০১. এখন কোনও কাজকর্ম নেই

এখন কোনও কাজকর্ম নেই। তিন-তিনটে মাস শুধু বই পড়ে আর ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিয়ে মন মেজাজ বিশ্রী হয়ে গিয়েছিল অর্জুনের। থানার দারোগা অবনীবাবু হেসে বলেছিলেন, মানুষের স্বভাব বড় অদ্ভুত। এই যে আমার জেলায় কোনও বড় ক্রাইম হচ্ছে না, চার-পাঁচ মাসে কিছু চুরি ডাকাতি ছাড়া কোনও প্রব্লেম নেই, এতে সবার খুশি হওয়ার কথা কিন্তু হাঁপিয়ে উঠছেন আপনি। ধরুন, এই শহরে ছ মাস ধরে কারও কোনও অসুখ করল না, এমনকী সর্দিজ্বরও নয়, সবাই হঠাৎ একদম ফিট হয়ে গেল তাতেও একদল মানুষ অখুশি হবে। ডাক্তাররা। তাঁরা বেকার হয়ে যাবেন।

অর্জুন হেসে ফেলেছিল। ব্যাপারটা হয়তো তাই। কিন্তু দুটো সমস্যার চেহারা একরকম নয়। তবে অবনীবাবু ভাল মানুষ। থানার দারোগা হয়েও দেশ-বিদেশের খবর রাখেন। শহরে এসেছেন বছরখানেক হল। অমলদা, অমল সোমের সঙ্গে আলাপ করার খুব ইচ্ছে ছিল ওঁর, কিন্তু হয়নি। অমলদা বেশ কিছুদিন মৌনী নিয়ে ছিলেন, কারও সঙ্গে দেখা করতেন না। তারপর একদিন হাবুর হাতে একটা চিঠি ধরিয়ে আগের বারের মতো দেশ ঘুরতে বেরিয়ে গেছেন।

বিকেলবেলায় অবনীবাবুব ঘরে বসে কথা হচ্ছিল। এর মধ্যে একবার চায়ের প্রস্তাব করেছেন ভদ্রলোক, অর্জুন রাজি হয়নি। থানার চা এত খারাপ যে, মুখে দেওয়া যায় না। কথাটা সে ভদ্রলোককে বলতে পারেনি। ওই চা মুখে দিয়ে প্রতিবার অবনীবাবু আঃ বলে শব্দ তোলেন।

থানার বিল্ডিংটার ওপর লেখা রয়েছে কোতোয়ালি। এই নিয়ে কথা হচ্ছিল। কোতোয়ালি হল কোতোয়ালের অফিস। কোতোয়াল মানে কোটাল, নগরপাল। শব্দগুলো এখন শোনা যায় রবীন্দ্রনাথের শ্যামা নৃত্যনাট্যে, বলরে নগরপালে। বাস্তবের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই। অবনীবাবু বললেন, হিন্দিভাষাভাষী মানুষেরা শব্দটাকে এখনও ব্যবহার করেন মশাই। আফটার অল হিন্দি তো আমাদের রাষ্ট্রভাষা। ভাবুন, তখন কী দিন ছিল! আমি কোটাল, নগররক্ষক। কী খাতির। তখন টিয়ার গ্যাস ছিল না, বন্দুক ছিল না, শুধু অসির ঝনঝনানি।

অবজেকশন! পেছন থেকে একটা হেঁড়ে গলা ভেসে এল। অর্জুন দেখল, ঘরের এক কোণে একজন বসে আছেন। ভদ্রলোকের বয়স সত্তরের কাছে, গায়ে ময়লাটে সাদা পাঞ্জাবি, গায়ের রং বেশ কালো। অবনীবাবু ভদ্রলোকের দিকে পিটপিট করে তাকালেন, মানে?

আজ পর্যন্ত অসি হাতে কোনও কোটালের ঘুরে বেড়ানোর গল্প পড়ার সুযোগ হয়নি। তখন একটা লাঠি আর দড়িই ছিল সাফিসিয়েন্ট। আর কোতোয়াল শব্দটি এসেছে ফারসি কোত্রা থেকে। বাংলা ভাষায় লেখা যে-কোনও অভিধানে পেয়ে যাবেন। ভদ্রলোক একটানা বললেন।

অ। আপনি যেন কী কাজের জন্যে এখানে এসেছেন? অবনীবাবু একটু বিরক্ত।

ছোট দারোগাকে বলেছি। তিনি এখানে আসতে বললেন। এসে ইস্তক আপনাদের কথা শুনছি।

ঠিক আছে। এবার বলতে পারেন।

আগে আমার পরিচয়টা দিয়ে নিই। দেওয়ার মতো অবশ্য কিছু নয়। পিতৃদেব নাম রেখেছিলেন রাম, রামচন্দ্র রায়। এককালে ভাল ফুটবল খেলতাম। রাইট ইনে। তখন তো ওইসব আধুনিক ছক চালু হয়নি। ফরোয়ার্ড লাইনেই পাঁচজন থাকত। আমি পুরো মাঠ চষতাম। প্রচণ্ড দম ছিল তো?

অবনীবাবু হাত তুলে ভদ্রলোককে থামিয়ে বললেন, ওটা নিশ্চয়ই আপনার ছেলেবেলার ঘটনা। আমরা আপনার এখনকার পরিচয় জানতে চাইছি।

রামচন্দ্র বললেন, ঠিক ছেলেবেলা বলা যাচ্ছে না। আমি আঠারো বছরে খেলা ছেড়েছি। একটু বেশি কথা বলছি বোধ হয়, শর্টকাট করি, জাহাজে চাকরি করতাম। পৃথিবীটা চক্কর দিয়েছি। আর জাহাজে জানেনই তো, সমুদ্রে ভাসলে হাতে অফুরন্ত সময়। তখন বই পড়েছি। পছন্দ বলে তো কিছু ছিল, হাতের কাছে যা পেয়েছি। দু-দুটো অভিধান মুখস্থ হয়ে গেল ওই সময়।

অর্জুন অবাক হয়ে গেল। ভদ্রলোকের শরীরের গঠন বেশ মজবুত হলেও চেহারায় বোঝা যায় বেশ অর্থকষ্টে আছেন। সে না বলে পারল না, অদ্ভুত।

অদ্ভুত কেন? আপনার হাতে যদি কোনও কাজ না থাকে, যদি একটা ঘরে কয়েক মাস বন্দি থাকেন এবং প্রচুর উল আর কাঁটা ধরিয়ে দেওয়া হয় তা হলে আপনিও সোয়েটার বুনতে শিখে যাবেন। পরিস্থিতি আপনাকে বাধ্য করবে শিখতে।

ইন্টারেস্টিং। অর্জুন বলল, আপনি একটু এপাশে এগিয়ে আসুন না।

রামচন্দ্র উঠে দাঁড়ান, ধন্যবাদ, না বললে আমি আগ বাড়িয়ে কাছে যাই। একটা চেয়ার ফাঁকা রেখে বসলেন ভদ্রলোক। কাছাকাছি হওয়ার পর অর্জুন ভদ্রলোককে লক্ষ করল। গম্ভীর দাদু-দাদু চেহারা। মুখে বেশ সৌম্য ভাব, মানুষটিকে একটুও কুটিল বলে মনে হয় না।

অবনীবাবু বললেন, আপনার পরিচয়টা এখনও জানলাম না। আপনি ফুটবল খেলতেন, জাহাজে চাকরি করতেন। এখন আপনি কী করেন?

রামচন্দ্রবাবু মাথা নাড়লেন, ওইটাই মুশকিল হয়ে গিয়েছে। ওরা আমাকে মিডিয়াম বানিয়ে ফেলেছে। প্রথম-প্রথম মজা লাগত, এখন এত অসহায় মনে হয় নিজেকে…।

মিডিয়াম? কিসের মিডিয়াম? অবনীবাবু সন্দিগ্ধ হয়ে উঠলেন।

আমি যা করতে চাই না, তাই ওরা আমাকে দিয়ে করায়।  রামচন্দ্র নিচুস্বরে বললেন।

আই সি! তার মানে এখন আপনি ক্যারিয়ার! আপনার মতো বয়স্ক সরল চেহারার মানুষ ক্যারিয়ার হলে পুলিশের বাবার সাধ্য নেই যে সন্দেহ করবে। ওদের হয়ে কী ক্যারি করেন আপনি? ড্রাগ না স্মাগল গুড়স? অবনীবাবু সোজা হয়ে বসলেন।

আজ্ঞে, ঠিক তা নয়, আপনি…। রামচন্দ্র বিড়বিড় করলেন।

বুঝতে পেরেছি। কিন্তু হঠাৎ আপনি নিজেকে সারেন্ডার করতে এলেন কেন? এই সুমতি কি স্বাভাবিক? ঠিক আছে, তার আগে বলুন আপনি কোথায় থাকেন? কলম খুললেন অবনীবাবু।

আপনি ভুল করছেন। আমি স্মাগলার বা ড্রাগকারবারিদের ঘৃণা করি। খবরের কাগজে, আমি এই নিয়ে প্রচুর লিখেছি। কলকাতার লিডিং ড্রাগকারবারি পাশা আমার রিপোর্টের জন্যে ধরা পড়ে। তা ছাড়া যে অভিধান মুখস্থ বলতে পারে সে ওই কাজ করতে পারে না। বেশ রাগত ভঙ্গিতেই প্রতিবাদ জানালেন রামচন্দ্রবাবু।

খবরের কাগজ? খবরের কাগজে আপনি কী করতেন?

সাব এডিটার ছিলাম। কিন্তু প্রায়ই ফিচার লিখতাম, মাঝে-মাঝে স্কুপও।

ভাবা যায় না। আপনি ফুটবল খেলতেন, জাহাজে চাকরি করতেন, আবার খবরের কাগজে চাকরি করেছেন। অদ্ভুত জীবন তো। তা হলে এই যে বললেন আপনাকে ক্যারিয়ার হতে ওরা বাধ্য করছে, সেটা তা হলে কী?

অবনীবাবু ধাঁধায় পড়ে গেছেন বোঝা গেল।

আমি একবারও বলিনি কেউ আমাকে ক্যারিয়ার করেছে। আমি বলেছি। আমাকে ওরা মিডিয়াম বানিয়ে নিয়েছে এবং এতে আমার কিছুই করার নেই। গম্ভীর গলায় বললেন ভদ্রলোক।

কারা আপনাকে মিডিয়াম বানিয়েছে? অবনীবাবুর গলার স্বরে একটু হালকা হাসি মিশল।।

আমি ঠিক জানি না কিন্তু অনুভব করতে পারি। মুশকিল হল, এব্যাপারে আমি অসহায়। আমার ইচ্ছের কোনও মূল্য নেই। ওরা যা চাইবে তাই আমাকে করতে হবে। শেষপর্যন্ত ভেবে দেখলাম আপনার কাছে আসাই ভাল। আমি একটা ডায়েরি করতে চাই।

ডায়েরি? কার বিরুদ্ধে? হাসি চাপতে পারলেন না অবনীবাবু। আর সেটা দেখে বেশ গম্ভীর হয়ে গেলেন রামচন্দ্র রায়, সত্যি বলতে কি, কারও বিরুদ্ধে নয়। আমি চাইছি ব্যাপারটা রেকর্ডেড হয়ে থাক। ধরুন, ওরা আমাকে দিয়ে কাউকে খুন করালো, তখন এই রেকর্ডটা কাজে লাগবে।

এই সময় টেলিফোন বাজল। বাঁ হাতে রিসিভার তুলে অবনীবাবু সাড়া দিলেন। ওপাশের বক্তব্য শুনতে-শুনতে তিনি সোজা হয়ে বসলেন, তারপর আসছি বলে রিসিভার নামিয়ে রাখলেন। অর্জুন ওঁর এই ভঙ্গি চিনে ফেলেছে। কোথাও কিছু ঘটেছে এবং অবনীবাবুকে এখনই সেখানে যেতে হবে।

সরি, মিস্টার রায়, আমি আপনাকে ঠিক এই মুহূর্তে সাহায্য করতে পারছি। আপনি বাড়িতে গিয়ে আর একবার ভাবুন। তারপরেও যদি মনে হয় এখনকার ভাবনাটাই ঠিক তা হলে আর একদিন আসবেন। আমাকে এখনই তিস্তার চরে যেতে হচ্ছে। অবনীবাবু উঠে দাঁড়ালেন।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, সিরিয়াস কিছু ঘটেছে নাকি?

না। জায়গাজমি নিয়ে ঝামেলা। আপনি কি বসবেন?

না। আর বসে কী করব। আপনি এখোন, আমি আসছি।

অর্জুনের কথা শুনে চোখে এমন একটা ইশারা করলেন অবনীবাবু রামচন্দ্রবাবুকে উদ্দেশ করে যে, তার একটাই অর্থ হয়, পাগলের পাল্লায় পড়বেন

মশাই। অবনীবাবু ঘরের বাইরে চলে গেলে অর্জুন রামচন্দ্রবাবুকে জিজ্ঞেস করল, আপনি কোনদিকে যাবেন?

আমি? রাজবাড়ির কাছে। রামচন্দ্রবাবু উঠে দাঁড়ালেন, আচ্ছা, আমার কথাবার্তা কি খুব অ্যাবনমাল শোনাল? মানে, পাগলের প্রলাপ বলে মনে হল?

হকচকিয়ে গেল অর্জুন, না, না। এ কথা আপনার মনে হচ্ছে কেন?

মনে হল। মাথা নাড়লেন ভদ্রলোক, আপনি পুলিশের লোক?

আজ্ঞে না। আমি মাঝে-মাঝে এখানে গল্প করতে আসি।

আশ্চর্য! থানাতে কেউ গল্প করতে আসে বলে শুনিনি।

আসলে অবনীবাবু, মানে উনি, মানুষ ভাল। আর আমার প্রোফেশনের সঙ্গে উনি জড়িয়ে আছেন। এখানে এসে নানান ধরনের মানুষের কথা শুনি, সেটা কাজেও লাগে।

কী প্রোফেশন আপনার?

সত্যসন্ধান।

অদ্ভুত চোখে তাকালে রামচন্দ্রবাবু। যেন শব্দটির মানে বোঝার চেষ্টা করলেন। তারপর বললেন, নাম কী ভাই?

অর্জুন।

ও, আপনিই অর্জুন। নাম শুনেছি কিন্তু বয়স এত অল্প, আন্দাজ করিনি। আচ্ছা, আমাদের বোধ হয় এই ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়া উচিত। চলুন, বাইরে যাই। রামচন্দ্র রায় দরজার দিকে এগোলেন। এই মুহূর্তে ভদ্রলোককে যথেষ্ট সুস্থ এবং বিবেচক বলে মনে হচ্ছে। অর্জুনের মনে হল, মানুষটি একটু আলাদা ধরনের। হঠাৎ সে আকর্ষণ বোধ করতে লাগল।

বাইরে বেরিয়েই রামচন্দ্র রায় বললেন, সন্ধে হয়ে গেল। মুশকিল।

মুশকিল কেন?।

আমি রাতের বেলায় ঘরের বাইরে থাকতে চাই না। যতক্ষণ আলো থাকে ততক্ষণ আমি নিরাপদ।

কী আলো? আপনি সূর্যের আলোর কথা বলছেন? অর্জুন মোটরবাইকের চাবি বের করল।

হ্যাঁ। সূর্যালোক। সেই আদিকাল থেকে মানুষকে বাচিয়ে রেখেছে। আমরা যে এককালে প্রকৃতিকে উপাসনা করে তাদেরই দেবদেবী বানিয়েছিলাম সেটাই ঠিক ছিল। আচ্ছা, চলি। রামচন্দ্রবাবু হাত জোড় করলেন।

আপনি কি বাড়িতে ফিরে যাচ্ছেন?

হ্যাঁ। তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে পড়তে চাই।

যদি কোনও অসুবিধে না হয় আপনাকে আমি লিফ্ট দিতে পারি। অর্জুন নিজের লাল মোটরবাইকটাকে দেখাল। তার অবশ্য সঙ্কোচ হচ্ছিল। অনেককেই সে বাইকের পেছনে বসিয়েছে কিন্তু রামচন্দ্র রায়ের বয়সী কোনও বৃদ্ধকে পেছনে বসিয়ে বাইক চালায়নি! সে ভেবেছিল বৃদ্ধ আপত্তি জানাবেন কিন্তু উলটোটা হল। রামচন্দ্রবাবু সোৎসাহে বললেন, তা হলে তো ভালই হল। আগে পৌঁছে যাওয়া যাবে।

বাইকে স্টার্ট দিয়ে অর্জুন ইশারা করতেই বৃদ্ধ ধুতি সামলে পেছনে উঠে বসলেন। তাঁর হাত অনকে আঁকড়ে ধরতেই সে আপত্তি জানাল, আমাকে নয়। আপনার আর আমার মাঝখানে একটা হাত আছে, সেটা ধরুন। খুব ইজি হয়ে বসে থাকুন। পাদানিতে পা রেখেছেন? গুড।

রামচন্দ্রবাবু বললেন, এত টেনল্ড হওয়ার দরকার নেই। আমি প্রশান্ত মহাসাগরে একা-একা প্যাড়লিং করেছি। অমন ঢেউ বঙ্গোপসাগরে ওঠে না।

জাহাজে যিনি চাকরি করেছেন তিনি সমুদ্রে অনেক কিছু করতে পারেন। অর্জুন আলো জ্বালিয়ে থানা থেকে বের হতে-না-হতেই বুঝল রামচন্দ্রবাবু স্বাভাবিকভাবে বসে নেই। তাঁর শরীর শক্ত হয়ে গেছে এবং একদিকে হেলে আছেন। সে সতর্ক হয়ে চালাতে লাগল। একটুও গতি না বাড়িয়ে শহরের জনাকীর্ণ এলাকা বাদ দিয়ে একটু ঘুরে করলা নদী পেরিয়ে রায়কতপাড়ার দিকে এগোতে লাগল। বাইক চলার পর থেকে মাঝে-মাঝে ঘোঁত-ঘোঁত করে শাস নেওয়া ছাড়া রামচন্দ্রবাবু কোনও শব্দ করেননি। রাজবাড়ির গেটের কাছে পৌঁছে সে বাইক থামাল, এবার কোনদিকে যাব?।

কোনও সাড়া এল না। অর্জুন মুখ ফিরিয়ে দেখল বৃদ্ধ চোখ বন্ধ করে বসে আছেন। সে আবার জিজ্ঞেস করল, আপনার বাড়ি কোন দিকে?

এবার চোখ খুললেন বৃদ্ধ, আমরা কোথায় এসেছি?

ঠিক রাজবাড়ির গেটের সামনে।

আর একটু এগিয়ে, ডান দিকে। রামচন্দ্রবাবু নিশ্বাস ফেললেন, নীল রঙের বাড়ি।

অর্জুন বাইকটাকে খানিকটা এগিয়ে নিয়ে যেতেই একটা নীল রঙের বাড়ি দেখতে পেল। সেই বাড়িতে কোনও আলো জ্বলছে না। কোনও মানুষ আছে বলেও মনে হচ্ছে না। সাদাসাপটা এতলা বাড়ি। অর্জুন স্টার্ট বন্ধ করে বলল, নামুন।

রামচন্দ্রবাবু যেভাবে নামলেন তাতে মনে হল ওঁর শরীরে বিন্দুমাত্র শক্তি অবশিষ্ট নেই। দাঁড়ানোর পরও তিনি টলতে লাগলেন। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আপনার শরীর খারাপ লাগছে? সেরকম নয়। আসলে ভেতরে-ভেতরে খুব দুর্বল হয়ে গেছি দেখছি। এই একমাসে ওরা আমাকে এতটা কাহিল করে দিয়েছে বুঝতে পারিনি। কী ছিলাম, কী হয়ে গেলাম।

অর্জুন বৃদ্ধকে ধরে ধীরে-ধীরে বাড়িটার দরজায় নিয়ে গিয়ে দেখল দরজায় তালা ঝুলছে।

রামচন্দ্রবাবু পাঞ্জাবির পকেট থেকে একথোকা চাবি বের করে রাস্তার আলোর সামনে তুলে ধরলেন। তারপর একটাকে বেছে নিয়ে তালা খুললেন। ভেতরে ঢুকে আলো জ্বালার পর তাঁকে অনেক স্বাভাবিক দেখাল। অর্জুন বলল, তা হলে এবার আমি যাই।

যাই মানে? এতদূরে পৌঁছে দিলেন, একটু কফি না খাইয়ে ছাড়ব কেন?

কী দরকার–।

নাথিং। কোনও দরকাব নেই। আসলে এখন আপনি থাকলে আমার ভাল লাগবে। দরজা বন্ধ করে বেতের চেয়ার দেখিয়ে দিলেন রামচন্দ্রবাবু।

বাড়িতে আর কেউ নেই?

কে থাকবে? না। এই পৃথিবীতে আমি একা। আরে ভাই নাবিকের কাজ করতাম। নিজের কাজ নিজে করার অভ্যেস এমন তৈরি হয়ে গেছে যে, কারও অভাব অনুভব করি না। শুধু এই একমাস ধরে। আর ওই কার্ভালোটাই আমার সর্বনাশ করল।

কার্ভালো কে? অর্জুনের মনে পড়ল সেই ঐতিহাসিক চরিত্রটির কথা, যাকে নিয়ে নাটক হয়েছে।

আমার বন্ধু। জাহাজে একসঙ্গে কাজ করতাম। দাঁড়ান, জল বসিয়ে আসি। রামচন্দ্র চলে গেলেন ভেতরে। অর্জুন তাকিয়ে দেখল এই ঘরে চারটে বেতের চেয়ার আর গোল টেবিল ছাড়া অন্য কোনও আসবাব নেই। শুধু পেছনের দেওয়ালে একটা বিরাট ছবি ঝুলছে। ছবিটি জাহাজের। নাবিকের বাড়ি বলেই সম্ভবত জাহাজের ছবি। হয়তো ভদ্রলোক ওই জাহাজেই অনেকদিন কাজ করেছেন। রামচন্দ্রের বন্ধু কার্ভালো। অদ্ভুত ব্যাপার। অর্জুন মনে-মনে হাসল। এতক্ষণ ধরে ভদ্রলোককে যা দেখেছে তাতে পাগল বলে মনে করার মতো কিছু ঘটেনি। কথায় কথায় অবশ্য একমাসের কথা শোনাচ্ছেন, কেউ বা কারা নাকি ওঁকে মিডিয়াম বানাচ্ছে। এই কারণেই তিনি থানায় গিয়েছিলেন ডায়েরি করতে। ব্যাপারটা পুরো না শুনলে হাস্যকর লাগা স্বাভাবিক। অপরাধ করে বা না করে গ্রেফতারের সম্ভাবনা থাকলে কেউ-কেউ কোর্টে যান আগাম জামিন চাইতে। এই প্রথা চালু আছে। কিন্তু কেউ আমাকে দিয়ে কোনও অপরাধ করিয়ে নিতে পারে বলে আশঙ্কা করে আজ পর্যন্ত কেউ কোথাও ডায়েরি করছে বলে সে শোনেনি। অর্জুনের কেবলই মনে হচ্ছিল রামচন্দ্র রায় মিথ্যে কথা বলেননি। তা হলে উনি কার মিডিয়াম হচ্ছেন?

কফির ট্রে নিয়ে ঘরে ঢুকে বেতের চেয়ারে রাখলেন রামচন্দ্রবাবু। চিনি আলাদা পাত্রে রয়েছে। পাশের ছোট কাপে সামান্য দুধ। বললেন, আমি চিনি-দুধ খাই না। আপনার যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু মিশিয়ে নিন।

চুপচাপ রান্নার কাজটা সেরে কফিতে চুমুক দিয়ে অর্জুন জিজ্ঞেস করল, এই বাড়িতে আপনি কদ্দিন আছেন? নিজের বাড়ি?

আছি বছরখানেক। হ্যাঁ, নিজের বাড়ি। কিনেছিলাম বছর কুড়ি আগে। এতদিন ভাড়াটে ছিল। অনেক কষ্টে তাদের তুলে এখানে এলাম। এই বাড়ির একটা গল্প আছে।

কী রকম?

এই জমিটা ছিল আমার বাবার। জলপাইগুড়ির রাজার কাছ থেকে পেয়েছিলেন তিনি। আমি জন্মাবার পরে তিনি মারা যান। অভাবের তাড়নায় মা এই জমিটাকে বিক্রি করতে বাধ্য হয়ে আমাকে নিয়ে চলে যান মামার বাড়িতে। মামা থাকতেন বালুরঘাটে। সেখানেই আমার শৈশব কাটে। মায়ের মনে খুব দুঃখ ছিল জমিটা বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিলেন বলে। কুড়ি বছর আগে আমি এই শহরে ফিরে এলাম জমিটাকে আবার কিনে নেব বলে। নিজেদের জমি অনেক বেশি দাম দিয়ে কিনতে হল। তখন অবশ্য মা পৃথিবীতে নেই। এই বাড়ি বানিয়ে ভাড়া দিয়ে চলে গিয়েছিলাম সে-সময়।

রামচন্দ্রবাবু চোখ বন্ধ করে মুখ ওপরে তুললেন, কিছু শুনতে পাচ্ছেন?

অর্জুন অবাক হয়ে শোনার চেষ্টা করল, কই না তো!

একটা মেটালিক সাউন্ড। টানা?

না। আমার কানে কিছু আসছে না।

আপনি তো সত্যের সন্ধান করেন। আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট। পুলিশ কী করবে জানি না, আপনি আমাকে সাহায্য করতে পারেন?

আপনি কী সাহায্য চাইছেন?

আমাকে বাঁচান। গত এক মাস ধরে, ওই কার্ভালো আসার পর থেকেই এই ব্যাপারটা আরম্ভ হয়েছে। রোজ রাত্রে কেউ বা কারা আমাকে অথর্ব করে দিচ্ছে। তখন আমার কোনও ইচ্ছাশক্তি থাকে না। আমি তাকাই কিন্তু কিছু দেখি না, আমি শুনি কিন্তু বলতে পারি না।

আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে সেইসব ভৌতিক গল্পের মতো।

হাত তুলে বাধা দিলেন রামচন্দ্রবাবু, না, না। ভুল করবেন না। এরা ভূত নয়। কর্মজীবনে আমি অনেক ভূতের গল্প শুনে খুঁজতে গিয়ে কিছুই পাইনি। অবশ্য তারা সবাই সামুদ্রিক ভূত। ইন ফ্যাক্ট, ভূত বলে কিছু আছে আমি বিশ্বাস করি না।

যারা আপনাকে অবশ করে দেয়, তাদের আপনি দেখতে পান?

না। কিন্তু অনুভব করতে পারি। আর অনুভব মানে পুরো দেখা নয়। মনে হয় প্রচণ্ড শক্তিধর ওরা। আমাকে যা বলছে তা না করে আমার উপায় নেই। ধরুন, ওরা যদি আমাকে বলে কাউকে খুন করে আসতে, তা হলে সেটা আমি নিজের অজান্তেই করে ফেলব। তারপর দিনের বেলায় পুলিশ যখন আমাকে অ্যারেস্ট করবে তখন বোঝাতে পারব না ওটা স্ব-ইচ্ছায় করিনি। আমি ঝড়, জল, উত্তাল সমুদ্রের সঙ্গে লড়াই করেছি। একবার অতলান্তিকে দশদিন লাইফবোটে ভেসে ছিলাম। কিন্তু এখানে আমি অসহায়, লড়াই করার কোনও সুযোগই নেই। বলতে বলতে হঠাৎ চুপ করে গেলেন রামচন্দ্র রায়, শুনতে পাচ্ছেন এবার? সিগন্যালিং টিউন?

অর্জুন কিছুই শুনতে পেল না। কিন্তু ওর মনে হল বৃদ্ধ বানিয়ে গল্প বলছেন। ব্যাপারটার পেছনে সত্যতা আছে। সে জিজ্ঞেস করল, কার্ভালোর বয়স কত?

অলমোস্ট মাই এজ। আমার তিন মাস বাদে কাজ ছেড়েছে সে।

উনি কেন এসেছিলেন আপনার কাছে?

একসঙ্গে জাহাজে কাজ করেছি। ভালই সম্পর্ক ছিল। ও অবশ্য বিবাহিত। দমনে নিজের বাড়ি। যে লাইফবোটে আমরা ভাসতে বাধ্য হয়েছিলাম তাতে ও আমার সঙ্গী ছিল। আমার ঠিকানা কার্ভালো জানত। হঠাৎ এক দুপুরে সে আমার কাছে এসে হাজির।

তারপর?

খুব অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল ওকে। একটা রাত ছিল। তার পরদিন হঠাৎই চলে গেল। যাওয়ার আগে বলে গেল অসমের দিকে যাচ্ছে। ফেরার সময় দেখা করে যাবে। আর হ্যাঁ, ওর সঙ্গে কিছু লাগেজ ছিল, তার একটা রেখে গেল ঝামেলা কমাতে।

কী লাগেজ?

একটা সুটকেস।

দেখতে পারি সেটা?

মানে? কার্ভালোর সুটকেস তার অনুমতি ছাড়া খোলা ঠিক হবে?

উনি একমাস হল অসমে চলে গেছেন। থাকেন সেই দমনে। এর মধ্যে আপনাকে কোনও চিঠি লেখেননি। যদি আর কখনও ভদ্রলোক ফিরে না আসেন তা হলে কী করবেন?

তা কেন? ফিরে আসবে না কেন?

আপনিই বললেন ভদ্রলোককে খুব অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল। ওই সুটকেসে কী জিনিস তিনি রেখে গিয়েছেন তা কে বলতে পারে। হয়তো বেআইনি কিছু যার জন্যে পুলিশ আপনাকে গ্রেফতার করতে পারে।

আমাকে কেন করবে? সুটকেস তো আমার নয়।

কী করে প্রমাণ করবেন? ওটা তো আপনার হেফাজতে পাওয়া যাবে।

আচ্ছা! রামচন্দ্র রায় গালে হাত বোলালেন, কিন্তু ওর চাবি তো আমার কাছে নেই।

সুটকেসটা কোথায়?

পাশের ঘরে।

চলুন। অর্জুন কফির কাপ রেখে উঠে দাঁড়াল।

নিতান্ত অনিচ্ছায় রামচন্দ্রবাবু পাশের ঘরে ঢুকলেন। এ-ঘরে একটা খাট, আলমারি এবং কিছু নিত্য ব্যবহারের জিনিসপত্র আছে। ঘরের কোণে একটা সুটকেস দাঁড় করানো। বাজারে চলতি এক নামী কোম্পানির দামি সুটকেস। কোনও ঢাকনা না থাকায় দীর্ঘ যাত্রার চিহ্নস্বরূপ প্রচুর দাগ সুটকেসের শরীরে। রামচন্দ্রবাবু বললেন, এইটি কার্ভালোর সুটকেস।

অর্জুন হাঁটু মুড়ে সে সুটকেসের লক পরীক্ষা করল। না, চাবি দিয়ে খোলার ব্যবস্থা নেই। নম্বর ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে কোড মিললে ওটা খুলবে। সুটকেসটি যথেষ্ট মজবুত। এই সুটকেস খোলা তার পক্ষে সম্ভব নয়। হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে নিশ্চয়ই খোলা যায় কিন্তু সেটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। অর্জুন উঠে দাঁড়াল, ল্যাংড়া-পাঁচুকে ডেকে আনতে হবে।

ল্যাংড়া-পাঁচু?

এই শহরের সবচেয়ে ওস্তাদ তালা-খুলিয়ে! আগে এটাই ব্যবসা ছিল। আমি একবার ওকে বাঁচিয়েছিলাম। কিন্তু ল্যাংড়া-পাঁচুকে এখন পাওয়া যাবে না। কাল সকালে ওকে নিয়ে আসব। আমি এখন চলি, আপনি বিশ্রাম করুন।

কিন্তু, কিন্তু আজ রাত্রেও ওরা আসবে।

নাও আসতে পারে।

অসম্ভব। আমি সিগন্যাল শুনতে পাচ্ছি। ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে।

আপনি কি চাইছেন আমি এখানে থাকি?

রামচন্দ্রবাবু তাকালেন, নাঃ। থাক। আপনি কাল সকালে আসবেন বললেন?

হ্যাঁ।

তা হলে একটু তাড়াতাড়ি আসবেন। আর যাওয়ার সময় বাইরের দরজায় তালা দিয়ে যান। আমি যদি এই বাড়ি থেকে বের হতে না পারি তাহলে নিজের অজান্তে কোনও অন্যায় করা সম্ভব হবে না। চাবির থোকটা এগিয়ে ধরলেন বৃদ্ধ।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও ওঁর কথা মান্য করল অর্জুন। বাইক চালু করে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল বাড়িটার জানলাগুলো খোলেননি রামচন্দ্রবাবু। আলো বেরিয়ে আসছে ঘুলঘুলি দিয়ে। সে গতি বাড়াল।

জেলখানার কাছে এসে বাইক থামাল অর্জুন। তার মনে হল, এটা ঠিক নয়। একজন মানুষকে তাঁর ইচ্ছানুযায়ী সারারাত বাড়িতে বন্দি করে রাখা উচিত হচ্ছে না। শরীর খারাপ হলেও বাড়ি থেকে বেরোতে পারবেন না ভদ্রলোক। কেউ এলে দরজা খুলে দিতে পারবেন না। সে বাইকটাকে বাঁ দিকে ঘোরাল।

ল্যাংড়া-পাঁচু এক সময় এই শহরের খুব নামী অপরাধী ছিল। যে-কোনও তালা খুলে দিতে তার জুড়ি ছিল না। চোর-ডাকাতের কাছে তাই ওর খুব চাহিদা ছিল! নিজে চুরি বা ডাকাতি না করলেও টাকা নিয়ে দলের সঙ্গে গিয়ে তালা খুলে দেওয়ার অপরাধে অনেকবার জেল খেটেছে সে। শেষবার একটা ডাকাতির কেসে তালা খোলার অভিযোগে পুলিশ ওকে গ্রেফতার করে। ডাকাতরা বাড়ির দারোয়ানটিকে মেরে ফেলেছিল। সেই খুনের দায় ল্যাংড়া-পাঁচুর ঘাড়েও চেপেছিল। কিন্তু পুলিশ ডাকাতদের ধরতে পারেনি, ল্যাংড়া-পাঁচুকে ধরেছিল অনুমানের ওপর নির্ভর করে। ল্যাংড়া-পাঁচুর বউ ছুটে গিয়েছিল অমলদার কাছে। তার স্বামী নিরাপরাধ, অন্তত এই ডাকাতির সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই, ডাকাতির রাত্রে পেট খারাপ হওয়ায় সে বাড়িতেই শুয়েছিল, এইসব বলে অমলদার সাহায্য চেয়েছিল পাঁচজনের পরামর্শে। অমলদা সেই মহিলাকে প্রশ্ন করেই নিশ্চিত হন ল্যাংড়া-পাঁচু নিরাপরাধ। তিনিই অর্জুনকে নির্দেশ দেন ল্যাংড়া-পাঁচু সম্পর্কে পুলিশের ভুল প্রমাণ দাখিল করে ভাঙিয়ে দিতে। বেশ পরিশ্রম করতে হয়েছিল সেবার অর্জুনকে। আর তারপর থেকেই ল্যাংড়া-পাঁচু ওকে খুব সমীহ করে। অর্জুনের কাছে কথা দিয়েছিল তালা খোলার কাজ সে ছেড়ে দেবে। ল্যাংড়া-পাঁচু এখন লটারির টিকিট বিক্রি করে কদমতলার মোড়ে। কিন্তু সন্ধে হলেই লোকটা খারাপ আড্ডায় চলে যায়। এই সময় তাকে দিয়ে কিছু করানো অসম্ভব। এই নেশার পেছনে তার যুক্তি হল, ওখানে গেলেই মাথার ভেতরটা ফাঁকা হয়ে যায়, তখন কোনও পার্টি এসে হাজার টাকা দিলেও সে তালা খুলতে পারবে না। চোর-ডাকাতরা ব্যাপারটা জেনে যাওয়ায় এখন আর ল্যাংড়া-পাঁচুকে বিরক্ত করে না।

ল্যাংড়া-পাঁচুকে এই সময় বাড়িতে পাওয়া যাবে না। দুদিন রাত দশটার পরে তাকে পুঁদ হয়ে বাড়ি ফিরতে দেখেছে সে। কিন্তু কোথায় কোন আড্ডায় যায় তা নিশ্চয়ই ওর বউ জানে। বাইক নিয়ে অর্জুন সোজা ল্যাংড়া-পাঁচুর বাড়িতে চলে এল। শহরের একপ্রান্তে খুবই গরিব পরিবেশে ল্যাংড়া-পাঁচু থাকে। ভেতরে হ্যারিকেন জ্বলছে। বাইকের আওয়াজ পেয়ে কিছু কৌতূহলী মানুষের সঙ্গে ল্যাংড়া-পাঁচুর বউও বেরিয়ে এসে ওকে দেখে ঘোমটা টানল, ওমা আপনি?

পাঁচুবাবু আছে?

আজ্ঞে, এই সময় আপনি তো সব জানেন!

হ্যাঁ, কোথায় গিয়ে খায় ওসব? আমার খুব দরকার ওকে।

ল্যাংড়া-পাঁচুর বউ ঠিকানাটা বুঝিয়ে দিয়ে বলল, একটু দাঁড়ান।

অর্জুন বাইকে বসে দেখল মহিলা ঘরের ভেতর চলে গেল দৌড়ে। ছেলে, বুড়ো, মহিলারা তাকে দেখছে। নিজেদের মধ্যে কথা বলছে তাকে নিয়ে। একটু পরে মহিলা ফিরে এসে একটা কাগজের মোড়ক দিল, কথা বলতে না পারলে এইটে দেবেন। আপনার উপকার আমি জীবনে ভুলতে পারব না বাবু। শুধু এই খারাপ আড্ডাটা যদি ওকে ছাড়িয়ে দেন।

অর্জুন কোনও মন্তব্য না করে মোড়কটি নিয়ে বাইক ঘোরাল। হাসপাতালের উলটো রাস্তায় ঢুকে নির্দিষ্ট একটা বাড়ির ভেতরের বারান্দায় ল্যাংড়া-পাঁচুকে পাওয়া গেল। দু হাতে ছিলিম ধরে টান দিতে গিয়ে তাকে দেখে থমকে গেল, আপনি?

যাক, ঠিক আছ এখনও। একটু এসো, কথা আছে।

করুণ দৃষ্টিতে হাতে ধরা জিনিসটার দিকে একবার তাকিয়ে সঙ্গীদের একজনের হাতে তুলে দিয়ে ল্যাংড়া-পাঁচু নেমে এল বারান্দা থেকে, বলুন বাবু।

তোমার মাথা ঠিক আছে?

আজ্ঞে? ও, প্রথম টান দিতে যাচ্ছিলাম। আজ সন্ধে-সন্ধে বেশ খদ্দের হয়ে যাওয়ায় এখানে আসতে দেরি হয়ে গেল। একদম ঠিক আছে মাথা। ল্যাংড়া-পাঁচু মুখ নিচু করল।

তা হলে তোমার বউয়ের দেওয়া এই জিনিসটার দরকার হচ্ছে না।

মোড়কটা দেখল ল্যাংড়া-পাঁচু। দেখে হাসল, তাই বলুন। এই ঠিকানা সে দিয়েছে। এই কাগজে কী দিয়েছে জানেন? দ্যাখেননি? তেঁতুল। নেশার পর তেঁতুল খেলেই আমার বমি হয়ে যায়।

বুঝলাম। বাইক চালু করে অর্জুন হুকুম করল, পেছনে ওঠো।

ল্যাংড়া-পাঁচু ইতস্তত করছিল কিন্তু আদেশ অমান্য করল না। বাইক চলতে আরম্ভ করলে সে বলল, আপনি যা ভাবছেন তা নয়। ইচ্ছে করলে আমি দিনের পর দিন নেশা না করে থাকতে পারি। আসলে সময় কাটে না বলেই এই আড্ডায় চলে আসি।

অর্জুন কিছু বলল না। সে রামচন্দ্র রায়ের বাড়ির দিকে যেতে লাগল।

সেটা লক্ষ করে ল্যাংড়া পাঁচু বলল, ও, যা ভেবেছিলাম তা নয়।

কী ভেবেছিলে? বাইক চালাতে-চালাতে জিজ্ঞেস করল অর্জুন।

আমি ভেবেছিলাম আবার আমাকে থানায় ঢোকাচ্ছেন আপনি।

আড্ডাটা না ছাড়লে সেটা করতে হবে।

আপনি আমাকে বাঁচিয়েছেন, যা বলবেন তাই করব।

অর্জুন আর কথা বাড়াল। রামচন্দ্র রায়ের বাড়ির সামনে পৌঁছে বাইক থামাল সে। ল্যাংড়া-পাঁচু নেমে দাঁড়ালে সে বলল, শোনন, এই বাড়িতে একটা সুটকেস আছে। চাবি পাওয়া যাচ্ছে না। তোমাকে খুলে দিতে হবে।

কথা বলে সে এগিয়ে গিয়ে বাইরের দরজার তালা খুলে ডাকল, মিস্টার। রায়।

যাচ্ছি। ভেতর থেকে গলা ভেসে এল। বা

ইরের ঘরের আলো জ্বেলে অর্জুন ল্যাংড়া-পাঁচুকে বসতে বললে সে সন্তর্পণে চেয়ারে বসে জিজ্ঞেস করল, সুটকেসটা কার বাবু?

কেন? চমকে তাকাল অর্জুন।

যাঁর সুটকেস তিনি সামনে না থাকলে আমি ওটা খুলব না বাবু।

হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত?

আজ্ঞে, হঠাৎ নয়। আপনি ছাড়াবার পর আমি তো এই কারবার ছেড়ে দিয়েছি। কত টাকার লোভ দেখানো হয়েছে কিন্তু আমি বলেছি, মন, তুই নরম হসনি। একটা কেস মানে কয়েক বছর জেল। তাই অন্যের সুটকেসে হাত দিই না।

ল্যাংড়া-পাঁচুর সিরিয়াস মুখের দিকে তাকিয়ে অর্জুন একটু অপ্রস্তুত হল। জেলের ভাত খাওয়া থেকে বের করে নিয়ে সে নিজে ল্যাংড়া-পাঁচুকে বলেছিল, অন্যের তালা মালিকের অজান্তে যেন কোনওদিন না খোলে। সেই কথাই আজ ল্যাংড়া-পাঁচু সুযোগ বুঝে ফিরিয়ে দিল। সে বলল, দ্যাখো, তুমি যখন অন্যের অজান্তে তালা খুলতে তখন মানুষের সর্বনাশ হত। আজকের কাজটা করলে একজন ভাল মানুষের উপকার হবে। তার চেয়ে বড় কথা, আমি তোমাকে অন্যায় কিছু করতে বলব না।

অর্জুনের কথা শেষ হওয়ামাত্র রামচন্দ্র রায় হাজির হলেন, কী ব্যাপার? কাল সকালে আসার কথা ছিল না?

অর্জুন বৃদ্ধকে দেখল, আপনি ঠিক আছেন তো?

তার মানে?

বাঃ, আপনিই তো বলেছেন কারও সিগন্যাল শুনতে পাচ্ছিলেন।

রামচন্দ্রবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, ওসব ব্যাপার হালকাভাবে না বলাই ভাল। এখন বলুন কী জন্যে আবার ফিরে আসতে হল! আমি তো রাত্রের খাওয়া সেরে নিলাম।

ভালই করেছেন। ইনি হলেন পাঁচবাবু। এঁর কথা খানিক আগে আপনাকে বলেছি। অর্জুন হাসল, সুটকেসটাকে দেখাতে চাই।

রামচন্দ্র কথা খরচ না করে ওদের ভেতরের ঘরে নিয়ে এলেন। ল্যাংড়া-পাঁচু সুটকেসটায় হাত দিয়ে কিছুক্ষণ বসে রইল। তারপর নম্বর ঘোরাবার জায়গাটায় আঙুল বোলাতে লাগল। অর্জুন সেটা লক্ষ করে বলল, ওহো, এই কথাটা বলা হয়নি। চাবি ঢুকিয়ে তালা খোলার সুটকেস এটা নয়। ঠিকঠাক নম্বর এলে এর ডালা খুলে যায়।

ল্যাংড়া-পাঁচু হাসল, নম্বরই বলুন আর চাবিই বলুন, ভেতরে তো একটা তালা আছে। হুকটা আটকে আছে তাতে। একটু অনুভব করতে দিন।

রামচন্দ্র রায় জিজ্ঞেস করলেন, অনুভব? শক্ত সুটকেসের বাইরে হাত দিয়ে ভেতরটা অনুভব করা যায়?।

যে যেমন পারে। তারে আঙুল দিলে কেউ শুধুই টুং টাং শব্দ করে, কেউ গান বাজায়। একটু চুপ করুন আপনারা। পারব কি না জানি না, তবু চেষ্টা করতে দিন।  ল্যাংড়া-পাঁচু চোখ বন্ধ করল।

এক, দুই করে বেশ কয়েক মিনিট যাওয়ার পর ল্যাংড়া-পাঁচু বলল, ওই যাঃ। যন্ত্রপাতি তো সঙ্গে আনিনি। এমনভাবে চলে আসতে হল! একটা সরু অথচ শক্ত তার পাওয়া যাবে?

রামচন্দ্রবাবু ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। সরু তার পাওয়া যাচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত ইলেকট্রিকের তার রবারের ভেতর থেকে বের করে পাকিয়ে কি এক অদ্ভুত কায়দায় সোজা করে চেষ্টা চালাল ল্যাংড়া-পাঁচু। প্রায় আধঘণ্টা ধরে নাছোড়বান্দা ল্যাংড়া-পাঁচু পড়ে রইল সুটকেস নিয়ে। শেষতক খট করে একটা শব্দ হতেই তার গলায় উল্লাস শোনা গেল, হু। হবে না মানে? আঙুলগুলো মরে গেছে নাকি! নিন বাবু, ডালাটা খুলুন। আপনিই দেখুন ভেতরে কী আছে!

সুটকেসটাকে টেনে এনে অর্জুন ডালা খুলল। সুটকেসের ভেতরে টাইট করে বসিয়ে রাখা হয়েছে থার্মোকোলের বাক্স। সেটাকে বাইরে বের করতে খানিকটা অসুবিধে হল। ওপরের ঢাকনা খোলর পর আবার একটি থামোকোলের বাক্স। খুব ভঙ্গুর অথচ মূল্যবান জিনিসকেই মানুষ এমন যত্নে সতর্কতার সঙ্গে রাখে। দ্বিতীয় বাক্সটা খুলতেই একটা নীল আলোর দপদপানি টের পাওয়া গেল। চকচকে এক ধাতব বস্তু থেকে নীল আলো জ্বলছে নিভছে।

ল্যাংড়া-পাঁচু জিজ্ঞেস করল, এ কী জিনিস বাবু?

অর্জুন তল পাচ্ছিল না। সে যন্ত্রের কাছে কান নিয়ে গিয়ে কোনও শব্দ শুনতে পেল না। একটা চকচকে চৌকো বাক্স। আলোটা জ্বলছে নিভছে ওর ভেতরে। ওপরের ছিদ্র থেকে তার একটা অংশ ছিটকে আসছে। সে যন্ত্রটার গায়ে হাত বোলাতে লাগল। হঠাৎ তার মনে হল রামচন্দ্র রায় যে সিগন্যাল শোনেন তা এখান থেকেই বের হয় না তো!

ওটা সরিয়ে ফেলুন। পেছন থেকে রামচন্দ্রবাবুর চাপা গলা শোনা গেল।

এটা কী? আমি এরকম জিনিস কখনও দেখিনি। কার্ভালো কি কিছু বলেছে আপনাকে?

না, কার্ভালো কিছু বলেনি। কিন্তু ওটা সরিয়ে ফেলুন। রামচন্দ্রবাবুর গলা অন্যরকম হয়ে যাচ্ছিল।

কেন?

যে-সিগন্যালটা আমি শুনি তা এই ঘরে ঢুকে ওই বাক্সের মধ্যে যেন মিলিয়ে যায়। কাল রাত্রেও আমার মনে হয়েছিল সেটা। আপনাদের বলতে পারিনি।

এই বাক্সে মিলিয়ে যায়, না বাক্স থেকে শব্দটা বের হয়?

আঃ, বললাম তো বাক্সে ঢুকে যায়। তখন তো বাক্স জানতাম না, মনে হত সুটকেসেই ঢুকে যাচ্ছে শব্দটা। প্লিজ, সরিয়ে ফেলুন ওটাকে।

আপনি এমন ভয় পাচ্ছেন কেন? সারা পৃথিবী ঘুরেছেন আপনি!

তাতে কিছু লাভ নেই। ওরা যখন আমাকে মিডিয়াম করে তখন নিজের কোনও ক্ষমতা থাকে না। একদম পুতুল হয়ে যাই তখন। আমার সামনে থাকলে ওরা যদি চায় তো আপনাকেও খুন করতে পারি। কিন্তু শব্দটা ওই সুটকেসের ভেতর ঢুকে না যাওয়া পর্যন্ত আমি ঠিক থাকি। রামচন্দ্রবাবুকে খুব নার্ভাস দেখাচ্ছিল। অর্জুন যন্ত্রটাকে দেখল। অমলদা থাকলে কী করতেন? এটা কি তা হলে রিসিভার গোছের কিছু? কী রিসিভ করছে? কে সিগন্যালিং করে? হঠাৎ তার মাথায় অন্য চিন্তা এল। মহাকাশ থেকে ওই সিগন্যাল ভেসে আসছে না তো?

সে চটপট যন্ত্রটাকে থার্মোকোলের মধ্যে ঢোকাল। দুটো বাক্সকে সুটকেসে নিয়ে সে রামচন্দ্রবাবুকে বলল, আমি যদি এটা আজকের রাত্রের জন্যে নিয়ে যাই, আপনার আপত্তি হবে?

আপত্তি? আপত্তি কিসের। তবে কার্ভালোর জিনিস, আর ওরা যদি এখানে এসে না পায় তা হলে হয়তো আমার ওপরে খেপে যেতে পারে। বিড়বিড় করছিলেন বৃদ্ধ।

যদি কেউ এসেও থাকে এই বস্তুটি না থাকলে আপনার কাছে আসবে না। অর্জুন উঠে দাঁড়াল, কদমতলার চৌধুরী মেডিক্যাল স্টোর্স চেনেন?

রামচন্দ্র মাথা দোলালেন।

চৌধুরী মেডিক্যালে গিয়ে আমার নাম বললে ওরা বাড়ি দেখিয়ে দেবে। কাল সকালে একবার আসুন। এসো পাঁচু। সুটকেস নিয়ে বাড়ির বাইরে পা বাড়াল অর্জুন।

বাইরে থেকে তালা দিয়ে যাবেন না? রামচন্দ্র রায় কাতর গলায় জিজ্ঞেস করলেন।

আমার বিশ্বাস, তার প্রয়োজন হবে না।

সুটকেস নিয়ে বাইকে ওঠা খুব মুশকিল। সে ল্যাংড়া-পাঁচুকে জিজ্ঞেস করল, এটাকে ধরে বসে থাকতে পারবে? ডালা খোলাই আছে।

ল্যাংড়া-পাঁচু এককথায় রাজি। পেছনের সিটে বসে সুটকেসটাকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করল, বাবু, এটা খুব দামি জিনিস, না?

হুঁ। অর্জুন অন্যমনস্ক ছিল।

কী রকম দাম হবে?

জানি না। রামচন্দ্র রায়ের কথা যদি ঠিক হয় তা হলে এর কোনও দাম কেউ দিতে পারবে না। শক্ত করে ধরে রাখো। অর্জুন বাইকে গতি দিল। পেছনে বসা ল্যাংড়া-পাঁচু সোৎসাহে বলে উঠল, আঃ। আজ কার মুখ দেখে উঠেছিলাম!

অর্জুন সোজা থানায় চলে এল। অবনীবাবু তখনও ফেরেননি। সেকেন্ড অফিসার শঙ্করবাবু অর্জুনকে দেখে মুখ খুলতে গিয়ে থেমে গেলেন পেছনে ল্যাংড়া-পাঁচুকে বসে থাকতে দেখে।

বাইকে বসেই অববাবুর খবরটা জেনে ইতস্তত করছিল অর্জুন। শঙ্করবাবু ল্যাংড়া-পাঁচুকে জিজ্ঞেস করলেন, আবার ফেঁসেছ? একদম সুটকেস সমেত তোমাকে ধরেছেন মনে হচ্ছে!

অর্জুন বাইক থেকে নেমে সুটকেসটাকে হাতে নিল, শঙ্করবাবু একটা উপকার করতে হবে।

নিশ্চয়ই! বলুন, এ আবার কাজ আরম্ভ করেছে তো?

না। ওকে আমিই নিয়ে এসেছি। আপনাদের এখানে মাটির নীচে একটা ঘর আছে না? মানে যেখানে দামি জিনিস রাখা হয়?

হ্যাঁ।

এই সুটকেসটাকে ওখানে আজকের রাত্রের জন্যে রেখে যেতে চাই।

ও। কী আছে ওতে?

মহামূল্যবান একটা জিনিস, কিন্তু কাল সকালের আগে এটা ভোলা যাবে না।

তা হলে তো মুশকিল হল।

কেন?

খাতায় লিখতে হয় কী জিনিস রাখছি। দামি জিনিসের জন্যে এই নিরাপত্তা।

ও। লিখুন সিগন্যালিং মেশিন।

তাই বলুন। স্মাগল গুড। রাখাটা বেআইনি কিন্তু আপনি বলেই রাজি হচ্ছি। দিন।

না। আমি নিজের হাতে রেখে আসব। তুমি এখানেই থাকো পাঁচু।

শঙ্করবাবুর পেছন-পেছন থানার ভেতরে ঢুকে একটা বিশেষ ঘরের মধ্যে দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে গেল অর্জুন। লোহার দরজায় দুটো তালা ঝুলছে। পাশের টেবিলে খাতা। সেই খাতায় লেখাপত্র শেষ করে সেপাইকে দিয়ে দুটো চাবি আনিয়ে দরজা খুললেন শঙ্করবাবু। খুব অন্ধকার। সুইচ টিপে আলো জ্বালতেই কয়েকটা র্যাক দেখা গেল। সবকটা র্যাকই শুন্য। অর্থাৎ, এই মুহূর্তে থানায় কোনও মূল্যবান জিনিস জমা নেই।

সুটকেসটাকে এমন একটা কোণে ঢুকিয়ে দিল অর্জুন যে, সরাসরি টেনে বের করে আনা যাবে না। আলো নিভিয়ে লোহার ভারী দরজা বন্ধ করে তালা দিয়ে দেওয়া হল। সে শঙ্করবাবুকে জিজ্ঞেস করল, ব্যবস্থা মজবুত তো?

মজবুত মানে? পিঁপড়ে ঢোকার পথ নেই। এই তালা স্পেশ্যালি বানানো।

অর্জুন মনে-মনে হাসল। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ল্যাংড়া-পাঁচুর কাছে কোনও তালাই কিছু নয়। তবে ভরসা এই যে, এখন শহরে ওর মতো প্রতিভা দ্বিতীয়টি নেই।।

আগামীকাল সকালে দেখা করবে কথা দিয়ে অর্জুন বাইরে বেরিয়ে এসে ল্যাংড়া-পাঁচুকে পাঁচটা টাকা দিল, যাও, রিকশা করে চলে যাও।

আপনি জানেন না এই সময়ে জলপাইগুড়িতে রিকশা পাওয়া যায় না।

ঠিকই। রাত নটা মানে রিকশাওয়ালাদের কাছে মধ্যরাত। ল্যাংড়া-পাঁচু বলল, আমি হেঁটেই যাব। আমার কথা ভুলবেন না বাবু। পাঁচটা টাকা সে নিয়ে নিল।

মাথার ভেতরটা যেন লোহা হয়ে গেছে। কিছুই ভাবতে পারছিল না সে। বাইকে স্টার্ট দিতেই হঠাৎ মহাদেববাবুর কথা মনে পড়ল। মহাদেব সেন। অমলদার বন্ধু। বয়সে অবশ্য অনেক বড়। দীর্ঘদিন মহাকাশবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করেছেন। এখন একটা চোখ প্রায় অন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাড়িতে চলে এসেছেন। খুব পণ্ডিত মানুষ। অর্জুনের মনে হল মহাদেববাবুর কাছে যাওয়া দরকার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *