হোমিওপ্যাথ
পিতৃপরিচয়
রুমা আর কমলের মাঝখানে এখন জ্যোৎস্না শুয়ে আছে। কমল এই গভীররাতে জ্যোৎস্নার দিকে তাকিয়ে থাকে। কমল নিঃশব্দে দু’বার ডাকে জোছনা, জোছনা। জোছনা কি ঘুমিয়ে পড়েছে? কমল জোছনা স্পর্শ করে রুমা বুঝতে পারছে না। জোছনা কমলকে জড়িয়ে ধরে। কমল জোছনার দিকে সরে যায়। তখন কমলের সারা শরীরে জোছনা। কমল জোছনার সঙ্গে মাখামাখি করে। জোছনা তো রোজ আসে না। জোছনা করেছে আড়ি, আসে না আমার বাড়ি…।
আগে প্রায়ই আসত। পুবদিকটা তখন খোলা ছিল, দক্ষিণও। চাঁদ প্রায়ই জানলা গলে ঘরে ঢুকত। গত দু’বছর হল পুবদিকটায় নতুন ফ্ল্যাটবাড়ি হয়েছে। সম্পূর্ণ বন্ধ। দক্ষিণেও বাড়ি উঠেছে। লম্বা-লম্বা পিলার বসে গেছে। ছ’তলা পর্যন্ত ঢালাইও হয়ে গেছে। ইটের কাজটা এখনও শুরু হয়নি। দেওয়াল হয়ে গেলে দক্ষিণ দিকটাও পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে। এখনও তাই কংক্রিটের ফাঁকফোকর দিয়ে চাঁদ দেখা যায়। জোছনার ফালি এসে পড়ে। কমল আর রুমার মাঝখানে এখন একফালি জোছনা। একফালি যেন এক মাঠ। কমল আর রুমার মাখখানে দেড়-দু’ফুট জায়গা যেন একটা মাঠ। ওরা দুজনে যেন দুটো আলাদা পাড়ায় শুয়ে থাকে।
কমলের আজ ঘুম আসছে না। আজ ঘুমের ওষুধ খায়নি। ওষুধ ফুরিয়ে গিয়েছিল। কমল নিজে হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার কিন্তু ঘুমের জন্য অ্যালোপ্যাথি ওষুধ খায়। হোমিওপ্যাথিতে কাজ হয়নি। প্যাসিফ্লোরা, ককুলাস, ল্যাকেসিস, এমনকী ওপিয়ামও ট্রাই করেছে। ওপিয়ামের লক্ষণ হচ্ছে বিছানা গরম বোধ হওয়া। ল্যাকেসিসের লক্ষণ হচ্ছে দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে যাওয়া। কিন্তু বিছানায় শুলেই কমলের মনে হয় কোনও গুহার ভিতরে শুয়ে আছে, দরজা-টরজা কিছু নেই। রাত্রে কোনও মাংসভোজী জানোয়ার গুহার ভিতরে ঢুকে ওকে ছিঁড়ে খাবে। জানোয়ারের ভয়ে স্ট্রামোনিয়াম কাজ করে। সামান্য কারণেই ক্রন্দন, আবেগের আধিক্য পালসেটিলার লক্ষণ। উদ্ভট কল্পনা, বিষণ্ণতাতে পডোফাইলাম। এই যে চাঁদের ফালিটা, মানে জোছনাটা এই বিছানায় শিশুর মতো হাত-পা ছুড়ছে এটা কি উদ্ভট কল্পনা! নাকি আবেগের আধিক্য? পডোফাইলাম, নাকি পালসেটিলা?
কমল জোছনার হাত-পা ছোড়া জোছনা-শিশুর দিকে তাকিয়েই থাকে। রুমা পাশ ফেরে। হাতটা প্রসারিত করে। ও রুমা, জোছনাকে ঘুম পাড়াবে বুঝি? দুধ খাওয়াবে? বুকের দুধ? জোছনা বড় কাঁদছে।
২
কমল ভোরবেলাতেই ওঠে। ভোরে উঠে গঙ্গার ধারে হাঁটতে যায়। রতনবাবুর ঘাটের ওপর বসে অনেককে প্রাণায়াম করতে দেখে সে। ভস্ত্রিকা, অনুলোম-বিলোম, কপালভাতি…। কিন্তু অনেকদিনই ভোরবেলায় মাংসপোড়ার গন্ধ পায় কমল। ইলেকট্রিক চুল্লিতে মানুষ পুড়ছে। ওদিকে জবাকুসুমশঙ্কাশং কাশ্যপেয়ম মহাদ্যুতিম, আর এদিকে মানুষের মাংস পুড়ছে। তারই মধ্যে অনুলোম-বিলোম কপালভাতি। মানুষ বড় বিচিত্র। পৃথিবীটাও।
কমল একদম মাংসপোড়া গন্ধ সহ্য করতে পারে না। ও রতনবাবুর ঘাট ছাড়িয়ে কাশীপুরের দিকে চলে যায়। শ্মশানের গন্ধ এতটা দূরে আসে না। এদিকে গঙ্গার ধারে এখন অসংখ্য ঝুপড়ি। ওখানে অনেক বাংলাদেশি। বিহার থেকে আসা কিছু মানুষজনও আছে। ওরা সব মূলত কাগজ কুড়োয়। ওদের ঝুপড়িগুলোর পাশে নোংরা কাগজ আর প্লাস্টিকের বান্ডিল। কিছুটা বস্তাবন্দি। বাতাসে একটা দুর্গন্ধ মিশে থাকে। কোথাও শান্তি নেই। কোথাও ঠিকঠাক জায়গা নেই। ওদের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে হাঁটা যায় না। সকাল থেকেই অটোর উৎপাত। প্রাইভেট টিউশন নিতে যায় যারা, ওরা সব সাইকেলে পোঁ পোঁ করে ছোটে। ওদের সময়ের বড় দাম। ওদের কাছে সময় বড় বিষম বস্তু। দু’-একজন আবার স্কুটারেও যায়। একদিন স্কুটারের ধাক্কা খেয়েছিল কমল। কোথায় হাঁটবে? তাই গঙ্গার ধার। গঙ্গার মতো এত সুন্দর নদীটা কী অবহেলায় অনাদরে থাকে। কলকাতা শহর নদীটার মর্ম বুঝল না। গঙ্গার ধারে হাঁটে কমল। এঁটো পলিথিন ছেঁচড়ায়, নোংরা কাগজ ওড়ে। ওরই ভিতরে মাদুর পেতে নামাজে বসে কেউ। ফজরের নামাজ। গঙ্গা থেকে ওজু করে আসে ওরা। ওজু মানে ভালো করে হাত-পা ধোয়া।
কমল দেখে গঙ্গা শুধু হিন্দুর নয়। সকালবেলা কোনও করিম কিংবা সিরাজ বা কোনও আলাউদ্দিন গঙ্গাস্নান সেরে নামাজে যায়। কোনও কোনও ঝুপড়ির ভিতর থেকে ঘণ্টার শব্দও ভেসে আসে। কমল হাঁটে। গঙ্গার ধারে ধারে, কোনও কোনও গাছের গোড়ায় কিছু কালো পাথর রাখা আছে। শিব। সকালে ভ্রমণকারীদের কেউ কেউ শিবের মাথায় জল দেয়, ফুল বেলপাতা দেয়। কমল ওসব করে না। তাই বলে কমল নাস্তিক নয়, আবার খুব একটা ভক্তিটক্তিও নেই। কমল গীতা-উপনিষদ পড়েনি, বাইবেল, কোরানও নয়। মন্দির দেখলে ছোট করে একটা প্রণাম ঠুকে দেয়। মন্দিরে কে আছেন, কালী না হনুমান জানার দরকার নেই, মন্দির মানে মন্দির।
একবার জ্যোতিষী দেখিয়েছিল সন্তান হবে কি হবে না জানতে। সে প্রায় বারোবছর আগে। জ্যোতিষী বলেছিলেন হবে। একটা পোখরাজ আর একটা গোমেদ পরতে বলেছিল। সেই আংটি এখনও হাতের আঙুলে। কয়েক লাখ টাকা ব্যাঙ্কে জমানো আছে। খুব একটা দান-ধ্যানও নেই, শেয়ারে টাকা খাটায় না, অর্থের খুব একটা লোভও নেই। গরিব-টরিবরা অনুরোধ করলে কম পয়সায় ওষুধ দিয়ে দেয়। নিজের ফ্ল্যাট; বছরে একবার বেড়াতে যায়। খুব দূরে কোথাও যায় না, পুরী কিংবা দীঘা কিংবা রাজগীর। সিগারেট বিড়ি খায় না। মদও নয়। জীবনে পাঁচ-ছ’বারের বেশি মদ খায়নি। ভালো লাগে না। গল্প-উপন্যাস পড়ার অভ্যেস নেই। দু-একটা বাংলা সাপ্তাহিক বা পাক্ষিক পত্রিকা মাঝে মাঝে কিনতে হয় মূলত চেম্বারের রুগিদের জন্য। তখন ওসব একটু উলটে-পালটে দেখে। ‘মেয়েরা কি ক্রমশ সস্তা হয়ে যাচ্ছে?’ কিংবা ‘বিয়ে না লিভ টুগেদার’ জাতীয় ফিচার-টিচার পড়ে। রাত দশটার পর ঘণ্টাখানেক টিভি দেখার অভ্যেস আছে। একটু সুগারও আছে রক্তে। ব্লাডপ্রেশার ওপরের দিকেই। চুল পড়ে যাচ্ছে। একদম গড়পড়তা লোক। কোনও উপন্যাসের নায়ক হবার কোনও যোগ্যতা নেই।
৩
প্রেম-ভালোবাসা করে বিয়ে করা কেবলমাত্র উপন্যাসের নায়কদেরই একচেটিয়া অধিকার নয়, অমল বিমল কমলরাও করে। কমলের বিয়েটা ওরকমই। রুমার অম্বল সারিয়েই রুমার মন পেয়েছিল কমল। কমল তখন আলমবাজারে একটা চিলতে ঘর পেয়েছে। ওখানে চেম্বার। দেওয়ালে একটা মানবদেহের ক্যালেন্ডার আর একটা টেবিল, দুটো চেয়ার। কোনওদিন দুজন, কোনওদিন তিনজন করে পেশেন্ট হচ্ছে। এমন দুঃসময়ের দিনেই রুমা আসে ওর মায়ের সঙ্গে। বলল টক জল ওঠে, খিদে নেই। কমল দেখেছিল ওর গায়ের রংটা ফ্যাকাশে। চোখের তলাটা টেনে বুঝেছিল রক্তহীনতার লক্ষণ। টেবিলে রাখা কাঠের ওষুধের বাক্সের দিকে চোখ রেখে জিজ্ঞাসা করেছিল পিরিওড কি নিয়মিত হয়?….রুমা নয়, ওর মা উত্তর দিয়েছিল—বেশি হয়। পাঁচ-ছ’দিন ধরে…। কথা বাড়ায়নি। কমল বলেছিল ওটা পরে হবে। আগে অম্বলটা কমাই।
কার্বোভেজ দিয়ে শুরু করেছিল কমল। এক সপ্তাহের ওষুধ। রুমা একা এসেছিল। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা হল লক্ষণভিত্তিক। খিটখিটে স্বভাবের মানুষের যদি মার্কসলে কাজ হয়, তো হাসিখুশি স্বভাবের মানুষের ওই ওষুধে কাজ হবে না। জ্বর-মাথাধরা-সর্দিজ্বরে মোটা লোককে একরকম ওষুধ, রোগা লোকের অন্য। অ্যালোপ্যাথির মতো নয়। মাথা ধরল তো সারিডন খাইয়ে দাও। হোমিওপ্যাথিতে দেখা হবে রুগির অনেক কিছু। দিনে বাড়ে না রাতে বাড়ে, আলোয় ভালো থাকে না অন্ধকারে ভালো থাকে, কম ঘামে না বেশি ঘামে, কম কথা বলে নাকি বেশি কথা বলে, ইন্ট্রোভার্ট না এক্সট্রোভার্ট সবকিছু দেখতে হয়। ফলে রুগির সঙ্গে অনেক কথা বলতে হয়।
দ্বিতীয় দিনে রুমার সঙ্গে কমলের এরকমই কথা হয়েছিল।
কমল : কেমন আছেন?
রুমা : একটু ভালো।
কমল : টক ঢেকুর?
রুমা : কম।
কমল : দিনে ক’বার?
রুমা : দু-তিন বার।
কমল : জল বেশি খাচ্ছেন তো?
রুমা : হ্যাঁ।
কমল : আর কী অসুবিধে?
রুমা : কিছু ভালো লাগে না।
কমল : দেখি পালস দেখি…
কিছু ভালো না-লাগাটা পালস-এ কিছু বোঝা যাবে না। জীবন সম্পর্কে বিতৃষ্ণা, কিছু ভালো না-লাগা, নিরাশা ইত্যাদি সোরিনামের লক্ষণ। গায়ের চামড়ায় এর প্রকাশ। চামড়াটা খসখসে হয়ে পড়ে। সেটা পরে হবে। কমল রুমার নাড়ি পরীক্ষা করতে লাগল। নাড়ি পরীক্ষাটা ভালো করে শিখলে পরে অনেক কিছু বোঝা যায়। আগেকার দিনে প্যাথলজিকাল পরীক্ষার বালাই ছিল না। এক্সরে ছিল না, এমনকী প্রেশার মাপার যন্ত্রও ছিল না। আগেকার দিনের চিকিৎসকরা শুধু নাড়ি টিপে বুঝে যেতেন বুকে কফ আছে কিনা, পিত্তর দোষ আছে কিনা। কমল রুমার রোগা হাতটা টেনে কবজিতে আঙুল রেখে চোখ বুজে ছিল। মনে হল নাড়ি দুর্বল। কিন্তু স্পন্দন বেশি। প্রথম দশ সেকেন্ডে যে স্পন্দন ছিল, তার পরের দশ সেকেন্ডে যেন বেড়ে গেল। পরের দশ সেকেন্ডে মনে হল নব্বই ছাড়িয়ে যাবে। চোখ খুলল কমল, দেখল মেয়েটা কমলের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। চোখাচোখি হয়। রুমা চোখ নামায়। কমল ওর ডান হাতের ওপর রুমার বাঁ হাত রাখে। হাতের তালুটি বেশ নরম। কিন্তু শীতল। তালুর ওপর হাত বোলায়। খসখসে মনে হচ্ছে। হাতের ওপরও হাত বোলায়। কমলের ভালো লাগে। কমল ভাবে, এভাবে ভালো লাগতে নেই। কমল নিজের ডাক্তারি সত্তাকে জাগ্রত করে। ক্লিনিক্যাল টেস্ট হচ্ছে এটা, স্রেফ ক্লিনিক্যাল টেস্ট।
চামড়ার খসখসে ভাব থাকলে সোরিনাম, পেলব হলে ডেইজি। ডেইজি একটা ফুল, এই ফুল দেখেনি কমল। হোমিওপ্যাথির মেটেরিয়া মেডিকাতে আছে। হ্যানিম্যান সাহেব একজায়গায় বলেছেন, মেয়েরা হল ডেইজি ফুলের মতন। ডেইজি গাছকে যত কাটুন, ভাঙুন, মচকে দিন, আবার নতুন করে ডালপালা মেলবে। ফুল ফুটবে। কমলের চোখের সামনে একটা ডেইজি ফুল। রুমার নাকের পাটাটা যেন একটু ফুলে উঠেছে। শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুততর। কমল চোখের তলাটা টানে। চোখের লালিমা দেখতে চায়, যেটা হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ জানায়। ফ্যাকাশে।
—দুধ খেতে বলেছিলাম। খাচ্ছেন না?
মাথা নাড়ায় রুমা।
—কেন? দুধ না খেলে হিমোগ্লোবিন বাড়বে কী করে?
—আপনি তো ডুমুর খেতেও বলেছিলেন। ডুমুর খাই। ডুমুর সেদ্ধ…
—সেদ্ধ? বাজে লাগে না?
—লাগে, কিন্তু ওষুধ তো।
—কিন্তু দুধ…
—অনেক দাম। আমরা গরিব।
—বাবা কী করেন?
—নেই।
—মা?
—অভিনেত্রী।
একটু থেমে রুমা বলেছিল—ছিলেন। অভিনেত্রী ছিলেন। অফিস-ক্লাবে অভিনয় করতেন। অভিনেত্রী ভাড়া করত অফিস ক্লাবগুলো। এখন অফিস ক্লাবে নাটক-টাটক হয় না। যদিও হয়, বাইরের অভিনেত্রী ভাড়া করতে হয় না। অঢেল মহিলা। মা এখন একটা বাড়িতে রান্না-বান্না করেন।
—মা আর আপনি ছাড়া আর কেউ নেই?
—না
—আপনি? কিছু করেন?
—টিউশনি।
কমল বলেছিল চিন্তা-দুশ্চিন্তা করবেন না বেশি। একদম দুশ্চিন্তা করবেন না। চিন্তায় অ্যাসিডিটি বাড়ে।
বই খুলে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত রুগির ক্ষেত্রে কী ওষুধ দেখতে লাগল কমল। বইয়ের দিকে চোখ রেখে জিজ্ঞাসা করল—শীত ভালো লাগে, না গ্রীষ্ম?
—শীত।
—নোনতা না মিষ্টি?
—মিষ্টি!
বইতে যদিও নেই, তবু জিজ্ঞাসা করে ফেলল পাহাড় না সমুদ্র?
রুমা বলল কোথাও যাইনি।
কমল বলল, ও।
কমল ওষুধ পালটে দিয়েছিল।
৪
কমলই কি খুব বেশি পাহাড় সমুদ্র দেখেছিল তখন? পাহাড় বলতে বেলগাছিয়ার পরেশনাথের মন্দিরের ভিতরের ওই কৃত্রিম পাহাড়টাকেই বুঝত কমল। তারপর পাহাড় দেখেছে বেলগাছিয়ায় কিংবা গড়ের মাঠে যখন মেট্রোরেলের মাটি ডাঁই করে রাখা হয়েছিল। পাহাড় তো দেখেছে ক্যালেন্ডারে, সিনেমায়। একবারই পাহাড় দেখেছে ভুবনেশ্বরে। উদয়গিরি খণ্ডগিরি। আর সমুদ্রও একবারই। মা-দিদি-দাদা-বউদি সবাই মিলে পুরী গেল যেবার। সমুদ্রও তখনই। আর একবার দীঘাও গিয়েছিল পাড়ার ‘চলুন ঘুরে আসি’ স্কিমে। সবাই খুব জোরাজোরি করল বলে যেতে হয়েছিল। ব্যস।
কমলের ঠাকুরদা ছিলেন কোনও এক বড়লোকের নায়েব। বরানগরের গঙ্গার পাড় ঘেঁষে কোনও বাগানবাড়ি ছিল। ওই বাগানবাড়ি দেখাশোনা করতেন। ওই বাগানবাড়িটা ছিল কয়েক বিঘে জুড়ে। মাঝখানে ছিল একটা পুকুর। ওই বাগানেরই একধারে কমলের ঠাকুরদা একটা বাড়ি পেয়েছিলেন। ওই অঞ্চলটার নাম মিত্তিরবাগান। কলকাতার মিত্তিরদের বাগানবাড়ি ছিল কিনা।
কমল যখন বালক, ও দেখেছে পুরোনো কয়েকটা আমগাছ রয়েছে। কয়েকটা কাঁঠালগাছ। পুকুরে ধোপারা কাপড় কাচছে, ওদের বাড়িটার ভিতরে অনেকরকম দেওয়াল, অনেকগুলো দরজা। কাকা-জ্যাঠাদের মধ্যে ঝগড়া। বাগানের খানিকটা দখল করেছে বাঙালরা। বাকিটা মালিকরা বেচে দিয়েছে। মিত্তিরদের মধ্যেও ঝগড়া। কমলের মনে পড়ে, গলায় সোনার হার-পরা ধুতি আর গিলে করা পাঞ্জাবি-পরা একটা ফর্সা লোক গাড়ি থেকে নামামাত্র অন্য দুটো লোক কোত্থেকে এসে মাথায় লাঠির বাড়ি মারল লোকটাকে। সাদা পাঞ্জাবি মুহূর্তে লাল। পরে জেনেছিল মিত্তিরদের শরিকে শরিকে গন্ডগোলের জের ওটা। লোকটা নাকি বাঁচেনি। মানুষ মরে গেলেও জমি বিক্রি হওয়া আটকে থাকে না। কমলদেরও উঠে যেতে বলা হয়েছিল। তখন কমলদের বাবারা সব শরিক এক হয়ে মামলা করতে লাগল। মামলা বহুদিন চলেছিল। মামলার খরচ নিয়ে কমলদের বাবা-কাকাদের মধ্যে ঝগড়া হত। একবার মনে আছে কমলদের ওই বাড়িতে শাবল কুড়ুল নিয়ে একদল লোক এল। মেঝেতে যত মার্বেল ছিল তুলে নিয়ে গেল। সেখানে সিমেন্ট বালি দিয়ে ভরাট হল। ১৯৮০ নাগাদ পুকুরেও মাটি পড়তে লাগল। লরি লরি মাটি। তারপর প্লট করে বিক্রি হয়ে গেল। এখন মিত্তিরবাগানের যেটা রিকশাস্ট্যান্ড, তার নাম বড়ঘাট। পুকুরের প্রধান ঘাটটা ওখানেই ছিল। মিত্তিরবাগানে এখন কম্পিউটার সেন্টার, বিউটি পার্লার, জিম, চাইনিজ রেস্টুরেন্ট, কিন্ডারগার্টেন স্কুল। পরের বাড়িটা এখনও আছে, পাড়ার একমাত্র বেমানান বাড়িটা। ভাঙা ঝুরঝুরে। গায়ে বটগাছ গজিয়েছে। কেলিয়ে রয়েছে ইট। ছাতের উড়ন্ত পরিটার ডানা নেই বহুদিন, ঠ্যাংও নেই।
কমলের ঠাকুরদার ছিল আট পুত্র, চার কন্যা। আর কমলের বাবার ছিল পাঁচ পুত্র, দুই কন্যা।
কমল পুত্রদের মধ্যে চার নম্বর।
কমলের এক নম্বর দাদা লন্ড্রির ব্যবসা করে। যখন মিত্তিরপুকুরটা বেঁচে ছিল, ব্যবসা তখনই শুরু করেছিল। দু’নম্বর বরানগর মিউনিসিপ্যালিটিতে চাকরি। মিউটেশন ডিপার্টমেন্টে বহুদিন ছিল। একটা ফ্ল্যাট কিনেছে। ও-বাড়িতেও একটা ঘর তালা দিয়ে রেখেছে। তিন নম্বর সাইনবোর্ডে লেখা থেকে চুল্লু অনেকরকম বিজনেস করেছে, কিছুতেই দাঁড়াতে পারেনি। প্রচুর দেনা নিয়ে সুইসাইড করে। ও নাকি ব্যাচেলার ছিল। মৃত্যুর পর দুজন মহিলা নিজেদের স্ত্রী দাবি করে সম্পত্তি চাইল। কমলের দু’নম্বর মিউনিসিপ্যালিটি-দাদা বলল, সম্পত্তি দাবি করার আগে ওর বাজারের দেনা মেটাও। তারপর ওরা আর তেমন কিছু বলে না। একজনের কোলে একটা বাচ্চা মেয়ে ছিল। লাল টেরিলিনের জামা পরানো। চোখে কাজল। মহিলাটি বাচ্চাটাকে কোল থেকে নামিয়ে বলল তবে এরে কিছু টাকা দাও। কী করে খাওয়াব। কথা শুনেই বোঝা যাচ্ছিল ভদ্রঘরের মেয়ে নয়। দেহপসারিণীও হতে পারে। মিউনিসিপ্যালিটির দাদাই কেসটা ম্যানেজ করেছিল। কমল চতুর্থ। পাঁচ নম্বর ভাই ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার। বাইরে বাইরেই থাকে। রাঁচিতে বাড়ি করেছে। ভাইদের সঙ্গে খুব একটা যোগাযোগ রাখে না।
নায়েববাড়িটার তিনটে ঘর এবং বারান্দার অংশ ভাগে পেয়েছিলেন কমলের বাবা। ওই তিনটে ঘরেই পাঁচ ভাই, দুই বোন মানুষ হয়েছে। বারান্দার একদিক ঘিরে রান্নার ব্যবস্থা ছিল। কমলের বাবার যখন মৃত্যু হয় কমলের বয়েস তখন কুড়ি। বিএসসি পাশ করেছে। কেমিস্ট্রিতে অনার্স ছিল। কোনওরকমে অনার্সটা বজায় রেখেছিল। ওই নম্বরে এমএসসি-তে চান্স পাওয়া যায় না। সব বাঙালি যা করে ও তাই করত। টিউশনি। সঙ্গে টাইপ শেখা। ও কাজ পেল একটা ছোট জায়গায়, যেখানে সিলভার নাইট্রেট তৈরি হয়। তখনও তো কম্পিউটারের যুগ আসেনি, ছবি ছাপতে ব্লক তৈরি করতে হত। আর ব্লকের জন্য দরকার হত সিলভার নাইট্রেট। চিৎপুরের যাত্রাপাড়ায় তখন অনেক ছোট ছোট রুপোর দোকান ছিল। ওখানে রুপোর কয়েন কিনতে পাওয়া যেত। সেই রুপোর কয়েন থেকে সিলভার নাইট্রেটের ক্রিস্টাল তৈরি হত। সেই সিলভার নাইট্রেট সাপ্লাই করতে হত ঈগল লিথো, বসুমতী, যুগান্তর এসব জায়গায়। ল্যাবরেটরিতে মাত্র তিনজন। মালিক, কমল আর একজন।
মালিক একদিন নাইট্রিক অ্যাসিড খেয়ে নেয়। ভুল করে নয়, ইচ্ছে করে। একটা ছোট্ট সুইসাইড নোট লিখে রেখে গিয়েছিল—’আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী রুপো।’ পুলিশ বলেছিল রুপো নিশ্চয়ই কোনও মেয়ের নাম। লোকটার পকেটে ছিল পঞ্চম জর্জের ছবি খোদাই করা দশ-বারোটা রুপোর টাকা। আসলে রুপোর দাম ক্রমেই বাড়ছিল। চিৎপুরের যাত্রাপাড়ার কাছেই বারাঙ্গনা পল্লী—সোনাগাছি। ওখানকার মেয়েরা আগে বাবুদের কাছে রুপোর টাকাই পেত। পরে কাগজের টাকা এলে জমানো রুপোর টাকা বিক্রি করে দিত। এ কারণেই রুপোর দোকানগুলো ও পাড়াতেই। রুপোর টাকা কিনলে রুপোর বাটের চেয়ে সস্তা পড়ত। কিন্তু পুরোনো রুপোর কয়েনের জোগান কমে যায়। আর এদিকে ব্লক তৈরির জন্য সিলভার নাইট্রেট নির্ভরতা কমতে থাকে। অন্য প্রযুক্তি আসে। পুরোনো প্রযুক্তি মরে যায়। প্রযুক্তি মানুষ মারে। মানুষই প্রযুক্তি বানায়, কিন্তু প্রযুক্তির কাছে মানুষ অসহায়।
এরপরের চাকরিটা টাইপিস্টের। গোপাললাল ঠাকুর রোডে এক লেদ কারখানার মালিকের ছেলেকে পড়াত। সেই ভদ্রলোক বললেন, একজন টাইপিস্ট দরকার। ওর তিন-চারটে কারখানা। রেলে মাল সাপ্লাই করত। জেসপেও। ওদের চিঠিপত্র টাইপ করতে হত। কী লিখতে হবে সেটা বাংলায় বলে দিলে কমল কোনওরকমে ম্যানেজ করে নিত। এসব কাজে ভুল ইংরেজিতে কোনও অসুবিধে হয় না। তখনই রাত্রে ডিএমএস-এ ভর্তি হয়। হোমিওপ্যাথিকে ভালোবেসে নয়, যার নাই কোনও গতি সে পড়ে হোমিওপ্যাথি। এরকম একটা প্রবাদবাক্য চালু ছিল সেসময়।
৫
দু-দুটো অত্মহত্যা দেখে ফেলল কমল। ওর দাদা, আর ওর অন্নদাতা। কিন্তু হোমিওপ্যাথিতে বারবার বলছে প্রাণশক্তির কথা। ভাইটাল ফোর্স। ভাইটাল ফোর্স ব্যাপারটা কী? ব্যাপারটা ঠিক বোঝে না কমল। রাত্রে ক্লাস করতে করতে, সিমিলিয়া সিমিলিবাস কিয়োরেন্টুর শুনতে শুনতে, সামান্য ওষুধে দেহের মধ্যেকার প্রাণশক্তির উত্থানের কথা শুনতে শুনতে মরে যেতে ইচ্ছে হয়েছে। জীবনে কোথাও আনন্দ নেই মনে হত। চৈত্র মাসের ঝড়েও নয়, আম-বকুলের গন্ধেও নয়। আনন্দ যেন একটা শব্দমাত্র; আনন্দবাজার পত্রিকার মাথায় থাকে। বাড়িতে সবসময় অশান্তি। ঠিকমতো শোবারই জায়গা নেই। পড়ার জায়গা তো ভাবাই যায় না। দাদাদের সংসারে বাড়ছে। মায়ের সঙ্গে খিটিমিটি বাড়ছে। চাকরিতেও বেদম খাটুনি। লোকটার ব্যবসা বাড়ছে, ফলে চিঠির পরিমাণও বাড়ছে, কিন্তু মাইনে বাড়ছে না। হোমিওপ্যাথি পড়তেও ভালো লাগছিল না। যারা পড়াচ্ছেন তাঁরা দু’-শ’বছরের পুরোনো তত্ব আউড়ে যাচ্ছেন। অ্যালোপ্যাথির নিন্দা দিয়ে ক্লাস শুরু হত। যেমন—আজ পড়াব স্কিন ডিজিজ বা চর্মরোগ। খোস, পাচড়া, দাদ, খুসকি এসব। অ্যালোপ্যাথ ব্যাটারা এর ওপর মলম লাগায়। মূর্খরা জানে না এটা বাইরের রোগ নয়, ভিতরের রোগ। বাইরে যেটা দেখি সেটা উপসর্গ। দেয়ালে ‘ড্যাম’ লেগে গেলে কি রং করলে সুরাহা হবে? রং খসে যাবে। চোখের নজর কম হলে আর কাজল দিয়ে কী হবে—একটা গান ছিল না! ছোটবেলায় শুনতাম। ওদের চোখের নজরেই গোলমাল। এই রোগগুলোর শিকড় হল রক্তে। আমরা ভিতর থেকে চিকিৎসা করি…।
কমল প্রশ্ন করলে ঠিকমতো উত্তর পেত না। কেন ওষুধের শিশিটা দশবার ঝাঁকালে ওষুধের শক্তি বেড়ে যাবে? উত্তর নেই। স্যারেরা বলেন—হ্যাঁ, হানিম্যান সাহেব বলে গেছেন, তাই সত্য। তত্ব বলছে যত ডাইলিউট করবে ওষুধের শক্তি বাড়বে। কেন এটা হবে? একজন স্যার বললেন—যত বেশি ডাইলিউট হয় আয়নিফিকেশন বেশি হয়। কিন্তু কমল তো কেমিষ্ট্রি পড়েছিল। ওখানে অসোয়াল্ডের ডাইলিউশন থিওরি পড়েছে, আরহেনিয়াস পড়েছে। ওখানে দ্রবণীয়তার সঙ্গে আয়নিফিকেশনের একটা সম্পর্ক ছিল বটে। কিন্তু সালফার বা আর্সেনিক বা কার্বন তো আয়নাইসড হয় না, আর নুন জাতীয় যেসব কম্পাউন্ডের আয়ন হয় তারও একটা সীমা আছে। যেমন নুন মানে সোডিয়াম ক্লোরাইড। জলে গুলে গেলে কিছুটা সোডিয়াম আর ক্লোরিন একটু আলাদা হয়ে যায় আর সোডিয়াম একটু পজেটিভ, ক্লোরিন একটু নেগেটিভ থাকে। এগুলোকে বলে আয়ন। যত বেশি পাতলা দ্রবণ হয়, আয়নের সংখ্যা বাড়ে। কিন্তু এর একটা সীমা আছে। গন্ধক, কয়লা, ধাতু এসবের আয়ন হবার কোনও প্রশ্নই নেই। কার্বন বা সোনা বা রুপো তো দ্রবীভূতই হয় না, অথচ কার্বোভেজ ওষুধ আছে—সবজি পোড়ানো কার্বন দিয়ে তৈরি। কিউপ্রাস আছে—তামা। অরাম আছে—সোনা। অরাম সোনার ল্যাটিন নাম।
থার্ড ইয়ারে পড়ার সময় একদিন এক জাঁদরেল স্যার, যাঁর তখনই একশো টাকা ফি, তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিল কমল, স্যার, মনে করুন আপনাকে এক শিশি সালফার টু হান্ড্রেড এবং আর্সেনিক টু হান্ড্রেড দেওয়া হল, কিন্তু লেবেল নেই, ছিঁড়ে দেওয়া হয়েছে, আর দেওয়া হয়েছে একটা আধুনিক ল্যাবরেটরি। আপনি কি পারবেন কোনটা সালফার আর কোনটা আর্সেনিক বলতে? স্যার ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। একটু আমতা আমতা করে বললেন, না। ল্যাবরেটরিতে টেস্ট করলে দুটোতেই শুধু অ্যালকোহলই পাব। আর কিছু নয়। কিন্তু হোমিওপ্যাথি ওষুধের টেস্ট ল্যাবরেটরিতে হয় না, মনুষ্যশরীরে হয়। শ্বেতপ্রদর যাতে কমবে সেটা সালফার, আর দাস্ত হচ্ছে, খুব পিপাসা, জল খাচ্ছে, জল খেয়েই বমি করছে—এমন রুগি যে ওষুধে ভালো হচ্ছে সেটাই হল আর্সেনিক।
কমল খুব একটা সন্তুষ্ট হতে পারল না। কমল জানে, কোনও হোমিওপ্যাথি ওষুধের তিরিশ শক্তির পর এক আউন্স ওষুধে একটা অণুও পাওয়া যাবে না। অথচ বলা হচ্ছে যত বেশি ডাইলিউট হবে, ওষুধের শক্তি তত বাড়বে। কীসের শক্তি?
নাকসভোমিকা একটা ভেষজ। নাকসভোমিকার নির্যাস অ্যালেকোহলে দ্রবীভূত করা হল। সেই নির্যাসের একফোঁটা এক লিটার অ্যালকোহলে ফেলা হল। সেই এক লিটার দ্রবণে দ্রবীভূত এক ফোঁটা আরক থেকে এক ফোঁটা নিয়ে একশো লিটার দ্রবণে দ্রবীভূত করা হল। তার থেকে এক ফোঁটা আমরা জলে মিশিয়ে খাচ্ছি। যদি ওষুধকে আরও শক্তিশালী করতে চাই যেমন ওয়ান-এম, টু-এম টেন-এম, তাহলে আরও আরও তরলীকরণ করতে হবে। এর মানে মিলিয়ন।
তার মানে ওষুধে কোনও ভেষজ থাকছে না, থাকছে ভেষজের স্মৃতি। থাকছে ভেষজের ইতিহাস। তাহলে ওষুধের পরিবর্তে আমরা ইতিহাস খাচ্ছি। স্মৃতি খাচ্ছি। যে জলটা এব্রেশ রেডিক্স বলে খাচ্ছি, তাতে আছে কোনও একসময়ের ওলটকম্বলের স্মৃতি। মেয়েদের ঋতুকালে তলপেটের ব্যথায় কাজ দেয়। কিন্তু কোনও বায়োকেমিস্টের বাপের সাধ্য নেই ‘এব্রেশ রেডিক্স থার্টি’র কোনও শিশি থেকে কোনও অ্যালকালয়েড বার করার।
কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় একটা প্রজেক্ট করেছিল। হোমিওপ্যাথিক ওষুধের ভিতরের রহস্যটা বের করার চেষ্টা করেছিল। সালফার ২০০, আর্নিকা ২০০, পালসেটিলা ২০০ এরকম বেশ কিছু স্যাম্পেলের বিশ্লেষণ করেছিল, কোনও তফাত পায়নি। স্যাম্পেলগুলোর স্পেস্ট্রোগ্রাফ ও করা হয়েছিল—বর্ণালী বিশ্লেষণ। সব একই রকম। অ্যালকোহলের বর্ণালী যেমন হয়। মাদার টিংচার এবং ৬ মাত্রার ওষুধের ক্ষেত্রে পার্থক্য বোঝা গিয়েছিল কিছু। যত বেশি মাত্রা, ওষুধটা তত পাতলা। বেশি ডাইলিউশন। বলা হয় বেশি মাত্রার ওষুধ বেশি শক্তিশালী। এর কোনও ব্যাখ্যা নেই।
অথচ সারে। রোগ সারে। থুজা দিয়ে বহু আঁচিল সারিয়েছে। চায়না দিয়ে, নাকসভোমিকা দিয়ে পেটফাঁপা সারিয়েছে। তাহলে ব্যাপারটা কী? কীভাবে সারে? কোনও যুক্তি খুঁজে পায় না কমল। যদিও খুব একটা যুক্তিবাদী নয় কমল। কমল ঠাকুর দেবতা দেখলে প্রণাম ঠুকলেও প্রমাণ ব্যাপারটাকে কে না ভালোবাসে। জ্যামিতির উপপাদ্য যতক্ষণ প্রমাণ না হত ততক্ষণ নম্বর পাওয়া যেত না। ফিজিক্স-কেমিস্ট্রির প্র্যাকটিক্যালে তো প্রুফটাই আসল।
কিন্তু হোমিওপ্যাথির প্রুফটা হচ্ছে মানুষের শরীর। শরীরে ওষুধ প্রয়োগ করে দেখা গেছে রোগ সারে। হোমিওপ্যাথির মূল কথা হল—সিমিলিয়া সিমিলিবাস কিয়োরেন্টুর। মানে সমান জিনিস সমান জিনিসেই সারে। একটা প্রবাদ আছে, বিষে বিষে বিষক্ষয়। বাংলা হোমিওপ্যাথি বইতে যা লেখা হয় সদৃশ বিধান।
কাঁচা কুইনাইনের রস কোনও সুস্থ মানুষকে খাইয়ে দিলে নাকি তার কম্প দিয়ে জ্বর আছে। সেই কুইনাইনকেই সূক্ষ্ম মাত্রায় প্রয়োগ করলে কম্প দিয়ে জ্বর আসার যে উপসর্গ তা কমে যায়। আর্সেনিক সুস্থ মানুষকে খাওয়ালে তার বমি হবে, দাস্ত হবে, আবার সূক্ষ্ম মাত্রায় যদি আর্সেনিক প্রয়োগ করা যায় তাহলে দাস্ত বমির উপসর্গ ভালো হয়ে যায়। এটাই হল হ্যানিমানের তত্ব। কিন্তু সূক্ষ্ম মাত্রাটা নিয়েই তো ঝামেলা। আর্সেনিক দুশো শক্তির এক ফোঁটা ওষুধে একটাও আর্সেনিকের অ্যাটম পাওয়া যাবে না। তবে?
আবার সবসময় কি এই তত্ব মানা হচ্ছে? কবিরাজি মতে হার্টের রুগিদের অর্জুন গাছের ছাল খাওয়ানো হয়। কিন্ত হোমিওপ্যাথির মাস্টারমশাইরা তো বলছেন হার্টের রুগিকে অর্জুনের মাদার টিংচার দাও। মানে আরক। সূক্ষ্ম মাত্রার কথা তো বলা হচ্ছে না। কাঁচা থুজা খেলে বর্ধিত মাংসপিণ্ড গজায়। গজায় না। তবে?
প্র্যাকটিস করে যাচ্ছে। কমল ওষুধ দিয়ে যাচ্ছে। কেউ বলে ভালো আছি ডাক্তারবাবু, কেউ বলে ভালো নেই। নিজে সর্দি জ্বর মাথাধরা পেট খারাপে হোমিওপ্যাথিই খায়। কখনও কমে, কখনও কমে না। তখন অ্যালোপ্যাথি খায়। আবার অ্যালোপ্যাথি-ফেরত কোনও কোনও রুগি কখনও কমলের কাছে আসে। কমলের এতে তেমন কোনও আনন্দ হয় না। কমলের ওষুধে কিডনির পাথর বহুবার প্রস্রাবের দ্বার দিয়ে বেরিয়ে গেছে অনেকের। অ্যালোপ্যাথরা বলেছে বেশি জলটল খেলে এমনিতেই কিডনির পাথর বেরিয়ে যায়। হয়তো যায়। কমল হোমিওপ্যাথিই সত্য—এরকম তীব্র মতবাদে বিশ্বাসী নয়। নির্বিকল্প কর্ম করে যায়। কর্ম করো ফল চেও না গোছের। কিন্তু ফল না হলে রুগি সন্তুষ্ট হবে কেন? কিন্তু কিছু কিছু ফল ফলে নিশ্চয়ই। নইলে চেম্বারে রুগি হবে কেন?
ওখানে একটা যুক্তিবাদী সমিতি আছে। ওরা একটা পত্রিকা দিয়ে যায় মাঝে মাঝে। ওখানে হোমিওপ্যাথির বিরুদ্ধে বিষোদ্গার থাকে। হোমিওপ্যাথিকে বলা হয় প্লাসিবো। প্লাসিবো হল একধরনের মানসিক সান্ত্বনা বা এমন মানসিক অবস্থা যখন প্রবল বিশ্বাসে কোনও রোগ সেরে যায়। যেমন অনেক ইনসমনিয়ার রুগি আছে যাদের প্রত্যেকদিন ঘুমের বড়ি দরকার। তারপর এমন হয়ে গেল যে ঘুমের বড়ি ছাড়া ঘুম হয় না। সেরকম রুগিকে যদি ঘুমের বড়ির পরিবর্তে একইরকম দেখতে চকের বড়ি দেওয়া যায়, দেখা যাবে ঘুম হচ্ছে। এখানে ওষুধ কাজ করছে না, বিশ্বাস কাজ করছে। একইরকম ভাবে ‘রেইকি’ মানুষের উপর কাজ করে। রেইকিও হল এক ধরনের প্লাসিবো। রেইকি মানে স্পর্শ চিকিৎসা। যারা রেইকি করেন, তাঁরা নাকি স্পর্শের মাধ্যমে প্রাণশক্তি সঞ্চারিত করেন রুগির শরীরে। রুগি বিশ্বাস করে এতে ওর ভালো হচ্ছে। একই যুক্তিতে তাবিজ, কবচ, মাদুলি, জলপড়া, ফুঁ, ঝাড়ফুঁক সবই প্লাসিবো। হোমিওপ্যাথিকে জলপড়া-ঝাড়ফুঁকের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়াটা কিছুতেই মেনে নিতে পারে না কমল।
কমল নিজেও দু-একটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে নিজের মতো করে। হোমিও-বইতে আছে গলায় মাছের কাঁটা ফুটলে সাইলেসিয়া কয়েকবার খাইয়ে দিতে হয়।
মাছের কাঁটা-ফোটা রোগীকে সাইলেসিয়া দিয়ে বলেছিল বারবার খাবেন। কাঁটা গলিয়ে দেবে। কয়েক ঘণ্টা পরে সেই কাঁটা-ফোটা লোকটা জানিয়ে দিল কাঁটা গলে গেছে ডাক্তারবাবু…।
পরদিনই মৃগেল মাছের ঝোল ছিল দুপুরে। মাছের ভিতর থেকে দুটো সূক্ষ্ম কাঁটা বেছে নিয়েছিল কমল। সাইলেসিয়ার মধ্যে ভিজিয়ে রেখেছিল। তিনদিন রেখেছিল কাঁটাটা। গলেনি।
তাহলে?
প্লাসিবো তো বিশ্বাসসঞ্জাত। একটা শিশু, যাকে বলে দুধের শিশু, তার আবার বিশ্বাস-অবিশ্বাস কী? শিশুদের তো অসুখ সারে। দুধ তুলে দেওয়া, পাতলা দাস্ত, সর্দি-কাশি কম তো সারায়নি কমল। এসব তো প্লাসিবো হতে পারে না।
জন্তুদের কি প্লাসিবো হয়? জন্তুরা কি শুনেছে কখনও যে বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহু দূর…। জন্তু-জানোয়ারদের ওপর কি হোমিওপ্যাথির প্রয়োগ হয়েছে কখনও? কমল ভেবেছিল নিজেই পরীক্ষা করবে। তখনও কমলের চেম্বার খুব একটা জমে ওঠেনি। রুগিপত্র খুব একটা হত না। ফলে অলস চিন্তা-ভাবনার জন্য অনেকটা সময় পাওয়া যেত। ভেবেছিল কুকুরকে সিনা খাইয়ে দেখবে কৃমি বেরোয় কিনা। কিন্তু কুকুরকে ওষুধ খাওয়ানো মুশকিল। মাংস বা বিস্কুটের মধ্যে এক ফোঁটা মিশিয়ে দিলে তত্ব অনুযায়ী ওষুধের গুণ থাকবে না। তাছাড়া ওদের গৃহপালিত কোনও কুকুর নেই। রাস্তার কুকুরকে ওষুধ খাওয়ানোর পর সেই নির্দিষ্ট কুকুরটির মলত্যাগ পর্যবেক্ষণ সম্ভব নয়। ওদের বাড়ির পাশে একটা ছোটখাটো খাটাল ছিল। গোয়ালাদের বলে রেখেছিল কোনও গরুর পেট খারাপ হলে খবর দিতে। কোনওদিন কেউ খবর দেয়নি। কোনও গরু-ছাগলের গ্যাস-অম্বল হয় কিনা জানে না কমল। কোনও গরু-ছাগলকে ঢেকুর তুলতে দেখেনি কমল। বাড়ির কাছে একটা মুদি দোকান ছিল। মুদিওলার কয়েকটা ছাগল ছিল। শিশু ছাগল। ছাগলদের লক্ষ করত কমল। শিশু-ছাগলরা শিশু অবস্থা থেকেই খুব সুন্দর নাদি ছাড়ে। মানবশিশুরা ছোটবেলায় পাতলা পায়খানা করে। ক্রমশ শক্ত হয়। কিন্তু ছাগলদের তা নয়। ছাগলদের পাতলা পায়খানা করতেও সচরাচর দেখত না। একদিন দেখেছিল। মলের রং কিঞ্চিৎ সবুজাভ। যা ইপিকাকের লক্ষণ। ইপিকাকের রুগির জিভটা সাদা হওয়ার কথা। কিন্তু পেটটাও কামড়াবে। ছাগলছানাটা ভ্যা ভ্যা করছিল। হয়তো পেটটা কামড়াচ্ছিল। মুদিওলাকে একটা ইপিকাকের শিশি দিয়ে বলেছিল—ছাগলছানাকে চার ঘণ্টা অন্তর জলের সঙ্গে এক ফোঁটা করে খাইয়ে দিতে। মুদিওলা অবাক হয়ে তাকিয়েছিল কমলের দিকে। ভাবটা বোধহয় এমন—আগে তো বুঝিনি আপনার মাথায় ছিট আছে…। আসলে কমল একটা প্রমাণ চাইছিল। আসলে পরিত্রাণ চাইছে। মুদিওলা বলেছিল—ছাগলের ওষুধ ছাগলই খুঁজে নেবে। সারা দুনিয়ায় ওষুধ ছড়ানো আছে। আপনার ওষুধ দরকার নেই। কমল বলেছিল—আমি শুধু দেখতে চাই আমার ওষুধে ছাগলের রোগ সারে কিনা। পয়সা লাগবে না। আমি এমনিই দিচ্ছি। লোকটা হাতজোড় করে বলেছিল, দয়া করে ছাগলকে ওষুধ দেবেন না।
লোকটা কি বিশ্বাস করল না?
কিন্তু রুমা বলেছিল, আপনাকে আমার খুব বিশ্বাস। ভীষণ বিশ্বাস।
৬
রুমার অম্বল-টম্বল সারিয়েছিল কমল। ওষুধ না বিশ্বাসে কমল জানে না। রুমা দাঁত ব্যথার জন্যও হোমিওপ্যাথি ওষুধ নিতে আসত কমলের কাছে। কমল বলেছিল, দাঁত ব্যথার মতো অ্যাকিউট পেইন হোমিওপ্যাথিতে সারবে না। পেইনকিলার খেয়ে নিন। রুমা বলত, না। আপনিই ওষুধ দিন। আপনার ওষুধেই কমবে। কী দেবে কমল? আর্নিকা? নাকি কলোসিন্থ নাকি লিডম? লিডমের রুগিরা খুব নরম মনের হয়। ওর মন কি খুব নরম? একবার ডেইজি দিয়ে সারিয়েছিল কমল। কমল লিডম দিয়েছিল। পরের দিনই এসে রুমা হাসতে হাসতে বলেছিল, আপনি ধন্বন্তরি।
একদিন রুমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল কমল—আপনি কি হোমিওপ্যাথিতে বিশ্বাস করেন? রুমা বলেছিল, আপনাকে বিশ্বাস করি, ব্যস। রুমা মাঝেমাঝেই আসত। অসুখ না থাকলেও। একবার এসে বলল, কাশি হচ্ছে, বুকে কফ। স্টেথো দিয়ে বুক পরীক্ষা করেছিল কমল। জোরে শ্বাস বলার আগেই জোরেই শ্বাস পড়ছিল রুমার। কমল বলেছিল কই, কফ-টফ তো দেখছি না কিছু…। রুমা বলেছিল আছে, আছে, ভালো করে দেখুন…।
কমল ভাবছিল বলবে, এবার ভালো করেই দেখব কিন্তু…। বলতে পারেনি। বলেছিল কিচ্ছু নেই। নুন জলে গার্গেল করুন…।
রুমার মা মারা গেলেন। রুমার বাবা অনেক আগেই মাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। রুমার বাবার কোনও ছবি ছিল না বাড়িতে। রুমার মামাবাড়িও ছিল না। রুমা বলল, এবার কী হবে আমার…।
রুমাদের ওই ভাড়াবাড়িতেই চলে গেল কমল। তার আগে রেজিস্ট্রি করে বিয়ে করে নিল। কমলের বাড়িতেও অশান্তি বেড়ে গিয়েছিল খুব। থাকা সম্ভব হচ্ছিল না। কমল যেন একটা আশ্রয় পেল। কমলের বয়েস তখন উনত্রিশ।
রুমাদের বাড়িটা ছিল টিনের চালের। টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ শুনেছে বর্ষা জুড়ে। সামনের বারান্দায় দর্মার বেড়া দিয়ে রান্নাঘর। ঘনঘন লোডশেডিং হত সেসময়ে। বেড়ার ফাঁকফোকর দিয়ে ঢুকত চাঁদের আলো। কুমড়ো ছেঁচকির সঙ্গে চাঁদের আলো মাখিয়ে রুটি খেত। শুক্লপক্ষে ইচ্ছে করেই বাতি নিভিয়ে বারান্দায় বসত ওরা। রুমার গালে চাঁদের কোল্ড ক্রিম পড়ত, দু’হাতে মাখিয়ে দিত কমল। চাঁদের আলোকে ভালো কথায় জ্যোৎস্না বলে। জ্যোৎস্না বলতে ভালো লাগে না কমলের। জোছনাই ভালো। জোছনার ইংরেজি হল মুনলিট। ইংরেজি শব্দটার মধ্যে কোনও মায়া নেই। কোনও জোছনা নেই। জোছনায় কী যে মন ভালো হয়ে যায়…। ডাক্তাররা তো বলে, সকালে হাঁটুন, বেশি করে জল খান, কেন বলে না গায়ে জোছনা মাখান? জোছনায় স্নান করুন। একটা যদি এরকম ওষুধ বানানো যেত—জোছনাইসিয়া…বাংলায় তো ওষুধের নাম হয় না, বাংলা ওষুধের নামে ওষুধের মান থাকে না। মুনলিটিয়া রাখা যেতে পারে। স্থির জলের মধ্যে চাঁদের ছায়া পড়বে, সেই জল শিশিতে ভরে ঝাঁকিয়ে নাও। মনখারাপে খাও।
খুব চাঁদ খেয়েছে ওরা বস্তিজীবনে। হনিমুনে গিয়েছিল চারবছর পর। চাঁদনি রাতে চাঁদিপুর। আর সেখানেই প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ। স্রাব।
ঋতুপ্রাবল্য আগেও ছিল। হোমিওপ্যাথিতে কখনও কিছুটা কম ছিল, কখনও বেশি। কিন্তু চাঁদিপুরে অপরিমিত রক্তস্রাবে ভয় পেয়ে গেল কমল। কোনওমতে ফিরে এসে ডাক্তার দেখানো, নানারকম পরীক্ষা এবং জানা গেল ওভারিতে সিস্ট। তখনও এমআরআই দূরের কথা আলট্রাসনোগ্রাফিও এতটা সহজলভ্য ছিল না। এক্সরে-তে ওভারির সিস্ট ধরা যায় না। অনেক ঝামেলার পর রোগ ধরা পড়ল। কমল ওর স্যার, কলকাতার এক নম্বর হোমিওপ্যাথকে দেখাল। উনিও কিছুদিন প্লাটিনা, থুজা, হ্যামামেলিস ইত্যাদি দিলেন। কমল বলল খাও, ভালো হয়ে যাবে। এতবড় ডাক্তার বলেছেন যখন তোমার টিউমার মিলিয়ে যাবে। কিন্তু রক্তপাত বন্ধ হল না। শেষ পর্যন্ত অপারেশনই করতে হল। অ্যাবডোমেন খুলে দেখা গেল জরায়ুর ভিতর ছড়িয়েছে দানা দানা অর্বুদ। ওগুলো চেঁচে বার করা সম্ভব নয়। রেখে দিলে অর্বুদগুলো আরও বড় হয়ে যাবে। ফলে দুটো ওভারি, ফ্যালোপিয়ান টিউবসমেত পুরো জরায়ুটাকেই বাদ দিতে হল। যার ডাক্তারি নাম হিস্টেরেকটমি। তখন রুমার বয়েস মাত্র চৌত্রিশ। কমল পঁয়ত্রিশ।
৭
আজ কমল সাতান্ন। ফাস্টিং সুগার একশো ষাট। খুব বেশি নয়, হাঁটাহাঁটি করলে, আর খাওয়াদাওয়া নিয়মমতো করলে বিনা ওষুধেই ঠিকঠাক থাকতে পারে। হোমিওপ্যাথি ওষুধ খায়। রুমার বয়স ছাপ্পান্ন হলেও বয়েস অনেক বেশি দেখায়। মাথার চুল পেকে গেছে, গায়ের চামড়া কুঁচকে গেছে। হাঁটু এবং কোমরে ব্যথা। অস্টিওপোরেসিস। অল্পবয়সে ওভারি বাদ যাওয়ার কারণে ইস্ট্রোজেন, প্রজেস্টেরন ইত্যাদি হরমোনের অভাবে হাড়ের ক্ষয় হয়েছে। হ্যানিম্যানের বইতে এইসব বাত-বেদনার লক্ষণভিত্তিক ওষুধের কথা বলা আছে, কিন্তু ওষুধে কোনও কাজ হয় না। ব্যথাও কমে না। বেশি ব্যথা হলে পেইনকিলার খায় রুমা। অনেকসময় কমলকেই ওষুধ কিনে আনতে হয়। পাড়ার দোকানদার বলে, কী ডাক্তারবাবু? অ্যালোপ্যাথি ওষুধ কিনছেন? কমল বলেছে অ্যালোপ্যাথেরাও হোমিওপ্যাথি খায়।
সত্যিই খায়। কমলের দুজন পেশেন্ট আছে যারা অ্যালোপ্যাথ। একজন সাইনাসের ক্রনিক রুগি, অন্যজন প্রতিরাতে অশ্লীল স্বপ্ন দেখেন। ওরা চেম্বারে আসেন না। এমপি যেমন এমএলএ-র বাড়ি আসে না, এমএলএ-রা এম পি-র বাড়ি যায়। ওই দু’জনই নাকি ভালো আছেন। তবে ডাক্তারদের বউরা চেম্বারে আসে। চেম্বারে রুগিপত্র মন্দ হয় না আজকাল। কেউ কেউ বহু দূর থেকে আসে। ওদের ধারণা কমলডাক্তার ধন্বন্তরী। ওর চেম্বারে বাচ্চারাই বেশি। ও যদিও বোর্ডে ‘শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ’ কথাটা লিখে রাখেনি তবুও শিশু-বিশেষজ্ঞ তকমা পড়ে গেছে একটা। কমল বাচ্চাদের ভালোবাসে। ওর চেম্বারের পর্দায় হনুমান ঝোলে। দেওয়ালে হাতির ছবি, ঘোড়ার ছবি। বাচ্চাদের আদর করে, স্টেথো দিয়ে পরীক্ষা করতে করতে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
একটা বাচ্চা দত্তক নেবার কথা ভেবেছিল রুমা। কমল অরাজি ছিল না। মিশনারিস অফ চ্যারিটিজ-এর দরখাস্তও করেছিল, কিন্তু রুমা এ নিয়ে আর এগোল না। পরে কমল সন্দেহ করেছিল, এ ব্যাপারে কোনও জ্যোতিষীর আপত্তি ছিল। রুমার জ্যোতিষে বিশ্বাস আছে। কমলের ততটা নেই। রুমা অবশ্য বলেছিল জীবনটা একটা তালে চলেছে, কী আর দরকার রুটিনটা চেঞ্জ করার। নিজের শরীরও ভালো নয়। একটা বাচ্চা আসলে ওর যত্ন-আত্তি করতে পারব না বাবা, থাক।
থাক তো থাক। এনিয়ে কমলও কোনও জোরাজুরি করেনি। কমল ওর চেম্বার থেকেই শিশুদের গায়ের গন্ধ, পেচ্ছাপ মাখানো ন্যাপির গন্ধ, দুধের গন্ধ, হাসির শব্দ, কাজলমাখা ঘুম চোখ, সদ্য দাঁত ওঠা মুখের হি-হি, এইসবই পেয়ে যায়। বাইরের সবকেই নিজের করে নিতে হয়, এই কাজটাই কঠিন। বসুধৈব কুটুম্বকম কথাটা বইতে লেখা থাকে বটে, কিন্তু নিজের জীবনে ঢুকিয়ে দেওয়াটা বড় কঠিন ব্যাপার। সিনেমা থিয়েটারে এসব দেখলে ভালোই লাগে।
কমল এখন গঙ্গার ধার দিয়ে হাঁটছে। ও জানে আস্তে আস্তে হাঁটলে রক্তের চিনি পোড়ে না, কিন্তু কমল আস্তেই হাঁটে। তাড়াতাড়ি হাঁটলে হাঁটাটা উপভোগ করা যায় না। গঙ্গায় দু-চারটে নৌকো। হয়তো জেলে নৌকো। কিন্তু কোনওদিন জাল ফেলতে দেখেনি। পাড়ে এসে মাছ বিক্রি করতেও দেখেনি কমল। ছোটবেলায় দেখেছে ঘাটে ইলিশ বিক্রি হত। ধুতি আর ফতুয়া-পরা বাবুরা ইলিশের মুখে দড়ি বেঁধে ঝোলাতে ঝোলাতে বাড়ি নিয়ে যেত। বর্ষাকালের গন্ধের মধ্যে ইলিশেরও অবদান আছে। বরানগরে পুরোনো বাড়িগুলোর পলেস্তারার গায়ে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। বাড়িগুলোর গা থেকে একটা গন্ধ উঠে আসছে, তার সঙ্গে মিশছে ইলিশ ভাজার গন্ধ…।
এখন বর্ষা প্রায় শেষ। ভাদ্র মাস। গাছগুলো ধোয়া, তাই সবুজ। গঙ্গার ধারের ঝুপড়িগুলো থেকে একটা গন্ধ বেরোচ্ছে। ডাঁই করে রাখা বস্তা ভরা পলিথিন—প্লাস্টিক। দু’-চারটে বস্তা থেকে বেরিয়ে রাস্তায় উড়ে বেড়াচ্ছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে। গঙ্গার ধারের এবড়ো-খেবড়ো পিচ রাস্তার পাশে বসে পায়খানা করছে একটি শিশু। পায়খানাটার রং চোখে পড়ল কমলের। সাদা রং। কাদার মতো। ওর তো জন্ডিস হয়েছে। চোখটা দেখতে ইচ্ছে করল কমলের। কমল একটু দূরে দাঁড়িয়ে রইল। ছেলেটা গঙ্গার জলেই শৌচকর্ম করে এল। এই জন্ডিসের কারণ যদি কোনও হেপাটাইটিস ভাইরাস হয়, তবে গঙ্গার জলে ওই ভাইরাস মিশল। ওই তো, পাশেই তো একটা লোক গঙ্গার জল মাথায় ঠেকাল, সূর্যপ্রণাম করল, তারপরই ওই জল দিয়ে কুলকুচি করতে থাকল। ছেলেটা উঠে এল। কমল বলল, একটু দাঁড়া। চোখটা দেখল। হলদেটে। হাতের নখও হলদেটে। কমল জিজ্ঞাসা করল, তোর পেচ্ছাপের রং কেমন?
ছেলেটা বলল, জানি না।
দেখিসনি?
উঁহু।
বমি বমি লাগে?
করি।
কী করিস?
বমি করি।
কতবার?
ছেলেটার অত ঝামেলার মধ্যে যায় না। আস্তে আস্তে ঝুপড়ির দিকে হাঁটতে থাকে। ওর বয়স কত হবে? চার থেকে পাঁচের মধ্যে। ওর মা-বাবা কি জানে ছেলের জন্ডিস হয়েছে? জানলেও হয়তো ন্যাবার মালা ঝুলিয়ে দেবে। এখুনি চায়না থ্রি এক্স চারঘণ্টা পরপর খাওয়ানো দরকার, এবং দুবার চিলিডেনিয়াম মাদার টিংচার। কিন্তু ও তো প্রাতর্ভ্রমণে এসেছে। সঙ্গে ওষুধ রাখার কোনও প্রশ্নই নেই। কাল কি সঙ্গে করে ওষুধ নিয়ে আসবে? ওর ঝুপড়িটা চিনে রাখতে পারলে ভালো হয়। সব ঝুপড়িগুলোই একইরকম দেখতে। জায়গাটা চিনে নেবার চেষ্টা করল কমল। বটগাছ, তার তলায় কতগুলো রং-চটা শীতলা মূর্তি। ছেলেটা মাথা নীচু করে থপথপ পা ফেলে ওর ঝুপড়ির দিকে এগিয়ে যায়। কমল ওকে ডাকে। এই, শোন। তোর নামটা কী বাবা? ছেলেটা উত্তর না দিয়ে ওর ঘরের দিকে যেতে থাকে।
কমল তো এরকম কত রুগিই দেখে রাস্তাঘাটে। মনটা তো এরকম হয় না। কত হিপারসালফারের ঘুংড়িকাশি ঘুরে বেড়াচ্ছে, সায়াটিকা-অ্যাসাইটিস ঘুরে বেড়াচ্ছে। যেচে ওষুধ দেবার কথা মনে হয়নি কখনও। এর হলদেটে চোখের মধ্যে যেন মায়া ভরা ছিল। কমল একটু পা চালিয়ে বাচ্চাটির কাছে যায়। ওর মাথায় হাত দেয়। বলে তোর নামটা কী রে?
ছেলেটা বলে, আমিনুল।
হাতটা মাথা থেকে সরে যায়।
কমল পিছন ফেরে।
৮
পরদিন ভোরবেলায় ছেলেটার কথা মনে পড়ল কমলের। ওষুধটা কি সঙ্গে নেবে? নামটা আমিনুল শুনে উৎসাহটা যেন কমে গেছে। ধুর, নিতে হবে না—এই ভেবে চটিটা গলাল কমল। তারপরই ভাবল, আমি কি এতটাই সাম্প্রদায়িক? ছেলেটা মুসলিম বলেই ওষুধটা নিচ্ছে না সে? না না, তা নয়। ওর নামটা মণ্টু কিংবা বাবলা হলেও হয়তো ওষুধটা নিয়ে বেরোত না। কে আর ঝামেলা নিতে ভালোবাসে? প্রতিদিন হাজার হাজার রোগী দু’পাশ নিয়ে পিছলে যাচ্ছে। সবাইকে ধরে ধরে ওষুধ খাওয়াতে হবে নাকি?
একবার থমকে দাঁড়াল কমল। নিজেকে অসাম্প্রদায়িক প্রমাণ করার জন্যই হয়তো কতগুলো পুরিয়া বানিয়ে নিল। একটা খামে ভরল।
বাইরেটা বেশ ভালো। শেষ রাত্রে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। হাওয়ায় একটা ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব। চুল্লিতে কোনও দেহ পুড়ছে না। হালকা ঠান্ডা হাওয়া। ওই শেতলা-রাখা বটগাছটার কাছে দাঁড়াল। ছেলেটা গতকাল যেখানে বসে মলত্যাগ করছিল, সেখানে একটু দাঁড়াল। কেউ নেই। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে কমল। এক জায়গায় দেখল একদলা সদ্যকৃত মল। সাদাটে রং, থকথকে। কয়েকটা মাছি বসেছে। সেই ছেলেটারই।
কমল ঝুপড়িগুলোর কাছে গেল। কোনটা আমিনুলের ঘর কমল জানে না। কমল জোরে জোরে ডাকতে থাকে আমিনুল, ও আমিনুল…।
ঝুপড়িগুলো বৈচিত্রে ভরা। কোনওটার চাল কেবল পলিথিন, কোনওটার চাল টিন-দর্মা-খড় মেশানো। কোনও দেওয়াল থার্মোকলের, কোনও দেওয়ালে বাঁশের বেড়া, প্যাকিং বক্সের কাঠ, সিনেমার হোর্ডিং। একটা ঝুপড়ির চালে শুয়ে আছেন মমতা ব্যানার্জী। কোনও কাট-আউট।
কমল আবার ডাকে আমিনুল…এই আমিনুল…।
একটি বউ এগিয়ে আসে। চোখে জিজ্ঞাসা।
কমল বলে আমিনুলকে খুঁজছি।
—কেন?
—ওর তো একটা অসুখ হয়েছে। ওকে ওষুধ দেব।
—ওষুধ?
—হ্যাঁ।
—আপনি কে?
—ডাক্তার।
—ডাক্তার!
কমল মাথা নাড়ায়। বউটা বিশ্বাস করছে না। কমল বলে, গতকাল গঙ্গার ধার দিয়ে বেড়াবার সময় ওকে সাদা পায়খানা করতে দেখলাম কিনা…। তাছাড়া ওর চোখটাও তো হলুদ। তুমি খেয়াল করোনি? বউটা বলল, করেছি তো। পঞ্চাননতলার জলপড়া দিয়েছি। আখের রস খাইয়েছি। কমলের কেমন বিস্ময় লাগে। মুসলিম রমণী পঞ্চাননতলার জলপড়া খাইয়েছে? পঞ্চাননতলা হল কমলদের পুরোনো বাড়ির কাছে। কলকাতা যখন কলকাতা হয়নি, বরাহনগর ছিল একটা গ্রাম, তখনও পঞ্চাননতলা ছিল। একটা পুরোনো শিবমন্দির। চড়ক হয়। গাজনের সন্ন্যাসী হয় এখনও। কমলের মনে পড়ে ওর যে দাদা আত্মহত্যা করেছিল, সে একবার সন্ন্যাস নিয়েছিল। বামুন কায়েতরা সাধারণত এসব গাজন-টাজনের সন্ন্যাসী হয় না, কিন্তু ওর সেই দাদা হয়েছিল। পঞ্চানন ঠাকুরের সেবাইতরা বংশপরম্পরায় জলপড়া দেয়। বউটা জলপড়াই বলল। পানিপড়া তো বলল না।
কমল জিজ্ঞাসা করল, তুমি কি মুসলিম?
বউটা বলল, উঁহু…।
—তবে তোমার ছেলের নাম আমিনুল রেখেছ কেন?
—ছেলের বাপ রেখেছিল। ছেলের বাপ মুসলিম ছিল।
—ছিল বলছ কেন? এখন নেই?
—আমাকে তালাক দিয়ে চলে গেছে।
—কোথায় গেছে?
—ওই পারে। লিলুয়া।
—কবে চলে গেছে?
—তিনবছর হয়ে গেল।
—তোমাদের চলে কী করে?
—খেটে খাই।
—কী কাজ করো?
—এই তো বাজার যাব। মাছ কুটব। আজ একটু দেরি হয়ে গেল।
ঘড়িটা দেখল কমল। পৌনে সাতটা।
—কী মাছ কোটো?
—সব মাছ। বাবুদের বউরা তো মাছ কুটতে জানে না, যাবার সময় চায়ের দোকান থেকে ছাই লিয়ে বাজার যাই….
—কত করে হয়?
—বেলা বারোটা পর্যন্ত থাকলে, ষাট-সত্তর টাকা হয়ে যায়।
—তোমার ছেলে কোথায়? আমিনুল?
—হাগতে গেছে।
—কখন?
—তা হল অনেক টাইম। সকালে বেরোলে ঘরে আসতে চায় না। গঙ্গার পাড়ে ঠায় বসে বসে লৌকো দ্যাকে। এক নম্বর—একের নম্বর হিজল দাগড়া ছেলে।
হিজল দাগড়া শব্দটা কতদিন পড়ে শুনল কমল। হিজল দাগড়া মানে একটু আলসে টাইপ। কোনও কাজে অনেকটা সময় লাগায়। এগুলো সব কলকাতার পুরোনো শব্দ। নিটপিটে, পাঁচপাচি, আগড়দম্বা, অনামুখো—এইসব কথাগুলো শোনাই যায় না আর। মা বলতেন….।
ছেলেটার মল দেখে এসেছে কমল। ওরকম সাদা, থকথকে, একদম চায়নার পেশেন্টের মল। ভাবল, ওর মায়ের কাছে রেখে যাবে। তবে একবার পেট টিপে লিভারটা দেখতে পেলে ভালো হত। এমনসময় দেখল ছেলেটা আসছে। একটা বড় পলিথিনের জ্যারিকেন, একটা কাদামাখা কাপড় টেনে নিয়ে আসছে আমিনুল। বউটা বলল, ভাটির মাল। গঙ্গা কত কি লিয়ে আসে। ভাঁটায় জল সরে গেলে পাড়ে রেখে যায়।
কমল বলে কাপড় কী হবে?
জোয়ার এলে থুপে কেচে লিব। সব বিককির হয়।
ছেলের মাথায় হাত দেয় কমল।
বলে, চিনতে পারছিস?
ছেলেটা কমলের মুখের দিকে তাকায়। বলে হ্যাঁ। হাওয়া-খাওয়া বাবু।
কাল কথা হয়েছিল মনে আছে?
ছেলেটা মাথা নাড়ায়।
কমল জিজ্ঞাসা করে কাল ক’বার বমি করেছিস?
ছেলেটা বলে, দু-তিনবার।
কমল বলে, একটু শুয়ে পড় তো…কোথায় শুবি?
ছেলেটা প্লাস্টিক পলিথিন ভরা বস্তাটার উপর শুয়ে পড়ে। দু’হাত দু’পাশে ছড়িয়ে দেয়। কমল পেটে হাত দেয়। লিভার প্যালপেট করে। বেশ বড় হয়েছে। একটু শক্তও। চিলিডোনিয়াম খাওয়া দরকার। কালমেঘের পাতার রসও ভালো।
কমল ছেলেটার মাকে জিজ্ঞাসা করল, কালমেঘ পাতা চেনো?
মাথা নাড়ায়।
কমল বলে, বাজারে ওঠে। মাসিদের বোলো। ওই পাতার একটু রস খাওয়াও। ওর রান্নায় তেল-মশলা দিও না।
মেয়েটা বলল, তরকারিতে হলুদও দিই না।
কমল বলল, হলুদ তো ভালো। হলুদ খেলে ক্ষতি হয় না। ওর পেচ্ছাপের রং হলুদ, তার সঙ্গে খাওয়ার হলুদের কোনও সম্পর্ক নেই।
বউটা মাথা মৃদু নাড়ায়। ব্যাপারটা ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না।
বউটা বলে, আপনি ডাক্তার বলছেন, কী নাম?
—নাম বললে চিনতে পারবে?
—বাজারে কতরকম আলোচনা হয়, ডাক্তারদের নিয়েও আলোচনা হয়।
—আমার নাম কমল।
বউটা হঠাৎ বসে পড়ল। পা চেপে ধরল কমলের। আপনি কমল ডাক্তার? আমার কী ভাগ্যি। আপনার কত সুখ্যাত শুনি। আপনার ডাক্তারঘরে কী ভিড়। যেতে সাহস করি না। আপনি দেবতার মতো দেখা দিলেন। কোথায় বসাই, কী করি…।
—লোকে আমায় ভালো বলে? কমল শুনতে চায় আবার।
—খুব ভালো বলে। চিংড়ি বেচা গনা, ওর সারা গা জ্বালপোড়া করত। আপনার ওষুধ খেয়ে সারিয়েছে। একজন বাবু আসেন চারাপোনা কুটোতে। উনি বলেছেন আপনি চারাপোনার ঝোল খেতে বলেছেন তাই অন্য মাছ খায় না। এমন বিশ্বাস। উনি তিনমাস বাজারে আসেনি। হাসপাতালে ছিল। কি একটা যেন অসুখ। এখন আপনার ওষুধ খাচ্ছে। আপনি ওষুধ দিয়েছেন যখন আমার ছেলেও ভালো হয়ে যাবে। কমল জিজ্ঞাসা করে, কী নাম তোমার?
বউটা বলল, ঝর্ণা।
ছেলেটা বলে, ঝন্না না, জরিনা।
বউটা হাসে। বলে ঝর্ণা নামটাকে একটু জড়িয়ে বললে তো জরিনার মতোই শোনায়। আমার স্বামী জরিনা বলেই ডাকত। সেই দেখাদেখি এরাও জরিনা ডাকে। কিন্তু বাজারে ঝর্ণা। ঝর্ণাও যা, জরিনাও তা। আমি তো আমি।
নমাজ-টমাজ পড়ো? কমল জিজ্ঞাসা করে।
নমাজের মন্তর বড় কঠিন। আমার স্বামী শেখাবার চেষ্টা করত। আমার মুখস্থ হত না। আর চেষ্টা করিনি। মসজিদ দেখলে একটা পেন্নাম ঠুকে দি। পীরের থান দেখলেও। মন্দির, শনি, শিব যা দেখি পেন্নাম করে দি। ক্ষতি তো নেই। আমার মা লক্ষ্মীর পাঁচালি পড়ত। মুখস্থ ছিল। আমার মা অনেক বড় সিঁদুরের টিপ পরত। কী সুন্দর লাগত…।
মা নেই?
না।
বাবা?
বাবাও নেই। আমার বাবা ছিল খুব বড়ঘরের লোক। বাবাকে মনে নেই। কী করে মনে থাকবে? বাবা যখন মরে যায় আমার তখন একবছরও হয়নি। তোমার বাবা কী করে মারা গেল? বউটা ঘাড় চুলকোতে চুলকোতে বলে শুনেছি তো গলায় দড়ি দিয়েছিল। ঝিনঝিন করে কমলের শরীর। হঠাৎ প্রেশার বেড়ে গেল মনে হয়। কমল বউটাকে জিজ্ঞাসা করল, তোমার বয়স কত ঝর্ণা?
ঝর্ণা বলল, কে জানে! পঁচিশ-তিরিশ হবে…।
ঝর্ণার দিকে তাকিয়ে থাকে কমল। অপলক। কিছু আবিষ্কার করতে চায়। কমল বলে, তোমার বাবা যখন মারা গেলেন, তোমার মা তোমাকে তখন নিয়ে গিয়েছিলেন?
ঝর্ণা নীচের ঠোঁটটা উলটে খুব তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বলল, ক্যা জানে। আমার কিছু মনে নেই।
কমল তখন মনে মনে হিসেব করে দেখল ওর সেজদা মারা গেছে ঠিক আঠাশবছর আগে। লাল ফ্রক পরা মেয়েটাই কি তবে আজকের ঝর্ণা? বুকটা ধড়াস করে উঠল কমলের। না, হতেই পারে না। আঠাশবছর আগে তো কত লোকই মারা গেছে। এই রতনবাবুর ঘাটেই তো সারাদিনে পঁচিশ-ত্রিশ জন পুড়ছে।
কমল বলে ফেলল, তোমার বাবার নামটা জানা আছে? বলার সঙ্গে সঙ্গেই বুকের ভিতর ধামসা বাজতে শুরু করল।
ঝর্ণার সেই একইরকম নিস্পৃহতা কিংবা তাচ্ছিল্য। নিজের বাবার নামটা কি মনে নেই আমার, কিন্তু পরের বাবা-টার নাম ছিল খগেন। হি হি। সবাই খিস্তিতে বলে বাপের নাম খগেন করে দেব। আমি বলি, আমার বাপের নাম তো খগেনই। আমার নিজের বাপ মরে যেতে মা যাকে বিয়ে করেছিল, তার নাম খগেন।
৯
পাশের বাড়িটা তরতর করে উঠে যাচ্ছে। মন্দার বাজারে সিমেন্ট লোহার দাম কিছুটা কমেছে, তার সুব্যবহার হচ্ছে। দেওয়ালগুলো হয়ে গেল। চাঁদের আলো আর আসে না। আসতে পারে না। দু’বাড়ির ফাঁকে একচিলতে আকাশ। ওই আকাশে কখনও তারা দেখা যায়, চাঁদ নয়।
রুমা বড্ড ভুগছে। কমবয়সে ওভারিটা বাদ দিতে হয়েছে। হরমোন পায়নি শরীর। হাড়গুলো ফোঁপরা। ক্যালসিয়াম বসছে না শরীরে। হোমিওপ্যাথির যাবতীয় বিদ্যা প্রয়োগ করেও লাভ হয়নি। ও বোধহয় পঞ্চাননের জলপড়াও খেয়েছিল। হোমিওপ্যাথিকে তো অনেকেই জলপড়া বলে। বরানগরে একটা মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন আছে। অনেকে এটাকে ডক্টরস ক্লাবও বলে। ওখানে বাইশজন ডাক্তার মেম্বার। ছ’জন হোমিও, একজন আয়ুর্বেদ। কয়েকজন অ্যালোপ্যাথ আছেন, ওদের হাতে পাথর বসানো আংটি। জামা খুললে হয়তো মাদুলিও দেখা যাবে। ওরাও হোমিওপ্যাথদের হ্যাটা করে। মিনারেল ওয়াটারের বোতল নিয়ে বলে একটু ঝাঁকিয়ে দিন তো দাদা, পোটেন্সি বাড়িয়ে দিন। কোনও চেনা-জানা লোকের ক্যান্সার হলে বলে—এই যে হোমিও দাদা, ক্যান্সারটা সারিয়ে দিন তো…। অনেক হোমিওপ্যাথ ডাক্তাররা বলেন ক্যান্সার সারিয়েছে। কমলের বিশ্বাস হয় না। হোমিওপ্যাথিতে যে অন্য অসুখ-বিসুখ সারছে, এসবই বা কী করে সারছে তার কোনও যুক্তি খুঁজে পায় না কমল। ক’দিন আগেই তো একজনের থুতনির আঁচিলটা পড়ে গেলে। আটবছরের পুরোনো আঁচিল। এটা ওষুধের দান নাকি হ্যানিম্যানবাবার আশীর্বাদ? একজন হোমিওপ্যাথকে জানে কমল, যে পুরিয়া বানিয়ে খামে ভরে হ্যানিমানের ছবিতে ছুঁইয়ে নেয়। ছবির ঠিক পায়ের কাছটায়।
রুমাকে নিয়ে গিয়েছিল কমল এক তিব্বতি কবিরাজের কাছে। রুমাকে কেউ সন্ধান দিয়েছিল ওই তিব্বতি কবিরাজের। ঠিকানা খুঁজে গেল ওরা। কবিরাজমশাই মুণ্ডিত মস্তক। বৌদ্ধ সন্ন্যাসী। ঘরে দলাইলামা, বুদ্ধদেব এবং নানা বৌদ্ধ দেবীদের মূর্তি। কবিরাজের নাম তেনজিং মনসা ভুটিয়া। বললেন দলাইলামার সঙ্গে যেসব তিব্বতিরা ভারতে এসেছে, তাদের একটা বসতি আছে হিমাচল প্রদেশে। সেখানে বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় আছে, মেডিকেল কলেজও আছে, যেখানে তিব্বতি চিকিৎসাশাস্ত্র শেখানো হয়। তিনবছর ওখানে পড়েছে সে। ওখানে কিছুটা আকুপাংচার, কিছুটা ম্যাকসিবুশনও শেখায়। ঘরময় কবিরাজি ওষুধের গন্ধ। শিশিতে ভরা সাদা, কালো, গোলাপি, বাদামি গোল গোল বড়ি।
নাড়ি দেখলেন অনেকক্ষণ। তারপর বললেন খুন খারাব হো গিয়া। ফার্স্ট উই নিড টু পিউরিফাই হোল ব্লাড। ব্লাড পরিষ্কার করনে কা দাবাই জরুরি হোগা। ওদেরও সেই পুরোনো শাস্ত্র, পুরোনো বিশ্বাস। হাড়ের ক্ষয়, ক্যালসিয়াম মেটাবলিজম এসব ওরা জানে না। আয়ুর্বেদের যেমন বায়ু-পিত্ত-কফ, হোমিওপ্যাথির যেমন সিফিলিফ, সোরিক, সাইকেসিস। পুরোনো শাস্ত্র সেই প্রাচীন অবস্থাতেই থেমে আছে। আজকের চীন কিন্তু ওদের পুরোনো চিকিৎসাপদ্ধতি নিয়ে গবেষণা করেছে, পরীক্ষা করেছে—আরও এগিয়ে নিয়ে গেছে। প্রাচীন গাছগাছড়া শেকড়-বাকড়ের সঙ্গে মিলিয়েছে অ্যান্টিবায়োটিক, এনজাইম, হরমোন থেরাপি। ওরা নিজেদের চিকিৎসা বিজ্ঞানকে নিজেদের মতো করে এগিয়ে নিয়েছে।
ভারতে যখন ব্রিটিশরা আসে, ব্রিটিশ সৈন্য এবং ব্রিটিশ নাগরিকদের চিকিৎসার প্রয়োজনে মেডিকেল কলেজ তৈরি করেন। দেশ থেকে তো ডাক্তার নিয়ে আসা সম্ভব ছিল না। দু’-আড়াইশো বছর আগে দেশীয় চিকিৎসার এতটা দুরবস্থা ছিল না। মেডিকেল কলেজে দেশীয় বিদ্যারই চর্চা হত। পড়তে আসতেন দেশীয় বৈদ্য সন্তানরা। পড়াতেনও দেশীয় বৈদ্যরা। বাংলা ভাষাতেই পড়ানো হত। দু’-একজন সাহেবও বাংলা শিখে পড়াতেন। বিভিন্ন আরক তৈরি হত, সেই সঙ্গে সঙ্গে শল্যচিকিৎসাও শেখানো হত। মৃতদেহ কাটাছেঁড়া করা হিন্দুশাস্ত্রে খারাপভাবে দেখা হত। মধুসূদন গুপ্ত প্রথম শব-ব্যবচ্ছেদ করেন ১৮৩৬ সালে। সে এক ইতিহাস।
কিন্তু চিকিৎসাবিদ্যার সিলেবাস পুনর্গঠিত হল। সাহেবরা একটা কমিশন করলেন। দেশীয় চিকিৎসার সমস্ত অধ্যায় বন্ধ করে দেওয়া হল। আমাদের শুধু ইউরোপীয় চিকিৎসা পড়তে হয়।
হোমিওপ্যাথিও তো ইউরোপীয় চিকিৎসা। হ্যানিম্যান সাহেব এর প্রবক্তা। ভারতে হোমিও চিকিৎসা এসেছিল ইংরেজদের হাত ধরেই। রাজেন্দ্রলাল দত্ত সেই ১৮৫১ সালে হোমিওপ্যাথি কলেজ তৈরি করেছিলেন। আর মহেন্দ্রলাল সরকার? কত বড় ডাক্তার ছিলেন তিনি। অ্যালোপ্যাথি ছেড়ে হোমিওপ্যাথি ধরলেন। ডা. প্রতাপ মজুমদারও কম কীসে? সেই হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাই তো করছে কমল। কিন্তু তৃপ্তি নেই। তিব্বতি ডাক্তার বললেন—দু’বছর ওষুধ খেতে হবে। রক্ত পরিষ্কার হলে পায়ের ব্যথা, হাঁটুর ব্যথা কমে যাবে।
কমল বেরিয়ে এসে রুমাকে বলল, দেখ ঠিক কমে যাবে। ধৈর্য ধরে খাও। কমে যাবে। কমবেই।
আসলে বিশ্বাস সংক্রমণ করতে চাইছে কমল। বিশ্বাস তৈরি হলে রোগ সারবে। প্লাসিবো! প্লাসিবো।
ট্যাক্সিতেই হঠাৎ চোয়াল ব্যথা করতে থাকল রুমার। ব্যথাটা হাতের কনুই পর্যন্ত গড়াল। লক্ষণ দেখেই কমল বুঝল এটা হার্টের গোলমাল। ট্যাক্সিকে ঘোরাল। সিদ্ধান্ত নিতে হবে হাসপাতাল না নার্সিংহোম। নার্সিংহোম হলে ভালো নার্সিংহোম। ওর মনে হল রুমার জন্য কিছুই করা হয়নি। বহুদিন কোথাও বেড়াতে যেতে পারেনি রুমার পায়ের জন্য। রুমার গয়নাগাটিরও শখ নেই। ও এখন যে জায়গায়, পিজি হাসপাতালেও যেতে পারে, বিড়লা হার্ট-এও যেতে পারে। কিন্তু সঙ্গে বেশি টাকা নেই। নার্সিংহোমে ভর্তি করলেই প্রথমে গাদাখানেক টাকা দিয়ে দিতে হয়। রুমার বেশ কষ্ট হচ্ছে। মাথায় হাত বোলাচ্ছে কমল। কমল বলল, একদম চিন্তা কোরো না। ড্রাইভারকে বলল, পি. জি হাসপাতাল।
১০
অল্পের ওপর দিয়েই গেল। কী করে রুমার রক্তে এতটা কোলেস্টেরল জমে গেল কে জানে! ঘি-মাখন এসব খাওয়াই হয় না বাড়িতে। অথচ কোলেস্টেরল ৩৮০। ট্রাইগ্লিসারয়েড দুশো সত্তর। এনজিওগ্রাফি করতে হল। আর্টারিতে ভালোমতন ব্লক ধরা পড়েছে। এসব তো আর হ্যানিমানের ভরসায় রাখা যায় না, বড় হার্ট স্পেশালিস্টকে দেখানো হয়েছে। অ্যাসপিরিনযুক্ত ওষুধ খেতে হচ্ছে, রক্ত যাতে সহজে জমাট না বাঁধতে পারে। আর ব্লকটা কীভাবে সারানো হবে তা নিয়ে এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি। এনজিওপ্লাস্টির কথা ভাবা হয়েছে। আবার একজন ডাক্তার বললেন, ওষুধ খেয়েই দেখা যাক না কিছুদিন। কেউ বললেন প্রাণায়ামই হল একমাত্র চিকিৎসা। কপালভাতিটা ঠিকঠাক করলে সব কোলেস্টেরল গলে যাবে। ব্লক-টক যা আছে সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। কেউ বলছে অর্জুনের ছাল ভেজানো জল রোজ সকালে খালি পেটে তিনমাস খেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। অর্জুনের জলও খাচ্ছে, প্রাণায়ামও একটু করছে, নিউস্প্রিন ক্লপিট্যাবও খাচ্ছে। আবার মন মানে না বলে স্পাইজেলিয়া থ্রি এক্সও খাওয়াচ্ছে কমল।
এখন দরকার একজন সবসময়ের লোক। পাওয়া যাচ্ছে না। বাসন মাজার মেয়েটিকে প্রচুর কাকুতি-মিনতি করে রান্নাটা করিয়ে নেওয়া হচ্ছে। অনেককেই বলেছে কমল, লোক পাওয়া যাচ্ছে না কিছুতেই। আমিনুলের মায়ের কথা মনে পড়ল একবার। ওই সেবার, যেদিন আমিনুলকে ওষুধ দিতে গেল দরদ দেখিয়ে, সেদিন কী বুক ধড়াস ধড়াস সকলের। এক্কেবারে ল্যাকেসিস-এর সিম্পটম। সেই বুক ধড়ফড়ানি অনেকক্ষণ ছিল। ওই মেয়েটা, আমিনুলের মা ওর সেজদার মেয়ে হয়ে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছিল। তাহলে আমিনুল তো কমলের নাতি হয়ে যাচ্ছে। কী মুশকিল।
কমল ভয়ে ভয়ে ওই পথ মাড়ায়নি বেশ কয়েকদিন। কেমন আছে ছেলেটা জানতে ইচ্ছে করেছিল খুব। সেই ইচ্ছে চেপে রেখেছিল। বরানগরের বাজারে তেমন যায় না কমল, সুতরাং আমিনুলের মায়ের সঙ্গে দেখা হবার কোনও সুযোগ নেই। কমল বেনেপাড়ার বাজারেই বাজার সারে। বরানগর বাজারটা ভালো। ওখানে মাঝে মাঝে যেতে ইচ্ছে করলেও আমিনুলের মায়ের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবার ভয়ে ও যায় না।
কিন্তু একদিন একটা কাণ্ড ঘটে গেল। বেলা একটা নাগাদ চেম্বার থেকে বেরোচ্ছে কমল, সেখানে দাঁড়িয়ে আছে আমিনুলের মা। সঙ্গে আমিনুল। কমলকে দেখেই পায়ে পড়ে গেল আমিনুলের মা। আপনার ওষুধে আমার আমিনুল ভালো হয়ে গেল। আপনি আর আসেন না, আপনার জন্য কতদিন দাঁইড়ে রইলাম, বাজার যেতে দেরি হয়ে গেল, তাই আপনার এখেনে এলাম। আপনার ওষুধ খেয়ে পরদিনই বড় বড় কিরমি বেরুল পাইখানার দ্বার দিয়ে। কত বড় কিরমি দেখা দেকি আমিনুল…।
আমিনুল দু’হাত ফাঁক করে কৃমির আয়তন দেখায়।
পেন্নাম কর, ডাক্তারবাবুকে পেন্নাম কর…আমিনুলের মা বলে।
আমিনুল প্রণাম করে।
আমিনুলের চোখটা অনেকটা পরিষ্কার।
ডাক্তারের স্বভাবে কমল প্রশ্ন করে, পেচ্ছাপের রং কেমন?
সাদা, জলের মতো।
পাইখানা?
হলদে?
আশেপাশের লোকজন অবাক হয়ে দেখে। এরকম দু-চারটে কেস হলে কমলের সুবিধাই হয়। পসার বাড়ে। খবর চলে যায়। পেশেন্ট বেশি হয়।
কিন্তু কমল ভাবে পৃথিবীটা কী রহস্যময়! কৃমির কোনও ওষুধই দেয়নি কমল। দিয়েছিল চায়না। চায়না-র সঙ্গে কৃমির বেরিয়ে যাওয়া কোনও হোমিওপ্যাথি বইতে লেখা নেই। কিন্তু কৃমি বেরিয়ে গেছে। রাউন্ডওয়ার্ম ছিল। কৃমি লিভারের ক্ষতি করে। ওই কারণেই জন্ডিসের উপসর্গ দেখা দিয়েছিল। কৃমি বেরিয়ে যাওয়ার পরে জন্ডিসের উপসর্গ কমে গেছে। কিন্তু চায়না প্রয়োগে কৃমি বেরোয়নি। এমনিই বেরিয়ে গেছে। কিন্তু একথা কাউকে বলা যাবে না। ছেলেটা ভালো হয়ে যাওয়াতে কমল তৃপ্তিবোধ করছে ঠিকই, কিন্তু এটা ডাক্তারের তৃপ্তি নয়, ডাক্তারের সন্তুষ্টি নয়। ঠিকমতো পর্যবেক্ষণ করে ঠিকমতো রোগ ধরে ঠিক ওষুধ দেবার পর রুগিকে ভালো হয়ে যেতে দেখলে যে ভালোলাগা, এ তৃপ্তি সেরকম নয়।
ঝর্ণা না জরিনা, একটা পলিথিন বের করল ব্যাগ থেকে। পলিথিনের ভিতরে কিছু কুঁচো মাছ। বলল, ডাক্তারবাবু, আপনার জন্য এনেছিনু, একদম জ্যান্ত মৌরলা। নে যান। কমল নিতে চায় না। ঝর্ণা আবার বলে, আপনার জন্যই এনেছিলু। কাতর দৃষ্টিতে তাকায় মেয়েটা।
কমলও ভীত চোখে চায়। অন্যরকমের কাতরতা। বলে, আমাদের তো রান্না-বান্না হয়ে গেছে।
ঝর্ণা বলে, ফিরিজে রেখে দেবেন…।
হাতটা বাড়ায় কমল। ঝর্ণার গা থেকে মেছো গন্ধ আসছে। কমল পলিথিনটা নেয়। ঝর্ণা হাসে।
আপনার বাড়িটা কোথায় ডাক্তারবাবু? ঝর্ণা জিজ্ঞাসা করে।
এই তো কাছেই। লালবাবার মন্দিরের পিছন দিকটা। মিত্তিরবাগানের কাছে।
ওখানে একটা নায়েববাড়ি আছে? ঝর্ণা জিগ্যেস করে।
সিনেমায় এ দৃশ্য দেখলে এইসময় কমলের মুখটা নেগেটিভে দেখাত।
কমলের মুখ থেকে তখন ক্র্যাচে ভর দিয়ে একটা বাক্য—ও-বাড়িটার কথা কী করে জানলে?
—মায়ের মুখে শুনেছি যেন মনে হয়।
ও, আচ্ছা। শোনো, এই মাছ নিয়ে যাচ্ছি, তবে এমন আর কোরো না। তোমার ছেলেকে এখনও একমাস তেল-মশলা কম দিও। ভালো থেকো। ‘ভালো থেকো’ কথাটা বিদায় অর্থে ব্যবহৃত। ‘ভালো থেকো’ বলা হয়ে যাওয়া মানে আর কোনও কথা নেই। এইভাবে ফুলস্টপ দেওয়ার প্রথাটা আধুনিক। কমল ‘ভালো থাকবেন’, ‘ভালো থাকিস’ এসব বলে না। ‘এবার আসি’ই বলে সাধারণত। এখন ‘ভালো থেকো’ বলল স্মার্ট হবার জন্য, নাকি নার্ভাস লাগল বলে?
রিকশায় উঠে যায় কমল।
১১
রাত্তিরে ঘুম আসে না কমলের। কেবল আমিনুল আর আমিনুলের মা ঝর্ণা। ঝর্ণার মায়ের নাম কী? সেজদার মৃত্যুর পর একটা ডাইরি পাওয়া গিয়েছিল। ওখানে কিছু পাওনাদারের নামধাম লেখা ছিল। কিছু মেয়েমানুষের নামও ছিল। একটা নাম মনে আছে কোকিলা। নামটা আনকমন বলেই মনে আছে। লেখা ছিল, কোকিলার অপারেশন খরচ ১২০০ টাকা। কোকিলা নামটা আরও কয়েকবার ছিল ডাইরিতে। আরও দু-চারটে মহিলার নাম ছিল। সেই নামগুলো মনে নেই। ডাইরিটা মেজদা পুড়িয়ে দিয়েছিল। পাওনাদারদের জন্য কোনও প্রমাণ রাখতে চায়নি। তাছাড়া ওই ডাইরিটা ছিল একটা পারিবারিক কলঙ্ক।
কোকিলা নামটা সাধাণত বাঙালদের ঘরের মেয়েদের হয়। নিজেদের জানাচেনা কারোর মধ্যে কোকিলা নেই। ঝি-টিদের মধ্যে ময়না পাওয়া যায়। কিন্তু কোকিলা পাওয়া যায়নি। বেদে-টেদের মধ্যে কোকিলা হয় বোধহয়। কী একটা গান আছে না, ও কোকিলা তোরে শুধাই রে…। কোকিলার সঙ্গে সেজদার কী সম্পর্ক ছিল ঠিক ঠিক জানা যায় না। একটা অপারেশন খরচ লেগেছিল। সেজদাই দিয়েছিল। কী অপারেশন? অ্যাবরশন? তাতে কি তখন বারোশো লাগত? কোকিলা যদি বাঙালই হবে, তো ঝর্ণার কথার মধ্যে একটু বাঙাল বাঙাল টান থাকা উচিত। কিন্তু ঝর্ণার কথায় তো ওরকম বাঙাল টান নেই। টান থাকতেই হবে? কে বলেছে? কোকিলা যে বাঙাল তাই বা কে বলেছে! আরে, কোকিলাই যে ঝর্ণার মা তাই বা কে বলেছে?
যে দুজন মহিলা চোখ মুছতে মুছতে বউ বলে এসেছিল, ওদের নাম মনে করতে পারছে না কমল। ওরা তো নামধাম বলেছিল। আসলে ওরা মানে কমলরা নাম-ধাম শুনতে চায়নি। শুনলেও মনে রাখতে চায়নি। মানুষ যা মনে রাখতে চায় না, তা ভুলে যায়।
বউ বলে দাবি-করা যে দুজন মহিলা এসেছিল, সেজদার সঙ্গে নিশ্চয়ই তাদের শারীরিক সম্পর্ক ছিল, নইলে নিজেদের স্ত্রী বলে দাবি করতে পারে না। ওরা কোনও প্রমাণ দেখাতে পারেনি। রেজিস্ট্রি করেনি সেজদা। ওরা বলেছিল কালীঘাট-টালিঘাট। তাদের একজন কোকিলা তো হতেই পারে। বড্ড কষ্টে কেটেছে নিশ্চয়ই। ঝর্ণা হল কোকিলার মেয়ে। কমল তাহলে ঝর্ণার কাকু হয়। আমিনুলের দাদু।
উঃ…। মাথার চুল ছেঁড়ে কমল। কে বলেছে কোকিলার মেয়ে ঝর্ণা? আর কোকিলার মেয়ে হলেই কি সেজদার সন্তান হবে নাকি? এইসব কোকিলারা তো অনেককে দিয়েই…। একমাত্র ডিএনএ টেস্ট এ-প্রমাণ করতে পারে। কমল আর আমিনুল বা ঝর্ণার ডিএনএ-র মধ্যে নায়েববাড়ি ঠিক রয়ে গেছে। ডি অক্সি রাইবো নিউক্লিক অ্যাসিডের ভিতরকার ডবল হেলিক্সের নিজস্ব ধর্ম আছে। ওখানে হিন্দু-মুসলিম নেই। ওদের বংশধারা বহন করছে কিছু রাসায়নিক। ডিএনএ টেস্ট। একমাত্র ডিএনএ টেস্ট।
রুমা ধাক্কা দিল কমলকে। ঘুমের মধ্যে এরকম ডিয়েনে ডিয়েনে বলছ কেন?
১২
একটা প্রবন্ধ পড়ছিল কমল একটা কাগজের কভার স্টোরিতে। জল নিয়ে। জল মানে দুটো হাইড্রোজেন পরমাণু আর একটা অক্সিজেন পরমাণুর বন্ধন। H2O হাইড্রোজেনের একটা আইসোটোপ আছে। ডয়টেরিয়াম। জলের মধ্যে অত্যন্ত সামান্য হলেও ডয়টেরিয়াম অক্সাইড বা D2O থাকে। জল বাষ্প হয় ১০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে। কিন্তু ডয়টেরিয়াম ফুটতে ১০০ ডিগ্রির বেশি তাপমাত্রা লাগে। তার মানে একশো লিটার জলকে ফুটিয়ে ফুটিয়ে যদি দশ লিটার করা যায়, সেই জলের মধ্যে ডয়টেরিয়াম অক্সাইডের পরিমাণ যা থাকবে, ফুটিয়ে এক লিটার করলে আরও বেশি থাকবে। মানে জল যত বেশিক্ষণ ফোটানো হবে, ডয়টেরিয়াম অক্সাইডের অনুপাত বাড়তে থাকবে। জলে ডয়টেরিয়াম অক্সাইড বেশি থাকলে জীবাণু বাড়তে পারে না। এ জন্যই কাসুন্দির জল অনেকক্ষণ ধরে ফোটাতে হয়। বরফ জলের চেয়ে হালকা। তাই জলে বরফ ভাসে। জল জমে যখন বরফ হয়, তখন হাইড্রোজেন-অক্সিজেনের যে বন্ধন এবং সেইসঙ্গে জলের একটা অণুর সঙ্গে অপর অণুর বন্ধনের জন্য একটু বেশি জায়গা দরকার হয়। তাই আয়তনের বেড়ে যায়।
প্রেমেন্দ্র মিত্র একটা গল্প লিখেছিলেন, গল্পের নাম টল। এবং নায়ক ঘনাদা। কোনও বিজ্ঞানী নাকি ‘টল’ আবিষ্কার করেছেন, এবং ওই ‘টল’ জলের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে পৃথিবীটা শেষ করে দেবার চক্রান্ত করছেন। টল সমস্ত জলকেই কাচের মতো শক্ত করে দেবে। ঘনাদা সেই টলের টেস্ট টিউবটা উদ্ধার করলেন। নষ্ট করেছিলেন টল, এবং এর প্রস্তুত প্রণালী, এবং পৃথিবীকে উদ্ধার করলেন।
জল নিয়ে কত কথা। পড়তে বেশ লাগছে কমলের।
গত শতাব্দীর ষাট এবং সত্তরের দশকে পৃথিবীর নানা দেশে গবেষণা হয়েছিল পলিওয়াটার নিয়ে। মানে জলের পলিমার নিয়ে। ইথিলিনের পলিমার হল পলিথিন। অনেকগুলো ইথিলিন অনু একসঙ্গে মিলে তৈরি করে পলিথিন। জলেরও পলিমার তৈরি করার চেষ্টা হয়েছিল সারা পৃথিবীর বিভিন্ন ল্যাবরেটরিতে। দুজন রাশিয়ান বিজ্ঞানী, নিকোলাই ফেদিয়াফিন এবং বারিস দেরিয়াগিন দাবি করে ফেললেন যে তাঁরা পলিওয়াটার তৈরি করে ফেলেছেন। আর এই পলিওয়াটার নাকি থকথকে। মাইনাস ছাপ্পান্ন ডিগ্রিতে বরফ হয়, আর ফোটে দুশো ষাট ডিগ্রিতে। ওঁরা আরও বললেন, সব জলই একদিন পলিওয়াটার হয়ে যাবে। নামীদামি বিজ্ঞান পত্রিকাগুলিতে পলিওয়াটার বিষয়ে নানা প্রবন্ধ ছাপা হতে লাগল। একদশক ধরে চলল ওই ধুন্ধুমার কাণ্ড। তারপর একদিন বলা হল, পলিওয়াটার ভুয়া। বিজ্ঞানীদের বিভ্রম। জলের কখনও পলিমার হতে পারে না। জলের সেই ক্ষমতাই নেই।
জলের অন্য একটা ক্ষমতার কথা বললেন, ড. জাঁকুই বুভুনেস্কি। একটা প্রবন্ধ ছাপা হল ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দের জুন সংখ্যার নেচার পত্রিকায়। যে নেচার পত্রিকাকে বিজ্ঞান গবেষণা প্রকাশের শ্রেষ্ঠ পত্রিকা ভাবা হয়। প্রবন্ধটির শিরোনাম—’হিউম্যান ব্যাসোফিল ডিগ্র্যানুলেশন ট্রিগারড বাই ভেরি ডাইলিউটেড অ্যান্টিসেরাম এগেনস্ট আই-জি-ই। ড. বুভুনেস্কি-র সঙ্গে আরও তেরোজন বিজ্ঞানীর নাম যুক্ত রয়েছে ওই গবেষণায়। শিরোনামটা বড়। শুনতে কঠিন। কিন্তু ব্যাপারটায় আছে জলের ম্যাজিক। বিষয়টা এরকম—রক্তের শ্বেতকণিকা বা ব্যাসোফিল রোগ প্রতিরোধে একটা বড় ভূমিকা নেয়। এই ব্যাসোফিল কোষের গায়ে লেগে থাকে ইমিউনোগ্লোবিন ই। যাকে ছোট করে বলে আই-জি-ই। ব্যাসোফিলের গায়ে আই-জি-ই লেগে থাকে দানার মতো। কোটি গুণ বড় করে দেখলে রসকদম্বের মতো দেখতে লাগবে। ব্যাসোফিল কোষের গায়ে লেগে থাকা গুঁড়োকে বলা হচ্ছে গ্র্যানিউল। কোনও বিশেষ প্রোটিন ওই গ্র্যানিউলগুলোকে খসিয়ে ফেলতে পারে। আর অ্যান্টিবডি মাত্রই হল প্রোটিন। ওই প্রোটিনের মাধ্যমে ব্যাসোফিলের গায়ে লেগে থাকা গ্র্যানিউল খসানোকে বলে ডিগ্র্যানিউলেশন। ড. বুভুনেস্কি এরপর বলছেন, অ্যান্টিবডির উপস্থিতি ছাড়াও ডিগ্র্যানিউলেশন হতে পারে। ধরা যাক, সামান্য একটু প্রোটিন অ্যান্টিবডি জলে গুলে ফেলা হল। পাওয়া গেল প্রোটিন দ্রবণ। এবার এই দ্রবণের এক ভাগের সঙ্গে নয় ভাগ জল মেশালে যে দ্রবণ তৈরি হবে, সেটা হবে প্রথমটার তুলনায় দশগুণ পাতলা। এবার এই দ্রবণের একভাগের সঙ্গে ন’ভাগ জল মেশালে তৈরি হল প্রথম দ্রবণের একশো গুণ পাতলা। এইভাবে ক্রমাগত পাতলা দ্রবণ করতে করতে একের পিঠে একশো কুড়িটা শূন্য বসালে যে বিশাল সংখ্যা পাওয়া যায়, তত গুণ পাতলা দ্রবণ তৈরি করা হল। এত পাতলা এই দ্রবণে মূল অ্যান্টিবডির আর অস্তিত্বই নেই। হারিয়ে যাওয়ার কথা। এক লিটার জলে একটি অ্যান্টিবডি অণুরও থাকার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু ড. বুভুনেস্কি দেখলেন ওই পাতলা দ্রবণও ব্যাসোফিলের দানা খসাচ্ছে। মানে শুধু জল, যে জলে একসময় ছিল প্রোটিন অ্যান্টিবডি, সেই জলে এখন তার ধূসর স্মৃতিটুকুই আছে। সেই স্মৃতিটুকুই কাজ করে যাচ্ছে। তবে কি জলের স্মৃতিশক্তি আছে?
কমলের শরীরের মধ্যে হাততালি বেজে উঠল। তাহলে আছে, আছে, আছে। হোমিওপ্যাথি তাহলে বুজরুকি নয়। এলাকায় একটা যুক্তিবাদী সমিতি হয়েছে। ওরা পোস্টারে লিখেছে, জ্যোতিষ-তান্ত্রিক-হোমিওপ্যাথ থেকে দূরে থাকুন। বলছে তাবিজ-কবচ-হোমিওপ্যাথি ওষুধ সব এক।
ওদের তাহলে জবাব দেবার মতো যুক্তি পাওয়া গেছে। যে প্রোটিন ব্যাসোফিলের গায়ের দানা ঝরিয়েছে, সেই প্রোটিনেরই কোটি কোটি গুণ পাতলা দ্রবণ, মানে একই কাজ করেছে। জলের মধ্যে আছে হাইড্রোজেন বন্ড। সেই বন্ডের মধ্যেই কোনও স্মৃতি লেগে থাকে নিশ্চয়ই। আর্সেনিক দুশো-র বা থুজা এক হাজারের মধ্যে একটাও আর্সেনিক বা থুজার অণু নেই। কিন্তু ওই দ্রবণের মধ্যে কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। হোমিওপ্যাথিক ওষুধ অ্যালকোহল আশ্রিত। অ্যালকোহলেও OH মূলক আছে। সুতরাং হাইড্রোজেন বন্ডও আছে। লেখাটা শেষ হয়নি। আরও পড়তে থাকে কমল। নেচারের ওই প্রবন্ধটা সাড়া ফেলেছিল সারা পৃথিবীতে। একটা সাংঘাতিক আবিষ্কার।
সত্যিই তো এতবড় একটা আবিষ্কারের কথা কমল জানতই না। কমল কেন, এদিককার তাবড়-তাবড় হোমিওপ্যাথ ডাক্তারদের কেউ কি জানত? কে-ই বা নেচার পড়েছে? এটা জানতে পারল কমল একজন বিজ্ঞান-সাংবাদিক এটা লিখলেন বলে।
শত্রুর অভাব থাকে না সারা পৃথিবীতে কোনওকালে। নেচার পত্রিকায় প্রতিবাদ আসতে লাগল বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। নেচার পত্রিকার সম্পাদক ড. বুভুনেস্কিকে বললেন বিশ্বের কয়েকজন জীবরসায়ন বিজ্ঞানীদের সামনে পরীক্ষাটা করে দেখাতে।
আবার পরীক্ষার পর পরীক্ষা হতে লাগল। তারপর নেচার পত্রিকা ছাপল তদন্ত রিপোর্ট। ওরা বললেন, ড. বুভুনেস্কি-র দাবি ঠিক নয়। আরও পরীক্ষার দরকার। ওরা বললেন, জলের কি তাহলে মাঝে মাঝে স্মৃতিভ্রংশ হয়? ড. বুভুনেস্কি বললেন, আমি প্রমাণ করে দেব আমি ঠিক।
এখনও প্রমাণিত হয়নি।
কিন্তু প্রমাণের অপেক্ষায় বসে আছে কমল। হ্যানিম্যানের পর কতগুলো প্রজন্ম কেটে গেল। কমলের জীবদ্দশায় যদি একটা ব্যাখ্যা মেলে তো নিস্তার পাওয়া যায়। মরে যাবার আগে জেনে যাওয়া যায় হোমিওপ্যাথি প্রতারণা নয়, প্লাসিবো নয়।
বসে আছি হে।
১৩
সকালবেলা থেকেই বেশ গরম। রুমা একবার বমি করল। কমল ভাবল, গরমের জন্য। একটু ক্যাম্ভর খেতে দিল। এরপর শ্বাসকষ্ট। পাশের ঘরে দরজা ধাক্কাতে লাগল কমল। পড়শিরা এল। নার্সিংহোম। অক্সিজেন এবং আইসিইউ। কয়েকটা ইনজেকশন লিখে দিল ডাক্তার। ইনজেকশন নিয়ে ছুটে এল কমল। কমল ও রুমার মাঝখানে একটা বড় কাচের দরজা। কমল কাচের এপাশে বসে আছে। এখন কি রুমার জ্ঞান আছে? ওকে কয়েকটা কথা বলার ছিল। কী কী বলার ছিল? ভাবতে লাগল কমল। প্রথমেই মনে এল ওই প্রবন্ধটার কথা। ড. বুভুনেস্কি। ওই প্রবন্ধটার কথা সহজ করে বলার ইচ্ছে রুমাকে।
ব্যস? এইটুকু?
সাদা পোশাকের নার্স কাচের ওপারে। হাতছানি দিয়ে ডাকল। কমল গেল। কাচের দরজাটা সামান্য ফাঁক করে সাদা পোশাক বলল, সিভিয়ার হার্ট অ্যাটাক। তারপর কিছুক্ষণ নীরবতার পর বলল, কিছু বলা যাচ্ছে না। ডাক্তাররা অ্যাটেন্ড করছেন। দরজার এপাশে চুপ করে বসে থাকা ছাড়া আর কী-ই বা করতে পারে কমল? পকেটে একটা মোবাইল ফোন আছে কমলের। বেশিদিন নেয়নি। নেবে না ভেবেছিল। কিন্তু শেষ অবধি নিয়েছে মাসখানেক হল। মোবাইলে সড়গড় নয় কমল। কাকে ফোন করবে? প্রথমেই ড. বুভুনেস্কির কথা মনে এল। পাগল? নিজেকেই বলে। আত্মীয়স্বজন—কাউকে বোধহয় ফোন করা উচিত। কিন্তু কিছু উৎসাহ বোধ করল না। আবার দরজার ওপাশে সাদা পোশাক। একটা টুকরো কাগজ বাড়িয়ে দিল। ইনজেকশন।
ইনজেকশন নিয়ে ছুটে এল কমল। কাচের দরজার সামনে দাঁড়ানো সাদা পোশাকের নারী বলল, সরি!
১৪
শূন্য ঘর। শূন্য বিছানা। বিছানায় স্মৃতি। শুধু স্মৃতি পড়ে থাকে। কমল ঘুমের ওষুধ খায়। কোনওদিন সকালে উঠে ঘুরতে বেরোয়, কোনওদিন বেরোয় না। ঘরেই থাকে। যে বাসন-টাসন-মাজে, সে-ই সামান্য কিছু রান্না করে দিয়ে যায়।
কমল রুগি দেখে, চেম্বারে যায়, জীবন তেমনই আছে। রুমার ছবি আছে দেওয়ালে।
রুমার কি কিছু বলার ছিল? কী বলার ছিল? ভালো থেকো সাবধানে থেকো শরীরের যত্ন নিও ছাড়া?
কমল আজ গঙ্গার ধারে বেড়াতে গেছে। জল। স্মৃতিময় জল। বাঁ-পাশে ঝুপড়ি। ওখানে জীবন। জীবনের জন্য যুদ্ধ। কমল আর জীবনকে ভোগ করে না তেমন। কিন্তু রুগি ভালো হলে ভালো লাগে শুধু। এই ভালো হওয়াটা কি সত্যিই ওষুধের গুণে? কীভাবে কাজ করে হোমিওপ্যাথি? ঠিকমতো জানা গেলে বেঁচে থাকার একটা সুখ পাওয়া যেত। জোর দিয়ে বলতে পারত আমি ঠিকমতো ওষুধ চয়ন করেছি, এবং একজন মানুষের অসুখ ভালো করেছি। বিষে বিষক্ষয় জাতীয় তত্ব যথেষ্ট নয়। সেই কবে হিপোক্রাটিস লক্ষ করেছিলেন কিছু ভেষজের মানবদেহের ওপর ক্রিয়ার সঙ্গে কয়েকটা রোগের লক্ষণ মিলে যায়। সুস্থ মানুষকে কাঁচা সিঙ্কোনা খাওয়ালে কম্প দিয়ে জ্বর হয়, আবার হ্যানিম্যান দেখলেন কম্প দেওয়া জ্বরের রুগিকে অল্পমাত্রায় সিঙ্কোনা প্রয়োগ করলে সেই উপসর্গ প্রশমিত হয়। কিন্তু ডাইলিউশন তত্ব? দ্রবণ যত পাতলা হবে—ওষুধের শক্তি তত বেড়ে যাবে? এমনকী এক লিটারে একটাও সেই ভেষজের অণু নেই, অথচ সেটাও ওষুধ। নিরাময়কারী ওষুধ।
ড. বুভুনেস্কি, তোমার পরীক্ষার যেন জয় হয়। ওটা দেখে যাবার জন্যই আমার বাঁচা।
ছিটকে গেল কমল। একটা মোটরবাইক ধাক্কা মেরেছে কমলকে। কমল অন্যমনস্ক ছিল। অন্যমনস্কই থাকে আজকাল। মুখ থুবড়ে পড়ল। হাতটা ছেঁচড়ে গেল। মাথায় হাত দিল। হাতে রক্ত নেই মনে হল। কয়েকজন লোক জড়ো হল। অনেকের মধ্যে ঝর্ণা আর আমিনুলও আছে। ঝর্ণাই যেন হাত ধরে টেনে তুলল। বলল, আমাদের ডাক্তারবাবু যে। জলের ঝাপটা দিল লোকজন। একটা অটোরিকশাও জোগাড় হয়ে গেল। ঝর্ণা আর আমিনুল বসল দুপাশে। অনেকবার ঝর্ণা জিজ্ঞাসা করল, কোথায় লেগেছে কাকু।
বাড়িতে উঠিয়ে দিল ওরা। ঝর্ণা বলল, কাকিমা নেই?
কমল ঘাড় নাড়ল। দেওয়ালে রুমার ছবি। কমল একটু আর্ণিকা খেয়ে নিল। ডেটল আর তুলো বার করল। ঝর্ণা হাতের কনুই, চেটো, থুতনিতে লাগিয়ে দিল।
ঝর্ণা বলল, আজ আমি আপনাকে ফেলে কাজে যাব না।
কমল বলল, তোমার কিছু চিন্তা করতে হবে না। কাজের লোক আসবে। কমল ঘড়ি দেখল। ওর আসার সময় পার হয়ে গেছে। কমল অনুভব করল, ওর মাথাটা খুব ব্যথা করছে। কমল শুয়ে পড়ল। মাথার ভিতরে চোট লাগেনি তো? কোনও ইন্টারনাল হেমারেজ? ইতিমধ্যে বাসনের ঝুনঝুন শুনতে পাচ্ছে কমল। ঝর্ণা তাহলে বাসন মাজছে। একটু পর ঝর্ণা এসে বলল, চা খাবেন কাকু?
কমল বলল, করে দাও।
১৫
ঝর্ণা সারাদিন ছিল। তারপর দিন সকালে বেরিয়ে গেল। সন্ধ্যার সময় এল না। কমল চেম্বারে না গিয়ে গঙ্গার ধারের ঝুপড়ির দিকে গেল। ঝর্ণার খোঁজ করল। শুনল, ঝর্ণা একটা বাজে মেয়েছেলে। একজন পুরুষমানুষের সঙ্গে ফস্টিনস্টি আছে। ওর সঙ্গে কোথাও ভেগে গেছে।
বাড়ি ফিরল কমল। বাড়িতে আমিনুল। মাথার ব্যথাটা আর নেই। তবে কি আর্ণিকাতেই কাজ হল?
কমল বলল, তোর মা যদি না ফেরে?
আমিনুল বলল, তোমার কাছেই থাকব। আমাকে রাখবে?
তোর মা কোথায় যেতে পারে বল তো?
আমিনুল শুধু শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
ঝর্ণা ফিরবে কিনা কমল জানে না। আমিনুল কে, কমল জানে না। হতে পারে ওই আমিনুলই সেজদার স্মৃতি। আমিনুলকে স্নান করিয়েছে। সাবান মাখিয়েছে। ডাল ভাত ডিম আলুসিদ্ধ দিয়ে ভাত খাইয়েছে। আলাদা বিছানা নয়, নিজের বিছানাতেই শোয়াল কমল।
ছেলেটা ঘুমোচ্ছে। পাশের খোলা জায়গায় বড় বাড়িটা ওঠার আগে চাঁদের ফালি এসে বিছানায় এমনই ঘুমোত।
এখনও ঘুমোচ্ছে। আমিনুল। চাঁদের স্মৃতি। চাঁদ নেই। স্মৃতি আছে। জলের ভিতরকার অন্তর্গত স্মৃতির মতো। ওষুধের ভিতরে থাকা অজানা ওষুধের মতো। না-ই বা জানল ওর পিতৃপরিচয়।