মেলার নিশি

মেলার নিশি

মেলায় পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধে পার হয়ে গেল। আকাশে পূর্ণ চাঁদ। বসন্ত পূর্ণিমা। আজ দোলের রাত্রি। মেলার কাছে এসে যখন পৌঁছলাম, পুব দিকের গাছগাছালি, বাঁশঝাড়ের মাথায়, পূর্ণ চাঁদ তখনও যেন তেমন উজ্জ্বল হয়ে ওঠেনি। গোল সোনার পাতে, তখনও ঈষৎ তামাটে ছাপ। জ্যোৎস্নার যেমন ফিকি ফোটে, আলো এখনও সেরকম স্পষ্ট হয়নি। এ আলো যেন কেমন অস্পষ্ট, ছায়া ছায়া, রহস্যময়। তবে, আকাশে কুয়াশার আভাস বা একটুও মেঘ নেই। চাঁদের আলোয় ফিনিক ফুটতে দেরি নেই।

চারদিকের পরিবেশটাই কেমন আলো-আঁধারিতে ভরা। তার কারণ, চারদিকেই গাছপালা। যেখানে এসে মোটরবাস থেকে নামলাম, সেখানে রাস্তার ধারে, অস্পষ্ট ছায়ায় অনেকগুলো সাইকেলরিকশা দাঁড়িয়ে আছে। গাছের তলায়, আলো-আঁধারিতে, দু-তিনটে খালি বাস। যাত্রী নিয়ে এসেছে। এখন আবার এখান থেকে ফিরতি যাত্রী নিয়ে যাওয়ার অপেক্ষা। খালি গাড়ি নিশ্চয়ই ফিরিয়ে নিয়ে যাবে না। তবে, এ মেলা থেকে ফিরতি যাত্রী পেতে পেতে রাত হবে। যারা এসেছে, এখন তারা কেউই ফিরবে না।

এক দিকের গাছতলায় দেখা গেল কতগুলো জোয়াল নামানো গোরুর গাড়ি। জোয়াল-মুক্ত বলদগুলোকে গাড়ির সঙ্গেই দড়ি বেঁধে রেখেছে। কোনও কোনও বলদের মুখের সামনে খড়। পথ চলার পরে বিশ্রাম এবং খাওয়া। আশেপাশে কিংবা দূর-দূরান্তের গ্রামের মানুষেরা এসেছে।

সব মেলাতেই যা শোনা যায়, এখানেও সেই মাইকের প্রচণ্ড কলরব। গান তো আছেই। তার সঙ্গে আছে, সার্কাসের খেলার ঘোষণা, জাদু আর নানা ইন্দ্রজালের খেলা দেখবার ডাকাডাকি, নকল বাঘের হাঁকড়ানি, বিচিত্র এবং উকট যান্ত্রিক শব্দ। সবই দর্শকদের আকর্ষণের জন্য। মেলার ভিড়ের মধ্যে ঢোকবার আগেই দেখতে পাচ্ছি হ্যাজাকের আলো, বাতাসে ধুলো উড়ছে। ধুলো উড়ছে মানুষের পায়ে পায়ে। বিজলি বাতির কোনও চিহ্ন নেই। কাছে কাছেই একটা মাপজোক করা তৈরি শহর থাকলেও, মেলার এই তল্লাটে এখনও বিদ্যুৎ এসে পৌঁছয়নি।

নানাবিধ শব্দ চিৎকার গান আলো, যা-ই থাক, মেলাটা কোনও দিক দিয়েই যেন শহুরে হয়ে উঠতে পারেনি। বিশাল প্রান্তর জুড়ে, ঘন এবং নিবিড়, আম লিচুর বাগান। আঁশশ্যাওড়া বুনো বাবলার ঝাড়। এখানে ওখানে কয়েকটা পুকুর। তার মধ্যেই মেলা। পুরোপুরি গ্রামীণ, কিংবা বলা যায়, যেন ঘন গাছপালায় ঘেরা, একটি বন্য পরিবেশের মেলা।

মেলায় ঢোকবার প্রধান রাস্তাটার দুপাশেই যা দোকানপাট রয়েছে। মেলায় যেমন দোকানপাট থাকতে হয়, তার সবই আছে। তার মধ্যে মনোহারি আর খাবারের দোকানই বেশি। ভিড়ও সে সব দোকানেই বেশি। মেয়েদের ভিড় মনোহারি দোকানে। যত পুরনো সিঁদুর আলতা হোক, যত মান্ধাতা আমলের হিমানী পাউডার হোক, মেলার জিনিসের ঝলক যেন বেশি। খাবারেরও তা-ই। বড় বড় কাঠের বারকোশে করে, থরে থরে সাজানো রয়েছে। খাজা গজা মণ্ডা জিলিপি। গামলা ভরে পানতুয়া রসগোল্লা। কাঁচা পথের পায়ে পায়ে ধুলো উড়ে প্রলেপ পড়ে যাচ্ছে। তা পড়ুক, তবু দেখ, কর্তা যেমন সাগ্রহে খাচ্ছে, গিন্নিটিও ঘোমটার আড়ালে কম খাচ্ছে না। কেবল যে মণ্ডা-মিঠাইয়ের দোকান, তা না। ভাতের হোটেলও আছে। ডাল-তরকারি মাছ-ডিম মাংস যা চাইবে, সব পাবে। এমনকী যাকে বলে রেস্টুরেন্ট, যেখানে চপ কাটলেট পাওয়া যায়, তাও মিলবে। খুবই স্বাভাবিক। এ মেলা তো কেবল আশেপাশের দু-চার গাঁ-ঘর নিয়ে নয়। বহু দূর-দূরান্তর থেকে তোক আসে, দু-চারদিন থাকে। সবাই কিছু পুঁটলিতে চাল-ডাল বেঁধে নিয়ে আসে না। আমার মতো যাযাবর যাত্রীও আছে, যারা ঘাড়ে বয়ে কিছু নিয়ে আসে না। তাদের তো একটা ব্যবস্থা চাই। যদিও অবিশ্যি, আমার যাযাবর বৃত্তি এক রাত্রের মেয়াদি। এখানকার অন্ন হয়তো আমাকে গ্রহণ করতে হবে না।

এই সব দোকানের ফাঁকে ফাঁকে আছে, বেলোয়ারি চুড়ির দোকান। পাশে পাশে নানারকম কাচের মালা, পুঁতির হার। পুতুলের দোকানও মেলাই। যেমন পুতুল খুঁজবে, সবই পাবে। মাথা কাঁপানো বুড়োবুড়ি থেকে ঠাকুর-দেবতা। এর মধ্যে যদি কারোর শখ হয় ফটো তোলার, তার ব্যবস্থাও আছে। রং-বেরঙের সিনসিনারি খাঁটিয়ে ফটোওয়ালা তার যন্তর নিয়ে বসে আছে।

এইসব দোকানপাটের গা ঘেঁষে, যেখানে একটু বেশি জায়গা পাওয়া গিয়েছে, সেখানেই সার্কাস আর ইন্দ্রজালের তাঁবু পড়েছে। মাইকের চিৎকারে, সেখানে দাঁড়ায় কার সাধ্যি। সে কথা বললে অবিশ্যি হবে না। দাঁড়াবার সাধ্যি অনেকেরই আছে। তাঁবুর সামনে গিজগিজে ভিড় দেখলেই সেটা বোঝা যায়। একমাত্র আমার মতো লোকেরই যা কানে পোকা পড়ে। অতএব তফাতে থাকাই ভাল।

কিন্তু এ সব হচ্ছে মেলার বহিরঙ্গ। এই হ্যাজাকের আলোর ঝলকানি, কেনাকাটা, খাওয়া-দাওয়া, হইচই, খেলা দেখা, মাতামাতি ফুর্তি। এটা আসল মেলা না। আসল মেলা, বহুদূর বিস্তৃত গাছতলার ছায়ায় ছায়ায়, কিংবা ছায়ার বাইরে জ্যোৎস্নার আলোয়। সেখানে হ্যাজাকের আলো নেই, কেনাকাটা নেই। সেখানে কেউ জ্বেলেছে হ্যারিকেনের আলো, কেউ প্রদীপ অথবা মোমবাতি। যার সঙ্গতি আছে, সে কারবাইডের আলো। যাদের তা জোটেনি, তারা কাঠের আগুন জ্বালিয়েছে। যার সেটুকুও জোটেনি, সে কিছুই জ্বালেনি। আশেপাশের দশজনের আলোয়, যেটুকু দেখতে পাওয়া যায়, তাতেই তার কাজ চলেছে। তা ছাড়া জ্যোৎস্নার আলো তো কেউ কেড়ে নেয়নি। গাছতলার বাইরে, চাঁদের আলো এখন রুপালি হয়ে উঠেছে।

সেখানে কিছুই স্পষ্ট নয়, সবই যেন ছায়া ছায়া। আবার সবই স্পষ্ট, সবই যেন দেখা যায়। এই বিশাল বাগান, কোথাও আঁশশ্যাওড়া নিশিন্দার ঝোঁপ, বেঁটে বাবলার ঝাড়, সর্বত্র যেন এক কী রহস্যের মেলা বসেছে।

আমি সেই আসল মেলার মধ্যে গিয়ে ঢুকলাম।

গিয়ে দেখলাম, সেখানে সকলের আলাদা আলাদা আসর। কেউ পেতেছে শতরঞ্চি, কেউ হোগলা মাদুর। কাঁথাও পেতেছে কেউ কেউ। যে কিছু খড়-পাতা জোগাড় করতে পেরেছে, তাই বিছিয়ে, তার ওপরে কাঁথা-মাদুর পেতে, গদি করে নিয়েছে। যার যেমন জুটেছে, ভেঁড়াখোঁড়া আস্ত, সে সেইরকম পেতেছে। যার তা জোটেনি, তার ধরিত্রীর আসন আছে। ঘাসের আস্তর না পাওয়া গেলে, মাটির ওপরেই আসর নিয়ে বসেছে।

হঠাৎ দেখলে মনে হয়, কেউ কেউ সংসার ছড়িয়ে বসেছে। সে কথা মিথ্যা না। মাটি খুঁড়ে উনোন করে, ভাতের হাঁড়ি বসেছে দেখতে পাচ্ছি। হাঁড়ির মুখে টগবগ করে ফুটছে। গেরস্থ বউ হাত নেড়ে তুলে, ভাত টিপে দেখছে। পাশেই কাত হয়ে শুয়ে, শিশুটি ঘুমোচ্ছে। অঘোর ঘুম, ঢাকা দেবারও দরকার হয়নি। এক বর্ষীয়সী বসে বসে কুটনো কুটছে। আর একটু ফারাকে বসে, এক পুরুষ, চোখ বুজে একতারা বাজাচ্ছে। সুর মেলাবার চেষ্টা করে গাইছে, গুরু, অবুঝ বুঝি, তোমায় খুঁজি, খুঁজে তো আর পাই না।..

সব জায়গায় এরকম রান্নার ব্যবস্থা নেই। অনেক জায়গায় কেবল গানের আসর। খোল বাজছে, করতাল বাজছে, গান চলেছে, গুরুর নাম করেছি সার, গুরুর নামেই পার।..

যেখানেই যাই, কেবল গুরুর নাম শুনি। কেউ ফিরে তাকায়, কেউ চেয়েও দেখে না। সব আপন আপন মনে আছে। যেন ধ্যানে আছে। আবার অন্যরকমও আছে। মাথায় বাঁধা চুড়ো করে চুল। মুখভরতি দাড়ি। কাছা নেই, একটি বস্ত্র কোমরে জড়ানো। আর একখানি গায়ে। এদের আসরে আলো নেই, বসবার জন্য কিছু পাতা নেই। গাছে হেলান দিয়ে বসে, একতারা বাজিয়ে, ঘাড় নেড়ে নেড়ে গান করছে। জ্যোৎস্নার আলোয় দেখি, তাদের কারোর কারোর দাড়ির ভাঁজে হাসি। ভুরু নাচে গানের তালে তালে। গান করে

গুরু তুই পাবি কোথা যেথা সেথা
জেনে তাঁর পথের খবর খুঁজে মরবি বেরথা!

 গাইতে গাইতে, হাসতে হাসতে হাতছানি দিয়ে ডাকে। নিজের পাশের জায়গাটি ইশারায় দেখায়। যেন ডেকে বসতে বলে। মনে হয়, সবাই যেন কোন এক অজ্ঞাত জগতে রয়েছে। এখানে দেহ নিয়ে বসে আছে। একতারার সঙ্গে অনেকে ডুগিতেও ডুগ ডুগ করে তাল দিচ্ছে।

সব জায়গায় যে এমন গানের আসর, তা-ইনা। কেউ কেউ নিজেদের মধ্যে বসে, কী সব কথাবার্তা বলছে। সকলেই নিজেদের নিয়ে রয়েছে।

সব জায়গায় যে কেবল একতারা ডুগি বাজে, খোলকরতাল বাজে, তা নয়। কোনও গাছতলায় হয়তো কাঠের আগুন জ্বলছে। সেখানে মাটিতে ত্রিশূল পোঁতা। ত্রিশূলে সিঁদুর লাগানো। সামনে ধ্যানস্থ ভৈরবী বসে। গেরুয়া রঙে তার শাড়ি ছোপানো। কপাল সিন্দুর-চর্চিত। কোথাও বা ছাইভস্ম মাখা, খালি-গা, সাধুর দল। সেখানে হাতে হাতে কলকে ফিরছে।

এরা কেন এ মেলায়, তা বুঝতে পারি না। তবে মেলা বলে কথা। কারোর আসতে মানা নেই। তাই এসে আসর জমিয়ে বসেছে।

এ হল কর্তাভজাদের মেলা। লোকে বলে ঘোষপাড়ার মেলা। জায়গার নাম ঘোষপাড়া, সেই হিসাবে ঘোষপাড়ার মেলা। দোলের মেলা। আসলে সতী মায়ের থান। কর্তাভজা সম্প্রদায়ের সকলেই আউল। এ হল আউলদের মেলা।

আউলরা বলে, যিনি ছিলেন শ্রীচৈতন্য, জন্মান্তরে তিনিই আউলচাঁদ। জন্ম তাঁর সতী মায়ের গর্ভে। সতী মায়ের এক সময়ে ভারী ব্যায়ো হয়েছিল। অন্য রূপে, অন্য পরিচয়ে, আউলচাঁদ তখন এখানে। তিনি এসে সতী মাকে শোয়ালেন ডালিম গাছের তলায়। কাছে এক জলাশয়, নাম তার হিমসাগর পুকুর। সেই পুকুরের পাঁক নিয়ে এসে, সতী মায়ের অঙ্গে লেপে দিলেন। দূররোগ্য ব্যাধি থেকে সতী মা বাঁচালেন। তখন মহাপুরুষের শক্তি দেখে, সতী মা আর তাঁর স্বামী রামচরণ পাল, মহাপুরুষের শিষ্য হলেন। তাঁর সেবাযত্ন করলেন। মহাপুরুষ এখানেই রয়ে গেলেন, দেহ রাখলেন। তার আগে ঘোষণা করে গেলেন, তিনি আবার সতী মায়ের গর্ভে জন্ম নিয়ে আসছেন। এসেছিলেনও।

আউলদের ঈশ্বরের রূপ কী? বাউলদের মতোই, তাদের কোনও ঈশ্বর নেই। বাউলদের দেহবাদ বা মহাসুখবাদ তাদের আছে কি, তা জানি না। তবু এদের দেখলে, কেমন যেন বাউলদের কথাই মনে পড়ে। এরা গুরুকে বলে কর্তা, শিষ্যকে বলে বরাতী। গুরুই এদের ধ্যান-জ্ঞান, গুরুই একমাত্র পূজ্য। সেজন্য এদের কর্তাভজাও বলে।

হিমসাগরের সম্পর্কে প্রবাদ, সেই জলে স্নান করলে, স্নান করে দণ্ডী খেটে ডালিমতলায় গিয়ে হত্যে দিলে, অন্ধ দৃষ্টি ফিরে পায়। বোবার মুখে কথা ফোটে। বিকলাঙ্গ সুস্থ হয়। যাবৎ ব্যাধির আরোগ্য ঘটে।

আমি এসেছি আউল মেলায়। আউলদের দেখতে, আউলদের গুরুনামের গান শুনতে। খোলা আকাশের তলায়, এই জ্যোৎস্না রাত্রে, বিশাল বাগানের আলো-আঁধারিতে, আমি যেন কেমন মোহাবিষ্ট হয়ে পড়ছি। একদিকে জ্যোস্নার আলো। যেন আলোর প্লাবন। আর একদিকে ছায়া আবছায়া অস্পষ্ট একটা রহস্যে দুলছে।

ঘুরতে ঘুরতে, আমি এক সময়ে হিমসাগর পুকুরের ধারে এসে দাঁড়ালাম। চাঁদের আলোয় দেখলাম, সেখানে নর-নারীর ভিড়। বাঁধানো ঘাটের সিঁড়ি দিয়ে সবাই ওঠা-নামা করছে। যারা উঠে আসছে, তাদের সর্বাঙ্গ ভেজা। স্নান করে উঠে আসছে। এই ঘাট থেকেই, সবাই দণ্ডী কাটতে আরম্ভ করেছে। অন্ধ, খঞ্জ, বধির, মূক, বিকলাঙ্গ, সকলেই দণ্ডী কেটে চলেছে। উপুড় হয়ে, সাষ্টাঙ্গে শুয়ে, হাতের দাগ দিয়ে, চলেছে। তাদের সঙ্গে সঙ্গে লোক। যে সব বিকলাঙ্গ দণ্ডী কাটতে পারছে না, তাদের জোর করে কাটানো হচ্ছে। এদের মধ্যে কি উন্মাদও আছে? দু-একজনকে যেন ছপটি মেরে, দণ্ডী খাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অদ্ভুত গোঙানি আর চিৎকার শোনা যাচ্ছে।

আমি এ সব মাহাত্ম্য বুঝি না। দণ্ডী খাটা দলের পথ ধরে মূল মন্দিরের প্রাঙ্গণে এসে দাঁড়ালাম। সেখানে নরনারীর ভিড়। অনেকে বসে আছে। অনেকে হত্যে দিয়ে মাটিতে পড়ে আছে। এ সবই হল আরোগ্যের জন্য, আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য মানত।

ডালিমতলাতেই বেশির ভাগ মেয়ে-পুরুষ হত্যে দিয়েছে। এই ডালিম গাছ নাকি সেই ডালিম গাছ, যেখানে সতীমা আরোগ্যলাভ করেছিল। দেখলাম, ডালিম গাছের ডালে ডালে ঢিল বেঁধে ঝুলিয়ে দিয়েছে। মানত করে দিল বেঁধে দিলে নাকি মনস্কামনা পূর্ণ হয়।

যারা হত্যে দিয়েছে, তারা অনেকে মাথা কুটছে। বিচিত্র রকমের গোঙানির শব্দ উঠছে। মাঝে মাঝে জয়ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। কারা যেন চারদিক থেকে বাতাসা বৃষ্টি করছে। সেই বাতাসা নেবার জন্য, অনেকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে, কাড়াকাড়ি করছে। এত ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা যায় না।

অন্য দিকে সরে যাব বলে ফিরতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালাম। ডালিম গাছের ঝোঁপ ঘেঁষে দুটি চোখের দিকে আমার চোখ পড়ে গেল। আমার চোখে কৌতূহলিত জিজ্ঞাসা। আমি দেখছি, দুটি আয়ত টানা চোখ। চোখের তারা কাঁপিয়ে, ভুরু নাচিয়ে, আমাকে যেন কিছু ইশারা করল।

কিন্তু আমাকেই কি? আমি পিছন ফিরে, ডাইনে বাঁয়ে দেখলাম। কাউকে সেদিকে তাকিয়ে থাকতে দেখলাম না। ভিড়ের মধ্যে, সকলেই আপনাতে আপনি মগ্ন। আমি আবার সেই চোখের দিকে তাকালাম। দেখলাম, সেই উজ্জ্বল চোখের দৃষ্টি আমার চোখের ওপর। আবার কালো তারা দুটিতে ঝিলিক হেনে উঠল। ভুরু নাচিয়ে কী যেন ইশারা করল।

কৌতূহলিত জিজ্ঞাসার সঙ্গে আমার মন জুড়ে বিস্ময়। আমি আবার সন্দিগ্ধ হয়ে উঠলাম। পিছনে, আশেপাশে ফিরে তাকালাম। সকলেই অন্যমনস্ক, নিজের নিজের ভাবনায় রয়েছে। সেই চোখ দুটির দিকে কারোর দৃষ্টি নেই। কিন্তু ওই অচেনা চোখ দুটি আমাকে কীসের ইশারা করছে। আমি ঠিক দেখেছি তো! নাকি এই মেলার নিশি আমাকে সম্মোহন করছে!

আমি আবার সেই চোখের দিকে তাকালাম, এবং আবার সেই উজ্জ্বল কালো তারায় ঝিলিক, ভুরু কাঁপানো। যেন আমাকে একটা কী ইশারা করছে। কিন্তু কেমন করে সম্ভব? ওই চোখ দুটি যার, সে তো আমার অচেনা। আমি তার দিকে ভাল করে তাকালাম। মুখোনি ঈষৎ লম্বা, শ্যামবর্ণ।

মাথার চুল এলো করা, মুখের দুপাশ দিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। রুক্ষু চুলের গোছা, কপালে মুখে একটু ছড়িয়ে পড়েছে। ঘাড়ের পাশ দিয়ে, চুলের গোছা পিঠে এলিয়ে পড়েছে। মাঝখানের সিথি অস্পষ্ট। সিঁদুর আছে কি না, বুঝতে পারছি না।

ডালিম ঝোঁপের আড়াল থেকে, তার শরীর খানিকটা বেরিয়ে আছে। বয়স অনুমান করতে পারি না। দেখে মনে হচ্ছে, সে যুবতী। অনেকটা গ্রাম্য যুবতীর মতো তাকে দেখাচ্ছে। লাল জামা আর খয়েরি রঙের শাড়ি তার পরনে। শাড়িটি নিতান্ত আটপৌরে ধরনের পরা। জামাকাপড়ের গোছগাছ, একটু যেন অবিন্যস্ত। তার স্বাস্থ্য তেমন উদ্ধত না, আবার নও না। কিন্তু সে যে স্বাস্থ্যবতী, তার শরীর দেখে বোঝা যাচ্ছে। আমি তার একটি হাত দেখতে পাচ্ছি। সেখানে কয়েক গাছা কাচের চুড়ি ছাড়া, আর কিছুই নেই। গলায় বা কানে, কোথাও কোনও অলঙ্কার নেই। ভুরু দুটি টানা এবং সরু, হঠাৎ দেখলে, গাঢ় করে আঁকা মনে হতে পারে। তার নাক সরু, প্রায় টিকোলো। সেই তুলনায়, ঠোঁট দুটি যেন একটু মোটা, এবং তাতেই যেন মুখের একটি বিশেষ শ্ৰী এনে দিয়েছে। মন্দিরের গায়ে, পাথরের মূর্তির মতো।

ডালিম গাছের আড়াল থেকে, সে যেন শরীরটিকে একটু বাঁকিয়ে, ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে। আমি দেখতে পাচ্ছি, সে যেন উদগত হাসি চাপবার জন্য ঠোঁট টিপে আছে, নাসারন্ধ্র কাঁপছে। তার কালো চোখের তারা, আমার চোখের দিকে। আমি দেখছি বলেই, তার দৃষ্টি যেন স্থির। এখন সে ভুরু নাচিয়ে কোনওরকম ইশারা করছে না।

সহসা মনে হল, পাগল নয় তো! অস্বাভাবিক কিছুই না। এখানে কত রকমের নর-নারী আসে। ও মুখ আমার চেনা নয়। কোনও দিন দেখিনি। অথচ তার ভাবভঙ্গি, অবাক আর কৌতূহলিত করে তোলবার মতো। সে যে-ই হোক, আমার কিছু যায় আসে না। কৌতূহল নিবৃত্ত করা ছাড়া, আমার কিছু করবার নেই। আমি একবার চারপাশে তাকিয়ে দেখে নিলাম, এ মুহূর্তে, আমাকেই কেউ বিশেষভাবে লক্ষ করছে কিনা। কারণ, এভাবে একটি যুবতাঁকে বিশেষ ভাবে নিরীক্ষণ করে দেখাটা, আমি খুব স্বাভাবিক মনে করি না। অভ্যস্তও নই, শোভনীয়ও নয়। কিন্তু দেখলাম, আমাকে কেউই লক্ষ করছে না। কেবল আমাকে বলে নয়, সেই যুবতীটিকেও কেউ বিশেষ ভাবে লক্ষ করছে না।

ফিরে যাবার আগে, আমি আর একবার তার দিকে ফিরে তাকালাম। অবাক হয়ে দেখলাম, সে সেখানে নেই। যাক, তা হলে ভুলই দেখেছিলাম। সে নিশ্চয় অন্য কারোকেই ইশারায় ডেকেছিল। ডেকে নিয়ে, সরে গিয়েছে। এই ভেবে যখন বাঁ-দিকে ফিরতে গেলাম, তখন আবার সেই চোখ দুটি আমি দেখতে পেলাম, এবং সেই চোখের দৃষ্টি আমার দিকেই নিবদ্ধ। ডালিম গাছের আর একটা অংশে সে সরে এসেছে। সেদিকে একটা শুকনো ইট বের করা দালানের মতো রয়েছে, সেই দালান সংলগ্ন বারান্দার পাশে ডালিম গাছের একটু আড়ালেই সে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বুঝতে অসুবিধা হল না, আমার অন্য দিকে লক্ষ করার অবসরে, সে ডালিম গাছের পিছন দিয়ে ঘুরে, এদিকটায় এসে দাঁড়িয়েছে। এখন সে আমার আরও কাছে। আমি এখন তাকে আরও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। স্পষ্টই দেখলাম, সে দুবার ভুরু কাঁপিয়ে, আমাকে যেন কিছু ইশারা করল। অথবা যেন আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করছে। এখন তার চোখের ঝিলিক, ঠোঁটের কোণে হাসি, আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।

আমার কী করণীয়, কিছুই বুঝতে পারলাম না। ব্যাপারটাকে যদি এক ধরনের পাগলামিও মনে করি, তবু এ ধরনের পাগল থাকতে পারে বলে আমি বিশ্বাস করতে পারি না। এরকম পাগলামি কি কেউ করতে পারে? অবিশ্যি, আমার জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, বাস্তব ব্যাপারটা খুবই অদ্ভুত। আমরা যাকে অসম্ভব এবং অপ্রাকৃত ঘটনা বলে জানি, বাস্তব জীবনে তার অনেক কিছুকেই সত্যি বলে জানতে পেরেছি। আমাদের বাস্তব বোধ অনেক ক্ষেত্রেই তৈরি এবং সীমিত। জীবনের বাস্তব ক্ষেত্রে, সে বাস্তবের অভিজ্ঞতা মেলে না।

তথাপি আমি বুঝতে পারছি, এ ক্ষেত্রে আমার করার কিছুই নেই। আমার মনের প্রকৃতি এমন নয় যে, এগিয়ে গিয়ে, এই অদ্ভুত যুবতীটিকে জিজ্ঞেস করি, সে আমাকে কিছু বলতে চায় কী না। কী চায় সে আমার কাছে? এরকম আচরণই বা করছে কেন? সে সব কোনও কিছুই না করে, তার চোখে চোখ রেখে, আমি ভ্রুকুটি করলাম। তৎক্ষণাৎ সে নিঃশব্দে হেসে উঠল। আমি তার ঝকঝকে সাদা দাঁতের ঝিলিক দেখতে পেলাম। তার এই হাসিমুখ অদ্ভুত। সুন্দর কি না বলতে পারব না, কিন্তু হাসিতে যেন বিদ্যুতের ঝলক। মনে হল, আমার কুটিকে বিদ্রূপ করার জন্যই যেন সে এভাবে হেসে উঠল। তার পরেই দেখলাম, সে এক পা এগিয়ে এল।

আমি চমকে উঠলাম। তাড়াতাড়ি আমি আমার চারপাশে আবার তাকিয়ে দেখলাম। ঘটনাটা কেউ লক্ষ করছে কিনা, ভেবে আমি যেন কেমন আড়ষ্ট হয়ে উঠলাম। বুঝতে পারিনি, আমার কুটি করা মানেই, এই রহস্যময়ী অদ্ভুত যুবতীটির বিচিত্র খেলার ব্যাপারটাকে এক ধরনের খেলাও বলা যায়) সঙ্গে আমিও জড়িয়ে পড়ছি। আমার এমন কোনও কিছুই করা উচিত না, যাতে বোঝা যায়, আমি তার এই উদ্ভট আচরণের জন্য বিন্দুমাত্র বিচলিত হয়েছি। নিতান্ত উদাস থেকেই আমার সে কথা বুঝিয়ে দেওয়া উচিত। আমার চারপাশে এত লোক, তাদের কথা আমি ভুলে যেতে পারি না। এবং তারা আমার অপরিচিত হলেও, তাদের মনে কোনও ভুল সৃষ্টি করতে পারি না।

আমার ভাগ্য ভাল যে, আমাকে কেউই লক্ষ করছে না। মন্দিরের সামনে সকলেই সতী মায়ের সিন্দুরচৰ্চিত ছবি দেখতে ব্যস্ত। লুটের বাতাসা কুড়োতে ব্যস্ত। অথবা যারা হত্যে দিয়ে আছে, তারা অনেক বেশি আকর্ষণীয়।

যুবতীটি আরও এগিয়ে আসবে কিনা, সেই ভেবেই আমি ভয় পাচ্ছিলাম। দেখলাম, সে আর এগোয়নি। এক পা এগিয়েই থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে। এবং আমার দিকে সেই ভাবেই তাকিয়ে আছে। অস্বীকার করতে পারব না, আমার ভিতরে একটা তীব্র কৌতূহলের আলোড়ন চলেছে। এখন এক পা এগিয়ে আসায়, তার সমস্ত শরীরটাই আমি দেখতে পাচ্ছি। তার সমস্ত শরীরটা যেন এখন আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। সে ঠিক ঋজু হয়ে দাঁড়িয়ে নেই। তার ক্ষীণ কটিতে যেন একটা মোচড় লেগেছে, এবং স্বভাবতই প্রশস্ত নিতম্বে যেন একটা ঢেউ জেগে আছে। তার সমস্ত শরীর এবং ভঙ্গির মধ্যে একটি বিশেষ আকর্ষণ ফুটে রয়েছে।

তা হোক। আমার পক্ষে একটি অচেনা যুবতীর এরকম অদ্ভুত আচরণের রহস্য ভেদ করা সম্ভব না। যদিও তার দিক থেকে চোখ ফেরাব ভাবলেই ফেরানো যায় না। মনুষ্যচিত কৌতূহল এবং জিজ্ঞাসা আমারও আছে। এবং সত্যি কথা বলতে কী, তার চোখ, হাসি এলানো রুক্ষ চুল, যৌবন এবং ভঙ্গি, আমার মস্তিষ্কের কোথায় যেন বিধে যাচ্ছে। তার আশেপাশে অনেক নরনারী। তার চার পাশ দিয়েই অনেকে যাতায়াত করছে। কিন্তু সে আমার চোখের সামনে যেন স্থির বিদ্যুতের মতো দাঁড়িয়ে আছে।

থাকুক, আমি আবার পিছন ফিরতে গেলাম। সেই মুহূর্তেই, দ্রুত পায়ে সে একেবারে আমার কাছে এসে পড়ল। আমি তার কাচের চুড়ির ঝনাৎকারও শুনতে পেলাম। দেখেই, বিদ্যুৎপ্রবাহের মতো যেন আমার ভিতরে কিছু খেলে গেল। আমি থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। কিন্তু সে দাঁড়াল না। আমার সঙ্গে কথাও বলল না, বা গায়ে কোনওরকম ধাক্কাও দিল না। আমাকে চমকে দিয়ে, সে এই মন্দির প্রাঙ্গণের বড় দেউড়ির দিকে এগিয়ে গেল। যদিও দেউড়ি বলতে কিছুই নেই। কোনও কাঠের পাল্লা বা চৌকাঠ, কিছুই নেই। অনেকদিন আগেই হয়তো তা ভেঙে গিয়েছে। এখন শুধু দুপাশে ইট বের করা পুরনো পাঁচিল, মাঝখানটা ফাঁক।

আমি দেখলাম, যুবতীটি বেরিয়ে যাবার মুখে পাঁচিলের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। সে এখন ঘাড় বাঁকিয়ে, অনেকটা যেন চোখের কোণে কটাক্ষ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তার সুন্দর ঝকঝকে সাদা দাঁত আবার দেখা যাচ্ছে। ঠিক বুঝতে পারছি না, নিঃশব্দ হাসিতে তার শরীর কাঁপছে কিনা। তার সামনে দিয়ে লোক চলাচলের জন্য, সে প্রায়ই ঘাড় এদিক-ওদিক করে আমাকে দেখছে।

আমি কী করব, বুঝে ওঠার আগেই, আমি তার কাচের চুড়ি পরা একটা হাত উঠতে দেখলাম। চোখেরই বিভ্রম কিনা বুঝতে পারলাম না, মনে হল সে আমাকে হাতছানি দিল। সেই সঙ্গে তার ঘাড়ও দুলে উঠল। মনে হল, ঘাড় দুলিয়ে সে আমাকে ডাকল, এবং তারপরেই সে দেউড়ি পেরিয়ে, বাঁদিকে চলে গেল। পাঁচিলের আড়ালে হারিয়ে গেল।

আমি যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম, সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম। প্রথমেই আমার মনে হল, যাক বাঁচা গেল। সে নিজের থেকেই চলে গিয়েছে। আমাকে একটা অদ্ভুত অবস্থার হাত থেকে নিষ্কৃতি দিয়েছে। আমি আবার মন্দিরের প্রাঙ্গণের নানা দৃশ্যেই মনোনিবেশ করার চেষ্টা করলাম। যদিও, এই আশ্চর্য ঘটনার রেশ আমার মন থেকে হারিয়ে গেল না। যুবতীটিকে আমি একেবারে ভুলে যেতে পারলাম না। মন্দির প্রাঙ্গণে মনোনিবেশ করতে গিয়ে, সেদিকে আমার তেমন মনোযোগ এল না। ব্যাপারটা কী হতে পারে, সেটাই আমার মস্তিষ্কের মধ্যে ঘোরাফেরা করতে লাগল। কৌতূহলটা একেবারে শেষ হয়ে গেল না।

আবার আমার মনে জিজ্ঞাসা জাগল, যুবতীটিকে কি আমি চিনি? আমার স্মৃতির মধ্যে কোথাও, ওরকম একটি মেয়েকে খুঁজে পেলাম না। আমি যে পরিবেশের মানুষ, সেখানে ও ধরনের প্রায় একটি গ্রাম মেয়ের অবস্থান সম্ভব না। অথচ, কিছুক্ষণ ধরে, আমি তার যে আচরণ দেখলাম, সেটা নিশ্চয় স্বপ্ন না। আমি যা দেখেছি, ঠিকই দেখেছি। কী করে এরকম একটা ব্যাপার সম্ভব, কিছুই ভেবে পাচ্ছি না। আমার চোখের সামনে, যুবতীটি যেন আরও স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠতে লাগল। তার সেই আয়ত টানা চোখ, কালো তারার ঝিলিক, তার অপরূপ হাসি, হাতছানি, ঘাড় দোলানো, সবই বারে বারে মনে পড়তে লাগল।

কিন্তু এ সবের থেকেও, যেটা বড় কথা, তা হল, মানুষ তার নিজের কাছে অনেকখানি অপরিচিত। নিজেকে চিনে ওঠাই তার পক্ষে দুষ্কর। মানুষ তার নিজের কাছে নিজেই যদি অনেকখানি পরিমাণে অজ্ঞাত না থাকত, তা হলে পৃথিবীতে অনেক ঘটনাই ঘটত না। নিজেকে চেনার অহংকার, মানুষের না। থাকাই উচিত। কেন না, এটা একটা আবিষ্কারের বিষয়। কেবল আবিষ্কারের বিষয়ই বা বলছি কেন। এটা মানুষের নিজের সঙ্গে নিজেরই একটা সংগ্রাম। মানুষ তার নিজেকে যত বেশি চিনতে পারে, তত বেশি অপরকেও।

এ কথাগুলো এখন অবিশ্যি অনেকটা বক্তৃতার মতোই শোনাচ্ছে। কারণ আমি যখন মন্দির প্রাঙ্গণ ছেড়ে, দেউড়ির দিকে এগিয়ে গেলাম, তখন এ সব আত্ম-আবিষ্কারের কথা আমার মনে আসেনি। এতক্ষণ ধরে, আমার মনে, এত যে যুক্তিপূর্ণ জিজ্ঞাসা বা মনের মধ্যে তর্ক উঠেছিল, সে সব কোনও কাজেই লাগল না। একটা নিশির টানের মতোই যেন আমাকে ভাঙা দেউড়ির দিকে টেনে নিয়ে গেল। এই মেলার কথা এখন আর আমার মনে নেই। নিজেকে কিছু জিজ্ঞেস করবার কথাও আমার মনে এল না। আমার চোখে তখন কেবল সেই যুবতীটি ভাসছে, এবং বারে বারেই মনে হতে লাগল, আমাকে কি সে ডাক দিয়ে গেল? আমাকে কোথায় যাবার জন্য সে ডাকল? সে কোথায় গেল? আমাকে সে বোধহয় কিছু বলতে চায়।

আমি দেউড়ির কাছে এসে একবার দাঁড়ালাম। তারপরে দুপা এগিয়ে বাঁয়ে ফিরলাম। কেন যেন মনে হচ্ছিল, দেউড়ির বাইরে, বাঁ দিকের পাঁচিলের পাশে সে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু দেখলাম, সেখানে কেউ নেই। আমি মনে মনে হতাশ হলাম। আমার দু পাশ দিয়ে মেলার মানুষেরা যাতায়াত করছে। কেউ দাঁড়িয়ে নেই। আমি সকলের ধাক্কা খাচ্ছি।

আবার বাস্তব বোধ ফিরে এল আমার মধ্যে। ভাবলাম, নিশ্চয়ই ভুল করেছি। এতক্ষণের সমস্ত ব্যাপারটাই বোধহয় ভুল। সে নিশ্চয়ই আমার দিকে চেয়ে হাসেনি, আমার চোখের দিকে চেয়ে তার সেই উজ্জ্বল কালো তারায় ঝিলিক হানেনি। তার জন্য অন্য কেউ ছিল, এবং তাকেই সে হাতছানি দিয়ে, ঘাড় দুলিয়ে ডেকে নিয়ে গিয়েছে। কিংবা এতক্ষণ ধরে সমস্ত ব্যাপারটাই আমি ভুল দেখেছি। এ সব কিছুই ঘটেনি। যদিও এভাবে মনকে ঠিক সান্ত্বনা দিতে পারছি না। তথাপি, ব্যাপারটাকে অবিশ্বাস্য ভেবেই, আমি বাঁদিকেই এগিয়ে চলোম।

দশ পা এগিয়েছি কিনা সন্দেহ। হঠাৎ আবার আমাকে থমকে দাঁড়াতে হল। আমি দেখলাম, ডান দিকে, রাস্তার ধারেই সে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমার দিকেই সে তাকিয়ে রয়েছে। সে এখন আমার মাত্র এক হাত দূরে। যেন সে আমার জন্যই অপেক্ষা করছিল। আমার দিকে চেয়ে সে ঠিক সেইভাবেই হাসল। ভুরু কাঁপিয়ে যেন কিছু ইশারা করল। কিন্তু সে দাঁড়াল না। ইশারা করেই, রাস্তার ধার থেকে সরে গিয়ে, একটা গাছতলায় দাঁড়াল। সেখান থেকে সে আমার চোখে চোখ রেখে হাসল।

আমি কী করব, বুঝতে পারলাম না। যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম, সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম। তার দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারলাম না। এখন, আমি আমার চারপাশের লোকজন সম্পর্কে তেমন আর সচেতন নই। এই অদ্ভুত ঘটনা, আর এই রহস্যময়ী (রহস্যময়ী-ই তো!) যুবতীটি আমার মস্তিষ্কের চারপাশের সীমায় যেন আবদ্ধ হয়ে গিয়েছে। এখন যেখানে সে দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে কোনও আলো নেই। দূরের আলো গিয়ে তার গায়ে পড়েছে। আবছায়ার মধ্যেও, তাকে আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। এখন তার মুখের এক পাশে, রুক্ষু চুলের গোছা যেন আরও একটু বেশি এসে পড়েছে। খয়েরি রং শাড়ির আঁচল, বুকের এক পাশ থেকে সরে গিয়েছে। আঁচলটা তার একটা হাতকে ঢেকে, ঝুলে পড়েছে।

তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার মনে হল, তার শরীর যেন একটু দুলে উঠল। ঢাকা পড়া হাতের ওপর থেকে আঁচলটাকে তুলে, যেন ঘাড়ের দিকে ছুঁড়ে দিল, এবং আমার দিকে ঘাড় বাঁকিয়ে চেয়ে হাসল। চোখের তারা কাঁপিয়ে, একটা কিছু ইশারা করার সঙ্গে সঙ্গেই, তার ঠোঁট নড়ে উঠল। যেন কিছু বলল, অথচ আমি কিছুই শুনতে পেলাম না। তারপরে, সেই দেউড়ির ধারের মতোই, আবার তার কাচের চুড়ি পরা হাত উঠল। এবার আর অস্পষ্ট না, স্পষ্টই যেন দেখলাম, সে আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকল। ঘাড় ঝাঁকিয়ে, ডাকার ইশারা করল এবং পিছন ফিরে চলতে আরম্ভ করল।

আমি আবার সচেতন হবার চেষ্টা করলাম। সেই মুহূর্তেই, তার পিছন পিছন এগিয়ে যেতে পারলাম না। যেদিকটায় সে যাচ্ছে, সেদিকে ঠিক কী আছে, আমি বুঝতে পারছি না। তবে মেলার দোকানপাট আলো সেদিকে নেই। গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে, সেইরকম মেলার যাত্রীদের যেন দেখতে পাচ্ছি, যারা রান্নাবান্না গান ইত্যাদির আসর নিয়ে বসেছে। এখানে ওখানে কয়েকটা হ্যারিকেন লম্ফর আলো দেখতে পাচ্ছি। কোথাও বা কাঠের আগুন, উনুনের আগুনও হতে পারে। দূরে দূরে দু-একটা উজ্জ্বল হ্যাজাকের আলোও দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু সেগুলো দোকান বলে আমার মনে হচ্ছে না। কেবল যে এ সবই দেখতে পাচ্ছি, তা নয়। ইতস্তত বিক্ষিপ্ত কয়েকটা ঘরের চিহ্নও যেন জ্যোৎস্নার আলোয় দেখা যাচ্ছে। কোনও চালাঘর নয়। অনেকটা ভাঙা পোডড়া বাড়ির মতো সেগুলোকে দেখাচ্ছে।

এ সব লক্ষ করতে করতেই, যুবতীটি আমার চোখ থেকে হারিয়ে গেল। গাছপালার আড়ালে, ফাঁকে ফাঁকে, অন্যান্য যাত্রীদের আসরের ভিড়ে। তাকে আর কোথাও দেখতে পাচ্ছি না। যদিও ওদিকে সেরকম ভিড় নেই। একতারা আর ডুগির বাজনার সঙ্গে গান শুনতে পাচ্ছি। কী গান হচ্ছে খেয়াল করতে পারছি না, কারণ গানের দিকে আমার মন নেই।

এখন আমি নিজের কাছে নিজেই অনেকটা অসহায়। দ্বিধা সংকোচ, সবই আমার চেতনার বাইরে অন্য কোথাও পড়ে আছে। আমার চোখের সামনে তার সেই মূর্তি ভাসছে, তার সেই হাতছানি ও ঘাড় দোলানো। ঠোঁট নেড়ে সে যেন কী বলে গেল, বুঝতে পারলাম না। সে কি আমাকে, ভিড়ের আড়ালে, নিরিবিলিতে ডেকে নিয়ে গিয়ে কিছু বলতে চায়? আমার যেন সেরকমই মনে হল। যে পথে গিয়ে সে হারিয়ে গেল, আমি সেই দিকেই এগিয়ে গেলাম।

আমি আউলদের আসরের আশপাশ দিয়ে এগিয়ে চলোম। গাছের তলা দিয়ে, জ্যোৎস্নায় ছায়া ফেলে, সব দিকে দেখতে দেখতে চলোম। তাকে কোথাও চোখে পড়ছে না। আমার মনে মনে আবার সন্দেহ আর হতাশা ফুটে উঠতে লাগল। অথচ যুবতীটির আচরণে, আর আমার কোথাও ভুল হবার কথা নয়। সে যে আমার দিকে চেয়েই হেসেছিল, চোখের তারা এবং ভুরু কাঁপিয়ে ইশারা করেছিল, হাতছানি দিয়ে, ঘাড় দুলিয়ে ডেকেছিল, তা আমি স্পষ্টই দেখেছি। আমি যে আউলদের মেলা দেখতে এসেছিলাম, সে কথা এখন আর আমার মনে নেই। আমি এখন কেবল, একজনের সঙ্গে বাঁধা পড়ে গিয়েছি। যাকে আমি চিনি না, জানি না, কখনও দেখিনি।

চলতে চলতে আমি একটা পুকুরের ধারে এসে দাঁড়ালাম। পুকুরের ওপারে একটা ভাঙা ইমারত দেখতে পাচ্ছি। তার প্রাঙ্গণে একটা হ্যাজাকের আলো এবং কিছু লোক। কী করছে, কিছুই বুঝতে পারছি না। সেই আলোয়, অস্পষ্ট ভাবে চোখে পড়ছে, পুকুরের আশেপাশে কিছু লোকজন জল তুলছে কিংবা যে কোনও কারণেই হোক, পুকুরের দিকে ওঠা-নামা করছে। পুকুরটা অনেক নীচে, যেন মজে গিয়েছে। জল প্রায় দেখাই যায় না। এখানে গাছপালা একটু নিবিড়। স্বভাবতই, অন্ধকারও যেন একটু বেশি।

এ পর্যন্ত এসে আর কোন দিকে যাব, কিছুই বুঝতে পারলাম না। তাদের বাঁদিকে, গাছপালা ছাড়িয়ে একটু দুরেই, আঁশশ্যাওড়ার জঙ্গল দেখতে পাচ্ছি। মনে হচ্ছে, তার পাশে পাশে ঘন বনশিউলি এবং বনগাঁদার জঙ্গল, এবং গোটা দুয়েক বাড়ি, যেখানে কোনও আলো জ্বলছে না। বাড়ি দুটো প্রায় জঙ্গলের মধ্যেই। দেখলেই মনে হয়, পোভড়া বাড়ি। এখানে কারা থাকত, কাদের বাড়ি, কিছুই বুঝতে পারছি না। দেখে মনে হয়, এ জায়গা এক সময়ে বোধহয় খুবই সম্পন্ন ছিল। এখন কেবল তার ধ্বংসাবশেষ পড়ে আছে।

তা থাকুক, আমার মস্তিষ্কের সীমায় যা বিধে আছে, আমি এখনও তার হাত থেকে মুক্তি পাচ্ছি না। অথচ এই বিশাল বাগানের আলো-অন্ধকারে, জ্যোৎস্নাপ্লাবিত জঙ্গলে, মাঠে এবং ধ্বংসাবশেষের মধ্যে, কোথায় তাকে খুঁজতে যাব, কিছুই বুঝতে পারছি না।

এ কথা ভাববার মুহূর্তেই, হঠাৎ আমি একটা শব্দ শুনতে পেলাম। যেন কেউ হাসতে গিয়ে হাসি চাপল। তারই একটা অস্ফুট ধ্বনি শুনতে পেলাম। শব্দ লক্ষ্য করে বাঁদিকে তাকাতেই চমকে উঠলাম। তাকে দেখতে পেলাম। বলতে গেলে, আমি যে গাছটার কাছে দাঁড়িয়ে আছি, সেই গাছেরই গা ঘেঁষে, নিজেকে অর্ধেক আড়াল করে সে দাঁড়িয়ে আছে। আমি তার চোখ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, চোখের তারায় ঝিলিক হানছে। একটা হাত দিয়ে সে ঠোঁট চেপে রেখেছে। বোধহয়, হাত চাপা দিয়েই, উদগত হাসি চাপা দিয়েছে।

আমাকে তার দিকে ফিরে দাঁড়াতে দেখে, সে গাছের আড়াল থেকে সম্পূর্ণ বেরিয়ে এল। তার সঙ্গে আমার দূরত্ব এখন এত কম যে, হাত বাড়ালেই ধরতে পারি। সে যে আমার এত কাছে আছে, এক মুহূর্ত আগেও বুঝতে পারিনি। সে কি আমার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুরছিল? দেখলাম, আস্তে আস্তে সে ঠোঁটের ওপর থেকে হাত নামাল। তার দাঁতের ঝিলিক দেখতে পেলাম, এবং মনে হল, ভুরু নেচে উঠল।

আমি তার সঙ্গে কথা বলবার জন্য মনে মনে প্রস্তুত হলাম। আমি তাকে জিজ্ঞেস করতে চাইলাম, আপনি কে, কী চান?

ঠিক সেই মুহূর্তেই, ঘাড় ঝাঁকিয়ে, গাছতলা থেকে সরে গেল। ঘাড় ঝাঁকানিটা ডাকের মতোই মনে হল। দেখলাম, সে গাছতলা থেকে সরে গিয়ে, জ্যোৎস্নায় ছায়া ফেলে, আঁশশ্যাওড়া আর বনশিউলির জঙ্গলের দিকে এগিয়ে গেল। আমি কী করব, বোঝবার আগেই সে দাঁড়াল। পিছন ফিরে তাকাল। এবার আর কোনও সন্দেহ নেই, সে হাত তুলে, ডাকবার ইশারা করল।

আমি অসহায় নিশির টানের মতো, তার দিকে এগিয়ে গেলাম। এখন আর আমাদের আশেপাশে কোনও লোক নেই। তার পিঠে ছড়ানো এলোচুল, তার ওপর দিয়ে খয়েরি রঙের আঁচল এলিয়ে পড়ে আছে। সে আস্তে চলছেনা। জ্যোৎস্নার আলোয় একটি শরীরের বিচিত্র তরঙ্গ আমি দেখতে পাচ্ছি। সে ক্রমাগতই একটা ভাঙা পোড়ো বাড়ির দিকে যাচ্ছে। এগিয়ে গিয়ে, ভেঙে পড়া পাঁচিলের তূপের ওপরে উঠে, সে দাঁড়াল। আমি স্কুপের নীচে গিয়ে দাঁড়ালাম। সে আবার পিছন ফিরে, ভূপের নীচে চলে গেল।

আমি বাড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, ভাঙা জরাজীর্ণ। ভাঙা ফাটলের গা বেয়ে, অশখগাছ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। দরজা-জানালা বলতে কিছুই নেই। অনেক অংশে মাথার ছাদও ভেঙে পড়েছে। এই ভাঙা পোড়া বাড়ির দিকে সে কোথায় চলেছে? ইটের স্তূপ আর ফাটলের দিকে তাকিয়ে, একবার সাপের কথা আমার মনে হল। তবু আমি ইটের তূপের ওপরে উঠে দাঁড়ালাম। দেখলাম, বিস্তর ভাঙাচোরা ইটের ওপর দিয়ে দালানের ওপরে গিয়ে উঠল। সেখান থেকে, পাল্লাবিহীন একটা দরজার ভিতরে, অন্ধকারের মধ্যে ঢুকে গেল।

সেই অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে, আমি কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমি আর তাকে দেখতে পাচ্ছি না। এ সময়েই, কোথায় যেন পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ শোনা গেল। সহসা আমার শিরদাঁড়ার কাছে যেন কেঁপে উঠল। তথাপি, আমি সেখান থেকে নড়তে পারলাম না। সে বেরিয়ে আসে কিনা দেখবার জন্য, আমি একটু অপেক্ষা করলাম। কিন্তু ভিতরের অন্ধকার নিরেট। সেখানে কাউকেই দেখা গেল না। কেবল ঝিঁঝির ডাক শোনা যাচ্ছে।

আমি ইটের স্তূপ থেকে আস্তে আস্তে নেমে গেলাম। সে যেদিকে গিয়েছে, সেদিকে এগিয়ে গেলাম। আমি ঠিক জেগে আছি কিনা, নিজেও যেন ঠিক বুঝতে পারছি না। এখন যেন আমি অনেকটা স্বপ্নের ঘোরে এগিয়ে চলেছি। আস্তে আস্তে দালানের বারান্দায় উঠে দাঁড়ালাম। সেই পাল্লাবিহীন অন্ধকার দরজার দিকে তাকালাম। তাকে দেখতে পেলাম না।

আমি চাঁদের আলোয় দাঁড়িয়ে। ভিতরের অন্ধকারে কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। ভিতরে কী আছে না আছে, কিছুই জানি না। আমার বুকের মধ্যে যেন শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছে। তবু আমি ফিরে যেতে পারলাম না। পায়ে পায়ে অন্ধকারের দিকে এগিয়ে গেলাম। দরজার ভিতরে পা দেবার আগে, আর একবার দাঁড়ালাম। ভাবলাম, কেউ আছে কিনা ডেকে একবার জিজ্ঞেস করি। কিন্তু ডাকতে পারলাম না। বাইরের জ্যোৎস্না এবং ভিতরের অন্ধকারের মধ্যে যে একটা নির্বাক স্তব্ধতা বিরাজ করছে, আমরা গলার স্বরে হঠাৎ সেটা ভেঙে গিয়ে, একটা ভয়ংকর কলরব জেগে উঠতে পারে।

আমি ভিতরের দিকে দু পা ঢুকেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। একটা কী নড়ে উঠতে, ডান পাশে ফিরে তাকালাম। দেখলাম, ভিতরে, ডান দিকের দেওয়াল ঘেঁষে, সে দাঁড়িয়ে আছে। আমি এক পা পেছিয়ে এলাম। তার মুখোমুখি দাঁড়ালাম। একবার মনে হল, সে আমাকে এখানে বোধহয় কিছু দেখাতে চায়, সেই জন্যই এভাবে ডেকে নিয়ে এসেছে। এখন সে আমার এত কাছে তার নিশ্বাসের শব্দও যেন শুনতে পাচ্ছি। তত স্পষ্ট না, তবু তার মূর্তি আমি দেখতে পাচ্ছি। এমনকী অন্ধকারেও, তার চোখের ঝিলিক যেন দেখা যায়। আমার চোখের ওপরেই তার চোখ, সন্দেহ নেই, এবং সে তেমনি হাসছে। আমার রুদ্ধ গলা দিয়ে বেরিয়ে এল, কে তুমি?

কোনও জবাব পেলাম না। মনে হল, হাসিতে যেন তার শরীর কেঁপে উঠল। একটু ঝুঁকে পড়ল। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি আমাকে কিছু বলতে চাও?

তবু সে কোনও জবাব দিল না। কিন্তু এবার সে হাসল না। আমি যেন স্পষ্টই দেখতে পেলাম, সে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। তার ঘাড় একবার বেঁকলো। যেন কিছু ইশারা করল। তারপরে আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই, সেহঠাৎ বাইরে জ্যোৎস্নায় গিয়ে দাঁড়াল। পিছন ফিরে আমাকে একবার দেখেই, বারান্দার নীচে নেমে, ইটের স্তূপ পার হয়ে, চলতে আরম্ভ করল।

আমিও বাইরে বেরিয়ে এলাম। ইটের ভূপ পার হয়ে দেখলাম, সে খোলা জায়গায় জ্যোৎস্নায় দাঁড়িয়ে আছে। আবার সেই হাতছানি এবং ঘাড় দোলানো। একই ব্যাপারের পুনরাবৃত্তি। কী করব, কিছুই বুঝতে পারছি না। অথচ তাকে অনুসরণ না করে, ফিরে যেতেও পারছি না।

দেখতে পাচ্ছি, সে আবার চলতে আরম্ভ করেছে পশ্চিম দিকের গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে, যেখানে গৃহস্থ আর ঘরবিরাগী আউলদের আসর বসেছে। যেতে যেতে দুবার পিছন ফিরে তাকাল। দুবারই হাত তুলে ডাকল। আমি অসহায়, নিয়তির টানে পা বাড়ালাম।

কিন্তু আমাকে দাঁড়াতে হল। হঠাৎ দেখলাম, একটি লোক যেন যুবতীটির ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল, এবং সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার শোনা গেল, পেয়েছি। পেয়েছি হে, পেয়েছি। সবাই ইদিকে এস।

লোকটার চিৎকারের মধ্যে গ্রাম্যতা সুস্পষ্ট। দেখলাম, আরও কয়েকজন মেয়ে-পুরুষ সেখানে দৌড়ে গেল। সবাই একসঙ্গেই যেন যুবতীটিকে আঁকড়ে ধরল। ঘিরে ধরল। দেখতে দেখতে সেখানে একটা ভিড় জমে উঠল। কী কথাবার্তা হচ্ছে, কিছুই বুঝতে পারছি না। সেই ভিড়ের ভিতর থেকে একটা মেয়েগলার আর্তনাদ শোনা গেল। আর্তনাদটা যেন একটা শঙ্কাকুল আহত মানুষের মতো।

কিছুই বুঝতে না পেরে, আমি এক জায়গাতেই দাঁড়িয়ে রইলাম। একটু পরেই, সমস্ত ভিড়টাই একদিকে চলতে আরম্ভ করল। দূর থেকে আমি অনুসরণ করলাম। ভিড়টা মেলার ঘিঞ্জি জায়গা ঠেলে, উত্তরের গাছপালার দিকে এগিয়ে গেল। এ সময়ে ভিড়টা আস্তে আস্তে পাতলা হয়ে গেল। আমি পা চালিয়ে আর একটু এগিয়ে গেলাম। মেয়েগলার সেই আর্তনাদ এখনও শোনা যাচ্ছে। দেখতে পেলাম, সেই যুবতীটিকে কয়েকজন, প্রায় চ্যাংদোলা করে টেনে নিয়ে চলেছে। কয়েকজন পুরুষ সঙ্গে সঙ্গে চলেছে। তারা কী বলাবলি করছে, শুনতে পাচ্ছি না।

চলতে চলতে দেখলাম, হিমসাগর পুকুরের ঘাটের কাছে এসে পড়েছি। যারা মেয়েটিকে ধরেছিল, তারা সবাই ঘাটের দিকে নেমে গেল। আমি ঘাটের ওপর দাঁড়িয়ে রইলাম। নীচের দিকে ধমক আর চিঙ্কারের সঙ্গে মেয়েটির আর্তনাদও শুনতে পাচ্ছি। বুঝতে পারলাম না, মেয়েটিকে ওরা মারছে কিনা। কিন্তু ওখানে যে আমার কোনও অধিকার নেই, তা বুঝতে পারছি।

বেশ কিছুক্ষণ পরে, মেয়েটিকে ওরা তুলে নিয়ে এল। তার শরীর ভেজা। ভেজা চুলের গোছা, মুখে গায়ে ছড়ানো। আমি এখন তার সামনেই, কিন্তু সে আমাকে দেখল না। মনে হল, একটি ভীত জন্তুর মতো অসহায় চোখে সে ফ্যাল ফ্যাল করে সকলকে দেখছে। একজন বলিষ্ঠ পুরুষ তাকে ঘাড় ধরে মাটিতে উপুড় করে শুইয়ে দিল, হেঁকে বলল, দে, দণ্ডী দে। দণ্ডী খেটে খেটে চল।

মেয়েটি আবার প্রতিবাদের সুরে আর্তনাদ করল। উঠে পড়তে চাইল। সবাই মিলে আবার তাকে শুইয়ে দিল। সেই দলেরই একজনকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ওর কী অসুখ করেছে?

সে বলল, ও বোবা।

বোবা! আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। অথচ আমি একবারও বুঝতে পারিনি। আমি তার প্রতিটি ইশারা ও ভঙ্গিতে যেন কথা ফুটে উঠতে দেখেছিলাম। কে একজন মোটা গলায় হেসে উঠল, বোবা। বোবাকে তোমরা বোল্ ফোঁটাবে গ?

ফিরে তাকিয়ে দেখি, এক দাড়িওয়ালা বুড়ো বুড়োর ঝকঝকে চোখে, দাড়ির ভাঁজে হাসি। আবার বলল, ও গ, এখানে যে বোবার বোল ফোটে, তার কথা কি তোমরা বুঝতে পারবে? সে বুলি যাঁর বোঝবার, তিনিই বোঝেন। ওকে অমন করে হেনস্থা করো না।

কিন্তু বুড়োর কথায় কেউ কান দিল না। বোধহয় পাগল ভাবল। মেয়েটিকে ওরা জোর করে দণ্ডী খাঁটিয়ে নিয়ে চলল। এখন আর মেয়েটির গলায় আর্তনাদের সেই জোর নেই। শরীরে প্রতিবাদের সেই শক্তি নেই। সে আছড়ে পড়ে, দণ্ডী খাটতে লাগল, আর গোঙাতে লাগল।

আমি আবার বৃদ্ধের দিকে তাকালাম। দেখলাম, তার চোখ করুণ, স্নেহে ভরা। আমাকে তাকাতে দেখে, আমার দিকে চেয়ে হাসল। বলল, বলো তো বাবা, এই করে কি বোবার বোল ফোটে, না অন্ধর নজর ফেরে? তাঁর দয়ায় বোবার যে বোল ফোটে, তা সবাই বোঝে না। অন্ধের সে নজর তুমি আমি দেখতে পাব না। যার দেখবার, সে নিজেই দেখতে পায়।

বলে বৃদ্ধ চোখ ঘুরিয়ে হাসল। ঘাড় দুলিয়ে চলতে আরম্ভ করল। আমি সেখানেই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার চোখের সামনে সেই মূর্তিটাই ভাসছে। এখন বুঝতে পারছি, এই মেলায় সে লুকিয়ে ফিরছিল। কিন্তু আমার প্রতি তার দৃষ্টি পড়েছিল কেন? আমাকে ওভাবে ডেকে নিয়ে বেড়িয়েছিল কেন? সে কথা বলতে পারে না, কিন্তু তার হৃদয় বোবা ছিল না। সে উন্মাদও ছিল না। সে কি আমাকে কিছু বলতে চেয়েছিল!

কিছু বুঝতে পারলাম না। আমি তাকে আর অনুসরণ করলাম না। আমি তার সেই অসহায় আর্তনাদ আর শুনতে চাই না। বৃদ্ধের কথাগুলো আমার কাছে যেন অর্থময় হয়ে উঠতে লাগল। মূকেরও কথা ফোটে, সে কথা সবাই বুঝতে পারে না।

পিছন ফিরে দেখলাম, কাল সন্ধেয় আকাশে যেখানে চাঁদ উঠেছিল, এখন সেখানে রক্তাভা দেখা দিয়েছে। আমি নতুন করে আউল মেলা দেখবার জন্য এগিয়ে গেলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *