খাদ্যাভাব ও যাগযজ্ঞ
খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতকের কাছাকাছি সময়, বা তার কিছু আগে থেকে উত্তর ভারতে উৎপাদন ব্যবস্থায় গভীর এবং ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। প্রত্নতাত্ত্বিকরা বলেন খ্রিস্টপূর্ব একাদশ শতকেই এখানে প্রথম লোহার দেখা মেলে; তবে সে লোহা হয়তো অস্ত্রশস্ত্র, অলংকার, ঘোড়ার খুর, ইত্যাদিতে ব্যবহার হত। আরও তিন শতক পরে খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতকের শেষে ও সপ্তম শতকের প্রথমে দেখি কৃষিতে লোহার লাঙলের ফলার চল হল। আগে কাঠের ফাল ছিল লাঙলের মুখে, তাতে বহু পরিশ্রমে দীর্ঘ সময়ে স্বল্প জমিতে অগভীর ‘সীতা’ রেখাপাত। এর অনেক অসুবিধে ছিল; বীজ গভীরে না পড়ার ফলে পাখি ও কীট পতঙ্গ খেয়ে নিতে পারত; সবটা বীজে গাছ গজাত না। দ্বিতীয়ত, অনেক পরিশ্রমে অনেক সময়ে লাঙল দিয়ে যে চাষটুকু হত তার ফসলের পরিমাণ বরাবরই অ-পর্যাপ্ত হত, ক্ষুন্নিবারণের পক্ষে তা ছিল নেহাতই অপ্রচুর; ফলে সারা সমাজে পরিব্যাপ্ত ক্ষুধা মেটাবার সম্ভাবনা ছিল না। এখন লোহার লাঙলের ফলা যেহেতু অনেক মজবুত তাই লাঙলের ফাল গভীর হল, বীজ গর্তে থাকল, পাখি বা কীটপতঙ্গ খেয়ে ফেলতে পারল না; গাছ জন্মাল বেশি। সবচেয়ে বড় কথা হল, অল্প সময়ে বেশি জমি চাষ করা গেল, ফলে ফসলের পরিমাণও হতে লাগল বেশি। এর সঙ্গে আরও কতকগুলো ব্যাপার যুক্ত হল, যেমন কম শ্রমে কম সময়ে বেশি জমি চষার সম্ভাবনা দেখা দিতেই সঙ্গে সঙ্গে হালের বলদের প্রয়োজন বাড়ল। সে রকম সংখ্যার বলদ পশুপালে ছিল; কিন্তু তার অনেকগুলোই অন্য ভাবে খরচ হয়ে যাচ্ছিল যজ্ঞের পশুহননে। প্রত্যেকটি বড় যজ্ঞে শ’য়ে শ’য়ে পশুহননের বিধান ছিল। মনে রাখতে হবে, যাগ ছিল তিন রকমের: পশু, ইষ্টি ও সোম। এর মধ্যে শুধু ইষ্টিতেই পশুহনন হত না, বাকি দুটোতে হত এবং বহু সংখ্যায় হত। সমাজে সহজে বেশি শস্য-উৎপাদনের নতুন সম্ভাবনা দেখা দিতেই যজ্ঞে বহুসংখ্যক পশুহনন সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর, অকল্যাণকর বলে স্বীকার করতে হল। তাই শতপথব্রাহ্মণে যাজ্ঞবল্ক্য বলছেন, ‘যে ধেনু ও ষাঁড়ের (মাংস) আহার করবে তার বিনাশ হবে… সে পাপী…।’ অতএব ধেনু ও ষাঁড়ের মাংস খাবে না। যাজ্ঞবল্ক্য এ কথা বলছেন কিন্তু, এও বলছেন, ‘আমি (কিন্তু) খাব যদি সুস্বাদ হয় – যা ধেম্বনডুহোরশীয়াদস্তগিতিরিব… পাপী… তস্মাদ্ধেন্বনডুহোর্নাশীয়াত্তদু হোবাচ যাজ্ঞবন্ধ্যোহ শামেবাহমংসলং চেদ্ভবতীতি।’ (শ/ব্রা ৩:১:২:২১) অন্যত্র দেখি, ‘এই হল শ্রেষ্ঠ আহার, এই মাংস তাই পশুবন্ধ যাগ করলে সে পরম অন্নের (অর্থাৎ মাংসের) ভোক্তা হয়— এতদু হ বৈ পরমমন্নাদ্যং ষন্মাংসং স পরমস্যৈবান্নাদ্যাস্যাত্তা ভবতি।’ (শ/ব্রা ১১:১:৬:১৯)
তখন অবশ্য গৃহপালিত পশুর অথবা শিকার করে বনের পশুর মাংস খাওয়া হত। ‘দুরকম পশুই (যজ্ঞে) হনন করা হয়, গ্রামের ও অরণ্যের উভয় পশুকে অবরোধ করার জন্যে— উভয়ান্ পশূনালভতে গ্রাম্যাংশ্চারণ্যাংশ্চ উভয়েষামবরুদ্ধ্যৈ।’ (তৈ/ব্রা ৩:৯:২২:৯) অর্থাৎ যজ্ঞে দু’ রকম পশু হনন করে মাংস হব্য হিসেবে দেওয়া হত, যাতে দু’ রকমের পশুমাংসই আহারের জন্যে অবরুদ্ধ বা নিশ্চিত হয়: যজ্ঞে যা দেওয়া হবে দেবতারা তাতে প্রসন্ন হয়ে মানুষের ভোগের জন্যেও তা দেবেন এই বিশ্বাস থেকে। কোনও এক রকমের মাংস থেকেও বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কায় এই বিধান। কিন্তু গ্রামের পশু যজ্ঞে যদি অনেক সংখ্যায় হনন করা হয় তা হলে চাষের সেই মৌলিক সমস্যাটা থেকেই যায় অর্থাৎ হালের বলদে টান পড়ে। তাই এখনকার শাস্ত্রে এ সব নিষেধের অবতারণা।
এ ত হল ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মধ্যে গাভীবলদ সংরক্ষণের নির্দেশ, এবং মনে রাখতে হবে যে এ নির্দেশ আকস্মিক নয়: এ নীতি স্পষ্টতই যজ্ঞের শাস্ত্রকে অগ্রাহ্য করছে অর্থনীতির স্বার্থে; যজ্ঞে বহু সংখ্যক পশু হননের যে অনুজ্ঞা কয়েকশো বছর ধরে চালু ছিল তার বিরুদ্ধতা করছে। এ ছাড়াও তখন বুদ্ধের পূর্বে যে সব সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়েছিল, যাঁদের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছিল প্রব্রজ্যার পথে যেমন আনাড় কলাম, নির্গ্রন্থ জ্ঞাতপুত্র, রুদ্রক রামপুত্র, পূরণ কশ্যপ, মস্করী গোশাল, অজিত কেশকম্বলী, সঞ্জয় বৈরাটীপুর— এঁরা সকলেই বেদবিরোধী এবং যজ্ঞবিরোধী, ফলে পশুহননের বিপক্ষে। এঁদের মধ্যে নির্গ্রন্থ জ্ঞাতপুত্র জৈনধর্মের প্রতিষ্ঠাতা এবং বুদ্ধ স্বয়ং বৌদ্ধধর্ম স্থাপন করেন। এই দুই ধর্মেরই একটি ভিত্তিপ্রস্থর হল অহিংসা, অর্থাৎ পশুহননের বিরোধিতা। বলা বাহুল্য, এ অহিংসার মূলে একটি আতঙ্ক: যজ্ঞে যদি ওই ভাবে শ’য়ে শ’য়ে পশুহত্যা চলতে থাকে তা হলে হালের বলদে টান পড়বে, ফলে যথেষ্ট চাষ হবে না। সম্ভবত টান তখনই পড়ছিল বলেই যজ্ঞবিরোধী, পশুহননবিরোধী, অহিংসার বাণী এত দ্রুত এত জনপ্রিয়তা পেল এবং যজ্ঞ ও পশুহত্যা ধীরে ধীরে কমে এল।
কাজেই লোহার লাঙলের ফলার সাহায্যে অল্প ক্রমে দ্রুত বেশি জমি চাষ করার কিছু কিছু সুফল সদ্যই পাওয়া গেল, প্রত্যাশার অতিরিক্ত। উদ্ধৃত ফসল। এ উদ্ধৃত্তের অর্থ এই নয় যে, প্রয়োজনের তুলনায় বেশি, সে প্রসঙ্গে পরে আসব। এর অর্থ আগে যে ক’জন মানুষ যতটা সময়ে যে কটা হালের বলদ দিয়ে, যতটা জমি চাষ করতে পারছিল এবং যে পরিমাণ ফসল উৎপাদন করতে পারছিল এখন তার চেয়ে অনেক বেশি পেতে শুরু করল।
এরই সঙ্গে আরও কতকগুলো ঘটনা সম্পৃক্ত। আর্যদের আসবার সঙ্গে সঙ্গে কিছু প্রাগার্য দূরে পূর্ব-দক্ষিণ অঞ্চলে সরে গিয়েছিল, তাদের ক্রমে ক্রমে দাস হিসেবে গ্রহণ করল আর্যসমাজ। লোহার লাঙলের ফলার কল্যাণে চাষেও কম মানুষ নিযুক্ত করা হচ্ছিল; কাজেই এই উদ্বৃত্ত শ্রমিকদের নিযুক্ত করা হল কুটির শিল্পে; কাঠ, ধাতু, চামড়া, পাথর মাটি, রত্ন, সোনারুপো ও অন্যান্য ধাতু দিয়ে প্রয়োজনীয় ও সুদৃশ্য বস্তু নির্মাণ করবার কৃৎকৌশল আয়ত্ত ছিল প্রাগার্য জনগোষ্ঠীর। এ কয় শতাব্দীর মধ্যে তাদের কাছ থেকে কিছু কিছু বিদ্যা আয়ত্ত করে নিল আগন্তুক— এবং তৎকালে মিশ্র জনগোষ্ঠী। কৃষির উদ্বৃত্ত এবং শিল্পে নির্মিত বস্তু দুই-ই রপ্তানিযোগ্য। প্রাগার্য যুগে খ্রিস্টপূর্ব অষ্টাদশ শতকেরও পূর্ব থেকে ভারতবর্ষের নৌবাণিজ্য ছিল; সমুদ্রপথে ভারতবর্ষের সঙ্গে বাণিজ্যসম্পর্ক ছিল মধ্যপ্রাচ্য, মিসর, চিন হয়ে দক্ষিণ ইয়োরোপ পর্যন্ত। আর্যরা আসবার অনতিকাল পরেই এ বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায়। পুনর্বার চালু হয় খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দী নাগাদ। আমরা দেখলাম, এই সময়টাতেই শস্যে ও শিল্পে এখানে উদ্বৃত্ত সৃষ্ট হচ্ছিল, এ উদ্বৃত্ত এখন নৌবাণিজ্যের পণ্যদ্রব্যে পরিণত হল। ফলে দূর বিদেশ থেকে প্রয়োজনীয় ও শৌখিন দ্রব্য এবং সোনারুপো যেমন আসতে লাগল, তেমনই ভারতবর্ষের উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য ও শিল্পজাত দ্রব্য রপ্তানিও হতে লাগল।
এরই কিছু পরে উত্তর ভারতে মুদ্রার প্রচলন হয়। এর একটা তাৎক্ষণিক সুবিধে হল বণিক সার্থবাহের বহু দীর্ঘ দলগুলির সঙ্গে ক্ষত্রিয় রক্ষিবাহিনী দস্যুদের সঙ্গে যুদ্ধ করবার জন্যে যেত। পূর্বের রেশমপথেই হোক বা এখনকার স্থলপথে কিংবা বণিক-নৌকার সহযাত্রী রক্ষা হিসেবেই হোক, এই রক্ষিবাহিনী থাকতেই হত। এখন তাদের মুদ্রায় বেতন দেওয়া সম্ভব হল। যে সব দেশের সঙ্গে বাণিজ্য, তারা এখানকার বণিকদের কবালা পাট্টার মতোই সম্মান করত সেই বণিকদের পাঠানো মুদ্রা। কাজেই বহির্বাণিজ্য এবং দূরস্থ প্রবেশগুলির মধ্যে অন্তর্বাণিজ্যেও খুব কাজে লাগল সদ্য প্রচলিত মুদ্রার ব্যবস্থা।
কারা এই বাণিজ্যের কর্তা ছিল? রাজারা ও রাজন্যরা, অর্থাৎ সমাজের মুষ্টিমেয় একটি ধনিক গোষ্ঠী। এরা বাহুবলে এবং লোকবলে বেশি জমির মালিক হয়েছিল, ফলে প্রথমে আমদানি করা ও পরে স্থানীয় লোহা ব্যবহার করে লাঙলের ফলা তৈরি করে চাষিদের নিযুক্ত করে চাষের উদ্বৃত্ত ফসল এদেরই হাতে আসত এবং টাকার জোরে কুটিরশিল্পের উপাদান কাঠ, ধাতু, মণিরত্ন, ইত্যাদির জোগান দিয়ে শিল্পদ্রব্য নির্মাণ করিয়ে দেশে রাজা- রাজন্যদের কাছে ও বিদেশের বণিকের কাছে তা বিক্রি করবার একচেটিয়া অধিকার ছিল সমাজের উপরতলার সেই মুষ্টিমেয় ধনিক সম্প্রদায়েরই। ক্ষত্রিয় যখন ইতস্তত ছোট ছোট যুদ্ধ ছাড়া অন্তর্বাণিজ্য ও বহির্বাণিজ্যে রক্ষী হিসাবে নিযুক্ত, বৈশ্য তখন পশুপালন ও চাষ করছে। কিছু ধনী বৈশ্য ও দরিদ্র শূদ্র তখন চাষে আসছে কারণ তত দিনে বাণিজ্যে ধীরে ধীরে বৈশ্যের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে। সময়টা খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতকের কাছাকাছি। তখন ক্ষত্রিয় রাজা ও রাজন্যর প্রসাদপুষ্ট কিছু ব্রাহ্মণ ভূসম্পত্তি, দাসদাসী ও পশুপাল দক্ষিণা হিসেবে পেয়ে, কেউ বা বহুসংখ্যক ছাত্রের অধ্যাপনার জন্যে ‘কুলপতি’ হয়ে বেশ ধনী ব্রাহ্মণের মর্যাদায় ছিলেন। শাস্ত্র বলে, দশ হাজার ছাত্রকে যে অন্নদান করে পোষণ করে, শিক্ষা দেয় সে-ই কুলপতি।
ছাত্রাণাং দশসহস্রং যোত্মদানাদিপোষণাৎ।
অধ্যাপয়তি বিপ্রর্ষিরসৌ কুলপতিঃ স্মৃতঃ।।
কাজেই এই বিপ্ৰর্ষি ধনীই হতেন। তা হলে সমাজে ক্ষত্রিয় রাজা, রাজন্য ছাড়াও কিছু ব্রাহ্মণ ধনী ছিল। আর ধনী ছিল এই সময়ে বাণিজ্যে অবতীর্ণ কিছু বৈশ্য, যারা দেশে ও বিদেশে পণ্যসঞ্চালেনর কর্ণধার ছিল। এই সব কটি শ্রেণিরই অধিকাংশ সাধারণ মানুষ দরিদ্রই ছিল। শূদ্র প্রধানত চাষবাসে নিরত ছিল; সে কিছু পশুপালনও করত, ক্রীতদাস ও গৃহদাস হিসাবে কাজ করত; শিল্পদ্রব্য নির্মাণেও তাকে নিযুক্ত করা হত। দরিদ্র ব্রাহ্মণ বিস্তর ছিল— যজ্ঞের অনুষ্ঠানে যাদের স্থান হত না, রাজপ্রাসাদের কাছেও যারা পৌঁছতে পারত না। দরিদ্র ক্ষত্রিয়ও অনেক ছিল— শিশু, বৃদ্ধ, রমণী, অসুস্থ বা ক্ষীণকায় অথবা যাদের কোনও ক্ষত্রিয়বৃত্তিতে স্থান জোটেনি তেমন মানুষ। তারা বর্ণধর্মের নির্দিষ্ট বৃত্তি ছেড়ে আপদ্ধর্মের নীতিতে জীবনরক্ষার জন্যে যে কোনও বৃত্তি অবলম্বন করত। সব বৈশ্য বণিক ছিল না। ওপরতলার মুষ্টিমেয় ক’জনই বাণিজ্যের সুযোগ পেত। বাকি বহুসংখ্যক বৈশ্য পশুপালন করে জীবিকানির্বাহ করত। আর শূদ্রের তো কথাই নেই, সে চিরকালই উচ্চ ত্রিবর্ণের পদসেবার দ্বারা প্রাণ ধারণ করত; আজও এটাই তার অবলম্বন। ব্যতিক্রমী দু-চারজন হয়তো সামান্য ধন সঞ্চয় করতে পারত শিল্পজীবী হয়ে বা শিল্পকর্ম করে, কিন্তু নেহাতই অল্পসংখ্যক ক’জন। তা হলে দেখা গেল, পুরো সমাজে বর্ণনির্বিশেষে অধিকাংশ লোকই দরিদ্র। এ সময়ে এক বর্ণের সঙ্গে অন্য বর্ণের বিবাহ হত এবং মিশ্রবর্ণগুলি সংখ্যায় বাড়ছিল এবং এরা ভিন্ন ভিন্ন বৃত্তি অবলম্বন করে ছোট ছোট স্বতন্ত্র বৃত্তিগোষ্ঠীতে পরিণত হচ্ছিল, তবে এ ব্যাপারটা অনেক দ্রুত ও বেশি পরিমাণে ঘটে মৌর্য যুগে ও তার পরে।
বহির্বাণিজ্যে শুধু পণ্যদ্রব্যই আসছিল না, নানা বিচিত্র ধর্মমত, দেবদেবী, সম্প্রদায়, জীবনবোধ, আচরণ-পদ্ধতিও আসছিল এবং এরই সঙ্গে সঙ্গে ভারতবর্ষের মানচিত্রে নতুন যে পরিবর্তনটা চোখে পড়ে তা হল আর্যাবর্তে ষোলোটি মহাজনপদের অভ্যুত্থান। এগুলি হল: গান্ধার, কাম্বোজ, কুরু, পাঞ্চাল, শূরসেন, মৎস্য, মল্ল, চেদি, বৎস, কাশী, কোসল, মগধ, অঙ্গ, অবন্তী, বৃজ্জি এবং অশ্মক। এই জনপদগুলির প্রত্যেকটি ছিল কোনও একজন রাজার দ্বারা শাসিত, রাজধানীর আশপাশে অনেকগুলি গ্রাম নিয়ে গঠিত। একটি জনপদে রাজধানী ছাড়া অন্য নগরও থাকত, বিশেষত, জনপদটি যদি আয়তনে খুব বড় হয়। নগরায়ণ ভারতবর্ষের ইতিহাসে এই দ্বিতীয়বার। প্রথমবার ঘটে প্রাগার্য সিন্ধু সভ্যতার আমলে, যখন পুরো সিন্ধুসভ্যতা জুড়ে নানা নগর ছিল। আর্যরা আসবার পরে যে বিপর্যয় ঘটে তাতে বেশ কয়েকশো বছর ধরে নগরসভ্যতার অবক্ষয় ঘটে। পোড়া ইঁটের বাড়ি করার দক্ষতা ছিল না; রোদে-শুকনো-ইঁটের বাড়ি মাটির নীচে মাটির সঙ্গে মিশে যায়। প্রত্নতাত্ত্বিকরা এই অংশে নগরের চিহ্নই পাননি। আবার খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতকের কাছাকাছি শস্যে স্বয়ম্ভরতা, শিল্পে স্বীকৃতিযোগ্য নির্মাণ, উদ্বৃত্ত অর্থে অধিকসংখ্যক চাষি ও কারিগরকে বৃত্তি দেওয়ার সম্ভাবনা, বাণিজ্য থেকে অধিক অর্থাগম এবং সাধারণ ভাবে নানা দিকে সমৃদ্ধির বিকাশ, অন্তত মুষ্টিমেয় একটি শ্রেণির পক্ষে— এ সমস্তই অনুকূল ছিল নতুন নতুন নগর নির্মাণের জন্যে।
নগর কী? যেখানে প্রাথমিক খাদ্যশস্যের চাষ প্রায়ই হয় না, হলেও অকিঞ্চিৎকর পরিমাণে হয়। সেখানে থাকে কে? রাজা, রাজকর্মচারী, বণিক, শিল্পী (তার কারখানা ও শিল্পশালায়), নানা জাতের কারিগর, প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত লোকেরা, ধনীদের ভৃত্যকুল, সৈন্যরা এবং আগন্তুক রাজ অতিথিরা। বোঝাই যায়, এদের সংখ্যা অনেক এবং সকলেই ভরণপোষণের জন্যে নগরের বাইরের গ্রামগুলির ওপরে নির্ভরশীল। সেখানে চাষি চাষ করে, জেলে মাছ ধরে, তাঁতি তাঁত বোনে। যা কিছু এদের শুধু খেয়ে পরে বাঁচবার জন্যে, এবং কিছু লোকের বাহুল্যপূর্ণ শৌখিন ভাবে বাঁচবার জন্যে দরকার, তার প্রায় সবই নির্মিত হয় গ্রামে। গ্রামের সঙ্গে শহরের যোগ প্রশাসনগত, রাজস্ব দেওয়া, সুরক্ষা পাওয়ার এবং উৎপন্ন দ্রব্য বিক্রি করার। সেই সময় ধনী মালিক চাষে বা কারিগরিতে যাদের নিযুক্ত করত— প্রায়শই পেটভাতায়— তারাই খাজনা দিত; আধপেটা খেয়ে বাঁচিয়ে রাখত নগরগুলিকে, জোগাত তাদের নানা বিলাসের উপকরণ এবং বাণিজ্যের জন্যে পণ্যদ্রব্য।
নগরায়ণের একটি অপরিহার্য অঙ্গ হল শ্রেণিবিভাজন। আগে আমরা ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র চার বর্ণের কথা শুনেছি। ক্রমে ক্রমে নানা বিশিষ্ট বৃত্তির প্রয়োজনে এবং বর্ণগুলির মধ্যে ক্রমাগত অন্তর্বিবাহে বর্ণের স্থান নিল জাতি। কিন্তু বর্ণ ও জাতি মুখ্যত ছিল বৃত্তিনির্ধারিত। এখন বর্ণ ও জাতিকে এফোঁড়-ওফোঁড় চিরে ফেলে নতুন যে বিভাজনে সমাজের মুখ্য পরিচয় হল, তা হল শ্রেণি বিভাগ। এ বিভাগে ধনী ও নির্ধন যেমন একটা প্রধান পরিচয়গত ভাগ, তেমনই সঙ্গে সঙ্গেই এল শ্রমজীবী ও বুদ্ধিজীবীর মধ্যে একটা দুর্লঙ্ঘ্য ব্যবধান। কিন্তু এ দুটি সমার্থক নয়। অনেক মূর্খ ধনী যেমন ছিল তেমনই অনেক দরিদ্র বিদ্বানও ছিল। কিন্তু সমাজ মেনে নিল যে, হাতেকলমে কাজ করাটা সামাজিক খাতিরের মানদণ্ডে নিচু, আর মাথা খাটিয়ে কাজ করাটা উঁচু মানের ব্যাপার। বোঝা কঠিন নয়, মান ও অর্থ এক আধারেই সর্বত্র থাকত না। কিন্তু সমাজের অধিকাংশ মানুষই মাথা নোয়াত ধনের কাছে এবং খুব উচ্চ কোটির বিদ্যাবত্তার কাছে। এ দুজনেই সংখ্যায় কম ছিল। সাধারণ মানুষ ছিল অবিদ্বান ও নির্ধন, এবং তারাই বহুগুণে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল সমাজে। দরিদ্র চাষি বা মজুরের শ্রম কেনার ক্ষমতা ছিল ধনীর; তেমনই নির্বিত্ত বুদ্ধিমানের বুদ্ধিবৃত্তিকে কিনে সমাজের উচ্চকোটির মানুষের স্বার্থে নিয়োজিত করার সামর্থ্যও ছিল অল্প কয়েকজনের।
যে-যুগের কথা বলছি তখন যাযাবর আর্যরা কৃষিতে নিযুক্ত; তারা আর ভ্রাম্যমান নয়। জমিতে তারা স্থায়ী ভাবে বসবাস করে। এ সময়ে যে দর্শন ও ধর্মচর্চা চলছিল— বৌদ্ধ, জৈন, আজীবিক ও উপনিষদ্— তার মধ্যে বৌদ্ধ ও জৈন এবং কতক পরিমাণে আজীবিকও, সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করে। উপনিষদের তত্ত্বের একটা দিক হয়তো সাধারণ মানুষ তার মতন করে বুঝতে পেরেছিল কিন্তু তার দর্শনের দিকটা তাদের বোধগম্য হওয়ার কথা নয়। যজ্ঞ তখনও চলছিল এবং জটিল ও দীর্ঘবিলম্বিত নানা যজ্ঞ ও তাদের নানা অঙ্গ প্রক্রিয়ার উদ্ভাবন চলছিল পুরোহিতকুলের হাতে। ধর্মানন্দ কোসাম্বীর কথায়, ‘সাধারণ ভাবে একটি স্থিতিশীল উৎপাদক সমাজের আপাত উদ্দেশ্য হল পুরোহিত তন্ত্রের অর্থাগম। এদের অনুজ্ঞা হল কিছু কিছু অনুষ্ঠান করা আবশ্যক: একটি স্তরে এই সব পল্লবিত প্রক্রিয়া পরবর্তীকালে সমাজের গতি রুদ্ধ করে, নতুন উদ্ভাবনের প্রতিবন্ধক হয়, সমাজের শ্রেণিবিন্যাস ও স্থিতাবস্থাকে বজায় রাখে।’[১] উৎপাদন ব্যবস্থায় স্থিতাবস্থা রক্ষিত হলে কৃষি একই জায়গায় থাকে, উৎপাদন বাড়ে যদি চাষের জমির পরিমাণ বাড়ে। ধনীরা চাষ, শিল্পপণ্য উৎপাদন এবং বাণিজ্যের দ্বারা মূলধন বাড়ালে চক্রবৃদ্ধি হারে তাদের লাভ ও ধনসম্পত্তি বেড়ে চলে ঠিকই, কিন্তু সাধারণ চাষি বা মজুর তার দ্বারা উপকৃত হয় না।
কাঠের ফলার লাঙলে যে ধরনের চাষ হত তার চেয়ে নতুন কৃষিবিপ্লবে অর্থাৎ লোহার ফলার লাঙলে অনেকগুণ বেশি ফসল ফলত। আগে যখন মানুষ বনেজঙ্গলে খাদ্য আহরণ করত, তার চেয়ে বেশি এবং নিশ্চিত খাদ্য সে পেল গোষ্ঠীবদ্ধ ভাবে শিকার করে ও প্রকৃতির উৎপাদন কুড়িয়ে নিয়ে, কিন্তু এতেও পরিবেশের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মানুষ নিতান্ত অসহায়ই ছিল।[২] চাষে মানুষ খাদ্য উৎপাদনে প্রকরণগত ভাবে নূতনতর, উন্নততর ধাপে পৌঁছয়। প্রথম দিকে কাঠের ফলার লাঙলে ফসল উৎপাদন অনেক বেশি সময়সাপেক্ষ এবং শ্রমসাধ্য ছিল; পরে লোহার ফলায় উৎপাদন বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। মূল খাদ্যশস্য যব, গম, নানা জাতের ধান ছাড়াও অন্যান্য রবিশস্য আখ, ফল, সবজি, ইত্যাদিরও চাষ হত। লোকে গরু, ছাগল, মোষ, ভেড়া, ইত্যাদি পালন করত দুধ এবং মাংসের জন্যে। পশুপালনের আগে মানুষ শিকার করে পশুমাংস খেত— মাংস খাবার অভ্যাস ও মাংসে রুচি সেই আদিম যুগ থেকেই আছে। এর পর পশুপালনের যুগেও মাংস খাওয়ার অভ্যাস ছিল এবং চাষের আগে পর্যন্ত, দুধ ও দুগ্ধজাত খাদ্যের সঙ্গে মাংসই মুখ্য খাদ্য ছিল। মাংস সম্বন্ধে দুর্বলতা শতপথব্রাহ্মণে যাজ্ঞবন্ধ্যের উক্তি থেকে বোঝা যায়। এ ছাড়াও পড়ি, মাংস অন্ন অর্থাৎ খাদ্য, ‘পশুরা অন্ন, পশুর মাংস খাদ্য— অন্নং পশবোহন্নমু পশোমাংসম্।’ (শতপথব্রাহ্মণ ৭:৫:২:৪২) শুধু তাই নয়, এমন কথাও শুনি-যে ‘এ-ই হল শ্রেষ্ঠ খাদ্য, (এই) মাংস, (পশুবদ্ধ যাগে যাগকারী) সে (এই) পরম খাদ্যের খাদক হয়— এতদু হ বৈ পরমমন্নাদ্যং ষন্মাংসং স পরমস্যৈবান্নাদ্যস্যাত্তা ভবতি।’ (শ/ব্রা ১১:৭:১:৬) পরবর্তী কালের পুরাণে মাংসহীন ভোজন (ভোজনং মাংসরহিতম্) অভিশাপের ও দুর্ভাগ্যের লক্ষণ। কিন্তু চাষ শুরু হওয়ার পর মাংস আর প্রধান আহার্য রইল না। প্রথমত, পশুপালন তখনও ছিল, কিন্তু সেটা তখন আর মুখ্য বৃত্তি ছিল না, চাষের সঙ্গে ফলমূলমধু-সংগ্রহের মতো একটা অনুপূরক আহার্য সংস্থানের ব্যবস্থা হয়ে রইল। দ্বিতীয়ত, মৃগয়া স্বভাবতই কমে এল। নিত্যকার বৃত্তি নয়, কালেভদ্রে কখনও কখনও আনুষ্ঠানিক ভাবে রাজা, রাজন্য ও ধনীরা মৃগয়া করতেন, খাদ্যসংস্থানের জন্যে ততটা নয়, যতটা শখ মেটানোর জন্যে। তৃতীয়ত, বহু ব্যাপ্ত পরিসরের জমি তখন হাতে এসেছে, লোহার লাঙলের ফলায় অল্পশ্রমে তাতে বেশি ফসল ফলানো যায়, তাই নানা রকম খাদ্যশস্য ফলসব্জি ফলানো চলছে এবং এগুলির বিশেষ সুবিধে হল, মৃগয়ালব্ধ মাংস যেমন তাহাতাড়ি খেয়ে শেষ করে না ফেললে পচে যায়, ফসল তত সহজে নষ্ট হয়ে যায় না, বেশ কিছুকাল ভাল ভাবেই জমিয়ে রেখে দেওয়া যায়। তাতে খাদ্য সম্বন্ধে একটা নিরাপত্তাবোধ আসে, যা মৃগয়ায় বা পশুপালনের যুগে ছিল না। তা ছাড়া মৃগয়া কমে যাওয়ায় এবং পশুপালন গৌণ উৎপাদনে পরিণত হওয়ায় ফসল ও সব্জির তুলনায় মাংস আর সহজলভ্য রইল না, কালেভদ্রে জুটত, অন্তত যারা খুব ধনী নয় তাদের ক্ষেত্রে। তত দিনে এরা মাছ খেতেও শিখেছে, তাই খাদ্যে বিকল্প বেড়েছে, খানিকটা বৈচিত্র্য এসেছে।
কার? অবশ্যই ধনীর। কারণ লোহার লাঙলের ফলার প্রচলনের ফলে কৃষিবিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গেই জনসংখ্যাতেও একটা বিপ্লব দেখা দিতে বাধ্য; সভ্যতার ইতিহাসে এ ব্যাপার সর্বত্রই বারে বারে ঘটেছে। ‘যখনই একটি জনগোষ্ঠী পূর্বের অনিয়মিত খাদ্য সংগ্রহ পদ্ধতির থেকে নিয়মিত ভাবে খাদ্য উৎপাদন করতে শুরু করে তখনই তাদের সন্তানসন্ততির জন্ম দ্রুত বৃদ্ধি পায়। উন্নততর খাদ্যের জোগানের অর্থ হল, অধিক সংখায় সন্তানের জন্ম, অধিক সংখ্যায় পূর্ণবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত বাঁচা, অধিক সংখ্যক ব্যক্তির বার্ধক্যে পৌঁছানোয়। আলোচ্য সময়কার ‘আর্য’ মানে পশুচারণের দ্বারা জীবনধারণ করত এমন এক লড়াইবাজ গোষ্ঠীবদ্ধ কৃষি জনগোষ্ঠী, যাদের বাড়তি খাদ্য জোগাত চাষ। এখন আর্যরা সেই ক্রান্তিকালে অবস্থিত যখন অল্পকালের মধ্যেই লাঙল পশুপালের চেয়ে বেশি খাদ্য জোগাবে। কাজেই যার প্রসার ঘটল তা হল, নতুন এক প্রণালীর জীবনযাত্রা… লাঙলের চাষ খাদ্যসংস্থানের অনেক বেশি উন্নতি ঘটাল এবং অনেক বেশি সুনিয়ন্ত্রিত ভাবে। এর অর্থ শুধু যে জনসংখ্যার বৃদ্ধি তা-ই নয়, কিন্তু এমন একটি জনগোষ্ঠী যার একক পরিবারগুলির সদস্যও অনেক বেশি সংখ্যায় একত্র বাস করত।’[৩] এই বৃহৎ পরিবারের পারিভাষিক নাম ‘কুল’, যেখানে তিন-চার প্রজন্ম একত্রে বাস করে। তখন চাষের জন্যে সমাজ স্থিতিশীল এবং কয়েক প্রজন্মের সমবেত পরিশ্রমের ফলে যেটুকু ফসল উঠত তা-ও প্রয়োজনের তুলনায় পর্যাপ্ত হত না। কাজেই সর্বব্যাপী অভাবটা থেকেই গেল। ধনী প্রচুর চাষের জমির মালিক এবং কারিগরি শ্রমিকদের মালিক মুষ্টিমেয় বিত্তবান মানুষ, প্রয়োজনের অতিরিক্ত খেতে পেত, সঞ্চয় করতে পারত, বাণিজ্যে সে-সঞ্চয়কে পণ্যে পরিণত করে চক্রবৃদ্ধি হারে ধন বাড়িয়ে চলতে পারত। সমাজে প্রতিপত্তিশালী ছিল এরাই। কিন্তু এদের তুলনায় নিরন্ন বা অর্ধাহারী চাষি মজুরের সংখ্যা বহু বহু গুণে বেশি ছিল। কাজেই সমাজে খাদ্যাভাব ছিল প্রায় সার্বত্রিক।
পরবর্তী কালের সাহিত্যে এই খাদ্যাভাবের প্রচুর প্রমাণ মেলে। ঋগ্বেদের ঐতরেয় ব্রাহ্মণে পড়ি ‘যে অন্নভোজন করতে চায় সে প্রযাজ আহুতির সঙ্গে দক্ষিণার ব্যবস্থা করুক— যোহন্নাদ্যমিচ্ছেৎ প্রযাজাহুতিভিদক্ষিণা স ইয়াৎ।’ (ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ২:৪) ‘এই আহুতি অগ্নিতে দেবে অন্নভোজনের জন্যে ‘অন্নপতিকে স্বাহা’ এই (বলে), অন্ন যে ভোজন করে সে-ই অন্নপতি হয়, সন্তানসন্ততির সঙ্গে (অন্ন) আহার করে, যে একথা জানে— এতামাহুতিং জু হোত্যগ্নয়েঽন্নাদ্যায়া অন্নপতয়ে স্বাহেত্যন্নাদো হান্নপতির্ভবত্যশ্নুতে প্রজয়ান্নাদ্যং য এবং বেদ।’ (ঐ ব্রা ৮:২:১১)
এখানে সন্তানসন্ততির ক্ষুধা নিবারণের জন্যে পিতামাতার স্বাভাবিক উদ্বেগ উচ্চারিত এবং এই বিশেষ যজ্ঞের দ্বারা নিজের ও সন্তানের অন্নসংস্থানের ব্যবস্থার চেষ্টা হয়েছে। অন্ন তো শুধু অন্ন নয়, জীবনধারণের উপায়, তাই শুনি ‘প্রাণকে অঙ্গীকার করে অন্ন এ জন্যে… মহাব্রত অনুষ্ঠান— প্রাণঃ প্রতিগৃণাত্যন্নমিত্যাদিত্যেন… মহাব্রতং… ভবতি।’ (ঐ ব্রা ৫:৫:৩)
অন্ন-সমস্যা আজ শুধু মানুষের, কিন্তু একদা এ সমস্যা দেবতাদেরও ছিল; ‘প্রজাপতি কামনা করলেন আমি অন্নভোজী হব, তিনি অশ্বমেধ যজ্ঞে এ দুটি মহিমান্বিত গ্রহ (যজ্ঞের আহুতিবিশেষ) ‘দেখলেন’, সে দুটি গ্রহণ করলেন। তার পরে তিনি মহান্ অন্নভোক্তা হলেন। যে কেউ এই ইচ্ছা করেন, তার উচিত এই ভাবে যজ্ঞের অনুষ্ঠান করা— প্রজাপতিরকাময়ত মহানন্নাদঃ স্যামিতি। স এতবশ্বমেধে মহিমানৌ (গ্রহৌ) অপশ্যৎ। তাবগৃহীত। ততঃ স মহানন্নাদোত্তবৎ তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ।’ (৩:৯:৯:৪১)
যজ্ঞ করে অন্ন পাওয়া যায় এ বিশ্বাস সে যুগের ধর্মবোধের ভিত্তিতেই ছিল। যজ্ঞের দ্বারা অন্ন লাভ করা যায় এ কথা জনমানসে প্রত্যয়যোগ্য করে তোলার সবচেয়ে বড় উপায় হল এই কথা বলা যে, একদা দেবতারাও অন্নাভাবে কষ্ট পেতেন; তাঁরা ঐশী শক্তির দ্বারা অন্ন সৃষ্টি করে ক্ষুধানিবারণ করেননি বা করতে পারেননি; তাঁদেরও যজ্ঞ করেই অন্নের সংস্থান করতে হয়েছিল। প্রভেদের মধ্যে এই যে, তাঁরা দেবতা বলে তাঁদের দিব্যদৃষ্টির সামনে প্রতিভাত হয়েছিল কোন্ যজ্ঞ করলে অন্নলাভ হবে। সেই যজ্ঞ তাঁরা অনুষ্ঠান করে অন্ন পেয়েছিলেন এবং যজ্ঞটির উত্তরাধিকার পেল মানুষ, যাতে সে ক্ষুধার প্রতিকার কীভাবে করতে হয় সেই জ্ঞান প্রজন্মপরম্পরায় সঞ্চারিত করে যেতে পারে, উত্তরপুরুষের অনুরূপ অন্নাভাবের প্রতিবিধানের জন্য। অতিকথা (মিথ)-এর শাস্ত্রে দেবতাদের এই প্রাথমিক যজ্ঞানুষ্ঠান যা সম্পাদিত হয়েছিল ‘সে-ই সেকাল’-এ ‘in illo tempore’-এর অনুষ্ঠানই যজ্ঞটির আদিকল্প, মানুষের দ্বারা যার অনুষ্ঠান পুনরাবৃত্তিমাত্র। এই ধরনের কাহিনি প্রচুর পরিমাণে ছড়ানো আছে ধর্মগ্রন্থগুলিতে। এর দ্বারা, (১) খাদ্যাভাব একটা নিত্যকালের অবস্থা বলে প্রতিপন্ন হয়; (২) খাদ্যাভাব দেব-মানব নির্বিচারে সার্বত্রিক বলে প্রতিপন্ন হয়, (৩) দেবতাদের দিব্যদৃষ্টি ছাড়া যে এর প্রতিবিধানের উপায় ছিল না, সে কথাও প্রমাণ হয়; (৪) বিশেষ ভাবে লব্ধ এই জ্ঞানের মহিমা প্রতিপাদিত হল— প্রজাপতি এর দ্বার অভীষ্ট লাভ করেছেন সে কথায়; (৫) যা দেবতাদের ক্ষেত্রে ফলপ্রসূ তা মানুষকেও প্রার্থিত ফল দিতে সমর্থ, মানুষের এ প্রত্যয়ও জন্মাল। অতএব যজ্ঞানুষ্ঠানের মহিমা কীর্তিত হল, যাতে মানুষ ওই বিশেষ যজ্ঞের দ্বারা ইষ্টলাভ করার ভরসা পায়।
মনে রাখতে হবে, সে যুগে মানুষ নিজের চেষ্টায় প্রকৃতিকে বশ করতে বা নিজের অনুকূলে আনতে পারত না বলেই যজ্ঞের উদ্ভাবন। ব্রাহ্মণ সাহিত্যে বারংবার এ ধরনের উপাখ্যান, যার পারিভাষিক নাম ‘অর্থবাদ’ (যা যজ্ঞক্রিয়ার ব্যাখ্যা ও মহিমাকীর্তন করে)। যজ্ঞে মানুষের বিশ্বাস ও ভরসা উৎপাদন করার জন্যেই এর আবিষ্কার। সে দিনের সমাজে মানুষ তার বেঁচে থাকার সব প্রয়োজনেই অতিলৌকিকের শরণ নিতে বাধ্য হত, পৃথিবীর সর্বত্রই আদিম পর্যায়ে মানুষের এই জাতীয় বিশ্বাস ও আচরণের নিদর্শন পাওয়া যায়। সম্ভাব্যতার নীতিতে কখনও কখনও তা ফল দিত, তাতে বিশ্বাস আরও বাড়ত; আবার ওই নীতিতেই অনেকবার তা ব্যর্থ হত, তখন অনুষ্ঠাতার বা অনুষ্ঠানের ত্রুটিকেই বিফলতার জন্যে দায়ী করা হত। এমনটা এখনও করা যায়। এ ছাড়া আর কোনও বিকল্প ছিল না বলেই এরই উপরে বিশ্বাস ন্যস্ত করে মানুষ শাস্ত্রনির্দিষ্ট অনুষ্ঠান করে চলত। যজ্ঞ সম্বন্ধে পরবর্তী কালের মীমাংসা-শাস্ত্রে স্পষ্টই বলা হয়েছে কত বার মানুষ বিধিমতে যজ্ঞ করেও প্রত্যাশিত ফল পায়নি। কিন্তু সে যুগের অনুন্নত বিজ্ঞান-চর্চা, প্রকৃতির ক্রিয়াকলাপ সম্বন্ধে নেহাৎ প্রাথমিক জ্ঞানটুকুই যাদের সম্বল, নানা দৈবদুর্বিপাকের সামনে যারা সম্পূর্ণ অসহায়, তারা যজ্ঞে খাদ্যসংস্থান হোক বা না হোক যজ্ঞ ছাড়া আর কীই বা করতে পারত? স্পষ্টতই মানবায়ত প্রয়াসে যেটুকু খাদ্য উৎপন্ন হত তা একেবারেই অপ্রতুল, তাই যজ্ঞ ও দেবতাই ছিল ভরসা। শতপথব্রাহ্মণ বলে, ‘যথাযথভাবে অনুষ্ঠিত যজ্ঞের পরে সমস্ত দেবতারা এলেন, সমস্ত বিদ্যা, সমস্ত যশ, সকল অন্নভোজন, সমস্ত সমৃদ্ধি— তাবনু সর্বে দেবা প্ৰেয়ুঃ সর্বা বিদ্যা সর্বং যশঃ সর্বমন্নাদ্যং সর্বা শ্রীঃ।’ (১:৬:২:১৫)
এ বিশ্বাস না থাকলে যজ্ঞ হয় না, আর যজ্ঞ ছাড়া ইষ্টসিদ্ধির কী-ই বা বিকল্প ছিল তখনকার মানুষের? সফল হোক বিফল হোক, যে কাজ মানুষ নিজের চেষ্টায় করতে পারছে না সে-ভার তার নিজের চেয়ে শক্তিমান দেবতার ওপরে অর্পণ করায় একটা লাভ ছিল: নিশ্চিন্ততা। ওই অসহায় যুগে সেটুকুও ত কম নয়, এই নিশ্চিন্ততা লাভ করার জন্যে এখনও ত মানুষ দেবতার ওপরে নিজের ভার সঁপে দেয়। ‘এই অন্নভোজন উদিত হল যা প্রজাপতির অন্নাহার; যে এমন জেনে এখন উপবাস করে প্রজাপতি তাকে রক্ষা করেন; সে এ ভাবেই অন্নভোজী হয় যে এ কথা জেনে এখন উপবাস করে– ইদমন্নাদ্যমভ্যুত্তস্থৌ যদিদং প্রজাপতেরন্নাদ্যং স যো হৈবং বিদ্বান্ সম্প্রত্যুপবসতি; অবতি হৈনং প্ৰজাপতিঃ স এবমেবান্নাদো ভবতি য এবং বিদ্বান্ সম্প্রত্যুপবসতি’; (শ/ব্রা ১:৬:৩:৩৭) ‘যে এমন জেনে সে কারণে হবন করে সে অন্নভোজিত্ব লাভ করে— প্রাপ্নোতি হৈবৈতদন্নাদ্যং য এবং বিদ্বাংস্তর্হি জুহোতি।’ (শ/ব্রা ২:৩:২:১২) দেবতারা যজ্ঞ সম্পাদন করেছিলেন (এই আশা নিয়ে যে) ‘সমৃদ্ধি লাভ করব, যশ লাভ করব, অন্নভোজী হব— দেবা হ বৈ সত্রমাসত শ্রিয়ং গচ্ছেম যশঃ স্যামন্নাদঃ স্যাম্।’ (শ/ব্রা ৪:৬:৯:১) শ্রী ও যশের আকাঙ্ক্ষার মতোই দেবতারাও আকাঙ্ক্ষা করেছিলেন, ‘অন্নভোজী হব।’ অর্থাৎ তাঁরা যজ্ঞ করার আগে অন্নভোজী ছিলেন না। এতে মানুষ ভরসা পায় অন্নাভাবে দেবতারাও একদা তাদেরই মতো কষ্ট পেয়েছেন। অতএব তাঁরা যে প্রক্রিয়ায় অন্নভোজী হয়েছেন সেটি মানুষকেও অন্নভোজী করবে। ‘যে অন্নভোজী এবং অন্ন-উৎপাদক দর্শপূর্ণমাস যাগ জানে, সে অন্নভোজী হয়— স যো হৈবৈতাবন্নাদঞ্চান্নপ্রদুঞ্চ দর্শপূর্ণমাসে বেদান্নাদ হৈব ভবতি।’ (শ/ব্রা ১২:২:৪:৬) ‘অন্নকে যে সমষ্টিযজু বলে জানে, সে অন্নকে অবরুদ্ধ করে (বেঁধে রাখে), অন্ন দিয়ে যা কিছু জয় করা যায় তা জয় করে— স যো হ বা অন্নং সমষ্টিযজুরিতি বেদাব হান্নং রুন্ধে যৎ কিঞ্চনান্নেন জয্যং সর্বং হৈব তজ্জয়তি।’ (শ/ব্রা ১১:২:৭:৩১)
এখানে লক্ষণীয় হল ‘যা কিছু অন্ন দিয়ে জয় করা যায়’: কী তা? ক্ষুধা, অভাব, কিছু কিছু রোগব্যাধি, দারিদ্র, মৃত্যু, নিরন্নতার সামাজিক গ্লানি, অযশ, সমাজের তাচ্ছিল্য। এখন বোঝা যায়, অন্ন প্রার্থনার সঙ্গে বারে বারেই কেন যশ, শ্রী যুক্ত হয়েছে। যে সমাজে ব্যাপক অন্নাভাব সেখানে যে অন্নবান্ অর্থাৎ যার যথেষ্ট অন্ন আছে সে সামাজিক প্রতিপত্তি পায়। ‘দ্বাদশাহ সোমযাগের দ্বারা অন্নভোজিত্ব লাভ করা যায়। (তাণ্ড্যমহাব্রাহ্মণ; ১০:৩:৯) ‘অন্নকামী ষোড়শী (যাগ) দ্বারা স্তব করবে। (ত/ম-ব্রা; ১২:১৩:১৮) ‘বিরাট্ (ছন্দ) অন্নভোজিত্বকে অবরোধ করার জন্যে— বৈরাজমন্নাদ্যাস্যাবরুদ্ধ্যৈ।’ (তা/ম-ব্রা; ১৩:৭:৮) এই ক্রিয়াপদটি— ‘অবরোধ করা’ বারবারই পাওয়া যায়। কী অবরোধ করা? অন্নভোজিত্বকে, অর্থাৎ প্রত্যেক দিন যেন ক্ষুধানিরসনের জন্য পর্যাপ্ত অন্ন পাওয়া যায় সেই নিশ্চয়তা। মনে পড়ে বাইবেলে ‘প্রভুর প্রার্থনা’য় খুবই দীন বিনীত নিবেদন: আজকের খাওয়াটুকু যেন জোটে তারই জন্য মিনতি। এ প্রার্থনা অভুক্ত মানুষ রোজই করবে, তার প্রাত্যহিক আহারটুকুর জন্যে। সোমযাগে তিনবার সোম ছেঁচে রস বের করা হত; সন্ধ্যার সময়ের পেষণটির নাম ‘তৃতীয় সবন’, ‘তার দ্বারা লোকে অন্ন, অনুচর, পশু লাভ করে এবং এগুলি দিয়ে প্রাচুর্যকে অবরুদ্ধ করে— অন্নবত্যো গণবত্যঃ পশুমত্যস্তৃতীযসবনে ভবন্তি ভুমানমেব তাভিরবরুদ্ধে।’ (তা/ম-ব্রা; ১৮:৭:৪) আবার সেই ‘নিশ্চয়তার’ উল্লেখ অবরোধ করার কথা। ‘গায়ত্রী (ছন্দ) মুখ, অন্ন সপ্তদশ, মুখে অন্নধারণ করে যে একথা জানে সে অন্ন আহার করে অন্নভোজী হয়— মুখং গায়ত্র্যন্নং সপ্তদশো মুখত এব তদন্নং ধত্তে। অন্নমত্যন্নাদো ভবতি য এবং বেদ।’ (তা/ম-ব্রা; ১৯:১১:৫-৬) ‘এগুলি (যজ্ঞীয় ক্রিয়া) দ্বারা অন্নভোজিত্ব অবরোধ করে— এতাভিরন্নাদ্যমবরুদ্ধে।’ (ত/ম-ব্রা; ২৩:১৭:২,৩) নানা প্রক্রিয়া, অঙ্গ, ছন্দ, স্তব, সোমপেষণ ইত্যাদি যজ্ঞের নানা অংশে বিভিন্ন স্থানে ‘অন্নকে অবরোধ’ করার শক্তি আরোপিত হয়েছে। ঠিক কোন কারণে কোন কার্য হয়, যজ্ঞের কোনও প্রকরণের দ্বারা অন্নকে জয় করা অর্থাৎ অন্নের জোগানকে নিশ্চিত করা যায় তা জানা নেই বলেই আন্দাজে এ ভাবে চেষ্টা করা হয়েছে। জ্ঞান যেখানে নেই সেখানেই তো অনুমান।
যজ্ঞ হল একটি প্রক্রিয়া কিন্তু অন্ন দেওয়ার ক্ষমতা শুধু দেবতাদেরই আছে, এ কথা নানা দেবতা সম্বন্ধে বারবার বলা হয়েছে। ‘এই অগ্নি হল অন্নভোজী এবং অন্নপতি— অন্নাদ বা এষ অন্নপতির্যদগ্নিঃ।’ (ঐতরেয় ব্রাহ্মণ; ২:১:৫) অগ্নিকে অন্নভোজী বলা হয়েছে কারণ যজ্ঞের হব্য অগ্নি দগ্ধ করে। ‘সে-ই অন্নাহারী ও অন্নপতি হয়। সন্তানদের সঙ্গে অন্নভোজিত্ব ভোগ করে যে এ কথা জানে— অন্নাদ্যোঽন্নপতির্ভবত্যশুতে প্রজয়া অন্নাদ্যং য এবং বিদ্বান।’ (ঐ/ব্রা; ২:১:৬) ‘পূষা পোষণ করেছিলেন… যে দেবতারা পুষ্টিপতি— পূষা অপোষয়ৎ… যে দেবা পুষ্টিপতয়ঃ।’ (তৈতিরীয় ব্রাহ্মণ; ১:৬:২:১৩) দেবতারা যজ্ঞে প্রীত হয়ে অন্নদান করে পোষণ করেন, তাই তাঁরা পুষ্টিপতি। ‘পূষাই অন্ন— অন্নং বৈ পুষা।’ (তৈ/ব্রা; ১:৭:৩:২০, ২১) পশুচারীদিগের দেবতা ছিলেন পূষা, শুধু যে পশুপালের তত্ত্বাবধান করতেন, তাদের প্রজনিকা শক্তির বৃদ্ধি ঘটাতেন তাই নয়, দল ছেড়ে কোনও পশু হারিয়ে গেলে তাকে পালে ফিরিয়েও আনতেন, এমন বিশ্বাস ছিল। কাজেই সেই পশুচারণের যুগে যখন পশুমাংস, দুধ, মাখন, দই, ইত্যাদি ছিল প্রধান খাদ্য, তখন পূষা পশুদের পুষ্টি ও কল্যাণসাধন করে অন্ন জোগাতেন। পরে চাষের যুগেও পশুচারণ অঙ্গ-বৃত্তি হিসেবে রইল, কাজেই তখনও ওই পশুপালের দেবতা, পুষ্টির দেবতা, অন্নের দেবতা হিসেবে থেকে গেলেন। ইন্দ্রের বিষয়ে শুনি ‘অন্ন বহন করে আনেন শক্তিমান ধনবান এই রাজা— ইষাং বোঢ়া নৃপতির্বাজিনীবান্।’ (তৈ/ব্রা ২:৮:৭:৫৫)
‘প্রজাপতি প্রজা সৃষ্টি করলেন, তাঁর কাছ থেকে সৃষ্ট হয়ে তারা তাঁর কাছ থেকে দূরে সরে গেল। তখন প্রজাপতি রোদন করলেন। তিনি অন্ন হয়ে উদিত হলেন। প্রজারা অন্নভোজন লাভ করে প্রজাপতির কাছে এল। অন্নকে থাকতে দেখলে প্রজা কাছে আসে। যারা এমন জানে সে সব পুরুষ (তাদের) সবই অন্ন হয়, তারা সমস্ত অন্নকে অবরোধ করে— প্রজাপতিঃ প্রজা অসৃজত। তা অস্মাৎ সৃষ্টা পরাচীরায়। স এবং প্রজাপতিঃ রোদনমপশ্যৎ। সোহন্নং ভূতোঽতিষ্ঠৎ। তা অন্নাদ্যমবিত্বা। প্রজাপতিং প্রজা উপাবর্তত। অন্নমেবৈবং ভূতং পশ্যন্তীঃ প্রজা উপাবর্তন্তে। য উ চৈমমিদং বেদ। সর্বান্যন্নানি ভবন্তি। সর্বে পুরুষঃ। সর্বান্যন্নান্যবরুদ্ধে। (তৈ/ব্রা; ২:৭:৯:২৪-২৬)
এখানে কয়েকটি ব্যাপার বেশ পরিষ্কার হয়েছে: প্রজাপতি প্রজা সৃষ্টি করলেও প্রজারা তাঁকে প্রত্যাখ্যান করে, পেছনে ফেলে চলে গেল, কারণ তারা খাবে কী? প্রজাপতির রোদনে কাজ হয়নি, কাজ হল যখন তিনি অন্ন হয়ে দেখা দিলেন, তখন খাদ্যের কাছে বুভুক্ষু প্রজারা ফিরে এল। খাদ্য সৃষ্টি করে খাদ্য দিয়ে প্রজার ওপরে আধিপত্য পেলেন প্রজাপতি। অন্যত্র পড়ি, প্রজাপতি প্রজা সৃষ্টি করলেন, ‘তারা এঁকে দেখে অন্নকামী হয়ে চারিদিকে সব কিছুর মধ্যে প্রবিষ্ট হল। তাদের (প্রজাপতি) বললেন, ‘কী চাও?’ তারা বলল, ‘অন্নভোজিত্ব (চাই)’ তিনি বললেন তা-ই (হবে), এই অন্নভোজিত্ব সৃষ্টি করেছি, (সেটি) সামগান। তাই তোমাদের দিচ্ছি— তা এনং দৃষ্ট্বা অন্নকাশিনীরভিতঃ সমস্তং পর্যবিশন্ তা অব্রবীৎ কিংকামাঃ স্থ ইতি। অন্নাদ্যকামা ইত্যব্রুবন। সো ব্রবীদেবং বৈ বেদমন্নাদ্যমসৃক্ষি সমৈব। তদ্বঃ প্রযচ্ছামীতি।’ (জৈমিনীয় ব্রাহ্মণ; ১:৩:১:১) মনে রাখতে হবে জৈমিনীয় ব্রাহ্মণটি সামবেদের অন্তর্গত, তাই এখানে প্রজাদের অভীষ্ট অন্ন আসবে যজ্ঞে সামগানের পথ ধরে। অর্থাৎ সামগানের ফল হিসেবে প্রজাপতি প্রজাদের অন্ন জোগাবেন। প্রজাপতি স্রষ্টা, প্রজা সৃষ্টি করা মাত্রই কিন্তু প্রজারা প্রজাপতির বশবর্তী নয়, অনেক আখ্যানেই তারা বিদ্রোহ করে। অবশ্য প্রায়ই বিদ্রোহের একটা সঙ্গত কারণ থাকে: প্রজাপতির সৃষ্ট প্রজা খাবে কী? বেদ বলে, যথাবিধি যজ্ঞ করলে দেবতারা আহারের সংস্থান করেন। কিন্তু যজ্ঞই যদি না করতে পারে?
‘যজ্ঞ দেবতাদের কাছ থেকে উঠে ওপরে পালিয়ে গেল। বলল, ‘আমি তোমাদের অন্ন হব না।’ দেবতারা বললেন, ‘না, তোমাকে আমাদের অন্ন হতেই হবে।’ তাকে (যজ্ঞকে) দেবতারা মন্থন করলেন। (যজ্ঞ তা সহ্য করতে পারল না, সে ক্ষীণ হয়ে গেল; দেবতারা তার শুশ্রূষা করে আবার তাকে পুষ্ট করলেন— যজ্ঞো বৈ দেবেভ্য উদক্রামৎ ন বোহং ভবিষ্যামীতি। নেতি দেবা অব্রুবন্ অন্নমেব নো ভবিষ্যসীতি। তং দেবা বি মেথিরে…।’ (গোপথব্রাহ্মণ, উত্তরভাগ; ২:৬)
এখানে কয়েকটি বিষয় বেশ স্পষ্ট হয়। অন্নার্থী মানুষ বিধিমতে যজ্ঞ সম্পাদন করলে যজ্ঞ থেকে আহার্য আপনিই পাবে এমন যে একটি বিশ্বাস ছিল তা অতিসরলীকৃত। যজ্ঞ মানুষের খাদ্যের উৎস হতে অস্বীকার করল। হয়তো এক সময়ে যে যজ্ঞ করে খাদ্য পাওয়া যাচ্ছিল না, সে ঘটনার স্মৃতি এতে বিধৃত আছে। যাই হোক, ক্ষুধা বড় সাংঘাতিক জিনিস। দেবতারা যজ্ঞকে এনে তার দেহ মন্থন করলেন, বললেন, ‘তোমাকে আমাদের খাদ্য হতেই হবে।’ যজ্ঞ এই মন্থন যন্ত্রণায় কাতর ও ক্ষীণ হলে দেবতারাই শুশ্রুষা করে তাকে সুস্থ করলেন। এর মধ্যে যেমন প্রথম প্রচেষ্টা— সরাসরি যজ্ঞ থেকে অন্ন লাভ— তা ব্যাহত হওয়ার কথা আছে, তেমনই চূড়ান্ত খাদ্যাভাবে যেমন করেই হোক আহার্যসংস্থানে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ দেবতারা যজ্ঞকে কোনও ভাবে পীড়ন করলেন, এমন অযজ্ঞীয় আচরণ করলেন যাতে যজ্ঞ যন্ত্রণায় কাতর হল, তাও আছে। তখন যজ্ঞ দেবতাদের খাদ্য হতে রাজি হলে দেবতারা শুশ্রূষা অর্থাৎ নিষ্ঠার সঙ্গে বহুল উপকরণ খাদ্য নিয়ে যজ্ঞকে প্রীত ও পূর্ণাঙ্গ করে তুললেন। এ কাহিনিতে যজ্ঞবিধির বিবর্তন, সংযোগ, বিস্তার, হব্যদক্ষিণার বাহুল্য এ সবই ব্যঞ্জিত হয়েছে। অর্থাৎ যেমন তেমন করে যজ্ঞ করলে যজ্ঞ খাদ্যদানে বিমুখ থাকলেন, যথাবিধি প্রভূত যত্নে যজ্ঞ করলে পর যজ্ঞ দেবতাদের খাদ্য হতে সম্মত হলেন। খোদ দেবতাদেরই যদি এই অবস্থা তা হলে মানুষের আরও কত সাবধানে যজ্ঞানুষ্ঠান করা উচিত, যাতে যজ্ঞ বাধাপ্রাপ্ত না হয়, ত্রুটি না থাকে কর্মকাণ্ডে। তা হলে দেবতাদের শর্তে যেমন যজ্ঞ শেষ পর্যন্ত রাজি হয়েছিলেন, মানুষের আর্তি দেখেও তেমনই দয়া করবেন। যজ্ঞ থেকে অন্নলাভের মধ্যে অনেক ইতিহাস, বিবর্তন, বাধা ও তার নিরসন এখানে বিবৃত হল। কিন্তু যজ্ঞই যে অন্নলাভের উপায়, সে কথা দৃঢ় ভাবে ঘোষিত হয়ে রইল।
সোমযাগে পুরোহিত অগ্নিকে বলে, ‘তুমিই আহার, অন্ন দিলাম, একথা যে জানে সে অন্নভোজী হয়— অত্তিরস্যন্নমদাসম্। অন্নাদো ভবতি যত্ত্বেবং বেদ।’ (জৈ/ব্রা; ২:৭:২:৮) যজ্ঞে হব্য অগ্নিতে আহুতি দেওয়া হত; চোখে দেখা যেত হব্য অগ্নিদগ্ধ হচ্ছে, কাজেই অগ্নি তা খেলেন, খাওয়ার যজ্ঞীয় চেহারা ছিল অগ্নির নৈবেদ্যভক্ষণ। তাই অগ্নিকে পুরোহিত বলেন, তুমি আহার স্বরূপ। যে এ কথা জানে, সে যজ্ঞে হবিদান করে অগ্নির কাছ থেকে প্রার্থিত আহার লাভ করে। উপরের অংশে দেখছি অগ্নি, পূষা, প্রজাপতি সরাসরি ভাবে খাদ্যসংস্থানের সঙ্গে জড়িত। অন্যত্র অন্যান্য কোনও কোনও দেবতা প্রাকারান্তরে খাদ্যের স্রষ্টা বা দাতা বলে উল্লিখিত হয়েছেন। যজ্ঞের মাধ্যমেই আসুক অথবা সরাসরি দেবতার আশীর্বাদেই পাওয়া যাক, প্রার্থনার ধরনটা একই: খাদ্য দাও। লোহার ফলার লাঙলের দিনে চাষে ফসল বাড়ল, কিন্তু ক্ষুধার উপশম হল না, অন্তত সাধারণ মানুষের নয়। বিশেষ একটি ‘যজ্ঞ এবং স্তোত্রের ফলে মানুষ অন্নভোক্তা হয়— ‘অন্নং বৈ ন্যূঙ্গঃ… অথোহন্নাদ্যং প্রজায়তে।’ (ঐতরেয় ব্রাহ্মণ; ৫:৩:২) ‘অন্নভোজী তা এর (সোমের) দ্বারা লাভ করে— তামনেন (সোমেন) সনতি।’ (এ/ব্রা ৩:২:৩৬) অন্নলাভের হেতু এই (যজ্ঞের ক্রিয়া) তা-ই সম্পাদন করে। (‘অন্নসনিমেবৈনং তৎ করোতি।’ ঐ। ব্রা ৩:২:৩৭)
তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ শুরুই হচ্ছে যে মন্ত্রে তা হল, ‘ব্রহ্মকে অবিচ্ছিন্ন কর, আমাকে তা পেতে দাও… ক্ষত্রকে… দাও অন্নকে… ঊর্জকে…. ধনকে…পুষ্টিকে— ব্রহ্ম সন্ধত্তম্ তন্মে জিন্বতম্ ক্ষত্রম্.. ইষম্…ঊর্জ… রয়িং… পুষ্টিম্।’ (তৈ/ব্রা ১:১:১:১) ‘খাদ্য, শক্তি আমাদের দাও— ইষমূজমস্মাসু ধত্তম্।’ (তৈ/ব্রা; ১:১:১:৪) ‘অথর্ব যেন আমাদের জন্যে খাদ্য রক্ষা করেন। এর দ্বারা অন্নকেই রক্ষা করে— অথর্ব পিতুং-মে সোপায়েত্যাহ। অন্নমেবৈতেন স্পৃণোতি।’ (তৈ/ব্রা; ১:১:১০:৭৮) অন্নকে রক্ষা করা, অর্থাৎ অন্ন যেন না লুপ্ত হয়, এ আশঙ্কা ও এ প্রার্থনা সে যুগটিকেই সূচিত করছে। ‘ধনের বৃদ্ধি, অন্ন, শক্তি আমাদের মধ্যে ধারণ করা হোক— রায়ম্পোষমিষমূজস্মাসু দীধরৎ।’ (তৈ/ব্রা; ২:৬:৪:১৩) ‘আমার আয়ু, অন্নাহার, সন্ততি, পশু বৃদ্ধি কর— আয়ুরন্নাদ্যং প্রজাং পশুং মে পিল্বস্ব।’ (তৈ/ব্রা ৩:৭:৬:৬০) ‘বল ও পুষ্টি আমাদের জন্যে নিয়ে এস— ঊর্জং পুষ্টিং চ দদত্যাবৃস্ব।’ (তৈ/ব্রা ৩:১০:৬:১) মন্ত্রগুলিতে বল, শক্তি, খাদ্য, পুষ্টি প্রায় সমার্থক হয়ে উঠেছে। মুখ্য প্রার্থনা খাদ্যের, যা মানুষকে বল ও পুষ্টি দেবে, তার আয়ু বৃদ্ধি করবে। গোপথ ব্রাহ্মণ বলছে, ‘অন্ন থেকেই বীর্য— অন্নাদ্বীর্যম্।’ (গো/ব্রা, উত্তরভাগ; ৬:৪) কথাটা ঋগ্বেদে এবং অন্যত্র বারবার বলা হয়েছে। নতুন দেশের আদি অধিবাসীদের প্রতিকূলতা জয় করে আত্মশক্তিতে বিজয়ী হয়ে ওঠার জন্যে প্রাথমিক প্রয়োজন ছিল বল, শৌর্য, অস্ত্র, বাহন ইত্যাদি। অস্ত্র, রথ, বাহন সঙ্গে নিয়েই এসেছিল আর্যরা; কিন্তু দীর্ঘদেহী, পেশীমান আর্যশরীর পর্যাপ্ত খাদ্য ছাড়া তো দুর্বল হয়ে পড়বে, হেরে যাবে প্রাগার্যদের সঙ্গে সংগ্রামে, তাই অন্নের এত আকুল প্রার্থনা, কেননা অন্ন থেকেই আসে বীর্য। অন্ন মানে ভাত শুধু নয়, খাদ্যমাত্রই অন্ন (যদদ্যতে তদন্নম্, যা খাওয়া হয় তাই অন্নম্)। এই শব্দটি ইন্দো-ইয়োরোপীয়, মূলত খাবার জিনিসই বোঝাত (তুলনীয় ইংরেজি edible, eat, জার্মান essen)। অন্ন যথেষ্ট পেলে তা থেকে শরীর বীর্য সংগ্রহ করবে, সেই শক্তিতে পরাক্রান্ত হয়ে স্থানীয় প্রতিদ্বন্দ্বীদের পরাস্ত করতে পারবে। তখন লুণ্ঠিত পশু, স্বর্ণ, ভূমি, দাস, শস্য সবই আসবে তার হাতে, জয়ী হবে সে, এবং বিজিতদের ওপরে তার প্রভুত্ব স্থায়ী হবে। অতএব এ সবের মূলে যে খাদ্য, যা তারা নিজেদের চেষ্টায় যথেষ্ট পরিমাণ উৎপন্ন বা সংগ্রহ করতে পারছে না, তার জন্যে যজ্ঞ ও দেবতার দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না।
অন্ন থেকে শুধু বল ও শক্তিই আসে না, সামাজিক প্রতিষ্ঠাও আসে। তাই এখানে যার প্রচুর অন্ন, সে-ই দেশে সম্মানিত— তস্মাদ্ যস্যেবেহ ভূয়িষ্ঠমন্নং ভবতি স এব ভূয়িষ্ঠং লোকে বিরাজতি।’ (ঐ/ব্রা; ১:৫:৩৩) যে-অবস্থায় দেশে ব্যাপক অন্নাভাব তখন যে সৌভাগ্যশালীদের ভাণ্ডারে অন্নের প্রাচুর্য, সমাজ তাদেরই খাতিরে করে, ধনীর খাতির চিরদিনই, সব দেশেই। তাই পড়ি তাই হল সমৃদ্ধি, যেখানে খাবার লোক কম, খাবার বেশি— তদ্ধি সমৃদ্ধং যত্রাত্তা কনীয়ান্নাদ্যো ভূয়ান্।’ (শতপথব্রাহ্মণ; ১:৩:২:১২) ‘অন্নাহারই শ্রী’; তাই শুনি ‘শ্রিয়ৈ অন্নাদ্যায়’ (শ/ব্রা; ১:৫:১:৫) অর্থাৎ অন্নাহার ও সমৃদ্ধি সমার্থক, খেতে পেলেই বা সঞ্চয়ে প্রচুর খাদ্য থাকলেই মানুষ শ্রী-যুক্ত। ‘অন্নই ‘গ্রহ’— (এ শব্দের যজ্ঞীয় পারিভাষিক অর্থ আছে, আর সাধারণ অর্থ হল ‘যা গ্রহণ করে,’ বা ‘যার দ্বারা গ্রহণ করা যায়)। অন্নের দ্বারাই এ-সব গৃহীত, তাই যারা আমাদের অন্ন আহার করে, তারা সকলেই আমাদের অধীন অন্নমেব গ্রহঃ অন্নেন হীদং সর্বং গৃহীতং তস্মাদ্ যাবতাং নোহশনমশ্নন্তি তে নঃ।’ (শ/ব্রা ৪:৬:৫:৪) এখানে খুব রূঢ় ভাবেই উচ্চারিত হয়েছে খাদ্যের সামাজিক মান, ওজন ও সম্ভ্রমের ভিত্তি। যে আমার অন্ন আহার করে সে আমার অধীন। সামগ্রিক খাদ্যাভাবের দিনে এ কথা সহজেই বোঝা যায় যে, আহার দিয়ে ক্ষুধিত মানুষকে কেনা যায়। ভৃত্য বা ভার্যা যে স্বামীর বশ, অধীন, সে ওই ভরণের দৌলতেই তো! ক্ষুধা এবং খাদ্যের সঙ্গে দেবতারা নানা ভাবে জড়িত। ‘অন্ন থেকে অগ্নি হয়েছিলেন, অন্নই সোম, অন্নদাতাও তাই, এই সবই অন্ন— অন্নাদেবাগ্নিরভবদন্নং সোমোহন্নাদশ্চ বা ইদং সর্বমন্নঞ্চ।’ (শ/ব্রা ১১:১:৬:১৯)
এই যে অন্ন এ দেবতাদেরই হোক (অর্থাৎ হব্য) অথবা মানুষেরই হোক (খাদ্য) এ কখনও বিক্রি করবে না— ন দেবানামন্নং বিক্ৰীয়েত ন মনুষ্যাণাম্।’ (জৈমিনীয় ব্রাহ্মণ; ১:১৫:১:৫) এটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ— অনুজ্ঞা হিসেবেও বটে, সমাজচিত্র হিসেবেও বটে। অনুজ্ঞার তিনটি দিক আছে: প্রথমত, অন্ন বিক্রয় করা যেতে পারত, অর্থাৎ সমাজে এর ক্রেতা-বিক্রেতা ছিল। দ্বিতীয়ত, বিক্রেতা হল সে যার প্রয়োজন ছাপিয়ে কিছু উদ্বৃত্ত আছে, আর ক্রেতা হল যার অন্ন নেই, ক্ষুধা আছে ও এমন কোনও সামগ্রী আছে, যার বিনিময়ে সে কেনাবেচা করতে পারে। সম্ভবত এ সময়ে মুদ্রার প্রচলন হয়েছে। তা হলে টাকা দিয়ে কেনাবেচারও সম্ভাবনা ছিল। তৃতীয়ত, সমাজে ক্ষুধা, ক্ষুধার্তের ক্রয়সামর্থ্য, উদ্বৃত্তের বিক্রেতা থাকা সত্ত্বেও অন্নবিক্রয় নিষিদ্ধ। সামাজিক দিকটি হল এ অন্ন ভোজনযোগ্য, অর্থাৎ পাক-করা অন্ন, শস্য নয়। খাদ্যশস্যের কেনাবেচা তো চলতই। কেন এ নিষেধ? সম্ভবত সমাজপতিদের চেতনায় এমন বোধ ছিল যে, যে-অন্ন প্রাণদায়ী, তা যদি একবার পণ্য হয়ে ওঠে তবে সমাজ এমন এক পর্যায়ে নৃশংসতার অনুমোদন করবে যাতে মানুষ অমানুষ হয়ে উঠবে। তাই অন্নদান পুণ্য, তাই আজও ‘ভাত-বেচা বামুন’ নিন্দিত (দ্রষ্টব্য বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আদর্শ হিন্দু হোটেল)। ক্ষুধিতের মুখের গ্রাস নিয়ে কেনাবেচা একটা সংকোচের, গ্লানির ব্যাপার ছিল। তাই ক্ষুধিতের অন্নদান সেবা সমস্ত সাহিত্যে মহাপুণ্য। দানে, দক্ষিণায়, অতিথি-আপ্যায়নে, দরিদ্র-ভোজনে, তীর্থে, ব্রতে, মানতে অন্নদানে বিশেষ পুণ্য ঘোষিত হয়েছে বৈদিক সাহিত্যে, মহাকাব্য দুটিতে, পুরাণে এবং পরবর্তী সাহিত্যেও। অন্নে মানুষের সহজাত অধিকার। জল বাতাসের মতোই এটি বেঁচে থাকার প্রাথমিক উপাদান। তাই জলবাতাসের মতোই অন্নকে শাস্ত্র কেনাবেচার বাইরে দেখতে চেয়েছে।
এখানে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য আছে— দেবতাদের অন্নও বেচো না। দেবতাদের অন্ন কী? হব্য। চারিদিকে ব্যাপক ক্ষুধার পরিবেশে যজ্ঞান্তে হব্যও হয়তো মূল্যের বিনিময়ে নিতে চাইত কিছু ক্ষুধার্ত মানুষ। কোনও প্রমাণ নেই, কিন্তু এই নিষেধই প্রকারান্তরে একটি প্রমাণ। মনে রাখতে হবে দর্শ পূর্ণমাস, চাতুর্মাস্য, অশ্বমেধ, বাজপেয়, রাজসূয়, অগ্নিচয়ন সোমযাগ, সত্র, ইত্যাদিতে বহু পশু হনন করা হত; প্রচুর পরিমাণে চরু, পুরোডাশ্, দই, দুধ, আমিক্ষা (ছানা), মন্থ (ঘোল) মধু, সৰ্পিঃ (ঘি), সোমরস ও সুরা এবং প্রভূত পরিমাণে পশুমাংস হত হব্য। সম্ভবত যজ্ঞকারী যজমান, সতেরো জন প্রধান ঋত্বিক্ পুরোহিত ও তাদের সহকারীরাও অত খাদ্য খেয়ে উঠতে পারত না। এবং ঘি ছাড়া এ সবই দু’ তিনদিনেই পচে যাবে, নষ্ট হবে। সেই নৈবেদ্যের উদ্বৃত্ত নিয়ে কিছু পুরোহিত হয়তো একটু আধটু ব্যবসা করতে অনিচ্ছুক ছিল না, তাই এ নিষেধ। দেবতার প্রসাদ বিক্রি আমাদেরও অচেনা নয়।
‘অথর্ব কবন্ধের পুত্র কাবন্ধি ‘বিচার’ ছিল বুদ্ধিমান্, মীমাংসাশাস্ত্রজ্ঞ, বেদজ্ঞ। তার অত্যন্ত সম্মানবোধের জন্য সে মানুষের কাছে বিত্ত গ্রহণ করত না। তাকে তার মা বললেন, এই কুরু-পাঞ্চালের, অষ্টমগধের, কাশি-কোশলের, শল্ব-মৎস্যের, শবস-উশীনরের, উদীচ্যের শক্তিমানরা বলেছিলেন, ‘এসবই তোমারই অন্ন (লোকে) খাচ্ছে, আমরা তোমার অতিরিক্ত মানের জন্যে খেতে পাচ্ছিনে, বাছা, যাও ঘোড়ার সন্ধান কর— বিচারো হ বৈ কাবন্ধি কবন্ধস্যাথবাস্য পুত্রো মেধাবী মীমাংসকোহচান আস। ন স্বেনাতিমানেন মানুষং বিত্তং নেয়ায়। তং মাতোবাচ ত এবৈতদন্নমবোচংস্ত ইমমেষু কুরুপাঞ্চালেম্বষ্টমাগধেষু কাশিকৌশলেষু শাল্বমৎস্যেষু শবস-উশীনরেষুদীচ্যেম্বন্নমদন্তীত্যথ বয়ং তবৈবাতিমানেনান্নাদ্যাস্নো বস বাহনমন্বিচ্ছেতি।’ (গোপথব্রাহ্মণ, পূর্বভাগ; ২:৯)
কাহিনিটি পরবর্তী কালের হতে পারে, হয়তো বা খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের কাছাকাছি সময়ের রচনা। কাবন্ধি ‘বিচার’ চাইলে শুধু তাদের পরিবারের সকলের যে ক্ষুণ্ণিবৃত্তি হয় তা-ই নয়, সে ধনীও হয়। মা তার দানে এই ঔদাসীন্য দেখে বললেন, যাও বাছা, যা তোমার পাওনা তা সংগ্রহ করতে ঘোড়ায় চড়ে রওনা হয়ে যাও।’ এখানে দেখি, বৃহৎ সম্পত্তির অধিকারী হতে পারত এমন এক অভিমানী পণ্ডিত ব্রাহ্মণ স্বেচ্ছায় অন্নচেষ্টা ত্যাগ করে ঘরে বসে ছিল। ফলে যা হওয়ার তা-ই হল। মা এবং সে, হয়তো পরিবারের অন্যরাও উপবাস করছে, কারণ ‘বিচার’ অন্যের কাছে সম্পত্তি নেবে না। এ সম্পতির মধ্যে তার উপার্জিত যজ্ঞক্রিয়ার দক্ষিণা; তার ঔদাসীন্যে অন্যেরা তা খাচ্ছে, তাই মা তাকে উদ্বুদ্ধ করে বললেন, ‘যা তোমার প্রাপ্য তা সংগ্রহ করে আনো।’ সে সম্ভবত গেল। কিন্তু এখানে যা লক্ষণীয়, কী বিপুল পরিমাণ অন্ন একজন পণ্ডিত ঋত্বিকের অধিকারে আসতে পারত। ব্রাহ্মণসাহিত্যের যুগে যজ্ঞের যখন রমরমা অবস্থা তখন পুরোহিতরা ইচ্ছে করলে কী রকম ধনী ও অন্নবান্ হতে পারতেন এখানে সেই খবর পাই।
‘ছ’টি ঋতু, প্রজাপতির দ্বারা (প্রথমে) তাঁর অন্নভোজিত্ব গ্রহণ করে ঋতুরা, পরে সেটা তাঁকে ফেরৎ দেয়— ষড় বা ঋতবঃ প্রজাপতিনৈবাস্যান্নাদ্যমাদায়র্তবো অস্মা অনু প্ৰ যচ্ছন্তি।’ (তৈ/সং; ৩:৪:৮:৬) ঋতুরা মাঝখানে একবার অন্নাহারী হয়। এ শক্তি মূলত প্রজাপতির, ঋতুরা নেয় কেননা ঋতুতে ঋতুতে ক্ষেত্রে নানা অন্ন জন্মায়, তা-ই ভোগ করে মানুষ, পরে সে-শক্তি প্রজাপতিতে ফিরে যায় এবং মানুষ প্রজাপতির নির্দেশিত যজ্ঞগুলি করে অন্ন লাভ করে। অর্থাৎ অন্নাহারের অধিকার প্রাথমিক ভাবে দেবতার— মানুষের নয়। ঋতুগুলি ফসল ফলিয়ে মানুষের অন্ন জোগায়, কিন্তু তা আহারের মুখ্য অধিকার প্রজাপতিরই থাকে। কাজেই অন্ন সম্বন্ধে মানুষের নিরন্তর অনিশ্চয় ও আতঙ্ক থেকেই যায়। এই অতিকথার পশ্চাতে সমাজের বাস্তব অন্নাভাবের একটা চিত্র রয়ে গেছে।
অন্নের মাহাত্ম্য প্রচারের জন্যে বলা হয়েছে, ‘সন্তান কামনা করে অদিতি ভাত রাঁধলেন, তার উচ্ছিষ্ট অংশ আহার করে তিনি গর্ভধারণ করলেন— অদিতির্বৈ প্রজাকামৌদনমপচৎ তদুচ্ছিষ্টমশাৎ সা গর্ভমধত্ত।’ (গোপথব্রাহ্মণ, উত্তরভাগ; ২:১৫) এখানে দেখছি অন্ন শুধু প্রাণ ধারণের উপকরণই নয়, প্রাণ সৃষ্টিরও উপাদান। অদিতি দেবমাতা; আদিত্যরা তাঁর সন্তান; এই দ্বাদশ আদিত্যে সূর্যের নানা প্রকাশ, এঁরা দেবমণ্ডলীতে প্রধান দেবতা। কাজেই এমন গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার— প্রধান দেবতাদের গর্ভে ধারণ করা— সেটা অদিতি কীভাবে সাধন করলেন? সেটা করলেন অন্ন পাক করে ও ভোজন করে। এতে অন্নের নতুন এক মহিমা প্রচারিত হল।
যজ্ঞে ব্যবহৃত কিছু কিছু বস্তুরও মাহাত্ম্য বেড়েছে অন্নের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে। যেমন ডুমুর (উদুম্বর) গাছের কাঠ হল শুদ্ধ, তা দিয়ে তৈরি আসন, হাতা ইত্যাদি সব যজ্ঞে ব্যবহার হত। ‘উদুম্বর হল অন্নভোজন, তাই তাতে বল ধৃত হয়। অন্নভোজন হল উদুম্বর— অন্নাদ্যমুদুম্বরমূর্জমেবাস্মিংস্তদন্নাদ্যং দধাতি, অন্নাদ্যমুদুম্বরমূর্জমেব তৎ।’ (ঐ/ব্রা; ৮:২:৪:৫) উদুম্বরের নিজের মাহাত্ম্য নগণ্য কিন্তু অন্নভোজনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তা বল হয়ে উঠল। এই কথা অন্যত্রও বলা হয়েছে। (তৈ/ব্রা; ১:২:৬:৪৮; ১:৩:৮:৪৯; তাণ্ড্যমহাব্রাহ্মণ ৫.৪.২; ১৬:৬:৪৩; ১৮:২:১১)
অন্নকে নানা রূপে দেখা হয়েছে, নানা গুণে ভূষিত করা হয়েছে, নানা ভাবে, নানা নামে, নানা কারণে চাওয়া হয়েছে। ‘অন্ন হল শান্তি, উত্তম চারণভূমিতে (এ শান্তি) ভগবতী হয়ে উঠুক— শান্তির্বা অন্নং সূর্যবসাদ্ ভগবতী হি ভূয়াঃ।’ (ঐ/ব্রা; ৭:২:২) দশাক্ষর বিরাট্ ছন্দের সঙ্গে অন্নের সম্বন্ধ বারবার বলা হয়েছে। (ঐ/ব্রা; ১:৫:৩৩; ৫:৩:৪; ৬:৫:১০; ৬:৪:৮; তাণ্ড্য মহাব্রাহ্মণ; ৮:১০:৮; ১২:১০:৮; ১২:১১:২২; তৈ/ব্রা; ১:৮:২:৪; ৩:৮:২:৮৩; ৩:৯:১৭:৬২; ১৩:৭:৮) অন্নের এই রূপ— সুরা— অন্নস্য বা এতদ্রুপং যৎসুরা।’ (তৈ/ব্রা ১:৩:৩:১৯) ‘জরাবোধীয় (নামক সামগান)-ই অন্ন, মুখ গায়ত্রী। মুখ দিয়ে অন্নধারণ করে, আহার করে— অন্নং বৈ জরাবোধীয়ং মুখং গায়ত্রী মুখ এব তদন্ন ধত্তে অন্নমত্তি।’ (তাণ্ড্য মহা-ব্রা; ১৪:৫:২৮) তেমন ‘এ-ই হল সাক্ষাৎ অন্ন, এই যে ইলান্দ (সাম গান)— এতদ্বৈ সাক্ষাদন্নং যদিলান্দম্।’ (তাণ্ড্য মহা-ব্রা; ৫:৩:২:১) আবার ‘এই হল সাক্ষাৎ অন্ন এই যে রাজন (সামগান)— (এতদ্বৈ সাক্ষাদন্নং যদ্ৰাজনম্।’ (তা/ম/ব্রা; ৫:৩:২) কোনও ব্রাহ্মণ সামগানকে অন্ন বলছে, কোনওটা-বা যজ্ঞ ও তার অঙ্গকে অন্ন বলছে, এর দ্বারা সব সম্প্রদায়ই অন্নের মাহাত্ম্য স্বীকার করে এর অত্যাবশ্যকতা প্রতিপন্ন করেছে।
শুধু অন্নের জন্যে অন্নকে অবরোধ করার কথা বারবারই পাই, ‘অন্নের অন্নের (জন্যে) হোম করে। অন্নের অন্নের অবরোধের জন্যে— অন্নস্যান্নস্য জুহোতি। অন্নস্যান্নস্যাবরুদ্ধ্যৈ।’ (তৈ/ব্রা; ১:৩:৮:৪৮; ১:৮:২:৪) যেমন করে হোক অন্নের জোগান যেন নিশ্চিত হয় সে চেষ্টাই নানা ভাবে প্রকাশ পেয়েছে। কখনও অন্ন শুধু অন্নরূপেই, কখনও কোনও দেবতার রূপে, আবার কখনও যজ্ঞে ব্যবহৃত কোনও উপকরণ, যজ্ঞের কোনও অংশ, কোনও ছন্দ, কোনও বিশেষ যাগ— এ সবের সঙ্গে সমীকৃত হয়েছে অন্ন। উদ্দেশ্য দুটি: প্রথমত, দেবতাদের বা যজ্ঞাঙ্গকে অন্নের স্বরূপ বললে দেবতারা প্রীত হয়ে অন্ন দান করবেন। দ্বিতীয়ত অন্ন যে স্বতই মহৎ, মহামূল্য, আরাধ্য— এটি প্রতিপন্ন হল। অন্ন থেকে সুরা তৈরি করা হত; সুরার জনপ্রিয়তাও অন্নের মাহাত্ম্য বাড়াল। ‘অন্ন পূষা… রাজন্য ইন্দ্রের, অন্ন পূষা। অন্নাহারের দ্বারা উভয়দিককেই পরিগ্রহণ করে।’ তাই রাজন্য অন্নাহারী হবে— ‘অন্নং বৈ পূষা… ঐন্দ্ৰো বৈ রাজন্যোত্নং পূষা। অন্নাদ্যেনৈবমুভয়তঃ পরি গৃহাতি। তস্মাদ্রাজন্যোঽন্নাদো ভাবুকঃ।’(তৈ/ব্রা ৩:৮:২৩:৯০) ‘অন্ন চন্দ্ৰমা অন্ন প্রাণ— অন্নং বৈ চন্দ্ৰমাঃ অন্নং প্রাণাঃ।’(তৈ/ব্রা ৩/২/৩/১৯) ‘অন্ন মরুদ্ণ— অন্নং মরুতঃ;’ (তৈ/ব্রা ১:৭:৭:৪৩) ‘এই যে ওদন এ-ই পরমেষ্ঠী- পরমেষ্ঠী বা এষ। যদোদনঃ।’(তৈ/ব্রা ১:৭:১০:৬৪) ‘অন্ন হল জল। তার থেকে অন্ন জন্মায়। যেহেতু জল থেকে অন্ন জন্মায় (তাই) তা (এর দ্বারা) অবরুদ্ধ হয়— ‘অন্নং বা আপঃ। তাভ্যো বা অন্নং জায়তে। যদভ্যোঽন্নং জায়তে।’ (তদবরুন্ধে। তৈ/ব্রা ৩:৪:১৪:৫) এ কথা অন্যত্রও আছে, ‘যা অন্ন তা-ই জল— তদ্ যদন্নমাপস্তাঃ।’ (জৈ/ব্রা ১:৯:২:৫) ‘যা কৃষ্ণ তা হল জল, অন্ন, মন ও যজু’র রূপ… নীল রূপ হল জল, অন্ন, মন ও যজুর রূপ— যৎ কৃষ্ণং তদপাং রপমন্নস্য মনসো যজুষঃ… নীলং রূপং তদপাং রূপমন্নস্য মনসো যজুষঃ।’(জৈ/ব্রা; ১:৮:১:৩)
জলের সঙ্গে অন্নের সম্পর্ক কৃষিজীবী মানুষের কাছে স্বতঃসিদ্ধ। জলকে অবরোধ করা মানে পানীয় জলের জোগান সম্বন্ধে নিশ্চয়তা। বারেবারেই শোনা যায় প্রাণ বা জীবনের সব চেয়ে বড় শত্রু হল ক্ষুধা, তৃষ্ণা, অশনায়পিপাসে। অর্থাৎ নিরাপদ পানীয় জল সম্ভবত খুব সুলভ ছিল না। জলে ধানগাছ বাড়ে তাই ধান দিয়ে জলের জোগান সম্বন্ধে একটা আশ্বাস সৃষ্টি করার চেষ্টা। এই কথাই আবার শুনি, ‘জলই অন্ন— পয় এবান্নম্।’ (শতপথব্রাহ্মণ; ২:৫:১:৬) ‘অন্ন প্রজাপতি— অন্নং বা অয়ং প্রজাপতিঃ।’ (শ/ব্রা ৭:১:২:৪) ‘বসুদের রূপ হল চাল— বসূনাং ব এতদ্রূপং যত্তণ্ডুলাঃ।’ (তৈ/ব্রা; ৩:৮:১৪:৫) ‘এগুলিই সাক্ষাৎ অন্ন, ঊষাগুলি’। অন্নাহারে এদের সমৰ্ধিত (সমৃদ্ধ) হয়।’ (এ তে হি সাক্ষাদন্নং। যদুষাঃ। সাক্ষাদেবৈনমন্নাদ্যে সমধয়ন্তি। তৈ/ব্রা ১:৩:৭:৪৫) ওপরের তালিকায় অন্ন পূষা, চন্দ্রমা, প্রাণ, বসু, মরুদ্গণ, ঊষা, পরমেষ্ঠী, জল (মনে রাখতে হবে ‘আপঃ’বা জলও স্বতন্ত্ররূপে দেবতা ছিল)— এতগুলি দেবতার সঙ্গে অন্নকে সম্পৃক্ত করা আকস্মিক বা অহেতুক নয়। অন্নাভাবে জর্জরিত জনগোষ্ঠীর কাছে অন্ন দেবতার মতোই সুদূর, দুষ্প্রাপ্য, ক্ষমতাশালী ও আরাধ্য।
অন্ন বলতে তখন ওদন, তণ্ডুল বোঝাত, নীবার-ও বোঝাত; ‘এ-ই পরম অন্ন, নীবার। এই পরম অন্নের আহারের দ্বারা অন্নকে অবরোধ করা যায়— এতদ্বৈ পরমমন্নং যন্নীবারাঃ। পরমেণৈবাস্মা অন্নাদ্যেনান্নমবরুদ্ধে।’ (তৈ/ব্রা ১:৩:৭:৩৮; ১:৬; ৪:৩৩) ‘অন্ন হল গম— অন্নং বৈ গোধূমাঃ।’(শ/ব্রা ৫:২:১:৩) আর ছিল চরু, দুধ ও তণ্ডুলে পক্ক খাদ্য, চরু দেবতাদের ওদন, চরু-ওদন হল প্রত্যক্ষ অন্ন— চরুর্বৈদেবানামোদনো হি চরুরোদনো হি প্রতক্ষ্যমন্নম্।’ (শ/ব্রা ৪:৪:২:১) নানা রকম শস্যবীজ তখন চাষ হচ্ছে, কোনও কোনওটাকে দেবতার ভোজ্য বলে তার সম্মান বাড়ানো হচ্ছে, যাতে যত্নে চাষ ও সংরক্ষণ হয়, যেন অপচয় না হয়।
‘অন্নই ‘বাজ’ (শক্তি), অন্নকেই অবরোধ করা হয়— অন্নং বৈ বাজঃ। অন্নমেবাবরুন্ধে।’ (তৈ/ব্রা ১:৩:৮:৫২; তাণ্ড্য ম-ব্রা ১৩:৯:১৩; ১৪:৫:৫) অন্যত্র বলেছে, ‘অন্নপেয়ই হল বাজপেয় (যাগ)— অন্নপেয়ং হ বৈ নামেতদ্ যদ্বাজপেয়ম্।’ (শ/ব্রা ৫:১:৩:৩; ৫:১:৪:১২; ৫:২:২:১) ‘অন্নই বাজ, অন্নের দ্বারা জয় করা এই কথা বলা হয়েছে— অন্নং হি বাজোহন্নজিত ইত্যেবৈতদাহ।’ (শ/ব্রা ৫:১:৪:১৫) বাজপেয় একটি পরবর্তী কালের প্রসিদ্ধ যাগ; এটা জটিল ও ব্যয়সাধ্য, কিন্তু যজমানের সম্মান বৃদ্ধি করত। এই শাস্ত্রাংশে বলা হল এ যজ্ঞ অন্নকেন্দ্রিক, অন্নই বাজ। এই কথা বলাতে অন্ন বিশেষ একটি সম্মান লাভ করল। ‘পূর্বকালে বাক্-ই দেবতাদের অন্ন ছিল— বাগ্ বৈ দেবানাং পুরান্নমাসীৎ।’ (তৈ/ব্রা ১:৩:৬:২৭) এ কথা বৈদিক সাহিত্যে শুধু নয়, সমস্ত প্রাচীন ধর্ম সাহিত্যে খুব তাৎপর্যপূর্ণ। বাক্ হল সেই উপাদান যা দিয়ে মন্ত্র নির্মিত হয়। এই মন্ত্রের বৈশিষ্ট্য কী? মন্ত্রে অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্ব সৃষ্টি করে, এর দ্বারা বিশ্বভুবন সৃষ্ট হয়; এ শুধু শব্দসমষ্টি নয়; শক্তিপূত, তেজোগর্ভ শব্দসমষ্টি। এবং এমন যে-বাক্, তা ছিল দেবতাদের অন্ন, যা আহার করে তাঁরা শুধু বাঁচতেন না, সৃষ্টি করতেন। কাজেই বাক্কে অন্ন বলে সৃষ্টির মূলীভূত শক্তিকে অন্নের সঙ্গে সমীকৃত করা হল। ‘অন্নকে প্রাণ, অন্ন অপান বলা হয়েছে। অন্নকে মৃত্যু, তাকেই জীবনের অবলম্বন বলা হয়েছে— অন্নং প্রাণমন্নমপানমাহুঃ। অন্নং মৃত্যুঃ তমু জীবাতুমাহুঃ।’ (তৈ/ব্রা ২:৮:৮:৬১) প্ৰাণবায়ু অপানবায়ু দেহের মধ্যে থাকে বলে মনে করা হত। কিন্তু মৃত্যু কেন? অন্নাভাবই মৃত্যু আর অন্নাহার হল জীবাতু, জীবনের মূল উপাদান। এ যেন অন্নের স্তব।
অন্নাভাব যে কী মারাত্মক হতে পারে সে সম্বন্ধে মানুষের বেশ প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছিল। সতেরো সংখ্যাটি যজ্ঞের সঙ্গে নানা ভাবে যুক্ত। বলা আছে অন্নই হল সপ্তদশ, ‘মধ্যে যে সাত থাকে, (দু’দিকে) পাঁচ পাঁচ থাকে, সেই মধ্যেরটিই ক্ষুধাকে ধারণ করে; তাতে প্রজা ক্ষুধাহীন হয়— অন্নং বৈ সপ্তদশ, যৎ সপ্ত মধ্যং ভবতি পঞ্চ পঞ্চাভিতোহন্নমেব তন্মধ্যতো ধীয়তে অনশনায়ুকো ভবত্যনশনায়ুকঃ প্রজাঃ।’ (ত/ম/ব্রা ২:৭:৭) দু’পাশে পাঁচ পাঁচ সংখ্যায়, ঊন, মধ্যের সপ্ত অধিক, এবং মধ্যেরটি নিরাপদে অক্ষুধা বা ক্ষুন্নিবারণকে ধারণ করে। যজ্ঞের এই রূপকবিনির্মাণের একটিই উদ্দেশ: ওই সপ্ত প্রজার অন্নসংস্থানকে নিরাপদে ধারণ করে, যাতে প্রজা ক্ষুধা থেকে অব্যাহতি পায়। এটি ছিল সে সমাজের একটি পরম কাম্যবস্তু।
যেন খেতে পাই, এই কথাটি অসংখ্য প্রার্থনার মূল কথা। ‘ব্রহ্মোদ্য’ হল ব্রহ্ম সম্বন্ধে আলোচনাসভা। এটা প্রায়ই ধনী রাজন্য বা রাজার আমন্ত্রণে ব্রহ্মজ্ঞ ব্রাহ্মণদের দ্বারা অনুষ্ঠিত হত। একটি উদ্দেশ্য অন্নলাভ, ‘ব্রহ্মোদ্য অন্নদান করে, ব্রহ্মপত্নী অন্নদান করেন— ব্রহ্মোদ্যং চান্নাদা ব্রহ্মপত্নী চান্নাদাঃ।’ (ঐ/ব্রা ৫:৪:৬) ‘আমি অন্ন আহার করছি- অহমন্নমহমদত্তমস্মি।’ (তৈ/ব্রা ২:৮:৮:৪৮) এই কথা বারবার বলা হয়েছে। মন্ত্র জপ করার ভঙ্গিতে বলা হয়েছে, ‘অন্ন (উৎপাদন) করব, অন্নে প্রবেশ করব, অন্ন জন্মাব— অন্ন করিষ্যাম্যন্নং প্রবিষ্যাম্যন্নঞ্জনয়িষ্যামি।’ (তা/ম/ব্রা ১:৩:৬-৭) তেমনই শুনি, ‘অন্ন (উৎপাদন) করেছি, অন্ন হয়েছে, অন্নের জন্ম দিয়েছি— অন্নমকরমন্নমভূদমজীজনম্।’ (তা/ম/ব্রা ১:৮:৭) রাজা কামনা করছেন, ‘অন্নবান্, ওদনবান্, আমিক্ষা (ছানা)-বান্, যেন এদের রাজা হই— অন্নবতামোদনবতামামিক্ষাবতাম্। এষাং রাজা ভূয়াসম্।’ (তৈ/ব্রা; ২:৭:১৬:৫৮) অর্থাৎ রাজার প্রজারা যেন থাকে দুধে-ভাতে; ভাত এবং দুগ্ধজাত খাদ্যের অভাব যেন তাঁর রাজ্যে না থাকে। বলা বাহুল্য, এটি বাসনামাত্রই। কোনও কোনও রাজার রাজ্যে, কোনও কোনও যুগে, স্বল্পকালের জন্যে ক্ষুধার প্রকোপ অপেক্ষাকৃত কম থাকত নিশ্চয়ই, কিন্তু মোটের ওপরে তা ব্যতিক্রমী, স্বল্পস্থায়ী। ব্যাপক ক্ষুধার পরিপ্রেক্ষিতেই শুধু এত অজস্র, এত আকরুণ প্রার্থনা উচ্চারিত হতে পারে এত দিন ধরে। তবে রাজা ত সুখী প্রজা অর্থাৎ খেতে পায় এমন প্রজারই স্বপ্ন দেখবেন। এ সেই স্বপ্নের বর্ণনা। আগেই যেমন দেখেছি পরীক্ষিৎ রাজার রাজ্যে ধনীগৃহের গৃহিণী স্বামীকে প্রশ্ন করছে— ‘দধি, মন্থ ও শরবৎ আছে বাড়িতে, কোন্টা দেব তোমাকে?’ (অথর্ব সং; ২:১২৮:৯)।
অন্নের অন্নপতি বলবত্তা নীরোগিতা দিয়েছিলেন, নমস্কার করি বিশ্বজনের মঙ্গলের জন্যে, হে পালয়িত্রি, আমাদের ক্ষতি কোরো না— অন্নস্যান্নপতিঃ প্রাদাদনমীবস্য শুষ্মিণো নমো বিশ্বজনস্য, ক্ষামায় ভুঞ্জতি মা মা হিংসীঃ।’ (তা/ম/ব্রা; ১:৮:৭) ‘অন্ন কাছে, অন্ন আমাদের কাছে (আসুক)— উপ বা অন্নমন্নমেবাস্মা উপাবঃ।’(তা/ম/ব্রা; ৬:৯:৩) অন্ন যখন দুর্লভ হয়, তখন মনে হয়, অন্ন দূরে সরে গেছে, তাই প্রার্থনা ওঠে ‘কাছে আসুক অন্ন।’ একটি খুব ঘরোয়া ছবি পাই রান্না খাওয়ার। ‘বাড়ি বাড়ি অন্ন প্রস্তুত হচ্ছে, তখন যদি (কেউ কেউ) প্রশ্ন করে ‘কী করছে? এই লোকগুলি?’ যজমানরা বলবেন— (ওরা) অন্ন আহার করছে— কুলে কুলে অন্নং ক্রিয়তে তদ্ পৃচ্ছেয়ুঃ কিমিদং কুর্বন্তীমে যজমানা অন্নমৎস্যন্তীতি ব্রূয়ুঃ।’ (তা/ম/ব্রা; ৫:৬:৯) রান্নার সময়ে ‘কী করছে’ প্রশ্ন করলে বলতে হবে ‘ভাত খাচ্ছে।’ এটা ইচ্ছাপূরক উত্তর, শুভ উত্তর, অশুভনিবারক উত্তর। ‘কুল’ মানে বৃহৎ একান্নবর্তী পরিবার, সেই সব পরিবারে ভাত রান্না হওয়ার সময়ে বলতে হবে, এরা খাচ্ছে। উদ্দেশ্য ‘যেন এরা খেতে পায়। ‘অন্নাহারকে নিশ্চিত করে— অন্নাদ্যমব রুন্ধে।’ (তা/ম/ব্রা; ৬:১৮:২,১১; ১৬:৬:৬,৭,৮) এই অবরোধ করার অর্থ ‘বেঁধে রাখে’— অসংখ্যবার এ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে কী করে অন্নকে অবরুদ্ধ করা যায়। অর্থাৎ আশঙ্কা ছিল, অসতর্ক হলে, যজ্ঞে, স্তবে, নৈবেদ্যে কোনও ত্রুটি ঘটলে অন্ন নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে, ক্ষুধার অন্ন জুটবে না, বা তার কোনও নিশ্চয়তা থাকবে না। এই কথাই অন্যত্র, ‘অন্ন হল ব্রত। যা খেয়ে, মানুষ বাঁচে, সংবৎসর এই অন্নের দ্বারা অন্নভোজনকে অবরোধ করে— অন্নংব্রতম্, সংবৎসরাদেতে-নান্নেনান্নাদ্যমবরুদ্ধে।’(তা/ম/ব্রা; ১৬:৭:৫) ‘প্রজাপতি মহান, তাঁর ব্রত এই অন্ন— প্রজাপতিবার মহাংস্তস্যৈতদ্ ব্রতমন্নমেব।’ (তা/ম/ব্রা; ৪:১০:২) প্রজাপতির ব্রত অন্ন মানে তিনি স্বয়ং অন্ন আহার করে বেঁচে থাকেন; এ কথার দ্বারা অন্নের গরিমা বৃদ্ধি পায়; মানুষ ত কোন্ ছার, স্বয়ং প্রজাপতি বেঁচে থাকেন অন্নের জোরে। অতএব অন্ন সম্বন্ধে একান্ত এই প্রার্থনা আরও জোর পেল: এ হল সেই অ যা স্বয়ং প্রজাপতিকে বাঁচিয়ে রাখে। ‘এর জন্যে সকল দিক থেকে অন্নাহারকে অবরোধ করে— সর্বাভ্য এবাস্মৈ দিভ্যোঽন্নাদ্যমেবাবরুন্ধে।’(তা/ম/ব্রা; ১৬:১৩:১১) সমস্ত সমাজে দীর্ঘকাল ধরে এই এক প্রবল আকাঙ্ক্ষা ও আর্ত প্রার্থনা ছিল: অন্ন যেন অবরুদ্ধ হয় অর্থাৎ তাদের ঘরে অন্ন ও অন্নাহার যেন বাঁধা থাকে। এর যেন কোনও ব্যত্যয় না হয়। এর জন্য শাস্ত্রে যা কিছু করণীয় বলে নির্দেশ করেছে সবই তারা অবিকল ভাবে পালন করবে, কিন্তু খাদ্য সম্বন্ধে অনিশ্চয় বা নিয়মিত অন্নলাভের সম্বন্ধে সংশয় যেন তাদের না থাকে। ‘অন্নই ভদ্র। অন্নাহারের দ্বারা একে সৃষ্টি করা হয়েছে— অন্ন বৈ ভদ্রম্। অন্নাদ্যেনৈবৈনং সংসৃজতি।’ (তৈ/ব্রা; ১:৩:৩:১৯)
অন্নকেও মাঝে মাঝে মালিন্য স্পর্শ করে তখন তা শোধন করার প্রয়োজন হয়। দেবতারা ব্রহ্মার ও অন্নের মালিন্য দূর করেছিলেন— দেবা বৈ ব্রহ্মণশ্চান্নস্য শমলমপাঘ্নন্।’ (তৈ/ব্রা; ১:৩:২:১৩) এমনই কথা আবার শুনি ‘যজমানের থেকে অন্নের মালিন্য দূর করে। অন্নের মালিন্য হল সুরা— অন্নস্যৈব শমলং যজমানাদপহন্তি। অন্নস্য বা এতচ্ছমলং যৎ সুরা।’ (তৈ/ব্রা; ১:৩:৩:১৪) অন্নের মালিন্য শুনলে খটকা লাগে, কিন্তু একই নিঃশ্বাসে বলা হয়েছে দেবতারা ব্রহ্মার ও অন্নের মালিন্য দূর করেছিলেন। ব্রহ্মার যখন মালিন্য হতে পারে, তখন অন্নের তো তা হতেই পারে; দেবতারা তা দূর করেছিলেন। এ দুটি শাস্ত্রাংশকে একত্র দেখা হয়তো ঠিক হবে না, যদিও সে সম্ভাবনা থেকেই যায়— এ দুটি তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণে খুব কাছাকাছি অংশ। তা যদি হয় তাহলে দেবতারা অন্নের যে-মালিন্য দূর করেছিলেন তা হল সুরা; ব্রহ্মা হয়তো সেই সুরায় আসক্ত ছিলেন, দেবতারা তা থেকে তাঁকে মুক্ত করেন। কিন্তু অন্ন থেকেও সুরা প্রস্তুত হত, তার সম্বন্ধে আসক্তিও সমাজ থেকে থাকবে। সমাজের একটি অংশের চোখে হয়তো সুরা প্রস্তুত করবার জন্যে যে-পরিমাণ অন্ন লাগত সেটা অপচয় বলে মনে হত। হওয়াটা অস্বাভাবিকও নয়, কারণ সাধারণ মানুষের পক্ষে যেখানে উদরপূর্তির পথে যথেষ্ট পরিমাণ অন্নের সংকুলান ছিল না, সেখানে নেশার জন্যে অন্নের অপচয়টা আপত্তির কারণ বলে মনে হতেই পারে। তাই অন্নের মালিন্য সুরা। অন্ন এবং ব্রহ্মার মালিন্য দূর করতে দেবতাদের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয়েছিল।
অন্নের অপচয় বন্ধের প্রচেষ্টার পশ্চাতে আছে অন্ন সংরক্ষণের একান্ত প্রয়োজন, এবং সে বিষয়ে সতর্ক যত্ন। কারণ, ‘অন্নই জীবন— অন্নং হ প্রাণঃ।’ (ঐ/ব্রা; ৮:৩:১) ‘(সদ্যোজাত) পুত্রকে অন্নাহারে যেমন স্তন দান করা হয়, তেমনই জীবকে অন্নাহার দান করা হয়— অস্মৈ জাতায়ান্নাদ্যং প্রতিদধাতি যথা কুমারায় স্তনম্।’ (ঐ/ব্রা; ৬:৫:৩,৪) শতপথব্রাহ্মণেও দেখি, ‘যেমন সদ্যোজাত কুমারকে বা বাছুরকে স্তন্য দান করা হয় তেমনই একে অন্ন দেওয়ার হয় যথা কুমারায় বা জাতায় বৎসায় বা স্তনমপি দধ্যাৎ এবমস্মা এতদন্নস্যাপি দধাতি।’ (শ/ব্রা; ২:২:২:১) সদ্যোজাত শিশু স্তন্য ছাড়া বাঁচে না, তেমনই মানুষ অন্ন ছাড়া বাঁচে না। অন্ন প্রাণস্বরূপ, ‘মানুষের অভ্যন্তরে প্রাণকে ধারণ করে সে যে (যজ্ঞীয়) অগ্নিগুলিকে ধারণ করে, তাদের মধ্যে এ শ্রেষ্ঠ অন্নভোজী হয়— প্রাণান্ বা এষ অভ্যাত্মন্ ধত্তে যোহগ্নীনাধত্তে তেষামেষোহন্নাদতমো ভবতি।’ (ঐ/ব্রা; ৭:২:১১) ‘অন্নই প্রাণ’— এ কথার সঙ্গে বলা হয়েছে ‘খাদ্যই হল প্রাণ, তাই নিজের মধ্যে প্রাণকে ধারণ করে— প্ৰাণো বৈ ভক্ষস্তৎ প্রাণঃ পুনরাত্মন্ ধত্তে।’ (শ/ব্রা; ৪:২:১:২৯) ‘খাদ্য হল আয়ুষ্কর রস- রসমন্নমিহায়ুষে।’ (তৈ/ব্রা; ১:২:১:২৫) দুধ এবং দুগ্ধজাত খাদ্যও প্রাণধারণের উপকরণ, তাই ‘গাভী হল প্রাণ, অন্নই প্রাণ— প্রাণো হি গৌরন্নং হি প্ৰাণঃ।’ (শ/ব্রা; ৪:৩:৪:২৫) উদুম্বর বা ডুমুর ছিল খাদ্য; এবং আগেই বলেছি, যজ্ঞে ডুমুরকাঠও ব্যবহৃত হত। উদুম্বর থেকে শক্তি, তেমনই অন্নাহার থেকে বনস্পতিদের শক্তি; এর (মানুষের) মধ্যে (হয়) অন্নাহার ও ভোজ্য অথ যদৌদুম্বরাদুর্জো বা এযোহন্নাদাদ্ বনস্পতীনামূজমেবাস্মিংস্তদন্নাদ্যং ভৌজ্যঞ্চ।’ (ঐ/ব্রা ৭:৫:৬) ‘এই সেই অন্ন যা প্রাণ ও প্রজাপতি সৃষ্টি করেছিলেন, এই হল সকল যজ্ঞ, যজ্ঞই হল দেবতাদের অন্ন— এতদ্বৈ তদন্নং যত্তৎপ্রাণাশ্চ প্রজাপতিশ্চাসৃজন্তৈতাবান্ বৈ সার্বা যজ্ঞো যজ্ঞ উ দেবানামন্নম্।’ (শ/ব্রা; ৮:১:২:১০) যজ্ঞে যা হব্য দেওয়া হয় তা দেবতারা আহার করেন এমন বিশ্বাস ছিলই; এখানে বলা হচ্ছে, অন্নই প্রাণ। অর্থাৎ দেবতারা যেমন যজ্ঞে আহার্য লাভ করেন, মানুষও তেমনই পায় অন্নে; কেউই আহার্য ছাড়া বাঁচতে পারে না। ‘প্রাণীর মধ্যে অঙ্গগুলি প্রাণকে ধারণ করে, সেই প্রাণই প্রাণ, প্রাণভূৎ অন্নই প্রাণকে ধারণ করে— প্রাণভৃতি অঙ্গানি হি প্রাণান বিভ্রতি, প্রাণাস্তু এব প্রাণা অন্নং প্রাণভূদন্নং হি প্রাণান্ বিভর্তি।’ (শ/ব্রা; ৮:১:৩:৯) অন্নকে এ ভাবে বারবার প্রাণের সমার্থক হিসাবে দেখানো হয়েছে। জল হল সাক্ষাৎ অন্ন, তা প্রাণের জন্যে অন্ন ধারণ করে— অন্নং বা আপোহনন্তর্হিতং তৎ প্রাণেভ্যোঽন্নং দধাতি।’ (শ/ব্রা; ৮:২:৩:৬) জল খাদ্যের মতোই জীবনধারণের একটি মুখ্য উপাদান; ক্ষুধা তৃষ্ণা দুই-ই মানুষের প্রাণকে পীড়িত ও ক্ষীণ করে, তাই অশনায়াপিপাসে, অর্থাৎ ক্ষুধা, তৃষ্ণাকে মৃত্যুর সমার্থক বলা হয়েছে।
আহারের পরে স্থালীতে যে-অন্নটুকু থাকে সেটা খাবে না ফেলে দেবে, এ নিয়ে একটা বিতর্ক ছিল। সে প্রসঙ্গে সিদ্ধান্ত হল, ‘যদি খায় তাহলে মহিমান্বিত অন্ন ভোজন করে। পরম আয়ুষ্মান হয়— যৎ প্রাশ্নীয়াৎ। জন্যমন্নমদ্যাৎ। প্রমায়ুকঃ স্যাৎ।’ (তৈ/ব্রা; ১:৩:১৫:৬২) এটি একটি তাৎপর্যপূর্ণ শাস্ত্রাংশ। খাবার পর স্থালীতে বেশি অন্ন থাকার কথা নয়, সামান্য কিছু গায়ে যা লেগে থাকে বিতর্ক তাই নিয়ে। সিদ্ধান্তটি লক্ষণীয়, ঐ-টুকু অন্ন মহিমান্বিত; অর্থাৎ অন্নের মতো দুষ্প্রাপ্য ও বহুমূল্য বস্তু সামান্য পরিমাণও অপচয় করলে কোথায় যেন ত্রুটি হয়, অন্নের মহিমা ক্ষুণ্ণ হয়; না করলে অন্নের মহিমা যথাযথ ভাবে রক্ষিত হয়। অন্নকে খাতির করলে অন্নও খাতির করে, অন্নাভাব থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। ‘তা-ই হল সমৃদ্ধি, যখন আগেকার অন্ন নিঃশেষ হওয়ার আগেই, অন্য অন্ন আসে; তারই (সেই মানুষের অর্থাৎ ওই অন্নের মালিকের বহু অন্ন হয়— তদ্ধি সমৃদ্ধং যদক্ষীণে এব পূর্বস্মিন্নন্নেহ্যাপরসন্নমাগচ্ছতি স হি বহুন্ন এব ভবতি।’(শ/ব্রা; ১:৬:৪:১৪) এ-ই ছিল স্বপ্ন। অন্ন নিঃশেষ হওয়ার আগেই পরবর্তী অন্নের পাক শুরু হওয়া— এই হল সমৃদ্ধির স্বরূপ। শুধু এ দেশে বা বৈদিক যুগেই নয়, সর্বত্র সর্বকালেই মানুষ চেয়েছে কিছু খাদ্য অবশিষ্ট থাকতেই পরবর্তী কালের খাদ্যের প্রস্তুতি হওয়া। অর্থাৎ ভাণ্ডার শূন্য হওয়ার পূর্বেই কিছু সংগ্রহ, যাতে ক্ষুধা মানুষকে আক্রমণ করার পূর্বেই তার প্রতিকার বিধান হয়। অর্থাৎ কিছু উদ্বৃত্ত। এই শাস্ত্রাংশে সেই ভাগ্যবানদেরই সমৃদ্ধ বলা হয়েছে যাদের ভাণ্ডার কখনওই শূন্য হয় না, যাদের স্থালী বা হাঁড়ি কখনওই একেবারে খালি হয় না। এই সব উক্তি প্রতিপন্ন করে যে এই অবস্থাটা কাম্য, কিন্তু বাস্তব ছিল না।
যজ্ঞ থেকে খাদ্য পাওয়া যেত এমন ধারণা ছিল, কিন্তু যে বছর যজ্ঞ সম্পাদন করা হত, শস্য সে বছর না-ও জন্মাতে পারত। তাই সে-ই কৃষির প্রথম যুগের রচনা তৈত্তিরীয় সংহিতায় পড়ি, ‘যে বছর সত্র হয়, সে বছর প্রজা ক্ষুধার্ত থাকে, তাদের খাদ্য ও বল নিয়ে নেয়; যে বছর অক্ষুধিত, সমৃদ্ধ সে বছর প্রজার অন্ন ও বল নিয়ে নেয় না— যাং সমাং সত্রং ক্ষোধুকাস্তাং সমাং, প্রজা, ইষং হ্যাসামূজমাদদতে, যাং সমাং বৃদ্ধমমক্ষোধুকাস্তাং সমাং প্রজা ন হ্যাসামিষমূজমাদদতে।’ (তৈ/সং; ৮:৫:৯:১) যজ্ঞ করার সঙ্গে সঙ্গেই তো ফসল হয় না, তাই এই সতর্কবাণী; কারণ ও কার্যের মধ্যে একটা কালগত ব্যবধান তো থাকবেই। তৈত্তিরীয় সংহিতাতেই যজ্ঞকর্ম সমাজে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। ক্ষুধার সঙ্গে যজ্ঞের সম্পর্ক নির্ণয় করতে হচ্ছে, আবার খুব দ্রুত ফললাভের আশা করতে বারণ করাও হচ্ছে। এই সময়টাতেই আর্যরা চাষ শিখেছে, শিখেছে ফসল বোনা ও কাটার মধ্যে একটা কালগত ব্যবধান থেকেই। সেইটেকেই যেন যজ্ঞকর্মের ওপরে আরোপ করা হচ্ছে। ক্ষুধিত অবস্থাটা সম্পর্কে কতকটা সহিষ্ণুতাও শেখানো হচ্ছে। ফললাভে বিলম্ব মানুষ যেন ধৈর্য ধরে সইতে পারে এমন উদ্দেশ্যও এতে নিহিত।
ক্ষুধা যে দুঃসহ, সে কথা মানুষ সংগ্রহী (ফলমূল খুঁজে আনা) যুগে এবং শিকারের যুগেই বিলক্ষণ উপলব্ধি করতে পেরেছিল। পশুপালনের যুগে প্রথম অবস্থাটা কতকটা তার আয়ত্তে এল। তখনও নানা দৈব-দুর্বিপাকে পশুপালে মড়ক লাগত, জমির ঘাস খরায় শুকিয়ে যেত, বন্যায় ডুবে যেত, পচে যেত। আশপাশের দস্যুদলের আক্রমণে, লুণ্ঠনে পশুসংখ্যা হ্রাস পেত। তবু এ সব অপেক্ষাকৃত সাময়িক, আগন্তুক উৎপাত। মোটের ওপরে, পালের পশুর দুধ এবং তা থেকে দই, ক্ষীর, ইত্যাদি জুটত এবং পশুমাংসের একটা নিশ্চিত জোগান ছিল। তবু ক্ষুধা জিনিসটা অচেনা ছিল না; অচেনা ছিল তা স্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা এবং তার জন্যে আতঙ্ক। ক্ষুধা যদি কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে দীর্ঘস্থায়ী হত, তাহলে মৃত্যুও হত। চাষ করতে শেখার পর খাদ্যের ব্যাপারে খানিকটা বেশি নিশ্চয়তা এল। তবু তখনও দৈব-দুর্বিপাকে মাঝে-মাঝেই চাষ উঠত না। অনাহার বাস্তবরূপে দেখা দিত। বেশি দিন অনাহারের অর্থ মৃত্যু। তাই সেই ঋগ্বেদের যুগ থেকেই অনাহারের ত্রাস সমাজচেতনাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল।
ক্ষুধাকে বলা হচ্ছে শত্রু। ক্ষুধার উদ্রেকের আগেই খাদ্যসংস্থান করে পরাক্রান্ত শত্রুর আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করে। ‘আমি অন্ন ও বল গ্রহণ করি— এই বলে অন্ন ও বলকে এক দিকে অবরুদ্ধ করে, সে দিকে যে বাস করে সে ক্ষুধার্ত হয়— ইষমূর্জমহমিদমা দদ ইতীষমেবোর্জং তস্মৈ দিশোহবরুন্ধে, ক্ষোধুকা ভবতি যস্তস্যাং দিশি ভবতি।’ (তৈ/সং; ৫:২:৫:৬) ‘ক্ষুধাই মৃত্যু— অশনায়া মৃত্যুরেব।’ (তৈ/ব্রা; ৩:৯:১৫:৫৭) তখন ক্ষুধার পীড়নে মৃত্যুর কথা অজানা ছিল না, অশনা মানে খাওয়া, কার? যে ক্ষুধিত তার (‘অথাতোহশনাহনশনস্যৈব (ব্রতম্)’; (শ/ব্রা ১:১:১:৭) জীবমাত্রেরই ক্ষুধা, এর প্রতিবিধান করার দায়িত্ব সৃষ্টিকর্তার। তাই প্রজাপতির চিন্তা ‘কেমন করে আমার সৃষ্ট প্রজারা পরাভূত হচ্ছে?’ তখন তিনি দেখলেন, ‘ক্ষুধার জন্যে আমার প্রজারা পরাভূত হচ্ছে (এর পর তিনি স্তন্যের ব্যবস্থার জন্য স্তন সৃষ্টি করলেন)— কথং নু মে প্রজাঃ সৃষ্টাঃ পরাভবন্তীতি। স হৈতদেব দদর্শানশনতয়া বৈ মে প্রজাঃ পরাভবন্তীতি।’ (শ/ব্রা ২:৫:১:৩) এই যে উপলব্ধি এটা মানুষেরই; প্রজাপতির ওপরে কেবল আরোপিত হয়েছে। ক্ষুধাজনিত মৃত্যুর আতঙ্ক এত স্পষ্ট ছিল বলেই অন্নের জন্যে এত ব্যাকুলতা। ‘একমাত্র ক্ষুধা (রূপ) মৃত্যুই পিছু নেয়… অন্ন দিয়ে ক্ষুধাকে হনন করে— এক উ এব মৃত্যুরন্বেত্যশনায়ৈব… অন্নেনাশনায়াং হন্তি।’ (জৈমিনীয় ব্রাহ্মণ ১:১:৩:৩) প্রজাপতির শিথিল দেহের মধ্যভাগ থেকে প্রাণ ওপরে উঠে যেতে চাইল, তাকে (তিনি) অন্নের দ্বারা গ্রহণ করলেন, তাই প্রাণ অন্নের দ্বারা সংরক্ষিত হয়, যে অন্ন ভোজন করে, সে বেঁচে থাকে; যে অন্ন ভোজন করে সে বীর্যবান হয়।… এই অন্ন প্রাপ্ত হয়ে সমস্ত দেবতারাই তার পর (অন্ন) লাভ করেন। এ সমস্তের জীবনই হল অন্ন— প্রজাপতের্বিস্রস্তাৎ প্রাণো মধ্যত উদচিক্রমিষৎ তমন্নেন অগৃহাৎ তস্মাৎ প্রাণো অন্নেন গৃহীতো যো হ্যেবান্নমত্তি স প্রাণিতি স উর্জয়তি। …তদেতদন্নং প্রপদ্যমানঃ সর্বে দেবা অনুপ্ৰাপদ্যন্ত অন্নজীবনং হীদং সর্বম্।’ (শ/ব্রা ৭:৫:১:১৬-১৮) এর মধ্যে লক্ষণীয় হল ওই কথাটি, ‘সকলেই অন্নজীবন’ অর্থাৎ অন্নেই বেঁচে থাকে; জীবমাত্রের পক্ষে এ কথা সত্য, তাই অন্নই জীবন। ‘তাই যে দেশে ক্ষুধা মানুষকে শীর্ণ করে, সে দেশে মানুষ বুভুক্ষু থাকে— তস্মাদ্ যত্রৈষা যাতযামা ক্রিয়তে তৎ প্রজা অশনায়বো ভবন্তি।’ (তা/ম/ব্রা ৬:৪:১২) ‘প্রজাপতি অগ্নি নিজের পরিমাণ মতো অন্নের দ্বারা (সৃষ্টি বা জীবকে) প্রীত করেন, যে পরিমাণ অন্ন নিজের জন্য প্রয়োজন তা রক্ষা করে, মানুষের ক্ষতি করে না, তার চেয়ে কম পরিমাণ অন্নে (প্রাণ) রক্ষা হয় না— প্রজাপতিরগ্নিরাত্ম সম্মিতেনৈবেনমেতদন্নেন প্রীণাতি যদু বা আত্মসম্মিতমন্নং তদবতি তন্ন হিনস্তি তদ্ যৎ কনীয়ো ন তদবতি।’ (শ/ব্রা ৯:২:২:২)
এটিও ওই ব্যাপক ক্ষুধার অন্য একটি প্রকাশ: ক্ষুধার অন্ন পরিমাণে এত কম ছিল যে তাতে প্রাণ রক্ষা হত না; যে অন্ন জীবনের সমার্থক তার অপ্রতুলতার অর্থ আধপেটা বা সিকিপেটা খাওয়া, সে খাওয়া ত নামেই খাওয়া, তাতে পিত্তরক্ষা হয়, প্রাণরক্ষা হয় না। এ অভিজ্ঞতাও পরিচিত ঘটনা ছিল, তাই ক্ষুধার অপর নাম মৃত্যু। দেখা যাচ্ছে, এ বোধে কোথাও কোনও অন্যথা ছিল না। খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম থেকে ষষ্ঠ শতকে রচিত এই ব্রাহ্মণগুলি সেই সমাজকেই বর্ণনা করছে যে সমাজে লোহার লাঙলের ফলার ব্যবহারে চাষে কিছু উদ্বৃত্ত হচ্ছে, অন্তর্বাণিজ্য ও বহির্বাণিজ্যে সমৃদ্ধি বেড়েছে কিন্তু ক্ষুধারূপ মৃত্যুর হাত থেকে পরিত্রাণ পাচ্ছে না মানুষ। ব্যাপক এক সন্ত্রাসকে জিইয়ে রেখেছে সর্বগ্রাসী এই ক্ষুধা। সমাজের গরিষ্ঠ সংখ্যক মানুষ ক্ষুধাজনিত মৃত্যুর আতঙ্কে সন্ত্রস্ত। তার কোনও প্রতিকার খুঁজে পাচ্ছে না। অন্ন দিয়ে ক্ষুধাকে হনন করার কথা বারে বারে উচ্চারিত হচ্ছে। বলা হচ্ছে, অনাহারজনিত মৃত্যুর প্রতিকার হল অন্ন। লোকে এ কথা জানত; সমস্যাটা জ্ঞানের ছিল না, ছিল অন্নের। এ মৃত্যু নিবারণের উপায় জানা থাকলেও সে উপায় অবলম্বন করার সাধ্য অভুক্ত মানুষের ছিল না। ‘যে অনাহারে আছে সে যে শেষ খাওয়াটি খায়। এই শেষ খাওয়াটা খায় উপবাসী মানুষ— অনদ্যমানো যদন্তমত্তীতি। অনদ্যমানো হোষা অন্তমত্তীতি।’ (জৈ/ব্রা ২:১:২:১)
সমাজে বিপুলসংখ্যক অনাহারী বা অর্ধাহারী না থাকলে যজ্ঞনির্ভর যে সব ধর্মগ্রন্থ তাতে এত অসংখ্যবার ‘ক্ষুধাই মৃত্যু’ এ কথা উচ্চারিত হত না। প্রকারান্তরে যজ্ঞের অন্যতম মুখ্য উদ্দেশ্য যে এই সংখ্যাগরিষ্ঠের খাদ্যসংস্থান করা সে কথাও এ সব বাক্যে স্বীকৃত। সমাজে অন্নাভাব ব্যাপক হলে শাস্ত্র বলে:
(১) দেবাতারাও অন্নের দ্বারা প্রাণধারণ করেন; (২) প্রজাপতি প্রজা সৃষ্টি করে আবিষ্কার করেন তাদের খাদ্য নেই, তাই তারা মারা পড়বে; তখন তিনি (৩) খাদ্য সৃষ্টি করতে উদ্যত হন; (৪) তাঁর সৃষ্ট প্রাণীর প্রাণ বেরিয়ে যেতে উদ্যত দেখে; (৫) তিনি অন্ন দিয়ে তাকে ধরে রাখেন; (৬) এই বৃহৎ বিশ্ব-সৃষ্টি মৃত্যুর দ্বারা আবৃত ছিল, সে মৃত্যু ক্ষুধা। অর্থাৎ প্রাণীর প্রাণধারণের পক্ষে পর্যাপ্ত খাদ্য ছিল না, তাই সর্বব্যাপী মৃত্যু আচ্ছন্ন করে ছিল সৃষ্টি। কী তার প্রতিকার? খাদ্য; (৭) সে খাদ্য পর্যাপ্ত হলে তবেই প্রাণীর প্রাণরক্ষা হয়।
কিন্তু সমস্যা হল, তা পর্যাপ্ত নয়, প্রজাপতি যত প্রাণী সৃষ্টি করে ফেলেছেন, তার উপযুক্ত খাদ্য কখনওই জোগাড় হল না।
***
১. ‘Generally the immediate purpose in settled producing society is profit for the priest class which insist that certain observances are necessary: at a deeper level, the unwidely mass of ritual serves to petrify the later society, to discourage innovation, to help preserve the class structure and the status quo’. D. D. Kosambi, An Introduction to the study of Ancient Indian history, p. 24
২. কোসাম্বী, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৩
৩. As soon as people take to regular food production from a previous irregular food gathering mode they bred more rapidly. The improved food supply means that more children are born, more survive to maturity, more people reach old age. ‘Aryan’ at the period under discussion means a warlike tribal people who lived by cattle-breeding, supplemented by plough cultivation. The Aryans were at the crucial stage where soon the plough cultivation would produce more than cattle. So what spread was a new way of living. ……plough cultivation greatly improved the food supply, made it more regular. This meant not only a far greater population, but one that lived together in greater units. Kosambi.’ পূর্বোক্ত; pp. 113-14