০৫. বর্ষার ঝোরার মতো

মঙ্গলা। বর্ষার ঝোরার মতো হঠাৎ যেন বেগে ঢল নামল। বুধুয়া, করমা আর দুধি সকলের মুখগুলো একে একে চোখের সামনে ভেসে উঠল। আর অন্ধ বুড়ি মা। খড়িবাড়ির ডাক্তার বলেছিল মায়ের চোখে ছানি পড়েছে, কাটাতে হবে। চোখের ছানি কী জিনিস, তা আবার কাটানো যায়, এ কথা মা কখনও বিশ্বাস করেনি। রুহিতনের টাকার জোগাড়ও ছিল না। মেয়েটার নাম দুধি রাখা হয়েছিল কারণ মেয়েটা বাপের রং পেয়েছিল। বাপ পেয়েছিল তার মায়ের গায়ের রং। পোশপত্ কুরমি চা বাগানের গজেন সাঁওতালের মেয়ে গঙ্গাকে বিয়ে করেছিল।

এটা একটা ব্যতিক্রম। কুরমির ছেলের সঙ্গে, সাঁওতাল মেয়ের বিয়ে। কিন্তু জায়গাটা ধলভূম বা মানভূমগড় না, সাঁওতাল পরগনাও না। পাহাড়ের নীচে, তরাইয়ের চা বাগান আর কৃষি জোতের অঞ্চল। সেখানে সমাজ সামাজিকতার চেহারা কিছু আলাদা, জাতিগত বৈষম্য অনেক কম। তা ছাড়া গজেন সাঁওতালের মেয়ে গঙ্গাকে, পশুপতি কুরমি, বলতে গেলে হরণ করেছিল। এমনি এমনি তো আর হরণ হয় না। গাই বাছুরে ভাব থাকলে বনে গিয়ে দুধ দেয়। বিয়ের আগে বাবার সঙ্গে মায়ের সেই রকম ভাব ছিল।

রুহিতনের ঠাকুরদা তখনও বেঁচে। তখনও পশুপতি ছিল, নকশালবাড়ি পূর্বাঞ্চল চা বাগানের মজুর। মা বাবার ব্যাপার নিয়ে বস্তিতে বস্তিতে খুব হইচই গণ্ডগোল হয়েছিল। মায়ের কাছে সেই সব গল্প শুনে, রুহিতনের মজাই লাগত। তার বাবা নাকি ঠিক করেছিল, বিয়ে না দিলে, সে মাকে নিয়ে চলে যাবে, মিরিক থানার উঁচুতে, গয়াবাড়ি বা অন্য কোনও চা বাগানে। শেষ পর্যন্ত তা করতে হয়নি। রুহিতনের ঠাকুরদা ছিল একজন মুখ্য আর মান্য ব্যক্তি। সাঁওতাল মুণ্ডা ওঁরাও মাহাতো সকলের সঙ্গেই ছিল তার মেলামেশা, ভাব ভালবাসা। একটা আপস রফা করা গিয়েছিল। গজেন সাঁওতালকে কন্যাপণ কিছু বেশি দিতে হয়েছিল। প্রায় অবিশ্বাস্য হলেও, দুটো সিকিমি মোরগ দিতে হয়েছিল। চা বাগানের সাহেব আর বড় জোতদার মহাজনের বাড়ি ছাড়া কেউ সিকিমি মোরগ কেনবার কথা ভাবতেই পারে না। অবিশ্যি মারোয়াড়ি মহাজনদের কথা আলাদা। তারা মাছ পর্যন্ত ছোঁয় না।

পশুপতি কুরমির আমলে, সবথেকে বড় ব্যতিক্রম চা বাগান ত্যাগ করা। জমি জিরেত চাষবাসের দিকে তার মন টেনেছিল। এটা একজন কুরমির আদিম পিপাসা। নিজের একটা ঘর, এক জোড়া বলদ লাঙ্গল, আর কিছু চাষের জমি। ঠাকুরদারও মনে এই আকাঙ্ক্ষা ছিল। পারেনি। উড়িষ্যা বিহারের সীমান্তে ফিরে গিয়েও, সে সম্ভাবনা আর ছিল না।

কিন্তু যেখানে চৌধুরী, জোতদার, মণ্ডল আর টিক্কাদাররা সমস্ত রকমের জমির ওপর দখল রাখে, সেখানে পোপত্ কুরমির মতো একজন সামান্য মজুর কোন সাহসে জমির স্বপ্ন দেখেছিল? কত টাকা সে জমিয়েছিল? একজন চৌধুরী হাঁ করলেই, বাবাকে গিলে খেয়ে ফেলতে পারত। চৌধুরীরা হল সব বাঙালি অফিসার, যারা জমির ভাগ বাটোয়ারা করে, খাজনা আদায় করে, আর সরকারের প্রতিনিধি হিসাবে সকলের বিচার ও শাসন করে। এক সময়ে ‘চৌধুরী’ নাম ছিল তরাই তাঞ্চলের পাগলা হাতির মতো হৃদকম্প। জোতদার আর টিকাদারদের হাতের লোক মণ্ডল, যারা আধিয়ারদের, কুকুরের গায়ে লেগে থাকা, রক্ত চোষা এঁটুলির থেকেও খারাপ।।

রুহিতন ভেবে অবাক হয়, কত টাকা জমিয়েছিল তার বাবা? আসলে পোশপত্ কুরমি একজন চৌধুরীর নেকনজরে পড়ে গিয়েছিল। না, তার বাবা একজন সাধারণ টিক্কাদারের অধিকারও জমিতে পায়নি। পেয়েছিল শুধু উঠ্বন্দি প্রজাস্বত্ব, যাদের বলে দার টিক্কাদার, অথবা কোরফা রায়ত। তারা বাস করে, চাষ করে, কিন্তু জমির ওপরে কখনওই কোনও অধিকার জন্মায় না। ওঠ বললেই ওঠো, যাও বললেই ভাগো।

তবু বাবার সে কী খুশ মেজাজ। লোকটা কিছুকাল পচাই খেতে পর্যন্ত ভুলে গিয়েছিল। নকশালবাড়ির পুবের চা বাগান থেকে, রাতারাতি চলে এসেছিল টুকরিয়াঝাড় জঙ্গলের দক্ষিণে, রেললাইনের পুব পারে। চা বাগানের পাঁচ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে। রামধন মৌজার নীচে, ময়নাগুড়ি মৌজার কিছু ওপরে। রেল লাইন সরে গিয়েছে পশ্চিমে, নেমেছে দক্ষিণে গলগলিয়া দিয়ে ঢুকেছে পূর্ণিয়া জেলায়। উত্তরে তাকালে মিরিকের বন পাহাড় দেখা যায়। পুবে আধ মাইলের মধ্যে মেচি নদী, নেপালের সীমানা। ওপারে মোরাং কারিয়াঝাড়। আরও দক্ষিণে ভদ্রপুর।

কিন্তু মাটি? পোশপত কুরমি চৌধুরী সাহেবের কৃপায় যে-জমি খণ্ড পেয়েছিল, তা ছিল জোতদার মোহন ছেত্রীর জোতের সীমানার মধ্যেই। সেই জমি খণ্ডে, বালি মেশানো সাদা ভাগই বেশি। কালো মাটির ছিটেফোঁটাও ছিল। লাল মাটি সেখানে নেই—যাকে বলে শুখা ক্ষেত। পাহাড়ে, তরাইয়ে কালো মাটি হল হিরার মতো দামি। সাদা, বালি মেশানো জমিতে সেই অঞ্চলে চুনেরও অভাব। মেচি নদীর পলি তুলে এনে সাদা জমিতে ছড়ানো হয়। তার সঙ্গে গোবরের সার। এ ভাবেই বন্ধ্যা জমিকে ফসল ফলানোর যোগ্য করে নিতে হয়। মকাই কোদো আর কালো মাটিতে হৈমন্তিক ধান। ওর নাম খাঁটি রুপিনি জমি। রোপা গড়ার কাজ যে জমিতে ভাল হয়। কিন্তু সেই ভূমিখণ্ডের গাছপালার মালিক জোতদার। একটা বাঁশঝাড়, তার মালিকও জোতদার।

পোশপত্ কুরমি দমেনি। এক রকম ভূমিহীন আধিয়ার ছাড়া সে কিছুই ছিল না। তবু সে যে কোরফা রায়ত। উঠবন্দি প্রজা। হয়তো তার মনে আশা আর স্বপ্ন ছিল, এক দিন সে রায়তি স্বত্ব পাবে। টিকাদার যাকে বলে। যা সে কোনওকালেই পায়নি। রুহিতন চা বাগানের বালক মজুর থেকে, চাষের কাজে লেগেছিল। মেচি নদী থেকে, বেতের ঝোড়ার বাঁকে, মন মন পলি মাটি ঘেঁটে নিয়ে আসত। ঝোরা আর আশপাশের সরু নালি স্রোতস্বিনীর জল ধরে রাখত, চার পাশে আল বেঁধে। পোশপত্ কুরমির ব্যাটা সে, বাবার তৃষ্ণাটা তার রক্তেও লেগেছিল। সেই তৃষ্ণাতেই সে যেন গায়ে গতরে সাজোয়ান হয়ে উঠেছিল। আর মাঠের শস্যের দিকে তাকিয়ে, মায়ের মনে হয়েছিল, রুহিতনের একটা বিয়ের দরকার। রাজবংশিদের মেয়ে টেপড়ির সঙ্গেও যে সেই সময় তার আঁশনাইয়ের বাড়াবাড়ি চলছিল। তারপরেই মঙ্গলা এল।…

সব মুখগুলো মনে পড়ে গেল, আর একসঙ্গে অনেকগুলো গলার স্বর হাসি কান্না। বুকের ভিতর থেকে পাক খেয়ে নামা ঝোরার ঢল সামলানো গেল না। রুহিতনের চোখ তখনও ডান দিকের পিছনে ফেরানো। কলকাতার সবুজ একটা ফালি, বাঁক খাওয়া নদীর মতো। অল্প দু-চারটি লোক। বেড়াচ্ছে না দৌড়চ্ছে বোঝা যায় না। দূরে দূরে আকাশের গায়ে ঠেকানো বাড়ি। আসলে মিরিকের নীল বন-তরাইয়ের ছবি। রুহিতন নিজে যেন এই প্রথম শুনল তার গলা সত্যি ভাঙা আর ফ্যাসফেসে। সে বলে উঠল, ‘চুনীলাল মৌজার খবর আমি কিছুই পাই না। ওদের কোনও খবর আমাকে দেওয়া হয় না। কেমন আছে সব?’

অফিসার বোধ হয় পিছন ফিরে রুহিতনের দিকেই তাকাতে যাচ্ছিল। লোকটার মাথা যেন তার মাথার পিছনে ঠেকে গেল। এক মুহূর্তের জন্য, আর লোকটি যেন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘চুনীলাল? ওহ, তোমার গ্রাম আর বাড়ির কথা বলছ?’ বলতে বলতেই তার মাথাটা সরে গেল।

রুহিতনও মুখ ফিরিয়ে নিল কিন্তু তার শীতে কাঁটা দেওয়া শরীরটা যেন উৎকর্ণ হয়ে রইল। একটু পরে সামনের আসন থেকে অফিসারের স্বর শোনা গেল। য়েন খুব সহজভাবেই বলল, এতক্ষণ যেভাবে সে বলে এসেছে, ‘সে সব খবর আমি কিছুই জানি না।’

রুহিতনের দাঁতে দাঁত চেপে বসল। চোখ দুটো কুঁচকে বুজে গেল। রাগে না, একটা অন্ধ যন্ত্রণায়। আত্মবিদ্বেষের যন্ত্রণাটা অন্ধের মতো, কোনও দিকেই তা নিষ্কৃতির পথ দেখতে পায় না। অফিসারটি ঠিকই বলেছিল বোধ হয়, রুহিতনের সঙ্গে তার কোথায় যেন একটা ব্যাপার রয়ে গিয়েছে। কিন্তু সে জন্যই এই চারবারের দেখা না। সাত বছর পরে আবার রুহিতনকে নিয়ে যাওয়ার ভার সেই জন্য তার ওপর পড়েনি। এখন রুহিতনের মনে হচ্ছে এ লোকটা বরাবর তার কাছে জিতে গিয়েছে। সেই জিতে যাওয়াটাই বরাবরের ব্যাপার। প্রথমবার দশ বছর আগে লোকটিকে যখন সে খড়িবাড়ি থানার কাছে দেখেছিল, তখন লোকটি তাকে চিনত না। তার দিকে ফিরে তাকিয়েও দেখেনি। দ্বিতীয়বার সে ছিল পরাজিত রক্তাক্ত পর্যুদন্ত। তৃতীয়বার যখন তার ওপর পুলিশ ক্যাম্পে প্রচণ্ড অত্যাচার চলছিল, সে যখন সাময়িকভাবে অসহ্য যন্ত্রণায় এলিয়ে পড়েছিল তখন এই লোকটি তাকে একটা সিগারেট খাইয়েছিল। কিন্তু তার বদলে কিছু আদায় চায়নি। তারপরে এখন—এই তিন দিন পরের রক্তহীন কাঁচা মাংস-রং ভোরে তার দুর্বলতম মুহুর্তে লোকটা যেন কযে একটা লাথি মারল রুহিতন কুরমির মুখে। মুখে না বুকে।

ঠিক করেছে, লোকটা কোথাও একটু ভুল করেনি। রুহিতন কুরমি তার নাম, সে এখন তা বুঝতে পারছে। লোকটা যা ঠিক তা-ই আছে। রুহিতন তা থাকতে পারল না। লোকটা তাকে এই তিন দিনে অনেক কথা বলেছে। অনেক কথা জিজ্ঞেস করেছে। হেসেছে। রুহিতনের কোনও প্রতিক্রিয়া হয়নি। সে যেমন তেমনি ছিল। কারণ সে-ই জানত তাদের দুজনের সম্পর্ক আলাদা। জানত অথচ লোকটার এত কথার মধ্যেও যেখানে তার মুখ বন্ধ রাখার কথা সেখানে ঠিক মুখ বন্ধ রেখেছে। আর রুহিতন না খোলবার জায়গায় মুখ খুলেছে। পুরনো এক স্মৃতি আচমকাই তার বুকে বর্ষার ঝোরা নামিয়ে দিল। থামিয়ে রাখা গেল না।

‘জীবনে একবার অন্তত তুমি কলকাতায় এসেছ।’অফিসারের ভেসে আসা স্বরে নিশ্চয়তা, ‘ট্রাম আর রাস্তাঘাট দেখে বুঝতেই পারছ আমরা কলকাতার মধ্যে ঢুকে পড়েছি…।’

অফিসার আরও যেন কী সব বলে যেতে লাগল। রুহিতনের কানে কিছুই আর ঢুকছে না। নিজের প্রতি জাতক্রোধের যন্ত্রণা থেকে কলকাতার সেই পুরনো স্মৃতি আবার তার মনে ফিরে এল। সভার পরদিন সকালে খেলু চৌধুরীর নেতৃত্বে তারা আর এক বার মিছিল করে কলকাতার ওপর দিয়ে গিয়েছিল। মিছিল করে কলকাতার বাইরে কোথায় একটা রেল স্টেশনে গিয়ে উঠেছিল। দিবা বাগচির সঙ্গে সেখানে দেখা হয়েছিল। দিবা বাগচিকে তাদের থেকেও খারাপ দেখাচ্ছিল। তার মুখটা দেখাচ্ছিল কঙ্কালের মতো রুগণ অসুখী আর রাগী। কিন্তু ভাদুয়া মুণ্ডা বলে উঠেছিল, ‘এই পয়লা আর এই আখেরি। শালা কলকাতায় আর না।’

দিবা বাগচির মতো লোক মুখ নিচু করেছিল। একটা কথা বলেনি। দুপুরের দিকে একটা রেলগাড়িতে সবাইকে তোলা হয়েছিল। গাড়িতে ওঠবার সময় আর একবার মঙ্গলার কথা মনে পড়েছিল। তার পকেটে তখনও কিছু পয়সা। থাকবার কথা না। কারোরই টাকা পয়সা নিয়ে আসার কথা ছিল না। তবু রুহিতন সামান্য কিছু পয়সা সঙ্গে রেখেছিল। আসবার আগে মঙ্গলা তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে মুখ টিপে হেসেছিল। রুহিতনের মনে কেমন একটা খটকা লেগেছিল। মঙ্গলা তো যখন তখন এ রকম হাসে না। সে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কী ?’

মঙ্গলা তো সহজে কথা বলে না। বুধুয়া তখন পেটে। ঠিক যেন একটা লক্ষ্মীমন্ত গাভীন নীল গাই। কেবল মাথা নেড়ে জানিয়েছিল, ‘কিছু না।’ কিছু না? চাষ আবাদ করে বলে সে কি মেয়েদের কিছুই বোঝে না? হাসি আর তাকানো দেখলেই তো বোঝা যায়। তার সঙ্গে যদি আবার নাকের পাটা কাঁপে। রুহিতন বলেছিল, ‘বল না, শুনতে দোষ কী?’

মঙ্গলা বলেছিল, ‘কলকাতা বলে কথা। সাবধানে থেকো।’

এই কথা বলবার জন্য, চোখমুখের ও রকম ভাব-ভঙ্গি? রুহিতনের ভুরু কুঁচকে উঠেছিল। মঙ্গলা হেসে উঠে বলেছিল, বলছি, কলকাতায় কি খালি লড়াই করতে যাচ্ছ?’

রুহিতন কেমন অপ্রস্তুত হয়ে বলেছিল ‘লড়াই মানে, কী আর! সারা দেশের কৃষি মজুর কলকাতার মাঠে জমা হয়ে সরকারের কানের তুলো খুলে দিয়ে আসব। ওরা যে কানে শুনতে পায় না। মস্ত ব্যাপার। গোটা দেশের কৃষি মজুর জমায়েত হবে, সকলের সাথে সকলের চেনাজানা হবে।’

কথাগুলো শুনেও যেন মঙ্গলার কালো গহীন চোখের কৌতূহল মুছে যায়নি। যেন লজ্জা পেয়ে চোখের পাতা নামিয়ে তেমনি মুখ টিপে হেসেছিল, তারপরে বলেছিল, ‘কলকাতায় যাচ্ছ, একটা কত বড় কথা! এ তো আর বিজনবাড়ি সফর মেলা না, না কি অ্যাঁ? অধিকারী বাবার মাঘ মেলাও না, অ্যাঁ? তাই বলছি মায়ের জন্য কিছু নিয়ে এসো। কলকাতার কোনও চিহ্ন।’ বলতে বলতে কোমরে জড়ানো শাড়ির আঁচলের গিট খুলে এক টুকরো কাগজ আর কিছু খুচরো পয়সা রুহিতনের দিকে বাড়িয়ে দিয়েছিল। মঙ্গলার পক্ষে কাজটা খুব সহজ ছিল না। সেই কয়েকটি কথা বলতে আর আঁচল খুলতে খুলতেই নাকে চিবুকে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছিল। ওর তখন অন্য এক রূপের খোলতাই। গাভীন হলেই ওদের আর একটা রূপ খোলে। তার সঙ্গে করম পরবের কোনও যোগ নেই। যে পরবে বুড়ো বুড়ির প্রবেশ নিষেধ। যুবা যুবী করম গাছের ডাল সরিয়ে দিয়ে নিজেদের ধর্মকর্ম করে। সেটাও মেয়েদের গাভীন করারই ধর্মকর্ম। মঙ্গলার চোখের কোলগুলো বসা, একটা ক্লান্তি সারা শরীর জুড়ে। কিন্তু তা কোনও রোগ ব্যামো না, এক রকম রূপ। দেখলে চোখ জুড়ায়, মায়া লাগে। চোখ জুড়ানোটাও এক রকমের মায়া।

রুহিতন অবাক চোখে ভুরু কুঁচকে পয়সাগুলোর দিকে তাকিয়েছিল। এক টুকরো কাগজটা আসলে পাঁচ টাকার একটা নোট। ময়লা দূর্বা ঘাসের একটা গুটলির মতো, যেন রাস্তা থেকে কুড়িয়ে আনা। রুহিতনের অবাক চোখের দিকে তাকিয়ে মঙ্গলা বোধ হয় অস্বস্তি বোধ করেছিল। একটু বা অপ্রস্তুত। বলেছিল, অনেক দিন আগের জমানো, বাপের ঘরে ছিলাম তখন। নাসির মিয়া মাস্টেরের জোতে তখন কাজ করতাম।’

রুহিতন তৎক্ষণাৎ হেসে ওঠেনি। বারে বারে নিজের হাতে নেওয়া পয়সাগুলো আর মঙ্গলার মুখের দিকে দেখেছিল। কিন্তু সে কি মেয়েদের কথার আড় বোঝে না? হাসি চাহনি—চেনে না? মায়ের দোহাই, কলকাতার চিহ্ন, কথার ঝোরা কোন ফাঁক দিয়ে কুলুকুলু বহে, সে কি একেবারেই টের পায় না? সে বলেছিল, ‘কলকাতার কী চিহ্ন নিয়ে আসব? মায়ের জন্য কি নাসার ফুল আনব, না রেশমি চুড়ি?’

মঙ্গলা যেন অবাক লজ্জায় ব্যস্ত হয়ে বলে উঠেছিল, ‘এই দেখ, লোকটা কী বলে!’

রুহিতন এত সহজে ছাড়বার লোক ছিল না। মঙ্গলা সামনে থেকে চলে যাবার চেষ্টা করতেই সে হাত টেনে ধরেছিল। বলেছিল, ‘লোকটা আর কী বা বলবে? সে কখনও কলকাতা যায়নি। কলকাতার কী চিহ্ন আনতে হবে, সেটা বলে দে।’

মঙ্গলা রুহিতনের গায়ে লেপটে বলেছিল, ‘তা আমি জানি না।’

রুহিতন তা জানত। মঙ্গলার তা ছাড়া কোনও জবাব থাকতে পারে না। জবাব জানবার কোনও দরকারও ছিল না। সে মাথা নুইয়ে গভীর নিশ্বাস টেনে, মঙ্গলাকে আঘ্রাণ করেছিল। মঙ্গলা তার মাথায় পিঠে হাত রেখে, ভাঙা নিচু স্বরে বলেছিল, ‘তিস্তা বুড়ি মায়ের সুনজর লাগে।’

রুহিতন কলকাতায় কিছুই কেনেনি। সকালবেলা মিছিলের আগে ভাদুয়া মুণ্ডা সকলের কাছে কুড়ি-পঁচিশটা করে পয়সা চেয়েছিল। ফেরবার পথে কেউ তাদের খাবার দেওয়া দূরের কথা, ডেকেও জিজ্ঞেস করেনি। সভার শেষে, পরের দিন সকালে, কলকাতার চেহারাটাই যেন বদলিয়ে গিয়েছিল। ভাদুয়া মুণ্ডা আর খেলু চৌধুরী সকলের জন্যই কিছু খাবার জোগাড় করেছিল। আর ব্যস্ত কলকাতা তাদের দিকে নির্বিকার চোখে তাকিয়েছিল। কলকাতার সে কী চেহারা! যেন গাড়ির গতি আর গর্জন চার দিক থেকে গিলতে আসছিল। খেলু চৌধুরীর নেতৃত্বে বাইরে একটা স্টেশন থেকে দুপুর নাগাদ তারা একটি রেলে উঠেছিল। লোকজনে ঠাসাঠাসি কামরা। কেউ কেউ রুহিতনদের ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে চেয়েছিল। চড়-চাপড়ও মারেনি এমন না। কিন্তু তারা মাথা ঠাণ্ডা রেখেছিল। ফিরে যেতে পারার জন্যই তারা তখন আকুল হয়ে উঠেছিল। তাদের সেই নীল বনানীর দেশে, পাহাড় যেখানে আকাশের গায়ে ঠেস দিয়ে থাকে। ঝোরার ঠাণ্ডা মিষ্টি জল যেখানে কখনওই প্রায় মহাজনি চশমখোরি অকৃপণ না। সবসময়েই ঘাস গজায় কিছু বেশি, নিড়ানের খাটুনি লেগেই থাকে। তা থাকুক। ওখানকার মাটির ধর্ম এই রকম। পাহাড়ি ঢল নামলে, সংসার টলে যায়। মানুষ জানোয়ার একসঙ্গে বাঁচবার চেষ্টা করে। ঢল গড়িয়ে যাবার পরে, নদীর উঁচু দুই পাড়ে সবুজ ফসলেরও ঢল নামে তা সে ধন যারই হোক। নিজের জায়গা বলে একটা কথা আছে।

রেল গাড়িতেই এক সময় দিবা বাগচি রুহিতনের পাশে এসে বসেছিল। কাশির কামাই নেই, ওদিকে বিড়ি সিগারেটের কামাই নেই। তাকে অনেক দিনের রুগির মতো দেখাচ্ছিল। রুহিতন মনে মনে গুটিয়ে গিয়েছিল। কলকাতার অভিযান সম্পর্কে কোনও আলাপে তার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু দিবা বাগচি আলাপ করেনি। বরং বলেছিল, ‘তোমাকে কিছু বলতে হবে না রুহিতন। আমি সব বুঝি। সীসায় ঘষা দিলে জেল্লা দেয়, কিন্তু বাজে না। কী, ঠিক না?’

রুহিতনের মনের মতো হয়েছিল কথাটা। সে হেসে বলেছিল, “ঠিক।’

দিবা বাগচি যেন কী ভাবছিল। ঘন ঘন সিগারেটে টান দিচ্ছিল, আর থেকে থেকে কাশছিল। কাশি শুনলে ভয় লাগত। ওই তো পাখির মতো বুক। বুকের খাঁচাটা ভেঙে যাবে না তো! অনেকক্ষণ পরে বলেছিল, কিন্তু এই রকম ভাবে চিরকাল যাবে না।এ সব কেবল বাজার গরম রাখা, বুঝলে রুহিতন। কেন, তাও বুঝি। তবে বুঝে কোনও লাভ নাই।’ বলে সিগারেটে টান দিয়ে, নাক মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে, বাঁশির শব্দ তুলে কেশেছিল।

রুহিতন বলেছিল, ‘সিগারেটে একটু থামা দাও। দাও, আমাকে দাও।’ বলে সে নিজেই জ্বলন্ত সিগারেটটা দিবা বাগচির হাত থেকে নিয়ে নিয়েছিল।

দিবা বাগচি মুখে একশো ভাঁজ ফেলে হেসে বলেছিল, ‘ওটা কেন, তোমাকে একটা আলাদা দিচ্ছি।’

‘দরকার নেই।’ রুহিতন দুই আঙুলের মধ্যে সিগারেট নিয়ে মুঠি পাকিয়ে বুড়ো আঙুলের কাছে মুখ রেখে জোরে টান দিয়েছিল।

দিবা বাগচি জিজ্ঞেস করেছিল, ‘বাড়ির জন্যে কিছু কেনাকাটা করলে নাকি?’

‘কেনাকাটা ?’ রুহিতনের বুকের কাছে সিগারেটের ধোঁয়া আটকে গিয়েছিল। রুদ্ধস্বরে বলেছিল, ‘না তো।’

দিবা বাগচি বলেছিল, ‘তাই জিজ্ঞেস করছি। দেখলাম কে কে যেন তেল সাবান চুড়ি ফিতে কিনেছে। তুমি বুঝি পয়সাকড়ি কিছু আনননি?’

‘আনবার কথা না।’ রুহিতন বলেছিল। ‘আসবার সময় বউ এই দিয়ে দিয়েছিল।’ বলে পকেট থেকে সেই পাঁচ টাকার নোট আর পয়সা দেখিয়েছিল।

দিবা বাগচি জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কিছু কিনবে?’

‘না না না।’ রুহিতন মাথা নেড়ে বলেছিল, কলকাতা ছেড়ে চলে এসেছি, আর কিছু কিনব না। বউ কলকাতার একটা চিহ্ন নিয়ে যেতে বলেছিল।’

দিবা বাগচি হেসে বলেছিল, নামেই কলকাতা। শিলিগুড়িতে সব পাওয়া যায়। কেবল দামের যা এক-আধটুকু ফারাক।’

রুহিতন মনে মনে ভেবেছিল, হতে পারে। কপালের টিপ ফোঁটা পায়ের আলতা খড়িবাড়ির দোকান থেকেও কেনা যায়। গড়তলি জলপেশের মেলা থেকে কিনে আনা টিপ আলতার দাম আলাদা। কিংবা যদি অধিকারী বাবার মেলা থেকে কিছু কেনা হয়, তা কি আর যেমন তেমন কেনা? তার দাম আলাদা। মঙ্গলা যাকে বলে ‘চিহ্ন’ এ হল তা-ই। এক এক জায়গার এক একটা চিহ্ন থাকে। পরে দেখলে, সেই সব জায়গার কথা মনে পড়ে যায়। কিন্তু রুহিতন সে কথা দিবা বাগচিকে বলেনি।….

সেই পুরনো দিনের কথাগুলো এখন যেন আরশির বুকে মুখ দেখার মতো মনে পড়ে গেল। আবার এক বার কলকাতার এই লাল-আভা ভোরে, সশস্ত্র রক্ষী বেষ্টিত জিপে, হাতে পায়ে বেড়ি পরা অবস্থায়। যত মনে পড়ছে, যন্ত্রণা তত তীব্র হয়ে উঠছে। মনের দুর্বলতা আর অপমান, এক সঙ্গে বুকের মধ্যে জ্বলছে। রুহিতন কেন অফিসারকে হঠাৎ চুনীলাল মৌজার কথা জিজ্ঞেস করতে গেল? সেই মৌজায় তার ঘর, নকশালবাড়ির পাঁচ মাইল দক্ষিণ-পুবে। যেখানে মঙ্গলা, ছেলেমেয়েরা আর বুড়ি অন্ধ মা আছে। লোকটার কোনও কথারই জবাব সে দেয়নি। তবে কেন এমন একটা কথা জিজ্ঞেস করতে গেল? সাত বছরের মধ্যে যে-খবর কোনও জেলে কেউ কখনও তাকে দেয়নি, সেই খবর তাকে দেবে এই অফিসার!

রুহিতন আজকাল কি দুর্বল হয়ে গিয়েছে? যাবৎকাল থেকে গায়ে এই রকম জ্বর জ্বর ভাব, সেই সময় থেকেই কি তার মনটা দুর্বল হতে আরম্ভ করেছে? কিন্তু কখনও সে তা প্রকাশ করেনি। আজ, এখন কেন করল? সেই যে এক বার কলকাতার জমায়েতে এসেছিল আর ভাঙা মন নিয়ে ফিরে গিয়েছিল, তা জোড়া লেগেছিল বেশ কিছু বছর পরে। দিবা বাগচিই একটা শোলোক নিয়ে এসেছিল, ‘গ্রাম দিয়ে শহর ঘিরতে হবে। শহরকে গ্রামের কবজায় ঘিরতে হবে। কলকাতায় জমায়েত না। দক্ষিণের যাবৎ শহর ঘিরতে ঘিরতে, কলকাতাকেও গ্রাম দিয়ে ঘিরতে হবে।’

রুহিতন সেই থেকে গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার লড়িয়ে। জানকবুল, কিন্তু শত্রুর শেষ রেখো না। রুহিতন রাখেনি। খতম আর ঘেরাও, একনাগাড়ে। সে সেই লোক। তবে কেন সাত বছর পরে বাড়ির কথা মনে হলে মন টাটিয়ে ওঠে? নিজেকে সামলাতে না পেরে, এই অফিসারকে জিজ্ঞেস করতে হয়? সেইজন্যই আজকাল তার গা গরম হয় নাকি? মুখের চেহারা বদলিয়ে যাচ্ছে? কান নাক মোটা হয়ে যাচ্ছে। আর চোখ বুজলেই সেই লালচে মেটে সাপটার রং ভেসে ওঠে। রক্তহীন কাঁচা মাংসের মতো গায়ে যার লাল চাকা চাকা দাগ? হ্যাঁ, তার নিজের গায়েও সেই রকম কতকগুলো দাগ ফুটে উঠেছে।

‘ভোরের এই হাওয়ায় আরাম লাগার কথা।’ অফিসারের স্বর শোনা যাচ্ছে এখনও ‘নেশার মতো ঘুম পেয়ে যায় আরামে আর তোমার শীত লাগছে? এটা তো ঠিক না। তুমি…।’

অথচ চুনীলাল মৌজার কথা লোকটা জানে না স্পষ্ট জানিয়ে দিল। রুহিতনের মাথাটা কষ্টে আর অপমানে বুকের কাছে নুয়ে পড়ল। কম্বলের ঢাকনা খাবার খসে গেল কাঁধের কাছ থেকে। সে পা দুটোকে আরও খানিকটা ছড়িয়ে দেবার চেষ্টা করল। ঘাড়ের পিছনটা সামনের আসনে আরও খানিকটা এলিয়ে দিল। কিন্তু কম্বল ঢাকা পায়ের ওপর হঠাৎ শক্ত কিছুর আঘাত পেয়ে চোখ মেলে তাকাল। ডান দিকের দুই সশস্ত্র রক্ষীর সঙ্গে তার চোখাচোখি হল। ওরাও তার দিকে তাকিয়েছিল। ওদের চোখগুলো অপলক ঠাণ্ডা। জেগে থাকার জন্যই যেন লাল। কিন্তু জ্বলে কেন!

রুহিতন তার কম্বল ঢাকা পায়ের দিকে তাকাল। তার চোখ দুটোও জ্বলে উঠল। সে বাঁ দিকের দুই সশস্ত্র রক্ষীর দিকে দেখল। ওরাও তার দিকে একরকম ভাবেই তাকিয়ে আছে। সে পিঠে চাপ দিয়ে পা দুটো টেনে আনবার চেষ্টা করল। কিন্তু টাল সামলাতে পারল না। কোমরের কাছ থেকে পা জোড়া ডান দিকে খানিকটা এলিয়ে পড়ল। পড়ল রক্ষীদের পায়ের ওপর। পড়তেই ডান দিকের একজন রক্ষী বুটের আঘাতে সোজা করে দিতে চেষ্টা করল।

রুহিতন তাকাল রক্ষীর দিকে। একটা তীব্র যন্ত্রণায় জ্বলছিল সে, তার সঙ্গে অপমানের জ্বালাও ছিল। রুহিতন কুরমি সে। চোখের পলকেই যেন তার পিঠের শিরদাঁড়াটা সোজা হয়ে উঠল। হাতে পায়ে বেড়ি বাঁধা অবস্থায় অনেকটা উঠে সে ডান দিকের রক্ষী দুজনের ওপর ঝাপিয়ে পড়ল। কাঁধ আর মাথা দিয়ে আঘাত করল দুজনকেই।

বাঁ দিকের দুই রক্ষী মুহুর্তে রুহিতনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। সামনের আসন থেকে দুটো রিভলবার উদ্যত হয়ে উঠল রুহিতনকে লক্ষ্য করে। অফিসার ইংরাজিতে বলে উঠলেন, ‘হোয়াটজ হ্যাপেন্ড?’

ডান দিকের দুই রক্ষী তার মধ্যেই রাইফেলের কুঁদোর আঘাতে আর ঘুষি মেরে, রুহিতনকে তার জায়গায় বসিয়ে দিয়েছে। বাঁ দিকের দুই রক্ষী তাকে হাত দিয়ে চেপে ধরেছে। রুহিতনের নাকের ছিদ্র আর ঠোঁটের কষে রক্ত চুইয়ে পড়ছে। কিন্তু সে আর এখন তাকিয়ে নেই। দাঁতে দাঁত চেপে দু চোখ বন্ধ করে রয়েছে। এ রকম অসম্ভব কোনও পরিকল্পনা তার মাথায় ছিল না। তার দুই পায়ের মাঝখানে, দুই বেড়ির বলয়ের সঙ্গে মোটা লোহার ফ্রেমটা মাত্র ছ ইঞ্চি লম্বা। তার এক একটা পা দশ ইঞ্চি থেকে বড়। একটা দম দেওয়া কলের পুতুলের মতোও তার হাঁটবার উপায় নেই। পুরোপুরি সোজা হয়ে দাঁড়ানোও সম্ভব না। পালানো দূরের কথা, রক্ষীদের সঙ্গে সংঘর্ষও দূরের কথা, তাদের সঙ্গে বিবাদের কথাও তার মাথায় কখনও আসেনি। তথাপি কেন সে এমন করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল? সশস্ত্র রক্ষী বা কোনও কোনও ওয়ার্ডারের চরিত্র সে ঝেতে পারে না, কেন ওরা বন্দিদের ওপর এক এক সময় অকারণেই দুর্ব্যবহার করে। কর্তব্য পালনের অতি সন্ত্রস্ততা থেকে কি সবসময়েই ওদের মনে ঘৃণা আর রাগ জমে থাকে? অথচ অন্য সময় হলে, সে হয়তো এ রকম ঝাঁপিয়ে পড়ত না। অত্যাচারের মাত্রা কতখানি উঠতে পারে তার অজানা নেই। রাইফেলধারী অচেনা এই সব রক্ষী, বুট দিয়ে তার পায়ে মেরে সরিয়ে দেবে, এটা তেমন একটা ঘটনাই না। তা ছাড়া তার হাতে যেভাবে ডান্ডাবেড়ি পরানো এ অবস্থায় স্বাভাবিক নড়াচড়া করাও অসম্ভব। হ্যাঁ, জেলের ভাষায় একে ডান্ডাবেড়ি বলা হয়। তবু, তবু কেন সে এমন ভয়ংকরভাবে ক্ষেপে উঠল?

রুহিতন নিজেকে ছাড়া এর জবাব আর কাকে দেবে? জবাব তার চোখের কোণে দুই বিদ্যুৎ অঙ্গারের মতো চিকচিক করে উঠল। অফিসারের প্রশ্নে রক্ষীদের জবাব সে শুনতে পেল, ইসকো ভাগনে কা মতলব হুয়া থা সাব।’

প্রতিবাদ নিরর্থক, রুহিতন জানে। কেন, কাদের কাছেই বা প্রতিবাদ। তার মনে বিন্দুমাত্র ইচ্ছাও জাগছে না। চুনীলাল মৌজার সংবাদ জানবার মতো এ রকম একটা প্রাণঘাতী ভুল সে তার করবে না। হয়তো রক্ষীরা মিথ্যা বলছে না। এ রকম অদ্ভুত ধারণা ওরা করতেও পারে। কারণ সে জানে, ওরা ভাবতেই পারেনি, তার মতো ডান্ডাবেড়ি পরানো অবস্থায় কেউ দাড়িয়ে পড়তে পারে।

অফিসারের স্বাভাবিক সহজ স্বর আর নেই। তার উৎকণ্ঠিত অবাক গলা শোনা গেল, ‘এই হল রুহিতন কুরমি। এমনি এমনি কি আর এই লোককে সবাই তরাইয়ের ভয়ংকর দাঁতাল বলে? কী বুঝলেন মিস্টার নাগ?’

‘ডেঞ্জারাস স্যার। টেরিফিক।’ মিঃ নাগ উচ্চারণ করলেন।

রুহিতন ইংরাজি কথাগুলোর মানে বুঝতে পারল না। দিবাবাবু, বিনোদ রায়, খেলুবাবুরা এই রকম গলার স্বরে একটা কথা প্রায়ই বলে উঠত, ‘ঐতিহাসিক।’ কথাটা শুনে শুনে রুহিতনের মুখস্থ হয়ে গিয়েছে। বেহুলার ভাসান গানে, লক্ষীন্দরকে সাপে কামড়াবার মতোই অতি দারুণ কোনও কথা হবে নিশ্চয়। কিন্তু রুহিতন কথাটার অর্থ কোনও দিন বুঝতে পারেনি। কথাটা ভয়ের, না রাগের, না উত্তেজনার, কখনও ধরতে পারেনি।

আন্ডার ট্রায়াল বন্দিশালার গেট পার হলেই একটা সরু গলির মতো ফালি। বাঁ দিকে জেনানা ফাটকের গেট। বন্ধ গেটের ওপার থেকে জেনানাদের গলার স্বর ভেসে আসছে। রুহিতন দেখল তারপরেই মাঠ। ঘাট বাঁধানো পুকুর, মাঠের সামনে। মাঠটা বেশ বড়ই। মাঠটাকে ঘিরে তিন দিকে দোতলা ওয়ার্ড। একতলা দোতলায় লোহার মোটা শিক ঘেরা দরজার মতো বড় বড় জানালা। কোনও কোনও জানালায় দু-একজন কয়েদিকে দেখা যাচ্ছে, যারা রুহিতনকেই লক্ষ করে দেখছিল। তাদের চোখে জিজ্ঞাসু কৌতূহল।।

স্বাভাবিক। দুজন ওয়ার্ডারের মাঝখানে, মাঠের ওপর নতুন একজন বন্দিকে দেখলে পুরনো বন্দিদের কৌতূহল হয়। কে এল? ঘরানা? ঘরানার কথা ভাবে অবিশ্যি অন্য ধরনের অপরাধীরা। পকেটমার চোর ডাকাত খুনি কেপমারি নারী-ধর্ষণকারী, বহু রকমের অপরাধী। সরকারের আইনের চোখে, রুহিতনও একজন অপরাধী। তার বিরুদ্ধেও খুন, লুট, আগুন লাগানো, রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল, বহুবিধ অপরাধের অভিযোগ। তথাপি সে আলাদা। কারণ সে নিজেকে একজন অপরাধী ভাবে না। তার মতো যারা থাকে, তারা নতুন কোনও বন্দিকে জেলে আসতে দেখলেই, তাদের মনে প্রথম প্রশ্ন জাগে, কোন দলের? অথবা বেনোজল? চলতি কথায় যাকে টিকটিকি বলে। ঘাসের মধ্যে ঘাস রঙের রক্তশোষা জোঁকের মতো। নাকি আমাদের কেউ?

রুহিতনকে এখন ডান্ডাবেড়ি পরানো নেই। দুজন ওয়ার্ডারের মাঝখানে, খোলা হাতে পায়ে সে হেঁটে চলেছে। সকালের রোদটা এখনও খুব গরম হয়ে ওঠেনি। দক্ষিণ না পুব, ঠিক কোন দিক থেকে হালকা বাতাস আসছে, সে বুঝতে পারছে না। রোদ চলকানো পুকুরের জল বাতাসে কাপছে। পুকুরের ধার থেকে কিছুটা দূরে ডান দিকে বড় একটা গাছের পাতাগুলো উড়ছে। রোদ লেগে পাতাগুলো চিকচিক করছে। এ রকম আবহাওয়ায় ভাল লাগবার কথা। কিন্তু রুহিতনের শীতভাবটাই গায়ে লেগে রয়েছে। জ্বর হলে যেমন গায়ে কাটা দেয়, সেই রকম ভাব। সেই আগের মতোই, যা নিয়ে এখন আর বিশেষ ভাবে না সে।

গাছটার কাছাকাছি ঘর দালানের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে, ওদিকটায় জেলের অফিস। গেটও ওদিকেই। রুহিতন অবিশ্যি মনে করতে পারছে না পরশু দিন সবে রোদ ওঠা সকালে তাকে ওখান থেকেই জেলের একটা আলাদা অংশের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল কি না। কলকাতার জেল, এইটুকুই তার খেয়াল আছে। জেলে ঢোকবার আগে যে ঘটনা ঘটেছিল, তাতে তখন তার মনের অবস্থা মোটেই ভাল ছিল না। রক্ষীদের প্রহারের ফলে তার নাকে মুখে বুকে বা পেটের ব্যথাটা তেমন কিছু মনে হয়নি। তার মন আচ্ছন্ন করে ছিল সেই আত্মধিক্কারের অপমান আর যন্ত্রণা, কেন সে চুনীলাল মৌজার কথা আফিসারকে জিজ্ঞেস করেছিল।

রুহিতন পরশু সকালেও জানত না, তাকে কলকাতা থেকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হবে। অথবা কলকাতায় তাকে বিশেষ কোনও কারণে আনা হয়েছে কি না। তবে পরশু সকালেই অফিসের মধ্যেই তার হাত পা থেকে ডান্ডাবেড়ি খুলে নেওয়া হয়েছিল। আহ! খালি হাত পায়ে সোজা হয়ে দাঁড়াবার যে কী আরাম। সেই অফিসারই আবার তাকে বলেছিল, ‘রুহিতন, একটা সিগারেট খাবে নাকি?’

রুহিতনের মনে যত যন্ত্রণা আর রাগই থাক, সে শান্তভাবে নিঃশব্দে মাথা নেড়ে অসম্মতি জানিয়েছিল। অফিসারটি আর অনুরোধ না করে, দুঃখিত স্বরে বলেছিল, ‘বেশ ভালভাবেই তোমাকে নিয়ে আসছিলাম। আমার মনটা বেশ ভাল ছিল। হয়তো তোমার সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না। হয়তো কেন, মনে হয়, আর হবে না। কিন্তু কলকাতায় ঢুকে তুমি কেন যে এ রকম একটা কাণ্ড করতে গেলে। তোমাদের সবটাই পাগলামি। আগাগোড়াই তোমরা পাগলামি করে এলে।’…

সাত বছরের মধ্যে রুহিতন একটা কাজ ভাল রপ্ত করেছিল। কানে কালা হয়ে যাওয়া। যে-যাই বলুক, আর জিজ্ঞেস করুক, শুনতে না পাওয়া আর জবাব না দেওয়া। তা ছাড়া কোনও উপায় ছিল না। পরশুদিন সকালেও সে অফিসারের কথাগুলো কানে না ঢোকাবার চেষ্টা করেছিল। বরং নিজেকে আরওই ধিক্কার দিয়েছিল সে, লোকটার সম্পর্কে সে অন্য রকম ভাবতে আরম্ভ করেছিল। লোকটাকে জবাব দেবার তার কিছুই ছিল না। জবাব দিতে হলে যাচ্ছেতাই গালাগাল দেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। তার পরিণতিও যে ভাল হত না, সে ভালই জানে। কিন্তু লোকটার মগজে কি এক বারও এ কথাটা এল না, রুহিতনের চুনীলাল মৌজার বিষয়ে খোঁজখবরে ও কী জবাব দিয়েছিল? ওর জবাব শুনে রুহিতনের মনের অবস্থা কী হতে পারে সে সব এরা বোধ হয় ভাবতে চায় না। উলটে রুহিতনকেই পাগলামির কথা বলছিল।

তা, হ্যাঁ, এক রকমের পাগলামি ছাড়া, রুহিতনের জিপের মধ্যে ক্ষেপে ওঠা .আচরণকে কী-ই বলা যায়। কষ্ট আর যন্ত্রণাও এক রকমের পাগলামি। সে না শুনলেও সিগারেট টানতে টানতে অফিসারটি সেই রকম দুঃখিতভাবে অনেক ভাল ভাল কথা বলে যাচ্ছিল। তার মধ্যেই এখানকার দপ্তরের একজন কী সব লেখালেখি করছিল, আর অফিসারটিকে কী সব জিজ্ঞেস করছিল। লোকটি সে কথারও জবাব দিচ্ছিল। কিন্তু রুহিতনকে বেশিক্ষণ দুর্ভোগ ভোগ করতে হয়নি। হুকুম পেয়ে একজন ওয়ার্ডার এসে তাকে ডান্ডাবেড়ি মুক্ত করে দিয়ে ভিতরে নিয়ে গিয়েছিল। আন্ডারট্রায়াল বন্দিদের বড় সীমানাটা পেরিয়ে তাকে পাঁচিল ঘেরা একটা বাড়ির উঠোনে নিয়ে গিয়েছিল। আন্ডারট্রায়াল বন্দিদের মাথায় ছাউনি দেওয়া, লোহার গরাদ ঘেরা ছাউনিটা বিরাট। ওটা যে আন্ডারট্রায়াল বন্দিদেরই জেল হাজত, রুহিতন তখন জানত না। সেই সাত সকালেই একদিকে অনেক বিচারাধীন বন্দিদের প্রাতঃকৃত্যের জন্য বের করা হয়েছিল। জেলখানায় লজ্জার অবকাশ কমই পাওয়া যায়। ওয়ার্ডার আর হাতে বা কোমরে চওড়া বেল্ট পরা মেট কয়েকজন বন্দিদের আশেপাশেই ঘোরাফেরা করছিল। মলমূত্রের দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছিল। বন্দিরা কেউ কেউ রুহিতনকে ডেকেও নানা রকম টিটকারি দিয়ে, সেই রকম ধরনের কথা বলছিল, ‘রাত না পোয়াতেই তুমি চাঁদ কে এলে?’দু-একজন ভঙ্গি সহকারে তাদের পুরুষাঙ্গ দেখিয়েছিল। রুহিতন তার দুপাশের ওয়ার্ডারদের দিকে দেখছিল। ওরা ওদিকে তাকায়নি। রুহিতনের মনে বিশেষ কোনও প্রতিক্রিয়া হয়নি। তাকেও সেখানে রাখা হবে কি না, এ রকম একটা দুশ্চিন্তা হয়েছিল। আর সেই অফিসারটির একটি কথা কেন যেন তার কানে লেগেছিল, ‘হয়তো তোমার সঙ্গে আর দেখা হবে না।’ পরে জোর দিয়েই বলেছিল, দেখা হবে না। কথাটার অনেক রকম অর্থ হতে পারে। কেন যে কথাটা কানে লেগেছিল, রুহিতন তা জানত না, ভাবেওনি। লোকটা যে কোনও কারণেই বলে থাক, সে মনে মনে বলেছিল, সত্যি যেন আর দেখা না হয়। এমনকী, কলকাতার জেলে তাকে ফাঁসি দিলেও।

ওয়ার্ডার দুজন তাকে পাঁচিল ঘেরা যে উঠোনে নিয়ে গিয়েছিল, সেখানে কয়েকটা গাছে লাল গোলাপ ফুল ফুটেছিল। উঠোনটাকে প্রায় বাগানই বলা যায়। শুধু গোলাপ না, আরও কোনও কোনও গাছে নানা রকম ফুল ফুটেছিল। রুহিতন সে সব ফুলের নাম জানে না। জুই বেলি হতে পারে। দুজন কয়েদি বাগানের কাজ করছিল। তারা অবাক কৌতুহলিত চোখে রুহিতনের দিকে তাকিয়ে দেখছিল। বাড়িটার পাঁচিলের বন্ধ দরজার সামনেই একজন ওয়ার্ডার ছিল। সে-ই দরজা খুলে দিয়েছিল। ভিতরেও দুজন ওয়ার্ডার ছিল। রুহিতনের মনে হয়েছিল, চা বাগানের কোনও ছোটখাটো সাহেবের কুঠিতে যেন সে ঢুকেছে। উঠোনের দুদিকে রসুইখানা গোসলখানার মতো দুটো ঘর ছিল। গোসলখানা মনে হয়েছিল, কারণ সেই ঘরটার কাছেই একটা বড় চৌবাচ্চায় পাইপের মুখ দিয়ে কলকল করে জল পড়ছিল। উঠোনের এক দিকে দোতলা একটা বাড়ি।

রুহিতন পরে বুঝেছিল, ওটা আদৌ কোনও বাড়ি না। জেলের মধ্যে কোনও বাড়ি থাকে না। বাড়ি বলতে যা থাকে, তা হল জেলারের কোয়ার্টার। তাকে যেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সেটাও একটা নিরালা বন্দিশালা। ওপরে আর নীচে দশটা সুরক্ষিত সেল। যে-দুজন ওয়ার্ডার রুহিতনের সঙ্গে এসেছিল তাদেরই একজনের হাতে চাবির গোছা ছিল। রুহিতনকে একতলার একেবারের শেষের এক কোণের একটি সেলের মধ্যে ঢুকিয়ে চাবি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। সেখানেও ব্যবস্থা আগে থেকেই করা ছিল। লোহার খাটিয়ায় কম্বল বিছানো এক কোণে একটা কমোড। আর এক কোণে জলের কুঁজো আর গেলাস। এমনকী কমোডের কাছে একটা জল ভরা বালতি, একটা অ্যালুমিনিয়ামের বাটিও ছিল। রুহিতন পরবর্তী ব্যবস্থার কথা কিছুই জানত না। সে আগেই লোহার খাটিয়ার ওপর শরীরটাকে টান টান করে ছড়িয়ে দিয়ে শুয়ে পড়েছিল। কতক্ষণ পরে, ঠিক খেয়াল নেই, সেলের লোহার গরাদ খোলার শব্দে তার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। পুরো তিন দিন পরে, ডান্ডাবেড়ি মুক্ত হয়ে টান টান হয়ে শুতে পাওয়াতে সে সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে পড়েছিল। চোখ তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে, প্রশস্ত সেলের মধ্যে সে দুজনকে দেখতে পেয়েছিল। একজন খাকি ইউনিফর্ম পরা, মাথায় টুপি হাতে একটি ছড়ি, চোখে কালো চশমা। আর একজন সাদা পোশাক, শার্ট প্যান্ট পরা। সে-ই কাছে এগিয়ে এসে বলেছিল, ‘নমস্তে। আপকো কাহা চোট লাগা?’

রুহিতনের তখনই চোখে পড়েছিল লোকটির গলায় বুক দেখবার ডাক্তারি নল ঝুলছে। হাসি হাসি কথাবার্তা ভদ্রলোকের মতোই। হিন্দিতে কেন বলছিল, কে জানে? ভদ্র ব্যবহার, প্রত্যাশিত কিন্তু তৎক্ষণাৎ সন্দেহের উদ্রেকও করে। কিন্তু কীসের চোট লাগার কথা জিজ্ঞেস করছিল? সে বাংলাতেই বলেছিল, ‘চোট তো হামাক লাগে না।’ বলতে বলতে উঠে বসেছিল।

‘হামাক’ শব্দটা তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। বাংলা সে দিবা বাগচি, খেলু চৌধুরীদের মতোই বলতে পারে। নিজের অঞ্চলে সে রাজবংশিদের আঞ্চলিক আর নেপালি ভাষায় কথা বলতেই অভ্যস্ত ছিল। ধলভূমগড়ের কুরমি মাহাতোদের কথাও তার অজানা ছিল না।

ডাক্তার ঝুঁকে পড়ে তার মুখের দিকে দেখেছিল। বলেছিল, ‘অ্যাঁ, এই তো নাকের কাছে ঠোঁটের ওপর রক্তের দাগ লেগে রয়েছে। এ সব জায়গায় একটু ওষুধ লাগিয়ে দিই।’ বলেই এক হাত রুহিতনের কাঁধের ওপর রেখে, আর এক হাত দিয়ে বুকের কাছে বুলিয়ে বুলিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, এ সব জায়গায় লাগেনি তো?’

‘না না, কোথাইয়ে লাগে নাই।রুহিতন জবাব দিয়েছিল। জিপের মধ্যে রক্ষীদের মারের ব্যাপারেই ডাক্তার এসেছে, সে বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু তার সে রকম কোনও ব্যথা যন্ত্রণা ছিল না। সে আবার বলেছিল, ‘দেন তো দেন একটু নাইবার ব্যবস্থা করে দেন। আর একটু গরম চা।’

ডাক্তার ভুরু কুঁচকে বলেছিল, ‘কিন্তু গা তো গরম। জ্বর রয়েছে মনে হচ্ছে। চান করাটা কি ঠিক হবে?’ বলে সে ইউনিফর্ম পরা লোকটির দিকেই যেন অনুমতি সাপেক্ষে তাকিয়েছিল।

রুহিতন বলেছিল, ‘ওইরকম গা গরম আমার থাকে। তিন দিন মোটে গায়ে জল দেই নাই। আজ দিতে হবে।’

ডাক্তার লোকটি রুহিতনের দিকে কয়েক মুহূর্ত তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে দেখেছিল। মুখ ফিরিয়ে ইউনিফর্ম পরা চোখে কালো চশমা মাথায় টুপি হাতে ছড়ি ভারিক্কি লোকটিকে ইংরাজিতে কী যেন বলেছিল। ইউনিফর্ম পরা লোকটি মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে ডাক্তারের কথা শুনেছিল। মোটা স্বরে দু-একটা কথাও বলেছিল। ডাক্তার তখনই রুহিতনের দিকে ফিরে ইউনিফর্ম পরা ব্যক্তিকে দেখিয়ে বলেছিল, ‘উনি হলেন জেল সুপারিন্টেনডেন্ট। তোমাকে, ইয়ে—মানে, আপনাকে দেখতে এসেছেন।’

রুহিতন জেল সুপারের দিকে এক বার তাকিয়ে দেখেছিল। তাকে সুপারের পরিচয় দেওয়া বা তার তাকিয়ে দেখা, কোনওটাই কোনও অর্থবহ না। সুপার হেসেছিল, নাকি চোখের কালো চশমায় ঝলক লেগেছিল, কিছু বোঝা যায়নি। ডাক্তারকে ইংরাজিতে কিছু বলেছিল। লোকটার গলার স্বর কোলা ব্যাঙের মতোই মোটা। চেহারাটাও খুব জাদরেল ভাবের ছিল। ডাক্তার হেসেছিল, আর বাংলায় বলে উঠেছিল, ‘সত্যি আশ্চর্য।’ তারপরে বাইরের দিকে তাকিয়ে কাকে যেন ডেকেছিল। একজন কয়েদির পোশাক পরা লোক, হাতে একটা বাকসো নিয়ে ভিতরে এসেছিল। ওর ডোরাকাটা পায়জামা আর মাথার টুপি দেখেই বোঝা গিয়েছিল, কয়েদিটা বোধ হয় জেল হাসপাতালের কাজ করে। ডাক্তার রুহিতনের খাটিয়ার ওপরেই বাকসোটা রেখে ঢাকনা খুলেছিল। একটা শিশির মুখ খুলে উগ্র গন্ধ কিছু তুলোর সঙ্গে ভিজিয়ে রুহিতনের নাকের কাছে ঘষে দিয়েছিল।

রুহিতন তৎক্ষণাৎ মুখটা ফিরিয়ে নিয়ে বলেছিল, ‘মশায়, কইলাম তো আমার চোট লাগে নাই।’

ডাক্তার বলেছিল, ‘রক্তের দাগ লেগে রয়েছে। একটু মুছে দিই।’

‘নাইবার সময় জল ঢাললেই সব ধুয়ে যাবে।’ রুহিতন বলেছিল।

ডাক্তারকে নিরস্ত হতে হয়েছিল। সে জেল সুপারের সঙ্গে ইংরাজিতে আরও কয়েকটা কথা বলেছিল। তারপরে বাকসোটা কয়েদির হাতে তুলে দিয়ে সুপারের সঙ্গে বেরিয়ে গিয়েছিল। দুটো দিন রুহিতনের সেই সেলে খারাপ কাটেনি। পরশু দিন ডাক্তার আর জেল সুপার চলে যাবার পরে, তাকে ওয়ার্ডার নীচে চান করতে নিয়ে গিয়েছিল। গরম চা দিয়েছিল সেলের বাইরের বারান্দাতেই। দুদিনই খাবার দিয়েছে সেলের বাইরে বারান্দাতেই।

আজ সকালে ঘুম ভেঙেও জানত তাকে এ রকম একটা নিরিবিলি জায়গাতেই রাখা হবে। কিন্তু নতুন হুকুমে তাকে ওয়ার্ডাররা অন্য জায়গায় নিয়ে চলেছে। আগেই বলা হয়েছে, অন্য ওয়ার্ডে তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। রুহিতন গতকাল স্নান করেনি। আজ শীতভাব থাকা সত্ত্বেও গায়ে মাথায় অল্প জল না ছিটিয়ে পারেনি। এখন এই খোলা মাঠের ওপর রোদ আর বাতাসে একটু ভালই লাগছে। পুকুরের ওপারে ডান দিকে গাছের তলায় ছায়ায়, ওয়ার্ডের বারান্দায় লোকজন চলাফেরা করছে। দেখলেই বোঝা যায়, ওদিকে সকলেরই কিছু ব্যস্তসমস্ত ভাব। মাঠের এদিকে ওদিকেও দু-একজন ওয়ার্ডারকে কয়েদির সঙ্গে চলাফেরা করতে দেখা যাচ্ছে। পায়রারা ঝাঁক বেঁধে উড়ে যাচ্ছে মাথার ওপর দিয়ে। সব জেলেই বোধ হয় পায়রা থাকে। রুহিতনের এই রকম ধারণা হয়েছে। যে কটা জেলে সে আজ পর্যন্ত থেকেছে, সব জেলেই প্রায় পায়রা দেখেছে। কেন, জেলকে ওদের ভয় নেই? দোতলা ওয়ার্ডের ছাদে, ছাদের থেকে দূরে আরও উঁচুতে টাওয়ারের ওপর জেলরক্ষীদের দেখা যাচ্ছে। পায়রাদের ভয় নেই তারা সেখানেও ঘুরে বেড়াচ্ছে। এমনকী পাগলা ঘণ্টির মাথার ছাউনির ওপরেও দুটো পায়রা মুখোমুখি ঘাড় ফুলিয়ে, মাথা নাড়ছে।

রুহিতনের মনে পড়ে গেল, বারো-তেরো বছর বয়সের সময় তার পায়রা পোষার শখ হয়েছিল। তখনই তার বাবা নকশালবাড়ির পুবের চা বাগান ছেড়ে, পাঁচ মাইল দক্ষিণ-পুবের মৌজায় চাষ আবাদ করতে চলে গিয়েছিল। ইতিমধ্যে বাগানে কাজ করে তার কিছু পয়সাকড়ি মায়ের কাছে জমা পড়েছিল। আরিশজোতে একটা শিবৱাত্রের মেলা হয়। রানধনের কাছে। সেই মেলা থেকে মা তাকে কিনে দিয়েছিল দুটো বাড়ি পায়রা পায়রি, আর চারটি বাচ্চা।

রুহিতন গ্রামের নানান জায়গা থেকে স্টেশনের আশপাশ ঘেঁটে কাঠের আর টিনের টুকরো জোগাড় করে নিজের হাতে একটা বাসা বানিয়েছিল। তার থেকে বয়সে বড় আশেপাশের গ্রামের আরও অনেকে পায়রা পুষত। আকাশে উঠে ডিগবাজি খাবে বা নানা রকম খেলা দেখাবে এই রকম লক্কা গোলা নোটন, নানা রকম মিশেল পায়রার চাষ করত তারা। লক্কা গোলা নোটন, অনেক কিছু তারা তৈরি করত। কিন্তু যেগুলোকে বাজ তৈরি করা হত, সেগুলোই আসল। পায়রা কখনও বাজ হয় না তবু এমন ভাবে তাদের শিক্ষা দেওয়া হত, সেইসব পায়রারা হয়ে উঠত শিকারি চতুর আর হরণকারী। অপরের পায়রার ঝাকের সঙ্গে মিশে তার ভাল পায়রাটিকে নিজের ঘরে ভাগিয়ে নিয়ে আসত। সেই সব পায়রাকেও শিকরে বাজ বলা হয়।

রুহিতনের স্বপ্ন ছিল, সে সেই রকম শিকরে বাজ তৈরি করবে। আর সেইজন্যই সে মুখের মধ্যে আঙুল ঢুকিয়ে জিভ গুটিয়ে শিস দিতে শিখেছিল। তার সেই শিকরে তৈরি স্বপ্নের সঙ্গী ছিল ছোট ভাই হরতন। হরতনের নামটাও ঠাকুরদা রেখেছিল। তারপরে তো পর পর চারটে বোন হয়েছিল। কিন্তু ছমাস পরেই তার স্বপ্নকে গলা টিপে মারা হয়েছিল। পায়রা পোষা অনেকটা সেই রকম। ভুঁয়ে রাখলে পিঁপড়েয় খায়, উঁচুতে রাখলে বাতাসে উড়ে যায়। নীচে রাখলে শেয়ালে হানা দেয়, ওপরে রাখলে খটটাস। তা-ই পায়রাগুলোকে সে দাওয়ার ওপরে চালের নীচে ঝোলানো বাসায় রেখেছিল। বাইরের উঠোন থেকে নিচু হলে বাসা দেখা যেত। শেয়ালের নাগাল পাবার উপায় ছিল না। খটটাসের পক্ষেও সেই ঝোলানো বাসার ঘাড়ে চেপে রীতিমতো খিল দেওয়া দরজা খোলা সম্ভব ছিল না। সন্ধ্যা হলেই খোপে পুরে ঢাকা দিয়ে রাখতে হত। কিন্তু এক দিন রাত পোহাতে দেখেছিল, খোপের দরজা খোলা। একটা পায়রাও নেই। বাচ্চাগুলো বেশ তৈরি হয়ে উঠেছিল। ধাড়ির সঙ্গীটা দুটো ডিম পেড়েছিল। খড়ের ওপরে ডিম দুটো ভেঙে পড়েছিল। দাওয়ার মাথার ওপর চালাতে কোথা থেকে কালো পিপড়ে গোটা বাসাটা ছেয়ে ফেলেছিল। ভাঙা ডিম দুটোর জন্যই।

কী করে এমন সর্বনাশ হতে পারে? রুহিতনের বুক ফেটে কান্না আসছিল। খটটাস? কিন্তু তার কোনও চিহ্নই ছিল না। হরতনটা তার মধ্যে চিৎকার করে কান্না শুরু করে দিয়েছিল। রুহিতনের মনে গভীর সন্দেহ হয়েছিল খটটাস সম্ভবত, ভাম কখনওই সে কাজ করেনি। করলে সবগুলো পায়রাকে সে নিয়ে যেতে পারত না। তা ছাড়া, কিছু চিহ্নও নিশ্চয় রেখে যেত। তার আরও মনে হয়েছিল, খটটাস কখনও এমন নিপুণভাবে খোপের খিল দেওয়া ঢাকা খুলতে পারে না। তবে চোর? চোরের কাজ!

রুহিতনের মা ছিল তখন গর্ভবতী। দুটো বোনকে নিয়ে বাবার কাছে মাঠের কাজে যাবার তোড়জোড় করছিল। রুহিতন হরতনেরও যাবার কথা। এত বড় একটা ঘটনাকে মা তেমন আমলই দেয়নি, বরং বলেছিল, ‘পায়রা গেছে, আবার আসবে। আমি পৌষ মাসে তিস্তা মাইয়ের মেলা থেকে ছটা পায়রা কিনে দেব। এখন চল যাই, তোদের বাবা একলা একলা কাজ করছে। লোকটার কষ্ট হচ্ছে, তারপরে রেগে যাবে।’

রুহিতনের কাছে মায়ের আচরণটা মোটেই স্বাভাবিক মনে হয়নি। নিখোঁজ পায়রাগুলোর জন্য মা কোনও দুঃখ আক্ষেপ প্রকাশ করা তো দূরের কথা, মন খারাপ করেও একটা কথা বলেনি। এক বার এসে দাঁড়ায়নি খোপের সামনে। দেখেনি তাকিয়ে, ঘটনাটা কী? রুহিতন দাওয়ায় আছাড় খেয়ে পড়েছিল। দাওয়া থেকে উঠোনের ধুলোয় লুটোপুটি। সে হরতনের মতো কাঁদেনি, চিৎকার করে গালাগাল আর অভিশাপ দিয়েছিল। রুহিতন যখন খুব খারাপ খারাপ গালাগাল আর শাপমন্যি করছিল তখন মা বেশ অবাক হয়ে ভয় পেয়ে বলে উঠেছিল, ‘নিজের বাপকে এ সব বলছিস তুই?’

নিজের বাপ! হ্যাঁ, মা বুঝিয়েছিল। গতকাল রাত্রে রুহিতনের বাবা কোথায় কোনখানে নিয়ে নাকি মানত করা পায়রা বলি দিয়েছিল। রাত্রে আর পায়রা কোথায় পাবে, তাই ঘরেরগুলোই নিয়েছিল। মানত? কোনখানে? আশেপাশে সেই সময়ে কোথাও কোনও পূজাপাট বলি, কিছুই ছিল না। রুহিতন ঘরের আশেপাশে আনাচেকানাচে জঙ্গলে চারদিকে ছুটোছুটি আরম্ভ করে দিয়েছিল। তার সন্দেহ আর ছুটোছুটি বৃথা যায়নি। মৃত পায়রার পালক-ঝোলকগুলো সে শুকনো পাতা ঢাকা দেওয়া উঁই থেকে খুঁজে বের করেছিল। তার সন্দেহ তখন বিশ্বাসে পরিণত হয়েছিল। আসল ঘটনা বাবা মায়ের ডেয়ং (হাড়িয়া) খাওয়ার ফল। ডেয়ং-এর নেশায় চুর হয়ে বাবার পায়রাগুলো খাবার ইচ্ছা হয়েছিল। মা হয়তো বাধা দিয়েছিল। বাবা কখনও সে-বাধা মানে? বাবা নিজের হাতেই পায়রাগুলো খোপ থেকে বের করেছিল, ঘাড় মটকিয়ে পালক ছাড়িয়েছিল। আর মা রান্না করে দিয়েছিল। রাত তখন কত, কে জানে?

কথাগুলো মনে হতেই, রুহিতন হিংস্র হয়ে উঠেছিল। হুংকার ছেড়ে হরতনকে নিয়ে মাঠে ছুটে গিয়েছিল। পোশপ তখন নিশ্চিন্ত মনে নিড়ানের কাজ করছিল। সে একলা না, মোহন ছেত্রীর জোতে আরও অনেকেই তখন কাজ করছিল। তরাইয়ের এই এক সমস্যা। বৃষ্টি হলেই আগাছার উৎপাত। নিড়ান দেওয়া একটা বড় কাজ। তবে আগের রাত্রে পায়রার মাংসের ভোজটা খারাপ হয়নি। শরীর বেশ গরম ছিল। বোধ হয় ডেয়ং আর পায়রার মাংসে একটা আমেজও ছিল।

রুহিতন আর হরতন দুটো বাঁশের লাঠি নিয়ে হই হই করে ছুটে গিয়েছিল। রুহিতন বাপের নাম ধরেই চিৎকার করেছিল, ‘কোথায় পোশপত্ কুরমি? আমার পায়রার মাংস যে খেয়েছে তার মাংস আজ আমি খাব।’

পশুপতি অবাক হয়ে নিড়ানি হাতে উঠে দাঁড়িয়েছিল। রুহিতন হরতনের পিছনে তাদের মাও ছুটে এসেছিল, আর ছেলেদের বাপকে চিৎকার করে সাবধান করছিল। তথাপি পশুপতি ব্যাপার ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি। রুহিতন যখন তার ওপর লাঠি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিল তখন সে নিজেকে বাঁচাবার জন্য দৌড় দিয়েছিল। রুহিতন হরতন বাপকে সমানে তাড়া করেছিল। মাটির ঢ্যালা কুড়িয়ে নিয়ে ছুড়ে মেরেছিল। মাঠের যত মজুর কিষাণ সবাই কাজকর্ম ফেলে দাঁড়িয়ে ঘটনা দেখছিল, আর রুহিতনের মায়ের চিৎকার থেকে আসল ঘটনাটা শুনে নিচ্ছিল। শুনে তারা সবাই হাসাহাসি আর হইহল্লা আরম্ভ করে দিয়েছিল। এ রকম একটা মজার ঘটনা সচরাচর ঘটে না। দুই বালক ছেলেকে সবাই উৎসাহ দিয়ে ক্ষেপিয়েছিল, হ্যাঁ, এ রকম মানুষের মতো দেখতে পায়রাখেকো শেয়াল খটটাসকে মারাই ভাল।

বাবা হয়তো তার দুই ছেলেকে সহজেই কাবু করে ফেলতে পারত। কিন্তু চুরি করে পায়রা খাওয়ার একটা তাপরাধ বোধেই সে ছেলেদের কাছ থেকে দৌড়ে পালিয়েছিল।…

‘কঁহা যাতা? ইধর আও।’ এই কথার সঙ্গেই, রুহিতনের পিঠের ওপর চাপ পড়ল।

রুহিতন দাঁড়িয়ে পড়ল। তার সামনে সাধারণ ছোট দরজা। দু দিকে দেওয়াল, মাঝখান দিয়ে সরু ফালি স্যাঁতসেঁতে ছায়াঘন পথ। মনে হয় বেশি উঁচু হলে মাথা ঠুকে যাবে। সামনে পিছনে দুজন ওয়ার্ডারের মাঝখানে রুহিতন সেই ফালি পথে ঢুকল। কিন্তু তার মনটা বিষাদে ভরে উঠল। পুরনো দিনের কথা মনে করে তার কষ্ট হয়। সে চায় না, পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে। যে জীবন তার পিছনে পড়ে রয়েছে, সে জীবনের কথা সে মনে করতে চায় না। ভাবতে চায় না। অথচ আজকাল প্রায়ই পিছনের জীবনটা মনে পড়ে যায়। পিছনের জীবন আর সেখানকার মানুষ। মনে পড়লেই অদেখা শুকনো ঝোরার জলের মতো কোথায় যেন কলকলিয়ে ওঠে। এ বড় বিষাদ।

সামনের ওয়ার্ডার দাঁড়ায়। ডান দিকের দেওয়ালে একটা বন্ধ দরজা। এ দরজা লোহার গরাদের না। মোটা কাঠের পাল্লার দরজা। দরজার গায়ে বেরিয়ে রয়েছে একটা বাঁকানো লোহার শিক। সেটা ধরে নাড়া দিতেই দরজার ওপারে শব্দ বেজে উঠল। তৎক্ষণাৎ দরজার গায়ে একটি কয়েক ইঞ্চি জানালার পাল্লা খুলে গেল। দরজার ওপার থেকে দুটি চোখ উঁকি দিল। সেই চোখের সঙ্গে চোখাচোখি হল রুহিতনের আর ওয়ার্ডারদের। পাখির খাঁচার থেকেও ছোট পাল্লা বন্ধ হয়ে গেল, চোখ অদৃশ্য হল। ভিতরে চাবির গোছা বা শিকলের ঝনঝন শব্দ হল। দরজা খুলে গেল।

দরজার চৌকাঠ উঁচু সিমেন্ট জমানো। সামনের ওয়ার্ডারের পিছনে রুহিতন চৌকাঠ ডিঙিয়ে ঢুকল। পিছনের ওয়ার্ডারও ভিতরে এল। দরজা আবার বন্ধ হয়ে গেল। সামনে একটা অন্য জগৎ। জেলখানাই। তবু—

দরজার কাছ থেকে তিরিশ-চল্লিশ হাত দূরে মাথায় ছাদ ঢাকা, চারপাশে দেওয়াল ঘেরা একটা ঘরের মতো। বাঁ দিকে একটা লম্বা চালা। রুহিতন ঠিক মতো খেয়াল করে না, লম্বা আর চওড়া উঠোনে কটা গাছ ডাইনে বাঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সমস্ত জায়গাটাই প্রায় ছায়া ঘেরা ঠাণ্ডা। কয়েদির পোশাক পরা কয়েকজন এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে ছিল। উঠোনটার মাঝখানের বাঁধানো নালা দিয়ে কলকল করে পরিষ্কার জলের স্রোত বহে যাচ্ছে। রুহিতনের ডান দিকে ঘরের দরজার কাছে কয়েকজন পোশাক পরা বন্দি জোট হয়ে দাড়িয়ে নিজেদের মধ্যে কোনও কথা বলাবলি করছিল। কয়েকজন—কতজন, রুহিতন ঠিক হিসাব করে দেখল না, ওয়ার্ডারও এদিকে ওদিকে দাঁড়িয়েছিল বা চলাফেরা করছিল। দরজা খোলা বন্ধের শব্দে প্রায় সকলেই রুহিতনদের দিকে তাকিয়েছিল। প্রায় সকলের চোখেই সন্দেহ আর অপরিচয়ের জিজ্ঞাসা।‘ রুহিতন কুরমি। রুহিততন!’ নির্বাক আর সন্দিগ্ধ উঠোনটাকে চমকিয়ে দিয়ে একটা উল্লাসের চিৎকার বেজে উঠল।

রুহিতন দেখল চোখের পলকে একটা মূর্তি তার দিকে ছুটে এল। দু হাতে গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরে, আর এক বার চিৎকার করে উঠল, ‘রুহিত্তন! কমরেড!’…

ইতিমধ্যে রুহিতনও লোকটির মুখ দেখে নিয়েছিল। খেলু চৌধুরী! খেলু চৌধুরী ধরা পড়েছে, এ কথা সে আগেই শুনেছিল। যেমন শুনেছে দিবা বাগচিও নাকি ধরা পড়েছে। সে বিশ্বাস করেনি। খেলু চৌধুরীর গ্রেপ্তারের কথা এখন আর বিশ্বাস না করে উপায় রইল না। উত্তেজনা আর উল্লাস রুহিতনের প্রাণেও কম না। এমন একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু আর নেতার দেখা সে বহুকাল পায়নি। এরাই তো পথ দেখিয়েছিল। এদের সঙ্গেই তো শুরু। তারপরেও অনেক এসেছে। তবু এদের সঙ্গে সম্পর্ক আলাদা। রুহিতনও খেলু চৌধুরীকে দুহাতে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরল। সে চিৎকার করে উঠল না, প্রায় গোঙানো স্বরে বলল, ‘অই ওহে খেলুবাবু! আহ্! খেলুবাবু হে!!…’

ওয়ার্ডের ভিতরে এবং বাইরে উঠোনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রায় সকল বন্দিই, রুহিতন আর খেলু চৌধুরীকে ঘিরে এগিয়ে এল। ওয়ার্ডারদের সবাইকে কিছুটা বিমূঢ় দেখাচ্ছিল। অবিশ্যি দু-একজনের মুখে হাসি দেখা যাচ্ছিল। সন্দিগ্ধ চোখ গোমড়া মুখই ছিল বেশি। তাদের চোখে মুখে একটা ত্রস্ত সাবধানতা।

বন্দিদের অধিকাংশের চোখগুলোই বিস্ময়ে আরও বড় হয়ে উঠেছিল। তার সঙ্গে সম্রম আর শ্রদ্ধা। রুহিতন খুব কাছেই শুনতে পেল, কে যেন প্রায় ফিসফিস করে বলছে, ‘সেই রুহিতন কুরমি? নকশালবাড়ির? এই মানুষকে কোনওদিন দেখতে পাব ভাবিনি। জীবনটা সার্থক হয়ে গেল। কমরেড রুহিতন কুরমি, জিন্দাবাদ!’

তৎক্ষণাৎ বেশ কয়েকটি স্বর উচ্চ রবে প্রতিধ্বনি করল, ‘জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ!’

‘হল্লাগুল্লা বন্ধ! শোর মচানা নহি চলে গা।’ আদেশের সুরে মোটা গম্ভীর স্বর শোনা গেল।

তার জবাবে রুখে ওঠা গলা শোনা গেল, ‘চুপ রহো। বাধা দিলে আগুন লেগে যাবে।’

সমর্থনসূচক আর কয়েকটি স্বর গর্জে উঠল, ‘মনে রেখো কে এসেছে। এর নাম রুহিতন কুরমি। এই ওয়ার্ডে মহাত্মা গান্ধী ছিল। রুহিতন কুরমিও এসেছে।’

শেষের কথাটা কানে যেতেই, রুহিতন খেলু চৌধুরীর ঘাড়ের কাছ থেকে মুখ তুলে, সকলের মুখের দিকে অবাক চোখে তাকাল। তার হাসি হাসি অবাক চোখে জিজ্ঞাসা। মহাত্মা গান্ধী, এই একটি নামের সঙ্গে তার জীবনের কোনও সম্পর্ক নেই। বরং আছে এক আশমান জমিন বিরোধ। গাঁধীবাবার নাম সে তার ছেলেবেলাতেই শুনেছে। ছবি দেখেছে। তাদের চা বাগানে কুলি ধাওড়ার ঘরের দেওয়ালে অনেকগুলো ছবির মধ্যে, একটি চশমা চোখে হাসি মুখ বুড়ো মানুষের ছবিও ছিল। বোধ হয় তাঁর কপালে লাল বা সাদা কোনও ফোঁটাও ছিল। গায়ে কোনও জামা ছিল না। মহাজন আর মুদি দোকানি চৌবের চেহারার সঙ্গে ছবিটার মোটামুটি একটা মিল ছিল। কিন্তু হাসি? হাসিটা ছিল তার ঠাকুরদার থেকেও অনেক সুন্দর। মনে হত এমনি এমনি কি আর ছবিটাকে সবাই নমস্কার করে? চৌবে চৌদ্দবার জন্মালেও এ রকম হাসতে পারবে না।

রুহিতন তার বাপ ঠাকুরদার কাছেও গাঁধীবাবার নাম শুনেছে। নামটা বলবার সময় তারা কপালে হাত ছোঁয়াত। তবু দার্জিলিং পাহাড়ের লেবং দেখবার কৌতুহলই রুহিতনের তীব্র হয়েছিল। বসন্তকালে ঘোড়দৌড় দেখার জন্য না। সে তার বাবার কাছে শুনেছিল বিপ্লবীরা বাংলার লাট বাহাদুর ‘আনারসন’-কে (স্যার জন অ্যান্ডারসন—গভর্নর জেনারেল) লেবং-এ হত্যা করার চেষ্টা করেছিল। রুহিতনের বয়স তখন ছিল আট বছর। দেশ ছিল পরাধীন। সারা পাহাড়, তরাই, ডুয়ার্স ঘিরে পুলিশ কিছুকাল জবর তাণ্ডব লাগিয়েছিল।

রুহিতনের মাথায় ঘটনাটা গেঁথে গিয়েছিল। কেন? এটাই তার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য, সে নিজেও জানে না। শত্রু নিধনঃ শ্রেয়ঃ। তার অন্তরের এই কথা সে নিজেও যথার্থ কখনও শুনতে পায়নি, কিন্তু রক্তের মধ্যে তা ক্রিয়াশীল ছিল। রুহিতন লেবং গিয়েছিল। মোটর বা রেল গাড়িতে চেপে না। চৌদ্দ-পনেরো বছর বয়সে, কয়েকজন বন্ধু মিলে, গায়ে কাপড় জড়িয়ে, চোর বাটো দিয়ে পাহাড়ে উঠেছিল। খেলতে খেলতে পাহাড়ে ওঠার মতো উঠে তারা লেবং গিয়েছিল। মিরিক আর জোড়বাংলো পাহাড়ের চা বাগান দিয়ে, লেবং।

তার কয়েক বছর পরেই, দার্জিলিং হিমালয়ান রেল মজুরদের ধর্মঘট। গোটা পাহাড়ে তরাইয়ে এঞ্জিনের ধোঁয়া ওড়েনি। রেলের চাকা ঘোরেনি। মাঠে মেচির পলি ছড়াতে ছড়াতে, রুহিতনের রক্ত টগবগিয়ে উঠেছিল। কেন? কোম্পানির সাহেবরা, মারোয়াড়ি বিহারি মহাজনেরা, বাঙালি-রাজবংশি, নেপালি জোতদাররা ক্ষেপে উঠেছিল। গরিবদের চিরশত্রুদের পরাজয়ে বুকের রক্ত টগবগিয়ে উঠেছিল। নিজের এই চরিত্রটা তার অজানা ছিল। দিবাবুরা তখন বাগানে আর শহরে আন্দোলন করছিল। চেনা শোনা হয়নি। রেল ধর্মঘট করেছিল অন্য একটা দল। সেই সার্থক ধর্মঘট এখনও তার মস্তিষ্কে বিধে আছে। বিধে আছে, তারপরের অনেক লড়াইয়ের ঘটনা।

কিন্তু রুহিতন যে কারণে আজ একজন খুনি, লুণ্ঠনকারী অগ্নিসংযোগকারী এবং রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকারী, এবং আরও অনেক অভিযোগে অভিযুক্ত সেই কারণগুলোর মধ্যেই রয়ে গিয়েছে, তার সঙ্গে গাঁধীবাবার বিরোধ। রুহিতন জানে, দুজনের মত আর পথের জন্য তারা পরস্পরের শত্রু। তবু এই ওয়ার্ডে গাঁধীবাবা ছিলেন, এই সংবাদ তার মনে কেমন একটা বিস্ময় আর চমক সৃষ্টি করল। সে শুনেছে, তিনি ইংরাজদের সঙ্গে অন্য এক রকমের লড়াই করেছিলেন, তার নাম অহিংসার রাস্তা। যার কোনও সম্যক অর্থই রুহিতনের জানা নেই। সাত বছরের জেল-জীবনে, সেও কয়েক বার অনশন করেছে। আর এই অনশনের হাতিয়ার নাকি তিনিই দিয়ে গিয়েছেন। যদিও দিবা বাগচি মাঝে মাঝে রেগে আর ঠাট্টা করে বলত, ‘উপোস করা আবার একটা আন্দোলন নাকি? ওকে বলে মাগভাতারের ঝগড়া। ভাতারের গুঁতোয় মাগ উপোস দিয়ে পড়ে থাকে। আবার ভাতার গিয়ে তাকে খোশামুদি করে খাওয়ায়। খলে ওষুধ না মাড়লে আবার অন্য রোগে ধরবে। ও সব হল মাগভাতারি আন্দোলন।

রুহিতন প্রথমে যখন এ কথা শুনেছিল, বিশ্বাস করেছিল। দিবা বাগচি খেলু চৌধুরীদের অনশনের অভিজ্ঞতা ছিল। এখন রুহিতনের মনে সেই বিশ্বাসে তেমন জোর নেই। অনশন যে একটা হাতিয়ার এটা সে জেলের মধ্যে প্রথম জানতে পেরেছিল। প্রত্যক্ষ ফলও পেয়েছিল। রুহিতনদের মতো মানুষদের পক্ষে জেলের মধ্যে যে কোনও মানবিক অধিকারের জন্য অনশন ছাড়া উপায় নেই। এখন তার দলের সবাই এটা মেনে নিয়েছে।

মতে ও পথে পরস্পরের শত্রু, সম্পর্কহীন গাঁধীবাবাকে রুহিতন যে কেবল কখনও চোখেই দেখেনি, তা না। অনশন ছাড়া গাঁধীবাবার সে কিছুই জানে না, কিছুই বোঝে না। তবু তিনি যে একজন খুব নাম করা লোক ছিলেন, একজন বড় মানুষ, তাঁর ছবিই শুধু যার প্রমাণ না, অনেকটা দেওতার মতোই লোকে তাঁর নাম করে, সব মিলিয়ে তার মনেও একটা ধারণা ছিল, তিনি একজন খুবই নামী দামি মানুষ। সে অবাক হেসে বলল, ‘মহাতমা গাঁধীও এখানে ছিলেন ?’

‘হ্যাঁ। ওই যে, ওখানে গাছতলায় নাকি তিনি রোজ প্রার্থনা করতেন।’ একজন হাত তুলে দেখিয়ে বলল।

খেলু চৌধুরী বলে উঠল, ‘আরে তাতে কী হয়েছে? রুহিতন কুরমি, তুমি আমাদের কাছে তার চেয়ে অনেক বড়।’

কে একজন বলে উঠল, ‘রুহিতন কুরমি যুগ যুগ জীও।’

তৎক্ষণাৎ কয়েকটি স্বর প্রতিধ্বনি করল, ‘রুহিতন কুরমি যুগ যুগ জীও।’

একজন বাঙালি ওয়ার্ডার বলল, ‘খেলুবাবু, কেন আপনারা এখানে এ সব করছেন। এখনই একটা গোলমাল লেগে যাবে। আপনারা ওয়ার্ডের ভেতরে কথাবার্তা বলুন। শ্লোগান দেওয়া চলবে না, জানেনই তো।’

একজন কে গর্জে উঠল, ‘পিটিয়ে মেরে ফেললেও আমরা রুহিতন কুরমির নামে শ্লোগান দেব।’

রুহিতনের নিজেরই ইচ্ছা হল, সে সবাইকে শান্ত করে। সকলের এই প্রাণের উচ্ছ্বাস তার ভাল লাগছে। কিন্তু শুধুমাত্র এইজন্যই, একটা দাঙ্গার সৃষ্টি হোক সে চায় না। নিরস্ত্র অবস্থায় পড়ে পড়ে মার খাওয়া কাকে বলে সে জানে। এইরকম একটা কারণে এই পরিস্থিতি সৃষ্টির ইচ্ছা তার হচ্ছে না। তার মনের ইচ্ছাকে খেলু চৌধুরী সমর্থন করে বলল, ‘আচ্ছা, এখন শ্লোগান-টোগান থাক। রুহিতন ভাই এইমাত্র এসেছে, আগে তাকে আমরা রিসিভ করি। আমাদের আজ সবথেকে বড় গর্ব রুহিতন ভাইকে আমাদের মধ্যে পেয়েছি। আগে একটু খবরাখবর নেওয়া যাক।’

খেলু চৌধুরীর কথা সকলেই যে মেনে নিল বোঝা গেল তাদের ঠেলাঠেলি ব্যস্ততা দেখে। সকলেই প্রায় একসঙ্গে বলে উঠল, ‘খেলুদা, আমাদের সঙ্গে কমরেড রুহিতন কুরমির আলাপ করিয়ে দিন।’

খেলু চৌধুরী বলল, ‘নিশ্চয়ই দেব। চলো আমরা নীচের তলার ভেতরে গিয়ে বসি।’ বলে রুহিতনের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, ‘রুহিতন, তোমার সঙ্গে আর কিছু নেই?’

রুহিতন এদিকে-ওদিকে ফিরে কারোকে যেন খুঁজে বলল, ‘একখানা বাকসো তো ছিল।’

একজন ওয়ার্ডার এগিয়ে এল। তার হাতে একটা টিনের সুটকেস। রুহিতন বলল, ‘খেলুবাবু, মোকে তা হলে তোমাদের সাথেই রাখবে?’

খেলু চৌধুরী হেসে উঠল। তার সঙ্গে প্রায় সব বন্দিরাই। খেলু চৌধুরী বলল,’ তা হলে আর তোমাকে এই খাতায় আনত? হুকুম আছে বলেই এখানে এনেছে। নইলে আমরা জানতেই পারতাম না, তোমাকে এই জেলে আনা হয়েছে। কখন আনল তোমাকে? কোথা থেকে আনল? এখানে তোমার নামে যে কত রকমের গুজব রটনা হয়েছে—।’

‘খেলদা।’ কথা শেষ হতে না হতেই কে একজন ডেকে উঠল। ধমকানো না হলেও, স্বর তর্জিত ত্রস্ত। ওয়ার্ডারদের সামনে খেলুদাকে মুখ না খুলতে বলা হচ্ছে।

রুহিতন ইতিমধ্যে বলে উঠল, ‘মোকে তো পরশু দিন বিহানবেলা এখানে নিয়ে এসেছে।’

খেল চৌধুরী বলে উঠল, ‘এখানে? পরশু? কোথায় রেখেছিল?’ বলে সে ওয়ার্ডারের দিকে তাকাল। যে-ওয়ার্ডারের হাতে রুহিতনের সুটকেস ছিল।

লোকটা সে কথার কোনও জবাব দিল না। তার ছোট চোখ দুটোতে এক ধরনের বিরক্তি আর অসন্তুষ্টি। বগলে লাঠি, নীচের ঠোঁট দেখে বোঝা যাচ্ছে খৈনি টিপে রেখেছে। হিন্দিতে জিজ্ঞেস করল, ‘এ তা হলে কোন ওয়ার্ডে থাকবে?’

রুহিতনের কথাই জিজ্ঞেস করছে। খেলু চৌধুরীর মুখ শক্ত হয়ে উঠল, বলল, ‘তোমার ওপর কী হুকুম আছে, তাই বলো না।’

ওয়ার্ডার তার ভাষায় বলল, ‘এই খাতায় জমা করে দেবার হুকুম আছে।’

‘তবে কোন ওয়ার্ডে থাকবে, সে কথা আবার জিজ্ঞেস করছ?’ খেলু চৌধুরী শক্ত স্বরে বলল, ‘তোমার দেখছি গোলমাল পাকাবার মতলব রয়েছে।’

ওয়ার্ডার বগল থেকে লাঠিটা হাতে নিল। অন্য একজন হিন্দিভাষী ওয়ার্ডার বলল, ‘কোনও গোলমাল নেই খেলুবাবু। আপনাদের দোস্তকে নিয়ে ভিতরে চলে যান, কি কোথাও বসুন। আপনাদের বন্ধু বারো নম্বরেই থাকবে, এর আর বাত পুছের কী আছে?’

‘আমাদের কিছুই নেই।’ একটি যুবক বন্দি বলে উঠল, সুটকেস হাতে ওয়ার্ডারের পাশ থেকে। তার ঠোঁটের কোণে ক্রুদ্ধ বাঁক, চোখ জ্বলছে। আবার বলল, ‘আজেবাজে কথা এই ওয়ার্ডারই বলছে।’

ওয়ার্ডারটি যুবকের মুখের দিকে তাকিয়েই একটু যেন সন্ত্রস্ত সাবধান হয়ে, সুটকেসটা নামিয়ে রেখে, এক পা পেছিয়ে গেল। তার লাঠি-ধরা হাত আর চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। বন্দিদের অনেকের চোখই জ্বলে উঠল। ওয়ার্ডারদের পরস্পরের মধ্যেও দৃষ্টি বিনিময় হয়ে গেল। হঠাৎ কে একজন বলে উঠল, ‘এই ওয়ার্ডারটার মুলুকে বোধ হয় জোতদারি আছে।’

কথাটা শুনেই কয়েকজন বন্দি হেসে উঠল। খেলু চৌধুরী আর রুহিতনও। খেলু চৌধুরী বলল, ‘ঠিক আছে, এখন ছেড়ে দাও। এই ওয়ার্ডারকে আর যাতে এই খাতায় না পাঠানো হয়, আমরা সেই দাবি জানাব। সনতু, তুমি এদিকে সরে এসো।’

ওয়ার্ডারের পাশে যে যুবকটি দাড়িয়েছিল, তার নাম সনতু। পরিস্থিতি একটা অত্যন্ত উত্তেজনাকর থমথমে হয়ে উঠেছে তা স্পষ্ট। সাধারণ কর্মী কয়েদিরাও তাদের কাজ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। সনত্ এবং আরও কয়েকজন তরুণ বন্দিদের শরীর মুখ-চোখের দৃষ্টি শক্ত হয়ে উঠেছিল। সনতু ইতিপূর্বে দু বার ওয়ার্ডারদের সঙ্গে হাতাহাতি করে, ডান্ডাবেড়ি পরে, নির্জন সেলে থেকেছে। ওর সম্পর্কে ওয়ার্ডাররাও সবসময়ে চকিত হয়ে থাকে। কিন্তু খেলু চৌধুরীর নির্দেশে সনতু সরে আসা মাত্রই থমথমে ভাবটা কেটে গেল। খেলু চৌধুরী রুহিতনের হাত ধরে ওয়ার্ডের দিকে পা বাড়িয়ে বলল, ‘ঘরে এসো সবাই সেখানেই আলাপ পরিচয় হবে। কিন্তু—।’ সে কথা থামিয়ে বলতে বলতেই বলল, ‘রুহিতন, তোমার গা বেশ গরম গরম। তোমার চেহারাটাও কেমন অন্য রকম দেখাচ্ছে।’

কী জানি কী হয়েছে।’ রুহিতন উড়িয়ে দেবার মতো করে বলল, ‘আজকাল প্রায়ই দেখি কেমন জ্বর জ্বর লাগে। গা তমতম করে, বুঝলে? আর হাতে পায়ে মুখে কী সব ঘা পা৬চড়ার মতন বেরোচ্ছে। আগের জেলের ডাক্তার কী সব মলম টলম দিত। ওতে কিছুই হয় না। ওরা কী দেয়, কী খাওয়ায় কে জানে? শরীরটা বড় বে-জুত বুঝলে খেলুবাবু? ওহ হ্যাঁ। ওটাকে কী বলে, এই জেলের মধ্যেই আছে, আন্ডার টেরাল না কী বলে?’

খেলু চৌধুরী বলল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ আন্ডার ট্রায়াল জেল হাজত।’

‘অই তাই হবে।’ রুহিতন বলল, ‘ওখান দিয়েই পরশু বিহানে আমাকে একটা ছোট জেল বাড়ির মধ্যে নিয়ে রেখেছিল। একটা দোতলা গারদখানা।’

পিছন থেকে একজন ওয়ার্ভার বলে উঠল, ‘গোরা ডিগরি।’

খেলু চৌধুরী বলল, হ্যাঁ হ্যা৬ শুনেছি, এই জেলে ইওরোপীয়ান ওয়ার্ড আছে। তাকেই গোরা ডিগরি বলে। কোনও দিন দেখিনি। ওহ, পরশু দিন সকালে তোমাকে ওখানে তুলেছিল? আর আজ এখানে দিয়ে গেল? এই যে, রুহিতন ভাই, এই দরজা দিয়ে ঢোকো। বাঁ দিকে সিঁড়ি আছে। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে চললা, আমরা ওপরে গিয়ে বসব।’ তার গলার স্বর শেষের দিকে বদলিয়ে গেল।

রুহিতন আর খেলু চৌধুরীর সঙ্গে সবাই ঠেলাঠেলি করে ওয়ার্ডের ভিতরে ঢুকতে চেষ্টা করল। ফলে, ওয়ার্ডের ছোট দরজার সামনে একটা বাধার সৃষ্টি হল। এক সঙ্গে দুজনের পাশাপাশি ঢোকাই অসুবিধাজনক। রুহিতন কুরমিকে দেখে আর পেয়ে, সকলেই উত্তেজিত। তাদের সকলের কাছেই রুহিতন কুরমি একটি বিশেষ নাম। দু-তিনজন তরুণতম বন্দি, যাদের বয়স খুব বেশি হলে সতেরো-আঠারো, তারা রুহিতন আর খেলু চৌধুরীকে ডিঙিয়ে এগিয়ে গেল আর সামনে থেকে বড় বড় উৎসুক উত্তেজিত গৌরবদীপ্ত চোখে রুহিতন কুরমিকে দেখতে লাগল। দেখতে দেখতেই পিছন হেঁটে তারা সিড়ির দিকে এগিয়ে গেল। সেইভাবেই সিড়িতে উঠতে লাগল।

নীচের এই লম্বা ঘরটা দিনের বেলাও ছায়া ছায়া আবছা অন্ধকার মতো। মাঠের দিকে বড় বড় দরজার মতো, গরাদ বসানো কয়েকটি জানালা আছে। সেই জানালা দিয়ে কিছুটা আলো ভিতরে আসছে। তবু সে আলো লম্বা ঘরটাকে স্পষ্ট করে তুলতে পারেনি। রুহিতন সেই তরুণতম ছেলে কয়েকটির দিকে তাকাল। ওদের চোখের দৃষ্টি তার চেনা। অন্যান্য জেলে, এই রকম বয়সের ছেলেদের উত্তেজনায় জ্বলজ্বল চোখ সে দেখেছে। তাদের সঙ্গে কথা বলেছে। এরা বেশির ভাগই সেই লড়াইয়ের ঘটনা শুনতে চায়। পুলিশ হঠাৎ আচমকা কেমন করে তাদের আস্তানা ঘিরে ফেলেছিল, তারপরে কী ভাবে তীর-ধনুক আর বন্দুকের গুলির লড়াই হয়েছিল এ সব কথাই এরা আগে শুনতে চায়। বুধুয়া-তার বড় ছেলেটা বোধ হয় এখন এদের মতোই বড় হয়েছে। বুধুয়ার পিঠোপিঠিই করম। সেও নিশ্চয়ই এ রকমই বড় হয়ে উঠেছে। রুহিতনকে দেখলে কি তারাও এমনি করেই তাকাবে? ওদের বাবার দিকে?

‘আহ, লাগল নাকি রুহিতন ভাই।’ খেলু চৌধুরী, দোতলায় সিঁড়ির মুখে প্রথম সিঁড়ির নীচেই তাকে দু হাতে জড়িয়ে ধরল।।

পিছন থেকেও কেউ কেউ হাত বাড়িয়ে দিল রুহিতনকে ধরবার জন্য। রুহিতন ঠিক মতো সিঁড়ির প্রথম ধাপটা দেখতে পায়নি। আসলে তার চোখ নীচের দিকে ছিল না। তার দৃষ্টি কি ওয়ার্ডের মধ্যেই ছিল? তার দৃষ্টি পৃথিবীর কোথাও ছিল না। বুধুয়া আর করমা নামে সাত বছর আগে দেখা দুটি বালকের মুখ তার চোখের সামনে ভাসছিল। যারা এখন তরুণ মূর্তি নিয়ে তার চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল। সে বলল, ‘না, লাগে নাই। সিঁড়িটা নজর করি নাই। ঘরটা বড় আন্ধার মতন।’

কিন্তু তার মনের মধ্যে এখন একটা যন্ত্রণা-বিদ্ধ অনুতাপ। ছেলেদের কথা তার মনে পড়ে গেল কেন? আজকাল প্রায়ই এ রকম ঘটে। নতুন নতুন ভাবে বাড়ি বউ ছেলেমেয়ের কথা মনে পড়ে যায়। সে রুহিতন কুরমি। এ সব দুর্বলতা তার কেন থাকবে? জীবনের সব কিছু পণ রেখে যার লড়াই, তার কি কোনও অতীত থাকে? অথবা স্মৃতি? এমন কোনও অনিবার্যতাকে সে মেনে নিতে পারে না।

‘এই যে আমার সঙ্গে পা তোলো। খেলু চৌধুরী বলল, এমন কিছু অন্ধকার তো এখানে নেই।’ তার চোখে বিস্ময়, ভুরু কুঁচকে পিছনে অন্যান্য বন্দিদের দিকে তাকাল।

খেলু চৌধুরীর বিস্ময় অন্যান্য বন্দিদের চোখেও ছিল। কিন্তু তা মুহূর্তের জন্য। নতুন জায়গায় এ রকম ভুল হতে পারে।

রুহিতনের চোখের সামনে সিড়ির ধাপগুলো এখন অনেক স্পষ্ট। কোনও দিকে বাঁক ফেরানো নেই, সোজা উঠে গিয়েছে। সে খেলু চৌধুরীর শেষ কথাটা ঠিক শুনতে পেল না। পিছনে যারা উঠছে, তাদের কথাও এখন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে না। খুব কাছে থেকে বললেই সে স্পষ্ট শুনতে পায়। সে সবথেকে তার কথাই ভাল শুনতে পায়, যার ঠোঁটের এবং মুখের দিকে তাকিয়ে সে কথা শোনে। এ সবের একটাই মাত্র কারণ। রুহিতন নিজে তা ভাল জানে। তার নিজের মনেই সন্দেহ জেগেছে, সে ঠিক আগের মতো আর সব কিছু কানে স্পষ্ট শুনতে পায় না। ছোটখাটো কয়েকটা ঘটনার মধ্য দিয়ে, নিজেই প্রমাণ পেয়েছে, সে আগের মতো আর কান খড়খড়ি নেই। নির্জন বনের গভীরে একটা শুকনো পাতা খসে পড়লে সে শুনতে পেত। বহু দূরের পায়ের শব্দ সে নতে পেত সাপের মতো, ভূমির মৃদুতম ঝংকারে। বাতাসের গায়ে, দূরান্তরের অচেনা গলার স্বর চিনতে পারত। রাত্রের পাখির মতোই সে সজাগ ছিল। ধরা পড়ার পরে, প্রথম জিজ্ঞাসাবাদের সময়েই পুলিশের এলোপাথাড়ি প্রহারে, তার একটা কানের পরদা হয়তো ছিঁড়ে গিয়েছিল। যেমন চলবার সময় তার নীচের বস্তিদেশ সবসময়েই একটু এগিয়ে থাকে। কারণ তার গুহ্যদেশের ওপরেই বাঁ দিকের হাড় চিড় খেয়ে গিয়েছে। সোজা হয়ে চলতে গেলেই চিড় খাওয়া হাড়ে চাড় পড়ে। যন্ত্রণা হয়। বস্তিদেশ সামনে এগিয়ে হাঁটলেও, যন্ত্রণা হয়। তবে অনেকটা কম। তবু এখনও সে অনেক কথা শুনতে পায়, যার শব্দ নির্জন বনে শুকনো পাতা খসে পড়ার মতোই ক্ষীণ। আবার অনেক সময় বদ্ধ কালা হয়েও যেতে পারে। বিশেষ করে যাদের কথা সে শুনতে চায় না।

ওপরের ওয়ার্ডে আলো অনেক বেশি। লোহার গরাদ লাগানো দরজার মতো বড় বড় জানালাগুলো দিয়ে মাঠটা এবং পুকুর দেখা যায়। রোদটা এখনও বাঁকা হয়ে জানালায় এসে পড়েনি। সূর্য আর একটু পুবের ঢাল ছাড়িয়ে উঠলেই পড়বে। তখন ঘরের মধ্যে আরও আলো ছড়িয়ে পড়বে। জানলাগুলো দিয়ে পুকুরের ওপারের গাছ আর অফিস ঘর, সবই দেখা যাচ্ছে। বিপরীত দিকের দেওয়ালেও একই রকম গরাদ দেওয়া বড় বড় জানালা। ওদিকটায় ওয়ার্ডের উঠোন, যে উঠোন দিয়ে রুহিতন সকলের সঙ্গে এখানে এসে উঠল। কয়েকটা গাছপালার জন্য আলো একটু কম আছে। তা হলেও দোতলায় আলো অনেক বেশি।

লম্বা ওয়ার্ডের দু দিকে বন্দিদের লোহার খাটিয়া সারি সারি রয়েছে। মাঝখানটা ফাঁকা। খাটিয়াগুলোতে কম্বল বিছানো। খেলু চৌধুরী তার নিজের খাটিয়ায় রুহিতনকে বসাল। একজন তরুণ বন্দি তার টিনের সুটকেসটা নীচের থেকে নিয়ে নিয়েছিল। সে জিজ্ঞেস করল, ‘খেলুদা, কমরেড রুহিতন কুরমির সুটকেস কোথায় রাখব?’

সেই জবাবের আগেই আর একজন প্রশ্ন করল, ‘কমরেডের বিছানা কোথায় হবে?’

‘এই ওয়ার্ডেই হবে।’ খেলু চৌধুরী বলল, ‘এখানে যখন রুহিতন ভাইকে পাঠিয়েছে, একটা খাটিয়াও ঠিক পাঠিয়ে দেবে। তোমরা যেখানে বলবে, সেখানেই রুহিতনের খাটিয়া পাতা হবে। সুটকেসটা এখন যেখানে তোক এক জায়গায় রাখো।’

রুহিতনের সঙ্গে বন্দিদের কৌতুহল-ঝকঝকে উৎসুক চোখগুলোর দৃষ্টি মিলল। একজন বলে উঠল, ‘আমরা তো সবাই চাইব, কমরেড রুহিতন কুরমি আমার পাশেই থাক।’

কথা শুনে সবাই হেসে উঠল। রুহিতন কুরমির মনটা এক ধরনের আনন্দ আর গৌরবে ভরে উঠছে। সে বলল, আমরা তো সব একসাথে থাকব। এটা আমাদের সকলের ঘর।’

‘ঠিক ঠিক।’ অনেকে একসঙ্গে প্রায় উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বলে উঠল। ইতিমধ্যেই সবাই পাশাপাশি দুটো লোহার খাটিয়ায়, এ ওর ঘাড়ে পিঠে, দলা পাকিয়ে বসে গিয়েছে। সকলেই ঝুঁকে পড়েছে রুহিতনের দিকে। খেলু চৌধুরী বলল, ‘আহ, কতকাল বাদে দেখা, বলো তো রুহিতন ভাই।’

‘হ্যাঁ, তোমার গেরেপ্তারের ঘটনাটা আমাকে আগে বলো দেখি?’ রুহিতন বলল, ‘আমি জানতাম, তুমি শনিলালের জোতঘরের উত্তরে, পদমের টঙে আছ। ঘণ্টাখানেক আগে তোমার সাথে আমার দেখা হইছিল, তাই ত? তারপর? এতদিনে কত কথা যে তোমার নামে শুনলাম। কেউ বলে, তুমি পলায়ে গেছ। কেউ বলে তুমি ধরা পড়েছ। কেউ বলে ওরা তোমাকে গুলি করে মেরে ফেলেছে। আবার কেউ বলে ফাঁসি দিয়েছে। একটা সাচা কথা জানার উপায় নাই। কী কপাল! তোমাকে এখানে দেখব, এক বারও কি ভেবেছি? এখন বলো তো বিত্তান্তটা শুনি?’

খেলু চৌধুরী হেসে জিজ্ঞেস করল, ‘কেন, পদম কিছু বলে নাই?’

‘আরে হায় হায়, যত গোলমাল তো সেইখানেই।’রুহিতন বলল, ‘আধ মরা পদমকে ওরা ধরে নিয়ে এল, আমি ভাবলাম, শনিলালের ঘরের উত্তরে, পদমের জঙ্গল ঢাকা টঙেও যখন ওরা গেছে, তখন আর বোধ হয় কেউ বাকি নাই। ও দিক থেকে বন্দুকের আওয়াজ আমি পেয়েছি। পদমের মুখে শুনলাম, সন্তোষ তার চোখের সামনে ওদের গুলি খেয়ে মরেছে। আর তুমি নাকি গুলি ভরা একখানা যন্তর নিয়ে খুব লড়াই করছিলে। করতে করতে কোন দিকে গেলে, পদম আর তোমাকে দেখতে পায় নাই।’

খেলু চৌধুরীর মুখ শক্ত হল। কপালে অনেকগুলো ভাঁজ পড়ল। তার মুখের হাসিটা যেন ঠিক হাসি না, রাগ আর বিদ্রুপ। বলল, ‘দেখতে পাবে কেমন করে। তখন যদি পারতাম, তোমাদের সবাইকেই বলে দিতাম, পালাও। পদমের টঙ থেকে আমি দেখেছিলাম, ওরা আমাদের কী ভাবে ঘিরে ফেলেছে। জিপ আর ট্রাক দিয়ে সমস্ত রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছিল। আমাদের থেকে দলে ওরা অনেক বেশি ছিল, প্রত্যেকটা বন্দুকের ডগায় বেয়নেট লাগানো ছিল, রাত্রে জঙ্গলে শিকার ধরার ফ্লাশ লাইট তো এনেছিলই। জিপ আর ট্রাকের আলোয় দিনের মতো হয়ে গেছিল। সেই আলোয় দেখলাম, ওরা চারদিকে গিজগিজ করছে। তার মধ্যে জোতদার রুকনুদ্দিন চৌধুরীকে পষ্ট দেখেছি ওদের সঙ্গে, হোমরা চোমরাদের সঙ্গে কথা বলছিল। আরও কে কে ছিল, কে জানে। আমাদের আস্তানাগুলো যে ওদের নখদর্পণে ছিল, তাতে সন্দেহ নাই। লড়াই করেও ওদের সঙ্গে পারা যেত না। তা ছাড়া, তখন আমাদের অনেকেই ছিল না। সে দিন অনেকে খাসমহলে গেছিল, মনে আছে?’

রুহিতন অপলক চোখে খেলু চৌধুরীর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। কিন্তু তার দৃষ্টি দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, সে খেলু চৌধুরীর মুখ দেখছিল না। তার মন জেলের মধ্যেও ছিল না। দার্জিলিং জেলার মিরিক থানার নিচুতে এক বনাঞ্চলের, সাত বছর আগের এক রাত্রে তার মন প্রাণ চলে গিয়েছিল। তবু সে খেলু চৌধুরীর জিজ্ঞাসার জবাবে তৎক্ষণাৎ মাথা ঝাঁকিয়ে শব্দ করল হঁ হঁ।’

‘আমার মনে হয়, সে খবরটাও ওদের জানা ছিল।’ খেলু চৌধুরী বলল, ‘সেই জন্যই রাতারাতি আচমকা ঘিরে ফেলে ঝাপিয়ে পড়েছিল। আমি দেখলাম, লড়তে লড়তে পালানো ছাড়া উপায় নেই। কথাটা পদমকে বলেছিলাম। ও কান দেয়নি, একেবারে ক্ষেপে গেছিল। আমি টুকারিয়াঝাড়ের জঙ্গলের দিকে পালিয়ে গিয়েছিলাম। রাতটা সেখানে কাটিয়ে, পরের দিন ভোরে মেচি নদী পেরিয়ে নেপালের মোরাং-এর পথে রওনা দিয়েছিলাম। আর ধরা পড়লাম সেখানেই।’

রুহিতনের অতিকায় চোখের পাতায় পুচ্ছ বলে কিছু নেই। লাল অবাক চোখ দুটো আরও লাল হয়ে উঠল। বলল, ‘মোরাং-এ ধরা পড়লে? নেপালের মধ্যে?’

‘হ্যাঁ, নেপালের মধ্যে।’ খেলু চৌধুরী হাসল। হাসিটা বাঁকানো আগুন-টকটকে লোহার শিকের মতো। বলল, ‘ভেবেছিলাম নেপালের ভেতরে ঢুকে গেলে সহজে ধরা পড়ব না। কয়েক দিন পরে আবার ফিরে আসব। কিন্তু মোরাং-এ গিয়ে ধরা পড়লাম। বিকালের দিকে একটা চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছিলাম। হঠাৎ কে পেছন থেকে ডেকে উঠল, আরে, খেলুদা যে! আর পেছন ফেরার সময় পাইনি। ভাল করে দেখতেও পাইনি, কারা আমার ওপর ঝাপিয়ে পড়ল, আর মাথায় একটা বাড়ি। কোমরে গোঁজা যন্তরটাও বের করতে পারিনি, চোখ উলটে গেছিল। একদম অজ্ঞান। তারপরে…।’ খেলু চৌধুরী কথাটা শেষ করল না।

রুহিতনের লাল চোখ দুটোতে তখনও অন্যমনস্কতা। বাকি চোখগুলো যেন এক বিস্ময়কর স্বপ্নের ঘোরে জ্বলজ্বলিয়ে জ্বলছিল। কারোর মুখে কথা ছিল না। কেবল একজন কেউ দাঁতে দাঁত চেপে উচ্চারণ করল, ‘বিশ্বাসঘাতকতা!’

‘তাতে কোনও সন্দেহ নেই।’ খেলু চৌধুরী বলল, তার হাসিটা এখন অনেক সহজ। বলল, রুহিতন ভাই তোমার কথা বলো। তার আগে সকলের সঙ্গে তোমার আলাপ করিয়ে দিই।’ বলে সে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে সকলের নাম বলে গেল।

রুহিতন সকলের দিকে দেখতে লাগল। তার চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। চোখের পাতায় পুচ্ছ না থাকায়, লাল ঘায়ের মতো দেখায়। তার ভুরুর চুলও উঠে গিয়েছে। নেই বললেই চলে। ভুরুর চামড়াও যেন ফেটে গিয়েছে। তার মাথায়ও চুল খুব কম। সাত বছর আগের সেই ঝাকড়া ঘন কালো চুল আর নেই। কিন্তু আগের মতোই তার মাথার চাঁদি বেরিয়ে অল্প চুল এখনও ঘাড় অবধি লম্বা। তার মুখের চামড়া যেন স্বাভাবিকের থেকে মোটা। সেই অনুপাতেইনাকের পাটাও ফোলা, ডগায় অনেকটা ছোট আবের মতো লাল ডুমো। নাকের মাঝখানটা হঠাৎ বসে গিয়েছে, যেন ভাঙা। দুই কানের লতিও মোটা, চার পাশের ডগাও। কিন্তু তার কানের ফুটোয় এখনও আছে সেই দুটো মোটা কাঠি পরানো। চিবুকে কপালে লাল গোল চাকা মতো ফোলা ফোলা দাগ।

রুহিতন কুরমির এই মুখ দেখলে, প্রথমেই চিনে উঠতে ধন্দ লেগে যায়। কিন্তু সব মিলিয়ে চিনে উঠতে দেরি লাগে না। তার রং খুব কালো না। যাকে বলে মাজা মাজা, সেই রকম। রংটা এখনও একেবারে নষ্ট হয়ে যায়নি।

নামগুলো বলা হয়ে যাবার পরেই, সবাই একসঙ্গে বলে উঠল, ‘কমরেড রুহিতন কুরমির নিজের কথা শুনব আমরা।’

‘হ্যাঁ, এখানে কোথা থেকে তোমাকে নিয়ে এল, তাই দিয়ে শুরু করো।’ খেলু চৌধুরী বলল, ‘পুরো সাত বছরের কথা শুনতে হবে তো।’

রুহিতন বলল, ‘সবই বলব। তার আগে কটা কথার জবাব দাও দেখি? একটা হল, খাটুনি থেকে তা হলে তোমাদের রেহাই?’

খেলু চৌধুরী আর বাকি সবাই, গম্ভীর মুখে নিজেদের দিকে তাকাল। যেন ঠিক জবাবটা কারোই জানা নেই। শেষ পর্যন্ত খেলু চৌধুরীই বলল, ‘কিছুই ঠিক করে বলা যায় না, বুঝলে রুহিতন ভাই। এই নিয়ে তানশন থেকে অনেক কাঠখড় পুড়েছে। আমাদের একটা দলকে অন্য জায়গায় আলাদা করে রেখেছে, এই জেলখানার মধ্যেই। তাদের খবর আমরা পাচ্ছি না। আমাদের কয়েক মাস খাটাচ্ছে না। কখন কী হুকুম হবে, কী ঘটবে, কিছু বলা যায় না।’

রুহিতন ঘাড় ঝাকিয়ে বলল, ‘তার মানে, সবখানেই এক ব্যবস্থা। আর গর্তের শিয়ালরা কী কয়? তাদের যাওয়া আসা আছে নাকি?’

খেল চৌধুরীর বদলে সুকুমার নামে একটি তরুণ জবাব দিল, ‘এখন নেই। আগে আগে দু-চারটের যাওয়া আসা ছিল, আর আমাদের সঙ্গে ভিড়িয়ে দিলেই মারামারি লেগে যেত। পরে অবিশ্যি আমরাই মার খেতাম বেশি।’

খেলু চৌধুরী হেসে বলল, ‘নিশ্চিন্ত থাকো রুহিতন ভাই, গর্তের শিয়ালরা গর্তেই আছে। জেলখানায় ওরা আর আসবে না। ওরা কাগজ ছাপিয়ে লড়াইয়ের লাইন বাতলাচ্ছে, আর ভোটের ভাগাভাগি করছে। ওরা গর্ত থেকে বেরিয়ে, খোঁয়াড়ে যাবে।’

সবাই হেসে উঠল। রুহিতন বলল, ‘বুঝলাম, লাইনে গলদ নাই।’ তার কথার ভঙ্গিতে আবার সবাই হেসে উঠল। সে না হেসে জিজ্ঞেস করল, ‘আর দিবাবাবু? তার কী খবর? আমি বেহারের জেলে শুনলাম, সে নাকি ধরা পড়েছে?’

সকলের চোখে মুখেই অবাক জিজ্ঞাসা ফুটে উঠল। তারা রুহিতন কুরমিকে দেখল, নিজেদের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করল। খেলু চৌধুরী অবাক স্বরে বলল, ‘এই তো সেদিনের কথা, দিবা বাগচি ধরা পড়ল, মারাও গেল। হার্টফেল করে নাকি মারা গেছে। তাকে আর আমাদের মতো জেল খাটতে হয়নি।’ শেষের দিকে তার স্বর কিছুটা নির্বিকার।

‘দিবাবাবু না?’ রুহিতন ফ্যাসফেসে ভাঙা আর্তস্বরে বলে উঠল। তার অতিকায় পুচ্ছহীন লাল চোখগুলো দগদগে ঘায়ের মতো দেখাল। সকলের মুখগুলো চোখের সামনে থেকে হারিয়ে গেল। দিবা বাগচির মুখ জ্বলজ্বলিয়ে উঠল। তার সবথেকে পুরনো সংগ্রামী বন্ধু, যে তাকে প্রথম নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখিয়েছিল। নতুন জীবনের সেই স্বপ্ন কদাপি বিফল হবার না। সেই সফল স্বপ্নে, অন্ধ দৃষ্টি ফিরে পায়। বোবায় কথা কয়। বন্ধ্যা নারীর সন্তান হয়। ভূমিহীনে ভূমি পায়। জনমজুরে রাজ্য চালায়!… রুহিতন কুরমির সাবালক জীবনে এই প্রথম শোকের আঘাত! সে দুই চোখ বুজল। তার বন্ধ চোখের সামনে দিবা বাগচির মুখ ভাসতে লাগল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *