ঘুম হয়েছিল কি হয়নি, ঘণ্টা তিনেক বিছানায় শুয়ে স্নান সেরে কিছু মুখে দিয়ে অর্জুন যখন থানায় ফিরে এল, তখন ঘড়িতে সাড়ে দশটা। শঙ্করবাবু তাঁর বাসস্থানে এখনও ঘুমোচ্ছেন, অবনীবাবু এস. পির বাংলোয় গিয়েছেন। অর্জুন জানল মহাদেব সেনের ঘুম এখনও ভাঙেনি। সে বারান্দা দিয়ে এগোতেই তিস্তাকে দেখতে পেল। একজন বয়স্কা মহিলার সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে। ওকে
দেখেই তিস্তা হাসল, গুড মর্নিং।
অর্জুন বলল, সুপ্রভাত। উনি কি এখনও ঘুমোচ্ছন?
হ্যাঁ। পুলিশটা বলল না জাগলে ভেতরে যাওয়া নিষেধ। কাল কখন আপনি মোটরবাইক নিয়ে গেলেন আমি টেরই পাইনি। তিস্তা হাসল।
আপনারা এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে ভিজিটার্স রুমে গিয়ে বসতে পারেন। অর্জুন কথা শেষ করতেই ডাক্তার দাসকে আসতে দেখা গেল। তিনি বললেন, কী ব্যাপার, উনি কেমন আছেন? ঘুম ভেঙেছে?
অর্জুন বলল, বোধ হয় না।
ডাক্তার দাস ঘড়ি দেখলেন, প্রায় ছঘণ্টা হয়ে গেছে। চলুন, একবার দেখে আসি।
ডাক্তার দাসের পেছন-পেছন ওরা ভেতরে ঢুকল। মহাদেব সেন সেই একই ভঙ্গিতে ঘুমোচ্ছন। মুখ খুব প্রশান্ত। ডাক্তার দাস তাঁর হাত তুলে পাল দেখতে লাগলেন। এই সময় চোখ খুললেন মহাদেব সেন। তাঁর মাথার পাশে তিস্তারা দাঁড়িয়ে ছিল, পায়ের কাছে অর্জুন। সে দেখল মহাদেব সেনের মুখে বিস্ময় ফুটে উঠছে। তিনি বললেন, কী ব্যাপার, তুমি এখানে? ডাক্তার দাস জিজ্ঞেস করলেন, কেমন বোধ হচ্ছে এখন?
এবার মহাদেব সেন বাকিদের দেখলেন। তিস্তা ঝুঁকে পড়ল, কেমন আছ দাদু?
আরে! আমি কোথায় শুয়ে আছি?
থানায়। তোমার খুব শরীর খারাপ হয়েছিল। আমরা চিন্তায় ছিলাম খু-উ-ব।
আমি থানায় শুয়ে আছি! মহাদেব সেন উঠে বসলেন, কাল রাত্রে, কাল রাত্রে তো অৰ্জুন এসেছিল। হ্যাঁ, ওর সঙ্গে বেরিয়ে শেষপর্যন্ত থানায় এসেছিলাম। মনে পড়ছে সব। তারপর আমার কী হয়েছিল অর্জুন? স্পষ্ট চোখে তাকালেন মহাদেব সেন।
অর্জুনের কেমন সন্দেহ হল। সে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, আপনি কি আমাকে দেখতে পাচ্ছেন?
প্রশ্নটি শোনামাত্র মহাদেব সেন হতভম্ব হয়ে পড়লেন, দুটো হাত তুলে চোখ রগড়ালেন, তারপর চিৎকার করে উঠলেন, আরে, এ কী হল?
তিস্তা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?
মুখ ঘুরিয়ে ঘরের সবাইকে দেখলেন মহাদেব সেন, আমি, আমি দেখতে পাচ্ছি, তোমাদের সবাইকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। কী করে হল! আমার যে কোনও সম্ভাবনাই ছিল না দেখার। আহ। দিস ইজ এ মিরাকল। নীচে নেমে দাঁড়ালেন তিনি কথাগুলো বলতে বলতে।
ডাক্তার দাস তাঁকে বাধা দিলেন, আপনি এত এক্সাইটেড হবেন না। টেক ইট ইজি।
টেক ইট ইজি? আরে, আমার মতো প্রায় অন্ধ হঠাৎ দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেল, এটা কি রোজকার ঘটনা? মাথা নাড়লেন মহাদেব সেন। তাঁকে খুব খুশি দেখাচ্ছিল। এই সময় সুব্রত সেন ঘরে ঢুকলেন অবনীবাবুর সঙ্গে। তাঁদের দেখামাত্র তিস্তা চিৎকার করে উঠল, দাদু এখন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন। আমি বাড়িতে যাচ্ছি সবাইকে খবর দিতে। তিস্তা বেরিয়ে গেল।
সুব্রতবাবু হকচকিয়ে গেলেন, দেখতে পাচ্ছেন মানে?
মহাদেব সেন ছেলের দিকে তাকালেন, হ্যাঁ সুব্রত, আমি দেখতে পাচ্ছি।
কী করে সম্ভব?
এবার ডাক্তার দাস বললেন, অঘটন ঘটে। আমাদের চিকিৎসাশাস্ত্রে যা অসম্ভব বলা হয়েছে জীবনে তার উলটোটা মাঝে-মাঝে হতে দেখেছি।
আপনি ডাক্তার? মহাদেব সেন বললেন।
অর্জুন বলল, হ্যাঁ। উনি ডাক্তার দাস। গত রাত থেকেই উনি আপনার কাছে আছেন বলা যেতে পারে।
গত রাত থেকে! হ্যাঁ, তাই তো, আমি এ কোথায় শুয়ে আছি?
আপনি থানায় রাত্রিবাস করেছেন সার। আমি এখানকার ওসি। অবনীবাবু হাসিমুখে এগিয়ে এলেন হাতজোড় করে।
নমস্কার ফিরিয়ে দিয়ে ছেলের দিকে তাকালেন মহাদেব সেন, আমার কী হয়েছিল?
সুব্রত সেন বললেন, পরে শুনবেন। এখন বাড়ি চলুন, আপনার বিশ্রামের দরকার।
মহাদেব সেন মাথা নাড়লেন, সারারাত ঘুমিয়ে এখন আবার বিশ্রামের দরকার হবে কেন? ডাক্তার, আপনি বলুন তো আমার কী হয়েছিল?
ডাক্তার দাস বললেন, আপনি খুবই এক্সাইটেড ছিলেন। সত্যি কথা বলতে গেলে বলতে হয় মস্তিষ্ক কাজ করছিল না। খুব অ্যাগ্রেসিভ হয়ে উঠেছিলেন। সেই অবস্থা থেকে সরিয়ে আনতে আপনাকে আমি ঘুমের ওষুধ দিই। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, সেই ওষুধ কাজ শুরু করে অনেক পরে, ভোরের একটু আগে। ততক্ষণ আপনার অবস্থা নর্মাল ছিল না। এখন অনুগ্রহ করে একটু শুয়ে পড়ুন, আমি পরীক্ষা করব।
মহাদেব সেন বাধ্য ছেলের মত আদেশ পালন করলেন। তাঁকে পরীক্ষা করার পর ডাক্তার দাসের মুখে হাসি ফুটল, নাঃ, একদম ঠিক আছেন। এবার বাড়ি যেতে পারেন।
শুয়ে-শুয়েই মহাদেব সেন প্রশ্ন করলেন, কটা বাজে এখন?
অবনীবাবু সময়টা বললেন। মহাদেব সেন বিড়বিড় করলেন, এত বেলা পর্যন্ত ঘুমোলাম!
ডাক্তার দাস বললেন, আপনার ঘুম শুরু হয়েছিল সাড়ে চারটে থেকে। সময়টা বেশি নয়।
মহাদেব সেন সোজা হলেন, আমার একটু টয়লেট যাওয়া দরকার। সুব্রত সেন বললেন, বাড়িতে চলুন।
মহাদেব সেন বললেন, বেশ। তাই চলো। কিন্তু অর্জুন, তুমি আমার সঙ্গে কখন দেখা করছ?
আপনি বিশ্রাম নিন। বিকেলের দিকে।
না, না। অত দেরি করা চলবে না। আমি আধঘণ্টার মধ্যেই তৈরি হয়ে নেব। তুমি চলে এসো। ছেলের সঙ্গে বেরিয়ে গেলেন মহাদেব সেন। তিস্তার সঙ্গে যে মহিলা এসেছিলেন তিনিও ওঁদের অনুসরণ করলেন। ঘরের জানলা খুলে দিয়ে অবনীবাবু বললেন, ব্যাপারটা কী হল?
ডাক্তার দাস বললেন, আমি বুঝতে পারছি না। গত রাত্রে যখন ওঁকে প্রথম দেখলাম তখন ওঁর দৃষ্টিশক্তি নিয়ে ভাবার প্রশ্নই ছিল না। বদ্ধ উন্মাদ মনে হচ্ছিল ওঁকে। কিন্তু এমন কিছু ঘটে গেছে ওঁর শরীরে, যে কারণে আমার ইনজেকশন কাজ করতে দেরি করেছিল। ব্যাপারটা কলকাতায় জানাতে হবে।
অবনীবাবু বললেন, সেটা জানাবার পরে অনেক সময় পাবেন। কিন্তু সত্যি কি উনি চোখে ভাল দেখতে পেতেন না? আমি বুঝতে পারছি না।
অর্জুন হতভম্ব হয়ে বসে ছিল। বলল, এর মধ্যে মিথ্যে কিছু নেই। উনি প্রায় অন্ধ ছিলেন। ওই যন্ত্রটির কাছে পৌঁছে যাওয়ার পর ওঁর আচরণে পরিবর্তন এল। মনে হয় তারই রি-অ্যাকশনে উনি এখন দেখতে পাচ্ছেন।
ডাক্তার দাস জিজ্ঞেস করলেন, কী যন্ত্র?
অবনীবাবু চট করে ঘুরে দাঁড়ালেন, একদম ভুলে গিয়েছিলাম। চলুন দেখা যাক।
ডাক্তার দাস ব্যাপারটা বুঝতে পারছিলেন না। যেতে-যেতে ওঁকে ওয়াকিবহাল করলেন অবনীবাবু। ভদ্রলোককে বলতে শোনা গেল, কী আজগুবি গল্প শোনাচ্ছেন।
নীচের ভল্টের সামনে পৌঁছে অবনীবাবু ডাক্তার দাসকে জিজ্ঞেস করলেন, কোনও সাউন্ড শুনতে পাচ্ছেন?
ভদ্রলোক জবাব দেওয়ার আগেই অর্জুন বলল, দিনের বেলায় ওটা শোনা যায় না। অন্তত রামচন্দ্র রায় তাই বলেছেন।
ভদ্রলোক সঠিক কথা নাও বলতে পারেন। অবনীবাবুর ইঙ্গিতে সেপাই তালা খুলল।
ডাক্তার দাস বললেন, দূর মশাই, আমি কিছুই শুনতে পাচ্ছি না।
ঘরের যে-কোণে সুটকেসটাকে ঢুকিয়ে রেখেছিল অর্জুন, সেখানেই ওটা পড়ে আছে। অবনীবাবু একটানে সেটাকে র্যাকের আড়াল থেকে বের করতে পারলেন না। অর্জুন সেইভাবেই ঢুকিয়ে রেখেছিল। এখন বলল, তালা লাগানো নেই। সাবধানে।
সুটকেস থেকে থার্মোকলের বাক্সগুলো খুলে যন্ত্রটাকে তুলে আনা হল। ধাতব বস্তুটি শব্দহীন। অর্জুনের খেয়াল হল, রামচন্দ্র রায়ের বাড়িতে যখন এটাকে সে দেখেছিল তখন এর ভেতর থেকে আলো বের হচ্ছিল। এখন কোনও আলোই নেই! ঘুরিয়ে ফিরিয়ে যন্ত্রটিকে দেখে অবনীবাবু বললেন, জিনিসটা কী তাই, বোঝা যাচ্ছে না।
সিগন্যাল রিসিভিং মেশিন। যখনই এটা সেই সিগন্যাল পায় তখনই এর ভেতর থেকে আলো বের হয় দপদপ করে। অর্জুন গম্ভীর গলায় বলল।
অবনীবাবু জিজ্ঞেস করলেন, সিগন্যালটা পায় কার কাছ থেকে?
সেটা জানি না। কাল রাত্রে যখন রামচন্দ্রবাবু সিগন্যালের শব্দ পাচ্ছিলেন তখন ওটা থেকে আলো বের হতে দেখেছি আমি। অর্জুন বলল।
এতক্ষণ ডাক্তার দাস যন্ত্রটির দিকে তাকিয়ে ছিলেন, এবার বললেন, একটা কথা খুবই বিনীতভাবে জানতে চাইছি। এটা যদি একটা সিগন্যাল রিসিভ করার মেশিন হয় তাহলে এর কাছাকাছি এলাকায় পৌঁছে মহাদেববাবুর নার্ভ বিকল হয়ে গেল কী করে, আর দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেলেন কোন যুক্তিতে?
অবনীবাবু বললেন, তাই তো!
অর্জুন বলল, এইটে জানতে আরও কিছু সময় লাগবে। আমরা এর মধ্যে জেনেছি এই যন্ত্রের কাছাকাছি এলে বেশিরভাগ মানুষের কিছুই হয় না। যেমন আমি, শঙ্করবাবু, ল্যাংড়া-পাঁচু, থানার সেপাইরা, এমনকী আপনারাও। কারণ আপনারাও কাল রাত্রে কোনও সিগন্যাল শুনতে পাননি। কিন্তু কিছু কিছু মানুষের পরিবর্তন হয়। আজ সকালে রামচন্দ্র রায় এসেছিলেন, কারণ যন্ত্রটির সঙ্গে রাত কাটানো তাঁর কাছে নেশার মতো হয়ে গেছে। ওঁর শরীরে যে বাতের ব্যথা ছিল তা উধাও হয়ে গিয়েছিল যন্ত্রটির সঙ্গে রাত কাটিয়ে! কিন্তু নির্যন্ত্র থাকার ফলে সেটা আবার ফিরে এসেছে।
শব্দটা কী বললেন ভাই? নির্যন্ত্র? ডাক্তার দাস জিজ্ঞেস করলেন।
হ্যাঁ। যদি নির্জন, নিবান্ধব হতে পারে, তখন নির্যন্ত্র হবে না কেন? অর্জুন হাসল। তারপর ঘড়ি দেখল।
অবনীবাবু হঠাৎ পুলিশি গাম্ভীর্য নিয়ে বললেন, কার্ভালোর পেট থেকে খবর বের করতে হবে যে, কোথায় সে যন্ত্রটা পেয়েছে?
সে যদি আর না ফেরে?
এত দামি একটা জিনিস ফেলে রেখে কতদিন বাইরে থাকবে?
ভদ্রলোক কিন্তু এক মাস ধরে উধাও।
ওই লোকটারও কোন রি-অ্যাকশন হয়নি। তাই তো?
হ্যাঁ, কার্ভালোও আমাদের দলে।
এটাই অদ্ভুত। হ্যাঁ মশাই এটার সঙ্গে অ্যাটমিক ব্যাপারের কোনও সংযোগ নেই তো? এইযে আমি ধরলাম। অবনীবাবুকে এবার নার্ভাস দেখাল।
সেটাও জানা দরকার। অর্জুন গম্ভীরভাবে বলল, আমি এখন মহাদেববাবুর বাড়িতে যাব। যাওয়ার সময় এটাকে সঙ্গে নেব।
এটাকে সঙ্গে নিয়ে বাইরে যাবেন?
কেন? দিনের বেলায় অসুবিধে কোথায়?
আরে মশাই, এত মূল্যবান জিনিস, ওঁর কাছে যাওয়ার দরকার কী?
এই শহরে একমাত্র উনিই এ-বিষয়ে কিছু বলার ক্ষমতা রাখেন। ভদ্রলোক চিরকাল বিজ্ঞানচর্চা করে এসেছেন।
অবনীবাবু ইতস্তত করছিলেন, এরকম জিনিস যে-কোনও মানুষের পক্ষে বিপজ্জনক হতে পারে। তা ছাড়া পথে যদি কিছু হয় তা হলে! বরং উনি তো এখন ভাল আছেন, এখানেই এসে দেখতে বলুন না।
অনেক তর্কের পর অবনীবাবু রাজি হলেন। কিন্তু পুলিশের জিপে অর্জুন যন্ত্রটিকে নিয়ে যাবে এবং সঙ্গে সেপাই থাকবে। অবনীবাবু ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে এই অদ্ভুত যন্ত্র পাওয়ার খবর পাঠাতে দেরি করলেন না। এটা নাকি তাঁর কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।
জিপে বসে থানার বাইরে আসামাত্র অর্জুন দেখল রাস্তার একপাশে রামচন্দ্র রায় ছাতি মাথায় দাঁড়িয়ে আছেন। ভদ্রলোককে খুব উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল। অর্জুন পুলিশ-ড্রাইভারকে বলল গাড়ি থামাতে। তাকে দেখতে পেয়ে রামচন্দ্র রায় এগিয়ে এলেন, আপনার জন্যে দাঁড়িয়ে আছি। আরে, ওটাই তো কার্ভালোর সুটকেস, তাই না?
অর্জুন দেখল রামচন্দ্রবাবুর চোখ চকচক করে উঠল। সে সেটাকে গুরুত্ব না দিয়ে বলল, আপনি এখানে আমার জন্যে অপেক্ষা করছেন? পাগল হয়ে গিয়েছেন নাকি?
তা বলতে পারেন। বাড়ি গিয়ে শুনলাম থানায় এসেছেন, তাই। রামচন্দ্রবাবু কাঁচুমাচু হলেন, আসলে আমার মনে হচ্ছে জীবনের অনেক কিছু হারিয়ে গিয়েছে। ফাঁকা লাগছে।
উঠে আসুন জিপে। অর্জুনের মায়া হল।
চটপট জিপে উঠলেন রামচন্দ্র রায়, নাইনটিন ফর্টি নাইনে আমি একটানা বাহাত্তর ঘণ্টা জিপ চালিয়েছিলাম। নাওয়া-খাওয়া সব মাথায় উঠেছিল।
অর্জুন বলল, থামেননি?
ওই যখন তেলের দরকার হত, তখনই। রামচন্দ্র হাসলেন, এখানে, মানে ইন্ডিয়ায় নয়। অস্ট্রেলিয়ায়। জাহাজ থেকে একটা জরুরি খবর নিয়ে ছুটতে হয়েছিল।
বাব্বা, আপনার তো অভিজ্ঞতা অনেক।
তা তো বটেই। বই লিখলে ইয়া মোটা হয়ে যেত।
লিখুন না।
ছাপবে কে? এ-দেশে গুণীর কদর নেই। কার বাড়ি?
অর্জুনের ইশারায় ড্রাইভার মহাদেব সেনের বাড়ির সামনে জিপ থামিয়েছিল। সুটকেস নিয়ে নামতে নামতে অর্জুন বলল, আপাতত এই শহরে আপনার সঙ্গে মিল আছে যে একমাত্র মানুষটির, তিনি এই বাড়িতে থাকেন। গতরাত্রে তাঁকে আপনার বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলাম।
এখানে কেন আনা হল?
উনি একজন বিজ্ঞানী। আপনার, আমার চেয়ে অনেকগুণ বেশি জানেন। ওঁর সাহায্য দরকার এই রহস্য সমাধান করতে। আপনিও আসুন না! অর্জুনের অনুরোধে রামচন্দ্র রায় যেন বাধ্য হয়েই অনুসরণ করলেন।
বাড়ির সবাই প্রস্তুত ছিলেন। তিস্তা ওদের মহাদেব সেনের ঘরে নিয়ে যাওয়ামাত্র তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ওটা কী?
এটাই কার্ভালোর রেখে যাওয়া সুটকেস। অর্জুন সযত্নে মেঝের ওপর রাখল সুটকেসটাকে। মহাদেব সেনকে এখন অনেকটা স্বাভাবিক দেখাচ্ছে। চোখের চশমা খুলে তিনি বললেন, এঁর সঙ্গে কোথায় দেখা হল?
থানার সামনে। জবাব দিয়ে অর্জুন দেখল রামচন্দ্রবাবু একদৃষ্টিতে মহাদেব সেনের দিকে তাকিয়ে আছেন। যেন ওঁর ভেতরটা পড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। তারপর হাসলেন, রামচন্দ্র মহাদেবের বাড়িতে এল অর্জুনের সঙ্গে।
ধন্যবাদ। মহাদেব সেনের চোখ ঘরের ভেতর দাঁড়ানো আত্মীয়স্বজনের ওপর পড়ল, এবার আমরা একটু কাজ করব। তোমরা দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে যাও।
আদেশ অমান্য করার সাহস কারও হল না, যদিও বেরিয়ে যেতে কারওরই মন চাইছিল না। রামচন্দ্র রায় বললেন, কাজেব সময় আমার থাকা কি উচিত হবে?
নিশ্চয়ই। এখানে আপনি-আমি গিনিপিগ। প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব। অর্জুন, দরজা দুটো বন্ধ করে সুটকেস খোলো। আগে যন্ত্রটাকে দেখা যাক। মহাদেব সেন বললেন।
দরজা বন্ধ করে সুটকেস খুলে থার্মোকলের ভেতর থেকে যন্ত্রটাকে বের করা হল। মহাদেব সেন সামনের টেবিলে সেটিকে রাখতে বললেন। জানলা দিয়ে আসা আলো পড়ায় যন্ত্র চকচক করছে। মহাদেব সেন বললেন, মেটালটা লক্ষ কবো। স্টিল অ্যালুমিনিয়াম মেশানো বলে ভুল হবে। তুমি বলেছিলে আলো বেরোতে দেখেছ, কোনও আলো নেই।
ওটা সিগন্যাল হলে বের হয় বলে মনে হচ্ছে।
হয়তো। মিস্টার রায়, আপনি কি কোনও শব্দ পাচ্ছেন?
রামচন্দ্র রায় মাথা নাড়লেন, নাঃ। দিনের বেলায় তো পেতাম না।
তা হলে তোমাব ধারণাই ঠিক অর্জুন। কিন্তু এই মেটাল কভারটায় কোথাও জোডের চিহ্ন নেই। ভেতরে যে যন্ত্রপাতি, না না, অর্জুন, এই জায়গাটা লক্ষ করো। ঝুঁকে পড়ে দেখতে-দেখতে মহাদেব সেন অর্জুনকে ডাকলেন। অর্জুন দেখল। কিছু একটা খুলে নেওয়া হয়েছে সেখান থেকে। বস্তুটিকে ধরে রাখার হুক এখনও এর গায়ে আছে।
অর্জুন বলল, এর গায়ে কিছু লাগানো ছিল।
মহাদেব সেন বললেন, হু। এখন এই যন্ত্রটি ঠিক কী জিনিস তা জানার জন্যে দুটো পথ আছে। এক, আমরা এই মেটাল কভার ভাঙতে পারি। সেক্ষেত্রে যদি যন্ত্রটাই খারাপ হয়ে যায় তা হলে চিরকাল আফশোস থেকে যাবে। দ্বিতীয় পথটা আরও কটা রাত পরীক্ষা করা।
রামচন্দ্র রায় বললেন, দ্বিতীয় পথটাই ঠিক। তা হলে আমার বাতের ব্যথাটা কমে যাবে।
আপনার বাত আছে? মহাদেব সেন মুখ তুললেন।
আর বলবেন না, নাইনটিন ফিফটি ওয়ানে…।
রামচন্দ্রবাবুকে থামিয়ে অর্জুন বলল, এটা কোথায়? আফ্রিকায়?
একদম ঠিক। অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল আমার। বাঁচার চান্স ছিল না।
অর্জুন ভদ্রলোককে থামাবার জন্যে বলল, উনি বলছেন রোজ রাত্রে এই যন্ত্রের সঙ্গে থাকার ফলে ওঁর শরীরে বাতের ব্যথা কমে গিয়েছিল। এক রাত ছাড়াছাড়ি হওয়ায় আবার বেড়ে গিয়েছে। আপনার চোখের ব্যাপারটা কীরকম?
মহাদেব সেন বললেন, উনি ঠিকই বলছেন অর্জুন। যখন ঘুম থেকে উঠেছিলাম তখন মনে হয়েছিল সব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু এরই মধ্যে মনে হচ্ছে দৃষ্টিশক্তি কমতে আরম্ভ করেছে। আগের থেকে অনেক ভাল, কিন্তু ওই পাওয়ার বেড়ে গেলে যা হয়।
অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আপনার কি মনে হয় এটা পৃথিবীতে তৈরি হয়েছে?
না হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। যদি কেউ করে থাকেন তা হলে তাঁর পক্ষে এমন ঝুঁকি নেওয়া খুবই বোকামি হবে।
বোকামি কেন?
তিনি নিশ্চয়ই লুকিয়ে রেখেছিলেন তাঁর আবিষ্কারের কথা। যন্ত্রটা নিশ্চয়ই তাঁর কাছ থেকে চুরি গিয়েছে। প্রতি রাত্রে তিনি সিগন্যাল পাঠান যন্ত্রটার অস্তিত্বটা জানার। না, তা হতে পারে না। তা হলে তিনি জেনেই যেতেন যন্ত্রটা কোথায় আছে, এসে নিয়ে যেতেন। যে-যন্ত্র একটি মানুষকে প্রভাবিত করে তার শরীরের ত্রুটি কমিয়ে দেয়, তাকে তিনি অনেক বড় কাজে ব্যবহার করবেন।
তা হলে?
হ্যাঁ। সেরকমই মনে হয়। এই ধাতব বস্তুটি আমার অচেনা। গড়নও অদ্ভুত। দিনের আলো নিভে গেলে পৃথিবীতে সিগন্যালটা আসে অথবা দিনের আলোর জন্যেই সিগন্যাল এলেও এটি অচল থাকে। সিগন্যাল পেলেই যন্ত্রটা সক্রিয় হয়। সক্রিয় যন্ত্রটি থেকে যে-তরঙ্গ বের হয় তা সেইসব মানুষের মস্তিষ্কের কোষে প্রতিক্রিয়া আনে, যাদের গঠনের সঙ্গে এই যন্ত্রে রাখা ফর্মুলার মিল আছে। কিন্তু কেন? কারা এটাকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছে। উদ্দেশ্য কী? তা ছাড়া এই যন্ত্রটি স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। এর শরীর থেকে কিছু একটা খুলে নেওয়া হয়েছে। কী সেটা? যেন বারংবার নিজেকেই প্রশ্ন করে গেলেন মহাদেব সেন। খুব চিন্তামগ্ন দেখাচ্ছিল তাঁকে।
অর্জুন বলল, বেশ, এবার আমরা একটা হিসেবে আসি। আমরা জেনেছি এই যন্ত্রটির একটা অংশ উধাও হয়েছে। দুই, এটি দিনের বেলায় নিষ্ক্রিয় থাকে। তিন, সন্ধের পরেই দূর থেকে ভেসে আসা সিগন্যালে এ রেসপন্স করে এবং ভোর হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই আবার নিষ্ক্রিয় হয়। তা হলে দিনের বেলায় সিগন্যাল আসে না অথবা এলেও এ গ্রহণ করতে পারে না।
মহাদেববাবু বললেন, আমাদের পৃথিবী যখন সূর্যের দিকে মুখ করে থাকে তখন ওই সিগন্যাল-প্রেরকের কাজ করার ক্ষমতা কমে যায়। হয়তো সূর্যতাপ সহ্য করতে পারে না।
অর্জুন বলল, বেশ। এবার দেখা যাচ্ছে, সন্ধে হওয়ার পর থেকেই এই যন্ত্রের কাছাকাছি আসামাত্র কোনও-কোনও মানুষ একটা ক্ষীণ শব্দ শুনতে পাচ্ছেন।
রামচন্দ্র রায় বললেন, ক্ষীণ কিন্তু ননস্টপ।
হ্যাঁ, সেটা একসময় বাড়তে আরম্ভ করে?
মিস্টার রায় বলতে পারবেন। আমি গতকাল রিকশায় বসেই যা শুনতে পেয়েছি তাতে মনে হচ্ছিল কালা হয়ে যাব।
ঠিকই। সন্ধে থেকে শুরু হয়। একটু-একটু করে বাড়তে থাকে। আমি চটপট রাত্রের খাওয়া খেয়ে নিতাম, কানে শব্দ বাজত। তারপর একসময় মনে হত কানের পরদা ফেটে যাবে। তখন আর জ্ঞান থাকত না। রামচন্দ্র রায় বললেন।
হ্যাঁ, আমি এই স্টেজটাই জানতে চাইছি। গত রাত্রে আপনার কানে ব্যথা হচ্ছিল শব্দটার জন্যে, রিকশাতে বসেই। আমার সঙ্গে যখন থানার ভেতরে ঢুকলেন তখনও আপনি স্বাভাবিক কথা বলছিলেন, মনে আছে? অর্জুন
মহাদেব সেনকে জিজ্ঞেস করল।
মনে আছে। তখন শব্দটা কানের ভেতর তুমুল হয়ে উঠছিল। যখন নীচের বন্ধ দরজার কাছে পৌঁছলাম তখন ওই আওয়াজের প্রাবল্যে যেন উন্মাদ হয়ে গেলাম।
হ্যাঁ। আপনি তখন দরজা খোলার চেষ্টা করছিলেন একাই। প্রচণ্ড শক্তি এসে গেল শরীরে। আপনাকে ধরে রাখা একজন সেপাইয়ের পক্ষে সম্ভব হয়নি। মিস্টার রায়, ওই অবস্থায় পৌঁছে আপনিও কি যন্ত্রটার দিকে যাওয়ার চেষ্টা করতেন? সেক্ষেত্রে তো আপনি সহজেই যন্ত্রটাকে পেতেন। ওটা আপনার ঘরে সুটকেসের মধ্যেই থাকত। অর্জুন তাকাল।
না। আমি বেরিয়ে পড়তাম। খালি হাতে নয়। কিছু একটা ভারী জিনিস বয়ে নিয়ে যেতাম। কোথায় যেতাম, কেন যেতাম তা জানি না। অনেকটা হাঁটতাম মধ্যরাত্রে। দু-একজন প্রতিবেশী পরের দিন সকালে দেখা হলে জিজ্ঞেস করেছে অতরাত্রে তিস্তা ব্রিজের দিকে কেন গিয়েছিলাম? জবাব দিতে পারিনি। রামচন্দ্র রায় হাসলেন, সকালে ডান হাতে খুব ব্যথা হত। এখন মনে হচ্ছে এমনও হতে পারে ওই সুটকেস বয়ে নিয়ে যেতাম। শুধু এই কারণেই একসময় ভয় হল, রাত্রে বেরিয়ে আমি কাউকে খুনও করতে পারি। এই ভয় বাড়তেই আমি থানায় গেলাম ডায়েরি করতে। আপনাকে বলেছিলাম আমার বাড়ির বাইরের দরজায় তালা দিয়ে যেতে।
ওই সময়ে আপনি কাউকে দেখেছেন বলে মনে পড়ে?
কাউকে বলতে? মহাদেব সেন জিজ্ঞেস করলেন।
এমন কেউ যে আপনাকে পরিচালনা করছে।
রামচন্দ্র রায় বললেন, আমার মনে হত কেউ পাশে আছে অথচ তাকে আমি দেখতে পাচ্ছি না। সে যা বলছে আমাকে, তাই করতে হচ্ছে।
আপনি?
ঠিক এক অনুভূতি নয়। আমি বুঝতে পারছিলাম আমাকে তালা দিয়ে কেউ চাবি নিয়ে গিয়েছে। সেই চাবিটা আছে এই যন্ত্রের মধ্যে। ওই যন্ত্র পেলে আমি মুক্ত হয়ে যাব। কিন্তু তোমরা আমাকে আটকে রেখেছিলে। মহাদেব সেন বললেন। এই সময় রামচন্দ্র রায় উঠে এসে পরম স্নেহে যন্ত্রের গায়ে হাত বোলালেন।
অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আপনারা দুজনেই কি আজ রাত্রে এই যন্ত্রটির সঙ্গে থাকার জন্যে কোনও টান অনুভব করছেন? রামচন্দ্র রায় বলে উঠলেন, নিশ্চয়ই। মহাদেব সেন বললেন, আমার শুধু কৌতূহল হচ্ছে।
ওই কৌতূহল থেকেই টান আসবে। এ মশাই নেশার মতন ব্যাপার। রামচন্দ্র রায় দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
আমাকে একটু ভাবতে দিন। এখনও কয়েক ঘণ্টা হাতে আছে। বিকেলে আমার কাছে এসো অর্জুন। একটা কিছু করতে হবে আজ রাত্রে।
আমি নিশ্চয়ই বাদ যাচ্ছি না? রামচন্দ্র রায় জিজ্ঞেস করলেন।
অবশ্যই না। মহাদেব সেন বললেন।
তা হলে এটিকে আবার থানায় রেখে আসি? অর্জুন বলল।
কেন? মহাদেববাব আপত্তি করলেন।
এখন এটা সরকারের সম্পত্তি, যেহেতু এর মালিককে পাওয়া যাচ্ছে না। অর্জুন বলল।