হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে – ২

দ্বিতীয় পৰ্ব

শ্বেত সম্ভ কথা

স্নেহের পিকোলো,

তোমাদের কথা আমার খুব মনে হয়। গত বছরটা আমি গঙ্গোত্রীতেই কাটালুম। ভূর্জবাসায় চীরবাসায়, গোমুখে বাস করেছি। অপূর্ব! লালবাবার আশ্রমেও ছিলুম। কই, এই গ্রীষ্মে তোমরা তো আর এদিকে এলে না? যাত্রীদের মধ্যে ছোট ছোট মেয়ে দেখলেই আমি তোমাদের কথা ভাবছিলুম।

জানো পিকোলো, একটা খুব দুঃখের কথা, তোমার মায়ের ভবিষ্যদ্বাণীই মিলে গেল। হৃষীকেশে যে চায়ের দোকানে আমি তিনশো ডলার জমা রেখেছিলুম, ওরা সে টাকা আমাকে ফিরিয়ে দেয়নি। আমি অনেক করে চেয়েছিলুম, অথচ সেই টাকাটা আমার প্রয়োজনের সময়ে আর পাইনি। প্রথমে তারা আমাকে চিনতেই পারছিল না। তারপর বলল, ‘সেই টাকাটা কি আপনি আমাদের দান করে দেননি? আমরা তো দান মনে করে খরচ করে ফেলেছি। আর হাতে টাকা নেই, ফেরত দিতে পারব না।’ আমার খুব মন খারাপ। এত সহজে যে মানুষ মানুষকে ঠকায় তোমাদের দেশে, তা বুঝতে পারিনি। এতে আমার খুব ক্ষতি হয়েছে। আমার মানুষে বিশ্বাস চলে গেছে। এখন সবাইকে সন্দেহ হয়। সবাইকে ধান্দাবাজ ও মিথ্যাবাদী মনে হয়। এতে আমার টাকাকড়ি কত রক্ষা পাচ্ছে জানি না, তবে মনের শান্তি রক্ষা পাচ্ছে না। তোমরা কেমন আছ? পড়াশুনো কেমন হচ্ছে? স্নেহ শুভেচ্ছা নিও। ঈশ্বর তোমাকে আশীর্বাদ করুন। ইতি শিবখৃষ্টস্বামী।

পুনশ্চ : তোমরা কি কেদারনাথে ও বদ্রীনাথে গিয়েছিলে? অপূর্ব নয়? তবে গোমুখ আরও অপূর্ব। তোমরা পরের বার অতি অবশ্যই গোমুখ দর্শন করে যাবে। ঠান্ডার জুতো, পোশাক নিয়ে এস। আমি এখনও দরিদ্রদের আশ্রম তৈরির কথা ভাবছি। সরকার নানা বাধা দিচ্ছেন। মিলিটারি ইত্যাদিরও অসুবিধে আছে। গঙ্গোত্রীতে বা বদ্রীনাথে সম্ভব নয়। আমার সমতলে থাকতে ইচ্ছে নেই। হিমালয়ের কোলেই আমি আশ্রয় নিতে চাই। তোমাদের সঙ্গে আশ্রম তৈরি বিষয়ে কথাবার্তা বলতে হবে। এখানে ভারতীয় সাধুদের অসুবিধে নেই। আমার যেহেতু ব্রিটিশ পাসপোর্ট এবং অঞ্চলটি খুব সঙ্কটময় বলে সরকারি ভাবে চিহ্নিত, সেহেতু বিদেশি সাধুদের ভালো চোখে দেখা হয় না। সাধুদের মতো এমনিতেই অসাধু মনে করা হয় (সবচেয়ে সহজ ছদ্মবেশ বলে), আর বিদেশি সাধু হলেই তাদের চরবৃত্তির অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। চরদের পক্ষে যে সাধু সেজে বিচরণ করাই কাজের শ্রেষ্ঠ উপায় তাতে অবশ্য সন্দেহ নেই। কিন্তু তারা বিদেশী হবে কেন? বিদেশি শত্রুরা তো দেশি চরই নিয়োগ করবে। কিন্তু এতটা তলিয়ে ভেবে দেখা কোনো দেশেরই সরকারের চরিত্র নয় বা অভ্যাসও নয়। যাই হোক আমাকে তোমাদের সরকার মাঝে মাঝে ভিসা-টিসা নিয়ে বেগ দিচ্ছেন। মাঝে মাঝে মনে হয়, দূর ছাই, সব ছেড়েছুড়ে ইংলন্ডে ফিরে যাই। আমার কী? আবার হিমালয় ফিরে ডাকে। ভারতবর্ষের সীমাহীন দারিদ্র্য চুলের মুঠি ধরে যেন টানে। কি জানি, আমি হয়তো কোনোদিনই এদেশ ছেড়ে যেতে পারব না। যীশুর যেমন ইচ্ছে, শিবের যেমন ইচ্ছে।

পূর্বদিকে জগন্নাথ দক্ষিণদিকে রামনাথ
পশ্চিমেতে রণছোড় উত্তরেতে বদ্রীনাথ
রাজকরণে জগন্নাথ যোগকরণে রামনাথ
ভোগকরণে রণছোড় তপকরণে বদ্রীনাথ
কোটিতীর্থফলভণে বদরীনাথের দরশনে

যমুনোত্রীর পরই ভেবেছিলুম আর নয়। আর যাব না তীর্থযাত্রায়। নানান কারণে উৎসাহে ভাঁটা পড়েছিল, শরীরে মনে প্রবল বিচলিত বোধ করেছিলুম। খচ্চরে চড়ে সর্বাঙ্গে প্রচণ্ড ব্যথা হয়েছিল আমার। যদিও পদব্রজেই নেমেছি প্রধানত, তবু ওঠার সময়ে হাঁপানি রুগী হয়ে অতটা চড়াই ভাঙার কথা ভাবতেও পারি নি। শরীরের সেই প্রচণ্ড অস্বস্তি ও যাতনা আমি দ্বিতীয়বার ডেকে আনতে রাজি ছিলুম না। এর পরে হেঁটে উঠলে উঠব, নইলে নয়। এবং কেদারনাথে চোদ্দ মাইল হেঁটে ওঠা সাধ্যে কুলোবে না। স্বদেশ কলকাতাতেই চোদ্দ মাইল প্লেন রাস্তায় হেঁটে আমি কোনোদিন গড়িয়াহাট থেকে দমদমে যেতে সাহস পাইনি, হিমালয়ের চূড়োয় উঠে সে সাহস পাব কোত্থেকে? কেদারনাথ আউট। ভেবেছিলুম গঙ্গোত্রীও যাব না। তারপর মাত্র ৩ মাইল হাঁটাপথ শুনে, রাজি হলুম যেতে। বদ্রীনারায়ণ তো এখন দিব্যি সিমলা-দার্জিলিংয়ের মতোই সিবিলাইজড টুরিস্ট স্পট হয়ে গেছে। সোজা মোটররাস্তা আছে দিল্লি থেকে। বাস যাচ্ছে, গাড়ি যাচ্ছে। কচিকাচা, বুড়োবুড়ি সবাই যাচ্ছে। কেউ মরে না ওপথে।কেউ কষ্ট পায় না। আশ্চর্য একটা বেড়ান হচ্ছে বটে! পি. আর. ও. বন্ধুর গাড়িড্রাইভার ফ্রী ধার পেয়েছি, আর রাজার হালে ঘুরে বেড়াচ্ছি চারধাম। আমার আর এক বন্ধু তার শ্বশুরশাশুড়ি বউছেলে নিয়ে এই রকম ভাবে ঘুরে গিয়েছিল এক ব্যাংকের পাবলিক রিলেশনস্-এর সঙ্গে। শুনে তখন কী হিংসেই না হয়েছিল সেই বন্ধুকে। আর এখন? আমিই স্বয়ং সেই অবিশ্বাস্য ভ্রমণের যাত্রী। ঈশ্বর বোধ হয় শুনতে পেয়েছিলেন আমার নীরব ঈর্ষার ভাষা। এটাই তাঁর ভর্ৎসনার ধরন।

সুরথ সিং আমাদের সারথি, কন্যা পিকোলো আর ভাই রঞ্জন আমার সহযাত্রী। বার বার মন ভাঙার কারণ ঘটছে। যমুনোত্রীতে আমাদেরই সাক্ষাৎ সঙ্গিনী এক বৃদ্ধা পাঞ্জাবিনী বর্ষায় পা ফসকে ঘোড়াসুদ্ধু, সহিসসুদ্ধু, দু’হাজার ফুট খাদের অতলে পড়ে তলিয়ে গেলেন। এভাবেই, শুনলুম, আগের দিনই গেছে এক পঞ্চদশী কন্যা। গঙ্গোত্রীর পথে বার বার অকৃতকাৰ্য, ব্যর্থমনস্কাম বৃদ্ধ তীর্থযাত্রীদের মৃতদেহ শয়ান দেখেছি, যাঁদের তীর্থযাত্রাটি সম্পূর্ণ হয়নি কিন্তু পুণ্যের অংশটা হয়েছে একশোয় একশো। সিধেই স্বর্গলাভ এখানে মরলে। যমুনোত্রীর রাস্তাটা প্রচণ্ড চড়াই এবং সঙ্কীর্ণ এবং দুর্গম। ওপরে উঠেও, বৃষ্টিতে কাদায় প্যাচপেচে যমুনোত্রী ক্যানিংয়ের নোংরা কাদার কথা মনে পড়িয়ে দেয়। হিমালয়ের চার-চারটে গ্লেসিয়ার ঘেরা শিখর যমুনোত্রী যদিও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে উদ্দাম, বন্য এবং তুলনাহীন। এবং খচ্চরের পিঠে চড়ে সেই পার্বত্য পথযাত্রাও যন্ত্রণাদায়ক বন্য এবং তুলনাহীন। যারপরনাই ব্যথা হয়েছিল সারা গায়ে—বরকোটে অদ্ভুতাঞ্জন কিনে মালিশ করতে হয়েছিল। সেই সময়েই ঠিক করেছিলুম, ঢের হয়েছে, আর কেদারনাথ নয়। ঠিক করেই ফেলেছিলুম গঙ্গোত্রী থেকে আমরা সোজা যাব বদ্রীনাথে। সেখান থেকেই নেমে যাব হৃষীকেশ। কিন্তু সব গোলমাল করে দিলেন এই সাহেব সন্নিসিটি—শিবখৃষ্টস্বামী। কোথা থেকে উদয় হলেন হঠাৎ গঙ্গোত্রীর সুরধুনীর তীরে। কবিতাদির মেয়ে ঘুচাই আর আমার মেয়ে পিকোর সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেললেন, আর নানাভাবে অনুরোধ উপরোধ করে আমাকে রাজি করালেন কেদারনাথ দর্শনে। উনি বললেন, কেদারে না গেলে উত্তরাখণ্ড ঘোরা হলই না। এত সুন্দর আর কোনো তীর্থ নয়। এত খোলামেলা, অথচ এত নির্জন, এত তীব্র সঘনসুন্দর। খচ্চরেও চড়তে পারব না, হেঁটেও চড়তে পারব না, অতএব যাবই না—এই আহ্লাদে কথাবার্তা শুনে বললেন, ‘কাণ্ডী চড়ে, ডাণ্ডী চড়েও যাওয়া উচিত। এত অহংকারের কী আছে, যুব বয়েসে ডাণ্ডী-কাণ্ডী নিতে লজ্জা করবে? যাবে তো ঈশ্বরের সঙ্গে দেখা করতে, যে-কোনো উপায়েই হোক গেলেই হল। সেখানেও যৌবনের দস্তু? একটু বিনয় নেই?’ শিবখৃষ্টস্বামীর বকুনি খেয়ে স্থির করলুম, সত্যিই তো! যেতেই হবে। ‘চারধাম’ করতে এসে তিনধাম করে ফিরব গায়ের ব্যথার ভয়ে? আমি কি উন্মাদ? মানুষে কত কষ্ট করেই আসত এককালে। এখনও আসে। কিন্তু তাদের মধ্যে পুণ্যার্জনের যে স্পৃহা ছিল আমার মধ্যে তো সেটা নেই। আছে বেড়ানোর লোভ আর সৌন্দর্যতৃষ্ণা। তার জন্য কষ্ট করা আর ভগবানের জন্য কষ্ট করা তো এক ব্যাপার নয়। ক্রিশ্চান সন্ন্যাসী শিবখৃষ্টস্বামীর তীর্থযাত্রা আর আমার হিমালয় ভ্রমণের স্বাদগন্ধ আলাদা হতে বাধ্য। প্রথমত আমার হিমালয় আর একজন ইংরেজের হিমালয় এক নয়। আজন্মই হিমালয় আমাদের মজ্জার মধ্যে রক্তের মধ্যে প্রবেশ করেছে, হিন্দুধর্মে হিমালয়ের ভূমিকাটি প্রবল। কি সংস্কৃত শাস্ত্রে, কি বাংলার লোকাচারে, লৌকিক গাথাগল্পে এবং ধ্রুপদী সাহিত্যে,—সর্বত্রই হিমালয়ের সঙ্গে আমাদের নাড়ীর বন্ধন। অথচ আজ শিবখৃষ্টস্বামী আমাকে হারিয়ে দিয়েছেন, হিমালয়কে ভালোবাসায়। সাগরপারের এই ম্লেচ্ছ, যবন সন্ন্যাসী ক্রিশ্চান হয়েও কেদারনাথকে ভালোবেসে ফেলেছেন মনেপ্রাণে। শিবখৃষ্টস্বামী বলেছিলেন সে বছরটা শীতে-গ্রীষ্মে উনি গঙ্গোত্রী অঞ্চলেই কাটাবেন। গোমুখে থাকবেন। পরের গ্রীষ্মে যদি যাই, আবার দেখা হবে। পরের গ্রীষ্ম এসে গেছে, আমি তো গেলুম ম্লেচ্ছ দেশে সভাসমিতির কাজে, সাত সমুদ্দুর পাড়ি দিয়ে, ডানা মেলে। ফিরে এসে দেখি এক বছর পরে শিবখৃষ্টস্বামী ঠিক চিঠি লিখেছেন পিকোকে।—’কই, তোমরা তো আর এদিকে এলে না?’

জেনারেশন গ্যাপ

আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে মানুষে নিজের শ্রাদ্ধ নিজে করে উত্তরাখণ্ডের তীর্থযাত্রায় বেরুত। পথ ছিল এত দুর্গম, ঘরে ফেরার কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। এখন লাক্‌সারি বাস সোজা চলে যায় বদ্রীনারায়ণের পদতলে। নেহাৎ বাসে বসে বসে কেদারনাথের শ্রীচরণে পৌঁছনো যাচ্ছে না এখনও, তাই সেই পথে প্রকৃতির রূপ যৌবনের মোহ এখনও কিছুটা রক্ষা পেয়েছে। বদ্রীনারায়ণের অবস্থা দাঁড়িয়েছে স্বামীর কাছে আটপৌরে রূপসী গৃহিণীর মতো। রূপটা চোখ ঝলসানো হলেও, সহজলভ্য বলে স্বগৃহে তার মূল্য নেই। এই যদি উঠতে হত প্রাণ হাতে নিয়ে ইষ্টনাম জপতে জপতে, পায়ে হেঁটে কি খচ্চরে চড়ে, তাহলেই ব্যাপারটা পালটে যেত।—’কাহারে হেরিলাম! আহা! এ কি স্বপ্ন! এ কি মায়া!’ বলে আর্তনাদ করে উঠতাম। যেহেতু আরাম করে গাড়িতে বসে বসে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে মাইলের পর মাইল উঠছি, কষ্টেসৃষ্টে চক্ষু মেলে খানিক দয়া করেই বুঝে ফেলে ছড়িয়ে দেখছি, খানিক দেখছিও না। ভারী তুষারনদীর তলে তলে তরলা অলকনন্দার অসামান্য লীলা, তার তীব্র অবাধ্য স্রোত, সত্যিই তুলনাহীন। কিন্তু বিনাশ্রমে পাওয়া যায় বলে তার দাম মানুষের কাছে কমে গেছে। আস্তে আস্তে মারোয়াড়িদের ভগবদ্ভক্তির এবং দৈহিক ওজন বৃদ্ধির কল্যাণে কোনো তীর্থই আর দুরধিগম্য থাকছে না। তার ওপর মিসেস গান্ধীর ভক্তিমতী হৃদয় যুক্ত হয়ে সর্বত্রই এখন হেলিপ্যাডের অস্তিত্ব রয়েছে। শুনেছি কেদারনাথ-বদ্রীনারায়ণ মন্দিরে পট যেদিন বন্ধ হয়—আর যেদিন খোলে, দু’দিনই হেলিকপ্টারে চড়ে বিড়লা মুন্দ্রা মহোদয়েরা নাকি সশরীরে উপস্থিত হন, পুরোহিতের প্রথম ও শেষ আশীর্বাদ গ্রহণ করতে। আর্মির মোটর-পথ বছরভর তৈরি আছেই। বড় অফিসারেরা মোটরে যান, মন্ত্রীরা যান উড়ে, আর ছোট অফিসারেরা বাসে চড়ে। আর আমার মতো দু’একটা ভাগ্যবতী ভক্তিমতীর জন্য গাড়ি যোগান ভগবান।

কিন্তু ভগবান পিকোলোকে (এবং রঞ্জনকেও) কেন যে গাড়ি যুগিয়েছেন, সেইটে অবশ্য আমি বুঝতে পারিনি। ওরা সমানেই যাত্রাপথে নানাজাতীয় বাধা বিঘ্ন তৈরি করছে। ভক্তির তো পরাকাষ্ঠা দুজনের মধ্যেই দেখা যাচ্ছে এবং সৌন্দর্য-পিপাসা বলতে যা কিছু ঝরনার জলেই তা মিটে যাচ্ছে। আর কিছু পথশোভা দেখাতে চেয়ে ভাতঘুমে ডিস্টার্ব করলেই মামা-ভাগ্নীর যারপরনাই বিরক্তি। ভোরে উঠে রওনা হওয়াটা নেহাতই আমার খামখেয়ালী অত্যাচার। এই কি ‘ওরে সবুজ ওরে আমার কাঁচা?’ এরাই তো আধমরা। এতৎসত্ত্বেও আমাদের যে কোনোরকমে আধখানা ‘যাত্রা’ সুসম্পন্ন হয়েছে তাতেই আমি খুশি। গঙ্গোত্রী থেকে আমরা ফিরে এলুম উত্তরকাশীতে। এবারে আর সেই বাজার-মধ্যস্থ টুরিস্ট লজে না উঠে অন্য টুরিস্ট লজটিতে চলে গেলুম। সেখানে এখন আর তত ভিড় নেই। বলতে গেলে সীজন ওভার।

চন্দন সিংহ

একটা বড় ঘর পেলুম ৪টে খাটওলা—পাশেই সার সার স্নানঘর। ডরমিটরিই আসলে এটা, কিন্তু লোকজন নেই। চন্দন সিং বলে একটি গাঢ়োয়ালী যুবক আমাদের সেবক এঘরে। জানলা দিয়ে সামনেই দেখা যাচ্ছে গঙ্গার উত্তাল গৈরিক তরঙ্গ, আর জানলা বন্ধ করলেও শোনা যাচ্ছে জলস্রোতের গর্জন। সামনেই সবুজ হিমালয়। এখান থেকে কোনো হিমশিখর দেখা যায় না। পাহাড়ে গায়ে অনেক ছোটো-বড়ো মন্দির দেখা যাচ্ছে। ঘণ্টাও শোনা যাচ্ছে আরতির। ঘরটি ভারি পছন্দ হয়ে গেল। বাথরুমে গরম জল নেই। দুটাকায় এক বালতি কিনতে পাওয়া যাবে।

চন্দন সিং হঠাৎ বললে, ‘আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে চলুন না মেমসাব? আমি রান্নাবান্না সব জানি। পাহারাও দিতে পারি। বর্তন মনা, প্রেস কর্না, সব কুছ আতা হ্যায় মুঝকো। পিওনের কাজও পারি। ক্লাস টেন তক স্কুল মে পঢ়া। অংগ্রেজী ভি পঢ়লেতা হুঁ। হিন্দি ভি।’

অবাক হয়ে আমি বলি, ‘সরকারি চাকরি ছেড়ে তুমি কেন যাবে?’

উত্তরে শুনলুম চন্দন সিংয়ের চাকরিটা সরকারি নয়। টেমপোরারি সার্ভিস।

এ অঞ্চলের সব সরকারি টুরিস্ট লজই এইভাবে চলে। গঙ্গোত্রীতেও দেখেছিলুম কেবলমাত্র কেরানীবাবুরই পাকা চাকরি, ছ’মাস উত্তরকাশীতে থাকেন, ছ’মাস গঙ্গোত্রী লজে। আর সব ক’টি ছোকরা টেমপোরারি লোকাল এমপ্লয়ি। ওখানেই তারা বসবাস করে, বছরে ছ’মাস চাকরি থাকে, ছ’মাস বেকার। কখনও নিচে গিয়ে কাজকর্ম করে, কখনও নিচে গেলেও কাজ পায় না। চন্দন সিংয়েরও তেমনি সীজনাল এমপ্লয়মেন্ট। যাত্রীদের সঙ্গে দিল্লি বম্বাই কলকাত্তা ঘুমনে যানা মাংতা। কেউই ওকে নেয় না। অথচ এই বছরেই তো মারোয়াড়ী বাবুরা নিয়ে গেছেন ওর বন্ধু দান সিংকে। দান সিং চিঠি লিখেছে দিল্লি থেকে। খুব ভালো আছে। ওকেও যেতে বলেছে। কিন্তু কেমন করে যাবে চন্দন সিং? উত্তরকাশীর বাইরে কোথাও যায়নি সে। কেউ নিয়ে গেলেই চলে যাবে।—’মেমসাব, লে চলোগে, সাথমে, মুঝকো?’ খুব মন খারাপ হয়ে যায়। আমার সঙ্গে কেউ যেতে চাইছে, অথচ আমি নিয়ে যেতে পারছি না।—এই উপলব্ধিটা অক্ষমতার। এবং তার স্বাদ ভাল নয়।

চন্দন সিংয়ের সঙ্গে গল্প করতে করতে আমি ধোপার বোঝার সমান কাপড় কাচলুম। এই ক’দিনে (সাতদিনে) তো কাপড় কাচার সময় হয়নি। এখানে জোরালোগঙ্গার হাওয়ায় রাতের মধ্যেই সব খটখটে হয়ে শুকিয়ে গেল, এমন কি পিকোর লিভাইস পর্যন্ত! আজ খেতে বেরুতে ইচ্ছে করল না, রঞ্জন একাই বেরুল। পিকোটা বমি করেছে খুব। ওর শরীর ভালো নেই। গঙ্গার বাতাস খেয়ে ঘুমিয়ে রইল। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে অন্ধকার পাহাড়ের গায়ে তারার মতন আলোর শোভা দেখতে লাগলুম অনেক রাত পর্যন্ত।

ভাই চন্দন সিং, তুমি ভুল লোককে মুরুব্বী ধরেছ। আমি তোমার বন্ধুর মারোয়াড়ী মনিবের পাদনখকণার তুল্য রোজগার করি না। গাড়িখানা দেখে ভুল করেছ তো? ও-গাড়িটা আমার নয়। আমার বন্ধুর। ওই উর্দিপরা সোফারও আমার নয়। ধারে পাওয়া। তোমাকে দেবার মতো কাজ আমার হাতে নেই। তোমার জন্যে আমার মন-কেমন করছে। করবেও চন্দন সিং। ক’জন মানুষই বা পৃথিবীতে আমার সঙ্গে চলে যেতে চেয়েছে!

পিকোলো বিগড়োলো

উত্তরকাশীতে আবার দেখা হয়ে গেল হান্না আর অস্টেনের সঙ্গে। তারা এখনও বসে আছে, হান্নার জ্বর সারেনি। ওদের সঙ্গে দেখি—ঘুচাই এবং পুতুল! পুতুল দৌড়ে এসে বলল, ‘আমাদের অনেক একট্রা জিওলিন আছে, সঙ্গে নিয়ে যান। ঝরনার জল আর যেন খাবেন না। এদের সবার পেট খারাপ হয়েছে। আমরা তো আজই হৃষীকেশে নেমে যাচ্ছি, আমাদের এত লাগবে না—‘

পুতুল, ঘুচাই, সমরেন্দ্র সব কটা সোনার টুকরো। কবিতাদিরা ঐ টুরিস্ট লজেই ছিলেন, অন্য একটা উইংয়ে। গঙ্গোত্রীটা খুব ভালো কেটেছে ওঁদের জন্যে। সমরেন্দ্র বললে, ‘আমাদের বিড়লা ধর্মশালাতে ঘর বুক করা আছে মা’র নামে, নবনীতাদি আপনি চিঠিটা নিয়ে যান, ২২-২৩ দুদিন থাকতে পারবেন। কেদারনাথে ঐটেই শ্রেষ্ঠ বাসস্থান।’

পুতুল, ঘুচাই ছুটল কবিতাদিকে ধরতে চিঠি এনে দেবে বলে।

হঠাৎ দেখি পিকোলো এদিকে ভয়ানক বিগড়ে গেছে। সে আর পাহাড় পর্বতে উঠবে না। কালকের মতো যদি বমি হয়? তার গা গুলোচ্ছে। তার মাথা ঘুরছে। তার পেটের মধ্যে কেমন-কেমন করছে। তার একটুও ভাল লাগছে না। তার দিম্মার জন্যে মন-কেমন করছে। তাওয়াং-এর জন্যে দুর্ভাবনা হচ্ছে। সেও আজই নেমে যাবে, ঘুচাইদের সঙ্গে দেশে ফিরে যাবে।

কিন্তু ঘুচাইরা তো এখনও দু’দিন থাকবে হৃষীকেশে। তারপর মুসৌরি যাবে। হরিদ্বারেও থাকবে। তাছাড়া ওদের ট্রেনে বুকিং আছে। তোর বুকিং নেই। অছাড়া তোকে নিয়ে ওরা ঘুরবে কেন? তোর তো বাসে ঘুরতে আরওই গা গুলোবে, পেট শূলোবে। বমি হবে। পর্দাটানা, নিঃশব্দ, ভি আই পি মোটর গাড়িতেই যখন এই কীর্তি তোমার! মা’র কোলে বালিশ পেতে শুয়ে শুয়ে এত মেজাজ গরম! ওখানে তো—?

বেশ, পিকোলো তাহলে হান্না আর অস্টেনের সঙ্গেই নেমে যাবে! ওরা যাচ্ছে এয়ার—কনডিশানড লাকসারি বাসে এখান থেকে দিল্লি পর্যন্ত। দিল্লি গিয়ে সে মিস্টার মুখার্জীর কাছে চলে যাবে। তাঁর স্ত্রী বন্দনা ওকে ট্রেনে তুলে দেবে। আর পাহাড় নয়। এবার সমতলে ফিরে সে যাবেই।—’কেদার-বদ্রী যাব না। না-না।’

কী ঝামেলা চেঁচামেচি, গুনগুন, আদর, ধমক, ভোলানি, বকুনি, সোনামণি, পাজিছুঁচো—চল্ তাহলে সবাই মিলে ফিরে যাই। এববিধ মিশ্রণের ফলে শেষ পর্যন্ত পিকোলোকে পর পর দু’বোতল ঠান্ডা গোলড স্পট খাইয়ে বদ্রীনাথ দর্শনে রাজি করান গেল। ইতিমধ্যে ঘুচাই যে গেছে কবিতাদির কাছ থেকে বিড়লার অনুমতিপত্র নিয়ে আসতে, যাতে আমরা গিয়ে কেদারনাথে আশ্রয় নাই—সেটা বেমালুম ভুল হয়ে গেল। তখন আমার একটাই উদ্দেশ্য, পিকোকে বগলে করে কোনোরকমে রওনা হয়ে পড়া। যাতে আবার কোনো সঙ্গী পেয়ে গিয়ে পিকো বিগড়ে না যায়। একেবারে চারদিন বাদে কেদারে পৌঁছে মনে পড়ল বিড়লার চিঠিটা নেওয়া হয়নি।

যুধিষ্ঠিরের সঙ্গী

গঙ্গোত্রী যাবার সময় আমরা উত্তরকাশী থেকে রওনা হয়ে সোজা হিমালয়ে উঠে যাই। কিন্তু বদ্রীনাথে যাবার জন্যে আবার নেমে যেতে হবে। ধরাসু, টিহরি, শ্রীনগরের পথ দিয়ে রুদ্রপ্রয়াগে পৌঁছতে হবে। মনে আছে বর্কোট থেকে ব্রহ্মখাল হয়ে ধরাসু আসার পথে পাহাড়ের গায়ে খাঁজ কেটে কেটে পাহাড়ীরা এমনই ক্ষেত তৈরি করেছে যে, হিমালয় পর্বতের ঢালু গা-টিকে যেন মনে হয় দূর থেকে দেখা বিপুল কারুকার্যখচিত উড়িষ্যার মন্দিরের গা। এমনিই আশ্চর্য গড়ন হয়েছে তার।

ধরাসুর কাছেই প্রথম দেখি নেকড়ে বাঘের মতো কুকুর। গোব্‌দা ঘাড়ে এক বিঘৎ চওড়া লোহার পাতের বলস বাঁধা, তাতে কাঁটা লাগান। বাপরে! এ আবার কেমন কুকুর? বোঝা গেল এরা পাহারাদার, শীপ-ডগ। ভেড়ার পাল সামলায়। সুরথ সিং জানায় এক-একটি কুকুরের দাম হাটে ৫০০ টাকা মিনিমাম। বেশিও হয় ট্রেনিং থাকলে। ‘পুলিশের মতো চৌকি দেয়।’ গলার কলারটি কেন লোহার এবং তাতে কাঁটা বসানো কেন? এবং অত চওড়া—পুরো ঘাড় জোড়া কেন? কুকুরটার ব্যথা লাগছে না?—’না না, ওর তলায় পুরু নরম কম্বলের লাইনিং দেওয়া আছে। এ কুকুর বাঘে ভয় পায় না। বাঘের সঙ্গে লড়াই করে। কিন্তু বাঘ যদি একবার ঘাড়টি কষে কামড়ে ধরতে পারে, তাহলেই কুকুর নট নড়ন-চড়ন, সিধে মরণ। তাই ঘাড়ে ওটা কলার নয়, বর্মই বলা যেতে পারে। বাঘেরই দাঁত ভেঙে যাবে ওটা কামড়াতে গেলে, যায়ও প্রায়ই। চওড়া লোহার বর্ম ওটা, যাতে বাঘ ঘাড় কামড়ে ধরতে না পারে।’

আমার আদরের তাওয়াং তো তিব্বতী, হাউন্‌ড, সেই তাওয়াং থেকে কোলে করে তাকে এনেছি, অবিকল এই জাতেরই কুকুর। একেবারে এরকম দেখতে। সুরথ সিং জানাল এই কুকুরগুলিও গাঢ়োয়ালী নয়, তিব্বতী, মানসসরোবরের ওদিক থেকে তিব্বতীরা নিয়ে আসে বেচতে। খুব সাহসী, খুব ইমানদার কুত্তা। ৫০০ টাকা দাম বটে, কিন্তু লক্ষ টাকার সম্পত্তি আগলায়। মানুষের চেয়ে ঢের ভালো। মেষপালকের ভগবান। এই রকমই একজন নিশ্চয়ই যুধিষ্ঠিরের সঙ্গী হয়েছিল হিমালয়ে।

রুদ্রপ্রয়াগের চটি

শ্রীনগর জায়গাটিও খুব সুন্দর, যদিও সেটা কোনো প্রয়াগ নয় এবং নিচের দিকে বলে অন্যান্য জায়গার তুলনায় একটু গরমও। (তবে টিহরির মতো নয়। টিহরি—গরমে দিল সে সবে শিহরি!) রুদ্রপ্রয়াগে এসে আমরা থামলুম। বেশ ক্লান্ত লাগছে শরীর।

গাড়ি কিছুটা ভুল রাস্তায় চলে গিয়েছিল, তাই রাত্রি হয়ে গেছে। আমার সঙ্গে গুচ্ছ গুচ্ছ চিঠি। কালী কম্বলীওয়ালার ধরমশালার জন্য এক গুচ্ছ আর সরকারি অতিথিশালার জন্য আর এক গুচ্ছ। কালী কম্বলীওয়ালা বহু গাড়ি ও তিনটি টুরিস্ট বাসের যাত্রীতে পরিপূর্ণ। স্থান নেই। রঞ্জন ফিরে এল।

সরকারি অতিথিশালাতেও কোনো ঘর বাকি নেই। তবে ডরমিটরিতে তিনটে সীট মিলতে পারে। মহা উল্লাসে তক্ষুনি তাই-ই বাগিয়ে ফেলি–এরপরে এটাও ফসকে যাবে, তখন কী করব? রুদ্রপ্রয়াগের টুরিস্ট লজটি ঠিক নদীর ধারে। প্রচণ্ড বেগে নদী ধাইছে ঘুরতে ঘুরতে—এটি অলকনন্দা। আর মন্দাকিনী এসে মিশেছে এরই সঙ্গে খানিক দূরে।

আহা, কী সব নাম! অলকনন্দা–মন্দাকিনী! যে-কোনো একটি নামের সঙ্গে দেখা হলেই মনপ্রাণ পরিপূর্ণ হয়ে যায়। এমন একটি নদী চর্মচক্ষে দেখলেই মনে হবে, যাক, এতদিন ধরে বেঁচে থাকা সার্থক। রুদ্রপ্রয়াগে এমন দুটি নদীর সঙ্গম।

যে-ঘরে আমাদের পাশাপাশি তিনটে খাটবিছানা দেওয়া হয়েছে সেই ঘরে আরও সতেরটি শয্যা আছে। একটিই আজ শূন্য। বাকি ষোলটিতে বোম্বাই-এর এক বাসভর্তি তীর্থযাত্রী আশ্রয় নিয়েছেন। আমাদের পাশেই একটি পিকোর বয়সী মেয়ে আছে, তার বাবার সঙ্গে সে তীর্থে এসেছে। বাবাকে খুব যত্ন করছে দেখলুম। মেয়েটির নাম কল্পনা দালাল, বি. এ. পড়ছে বম্বেতে।—’বাবাকে তুমি খুব যত্ন করো, দেখে বড় ভালো লাগছে কল্পনা। ‘

বলতে মেয়েটি চোখ নিচু করে চুপ করে রইল। একটু পরে বলল, ‘আমার মা এক মাস হল হঠাৎ মারা গেছেন। বাবা খুব ভেঙে পড়েছেন।’ একটু থেমে বলল, ‘এই ট্রিপটা বাবার পক্ষে খুব ভালো হল। আমরা বদ্রীনাথে যাচ্ছি, ব্রহ্মশিলার ওপরে মায়ের শ্রাদ্ধ-তর্পণাদি করে আসতে চান বাবা

বদ্রীনাথ শেষ ধাম। যমুনোত্রী, গঙ্গোত্রী, কেদারনাথ হয়ে গেছে কল্পনাদের। বম্বে থেকে কিছু গুজরাটি কিছু মারাঠি ভক্ত এসেছেন তীর্থ করতে। সাধারণত কিন্তু প্রত্যেকটা বাসই বঙ্গসন্তানে ঠাসা। হরিদ্বার থেকেই আসুক আর হৃষীকেশ থেকেই আসুক, দিল্লি থেকেই রওনা হয়ে থাক আর কলকাতা থেকেই—বাসের অর্ধাংশ ভর্তি থাকবেই বাঙালী যাত্রীতে। গঙ্গোত্রী যমুনোত্রীতে তবু প্রচুর উত্তরপ্রদেশী, গাঢ়োয়ালী, পাঞ্জাবী দেহাতী তীর্থযাত্রী আসে—কিন্তু কেদার-বদ্রী প্রধানত বাঙালীর তীর্থ।

ভোরবেলা ঘুম ভাঙল, দেখি খুব ব্যস্ততা বম্বের যাত্রীদের মধ্যে। ঘরের মধ্যিখানে একটা টেবিলে দুটো পাত্রে চা আর কফি—যে যা চাইছে তার গেলাসে তাই ঢেলে দেওয়া হচ্ছে। আমি আমার গেলাসটি নিয়ে গিয়ে বললুম—কফি! শুনে লোকটি হাঁ করে তাকিয়ে রইল। তারপর আমাকে অগ্রাহ্য করে অন্যদের পরিবেশনে মন দিল। আমি আরেকবার বললাম কফি! এবার লোকটি নাক কুঁচকে বলল, ‘বম্বাই বালোকো কফি হ্যায় ইয়ে, পাবলিক কফি থোড়াই হ্যায়!’

ছি ছি! লজ্জা পেয়ে পালাতে পথ পাই না। গ্রুপ ট্র্যাভেলের এই সুবিধা, ভোরবেলা কী সুন্দর চা কফি বিস্কুট দেয়। অগত্যা আমি একজন বেয়ারাকে ডেকে এনে টাকা দিলুম, ‘দয়া করে বাইরে থেকে তিনপেয়ালা চা এনে দেবেন আমাদের?’

রুদ্রপ্রয়াগের চিতার গল্পেই রুদ্রপ্রয়াগ নামটি আবাল্য পরিচিত। চা খেয়েই রুদ্রপ্রয়াগ থেকে বেরিয়ে পড়ি। পথে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছি—অনেক অচেনা, স্বপ্নে চেনা নাম। কর্ণপ্রয়াগ (পিণ্ডারগঙ্গা আর অলকনন্দা নদীর মিলন সেখানে), নন্দপ্রয়াগ (অলকানন্দা আর মন্দাকিনীর সঙ্গম; কোথাও যে ‘নন্দাকিনী’ নদী আছে, তাই জানি না), চামেলি, পীপলকোটি, যোশীমঠ। এখানে জগদ্‌গুরু শ্রীমদ্ শংকরাচার্যের মন্দিরটি রাস্তা থেকেই দেখা যায়, কিন্তু অনেকখানি, নামতে হয়, আবার তো উঠতে হবে? প্রথমে পীপলকোটিতে এবং তারপর যোশীমঠে অনেকক্ষণ গাড়ি থামাতেই হল। একমুখো রাস্তা, খোলা আছে কিনা, ‘গেট’ পাব কিনা। চা খেলুম। দু’জন সাহেব হিপি প্রায় নেংটি পরে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়েই সুখে গঞ্জিকা সেবন করছেন। এঁরা স্পষ্টতই পর্বতারোহী নন, ধর্মপাগল বলেও মনে হল না। এঁদের এখানে একটুও মানাচ্ছে না। চায়ের দোকানে দিব্যি থালায় করে ভাত-ডালও দিচ্ছে। আমরা একেবারে বদ্রীনাথ গিয়ে খাব। পিকোলোটা পথে খেতে চায় না, ওর গা-বমিবমি করে। সর্বত্র তো টিহরির ওয়েটিং রুম নেই।

জড়ায়ে আছে বাধা

এই যে আমি সপরিবারে, স-সংসারে বেড়াচ্ছি, বালতি-মগ-ইকমিক কুকারটাই যা সঙ্গে আনা হয়নি, এর স্বাদ কিন্তু মোটেই ভালো লাগছে না আমার। একা না হলে হিমালয়ের দিকে আসা উচিত নয়। এসেছি বটে, কিন্তু এ-ভাবে আসাটা কেমন যেন এলেবেলে হয়ে যাচ্ছে। মনটা কেবলই বাঁধা থাকছে ঘরে-সংসারে। রঞ্জন কী খেল, পিকো কেন দুধ খেল না, কার কী ওষুধ চাই, কাকে শান্ত করতে হবে, কাকে বকতে হবে—বাপরে বাপ। এর জন্যে এতদুরে কষ্ট করে না এসে তো হিন্দুস্থান পার্কে থাকলেই হত। তীর্থে আসা উচিত বোধ হয় হয় একেবারে একা নয়তো সমবয়সীদের সঙ্গে—যেখানে প্রত্যেকের নিজের দায়িত্ব নিজের। তাছাড়া হৃদয়মনও একতারে বাঁধা থাকা উচিত। এমনিতে পিকোর সঙ্গে, রঞ্জনের সঙ্গে আমার খুবই ভাব-ভালোবাসা। ওয়েভ লেংথের ফারাক নেই। অথচ হিমালয়ে এসে দেখছি সব গড়বড় হয়ে যাচ্ছে। হিমালয় মানুষকে এক করে দেয় যেমন তেমনি একাও করে দেয় তার মাঝে। আমি এখানে এসেও নবনীতা হইনি। মা থেকে গেছি, আর দিদি থেকে গেছি। এই মা আর এই দিদির চাপে নবনীতা মাথা তুলতে পারছে না।

পিকো বেচারারও দোষ নেই। তার সমস্যাটা শারীরিক। পাহাড়ী ঘুরপথে আমারও ছোটবেলায় ভয়ানক কষ্ট হত। বিয়ের পরেও অনেকদিন এই কষ্ট ছিল। সমানেই ‘অ্যাভোমিন’ ‘ড্রামামিন’ খেয়ে গাড়িতে ঘুরেছি। নিজে গাড়িটা চালালে কিন্তু আমার কার-সিকনেস হয় না। অন্যে চালালেই যত গণ্ডগোল। ১৯৭৫-এ শিলং যেতে গিয়ে আমার, পিকোর, টুম্পার তিনজনেরই এত কষ্ট হয়েছিল যে আর কখনও পাহাড়ে যাব না ঠিক করেছিলুম। এই বমি-ভাবের যন্ত্রণা যার হয় না তাকে বোঝানো যাবে না। তাই পিকোর ওপর চটেও উঠতে পারছি না। কি ভাগ্যি এ যাত্রায় আমার কার-সিকনেস হচ্ছে না। সেবার তাওয়াং যেতেও হয়নি। বোধ হয় অন্যান্য রোগের প্রকোপে এ রোগটা সেরেই গেল! সমুদ্রযাত্রাও আমি উপভোগ করতে পারি না এই কারণে। সি-সিক্ হবই হব। সেটা ‘কুইন এলিজাবেথ টু’-ই হোক আর ‘স্ট্র্যাথনেভার’-ই হোক, কি চ্যানেল পারাপারের একটা ইস্টিমারই হোক। আগে বিলেত থেকে প্যারিস যাবার সময়ে আমি তো প্রত্যেকবার স্টিমারে উঠেই ছুটতুম কেবিনের খোঁজে। যাতে শয্যাশ্রয়ী হয়ে পড়তে পারি। মাত্র ১০/১২টা বিছানা কম পয়সার পাওয়া যায়, সঙ্গে সঙ্গে দখল না নিলেই হাতছাড়া!

ইদানীং সে-ঝামেলা মিটেছে হভারক্রাফ্ট হয়ে। আন্দামান আমার জাহাজে যেতে ইচ্ছে, অথচ প্রাণে বমির ভয়। তাই পিকোর হঠাৎ সমতলে নেমে যাবার গোঁ-টা আমি বুঝতে পারি।

ত্রিশঙ্কু বাস

যোশীমঠ থেকেই নানারকম হিমালয়ান পর্বত অভিযানগুলি শুরু হয়। এটাকেই প্রথম বেস ক্যাম্প করে। আর ৭/৮ মাইল পরেই গোবিন্দঘাট—চমৎকার গুরদোয়ারা আছে, লগ্‌-ক্যাবিন আছে সেখানে। সেখান থেকেই হাঁটাপথে যেতে হয় ভ্যালি অব ফ্লাওয়ার্স আর হেমকুণ্ড। সুরথ সিং বললে, সে গোবিন্দঘাটে গেছে। গুরদোয়ারায় চমৎকার বিছানা দেয়। শুধু দাড়ি কামানো আর ধুমপান বারণ আছে। আর স্ত্রীলোকের রাত্রিবাস করার জায়গা নেই। অতএব গোবিন্দঘাট গিয়ে সুবিধে হবে না। ভ্যালি অব ফ্লাওয়ার্সের দিশি নাম নন্দন-কানন–এ বছর সেটি ভ্রমণকারীদের জন্য খোলা নেই। সরকারী কোনো লালফিতের কারণে বন্ধ রয়েছে। হেমকুণ্ডে যেতে হয় বেশ খানিক সময় নিয়ে। ওসব আমাদের এ যাত্রায় হবে না। আমরা অবশ্য আপাতত যোশীমঠ ছেড়েই উপরে উঠতে পারছি না, ‘গেট’ আর মিলছেই না! কী ব্যাপার? বাসের ড্রাইভারদের সঙ্গে কাদের যেন ঝগড়া হয়েছে। বাস-ড্রাইভাররা হঠাৎ স্ট্রাইক করেছে। পথ রুদ্ধ হয়ে আছে। তারা বদ্রী থেকেও নামছে না। এখান থেকেও উঠছে না। মিলিটারি পুলিশ নানাভাবে গোলমাল মেটাতে চেষ্টা করছে। অবশেষে ‘গেট খুলে দিল প্রাইভেট গাড়িদের ছেড়ে দেবে বলে। জমতে জমতে সকাল থেকে দিব্যি এক প্রমাণ সাইজের গাড়ির মিছিল খাড়া হয়ে গেছে যোশীমঠের গেটের সামনে।

ফাঁড়িতে একটি অল্পবয়সী মিলিটারি পুলিশ এসে আমাদের গাড়িতে লিফ্ট চাইল। বদ্রীনাথে কিছু পুলিশ যাওয়া দরকার। সব গাড়িতে-গাড়িতেই কিছু কিছু যাচ্ছে। পুলিশের এখন কোনো পাড়ি নেই এখানে। সুরথ সিং, রঞ্জনের সঙ্গে পুলিশটি বসল। স্কুল ফাইনাল পাস করে পুলিশে ঢুকেছে। বছর কুড়ি-বাইশ বয়েস হবে। আমাদের সঙ্গে খুব জমে গেল তার। সারা পথই হইহই করতে করতে গেলুম। খানিক বাদে দেখি লাইনের পর লাইন বাস নেমে আসতে শুরু করেছে। স্ট্রাইক ভঙ্গ হয়ে গেছে।

যাত্রীদের মুক্তি

যোশীমঠ থেকে রওনা হয়েই একটি বাস দেখলুম পথের ধারে ত্রিশঙ্কু হয়ে বিপজ্জনক ভাবে শূন্যে খাদের ওপর ঝুলে আছে। বাসে কেউ নেই। পুলিশ বললে, ১১ তারিখ থেকেই ওটি ওভাবে আছে। কেউ মরেনি। ওই ঘটনা অ্যাকসিডেন্ট নয়। ওখানটাতে এক আত্মা আছেন, তিনি এই টানাটানিটা করেন। আগেও অনেকবার ঘটেছে। তবে কাউকে প্রাণে মারেননা। কোনো সাধু-মহাপুরুষের আত্মা হবে। আজ বিশ তারিখ না একুশ তারিখ, এখনও বাসটি কেউ টেনে তোলেনি, এটাই অবাক কাণ্ড। গাড়োয়াল মণ্ডল বিকাশ নিগমের বাস। সুরথ সিং, সাবধানে চালিও ভাই, কে জানে কোথায় কোন্ আত্মাকে খচিয়ে দেব। শেষে ঠেলা মেরে দেবে! সব আত্মা তো সাধু-মহাপুরুষের নাও হতে পারে!

অলখ্ নিরঞ্জন

বেশ ক’দিন ধরেই একেবারে হৃষীকেশ থেকেই দেখছিলাম সারাপথ কিছু শিখ তীর্থযাত্রী হেঁটে হেঁটে ছুটে ছুটে চলেছেন। নিরঙ্কারী সর্দারও আছেন একটি একটি গ্রুপের সঙ্গে সঙ্গে গাঁদার মালা পরা। নীল পাগড়ি বাধা, সাদা কামিজ পরনে, কোমরে গেরুয়া, কোমরবন্ধে কৃপাণ ঝুলছে, হাতে পতাকা। যোশীমঠে এসে তাঁরা গোবিন্দঘাটের পথে চলে যাচ্ছেন।

এঁরা পুরনো দিনের নিয়মে তীর্থে বেরিয়েছেন। যাচ্ছেন গোবিন্দঘাটে শিখদের মহাতীর্থে, পুরোটা রাস্তা পদব্রজে। পথে থামতে থামতে, বিশ্রাম নিতে নিতে, দলে দলে চলেছেন। কখনও বা প্রার্থনাসঙ্গীত গাইতে গাইতে। রুদ্রপ্রয়াগ থেকে আজ তো সমানে একটির পরে একটি দল পেরিয়ে এলাম। বিশ বছরের তরুণ থেকে সত্তর বছরের বৃদ্ধ পর্যন্ত হাঁটছেন, নিষ্ঠার নির্মল শ্রদ্ধেয় মূর্তি, মন্ত্রপাঠ করতে করতে হাঁটছেন, দ্রুতপায়ে পার হয়ে যাচ্ছেন বাঁকের পর বাঁক। সন্ন্যাসীরা হাঁটছেন। সমস্তটা উত্তরাখণ্ড সন্ন্যাসীদেরই দেশ, তাঁদেরই মাতৃভূমি, তাঁরা তো হাঁটবেনই। কিন্তু পদচারী এই শিখ তীর্থযাত্রীরা বোধ হয় গৃহী। অন্তত সন্ন্যাসী কিনা বুঝতে পারিনি, কেননা লক্ষণ জানা নেই আমার। কী দিয়ে চিনব? যোশীমঠের পর থেকে আর শিখ যাত্রীদের দেখা গেল না। ওদের বর্ণময় উপস্থিতির অভাবে হিমালয়ের পথ একটু যে ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ল। জুন মাসে টরন্টোয় বসে যখন টিভিতে দেখছি, ভারতে এবং ভারতের বাইরেও শিখদের উন্মত্ত রোষবহ্নি—আমার ওই তীর্থযাত্রীদের মনে পড়ে যাচ্ছিল। মানুষ চায় এক, হয় আর। স্বর্ণমন্দিরের ব্যাপারে কেউ জেতেনি। পরাজয় হয়েছে প্রত্যেকের। শহীদ হলেও ভিন্দ্রানওয়ালে জেতেনি, সার্থককামা হয়েও ইন্দিরা জেতেননি। হিংস্রতা প্রত্যেকটি জয়কে পরাজয়ে পৌঁছে দিয়েছে।

অন্তঃসলিলা

বদ্রীনাথের পথ খুব চট করেই সুন্দর হয়ে উঠল। আস্তে আস্তে বরফের চাঙড়, বরফের দেওয়াল, বরফের গুহার আবির্ভাব ঘটতে লাগল পথের ধারে। থামো থামো করতে করতেই গাড়ি পার হয়ে গেল সেই অপূর্ব তুষারগুহা, তার ভেতরে ঠান্ডা নীল অন্ধকারে ঝরঝর শব্দে ঝরনা ঝরছে—যেন কোনো ইংরেজি সিনেমার সেট থেকে তুলে আনা। হায় হায় করতে থাকি। নামা হল না। ক্যামেরাটা রয়েছে কী করতে? ফটোও তোলা হল না। হা-হুতাশের মধ্যে দেখি, আরে! ঠিক আরেকটা অমনি গুহা এখানে, আরও তুষার আরও মোটা ধারার ঝরনা, আরও জটিলগুহাভ্যন্তরের বরফের জারি-কাটা জালির কাজ।

লাফিয়ে লাফিয়ে নেমে পড়লুম সবাই মিলে। ছবি তুললুম, রাঙামুখো সেপাইসুদ্ধু বরফের মধ্যে হুড়যুদ্ধ শুরু করে দিলে। পিকো আবার বরফের চাদর বেয়ে বেয়ে বাঁদরের মতো (কিংবা হিলারী-তেনজিংয়ের মতো) উপরদিকে উঠতে লাগল। তখনও বাচেন্দ্রি পাল এভারেস্টে চড়েননি, পিকোকে এই এক বছর ট্রেনিং দিলে, সে-ই পেরে যেতে বোধ হয় কাজটা। পাহাড়ে পায়ে হেঁটে তো চড়তে ওর আপত্তি নেই, পেট্রলচালিত শকটেই যত গণ্ডগোল। অতি কষ্টে ডেকে-ডুকে সুরথ সিং ও সেপাইজী পিকোকে নামালে—সত্যিই এটা একটা প্লেসিয়ার। এবং পিছল। হঠাৎ পা ফসকে পা পিছলে পড়লে কোথায় পড়বে তার ঠিক নেই। ডানদিকে পাহাড় আর বাঁদিকে অলকনন্দার খেলাধুলো। গ্লেসিয়ারের বরফের চাদরের তলা দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারছে তার ঘননীল উপল উচ্ছল জলরাশি। বরফ ওপরটাতে জমে আছে। তলায় স্বচ্ছ উচ্ছ্বসিত তরঙ্গ হৃদয়। অর্থাৎ অন্তরসলিলা হিমবাহ। দৃশ্যটি সত্যি অদ্ভুত সুন্দর। পাঁচটি পথের বাঁকে একই জায়গায় একই ভাবে এল এই বিশাল গ্লেসিয়ারটি। যা বোঝা গেল এটাকে কেটে কেটেই বাঁকে বাঁকে পথ তৈরি করা হয়েছে। মিলিটারির তৈরি রাস্তা, সর্বদা সযত্নে প্রস্তুত থাকে ট্যাংক ইত্যাদি বহনের জন্যে। বদ্রীনাথের পরেই ভারতের শেষ গ্রাম মানাগ্রাম। তারপর তিব্বত। সীমান্তসৈন্যের সদা জাগ্রত নজর থাকে এই পথের দিকে। গাড়ি থেকে নেমে প্রত্যেকবারই আমরা বরফের ঝরনায় খেলাধুলো করলুম। একসময়ে হঠাৎ বদ্রীনাথ এসে পড়ল।

বদরিকাশ্রমে

খোলামেলা উপত্যকা। মস্ত বড়। অনেকখানি খোলা। দূর থেকেই একবার দেখা গেল মন্দির। বিরাট দরজা মন্দিরের। বহুবর্ণ তোরণ। কাছাকাছি আসতেই মাইকে ভজন শোনা গেল। রামভজন। খুব সুন্দর সুর। ভারি চমৎকার একটা ভক্তির আবহাওয়া তৈরি হয়েছে। এই প্রথম দেখছি মাইকের কারণে ভগবদ্ভক্তি উবে না গিয়ে মনে আকুলতা আসছে। স্থানমাহাত্ম্য? পুলিশ নেমে গেল ফাঁড়িতে। আমরা খোঁজ করতে লাগলুম বাসস্থানের। রুদ্রপ্রয়াগের টুরিস্ট লজে বলেছিল এখানকার টুরিস্ট লজে খোঁজ নিতে। নয়তো দেবলোক হোটেলে। দুটোই ভর্তি। তখন আমি দেবলোকের পার্শ্ববর্তী ঝকঝকে ধর্মশালাটিতে বালানন্দ ব্রহ্মচারীর আশ্রমে খোঁজ নিই। হ্যাঁ, ঘর আছে। না, খরচ লাগে না। বিছানা ভাড়া পাওয়া যায়। খাবারের ব্যবস্থা নেই। সামনেই বাঙালীর হোটেল আছে, সুপ্রিয়া হোটেল, পাঁচ টাকাতে ভাত ডাল চচ্চড়ি দই পাবেন। আর কোনো কথা নয়, এইখানেই থাকব। জায়গাটি খুব ভালো। এবং সঙ্গে লাগোয়া কলঘর বালানন্দ ব্রহ্মচারীর আশ্রম মানে যে মোহনানন্দ মহারাজেরই গুরুদেবের আশ্রম সেটা এতক্ষণে খেয়াল হল। এখানেই তার মানে সেই ‘যদি হও সুজন’ ন’জন বঙ্গসন্তানও উঠবেন। তাঁরাও বালানন্দ ব্রহ্মচারীর শিষ্য। আর সেই চারজন ভদ্রলোক আর এক তরুণ সন্ন্যাসী দেওঘরবাসী, তারাও তাই। যমুনোত্রীতে, গঙ্গোত্রীতে, উত্তরকাশীতে তাঁদের দেখা পেয়েছি। বার বার একসঙ্গে নানাভাবে ছুঁড়ে দিয়েছেন ঈশ্বর আমাদের।

ভৈরবঘাঁটিতে উঠে আবিষ্কার করেছিলুম ওঁদের মধ্যে একজনের বয়স সত্তর, পায়ের আথ্রাইটিসে পঙ্গু ছিলেন, আরেক জনের অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল উরুর হাড় ভেঙে গেছে, তার জায়গায় লৌহশলাকা প্রবিষ্ট করানো আছে, তিনিও সত্তরের ঘরে—তাঁরা সবাই খচ্চরে চড়ে যমুনোত্রী, পদব্ৰজে গঙ্গোত্রী যাত্রা সম্পূর্ণ করেছেন বিনাবিঘ্নে। কিন্তু ওঁদের সঙ্গে অল্পবয়সীরাও তো? তাই ভৈরবঘাঁটিতে আমরা আগে পৌঁছোলেও, ওঁরাই জিপটা পুরো ভাড়া নিয়ে চলে গেলেন, আমাদের নিলেন না। আমরা বাসে গেলুম গঙ্গোত্রী। প্রচণ্ড ভিড়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। ফেরার সময়ে আগে আমরাই জিপ ভাড়া করেছিলুম, ৭ জন হয়ে গেছি ততক্ষণে, কবিতাদিদের ৪ জনকে সঙ্গে পেয়ে। ওঁরা অস্থির। জিপ পাচ্ছেন না, কেননা ২০শে গঙ্গাদশেরা, সেদিন ১৯শে লক্ষ লক্ষ মানুষ উঠে আসছে গঙ্গোত্রীতে, প্রচণ্ড ভিড়। ব্যস্ততা। আমরা কষ্ট করেও কিন্তু ওঁদের নিয়েছিলুম আমাদের জিপে। এই প্রথমবার এক জায়গায় এসেও ওঁদের সঙ্গে দেখা হল না।

সুপ্রিয়ার হোটেলের মালিকানি সুপ্রিয়া বলে এক বাঙালী মহিলা স্বয়ং। তাঁর কাজের লোকেরা তখন ঘুমিয়ে পড়েছিল। সুপ্রিয়াদির মা তাদের ডেকে তুললেন। দুটি অল্পবয়সী বাঙালি ছেলে। আমাদের গরম ভাত পরিবেশন করল তারা। সেখানে একটি সুন্দরী বালিকাকে দেখে চেনে-চেনা লাগল। খুকু, তোমার নাম কী? নীতা। নীপা-নীতার নীতা কি? তুমি কি নমিতার মেয়ে? বলতেই সে যেমন অবাক, ঠিক তেমনি খুশি। হ্যাঁ। সে নীপার বোন নীতাই। বাবার বন্ধু কানাই (গাঙ্গুলি) কাকাবাবুর নাতনী। গীতা (ঘটক) দিদির বোনঝি। সুপ্রিয়া তার জেঠিমা। যা বুঝলুম এই বাঙালী মহিলা ছেলেকে নিয়ে কলকাতা থেকে সুপ্রিয়া ট্রাভেলস্ এবং এখানে সুপ্রিয়া হোটেলটি চালান। দুটোই ব্যক্তিগত পরিদর্শনে খুবই ভালো চলছে। নীতা পরীক্ষার পর বেড়াতে এসেছে জেঠিমার কাছে। সুপ্রিয়ার মাও এসেছেন। ভালো ভাবেই সার্থক ব্যবসা চালাচ্ছেন। ট্র্যাভেলে ওঁর পুত্রটি ওঁর সহায়। এ বছর সে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া (Ph. D) খতম করেছে। বাঙালী মহিলাটি এই শীতেও প্রত্যহ স্বয়ং বাজার করে আনেন মানাগ্রাম থেকে। চাল, ডিম, সবজী ফল কিছুই বাকি থাকে না। খুবই ভালো লাগল বঙ্গমহিলার এই বাণিজ্যপ্রয়াস।

সুপ্রিয়ার হোটেলে ভাত খেয়ে আমরা বেরুই মন্দিরের রাস্তায়। মন্দিরে যাব পরে। শীত করছে। আমার শালটা তো রঞ্জন যমুনোত্রীর পথে হনুমানচটিতে হারিয়ে ফেলেছে। একটা শাল কিনে নিতে হবে। শুধু তো বদ্রীই নয়, কেদারেও যাওয়া আছে। সেটা তো চোদ্দ হাজার ফিট। আরও শীত করবে। বেশ সুন্দর একটা নরম গরম লেডিজ লুধিয়ানা শাল পঞ্চাশ টাকায় কিনে ফেলা হল। চারিদিকে বাজার বসেছে। কত রকমের কুঙ্কুম, সিঁদুর। বদ্রীর লক্ষ্মীর সিঁদুরকৌটো, পুঁতির মালা, তামা-পেতলের আংটির ছড়াছড়ি। আর আছে চারধামের ছবির বই, বদ্রীনাথের পট। এ ছাড়া পবিত্র অলকনন্দার জল বয়ে নিয়ে যাবার ছোট-বড়ো হাজার রকম ঘটি। গঙ্গোত্রীতেও ছিল। এক যমুনোত্রীটাই যা জংলী ঠাঁই। তবে বদ্রীনাথ প্রায় বদ্যিনাথের মতোই মফঃস্বল শহরের চেহারা নিয়েছে। সরকারি মস্ত ডাকঘর। বেশির ভাগ বাড়িই কোনো না কোনো প্রতিষ্ঠানের বা ব্যক্তির অতিথিনিবাস, ধর্মশালা। একটা সংস্কৃত স্কুলও যতদূর মনে হয় চোখে পড়েছিল। সিনেমা হল ছিল কিনা জানি না। খোঁজ করিনি। পথের লোকেদের হাতে কিন্তু ট্রানজিস্টার ছিল না। সর্বত্রই শোনা যাচ্ছে মন্দিরের ভজন। দোকানদারও গুনগুন করে গেয়ে উঠছে রামায়ণেরই দু’কলি।

মন্দিরেরই রাস্তায় এইসব বাজার। এবং প্রচুর চায়ের দোকান। দোসা, ইডলি, কফির দোকান আছে, অমলেটও পাওয়া যায় শুনলুম, যদিও সারা উত্তরখণ্ডেই মাছ-মাংস-ডিম রান্না হত না এককালে। আর উঃ, কী ভিখিরির অত্যাচার! বদ্রীনাথে ভিখিরিদের আর পাণ্ডাদের রাজত্ব। অলকনন্দা পার হয়ে মন্দিরে যেতে হয়। সেতুর দু’ধারে ভিখিরিরা মিছিল করে বসে আছে। পুণ্যার্থী পয়সা ফেলতে ফেলতে যাচ্ছেন। সেতুতে ওঠার খানিক আগে থেকে শুরু হয়ে যায় এই ভিখিরির কিউ। এক একজন ভিখিরি আবার যে-সে ভিখিরি নয়। তাদের ছোটখাটো ব্যবসা আছে। বাটা নিয়ে খুচরো যোগান দেয় তারা যাত্রীদের, এক টাকার খুচরো নিলে ১৫ পয়সা বাটা লাগে। সেইসব খুচরো আবার ভিখিরিদের থালায় ফেরত যায়।

মুনস্টোন ব্ল্যাকস্টোন

রাস্তায় হাঁটছি, পথের দু’পাশে কত রকমের যে সাধুবাবাদের আস্তানা। কেউ আসল, কেউ নকল। আমি দেখে অত বুঝি না। যাকে ইচ্ছে হয় পয়সা দিই। সবাই পয়সা চায়ও না। কেউ ধুনি জ্বালিয়ে ব্যোম হয়ে, কেউ সামনে মালা, পাথর, আংটি নিয়ে, কেউ শেকড়বাকড় জড়িবুটি নিয়ে বসে আছে। একজন সাধুবাবা, মাথায় মস্ত রাজপুত পাগড়ী গেরুয়া রঙের, পরনের ধুতিও গেরুয়া, হঠাৎ পিকোকে ডেকে বললে—’ও খুকি, এত রাগ ভালো নয়, রাগ একটু কমাও, একটা মুনস্টোন পরিধান কর। তোমার মনটা খুবই নরম, কিন্তু একটুতেই ভয়ানক চটে ওঠা পিকো তো অবাক! এবং আমি তো ভাবলুম বুঝি এক্ষুনি চটেও উঠবে : ‘কে তোমাকে এসব বলতে বলেছে?’ কিন্তু চটল না। বদ্রীনাথের পথে সারাক্ষণ থেমে থেমে বরফের গুহায় ঝরনায় এত খেলা করে তার মেজাজ বেশ প্রফুল্ল। আর বদ্রীনাথে পৌঁছে চতুর্দিকের সবুজ উপত্যকা, বাতাসে ভজনের সুর, আকাশে নরনারায়ণ, নীলকণ্ঠ শিখরের হিমেল শোভা তার মেজাজ ঠান্ডা করে দিয়েছে। মজা পেয়ে পিকো দাঁড়িয়ে পড়ল। আমিও। সাধুটি পিকোকে বলল, তোমার মন বড় ছটফট করে। পড়াশুনোয় মন বসে না। তুমি একটা মুনস্টোন পরে নাও। আর তোমার মা-বেচারীর বড় ঝামেলা, একা-একাই সংসারটা সব দেখতে হয়। তোমার বাবা তো কোনো কাজের নন, সংসার দেখেন না। তোমার মাকে সাহায্য করবে। তোমার মা চাকরি ছাড়াও অন্য যে-কাজটা করেন, সে ব্যবসায় ওঁর খুব উন্নতি হবে। আর তোমার দিদিমার জন্যে একটা ব্ল্যাকস্টোন নিয়ে যাও—শনির দশা চলছে। রঞ্জনকে বললে, তোমার কেবলই নতুন নতুন ব্যবসার ফন্দি, কোনোটাই হবে না। ব্যবসা কর না, চাকরিই তোমার ভালো।

চিরদিন শুনেই আসছি তীর্থে-তীর্থে একরকম সব সাধুবাবা থাকেন। চোখে না দেখলে যেন মজাটা সম্পূর্ণ হত না!

সাধুবাবার কেরামতি দেখে আমরা থ’। তিনি স্টোন বেচতে এসব বলছেন কিনা বোঝা গেল না। কেননা পিকোকে তিনি মুনস্টোন ধারণ করতে বললেন, কিন্তু তাঁর নিজের ঝুলিতেই চন্দ্রকান্ত মণি নেই। অন্য কোথাও কিনে নাও, বললেন। এখানে অনেক পাবে। ব্ল্যাকস্টোন কাকে বলে জানি না, একটা কিনলুম মা’র জন্যে। সেটা কলকাতা অবধি এসেছিল কিন্তু মায়ের আঙুলে ওঠেনি। হারিয়ে গেছে। মা বললেন, উনি পাথর ধারণ করেননি কখনও, করবেনও না শেষ বয়েসে। যে যাই বলুক। আমিও ওসব পরিনি। কিন্তু এ কথাও মিথ্যে নয় যে পিকোর স্বভাবে হঠাৎ মনোনিবেশ ব্যাপারটা সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। সাধুটি বুঝল কি করে? পিকোকে দিল্লি থেকে একটা মুনস্টোনের আংটি এনে দিলুম। সে ‘থ্যাংকিউ মা’ বলে মিষ্টি হেসে নিলে। তারপর থেকে দেখছি সমানেই আমার ছোট মেয়ে টুম্পা সেটি পরে বেড়াচ্ছে। রঞ্জন এঞ্জিনিয়ার। কিন্তু চাকরিতে সন্তুষ্ট না থেকে সত্যি সত্যি নানা রকমের ব্যবসার চেষ্টা করত। উপরির ধান্দায় ঘুরতো দিনরাত। কোনোটাই সফল হত না সেও ঠিক। রঞ্জন সেই বছরেই ঐ চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। এখন দিল্লিতে ঠিক ডবল মাইনের একটা চাকরি করছে। ওর হাতে বদ্রীর একটা তামা পেতলের আংটি আছে। এখনও ও তো বলে, ওটার জন্যেই সব উন্নতি! পঁচিশ পয়সা দাম ছিল আংটিটার। পিকোর বাবা কোনো কাজের নয়—একথা তাঁর পরম শত্রুও বলবে না। তিনি প্রচণ্ড কর্মীব্যক্তি, বিশ্রামহীনভাবে দিবারাত্র পড়াশুনা করেন। তবে হ্যাঁ, ঘর সংসার দেখবার মতো অতটা সময় তাঁর কই। সাধুটা কেমন করে কী বলল কে জানে। সাধুর দেশ কোথায়? বললে, জয়পুর। ললাটলিপি পড়তে পারি। কলকাতাতেও যাই মাঝে মাঝে। ডালহাউসিতে (না ব্রেবর্ন রোড, কোথায় যেন?) ইউ. বি. আই আছে, তার কাছেই ফুটপাথে বসি। রঞ্জন বলেছিল, খুঁজে বের করবে। আর আমি ‘চাকরি ছাড়াও’ যেটা করি, সেটা যদি এই কলম ঠেলা হয়, তবে সেটাকে ‘ব্যবসা’ বলায় পিকোরা খুব মজা পেয়ে গেল।—’কি গো, ব্যবসা কেমন চলছে?’ বলে খ্যাপাতে লাগল। ভুল-ঠিক যাই হোক, সাধুবাবার অলৌকিক ক্ষমতায় মুগ্ধ হয়ে আমরা মন্দিরের আশেপাশে ঘুরে অলকনন্দার উন্মত্ত ঘূর্ণিস্রোতের সৌন্দর্য সন্দর্শন করে বালানন্দ ব্রহ্মচারীর আশ্রমে ফিরলুম!

দুরাকাঙ্ক্ষীর স্বর্গারোহণ

মানাগ্রামে যেতে হবে এইবার। বিশ্রাম হয়ে গেছে সুরথ সিংয়ের। একজন বাঙালী ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হল। তিনি ডানলপে চাকরি করেন। আমাদের সঙ্গে তাঁকেও মানাগ্রামে ধরে নিয়ে গেলুম। মানাগ্রামে যেতে হলে অলকনন্দার ওপারে যেতে হয়। চমৎকার দৃশ্য। অনেকখানি গ্লেসিয়ার পার হতে যেতে হবে। গাড়ির রাস্তা শেষ। বরফের মধ্যে পায়ে-চলা পথ রয়েছে। পাথুরে রাস্তা থেকে নেমে সেখান দিয়ে ওপারে গিয়ে নদীর ধার দিয়ে গিয়ে সেতু পার হয়ে যেতে হবে। এদিকে ছোট্ট মিলিটারি ফাঁড়ি মতন আছে একটা। সেখানে গাড়ি রেখে গেলেই হবে। মানাগ্রামটি ছবির মতো দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। তারও পিছনে দেখা যাচ্ছে বসুধারা জলপ্রপাতের দীর্ঘ জলধারা। আমার ওখানেই যাবার ইচ্ছে। মানাগ্রামের পথেই ব্যাসগুহা। যেখানে ব্যাসদেব তপস্যা করেছিলেন।

বসুধারা জলপ্রপাতের কাছ অষ্টবসুরা আট ভাই তপস্যা করেছিলেন। বদ্রীনাথ থেকে ‘সত্যপথ যাত্রা’ বলে আগেকার দিনে একটি তীর্থযাত্রা ছিল, এখনও যাত্রীরা যায়। সারাদিন লাগে। আষাঢ় শ্রাবণ মাসে ছাড়া এপথে যাত্রা হয় না। বরফ ঢালা রাস্তা দিয়ে, বসুধারা পেরিয়ে, মুকুন্দ গুহা চক্রতীর্থ পেরিয়ে সত্যপথ সরোবর, সেখান থেকে চন্দ্রকুণ্ডে ও সূর্যকুণ্ডে যাওয়া যায়। এ অঞ্চলে পুরনো মুনি-ঋষিদের বহু গুহা পড়ে আছে। চমৎকার দৃশ্য। একেই নাকি আগে বলত ‘স্বর্গারোহণ’। এটাই সশরীরে স্বর্গে যাওয়ার পথ।

মানাগ্রামে গেলে ভীম-পুলটাও দেখা হয়। ভীম নাকি বড় বড় কালো কালো পাথরের চাঁই ফেলে এই প্রাকৃতিক পুল তৈরি করেছিলেন। অলকনন্দার জল এখানে উদ্দাম হয়ে ফুঁসছে।

মানাগ্রামের বাসিন্দারা সবাই উপজাতীয়, তারা তিব্বতের সঙ্গে উলের ব্যবসা করত। চিনযুদ্ধের পর সেসব বন্ধ।

এখন ওদের বোনা কম্বল আর শাল ‘খাদি গ্রামোদ্যোগ’ কিনে নেয়। ভেড়া পোষা, উল তৈরি, তাতে বোনা সবই গ্রামের লোকেরা করে। গ্রাম ছাড়িয়ে আর কয়েক কিলোমিটার গেলে মানা-পাস, মানা-গিরিপথ। সেখানে যেতে দেয় না, মিলিটারি পাস চাই।

যেতে দিলে মানা-গিরিপথ দিয়ে সশরীরে যেখানে যাওয়া যেত সেটা স্বৰ্গ নয়, তিব্বত। এবং প্রায়ই তিব্বত থেকে রিফিউজি মানুষ চলে আসে এপারে পালিয়ে চাকরির আশায়, উন্নতির আশায়। আমাদের সঙ্গেই তো দেখা হয়ে গেল একটা ছেলের। বছর ষোলো-সতেরোর ছেলে হবে–আমাদের সঙ্গে জুটে গেল হঠাৎ। ‘মেমসাব কাম দো! হমকো সাথমে লে চলো! কেবল মোট বইবার কাজটা আমি পারব না, আর যে কোনো কাজ করতে পারি।’

‘কেন? মোট বইতে পারবে না কেন?’

‘মোট বইতে বইতে মুখে রক্ত উঠে আমার পিতাজী মরে গেলেন যে—আমার মা বারণ করে দিয়েছে—মোট বইবার কাজ ছাড়া অন্য যে কোনো কাজ—পেট চলে না মেমসাব—ছেলেটির ফুলের মতো মুখখানি দেখে মন খারাপ হয়ে যায়। আমার কী ক্ষমতা যে আমি তার পেট চালানোর ব্যবস্থা করব! যিনি সকলের পেট চালান তিনিই তোমার পেটও চালাবেন বাছা বদ্রীনাথকে বলো। আমাকে বলে কী হবে? আমার দেশ অনেক দূরে, সেখানে চলে গেলে তোমার মায়ের কাছে ফেরা খুব কঠিন হয়ে যাবে। বরং এখানে চায়ের দোকানটোকানে কাজ খোঁজো।

ও চাঁদ

সন্ধে হয়ে গেল ধর্মশালায় ফিরতে। টর্চ যদিও আছে, ঘরে মোমবাতি চাই। এঁরা আলো দেন না। বাজারে যেতে হবে বাতি কিনতে। আলোচনা করছি, হঠাৎ একটি ছেলে উঠে এল। ধর্মশালার সামনে অনেকে বসে আছেন, গল্পসল্প করছেন, প্রত্যেকেই বাঙালি বলে মনে হচ্ছে। ছেলেটি এসে বলল—কী দিদি, মোমবাতি চাই? দাঁড়ান এক মিনিট-বলে দৌড়ে ভেতরে ঢুকে গেল। ফিরে এল একটা মোটা মোমবাতি নিয়ে। ছেলেটার নাম অলোকনাথ। একলাই এসেছে কেদারবদ্রী ঘুরতে। আমাদের দলের সঙ্গে ওকে জুড়ে নিলাম বিনা বাক্য-ব্যয়ে। বাক্য অবিশ্যি বিশেষ ব্যয় করে না ছেলেটি। নদীর ধারে একটা মাদ্রাজী দোকানে দোসা কফি দিয়ে ডিনার সেরে নিলুম। জানলা দিয়ে অলকানন্দার মত্ততা দেখা যাচ্ছে, তার ওধারে মন্দির মন্দিরে ঘণ্টা বাজছে। আজ সব ঘুরে দেখে এসেছি। কাল যাব বদ্রীনারায়ণ দর্শনে। গলির পর গলি, তাতে ভোগ আর প্রসাদ বিক্রি হচ্ছে। বদ্রীনাথের প্রসাদটি ভারি ভালো। মেওয়া, শুকনো ফল, ডাল ও মুড়কির প্রসাদ। নানা রকমের ডালা পাওয়া যায় এখানেও।

পাঁচসিকে থেকে শুরু করে হাজার টাকার পর্যন্ত পুজো আছে। মন্দিরের পাশে একটা নোটিস বোর্ডে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া আছে বিভিন্ন দামের পুজোর। এটা আমি খেয়াল করিনি—অলোক বললে।—দূর শালা, ঠাকুর-দেবতাকে নিয়ে ঘোর ব্যবসা ফেঁদেছে ব্যাটারা! পঞ্চাশ টাকার পুজো, পাঁচশো টাকার পুজো, ছি ছি, কী লজ্জা!—‘

আমরা আগামীকাল মন্দিরে যাব, ঐ ৫ টাকার পূজোই যথেষ্ট আমাদের পক্ষে। ৫ টাকাতে যদি পছন্দসই প্রসাদ না থাকে, তবে অবিশ্যি ১১ টাকাতে উঠতে রাজি আছি।

চমৎকার একটা সর্বগ্রাসী চাঁদ ইতিমধ্যে উঠে পড়ল আকাশে। চাঁদের আলোয় মুহূর্তের মধ্যে একেবারে পালটে গেল বদ্রীনাথের উপত্যকা। ভজনের সুর এখনও বন্ধ হয় নি। সব ঘরদোর যেন এক মিনিটেই তরল হয়ে গেল, যেন কোথাও কোনো ইট কাঠ পাথর নেই—এই যে উত্তুঙ্গ হিমালয়—সেও যেন জমাট কিছু আলো আঁধার মাত্র। একুশ হাজার ফুট উঁচুতে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছেন রজতনিভ নীলকণ্ঠ পর্বত-নর আর নারায়ণ দুই শিখরকে দুই পাশে নিয়ে। দেখে দেখে যেন আশ মেটে না। এদিকে ঘুম পাচ্ছে, শীত করছে। ঘরে এসে ঢালা সতরঞ্চি পাতা। তক্তাপোশে ভাড়া করা নরম পরিচ্ছন্ন লেপ তোশক পেতে, নিজেদের সঙ্গে তো বালিশ আছেই—শুয়ে পড়া গেল। জানলা ঘরের মধ্যে মাত্র একটি। জানলা বন্ধ না করলে শীত,—এদিকে সব বন্ধছন্দ করে আমি ঘুমোতে ভালবাসি না। অতএব একপাল্লা খুলে রাখার ব্যবস্থা। ঘরের মধ্যে ধূমপান করতে রঞ্জনকে আমার কড়া নিষেধ। যেহেতু আমি আর পিকো শুয়ে পড়েছি; রঞ্জনের খাটটাও ওদিকেই—ও ভাবল চুপিচুপি জানলায় গিয়ে লুকিয়ে একটা সিগারেট খেয়ে নেবে। ঘরটা বড়। এদিকে শুয়েছি আমরা, অত টের পাব না, ধোঁয়া যদি ঘরে না ঢোকে। কিন্তু জানলায় দাঁড়িয়েই রঞ্জন সব ভুলে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠল।—’দিদি! দিদি! পিকো! পিকো! ওঠ! ওঠ! এদিকে আয়!’ হাতের সিগারেট হাতেই রইল জলজ্যান্ত সাক্ষী হয়ে। আমরা ‘কেন? কেন? কী বল, কী হল?’ বলে পড়িমরি করে ছুটে গেলুম। গিয়ে দেখি জানলায় চাঁদসমেত নীলকণ্ঠ! যে দৃশ্য ছেড়ে কিছুতেই ঘরে আসতে চাইছিলুম না, সেই দৃশ্যই বরং আরও অপরূপ হয়ে দোতলার জানলার ফ্রেমে এসে ধরা দিয়েছে। মাথায় গলায় বেশ করে কম্ফর্টার জড়িয়ে, হি হি করে কেঁপে, ঘরটর সব ঠান্ডা করে ফেলে আমরা অনেক রাত পর্যন্ত জানলা খুলে চন্দ্রমৌলি নীলকণ্ঠকে দর্শন করলুম—যতক্ষণ না চাঁদ ম্রিয়মাণ হয়ে নীলকণ্ঠর গলা ছেড়ে দিয়ে নিজের দেশে ফিরে গেল।

পর্দা-বেপর্দা হ্যায়

সকালবেলায় করিডরে চা-ওলা চলে এল—’চা! চা! চা! গরম চা চাই’—পরিষ্কার বাংলায়। সুপ্রিয়া হোটেলের সেই ছেলেরা। দু’জনেরই কবির নামে নাম। একজন জয়দেব আর একজন কালিদাস। অনেকদিন আছে সুপ্রিয়া ট্র্যাভেলসের সঙ্গে। চা খেয়ে মুখ ধুয়ে জামাকাপড় বগলে নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। অলোকনাথ এসে গেছে। আমরা হাঁটতে হাঁটতে নদী পেরিয়ে চললুম তপ্তকুণ্ডে। তপ্তকুণ্ডে স্নান করে, ব্রহ্মশিলায় পিতৃতর্পণ করে, বদ্রীনারায়ণ দর্শন করে ব্রেকফাস্ট খাব।

তপ্তকুণ্ড দু’চারটে আছে। প্রধান যেটা, তার পাশেই একটা কুণ্ড আছে ‘মহিলাদের জন্য’। অলোক আর রঞ্জন গেল খোলা তপ্তকুণ্ডে, আমি আর পিকো গেলুম একটু আরুর খোঁজে। সেখানে সত্যি ঢাকা জায়গা, পরিচ্ছন্ন, জলও পরিষ্কার। তবে প্রচণ্ড গরম। জলে নামা প্রায় অসম্ভব। এক মোটা পাঞ্জাবিনী ঘাটে বসে বালতি ঘটি নিয়ে স্নান করছেন। উল্টোদিকে ৩/৪টি বালিকা জলে নেমে খেলা করছে। নামল কী করে? আমি একটু একটু তবু জলে নামছি—পিকো তো একটুও না। শেষে ঐ মহিলার ঘটিটা চেয়ে নিয়ে স্নান সারতে হল। কিন্তু ভিজে কাপড় বদলাতে গিয়ে দেখি এক মজা। এদিকে ঢাকাঢুকি, কিন্তু একতলা উঁচু দেওয়ালের ওপাশে তিন-চারতলা উঁচু ধর্মশালা। তার প্রতি তলায় বারান্দায় বারান্দায় দর্শকের ভিড়। আমরা হলাম দ্রষ্টব্য। বড়ই লজ্জার ব্যাপার। কী আর করা। ওদিকে পাঁচিলের ওপর থেকেও উঁকি দিচ্ছে পুণ্যলোভী পুরুষমানুষের হাত, কপাল, চক্ষুতারকা। ভক্তের জন্যে ভগবানের কী আশ্চর্য ব্যবস্থা। মন্দিরের ঠিক সামনেই স্বাভাবিক উষ্ণনির্ঝর—একেবারে হিমশীতল অলকনন্দার গা দিয়েই উঠে এসেছে তপ্তকুণ্ড। যমুনোত্রীতেও এই জিনিস দেখেছি। গঙ্গোত্রীতেই কেবল কোনো উষ্ণকুণ্ডের খবর পাইনি। কেদারনাথের পথে শুনেছি গৌরীকুণ্ডেও এমনি উষ্ণপ্রস্রবণের কুণ্ড। যাত্রীদের ক্লান্তি অপনোদনের কী চমৎকার সুব্যবস্থা।

প্রবঞ্চক, সাবধান!

স্নান সেরে আমি অলোক আর রঞ্জন চললুম ব্রহ্মকপালী শিলার খোঁজে, পিতৃতর্পণ করব। পিকো লাফাতে লাফাতে ক্যামেরা নিয়ে মন্দিরে গেল। পিণ্ডদানের নানা বিচিত্র ব্যবস্থা। হরেক রকম দামের পিণ্ড দিতে পারেন। কেবল আপনার পিতৃকুলের কার কত টাকা পর্যন্ত নৈবেদ্য প্রাপ্ত হতে পারে, হিসেব করে নিন। চাল, কলা, পৈতে, হণ্ডুকি—কী সব যেন আছে একটা পাতায় মোড়া। গঙ্গাতুলসীও আছে দেখলুম। গঙ্গার ধারে সারি সারি পাণ্ডারা বসে শ্রাদ্ধতর্পণ করাচ্ছেন যাত্রীদের। প্রচুর দেহাতি মানুষ দেখলুম এখানে।

সকালবেলায় আমাদের ঘরে একজন দীর্ঘ গৌরবর্ণ সুদর্শন পুরুতঠাকুর এসে আমাকে একটা কার্ড দিয়ে গেছেন। শ্রীযুত ভট্ট, তিনি বাঙালীদের পাণ্ডা। অবশ্য পাণ্ডা শব্দটা তাঁর পছন্দ নয়, কার্ডে লেখা আছে তীর্থগুরু (ব্র্যাকেটে পাণ্ডা)। তিন পুরুষের নাম আছে কার্ডে। এবং বদ্রীনাথের, দেবপ্রয়াগের, হরিদ্বারের ও কলকাতার চারটি ঠিকানা আছে। এছাড়া ছাপা আছে, তাঁরা নিম্নলিখিত আশ্রমের ও ব্যক্তির তীর্থগুরু। ভারত সেবাশ্রম, দেবসংঘ, গৌড়ীর মঠ, আনন্দময়ী মায়ের আশ্রম, শ্রীমোহনানন্দ ব্রহ্মচারী মহারাজ ও শ্রীসীতারামদাস ওঙ্কারনাথ মহারাজ। এতগুলি নাম? প্রায় সব ক’টি বাঙালী ধর্মগুরুর ও আশ্রমেরই ভার নিয়ে বসে আছেন যে এই ভট্ট পরিবার! বেশ, আমাদেরও তবে তর্পণ করিয়ে দেবেন। কার্ডের নিচে বড় হরফে ছাপান আছে, ‘বিঃ দ্রঃ-প্রবঞ্চক হইতে সাবধান থাকিবেন।’

স্নান সেরে উঠে যেখানে ভট্টবাবুর দেখা পাবার কথা ছিল সেখানে তাঁকে পাওয়া গেল না। তিনি কোনো শাঁসাল মক্কেল পেয়ে গেছেন নিশ্চয়। মনে বেশ হালকা বোধ করলুম। নিজের মনে ব্রহ্মশিলায় গিয়ে এবার জলে পিণ্ড অর্পণ করি। পিণ্ডের সঙ্গে সঙ্গে পা পিছলে আমিও পড়ে যাচ্ছিলুম জলে। ‘যা চেয়েছ তার কিছু বেশি দিব’ বলে পিণ্ডের সঙ্গে পিণ্ডদাতাও সশরীরে গিয়ে স্বর্গে উপস্থিত হলে কি জানি পিতা আর শ্বশুরমশাইয়ের কেমন লাগত!

রঞ্জন খপাৎ করে ধরে ফেলে সেটা হতে দিলে না। অলোকও একজন পাণ্ডা পাকড়ে বাবার শ্রাদ্ধশান্তি করে নিলে। মাত্র বছরখানেক হল সে পিতৃহীন হয়েছে, এখনও গুরুদশা চলছে। হঠাৎ মনে পড়ল সেই কল্পনা দালালের কথা। তার মায়ের শ্রাদ্ধ এই ব্রহ্মশিলায় করবার ইচ্ছে ছিল তার বাবার।

পথের শেষ কোথায়

কী আশ্চর্যই লাগে আমাদের এই পিণ্ডদানের রীতিটাকে আমার। সব সুন্দর জায়গাতেই আগে আমরা ঈশ্বরের পীঠস্থান রচনা করি, আর ঈশ্বরের সামনে এসে দাঁড়াতে গেলে আমরা একবার শ্রদ্ধায় কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করে নিই আমাদের জন্মের কারণকে। জন্মদানের জন্য। এই যে এতদূরে আজ এসে পৌঁছেছি, এই যাত্রা শুরু করে দেওয়ার জন্য পিতৃপুরুষকে ধন্যবাদ দিয়ে তবে আমাদের পুণ্য অর্জন হয়। হিন্দুধর্মের মধ্যে চট করে নেমকহারামির সুযোগ নেই। পিণ্ডদান, পূর্বপুরুষকে তৃষ্ণায় জল দান এই যে অচ্ছেদ্য যুগযুগান্তের মধ্যে যোগাযোগ সংরক্ষণ, এই ব্যাপারটার মধ্যে একটা আত্মিক সৌন্দর্য আছে। নম্রতার, কৃতজ্ঞতার একটা শোভা আছে। মন্তকমুণ্ডনে যে বিনয়, আত্মসুখ-বিসর্জনের যে বিমল প্রভা আছে, অশৌচ পালনের মধ্যে যে হাহাকার আর অভাববোধের প্রকট অনুভব—সেগুলি আধুনিকতার নাম করে চিন্তাহীন কুলোর বাতাসে অযথা উড়িয়ে দিচ্ছি আমরা। পরে আর ডেকেও আনতে পারব না ফিরিয়ে। রিচুয়ালভক্ত আমি এমনিতে নই। কিন্তু মৃত্যু সম্পর্কিত রিচুয়ালগুলি আমাকে আন্তরিক স্পর্শ করে। পুজোআচ্চায় বিশ্বাস করি না। আমার ধারণা ভগবান খুবই চালু ব্যক্তি, দ্রুততম ইলেকট্রনিক ডিভাইসের চেয়েও দ্রুত তিনি মনের কথা পড়ে নেন। পুজোপাঠের কোনো দরকার হয় না। প্রাণে ভক্তি থাকলেই হল। সেটা ওঁর কম্পিউটারে নোট করা হয়ে যায়, এড়ায় না কখনও।

একদিক থেকে দেখলে সত্যি এইসব পিণ্ডদান-টানের মানে নেই। কেননা যে মানুষ মরে যায়, সে মানুষ ভাত খায় না, জলপানও করে না। তবে কেন ভালো লাগা? যে মানুষটি বেঁচে আছে, যে মরে যায়নি, কিন্তু একদিন মরে যাবে, যার সব কর্মকাণ্ডের শেষেই স্থির দাঁড়িয়ে আছে সেই অসীম ধৈর্যশীল পাওনাদার—মৃত্যু, এইসব তুচ্ছ অনুষ্ঠান তারই জন্যে। যে পিণ্ড দান করে, তারই তো তর্পণ, তারই তৃপ্তিসাধন। মৃতব্যক্তি নিমিত্ত মাত্র। যাকে পিণ্ড দেওয়া হয়, সে এসবের পরোয়াই করে না।

পিতাকে পিণ্ডদান করে অলোকই তার পিতৃদায় উদ্ধার করল। তার পিতার এতে কোনোই দায় ছিল না। অলোকই মনে মনে বাঁচিয়ে তুলল তার মৃত বাবাকে, যিনি কোনোদিনই সশরীরে এই অপরূপ অলকনন্দার রূপরাশি দেখতে আসবেন না। পিণ্ডদানের ব্যবস্থাটা মানুষকে কৃতজ্ঞতার শিক্ষা দেয়, নিজেকে ছাড়িয়ে অন্যের দিকে হাত বাড়িয়ে দেবার শিক্ষা দেয়। বদলে কিছুই পাওয়া যাবে না জেনেও কিছু দেওয়ার শিক্ষা দেয়।

আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম পিণ্ডদান করবে না। তারা যুক্তিবিবর্ণ একচক্ষু জীবনযাপন করবে। আমার সমবয়স্ক বন্ধুরাই তো আর তর্পণ করে না। পিতৃদায়ে মস্তকমুণ্ডন করে না। অশৌচ পালে না। একটা পুরো মানুষ জন্মের মতো চলে যায়, অথচ জীবন বাইরে থেকে এমনভাবে চলতে থাকে, যেন কিছুই ঘটেনি। সবই যেমন ছিল তেমনি আছে। যেন জন্মদাতা, কি জন্মদাত্রীকে আর দেখতে-না-পাওয়ার মতো চিরজীবনের ঘটনাটা কোনো ঘটনাই নয়।

জয় বাবা বদরী বিশালজীউকি!

বদ্রীনারায়ণের মন্দিরেও অনেকগুলো তোরণ পেরিয়ে ঢুকতে হয়। অনেক কষ্টে নানা লাফালাফি করেও খুব ভালোভাবে মনের মতো করে হয়নি বদ্রীনারায়ণের দর্শন পাওয়া। বাইরে যেসব বদ্রীনারায়ণের পট দেখেছি, ভিতরের দৃশ্য তার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পারি নি। ফুলে, জরিতে, মালায়, চাদরে এতই জবরজঙ্গ ব্যাপার, কিছুই প্রায় দেখতে-বুঝতে পারিনি। এর ভেতরেও স্পেশাল দর্শন-টর্শন আছে, স্পেশাল আরতির টিকিট আছে, যে যত টাকার পুজো দেবে সে ততক্ষণ বেশি ভেতরে থাকতে পারবে এরকমও একটা ব্যবস্থা থাকতেও পারে বলে মনে হল। কেবলই পাণ্ডারা মন্দির থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছেন দর্শকদের, মোটে দাঁড়াতে দিচ্ছেন না। ভালো করে দেখব কী? মন ভরে নি। শুনেছিলুম বংশানুক্রমে কেদারবদ্রীর পুরোহিতরা সুদূর কেরালার নাম্বুদ্রিপাদ ব্রাহ্মণ। দেখে বুঝলাম সব পুরুত বামুনেরই এক স্বভাব।

যেমন কালীঘাটের, যেমন বিশ্বনাথের, তেমন জগন্নাথের। সব্বাই সমান।

ভিখিরিদের এই প্রবল প্রতাপ সত্যি দেখবার মত। সবাই থালাবাটি পেতে বসে আছেন, যাত্রীরা সেধে ভিক্ষে দিয়ে যাচ্ছেন। নির্বিকার ভিখিরি মহারাজেরা সদয় হয়ে তা গ্রহণ করে, জয়ধ্বনি দিচ্ছেন বদরী বিশালজীউয়ের। হঠাৎ লক্ষ্য করি ভিখিরিদের মধ্যে চিত্তচাঞ্চল্য ঘটেছে! ব্যাপার কী? অলকনন্দার ওপরে সেতুর একধারে ভিখিরির লাইন। দূর থেকে দেখি এক পৃথুলা মারবাড়বাসিনী আসছেন, তাঁর সামনে পিছনে দুই ভৃত্য দুটি ঝুড়ি বয়ে আনছে। একটা ঝুড়িতে বিপুলকায় লাড্ডু, আরেক ঝুড়িতে বিশাল অমৃতী জিলেইবি। মহিলা কষ্ট করে কোমর নিচু করে ভিখিরিদের পাত্রে ঠকাঠক লাড্ডু-জিলেইবি ছুঁড়তে ছুঁড়তে, পুণ্য লুফতে লুফতে মন্দিরের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। অলোক, রঞ্জন, পিকোলো, কেউই এই মুহূর্তে আমার সঙ্গে নেই। অতএব আমি চট্ করে ভিখিরিদের পাশে বসে পড়ি। সঙ্গে পাত্র নেই কিন্তু স্নান করে আসছি, তোয়ালে আছে। পথে সেটি বিছিয়ে বসে থাকি। আসবে, আমার টার্ন আসবে। ঠক্ করে লাড্ডু, ঠাস করে জিলেইবি, পড়বে! উৎসুক হয়ে চেয়ে থাকি।

‘মা! মা! কী হচ্ছেটা কী?’ লৌহনিগড়ের মতো মুঠোয় আমার প্রার্থী হাত চেপে ধরেছে, ও কে? মেয়ে পুলিশ! আবার কে?—’ওঠো বলছি, শিগগির ওঠো—পাগল করে ছাড়বে আমাকে’—

-’তুই বসে পড়ে যা পিকো, গামছাটা পেতে নে—’

—অনেস্টলি, মা! তুমি একটা আস্ত উন্মাদ! যদি কেউ চিনে ফেলে? ওঠো, ওঠো, উঠে পড়ো—’

–’আহা, চেয়ে দ্যাখই না কী সাইজ’—

–’কত লাড্ডু খাবে, মা? আমি তোমাকে কিনে দিচ্ছি চলো’—

—’কিনে কোথায় পাবি ও জিনিস? দেখছিস না অর্ডারি মাল? আলি ঘিউ-কা? কী সুগন্ধ!‘

–’মা, প্লিজ কথা শোন, আমার খুব লজ্জা করছে—এই, এই ভিখিরিদের সঙ্গে—ছি ছি—’—’আমরা তো সবাই ভিখিরিরে, ভগবানের কাছে তীর্থস্থানে কে ভিখিরি নয়? ঐ যে মোটা মহিলা লাড্ডু দান করছেন, উনিও পুণ্যের ভিখিরি—’

—’লম্বা লম্বা কথা রাখ, লোভী কোথাকার। তুমি একজন গরিব ভিখিরির শেয়ারটা খেয়ে নিতে চাইছ—বুঝেছ সেটা?’ পিকোর এই কথাটা আমার মাথায় ঠং করে বুদ্ধির হাঁড়িতে একটা ঘা দিলে!

—’তুমি তো কিনেই খেতে পার মা? তুমি কেন আরেকটা ভিখিরির খাবার কেড়ে খাবে?’ এ কথাটা খুবই সত্যি। আমি তো মজা করবার জন্য খেতে বসেছিলুম, অন্যের ভাগ কেড়ে খাচ্ছি সেটা খেয়াল হয়নি। কত জ্ঞানী গুণী লক্ষ্মী মেয়ে আমার, সেটা ভাগ্যিস খেয়াল করিয়ে দিলে! নইলে তো!—হাঁটু-টাটু ঝাড়তে ঝাড়তে উঠে দাঁড়িয়ে দেখি অন্য প্রান্তে আমার দেখাদেখি রঞ্জনও বসে গেছে। পিকো চোখ রাঙাতেই উঠে পড়ল।

—’উঃ, পারি না বাবা এদের নিয়ে! যেমন দিদি, তেমনি ভাই!’ বলে গজ গজ করতে করতে পিকো শক্ত করে আমার কব্জী পাকড়ে নিয়ে চলল।

সেতু পেরিয়েই দেখি কল্যাণী দালাল। ছুটে এল কাছে—হ্যাঁ, হয়ে গেছে তার মাতৃতর্পণ। তার বাবা তৃপ্ত। তৃপ্যন্তু সর্বদেবতাঃ।

নন্দাকিনী, মন্দাকিনী

বেলা দেড়টার ‘গেট’ ধরে রওনা হলুম। বদ্রীনাথ থেকে আবার সেই আশ্চর্য সুন্দর ঝরনা, গুহা, হিমবাহ, আর অন্তঃসলিলা অলকনন্দার খেলা দেখতে দেখতে নেমে এলুম। সঙ্গে অলোকনাথ যোগ হয়েছে সেও কেদারে যাবে আমাদের সঙ্গে। এটা উল্টোযাত্রা হয়ে গেছে। সবাই আগে কেদারে যান, পরে বদ্রীনাথে। অলোক আগেই বদ্রী চলে এসেছে আমাদের মতো। এখন আর সঙ্গী পাচ্ছে না। বদ্রী থেকে সবাই হরিদ্বারের যাত্রী। আমরা আজ সন্ধ্যার মধ্যে রুদ্রপ্রয়াগে পৌঁছোতে চাই যাতে কালই গৌরীকুণ্ডে যাওয়া যায়। পারলে কালই কেদারনাথ পর্যন্তও পৌঁছে যাওয়ার ইচ্ছে। রঞ্জনের হয়তো সাধ্য হবে না। এদিকে পঞ্চপ্রয়াগের পথেই যাব। কৰ্ণপ্ৰয়াগ, নন্দপ্রয়াগ, বিষ্ণুপ্রয়াগ দেখেও থামব না?

মনে মনে গজগজ করতে করতে যাই। রঞ্জন আপিস কামাই করে এসেছে, কোনো ছুটি নাকি পাওনা নেই ওর (তবে এলি কেন?), আবার পিকোলোর তো কলেজ। খুলেই পার্ট ওয়ান পরীক্ষা (তুইই বা এলি কেন?)। অতএব যখন যেখানে খুশি থামতে থামতে যাওয়া যাবে না। এই ২০/২১ তারিখেই আমাদের কলকাতায় ফেরবার কথা ছিল। মা ওদিকে ভাবতে শুরু করে দেবেন। আজ ২২শে, আমরা এসে অবধি মা’র কোনো চিঠি পাইনি, টেলিফোনও করা যায় নি। আজ রুদ্রপ্রয়াগে পৌঁছে ফোনের চেষ্টাও করতে হবে। কে কেমন আছে কে জানে? পিকোলো আর আমি দুজনেই বাইরে বলে মা’র জন্যে ভাবনা। অতএব—’পশ্চাতে রেখেছ যারে, সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে!’

রঞ্জন আর অলোক সামনে। পিকো যথারীতি ঘুমিয়ে পড়েছে আমার কোলে। আমি জানলা দিয়ে চেয়ে আছি। তিনধাম হয়ে গেল। বদ্রীনাথ ছেড়ে নেমে যাচ্ছি। আবার যোশীমঠে চা। তারপর বিকেলের ম্লান মায়াবী আলোয় অদ্ভুত একটা উজ্জ্বল রঙিন আকাশের পটভূমিতে একের পর এক প্রয়াগ আবির্ভূত হতে থাকে। চোখে, চোখ থেকে হৃদয়ে। নন্দপ্রয়াগটা এমন কিছু নয়। সরকারি গাইডের মত সঙ্গমটি হচ্ছে নন্দাকিনী আর অলকনন্দার। তাই নাম নন্দপ্রয়াগ। এদিকে আমার একটা বহু পুরনো ‘গাইড বহি’ আছে। সেখানে ‘খাওয়ার খচর জনপিছু প্রতিদিন ১০ টাকা হইতে ২ পড়িয়া যায়। কুলীদের মজুরী ছাড়া প্রতিদিন দুই পয়সা করিয়া ছোলা খাওয়ার জন্য দিতে হয় এবং সমস্ত তীর্থে কুলীদের খিচুড়ী খাইতে দিতে হয়। পাহাড়ী ঘোড়ার ভাড়া ॥০ হিসাবে প্রতি মাইল… যাত্রীকে নিজেই ডাণ্ডী কিনিয়া লইতে হয়… ইত্যাদি লেখা আছে। সেই অপূর্ব গাইড বইতে বলছে নন্দপ্রয়াগের সঙ্গমটি মন্দাকিনী আর অলকনন্দারই এবং নন্দ নামে এক রাজা এই প্রয়াগে যজ্ঞ করেছিলেন, সেই থেকে ওটার নাম নন্দপ্রয়াগ। আমার এটাই বেশি পছন্দ, যেহেতু নন্দাকিনী নামে কোনো নদীর উল্লেখ আগে দেখিনি। নন্দপ্রয়াগ থেকে কর্ণপ্রয়াগ যাবার রাস্তাটা খুব সুন্দর, বড্ড সুন্দর, কি রকম একলা করে দিতে পারে।

ঐ গোধূলিবেলার মন-খারাপ-করা আলো পাহাড়ের গায়ে লেগে রইল বহুক্ষণ, গলে গলে নদীর ওপরে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। এখানে নদী বেশ চওড়া, মাঝে মাঝেই চড়া পড়েছে, নুড়ি পাথরের ঘাস ঝোপের চর জেগেছে। নদীর ওপারে পাহাড়, এপারে পাহাড়। ওপারে মানুষজনের চিহ্ন নেই, কোনো পথরেখা দেখা যায় না, মন্দির না, গ্রাম না, ক্ষেত না। এপারে রাজপথ, গ্রাম, দোকানপাট। ওপারে কি তবে সন্ন্যাসীদের রাজ্যপাট? ওপারে কি বাঘ-ভাল্লুক? জিম করবেট? এই তো জিম করবেটের পাড়া। রুদ্রপ্রয়াগে বিরাট বিজ্ঞপ্তি আছে করবেট ন্যাশনাল পার্কের। এপার দিয়ে ছুটে যাচ্ছে সুরথ সিংয়ের গাড়ি।

মুকুলগুলি ঝরে

গাড়িতে যেন আমি ছাড়া কেউ নেই, সুরথ সিংও না।

এত ভালো লাগার মতো জায়গা, অথচ কেন যেন সম্পূর্ণভাবে আমার করে নিতে পারছি না। কী যেন নেই। কী থাকা উচিত ছিল? কে থাকলে ভালো হত?

কেমব্রিজের ছাত্রজীবনে আমার পশ্চিম পাকিস্তানী বান্ধবী শিরিন কাদেরকে কিছু অফার করার উপায় ছিল না। হরিণ-নয়না সুন্দরী শিরিন সব কথার উত্তরে সবিনয়ে মাথা নেড়ে বলবে—’মেরে পাস সব কুছ হ্যায়’। আমার শুনে মনে হত, কী অসভ্য রে বাবা? কী দম্ভ? পরে টের পেলুম লক্ষ্ণৌ, লাহোরের ভদ্রতার ধরনই ওইটে, কিছু চাই না, আমার কাছে আছে। সব আছে। যাহা কিছু সব, আছে আছে আছে।

এই রাস্তা যেন তেমনি ভাষায় কথা বলছে। বলছে, ওর কাছে সবকিছু আছে। ওর কিছু চাই না। এমন কি দর্শকও না। কিন্তু আমার কেন তাতে অন্তর পরিপূর্ণ হয়ে উঠছে না? অস্পষ্ট অভাববোধে মন-কেমন করছে কেন আমার? নিজেকে অপূর্ণ মনে হচ্ছে। কিন্তু কার জন্যে অপূর্ণতা?

কে সঙ্গে থাকলে এই আকাশ বাতাস নদী পাহাড় ঝম্‌ ঝম্ করে বেজে উঠত পূর্ণতায়? তাছাড়া সত্যিই তো আমি নিঃসঙ্গ নই। আমরা এখনও পাঁচজন গাড়িতে। সঙ্গে আছে আমার প্রথম সন্তান যাকে জন্ম দেওয়ার কর্মটি আজ পর্যন্ত আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের ঘটনা। সঙ্গে আছে অনুজোপম রঞ্জন, সেও অপত্য স্নেহেরই পাত্র। প্রীতির অভাব নেই। সঙ্গে বন্ধনের অভাব তো নেই-ই বরং একটু যেন বেশিই। তবে কেন এত অস্থির এত চঞ্চল লাগছে আমার? এই অরণ্য-পর্বত, এই নদী-প্রপাত, এই মেঘ-আকাশ, এদের মধ্যে এমন চিৎকার করে উঠছে কেন আমার একাকিত্ব? একে একে বুকের মধ্যে মিছিল করে গেল খুব ঘনিষ্ঠ চেনা মুখের সারি–না, কেউ না, কেউ না, কেউ না। কাউকে চাই না।

উত্তরকাশীতে মার্কিন মেয়ে অস্টেন বলেছিল, I want to be first in someone’s life. আমিও বোধ হয় তাই চাইছি। কারুর জীবনের প্রথম নামটি হয়ে উঠতে চাই। কিন্তু আমার জীবনের প্রথম নামটি কার? একদিন উত্তর খুব সহজ ছিল,—মা। তারপর উত্তর বদলে গেল কিন্তু সহজই রইল, স্বামী।

তারপর আরেকবার বদল হল, কিন্তু এবারও কোনো বয়সের প্রশ্ন ছিল না, কঠিন কোনো সমস্যা হল না, জীবনের প্রথমতম শব্দটি সন্তান।

কিন্তু এখন, যার যার জীবন তার তার নিজস্ব অঙ্গনে। জমানা বদল গয়া। আমার সন্দেহ হচ্ছে এখন আমার জীবনে প্রথম মানুষটির নাম হয়তো ‘আমি’। তাই একাকিত্ব। তাই অপূর্ণতা। কাকে দেব এই সন্ধ্যার আকাশে বিলোল অলকনন্দা? কার হাতে দেব?

যার জীবনে মানুষ নয়, ঈশ্বরই প্রথম, তার কোনো অপূর্ণতা নেই। সেই সুখী। কারুর জীবনে প্রথমতম হয়ে ওঠার তৃষ্ণা তাকে কুরে কুরে খায় না।

যত ঝামেলা এই পালকবিহীন দু’পেয়ে প্রাণীটির বেলায়। কে নেবে আমার এই মুগ্ধতার ভাগ? কাকে দেব এই নন্দপ্রয়াগের স্তব্ধ সৌন্দর্য? তোমার একার সম্পত্তি বলে মেনে নিতেই বা অসুবিধা কিসে? তাঁর অনেক আছে, তিনি তো তোমাকে এটুকু দিতেই পারেন। সবকিছু ভাগাভাগি করে নিতে হবে কেন মানুষেরই সঙ্গে? নবনীতা, বুকের পাত্রটি বাড়াও, বাড়াও। বুকের ভেতর এই অলৌকিক আকাশ-বাতাস, অরণ্য-পর্বত, নদী-নির্ঝর, সব ভরে নাও, সব সঙ্গে নিয়ে নাও। ভাগ দেবার সময় অনেক পড়ে আছে।

চিরসখা হে

নন্দপ্রয়াগের কাছে সোমলা ডাকবাংলো আছে-কিন্তু থামা গেল না। কর্ণপ্রয়াগে পিণ্ডারনদ আর অলকনন্দার মিলনক্ষেত্র। পিণ্ডার হিমবাহের যত নাম, নদীটি তত কিছু নয়। এই প্রয়াগে কর্ণ যজ্ঞ করেছিলেন। কর্ণপ্রয়াগ থেকে পথ নেমে চলল রুদ্রপ্রয়াগের দিকে। কর্ণপ্রয়াগের সঙ্গম ছাড়িয়েই অলকনন্দার ওপারে দেখতে পেলুম বিশাল চতুষ্কোণ এক গুহামুখ—তার সামনেই দু’পাক সিঁড়ি নেমে গেছে নদীর জলে। অথচ কোথাও কোনো রাস্তা চোখে পড়ল না। কোনো গরু ভেড়াও চরছে না। আশ্চর্য হয়ে গুহাটির কথা ভাবছি—নিশ্চয় ওখানে বহু যুগ আগে মানুষের বাস ছিল, সন্ন্যাসীর আস্তানা ছিল, নইলে ঐ সিঁড়ি দু’থাক কে তৈরি করলে? কেনই বা? ওই রকম একটি গুহায় অমন অলকনন্দার তীরে যাঁরা বাস করতেন তাদের তপস্যায় সিদ্ধি কেন হবে না? কিন্তু এখন ও গুহা মানুষের কাজে লাগে না, কোনো পথ থাকত তাহলে। ভাবতে ভাবতেই আরেকটি মস্তবড় গুহা দেখা গেল ওপারে। তার সামনে আবার একটি বিশাল মহীরূহের তলাটা বেদী করে বাঁধান। এখানে সিঁড়ি নেই কিন্তু নদীর খুব কাছে গুহা থেকেই উপলবিস্তীর্ণ এক সৈকত গড়িয়ে নেমে এসেছে অলকনন্দার স্রোতের মধ্যে। যেন ‘প্রাইভেট বিচ’ একটি। এখানেও কোনো রাস্তা নেই। একটু দূরে একটা পায়ে চলার পথের রেখা উঁকি দিল, কিন্তু ধরা দিল না।

এই গুহা দুটি আমার মনের মধ্যে একটা গভীর নাড়া দিয়ে গেল। মুনিঋষিদের নিষ্ঠাবান সহজ জীবনের স্মৃতি বহন করে পড়ে আছে গুহা দুটো। দেখতে দেখতে আমার বুকের মধ্যে কান্না ঠেলে উঠল। মনে হল ওগুলো আমাকে ডাকছে। আমি কী চাই? সত্যি সত্যি? কেন বাঁচি? কেন আমি চাকরিটা ছেড়ে দিচ্ছি না? কিসের জন্য লিখি? কেন সংসারে থাকি? কেন আমার কোনো কাজই শেষ হয় না? মনের মতো হয় না কোনো ক্লাসটাই, মন ভরে না কোনো লেখা লিখেই—কেন আমি কিছুই ধরে রাখতে পারি না—হাতে পেয়েও মুঠো বন্ধ করি না, ছেড়ে দিই, আঙুলের ফাঁক দিয়ে ঝরে যেতে দিই, ধরে রাখতে পারি না কিছুই—না বন্ধুত্ব, না, প্রণয়, না সন্তান, না সংসার, না শিল্প, না কর্ম, না প্রতিষ্ঠা, না ধর্ম, না বোধ, না বোধি কী চাই তাই-ই বুঝি না। সবই আছে, অথচ কিছুই আমার নয়, কোনো কিছুতেই আমি ‘আমার’ বলে অধিকার করতে শিখি নি-বুকের মধ্যে সর্বক্ষণ ঘণ্টা বাজছে নেই নেই নেই—কী নেই? কী পেলে এই সর্বগ্রাসী ‘নেই’ ‘আছে’ হবে? কী এনে দিলে মিটবে তোমার বায়না? ওই শূন্য বিশাল দুটি গুহার মধ্যে যেন আছে সব উত্তর। ওখানে একবার পৌঁছুতে পারলেই হল।

নইলে কিসের চার-ধাম ভ্রমণ? হল না, হল না। কিছুই দেখা হল না। এমন সময়ে আকাশ আরও লাল করে সূর্যদেব ডুবে গেলেন হিমালয় পর্বতের আড়ালে। এক বছরের জন্যে কি সন্ন্যাস নেওয়া যায় না? দেখে যেতেই হবে এই বিশ্বসংসারটা কেমন। এসে অবধি তো শুধু ঘরসংসারটাই দেখা হল।

সূর্য ডুবে গিয়ে সমস্ত পৃথিবীটাকেই এক আবিল বিষণ্ণতায় আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। আবার আমার মনে সেই একাকিত্বের গুঞ্জন উঠছে—তীর্থ গমন দুঃখ ভ্রমণ যেও না মন কারও দ্বারে। বলি, ব্যাপারটা কী? নবনীতা? কী চাও?

নির্ভর চাই। আমি চাই আমার কেউ আশ্রয় দিক। আজ কোথায় থাকব, কী খাব সেটা অন্য কেউ স্থির করে দিক। আমি একটু আড়াল চাই। একজন কেউ আমার কথা ভাবুক। কে আছে? এমনজন কে আছে? কেউ না। কেউ নেই। কেউ ভাবে না।

কেউ ভাবে না? কেউ নেই? এতবড় বেইমান? ছি ছি, নবনীতা!

কে তোমার জীবনের বোঝাটা বইছে? তুমি নিজে? তুমি কি এতই শক্তিমান? তোমার কি এমনভাবে রাজার হালে চারধাম পরিব্রাজন করার কথা? অর্থবল, লোকবল, স্বাস্থ্য—কোটা আছে তোমার? তবুও তো ঘটছে? কোনো চোরা পথে নয়, চেয়ে-চিন্তে নয়। তবু বলবে তোমার ভার কেউ নেয় না? তুমি নিরাশ্রয়? নির্বান্ধব? নিঃসঙ্গ? তুমি আসলে একটি বেইমান। যার হাত না বাড়াতেই বন্ধু, সেই বলছে, আমার কেউ নেই। আমি জগতে একা। তুমি একটি মিথ্যাবাদী।

নিজেই মনে মনে খুব লজ্জা পেয়ে গেলুম। আকাশ অন্ধকার, একটি দুটি তারা ফুটছে। গাড়ি ছুটেছে রুদ্রপ্রয়াগের পথে। চিরসখা হে মার্জনা করো।

দু’দলে দেখা হলো মধুযামিনী রে!

আমাদের রাত্রি হয়ে গেল রুদ্রপ্রয়াগ পৌঁছোতে। আবার সেই টুরিস্ট লজে গাঢ়োয়াল মণ্ডল বিকাশ নিগমের আতিথ্য নিলুম। এবারে অন্য একটি ডরমিটরিতে ঠাঁই মিলেছে। সেবারেরটা তুলনায় বেশি দামী ও আরামপ্রদ ছিল। এটা আরও সস্তা, আর কম আয়েসের।

এই ঘরে চারটিই খাট খালি, তাতে ঠিকঠাক আমরা চারজনে এঁটে গেলাম। আমাদের ঘরসঙ্গী কারা? সেই জীপের সঙ্গীরা।—বাঃ! এতদিন যে বসেছিলেম পথ চেয়ে আর কাল গুণে—মেসোমশাইদের দলটি এসে গেছেন কেদারনাথ দর্শন করে। কাল আমরা যাব কেদারে, ওঁরা রওনা হবেন বদ্রীনাথে।

আমাদের মধ্যে আর বন্ধুত্ব হয়নি জীপের সেই ব্যাপারের পরে। একই ঘরে থাকায় একটু মানসিক চাপ সৃষ্টি হচ্ছিল। সবাই তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লেন, কেদার ঘুরে এসে ক্লান্ত। কেবল অনেক রাত্রি পর্যন্ত সেই অক্লান্ত ব্রহ্মচারী (লিডার) আর গম্ভীর কলেজ ছাত্রী (সেক্রেটারি) টাকাকড়ির হিসেব কষতে লাগলেন। আমি একটু একটু চিঠি লিখলুম মাকে! আর পিকো আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল কলকাতাতে ফোন করতে। দিম্মার জন্যে তার ভয়ানক উৎকণ্ঠা হচ্ছে। কিন্তু লজ থেকে তো পাওয়া গেলই না, কাছাকাছি রুদ্রপ্রয়াগ টেলিফোন এক্সচেঞ্জে গিয়েও রাত ১১টা পর্যন্ত চেষ্টা করে পারলে না। অলোক, রঞ্জন, সুরথ সিং সমেত ফিরে এল মনখারাপ করে।

শুয়ে পড়েছি। ব্রহ্মচারীদের হিসেব তখনও শেষ হয়নি। দেখি আমাদের মেসোমশই, আরও দুজনে মিলে কী সব পরামর্শ করছেন বিছানা থেকে উঠে। অনেক ফিসফিস হল। তারপর টর্চ হাতে মেসোমশাই আমার খাটিয়ার ধারে (ওপরের ডরমিটরিতে পালিশের খাট ছিল। এখানে খাটিয়া) গুটিগুটি এসে ডাকলেন—’মালক্ষ্মী কি ঘুমিয়ে পড়েছে?’

—’না মেসোমশাই।’

—একটা কথা ছিল। একটু গোপনে।’

-’বলুন, বলুন।’ উঠে বসি। তবুও মেসোমশাই ইতস্তত করছেন।

–’মাকে আমি যা বোলব তোমার তাতে আপত্তি থাকলে কিন্তু করতে হবে না।’

–’বলুন তো আগে?’

খুব গলা নামিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে নিয়ে মেসোমশাই বললেন,—হাতের প্যাকেটটি দেখিয়ে—এই যে, কিছু গাঁজা, কিছু ভাং। আমি ভুলে গৌরীকুণ্ডে ফেলে গিয়েছিলুম। তুমি মালক্ষ্মী একটু সঙ্গে নিয়ে যাবে? কেদারনাথকে দেব বলে আমার মানত করা ছিল। তোমরা যখন পুজো দেবে তার সঙ্গে এগুলোও যদি ধরে দাও—পৈতে, হণ্ডুকি ধুপ, ধুনো এই সব আর কি। আর বেলপাতা। আকন্দ ফুলের মালা, ধুতরো ফুলের মালাও ছিল। কিন্তু প্লাস্টিকের মধ্যে ভেজা নেকড়া মুড়ে আনার জন্যে সে সবই পচে গেছে। তুমি যদি মা আমার মানতটি বাবার কাছে পৌঁছে দাও। এমন যম তাড়া লাগালে যে গৌরীকুণ্ডেই সব পুজোর জিনিস পড়ে রইল, আমি ধড়ফড় করে শূন্যহতে বাবার কাছে চলে গেলুম। মনটি বড় খারাপ, মা।’

—কোনো ভাবনা করবেন না মেসোমশাই, দিয়ে দিন আমাকে প্যাকেট, কেদারনাথের পায়ে নিজের হাতে পৌঁছে দেব আপনার মানত। আমি যদি পৌঁছই, আপনার গাঁজা ভাংও পৌঁছোবে, কিছু উদ্বেগ করবেন না।’ মেসোমশাই ফোকলা মুখে মিলিয়ন ডলার একটি হাসি উপহার দিয়ে প্যাকেটটি আমাকে দিলেন। কেদারনাথের জন্য পুজোর ব্যবস্থা এখন থেকেই শুরু হয়ে গেল। আমার নিজের তো পুজো দেবার কোনো প্ল্যানই ছিল না। মিসেস মুখার্জীর পুজোই দিয়ে বেড়াচ্ছি প্রধানত। না হয় মেসোমশায়ের মানতটাও দেব! এ যাত্রাটা তো অন্যের পুজো পৌঁছে দেবারই যাত্রা দেখছি।

গুল্ কা খেল্‌

রুদ্রপ্রয়াগ থেকে সকালে চা খেয়ে বেরিয়ে প্রথমে চললুম প্রয়াগটা দেখতে। প্রয়াগ দেখতে হলে একটা গলি দিয়ে যেতে হয়। তর মুখেই হেলথ ডিপার্টমেন্ট-এর আপিস। চৌকিদার এসে সুরথ সিংকে ধরলে—’সুই লগায়া? পড়ছি দিখাও।’

আগেও দু’এক জায়গায় এরকম বলেছিল। সুরথ সিং গম্ভীর গলার প্রত্যেকবার ‘লোকাল আদমী’ বলে পার পেয়ে গেছে। এবারেও বললে। কিন্তু ভবী ভোলে না। চৌকিদার ওকে লোক্যাল বলে মানলেও আমাদের লোক্যাল বলে মানছে না। শেষে পিকোলো গেল আপিসে। অফিসারকে গুলতাবিজ মারতে। রঞ্জন একদম চুপচাপ। অলোকের পড়ছি আছে।

পিকোলো গিয়ে ঝড়ের বেগে ভুল হিন্দিতে একটা কথার মধ্যে পঞ্চাশবার খিলখিল করে হেসে কী যে গুল সব মারতে লাগল, আপিসের কেরানী, দিদিমণি দুজন কেবলই হেসে গড়াতে লাগল সিরিঞ্জ হাতে করে। পিকোর তো সিরিঞ্জ দেখেই হাত টনটন করতে শুরু করেছে এবং জিহ্বায় দুষ্ট সরস্বতী ভর করে মিথ্যে কথার যোগান দিচ্ছেন। ‘কে বলেছে আমরা কেদারে যাব? দূর দূর, আমরা তো লোক্যাল লোক, হৃষীকেশে থাকি। হ্যাঁ ওখানেই পড়ি। দেখুন না গাড়ির নম্বর, হৃষীকেশের গাড়ি। আমরা বেড়াতে বেড়াতে এদিকে এসেছি, বিকেলবেলাই ফিরে যাব দেবপ্রয়াগে। এখন তো আমরা কাশীতে শঙ্কর ভগবানের মন্দিরে যাচ্ছি। কেদারে আমরা অনেক গেছি। না না, আমরা মোটেই তীর্থযাত্রী নই। টুরিস্টও নই। এই দু’তিন দিনের জন্য ঘুরতে এসেছি। প্রায়ই আসি তো।’ এই সব কথা বলে পিকো যখন তাঁদের বাগ মানিয়ে ফেলেছে, রঞ্জনের মনে হল ‘মেয়েটা একা একা কতক্ষণ লড়বে? যাই একটু সাহায্য করে আসি।’ মনে হতেই সে আপিসে ঢুকল এবং পিকোর চেয়ে তিনগুণ খারাপ হিন্দিতে করুণ কণ্ঠে আবেদন জানতে লাগল—কেন মিছিমিছি ঝামেলা করছেন দিদিরা? এই যে আমরা তিনধাম ঘুরে এলাম, আমাদের কলেরা হল না, কেবল কেদার গেলেই হবে? আশ্চর্য কথা সত্যি! আমাদের মাত্র তিনদিন হাতে আছে আর, তার মধ্যে ফিরতেই হবে—এখন ইঞ্জেকশন নিয়ে যদি জ্বর হয়ে যায় তাহলে কেদার যাত্রা হবে না। এতদূর এসে ফিরে যাব? ভেবে দেখুন! সেই কলকাতা থেকে আসছি! প্রমিস করছি, আমরা কেদারে কিচ্ছু খাব না—চা বিস্কুট ছাড়া কিচ্ছু খাব না, প্রমিস। কেমন? প্লীজ ইঞ্জেকশন দেবেন না!—

অলোক শাস্ত ছেলে। সে পিকোর কথাও শুনেছে, আবার রঞ্জনেরটাও শুনল। কেলেংকারিটা ম্যানেজ করতে বলল—’আসলে ওঁরা সক্কলেই কলেরার ইঞ্জেকশন নিয়ে এসেছেন কলকাতা থেকে। বাড়ির ডাক্তারের কাছে। নিজেদের প্রোটেকশনের জন্য। সার্টিফিকেট নিতে হয় তা জানতেন না বলে পড়ছি নেই। এই আমিই শুধু হরিদ্বারে এসে ইঞ্জেকশন নিয়েছি। আমার তাই পড়ছি আছে।’ রঞ্জনের কথাবার্তার ফলে পিকোর গুলশন গুল ধরতে পেরে হেলথ ডিপার্টমেন্টের লোকেরা অত্যাশ্চর্য। ওরা এতদিন ভাবত, জগতের শ্রেষ্ঠ গুল বুঝি কেন্দ্রীয় সরকারই দিয়ে থাকেন। যাই হোক তাঁরা শেষ অবধি আমাদের ছেড়েই দিলেন। পিকোলো তাদের সেধেই জানাল, জলে জিওলিন দিয়ে জল খাবে, কাটা ফলটল কিছু খাবে না। কলেরা কিছুতেই হতে দেবে না।

সেন্ট অগাস্ট, এবং বাবার বিয়ে

ইঞ্জেকশনের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে রুদ্রপ্রয়াগের সঙ্গম দেখতে গেলুম। ছোট্ট সাদা একটি মন্দির, ঠিক নদীতীরে অবস্থিত। তারই দোতলার ঝুলবারান্দা থেকে মন্দাকিনী আর অলকনন্দার সঙ্গমটা দারুণ দেখায়। দুই রঙের জল, নীল আর গেরুয়া, অনেকক্ষণ পাশাপাশি বয়ে যায়—একটি উদ্দাম, অন্যটি শান্ত। নীলটি শান্ত, মন্দাকিনী, গেরুয়া উদ্দাম অলকনন্দা। বদ্রীনাথের সঙ্গিনী অলকনন্দা

কেদারনাথের মন্দাকিনী। যে-পথে কেদারে উঠব, মন্দাকিনীর যাত্রাপথ বেয়ে সেই রাস্তা তৈরি।

রুদ্রপ্রয়াগ থেকে তিলবাড়া হয়ে অগস্ত্যমুনি বলে একটি জায়গা। অগস্ত্যমুনির মন্দির আছে সেখানে। সরকারি গাইডে লেখা—Temple of Saint August! এমন পোড়াদেশের মরণই ভালো। সেইন্টি অগাস্টের দেশ। অগস্ত্যমুনির পরে গুপ্তকাশী। সেখানে অনেকক্ষণ বাস থামে। গেট পাবার ব্যাপার আছে বোধ হয়। গুপ্তকাশীর পরে শোনপ্রয়াগ। শোনগঙ্গা আর মন্দাকিনীর সঙ্গম সেখানে। সব বাসও শেষ। বাকিটুকু হেঁটে গৌরীকুণ্ডে যেতে হয়। গাড়ি অবিশ্যি আরও খানিকটা গেল। গৌরীকুণ্ডে যেতে হয় একটা বাজার পার হয়ে খানিকটা পাহাড়ের ওপরে উঠে। বেজায় নোংরা এক গলি দিয়ে যাত্রা। শোনপ্রয়াগ থেকেই ত্রিযুগী নারায়ণে যেতে হয়। ৬ কিলোমিটার পথ। পায়ে হেঁটে। কপাল ভালো থাকলে খচ্চর মেলে। ‘ত্রিযুগী নারায়ণে’ যজ্ঞাগ্নির শিখা অলিম্পিকের শিখার মতো অনন্তকাল জুলমান। ওটি প্রজ্বলিত হয়েছিল শিবপার্বতীর বিবাহাযজ্ঞে। সেই থেকে সমানে জ্বলছে। তিন যুগ কেটে এখন ঘোর কলিযুগ। পবিত্র হোমানল তিন যুগ ধরেই জ্বলছে, তাই ত্রিযুগী নারায়ণ নাম। পুণ্যার্থীরা হেঁটে দেখে আসেন বাবার বিয়ের যজ্ঞাগ্নি।

সুনীল লজ

শোনপ্রয়াগের পর গৌরীকুণ্ড। এই উষ্ণনির্ঝর একটি বিরাট কুণ্ডের চেহারা নিয়ে অবস্থিত। তারই চারপাশে ধর্মশালা, হোটেল প্রভৃতি গড়ে উঠেছে। আমরা এখন গৌরীকুণ্ডের দিকে না গিয়ে সোজা উঠে যাই টুরিস্ট লজের দিকে। একেবারে তার ডাইনিং হলে গিয়ে থামি। হ্যাঁ, কিছু খাবার জিনিস তারা বানিয়ে দিতে পারবে নিশ্চয়ই। হ্যাঁ, এক্ষুনিই পারবে, কিন্তু ঘর নেই। ঘর খালি নেই। পাশেই ‘সুনীল লজ’ আছে, ওখানে দেখুন। ততক্ষণে খাবার তৈরি হচ্ছে। ভাত রুটি ডাল আলুর তরকারি, পাঁপর ভাজা, আচার, দই এবং ডিমভাজা। খুব ক্লান্ত হলেও গৌরীকুণ্ডে গিয়ে স্নান সেরে আসার মতো এনার্জি পাচ্ছি না কেউ। এদিকে অল্প অল্প বৃষ্টি হতে শুরু করেছে। ‘সুনীল লজ’ ব্যাপারটি বেশ ইন্টারেস্টিং। পাহাড়ের গায়েই মার্কিন মোটেলের স্টাইলে পর পর ৬টি ঘর, দুটি করে খাটওলা, ১২ জনের জন্য তৈরি। এক পাশে অফিস ঘর, অন্য পাশে কমন স্নানঘর ও ল্যাভেটরিগুলি। সামনে একফালি খুব সরু টানা বারান্দা আছে, রেলিং দেওয়া। সেটাকে রাস্তাও বলা যায়, প্যাসেজ বলতে আলাদা কিছু নেই। এই টানা বারান্দাই একমাত্র যোগসূত্র। ঘরের সঙ্গে ঘরের, অফিসের, বাথরুমের। একেবারে যেন পাহাড় কেটে বসানো ঘরগুলি। সামনেই খাদ। নীচে রাস্তা। ওদিকে জঙ্গলে ভরা হিমালয়ের গা বেয়ে ঝরে পড়ছে মন্দাকিনীর উত্তাল স্রোত। তার ঝরঝর শব্দে সর্বক্ষণ মনপ্রাণ ভরে থাকছে।

দূরে দেখা যাচ্ছে গৌরীকুণ্ড এবং কালীকম্বলিবালার ধরমশালা। ‘সুনীল লজ’-এর মতো করেই প্রায় ‘টুরিস্ট লজ’টি তৈরি—ঠিক ‘সুনীল লজ’-এর এক ধাপ ওপরে। ওদের কয়েকটা ঘরের সঙ্গে অ্যাটাচ্‌ড বাথরুম আছে। এবং ‘সুনীল লজ’-এর ডাইনিং রুম নেই। আমরা সুনীল লজ-এ দুটি ঘর চাইলুম মাথা নেড়ে তরুণ প্রোপ্রাইটার বললেন,—’একটি মাত্র ঘর আছে, চল্লিশ টাকা ভাড়া। ওর মধ্যেই যতজন খুশি থাকতে পারেন। এক্সট্রা খরচ নেই।’ ঘর খুলে দেখি দুটি সিঙ্গলখাট। জোড়া দিয়েও চারজন কেন, তিনজনেও শোয়া যাবে না। তবে মেঝেতে স্লিপিং ব্যাগ পাতা যাবে। অলোকের সঙ্গেও আছে, রঞ্জনের সঙ্গেও। ওরা দুজনেই মাটিতে শুতে রাজি। কিন্তু বিছে-টিছে নেই তো? বিছের হিন্দি জানি না। অনেক কষ্টে বোঝাতে চেষ্টা করি। গম্ভীর মুখে সব শুনে ছোকরা বলে—’ছিলি? হ্যায়।’ তারপর সোজা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় জানলার কোণে একটি ক্ষুদ্রকায় টিকটিকি।

—‘না না ছিলি নয়, বিছে, বিছে’—

—’নেই হ্যায়।’ বলে ছোকরা চলে যায়।

‘এ্যাই, এ্যাই, চা দিয়ে যাও’—বলে রঞ্জন, অলোক চেঁচায়।

খেয়ে উঠতেই আড়াইটে বেজে গেল। নেমে আসছি, দেখি টুরিস্ট লজ-এর একটি কামরায় দু’জন যাত্রী ফিরলেন। ছোট মেয়েটি ঘোড়া থেকে নামল, তার মা ডাণ্ডী থেকে। পুরুষমানুষ সঙ্গে নেই।

–’আপনারা কেদারে গিয়েছিলেন? আজই?’

–’না না, গতকাল। আজ সকলে ফেরৎ রওনা হয়ে, এই পৌঁছোলাম। কী বৃষ্টিই নেমে গেছে! রাস্তা খুব পিছল হয়ে যায়। বহুৎ ডর লাগতা। বাবুজী তো পায়দল আ রহা, অবতক পৌঁছা নেহি।’

-’ভয় নেই, এসে যাবেন এক্ষুনি। কত খরচ লাগল ঘোড়ায়?’

–’যাতায়াত ১১০ নিচ্ছে। আর ডাণ্ডী সাড়ে চারশো।‘

পাহাড়ি বৃষ্টি, ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। এখান থেকে সুনীল লজে নিজেদের ঘর অবধি পৌঁছোতে পৌঁছোতেই এক ঝাপটায় ভিজে গেলুম।

বাবার পেসাদ

বারান্দায় বসে বসে বৃষ্টি দেখতে দেখতে দুপুরটা দারুণ কাটল। রঞ্জন তো অলোককে পেয়ে বেঁচে উঠেছে। দুজনে দূরে গিয়ে ধূমপান করছে। পিকোলো মুগ্ধ হয়ে পাহাড়ের বৃষ্টি, আর বর্ষণে ফেঁপেফুলে গর্জে নেচে ধেয়ে চলা মন্দাকিনীর দিকে চেয়ে চৌকাঠে বসে আছে। ফ্লাস্কে চা ভরে নিয়েছি। মাঝে মাঝে খাচ্ছি। ভারি রিল্যাক্সড সময়। হাতে কোনো কাজ নেই। ঘরে আলো নেই। লেখাপড়ার প্রশ্ন নেই। মেঘছায়াঘন বরিষণ মুখরিত ইত্যাদি বিশেষণ অলংকৃত দিন। রঞ্জন এবং অলোকের মুখে এমনিতেই কথা কম, এখন একেবারেই কথা নেই। আমার কেমন যেন সন্দেহ হল। গুটিগুটি কাছে গিয়েই গন্ধ পেলুম। এ-ধুম তো সে-ধুম নয়? সিগারেটে গাঁজার গন্ধ অছে মনে হচ্ছে? হেসে ফেলল ছেলেগুলো।

—ঠিক ধরেছ তো দিদি? ভেবেছিলুম বুঝতে পারবে না! খুব শস্তা যে গাঁজা এখানে! এখানে চার আনায় যা দেয়, কলকাতায় দু’টাকাতেও পাবে না! বাবার পেসাদ!

-‘আর চার টাকাতে হাশিশ!’ অলোক বলে।

–’তোমরা সেও খাবে? হাশিশ খেতে খেতে কেদারনাথে উঠবে? তোমরা কি হিপি?’—-’এই সেরেছে। আমরা খাব কেন? আমরা ব্যবসা করব। যাবার সময় অনেক হাশিশ কিনে নিয়ে যাব কলকাতায়, চার টাকার হাশিশ পঁচিশটাকায় বিক্রি হবে। আর এর কোয়ালিটি’—

–’মোটেই ওসব কিচ্ছু করবে না। ওসব নিয়ে আমাদের গাড়িতে চড়বে না। নিজে নিজে রেলগাড়ি করে যাও।’

-‘কেন যে তুমি হাশিশের ব্যাপারটা খামকা দিদিকে বলে দিলে অলোক। কোনো দরকার ছিল না। দিলে নেশাটার বারোটা বাজিয়ে।’

বৃষ্টি চলতেই থাকল। আমাদের কবিত্ব অন্ধকারের সঙ্গে সঙ্গে ফুরিয়ে এল। ঘরে মোমবাতি জ্বেলে বসে বসে ভূতের গল্প করবার যথাযথ স্থান এবং কাল এটা। কিন্তু পাত্ররা অরাজি। এই জলের মধ্যে ট্যুরিস্ট লজে’ খেতে ওঠাও সম্ভব নয়। আমাদের ‘সুনীল লজ’-এর প্রোপ্রাইটার এসে বললেন—’খানা হামলোগ বনা দেংগে। উসলোগকো কিতনা দিয়া? পাঁচ পাঁচ রূপাইয়া? হমকো ভি পাঁচ দে দো। কামরামে খানা মিল যায়েগা? আব বতাও কেয়া খাওগে?’

—’খিচুড়ি-ডিমভাজা মিলেগা?’

-‘জরুর।’

-’আউর পাঁপড়ভাজা। আলুভাজা?’

—জরুর।’

যতই স্লিপিং ব্যাগ থাকুক, হিমালয়ের এই বর্ষায় পাথরের মেঝেতে শোওয়া সোজা নয়। লেপতোশক ভাড়া করে আনানো হল নীচের বাজার থেকে, মেঝেয় বিছিয়ে তার ওপরে স্লিপিং ব্যাগ পাতা হবে।

বিছানায় কাগজ পেতে বসে মোমের কাঁপা কাঁপা আলোয় আর মন্দাকিনীর ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকে দারুণ জমল বর্ষা রাতের খিচুড়ি খাওয়া।

—’ব্র্যাণ্ডি হবে নাকি? দু’চামচ করে?’

—’এক চামচ হতে পারে! এখনও কেদারনাথ বাকি! সবচেয়ে ঠান্ডা, সবচেয়ে উঁচু।’

—বোতল তো ভর্তিই রয়েছে দিদি, কী করবে অতটা বাঁচিয়ে?’

—যাই-ই করি। তোমাদের তাতে কী? এক চামচ করে, চায়ের মধ্যে দিতে পারি।’

-’তাই সই! বাবার পেসাদ!’

ঘোড়েল কাহিনী

আমাদের ‘সুনীল লজ’-এর মালিকের নাম সূরয সিং। তার ছেলের নাম সুনীল, বয়স তিন বছর। সূরয সিং নিজে তার চেয়ে বছর কুড়ির বড়ো হতে পারে। আমাদের সঙ্গে খুব জমেছে। সূরয সিং বললে—’আমি নিজেই চলে যাব তোমাদের সঙ্গে ঘোড়া নিয়ে। আমাদের অনেক ঘোড়া আছে। কুছ মুশকিল নেহি হ্যায়। ‘

কেদারনাথের দয়ার প্রমাণ প্রথম থেকেই পাচ্ছি। অশ্বতর নয়, ঘোড়াই। দিব্যি Pony যাকে বলে, দেখতে শুনতে ভদ্র। আর পথ তো রীতিমত প্রশস্ত। চওড়া রাস্তায় ৬টা ঘোড়া পাশাপাশি যেতে পারে। যমুনোত্রীর মতো সরু ভয়ংকর গিরিপথ নয়। বাঁদিকে পাহাড়, ডাইনে মন্দাকিনীর খাদ। পদযাত্রীদের—’অন্দরসে বচাইয়ে’–সূরয সিংও সেই সূজন সিংয়ের বুলিই বলছে শুনতে পাই—’জারকো বিসোয়াস নেহি’–!

সত্যি কি তাই? জানোয়ারদের বিশ্বাস করতেই বেশি ভয় কি?

পিকোলোর ঘোড়া ধরেছে লছমন সিং বলে একটা বাচ্চা ছেলে। আমি বদল করে নিলুম। সেবারে যমুনোত্রীতেও আমার বেলায় সুজন সিং আর পিকোর বেলায় বাচ্চা রবীন্দর সিং ছিল। আর আমার উদ্বেগে প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছিল। লছমন সিংকে আমি নিয়ে সূরয সিংকে পিকোর ঘোড়া ধরতে বলি। এ ব্যবস্থায় সবাই খুশি। লছমনের সঙ্গে আমার খুবই ভাব হয়ে গেল, সূরযের সঙ্গেও পিকোর দিব্য বনিবনা! রঞ্জন পদব্রজে, অলোকের সঙ্গে। এ যাত্রায় ওর কষ্ট নেই, সঙ্গী আছে। প্রত্যেক চটিতে থামবে, চা-জিলিপি ওড়াবে। জিলিপি খাওয়া আমার কড়া বারণ, যেহেতু কলেরার ইনজেকশন নেওয়া হয়নি, পকোড়া-জিলিপি-লাড্ডু খাওয়া চলবে না। কিন্তু ওই বয়েসের ছেলে, আড়াল পেলে কি আর কথা শোনে? (কোনো বয়েসের ছেলেই অবিশ্যি আড়াল পেলে কথা শোনে না।) তার ওপর চটিতে চটিতে গঞ্জিকার ঘোর আড্ডা আছে সাধুদের দয়ায়। কে জানে হাশিশ্-মাশিশ্ ও খায় কিনা সাধুরা? ওদের কথা না ভাবাই ভালো!

পিকোলো আর আমি কেদারযাত্রাটি খুবই আনন্দের সঙ্গে উপভোগ করছি। চওড়া রাস্তায় পড়ে যাবার ভয় নেই, দিব্যি রোদভরা শুকনো দিন, অথচ চড়ারোদ্দুর নয়, চমৎকার ঘোড়া, লাফাচ্ছে না, গায়ে ব্যথা হচ্ছে না, দুলকিচালে চলছে, পথে পদযাত্রীদেরও ঠেলা মারছে না। হাঁটবার জন্যেও প্রচুর জায়গা রয়েছে পথে, যাত্রায় কোনো টেনশন নেই। সুন্দর অবশ্য যমুনোত্রীর পথও, বরং ভয়ংকর বলেই আরও সুন্দর। কেদারনাথ দুর্গম নন মোটেই, কেন যে লোকে দুর্গম বলে! আমাদের পোঁটলাপুঁটলি সব রেখে এসেছি ‘সুনীল লজ’-এর অফিসে, জমা। পয়সা দিতে হবে মালপিছু দিনে এক টাকা, এই লেফটে লাগেজ সার্ভিসের জন্য। রাত্রে কেদারনাথে থাকব, সকলে কেদারনাথ দর্শন করে ফেরৎ রওনা হব। এটাই সাধারণ নিয়ম।

লছমন সিং স্কুলে পড়ে। ভেড়াও চরায়। এই ঘোড়া ওদের নয়, সূরয সিংয়ের বাবার। লছমনের বাবার ঘোড়া নেই। সেও অন্যের ঘোড়া চরায়। মাহিনামে ৭৫ তনখা পায়। খাওয়া নিজের। এই ১১০ থেকে সে কিছুই পাবে না। দিনে অন্তত দুটো ট্রিপ তো করতেই হয়। একবার ওঠা, একবার নামা। দুবার ওঠানামা একদিনে সম্ভব হয় না সাধারণত। সীজন তো বছরে ছ’মাহিনা, যতদিন খোলা থাকে কেদারনাথের মন্দির। অক্ষয়তৃতীয়া থেকে দীপাবলী পর্যন্ত। বাকি ছ’মাস? মুশকিলসে খানা মিলতা। কাম নেহি!

বহুগুণা সত্যি গাড়োয়ালের প্রভূত উন্নতি করেছেন। গ্রামে গ্রামে ইলেকট্রিক, স্কুল, ব্যাঙ্ক, হাসপাতাল, মেডিক্যাল ইউনিট, পানীয় জলের ব্যবস্থা, ভেড়ামহিষ কেনো, তাঁত কেনো, উল কেনো, জমি লাঙল, বীজ-টিজ কেনো, এবং পাম্প কেনো। ‘বন-বাঁচাও’-অভিযানে মদত দিয়েছেন, ‘একটি বৃক্ষ দশটি পুত্রের সমান’ ‘তুমি গাছকে রক্ষা করো, গাছ তোমার পরিবারকে রক্ষা করবে’ ইত্যাদি ধ্বনি চতুর্দিকে এঁটেছেন—এত করা সত্ত্বেও দেখছি গাড়োয়াল খুব গরিব দেশ। সবাই তো আন্ডার-এমপ্লয়েড! অন্তত পার্বত্য অঞ্চলে। এদের তো আগে শুনতুম খুব যক্ষ্মা হয়, দার্জিলিঙের নেপালীদের মতো, পাহাড়ে মাল নিয়ে ওঠে-নামে, খাওয়া-দাওয়া পায় না, শরীর অল্পবয়সেই ভেঙে যায়। অবশ্য এদের বয়েস সকলেরই খুবই অল্প বলে মনে হয়, নইলে খুব বুড়ো। এদের দাড়ি-গোঁফ নেই, মধ্যবয়সেও হয় না।

ফুল খিলে হ্যায় গুল্শন্‌ গুল্‌শন্

রাস্তার ধারে প্রচুর গুচ্ছ গুচ্ছ শুভ্র লতাপুষ্প ছেয়ে আছে। কী ফুল?—গোলাপ। মনে তো হয় না গোলাপ ফুল বলে। পাতলা পাঁচ পাপড়ির ফুল। লছমন সিং ছুটে গিয়ে এনে দেয়।—দেখিয়ে মেমসাব। গুলাব হ্যায়।’ গন্ধ শুঁকে দেখি ওমা ঠিকই তো! গন্ধ গোলাপেরই। পাতাগুলি বড় বড় হলেও গোলাপ পাতাই, কাঁটাও আছে। সাদা বনগোলাপে, সবুজ লতাগুল্মে ঢাকা পথের পাশের পাথুরে দেওয়াল। আরও অনেক ফুল ফুটেছে—বেগুনী হলুদ। গোলাপি, কুচিকুচি কত রকমের ফুল-যমুনোত্রীর মতো অত না হলেও খুব কমও নয়। টুকটুকে লাল একরকম ফুল ফুটে আছে অনেক ওপরে ওপরে, পাড়া গেল না। বাকি সব ফুলপাতা তুলতে তুলতে পিকোলো আর আমি ফুলবালা হয়ে পড়লুম ক্রমশ।

সবচেয়ে অবাক করল মাটির খুব কাছাকাছি ফোটা একরকমের ফুল। ঠিক যেন গোখরো সাপের ফণা! ফুলটি একটা সবুজ ডাঁটায় জন্মায়। প্রথমে সবুজ ভাঁটাটা চ্যাপ্টা হয়ে যায় ঠিক ফণার আকৃতিতে। তারপর তাতে ডুরে ডুরে দাগ হয়। তারপর ডুরেগুলো কালো হয়। তারপর সেই চ্যাটাল, ডোরাকাটা ফণার ওপরে স্পষ্ট গোখরো সাপের মাথায় যেন আল্পনা থাকে, তেমনি একটা চিহ্ন আঁকেন প্রকৃতি। প্রকৃতির এত কেরামতি কেন? না দুর্দান্ত পাহাড়ি ছাগলদের মুখ থেকে এই নিরীহ উদ্ভিদটিকে রক্ষা করা দরকার।

যাত্রীরা সকলেই এই ‘নাগফণ’ পুষ্পের অলৌকিক রূপলালিত্যে বিমোহিত হয়ে পড়ছেন। তবে দু’এক জন বাচ্চাছেলে, এবং এই পিকোলো আর তার মা জননী ছাড়া কাউকে নাগফল ফুল তুলতে দেখলুম না। ফুলটি সুন্দর নয়, অদ্ভুত। কোনো গন্ধ নেই। কাঁটাও না। আঠাও না। লছমন সিং, সূরয সিং দুজনেই উৎসাহভরে অনেক তুলেছে। বনফুলের গুচ্ছ বাহারী পাতার বোঝায়, এবং ‘নাগফণ’ ফুলের গোছা, এত সামলে, ঘোড়া, ব্যাগ, জল ক্যমেরা, শাড়ি, শাল, এসব সামলানোর জন্য আর হাত বাকি থাকে না। আমি তো দশভুজা নই। পথে একটা গ্লেসিয়ার পড়ল। ঘোড়ারা মনের আনন্দে পথহীন বরফের মধ্যে চলতে শুরু করল। কিন্তু আমার খুব ভয় করছিল। ‘নেমে, হেঁটে যাই’—যত বলি, লছমন বলে, ‘ঠিক হ্যায়, বৈঠ রহিয়ে।’ এক জায়গায় দেখি মিলিটারির লোকেরা তুষার কুড়ুল দিয়ে কুপিয়ে সিঁড়ি তৈরি করছে। পায়ে যাঁরা হাঁটছেন, এই বরফের ঢালু পথে ওঠা তাঁদের পক্ষে কঠিন।

দূর থেকে যেই ‘রামবাড়া’ চটি দেখে গেল, লছমন সিং বললে—‘আধা রাস্তা খতম্!’ রামবাড়া ঠিক মধ্যপথে। প্রথমে পড়েছিল জঙ্গলচটি। সেটা ছোট কয়েকটা চায়ের দোকান। রামবাড়া কিন্তু বেশ বড় চটি। কালীকম্বলিবালার ধর্মশালা আছে, বিড়লার গেস্ট হাউস আছে, এবং জায়গাটিও বড় চমৎকার। উপত্যকার ধার দিয়ে মন্দাকিনী প্রবাহিত হচ্ছেন, দূরে চারিপাশেই তুষারমৌলি হিমালয়ের শিখর যেন ঘিরে আছে। অপরূপ স্নো-ভিউ। মনে হল কেন যে লোকে দার্জিলিং-সিমলা যায়? এমন সুন্দর জায়গায় হলিডে-রিসর্ট করে না? সাহেবগুলো এতদিন ধরে এদেশে তবে করছিল কী? সুইজারল্যান্ডে এর চেয়ে সুন্দর স্পট ক’টাই বা আছে? প্রকৃতি তো ছপ্পড় ফোড়কে দিয়া-মানুষ তাতে বিশেষ কিছুই যোগ করেনি।

মাধোদাসজী

অনেকক্ষণ ধরেই পথে প্রায় আমার পাশাপাশি আসছেন একজন দণ্ডধারী সাধু। এপথে অনেক রকমের সাধু দেখা যায়। দণ্ডধারী অনেককে দেখেছি। এঁরা দণ্ডীস্বামীর শিষ্য। গঙ্গোত্রীতে দণ্ডীবাবার আশ্রম আছে, ধর্মশালা আছে, কবিতাদিরা একদিন ছিলেন শুনেছি। খুব শান্তিপূর্ণ আশ্রম, তবে মন্দিরের থেকে অনেকটা দূরে। আমি এই দণ্ডীবাবাকে জিগ্যেস করি,—’আপনার নাম কী, বাবা?’ সাধু বাবা বেশ তরুণ, ত্রিশের নিচেই বয়স হবে। ঝকঝকে এক মুখ হেসে উত্তর দিলেন—‘মাধোদাসজী?’

–’আপনি কোথা থেকে আসছেন মাধোদাসজী?’ তিনি হেসে বললেন, তাঁর তো কোনো বাঁধা ঘর নেই। এই মুহূর্তে আসছেন গঙ্গোত্রী থেকে। তিনি সারা বছরে ছ’জায়গায় থাকেন : অযোধ্যা, মথুরা, বৃন্দাবন, প্রয়াগ, কাশী, হরিদ্বার। এবং প্রতি বছরই চারধাম ভ্রমণ করেন। এটা সাধুদের কর্তব্য। চারধাম ভ্রমণ, সাধুদের জন্য, বলতে গেলে ফ্রী। কালী কম্বলিওয়ালার প্রতিষ্ঠান থেকে মোট বিয়াল্লিশটা পড়ছি (কুপন) দেয়।—ডেইলি র‍্যাশন উঠানেকে লিয়ে। উসসে জ্যাদা খায়গা তো আপনা পয়সা লাগেগা।’ কিন্তু ওই বিয়াল্লিশটা কুপনেই সাধারণত চারধাম হয়ে যায়। সন্ন্যাসীরা দিনে একবার খান, বিয়াল্লিশ দিনের রসদই যথেষ্ট। চারধাম ঘুরতে তার চেয়ে বেশি বড় জোর তিন চার দিন লাগে। নিজে রেঁধে নিতে হয়। আটা, আলু, উনুন, কাঠ, সব দেয়। কালীকম্বলিবালা। শুতেও দেয়। হ্যাঁ সন্ন্যাসীদের সব রকম যত্ন করে কলীকম্বলিবালার প্রতিষ্ঠান!

আমার শুনে ভয়ানক লোভ হতে লাগল ওই বিয়াল্লিশটা পড়ছি হাতে করে পায়ে হেঁটে ঘুরতে। কিন্তু প্রপারলি রেজিস্টার্ড সন্ন্যাসী হতে হবে তো। আর বাথরুমের একটা সমস্যা হয়তো আমার হবে, সন্ন্যাসিনী প্রপার হলে যেটা হয় না। এতদিন যে ঘুরছি, সত্যি বলতে কি সন্ন্যাসিনী কিন্তু চোখে পড়ল না একজনও। তাঁরা কি ঘোরেন না? তাঁদের সন্ন্যাস কি আশ্রমবাসিনী থাকার? তাদের চারধাম ভ্রমণের বাধ্যবাধকতা নেই?

–’মাধোদাসজী, আপনি কতদিন সাধু হয়েছেন?’

-’বচ্‌পনসেই সাধু হুঁ ম্যায়। যিন্‌কো ভগবান বুলালেতা আপনে কামমে, উয়ো সাধু বন যাতা।’

‘হঠাৎ কেন সাধু হতে ইচ্ছে করল আপনার?’

—’ক্যা জনে? কোই চোর-ডাকু বন্তা, কোই সাধু-সন্ত বনতা। ভগবান বনা লেতা।’

—’এত অল্পবয়সে এই কঠোর জীবন আপনার ভালো লাগে? আপনার বয়েস এখন কত?’

লাজুক হেসে মাধোদাসজী বললেন—‘উন্নিস সালকা হুঁ।’

এতক্ষণ লছমন সিং চুপচাপ আমাদের বাক্যালাপ মন দিয়ে শুনছিল আর হাতে ছপটি দিয়ে পথের ধারের গাছপালাকে ছপাং ছপাং করে শায়েস্তা করছিল। ঘোড়াটি যেহেতু অতি ভদ্রলোক, তাকে কিছুই বলতে হয় না। দেখতেও অভিজাত ধবধবে সাদা, স্বভাবটিও ‘নোব্‌ল অ্যানিম্যাল’ অভিহিত হবার যোগ্য। লছমন সিং এবার মাধোদাসজীকে একটা কথা বলে বসল—’কভি হো নেহী সকতা।’

–’ক্যা হো নেহী সকতা?’

—তুমহারা উমর চৌর্ভিস/পচ্চিস সাল হোগা। উন্নিস হো নেহী সকতা। হম্‌কো পতা হ্যায়।’

-’ক্যায়সে পতা চলা?’

-’দেখনেসে মালুম পড়তা।’

মাধোদাসজী দেখলুম একেবারে ক্ষেপে গেলেন। কী? তাঁর বয়স বাড়িয়ে দেওয়া? চ্যালেঞ্জ করা? তাঁকে হয় মিথ্যেবাদী অথবা অজ্ঞান বলা? মাত্র তেরো চোদ্দ বছরের চেয়ে বেশি নয় লছমনের নিজের বয়েস। তার নিশ্চিত কথা বলার ধরনে আমার তো খুব হাসি পাচ্ছে। কিন্তু মাধোদাসজীর হাসি পায়নি।

–’আরে, তুমি পাহাড়ি লোগ, খানাপিনা করতা নেই, তাগদ ভি নেহী হোতা, বাড়তা নেহী ঠিক সে, জিন্দগী ভর ইতনা ছোট-ছোটাহী রহ্ যাতা, ঠিকসে মোচদাড়ি ভি নিকলাতা নেহী। একদম জংলা আদমি হোতে হো তুমলোগ, হিলস্ পিপলকো খানা ভি নেহী মিলতা তুমকো—হম্‌লোগ প্লেনসবায়লা, প্লেনসবায়লা সবকো তাগদ হোতা হ্যায়, যিতনা পয়সা কামাতা, সব খানা খা-কে খতম করতা, ইসলিয়ে ইতনা তাগদ, উমর জেয়াদা লাগতা—আরে তুম্ লোগোঁকে তো ঘরমে খানা ভি মিলতা নেহী, সালভর—’

—কিউ নেহী মিলতা? জরুর মিলতা। বহুৎ মিলতা খানা পাহাড়মে—এইসা মত বোলনা’–লছমন সিং হঠাৎ তেড়েফুঁড়ে উঠেছে। সঙ্গে সঙ্গে কথার সুর পালটে ফেলেন মাধোদাসজী—’আরে খালি খানা খানেসে কেয়া হোগা? আসনতো নেহী করতা তুমলোগ? হমলোগ সাধু বাবা, সাধুলোগকো উমর বাড়তা নেহী যেইসা আদমী লোগকো উমর বাড় যাতা না, সাধুলোগকো উইসা নেহী হোতা—ইলিয়ে কি হমলোগকো কড়া রুটিন হ্যায়। জপতপ, ধ্যান-পূজা, সাধন-ভজন, আউর যোগাসন-এই করনেসে দিল শান্ত হো যাতা, তবিয়ৎ শরীফ রহতা, আউর উমর বি নেহী বাড়তা। শুনা? যমুনাতীর মে এক সাধুবাবা হ্যায় দণ্ডীবাবাই হ্যায় এক, হম উনকো দেখকে আতা হুঁ, উল্কা উমর আর দোশ সাল হোগা, দেখনেসে মালুম পড়ে গা, পঁচাশ! সাধুলোগকো। উমর কোঈ কভী বোল নেহী পাতা—তুম ক্যায়সে সকোগে?’

লছমন সিং একথার উত্তর দিল না। দুশো বছরের সাধুকে পঞ্চাশ বছরের মতো দেখালে, ওর তাতে কিছুই বলার নেই। উনিশ বছরের সাধুকে পঁচিশ বছরের মতো দেখালে ওর আপত্তি। সংসার ত্যাগী দণ্ডী সাধুর নিজের বয়েস বিষয়ে এই দুর্বলতা দেখে অবাক হয়ে যাই! ‘হিলস পিপল’ আর ‘প্লেনস বায়লা’-দের বিষয়েও তাঁর বেশ সাম্প্রদায়িক মতামত রয়েছে। পাহাড়ীরা গরিব দুঃখী, খেতে পায় না, সমতলের লোকেরা খেয়েদেয়ে রসেবশে থাকে। কে যে কী জন্যে সন্ন্যাস নেয়!

প্যার-কি-কহানী

গাড়োয়ালের গরিব লোকেরা কি খায়, কী পরে, কী করে আমি আর লছমন সিং যখন এই সব কথা বলছি, ওদিকে পিকো আর সূরয সিংয়ের আরেক ধরনের গল্প হচ্ছে। সিংয়ের দাদা জিওগ্রাফির প্রফেসর কোনো এক কলেজে। সূরষ সিংয়ের ছোট ভাই বি. কম. পড়ছে। উত্তরকাশীতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে আরেক ভাই। ও নিজে ‘লজ’ চালায়। ঘোড়া ওদের নৌকর লোগ চালায়। আজ খুদ্ হি চলা আয়া,–আপনা শখসে।—পিকো সুযোগ পেলেই চেঁচিয়ে আমাকে খবরগুলো পাস অন করে দিচ্ছে,–’মা, মা জানো ওর দাদাও প্রফেসার; কলেজে জিওগ্রাফি পড়ায়।’ ইত্যাদি। এক সময় শুনি গান হচ্ছে—’তৈরি প্যারী প্যারী সুরতকো, কিসিকে নজর ন লাগে, চশমে বদূর-’পিকো এটা রিলে করল না। তারপর শুনি, ‘ইয়াদ কিয়া দিলমে কাঁহা হো তুম্—প্যার-সে পুকার লো যাঁহা হো তুম—’। খানিক পরে শোনা গেল খুব মিষ্টি সুরে কী একটা গান—লছমন সিং উতলা হয়ে বলে—’ইয়ে পাহাড়ী গানা হ্যায়, গাড়োয়াল কি গানা—বহুৎ আচ্ছা লাগতা হম্‌কো—’

–’কিসের এত গান শুনছিস রে পিকো?

–’সূরষ সিং শোনাচ্ছে ওদের গান-আমাকে বলছে আমাদের গান গাইতে—’

—’কেবলই তো প্রেমের গান শোনাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে—’

‘তাই শোনাচ্ছে গো—কী করব?’

—’করবি আবার কী? শুনে যা! ইগনোর কর। তুই যেন আবার ওকে গান শোনাতে বসিস নি।’

—’পা-গল?’

.

পিকো গান না গাইলেও ক্ষতি হয় নি। সূয়য সিং ছুটে ছুটে ফুল তুলে, দৌড়ে দৌড়ে গান গেয়ে, দেবানন্দের স্টাইলে ঘোড়ার লেজ মলে দিয়ে, মনের সুখে নিরাপদেই পথ কাবার করলে। কেবল একবারই, সে যখন ফুল তুলছিল, পিকোর লাল ঘোড়া হঠাৎ ছুট লাগাল–অন্য একটা সাদা ঘোড়াকে তার লিডার মনে করে। সে সর্বক্ষণই আমার সাদা ঘোড়াকে অনুসরণ করে পথ চলে। ‘মামেকং শরণং ব্রজ’ বলে দিয়েছিল বোধ হয় তাকে আমার ঘোড়া। আমার সাদা ঘোড়ানী বয়স্কা মহিলা, আর সে অল্পবয়সী খোকা; সর্বদা বড়কে মান্য করে চলে। আমি একটু এগিয়ে গিয়েছি, ফুলে ফুলে এবং গানে গানে পিকো পিছিয়ে পড়েছে। তার ঘোড়া হঠাৎ আমার ঘোড়াকে দেখতে না পেয়ে ঘাবড়ে গিয়ে দৌড় লাগালো অন্য একটি সাদা ঘোড়ার পেছনে। পিকো তো প্রাণ দিয়ে লাগাম ধরে আছে—আর সূরয সিং চেঁচাচ্ছে—’লাগাম পাকড়ো, ছোড় মত দেনা—’ তার হাত ভর্তি ফুল। লছমন সিং শুনতে পেয়ে ছুটে ধরল এস্ত ঘোড়াকে—পিকোর তো ধড়ে প্রাণ এল, এবং পিকোর মায়েরও।

.

–’আর একটাও ফুল তুলবে না।’ ফুলের ওপর মায়ের নিষেধাজ্ঞা জারি হয়ে গেল। এমন কি ‘নাগফণ’ ফুল দেখলেও তোলা বারণ। রামবাড়া চটির পরে গরুড়চটি। সেখানে সবাই চা খাচ্ছে। সারা পথে, এক বাঙালী দম্পতি আমাদের প্রায় পাশে পাশেই ছিলেন। এক ঘোড়ায় স্ত্রী খুবই ক্লান্ত, কাতর, অরেক ঘোড়ায় তার কর্তা, বেশ শক্তই আছেন। ফেরৎ যাত্রীদের সারা পথই জিজ্ঞেস করছেন—’আর কত দূর ভাই?’ সবাই বলছে—’এই তো এসে গেছেন! জয় বাবা কেদারনাথ কী! শুনে কর্তা স্ত্রীকে সাহস দিচ্ছেন—ঐ তো, এসে গেছে! শুনলে তো?’ গরুড়চটিতে তাঁরাও চা খেতে থামলেন। আমরা এগিয়ে চললুম, কেদারনাথ আর ২/১ কিলোমিটারের মধ্যেই। ‘দেওদেখানি’ বলে এক জায়গায় এসে ঘোড়াওলারা ঘোড়া থামিয়ে দূরে আঙুল তুলে দেখাল—’ওই যে, কেদারনাথ!’

দেখলুম দূরে ধবধবে ঝকঝকে তুষারশৈলের বলয়ের মাঝখানে ফোটোতে দেখা কেদারনাথের মন্দির ঝল্‌মল্ করছে।

দেবতার মন্দির দেখা যায় বলেই বোধ হয় জায়গাটার নাম ‘দেওদেখানি।’

রামবাড়াতে চা খেতে থেমে, রঞ্জন এবং অলোকের জন্যে অপেক্ষা করেছিলুম। ওরা মিনিট পনেরোর মধ্যেই এসে পড়ল। সূরয সিং তার চেনা একটি পরিচ্ছন্ন দোকানে নিয়ে গিয়ে আমাদের চা খাইয়ে দিয়েছে ততক্ষণে।

রঞ্জন আর অলোককে চা-টা খাইয়ে আমরা আবার রওনা হলুম একসঙ্গে। অতএব আশা করছি কেদারেও ওরা এসে পড়বে মিনিট পনেরোর মধ্যে।—লছমন সিং পুলের কাছে অপেক্ষা করতে লাগল ঘোড়া নিয়ে। সূরয সিং আমাদের সঙ্গে এল। সে মাস্তান আদমি, কেদারনাথের পাণ্ডাদের চেনে-টেনে। ধরমশালা ঠিক করে দেবে আমাদের জন্যে।

ছোটাসা ঘর হোগা বাদলোঁ কি ছাঁও মে–

প্রথমে কালীকম্বলীবালা। অন্ধকার মাটির ঘর। ঠিক পছন্দ হল না।

আরেকটা ধরমশালা। দোতলার ওপর মস্ত ঘর-ঘরের তিন দিকে মাটির মোটা দেয়াল, মাথায় টালির ছাদ। এক দিকটা খোলা। কোনো দরজা নেই—সেখানে বারান্দায় সিঁড়ি এসে থেমেছে। ফ্রি। ঘরটা খুব সুন্দর—মেঝেয় খড়ের ওপর শতরঞ্চি পাতা। ছ’ টাকাতে লেপ তোশক ভাড়া পাওয়া যাবে। ঘরে অনেক লোক থাকার ব্যবস্থা। একা আমরা নই, অন্তত বিশ-পঁচিশ জনের ঘর। পিকোর খুবই পছন্দ দরজা বিহীন ঘর বলে—কিন্তু আমার মনে হল রাত্রে যখন বরফের দেশ থেকে হাওয়া দেবে, তখন নিশ্চয়ই ব্রঙ্কোনিমোনিয়া হয়ে যাবে।—নাঃ।

–’চলো বাবা, আরেকটা ঘর দেখি। বেশ অ্যাটাচড বাথরুমওলা পাকা ঘরদোর কি নেই কোনো? পয়সা দিতে আপত্তি নেই।’

এবারে দেখল জে. কে. কোম্পানির ধরমশালা। সুন্দর একতলা ডাকবাংলো প্যাটার্নের বাড়ি। হ্যাঁ, বাথরুম অ্যাটাচড বটে কিন্তু তা এমন কায়দায় তৈরি যে একসঙ্গে ৪টে ঘরের সঙ্গেই অ্যাটাচড। সব চেয়ে পেছনের ঘরটা দিতে পারে, অন্য সব যাত্রী ভরা। এও ফ্রী। এও মেঝেয় শতরঞ্চি পাতা। ছ’টাকা দিলে বিছানা। গাঁইগুই করছি দেখে ছেলেটি বললে—’খুব দামি একটা ঘর আছে দোতলায়। পঁচিশ টাকা ভাড়া। নেবেন?’

‘নিশ্চয়, নিশ্চয়, যদি ভালো হয়।’

জে. কে. ধরমশালার উঠোনের ভেতরেই ছোট এই দোতলা। পাণ্ডার বাড়ি। নীচেও ঘর আছে। সেটা দশ টাকা। দোতলা পঁচিশ, বারান্দাঘেরা। জানলা দরজা আছে। নীচে, চাবি-দেওয়া এক্সক্লুসিভ টয়লেট। উপরের ঘর যার, চাবি তার। একতলারও বাথরুম আছে, অন্যদিকে। এই ঘরেও শতরঞ্চি পাতা, হ্যারিকেনও রয়েছে। ঘরে লোকজনও রয়েছে।—’আমরা এখুনি নেমে যাব। ভাড়া মেটানো হয়ে গেছে।’ বললেন বাঙালি গিন্নিটি।

—আপনারা ক’জন ছিলেন এঘরে?’

—ছ’জন।’ ছ’জন কেন দশজনও থাকতে পারত। ঘর বেশ বড়ো। এটাই নেওয়া স্থির করলুম। ছেলেটিকে দুটি টাকা দিতে সে খুশি হয়ে পাণ্ডাকে খুঁজতে গেল। সূরয সিং বললে—‘বিড়লা ধরমশালাই সবসে বেস্ট—আপলোক ট্রাইতো কীজিয়ে? মালীকা সাথ বাত তো করনা?’

মালীর সঙ্গে বাত করে আর কী হবে? জে-কে-র একেবারে পাশেই বিড়লা ধর্মশালা। ২২/২৩ কবিতাদিদের চারজনের বুকিং ছিল। চিঠিটা নিয়ে আসতে ছুট দিয়েছিল ঘুচাইসোনা। আমরাই তাড়াহুড়ো করে চলে এসেছি। তাছাড়া আজ ২৪শে। বুকিং-এর দিন ফুরিয়েছে। মালীর খোঁজে একবার গেলুম। চমৎকার বাড়িটা, সত্যি। একটু ঘুরে দেখে চলে এলুম, মালীর পাত্তা নেই। একজন উটকো লোক ছিল। সে আগ বাড়িয়ে বললে—‘বুকিং হ্যায়? পড়ছি হ্যায়? বিনা চিঠিসে ঘর নেহী মিলতা।

—‘তুমি কে?’

-’আমি কুলি।’

–’ঘর আছে?’

–’হম্ কুছ নেহী জানতা। মালীকো পুছো।‘

আমি জে. কে.-তে ফিরে এলুম। পিকো আর সূরয সিং গেল মালীর খোঁজে।

নাম রেখেছি কবিতামাসি

খানিক বাদে লাফাতে লাফাতে অলিম্পিকে ৪টে সোনা পাওয়ার একখানা মুখ করে পিকো ফিরল। যেন জেস্ আওয়েনের স্ত্রী-সংস্করণ।—’হয়ে গেছে। বিড়লায় চলো। তোলো পুঁটলি।’

—সে কি রে? কী করে হল?’

–’কবিতামাসির বুকিংয়ের দৌলতে। আমি বললুম—আমাদের ২২/২৩ বুকিং ছিল, খাতায় দ্যাখো, কলকাতা থেকে বুকিং শ্রীমতী কবিতা সিনহার পার্টি—অল ইনডিয়া রেডিওর অফিসার, তাঁর দুই ছেলে, আর মেয়ে। আমাদের আসতে দেরি হয়েছে। আমরা আজ এসেছি। মাত্র এক রাত্রিই থাকব। একটু ব্যবস্থা করে দেবে না?’ মালী খাতা খুলে বলল, ‘সিন্হা? হাঁ, হাঁ, বুকিং থা। কিন্তু কালই ছেড়ে দিতে হবে। আজ ঘর খালি আছে। কাল থেকে আবার বুকিং হয়ে আছে।’ বলে ঘর খুলে দিয়েছে।

আমি তখনও বিশ্বাস করতে পারছি না।—’পড়ছি? পড়ছির কী হবে?’

-’পড়ছি তো চায় নি রে বাবা? চাইলে তখন দেখা যবে। এত ভয় পাচ্ছ কেন?’

আমি আবার ধর্মভীরু লোক। তীর্থে এসে এত গুলতাপ্পি?—’পিকো, এটা কি ভালো করলি? যদি ধরা পড়ে যাই? আমি কিন্তু বলতে পারব না আমি কবিতা সিন্হা। তারপর যদি পুলিশে দেয়?’

–’পুলিশে দেবে না, মা, বড় জোর তাড়িয়ে দেবে। তখন তুমি এখানে এসে থেকো।’—তখন যদি এটা না পাই?’

—’তাহলে আর কোথাও পাবে। অত ভয়ের কী আছে?’

–’ঠকিয়ে থাকবি? আমি বাবা কবিতাদি সাজতে পরব না। তুমিই সাজোগে কবিতাদি। আমি বরং তোমার মেয়ে হই!’

–’তুমি কেবল কথাটা বেশি বলো না মা, চুপচাপ থেকে। আমরাই ম্যানেজ করে নেব।’

ভয়ে বুক ধুকপুক করতে লাগল, অথচ ইচ্ছেও আছে, পিকোর সঙ্গে আমি অগত্যা বিড়লায় চললুম। সূরয সিং ফিরে গেল ঘোড়ার কাছে, রঞ্জনদের বিড়লায় নিয়ে আসবে বলে। আধ ঘণ্টা হয়ে গিয়েছে, ওরা আসেনি।

পিকো গিয়ে নীচের বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইল। পাছে রঞ্জন এসে মালীকে ভুল-ভাল কিছু বলে ফ্যালে। ঘরটি ভারি মনের মতো। দোতলার ওপরে। সঙ্গে বিলিতি কলঘর, ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন। ঘরে ডবল বেড, সোফাসেট, ড্রেসিং টেবিল, পোশাকের আলমারি। চমৎকার দামি হোটেলের মতো ব্যবস্থা। ফর্সা চাদর, ফর্সা বালিশের ওয়াড়, অবশ্য চেয়ে নিতে হল। না-চাইলে ঐ ময়লাতেই শুতে দিত সর্বশক্তিমান মালী। খানিক বাদে পিকো আর রঞ্জন, (অলোক সমেত) ঝগড়া করতে করতে এসে হাজির। রঞ্জন বলছে, ভুরু কপালে তুলে।

—ব্যাপার কী? তুই কি পাগল হয়ে গেছিস? আমাদের দেখাবামাত্র মালীর কানের কাছে অমন, ‘এই যে, হামকো দাদালোগ আ গিয়া’ বলে চেঁচাতে লাগলি? আমি তোর দাদালোগ হলুম কবে?’

—’আজকেই। তুমি কবিতা সিন্হার ছেলে। আমি তার মেয়ে। বুঝলে? তুমি পুতুলদা, আমি ঘুচাই, অলোক সমরেন্দ্রদা। মা কবিতামাসি।’

—’অর্থাৎ, আজ যদি এবাড়িতে আগুন লাগে, জতুগৃহটি পাকাপোক্ত! আমার বাবা এসব ব্যবস্থা একেবারেই ভালো লাগছে না। শিগগিরি চা আনতে বল!‘

চা আসে। এবং তারপরেও অমি কাষ্ঠপুত্তলির মত বসেই থাকি। যতবার মালী আসে আমি চোখ ফিরিয়ে নিই। স্নানের কি গরম জল লাগবে? সেটা পিকো বলে। দুপুরে কী খাব? সেটা রঞ্জন বলে। ভয়ানক ঠান্ডা, একটা আগুন জ্বালান যাবে নাকি ঘরের মধ্যে—অলোক বলে। আগুন আসে। গরম জল আসে। খানাও আসে। আমার বুক কাঁপে। আমি রিল্যাক্স করতে পারছি না। আমি মালীকে সমানে এড়িয়ে যাই। ভুলেও চোখাচোখি করি না। কী দরকার?

চা-টা বেশ ভালো। দাম কেবলই বাড়ছে। গৌরীকুণ্ডে ষাট, আশি পয়সা দাম ছিল রামবাড়ায়। এখানে ১ হয়ে গেল। খানা কিন্তু সেই ৫। ডালপাপড়-পুরি সবজি দেয়। ঘরের মধ্যে, এই বালতির আগুনটা খুব কাজে দিচ্ছে। প্রবল ঠান্ডা এখনই। রাত্রে কী হবে? জানলার বাইরের প্রহরী স্বয়ং তুষারধবল হিমালয়, আর সবুজ ঘাসে ঢাকা উপত্যকা। জানলা খোলা দুঃসাধ্য—যা শীত বাইরে। শুনেছিলাম অবিশ্যি কেদারে মাত্রাতিরিক্ত ঠান্ডা পড়ে বলে যাত্রীরা রাত্রে রামবাড়িতে নেমে গিয়ে থাকেন।

রাজার চিঠি

পরিষ্কার চাদর বালিশের ওয়াড় আনিয়ে সুন্দর করে বিছানা পেতে খেয়ে-দেয়ে শোবার বন্দোবস্ত করছি, রঞ্জনরা বাইরের লবিতে সিগারেট খাচ্ছে, এসে বলল—‘কারা যেন সব এসেছে দিল্লি থেকে, একট ফিল্মের ইউনিট। তাদের ঘর নেই। তারা নাকি জি. ডি. বিড়লার চিঠি নিয়ে এসেছে। ‘

—’আমরাও তো বিড়লার চিঠি নিয়ে এসেছি। চিঠিটা অবশ্য উত্তরকাশীতেই রয়ে গেছে!’ বলে পিকোলো।

—’কিন্তু কে লিখেছে সেই চিঠিটা? কে. কে. না জি. ডি. না বি. কে—কিছুই তো জানিস না। চিঠি-পত্রের কথা না তোলাই ভালো। বরং ফোনের কথা আমরা বানিয়ে বলতে পারি। ওরা ব্যস্ত মানুষ, ফোনেই সব ঠিকঠাক করতেই পারে।’ রঞ্জন বুদ্ধি দেয়।

—’ওরে বাবারে—একদম ওসবের মধ্যে যাবি না,—খবদ্দার বানিয়ে বানিয়ে বলিস না পিকো, সর্বনাশ হবে, শেষ রক্ষা করতে পারবি না, সোজাসুজি সত্যি কথা বলে দে বরং—’

–‘সত্যি মিথ্যে কিছুই বলবার দরকার নেই দিদি, স্রেফ চেপে যান’–বলে অলোক। চেপে আর কী করে যাই? মালী এল মাথা চুলকোতে চুলকোতে। মালী জানাল, জি. ডি. বিড়লা সাহেব লিখেছেন, ওদের দোতলার ঘর ছেড়ে দিতে। অন্যান্য সব ঘর আগে থেকেই বুক্ড, লোক আছে। আমাদেরই বুকিং খতম হবার পরে এসেছি, তাই আমরা যদি এ ঘরটা ছেড়ে দিয়ে ঠিক এর নীচের ঘরটায় যাই তাহলে খুব ভাল হয়। সরেজমিনে তদন্ত করবার উদ্দেশ্যে, যুদ্ধং দেহি হয়ে পিকো বাইরে গেল। আমিও। তাকে সামাল দিতে। দেখি ভয়ানক টাশ-মার্কা উদ্ধত কয়েকজন পুরুষ, একটি দাম্ভিক মহিলা, আমারই বয়সী হবেন, খুব রংচং করা মুখ, সোয়েটার স্ল্যাক্স পরা,–’ইলেকট্রিক হীটার কেন নেই’, বলে খুব হম্বিতম্বি করছেন লবি-তে। তাঁদের চা দেওয়া হয়েছে—খেতে খেতে তাঁরা নাক তুলছেন, মুখ বাঁকাচ্ছেন, এবং বলছেন রানিং হটওয়াটারটা চালিয়ে দিতে। তাঁদের কথাবার্তা মালী কিছুই বুঝতে পারছে না। পিকোলোই তাঁদের সবিনয়ে জানাল,—‘কেদারনাথে আপাতত ছ’মাস হল বিজলী নেই। তুষারঝড় হয়েছিল, ধস্ নেমেছিল, বিদ্যুতের স্তম্ভ উপড়ে লাইন ছিঁড়ে দিয়েছে। এখনও সে সব লাইন সারানো হয় নি। পিসার-লীনিং-টাওয়ারের মতো পড়ো-পড়ো দেখতে বিজলী স্তম্ভটা পথে দেখেননি? আমরা তো দেখলাম!’ তাঁরা অন্যমনস্ক হয়ে শুনলেন। কোনো উত্তর দিলেন না। শুনলেন কিনা টের পাওয়া গেল না। আমাদের যে তাঁরা খুবই নিম্নস্তরের প্রাণীজ্ঞান করছেন সেটি ভিন্ন আর কিছুই বুঝতে দিতে তাঁদের উৎসাহ ছিল না। কিন্তু জি. ডি. বিড়লার চিঠি নিয়ে এসেছেন এটা তাঁরা সেধেই বললেন এবং তৎক্ষণাৎ পিকো বলে ফেলল, ‘সে তো আমাদেরও আছে।’

আর আমার মস্তিষ্কে বজ্রাপাত হল। আমার মনে হল, সর্বনাশ! এক্ষুনি তো বলবে—’কই, দেখি?’ তখন?

‘আমি তাড়াতাড়ি ঘরে গিয়ে বাক্সপুঁটলি বন্ধ করে গুটিগুটি নীচের ঘরে নেমে চললুম। ফরসা চাদর-ওয়াড়গুলো খুলে নিয়ে যেতে ভুললুম না, অবশ্যই, তোয়ালেও।

রঞ্জন বললে, ‘কেন চলে যাচ্ছ? ওরাই নীচে থাকুক। বাজে লোক!’

আমি বললুম—’তাই, ঝামেলা বাড়িও না। অর্ধং ত্যজতি পণ্ডিতঃ শোননি? সর্বনাশ সমুৎপন্ন হয়েছে, অর্ধেক ত্যাগ করাই মঙ্গল। যদি ধরে ফেলে?’

আমরা বিনা বাক্যে নীচে চলে যাব, এটা বোধহয় মালীও ভাবেনি। ঝামেলা বাধল না দেখে আমাদের প্রতি সে যারপরনাই প্রসন্ন হয়ে উঠল। এবং ওপরের অগ্নিকুণ্ডটি নিবে এসেছিল বলে, নিচে আবার একটি অগ্নিকুণ্ড জ্বালিয়ে এসেছিল। কিন্তু বলে দিল, রাত্রে দেবে না। রাত্রে ঘরে আগুন জ্বালান বারণ।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ওপরের ঘরে মদের গন্ধ বেরুতে লাগল—কেননা একটু পরে আমরা দোতলার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালুম—আশ্চর্য এক চাঁদ উঠছিল তখন কেদারের মাথাতে। এত শীত করছে, উঠোনে যেতে পারছি না। ওপরে ঢাকা বারান্দা আছে।

ফিল্ম ইউনিটের লোকেরা কেন এসেছিল, তারা কারা, সরকারি ফিল্মস ডিভিশন, না কোনো ব্যক্তিগত প্রযোজক পরিচালকের প্রয়াস কিছুই বোঝা গেল না। কিসের ছবি হবে, কেদার সম্পর্কিত ছবি, না কেদারটা একটা প্রাসঙ্গিক ঘটনা—কিছুই জানা হল না।

জয় বাবা কেদারনাথ!

বিকেল থেকেই বর্ষা শুরু হয়ে গেল। ২০টে/৩টে থেকেই ভয়ানক বৃষ্টি পড়ে এদেশে। কেদার থেকে তাই বিকেলের দিকে কেউ নামতে চায় না, বা উঠতেও চায় না গৌরীকুণ্ড থেকে। পথ পিছল হয়ে যায়, ঝাপসা হয়ে যায় চোখ, এবং হাড়ের ভেতর পর্যন্ত কাঁপুনি শুরু হয়।

এখানে ঘরের মধ্যেই কী শীত! কী শীত! আমরা নানারকমের খেলা শুরু করেছি। এই খেলাটায় গল্প বলো, কান ধর, নাচ কর, গান কর, হামাগুড়ি দাও, যাকে যা করতে বলা হচ্ছে, সে তাই করছে—শুধু অলোক কিছু করছে না। প্রতিবার অলোকের দান এলে, সে চুপটি করে থাকছে। আমরা বলতে বলতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠে শেষে রঞ্জনকে বললুম, ‘ধর তো রঞ্জন পাদুটো! এ-ব্যাটা তো মরেই গেছে—এটাকে বাইরে ফেলে দিয়ে আসি!’ বলেই, যেমন কথা, তেমনি কাজ। আমি ধরলুম পা দুটো, রঞ্জন হাত দুটো—পিকো দরজা খুলে ধরল, চ্যাং দোলা করে দুলিয়ে অলোককে নিয়ে উপস্থিত হলুম বাইরে লবি-তে। অলোক বিন্দুমাত্রও আপত্তি করছে না, দিব্যি আত্মসর্পণ করে শুয়েই আছে শূন্যে। আমরা ওকে উঠোনে হিহি শীতের মধ্যে সত্যি সত্যি ফেলে দেব বলে দরজার কাছে গিয়ে দেখি একটি পাঞ্জাবি পরিবার লবিতেই আশ্রয় নিয়েছে। ঠক্‌ঠক্ করে কাঁপছে। এরা শোবে কোথায়? বাচ্চাকাচ্চাও রয়েছে সঙ্গে। কখন এলই বা?

অলোককে উঠোনে ফেলে না দিয়ে ‘জয় বাবা কেদারনাথকি’ বলে লবিতে সোফার ওপরেই বিসর্জন দিয়ে ফিরে এলুম। খানিক বাদে দেখি অলোক ফিরে এসেছে। দরজায় টোকা দিয়ে বলছে, ‘এই মহিলা আর তার বাচ্চারা বাথরুমে যেতে চান, আমরা কি যেতে দেব?’ সঙ্গে করেই মহিলা এবং শিশুদের নিয়ে এসেছে।

বাথরুমের পর তাদের জিজ্ঞেস করলাম, ‘শোবেন কোথায়?’

মহিলা বললেন, তাঁর স্বামী গেছেন ব্যবস্থা করতে।

-’বাচ্চারা এই বিছানায় শুতে পারে খানিকক্ষণ’–বলতে তাড়াতাড়ি মহিলা বললেন, না না, তার দরকার নেই। ওঁরা মন্দিরে আরতি পুজো দেখতে যাচ্ছেন। এনার্জি আছে বটে! তাঁদের আর দেখিনি, ব্যবস্থা হয়েছিল নিশ্চয়।

কেদারনাথের মন্দিরের ঠিক পাশেই আমাদের বিড়লা ধর্মশালা। ধর্মশালা তো নয়, দামি বিলিতি কায়দার হোটেলের মতই মূল ব্যবস্থা। কেদারনাথের আরতির ঘণ্টা শোনা যাচ্ছে—কিন্তু একটু সর্দি হয়েছে-ভয়-ভয় করল অতটা শীতে পথে বেরুতে। তবু বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালুম। বাইরে চন্দ্রালোকিত হিমালয়ের পটভূমিতে বিশাল পাথরের নিঃশব্দ ছায়াময় মন্দিরটি আশ্চর্য দেখাচ্ছে। সুন্দর শব্দটি যথেষ্ট নয়!

বদ্রীনাথের মন্দিরটি বিশাল। পঁয়তাল্লিশ ফুট উঁচু বহুবর্ণ তোরণ, অনেকটা তিব্বতী ধাঁচের। ভিতরে তো শুনেছি ওটা স্বর্ণমন্দির। শুনেছি বটে, কিন্তু যখন পুজো দেওয়ার জন্য গেলুম, তখন সোনার কিনা, দেখে নিতে মনে ছিল না।

তিরুপতির রুপোর তোরণ সোনার তোরণ দেখে নিতে হয় না, তারাই চোখে আঙুল ফুটিয়ে নিজেদের প্রদর্শন করে। এত ঝকঝকে পরিষ্কার পালিশ করা সোনারুপো ভালো লাগেনি। দেশের মানুষ খেতে পায় না, কিন্তু সোনারূপো দিয়ে দেবতার চৌকাঠ মুড়ে রেখে দেয়। অবিশ্যি দেবতার আর তাতে কি? তার কাছে পেতল-সোনার কাঠ-পাথরে থোড়াই ফারাক পড়ে! যাই হোক কেদারনাথের এই পাথুরে মন্দিরটির স্থাপত্যও আমার খুব ভালো লাগল—এর মধ্যে কেমন একটা গুরুগম্ভীর, রাশভারি, austere শ্রদ্ধানন্ত্র ব্যাপার আছে। এই শীত, এই তুষার, এই দীর্ঘ পার্বত্য পথ হেঁটে পার হয়ে আসা কাতর যাত্রীদল, এসবের সঙ্গে এমন একটি মন্দিরই ঠিক মানায়। এখানে ঢাক বাজছে, বদ্রীনারায়ণের ভজন হচ্ছে না। মাইক নেই। কেদারনাথের মন্দির অঞ্চলটি ছোট্ট, বাজারও ছোট্ট, গঙ্গোত্রীর মতো অনেকটা। বদ্রীর মতো এলাহি কাণ্ড নয়। মন্দাকিনীও ঠিক পাশ দিয়ে ছোটে না। কেদারনাথের কাছে কোনো উষ্ণনির্ঝরও নেই, আছে সেই পাহাড়ের নীচে গৌরীকুণ্ডে। এখানে পথশ্রান্তি দূর করতে আছেন হাজির হিমালয়, আর কেদারনাথ স্বয়ং।

স্বপ্ন? মায়া? মতিভ্ৰম?

বদ্রীনারায়ণে জানলা খুলে চন্দ্রমৌলী নীলকণ্ঠ পর্বতকে দেখেছিলুম। কেদারনাথে রাত্রে খাওয়াদাওয়ার পরে একবার ইচ্ছে করল মন্দির, আর হিমালয়কে রাত্রের দেখা দেখে নিতে। কাল সকালেই তো নেমে যাব। এই প্রথম রজনী, এই শেষ রাত্রি।

শোবার আগে আরেকবার কেদারনাথের দর্শন পেতে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালুম।

—ওকি?

-ওরা কারা? কোথা থেকে এল? কখনই বা এল?

—কেমন করে এত কাছে এগিয়ে এসেছে সূদুর হিমালয়। হঠাৎ খুলে গিয়েছে কুয়াশার পর্দা, অনাবৃত হয়েছে জ্যোৎস্না-ধবধবে তুষারে ঢাকা শৃঙ্গের পরে শৃঙ্গ—এক সারি দুধেল ঘোড়ার ঘোড়সওয়ার, ছুটে এসেছে অলক্ষ্য থেকে,—ঝক্ ঝকে তীক্ষ্ণ ইস্পাতের বর্শাফলক তাদের উদ্যত মুঠোয়। এই তরল চাঁদের আলো, এ অলৌকিক স্নেহপদার্থ পিছলে যাচ্ছে পেশীবহুল পর্বতের শক্ত শরীরে। সুন্দরী চাঁদ বুঝি এখান থেকে বেশি দূরে নয়, তাকে দেখেই এই প্রতিবেশী সৈন্যদের সর্বাঙ্গে হাসির আভা উথলে পড়ছে। এই চোখের কত কী পাওয়া বাকি ছিল সারাদিন। কোথায় লুকিয়ে ছিলে তোমরা, যৌবনদৃপ্ত ধবধবে শিখরশ্রেণী, কোথায় যেতে যেতে থমকে দাঁড়িয়েছ? চঞ্চল গতিময়তা এখনও সর্বাঙ্গে মাখান। এমন অসামান্য চমকে দেওয়া প্রকৃতির নিজস্ব নাটকেই সম্ভব। ‘স্বপ্নলোকের চাবি’ কথাটা শোনাই ছিল, এখন মনে হল কেউ যেন সেটা হাতে পেয়ে খুলে ফেলেছে গোপন দরোজা। হিমালয়ের এই প্রসন্ন হাসিটিই সেই স্বপ্নালোক।

সামনে যদি কেদারনথের মন্দির স্থির হয়ে না দাঁড়িয়ে থাকত হয়তো ভাবতুম আমি ভুল করে অন্য কোথাও চলে এসেছি। কোথাও চিহ্নমাত্র ছিল না এতগুলি ধবধবে শিখরের। দিনভর এবার দুষ্টুমি করে লুকিয়ে ছিল মেঘ কুয়াশার আড়ালে। এদের পিছনে দূরবর্তী পর্বতটিই দেখা যাচ্ছিল শুধু। এখন দেখি উত্তুঙ্গ রুপোর পাহাড় একেবারে ঘিরে ধরেছে। ‘রজতগিরিনিভ’ বলেছে কেন যে ‘চারুচন্দ্রাবতংস’কে তা বোঝা গেল। স্তম্ভিত হয়ে কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিলুম জানি না। এত করুণা? এত করুণা তোমার? এ যেন আমারই জন্যে একটা স্পেশাল শো! হে ইংরেজ সাধু শিবখ্ৰীষ্টস্বামী, তোমাকে শতকোটি ধন্যবাদ। তুমি অত জোর না করলে আমি তো আসতুমই না। আর কেদারে না এলে সত্যি সত্যি অপুরণীয় লোকসান থেকে যেত। কোনোদিন জানতেও পারতুম না কী হারালুম। ছেলেবেলার সেই কাঁচি সিগারেটের বিজ্ঞাপনের মতো : ‘আপনি জানেন না আপনি কী হারাইতেছেন!’

লোভীর মতো, একান্ত লোভীর মতোই—মুগ্ধ অতৃপ্ত নয়নে রইলুম একটানা—যতক্ষণ না শীতের প্রকোপে দাঁড়িয়ে থাকা একেবারেই অসম্ভব হল বারান্দায়। কাশি শুরু হয়ে গেল।

ঘরে ফিরতে গিয়ে দেখি বারান্দায় অল্প একটু দূরেই অলোক আর রঞ্জন। নিস্তব্ধ। জানি না কখন এসেছে।

একবার এই বিপুল মহান্ বিস্ময়ের সামনে পড়ে গেলে—বাহিত হয়ে যাওয়া ভিন্ন গতি নেই! এই রাতটি সারাজীবন ধরে আমার চেতনার স্রোতে স্বপ্ন-দেখার মতো ভেসে উঠবে। হয়তো রঞ্জন-অলোক ওখানে সাক্ষী না থাকলে আস্তে আস্তে একদিন ওটা সত্যিকারের স্বপ্নই হয়ে যেত। স্বপ্নের কোনো সাক্ষী থাকে না। এখনও চোখ বুজলে দেখতে পাই সেই সাদা ধবধবে পর্বতের পায়ের কাছে কেদারনাথের নিস্তব্ধ কালো পাথরের মন্দিরের সিলুয়েৎ। মানুষের তৈরি হয়েও ভারি সুন্দর মানিয়ে গেছে, প্রকৃতিকে একটুও ডিস্টার্ব করে না। যেন এই প্রকৃতিরই অঙ্গ সন্ধ্যারতি দেখতে নাই বা গেলুম, এই যে আরতি দেখা হয়ে গেল। এর আর তুলনা কোথায় পাব? এই তো চন্দ্রতপনের আরতি।

ওখানে দাঁড়িয়ে আবার মনে হল এবারের আসাটা ব্যর্থ। এ-আসা আসা নয়, আবার আসতে হবে। যেখানে খুশি যতদিন খুশি থামতে হবে। এই যে কেদারনাথে প্রথম এবং শেষ রজনী, এতে তো মন ভরে না। সন্ন্যাস নিয়ে আসতে হবে। সংসারী লোকটাকে আগে বিসর্জন দিয়ে, তারপর আসতে হবে। তবে হিমালয় আমাকে কফিডেন্সের মধ্যে নেবেন। সন্ন্যাসী না হলে এই মহাসন্ন্যাসীর সঙ্গে ভাব জমাবো কেমন করে?

ভি. আই. পির ছয়লাপ

আবার রাত্রে ছেলেরা মাটিতে, মেয়েরা খাটে—এই বন্দোবস্তেই ঘুমোনো গেল। বিশাল ঘর, খাট মাত্র দুটো। আরও দুটো খাটিয়া যদি ওরা দিতে পারত, পাতবার যথেষ্ট জায়গা ছিল। কিন্তু রাত্রে একবার বারান্দায় যাব ভেবে ঘরের বাইরে বেরিয়ে দেখি লবিতে খাটিয়া পাতা হয়েছে। সব ঘরেই অনেক বেশি বেশি লোক। এঁরা সবাই জি. ডি. বিড়লার সই করা চিঠি নিয়ে এসেছেন বলে মনে হল না। রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নরের সই করা চিঠির দৌলতেই নির্ঘাৎ ঢুকেছেন। তা ভালো, ধর্মশালা মানেই আতুর নিরাশ্রয় তীর্থযাত্রীকে আশ্রয় দেবার ঠাঁই। কে কার চিঠি আনল সেটা জরুরি হওয়া উচিত নয়।

যা বুঝলুম একতলার ঘরগুলো মালী দু’চার টাকার বিনিময়ে ফার্স্ট কাম ফার্স্ট সার্ভ বেসিসে খয়রাতি করে, দোতলারগুলো ভি. আই পিদের জন্য চাবি দেয়া থাকে, বিড়লারা চিঠি দিলে সেগুলো মেলে। নীচের বাথরুম দিশি। উপরেরটা বিলিতি। অবিশ্যি নীচেরটাই বেশি পরিচ্ছন্ন। মস্ত স্নানঘর, গরম জল নিয়ে সকালবেলা ভালো করে স্নান করা গেল আরামে। গৌরীকুণ্ডে যা সম্ভব হয়নি। স্নান করে চা খেয়ে চললুম মন্দিরে। ভোরবেলা একজন পাণ্ডা এসে আমাদের কার্ড দিয়ে গেছেন যথানিয়মে। তিনিই আমাদের মন্দিরে নিয়ে যাবেন। অল্পবয়সী গাড়োয়ালী ছেলেটিকে বেশ ভালোই লাগল। বললে—রঞ্জন-অলোকরা যেন এক্ষুনি গিয়ে কিউ-তে দাঁড়ায়, জায়গা রাখে একজন একজন করে। বিশাল কিউ তো? সবাই মিলে স্নান সেরে একসঙ্গে যেতে যেতে ভীষণ দেরি হয়ে যাবে। ছেলেরা তো চায়ও না স্নান করতে। খুব আহ্লাদের সঙ্গেই ছুটল তারা লাইনে দাঁড়াতে। জানে না তো মন্দির-চত্বরে ধূমপান নিষিদ্ধ।

ইয়ম গঞ্জিকা ওঁ নমঃ শিবায় নমঃ

ঠাকুর কার পুজো কার হাত থেকে নেন! মেসোমশাইয়ের মানতের পুজোর দানসামগ্রী বের করতে গিয়ে দেখি গাঁজা, ভাং, হর্তুকি, বেলপাতা, পৈতে, ধুপ, ধুনোর সঙ্গে দিব্যি মাটির কলকেও রয়েছে ৪টে। অবাক কাণ্ড! সবই দেখি গোনা গুনতি ৪টে করেই প্যাকেট আছে। যেন আমাদের ৪ জনের হাত দিয়ে সাজিয়ে পৌঁছে দেবার জন্যেই! মন্দিরে গিয়ে ছেলেদের রিলিফ দিলুম। তারা গেল পুজোর ডালা কিনতে। ৪টে ডালা নিয়ে এল বাজার থেকে। ডালায় কাপড়, সিঁদুর, অনেক কিছু রয়েছে। কার্ডে আমাদের পাণ্ডার নাম আছে শ্রীমহাদেবপ্রসাদ ও শ্রীগুরুপ্রসাদ শর্মা, চামোলির লোক। কেদারনাথের ঠিকানা—যোগমায়া আশ্ৰম।

যোগমায়া আশ্রম উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মাতৃদেবীর পুণ্যস্মৃতিতে তৈরি ধর্মশালা। বাঙালি যাত্রীদের নিশ্চিত আশ্রয়। আমাদের সেই খুদে পাণ্ডাটি বলেছিল এর কথা, দেখিয়েও দিয়েছিল দোতলা বাড়িটি, কিন্তু স্থানাভাব ছিল। অনেক বাঙালি যাত্রী আশেপাশে তখনও ছিলেন দাঁড়িয়ে।

এই পুজোর কিউ-তে আজ সকালে কিন্তু বাঙালির সংখ্যাই বেশি। প্রচুর এই অঞ্চলের গ্রামের মানুষ এসেছেন, তাঁদের হাতের সস্তা ডালায় আমাদের চেয়ে অনেক মূল্যবান ভক্তির রসদ আছে। পাণ্ডারা খবরদারি করে বেড়াচ্ছে যার যার যজমানের।

কিনে আনা ডালাতে আমাদের মেসোমশায়ের মানতের দ্রব্যগুলি সাজিয়ে দিতেই সত্যি বেশ স্পেশাল-ডালা, স্পেশাল-ডালা দেখাতে লাগল। ভালো করে নজর করে চক্কর মেরে দেখে এলুম। মন্দির চত্বর জোড়া অতদীর্ঘ, ভক্তসারিতে আর কারুর ডালাতেই গাঁজার ককে শোভা পাচ্ছে না। অর্থমূল্যে এমন ডালাটি কিনতে পারা যেত না এখানে!

এখানেও নানান দামের পূজার ব্যবস্থা রয়েছে। এখানে টাকার অংকের সঙ্গে পুজোর সময়টা যুক্ত। যত বেশিক্ষণ ধরে কেদারনাথকে পুজো করা হবে তত বেশি খরচ। পাঁচ মিনিটের, পনের মিনিটের, আধ ঘণ্টার, পঁয়তাল্লিশ মিনিটের পুজো থেকে টানা চব্বিশ ঘণ্টার পুজো পর্যন্ত আছে। এমন কি এক বছরের প্রাত্যহিক পুজার ব্যবস্থাও। এবং সত্যিই হাজার হাজার টাকার পুজো দেওয়া যায়।

বদ্রীনাথে ছিল নানা দামের আরতি দর্শনের ব্যবস্থা। সাড়ে পাঁচটা থেকে সাড়ে সাতটা সাধারণের দর্শন বন্ধ। তখন শুধু ‘স্পেশাল আরতির’ সময়। ‘ভিজিটরস ওনলি’। গোলডেন আরতি সিলভার আরতির (এটা মাত্র ১১) টিকিট কিনতে পাওয়া যায়। সত্য সেলুকাস! কি বিচিত্র এই ভক্তি!

জুতো খুলে জমা রাখতে হয় মন্দিরের বাইরে। সেখানে দেখা হল সেই পথের বাঙালি দম্পতির সঙ্গে। তাঁরা দিব্যি তাজা হয়ে উঠেছেন, ফোটো তুলছেন। মিশুক মানুষ বিমলবাবু ন্যাশনাল ইনসিওরেন্সে কাজ করেন, মিল্ক কলোনিতে বাস। ওঁকে বললুম আমার ক্যামেরায় দু একটা ফোটো নিতে, যাতে আমিও থাকতে পারি তাতে। উনি মহা উৎসাহে অনেকগুলি ফোটো তুলে দিলেন। নিজের দামি ক্যামেরাতেও তুললেন। (গোপনে জানাই, কলকাতায় এসে কিন্তু দেখি বিমলবাবুর তোলা ছবিগুলি ওঠে নি! ভাগ্যিস একটা ছবি পিকোলো তুলেছিল, তাই তবু একখানা ছবি রয়েছে আমার কেদারে)।

যতই দীর্ঘ লাইন হোক, এক সময়ে টার্ন এল, জুতোটুতো খুলে মন্দিরে ঢোকা হল। প্রথমেই বৃষ, তারপরে সিদ্ধিদাতা গণেশ। এবম্বিধ অনেক অবান্তর ঠাকুর দেবতার মনোরঞ্জন করতে করতে অবশেষে স্বয়ং কেদারনাথের গর্ভগৃহে প্রবেশের সুযোগ মিলল। মন্দিরের ভেতরটা অন্ধকার। কিন্তু এখানকার আবহাওয়া বদ্রীনাথের মতো নয়, এখানে তো উঁচুনাক নারায়ণের মন্দির নয়। শিবঠাকুরের। শিবঠাকুরের স্বভাবটি আলাভোলা, তাঁর মন্দিরে অত কড়াক্কড়ি নেই, দিব্যি বিগ্রহের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে তাঁর প্রসন্নতা আদায় করা যায়। স্পর্শপূজাই প্রচলিত।

কেদারনাথের বিগ্রহ বলতে আছে ষাঁড়ের পিঠের কুঁজের আকৃতির একটি কষ্টি পাথরের চাঁই। যেন কচিকাঁচা একটি পাহাড় সবে আকাশের দিকে মাটি ঠেলে উঠতে শুরু করেছিল, হঠাৎ তার মাথার ওপরে মন্দির চাপা দিয়ে দেওয়া হয়েছে।

অথবা, মাটির তলা লুকিয়ে আছে এক বৃহৎ ঋষভ তার কুঁজটুকুই ভেসে আছে উপরে, এক্ষুণি বুঝি তেড়েফুঁড়ে উঠে আসবে, লণ্ডভণ্ড করে দেবে সাজানো পুজো-পুজো খেলা।

আমার খুব ভালো লেগে গেল কেদারনাথ মন্দির। আর আমাদের নৈবেদ্যও খুবই মনে ধরে গেল কেদারনাথের। অন্তত তাঁর পূজারী ব্রাহ্মণদের তো বটেই। গাঁজার কল্কে দেখে তাঁদের চোখেমুখে কী বিমল দিব্য বিভাই যে ফুটে উঠল! অতি যত্ন করে পুরিয়া খুলে গাঁজা নিয়ে কলকে সাজালেন, সুন্দর করে দাঁড় করিয়ে দিলেন পরপর চারটে কলকে। সিদ্ধি-টিদ্ধি দেখেও মহা পরিতৃপ্ত! সবচেয়ে ভালো লাগল পূজোর সময়ে অন্যান্য নৈবেদ্যর সঙ্গে যখন আমায় দিয়ে বলালেন—’ইয়ম্ গঞ্জিকা ওঁ নমঃ শিবায় নমঃ!’ আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই হাজার টাকার পুজো দিলেও কি শিবঠাকুর কি পুরুতঠাকুর কেউ অত খুশি হতেন না, কালীঘাটের কলকেগুলি দেখে যত উল্লসিত হয়েছেন। মেসোমশায়ের প্রতি কেদারনাথের আর প্রসন্ন না হয়েই উপায় নেই। ফাঁকতালে আমরাও পেয়ে গেলুম দয়ার ভাগ।

শিকে ছিঁড়ল

পুজো দিয়ে বেরিয়ে বিমলবাবুদের সঙ্গে খাওয়া-দাওয়ার সন্ধানে গেলুম। শুনলাম কেদারনাথ মন্দির নাকি পাণ্ডবদের তৈরি। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পর স্বজন হত্যার মহাপাপ থেকে রক্ষা পেতে তাঁরা শিবের খোঁজে এখানে অবধি তেড়ে এসেছিলেন। শিব পাণ্ডবদের নিষ্ঠা পরীক্ষা করবার জন্যে তাঁদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে লাগলেন কাশীবিশ্বনাথের মন্দির থেকে পালিয়ে এলেন গুপ্তকাশীতে, সেখান থেকে একেবারে দুর্গম কেদারে! সেখানে শিব ষাঁড় সেজে লুকিয়ে রইলেন পার্বত্য গরু ষাঁড়েদের দলে। ভীম তখন দুই পাহাড়ে দুই পা স্থাপন করে শিবের পথ আটকালেন, দেবতা তো মানুষের পায়ের ফাঁকে গলতে পারবেন না। ধরা পড়ে গিয়ে নিরুপায় হয়ে শিব তখন পাতাল প্রবেশ করলেন।–কিন্তু ‘পালাবি কুথা’ বলে ভীমসেন পালোয়ান তাঁকে জাপটে ধরলেন, চিনতে পেরেছি ঠাকুর! তখন পঞ্চকেদারে ফুটে উঠল শিবঠাকুরের পঞ্চ অঙ্গ। সেই ষাঁড়ের পিঠই এই পুণ্য কেদারনাথের বিগ্রহ যাঁর পুজো করে স্বজন-হননের পাপ থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন পঞ্চপাণ্ডব।

হায় কেদারনাথ—কি আশীর্বাদ করেছিলে তুমি? সেই স্বজন-হননের কলঙ্কিত অভ্যাস আমাদের আজও তো ঘুচলো না! পাঞ্জাবে, আসামে, অন্ধ্রে, কাশ্মীরে, বাংলাদেশে, শ্রীলঙ্কায়। এই বিশাল ভূখণ্ডের যেদিকেই তাকাই, স্বজনের রক্তে মাটি রাঙা। হে কেদারনাথ, আমাদের পূর্বপুরুষকে তুমি কেমনতর আমনা মুক্তি দিয়েছিলে? আমি তো দেখছি সেই স্বজন-হননের মহাপাপেই অক্ষয় ফলভোগ করছে এই মহান ভারতীয় উপমহাদেশ। অদ্যাবধি!

ছবি যেমনই তুলুন, বিমলবাবু কিন্তু লোক চমৎকার। লাইনে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়েই বলছিলেন, ‘ব্রেকফাস্ট কী খাবেন অর্ডার দিয়ে দিন বরং। আমরা কাল দারুণ খিচুড়ি খেয়েছি এই ধারায় অর্ডার দিয়ে। যদি পুরি-হালুয়া খান, তাহলে ৬ জনেরটা অর্ডার দিলে সুবিধা, ওরা ওজনের মাপমতন অর্ডার নেয়। কত কিলো সুজি, কত কিলো আটা, এই রকম হিসেবে দাম ধরে, ক’গণ্ডা লুচি কহাতা হালুয়া এভাবে নয়।’ বেশ তো, দিয়ে দিন আন্দাজ মতো অর্ডার, আমরা ভাগ করে নেব। সত্যি খুব ভালো পুরি-হালুয়া খাইয়েছিলেন। পুজোর পরে, মন্দিরে পাথুরে দেওয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে, গরম গরম পুরি, হালুয়ায় আবার গাওয়া ঘি-য়ের সুবাস, চমৎকার দুধের চা। পিকোলোর তো আছে নানান বায়না, সে হালুয়া খাবে না, নোন্তা খাবে। নো প্রবলেম, তাঁর জন্যে এনে ফেললেন ফার্স্ট কেলাস আলুর তরকারি। তখন প্রত্যেকেরই অবশ্য পিকোর আলুর তরকারিটার দিকেই নজর পড়ল। মা হিসেবে আমি চেষ্টা করলুম নজর না দিতে (একেবারে বিমাতৃসুলভ কর্ম)! কিন্তু একটু একটু নজর আর দিইনি? কেদার থেকে নামবার সময়ে বিমলবাবুর স্ত্রী আমাদের সঙ্গে ঘোড়ায় নামলেন, কিন্তু কর্তা এবার অশ্বারোহণে রাজি নন। তিনি রঞ্জন, অলোকের সঙ্গে পদব্রজে নামবেন ঠিক করেছেন। তাঁরা হেঁটেই যাবেন ত্রিযুগীনারায়ণ। পরে তুঙ্গনাথ। রুদ্রনাথেও যাবার ইচ্ছে আছে।—গৌরীকুণ্ডে পৌঁছে কিন্তু অলোক বলেছিল—’বিমলবাবুরা আর ত্রিযুগীনারায়ণে যেতে পারবেন বলে মনে হয় না, বিমলবাবুর হাঁটা সহ্য হয়নি, পা দারুণ ফুলে গেছে। ঘোড়া নেওয়া উচিত ছিল।’

শুনে খুব মন খারাপ হয়ে গেল। প্রবল উৎসাহ ছিল, জানি না ওঁদের হরগৌরীর বিয়ের যজ্ঞে আহুতি দেবার সুযোগ শেষ পর্যন্ত হয়েছিল কি না।

নাম, শুধু নাম

সমস্যা হল ঘর ছাড়তে গিয়ে। মালী খাতা হাতে এসে দাঁড়াল, নাম ঠিকানা লিখে যেতে হবে রেজিস্টারে, কখন এলুম, কখন গেলুম, কোথা থেকে এসেছি, কোথায় যাচ্ছি—এই সব, খুব গুরুত্বপূর্ণ খবর। সে প্রশ্নের উত্তর জানতে জানতে একটার পর একটা যাম পার হয়ে যায়।

আমি বললুম—’ওরে বাবা রে আমি তো কবিতা সিংহ সই করতে পারব না। অ পিকো, কোন্ ঠিকানা লিখব? আমার হিন্দুস্থান পার্ক, না কবিতাদির গোবিন্দ ঘোষাল লেন?’ পিকো তো হেসেই আকুল। আমার সমস্যাটা তাকে স্পর্শই করছে না! আমি সই করলাম বাংলায়, নবনীতা দেবসেন। তারপর ইংরেজিতে, কেয়ার অব শ্রীমতী কবিতা সিংহ, আকাশবাণী, কলকাতা। তারপর বলছি—’ভাই মালী, কবিতা সিন্হা হামারা দিদি হ্যায়, হামকো লিয়ে ঘর বুক কিয়া থা, হাম উল্কা ছোটি বহেন হ্যায়। মালী কিছুই বলছে না, শুধু তাকাচ্ছে। পিকোর দিকে একবার, আমার দিকে একবার।

আর রঞ্জন রানিং কমেন্টারি দিয়ে যাচ্ছে—’ওরে বাব্বা! তাকাচ্ছে কী! অ পিকো, খবদ্দার ওর চোখে চোখ রাখিসনি, ভস্ম হয়ে যাবি! অ দিদি, পালিয়ে এসো, পালিয়ে এসো, আর দেরি করলে ঘটি বাটি কেড়ে নেবে’—কিন্তু মালী কিছুই বললে না। বকশিস নিয়ে দিব্যি হেসে নমস্কার করে চলে গেল। তবে কি বৃথাই আমার এত ভয়, এত উদ্বেগ, এত দ্রুত নাড়ীর স্পন্দন? মালীর কিছুই এসে যায় নি? যাঃ—

আমি আরেকবার কেদারনাথকে—আরেকবার সাদা ধবধবে উত্তুঙ্গ হিমালয়ের সেই শিখরশ্রেণীকে খুঁজে দেখলুম। নেই। কাল রাত্তিরের সেই যুবক হিমালয় আজকে সকালে আর নেই। এখন সাদা মাটা, সাদা-কালো, বৃদ্ধ এক পাহাড়। কুয়াশার চাদরে পা ঢেকে, অন্যমনস্ক, স্থির বসে আছে। কালরাত্রের দুর্দান্ত সহাস্য অশ্বারোহীর দর্ল কোথায় লুকিয়ে পড়েছে। চন্দ্রালোকিত মধ্যরাত ভিন্ন বোধহয় তারা দেখা দেয় না।

শংকরচার্যের সমাধি ঠিক মন্দিরের পিছনেই। অলোক আর রঞ্জন গেল। আমি আর পিকো ততক্ষণে থলি গুছিয়ে নিতে লেগে যাই। মন খারাপ! এই তো চারধাম শেষ। এবার কেবলই ফেরার পথ।

মন্দাকিনীর সেতুর ধারে গিয়ে দেখি ঠিক ঘোড়া নিয়ে লছমন সিং, সূরয সিং রেডি। তারা পৌঁছে গেছে এত সকাল সকাল! যাত্রী না থাকলে ঘোড়া দৌড়ে উঠে আসে। তার চালকও। ঘোড়ায় চেপে আসে না, পাছে ঘোড়া ক্লান্ত হয়ে পড়ে?

ফেরার সময়ে তাড়াতাড়ির চেষ্টা না করলেও তাড়াতাড়ি হয়ে যায়। বারে বারে যদিও ঘোড়া থামিয়ে ফিরে ফিরে চাইছি। ‘দেওদেখানি’তে এসে শেষ বারের মতো দেখে নিলুম কেদারনাথের মন্দির। এমন অসামান্য স্নো-রেনজ আগে দেখি নি। পৃথিবীর তো অনেক পর্বতমালাই দেখবার সুযোগ করে দিয়েছেন দয়াময় ভগবান। তবু কত বিস্ময় যে বাকি থাকে জীবনে! কত রহস্য!

পুনরপি শ্বেত-সন্ত-কথা

আর বিস্ময় বাকি ছিল। গৌরীকুণ্ডে পৌঁছে, বাক্সপ্যাঁটরা নিতে ‘সুনীল লজ’-এর আপিসে গেলুম। এখানেই ঘোড়ার ভাড়া, ঘরের ভাড়া, খানার দাম, বিছানার ভাড়া, লেফট লাগেজের চার্জ—সব কিছু মেটাতে হবে। কোনোটাই বেশি দামি নয়, কিন্তু সব মিলিয়ে বেশ কয়েকশো দাঁড়াল। গভীরভাবে ব্যাগে হাত পুরে টাকা পয়সা বের করে, মেটাতে গিয়ে দেখি—কী কাণ্ড? কখন ফুরিয়ে গেছে চপলা লক্ষ্মীর ভাণ্ডার। টাকা তো নেই? কোথায় টাকা? কী করব এবারে? কী সর্বনাশ!

রঞ্জনের সঙ্গে কিছুই টাকা ছিল না। ড্রাইভার সূরয সিংয়ের কাছে কত আছে একবার জিগ্যেস করব নাকি? পেট্রল কেনার টাকা আছে ওঁর কাছে, তা জানি। এই সব ভাবছি আর পাগলের মতন হিসেব করছি। এখানেই থাকতে হবে, এবং T M O করে টাকা আনাতে হবে? দেখি যদি দিল্লিতে টেলিফোন করা যায়। বুকের মধ্যে ভয়ের ধস নেমেছে। আর ব্যাগটা হাতড়াচ্ছি। মাঝে মাঝে আমার ব্যাগে আমারই ভুলে যাওয়া পুরনো টাকাকড়ি বেরিয়ে পড়ে—যদি বেরোয়? নাঃ বেরোচ্ছে না। ফোন? এখানে কোথাও থেকে ফোন করতে পারা যাবে?

হঠাৎ হাতে-ঠেকলো একটা পুরুমতন খাম। বের করে দেখি, শিবখ্রীস্টস্বামীর জমা দেওয়া পঁচিশশো টাকা। আঃ! যেন তাঁর ফোকলা মুখের হাসিটা চোখে দেখতে পেলুম। গঙ্গোত্রীর সেই সাহেব সাধু জোর করেই পিকোকে এই টাকাটা তখন গছিয়ে দিয়েছিলেন। আমি প্রবল আপত্তি করেছিলুম। নিতে চাইনি পরের টাকার দায়িত্ব। যদি মরে-টরে যাই, ঋণী মরব? নাছোড় সাধু বললেন, ‘তাহলে ধরে নাও এই টাকাটা তোমার মেয়েকে আমার ‘দানম্’। আবার আমার যখন এই টাকাটা দরকার হবে, আমি তোমাদের কাছে চাইব। তখন তোমরাও ওটা আমাকে ‘দান’ করবে? ধার শোধ-বোধের ব্যাপারই রইল না তাহলে!’ শিবখ্রীস্টস্বামীজী একটি অনাথ-আশ্ৰম গড়তে চান। জমি কিনবেন। তাই টাকাটা ব্যাঙ্কে রেখে বাড়াতে চান, ঘুচাই আর পিকোর কাছে জানিয়েছেন। কিন্তু উনি তো সন্ন্যাসী, উনি ব্যাঙ্কে অ্যাকউন্ট খুলতে চান না। তাই লোকেদের দিয়ে দেন, পরে আবার চেয়ে নেবার ভরসায়।

—’এই তো হৃষিকেশের এক চায়ের দোকানে তিনশো ডলার জমা রেখেছি। ফেরার পথে চেয়ে নেব।’

–’সর্বনাশ করেছেন। ও টাকা আপনি আর পাবেন না।’ আমি বলে ফেলি।

-’কেন পাব না?’

—এরা বড় গরিব। টাকা খরচ হয়ে যাবে। ফেরৎ দিতে পারবে না। ওভাবে টাকা ছড়াবেন না আপনি।’ তারপরেই ওই টাকাটা রাখতে আমি রাজি হয়ে যাই। কি জানি কাকে কোথায় দেবেন, কার কীভাবে ক্ষতি হয়ে যাবে। ওঁর নিজেরও টাকাটা যাবে, তাদেরও চোর বদনাম হবে। শিবখ্রীস্টস্বামী বলেছেন, কলকাতায় এসে টাকাটা নিয়ে যাবেন। খামের ওপরে দিল্লির একটা ঠিকানা, আর নিজের ব্রিটিশ পাসপোর্টের নম্বরটা লিখে দিলেন। ‘আমি টাকা তো রাখব, কিন্তু তারজন্যে নিশ্চিত একটা ঠিকানা চাই, আইডেন্টিফাইং একটা কিছু চাই—’ বলে চেঁচামেচি করাতে উনি লিখলেন। উনি বললেন, পঁচিশশো টাকা আছে। আমরা কিন্তু গুনে নিইনি। শ্বশুরমশাই বলতেন, সর্বদা টাকা গুনে দেবে, গুনে নেবে। আমার মনে থাকে না।

এই সেই টাকা। কেদারনাথ আমাকে আসতে রাজি করিয়েছিলেন সেই খ্রীস্টান সাধুই। ভ্রমণের খরচও যুগিয়ে দিলেন তিনিই। শিবখ্রীস্টস্বামীর খাম থেকেই দরকার মতো টাকা নিলুম। ধার নিচ্ছি। পথে আবার ধার নিতে হবে। ফেরার পথ-খরচ পুরোই বাকি। টাকাটা এখনই গুনে রাখা দরকার। গুনতে বসে দেখি পঁচিশ নয়, সাধু দিয়েছেন মোট ছাব্বিশ শো টাকা। ছাব্বিশটি কড়কড়ে একশো টাকার নোট।

পথের মধ্যে হঠাৎ এভাবে টাকা ফুরিয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা জীবনে এই প্রথম। কিন্তু এর চেয়েও আশ্চর্য এই ছাব্বিশশো টাকা আবিষ্কার। শিবখ্রীস্টস্বামীর খামটি দেউলিয়া অবস্থায় হাসতে হাসতে তোমার হাতে যিনি এগিয়ে দিলেন তিনি কে?

এই যে বেইমান নবনীতা, সকলের ভার বইতে বইতে তোমার নাকি পিঠ কুঁজো হয়ে গেছে? তোমার ভার নাকি কেউ নেয় না? তুমি নাকি নিরাশ্রয়, নিবান্ধব, জগৎ পারাবারের তীরে একলা?

খুব শক্ত একটা মুঠোর মধ্যে ধরা রয়েছে তোমার হাত, নবনীতা। সেই হাত কখনও ছেড়ো না। কখনও ভুলো না।

শিকে ছিঁড়ল

শোনপ্রয়াগে অলোককে নামিয়ে দিয়ে গাড়ি চলেছে গুপ্তকাশী। পিকো চেঁচিয়ে উঠল, ‘মা—-ঐ যে, সেই সাধু।’ আশ্চর্য-এঁকে আমরা সেই যমুনোত্রীতে দেখেছিলাম–যাত্রার শুরুতে। একটি মাত্র পা, পরনে কৌপিন, মাথায় জটা, হাতে দণ্ড। যমুনোত্রী হয়ে, হয়তো গঙ্গাদশেরায় গঙ্গোত্রী ঘুরে, কেদারনাথে আসছেন। পঙ্গুকে গিরিলঙ্ঘন যিনি করান, আমাকেও তিনিই হাতে ধরে নিয়ে চলেছেন? এই সন্ন্যাসীর যে একটি পা নেই সেটা সবাই দেখতে পাচ্ছি। আর আমিও যে হস্তপদহীন বিকলাঙ্গ, সে খবর শুধু তিনিই জানেন।

যাত্রারম্ভে যাঁকে দেখেছিলাম, যাত্রা শেষেও তাঁর দেখা পেয়ে মনটা পরিপূর্ণ হয়ে উঠল। শোনগঙ্গার সঙ্গে মন্দাকিনীর সঙ্গমের প্রবল গর্জনের শব্দের মধ্যে যেন আমারই বুকের উদ্যত উত্তাল কৃতার্থতা প্রতিধ্বনিত হতে লাগল।

আবার আসব, হিমালয়, আবার দেখা হবে। নিজের নামে একটা পোস্টকার্ড ছেড়েছি গৌরীকুণ্ড থেকে। যেন ভুলে না যাই—প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাচ্ছি, এবারে একা আসব, তখন আরেকটু ঘনিষ্ঠ হতে দিও, হিমালয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *