॥ ১ ॥
ক্যাপ্টেন স্কটের মেরু অভিযানের বিষয়ে একটা দারুণ লোমখাড়াকরা বই এই সবে শেষ করেছি, আর তার এত অল্প দিনের মধ্যেই যে বরফের দেশে গিয়ে পড়তে হবে সেটা ভাবতেই পারিনি। অবিশ্যি বরফের দেশ বলতে কেউ যেন আবার নর্থ পোল সাউথ পোল ভেবে না বসে। ওসব দেশে কোনো মামলার তদন্ত বা রহস্যের সমাধান করতে ফেলুদাকে কোনোদিন যেতে হবে বলে মনে হয় না। আমরা যেখানে গিয়েছিলাম সেটা আমাদেরই দেশের ভিতর; কিন্তু যে সময়টায় গিয়েছিলাম তখন সেখানে বরফ, আর সে বরফ আকাশ থেকে মিহি তুলোর মতো ভাসতে ভাসতে নিচে নেমে এসে মাটিতে পুরু হয়ে জমে, আর রোদ্দুরে সে বরফের দিকে চাইলে চোখ ঝলসে যায়, আর সে বরফ মাটি থেকে মুঠো করে তুলে নিয়ে বল পাকিয়ে ছোঁড়া যায়।
আমাদের এই অ্যাডভেঞ্চারের শুরু হয় গত মার্চ মাসের এক বিষ্যুদবারের সকালে। ফেলুদার এখন গোয়েন্দা হিসাবে বেশ নাম হয়েছে, তাই ওর কাছে মক্কেলও আসে মাঝে মাঝে। তবে ভালো কেস না হলে ও নেয় না। ভালো মানে যাতে ওর আশ্চর্য বুদ্ধিটা শানিয়ে নেওয়ার সুযোগ হয় এমন কেস। এবারের কেসটা প্রথমে শুনে তেমন আহামরি কিছু মনে হয়নি। কিন্তু ফেলুদার বোধহয় একটা আশ্চর্য ক্ষমতা আছে যার ফলে ও সেটার মধ্যে কিসের জানি গন্ধ পেয়ে নিতে রাজী হয়ে গেল। অবিশ্যি এও হতে পারে যে মক্কেল ছিলেন বেশ হোমরা-চোমরা লোক, আর তাই ফেলুদা হয়ত একটা মোটা রকম দাঁও মারার সুযোগ দেখে থাকতে পারে। পরে ফেলুদাকে কথাটা জিজ্ঞেস করাতে ও এমন কট্মট্ করে আমার দিকে চাইল যে আমি একেবারে বেমালুম চুপ মেরে গেলাম।
মক্কেলের নাম দীননাথ লাহিড়ী। বুধবার সন্ধ্যাবেলা ফোন করে পরদিন সকালে সাড়ে আটটায় আসবেন বলেছিলেন, আর ঠিক ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় একটা গাড়ি এসে থামার আওয়াজ পেলাম আমাদের তারা রোডের বাড়ির সামনে। গাড়ির হর্নটা অদ্ভুত ধরনের, আর সেটা শোনামাত্র আমি দরজার দিকে এগিয়ে গিয়েছিলাম। ফেলুদা একটা ইশারা করে আমায় থামিয়ে দিয়ে চাপা গলায় বলল, ‘অত আদেখ্লামো কেন? বেলটা বাজুক।’
বেল বাজার পর দরজা খুলে দিতে ভদ্রলোকের সঙ্গে সঙ্গে চোখ পড়ল তার গাড়িটার দিকে। এমন পেল্লায় গাড়ি আমি এক রোল্স রয়েস ছাড়া আর কখনো দেখিনি। ভদ্রলোকের নিজের চেহারাটাও বেশ চোখে পড়ার মতো, যদিও সেটা তার সাইজের জন্য নয়। টক্টকে ফরসা গায়ের রং, বয়স আন্দাজ পঞ্চান্নর কাছাকাছি, পরনে কোঁচানো ফিন্ফিনে ধুতি আর গিলে করা আদ্দির পাঞ্জাবি, আর পায়ে সাদা শুঁড় তোলা নাগরা। এছাড়া বাঁ হাতে রয়েছে হাতির দাঁত দিয়ে বাঁধানো হাতলওয়ালা ছড়ি আর ডান হাতে একটা নীল চৌকো অ্যাটাচি কেস। এ রকম বাক্স আমি ঢের দেখেছি। আমাদের বাড়িতেই দুটো আছে—একটা বাবার, একটা ফেলুদার। এয়ার ইন্ডিয়া তাদের যাত্রীদের এই বাক্স বিনি পয়সায় দেয়।
ভদ্রলোককে আমাদের ঘরের সবচেয়ে ভালো আর্ম চেয়ারটায় বসতে দিয়ে ফেলুদা তার উল্টোমুখে সাধারণ চেয়ারটায় বসল। ভদ্রলোক বললেন, ‘আমিই কাল টেলিফোন করেছিলাম। আমার নাম দীননাথ লাহিড়ী।’
ফেলুদা গলা খাক্রিয়ে বলল, ‘আপনি আর কিছু বলার আগে আপনাকে দুটো প্রশ্ন করতে পারি কি?’
‘নিশ্চয়ই।’
‘এক নম্বর—আপনার চায়ে আপত্তি আছে?’
ভদ্রলোক দু’হাত জোড় করে মাথা নুইয়ে বললেন, ‘কিছু মনে করবেন না মিস্টার মিত্তির, অসময়ে কিছু খাওয়ার অভ্যাসটা আমার একেবারেই নেই। তবে আপনি নিজে খেতে চাইলে স্বচ্ছন্দে খেতে পারেন।’
‘ঠিক আছে। দ্বিতীয় প্রশ্ন—আপনার গাড়িটা কি হিস্পানো সুইজা?’
‘ঠিক ধরেছেন। এ জাতের গাড়ি বেশি নেই এদেশে। থার্টি ফোরে কিনেছিলেন আমার বাবা। আপনি গাড়িতে ইন্টারেস্টেড?’
ফেলুদা একটু হেসে বলল, ‘আমি অনেক ব্যাপারেই ইন্টারেস্টেড। অবিশ্যি সেটা খানিকটা আমার পেশার খাতিরেই।’
‘আই সী। তা যাই হোক্—যেজন্য আপনার কাছে আসা। আপনার কাছে ব্যাপারটা হয়ত তুচ্ছ বলে মনে হবে। আপনার রেপুটেশন আমি জানি, সুতরাং আপনাকে আমি জোর করতে পারি না, কেবলমাত্র অনুরোধ করতে পারি যে, কেসটা আপনি নিন।’
ভদ্রলোকের গলার স্বর আর কথা বলার ঢঙে বনেদী ভাব থাকলেও, হাম্বড়া ভাব একটুও নেই। বরঞ্চ রীতিমত ঠাণ্ডা আর ভদ্র।
‘আপনার কেসটা কী সেটা যদি বলেন…’
মিস্টার লাহিড়ী মৃদু হেসে সামনে টেবিলের উপর রাখা বাক্সটার দিকে দেখিয়ে বললেন, ‘কেসও বলতে পারেন, আবার অ্যাটাচি কেসও বলতে পারেন…হেঁহেঁ। এই বাক্সটাকে নিয়েই ঘটনা।’
ফেলুদা বাক্সটার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, ‘এটা বার কয়েক বিদেশে গেছে বলে মনে হচ্ছে। ট্যাগগুলো ছেঁড়া হলেও, ইলাস্টিক ব্যাণ্ডগুলো এখনো দেখছি হাতলে লেগে রয়েছে। এক, দুই, তিন…’
ভদ্রলোক বললেন, ‘আমারটার হাতলেও ঠিক ওইরকম রয়েছে।’
‘আপনারটার…? তার মানে এই বাক্সটা আপনার নয়?’
‘আজ্ঞে না,’ মিস্টার লাহিড়ী বললেন, ‘এটা আরেকজনের। আমারটার সঙ্গে বদল হয়ে গেছে।’
‘আই সী…তা কীভাবে হল বদল? ট্রেনে না প্লেনে?’
‘ট্রেনে। কালকা মেলে। দিল্লী থেকে ফিরছিলাম। একটা ফার্স্ট ক্লাস কম্পার্টমেন্টে চারজন যাত্রী ছিলাম। তার মধ্যে একজনের সঙ্গে বদল হয়ে গেছে।’
‘কার সঙ্গে হয়েছে সেটা জানা নেই বোধহয়?’ ফেলুদা প্রশ্ন করল।
‘আজ্ঞে না। সেটা জানা থাকলে বোধ হয় আপনার কাছে আসার প্রয়োজন হতো না।’
‘বাকি তিনজনের নামও অবশ্যই জানা নেই?’
‘একজন ছিলেন বাঙালী। নাম পাকড়শী। দিল্লী থেকে আমারই সঙ্গে উঠলেন।’
‘নামটা জানলেন কী করে?’
‘অন্য আরেকটি যাত্রীর সঙ্গে তাঁর চেনা বেরিয়ে গেল। তিনি, হ্যালো মিস্টার পাকড়াশী বলে, তাঁর সঙ্গে আলাপ জুড়লেন। কথাবার্তায় দুজনকেই বিজনেসম্যান বলে মনে হল। কনট্রাক্ট, টেণ্ডার ইত্যাদি কথা কানে আসছিল।’
‘যার সঙ্গে কথা হচ্ছিল তার নামটা জানতে পারেননি?’
‘আজ্ঞে না। তবে তিনি অবাঙালী, যদিও বাংলা জানেন, আর মোটামুটি ভালোই বলেন। কথায় বুঝলাম তিনি সিমলা থেকে আসছেন।’
‘আর তৃতীয় ব্যক্তি?’
‘তিনি বেশির ভাগ সময় বাঙ্কের উপরেই ছিলেন, কেবল লাঞ্চ আর ডিনারের সময় নেমেছিলেন। তিনিও বাঙালী নন। দিল্লী থেকে ট্রেন ছাড়ার কিছুক্ষণ পর তিনি আমায় একটা আপেল অফার করে বলেছিলেন সেটা নিজের বাগানের। আন্দাজে মনে হয় তিনিও হয়ত সিমলাতেই থাকেন, আর সেখানেই তাঁর অরচার্ড।’
‘আপনি খেয়েছিলেন আপেলটা?’
‘হ্যাঁ, কেন খাব না। দিব্যি সুস্বাদ, আপেল।’
‘তাহলে ট্রেনে আপনি আপনার অসময়ের নিয়মটা মানেন না বলন!’ ফেলুদার ঠোঁটের কোণে মিচ্কি হাসি।
ভদ্রলোক হো হো করে হেসে বললেন, ‘সর্বনাশ! আপনার দৃষ্টি এড়ানো তো ভারী কঠিন দেখছি। তবে আপনি ঠিকই বলেছেন। চলন্ত ট্রেনে সময়ের নিয়মগুলো মন সব সময় মানতে চায় না।’
‘এক্সকিউজ মি,’ ফেলুদা বলল, ‘আপনারা কে কোথায় বসেছিলেন সেটা জানতে পারলে ভালো হতো।’
‘আমি ছিলাম একটা লোয়ার বার্থে। আমার উপরের বার্থে ছিলেন মিস্টার পাকড়াশী; উল্টোদিকের আপার বার্থে ছিলেন আপেলওয়ালা, আর নিচে ছিলেন অবাঙালী বিজনেস্ম্যানটি।’
ফেলুদা কয়েক মুহূর্ত চুপ। তারপর হাত কচলে আঙুল মট্কে বলল, ‘ইফ ইউ ডোন্ট মাইণ্ড—আমি একটু চা বলছি। ইচ্ছে হলে খাবেন, না হয় না। তোপ্সে, তুই যা তো চট্ করে।’
আমি এক দৌড়ে ভেতরে গিয়ে শ্রীনাথকে চায়ের কথা বলে আবার বৈঠকখানায় এসে দেখি, ফেলুদা অ্যাটাচি কেসটা খুলেছে।
‘চাবি দেওয়া ছিল না বুঝি?’ ফেলুদা জিগ্যেস করল।
‘না। আমারটাতেও ছিল না। কাজেই যে নিয়েছে সে অনায়াসে খুলে দেখতে পারে ভেতরে কী আছে। এটার মধ্যে অবিশ্যি সব মামুলি জিনিস।’
সত্যিই তাই। সাবান চিরুনি বুরুশ টুথব্রাশ টুথপেস্ট, দাড়ি কামানোর সরঞ্জাম, দুটো ভাঁজ করা খবরের কাগজ, একটা পেপার ব্যাক বই—এই সব ছাড়া বিশেষ কিছুই চোখে পড়ল না।
‘আপনার বাক্সে কোনো মূল্যবান জিনিস ছিল কি?’ ফেলুদা প্রশ্ন করল।
দীননাথবাবু বললেন, ‘নাথিং। এ বাক্সে যা দেখছেন, তার চেয়েও কম মূল্যবান। কেবল একটা লেখা ছিল—একটা হাতের লেখা রচনা—ভ্রমণকাহিনী—সেটা ট্রেনে পড়ব বলে সঙ্গে নিয়েছিলাম। বেশ লাগছিল পড়তে। তিব্বতের ঘটনা।’
‘তিব্বতের ঘটনা?’ ফেলুদার যেন খানিকটা কৌতূহল বাড়ল।
‘হ্যাঁ। ১৯১৭ সালের লেখা। লেখকের নাম শম্ভুচরণ বোস। যা বুঝেছি, লেখাটা আসে আমার জ্যাঠামশাইয়ের সঙ্গে। কারণ ওটা আমার জ্যাঠামশাইকে উৎসর্গ করা। আমার জ্যাঠামশাই হলেন সতীনাথ লাহিড়ী, কাঠমুণ্ডুতে থাকতেন। রাণাদের ফ্যামিলিতে প্রাইভেট টিউটরি করতেন। উনি অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে প্রায় অথর্ব অবস্থায় দেশে ফেরেন—পঁয়তাল্লিশ বছর আগে। তার কিছুদিন পরেই মারা যান। ওর সঙ্গেই জিনিসপত্তরের মধ্যে একটা নেপালি বাক্স ছিল। আমাদের বাড়ির বক্সরুমের একটা তাকের কোণায় পড়ে থাকত। ওটার অস্তিত্বই জানতাম না। সম্প্রতি বাড়িতে আরসোলা আর ইঁদুরের উপদ্রব বড্ড বেড়েছিল বলে পেস্ট কন্ট্রোলের লোক ডাকা হয়। তাদের জন্যই বাক্সটা নামাতে হয় আর এই বাক্সটা থেকেই লেখাটা বেরোয়।’
‘কবে?’
‘এই তো—আমি দিল্লী যাবার আগের দিন।’
ফেলুদা অন্যমনস্ক। বিড় বিড় করে বলল, ‘শম্ভুচরণ… শম্ভুচরণ…’
‘যাই হোক’, মিস্টার লাহিড়ী বললেন, ‘ওই লেখার মূল্য আমার কাছে তেমন কিছু নয়। সত্যি বলতে কি, আমি বাক্সটা ফেরত পাবার ব্যাপারে কোনো আগ্রহ বোধ করছিলাম না। আর এই যে বাক্সটা দেখছেন, এটারও মালিককে পাওয়া যাবে এমন কোনো ভরসা না দেখে এটা আমার ভাইপোকে দিয়ে দিয়েছিলাম। তারপর কাল রাত থেকে হঠাৎ মনে হতে লাগল—এসব জিনিস দেখতে তেমন জরুরী মনে না হলেও, এর মালিকের কাছে এর কোনো কোনোটার হয়ত মূল্য থাকতেও পারে। যেমন ধরুন এই রুমাল। এতে নকশা করে G লেখা রয়েছে। কে জানে কার সূচিকর্ম এই G? হয়ত মালিকের স্ত্রীর। হয়ত স্ত্রী আর জীবিত নেই! এই সব ভেবে মনটা খুঁতখুঁত করতে লাগল, তাই আজ আমার ভাইপোর ঘর থেকে বাক্সটা তুলে আপনার কাছে নিয়ে এলাম। সত্যি বলতে কি, আমারটা ফেরত পাই না-পাই তাতে আমার কিছু এসে যায় না, কিন্তু এ বাক্স মালিকের কাছে পৌঁছে দিলে আমি মনে শান্তি পাব।’
চা এল। ফেলুদা আজকাল চায়ের ব্যাপারে ভীষণ খুঁতখুঁতে হয়ে পড়েছে। এ চা আসে কার্সিয়ঙের মকাইবাড়ি টি এস্টেট থেকে। পেয়ালা সামনে এনে রাখলেই ভুর ভুর করে সুগন্ধ বেরোয়। চায়ে একটা নিঃশব্দ চুমুক দিয়ে ফেলুদা বলল, ‘বাক্সটা কি অনেকবার খোলার দরকার হয়েছিল ট্রেনে?’
‘মাত্র দু’বার। সকালে দিল্লীতে ওঠার কিছুক্ষণের মধ্যেই লেখাটা বার করে নিই, আর রাত্রে ঘুমোবার আগে আবার ওটা ভেতরে ঢুকিয়ে রাখি।’
ফেলুদা একটা চারমিনার ধরাল। দীননাথবাবু সিগারেট খান না। দুটো ধোঁয়ার রিং ছেড়ে ফেলুদা বলল, ‘আপনি চাইছেন—এ বাক্স যার তাকে ফেরত দিয়ে আপনার বাক্সটা আপনার কাছে এনে হাজির করি—এই তো?’
‘হতাশ হলেন নাকি? ব্যাপারটা বড্ড নিরামিষ বলে মনে হচ্ছে?’
ফেলুদা তার ডান হাতের আঙুলগুলো চুলের মধ্যে দিয়ে চালিয়ে দিয়ে বলল, ‘না। আপনার সেন্টিমেন্ট আমি বুঝতে পেরেছি। যে ধরনের সব কেস আমার কাছে আসে সেগুলোর তুলনায় এই কেসটার যে একটা বৈশিষ্ট্য আছে সেটাও তো অস্বীকার করা যায় না।’
দীননাথবাবু যেন অনেকটা আশ্বস্ত হলেন। একটা লম্বা হাঁপ ছেড়ে বললেন, ‘আপনার রাজী হওয়াটা আমার কাছে অনেকখানি।’
ফেলুদা বলল, ‘আমার যথাসাধ্য আমি চেষ্টা করব। তবে বুঝতেই পারছেন, এ অবস্থায় গ্যারান্টি দেওয়া সম্ভব নয়। যাই হোক্, এবার আপনার কাছ থেকে কিছু তথ্য জেনে নিতে চাই।’
‘বলুন।’
ফেলুদা চট্ করে উঠে পাশেই তার শোবার ঘর থেকে তার বিখ্যাত সবুজ নোট বইটা নিয়ে এলো। তারপর হাতে পেনসিল নিয়ে তার প্রশ্ন আরম্ভ করল।
‘কোন তারিখে রওনা হন দিল্লী থেকে?’
‘পাঁচই মার্চ রবিবার সকাল সাড়ে ছটায় দিল্লী ছেড়েছি। কলকাতায় পৌঁছেছি পরদিন সকাল সাড়ে নটায়।’
‘আজ হল ৯ই। অর্থাৎ গত তরশু। আর কাল রাত্রে আপনি আমাকে টেলিফোন করেছেন।’
ফেলুদা অ্যাটাচি কেসটার ভেতর থেকে একটা হলদে রঙের কোডাক ফিল্মের কৌটো বার করে তার ঢাকনার প্যাঁচটা খুলতেই তার থেকে কয়েকটা সুপরি বেরিয়ে টেবিলের উপর পড়ল। তার একটা মুখে পুরে চিবোতে চিবোতে ফেলুদা বলল, ‘আপনার ব্যাগে এমন কিছু ছিল যা থেকে আপনার নাম-ঠিকানা পাওয়া যেতে পারে?’
‘যতদূর মনে পড়ে, কিছুই ছিল না।’
‘হুঁ…এবার আপনার তিনজন সহযাত্রীর মোটামুটি বর্ণনা লিখে নিতে চাই। আপনি যদি একটু হেল্প করেন।’
দীননাথবাবু মাথাটাকে চিতিয়ে সিলিং-এর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘পাকড়াশীর বয়স আমার চেয়ে বেশি। ষাটপঁয়ষট্টি হবে। গায়ের রং মাঝারি। ব্যাকব্রাশ করা কাঁচাপাকা চুল, চোখে চশমা, কণ্ঠস্বর কর্কশ।’
‘বেশ।’
‘যিনি আপেল দিলেন তাঁর রং ফরসা। রোগা একহারা চেহারা, টিকোলো নাক, চোখে সোনার চশমা, দাড়ি গোঁফ কামানো, মাথায় টাক, কেবল কানের পাশে সামান্য কাঁচা চুল। ইংরেজি উচ্চারণ প্রায় সাহেবদের মতো। সর্দি হয়েছিল। বার বার টিসুতে নাক ঝাড়ছিল।’
‘বাবা, খাঁটি সাহেব! আর তৃতীয় ভদ্রলোক?’
‘আদৌ মনে রাখার মতো চেহারা নয়। তবে হ্যাঁ—নিরামিষাশী। উনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি ভেজিটেব্ল থালি নিলেন ডিনার এবং লাঞ্চে।’
ফেলুদা সব ব্যাপারটা খাতায় নোট করে চলেছে। শেষ হলে পর খাতা থেকে মুখ তুলে বলল, ‘আর কিছু?’
দীননাথবাবু মাথা নেড়ে বললেন, ‘আর তো কিছু বলার মতো দেখছি না। দিনের বেলা বেশির ভাগ সময়ই আমার মন ছিল ওই লেখাটার দিকে। রাত্রে ডিনার খাবার কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছি। ট্রেনে সচরাচর এত ভালো ঘুম হয় না। ঘুম ভেঙেছে একেবারে হাওড়ায় এসে, আর তাও মিস্টার পাকড়াশী তুলে দিলেন বলে।’
‘তার মানে আপনিই বোধ হয় সব শেষে কামরা ছেড়েছেন?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’
‘আর তার আগেই অবিশ্যি আপনার ব্যাগ অন্যের হাতে চলে গেছে।’
‘তা তো বটেই।’
‘ভেরি গুড।’ ফেলুদা খাতা বন্ধ করে পেনসিলটা সার্টের পকেটে গুঁজে দিয়ে বলল, ‘দেখি আমি কী করতে পারি!’
দীননাথবাবু চেয়ার থেকে উঠে পড়ে বললেন, ‘এ ব্যাপারে আপনার যা পারিশ্রমিক তা তো দেবই, তাছাড়া আপনার কিছু ঘোরাঘুরি আছে, তদন্তের ব্যাপারে আরো এদিক ওদিক খরচ আছে, সেই বাবদ আমি কিছু ক্যাশ টাকা আপনার জন্য নিয়ে এসেছি।’
ভদ্রলোক তাঁর পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা সাদা খাম বার করে ফেলুদার দিকে এগিয়ে দিলেন, আর ফেলুদাও দেখলাম বিলিতি কায়দায় ‘ওঃ—থ্যাঙ্কস’ বলে সেটা দিব্যি পেনসিলের পিছনে পকেটে গুঁজে দিল।
দরজা খুলে গাড়ির দিকে এগোতে এগোতে ভদ্রলোক বললেন, আমার টেলিফোন নম্বর ডিরেক্টরিতেই পাবেন। কিছু খবর পেলেই কাইন্ডলি জানাবেন; এমনকি সটান আমার বাড়িতে চলেও আসতে পারেন। সন্ধে নাগাদ এলে নিশ্চয়ই দেখা পাবেন।’
হলুদ রঙের হিস্পানো সুইজা তার গম্ভীর শাঁখের মতো হর্ন বাজিয়ে রাস্তায় জমা হওয়া লোকদের অবাক করে দিয়ে রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের দিকে চলে গেল। আমরা দুজনে বৈঠকখানায় ফিরে এলাম। যে চেয়ারে ভদ্রলোক বসেছিলেন, সেটায় বসে ফেলুদা পায়ের উপর পা তুলে দিয়ে আড় ভেঙে বলল, ‘এই ধরনের বনেদী মেজাজের লোক আজ থেকে পঁচিশ বছর পরে আর থাকবে না।’
বাক্সটা টেবিলের উপরই রাখা ছিল। ফেলুদা তার ভিতর থেকে একটা একটা করে সমস্ত জিনিস বার করে বাইরে ছড়িয়ে রাখল। অতি সাধারণ সব জিনিস। সব মিলিয়ে পঞ্চাশ টাকার মাল হবে কিনা সন্দেহ। ফেলুদা বলল, ‘তুই একে একে বলে যা, আমি খাতায় নোট করে নিচ্ছি।’ আমি একটা একটা করে জিনিস টেবিলের উপর থেকে তুলে তার নাম বলে আবার বাক্সে রেখে দিতে লাগলাম, আর ফেলুদা লিখে যেতে লাগল। সব শেষে লিস্টটা দাঁড়াল এই রকম—
১। দু’ভাঁজ করা দুটো দিল্লীর ইংরিজি খবরের কাগজ—একটা Sunday Statesman, আর একটা Sunday Hindusthan Times.
২। একটা প্রায় অর্ধেক খরচ হওয়া বিনাকা টুথপেস্ট। টিউবের তলার খালি অংশটা পেঁচিয়ে উপর দিকে তুলে দেওয়া হয়েছে
৩। একটা সবুজ রঙের বিনাকা টুথব্রাশ
৪। একটা গিলেট সেফটি রেজার
৫। একটা প্যাকেটে তিনটে থিন গিলেট ব্লেড
৬। একটা প্রায় শেষ-হয়ে-যাওয়া ওল্ড স্পাইস শেভিং ক্রীম
৭। একটা শেভিং ব্রাশ
৮। একটা নেল্ক্লিপ—বেশ পুরোনো
৯। একটা সেলোফেনের পাতের মধ্যে তিনটে অ্যাস্প্রোর বড়ি
১০। একটা ভাঁজ করা কলকাতা শহরের ম্যাপ—খুললে প্রায় চার ফুট বাই পাঁচ ফুট
১১। একটা কোডাক ফিল্মের কৌটোর মধ্যে সুপুরি
১২। একটা টেক্কা মার্কা দেশলাই—আনকোরা নতুন
১৩। একটা ভেনাস মার্কা লাল-নীল পেনসিল
১৪। একটা ভাঁজ করা রুমাল, তার এককোণে সেলাই করা নকশায় লেখা G
১৫। একটা মোরাদাবাদি ছুরি বা পেন নাইফ
১৬। একটা মুখ-মোছা ছোট তোয়ালে
১৭। একটা সেফটি পিন, মর্চে ধরা
১৮। তিনটে জেম ক্লিপ, মর্চে ধরা
১৯। একটা সার্টের বোতাম
২০। একটা ডিটেকটিভ উপন্যাস—এলেরি কুইনের ‘দ্য ডোর বিটউইন’
লিস্ট তৈরি হলে পর ফেলুদা উপন্যাসটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে বলল, ‘হুইলার কোম্পানির নাম রয়েছে, কিন্তু যিনি কিনেছেন তাঁর নাম নেই। পাতা ভাঁজ করে পড়ার অভ্যাস আছে ভদ্রলোকের। দুশো ছত্রিশ পাতার বই, শেষ ভাঁজের দাগ রয়েছে দুশো বারো পাতায়। আন্দাজে মনে হয় ভদ্রলোক বইটা পড়ে শেষ করেছিলেন।’
ফেলুদা বই রেখে রুমালের দিকে মন দিল।
‘ভদ্রলোকের নাম কিংবা পদবীর প্রথম অক্ষর হল G। সম্ভবত নাম, কারণ সেটাই আরো স্বাভাবিক।’
এবার ফেলুদা কলকাতার ম্যাপটা খুলে টেবিলের উপর পাতল। ম্যাপটার দিকে দেখতে দেখতে ওর দৃষ্টি হঠাৎ এক জায়গায় থেমে গেল। ‘লাল পেনসিলের দাগ…হুঁ…এক, দুই, তিন, চার…পাঁচ জায়গায়…হুঁ…চৌরঙ্গি…চৌরঙ্গি…পার্ক স্ট্রীট…হুঁ…ঠিক আছে। তোপ্সে একবার টেলিফোন ডিরেক্টরিটা দে তো আমায়।’
ম্যাপটা আবার ভাঁজ করে বাক্সে রেখে টেলিফোন ডিরেক্টরির পাতা উল্টাতে উল্টাতে ফেলুদা বলল, ‘ভাগ্য ভালো যে নামটা পাকড়াশী।’ তারপর ‘পি’ অক্ষরে এসে একটা পাতায় একটুক্ষণ চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, ‘সবসুদ্ধ মাত্র ষোলটা পাকড়াশীর বাড়িতে টেলিফোন—তার মধ্যে আবার দুজনে ডাক্তার। সে দুটো অবশ্যই বাদ দেওয়া যেতে পারে।’
‘কেন?’
‘ট্রেনে তার পরিচিত লোকটি পাকড়াশীকে মিস্টার বলে সম্বোধন করেছিল, ডক্টর নয়।’
‘ও হ্যাঁ, ঠিক ঠিক।’
ফেলুদা টেলিফোন তুলে ডায়ালিং শুরু করে দিল। প্রতিবারই নম্বর পাবার পর ও প্রশ্ন করল, ‘মিস্টার পাকড়াশী কি দিল্লী থেকে ফিরেছেন?’ পর পর পাঁচবার উত্তর শুনে ‘সরি’ বলে ফোনটা রেখে দিয়ে আবার অন্য নম্বর ডায়াল করল। ছ’বারের বার বোধহয় ঠিক লোককে পাওয়া গেল, কারণ কথাবার্তা বেশ কিছুক্ষণ চলল। তারপর ‘ধন্যবাদ’ বলে ফোন রেখে ফেলুদা বলল, ‘পাওয়া গেছে। এন সি পাকড়াশী। নিজেই কথা বললো। পরশু সকালে দিল্লী থেকে ফিরেছেন কালকা মেলে। সব কিছু মিলে যাচ্ছে, তবে এঁর কোনো বাক্স বদল হয়নি।’
‘তাহলে আবার বিকেলে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করলে কেন?’
‘অন্য যাত্রীদের সম্পর্কে ইনফরমেশন দিতে পারে তো। লোকটার মেজাজ অত্যন্ত রুক্ষ, যদিও ফেলু মিত্তির তাতে ঘাবড়াবার পাত্র নন। তোপ্সে, চ’ বেরিয়ে পড়ি।’
‘সে কী, বিকেলে তো অ্যাপয়েন্টমেন্ট।’
‘তার আগে একবার সিধু জ্যাঠার কাছে যাওয়া দরকার।’