তারপর ঘণ্টাখানেক গত হইয়াছে। হল-ঘরে আলো জ্বলিয়াছে, কিন্তু ঘরে কেহ নাই।
বাহিরে মোটরের শব্দ হইল; তারপর সদর দরজা ঠেলিয়া নন্দা প্রবেশ করিল। তাহার পশ্চাতে কয়েকটা নূতন বই হাতে লইয়া যদুনাথ আসিলেন।
যদুনাথ লাইব্রেরি-ঘরের দিকে চলিয়া গেলেন; নন্দা কিন্তু হল-ঘরে দাঁড়াইয়া চারিদিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিক্ষেপ করিতে লাগিল। তাহার মুখে আশঙ্কার ছায়া পড়িল। ঘরে কেহ নাই কেন? সব গেল কোথায়?
একটি ভৃত্য কয়েকটা থালা গেলাস হাতে লইয়া ভিতরের দিক হইতে ভোজনকক্ষে যাইতেছে দেখিয়া নন্দা তাহাকে ডাকিল বেচু, সেবক কোথায়?
বেচু বলিল—তা তো জানিনে দিদিমণি। আমি রান্নাঘরে ছিলাম।
আর—দিবাকরবাবু?
তেনাকে তো বিকেল থেকে দেখিনি।
বেচু চলিয়া গেল। নন্দার উদ্বেগ আরও বৃদ্ধি পাইল। সে গিয়া ড্রয়িংরুমের পর্দা সরাইয়া উঁকি মারিল, কিন্তু সেখানে কাহাকেও না দেখিয়া লাইব্রেরি-ঘরে প্রবেশ করিল। লাইব্রেরি-ঘরে যদুনাথ। নূতন বইগুলি সযত্নে আলমারিতে সাজাইতেছিলেন, বলিলেন—
কী রে নন্দা? কিছু খুঁজছিস?
নন্দা বলিল—না দাদু, অমনি
আবার বাহিরে আসিয়া নন্দা ক্ষণকাল দাঁড়াইয়া রহিল, তারপর সিঁড়ি দিয়া উপরে উঠিতে লাগিল।
দ্বিতলে আপন ঘরে দিবাকর টেবিলের সম্মুখে বসিয়া আছে। তাহার সামনে চকচকে পর-চাবিটি রাখা রহিয়াছে, দিবাকর একদৃষ্টে চাবির পানে তাকাইয়া আছে। তাহার ললাটে সংশয়ের ভ্রূকুটি।
দ্বারে মৃদু টোকা পড়িল। দিবাকর বিদ্যুদ্বেগে চাবি পকেটে পুরিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল এবং তাড়াতাড়ি গিয়া দ্বার খুলিয়া দিল।
দ্বারের বাহিরে নন্দা। দিবাকরকে দেখিয়া তাহার চক্ষুদুটি উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। তারপর সে একটু অপ্রতিভ হইয়া পড়িল।
দিবাকর বলিল—আপনারা ফিরে এসেছেন! আমি জানতে পারিনি!
নন্দা জিজ্ঞাসা করিল—কি করছিলেন একলাটি ঘরে বসে?
দিবাকর বলিল——কিছু না। হিসাবের খাতাটায় চোখ বুলোচ্ছিলাম। কিছু দরকার আছে কি?
নন্দা একটু অপ্রতিভভাবে বলিল—না, দরকার আর কি? নীচে আপনাকে দেখতে পেলাম না, তাই ভাবলাম–লজ্জিতভাবে ঢোক গিলিয়া বলিল—বাজারে একটা কলম দেখলাম, পছন্দ হল তাই কিনে আনলাম—
নন্দা একটি ফাউন্টেনপেন দিবাকরকে দেখাইল। দিবাকর কলম হাতে লইয়া দেখিতে দেখিতে হাসিমুখে বলিল—সুন্দর কলম। কিন্তু আপনার তো আরও অনেক কলম আছে।
নন্দা অপ্রস্তুতভাবে বলিল—এটা আপনার জন্যে এনেছি।
দিবাকর বিস্ফারিত চক্ষে চাহিয়া বলিল—আমার জন্যে!
হ্যাঁ। নন্দা জড়িত স্বরে বলিল—আপনাকে হিসেব লিখতে হয়—তাই। কলমটা পছন্দ হয়েছে তো?
দিবাকর তদগতমুখে নন্দার পানে চাহিয়া নম্রকণ্ঠে বলিল— নন্দা দেবী, আপনাকে কী বলে কৃতজ্ঞতা জানাব? আমার ঋণ ক্রমে বেড়েই যাচ্ছে—
না না, এই সামান্য জিনিসের জন্যে
শুধু এই সামান্য জিনিসের জন্যে নয়। আপনার বিশ্বাস, আপনার সমবেদনা—আমাকে আমার অতীত ভুলিয়ে দেবার এই চেষ্টা—এ ঋণ আমি শোধ করব কি করে? পারব না; কিন্তু আমি যেন এর যোগ্য হতে পারি।
কলমটি দুহাতের মধ্যে লইয়া সে মাথা নত করিল।
.
গভীর রাত্রি। দূরে গির্জার ঘড়িতে বারোটা বাজিতেছে। দিবাকর নিজের ঘরে টেবিলের সম্মুখে বসিয়া আছে; তাহার মুখ দেখিয়া মনে হয়, সে যেন জীবনের চৌমাথায় পৌঁছিয়া কোন পথে যাইবে ভাবিয়া পাইতেছে না।
নবলব্ধ কলমটা তাহার বুক-পকেটে আটকানো ছিল, সে তাহা বাহির করিয়া নিবিষ্ট চক্ষে নিরীক্ষণ করিল। কলমের শিরস্ত্রাণ খুলিয়া হিসাবের খাতার একটা পাতায় ধীরে ধীরে লিখিল সূর্যমণি।
কিছুক্ষণ লেখার দিকে চাহিয়া থাকিয়া সে লেখাটা কাটিয়া দিল, তাহার নীচে লিখিল নন্দা। তারপর আবার লিখিল-নন্দা নন্দা
.
অতঃপর অনুমান তিন হপ্তা কাটিয়া গিয়াছে।
যদুনাথের লাইব্রেরি-ঘরে নন্দা বৈকালিক চায়ের সাজসরঞ্জাম লইয়া ব্যস্ত। যদুনাথ চশমা পরিয়া দিবাকরের হিসাবের খাতা পরীক্ষা করিতেছেন। দিবাকর তাঁহার চেয়ারের পাশে দণ্ডায়মান। আজ মাসপয়লা।
নন্দা এক পেয়ালা চা ঢালিয়া যদুনাথের দিকে বাড়াইয়া দিল, কিন্তু তিনি তাহা লক্ষ্য করিলেন না; খাতা দেখিতে দেখিতে হঠাৎ বলিয়া উঠিলেন—
হিসেবে গোলমাল আছে!
নন্দা চমকিয়া উঠিল। দিবাকর যদুনাথের দিকে ঝুঁকিয়া উদ্বিগ্ন স্বরে বলিল—
গোলমাল। কিন্তু
যদুনাথ বলিলেন—আলবৎ গোলমাল আছে। হয় ঠিক্ দিতে ভুল করেছ, নয় তো-। নন্দা, তুই হিসেব দেখেছিস?
নন্দা শঙ্কিত কণ্ঠে বলিল—না দাদু। দিবাকরবাবু কি সব ভণ্ডুল করে ফেলেছেন?
যদুনাথ কহিলেন—ভণ্ডুল! একেবারে লণ্ডভণ্ড। (দিবাকরকে কড়াসুরে) আজ বাইশ দিন হল তুমি কাজ করছ। তুমি বলতে চাও এই বাইশ দিনে আট শ টাকা খরচ হয়েছে।
দিবাকর ভয়ে ভয়ে বলিল—আজ্ঞে আট শ তিন টাকা ছয় আনা। বড্ড বেশি হয়েছে কি?
যদুনাথ হিসাবের খাতা টেবিলের উপর আছড়াইয়া গর্জন ছাড়িলেন
চোর! ডাকাত!! ঐ ভুবনটা আস্ত ডাকাত ছিল। তার আমলে দু হাজার টাকার কমে মাস কাটত না! উঃ এক বছর ধরে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে আমার গলা কেটেছে! হতভাগা! পাজি! রাস্কেল!
নন্দা বলিল-তাহলে এবার খরচ কম হয়েছে।
যদুনাথ বলিলেন—এতক্ষণ তাহলে বলছি কি? কিন্তু এত কম হল কী করে? তুমি কারুর বকেয়া ফেলে রাখোনি তো?
আজ্ঞে এক পয়সা বকেয়া ফেলে রাখিনি।
হুঁ–ভুবনটাকে পেলে জেলে দিতাম। দিবাকরের দিকে হাত বাড়াইয়া বলিলেন—দেখি তোমার হাত।
হাত!
হ্যাঁ হ্যাঁ হাত, তোমার করকোষ্ঠী দেখব।
দিবাকরের ডান হাতটা টানিয়া লইয়া যদুনাথ দেখিতে লাগিলেন; নন্দা ও দিবাকর একবার সশঙ্ক দৃষ্টি বিনিময় করিল।
যদুনাথ দেখিতে দেখিতে বলিলেন-হুঁ, খাঁটি মেষ তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এগুলো কি? খুবরি খুবরি দাগ রয়েছে।
নন্দা সস্নেহে প্রশ্ন করিল—ওতে কি হয় দাদু?
যদুনাথ বলিলেন—কারাগার বাস। তুমি কখনও জেলে গেছ?
দিবাকর চমকিয়া বলিল—জেলে! আজ্ঞে কখনো না। তবে একবার স্বদেশীর হিড়িকে পুলিস ধরে হাজতে রেখেছিল—
যদুনাথ বলিলেন—তাই হবে বোধহয়। রেখাগুলো কিন্তু ভাল নয়।
তিনি সন্দিগ্ধভাবে রেখাগুলির দিকে চাহিয়া রহিলেন। নন্দা তাঁহার মন বিষয়ান্তরে সঞ্চারিত করিবার জন্য বলিল—দাদু, তোমার চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।
দিবাকরের হাত ছাড়িয়া যদুনাথ চায়ের বাটি টানিয়া লইলেন; কতকটা আত্মগতভাবেই বলিলেন—ও রেখা যার হাতে আছে তাকে কখনও না কখনও কারাবাস করতেই হবে–
নন্দা হালকা সুরে বলিল—তা রেখাগুলো রবার দিয়ে ঘষে মুছে ফেলা যায় না?
যদুনাথ হাসিলেন-পাগলি! রবার দিয়ে কি কপালের লেখা মোছা যায়!
এই সময় মন্মথ প্রবেশ করিল। সামুদ্রিক গবেষণা চাপা পড়িল। নন্দা চা ঢালিয়া মন্মথকে দিল। এই অবকাশে দিবাকর হিসাবের খাতাটি লইয়া দ্বারের দিকে চলিতেছিল, যদুনাথ তাহাকে ডাকিলেন—দিবাকর, তুমি চা খেলে না?
দিবাকর বলিল—আজ্ঞে আমি চা খাই না; অভ্যেস নেই।
যদুনাথ বলিলেন—না না, চায়ের অভ্যেস ভাল। একটা ছোট নেশা থাকলে বড় নেশার দিকে মন যায় না। টিকে নিলে যেমন বসন্ত হয় না, চা খেলে তেমনি হুইস্কি ব্রাণ্ডির খপ্পরে পড়বার ভয় থাকে না। নাও, আজ থেকে দুবেলা চা খাবে।
নন্দা হাসিতে হাসিতে বলিল—আসুন দিবাকরবাবু, সাবধানের মার নেই। এই নিন।
দিবাকর আর দ্বিরুক্তি না করিয়া নন্দার হাত হইতে চায়ের পেয়ালা লইল—এই সময় মন্মথর দিকে তাহার নজর পড়িল। মন্মথর মুখ বিরক্তিপূর্ণ; ভৃত্যস্থানীয়ের সহিত এরূপ রসালাপ সে পছন্দ করে না। দিবাকর চায়ের পেয়ালা হাতে লইয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল; প্রভু-পরিবারের সম্মুখে চা পান করিবার ধৃষ্টতা তাহার নাই। মন্মথ বিরাগপূর্ণ নেত্রে নন্দাকে নিরীক্ষণ করিয়া যদুনাথের দিকে ফিরিল
দাদু, নন্দার বিয়ের কিছু করছ?
এই প্রশ্নের অন্তরালে যে একটা খোঁচা আছে তাহা অনুভব করিয়া নন্দার মুখ শক্ত হইয়া উঠিল; কিন্তু সে কিছু বলিবার পুর্বেই যদুনাথ বলিলেন—নন্দার এখন বিয়ের যোগ নেই। ওর কোষ্ঠী দেখেছি, শুক্রের দশায় রাহুর অন্তর্দশা আরম্ভ হয়েছে। এখন তিন বছর বিয়ের যোগ নেই।
নন্দা বলিল—দাদু, দাদার বিয়ের কি করছ?
মন্মথ বলিল—আমি এখন বিয়ে করব না।
যদুনাথ বলিলেন–হ্যাঁ হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি কী! আরও কটা মাস যাক।
মন্মথ বলিল—কিন্তু নন্দার বিয়ে একটু তাড়াতাড়ি হলেই ভাল হত।
নন্দা বলিল—দাদার বিয়েও তাড়াতাড়ি হলে ভাল হত।
এই পরোক্ষ কথা কাটাকাটি বোধকরি আরও কিছুক্ষণ চলিত, কিন্তু এই সময় সেবক দ্বারের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। বলিল—
স্যাকরাবাবু এসেছে! পাঠিয়ে দেব?
যদুনাথ বলিলেন—কে নবীন? হ্যাঁ হ্যাঁ, পাঠিয়ে দে।
চামড়ার ব্যাগ হাতে নবীন স্যাকরা প্রবেশ করিল। মধ্যবয়স্ক, মধ্যমাকৃতি, পুষ্টমধ্যদেশ; চোখে অর্ধচন্দ্রাকৃতি চশমা। মাথা ঝুঁকাইয়া প্রণামপুর্বক নবীন ব্যাগটি টেবিলের উপর রাখিল। বলিল—নন্দা-দিদির লকেট-হার এনেছি।
নন্দা সহর্ষে বলিল—আমার লকেট-হার!
ব্যাগ হইতে একটা ছোট কৌটা বাহির করিয়া নবীন যদুনাথের চোখের সম্মুখে খুলিয়া ধরিল। নীল মখমলের আসনে একটি সরু সোনার হার, তাহার মধ্যস্থলে হীরামুক্তাখচিত একটি পেণ্ডেন্ট।
নন্দা দাদুর পাশে গিয়া দাঁড়াইয়াছিল; যদুনাথ গহনাটি দেখিয়া নন্দার হাতে তুলিয়া দিতে দিতে বলিলেন—বাঃ, খাসা গড়েছ হে নবীন। এই নে, নন্দা।
নন্দা কৌটাটি হাতে লইয়া কিছুক্ষণ আনন্দোজ্জ্বল চোখে চাহিয়া রহিল; তারপর মন্মথ যেখানে জানালার পাশে দাঁড়াইয়া চা পান করিতেছিল সেইখানে ছুটিয়া গেল। ইতিপূর্বে দাদার সহিত যে বেশ একটু কথাকথান্তর হইয়া গিয়াছে তাহা আর তাহার মনে রহিল না। সে বলিল—দাদা, দেখ দেখ, কী সুন্দর!
মন্মথ নূতন গহনাটি দেখিল; তাহার মনের মধ্যে ঈর্ষার মতো একটা দাহ জ্বলিয়া উঠিল। আহা, এমনি একটি গহনা সে যদি লিলিকে দিতে পারিত তাহা হইলে তাহার মান থাকিত। সে শুষ্ক স্বরে বলিল—বেশ, ভাল।
মন্মথ ঘর হইতে নিষ্ক্রান্ত হইল। নন্দা তখন ফিরিয়া আসিয়া যদুনাথের পায়ের ধুলা লইল।
যদুনাথ বলিলেন—বেঁচে থাক্। এখন যা, নিজের ঘরে গিয়ে গলায় পরে দ্যাখ
নন্দা চলিয়া গেলে যদুনাথ নবীনকে জিজ্ঞাসা করিলেন—নবীন, তোমার হিসেব এনেছ?
নবীন বলিল—আজ্ঞে এনেছি
নবীন আবার ব্যাগ খুলিতে প্রবৃত্ত হইল।
.
দ্বিতলে নিজের ঘরে মন্মথ আয়নার সম্মুখে দাঁড়াইয়া বিরসমুখে সাজগোজ করিতেছে। নন্দার নুতন অলঙ্কারটি দেখিয়া তাহার মন খারাপ হইয়া গিয়াছে। সে কল্পনায় ঐ অলঙ্কারটি লিলির কণ্ঠে শোভিত দেখিতেছে এবং মনে মনে নিজেকে ধিক্কার দিতেছে। দাশু ও ফটিক লিলিকে নিত্য নূতন উপহার দিয়া থাকে আর তাহার সে ক্ষমতা নাই। ছি ছি, লিলি হয়তো মনে করে, মন্মথ কৃপণ, ক্ষুদ্রমনা
ওদিকে না নিজের ঘরে আসিয়া আয়নার সম্মুখে নূতন হারটি গলায় পরিয়াছিল এবং উৎফুল্ল মুখে ঘুরিয়া ফিরিয়া দেখিতেছিল। তৃপ্তির একটি ক্ষুদ্র নিশ্বাস ফেলিয়া সে হারটি গলা হইতে খুলিয়া আবার কৌটার মধ্যে রাখিল। এই সময় দ্বারের নিকট হইতে সেবকের গলা আসিল
দিদিমণি, কর্তা তোমাকে একবার নীচে ডাকছেন।
নন্দা বলিল—যাই সেবক
কৌটাটি পড়ার টেবিলের উপর রাখিয়া নন্দা তাড়াতাড়ি ঘর হইতে বাহির হইল।
মন্মথ নিজের ঘর হইতে সেবকের কথা ও নন্দার উত্তর শুনিয়াছিল। সে টাই বাঁধিতে বাঁধিতে হঠাৎ থামিয়া গিয়া উৎকৰ্ণভাবে শুনিতে লাগিল; তাহার চোখের দৃষ্টি উত্তেজনায় তীব্র হইয়া উঠিল।
বারান্দায় সেবক ও নন্দার পদশব্দ মিলাইয়া গেলে মন্মথ চোরের মতো দরজা খুলিয়া এদিক ওদিক দৃষ্টিপাত করিল। কেহ নাই। সে দ্রুত বারান্দা পার হইয়া নন্দার ঘরে প্রবেশ করিল।
ঠিক এই সময় দিবাকর নিজের ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিল।
সে মন্মথকে নন্দার ঘরে প্রবেশ করিতে দেখে নাই, কিন্তু সিঁড়ির দিকে দুএক পা অগ্রসর হইতেই সহসা থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল। দেখিল, মন্মথ নন্দার ঘর হইতে বাহির হইয়া বিদ্যুদ্বেগে নিজের ঘরে প্রবেশ করিল এবং দ্বার বন্ধ করিয়া দিল।
দিবাকর সবিস্ময়ে চাহিয়া রহিল। মন্মথ সম্ভবত দিবাকরকে দেখিতে পায় নাই; কিন্তু সে নন্দার ঘরে প্রবেশ করিয়াছিল কি জন্য? এবং এমন সন্দেহজনকভাবে বাহির হইয়া আসিল কেন? নন্দা কি নিজের ঘরে আছে? ব্যাপারটা যেন ঠিক স্বাভাবিক নয়। দিবাকর সংশয়িত চিত্তে দাঁড়াইয়া ঘাড় চুলকাইতে লাগিল।
.
সিঁড়ির নিম্নতন সোপানে দাঁড়াইয়া নন্দা যদুনাথের সহিত কথা কহিতেছে। যদুনাথ বলিতেছেন—বলছিলাম, আজ আর নূতন গয়নাটা পরে কাজ নেই। কাল রবিবার, কাল পরিস। কেমন?
নন্দা বলিল—আচ্ছা দাদু
যদুনাথ বলিলেন—আর দ্যাখ, দিবাকর বোধ হয় ওপরে আছে, তাকে বলে দিস্ হিসেবের খাতায় যেন নোট করে রাখে, সোমবার দিন ব্যাঙ্ক থেকে বারো শ টাকা বের করতে হবে। নবীনকে আসতে বলেছি, যেন ভুল না হয়।
আচ্ছা দাদু
নন্দা আবার উপরে উঠিয়া গেল।
উপরের বারান্দায় পৌঁছিয়া নন্দা দেখিল, দিবাকর অনিশ্চিতভাবে দাঁড়াইয়া মাথা চুল্কাইতেছে। সে বলিল—এ কি, আপনি এখানে দাঁড়িয়ে।
দিবাকর দ্বিধাভরে বলিল—না, কিছু নয়।
নন্দা বলিল— শুনুন। দাদু বললেন, খাতায় নোট করে রাখুন, সোমবার ব্যাঙ্ক থেকে বারো শ টাকা বার করতে হবে। যেন ভুল না হয়।
খাতা দিবাকরের সঙ্গেই ছিল, সে নোট করিয়া লইল। বলিল—
কি জন্যে টাকা বার করতে হবে তা কিছু বলেননি?
নন্দা বলিল—স্যাকরাকে দিতে হবে।
ও– দিবাকর নোট করিয়া বলিল—স্যাকরাকে যখন টাকা দিতে হবে তখন নিশ্চয় গয়না এসেছে। এবং বাড়িতে গয়না পরবার লোক যখন আপনি ছাড়া আর কেউ নেই তখন নিশ্চয় আপনার গয়না। কেমন?
নন্দা হাসিয়া বলিল—ঠিক ধরেছেন। আপনার দেখছি ডিটেকটিভ হতে আর দেরি নেই। কী গয়না বলুন দেখি?
তা জানি না।
তবে আর কী ডিটেকটিভ হলেন! আসুন দেখাচ্ছি। ভারি সুন্দর পেণ্ডেন্ট হার!
নন্দা নিজের ঘরে প্রবেশ করিল; দিবাকর পিছন পিছন গেল।
নন্দা টেবিলের সম্মুখীন হইয়া দেখিল হারের বাক্স নাই। সে ক্ষণকাল অবুঝের মত চাহিয়া রহিল।
এ কি! কোথায় গেল?
দিবাকর জিজ্ঞাসা করিল—কী কোথায় গেল?
নন্দা বিচলিত স্বরে বলিল—হারের কৌটো। টেবিলের ওপর রেখে এক মিনিটের জন্যে নীচে গিয়েছিলাম
দিবাকরের মুখ গম্ভীর হইল। সে বুঝিতে পারিল হারের কৌটা কোথায় গিয়াছে।
তবু সে প্রশ্ন করিল—অন্য কোথাও রাখেননি তো?
নন্দা দ্রুত গিয়া ওয়ার্ডরোব খুলিয়া দেখিল।
না, এখানেও নেই।
সে ফিরিয়া আসিয়া দিবাকরের সম্মুখে দাঁড়াইল; তাহার মুখ এই অল্পকালের মধ্যেই বিবর্ণ ও কঠিন হইয়া উঠিয়াছে।
সে বলিল—কেউ নিয়েছে। নইলে যাবে কোথায়?
দিবাকর বলিল—আপনি বলছেন—কেউ চুরি করেছে?
তা ছাড়া আর কী হতে পারে? কর্পূরের মতো উপে যেতে তো পারে না!
দিবাকর একটু চুপ করিয়া রহিল; তাহার মুখে একটি অস্বচ্ছন্দ হাসি ধীরে ধীরে ফুটিয়া উঠিল। সে বলিল—বাড়িতে জানা চোর এক আমিই আছি। সুতরাং আমাকে সন্দেহ করাই স্বাভাবিক।
নন্দা বলিল—আমি আপনাকে সন্দেহ করতে চাই না। কিন্তু আর তো কেউ নেই। উঃ, আমি কত আশা করেছিলাম। আমার সব আশা মিছে হয়ে গেল
নন্দা হঠাৎ যেন ভাঙিয়া পড়িল; সে চেয়ারে বসিয়া দুহাতে মুখ ঢাকিল। দিবাকর ক্ষণকাল করুণচক্ষে তাহার পানে চাহিয়া রহিল।
শেষে বলিল—আপনি যে আমাকে সন্দেহ করতে চান না সেজন্যে ধন্যবাদ। কিন্তু এখন আপনি কি করবেন?
নন্দা মুখ তুলিল।
কী করব?—একথা তো আর লুকিয়ে রাখা যায় না; দাদুকে বলতে হবে। সব কথাই এখন দাদুকে বলতে হবে।
সব কথা?
নন্দা উঠিয়া দাঁড়াইল, একটু ঝোঁক দিয়া বলিল—হ্যাঁ, সব কথা। দাদুকে ঠকিয়েছিলাম তার ফল এখন পাচ্ছি। কোনও কথাই আর চেপে রাখা চলবে না, দিবাকরবাবু।
নন্দা দ্বারের দিকে পা বাড়াইল।
দিবাকর বলিল—আমার একটা অনুরোধ আপনি রাখবেন?
অনুরোধ!
আজ কর্তাকে কিছু বলবেন না। যা হারিয়েছে তা যদি রাত্তিরের মধ্যে না পাওয়া যায় তখন যা হয় করবেন।
নন্দা তীক্ষ্ণ চক্ষে দিবাকরকে নিরীক্ষণ করিল; একটু ইতস্তত করিয়া বলিল—আচ্ছা বেশ। আজ রাত্তিরটা সময় দিলাম।
সে আবার চেয়ারে বসিয়া পড়িল। দিবাকর একবার মাথা ঝুঁকাইয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।
.
অতঃপর কয়েক মিনিট অতীত হইয়াছে।
বাড়ি হইতে ফটকে যাইবার পথের ধারে একটা হাসুহেনার ঝোপের আড়ালে দিবাকর লুকাইয়া আছে এবং বাড়ির সদর লক্ষ্য করিতেছে। তাহার চোখে শিকারপ্রতীক্ষ ব্যাধের দৃষ্টি।
সদর দরজা দিয়া মন্মথ বাহির হইয়া আসিল; একবার হাত দিয়া নিজের পকেট অনুভব করিল, তারপর দ্রুতপদে ফটকের দিকে চলিল।
দিবাকরের কাছাকাছি আসিতেই দিবাকর হঠাৎ একটা চিৎকার ছাড়িয়া ঝোপের আড়াল হইতে বাহির হইয়া আসিল এবং ছুটিয়া গিয়া মন্মথকে একেবারে জড়াইয়া ধরিল।
পালান পালান! সাপ! সাপ!!
অ্যাঁ! সাপ!
দুজনে জাপটা-জাপটি করিয়া প্রায় পতনোম্মুখ হইল; তারপর একসঙ্গে ফটকের দিকে ছুটিল। ফটকের বাহিরে আসিয়া মন্মথ হাঁপাইতে হাঁপাইতে থামিল।
মন্মথ জিজ্ঞাসা করিল-কি সাপ?
দিবাকর বলিল—হাস্নুহেনার ঝাড়ের মধ্যে ছিল—ইয়া বড় কেউটে সাপ। আর একটু হলেই মেরেছিল ছোবল! যাক, আর ওদিকে যাবেন না; আমি সাপ মারার ব্যবস্থা করছি।
কি আপদ!
মন্মথ আর একবার নিজের পকেট অনুভব করিয়া দেখিল, পকেটের জিনিস পকেটেই আছে। সে তখন আর কোনও কথা না বলিয়া চলিয়া গেল।
.
সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়াছে। লিলির ঘরে নৃত্য গীত চলিতেছে। দাশু পিয়ানো বাজাইতেছে; লিলি নাচিতেছে। ফটিক ঘরের এক কোণে বসিয়া নৃত্যের তালে তালে তুড়ি দিতেছে; অন্য কোণে মন্মথ বসিয়া অপলক নেত্রে চাহিয়া আছে। লিলি নাচিতে নাচিতে গাহিতেছে
আমার
কল্পনাতে চলছে জাল-বোনা
মনের ওপর রঙের আলপনা।
আমরা দুজন বাঁধব সুখনীড়
অজানা কোন্ গিরি-নদীর তীর
রইব দূরে কারুর কথা মানব না!
কল্পনাতে চলছে জাল-বোনা।
মোদের ছোট্ট খেলাঘর
খেলব মোরা নতুন বধুবর
সোনার স্বপন প্রেমের স্বপন ভাঙব না!
কল্পনাতে চলছে জাল-বোনা।
ডাকবে ময়ুর মোদের আঙিনায়
নাচবে হরিণ তরুণ ভঙ্গিমায়
মোরা দেখব শুধু ভুলেও তাদের বাঁধব
না!
কল্পনাতে চলছে জাল-বোনা!
নাচগান সমে আসিয়া থামিলে লিলি মন্মথর সম্মুখে গিয়া হাসিমুখে দাঁড়াইল। মন্মথ উঠিয়া মুগ্ধনেত্রে চাহিল।
লিলি বলিল—কেমন লাগল, মন্মথবাবু?
মন্মথ গদগদ স্বরে বলিল—কি বলব, ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। আপনার জন্যে সামান্য উপহার এনেছি, তাই দিয়ে মনের ভাব বোঝাবার চেষ্টা করি। —
মন্মথ পকেট হইতে মখমলের কৌটাটি বাহির করিল। দাশু ও ফটিক উপহারের নামে কাছে আসিয়া জুটিল; মন্মথ বেশ একটু আড়ম্বরের সহিত বাক্সটি খুলিয়া লিলির সম্মুখে ধরিতে গিয়া চমকিয়া উঠিল। বাক্স শূন্য, হার নাই! মন্মথ বুদ্ধিভ্রষ্টের মতো চাহিয়া রহিল।
অ্যাঁ–কোথায় গেল!
সে ক্ষিপ্রহস্তে দুই পকেট খুঁজিয়া দেখিল কিন্তু কিছু পাইল না। তাহার মুখ পাংশু হইয়া গেল
নিশ্চয় কেউ আমার পকেট মেরেছে
দাশু ও ফটিক হো হো শব্দে হাসিয়া উঠিল। লিলির অধরেও একটা চাপা হাসি খেলিয়া গেল
লিলি জিজ্ঞাসা করিল–কি ছিল, মন্মথবাবু?
জড়োয়া পেণ্ডেন্ট হার। বাড়ি থেকে যখন বেরিয়েছি তখনও ছিল—অ্যাঁ!
দিবাকরের সর্পভীতির কথা তাহার মনে পড়িয়া গেল। তবে কি তবে কি-? মন্মথ ধীরে ধীরে চেয়ারে বসিয়া পড়িল।
লিলি সদয় কৌতুকের ভঙ্গিতে বলিল—তবে বোধহয় রাস্তায় কোথাও পড়ে গেছে। কী আর হবে? যা গেছে তার জন্যে দুঃখ করে লাভ নেই। আসুন মন্মথবাবু, এক গ্লাস শরবত খান। ওরে কে আছিস!
মন্মথ মোহগ্রস্তের ন্যায় বসিয়া রহিল; দাশু ও ফটিক শিস্ দিতে দিতে ঘরের অন্যদিকে চলিয়া গেল। হঠাৎ মন্মথ লাফাইয়া উঠিল; তাহার মুখ-চোখ উত্তেজনায় লাল হইয়া উঠিয়াছে।
বুঝেছি কে নিয়েছে। এ ছাড়া আর কেউ নয়। দেখে নেব—আজ দেখে নেব আমি!
সে ঝড়ের মতো বাহির হইয়া গেল। বাকী তিনজন জিজ্ঞাসুনেত্রে পরস্পরের পানে চাহিল।
ফটিক বলিল—ব্যাপার কি?
দাশু হাত উল্টাইয়া নিশ্বাস ফেলিল—বুঝলাম না।
.
নন্দা তাহার ঘরে আলো জ্বালিয়া পড়িতে বসিয়াছিল; কিন্তু পড়ায় তাহার মন বসিতেছিল না। তাহার মুখখানি বিষণ্ণ ও উৎকণ্ঠিত।
কিছুক্ষণ বই নাড়াচাড়া করিয়া সে উঠিয়া পড়িল। বারান্দায় বাহির হইয়া দেখিল, দিবাকরের ঘরের দরজা ভেজানো রহিয়াছে। সে সন্তর্পণে দরজা ঠেলিয়া দেখিল, ঘর অন্ধকার, ভিতরে কেহ নাই। নন্দার উৎকণ্ঠা আরও বাড়িয়া গেল। কোথায় গেল দিবাকর?
তবে কি তাহাকে মিথ্যা স্তোক দিয়া পলায়ন করিয়াছে? নন্দা নীচে নামিয়া চলিল।
হল-ঘরের ঘড়িতে রাত্রি সাড়ে আটটা বাজিয়াছে। নন্দা সিঁড়ি দিয়া নীচে নামিতে নামিতে দেখিল মন্মথ সদর দরজা দিয়া প্রবেশ করিতেছে। মন্মথর মুখ ক্রোধে বিবর্ণ; সে একবার কটমট চক্ষে চারিদিকে তাকাইয়া লাইব্রেরি-ঘরের দিকে চলিল।
লাইব্রেরিতে যদুনাথ বসিয়া অধ্যয়ন করিতেছিলেন; মন্মথ বুনো মোষের মতো প্রবেশ করিতেই তিনি বই হইতে মুখ তুলিলেন।
মন্মথ! আজ দেখছি নটার আগেই ফিরেছ। কি হয়েছে?
মন্মথ ক্রুদ্ধস্বরে বলিল—দাদু, তুমি ঐ দিবাকরটাকে তাড়িয়ে দাও।
যদুনাথ চশমা খুলিয়া বিস্ফারিত চক্ষে চাহিলেন।
দিবাকরকে তাড়িয়ে দেব! কেন, কি করেছে সে?
মন্মথ একটু থমকিয়া বলিল—সে-তাকে আমার পছন্দ হয় না।
যদুনাথ ভ্রু তুলিয়া বলিলেন—পছন্দ হয় না। কিন্তু কেন? একটা কারণ থাকা চাই তো! আমি তো দেখছি সে ভারি ভাল ছেলে, কাজের ছেলে। ভুবনটা ছিল চোর। দিবাকর আসার পর সংসার খরচ অর্ধেক কমে গেছে, তা জানো?
কিন্তু ও ভাল লোক নয়, ভারি বজ্জাত
বজ্জাত! কোনও প্রমাণ পেয়েছ?
প্রমাণ আবার কি? আমি জানি ও ভারি বদ্ লোক।
যদুনাথ ভুকুঞ্চন করিয়া সরোষে মাথা নাড়িলেন—
ছি মন্মথ! যার বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণ নেই তাকে তুমি বজ্জাত বলতে পার না! তুমি যদি দেখাতে পারো যে দিবাকর কোনও অন্যায় কাজ করেছে, আমি এই দণ্ডে তাকে বিদেয় করে দেব। কিন্তু বিনা অপরাধে বাড়ির কুকুর-বেড়ালকেও আমি তাড়াব না। এ তোমার কি রকম স্বভাব হচ্ছে? তুমি তাকে পছন্দ কর না বলে তার অন্ন মারতে চাও?
মন্মথ মুখ গোঁজ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল, উত্তর দিল না।
যদুনাথ বলিলেন-যাও। আর যেন এরকম কথা আমাকে শুনতে না হয়। ন্যায়বান হবার চেষ্টা কর, মন্মথ। নিজের চাকরবাকরের প্রতিও কর্তব্য আছে একথা ভুলে যেও না।
মন্মথ মুখ কালীবর্ণ করিয়া চলিয়া গেল। দ্বারের বাহিরে পর্দার আড়ালে দাঁড়াইয়া নন্দা সমস্তই শুনিয়াছিল; মন্মথ সিঁড়ি দিয়া উপরে উঠিয়া গেলে সেও সংশয়-মন্থর পদে উপরে চলিল।
উপরে মন্মথ নিজের দরজা ধাক্কা দিয়া খুলিয়া সহসা দাঁড়াইয়া পড়িল; দেখিল দিবাকর পিছনে হাত দিয়া দণ্ডায়মান রহিয়াছে। তাহার শান্ত মুখে একটু মোলায়েম হাসি। সে বলিল-দরজাটা বন্ধ করে দিন।
দরজা বন্ধ করিয়া মন্মথ প্রজ্বলিত চক্ষে তাহার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। বলিল—ইউ! তুমি আমার ঘরে কি করছ?
কিছু না, এই ছবিখানা দেখছিলাম।
পিছন হইতে হাত বাহির করিয়া দিবাকর লিলির ফটোখানা মন্মথর চোখের সামনে ধরিল। মন্মথ ক্ষণেকের জন্য স্তম্ভিত হইয়া গেল, তারপর এক ঝাপটায় ছবিটা কাড়িয়া লইয়া পকেটে পুরিল।
ইউ স্কাউন্ড্রেল! বেরোও আমার ঘর থেকে। গেট আউট।
দিবাকর শান্তভাবে বলিল-বেরুচ্ছি। কিন্তু তার আগে আপনাকে দুএকটা কথা বলতে চাই। মন্মথবাবু, আপনি যে স্ত্রীলোকের ফটো যত্ন করে দেরাজে লুকিয়ে রেখেছেন তার আসল পরিচয় বোধহয় জানেন না—
মন্মথ চাপা গর্জনে বলিল—চোপ্ রও উল্লুক! চোর কোথাকার!
বাহিরে বারান্দায় এই সময় না নিজের ঘরে প্রবেশ করিতে যাইতেছিল; মন্মথর উগ্র কণ্ঠস্বর শুনিয়া থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল। ঘরের মধ্যে দিবাকরের মুখের হাসি মিলাইয়া গিয়াছিল। সে একটু ভ্রূ তুলিয়া বলিল—চোর! আপনি আমাকে চোর বলছেন! কেন? আমি আপনার পকেট থেকে এই জিনিসটা তুলে নিয়েছিলাম বলে?
দিবাকর পকেট হইতে হারটি লইয়া আঙুলের ডগায় তুলিয়া ধরিল। এবারও মন্মথ ঝাপটা মারিয়া হারটা কাড়িয়া লইবার চেষ্টা করিল কিন্তু পারিল না। ঠিক সময়ে দিবাকর হাত সরাইয়া লইল।
মন্মথ দাঁতে দাঁত পিষিয়া বলিল—তুমি—তুমি।
দিবাকর হার পকেটে রাখিয়া বলিল—হ্যাঁ, এ হার আমি আপনার পকেট থেকে তুলে নিয়েছিলাম। কিন্তু এ হার আপনার পকেটে গেল কি করে, মন্মথবাবু? নন্দা দেবীর হার পকেটে নিয়ে আপনি কোথায় যাচ্ছিলেন?
সে খবরে তোমার দরকার নেই, পাজি রাস্কেল কোথাকার! আমি যাচ্ছি দাদুকে বলতে যে তুমি আমার পকেট মেরেছ।
বেশ তো, চলুন না আমিও সঙ্গে যাচ্ছি। আপনার যা বলবার আপনি বলবেন, আমার বক্তব্য আমি বলব। আপনার বোনের নতুন গয়না নিয়ে আপনি কোথায় যাচ্ছিলেন, জানতে পারলে কর্তা খুব খুশি হবেন। চলুন তাহলে, আর দেরি করে কাজ নেই।
মন্মথ একটা চেয়ারে জবুথবু হইয়া বসিয়া পড়িল; তাহার আর যুদ্ধস্পৃহা রহিল না। ক্লান্তকণ্ঠে বলিল—যাও– যাও আমার সামনে থেকে
দ্বারের বাহিরে নন্দা প্রায় হতজ্ঞান হইয়া শুনিতেছিল। কে চোর তাহা বুঝিতে তাহার বাকী ছিল না।
দিবাকর বলিল—মন্মথবাবু, আপনি কোন পথে চলেছেন তা একবার ভেবে দেখেছেন কি? নিজের বোনের গয়না চুরি করে আজ আপনি এক অপদার্থ স্ত্রীলোককে দিতে যাচ্ছিলেন। আপনি জানেন না, আপনার মতো অনেক লোকের সর্বনাশ করেছে লিলি—এই তার পেশা–
মন্মথর ক্ষাত্ৰতেজ আর একবার চাগাড় দিয়া উঠিল।
দ্যাখো, ভাল হবে না বলছি
দিবাকর বলিল—আমি কর্তাকে সব কথাই বলে দিতে পারি। শুনে তিনি সম্ভবত আপনাকে বাড়ি থেকে বার করে দেবেন। কিন্তু আমি তা চাই না। এখনও সামলে যান, মন্মথবাবু, নইলে আপনার ইহকাল পরকাল সব যাবে, লোকালয়ে মুখ দেখাতে পারবেন না।
যাও তুমি
যাচ্ছি। কিন্তু মনে রাখবেন।
দিবাকর দ্বার খুলিয়া বাহির হইয়া গেল।
বাহিরে আসিয়াই নন্দার সহিত তাহার চোখাচোখি হইয়া গেল। কোনও কথা হইল না; দিবাকর ঘাড় নিচু করিয়া নিজের ঘরে চলিয়া গেল। নন্দা লজ্জা-লাঞ্ছিত মুখে কিছুক্ষণ চাহিয়া রহিল, তারপর ধীরে ধীরে দিবাকরের অনুসরণ করিল।
দিবাকর ঘরে গিয়া চেয়ারে বসিয়াছিল, নন্দা আস্তে আস্তে টেবিলের পাশে দাঁড়াইল। দিবাকর চেয়ার ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইল; কিছুক্ষণ কোনও কথা হইল না। তারপর দিবাকর গম্ভীর মুখে হারটি পকেট হইতে বাহির করিয়া নন্দার সম্মুখে টেবিলের উপর রাখিল।
নন্দা হারের পানে ফিরিয়াও চাহিল না। কাতর চক্ষু দিবাকরের পানে তুলিয়া ম্রিয়মাণ কণ্ঠে বলিল—দিবাকরবাবু, কি বলে আপনার কাছে ক্ষমা চাইব?
দিবাকর শুষ্কস্বরে বলিল—ক্ষমা চাওয়ার কোনও কথাই ওঠে না, নন্দা দেবী। কিন্তু আশা করি, এর পর আপনার দাদুকে আর কিছু বলবার দরকার হবে না।
নন্দা অবরুদ্ধস্বরে বলিল—দাদুকে কী বলব। দাদা আমার হার চুরি করেছিল এই কথা দাদুকে বলব! উঃ দিবাকরবাবু, সত্যি বলছি আপনাকে, লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছে। শেষে দাদা এই করলে!
দিবাকর বলিল—মন্মথবাবুকে খুব বেশী দোষ দেওয়া যায় না। উনি বড় অসৎ সঙ্গে পড়েছেন।
নন্দা বলিল—এখন বুঝতে পারছি দাদা কিসে এত খরচ করে। কিন্তু থাক ওকথা। দিবাকরবাবু, আপনাকে অন্যায় সন্দেহ করেছিলাম, আপনি আমাকে ক্ষমা করুন।
দিবাকর নিশ্বাস ফেলিল—ক্ষমা করবার কিছু নেই, নন্দা দেবী। আমাকে সন্দেহ করে কিছুমাত্র অন্যায় করেননি। কিন্তু এবার আমাকে যেতে হবে।
নন্দা শঙ্কিত কণ্ঠে বলিল—যেতে হবে।
হ্যাঁ, আমি চাকরি ছেড়ে চলে যেতে চাই। দেখুন, আমি যতদিন এ বাড়িতে থাকব, আপনার সন্দেহ যাবে না; আমি চোর একথা আপনি ভুলতে পারবেন না। তার চেয়ে চলে যাওয়াই ভাল।
আর কখনও আমি আপনাকে অবিশ্বাস করব না।
দিবাকর ম্লান হাসিয়া বলিল—এখন তাই মনে হচ্ছে বটে এর পরে যখনই বাড়িতে কিছু ঘটবে, আপনি আমাকে সন্দেহ করবেন। আপনি এক দণ্ড প্রাণে শান্তি পাবেন না। তার কী দরকার? আপনার অশান্তি আর বাড়াব না।
নন্দার চক্ষু সহসা অশ্রুপূর্ণ হইয়া উঠিল।
আপনি এখনও আমাকে ক্ষমা করতে পারেননি, তাই চলে যেতে চাইছেন।
না, সেজন্যে নয়। আপনার অশান্তির কথা ভেবেই আমি
আমার অশান্তির কথা আপনাকে ভাবতে হবে না।
আপনি আমার জন্যে যা করেছেন—
আমি আপনার জন্যে যা করেছি তার জন্যে যদি আপনার এতটুকু কৃতজ্ঞতা থাকে তাহলে আপনি চলে যেতে পারেন না।
দিবাকর ক্ষণেক নীরব রহিল। শেষে বলিল—এই যদি আপনার হুকুম হয়—
নন্দা বলিল—হ্যাঁ, এই আমার হুকুম।
নন্দা দ্রুতপদে দ্বারের পানে চলিল। পিছন হইতে দিবাকর ডাকিয়া বলিল—আপনার হার ফেলে যাচ্ছেন।
নন্দা কিন্তু দাঁড়াইল না।