অন্ন ব্ৰহ্ম
ব্রাহ্মণ সাহিত্যের বহু কথাই উপনিষদে আবার বলা হয়েছে। তেমনই বৃহদারণ্যক উপনিষদে শুনি, ‘প্রথমে এখানে (এই বিশ্বভুবনে) কিছুই ছিল না, এ সব মৃত্যু দিয়ে আবৃত ছিল। ক্ষুধা দিয়ে, ক্ষুধাই মৃত্যু— নৈবেহ কিঞ্চনাগ্র আসীমৃত্যু নৈবেদমাবৃতমাসীৎ। অশনায়য়াহশনায়া হি মৃত্যুঃ।’ (২:২:১) এ কথা ব্রাহ্মণসাহিত্যে বহুবার শুনেছি, এখন উপনিষদেও শোনা যাচ্ছে। অবশ্য বৃহদারণ্যক উপনিষদ তো সরাসরি শতপথব্রাহ্মণেরই শেষাংশ। ব্রাহ্মণসাহিত্যই যেন বিবর্তিত হয়েছে উপনিষদে, কাজেই এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। সেই প্রসঙ্গে আগের মতোই শোনা যায়, ‘অন্ন থেকে বীর্য— অন্নাদ্বীর্যম্।’ (প্রশ্ন উপ. ৬:৪) এ যেন ব্রাহ্মণসাহিত্যেরই অনুবৃত্তি, চেনা কথার পুনরুচ্চারণ। ছান্দোগ্য বলে, ‘যে কুলে (বৃহৎ যৌথ পরিবারে) এই আত্মা বৈশ্বানর (অগ্নি)-কে উপাসনা করা হয়, সেখানে (লোকে) অন্ন আহার করে, শ্রী’র দেখা পায়, তার ব্রহ্মদীপ্তি আসে— অভ্যন্নং পশ্যতি শ্রিয়ং ভবত্যস্য ব্রহ্মবর্চসম্। কুলে য এতমেবাত্মানং বৈশ্বানরমুপাস্তে।’ (ছা/উ ৫:১২:২; ৫:১৩:২; ৫:১৪:২; ৫:১৫:২) এই ধরনের কথাই শুনি অন্যত্র: ‘মহ হল অন্ন। অন্নের দ্বারাই সকল প্রাণ মহিমান্বিত হয়— মহ ইত্যন্নম্। অন্নেন বাব সর্বে প্রাণা মহীয়ন্তে।’ (তৈত্তিরীয় উপ. ১:৫:৩) হঠাৎ শুনলে কেমন অবাক লাগে, উপনিষদের যুগে— যখন আধ্যাত্মিকতাই জয়যুক্ত, যখন ব্রহ্মই পরম সত্য— তখন নেহাৎ তুচ্ছ দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় বস্তু অন্নকে এই গৌরব দেওয়া হচ্ছে: ‘অন্নের দ্বারা সকল প্রাণ মহিমান্বিত হয়।’ যত দিন গেছে ততই মানুষ স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর ভাবে বুঝতে পেরেছে উচ্চ কোটির দার্শনিক চিন্তা গৌরবের বস্তু হলেও সে চিন্তার আধার যে শরীরটা, তাকে বাঁচিয়ে রাখে অন্নই, কাজেই চিন্তার মহিমা অন্নের ওপরে একান্ত ভাবেই নির্ভরশীল, এ অন্ন ‘মহ’, মহৎ, এর মধ্যে নিহিত প্রাণের মহিমা। ‘অন্নেই এই সমস্ত প্রাণী নিহিত— অন্নে হীমানি সর্বানি ভূতানি বিষ্টানি।’ (বৃ/আ/উ ৫:১১:১) সমস্ত প্রাণীর আধারভূত অন্ন, অন্ন বিনা প্রাণীরা জীবন ধারণ করতে পারে না, আর জীবনই যদি বিপন্ন হয় ত উচ্চ চিন্তা তো নিরবলম্ব হয়ে পড়ে। কাজেই এদের মুক্তদৃষ্টিতে অন্নের তত্ত্বটি খাঁটি ভাবেই ধরা দিয়েছিল। অন্য রকম চিন্তাও ছিল, কিন্তু এই ধরনের নির্মোহ দৃষ্টিও ছিল।
ছান্দোগ্য উপনিষদ সামবেদের; সামবেদ যজ্ঞের গানের সংকলন। সামগানের একজন গায়কের পারিভাষিক নাম ‘প্রতিহতা’। ছান্দোগ্য ওই প্রতিহতার প্রতিহরণ কর্মটির একটা অন্য ব্যাখ্যা দিয়ে বলছে, ‘এই সব প্রাণীই অন্ন প্রতিহরণ (সংগ্রহ) করে বেঁচে থাকে। এই দেবতাটি প্রতিহারের অধীন— সর্বাণি হ ইমানি ভূতান্যন্নমেব প্রতিহরমাণানি জীবন্তি সৈষা দেবতা প্রতিহারমন্বায়ত্তা।’ (ছা/উ ১:১০:৯) আচার্য শিষ্যকে বলছেন ‘হে সৌম্য, মন হল অন্নময়— অন্নময়ং হি সৌম্য মনঃ।’(ছা/উ ৬:৫:৪) এখানে মনে করতে হবে যে উপনিষদ জ্ঞানকাণ্ডের অন্তর্ভুক্ত, এবং এই জ্ঞানকাণ্ডের যুগে মন ও দেহের ব্যবধানটা নানা ভাবে উপলব্ধ ও স্বীকৃত হচ্ছে। তার একটা প্রকাশ হল, কায়িক শ্রমকে তখন নিচু চোখে দেখা হচ্ছে, সমাজে শ্রেণিবিভাজন হয়েছে প্রত্যক্ষ ভাবে, এবং উচ্চতর শ্রেণির সংজ্ঞা হল: সে হাতপায়ে খাটে না, মাথা দিয়ে পরিশ্রম করে এবং সমাজে সে অপেক্ষাকৃত বিত্তবান ও সম্ভ্রান্ত। কারণ, তাত্ত্বিক, দার্শনিক, পুরোহিত, শাস্ত্রকার ও সমাজপতিরা রাজা ও রাজন্যে প্রসাদপুষ্ট। অতএব এরা উৎপাদন ক্রিয়ার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে সংযুক্ত নয়, এরা বুদ্ধি দিয়ে মতবাদ ও তত্ত্ব উদ্ভাবন করে, দিনপাতের জন্যে প্রয়োজনীয় অন্ন এদের তারাই জোগায় যারা উৎপাদন করে— সেই চাষি ও মজুররা। পরান্নজীবী এই শ্রেণিটিও কিন্তু এ বিষয়ে অবহিত যে যে-অন্ন তারা উৎপাদন করে না বটে কিন্তু আহার করে। সে-অন্ন দুঃস্থশ্রেণি কায়ক্লেশে উৎপাদন করে এবং সে-অন্ন না হলে উচ্চমার্গের চিন্তা করার সামর্থ্যই এদের থাকত না। যখন অন্ন-উৎপাদক সমাজে নিচের তলার নাগরিক, সামাজিক সংবিধানে সব রকমে অধিকারচ্যুত, তখনও প্রথম শ্রেণির নাগরিকরা, যারা এই শাস্ত্র রচনা করছে, তারা অকুণ্ঠ ভাবে স্বীকার করছে যে, অন্নেই প্রাণ প্রতিষ্ঠিত।
অন্ন মহৎ, প্রাণি-মাত্রকেই জীবনধারণের জন্য অন্নের উপর ভরসা করতে হয়, কারণ অন্ন বিনা প্রাণরক্ষাই হয় না। তাই এদের বলতে হয় যে, ব্রহ্ম-আত্মা-ঐক্য কে যে অবধারণ করবে অর্থাৎ জানবে সেই মন হল অন্নময়। এবং অন্নের এই মহিমার স্বীকৃতি নানা ভাষায়; আর এর স্বীকারের পিছনে আছে তার দুষ্প্রাপ্যতা। অন্ন সহজলভ্য হলে তার এত মহিমা কীর্তন থাকত না। বৃহদারণ্যক উপনিষদ খুব খোলাখুলি ভাবে বলেছে, ‘অন্ন বিনা প্রাণ শুকিয়ে যায়— শুষ্যতি বৈ প্ৰাণ ঋতেহন্নাৎ।’ (বৃ/আ/উ ৫:১২:১) অন্নের মাহাত্ম্য প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘অন্ন বলের চেয়ে অধিক… অন্নকে যে ব্রহ্ম বলে উপাসনা করে সে অন্নবান, পানীয়বান লোকে প্রতিষ্ঠিত হয়— অন্নং বাব বলাদ্ভূয়ঃ… যোহন্নং ব্রহ্মেত্যুপাস্তেঽন্নবতো বৈ স লোকান্ পানবতোৎভিসিধ্যাত।’ (ছা/উ ৭:৯:১) এখানে প্রণিধান করবার মতো কথাটা হল, ‘অন্নকে যে ব্রহ্ম বলে উপাসনা করে।’ উপনিষদে মাঝে মাঝেই অনেক বস্তুকে ব্রহ্ম বলা হয়েছে, যেমন প্রাণ, মন, ইত্যাদি। এগুলি দার্শনিক তত্ত্বের উপাদান, ব্রহ্মের কল্পনা থেকে দূরে নয়। কিন্তু অন্ন? সে যে নেহাতই স্থূল বস্তুজগতের দৈনন্দিন প্রয়োজনের সাদামাটা বস্তু। ধর্ম, দর্শন, ব্রহ্মতত্ত্ব থেকে বহু যোজন দূরে তার অবস্থান। সেই অন্নকে ব্রহ্মজ্ঞানে উপাসনা করার কথা বলা হল। যে তা করে সে অন্ন, পানীয় লাভ করে। সহজেই মনে আসে, অশনায়াপিপাসে’র কথা, যার অপর নাম মৃত্যু। অর্থাৎ অন্নকে ব্রহ্মবোধে উপাসনা করলে অন্ন ও পানীয়ের অভাব ঘটে না, অতএব মৃত্যুকে পরাস্ত করা যায়। আরও একটি তাৎপর্যপূর্ণ শব্দ হল ‘উপাসনা করা’: অন্নকে উপাসনা করার কথা অসংকোচে উচ্চারিত হচ্ছে।
মনে রাখতে হবে কর্মকাণ্ডে উপাস্য ছিলেন ইন্দ্র, সূর্য, আদি দেবতারা। যজ্ঞে তাঁদের উদ্দেশে হবিঃ সমর্পণ করে তাদের স্তব করাই ছিল তখনকার উপাসনা। তার থেকে নানা ফল প্রত্যাশিত ছিল, এগুলির মধ্যে অন্ন-পানীয়ও ছিল। কর্মকাণ্ডের যজ্ঞনির্ভর উপাসনার যে ফলপ্রাপ্তির প্রত্যাশা ছিল, জ্ঞানকাণ্ডে যজ্ঞ যখন বাহুল্য বা নিষ্প্রয়োজন বলে প্রতিপন্ন হয়েছে, যখন উদ্দেশ্য হল ব্রহ্মজ্ঞানের মাধ্যমে মুক্তি, তখন উপাস্য কী? অন্ন। কেমন ভাবে? ব্রহ্মরূপে। এ ব্রহ্ম হল বেদের কর্মকাণ্ডের দেবতাদের ঊর্ধ্বে এক পরম তত্ত্ব। তার বাস্তব রূপ হল অন্ন, প্রতীকী অর্থে নয়, ব্রহ্ম এখানে অন্নের সঙ্গে অভিন্নরূপে সমীকৃত। এই কথাই পড়ি অন্যত্র: ‘অন্নকে ব্রহ্ম বলে’ জানলেন। অন্ন থেকেই প্রাণীরা জাত হয়, অন্ন দিয়েই জাত প্রাণীরা বেঁচে থাকে। অন্নে প্রবিষ্ট হয়ে প্রাণীরা লীন হয়ে যায়— অন্নং ব্রহ্মেতি ব্যজানাৎ। অন্নাদ্ভুতানি জায়তে, অন্নেন জাতানি জীবন্তি, অন্নং প্রযন্ত্যভিসংবিশস্তি।’ (তৈ/উ ৩:২:১-৩) সামান্য পৃথক ভাবে বলা হয়েছে, ‘অন্ন থেকে প্রজারা জন্মায় যারা এ পৃথিবীতে আশ্রিত; তার পর অন্ন দ্বারাই প্রাণীরা বেঁচে থাকে। অন্নই প্রাণীদের জ্যেষ্ঠ। অন্ন থেকে প্রাণীরা জন্মায়। প্রাণীরা ভোজন করে ও ভুক্ত হয় তাই অন্নকে অন্ন বলে— অন্নাদ্বৈ প্রজাঃ প্রজাঃ প্রজায়ন্তে যাঃ কাশ্চ পৃথিবীংশ্রিতাঃ… অথো অন্নেনৈব জীবত্তি… অন্নং হি ভূতানাং জ্যেষ্ঠম্। অন্নদ্ভুতানি জায়ন্তে। জতান্যন্নেন জীবন্তি। অদ্যতে অত্তি ভূতানি। তস্মাদন্নং তদুচ্যতে।’(তৈ/উ ২:২:১-৩) দুটি শাস্ত্রাংশের মধ্যে পার্থক্য বেশি নেই, একটিতে প্রজার উল্লেখ আছে, অন্যটিতে প্রাণী বলা হয়েছে; প্রজাপতির প্রজাই হল প্রাণী। যে বাগ্ভঙ্গিটি ব্যবহার করা হয়েছে সেটি লক্ষণীয়। এর আদিকল্পটি হল ‘আনন্দাদ্ধ্যেব খল্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে। আনন্দেন জাতানি জীবন্তি। আনন্দং প্রযন্তি অভিসংবিশন্তি।’ এই আনন্দব্রহ্মের স্বরূপ হল: তিনি সৎ, চিৎ ও আনন্দ। এই বারে লক্ষ্য করি ব্রহ্মবাচক আনন্দ পদটিরই জায়গায় ‘অন্ন’ ব্যবহার করা হয়েছে। তা হলে ব্রহ্ম আর অন্ন স্পষ্টতই সমার্থক, অন্নই ব্রহ্ম এই কথাটাকেই এই ভাবে শব্দ বিপর্যাসের দ্বারা আরও স্পষ্ট করে বলা হল। এর ফলে অন্নব্রহ্ম তত্ত্বটি আরও দৃঢ় ভাবে প্রতিষ্ঠিত হল। এইখানে সেইটেই উদ্দিষ্ট।
মনে রাখতে হবে, এই যুগে ব্রহ্মের কল্পনাও নতুন। কর্মকাণ্ডে ব্রহ্মা একজন দেবতা, পুরুষ, হিরণ্যগর্ভ, ব্রহ্মণস্পতি, বৃহস্পতির মতোই একজন প্রধান দেবতা— প্রায়শই বিমূর্ত ভাবে কল্পিত। উপনিষদের ব্রহ্ম কিন্তু সে রকম দেবতা নন। পরবর্তী বেদান্ত সাহিত্যে ব্ৰহ্ম পদার্থ ও শব্দটি ক্লীবলিঙ্গ। উপনিষদে ঠিক তা নয়, তবে তার সূচনা এখানে দেখা যায়। ব্রহ্মের মধ্যে দেবতাদেরও ঊর্ধ্বে যে সর্বাতিগ, সর্বাতিশায়ী শ্রেষ্ঠ একটি সত্তা কল্পনা করা হয়েছে, এ সব শাস্ত্রে বলা হচ্ছে অন্ন, সে ব্রহ্ম থেকে অভিন্ন। সৃষ্টির মধ্যে, প্রাণীদের মধ্যে অন্ন জ্যেষ্ঠ— সেটাও অন্নের মহিমাই সূচিত করে। এই জ্যেষ্ঠত্বের উল্লেখ করা হচ্ছে, কারণ ব্রাহ্মণ সাহিত্যে বেশ কয়েকটি উপাখ্যানে আছে প্রজাপতি প্রজা সৃষ্টি করার পরে প্রজারা খুব ক্লিষ্ট হল ক্ষুধায়, তখন প্রজাপতি তাদের জন্যে খাদ্য সৃষ্টি করলেন। সৃষ্টির এই ক্রমকে বিপর্যাসের মধ্যে ফেলে অন্নকে সৃষ্টির জ্যেষ্ঠ বলা হচ্ছে, কারণ অন্নহীন বিশ্বে প্রাণী থাকা সম্ভব নয়, তাই অন্নকে আদি সৃষ্টি বলা হয়েছে। আর সৃষ্ট প্রাণীদের মধ্যে একে অপরকে যে খায় সে তো জানা কথা তাই ‘অদ্যতে’, ‘অত্তি’। অদ্ ধাতু নিষ্পন্ন এই দুটি শব্দের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে ‘অন্ন’ শব্দের ব্যুৎপত্তি বলা হল। অন্ন হল সেই বস্তু যাকে কিছু প্রাণী খায় এবং তাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার অন্য প্রাণীর দ্বারা ভক্ষিতও হয়। যেমন তৃণভোজী প্রাণী মাংসাশী প্রাণীর খাদ্য, ছোট মাছ বড় মাছের খাদ্য, বহু কীটপতঙ্গ ও মাছ অনেক পাখির খাদ্য। এই সব পরস্পরের ‘অদন’ বা খাওয়ার ভিত্তিতেই সৃষ্টিতে বিভিন্ন জীবের আহার সংস্থান চলছে। এই বিরাট, ব্যাপ্ত ও জটিল প্রক্রিয়ার মধ্যে সৃষ্ট প্রাণীদের ক্ষুন্নিবৃত্তি ঘটছে। তাই মনে হয়, একটি ব্যাপক অর্থে অন্ন ব্রহ্ম। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে আহার একটি অপরিহার্য ব্যাপার, যার উল্টোদিকে আছে অনাহার ও মৃত্যু, তাই অন্ন জীবন। অন্নই ব্ৰহ্ম।
কৃষিপ্রধান দেশে ফসল জলের ওপরে একান্ত ভাবে নির্ভরশীল। তাই শুনি প্রজাপতি বলছেন:
প্রজার জন্যে আমি বহু হব। (তিনি) জল দেখলেন জল (বলল) বহু হব, প্রজার জন্ম দেব। জল তখন অন্ন সৃষ্টি করল, তাই যে কোনও জায়গায় বৃষ্টি হয় সেখানেই প্রচুর অন্ন (হয়) তাই জল থেকে আহার্য অন্ন উৎপন্ন হয়।— তা আপ ঐক্ষন্ত বহুঃ স্যাম প্রজায়েমহীতি তা অন্নমসৃজন্ত তস্মাদ্ যত্র ক্ব বর্ষতি তদেব ভূয়িষ্ঠমন্নং ভবত্যদ্ভ্য এব তদান্নাদ্যং জায়তে। (ছান্দোগ্য উপ ৬:২:৪)
সিন্ধুসভ্যতায় যে সেচ ব্যবস্থা ছিল, আর্যরা এ দেশে আসবার পরে তার অনেকটাই বিনষ্ট হয়েছিল, ফলে প্রথম সহস্রাব্দের দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই কৃষি বৃষ্টিনির্ভর। জল থেকে অন্ন, সেই অন্ন প্রজার জীবন। তৈত্তিরীয় উপনিষদ্ বলছে:
অন্নকে নিন্দা করবে না। তাই বেঁচে থাকার অবলম্বন (ব্রত)। প্রাণই অন্ন। শরীর হল অন্নভোজী।… তাই এই অন্ন অন্নে প্রতিষ্ঠিত— অন্নং ন নিন্দ্যাৎ। তদ ব্রতম্। প্রাণো বা অন্নম্। শরীরমন্নাদম্।… তদেতদন্নমন্নে প্রতিষ্ঠিতম্। (তৈ/উ ৩:৭)
শরীর বেঁচে থাকে প্রাণে, প্রাণের অবলম্বন অন্ন, অন্ন জীবনকে রক্ষা করে, তাই অন্নকে নিন্দা করবে না। তার মানে অন্নকে নিন্দা করার প্রসঙ্গ কিছু হয়তো ছিল। অর্থাৎ প্রাগার্য বা অপরিচিত জনগোষ্ঠীর কিছু খাদ্যকে হয়তো আগন্তুক আর্যরা তাচ্ছিল্য করত; হীন, অখাদ্য মনে করত। কিন্তু যে সমাজে ব্যাপক খাদ্যাভাব, সেখানে কোনও রকম খাদ্যের নিন্দা করা বা তাকে পরিহার করা প্রকারান্তরে আত্মঘাতী। এ সম্বন্ধে পরে দেখতে পাব যে আপৎকালে শুচি অন্ন ও অশুচি অন্নের বোধ কেমন করে ভেঙে যায়। কিন্তু নিশ্চয়ই প্রাকৃতিক দুর্যোগে বা কোনও বিপর্যয়ে যখন পরিচিত, অভ্যস্ত অন্ন দুর্লভ হত, তখন মানুষ অনভ্যস্ত খাদ্য দিয়েই উদরপূর্তি করতে বাধ্য হত। এবং তখন সে-অখাদ্য’ শুধু খাদ্য হয়েই উঠত না, প্রাণরূপে দেখা দিতে। যার অপর পিঠে আছে বুভুক্ষা, অশনায়া, যার অন্য নাম মৃত্যু। কাজেই শরীরকে যে বাঁচিয়ে রাখে, শরীরে প্রাণকে সেই আশ্রয় দেয়, অন্নের নিন্দা করা উচিত নয়। কারণ, তা অপরিহার্য, তা যে-রূপেই দেখা দিক না কেন। অতএব এই ব্রহ্মতত্ত্বের যুগে, জ্ঞানকাণ্ডের এই উপনিষদের যুগে তাকে চূড়ান্ত সম্মান দিতে গেলে তাকে ব্রহ্ম বলতে হয়, সৃষ্টির ওপারের পরমতত্ত্বের সঙ্গে অভিন্ন বলে দেখতে হয়। আমরা দেখেছি কর্মকাণ্ডের যজ্ঞের যুগে অন্নকে নানা দেবতার সঙ্গে অভিন্নরূপে দেখা হয়েছিল। সে যুগে দেবতারাই ছিলেন শ্রেষ্ঠ সত্তার প্রতীক। এখন সেখানে শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিপাদক ব্ৰহ্ম, তাই অন্ন এখন ব্ৰহ্ম। তাই যে-কেউ অন্নকে ব্রহ্মরূপে উপাসনা করে তার কখনও অন্নাভাব হয় না, এমন কথা বারে বারেই শোনা গেছে।
মৃত্যুকালে পিতা পুত্রকে তাঁর সব কিছু উত্তরাধিকার হিসেবে দিয়ে যেতেন। একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পিতা পুত্রকে তাঁর ইন্দ্রিয়, মন, শক্তি, ধন ইত্যাদি দান করতেন। এই প্রসঙ্গে বলতেন, ‘আমার অন্নরস তোমাতে নিহিত করছি… আমার যশ, ব্রহ্মবর্চস, আহার কীর্তি তোমার সেবা করুক- অন্নরসান্মে তৃয়ি দধামীতি পিতা… যশো ব্রহ্মবচসম্ অন্নাদ্যম্ কীর্তিঃ ত্বা জুষতামিতি।’ (কৌষীতকি উপ. ২:২২) পিতা যখন পুত্রকে অন্নরস উত্তরাধিকার সূত্রে সমর্পণ করেন তখন সম্ভবত অন্নরস গ্রহণ করে তাঁর শরীরে যে পুষ্টি, শক্তি, স্বাস্থ্য, তেজ ও পরমায়ু বৃদ্ধি পেয়েছিল সে সবই ছেলেকে দিয়ে যেতে চান। এ ছাড়াও তিনি বলেন আমার ‘অন্নাহার’ তোমাকে দিলাম। অর্থাৎ ক্ষুধা নিরসনের জন্যে আমি যে খেতে পেতাম, সেই ক্ষুধা নিবারণের অধিকার তোমাকে দিলাম। এ বড় কম দেওয়া নয়, যে সমাজে ক্ষুধার অনুপাতে খাদ্য কম, যেখানে সকলে খেতে পায় না, যারা পায় তারাও নিয়মিত পায় না, প্রয়োজনের তুলনায় কম পায়, সেই সমাজে খেতে পাওয়ার উত্তরাধিকার পুত্রকে অর্পণ করা একটি তাৎপর্যপূর্ণ দান। পিতা হিসেবে পৃথিবীর সর্বত্র সর্বকালের পিতার মতো এ পিতাও কামনা করছেন, ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে।’ কামনা কামনাই, এ-দান ইচ্ছাপূরক দান; যশস্বী পিতার পুত্র অনেক সময়েই অপযশস্বী হয়, কাজেই পিতা দিতে চাইলেই যে পুত্র যশ, তেজ, কীর্তি লাভ করবে তার কোনও নিশ্চয়তা নেই; ঠিক তেমনই অন্নাহারে অধিকারও যে পিতার অভিলাষ বলেই পুত্র পাবে তারও ঠিক নেই। অন্নাহারের অধিকার যথেষ্ট ধনী পিতাই হয়তো পুত্রের জন্যে নিশ্চিত ভাবে দান করে যেতে পারবে। কিন্তু এ কামনা সব পিতারই থাকবে এবং এর একটা তীক্ষ্ণতা আছে, এই কারণে যে, সমাজে খাদ্যাভাব ছিল।
সৃষ্টির একটি উপাখ্যানে পড়ি, ‘(প্রজাপতিকে) ক্ষুধা ও তৃষ্ণা বলল, আমাদের জন্য আধার নির্দিষ্ট করুন, (প্রজাপতি) বললেন, এই দেবতাদের মধ্যে তোমাদের ভাগ বিধান করব। তাই যে কোনও দেবতাকেই হবিদান করা হোক না কেন, তাঁরা ক্ষুধা ও তৃষ্ণার ভাগী তমশনায়াপিপাসে অব্রুতাম আবাভ্যামভি প্রজানীহীতি। স তেহব্রবীৎ এতাস্বেব বাং দেবতাস্বাভজাম্যেতাসু ভাগিন্যৌ করোমীতি। তস্মাদ্ যস্যৈ কস্যে চ দেবতাউয় হবিগৃহ্যতে ভাগিন্যোবেবাস্যামশনায়াপিপাসে ভবতঃ।’ (ঐতরেয় উপ ১:২:৫) এই অংশে যা প্রথমেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে তা হল, ক্ষুধাতৃষ্ণা তো মানুষের চিরশত্রু, প্রজাপতি তাদের প্রশ্নের উত্তরে তো বলতে পারতেন, ‘মানুষের শরীরের অভ্যন্তরে তোমাদের স্থায়ী আবাস নিরূপণ করছি।’ বললে সেটা সহ্যও হত, মানুষের অভিজ্ঞতায় নির্ভরযোগ্য বলেও প্রতিপন্ন হত। তা না বলে প্রজাপতি এমন একটা উত্তর দিলেন যার সপক্ষে কোনও প্রমাণই নেই: কেউ কোনও দিন জানতে পারবে না দেবতা আছেন কিনা এবং থাকলে তাঁদের ক্ষুধাতৃষ্ণা আছে কিনা। তবু প্রজাপতি কেন এমন উত্তর দিলেন? এ জন্য যে, এতে সহজ একটা সমাধান হল, তিনি ক্ষুধাতৃষ্ণাকে দেবতাদের মধ্যে সঞ্চারিত করে ক্ষুধাতৃষ্ণার গুরুত্ব বাড়ালেন। সঙ্গে সঙ্গে যজ্ঞেরও; কারণ, যজ্ঞে উৎসর্গ করা খাদ্যপানীয় দেবতাদের ক্ষুধাতৃষ্ণা নিবারণ করে। কিন্তু যজ্ঞ ত হচ্ছিলই, এ শাস্ত্রাংশে আরও যেটা প্রতিপন্ন হল তা হল ক্ষুধাতৃষ্ণার আক্রমণ থেকে দেবতারাও অব্যাহতি পান না, ক্ষুধাতৃষ্ণার এতই অপ্রতিহত শক্তি। শুধু তাই নয়, এ বিধান স্বয়ং প্রজাপতিরই, তিনিই ক্ষুধাতৃষ্ণাকে দেবতাদের দেহে স্থাপন করেছেন। স্বভাবতই মানুষ ভাববে, স্বয়ং দেবতারাই যখন ক্ষুধাতৃষ্ণার আক্রমণ থেকে মুক্ত নন, তখন সমাজে যে ব্যাপক অপ্রতিকার্য ক্ষুধা, তাকে মানুষ গুরুত্ব দেবে, এই বুঝে যে দেবতাদেরও ক্ষুধা আছে। মানুষ যজ্ঞ না করলে তাঁরাও অভুক্ত থাকেন। তা ছাড়া ক্ষুধার মহিমাও প্রচার করা হচ্ছে এই ভাবে, যেন প্রয়োজন হলে মানুষ সহিষ্ণু ভাবে মেনে নেয়, মনে করে দেবতারাও যে কষ্টে পীড়িত হন, আমার পক্ষে তা সহ্য করা কী আর এমন ব্যাপার!
কিন্তু অন্য এক জায়গায় বলা হয়েছে, ‘দেবতারা আহারও করেন না, পানও করেন না। শুধুমাত্র এই অমৃত দেখেই তৃপ্ত হন— ন বৈ দেবা অশান্তি ন পিবন্ত্যেতদেবামৃতং দৃষ্টা তৃপ্যন্তি।’ (ছা/উ ৩:৬:১) তবে? তবে কেন বলা হল, প্রজাপতি ক্ষুধাতৃষ্ণাকে দেবতাদের শরীরে স্থাপন করলেন? লক্ষ করলে দেখব, এ শাস্ত্র একবারও বলছে না যে দেবতাদের ক্ষুধাতৃষ্ণার বোধ হয় না। বরং ক্ষুধাতৃষ্ণার পরিপ্রেক্ষিতেই যেন বলা হচ্ছে, যখন দেবতারা ক্ষুধাতৃষ্ণা বোধ করেন তখনও মানুষের মতো খাদ্যপানীয় দিয়ে তাঁরা ক্ষুধাতৃষ্ণার নিরসন করেন না। তাঁরা অমৃত দেখেই তৃপ্ত হন। অর্থাৎ অমৃতের দর্শনেই তাঁদের ক্ষুধাতৃষ্ণা তৃপ্ত হয়। কিন্তু যজ্ঞে তো অমৃত কখনও নৈবেদ্য দেওয়া হয় না, হব্য পানীয়ই দেওয়া হয়। দেবতাদের অমৃত দেবলোকেরই ব্যাপার, সেখানেই তা কোনও ভাবে সংগৃহীত হয় তাঁদের জন্যে। এ শাস্ত্রে মানুষ তার প্রয়োজনীয় যে খবরটা পেল তা হল যজ্ঞে যে নৈবেদ্য, খাদ্য, পানীয় দেওয়া হয় দেবতারা তা দিয়ে তাঁদের ক্ষুধাতৃষ্ণা নিবৃত্ত করেন না, তাই অগ্নিদগ্ধ নৈবেদ্যের ধূম ঊর্ধ্বদিকে চলে যায়, ভস্ম নীচে পড়ে থাকে। এটা না বললে যজ্ঞে দেবতাদের উদ্দেশে ভক্ষ্য ও পেয় দেওয়া অবান্তর, অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। এবং তা হলে ওই আগের কথা— প্রজাপতি দেবতাদের দেহে ক্ষুধাতৃষ্ণা স্থাপন করলেন— এটা অর্থহীন হয়ে পড়ে। তাই বলা হল, প্রজাপতির বিধানে দেবতাদেরও ক্ষুধাতৃষ্ণা অবশ্যই আছে, কিন্তু মানুষের দেওয়া খাদ্যপানীয়ে তা নিবৃত্ত হয় না, হয় অমৃতে। দেবতাদের দেবলোক যেহেতু সম্পূর্ণ ভাবেই মানুষের অগোচরে, তাই সেখানে কীভাবে অমৃতের সংস্থান হয় কীভাবে তা দর্শনমাত্রেই দেবতাদের ক্ষুধাতৃষ্ণা অন্তর্হিত হয়, তার কোনও ব্যাখ্যাই দেওয়া হয়নি। লক্ষণীয়, দেবতাদের ক্ষুধাতৃষ্ণা যাতে মেটে তার নাম ‘অমৃত’। সার্থক নাম, কারণ ক্ষুধাতৃষ্ণা, অশনায়াপিপাসের অপর নাম মৃত্যু। মৃত্যু থেকে দেবতাদের যা বাঁচায় তা অমৃত। যার দর্শনমাত্রই ক্ষুধাপিপাসা মিলিয়ে যায়।
অন্ন কার জন্যে? সাধারণ বুদ্ধিতে মনে হয় শরীরের জন্য। উপনিষদ্ একটু এগিয়ে গিয়ে বলছে, প্রাণের জন্যে। ‘কুকুর থেকে শুরু করে শকুনি পর্যন্ত এই যা কিছু… তা সবই এর (প্রাণের) অন্ন— যৎ কিঞ্চিদিদমাশ্বভ্য আশকুনিভ্যঃ… এতাবানস্যান্নম্।’(ছা/উ ৫:২:১) কুকুর ও শকুনির উল্লেখ করা হচ্ছে সেটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ, আরও এই কারণে যে, এ সব কিছুকে শরীরের অন্ন বলা হচ্ছে না, বলা হচ্ছে প্রাণের অন্ন। অর্থাৎ প্রাণ বাঁচাবার জন্যে যখন অন্য ভদ্রতর গ্রাহ্যতার কোনও খাদ্য জুটছে না তখন শুধু প্রাণ বাঁচাবার জন্যেই যে কোনও হীন খাদ্য, কুকুর-শকুনির মাংস যা স্বাভাবিক অবস্থায় ভদ্র মানুষের খাদ্যতালিকার মধ্যে থাকে না, আপৎকালিক সেই খাদ্যই প্রাণকে বাঁচায়। এর চেয়ে বড় তাগিদ প্রাণীর আর নেই।
মাঝে মাঝেই শুনছি, ‘যে এ কথা জানে’, যেমন, ‘(বিরাজ ছন্দ) দ্বারা, সে অন্নাহারী হয়, এ সকলই তার দৃষ্ট হয়, তার দৃষ্ট সবই তার অন্নাহার (-এ পরিণত) হয়, যে এ কথা জানে- অন্নাদী তয়েদং সর্বং দৃষ্ট সর্বমস্যেদং দৃষ্টং ভবত্যন্নাদো ভবতি য এবং বেদ য এবং বেদ।’ (ছা/উ ৪:৩:৮] মাণ্ডুক্য উপ ১:৩:৬) ‘যে এ কথা জানে’ এই বাক্যাংশ দু’বার ব্যবহৃত হয়েছে শুধু পরিচ্ছেদ শেষ হওয়ার সূচনা জানাতে নয়, এর গুরুত্ব বোঝাতেও। গুরুত্ব কেন? এটা উপনিষদের যুগ; কর্মকাণ্ডের যুগে যজ্ঞ সম্পাদন করলেই তার দ্বারা অভীষ্ট বস্তু পাওয়া যায় এমন বিশ্বাস ছিল। এখন লক্ষ্য চলে গেছে পার্থিব কাম্য বস্তুর ওপারে— মোক্ষে, নির্বাণে, ব্রহ্মে লয় হওয়ার। এবং তার উপায় আর যজ্ঞ নয় জ্ঞান; ব্রহ্মজ্ঞান অর্থাৎ জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার অভিন্নতার জ্ঞান; মানুষকে জানতে হবে তার বিচ্ছিন্ন সত্তাটা আপেক্ষিক সত্য, পরম সত্য হল সে বিচ্ছিন্ন নয়, পরমাত্মারই রূপভেদ মাত্র। অতএব এখন কর্মকাণ্ডের দ্বারা সভ্য যা কাঙ্ক্ষিত বস্তু, যেমন অন্ন, বা অন্নাহারী হওয়া সেটিও পাওয়ার উপায়, এ তত্ত্ব ‘জানা’। তাই যে এই কথা জানে সে অন্নাহারী হয়। অর্থাৎ পূর্বে যা যজ্ঞের দ্বারা সিদ্ধ হত এখন সেটা ঘটবে ‘জানা’র দ্বারা। এর মধ্যে বিরাজ ছন্দের যজ্ঞীয় মাহাত্ম্যও কীর্তিত হল, আবার যজ্ঞোত্তর জ্ঞানমার্গেরও মহিমা ঘোষিত হল। অর্থাৎ এ এমন একটা যুগ যখন, যজ্ঞ চলছে বৃহত্তর ব্রাহ্মণ্যসমাজে এবং তাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করাও চলছে উপান্তের আরণ্যসমাজের নানা সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে। এরা বিভিন্ন মতের, কিন্তু কেউই বেদ বা যজ্ঞকে স্বীকার করে না। এদের সব মতই বুদ্ধি দিয়ে বুঝে নেওয়ার, কাজেই ব্যাপক এক অর্থে এরা এখন সারা দেশে পরিব্যাপ্ত যে জ্ঞানকাণ্ড তারই অন্তর্ভুক্ত।
ভারতের বহির্বাণিজ্য যখন মিশর, চিন, মধ্যপ্রাচ্য হয়ে ইয়োরোপের দক্ষিণ প্রান্তে আনাগোনা করছে তখন ওই সব অঞ্চল থেকে নানা ভাবধারাও এখানে আসছে। খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম-ষষ্ঠ শতাব্দী তেমনই একটা সময়, যখন ভারতবর্ষের বাইরে ওই সব অঞ্চলেই, চিন্তা-বিশ্বাস-ধর্ম- দর্শনের জগতে একটা প্রবল আলোড়ন চলছে এবং সে-সবটাই মূলত বুদ্ধির পরিধিতে। জানার পরিধি, গভীরতা, বৈচিত্র্য সম্বন্ধে, জীবনজিজ্ঞাসা নিয়ে একটা অস্থিরতা, ব্যাকুলতা এই বৃহৎ অঞ্চলকে ব্যাপ্ত করে রেখেছে। তারই ঢেউ আছড়ে পড়েছে ভারতবর্ষের চিন্তাজগতের তটেও। তাই এখন বৈদিক এবং বেদবিরোধী সকল সম্প্রদায়ের মধ্যেই ‘জানা’-ই হয়েছে মুখ্য। এখন যজ্ঞ দিয়ে কাঙ্ক্ষিত বস্তু পাওয়ার পর্ব হয়েছে গৌণ জ্ঞান দিয়ে ‘জেনে’ লাভ করাই হয়েছে উপায়।
জৈমিনীয় উপনিষদেও এমন কথা শুনি:
যে এ ভাবে ব্যাখ্যাত এই মহাসংহিতা জানে (বা এই মহাসংহিতাকে এই ভাবে ব্যাখ্যাত বলে জানে) সে যুক্ত হয় প্রজা (সন্তান) ও পশুর সঙ্গে, ব্রহ্মতেজ ও অন্নাহারের সঙ্গে এবং স্বর্গলোকের সঙ্গে (অর্থাৎ এগুলি লাভ করে)— য এবমেতা মহাসংহিতা ব্যাখ্যাত বেদ। সন্ধীয়তে প্রজয়া পশুভিঃ। ব্রহ্মবর্চসেনান্নাদ্যেন সুবর্গেণ লোকেন। (জৈ/উ ১:৩:৬)
এখন যজ্ঞক্রিয়ার চেয়ে গুরুত্ব পাচ্ছে তার সম্বন্ধে যে বেদাংশ তার যথাযথ ব্যাখ্যা। কর্মকাণ্ডে যজ্ঞটাই ছিল মুখ্য, যথাযথ অনুষ্ঠিত হলে দেবতারা স্তবে ও নৈবেদ্যে প্রসন্ন হয়ে ভক্তের প্রার্থনা পূরণ করতেন। এখন সে সবই গৌণ হয়ে গেল, মুখ্য হল যজ্ঞসম্বন্ধীয় শাস্ত্রের বুদ্ধিগ্রাহ্য যথার্থ ব্যাখ্যা। যজ্ঞ যা ক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে সম্পন্ন করত, এখন তা করছে ব্যাখ্যা, বুদ্ধির কাছে পৌঁছে। এইখানে উপনিষদ জৈন, বৌদ্ধ, আজীবিক ও অন্য বহু বিভিন্ন দর্শনপ্রস্থানের মিল আছে: তারা সবাই যজ্ঞকর্মকে পরিহার করে বোধের ওপরে নির্ভরশীল। তাই এই মহাসংহিতার যারা ঠিকমতো ব্যাখ্যাটি জানে তারা সন্তান, পশু, ব্রহ্মতেজ, অন্নাহার, এমনকী স্বর্গলোকও পাবে। বেদে স্বর্গের কথা খুব কমই আছে। দুই একটি যাগের প্রসঙ্গে শুনি স্বর্গকামী জ্যোতিষ্টোম যজ্ঞের অনুষ্ঠান করুক, অর্থাৎ জ্যোতিষ্টোম যাগ করলে স্বর্গে যাওয়া যায়। কিন্তু সে-ও ত পরিষ্কার একটি যাগের মধ্যেমেই স্বর্গের নাগাল পাওয়া। আর এখন? এই মহাসংহিতার এই ভাবে ব্যাখ্যা যে জানে, সে পশু, প্রজা, অন্ন, তেজ, এবং স্বর্গ সবই পাবে। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, ধর্মাচরণ এবং ধর্মতত্ত্বের ভরকেন্দ্রটি একেবারে বিপরীত মেরুতে চলে গেছে। মোক্ষ কাম্য হওয়ার আগে তো মানুষের কাম্য ছিল এবং এইগুলিই, প্রজা, পশু থেকে স্বর্গ পর্যন্ত; এবং এগুলি-সংবলিত দীর্ঘজীবন, ইহলোক, এ জন্মেই। তাই সেই সব কাম্যবস্তুও জ্ঞানের দ্বারা পাওয়া যায় এমন কথা বলে জ্ঞানমার্গের মাহাত্ম্য সূচিত হল। তার পর যেন বলছে এ সব ত পাওয়া যায়ই, এর চেয়েও কঠিন ও দুর্লভতর যা— জন্মান্তরের অনন্ত শৃঙ্খল থেকে অব্যাহতি— তা-ও পাওয়া যায়।
তত দিনে অভীষ্ট বা কাম্য পাল্টেছে। জ্ঞানমার্গকে প্রতিষ্ঠা করার একটা উপায় হল এ কথা বলা যে, এ মার্গ তাকে কর্মমার্গের প্রার্থিত বস্তু দান করতে সমর্থ এবং তার পরে এই মার্গের সুদূরতর, দুর্লবতর, দুরূহতর লক্ষ্য, মোক্ষ, দান করতে সমর্থ। এই ধরনের কথাই তৈত্তিরীয় উপনিষদেও শুনি:
যে কেউ এই অন্নকে অন্নে প্রতিষ্ঠিত বলে জানে, সে প্রতিষ্ঠিত হয়, অন্নবান এবং অন্নভোজী হয়। প্রজায় এবং পশুতে এবং ব্রহ্মতেজে মহান হয়, কীর্তিতে মহান হয়— স য এতদন্নমন্নে প্রতিষ্ঠিতঃ বেদ প্রতিতিষ্ঠতি। অন্নবানন্নাদো ভবতি। মহান্ ভবতি প্রজয়া পশুভিব্রহ্মবর্চসেন। মহান্ কীৰ্তা। (তৈ/উ ৩:৮)
এটি আগেরটিরই অনুরূপ, প্রভেদের মধ্যে এখানে নতুন একটি প্রতিশ্রুতি, কীর্তির। সব মিলে মানুষ সমাজে প্রতিষ্ঠা পেতে চাইলে যা যা দরকার— সমৃদ্ধি, সামাজিক প্রতিপত্তি, তেজ, কীর্তি সবই পাওয়া যাবে অন্নকে অন্নে প্রতিষ্ঠিত জানলে। কোনও যজ্ঞক্রিয়া করে নয়, শুধু ‘জেনে’। এটিই উপনিষদের যুগের বৈশিষ্ট্য।
ব্রহ্মের সঙ্গে অন্নকে অন্বিত করে বহু কথাই বলা হয়েছে:
তপস্যার দ্বারা ব্রহ্ম সংগ্রহ করা যায়, তার থেকে অন্ন জাত হয়। অন্ন থেকে প্রাণ, মন, সত্য; লোকগুলি এবং কর্মে অমৃত— তপসা চীয়তে ব্রহ্ম ততোহন্নম্ভিজায়তে। অন্নাৎ প্রাণো মনঃ সত্যং লোকাঃ কর্মসু চামৃতম্। (মুণ্ডক উপ ১:১:৮)
তপস্যার দ্বারা ব্রহ্মজ্ঞান লাভ হয়, এ পর্যন্ত বেশ বোঝা গেল, মননজাত এই তপস্যা উপনিষদের কেন্দ্রস্থ উপায়, কারণ ব্রহ্মজ্ঞানেই মোক্ষ লাভ করা যায় এবং তখনকার সমাজে ত মোক্ষই পরমার্থ। কিন্তু তার পরেই প্রায় এক নিঃশ্বাসেই বলা হচ্ছে: ব্রহ্ম থেকে অন্নলাভ হয়। অন্ন থেকে প্রাণ, মন, সত্য এবং কর্মে অমৃত লাভ করা যায়। এ অংশটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। যে যুগ ব্রহ্মজ্ঞান দিয়ে মোক্ষ লাভ করতে উৎসুক তাকে এই শাস্ত্র কিন্তু প্রথমেই বলে, ব্রহ্ম থেকে অন্ন লাভ হয়। অর্থাৎ অন্নের প্রয়োজন ফুরোয়নি তখনও; যজ্ঞ দিয়ে না হলে ব্রহ্মজ্ঞান দিয়েই হোক, কিন্তু অন্নটা পাওয়া চাই। মনে পড়ে, একবার জনকের সভায় যাজ্ঞবল্ক্য এসে দাঁড়াতে জনক জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী মনে করে,’ ঠাকুর— ব্রহ্মবিদ্যা না গোধন, কোনটা লাভ করবার জন্যে আসা?’ যাজ্ঞবল্ক্য নিঃসংকোচে অম্লানবদনে বললেন, ‘দুটোর জন্যেই, রাজা।’ অর্থাৎ ব্রহ্মবিদ্যাতে অন্নাভাব মেটে না। ব্রহ্মজ্ঞান থেকে অন্নলাভ হয় এ কথা আক্ষরিক অর্থে সত্য নয়, তবে ব্রহ্মজ্ঞানী পণ্ডিতরা রাজদ্বারে যে সম্মান পেতেন, রাজপ্রসাদে সেটা সহজেই সম্পত্তিতে ও অন্নে রূপান্তরিত হত। অন্ন থেকে প্রাণ লাভ বা রক্ষা হয় এ তে সহজেই বোঝা যায়। প্রাণ রক্ষা পেলে তবেই মন কাজ করে এবং তখন মানুষ যে কর্ম করে সেটা ব্রহ্মসন্ধান, ব্রহ্মোদ্যে অংশগ্রহণ, ব্রহ্ম সম্বন্ধে আলোচনা— যাতে সিদ্ধি লাভ করলে অমৃত অর্থাৎ অমরত্ব লাভ হয়, অর্থাৎ পুনর্জন্ম— উপনিষদে যাকে প্রথমে পুনমৃত্যু বলা হয়েছে, তা থেকে উদ্ধার পাওয়া যায়। মৃত্যু থেকে পরিত্রাণই অমৃত। এই তত্ত্বের দিকে পরিপূর্ণ সংহতি আছে, কিন্তু এই কার্যকারণ পরম্পরার মধ্যে প্রথমটিই একটু বিস্ময়কর: ব্রহ্ম থেকে অন্নলাভ। এর দুটি তাৎপর্য: ব্রহ্মজ্ঞান ঐহিক প্রয়োজন মেটাতে সমর্থ, অন্নসংস্থান করে দিতে পারে। দ্বিতীয়ত, এ যুগের যা সবচেয়ে কাম্য প্রাপ্তি— মোক্ষ, তার পথও ত ব্রহ্মজ্ঞানেই নিহিত আছে। তথাপি, তার পরেও নেহাতই স্থূল ঐহিক প্রয়োজন অন্নসংস্থান, সেটিও উপেক্ষিত নয়, বরং ব্রহ্ম থেকে সর্বপ্রথম প্রাপ্তিই অন্ন। বাকিটা বারবার উচ্চারিত হয়েছে, অন্ন জীবন বা প্রাণ রক্ষা করে। শরীরেই মনের আধার, সেই মন সজীব থাকে, দেহ তার প্রয়োজনীয় অন্ন পেলে। সক্রিয় মনই সত্যসন্ধান করে এবং এই সন্ধানের শেষ প্রান্তেই আছে অমৃত
অন্নলাভ, এই উপনিষদের যুগেও সহজ ছিল না। ঐতরেয় উপনিষদে পড়ি প্রজাপতির বিষয়ে বলছে, ‘তিনি দেখলেন এই সব লোকগুলি ও লোকপালদের। ‘এদের জন্যে অন্ন সৃষ্টি করি’। তিনি জলরাশিকে তপস্যায় অভিতপ্ত করলেন। সেই জলরাশি তপ্ত হলে তাদের থেকে মূর্তি জাত হল, অন্নই হল সেই মূর্তি— স ঈক্ষতেমে নু লোকাশ্চ লোকপালাশ্চ। অন্নমেভ্যঃ সৃজা ইতি। সোহপোহভ্যতপহ। তাভ্যোঽভিত্তপ্তাভ্যো মূর্তিরজায়ত। যা বৈ সা মূর্তিরজায়তান্নং বৈ তৎ।’ (ঐ/উ ১:৩:১) অন্যত্র অন্নকে সৃষ্টির পর স্রষ্টার খেয়াল হল, ‘এরা খাবে কী?’ তখন তিনি জলকে তপ্ত করলেন, সেই তপ্ত জলের অভ্যন্তরে মূর্তির জন্ম হল; সে মূর্তি অন্ন। বিজ্ঞানও বলে জলে তাপ সংযাগ হলে তার মধ্যে উদ্ভিদের জন্ম হয়। সেই উদ্ভিদই প্রাণীর প্রথম খাদ্য। এর মধ্যে লক্ষণীয় শব্দটি হল ‘তাপ’। ‘তপস্যা’ এই শব্দেরই সজন্মা; প্রজাপতি কোথাও তপস্যা করে খাদ্য সৃষ্টি করছেন, কোথাও-বা জলকে তপ্ত করে তার থেকে প্রথম শৈবাল বা উদ্ভিদ সৃষ্টি করছেন যা প্রাণী আহার করতে পারে। অন্নের সংস্থান করা সৃষ্টিকর্তার দায়, তা না হলে তো তাঁর সৃষ্টি অকালে বিনষ্ট হবে, খাদ্যাভাবে মৃত্যু ঘটবে তাঁর সৃষ্ট প্রাণীর। তাই জীবসৃষ্টির অনতিকাল পরেই তিনি জীবনের অবলম্বন, জীবাতু বা জীবনদায়ী অন্ন সৃষ্টি করেন যাতে তাঁর জীবসৃষ্টি ব্যর্থ না হয়।
এত মহিমা যে-অন্নের তার সম্বন্ধে উপনিষদ বলে:
অন্নের নিন্দা কোরো না। তা (জীবনধারণের উপায়) ব্রত। প্রাণই অন্ন, শরীর অন্নভোজী… অন্নকে কখনও প্রত্যাখ্যান কোরো না, তা ব্রত। (অর্থাৎ জীবনধারণের উপায়)। অন্নকে বহুল করে তুলো। পৃথিবী অন্ন, আকাহ অন্নভোজী— অন্নং ন নিন্দ্যাৎ। তদ্রতম্। প্রাণো বা অন্নম্। শরীরমন্নাদম্। …অন্নং ন প্রত্যাচক্ষীত। তদ্ ব্রতম্। অন্নং বহু কুর্বীত। পৃথিবী বা অন্নম্। আকাশোহন্নাদঃ। (তৈ/উ ৩:৭-৩:৯)
এখানে অন্নের প্রতি যথাবিধি সমাদর প্রদর্শন করার কথা আছে। অন্নের নিন্দা করার কথাই ওঠে না। বিশেষত, যখন সমাজে ব্যাপক অন্নাভাব, তখন মানুষ নিজের অভিজ্ঞতা দিয়েই জানে প্রাণই অন্ন, কারণ অন্ন বিনা প্রাণ ধারণ করা অসম্ভব, অনাহারের অর্থই মৃত্যু। এই সমাজে যেখানে ক্ষুধার অনুপাতে খাদ্য উৎপন্ন হচ্ছে না, সর্বদাই ক্ষুধা ও অন্নের পরিমাণের মধ্যে বেশ বড়, দুরতিক্রম্য একটি ব্যবধান রয়ে যাচ্ছে, সেখানে বেঁচে থাকার জন্যে সবচেয়ে জরুরি কর্তব্য হল ওই ব্যবধানটি ঘোচাবার চেষ্টা করা। এর উপায় হল প্রচুর পরিমাণে অন্ন উৎপাদন করা অন্নকে বহুগুণিত করা। ক্ষুধার অন্ন যে চেহারাতেই আসুক না কেন, তাকে প্রত্যাখ্যান না করা। তখন মানুষ জপ করবে, ‘আমি অন্ন, আমি অন্ন, আমি অন্ন; আমি অন্নভোজী, আমি অন্নভোজী, আমি অন্নভোজী— অহমন্নমহমন্নমহমন্নম্। অহমন্নাদোঽহমন্নাদোঽহমন্নাদঃ।’ (তৈ/উ ৩:১০:৬) এই শাস্ত্র যেখানে বিস্মিত করে তা হল, এটা জ্ঞানকাণ্ডের যুগ; এখন মানুষকে দৈনন্দিন প্রয়োজনের জগতের ঊর্ধ্বে আত্মা ও ব্রহ্মের অভিন্নতা উপলব্ধি করতে উপদেশ দেওয়া হচ্ছে, কারণ নিরবিচ্ছিন্ন জন্মান্তরের আবর্তনকে ছেদন করে মানুষকে মুক্তি দেবে ওই বোধ। আর অন্ন তো ক্ষুধা প্রশমিত করে দেহকে সুস্থ, পুষ্ট ও দীর্ঘায়ু করবে, জন্মান্তরের ধারার অবসান করতে বিলম্ব ঘটাবে। যে আর জন্ম নিতে না চায়, সে কেন দেহকে পুষ্ট করতে, দীর্ঘ পরমায়ুর অধিকারী হতে চাইবে?
আপাত ভাবে কোনও বিরোধ না থাকলেও, ইহমুখীনতা ও মোক্ষমুখীনতার মধ্যে একটা বিরোধ তো আছেই। কঠোপনিষদে নচিকেতা যমকে ইহলোকের সুখ সম্বন্ধে তাঁর অনীহা জানিয়েছেন। সুদীর্ঘ কঠোপনিষদের কাছে জেনে নেওয়া, কারণ ‘কেউ কেউ বলে মৃত্যুর পরে কিছু থাকে, আবার অনেকে বলে, কিছুই থাকে না।’ সেই খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতকের কাছাকাছি সময়েও অনেকে বলত, মৃত্যুর পরে কিছুই থাকে না! এই নিয়ে যখন এত ব্যাকুলতা, তখন অন্নের জন্যে এই দুশ্চিন্তা খানিকটা অবাক করে বৈকি। যাজ্ঞবল্ক্য তপস্যা করবার উদ্দেশে বনে যাওয়ার আগে তাঁর স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি দুই স্ত্রী কাত্যায়নী ও মৈত্রেয়ীর মধ্যে ভাগ করে দিতে উদ্যত হলে মৈত্রেয়ী প্রশ্ন করেন, যা তিনি দিয়ে যাচ্ছেন তাতে অমরত্বের সম্ভাবনা আছে কিনা। মনে রাখতে হবে ব্রহ্ম সম্বন্ধে সভাসমিতিতে বারেবারে নানা তত্ত্বকথা বলে যাজ্ঞবল্ক্য জনক রাজা ও অন্যদের কাছ থেকে প্রচুর সম্পত্তি লাভ করেন। সেই বিপুল সম্পত্তির অর্ধেকের অর্থ অন্নাভাব থেকে চিরতরে অব্যাহতি এবং প্রাচুর্য। এই সহজ কথাটা কাত্যায়নী বুঝেছিলেন, তাই আর কোনও প্রশ্ন তোলেননি। মৈত্রেয়ী তুলেছিলেন। ক্ষুধা বা অশনায়া যখন মৃত্যু, তখন কোনও মতেই যাতে মৃত্যুর বশবর্তী না হতে হয় সে জন্যে কাঙ্ক্ষিত বস্তু হল অমৃত, বা মোক্ষলাভ। সেই সাধনাতেই যাচ্ছেন যাজ্ঞবল্ক্য। স্ত্রী হিসেবে স্বামীর সম্পত্তির অর্ধাংশে তাঁর অধিকার আছে, কাজেই যাজ্ঞবল্ক্য অমৃতের অধিকারী হলে মৈত্রেয়ীও তার অর্ধেকে অধিকারিণী।
এই অমৃতত্ব জন্মান্তর-পরম্পরা-ছেদেরই অপর নাম। উপনিষদের যুগে এইটিই পরম অভিলষিত বস্তু। অধিকাংশ উপনিষদের অধিকাংশ জুড়েই এ নিয়ে আলোচনা। কর্মকাণ্ড থেকে জ্ঞানকাণ্ডে উত্তরণের সঙ্গে সঙ্গে ইহলোকে ভাল ভাবে বেঁচে থাকার উপকরণগুলির জন্যে সন্ধান গৌণ হয়ে গেল; অমৃতের সন্ধান, জন্মান্তর-নিরোধের সাধনাই হল মুখ্য। এই পরিপ্রেক্ষিতে ‘অন্নকে নিন্দা কোরো না, অন্নকে প্রত্যাখ্যান কোরো না… অন্নকে প্রচুর করে তোলো… আমি অন্ন, আমি অন্ন, আমি অন্ন, আমি অন্নভোজী, আমি অন্নভোজী, আমি অন্নভোজী’— বারে বারে এ কথা বলা যেন মূল প্রসঙ্গকে লঙ্ঘন করে, উপেক্ষা করে গৌণ, অপেক্ষাকৃত তুচ্ছ বিষয়ে মনোনিবেশ করা। কিন্তু সমস্ত উপনিষদ জুড়ে এত বেশি বার এত বিভিন্ন ভাষায় ও নানা প্রসঙ্গে অন্ন সম্বন্ধে মানুষের তীব্র উদ্বেগ, আশঙ্কা, প্রার্থনা ও অন্ন সম্বন্ধে এত সশ্রদ্ধ মনোভাব দেখা যায় যে বিস্ময় জাগতে বাধ্য।