হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে – ১

প্ৰথম পৰ্ব

মুখবন্ধ

সেখানে অদ্ভুত বৃক্ষ, দেখিতে সুচারু।
যাহা চাই তাহা পাই, নাম কল্পতরু।

কল্পতরু কি আর আমরা চিনি? ধরুন আপনি একদিন খুব মনে দুঃখু করে ভাবলেন—আহা, এজন্মে তাহলে আর উত্তরাখণ্ড ঘোরা হবে না। অমনি আপনার সামনে একটা সাদা ধবধবে নতুন গাড়ি এসে থামল, জানলায় জানলায় নীল পর্দা। ঝকঝকে উর্দিপরা ড্রাইভার নেমে বলল—’সেলাম বিবিজি। গাড়ি হাজির।’ আপনি অবাক। কিসের গাড়ি? কার গাড়ি?—’জি আপকো লিয়ে—চারোধাম যানা হ্যায় না?’ আপনি তখন চোখ বুজে মনে মনে বললেন, ‘হৃষীকেশ!’ অমনি বোঁ করে গাড়ি ছুটল—মীরাট, রুড়কী, হরদুয়ার হয়ে হৃষীকেশ। যেন হৃষীকেশ নয়, শুণ্ডিরাজ্য! ভূতের রাজার বর কিন্তু দুঃখীরা সত্যি সত্যি পায়। গুপী গাইনের গল্পটা একদম মিথ্যে নয়। মনের দুঃখে বনে গিয়ে আপনি যখন বলছিলেন, ‘উত্তরাখণ্ড যাত্রা, আমার আর হল না’—তখন সেই গাছটাই যে কল্পতরু বৃক্ষ ছিল, তা কি আর আপনি জানতেন? জানতেন না তো? এখন জানলেন। জগতে মানুষের ইচ্ছাপূরণ যে এমন করেও হয়, তা কে জানত? আজ আপনাদের যে রূপকথার গল্পটা বলব, তার এককণাও আপনারা বিশ্বাস করবেন না। আপনারা কেন, আমার নিজেরই তো বিশ্বাস হচ্ছিল না। এখনও যেন বিশ্বাস হয় না যতবার ভাবি—সুরয সিং, জগৎ সিং, মিস্টার মিটার, শিব খৃস্টানন্দ, মেসোমশাই—সবই যেন স্বপ্নের মতন সত্য অথচ অলীক মনে হয় আমার জীবনটাই যে স্বপ্ন আর দুঃস্বপ্ন সাজিয়ে গড়া। ছেলেবেলাতে মা বলেছিলেন, খুব মন দিয়ে যদি কিছু চাওয়া যায়, ঈশ্বর সেই ইচ্ছে ঠিক পূর্ণ করেন। কিন্তু সেইজন্যেই ঈশ্বরকে এটা-ওটা চেয়ে বিরক্ত করতে নেই। আমাদের ধর্মে বড্ডই ভিকিরিপনা। কেবল দাও দাও। দেহি দেহি। সংস্কৃত মন্তরেও রূপং দেহি যশং দেহি জয়ং দেহি, আবার বাংলা পাঁচালিতেও। পুরুষমানুষও চেয়ে চেয়ে কূল পাচ্ছে না, মেয়েমানুষও তাই। পুরুষ বলছে দ্বিষো জহি—তুমিই আমার শত্রুদের মেরে দাও। নারী বলছে, শিবের মতন স্বামী দাও, সভাউজ্জ্বল জামাই দাও, আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে। কী নির্লজ্জ ধর্ম রে বাবা! পনেরো-ষোলো বছর বয়সে হঠাৎ আবিষ্কার করলুম, ঈশ্বরের কাছে কিছু চাইব যে, ভক্তিই তো নেই। ঈশ্বরই আছেন কি নেই সেইটে নিয়েও মনে মনে নতুন প্রশ্ন। বড়ই মুশকিল হল। তারপর থেকে ঈশ্বরের কাছে একটাই প্রধান চাইবার জিনিস। মশাই হে, যদি থাকো, তবে সেটা বুঝিয়ে দাও। টের পাইয়ে দাও। অর্থাৎ কিনা, পূর্ণ ভক্তি দাও। পূর্ণ বিশ্বাস দাও। এই ত্রিশঙ্কু অবস্থা বড় কষ্টের।

ওদিকে দেখতে পাই ঈশ্বরের সব স্পয়েন্ট্ চাইল্ড চাদ্দিকে খেলা করে বেড়াচ্ছে। তারা ভগবানের খায় ভগবানের পরে আবার ভগবানেরই দাড়ি ওপড়ায়। আমার এরকম কয়েকজন ‘হাইলি সাকসেসফুল’ রূপেগুণে ধনেমানে জগদ্বিখ্যাত বন্ধুবান্ধব আছেন, যাঁদের জীবন ঈশ্বরের অসীম করুণার স্পষ্ট ছবি এবং যাঁরা ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না। তাঁরা ঘোরতর নাস্তিক। কেউ স্ববুদ্ধিতে, কেউবা গুরুর আদেশে (অর্থাৎ রাজনীতির কল্যাণে)। তাঁরা যা কিছু পেয়েছেন সবই তাঁদের নিজগুণে প্রাপ্ত বলে তাঁদের বিশ্বাস। ভগবান তাঁদের ছপ্‌পড় ফুঁড়ে সবই দিয়েছেন, কেবল নিজেকে ছাড়া। জীবনে কখনও তাদের এতটুকু টক্করও লাগতে দেননি, যাতে হঠাৎ ছিটকে এসে তাঁর পায়ে না পড়ে। তার বদলে দিয়েছেন কী? দর্পিত নাস্তিক্যের আত্মাহীন আত্মবিশ্বাস। আর আমার মতন স্পয়েন্ট্ চাইও আছে। অনবরত অনর্জিত সৌভাগ্যে যার জীবন উপচে পড়ছে। আর সবসময়ে বুকের মধ্যে কে যেন সাবধান করছে, এসব কিচ্ছু তোর নয়, এ হল পরের ধনে পোদ্দারি। তুমি বাপু মনে করো না এসব নিজগুণে অর্জন করেছ, যা পাচ্ছ সবই তিনি দিচ্ছেন বলেই। চিরকৃতার্থ থাকা উচিত। এর বদলে কী করছ তুমি হে,—যে এত এত পাবে? এই যে বৃষ্টির গন্ধ, এই যে হঠাৎ চোখের সামনে রংচটা শুকনো গাছপালাগুলো ভিজে গিয়ে কাঁচা সবুজ রঙের হয়ে গেল, যেন হাত দিলেই পাতা থেকে হাতে কাঁচা রং উঠে আসবে—এই যে পালুসকরের ‘চলো মন’, এই যে আমীর খানের মালকৌষ এসব ম্যাজিক তোমার প্রাপ্য নাকি? মনে রেখো, মনে রেখো।

আর শুধু কি তাই? ভক্তি দাও ভক্তি দাও করে চ্যাঁচানোর ফলেই বোধ হয় হ্যাঁচকাটানে এনে পায়ের ওপরে ফেলেছেন। ‘হে ঈশ্বর রক্ষা করো’ বলা ছাড়া তখন আর পথ ছিল না, আর ঈশ্বরেরও তাই আশ্রয় না দিয়ে উপায় ছিল না।

সেই নিশ্চিন্ত আশ্রয়টায় বসে বসেও, মাঝে মাঝে সব গোলমাল হয়ে যায়। আবার খোঁচাই, আবার বলি—’কী হে, এখনও আছ, না নেই? আর তো পারছি না। থাকো যদি, তবে একবার দেখিয়ে দাও?’ অন্তরালবর্তী তিতিবিরক্ত হয়ে মাঝে মাঝে বলেই বসেন—’তবে দ্যাখ, বেটি! দেখে নে!’

আর তখনই শুরু হয় আমার সফল স্বপ্নের দিন। এমনি একটা স্বপ্নের সত্যি হওয়ার কাহিনি আমার উত্তরাখণ্ড ভ্রমণ। স্বভাবটি যাঁর পরশ্রীকাতর, তাঁকে বলব, এ লেখাটা পড়বেন না। কল্পতরুর গল্প কিন্তু সকলের জন্য নয়। হিংসুটে হলে আপনার পুজোর ছুটিটাই মাটি। রূপকথার মতন অযাচিত অভাবিত ভাগ্যের গল্পে অবিশ্বাসীর ভীষণ মন খারাপ হয়ে যেতে পারে। মা বলেন যারা হিংসুটে, তাদের মত দুঃখী কেউ নেই। তারা দিনরাত জ্বলছে পুড়ছে। এ লেখাটা পড়লে তাদের দহনজ্বালা আরও বাড়বে—তখন হকি প্যারির কমণ্ডলু থেকে গঙ্গোত্রীর হিমজল ঢেলে আমি সে-জ্বালা জুড়োতে পারব কি?

পূর্বকথা

কলকাতা থেকে রওনা হয়েছিলুম দিল্লিতে–কেননা ১৯৮১-তে এই দিল্লি থেকেই আমার স্বপ্ন দেখার শুরু। যেমন হয় আমার ক্ষেত্রে, নব্বই ভাগই অ্যাক্সিডেন্টাল, দশভাগ গোছগাছ করে। সেবারে ফরিদাবাদের বড়খল লেকে একটা অল্ ইন্ডিয়া সেমিনার ছিল। সেমিনার শেষে দিল্লিতে এসেই দেখি আমার বৌদিভাই আর রিনিমা এসেছে কলকাতা থেকে, গাড়ি করে হৃষীকেশে যাচ্ছে, গুরুর আশ্রমের পুজো দেখতে। আমিও নিমন্ত্রিত। লাফিয়ে উঠলুম। পরদিনই যাত্রা শুরু। কী ভালোই লেগেছিল, দিল্লি থেকে হরিদ্বার হয়ে হৃষীকেশের পথ। আর হৃষীকেশে পৌঁছে যেন প্রাণটা জুড়িয়ে গেল। আমরা যে অন্ধ্র আশ্রম ধর্মশালায় ছিলুম, তার দুপাশে দুটি মন্দির। সুন্দর কাঁসরঘণ্টা ঢাক শানাই বাজে। মন্ত্রধ্বনি ঘরে বসে শোনা যায়। মন্দিরে আরতি দেখা যায়। ঘর ভরে যায় ধূপধুনোচন্দনের সুবাসে। ঘরই নয়, মনও। আর জানলায় খাড়া পাহাড় হিমালয়। হিমালয়ের সেই সূর্য-ওঠা দেখবার জন্যে আমি রোজ সূর্যের আগেভাগে উঠে পড়তুম।

অনেকক্ষণ ধরে অভিষেকের বন্দোবস্ত চলত। আকাশ নীল থেকে বেগুনি, বেগুনি থেকে গোলাপি, গোলাপি থেকে লাল হলুদ, লাল হলুদ থেকে তীব্র উজ্জ্বল চোখধাঁধানো সোনার তৈরি হয়ে যেত। আর মহান্ হিমালয়ের যে নামহীন শিখর দুটি আমার জানলার সামনে, নিশ্চয় তারা নেপালের মৎস্যপুচ্ছ, কিংবা আন্দেস-এর মাচুপিচু নয়, কিন্তু তেমনিই দেখতে—তারা আস্তে আস্তে কালো পাথরের সিংহাসনের মতন গুরুগম্ভীর চেহারা করে ফেলত। তারপর হঠাৎ একসময়ে টুকুস করে একলাফে সূয্যিদেব উঠে আসতেন পৃথিবীর ওপার থেকে এপারে। লাল টুকটুকে আপেলের মতো চেহারা। হনুমানের দোষ ছিল না-খেতে ইচ্ছে হতেই পারে। সিংহাসনে বসতেন অল্প কিছুক্ষণ। তারপরেই উঠে যেতেন আকাশে। সোনার বর্ণটি হয়ে। রোজই দেখতুম, আর রোজই মনে হত যেন ম্যাজিক দেখছি।

আর গঙ্গা? কলকাতার গঙ্গাকে দেখেই যে-চোখ অভ্যস্ত, সে-ই কি করে হৃষীকেশের গঙ্গাকে গঙ্গা বলে চিনে নেবে? একজন চওড়াপেড়ে গরদপরা গিন্নীবান্নি, আরেকজন নীল ডুরেশাড়ি জড়ানো ছটফটে কিশোরী। গঙ্গাকেও কী ভালোই লেগেছিল! রোজ যেতুম, শালপাতার বাটিতে করে ফুল নিয়ে নদীতে ভাসিয়ে দিতুম ত্রিবেণী ঘাট থেকে।

হে স্বর্গবাসী আত্মীয়বন্ধুরা, মুক্ত হও তোমরা, তৃপ্ত হও তোমরা, হে মর্ত্যবাসী আত্মীয়বন্ধুরা, তোমরাও সুখেশান্তিতে থাক।

ঠান্ডা-কনকনে স্বচ্ছতোয়া গঙ্গার জলের নিচে কী অপরূপ রং-বেরঙের আর নির্ভুল গড়নের নুড়িপাথর! প্রত্যেকটি যেন দৈব কারিগরের হাতেগড়া, যেন বাটালি দিয়ে চেঁচে পালিশ করে সাজানো হয়েছে। ওঙ্কারনাথ আশ্রম থেকে গঙ্গায় স্নান করতে হলে যে পাথুরে পথটি বেয়ে যেতে হয় তার চারিপাশে প্রত্যেকটি পাথরকেই মনে হত কোলে তুলে বাড়িতে নিয়ে যাই। যেন নাড়ুগোপালটি। হাজার বছর ধরে গঙ্গার স্রোত আর হিমালয়ের বাতাস তাদের কত যত্নে কত আদরে গড়েপিটে তৈরি করেছে। হৃষীকেশের হিমালয় তুষারচূড় নয়। অরণ্যশীর্ষ। হৃষীকেশের হিমালয়ও হৃষীকেশের গঙ্গার মতই তরুণ, সবুজ, বাড়ন্ত।

কী ভালোই লেগেছিল। জীবনে পুজোআচ্চা করি না। ধূপধুনো-ফুল-চন্দনের সঙ্গে মুখ-দেখাদেখি নেই। অথচ ঘরে বসে সেই পুজোর গন্ধে কী করে যেন মনটা ভরে যেত! গির্জের ভিতরে গেলে তার নিস্তব্ধতায় আর ধূপের গন্ধে আর মোমের আলোয় মিলে যেরকম একটা পবিত্রতার স্বাদ দেয়, যে রকম মুগ্ধতা তৈরি করে, ঠিক তেমনি লাগত ঘরে বসেই। অথচ একদিনও ঐ দুটি মন্দিরে যাইনি। বিগ্রহ কেমন, দেখতেও আগ্রহ হয়নি। বিগ্রহের যা কাজ, তা তো বুকের মধ্যে আপনিই হয়েছে। আর ভিতরে ঢুকে কী হবে?

আমার বুকের ভেতরটা বড় জটপাকানো—আমি ঠিক বিশুদ্ধ হিন্দু নই। আমি তো মুসলমানও নই। খৃষ্টানও নই। আমি কি বৌদ্ধও নই? কি জানি! একটু একটু বৌদ্ধ বরং হতে রাজী আছি। হৃষীকেশ হিমালয় আর গঙ্গার এই কম্বিনেশনের কিন্তু মানুষকে ঘাড় ধরে হিন্দু বানিয়ে দেবার একটা অতিরিক্ত শক্তি আছে—অন্ততপক্ষে আস্তিক তো হতে বলবেই। এখানকার আকাশ-বাতাসই বলছে—অস্তি, অস্তি। তুমি একা একা নাস্তি, নাস্তি বললে কী হবে! শুনছে কে?

নাম শুধু নাম

সেই হৃষীকেশে গিয়েই পথের বাঁকে বাঁকে প্রবল লোভনীয় নামের পাল্লায় পড়ে গেলুম। আহা, এত সব সুন্দর সুন্দর নামের জায়গাও আছে পৃথিবীতে? এই আমারই নিজের দেশে? দেবপ্রয়াগ—এত মাইল, রুদ্রপ্রয়াগ—এত মাইল, শ্রীনগর-এত, উত্তরকাশী, গুপ্তকাশী, পিপ্পলকোটী, যোশীমঠ, নন্দপ্রয়াগ, কর্ণপ্রয়াগ, শোণপ্রয়াগ—কত দেশ, কত চমৎকার সব রূপকথার মত নাম। কেদারবদ্রী যেতে হলে এসব জায়গা পথে পড়ে। এমনিতে নাকি এসব জায়গায় কেউ যায় না। এসব সুন্দর নামের জায়গাগুলিতে যাব বলেই আমি ঠিক করলুম, কেদারবদ্রীই যেতে হবে। নইলে তো আর এতগুলো প্রয়াগ দেখা হবে না। হৃষীকেশে জিজ্ঞেস করে জানলুম, অসামান্য কাণ্ড-সব পৌরাণিক নদনদীরা এখানে ঠেসাঠেসি করে নামছেন—কোথায় মন্দাকিনী নদীর সঙ্গে অলকানন্দার দেখা হচ্ছে, কোথায় হনুমানগঙ্গার সঙ্গে যমুনার। কিন্তু বৌদি রিনিমাকে রাজী করানো গেল না কেদারবদ্রীর পথে বেরিয়ে পড়তে। জামাকাপড়, বিছানাপত্তর, টাকাকড়ি কিছুই সঙ্গে নেই, পাগলামি তো করলেই হল না? আমার সঙ্গে কিছু টাকা ছিল—আমি একাই বাসে করে বেরিয়ে পড়ব ঠিক করলুম। তখন পুজোর ছুটি। এমন সুযোগ আর হবে না। বাসের খোঁজখবর নিলুম হৃষীকেশে গাঢ়োয়াল মণ্ডল বিকাশ নিগম সংস্থায়, আর হরিদ্বারে গিয়ে উত্তরপ্রদেশ ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট অফিসে

রিনিমাটা ভারী দুষ্টু।

—তুমি যাবে বাসে করে? তাহলেই হয়েছে, দিদি! ওই দ্যাখো তো, বাসের জানলার নিচে বাসের গা-ভর্তি সাদা সাদা ওগুলো কী? ঐ স্ট্রাইপস?

-কী রে রিনিমা?

—বমি। শুকনো বমির দাগ। বাসসুদ্ধু সবাই বমি করতে করতে যাবে। তুমি না পারবে থামতে, না পারবে নামতে—সেটা ভালো হবে?

এক মিনিটেই আমার যাবার মত্ত উৎসাহে ঠান্ডা পানি। না বাপু, বমি করতে করতেও যেতে পারব না, বমি করা দেখতে দেখতেও যেতে পারব না।—ট্যাক্সি? ট্যাক্সির খরচ কত?

একবার কাশী টু কুম্ভ ট্যাক্সিতে গিয়ে খুব স্মার্ট হয়ে গেছি। অন্তত ট্যাক্সি ভাবতে অসুবিধা হয় না, কার্যত ভাড়া করতে হয়তো হবে। U. P. Tourism-এর ট্যাক্সি, হরিদ্বার-কেদারবদ্রী—হরিদ্বার—চারদিনে আড়াই হাজার টাকা। থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও ট্যাক্সিওলাই করে দেবে। বিছানাপত্রও জোগাড় করে দেবে। হৃষীকেশ থেকে ট্যাক্সি নিলে দুই। পাঁচশো বাঁচছে। ট্যাক্সিতে আর দু’এক জনকে নিলে ভাড়াটা ভাগাভাগিও করে নেওয়া যায়। আমি তক্ষুনি ঠ্যাং তুলে রাজী। দুই বউ যে কী শত্রুতাই করেছিল সে-বছর। বৌদি বললে, না মশাই, আমি তোমাকে একা একা ট্যাক্সিতে করে অজানা অচেনা লোকদের সঙ্গে কেদারবদ্রী যেতে মোটেই ছেড়ে দিচ্ছি না! ও-পুজোয় বরং আমরা তিনজনে মিলে আবার আসব কেদারবদ্রীতে।

হল না। বৌদির মনের মতন সঙ্গী জুটল না। চেনা সঙ্গী না হলে বৌদি ছাড়বে না। চেনা যাঁদের সঙ্গে দেখা হল তাঁরা সবাই বাসে যাচ্ছেন। ট্যাক্সির খরচ অনেক বেশি। হল না, হল না, হল না, হল না—মনের মধ্যে কেবল এই শব্দ শুনতে শুনতেই দিল্লি ফিরলুম। ফিরে বুঝলুম এটাই ভাল হয়েছে—যাইনি। বাড়িতে আমার অনুপস্থিতি দীর্ঘায়িত হওয়া ঈশ্বরের অভিপ্রেত ছিল না—নানান বিপদ-আপদ গিয়েছিল আমি যখন ছিলুম না। তীর্থ-টীর্থের ব্যাপারে, কথায় বলে না, ‘না টানলে, হয় না’!

গাইডবহি

এর আগে কেদারবদ্রীতে যাওয়ার কোনও ইচ্ছে একবারও অনুভব করিনি, যদিও ইচ্ছে হয়েছে বিষ্ণোদেবী যাবার, জ্বালামুখী দর্শন করবার। এসব জায়গা শুধুমাত্র দুর্গম বলেই যেতে শখ হয়েছে, ধর্মীয় কারণে নয়। কিন্তু কেদারনাথে, বদ্রীনাথে অনেকদিনই যাত্রা সুগম হয়েছে—কত রকম ‘স্পেশাল’ ছুটছে কত ধরনের যাত্রীদের পিঠে বেঁধে। তাই আমার উৎসাহ জাগেনি। এবারে হৃষীকেশে গিয়ে এই একটা প্রবল ঝোঁক এল, একটা জেদ—যাবই। ফেরার পথে হরিদ্বার আর কন্খল থেকে দুয়েকটা বইপত্তরও কিনে ফেললুম।

সবচেয়ে জরুরি বইটির লাল মলাটের সামনে বদ্রীনাথের মন্দিরের ছবি। তাতে স্পষ্ট বাংলায় লেখা—’শ্রী চারোধাম যাত্রা ঔর মহাতম্।। শ্রী বদ্রীনাথ-কেদারনাথ গঙ্গোত্রী—যন্মোত্রী।’—এত সুন্দর নামকরণ যে-বইয়ের, সে-বই কি না কিনে পারি? কলকাতায় এসে সেই বইটিই হল আমার প্রধান অনুপ্রেরণা। তাতে একটি অপরূপ ম্যাপে (ভগীরথ ও শিবের ছবি সমেত) মানস-যাত্রার মার্গও দেখানো রয়েছে। ‘গাইড-বহি’ কিনা। যাত্রার সব খরচ-খরচা দেওয়া আছে—প্রস্তুতি, খাওয়া, থাকা, ডাণ্ডী, কাণ্ডী, ঘোড়া কুলি সমেত। ‘খাওয়া-খরচ জনপিছু প্রতিদিন ১০০ হইতে ২ পড়িয়া যায়—তবে গরীব যাত্রীরা খাওয়াদাওয়া কাপড়জামা কেনা সব করিয়া ৬৫-১০০ মধ্যে বদরীনাথ যাত্রা সমাপন করিতে পারে। পাহাড়ী ঘোড়ার ভাড়া।।০ আনা মাইল প্রতি, তবে বিশেষ পাওয়া যায় না। কুলীদের মজুরী ছাড়া প্রত্যহ দুই পয়সার ছোলা খাইতে দিতে হয়।’ এই গাইড-বহি পাঠকরতঃ কেউ যদি ভক্তিভরে দুই পয়সার ছোলা নিয়ে একজন কুলির কাছাকাছিও যান, তাহলে তাঁর কী হবে আমি ভাবতেও ভয় পাচ্ছি।

খাওয়ার খরচ এখনও ওখানে শস্তাই—দিনে দশ থেকে পনেরো টাকার মতন। ঘোড়া? মাইলপ্রতি আট আনা ছিল, এখন চোদ্দ কিলোমিটারে পঞ্চাশ টাকা (হিসেবটা আপনি কষে নিন)। যাই হোক, ওতে কেদারনাথের স্তোত্র আছে, বদ্রীনাথের মাহাত্ম্যবর্ণনা আছে, চারধামের মহিমাগাথা আছে। আর আছে কিছু অসামান্য মন্তব্য। যেমন এই তিনটি :

এক।। মানবের মনই মানবকে বন্ধনে জড়িত বা বন্ধনমুক্ত করে।

দুই।। নিশ্চিন্ত ও নির্দ্বন্দ্ব মনে, তন্ময় হইয়া, আস্তিকতার সহিত, সমস্ত ভুলিয়া, নিজে প্রসন্ন থাকিয়া ও অপর যাত্রীদিগকে প্রসন্ন করিয়া পথ চলিতে হয়। সেই সব যাত্রীই যাত্রার বাস্তবিক আনন্দ উপভোগ করে।

তিন।। উত্তরাখণ্ডের অদ্ভুত যাত্রামাহাত্ম্য আজও রহিয়া গিয়াছে। অন্যান্য তীর্থস্থানের মাহাত্ম্য তো রেলগাড়ি অপহরণ করিয়া লইয়াছে।

.

ইংরিজি বাংলা আরও কিছু বই কেনা হল। পরের বছর পুজোর ছুটি পেরিয়ে গেল। যাত্রা হল না। কলকাতায় ফিরে অবধি চেষ্টা করছি সঙ্গী সংগ্রহের। যাতে ট্যাক্সিভ্রমণ নিরাপদে এবং কম খরচে হয়। তা আমি একা চেষ্টা করলে কি হবে, কেদারনাথ-বদ্রীনাথের পক্ষে কোনোই চেষ্টা ছিল না। অতএব সঙ্গী আর জোটে না। বৌদি রিনিমা আর নামও করে না যাবার। অথচ স্বয়ং হৃষীকেশকে আমি কথা দিয়ে এসেছি। বলেছি ঠিক আসব, আবার আসব, দেখা হবেই। আর কেউ যাক্ বা না যাক্—আমার না গেলেই নয়। সেই ১৯৮১-র পুজোর প্রণাম করে এসেছি হৃষীকেশে সীতারামদাস ওঙ্কারনাথকে, কখলে আনন্দময়ী মাকে, ঋষিদের আশীর্বাদ কি বিফলে যেতে পারে? ১৯৮২-তে এঁরা দু’জনেই দেহ রাখলেন, হৃষীকেশ এবং কন্ধল দুটি ঠাইয়ের আলোবাতাসের রং বদলে দিয়ে। বিরাশির গ্রীষ্মে ঘোরাঘুরি অনেক হল : ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, রাশিয়া, আমেরিকা, ক্যানাডা। পুজোর ছুটিতেই দেশে ফিরে আবার বেরুনো অসম্ভব। তাই ওটা পিছিয়ে দিতে হল।

মনকে বললুম সামনের বারে। গ্রীষ্মের ছুটি পড়লেই। যত কিছু কাজকর্ম থাকুক, সব ফেলে রেখে চলে যাব। আমার মনের ভাবখানা ঠিক যেন কোনো মানত আছে, রক্ষা করতেই হবে।

চলো দিল্লি পুকারকে

যেহেতু সেবার দিল্লি থেকে গিয়েছিলুম সেই জন্যেই এবারেও সোজা দিল্লি গিয়ে হাজির হব ঠিক করলুম। ট্যাক্সিভাড়া করে যখন যাবই তখন যে ক’জনকে পারি তাতে ভরে নিই, এই ভেবে শেষমুহূর্তে মা সঙ্গে দিয়ে দিলেন পিকোলোকে, আমার বড় মেয়ে—যার পার্ট ওয়ান পরীক্ষা এক মাস পরেই। আর একা একা স্ত্রীজাতির দু’জন ট্যাক্সি করে হিমালয়ের নির্জন বাঁকে বাঁকে ঘুরে বেড়াবে এটা সইতে না পেরে দীপঙ্কর শেষতম মুহূর্তে, বেলা ৫টার সময় জোকা থেকে রঞ্জনকে তুলে নিয়ে এল। রঞ্জনের জন্যে নিজের জামা-কাপড় দিয়েই একটা ব্যাগ গুছিয়ে দিল দীপঙ্কর—যেহেতু নিজের ছুটির আবেদন অফিস নাকচ করে দিয়েছে। উল্লাসে ভাসতে ভাসতে তিনজন যাত্রী দিল্লি রওনা হলেম। চেকার এলেন যখন ট্রেন চলতে শুরু করেছে। তখন খেয়াল হল—টিকিট? ওদের টিকিটই নেই তো! টিকিট আছে তো কেবল আমার। আমি তো একলাই আসছিলুম।

যথারীতি সমস্ত আত্মীয় পরিজনই আপত্তি করছিলেন :

এ কি তোমার কুম্ভমেলা যে একরাত্তির দু’রাত্তিরেই হয়ে গেল? এ অনেকদিনের ব্যাপার—অসুখবিসুখ করলে? বয়েস তো রোজ রোজ কমে যাচ্ছে না? তারপরে আরও সাতটা বছর গেছে—হেঁপো রুগীদের পাহাড়ে চড়া কি উচিত? হ্যাঁরে, তোর হার্টের সেই ব্যথাটা?

-ওসব কবেই সেরেসুরে গেছে। এখন হার্টে ব্যথা লাগেও না, করেও না। তাছাড়া একা তো ঠিক যাচ্ছিও না।

-তবে যে শুনলুম, বাড়ির কেউ যাচ্ছে না?

—বাড়ির কেউ যাচ্ছে না বটে তবে আরও অনেকেই যাচ্ছে।

–কারা?

-ওই কুম্ভমেলায় যারা গিয়েছিল না, তারাই যাচ্ছে।

—যাচ্ছে? তবু ভাল। বিপদে-আপদে ওরা তোকে দেখবে। আমাদের জন্যে গঙ্গোত্রীর জল আনতে ভুলিসনি কিন্তু। আর সব জায়গা থেকেই প্রসাদ নিবি। তুই যেমন, হয়তো কিছুই আনবি না!

যাক, যে কোনো একটা ব্যাখ্যা দিয়ে খুশি করে দিয়েছি মাসি-পিসিদের। কুম্ভে কারা গিয়েছিল? সারা ভারতবর্ষের মানুষ। তারাই তো যাবে কেদারনাথে, বদ্রীনাথে। আমার কথাটা মিথ্যে নয়। আমার সঙ্গীরা পথ জুড়ে ছড়ানো। আবার তারই প্রমাণ পাওয়া গেল যেই চেকার উঠলেন, আর আমাদের খেয়াল হল যে ওদের টিকিটই কাটা হয়নি! গুরুগম্ভীর চশমাপরা একজন মাস্টারনী যে ভুলে ভুলে বিনা টিকিটে দুটি প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়ে নিয়ে হাস্যবদনে এয়ার কন্ডিশন্ড কামরায় উঠে বসে থাকে, এটা তো চোখে দেখেও বিশ্বাস হবার কথা নয়। তাই তাঁরা বিব্রত হয়ে বার-বারই বলতে লাগলেন—’দুটো প্ল্যাটফর্ম টিকিটও নেই? কী আশ্চর্য! এখন কী করি? এদের নামিয়ে দেওয়া ছাড়া উপায় নেই।’ দুঃসময়ে আমাদের অভিভাবক হয়ে উঠলেন মিস্টার মুখার্জি, আমার বন্ধুর দাদা। তিনি সপরিবারে এই কামরাতেই যাচ্ছেন। নগদ বিশ হাজার টংকা বেতনে এক বিদেশী কোম্পানীতে মাস্তানি করে এই দেশেই বসে উনি ওই মাইনেটা পান। তাই তাঁর আত্মবিশ্বাসের রকমটাই কিঞ্চিৎ আলাদা। এবং পরিমাণটাও (ভারতবর্ষের রাষ্ট্রপতির দ্বিগুণ)। অনতিবিলম্বেই মিঃ মুখার্জি খানিক কহতব্য এবং খানিক অকহতব্য উপায়ে বহুৎ গচ্চা দিয়ে সমস্যাটা আমাদের পকেট থেকে চেকারদেরই পকেটে চালান করে দিলেন। ফলং পথে যে কোনো ইস্টিশানে রোরুদ্যমান অবতীর্ণ না হয়ে দিল্লি স্টেশনেই আমরা তিনটি টিকিট সমেত ‘সসম্মানে উত্তীর্ণ’ হতে পারলুম।

‘আপনারা রাইটাররা যে কী করেন?’ খুব মাইল্ডলিই বলেছিলেন মিঃ মুখার্জী। ‘এত রাত্রে পথের মধ্যে বাচ্চা মেয়েটাকে নামিয়ে দিলে কী যে হত!’ অবশ্য আমার বিশেষ দুর্ভাবনা হয়নি। প্রথম থেকেই ‘যে খায় চিনি তার চিনি যোগান চিন্তামণি’ পলিসিতে গা ছেড়ে আছি। যা হয় হবে। অতশত ভাবতে পারি না বাবা। তাহলে আর অত বড় ভগবান আছেন কী করতে, জগতের সব ভাবনা-চিন্তা যদি এই তুচ্ছ আমাকেই করতে হল!

অগত্যা ভগবান মিঃ মুখার্জিকে অকুস্থলে পাঠিয়ে দিলেন। অকৃত্রিম স্নেহমমতা পরোপকারের ইচ্ছে এবং সক্ষমতার এমন সুঠাম সম্মেলন দেখা যায় না চট্ করে। তদুপরি এমন নিখাদ ভালোমানুষী!

অর্থম্ অনর্থম্

আগে থেকেই দিল্লিতে বন্ধুবান্ধবদের বলে রেখেছি খোঁজখবর জেনে রাখতে। রত্না নিয়েছিল সব সন্ধান। তবে চারধাম যাত্রার নয়, শুধুই কেদারবদ্রীর। দিল্লি ট্যুরিজমের ট্যাক্সি—যাতায়াত পাঁচ হাজার। দিল্লি ট্যুরিজমের বাসট্রিপ-সাতশো দশ জন প্রতি। তবে বাস না ভরলে ট্রিপ দেয় না। এক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে। লাকসারি বাসট্যুরও আছে, তবে আগামী তিনহপ্তা বুকড।

নানা মুনির নানা মত। এ বলে এটা করো ও বলে ওটা কর না, আর আমি তো একদম মনস্থির করতে পারি না। মহা মুশকিলে পড়লুম। দুটো জায়গা পাঁচ হাজার হলে, চারটে তো দশ হবে। পাঁচ বা দশ দুটোই আমার ক্ষমতার বাইরে। এদিকে সঙ্গে মেয়ে। তিনি আবার বাসে চড়ে বসতে পারেন না। কলকাতার রাস্তায় আমার গাড়িতেই তাঁর মাথা ঘোরে, গা গুলিয়ে ওঠে। দুটি কন্যাই এ বিষয়ে এক। ওই মেয়েকে নিয়ে বাসে করে পাহাড়ি পথে পথে এঁকেবেঁকে ওঠানামার প্রশ্ন নেই। সেই রিনিমার প্রদর্শিত লাল বাসের গায়ের রেড অ্যান্ড হোয়াইট স্ট্রাইপস মনে পড়ে গেল। নাঃ! আর বাসে যাওয়া হবে না। গাড়িই নিতে হবে। বরং কাল রাত্রের ট্রেনে হরিদ্বার চলে যাই। সেখান থেকে হৃষীকেশ। সেখান থেকে ট্যাক্সি।

এখানে এসে শুনছি ওই অঞ্চলে দৈনিক ৪ / ৫-তে থাকা-খাওয়ার গল্প সব গুল্পই জনপ্রতি এক একটা মীল ৪ থেকে ৬ এবং বাথরুমসহ ভদ্রস্থ বাসস্থানে ১০ থেকে ৫০ পর্যন্তও লাগে। অর্থাৎ খরচ আছে। তদুপরি ট্যাক্সিভাড়া। পাঁচজনকে নেয়। অর্থাৎ আমরা আরও দুজনকে নিতে পারি। এখনও যদি আড়াই থাকে, তবে হয়তো বা দেড় হাজারেই—কিন্তু এ কী, আমি তো কেবল কেদারবদ্রী ভাবছি। কিন্তু যমুনোত্রী—গঙ্গোত্রী সুদ্দু? দ্বিগুণ? কি হয়তো তারও বেশিই পড়ে যাবে। তার জন্যে যাত্রী জোটাও শক্ত। কিছু টাকা ধার নিতে হবেই দিল্লি থেকে। ধার মানেই তো শোধও দিতে হবে? কে জানতো ভাড়া এত বেড়ে গেছে? একা এলে বাসেই চলে যেতুম। এখান থেকেই বাসে বাসে। হরিদ্বার, হৃষীকেশ, দেরাদুন, মুসৌরী, শ্রীনগর, দেবপ্রয়াগ, রুদ্রপ্রয়াগ, কর্ণপ্রয়াগ—যেখানে খুশি থামতে থামতে–বাস বদলাতে বদলাতে। যতদিন খুশি থাকতে থাকতে। সেই যাওয়াই ঠিক হত। এখন হয়ত যাওয়াই হবে না। হৃষীকেশ থেকে চারধামের ট্যাক্সিভাড়া কত কেউ বলতে পারল না। তবে পাঁচের কম হবে না—এটা সবাই বললে। তার ওপর তিনজনের থাকা-খাওয়া পুজো-পাণ্ডা ঘোড়া-ডাণ্ডী এটা ওটা কেনা ওরে বাবা, এ তো বিলেত যাবার সমান। তাহলে বরং নাই বা গেলাম! রঞ্জন বলল, ‘তাহলে খুবই ভাল হয়, আমার অকারণ কামাই হচ্ছে। ছুটি পাওনা নেই। দীপঙ্করদার চাপে পড়ে লিভ উইদাউট পে-তে এসেছি।’ পিকো বলল, ‘তাহলে তো খুবই ভাল হয়। আমারও হাতে সময় নেই। সামনে পার্ট-ওয়ান, জার্মানটা একদমই তৈরি হয়নি। দিম্মার আর শিবুমামার জোরজুলুমে এসেছি—চল, দিল্লি বেড়িয়েই ফিরে যাই।’

যাত্রাসঙ্গীদের এই অপরূপ প্রেরণাপূর্ণ কথাবার্তা শুনে মন অমৃতরসে সিঞ্চিত হল। গেলেও ভাল, না গেলেও ভাল—এই অবস্থায় এদের নিয়ে রওনা হয়েছিলুম। এখন দেখি দুজনেই না গেলেই ভাল-য় এসে দাঁড়িয়েছে। এদের সঙ্গে নিয়ে কোথাও যাওয়া যায়? এত অনিচ্ছুক সঙ্গী নিয়ে ভ্রমণে বেরুলে ‘যাত্রার বাস্তবিক আনন্দ অনুভূত হইবে’ কী উপায়ে?

আমি বললুম, ‘যাক গে, ওরা না-হয় কলকাতাই ফিরে যাক। আমি যাবই। ট্রেনে হরিদ্বার চলে যাই কালই।’ মিঃ মুখার্জী আবার উদ্ধারকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে বললেন, ‘দাঁড়ান, দাঁড়ান, একটু ভেবে দেখি কোনো ব্যবস্থা করা যায় কিনা। রাত্রে তো আপনার বন্ধুর বাড়িতে আমাদের নেমন্তন্ন। ওখানে নিশ্চয় অনেকের সঙ্গেই দেখা হবে আপনার।’

শিকে ছিঁড়ল

দেখা হলও। নানা ধরনের শক্তিমান, পদমর্যাদাবান ব্যক্তিত্বে দিল্লি শহর পরিপ্লাবিত। তাদের মধ্যে আমার মতন তৃণদুর্বাদলেরও মহীরূহ বন্ধুর অভাব নেই। আমার যাত্রার যন্ত্রণা শুনে হাত উলটে একজন বললেন, ‘এজন্য ভাবনার কী আছে? আমার সেক্রেটারি সব বন্দোবস্ত করে ফেলবে। আপনি কেবল একটা দিন সবুর করুন। কেদারবদ্রী অনবরত সবাই যাচ্ছে। বি আওয়ার গেস্ট!’

-তার মানে?

—মানে বোঝার কিছুই নেই। এটা পি. আর. ফর্ম আর কি—পাবলিক রিলেশানস্। কালকের দিনটা আমাকে দিন, পরশুই আপনাদের রওনা করিয়ে দেব। কোথায় কোথায় যেতে চান? জায়গাগুলোর নাম বলুন তো?

—যমুনোত্রী, গঙ্গোত্রী, কেদারনাথ, বদ্রীনাথ। এই তো, ব্যাস। ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স বন্ধ হেমকুণ্ডে হাঁটতে হয়। ওসব যাব না। গোমুখ ইচ্ছে ছিল, কিন্তু রওনা হবার সময় গোমুখ যেতে মা বারণ করে দিয়েছেন। কাজেই আর যাবার কিছু নেই। পি. আর. দেখে বিমুগ্ধ হয়ে গড়গড় করে বলে যাই। মন দিয়ে শুনে বন্ধুটি বললেন, ‘ও.কে.। কাল টেলিফোনে সব জানাব। ইতিমধ্যে প্লিজ রিল্যাক্স। বাসে করে বেরিয়ে পড়বেন না। কী ভাবে কী করা যায় দেখছি। হয়ে যাবে একটা কিছু। ইউ শ্যাল বি আওয়ার গেস্ট।’

টেলিফোন এল। ‘ব্যবস্থা সম্পূর্ণ। কোম্পানির গাড়ির ড্রাইভার এখানে আপনাকে তুলে নেবে। হৃষীকেশে আপনি কোম্পানিরই গেস্টহাউসে থাকবেন, ওখানকার গাড়ির ড্রাইভার আপনাদের চারধাম ঘুরিয়ে আনবে। ওসব অঞ্চলে হিল-ড্রাইভিং জানা চাই কিনা? আমাদের দিল্লির ড্রাইভার ওটা ঠিক পারবে না। পাহাড় থেকে ফিরে আবার আমাদের কোম্পানির গাড়িই আপনাকে দিল্লি নিয়ে আসবে। উইল টেন ডেজ বি ইনাফ্! অর ডু ইউ নিড ফিফটিন্‌?’

আমি টেলিফোনটা কানে ধরেই আছি, কিন্তু ঠিক বাংলা ভাষা বলে বোধ হচ্ছে না।

‘বি আওয়ার গেস্ট’ মানে তো নিখরচায়। কিন্তু সেটা ভুল বুঝিনি তো? গাড়ি, ড্রাইভার, টেন-ফিফটিন্‌ ডেজ, গেস্ট-হাউস—এসব কী বলে রে বাবাঃ! আমি চুপচাপ শুনেই যাচ্ছি। বিশ্বাস করতে পারছি না। প্রশ্ন করেই উনি মুশকিলে ফেলে দিলেন। দশ দিন, না পনেরো দিন? খরচ-খরচা কত? বুঝতেই তো পারছি না ব্যাপারটা? এটা কি সত্যি?

–খরচ-খরচা কত, তার ওপরে অনেকটা নির্ভর করবে, তাই না? গাড়ি ড্রাইভারের জন্য কি ডেইলি-বেসিসে?

-কী আশ্চর্য! কালই বললাম না? ইউ আর আ ডিয়ার ফ্রেন্ড অব্ আওয়ার হাউস। অ্যান্ড আওয়ার মোস্ট অনারড্ গেস্ট। আপনাকে আতিথ্য দিতে পেরে আমরাই কৃতার্থ। আপনার কোনো খরচের প্রশ্ন উঠছে না। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে এই যে শুধু গাড়ি ড্রাইভার পেলেই তো হল না? প্রত্যেক জায়গায় বুকিং চাই! সেটার সময় নেই। ওসব জায়গায় ফোন করাও অসম্ভব। এখন ‘ঠাই নাই ঠাই নাই ছোট এ তরী’ অবস্থায়, সীজনের শেষ প্রান্ত—সব ট্যুরিস্ট-লজ ভর্তি। আপনারা থাকবেন কোথায়? চেষ্টা করছি এক মিনিস্টারের কাছ থেকে চিঠি নিয়ে নেবার, যাতে জায়গা পেতে সুবিধা হয়। দেখি!

ঠিক বেলা একটায় ঝকঝকে চকচকে জানলায় জানলায় সাদা লেসের পর্দা আঁটা সবুজ গাড়ি এসে দাঁড়াল। ধবধবে উর্দিপরা তরুণ ড্রাইভার নেমে নমস্কার করে বললে, ‘দ্য কার ইজ হিয়ার, ম্যাডাম। লাগেজ রেডি?’

জাদুর চটিটি পায়ে গলিয়ে হাতে হাতে তালি পড়লে। চলো হৃষীকেশ! রঞ্জন উঠল, পিকো উঠল, আমি উঠলুম। হৃষীকেশ নয়, প্রথমে চলো জনপথ আর পালিকাবাজার। রঞ্জনের কিছু জামাপ্যান্ট কিনতে হবে। টুপি চাই জুতো চাই। আমিই কেবল টুম্পার স্কুলের পি. টি. জুতোজোড়া নিয়ে এসেছি পাহাড়ে চড়বার জন্যে। রঞ্জন আর পিকোর পায়ে চটি।

বাজার করে রওনা হতে হতে বেলা তিনটে সাড়ে তিনটে হয়ে গেল।

যাত্রা

কল্পতরুর যাত্রা শুরু।

কী হল? বিশ্বাস হচ্ছে না তো? শুধু কেদার-বদ্রীর পাঁচ হাজার-ট্যাক্সিতে। সেই শুনে পরশু যাত্রার আইডিয়াটাই ত্যাগ করছিলুম। মনে আছে তো? আর এখন? রওনা হলুম চারধাম। ফ্রি। বিনা খরচে। বাঙালিকে বাঙালি না দেখিলে কে দেখিবে? আর ভাগ্যিস, কুম্ভের যাত্রাটা ইনি পড়েছিলেন! সেই থেকেই নাকি তাঁর ইচ্ছে ছিল একটু আরামে যদি এই মহিলাকে তীর্থভ্রমণ করানো যেত? আহা, কত কষ্ট করেছি সেবার? কিন্তু এই আরামই বোধ হয় আমার কাল হল। কৃচ্ছ্রসাধন ছাড়া কি তীর্থভ্রমণ হয়? তীর্থগমন দুঃখভ্রমণ হওয়া চাই—তা নইলে তীর্থপতির টনক নড়বে কেন? মনটা যেন ভরে না। কিন্তু আমার বেলায় তীর্থপতি নিজেই যদি সেধে সেধে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত উপায়ে আকস্মিক ভাবে বিলাসভ্রমণের ব্যবস্থা করে দেন, তবে আমি কী করি? তারপর থেকে কাণ্ডকারখানা সবই যা হতে লাগল তা বলবার নয়। লেডি গুপী গাইন হয়ে উঠলুম বলতে গেলে।

হাতে একগুচ্ছ চিঠি। কতকগুলিতে আমাকে ইনট্রোডিউস করা হচ্ছে—ইনি প্রসিদ্ধ লেখিকা, বাংলা সাহিত্যের গজমোতিবিশেষ, আমাদের হাউসের গভীর শুভার্থী প্রবল বন্ধু এবং আমাদের সম্মানিত অতিথি, আপনার যথাসাধ্য সহায়তা এঁর প্রতি দিলে আমাদের হাউস কৃতার্থ হবে।

আর কতকগুলিতে বলা হচ্ছে—ইনি প্রসিদ্ধ লেখিকা অমুক মন্ত্রীর ভাইঝি (?), এঁর জন্য অতি অবিশ্যি ঘরটর দেবেন। কেন রে বাবা আমি অমুক মন্ত্রীর ভাইঝি হব? অল্পস্বল্প চিনি এই পর্যন্ত। বুঝলাম এসব জায়গায় তো কোম্পানির নামের জোর খাটে না। তাই মন্ত্রীর নাম ধরে টানাটানি করে কোম্পানির হাত শক্ত করছেন আমাদের বন্ধু মশাই। সত্যিমিথ্যে চিঠিপত্রের দৈব দুর্দৈব অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে তো আমরা জয় বাবা কেদারনাথ জয় বাবা বদ্রীনাথ জয় যমুনামাঈকি জয় গঙ্গামাঈকি বলে বলে হুউশ্ করে দিল্লি থেকে রওনা হয়ে ভেসে গেলুম।

যেন স্বপ্নের মধ্যে।

হৃষীকেশ

তবু লোকে বলবে ঈশ্বর নেই? নেই তো আমি এই এয়ারকন্ডিশন্ড ডাবল স্যুইটে শুয়ে শুয়ে কাচের দেয়ালের বাইরে ঝাউবন আর হিমালয় দেখতে দেখতে আকাশপাতাল ভাবছি কী করে? পাশের স্যুইটে রঞ্জন। আমার পাশে পিকোলো ঘুমিয়ে পড়েছে। ঝাউবনে অন্ধকার নেমেছে। আসতে আসতে অদ্ভুত একটা চাঁদ দেখতে পেলুম হরিদ্বারের আকাশে। চাঁদটা ভাঙাচোরা, মলিন, এবং বেশ দীনদুঃখী। তার মাথার ঠিক ওপরে প্রকাণ্ড জ্বলজ্বলে একটা দাম্ভিক তারা। হাতি কাদায় পড়েছে আর ব্যাঙে পদাঘাত করছে—ঠিক যেন তার নৈসর্গিক ছবি। সারাটা আকাশ ঘোর অন্ধকার। একটুও অন্ধকার কমাতে পারছে না ঐ আঁকাবাঁকা একটুকরো চাঁদ। আর কোনো তারাও নেই। এটা কি লুব্ধক? ডস্টার? বোধ হয় তাই। বড় ভয়ানক দেখাচ্ছিল ওকে আজ।

পথে হরিদ্বার দেখতে দেখতে এলুম। খুব ভালো লাগছিল। এদিকের প্রাচীন তীর্থনগরী, পিকোলো এলাহাবাদ, গয়া, কাশী, কিছুই দ্যাখেনি। রঞ্জনও না। (রঞ্জন কে? আমার একটি ছোট ভাই। দীপঙ্কর, রঞ্জন, শিবু—এরা সব আমার পরিবারের অন্তর্গত। এদের চিনে রাখুন।) পুরনো তীর্থস্থানের এই যে একটা আলাদা চরিত্র আছে উত্তরপ্রদেশে এটা আমাকে বড় মুগ্ধ করে।

পথে একটা জুলুস বেরিয়েছিল। বিয়ের মিছিল। ঘোড়ার ওপরে বছর ষোলো-সতেরোর বর। দাড়িগোঁফ গজায়নি। রাস্তায় বাড়ির মেয়েরা নাচছেন। বয়স কোনো ব্যাপার নয়। এঁরা গৃহস্থ পরিবার। আগে আগে মাইকে গান গাইতে গাইতে একজন হেঁটে যাচ্ছেন। তিন-চাকার সাইকেলগাড়িতে চড়ে সঙ্গে যাচ্ছেন অ্যামপ্লিফায়ার। আমি ড্রাইভারকে ‘দাঁড়ান! দাঁড়ান!’ বলে গাড়ি থামালুম। দেখতে হবে। ওই ভাঙা চাঁদের নিচে, পিচের পথে, ওই নিঃশব্দ গঙ্গার পাশে, ম্লান হলুদ বাতি-জ্বলা, ধূপধুনোর গন্ধওলা কয়েকশো বছরের প্রাচীন গলির মুখে দাঁড়িয়ে ওই উচ্ছল নৃত্যগীত যে কতটা অদ্ভুত লাগল, কি বলব? গানটা বোধ হয় হিন্দি ফিলমের। গানের বোল হচ্ছে :’কচৌড়ি খায়েগি ছোরি—। ও পাত্তা চাটেগা ছোরা।’ সামনে দাঁড়াল এই মুহূর্তে দুটি ভিন্ন ভারতবর্ষ, তার বিভিন্ন সংস্কৃতি, ধর্মীয় অতীত আর ফিল্মি বর্তমান নিয়ে। আর মাথার ওপরে সাক্ষী রইল চিরন্তন সময়–চাঁদে বিকীর্ণ, গঙ্গায় বহমান।

গতিরুদ্ধ হয়ে ড্রাইভার অবাক, একটু মজা পেল, আর একটু বিরক্তি। সবিনয়ে জানতে চাইল, এবার রওনা হই? পথে একটুখানি বনাঞ্চল পার হতে হয়। সেখানে হঠাৎই গাড়ির সামনে বেরিয়ে এল একটি শিশু—বন থেকে। বুনো শেয়ালের মতো। একেবারেই গাড়ির নিচে। চাপা দিতে দিতে অনেক কষ্টে গাড়ি সামাল দিয়ে দিল ড্রাইভার। ‘শালাঃ—মার ডালা থা মুঝকো’ বলে কপালের ঘাম মুছলো জগৎ সিং। হঠাৎ হেডলাইটের আলোয় স্পষ্ট দেখতে পেলুম শিশুটির দু’চোখই সাদা, মণিহীন।

‘আন্ধা! বিচারাঃ! ওফ্! ভগবাননে বচা লিয়া উস্‌কো!’ মুহূর্তেই জগৎ সিং কণ্ঠস্বরে একেবারে অন্য মানুষ। অভিভাবকহীন শিশুটি বোধ হয় পাগল। নিজের মনেই চলতে লাগল। নির্জন বনের পথে। একা!

হয়তো ভোরের কাক হয়ে

আবার সেই সূর্যোদয়। সেই আকাশ, সেই পাহাড়, সেই গঙ্গা। কিন্তু এবার কানে নেই শঙ্খঘণ্টার বাজনা, নেই দেবমূর্তিদের স্নান করাতে করাতে দক্ষিণী পুরোহিতের সস্নেহ মন্ত্রোচ্চারণের সুর। তার বদলে পেলাম—কী? বশংবদ এয়ারকন্ডিশনারের কলগুঞ্জন। সামনে কাচের বাইরে খোলা সযত্নচর্চিত কদমছাঁট মাঠ, যার নাম লন, তার ওপারে সৈন্যের মতো সারিবাঁধা ডিসিপ্লিন্ড ইউক্যালিপটাস। ওপাশে উহ্য খাদের মধ্যে গঙ্গা। তার ওপারে জঙ্গল পাহাড় ঝাউবন।

ভোর পাঁচটায় যখন সূর্যের জন্যে উঠেছিলুম, আকাশ ফর্সা হচ্ছিল, সূর্য ছিল না, দোরের সামনে গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তলাল পপিফুল ফুটেছিল। এখন সূর্যের আলোতে দূরের পপিগুলি গোলাপ হয়ে গেছে, আর কাছের পপিরা হয়েছে পিটুনিয়া। কুয়াশায় যারা দুর্লভ পপি ছিল, রোদ্দুর তাদের সস্তা আটপৌরে করে দিয়েছে। আটটা বাজে। একটা কাকপক্ষী ওঠেনি। কেবল একটি কোকিল আপ্রাণ ডেকে যাচ্ছে। রাত্রেও সে বহু ডাকাডাকি করেছে। কি অলস রে বাবা এখানকার পাখিরা! আমার মেয়ে দুটির মতো স্বভাব দেখছি। বেলা ১টা না বাজলে উঠবে না।

৮১ সালে এখানে এসে একটা ভোরবেলাতে রিনিমা বৌদি আর আমি মুনি কী রেতী ঘাটে গিয়েছি চা খেতে। তখন সদ্য ভোর হচ্ছে গীতা ভবনের পিছনের পাহাড়ি আকাশে। চায়ের দোকানে তখনও কাঠের জ্বালের ধোঁয়া উঠছে। মুনি কী রেতীর বাঁধানো উঠোনটা ঝাঁট দিচ্ছে ধুলোর মেঘ উড়িয়ে একজন দেহাতী বৃদ্ধ। আমাদের দেখে ফোকলা হেসে ভারী সুন্দর ‘নমস্তে’ বলল। সবারই মেজাজ ভোরবেলায় ভালো। আমার মনটাও খুব খুশি-খুশি লাগল। হঠাৎ একটি কাক। কাকটা এসে লাফিয়ে নেচে বেড়াতে লাগল আমাদের সামনে, আর ডাইনে বাঁয়ে ঘাড় বেঁকিয়ে বেঁকিয়ে আমাদের ঘোরতর পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। আমি খুশি হয়ে বলে ফেললুম, ‘হ্যালো, কাক! গুড মরনিং!’ কাক কী বুঝল সে-ই জানে, সুন্দর করে ঘাড়টি বেঁকিয়ে গুরুগম্ভীর জবাব দিল, ‘কা—! ‘

ঐ ঝাড়ুর ধুলোয়, কাঠের ধোঁয়ায়, আধোভোরে কুয়াশামাখা নৌকা-বাঁধা ঘুম-ঘুম নদীর তীরে হিমালয়ের ছায়ায় ভোরের প্রথম কাকটিকে দেখে বুক ছ্যাঁৎ করে উঠেছিল, মনে পড়েছিল হঠাৎই, ‘হয়তো ভোরের কাক হয়ে—

আজ, এই এয়ারকন্ডিশাল্ড গেস্ট হাউসে শুয়ে সেকথা মনে এল। খুব ইচ্ছে হল মুনি কী রেতীতে আরেকবার যেতে। এমন সময়ে দোরে টোকা পড়ল।—’চায়।’ চা দিয়ে বেয়ারা জানাল—’গাড়ি তৈয়ার। বাহার যানা হ্যায় তো—’ আরে হামভি তৈয়ার। এক্ষুনি মুনি কী রেতী যাব। চল্ চল্—ওঠ ওঠ।

তারপর মুনি কী রেতী।

কিন্তু এত বেলা হয়ে গেছে!

এখন কি আর তার সঙ্গে দেখা হবে? গেলুম। চা খেলুম। সিঙাড়া জিলিপি পর্যন্ত ভাজা হয়ে গেছে। কাকের সঙ্গে আজ দেখা হল না।

হিমালয়

—‘তুমি পর্বত ভালোবাসো, না সমুদ্র?’ বেড়াতে বেরুতে হলেই সাহেবদের এই এক ছকবাঁধা প্রশ্ন। কেন যে এই প্রশ্নটা ওঠে, আমি বুঝি না। এই হয় এটা নয় ওটা—এমনি দ্বিধারায় ভাবনা করাই আমার পোষায় না, এই ভাবধারাটা পুরো ধার-করা, সায়েবীয়ানা। আমাদের তো আইদার-অর বলে কোনো ব্যাপারই নেই। হয় এটা, নয় ওটা, নইলে সেটা, নইলে আরেকটা,

–সব একসঙ্গে একশোটা চয়েস দিতে পারি। সে যে প্রশ্নই করো না কেন। জগৎ কী? জীবন কী? মৃত্যু কী? ঈশ্বর কী? আনন্দ কী? এটা নয় ওটা নয় সেটাও নয় করে করে এগুতে এগুতে সেই কোথায় নিয়ে গিয়ে ফেলতে পারি! হয় সমুদ্র, নয় পাহাড়? কেন? এটা কি ইংল্যান্ডের মতন একমুঠো দেশ? আমাদের আরও তো কত কিছু রয়েছে দেখতে যাবার। জলজঙ্গল, বনপাহাড়ী, শালপিয়াল, বাঘ-ভাল্লুক, ঠাকুর-দেবতার ঠাঁই, রাজারাজড়ার প্রাসাদ-কেল্লা—স্মৃতি-সমাধি—কী নেই? সমুদ্রেও যেতে হবে না, পর্বতেও নয়।

বরং মরুভূমিতে যেতে পার। সেখানেও কি দেখবার জিনিস কম আমাদের? তীর্থও পাবে, প্রাসাদও পাবে; কেল্লাও পাবে, জীবজন্তুও পাবে। ধর্ম করো, কি শিল্প করো—ইতিহাস করো কি বিজ্ঞান কর। যা প্রাণ চায় তাই করো। আসমুদ্র হিমাচল মানে তো সমুদ্র আর হিমাচল নয়!

সমুদ্রতীরে যাওয়া মানে যেমন সমুদ্রযাত্রা নয়, তেমনি হিলস্টেশনে যাওয়া মানে হিমালয় যাত্রা নয়। পাহাড়ে বেড়াতে যাবে বললে লোকে তো ত্রিযুগীনারায়ণ কি নীলকণ্ঠের কথা ভাবে না। বিচ-রিসর্টসে যেমন গভীর গম্ভীর নিশ্চল মধ্য সমুদ্র নেই, হিল-স্টেশনে তেমনি হিমালয় থাকেন না। হিমালয় একেবারে অন্য ব্যাপার। পাহাড়, না সমুদ্র—এই প্রশ্নোত্তরের আওতার বাইরে হিমালয় নামে অন্য এক ভূ-পূর্বস্বঃদেশ আছে। অন্য এক লোক। যার ছবি ভূগোলের খাতায় বাদামি রঙে কিরিকিরি করে আঁকা যায় না। তার তো মানচিত্র হয় না, তার তো হয় সম্মানচিত্র। এভারেস্টের চূড়োয় গিয়ে উঠলেও, হায়রে, এডমাণ্ড হিলারীদের সঙ্গে সেই হিমালয়ের এজন্মে দেখাই হয় না। হবে কি করে? হিমালয়কে তো দেখা যায় না, হিমালয় দেখা দেন। এ তো তোমার আল্পস পাহাড় নয়, টিকিট কেটে যে কেউ যাবে সে-ই দেখে ফেলবে।

হিমালয়ের ভেতরে যে রয়েছে আরেকটা কাণ্ডকারখানা-যার জন্যে তাকে ‘দেবতাত্মা’ বলে ডাকা যায়, ‘ভারতাত্মা’ বলে ডাকা যায়। আল্পস পাহাড় তো ইউরোপের আত্মা নয়? মানচিত্রে অবস্থিত শৈলশ্রেণী মাত্র। হাজার হাজার বছর ধরে পুরাণে, ধর্মগ্রন্থে, রসসাহিত্যে গড়ে ওঠা হিমালয়ের সঙ্গে পাল্লা দেবে কোন আল্পস?

এই হিমালয়েই এবার আমার যাত্রা। হিমালয়ে যেতে অন্য ড্রাইভার লাগবে। অন্য গাড়ি। ধবধবে সাদা অ্যাম্বাসাডার এসে দাঁড়াল—তার জানলায় জানলায় নীলরঙের পর্দা। ঝকঝকে উর্দি পরা সুরথ সিং নেমে এসে নমস্কার করে বলল—’নমস্তে বিবিজি। গাড়ি তৈয়ার। লাঞ্চ-বক্স বি ডাল্ লিয়া। আব কম্বল তাকিয়া উবারা উঠা লেঁ?’

গেস্ট-হাউস থেকেই প্রত্যেককে কম্বল, চাদর, বালিশ দিয়ে দিলেন, সঙ্গে লাঞ্চ, ডিনার, স্ন্যাক্স, আর জরুরি ওষুধপত্রের একটা খাম। আর হাতে আবার একতাড়া চিঠি। কালীকম্বলীওয়ালার ধর্মশালাতে, আর গাড়োয়ালমণ্ডল বিকাশ নিগমের ট্যুরিস্ট লজে ঠাঁই দেবার অনুরোধ-পত্ৰ।

সুরথ সিং এই গাড়োয়ালেরই মানুষ। অনেকবারই গাড়ি নিয়ে কেদারবদ্রী গেছে। যমুনোত্রী গঙ্গোত্রী যায়নি। তাই তার নিজেরও খুব উৎসাহ যেতে। ভোর ছ’টায় হল না, ৭টায় বেরিয়ে পড়লুম। দেহরাদুন মুসৌরির পথে।

সহস্রধারা

গতকালও আমরা দেরাদুনে গিয়েছিলুম জগৎ সিং আর রামপ্রসাদ শর্মার সঙ্গে, সে-পথই ছিল আলাদা। একের পর এক নুড়িঢালা শুকনো নির্জলা চওড়া পাহাড়ি নদীর সোঁতা পেরিয়ে, নানান্ বনজঙ্গল দিয়ে পাহাড়ি পথে ঘুরে ঘুরে। পথে একটা বেড়াল চোখে পড়তেই জগৎ সিং থুথু ফেলে কান মুলল। বড়ই অলক্ষণ যাত্রাপথে বেড়াল দেখা। এক এক অঞ্চলের ড্রাইভারদের এক-একটা আলাদা ধরনের কুসংস্কারের ঐতিহ্য থাকে। জগৎ সিং সোসাল সায়েন্স গ্র্যাজুয়েট। কিন্তু সংস্কারমুক্ত নয়। এই নিয়ে শর্মাজি ওকে খ্যাপাচ্ছিলেন সর্বক্ষণ। আমাদের গন্তব্য ছিল সহস্রধারা ঝরনা।

দিল্লিতে সুনীলদা বৌদি বার বার বলে দিয়েছেন—’দেখে যেও’। ছেলেবেলায় মা-বাবার সঙ্গেও এসেছিলুম, কিন্তু ভালো মনে নেই। বিয়ের পরেও স্বামীর সঙ্গে মুসৌরী এসেছিলুম, তখন কেম্পটি ফলসে গেছি, সহস্রধারায় যাইনি। শর্মাজি সঙ্গে এসেছেন পথ দেখাতে। তিনিই জমিয়ে রেখেছেন সারাটা রাস্তা হৈ-চৈ করে। পথটথ তিনি চেনেন না। প্রথমেই আমরা পথ ভুল করে অনেক দূরে রায়পুর বলে একটা একলা-ফ্যাকলা ছোট্ট পাহাড়ি গ্রামে চলে গেলুম। কী সুন্দর লুকোনো মতন সেই মুসলমানী গ্রামটি। বোরখা পরা মেয়েরা আর ছোট্ট ছোট্ট মসজিদের পরিচয়ে তার চরিত্র চেনা যাচ্ছে। কী চমৎকার সব কুকুর এখানে! প্রত্যেককে আমাদের কলকাতার বাড়ির তাওয়াংয়ের মতন দেখতে। তাওয়াং তিব্বত বর্ডার থেকে আমার কুড়িয়ে পাওয়া কুকুর। রায়পুরে চমৎকার নীল একটা শীর্ণ জলস্রোত আছে। নালাই বলব, সেটাকেই শর্মাজি সহস্রধারার একটি ধারা বলে চালাতে চেষ্টা করলেন কিছুক্ষণ, তারপর ফিরে যেতে স্বীকৃত হলেন। সহস্র ধারায় পৌঁছে সবাই খুব খুশি। ঝরনায় স্নান করবে বলে পিকোলো আর রঞ্জন তোয়ালে এনেছিল, কিন্তু স্নানের উৎসাহ রইল না এমন নোংরা আশপাশ। আব্রুও নেই। জগৎ সিং কিন্তু নেমে পড়ল রঞ্জনেরই তোয়ালেটা নিয়ে। আনডারওয়্যার পরে দিব্যি নেয়েধুয়ে উঠল। পুণ্য হয়ে গেল একটু এই ফাঁকে। সহস্রধারার নামে একটা পৌরাণিক কাহিনি আছে, যার বলে সে পুণ্য দিতে পারে। রঞ্জন যত মুগ্ধ হয় আমি তত বলি, ওরে, এ তো কিছুই নয়। এরকম লক্ষ লক্ষ দেখবি। এ বছর দেহরাদুন অঞ্চলে খরা-মাটি শুকিয়ে ধূ-ধূ করছে। সহস্রধারার যৌবনেও খরা লেগেছে। জল কোথাওই বেশি নেই।

পথের ধারে পাহাড় খুঁড়ে চাদ্দিকে শ্লেট রং-এর পাথরকুচি সাজিয়ে রেখেছে—যেদিকে চাইবে চলেছে পাহাড় ভেঙে গুড়িয়ে পাথরকুচি চালান দেওয়া। সর্বত্র লরি। সোডিয়াম সালফেট, না ক্যালসিয়াম কার্বনেট—কী সব যেন বলতে লাগলেন শর্মাজি। মোট কথা, এই সব প্রস্তরখণ্ড থেকে সংগৃহীত হবে কতিপয় কেমিক্যাল্স। শর্মাজি দারুণ লোক। জগৎ সিং যখনই একটু আনকোঅপারেটিভ হয়, তখুনি তাকে গুরু মহারাজ, মহাপ্রভু, প্রভুজি, মেরে পুরুষোত্তম ইত্যাদি সম্বোধনে জল করে ফেলেছেন। এই শর্মাজি অদ্ভুত মানুষ! বিয়ে-থা করেননি। মাকে নিয়ে একাই থাকেন। হৃষীকেশ বাজারে নিজের পৈতৃক বাড়ি ও মিষ্টির দোকান আছে। এমন প্রাণবন্ত, ফুর্তিবাজ, হাসিখুশি মানুষটিকে সঙ্গে পেলে আমাদের যাত্রা সত্যি জমতো ঢের ভালো। আজ সূরথ সিং ওপথে না গিয়ে শহর দিয়ে-দিয়েই চলে এল দেহরাদুন। সেখান থেকে পাহাড়ে চড়া শুরু হল-মুসৌরির পথ। আর শুরু হল পথে পিকোলোর গা গুলিয়ে ওঠা। পথে টোল গেটে থামতে হল। তখন রঞ্জনকে পাঠালুম লেবু কিনতে। একটা পানের দোকান থেকে বারো আনা দিয়ে একটি লেবু নিয়ে এল। আর একটি অরেঞ্জ ড্রিংক। ইত্যাকার প্রচেষ্টায় পিকো তো একটু স্বস্তি পেল। আট টাকা শুল্ক দিয়ে গাড়ি চলল।

ফুলবালা

পথে ফের সমস্যা। নাকে প্রবল পেট্রলের গন্ধ। এটা আবার কোথা থেকে? এর জন্যেই তো গা সবারই গুলিয়ে উঠতে পারে। গাড়ি থামানো দরকার। সূরথ সিং বললে, বিশ লিটার রিজার্ভ পেট্রল একটা বোতলে আছে। তার মুখ থেকেই উপচে পড়ছে সেটা কমাতে হবে। কিছুটা ঢেলে নেওয়া হল গাড়িতে—যাতে উথলে ওঠার সম্ভাবনা কমে। আবার যাত্রা। পিকোর জন্যে টাটকা পাতার সুবাস সংগ্রহ করতে গিয়ে পাহাড়ের গায়ে সুন্দর সুরভিত একটি উদ্ভিদ আবিষ্কার করলুম। পাতাগুলি চন্দ্রমল্লিকার পাতার মতোই দেখতে। কিন্তু ফুল নেই। এই সময় সুরথ সিং একরকম কচি কচি ফল তুলে এনে পিকোকে খেতে দিল। কমলা রঙের ছোট মালবেরির মতো দেখতে। টকমিষ্টি খেতেও। খুব কাঁটাওলা ঝোপে ফলেছে। খেয়ে ভালো লাগাতে আবার গাড়ি থামানো হল। এবার রঞ্জনকে পাঠিয়ে দেওয়া হল ফল তুলতে, হাতে সাজির বদলে একটি সেলোফেনের ঠোঙা দিয়ে। কাঁটা হেরি ক্ষান্ত না হয়ে অতি সন্তর্পণে বহু সময় নিয়ে, মন দিয়ে রঞ্জন ফল তুলতেই লাগল।

গাড়ির দূরত্ব থেকে ওকে ফুলচয়নে রত আশ্রমবালার মতো দেখাচ্ছে। বুনো মালবেরি ফল খেতে খেতে মুসৌরী। সেখানে আরেক রকম ফল বিক্রি হচ্ছে—খুবানী। স্পষ্ট দেখলুম কাঁচা এপ্রিকট। মুসৌরি শহরের ভিতরে গাড়ি ঢুকতে দিত না আগে। গতবার যখন অমর্ত্যর সঙ্গে বাচ্চাদের নিয়ে এসেছিলাম দিল্লি থেকে গাড়িতে, সেবারে গাড়ি শহরের বাইরের পার্কিঙে রাখতে হয়েছিল বলেই স্মরণ হচ্ছে যেন। গাড়ি যেখানে থামল সেখানে একটা নল থেকে পীনে-কা-পানি ঝরছিল—এত শীতল, এত মিঠা পানি খুব কমই খেয়েছি জীবনে। কুলিরা বোঝা নামিয়ে মুখহাত ধুচ্ছে সেই জলে। আমরাও ধুলুম। পিকো অনেকটা তাজা হল। পাশ দিয়ে একটা খচ্চরে-টানা বাক্স-গাড়ি ভর্তি কিছু ছেলেমেয়ে গেল, পাহাড়ি মানুষজন, একঝলক বিদেশি চার্লি-পারফিউমের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল বাতাসে। এ অঞ্চলেও বেশ স্মাগলিঙের ব্যাপার-স্যাপার আছে তাহলে?

গাড্ডি হটাও!

মুসৌরি থেকে খানিক দূরে কেম্পটি ফল্স। চমৎকার ঝর্না। অনেক দূর থেকেই দেখা যাচ্ছে সেখানে গাড়ি ও বাসের সারি। বাস থেকে টিফিন ক্যারিয়ার, শতরঞ্জি, কাচ্চাবাচ্চা নিয়ে গৃহস্থরা নামছেন। যতই রূপ থাক, নেহাৎ উটকো বিলিতি ঝর্না এই কেম্পটি ফল্স। নামের মতনই সে বেচারার কোনো পৌরাণিক ঐতিহ্য নেই। তাই তার জলে পুণ্যস্নান হয় না। সে শুধুমাত্রই ছুটির দিনে পিকনিক স্পট। সহস্রধারার মতো মানুষকে পুণ্যি দেবার রাইট তার নেই।

কেম্পটির ধারের রাস্তাও মেরামত হচ্ছে। প্রচুর পাথর ঢালছে। একটি পাথর-ভর্তি টেম্পো গাড়ি রাস্তা বন্ধ করে খাড়া।

‘গাড়ি হাটাও?’

‘কৌন হটায়গা? ড্রাইবার নেই। খানা খানে গয়া। ‘

‘বাঃ!’ সূরথ সিং ভুরু কুঁচকে বসে রইল। তার ভাবনা হচ্ছে। সময় হিসেব করা দৌড় তো? এখানে অকারণে আটকে থাকলে সময়মতো আশ্রয়স্থলে পৌঁছব না। আজই আমাদের হনুমানচটিতে পৌঁছোনোর কথা, যমুনোত্রীর পথে। সেখানে থাকার জায়গাও নাকি বেশি নেই। ট্যুরিস্ট বাসগুলো ভোর ছ’টায় ছেড়েছে হৃষীকেশ, তারা যায় অন্য একটা পথে, ওরা আগে পৌঁছলে সব বাসস্থান ভরে যাবে। আমাদের এই শিক্ষাটা দিয়ে দিয়েছেন পি. আর. ও. গুপ্তাজি। হাতে সরকারি বাসযাত্রীদের ইটিনেরারীর একটি সিডিউল গুঁজে দিয়েছেন, সঙ্গে আমাদের নিজেদের ভ্রমণেরও একটি সূচি তৈরি করে টাইপ করে তার দুটি কপি দিয়েছেন। সেই হিসেবমাফিক পৌঁছুতে চেষ্টা করতে হবে তো!

এমনিতেই পথে ফল তুলে, পাতা তুলে, ঝর্নার জলে মুখ ধুয়ে থামতে থামতে চলেছি। তার ওপর টেম্পোওলার লাঞ্চ ওভার হওয়ার জন্যেও অপেক্ষা করতে হলে তো গেছি! সূরথ সিং স্বভাব-ভদ্র মানুষটি। একজন খেতে বসেছে, তা সে যতই তোমার অসুবিধে করুক আর যতই তোমার অচেনা হোক, তাকে তাড়া দেবার কথা ওর মাথায় আসবে না। কিন্তু আমার মাথায় আসবে। আমি স্বভাব-অসভ্য। আমি লাফিয়ে নেমে পড়ে দূরে দেখা-যাওয়া কুলিদের ঝুপড়ির দিকে রওনা হই। ধোঁয়া উঠছে। হয়তো রান্না হচ্ছে। কিন্তু এখনও তো লাঞ্চ টাইম হয়নি। এখনই ভাত খাবে কি? চা খাচ্ছে নিশ্চয়। ঝুপড়িতে গিয়ে চেঁচামেচি করতে একটি ছেলে ধীরেসুস্থে বেরিয়ে এল এবং ধীরেসুস্থে টেম্পো সরাতে চলল। প্রথমে অবশ্য সে সমস্ত পাথর পথে ঢেলে গাড়ি খালি করে নিল। তার জন্য সময় লাগল যৎসামান্য। এটা সে কেন যে আগেই করেনি! না করে হাই-ওয়েটা বন্ধ করে গাড়ি রেখে চা খেতে গিয়েছিল কেন, এর উত্তর মেলা শক্ত।

পানিচাক্কী

পথে খিদে-খিদে পাচ্ছে। সঙ্গে নাকি চিজ স্যান্ডউইচ আছে, পুরী-আলু আছে। আলুর দমের সুগন্ধে প্রাণ পাগল। চিজ-স্যান্ডউইচ খাবার চেষ্টা আগেই করেছি। মাখনরুটি আছে, চিজটা ছিল না। পুরী-আলুটা খেতে হবে এবার। সুরথ সিং বললে, ‘আমি তো নৈনিবাগে ভাত খাব। আমি আবার দুপুরে ভাত না খেলে পারি না। রাত্রে বরং পুরী হবে।’ ঘুরতে ঘুরতে গাড়ি অনেক ওপরে উঠেছে। হঠাৎ দেখি বহু বহু নিচে ছবির মতো উপত্যকা। সেই উপত্যকায় সরু সুতোর মতো নদী। নদীতে খেলনা-ব্রিজ। নিশ্চয় যমুনা! আমরা যমুনা ব্রিজের দিকেই যাচ্ছি। সম্ভাব্যস্থল যমুনোত্রী। পথে যমুনা-উপত্যকা তো ধরতেই হবে। এই উঁচু পথই ঘুরে ঘুরে নেমে যাবে ঐ উপত্যকায় ঐ নদীর ধারে, ঐ ব্রিজের কাছে।

‘ঐ দ্যাখ ঐ দ্যাখ, যমুনা! ‘

‘কই? কই? কোথায়? কোথায়?’

হৈ হৈ করে যমুনা দেখছি। আমার মনে পড়ে গেল কামেং নদীর অবিকল চেহারা, কামেং উপত্যকার বুক–তাওয়াং যাবার সময় ঠিক এমনিই দেখিয়েছিল।

ঘুরতে ঘুরতে সত্যিই নদীর কাছে এসে পড়লুম। এক জায়গায় খুব তোড়ে দারুণ একটা ঝর্না ঝরছে পানিচাক্কী থেকে। পথের ওপর দিয়েই বয়ে যাচ্ছে তার জল। পাহাড়ি মানুষজন জল ভরছে, কেউ কেউ স্নান করছে। আমরা গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়ি। ঝর্নার ঠান্ডা জলে তোয়ালে ভিজিয়ে নিই পিকোলোর জন্যে। ফ্লাস্কটা ভরবার চেষ্টা করতে রঞ্জনকে ডাকি। রঞ্জন এসেই আগেই মুণ্ডুটা বাড়িয়ে দিয়ে জামাকাপড় না ভিজিয়ে মাথা ধোবার আপ্রাণ কসরৎ করতে লাগল। কিন্তু ঝর্নার সঙ্গে এঁটে উঠতে পারল না। ইতিমধ্যে পিকোলো নেমে ঝর্নার অন্য একটা সরু ধারা থেকে দিব্যি ফ্লাস্কটা ভরে নিয়েছে—মুখে চোখে জল দিয়ে খানিকটা তাজা হয়েছে। আমি চটি খুলে ছপ্ ছপ্ করে পথে যে জলটা বয়ে যাচ্ছে তার মধ্যে হেঁটে বেড়াই। পা ভেজাই। খানিক পাশেই নদী। চাঙ্গা হবার ফলে পিকোলোর ঝোঁক হল নদীতে নামবে। রঞ্জনের তাতে পুরো সায়, কিন্তু পাহাড়ের মায়াবী দূরত্বের কথা ওরা ভুলে গেছে। নদীকে মনে হচ্ছে বুঝি পাশেই। নামতে গেলেই টের পাবে বাছাধনেরা, ঢের ঢের দূরে। যাওয়া সহজ হলে পাহাড়িরা ওখান থেকেই জল আনছে না কেন? ওখানেই চান করছে না কেন? অতিকষ্টে ঠেকানো গেল পিকোর নদী অভিযান। ফের যাত্রা। এবার থামলুম নৈনিবাগে। গরম গরম ভাত। চমৎকার ছোট্ট একটা রেস্তোরাঁ। জানলার পাশ ঘেঁষে আমরা যে টেবিলে বসলুম, তার নিচে সবেগে বয়ে যাচ্ছেন খরস্রোতা ঝর্নার মতো নীল যমুনা, ফেনায় ফেনায় দুধ-সাদা হয়ে। খাওয়াটা জমল দারুণ। ধবধবে ভাত, ডালফ্রাই, দই, আমি একটি সব্জী, ওরা তিনজনে ওমলেট।

উত্তরাখণ্ড অঞ্চল এমনিতে নিরামিষ। হরিদ্বারের পর থেকেই মাছ মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ ছিল এতকাল। চিরদিন শুনে এসেছি হৃষীকেশে মাছ মাংস ডিম ঢোকে না। কার্যত দেখলুম বাজারে না থাকলেও ডিম আছে প্রায় সব দোকানেই। এখানে গাড়োয়ালের নামহীন পাহাড়ি গ্রামে মাংসের চলটাও আছে। মাছ খায় না কেউ। (মাছখোর বাঙালি তো নয় এরা!) তবে ছোট ছোট খাবার দোকানে মাংস থাকে না। চমৎকার পরিচ্ছন্ন ঝকঝকে নতুনের মতো স্টিলের বাসনপত্রে খাবার দিল। কলকাতা কেন, পশ্চিমবঙ্গেই কোনো এরকম ছোট্ট দোকানে এ ধরনের পরিচ্ছন্নতা অকল্পনীয়। বড় দোকানেই যা দেখি।

পর্বতশৃঙ্গের আরোহিণী

একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলুম বুঝি। পিকো তো প্রথম থেকেই দুটি বালিশ নিয়ে জাঁকিয়ে তার মা’র কোলে শুয়ে আছে। আর রঞ্জন সুরথ সিংয়ের পাশে বসে মাঝে-মাঝেই ঘাড় কাত করে ঘুমিয়ে পড়ছে। আমিই যা চোখ কান খুলে বসে আছি সুরথ সিংয়ের সঙ্গে সঙ্গে। বড্ড শুষ্ক, বর্ণহীন অঞ্চল। ঘুম-ঘুম ভাবটা কাটতে দেখি ঝাউবনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, ঠান্ডা হিম-হিম হাওয়া দিচ্ছে। নিজে সোয়েটার পরলুম, মেয়েকে পরালুম, ‘রঞ্জন ওঠ ওঠ, সোয়েটার পরে নে।’ অসম্ভব গরম ছিল সারাটা পথ। লোকে বলে মুসৌরি-টুসৌরি ঠান্ডা জায়গা—কই ভাই? আমরা তো দেখলুম ফুটিফাটা গরম। অত গরমেই পিকোর শরীর খারাপ করেছিল। আমি অবশ্য ওষুধও খাইয়ে দিয়েছি। ঠান্ডায় মন ভালো হল। রঞ্জন বলল নামবে। নেমে একটু হেঁটেই সে হঠাৎ বনের দিকে গিয়ে বমি করতে শুরু করল। ঘুরনচাক্কী পথের শিকার নং ২। ইতিমধ্যে পিকোলো কই? কখন উঠে দরজা খুলে নেমে পড়েছে এবং পাহাড়ে উঠতে আরম্ভ করেছে। সুরথ সিং ভাগ্যিস দেখেছে ঐদিকে গেছে! ওর শরীর এখন নাকি ‘ফি’। রঞ্জন উঠে এসেছে গাড়িতে, পিকোলো এদিকে নামেই না। অগত্যা আমিই পাহাড়ে চড়তে থাকি আর হাঁক পাড়তে থাকি রাতের চৌকিদারের মতন—’পিকোলো-হো-ও-ও…।’ হঠাৎ সামনে একটা ঝকঝকে ছোট লাল টুকটুকে মণির মতন দেখতে ফল। একটা লতানে টোমাটোর ধরনের গাছে ফলে আছে। নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছে না। স্ট্রবেরি যে!

হ্যালো, স্ট্রবেরি! এই জীবনে প্রথম বুনো স্ট্রবেরি দেখলুম। স্ট্রবেরি ক্ষেতে গিয়ে চাষের ফল তুলেছি ঢের যদিও, কিন্তু এটা দেখে প্রবল আহ্লাদ হল।

‘পিকোলো-হো-ও-ও!’

‘যাই-ই-ই—’ অনেক উঁচু থেকে সরু গলায় সাড়া এল। দেখি বন-বাদাড়ের ভেতর দিয়ে প্রায় চোখ-বন্ধ-অবস্থায় পিকো নেমে আসছে। বেশ খাড়াই পথ। পথই নয়—ছাগল-টাগল হয়তো উঠতে পারে। আমি ভগবানের নাম করতে লাগলুম। পিকো কাছাকাছি এসে পড়াতেই খপ্ করে পাকড়াও করলুম।—অত উপরে কী করতে উঠেছিলি? বনবাদাড় দরকার হলে তো এদিকেই ছিল?

-বনবাদাড়? বনবাদাড় দিয়ে কী হবে?

—তাহলে কোথায় যাচ্ছিলি?

—পর্বত-শৃঙ্গে।

—প-র্-ব-ত-শৃঙ্গে? মারব টেনে এক থাবড়া। ইয়ার্কির জায়গা পাওনি? কাউকে কিছু না বলে তুমি তেনজিং নোরগে হচ্ছ?

পিকোর ফ্যালফেলে চোখ দেখে হঠাৎ বুঝতে পারি ও পুরো জাগ্রতই নয়। ঐ যে ওকে বমি-নিরোধক ভ্রমণ-বড়িটি খাইয়েছি, তাতেই ঘুমের নেশা হয়েছে। নেশার ঘোরে অর্ধজাগ্রত চেতনায় ও পাহাড়ে উঠছিল। যদি পড়ে যেত? ‘পর্বতশৃঙ্গে’ ভাষাও তাই। ঘুমের মধ্যে থেকে উঠে আসা শব্দ। বাব্বাঃ! ভগবানের দয়ায় পর্বতশৃঙ্গারোহিণীকে গাড়িতে পুরে বেঁধে নিয়ে চললুম সায়নচট্টি।

সায়নচট্টি, হনুমানচট্টি

এতক্ষণ আমরা সমানে যাচ্ছিলুম ‘বরকোট’-এর পথ ধরে। পথে নওগাঁও পার হলুম। সেখানে এক পেয়ালা করে চা খাওয়া হল। বরকোটে না ঢুকে আমরা সায়নচট্টির পথ ধরে ছুটি। এই প্রথম ‘চটি’। ছেলেবেলা থেকে এই শব্দটি শুনে আসছি হিমালয়ের প্রসঙ্গে। দেবেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ, প্রবোধ সান্যাল—প্রত্যেকেই এই ‘চটি’র উল্লেখ করেছেন। এছাড়া আমি হিমালয়-ভ্রমণ-সাহিত্য কিছুই পড়িনি। এমনকি উমাপ্রসাদও পড়া হয়নি। তাছাড়া ভক্তি বিশ্বাস, শঙ্কু মহারাজ, বৈতালিক, কতজনের তো কত বই আছে। এটা লিখতে-লিখতেই নারায়ণ সান্যালের ‘পথের মহাপ্রস্থান’ বইটি উপহার পেলুম। আগে পড়ে গেলে উপকার হত। ‘-কে কী লিখেছেন জানা থাকলে সেগুলো না লিখে পারা যায়’ বললেন নারায়ণবাবু। ‘নইলে না জেনেই পুনরুচ্চারণের দোষ এসে যেতে পারে।’

আর পুনরুক্তি করলেই বা কী? এই বহু পুরাতন হিমালয়ে, এই বহু পুরাতন পথে নতুন আর কী লিখব? যাই লিখব তাই হবে পুরনো কথা। সনাতন কাহিনি। ‘সায়নচট্টি’ নামটিও আমার খুব পছন্দ হল, মুনির নামে স্থান–আর ‘চট্টি’ কেমন হয় দেখবার জন্যে চোখ আকুল হয়ে আছে। উন্মুক্ত উপত্যকাটিতে প্রথমেই চোখে পড়ে খেলার মাঠ। ইস্কুলই বোধ হয়। নাকি মিলিটারি ব্যারাক? জানি না। যাই হোক, জনমনিষ্যি নেই। মরুভূমির মতো জনহীন। একধারে চমৎকার ঝর্না, সেতু পেরিয়ে পথ গেছে হনুমানচটির দিকে। এক কাপ চা পর্যন্ত পাওয়া গেল না। অথচ শুনেছি এখানে অনেক থাকার জায়গা। ট্যুরিস্ট-লজ আছে, কালীকম্বলীওয়ালার ধরমশালা আছে। একবার ভাবলুম এখানেই থামি। আবার মনে হল, যতটা পারি এগিয়ে থাকি। যমুনোত্রীর যতটুকু কাছে সম্ভব। কাল ভোর ছ’টায় না বেরুলে সন্ধের মধ্যে নীচে ফিরে আসা যাবে না। এতদূর থেকে গিয়ে ঘোড়া-টোড়ার ব্যবস্থা করে রওনা দিতে-দিতেই ঢের বেলা হয়ে যাবে। এক বৃদ্ধ এসে হাতে একটি কার্ড গুঁজে দিয়ে গেলেন। ‘আমার ছেলে হনুমানচটিতে আছে—সে যমুনোত্রীর পাণ্ডা। পুজো দিতে হলে ওর সাহায্য নিও।’ এখানকার পাণ্ডারা তো তাহলে বেশ অন্যরকম? পুরীর মতন নয়। কার্ডে লেখা—’রামেশ্বর। তদাত্মজ ভাগীরথপ্ৰসাদ ঘনশ্যাম। জনোত্রীকে পাণ্ডা, জনোত্রী, উত্তরপ্রদেশ।’

ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ঝর্না পেরিয়ে সুন্দর পথ দিয়ে যখন হনুমানচটিতে পৌঁছোলুম পরম চা-তৃষ্ণ অবস্থায়, তখন সেখানে হাড়-কাঁপানো শীত। অজস্র বাস দাঁড়িয়ে আছে। এখানটি সায়নচটির বিপরীত। উন্মুক্ত নয়, ছোট্ট একটুখানি ঠাই, বাসে বাসে ভরা। এবং গাড়িতে গাড়িতে। এবং খচ্চরে। প্রচুর সারিবন্দী খচ্চর এবং এলোমেলো মানুষের ভিড়। বৃষ্টি, কাদা, নোংরা। এখানে থাকব কোথায়? একদিকে উঁচু পথহীন পাহাড়। অন্যদিকে নৃত্যপরা যমুনার খাদ। মাঝখানে যে একটুখানি চাতাল আছে, তাতে এইসব রকেট-পুণ্যার্থী এবং পকেট-পুণ্যার্থীদের ভিড়ে পাদমেকং জায়গা নেই। একপাশে কতগুলো সেই আবোল-তাবোলের ‘বুড়ির বাড়ি’র মতন দেখতে কাঠের নড়বড়ে ঘরবাড়ি, খুবই নোংরা দেখতে, একটির সামনে আবার লেখা ‘আনন্দভবন’। প্রত্যেকটির সামনে নিচের তলায় চায়-জিলাইবী-পুরী-পাকৌড়ে-কে দুকান থেকে কাঠের ধোঁয়া উঠে বৃষ্টির মধ্যে মিশে যাচ্ছে। খচ্চরের মলমূত্র ও কাদার মিশ্রণে ‘পূতিগন্ধময়’ শব্দটির অর্থ প্রাঞ্জল হচ্ছে। কে নামবে বাবা এর মধ্যে? আমার অত শখ নেই। থাকবোই বা কোথায় এখানে? হঠাৎ দেখি একটা উৎরাই পথ, খুব খাড়া নিচে নেমে যাচ্ছে, অল্প একটু গিয়েই আরেকটা চাতাল। সেখানে তিন-চারটে গাড়ি এবং একটি ঝকঝকে খেলাঘর প্যাটার্নের কংক্রিটের বাংলো। ‘সুরথ সিং, ঐখানে চলো ভাই।’ পড়েছি এমনই ধনবান স্টাইলে বেরিয়ে, এখন অত কষ্ট করে থাকবার কথা মাথাতেই আসবে কেন!

যমুনোত্রী যাবার ঘোড়া-খচ্চর-ডাণ্ডী-কাণ্ডী সব এখানেই মিলবে। এই হল যাত্রারম্ভের স্টেশন। অথচ এত নোংরা? এত অযত্ন-লালিত? সরকারের দৃষ্টি কেন এখানে নেই?

গুরু মহারাজ

গাড়িসুদ্ধু নিচের চত্বরে নেমে সূরথ সিং জেনে এল যে বাড়িটি একটি P. W. D. Inspection Engineer-এর কোয়ার্টার। ওটা বাংলো নয়। ভাড়া দেয় না। তখন মরীয়া হয়ে ভাবলুম, এনজিনিয়ার বাবুকেই ধরব, একরাত্রি যদি দয়া করে ঠাঁই দেন! কোথায় তিনি? রঞ্জনকে পাঠালুম খবর নিতে। রঞ্জন এসে বলল, ব্যাপার কিঞ্চিৎ গোলমেলে। ভাড়াটাড়া ছ’টার আগে হবে না। ছ’টা অবধি অন্য লোক আছে। চাবি তাদের কাছে। ছ’টার পরে দিতেও পারে—না দিতেও পারে। ওটাকে ‘দিতেই হবে’ করতে এবার পাঠান হল রঞ্জন আর পিকোলোকে। পিকো এসে বলল, ‘রঞ্জনমামা ঠিক শর্মাজির মতন করে কথা বলতে লাগল—’আরে মহাপ্রভু, ঘর দে দো দোস্ত, তুম মেরে গুরু মহারাজ, নেহি দেগাতো মর্ জায়গা—চলো, চা খায়গা? চা খাও পুরুষোত্তম, আউর ঘর খোলো।’ এই করে সত্যি সত্যি চা খেতে খেতে ঘর জোগাড় করে ফেলেছে। চল্লিশ টাকা লাগবে। আর ঐ নোংরা-টোংরা বাড়িগুলোই হচ্ছে এখানকার হোটেল। এক-একটা ঘর চল্লিশ থেকে ষাট টাকা, ঘরে খাটও নেই। কাঠের দেয়াল, কাঠের মেঝে, মেঝেয় খড় পাতা, ইলেকট্রিক নেই, বাথরুম নেই—কিচ্ছু নেই মা, ঠিক আস্তাবলের মতন তাতেই লোক থাকছে।’ ওদিক থেকে সুরথ সিং এসে জানাল : ‘ হোটেলে ঘর আছে। কিন্তু হোটেল আপনার যুগ্যি নয়। ঘরগুলো বেডরুম নয়, কিচেনের মতো। কালীকম্বলী ওয়ালার ধর্মশালা আছে, সেও মানুষ থাকার যোগ্য নয়। মাটির তৈরি ঘর, মাটির মেঝে, দরজা-জানলা নেই, একটা করে গর্ত—তা দিয়ে ঝড়জল বৃষ্টি-বাতাস সব ঢুকবে, খড় ভিজে যাবে। তাছাড়া খড়ের গাদায় শোবেনই বা কী করে? এবং বাথরুম কোথাওই নেই—হোটেলেও না, ধর্মশালাতেও না। তবে শেষেরটা ফ্রী। হোটেলে খুব খরচা।’

অতএব ‘হে মহাপ্রভু’, ‘আও মেরে গুরুজী’, এসব আরও চালাতে হবে রঞ্জনকে যতক্ষণ না ঘর মিলছে। এ ঘরের সঙ্গে অ্যাটাচ্‌ড বাথরুম আছে। ঘরে শতরঞ্জি পাতা এবং সোফা ও টেবিল আছে। অর্থাৎ এটি বসবার ঘর। শোবার ঘরটি খুলে দেবে না। সেখানে নাকি খাট পর্যন্ত বর্তমান। কিন্তু তার মালিকও বর্তমান—আপাতত যমুনোত্রীতে।

বৃষ্টি ধরার নাম নেই। ওরই মধ্যে চড়াই পথ ভেঙে নোংরা কাদার মধ্যে সারসের মতো ঠ্যাং ফেলে ফেলে কোনো রকমে সামনের ‘হোটেলে’ উপস্থিত হলুম চা খেতে। দোতলায় উঠে কাঠের রেলিং-ঘেরা বারান্দায় ভাঙা বেতের চেয়ারে বসে পড়লুম। একটি মাত্র চেয়ার। অন্যরা দণ্ডায়মান। দুটি ছেলে দেখি ভিতরের ঘরে বাংলা ভাষায় কথা বলছে। অমনি আমি চেপে ধরেছি।—’ও ভাই, কলকাতা থেকে নাকি?’ ‘হ্যাঁ দিদি, বেলেঘাটা-আপনারা?’ ‘গড়িয়াহাট।’ ছেলে দুটি আজই এসেছে—গঙ্গোত্রী ঘুরে। খুবই ভালো লেগেছে, তবে একটু ডেনজারাস হয়ে গেছে গোমুখ-ট্রিপটা!

‘আপনারা যেন গোমুখে যাবেন না—উপযুক্ত জুতোফুতো চাই, ঠান্ডাও আর্কটিকার মতন, মাথার ওপরে আজেবাজে অ্যাঙ্গেলে উটকো পাথর ঝুলে আছে, খসে খসেও পড়ছে। পায়ের নিচের পাথরও পিছল, অনবরত হড়কে যাচ্ছে—ওরে বাবারে, বড্ড স্ট্রেন হয়েছে। আগে কেদারবদ্রী গেছি, লাস্ট ইয়ারে অমরনাথ ঘুরে এয়েছি, এত টেনশনে ভুগিনি। এমনি গঙ্গোত্রী মোস্ট বিউটিফুল।’

‘গোমুখ বিউটিফুল নয়?’

‘হ্যাঁ, সে আরও বিউটিফুল হতে পারে, কিন্তু এনজয় করবার মতো শক্তি থাকে না। লালবাবার আশ্রমটি অবিশ্যি অসামান্য। ওফ্, এত যত্ন—এত যত্ন! গেলেই গরম চা হাতে ধরিয়ে দেবেন, রাত্রে হটওয়াটার ব্যাগ পর্যন্ত—কী যে আদর-আপ্যায়ন, তার তুলনা হয় না। শুধু ওটার জন্যেই যাওয়া যায়। গোমুখের উৎসটা ইন্টারেস্টিং নয়।’

‘তবে?’

‘জুতোফুতো নিয়ে আসবেন। মে মাসে আসবেন। এইরকম মিড-জুনে নয়। বৃষ্টি নামার আগেই যাবেন।’

গোমুখ আমরা এমনিতেই যাব না। কলকাতা ছাড়বার আগে মা প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছেন—গোমুখে যাবে না। যেখানে হেঁটে যেতে হয়, সব বারণ। অতএব গোবিন্দঘাট থেকে যে ভেবেছিলুম হিমকুণ্ডে যাব, শোণপ্রয়াগ থেকে যে ত্রিযুগী নারায়ণে যাব—সব নিষিদ্ধ। তবু কেন সেধে সেধে এত গোমুখের অসুবিধের তালিকা বর্ণনা শ্রবণ? রঞ্জনকে শোনানোর জন্যে। সে খেপেছে গোমুখ যাবে।

আমি যেতে দিতে রাজী নই, তাহলে তিনদিন গঙ্গোত্রীতে থাকতে হবে। তাছাড়া রঞ্জনের শরীরও দুর্বল, ছেলেমানুষী ঝোঁকের পাল্লায় পড়ে অসুখ করলে এই যাত্রা পণ্ড। বৌদি-রিনিমার মতো শক্ত হয়েছি—’গোমুখ হবে না।’ তখন ঘরগুলো দেখলুম। সত্যি মিরাল। ছ’ বাই আট ঘরে ছ’জন-আটজন মানুষ। উঃ! এখানে থাকবার মতো অত পুণ্যের জোর আমার নেই।

খচ্চর-কাঁহাকা

গাড়িতে গিয়ে পুরী-আলুর দম সদ্ব্যবহার করতে গিয়ে দেখি সারাদিনের গরমে আলুর দম পচে গেছে। পুরী শুকিয়ে নেড়ো বিস্কুট। আলু ফেলে দিয়ে ফ্লাস্ক দিয়ে রঞ্জনকে পাঠালুম চা আর কলা কিনে আনতে। তাই দিয়ে পুরী ঠেলতে হবে গলায়। খাবারের বাক্সে দেখি গেস্ট-হাউস থেকে গুপ্তাজি তিন প্যাকেট ডালমুট, তিন প্যাকেট বিস্কুট, একটিন ল্যাকটোজেন, কিছু মৌরি আর মিছরি, কিছু চিনি দিয়েছেন। ডালমুট ও বিস্কুট খাওয়া শুরু হয়ে গেল। পুরী পড়ে রইল।

ঘর ছ’টার সময় খালি হল। মালপত্র কিছু গাড়িতেই রইল। গাড়ি উঠোনেই পার্ক করা। সুরথ সিং গাড়িতেই ঘুমোবে। তার সঙ্গে আছে তার ঘরে তৈরি নিজের পোষা ভেড়ার লোমের ধবধবে সাদা দুটি গাড়োয়ালি কম্বল। ঠান্ডা যতই পড়ুক ওই যথেষ্ট, দুটো হাত পুরো পুলোভারও আছে তার। সুরথ সিং চা খেতে গিয়ে রাত্রে খেয়ে এল। আমাদের খাওয়াটা ঠিক জমলো না। তবু কেউই যেতে চাইলুম না ঐ হোটেলে। বাংলোর বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি। রঞ্জন আর তার প্রভুজী চা খেতে গেছে। তিনজন বাঙালিনী মাঝবয়সী মহিলা এলেন। আমি এগিয়ে গিয়ে আলাপ করি। প্রত্যেকের পরনে সুতী তাঁতের শাড়ি। একজনের রঙিন, দুজনের সাদা। এঁরা ‘রাখী ট্র্যাভেলসে’র সঙ্গে এসেছেন—একজন কলকাতার, বাকি দুজন মফঃস্বলের মানুষ, প্রত্যেকেই যে যার পরিবার থেকে একাই বেরিয়েছেন। দুজন বিধবা না কুমারী বুঝতে পারিনি, কিন্তু একজন সধবা। এঁরা আগে অমরনাথে গেছেন, যমুনোত্রী যেতে ওঁদের ভয় নেই, চার-ধামেই যাবেন। খচ্চরে চড়ে উঠবেন যমুনোত্রী ও কেদার। বদ্রীনাথে পুরোটা গাড়ি যাবে। গঙ্গোত্রীতে তিন কিলোমিটার হাঁটতেই হবে। ‘খচ্চরে চড়ে গেলে কোনো কষ্টই নেই।’

একজন বললেন, ‘শুধু একটু গায়ে ব্যথা হতে পারে।’ আরেকজন বললেন, ‘অনভ্যাসের দরুন।’ ‘ও-ব্যথা চলে যায়।’ তৃতীয়জন বললেন। আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘খচ্চর থেকে পড়েটড়ে যাব না তো?’

‘হ্যাঁ, তাও যেতে পারেন।’ প্রথমজন উত্তর দেন। ‘আমার খচ্চরটাই তো পড়ে গিয়েছিল আমার ওপরে।’

‘আপনার ওপরে? তার মানে?

‘মানে আমিও খচ্চর থেকে পড়ে গেলুম, খচ্চরটাও পা পিছলে পড়বি তো পড় আমার বুকের ওপরে পড়ে স্রেফ অজ্ঞান হয়ে গেল। আর তোলা যায় না।’

‘কে অজ্ঞান হয়ে গেল?’

‘খচ্চর, খচ্চর। ব্যাটা পড়ে আছে অজ্ঞান হয়ে, নড়ছে না। হঠাৎ দেখি পিট পিট করে তাকাচ্ছে। তখন ওকে টেনেহিঁচড়ে তোলা হল।’

‘আর আপনাকে? আপনার কিছু হল না?’

‘আমার খুব গায়ে ব্যথা হল। সঙ্গে ডাক্তার ওষুধ সবই ছিল—তাই কিছু হয়নি।’

‘উঠলেন অমরনাথে তারপরে? ঐ একই খচ্চরে চড়ে?’

‘হ্যাঁ, ঐ খচ্চরেই উঠলুম অমরনাথে।’

‘ভয় করল না?’

‘ভয়ের কী আছে? খুব শিওরফুটেড অ্যানিম্যাল বলেই তো ওদের ব্যবহার করে।’ ‘আমরাও খচ্চর নেব ভাবছি।’

‘খরচা কত জানেন?’

‘শুনেছি ১১০/১২০ মতন। দর করতে হয়।’ এমন সময়ে বাসে ভোঁ। ওঁরাও ছুটলেন। ‘বাসে করে কোথায় যাচ্ছেন এখন?’

‘বাসে নয়, হোটেলে যাব। সবাইকে ডাকছে আর কি জড়ো হতে।’

ঘরওয়ালা

রঞ্জনের প্রভুজী বড়ই সুন্দর দেখতে, বছর বাইশ-তেইশের একটি তরুণ। জানা গেল ঐ হোটেলটি ওরই দাদার এবং ওদের অনেক খচ্চর আছে। ওরাই খচ্চর পাঠাবে সকালে ১১০ করে এক-একটা। রঞ্জন বলল, হেঁটে উঠবে। পিকো হেঁটে উঠতে পারবে না, তার কোমরে হাঁটুতে ব্যথা, ব্রুফেন খেতে খেতে চলেছে দিনে তিনবার করে।

আমরা শোব কিসে? খাট-বিছানা কিছুই তো নেই। ধরো গুরুজীকে। গুরুজী বললেন, কুছ মুশকিল নহী, আ জায়েগা বিস্তারা। তিন রাজাই তিন গদ্দা! আমাদের সঙ্গে আছে গেস্ট-হাউসের তিন কম্বল তিন চাদর ও তিন তাকিয়া। আর দ্যাশ থিক্যা আনসি দুইডা কম্বল। এটা স্লিপিং ব্যাগ। এটা আমার জন্যই ধার করেছিলুম, আর কম্বল দুটো ওদের জন্য লাস্ট মোমেন্টে নিয়ে এসেছি। গুরু মহারাজের ভৃত্য গিয়ে পরিষ্কার মার্কিনের ওয়াড় পরানো গদি লেপ এনে দিল, গদি ২ লেপ ১ হিসেবে এবং তিনটে মোটকা মোমবাতি কেনা হল, সারারাত জ্বেলে রাখা দরকার। এসব অঞ্চলে খুব পোকামাকড় আছে। ওডোমস আনা উচিত ছিল এবং পোকার স্প্রে-ও। আমাদের অবিশ্যি মশা বা পোকায় কামড়াচ্ছিল না, কামড়াচ্ছিল শীতে। দুপুরের গা-গুলোনো বমি-পাওয়া গরমটাকে দুঃস্বপ্ন মনে হচ্ছে। বৃষ্টি ও ঠান্ডা বাতাসে মর্মভেদী অবস্থা। যমুনা এখানে খরস্রোতা ঝর্না, বেশ ঝকঝকে নির্মল; রেলিংয়ে দাঁড়িয়ে যে একটু দেখব, ঠান্ডার চোটে তারও উপায় নেই। ঘর থেকে বেরুনো যাচ্ছে না। জানলা একটি তার একটা কাচ ভাঙা। সেখানে একটা ব্যাগ রেখে কিছুটা সামাল দেওয়া গেল। ঘরে ঐসব গদ্দা পেতে ফেলতেই ঘর ভর্তি হয়ে গেল। বালিশ, চাদর, লেপ, কম্বল দিয়ে চমৎকার লোভনীয় দুটি বিছানা করে ফেললুম। একটি চওড়া—তাতে মা ও মেয়ে। তাদের মাথার কাছে একটি সরু—তাতে মামাবাবু। ইংরিজি T অক্ষরের মতন। এভাবে ছাড়া অতটুকু ঘরে জায়গা নেই। সবে বিছানা করে শুয়েছি, হঠাৎ রঞ্জন বলল, দিদি? একটু আস্তে করে উঠে পড়ে ডানদিকে সরে এস তো পিকোকে নিয়ে।

-কেন? এখন পারব না।

–এসো না? আস্তে করে ঘর থেকে বেরিয়ে যাও যদি, সেটাই বেস্ট।

-কেন?

–প্লিজ, দেরি করো না। একটা কিছু দেখেছি—বেরিয়ে পড়, বলছি। ওর গলায় কী ছিল, পিকো এবং আমি উঠে গায়ে সোয়েটার জড়াতে জড়াতে বেরিয়ে পড়ি ছিটকিনি খুলে। রঞ্জন একপাটি জুতো হাতে করে ঢোকে। আমি ওর পিছু পিছু ঢুকেই ‘ঈ ঈ ঈ ঈ ক্ ক্ ক্’ করে এক নারকীয় চিৎকার করে ঘর ছেড়ে পালাই পিকোকে টেনে নিয়ে। ঘরের দেওয়ালে মোমের আবছা ভূতুড়ে আলোয় একটা ইয়াব্বড়া রোঁয়াওয়ালা কালো কুচকুচে মাকড়সা। এখনও সেই দৃশ্য মনে পড়লে হাত-পা এলিয়ে পড়তে চায়। পিকো সাহসী হবে বলে জুতোর পাটি হাতে চৌকাঠের কাছে দাঁড়াল, রঞ্জন সেই ছুটন্ত মাকড়সাকে তাড়া করে শেষ পর্যন্ত মারল। বাব্বাঃ, বাঁচলুম! রঞ্জন না দেখে মধ্যরাত্রে ওটিকে আমিই যদি দেখতুম বা উনিই যদি আমাদের দেখাশুনো করতে আসতেন, তবে কী হত ভাবা যায় না! আরশোলার চেয়েও মাকড়সা বেশি ভয় করে আমার এবং এটাকে ভয় না পাবে, এমন মানুষ কমই আছে। রঞ্জন মোমবাতি এবং টর্চ নিয়ে আঁতিপাতি করে ঘরের কোণাঘুপচি সব খুঁজল—ওর মতোই আর কোনো বাসিন্দা আছে কিনা এ-ঘরে। না পেয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে বড় মোমটি জ্বেলে রেখে ফের লেপের তলায় ঢোকা এবং ঘুম।

নিশি-কুটুম্বিতা/রাতের অতিথি

মধ্যরাত্রে ঘুম ভাঙল। প্রচণ্ড হৈ-চৈ হচ্ছে বাইরে। এত কথাবার্তা চেঁচামেচি কারা করছে? বকুনি দিতে হবে তো! একটু দ্যাখ তো রঞ্জন? রঞ্জন দোর খোলামাত্র একদমক ঠান্ডা বাতাস হাড়ে হাউ-ডু-ইউ-ডু বলে গেল। এবং অল্প আলোয় দেখলুম বারান্দা ভর্তি মানুষ। নারী শিশু বৃদ্ধ। কী ব্যাপার? বান ডেকেছে নাকি? না, এঁরা যমুনোত্রীর যাত্রী। নওগাঁও থেকে এসেছেন। থাকার জায়গা নেই, বৃষ্টি থেকে বাঁচতে বারান্দায়। রঞ্জন জিজ্ঞেস করল, ‘ওদের ভেতরে এসে বসতে বলি, দিদি?’

‘নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই।’ প্রথমে অবিশ্বাসী, অবাক—তারপরে ধন্য হয়ে ঘরে ঢুকে এল ন’জন নারী, দু’জন পুরুষ। রঞ্জন টেনেহিঁচড়ে সোফাগুলো বারান্দায় বের করে দিল ফোমের কুশনসুদ্ধু, চৌকিদারকে ডেকে বলল কুশনগুলো তুলে রাখতে, সোফা বের করতে যে একফালি ঠাঁই হল, সেখানে ঝটপট ভোটকম্বল বিছিয়ে সারিবন্দী উবু হয়ে বসে পড়ল মেয়েরা। তারপর শুরু হল তাদের গল্প। গল্পের মধ্যে প্রধান হয়ে উঠল একটিই শব্দ, ‘ভোখ্ লাগা।’ আমাদের খাদ্যের বাক্স গাড়িতে কিন্তু ঠোঙাভর্তি পুরী আর কলা আছে। উঠে পুরীর ঠোঙাটি আর কলা এগিয়ে দিলুম, ‘জুঠা নেহি, আপ লোগ লে সকতে হেঁ।’ তারা প্রচণ্ড খুশি হয়েই ‘জয় যমনা মাঈকি’ বলে গ্রহণ করল এই সামান্য বস্তুটি। যা আমরা খাবার যোগ্য বলে মনে করিনি। আলুর দম অবিশ্যি দিতে পারলুম না, ওটা পচে গেছে। পুরীটা বড্ড শক্ত বানিয়েছে এবং তরকারি নেই বলে খেতে পারিনি। কিন্তু ওদের খেতে কষ্ট হল না, ‘ভোখ্’ এমনই বস্তু।

ছোট্ট ঘর। তিনজনের পক্ষেই ছোট—সেখানে যে এখন চোদ্দজন। যদি হও সুজন—! এতগুলি মানুষ নিজেদের গুটিয়ে নিয়ে খুব কম জায়গায় কী করে যে বসে আছে আমার অবাক লাগছে।

অসভ্যের মতো আমরা শুয়ে আছি। ‘এই বিছানায় এসে শোও’ বলবার মতো উদারতা আমার নেই। অনেকবার ভেবেও কিছুতেই বলতে পারলুম না। এজন্য খুব খারাপ লাগছিল নিজেকে। ওদের গায়ে অতি জীর্ণ, ছিন্নভিন্ন কাপড়চোপড় সবই সুতীর, জোড়াতালি দেওয়া, হতদরিদ্র গ্রাম্য চাষী পরিবার। একজন বৃদ্ধা আছেন, তাঁর হাঁপানির টান আমার চেয়ে বেশিই এই মুহূর্তে। একটি বউ আছে, বুকের মধ্যে কয়েক মাসের শিশু। পুরুষ দুজন—একজনের বয়স হয়েছে, আরেকজন যুবক। বাকীরা নানা বয়সী মেয়ে। এত অল্প জামাকাপড় নিয়ে (কোনো গরম জামা কি গরম চাদর কারুরই নেই) এরা কী করে অত ঠান্ডায় যাবে?

‘তোমরা কি প্রতি বছরেই যাও?’

বুড়ো বললে, আমি যাই। এরা সবাই আমার সঙ্গে যাচ্ছে। অনেকেই অবশ্য অনেকবার গেছে। সবই নওগাঁও গ্রামের। একসময়ে কথাবার্তা ফুরুল। সবাই ঘুমিয়ে পড়লুম। ভোর হবার আগেই আমাদের রাতের অতিথিরা যাবার জন্যে তৈরি। বুড়ি আমাকে ডেকে তুলে বললে, তোমার অনেক দয়া। তুমি দোর খুলে না দিলে ঠান্ডায় জমে মরে যেতুম-রাতে খিদের সময় তুমি পুরী খেতে দিয়েছ, নিজের ঘরে শুতে দিয়েছ, তোমার তীর্থযাত্রা সার্থক হবেই। আজ হমলোগ ইতনা বারিষমে তো জান্‌সে মর যাতা থা। বাচ্চা বুঢ়া লে-কর মাথেপর ছজ্জা নাহি, গাওপর আচ্ছাদন নাহি—, তুম সবকুছ দিয়া। নামাঈ তুমহারা ভালা করে।’

বিলিতি থ্যাংকিউকে হার মানিয়ে দেওয়া এই গ্রাম্য সৌজন্যে আমি লজ্জায় মরে যেতে থাকি। দুটো কম্বল একটা লেপেও হি হি করে কেঁপেছি। সারারাত সোয়েটার পরে মোজা পরে মাথায় মাফলার বেঁধে শুয়েছিলাম, তবুও। আর ওদের একটা কম্বলও অফার করিনি। যা খেতে পারিনি নিজেরা, তাই ওদের খেতে দিয়েছি ‘উড়ো খৈ গোবিন্দায়’ করে। ঘরটুকুতে বসতে দেওয়া ছাড়া কিছুই করিনি। দিতে পারতুম কম্বলের ভাগ। কিছুই দিইনি। তবুও এত প্রশংসাবাক্য শুনে কৃমিকীটের মতো লাগছে নিজেকে। ওরা এখন রওনা হলে বাঁচি। শীত এখনও যথেষ্ট। তবে বৃষ্টিটা ধরেছে।

ভোরের অতিথি

যমুনামাঈ-এর জয়ধ্বনি দিয়ে ওরা রওনা হয়ে গেল। আমরাও উঠে পড়ি। কিন্তু বাথরুমটি ভেতর থেকে বন্ধ। এ কী করে হয়? হয় হয়। গুরু মহারাজ এবং এ-বাড়ির চৌকিদার মহারাজের যুগ্ম মদতে হয়। ঐ হোটেলগুলোর তো বাথরুম নেই। মহিলাদের জন্য এটা খুলে দেওয়া হচ্ছে। ওপাশে একটা দরজা আছে না মেথর যাবার? সেটার বাইরে তালা, ওদের হাতে চাবি। ওরা সেটা পয়সা নিয়ে ব্যবহার করতে দেয়। অগত্যা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে নিজেদেরই অ্যাটাচ্‌ড বাথরুমে ঢোকবার টার্ন নিতে হল। গুরুজীর স্লোগান : ‘কুছ ফিক্ মত করো বিবিজী, সব ঠিক হো জায়েগা।’ রঞ্জন চৌকিদারকে দিয়ে ফ্লাস্কে ভরে চা আনাল। বিস্কুট-চা খেয়ে বিছানাপত্র গাড়িতে তুলে রওনা দিতে গিয়ে খেয়াল হল সোফার ওপর আমার শালটা আর তোয়ালে ছিল—কোনোটাই নেই। সোফা তো রাত্রে বাইরে ছিল। কারা নিয়ে গেছে কে জানে? প্রথমে প্রচণ্ড রাগ হল রঞ্জনের ওপর। ভালমানুষী করে সোফা বের করলি, শালটা তোয়ালেটা নামিয়ে রাখলি না! সঙ্গে আর মাত্র একটা তোয়ালে আছে, শাল নেই। যাত্রারম্ভেই অলুক্ষুণে কাণ্ড। রঞ্জনটার যদি কাণ্ডজ্ঞান থাকে!

তারপর মনে হল, যদি ওই নওগাঁওয়ের অতিথিদের সঙ্গে ভুল করে চলে গিয়ে থাকে তাহলে অবিশ্যি খুবই ভাল হয়। কিন্তু তা কি আর হবে? নিয়েছে ঠিকই চৌকিদার, কুশনগুলো তুলতে এসে। যাকগে, সেও বেশ গরীব লোকই। কুলুর শাল। হিমাচলের জিনিস হিমাচলে থাকুক।

জয় যমুনা মাঈকি

চা খেতে খেতে যমুনাকে গুড মর্নিং করতে গিয়ে আমরা অবাক। আরে কোথায় সেই স্বচ্ছসলিলা ঝর্না! এক রাত্রের বর্ষণেই তার রং গেরুয়া হয়ে গেছে। আশপাশ থেকেও আর দু’একটা সরু ঝর্না নামতে শুরু করেছে। আমাদের গুরু মহারাজ এসে গেছেন, সঙ্গে এক ঘোড়াওলা। তার নাম কুন্দন সিং। আমাদের এখন হেঁটে হেঁটে ঘোড়া পর্যন্ত যেতে হবে। সেই মল-কদমাক্ত পূতিগন্ধময় নরক পার হয়ে।

দুটো সোয়েটার, ছাত্রাবস্থার একটা ডা কোট, দু’ জোড়া মোজা, টুমপীর পি. টি. শুজ এবং মাফলারে নিজেকে বেশ সুরক্ষিত মনে হচ্ছে। পকেটে চামড়ার দস্তানাও আছে। পেনটুলুন যদিও আছে সঙ্গে, ঘোড়সওয়ার হবার উদ্দেশ্যেই শিবু ভরে দিয়েছে বাক্সে। কিন্তু এখানে বড্ড বেমানান লাগবে মনে হল। রঞ্জন আর পিকোলো দুটি ভাইয়ের মতন সেজেগুজে রেডি। শার্টপ্যান্ট, নতুন কেড্‌সজুতো, সোয়েটার, মাফলারে কোটে—খুব স্মার্ট। পিকোর মাথায় আবার স্কার্ফ

স্কার্ফ মানে ৫ মিটারের এক মিটার নীল সুতি ছিট্‌ হৃষীকেশ বাজার থেকে কিনে মাঝখানে লম্বালম্বি ছিঁড়ে আধখানা করে নিয়েছি : স্কার্ফ। মা-মেয়ের চুলে বাঁধবার জন্যে। মাকে যাতে গাঁইয়া এবং মেয়েকে যাতে মেমসাহেব মনে হচ্ছে।

যমুনা আর হনুমান গঙ্গার মিলনক্ষেত্র এই হনুমান চটি। সেই সঙ্গমটা যে কী অপূর্ব! দুটি রাগী পার্বত্য ধারা ফুঁসতে ফুঁসতে এসে মিশছে—জলটা যেন ফুটছে—পাথরে, জলে, ফেনায় ছিটিয়ে আশ্চর্য এক চেহারা। আমি ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে বললুম, ‘একটা ছবি তুলি।’ রঞ্জন এবং পিকো বললে, ‘এখন থাক, পরে।’ ফলে ছবি তোলা হয়নি। ফিরেছি বৃষ্টিতে, সন্ধ্যার ম্লান মন-খারাপের মধ্যে।

অস্বস্তিতে যমুনোত্রীর পথে রওনা হলুম। ব্রিজটি পার হয়েই দুটি খুদে খুদে খচ্চরের পিঠে চড়িয়ে দিলেন মহারাজ। কুন্দন সিং একটার সঙ্গে আর অন্যটার দড়ি ধরে আছে খুদে গুড়গুড়ে এক বালক। রবীন্দ্র সিং তার নাম। খচ্চরের পিঠে বসে মনে হল পড়ে যাচ্ছি, পড়ে যাবই, পড়ে যাওয়া থেকে নিস্তার নেই, মাধ্যাকর্ষণ যেন ডাকিনী মায়া হয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরেছে। অথচ ঘোড়ায় বহু চড়েছি, কিন্তু খচ্চরে চড়িনি। এ খচ্চরের সাইজ আবার গাধার মতন। পিকোকে বেশ মানিয়ে গেল। যেন চিরকাল ও এভাবেই জীবন যাপন করেছে—যা দেবী সর্বভূতেষু খচ্চরপৃষ্ঠে আরোহিতা। রঞ্জন স্মার্টলি লাফিয়ে পাহাড়ের পথে চলল। এই ডানদিকে হনুমান গঙ্গার খাদ, বাঁদিকে পাহাড় কেটে রাস্তা। মাথার কাছে পাথরের চাঁইগুলো ঝুলে আছে। ‘শির্ বঁচাকে, শির বঁচাকে’ বলে সতর্কবাণী হাঁকছে সব ঘোড়াওয়ালা। একটু পরে পথ বাঁক নিল। বাঁহাতে এল গভীর খাদের মধ্যে যমুনা আর ডানদিকে পাহাড়। পথ চওড়া খানিকটা, বড় বড় গাছের ছায়ায় ঢাকা। ফুলে ফুলে পথ ছেয়ে আছে। কী ফুল! কী ফুল! মন্দার। দেখতে ঠিক চেস্টনাট গাছের মতো। ফুলও। কী ফুল বললে? মন্দার। ‘এই তবে মন্দার তরু?’ দেশের মমাদারি গাছ, বিদেশের চেস্টনাট ট্রি আর এই মন্দার—এরা কি সব একই গাছ? কে বলে দেবে? মন্দার পুষ্প বড় সুশ্ৰী।

হেলে, ঝুঁকে

পথটি শুল্ক শ্যামল, ঝোপঝাড় গাছপালা, ফুলে ফুলে ভর্তি। পিকো কেবলই হাত বাড়িয়ে ফুল তুলছে। আমি দুই হাতে খচ্চরের পিঠের আসনের একটা কোণা প্রাণপণে চেপে ধরে আছি, যাতে পড়ে না যাই। লাগাম-টাগাম, রাশটাশের বালাই নেই বলে ব্যালান্স রাখা খুব শক্ত। কুন্দন সিং যত বলে উৎরাইয়ের সময়ে পেছনে হেলে থাকতে হবে, আর চড়াই ভেঙে ওঠার সময়ে ঝুঁকে থাকতে হয়—আমার কিছুতেই মনে থাকে না। কেবলই উল্টোপাল্টা হয়ে যায়। প্রধান শত্রু পেছনেই আছে। কেবলই চেঁচায়—’এবার ঝুঁকে, এবার হেলে।’ মাকে জ্ঞান দিতে পেরে তার স্বর্গীয় আহ্লাদের ফোটো খিচকর রাখা আছে।

খচ্চর আমার বুকের ওপর চার ঠ্যাং মেলে শুয়ে পড়ে অজ্ঞান হয়ে যায়নি ঠিকই, কিন্তু আমার অবস্থা শ্রীরাধিকার মতো। প্রতি অঙ্গ কাঁদে মোর প্রতি অঙ্গ লাগি। এই শীতেও ম্বেদ-কম্প সব কিছুই দেখা দিয়েছে এবং দুই পায়ের ডিমে ক্রমাগত সপ্রেম রামচিমটি কাটছে খচ্চরের স্যাডলের বেল্ট। পা ঢোকাব কোথায়? রেকাব নেই। যে নেয়ারের দড়িটি ঝুলছে, তার ফাসের মধ্যে পা গলাতে হবে। পা এদিকে ফিট্ করছে না। ফাঁসটাস ঢের নিচে। পায়েরা আপনমনে ঝোঝুল্যমান, পায়ের নিচে ‘মাটি’ তো নেই-ই, রেকাব দড়ি ফাঁস কিছুই নেই, বিশুদ্ধ পার্বত্য বায়ু খেলে যাচ্ছে। ফলে আমার আত্মবিশ্বাসের কিঞ্চিৎ অভাব দেখা দিয়েছে। পিকোর হাতেও সিট আঁকড়ানো, কিন্তু পা রেকাবে ভরা আছে, তবু রক্ষে। আমার ক্ষেত্রে ঈশ্বরই একমাত্র সাপোর্ট, কেননা হাতেও সাপোর্ট নেই, পায়েও সাপোর্ট নেই। খচ্চরটি অবশ্য আমার চেয়ে ঢের বেশি ভদ্রমহিলা। তার নাম যী। সে তার গতিপথ ভালরকম চেনে এবং মনিবের সব কথাই বশংবদ কুকুরের মতো ভক্তিভরে মানে। অত্যন্ত ভয়ে কাঁটা হয়ে যাচ্ছি। বাঁদিকে যমুনার খাদ।

সুন্দর দৃশ্য নিশ্চয় আছে, কিন্তু দেখবার সুযোগ নেই। ঝুঁকে এবং হেলে, হেলে এবং ঝুঁকে, স্যাডল আঁকড়ে এবং সামনে দেখে চক্ষু কর্ণ পেট পিঠ ঘাড় কাঁধ হাত পা প্রত্যেকটি অঙ্গের যথাযথ অস্তিত্ব সম্পর্কে ক্রমশই উত্তরোত্তর নিঃসন্দেহ হয়ে উঠছি। ব্যথায় ব্যথায়। সামনে হঠাৎ দেখলুম তিনটি গাছের মোটা মোটা শেকড়। তার ওপর দুয়েকটা পাথর-পথ বলতে এই। তলা দিয়ে যমুনার লীলা-চাঞ্চল্য দেখা যাচ্ছে, খচ্চরের পা তার ওপর পড়ছে দেখেই ‘চক্ষু মুদিয়া ইষ্টনাম জপ করিতে লাগিলাম’। তারপর পেছন ফিরে দেখলুম মেয়ে আছে, না নেই! আছে! রঞ্জন হেঁটে আসতে আসতে অনেক পেছিয়ে পড়েছে।

প্রচুর জাঠ আর রাজস্থানী যাত্রী। কী বর্ণবৈচিত্র্য! গাঢ় হলুদ, গাঢ় লাল, ম্যাজেন্টা, ঘন নীল। ঘাঘরার আর ওড়নার মধ্যে দেখছি এই রংগুলিরই প্রাধান্য। পায়ে কেড্স অথব নাগরা জুতো। কেউ কেউ কেডসের পেছনটা কেটে চটিজুতো বানিয়ে নিয়েছে। জুতোর ওপর মোটা মোটা রুপোর ঝমর ঝমর মল বাজছে। হাতে মোটা বালা, কঙ্কন, রঙিন গালার ওপর হীরের মতন : কাচবসানো চুড়ি। কী সুন্দর সব অলঙ্কার! আভরণ সত্যিই যে মানুষকে কত সুন্দর করে তা আরেকবার নজরে পড়ল। বৃদ্ধাদেরই গায়ে বরং রূপোর ভার ঢের বেশি। অল্পবয়সীদের মল চুড়ির মতো সরু হয়ে এসেছে। তাদের গলার হারও সরু। বৃদ্ধাদের গলায় মোটা মোটা হাঁসুলি, সীতাহারের মতো গয়না শার্টের বুকের ওপর লুটিয়ে আছে। ঘাঘরার সঙ্গে শার্ট পরাই এদের স্টাইল। আর কাঁচুলিও আছে। বুকের মধ্যে ওড়না গোঁজা। মাথায় তোলা। ভোম্বল কাঁধে। প্রত্যেকের হাতে লাঠি। রঞ্জন লাঠি নিতে ভুলে গেছে। অনেকক্ষণ ওকে দেখা যাচ্ছিল। একসময়ে হারিয়ে গেল।

এই জায়গাটার নাম কী গো?

পথটা অসহ্য সুন্দর। অনেকক্ষণ বাদে একটা উপত্যকায় এলাম। গম হচ্ছে, যব হচ্ছে, ধানও হচ্ছে—ছোট ছোট বারান্দার মতো কোণাচকাটা প্লটে। রাস্তা চওড়া হল। এখানে দু’একটা ধর্মশালা আছে। কালীকম্বলীওয়ালার উঠোনে একটি কচি বউ কাপড় কাচতে কাচতে বলে উঠল, ‘এই জায়গাটার নাম কী গো?’ খালি গায়ে ধুতি পরা এক ভদ্রলোক গামছা শুকোতে দিতে দিতে হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, ‘ফু-উ-উল্, চো-ও-ওট্টি।’ বুকের পৈতেটা দেখা যাচ্ছে।

হঠাৎ খাস বাংলা কথা শুনে প্রাণ জুড়োনো, মুহূর্তের জন্যে ভুলে গেলুম খচ্চরে বসে আছি, চারিদিকে হিমালয় ঠিক কলকাতার মতো চিরচেনা বোধ হল। তারপরেই দেখতে পেলুম সেই দাঁড়কাকটাকে এবং খেয়াল হল, এতক্ষণ একটাও পাখি দেখিনি। এত গাছগাছালির ভেতর দিয়ে এলুম, একটা পাখির ডানার শব্দ একটা পাখির ডাক কানে যায়নি। আশ্চর্য তো! আর দেখিনি বেড়াল। সেই জগৎ সিংহের দৃষ্ট অলক্ষুণে বেড়ালের পরে দেরাদুন থেকে ফুলচটি অবধি একটাও বেড়াল দেখিনি, কেবল কুকুর আর কুকুর। ফুলচটির পর রাস্তা কিছুটা সহজ হল খানিকক্ষণ।

পাহাড়ের গায়ে সারাপথে নানান উপদেশ লেখন। বেশির ভাগই সরকারী উপদেশ—স্বাস্থ্যবিভাগ থেকে, পি. ডব্লু. ডি. থেকে, গাড়োয়াল মণ্ডল বিকাশ নিগম থেকে। তেড়ে যাত্রীদের জ্ঞান দিয়েছে। রাস্তার মাঝে মাঝে ছোট্ট ছোট্ট সাদা রং-করা ক্যানভাসের হাফঘর (চার ফুট বাই আড়াই ফুট হবে)—তার গায়ে বড় বড় (দুই বাই এক) হরফে লেখা শৌচাগার, মূত্রালয় ইত্যাদি। তার ওপরে মহিলা পুরুষও চিহ্নিত আছে। এবং কাছ দিয়ে যাবার সময় নাকে কাপড় দিতে হয়। জলের কোনো বন্দোবস্ত দেখিনি। ঝাড়ু বালতি সমেত কোনো মূর্তিও চোখে পড়েনি। তবে পাহাড়ের গায়ে অনবরত লেখা আছে টিকে নেবার কথা, কলেরার ইনজেকশন নেবার কথা। লেখা আছে ‘লেবু খাও, রোগ থেকে বাঁচবে’ বা ‘চলতি পথে যাত্রীদের সাহায্য করুন’’দাস্তবমির ওষুধ এক্ষুনি খাও, দেরি করো না।’ ওষুধটা দেবে কে? পথে স্বাস্থ্যবিভাগের কোনোই আপিস চোখে পড়েনি। এমন কি কোনো ফার্স্ট এড আপিসও না। অথচ কী কঠিন পথ, কত যাত্রীই তো অসুস্থ হয়ে পড়ছেন! প্রধানত বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা গ্রাম থেকে আসেন এখানে, স্বাস্থ্যবিভাগের স্লোগান তাদের রক্ষাকর্ম কতটা করতে পারে কে জানে? এই জন্যই বোধ হয় স্বাস্থ্যবিভাগ থেকে প্রায়ই লেখা হয়েছে—’ভগবান আপকো যাত্রা সফল করে।’ (কেননা আমরা সাহায্য করতে পারছি না। )

জাকীচটিতে ইস্কুল আছে, গ্রাম্য বালক-বালিকারা যায়। সুরথ সিং গাড়ির পথে আসতে আসতে বলেছিল বটে। বহুগুণাজী হিমাচল প্রদেশের বহু উপকার করেছেন। এইসব ভালো মোটর রাস্তা বানিয়ে দিয়েছেন, গ্রামে গ্রামে বিজলী বাতি এনেছেন, প্রতি পাঁচ কিলোমিটারে ফ্রি ইস্কুল হয়েছে, হাসপাতালের মতো ছোটখাটো স্বাস্থ্য-অফিস বানিয়েছেন (সারাপথ লাল ত্রিকোণ, দো ইয়া তিন ইত্যাদি দৃশ্যমান) এবং পোস্ট অফিসও এনেছেন। সবচেয়ে ভাল কাজ করেছেন—গ্রামে গ্রামে ব্যাঙ্ক বসিয়েছেন। এই ব্যাঙ্কগুলো পাহাড়ীদের ঋণ দেয়। তাইতে কেউবা ছাগল ভেড়া কেনে, কেউ চাষের যন্ত্রপাতি কেনে, কেউ দোকান খোলে। মোট কথা হিমাচলের গ্রামে কেউ আর কাজের অভাবে বসে থাকে না। সব বাচ্চারাই ইস্কুলে যায়। একা নাকি বহুগণার গুণেই।

জান্‌কীচট্টি আ গয়া

জাকীচটিতে প্রচুর দোকানপাট, সবাই চা-জিলিপি আর গরম গরম পকৌড়া বিক্রি করছে। আমরা পথে যেতে যেতে দেখলাম দুটি ছিপছিপে বাঙালী মহিলা, ছাপা লালপাড় সুতী শাড়ি আর সাদা ব্লাউস পরনে, কোমরে সোয়েটার বেঁধে কেড্‌স পায়ে দৌড়চ্ছেন। লাঠি হাতে প্রায় দৌড়েই জাকীচটি পৌঁছে যাচ্ছেন। পথে আরেক জায়গায় একজন টাকমাথা তরুণকেও দেখেছি ট্রেকিং স্যুট পরে লাঠি হাতে ছুটতে। একটু পরে তাঁকে দেখি বাঁকের মুখে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন। পিঠে হ্যাভারস্যাক, হাতে লাঠি, কাঁধে ফ্লাস্ক। কম্বল কাঁধে পুঁটলি মাথায় নাগরা পায়ে চাদর গায়ে দলে দলে মানুষগুলির মধ্যে রীতিমতো বেমানান একক। যেন শোভাযাত্রা করে চলেছে এই রঙবেরঙের মেয়েপুরুষের গ্রাম্য জনতা। এই আদিম পাহাড়, আকাড়া বন, এই উদ্দাম ঝর্না, এই অযত্নে গড়া পথ—এর মধ্যে এরাই ঠিক মানিয়ে যাচ্ছে। পথের বাঁকে-বাঁকেই বিশ্রাম করছে পুঁটলি নামিয়ে। দেখা হলেই জয়ধ্বনি—জয় যীজি কী, জয় জামাঈকী। ঘোড়ায় (খচ্চরে) চড়া মানুষগুলি উত্তরে প্রথম প্রথম কিছুই বলে না। কিন্তু জানকীচটিতে পৌঁছুতে পৌঁছুতে তাদের কনডিশানিং হয়ে যায়। তখন শুনি ঘোড়সওয়ার সাহেব মুখ থেকে চুরুট নামিয়ে বলছেন—’জয় হো জাজকী’—পুঁটলি মাথায় পদযাত্রী বুড়ির দিকে চেয়ে। বুড়ি হেসে বলে, ‘জয় জাজকী—আব তো আধা রাস্তা আ গয়ে হো—জাকীচটি তো ইধরই হ্যায়।’ পরস্পরকে মনোবল দিতে দিতে অগ্রসর হচ্ছে অসংলগ্ন অথচ পরস্পর অন্তর্লগ্ন এক আশ্চর্য জনতা। যাঁরা নেমে আসছেন তাঁরাও আমাদের আত্মীয়। যাঁরা উঠতি তাঁরা তো বটেই।

জাকীচটিতে নেমেই পিকো ব্যথার ওষুধ, আমি শ্বাসকষ্টের ওষুধ চা দিয়ে খেয়ে ফেললুম। ঘোড়াওয়ালারাও চা খাচ্ছে। পুরো রাস্তা কুন্দন সিং অন্য সমস্ত পদযাত্রী ও অশ্বতরারোহীদের যাত্রার নিয়মকানুন শেখাতে শেখাতে এসেছে। মোড়ে বাঁক নেবার সময়ে পদযাত্রীরা কদাচ যেন খাদের দিকে যাবেন না। খচ্চররা বাইরের দিক বাঁক নেয়, তারা ঠেলে দিতে পারে। ‘ভাইসাব, জানবর কো বিশোয়াস নাহি—পাহাড়কা সইসে চা’—চোখে দেখলুমও খচ্চর কী ভাবে ঠেলা মারে। একেবারে জান্তব। কুন্দন সিং খুব লোক ভালো এবং প্রথম শ্রেণীর ট্রেনার। খুদে রবীন্দ্র সিংকে সে যত্নে শিক্ষা দিতে দিতে আসছে। পিকোর ঘোড়াটি বয়সে ছোট, তার ট্রেনিং কম, আমার যম্নী পাকাপোক্ত। যম্নী যা করে, মোহন দেখাদেখি তাই করে। যম্নী যেই পাহাড়ী ঘাস ফুল খেতে পাথরে চড়তে চেষ্টা করে, মোহনও করে। যম্নী যেই ঝর্নায় জল খেতে মুখ নামায়, মোহনও জল খায়। আর যম্নী যদি সেই মন্দ কর্মটি করে পথ নোংরা করে, মোহনও সেটি করবেই। দুর্গা-অপুর মতো আর কি। রবীন্দ্রকে প্রায়ই কুন্দন সিং বলছে, ‘থক্ তো নাহি গয়ে হো? জরা রেস্ট লোগে?’ রবীন্দ্র বিরক্ত হয়ে মাথা নাড়ছে। সে বাক্যব্যয়ে বিশ্বাস করে না, খচ্চরদের মতোই লাফিয়ে লাফিয়ে পাথরে পাথরে পা ফেলে পথ চলছে। খচ্চররা যা বুঝলুম, মাটি কাদা দিয়ে চলা পছন্দ করে—তা যদি সেই রাস্তা ছ’ ইঞ্চিও চওড়া হয়, চার ফুট চওড়া ভুঁড়ি নিয়েও সেই ছ’ ইঞ্চি দিয়েই চমৎকার হেঁটে যাবে তারা। নুড়িপাথরে, বা সিঁড়িভাঙা পথে উঠতে তাদের কষ্ট হয়। দেখতে দেখতে জাকীচটিতে রঞ্জন এসে পড়ল।

ডাণ্ডী, কাণ্ডী কাণ্ডজ্ঞান

চা খেয়ে ফের রওনা হব, দেখি এক থুরথুরে বুড়ি পাঞ্জাবি মহিলা কাঁদো কাঁদো মুখে কোনরকমে হুমড়ি খেয়ে ঘোড়ায় বসে আছেন, তাঁকে ধরাধরি করে নামান হচ্ছে। অন্য ঘোড়াবরদাররা তাঁর সহিসকে বকুনি দিচ্ছে, ‘এরকম সওয়ারী কেন নিয়েছ? পড়ে গেলে কে দায়ী হবে? বড্ড তোমার লোভ!’ সহিসও চুপ করে নেই। বলছে, ‘কী করব? অনেক করে বলল, ধরল তাই।’ মহিলার ডাণ্ডী বা কাণ্ডী নেওয়া উচিত ছিল। এ বয়সে শরীরের এ অবস্থায় কেউ ঘোড়ায় চড়ে না। ডাণ্ডী অবশ্য বড্ড খরচ। আর কাণ্ডীতে খুব ভয় করে।

একটা মোড়ে দেখছিলুম প্রচণ্ড পেন্ট করা, মুখময় রং মাখা এক ফ্যাশানেবল মোটা যুবতী, প্রচুর গরম পোশাকের মধ্যে টবের গোলাপ ফুলটির মতো কাণ্ডী থেকে মুখ বের করে বসে আছেন। মোটা শরীরে কষ্টের চিহ্ন নেই। কাণ্ডীওলাটি তরুণ। সে কাণ্ডীটি একটা পাথরে ঠেস্ দিয়ে রেখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছে। প্রায় জিব বেরিয়ে পড়েছে তার। দেখে বড্ড মায়া হল। আর লজ্জাও। অমনি শুনলুম মেমসাব বলছেন, ‘চলো চলো, দের্ কিউ কর্তা? ফির ঘুমকে তো আনা হ্যায়!’ কাণ্ডীওলার কপাল থেকে এই শীতেও সহস্রধারায় ঝর্না ঝরছে।

কাণ্ডী হচ্ছে একরকম কুলোর মতো গড়নের চ্যাপ্টা ঝুড়ি, কুলিরা ভালো করে পিঠে বেঁধে নেয়। ঝুড়ির মধ্যে উবু হয়ে বসে থাকে যাত্রী। বসার এই ভঙ্গিটা ভালমতোই প্র্যাকটিস করা থাকে—ভ্রূণাবস্থায়। মাতৃজঠরে আমরা এই ভঙ্গিতেই থাকি, হাঁটু দুটি চিবুকের কাছে গুটিয়ে। আর একবার একজন কাণ্ডীওলার পিঠে একটি দেহ দেখলুম। দেহে প্রাণ আছে কি নেই বুঝিনি। মুখ হাঁ, চোখ উল্টোনো, ঘাড় কাত। দেহাতী বৃদ্ধা। মুখ-চোখে মাছি বসছিল না। হয়ত জীবিতই ছিলেন, অচৈতন্য। পিঠে পিঠ দিয়ে ঝুলে থাকা নিশ্চয় আরামপ্রদ নয়। গ্রীসে এককালে বড় বড় জালার মধ্যে মৃত মানুষকে এই ভঙ্গিতে পুরে গোর দেওয়া হত, অনেক কঙ্কাল পাওয়া গেছে। হঠাৎ মনে পড়ে গেল, আথেন্সের জাদুঘরে দেখেছিলুম।

মাঝে মাঝে হুম্-হাম্ করে সদর্পে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে ডাণ্ডী। শেঠজী আর তাঁদের বিবিজীরা আরামকেদারায় কাত হয়ে আছেন। কাণ্ডী শিশু ও বৃদ্ধদের জন্যে। কাণ্ডীর আর খচ্চরের একই খরচ পড়ে। তবে ভারবাহী মানুষটির চেয়ে পার্বত্য পশুটি বেশি ভারসই এবং নিরাপদ এবং মূল্যবান প্রাণীও বটে। কিনতে গেলে তো মূলধন চাই।

এবারে হেঁটে রওনা দিল পিকো। খচ্চরে চড়ল রঞ্জন। পথটা ভারি সুন্দর এখন। চওড়া সবুজ শস্যভরা উপত্যকা। চারিদিকে পাহাড়। ডানপাশে যমুনার নৃত্যলীলা। পথটা একটুক্ষণ কিছু পাহাড়ী গাছের নীচে দিয়ে যায়। কী গাছ জানি না–চেনা ঝাউ, পাইন নয়। ঝিরঝিরে, বেটে, ছড়ানো ছাতার মতো নাম না-জানা গাছ। এখানেই কেবল দেখা গেল গোটা পঁচিশ-তিরিশ গাছ। যেন উপবন। তারপর শুরু হল খাড়া চড়াই। রাস্তা এবার জ্যামিতিক ধাঁচে ডাইনে বাঁয়ে কোনাকুনি বাঁক নিতে আর চওড়াতে কমতে শুরু করল। পিকোকে কুন্দন সিং ঘোড়ায় তুলল আর রঞ্জন চলল পাকদণ্ডী বেয়ে। পাহাড়ি মানুষজনদের দেখাদেখি।

পথটা সত্যি আশ্চর্য-সুন্দর। চারিদিকে ঘিরেছে উদ্ধত সবুজ পাহাড়, একদিকে খুব নীচে—অনেক নীচে যমুনার খাদ। প্রপাত গর্জন পর্যন্ত মৃদু হয়ে যায়। তাকাতে ভয় করে। পথ ক্রমশ সরু হচ্ছে আর এবড়ো-খেবড়ো পাথুরে হচ্ছে। ঘোড়া গেলে মানুষ যেতে পারে না। মানুষকেই দেয়ালে পিঠ সেঁটে দাঁড়িয়ে খচ্চরকে সসম্ভ্রমে পথ ছেড়ে দিতে হয়। মাঝে মাঝে দেয়ালে একটু গুহামতো আছে। তাতে মাঝে মাঝে একটি তরুণ সাধুকে দেখছি, বসে গাঁজা খাচ্ছেন। অনেকবারই ওর সঙ্গে দেখা হল। পথে কখন যে আমাদের পেরিয়ে যাচ্ছেন টের পাচ্ছি না। যখন বসে গাঁজা খাচ্ছেন তখন দেখতে পাচ্ছি। কুন্দন সিং বলল, ‘মরেগা শালা সাধো। গাঞ্জা থাকর চল্ রহা। বহুৎ খতরনাক্ রাস্তা।’

জারকো বিশোয়াস নহী

ইতিমধ্যেই বৃষ্টি শুরু হয়েছে। পথের অবস্থা, পাহাড়ের মধ্যে গর্ত খোদাই করে রাস্তা কোঁদা, ঢাকা বারান্দার মতন মাথার ওপর ঝুঁকে আছে পাথরের এবড়ো-খেবড়ো ছাদ। খচ্চরারোহীদের মাথায় যখন-তখন ‘অতিবাড় বেড়ো নাকো’ বলে গোঁত্তা মারতে পারে। কুন্দন সিং চেঁচাচ্ছে, ‘শির্ বাঁচকে, শির্ বাঁচাকে।’ রেলিং দেওয়া আছে খানিকটা রাস্তা। এক জায়গায় দেখি রেলিং ভাঙা। কুন্দন সিং বলল, ‘কাল এক লড়কী গির গয়ি।’ সে কি? পনেরো-ষোলো বছরের উত্তরপ্রদেশী মেয়ে, নাচতে নাচতে আসছিল আগে আগে, বাবা মা দাদা পিছনেই ছিল, খচ্চরের হঠাৎ ধাক্কা সামলাতে না পেরে আট হাজার ফিট্ নিচের খাদে যমুনার স্রোতে–’শালে জানবর্ কো বিশোয়াস নাহি—আগে বাঢ় যম্নী, ঈ ঈ ঈঃ লীঃ লীঃ—’

রেলিং পার হবার পরে হঠাৎ একটা জায়গায় যম্নীকে দাঁড় করাল কুন্দন সিং।—’উতার যাইয়ে। আব্ পায়দল এক-দো কিলোমিটার। খচ্চর নাহি যায়েগা। ডাণ্ডী, কাণ্ডী, কুবি নাহি যায়েগা।’ সত্যি সত্যি এইখানে সব ডাণ্ডীকাণ্ডীর চড়ন্দারদের একেবারে পথে বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। হাঁটো। সরকারের বারণ আছে। এ পথে অন্যের ওপরে নির্ভর করে ওঠা যাবে না হাতে পায়ে, হামা টেনেও উঠতে হতে পারে। এটা যার যার নিজের ব্যাপার। কিন্তু আগে কেন বলেনি? হয়তো বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা অনেকেই তাহলে আসতেন না। সারাপথ ডাণ্ডীতে বা কাণ্ডীতে যাবেন বলে রওনা হয়ে, তারপর পথ চলতে বাধ্য হওয়া এবং সবচেয়ে কঠোর সবচেয়ে কঠিন চড়াই অংশেই—এটা ব্রিচ অব কনট্র্যাক্ট। বুড়ো মানুষদের মুখের সেই অসহায় চেহারা ভোলবার নয়। এমন তো কথা ছিল না! এটা কী হল? পারব তো? জয় যমুনামাঈ, বাঁচিয়ে দিও মা।

কিন্তু মা বাঁচিয়ে আর দেয় কই! আমার নিজের ঘরে একটা অবাধ্য ছটফটে পঞ্চদশী আছে। আমি কুন্দন সিংয়ের ম্যাটার-অব-ফ্যাক্ট স্বরে বলা পনেরো বছরের মেয়ের খাদে পড়ে যাওয়ার সংবাদে প্রস্তরীভূত হয়ে গেছি। ভুলতে পারছি না, এ দুর্ঘটনা মা-বাবার চোখের সামনেই ঘটেছে। অথচ আটকাতে পারেননি। তাঁরা অন্য বাঁকে তখন। পুণ্যার্জন করে ঘরে ফিরবেন কোলের সন্তানকে যমুনায় বিসর্জন দিয়ে। যমুনোত্রীর পথশোভা একেবারে বিবর্ণ বিস্বাদ হয়ে গেল। কেবলই পিকোকে সামলাচ্ছি। সেও বড্ড স্বেচ্ছাপ্রবণ মেয়ে, বড়ই চঞ্চল। যমুনোত্রীকে মেয়ে উপহার দিয়ে যাবার কোনো ইচ্ছে নেই আমার।—’পিকো, খুব সাবধান। ঝুঁকে ফুল তুলবি না। আমার সামনে সামনে চলবি।’

কিন্তু এখন তো হন্টন! হাঁটব কি? পথ জুড়ে শুয়ে পড়েছেন প্রায় এক বিশাল পাঞ্জাবী বৃদ্ধা। তাঁকে ধরাধরি করে তিন-চারজন ঘোড়াওয়ালা মিলে ঘোড়া থেকে টেনেহিঁচড়ে নামিয়ে দিয়েছে এই পিছল পাথুরে চড়াই পথে। তিনি কেঁদে ফেলেছেন আর কেবলই বলছেন, ‘আমার ছেলে কই? আমার থলি কই?’—’মেরে বেটা, মেরা থৈলিয়া?’ এঁকেই জাকীচটিতে দেখেছিলুম। ভারী শরীর, প্রায় আশি বছর বয়েস। হিসি করে ফেলেছেন দৈহিক স্ট্রেনে এবং প্রাণভয়ে। ঘোড়ার সঙ্গে কোনো আত্মীয়-বন্ধু নেই। সহিসটি খুবই দুষ্টু। খুব ধমকাচ্ছে এবং রুক্ষ ব্যবহার করছে। যেহেতু একেই গ্রাম্য, তায় জরাবিধ্বস্ত এবং অবস্থাপন্ন নিশ্চয়ই নন—তা হলে ডাণ্ডী নিতেন। এই বয়েসে কেউ (এই রকম রাস্তায়) খচ্চরে ওঠে? পিকোলো তাড়াতাড়ি এগিয়ে যায়। আমরা তাঁকে হাত ধরে পথ থেকে তুললুম।—’চলুন মাঈ, আমাদের ধরে ধরে চলুন—কোনো ভয় নেই।’ দুই হাতে পিকো তাঁকে জড়িয়ে ধরল (নিজেই পায়ের টাটানি ব্যথায় ভাল করে পা-টাও ফেলতে পারছে না) আর আমি তাঁর ডান হাতটা শক্ত করে ধরলুম। হাঁপানিতে, ভদ্রভাবে শ্বাসপ্রশ্বাস ফেলতেও জানি না, তারপর তিন রুগীর অপূর্ব প্রসেশান যেমন-তেমন করে এগিয়ে চলল ট্যারা ব্যাকা হয়ে যমুনোত্রী অভিমুখে। প্রথমটা উনি খুনখুন করে কাঁদছিলেন। ক্রমশ থামলেন, অল্প অল্প কথাও বললেন। ছেলে নিচে। হেঁটে উঠছে দুটি নাতিও। থলিটি খচ্চরের গলায় বাঁধা। সে ব্যাটা একা আগে চলে গেছে। তাতেই সৰ্বস্ব। এখন উঠতে হাঁটতে পেরে ওঁর সেই যথাসর্বস্ব বিষয়ে উদ্বেগ হচ্ছে।—’ভাববেন না মাঈ, এরা চোর নয়, থলি ঠিকই থাকবে।’ আশ্বস্ত হয়ে উনি পা ঠিকমতন ফেলবার চেষ্টা করতে থাকেন। জলন্ধরের এক গ্রামে ওঁদের বাড়ি। ছেলের সঙ্গে চারধাম করতে বেরিয়েছেন। যমুনোত্রী প্রথম ধাম।—’এমন জানলে আসতাম না। মরে যাব আমি ঠিকই, নিশ্চয়ই মরে যাব। কেউ বলেনি এত হাঁটতে হবে, কেউ বলেনি ঘোড়া এত ভয়ংকর—’ বলতে বলতে প্রায় কেঁদেই ফেলছেন। অনেক কষ্টে শিশুর মতো ওঁকে ভুলিয়েভালিয়ে হাঁটি। পথশ্রমে বাক্যালাপ আপনি বন্ধ হয়ে যায়। আমাদের ঘোড়াওলারা যে যার ঘোড়া নিয়ে সবাই অনেক এগিয়ে গেছে, কারুর টিকি দেখা যাচ্ছে না। কেবল ওঁর ঘোড়াওয়ালা যাচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে। স্বেচ্ছায় নয়, অন্যান্য ঘোড়াওলাদের চাপে। এক এক সময় পথ খুবই খারাপ যেখানে, তখন এসে সাহায্য করছে ওঁকে। পথটাও যেন ফুরোতে চায় না। যদিও আমার এটাই ভাল লাগছে। গাছপালা পথ পাথর ঝর্না আর ওদিকে পাহাড়ের গায়ে চার-চারটে ধবধবে গ্লেসিয়ার—চোখ মেলে তবু দেখতে পাচ্ছি। খচ্চরে চড়লে মন এতই একাগ্র, কেবল মাথার ওপরের পাথর সামনের মানুষ আর নিচের রাস্তাটি ছাড়া কিছুই দেখতে পাই না। অথচ টের পাচ্ছি—যেতেছে বহিয়া সুসময়।

একসময় হামাগুড়ি সত্যিই প্রায় দিতে হল, বৃষ্টি-পিছল পথ, সিঁড়ির মতো বড় বড় পাথর সাজান, কখনও বা ঝর্নার ভিতর দিয়ে যাওয়া, আমার মাথায় ডালকোটের হুড, পিকোর রেনকোটের ঘোমটা, ছাতা রঞ্জনের কাছে। রঞ্জনকে আর দেখিনি। ব্র্যান্ডি, গ্লুকোজও রঞ্জনের কাছে। অতএব বৃদ্ধাকে সাহায্য করার উপায় নেই। আবার ঠেলেঠুলে অতি কষ্টে দুর্গাশ্রীহরি সংকটনাশিনি বলে তো মাঈকে তাঁর খচ্চরে তুলে দেওয়া হল। খচ্চর বিনীতভাবে গলায় তাঁর থলি ঝুলিয়ে দাঁড়িয়েছিল। থলি দেখেই অনেকটা আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলেন মহিলা। ওঁকে রওনা করে আমরাও উঠে পড়ি। ‘উঠে পড়া’ অত সোজা নয়। আমার প্রত্যেক বারই মনে হয়েছে—এই শেষ, আর নয়। দুই পায়ের ডিমে বিশ্রী কালসিটে পড়েছে, জানি না কিসের ফাদ সমানে চিমটি কেটে যাচ্ছে ঐ একটা স্পটে। আর ঘণ্টাখানেক। চার ঘণ্টা হয়ে গেছে। নামছেন এমন হলুদ পাগড়ী বাঁধা একটি দেহাতী বৃদ্ধকে যেই বলেছি ‘যমুনোত্রী মাঈকি জয়’ (ঠিক কলকাতার বিসর্জন-পার্টির সুরে), উনি ফোকলা হেসে বললেন, ‘বাস্ আর্ তো জ্যায়দা তকলিফ নেহি হোগা—আ গয়ে হেঁ আপ।’ আমার গলার স্বরে নিশ্চয় ক্লান্তি ছিল। জয়ধ্বনিতেই লুকিয়ে ছিল প্রশ্ন।—’আরও কত দূর?’

এক লড়কি মিলে গা?

কি যে আরাম পেলুম ওই আশ্বাসে। চুড়ার কাছাকাছি পৌঁছেছি তাহলে! হঠাৎ দেখি সুরথ সিং—সুরথ সিংই তো? আমাদের গাড়ির ড্রাইভার—নাম আসছে।

‘সুরথ সিং?’ আমি চেঁচাই।

‘হাঁ বিবিজী। হো গয়া আস্নান হামরা।’

‘ইতনা জলদি পহুঁচ গয়া?’

‘ম্যায় তো পাহাড়ি হুঁ? পাকদণ্ডীসে চলা আয়া। দেড়ঘণ্টে মে পৌঁছা। গাড়িকো দেখনেবালা রাখকেই আয়া হাম। বারিষ আ গয়া, আপ জদি যাইয়ে! ঘুমনা মুশকিল হোগা। ‘ কেননা বৃষ্টি হচ্ছে। পথ পিছল হচ্ছে। ফেরার পথ আরও পিছল হবে। যেন অন্ধকারের আগে নিশ্চয় ফিরি। সুরথ সিংয়ের হাতে লাঠি নেই, তবু কত স্বচ্ছন্দ! রঞ্জনেরও হাতে লাঠি নেই—ওর খুবই উঠতে অসুবিধা হচ্ছে এজন্যে। লাঠিটা মস্ত ভরসা। অনেকখানি সাহায্য করে। জাকীচটিতে ওর জন্যে একটা লাঠি চাইতে গিয়ে কী হেনস্থা! যেই বলেছি ‘মেরা ভাইকে লিয়ে এক লাড়কি মিলেগা ভাই?’ দোকানদারের চক্ষুস্থির। পিকো হেসেই গড়াগড়ি। ব্যাপার কি? আবার বলি।-’এক লড়কি!’ এবার রঞ্জন তাড়াতাড়ি শুধরে দেয়, ‘লড়কি নেহি,—লাকড়ি, লাকড়ি! লড়কি নেই চাইয়ে-লকড়ি চাই, লকড়ি! স্টিক! লাঠি!’

‘ওঃ লাকড়ি? কুছ পেড়সে তোড় লো না আপ? লাকড়ি নিচেসে লানা থা। ইধর নাহি মিলতা।’

হাঁটবার সময়ে টের পাচ্ছিলুম, লাঠি থাকলে কী কাজই দিত। গঙ্গোত্রীতে লাঠি নিয়ে নেব। তিন কিলোমিটার হাঁটতে হবে—যদি শেষতক যাই। যমুনোত্রী যেতে গায়ে হাতে পায়ে যে ব্যথা হয়েছে এরই মধ্যে, পরে আর কোথাওই খচ্চরে উঠব না। এটা নিশ্চিত। অতএব কেদার যাব না।

যমুনে, এই কি তুমি সেই যমুনা?

যমুনোত্রীর পথ যেখানে শেষ হয় সেখানটা আরও সরু, খুব পিছল, পাথুরে এবং কাদাময়, নোংরা। ঘোড়া থেকে নামলুম যেখানে (অর্থাৎ খচ্চর থেকে), সেখানে ফের সেই পশুর মলমূত্রের বাড়াবাড়ি এবং তার মধ্যে বর্ষার জলস্রোত—হেঁটে পেরিয়ে খুব সরু একটা গলি দিয়ে যেতে হয়। সবে উঠেছি, হঠাৎ একটা ঘোড়া একজন গ্রাম্য জাঠ বুড়োকে ধাক্কা দিল। সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়াওলারা ধমকে উঠল, ‘কী, চোখে দেখতে পাও না? অন্ধ নাকি? মরবে একদিন, শালা বেওকুফ।’ বুড়ো ধাক্কা খেয়ে হঠাৎ গড়গড় করে পিছলে পাহাড়ের গা বেয়ে পড়ে গেল। আমি চোখ বুজেই ফেলতুম—তার আগেই দেখি খানিক নিচেই একটা চত্বর মতো, তাতে এক বুড়ী জাঠনী ছুটে এসে বুড়োকে জাপ্টে ধরে ফেলল। নইলে ওটুকু চত্বর পার হয়ে, ওপাশে খাদের মধ্যে পড়ে যাওয়া এমন কিছু কঠিন ছিল না। দুই বুড়ো-বুড়ীর মাথা গা ঢেকে বিরাট বড় বড় দুটি লাল নীল প্লাস্টিকের শিট কাদায় লুটোচ্ছে, তারই ওপর পা পড়ে হড়কে গেছে। খুবই বিপজ্জনক বর্ষাতি।

যমুনোত্রীতে পৌঁছে মনে হল, কেন এলুম? এই জন্য আসা? এই কুশ্রী অপবিত্র নোংরা, মলমূত্র-জর্জরিত কর্দমাক্ত জায়গায়? পাহাড়ের ওপরে আকাশ কত পবিত্র, কত বীজানুশূন্য, কত শুদ্ধ। আর মাটি এত অশুদ্ধ এত অপবিত্র এত রোগবালাইয়ের আড়ত হবে? একদিকে একটা ধর্মশালার দেয়াল। অন্যদিকে ছ’ ইঞ্চি কাদার ওপর প্লাস্টিক বিছিয়ে ত্রিপলঢাকা চা-জিলিপি-পুরী-হালুয়ার দোকান। মাঝখান দিয়ে সরু যাতায়াতের গলিপথ। ডালায় করে পুজোর নৈবেদ্য বিক্রি হচ্ছে–৫, ৭, ১১, ২১ দেখলুম। মিসেস মুখার্জী বলেছেন তাঁর স্বামীর নামে পুজো দিতে। ৫০ সঙ্গে দিয়েও দিয়েছেন। পুজো কী করে দেয় কে জানে! একটা ১১ থালা কিনে আমি পিকোকে দিই। বলি, ‘যা, শিখে আয় দিকি কী করে পুজো দিতে হয়!’ দোকানী বলে, ‘ছি ছি, এতদিনেও নিজে শিখলে না?’ তাড়াতাড়ি বলে দেয়, ‘থালাটাও যেন পুজোয় দিও না, ওটা আমাকে ফেরত দিও কিন্তু।’ হয় মলিন অ্যালুমিনিয়মের কাঁসি, নয় নোংরা এনামেলের প্লেটে পুজো সাজান একটু সিঁদুর, একপাতা প্লাস্টিকের টিপ, একটা বিশ্রী চুলের ফিতে, একটা ছোট আয়না, কাচের চুড়ি এক জোড়া, একটা পুঁতির মালা, কিছু বাতাসা-এলাচদানা, তুলসী-ধুপ এই ২৫। জিনিস যত কমবে দামও তত কমবে। নৈবেদ্যের ছিরি দেখেও খারাপ লাগল খুব।

—মন্দির কই?

–’ওই পেছনে। প্রথম তো কুণ্ডে যান। সপ্তকুণ্ড। স্নানটা সারুন। চাল, আলু এনেছেন? রুমালে বেঁধে কুণ্ডে ডুবিয়ে নিন, আলুভাতে ভাত খেতে পারবেন। আমরা এনেছি।’

–ও বাবা, ঐ জলেই স্নান! ভাতেভাত হয়ে যাব যে!

–না না, ওটা স্পেশাল কুণ্ড। ওতে স্নান নয়। স্নানের আলাদা তিন-চারটে কুণ্ড আছে। অনেকগুলি বাঙালী এখানে। এঁদের পথেও দেখেছি।, খচ্চরে চড়ে বিচ্ছিরি পথটা পার হচ্ছেন জোরে জোরে হরেকৃষ্ণ হরেকৃষ্ণ নাম জপ করতে করতে। মহিলারা সবাই সাধারণ করে সুতী তাঁতের শাড়ি পরেছেন, কিন্তু আমার মতো ঠ্যাং বেরিয়ে পড়ছে না কারুরই। সবাই নিচে পা-ঢাকা লম্বা গেঞ্জির আন্ডারওয়্যার পরেছেন আব্রু রাখতে। ঘোড়ার ব্যাপারটার জন্য পূর্ব-প্রস্তুতি ছিল। ওঁদের কেউ শিখিয়ে রেখেছিল।

এইসব কথাবার্তা শুনছি চায়ের দোকানে বসে। মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছে। দোকানে বসার জায়গা নেই। আর সবাই দাঁড়িয়ে। দুটিমাত্র চেয়ার ছিল টিনের—আমি আর পিকো প্রথমেই পেয়ে গেছি। এত ক্লান্ত ছিলুম আর যমুনোত্রী এতই হতাশ করেছে যে চেয়ার ছেড়ে উঠতেই ইচ্ছে করছে না। যদিও বয়স্ক কিছু লোক দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছেন। হঠাৎ দেখি সেই পাঞ্জাবি বৃদ্ধা। এসে পৌঁছেছেন তাহলে? তাড়াতাড়ি তাঁকে চেয়ার ছেড়ে দিই। মেঝেতে বসার জায়গা নেই। সবটা কাদায় কাদায় লেপে গেছে। ইতিমধ্যে রঞ্জনও এসে যায়। হাতে একটা ভাঙা গাছের ডাল ল্যাকপ্যাক করছে।

‘এই যে দিদি, এই নাও লড়কি!’

চা-জিলিপি-পুরী হালুয়া দারুণ জমল। চায়ে ব্র্যান্ডি মিশিয়ে খাই। বৃদ্ধাকেও খাওয়াই। ‘দাবাই দিয়া? চায়মে কুছ দাবাই ডালা? অ্যায়সা লাগতা হ্যায় কিউ?’ বলে নাক ভুরু কুঁচকোতে কুঁচকোতে উনি চা খেয়ে নিলেন। এরপর গ্লুকোজের প্যাকেট খোলা হল। রঞ্জন কোনটাই খায়নি। বৃদ্ধাকে গ্লুকোজ খাওয়ানো এবং সঙ্গে পথের জন্য দেওয়া হল। ইতিমধ্যে নাতি দুটি এসে গেছে। নাতি দেখে ঠাম্মার ফোকলা মুখে কী হাসি! ছেলের জন্য অপেক্ষা করে আছেন। আমরা কুণ্ড দেখতে চললাম।

ছন্দে ছন্দে দুলি আনন্দে

এক মুহূর্তও ভালো লাগছে না এখানে। যদিও এখানে যমুনা-শিশুর খেলাধুলা সত্যি বড় চমৎকার। গ্লেসিয়ার থেকে নামছে তুহিনশীতল ঝকঝকে নীলধারায় উন্মত্ত গর্জিত প্রপাত। তার মধ্যে মধ্যে উষ্ণ স্রোত—সপ্তকুণ্ডের সালফার স্প্রিংয়ের ধারা পাশে-পাশেই ছুটছে, গরম, তাতে হাত-মুখ ধুচ্ছেন ক্লান্ত যাত্রীরা। বৃষ্টির পরে এই শিখর হঠাৎ-হঠাৎ কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে। গাঢ় মেঘের চাদরে দু’হাত দূরেও কিছুই দেখা যাচ্ছে না। চারটে মস্ত গ্লেসিয়ার সমেত হিমালয় পর্বত অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছেন। বাপ রে, এভাবে ঐ ভয়াবহ পথ দিয়ে নামব কেমন করে! মর্মভেদী হাওয়ার মধ্যেই উষ্ণকুণ্ডে বহু মানুষ স্নান করছেন। নারী পুরুষ শিশু। আমি অঞ্জলিতে জল নিয়ে মাথায় দিলুম। নমো বিষ্ণু। স্নানের জন্য প্রস্তুত নই, উৎসাহও নেই। পিকোরও প্রস্তুতি নেই। উৎসাহ থাকলেও তাই তার স্নান হল না। কেবল অপ্রস্তুত অবস্থাতেই রঞ্জন নেয়ে ফেলল। কুন্দন সিং চায়ের দোকান থেকে তোয়ালে ভাড়া করে এনে দিল। মেয়েদের পোশাক বদলের ঘরটর নেই। ভিজে কাপড়ে বেশ খানিকটা গিয়ে একটা দেয়ালের পাশে মেয়েরা কোনওরকমে কাপড় পরছেন। অব্যবস্থার চূড়ান্ত। হঠাৎ শুনি গিটকিরি লাগিয়ে গলা ছেড়ে কেউ গাইছেন—’ছন্দে ছন্দে দুলি আনন্দে আমি বনফুল গো—’ এক পঞ্চাশোর্ধ্ব ভদ্রলোক। সদ্যস্নাত, পরনে গামছা, শীতের চোটে গলায় গান বেরিয়েছে। বাঙালী না হলে এরকম জমাবে কে।

মন্দিরও দেখবার মতো নয়। একটা বসবার চাতাল পর্যন্ত নেই। এত কষ্ট করে প্রাণ হাতে নিয়ে এই যে ছুটে আসছে গ্রাম-গ্রামান্তর থেকে বিশ্বাসী মানুষ, তাদের বিশ্রামের কোনো ব্যবস্থা নেই! বসবার পর্যন্ত ঠাঁই নেই! তারা এসে একটু জুড়োবে কোথায়? একটু গা এলাবে কোথায়? দুটো খাবে যে রেঁধে বেড়ে, তারই বা জায়গা কই? ঐ এক কালীকম্বলীওয়ালার ধরমশালাই আছে।

বিশ্বপ্রকৃতি যমুনোত্রীকে যতদূর সাধ্য সুন্দর, স্বাস্থ্যকর করেছেন। আমার দেশের মানুষ তাকে তার সাধ্যমতন অসুন্দর, অস্বাস্থ্যকর করেছে। পাশ্চাত্ত্য সংস্কৃতিতে দেখেছি নৈসর্গিক রহস্যবিহ্বল কোনো সুন্দর জায়গাকে, হোক তা পর্বতচূড়া বা সমুদ্রতীর, পশ্চিমী মানুষ মানুষের ভোগের উপযুক্ত করে তোলে। পারলে সেখানে সরাইখানা খোলে, নিদেনপক্ষে শুঁড়িখানা বসায়। পাবলিক টয়লেট বসায়। নিসর্গদৃশ্য ভাল করে দেখবে বলে বাইনোকুলারও বসায়। সম্ভব হলে (ট্রেকিং/স্কীইং/সুইমিং/বোটিং) খেলাধুলোর বন্দোবস্তও থাকে। আর আমরা? সেই একই জায়গাকে ঈশ্বরের ভোগের ঠাই করি। মন্দির স্থাপনা করি। সেই ভাবেই আমাদের আনন্দ উপভোগের ব্যবস্থা করি। মনটাকে ঊর্ধ্বে তুলে শরীরের সুখ স্বস্তি নয়, চিত্তের আনন্দ, শান্তির দিকে তাকাই। কত তফাত দুটো সভ্যতায়। এইটে ভেবে এতদিন আমার গর্ব হতো।

যমুনোত্রীতে এসে বুঝলুম আমরা নশ্বর দেহধারী, সভ্যতা-শাসিত মর্ত্যবাসী। আমাদের পরিষ্কার টয়লেটের খুব জরুরি দরকার। পাঁচ ঘণ্টা খচ্চরে, অথবা আট ঘণ্টা পদব্রজে এই পর্বতশৃঙ্গ অভিযানের পরে শরীর বিশ্রাম চায়, বসতে চায়, একটু স্বস্তি চায়। বেশিরভাগই আসেন ভক্তিপ্রাণ বুড়োমানুষ। তাদের অপরিসীম ক্লান্তির অপনোদন ঠিক ভাবে হয় না। এই মন্দিরের দর্শনের সুখ নেই। অনতিবিলম্বেই উত্তরপ্রদেশ সরকারের উচিত পথে টিকে দেবার এবং ডাক্তারের ব্যবস্থা করা। বিশেষত যেখানে ডাণ্ডী কাণ্ডী ঘোড়ার যাত্রীদের বিনা নোটিশে পদব্রজে পর্বতারোহণ করাচ্ছেন, সেই অংশে। ঐ দুটি শাদা ক্যানভাসের ক্ষুদ্র খোপের চেয়ে ঢের বেশি সংখ্যক ও বেশি উন্নত পার্মানেন্ট বাথরুমের আশু প্রয়োজন এবং যথেষ্ট মেথর চাই। পাবলিক কনভিনিয়েন্সের কোনোই সুবিধা নেই যমুনোত্রীতে। ছোট্ট জায়গা, বিস্তর লোক, খাড়া পাহাড়, পথহীন। বনবাদাড়েও যাওয়া যায় না। নদীর পাড় উন্মুক্ত। লোকে করবেটা কী? সরকারের উচিত যমুনোত্রীতে একটা ট্যুরিস্ট রেস্ট হাউস জাতীয় বিশ্রামস্থল করা। নিদেনপক্ষে বিড়লা শেঠজী তো এদিকে তাকাতে পারেন? অথচ এই অঞ্চল বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের দ্বারা সুরক্ষিত। মোটর রাস্তাগুলি বি. এস. এফের তৈরি। এক্ষুণি কেন্দ্রীয় সরকার মহারাজ ইচ্ছে করলেই যমুনোত্রীর রাস্তা উন্নয়ন সম্ভব। মিলিটারি লাগিয়ে যমুনোত্রীর ওখানে একটি সিমেন্টের নাটমন্দির গোছের চাতাল অন্তত বানিয়ে দিতে পারেন, যেখানে ক্লান্ত সাধুসন্ন্যাসীরা এবং যাত্রীরা ঝড় বৃষ্টি বরফ রোদ্দুরের হাত থেকে বাঁচতে পারবেন। কী অসামান্য পথশ্রম সহ্য করে গ্রাম্য বৃদ্ধবৃদ্ধাদের এই তীর্থযাত্রা! চোখে না দেখলে টেরই পেতুম না, এ ব্যাপার যে আজও ঘটে।

যমুনোত্রীই হয়তো বা একমাত্র জায়গা, যেখানে ‘কৃচ্ছ্রসাধন’ শব্দের অর্থবোধ হয়। অথচ যাত্রাশেষে তীর্থের প্রার্থিত শান্তির স্বাদ আমি অন্তত পাইনি। অন্যদের কথা জানি না। তাঁদের মূল্যবোধের থেকে হয়তো আজ আমি দূরে চলে এসেছি। আমার যতটা অসহ্য লাগছে, শ্রীহীন, প্রীতিহীন, ভক্তিহীন ব্যবসাসর্বস্ব একটি অস্বাস্থ্যকর দমবন্ধ পরিবেশ মনে হচ্ছে, ওঁদের তেমন মনে না হতেও পারে। অন্ধবিশ্বাসের আফিম ওঁদের খাইয়ে রেখেছি আমরা।

তবুও, ওঁরা নিশ্চয়ই বিশ্রামাগার, শৌচাগার, স্নানের জন্য ঢাকা ঘরের দাবী করতে পারেন। না পেয়ে না পেয়ে ওঁরা চাইতে ভুলে গেছেন। গ্রামে যেমন কষ্ট করে বাঁচেন সেই ভাবেই মানিয়ে নিচ্ছেন। জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে আধাআধি ভাগ করে নিচ্ছেন তীর্থযাত্রার অভিজ্ঞতা। যেদিকে বেশিটা যায় যাক। ভয় কি? উত্তরাখণ্ডে মৃত্যু হলে সঙ্গে সঙ্গেই স্বর্গ। এই তো মহাপ্রস্থানের সেই পথ। কাশীতে মরলে তবু তারকব্রহ্ম শুনতে হয় কানে, তবে মুক্তি হয়। এখানে ওসবেরও নাকি দরকার নেই। এহ বাহ্য। এখানকার শুদ্ধ বায়ুই কানে তারকব্রহ্ম শুনিয়ে দেয়।

‘সব চেয়ে ভালো পা-গাড়ি’

ফেরবার পথে আমরা হেঁটেই নামলুম জানকীচটি পর্যন্ত। লাকড়ি না থাক, আমার লড়কি ছিল সঙ্গে, রঞ্জন আগে আগে একা একা নেমেছে। এই হেঁটে নামার সময়ে আমি পথের সৌন্দর্য দু’চোখে পান, লেহন ও চর্বণ করতে করতে এসেছি। এখন তা স্মৃতিতে চোষে রূপান্তরিত।

জানকীচটিতে এসে বেজায় খিদে। আমাদের ঘোড়াওলারা আগেই হাজির। রবীন্দ্র সিং একটা ছোট হোটেলে বসে ‘ডালরোটি’ খাচ্ছে। দেখে আমরাও সেখানে যাই। চমৎকার ডালফ্রাই, নরম রুটি, আর গরম আলুর ঝোল। এবং চা। আঃ! দারুণ! খেতে খেতে রঞ্জন বলল, তার এবার বাহন চাই। জুতো পরে পায়ের একটা লম্বা নখ ওর একটা আঙুলে ঢুকে গেছে, ভীষণ ব্যথা করছে। ঘোড়া জুটলোও জানকীচটি থেকে, (খচ্চর না, ঘোড়াই) গোটা ত্রিশেক টাকাতে।

খচ্চর থেকে নামলেই আরাম। পথে একবার চা খেতে থেমেছি, চা নয় নামাই উদ্দেশ্য। জায়গাটির কোনো নাম নেই। চটি নয়, পথযাত্রীদের জন্য চা, পকৌড়ার দোকান। কিছু গাছপালা, পাথর-টাথর আছে। বড় পাথর খুঁজে যেখানেই বসতে চেষ্টা করি হাঁ হাঁ করে কুন্দন সিং বলে, ‘বসো না, বসো না, ওখানে ঘোড়ায় পিশাব করেছে।’ ধুত্তোর, ঘোড়াদের কি মন্দ স্বভাব রে বাবা! শেষে দাঁড়িয়েই চা খাচ্ছি। হঠাৎ দেখি সেই গেঁজেল সাধুটি এবার নামছেন। যথারীতি কল্কে হাতে বসে আছেন। আমি দৌড়ে কাছে যাই।

‘সাধুজী? আপ কাঁহাসে আয়ে হেঁ?’

‘মালুম নহী।’

‘কিধর যায়েঙ্গে আপ?’

‘মালুম নহী।’

মিষ্টি করে হাসলেন, কল্কেতে মুখ দিয়ে চোখ বুজে ফেললেন। আরেকজন সাধু চা খাচ্ছেন। ‘সাধুজী, আপ কাঁহাসে আয়ে হেঁ?’

‘মাদরাসসে।’

‘কিধর যানা হ্যায়?’

গঙ্গৌত্রীধাম।’

‘আপ কিধর ঠাহরতে হেঁ?’

হাত উলটে হাসলেন। হাতে বালতি আর পুঁটলি। আজকাল সাধুদের সাজবদল হয়েছে। ধাতুর তৈরি কমণ্ডলু দেখা গেল না একটাও। দু’একজনের হাতে লাউয়ের কমণ্ডলু অবশ্য আছে। একজন কোঁকড়াচুল স্মার্ট গেরুয়াধারী সাধুকে মাঝে মাঝেই দেখেছি লাঠি হাতে লাফিয়ে লাফিয়ে আমাদের পেরিয়ে যাচ্ছেন। এবারেও দেখি তিনি নেমে যাচ্ছেন। গায়ে নীল প্লাস্টিকের রেনকোট। সঙ্গে অনুরূপ রেনকোট শোভিত চেলা।

চেঁচালুম, ‘সাধুজী, আপ কাঁহাসে আতে হেঁ?’

‘দেওঘর থেকে।’ বলে এক লাফে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। মোটেই এতক্ষণ টের পাইনি তিনি বাঙালী। গৈরিক আর জটাজুটের মধ্যে কে মাদ্রাজী কে বিহারী কে বাঙালী বোঝার কোনো উপায় নেই। ভাষাও সবারই ভাঙা হিন্দি। সাধুরা অবিশ্যি একদম বাইরে এক, আর একদম ভিতরে এক–মাঝখানে নানান ভেদ-বিভেদ। মঠ-মন্দিরে বড্ড ক্ষমতার লোভ, কাড়াকাড়ি, দলাদলি। দেখেছি তো। ভগবান নিশ্চয়ই শত হস্তেন দূরে থাকেন যাবতীয় ধর্মের মঠ-মন্দির থেকে। কিন্তু উত্তরাখণ্ডের এই শীতের মধ্যে ঘাম ছোটানো রাস্তায় সাধুদের বিষয়ে অভিজ্ঞতা একেবারে আলাদা। এখনও পর্যন্ত কেউ ভিক্ষে চায়নি। শতচ্ছিন্ন বস্ত্রে যাত্রীরা উঠছেন, প্রায় বস্ত্রহীন সাধুরা উঠছেন, কারুর কিছুই চাইবার নেই। মানুষের কাছে হাত পাতবার নেই। অন্যান্য তীর্থের চেয়ে অনেক আলাদা। সায়নচটিতে যে পাণ্ডাকে দেখলুম, তার ছেলে যমুনোত্রীতে মন্দিরে হয়তো পুজো দেন, কিন্তু পাণ্ডার অত্যাচার নেই। নিজেই তো পিকো গিয়ে পূজারীর হাতে পুজো দিয়ে এল মিস্টার মুখার্জির নামে। একমুঠো ফুটকড়াই ভাজা ন্যাকড়ায় বেঁধে প্রসাদ দিয়ে বাকি সব কিছু নিয়ে নিয়েছে মন্দিরে। বুঝলুম, রি-সাইক্লিং হয়ে আবার দোকানেই ফিরবে। যেটুকু মন্দিরের সঙ্গে যোগ, সেইটুকুনিতেই আছে অসাধুতা, ব্যবসা বাণিজ্য, অধর্মীয় আচার আশ্চর্য!

নৌকর হ্যায়

-’ভোক লাগা, বেটা?’—’নেহী।’ সারাপথ এত যত্ন করছিল কুন্দন সিং রবীন্দ্র সিংকে, পিকো জিজ্ঞেস করলে, ‘তোমার বাবা?’ রবীন্দ্র সিং ঘেন্নার সঙ্গে বললে, ‘ও? বাবা কেন হবে? ওকে আমি চিনিই না। নৌকর হ্যায়।’ কুন্দন সিং তখন আমাকে বলছে—’রবীন্দ্র সিং কখনও যমুনোত্রী যায়নি তাই ভাবলাম নাহাকর্ লায়েঙ্গে। এই প্রথম ট্রিপ, বাচ্চা ছেলে। ঘোড়া সামলাতে পারবে কিনা কে জানে তাই ওকে যীর সঙ্গে দিচ্ছি। যনীর কোনো ঘোড়াওলা লাগে না। মোহনের বয়স অল্প, ওর সঙ্গে আমি আছি।’ এতে আমিও খুশি কেন না মোহনের পিঠেই আমার মোহিনীটি বসে আছেন।

রবীন্দ্র সিং রঞ্জনের সেই গুরুমহারাজের ভাইপো। ওদের নানা ধরনের ব্যাবসা, হোটেল আছে, কাঠের গুদোম আছে, ঘোড়া খচ্চর আছে আর আছে অহংকার। রবীন্দ্র ক্লাস সেভেনে পড়ে, কুন্দন সিং স্পষ্টতই তার খচ্চর শাস্ত্রের গুরু। পদে পদে শেখাচ্ছে কখন লাগাম আলগা করবে কখন কষে ধরবে, কখন ডাইনে ছুটতে হয় কখন বাঁয়ে, কখন জানোয়ারকে জল খেতে দেবে কখন দেবে না। অথচ রবীন্দ্র সিংয়ের কাছে তার পরিচয়-’নৌকর হ্যায়’।

একটি মানুষকে হঠাৎ সামনে দেখে ভয়ানক অবাক হয়ে গেলুম। একটু আগেই কুন্দন সিং এক খচ্চরওয়ালাকে বকেছে—পিঠে বেশি বেশি মাল চাপিয়েছে বলে-’জারকো মার্ ডালেগা, ক্যা? জরাসা দিল লগা কর দেখ লো তো—উসকা কিতনা তলিফ হো রহা?’ এই মানুষটির পিঠে তার চারগুণ বেশি মাল। সে বেঁকে আধখানা। দ-এর মতো হয়ে হাঁটছে। এত মালপত্র একজন কুলির নেওয়া উচিতই হয়নি। তিনজন কুলির মাল। মানুষের এত অপমান—যেন ক্রীতদাসদের যুগের নকল দৃশ্য দেখছি–এ আমার সহ্য হয় না। রঞ্জনের ঘোড়া অত্যন্ত ঢিমেতেতালায় খুড়িয়ে গড়িয়ে পেছনে পেছনে আসছে। আমাদের খচ্চরগুলি ঘরে ফেরার উল্লাসে দ্রুত পায়ে পথ অতিক্রম করছে। হনুমানচটি থেকে আরও চার কিলোমিটার ওদের বাড়ি।

‘কুলিটা অত বেশি মাল বইছে, কত বেশি টাকা ও পাবে, কুন্দন সিং?’

‘কত আর পাবে? এই আড়াইশো মতন। ভালই পাবে বলে মনে হচ্ছে ঐ পাহাড়প্রমাণ মাল দেখে। ঠিকসা খানাভি নহি খাতা, একরোজ মর যায়েগা শালা বুদ্ধ।’ ওর পুরো চেহারাটাই বলছে, ‘নৌকর হ্যায়’।

পঙ্গুং লঙ্ঘয়তে গিরিম

আমরা যখন নেমে এলুম, দেখি রোগা একটি সাধু উঠছেন তখন—তাঁর চোখের দৃষ্টির তীব্রতা মনে থাকার মত। একটিমাত্র পা। দুহাতে একটি দীর্ঘ লাঠি ধরে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠে যাচ্ছেন। অনায়াসে। কোথা থেকে আসছে এই শক্তি? দু’পায়ে এবং ছ’ পায়েও যে আরোহণ কঠোর কৃচ্ছ্র, এঁর চলার ধরনে তা মনেই হল না। আমি আর পিকোলো দু’জনেই কিছুক্ষণের জন্য কথা বলতে পারলুম না আর।

হনুমানগঙ্গার কাছেই হনুমান মন্দির হচ্ছে। তাঁবু পেতে কিছু সন্ন্যাসী বসে আছেন ধনি জ্বেলে। খচ্চর থামিয়ে মুখে চিনি-প্রসাদ ধরে দিলেন। আগে খচ্চরকে খাওয়াচ্ছেন।—’আ বেটা, বহুৎ পরেশানি হুয়া তুঝকো?’ তার পরে সওয়ারিকে। তারপর থালাটি পাতছেন। সাধুর মাথায় মাংকিক্যাপ, পায়ে হান্টার জুতো। হিউয়েন সাং-এর মতো দেখাচ্ছে। যমুনোত্রী যাত্রায় এই প্রথম থালা। মন্দির নির্মাণের চাঁদা। পুণ্যার্জন করে ফেরার পথে এঁদের কেউ বিমুখ করতে পারছে না। শেষে ঐটুকু কার্পণ্যের জন্য না পুণ্যে খুঁত পড়ে যায়।

যখন আমরা বরকোটে পৌঁছোলুম, নড়তে চড়তে কষ্ট হচ্ছে। হনুমানচটিতে আর না থেমে সোজা বরকোটে। সেই বাঙালী ছেলে দুটি বলেছিল ১৫ তে ডবল বেড়ওলা ঘর আর ৫ তে গরম গরম মাংস ভাত পাওয়া যায় বরকোটে।

অম্রুতাঞ্জনের সন্ধানে

সূর্যাস্তে উদ্ভাসিত শান্ত সুশ্রী বরকোটে পৌঁছে দেখি ট্যুরিস্ট লজটি বন্ধ। স্ট্রাইক চলছে। ওদেরই একজন সঙ্গে এসে একটি হোটেল দেখিয়ে দিল। গাড়ি থামলেই পিকো খুব খুশি হয়। যতক্ষণ গাড়ি চলে পিকোর মেজাজও ক্রমশ পর্বতশৃঙ্গে আরোহণ করে। যতই গা গুলোয়, মাথাও তত গরম হয়। ঝর্নায় ঝর্নায় তোয়ালে ভিজিয়ে তার মাথা ঠান্ডা করতে করতে ভয়ে ভয়ে যাওয়া হচ্ছে। যমুনোত্রী থেকে বরকোটে আসার পথে স্নোভিউ যতবারই দেখি, অমনি ‘ঐ দ্যাখ দ্যাখ’ করে আমি চেঁচিয়ে উঠি। পিকো বিরক্ত হয়ে বলে—‘ আমাকে নিজে নিজে দেখতে দাও তো? অত চেঁচামেচির কী আছে?’ স্বভাবই যে আমার আহ্লাদে চেঁচামেচি করা। ‘কিছু’ থাক বা না থাক। আমার বাবার মতন।

বরকোটের হোটেলটা মন্দ নয়। দোতলায় জোড়াখাটওলা ঘর। একটা নেয়ারের খাটিয়া দিয়ে দিল রঞ্জনের জন্যে। কুড়ি টাকা সব মিলিয়ে। স্নানের গরম জল নিলে বালতি প্রতি দু’টাকা। তিনটে লেপ দিয়ে দিল, দু’টাকা করে। চা একটু দামি। ষাট পয়সা। যমুনোত্রীতে সত্তর। জানলা আছে পর পর তিনটে। খুলে দেখি হিমালয়ের ছায়ামূর্তি চাঁদের আলোতে স্থির হয়ে আছে। জানলা বন্ধ করতে ইচ্ছে করল না। বরকোটে খুব বেশি ঠান্ডা নেই। মশারিও অবশ্য নেই। তবে মাছির উপদ্রবটাই দেখা গেল উত্তরাখণ্ডে বেশি। মশা নেই তেমন। ঝুপ করে বাতি নিবে গেল। অমনি চেঁচাই।—’রঞ্জন, ভালো করে মোমবাতি নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখে নে বাবা ঘরে আবার টারানটুলা আছে কিনা? ‘

‘টারানটুলা মাকড়সা কেবল আফ্রিকায় হয় মা। এখানে কেমন করে আসবে?’

‘কিন্তু এসেছিল তো। হনুমানচটিতে আসেনি কি?’

‘সেটা টারানটুলা কে বললে?’

‘যা হোক একটা নাম দিতে হবে তো?’

ঘরে পোকামাকড় ছিল না। বিজলীও মিনিট পনেরোর মধ্যে ফিরে এল। হোটেলের নিচেই খাবারের দোকানে ডালফ্রাই মাংস রুটি দই খেতে তিনজনের কুড়ি টাকা লাগল—এবং চা।

খচ্চর পিকোকে একটুও কাহিল করতে পারেনি। কিন্তু রঞ্জনের আর আমার সারা গায়ে ব্যথা। রঞ্জন বেরুল অদ্ভুতাঞ্জনের সন্ধানে। পিকোকেও বললুম ঘুরে আয় ফাঁকা হাওয়ায়। আমার তো নড়ার শক্তি নেই। ওরা এসে বলল দোকানে অদ্ভুতাঞ্জন তো আছেই, ক্যাসেট টেপও আছে। লতা, হেমন্ত, মেহদী হাসান, গুলামালি। ‘আর যাব না আর যাব না যমুনায় জল আনিতে’।

শুধু যমুনা কেন? অশ্বপৃষ্ঠে কোথাও যাব না। কেদারনাথ আউট হয়ে গেলেন। ঐ চোদ্দ কিলোমিটার হেঁটে-ওঠা আমার সাধ্য নয়। ডাণ্ডী চড়তে রুচিতে বাধে। কাণ্ডীর প্রশ্ন নেই। অতএব কেদার হল না। কৃচ্ছ্রসাধন না করলে তীর্থভ্রমণ হয় না, তা কৃচ্ছ্র দিয়েই শুরু হল যাত্রা। চারধাম হল না, তিনধাম।

সাহেবরা এত আরামের ব্যবস্থা করে রাখে, যে আরামে ডুবে বসে ঈশ্বরের মাহাত্ম্য নিয়ে মুগ্ধ হবার সুযোগ হয়। হয়তো ওরা খোলসটার আরামের ব্যবস্থা করে বলেই আত্মার দিকে আপনি নজর গিয়ে পড়ে। আমরা খোলসটার কথা না ভেবে শুধু আত্মার কথাই ভাবছি—ফলে খোলস বলে—’আমাকে দেখ’–বলে সবটা মন টেনে নেয়। অধ্যাত্মর দিকে আর যেতেই দেয় না। মেটিরিয়্যাল কম্‌ফর্টস মোটেই ইমেটিরিয়্যাল নয়, প্রাথমিক পরিচয়ে শরীরধারী জীব তো আমরা।

ব্রহ্মখাল, ধরাসু, ডুনডা

বরকোটে ভোরবেলা মোরগের ডাকে ঘুম ভাঙল। ঘরে বসেই পর্বতের সূর্যোদয় প্রত্যক্ষ করলাম। যতবার দেখার সৌভাগ্য হয়, ততবারই ধন্য বোধ করি। হোটেলে একজন পাঁড়েজী আছেন, খাটিয়া থেকে বেড-টী পর্যন্ত তিনিই সাপ্লাই করেন। গরম জল এল। অন্ধকূপ বাথরুমে স্নান সেরে ফের গরম ভাত, মাংস, ভিণ্ডিকা সবজি, ডালফ্রাই, দই খেয়ে রওনা হয়ে পড়ি।

বরকোট থেকে প্রথমে প্রচুর ঝাউবনের মধ্য দিয়ে পথ। আর একটু পেরিয়েই অপূর্ব স্নো-রেঞ্জ দেখা যায়। বেশ অনেকক্ষণ বরকোট থেকে প্রায় ব্রহ্মখাল পর্যন্ত এই ঝাউবন ঘেরা পথ। মাঝে মাঝে আশ্চর্য সুন্দর ঝরনা।

সারাটা পথ রাস্তায় শুধু সাধুদের হাঁটতে দেখেছি। হিমালয় সত্যিই সাধুসন্নিসির স্থান। মোটরের রাস্তা বেয়ে সমানেই একা একা যাঁরা হাঁটছেন, তাঁদের বগলে একটুখানি কম্বলের পুঁটলি, হাতে একটা ঝুলন্ত জলপাত্র। লোটাকম্বল। কমণ্ডলুকে রিপ্লেস করেছে অ্যালুমিনিয়ামের ‘হারা’। তোমরা সাধুরাই আমাদের পথসঙ্গী। যদিও আমরা তোমাদের পথসঙ্গী নই। যদিও তোমরা আমাদের দিকে ঘেন্না করেও ফিরে তাকাবে না, জানি এই নীলপর্দাওলা শাদা গাড়ির সঙ্গে মিলিটারি ট্রাক আর ঝড়ঝড়ে বাসের কোনো প্রভেদ নেই, তোমাদের কাছে সবই এক, সবই এহ বাহ্য। তবু, তোমরা জানো না এই যে ঝাউবন, এই যে ঝরনা, তোমরাই এদের আলাদা করেছ, জ্যোতির্ময় করেছ। এই তোমাদের গৈরিকের ছোঁওয়া লেগেই এই সব গ্লেসিয়ার আল্পসের আর আন্দেজের ধবধবে গ্লেসিয়ারের চেয়ে অনেক বেশি শুভ্র। আমার চোখের বাইরেই শুধু থেকো না। এসো ভেতরে এসো। এই গাড়ি এই আরাম, এই পর্দা, এ আমার নয়। এ আমার গায়ে ফুটছে, তোমরা জানো না তোমরা জানো না! আমারও আছে তোমাদের মতোই লোটাকম্বল, আছে জটাজুট। পূর্বাশ্রমের পরিচয় বিসর্জন দিয়ে আমিও এখন নতুন জন্মে—। কেবল একটু সময়ের অপেক্ষা। দেখা হবে। একদিন সমানে সমানে দেখা হবে। এমনি মেঘের আলোছায়া ভরা ঝাউবনের পথে, এমনি ঝরনার ধারে। দেখা হবে। এ তো তারই প্রস্তুতি। সবাই তো লালাবাবুর মতো ডাক শুনতে পায় না। আর কেউ কেউ ডাকাডাকি শুনেও কানে হাত চাপা দিয়ে থাকে।

একটা প্রচণ্ড ঝরনায় বাচ্চা পাহাড়ী ছেলেরা স্নান করছে। হঠাৎ দেখি ঝরনা বেয়ে পাথরে পা রেখে রেখে ওপর দিকে উঠে যাচ্ছেন এক সন্ন্যাসী। হাতে জলপাত্র। শুদ্ধতার আশায়। এই ঝরনা বেয়ে ওঠাই আমাদের একমাত্র উপায়। উৎসের সন্ধানে ওঠা।

ঝাউবনের ছায়ায় মাটিতে পথের ধারে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে সুখী গেঁজেলরা। চোখ উদাস, গাড়িতে, গাছে, মেঘে উড়ে বসছে কি বসছে না।

উত্তরাখণ্ডে এসে ইস্ট ইউরোপ আর রুশদেশের সঙ্গে একটা বড় মিল চোখে পড়ল। দেওয়ালগুলি ফাঁকা। কোথাও কোন বিজ্ঞাপন নেই। একমাত্র সরকারি বিজ্ঞাপন ‘দো ইয়া তিন’ ছাড়া।

এইখানে অবশ্য মালুম হয় স্থানমাহাত্ম্যটি। ওদেশে দশ ছেলের মা সোনার মেডেল পায়। একটু ভুল হল—ছিল, হাতে লেখা বিজ্ঞাপন ছিল বটে একটা। প্রত্যেক গ্রামেই কোনো না কোনো দেয়ালে হয় পূরণবিড়ি নয় তো পবনবিড়ির বিজ্ঞাপন। হঠাৎ ডুন্‌ডা গ্রামে একটি দোকানে দেখি ‘জেন্টেলম্যানস টেলারিং শপ্’-এ বসে বসে পায়ে সেলাইকল চালাতে চালাতে ট্রানজিস্টার শুনছে একটি ছেলে, দেয়ালে মস্তবড় অমিতাভ বচ্চন গোমড়ামুখে চেয়ে আছেন। এই প্রথম ট্রানজিস্টার, বোম্বাইচিত্র। সেলাম ডুন্‌ডা!

ধরাসুর কাছ থেকেই নদী পাথরে পাথরে ধবধবে সাদা, ফুটন্ত দুধের মতো উথলোচ্ছে। বাবা-মার সঙ্গে যখন ইন্টারলাকেন গিয়েছিলুম, ট্রেনের ধারে ধারে ঠিক এমনি একটা দুধশাদা ঝরনা নদী ছুটছিল। আমার সঙ্গে মনে মনে তার সখিত্ব হয়ে গিয়েছিল। একসময়ে ইন্টারলাকেন এসে গেল। ট্রেন থেকে আমি নেমে এলুম। উন্মত্ত নদী ছুটেই চলল। বুকের মধ্যে মন-কেমন-করা নিয়ে চললুম। হোটেলে পৌঁছে ঘরের জানলা খুলেই—কী দেখি? আমার জানলার নিচে দিয়েই হাসতে হাসতে ছুটে যাচ্ছে আমারই সেই প্রিয় সখী—ফুটন্ত দুধের নদীটি! এতটা আনন্দ জীবনে কবার হয়? হঠাৎ শাদা নদী দেখে সেই কথা মনে পড়ে গেল!

বেড়িয়ে পড়লুম ভগবানের নাম করে

উত্তরকাশী নামটা আমাকে চিরকাল টেনেছে। উত্তরকাশী, গুপ্তকাশী—যোশীমঠ—নামগুলোই যেন গৈরিক অক্ষরে লেখা। উত্তরকাশীর গৈরিকা গঙ্গা হৃষীকেশের স্বচ্ছ তরুণীটির চেয়ে বহুগুণ বেশি চঞ্চলা, বরকোট থেকে ধরাসু, ধরাসু থেকে ভাগীরথীকে ধরে ফেলে উত্তরকাশী।

ডুড়ার পর মাতলিগ্রামের মস্ত সৈন্য শিবিরও ভাগীরথী তীরের অসহ্য সৌন্দর্য নষ্ট করতে পারেনি। উত্তরকাশী ট্যুরিস্ট লজে একটা বাজে ঘর পেলুম। বাজারের মধ্যে বাস স্টেশনের গায়েই ট্যুরিস্ট লজ। জায়গাটির নিসর্গশোভার মূল্য শূন্য, কিন্তু সুবিধে অনেক। যাঁরা বাসের যাত্রী তাঁদের হাঁটতে হবে না। উত্থীমঠের দিকে রাস্তাটা যত উঠে যাচ্ছে, গঙ্গার তীরে একের পর এক সাধুর আশ্রম। পুরাণের গল্পে এই উখীমঠেই ঊষা-অনিরুদ্ধর ভালোবাসা গড়ে উঠেছিল। অনেক বয়স্ক বাঙালী যাত্রী দেখলুম, যে যাঁর গুরুদেবের আশ্রমে বেড়াতে এসেছেন। উত্তরকাশীই তাঁদের গন্তব্য, চারধাম নয়। একজন সাধুকে বিশ্বনাথ মন্দিরের পথ জিজ্ঞেস করলুম। তিনি ইংরিজিতে উত্তর দিলেন। নিজেই কামাখ্যা থেকে এসেছেন। অসমীয়া। উত্তরকাশী চেনেন না। উত্তরকাশীতেও বিশ্বনাথ মন্দির আছে। আমরা গেলুম মিস্টার মুখার্জীর নামে পূজো দিতে। মিসেস মুখার্জী ভার দিয়েছেন। বিশ্বনাথ মন্দিরটি ভেঙে গিয়েছিল, পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বেশ শান্তিপূর্ণ। অনাড়ম্বর। জনমানবহীন, ধুপ-ধুনো ফুলের গন্ধওলা বড় উঠোন, ইঁদারা, বেলগাছ, টগরফুল, করবীফুলের গাছ। ভারী সুন্দর, অতি সাধারণ। না আছে ইতিহাসের গৌরব, না শিল্পের দত্ত, কেবল দেবতাটুকুই তার সর্বস্ব

আমি মন্দিরের মধ্যে যাচ্ছি না। রঞ্জনকে বললুম, ‘যা, পুজোটা তুই দিয়ে আয়।’ এক বৃদ্ধা বসেছিলেন সিঁড়িতে। বললেন, ‘বেটি, কোথা থেকে আসছ? যাবে কোথায়?’ চারধামযাত্রী শুনে বললেন, ‘গোমুখে যেও না যেন। খুব কষ্ট হবে। আমার নাতি কালই ফিরেছে, পা ফুলে নীল। প্রচণ্ড বরফে পা জমে ঘা হয়ে গেছে। বেটি, গোমুখ নাহি যানা। এবার ওদিকে যাও—সঙ্কটমোচনের মন্দিরে পুজো দিয়ে এস। তাঁর কাছে যা চাইবে তাই মিলবে।’ ওদিকে যে আরেকটাও মন্দির আছে, বুঝিনি। ভিতরে গিয়ে দেখি মস্ত হনুমান মন্দির। সঙ্কটমোচনের মন্ত্র লেখা দেয়ালে। কাশীতেও সঙ্কটমোচনের মন্দির দেখেছি, নৌকো থেকে নেমে। ভারী সুন্দর সে মন্দির। বিশ্বনাথ মন্দির থেকে বেরুতে যাব, দেখি সেই দেওঘরের বাবাজী ঢুকছেন। সঙ্গে চারজন সোয়েটার ট্রাউজার পরিহিত যুবক বাঙালী চেলা।-’এই যে, দেওঘরের বাবাজী!’ মস্তিষ্ক কিছু ভাববার আগেই আমার জিব কাজ করে।—’কবে এলেন?’—আজই!’ বলেই বাবাজী চলে যাচ্ছিলেন। আমি আবার চেপে ধরি। ‘গঙ্গোত্রীতে কি যাচ্ছেন? কেদার বদ্রী?’—’নিশ্চয়ই। আপনারা?’—’আমি তো ভাবছি ফিরে যাব কিনা? সোজা বদ্রীনাথ হয়ে বাড়ি। যমুনোত্রীতে বড্ড কষ্ট হয়েছে।’ অবাক হয়ে বাবাজি বললেন, ‘সে কি? ফিরে যাবেন কেন? গঙ্গোত্রীতে কোনো কষ্ট নেই। পুরো রাস্তা বাস পাবেন। মাঝে তিন কিলোমিটার কিছুতেই বাগ মানাতে পারেনি। সেটুকুই হাঁটা। কষ্ট হয় না। আর কেদারনাথ না গিয়ে যাত্রা সম্পূর্ণ হয় কখনও? কেদারের পথ যমুনোত্রীর চেয়ে ভাল। বেরিয়ে পড়ুন তো ভগবানের নাম করে, কিছু হবে না। ঠিকই পেরে যাবেন।’ বলেই তিনি পালালেন।

সন্ধ্যাবেলায় তারপর গঙ্গার একটি বাঁধের ওপরে বসে বসে চা ডালমুট বিস্কুট খাচ্ছিলুম। সুরথ সিং একটা সময়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গিয়ে গেলাসে করে জল এনে হাতে দিল।—’গঙ্গামায়ী।’ স্বচ্ছ, তুহিনশীতল। চোখে মুখে মাথায় দিলাম। বাঁধের নীচে বড় বড় পাথরে ঘুরে ঘুরে যে উদ্দাম, উত্তাল জলস্রোত ছুটছে, তার রং কিন্তু গেরুয়া। সূর্যের অস্তগমনটি দেখা হল না, পাহাড়ের পিছনে ঘটে গেল। জলের রংয়ে তার ছায়া ধরা পড়ল এইমাত্ৰ—যেন তাম্রপত্রের মতো আকাশ আর গঙ্গা।

মরণ বলে আমি তোমার জীবনতরী বাই

রাত্রে দেখি ট্যুরিস্ট লজে একদল বঙ্গসন্তান। যমুনোত্রীতে এদের সঙ্গেই দেখা হয়েছিল। কবে এলেন? কোথায় যাচ্ছেন? ইত্যাদির পরেই তাঁরা বললেন, ‘জানেন তো সেদিন কী কাণ্ডটা হল!’ আপনারা তো অনেক আগেই চলে এলেন। বৃষ্টিতে পথের সে যে কী অবস্থা।’

মহোৎসাহে এক মহিলা বললেন, ‘অ্যাক্সিডেন্ট। বিরা-ট অ্যাক্সিডেন্ট। সেই তো বৃষ্টি শুরু হল, আমাদের ফিরতে রাত্রি হয়ে গেল। বেশ অন্ধকার। কী কষ্টেই যে ফিরেছি! তারই মধ্যে একজন পাঞ্জাবী মহিলা ঘোড়াসুদ্ধ, সহিসসুদ্ধ, খাদের মধ্যে পড়েই গেছেন। আমি তাঁকে দেখিনি, তবে দুটি ছোট ছোট ছেলে বুড়িকে খুঁজছিল দেখলাম। তাদের নাকি ঠাকুমা। তাইতে জানলুম। কী কেলেঙ্কারি ভাবুন। পরপর দুদিন। আগের দিনই একটা বাচ্চা মেয়ে গেছে। এদিন গেল ফের এই মহিলা। তা, বয়েস হয়েছিল যথেষ্ট, শুনলুম। ভালই গেছে, উত্তরাখণ্ডে মরলে নিশ্চিত স্বর্গবাস। সঙ্গে নাকি ছেলেও আছে।’

পাছে পিকোলো শুনতে পায়, আমি খবরটা চেপে গেলুম।

‘এমন জানলে কক্ষনো আসতুম না, আসতুম না! মরব। আমি এ যাত্রায় নিশ্চয় মরব। আমার ছেলে? আমার থলে?’

এখন তো আমরা পর্বতশিখরে নেই। তবে বুকের মধ্যে এত অসম্ভব চাপ লাগছে কেন? এই কি উচিত, হে বিরাট উদার হিমালয়? একটি কচি প্রাণ, একটি দরিদ্র প্রাণ, একটি ভীরু প্রাণ কেড়ে নিয়ে তোমার কী উপকারটা হল? থাক। তীর্থে তীর্থে বৃথা ভ্রমণে আর যাব না। মন তো কেবলই ধাক্কা খাচ্ছে। লোভী যমুনা, তোমাকে মা বলে ডাকব না।

ম্যাগনেটিক ফীল্ড

তবুও খেতে গেলুম ক্যান্টিনে। পিকোকে না নিয়েই। ও শুনেছে কিনা বুঝছি না শুয়ে পড়েছে। বলছে মাথা ধরে আছে। রুটি, ভিত্তিকা সবজী, ডালফ্রাইয়ের চিরাচরিত খানা অর্ডার দিয়ে বসে আছি। ওদিকের টেবিলে দুটি মার্কিনী যুবতী তর্ক করছে। পরনে সালোয়ার কামিজ। কিন্তু হিপি বলে মনে হয় না। খাওয়া শেষে ওদের কাছে গিয়ে বসলুম। অস্টিন আর হান্না ওদের নাম। আমেরিকার মধ্য পশ্চিম থেকে এসেছে। অস্টিন কাজ করত প্যানঅ্যামে। সে কুমারী, প্যানঅ্যামে ছাঁটাই হয়েছে। হয় ১৮ মাস দেশবিদেশে ঘুরে বেড়ানোর দুটি টিকিট নয়তো কিছু টাকা ওদের ক্ষতিপূরণ দিচ্ছিল, ও নিয়েছে দুটি টিকিট।

দুই বোনে বেরিয়েছে। হান্না আর্টিস্ট। বিয়ে করেছে ৬/৭ বছর। স্বামী জাপানি ছাত্র। সে শুধুই নামেমাত্র অধ্যয়ন করে যাচ্ছে। পড়াশুনো আর শেষই করে না। চাকরি-বাকরিও করে না। কিছুই করে না। হান্না এবারে ডিভোর্স চেয়েছে। তাতেও সে রাজী নয়। তাহলে আমেরিকার ভিসা নিয়ে গণ্ডগোল হবে। খাবেই বা কী উপায়ে? ওর কোনোই উপার্জন নেই। তাই হান্না ছুটিতে বেরিয়েছে। ঘোর ঈশ্বরবিশ্বাসী। হান্না হিন্দু। নানান বিভূতিতেও সে বিশ্বাস করে। মার্কিন দেশেই হিন্দু গুরুজী পেয়ে সে হিন্দু হয়েছে। কিন্তু তার জাপানি স্বামী হিন্দু হয়নি। সে বৌদ্ধও নয়। সে ক্যাথলিক। ক্যাথলিকরা ডিভোর্স দেয় না। জাপানি ক্যাথলিক তো আরও খারাপ!

অস্টিন ঘোরতর মার্কিনী যুবতী। হিন্দু ক্রিশ্চান সে কিছুই নয়। ধর্মকে সে ‘সঙ্গম’ করে। কিন্তু অস্টিন ডিভোর্স-টিভোর্স পছন্দ করে না। ‘আমি চাই সংসার, সন্তান, স্টেবিলিটি। এমন একজন পাত্র চাই, যে বেশি ব্রিলিয়ান্ট নয়, নেহাৎ সাধারণ। সৎ। বুদ্ধিমান। তার জীবনে আমিই হব সবার আগে। প্রধান মানুষ। নাম্বার ওয়ান ইন হিজ লাইফ। ডোন্ট ইউ ওয়ান্ট টু বি নাম্বার ওয়ান ইন্‌ সামওয়াস্‌ লাইফ?’

অন্তরের কানে ঘণ্টাধ্বনির মতন আজও লেগে আছে অস্টিনের হঠাৎ ঝরিয়ে দেওয়া কঠিন সত্যের আর্তিটুকু। কে চায় না? কে না চায় জগতে আর একজন মানুষের জীবনে সবার আগে আসতে। প্রথম নামটি হয়ে ওঠার মহা সৌভাগ্য অর্জন করতে? সন্তানের মা হলে অবশ্য কিছু দিনের জন্য এ সৌভাগ্য ঘটিয়ে দেন প্রকৃতি। কিন্তু ঐ। কিছুদিনের জন্যে। তারপর সন্তানের জীবনে প্রথম নামটি অন্য কিছুর। অন্য কারুর

‘আমি বাপু স্বামী ত্যাগ করতে পারতাম না হান্নার মতো। ছেলেটা দোষ তো করেনি কিছু। কেবল বোরিং হয়ে গেছে। তার বেলায় হিন্দুয়ানা কোথায় গেল? হিন্দুরা কি স্বামীকে ত্যাগ করতে বলে?’ অস্টিন তেরছা চোখে দিদিকে শাসায়। আর্টিস্ট দিদিটি পরমা সুন্দরী। দীর্ঘ পেলব, লতানে শরীরে উদাস দুটি বড় বড় নীল ফুলের মতো চোখ সপল্লবে ফুটে রয়েছে। ‘আমি স্বামী-সন্তান নিয়ে সংসার করতে চাই, এদিকে বরই খুঁজে পাই না। হান্না সন্ন্যাস নিতে চায়। সংসার ওর দু’চক্ষের বিষ। অথচ ওরই ঘরে স্বামী আছে। দ্যাখো তো মজাটা!’

‘তা তুমিই হান্নার স্বামীকে বিয়ে করে ফেললে পার?’

‘এটা অবশ্য স্ট্রাইক করেনি আগে। আমার ওসব জাপানি-টাপানির প্রতি প্রণয় নেই কিনা। আমি অল্-অ্যামেরিকান মেয়ে, অল্-অ্যামেরিকান ছেলের কথাই ভাবি। এবার এটা ভেবে দেখতে হবে। অবশ্য হান্নার বরকেও আমি ঠিকই চাকরি করিয়ে ছাড়তুম, যদি সে ব্যাটা আমাব বর হত!’

‘আনন্দময়ী মাকে চেনো?’ হান্না হঠাৎ বলল।

‘আলাপ হয়েছিল। কেন বলো তো?’

‘ওঁর ম্যাগনেটিক ফিলড সৃষ্টির ক্ষমতার কথা জানো?’

‘ঠিক বুঝলুম না

‘ওঁর সমাধিস্থলে ম্যাগনেটিক ফিল্ড তৈরি হয়েছে। আমরা কিছুতেই সরে আসতে পারছিলুম না, পা দুটো যেন কেউ জোর করে আটকে রেখেছিল মাটিতে। আমি আবার যেতে চাই কখলে। ওখানে থাকতে চাই। মা আনন্দময়ীকে তুমি দেখেছ? তুমি কী ভাগ্যবতী! ‘

ওদের ডাঃ ত্রিগুণা সেনের ঠিকানা দিয়ে বললুম কখলে কোনো দরকার হলে যোগাযোগ করতে পারে।

জাঠ, গুর্জর, গাঢ়োয়ালী

উত্তরকাশী থেকে যাত্রা সোজা হিমালয়ের শিখর অভিমুখে। লংকাচটির পথ কিন্তু হনুমানচটির মতো নয়। নওগাঁ-বরকোট হয়ে রাস্তাটি যমুনোত্রীর পর্বতের পায়ের কাছে পৌঁছে দেয় আমাদের, ভাটওয়াড়ি গাঙ্গনানী হয়ে লংকাচটিতে পৌঁছে দেওয়া পথটি তার চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর। এ পথে গ্রাম, বন, ঝরনা, নদী সবই ঢের বেশি বেশি। এবং স্নো-ভিউও। পথের একপাশে প্রবল কলোচ্ছ্বাসে গভীর খাদ কেটে ভাগীরথী বয়ে যাচ্ছেন। পিকোলো বললে, ‘মা, ফেনিল ধবধবে জল ছুটে যাচ্ছে, মনে হয় যেন হিমালয়ের সাদা ভেড়ার পাল যাচ্ছে—তাই না?’ সত্যি যখন জাঠেরা তিন-চারশো ধবধবে ভেড়া নিয়ে মোটর রাস্তা দিয়ে যায়, সঙ্গে নেকড়েবাঘের মতো কুকুর, তখন পথটাকে এমনি উন্মত্ত কল্লোলিত তটিনীর মতোই দেখায় বটে। (অবশ্য নদীর নাম এখন ভাগীরথী) দেবপ্রয়াগে পৌঁছে অলকানন্দার সঙ্গে মিলন হবার পরে তার নাম হবে গঙ্গা। গঙ্গার নাম কি একটা? যা আদুরে মেয়ে আমাদের!

পাহাড়ের গায়ে গায়ে লুকোনো আর খোলামেলা হাজারটা গাড়োয়ালী গ্রাম। প্রায় পাহাড়ে সিঁড়ির মতো জমি কেটে কেটে নানারকম শস্য চাষ হচ্ছে—’টেরা’ শস্য ক্ষেত্র, কোথাও কোথাও ঝুম চাষও হয়—পাহাড়ের খাড়াই গা বেয়ে আশ্চর্য চুম্বকী উপায়ে ছাগল ভেড়া এমনকি মহিষও চরছে। আর পথে হাঁটছেন কারা? সাধুরা।

ভাগীরথীর স্রোতকে বেঁধে ফেলে তৈরি হয়েছে মানেরী বাঁধ। এখনও কাজ চলছে। তার ফলেই হয়তো দেখতে পেয়েছি ভাগীরথীতে চওড়া বিস্তীর্ণ চড়ার পর চড়া ভেসে উঠেছে। মানেরী হাইড্রো প্রজেক্ট পার হয়ে রাস্তা চলল। প্রজেক্টের ভিড়ভাট্টা ভরা কলোনী পেরিয়েই দেখি এক বিরাট মহিষের মৃতদেহ পথের আধখানা জুড়ে। সেখানে শকুনিদের মেলা। দুর্গন্ধের রেশ চলন্ত গাড়িতেও ঢুকে এল।

এত কাছে এতগুলি মানুষের বাস। তারা এই দূষিত পরিবেশে কাজ করছে। সারাদিন বাস যাচ্ছে, ট্রাক যাচ্ছে মিলিটারির (গঙ্গোত্রী বর্ডার ফোর্সের দ্বারা প্রোটেকটেড এরিয়া)—মৃত পশুটার একটা গতি হচ্ছে না? জাতীয় চরিত্র এখানে সুস্পষ্ট। এত শীতেও যখন পচ ধরছে, বেশ কদিনের ব্যাপার নিশ্চয়। তখন বুঝিনি যে দুদিন পরে গঙ্গোত্রী থেকে ফেরবার সময়েও আবার সেই মৃত মহিষ, সেই তৃপ্ত শকুনিরা আমাদের স্বাগত জানাবে উত্তরকাশীতে। আরও তীব্র উৎকট পচনের গন্ধে। অথচ বিজ্ঞানই এখানে দেবতা, এই মানেরীতে। এ তো যমুনোত্রী তীর্থের পর্বতশিখরে তুষার নদী নয়। এই আমাদের জাতীয় চরিত্র। পাবলিক হেলথ বিষয়ে পরিপূর্ণ অচেতনতা, এবং সর্ববিষয়ে দীর্ঘসূত্রিতা। এখানে, কে জানে, হয়তো জাতপাতের ব্যাপারও আছে। মৃত পশু সরানোর যোগ্য জাতের কেউই হয়তো এদিকে বাস করে না। অতএব থাকুক পড়ে।

মানেরী পার হয়ে ভাটওয়াড়ী, তারপরে গাঙ্গনানী। আশ্চর্য দুধ-সমুদ্রের মতো কল্লোলিত পাহাড়ী ভেড়ার আর ছাগলে মাঝে মাঝেই রাস্তা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কী সুন্দর দেখতে! এত দেশ দেখেছি—অনেক রকমের গরু ভেড়া দেখা আছে, আমেরিকার তো তার ক্যাট্ল সম্পদের গর্বে মাটিতে পা পড়ে না। কিন্তু এমন হিমালয়ের ছাগলের মতো সুন্দর ছাগল আমি কখনও দেখিনি। ধবধবে সিল্কের মতো দীর্ঘ লোমে ঢাকা শরীর, গোলাপী খরগোশের মতো চোখ। দেখে লজ্জা হয়েছিল—এই জিনিস আমি কেটেকুটে রেঁধেবেড়ে খাই, আমার মনে হল, আর মাংস খাব না। যাঃ! এত সুন্দর জীবকে মেরে ফেলি! কিন্তু এ সদিচ্ছা রাখতে পারিনি। রসনা হৃদয়ের চেয়ে প্রবল। এখানকার ভেড়াও বড় রূপবান, লাবণ্যময় প্রাণী। স্কটল্যান্ডের সবুজ পাহাড়ে চরে বেড়ানো ভেড়াদের স্বাস্থ্য ঈর্ষণীয়, কিন্তু এত রূপ তাদেরও নেই। প্রায়ই গাড়ি থেমে থাকছে। দু-তিনটি রাখাল ছেলে দু-তিনশো ছাগল ভেড়া নিয়ে চরাতে যাচ্ছে। ধবধবে সাদা ছাগলগুলোর দীর্ঘ লোমে ভরা শরীর।-’জাঠ। সব জাঠ। কেউ গাঢ়োয়ালী নয়—’ বলে সুরথ সিং। ‘জাঠেরা জানোয়ার পোষে, আর কসাইদের কাছে বেচে দেয়। এই সব নিয়ে যাচ্ছে মিলিটারি ক্যাম্পে বেচবে।’ গাঢ়োয়ালবাসীরা জাঠদের খুব ভাল চোখে দেখে বলে মনে হল না। ‘গাঢ়োয়ালীরা কী করে?’—’চাষবাস করে। ভেড়াও অবশ্য পোষে। পশম বানায়। ছাগলও যে পোষে না তা নয়, তবে কেবল দুধ খাবার জন্য। কসাইদের কাছে বেচবার জন্য নয়।’

এক সময়ে কিছু অদ্ভুত পুরনো নেপালী পাজামার মতো প্রচুর কুঁচি দেওয়া সালোয়ার, শার্ট উড়নি পরা কিছু সুন্দরী গেল ঘোড়ায় চেপে। বেশ কিছু মালপত্তর সমেত

-ওরা কারা? জাঠ?

—না না, জাঠ কেন হবে, ওরা তো গুর্জর।

—মানে?

—জাঠেরা যেমন পাহাড়ি নয়, তাদের নাক চোখ আলাদা। গুর্জররাও পাহাড়ি নয়। তারা সেই বহু দূর দেশের মানুষ। কাশ্মীরের ওপাশের উপত্যকার জংলী লোক। মুসলমান। মহিষ চরায়। দুধ বেচে। গুর্জররা মোটে গ্রামের ভেতরেই থাকে না, ওরা জাঠদের মতো নয়। ওরা বনের মধ্যে বাস করে। তাঁবুতে। ‘জানবর লোগোঁকো সাথ সাথ রহতা।’ শীতে নিচের দিকে নামতে শুরু করে। জানোয়ারদের নিয়ে হৃষীকেশের সরকারি সংরক্ষিত অরণ্যে চলে যায়। অন্যান্য বনবাদাড়ে জীবজন্তুরা নির্ভয় হতে পারে না।

ইন্দর সিং

ভাটওয়াড়ির পর গাঙ্গনানীর কিছু আগে অবশেষে একটা ছোট চায়ের দোকান দেখা গেল। গাড়ি থামিয়ে নামলুম। সকাল বেলাই বেরিয়ে পড়েছি, চা পর্যন্ত না খেয়ে। ছোট্ট কাঠের ঘরে কাঠের উনুন জ্বলছে। একজন বৃদ্ধ গাঢ়োয়ালী চা তৈরি করছে। আমি আর সুরথ সিং ঘরের মধ্যে বসলুম। ছোটরা বাইরের পাথরের ওপরে বসে ভাগীরথীর শোভা নিরীক্ষণ করছে।

ঘরটা ছোট্ট। একদিকে কাঠকুটো জমা করা। অন্যদিকে পাটাতনে বসে আছে ইন্দর সিং। তাকের ওপর ডিম, বিস্কুট, ছোট্ট ছোট্ট পাউরুটি, চা, চিনি। দুটো বেঞ্চি পাতা। একটাতে আমি, অন্যটায় সুরথ সিং। সুখদুঃখের কথা হচ্ছে দুই পাহাড়ী বৃদ্ধে।

ইন্দর সিংদের গ্রামের জাঠ-গাঢ়োয়ালী জল-চল একটু-আধটু থাকলেও, বিয়েথা একেবারেই হয় না। গুর্জরদের সঙ্গে জল-চলও নেই। গুর্জররা তো কোনো গ্রামেরই বাসিন্দা নয়। গ্রীষ্মে থাকে গঙ্গোত্রীরও পিছনের গহন বনে। শীতে নেমে যায় সেই হৃষীকেশের জঙ্গলে। জংলী আদমি সব। ওদের সঙ্গে জলচল থাকবে কি করে? ওরা না জানে রাঁধতে, ঝুপড়ি মতন বানিয়ে, কি তাঁবু খাটিয়ে মাথা গুঁজে থাকে। না জানে চাষবাস করতে, না রাঁধতে-বাড়তে। পোড়া রুটি, পোড়া মাংস খায়। মেয়েরা পর্যন্ত যখন-তখন যেখানে-সেখানে আগুন জ্বেলে রাঁধতে বসে যায়। রান্নাঘরের আব্রুও নেই। ওরা যা তা।

পাহাড়ীরা নিজেদের জাত নিয়ে খুবই গর্বিত দেখলাম, বিষ্টই হোক বা ছেত্রীই হোক, ওরাই পাহাড়ী যোদ্ধার জাত, রাজপুতের জাত। আর জাঠেরা? জানবর পালনেবালা জাত হ্যায়। আর গুর্জর তো জংলী লোগ। ঝকঝকে স্টিলের গ্লাসে ভর্তি চমৎকার দুধ-চা এল। রুমালে জড়িয়ে গেলাস ধরতে হল।

ছোট্টখাট্টো ফোকলা দাঁত, ছানি পড়া চোখ, কুলুর টুপি মাথায় ইন্দর সিং বারবার বলল, ‘আমার এখানে তো যাত্রীরা কেউ থামে না। কোঈ নেহী, কোঈ নেহী রুখতা। সবাই সামনে দিয়ে চলে যায়। বাস যায়, ট্রাক যায়, মোটর যায়। কেউ কোনোদিন থামেনি। আজ পর্যন্ত নয়। তোমরাই প্রথম। যাত্রীরা সবাই ভাটওয়াড়ি বা গাঙ্গনানীতে চা খায়। এত গাড়ি যায় আমি কেবলই ভাবি, কে থামবে? কেউই কি থামবে না? আমার কত ভাগ্য যে আজ তোমরা থামলে। সারা জীবনই এটার কথা কল্পনা করেছি।’ চায়ের দাম নিল পঞ্চাশ। দশ পয়সা কম। কারা এই দোকানে আসে? কেবল পাহাড়ী রাখালরাই! আমি ইন্দরকে কথা দিলুম, ফেরার পথেও থামব, চা খেয়ে যাব, ইন্দর সিংয়ের দোকানে। তার নাতিরা এখন ভেড়া চরাচ্ছে ঐ ৩/৪টে যা আছে। আর ছেলেরা ক্ষেতে চাষবাস করছে। বুঢ়া হয়েছে ঠাকুর্দাদা, তাই এখানে চায়ের দোকান খুলে চুপচাপ বসে আছে। যথালাভ! ‘গঙ্গোত্রী গিয়েছ? ইন্দর সিং?’

‘নাঃ। ক্যায়সে যানা? গরীব আদমী।’

ঝরনা! ঝরনা!

গাঙ্গনানীর পর পথটা সত্যি খুব অদ্ভুত। কাঁচা রাস্তা তো বটেই, নুড়ি পাথর ধুলো কাদা আর ঝর্ণার পরে ঝরনা। এত ঝরনা আমি জীবনে আর একবারই দেখেছি, একটা বন্যায় আটকে যাওয়া ট্রেন থেকে। ফেদার রিভার ক্যানিয়নে যখন প্রচণ্ড বর্ষণে বিশালকার রেড-উডট্রীদের শিকড়সুদ্ধু উপড়ে রাস্তার ওপরে টেনে আনছিল এই সব নবজাত জলপ্রপাতের মরণস্রোত। কিন্তু এখনকার ঝরনার জাত আলাদা। এরাই এইসব পাহাড়ী গ্রামের প্রাণধারা। গাড়িকে প্রায়ই নিয়ে যেতে হচ্ছে ঝরনার ওপর দিয়ে, খুব সাবধানে, যাতে পিছলে পড়ে না যাই। প্রত্যেকটা বাঁক ঘুরতে হচ্ছে ভীষণ যত্নের সঙ্গে, প্রত্যেকটাই ব্লাইন্ড করনার। এবং প্রায়ই ইউ-বেন্‌ল্ড, হেয়ার পিন বেড। উল্টোদিক থেকে মত্ত বরাহের মতো প্রায়ই চলে আসছে ‘যাত্রা’ চিহ্নিত বাস। ট্যাক্সি চোখে পড়ল দুটি-একটি। প্রাইভেট একটিও না। একটি জায়গায় বাঁ পাশে চওড়া, চমৎকার ভাগীরথী নদী–সেই উন্মত্ত পার্বত্য মূর্তি নেই—মাঝে ‘চড়া, গ্রামের মেয়েরা তামা পেতলের কলসীতে জল ভরছে।

আমরা প্রত্যেক ঝরনায় থামছি আর ফ্লাস্কে খাবার জল ভরছি। ঝরনার জল ফ্রিজের মতো ঠান্ডা আর কি মিষ্টি! একটাও অস্বচ্ছ, অমিষ্ট ঝরনার জল দেখিনি। থামবার প্রধান কারণ অবিশ্যি ফ্লাস্ক নয়। ইঞ্জিন। উত্তরকাশী ছাড়বার পরেই আমাদের গাড়ির একটা তেষ্টা রোগ হয়েছে। কেবলই তার জল শুকিয়ে যাচ্ছে, ইঞ্জিন গরম হয়ে যাচ্ছে। এ রাস্তা যে জীপগাড়ির। আয়েসী অ্যাম্বাসাডারের রাস্তা তো এ নয়? তার স্নায়ুতে চাপ পড়ছে এত চড়াই ভাঙতে। মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। প্রত্যেকটি ঝরনায় র‍্যাডিয়েটারে জল ঢালছি, আর দুটো বোতলে জল ভরে নিচ্ছি। পিকোর গা গুলোনো সেরে গিয়েছে। এই পথ যথেষ্ট ঠান্ডা, খোলা মেলা। বারবার থামতে হচ্ছে, নামতে হচ্ছে, ঝরনা-টরনার সঙ্গে মাখামাখি হচ্ছে, ভাববিনিময় হচ্ছে, এসব পিকোর খুব পছন্দ। মনের সুখে ছুটোছুটি, জল ঘাঁটাঘাঁটি করছে সুরথ সিং আর রঞ্জনের সঙ্গে। আমিও করছি না এমন বলতে পারি না।

পথটির সৌন্দর্য ঠিক বর্ণনা করতে পারব না। প্রাণ জুড়ানো। ভাগীরথীর উৎস সন্ধানে গেলে পথ এমনটিই হওয়ার কথা। তবে এই মুহূর্তে খুব বিপজ্জনক হয়ে রয়েছে। যে কোন ঝরনায়, যে কোনো বাঁকে, গাড়ি পিছলে যেতে পারে। উন্মত্ত বাসের সঙ্গে ধাক্কাও লাগতে পারে। বর্ডার ফোর্সের লোকেরা রাস্তা মেরামতির কাজ করছে।

কে তুমি?

পথের ধারে হঠাৎ দেখি বিরাট, সুগোল, একটি সাদা গ্লোবের মতো বস্তু। কি সুন্দর, কত বড়ো শ্বেত পাথর! এখানে পাথরের নানারকম রং—কমলা, সাদা, ধূসর, কালো—দুদিকে কালো মধ্যে কমলা, সাদা কালো লাল কতরকমের স্যান্ডুইচের মতো প্রস্তরখণ্ড—পিকো আর রঞ্জন চেঁচাচ্ছে—’মেটামরিফিক রক্ ফর্মেশন’, ‘স্ট্যাটিফায়েড রক্’, ভূগোলে পড়া পাতি—

চ-ভূতত্ত্ব। আমি দুয়েকবার ‘ফসিল! ফসিল!’ বলে চেঁচিয়েও পাত্তা পেলুম না তবে এতবড় শ্বেতপাথরের চাই একটাও দেখিনি। রঞ্জনের চেঁচানি শুনে হাসিমুখে সুরথ সিং বলল, ‘উয়ো তো পখল নহি হ্যায়। বরফ খন্ড হ্যায়। আইস। স্নো থা, জম্ কর্ আইস বন্ গয়া হোগা।’ ও হরি, এই রোদের মধ্যে ঝকমক করে পথের ধারে গোলচে হয়ে বসে আছেন। আপনি তবে তুষার বাবু! এই প্রথম স্নো-র নৈকট্যে এসে দুই বাঙ্গাল, সুরথ সিংয়ের দুই ‘বাবা’ ঔর ‘বেবি’ মহা উত্তেজিত। কিন্তু হায়! গাড়ি থামল না। ‘ঔর বহোৎ মিলেগা। বদ্রীমে বরফকা উপরসে চলা হ্যায়। কেদারমে বরসে পায়দল যানা। ইয়ে তো কুছ বি নেহি!

লংকাকাণ্ড

লংকায় পৌঁছে গেলুম নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই। এখানেই মোটররাস্তা শেষ। ট্রেকিং শুরু। তিন কিলোমিটার পরে ‘ভৈরবঘাঁটি’ শিখরে পৌঁছে ফের মোটর রাস্তা মিলবে। মিলিটারিদের তৈরি রাস্তা। গঙ্গোত্রীর ওপারেই মিলিটারি ঘাঁটি—ভারত তিব্বত বর্ডার। ভৈরবঘাঁটিতে জীপগাড়ি আর বাস থাকবে। এই মাত্র তিন কিলোমিটার রাস্তা মোটরেব্ল করা যায়নি। একটা ব্রিজ তৈরি হচ্ছে যমুনার মাথায়—সেটা শেষ হয়ে গেলেই আর সমস্যা থাকবে না। সোজা মিলিটারি ট্রাক চলে যাবে ভৈরবঘাঁটি পর্যন্ত। সেই সঙ্গে সঙ্গে যাত্রীদের বাসও।

.

যাত্রীদের জন্য লংকাতে ‘হাট’ আর ‘টেন্ট’ আছে বলেছে ইউ পি ট্যুরিজমের গাইডবই। সেখানেই রাত্রে থাকব ঠিক করেছি। এটা এক বিশাল বাস স্ট্যান্ড। বিশ-পঁচিশটা বাস দাঁড়িয়ে আছে বিভিন্ন কোম্পানির, কিছু রেগুলার পাবলিক ট্রান্সপোর্টের, কিছু রিজার্ভ ট্যুরিস্ট কোম্পানির। প্রত্যেকটিরই শিয়রে লেবেল আঁটা ‘যাত্রা’—ইংরিজিতে হিন্দিতে। মাথার ওপরে বুকে পিঠে লেখা—’যমুনোত্রী-গঙ্গোত্রী-কেদারনাথ-বদ্রীনাথ।’

সারাপথ এদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে। ভেতরে আকুল কিছু পুণ্যার্থী মুখচ্ছবি।—অধিকাংশই দেহাতী। কিছু বঙ্গসন্তান

রঞ্জন বললে, ‘আগে চল খেয়ে নিই।’ পিকো থাকার ব্যবস্থাটা করে আসতে গেল। এসে বলল, ‘তাঁবুর ভেতরটা দেখা হয়নি। তবে বাথরুম নেই, ঐ ক্যানভাস—’মূত্রাগার’ ইত্যাদি ছাড়া। আর কুটির বলতে টিনের বিস্কুটের বাক্সোর মতন কয়েকটা ঘর। বাথরুম আছে। ঘোর অন্ধকার কিউবিকূলে, একটা গর্ত! অফিসার লাঞ্চ খেতে ব্যস্ত, কথা বলবেন না এখন।’—’চল্ তবে আমরাও খেয়ে নিই।’ লংকা-চটিতে খাবারের দোকানের সমুদ্র—সেখানে একধারে খাদ্য অন্যধারে কাঠের পাটাতনে শতরঞ্চি পাতা। আর লেপ-তোষক ডাঁই করা। খেতে পেলেই বোধহয় যাত্রীরা শুতেও চায় এখানে। গরীব দেহাতী যাত্রীরা রাত্রে এখানেই আশ্রয় পায়, বোধ হয় দু’তিন টাকায় লেপ-তোষক ভাড়া করে।

বেঞ্চি পেতে খেতে বসলুম। দোকানি খুবই যত্নআত্তি করল। নিম্বু? হরা মির্চা? পাপ্পড়? আচার? ঘিউ? পাঁচ টাকায় এক শো ঘি দিয়ে ডালফ্রাই করে দেব কি? শেষে দেখা গেল, নুন আর জল ছাড়া প্রত্যেকটা এক্সট্রাই এক রুপাইয়া, আচার দো রুপাইয়া! রঞ্জন সর্বত্র জিলিপি খাচ্ছে। আমি আর পিকো খাচ্ছি না, কেউ টিকে নিইনি কলেরার। কেবল ওকে হিংসে করছি। আর ‘খাসনি, খাসনি’ বলছি।

.

রোদ ঝাঁ ঝাঁ। বাসস্ট্যান্ডের একধারে গাছতলায় ছায়া ছায়া খানিকটা জায়গা। তীর্থযাত্রী মানুষেরা সেখানে সংসার পেতেছেন। তিনপাথরের অনেক উনুন জ্বলছে, বিভিন্ন সংসারের হাঁড়ি চড়েছে, গরম ভাতের গন্ধ বেরুচ্ছে। যাত্রীরা খাওয়া-দাওয়া করছেন। বিছানাও পাতা হয়েছে এখানে ওখানে। বাচ্চা ঘুম পাড়ান হচ্ছে। রঙের মেলা বসেছে—উজ্জ্বল নীল, হলুদ, বেগুনী, খয়েরী। দেখে মনে হয় দলে দলে পিকনিক পার্টি, ওপাশে সেই ক্ষুদে ক্যানভাস ঘেরা দুটি শৌচাগার আর মূত্রালয়, মহিলা, পুরুষ। যথেষ্ট মোটেই নয়, মানুষের তুলনায়।

চার-পাঁচটা মানুষ লাঠিহাতে ফিরে এল। দেখে মনে হল বাঙালী—জিজ্ঞেস করি, ‘খুব ক্লান্তিকর কি?’

হাঁপাতে হাঁপাতে বললে, ‘নাঃ, খুব বেশি নয়। যাবার সময়ে তত কষ্ট নেই, তবে ফেরবার সময়ে একটু বেশি চড়াই মনে হয়। একদিনেই দু’বার যাতায়াত না করলে সেটুকুও হত না।’

‘রাত্রে রইলেন না কেন?’

‘এখানেই খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা, তা ছাড়া বাস ধরতে হবে তিনটের সময়। এখনই রান্না-বান্না আছে—‘

‘কী করে রাঁধবেন? উনুন বানিয়ে?’

‘না না, স্টোভ কিনে ফেলেছি। প্রথম প্রথম বাইরেই খাচ্ছিলুম। বড্ড বেশি খরচ—দিনে পার পারসন দশটাকা, চারজনে চল্লিশ টাকা পড়ে যাচ্ছে। শেষে স্টোভ, হাঁড়ি, কেরোসিন, চাল ডাল আলু পেঁয়াজ নুন তেল কিনে ফেললুম। খিঁচুড়ি-ডিমভাজা দিব্যি চালাচ্ছি, দশটাকাতে হয়ে যাচ্ছে। এখনও কেদারবদ্রী বাকী, বুঝলেন না? খরচের দিকটা তো দেখতে হবে?’ আমি মন দিয়ে শুনছি। পিকো প্রচণ্ড বোর্ড হচ্ছে। ‘খরচের দিকটা’ ওকে তো দেখতে হয় না, এ প্রসঙ্গ ওর অচেনা।

‘মা, অফিসে বলেছিল আটার লাঞ্চ খোঁজ নিতে।’

.

না, গঙ্গোত্রীতেই থাকব ভাবছি, লংকাতে নয়। এখানটা সুবিধের হবে না, একদিনে দুবার যাতায়াত না করলেই তো ভালো। গঙ্গোত্রী নাকি যমুনোত্রীর মতো নয়। চমৎকার মন্দির আছে বড় চত্বরওলা, গঙ্গার ঘাট আছে প্রাণ জুড়োনো, মুনিঋষিদের আশ্রম আছে। ধরমশালা, ট্যুরিস্টলজ, বাসস্থানের অভাব নেই। অফিসার বললেন, ‘এখানে বুকিং নিষ্প্রয়োজন। ওখানে গিয়েই জায়গা পাবেন। তাছাড়া এখান থেকে খবর দেবার উপায়ও নেই। যাবার সময়ে লাঠি ভাড়া করতে ভুলবেন না যেন। অনেক চড়াই উৎরাই আছে।’

রঞ্জনের সঙ্গে সুরথ সিং লাঠি আনতে গেল। ওর মন ভালো নেই। গঙ্গোত্রীতে স্নান হবে না। লংকা অনেক দূর। এখানে গাড়ি ছেড়ে যেতে পারবে না বেচারী।

রামশরণ

অফিস থেকে বেরিয়ে গাছতলা দিয়ে যেতে যেতে দেখি কম্বল মুড়ে একজন তীর্থযাত্রী শুয়ে। তার পাশে বসে এক মধ্যবয়সিনী দেহাতী নারী খুনখুন করে কাঁদছেন। অসুখ করেছে?

‘কী হয়েছে, মাঈ?’ মাঈ আর কোনো উত্তর দেন না। ওড়নায় মুখ ঢেকে খুব মৃদুস্বরে কাঁদেন। এই সময়ে একজন বৃদ্ধা আর একটি বালিকার উদয় হল। বৃদ্ধা বললেন, ‘উস্কা রামশরণ হো গয়া, বেটি।’

‘ক্যায় যা!’

‘রামশরণ। রামজীকা পাস্ চলা গয়া উয়ো।’ শান্ত কণ্ঠস্বর।

মাথায় বাজ পড়ল আমার। মৃতদেহ? মৃতদেহ আগলে বসে আছেন এই মহিলা? এই দূর বিদেশে?

‘কাঁহাসে আয়ে হেঁ?’

‘গাঁওসে–রাজস্থানসে—‘

‘সাথমে ঔর কৌঈ—?’

‘হাঁ হ্যায়, সাথমে তিস্ আমি হ্যায়, উসকো দেশওয়ালোঁ সব গঙ্গামাঈকে পাস নাহানে গয়া। ইকো গঙ্গোত্রী দরশন বি নাহি হুয়া। বিচারা। তদির।’

‘কল্ জাউঙ্গী,’ কাঁদতে কাঁদতেই হঠাৎ মহিলা বলেন। একটু চমকে যাই।

কী হয়েছিল? দাস্তবমি? জ্বর? হঠাৎ দেখি একটু দূরেই দাস্ত পড়ে আছে। মাছি ভন্‌ভন্।

 মুহুর্তেই বুকের মধ্যে লাফিয়ে উঠল ভয়। অমনি নিজের মেয়েটিকে কোলে টেনে নিয়েছি আর বলেছি—’পিকো রে পালা! কলেরাও হতে পারে! আর এখানে এক মিনিট নয়। চল—থানায় খবর দিই গে।’

যেতে যেতে শুনি বালিকাটি কিছু জিজ্ঞেস করছে। কান্না থামিয়ে মৃত ব্যক্তির বোন তাকে বুঝিয়ে বলছেন পুঁটলির কোনখানে আটা পাওয়া যাবে, কোনখানে ঘিউ, কোথায় শঙ্কর—এই সব শুনে পিকোটা কেমন উদ্ভ্রান্ত হয়ে গেল। এই প্রকট মৃত্যু আগলে বসে মহিলা কী করে’ ঘি-আটা-চিনির কথা ভাবছেন? কিন্তু আমি অবাক হইনি। শুধু মৃত্যু আগলে থাকলেই তো হবে না? জীবনটাও তো আগলাতে হবে! ঐ বাচ্চাটা খাবে তো? এখন যে সবার ‘খানা পকানেকো টাইম’!

সদাশিব পুলিশ বললে, কুছ দিক্কত্ নেহি। যদি পোড়াতে চায়, লাকড়ি লা দুংগা, যদি ঘরে নিয়ে যেতে চায় সার্টিফিকট দুংগা। ইয়ে তো হামেশাই হোতা হ্যায়। হর্ রোজ কোঈ ন কোঈ মরতা ইধরমে আর্ ক।

তবু যাত্রী আসবে, যদিও পথ দুর্গম, যদিও রোজই কেউ মরছে এখানে পৌঁছে। তথাপি আসা কেন? তীর্থভ্রমণ কিসের আশায়? আশা একটিই। চিরত্বের, স্থিরত্বের আশা। অহনি অহনি ভূতানি গচ্ছত্তি যমমন্দিরম্ শেষাঃ স্থিরত্বমিচ্ছন্তি। এর পরে আর আশ্চর্য কী?

জাহ্নবী-যমুনা

হাঁটা পথের রাস্তাটা অনন্যসুন্দর। যমুনোত্রীর পথের মতো নয়, অনেক চওড়া। গঙ্গা অনেক কাছাকাছি, যমুনার মতো অত গভীর খাদ নয়, গঙ্গার সঙ্গে চেনাশুনো হয় সহজে। রূপসীও সে অন্য ধরনে। সারাটা পথ কত ঝরনা ঝরছে, গঙ্গার স্রোতের সঙ্গে এসে মিলছে। প্রথমে খানিকটা উত্রাই। তারপর সিঁড়ির মতো চড়াই। পথে অনেকখানি রাস্তা কাঠের রেলিং ঘেরা। বেশ মনের আনন্দে চলেছি। ভাগ্যিস খচ্চর নেই এখানে! প্রথম কিলোমিটার যখন ফুরাল, কী উল্লাস আমার মনে, পরিশ্রম অবশ্য হল পাঁচ কিলোমিটার হাঁটার মতন। হাঁপানিকে প্রশ্রয় না দিয়ে, খুব আস্তে আস্তে হাঁটছি। পথে দলকে দল মানুষ ‘জয় গঙ্গামাঈ’ বলে হাতে জলপাত্র নিয়ে ফিরছেন। মাথায় পুঁটলি। কোলে শিশু, হাতে জলপাত্র। স্ত্রী, পুরুষ উভয়েরই। যমুনোত্রীর মতো বন্য নয় গঙ্গোত্রী—যমুনোত্রীর বন্যতা যদি হয় সাবলাইম, গঙ্গোত্রীর সভ্যতা তাহলে বিউটিফুল।

এ পথে রাখাল বালিকা বাছুর নিয়ে হাঁটে। পথে ডাণ্ডীর উৎপাত নেই। খচ্চরও নেই ভেবেছিলুম। কিন্তু কার্যত তা হল না। সারা পথটা খচ্চরের মোকাবিলা করতে করতে যেতে হল। এই খচ্চরগুলি হিমালয় পর্বতের উপযুক্তই বটে। মিলিটারি মিউল এরা, ভারত সরকারের সেবায় নিযুক্ত। দৈর্ঘ্যে প্রস্থে যে কোনো উচ্চবংশীয় অশ্বকে হার মানাতে পারে। ‘অশ্বতর’ মানে ‘অশ্বের চেয়েও অশ্ব’ যদি হত, তাহলে এরা সেই সংজ্ঞা পাবার যোগ্যতা রাখে। কী বিশালদেহ, তেজোদৃপ্ত, তেলচকচকে চামড়া দলাই মলাই করা চেহারা। কে বলবে, এরাও খচ্চর। খচ্চর যারা গালি হিসেবে ব্যবহার শুরু করেছিল তারা নিশ্চয় এদের দেখেনি। ভালো ঘোড়ার সম্ভ্রান্ত স্বাস্থ্য ঔজ্জ্বল্য এবং খচ্চরের পার্বত্য কুশলতার এক অসামান্য সমন্বয় এরা। একটি সিঁড়িপথে একশো কুড়িটি খচ্চর নামলেন। সব যাত্রীরাই যাত্রা স্থগিত রেখে, পাহাড় ঘেঁষে দাঁড়িয়ে এই অপূর্ব খচ্চর মিছিলকে গার্ড অব অনার দিতে লাগলুম। তাঁদের প্রত্যেকের পিঠে কামান বাঁধা। তাঁদের প্রত্যেকের সঙ্গে দু’তিনজন করে সেবক জোয়ান ছুটছেন। মুগ্ধনয়নে এই দৃশ্যের ছবি তুলব বলে আমি প্রস্তুত, হঠাৎ মেয়ে ছুটে এসে বললে, ‘লেন্সের ঢাকাটা বন্ধ।’ লেন্সের ঢাকনি খুলে ফের ক্যামেরা তাক্ করেছি, এবার পিঠে টোকা পড়ল। ফিরে দেখি এক গুরুগম্ভীর মিলিটারি অফিসার। ‘মিলিটারির ছবি তুলতে হয় না, সিস্টার’

‘এমনকি তার খচ্চরেরও না?’

হেসে ফেলে অফিসার বলেন, ‘না, এমন কি খচ্চরেরও নয়। এটা মিলিটারি অপারেশন।’ ‘অ’

বর্ডার থেকে যখন কোনো রেজিমেন্ট বদলি হয়ে যায় তারা নিজেদের অস্ত্রশস্ত্র সমেত চলে যায়। পরবর্তী রেজিমেন্ট তাদের নিজেদের কামান-টামান সঙ্গে করে আনবে। আমার এটা খুব আশ্চর্য মনে হল। এই পার্বত্য অঞ্চলে, কঠিন পথে এত কষ্ট করে বারংবার কামান ওঠানো নাবান কি একান্তই আবশ্যক? এতে কেবল জন্তুগুলিরই কষ্ট হচ্ছে তা নয়, মানুষের কষ্টও কম নয়। সিঁড়ি ভাঙতে খচ্চররা ভয় পায়। সেই তাদের সিঁড়ি ভাঙানোর চেষ্টায় কি মানুষেরই কম কষ্ট হচ্ছে? ভীত, অনিচ্ছুক জীবগুলিকে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে নামতে হচ্ছে পিঠে ভারী কামান বয়ে। শেষদিকে ৪/৫টি কামান এল মানুষ-বাহিত হয়ে। চারজন করে জোয়ান স্ট্রেচার বহনের মতো কামান বহন করে ছুটছে। মুখে ছাদ-পেটাইয়ের কি রাস্তা-পেটাই কুলিদের মতো ছড়ার গান শুনেই বুঝেছি তাদের প্রচণ্ড পরিশ্রম হচ্ছে। ঘর্মাক্ত মুখগুলি নেহাৎ কচি। ভৈরবঘাঁটির সৈন্যশিবির থেকে আসছে এরা।

গঙ্গাযমুনার সঙ্গম বলে একটি জায়গায় লেখা আছে। সেখানে দুটি রঙের দুটি নদী প্রচণ্ড বেগে এসে মিশছে। একটি নীল অন্যটি গেরুয়া। দুটি রং স্পষ্ট আলাদা। এই নদীর পাথরগুলির গড়নও খুব অদ্ভুত। বিরাট গোলাকার। ইংরিজিতে যাকে ‘বোলডার’ বলে তাই। যমুনা যথারীতি গভীর সোজাসুজি খাদ তৈরি করে বয়ে যাচ্ছে প্রচণ্ড বেগে—ভাগীরথী তীরটা আরেকটু ছড়ানো। সঙ্গমের কাছে নামা যায়, পাথরে গিয়ে বসা যায়। একটি পরিবার শিশুসমেত ওখানে বসে খাওয়াদাওয়া করছেন দেখা গেল। যমুনার দুধারে প্রায় পাঁচ-ছ’ হাজার ফিটের খাড়া পাথুরে দেওয়াল উঠে গেছে, ঠিক যেন কোনো কেল্লার পরিখা।

হৃদয়ে তোমার দয়া

ভৈরবঘাঁটি যত কাছে আসে, পিকো ততই দেহাতীদের দেখাদেখি পাকদণ্ডী বেয়ে উঠতে চায়। আমি যমুনোত্রীর গল্প শুনে এসেছি, আমি তো ওকে কিছুতেই পাকদণ্ডী বাইতে দেব না। অত্যন্ত বিরক্ত ও বিমর্ষ হয়েই পিকো শেষ পথটুকু অতিক্রম করল।

পৌঁছুতে পেরে আমার কী গর্ব! তিন কিলোমিটার যে পারে, তেরো কিলোমিটারও সে পারে। তবে টাইম লাগবে তিন যদি দেড় ঘণ্টা হয়, তেরো তবে সাত আট ঘণ্টা? নাঃ, থামতে হবে। বেশ, দশ ঘণ্টা? যমুনোত্রীটা হেঁটে উঠলেই ঠিক হত। এত কষ্ট হত না। দেখাটাও সুসম্পূর্ণ হয়নি। চোখের ভেতর মনটা ছিল না।

ভৈরবঘাঁটিতে পৌঁছে দেখি সেই বাঙালী দলটির একজন বৃদ্ধ বসে আছেন। ‘মেসোমশাই, বেশ তো এত আগে একা একা উঠে এসেছেন, দলের বাকীরা কই?’

একথা শুনে তিনি খুব খুশি—’ভেবেছিলুম পারবই তো, তা কার্যত দেখছি আমিই ফার্স্ট হয়েছি।’

আমরা চা খাব। মেসোমশাইকেও খাওয়ালুম। একসঙ্গে বসে গল্প করছি, কেননা এখন কোনো বাস নেই। জীপ দশ-বারোজন লোক চায়। ষাট টাকা ভাড়া, ও বারোজন মানুষ না হলে ছাড়বে না। ঠিক আছে, বাকি বাঙালীরা চলে আসুন, তারপর ব্যবস্থা নিশ্চয় হবে। আরেকজন বৃদ্ধ এসে গেলেন ওঁদের দলের। অল্পবয়সীদের চিহ্ন নেই। চা খেতে খেতে গল্প হল। মেসোমশায়ের প্রবল বাত। এককালে বাতে পঙ্গু ছিলেন। এখন সত্যি সত্যিই পর্বত লঙ্ঘন করছেন। বিনা কষ্টে। আর অন্যজনের (কাকাবাবু?) একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে হিপজয়েন্ট পুরো ভাঙা। একটি লৌহশলাকা ঢুকিয়ে অস্থি দুটি গাঁথা আছে। কলকাতায় বেশিদূর হাঁটা বা দোতলা বাসে চড়া তাঁর বারণ। তিনিই খচ্চরে চড়ে যমুনোত্রী করে এসেছেন। এখন পদব্রজে গঙ্গোত্রী।

‘তিনি দয়া না করলে হয় না।’

‘তাঁর দয়া থাকলে সবই হয়।’

হাসিমুখে পাকা দাড়ি নেড়ে চকচকে টাক নিয়ে কাকাবাবু আর মেসোমশাই ঈশ্বরকে সার্টিফিকেট দিলেন। মনে মনে বলি, ‘আমার যা হাঁপানি, তবু এই আমিও তো পেরে যাচ্ছি!’

.

একটু বাদেই তাঁদের দলবল এসে পড়ে। ভৈরবঘাঁটিতে ভৈরবমন্দির আছে। সেখানে গিয়ে ওঁরা ছবি তুলতে লাগলেন। ওঁদের সঙ্গে একটি তরুণ ব্রহ্মচারী আছেন। তিনিই পথপ্রদর্শক। অনেকবার এপথে এসেছেন। তাঁর তো সমগ্র উৎসাহ দেখলুম তাঁর দলের তরুণী ছাত্রীটির প্রতিই অনন্য-নিবদ্ধ। এটা খেয়াল করেছে রঞ্জন। (সেও হয়তো ছাত্রীটির প্রতি উৎসাহিত বোধ করতে গিয়েছিল!) তাঁরা বাসের খোঁজ নিচ্ছিলেন। আমি জীপের কথা তাঁদের বললুম। এবং ঠাঁই চাইলুম। মেসোমশাই পিকোকে ‘নাতনী’ ডাকছেন এবং চা খেয়ে খুব খুশি। তাঁর খুব ইচ্ছে ছিল একসঙ্গে যাওয়ার।

‘কেন জায়গা হবে না? যদি হও সুজন, তেঁতুলপাতায় ন’জন, সবাই মিলেই যায়।’

কিন্তু ওঁর দলটি মেসোমশায়ের ‘সৌজন্যপূর্ণ’ কথা শুনল না। তাঁরা জানালেন জায়গা নেই—জিপ ভর্তি হয়ে গেছে। ওঁরাই যথেষ্ট সংখ্যক। ‘দুঃখিত ভাই’ বলে মিষ্টি হেসে ওঁরা চলে গেলেন। বাস-স্টেশন তখনও ফাঁকা। মরীয়া হয়ে মেসোমশাই বলে ফেললেন, ‘এরা আমাদের আগে এসেছে, কতক্ষণ দাঁড়াবে? নাতনীকে অন্তত আমি কোলে নিয়ে যাই—’

পিকো রাজী হল না।

বাস-বাসনা

পিকো গেল না। তক্ষুনি উল্টোদিক থেকে বাস এসে দাঁড়াল। কুলকুল তার করে চতুর্দিক দিয়ে শতধারায় মানুষ ঝরে ঝরে পড়তে লাগল। ঝরতে ঝরতে বাস খালি হতে না হতেই মানুষ আরেকদিক থেকে চড়ছে (দুটো দরজা আছে)। রঞ্জন এসে বলল, ‘তাড়াতাড়ি উঠে পড়ো—জিপ আর নেই।’

দৌড়ে গিয়ে আমি আর পিকো উঠে পড়ি। ড্রাইভারের পাশের সরু সিটে অনেক মালপত্র নিয়ে এক মহিলা। তাঁকে ঠেলেঠুলে মাল সরিয়ে আমি বসে পড়ি। পিকোকে গিয়ারবাক্সের ওপর তুলে বসাই। মিনিবাসে ওখানে তো সীট পর্যন্ত সেঁটে দেয় আজকাল! রঞ্জন ছাদে গিয়ে উঠল রঞ্জনের কাঁধেই প্রধানত আছে রাকস্যাকটি। কখনও বা পিকোর কাঁধেও থাকছে। সেটা নামিয়ে ভেতরে নিয়ে নিয়েছি।

খানিক পরে বাসের মধ্যে সার্ডিন মাছের টিন ঠাসার মতন সূচীভেদ্য অবস্থা হল। ঠিক এই সময়ে পেছনে একটা করুণ আর্তি কানে এল—’দিদি! ছাদ থেকে নামিয়ে দিয়েছে।’

রঞ্জন সারারাস্তা বাসের শেষ সিটের সামনে দাঁড়িয়েছিল, বাসের পশ্চাদ্বর্তী পথ দেখতে দেখতে এসেছে। আমরা একদম সামনের কাচ দিয়ে পরিষ্কার বিপুল তুষার মেঠলি ভগীরথ পর্যন্ত এবং তার আশেপাশের সব শুভ্র চূড়াগুলি দেখতে দেখতে এসেছি। স্বচ্ছনীল আকাশের গায়ে ঝকঝকে রুপোলি শিখরমালা। সবুজ বনে ঢাকা উপত্যকা। আর সেই অবিরাম ঝরনা, ঝরনা। তফাৎ এই, ইচ্ছেমতন বাস থামে না। ঝরনার জল স্পর্শ করা, পান করা যায় না আর বাস যেন উন্মত্ত হাতির মতো দাপিয়ে ছুটছে। মোড় নিচ্ছে কী স্টাইলে—যেন সে বাসই নয়,মোটরবাইক!

আমার প্লেনে যেতে সবচেয়ে খারাপ লাগে। কিছুই দেখা যায় না। তার চেয়ে ট্রেন ভালো। কিন্তু ট্রেনও বাঁধা লাইনে যায়। তার চেয়ে বাস ভালো। বেশ গাছপালার ভেতর দিয়ে, বনজঙ্গল ভেদ করে, জীবজন্তুর চোখে আলো ফেলে, নদী-ঝরনার গা ঘেঁষে কিম্বা জল ছুঁয়েই বাস ছোটে। তার চেয়েও গাড়ি ভালো, কেননা তার কন্ট্রোল নিজেরই হাতে। ইচ্ছেমতন থামা যায়, যা খুশি ছোঁয়া যায়। একটা বইতে পড়েছিলুম যে গাড়ির চেয়েও মোটরবাইক ভালো। সেখানে পা বাড়ালেই মাটি, আর তোমার চারিপাশে আলো হাওয়া বৃষ্টির সর্বাঙ্গীণ স্পর্শ। কিন্তু যেটি সবার চেয়ে ভালো, সারা হিমালয় জুড়ে সাধুরা সেটাই করে দেখাচ্ছেন। পায়ে হাঁটা। গঙ্গোত্রীর এই তিন কিলোমিটারের জন্যে আমি সরকারের কাছে কৃতজ্ঞ। যমুনোত্রীতেও অবশ্য ফেরার পথে হেঁটে নেমেছিলুম জানকী চটি অবধি। সাত কিলোমিটার। ভালো লাগা বলতে যেটুকু সেই জন্যেই। কিন্তু ওই বৃষ্টি কাদা এবং তার পূর্ববর্তী অপ্রিয় অভিজ্ঞতায় সেই যাত্রার পরিপূর্ণ রসাস্বাদন ঘটেনি। আজ আকাশে ঝকঝকে অথচ অনুষ্ণ রোদ,গায়ে শীতের তাজা বাতাস, চারদিকে উজ্জ্বল হাসিমুখের শোভাযাত্রা, সেদিনকার মতো অত ক্লান্ত, বিষণ্ণ মুখের সারি নেই—আজ গঙ্গোত্রী অন্য স্বাদ দিয়েছে। হিমালয়ের বাস-যাত্রাটিও মন্দ হল না। মাত্র সাড়ে তিন টাকা ভাড়া। তিনজনের সাড়ে দশ। জীপে না গিয়েই ভালো হল। এদের সঙ্গে, এই জনতা যাত্রীদের সঙ্গে ‘যাত্রা’ হল। এটা না হলে এ-যাত্ৰা সম্পূর্ণ হত না।

কাহারে হেরিলাম! আহা!

গঙ্গোত্রীতে নেমে আমরা দেখি, ভাল ট্যুরিস্ট লজটি নদীর ওপারে। ব্রিজ পার হয়ে। দণ্ডীস্বামীর আশ্রমের পাশে। ওখানে অ্যাটাচড বাথ আছে। যদি দু’তিনদিন থাকতে হয় তবে ওটাই ভাল। কিন্তু একবেলার জন্যে যদি ওখানে উঠি তবে যাতায়াতেই প্রচুর সময় এবং শ্রম ব্যয়িত হবে। গঙ্গামন্দির অনেক দূরে। চললুম দ্বিতীয় ট্যুরিস্ট লজে। সেটি মন্দিরের পাশেই। প্রথমেই তো মন্দিরে ঢুকেছি। সত্যি মনজুড়োনো মন্দির। প্রাঙ্গণটি পরিচ্ছন্ন, চারদিকে ছোট ছোট অনেক মন্দির, তাদের সামনে বারান্দা আছে, বসার জায়গা আছে, যাত্রীরা পুঁটলি বোঁচকা নিয়ে বসে আছে মন্দিরপ্রাঙ্গণে। যমুনোত্রীতে এসব নেই। এমন্দিরে গঙ্গাদেবীর প্রতিমা

বেরিয়ে এসেছি, ভাবছি ট্যুরিস্ট লজটি কোনদিকে, অকস্মাৎ কানে এল—‘নবনীতা মাসী!’

স্বপ্ন? মায়া? না মতিভ্ৰম?

‘নবনীতা মাসী! এই যে, ওপরে!’

ওপরে চোখ তুলে দেখি সামনেই কিছুটা ওপরে একটি হোটেল জাতীয় আস্তানা। তারই চত্বর থেকে ঝুঁকে পড়ে আমাকে ডাকছে খুব মিষ্টি একটা গলা।-’কে রে তুই? আমি দেখতে পাচ্ছিনা।’ তখন আঁধার নামতে শুরু করেছে আর মেয়েটা আলোর বিপরীতে।

‘আমি তো ঘুচাই!’

‘ঘুচাই? তুই এখানে?’

‘তুমি এখানে? আমি তো মা’র সঙ্গে এসেছি। এই ট্যুরিস্ট লজে আছি।’ ‘ও, এঁটেই ট্যুরিস্ট লজ বুঝি? আমিও ওখানেই থাকব। দাঁড়া, আসছি।’

সেখানে লাঠি হাতে দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের মতো কানঢাকা টুপি মাথায়-কে? কবিতাদি! হ্যাঁ, পাঠক, হ্যাঁ। বিশ্বাস হচ্ছে না তো? কবি কবিতা সিংহ, সশরীরে। নবনীতার সামনে। সপুত্রকন্যা। দুজনেই একসঙ্গে গঙ্গোত্রীধামে গিয়ে হাজির? বললেই হল? এতক্ষণ তবু সব ঠিকঠাকই হচ্ছিল, এবারে গল্প বানানো শুরু। এই ভাবছেন তো? ভুল করছেন, গল্প নয় সত্যি। ভুললে হবে না, এটা গোড়া থেকেই ম্যাজিকট্রিপ। গুপী গাইন! তাই এরকম হল। কবিতাদি, পুতুল, ঘুচাই, সমরেন্দ্র—মহাখুশি স্বগোত্রের মানুষ পেয়ে। আমিও খুব খুশি। পিকো-ঘুচাইতে মুহূর্তে শ্যামদেশী যমজ হয়ে গেল! সমরেন্দ্র আর পুতুলের সঙ্গে জুড়ে গেল রঞ্জন। এই ট্যুরিস্ট লজেই উঠেছেন আমাদের তেঁতুলপাতার নি-সঙ্গীরা। মেসোমশাই আমাকে দেখে যতখানি খুশি—ততটাই লজ্জিত—’যাক—তোমরা এসে পড়েছ! ইয়ে, দ্যাখো, আমি তো বুড়োমানুষ, আমার কোনো হাত ছিল না—’

আমি জানি। বুড়োমানুষদের এক ফোঁটাও কোনো হাত না-থাকার দিনেই আমিও বুড়ো হব।—’মেসোমশাই, আপনি কিছু ভাববেন না। আমাদের কোনোই অসুবিধে হয়নি।’

‘ঠিক তো মা? যাক! ‘

নিচের বাজারটা ছোট্ট, সেখানে অল্পই দু’চারটি চা-জিলিপি-পকৌড়ার দোকান, চা খেতে গিয়ে আবার দেখা সশিষ্য দেওঘরের বাবাজীর সঙ্গে। ব্রহ্মচারীর সঙ্গেও তাঁর চেনাশুনো আছে দেখা গেল। সম্ভবত গুরুভাই। একটা গ্র্যান্ড রি-ইউনিয়ন চলতে লাগল। চা এবং গঙ্গাজলের মধ্যে বসে।

সন্ধ্যায় গঙ্গামন্দিরে আরতি দর্শন করলুম প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে। বড়ো ভালো লাগল। অবাক হয়ে দেখলুম এবং কানে শুনলুম, এখানে সেই বিরাট দক্ষিণ ভারতীয় ভেঁপু (এই কি তূর্য) বাজছে, কর্ণাটকের মন্দিরে যা শুনে প্রথম মুগ্ধ হয়েছিলুম।

বদ্রীনাথের মন্দিরে শুনেছি কেরালার নাম্বুদ্রি ব্রাহ্মণ পূজারী হন। এই এক আশ্চর্য নিয়মে দক্ষিণ সমুদ্রকে গাঁথা হয়েছে উত্তরের তুহিন শিখরের সঙ্গে। এই গঙ্গোত্রীতেও তো দেখছি দক্ষিণী বাজনা বাজছে। কে বলে ভারতবর্ষ এক দেশ নয়?

মহাদেবের জটা

অঙ্গনেই অনেক সাধুসন্ন্যাসীর আড্ডা। ধুনিটুনি জ্বলছে, গাঁজাটাজা চলছে। দক্ষিণে সিঁড়ি নেমেছে ছোট্ট ভগীরথ মন্দিরে, সেইখানেই নাকি প্রথম গঙ্গাদেবী উৎসারিত হয়েছিলেন। এদের মতে ছ’হাজার বছর আগে। এখন গ্লেসিয়ার সরে গেছে বিশ কিলোমিটার দূরে। ভগীরথ পর্বতের গ্লেসিয়ার থেকে নেমেছে গঙ্গা। শুনেছি তুষার নদীরা হাজার বছরে মাত্র এক ইঞ্চি মতন সরেন। সেই হিসেবে সময়টা হাজার হাজার বছর আগে হবার কথা। এই সিঁড়ি থেমেছে গঙ্গাতীরে। তারপর উপলকীর্ণ বালির পথ গেছে জলধারার কাছ পর্যন্ত। আরতির বাজনা থেমে যাবার পরে নৈঃশব্দ্যে অন্ধকার যেন ঘনতর হল। গঙ্গার কলধ্বনি মন্ত্রতর। পায়ে পায়ে এগোলুম জলের দিকে। প্রচণ্ড শীতল বাতাস দিচ্ছে—এগোনো সমীচীন মনে হল না। অসুস্থ হলে অন্যদের মহামুশকিলে ফেলব। হেঁটে হেঁটে লংকাচটিতে ফেরা বাকি। গঙ্গাতীর থেকে ফিরে এসে, ট্যুরিস্ট লজেই খেয়ে নিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়েছি। পিছনের পর্বতের বিপুল ছায়ার দিকে তাকিয়েই হঠাৎ স্পষ্ট দেখলুম শিবের মাথায় চাঁদ। হিমালয়ের বিরাট অন্ধকার ছায়াশরীরের মাথায় এক অসম্পূর্ণ রূপোর তৈরি চাঁদ উঠছে। মুহূর্তেই পুরাণের চিত্রকল্পটির সত্যতা চোখের ওপর প্রমাণিত হয়ে গেল। ছায়ার নীচেই গঙ্গার ঝিঝিক্ কুলুকুলু।—’নদী, তুমি কোথা হইতে আসিতেছ? মহাদেবের জটা হইতে।’

ওই তো মহাদেবের জটা। জটাজুটধারী চন্দ্রমৌলি দেবাদিদেব। এই স্থির, নিশ্ছিদ্র প্রাপ্তির অনুভূতি নিয়ে শুতে গেলুম। প্রচণ্ড ঠান্ডা, আর বেশিক্ষণ বাইরে দাঁড়ান অসম্ভব।

শুতে গেলুম, কিন্তু ঘুম আসে না। ছোট্ট ঘর, তিনজন লোক, ঠিক উত্তর কাশীর সেই ট্যুরিস্ট লজের মতোই। কেবল আরও ছোট ঘর। লণ্ঠন দিয়ে গেছে। সেটা কমিয়ে কোণে রেখেছি। একটাই জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছিল একটা উঁচু পাথরের তৈরি দেয়াল। প্রচণ্ড শীত। সে জানলাও বন্ধ করে দিতে হয়েছে। ছাদ আর দেওয়ালের মধ্যে যথেষ্ট বড় বড় ফাক আছে, দম আটকে মরব না। রঞ্জন হঠাৎ বেদম হাঁচতে এবং ঠকঠক কাপতে শুরু করল। ক্রমশ দুটো কম্বল প্লাস দুটো পুলোভার। পায়ে মোজা, কানে মাথায় উলের মাফলার। তবুও ঠক্‌ঠক্। উঠে এবার বিলিতি ওভারকোট চাপাল। তবুও দাঁতে দাঁতে মিউজিক। এটা স্ট্রেট ব্র্যান্ডির কেস! ওপরে উল চড়িয়ে কিছু হবে না, ভেতরে অ্যালকোহল চড়িয়ে গরম করতে হবে। চটপট ব্র্যান্ডি গিলিয়ে ঝটপট কম্বলের তলায় গোর দিলুম থরথর-কম্পিত রঞ্জনকে। তার পালা চুল। এবার পিকোলো। উঠল। মাথায় কম্ফর্টার জড়াল। শুলো। আবার উঠল। গায়ে বড় কোটটি চড়াল। শুলো। আবার যেই উঠেছে আমি বললুম, ‘দাঁড়া, এবারে গরম হওয়ার ওষুধটা খেয়ে ফ্যাল!’ তারপরে আমিও যথাক্রমে কম্ফর্টার, কোট, গরম হয়ে ওঠার ওষুধ ইত্যাদি ইত্যাদি। অবশেষে রাত দেড়টা নাগাদ গঙ্গোত্রীদেবী দয়া করে তিনটি শীতকাতর হিমার্ত সকরুণ বঙ্গসন্তানকে নিদ্রাদেবীর উষ্ণ কোলে তুলে দিলেন।

ইয়েতি!

পরদিন অন্ধকার থাকতে থাকতে উঠেছি। পরিষ্কার বাথরুমে যাবার দুর্লভ পুণ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে। কিন্তু বাদ সাধছে পিকো স্টুপিড। পিকোলোর ধারণা, তার মহার্ঘ মা-জননীটিকে কোনো ইয়েতি কিম্বা রেপিস্ট খপ্ করে তুলে নিয়ে যাবে বলে ঘাপটি মেরে ওৎ পেতে আছে নিশ্চয়। পিকো সঙ্গে যাবার জন্যে জেদ ধরল। সে পালোয়ান গেলে অবশ্যই দুষ্কৃতকারী প্রাণীরা পালাতে পথ পাবে না! শেষ পর্যন্ত মায়েতে মেয়েতে দোর খুলে গলিতে নামি। বাড়ির পিছনে বাথরুমের সারি। সেখানে ওটা কে? ইয়েতি নাকি! দাঁড়িয়ে দাঁত মাজছে? ছেলেটাকে চেনা-চেনাই লাগল। এই লজের ক্যান্টিন চালায়।—’কী? চা হুয়া?’

‘আবি ক্যায়সে হোগা? চুলা তৈয়ার করতা হ্যায়।’ তারই জিম্মায় পিকোকে সমর্পণ করি। আহা! ফিনাইলের সুবাতাস মনেপ্রাণে নটভৈরব বাজিয়ে দিল। এই প্রথম!

আমি বেরুতে পিকোলো গেল। সামনে ধ্যানস্থ শান্ত ভোরের হিমালয়। নীচে উত্তাল গৈরিক স্রোত। কাল রাত্রের সেই জ্যান্ত ছবিটা মনে ভেসে এল। কুয়াশাচ্ছন্ন তারাহীন আকাশে বদ্ধ অন্ধকার যেন কঠিন, ঘন ওজনদার ধাতব পদার্থ হয়ে উঠেছে—সেই পটভূমিতে আরও অন্ধকার, আরও ভারী পাথরের মূর্তির মতো হিমালয়ের একটি অংশ। যেন জটাজুটধারী শিবের সিলুয়েট—মাথার ওপরে চাঁদ। পায়ের কাছে চিক্‌চিক্ করছে গঙ্গা। সকালে সেই আকাশ‍ই নীলচে, বেগুনী, স্বচ্ছ, ফিন্‌ফিনে পাতলা, বাতাসে যেন থিরথির কাঁপছে, পাহাড়টি ফিটফাট সবুজ পরিচ্ছন্ন, দাড়ি কামানো তরুণের মতো, আর উত্তাল, পিঙ্গলা, কলস্বনা গঙ্গা নিজেই যেন শিবের জটার একটা গুচ্ছ।

পৃথিবীতে যে কোনো ব্যাপারেই প্রথম হতে পারলে যে বিমল আহ্লাদ হয়, সেটা মনেপ্রাণে উপলব্ধি করে ঘরে ফিরে দেখি রঞ্জন বসে চা খাচ্ছে। এক পাহাড়ি বালক তাকে চা দিচ্ছে। সে পিকোকে দেখেই বলল, ‘আপকো ঘড়িকা ভাও কিতনা!’ পিকোলো আমার দিকে প্রশ্নভরা দৃষ্টি মেলল। এই বিদেশি ইলেকট্রনিক ঘড়িটা আগে ওর বাবার ছিল। এর দাম আমি জানি না। এত সোয়েটার, কোটের হাতার নিচে ঘড়িটি আবিষ্কার করাও সহজ নয়। বাঃ। খোকার বেড়ে নজর আছে তো? অন্তর্দৃষ্টি আর কাকে বলে!

‘ঘড়িটা আমরা বেচব না।’

‘না না, সেজন্যে নয়। একজন আমাকে এই রকমই একটা ঘড়ি বিক্রি করতে চায়। দামটা জেনে নিতে চাইছি। সে বলছে সাড়ে তিনশো। নেপাল সে লায়া। আম্রিকান, ইয়া জাপানীজ হোগা।’

‘এই রকম চারটি বোতাম আছে? স্টিলের ঘড়ি তো? প্লাস্টিক বডি নয় তো? সাড়ে তিনশো খারাপ নয়। অ্যালার্ম আছে কি? আমার ঘড়িতে তিন রকমের অ্যালার্ম আছে, অ্যালার্ম ক্রনোগ্রাফ আছে, স্টপওয়াচ আছে, ডেট আছে, ডে আছে।’

‘অ্যাঁ, এত সব আছে? মিউজিকাল অ্যালার্মও আছে?’

‘এবারে ঘড়িটা চুরি যাবেই।’ রঞ্জন ফিসফিস করে জানাল, ‘পিকো যা গুণকীর্তন শুরু করেছে! ঘড়িটা সাবধানে রাখতে বলব।’

‘মিউজিক নেই, অ্যালার্ম আছে।’

‘আমারটা ভালো করে আগে দেখে আসতে হবে। আর চা চাই? আরতি দেখতে যাবেন না? শুরু হয়ে গেছে এতক্ষণে।’

‘নিশ্চয়ই যাব!’ মন্দিরে ছুটলুম। চা চুলোয় যাক। ছুটল রঞ্জনও। পিকোটা পাশ ফিরে ঘুমোতে লাগল।

গঙ্গাতুলসী

বাজারে গিয়ে মিস্টার মুখার্জির নামে পুজোর থালা কিনে এনে পুজো দিলুম গঙ্গামন্দিরে। বিশ্বাস করে দেওয়া পরের টাকা সঙ্গে এনেছি, বাবা, সর্বত্র সদ্ব্যবহার করে যাই। বিশ্বনাথে, সঙ্কটমোচনেও পুজো দিতে ভুলিনি। গঙ্গাদেবীর নৈবেদ্যটিও সুন্দর। দিব্যি পিতলরঙা আয়না-বসানো ছোট্ট সিঁদুরকৌটোভর্তি সিঁদুর (প্লাস্টিকের দায়সারা টিপ নয়, দিব্যি একজোড়া নীল কাচের চুড়ি, চুলের সোনালি ট্যাসল, এলাচদানা, মটরভাজা, ধূপ আর গঙ্গাতুলসীপাতা। পুষ্পবিহীন পুজো। কোথাও ফুল নেই। পথে ফুল ফুটতেও দেখিনি। এদেশে নাকি তুলসীগাছ হয় না, এটিই তার বলি খাটে—কাজ-চালান পবিত্র উদ্ভিদ। গঙ্গাতুলসীকে কিন্তু আমার খুব চেনা-চেনা লাগল। তারপর গন্ধ শুঁকেই নিঃসন্দেহ। ও হরি! তুমি তো আমার মুসৌরী পাহাড়ের গায়ে আবিষ্কার করা সেই আগাছা, যাতে ফুল নেই, কিন্তু পাতাতেই মিষ্টি সুবাস। পিকোর গা-গুলোনো সারাতে তোমায় ব্যবহার করেছিলুম। এখানে এসে তুমিই পতিতোদ্ধারিণী গঙ্গাতুলসী হয়েছ? তা ভালো। কবিতাদি কয়েকটি শিকড়সুদ্ধ চারা তুলে সঙ্গে এনেছিলেন, জানি না তারা কলকাতার মাটিতে বসে গেছে কিনা। আমি ডায়ারির পাতায় যেটিকে ভরে এনেছিলুম, সে তেমনই আছে।

মন্দিরে পুজো দেবার পর সবাই দেখছি ডালিসহ গঙ্গায় যাচ্ছে, সেখানেও পুজো দিচ্ছে, গঙ্গাতুলসীর পাতা জলে ভাসিয়ে আসছে। আমিও চললুম। রঞ্জন সুদ্ধু। নদীর ধারে ভোরবেলা ভয়াবহ ঠান্ডা। সুন্দর বালি-বিছানো সরু পায়ে চলা পথটি মন্দিরপ্রাঙ্গণ থেকে বেরিয়ে কিছুদূর এগিয়ে নদীতীরের বড় বড় পাথরের ভিড়ে হারিয়ে গেছে।

বাইরে পাঁচিলের ধারেই মস্ত ধুনি জ্বালিয়ে বেশ কয়েকজন মস্তান সাধু আড্ডা গেড়েছেন। কুম্ভমেলাতে এমনি একটা দলের মধ্যে আমি ঢুকে বসে পড়েছিলুম। পেতলের বাটিভর্তি দুধ-চা দিয়েছিলেন সাধু আমাকে, কিন্তু হাতে হাতে যে কল্কেটি ঘুরছিল তার টার্ন আসেনি আমার। রঞ্জন বললে মহোৎসাহে, ‘কল্কের টার্ন মেয়েদের দেয় না। আমাকে দেবে। দেখবে?’

‘দেখে কাজ নেই ভাই। অমনিই বিশ্বাস করছি। ‘

নদীতীরে পাণ্ডারা যাত্রীদের পুজো করতে সাহায্য করছেন। যাগযজ্ঞ, তর্পণ, পিণ্ডদান, নানা রকমের ধর্মীয় কার্যকলাপ চলছে। আর চলেছে এই কাকভোরে ঐ হাড়-হিম-করা উদ্দাম বেপরোয়া স্রোতে ঘটি ডুবিয়ে ভয়ে ভয়ে মন্ত্র পড়তে পড়তে পুণ্যস্নান। জলে নেমে ডুব-টুব দেবার প্রশ্ন নেই এদিকটাতে। প্রচণ্ড ঘূর্ণি, দুর্বার স্রোত। ভাগীরথী অগভীর, পার্বত্য নদীজলে হাঁটুও ডোবে না। কিন্তু পাথরে পদস্খলন ঘটলেই সি-ধা মানেরী ড্যাম। উত্তরকাশী। সেই মরা মহিষের অবস্থা হবে। কিম্বা হয়তো মধ্যপথে যমুনা তুলে নেবে, চলে যাব সেই লালকেল্লা, তাজমহল, মথুরা, বৃন্দাবন। হয়তো আবার দেখা হবে জলন্ধরের ঠাকুমা আর তাঁর সহিসের সঙ্গে, সেই অদেখা পঞ্চদশীর সঙ্গে। স্থানমাহাত্ম্যে কতটা মনের উন্নতি হয় জানি না, তবে অধিকাংশ নারীরই দেখলুম বসন-ভূষণে আর রুচি নেই। এই ভূষণটির নাম লজ্জা। এদের হায়াহীনতায় আমার মতো বেহায়াও লজ্জা পাচ্ছে।

নাঃ, এখানে স্নান আমার পোষাবে না। একেই সোজা তুষার নদী থেকে বেরুনো বরফগলা পানি। যতই পবিত্র হোক, একবার বুকে সর্দি বসলেই ব্যাস। একলা তো আসিনি যে অসুখ করলে ভগবান দেখবেন। এখন ভগবান নিজে না এসে আমার মেয়েকে, ভাইকে ডেপুটি করে দেবেন। অতএব কমলাকান্তের উপদেশই ভালো, আপনারে আপনি দ্যাখো, যেও না মন কারও ঘরে।-’চল্ রঞ্জন, আমরাও গঙ্গাতুলসী ভাসিয়ে আসি নদীর স্রোতে।’ নমো গঙ্গা। নমো গঙ্গায়ৈ নমঃ।

তারপর আরেকটু এগোই। প্রথমে শুধু জলস্পর্শ করে বসা। তারপরে সাহস বাড়ে। তখন অঞ্জলিতে পুণ্যবারি গ্রহণ করে প্রথমে বাবাকে, তারপর শ্বশুরমশাইকে জলাঞ্জলি দিই। তৃপ্ত হও, হে মৌগ্দল্য-বংশোদ্ভূত দেবশর্মণঃ, তৃপ্ত হও, ওহে ধন্বন্তরী গোত্রের সেনশর্মণঃ। তোমরা আমার অপটু হাতের এই নির্মল পবিত্র উদকে আরেকবার চিরতরে পরিতৃপ্ত হও। পিপাসামুক্ত হও। বাসনামুক্ত হয়ে এই বিচিত্র বিশ্ববীজের মধ্যে পরিব্যাপ্ত হও তোমরা। আর স্মরণ করি তোমাদের, যাদের জল দেবার কেউ নেই। হে অভাগা আত্মারা, তোমরা আমার ভালোবাসার অর্ঘ্য গ্রহণ করো। আমার প্রদত্ত উদকে তোমাদের তৃষ্ণামোচন হোক, আত্মার শান্তি হোক!

এইটুকু, দু’মিনিটের মাত্র কথাবার্তা। বাবা, শ্বশুর অথবা এইসব নাম-না-জানা স্বজনহীন পরিজনদের সঙ্গে কথা কইতে কমুহূর্তই বা লেগেছে? হাত অসাড় হয়ে গেছে বরফজলে থেকে। এরা নাইছে কী করে? কী করে আবার, যে ভাবে পঙ্গুতেও গিরি লঙ্ঘন করে, সেই উপায়ে।

দেবী সুরেশ্বরী ভগবতী গঙ্গে

উচ্চৈঃস্বরে সংস্কৃত মন্ত্র পড়তে পড়তে সদ্য নেয়ে ওঠা এক সাধু জলসুদ্ধু জটা ঝাকাতে ঝাঁকাতে কাঁপতে কাঁপতে এসে গঙ্গামন্দিরের চওড়া পাঁচিলের ওপরে উঠে বসলেন। রোদ উঠলেই এখানটায় রোদ পড়বে। সাধু শুরু করলেন ভজন গান। মাথার ঝাঁকুনিটা আর থামল না, গানের ছন্দে গ্রথিত হয়ে গেল।

আধফোটা সকালে হিমালয়ের খোলা হাওয়ায় গঙ্গার কলধ্বনির সঙ্গে ভাঙা পাঁচিলে তরুণ সন্ন্যাসীর ভোরালী ভজনের সুর কানে রয়ে গেল।

সদ্যোস্নাত তিনটি দেহাতী মানুষ নদীর ধারে ষড়যন্ত্রীর মতো উবু হয়ে বসেছে। বয়স্কাটি একটি বড় কৌটো খুলে তিনটি ছোট কৌটো বের করলেন, একটিতে প্রচুর কাঠের চোকলা, পাতলা এবং কুচোকুচো, একটিতে ঘি, আর একটাতে মেটে সিঁদুর। এছাড়া ধুপ, দেশলাই, একজোড়া কাচের চুড়ি। আর গঙ্গাতুলসী।

তিনটি ছোট নুড়ি সাজিয়ে হোমের উনুন হল, তাতেই ঐ ছুতোরের দোকানঝাঁট-দেয়া কাঠের চাঁচি ঢেলে তাতে ঘি দিয়ে আগুন ধরানো হল। ছোট প্রদীপ বেরুল সলতে সমেত, জ্বালান হল। নদীর তীরে প্রবল বাতাসে দীপ জ্বলে রইল না। হোমাগ্নিও কেবল নিবে যায়। ধূপ জ্বলল, চিনির এলাচদানা বেরুল আরেকটা খুদে কৌটো থেকে, তিনজনের মাথা একত্র করে ভক্তিভরে দেহাতী উচ্চারণে মন্ত্রপাঠ হল, ঘৃতাহুতি দেওয়া হল। বারে, এরা তো বেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ তীর্থ-পার্টি! ব্রাহ্মণ পাণ্ডা ছাড়াই দিব্যি পুজোপাঠ মায় যাজযজ্ঞাদি পর্যন্ত করে ফেলছে। দেহাত থেকেই বয়ে এনেছে পিকনিক-পুজোর যাবতীয় দরকারি সরঞ্জাম মায় মস্তরটি পর্যন্ত। এই পুতুলখেলার মতো মিনি-হোমানল জ্বেলে মিনি-পুজো দেখতে খুব ভালো লাগছিল।

সবটা দেখা হল না। আমার সঙ্গে সঙ্গেই কোট প্যান্টুলুন পরা এক ভদ্রলোক হাতে পুজোর ডালি নিয়ে পাণ্ডার সঙ্গে সঙ্গে গঙ্গাতীরে আসছিলেন উচ্চৈঃস্বরে মন্ত্রপাঠ করতে করতে। এখানে এসে সেটা স্থগিত ছিল। আমি আর তাঁকে খেয়াল করিনি। হঠাৎ আবার প্রচণ্ড উৎসাহে সশব্দে মন্ত্রপাঠ শুনে দেখি সেই ভদ্রলোক-পরনে শুধুই আন্ডারওয়্যার আর পৈতে। সযত্নে পাট-পাট করে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে প্রচণ্ড চেঁচামেচি অর্থাৎ মন্ত্রোচ্চারণ করছেন, স্নান সমাপ্ত। ক্ষুরধার বাতাসে আমিই প্রায় পোশাকের মোড়কসুদ্ধু নিহত হবার জোগাড়। ভক্ত ভদ্দরলোক মন্ত্রের ঢাল-তলোয়ারে নিজেকে রক্ষা করছেন। ঐ ভাবে পুজোও বোধ হয় করেছেন, কে জানে? নাঃ, এলেম আছে। একেই কৃচ্ছ্র বলে।

যেসব মহিলারা ‘স্ট্রিপ’ করছেন গঙ্গাতীরে (কিন্তু ‘টিজ’ করছেন না) তাঁদেরও আছে। ভক্তি এবং শক্তি। শিল্প-সাহিত্যে নারীদেহের গুণগান শুনে শুনে নিজেদের না-জানি কী একটা দারুণ ব্যাপার মনে হয়েছিল। এখানে একসঙ্গে এতগুলি এত বয়সের এত বৈচিত্র্যময় উন্মুক্ত নারীমাংস দেখতে দেখতে গা গুলিয়ে উঠল। অনেকেই যৌবনবতী, বয়স যাই হোক। কিন্তু এই প্রথম মনে হল, লজ্জা না থাকলে বোধ হয় রূপ ব্যর্থ হয়। সবাই এরা ধবধবে ফর্সা, বাঙালি চোখে তো ফর্সা মানেই ‘প্রকৃত সুন্দরী’। গঙ্গার ঘাটে আমি তর্পণ করতে যাই মহালয়ায়, অনেক বাঙালি বেদিং বিউটি দেখি, সেখানে এতটা অলজ্জা দেখিনি। উত্তর ভারতের চামড়ার জাতই অন্য। একটিও শ্যামলা শরীর দেখলুম না। জামার নিচে বেশ মজার একরকম ভি-গলা হাতকাটা রঙিন সুতী ফতুয়া পরে আছেন—যাত্রী যাত্রিণী দুজনারই—পিরানের মতো তেরছা করে বুকে একটা খাপ। এবং দুটি পকেট। ফতুয়ার মধ্যেই, বুঝলুম, যাত্রার মালমশলা সর্বস্ব থাকে। বুকে ছুরি না বসালে সেসব পকেট কাটা যাবে না। যমুনোত্রীর বৃদ্ধা পাঞ্জাবী মহিলার পরনে এরকম ফতুয়া নিশ্চয়ই ছিল না। তাই ‘মেরে থৈলিয়া’!

রঞ্জন গেল কোথায়? সে তো গঙ্গাতীরে নেই! খুঁজে পেতে দেখি রঞ্জন সেই ধুনি-জ্বালান সাধুদের আড্ডায়, নেমন্তন্নবাড়িতে কাঙালিভোজনের আশায় যেমন দাঁড়ায়, তেমনি দাঁড়িয়ে আছে একধারে। আগুনে গরম হচ্ছে, না গঞ্জিকায় কে জানে?—’চ’ ব্যাটা চ, বাড়ি যাই। চা—জলখাবার খেয়ে বেরিয়ে পড়ি।’

ঘুচাই আর পিকো ইতিমধ্যে উঠে নিজের মনে ঘুরছে। লাফাতে লাফাতে এসে বললে, ‘মৌনীবাবার আশ্রমে গিয়েছিলুম মা! ফোটো তুলেছি!’ সবাই মিলে ব্যালকনিতে গিয়ে বসলুম ব্রেকফাস্ট খেতে। ভগীরথ পর্বতের বরফচূড়োটি দেখা যাচ্ছে, দেখা যাচ্ছে তার তুষারনদী, সূর্য উঠে গেছেন। কবিতাদির গলার রুদ্রাক্ষের মালাটি সারদামায়ের সাক্ষাৎ আশীর্বাদ-ধন্য—সেই গল্প শুনতে শুনতে আলু পরটা আর চা খেতে খেতে নেমে যাবার জন্য তৈরি হয়ে গেলুম। রঞ্জন ভয়ানক ‘তং’ করছিল—গোমুখ যাবেই। কাল রাত্রের ঠক্‌ঠক্ কাঁপুনি এর মধ্যে ভুলে গেছে। এ তো গঙ্গোত্রী। গোমুখ আরও বিশ কিলোমিটার উত্তরে, তুষার নদীর মধ্যে। কে তোকে যেতে দিচ্ছে? মরে যাবি তো রে ঐ আহ্লাদী-পেহ্লাদী শরীর নিয়ে। আসলে সমরেন্দ্র-পুতুলরা গিয়েছিল বলেই ওর এত দুঃখ। যেতে ওদের বেশ কষ্টই হয়েছে বললে। ঘুচাই, পিকো আর রঞ্জনকে বললুম, ‘বড় একটা জলপাত্র কিনে, বেশ করে গঙ্গোত্রীর নির্মল পানি ভরে নে।’ খানিক বাদে তারা ‘বাপরে মারে’ করতে করতে জল নিয়ে ফিরল-’হাতে প্যারালিসিস হয়েছে’–’আটু হলেই আজ জলের মধ্যে পাত্র বিসর্জন হয়ে যাচ্ছিল’—’ওরে বাবা’র মধ্যেই কবিতাদি জানালেন, উনি ঐ জলে দুদিন সশরীরে সবস্ত্রে চান করেছেন। ভিজে কাপড়ে, এই বাতাসে! নাঃ, সারদামায়ের আশীর্বাদী রুদ্রাক্ষের ক্ষমতা আছে!

ভাগীরথী

ঘুচাই আর পিকো আবার পালিয়েছে। গঙ্গোত্রীর ট্যুরিস্ট লজের কর্মকর্তা ছেলেটির বয়স বেশি না। সে খুব একটা ধর্মকর্মের জীবনে বিশ্বাসী বলে মনে হল না। তার খুব ফাঁকা, একা লাগে এখানে।—’এই তো মোটে ছ’মাসই লোকজন আসে, তারপর সব বন্ধ সুনসান্ হয়ে যায়। একটা সিনেমা নেই, থিয়েটার নেই। উত্তরকাশীর আগে কোনো শহরই নেই। শহুরে মানুষ টিকতে পারে এখানে? এখানে ঐ এক সাধু-সন্নিসি আর মিলিটারি রেজিমেন্ট্, এই দু’ধরনের সংসারত্যাগী ব্রহ্মচারীর পক্ষেই বাস করা সম্ভব। মন্দিরের দরজা বন্ধ হয় দীপাবলীতে। কেদারবদ্রী, গঙ্গাযুমনা, সব মন্দিরের। পুরো উত্তরাখণ্ডেরই দরজা বন্ধ হয়ে যায়, দীপ নিবে যায়, শঙ্খঘণ্টা স্তব্ধ হয়ে যায়। লজ বন্ধ করে আমরাও তখন উত্তরকাশীতে নেমে যাই। বেয়ারা, কু এরা সবাই তো টেম্পোরারি। এদের তখন চাকরি যায়। আমি অবশ্য সরকারি চাকুরে! আমা চাকরি যায় না।’

ছেলেটির সঙ্গে কথা বলতে বলতে হঠাৎ বুঝতে পারলাম চা-ওলা ছোকরার দামি ঘাড় জন্য অমন লোভ কেন। ছ’মাস পরেই ওর জীবনে তুষার-যবনিকা নামবে। এর মধ্যে যা পারও, যতটা পার, জোগাড় করে নাও। দুদিন বাদে ভাতও জুটবে কিনা ঠিক নেই। ট্যুরিস্ট লজের পাশেই কালীকম্বলীওয়ালার ধর্মশালা। মাটির ঘুপচি ঘর। পাশাপাশি ৫/৬টা দরজা-জানলা আছে। সামনে ফালি বারান্দা। যাত্রী ভর্তি। ইলেকট্রিক আছে বলে মনে হল না। ওপাশে গ্রামের গৃহস্থবাড়ি। পিকোলো একটি বউয়ের সঙ্গে ভাব করল। বউটি ওর সমবয়সীই হবে, নাম ভাগীরথী। এই গাঁয়েরই মেয়ে। শাশুড়িটি খুব তিরিক্ষি। শাশুড়ি এসে পড়লেই ভাগীরথী ভয়ে আর কথাই বলছে না। একটা টাটকা টোমাটোর মতন মুখটা ভাগীরথীর, হাসিখুশি, স্বাস্থ্যে—প্রাণে উজ্জ্বল কোনোদিন উত্তরকাশীর চেয়ে দূরে যায়নি তাদের বাড়ির কেউ। কলকাতাকে কিন্তু সে নামে চেনে। গর্বের হাসি হেসে বলেছে—’উধার তুমলোগ গঙ্গাজী কো ভাগীরথী ক্যাহতা, না?’ তার কাছে কলকাতার মানে, গঙ্গার যাত্রার শেষ ইস্টিসান। গঙ্গাকে দিয়েই তার ভারতবর্ষের মাপজোক। আর নামের মাহাত্ম্যে সে নিজেকেও পবিত্র আর বিশিষ্ট মনে করে। গল্প করতে করতেই সংসারের কাজ করছিল ভাগীরথী। তারই কাছে পিকো শুনল, এখানে হেলিকপ্টারে চড়ে ইন্দিরা গান্ধী এসেছিলেন। অমনি ঘুচাই আর পিকো ছুটল হেলি-প্যাড দেখতে। যদি এসে পড়ে কেউ? বিড়লার কি মিসেস গান্ধীর কি ধীরেন ব্রহ্মচারীর প্লেন?

খানিক বাদেই আবার পাঁই পাঁই ছুটে ফিরে এল। কোথায় যেন সাধুদের ছবি তুলতে চেষ্টা করেছিল, তাঁরা চিমটে তুলে তেড়ে এসেছেন। ঘুচাইরা দুদিন দণ্ডীস্বামীর ধর্মশালায় ছিল। প্রসাদ খেয়ে স্বহস্তে বাসন মেজেছে। এঁটো পেড়েছে। সেই নতুনত্ব খুব ভাল লেগেছে। পিকোর মহাদুঃখ। ধর্মশালায় থাকা হল না। যত বলি, বাড়ি গিয়ে রোজ-রোজই না হয় এঁটো পাড়িস বাসন মাজিস, চটে যায়।—’তোমার কেবল ইয়ার্কি।’

‘আর তোমার কেবল গুস্সা। আলবার্ট পিন্টো কাঁহাকা।’

‘চলরে ঘুচাই, ওদিকটা ঘুরে আসি। ওখানে গঙ্গার তীরে একজন সাধু ঘুরে বেড়াচ্ছেন, গায়ে একটুকরো সুতো পর্যন্ত নেই অথচ হাতে একটা লম্বা বাঁশ। তাতে নানান রং-বেরঙের কাপড়ের টুকরো আঁটা—কাপড়গুলো ঠান্ডা হাওয়ায় উড়ছে—দেখেছিস তাঁকে?’

‘না তো? চল চল দেখি!’ দুজনে মুহূর্তেই হাওয়া

শিবখৃষ্টস্বামী

খানিক পরে ঘুচাই আর পিকো ছুটতে ছুটতে এসে বলল, ‘কলম আছে?’

‘কী হবে?’

‘দরকার আছে। ঠিকানা লিখতে হবে।’

‘একজন সাধুর সঙ্গে আমাদের খুব ভাব হয়েছে তো!’

কলম নিয়ে লাফাতে লাফাতে আবার দুজনে পালাল। দুটো প্রজাপতির মতো নেচে বেড়াচ্ছে। ওপর থেকে দেখলে দুজনেই গঙ্গোত্রীতে কিছুটা বেমানান। ছোট করে ছাঁটা চুল, পরনে ব্লু জিনস আর সোয়েটার, আমাদের ছেলেবেলায় এরকম সাজপোশাককে বলত ‘ট্যাশ ফিরিঙ্গিয়ানা’। ঠিক দুই বোনের মতন দেখাচ্ছে। দুজনেরই চোখে মোটা কাচের ভারী চশমা আর পায়ে ফড়িংয়ের পাখার লঘুচাঞ্চল্য। মালপত্র গুছিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, মেয়েদের টিকি দেখা যাচ্ছে না। ট্যুরিস্ট লজের ছেলেটি বলছে, ‘আজই চলে যাচ্ছেন? অথচ আগামী কাল ভগীরথের গঙ্গা আনয়নের সেই তিথি। কালই বাৎসরিক গঙ্গাপূজার উৎসব। গঙ্গাদেবীর মন্দিরের মূর্তিকে নদীতে নিয়ে যাওয়া হবে শোভাযাত্রা করে। লোকে দূর দূর থেকে এই গঙ্গাসেবার পুণ্যস্নানের জন্যেই আসে। আপনি থেকেও চলে যাবেন? দেখে যাবেন না? স্নান করবেন না? আজ কেউ গঙ্গোত্রীধাম ত্যাগ করে যায়?’

কিন্তু কবিতাদি তো যাচ্ছেন। বাঙালিদের দলটিও আগেই নেমে গেছে। এঁরা কেউ কি জানেনও না কাল এত বড়ো উৎসব? কবিতাদি বললেন, ‘জানি বৈকি। কিন্তু কাল এখানে যে কী কাণ্ড হবে তা ধারণা করতে পারছ না। দেহাতী লোক শ’য়ে শ’য়ে আসবে। বাসে আর জায়গা থাকবে না ফেরার সময়ে। তারাও তো সব ফিরবে? তাই আগেই

কবিতাদির ছেলে পুতুল বলল, ‘তাছাড়া খাবার-দাবারেরও অসুবিধে হবে—ছোট্ট জায়গা, যথেষ্ট কিছুই নেই—নোংরামিও হবে—নাইতে পারবেন না, প্রচণ্ড ভিড় হবে—ছোটখাটো কুম্ভমেলার মতো।’

সমরেন্দ্র বললে, ‘আজ কেটে পড়াই বুদ্ধিমানের কাজ। নতুন আর কী দেখবেন? ‘

আমি ওদের থাকতে বলছি না, বাসে জায়গা না পাওয়ার সমস্যাটা খুবই সত্য। কিন্তু আমাদের তো শুণ্ডিমার্কা ম্যাজিকট্রিপ, ওসব ঝামেলা নেই। আমি তবে কেন থেকেই যাই না? একটা দিনের তো মামলা। কালই বরং বিকেলের মধ্যে নেমে যাব। ভিড় তো কালই ভাঙবে না, যারা আসবে তারা তো কালই নামবে না?

পিকো আর ঘুচাইকে খুঁজতে মন্দিরে গিয়ে দেখি পাঁচিলের ওপরে বসে বসে দুজনে এক ন্যাড়ামাথা সাধুর সঙ্গে গল্প করছে। আমি যেতেই পিকো ছুটে এসে বললে, ‘এই নাও, এই খামটা একটু রেখে দাও তো—’ বলে একটা নোংরা মতন খাম আমাকে এগিয়ে দিয়েই পালাল। ঘুচাই চেঁচিয়ে বলল, ‘ওতে আড়াই হাজার টাকা আছে—’বলে ফের গল্প করতে লাগল।

আমি চেঁচাচ্ছি—’চলে আয় ঘুচাই-ওঠ, বাস চলে যাবে—’ বলতে বলতে হঠাৎ কথাটা বোধগম্য হল।—’ঘুচাই, কী বললি?’

‘ওতে আড়াই হাজার টাকা আছে?’

‘কার টাকা? কিসের টাকা?’

‘পিকোর কাছে রাখতে দিয়েছে। ঐ যে ঐ সাধুর টাকা। বলেছে, কলকাতায় গিয়ে আবার ফেরত নেবে।’

‘কেন? ও বাবা, ওসব হবে না। এক্ষুনি ফেরত দাও। পরের ধন আমি যক্ষ হয়ে সামলাতে পারব না বাপু! আমার নিজেরই সর্বস্ব হারিয়ে যায়। শেষকালে আড়াই হাজার টাকা নিজের পকেট থেকেই গচ্চা দিতে হবে।’ সাধুর কাছাকাছি তেড়ে যাই খরখর্ করে। ইয়ার্কি নাকি? কাছে গিয়ে দেখি গল্পটা হচ্ছে ইংরিজি ভাষাতে।

সায়েব সাধু। ও, তুমি বুঝি কৃষ্ণকশাস? ‘মাই নেম ইজ শিবখৃষ্টস্বামী, আই অ্যাম আ ক্যাথলিক সন্ন্যাসী ইন লাভ উইথ হিন্দুইজম অ্যান্ড ইন্ডিয়া।’

‘নমস্কার।’

খাস ইংরেজি উচ্চারণ। ওরে বাবা, একি মাল? একে তো সোজাসুজি সি আই এ কিম্বা কে জি বি কোনো প্লট্-এই ফেলা যাচ্ছে না? বেশি ঝামেলায় না গিয়ে আমি সোজাসুজি ‘পয়েন্টে’ চলে যাই—’সব আপনার টাকা?’

‘ঐ একরকম বলতে পারেন। টাকা কি কারুর হয়!’

‘আমি এর দায়িত্ব নিতে পারব না।’

‘দায়িত্ব তো আপনার নয়। আমি ওটা আপনার মেয়েকে দিয়েছি।’

‘আমার মেয়ে ছোট, তার দায়িত্বটাও এখনও আমারই। ধরুন যদি এখন আমার মেয়ে হঠাৎ মরে যায়? হিন্দুধর্মে বলে অঋণী মরতে হয়।’

‘মরবে কেন? বালাই ষাট! বাচ্চা মেয়ে!’

‘বেশ। ধরুন হয়তো আপনিই স্বর্গে গেলেন। আর টাকা ফেরত নিতে এলেনই না। তা হলেও তো ও ঋণী হয়ে মরবে।’

‘ঋণী কেন? ওকে তো আমি ঋণ দিইনি?’

একমুখ হেসে সাধু বলেন, ‘ওটা তো ওকে আমার ‘দানম্’। দান নিলে ঋণী হবে কেন?’

‘ ‘দানম্’ মানে? আমার মেয়ে হঠাৎ আপনার দান নিতেই বা যাবে কেন? আপনি কলকাতায় গিয়ে টাকাটা ফেরত নেবেন বলেই না ও রেখেছে।’

‘তখন সেইটে হবে আমাকে ওর দানম্। ইচ্ছে না করলে নাও দিতে পারে। টাকাটা এখন তো ওরই সম্পত্তি। আমি দিয়ে দিয়েছি।’

‘বেশ কথা। ওর সম্পত্তি। সেটা দিয়ে ও কী করবে?’

‘পিকোলো জানে। জানো না পিকোলো, টাকাটা দিয়ে কী করবে? আশ্রম হবে। অনাথ শিশুদের জন্য। ভারতবর্ষে গরিব লোকেরা বড় কষ্টে থাকে। আমি একটা জমি কিনতে চাই। ঐ টাকা সেই জন্যে জমাচ্ছি। জমি কিনে আশ্রম করব। অন্তরা বলল কীসব স্কিমে যেন টাকা বাড়ে। তাতে জমি কেনার সুবিধে হবে।’

এতক্ষণে বেশ ইন্টারেস্টিং লাগছে সাধুকে। শিবখৃষ্টস্বামী নাম ওকে দাক্ষিণাত্যের এক আশ্রমে দিয়েছে। সাধুর নাম ক্রিস্, ক্লাস সেভেনের পরে এখানে ওখানে চাকরি করে বেড়িয়েছে। পরের বছর থেকে সে ঘরছাড়া। শেষে সাধু হয়ে গেছে। কিন্তু ক্যাথলিক ধর্ম তাকে শাস্তি দেয় না, পাশ্চাত্ত্য সভ্যতা তাকে তিষ্ঠুতে দেয় না। তাই ভারতবর্ষ। হিন্দু ভারতবর্ষকেই সে বেছে নিয়েছে।

‘সঙ্গে টাকা নিয়ে ঘুরব না বলে হৃষীকেশের এক চায়ের দোকানেও তিনশো ডলার জমা রেখে এসেছি। নেমে গিয়ে নেব।’

‘রসিদ আছে?’

‘রসিদ?’ আশ্চর্য সরল চোখে তাকালেন, নীলাক্ষ সন্ন্যাসী।—‘না তো?’

‘তবে গেছে। ও টাকা আর পাবেন না। গরিবলোক খরচ করে ফেলবে।’

‘না না, ওদের দোকানে আমি রোজ চা খেতাম। ওরা খুব সৎ। টাকা মার যাবে না।’

একগাল হাসলেন ফোকলা সাধু। না গেলেই ভালো। কথা ঘোরাই।—’কবে ফিরবেন?‘

‘আর তো ফিরব না? এবারে এখানে থাকব বলেই এসেছি। জমি কিনব। আশ্রম করব। সেবা করব দরিদ্রের।’

তারপর আমাদের বিষয়ে সংবাদ সংগ্রহ হল। কেদারনাথে যাব না, গঙ্গোত্রী থেকে নেমে সোজাই বদ্রীনারায়ণে চলে যাব শুনে শিবখৃষ্টস্বামী অত্যন্ত বিচলিত হলেন।—’সে কি? কেদারনাথে না গেলে হয়? কেদারনাথই সবচেয়ে সুন্দর।’

‘এই গঙ্গোত্রীধামের চেয়েও? আরও সুন্দর হওয়া কি সম্ভব?’

‘আরও সুন্দর। ইটস ওপেন-ও-পেন নট সো ক্লোজড—মনটা উদার হয়ে যায়। খোলা হয়ে যায়—কত বরফচূড়া কত তুষারনদী—না না, তোমরা অতি অবশ্যই কেদারনাথে যাবে। নইলে চারধাম সম্পূর্ণ হবে না।’

ক্যাথলিক সাধুর চারধাম সম্পূর্ণ করানোর উৎসাহে একটু অবাক না হয়ে পারি না। তারপরে বলি, ‘দ্যাখো সাধু, বড্ডই কষ্ট পেয়েছি—প্রচণ্ড মানসিক টেনশানে এবং গায়ে ব্যথায়। খচ্চরে চড়ে এখনও সর্বাঙ্গে কালশিটে। ওই অভিজ্ঞতাটি আমি আর দ্বিতীয়বার চাই না। আমি তো হেঁটে উঠতে পারব না, হাঁপানী রুগি—তাই যাবই না। বরং ওরা যায় যাবে, আমি গৌরীকুণ্ডে থাকব।’

‘কেন? তুমি ডাণ্ডী নিয়ে যাবে। কষ্ট হবে না।’

‘না সাধু। প্রথমত বড্ড বেশি খরচ। দ্বিতীয়ত, ওইভাবে যাবার বয়েস আমার এখনও হয়নি। আমার লজ্জা করবে বুড়োদের মতন শুয়ে বসে যেতে। তার চেয়ে না যাওয়া ভালো।’

‘আরে ছি ছি! এটা কি রকম দাম্ভিক কথা হল? ভগবান দর্শনে যাবে, কী ভাবে যাচ্ছ, তাতে কী এসে যায়? ভগবানের কাছে যাবে, ঠিক যেভাবে তোমার শরীর সহজে যেতে পারবে, সেই ভাবেই যাও। স্বয়ং কেদারনাথকে বাদ দিয়ে টাকাপয়সা নিয়েই বা তুমি কী করবে? ডাণ্ডী নাও, কাণ্ডী নাও। যৌবনের গর্ব কোর না। ঈশ্বরের সমীপে বিনীত হয়ে, বিনম্র হয়ে যেতে হয়।’

হঠাৎ ভয়ঙ্কর লজ্জা করল।’—’বি হাম্বল, ডোন্ট বি সো প্রাউড,’ যেন বুকের ভেতরে হাতুড়ির ঘা মারল। কী ভুল, কী ভুল করছিলুম! কত সহজে, কত প্রকাণ্ড একটা ভুল ধরিয়ে দিলেন শিবখৃষ্টস্বামী।—নাঃ, যেতেই হবে কেদারে। ‘চারধাম’ বলে বেরিয়েছি যখন! কেদারনাথ যাব বরং ফেরার পথে। স্ট্রেন হলে হবে। তখন তো ঘরমুখো। আগে কেদার, পরে বদ্রী, এটাই যাত্রার রীতি।—’যদি আগে বদ্রীই চলে যাই? পরে কেদার গেলে কিছু হবে না তো?’

‘হবে আবার কী? যখন যেখানে যাবে, সেটাই ঠিক সময়। চলে যাও। শুভযাত্রা। আবার দেখা হবে।’

‘কলকাতায়।’

‘অথবা অন্যত্র!’

তেঁতুলপাতায় ক’জন?

বাস স্টেশনে এসে দেখি এক ভয়াবহ ব্যাপার চলছে। বাস আসছে বেঁকে—ছাদের ওপরে ভর্তি পোঁটলাপুঁটলি আর মানুষ। কী প্রচণ্ড ভিড়। অনেকগুলো জিপও আছে—প্রত্যেকটা থেকেই মানুষ খসে খসে পড়ছে। বিশ-পঁচিশজন করে তুলছে। ছ’টাকা ভাড়া। সমরেন্দ্র, রঞ্জন, পুতুল ছুটোছুটি করতে লাগল। বাসে ওঠার প্রশ্ন নেই। দলে দলে মানুষ আসছে গঙ্গাদশেরার জন্যে।। একটা জিপ শেষ পর্যন্ত ঠিক করে ফেলল ছেলেরা।

‘দৌড়ে এসে উঠে পড়ো এক্ষুনি।’

আমরা ছুটে গেলুম, যেই উঠে বসেছি, তেঁতুলপাতার সুজন সেই বাঙালীদের ৪/৫ জন নারীপুরুষ দৌড়ে এলেন-’একটু জায়গা হবে আপনাদের জীপে?’

ওঁরা কোথাও উঠতে পারছেন না—বাকী ক’জন, মেসোমশাই সমেত, আগেই চলে গেছেন অন্য এক জিপে। আমরা আছি সাতজন—পুরো জিপ ভাড়া নিয়েছি। কবিতাদিদের সত্যি প্রচুর মালপত্র।—’নিশ্চয়ই, অবশ্যই। চলে আসুন। যদি হও সুজন, তেঁতুলপাতায় ন’জন।’

ওঁরা অলরেডি ন’জনই ছিলেন, তাই আমাদের আরও তিনজনকে ওঁদের জিপে আঁটেনি। কিন্তু আমরা তো কপালকুণ্ডলা পড়েছি, তুমি অধম বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন? অতএব গঙ্গামাঈর জয়ধ্বনি দিয়ে রওনা হয়ে গেলুম ভৈরবঘাঁটির দিকে। নোল রিভেঞ্জের নৃশংস আনন্দের পাপে যদিবা একটুকুও পুণ্যসঞ্চয় করে থাকি, সবই ঘুচে গেল সন্দেহ নেই।

ভৈরবঘাঁটির ভৈরবমন্দিরে পিকো গেল একটা উঁকি মেরে আসতে, কবিতাদিরা তখন কুলি সংগ্রহে ব্যস্ত। ১১ টাকাতে একজন মালপত্র বয়ে নিয়ে যাবে লংকায়। মন্দিরের সামনে সাধুদের আখড়া। সেখানে সাধুবাবারা গঞ্জিকা সেবনে ব্যস্ত, ধুনি ঘিরে সুখী-সুখী মুখে বসে আছেন। পিকোকে দেখবামাত্র এক সাধু দৌড়ে মন্দিরে গিয়ে একটি বই খুলে তার ওপরে উপুড় হয়ে পড়লেন এবং জোরে জোরে ভাবগম্ভীর স্বরে কুমারসম্ভব পাঠ শুরু করে দিলেন—’তারপর শিব পার্বতীকে আলিঙ্গনপূর্বক, বললেন,–’হে পার্বতী—তোমার অঙ্গের অপরূপ সুরভি’—’

পিকোকে দেখেই তাঁর গাঁজা ছেড়ে উঠে কেন যে কুমারসম্ভব পড়বার গূঢ় ইচ্ছেটি হল, কে তা বলতে পারে? পিকোকে বললুম, ‘গেঁজেল সাধুর ধ্যানভঙ্গ করেছিস, উমারই যোগ্য উত্তরসাধিকা তুই।’

এই উচ্চপ্রশংসায় পিকো একটুও বিচলিত হল না। ঠোঁট উলটে—’সাধু না ছাই’ বলে নাচতে নাচতে ঘুচাইয়ের সঙ্গে পাকদণ্ডী বেয়ে অন্যায়পথে স্বেচ্ছাচারপূর্বক নামতে শুরু করে দিল। দুদিকে দুই মেয়েকে নিয়ে খুব আহ্লাদেই খানিকটা এগোলাম।

পথে হঠাৎ একজন সাধু থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আপনারা বাঙালী? কোথায় চললেন, কেদারবদ্রী? ওখানে তো দারুণ অ্যাকসিডেন্ট।’

‘সে কি? সে কি? কি রকম?’

‘বাস খাদে পড়ে গেছে। ত্রিশ-চল্লিশজন যাত্রী খতম।’ বেশ উৎসাহের সঙ্গেই সাধুটি জানালেন, যেন সুখবর!

‘আপনি কি বাসে চড়েন না?’

‘খুব কম।’

‘এখন কোথা থেকে আসছেন?’

‘যমুনোত্রী। পথে শুনে এলাম খবরটা।’

‘আপনি কোথায় থাকেন?’

‘থাকি না কোথাওই, ঘুরি তো! বছরে একবার করে উত্তরাখণ্ডে আসা আমাদের নিয়ম। এখানে তাই আসি প্রত্যেক বছর। অভ্যাস আর কি–ত্রিশ বছর বাংলাদেশ ছাড়া।’—সাধু বয়েসই ত্রিশ-বত্রিশের বেশি মনে হয় না।

‘বাংলাদেশে কোথায় আপনার বাড়ি?’

‘হাওড়া জেলা।’

পিকো বলে, ‘হাওড়া তো বাংলাদেশে নয়, পশ্চিমবঙ্গে।’

‘তখন সবই বাংলাদেশ ছিল ভাই। আমার কাছে বাঙালির চিরদিন যে মাটিতে জমিজমা, জন্ম, কর্ম, সেই মাটির নাম বাংলাদেশ। হাওড়া বাংলাদেশ, হুগলী বাংলাদেশ, কলকাতা বাংলাদেশ—বুঝলেন? বাঙালির দেশ মানেই বাংলাদেশ-তাই না?—দেবেন নাকি, মা, গঙ্গাদশেরার জন্যে সন্ন্যাসীকে কিছু দান?’ প্রসারিত তালুতে দুটো টাকা রাখি।—’জয় হোক মা, মঙ্গল হোক।

এই যাত্রায় এই প্রথম ভিক্ষে। এতদূরে এসেও তীর্থে প্রথম ভিক্ষেদান বাঙালি সাধুকেই! ‘দান’ শব্দে স্যাৎ করে মনে পড়ে গেল, গলায় ঝোলান পার্সে আমার নিজস্ব সম্বলটুকুর সঙ্গে এখন আছে আরও একটা খাম—শিবখৃষ্টস্বামীর ‘দানম্’। যাব, তোমার অত প্রিয় কেদারনাথে নিশ্চয় যাব, স্বামীজী। দরকার হলে ডাণ্ডী নিয়েও যাব। অন্তত এটুকু বিনয় আমার শিক্ষা হোক

পায়ে চলার পথের শেষে

হেঁটে হেঁটে হেঁটে চড়াই উৎরাই ভেঙে গঙ্গা-যমুনার হাত ধরে লংকায় এসে পৌঁছুই। পথে একবার দেহাতী এক যাত্রী হঠাৎ অনেক উঁচুতে দুটি অদৃশ্যপ্রায় পর্বতচূড়ায় গভীর যমুনার খাদের ওপর খাড়া দুটি পাড়ের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, ‘উয়ো বন্ রহা হ্যায় মিলিটারি পুল। যব খতম হো যায়গা ইস রাস্তে বি, ব্যস্, খতম্! সি-ধা আ যায়গী বাস্-মোটর, হর চিজ। যাত্রা খতম।’

আমারও মনে হল কথাটা ঠিক। এই এত সুন্দর, অসামান্য পথটি মিথ্যে হয়ে যাবে। এমন কি সাধুরাও এপথে যাবেন না, লোটা কম্বল নিয়ে মিলিটারি পুল দিয়ে শর্টকাটে চলে যাবেন ভাগীরথীর উৎস সন্ধানে। এত চমৎকার নদী, ঝরনা, বন পাথরের জলছবি—সব আবার অনধিকৃত, বুনো হয়ে যাবে? ফিরে যাবে প্রকৃতির নিজস্ব তোরঙ্গে। অব্যবহারে অব্যবহারে আবার প্রথম দিনের মতো নতুন হয়ে উঠবে। একমাত্র প্রকৃতিতেই এটা সম্ভব। ভাগ্যিস তুমি এখনও তৈরি হওনি ভৈরবঘাঁটির পুল ভাগ্যিস এখনও এই অলোকসামান্য পথে আমার অধিকার অক্ষুণ্ণ!

লংকায় পৌঁছে খবর নিলুম বাস-ড্রাইভারদের কাছে। না, সাধুজী পুরোপুরিই বঙ্গসন্তান। ত্রিশ বছরে স্বভাব পালটায়নি কিছুই। কেদারবদ্রীতে কোনোই বাস্ পড়েনি! অকারণ গুজব। হ্যাঁ, এগারোই একটা বাস্ পড়ে যাচ্ছিল, কিন্তু আটকে গেছে। কেউ মরেনি।

দেখতে পেয়ে ছুটে এল সুরথ সিং।–’নমস্তে। হমভি গঙ্গাজীমে নাহাকে আয়া। ‘

‘আরে, কখন গেলে?’

কালই সে গেছে, স্নান করেছে এবং ফিরেও এসেছে। হেঁটে। আগাগোড়া। ভৈরবঘাঁটির বাসের জন্যে বসে না থেকে হেঁটেই মেরে দিয়েছি সাত সাত চোদ্দ কিলোমিটার। ওর কাছে নস্যি। বাসের জন্যে বসে থাকলে হতই না স্নান!

কালকের সেই মৃতদেহের কী হল?

সে তো কালই পোড়ানো হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে আরও তিনজন মারা গেছে—ইধর ইয়ে তো হামেশা কী বাত। যাত্রা কা পরেশানিসে বুঢ়া লোগ গুজর যাতা।’

কবিতাদিরা লাঞ্চে বসলেন, বাসের বুকিং পেয়ে গেছেন। আমরা রওনা হই উত্তরকাশী। পথে ইন্দর সিংয়ের কাছে চা খেয়ে যেতেই হবে। কথা দেওয়া আছে। এখন সমস্যা, দোকানটা খুঁজে পাওয়া নিয়ে। ছোট একটা কাঠের ঘর, ভাগীরথীর তীরে। গাঙ্গনানীর পরে, ভাটওয়াড়ীর আগে পড়বে। চিনতে পারব তো? আমাদের বেজায় ক্ষুধার উদ্রেক হয়েছে, অর্থাৎ রঞ্জনের এবং আমার। কিন্তু পিকোলো ভয়ের চোটে কিছুতেই খেয়ে রওনা হবে না। ওর ধারণা খেলে গা গুলোবেই। আসার সময়ে খালিপেটে ছিলুম, ওর শরীরও তাতে খারাপ হয়নি। অতএব সবাই খালি পেটেই রওনা হই। ডালমুট আর বিস্কুট ভরসা করে। একটা একটা করে যত চেনা ঝরনা পার হচ্ছি, যতই গঙ্গোত্রী পেছনে পড়ে যাচ্ছেন, ততই আমার মন খারাপ হচ্ছে। একসময়ে সেই বিশাল তুষারখণ্ডও পার হয়ে যাই। ফেরার পথে সেই সব ঝরনাগুলো চেনা বন্ধুর মতো আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে। যাবার পথে এদের প্রত্যেকের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপ পরিচয় হয়েছে। এবারেও থামছি, ইঞ্জিনে জল ভরছি, বোতলে জল ভরছি, মুখ ধুচ্ছি, সুখে জলকেলি করতে করতে এগোনো হচ্ছে। একসময়ে গাঙ্গনানী পেরিয়ে যাই, অপূর্ব সুন্দর স্নোভিউ এখানেই শেষ। এরপরে হঠাৎ হঠাৎ একটু-আধটু। দয়া করে দর্শন দেয়া।

দিলনে ফির্ ইয়াদ কিয়া

পথের বাঁকে হঠাৎ দেখা গেল ইন্দর সিংয়ের দোকানঘর। অমনি কোরাস—’থামো, থামো, সুরথ সিং? এই তো!’

সুরথ সিং নিজেও দেখেছে। আমরা নামবার আগেই দৌড়ে বেরিয়ে এসেছে ইন্দর সিং। ফোলামুখের সেই অভাবিত আনন্দের জ্যোতির তুলনা আমি দিতে পারব না। আমাদের মুখেও নিশ্চয় তার কিছুটা প্রতিবিম্বিত ছিল।… ‘সচমুচ ইয়াদ রাখা? সচমুচ আয়া আপলোগ? ফিরভি আ গয়া? হম্ তো কারসে হখ্ গাড়িকো দেখ রহা থা। ম্যয়নে সোচা কি ভুল গয়া হোগা। ইত্‌ না দূর যানা হ্যায়, দোবারা রুখেঙ্গে নহী।’

ভুলব কেন? ভোলা যায় নাকি? পিকোলো, রঞ্জন, সুরথ সিং আমাদের প্রত্যেকেরই আলাদা করে মনে আছে, তোমার কাছে কথা দিয়ে গেছি। জীবনে ক’টা কথাই বা রাখা যায়, ইন্দর সিং? বেশি করে দুধ দিয়ে খুব যত্নে চা তৈরি করল ইন্দর সিং, গরম গেলাস হাতে ধরতে পারব না বলে কাপের মধ্যে গেলাস ভরে রুশদেশের কায়দায় চা পরিবেশন করল, দু’প্যাকেট গ্লুকোজ বিস্কুট দিল। প্রথমে তো দামই নেবে না একটার-’বেবিকো দিয়া’—অতিকষ্টে সুরথ সিং তাকে রাজী করাল। এবার রওনা। ভাটওয়াড়িতে লাঞ্চ খেয়ে উত্তরকাশী।

গাড়িতে তুলে দিয়ে ইন্দর সিং বলল, ‘বিবিজী, হম্ ক্যা বোলেগা, দিল্‌ ভর্ গয়া হম্‌কো, জিন্দেগী ভর্ ইয়াদ্ রহেগা ইস্ দিন–’

দিল্ ভরে গেছে আমাদেরও। আমাদেরও মনে থাকবে, ইন্দর সিং, জিন্দেগী ভর। তোমার আদর, তোমার খুশি, তোমার এই পাহাড়, গঙ্গা। জিন্দেগী ভর ভুলব না যমুনার প্রলয়প্রবাহ! ভাগীরথী, তোমাকেও মনে থাকবে, শিবখৃষ্টস্বামী, তোমাকেও, মেসোমশাই, কুন্দন সিং, দেওঘরের বাবাজী ভুলব না কাউকেই। বাবাজী সেদিন ‘ভগবানের নাম করে বেরিয়ে পড়ুন’ না বললে গঙ্গোত্রীতে আসাই হত না আমার। গাছের তলায় কম্বল জড়ানো হে রামশরণাশ্রিত পথিক, তোমাকেও মনে থাকবে। আর দূর জলন্ধরের গ্রামের পথক্লান্ত ঠাকুমা, তোমার শেষ অশ্বারোহণে আমরা সঙ্গী রইলুম না।

গাড়ি ছুটেছে ভাটওয়াড়ী হয়ে উত্তরকাশী। কাল সকালেই রওনা হব বদ্রীনারায়ণের পথে, সেই সব আশ্চর্য প্রয়াগের সারি যে পথে অপেক্ষা করে রয়েছে আমার জন্যে। মন্দাকিনী, নন্দাকিনী, পিনডার, অলকনন্দা—একদিকে স্বপ্নচারিণী নদীরা সবাই, আর অন্যদিকে কল্পনার দেশঘর রুদ্রপ্রয়াগ, কর্ণপ্রয়াগ, নন্দপ্রয়াগ, দেবপ্রয়াগ—যেন স্বপ্নের মধ্যে সোনার ঘণ্টা বাজাচ্ছে-স্বপ্ন সফল হবার দিন তো সবে শুরু।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *