রাত্রি। লিলির ড্রয়িংরুম।
দাশু, ফটিক ও লিলি বসিয়া শরবত খাইতেছে। লিলির পরিধানে নৃত্য-বেশ; দাশু ও ফটিকের সাহেবী পোশাক।
দাশু গেলাস হাতে লইয়া রাস্তার দিকের জানালার সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইল। বলিল—খোকার আসবার সময় হল। রাস্তার ওপর নজর রাখি। আচমকা এসে না পড়ে।
ফটিক বলিল-লিলি, আর দেরি নয়। অনেক খেলিয়েছ, এবার মাছ ডাঙায় তোলো।
লিলি মাথা নাড়িয়া বলিল-উহু, আরও খেলবে।
ফটিক বলিল—খেলালে খেলবে না কেন? কিন্তু আর খেলাবার দরকার আছে কি? আমার তো মনে হয়, এবার টান দিলেই মাছ ডাঙায় উঠবে।
লিলি বলিল—উহু, আরও সময় চাই। তুমি ওদের ধাত জানো না, ফটিক, ওরা বড়মানুষের ছেলে; চুনোপুঁটি নয়, রুই-কাতলা, হঠাৎ টান মারলে সুতো ছিঁড়ে যাবে।
বেশ, তোমার কাজ তুমি জানো। কিন্তু মনে রেখো, চোরাবাজারেও সূর্যমণির দাম দুলাখ টাকা। শেষে ফসকে না যায়।
ফসকাবে না।
জানালা দিয়া মোটর হর্নের আওয়াজ আসিল। দাশু বলিল
এসেছে।
লিলি বলিল-এবার তাহলে অভিনয় আরম্ভ হোক।—দাশুবাবু, আর এক পেয়ালা শরবত
মন্মথ প্রবেশ করিল। দাশু ও ফটিককে দেখিয়া তাহার মুখের হাসি মিলাইয়া গেল; সে থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল। লিলি স্বাগত করিল—এই যে মন্মথবাবু! আসুন।
মন্মথ লিলির পাশে গিয়া দাঁড়াইল, ক্ষুব্ধস্বরে বলিল-ভেবেছিলাম আজ আপনি একলা থাকবেন।
দাশু একটা মুখভঙ্গি করিল; ফটিক যেন শুনিতে পায় নাই এমনিভাবে সিগারেট ধরাইল। লিলি মিষ্ট হাসিয়া বলিল—একলা থাকবার কি যো আছে, মন্মথবাবু! এই দেখুন না, ফটিকবাবু নেমন্তন্ন করেছেন, গ্র্যাণ্ড হোটেলে যেতে হবে। সেখানে আজ বল ডান্স আছে।
মন্মথ নিরাশকণ্ঠে বলিল—বল ডান্স!
লিলি কহিল–বসুন না, এখনও আমাদের বেরুতে দেরি আছে। এক গ্লাস ঘোলের শরবত আনতে বলব?
না, থাক মন্মথ একটা চেয়ারে উপবেশন করিল। এই সময় লিলির গলায় একটি সুন্দর জড়োয়া কষ্ঠি তাহার দৃষ্টি আকর্ষণ করিল। তাহার দৃষ্টি অনুসরণ করিয়া লিলি নিজের গলায় হাত দিল—
কী সুন্দর পেণ্ডেন্ট দেখেছেন, মন্মথবাবু? আজ ফটিকবাবু উপহার দিলেন।
মন্মথ এ পর্যন্ত লিলিকে কোনও দামী জিনিস উপহার দিতে পারে নাই; তাহার মুখে ঈর্ষামিশ্রিত লজ্জা ফুটিয়া উঠিল। ফটিক সবিনয়ে তাচ্ছিল্যের সহিত বলিল—তুচ্ছ জিনিস, তুচ্ছ জিনিস, লিলি দেবী। আপনার মরাল-গ্রীবার যোগ্য নয়।
দাশু আসিয়া টেবিলের উপর শুন্য গেলাস রাখিল। বলিল—আমার কথাটা ভুলবেন না, লিলি দেবী। আসছে হপ্তায় আমার পার্টিতে যেতেই হবে, না গেলে ছাড়ব না। আপনার জন্যই এত আয়োজন করছি।
লিলি বলিল—তা যাবার চেষ্টা করব। জানেন মন্মথবাবু, দাশুবাবু এত ভাল পার্টি দেন যে কী বলব। চার-পাঁচ হাজার টাকা খরচ করেন।
দাশু উদার কণ্ঠে বলিল—চার-পাঁচ হাজার টাকা আর এমন কি বেশী! আমার সমস্ত জমিদারীটাই আপনার পায়ে তুলে দিতে রাজি আছি, লিলি দেবী। কিন্তু আপনি নিচ্ছেন কৈ?
লিলি চোখ বড় বড় করিয়া বলিল—তা কি আমি নিতে পারি? মন্মথবাবু, আপনি বলুন তো, এ রকম উপহার কি কোনও ভদ্রমহিলার নেওয়া উচিত? তাতে কি নিন্দে হয় না?
ফটিক বলিল—ও আলোচনা এখন থাক। দেরি হয়ে যাচ্ছে। মন্মথবাবু, আপনি যদি আসতে চান তো আসুন না। নাচতে জানেন নিশ্চয়ই?
মন্মথ অপ্রতিভ ও মর্মাহত হইয়া অর্ধস্ফুটস্বরে বলিল—আমি—আমি—নাচতে জানি না
ফটিক দাঁত খিচাইয়া হাসিল—তাতে কি? আমরা আপনাকে নাচাব অখন—মানে, আমাদের নাচ দেখতে দেখতেই শিখে যাবেন।
মন্মথ শুষ্কস্বরে বলিল—না, আজ আমাকে সকাল সকাল বাড়ি ফিরতে হবে। কাল রাত্রে বাড়িতে চোর ঢুকেছিল।
দাশু চমকিয়া উঠিল—চোর!
ফটিক তাহার প্রতিধ্বনি করিল—চোর!
লিলি শঙ্কিত কণ্ঠে বলিল—কিছু চুরি গেছে নাকি?
মন্মথ বলিল—না, চুরি যায়নি। কিন্তু সাবধান থাকা দরকার। আচ্ছা আজ আমি চললাম, আর একদিন আসব।
লিলি মধুর কণ্ঠে বলিল—নিশ্চয় আসবেন, ভুলবেন না যেন।
মন্মথ প্রস্থান করিলে তিনজনে উদ্বিগ্নভাবে পরস্পর মুখের পানে চাহিল।
ফটিক বলিল—এ আবার এক নতুন ফ্যাসাদ। চোর! হয়তো সূর্যমণির ওপর আর কারু নজর পড়েছে—
দাশু মুখ অন্ধকার করিয়া বলিল—আমরা তোড়জোড় করে কাজটা বেশ গুছিয়ে এনেছি, এখন যদি আর কেউ ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খেয়ে যায়।
ফটিক বলিল—লিলি, আর নয়, চটপট জাল গুটিয়ে ফ্যালো। নইলে জেলের মাছ চিলে ছোঁ মারবে। কলকাতা শহরে আমাদের মতো অনেক ঘাগী জাল পেতে বসে আছে।
লিলি ভাবিতে ভাবিতে বলিল—হুঁ। আমি ভাবছি সূর্যমণির দিকে হাত বাড়াবে এত বুকের পাটা কার? কানামাছি নয় তো?
দাশু চোয়াল ঝুলিয়া পড়িল—কানামাছি!
তিনজনের মুখেই আশঙ্কার ছায়া ঘনীভূত হইল।
.
পরদিন প্রাতঃকালে যদুনাথের লাইব্রেরি ঘরে বসিয়া দিবাকর এক তাড়া নোট গুনিতেছিল; তাহার সম্মুখে একটি বাঁধানো হিসেবের খাতা। নোট গোনা শেষ হইলে সে নোটগুলি টেবিলের উপর রাখিয়া হিসাবের খাতা টানিয়া লইল। কিন্তু কি করিয়া সংসারের হিসাব লিখিতে হয় তাহা তাহার জানা নাই; সে খাতাটা কয়েকবার উল্টাইয়া পাল্টাইয়া শেষে তাহার প্রথম পৃষ্ঠায় পেন্সিল দিয়া লিখিতে আরম্ভ করিল।
এই সময় ঠাকুরঘর হইতে পুজারতির ঘন্টা ও নন্দার গানের আওয়াজ ভাসিয়া আসিল। দিবাকর কয়েক মুহূর্ত স্থির হইয়া শুনিল, তারপর নোটগুলি পকেটে পুরিয়া এবং হিসাবের খাতাটি বগলে লইয়া লাইব্রেরি হইতে বাহির হইল।
ঠাকুরঘরে তখন সূর্যদেবতার পূজা আরম্ভ হইয়াছে। যদুনাথ এক হাতে ঘন্টা নাড়িয়া পূজা করিতেছেন; নন্দা সূর্যের স্তব গাহিতেছে—
নমো নমো হে সূর্য,
তুমি জীবন জয়-তুর্য।
জবাকুসুম সঙ্কাশম
সকল কলুষ-তম নাশম,
নমো নমো হে সূর্য।
চির-জ্যোতির্ময়, অন্তর-পঙ্ক
বহ্নি প্রবাহে কর অকলঙ্ক।
তব কাঞ্চন লাবণ্য
যুগে যুগে ধন্য হে ধন্য,
সুন্দর, ত্রিভুবন পূজ্য
নমো নমো হে সূর্য।
দিবাকর দ্বারের বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল। যদুনাথ তাহাকে দেখিতে পাইয়া হস্ত সঙ্কেতে তাহাকে ভিতরে আসিয়া বসিতে বলিলেন। দিবাকর এক কোণে আসিয়া বসিল এবং দেবতাটিকে নিরীক্ষণ করিতে লাগিল।
গান শেষ হইলে যদুনাথ পুষ্পাঞ্জলি দিয়া প্রণাম করিলেন। নন্দা গলায় আঁচল দিয়া প্রণাম করিল, দিবাকর অবনত হইয়া যুক্ত কর কপালে ঠেকাইল। যদুনাথ উঠিবার উপক্রম করিয়া বলিলেন—
দিবাকর, আমার ঠাকুরকে চিনতে পারলে?
দিবাকর বলিল—আজ্ঞে না, এমন ঠাকুর আমি কখনো দেখিনি। কে ইনি?
যদুনাথ ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন—ইনিও দিবাকর।
আজ্ঞে!!
দিবাকর, সূর্য, হিরন্ময় পুরুষ, জগতের প্রাণ, জীবের জীবন। সোনার মণ্ডলের মধ্যে পদ্মরাগমণি; বিগ্রহ দেখে চিনতে পারলে না! ইনিই আমার কুলদেবতা।
পদ্মরাগমণি! এতবড় পদ্মরাগমণির তো অনেক দাম!
দাম! টাকা দিয়ে এর দাম হয় না, দিবাকর। এই সূর্যমণি আমার বংশে সাতপুরুষ ধরে আছেন। ইনি যতদিন আছেন, ততদিন কোনও অনিষ্ট আমার বংশকে স্পর্শ করতে পারবে না।
সকলে ঠাকুরঘরের বাহিরে আসিলেন। যদুনাথ দরজায় তালা লাগাইয়া চাবির গোছা কোমরে গুঁজিলেন। দিবাকরকে বলিলেন
তোমাকে সকালে খরচের টাকা দিয়েছি। যেমন যেমন খরচ হচ্ছে, হিসেব রাখছো তো?
দিবাকর বলিল—আজ্ঞে রাখছি। কিন্তু হিসেবটা ঠিক রাখা হচ্ছে কিনা বুঝতে পারছি না। যদি একবার দেখিয়ে দেন—
যদুনাথ বলিলেন-সংসারের খুঁটিনাটি হিসেব রাখা শক্ত বটে। আমার চশমা—(চশমা খুঁজিলেন) কোথায় রেখেছি। নন্দা, তুমি দেখিয়ে দাও কি করে হিসেব রাখতে হবে।
নন্দা বলিল—আচ্ছা, আসুন আমার সঙ্গে
নন্দার পিছু পিছু দিবাকর ড্রয়িংরুমে গেল। নন্দা একটা সোফায় বসিয়া বলিল—কৈ দেখি, কি হিসেব লিখেছেন।
দিবাকর সোফার পাশে দাঁড়াইয়া হিসাবের খাতা নন্দাকে দিল।
নন্দা বলিল—দাঁড়িয়ে রইলেন কেন? বসুন না। এইখানে বসুন।
নন্দা নিজের পাশে নির্দেশ করিল। দিবাকর বিহ্বল হইয়া পড়িল—
আমি-না না—আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই
নন্দা বলিল—কি মুশকিল! কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবেন? এত সঙ্কোচ কিসের?
দিবাকর বলিল—না না, সঙ্কোচ নয়। কিন্তু আপনার পাশে
নন্দা বলিল—আমার পাশে বসলে কোনও ক্ষতি হবে না, আমার সংক্রামক রোগ নেই। আপনি দেখছি ভারি সেকেলে।
মোটেই না। তবে
তবে আপনার মনে নিজের সম্বন্ধে ক্ষুদ্রতা-বোধ আছে।—দিবাকরবাবু, নিজেকে ছোট মনে করবেন না, অতীতের কথা ভুলে যান। ভাবতে শিখুন, আপনি কারুর চেয়ে হীন নন। তবেই অতীতকে কাটিয়ে উঠতে পারবেন।
তাহলে বসি—? দিবাকর সঙ্কুচিতভাবে বসিল।
নন্দা হাসিয়া বলিল—হ্যাঁ, অনেকটা হয়েছে। এবার দেখি খাতা।
নন্দা খাতা খুলিল।
এই সময় উপরে নিজের ঘরে মন্মথ সাজগোজ করিতেছিল। কোট পরিয়া ড্রেসিং টেবিল হইতে মনিব্যাগ লইয়া খুলিয়া দেখিল তাহাতে মাত্র দুই-তিনটি টাকা আছে। মন্মথর কপালে উদ্বেগরেখা পড়িল। সে অধর দংশন করিয়া চিন্তা করিতে লাগিল।
নীচে ড্রয়িংরুমে না দিবাকরের হিসাব দেখিয়া কলকণ্ঠে হাসিতেছে—
এ কী লিখেছেন! এরকম করে বুঝি হিসেব লেখে?
দিবাকর লজ্জাবিমূঢ় কণ্ঠে বলিল—আমি জানি না; আপনি শিখিয়ে দিন।
নন্দা সদয় কণ্ঠে বলিল—আপনি কখনও লেখেননি তাই ভুল করেছেন। নইলে হিসেব লেখা খুব সহজ; তার জন্যে বি-এ এম-এ পাস করতে হয় না। এই দেখুন। —যে খাতায় হিসেব লিখবেন তাকে দুভাঁজ করুন। এই ভাবে—কেমন? এটা হল জমার দিক, আর এটা খরচের দিক। বুঝলেন? এখন পাতার মাথায় আজকের তারিখ দিন। (নিজেই তারিখ লিখিল) হয়েছে? আচ্ছা, আজ দাদু আপনাকে কত টাকা দিয়েছেন?
দিবাকর বলিল–পঞ্চাশ টাকা। তার মধ্যে খরচ হয়েছে
নন্দা বলিল—খরচের কথা পরে হবে। এখন জমার পঞ্চাশ টাকা এই দিকে লিখুন—নিজেই লিখিল)—আজ যদি দাদু আপনাকে আরও টাকা দেন তাহলে এই দিকে জমা করবেন
দিবাকর বলিল—এইবার বুঝেছি। খরচের হিসেব এই দিকে থাকবে। আমায় খাতা দিন, এবার আমি লিখতে পারব।
নন্দা হাসিতে হাসিতে তাহাকে খাতা ফিরাইয়া দিল।
এই সময় মন্মথ সিঁড়ি দিয়া নীচে নামিয়া আসিতেছিল। সে অর্ধেক সিঁড়ি নামিবার পর নন্দা হাসিমুখে ড্রয়িংরুম হইতে বাহির হইয়া আসিল এবং উপরে উঠিতে লাগিল। মন্মথকে সকালবেলা সাজগোজ করিয়া বাহির হইতে দেখিয়া সে একটু বিস্মিত হইল, কিন্তু কোনও প্রশ্ন করিল না।
মন্মথ হল-ঘরে নামিয়া এদিক ওদিক চাহিতে লাগিল, যেন কাহাকেও খুঁজিতেছে। তারপর ড্রয়িংরুমের পর্দা সরাইয়া ভিতরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিল। সে জানিল না, নন্দা সিঁড়ির অর্ধপথে দাঁড়াইয়া তাহাকে লক্ষ্য করিতেছে।
দিবাকরকে ড্রয়িংরুমে দেখিয়া মন্মথ প্রবেশ করিল। দিবাকর মনোযোগের সহিত খাতা লিখিতেছিল, সসম্ভ্রমে উঠিয়া দাঁড়াইল।
মন্মথ বলিল—তুমি নতুন বাজার-সরকার না? কি নাম তোমার
দিবাকর বলিল—দিবাকর।
হা হা। দ্যাখো, আমার হঠাৎ কিছু টাকার দরকার হয়েছে। তোমার কাছে টাকা আছে তো?
আছে—
আমাকে আপাতত গোটা পঁচিশ দাও তো।
আজ্ঞে–তা—হিসেবে কী খরচ লিখব?
হিসেবে কিছু লেখবার দরকার নেই। তুমি নতুন লোক, তাই জানো না। দাও দাও, দেরি হয়ে যাচ্ছে–
কিন্তু কর্তাবাবু যখন হিসেব চাইবেন, তখন এই পঁচিশ টাকার কী হিসেব দেব?
আঃ, তুমি দেখছি একেবারেই গবেট। দাদুকে এ টাকার কথা বলবে না। হিসেবের খাতা তোমার হাতে, তুমি adjust করে নেবে বুঝলে? ভুবনবাবুও তাই করত—
দিবাকর ফ্যালফ্যাল করিয়া চাহিয়া রহিল। ইতিমধ্যে নন্দা যে নিঃশব্দে আসিয়া দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়াছে তাহা কেহই লক্ষ্য করে নাই। তাহার কণ্ঠস্বর শুনিয়া উভয়ে চমকিয়া উঠিল।
দাদা
নন্দা কাছে আসিয়া তীক্ষ্ণ তিরস্কারের চক্ষে মন্মথর পানে চাহিল। ধরা পড়িয়া গিয়া মন্মথ কাঁচামাচুভাবে চক্ষু নত করিল।
নন্দা বলিল—দাদা, এ তুমি কী করছ, নিজের কর্মচারীকে জোচ্চুরি করতে শেখাচ্ছ?
মন্মথ আমতা-আমতা করিয়া বলিল—আমি—আমার কিছু টাকার দরকার।
নন্দা সবিস্ময়ে বলিল—টাকার দরকার। মাসের পয়লা হাত-খরচের টাকা তুমি পাওনি?
এঁ—পেয়েছিলাম। কিন্তু
এই এগারো দিনে একশ টাকা খরচ করে ফেলেছ! কিসে খরচ করলে? (মন্মথ নীরব) দাদা, কি করো এত টাকা নিয়ে। দাদু যদি জিগ্যেস করেন, তখন কী জবাব দেবে?
মন্মথ ভয় পাইয়া বলিল—না না, দাদু জানতে পারবেন কেন? আমার পকেট থেকে টাকা চুরি গিয়েছিল—তাই
নন্দা বলিল—কেন মিছে কথা বলছ দাদা, তুমি খরচ করেছ। কিসে খরচ করেছ তুমিই জানো। কিন্তু এসব ভাল কথা নয়।
নন্দার তিরস্কার মন্মথর অসহ্য বোধ হইতেছিল, কিন্তু এ সময় মেজাজ দেখাইবার সাহস তাহার নাই; সে প্যাঁচার মতো মুখ করিয়া দ্বারের দিকে চলিল।
নন্দা বলিল—শোনো। বাইরে যাচ্ছ দেখছি। হাতে কি একটিও টাকা নেই?
মন্মথ বলিল-না।
নন্দা তখন দিবাকরের দিকে ফিরিয়া বলিল—দিবাকরবাবু, দাদাকে পাঁচটা টাকা দিন।
দিবাকর মন্মথকে টাকা দিয়া বলিল—হিসেবে কি লিখব?
নন্দা বলিল—আমার নামে খরচ লিখুন; আমি এখনও হাত-খরচের টাকা নিইনি। কিন্তু দাদা, মনে থাকে যেন!
আচ্ছা আচ্ছা
মন্মথ একরকম রাগ করিয়াই চলিয়া গেল। ভ্রাতা ভগিনীর মধ্যে এই কলহের সাক্ষী হইয়া দিবাকর বড়ই অস্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করিতেছিল এবং হিসেবের খাতার আড়ালে আত্মগোপনের চেষ্টা করিতেছিল! নন্দা তাহার ভাব দেখিয়া একটু হাসিল, বলিল
দিবাকরবাবু, দাদা টাকাকড়ি সম্বন্ধে বড় আলগা। দাদুকে আজকের কথা যেন বলবেন না।
না না।
আর একটা কথা। রাত্রি দশটার পর আমরা কেউ বাড়ির বাইরে থাকি দাদু পছন্দ করেন না। কিন্তু দাদা প্রায়ই দেরি করে বাড়ি ফেরে। একথাটাও দাদুর কানে না ওঠে। দাদু সেকেলে মানুষ
আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, কাউকে কোনও কথা আমি বলব না। কিন্তু মন্মথবাবু যদি আবার টাকা চান?
নন্দা দৃঢ়স্বরে বলিল-আপনি দেবেন না।
.
লিলির ড্রয়িংরুমে লিলি সোফায় অঙ্গ এলাইয়া চকোলেট চিবাইতেছে এবং একটা সচিত্র বিলাতী পত্রিকার ছবি দেখিতেছে। ঘরে আর কেহ নাই।
মন্মথ প্রবেশ করিল। তাহার দুই হাত পিছনে লুক্কায়িত, মুখে হাসি।
সে বলিল—মিস লিলি, আপনার জন্যে একটা জিনিস এনেছি।
লিলি হাস্যোজ্জ্বল মুখে উঠিয়া দাঁড়াইল
মন্মথবাবু! কি জিনিস এনেছেন। দেখি দেখি—
একটি গোলাপ ফুলের তোড়া মন্মথ লিলির সম্মুখে ধরিল। লিলির মুখ দেখিয়া বোঝা গেল সে নিরাশ হইয়াছে, কিন্তু সে চকিতে মনোভাব গোপন করিয়া হাততালি দিয়া হাসিয়া উঠিল।
বাঃ! কি সুন্দর ফুল! আমি গোলাপ ফুল বড্ড ভালবাসি।
মন্মথ বলিল—আমি কিন্তু অন্য ফুল ভালবাসি।
সত্যি? কী ফুল ভালবাসেন?
কমল ফুল—যার বিলিতি নাম লিলি।
লিলি সলজ্জ মুখভঙ্গি করিয়া বলিল—কী দুষ্টু আপনি!
মন্মথ গদগদ-মুখে লিলির একটা হাত চাপিয়া ধরিল—
লিলি! সত্যি বলছি, তোমাকে আমি লভ করি। এত দিন মুখ ফুটে বলতে পারিনি; যখনি বলতে চেয়েছি, হয় দাশুবাবু নয় ফটিকবাবু—
এই সময় যেন তাক বুঝিয়া দাশু প্রবেশ করিল! লিলি তাড়াতাড়ি হাত ছাড়াইয়া লইল বলিল—
ওঃ! দাশুবাবু
মন্মথ ক্রোধে মুখ বিশ্বম্ভর করিয়া জানালার কাছে গিয়া দাঁড়াইল। দাশু লিলির কাছে আসিয়া ছদ্ম বিরক্তির সহিত বলিল—ভেবেছিলাম আপনি একলা থাকবেন, কিন্তু! (তোড়া দেখিয়া) ফুল কোথা থেকে এল? মন্মথবাবু এনেছেন নাকি?
লিলি বলিল—হ্যাঁ, কি সুন্দর ফুল দেখুন, দাশুবাবু!
দাশু অবজ্ঞাভরে বলিল—ফুল আমি অনেক দেখেছি, লিলি দেবী। ফুল মন্দ জিনিস নয়; কিন্তু তার দোষ কি জানেন? শুকিয়ে যায়, বাসি হয়ে যায়; দুদিন পরে আর কেউ তার পানে ফিরে তাকায় না।
মন্মথ ফিরিয়া দাঁড়াইয়া গভীর ভ্রূকুটি করিয়া দাশুর পানে তাকাইয়া ছিল; দাশু কিন্তু তাহার ভুকুটি সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করিয়া বলিল—
কিন্তু দুনিয়ায় এমন জিনিস আছে যা শুকিয়ে যায় না, বাসি হয় না; যার সৌন্দর্য চিরদিন অম্লান থাকে—এই দেখুন।
দাশু পকেট হইতে একটি মখমলের ক্ষুদ্র কৌটা লইয়া লিলির চোখের সামনে খুলিয়া ধরিল; সোনার আংটিতে কমলকাট হীরা ঝকমক করিয়া উঠিল। দাশু মন্মথর দিকে মুখ বাঁকাইয়া একটু হাসিল
ফুলের চেয়ে এর কদর বেশি, লিলি দেবী।
লিলি আগ্রহাতিশয্যে ফুলের তোড়াটা টেবিল লক্ষ্য করিয়া ছুঁড়িয়া দিল, তারপর আংটির কৌটা হাতে লইয়া উদ্দীপ্তচক্ষে দেখিতে লাগিল। তোড়াটা টেবিলের কানায় লাগিয়া মেঝেয় পড়িল।
লিলি বলিল—কি চমৎকার হীরের আংটি। মন্মথবাবু, দেখুন দেখুন
মন্মথ অন্ধকার মুখে ফুলের তোড়াটা তুলিয়া টেবিলের উপর রাখিল এবং লিলির পাশে আসিয়া দাঁড়াইল।
লিলি বলিল—দেখছেন, হীরেটা জ্বলজ্বল করছে! নতুন কিনলেন বুঝি, দাশুবাবু?
দাশু বলিল—না, আমার ঠাকুমার গয়নার বাক্সে ছিল; কত দিন থেকে আমাদের বংশে আছে তার ঠিক নেই। স্যাকরাকে দেখিয়েছিলাম, সে বললে আড়াই হাজার টাকা দিয়ে কিনে নিতে রাজি আছে। আমি দিলাম না। হাজার হোক বংশের একটা এয়ারলুম—
মন্মথ মনে মনে জ্বলিতেছিল, আর চুপ করিয়া থাকিতে পারিল না; বিকৃতমুখে বলিয়া উঠিল—
কী এয়ারলুম দেখাচ্ছেন আপনি! এ আবার একটা হীরে! আমার বাড়িতে যে-জিনিস আছে তা দেখলে ট্যারা হয়ে যাবেন।
দাশু ভঙ্গি করিয়া কিছুক্ষণ মন্মথর পানে চাহিয়া রহিল।
বটে? কি জিনিস আছে আপনার বাড়িতে?
সূর্যমণির নাম শোনেননি কখনও? লিলি দেবি, আপনিও শোনেননি?
লিলি যেন অবাক হইয়া বলিল—না। সে কি জিনিস, মন্মথবাবু?
মন্মথ সগর্বে বলিল—অ্যাতবড় বিলিতি বেগুনের মতো একটা পদ্মরাগমণি—যাকে রুবি বলে। আমাদের বংশে সাত পুরুষ ধরে আছে।
লিলি বলিল—আঁ—সত্যি! টমাটোর মতো রুবি! কত দাম হবে, মন্মথবাবু?
মন্মথ উচ্চাঙ্গের হাসিয়া বলিল—দাম তার সাত পয়জার। টাকা দিয়ে কিনবে এমন লোক ভারতবর্ষে নেই।
লিলি বলিল—উঃ! এত দামী রুবি! আমার যে ভারি দেখতে ইচ্ছে করছে। মন্মথবাবু, একবারটি দেখাতে পারেন না?
মন্মথ থতমত হইয়া বলিল—সে—সে আমাদের গৃহদেবতা, ঠাকুরঘরে থাকে। দাদু সর্বদা ঠাকুরঘরে চাবি দিয়ে রাখেন।
দাশু ব্যঙ্গ হাস্য করিয়া বলিল—বিলিতি বেগুনের মতো রুবি দেখা আমাদের কপালে নেই। কি আর করবেন, লিলি দেবী, আপাতত এই মটরের মতো হীরেটাই দেখুন। পছন্দ হয়?
লিলি মুগ্ধভাবে নিরীক্ষণ করিল। বলিল—খুব পছন্দ হয়। কিন্তু
দাশু উদার স্বরে বলিল—তাহলে ওটা আপনিই নিন। আপনাকে উপহার দিলাম।
লিলি বলিয়া উঠিল—আঁ-না না, এত দামী জিনিস।
দাশু জোর করিয়া লিলির আঙুলে আংটি পরাইয়া দিতে দিতে বলিল—দামী জিনিসই আপনার হাতে মানায়। আমি আমার দামী জিনিস ঠাকুরঘরে বন্ধ করে রাখি না—
লিলি বিগলিত কণ্ঠে বলিল—ধন্যবাদ দাশুবাবু। আপনার মতো উঁচু মেজাজ
দাশু বলিল—থাক থাক, আমাকে লজ্জা দেবেন না। বরং তার বদলে চলুন নদীর ওপর বেড়িয়ে আসা যাক। আমার মোটর লঞ্চটা তৈরি করে রেখেছি। দুজনে গঙ্গার বুকে—খুব আমোদ হবে।
লিলি থমকিয়া বলিল—শুধু আমারা দুজন—আর কেউ নয়?
দাশু বলিল—কেন, তাতে দোষ কি? আমি ভদ্রলোক, আপনি ভদ্রমহিলা—এতে আপত্তির কী আছে?
লিলি কুষ্ঠিতভাবে বলিল—না না, আপত্তি নয়, কিন্তু মন্মথবাবু, আপনিও চলুন না।
এই সব কথা শুনিতে শুনিতে মন্মথ একেবারে নিভিয়া গিয়াছিল। লিলির প্রস্তাবে তাহার মুখে একটা একগুঁয়ে ভাব ফুটিয়া উঠিল। সে বলিল—না। আমি চললাম—
সে দ্বারের দিকে চলিল। দাশু ও লিলির মধ্যে একটা চোখের ইশারা খেলিয়া গেল। লিলি দ্রুত গিয়া মন্মথকে দ্বারের কাছে ধরিয়া ফেলিল। বলিল—মন্মথবাবু, আপনার সঙ্গে একটা কথা আছে, শুনুন।
মন্মথকে হাত ধরিয়া আড়ালে লইয়া গিয়া লিলি চুপি চুপি বলিল—দেখুন, দাশুবাবু খুবই ভদ্রলোক, সচ্চরিত্র সজ্জন ব্যক্তি। তবু, ওঁর সঙ্গে যদি একলা যাই, পাঁচজনে পাঁচ কথা বলবে। কিন্তু আপনি সঙ্গে থাকলে কারুর কিছু বলবার থাকবে না। আপনি চলুন, মন্মথবাবু।
মন্মথর মুখ উজ্জ্বল হইয়া উঠিল।
তুমি যখন বলছ, লিলি, নিশ্চয় যাব।
লিলি তাহার হাত ধরিয়া ভিতরে আনিল। বলিল-দাশুবাবু, এঁকে রাজি করিয়েছি। আমরা তিনজনেই যাব।
দাশু ক্ষুব্ধতার অভিনয় করিয়া বলিল—তা—আপনার যখন ইচ্ছে—উনিও চলুন। তাহলে আর দেরি নয়, চটপট বেরিয়ে পড়া যাক।
.
সন্ধ্যার প্রাক্কাল। যদুনাথের লাইব্রেরি-ঘরে দিবাকর একাকী বইভরা আলমারিগুলির কাছে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে; দুএকটা বই খুলিয়া পাতা উল্টাইতেছে, আবার রাখিয়া দিতেছে। তাহার ভাব দেখিয়া মনে হয়, বইগুলি তাহার পড়িবার ইচ্ছা। কিন্তু সাহস নাই।
এই সময় বাহিরে গাড়িবারান্দার সম্মুখে মোটর হর্নের শব্দ হইল—দিবাকর উৎকর্ণ হইয়া শুনিল
গাড়ি বারান্দায় যদুনাথের মিনাভা গাড়ি দাঁড়াইয়া আছে; ইঞ্জিন সচল। যদুনাথ গাড়ির দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া অধীরভাবে সদর দরজার দিকে তাকাইতেছেন। তাঁহার গলায় চাদর, হাতে আবলুশের লাঠি। বাহিরে যাইবার সাজ।
যদুনাথ ডাকিলেন–ওরে নন্দা, আয় না। আর কত সাজগোজ করবি? দেরি হয়ে যাচ্ছে যে—
নন্দা বাড়ি হইতে বাহির হইয়া আসিল। তাহারও সাজপোশাক বহির্গমনের উপযোগী, কিন্তু মুখে একটু উদ্বেগের ছায়া।
যদুনাথ বলিলেন—আয়, কত দেরি করলি বল দিকি! সন্ধ্যের পর হয়তো দোকান বন্ধ হয়ে যাবে। আয়।
নন্দা আমতা-আমতা করিয়া বলিল—দাদু, আজ তুমি একাই যাও, আমি আর যাব না
যাবিনে? কেন? কি হল আবার
হয়নি কিছু। তবে, বাড়িতে কেউ থাকবে না, দাদাও বেরিয়েছে।
তাতে কি হয়েছে? আমরা তো যাব আর আসব। বড় জোর এক ঘন্টা! তাছাড়া ঠাকুরঘরের চাবি আমার পকেটে।
তবু
দিনের বেলা তোর এত ভয় কিসের? চাকরবাকর রয়েছে, দিবাকর রয়েছে। না না, চল, তুইও হয় দুচারখানা বই কিনিস!—উচ্চকণ্ঠে বলিলেন—ওহে দিবাকর!
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দিবাকর ভিতর হইতে আসিয়া দাঁড়াইল
আজ্ঞে।
যদুনাথ বলিলেন—হ্যাঁ—দ্যাখো, আমি আর নন্দা একটু বেরুচ্ছি, গোটা কয়েক বই কিনতে হবে। তা—তুমি চারদিকে নজর রেখো।
দিবাকর বলিল—যে আজ্ঞে—
যদুনাথ বলিলেন–আয় নন্দা।
নন্দা পলকের জন্য দিবাকরের পানে অনিচ্ছা-সংশয়-ভরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করিল, তারপর গাড়িতে উঠিল। যদুনাথও উঠিলেন।
গাড়ি চলিয়া গেল; দিবাকর দাঁড়াইয়া দূরায়মান গাড়ির দিকে চাহিয়া রহিল। গাড়ি ফটকের বাহিরে অদৃশ্য হইয়া গেলে, তাহার মুখের ভাব অল্পে অল্পে পরিবর্তিত হইতে লাগিল; একটা কঠিন সতর্ক তীক্ষ্ণতা তাহার চোখে পরিস্ফুট হইয়া উঠিল; নাসাপুট চাপা উত্তেজনায় স্ফুরিত হইতে লাগিল।
পকেট হইতে একটা চকচকে নূতন চাবি বাহির করিয়া সে মুঠি খুলিয়া দেখিল; তাহার মুখে একটা ত্বরিত সঙ্কল্পের অভিব্যক্তি প্রকাশ পাইল। সে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করিয়া দ্বার বন্ধ করিয়া দিল।
হল-ঘরে তখন সন্ধ্যার ম্লানিমা নামিয়াছে। দিবাকর একবার চারিদিকে দৃষ্টি ফিরাইল, কেহ নাই; তখন সে অলস-পদে ঠাকুরঘরের দিকে অগ্রসর হইল।
ঠাকুরঘরের দ্বারে নিরেট মজবুত তালা ঝুলিতেছে। আর একবার চারিদিকে ক্ষিপ্রদৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া দিবাকর নিঃশব্দে তালাতে চাবি পরাইল।
হঠাৎ এই সময় অদূরে টেবিলের উপর টেলিফোন বাজিয়া উঠিল। তাহার ঝন্ঝন্ শব্দ দিবাকরের কানে বর্জনাদের ন্যায় মনে হইল। সে ত্বরিতে তালা হইতে চাবি বাহির করিয়া ছুটিয়া গিয়া টেলিফোন ধরিল, বিকৃতস্বরে বলিল—
হ্যালো
কিছুক্ষণ শুনিয়া তাহার মুখ কঠিন হইয়া উঠিল। সে দাঁত চাপিয়া বলিল— না।
টেলিফোন রাখিয়া ফিরিতেই সে দেখিল সেবক কখন পাশে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে।
সেবক বলিল—কে টেলিফোন করছিল, ছ্যাকড়াগাড়িবাবু?
দিবাকর বলিল—রং নম্বর।
সেবক বলিল—ও। আচ্ছা ছাকড়াগাড়িবাবু, আপনি টেলিফোন করতে জানেন?
দিবাকর সন্দিগ্ধভাবে চাহিল—কেন বল দেখি?
সেবক বলিল-তাহলে একবার থানায় টেলিফোন করে দেখুন না, চোরের কোনও সুলুক সন্ধান। পাওয়া গেল কিনা।
দিবাকর কিছুক্ষণ স্থিরনেত্রে সেবককে নিরীক্ষণ করিল। শেষে বলিল—চোরের জন্য তুমি ভারি ব্যস্ত হয়ে পড়েছ দেখছি। কিন্তু মনে কর, চোর যদি হঠাৎ এমনি করে তোমার সামনে হাজির হয়, তখন কি করবে?
দিবাকর এমন মুখভঙ্গি করিয়া তাহার সম্মুখে দাঁড়াইল যে সেবক দুই পা পিছাইয়া গেল। কিন্তু তৎক্ষণাৎ সামলাইয়া লইয়া বলিল——
কি করব? আমাকে চেনেন না, ছাকড়াগাড়িবাবু! চোরকে লেঙ্গি মেরে মাটিতে ফেলে তার বুকে হাঁটু দিয়ে চেপে বসবো, আর চেঁচাব-পুলিস! পুলিস।
দিবাকর সেবকের পিঠ চাপাড়াইয়া গম্ভীরমুখে বলিল—
বেশ বেশ। বীর বটে তুমি।
সন্তুষ্ট সেবক কাঁধ হইতে ঝাড়ন লইয়া টেবিল ঝাড়িতে আরম্ভ করিল। দিবাকর ধীরপদে উপরে উঠিয়া গেল।