হুলুক পাহাড়ের ভালুক

হুলুক পাহাড়ের ভালুক — ঋজুদা — বুদ্ধদেব গুহ

ঋজুদার সঙ্গে আমরা বিহারের পালামৌ-র মারুমারের বাংলোতে এসে উঠেছি আজ সকালে। এখন বর্ষাকাল।

বর্ষার মারুমারের রূপের বর্ণনা দেব এমন ভাষা আমার নেই। কোয়েলের ব্রিজ পেরিয়ে গাড় হয়ে, মিরচাইয়া জলপ্রপাতের পাশ দিয়ে এসে, মারুমারের বনবাংলোতে এসে পৌঁছেছি সকাল এগারোটা নাগাদ।

কালকে মোহন বিশ্বাসদের ছিপাদোহরের ডেরাতে ছিলাম। সেখানে ডালটনগঞ্জ থেকে রমেনবাবু, রমেন বোস, আর মোহনবাবুর ছোটভাই রতন বিশ্বাস আমাদের পৌঁছে দিয়ে গেছিলেন। এই রমেনদা দারুণ ইন্টারেস্টিং মানুষ। কত গল্পই যে তাঁর ভাঁড়ারে আছে! কয়েকবছর আগে জিপ অ্যাকসিডেন্টের পরে তাঁর একটা পা ছোট হয়ে গেছে। ক্রাচ নিয়ে চলেন কিন্তু তাতে তাঁর জীবনশক্তির একটুও তারতম্য হয়নি। এই রমেন বোস-এর কথাই বিস্তারিত আছে কোয়েলের কাছে এবং কোজাগর উপন্যাসে।

ঋজুদা বলছিল যে, দুটি উপন্যাস রমেন বোস এবং মোহন বিশ্বাসের আরও চেলা-চামুণ্ডাদের বাঙালি পাঠকপাঠিকাদের কাছে বিখ্যাত করে দিয়েছে।

ঋজুদা দেখছি মোহনবাবুর কথা বলতে অজ্ঞান। বলে, আমার জীবনে দুজন মানুষকে দেখেছি, যারা বিনা স্বার্থে মানুষকে কী করে এবং কতখানি ভালবাসতে পারা যায় তা দেখিয়ে গেছেন। এর একজন হলেন ডালটনগঞ্জের মোহন বিশ্বাস আর অন্যজন হলেন কলকাতা ও যসিডির দ্বারিকানাথ মিত্র। ঋজুদার মোহন এবং দ্বারিকদা। দ্বারিকানাথ মিত্র চলে গেছেন গতবছর।

এঁদের দুজনের কথা বলতে গেলেই ঋজুদার মতো শক্ত মানুষের গলাও ভারী হয়ে আসে। অবশ্য ঋজুদার বাইরেটাই ভারী শক্ত, ভিতরটা তুলতুলে নরম। যারা জানে তারাই জানে।

মারুমার বনবাংলোতে দুটিই ঘর। কোনও খাবারঘর কোনও ড্রয়িংরুম নেই যা অধিকাংশ বনবাংলোতেই থাকে। পুরনো বাংলোর সামনেই নিচু জায়গাটাতে, যার পেছন দিয়ে একটি ঝরনা বয়ে গেছে হুলুক পাহাড় থেকে নেমে, একটা মস্ত কুসুম গাছ আছে। বনবিভাগ সেই গাছে একটি ট্রিকটেজ বানিয়েছে। সুন্দর। এটা বানিয়েছেন সাউথ কোয়েলের ডি.এফ.ও মহম্মদ কাজমি। কাজমি সাহেব লম্বা চওড়া দিলেরি মানুষ। লক্ষ্মৌতে বাড়ি। ঋজুদা এসেছে শুনে ছিপাদোহরে ঋজুদার সঙ্গে দেখা করে গেছেন গতকাল।

ঋজুদা বলেছে আমি পুরনো বাংলোতেই থাকব। কত স্মৃতিই না আছে আমার এই বাংলোর। তোরা বরং ট্রিকটেজে গিয়ে থাক রাতে, ভাল লাগবে। ট্রি কটেজটির নাম কুসমি।

ঋজুদা বলছিল, কুসমি নামের এক রকম স্টিকল্যাক বা লাক্ষা হয় কুসুম গাছে–সেই crop-কেই লাক্ষার জগতে বলা হয় কুসমি।

সত্যি! ঋজুদা কতই না জানে! কোনও অ্যাডভেঞ্চার বা মানুষখেকো বাঘের শিকার বা রহস্যভেদ না হলেও ঋজুদার কাছ থেকে মারুমার বনবাংলোর বারান্দাতে বসে নানা গল্প শুনেই দিন কেটে যাবে স্বচ্ছন্দে। মোহনবাবু নেই বটে কিন্তু মোহনবাবু বিখ্যাত আদিবাসী বাবুর্চি ‘জুম্মানকে’, যার কথা কোয়েলের কাছে’তে বারবার এসেছে, রমেনবাবু আর রতনবাবু ধরে পাকড়ে নিয়ে এসে ঋজুদার ডিউটিতে লাগিয়ে দিয়েছেন। দেখলাম বহুদিনের জান-পহচান ঋজুদারও জুম্মানের সঙ্গে। জুম্মান বিরিয়ানির ইন্তেজাম করছে বাবুর্চিখানাতে আর আমরা এক কাপ করে কফি খেয়েছি। ঋজুদার পাইপটা ইংলিশ গোল্ড ব্লক টোব্যাকোতে ঠেসে নেওয়া হয়ে গেলে, তাতে রনসন-এর লাইটার দিয়ে আগুন ধরিয়ে মৌজ করে একটা টান দিয়ে ঋজুদা যেন অতীতের গভীরে ডুব দিল। আমরা বুঝলাম, এই মওকা। আমি আর ভটকাই ধরে পড়লাম, ঋজুদা, এই মারুমার আর হুলুক। পাহাড়ে তোমার কত কী অভিজ্ঞতাই তো হয়েছে। আমাদের বলো না তার কিছু। রান্না হতে তো এখনও ঘণ্টা দুই লাগবেই। বিরিয়ানি রান্না কি কম হ্যাঁপা! তার উপরে চাঁব, চওরি, এবং লাব্বাও হবে।

বলো না প্লিজ ঋজুকাকা, তিতিরও ধরে পড়ল।

ঋজুদা নিমরাজি হয়ে বলল, দাঁড়া। দাঁড়া। পাইপটা সবে ধরালাম, পাইপের একটা ফিল অন্তত খেতে দে, সামনের হুলুক পাহাড়ের দিকে চেয়ে থেকে। তারপর যা মনে পড়বে, তা বলব এখন।

আমরা তিনজনেই খুব খুশি হলাম। ইতিমধ্যে কিশোর ও পাপড়ি চৌধুরী এসে হাজির। ওঁরাই বেতলার নইহার হোটেল বানিয়েছেন। তা ছাড়া মারুমারেও ওঁদের বাড়ি আছে একটা। বাড়ি মানে, চালিয়াতির নয়, খুবই সাদামাঠা কিন্তু দারুণ। হাতিরা মাঝে মাঝেই এসে সে বাড়ি ভেঙে দিয়ে যেত প্রথম দিকে। নইহার নামটির মানে হচ্ছে বাপের বাড়ি। হাতিদের বাপের বাড়ি, এই অর্থেই বেতলার হোটেলের নাম দিয়েছেন ওঁরা নইহার। চৌধুরীরা যখন প্রথমবার গাড়িতে করে পালামৌ-এর এই সব অঞ্চলে আসেন তখন থেকেই ঋজুদার সঙ্গে তাঁদের আলাপ। ঋজুদা সেবারে কেঁড় বাংলোতে উঠেছিল।

ঋজুদা কিশোরবাবুকে বলল, কিশোর, তুমি এদের একটু সুগা বাঁধটা দেখিয়ে দিও তো।

সুগা বাঁধটা কী ব্যাপার?

ওভার-ইনকুইজিটিভ ভটকাই জিজ্ঞেস করল।

সুগা মানে যে টিয়া তা তো জানিসই।

 হ্যাঁ তা তো জানিই।

সেই সুগারা তাদের ঠোঁট দিয়ে ঠুকরে ঠুকরে এই বাঁধ বানিয়েছিল এমনই রূপকথা আছে ওঁরাও আদিবাসীদের। কিশোর পাপড়ি বলবে তোদের।

তুমি যাবে না আমাদের সঙ্গে?

নাঃ।

কেন?

আমি কোনওদিনই যাইনি। দেখিইনি সুগা বাঁধ আজ অবধি। তাই আর বড় বয়সে দেখে কী লাভ? আমি সবকিছুই প্রথমে করাতে বিশ্বাসী। এই ব্যাপারটাতে যখন কিশোর ও পাপড়ি আমাকে সেকেন্ড করেই দিয়েছে তখন সেকেন্ডই থাকি বরং।

আমি ভাবছিলাম, ঋজুদার কী যেন হয়েছে ইদানীং। অনেক কিছুই জানেনা বলছে, দেখেনি’ বলছে। ঋজুদাও জানেনা বা দেখেনি এমন কোনও জিনিস যে থাকতে পারে তা আমাদের বিশ্বাসই হয় না, যদিও ঋজুদা নিজেকে কোনওদিনই সর্বজ্ঞ হিসেবে জাহির করেনি কারও কাছেই, আমাদের কাছে তো নয়ই! বরং যারা নিজেদের সর্বজ্ঞ ভাবে তাদের নিয়ে ঠাট্টাই করে ঋজুদা। তবু আমাদের যেন কীরকম অবাক লাগে। আমার সবচেয়ে বেশি লাগে, কারণ আমিই তো ঋজুদার সবচেয়ে পুরনো ও ওরিজিনাল চেলা।

ভটকাই প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে বলল,–তোমার পাইপের টোব্যাকো তো জ্বলে গেছে ঋজুদা। এবারে শুরু করো আরেকবার পাইপ ফিল না করেই। গল্প শেষ হলে তারপর আবার ভরবে।

ঠিক আছে। বলল, ঋজুদা।

ওই যে হুলুক পাহাড়টা দেখছিস সামনে সোজা তার উপরে একটা মালভূমি মতো আছে। আজকাল তোদের মতো অনেক তরুণ তরুণীই ট্রেকিং করছে এই সব অঞ্চলে…

তার হোত তো আপনিই।

 কিশোরবাবু বললেন।

তা কেন? আসলে আজকালকার ছেলেমেয়েরা অনেক বেশি অ্যাডভেঞ্চারাস, আমাদের চেয়ে অনেক বেশি জানে শোনে, তাদের জানার ইচ্ছাটাও আমাদের চেয়ে অনেকই বেশি তাই তারা নিজেদের তাগিদেই বনেজঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়, ট্রেকিং করে, পাহাড় চড়ে। এখন তো অজানাকে জানার ও জয় করারই যুগ। তারা যা-কিছুই করে নিজেদের জন্যেই করে। আমার অবদান কিছুমাত্র নেই।

ঋজুদা বলল।

আমরা সকলে চুপ করে রইলাম। কিশোরবাবু আপনিই হোতা বলেই ট্রেনটাকে ডি-রেইলড করে দিলেন। কিন্তু ভটকাই এমন ভবি যে, সে সহজে আদৌ ভোলে না। সে বলল, ব্যাক টু হুলুক পাহাড় এগেইন।

হ্যাঁ। ঋজুদা নিজেকে গুটিয়ে এনে বলল।

তারপর বলল, প্রতি শীতে মোহনের একটা ক্যাম্প পড়ত ওই পাহাড়ের উপরে। বহুবার যে গেছি এমন কথা বলব না তবে অনেকবারই গেছি। মোহনের মাসতুতো ভাই শান্টু, লম্বা, সুপুরুষ, কালো এবং তার সঙ্গে ছিপাদোহরের জাঙ্গল-ম্যানেজার মুসলিম দেখাশোনা করত ক্যাম্প। বাঁশ কাটাই ও লাদাই-এর ক্যাম্প। কেটে, সাইজ করে রেখে বাঁশ ট্রাকে করে নামিয়ে আনা হত ছিপাদোহরে। তারপর রেল-এর ‘রেক’-এ করে চলে যেত বঙ্গভূমে অ্যান্ড্রু ইয়ুল কোম্পানির আই.পি.পি. অর্থাৎ ইন্ডিয়ান পেপার পাল্প কোম্পানির কারখানায় কাগজ তৈরি হতে। তখন সারাদিনই বাঁশ বোঝাই ট্রাক চলত এই পথে। টাইগার প্রোজেক্ট হয়ে যাওয়ার পরে সমস্ত জাঙ্গল-অপারেশন এখন বন্ধ। তাই এত শান্ত সুনসান মনে হয় পুরো অঞ্চল।

ভটকাই বলল,তুমি দেখি আমাদের বাঁশ-বিশারদ করে দেবে। অন্য গল্প বলো না।

তাই তো বলছি। এসবই তো সেই গল্পেরই প্রস্তাবনা। আমি অবশ্য ক্যাম্পে রাত কাটাইনি কখনও। মারুমার থেকে জিপে গেছি, হয়তো সারাদিন থেকেছি, তার পরে সন্ধের আগেই নেমে এসেছি কারণ হুলুক পাহাড়ে ওঠানামার পথটা আদৌ সুবিধের ছিল না।

আমরা যেতে পারব না? আমাদের জিপ নিয়ে?

সম্ভবত না। কারণ, জঙ্গলের কাজ তো বহুবছরই বন্ধ। মোহনই নিজের গরজে রাস্তা মেরামত করে নিত। তা ছাড়া বনের মধ্যের সব কাজই, যখন সেই সব কাজ করতে দেওয়া হত, বন্ধ হয়ে যেত ত্রিশে জুন। পথঘাট খুলত পয়লা অক্টোবর। সারা ভারতের অধিকাংশ বনবিভাগেই এ নিয়ম। রাজস্থান বা অন্য রুখু জায়গাতে কী নিয়ম খোঁজ করিনি।

বন্ধ থাকত কি বৃষ্টির জন্যে?

 তাও বটে। আবার জন্তু জানোয়ারদের শান্তিতে থাকতে দেওয়ার জন্যেও হয়তো কিছুটা। ওই কটি মাস শিকারেরও closed-season ছিল সব জঙ্গলেই। এসব নিয়মকানুন সাহেবরাই বানিয়ে গেছিল তারপরে পঞ্চান্ন বছরেও সেই সব আইনের কোনও রদবদল হয়নি।

বলো, তারপর ঋজুকাকা। আবারও বাঁশ! আমাদের কি তুমি কোজাগর’ উপন্যাসের বাঁশবাবু’ করে দেবে না কি?

তা হলেই বা মন্দ কী? আহা! আমি যদি বছরের পর বছর ওইরকম এই সব অঞ্চলে থাকার সুযোগ পেতাম তবে কী মজাই না হত। স্থায়ী ভাবে কোথাওই বসবাস না করলে যা জানা যায়, তাতে আমার মতো মূর্খই হওয়া যায়, সত্যিকারের পণ্ডিত হওয়া যায় না।

আবারও তুমি গল্প থেকে নড়ে যাচ্ছ ঋজুদা। তুমি আগে তো এরকম ছিলে না?

চরিত্রের অবনতি হয়েছে বলছিস?

ভীষণই।

তা একবার গরমের দিনে মারুমার থেকে জিপ নিয়ে গেছি হুলুক-এর উপরে শান্টুর সঙ্গে দেখা করতে। আর গরম কী গরম! সকাল আটটার পরে বাইরে বেরোনোই যায় না। কিন্তু বাঁশকাটা কুলিরা যখন এই গরমেও কাজ করে, তখন আমাদের না-বেরোনোর কোনও অজুহাত নেই। বনবিভাগের সব বাংলোতেই গরমের দিনে যব-এর ছাতু রাখা থাকে। ফরেস্ট গার্ডরাও বনে বেরোবার আগে বড় এক গ্লাস যবের ছাতু গুলে খেয়ে নিয়ে তারপর হেঁটেই হোক কী সাইকেলেই হোক ডিউটিতে বেরোয়। কুলি কামিনদের জন্যেও মোহন যবের ছাতুর ঢালাও বন্দোবস্ত রাখত।

তারপর?

মে মাসের শেষ। সকালে ব্রেকফাস্ট করে মোহনের পার্সোনাল ড্রাইভার কিষুণকে নিয়ে বেরিয়েছি। লাল ধুলোতে লাল ভুত হয়ে যখন পৌঁছলাম তখন দেখি খুব শোরগোল সেখানে। শান্টু ‘জাম্পিং-বিন’-এর মতো লাফাচ্ছে। তিন-তিনজন কুলি রক্তাক্ত অবস্থাতে ডেরার সামনে চৌপাইতে শুয়ে আছে। সমস্ত শরীর ক্ষতবিক্ষত। ক্ষতবিক্ষত না বলে ফালা ফালা বলাই ভাল। জামাকাপড়ও নেই বললেই চলে। কারও নাক নেই, ঠোঁট নেই, কারও কান নেই, কারও গলার কাছে বীভৎস ক্ষত। যাদের নাক নেই তাদের নাকের জায়গাতে দুটি রক্তাক্ত ফুটো আছে। কাজ বন্ধ। কুলিকামিনরা গোল হয়ে ঘিরে আছে শায়ীন আহতদের। আর শান্টু আর মুসলিম চিৎকার করে ওদের সরে যেতে বলছে। বলছে, হাওয়া আসতে দাও, ওদের নিশ্বাস নিতে দাও। তা ছাড়া, হাওয়াতে না রাখলে ওদের ক্ষত খুব তাড়াতাড়ি পচে যাবে।

তিনজনের মধ্যে একজনের জ্ঞানই ছিল না। অন্য দুজন মাঈরে! বাপ্পারে! করছিল।

শান্টু বলল, ভগবান আপনাকে পাঠিয়েছে ঋজুদা। কারণ, প্রথম ট্রাক আসতে আসতে তো বারোটা-একটা বেজে যাবে। এখুনি জিপে করে এদের ছিপাদোহরে বা মহুয়াডাঁরে পাঠাতে না পারলে এরা মরেই যাবে।

তারপর?

ভটকাই বলল।

ক্ষত দেখেই বুঝেছিলাম যে এ ভাল্লুকের কাজ। কিন্তু একসঙ্গে তিন তিনজনের এই অবস্থা করেছে দেখে অবাক হলাম।

শান্টু বলল, বন্দুক রাইফেল এনেছেন তো ঋজুদা?

তা তো এনেছি কিন্তু সে তো মারুমারের বাংলোতে আছে। তা ছাড়া আমার পারমিটে শুয়োর আর ভালুক ছাড়া আর কিছু মারার অনুমতি নেই। আর আছে একটা লেপার্ড।

ভাল্লুকই তো মারবেন! আর ভাল্লুক কী ভাল্লুক। ড্যাডি অফ অল ড্যাডিজ। এত বছর এই পালামৌর জঙ্গলে বছরের ন মাস কাটাচ্ছি এত বড় ভাল্লুক আমি কখনও দেখিনি।

বললাম, এখন বাক্যব্যয় না করে এদের কোথায় পাঠাবে পাঠাও।

 শান্টু বলল, মুসলিম, যাও এদের নিয়ে জিপে করেই। এখনও তো একটিও ট্রাক এসে পৌঁছয়নি ডালটনগঞ্জ থেকে। কিন্তু যাবে কোথায়?

ডালটনগঞ্জেই নিয়ে যাই একেবারে। ওখানে বাবু’ আছেন সবরকম সুযোগ সুবিধা করে দেবেন।

তাই যাও।

 বলেই, ছোট ঘোট বাঁশ দিয়ে তৈরি তার ঘরের মধ্যে থেকে ডেটল-এর একটা নতুন শিশি নিয়ে এসে সেটাকে খুলে আহতদের তিনজনেরই ক্ষত স্থানে গবগব করে ঢেলে দিল। যে লোকটা অজ্ঞান হয়ে ছিল সে যুবক এবং তার স্বাস্থ্যও খুব ভাল কিন্তু সেই অজ্ঞান হয়ে হয়েছে। ক্ষতস্থানে ডেটল পড়তেও তার কোনও ভাবান্তর হল না। অন্য দুজন সঙ্গে সঙ্গে আরও জোরে মাঈরে। বাপ্পারে! বলে চেঁচিয়ে উঠল।

শান্টু বলল, গেল ডেটলটা। কালই নতুন বড় শিশি আনিয়েছিলাম। ডালটনগঞ্জ থেকে। এখন দাড়ি কামাতে গিয়ে গাল কাটলেও এক ফোঁটা ডেটল পাব না।

গাল কাটলে তো আর প্রাণ যাবে না। ওদের যে প্রাণ বিপন্ন।

জানি তো। তাই তো দিলাম।

 কিষুণ ওদের নিয়ে চলে গেল। সঙ্গে আরও দুজনকে নিয়ে গেল, আহতদের ধরে বসে থাকবে বলে।

শান্টু বলে দিল ডালটনগঞ্জসে তুম নেহি লওটনে শেকেগা তো ঋজুদা কি লিয়ে দুসরা জিপোয়া ভেজাও বাবুকো কহকে। হিয়া সাব রাত নেহি না বিতায়েগা।

উওতো জরুর। মগর জিপোয়া আতে আতে দেরতো লাগেগি। আপ হিয়াই সাবকি খানেপিনে কি ইন্তেজাম তো কিজিয়ে।

শান্টু বলল, উসকি ফিকির তুমহারি নেহি। তুম যাও জলদি আউর বাতিয়া না বানাও।

ঋজুদা বলল, আমি জিজ্ঞেস করলাম, হল কী করে?

আর বলবেন না ঋজুদা, এখানে একজন ডি.এফ.ও ছিলেন বহুদিন আগে, রামসেভক পাঁড়ে। তা পাঁড়েজি একটা সেকেন্ড হ্যান্ড অ্যাম্বাসাড়ার গাড়ি কিনে রং-টং করিয়ে নিজে চালিয়ে বউ-আন্ডা-বাচ্চা সব নিয়ে কলকাতা দেখতে গেলেন। নিজের গাড়ি ‘সেলফ-ড্রাইভ করে কলকাতার যা কিছু দ্রষ্টব্য তো দেখলেন। যখন ফিরলেন, তখন গাড়িটাকে যদি দেখতেন! গাড়ির সারা শরীরে কোথাও ট্যাঁপারি, কোথাও আমড়া, কোথাও আঁশফল, কোথাও ডাব। কোথাও বা গভীর গাড্ডা, চাকা-চাকা দাগ।

আমরা গাড়ির হাল দেখে জিজ্ঞেস করলাম, হুয়া ক্যাথা পাণ্ডে সাব?

পাণ্ডে সাব অত্যন্ত রেগে গিয়ে বললেন ঔর মত পুছিয়ে। কলকাত্তাকি সব ট্রামওয়ালালোগ লাইন ছোড়কর আকর হামারা গাড়িমে টকরাতা থা। অজিব বাত হ্যায় ভাই।

তা আমি বললাম, কলকাত্তাকি সবহি ট্রাম-ড্রাইভারতে বিহারিই না হ্যায়। বিহারকি নাম্বার প্লেট দিখকর উনলোগোকি পেয়ার চড় গিয়া থা হোগা।

আরে মজাক নেহি শান্টুবাবু। গাড়িকি হালত দেখিয়ে। হায় বজরঙ্গবলি!

ঋজুদা বলল, তার সঙ্গে ভালুকের কী সম্পর্ক?

এই ভাল্লুকও কলকাতার ট্রাম-ড্রাইভারদের মতো বেশ কিছুদিন হল লাইন ছেড়ে এসে যাকে তাকে আক্রমণ করেছে। কারও পেছন আঁচড়ে হাটিয়াতে নতুন কেনা লাল রঙের প্যান্টের এক গিরে কাপড় খুবলে নিচ্ছে প্যান্টের নীচের মাংস সমেত। কারও নাক, কারও কান, কারও চোখ। এ ভাল্লুকের মতো ত্রাস এ অঞ্চলে কখনও কোনও মানুষখেকো বাঘেও সৃষ্টি করেনি। বাঘে ধরলে ঝামেলা নেই। প্রাণ যে যাবে তা প্রায় গ্যারান্টিড। কিন্তু এ কী বিড়ম্বনা বলুন তো! আর যা শুনছি তাতে তো আতঙ্ক হচ্ছে। ভাল্লুকটা আপনার মতোই।

ঋজুদা বলল, আমি বললাম, তার মানে?

মানে আপনার চেয়েও লম্বা চওড়া। প্রায়, সাত ফিট লম্বা হবে। বুকের মধ্যে একটা সাদা ভি চিহ্ন। আমার ছোট মাসি আমাকে যেমন একটা কালো সোয়েটার বুনে দিয়েছিল তেমন ডিজাইনের।

 সোয়েটারটা আছে এখনও?

না।

ভাগ্যিস নেই।

কেন?

থাকলে, কোনও শিকারি ভাল্লুক ভেবে তোমাকেই গুলি করে দিত হয়তো।

শান্টু হাসল।

ঋজুদা বলল, আমি বললাম এ আর নতুন কী? ভারতবর্ষের বনেজঙ্গলে ভাল্লুকের মতো পাজি জানোয়ার আর দুটি নেই। বিনা কারণে, কোনওরকমে প্ররোচনা ও উত্তেজনা ছাড়া, কেউ তাকে কোনওভাবে বিরক্ত না করলেও সে কোথা থেকে যে দৌড়ে এসে মানুষকে আক্রমণ করে বসবে তার ঠিক নেই। দিন রাতের কোনও ভেদ নেই। মানুষের উপরে তার জাতক্রোধ। ভারতের সব বনে জঙ্গলে যত মানুষ দেখা যায় যায় চোখহীন, নাকহীন, কানহীন তার জন্যে দায়ি এই ভাল্লুকেরাই। বড় বড় নখ দিয়ে পেছনের দু পায়ে দাঁড়িয়ে উঠে মানুষের মাথা থেকে পা অবধি আলিঙ্গন করে একেবারে চিরেফেড়ে দেয়। যারা বাঁচে, তাদের ওই অবস্থা হয় আর তাদের আক্রমণে মরেও যে কত মানুষ তার ঠিক নেই।

শান্টু বলল, তা আর জানি না! একবার, তখন আমি নতুন এসেছি মোহনদার কাছে কলকাতা থেকে চাকরি করব বলে–বেকার বসে আছি বি কম পাশ করে তাই। মোহনদা ছিপাদোহরে পাঠাল মুসলিম-এর সাগরেদি করে কাজ শিখতে। আপনিই নিশ্চয়ই জানেন ছিপাদোহর থেকে কেঁড়-এ যাবার একটা কাঁচা রাস্তা আছে। পিচের বড় রাস্তা দিয়ে যেতে গেলে পথ বেশি পড়ত বলে আমরা সবাইই ওই পথটাই ব্যবহার করতাম। কেঁড় বাংলোতে মোহনদার অতিথিরা এসেছিল কলকাতা থেকে। ফিল্ম আর্টিস্টরা। ভাল খাওয়া-দাওয়া ছিল বলে মোহনদা ছিপাদোহর থেকে আমাকে যেতে বলেছিল খেতে। এই রকম গরমের দিন। চাঁদনি রাত। ফুরফুরে হাওয়া দিয়েছে। হাওয়াতে মহুয়া করৌঞ্জের গন্ধ ছুটছে। পোলাও মাংস খেয়ে সাইকেল চালিয়ে কেঁড় থেকে ফিরে আসছি আমি আর মুসলিম। মাইলখানেক আসার পরেই পথের বাঁদিক থেকে হঠাৎ একটা প্রকাণ্ড ভাল্লুক বেরিয়ে দৌড়তে দৌড়তে আমাদের দিকে আসতে লাগল। মনে হল আমাদের কোনও জরুরি খবর দিতে চায়। ছিপাদোহর স্টেশন থেকে যেন মাস্টারবাবুকে বলে টরে-টক্কা করে টেলিগ্রাফে সেই খবর পাঠিয়ে দিতে হবে।

আমি তো তাকে সাহায্য করার জন্যে সাইকেল থেকে প্রায় নেমেই পড়েছিলাম। জঙ্গলে সেই আমার প্রথম ভাল্লুক-দর্শন। মুসলিম চেঁচিয়ে বলল, সাইকেল তেজ চালাইয়ে শান্টুবাবু জান বাঁচানা চাহতা তো। আপকো ফাড় দেগা। ঔর কুস্তি লড়না হ্যায়তো উতারকে লড়িয়ে কুস্তি। ব্যাবাগো! ম্যাগো বলে যত জোরে পারি সাইকেল চালিয়ে সেই রাতে আমরা ছিপাদোহরের ডেরাতে ফিরেছিলাম। পোলাও-মাংস সব জোরে সাইকেল চালানোতে হজম হয়ে গেল। ক্ষিদে পেয়ে গেল। ডেরাতে পৌঁছে লাল্ট পাণ্ডেকে পুরি হালুয়া বানাতে বললম।

ঋজুদা বলল, তা তো হল, এখন আমার কী করণীয় বলো।

 আবার করণীয়! ভাল্লুকটাকে মেরে দিন নইলে আমাদের কাজ বন্ধ হয়ে যাবে। গত সাতদিনে এই নিয়ে আটজনকে জখম করেছে ব্যাটা। তার মধ্যে দুজন বোধহয় বাঁচবেই না। আজকেও একজন বাঁচে কি না সন্দেহ। আপনি যে এসেছেন তা তোতা আমি জানিই না। আজই যখন জগদীশ ড্রাইভার লাদাই ট্রাক নিয়ে ভোরে নীচে নামছে সে বলল, কাল ঋজুবাবুকো দেখা থা। মিরচাইয়াকি সামনে টহলতা থা। জরুর মারুমারমেই ঠাহরা হোগা উনোনে। হাতমে রাইফেল থা। কাহেনা উনকি খবর ভেজ সেঁতে হ্যায় আপ?

তখন ওকেই বললাম আপনাকে খবর দিতে মারুমারে।

ঋজুদা বলল, কই সে তো খবর দেয়নি? কেউই খবর দেয়নি। তুমি আছ তা কিষুণ ড্রাইভারের কাছে জানতে পেরে আমি নিজেই তো এলাম।

তাই? দেখুন, ভগবান পাঠিয়ে দিয়েছেন আপনাকে। আপনি আছেন কদিন?

 তিনদিন।

যে করে হোক এই বদমাইশ ভাল্লুকটাকে মেরে দিন ঋজুদা। নইলে বাঁশের কাজ বন্ধ হয়ে যাবে। এদিকে ছিপাদোহরে ‘রেক’ এসে পড়ে আছে। গোমো থেকে বন্দোবস্ত করে ওয়াগনের রেক পাওয়া যা অসুবিধের তা কী বলব! তারপর দিনে আট ট্রাক বাঁশ নামে পাহাড় থেকে। ট্রাকগুলোও সব বসে থাকবে।

ভাল্লুকটা থাকে কোথায়? কুলিরা কেউ জানে?

কোথায় থাকে, তা কেউ বলেনি। তবে হুলুক পাহাড়ের মাথা থেকে ওদিকে সমান জমিতে মিরচাইয়া ফলস অবধি তার যাতায়াত। মিরচাইয়াতে একটি মেয়ে পরশু বিকেলে জল আনতে গেছিল তাকে একেবারে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে। ডালটনগঞ্জের হাসপাতালে সে এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে।

ঋজুদা এবারে থেমে বলল, একটু পাইপ খেয়েনি এবারে। আর কিশোররা কখন এসেছে ওদের এখনও এক কাপ কফিও খাওয়ালি না। কী রে তিতির! ভারতীয় নারীরা উইমেনস লিব-এ সামিল হয়ে নারীত্বই বিসর্জন দিল কি? আসলে তোদের মিষ্টি কথা শুনতে, তোদের হাতে একটু চা-কফি খেতে, তোদের হাতের রান্না খেতে, তোরা সামনে বসে খাওয়ালে আমাদের কী ভালই যে লাগে তা তোরা বুঝবি কী করে।

তারপর বলল, শুধু চা বা কফিই নয় কিশোরদের খেয়ে যেতেও বল দুপুরে। গতবারে আমাকে দারুণ খাইয়েছিল ওরা মারুমারের বাড়িতে। শুধু আমাকেই নয় সঙ্গে আমার ব্যাটালিয়ন ছিল বামা, সুশান্ত, কৌশিক।

কোন সুশান্ত? চিড়িয়াখানার অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর?

 ভটকাই বলল।

হ্যাঁরে। আর চর্ম বিশেষজ্ঞ ডাঃ কৌশিক লাহিড়ী এবং কাস্টমস-এর বামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। বিদেশ যেতে আসতে দমদম এয়ারপোর্টে যে আমার সব দায়িত্ব হাসিমুখে পালন করে।

তিতির বলল, আমি একটু ঘুরে আসছি। কী খাবেন? চা না কফি? না কি ঠাণ্ডা কিছু খাবেন। ফ্রিজ তো নেই এখানে ঠাণ্ডা তো সেরকম হবে না।

কফি খাব।

আমি আগেই জিজ্ঞেস করতাম কিন্তু ঋজুদার গল্প শুনতে এতই মগ্ন ছিলাম যে ভদ্রতা জ্ঞান লোপ পেয়ে গেছিল।

ঋজুদা বলল, তা হলে গল্প এখানেই শেষ। কফি যখন করতে বলছিসই তখন আমরা সকলেই খাব।

তিতির যেতে যেতে বলল, আমি না ফেরা অবধি শুরু কোরো না কিন্তু ঋজুকাকা।

না। তুই আয় কফির অর্ডার দিয়ে। আমি ততক্ষণে ছাই ঝেড়ে পাইপটা ভরি। কফির পরে দুটান তো মারতে হবে।

তিতির চলে গেল। ঋজুদা পাইপের ছাই ঝেড়ে ফেলতে ফেলতে বলল, ওই দ্যাখ।

কী? কিউমুলো-নিম্বাস?

 ভটকাই বলল।

ঋজুদা বলল, কাররেক্ট। আন্দামানের ট্রেনিং তবু কিছু কাজে লেগেছে দেখছি।

 কিশোরবাবু বললেন, সকাল থেকেই সাজছে আকাশ। এবার নামবে।

ঋজুদা বলল, তিতির কোথায় গেল? ও, ওতো গেছে কফির অর্ডার করতে। ও এলে সেই গানটা গাইতে বলব ওকে।

 পাপড়িদি বললেন, কোন গানটা?

 আজ যেমন করে গাইছে আকাশ তেমন করে গাও গো।

 বলেই বলল, পরের লাইনগুলো যেন কী, আজ যেমন করে চাইছে আকাশ তেমনি করে চাও গো।

আজ হাওয়া যেমন পাতায় পাতায় মর্মরিয়া বনকে কাঁদায়।

তেমনি আমার বুকের মাঝে কাঁদিয়া কাঁদাও গো।

তারপরই বলল, এই তো তিতির। গা তো গানটা। আরে! এতক্ষণ তো খেয়ালই করিনি। কী সুন্দর দেখাচ্ছে তোকে আজ শাড়ি পরে। জিনস-ফিনস, সালোয়ার কামিজ যত কম পারিস পরবি। তোর শাড়ির রংটা কী বল তো?

এই ভিয়োলেট আর ম্যাজেন্টার মাঝামাঝি।

কেন? দিশি নাম নেই কি? তোর শাড়িটা দেখেই রবীন্দ্রনাথের কবিতার লাইন মনে পড়ে গেল।

কোন লাইন?

ফলসাবরণ শাড়িটি চরণ ঘিরে। আহা। কবিতা হবে তো এরকম। চারটি শব্দতে কেমন এক আবহ তৈরি হয়ে গেল বল তো? এমনিতে কি রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ?

ঋজুদা বলল, আকাশের ঘনায়মান কালো মেঘের দিকে পাইপসুদ্ধ হাত তুলে দেখিয়ে, ওই দ্যাখ, ওই আসে ওই অতি ভৈরব হরষে।

পাপড়িদি বললেন, মারুমারে বৃষ্টির শব্দ শোনা যায় দূরাগত এক্সপ্রেস ট্রেনের মতো। ওই দ্যাখো হুলুক পাহাড়ের ভালুকের মতো আসছে বৃষ্টি–তার শিস শোনা যাচ্ছে–পাহাড় চুড়ো থেকে এখানে এসে পৌঁছতে মিনিট তিনেক তো লাগবেই।

ভটকাই রিলে করতে লাগল, আসছে, আসছে, এসে গেল। কিউমুলো-নিম্বাস ফেটে গেছে, মামাদাদুর কপালের ফোঁড়ার মতো।

ঝমঝমিয়ে নামল বৃষ্টি। ঝমঝমিয়ে বলাটা ঠিক নয়। ছোটনাগপুর উপত্যকার সব জায়গাতেই সে পালামৌই হোক কি রাঁচি কি হাজারিবাগ জেলা, বৃষ্টি হয় ফিসফিসিয়ে। আর প্রতিবার বর্ষণের সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন মিশ্র গন্ধ ওড়ে, বনের গন্ধ, মাটির গন্ধ, জলের গন্ধ।

কিশোরবাবু বললেন।

সেটা ঠিক। এ কথা সব বনের বৃষ্টির বেলাতেই খাটে। ততক্ষণে কফি নিয়ে এল চৌকিদার এক হাতে ছাতা ধরে আর অন্য হাতে ট্রেতে কফির কাপগুলো বসিয়ে। সদ্য আসা বৃষ্টির গন্ধের সঙ্গে কফির গন্ধ মিশে গেল। কফিতে চুমুক দিয়েই ঋজুদা পাইপটা ধরাল। এবং সঙ্গে সঙ্গেই ভটকাই বলল, নাউ ব্যাক টু হুলুক অ্যান্ড ভালুক।

ঋজুদা বলল হ্যাঁ।

 জিপ তো কিষুণ নিয়ে চলে গেছে। ফিরতে ফিরতে বিকেল তিনটে চারটে হবে। সঙ্গে বন্দুক রাইফেলও আনিনি কিছু। কিন্তু এতখানি সময় মিছিমিছি বসে নষ্ট করারও মানে হয় না। এদিকে কাজও সব বন্ধ হয়ে গেছে। কুলিকামিনেরা ওই সাংঘাতিক তাপের মধ্যেই ছায়া খুঁজে নিয়ে জিরোচ্ছে। একটু পরে ওদের নিজের নিজের স্টেইনলেস স্টিলের বাটি খুলে যা-কিছুই এনেছে বাড়ি থেকে তাই খাবে। যা গরম! পাখিরাও ডাকছেনা। ঝোপঝাড়ের ছায়াতে বসে বড় বড় হাঁ করে নিশ্বাস নিচ্ছে। ঠোঁটের ফাঁকে তাদের লাল টাগরা দেখা যাচ্ছে।

ঋজুদা বলল, আমি শান্টুকে জিজ্ঞেস করলাম, কোনও হাতিয়ার আছে?

আমার কাছে একটা স্পেশাল টাঙ্গি আছে। লম্বা বাঁশের, মস্ত ফলাওয়ালা, গাড়ুর লোহারকে দিয়ে অর্ডার মতো বানানো।

তাতেই হবে। আরও একটা বড় টাঙ্গি কুলিদের কাছ থেকে চেয়ে নাও।

কিন্তু এই রোদে কি বেরোনো ঠিক হবে ঋজুদা? লু লেগে যাবে যে!

বেরোতেই হবে। উপায় কী?

তবে দাঁড়ান। বলে, শান্টু ডেরার মধ্যে ঢুকে দুটো গামছা নিয়ে এল। বলল, ভাল করে কাঁচা। ভাল করে নাক কান বেদুইনদের মতো ঢেকে নিন। ঠাণ্ডা বলুন, গরম বলুন সবই ঢোকে শরীরের ফুটো-ফাটা দিয়ে। সেখানে প্রোটেকশন থাকাটা অবশ্যই দরকার। তার আগে এক গ্লাস করে যবের ছাতুর শরবতও খেয়ে নিতে হবে। কিন্তু যাবেনটা কোথায়? ভাল্লুক কি তার ফোন নাম্বার পিন নাম্বার ঠিকানা রেখে গেছে?

রেখে যায়নি বলেই তো।

তারপরে বললাম, এমন একজন কুলিকেও সঙ্গে নাও যার কাছের কোনও লোককে ভাল্লুক ইনজিওরড করেছে আর যে শিকার-টিকার করেছে কখনও।

শান্টু ডাকল, রে ভোগতা।

 ভোগতা নামের একটি দুবলা-পাতলা মানুষ এসে দাঁড়াল।

শান্টু বলল, যাবি আমাদের সঙ্গে? আমরা ভালুকটার রাহান-সাহানের খোঁজে যাচ্ছি।

ও সাগ্রহে বলল, যাব হুজৌর।

 শান্টু বলল, খেয়ে নে। আমাদের ফেরার কোনও ঠিক নেই।

ও বলল, আপনারাও তো খাননি। ফিরেই খাব।

তা হলে ফিরে তুই আমাদের সঙ্গেই খাস তখন। বলেই, রামধানিয়া বলে হাঁক দিল। হাঁক দিতেই ডেরার অন্য প্রান্তের ঘর থেকে একটি অল্পবয়সি ছেলে এসে দাঁড়াল। শান্টু বলল, ভোগতাও আমাদের সঙ্গে খাবে। কী রান্না করছিস?

চাউল, অড়হড়কি ডাল, লাউকিকি সবজি আর আমকি চাটনি।

ঠিক আছে।

ঋজুদা বলল, আমি স্পষ্ট দেখলাম ভোগতার মুখ দিয়ে যেন লালা গড়াল। এই খাবার তো ওরা বিয়ে-চুড়োতে খায়।

ঠিক এই সময়ে পাপড়িদি বললেন, এবারে আমাদের উঠতে হবে। কলকাতা থেকে একজন আসবেন। কবি শঙ্খ ঘোষ এসে থাকবেন কদিন আমাদের এখানে তারই তত্ত্বতালাশ করতে আসবেন তিনি ডালটনগঞ্জ থেকে। আজকে আমাদের খাওয়াটা বাদ যাক।

তোমরা অতিথিকে নিয়েও আসতে পারে। তবে আমার মতো জংলির সামনে যদি শঙ্খ ঘোষের প্রতিভূকে না আনতে চাও তবে ঠিক আছে। তোমরা রাতে এসে খেয়ো। খাবার তোলা থাকবে। বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে আমারও ঠিক পটে না। আমি জংলি মানুষ, স্বভাবে এবং পরিবেশে, ওঁদের থেকে একটু দূরে থাকতেই ভালবাসি। তবে শঙ্খ ঘোষ আমার অন্যতম প্রিয় কবি। আজকালকার মতলববাজ অকবিদের নানা আড়ত-এর মধ্যে এমন কবিদের খুঁজে পাওয়া খুব কমই যায়। ঠিক আছে। তোমরা এসো।

ব্যাক টু হুলুক।

ভটকাই অসভ্যর মতো বলল, ওঁরা চলে যাবার আগেই।

হ্যাঁ। ভোগতাকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ভাল্লুকটা আজ ওদের যেখানে আক্রমণ করেছিল সে জায়গাতে একটু নিয়ে চলো তো আমাদের।

চালিয়ে হুজৌর।

ভোগতা কোনও নাম না, ওর জাতের নাম। এই জাত-পাতের হাত থেকে বিহার যে কবে নিজেদের বাঁচাবে তা ঈশ্বরই জানেন।

বিহার কেন বলছ ঋজুকাকা এখন তা ঝাড়খণ্ড।

ঠিক। ভুল হয়েছিল। তবে বিহারও তো বিলক্ষণ আছে। তার অঙ্গচ্ছেদ করেই না ঝাড়খণ্ড হল!

পথ থেকে এদিক ওদিকে চলে যাওয়া গোরু ছাগলকে যেমন হ্যাট-হ্যাট করে তাড়িয়ে পথে নিয়ে আসে রাখাল ছেলে, ভটকাইও ঋজুদার পথ ভোলা গল্পকে তাড়িয়ে পথে আনল।

ভোগতা যেখানে নিয়ে গেল সেখানে গিয়ে দেখলাম নলি বাঁশের ঝোপে ওরা বাঁশ কাটছিল। বাঁশেরই জঙ্গল সব বনে পাহাড়ে। তার সঙ্গে হরজাই জঙ্গল। গামহার, সিধা, শিশু, অর্জুন, কেঁদ, পিয়ার, মহুয়া, শাল, পিয়াশাল, ক্কচিৎ সেগুন, জংলি আম (যে আমের টক রাঁধছে আজ রামধানিয়া), আমলকী, তেঁতুল, ঘোড়ানিম এসব গাছ। তবে ওই বাঁশগুলোর পেছনে একটা মস্ত চাঁর গাছ ছিল। এই চাঁর গাছ, মস্ত বড় বড়, সারান্ডার জঙ্গলে আছে।

আমাদের তো একবারও নিয়েই গেলে না সারান্ডাতে।

তিতির বলল, অনুযোগের স্বরে।

যাব, যাব, একবার নিয়ে যাব। ল্যান্ড অফ দ্য সেভেন হান্ড্রেড হিলস। সাতশো পাহাড়ের দেশ। কারো, কয়না আর কোয়েল নদীর দেশ। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের খুবই প্রিয় ছিল সারান্ডা।

ভটকাই ছপটি মারল, ব্যাক টু হুলুক। তারপর বিরক্তির সঙ্গে বলল, নাঃ। এমন ভাবে কি গল্প শোনা যায়? ইমপসিবল।

হ্যাঁ। চাঁর গাছটার নীচ থেকে ভাল্লুকটা হঠাৎ রে রে রে করে বেরিয়ে এসে পেছনের দু পায়ে দাঁড়িয়ে উঠে ওরা কিছু বোঝার আগেই ওদের ফালা ফালা করে দিয়েছিল।

হাতে তো টাঙ্গি ছিল, মারল না?

ঝিন্টু মেরেছিল একেবারে ভাল্লুকের নাকের উপরে। কিন্তু টাঙ্গি ছিটকে উঠল যেন।

তারপর ভোগতা বলল, ভাল্লুকের নাক কি রাবার দিয়ে তৈরি হয় হুজৌর?

 ঋজুদা কথাটা বলতে বলতেই হেসে ফেলল।

আমি বললাম, না রাবার দিয়ে তৈরি হয় না তবে সে এক অদ্ভুত জিনিস অবশ্যই।

তারপর বললাম, নাকে ভাল মতো লেগেছিল?

জি হুজৌর। ভালু উঁক করে আওয়াজ করেছিল একটা আর তারপরই তো ঝিন্টুকে মাটিতে ফেলে দিয়ে একেবারে ক্ষতবিক্ষত করে দিল। বেহোঁস হয়ে গেল সে।

কিন্তু তুমি কোথায় ছিলে তখন?

আমি ঝিন্টুর থেকে হাত দশেক ডানদিকে ছিলাম।

তুমি ঠিক দেখছিলে যে নাকে ভাল করে টাঙ্গির কোপ পড়েছিল।

জি হুজৌর।

 মগর ইতনা আদমিকো ভালু কেইসে নোচ লিয়া?

শান্টু জিজ্ঞেস করল ভোগতাকে।

 আয়া ঔর গ্যয়া।

ভটকাই বলল, বিধানসভা কি লোকসভার সদস্য ছিল না তো মিস্টার ভাল্লুক।

 আমরা হেসে উঠলাম। আমি বললাম, এবার কে ডিসট্রাক্ট করছে?

সরি। বলে, দুহাত দিয়ে দুকানে হাত ছোঁয়াল ভটকাই।

 তিতির বলল, তারপর?

তারপর জায়গাটাতে ভাল্লুকের হাত পায়ের দাগ খুঁজতে গিয়ে একটু পরেই দাগ পাওয়া গেল। ঝিন্টুকে যেখানে মাটিতে ফেলে আঁচড়েছিল সেখানকার মাটিতেও ধ্বস্তাধ্বস্তির দাগ দেখা গেল। গরমের দিনে মাটি শুকনো এবং আলগা, তার উপরে ধুলোর আস্তরণও পড়ে থাকে তাই দাগ পাওয়াটা অসুবিধের ছিল না। আমরা ধীরে ধীরে এগোতে লাগলাম। ভোগতার চোখ আমার চেয়ে অনেক তীক্ষ্ণ। সে আগে যেতে লাগল টাঙ্গি কাঁধে তার পেছনে আমি শান্টুর স্পেশাল টাঙ্গি কাঁধে তারও পেছনে শান্টু খালি হাতে। দেখলাম, ভাল্লুকটা কিছুদূর গিয়েই বাঁদিকে নেমে গেছে পাহাড় থেকে। যে কোণে গেছে তাতে মনে হয় মিরচাইয়ার কাছে গিয়ে নামবে। তোরা এই ভরা বর্ষাতে মিরচাইয়ার এক রূপ দেখছিস আবার প্রখর গ্রীষ্মে এলে দেখবি অন্য রূপ। প্রকাণ্ড কালো পাথরের সব শিলাসন। জল পড়ছে। ক্ষীণ ধারায়। একটা সময়ে এসে তাও বন্ধ হয়ে যায়। নীচের দহতে জমে থাকে সামান্য জল। সেখানে বাইসন শম্বর চিত্রল হরিণ এবং তাদের পেছনে পেছনে বাঘ বা চিতাও আসে জল খেতে গভীর রাতে। সকাল সন্ধেতে এখানে কম জানোয়ারই আসে কারণ মহুয়াডাঁর অবধি বাস যাতায়াত করে, প্রাইভেট গাড়ি ও ট্রাকও যায়।

তারপর?

তারপর ভাল্লুক তো নেমে গেছে, তবু পাহাড়ের ওপরটা ভাল করে একটু ঘুরে দেখব মনস্থ করলাম। কিন্তু হাঁটাচলা করাই দায়। লু বইতে শুরু করেছে। অনেকক্ষণ। এয়ারকন্ডিশনারের পেছন দিয়ে যেমন গরম হাওয়া বেরোয় তার চেয়েও গরম হাওয়া শুকনো পাতা ধুলো খড় সব উড়িয়ে তীব্র বেগে বয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে মাথা ঘুরে পড়ে যাব। মাঝে মাঝে ধুলো বা পাতাপুতাকে অতিকায় সাপের মতো বায়ুস্তম্ভ উপরে তুলছে–অনেক উপরে-তারপর কোমরে গুলি-খাওয়া সাপ যেমন ধপ করে পড়ে যায়, তেমন করে ভেঙে পড়ছে জমিতে।

তারপরই ঋজুদা বলল, তোরা জলস্তম্ভ দেখেছিস কেউ নদীতে বা সমুদ্রে?

নাঃ।

আমরা সমস্বরে বললাম।

 দ্যাখাব, যদি সুযোগ হয়।

তারপর?

 তারপর ভোগতাকে শুধোলাম হিয়া কোঈ মাঁন্দ-উন্দ হ্যায়?

মাঁন্দ মানে? তিতির বলল।

 মাঁন্দ মানে গুহা। মাঁন্দ-উন্দ মানে গুহা-টুহা।

ও।

 ভোগতা বলল, হ্যায় না হুজৌর। বহত বড়া বড়া মাঁন্দ হ্যায়।

কওন তরফ।

উস তরফ। বলে, ও তার টাঙ্গির ডাণ্ডা দিয়ে দিক নির্দেশ করে দেখাল।

 কিতনা দূর হোগা হিয়াসে?

দূরতো হোগা করিব আধা মিল।

শান্টু বলল, এখন ফিরুন ঋজুদা। আপনি বাঁচলে বাবার নাম। কালকে একেবারে ভোরে চলে আসবেন না হয়। তা ছাড়া খালি হাতে কি ভালুককে কথাকলি বা ওড়িশি নেচে বশ করবেন? অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আসুন, আজ আমি না হয় ভোগতাকে আমার কাছে রেখে দেব যাতে কাল ভোরে ও আপনার সঙ্গী হতে পারে। এই পাহাড়-জঙ্গলই তো ওদের ঘর বাড়ি–আপনি তো আর ওদের মতো ভাল চিনবেন না এসব।

তা তো বটেই। তবে তাই চলো।

 বলে, শান্টু আপাতত প্রাণটা বাঁচাল বলে ওর প্রতি কৃতজ্ঞ হয়ে ফিরে চললাম আমরা।

.

ঋজুদা একটু পাইপ খেয়ে আবার শুরু করল।

ভোর চারটেতেই আলো ফোটে এখানে গরমের সময়ে। ঠিক আলো নয়, পুবের আকাশ আলোর আভাসে ভরে যায়। রোদ ওঠে সাড়ে চারটে নাগাদ। এক কাপ চা আর দুটি বিস্কিট খেয়ে ফোরফিফটি-ফোরহান্ড্রেড জেফরি নাম্বার টু রাইফেলটি আর পাঁচ রাউন্ড গুলি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সঙ্গে একটি থার্মোস নিলাম জুম্মানের কাছ থেকে চেয়ে। আর জলের বোতল। আর্মির জলের বোতল। তামার উপরে ফ্লানেল জড়ানো।

যখন পৌঁছলাম পাহাড়ের উপরে তখন দেখি শান্টু রামধানিয়াকে দিয়ে খাঁটি ঘিয়ের গরম পুরি আর আলুর চোখা ভাজিয়েছে গরম গরম আর তেজপাতা এলাচ দেওয়া গোরখপুরি চা।

এত সকালে ব্রেকফাস্ট?

শান্টু বলল, আপনার তো মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন’। আমি জানি তা। তাই খেয়ে নিন পেট ভরে। ভোগতাকেও খাইয়ে দিয়েছি। আমি কি যাব?

তুমি গেলে এখানের দক্ষদজ্ঞ কে সামলাবে? তুমি থাকো।

 কিষুণকে নিয়ে যান যতদূর জিপ যাবে। তারপর তো হাঁটতেই হবে। জলের বোতলে জল ভরাই ছিল। মারুমারের কুয়োর ফার্স্ট ক্লাস জল। বোতলের উপরের ফ্লানেলটা পুরো ভিজিয়ে নিলাম। যতক্ষণ ঠাণ্ডা থাকে জল। আর থার্মোসে ওই চা-ইনতুন করে করিয়ে ফ্লাস্ক ভর্তি করে দিল শান্টু। তারপর আমরা বেরিয়ে পড়লাম। বেরিয়ে পড়ার মুহূর্তেই একটা ট্রাক এল নীচ থেকে কঁকিয়ে কেঁদে ফার্স্ট গিয়ারে। মোহনের সব ট্রাকে মা কালীর ছবি থাকে সামনে। দিনে তো দেখা যায়ই, রাতেও ফোটোর দুপাশে আলো জ্বলে বলে দেখা যায়। ড্রাইভার ট্রাকটাকেই থামিয়ে স্টিয়ারিং ছেড়ে নেমে আমার কাছে দৌড়ে এল। বলল, একটু আগেই চৌকিদারের বউকে আক্রমণ করেছে প্রায় বাংলোর হাতার মধ্যে।

শান্টুও দৌড়ে এল ডেরা থাকে।

কী করা যায়। ভাল্লুক তো আর মাংস খায় না। মাংস খায় বলেই মানুষখেকো বাঘে আক্রান্ত মানুষকে বয়ে নিয়ে যায় আর সে জন্যেই বাঘকে অনুসরণ করা সোজা হয়। এই হতচ্ছাড়া ভাল্লুক গত জন্মের কোন রাগের কারণে একের পর এক মানুষকে আক্রমণ করে যাচ্ছে কে জানে। ড্রাইভার বলল, ও নাকি গাডুতে কাল শুনেছে যে কে বা কারা দুটি ভাল্লুকের বাচ্চাকে ধরে নিয়ে এসেছে তিনদিন আগে। এনে বিক্রি করে দিয়েছে এক ব্যাপারির কাছে! তখন ব্যাপারটা পরিষ্কার হল। প্রথমে ভেবেছিলাম নীচে নেমে যাই। পরে ঠিক করলাম যেনা যা ঠিক করেছিলাম তাই করব। যদি এই সব গুহার কোনও একটিতে তার আস্তানা হয়ে থাকে তবে সে ফিরে এসে এই গরমে দিনের বেলাটা হয়তো গুহাতেই থাকবে। রাতে মূল খুঁড়ে, ফল খেয়ে, উইয়ের ঢিপিতে নাক ঢুকিয়ে উইপোকা শুষে খেয়ে সে হয়তো গুহাতেই ফিরবে। তাও আবার ঝিন্টু তার নাকে টাঙ্গি মেরে নাকটাকেও চোট করে দিয়েছে। সন্তানহারা পশুরা সন্তানহারা মানুষীর চেয়েও বিপজ্জনক হয়। তাদের অন্ধ ক্রোধে তারা তখন এমনই করে থাকে। বেচারি। যাই হোক, তার রাগ সঙ্গত জেনেও তাকে তো আরও মানুষকে ক্ষতবিক্ষত করতে দেওয়া যায় না। কিছু একটা করতেই হয়। কুলি কাবাড়িরাও বলেছে যতক্ষণ না এই ভাল্লুককে মারা না। হচ্ছে ততক্ষণ তারা না খেয়ে থাকবে সেওভি আচ্ছা কিন্তু কাজে আসবে না।

কিষুণ বেশিদূর যেতে পারল না। পথ নেই। না, জিপ যেতে পারে এমন পথও নেই। তাকে ডেরাতে ফিরে গিয়ে নাস্তা করতে বলে ভোগতার কাঁধে জলের বোতল আর চায়ের ফ্লাস্ক দিয়ে রাইফেল কাঁধে এগোলাম আমরা। সোয়া কিমি মতো গিয়ে আমরা বিরাট বিরাট কতগুলো গুহার সামনে এসে পৌঁছলাম। ওই দিকে যাবার একটি জানোয়ার চলা পথের হদিশও পেলাম। ওই পথটিই চলে গেছে গুহাগুলোর দিকে। পথে কিছু ঝাঁটিজঙ্গল গরমে ভাজা ভাজা হয়ে গেছে। ভাল করে পরীক্ষা করে দেখলাম সেই পথে শজারু, একটি বড় বাঘ, একটি ছোট চিতার পায়ের দাগও আছে। কিন্তু দাগগুলো বেশ পুরনো। প্রায় মুছে গেছে। শুধুমাত্র মস্ত একটি ভাল্লুকের পায়ের দাগই টাটকা। ওখানে আড়াল নিয়ে বসার মতো পাথর-টাথর বিশেষ নেই। গুহার কাছে গিয়ে আড়াল নিয়ে পাথরের উপরে বসা যায় কিন্তু বেলা বাড়লে সেখানে বসা আর উনুনের উপরে বসা একই ব্যাপার হবে। তার চেয়ে ঠিক করলাম একটা বড় মহুয়া গাছে বসব। গাছটা ওই জানোয়ার চলা পথ থেকে একটু দূরেই তবে রাইফেলের পাল্লার মধ্যে। ভোগতাকে জিজ্ঞেস করলাম ওর মতামত কী? দেখলাম, ও-ও আমার সঙ্গে একমত।

ভোগতা তো তরতরিয়ে গাছে উঠতে পারবে তাই ও আগে আমাকে ঠেলেঠুলে তুলে দিল। বেশি উপরে তো বসার দরকার নেই। বেশি উপরে বসলে চারধার দেখারও অসুবিধা। আমি ওঠার পরে ওর হাতের টাঙ্গিটা আমি ধরতেই ভোগতা উঠে এল। ওকে বললাম, উপরে উঠে সুবিধেমতো ডাল দেখে বসতে। ও ইচ্ছে করলে আমার মাথাতে লাথি মারতে পারে। ওকে বললাম যে ভাল্লুক আসছে দেখলে যেন আমার মাথাতে পায়ের আঙুল দিয়ে খোঁচা মেরে কোন দিক দিয়ে আসছে তা সম্ভব হলে আঙুল দিয়ে দেখায়।

আমরা উঠে বসার পরেই আমাদের পেছন থেকে একটা কোটরা হরিণ হিস্টিরিয়ারোগীর মতো হিক্কা তুলে তুলে ডাকতে লাগল। মিনিট পনেরো পরেই দেখি একটি মাঝারি মাপের চিতাবাঘ দ্রুত পায়ে ওই গুহাগুলোর দিকে যাচ্ছে। তখন সূর্য সবে উঠেছে তবে উঁচু গুহাগুলোর জন্যে গুহার এপাশে তখনও আলো এসে পৌঁছয়নি।

আমার পারমিটে চিতা ছিল। মারলেই মারা যেত কিন্তু তখন ভালুক মারাটা আশু কর্তব্য। এতগুলো মানুষকে সে জখম করেছে। চিতাটি চলে গেল চোখের আড়ালে। রাতে হয়তো মারুমার বা পাহাড়ের ওদিকের ঢালের কোনও গ্রামে গেছিল ছাগল, বাছুর বা কুকুর ধরার জন্যে। কুকুর চিতার বড় প্রিয় খাদ্য।

পাইপটা বের করে রনসনের লাইটার জ্বেলে ধরালাম। ব্রেকফাস্ট আর্লি হলেও যথেষ্ট হেভি হয়েছে। ঘুম পেয়ে যাবে পাইপ না খেলে। বেশিক্ষণ নয় মিনিট পনেরো বসার পরেই ভোগতাচন্দ্র আমার মাথাতে পদাঘাত করল। টুপিটা খুলে ওর দিকে তাকাতেই ও আঙুল দিয়ে যেদিকে দেখাল সেটা আমাদের পেছন দিক। ভাল্লুকটা ওই রাস্তা ধরে আগাগোড়া না এসে শর্টকাট করছিল। কিন্তু আমি তো তাকে দেখতেই পাচ্ছি না তাই রাইফেল পেছনে ঘুরিয়ে মারতেও পারব না। তাই সামনে তাকিয়েই অপেক্ষা করতে লাগলাম। ভালুকীকে যখন আমি দেখতে পেলাম সে তখন প্রায় গুহাগুলোর নীচে। একটু পরেই চোখের আড়ালে চলে যাবে। তাড়াতাড়িতে রাইফেল তুলেই গুলি করলাম কিন্তু ভাল্লুকের বুক বা কাঁধ কোনও কিছুতেই মারার উপায় ছিল না। তাই তার পিঠ লক্ষ করেই তাড়াতাড়ি গুলি করলাম। হেভি রাইফেলের শব্দে গমগম করে উঠল গুহাগুলো আর শব্দ দৌড়ে গেল মালভূমিতেও। গুলি লাগার সঙ্গে সঙ্গে ভাল্লুকটা পড়ে গেল কিন্তু পরক্ষণেই উঠে দৌড় লাগাল গুহাগুলোর দিকে। প্রায় লাফিয়ে নামলাম গাছ থেকে। জলের বোতল আর চায়ের ফ্লাস্ক নিয়ে ভোগর নামতে একটু সময় লাগবে জেনেই ওকে বললাম, তুমি গাছতলাতেই থাকো। আমি ফিরে আসছি তোমার কাছে। বলেই, রাইফেল কাঁধে নিয়ে দৌড়ে গেলাম ভাল্লুক যেদিকে গেছে সেই দিকে।

যেখানে গুলি খেয়ে ভাল্লুক পড়ে গেছিল তার একটু পর থেকেই ছোপ ছোপ রক্ত দেখা গেল, তাড়াতাড়িতে মারার জন্যেই ভাল্লুকের মেরুদণ্ডতে লাগেনি গুলি। লাগলে সে আর উঠে দাঁড়াতে পারত না। রক্তের স্রোতে ভাল্লুকের যাত্রাপথ চিনতে আমার কোনও অসুবিধে হচ্ছিল না। কিন্তু উপরে উঠে দেখলাম ভাল্লুক গুহার মধ্যে ঢুকে গেছে।

আহত ভাল্লুক এবং এমন অতিকায় ভাল্লুক যাঁরাই অনুসরণ করে কখনও মেরেছেন তাঁরাই জানবেন সেই ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা। ফোরফিফটি-ফোরহান্ড্রেডের সফটনোজড গুলির মার। ভাল্লুক বাঁচবে না। ওই গুহার মধ্যেই মরে পড়ে থাকবে কিন্তু কোনও ভাল শিকারিই আহত জানোনায়ারের যন্ত্রণা প্রলম্বিত করতে চান না, চাওয়াটা অমানুষিক অপরাধও। যেখানে উপায় থাকে না অথবা জানোয়ারের হদিশ না পাওয়া যায় বা রাতের বেলা চোট করা হয় সেখানে অন্য কথা।

গুহাটার মুখে পৌঁছে মনে হল একটা টর্চ আনা খুবই জরুরি ছিল। শিকারে গিয়ে জলের বোতল আর টর্চ শিকারির সব সময়ের সঙ্গী হওয়া উচিত। একটা পাঁচ ব্যাটারির টর্চ সঙ্গে থাকলে ভোগ আলো হাতে আমার পাশে থাকলে ওই অন্ধকার গুহাতে তখনই ঢোকা যেত। কিন্তু তা যখন আনিনি তখন গুহামুখের এক পাশে দাঁড়িয়ে ঘড়ি দেখলাম। পনেরো মিনিট রক্তক্ষরণ হবার পরে সে যখন একটু দুর্বল হয়ে যাবে তখনই ঢুকব ঠিক করলাম। মিনিট পাঁচেক হয়েছে এমন সময়ে পেছনে কোনও কিছুর পদশব্দ পেলাম। তাকিয়ে দেখি ভোগতা শান্টুর টাঙ্গিটা হাতে নিয়ে এসে হাজির। সে আমাকে ইশারাতে তার পেছনে আসতে বলে তরতরিয়ে গুহাটার মাথাতে চড়ে গেল। আমিও উঠলাম ওর পেছন পেছন। গুহাটা কত বড়, কত গভীর এবং তার অন্য কোনও মুখ আছে কি নেই কিছুই জানি না। আমি জানি না কিন্তু ভোগতা জানে। ছেলেবেলায় সে হয়তো বন্ধুদের সঙ্গে এই গুহার মধ্যেই খেলা করেছে। বড়বেলাতে তির-ধনুক নিয়ে শিকারও করেছে।

গুহার মাথার উপর দিয়ে প্রায় শেষ প্রান্তে পৌঁছে বোঝা গেল যে গুহার পেছনে একটা মুখ আছে এবং সেটা বেশ বড়। যে মুখে আমি গিয়ে পৌঁছেছিলাম সেটা শুধু সরু বলেই নয়, গুহাটার ভিতরটা নিশ্চয়ই ‘L’ শেপ-এর, তাই ওদিক দিয়ে অন্ধকার দেখাচ্ছিল।

ভোগতা বাঁদরের মতো আবার তরতরিয়ে নীচে নামল। তার পেছনে পেছনে আমি। আমি নামামাত্রই গুহার ভিতর থেকে হুংকার দিয়ে ভাল্লুকটা বেরিয়ে এসে পেছনের দুপায়ে দাঁড়িয়ে উঠল এবং সামনের দুহাত ছুঁড়তে ছুঁড়তে মুখে থুথু ছিটোতে ছিটোতে এগিয়ে এসে ভোগতাকে প্রায় ধরে ফেলল। ভোগতা তার টাঙ্গি তুলল মাথার উপরে কিন্তু আমি তাকে এক ঠেলা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে ভাল্লুকের বুক লক্ষ করে গুলি করলাম। তিন-চারহাত দূর থেকে। সে ঘুরে পড়ে যেতে যেতে তার গলা লক্ষ করে আরেকটা গুলি করলাম। আর তারপরেই কাণ্ডটা ঘটল। মানুষ যেমন করে যন্ত্রণাতে কাঁদে, ভাল্লুটা ঠিক তেমনি করে কাঁদতে লাগল শুয়ে শুয়ে। তবে বেশিক্ষণ তার কাঁদতে হল না। কান্না স্তিমিত হতে হতে থেমে গেল একেবারে।

অনেক শিকারির মুখে ভাল্লুকের এই মানুষের মতো কান্নার কথা শুনেছিলাম কিন্তু তার আগে বিভিন্ন রাজ্যে চারটে ভাল্লুক মারলেও কোনও ভাল্লুকই মরার আগে এমন করে কাঁদেনি।

মনটা ভারি খারাপ হয়ে গেল। বেচারি সন্তানহারা মা। তার দুগ্ধপোষ্য বাচ্চাদের যে সব মানুষে নিয়ে গেল তাদের কোনও শাস্তি হল না। কিন্তু মানুষের আইনে তাকেই জীবন দিতে হল।

ভোগতা বলল, চায়ে হিয়া পিজিয়েগা হুজৌর?

আমি মাথা নাড়লাম। তারপর মাথার টুপিটা খুলে মহুয়া গাছটার দিকে রওনা হলাম। আবার সেই গুহার মাথায় চড়ে এবং নেমে। ভোগতা গুহাটা সম্বন্ধে সব জানত বলে, নইলে অন্ধকারে আমি একা রাইফেল নিয়ে ঢুকলে ভাল্লুক অবশ্যই আমাকে আগে মেরে তবে মরত।

ফ্লাস্ক থেকে চা ঢেলে খেলাম এবং ভোগতাকেও ফ্লাস্কের ঢাকনি ভরে চা দিলাম। ভোগতা কুণ্ঠার সঙ্গে বলল, আপকি ওহি মহকতা-হুঁয়ে তামাকু জারা দিজিয়েগা সাব?

কী করবে?

খইনির মতো হাতে মেরে খাব।

ওকে গোল্ড ব্লক টোব্যাকো দিলাম ওর হাতের তেলোতে। চাটা চার চুমুকে শেষ করে সে বলল, আপ তামাকু পিজিয়ে ম্যায় যাতা হ্যায় শান্টুবাবু ঔর সবকৌঈকো লানে কি লিয়ে।

যেতে যেতে ফিরে দাঁড়িয়ে বলল, আপ ক্যামিরা নেই লেতে আয়া হুজৌর? ফোটো নেহি খিচাইয়েগা?

আমি রাগের গলাতে বললাম, নেহি।

.

জুম্মান এসে বলল, খনা বন গ্যয়া হুজৌর। লাগা দুঁ ক্যা?

আমরা, মানে, আমি ভটকাই আর তিতির একই সঙ্গে ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখি দেড়টা বেজে গেছে।

ভটকাই বলল, থ্যাঙ্ক ইউ ঋজুদা।

আমি আর তিতিরও বললাম, থ্যাঙ্ক ইউ ইনডিড।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *