০৩. দীননাথবাবুর ভাইপো

॥ ৩ ॥

‘কাকা একটু বেরিয়েছেন। সাতটা নাগাত ফিরবেন।’

ইনিই তাহলে দীননাথবাবুর ভাইপো।

গ্র্যান্ড হোটেল থেকে বেরিয়ে নিউ এম্পায়ারের সামনের দোকান থেকে মিঠে পান কিনে আমরা সোজা চলে এসেছি রডন স্ট্রীটে দীননাথবাবুর বাড়িতে। কারণটা হল আজকের ঘটনার রিপোর্ট দেওয়া। বাড়ির গেটের ভিতর দিয়ে ঢুকে বাঁ দিকে পর পর চারটে গ্যারাজ, তার তিনটে খালি, আর একটাতে রয়েছে আরেকটা অদ্ভুত ধরনের পুরনো গাড়ি। ফেলুদা বলল ওটা নাকি ইটালিয়ান গাড়ি, নাম লাগণ্ডা।

দারোয়ানের হাতে কার্ড দেবার এক মিনিটের মধ্যেই এই ইয়াং ভদ্রলোকটি বেরিয়ে এলেন। বয়স মনে হয় ত্রিশের নীচে, মাঝারি হাইট, দীননাথবাবুর মতোই ফরসা রং, উস্‌কোখুস্‌কো চুলের পিছন দিক বেশ লম্বা, আর কানের দু’পাশে লম্বা ঝুলপি, যে রকম ঝুলপি আজকাল অনেকেই রাখছে। ভদ্রলোক একদৃষ্টে ফেলুদার দিকে চেয়ে আছেন।

ফেলুদা বলল, ‘আমরা একটু বসতে পারি কি? একটু দরকার ছিল ওঁর সঙ্গে।’

‘আসুন…’

ভদ্রলোক আমাদের ভিতরে বৈঠকখানায় নিয়ে গিয়ে বসালেন। দেয়ালে আর মেঝেতে বাঘ ভাল্লুকের ছালের ছড়াছড়ি, সামনের দরজার উপরে একটা প্রকাণ্ড বাইসনের মাথা। দীননাথবাবুর জ্যাঠামশাইও কি তাহলে শিকারী ছিলেন? হয়ত শিকারের সূত্রেই শম্ভুচরণের সঙ্গে এত বন্ধুত্ব।

‘কাকা বিকেলে একটু বেড়াতে বেরোন। এইবার আসবেন।’

ভদ্রলোকের গলার স্বর একটু বেশি রকম পাতলা। একেই কি দীননাথবাবু ধমীজার বাক্সটা দিয়েছিলেন?

‘আপনিই কি ফেলু মিত্তির—যিনি সোনার কেল্লার রহস্য সলভ্‌ করেছিলেন?’ ভদ্রলোক জিগ্যেস করলেন।

ফেলুদা হ্যাঁ বলে বেশ মেজাজের সঙ্গে পায়ের উপর পা তুলে দিয়ে একটু পিছন দিকে হেলে আরাম করে বসল। আমরা কেন জানি ভদ্রলোকের মুখটা চেনা চেনা লাগছিল, যদিও কারণটা বুঝতে পারছিলাম না। শেষটায় ভাবলাম একটা চান্স নিয়ে দেখতে ক্ষতি কী? জিগ্যেস করলাম—

‘আপনি কি কোনো ফিল্মে অ্যাকটিং করেছেন?’

ভদ্রলোক একটা গলা খাক্‌রানি দিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ। “অশরীরী”। থ্রিলার। ভিলেনের পার্ট করেছি। অবিশ্যি ছবিটা এখনো রিলিজ হয়নি।’

‘কী নাম বলুন তো আপনার?’

‘আসল নাম প্রবীর লাহিড়ী। ফিল্মের নাম অমরকুমার।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ—অমরকুমার—মনে পড়েছে।’

কোনো একটা ফিল্মের পত্রিকায় ভদ্রলোকের ছবি দেখেছি। এত পাতলা গলার স্বরে কিরকম ভিলেন হবে কে জানে!

‘অ্যাকটিং কি আপনার পেশা?’

এবার প্রশ্নটা ফেলুদার। ভদ্রলোক চেয়ারে না বসে কেন যে দাঁড়িয়ে আছেন জানি না।

‘কাকার প্লাস্টিকের কারখানায় বসতে হয়। কিন্তু আমার আসল ঝোঁক অ্যাকটিং-এর দিকে।’

‘কাকা কী বলেন?’

‘কাকার…উৎসাহ নেই।’

‘কেন?’

‘কাকা ওইরকমই।’

অমরকুমারের মুখ গোমড়া। বুঝলাম কাকার সঙ্গে ফিল্মের ব্যাপারে কথা কাটাকাটি হয়েছে।

‘একটা কথা আমার জিগ্যেস করার আছে।’ লোকটার মধ্যে একটা রাগী রাগী ভাব আছে বলেই ফেলুদা বোধহয় এত নরম করে কথা বলছে।

অমরকুমার বললেন, ‘আপনার কথার জবাব দিতে আমার আপত্তি নেই, কিন্তু কাকার কন্‌স্ট্যান্ট খোঁচানোটা…’

‘আপনার কাকা আপনাকে একটা এয়ার ইন্ডিয়ার ব্যাগ দিয়েছিলেন কি?’

‘হ্যাঁ। কিন্তু সেটা দেখছি কে যেন ঝেড়ে দিয়েছে। আমাদের একটা নতুন চাকর—’

ফেলুদা হেসে হাত তুলে প্রবীরবাবুকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘না, কোনো নতুন চাকর আপনার ব্যাগ ঝেড়ে দেয়নি। ওটা রয়েছে আমার কাছে।’

‘আপনার কাছে?’ প্রবীরবাবু, অবাক।

‘হ্যাঁ। আপনার কাকাই হঠাৎ ডিসাইড করেন ওটা যার ব্যাগ তাকে ফেরত দেওয়া উচিত। সে কাজের ভারটা আমাকে দিয়েছেন। এখন কথা হচ্ছে, ওর ভেতর থেকে আপনি কোনো জিনিস বার করে নিয়েছেন কি?’

‘ন্যাচারেলি। এই তো—’

প্রবীরবাবু পকেট থেকে একটা ডট পেন বার করে দেখালেন। তারপর বললেন, ‘ব্লেড আর শেভিং ক্রীমটাও ইউজ করার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু সে তো চান্সই হল না।’

‘কিন্তু বুঝতেই পারছেন প্রবীরবাবু, বাক্সটা ফেরত দিতে হলে সব জিনিসপত্তর সমেত ফেরত দিতে হবে তো—একেবারে ইনট্যাক্ট!’

‘ন্যাচারেলি!’

প্রবীরবাবু ডট পেনটা ফেলুদার দিকে এগিয়ে দিলেন। ফেলুদা ধন্যবাদ দিয়ে সেটা পকেটে পুরে নিল। কিন্তু কাকার উপরে প্রবীরবাবুর রাগটা এখনো পড়েনি। বললেন, ‘জিনিসটা যখন দিয়েই দিয়েছিলেন তখন সেটা নেবার সময় একবার—’

প্রবীরবাবুর কথা শেষ হল না। দীননাথের গাড়ির গম্ভীর হর্নের আওয়াজ পাওয়া মাত্র ফিল্মের ভিলেন অমরকুমার সুড়সুড় করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

‘এহে—আপনারা এসে বসে আছেন?’

দীননাথবাবু ঘরে ঢুকে অত্যন্ত লজ্জিত ভাবে ঘাড় বেঁকিয়ে হাত দুটো নমস্কারের ভঙ্গিতে জড়ো করে আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। আমরা দুজনেই উঠে দাঁড়িয়েছিলাম, ভদ্রলোক ব্যস্তভাবে বললেন, ‘বসুন বসুন—প্লীজ।…আপনাদের অসময়ে চা খেতে আপত্তি নেই নিশ্চয়ই। ওরে—কে আছিস—’

চাকরকে চায়ের অর্ডার দিয়ে ভদ্রলোক আমাদের পাশের সোফায় বসে বললেন, ‘বলুন, কী খবর।’

ফেলুদা বলল, ‘আপনার ব্যাগ বদল হয়েছে আপেলওয়ালার সঙ্গে—নাম জি সি ধমীজা।’

দীননাথবাবু চোখ গোল গোল করে বললেন, ‘আপনি এর মধ্যে এই একদিনেই নামটা বের করে ফেললেন? একি ম্যাজিক নাকি মশাই!’

ফেলুদা তার ছোট্ট একপেশে হাসিটা হেসে তার রিপোর্ট দিয়ে চলল, ‘ভদ্রলোক থাকেন সিমলায়, ঠিকানাও জোগাড় হয়েছে। গ্র্যাণ্ড হোটেলে এসে ছিলেন, তিনদিন থাকার কথা ছিল, দুদিন থেকে চলে গেছেন।’

‘চলে গেছেন?’ দীননাথবাবু যেন একটু হতাশভাবেই প্রশ্নটা করলেন।

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’ হোটেল থেকে চলে গেছেন, তবে সিমলা গেছেন কিনা বলতে পারি না। সেটা অবিশ্যি ওঁর সিমলার ঠিকানায় একটা টেলিগ্রাম করলেই জানতে পারবেন।’

দীননাথবাবু কিছুক্ষণ চিন্তিতভাবে চুপ করে থেকে বললেন, ‘আপনি এক কাজ করনে। টেলিগ্রাম অবিশ্যি আমি আজই করছি, কিন্তু ধরুন জানতে পারলাম তিনি সিমলা ফিরেছেন এবং তাঁর কাছে আমার বাক্সটা রয়েছে—তাহলেই তো আর কাজটা ফুরিয়ে যাচ্ছে না। তাঁর ব্যাগটা তো তাঁকে ফেরত দিতে হবে।’

‘হ্যাঁ—হ্যাঁ—তা তো বটেই। তাছাড়া ওই ভ্রমণকাহিনীটা সম্পর্কে আমার একটা কৌতূহলও রয়েছে, কাজেই আপনার বাক্সটাও ফেরত আনতে হবে।’

‘ভেরি গুড। আমার প্রস্তাব হচ্ছে—আমি আপনাকে সব খরচ দিচ্ছি, আপনি চট্ করে সিমলাটা ঘুরে আসুন। আমি বলি কি, আপনার এই ভাইটিকেও নিয়ে যান। সিমলায় এ সময় বরফ—জানেন তো? হাতের কাছে বরফ দেখেছ কখনো খোকা?’

অন্য সময় হলে খোকা বলাতে আমার রাগই হতো, কিন্তু সিমলায় যাবার চান্স আছে বুঝতে পেরে ওটা আর গায়েই করলাম না। আমার বুকের ভেতর অলরেডি ঘোড়দৌড় শুরু হয়ে গিয়েছে।

ফেলুদার পরের কথাটা শুনে কিন্তু আমার বেশ বিরক্তই লাগল। ও বলল, ‘একটা জিনিস ভেবে দেখুন মিস্টার লাহিড়ী—আপনি কিন্তু ইচ্ছে করলে এখন যে-কোনো লোককেই সিমলা পাঠিয়ে দিতে পারেন। ওঁর বাক্সটা ফেরত দিয়ে আপনারটা নিয়ে আসা—এ ছাড়া তো কোনো কাজ নেই। কাজেই—’

‘না না না’, লাহিড়ী মশাই বেশ জোরের সঙ্গে প্রতিবাদ করলেন। ‘আপনার মতো রিলায়েব্‌ল লোক আর পাচ্ছি কোথায়? আর শুরুটা যখন আপনাকে দিয়ে হয়েছে, শেষটাও আপনিই করুন।’

‘কেন, আপনার ভাইপো—’

দীননাথবাবু মুষড়ে পড়লেন। ‘ওর কথা আর বলবেন না। ওর দায়িত্বজ্ঞানটা বড়ই কম। কোথায় যেন এক বাংলা সিনেমায় নাম লিখিয়ে অ্যাকটিং করে এসেছে। ভাবুন তো দিকি! ওর কোনো মতিস্থির নেই। না না—ও ভাইপো-টাইপো দিয়ে হবে না। আপনিই যান। আমার চেনা ট্র্যাভেল এজেন্ট আছে—আপনাদের টিকিটপত্তর সব করে দেবে। দিল্লী পর্যন্ত প্লেন, তারপর ট্রেন। যান—গিয়ে কাজটা সেরে, দিন চারেক থেকে আরাম করে আসুন। আপনার মতো গুণী লোককে এই সুযোগটুকু দিতে পারলে আমারই আনন্দ। এই কয়েক ঘণ্টার মধ্যে যা করলেন—সত্যিই রিমার্কেবল্।’

চা এসে গিয়েছিল, আর তার সঙ্গে কিছু খাবার জিনিসও। ফেলুদা এক টুকরো চকোলেট কেক তুলে নিয়ে বলল, ‘একটা জিনিস দেখার ভারী কৌতূহল হচ্ছে। যে নেপালী বাক্সটার মধ্যে লেখাটা পেয়েছিলেন, সেই বাক্সটা। হাতের কাছে আছে কি?’

‘সে তো খুব সহজ। আমি বলে দিচ্ছি।’

যে চাকর চা এনেছিল, সে-ই নেপালী বাক্সটা এনে দিল। এক হাত লম্বা, ইঞ্চি দশেক উঁচু প্রায়-চৌকো কাঠের বাক্সের গায়ে তামার পাত আর লাল-নীল-হলদে পাথরের কাজ করা। ডালাটা খুলতেই একটা গন্ধ পেলাম যেটা আজই আরেকবার পেয়েছি, এই কিছুক্ষণ আগেই। নরেশ পাকড়াশীর আপিসঘরের ধুলো, পুরনো ফার্নিচার আর পুরনো পর্দার কাপড় মিলিয়ে ঠিক এই একই গন্ধ।

দীননাথবাবু বললেন, ‘এই যে দুটো তাক দেখছেন, এর উপরটাতেই ছিল খাতাটা—একটা নেপালী কাগজের মোড়কের ভেতর।’

‘বাক্স যে দেখছি জিনিসে ঠাসা’, ফেলুদা মন্তব্য করল।

দীননাথবাবু হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, একটা ছোটখাটো কিউরিও শপ বলতে পারেন। যা নোংরা, ঘেঁটে দেখার প্রবৃত্তি হয়নি আমার।’

ফেলুদা উপরের তাকটা বাইরে বার করে ভিতরের জিনিসগুলো দেখছিল। পাথরের মালা, তামা ও পিতলের কাজ করা চাকতি, রোল করা তেলচিটে তাখো, কয়েকটা অচেনা ওষুধের খালি বোতল, দুটো মোমবাতি, একটা ছোট ঘণ্টা, একটা কিসের জানি হাড়, ছোট ছোট দু-তিনটে বাটি, কিছু শিকড় বাকল জাতীয় জিনিস, একটা শুকনো ফুল—সব মিলিয়ে সত্যিই একটা কিউরিওর দোকান।

ফেলুদা বলল, ‘এ বাক্স আপনার জ্যাঠামশাইয়ের কি?’

‘ওঁর সঙ্গেই তো এসেছিল, কাজেই…’

‘কাঠমুণ্ডু থেকে কবে আসেন আপনার জ্যাঠামশাই?’

‘টোয়েন্টিথ্রিতে। সে বছরই মারা যান। আমার বয়স তখন সাত।’

‘ভেরি ইন্টারেস্টিং’ বলে চায়ে চুমুক দিয়ে ফেলুদা উঠে পড়ে বলল, ‘আপনি যখন বলছেন তখন আমরা সিমলা যাওয়াই স্থির করলাম। কাল হবে না, কারণ আমাদের দুজনেরই গরম কাপড় লন্ড্রি থেকে আনতে হবে। পরশু কালকা মেলে বেরোন যেতে পারে। তবে আপনি ধমীজাকে কাল টেলিগ্রাম করতে ভুলবেন না।’

প্রায় সাড়ে আটটার সময় দীননাথবাবুর বাড়ি থেকে ফিরে এসে বৈঠকখানায় ঢুকেই দেখি জটায়ু বসে আছেন, তাঁর হাতে একটা ব্রাউন কাগজের প্যাকেট। আমাদের দেখেই একগাল হেসে বললেন, ‘বায়স্কোপ দেখে ফিরলেন বুঝি?’

1 Comment
Collapse Comments

চমৎকার

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *