বাড়ির বাহির হইতে উচ্চকণ্ঠে শোনা যাইতেছিল, ও চালাকি চলবে না হে বাপু, সুদের টাকা আমাকে মাস মাস মিটিয়ে দেবার কথা; দিতে হবে, দাও।
গোষ্ঠর মৃদুকণ্ঠ শোনা গেল, বর্ষার কমাস মাপ করুন দত্ত মশায়, কমাস নীরব।
দত্ত, রসিক দত্ত গ্রামের মহাজন, লোকে কহে মহাযম। তীক্ষ্ণদন্ত শৃগালের মতই কঙ্কালঢাকা চামড়াটুকু লইয়া টানাটানি করে; দত্ত তীক্ষ্ণ চিৎকার করিয়া উঠিল, গা জল হয়ে গেল। মাইরি; কাদুনি ছাড়, টাকা আন।
দামিনী ধীরে ধীরে আসিয়া দাওয়ার উপর উঠিল, ভিতরে ছেলেটা জ্বরে গোঙাইতেছিল, কিন্তু সেদিকে তাহার পা উঠিল না, দুনিয়া ভুলিয়া শঙ্কিত বক্ষে দাওয়ার উপর দাঁড়াইয়াই রহিল।
গোষ্ঠ কাকুতি করিয়া কহিল, দোহাই দত্ত মশায়, খেতে জুটছে না—
দত্ত ভেঙাইয়া কহিল, খেতে জুটছে না তো আমার কি রে জোচ্চোর? খেতে জুটছে না!
ভঙ্গি সে কি বীভৎস, কণ্ঠস্বর সে কি নির্মম!
দত্তর খর জিহ্বা সাপের মতই তীক্ষ্ণ, ঘন ঘন লকলক করিয়া নড়ে।
ঘটি-বাটি বাধা দাও, না থাকে পরিবারের শাঁখা-খাড়ু বেচ, কোথা পাবে সে আমার দেখবার দরকার নাই; আমার পাওনা আমায় পেতে হবে, দাও।
গোষ্ঠ জোড়হাত করিয়া কাঁদিল।
দত্ত কহিল, বেটারা শুধু কাঁদতেই জানে।
কথাটা ঠিক।
চির নত যে দূর্বাদল সে পদদলনে পত্রপুষ্প হারাইয়া বিদ্রোহ করে, শুষ্ক তৃণাঞ্জুর পায়ে ফোটে।
এরা কিন্তু তাহাও পারে না; হয়ত বুঝি বা বুকের মাঝে রাগও জাগে না। যুগ-যুগান্তর ধরিয়া সমাজে রাষ্ট্রে পিষ্ট হইয়া বুঝি পাষাণ হইয়া গিয়াছে। না; পাষাণও রৌদ্রে আগুনে উত্তপ্ত হয়।
ইহারা তবে কি? ইহারা প্রকৃত স্বভাবকে অতিক্রম করিয়া গিয়াছে, অস্বাভাবিক ইহারা। মানুষের সৃষ্টি-করা সভ্যতার চাপে ধ্বংস-হওয়া মানুষের তুলনা বিধাতার সৃষ্টির মাঝে নাই।
গোষ্ঠ কাঁদিয়াই কহিল, ওই দেখুন, পয়সা অভাবে ছেলেটা ওষুধ পায় নাই।
পাথর জলে গলে না। দত্ত খিঁচাইয়া উঠিল, তা সে পয়সাও আমাকে দিতে লাগবে নাকি, বলছ কি?
ইহার উত্তর কি? গোষ্ঠর অভিধানে অন্তত তা নাই, চোখ দিয়া শুধু জল পড়িল।
মহাজন বলিয়াই চলিল, থাক, এ মাসেই নালিশ করব আমি, যত বেটা বজ্জাতের পাল্লায় পড়ে মাটি হলাম আমি। ইঃ, এদিকে পরিবারের পরনের কাপড়ের বাহার দেখ না! ঢাকাই, না। শান্তিপুরে হে গোষ্ঠী
পরনে কাপড় জোটে নাই, তাই শ্বশুরের দেওয়া অতি পুরাতন পোশাকী কাপড়খানা দামিনী সেদিন পরিয়াছিল।
দত্তর কথায় ওই ছিন্ন-পাড় জীৰ্ণ কাপড়খানা অঙ্গে কাটার মতই বিধিতে লাগিল; লজ্জায় অপমানে বুক ঠেলিয়া কান্না আসিল, আঁচলটা মুখে পুরিয়া ত্বরিত পদে ঘরে ঢুকিয়া ছেলেটার শয্যাপার্শ্বে বসিয়া পড়িল; অবশ হাত হইতে অতর্কিতে টাকা দুইটা মাটিতে পড়িয়া বাজিয়া উঠিল, ঠনঠন।
শব্দ দত্তকে ফিরাইল, সে কোলাহল করিয়া উঠিল, ওই যে, ওই যে টাকা! হুঁ হুঁ বাবাঃ, মহাজনের কথা মিথ্যে হবার কি যো আছে রে বাবা? সোজা আঙ্গুলে ঘি উঠবে কেন? আন্ গোষ্ঠ, টাকা আন্।
গোষ্ঠ দামিনীর পাশে আসিয়া দাঁড়াইল।
কথা না কহিতেই, দামিনী টাকা দুইটা মুঠার ভিতর সজোরে যেন আঁকড়াইয়া ধরিয়া জবাব দিল, না, আমি কবরেজকে দোব।
গোষ্ঠর তখন যেন সব সহিত, মানের দায়ে প্ৰাণ তুচ্ছ হইয়া উঠিয়াছিল। কণ্ঠে তাহার বাক সরিতেছিল না, সে অতি রুক্ষস্বরে শুধু কহিল, দাও।
কাকুতি করিয়া দামিনী কহিল, না গো, না, তোমার পায়ে পড়ি।
গোষ্ঠর সেই এক বুলি, দাও। সেই কণ্ঠ, সেই ভঙ্গি, যেন আরও উগ্র।
দামিনী কাঁদিয়া কহিল, ছেলেটার পানে তাকাও।
দত্ত তাগিদ করিল, গোষ্ঠ, আমাকে অনেক জায়গা ঘুরতে হবে।
গোষ্ঠ পাগলের মত কহিল, মরুক ছেলে।
দামিনী টাকা দুইটা ষ্টুড়িয়া ফেলিয়া দিল।
শুধু টাকা নয়, মনে হইল ঘর-দ্বার এই দরদহীন বিশ্বসংসারটা পর্যন্ত এমনই করিয়া ঘঁড়িয়া ফেলিয়া দিয়া যদি কোথাও স্থান থাকে সেথা সরিয়া দাঁড়ায়। ছেলেটা কাতরাইয়া উঠিল, মা গো!
দামিনী মাথায় গায়ে হাত বুলাইয়া শান্ত উদাস কণ্ঠে কহিল, আর দেরি নাই, সব ভাল হয়ে যাবে। তুমিও জুড়াবে, আমিও।
আমি জুড়োব—এ কথাটা বুঝি মায়ের মুখে বাহির হয় না, বুকে উচ্ছাস উথলিয়া ওঠে, সব ভাসাইয়া দেয়; দামিনী হু-হু করিয়া দে।
গোষ্ঠ টাকা দুইটা দত্তর পায়ের গোড়ায় ফেলিয়া দিয়া দাওয়ায় উঠিয়া কাঠের উপর বসিয়া রহিল।
দামিনীর কান্নায় তাহারও চোখে জল আসিতে চাহিল; চোখের জল ছোঁয়াচে, একের কান্না অপরের সংযমের বাঁধ টলাইয়া দেয় প্ৰায় ভাঙিয়াই দেয়।
মুখখানা বিকৃত করিয়া গোষ্ঠ উদ্যত অশ্রু গোপন করিতে চাহিল। দত্ত টাকা দুইটা বাজাইতে বাজাইতে কহিল, কি পাজী রে তোরা মাইরি, আঁ! টাকা থাকতে বলিস, নাই, উসুল পড়বে কার বাবা? আমার, না তোর?
***
কই মোড়ল, ছেলের অসুখ কদিন?
কবিরাজ অশ্বিনী সিং আসিয়া বাড়ি ঢুকিল, পিছনে পিছনে সুবল, অতি সংকোচে এক পাশে দাঁড়াইয়া রহিল।
পত্নীর বাল্য-সাথীর উপর বিরূপ সংসারে হাজারে নশো নিরেনব্বই জন। মনের গতি মানুষের বাকা; আর প্রীতি ও পিরিতির মাঝে ভেদ করা বড় কঠিন, বিশেষ পুরুষ ও নারীর মাঝে।
গোষ্ঠও সুবলকে সুচক্ষে দেখিত না, বাড়ি আসিলে যেন বিরক্ত হইত, কারণে অকারণে কঁঝিয়া উঠিত।
সুন্দর তরুণ সুবলকে দূরে রাখিয়া নিজের আড়ালে দামিনীর দৃষ্টি হইতে ঢাকিয়া রাখিতে চাহিত।
সুবলও তাহা বুঝি, তাই তার এ সঙ্কোচ।
গোষ্ঠ কহিল, তুমি কেন হে মহান্ত, কি কাজ কি?
কবিরাজ উত্তর দিল, ওই তো আমায় ডেকে নিয়ে এল।
গোষ্ঠ কহিল, এস কবরেজ, এস, ছেলেটার কদিন থেকে উন্দো ধুলো জ্বর, চেতনা নেই; দেখ ভাই একবার।
ভিতর হইতে দামিনী পাগলের মত কহিল, না না, দেখতে হবে না; টাকা নাই, টাকা নাই আমার।
গোষ্ঠ মিনতি করিয়া কহিল, দোব দোব, টাকা দোব ভাই কবরেজ; দুদিন আগে আর পিছু; দেখ ভাই, দেখ।
কবিরাজ সুবলের পানে চাহিল।
বিবৰ্ণমুখ সুবল সে দৃষ্টির অৰ্থ বুঝিল, কিন্তু মনের কথা তো বলা যায় না। হয়ত দামিনী ষ্টুড়িয়া ফেলিয়া দিবে; গোষ্ঠ কি কথায় কি ধরিয়া বসিবে। সহসা ঘরের ভিতরে দামিনীর মুখখানা চোখে পড়িল, দামিনীর চোখের জলে বুক ভাসিয়া যাইতেছে।
বেদনায় মূকের মুখও ফোটে, ভাষা না হউক, যাতনার স্বর ধ্বনিয়া ওঠে।
সুবলের মুখও ফুটিল, সে মূকের মতই জড়িতকণ্ঠে কহিল, টাকা দেবে কবরেজ মশায়, টাকা দেবে।
কবিরাজ বাজাইয়া লইল, না দিলে—না দিলে আমি তোমার কাছে নোব, তুমি সে দেখে নিও।
সুবল কহিল, তাই দোব, আমিই দোব।
দীনতার মত মনুষ্যত্বনাশী এতবড় ব্যাধি আর দুনিয়ায় নাই, দীনতার চাপে হীনতা আসিবেই।
আজ এই দীনতার চাপে সুবলের অনুগ্রহ গোষ্ঠকে মাথা পাতিয়া লইতে হইল; সে কহিল, তাই দেবে, সুবলই তোমাকে দেবে, আমি সুবলকেই দোব; এই চার-পাঁচ দিনেই দোব। বলিয়া সে সুবলের মুখপানে চাহিল।
সুবল সান্ত্বনা দিয়া কহিল, না না, তাগিদ নাই আমার, যখন হবে দিও।
কবিরাজ হাসিয়া কহিল, আর না হয় নাই দিলে, মহান্ত মহাজন ভাল।
সুবল কেঁচড় হইতে টাকা খুলিয়া কবিরাজকে দিল, কহিল, আর যা লাগবে দোব।
কবিরাজ টাকা ট্যাকে পুঁজিতে খুঁজিতে কহিল, নগদ বিদেয়, তা ভাল। তা মহান্ত, তোমার তেজারতি সেরেস্তায় উসুলের ঘর বুঝি শূন্য?
সুবল লজ্জিত ও ম্লান হাসি হাসিল।
কবিরাজ কহিল, এবার তুমি মানুষ কোরোক কর মহান্ত; না দিলে মানুষ ধরে নিয়ে যাবে, ঘরে খেতে পরতে দেবে, তেজারতি তোমার আরও ফলাও হবে।
আপন রসিকতায় কবিরাজ আপনি হা-হা করিয়া হাসে; ওদিকে এই তরল কথাটা গাঢ় কঠিন হইয়া আর একজনের কানে বাজে, ঘরের মাঝে দামিনী হাঁপাইয়া ওঠে, তাহার মনে হয়, ওই টাকাটা দেনাও নয়, দানও নয়, ও দাদন—তাহারই উপরে দাদন। কোরোকী পরোয়ানার লেখার রেখা সুবলের বুকের মাঝে আঁকা, যেন সে দেখিতে পায়। সে কণ্ঠস্বর চাপিতে ভুলিয়া গেল। উচ্চ আর্তকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, না না, না গো, কবরেজ দেখাতে হবে না, ধার করতে হবে না; ছেলে ভাল আছে, ছেলে ভাল আছে আমার।
গোষ্ঠ ধমক দিয়া ওঠে, থাম থাম, কত্তাতি ফলাতে হবে না, থাম।
মুখ থামিলে রব থামে, কিন্তু রোদন তো থামে না।
দামিনী নীরব হইল, কিন্তু শ্বাসরুদ্ধের মতই পাগল হইয়া উঠিল।
মরণ টুঁটি চাপিয়া ধরে, রোগীর শ্বাস রুদ্ধ হইয়া আসে, সে সমস্ত অঙ্গের শিথিলতম বাঁধনটুকু পর্যন্ত কাটিতে চায়, যেন ওইটুকু টুটিলেই সে আরামের শ্বাস ফেলিয়া বাঁচিবে। তেমনই অস্থিরতায় দামিনী আপনার সারা অঙ্গের মাঝে যদি কোথাও কোনো সোনারুপার বাঁধন থাকে, তাহার খোঁজ করিয়া যায়।
নাই, মেলে না; চোখে পড়ে রোগা ছেলেটার সরু লিলিকে হাতে শতচ্ছিদ্র জীর্ণ রুপার বালা দুইগাছা।
দামিনী তাই খুলিয়া লয়, হুঁড়িয়া সুবলের দিকে ফেলিয়া দেয়। ছেলেটা শ্ৰান্ত সরু গলায় কাঁদয়া ওঠে, আমার গন্না—আঁ—আঁ।
গোষ্ঠও একটা আরামের নিশ্বাস ফেলিয়া বলে, তাই রাখ ভাই, তাই রাখ; শুধু হাতে কারবার ভাল নয়, কিছু থাকা ভাল।
ছেলেটার কান্না কিন্তু থামে না, সে কাঁদিয়াই চলে, আমার গন্না-আঁ—আঁ।
দামিনী পাষাণের মত বসিয়া রহিল, ছেলেটাকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা পর্যন্ত করিল না। করিল না নয়, বোধহয় পারিল না।
গোষ্ঠ কহে, দূর, শুধুই আঁ—আঁ। সে উঠিয়া চলিয়া যায় মাঠের পানে। দাওয়া হইতে নামিয়াই নতদৃষ্টিতে পড়ে ছেলেটার জীর্ণ বালা দুইগাছা, সুবল ফেলিয়া দিয়া গিয়াছে।
দয়া! সর্বাঙ্গ তাহার রি রি করিয়া ওঠে; বালা দুইগাছা হাতে তুলিয়া সে সঙ্কল্প করে, সুবলের মুখে ঘুড়িয়া মারিয়া আসে। আবার মনে হয়, কত দাম ইহার, বড়জোর বার গণ্ডা পয়সা; সঙ্গে সঙ্গে আপনিই সে হাসে, বড় দুঃখের হাসি। চারিটি টাকা দিয়া বার আনার দ্রব্য বিনিময়, যদি নাই লয় সে। বালা দুইগাছা সে ছেলেটার দিকে ছুঁড়িয়া দিয়া মাঠের পথ ধরে। ছেলেটা বালা দুইগাছা বুকে চাপিয়া ধরে, মানিকের মত নাড়েচাড়ে; ওইটুকু যে এ বিশ্বে উহার আভরণের গৌরব।