সবুজ মাঠে গোষ্ঠের বুকখানা জুড়াইয়া যায়; সে ভাবে, আশা বোধহয় সবুজবরনী। হালে পোঁতা তরকারির বীজের চারার কাছে বসিয়া আঙুলের ডগা দিয়া সন্তৰ্পণে মাটি সরায়, একটি প্যাঙাশে নরম অঙ্কুরের প্রত্যাশায়।
তরুণী নারী যেমন ভাবী সন্তানের স্বপ্ন দেখে।
অঙ্কুর ওঠে নাই, মরা মন লইয়া বেচারি উঠিয়া দাঁড়ায়, একটা দীর্ঘশ্বাসও পড়ে; আপন মনেই বলে, মোটে তো আজ তিন দিন, আর দু-তিন দিনে বেরুতেই হবে। আর ও কটা যদি নাই হয়, তাই বা কি, ধানেই এবার ছয়লাপ।
আল-পথের পরে দাঁড়াইয়া ধানী জমির পানে তাকায়, চোখ যেন জুড়াইয়া যায়, সে বলে, বলিহারি, কি রং মাইরি, কালো, আঁধার, যেন আষিঢ়ে মেঘ নেমেছে জমিতে।
সে মনের আনন্দে গান ধরে, ও কালো কালিন্দী-কূলে দেখ সখি কালো মেঘ নেমেছে। ওদিকের রাস্তা হইতে কে হকে, গোষ্ঠ! গোষ্ঠ।
ও গায়ের সতীশ সরকার, জেলার সদরে থাকে, পাঁচজনের মামলার তদ্বির করে; বেঁটেখাটো চেহারা, পেটটা মোটা, কবিরাজ বলে—সঁচসের পিলে ওটা। সতীশ তবু ওষুধ খায় না। বলে, কচু জান তুমি, ও আমার বুদ্ধির গেঁড়ো, ওরই জোরে করে খাই বাবা।
লোকে বলে, ও একরকম পুঁড়ি, বদহজমের কুঁড়ি, বেটার টাকা হজম হয় না, তাই খুঁড়িটা। অমনই।
গোষ্ঠ অগ্রসর হইয়া প্ৰণাম করিয়া কহে, সরকার মশায়, তা সব কুশল তো?
সরকার কুশলের ধার দিয়া যায় না, সোজাসুজি কাজের কথা পাড়ে, মামলাকে এত ভয় করলে চলবে কেন গোষ্ঠী
গোঁফ তাহার ঘন ঘন এপাশে ওপাশে নাচে; ওইটা তাহার মুদ্রাদোষ। গোষ্ঠ কথাটার মাঝে গুরুত্ব খুঁজিয়া পায় না, সে হাসিয়া কহে, মামলাকে কি আর ডরাই সরকার মশায়, ডরাই যত। আমলাকে, খাই আর মেটে না।
কথাটা সরকারের গায়ে বাজে, সেও ওই শ্ৰেণীভুক্ত যে; সে তীব্ৰকণ্ঠে কহে, শুধু পয়সা কেউ চায় না রে, শুধু পয়সা কেউ চায় না, তারা তো ভিখিরি নয়। এই তো বাবা, নিলে বেটা দত্ত নিলেম করে তোর জোতকে জোত। সে মামলা করলে, ডিক্রি করলে, নিলেম করলে, জানতে পারলি? আমলারা পয়সা খেয়ে নেমখারামি করে না, যার পয়সা খায় তার কাজ বজায় দেয়, বুঝলি?
গোষ্ঠর মাথায় যেন কে মুগুরের ঘা মারে, সব যেন গোলমাল হইয়া যায়। তাহার জমি, তাহার অন্নদাত্রী মা ভূমিলক্ষ্মী। তবু সে স্বস্তির আশায় কথাটা অবিশ্বাস করিতে চায়, কহে, আজ্ঞে না, তাই কি হয়, আজই যে দু টাকা সুদ নিয়ে গেল।
সরকার হাসিয়া ওই সরল বিশ্বাসের জন্য গোষ্ঠকে গালি দেয়, চাষা কি সাধে বলে রে, বুদ্ধিগুণেই চাষা বলে; হুঁ, তোমার দোষ কি, বল? ন চাষা সজ্জনায়তে—এ যে শাস্ত্ৰবাণী। বলি নাই আমি একবার, ওরে গোষ্ঠ, দত্ত নালিশ করেছে, একটা জবাব দে। তুই বললি, টাকা না। নিয়ে আর জবাব কি দোব সরকার মশাই? তবে ধরে পেড়ে দেখি, দত্তকে এখন থামাই; তুই ধরলি পাড়লি, দত্তকে মুখে রাজিও করলি, কিন্তু আদালত তো হাঁটলি না, মামলাটা তুলে নিলে, কি না নিলে, তা দেখলি না। ভয় হল আমলার হা দেখে। নে, এখন তার ফল দেখু।
গোষ্ঠ স্তম্ভিত হইয়া গেল। চোখে তাহার দৃষ্টি জাগ্রত ছিল, কিন্তু দৃশ্য সমস্ত যেন অর্থশূন্য বোধ হয়।
সরকার কহে, তুই নিলেম রদের মামলা কর্। দেখ, বেটা চামারকে কেমন ফাসাই, তদ্বিরের ভার আমার, সে তোকে ভাবতে হবে না। ও বেটা বেনে, আমিও কায়েত।
কথা গোষ্ঠর কানে যায় না, তাহার বুকের মাঝে ক্ষোভে দুঃখে ক্ৰোধে একটা ঘূর্ণি জাগিয়া ওঠে।
একটি বিধিবদ্ধ সজ্ঞাবদ্ধ অত্যাচারে নিঃশেষিতপ্রায় মানবাত্মার যেটুকু অবশেষ এই নিরীহের বুকে ছিল, সে বুঝি বিদ্রোহ করিয়া ওঠে; বাহিরের দেহেও তাহার বিকাশ হয়, দীর্ঘ মোটা মোটা হাড় বাহির করা দেহখানার শিথিল পেশিগুলার মাঝে একটা চাঞ্চল্য বহিয়া যায়, কাঠিন্য ফুটিয়া ওঠে, শিরাগুলা মোটা হয়, বোঝা যায়, রক্তের স্রোতে জোর ধরিয়াছে।
মানুষকে সে আর বিশ্বাস করিতে চায় না, তাহার ঘূণা-ভরা সন্দিগ্ধ চোখে সরকারের মতলব আজ ধরা পড়ে, সে হাসিয়া কয়, মামলার খরচ কে দেবে সরকার, বুদ্ধি তো তোমার কায়েতের বটে, কিন্তু যাতে রস, ওই জমি আমার লক্ষ্মী মা, ও গেলে খরচ যোগাবে কে? তুমি দেবে?
সরকার কহে, ওরে, কায়েতের বুদ্ধিতে সব আছে, জমিতে তুই দখল দিবি না; জমি তো তোর দখলে, বাঁশগাড়ি করতে যায়, তুলে ফেলে দিবি।
কথাটা ক্ৰোধতপ্ত কানে লাগে ভাল, গোষ্ঠ কহে, দখল আমি ছাড়ব না সরকার। যা হয় হবে, আমার জমিতে গেলে ওকে আমি গোটা রাখব না। মামলা-ফামলা যা করতে হয় ও করুক।
সরকার শিহরিয়া কয়, সৰ্ব্বনাশ, সৰ্ব্বনাশ, জেল হয়ে যাবে; মামলার বল না নিয়ে কি ফৌজদারি করা হয়; অৰ্থ না হলে শুধু সামথ্যে কি হয়?
গোষ্ঠ কহে, তা অৰ্থ নাই যখন, তখন সামথ্য ছাড়া উপায় কি?
সরকার চোখ দুইটি বড় করিয়া কহে, বেটা ডাকাত রে! বলে কি? খবরদার, মরবি, মরবি। ওরও লাঠি আছে, ও শালা কি কম ধুতু, শালা ধুতু শেয়াল, টাকায় জমিদারকে বশ করেছে; দেখেছি তো, জমিদারের চাপরাসীর পেতলে বাধা লাঠি?
যুগ-যুগান্তের, পিতৃ-পিতামহের পুষিয়া-রাখা জমিদার-ভীতির সংস্কার বুকের মাঝে চাড়া দিয়া ওঠে। বুকের ঘূর্ণিটার বল, বেগ ক্ষীণ হইয়া পড়ে।
এই সেদিনই সে যে কথাটা বলিয়াছিল, সেই কথাটা তাহার মনে পড়ে, বাঘে ধান খায় তো তাড়ায় কে?
সরকার বলিয়াই যায়, তার চেয়ে শোন, খরচ বেশি হবে না, পপরের মকদ্দমা করে দেবি, হাকিমকে এক দরখাস্ত দোব, হুজুরের অধীন গরিব, মামলা-খরচের সামথ্য নাই—
গোষ্ঠ যেন কূল পায়, সে ব্যর্থ হইয়া বলিয়া ওঠে, তা হয় সরকার মশায়, হয়, আঁ?
সরকারের গোঁফ-নাচানো মুদ্রাদোষটা প্রবল হইয়া ওঠে, সে হাসিয়া কহে, হয়, না হয় সে আমার ভার, তার ভাবনা তোর না; আসছে সোমবার করে তুই গোটা দশেক টাকা নিয়ে সদরে যাস। আমার বাসা জানিস তো—বাসা? আচ্ছা, না জানিস, নাই, ওই হোটেলে নেমে তুই আগে খেয়ে নিবি, তারপর ওইখানেই থাকবি, আমি খুঁজে নেব, বুঝলি?
গোষ্ঠ হতাশ হইয়া পড়ে, দশ টাকা যে তাহার পক্ষে দুই শো, দুই হাজার বলিলেও ক্ষতি নাই; সে স্লানকণ্ঠে কহে, দশ টাকা যে আমাকে কাটলে বেরুবে না সরকার মশায়; ধারও মিলবে না।
সরকার এবার খিঁচাইয়া ওঠে, তবে কি মামলা তোমার অমনই হবে, তোমার চাদ-বদন। দেখে নাকি?
ওই যে বললেন, পরের দরখাস্ত দিলেই হবে?
খরচ হবে না বলে কি একেবারে তিন শূন্যতে চলে বাবা? দরখাস্ত দিতে খরচ নাই? এই ধৰ্ব না, হিসেব তোর মুখে মুখেই হবে উকিল পাঁচ টাকা, মুহুরী সেও পাঁচ সিকের কম ছাড়বে না, কোট-ফী এক টাকা, ডেমি দু পয়সা, ম্যাদ আট আনা, বিত্তি চার আনা, আর এদিক ওদিক বাজে খরচ সেও তোর দু টাকার কমে তো হয় না, এই তো তোর দশ টাকা দু পয়সা, তা ডেমির দু পয়সা তোকে লাগবে না, ডেমি আমি দোব।
গোষ্ঠর চোখ দিয়া জল পড়ে, সে ঘাড় ফিরাইয়া জমিগুলার পানে চায়, দূর হইতে ঘন সবুজ ধানগুলি সত্য সত্যই কালো মেঘের মত দেখায়।
সরকার কহে, আচ্ছা, এক কাজ কর, তোর ওই নাখারাজ গড়েটাওইটা বাঁধা দে, টাকার বন্দোবস্ত আমি করে দেব। যাস সোমবারে, বুঝলি? সবই হবে সেইদিন, বন্ধকী দলিলও হবে, দরখাস্তও দেওয়া হবে, কি ব?
তখনও গোষ্ঠর চোখ ফেরে নাই, মমতায় সারা বুক টনটন করিয়া ওঠে, সে কহে, তাই। যাব সরকার মশায়, কিন্তু দেখবেন যেন ফিরতে না হয়; এ বিপদে আপনাকে রাখতেই হবে।
সরকারের পা দুইটা সে চাপিয়া ধরে।
মন বিশ্বাস করতে চায় না, ভরসা হয় না।
কিন্তু মাটির পরে চাষীর মমতার মোহ কহে, তবু যদি।
সরকার ভরসা দিয়া আপন পথ ধরে, গোষ্ঠ ফিরিয়া আপন জমির আঙুলের উপর মাথায়। হাত দিয়া বসিয়া ধানের পাতা নাড়েচাড়ে, কচি কচি সতেজ ধানগুলি হাওয়ায় লুটোপুটি খেলে, গোষ্ঠর গায়ে পড়ে, পায়ে পড়ে। যেন দুরন্ত চঞ্চল শিশুর দল।
সহসা গোষ্ঠ নারীর মত ফুঁপাইয়া কাঁদিয়া ওঠে।
পথে যোগী মোড়লের বৈঠক; সেথায় গোষ্ঠ আসিয়া বসে।
মাইনার-পাস যোকরা রমাপতি মাস্টার সেখানে পাঠশালা করে। মোড়ল-কর্তার সাপ্তাহিক খবরের কাগজ পড়ে, আগে পড়ে নারী-হরণের কলম-দিবাদ্বিপ্রহরে নারী হরণ, পাশবিক অত্যাচার, বাড়িতে পুরুষ কেহ ছিল না, চারি জন বদমাইশ ঘরে প্রবেশ করিয়া–
মোড়ল-কর্তা চেঁচাইয়া ওঠে, ওরে মদনা, ওরে শালা ডোম।
মদনা বাড়ির রাখাল, সে উত্তর দেয়, কিন্তু মোড়ল-কর্তার কানে যায় না।
মদনা আসিয়া সমুখে দাঁড়ায়।
মোড়ল-কর্তা খিঁচাইয়া ওঠে, বলি, লবাব, ছিলেন কোথা, রা দাও না যে?
মদনা বলে, বলি, রা মানুষে কবার কাড়ে, রা তো দিলাম।
আবার মুখের উপর মুখ! কর্তা ঠেঙাগাছাটা হাতড়ায়, হাতে ঠেকিতেই সে গাছটা ফাবড়াইয়া দেয়। মদনার লাগে না, তবু সে বলে, মেলে তুমি আমাকে?
কর্তা কহে, বেশ করেছি। বলিয়া হ্রকা টানে, ক্ষণেক পরে আবার কহে, বুড়ো মানুষের রাগ তো জানিস, তুই সরে গেলি না কেন? তা বিকেলে এক সের চাল নিস, মদ খেলেই গায়ের বেথা সেরে যাবে। যা দেখি, রতে ছুতোরকে ডেকে আনু, বল, খিল আঁটতে হবে দুয়োরের। আর হরিশ, বলে দাও চব্বিশ ঘণ্টা দুয়োরে খিল–শালারা, দিবা দ্বিপ্রহরে, আয় শালারা
আবার লড়াইয়ের সময় মাস্টার লড়াইয়ের খবর পড়ে, ম্যাপ আঁকিয়া লাইন বুঝায়, বলে, এই দেখ কর্তা, এই হল ফ্রান্স, এই তোমার জার্মানি, আর এই রুশ।
বুড়া বলে, এ তো শুধু দাগ হে মাস্টার, নকশা এঁকে লড়াই বোঝা যায়? এখন কে হারল তাই বল, এ সায়েবরা, না উ সাহেবরা?
মাস্টারের বয়সী বাগাল রায় বলে, বুঝতে কেনে নারবে খুড়ো, এই দেখ, এই হল ফেরান্স।
বুড়া বিরক্ত হইয়া কহে রাখ বাপু তোর ফেরাঙ-টেরাঙ, ওসব তোরা বোঝা গিয়ে। এখন কাপড় সস্তা কখন হবে তাই বল হে মাস্টার?
মাস্টার বলে, তবে ড়ুবোজাহাজের ঠেলা কত্তা, মাল নিয়ে ভাসা জাহাজের কি পার আছে? মাল নিয়ে জলে ভেসেছেন কি দুই, তিন কোশ দূর থেকে তাল মেরে, চোল—চোল-মারা যুঁ, আর এক উঁতেই বাস্ চিচিং ফক, জলের তলায় ভরতর–ফস।
বাগাল বলে, তবে ড়ুবোজাহাজের টিরিক-ফিরিক মল এইবার, আকাশে ফরফর উড়বে। আর কলকাতায় এসে নামবে তোমার; কাটুক শালা ড়ুবোজাহাজ জলের তলে বুটবুটি।
বিস্ময়ে বুড়ার চোখ দুইটা ভাটার মত পাকাইয়া ওঠে, সে কহে, উড়বে কি করে বাপু গরুড়পাখির বাচ্চা ধরেছে নাকি, আঁ?
মাস্টার হাসিয়া বলে, না কত্তা, কল কল কলে উড়বে—অ্যারোপ্ল্যান।
কাগজে অ্যারোপ্লেনের ছবি আঁকে, ছবিটা দাগে দাগে হয় একটা বৃত্ত।
বুড়ো বলে, দূর, এ কি হল, রসগোল্লা আবার ওড়ে?
মাস্টার বলে, কেন কত্তা, রাহুর ছবি, চাঁদের চেহারা দেখ নি? ওই সব থেকেই ওরা এই সব করলে; সব আমাদের নিয়ে, আমাদের পুষ্পক রথ–
বুড়া চটিয়া কহে, সবই তো শুনি তোদের, ও ছিল-ফিল বুঝি না, করতে পারিস তো বুঝি, পারিস বানাতে ওই কি বলছিস এলাং-পেলাং না কি?
বর্তমানের নগ্ন রিক্ততায়, দারিদ্র্যে, মরণ-দ্বারের বৃদ্ধের পর্যন্ত অতীতের পানে চাহিবার অবকাশ নাই।
তরুণ চাহে ভবিষ্যতের পানে, সে স্বপ্ন হয়।
বাগাল কহে, হবে বৈকি খুড়ো, আমাদেরও হবে।
সে সব পুরনো কথা।
আজ মাস্টার পড়িতেছিল, অসহযোগ আন্দোলন, বক্তৃতার সুরে সে পড়িতেছিল, মহাত্মার বাণী, স্বরাজ আসিবে, স্বরাজে আমাদের জন্মগত অধিকার, শুধু বাণী পালন কর। বুঝলে কত্তা, স্বরাজ হলেই আর চাই কি!
স্বরাজ মানেটা আমায় বুঝিয়ে দিতে পার, তবে তো বুঝি ব্যাপারটা কি?
মানে, বুঝলে না কত্তা? আমরাই আমাদের মালিক রাজা, ওই ওতেই আমাদের দুঃখ ঘুচবে কত্তা।
তাই কি হয় মাস্টার? রাজা থাকবে না—
বহুযুগ নিরক্ষরের কানে কথাটা বিস্ময়ের মত ঠেকে।
তরুণ রক্ত, যুগে হাওয়ায় উষ্ণ চঞ্চল; বাগাল কহে, কেন হবে না খুড়ো, এই তো ফেরান্স অ্যামেরিকা–
কর্তা চটিয়া যায়, তুই থাম বাপু, তুই আর পাকামি করিস না, মাস্টার বলছে তাই বলুক, না খালি ফেরা ফেরান্! হলি কিরে বাপু, বাপখুড়োর খাতিরও করবি না।
ও পাড়ার গণেশ দেবাংশী কহে, যা বলেছ ভাই, আমাদের আমল পালটিয়ে গেল; সেসব আর কিছু রইল না।
মাস্টার বলে, তফাত তো হবেই কত্তা, তোমরা হলে পুরনো, আমরা নতুন।
গোষ্ঠর দুঃখার্ত মন দুঃখ দূরের কথাটা ভোলে না, কহে, জমিদার-মহাজন উঠবে বলতে পার?
অন্তর-ফাটা বাণী, আন্তরিকতার গাম্ভীর্যে এত গম্ভীর যে, মজলিসের চটুল ভাবটুকু উবিয়া গেল। মরুর বুক-চেরা ঝঞা বায়ুস্তরের রস পর্যন্ত যেমন শুষিয়া লয়।
সবার বুক চিরিয়াই দীর্ঘশ্বাস বহে।
যোগী বলে, ওই যা বলেছে গোষ্ঠ, স্বরাজ-ফরাজ বুঝি না আমরা, যমের হাত হতে বাঁচি কিসে তাই মহাত্মা বলুক। হ্যাঁ, চাচা আপন জান বাঁচা।
অতকালের অত্যাচারে, অনাহারে অতীতের সব দেশ, ধর্ম, সমাজ সমস্ত ইহাদের কাছে বুঝি তুচ্ছ হইয়া উঠিতেছে। শুধু জীব-জগতের একমাত্র জন্মগত প্রেরণা, বাঁচিবার চেষ্টায় কঙ্কালগুলা পাগল।
কিন্তু ক্লান্ত মস্তিষ্কে উপায় আসে না; শ্ৰান্ত দেহ এলাইয়া পড়ে।
কে যে ইহাদের জীবন অদৃশ্যভাবে যুগ-যুগান্তর ধরিয়া শোষণ করিয়া লইতেছে, তাহাও ইহারা জানে না; বিধাতা, না মানুষ?
আর সে জীবন ফিরিয়া চাহিতে চিৎকার করিতেও বুঝি ক্লান্তি আসে। তবে তাহা চায়। তাহারা; মাটির তলের অঙ্কুর যে সুরে যে ভাষায় আলো বাতাস চায়, সেই সুরে সেই ভাষায় ইহাদের সে চাওয়ার বাণী বুকের মাঝে অহরহ বাজে।