০২. বিপ্লববাদী সমাজের অভ্যুত্থান

বিপ্লববাদী সমাজের অভ্যুত্থান

বিগত শতকের সবচেয়ে বড় ঘটনা হচ্ছে ১৯৪৭ খ্রীস্টাব্দে ভারত থেকে ইংরেজের মহাপ্রস্থান ও ভারতের স্বাধীনতা লাভ। সেটা কি করে ঘটেছিল, সেটাই এখানে বলছি।

যদিও স্বাধীনতা লাভের উদ্দেশ্যে জনমত গঠনের জন্য ১৮৮৫ খ্রীস্টাব্দেই ‘ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস’ স্থাপিত হয়ে গিয়েছিল, তা হলেও ওটা বিপ্লববাদী সংস্থা ছিল না। জাতীয় কংগ্রেস সহাপনের পাবে। সংঘটিত যে সব ঘটনাকে আমরা স্বাধীনতা লাভের পদক্ষেপ বলে চিহ্নিত করি সেগলো বিপ্লব নয়, বিদ্রোহ মাত্র। প্রকৃত বিপ্লববাদের আগুন জ্বলে ওঠে। বঙ্গভঙ্গকে উপলক্ষ করে। বঙ্গদেশের আয়তন এককালে অনেক বড় ছিল। কিন্তু তাকে ছোট করে আনা হয়েছিল বঙ্গ, আসাম, বিহার, ওড়িষা ও ছোটনাগপুরে। তারপর আসাম প্রদেশকে পথিক করে একজন চীফ কমিশনারের শাসনাধীনে ন্যস্ত করা হয়। মোট কথা নানারকম রাজনৈতিক কারণে ব্রিটিশ সরকার বঙ্গদেশকে খর্ব করবার অপচেষ্টায় ব্যস্ত ছিল। ১৯০৩ খ্রীস্টাব্দে মধ্যপ্রদেশের চীফ কমিশনার স্যার অ্যানড্রু ফ্লেজার প্রস্তাব করেন যে বঙ্গদেশকে দু’খণ্ডে বিভক্ত করা হউক। প্রস্তাবটা বঙ্গদেশের সবার গভীর অসন্তোষ সৃষ্টি করে। এমন কি ইংরেজ মালিকানাবিশিষ্ট ও ইংরেজ কর্তৃক সম্পাদিত ‘ইংলিশম্যান’ পত্রিকাতেও বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে লেখা হয়। কিন্তু এসব সত্বেও ১৯o৫ খ্রীস্টাব্দের ১৭ অক্টোবর তারিখে বঙ্গদেশকে দ্বিখণ্ডিত করে দেওয়া হয়। পূর্বদিকে সৃষ্টি হল আসাম ও পূর্ব বঙ্গ প্রদেশ ও পশ্চিমে বাকি অংশ। চতুর্দিকে বিদ্বেষের বহ্নি জ্বলে উঠল। বিলাতী পণ্য বর্জন করা হল। যারা বিলাতী জিনিষের দোকানে পিকেটিং করল, তাদের ওপর পুলিশ নিষ্ঠুর অত্যাচার করল। এর প্রতিক্রিয়ায় শিক্ষিত সমাজের মধ্যে ভীষণ অসন্তোষ প্রকাশ পেল।

আন্দোলন থেকে উদ্ভূত হল জাতীয়তাবাদ, আর জাতীয়তাবাদ এক শ্রেণীর মধ্যে বীজ বপন করল বিপ্লববাদের। বিপ্লববাদ প্রসারের জন্য প্রথম যে সমিতি গঠিত হল, তা হচ্ছে অনুশীলন সমিতি। এর শাখা প্রশাখা চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল। এদিকে শ্রীঅরবিন্দের ছোট ভাই বারীন্দ্রের নেতৃত্বে গঠিত হল এক সশস্ত্র বিপ্লবীদল। তারা তাদের গোপন কেন্দ্র করল মানিকতলার খালের ওপারে মুরারীপুকুরে এক নিভৃত বাগানবাড়িতে। বারীন্দ্রের নেতৃত্বে যে দল গঠিত হল, তারা দ’জন সদস্যকে বিদেশে পাঠাল বোমা তৈরী করবার প্রণালী শিখে আসবার জন্য। তারপর মুরারীপুকুরের বাগানবাড়িতে বোমা তৈরির আয়োজন চলতে লাগল। বারীন্দ্রের দলের দজন প্রফাল্ল চাকী ও ক্ষুদিরাম বসু মজাফরপরের দিকে রওনা হল কলকাতার প্রাক্তন প্রেসিডেন্সী ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যা করবার জন্য। ভুল করে তারা কিংসফোর্ডের গাড়ির মত দেখতে অন্য একখানা গাড়ির ওপর বোমা নিক্ষেপ করে। নিহত হয় মিস্টার কেনেডি নামে এক আইনবিদের স্ত্রী ও কন্যা। প্রফুল্ল ঘৃত হয় বটে কিন্তু সে আত্মঘাতী হয়। ক্ষুদিরামের বিচার হয় এবং তাকে ফাঁসি দেওয়া হয়।

এরপর আসে বিশ্বাসঘাতকের পালা। নরেন্দ্ৰ গোস্বামী নামে দলের একজন সদস্য পুলিসের কাছে গোপন তথ্য সরবরাহ করে বারীন্দ্রের দলকে ধরিয়ে দিয়েছিল। কানাইলাল দত্ত ও সত্যেন বসু নামে দলের দু’জন বন্দী জেলখানার মধ্যেই নরেন্দ্রকে হত্যা করে। বিচারে বারীন্দ্র সমেত ১৪ জন অপরাধী সাব্যস্ত হয়। তাদের যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয়। কিন্তু এই সঙ্গে বিপ্লববাদের পরিসমাপ্তি ঘটে না। ১৯০৭ থেকে ১৯১৭ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে ন্যুনাধিক ৬৩ জন নিহত হয়। সংগ্রামের জন্য অর্থসংগ্রহের প্রয়াসে বিপ্লবীদল রাজনৈতিক ডাকাতি শুরু করে। ১৯০৭ থেকে ১৯১৭ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে ১১২টা ডাকাতি হয় এবং ডাকাতরা এভাবে সাত লক্ষ টাকা সংগ্রহ করে।

।।দুই।।

বিপ্লবের জন্য বিদেশে হরদয়ালের নেতৃত্বে এক দল গঠিত হয়। এই দল বিদেশ থেকে ভারতে অস্ত্রশস্ত্ৰ পাঠাবার ব্যবস্থা করে। অস্ত্রশস্ত্র আসছে, এই খবর পেয়ে সেগলো কোন নিভৃত স্থানে নামাবার জন্য যাদুগোপাল মুখুজ্যে যান সুন্দরবনে ও যতীন মুখুজ্যে যান বালেশ্বরে। বালেশ্বরে যতীন মুখুজ্যের কাছে বাটাভিয়ায় অবস্থিত সহানুভূতিশীল জারমান সরকারের প্রতিভূরা বিপ্লবে সাহায্য করবার জন্য টাকা পাঠাতে থাকে। কিন্তু শেষ কিস্তির দশ হাজার টাকা ব্রিটিশ সরকারের হাতে গিয়ে পড়ে। সেই সূত্র ধরে পুলিস যতীন মুখুজ্যের তল্লাসে বেরিয়ে পড়ে। বুড়িবালামের তীরে যতীন মুখুজ্যে ও তার সহকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের এক ভীষণ যুদ্ধ হয়। পুলিশের সঙ্গে সর্ব শক্তি দিয়ে যতীন মুখুজ্যে লড়ে যান। তিনি আহত হন। আহত অবস্থায় হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়।

এদিকে রাসবিহারী বসু, ভারতীয় সৈন্যবাহিনীকে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে উদ্বুদ্ধ করে। বিদ্রোহের দিন নিদিষ্ট হয় ১৯১৫ খ্রীস্টাবেদার ১৯ ফেব্রুয়ারী তারিখে। কিন্তু রাসবিহারীর দলে কিরপাল সিং নামে পুলিশের একজন গুপ্তচর যোগদান করে। তার মারফত সরকার আগে থাকতেই খবর পেয়ে এ চেষ্টা বিফল করে দেয়।

।।তিন৷৷

রাউলাট আইন ও জালিওয়ানাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পদাঙ্কে ১৯২০ খ্রীস্টাব্দের পর থেকে গান্ধীজী হন ভারতীয় কংগ্রেসের অপ্রতিদ্বন্দী নেতা। গান্ধীজী অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভের পথ ঘোষণা করেন। কিন্তু বিধানসভার মাধ্যমে স্বরাজ লাভের আন্দোলন পরিচালনা করবার জন্য দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ গঠিত করলেন ‘স্বরাজ্য পার্টি’। তাঁরা বিধানসভার মধ্যে নানাভাবে সরকারকে বিপর্যস্ত করে তোলেন।

এর মধ্যে কংগ্রেসের মধ্যে বামপন্থী দলের প্রাদুর্ভাব ঘটল। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠিত হল। বিনয়, বাদল, দীনেশ রাইটাস বিলডিং-এর অভ্যন্তরে সিম্পসন সাহেবকে হত্যা করল। ঢাকায় পুলিশ সুপারিনটনডেণ্ট লোম্যান সাহেবও নিহত হল।

আইন অমান্য করে লবণ প্রস্তুতের উদ্দেশ্যে গান্ধীজী ১৯৩০ খ্রীস্টাব্দে ডাণ্ডি অভিমখে যাত্রা করলেন। ১৯৩২ খ্রীস্টাবেদের মধ্যে আইন অমান্য আন্দোলন দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। দলে দলে লোক কারারুদ্ধ হল।

।।চার।।

তারপর এল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। কংগ্রেস প্রথমে যুন্ধে সহযোগিতার প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু সরকার তাতে সাড়া না দেওয়ায় ১৯৪২ খ্রীস্টাব্দে আবার সত্যাগ্ৰহ আন্দোলন শহর হল। সেদিন সমস্ত দেশবাসী আত্মবলে বলীয়ান হয়ে উচ্চকণ্ঠে বলে উঠল-‘করেংগে ইয়া মরেংগে।’ সরকার নেতৃবন্দকে কারারদ্ধ করল। বিক্ষুব্ধ দেশবাসী সংগ্রাম শহর করল ইংরেজের বিরুদ্ধে। ‘আগস্ট বিপ্লব’ নামে আখ্যাত এই সংগ্রাম তীব্র আকার ধারণ করল মেদিনীপর জেলায়। সতীশচন্দ্র সামন্তের অধিনায়কত্বে বিপ্লবীরা সেখানে প্ৰতিষ্ঠিত করল এক স্বাধীন সরকার। প্রায় দেড় বৎসর ইংরেজ শাসন সেখানে বিলুপ্ত হল। ইংরেজ চালালো অমানুষিক অত্যাচার ও ব্যাপক নারীধর্ষণ, পুলিশের গুলি অগ্রাহ্য করে অপূর্ব দেশপ্রেম ও সাহস দেখাল মাতঙ্গিনী হাজরা। সত্তর বৎসর বয়স্কা এই বীরাঙ্গনা মহিলা ললাটে গলিবিদ্ধ অবস্থায় জাতীয় পতাকা দৃঢ়মুষ্টিতে ধরে মৃত্যুবরণ করল। বাঙলার সর্বত্রই চলল উত্তেজনা ও পুলিশের অকথ্য অত্যাচার।

ইতিমধ্যে লড়াইয়ের মধ্যেই ঘটে গেল এক চমকপ্রদ ঘটনা। ‘আগস্ট বিপ্লব’-এর সময় সুভাষ চন্দ্র বসকে কারারুদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু অসুস্থতার কারণে তাঁকে জেলখানা থেকে এনে নিজগহে অন্তরীণ করা হল। কিন্ত ইংরেজের চোখে ধুলো দিয়ে তিনি অন্তর্হিত হলেন ১৯৪১ খ্রীস্টাব্দের ১৮ জানুয়ারী তারিখে। আফগানিস্তানের ভিতর দিয়ে তিনি গিয়ে পৌঁছালেন জারমানীতে। সেখান থেকে জাপানে গিয়ে তিনি গঠন করলেন আজাদ হিন্দ ফৌজ। জাপানী সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে আজাদ হিন্দ ফৌজ আক্ৰমণ হানল ব্ৰহ্মদেশের ওপর। তাসের বাড়ির মত টলমল করে পড়ে যেতে লাগল শহরের পর শহর ও গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটিসমূহ। নেতাজী এসে উপনীত হলেন আসাম সীমান্তে। ধ্বনি তুললেন–‘দিল্লী চল’, ‘লালকেল্লায় গিয়ে স্বাধীন ভারতের পতাকা তোল।’ কিন্তু যুদ্ধের পর নেতাজী আবার হলেন অদৃশ্য।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অবসান ঘটে ১৯৪৫ খ্রীস্টাব্দের মে মাসে। যুদ্ধে জয়লাভ করলে ভারতকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেবে, এ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ইংরেজ। কিন্ত স্বাধীনতার ব্যাপার নিয়ে বিবাদ বাঁধল কংগ্রেস ও মুসলিম লীগে। ১৯৪৬ সালের মাৰ্চ মাসে এল ক্যাবিনেট মিশন, হিন্দু মুসলমানের মধ্যে মীমাংসা করবার জন্য। কিন্ত মীমাংসার সব চেস্টাই ব্যর্থ হল। ওরই পদাঙ্কে লাগল হিন্দ-মুসলমানের মধ্যে দাঙ্গা। নোয়াখালি ও পূর্ব বঙ্গের অন্যত্র দাঙ্গা চরম আকার ধারণ করল। কলকাতাতে দাঙ্গার হাঙ্গামা তরঙ্গে উঠল। ওই দাঙ্গার পদাঙ্কেই দেশ-বিভাগ ও স্বাধীনতা লাভ ঘটল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *