ডাক্তার, বিশেষণহীন

ডাক্তার, বিশেষণহীন

ধর্মপিতা

কলমির ডগাগুলো লকলকাচ্ছে। নতুন পানি যেন নতুন ভাতারের সোহাগ। বর্ষা পেয়েই সেজে উঠেছে চারদিক। পুকুরে শাপলা, গেঁড়ি-গুগলি গুলগুল। ব্যাঙের ফুর্তি, কচুগাছ নতুন নতুন নতি ছাড়ছে ভুঁইয়ে। জুঁই ফুটছে। এগুলোকেই তো পোকিতি বলে। কী সোন্দর! সবই তেঁনার রহমত। কুঁচো চিংড়ি ধরে এনেছে গুণের দ্যাওর ওর ছাঁকি জালে। চিংড়ি যদি হল তবে একটু কলমির জোগাড় কোত্তি হয়। কলমি তো চোখের সামনেই। সায়িদা একটু কলমির জোগাড়ে পুকুরপাড়ে দাঁড়ায়। শাপলার ডগা দিয়ি চিংড়ি রাঁধলেও খুব স্বাদের হয়। এই রোজার মাসে রাতের বেলা একটু ভালোমন্দ রেঁধি দিতি ইচ্ছে হয়। বাড়িতে তিনজন রোজা-রাখা ব্যাটাছেলে। এ-বছর সায়িদা রোজা রাখেনি। সবাই নিষেধ করল। এ সময় রোজার দরকার নেই। মৌলবি সাহেব কয়ে দিয়েছেন যে গর্ভবতী নারীর জন্য নিয়ম হল গায়ে বল আর শরীরে জোর থাকলি ছয় মাসের গভ্ভকাল পর্যন্ত রোজা রাখা যায়। এরপর দয়ালু আল্লাহ রোজা মকুব করে দিয়েছেন। সায়িদার এখন আটমাসের গভ্ভ। আর ক’দিন পরই কোল ভরবে গো…। পুকুরে নেমে একটু সাঁতার দিতে ইচ্ছে যায়। জলপিপিগুলো কেমন সাঁতরাচ্ছে দেখো। কতদিন হয়ে গেল সাঁতার দেওয়া হয়নি। বৃষ্টির মধ্যে সাঁতার দিতে কী মজা! সেই ছেলেবেলায় হত। গুঁড়িগুঁড়ি একটু বৃষ্টি নামল আবার। ইলশেগুঁড়ি। ইলিশ মাছ কী ভালোটাই না লাগত! এই পোয়াতিবেলায় ওই গন্ধটা সহ্য হয় না। সেদিন এনিছিল খেতি ইচ্ছে করছে না। ঘরে গিয়ে আবার তো সেই আন্নাঘর। ওদিকে সুয্যি হেলে গেছে। সেই পশ্চিমে, যেদিকে কাবা-মক্কা। আর দেরি করলি চলবে না। আজকের ইফতারে খাজুর, আম, বেসনে ডুবোয়ে আলুভাজা, পরোটা, বুটের ডাল। লতু একটু ভাত পছন্দ করে। লতু মানে লতিফ। লতিফ মানে হ্যাজব্যান। হ্যাজবেনের নাম ধরে ডাকতি নেই। বাড়িতে তো ডাকে না। বাইরে লতু ডাকে, ডাল্লিংও ডাকে আস্তে আস্তে। লতুও। লতু ওর চেয়ে সাত বছরের বড়। ওর যখন বে’ হয়েছিল, তখন ওর বয়েস ছিল সতেরো। চার বছর আগে বে’ হয়েছে। যদি আজকের দিন হত, তবে ঠিক আরও একবছর-দুবছর পরে বে’ বসত। কন্যাশ্রীতে কতকগুলো টাকা পাওয়া যেত। ইস্কুলটাও ছাড়ত না। ইস্কুলে এইট অব্দি পড়েছে। এইট অব্দি তো পাশ-ফেল নেই।

শাশুড়ির ইন্তেকাল হয়ে গেল এক বছর আগে। কেবল পান-দোক্তা খেত। টিভিতে দেখায় তো পান দোক্তায় কী হয়! তেনারও তাই হয়েছিল। মেলা টাকা খরচ হয়ে গেল। এখন সংসারের ভার পড়েছে ওর ওপর। দেওরের বয়েস এখন তেইশ-চব্বিশ হবে। ওর যদ্দিন বে’ না হচ্ছে, তদ্দিন কুনও সুরাহা নেই। এই রমজান মাস শেষ হতে আরও সাত দিন। রমজান শেষ হলে ইদ। এবার রথ আর ইদ একদিনে হবে, যদি চাঁদরাতে চাঁদ দেখা যায়। জগৎপুরের রথের মেলায় যাওয়া হবে সেজেগুজে। এই পেট নিয়ে যেতে দেবে না? তাহলে? ইদ আর রথের মেলা একই দিনে আবার কবে হবে? সামনের বার ইদ আরও ক’দিন আগে হয়ে যাবে। তখন কোল আলো করা ছালো। ইদের জামা গায়ে পরিয়ে কপালে নজর না-লাগা কালো টিপ পরিয়ে মেলায় যাওয়া যাবে। না, আর টাইম নষ্ট করা যাবে নি। ‘সময় বহিয়া যায় নদীর স্রোতের প্রায়।’ কত কাজ। ইফতারের জোগাড় করা, রাত দশটা নাগাদ ওরা খেতে বসে। রাত সাড়ে তিনটের সময় আবার শেহরি খাওয়ার জন্য গরম ভাত রেঁধে দেয়া। এখন যা তরকারি করে রাখবে, তা দিয়ে রাতের খাওয়াও হবে, শেহরিও হবে। বুটের ডাল তো আছেই, ডিমের ডালনা আর কলমি-শুষনির ঝোল। লতু আগে ভ্যান চালাত। এখন অটো চালায়। কদমগাছি-জাগুলে। লোন করে কেনা। দেওর বাবাজিকে ভ্যানটা দিয়েছিল চালাবার জন্য, উনি আবার নিজে ভ্যান চালাবে নি। পেস্টিজ। ভ্যান ভাড়া দেয়। মোবাইলে টাকা ভরার দোকান দিয়েছে ছোট, আর একজন নেতাবাবুর শাকরেদি করে, তা বাদে তাজ স্পোর্টিং কেলাবের কেউটে, হিহি, কেউকেটা। ও-ই তো মোবাইলে গান ভরে দেয়। ওর নাম শাকুর। একটুর জন্য শারুক হল না। ও শারুক খাঁ-এর ফ্যান। সায়িদাও তাই। বাড়িতে ভিসিডি চালিয়ে দেখা হয়। দিলওয়ালে দেখা হল পরশুদিন। শ্বশুরমশাই দেখেও দেখে না। যখন ঝাড়পিট চলে, কিংবা মেয়েরা নাচে, কিংবা মদ খায়, শ্বশুরমশাই টেরিয়ে দেখে আর বিড়বিড় করে—কেয়ামত ইবার আসবেই আর দেরি নাই, সব আলামত দেখা যাচ্ছে। কান পেতি আছি কবে ইস্রাফিলের শিঙার আওয়াজ শুনব। উনি মানুষটা ভালো, কিন্তু একটু খ্যাপা খ্যাপা। সামান্য একটু জমি-জিরেত আছে, সেটাই দেখাশুনো করে। ভিটের পিছনের ডাঙ্গা জমিতে সবজি চাষ। শীতে কপি-মুলো, গরমে বেগুন-ঢেঁড়স, কুমড়ো। পটলের চাষ কক্ষুনো করে না। ওই যে বলে না, পটল তোলা? মানে তো মরে যাওয়া, ওই জন্য। খ্যাপা লোক আর কাকে বলে! শ্বশুরমশাইয়ের একটা মোটা খাতা আছে। ওর মধ্যে নিজে নিজে কীসব লেখে। খাতাটা আবার কুলঙ্গিতে কোরানের পাশে রাখে। তবে এক ঢাকায় ঢাকা রাখে না। কোরান লাল ভেলভেটের কাপড়ে ঢাকা, আর ওই খাতা সাদা কাপড়ে। শাশুড়ি আম্মা লতাপাতা নকশা করে মাঝখানে ৭৮৬ লিখে দিয়েছিলেন সুতোয় সুতোয়। ওর’ম দুটো আছে। কতবার পড়ে শুনিয়েছেন। যেমন—

আকাশভরা সূর্যতারা

বিশ্বভরা প্রাণ

যার হুকুমে চলে তিনিই

আল্লা মেহেরবান।

আকাশভরা সূর্যতারা তো রেডিয়ো-টিভিতে হয় খুব। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরের লাইনটা আব্বুজির পছন্দ না। নিজের মতো করে লিখেছেন। অন্যরকমও আছে। এতবার পড়েছেন যে প্রায় মুখস্থই।

এই আসে কেয়ামত, হও সাবধান

মোমেন চেষ্টা কর রাখিতে ইমান।

বেহায়া হয়েছি মোরা আদম সন্তান

স্কন্ধে চাপিয়াছে ইবলিশ শয়তান

শয়তান সঙ্গে লয়ে করি যে আমোদ

হারামের দিকে চলি, ঘরে ঘরে মদ

নারীরা পুরুষ হয়, পুরুষেরা নারী

কেয়ামত আসিবেই খুব তাড়াতাড়ি

এক চক্ষু দজ্জাল হয়েছেন রাজা

ভেড়া করে দিয়েছেন লাখ লাখ প্রজা

ফেরেস্তা বধির হল নাহি শুনে কথা

ইবলিশ এসে বলে, কহ মন ব্যথা।

ফুলেতে খুসবু নাই দুধে নাই সর।

বর্ষায় বৃষ্টি নাই নদীখাতে চর।

ডাবে দেখ পানি নাই, গুড়ে না মিষ্টি।

আল্লাহতালা এইসব ধ্বংসিবে সৃষ্টি।

সব আলামত দেখি, যা আছে কিতাবে।

হে আল্লাহ, তৌফিক দেন সহিব কেমনে

আকাশ ফাটিয়া যাবে, নামিবে আগুন।

তথাপি আলম দার দিয়েছে ফাগুন।

আরও আছে অনেকটা। বলছে কেয়ামত যখন আসবে তখন আসবে, কিছু করার নেই। ততদিন শুদ্ধ মনে, ইমান রেখে এইসব এনজয় করো। ফাল্গুন, আমবকুল, কদমফুল, সব। খ্যাপাটে, সলমানের কী একটা সিনেমায় ছিল না। যো হোগা দেখ লেঙ্গে। ডরনা নেহি। ওই কোরানটা কিংবা এই খাতাটা ধরার অধিকার সায়িদার কেন, কারুর নেই। আব্বাজি যখন খাতাটায় লেখেন কিছু তার আগে একটু অজু করে নেন, কুলি করে নেন। আবার একাদশীর দিন উপোস থাকেন। এই উপোস রোজা রাখার মতো না। সন্ধের পর ইফতারির মতো খেয়ে নেন। নিরামিষ। শেহরি লাগে না। এতে নাকি বাত ভালো থাকে। রান্না ভালো হলে বলে, খুব স্বাদের হয়েছে, আলহামদুল্লিহ। এর মানে হল প্রশংসা আল্লার প্রাপ্য। সায়িদা ভাবে রান্না করলাম আমি, প্রশংসা আল্লার। আজও ওরকম আলহামদুল্লিহ বলবে। জম্পেশ করে হবে চিংড়ি-কলমি। শুষনি কলমি ল’ ল’ করে। রাজার বেটি পক্ষী মারে…। পুকুরপাড়ে নেমে নীচু হয়ে ছিঁড়ল কয়েক গাছা। কোঁচড়ে ভরল। আরও ক’টা। এবার আর না। ভরা পেটে পিছলে পড়লে বিপদ। পা-টা সুড়সুড় করে উঠল। কেঁচো? কী একটা সড়সড় করে চলে গেল। বেজি? পায়ে টনটন ভাব। দু-পা হাঁটার পর রক্ত। ব্যথাটা ওপরের দিকে উঠছে। গোড়ালির একটু ওপর থেকে রক্ত পড়ছে। ছুটল বাড়ির দিকে। তবু কোঁচড় ছাড়েনি। মাথা শিরশির করে উঠল। সাপ? সাপ কেটেছে, গাছপালা ঘুরছে। গোধূলির আলো অন্ধকার। কলমি শুষনি ল’ ল’ করে। রাজার ব্যাটা পক্ষী মারে। উড়ল পক্ষী পড়ল বাজ। রাজার বেটি মরল আজ।

কখন ভুঁইয়ে পড়ে গেছে, সায়িদা জানে না।

দুই

বাড়িতে তখন সায়িদার শ্বশুর-শাশুড়ি ছাড়া কেউ ছিল না। একটা মোবাইল ছিল ঘরে, ওটা শাকুরের পুরোনোটা, সায়িদাকে দিয়ে দিয়েছে। কেউ মোবাইল চালাতে জানে না। খলিলা বিবি হে আল্লা বলে চেঁচায়। কাদের মিঞা ছুটে যায় ইমাম সাহেবের কাছে। ওদের বাড়ি থেকে পুকুরটা পিছনের দরজা দিয়ে কাছেই। তিন মিনিটের পথ। কিন্তু বাড়ি পর্যন্ত আসতে পারেনি সায়িদা। ওকে এইভাবে আসতে দেখে একটি বালিকা খবরটা দেয়। তোমাদের বাড়ির বউ পড়ে গেছে, কাতরাচ্ছে। তখনই ছুটে যায় মেয়েটা। ওর কাকুদের খোঁজ করে। সব কাকুরাই তখন যে যার কাজে। কাছের মাঠে কাজ-করা দুজন ছুটে এল। দেখেই বলল—সাপে কেটেছে। ওঝা ডাকতি হবে। নিবারণ ওঝা! নিবারণ ওঝা! একজন বলে। এক সদ্য গোঁফ-ওঠা বালক বলে, ওঝা কী করবে! সাপে কেটেছে তো হাসপাতালে নে’ চলো। শাকুরচাচা, লফিতচাচাকে খবর দিতে হবে। ফোন আছে? ছুটে গিয়ে মোবাইলটা নিয়ে আসে খলিলা। ফোনটা চালুই আছে। নম্বর? নম্বর তো জানা নেই। কে জানে নম্বর? যে পাঁচ-ছ’জন ছিল তাঁদের মধ্যে দু’জন বাদে সবাই বালক-বালিকা। ছেলেটি মোবাইল নিয়ে লতিফের নাম খোঁজে। লতিফ বলে কোনও নাম সেভ করা নেই। আগে এটা শাকুরের যখন ছিল দাদা বলে সেভ ছিল। সায়িদা ওটা কবে এডিট করে শাহরুক করে রেখেছে—বালক জানে না। আব্বাজান বলে যেটা সেভ আছে সেটা নিশ্চয়ই এই ভাবির বাবা। বাবাকেই জানিয়ে দেবে? তার আগে শাকুরভাই সেভ আছে কি না দেখতে লাগল। খলিলা বিবি উবু হয়ে সায়িদার কানের কাছে মুখ নিয়ে চেঁচাল, অ মেয়ে, লতিফের লম্বরটা বল ও রে বল। কথা ক’…।

সাদিয়ার ঠোঁট কেঁপে ওঠে।

কয়েকজন উল্লাসে বলে, জ্ঞান আছে, জ্ঞান আছে।

একটি বালক বলে সাইকেল নিয়ে বড় রাস্তায় চলে যাই, লতিফচাচার খোঁজ পেয়ে যাব। বালকটি শাকুরের নম্বর পেয়ে গেল। এবং ব্যাপারটা জানাল।

সায়িদা তখনও ভুঁইয়ে। ঘরে নেওয়া দরকার মনে হল খলিলার। কিন্তু এই বাচ্চারা কি পারবে? দু’হাত দুজন, দু’পা দুজন…। মাঠের কাজ করা দুই জোয়ান ব্যাটাছেলে সামনেই আছে। সায়িদার বুকের কাপড় ঠিক করে দেয়। হোক পরপুরুষ, তবু বলে, বউকে ঘরে নেব বাবা, দুজনে পা দুটো ধরো, আমরা হাত ধরি। ওদের একজন বলে, এভাবে হয় নাকি! একটা বিছানার চাদর নে’ আসুন না। ওটাই শুইয়ে চারজন চারকোনা ধরতি হবে। পোড়ারমুখো মিনসে এসব না করি গেছে ইমাম ডাকতে। কী মানুষ নিয়ি ঘর করতি পাঠালে আল্লা…বিড়বিড় করতে করতে বিছানার চাদর নিয়ে আসে। ঘরে শুইয়ে দিয়ে বালকটি পায়ের দংশনের জায়গাটা দেখে। কইতে থাকে দুটো দাগ হবে বিষাক্ত, অনেকগুলি দাঁতের দাগ হলে বিষহীন। কিন্তু এই পায়ে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। গোড়ালির একটু ওপরে ছোবলটা পড়েছে। রক্ত এখনও গড়াচ্ছে। জল দিয়ে রক্তটা পরিষ্কার করে কিন্তু একাধিক দাগ দেখতে পায়। তবে কি নির্বিষ সাপই কামড়েছে? অনেক সময় ভয়েও এমন হয়। সবার আগে যেটা দরকার, একটা পাটের দড়ি জোগাড় করে ক্ষতস্থানের ফুটখানেক ওপরে বেঁধে দেয়। ইতিমধ্যে আরও লোকজন চলে এসেছে। বউ-ঝিরাও। শোরগোল শুরু হয়। কেউ বলে জাগিয়ে রাখতে হবে, ঘুমোলেই বিপদ, চিমটি কাটো, কেউ চোখের পাতা টেনে তোলে। একজন একটা শুকনো লঙ্কা দেশলাই জ্বেলে পুড়িয়ে নাকের সামনে ধরে। সায়িদা মুখ নাড়ায়, ওই তো, ওই তো জ্ঞান আছে। কেউ চামচ দিয়ে জল খাওয়ায়। কেউ বলে—এত রক্ত পড়ছে যখন রক্তবোড়া। কেউ বলল ভুসোবোড়াও হতি পারে। একজন বলল ভুসো বোড়ায় এত রক্ত বেরয়? অন্য কেউ বলল—শামুক ভাঙাই হবে। পুকুরের দিকি গেছিল যে কালে…। একজন বলল ওঝা ডাকতি গেছে কেউ? ইতিমধ্যে গৃতকর্তা কাদের মিয়া এসে গেছে। সঙ্গে ইমাম সাহেব। ইমাম সাহেবের বাইক আছে। বাইকের পিছনে কাদের। কাদের প্রথমেই বলে, আছে তো, বেঁচি আছে তো?

আছে আছে আছে…।

ইমাম সাহেব মৌলবিও বটেন। মুখে লম্বা নুর, গোঁফ কামানো, পাজামা গোড়ালির ইঞ্চি খানেক ওপরে। মাথায় টুপি। বললেন বারান্দা থেকে সরো সব্বাই, ফাঁকা করো। ওদের বাড়ির সামনে বারান্দা। বারান্দায় গ্রিল লাগানোর ফ্রেম হয়েছে, কিন্তু গ্রিল বসেনি। তিনটে রুম, বারান্দাটা কেটে একপাশে রসুইঘর। টিনের ছাদ, ইটের দেওয়াল, পাকা মেঝে।

ইমাম সাহেব দোয়া পড়লেন। তারপর কাদেরকে বললেন মিঞা, দোয়া মাছুরা জানা আছে? জানা থাকলি পড়ো। কাদের পড়ল। এর মানে হে আল্লাহ, যে মৃত্যুমুখে পড়ে আছে তাকে ক্ষমা করো। মাছুরা পড়তে বলল কেন? ও কি তবে মরণাপন্ন? কাদের দোয়াপড়ার পর পুত্রবধূর ক্ষতস্থানে ফুঁ দিল।

ইমাম বলল, তুমি ফুঁ মারার কেডা? আল্লাহর কাছে দোয়া করেছ উনি যা করার করবেন। এইসব মুশরিকি করতি কে বলছে? আমি কখনও পানিপড়া তেলপড়া দিই না।

আমার কাজ আমরা করলাম এবার তোমার কাজ করো। হাসপাতালে যাও। ওঝাদের মন্তরে কিছু হয় না। এবার মোটরসাইকেল নিয়ে শাকুর চলে আসে। সায়িদার দেওর। আরও দুটো বাইক। পাঁচ-ছ’জন যুবক। ওরা তাজ স্পোর্টিং ক্লাবের। শাকুর পরিস্থিতিটা একবার দেখে নিল। কাকে যেন ফোনে বলে দিল ভাবিকে নিয়ে বারাসত সদর হাসপাতালে যাচ্ছি। একটু এমএলএ-কে বলুন ওই হাসপাতালে বলে দিতে, আমরা ওর লোক। যেন ঠিকঠাক হয়। যে যুবকগুলি এসেছে, সবাই ওদের মোবাইল নিয়ে বিভিন্নরকমভাবে ব্যস্ত। কেউ বলল, অ্যাই শালা বুচু, তোর অ্যাম্বুলেন্স কী হল! একজন মোবাইল বাগিয়ে শুয়ে থাকা সায়িদার ছবি তুলল। শাকুর ধমকাল—আর কতক্ষণ? রিজার্ভ যাবার দিন পেলি না। শাকুর বলল, রিজার্ভ নিয়ে যোগীর হাট গেছিল। ও আসছে। নয়াগ্রাম পৌঁছে গেছে, আর পাঁচ-সাত মিনিট। অ্যাম্বুলেন্স না এলে অটো করেই নিয়ে যাব। আমাদের ক্লাবে একটা অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করবই করব। টাকির দুটো অ্যাম্বুলেন্স। একটা খারাপ, অন্যটায় পেশেন্ট। হে আল্লা হে রব হে দয়াল ইত্যাদি অস্ফুট শব্দপুঞ্জর ভিতর লতিফ ঘরে ঢোকে। শাকুর বলে, কোনও কথা নয়। বারাসত। পিছন পিছন তিন-চারটে বাইক।

তিন

বারাসতে এভিএস মানে অ্যান্টিভেনাম সিরাম ছিল। একজন ডাক্তার বলল, ভালোরকমই বিষ ঢেলেছে। যতদূর মনে হয় বোড়া জাতীয় সাপ। চন্দ্রবোড়াও হতে পারে।

এধার থেকে একটা আওয়াজ এল—আমি তো আগেই বলে দিয়েছিলাম চন্দ্রবোড়াই হবে। ডাক্তার আবার বলল—একটা কথা বলার ছিল। আগে মা বাঁচুক, পরে সন্তান, আমরা এই লাইনে এগোচ্ছি।

লতিফ বলল, না-না, বিয়ের বাচ্চাও চাই, চার বছর পর।

কে একজন বলল—বাচ্চা নষ্ট করা চলবে না বলে দিলাম। যেভাবেই হোক দুজনকেই বাঁচাতে হবে। আমরা কিন্তু ননীদার লোক। কেউ ফোন করেনি?

ডাক্তার জিজ্ঞাসা করল, ননীদা কে?

—ননীদাকে চেনেন না? ক’বছর বারাসতে চাকরি করছেন?

ডাক্তার বললেন, সরি। চিনি না। কেউ ফোন করুক আর না করুক, আমরা সবরকমভাবে চেষ্টা করব যেন দুজনই বাঁচে। আপনারা ভিতরে ভিড় করবেন না। বাইরে গিয়ে বসুন। পেশেন্টকে অক্সিজেন দেওয়া হয়েছে। একটু পরেই এভিএস দিয়ে দেব।

এভিএসটা কী? একজন জিজ্ঞাসা করল। ডাক্তারবাবু বললেন, পরে বলে দেব।

বাইরে সাত-আটজন। বাড়িতে বাপ-মা। ফোনে খবর দিচ্ছে। ওরা ফোন এলে কোনটা টিপে কথা বলতে হয়, আর কোনটা টিপে কথা বন্ধ করতে হয়, তা জানে। ফোনে জানিয়ে দিচ্ছে ওরা। সদ্য গোঁফ ওঠা তরুণ ছেলেটির নাম হায়দার। ও স্কুলে হায়দার আলি নামে নথিবদ্ধ হলেও বাংলাদেশি কায়দায় ও নিজের নাম লেখে হায়দার বিক্রম। আরবিতে হায়দার মানে সিংহ। স্কুলে ওকে অনেকে বিক্রম নামেও ডাকে। ও বলল এভিএসটা কি জিনিস বলব? ওটা হল একটা জানোয়ারের শরীরে অল্প করে সাপের বিষ ঢোকানো হয়। এই বিষকে বলে ভেনাম। এবার সেই জানোয়ারের রক্তের ভিতরেই ওই বিষের সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাকে। তারপর শরীরই কতকগুলো উপাদান তৈরি করে নেয়, যা বিষের দোষগুলো কাটাতে পারে। সেই রক্তরসকে বলে অ্যান্টিভেনাম সিরাম। রক্তরসকে ইংরেজিতে বলে সিরাম।

কে একজন বলল, শুয়োরের রক্ত দেয় না তো?

ওর থুতনিতে দাড়ি।

হায়দার বলে, না না, শুয়োরের না। ঘোড়ার কিংবা ভেড়ার।

লোকটা বলে, তবে ঠিক আছে।

হায়দার লেখাপড়ায় ভালো। সায়িদাদের প্রতিবেশী। স্কুলে ফার্স্ট-সেকেন্ড হয়।

যে ডাক্তারটি চিকিৎসার দায়িত্বে, ওর বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। গ্রামের হাসপাতালে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। সাপে কাটা রোগীও পেয়েছেন বেশ কিছু। পুরুষ, বৃদ্ধা, বালিকা, এরকম আটমাসের গর্ভবতী পাননি। গর্ভবতী মহিলাকে এভিএস দিলে কী পরিণতি হতে পারে, এ নিয়ে দুজন সিনিয়ার ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলছিলেন। একজন বলেছিলেন—গর্ভবতীদের ভ্যাকসিন দেওয়া যায়, কিন্তু সিরাম দিলে বাচ্চাটার অ্যানাফিলেকটিক শক হয়ে যেতে পারে। অন্যজন বলল—দেওয়া যেতেই পারে। তবে রোগী যদি স্টেডি থাকে, তাহলে সিন্টো চার্চ করে আগে বাচ্চাটা ডেলিভারি করে নেওয়াই ভালো। সিন্টোসিনন একটা ড্রাগ। এটা শরীরে ঢুকিয়ে দিলে প্রসব বেদনা হয়। এবং প্রসবও হয়ে যায়। সিন্টোসিননকে ডাক্তারবাবু ছোট করে সিন্টো বলে। ডাক্তারবাবুটি সংকটে পড়েন। উভয় সংকট। রোগীকে এখনও দু-তিন ঘণ্টা এভিএস না দিয়ে প্রসব করানো কি ঠিক হবে? ইতিমধ্যেই ঘণ্টা তিনেক কেটে গেছে।

ডাক্তারটির নাম সুবিমল আচার্য। একটু ধার্মিক প্রকৃতির লোক। ঠাকুর-দেবতায় আস্থা আছে। গায়ত্রী মন্ত্র জপ করতে করতে সিরিঞ্জে করে স্যালাইনের বোতলে এভিএস ঠুসে দিলেন। এবার এভিএস মেশানো স্যালাইন মেয়েটার শরীরে ঢুকছে। দুর্গা দুর্গা। যেন ভালো হয়ে যায়। বাইরের সব সুবিধের নয়। ডাক্তাররা প্রায়ই মারধর খাচ্ছে।

রাত্তির দশটা নাগাদ ডাক্তার আচার্য বের হলেন। শাকুর বলল, কী ডাক্তারবাবু, বাড়ি যাচ্ছেন? ডাক্তার আচার্য বললেন, হ্যাঁ, সকাল সাড়ে ন’টায় এসেছিলাম। যখন ফিরব, তখনই তো এই পেশেন্ট এল।

—রাত্তিরে কিন্তু এধার-ওধার হলে?

—অন্য ডাক্তারবাবুরা আছেন। সব বলা আছে। সেরকম হলে ওরা আমাকে ফোন করবে।

—আপনার ফোন নম্বরটা দিয়ে যান। কড়া গলায় প্রায় হুকুম।

আচার্য মুহূর্তের জন্য ভাবলেন নম্বর দেবেন কি না। দেব না বলা যাবে না। ভুল নম্বর দিয়ে দেবেন? সেই ভুল নম্বরে যদি এখনই আবার করে? ঠিক নম্বরটাই দিলেন। লতিফ বলল, বাচ্চাটাকে ঠিকঠাক পাব তো ডাক্তারবাবু? ওর কণ্ঠে অসহায়তা, মিনতিও। বলল—চার বছর বিয়ে হয়েছে ডাক্তারবাবু, বাচ্চা হয়নি, সেই তেহট্টে গিয়ে পিরের পুকুরে চান করিয়ে আনলাম, তারপর…।

সুবিমল বলল, সবই ওপরওয়ালার হাত।

রাত্রে শাকুর আর লতিফ হাসপাতালে ছিল, বাকি সবাই ফিরে গেল বাড়ি। মাঝে দু’বার ওপরে দেখতে গিয়েছিল। সায়িদা শুয়ে আছে। নাকে অক্সিজেন, হাত দিয়ে ঢুকছে উপুড় করা বোতলের স্যালাইন। নার্সদের ঘরে ঘুমন্ত নার্স। শাকুর বলল আমাদের রোগী কেমন আছে? নার্স বলল, ভালো ভালো।

ভোরবেলা দু ভাই বাড়ি গেল, ফিরল সকালবেলার কাজকর্ম করে ঘণ্টা তিনেকের মধ্যে। খোঁজ নিতে গেল। শুনল, কন্ডিশন একইরকম।

একইরকম কেন? এতক্ষণে তো কিছুটা ভালো হয়ে যাবার কথা। ডাক্তারবাবু কোথায়? রাত্তিরের ডিউটির ডাক্তার রাউন্ডে ছিল। সে এল। শাকুর বলল, কালকের ডাক্তারবাবু কোথায়? এই ডাক্তার বলল—ওনার এখন ডিউটি নেই।

ডিউটি নেই বললেই হল?

ফোন লাগাল শাকুর।

—কী হল? কাল রাত্রে নার্স বলল ভালো। অথচ এখনও চোখ চায়নি।

—…………

—তো, আপনি কখন আসবেন?

—………..

—ওসব ডিউটি ফিউটি রাখুন তো, একটা সাপে কাটা পেশেন্ট। অথচ…

—………..

—এই জন্য, অ্যাই জন্য হাসপাতাল টাসপাতাল ভাঙচুর হয়। যদি কিছু হয়ে যায়….

—……….

—শালা ডাক্তার ফোনটা ছেড়ে দিল।

শাকুর অন্যদের বলল।

কেউ একজন বলল, নাড়ুদাকে একটা ফোন লাগাই। অন্য একজন বলল—ননীদাকে বলা আছে না? ননীদা নিশ্চয়ই অ্যাকশন নেয়নি। নইলে পিকচার আলাদা হত। কাউকে বিশ্বাস নেই শালা।

এমন সময় ওদের ভিতরে ডাকল। যে-কোনও দুজন আসবেন।

সকালে যে ডাক্তার ছিলেন উনি বললেন, আমরা রেফার করে দিচ্ছি, মেডিকেল কলেজে নিয়ে যান। আমরা যা করার করে দিয়েছি। এখন এখানে রাখায় বিপদ আছে। ডায়ালিসিসের দরকার হতে পারে। ভেন্টিলেশনও। সমবেত লোকজনের একজন বলল—এখানে তো জানালা-টানালা ভালোই আছে…। ভেন্টিলেশন বলতে ওরা তো এটুকুই বোঝে।

লতিফ বলে—অবস্থা কি ভালো নয়?

ডাক্তারবাবু বলেন—ভালো বলা যায় না। খুব খারাপও নয়। যে বিষটা ঢুকেছে, এটা রক্তকে নষ্ট করে দেয়। এতে নানারকম সমস্যা হয়। আর সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না। শাকুর বলে—মেডিকেল যদি বলে সিট নেই, ফেরত দেয়?

ডাক্তার বলেন—সিট না থাকলেও ফেরত পাঠাবে না। হাসপাতালের নিজস্ব অ্যাম্বুলেন্স কী সব অসুবিধার কথা বলল। সময় নষ্ট করা যাবে না। একটা অ্যাম্বুলেন্স এল, সারা গায়ে অনেক অক্ষর। ক্লাবের নাম—খামখেয়ালি সংঘ। দুপাশে সাংসাদ অমুকের বদান্যতায় রোগীদের পাশে দাঁড়াবার জন্য…। ধূমপান বর্জন করুন। ওখানে ঢোকানো হল। স্ট্রেচারে করে যারা এনেছিল ওরা বকশিসের জন্য দাঁড়িয়ে রইল। শাকুর বলল, আমরা ননীদার লোক। ড্রাইভার বোধ হয় অবাঙালি। ও জানতে চাইল—মাটিয়া কলেজ?

অ্যাম্বুলেন্স একটা অদ্ভুত ভয়-ভয় শব্দে নিজেকে জাহির করতে করতে চলে। ওই একইরকম হর্ন মন্ত্রীর পাইলটকারেও বাজে। তখন ওই শব্দটাকে রংবাজি সাউন্ড মনে হয়। মন্ত্রীর গাড়িতে কখনও বসেনি শাকুর। অ্যাম্বুলেন্সে বসল। সেই একই শব্দ।

কলকাতার মেডিকেল কলেজে কাকে দিয়ে সেটিং করাবে? ওরা বারাসত পর্যন্ত পারে। কিন্তু কলকাতার হাসপাতালে হাইফাই ব্যাপার। ওখানে ডাক্তাররাও হাইফাই। ননীদা নাড়ুদারা র‍্যালা দেয়, বলে মিনিস্টার লেবেল পর্যন্ত কানেকশান আছে, সব ফালতু। ডিএমকে কিছু বলতে গেলে প্যান্ট খারাপ হয়ে যায়। তবু কাকেই বা বলবে? একজন বলল—শুনেছি বাসস্ট্যান্ডের গোবিন্দ, যার চায়ের দোকান, ওর মেয়ে নার্স। পতা লাগাতে হবে।

মেডিকেল কলেজের এমার্জেন্সির সামনে কয়েকজন চোখের তলাফুলো লোক। কী কেস? স্ট্রেচার চাই? এসব প্রশ্ন। শাকুর বুঝে যায় এরা কারা। অ্যাম্বুলেন্সের স্ট্রেচারেই ওরা সোজা বয়ে নিয়ে গেল এমার্জেন্সির ভিতরে। কচি ডাক্তার দুজন। এরা কী বুঝবে? কিন্তু ওরা অন্য একজন ডাক্তারবাবুকে ডেকে নিয়ে এল। উনি বললেন এক্ষুনি বেডে দিয়ে দিচ্ছি। যা কাগজপত্র আছে দিন।

চার

বেড খালি নেই। মেঝেতে শুইয়ে দিতে হল। মেডিসিন ডিপার্টমেন্টে যিনি ছিলেন, তার নাম ডাক্তার অংশুমান তালুকদার। কাগজপত্র দেখে মনে হল আগে যা চিকিৎসা হয়েছে ঠিকমতোই হয়েছে। বাইটের দু-তিন ঘণ্টার মধ্যেই এভিএস পড়ে গেছে। ওর জ্ঞান হারানোটা ভয়ের। এরকম শক অনেকেরই হয়। সাপে কাটা রোগী বেশ কিছু পেয়েছিলেন বাঁকুড়ায় যখন পোস্টিং ছিল। সাপে কাটলে নানারকম উপসর্গ হয়, যা বইতে থাকে না।

একটি বছর দুয়ের বাচ্চার কথা মনে এল। ওর মা দুপুরের দিকে নিয়ে এসেছিল কোলে করে। বাচ্চাটার পায়ের বুড়ো আঙুলে সামান্য রক্ত চোঁয়াচ্ছে। ওর মা দুব্বো ঘাস, গাঁদা ফুলের পাতার রস দিয়েছে, রক্ত পড়ছে তবু। কীসের কামড় ওরা জানে না। ছুঁচো না কোনও পোকা কিছু বলতে পারছে না, বাচ্চাটা উঠোনে খেলছিল। বাচ্চাটা দিব্যি কথা বলছিল, অক্সিজেন সিলিন্ডার কিংবা ব্লাড প্রেশার মাপার যন্ত্রর দিকে তাকিয়ে এটা কী ওটা কী করছিল। অরুণাংশু অ্যান্টিসেপটিক লোশনে ছোট ক্ষতটা মুছে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছিলেন। ঘণ্টাখানেক পরে একবার বমি করল, তখন দেখল গোড়ালির কাছে একটা ফোসকা। বিকেলে আরও দু-তিনটে ফোসকা। যাকে ইংরেজিতে বলে ব্লিস্টার। এটা কি এলার্জি? পোকা বা ইঁদুরের কোনও বাইট থেকে? অ্যান্টি এলার্জিক কিছু দিল। কোয়ার্টার থেকে রাত আটটা নাগাদ দেখতে এল। দেখল ফোসকার সংখ্যা বেড়েছে। বাচ্চাটা একটু নিস্তেজ, কিন্তু কথা বলছে। ব্যান্ডেজে রক্ত। তার মানে রক্ত চোঁয়াচ্ছে? তার মানে কি জমাট বাঁধছে না? তার মানে হেমাটোটক্সিক বিষ? তবে কি সাপ? ওদিকে চিতি সাপের উৎপাত আছে। ব্লকের ওই হাসপাতাল থেকে বাঁকুড়ায় পাঠিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু বাচ্চাটাকে রাখতে পারেননি। পরদিন দুপুরে মারা গিয়েছিল। ফোসকা যে একটা সাপ কাটার উপসর্গ হতে পারে সেটা টক্সিকোলজির কোনও বইতেই পায়নি। অনেক পরে একটা বই পড়ে জেনেছে একই সাপের বিষে অঞ্চলভেদে কিছু আলাদা এনজাইম থাকতে পারে এবং বিভিন্ন শরীরে আলাদারকম উপসর্গ হতে পারে। যা যা উপসর্গ আছে তার মধ্যে ব্লিস্টার ফর্মেশন বা ফোসকা পড়াও ছিল।

আসলে ভারতে ডাক্তারির সিলেবাসটা বানিয়েছিল ইংরেজরা। ওদের দেশের রীতি এবং অসুখ-বিসুখগুলো সামনে রেখেই তো সিলেবাস বানানো হয়েছিল, স্বাধীনতার বহু বছর পরেও জ্বর হলে বার্লি পথ্য দেওয়া হত। কারণ ওদের দেশে চাল হয় না, বার্লি হয়। আজকাল ডাক্তারবাবুরা বলেন পাতলা করে খিচুড়ি খেতে পারেন। ইউরোপের ঠান্ডা দেশগুলোতে সাপের উপদ্রব নেই। সিলেবাসে সাপে কাটার চিকিৎসাও ছিল না। অনেক পরে কিছুটা ঢোকানো হয়েছে। আসলে সাহেবরা গুরুত্ব দেয়নি বলে পরবর্তীকালেও গুরুত্ব পায়নি।

পেশেন্ট পার্টি চার-পাঁচ জন। একজনের একটু হোমরা-চোমরা ভাব আছে। নীচে শোয়ানো হয়েছিল বলে গজগজ করছিল। বেড নেই কেন? একজন মন্ত্রী এমএলএ ফোন করলেই তো সুড়সুড় করে বেড হয়ে যায়। তখন খালি হয় কী করে?

অংশুমান বলেছিলেন, তবে কি বেড নেই বলে ফিরিয়ে দিলেই ভালো হতো? বেড ফাঁকা হলেই দিয়ে দেওয়া হবে।

ছেলেটা ফোন বার করে কাকে যেন বলল, দেয়নি, বেড দেয়নি। হেড? শাকুর জিজ্ঞাসা করে, এই হাসপাতালের হেড কে আছে? অংশুমান বলেন, সুপার।

সুপারের নাম কী?

অংশুমান ইচ্ছে করলে বলতে পারতেন জানি না যান। কিন্তু কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। রুগি দেখতে হবে। সুপারের নাম বলেন,। আর বলেন, নীচে যান। অপেক্ষা করুন। তবে একটা কথা, বোড়া জাতীয় সাপ কামড়েছে, নানারকম সমস্যা হয়। আমরা চেষ্টা করব। আমাদের ওপর আস্থা রাখুন। তবে বলে রাখা উচিত, অনেক সময় হঠাৎ করে কিছু হয়ে যেতেও পারে।

পেশেন্ট পার্টির আর একজন ছিল। ও নিশ্চয়ই মেয়েটির স্বামী। হাত জোড় করে বলল, ডাক্তারবাবু, পেটের বাচ্চাটা যেন…কান্নায় গলা ভেঙে যায় লোকটার।

অংশুমান মেয়েটিকে দেখেন। জ্ঞান আছে। বলেন, ভয় নেই বোন। কিচ্ছু ভয় নেই। সব ঠিক হয়ে যাবে। অংশুমান বোঝেন ভয় তাড়ানোটাই প্রাথমিক চিকিৎসা। মেয়েটি পেটে হাত দিতে চায়। হাতটা নড়ে ওঠে। পেট পর্যন্ত যায় না। হতে পারে মেয়েলি লজ্জায়। বলে, বাচ্চাটা কি?…

অংশুমান দেখে মেয়েটির মুখে একটা হাসির রেখা ফুটে উঠল। অংশুমান একটু সামনে যেতেই সায়িদা পেটে হাত দিয়ে দেখল ধুকপুকি আছে কি না। অংশুমান এটা লক্ষ করেন। অংশুমান আবার আসেন। বলেন—শুনিয়ে দিচ্ছি। স্টেথোস্কোপটা সায়িদার কানে লাগান, আর বাচ্চার স্পন্দন শোনান। কী আশ্চর্য এক প্রশান্তি ফুটে ওঠে মেয়েটার মুখে। যেন জ্যৈষ্ঠর মাঠে মেঘের ছায়া। এইটুকু আনন্দ তো একজন ডাক্তার দিতেই পারে। অংশুমানের দায়িত্বে তো এই মেয়েটিই শুধু নেই, আরও তো বেশ কয়েকজন। সংকটাপন্ন রোগীও আছে দু’জন।

অংশুমান ওঁর কর্তব্য-কর্ম ছকে নিয়েছেন। দ্রুত রক্ত, প্রস্রাব ইত্যাদি পরীক্ষা করিয়ে নিতে হবে। ইসিজি করিয়ে নিতে হবে। নেফ্রোলজিস্ট দেখাতে হবে, কার্ডিওলজিস্ট দেখাতে হবে।

বিভিন্ন পরীক্ষার রিপোর্ট দেখে বোঝা গেল সাপের বিষ রক্তকে অনেকটাই ভেঙে দিয়েছে। হিমোগ্লোবিন কমে গেছে অনেকটাই। রক্তের ভাঙা কণিকাগুলিকে বের করতে পারছে না কিডনি। কিডনি নিজের কাজ করতে পারছে না। ডায়ালিসিস দরকার এবং এর পরে দরকার হবে প্লাজমা। অনেকটাই দরকার হতে পারে। এটাও জানা ছিল যে এখন ব্লাড ব্যাংকের রক্তভাণ্ডারের অবস্থা ভালো নয়। গ্রীষ্মকালে এই সংকটটা চলে। তাছাড়া কিছুদিনের মধ্যে এতগুলো মারামারিজনিত রক্তপাত হয়ে গেছে যে রক্ত রাস্তায় ধুলোয় পড়ে নষ্ট হয়েছে, বিভিন্ন ব্লাড ব্যাংকের সঞ্চয় থেকেই তো এই রক্ত আহত শরীরগুলোতে গেছে।

অংশুমান ডাক্তার হয়েও শিউরে ওঠেন ছবিগুলো দেখে। খবর কাগজের সাদা-কালো ছবিতে ততটা শক হয় না, ফেসবুকের রঙিন ছবিতেই সেই বিচ্ছিরি অনুভূতিটা হয়। চাপাতি দিয়ে গলায়…। বাংলাদেশে পুরোহিতরা…যাজক… তরুণ ছেলেগুলো যারা ব্লগে নিজেদের চিন্তা জানিয়েছিল, জমাট রক্তপিণ্ডের ভিতরে ফুটপাথে ওরা। বোমায় উড়ে যাচ্ছে শরীর, রক্তফোয়ারা। এলোপাথাড়ি গুলি চালিয়ে ঝাঁঝরা হয়ে যাচ্ছে হৃদপিণ্ড, ফুসফুস, পিচকিরির মতো রক্ত। ধর্মের নামে।

অংশুমান হিপোক্রিটেসের শপথ নিয়েছে ডাক্তারি পাশ করার সময়। মানুষকে মারা নয়, বাঁচানোটাই ধর্ম।

অংশুমানের হাউস স্টাফ পেশেন্ট পার্টিকে বলে, রক্তের দরকার হবে। আপনারা যতজন পারেন রক্ত দান করুন, আপনাদের দান করা রক্তের পরিবর্তে আমরা ওর জন্য রক্ত পেয়ে যাব।

কে একজন বলল, এটা তো রমজান মাস, রোজা রাখছি, এখন রক্ত…মানে ধর্ম বলে একটা ব্যাপার আছে না…!

পাঁচ

তিন দিন কেটে গেল। গাঁয়ের লোকজন গতকাল আসেনি কেউ। লতিফ আছে, আর শাকুরও এসেছিল। আজ শাকুরও আসেনি। কামধান্দা ফেলে রোজ এলে কি চলে! সায়িদার বাপের বাড়ির লোকজনও ছিল গত দু’দিন। আজ কেউ নেই। লতিফ একাই। বেলা দশটা থেকে এগোরোটা ওপরে যেতে দেয়।

নার্স দিদিদের সঙ্গে দেখা করে কেমন আছে জিজ্ঞাসা করলে বলে ডাক্তারবাবুরা বলবে। বড় ডাক্তারবাবুদের সঙ্গে আর দেখা হচ্ছে কই? সন্ধের সময় ছোট ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলা যায়। গতকাল ছোট ডাক্তারবাবুরা বলল দুই-একদিনের মধ্যেই ডেলিভারি করিয়ে দেবে।

কতক্ষণ আর হাসপাতালের সিঁড়িতে বসে থাকা যায়? রাস্তায় বের হয়। হাসপাতালের উলটো দিকে একটা মন্দির। ওখানে ঘণ্টা আছে। ঘণ্টার আওয়াজ হাসপাতালের সিঁড়িতে বসেও শোনা যায়। মন্দিরের সামনে গিয়ে একটু দাঁড়াল লতিফ। ঘণ্টা নেড়ে কি মনোবাঞ্ছা জানাতে হয়? কেউ কেউ ঘণ্টা বাজাচ্ছে। না, এটা রোজার মাস। রোজাটা ঠিকমতো রাখলে সওয়াব হয়। রোজাদারদের প্রার্থনা পরমেশ্বর কবুল করেন। হঠাৎই বিড়বিড় করে বলল—বাচ্চাটা যেন সুস্থভাবে, ঠিকঠাক…যেন তাগতদার হয়। তারপর ঠং করে একবার ঘণ্টাটা বাজিয়ে ওখানে দাঁড়াল না আর।

ট্রাম যাচ্ছে ঘড়ঘড়। বুকের মধ্যে কী যেন ছেঁচড়ে যাচ্ছে। কী একটা যেন, শুকনো পাতা, নাকি গিরগিটি। কার কাছে ফরিয়াদ জানাল ঘণ্টা নেড়ে?

পরমেশ্বর, মালিক, প্রভুর কাছে বান্দার ফরিয়াদ।

ঘণ্টা নাড়ল কেন?

ঘণ্টা তো এমনি। একটা শব্দ। ঠিক আছে?

ঘণ্টার ওধারে কী ছিল।

ঈশ্বর।

একটা মূর্তি ছিল না?

দেখিনি। তবে ঈশ্বর তো সব কিছুতেই…

ভক্ত পেল্লাদের মতন কথা কইচিস যে…।

আমিও তো ভক্ত পেল্লাদের মতোই।

ঠিক আছে। কাউকে বলিস না।

আচ্ছা।

তবে তুই তাগতদার বাচ্চাটাই চাইলি যে বড়? তোর বউকে চাইলি না? তোর বউ যেন ঠিকঠাক ফিরে আসে তোর ঘরে, তেমন দোয়া করলি না তো…।

নিজের সঙ্গে কথা বলছিস লতিফ। সত্যিই তো। সায়িদার জন্য দোয়া করল না কেন? মনের ভিতরে কি এমন কিছু ছিল, টায়ারের ভিতরের টিউবের চোরা লিক যেমন থাকে, যে বউ গেলে আবার বিয়ে করা যাবে, কিন্তু নিজের প্রথম সন্তান… কাঁঠালে বসা মাছি তাড়াবার মতো মন থেকে তাড়ায় এটা। এরকম ভাবনা ঠিক নয়, অন্তত এই রমজান মাসে। রোজ রাতে তো এশার নামাজের পর আল্লাহপাকের কাছে মোনাজাতের সময়ে বলে আমার সায়িদা বিবি বড় ভালো, ওকে রহম করো, ওকে ভালো করে দাও…। বলে তো। নামাজটা ঠিকমতো আদায় করা হয় না। ক’টা অটোওয়ালা-রিকশাওয়ালা পাঁচবার নামাজ পড়তে পারে? তবে রমজান মাসে লতিফ পাঁচবারই পড়ে।

সন্ধের সময় ছোট ডাক্তারবাবুরা বলল কাল ডেলিভারি করানো হবে। একটা সিন্টোচার্জ করে, মানে ইনজেকশন দিয়ে আর্টিফিসিয়াল লেবার পেইন দিয়ে নর্মাল ডেলিভারি করে বাচ্চা তুলে নেবে, নইলে সিজার করতে হবে। রক্ত দরকার হতে পারে। লোক রেডি রাখতে হবে।

বাঙালির ছেলে বাংলা বললেই তো পারিস। ডাক্তার পড়লেই কি ইংলিশ ঝাড়তে হয়? লতিফ ইংরেজি জানে না এমন নয়। মাধ্যমিক পাশ তো দিয়েছিল। তবে মোদ্দা কথাটা বুঝতে পেরেছে। ইনজেকশন মেরে জোর করে ‘অরজিনাল’ ডেলিভারি করিয়ে দেওয়ার ট্রাই নেবে। না হলে অপারেশন করে বাচ্চা খালাস করে দেবে, তারপর সায়িদাকে আরও কীসব করবে বিষ লাবানোর জন্য।

বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল। তখন হুজুরদের পাওয়া যায় না। সকালে ফজরের নামাজের সময় মসজিদে গেল। এই গাঁয়ে ক’জনই বা তেমন আলেম লোক আছে! ইমাম বলল—আল্লাহপাক তাঁর উম্মতের শরীরী যা রক্ত দেছেন সিটা নিজির মর্জিমতো খরচ করা যায় না। লতিফ মনে মনে প্রশ্ন করে তবে কি নিজের হাতে অন্যের রক্তটা নেওয়া যায়? জেহাদিরা ধর্মের কথা বলে অন্যের রক্ত নিচ্ছে যে…! মনে মনেই। মুখে বলে না। কিন্তু অন্য একটা যুক্তি শোল মাছের মতো ঘাই মারে। তবে হুজুর, রক্ত থেকেই তো মাতৃদুগ্ধ। মা কি তাঁর সন্তানকে দুধ দান করবে না?

ইমাম বললেন আল্লাহ মায়ের বুকে দুধ দেছেন সন্তানের জন্য, আর রক্ত নিজির জন্য। এবার লতিফ নয়, অন্য আরেকজন বলে—তবে বাচার যদি অ্যাকসিডেন হয়, রক্ত দরকার হয়, বাপ-মা দেবে না?

এ প্রশ্ন এখন ওঠে কেন? ইমাম সাহেব জিজ্ঞাসা করেন।

লতিফ বলে, আমার স্তিরির লাগবে। অনেক। শুধু আমার দিলি হবে না, আমার গাঁয়ের লোকদেরও দিতি হবে।

লতিফ ‘স্ত্রী’ কথাটা যে শুদ্ধভাবে উচ্চারণ করতে পারে না এমন নয়। কিন্তু ইমাম সাহেবের সামনে এত শুদ্ধ উচ্চারণ ‘আদব’ নায়। বিবিও বলা যায় না। সম্মানীয়দের বউ বিবি হয়। সাধারণ লোকের বউ পরিবার। স্তিরি বা ইস্ত্রিও চলতে পারে।

ইমাম সাহেব বললেন—আল্লাহ কেমন রাখিছেন তারে জিজ্ঞাসা করা হয়নি। ওরজন্য দোয়া করি আমি। এতদিন যখন জিন্দা আছে, আরাম হয়ে যাবানে। দাঁড়াও ফয়সলা দিচ্ছি। লম্বা পাঞ্জাবির পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করলেন ইমাম সাহেব। কাকে যেন ফোন করলেন। দু-একটা আয়াত আদান-প্রদান হয়। তারপর বললেন—শোনো লতিফ, জায়েজ। চলবে। রক্তদান জায়জ আছে। তোমরা রক্ত দিতে পারো। তোমার পরিবার ফিরি আসবে ইনসাল্লা। ফিরি এলি ভালো করে ফিতরা দিয়ে দিও।

—তা আর বলতি? সে তো মনেই রেখেছি।

—তাছাড়া মসজিদের অজুর জায়গাটা টাইল বসায়ে দেব। ঝকঝকা থাকবে।

ওরা দু’ভাই আর লতিফের দুই শ্যালক সকাল দশটার মধ্যেই হাসপাতালে পৌঁছে গেল। শুনল ইনজেকশন দেওয়া হবে এক্ষুনি। ডাক্তারবাবুরা এসে গেছেন। ওরা লেবার রুমের বাইরে বারান্দায়। বুক দুরু দুরু। আল্লা নাম…।

দেড়টা নাগাদ হাসতে হাসতে নার্স এল একজন। সায়িদা বিবির স্বামী আছেন এখানে? লতিফ উঠে দাঁড়ায়। হাসছে যখন জিন্দা বাচ্চাই হয়েছে।

—কী বাচ্চা চেয়েছিলেন? ছেলে না মেয়ে?

—ছেলে-মেয়ে সমান। ওপরওয়ালা যা দেবেন।

—ছেলে হয়েছে। মা, বেবি দুজনেই ঠিক আছে।

নার্সকে হুরি মনে হল। হুরি না, ফেরেস্তা।

লতিফ সবাইকে বলল, চলো, মিষ্টি খাই। ভুলেই গিয়েছিল এটা রোজার মাস।

অদ্ভুত একটা ঘণ্টা বাজছে বাইরে, মনের ভিতরে।

বাড়িতে ফোন করে। মাকে বলা ছিল। লতিফ বলে মা উলু দাও গো, তোমার নাতি হয়েছে। ফোনে উলুর শব্দ শোনে। মন্দিরের ঘণ্টায় উলুর শব্দ মেশে।

আজ রামজান মাসের বারো তারিখ।

লতিফের বড় শ্যালক বলল—বারো তারিখ খুব পয়া দিন।

রবিয়াল আওয়ালের বারো তারিখ নবি রাসুলের জন্ম। তাছাড়া আজ ফ্রাইডে। জুম্মাবার। কথায় আছে—জুম্মাবারে সওয়াবি, ছেলের টাকায় নবাবি। জুম্মাবারে জন্মালে ছেলের খুব পুণ্য হয়। আর রোজগেরে হয়। ছেলের টাকায় বাপ নবাবি করে।

লতিফের কি এত ভালো নসিব? সব কাজে বাধাই পেয়েছে জীবনে। জীবনের চলর পথে বারবার বাম্পার। অথচ রমজান মাসের জুম্মাবারে জন্ম নিল ওর ছেলে, তার ওপর আবার বারো তারিখ। বারো তারিখের ব্যাপারটা জানত না লতিফ। বড়শালাটা এসব অনেক কিছু জানে। লতিফ ভাবে ছেলের নাম রাখবে আয়মন। ও জানে আয়মন মানে পুণ্যবান।

সেই ডাক্তারবাবুটা, বড় ডাক্তার, লেবার রুমে ঢুকলেন। তিন-চার মিনিট পরে ফিরে এসে বললেন, কথা আছে। সায়িদা বিবির এমনিতেই অ্যানিমিয়া ছিল মানে রক্তে হিমোগ্লোবিন কম ছিল। ওই জিনিসটার অনেক রকম কাজ। বিষে অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেছে। সুতরাং রক্ত দিতে হবে।

অলরেডি দু’বোতল দেওয়া হয়ে গেছে। এছাড়া প্লাজমা দিতে হবে। প্লাজমা মানে হল রক্তরস। রক্তের পরিবর্তে ব্লাড ব্যাংক থেকে পাওয়া যাবে। ক’জন রক্ত দিতে রেডি আছেন?

লতিফ আর শাকুর দেবে। সায়িদার দু’ভাই এসেছে। বড় ভাই যে বলেছিল ওর ভাগনে পুণ্যবান, সে বলল ওর মাথা ঘোরে। দুর্বল কিনা…মানে দেবে না।

লতিফ তিনটে আঙুল দেখায়।

ডাক্তারবাবু বলেন—তিনজনে কী হবে? অন্তত কুড়িজন চাই, যাঁরা একবার একবার করে দেবে। পাড়া-প্রতিবেশী ক্লাব নেই? লোক জোগাড় করুন। কালই। আজ তিনজনই দিয়ে দিন।

ওরা রক্ত দেয়নি কোনও দিন। কোনও ধারণা নেই কতটা রক্ত নেয়। ডাক্তারবাবুরা একটা হাসপাতালের কাগজ দিয়ে বললেন, ব্লাড ব্যাংকে চলে যান।

ছয়

প্রফেসর অংশুমান তালুকদার পড়ানও। ওঁর মেডিসিনের ক্লাসে ছাত্রদের বললেন—তোমার হিপোক্রেটিস ওথ নেবে কিছুদিন পরই।

যিশুখ্রিস্টের জন্মেরও সাড়ে চারশো বছর আগে জন্মেছিলেন তিনি। তিনি বলেছিলেন, তোমার রোগীকে তোমার আত্মীয়ের মতো দেখবে। বলেছিলেন, শিক্ষকের কথা শুনবে।

আমি তোমাদের শিক্ষক। কিন্তু শিক্ষকদেরও শিক্ষক, সবার শিক্ষক আইনস্টাইনের একটা কথা আছে, যার মূল কথা হল, প্রাচীনকালে প্রত্যেক মানুষকেই নিজের শরীরের আচ্ছাদন তৈরি করে নিতে হত, খাবার জোগাড় করতে হত। আত্মরক্ষা করতে হত। এখন আমাদের পোশাক অন্যরা তৈরি করে দেয়। আমাদের খাদ্য অন্যরা উৎপাদন করে। আমাদের আরামের সামগ্রী যেমন চেয়ার, টেবিল, খাট, হিটারটাও অন্যরা বানিয়ে দেয়। লেখার কাগজ, কালি, কলমও আমরা নিজেরা তৈরি করি না। আমরা সমাজের থেকে নিই। সুতরাং আমাদেরও কর্তব্য আছে সমাজের প্রতি। যেহেতু আমরা ঋণী। ঋণ ফেরানোর জন্য আমাদের নিরন্তর চেষ্টা করে যেতে হবে। এটাই এ সময়ের মানবধর্ম।

আমার বেড-এ একটা স্নেক বাইটের পেশেন্ট আছে। হেমাটোটক্সিক পয়জন। সুতরাং বুঝতেই পারছ প্রচুর ব্লাড ও ফ্রেশ প্লাজমা দরকার। এখন ব্লাডের ক্রাইসিস আছে। পেশেন্ট পার্টি ব্লাড ডোনার জোগাড় করতে পারেনি। পেশেন্টটাকে বাঁচাতে হবে। তোমাদের মধ্যে কে কে ভলেন্টিয়ার হতে চাও? একবার করে ব্লাড ডোনেট করবে…। আমিও দিচ্ছি…।

প্রথমেই তিনটে হাত উঠল। তারপর আরও ছ-সাতটা। কয়েকটা হাতও অর্ধেক উঠে থেমে রইল। তিরিশ সেকেন্ডের মধ্যে বলা যায় সবগুলো হাতই উঠে গেল। অংশুমান আগেই ওঁর এন্টর্নি এবং হাউস স্টাফদেরও একই কথা বলেছিলেন। সেই সঙ্গে বলেছিলেন নিজেদের রক্ত দিয়ে একজন পেশেন্ট বাঁচানোর স্মৃতিটা তোমাদের মনে গেঁথে থাকবে। যখন সার্ভিসে যাবে দেখবে ভেতর থেকেই একটা আর্জ আসছে, সিনসিয়ারলি কাজটা করার। প্রাণ দিতে পারি না আমরা। কিন্তু প্রাণটাকে আগলে রাখার চেষ্টা করাটাই ডাক্তারি। জুনিয়ার ডাক্তাররা প্রায় সকলেই রাজি হয়েছিল এবং ওদের একজনকে ভার দেওয়া হয়েছিল একটা সিডিউল করার। কে কবে ডোনেট করবে এবং পরিবর্তে ব্লাড বা প্লাজমা নিয়ে আসবে।

স্টুডেন্টদের বললেন—খুব খুশি হয়েছি। তোমরা তোমাদের কমিটমেন্টটা রেখো। তোমরা পড়েছ বোনম্যারো কীভাবে রক্ত তৈরি করে এবং যে রক্তটা ডোনেট করছ সেটা তৈরি হতে তিন-চার দিনের বেশি লাগে না। আমার এখন পাঁচ-ছ’জন হলেই চলবে।

অংশুমান একটু পুতুপুতু আদুরে আদুরে ছ’জনকে বেছে নিলেন। প্রধান উদ্দেশ্যটা ছিল এদের মন থেকে ভয় তাড়ানো। একবার ব্লাড ডোনেট করলেই ভয় কেটে যায়।

সায়িদার ডায়ালিসিস চলছিল একদিন অন্তর। প্লাজমাও দিতে হচ্ছিল। বাচ্চাটা হাত-পা ছুড়ছিল। বাচ্চাকে মায়ের দুধও কিছুটা খাওয়ানো হচ্ছিল। বাচ্চাটাকে কিছুদিন আগেই জন্ম নিতে হয়েছিল বলে ওজন কিছুটা কম ছিল। এবং কিছু কিছু অন্য ধরনের সাবধানতাও নিতে হয়েছিল। যে নার্সরা প্রায় সময় বড্ড খ্যাচখ্যাচ করে, ওরা কেমন যেন হয়ে উঠল। মানবতাও ইনফেকটেড হয়। ভালো কিছু শুরু হলে সংক্রামিত হতে পারে। শুরু করাটাই আসল।

ছাত্র এবং ডাক্তাররাও রক্ত দিচ্ছে শুনে লতিফ-শাকুরের গাঁয়ের লোকজন সব অবাক। এ কী কাণ্ড! এমন হয় নাকি? একজন আধা আলেম বলল তবে তো কেয়ামত আসতে ঢের বাকি। কেয়ামতের আলামত যা যা দেখা যাচ্ছে, তার সঙ্গে তো এটা মানায় না। লতিফের বাবা বলল—এজন্যই মানুষকে বলে আশরাফুল মখলুকত। আল্লাপাকের সবচেয়ে বেস্ট সৃষ্টি। মানুষের মধ্যে দিয়েই দয়া নাজিল করেন, তিনি দয়ালু। রহিম। তিনি শাফিক।

লতিফ হুঁ-হাঁ করে।

লতিফের বন্ধুস্থানীয় দু-একজন এই ঘটনা শুনল। লতিফের প্রতিবেশীরাও। আরও ছ-সাত জন বলল, আমরাও রক্ত দেব। ওরাও রক্তদান করে এল।

লতিফের মা কাঁথা সেলাই করছে। গুনগুন গাইছে—’বোরাকে চড়িয়ে রসুল খোদার কাছে যায়। ওরে আমার পরানধন আমার কাছে আয়।’ কাঁথার মধ্যে সুতোয় সুতোয় বোরাক আঁকছে, অনেকটা গরুর মতো মুখ, দু-পাশে ডানা। লতিফের বাবা তাঁর সাধের খাতাটা বের করে লিখলেন,

শয়তান সাপের বেশে দিয়েছিল কুমন্ত্রণা

এখনও সেই সাপ দেয় যত যন্ত্রণা।

শয়তান এখনও আছে তৈরি করে ক্ষত।

মানুষ তারও ওপর। আশরাফুল মখলুকত।

সায়িদার ছুটি হয়ে যাবে আর দুদিনেই। ইদের নতুন শাড়িটা পরেছে আজ। একুশ দিনের যুদ্ধ শেষ হয়েছে। লতিফ সায়িদার বিছানার পাশে, টুলে। দেওয়ালে চুনের কাজ চটে গিয়ে কী একটা নকশা তৈরি হয়েছে, যেন বোরাক, যে ঈশ্বরের কাছে নিয়ে যায়। হাসাপাতালের ছোট আলমারিটা, অক্সিজেনের সিলিন্ডার, প্লাস্টিকের গামলা, সবই যেন কেমন মেঘ থেকে নেমে আসা লাগে।

সায়িদা লতিফের কানের কাছে মুখ রেখে বলল, আমি কিন্তু ছেলের নাম রাখব অংশুমান।

একথা আগেও বলেছিল সায়িদা। লতিফ তখন বলেছিল দেখা যাক। বাড়িতে আলোচনা হয়েছিল। একটা পয়া দিনে হয়েছিল বলে আয়মন রাখার কথা ভেবেছিল লতিফ। কেউ বলল, কত বাধা জয় করেছে ও, তাই নাম রাখো গালিব। লতিফ তখন বলেছিল সায়িদা’র ইচ্ছা ডাক্তারবাবুর নামে ছেলের নাম রাখবে। ডাক্তারের নাম অংশুমান।

লতিফের বাবা মাথা নাড়লেন। এমন নাম হয় না। বললেন, ডাক্তারবাবু খুব ভালো। ওর নাম আমরা মনে রাখব। ওর নামে একটা কবিতাও লিখব। কিন্তু ওর’ম নাম তো আমার নাতির হতি পারে না। মইনউদ্দিন হতি পারে। অংশুমানের ‘মান’ আওয়াজটা ‘মইন’-এর মধ্যে পাওয়া যাবে।

লতিফের খুব একটা পছন্দ হল না। কিন্তু বাবার কথা তো শুনতেই হবে। লতিফ জেনেছে অংশু মানে চাঁদ। অংশুমান মানে চাঁদ যার গায়ে লেগে থাকে। বাবাকে জিজ্ঞাসা করল, চাঁদ দিয়ে কোনও নাম হয় না? উনি বললেন—খুব ভালো হয়। ‘কোমার’ মানে চাঁদ, ‘হেলাল’ হল চাঁদের ফালি। ‘বদর’ মানে পূর্ণচন্দ্র। বদরউদ্দিন রাখা যেতে পারে।

লতিফ একথা বলেছিল সায়িদাকে। সায়িদা আস্তে করে বলল, তোমরা যা খুশি ডাকো। আমি আমার সোনাবাবারে অংশুই ডাকব।

যেদিন ছুটি হবে, সেদিন গাড়ি ভাড়া করা হল। বাবা-মাও গেল হাসপাতাল। শাকুর যায়নি। একদিনের রোজ কামাই মানে অনেক লস।

লতিফের বাবা গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে, কখনও বসার জায়গাটা কাঁপিয়ে গদি উপভোগ করছিল। গাড়ি-টাড়ি তো চাপা হয় না। পরিচিত মাঠ-ঘাট গাড়ির কাচের ভিতর দিয়ে অচেনা-অচেনা লাগছে। বাসে চাপলে এমন হয় না তো।

জানলার কাচে দু-চার ফোটা, যেন মুক্তো। ভিতর দিয়ে দেখা যায় মেঘলা দুনিয়ার সবুজ। কলাগাছগুলো, বাবলাগাছগুলো, রাস্তার ধারের কচুগাছগুলোও কী সুন্দর। আল্লাপাক সব সাজায়ে রেখেছে যেন। সুন্দর সরে সরে যায়। সুন্দরের ওপরে লেগেছে জীবন। আহা জীবন!

লতিফ বলল—জানেন আব্বাজান, প্লাজমা নামে একটা বস্তু আছে, পলিথিনের প্যাকিটে থাকে। ওটাই হল রক্তের আসল জিনিস। লাল নয় মোটে, কাঁচা কুমড়োর মতো রং। কী করে বানায় জানেন, মানুষেরা রক্ত দেয়, বেচে না, এমনিই দেয়। কখন কার লাগে সেই ভেবে দেয়। রক্ত পরীক্ষে করে বাগদি, বাউন, মোসলমান, ইহুদি, নাসারা কিছু বোঝা যায় না, শুধু গুরুপ বোঝা যায়। তোমাদের ঘরের বউ-এর গুরুপের নাম ‘ও’। এ আছে, বি আছে…এইসব কত শুনলাম, কত জানলাম। ওকে সেই গুরুপের রক্তই দেওয়া হয়েছে। সেই গুরুপে বাউন, বাগদি, মুচি, মোসলমান…। ডাক্তাররাও রক্ত দিয়েছে…।

লতিফের বাবা বললে—আল হামদুলিল্লাহ। মানে সবই ঈশ্বরের মহিমা।

কতকগুলো কাক উড়ছিল।

লতিফের বাবা বললে—আজ বড় ভালো দিন। এই দিনে কাককেও মনে হয় আবাবিল। এই পাখি সুসংবাদ বয়ে আনে। আরবে রসুলের কাছে এই পাখি যুদ্ধজয়ের খবর বয়ে নে’ গেছিল।

এবার চায়ের দোকানের সামনে চা খাবার জন্য একটু থামা হল।

শিঙাড়াও ভাজছে।

খবর কাগজখানা রয়েছে বেঞ্চিতে।

এলোপাথাড়ি গুলি চালিয়ে এক ধর্মস্থানে ঈশ্বরের নামে স্লোগান দিতে দিতে চল্লিশজনকে হত্যা করেছে আত্মঘাতী জেহাদি।

রক্ত-মাখামাখি কয়েকটা মৃতদেহ। ছবিতে রক্তের রং কালো। উচ্চবর্ণের পুকুরে স্নান করতে নেমেছিল বলে নিম্নবর্ণের মানুষের বস্তিতে গিয়ে গুলি। চারজন মৃত। রক্তমাখামাখি মৃতদেহ। ছবিতে রক্তের রং কালো।

থার্মোকলের সাদা পাত্রে শিঙাড়া।

আকাশে পাখি।

কাক, শকুন, নাকি আবাবিল পাখি?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *