মৃত্যু ও সংশয়
যজুর্বেদ যজ্ঞ অনুষ্ঠানের সংহিতা, সেখানে এ-জাতীয় চিন্তা বা প্রশ্নের অবকাশ নেই। তবু তৈত্তিরীয় সংহিতায় এক জায়গায় পড়ি, ‘এই লোক থেকে (মনুষ্যলোক থেকে) ভাল ভাবে আসতে হবে এ কথা বলেছেন (তাঁরা), কে তা জানে যে ওই লোকে (= পরলোকে) (কিছু) আছে বা নেই।’[১] যজুর্বেদের কিছু অংশ ঋগ্বেদের সমসাময়িক, কিছু অংশ হয়তো পরে রচিত। ঋগ্বেদের দশটি মণ্ডলের শেষটিতে বেশ কয়েকটি সূক্ত অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত। যম সম্বন্ধে অথর্ববেদে বলা হয়েছে, ‘মর্ত্য (মানুষদের) মধ্যে যিনি প্রথমে মারা যান— যো মমার প্রথমো মর্ত্যানাম্।’ (অথর্ববেদ ১৮:৩:১৩) তিনি মারা গিয়ে প্রথমে পরলোকে গেছেন, সেখানেই আছেন। এই বিশ্বাসে মানুষ তার সদ্যোমৃত প্রিয়জনের শবদাহকালে যমের কাছে প্রার্থনা করে বলত, এ লোকটি সেই জগতের পথঘাট চেনে না, তুমি এক সঙ্গে করে নিয়ে যাও, অন্যদের সঙ্গে বৃক্ষতলে একে নিয়ে আনন্দ কোরো। মৃতের আত্মীয়দের স্বাভাবিক উদ্বেগ ও মৃতের কুশল, কল্যাণ ও আনন্দবিধানের ব্যবস্থা করার জন্যে অতি স্বাভাবিক উৎকণ্ঠা এই ধরনের কথার মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে। আমাদের চেনা জগৎ থেকে এ চলে গেছে, এখন এর সুখদুঃখ মঙ্গল-অমঙ্গলের ওপরে আমাদের কোনও প্রভাব থাকবে না, তাই আমাদের রইল শুধু উৎকণ্ঠা। এটা যেমন অনিবার্য ভাবে স্বাভাবিক, তেমনই মধুর। ধরে নেওয়া যেতে পারে আর্যরা তার আগের কয়েক শতাব্দী ধরেই এ ভাবেই মৃতদেহের সৎকার করত এবং সে সময়ে এ ধরনের প্রার্থনাই উচ্চারিত হত; অতএব মৃত্যুর পরে মানুষ যমের তত্ত্বাবধানে কোনও এক জগতে পূর্বের মৃতদের সঙ্গে ভালই থাকে, যম এবং পূর্ববর্তী মৃতরা ‘সধমাদং মদন্তি— এক সঙ্গে আনন্দ করে।’ মনে রাখতে হবে, যম তখনও মৃত্যুর দেবতা নন, মৃতদের দেবতা। তাঁকে পরলোকে স্থাপন করায় জীবিত মানুষের বিশেষ স্বার্থ ছিল। মৃত্যুকে মানুষের কোনও প্রাচীন সভ্যতাই জীবনের একান্ত সমাপ্তি রূপে মেনে নিতে যে পারেনি, তার একটা বড় কারণ হল, জীবিত আত্মীয়রা মৃতকে স্বপ্ন দেখত এবং মনে করত যাকে দেখা যাচ্ছে সে নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও আছে। কোথায় থাকবে তার সন্ধান তারা জানত না, কিন্তু স্বাভাবিক ভাবেই তারা মনে করত প্রথম মৃত মানুষ যম যেখানে আছেন সদ্যোমৃতও সেখানেই থাকবে। তাই দশম মণ্ডলের যম-সূক্তগুলিতে ওই আকুতি— এ ওখানে যাচ্ছে কিন্তু পথঘাট চেনে না, একে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাও, সুখে রাখো।
যজুর্বেদেরই অন্তর্গত শতপথ ব্রাহ্মণে পড়ি, ‘এই যে পথগুলি বিপৎসংকুল, যেগুলি আকাশ ও পৃথিবীর মাঝখানে— এতে হ বা আধ্বানো বারণা য ইমেহন্তরেণ দ্যাবাপৃথিবী।’ (২:৩:৪:৩৭) এই ধরনের কথা কৌষীতকি ব্রাহ্মণ (৮:২)-এও আছে। যখন সদ্যোমৃতের অন্ত্যেষ্টির সময়ে তাকে লোকান্তরে যেতে বলা হয় তখন মানুষ কল্পনা করে যে, সে বা তার আত্মা পৃথিবী ছেড়ে অন্তরিক্ষ-পথে পরলোকে যাবে। অন্যত্র বলা আছে দেবলোক মর্ত্যলোক থেকে ‘অন্তর্হিত’ অর্থাৎ আড়ালে— অদৃশ্য। হয়তো সেই কারণেই মানুষ ভেবেছিল পরলোকে যাওয়ার পথটি আকাশ ও পৃথিবীর মাঝখানের অন্তরিক্ষ-পথ ধরেই। কিন্তু শাস্ত্ৰ বলছে, সে পথ বিপৎসংকুল; এ বিপদ যে ঠিক কী তা কোথাও বলা নেই। তবে তখনকার শাস্ত্র, ঋগ্বেদ ও অথর্ববেদ থেকে আমরা জানতে পারি, নানা নামের ও গোত্রের মন্দ আত্মা, অপদেবতা ও প্রেতাত্মাতে তখন মানুষের বিশ্বাস ছিল, এবং এ বিশ্বাসও ছিল যে এরা অন্তরিক্ষবাসী। অতএব ইললোক থেকে পরলোকে যাওয়ার যে পথ অন্তরিক্ষ দিয়ে সেগুলি তো প্রেত, যক্ষ, রক্ষ, গন্ধর্ব, কিন্নরদের জগতে। তারা মানুষের ক্ষতিই করে এমন কথা প্রায় সর্বত্রই শোনা যায়। তা হলে মৃত্যুর পরের ওই বিপৎসংকুল পথ পেরোনোটাও অনিশ্চয়ে ও আশঙ্কায় আকীর্ণ।
যমলোকে ঢুকলে যম না হয় পথ দেখিয়ে পূর্ব মৃতদের সঙ্গে আরামে থাকার ব্যবস্থা করে দেবে, কিন্তু ঢোকার পথেই তো নানা বাধা। যমের দুটি ভয়ংকর কুকুর আছে, নাম শ্যাম ও শবল। কোনও মৃতের আত্মা যমলোকে ঢুকতে এলেই এরা তাকে ছিঁড়ে খাওয়ার চেষ্টা করে এমন আশঙ্কা ছিল বলে, একটা গরুকে মেরে চিরে ফেলে, মৃতদেহের ওপরে উপুড় করে শুইয়ে তার দুই হাতে মরা গরুর নাড়িভুঁড়িগুলো দিয়ে দিতে হবে। শ্যাম ও শবল যখন ওই নাড়িভুঁড়িগুলো খেতে থাকবে ততক্ষণে আত্মাটি ঢুকে যাবে যমলোকে। সেখানে যে মৃত গরুটি পার করে দেয়, শাস্ত্রে তার নাম অনুস্তরণী গৌঃ। শ্যাম ও শবল, মন্দ আত্মা, রোগব্যাধির সঙ্গে সম্পৃক্ত অশুভ শক্তি, প্রেতাত্মা, তথা যক্ষ, রক্ষ, গন্ধর্ব, কিন্নর এত সব বিপদে আচ্ছন্ন পরলোকে যাওয়ার পথ। কাজেই পরলোকে পৌঁছোনোটা বেশ বিপজ্জনক এবং অনিশ্চিত। মানুষের জ্ঞানবুদ্ধিকল্পনায় সে পথ আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যবর্তী নানা আত্মার রাজত্বের অঞ্চল অন্তরিক্ষ পেরিয়ে। যেহেতু ওই পথে পরলোকে পৌঁছে সেখান থেকে আবার ফিরে এসে কেউ কোনও দিন পথ এবং গন্তব্যস্থল সম্পর্কে যথাযথ হদিস দেয়নি, তাই সমস্ত ব্যাপারটাই সংশয়ে আকীর্ণ। কে তার যথার্থ খবর জানে? অর্থাৎ কেউই জানে না। জীবন নিয়েই যেখানে নানা অনুত্তরিত প্রশ্ন সেখানে পরলোক পর্যন্ত যাওয়ার পথ মানুষের অজ্ঞানের অন্ধকারে আবৃত, অতএব নিরতিশয় বিপৎসংকুল। কাজেই মৃতের জন্য জীবিতের প্রার্থনা, ‘হে যম, তুমি আগে সেখানে গিয়েছ, এদের পথঘাট চিনিয়ে দিয়ো, যত্ন কোরো, দেখো এরা যেন আনন্দে থাকে।’ যার প্রিয়জনের মৃত্যু ঘটেছে তার পক্ষে এমন প্রার্থনা করা তো খুবই স্বাভাবিক। আর এই ধরনের প্রার্থনা করতে করতে ধীরে ধীরে একটি বিশ্বাস লোকের মনে রূপ নিচ্ছিল: মৃত্যুর পরে মানুষ স্থূলদেহে না হলেও সূক্ষ্মদেহে— যে-দেহে সে স্বপ্নে দেখা দেয়— কোথাও না কোথাও থাকে; সেখানে যম থাকেন এবং মৃতদের সূক্ষ্ম দেহে অবস্থানের সুখস্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করেন। এই ভাবে প্রতি অন্ত্যেষ্টিতে উচ্চারিত প্রার্থনার মধ্যে দিয়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম পরম্পরাগত ইচ্ছাপূরক কল্পনায় মৃত্যুর পরে থাকবার একটি জগৎ নির্মাণ করে নিয়েছিল।
এর বাইরে বেদের অন্যত্র মৃত্যুর পরবর্তী অবস্থান একটি অন্ধকার নিরানন্দ লোকে, এমন কথাও পাওয়া যায়। মৃত্যুর পরে এ জীবনের ভোগসুখ কিছু থাকে না, এমন একটি বিশ্বাস ছিল বলেই বেদে বারংবার প্রার্থনা করা হয়েছে: ‘জ্যোক্ পশ্যেম সূর্যমুচ্চরন্তম্— দীর্ঘকাল ধরে যেন সূর্যকে উদিত হতে দেখি’; অথবা, ‘পশ্যেম শরদঃ শতং, জীবেম শরদঃ শতং, সুখিনঃ সাম শরদঃ শতম্— একশো শরৎ (= বৎসর) দেখব, একশো শরৎ বাঁচব, একশো শরৎ সুখী হব।’ তখন মানুষ বিশ্বাস করত ‘শতায়র্বে মনুষ্যঃ’— মানুষের পরমায়ু হল একশো বছর, এবং এই একশো বছর পৃথিবীতে আনন্দে, সুস্থ, সমৃদ্ধ ভাবে বাঁচারই আকাঙ্ক্ষা ছিল তার। এ আকাঙ্ক্ষার পশ্চাতে ছিল একটি আতঙ্ক: মৃত্যুর পরে তো সে আবছা অন্ধকারে দুঃখময় স্থানে থাকে। তাই মৃতব্যক্তির জীবিত আত্মীয়রা মৃতের জন্যে যমের অধীনে সুখে থাকবার একটি কল্পস্বর্গ নির্মাণ করেছিল, যাতে জীবিতরা স্বস্তি পায় এই ভেবে যে, যে সব সুখ আমরা এখানে পাচ্ছি, ওরাও অনুরূপ একটি সুখের জগতে বেঁচে থাকে। এমন চিন্তায় প্রিয়জনের মৃত্যুর পরে ইহলোকের সুখভোগ করতে কোনও দ্বিধা বা কুণ্ঠা জাগে না। না হলে অনুক্ষণ একটি কুণ্ঠা ও অপরাধবোধ এখানকার সমস্ত ভোগসুখকে ক্লিষ্ট করবে।
কিন্তু প্রত্যক্ষের বড় প্রমাণ নেই— তাই ওই জগৎটার অস্তিত্ব সম্বন্ধে মানুষের মনে কোনও নিশ্চয়তা আসে না। তার আরও একটা বড় কারণ হল, প্রত্যেক মানুষই তো মরবে এবং তার মরণের পরে তার কী হবে তা নিয়ে যা জল্পনা সে তো সম্পূর্ণ ভাবে তার ইচ্ছাপূরক কল্পনারই সৃষ্টি। কে কবে পরলোকে গিয়ে ফিরে এসে সাক্ষ্য দিয়েছে যে সত্যিই তেমন একটা জগৎ আছে, যেটা সুখের, যেখানে মৃত্যুর পরে মানুষ ভালই থাকে? যদি সবটাই নিছক কল্পনানির্ভর হয়, যদি সত্যিই তেমন কোনও জগৎ না থাকে? এই বিষম মর্মান্তিক আশঙ্কার প্রকাশ তৈত্তিরীয় সংহিতার ওই উক্তিতে: ‘কে তা জানে যে পরলোকে কিছু আছে কি না আছে?’ কেউ তো প্রত্যক্ষ দেখেনি, মানুষ মৃত্যুর পরে কোনও আকারেই, কোথাওই থাকে কি না। মরণোত্তর ইহলোকের ওপারের আর-এক ভুবনের অস্তিত্বের কোনও প্রমাণ যেখানে নেই, সেখানে এই-যে সংশয় কেউ যা দেখেনি কেউ যা জানে না, যেটার একমাত্র ভিত্তি অনুমান, সেটা যদি সত্যিই না থাকে তা হলে? তা হলে মৃত্যুই অন্তিম পরিণাম, ইহলোকই একমাত্র লোক— মৃত্যুর পরে, ইহজগতের পরে আর কিছুই নেই। ওই বিরাট কালো শূন্য গহ্বরটার মুখোমুখি হওয়াটা একটা সাংঘাতিক অভিজ্ঞতা। এই মারাত্মক সংশয়ের প্রথম উচ্চারণ তৈত্তিরীয় সংহিতায়, পরে আরও আছে। কিন্তু এই উক্তিটি খুব-একটি সাহসী উক্তি এবং নিশ্চয়ই এটি আরও অনেকের গভীর ও মর্মান্তিক সংশয়ের উচ্চারণ। কল্পনায় সযত্ন-রচিত একটি আরামপ্রদ পরলোক থাকলে এবং থাকার নিশ্চিত প্রমাণ মিললে কী আনন্দেরই না হত! কিন্তু প্রমাণ যেখানে নেই সেখানে না থাকার সম্ভাবনাটাকে তো উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অতএব বহু মানুষের মর্মন্তুদ সংশয় উচ্চারণ করার মধ্যে একটা বুদ্ধির স্বচ্ছতা ও প্রত্যয়ের সীমাবোধের সচেতনতার পরিচয় আছে। প্রত্যয় নিশ্চিত হতে গেলে প্রত্যক্ষ জ্ঞান বা তদনুরূপ সিদ্ধ অনুমান প্রয়োজন। যেখানে সেগুলির একান্ত অভাব সেখানে প্রত্যক্ষ তো নয়ই, গ্রহণযোগ্য অনুমান বলেও সিদ্ধ হয় না। তা হলে বাকি থাকে সংশয়। মরণের পরে অতলান্তিক ওই গহ্বরের শূন্যতা ও অন্ধকারকেই প্রকারান্তরে স্বীকার করা হচ্ছে এই সংশয়ের উচ্চারণে। অন্যান্য সংশয়ের তুলনায় ওই সংশয়টির গুরুত্ব বেশি, কারণ এর সমস্তটাই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের ওপারে। ‘সংশয় ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের সমস্ত অনুসন্ধিৎসা ও আবিষ্কারের সঙ্গেই অন্বিত।’[২] সহজেই লক্ষ্য করা যায়, সূর্য, চন্দ্র, আকাশ, পৃথিবী, অগ্নি এ সব নিয়ে কোনও সংশয় নেই, কারণ এগুলো প্রত্যক্ষ। যা সরাসরি প্রত্যক্ষ নয়, যেমন বীজ থেকে গাছ হওয়া, ভ্রুণ থেকে শিশুর বা শাবকের জন্ম, খাদ্য থেকে পুষ্টি, অনাহারে-রোগে দুর্বলতা, এ-ও প্রত্যক্ষ এবং সহজ অনুমানের ভিত্তিতে সিদ্ধ। মৃত্যু প্রত্যক্ষ, অতএব অনস্বীকার্য, সর্বজনীনও বটে, এ নিয়ে কোনও সংশয়ের অবকাশ নেই। সংশয় আছে মৃত্যুর পরের অবস্থা নিয়ে।
অনেকে বলেছেন, এই আমাদের পৃথিবী থেকে ভাল ভাবে আসা উচিত (স + এতব্যম্ = স্বেতব্যম্)। সে-কথা মনে রেখেই ঋষি বলছেন, আসা তো উচিত কিন্তু আসব কোথায়? কেউ কি জানে, মৃত্যুর পরে যাওয়ার কোনও জায়গা আছে কি না। প্রিয়জনের মৃত্যুর পটভূমিকায় আমরা তার অদৃশ্য ভবিষ্যতের জন্যে যে একটি নিটোল কল্পনা করে নিয়ে যম এবং পূর্ব মৃতদের সঙ্গে সুখে থাকবার জন্যে তাকে রওনা করিয়ে দিই, মুখে আশ্বাসবাণী উচ্চারণ করে, তার পর? যদি সত্যিই তার যাওয়ার কোনও জায়গা না থাকে? তা কেউ জানে না, কেউ দেখেনি, দৃঢ় ভাবে কেউ বলতে পারে না তেমন কোনও জগৎ মৃত্যুর ওপারে আছে কি না। এ সংশয় উচ্চারণ করায় সাহস আছে। যে বিশ্বাসটুকু— ধারণা, কল্পনা যাই হোক— অবলম্বন করে মানুষ প্রিয়জনের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পাদন করে; নিজেকে বলে— ‘ওর ভবিষ্যতের একটা সুখের, স্বস্তির নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা করে দিলাম’; সেই বিশ্বাসের ভূমিতেই এই সংশয়। এ কথা উচ্চারণ করা মানে যারা পূর্বে প্রিয়জনের অন্ত্যেষ্টি সম্পাদন করেছে, যারা এখন করছে, পরে যারা করবে তাদের সকলেরই পায়ের তলার মাটি টলিয়ে দেওয়া। কাজটি এক অর্থে নিষ্ঠুর, অমানবিক, তবু যিনি এমন উচ্চারণ করছেন এ তাঁর একক উপলব্ধি নয়; তাঁর পূর্বের ও তাঁর সমকালীন বহু মানুষের মনে এ সংশয় উদিত হয়েছে। পরে যারা মৃত আত্মীয়দের অগ্নিকৃত্য করবে ওই সান্ত্বনাবাণী উচ্চারণ করে, অনিবার্য ভাবে তাদেরও মনে ওই সংশয় জাগবে। এরা স্থানে কালে ছড়িয়ে, এবং সংখ্যায় ভারী। ফলে তিনি এ সংশয় উচ্চারণ করেছেন, তিনি অতীতের সমকালের এবং আগামীকালের বহু মানুষের সংশয় উচ্চারণ করেছেন— না করে উপায় ছিল না। কেউ যা দেখেনি, যে জগতের অস্তিত্বের কোনও নিশ্চিত প্রমাণ নেই, তেমন একটা জগতে প্রিয়জনকে পাঠানো হচ্ছে, তা কি এই মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে? তাতে তো প্রিয়জনের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়। পরে যারা এসে এই সব কথা বলে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পাদন করবে তারাও তা হলে অনিশ্চিতকে নিশ্চিতের রূপে আবৃত করে আত্মীয়বন্ধুদের সঙ্গে শঠতা করবে?
মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় প্রশ্নের কেন্দ্রে মৃত্যু। অন্যান্য সামাজিক অভাব মেটানো যায়, অসুবিধার প্রতিকার হয়, অভাব ঘোচে, রোগও সারে; কিন্তু মৃত্যুই একমাত্র যা চূড়ান্ত, নিষ্প্রতিকার, একান্ত। কাজেই মরণোত্তর অবস্থা নিয়ে যে-সংশয় তার আক্রমণ অমোঘ। তাই তখনকার সমাজ এই সংশয়কে ভাষায় উচ্চারণ করেছে এবং ঋষিরা সে-উচ্চারণকে বেদের মধ্যে সংরক্ষণও করেছেন। মধুর সান্ত্বনা ও ইচ্ছাপূরক আশ্বাসবাণীর মধ্যে যদি যথার্থ সত্য না থাকে, তা হলে প্রকাণ্ড যে সংশয়ের কালো পর্দাটা চোখের সামনে দুলতে থাকে, তা জীবনমরণকে আচ্ছন্ন করে একান্ত হয়ে ওঠে। কোনও নিশ্চয় বোধ দিয়ে একে খণ্ডন করা যায় না, তাই এ উচ্চারণ এত তাৎপর্যপূর্ণ, এত মারাত্মক ভাবে ভয়াবহ এবং এত অনুত্তরণীয়। বেদের ঋষিদের সততার ও সাহসিকতার প্রমাণ তৈত্তিরীয় সংহিতার এ অংশ। বেদকে এক ভাবে এটি মহিমান্বিতও করেছে, কারণ আজও এ সংশয়ের কোনও সমাধান মেলেনি, এইখানে দাঁড়িয়ে আজকের মানুষ একই রকম অসহায় বোধ করে।
জীবনটাই প্রত্যক্ষ, মৃত্যুর পরের সবটাই অনুমাননির্ভর। সেই জন্যে তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণে বলে, ‘মানুষের উচিত প্রতি মাসে যথাবিধি যজ্ঞ করে যাওয়া, কারণ মানুষের কথা কেই-বা জানে?’[৩] জীবনে যতটুকু তা করা যেতে পারে, তার পরে সবটাই দুয়ে, ‘কে-ই বা জানে?’ অর্থাৎ কেউই জানে না। মৃত্যুর পরে যজ্ঞ করা যায় কি না সেটা যেহেতু অনিশ্চিত, তাই ইহজীবনে নিয়ম মেনে মাসে মাসে যজ্ঞ করা উচিত। হয়তো তার ফল সুদূরবিস্তৃত। তবে সেটা তো ঘোর অনিশ্চিত; কে জানে মানুষের জীবন সম্বন্ধে শেষ কথাটা? এই অনিশ্চয়ই বহু সংশয়ের মূলে।
***
১. মনুষ্যল্লোকান্নাস্নাল্লোকাৎ স্বেতব্যমিত্যাহুঃ কো হি তদ্বেদ যদ্যমুষ্মিন্ লোকেঽস্তি বা ন বেতি। (৬:১:১:১)
২. ‘Doubt is inseparable from all inquiry into and discoveries about the empirical world.’— Macmillan Encyclopaedia of Religion. p. 427
৩. তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ (১:৮:৪:৩); এই কথাই পড়ি শতপথ ব্রাহ্মণেও (৫:২:২)