল, পার ফ্লোর তিনটে করে ফ্ল্যাট তোলাই যায়। আমরা একটা ফ্লোর, জ্যাঠামশাইদের তরফের একটা, বাকি দুটো তলা প্রোমোটার বেচুক।

অনুপম রীতিমতো চমকিত। চোখ কপালে তুলে বলল, তোমরা বাড়িখানা ভাঙার প্ল্যান করছ নাকি?

বাহাত্তর বছর তো বয়স হল, এবার তো এটাকে ছুটি দেওয়াই যায়। প্রচুর জল-ঝড়-বৃষ্টি তো খেয়েছে। সশব্দে চায়ে চুমুক দিয়ে দেবোপম ঝুঁকল সামনে। প্যাকেট থেকে সিগারেট নিয়ে ধরিয়েছে। দেশলাইকাঠি নিভিয়ে বলল, ঠাকুরদা অনেক স্বপ্ন নিয়ে বাড়িটা বানিয়েছিল রে। এখন তো সে ওপর থেকে দেখছে, উত্তরাধিকারীরা খুব একটা আরামে নেই। নিশ্চয়ই তারও মনখারাপ হচ্ছে। নির্ঘাত ভাবছে, পণ্ডিতিয়ায় এমন একটা অ্যাসেট ছেড়ে এলাম, কিন্তু নাতিরা প্রপারলি ইউজ করতে পারছে না!

বড়দা এমন সরলভাবে বলে! যেন চর্মচক্ষে দেখতে পাচ্ছে বাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাট উঠলে স্বর্গধাম থেকে পুলকে পুষ্পবৃষ্টি করবে ঠাকুরদা! কেজো সুরে অনুপম বলল, মেজদার কাছে পেড়েছ প্রোপোজালটা?

ঝন্টু বলেছে।

মেজদার কী মত?

সে তো ও তরফের চেয়েও এক কাঠি সরেস। বলেছে, প্রোমোটার ডাকো, তার সঙ্গে এস্টিমেটে বসতে হবে। ফ্ল্যাট তুলতে কত কস্ট পড়বে, সে জানাক। তারপর টোটাল বারোটা ফ্ল্যাটের হিসেব হোক। তৈরির দাম নয়, বিক্রির দাম। এই সব কিছু ক্লিয়ার হলে তবে জয়েন্ট ভেঞ্চারের প্রশ্ন।

মেজদার কাছে এমন একটা কুটবুদ্ধিই প্রত্যাশিত ছিল। শুধু ফ্ল্যাটই নয়, সঙ্গে সম্ভবত কিছু ক্যাশ বাগানোর ধান্দা আছে মেজদার। চুলচেরা পাইপয়সার হিসেব না বুঝে মেজদা এ-বাড়িতে কোদাল-গাঁইতি মারতেই দেবে না।

দেবোপম অ্যাশট্রেতে ছাই ঝাড়ল, তা তোর কী মতামত?

উঁ? অনুপম ঠোঁট টিপল, হুঁ।…ঠিক আছে, কথাবার্তা তো এগোক।

অর্থাৎ তোর দিক থেকে গ্রিন সিগনাল?

সবাই মিলে একটা কিছু করতে চাইলে আমি কেন ভগ ইন দা মেন্জার হব!

না না, তুই আমার সোনা ভাই, আমি জানি না!

সম্বোধনটায় একটু যেন মেদুর হল মন। বড়দা ছোটবেলায় অনুপমকে ওই নামেই ডাকত কিনা। বাবার শাসনে যদি সামান্য ঠোঁট ফুলল অনুপমের, ওমনি দাদা চুল ঘেঁটে দিত, আহা রে, আমার সোনা ভাইকে কে বকল রে…!

দেবোপম ভারী পরিতৃপ্ত মেজাজে সোফায় হেলান দিয়েছে, আমাদের তো নো প্রবলেম। তিন ভাই, তিনটে ফ্ল্যাট। ঝন্টুদেরই ফ্যাসাদ। বড়দি-ছোড়দি কি ভাগ ছাড়বে? দু’বোনকে অংশ দিতে হলে তিনটে ফ্ল্যাটকে চারখানা করতে হবে না?

যাদের সমস্যা, তাদেরই বুঝতে দাও।

দ্যাখ না তুই, লাঠালাঠি বেধে যাবে। ঝন্টুর যা মেন্টালিটি, ও দিদিদের এন্ট্রি দেবে বলে মনে হয় না। কেনই বা দেবে বল? বড়দি-ছোড়দি তো জ্যাঠামশাইয়ের অসুখের সময়ে…

অনুপম আর শোনার আগ্রহ বোধ করছিল না। পারিবারিক এইসব কূটকচালি থেকে সে বহু কালই দূরে দূরে। এখনও দূরেই থাকতে চায়। দেবোপমকে মাঝপথে থামিয়ে বলল, তোমার দরকারি কথা হয়ে গেছে তো?

হ্যাঁ।…কেন?

এবার আমি একটু কাজে বসব। ক্লাস টেস্টের খাতা দেখতে হবে।

ও। তা হলে তো এবার উঠতে হয়। বলল বটে, দেবোপমের তবু নড়ার লক্ষণ নেই। ফের একখানা সিগারেট ধরিয়ে বলল, আমার ওই বিষয়ে কিছু ভাবলি?

কোনটা বলো তো?

বললাম না… সম্প্রতি একটা ভাল মিউচুয়াল ফান্ড বেরিয়েছে। ভেরি সেফ ইনভেস্টমেন্ট। চোখ বুজে দু’-চার লাখ লাগিয়ে রাখতে পারিস।

এখনই হবে না গো। একটু অসুবিধে আছে।

তোর আবার কীসের অসুবিধে রে অন্তু? ঝাড়া-হাত-পা মানুষ, লাখ লাখ ডলার ব্যাঙ্কে পচছে… এখানেও মোটা মাইনে পাচ্ছিস…!

অনুপম বলতে পারল না, সবাই তাকে যতটা অর্থবান ভাবে ততটা সে নয়। স্টেটসে যেটুকু সঞ্চয় করেছিল, তার একটা মোটা অংশ দিয়ে আসতে হয়েছে মারিয়াকে। বিবাহ বিচ্ছেদের খেসারত। মেয়েকে মারিয়াই পেল কিনা। শুধু তাই নয়, এখনও মেয়ের খরচ বাবদ তাকে নিয়মিত টাকা পাঠাতে হয়। ডলারের হিসেবে হয়তো অকিঞ্চিৎকর, কিন্তু ভারতীয় মুদ্রায় নেহাত কম নয়। তা এসব গল্প বড়দাকে শুনিয়ে লাভ আছে কোনও? অনুপম বলবেই বা কেন?

অল্প হেসে অনুপম বলল, না বড়দা, এখন পারব না। প্লিজ।

ঠিক আছে, আমারও কোনও জোরাজুরি নেই। দেবোপম গাত্রোত্থান করেছে। দরজায় গিয়ে বলল, তোর রাত্তিরের রান্না হয়ে গেছে?

ভাতে ভাত বসিয়ে দেব।

যদি বলিস তো মাছের ঝোল পাঠিয়ে দিতে পারি। তোর বউদি আজ কাতলা মাছের ঝালটা বেশ রেঁধেছে।

কিচ্ছু দরকার নেই।

ঝটিতি নাকচ করে দিল অনুপম। এধরনের আদান-প্রদানে সে একদম নেই। বড়দা-বড়বউদি বেশ কয়েকবার একত্রে খাওয়া-দাওয়ার প্রস্তাব তুলেছে। তাতে হয়তো বড়দারও সুসার হয়, অনুপমেরও কিঞ্চিৎ হ্যাপা বাঁচে। তবু অনুপম সম্মত হতে পারেনি। কোথায় যেন একটা আটকায়। পারস্পরিক নির্ভরশীলতা থেকে ধীরে ধীরে একটা বাধ্যবাধকতা তৈরি হতে পারে, সেই আশঙ্কাতেই কি…? তা ছাড়া নিজের স্বাধীনতাও তো খানিক খর্ব হয়। আত্মীয়পরিজনদের সঙ্গে বেশি মাখামাখিতে নৈকট্য হয়তো বাড়ে, আবার একটা মানসিক ব্যবধানও তো গড়ে ওঠে। নয় কি?

দেবোপম বুঝি ক্ষুন্ন হয়েছে সামান্য। ঘাড় দুলিয়ে বলল, যা তার ইচ্ছে।… তবে দিনের পর দিন হাত পুড়িয়ে খাচ্ছিস, আমাদের দেখতেও তো খারাপ লাগে।

রান্নার অভ্যেস আমার আছে বড়দা। রাঁধতে ভালবাসি।

তবু…। দেবোপম হঠাৎই থমকাল। ভাইকে আগাগোড়া জরিপ করতে করতে বলল, বয়স তো এমন কিছু হয়নি, আবার একটা বিয়ে করছিস না কেন?

দেখি।…ভাবছি।

পছন্দ হয়েছে বুঝি কাউকে?

প্রশ্নটা যথেষ্ট অর্থবহ। এ-বাড়িতে সোহিনীর যাতায়াত নিয়ে ইঙ্গিত আছে কি কোনও? থাকলে আছে। অনুপম ঢ্যাঁড়া পেটাতে যাচ্ছে না, আবার তার লুকোছাপাও নেই। মা’র শ্রাদ্ধে ভাস্কর আর সোহিনী এসেছিল, তারপর থেকে তো সোহিনীর একাই আনাগোনা—এই ঘটনাপরম্পরা থেকে বাড়ির লোক যদি কোনও ধারণা তৈরি করে, অনুপম তো তাদের দোষ দিতে পারে না!

আলগা হেসে অনুপম উত্তরটা এড়িয়ে গেল। বড়দা যাওয়ার পর দরজা বন্ধ করে সত্যি সত্যি বসল খাতার গোছা নিয়ে। দুটো-তিনটে দেখেই স্থৈর্যে চিড়। সব একরকম, সব একরকম! এত টোকাটুকি করলে ক্লাস টেস্টের কোনও গুরুত্ব থাকে? নাহ্, এবার ওপেন বুক এগ্জ্যাম চালু করতে হবে। খানপাঁচেক প্রবলেম ধরিয়ে দেবে, সবাই মিলে মাথাখুঁড়ে মর!

চশমা খুলে চোখ মুছল অনুপম। ফের ডাঁটি কানে লাগাচ্ছিল, তখনই উন্মন সহসা। কোত্থেকে একটা মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসে না? বাড়ির সামনেটায় ছাতিমগাছে ফুল ফুটেছে, বাতাস কি সেই সৌরভই বয়ে আনল? গন্ধটা তো সন্ধে থেকেই ছিল, এতক্ষণ সেভাবে নাকে লাগেনি, হঠাৎই যেন ঝাপটা মারছে। মাতাল করা ছাতিম ফুলের সুবাসে এখন সোহিনীর ঘ্রাণ।

চার-চারটে দিন দর্শন নেই সোহিনীর, কোনও মানে হয়? ঘাড়ে ব্যথা বলে বর নয় ছুটিতে, তা বলে সোহিনী সোজা বাড়ি ফেরে কেন? কীসের দায়? ভাস্করকে তো সোহিনী বলেই ফেলেছে, তার সঙ্গে আর থাকবে না…! ভাস্কর নাকি এতই বোদা, শুনেও নাকি মগজে ঢোকেনি!

সত্যিই কি ভাস্কর নির্বোধ? সোহিনী-অনুপমের সম্পর্ক কিছুই আঁচ করতে পারে না? নাকি বউ আর বন্ধুর ওপর অগাধ বিশ্বাসের কারণে সন্দেহটাকে আমল দিতে চায় না?

কথাটা মনে হতেই বুকে একটা পেরেকের খোঁচা। বন্ধুর সারল্যের সুযোগ নিয়ে অনুপম তাকে প্রতারণা করছে না কি? তা কেন, সোহিনী আর ভাস্করের মাঝে বড় একটা ফাঁক ছিল বলেই তো…। নাহ্‌, ভাস্করকে সোহিনী কোনওদিনই ভালবাসতে পারেনি। শুধুমাত্র সামাজিক বিধির কারণে সোহিনী অনুপমকে চাইতে পারবে না, এমন দাবিও তো হাস্যকর। মন তো ক্রীতদাস নয়, নিয়মের শৃঙ্খলকে সে থোড়াই পরোয়া করে! স্বয়মাগতা সোহিনীকে অনুপমই বা কেন ফেরাবে? আজ যদি সে সরেও আসে, তা হলেই কি ভাস্করের জীবনে সুখের বন্যা বইবে? নাকি সোহিনী ভাল থাকবে? অতএব সে নিজেকে দায়ী ভাবছে কেন? সে তো নিয়তির হাতের পুতুল মাত্র। যেভাবে সুতো নড়ছে, সেভাবেই নাচছে। মারিয়া যে তাকে ছেড়ে দিল, তাও তো ওই সুতোর খেলা। কলকাতায় ফিরে কেনই বা যোগাযোগ করল ভাস্করের সঙ্গে? কে তাকে বাধ্য করল ভাস্করের বাড়ি যেতে? সোহিনীকে দেখে কেন তার মনে হল, বিয়ের বাঁধনে আটকে থেকেও ওই নারী একা, ভয়ংকর একা? প্রায় অনুপমের মতোই?

নাহ্, সবই সেই বাজিকরের কারসাজি। অনুপম নেহাতই নিরুপায়।

নিজের পক্ষে এভাবে যুক্তি সাজিয়েই তো স্বস্তি পায় মানুষ। মনকে চোখ ঠেরে নিজেকে ভারমুক্ত করার এ এক সূক্ষ্ম কৌশল। আসলে অনুপমের কাছে এখন সত্যি তো একটাই। সোহিনী তার সমস্ত শূন্যতা ভরিয়ে দিয়েছে। সোহিনী বিনা অনুপমের গতি নেই।

উদাসী পায়ে অনুপম পায়চারি করল খানিকক্ষণ। সিগারেট ধরাল একটা। আনমনে অন্দরের চওড়া প্যাসেজে হাঁটছে। প্যাসেজের প্রান্তে অনুপমের লাগানো গ্রিল দরজা, ওপারে গাছ-আগাছার জঙ্গল। পাঁচিলঘেরা জমিটায় এক টুকরো আলো এসে পড়েছে, ঝোপঝাড়ে এখন এক রহস্যময় আবছায়া। আলো আর অন্ধকারের ওই মায়াজাল সোহিনীর ভারী প্রিয়।

হঠাৎই অনুপমের মনে হল, বাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাট উঠলে পিছনের জমি তো থাকবে না! সোহিনীর হয়তো খারাপ লাগবে। খবরটা জানাবে সোহিনীকে? এখনই?

কী কাণ্ড, ঘরে ফিরতে না-ফিরতে সোহিনীর ফোন! অনুপম উল্লসিত স্বরে বলল, এ যে দেখি মেঘ না চাইতেই জল!

থাক। নিজে থেকে তো খবর নাও না! একা একা কী ধ্যানে আছ মশাই?

তোমার শরীরের ঘ্রাণ নিচ্ছি, প্রিয়ে। সামনের ছাতিমগাছ তোমার সুরভি পাঠাচ্ছে।…তুমি করছটা কী?

আমার তো কাব্য করার জো নেই। এখন বাড়িতে নীরস গদ্য। শাশুড়ি ফিরলেন। সঙ্গে ননদ। ভাস্করকে নিয়ে প্রচুর আহা-উহু চলছে।

ভাস্কর এখন আছে কেমন?

শুয়ে-বসে সময় কাটাচ্ছে। আর মাঝে মাঝে পেনকিলার গিলছে।

ব্যথা এখনও যায়নি?

বাড়ে…কমে…বাড়ে…কমে…। আজ বিকেলে তো স্ক্যান রিপোর্টটা নিয়ে এলাম।

কিছু পাওয়া গেল?

বুঝতে পারছি না। দিদি নিয়ে যাচ্ছে রিপোর্টটা। তরুণদা কাল ডাক্তারকে দেখাবে। ব্রেনে বোধহয় কিছু স্পট-টট আছে। কী সব ওপাসিটিজ ইন ফ্রন্টাল লোব অফ ব্রেন…ইন্ট্রাটেনিয়াল টেনশন…এই সবই তো লেখা।…খারাপ কিছু কি?

অনুপম জোর চমকেছে। সোহিনী যা বলছে…খারাপ তো বটেই! লক্ষণ তো আদৌ ভাল নয়! ঘাড়ে যন্ত্রণা…ব্রেন-স্পট, যা সম্ভবত ইডিমা…মস্তিষ্কের সম্মুখভাগে অস্বচ্ছতা…প্রতিটি ফাইন্ডিংস তো একটা নির্দিষ্ট অভিমুখে আঙুল দেখায়!

ফের সোহিনীর গলা, কী গো, চুপ মেরে গেলে কেন? কী বুঝছ? ব্রেন-টিউমার নয় তো? অপারেশন-টপারেশনে যেতে হবে?

জানি না। ডাক্তার বলতে পারবে।…কে যেন বেল বাজাচ্ছে। ছাড়ছি।

আচমকা ফোন কেটে দিয়ে অনুপম একটু দম নিল। হে ঈশ্বর, সন্দেহটা যেন সত্যি হয়।

পরক্ষণে মনকে চাবুক কষাল। ছিঃ, এমনটা ভাবতে আছে? হে ঈশ্বর, সন্দেহটা যেন মিথ্যে হয়।

.

০৪.

সোহিনীর কাউন্টারে তেমন ভিড় ছিল না আজ। মাসের তৃতীয় সপ্তাহ, পেনশনারদের চাপ নেই বললেই চলে, সকালে তাও খানিক লাইন পড়েছিল, টিফিনের পর তো বিলকুল ফাঁকা। সাড়ে তিনটে নাগাদ সোহিনীর মনে হল, এবার ঝাঁপ নামালেই হয়।

অতএব প্রস্তুতি শুরু। ড্রয়ারের টাকাগুলো তুলে সোহিনী জড়ো করছে টেবিলে। কাজ এখনও অনেক বাকি, তবু যতটুকু যা এগিয়ে রাখা যায়। দশ, বিশ, পঞ্চাশ, একশোর নোট আলাদা আলাদা করে বান্ডিল বাঁধল। গোছা ধরে ধরে গুনে নিচ্ছে কাউন্টিং মেশিনে।

কাচের খোপের ওপারে রূপক, খুব ব্যস্ত নাকি, সোহিনীদি?

একটা পঞ্চাশ টাকার বাণ্ডিলে গার্ডার লাগাচ্ছিল সোহিনী। চোখ তুলে বলল, তুমি ঘুরে বেড়াচ্ছ কেন?

কাজেই ঘুরছি। বছর বত্রিশের রূপক ফিক করে হাসল, একটা উপহার দেওয়ার ছিল।

হঠাৎ? আমাকে?

সবাইকে দিচ্ছি। একটা দুঃসাহসিক কাজ করে ফেলেছি কিনা।

পাশের খোপ থেকে অনুশ্রী গলা তুলেছে, অত ভ্যানতাড়া করছে কেন? বলো না, তোমার গানের সিডি বেরিয়েছে।

তাই বুঝি? সোহিনী ঈষৎ কৌতূহলী, কই, দেখি।

খাপসুদ্ধু ডিস্‌কটা বাড়িয়ে দিল রূপক। রবীন্দ্রসংগীত। রূপকের এ গুণটা তো সোহিনীর জানা ছিল না! নিজের খরচায় বার করেছে?

রূপক আবার বলল, বারোটা গান আছে। ক্লাসিক্যাল বেসের। আপনি তো ক্লাসিক্যাল ভালবাসেন, কাইন্ডলি একটু শুনবেন।

অবশ্যই। আজই চালাব।

আপনার বাবাও তো নাকি ক্লাসিক্যালের খুব সমঝদার? এক সময়ে চর্চা-টর্চা করতেন…

ভোকাল নয়। বাবা সেতার বাজাত। বহু কাল ছেড়ে দিয়েছে।

তবু…ওঁদের কানটা তো খুব তৈরি…উনিও যদি শোনেন…। বলেন তো ওঁর জন্যও একটা…

না না। এটাই বাবাকে দেব।

মতামত জানার অপেক্ষায় রইলাম কিন্তু।

রূপক সরে যেতে সিডিটা ব্যাগে ভরে সোহিনী ফিরেছে নোট গণনায়। বাবা কি আর সেই ধ্যানস্থ হয়ে গান শোনার বাবা আছে? কেমন যেন বুড়িয়ে গেল বাবা। চাকরির পাট চোকার পরেও প্রথম ক’বছর বেশ তড়বড়ে ছিল। মাকে নিয়ে হইহই করে গোটা ভারত ঘুরল, ছাদে বাগান করছে, গানের আসরে ছুটছে নিয়মিত, তাসের আড্ডাতেও হাজিরায় ছেদ পড়ে না…। ইদানীং সেই বাবার শরীরেও যেন প্রবল ভাঁটির টান। হাঁপানি তো ভালই বেড়েছে, সিগারেট খেয়ে খেয়ে ফুসফুসের দফারফা। রবিবার দাদা এসেছিল, ভাস্করের শরীর খারাপ শুনে। বলছিল, এত নিশ্বাসের কষ্ট, তবু নেশাটি বাবা ত্যাগ করবে না। সারারাত খকখক কাশি, উঠে বসে থাকছে…। সঙ্গে মা’রও ভোগান্তি। সমানে জেগে। আর মা বেচারিও তো সুস্থ নয়। সেই যে বছর সাত-আট আগে হাঁটুর সমস্যাটা ধরল, সে তো আর কমার কোনও লক্ষণ নেই। গাদা গাদা ওষুধ, ইঞ্জেকশন, ফিজিওথেরাপি, তবুও কোঁকাচ্ছে। এবার বোধহয় হাঁটু দুটো বদলাতেই হবে। প্রায় দিন পনেরো শোভাবাজারের পথ মাড়ানো হয়নি। একবার যাওয়া উচিত। নিজের বাড়িতে অসুখ, বাপের বাড়িতে অসুখ…উফ্, সোহিনী কী যে করে! ভাস্করের রোগটা তো ডাক্তার ধরতেই পারছে না। তরুণদা একবার বলে, হ্যাঁ হ্যাঁ টিউমার! একবার বলে, না না টিউমার নয়! কাল তো ভাস্করকে চেস্ট এক্স-রের করাতে নিয়ে গেল। ঘাড়ের যন্ত্রণার উৎস খুঁজতে বুকের ছবি তোলাতে হয়…? অনুপম অবশ্য বোঝাল, ব্রেনের স্পটগুলোর নেচার জানার জন্য ফুসফুসের এক্স-রে নাকি জরুরি!

কে জানে কী হচ্ছে! সোহিনীর ভাল লাগছে না। এরকম চিন্তা মাথায় কিলবিল করে আজকাল! শেষ পর্যন্ত অনুপমের কাছে যদি সে চলে যায়…যদি কেন, যাবেই…কেমন দাঁড়াবে ব্যাপারটা? তাদের শোভাবাজারের বাড়ি এখনও অতি রক্ষণশীল। গাঙ্গুলি বাড়ির মেয়ে, যে কিনা একটা দামড়া বাচ্চার মা, ডিভোর্স নিচ্ছে অন্য একজনকে বিয়ে করবে বলে…! বাবা-মা তো ইহজন্মে আর সোহিনীর মুখদর্শন করবে না। দাদাও না। নিকটতম মানুষদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে প্রায় দ্বীপের মতো বাস…ভাবলেই কেমন বুক ঢিপঢিপ।

ম্যাডাম, এই চালানটা নেবেন।

সোহিনী নড়ে উঠল। কাউন্টারে চেনা মুখ। মধ্যবয়সি সরকারি অফিসার। ট্রেজারি চালানে টাকা জমা দিতে এসেছে। এই শেষবেলায়।

লোকটা সব সময়ে সোহিনীর কাউন্টারেই দাঁড়ায়। বেজার মুখে চালানটা হাতে নিয়ে টাকার পরিমাণ দেখল সোহিনী। চার লক্ষ বিরাশি হাজার। হয়ে গেল, এখন বসে নোংরা নোংরা নোট গোনো! পারেও বটে লোকটা! পাঁচশো-হাজারের বান্ডিল প্রায় আনেইনি, শুধু গাদা গাদা পঞ্চাশ আর একশো। কেন আনে? বেশিক্ষণ সোহিনীকে দেখবে বলে? ঝটপট কাউন্টিং মেশিনে চাপিয়ে যে কাজ সারবে, সে উপায়ও নেই। আজকাল জাল নোটের যা রমরমা, পঞ্চাশ-একশোর গোছা ভাল করে পরখ করতে হয়।

পাক্কা চোদ্দো মিনিট সময় লেগে গেল। তার মাঝে অন্তত দু’বার ওড়না টানতে হল বুকে। অবশেষে কার্যটি যখন সমাধা হল, শীতাতপনিয়ন্ত্রিত দপ্তরে সোহিনী টিপটিপ ঘামছে, মুখখানা তোলো হাঁড়ি।

লোকটা কাউন্টার ছাড়তেই ‘ক্লোজড’ বোর্ড টাঙিয়ে দিল সোহিনী। ঘড়ি দেখল, চারটে দশ। মাথা ঝাঁকিয়ে উঠল সিট ছেড়ে। ড্রয়ারে তালা মেরে সোজা টয়লেট। মুখে জল ছেটাচ্ছে, পিছনে মালবিকা।

মুচকি হেসে মালবিকা বলল, দারুণ একটা দিওয়ানা জোগাড় করেছিস তো!

সোহিনী অন্যমনস্ক ছিল, চোখ কুঁচকে বলল, আমি?

না তো কে!…ইস, লোকটা পুরো পতঙ্গের মতো আসে। তুই একটা কটাক্ষ হানলেই লোকটা পুড়ে ছাই হয়ে যাবে।

ও, তুই ওই সরকারি ঢ্যামনাটার কথা বলছিস? খিস্তিটুকু মারতে পেরে একটু যেন প্রশমিত হল সোহিনী। চোখ বেঁকিয়ে বলল, দ্যাখ, না, নেক্সট দিন মালটাকে কেমন টাইট দিই!

কী করবি?

দেখলেই কাউন্টার ছেড়ে কাট্। পাঁচটার আগে ফিরব না।

বেচারা তখন গেটে ধর্না দেবে রে!

লঘু আলাপচারিতায় মেজাজ হালকা খানিক। হাসতে হাসতে সোহিনী স্বস্থানে ফিরল। এবার ঠান্ডা মাথায় কাজ গোটানোর পালা। সারা দিনের জমাখরচের হিসেব মেলানো তো আছেই, এ ছাড়া দেখতে হবে প্রতিটি চেক-ভাউচার-ডিপোজিট স্লিপ কম্পিউটারে ঠিকঠাক এন্ট্রি হল কিনা। তারপর দীপকদার হাতে নগদ টাকা বুঝিয়ে দিয়ে আজকের মতো নিশ্চিন্ত।

মিনিট পাঁচেকও যায়নি, ভ্যানিটি ব্যাগে মোবাইল সরব। নিশ্চয়ই অনুপম নয়! কালই সোহিনী পণ্ডিতিয়া গিয়েছিল, তখন তো অনুপম বলল আজ পাঁচটা অবধি সেমিনার। তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল নাকি?

ভাবতে ভাবতে মনিটরে চোখ। উঁহু, তরুণদার ফোন।

হ্যাঁ, তরুণদা, বলুন?

তুমি বেরোচ্ছ কখন, সোহিনী?

একটু সময় লাগবে। কেন?

আমি তোমাদের ব্যাঙ্কের সামনে দাঁড়িয়ে।

সে কী, ভেতরে আসুন।

না সোহিনী। আমি এখানেই ওয়েট করছি। তুমি কাজ সেরে নাও। তোমার সঙ্গে একটা ডিস্‌কাশন আছে।

সোহিনী ঈষৎ কেঁপে গেল। ভাস্করের এক্স-রে-তে কি বাজে কিছু বেরিয়েছে? অফিস বয়ে তরুণদা কি সেটাই জানাতে এল? না হলে তরুণদা তো কখনও সোহিনীর ব্যাঙ্কে…!

বিড়বিড় করে সোহিনী বলল, ভাস্করের অসুখ সংক্রান্ত কিছু কি…?

হুঁ। তাড়া নেই, তুমি টাইম নিয়ে এসো।

তা হলে বোধহয় তত খারাপ কিছু নয়। সোহিনী আশ্বস্ত করল নিজেকে। তরুণদার স্বরও তো স্বাভাবিক শোনাচ্ছে। তবে তরুণদা যা ধীরস্থির মানুষ, গলা শুনে আন্দাজ করার উপায় নেই। নিজের মা’র মৃত্যুসংবাদই যেভাবে শুনিয়েছিল! যেন মা পুরী-বেনারস কোথাও গেল, ছেলে তাকে রওনা করিয়ে ফিরছে!

চোরা একটা অস্বস্তি নিয়ে দ্রুত হাত চালাল সোহিনী। আধঘণ্টার মধ্যে আবশ্যিক ক্রিয়াকর্ম চুকিয়ে অফিসের বাইরে। চোখ চালিয়ে তরুণদাকে খুঁজছে।

ব্যাঙ্কের গায়ে পরপর কয়েকটা দোকান। মোবাইলের শোরুমটা থেকে হন্তদন্ত পায়ে বেরিয়ে এল তরুণ। পরনে ট্রাইজার-ফুলশার্ট, হাতে ব্রিফকেস। ব্যস্তভাবে বলল, সরি। মোবাইলটা রিচার্জ করে নিলাম। নিশ্চয়ই বেশিক্ষণ দাঁড়াওনি?

এই হল তরুণ ব্যানার্জি! নিজে না হোক চল্লিশ মিনিট অপেক্ষায়, অথচ কোনও তাপউত্তাপ নেই! উলটে সোহিনীর অসুবিধে হল কি না জানতে চায়! সোহিনীর ননদটি এতকাল তরুণদার ঘর করছে, বরের এই একটি গুণও যদি পেত!

চিলতে হেসে সোহিনী বলল, না না, আমি তো এইমাত্র…

তাই বলো। সামান্য একটা কাজে যা সময় নিচ্ছিল!…চলো একটু গলা ভেজাই।

নিঃশব্দে তরুণকে অনুসরণ করল সোহিনী। নিউ বালিগঞ্জের এই এলাকাটা বছর কুড়ি আগেও বেশ শুনশান ছিল, এখন অজস্র বাড়িঘর। পাল্লা দিয়ে দোকান বাজার ব্যাঙ্ক ভোজনালয়। নতুন গজিয়ে ওঠা একটা রেস্তরাঁয় ঢুকল তরুণ। মুখোমুখি বসে বলল, কিছু খাবে?

ইচ্ছে করছে না। শুধু চা।

বেয়ারাকে অর্ডার দিয়ে তরুণ সোজা হয়ে বসল। বলছে না কিছু, চুপচাপ ভাবছে কী যেন।

সোহিনী ঈষৎ অধৈর্য বোধ করছিল। গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করল, এক্স-রে রিপোর্টটা পেয়েছেন?

হুঁ। সকালে কালেক্ট করলাম।

কী বলছে রিপোর্ট?

ভাল নয় সোহিনী। ইতস্তত ভাব ঝেড়ে তরুণ বলেই ফেলেছে, কেসটা কিন্তু একটু সিরিয়াস দিকেই গড়িয়েছে।

কীরকম?

তোমায় তো বলেছি, ভাস্করের স্ক্যান রিপোর্টে গোলমাল ছিল। ডক্টর সেনগুপ্ত ওয়াজ সাসপেক্টিং সামথিং। এবং সেইজন্যই চেস্ট এক্স-রে…। তরুণ পলক থেমে থেকে বলল, এক্স-রে রিপোর্টটাও খারাপ। রাইট লাং-এ প্রচুর শ্যাডো পাওয়া গেছে।

তো?

ডক্টর বললেন, ইমেডিয়েটলি সিটি এফএনএসি করতে হবে। শুনেই তো তোমার অফিসে দৌড়ে আসছি।

সেটা কী?

সিরিঞ্জ দিয়ে লাং থেকে ফ্লুয়িড বার করে পরীক্ষা। নিডল বায়োপসি।

‘বায়োপসি’ শব্দটার এমন এক অভিঘাত আছে, সোহিনী সমূলে নাড়া খেয়েছে এবার। অজান্তেই গলার পরদা চড়ে গেল, মানে?

মানে বোঝার মতো বুদ্ধি তোমার আছে সোহিনী। তরুণ আশ্চর্য রকমের অবিচল। নাকি নিজেকে সংযত রাখছে? নিরুত্তাপ গলায় বলল, ব্রঙ্কিয়াল প্যাচটাকে ডাক্তার মোটেই ভাল চোখে দেখছে না। অতএব রসটা তো পরীক্ষা করাতেই হবে।

ও। সোহিনীর আর স্বর ফুটছিল না। বেশ খানিকক্ষণ পর ঠোঁট নড়ল, অর্থাৎ ভাস্করের…?

হ্যাঁ। স্ক্যান আর এক্স-রে রিপোর্ট মিলিয়ে দেখলে সেরকমই দাঁড়ায়। তবু ওই টেস্টটা করিয়ে ডাক্তার একশোভাগ নিশ্চিত হতে চান।

সোহিনী ঝুম মেরে গেল। টেবিলে চায়ের কাপ, কিন্তু ছুঁতে ইচ্ছে করছে না। নিমেষের জন্য মগজ বেবাক ফাঁকা। পরের মুহুর্তেই অগুনতি চিন্তা দলা পাকাচ্ছে মস্তিষ্কে। অনুপমের সঙ্গে কাল অ্যাকাডেমিতে নাটক দেখতে যাওয়ার কথা। হবে না। টানা ছুটি নিতে হবে নাকি? ভাস্করের মা ভেঙে চুরচুর হয়ে যাবেন নিশ্চয়ই! অনুপমদের বাড়িটা কবে ভাঙা পড়বে? জামাইয়ের খবরে কী প্রতিক্রিয়া হবে সোহিনীর বাবা-মা’র? পাপানের হোমটাস্ক নিয়ে সোহিনী কি বসতে পারবে আজ? রূপকের সিডিটা বোধহয় পড়েই থাকবে। অনুপম আজ এখনও ফোন করল না তো?

ভেবে কোনও লাভ আছে সোহিনী? দিস ইজ টাইম টু অ্যাক্ট।

তরুণের কথাগুলো যেন দূরাগত ধ্বনির মতো ভেসে আসছে। সোহিনী ফ্যালফ্যাল তাকাল। আবছা ঘাড় নেড়ে বলল, তা তো বটেই।

সো ডিসাইড, এখন কীভাবে এগোবে।

আপনি বলুন।

আমার তো মনে হয় এখনই রাষ্ট্র করার প্রয়োজন নেই। বাবুনকেও এখন কিছু বোলো না। আমি ওকে বুঝিয়ে-বুঝিয়ে বায়োপসিটা করিয়ে নেব। মাকে তো জানানোর প্রশ্নই নেই। ভাস্বতীকেও আমি বারণ করে দিচ্ছি। ভাস্বতী অবশ্য একটু বেশি সেন্টিমেন্টাল, মা’র সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে কান্নাকাটি না জুড়ে দেয়।

কিন্তু…গোপন রেখেই বা কী হবে?

আহা, এখনও তো সম্পূর্ণ শিয়োর নই। আর এখনই আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করাও তো নিস্প্রোয়োজন। এক পারসেন্ট হলেও নেগেটিভ হওয়ার চান্স তো একটা আছে। সেইটুকু আশাতেই নয় থাকি। দু’-এক সেকেন্ড চিন্তা করল তরুণ। তারপর বলল, তুমিও যতটা সম্ভব নরমাল থাকো। অ্যাটলিস্ট নরমাল থাকার ভান করো। এতে বাবুনের মেন্টাল হেলথ অনেক স্টেডি থাকবে।

হুম।…কবে বায়োপসি করাবেন?

পরশু।

কোথায় হবে?

কিয়োর ক্লিনিকে। ডক্টর সেনগুপ্তের চেম্বার থেকে বেরিয়েই অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে নিয়েছি। ওভার ফোন। সকাল ন’টায় ভাস্করকে আমি তুলে নিয়ে যাব।

কী অদ্ভুত নিরাবেগ ভঙ্গিতে বলে যাচ্ছে তরুণদা! দিদির সঙ্গে এতকাল ঘর করেও কী করে যে তরুণদা এমন মেথডিক্যাল রয়ে গেল!

তরুণের চা শেষ। কাপ-ডিশ পাশে ঠেলে বলল, এ কী, তোমারটা যে জুড়িয়ে জল! খেয়ে নাও।

হুঁ। চুমুক দিয়েও কাপ নামিয়ে রাখল সোহিনী। ভেতরে একটা চাপা বিবমিষা। চায়ের দিকে আর তাকাতেই ইচ্ছে করছে না।

তরুণ বুঝি পড়ে ফেলেছে সোহিনীকে। গম্ভীর মুখে বলল, থাক, ছেড়ে দাও। কিন্তু বাড়িতে তো এধরনের আচরণ চলবে না। তুমি যদি আহার-নিদ্রা বর্জন করো, তাতে তো আর এক প্রবলেম তৈরি হবে।

সোহিনী ঢোক গিলল, দুশ্চিন্তা করবেন না তরুণদা। আমি ঠিক আছি।

দ্যাটস গুড। তরুণ ঘড়ি দেখল। হিপপকেট থেকে পার্স বার করে বলল, চলো তবে উঠি। এখন আবার সল্টলেক যেতে হবে। ছোটমামার হঠাৎ উইল করার সাধ জেগেছে, আমার পরামর্শ চাই।

পারেন বটে। সারাদিন শুধু চরকি খাচ্ছেন। সোহিনী নিজেকে সহজ দেখাতে চাইল। ঠোঁটে হাসি এনে বলল, এত এনার্জি পান কোত্থেকে?

কী জানি ভাই, ক্লান্ত তো হই না। কারও কোনও কাজে লাগছি ভাবলেই পা দুটো কেমন আপনাআপনি চলতে শুরু করে।

এও এক ধরনের মানুষ। অন্যের উপকারে লাগার জন্য তরুণ যেন মুখিয়ে আছে। গ্লোরি ফার্মাসিউটিকালসের প্রচার বিভাগে মোটামুটি দায়িত্বশীল পদে চাকরি, তবু পেশাগত ব্যস্ততার মাঝেও ঠিক সময় বার করে নেয়। অন্যের দায় কাঁধে চাপিয়ে যন্ত্রের মতো ছোটে। কার যে কীসে আনন্দ!

বাইরে বেরিয়ে তরুণ তার দাঁড়াল না। বেঁটেখাটো গাঁট্টাগোট্টা মানুষটা প্রায় দৌড়েছে রাস্তার ওপারে। চলন্ত বাসকে হাত দেখিয়ে উঠে পড়ল।

একটুক্ষণ থম দাঁড়িয়ে থেকে সোহিনী একটা ট্যাক্সি ধরেছে। অন্ধকার এখনও গাঢ় হয়নি, চুঁইয়ে চুঁইয়ে নামছে সবে। নবীন চৈত্রের বাতাস এখন যথেষ্ট উদ্দাম। হাওয়ার ঝাপটা ভাল লাগছিল না সোহিনীর, জানলার কাচটা তুলে দিল। সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজেছে। মন যেন এখনও খবরটা মানতে চাইছে না। ভাস্করের মতো শক্তসমর্থ লোকের এ হেন ভয়ংকর ব্যাধি? নিশ্চয়ই কোথাও ভুল হচ্ছে। ছিল ঘাড়ে ব্যথা, অথচ অসুখ কিনা ফুসফুসে? ডক্টর সেনগুপ্ত বলে যাকে দেখাচ্ছে, সে ঠিকঠাক তো? অনেক সময়ে ডাক্তাররা আসল রোগ ধরতে পারে না, যা হোক তা হোক নিদান হাঁকে। কিংবা ভয় দেখিয়ে রোগী হাতে রাখতে চায়। চিকিৎসা তো এখন ব্যাবসা। গুচ্ছের টেস্ট করিয়ে ডাক্তাররা কমিশন তো খায়ই, তারপর ভুলভাল ট্রিটমেন্টে রোগীর পরিবারকে ছিবড়ে করে ছাড়ে।

কিন্তু তরুণ ব্যানার্জি কি আজেবাজে ডাক্তারের কাছে যাবে? নিজের একমাত্র শ্যালককে নিয়ে? তা ছাড়া সোহিনী নিজেও তো দেখেছে স্ক্যান রিপোর্ট। গোলমাল তো একটা রয়েছেই।

কী বিচ্ছিরি দোলাচল! অদৃশ্য এক তুলাদণ্ডে যেন ওজন হচ্ছে সত্যি-মিথ্যের শঙ্কা। সংকটের মুহূর্তে তুলাদণ্ডও বুঝি অসহায়। কোন দিকে যে ঝুঁকবে ভেবে পায় না।

সোহিনীর এখন কী যে করা উচিত? থই না পেয়ে ব্যাগ থেকে মোবাইল হাতে তুলেছে। অশান্ত আঙুল খুঁজছে অনুপমকে। সুইচ্ড অফ। ছ’টা বেজে গেল, এখনও চলছে সেমিনার? কিন্তু একজন কাউকে তো বলা দরকার। একা একা দুশ্চিন্তার বোঝা টানা বড় দুঃসহ। দাদাকে ফোন করবে? নাহ্, যা নার্ভাস টাইপ, হিতে বিপরীত হতে পারে। সুকন্যার বর ডাক্তার। গায়নোকলজিস্ট। তবু তার মতামত তো নেওয়াই যায়। কিন্তু আবার সেই বন্ধুকে সব খুলে বলো, হাজার প্রশ্নের উত্তর দাও…।

ভার ভার মাথায় আবাসনের গেটে ট্যাক্সি ছাড়ল সোহিনী। ফ্ল্যাটে ঢুকেই স্নায়ুতে জবরদস্ত ঝাঁকুনি। দিব্যি ফুর্তির হাট বসেছে লিভিংহলে। টিভির মনে টিভি চলছে গাঁকগাঁক, আর এদিকে বাপ-ছেলে লুডো খেলায় মত্ত। শাশুড়ি ঠাকরুনও গদগদ মুখে নাতির পাশটিতে আসীন। উপভোগ করছেন বাপ-ছেলের দ্বৈরথ।

পলকের জন্য সোহিনী বিবশ। দ্যাখো কাণ্ড! যার অসুখ তার বিন্দুমাত্র বিকার নেই! তার মাতৃদেবীও যথেষ্ট প্রফুল্ল! আর ছেলে তো খুশিতে চনমন! আর যে এই সংসার থেকে এক পা উঠিয়ে নিয়েছে, সেই কিনা ভেবে ভেবে আকুল!

পাপানই দরজা খুলেছিল। ফের গিয়ে বসেছে সোফায়। উল্লসিত স্বরে বলল, দেখে যাও মা, দেখে যাও। বাবার তিনটে রেড গুটি এখনও ঘরে।

তৎক্ষণাৎ ভাস্করের লঘু ধমক, অত তিড়িংবিড়িং লাফাস না। খেলার এখনও ঢের বাকি। ঘর থেকে বেরোলেই তোর একটা পাকা গুটি কপাং খাব।

আগে বেরোও তো।

এই তো, ছক্কা পড়ল বলে।

চিটিং করবে না কিন্তু।

অ্যাই, আমি কখনও চোট্টামি করি? ভাস্কর চ্যাটার্জি অলওয়েজ ফেয়ার গেমে বিশ্বাসী। ঠিক কি না, সোহিনী?

সোহিনীর মুখখানা আরও গোমড়া হল। ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা জলের বোতল নিয়ে খেল এক ঢোক। ঘরে যেতে যেতে ছেলেকে বলল, পড়তে কখন বসা হবে?

আর একটা গেম, মা। বাবাকে মোট তিনবার হারিয়ে….

না। এই দানটা খেলেই ওঠো।

ওমনি বাপ-ছেলেতে চোখে চোখে ইশারা। ভাস্কর তড়িঘড়ি বলল, আজ তোমার রেস্ট। আমিই হোমটাস্ক করিয়ে দেব।

এধরনের আহ্লাদি কথায় সোহিনীর মাথা গরম হয়ে ওঠে। কস্মিনকালে যে ছেলের লেখাপড়ার খোঁজ রাখে না, হঠাৎ হঠাৎ তার দায়িত্বশীল পিতা সাজার শখ যথেষ্ট পিত্তি জ্বালানো। কিন্তু এই মুহূর্তে রাগ দেখানো সোহিনীর সাজে কি?

বাড়তি কথায় না গিয়ে সোহিনী ঘরে এসে বিছানায় বসল। প্রায় তার পিছন পিছন বনানীও দরজায়, চা খাবে তো?

সোহিনী দায়সারা ভাবে বলল, করতে পারেন। না করলেও হয়।

না না, জল বসিয়েছি। বাবুনও চা-চা করছিল। একটু থেমে বনানী ফের বলল, সঙ্গে মোহনভোগ দিই? বাবুন খেতে চাইছিল বলে বিকেলে বানিয়েছি।

অতি সাধারণ ঘটনা। ছেলের বাসনা জেগেছে, মা তা পূরণ করেছে— এমনটা তো এ-বাড়িতে হরবখতই ঘটে, তবু সোহিনীর আজ কেমন কানে লাগল। কানে? নাকি আরও ভেতরে কোথাও? এক দিকে সুনামি ধেয়ে আসছে নিঃশব্দে, অন্য দিকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু ছোট্ট পৃথিবীটি সুছন্দে বহমান—দুটো দৃশ্য একই সঙ্গে বোধের মধ্যে আনা সত্যিই ভারী কঠিন।

সোহিনী এই সুখী সুখী পরিবেশের শরিক নয়। হওয়ার ইচ্ছেও নেই। তবু বলে ফেলল, দিন অল্প করে।

শুনেই গেল না বনানী, দাঁড়িয়ে আছে। লাগোয়া বাথরুমে ঢুকতে গিয়েও সোহিনী ঘুরে তাকাল, আর কিছু বলবেন?

বাবুনের নাকি আবার একটা টেস্ট হবে?

সোহিনীর চোখে বিস্ময়, কে বলল?

একটু আগে তরুণ ফোন করেছিল। এক্স-রে দেখে ডাক্তার নাকি…। কী টেস্ট তুমি জানো কিছু?

না তো। ফস্ করে বলে দিয়ে সোহিনী ঈষৎ তটস্থ। বনানীর একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকাটা সহ্য হচ্ছে না। ভাস্করের জামাইবাবুটি তো আজব ব্যক্তি! সোহিনীকে বারবার নিষেধ করে নিজেই পুটুস ফোন ঝেড়ে দিয়েছে! সবই করে তরুণদা, কিন্তু সবেতেই যেন বেশি সর্দারি! বাথরুমের দরজা বন্ধ করতে করতে সোহিনী বলল, দেখছি। বেরিয়ে ফোন করছি তরুণদাকে।

ছোট্ট একটা স্নানে বুঝি খানিক সুস্থিত হল দেহমন। টেবিলে বসে চা-জলখাবার খেল সোহিনী। ভাস্কর সত্যি সত্যি পড়াচ্ছে ছেলেকে। দেখার প্রয়োজন নেই, শোনা যায় দিব্যি। যত না বোঝায় ভাস্কর, তার চেয়ে চেঁচায় বেশি। মাঝে মাঝে তার বিদঘুটে উপমায় ছেলে হাসছে খিলখিল। পাল্লা দিয়ে বাবারও পিলে চমকানো হাসি।

এই লোকের নাকি মারণব্যাধি? বিশ্বাস হয় না, সোহিনীর বিশ্বাস হয় না।

টিভির সামনে গিয়ে বসল সোহিনী। একটা-দুটো হিন্দি মেগা সিরিয়াল দেখে মাঝেমধ্যে, বুঝে নেয়, কাহিনি কতটা এগোল। সিরিয়াল তো জীবনের মতো দ্রুত ধাবমান নয়, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়েই চলে। হপ্তাখানেক বাদে দেখতে বসলেও খুব একটা অসুবিধে হয় না।

আজ অবশ্য সোহিনীর সামনে শুধুই চলমান ছবি। চোখ দেখছে, মগজ ভাবছে অন্য কথা। যদি সত্যিই ভাস্করের অসুখটা হয়ে থাকে, সোহিনীর কী হবে? নিশ্চয়ই সে ভাস্করকে ছেড়ে পালাতে পারবে না। পালানো যায়ও না। এত স্বপ্ন, এত বাসনা, এত আকাঙক্ষা, সব কিছুরই কি তবে অপমৃত্যু ঘটবে? অনুপম দূরে দূরেই থাকবে চিরকাল?

আশ্চর্য, অনুপম কেন এখনও ফোন করল না? সোহিনীর বিফল আহ্বানের বারতা পেয়েও? সঙ্গে সঙ্গেই অবশ্য মনে পড়েছে, মোবাইল তো ব্যাগে! বাজলেও তো কানে আসবে না।

উঠে ফোনটা আনার কথা ভাবছিল সোহিনী, পাশে ভাস্কর। সেন্টারটেবিলে পা তুলে দিয়ে আপন মনে বলল, বাচ্চাদের পড়ানো খুব ঝঞ্ঝাটের কাজ। আমি আর ওতে নেই।

বলব না, বলব না করেও সোহিনীর মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, এক দিনেই দম শেষ?

বলতে পারো। সত্যি, বেশি স্ট্রেন নিতে পারছি না।

কেন, বেশ তো খেলছিলে, হাসছিলে…

তখন অনেক বেটার ছিলাম। ইনফ্যাক্ট, আজ সারাদিনই ভাল আছি। এই এখন আবার মাথা টিপটিপ শুরু হল।

বাড়তে দিয়ো না। ওষুধটা খেয়ে নাও। সোহিনী আড়ে তাকাল, তরুণদা তোমায় ফোনে কী বলেছে?

হ্যাঁ, লাঙ্‌সে নাকি জল জমেছে। শালা কী করে জমল? ভাস্কর ফ্যাকাশে হাসল, শরীরটা আমার একদম পচে গেছে, বুঝলে। এদিকে ব্রঙ্কিয়াল প্যাচ, ওদিকে ব্রেনে গড়বড়…

সোহিনী চুপ। ভাস্কর নিজেই আবার বলল, এখন আবার লাং-এর রস টেস্ট করানো…কোনও মানে হয়?

যা করাতে হবে, তা করাতেই হবে। সোহিনীর স্বর সতর্ক, এত মানে খুঁজলে চলে না।

আমার আর ইচ্ছে করছে না। শুয়ে-বসে থেকে শরীরটাও কমজোরি মেরে যাচ্ছে…

সোহিনী উঠে দাঁড়াল। ভাস্করের সঙ্গে বেশি কথোপকথন এখন নিরাপদ নয়। কখন মুখ ফসকে কী বেরিয়ে যায় তার ঠিক আছে? পাপানকে খাওয়াচ্ছে বনানী, সেদিকে একবার তাকিয়ে সটান ঘরে। ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে মোবাইলখানা নিয়ে দেখল মিস্ড কল আছে একটা। অনুপমের নয়, বৈশাখীর।

দেখেই কেমন এক অস্বচ্ছন্দ অনুভূতি। তার উকিল বন্ধুটি কলকাতায় ফিরেছে তা হলে? সৌজন্যের খাতিরেও তো সোহিনীর তাকে ফিরতি-ফোন লাগানো উচিত। কিন্তু সে বলবেটা কী?

খানিক দোনামোনা করে বৈশাখীর নম্বরটা টিপল সোহিনী। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ওপারে বৈশাখীর গলা, কী রে, কোথায় থাকিস? ঘণ্টি বেজে যায়?

এই একটু…। ফিরলি কবে?

পরশু। হঠাৎ এখন চেম্বারে বসে খেয়াল হল, তোকে তো কল করা হয়নি!…তুই শনিবার আসছিস তো? তোর জন্য ইভনিংটা কিন্তু ফ্রি রাখছি।

সোহিনী আমতা আমতা করে বলল, এখন আমার একটু অসুবিধে হয়ে যাচ্ছে রে।

অ। বরের সঙ্গে বুঝি মিটমাট হয়ে গেল?

না, ঠিক তা নয়…

বুঝেছি। এখনও বলে উঠতে পারিসনি, তাই তো?

হ্যাঁ।…অ্যাকচুয়ালি ও এখন একটু অসুস্থ…

সো হোয়াট? শরীর থাকলেই খারাপ হবে। তার জন্য তুই ফালতু ডিলে করবি কেন?

সোহিনী দ্বিধায় পড়ে গেল। ভাস্করের অসুখটার কথা বলে দেবে বৈশাখীকে? কিন্তু রোগটা যদি না হয়ে থাকে…।

ফের বৈশাখীর স্বর বাজছে, কী ব্যাপার বল তো? তুই নিজেই এসে বললি, বরের সঙ্গে আর এক মুহূর্তও, টিকতে পারছিস না… তোর লাইফ হেল করে ছাড়ছে…!

সোহিনী এবারও চুপ। কথা খুঁজে পাচ্ছিল না। কথা হাতড়াচ্ছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *