হ্রেষাধ্বনি

হ্রেষাধ্বনি

শনিবারের সকাল বেলা। বেলা এখন সাড়ে দশটা প্রায়। একটু একটু করে গরম পড়তে আরম্ভ করেছে। ফায়ূন মাস। আবার রাত্রের দিকে একটু ঠাণ্ডাও পড়ে। ভোরবেলা ঘাসে এবং গাছের পাতায় এখনও শিশিরবিন্দু চিকচিক করে। রোদ উঠতে না উঠতেই উবে যায়।

কলকাতার পঁচিশ মাইলের উপকণ্ঠে, এই শহরে, রাত্রি পোহায় অন্ধকার থাকতেই। শিল্পাঞ্চল, কারখানার বাঁশি বাজার সঙ্গে সঙ্গেই শ্রমিক কর্মচারীদের সাড়া জাগে। শহর জেগে ওঠে। দোকানপাটও তাই তাড়াতাড়ি খোলে। তারপরে আর এক শ্রেণীর লোকের কাজের তাড়া পড়ে যায়। যারা এখান থেকে কলকাতায় দৈনিক যাত্রী, চাকরি করতে যায়, তারা তাড়াহুড়ো করে বাজার দোকান করে। কোনওরকমে স্নান-খাওয়া সেরে ইস্টিশনের দিকে দৌড়।

তারপরে শহরের নিজের সঙ্গে, নিজের যতটুকু লেন-দেন, ততটুকুই চলে। সেই সন্ধের দিকে, শহর আবার সরগরম হয়। কারখানার লোকজনদের চলাচল কেনাকাটা বাড়ে। কলকাতার যাত্রীরাও ফিরে আসতে থাকে।

এখন বেলা সাড়ে দশটায়, শহরে কোনও চঞ্চলতা নেই। খানিকটা নিঝুম ভাব। বিশেষ করে, বাজার দোকানপাট সীমানার বাইরে, পাড়া ঘরে। প্রাচীন ঠাকুরবাড়িতে প্রত্যহ যা ঘটে, তা-ই ঘটছে। অশোক ওর বন্ধুদের সঙ্গে, মন্দির সংলগ্ন বাইরের রোয়াকে বসে আড্ডা দিচ্ছে। ওদের প্রাচীন বাড়ির বাইরের মহলে অনেকগুলো ঘর। এক সময়ে এই ঠাকুরবাড়ি রীতিমতো জমজমাট ছিল। তথাকথিত আমোদ-প্রমোদ না; বহুতর ধর্মসভা, নানা পাণ্ডিত্যের আলোচনা বিতর্ক চলত। ন্যায় স্মৃতি, নানান দার্শনিক কূট তর্কে যোগদান করার জন্য এ ঠাকুরবাড়িতে নানা দেশের পণ্ডিতেরাও এক সময়ে থাকতেন মাসের পর মাস। সে হিসাবে এ বাড়ি জমজমাট ছিল, নাম ছিল।

এখন এ বাড়ির তিন বংশধর অবশিষ্ট। শহরের লোকে বলে তিন পাগলের বাড়ি। তিন ভাই, অশোক তার মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ। ওর বড় দাদা প্রায় চল্লিশ ছুঁই ছুঁই বয়স। বিয়ে-থা করেনি। করবেও না কোনওদিন। এখন শোনা যাচ্ছে, বাইরের কোনও এক ঘরে, তারস্বরে সে ধ্রুপদ সাধনা করছে। তানপুরা বাজছে, তার সঙ্গে হারু মুচি পাখোয়াজ সঙ্গত করছে।

আর একটি ঘরে যে প্রচণ্ড চেঁচামেচি চলেছে, অনেকে একসঙ্গে কথা বলছে, তা মোটেই ঝগড়া-বিবাদ না। একটু কান পাতলেই শোনা যাবে সেখানে রাহু এবং মঙ্গলের অবস্থিতি, শুক্রের গতি, শনির দৃষ্টি, পঞ্চমে বৃহস্পতি, কেতুর আগমন ইত্যাদি নানাবিধ কথা, এবং তার সঙ্গে যাবতীয় রাশি লগ্নের নাম ঘন ঘন উচ্চারিত। অর্থাৎ ও ঘরে চলছে জ্যোতিষ শাস্ত্রের চর্চা। অশোকের মেজদা হল প্রধান। বয়স তিরিশের উর্ধ্বে। বিয়ে করেনি, করবেও না কোনও দিন।

এই সংগীত জ্যোতিষী বাদ দিলে, অশোককে তেমন বাতিকগ্রস্ত মনে হয় না। ট্রাউজার শার্ট পরে, দামি সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে, বেকার কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে গল্প করছে। অন্তঃপুরে এক দূর সম্পর্কের প্রৌঢ়া আত্মীয়া, তিনি রান্নাবান্না করেন। সেখানে ঘন ঘন চা চেয়ে পাঠানো যায় না। অতএব চায়ের দরকার হলে, রাস্তার মোড়েই চায়ের দোকানে খবর দেওয়া হয়, একটা ছেলে এসে মাটির ভাঁড়ে চা দিয়ে যায়। ইতিমধ্যেই বার দুয়েক তা এসে গিয়েছে। দূপুর পর্যন্ত চলবে।

কিন্তু অশোকের দাদাদের যদি বেকার না বলা যায়, অশোককেও যাবে না। এ শহরে, ইতিমধ্যেই জানাজানি আছে, কোথাও কোনও হত্যা খুন বা বড় রকমের জালিয়াতি হলে, অশোক সঙ্গে সঙ্গে সজাগ হয়ে ওঠে। তখন ও প্রায় কুকুরের মতোই শুঁকে শুঁকে অপরাধের সূত্র এবং অপরাধীকে খোঁজে। এ শহর এবং তার আশেপাশে কয়েকটি খুনের ঘটনায় অপরাধীকে খুঁজে বের করতে পুলিশ ওর সাহায্য পেয়েছে বেশি। সেজন্য ডি, এম. এস. ডি. ও. এবং ডিস্ট্রিক্ট ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ ওকে যথেষ্ট খাতির করে, চিঠি দিয়েও ওকে সম্মানিত করা হয়েছে। যদিও এখানকার থানার ও. সি. শ্যামাপদর ধারণা, অশোক একটি ধাপ্পাবাজ, প্রাচীন ধনী বাড়ির বেকার, সিগারেট ফুকে, দামি পোশাক পরে, দশটা ক্লাব নিয়ে মেতে থাকে। সে মনে করে, অশোক নিজেই একজন অপরাধী–সেইজন্যই সে অপরাধের ঘটনায় জড়িয়ে পড়ে। অশোক নিজেই বলেছে, নিজেকে অপরাধী ভেবেই ও অপরাধের সূত্র খোঁজে। অতএব শ্যামাপদর ধারণা, অশোক নিজেও একজন অপরাধী, নিজেকে বাঁচাবার জন্যই ও আগে থেকে ইনভেস্টিগেট শুরু করে দেয়। অথচ, এ শহরের অন্তত তিনটি মারাত্মক খুনের ঘটনায় খুনি আসামিদের সন্ধান ও-ই দিয়েছে, খুনের কারণ খুঁজে বের করেছে। শ্যামাপদ মুখে যা বলে মনে মনে নিজে তা কতখানি বিশ্বাস করে কে জানে। তবে বড় রকমের কোনও ঘটনা ঘটলেই, সে আগে অশোকের সন্ধান করে। কখনও কখনও মনে হয়, পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের অশোকের প্রতি বোধহয় তার কিঞ্চিৎ স্নেহ-ভালবাসাও আছে। তবে তা ধরা খুবই মুশকিল। অশোককে সে ধমকে ছাড়া কথা বলে না। অশোক মিটিমিটি হাসে। শ্যামাপদ চল্লিশ ছাড়িয়েছে। আজও বিয়ে করেনি, চা সিগারেট কিছুই খায় না, সাত্ত্বিক ধরনের এবং রক্ষণশীল দারোগা। চেহারাটা জবরদস্ত। সেই তুলনায় অশোক একটি ছিপছিপে, লম্বা, রোমান্টিক ছেলে।

.

বেলা সাড়ে দশটায়, ঠাকুরবাড়ি যখন ধ্রুপদে পাখোয়াজে, জ্যোতিষশাস্ত্রের আদ্যশ্রাদ্ধতে এবং লিগের খেলা ও রাজনীতি আলোচনায় ঘর ও রোয়াক সরগরম, তখনই শ্যামাপদর জিপ এসে দাঁড়াল বাইরের বোয়াক ঘেঁষে, একেবারে অশোকদের আড্ডার সামনে। ড্রাইভারের সিটে স্বয়ং শ্যামাপদ। আর কেউ নেই।

অশোক ডেকে বলল, আরে দারোগাবাবু যে। আসুন।

অশোক জানে, ওর মুখে দারোগাবাবু শুনলেই শ্যামাপদ চটে যায়। শ্যামাপদ গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে, তার ঈষদার চোখে একবার অশোককে দেখল, তারপরে ওর বন্ধুদের প্রতি। বেকার দেখলেই শ্যামাপদ খাপ্পা। তার ওপরে তাদের যদি আবার রকে বসে আড্ডা দিতে দেখে, তবে তো কথাই নেই। শ্যামাপদ গাড়ি থেকে নেমে বলল, রকবাজি বেশ ভালই চলছে দেখছি। তা কটি মেয়েকে দেখে শিস দেওয়া আর টিজ করা হল?

অশোক বলল, যে মহিলাকে দেখে আমরা হিড়িক দিই, তিনি তো সন্ধের আগে সেজেগুজে বেরোন না। ওইসময়েই তো উনি রিফুজি মেয়েদের উদ্ধার করতে বেরোন।

অশোকের বন্ধুরা হেসে উঠল। শ্যামাপদ ধমকে উঠল, থাক, তোমার মুখ থেকে আমি ও সব কথা শুনতে চাই না। এখন দিলালি গল্প আর বন্ধুদের ছেড়ে আমার সঙ্গে একটু যেতে পারবে?

অশোক জিজ্ঞেস করল, কোথায়? থানায় নাকি?

 শ্যামাপদ বলল, না, রেললাইনের ধারে, মালীপাড়ায়।

সেখানে কী ব্যাপার?

শ্যামাপদর ভ্রুকুটি চোখে সন্দিগ্ধ জিজ্ঞাসা। বলল, শোনোনি কিছু?

 অশোক বলল, না তো।

শ্যামাপদ অশোকের বন্ধুদের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বলল, তোমার এ সব বেকার বন্ধুরাও কিছু বলেনি?

অশোক বলল, ওরা বোধহয় জানে না।

শ্যামাপদ তার মোটা ঠোঁট উলটে, একটু হাসির ভাব করে বললে, কিংবা ইচ্ছে করেই বলেনি, কারণ নিজেরাই কেউ হয়তো অপরাধ করে এসেছে।

অশোক হেসে উঠে, সিগারেটের প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বলল, দারোগাবাবু, সিগারেট খান। আপনি ৬৭৮ কি রকে বসে একটু চা খাবেন?

শ্যামাপদ হুমকে বলল, আমি ও সব কিছুই খাই না।

তা হলে আমার বন্ধুদের খাওয়াই।

বলে ও ওর বন্ধুদের দিকে সিগারেট বাড়িয়ে দিল। ওর বন্ধুরাও নীরবে হাসছে। হুমকানো দারোগা শ্যামাপদকে ওরাও খানিকটা চেনে। জানে, অশোক আর শ্যামাপদর মধ্যে এখন মান সম্মানের লড়াই চলছে। সকলেই সিগারেট ধরাল।

শ্যামাপদ আবার হাঁকল, কী তুমি যাবে কি যাবে না?

 অশোক সিগারেট ধরিয়ে বলল, কী ব্যাপার কিছুই তো বললেন না। মালীপাড়ায় কী হয়েছে?

ওহ্, না শুনলে বুঝি যাওয়া যায় না? গাড়িতে যেতে যেতে শুনলে হবে না?

অশোক বলল, আপনি যদি তা-ই বলেন, হবে না কেন? তবে আপনি আমার বন্ধুদের দোষারোপ করতে চাইছিলেন, তাই ঘটনাটা শুনতে চাইছিলাম।

শ্যামাপদ আবার সকলের দিকে একবার ভ্রুকুটি চোখে দেখে নিয়ে বলল, মালীপাড়ার পান্না গোয়ালার পাঁচ বছরের মেয়েকে কে বা কারা খুন করে, একটা ভাঙা শিবমন্দিরে ফেলে রেখেছে।

অশোক ভুরু কুঁচকে উচ্চারণ করল, পাঁচ বছরের মেয়ে?

ওর বন্ধুরাও অবাক হয়ে শ্যামাপদর দিকে তাকাল। শ্যামাপদ বলল, হ্যাঁ, আধঘণ্টা আগে থানায় খবর দিয়েছে। সকাল সাড়ে সাতটা-আটটা থেকে মেয়েকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। পাড়ার কোন বুড়ি সেই ভাঙা মন্দিরের গায়ে খুঁটে দেয়, তার চোখেই প্রথম পড়ে। সে দেখতে পায়, পান্না গোয়ালার মেয়ে, মন্দিরের ভেতরে, দেওয়ালের গায়ে ঝুলছে। গলায় দড়ি বাঁধা। এখনও সেই অবস্থায় আছে। আমি এখন যাচ্ছি। ভাবলাম তোমাকে ডেকে নিয়ে যাই। কারণ তোমার কারবার তো সব ক্রিমিনালদের সঙ্গেই।

অশোক আবার হাসল, বলল, আর আপনার কারবার তো শহরের যত পুণ্যিবানদের সঙ্গে, যাদের বাইরে কেঁচোর পত্তন, ভেতরে ছুঁচোর কেত্তন। চলুন যাওয়া যাক।

অশোকের বন্ধুরা হেসে উঠল। শ্যামাপদ ধমক দিল, খুব হাসি পাচ্ছে, না? যেদিন সব কটাকে শ্রীঘর পাঠিয়ে দেব

অশোক বোয়াক থেকে নেমে বলল, সে তো আপনি সবসময়েই পারেন। চলুন এখন যাই।

অশোক বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে হেসে, বিদায় নিল। শ্যামাপদর পাশের সিটে গিয়ে বসল। শ্যামাপদ গাড়িতে উঠে, গাড়ি স্টার্ট করে, শহরের ভিতরের আঁকাবাঁকা সরু রাস্তা দিয়ে চলল। খানিকক্ষণ পরে জিজ্ঞেস করল, এরকম একটা খুন, তোমার কী মনে হয় বলল তো?

অশোক বলল, কিছুই তো বুঝতে পারছি না। চলুন গিয়ে দেখা যাক। জ্ঞাতি বিবাদে এরকম কিছু ঘটতে পারে কিনা, বুঝতে পারছি না। অনেক সময় প্রতিবেশীদের ঝগড়া আর রেষারেষিতেও নিরপরাধী শিশুর প্রাণ যেতে পারে। তবে এরকম ঘটনা বিহারের গ্রামের অঞ্চলেই বেশি হয়। আমাদের দেশে বিশেষ দেখা যায় না।

শ্যামাপদর মুখ চিন্তিত দেখাল। অশোকের কথার ওপরেই সে ভাবতে আরম্ভ করেছে। দশ মিনিটের মধ্যেই ওরা সেই ভাঙা মন্দিরের সামনে এসে থামল। মালীপাড়াটা রেল লাইন ঘেঁষে। রেললাইনের দিকে পাঁচিল তোলা, লাইন দেখা যায় না। মন্দিরটা মালীপাড়ার প্রায় শেষে। মালীপাড়াকে গরিবদের পাড়া বলা চলে। তবে কিছু কিছু নতুন বড়লোকেরাও এখানে ভাড়া বাড়ি বা বস্তি কিনে,নতুন বাড়ি তুলেছে। তাদের বাদ দিলে অধিকাংশই গরিব। তবে পান্নাগোয়ালাকে খুব গরিব বলা চলে না। তার দুধের এবং ছানার ব্যবসা খারাপ না। পুরনো টালির ঘরের পাশে, দু কামরার একটা পাকা বাড়িও সে তুলেছে।

পান্নার স্ত্রী মন্দিরের কাছে পড়ে, চিৎকার করে মাথা ঠুকে ঠুকে কাঁদছে। ওরে আমার এমন সব্বোনাশ কে করলে রে, আমার এই দুধের শিশু কার কী করেছে গো।..

পান্না গোয়ালাকে দেখা গেল, কয়েকজন ধরে রেখেছে। সে-ও কাঁদছে। পাড়ার লোকেরা ভিড় করেছে। ইতিমধ্যেই থানা থেকে একজন এস. আই. ও কয়েকজন সেপাই এসে গিয়েছে। কালো পুলিশভ্যান দাঁড়িয়ে আছে। তারা সবাই মন্দিরটাকে প্রায় ঘিরে আছে। শ্যামাপদর সঙ্গে অশোকও জিপ থেকে নামল। এগিয়ে গেল মন্দিরের দিকে। সবাই ওদের পথ ছেড়ে দিল। অশোক দেখল, মালীপাড়ার এ মন্দিরটা একটা সরু গলির মুখে, যে গলিটা মালীপাড়ার মূল রাস্তা থেকে একটা নামহীন গলি দিয়ে (ঠিক নামহীন নয়, এ গলিকে মন্দিরের গলি বলা হয়।) ভরদ্বাজ পাড়ার দিকে গিয়েছে। মন্দিরের গলিটা এক দিক থেকে বেশ নিরিবিলি, অনেকগুলো বাড়ির পিছন দিক। সদরের মুখ অন্যদিকে, লোকচলাচলও সেই দিকে। আশেপাশে কয়েকটা গাছও আছে, সবই গৃহস্থের আম, জাম, জামরুলের গাছ। জায়গাটাকে নিরিবিলি বলা যায়।

মন্দিরের ভাঙা দাওয়ায় শ্যামাপদর সঙ্গে উঠে, অশোক মন্দিরের ভাঙা দরজার কাছে গেল। দরজার পাল্লা বলে কিছু নেই। এমনকী শিবলিঙ্গের বিগ্রহও নেই। ভিতরের দিকে, দিনের আলো থেকে চোখ ফিরিয়ে তাকালে, হঠাৎ একটু অন্ধকার মনে হয়। কয়েক সেকেন্ড পরেই মন্দিরের ভিতর সবকিছু স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অশোক শ্যামাপদকে জিজ্ঞেস করল, ভেতরে ঢুকব?

শ্যামাপদ বলল, চলো দুজনেই ঢুকি।

তবু ঢোকবার আগে, অশোক সামনের এস. আই-কে জিজ্ঞেস করল, ভেতরে এর আগে কেউ ঢুকেছিল?

এস. আই. বলল, আমি আসার পরে আর কেউ ঢোকেনি। এসেও কারোকে ভেতরে দেখিনি, সবাই বাইরে থেকেই উঁকি মেরে দেখছিল।

অশোক বাইরে থেকে উঁকি মেরে দেখল। দেখা যায়। মন্দিরের ভিতরে প্রায় একটা কোণ ঘেঁষে, যেখানে অন্ধকার একটু বেশি, সেখানে দেওয়ালের গায়ে প্রায় তিনফুট লম্বা খালি গা একটি মেয়ের দেহ ঝুলছে। চুলগুলো খোলা, পরনে একটি ইজের। এর বেশি বাইরে থেকে কিছু দেখা যায় না। অশোক শ্যামপদকে বলল, চলুন ভিতরে যাই। তবে বাড়িটার মুখোমুখি না দাঁড়িয়ে, ভিতরে গিয়ে, পাশে দাঁড়িয়ে আমরা দেখব।

শ্যামাপদ ভ্রুকুটি করে জিজ্ঞেস করল, কেন?

অশোক বলল, মন্দিরের ভেতর মেঝের পাকা শান নষ্ট হয়ে গেছে। কেবল ধুলো। বডিটা যে বা যারা ওভাবে ঝুলিয়ে রেখেছে, তাদের পায়ের ছাপ থাকতে পারে। সেটা নষ্ট করা ঠিক হবে না।

কথাটা শ্যামাপদর মনঃপূত হল বলে মনে হল না। তবু ভিতরে ঢুকে, ওরা দেওয়ালে ঝোলানো পান্না গোয়ালার মেয়ের মুখোমুখি না গিয়ে পাশ দিয়ে এগিয়ে গেল। দেখা গেল, একটা বড় লোহার গজাল দেওয়ালে গাঁথা রয়েছে। সেই গজালের সঙ্গে মেয়েটির গলায় ফাঁস দেওয়া, দড়ি দিয়ে ঝোলানো। দৃশ্যটা রীতিমতো বীভৎস। পাঁচ বছরের একটি মেয়ে। দড়ির ফাঁস দিয়েই হোক, বা আগে গলা টিপে খুন করেই হোক, তারপর গজালের সঙ্গে ঝোলানো হয়েছে। চোখ খোলা, উদ্দীপ্ত, স্থির দুটো কালো তারা। এখনও যেন বাঁচবার আর্তি ফুটে রয়েছে। মুখ-গহ্বর একটু হাঁ করা। জিভটা বেরিয়ে আসেনি, মুখের মধ্যেই যেন দলা পাকিয়ে রয়েছে। ঠোঁটের কষে জমাট রক্ত, চিবুক পর্যন্ত বেয়ে এসেছে।

অশোক পাশ ঘেঁষে আরও কাছে এগিয়ে গেল। বোঝা যায়, ছেলেমানুষ মেয়েটির গায়ে কোনও জামা ছিল না। গলার কাছে দৃষ্টি হেনে বুঝতে পারল, দড়ির বাঁধন ছাড়া আর কোনও দাগ নেই। তার মানে, খুনি অতীত দিনের ঠগিদের মতো দড়ির ফাঁস পরিয়ে, এক টানেই হত্যা করেছে। তারপরে অবশিষ্ট দড়ি দিয়ে, গজালের সঙ্গে বেঁধে, ঝুলিয়ে দিয়েছে। সম্ভবত গলার পিছনে দড়ির দুটো গিট আছে। একটা গিট খুন করার সময়, দ্বিতীয় গিট ঝোলাবার সময়। খুনি সামনে থেকে ফাঁস দেয়নি, কেননা, গলার সামনে কোনও গিট দেখা যাচ্ছে না। বোধহয়, আচমকা পিছন থেকে ফাঁস পরিয়ে দিয়েছিল।

কিন্তু কেন?

এই প্রশ্নটাই সর্বাগ্রে জাগে। পাঁচ বছরের একটি মেয়ে, সে কারোর শত্রু হতে পারে না। তার কাছে। কী স্বার্থই বা থাকতে পারে? মানুষ যখন পাশবিকতায় মাতে, তখন তার পশু উন্মত্ততাকে মাপা যায় না। তাই অশোক খুব ভালভাবে মেয়েটিকে নিরীক্ষণ করে দেখল। কিন্তু পরিষ্কার বোঝা যায়, মেয়েটির ইজের নিয়ে কোনওরকম টানাটানি করা হয়নি, খোলাও হয়নি। শরীরের কোথাও কোনও দাগ চোখে পড়ে না। অবিশ্যি বাইরের আলোয় হয়তো আরও কিছু চোখে পড়তে পারে। সেটা দেখতে হবে।

অশোক নীচের দিকে তাকাল। না পরিষ্কার কোনও পায়ের ছাপ নেই। এবড়ো-খেবড়ো ধুলোর মধ্যে নানান রকমের পায়ের ছাপ, তাও এলোমেলো। স্পষ্ট কিছুই না। অশোক বলল, ফটো তুলবেন নাকি?

শ্যামাপদ বলল, তার দরকার হবে কি? বলো তো তোলাতে পারি।

মফস্বল শহরে অনেক কিছুই হয়ে ওঠে না। এখন আবার পেশাদার ফটোগ্রাফারকে ডাকতে যেতে হবে। থানায় কোনও ব্যবস্থা নেই। অশোক বলল, তা হলে এস. আই-কে নিখুঁত ভাবে একটা বিবরণ লিখতে বলুন, তারপরে ডেড বডি গজাল সুদ্ধ খুলে বাইরে নিয়ে চলুন।

অশোক মন্দিরের ভিতরে চারপাশে নিরীক্ষণ করে দেখল। বিশেষ কিছুই চোখে পড়ে না। একপাশে কিছু মাটি, একটা গোবরমাখা ভাঙা চ্যাঙাড়ি। একটা গোবর মাখা ছোট কাঠের পাটাতন। ছাগলের নাদি ছড়ানো রয়েছে। বোধহয় কুকুরেরাও কখনও কখনও এসে আশ্রয় নেয়।

অশোক বাইরে বেরিয়ে এল। মনে এক প্রশ্ন, কেন? এরকম একটি শিশুকে খুনের কারণ কী? ও কি কারোর গোপন কথা শুনে ফেলেছিল? যে কথা কারোর পক্ষে মারাত্মক ক্ষতিকর? জানাজানি হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে? অথবা, এমন কোনও ঘটনা কি ওর চোখে পড়েছিল, যে ঘটনার কোনও সাক্ষী থাকা মানেই সর্বনাশ! জানাজানির ভয়ে, আগেই হয়তো মেয়েটিকে মেরে ফেলার প্রয়োজন হয়েছিল। এবং সে ঘটনাই বা কী হতে পারে? কোনও খুনের সাক্ষী ছিল কি পান্না গোয়ালার মেয়ে? প্রাথমিক ভাবে এ চিন্তাই মস্তিষ্ক জুড়ে থাকতে চাইছে। আরও গুরুতর বিষয় ভাববার আছে। একটু কথাবার্তা না বললে বোঝা যাচ্ছে না। বিশেষ করে, পান্না এবং তার স্ত্রীর সঙ্গে। অশোক বাইরে এসে দেখল, পান্নার স্ত্রীকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পান্না তখনও কোঁচার খুঁট দিয়ে চোখ মুছছে। তাকে কয়েকজন ঘিরে রয়েছে।

শ্যামাপদ অশোকের মুখের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে জিজ্ঞেস করল, কী বুঝছ বলো তো? কোনও সেকস ম্যানিয়াকের কাণ্ড?

অশোক বলল, দেখে তো সেরকম কিছু মনে হচ্ছে না। তবে মনে হচ্ছে, মেয়েটির পিছু পিছু চুপিসাড়ে এসে কেউ হঠাৎ ফাঁস পরিয়ে মেরেছে। পান্নাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করব?

শ্যামাপদ যেন একটু থামল। তারপরে বলল, কিরে দেখো। বলেই শ্যামাপদ হাঁক দিল, পান্না গোয়ালা, এদিকে এসো। এখন ও সব কান্নাকাটি রাখো।

কিছু বলবার নেই, শ্যামাপদ একেবারে আগাপাশতলা পুলিশ! পান্না এগিয়ে এল, ভাঙা গলায় বলল, বলেন দারোগাবাবু।

তোমার মেয়ের নাম কী? শ্যামাপদ নিজেই প্রশ্ন শুরু করল।

আজ্ঞে নমিতা ঘোষ।

বয়স ঠিক কত?

পাঁচ চলছে।

 ইস্কুলে পড়ত?

আজ্ঞে না।

কে তোমার মেয়েকে মেরেছে, কিছু আন্দাজ করতে পারো?

পান্না ঝর ঝর করে কেঁদে উঠল। শ্যামাপদ ধমক দিল, বলছি এখন ও সব কান্নাকাটি রাখো। যা জিজ্ঞেস করছি, তার জবাব দাও।

পান্না কান্নাভাঙা স্বরে জবাব দিল, সে কথা কী করে বলব দারোগাবাবু? আমার এতটুকু মেয়েকে কেন কেউ মারবে, আমি কিছু জানি না।

শ্যামাপদ অশোকের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কী জিজ্ঞাসা করতে চাও করো।

অশোকের কাছে পান্না অপরিচিত না। পান্না গোয়ালাকে ও পান্নাদা বলে ডাকে। বয়সের একটা সম্মান আছে। ও জিজ্ঞেস করল, পান্নাদা, তোমার ছেলে-মেয়ে কটি?

পান্না বলল, দুই ছেলে আর এই একটি মেয়ে।

তোমার দাদা, ভাই কেউ আছে?

দাদাবাবু, কেউ নেই।

 জ্ঞাতি আত্মীয়-স্বজন?

আছে, তারা এখানে কেউ থাকে না। রানাঘাট থেকে আমার বাবা এখানে এসে ব্যবসা শুরু করেছিল, এখানেই বাড়ি করেছে। বাবার ব্যবসাই আমি চালাচ্ছি।

অশোক বলল, শোনো পান্নাদা, একটু অন্যদিকে এসো, তোমাকে আলাদা একটা কথা জিজ্ঞেস করব। শ্যামাপদকে বলল, আপনিও আসুন।

পান্নাকে নিয়ে একটু সরে গিয়ে অশোক জিজ্ঞেস করল, পান্নাদা, ভেবে বলো তো, পাড়ায়, আশেপাশে তোমার সঙ্গে কারোর কোনও ঝগড়া-বিবাদ আছে? তোমার বা তোমার বউয়ের ওপরে রাগ আছে কারোর?

পান্না একটু ভেবে বলল, কই দাদাবাবু, তেমন তো কিছু মনে করতে পারি না। নমির মায়ের সঙ্গে পাড়ায় কারোর কখনও ঝগড়া হতে দেখিনি। আমিও সাতে-পাঁচে বড় একটা থাকি না। সারাদিন আমার দুধ ছানা নিয়েই কেটে যায়। ছেলেরা দুধ বিলি করতে বেরিয়ে যায়, ফেরে দুপুরে। আমি আর বউ ছানা তৈরি করি। তার মধ্যেই রান্নাবান্না হয়। দুপুরে খেয়ে, ছানা নিয়ে দোকানে চলে যাই। বাজার করে সন্ধের পর ফিরি। তারপরে তো গোরুর জাব তোয়ের করা, খাওয়ানো…

অশোক বাধা দিয়ে বলল, বুঝেছি। এমনিতে তোমার সঙ্গে কাতোর ঝগড়া নেই। শান্তিতেই আছ। তোমার কি সুদী কারবার আছে?

পান্না যেন একটু চমকে উঠল। শ্যামাপদর দিকে একবার দেখে বলল, কারবার কিছু নেই দাদাবাবু। চেনাশোনা বিশ্বাসী কেউ অভাবে পড়লে, চাইলে ধার দিই, তবে সুদ নিই। কিন্তু বেশি না।

তাদের নাম বলতে পারো?

পারি। বলে কয়েকজনের নাম বলল। সব কটিই প্রায় স্ত্রীলোকের নাম। তবু অশোক টুকে রাখল। জিজ্ঞেস করল, তোমার বউ কোথায়?

তাকে বাড়ি নিয়ে গেছে।

চলো, তাকে দু-একটা কথা জিজ্ঞেস করে আসি।

শ্যামাপদ নীরস স্বরে বলে উঠল, তাতে কী লাভ হবে, এক কথাই তো শুনতে হবে।

অশোক বলল, তবু জিজ্ঞেস করা উচিত।

শ্যামাপদ অশোকের সঙ্গে চলতে চলতে বলল, এদের আমি একদম বিশ্বাস করি না। হয়তো অনেক কিছু জানে, বলবে না। ভাবে, যে কোনও রকমে পুলিশের হাত থেকে ছাড়া পেলেই বাঁচি।

অশোক সে কথার কোনও জবাব দিল না। পান্নার বাড়িতে এল। নতুন দালানের বারান্দার পাশে স্ত্রী বসে ছিল। তার কাছে আরও কয়েকজন স্ত্রীলোক। সকলেই মাথায় ঘোমটা টেনে সরে গেল। অশোক পান্নার স্ত্রীর কাছে গিয়ে দাঁড়াল। পান্নার স্ত্রী চোখ মুছতে মুছতে, ঘোমটা টানল। অশোক জিজ্ঞেস করল, সকালবেলা মেয়ে বেরিয়েছিল কখন? মনে আছে?

পান্নার স্ত্রী ঘাড় নেড়ে বলল, সময় তো বলতে পারি না বাবা। তখন উঠোনে রোদ এসে পড়েছে। নমির বাবার সঙ্গে তখন ছানা করছি, দেখলাম ঘর থেকে এক মুঠো গম নিয়ে ছড়িয়ে দিল। কোথা থেকে কতগুলান পায়রা উড়ে এল। নমি পায়রা ধরবার জন্য ছুটোছুটি করছে।

অশোক জিজ্ঞেস করল, সেই কি শেষ দেখা?

পান্নার স্ত্রী মাথা ঝাঁকিয়ে, মুখে কাপড় চাপা দিয়ে, কেঁদে উঠল। শ্যামাপদ ধমক দিতে যাচ্ছিল। অশোক হাত তুলে নিরস্ত করল। জিজ্ঞেস করল, কতক্ষণ বাদে খোঁজ পড়ল?

পান্নার স্ত্রীর কান্না একটু প্রশমিত হলে বলল,খোঁজ তো সব সময়েই করেছিলাম বাবা। হাতে কাজ, এটা ওটা দরকার হলে ওকেই তো ডাকি, অ নমি কোথায় গেলি, এটা দে, ওটা দে। সবথেকে ছোট কিনা…।

পান্নার স্ত্রীর গলা আবার বুজে এল। তার মধ্যেই গলা-খাঁকারি দিয়ে, পরিষ্কার করে বলল, কখনও তেমন বকাঝকা করি না। একবার বাড়ি ঢোকে, আবার ছুটে বেরিয়ে যায়, এমনি হয়। আজ যে সেই পায়রাদের গম খাইয়ে বেরিয়েছিল, তারপরে আর ফেরেনি। ওর বাবা রেগে খোঁজ করতে বেরিয়েছিল। পাড়ার কাহোর বাড়িতে যায়নি। এমনটা হয় না। তখন একটু চিন্তা হল, মেয়ে কোথায় যেতে পারে। তারপরেই তো মাতি বুড়ি খুঁটে দিতে গিয়ে দেখতে পেয়ে ভিরমি গেল।

অশোক ভুরু কুঁচকে চুপ করে ভাবল। চকিতে ওর মুখে একটা নতুন চিন্তার ঝিলিক দেখা গেল। জিজ্ঞেস করল, ওর গায়ে কি সোনা রুপো কিছু ছিল?

পান্নার স্ত্রী বলল, ছিল বাবা। কানে ছিল বড় বড় মটরদানার বল লাগানো সোনার দুল। হাতে চারগাছি চুড়ি, ব্রোঞ্জের ওপর সোনা দিয়ে গড়া।

অশোকের চোখ উজ্জ্বল হল, এবং মনে মনে ভাবল, সবথেকে সহজ ব্যাপারটা কত অসহজ পথে চিন্তা করছিল। পরিষ্কার মেয়েটির মৃতদেহের ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠল। মেয়েটির গায়ে কোথাও সোনার চিহ্ন ছিল না। ও শ্যামাপদকে বলল, চলুন, আর একবার ডেডবডিটা দেখি। এতক্ষণে বোধহয় বাইরে নিয়ে এসেছে।

অশোক পারলে যেন ছোটে। তাড়াতাড়ি এল মন্দিরের কাছে। নমিতার দেহ বাইরে আনা হয়েছে। কাছে গিয়ে, ও প্রথমেই দেখল কান আর হাত, কোথাও একটু আঁচড়ের দাগও নেই। যার অর্থ দাঁড়ায়, মেয়েটিকে মারার পরে, কানের দুল আর হাতের চুড়ি খুলে নেওয়া হয়েছে, খুনি কোনও বাধা পায়নি।

পান্নাও সঙ্গে এসেছে। অশোক তাকে জিজ্ঞেস করল, পান্নাদা সব মিলিয়ে কত আন্দাজ সোনা ছিল?

পান্না বলল, সে আমার মনে আছে দাদাবাবু। চুড়ি চারগাছা ছিল আধ ভরি, দুল জোড়া সাড়ে ছ আনা।

সাড়ে চৌদ্দ আনা সোনা। অশোকের তৎক্ষণাৎ মনে হল, খুনি খুব নিষ্ঠুর সন্দেহ নেই, কিন্তু বড় ধরনের দাঁও মারার মতো লোক না। এদিক থেকে খুনি ছিঁচকে। মাত্র সাড়ে চৌদ্দ আনা সোনার জন্য একটি শিশুকে সে হত্যা করতে পারে। মোটামুটি মোটিভ পাওয়া গেল, এবং খুনির সামাজিক শ্রেণীর চেহারাটাও যেন অস্পষ্ট ভাবে বোঝা যাচ্ছে।

শ্যামাপদ এই পর্যন্ত শুনেই হুমকে উঠল, এ পাড়ার সব বেকার ছোঁড়াদের আমি ধরে নিয়ে যাব। একটাকেও ছাড়ব না। রুলসই করে কথা আদায় করব।

বলেই সে তার নিজের কাজে লেগে গেল। তার মূর্তি দেখেই, কৌতূহলী জনতা সরে পড়তে লাগল। পাড়ার কিছু জোয়ান ছেলের কপালে দুর্গতি আছে, বিশেষত যাদের কাজকর্ম নেই নানান ফিকিরে ঘোরে। ওদের মধ্যে মস্তান ধরনের ছেলেও কিছু কিছু আছে, যারা নানা অসদুপায়ের ধান্দায় ঘোরে। অবিশ্যি তাদের মধ্যে কেউ এ কাজ করেনি তা একেবারে নিঃসন্দেহে বলা যায় না।

পুলিশি তৎপরতা শুরু হতেই অশোক সরে পড়ল। প্রথমেই দেখা করল মাতি বুড়ির সঙ্গে, যে মন্দিরে প্রথম মৃতদেহ পেয়েছিল। সে কথার মধ্যে কেবল গোঙাল, কিছু বলতেই পারল না। তবে এটা জানা গেল, মৃতদেহ স্পর্শ করার সাহস তার ছিল না। কাছে গিয়ে দেখেনি, এবং খুঁটে দিতে যাবার সময় আশেপাশে কারোকে দেখতে পায়নি।

তারপর অশোক চেনামুখ বেকার ছেলেদের খুঁজে বেড়াল। বিশেষ করে যারা একটু মস্তান ধরনের, ওয়াগন ভাঙা বা লরি লুঠ করার দলে থাকে। এরা অধিকাংশই অশিক্ষিত বস্তিবাসী। ভদ্রলোকের ছেলেরা আজকাল যে রকম মস্তান হয়, সে রকম না। কিন্তু কারোর সঙ্গে কথা বলেই, সেরকম কোনও ফল পাওয়া গেল না। অনেককে পাওয়াই গেল না, পাড়ার ঘটনা শুনেই গা-ঢাকা দিয়েছে। না দিয়েও উপায় নেই। তারা সত্যি কথা বললেও, শ্যামাপদ ওদের ছাড়বে না। আগে হাজতে নিয়ে গিয়ে পুরবে।

বাড়ির পথে ফিরতে ফিরতে প্রথম যে কথা অশোকের মনে এল তা হচ্ছে, খুনির টাকার খুব জরুরি প্রয়োজন, তার জন্য যে কোনও অপরাধ করতে তার দ্বিধা ছিল না। অতএব দুল আর চুড়ি হয়তো সে ইতিমধ্যেই বিক্রি করেছে। এ শহরে স্বর্ণকারের সংখ্যা কম না। সব জায়গায় হানা দিয়ে জানাও বোধহয় সম্ভব না। বিশেষত এই খুনের ঘটনা জানার পরে, কোনও স্বর্ণকার বা স্বর্ণ ব্যবসায়ী যদি সেই চুড়ি-দুল কিনেও থাকে, এখন আর স্বীকার করবে না। তার পক্ষে দুটো পথ খোলা। খুনের ঘটনা জানার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে সব জানিয়ে দেওয়া, অথবা একেবারে মুখে কুলুপ আঁটা। এমনকী খুনি ধরা পড়ে যদি স্বীকারও করে, তখনও সে স্বীকার করবে না। চুড়িদুলের কোনও পাত্তাই পাওয়া যাবে না। ব্যবসায়ীর ঘরে সেই চুড়ি-দুল যায়নি। পাড়ার কাছেপিঠেই কেউ অল্প টাকায় সোনা কিনে নিয়েছে। শহরে সে রকম লোকের অভাব নেই।

বাড়ি ফিরে আসার পথে, অশোকের সঙ্গে হারাণ ভট্টাচার্যের দেখা হল। বয়স পঞ্চাশ বাহান্ন। বেশ ধোপদুরস্ত ধুতি-পাঞ্জাবি পরে, পান চিবোতে চিবোতে, হনহন করে হেঁটে চলেছে। অশোককে জিজ্ঞেস করল, কী হে অশোক, এত বেলায় কোথা থেকে এলে?

অশোক বলল, এই এদিকেই একটু গিয়েছিলাম। আপনি এত হনহনিয়ে কোথায় চলেছেন?

হারাণ ভট্টাচার্য বলল, আজ শনিবার, তাও জান না? শালারা এত দেরি করিয়ে দিলে, এখন কোন ট্রেন পাব কে জানে। কলকাতার মাঠে গিয়ে দেখব, একটা ঘোড়াও নেই।

অশোকের মনে পড়ে গেল, হারাণ ভট্টাচার্য একজন মস্ত রেসুড়ে। সামান্য একটি কয়লার গোলা আছে। তাতে সংসার কতটুকু চলে, কে জানে। তার গোলায়, সারাদিনই এ শহরের সমস্ত ভদ্র অভদ্র, যারা রেস খেলে তাদের ভিড় লেগে থাকে। ঘোড়ার নাড়িনক্ষত্র তার জানা। অনেকেই তার উপদেশে লাভবান হয়েছে। হারাণ ভট্টাচার্যের নিজেরও কিছু কিঞ্চিৎ আয় হয়।

অশোক নিজের ঘড়ি দেখে বলল, এখন আর একটা পাঁচ মিনিটের আগে কোনও ট্রেন বোধহয় পাবেন না।

হারাণ ভট্টাচার্য সরোষে বলে উঠল, দেখো দেখি কাণ্ডটা। শালারা একেবারে উকুনের মতো লেগে থাকে, ছাড়তে চায় না। এখন দেখো, কোনও ব্যাটা আমার জন্য বসে নেই, যে যার এতক্ষণে বোধহয় কলকাতায় পৌঁছে গেছে। হাঁদুটা প্রত্যেক শনিবার ডেকে নিয়ে যায়, সে হতভাগাও আজ আসেনি।

বলে হারাণ ভট্টাচার্য প্রায় দৌড়াতে লাগল। অশোক ভাবল, কী নেশা রে বাবা! একেই বোধহয় জুয়ার নেশা বলে। এখন স্ত্রী-সন্তানের মৃত্যুর খবর পেলেও বোধহয় হারাণ ভট্টাচার্যকে আটকানো যাবে না। শোক করতে হলে, ফিরে এসে করবে। অশোক মনে মনে হাসল। বাড়ি এসে পৌঁছুল। বাড়ির বাইরের ঘরের গান এবং জ্যোতিষী-চক্রের আড্ডা ভেঙেছে। ও বাড়ির ভিতরে ঢুকে দোতলায় গেল। গিয়ে দেখল, কাঞ্চন বউদি ওর ঘরের সামনে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে।

কাঞ্চন ওর জ্ঞাতি-সম্পর্কে দাদার স্ত্রী। পাশেই বাড়ি। বাড়ির ভিতর দিয়ে বাড়িতে আসার রাস্তা আছে। সুন্দরী কাঞ্চন অশোকেরই বয়সি প্রায়, জীবনটা খুবই অসুখের। অশোকের যে দাদার সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে, সে এক ধরনের হাবা এবং বিকলাঙ্গ। প্রচুর অর্থের মালিক, অতএব কাঞ্চনের মতো স্ত্রী ভাগ্যও আছে। কাঞ্চন অবিশ্যি তার স্বামীকে সেবা শুশ্রূষা করে। এ বাড়িতে অশোকের কাছে মাঝে মাঝে আসে, প্রতিদিন চা করে খাওয়ায়, তত্ত্ব-তল্লাশ করে। দুজনের মধ্যে একটি বন্ধুত্ব আছে, কথাবার্তায় অনুমান করা যায়।

কাঞ্চনের সিথেয় সদ্য সিঁদুর ছোঁয়ানো। অশোককে দেখে বলল, ভাবলাম বুঝি, পান্না গোয়ালার মেয়ের খুনিকে একেবারে হাজতে পুরে বাড়ি ফিরবে।

অশোকের চোখে তখন এলোমেলো চিন্তার ছায়া, বলল, খবর পেয়েছ তা হলে! না, এখনও হদিস আর করতে পারলাম কোথায়। ঘটনাটা শুনেছ?

কাঞ্চন বলল, আমার ঘটনা শুনে দরকার নেই। বাটিতে করে তেল রোদে দিয়েছি। মেখে নাইতে যাও। বুড়ি পিসিমা এখন ভাত নিয়ে বসে আছেন।

অশোক বলল, গরম পড়ে গেছে, এখন আর গায়ে তেল মাখতে ইচ্ছে করে না। বলছ যখন একটু মাখি!

অশোক ঘরে ঢুকে জামা-প্যান্ট ছেড়ে, চান করবার কাপড় পরে, তেল মাখতে লাগল। কাঞ্চন বলল, তোমার টেলিফোন এসেছিল।

অশোক বলল, নিশ্চয়ই থানা থেকে?

হ্যাঁ, কী বিচ্ছিরি বড় দারোগার কথাবার্তা। আমাকেই ধমক দিয়ে বলল, তুমি বাড়ি এলেই যেন ফোন করতে বলি।

অশোক হাসল। না জানিয়ে সরে পড়বার দরুনই এত রাগ। শ্যামাপদর ভয়, পাছে অশোক আগেই সব জেনে নিয়ে খুনিকে ধরে ফেলে। সে চায় অশোক তাকে সব বলুক, সে গিয়ে খুনিকে ধরে নিয়ে আসে। বলল, লোকটা ওই রকম। কিন্তু সে কথা যাক, ব্যাপারটা কী রকম বুঝছ বলো তো?

কাঞ্চন বলল, কী আর বুঝব। ঘটনাটা কী, শুনি?

অশোক সমস্ত ব্যাপারটা বলল। খুনের উদ্দেশ্য যে সামান্য কয়েকটি অলংকার, সে কথা জানাল। কাঞ্চন খানিকক্ষণ ভেবে বলল, কী জানি বাপু, বুঝতে পারছি না। তবে খুব উঞ্ছ প্রকৃতির লোক এ খুন করেছে মনে হয়।

 উঞ্ছ মানে?

উঞ্ছ মানে চালচুলোহীন হতভাগা। তোমারও কি তাই মনে হচ্ছে না? ভেবে দেখ না, যেন টাকার খুবই দরকার, হাতের সামনে যা পাওয়া যায় তাই নিয়ে নিই। মনে হচ্ছে, যেন মেয়েটার গায়ে দু চিলতে সোনা দেখেছে, আর এদিক ওদিক দেখে মুরগি চুরির মতো কোপ মেরেছে। যা করেছে, খুব তাড়াতাড়ি করেছে।

অশোক তেল মাখতে মাখতে, কাঞ্চনের মুখের দিকে নিবিষ্ট চোখে তাকিয়ে ছিল। ও জানে, কাঞ্চন বউদি মাঝে মাঝে সহজ ভাষায়, অসাধারণ সত্য বলতে পারে। কাঞ্চনের কথা শুনে, ওর চোখের সামনে যেন একটা ছবি ভেসে উঠল। ও বলল, তা হলে বউদি এ কথাও সত্যি, মেয়েটা খুনিকে চিনত?

কাঞ্চন জোর দিয়ে বলল, নিশ্চয়ই। তা না হলে খুন করবে কেন? মেয়েটা চেঁচামেচি করবে, সেই ভয়ে আগেই মেরে ফেলেছে, কারণ শেষ পর্যন্ত মারতেই হত।

তা হলে বলতে চাও, লোকটা পাকা খুনি?

কাঞ্চন বলল, তা আমি বুঝি না।

অশোকের তেল মাখা বন্ধ হয়ে গেল। ভাবতে বসল। কাঞ্চন বলল, এখন চান করতে যাও।

অশোক অন্যমনস্ক ভাবে বলল, তা হলে খুনি মালীপাড়া বা তার কাছাকাছির লোক। তা না হলে মেয়েটা তাকে চিনত না। কিন্তু কার এমন টাকার দরকার পড়তে পারে যে, মেয়েটাকে মেরে ফেলল? এমন কী দরকার? সংসারের অভাব-অনটনে কি লোক এরকম কাজ করে?

কাঞ্চন হেসে বলল, দেখো হয়তো কোনও মদো মাতাল চণ্ডু-চরসের নেশাখোরের কাজ।

নেশার জন্য খুন?

হতে পারে না? মা বাপের বাক্স ভেঙে, বউয়ের গায়ের গহনা ছিনিয়ে নিয়ে যায় অনেকে।

অশোক যেন চিন্তায় একেবারে ধ্যানমগ্ন হয়ে গেল। কাঞ্চন তাড়া দিল, কী হল, স্নান করতে যাও।

অশোক সেই অবস্থায় আরও খানিকক্ষণ থেকে, লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। ওর চোখের সামনে এখন একটি মাত্র মূর্তিই ভাসছে। বলল, না, আর খাওয়া হল না।

কাঞ্চন ধমকে বলল, খবরদার ঠাকুরপো, এখন তুমি নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে বেরোলে খুব অন্যায় হবে বলছি।

অশোক স্নানের ঘরের দিকে যেতে যেতে বলল, যাও, পিসিমাকে শিগগিরি ভাত বাড়তে বলল, আমি এলাম বলে।

.

অশোক নাকে-মুখে, কোনও রকমে কিছু খুঁজেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল। যাবার আগে কাঞ্চনের গালে একটা টোকা মেরে বলে গেল, খুনি যদি ঠিক ধরা পড়ে, তা হলে তোমারই ক্রেডিট।

কাঞ্চন কপট রাগে ঝামটা দিল, তা বলে তুমি আমার গালে টোকা মারবে? ফিরে এসো, তখন দেখাব।

অশোক ছুটল। কাঞ্চন পিছন থেকে নিঃশব্দে হাসল। তারপরে একটা নিশ্বাস ফেলল।

অশোক প্রথমে এল থানায়। শ্যামাপদ তখন থানা সংলগ্ন তার বাড়িতে খেতে গিয়েছে। একজন এস. আই. জানাল, অশোক এলেই যেন শ্যামাপদর বাসায় চলে যায়, এ রকম নির্দেশ আছে। অশোক তা-ই গেল। শ্যামাপদর হুমকে ওঠার আগেই ও জিজ্ঞাসা করল, দুল-চুড়ি বিক্রি হয়েছে কি না, খোঁজ করেছিলেন?

শ্যামাপদ তবু ধমকে উঠল, তুমি বলবে তবে তার খোঁজ করব?

পেয়েছেন?

না।

 আমার যতদূর মনে হচ্ছে, চুড়ি-দুল বিক্রি হয়নি কখনও, এবং খুনি বোধহয় বাড়িতেই আছে।

শ্যামাপদ অস্থিরভাবে জিজ্ঞেস করল, কে, কে?

অশোক বলল, শুনুন, কতগুলো ঘটনা পরম্পরায় আমি একজনকে সন্দেহ করেছি মাত্র। মন্দিরের কাছেই ভরদ্বাজ পাড়ায় আপনি নিজে একবার তোক নিয়ে যান। আপনি যথেষ্ট শক্ত মানুষ। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আপনাকে খুব শক্ত করে ধরতে হবে। আমি যাব না। আপনার দেরি করলে হবে না। পাখি হাওয়া কাটবে না, মাল সরে যেতে পারে।

শ্যামাপদ ছেলেমানুষের মতো হাত-পা ছুঁড়ে বলল, কাদের বাড়ি, লোকটার নাম বলবে তো?

অশোক বলল, হাঁদু চক্কোত্তি। চেনেন তো?

রেসুড়ে হাঁদু?

হ্যাঁ।

 সে এ রকম খুন করবে?

করতে পারে। হাঁদুর ঘরে ভাত নেই, আসবাবপত্র তেমন কিছু নেই। শুনেছি, যেদিন বাড়িতে রান্না হয়, মেঝেয় গর্ত করে পাতা পেতে ডাল রাখে। চুড়ি-দুল খুঁজে বের করতে অসুবিধে হওয়া উচিত নয়, অবিশ্যি যদি ওর কাজ হয়।

কিন্তু আজ তো শনিবার। ও কলকাতা চলে যায়নি?

অশোক বলল, বোধহয় যাওয়া হয়ে ওঠেনি। আপনি চলে যান।

শ্যামাপদ তখন খালি গায়ে। তাড়াতাড়ি গলার পৈতাটা পিছন দিকে ঠেলে, অন্য ঘরে যেতে যেতে বলল, তুমি অফিসে গিয়ে বসো। আমি হাঁদুর বাড়ি থেকে না ফেরা পর্যন্ত যাবে না।

অশোক চলে এল অফিসে। চক্রবর্তীদের বিরাট পুরনো ভাঙা জীর্ণ বাড়িটা ওর চোখের সামনে ভাসছে। বিপত্নীক, কয়েকটা ছেলেমেয়ে আছে। তাদের দুর্দশাও চূড়ান্ত। হাঁদু ছাড়া, তার আর সব ভাইদের অবস্থা মোটামুটি ভাল। সকলেই চাকরিবাকরি করে। এক বাড়িতেই থাকে, আলাদা আলাদা। হাঁটুর সঙ্গে কেউ মেশে না, কথাও বলে না।

অশোক অন্ধকারে তীর ছুঁড়ে বসে আছে। এখন শিকারের আর্তনাদের অপেক্ষা, অথবা হতাশা। ও দাঁত দিয়ে নখ ছিঁড়তে লাগল।

.

 প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট বাদে, হাঁদুকে দড়ি দিয়ে বেঁধে থানায় নিয়ে এল। চোখের কোল ফোলা, ঠোঁটের কষে খানিকটা রক্ত। শ্যামাপদ অশোককে ডেকে নিজের খাস ঘরে নিয়ে এল। পকেট থেকে বের করে, একটা ন্যাকড়ার পুঁটুলি রাখল। খুলতে দেখা গেল তার মধ্যে চারগাছা ছোট ছোট চুড়ি, মটরদানার দুটি দুল। অশোকের সঙ্গে শ্যামাপদর চোখাচোখি হল। অশোক বলল, এগুলোর সাক্ষীদের সই-সাবুদ লিখেছেন তো?

শ্যামাপদ গম্ভীর গলায় বলল, সে কথা পরে, আগে আসল কথা বলো। জানলে কী করে?

অশোক সে কথার জবাব না দিয়ে বলল, যাক, আন্দাজটা ঠিকই করেছিলাম। হাঁদু চক্কোত্তির আজ কলকাতায় রেসের মাঠে যাওয়া হয়নি। অথচ এর জন্যই একটি শিশু খুন।

শ্যামাপদ প্রায় ছেলেমানুষের মতো চিৎকার করে উঠল, এখন তুমি মুখ খুলবে, না কি?

অশোক সিগারেট ধরিয়ে বলল, একটু চা খাব।

 স্টুপিড। শ্যামাপদ চিৎকার করে চা আনতে হুকুম করল।

.

কথা হচ্ছিল কাঞ্চনের সঙ্গে, সন্ধেবেলা। কাঞ্চন অবাক হয়ে বলল, নেশাখোরদের কথা বলতেই তোমার হাঁদুর কথা মনে পড়ল?

হ্যাঁ। তার আগে অবিশ্যি হারাণ ভট্টাচার্যকে কলকাতার রেসের ময়দানে ছুটতে দেখেছিলাম। সে বলেছিল, হাঁদু আজ তাকে ডেকে নিয়ে যায়নি। তারপরে তুমি বললে, বউয়ের গায়ের গহনা ছিনিয়ে নিয়ে যায় নেশাখোরেরা, তখন মালীপাড়া বা কাছাকাছি অনেকের মুখ ভেসে উঠল। একে একে অনেকের মুখ ছেড়ে, হাঁদুর কাছে এসে থামল। ওদের বাড়ির পিছন দিকেই মন্দির। মনে পড়ল, আজ শনিবার। শনিবার সকাল হলেই, হাঁদু চক্কোত্তির মাথা খারাপ হয়ে যায়, এ কথা শহরের সকলেই জানে। দুদিন না খেতে পেলেও তার এরকম হয় না।…তারপরেই মনে পড়ল, বছর দুয়েক আগে, হাঁদু বাড়ির মধ্যেই এক ছমাসের ভাইঝির গলা থেকে সোনার হার খুলে নিয়েছিল, ধরা পড়েছিল। মনে পড়ল, সেই দিনটাও ছিল শনিবার। গত বছরের আর একটা ঘটনা, ভরদ্বাজ পাড়ার একটি ছেলে মাত্র দুটাকার নোট হাতে পাকাতে পাকাতে দোকানে যাচ্ছিল। হাঁদু তা কেড়ে নিয়েছিল। সেই দিনটিও শনিবার ছিল। আর আজ? আজও শনিবার! শনিবার হলেই হাঁদু চক্কোত্তি ঘোড়ার ডাক শুনতে পায়। কিন্তু সেই প্রেত ঘোড়ার ডাকটা ওর পক্ষে শুভ নয়।

কাঞ্চন বলল, শুধু এর ওপর নির্ভর করেই তুমি ঠিক করে ফেললে?

হ্যাঁ, অনেক দিক দিয়ে মিলে গেল। হাঁদু নিজেও স্বীকার করেছে, আর তুমি যে রকম বলেছিলে, ও ঠিক সেইভাবেই মেয়েটাকে মেরেছে।

কাঞ্চন বলে উঠল, আহ, কী নেশা। ওর কী সাজা হবে?

অশোক গম্ভীর মুখে বলল, আমার মতে লোকটাকে কোনও মেন্টাল অ্যাসাইলামে পাঠানো উচিত। এরা অসুস্থ, চিকিৎসা হওয়া দরকার। শোনোনি, তাকে বলে, গরিবের ঘোড়া রোগ।

কাঞ্চন অবাক হয়ে অশোকের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *