০৩. শেয়ালের গর্ত

৩. শেয়ালের গর্ত

বিকেলবেলা খেলতে বের হয়ে বুবুন দেখল গাব্ব, পিয়াল এবং অন্য ছেলেরা ক্রিকেট ব্যাট এবং বল নিয়ে খেলার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে। বুবুন মনে-মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল–সে এই খেলাটাতে কিছুতেই সুবিধে করতে পারে না। ছেলেরা যখন বাঁশের কঞ্চি দিয়ে স্ট্যাম্প তৈরি করে মাটিতে গাঁথছে তখন সুমি এসে বলল, “এই, তোমরা এখন ক্রিকেট খেলবে?”

পিয়াল মুখ ভেংচে বলল, “না আমরা বুড়ি চি খেলব!”

“ফাজলেমি করবি না বলছি, মুখ ভেঙে দেব।

পিয়াল কোনো কথা বলল না, সুমি মনে হয় ভুল করে মেয়ে হয়ে জন্মেছে, তার ছেলে হওয়ার কথা ছিল, তাকে সবাই অল্পবিস্তর ভয় পায়। সুমি বলল, “আমরা এখানে আগে খেলতে এসেছি, আমরা খেলব। তোরা অন্য জায়গায় যা।”

সুমির কথা শুনে পিয়াল মনে হল একটু অবাক হয়ে গেল, বলল, “তোরা খেলবি? মানে মেয়েরা?”

“হ্যাঁ। তোরা যদি চাস আমাদের সাথে খেলতে পারিস।”

“কী খেলবি তোরা?”

“সাত-চাড়া।”

“সাত-চাড়া?” গাব্বু এবং পিয়াল একসাথে হেসে উঠল।”হাসছিস যে বড়? খেলিসনি কখনো সাত-চাড়া?”

“খেলব না কেন? কিন্তু সাত-চাড়া কি একটা খেলা হল? কোথায় ক্রিকেট আর কোথায় সাত-চাড়া!”

“খেলা তো খেলাই। যেটা খেলতে মজা লাগে সেটাই খেলা।”

“তোকে বলেছে!” পিয়াল মুখ শক্ত করে বলল, “কোনোদিন শুনেছিস সাত চাড়া টুর্নামেন্ট হচ্ছে? শুনেছিস ওয়ার্ল্ড কাপ হচ্ছে সাত-চাড়া খেলায়?”

গাব্বু হিহি করে হাসতে হাসতে বলল, “সাত-চাড়া ওয়ার্ল্ড কাপ! হি হি হি!”

পিয়াল বলল, “বুকের পাটা থাকে তো আয় ক্রিকেট খেলতে। টেনিস বল না, একেবারে খাঁটি ক্রিকেট বল!”

সুমি কোমরে হাত দিয়ে বলল, “কী ভাবছিস? আমি পারব না?”

সুমির সাথে আরও কয়েকজন মেয়ে ছিল, তাদের একজন বলল, “থাক বাবা দরকার নেই। চল যাই আমরা আমাদের খেলা খেলি।”

সুমি চোখে আগুন ঢেলে বলল, “আমরা মাঠে আগে এসেছি আমরা খেলব।”

মেয়েটা নরম গলায় বলল, “থাক সুমি। ছেড়ে দে। ঝগড়া করে কী লাভ? আয়, আমরা ওইপাশে চলে যাই।”

“ফাজলেমি নাকি? কক্ষনো না।”

“আয়, আয়। ছেলেদের সাথে ঝগড়া করে কী লাভ! আমাদের তো বেশি জায়গাও লাগবে না!”

সুমি আরও কী-একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু অন্য মেয়েরা তাকে টেনে সরিয়ে নিল। গাব্বু হা হা করে হেসে বলল”সাত-চাড়া ওয়ার্ল্ড কাপ! সাত-চাড়া ওয়ার্ল্ড কাপ!”

পিয়াল চেঁচিয়ে বলল, “সাত-চাড়া চ্যাম্পিওন সুমি!”

বুবুন একটু অস্বস্তি নিয়ে বলল, “কেন তোমরা ওকে জ্বালাচ্ছ? ও তো ঠিকই বলেছে। ওরা আগে এসেছে ওদেরই তো খেলার কথা!”

“ধুর! মেয়েরা আবার কী খেলবে?”

“একসাথে সাত-চাড়া খেললেই হত। আমার তো ভালোই লাগে সাত-চাড়া খেলতে।”

“ভলো লাগে”

“ধুর!” গাব্বু হাত নেড়ে উড়িয়ে দিয়ে দল ভাগাভাগি শুরু করে দিল।

কিছুক্ষণের মাঝেই খেলা শুরু হয়ে গেল। পিয়াল ব্যাট করতে নেমেছে, গাব্বু উইকেট কিপার। ফরসামতন হালকা-পাতলা একটা ছেলে ছুটে এসে বল করল। পিয়াল বড় হয়ে দুর্ধর্ষ ব্যাটসম্যান হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই, শরীর ঘুরিয়ে মারতেই বল উড়ে গেল আকাশে, সবাই অবাক হয়ে দেখল ঘুরতে ঘুরতে নেমে এসে লাগল জানালার কাঁচে। শক্ত জানালার কাঁচ–ক্রিকেট বল পর্যন্ত ধাক্কা খেয়ে ফিরে এল। আতঙ্কে আটকে থাকা নিঃশ্বাসটি মাত্র বুক থেকে বের করেছে ঠিক তখন কথা নেই বার্তা নেই ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল জানালার কাঁচ।

পিয়াল রক্তশূন্য মুখে বলল, “সর্বনাশ!”

গাব্বু বলল, “পালা।”

কথা শেষ হবার আগেই ব্যাট ছুঁড়ে ফেলে স্ট্যাম্প তুলে নিয়ে সবাই উধাও হয়ে গেল। দৌড়ে পালাতে বুবুনের কেমন জানি লজ্জা করছিল, কিন্তু যখন অন্য সবাই পালিয়ে গেছে তখন একা দাঁড়িয়ে থাকা মনে হয় বুদ্ধিমানের কাজ নয়। বুবুন ঠিক যখন দৌড় দেবে তখন ভাঙা জানালা দিয়ে পাহাড়ের মতো একজন মানুষের মাথা উঁকি দিল, মানুষটির পিয়ালের মতো বোচা নাক এবং উঁচু কপাল, দেখেই বোঝা যায় তার বাবা। বুবুন আর দৌড়ানোর সাহস পেল না, যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল।

মানুষটি ভাঙা জানালা দিয়ে মাথা বের করে একটা হুংকার দিয়ে বলল, “কে কাঁচ ভেঙেছে?”

মেয়েদের সবাই কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেল, এই মানুষটাকে শুধু পিয়াল নয়, মনে হয় সবাই ভয় পায়। মানুষটা চোখ পাকিয়ে সবার দিকে তাকিয়ে আরও জোরে হুংহার দিয়ে বলল, “কে ভেঙেছে?”

সুমি সাত-চাড়া খেলার টেনিস বল হাতে নিয়ে একটু এগিয়ে গিয়ে বলল, “আমরা দেখি নাই চাচা।”

“দেখ নাই মানে? তোমরা এখানে দাঁড়িয়ে আছ না?”

“না চাচা, আমরা তো খেলছিলাম?”

“পিয়াল হারামজাদা কই? নিশ্চয়ই পিয়াল–ক্রিকেট বল দিয়ে—”

সুমি জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, “না চাচা, আজকে কেউ ক্রিকেট খেলছে না। সবাই মিলে সাত-চাড়া খেলছি।” সুমি বুবুনের দিকে তাকিয়ে বলল, “তা-ই বুবুন?”

বুবুন বোকার মতো মাথা নাড়ল। সুমি জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, “আজকে ছেলের টিম আর মেয়ের টিম খেলা হচ্ছে।”

“কোথায় গেছে সবাই?”

“চাড়া ভেঙ্গে লুকিয়ে আছে। সাত-চাড়া খেলার নিয়ম জানেন তো? প্রথমে চাড়া ভেঙে—”

“তা হলে জানালার কাঁচ ভাঙল কেমন করে?”

“মনে হয় মডেল স্কুলের ছেলেরা ভেঙেছে।”

পিয়ালের আব্বা অবাক হয়ে বললেন, “মডেল স্কুলের ছেলেরা?”

“জি চাচা। ডিবেটে আমাদের স্কুলের টিমের কাছে হেরে গিয়েছিল তো তাই আমাদের উপর খুব রাগ। আমাদের দেখলেই ঢিল মারে।” সুমি কাছাকাছি দাঁড়িয়ে-থাকা একটা মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “তাই না রে বকুল?”

বকুল নামের মেয়েটি ফ্যাকাশে হয়ে ঢোক গিলে মাথা নাড়ল। পিয়ালের আব্বা সুমির কথা বিশ্বাস করলেন কি না বোঝা গেল না। নাক দিয়ে ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে ভিতরে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

কিছুক্ষণের মাঝেই গুটিগুটি পায়ে ছেলের দল এসে হাজির হল–তারা কাছাকাছি কোথায় লুকিয়ে থেকে সুমির সাথে পিয়ালের আব্বার কথাবার্তা শুনেছে। পিয়াল দুর্বল গলায় বলল, “সুমি!”

“কী হল?”

“আমি তোকে আচার কিনে-খাওয়াব। খোদার কসম।”

সুমি মুখ ভেংচে বলল, “আমি তোর আচার খাওয়ার জন্য মারা যাচ্ছি!”

“সত্যি সুমি। তুই বাঁচিয়েছিস আমাকে–এখনও বিপদ পুরোপুরি যায়নি কিন্তু যদি সত্যি কথাটা বলে ফেলতি একেবারে অবস্থা কেরোসিন হয়ে যেত।”

গাব্বু মাথা নেড়ে বলল, “একেবারে কেরাসিন!”

“আব্বা মেরে একেবারে ভর্তা করে ফেলতেন।”

গাব্বু বলল, “লাশ পড়ে যেত।”

সুমি মুখ শক্ত করে বলল, “দ্যাখ পিয়াল, অন্য কেউ হলে আমি কখনো এত বড় মিথ্যা কথাটা বলতাম না। কখনো না। শুধু তো আব্বা বলে”

বুকুল নামের মেয়েটি এগিয়ে বলল, “সত্যি কথাটাই বলা উচিত ছিল। মনে আছে আমাদের সাথে কীরকম ব্যবহার করেছিস?”

আরেকটি মেয়ে বলল, “মনে আছে?”

সুমি হাত নেড়ে বলল, “ছেড়ে দে! এরা তো বড় হয়ে পুরুষমানুষ হবে তাই এখন থেকে প্র্যাকটিস করছে।”

পিয়াল বলল, “আর কখনো করব না, খোদার কসম।”

বুবুন বলল, “এখানে এরকম দাঁড়িয়ে না থেকে আসলে আমাদের সবাই মিলে এখন সাত-চাড়া খেলা উচিত।”

গাব্বু মাথা নাড়ল, “ঠিকই বলেছে বুবুন। নইলে সন্দেহ করতে পারে।”

“হ্যাঁ। চল খেলা শুরু করে দিই।”

সুমি দাঁত বের করে হেসে বলল, “চল। কে জানে তোরা হয়তো একদিন সাত-চাড়া ওয়ার্ল্ড কাপ খেলতে পারবি!”

পিয়াল অপরাধীর মতো সুমির দিকে তাকাল, কিছু বলল না।

সাত-চাড়া খেলা নিয়ে ছেলেদের একটা তাচ্ছিল্যের ভাব থাকলেও দেখতে দেখতে খেলা খুব জমে উঠল। একেবারে সন্ধ্যে না হওয়া পর্যন্ত তারা খেলে গেল। খেলাশেষে সবাই নিজেদের বাসায় ফিরে যাচ্ছে। পিয়াল বিপদ হতে পারে বলে ক্রিকেট ব্যাটটা বুবুনকে রাখতে দিয়েছে, বুবুন ব্যাটটা ঘাড়ে করে হাঁটছে সাথে গাঙ্কু আর সুমি। গাব্বু বলল, “সাত-চাড়া খেলাটা আসলে খারাপ না।”

বুবুন বলল, “আসলে সবাই মিলে খেললে সব খেলাই মজার।”

সুমি বলল, “দিনরাত ক্রিকেট খেলে তোরা যে কী মজা পাস।”

গাব্বু বলল, “খেলিসনি তো, তাই জানিস না।”

বুবুন হঠাৎ ঘুরে তাকিয়ে বলল, “পিয়ালের আব্বা যদি জানতে পারেন ক্রিকেট বল দিয়ে জানালার কাঁচ ভেঙেছে তা হলে সত্যি সত্যি পিয়ালকে মারবেন?”

সুমি বলল, “জানে শেষ করে দেবেন।”

বুবুন বলল, “সত্যি? ইচ্ছে করে তো ভাঙেনি।”

“তাতে কী হয়েছে?”

গাব্বু দার্শনিকের মতো বলল, “আসলে আব্বা জিনিসটা হচ্ছে একটা কপালের ব্যাপার। যেমন মনে করো সুমির কপালটা একেবারে ফাস্ট ক্লাস। সুমি যদি একটা মার্ডার করে আসে সুমির আব্বা বলবেন, ভেরি গুড সুমি। কী সুন্দর করে মার্ডার করেছে দেখেছ! আর কেউ এত সুন্দর করে মার্ডার করতে পারবে?”

গাব্বুর কথা বলার ভঙ্গি শুনে সুমি আর বুবুন দুজনেই হেসে ফেলল। বুবুন জিজ্ঞেস করল, “সত্যি?”

গাব্বু বলল, “সত্যি না তো মিথ্যা? সুমি যে এইরকম বেড়েছে তার কারণটা কী? আমাদের ছেলেদের যেসব জিনিস করা নিষেধ সুমি সেগুলো পর্যন্ত করতে পারে ওর আব্বা কিছু বলেন না। উলটো উৎসাহ দেন। একেবারে ফার্স্ট ক্লাস আব্বা!”

“তোমার আব্বা?”

“আমার আব্বা মাঝামাঝি। পিয়ালের আব্বা হচ্ছে ডেঞ্জারাস। ওর কপালটা খারাপ। এখন মনে করো জানালার কাঁচ ভেঙেছে, সুমি চেষ্টা করছে ওকে বাঁচানোর, কিন্তু তবু মনে হয় মার কিছু খাবে। যদি জানালার কাঁচ না ভাঙত তবু মার খেত–”

“কেন?”

“যদি ভেঙে যেত সেজন্যে। পিয়ালের আব্বা সবসময় অ্যাডভান্স কিছু পিটিয়ে রাখেন।”

সুমি মাথা নাড়ল, বলল, “আসলেই পিয়ালটার কপাল খারাপ।”

বাসায় ফিরে যেতে যেতে বুবুনের মাথায় একটা প্রশ্ন এল, যদি সুমির কপাল ভালো, গাবুর কপাল মাঝামাঝি এবং পিয়ালের কপাল খারাপ হয়ে থাকে তা হলে তার কপাল কি? কপার কি কখনো নাই’ হতে পারে?

রাত্রিবেলা বুবুন নিজের ঘরে ঘুমানোর চেষ্টা করছে। অনেক মানুষই আছে যারা শোয়ামাত্রই ঘুমিয়ে যায়, বুবুন ওরকম না,শোয়ার সময় হলেই ঘুরেফিরে তার মাথায় রাজ্যের যত চিন্তা এসে জড়ো হয়। আজকেও শুরু হচ্ছিল কিন্তু সে জোর করে সব ঠেলে সরিয়ে দিল। চেষ্টা করে সে যখন প্রায় ঘুমিয়ে যাচ্ছিল, হঠাৎ করে কে যেন তাদের বাসার খুব কাছে ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠল, সাথে সাথে আরও অনেকে। বুবুন ভয় পেয়ে লাফিয়ে উঠে বসল, তারপর তড়াক করে এক লাফে বিছানা থেকে নেমে এক দৌড়ে একেবারে আম্মার কাছে। আম্মা নাকের ডগায় চশমা লাগিয়ে কী-একটা বই পড়ছিলেন, বুবুনকে দৌড়ে আসতে দেখে বললেন, “কী হল, বুবুন?”

“ওটা কিসের শব্দ?”

আম্মা হেসে ফেলে বললেন, “কী লজ্জার কথা! বাঙালির ছেলে শেয়ালের ডাক চেনে না!”

“এটা শেয়ালের ডাক?”

“হ্যাঁ।”

“কিন্তু শেয়াল নাকি হুক্কা হুয়া হুক্কা বলে ডাকে? এটা তো সম্পূর্ণ অন্যরকম। মনে হয় কেউ কাঁদছে।”

“এটাই শেয়ালের ডাক। আগে তো শহরের মাঝখানে ছিলি, শেয়ালের ডাক শুনিসনি। এখন পিছনে টিলা জঙ্গল নদী এসব আগে তা-ই শুনছিস। যা ঘুমা গিয়ে।”

বুবুন আবার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পরে একটু দূরে থেকে আবার শেয়ালেরা ডেকে উঠল। প্রথমে একটা ডেকে ওঠে তারপর একসাথে অনেকগুলো। আর সবচেয়ে অবাক ব্যাপার শেয়ালের ডাক শুনলেই বুকের ভিতরে কীরকম জানি করতে থাকে। একই সাথে এরকম ভয় আর একরকম খালি-খালি মন-খারাপ-করা ভাব। কেন এটা হয়?

বুকের মাঝে খালি-খালি এক ধরনের ভাব নিয়ে বুবুন একসময় ঘুমিয়ে পড়ল।

পরদিন বিকেলে সবাই একত্র হয়েছে, জানালার কাঁচ ভাঙার ঘটনার পর থেকে কয়েকদিন হল ক্রিকেট খেলা আপাতত বন্ধ। কী খেলা যেতে পারে সেটা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, তখন বুবুন হঠাৎ করে বলল, “কাল রাত্রে তোমরা শেয়ালের ডাক শুনেছিলে?”

গাব্বু অবাক হয়ে বলল, “কেন? কী হয়েছিল শেয়ালের ডাকে?”

“কিছু হয়নি। কিন্তু–”

“কিন্তু কী?”

“শুনলে কীরকম লাগে না? ভয়-ভয় খালি-খালি–”

পিয়াল চোখ ছোট ছোট করে বলল, “তুমি আগে কখনো শেয়ালের ডাক শোননি?”

“না। কীভাবে শুনব? বইয়ে পড়েছিলাম হুক্কা হুয়া–”

সুমি হি হি করে হেসে বলল, “তুই কি মঙ্গল গ্রহ থেকে এসেছিস নাকি? পরে শুনব কোনদিন মশাও দেখিসনি।”

এখানে সবাই সবাইকে তুই তুই করে বলে, বুবুন নুতন এসেছে বলে এখনও তুমি তুমি করে বলছে। সুমি অবশ্যি তুই শুরু করে দিয়েছে। সুমির কথা শুনে সবাই হি হি করে হেসে উঠল, বুবুন একটু লজ্জা পেয়ে বলল, “আমাকে নিয়ে হাসছ কেন? খোঁজ নিয়ে দেখো ঢাকা শহরে কয়জন শেয়ালের ডাক শুনেছে!”

পিয়াল বলল, “তার মানে তুমি শেয়াল দেখওনি!”

“না। কিন্তু টেলিভিশনে দেখেছি। অনেকটা কুকুরের মতো।”

গাব্বু বলল, “লজ্জার ব্যাপার। একটা মানুষ কোনোদিন শেয়াল দেখেনি।”

সুমি বলল, “চল শেয়াল দেখিয়ে আনি।”

 বুবুন অবাক হয়ে বলল, “কেমন করে দেখাবে?”

গাব্বু বলল, “শেয়ালদের কলেজ আছে, সেখানে গেলেই দেখবে সবাই বই খাতা নিয়ে পড়াশোনা করছে। হি হি হি–” গাব্বু নিজের রসিকতায় নিজেই হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল।

পিয়াল বলল, “বেশির ভাগ সময় পড়াশোনা না করে পলিটিক্স করে। শ্লোগান দিতে থাকে হুক্কা হুয়া হুক্কা হুয়া–” এটা শুনে গাবুর মনে হল আরও বেশি আনন্দ হল, হাসতে হাসতে সে এবারে প্রায় মাটিতে গড়িয়ে পড়ল।

বুবুন বলল, “যাও! ঠিক করে বলল-না–”

সুমি বলল, “ঐ টিলায় শেয়ালের গর্ত আছে। গর্তের মুখে আগুন দিয়ে ধোঁয়া দিলেই শেয়াল বের হয়ে আসবে।

“সত্যি?”

“সত্যি না তো মিথ্যা?”

“আগে কখনো বের করেছ?”

“এখনও বের করিনি, চল, আজকে বের করব।”

“ধোয়া কেমন করে দিতে হয়?”

“খবরের কাগজ পেঁচিয়ে আগুন ধরালেই ধোঁয়া হবে। আবার কঠিন কী?”

গাব্বু বলল, “সবচেয়ে ভালো হয় যদি একটা টেম্পো ধরাধরি করে টিলার উপরে নিয়ে যাই। টেম্পোর পিছনে দিয়ে কীরকম কালো ধোঁয়া বের হয় দেখেছিস?”

গাব্বু আবার নিজের রসিকতায় নিজেই হি হি করে হাসতে শুরু করল। সুমি চোখ পাকিয়ে বলল, “গা! তুই দিনে দিনে দেখি সিনেমার জোকার হয়ে যাচ্ছিস!”

কিছুক্ষণ পরেই দেখা গেল এই ছোট দলটি টিলার দিকে হেঁটে যাচ্ছে। ধোঁয়া দিয়ে শেয়ালের গর্ত থেকে শেয়াল বের করা হবে শুনে আরও কিছু বাচ্চাকাচ্চা দলে যোগ দিয়েছে। সুমি অন্য মেয়েদের ডাকাডাকি করছিল, কিন্তু তাদের কেউ আসতে সাহস পেল না। বকুল সুমিকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে থামানোর চেষ্টা করছিল কিছু-কিছু কাজ মেয়েদের করতে হয় না সেটা নিয়েও একটা লেকচার দিয়েছিল, কিন্তু কোনো লাভ হল না।

টিলার নিচে একটা ডোবামতো জায়গা আছে, সেটাকে পাশ কাটিয়ে তারা উপরে উঠে গেল। জায়গাটা বেশ নির্জন, কিন্তু একেবারে উপরে উঠে দেখতে পেল সেখানে একজন মানুষ বসে আছে। মানুষটার চেহারায় একটা ইঁদুর-দুর ভাব, কালচে গায়ের রং, ছুঁচালো মুখ, সরু গোঁফের রেখা। মানুষটা তাদের দিকে খুব সন্দেহের চোখে তাকাল কিন্তু কিছু বলল না। সুমির পিছনে পিছনে অন্য সবাই হেঁটে হেঁটে টিলার অন্যপাশে হাজির হল। খানিকটা জায়গা বেশ খাড়া, পাথর মাটিতে মেশানো, ছোট ছোট ঝোঁপঝাড়ে ঢাকা। সেখানে ছোটবড় অনেকগুলো গর্ত। সুমি থেমে বলল, “এই যে শেয়ালের গর্ত।”

বুবুন জিজ্ঞেস করল, “তুমি কেমন করে জান?”

“একদিন শেয়ালকে ধাওয়া করেছিলাম, তখন দেখেছি এখানে এসে ঢুকেছে।”

গাব্বু বলল, “হতে পারে চা-নাশতা খাওয়ার জন্যে ঢুকেছে, কিন্তু থাকে অন্য জায়গায়।”

সুমি ধমক দিয়ে বলল, “খালি বাজে কথা বলিস না।”

খবরের কাগজ পেঁচিয়ে দলা পাকানো হল, ম্যাচ বের করে সেখানে আগুন দেয়া হল, একটু আগুন এবং অনেকখানি ধোয়া হওয়ার কথা ছিল কিন্তু হল উলটোটা, অনেকখানি আগুন এবং একটুখানি ধোয়া। সেই ধোঁয়া শেয়ালের গর্তে ঢোকার কথা কিন্তু ধোঁয়া ভিতরে না ঢুকে গর্তের মুখে পাক খেতে থাকল। বুবুন মাথা নেড়ে বলল, “ধোঁয়া তো ঢুকছে না!”

গাব্বু বলল, “যারা সিগারেট খায় তাদের নিয়ে এলে হত, সবাই মিলে। সিগারেটে টান দিয়ে ভিতরে ধোয়া ছাড়ত।”

সুমি কোনো কথা না বলে বিষদৃষ্টিতে গাব্বর দিকে তাকাল। কিছুক্ষণের মাঝেই যেটুকু খবরের কাগজ আনা হয়েছিল পুড়ে ছাই হয়ে গেল, লাভের মাঝে লাভ হল সবাই কয়েক জায়গায় ছ্যাকা খেল, নাক দিয়ে ধোঁয়া ঢুকে খানিকক্ষণ কাশাকাশি করল, চোখে লেগে চোখ জ্বালা করতে লাগল। যে-শেয়ালকে বের করার জন্যে এত চেষ্টা-চরিত্র তার টিকিটিও দেখা গেল না। সুমি বলল, “পরের বার বেশি করে খবরের কাগজ আনতে হবে।”

“খবরের কাগজে হবে না–” পিয়াল মাথা নেড়ে বলল, “লাকড়ি নিয়ে আসতে হবে। সাথে বড় টেবিল ফ্যান। ফ্যান দিয়ে ধোঁয়া ভিতরে ঢোকাতে হবে।”

“ফ্যানটার প্রাগ লাগাবে কোথায়?”

পিয়াল থতমত খেয়ে বলল, “তাও তো কথা!”

সবাই মিলে হেঁটে হেঁটে ফিরে যেতে যেতে টিলার চূড়োয় এসে আবার সেই আগের ইঁদুরের মতো মানুষটাকে দেখতে পেল, উদাস-উদাস মুখ করে তাকিয়ে আছে। তাদের এই ছোট দলটাকে দেখে আবার কেমন যেন সন্দেহের চোখে তাকাল। ওরা যখন প্রায় চলে যাচ্ছিল তখন লোকটা বলল, “তোমরা কোথায় থাক?”

অচেনা সন্দেহজনক মানুষের সাথে কথাবার্তা বলা ঠিক না, কিন্তু একজন মানুষ যখন প্রশ্ন করছে কিছু-একটা তো বলতে হয়। গা অনিশ্চিতের মতো হাত নেড়ে বলল, ঐ তো ওইখানে।”

মানুষটা দূরে তাদের বাসার দিকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, “রওশন মানে একজন মেয়েলোক থাকে তারা বাসা কোনটা জান?”

বুবুন একটু চমকে উঠল, তার আম্মার নাম রওশন জাহান কিন্তু সবাই ডাকে ডক্টর রওশান। কখনো কেউ তাকে মেয়েলোক’ বলবে না, আরকিছু না হলে অন্ততপক্ষে ভদ্রমহিলা তো বলবে। বুবুনের সাথে সাথে সবাই তখন লোকটার দিকে সন্দেহের চোখে তাকাল। গাব্বু জিজ্ঞেস করল, “কি করবেন তার বাসা দিয়ে?”

লোকটা এইবার থতমত খেয়ে গেল, ইতস্তত করে বলল, “না, মানে, এমনি জানতে চাচ্ছিলাম।”

বুবুন একটু এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কী করেন?”

“আমি?”

“হ্যাঁ। কী করেন আপনি? নাম কী আপনার? কোথায় থাকেন?”

লোকটার মুখ হঠাৎ কেমন জানি শক্ত হয়ে যায়, কর্কশস্বরে বলল, “আমি কী করি না-করি সেটা দিয়ে তুমি কী করবে?”

বুবুন বলল, “আপনি কিছু জানতে চাইলে দোষ নেই, আমরা জানতে চাইলে দোষ?”

সুমি বলল, “কথা বলে কাজ নই বুবুন, চলে আয়।”

বুবুন অন্য সবার সাথে ফিরে চলল, যেতে যেতে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখল মানুষটা চোখ ছোট ঘোট করে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। কেন মানুষটা আম্মা কোন বাসায় থাকেন জানতে চেয়েছিল?

রাতে আম্মা একটা খাম খুলে একটা চিঠি বের করে পড়তে পড়তে হঠাৎ খুব গম্ভীর হয়ে গেলেন। বুবুন একটু ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে আম্মা?”

“না, কিছু না।” খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “এই চিঠিটা কে দিয়েছে তুই জানিস?”

“না, আম্মা। কিন্তু–”

“কিন্তু কী?”

শেয়ালের গর্তে আগুন দিতে গিয়ে যে-মানুষটার সাথে দেখা হয়েছিল তার কথা বলবে কি না চিন্তা করে বুবুন বলেই ফেলল।”আমরা টিলায় গিয়েছিলাম সেখানে একটা লোক তোমার কথা জিজ্ঞেস করেছিল।”

“কী রকম দেখতে?”

“ইঁদুরের মতো।”

আম্মা হেসে ফেলেন, “মানুষের চেহারা আবার ইঁদুরের মতো হয় কেমন। করে?”

“হয় আম্মা হয়। তুমি দেখলেই বুঝতে পারবে।”

আম্মা কিছু বললেন না, হাতের চিঠিটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। বুবুন জিজ্ঞেস করল, “কী লেখা আছে চিঠিতে!”

আম্মা উড়িয়ে দেবার ভঙ্গি করে বললেন, “ঐ তো যা থাকে। ভয়-টয় দেখার আর কি!”

“কেন ভয় দেখায় আম্মা?”

“নিজেরা ভয় পায় তো সেইজন্যে ভয় দেখায়। আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষ তো পড়াশোনা জানে না তাই ধর্মের কথা বলে কাঠমোল্লারা তাদের কন্ট্রোল করে। যখন মানুষ পড়াশোনা করে তখন সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় এই কাঠমোল্লাদের। তাই মানুষজন পড়াশোনা করলে তারা খুব রেগে যায়।”

“পড়াশোনা করলে ক্ষতি হয় কেন আম্মা?”

“মনে কর এক জায়গায় ভূমিকম্প হল। তখন এই কাঠমোল্লারা বলবে এখানে আল্লাহর গজব হয়েছে। কিন্তু যদি তারা পড়াশোনা করে তা হলে জানবে আসলে আল্লাহর গজব না, এটা হয় ফল্ট লাইন থেকে টেকটোনিক প্লেটের নড়াচড়া থেকে। তখন তো তাদের ধোঁকা দেওয়া যায় না। যারা পড়াশোনা জানে না অসুখ হলে তারা পানিপড়া খায় আর যারা পড়াশোনা করেছে তারা খায় ওষুধ। এই হচ্ছে পার্থক্য।“

“কিন্তু তোমাকে কেন ভয় দেখায়?”

“আমার উপরে রাগ বেশি। একে আমি পড়াশোনার কথা বলি, তার উপর মেয়েদের পড়াশোনার–সেইজন্যে যা এখন ঘুমা গিয়ে।”

বুবুন যেতে ফিরে এসে বলল, “তারা তোমার কিছু করবে আম্মা?”

আম্মা হেসে বললেন, “ধুর বোকা! কী করবে আবার? এরা হচ্ছে যত রাজাকার আলবদর জামাতিদের দল। সেভেনটি ওয়ানে একবার তাদের টাইট দেওয়া হয়েছে–এখন আবার দেবে!”

বুবুন নিজের ঘরে ফিরে এল। আম্মা পুরো ব্যাপারটি হেসে উড়িয়ে দেওয়ার ভান করেছেন কিন্তু বুবুন লক্ষ্য করেছে আম্মার মুখে সূক্ষ্ম একটা দুশ্চিন্তার ছায়া।

ইশ! তার যদি একটা বাবা থাকত! বিশাল শক্তিশালী একটা বাবা। সেই বাবা যদি তাকে আর তার আম্মাকে সমস্ত বিপদ থেকে বুক পেতে রক্ষা করত।

বুবুন বিছানায় শুয়ে শুয়ে একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *