মোটকা গোগোই

মোটকা গোগোই — ঋজুদা — বুদ্ধদেব গুহ

০১.

কাজিরাঙার ফিল্ড ডিরেক্টর বরজাতিয়া সাহেব ফরেস্ট সেক্রেটারি মহান্ত সাহেবের নির্দেশে ঋজুদার শরণাপন্ন হয়েছিলেন। ঋজুদা ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছিল অনেকবার। অনেকই দিন ধরে। কিন্তু সঞ্জয় দেবরায় সাহেব তাকে ব্যক্তিগত চিঠি লেখাতে আর না করতে পারেনি। তারপরে ফোনও করেছিলেন।

সঞ্জয় দেবরায় সাহেব অনেকদিন আগে মানাস টাইগার প্রজেক্টের ফিল্ড ডিরেক্টর ছিলেন। মানাস’ লোকে বলত তাঁরই মানসপুত্র। তারপর আসামের চিফ কনজার্ভেটর হয়ে, (তখনও প্রিন্সিপাল কনজার্ভেটরের পদ সৃষ্টি হয়নি) চাকরির শেষ পর্যায়ে দিল্লিতে ডিরেক্টর জেনারেল অফ ফরেস্ট হয়ে অবসর নিয়েছিলেন। আসামেই বসবাস ওঁদের, যদিও বাঙালি। বাংলা সাহিত্যের খুব ভক্ত ওঁরা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই। ঋজুদার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল দেবরায় সাহেবের অনেক বছর আগে। তখন উনি বরপেটা রোডে ছিলেন মানাসের ফিল্ড ডিরেক্টর হিসেবে। জঙ্গলপাগল মানুষ, অনেক করেছেনও মানাসের জন্যে।

আসামের বনবিভাগ এবং পুলিশ বিভাগের অনেকই দক্ষ অফিসার আছেন কিন্তু তাঁদের অধিকাংশই এখন বোড় এবং অন্যান্য উপজাতিদের সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলায় ব্যস্ত, বিশেষ করে নামনি আসামে। তা ছাড়া, ঋজুদার অভিজ্ঞতা বিশ্বব্যাপী। পুব আফ্রিকার আন্তর্জাতিক চোরাচালান চক্ররও মোকাবিলা করে এসেছি বলতে গেলে দোকা হাতে আমি আর ঋজুদা। পরে অবশ্য তিতিরও গেছিল। তাই ওঁদের সনির্বন্ধ অনুরোধে শেষ পর্যন্ত ঋজুদাকে আসতেই হয়েছে।

গুয়াহাটিতে প্লেনে নেমে আমরা কাজিরাঙার বনদপ্তরের অতিথিশালাতে না থেকে নওগাঁর সার্কিট হাউসে গিয়ে উঠেছিলাম। এই নওগাঁতে এসে ওঠার নানা কারণ ছিল।

সকালে গুয়াহাটিতে প্লেন থেকে নেমে একটি অ্যাম্বাসাডর গাড়িতে করে বেরোলাম আমরা নওগাঁর দিকে। ঋজুদা বলল, আজ থেকে পঁয়ত্রিশ বছর আগে সুপুরি গাছে ভরা গুয়াহাটিকে যারা দেখেছে, তারা আজকে এ শহরকে চিনতেই পারবে না। ঘুমন্ত শহর ছিল। অবশ্য ঘুম এখন সব শহরের চোখ থেকেই বিদায় নিয়েছে।

পথে জাগগি রোডে (নাথোলা) হিন্দুস্থান পেপার কর্পোরেশনের মস্ত কারখানা। কাগজ কলে দু’দিক থেকে সারি সারি ট্রাক আসছে বাঁশ ও কাঠ নিয়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে। প্রকাণ্ড শহর গড়ে উঠেছে ওই কারখানাকে কেন্দ্র করে। ইউনিট টু-র ছোট ঘোট বাড়ি আর ইউনিট ফোর-এর ফ্ল্যাটবাড়িগুলো পথের পাশে। এখান থেকে নওগাঁর পথেই পড়ে আইততবি গ্রাম। ঋজুদা দেখাল আমাদের। বিখ্যাত অহমিয়া লেখক লক্ষ্মীনারায়ণ বেজবরুয়ার জন্মস্থান। মূল পথ থেকে ভিতরে যেতে হয় কিছুটা। ঋজুদা বলল, বেঁচে ফিরলে, ফেরার পথে তোদের নিয়ে যাব। পথের ওপরে বোর্ডও আছে।

আমাদের শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সামবেড়ে গ্রামে যাওয়ার পথ নির্দেশ করে তো কোনও বোর্ড নেই বম্বে রোডে।

শরৎবাবুকে তো আধুনিক বাঙালি লেখকরা লেখক বলেই স্বীকার করেন না, সরকারও করে কিনা জানি না।

ঋজুদা বলল।

তা তাঁরাই বা কী লিখলেন!

 ভটকাই ফুট কাটল।

 ঋজুদা বলল, যাক। আমরা এখন গণ্ডারের বিচরণভূমি কাজিরাঙায় বেড়াতে যাচ্ছি, সাহিত্যর কমলবনের কথা না হয় থাকই এখন।

একটু পরই পথের বাঁ পাশে ব্রহ্মপুত্র দেখা গেল। মার্চের শেষেও তার বিস্তৃতি দিগন্ত অবধি। দেখতে দেখতে কুওয়ারিটোলাতে এসে পৌঁছোলাম। এখান থেকেই বাঁদিকে পথ চলে গেছে সিলঘাটে। ৯ কিমি মতো পথ। ব্ৰহ্মপুত্ৰর ওপারে যেতে হলে সিলঘাট হয়ে যেতে হয়। তাদের এখান থেকেই নদী পেরোতে হবে ফেরিতে। গাড়ি ট্রাক বাস–সবই ফেরিতে করে গিয়ে ওপারের ভোমরাঘাটে ওঠে। ভোমরাঘাটে একবার পৌঁছে গেলে ওখান থেকে তেজপুর সামান্যই পথ।

ঋজুদা বলল, কথা হচ্ছে ব্রিজ হবে, তখন আর ফেরি পেরোবার ঝঙঝাট থাকবে না। আমরা অবশ্য সোজাই এগোলাম নওগাঁর দিকে। অনেকই পেছনে জোড়বাটকে ফেলে এসেছি। মেঘালয়ের সীমানা জোড়বাট হয়েই ডানদিকে শিলংয়ে যাওয়ার পথ চলে গেছে।

নওগাঁতেই ঋজুদার লিস্ট অনুযায়ী সব কিছু জিনিসপত্র এই জলপাই-সবুজ বোলেরো জিপটিতে ভরে নেওয়া হল। জিপটি নওগাঁ সার্কিট হাউসেই আমাদের হাতে তুলে দেন বনবিভাগের অফিসারেরা। বন্দুক রাইফেলও আমরা নিয়ে আসি ট্রাঙ্কে করে। পশ্চিমবঙ্গের হোম সেক্রেটারি সৌরীন রায় এবং নেতাজি সুভাষ এয়ারপোর্টের বড়সাহেবকে আগে থাকতে বলা ছিল বলেই লাগেজের এক্সরে-তে সেগুলো ধরা পড়লেও, ওঁরা আটকাননি। ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের পূর্বাঞ্চলের ডিরেক্টর কল্যাণ মজুমদার সাহেবও আগে থাকতে সিকিউরিটি স্টাফকে বলে রেখেছিলেন। রাইফেল বন্দুক পাইলটের কাছে জমা রাখা যেত, কিন্তু তাহলে গুয়াহাটি এয়ারপোর্টেই জানাজানি হয়ে যেত আমাদের আসার কথাটা এবং আমরা যে এতগুলো আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে খেলা করতে যাচ্ছি না, সে কথাও। সেই জন্যেই এই গোপনীয়তা।

নওগাঁ থেকে সন্ধেবেলা বেরিয়ে রাতের বেলা, টাটার চা-বাগান পেরিয়ে অন্য একটি বাগান হাতিখুলিকে ডান পাশে রেখে বাঁদিকে আমরা ঘাসবনে ঢুকেছিলাম।

রাতের বেলা কাজিরাঙাতে কোনও গাড়ি ঢুকতে পারে না, কোনও পর্যটকও যেতে পারেন না, কিন্তু বনবিভাগের সহায়তায় আমরা ঢুকেছিলাম। হেডলাইট নিভিয়ে আস্তে আস্তে গাড়ি চালিয়ে আমরা যে অবজার্ভেশন পোস্টটা আছে কাঠের, দোতলা সমান উঁচু, সেখানে বসে বনবিভাগের কাছ থেকে সব বুঝে নিয়েছিলাম। ম্যাপও তাঁরাই দিয়েছিলেন দাগ-টাগ দিয়ে।

খুব গর্বভরে প্রথমবার কাজিরাঙাতে আসার গল্প করে ঋজুদা আমাদের। ঋজুদা তখন, বলতে গেলে শিশু। জেঠুমনির সঙ্গে এসেছিল। কাজিরাঙাতে তার পরেও বহুবার এসেছে এবং বনবিভাগের অতিথি হয়ে বনের ভিতরে ভিতরে ঘুরেছে। সাধারণ পর্যটকের মতো সে যাওয়া নয়। তাই ম্যাপটা দেখে কোন কোন জায়গাতে চোরাশিকারিরা গণ্ডার মেরেছে এ পর্যন্ত, তা ঋজুদা ভাল করে দেখে নিয়েছে। একটা ছোট দল নাকি এসে কাজিরাঙার মধ্যেই ডেরা করেছে। নাগা ও গারো তারা। এর আগেও তারা এসেছিল বছর কয়েক আগে, তখন তাদের একজনকে ফরেস্টগার্ডরা গুলি করে মেরেও ছিল। তাতেও তারা দমেনি। আবার এসেছে।

পশ্চিমি দেশ হলে হেলিকপ্টারে করে কাজিরাঙার ওপরে ভাল করে টহল দিলেই এই ঘাসবনের চোরাশিকারিদের ধরা যেত। কিন্তু আমাদের দেশের সব রাজ্যেরই বনবিভাগের টাকা কোথায়? জিপ কিনতেই যাদের রেস্ত ফুরোয়, তারা হেলিকপ্টার কিনবে কোত্থেকে? তাও টাইগার প্রজেক্টের জন্যে ওয়ার্ল্ড লাইফ ফান্ড টাকা দেওয়াতে টাইগার প্রজেক্টগুলোর অবস্থা একটু ভাল হয়েছে। কিন্তু রাইনো বা এলিফ্যান্ট প্রজেক্টের জন্যে বিদেশ থেকে কোনও টাকা তো আসে না।

আমরা রাতটা ওই অবজার্ভেশন পেপাস্টেই শুয়ে থেকে শেষরাতে নেমে জিপে বসে জিপের হেডলাইট না-জ্বেলে কাজিরাঙার মধ্যে যেখানে ডাঙা জমি ও গভীর জঙ্গল আছে, স্থানীয় ভাষায় যাকে বলে কাঠোনি’, হাতি, গণ্ডার, হগডিয়ার যেখানে থাকতে ভালবাসে, সেই দিকে এসে একটি বড় অশ্বত্থাগাছের নীচে জিপটা পার্ক করেছিলাম। সকালের চা-বিস্কিট খেয়ে ওই ম্যাপটাকেই ভাল করে দেখছিলাম আমরা। বলতে ভুলে গেছি, আমাদের রান্না করা আর খিদমদগারি করার জন্যে অল্পবয়সি ফরেস্ট গার্ডকে দিয়েছেন ওঁরা, সে আমাদের গাইডও বটে। সে মেচ উপজাতির মানুষ। তামার মতো গায়ের রং। বেঁটেখাটো। তবে তাগা সঙ্গে বন্দুক রাখেনি, দূরপাল্লাতেও যাতে লক্ষ্যভেদ করতে পারে তাই ইন্ডিয়ান অর্ডন্যান্স কোম্পানির থ্রি-ফিফটিন রাইফেল নিয়েছে একটা। বনবিভাগের আমারি থেকে। ভালই করেছে। বন্দুকে তার হাত নাকি খুব ভাল। সে নাকি ভাল রাঁধুনিও। তারই নাম তাগা মেচ। সে নাকি খুবই উৎসাহী ও অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়। সেই জন্যেই চিফ কনজার্ভেটর দাস সাহেব ওকে আমাদের সঙ্গে দিয়েছেন। ভারি হাসিখুশিও সে। ঋজুদার সাকরেদি করতে পেরে যেন ধন্য হয়ে গেছে।

ঋজুদার কাছে যখন শুনেছে তাগা যে, ঋজুদা তাদের গ্রামেও গেছে, তখন সে রীতিমতো হাঁ হয়ে গেছিল।

তাগা মেচ-এর গ্রাম নামনি আসামের গোয়ালপাড়ার রাঙামাটি পাহাড়ে। গৌরীপুর থেকে যে পথটি চলে গেছে বরবাধা ফরেস্ট রেঞ্জে, সেই পথে। কুমারগঞ্জ আর তামাহাটের মধ্যে ডানদিকে একটি পাহাড় পড়ে। সেই পাহাড়ে যেতে হয় নাকি একটি টুঙবাগান পেরিয়ে। পাহাড়ের নাম আলোকঝারি। আলোকঝারিতে সাতই বোশেখে মস্ত বড় মেলা বসে প্রতি বছর। দেখার মতো মেলা সে। কত আদিবাসী আসে, পুজো দেয়, মুরগি ও কবুতর বলি দেয়। সেই আলোকঝারি পাহাড়ও পেরিয়ে গিয়ে নাকি রাঙামাটি। এক সময়ে মস্ত জঙ্গল ছিল সেখানে। বড় বাঘের ডেরা।

ঋজুদার কাছে সে সব গল্প একটু শুনেই তাগা মেচ ঋজুদাকে ঘরের মানুষ বলে মেনে নিয়েছে। এখন তারা নাকি রাঙামাটি ছেড়ে গারো পাহাড়ের পায়ের কাছে জিজিরাম নদীর পারের একটি গ্রামে এসে আস্তানা গেড়েছে। গ্রামের নাম মেচতালা। পাশেই রাভাতালা।

ম্যাপ তো আমাদের কাছে ছিলই, কিন্তু তাগাই আমাদের এনসাইক্লোপিডিয়া।

.

০২.

চিক-চুঁ ই ই ই ই…

শব্দটা দিগন্তব্যাপী ঘাসবনের মধ্যে দিয়ে অনেকই দূর থেকে যেন হাজার হাজার ঘাস চিরে কাজিরাঙার মে মাসের শান্ত সকালকে ঝুঁটি-নাড়া করে দিয়ে গেল।

দূরের পেলিক্যান কাঠোনির উপরে কিছু পাখি চক্রাকারে উড়তে লাগল গুলির শব্দ শুনে। ঘুরতে লাগল নীল আকাশে তারস্বরে ডাকতে ডাকতে। পেলিক্যানদের আচ্ছা ছিল এক সময়, তাই নাম পেলিক্যানকাঠোনি৷ পেলিক্যানরা এখন সরে গেছে অনেক ভিতরে। পুরো কাজিরাঙার এই এলাকার ঘাসবনের বাদা-জলাতে যে সব পাখি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল তারাও মাটি ছেড়ে উড়ে আকাশে ঘুরপাক খেতে লাগল।

আমরা, মানে আমি, ঋজুদা আর ভটকাই কাজিরাঙার মধ্যে দিয়ে যে কাঁচা রাস্তাটা পাক দিয়ে দিয়ে গেছে, যে রাস্তাতে শুধু বনবিভাগের জিপারোহী আমলাদের আর সাইকেল আরোহী বনরক্ষীদের যাতায়াত, সেই পথের ওপরেই একটা মস্ত গাছের নীচে জিপ দাঁড় করিয়ে বসে ছিলাম। স্টিয়ারিংয়ে ছিলাম আমি। আমার পাশে ঋজুদা, পাইপ মুখে, কাজিরাঙার একটা ম্যাপ দু’হাঁটুর ওপরে মেলে রেখে। মনোযোগ সহকারে দেখছিল। আর পেছনের সিটে ভটকাইচন্দ্র। তার পিপাসা লাগাতে, বরফে-রাখা প্লাস্টিকের বাক্সর মধ্যে থেকে একটা প্রাইটের বোতল বের করে সবে বিড়বিড় করে বলেছে, ‘দিখাওমে মত যাও, আপনা অকল লাগাও’ আর সঙ্গে সঙ্গেই ওই গুলির শব্দ।

ভটকাইয়ের পাশে বসেছিল তাগা মেচ, আমাদের সঙ্গী-কাম-গাইড। তাগা মেচ শেয়ালের মতো কান খাড়া করে শব্দটা শুনে বলল, ওই! মোটকা গোগোই-এর দল আইস্যা পৌঁছাইয়া গেছে। একটা গেন্দারে মাইর্যাই দিল বোধহয়।

আমাদের সকলের মনেই সেই আশঙ্কাই হয়েছিল। ঋজুদা নিচু গলাতে বলল, ভটকাই, অকল লাগাও।

ভটকাই একটু চুপ করে থেকে বলল, হেভি বোরের রাইফেলের শব্দ। এখান থেকে বেশ দূরে হয়েছে গুলিটা। প্রায় ব্রহ্মপুত্রর কাছাকাছি।

আসামে গণ্ডারকে বলে গেন্দা।

ঋজুদা বলছিল যে প্রথম যেবারে এসেছিল কাজিরাঙায় তখন কাজিরাঙা এত বিরাট কিছু ছিল না। এত সব বাংলোর বাহারও ছিল না। একটি ছোট্ট খড়ের ঘর ছিল কাজিরাঙা ফরেস্ট অফিস। কাঠের বেড়া দেওয়া ছিল চতুর্দিকে, বাঘ, গণ্ডার ও হাতির হাত থেকে বাঁচার জন্য। সেই বাংলোর কাঠের গেটের দু’দিকের পাল্লার মাথাতে কাঠের দুটো গণ্ডার-মূর্তি ছিল। সে সব অনেকদিনের কথা। স্কুলে পড়ত তখন ঋজুদা। একটা খুব বুড়ো আর মস্ত গণ্ডার ছিল এই ঘাসবনে। তার নাম ছিল বুড়া গেন্দা। তার সঙ্গে বনবাসীদের বন্ধুর মতো সম্পর্ক ছিল। তাকে সকলেই ভালবাসত। সে মারা গেছিল অবশ্য স্বাভাবিক কারণে, চোরাশিকারিদের হাতে নয়। মরে যাওয়ার পর তার খড়্গটি সযত্নে রাখা ছিল সেই খড়ের বনবাংলোতে। এখন কাজিরাঙায় যে মিউজিয়াম মতো হয়েছে সেখানেও রাখা আছে সেটি।

বনের মধ্যে যে কোনও শব্দ শুনেই তার দিক ঠিক করা এবং দূরত্ব মাপা শিখতে জীবন কেটে যায়। পাহাড়ের ওপরে একরকমভাবে তা মাপতে হয়, গভীর জঙ্গলের মধ্যে আবার অন্যরকমভাবে। পুব আফ্রিকার সেরেঙ্গেটির অথবা কাজিরাঙার মতো এইরকম দিগন্তবিস্তৃত ঘাসবনে আরও অন্যরকমভাবে। পাহাড় ও জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে আমরা সেখানের শব্দ শুনে দূরত্বর আন্দাজ একটু একটু করতে পারি আজকাল, তবুও গণ্ডগোলও হয়ে যায় প্রায়ই। শব্দটা ডানদিক থেকে হল ভাবলাম, হয়তো পরে দেখা গেল বাঁদিক থেকে হয়েছে। প্রথমে মনে হল, দেড়শো-দুশো মিটার দূরে হয়েছে, কিন্তু পরে বোঝা গেল আরও দূরে হয়েছে। পাহাড় জঙ্গলেই এখনও আমরা গুবলেট করে ফেলি, আর এ তো ঘাসবন! দিগন্তলীন।

তবে ভটকাইচন্দ্রর ব্যাপারই আলাদা। হিন্দিতে বলে না, ‘গুরু গুড় আর চেলা চিনি’–সেইরকমই ব্যাপার আর কী! সে এখন ঋজুদারও ওপর দিয়ে যায়।

আমি ফিসফিস করে ঋজুদাকে বললাম, কী করব আমরা?

 ভটকাই বলল, গুলির আওয়াজটা বাঁদিক থেকে এল, না?

 ঋজুদা বলল, না। সোজা।

ভটকাই বলল, দুশো মিটার দূর থেকে হবে?

আমি বললাম, বেশি, চারশো মিটার হবে।

 মনে হয় তিনশো মিটার। বন্দুকের গুলি নয়, রাইফেলের গুলির আওয়াজ। ঋজুদা বলল।

জিপ নিয়ে এগোব কি?

জিজ্ঞেস করলাম ঋজুদাকে।

এগো, তবে ফাস্ট-গিয়ার সেকেন্ড-গিয়ারে। দূর থেকে যেন একটুও শব্দ শোনা না যায়।

 ঠিক আছে।

আমি বললাম, মাথার অলিভ-গ্রিন রঙা টুপিটাকে ঠিক করে বসিয়ে। তারপর ফাস্ট-গিয়ারে দিয়ে, বাড়ালাম জিপটাকে। একটা ঝাঁকুনি দিয়ে এগিয়ে চলল জিপটা। এই জিপটা সাধারণ জিপ নয়। মাহিন্দ্রর বোলেরো। ডিজেলে চলে। এয়ারকন্ডিশানড। প্রায় শব্দহীন। মধ্যে অনেকই জায়গা। অবশ্য আমাদের মালপত্রও কম নয়। একটা তাঁবু, শুকনো খাবার-দাবার, টিনের স্যুপ, ক্যানড সার্ডিনস এবং ম্যাকারেল। চা-বিস্কিট, মুড়ি-চিঁড়ে-গুড়, চাল-ডাল-আটা-আলু, সর্ষের তেল, গাওয়া ঘি-ব্যসস। এমনই ঠিক হয়েছে যে, প্রয়োজনে আমরা জিপ কোথাও জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে রেখে তাঁবু খাঁটিয়ে থাকব। বড় গাছে মাচা করেও থাকতে পারি। দুটি বাইনাকুলার আছে সঙ্গে, জাইস-এর। তাতে গাছের ওপরের মাচায় বসে চারদিক দেখতে সুবিধা হবে। মাচা বাঁধার জন্যে সফট উড-এর চারটি তক্তা এবং নাইলনের দড়িও এনেছি সঙ্গে। ডিজেলের ট্যাঙ্ক ভর্তি আছে। তবুও সঙ্গে এক জেরিক্যান ডিজেলও নেওয়া আছে। রান্নার জন্যে ছোট গ্যাস সিলিন্ডার খড়ের ঝুড়িতে বসানো, যাতে ঝাঁকুনি লেগে শব্দ না হয়। ডিম, ছোট স্টেইনলেস স্টিলের হাঁড়ি, প্লাস্টিকের কাপ ডিশ কাঁটা চামচও খড়ের ঝুড়িতে বসানো, যাতে শব্দ না হয়। আমার আর ঋজুদার কোমরে যার যার পিস্তল। ভটকাইয়ের কাছে ডাবল-ব্যারেলড শটগান, ঋজুদারই সেটা। চার্চিল, টুয়েলভ বোর-এর। গুলির বেল্টটা ব্যাঙ্কের দারোয়ানেরা যেমন করে ক্রশ-বেল্ট করে বুকে পরে, তেমন করেই পরে নিয়েছে। শটগানের রোটাক্স আর লেথাল আর স্কেরিক্যাল বুলেট, আছে এল. জি. এবং চার নম্বর শটস আছে কিছু। আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলি যা আছে তা দিয়ে যুদ্ধ লড়া যায় তবে আমরা লড়াইটা বুদ্ধির লড়াইই লড়তে চাই মোটকা গোগোই-এর সঙ্গে। গুলি-বনকের নয়। আমার কাছে আছে থার্টি-ও-সিক্স রাইফেল। ম্যানলিকার শুনারের। জার্মানির। আর ঋজুদার কাছে তার প্রিয় ডাবল-ব্যারেল রাইফেল ইংলিশ হল্যান্ড অ্যান্ড হল্যান্ডের থ্রি সেভেন্টিফাইভ ম্যাগনাম। স্পোটিং বন্দুক-রাইফেল বলতে এখনও ইংলিশ, জার্মান, আমেরিকান, স্প্যানিশ, ইটালিয়ান, বেলজিয়ান। মানে, যে সব জাতের মধ্যে জলদস্যু বেশি ছিল তারাই আগ্নেয়াস্ত্রর ব্যাপারে এগিয়ে আছে বলে মনে হয়। অবশ্য আমেরিকার কথা। আলাদা–তারা তো সেদিনের দেশ। এই সব দেশের মানুষরা বা অন্য নানা দেশের মানুষরাই তো গিয়ে বসবাস করা শুরু করেছে সেখানে। তবুও আমেরিকান স্পোর্টিং রাইফেলবন্দুকও কম যায় না। উইনচেস্টার, রেমিংটন ইত্যাদি ইত্যাদি।

কিছুদূর যাওয়ার পরেই একটা কাঠোনির মধ্যে পৌঁছোতেই ঋজুদা বলল, দাঁড় করা জিপ।

জিপ থামালে ঋজুদা বলল, ভটকাই, গাছে চড়তে পারবি, তাড়াতাড়ি।

হ্যাঁ।

শেষ কবে গাছে চড়েছিলি?

তোমার সঙ্গে নিনিকুমারীর বাঘ মারতে গিয়ে। ওড়িশায়।

ঋজুদা কিছু বলার আগেই তাগা বলল, আমি চড়ছি স্যার। আমি তো প্রায় রোজই চড়ি।

ঋজুদা বলল, তাই ভাল। তুমিই তাড়াতাড়ি গাছে চড়ে পড়ো তো দেখি। রুদ্র, বাইনাকুলারটা তাগার গলাতে ঝুলিয়ে দে।

তারপর বলল, শোনো তাগা। ওপরের ডালে উঠে যেদিকে ফাঁকফোকর আছে সেদিকে এগিয়ে যাবে। গুলির আওয়াজ যেদিক দিয়ে এল সেদিকে এই দূরবিনটা চোখে লাগিয়ে খুব ভাল করে নজর করবে কিছু দেখতে পাও কিনা। তাড়াহুড়ো করবে না। অনেকক্ষণ ধরে ভাল করে দেখবে। কোনও কিছু দেখতে পেলে নেমে এসে বলবে আমাদের।

বুঝছি স্যার।

 রুদ্র বাইনাকুলারটা কী করে অ্যাডজাস্ট করে দেখিয়ে দে তাগাকে।

 তাগা বললে, আমি জানি স্যার। আমাগো ডিপার্টে আছে না চারখান।

তাহলে তো ভালই।

তাগা গাছে উঠে গেলে ঋজুদা ভটকাইকে বলল, একটা কাজে তোকে লাগাব ভেবেছিলাম। তোর লেজ তত বেশিদিন খসেনি। সেই কাজটাই যখন তাগাই করে দিল, তখন তোকে ফেরতই পাঠিয়ে দেব ভাবছি। কাজিরাঙার আই. টি. ডি. সি-র লজে গিয়ে থাক। ফার্স্ট ক্লাস খাওয়া-দাওয়া। জমিয়ে ঘুম লাগা। তুই থাকলে, এখানে জায়গারও অকুলান হবে। তা ছাড়া, তুই তো যেখানেই যাস, খেতে আর ঘুমোতেই চাস।

এবারে প্রথম থেকেই ঋজুদা ভটকাইকে একটু টাইট করে রাখছে দেখে খুশি হলাম আমি। যা বাড় বেড়েছিল ওর।

ভটকাই একটু আহত হয়ে বলল, খেতে আর ঘুমোতে তো কলকাতাতেই। পারতাম। তার জন্যেই কি এত কাণ্ড করে এখানে আসলাম! তা ছাড়া, বন্দোবস্ত সব করি আমিই–আর রেলিশ করে খাও তোমরা সকলেই। আর তোমাদের গালাগালিটা শুধু আমি খাই।

তোর খাওয়া-দাওয়ার কষ্ট হবে যে এখানে। তাই তো বলছিলাম।

ভটকাই উত্তর না দিয়ে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে চুপ করে রইল। মনে হল তার গোসা হয়েছে।

একটুক্ষণ পর তাগা নেমে এল গাছ থেকে। বলল, বড্ড ঘাস, জঙ্গলও আছে, দেখা গেল না কিছুই।

জানতাম।

 ঋজুদা বলল।

তারপর বলল, এখন শুক্লপক্ষ। চৈত্র মাস। আজকে নবমী-দশমী হবে। যথেষ্ট আলো থাকবে রাতে। রাতের বেলা আমাদের ছড়িয়ে যেতে হবে। আমার ধারণা, ওরা মাচা বেঁধে আছে ওখানে। আবার নাও থাকতে পারে। দল বেঁধে গেলে হবে না। ওরাও যে মাচার ওপরে বসে দূরবিন দিয়ে আমাদের দেখছে না, তা কে বলতে পারে! ব্যাপারটা যদিও খুবই বিপজ্জনক হবে কিন্তু আমাদের একা একাই যেতে হবে। আগে পরে, ডাইনে বাঁয়ে, নিঃশব্দে এবং আস্তে আস্তে, গাছ-গাছালি এবং ঘাসের আড়াল নিয়ে নিয়ে।

তারপর একটু চুপ করে থেকে বলে, আরও একটা আইডিয়া এসেছে আমার মাথাতে।

কী আইডিয়া?

আমি বললাম।

ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের কুনকি হাতির পিঠে শুয়ে যদি অলিভ গ্রিন শর্টস আর খালি গায়ে রাতের বেলা এগোনো যায়, তবে ওরা জংলি হাতি ভেবে হয়তো সন্দেহ করবে না কোনও আর আমরাও ওদের চমকে দিয়ে কাজ হাসিল করতে পারি। তবে তিন-চারটে হাতি লাগবে।

হাতির মাহুত লাগবে তো?

না। মাহুতটাহুত নিয়ে ঝালর-দেওয়া হাওদা চাপিয়ে কি বিয়ে করতে যাবি রাজাদের মতো? হাতি তো চালিয়েছিস রুদ্র তুই উত্তর বাংলার তিস্তা পারের চ্যাংমারির চরে আর লালজির যমদুয়ারের হাতি-ধরা ক্যাম্পে। পারবি চালাতে তুই। তবে ভটকাই চালায়নি কখনও। তাগা তো পারবেই। ভটকাই না হয় না-ই যাবে।

ভটকাই চুপ করে থাকল। কী-ই বা বলবে!

ঋজুদা বলল, সন্ধে তো নামল। আজকে পায়ে হেঁটেই যেতে হবে। যেখানে দরকার হবে, লেপার্ড-ক্রলিং করে যেতে হবে। ব্যাপারটা হচ্ছে, যদি ওদের দেখামাত্র গুলি করে মারা সম্ভব হত, তবে তো অসুবিধের কিছুই ছিল না। কিন্তু মানুষ তো, অমনভাবে মারা যাবে না। মারাটা কখনও উচিতও নয়। মারলে নিজেদের ফাঁসি হয়ে যাবে। আর ওরা কিন্তু আমাদের দেখতে পেলেই কড়াক-পিং করে দেবে।

ভটকাই বলল, কেন মারা যাবে না? শাস্ত্রে বলেছে, শঠে শাঠ্যং সমাচরেৎ’। শঠের সঙ্গে তো শঠের মতোই ব্যবহার করা উচিত।

তা উচিত। তবে তুই যদি গুয়াহাটি জেলে সারা জীবন কয়েদ থাকতে চাস অথবা ফাঁসিতে লটকে যেতে চাস, তবে তাই করিস। তোর বড় পিসিমা যেন আমার নাক বঁটি দিয়ে কাটতে না আসেন তাঁর আদরের ভেটকুর অমন দশা করলাম বলে। এদিকে অ্যাডভেঞ্চার করার শখও আছে, আর ওদিকে পিসিমার রিমোট কন্ট্রোলের দাস, তা তো হয় না।

আমি বললাম, তুই রবীন্দ্রনাথের তিনসঙ্গীর ল্যাবরেটরি’ গল্পটি কি পড়েছিল? পিসিমা বললেন, রেবু চলে আয়। আর অমনি অত্যাধুনিক দুঃসাহসী রেবতী সুড়সুড় করে পিসিমার পেছন পেছন চলে গেল।

না পড়িনি।

কলকাতাতে ফিরেই পড়ে ফেলিস৷ যেসব আধুনিক গল্পকার বলেন রবিঠাকুর গান ছাড়া কিসুই লেখেননি, যা লেখার তা সব তেনারাই লিখেছেন তাঁদেরই তো গুরু মেনেছিস তুই। তোর ইহকাল-পরকাল সব ফর্সা। শ্রদ্ধা ও ভক্তি না থাকলে, বিশেষ করে পূর্বসূরিদের প্রতি, তার কিছুই হয় না। ঔদ্ধত্য, অসভ্যতা আর দুর্বিনয়ের সঙ্গে সপ্রতিভতার কোনও সম্পর্ক নেই, অথচ তোরা মনে করিস তাই।

‘সপ্রতিভ’ কথাটার মানে কী?

ঋজুদা লজ্জিত গলায় বলল।

 আমি বললাম, স্মাটনেস।

বাবাঃ, তুই তো বাংলায় পণ্ডিত দেখছি।

 তিতিরের ইনফ্লুয়েন্স।

তিতির তো শুধু বাংলাতেই পণ্ডিত নয়, অনেক ভাষাতেই পণ্ডিত।

আমি তো আর কখনও হতে পারব না। আমার মা বলেন, ওর বুদ্ধিই আলাদা। আমার ঠাকুমা নাকি বলতেন, যে ছাও ওড়ে তার ডানা ফরফর করে। তিতিরকে প্রথম দিন দেখেই মায়েরও সেরকমই নাকি মনে হয়েছিল।

মানে?

কীসের মানে?

ওই ডানা ফরফর করার।

 ভটকাই বলল।

মানে, যে বড় হবে তার মধ্যে শিশুকাল থেকেই বড়র লক্ষণ পরিস্ফুট হয়।

পরিস্ফুট মানে কী?

ঋজুদা বলল।

আমি বললাম, এবারে তুমিও আমার সঙ্গে…

ঋজুদা হেসে বলল, ওক্কে।

তারপর বলল, আয় এবারে তোদের কাজিরাঙার সিনটা আর পটভূমিটা ভাল করে বুঝিয়ে দি। এর পরে হয়তো সুযোগ পাব না। তা ছাড়া মোটকা গোগোই অ্যান্ড কোম্পানি সম্বন্ধেও তোদের অবহিত করা দরকার।

ভটকাই বলল, আমরা আজ সকাল থেকেই একটু বেশি হাসাহাসি করছি না? যত হাসি তত কান্না বলে গেছে রাম শন্না।

ঋজুদা বলল, ঠিকই বলেছিস। এবারে যা বলি সব মন দিয়ে শোন।

 বলেই বলল, তাগা আমার চেয়েও ভাল জানে। তাগাই বলল। আমরা সকলেই শুনি।

তাগা বলল, তিন-চার বছর আগে মোটকা গোগোই নামের একজন চোরাশিকারি একটি গেন্দাকে গুলি করেছিল বুড়হা পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে যে পথটা কাঞ্চনজুরি গেটের দিকে চলে গেছে সেই পথের পাশে। তবে গোটা মরেনি, মোটকা গোগোই ধরাও পড়েছিল। তার বিরুদ্ধে কেসও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু গেন্দা নিজে তো আর কোর্টে গিয়ে সাক্ষী দিতে পারেনি তাই আমাদের দেশে যা হয় গোগোই বেকসুর খালাস হয়ে গেছিল সাক্ষীপ্রমাণের অভাবে। তবে তাকে আমরা ভালমতো ঠেঙিয়ে ছিলাম। ঠেঙানি দেওয়ার সময়েই সে শাসিয়েছিল যে আমাদের দেখে নেবে এবং গেন্দাদের গুষ্টিনাশ করবে একবার ছাড়া পেলে।

ঋজুদা বলল, বেচারি। সে তো উপলক্ষমাত্র। গণ্ডারই বল, বাঘই বল আর দাঁতাল হাতিই বল, ওদের যারা মারে তারা তো Tip of the Iceberg। তা ছাড়া তারা সকলেই গরিব মানুষ। খুবই গরিব, কিন্তু দুঃসাহসী এবং আমাদের দেশের জঙ্গল-পাহাড় তারা যেমন জানে আমাদের জানা সে তুলনাতে কিছুই নয়। আমরা তো শহরেই থাকি, মাঝে মাঝে বনে আসি আর ওরা তো শিশুকাল থেকে বনেই বড় হয়ে ওঠে। আমাদের জ্ঞান অনেকখানিই কেতাবি। ওদের ক্রীড়নক করে বড় বড় রাঘব বোয়ালেরা। তাদের বাস হয়তো গুয়াহাটি কলকাতা পটনা মুম্বই চেন্নাই বা বাঙ্গালোরে। কোটি কোটিপতি তারা। পুব আফ্রিকাতে দেখিসনি কত বড় চক্র ছিল ভুষুণ্ডাদের পেছনে, কত তাদের অর্থবল জনবল। তাই যদি না হত তবে নীলগিরি পাহাড়ের চন্দন গাছ আর হাতির দাঁতের যম বীরাপ্পনকে কি তামিলনাড়ু আর কর্ণাটক সরকারে মিলেও এত বছরে ধরতে পারত না?

ভটকাই বলল, বীরাপ্পনের কথা বোলো না ঋজুদা। শুনলেই আমার মন খারাপ হয়ে যায়। মিছিমিছি মাথাটা ন্যাড়া করলাম আর তুমি কোল্লেগালের জঙ্গলে আমাদের না নিয়ে গিয়ে মণিপুরের ইম্ফল, মায়ানমারের মোরে আর নাগাল্যান্ডের কাঙ্গপোকপিতে নিয়ে গেলে হিরে চুরির রহস্য ভেদ করতে।

তারপর বলল, আমি জানি কেন বীরাপ্পনকে ধরতে পারছে না ওরা।

কেন?

 কেউই যে মরতে চায় না। কেউ যদি মনস্থির করে আমারই মতো যে নিজে মরেও কোনও অপরাধীকে ধরব কী মারব তবে সেই অপরাধীকে সাক্ষাৎ ভগবানও রক্ষা করতে পারবেন না।

ঋজুদা বলল, গতস্য শোচনা নাস্তি। ও কথা এখন আর আলোচনা করে কী হবে। তবে নিজে না মরে মোটকা গোগোইকে ধর কি মার দেখি এবারে, যদি না অবশ্য তাগাদের অনুমান সত্যিই হয়, মোটকা গোগোইই এসেছে এখানে তার অপমান অসম্মানের বদলা নিতে।

ভটকাই দেখল বড় বেশি সাহস দেখিয়ে ফেলেছে, এবার সত্যি সত্যিই প্রাণ না যায়। তাই একটু চুপ করে থেকে বলল, দেখা যাক কী করতে পারি। ফলেন পরিচীয়তে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম তাগাকে, আমরা যখন শেষরাতে ওয়াচ টাওয়ার থেকে নেমে এখানে এলাম, পথের ডানদিকে একটা বিলের পাশে তিন-চারটে প্রকাণ্ড হাতি, দুটো গণ্ডারের সঙ্গে দাঁড়িয়েছিল, ওই বিলটার কী নাম? আর ম্যাপে তো আছেই অনেক কিছু, তুমি ভাই আমাদের কাজিরাঙা সম্বন্ধে যা জানো একটু ভাল করে বলে দাও। কী কী নদী, কী কী বিল, কী কী গাছ আছে ওখানে।

তাগা বলল, ব্যাস। কইতাছি।

ভটকাই টীকা কাটল, বলল, কেন জিজ্ঞেস করছে রুদ্র বুঝছ তো তাগাদাদা? ঋজুদা না হয় এসব অঞ্চল ভালই চেনে, আমরা তো আর চিনি না। কিন্তু ঋজুদার না হয় বেড়ালের মতো নটা জীবন আর আমাদের তো মোটে একটা করে। বুঝছ তো ব্যাপারটা?

তাগা হেসে বলল, বুঝুম না ক্যান? বুঝছি।

তারপর বলল, ওই বিলটার নাম মিহিমুখ বিল। আর ওই যে বিরাট দাঁতালগুলান দেইখ্যা আইলেন ওগুলানরে আমরা কই বুরুন্টিকা।

ঋজুদা বলল, কী বললে?

বুরুন্টিকা স্যার।

তাই?

হ স্যার।

ঋজুদা বলল, বেশ। এবার তাহলে তুমি ওদের বলল যা বলার। ঠিকই তো, ওদের কাছে এ জায়গা একেবারেই নতুন। তা ছাড়া এ তো আর ডাঙা জমি নয়, মানে যাকে আমরা হাই-ফরেস্টস বলি, এ তো বাদা বিল আর এলিফ্যান্ট গ্রাস-এর জঙ্গল। কোনও অভিজ্ঞতাই নেই। মোটকা গোগোইয়ের যে বর্ণনা তুমি দিলে তাতে তো মনে হচ্ছে শুধু গেন্দা শিকার করেই ক্ষান্ত হবে না সে, যাকে বলে personal vendetta তাই বোঝাপড়ার জন্যেই এবার সে এসেছে সদলবলে। আমাদের সকলেরই প্রাণ চলে যেতে পারে। ভাল করে সব জানা তো দরকারই।

তাগা বলল, কইতাছি সবই, শানেন স্যার। এই কাজিরাঙার ন্যাশনাল পার্কের এলাকা প্রায় সাড়ে চারশো বর্গকিমির মতো।

সাড়ে-চার-শ বর্গকিমি! বলো কী তুমি তাগাদাদা?

তাইলে আর কইতাছি কী? কার্বি অ্যাংলং পাহাড়েরও আরও কিছু এলাকা এর মধ্যে ঢোকার কথা আছে।

কাৰ্বি আংলং ব্যাপারটা কী?

কার্বি একটা ভাষার নাম। যে পাহাড়িরা ওই ভাষায় কথা বলে তারা হইতাছে মিকির। আদিবাসী। নির্বিরোধী। তারা নিজেদের নিয়েই থাকতে ভালবাসে আর ওই যে বুড়হা পাহাড়েরও ওপরে মেঘ মেঘ সব পাহাড় দেখা যায় ওগুলোই হচ্ছে মিকির হিলস। পুরনো জীবনযাত্রা নিয়ে নিজেদের সামাজিক রীতিনীতি নিয়ে নিজেদেরই মতো সুখে থাকে ওরা। সমতলের মানুষদের ওরা এড়িয়েও চলে। সন্ধে হলেই শুনতে পাবেন ওই মেঘ মেঘ পাহাড় থেকে দ্রিদিম দ্রিদিম করে ঢোলের মতো বাজনা ভেসে আসছে। ওই কাৰ্বি আংলং-এর অঞ্চল না ঢুকলেও গোটাঙ্গা, সিলডুবি, পানবাড়ি, কাঞ্চনজুরি, হলদিবাড়ি এবং ব্রহ্মপুত্রের প্রায় চারশো বর্গকিমি এলাকাও এখনকার সাড়ে চারশো বর্গকিমি এলাকার মধ্যে পড়ে। এইসব অঞ্চল বিভিন্ন সময়ে ওই অভয়ারণ্যের আওতার মধ্যে এসেছে।

এখানে কি নদী বলতে ব্ৰহ্মপুত্ৰই?

আমি বললাম।

 ঋজুদা বলল, নদী নয়, নদ। তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র দুই-ই নদ, যেমন মধ্যপ্রদেশের নর্মদা।

নদ আর নদীতে তফাত কী?

 নদ পুরুষ আর নদী মেয়ে।

ভটকাই বলল, তা তো বুঝলাম কিন্তু বুঝতে হয় কী করে। মানুষের মেয়েদের যেমন গোঁফ থাকে না, তারা দাড়ি কামায় না, তা থেকে বোঝা যায় যে তারা মেয়ে কিন্তু নদীর বেলা…।

ঋজুদা বলল, কঠিন প্রশ্ন করেছিস। তিতির থাকলে হয়তো বলতে পারত কিন্তু আমাকে একজন নদী বিশেষজ্ঞ বলেছিলেন যে, যে জলধারা হিমবাহ থেকে জন্মায় তারা নদী আর যাদের উৎস কোনও হ্রদ তারা নদ। ব্রহ্মপুত্রর উৎস মানস সরোবর, নর্মদার উৎসও এক অদৃশ্য জলরাশি। শোনেরও তাই। মধ্যপ্রদেশের অমরকন্টকে যদি কখনও যাস তো দেখবি নর্মদা উদগম এবং শোনমুড়া– অন্তঃসলিলা কোনও হ্রদ থেকে তারা জন্মেছে। যেখানে তারা বাইরে বেরিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে সেই জায়গাই নর্মদা উদগম এবং শোনমুড়া।

ভটকাই বলল, তুই বড় বাগড়া দিস। তাগাদাকে কাজিরাঙার কথা বলতে দে না।

আমি বললাম, হ্যাঁ! বলো তাগাদা।

ব্রহ্মপুত্র তো আছেই। ব্ৰহ্মপুত্ৰ বর্ষাতে পুরো কাজিরাঙার অধিকাংশ জায়গাই ভাসিয়ে দেয়। শুধু মধ্যে মধ্যে জেগে থাকে বড় বড় উঁচু কাঠোনিগুলো। হরিণ, সম্বর, হগডিয়ার, শুয়োর, বাইসন, গণ্ডার ভেসে যায়–জল এড়াতে বুড়হা পাহাড়ে গিয়ে ওঠে ন্যাশনাল হাইওয়ে পেরিয়ে। ন্যাশনাল হাইওয়ের ওপরে দাঁড়িয়ে থাকে অনেক জানোয়ার তখন। সে এক দৃশ্য।

আর কী নদী আছে?

 আমি জিজ্ঞেস করলাম।

 নদী বলতে ডিফফুলু, মরা ডিফফুলু, ভেংড়া বরজুরি, ডিরিং, কোহরা, ডেহিং, ভালুকজুরি আর দেওপা বয়ে গেছে কাজিরাঙার মধ্যে দিয়ে। এদের মধ্যে কেউ কেউ পুব থেকে পশ্চিমে, কেউ বা কাৰ্বি অ্যাংলং পাহাড় থেকে নেমে এসে ব্রহ্মপুত্রে গিয়ে পড়েছে দক্ষিণ থেকে উত্তরে। এইসব নদীর মধ্যে ছোট ছোট চরের দ্বীপ গজিয়ে যায় শরতের শেষে তাদের বলে চাপারি। দেখতে পাবেন এই সময়ে। বর্ষা এলে ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে সব একাকার হয়ে যায়। সে এক দৃশ্য বটে। ভয়ও লাগে। তখন নদ ব্ৰহ্মপুত্র তো নয়, মনে হয় সাক্ষাৎ ব্রহ্মদৈত্য।

ভটকাই বলল, কাজিরাঙার মধ্যে গেন্দা আর হাতি ছাড়া আর কোন কোন। জানোয়ার আছে?

কী নেই? বুনো মোষ, বিরাট বিরাট শিং তাদের, গাউর বা ভারতীয় বাইসন, সম্বর, হগডিয়ার, উল্লুক বা হোয়াইট-ব্র্যাওড গিব্বন, হনুমান বা লাঙ্গুর, সাদা মাথার, বড় বাঘ, নানারকম মাছখেকো সিডেট ক্যাট, বেজি, উদবেড়াল, ভালুক, সোয়াম্প-ডিয়ার। আর আছে ডলফিন, যাদের বলে গ্যানজেটিক ডলফিন।

সাপ-টাপ নেই?

নেই আবার? কমন-কোবরা, কিংকোবরা, এ ছাড়াও নানা জাতের বিষধর ও নির্বিষ সাপ।

আর কী আছে?

পাখি আছে নানারকম। ফ্লোরিকান, যাদের বলে বেঙ্গল ফ্লোরিকান স্কাইলার্ক, ধূসর পেলিক্যান, নানারকম বক, যারা কাদামাখা বিরাট বিরাট বুরুন্টিকার পিঠে চড়ে তাদের মাহুতেরই মতো চরিয়ে বেড়ায়, গণ্ডারের গায়ের পোকা-খাওয়া ছোট ছোট রাইনো বার্ড।

এইসব নদীতে মাছ নেই?

আছে বইকি! ইয়া বড় বড় চকচকে রুপোলি চিতল। হুলালপথ নদীর পাশে ফরেস্ট গার্ডদের একটা আউটপোস্ট আছে চোরাশিকারিদের নজর করবার জন্যে। সেই সরু নদীর পাশে দাঁড়ালে দেখবেন ঘাই মারছে সেইসব চিতল। এই হুলালপথ গিয়ে পড়েছে ব্রহ্মপুত্রে। সেই মোহানার নাম ডিফফুলমুখ। কী চমৎকার যে তেল এইসব চিতল মাছে। ধনেপাতা কাঁচালঙ্কা বা সর্ষে দিয়ে ওইসব চিতলের পেটি রাঁধলে যা স্বাদ হবে না!

খাও? তোমরা?

সাধ্যি কী আমাদের। এ যে অভয়ারণ্য। এখানে মশা মারলেও চাকরি যাবে আমাদের। স্বপ্নে খাই।

মিহিমুখ বিলের পাশ দিয়ে তো এলাম। অন্য কোনও বিল নেই এর মধ্যে?

ভটকাই বলল।

নেই? মিহিমুখ তো ছোট্ট বিল। বড় বিলের মধ্যে আছে ভইমারি, ঘাসিয়ামারি।

আর গাছ?

ঋজুদা জিজ্ঞেস করল পাইপটাতে নতুন করে টোব্যাকো ভরে।

 নানারকম গাছ আছে স্যার। ঘাসবন হইলে কী হয়। তবে এইসব গাছের চেহারা-ছবি পাহাড়ের বা ডাঙা জমির বনের গাছেদের থেকে একেবারেই আলাদা। এতটাই আলাদা যে চিনতে পর্যন্ত ভুল হয়ে যায়।

তা তো হবেই।

ভটকাই বলল। বাংলার টোপর-পরা গিলে করা ধুতি-পাঞ্জাবি পরা বর আর আফগানিস্তানের বা তানজানিয়ার বরের চেহারা কি একরকম হবে?

ঋজুদা হেসে বলল, একশোতে একশো।

 ভটকাই একটু লজ্জা লজ্জা করল মুখটা।

ঋজুদা বলল, গাছের কথা বলো তাগা।

 কই স্যার।

বলেই তাগা বলল, শিমুল, শিশু, হিজল, গামহার, সিধা। এসব গাছেদের বিহারি বা উত্তরপ্রদেশের ভায়েদের সঙ্গে চেহারার কিন্তু কোনওই মিল নাই। আমাদের ভাষাতে এইসব গাছরে কয় পোমা, নাহর, বনশুক, গামারি, সিধা, বরুণ, সাতিয়ানা, এজার, হুয়ালো, ভেঁলো। ভেঁলো হচ্ছে শিমুল বা সাতিয়ানার মতো।

সাতিয়ানাটা কী বুঝলি?

ঋজুদা বলল আমাকে।

ছাতিম। যে গাছের নীচে পালকি থামিয়ে বিশ্রাম নিয়েছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। শান্তিনিকেতনের ছাতিম। নামনি আসামে এবং উত্তরবঙ্গে বলে ছাতিয়ান।

তবে আমাদের ভেঁলো দিয়ে ভাল তক্তা হয়। এজারম বলে একরকমের গাছ আছে তাতে বৈশাখ মাসে সুন্দর গোলাপি ফুলও ফোটে। আর কিছুদিন পরেই দেখতে পাবেন। শিমুল গাছের বীজ ফেটে তুলোর আঁশ যখন দিকে দিকে উড়ে যায় তখন কাজকর্ম সব ছেড়েছুঁড়ে দিয়ে তাদের দিকে চেয়ে বসে থাকতে ইচ্ছে করে এত সুন্দর দেখায়।

চৈত্রে এরা তখন ন্যাংটা, পাতা নেই একটাও। আকাশের দিকে হাত তুলে সারি সারি এরা পথের পাশে দাঁড়িয়ে কী যেন প্রার্থনা করে আল্লার কাছে দোয়া মাঙ্গার মতো।

তারপর বলল, তবে কাঠোনিতে বড় বড় শিমুলই বেশি।

 দু’-চারটে বড় বড় বট-অশ্বত্থাও আছে। ব্রহ্মপুত্রের বানের মধ্যে এদের বেঁচে থাকতে হয় তাই কাদা মাখা চেহারাগুলো অন্য সময়ে কেমন রুগ্ন-সুখু দেখায়। যেন ডাঙায় রোদ পোয়ানো কুমির।

তাগা মেচের বর্ণনা শুনে আমাদের সত্যিই অনেক কিছু শেখা হল।

 তাগা বলল, বলতে ভুলে গেছিলাম, এখানে খুব বড় বড় মনিটর লিজার্ডও আছে।

তাই?

ঋজুদা বলল।

তারপর আমরা অনেকক্ষণ সকলেই চুপ করে থাকলাম। যে যার ভাবনা ভাবছিলাম। এত সাপখোপ মনিটর লিজার্ড–এর মধ্যে ঘাসবনে রাতের বেলা লেপার্ড-ক্রলিং করে যাওয়ার আগে নিজের নিজের প্রাণের মায়া ত্যাগ করেই যেতে হবে। কিন্তু উপায় নেই। যেতে হবেই। মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন। ইজ্জত রাখতে প্রাণ তো দিতে হতেই পারে।

ঋজুদা বলল, কাল রাতে কারওরই তো ভাল ঘুম হয়নি। ভটকাইচন্দ্র দুপুরে কী খাওয়া-দাওয়া করা যায় ঠিক করে লেগে পড়। খেয়ে-দেয়ে ভাল করে ঘুমুতে হবে। তারপর বিকেলে এক কাপ করে চা খেয়ে সন্ধে নামতেই বেরিয়ে পড়তে হবে। ঘুমটা খুবই দরকার। আজ রাতে ঘুমের সম্ভাবনা নেইই বলতে গেলে।

তারপর বলল, আমাদের প্রত্যেকেরই কিন্তু গাছে উঠে যেখান থেকে গুলির শব্দ হয়েছিল সে জায়গাটা ভাল করে দেখে নিতে হবে। আমরা নিজের নিজের দায়িত্বে যাব রাতভর তো বটেইকাল সকাল এবং দুপুরও কাটিয়ে এখানে ফিরে আসতে হবে। ওই গাছটাকেও ভাল করে চিনে রাখতে হবে। পিঠের রাক-স্যাকে কটা বিস্কিট এবং যার যার জলের বোতল নিয়ে নিতে হবে। তাগা, তুমি আর ভটকাইবাবু একসঙ্গে থেকো।

ভটকাই আপত্তি করে বলল, বাঃ, তা কেন?

তোর ভালর জন্যেই বলছি। ঠিক এইরকম টোপোগ্রাফিতে তো তুই আগে…

তা রুদ্রই কি গেছে নাকি?

তুই সবসময় রুদ্রর সঙ্গে তুলনা করিস না তো। রুদ্র এসব ব্যাপারেই তোর চেয়ে অনেকই সিনিয়র। বয়স এক হলেই কি অভিজ্ঞতা এক হয়?

ভটকাই চুপ করে গেল।

তারপরে হঠাৎই বলল, আচ্ছা হাতি তো মারে চোরাশিকারিরা হাতির দাঁতের জন্যে, গণ্ডার কেন মারে?

ঋজুদা হেসে ফেলল। বলল, এতদিন পরে তোর মনে এই প্রশ্নটা জাগল। সত্যি!

তাগা বলল, গণ্ডারের খড়্গর গুঁড়োর পৃথিবীর পয়সাওয়ালাদের দেশে খুব চাহিদা। ওই গুঁড়ো খেলে নাকি মানুষে জোয়ান থাকে, বুড়ো হয় না কখনও। তাই বহুৎ দামে বিক্রি হয় গণ্ডারের খড়্গ।

তাই? হাড়ের গুঁড়ো?

গণ্ডারের খড়্গে কিন্তু হাড় একেবারেই নেই।

তবে? খড়্গের এক ঝটকাতে জিপ উলটে দেয়, বুরুন্ডিকা হাতির পেট ফাঁসিয়ে দিতে পারে আর সেটা হাড়ের নয়?

না। গণ্ডারের খড়্গ লোমের।

লোমের?

সত্যই কইতাছি স্যার।

 তাগা বলল।

ভটকাইয়ের যেন তাও বিশ্বাস হল না। ঋজুদাকে জিজ্ঞেস করল, সত্যি ঋজুদা?

সত্যি বলেই তো জানি।

ফ্যান্টাসটিক ব্যাপার-স্যাপার।

বলল, ভটকাই।

ঋজুদা বলল, লাঞ্চের কী হবে?

চলো তাগাদাদা। চালে-ডালে খিচুড়ি বানিয়ে ফেলি। মধ্যে একটু আলু, কাঁচালঙ্কা ফেলে দিয়ে।

পেঁয়াজ দিবেন না?

তাও দেওয়া যায়।

তাহলে কাজে লেগে যা।

ঋজুদা বলল।

তারপর বলল, আমাকে একটা বাইনাকুলার দে তো রুদ্র। একবার উঠে ভাল করে দেখি।

ঋজুদা গলফ-শু পরেছিল। বলল, জুতোটা কি খুলব নাকি রে?

 যদি না খুলে উঠতে পারো তো ওঠো।

 দেখি চেষ্টা করে। উঠতে পারা তো উচিত।

বলে ঋজুদা আস্তে আস্তে ওপরে উঠে গেল। তাগা আর ভটকাই গ্যাস সিলিন্ডারটা বের করে কাজে লেগে গেল। বললে হবে না, ভটকাই খেতেও যেমন ভালবাসে, রান্না-বান্না করতেও পারে। ঋজুদাও পারে, তবে করে না। আমি শুধু খেতে পারি–অকর্মার ঢোক।

.

০৩.

বেলা দশটার মধ্যে ভটকাই আর তাগা মেচ খিচুড়ি বেঁধে ফেলল। তবে আল ও পটল এবং শুকনো লঙ্কা ভাজাও করে ফেলল ওরা সেদ্ধ না দিয়ে। তাতে স্বাদ আরও ভাল হয়। এবং আমরা যখন আবিষ্কার করলাম যে আমাদের খাবার-দাবারের মধ্যে এক টিন পাঁচরঙ্গ আচারও রয়েছে তখন আর জানতে বাকি রইল না যে এই অপকর্ম ভটকাই ছাড়া আর কারও পক্ষে করা সম্ভব ছিল না। এমন বিপজ্জনক mission-এ এসে, মরি কি বাঁচি তার ঠিক না থাকা সত্ত্বেও আচার খাবার মানসিকতা এই ভটকাই ছাড়া আর কারওরই থাকার কথা ছিল না। নওগাঁতে পৌঁছে টর্চের ব্যাটারি এবং টুকটাক কেনার জন্যে ঋজুদা যখন ভটকাইকে পাঠিয়েছিল তখনই ভটকাই এই অপকর্মটা করেছিল মনে হয়। কিন্তু যার অপকর্মই হোক কাজিরাঙার এক কাঠোনির মধ্যে বসে পাঁচঙ্গ আচার দিয়ে খিচুড়ি খাওয়ার মতো বিলাসিতার কথা আমাদের পক্ষে স্বপ্নেরও অতীত ছিল। আমরা সকলেই কৃতজ্ঞতার চোখে ভটকাইয়ের দিকে তাকালাম। ভটকাই এমনই একটা ভাব করল চোখে-মুখে যেন বলতে চাইছে বিন্দাস।

ঋজুদা গাছে ওঠার পরে আমি আর ভটকাইও উঠেছিলাম। খাওয়া-দাওয়ার পরে ঋজুদা আমাদের জিজ্ঞেস করল, আমরা কী দেখলাম এবং কী মনে হল আমাদের। আমরা নিজের নিজের অবজার্ভেশনের কথা বললাম। আমাদের কথা শোনার পরে ঋজুদা বলল, আজ রাতে পায়ে হেঁটে ওইরকমভাবে আত্মহত্যা করতে যাওয়াটা ঠিক হবে না কারণ আমার মনে হয় না যে মোটকা গোগোই অ্যান্ড কোম্পানিই হোক আর যেই হোক ওই গণ্ডার মেরেছে বলে।

তাগা মেচ অবাক হয়ে বলল, ক্যান এ কথা কইতেছেন স্যার?

ঋজুদা বলল, সকালে গেন্দা যদি ওরা মারতই তবে এতক্ষণে খড়্গটা কেটে নিয়ে গণ্ডারটাকে ফেলে রেখে চলে যেত। এবং গেলে এতক্ষণে শকুন পড়ত গেন্দার ওপরে।

ভটকাই বলল, শকুন কি গণ্ডারের ওই মোটা চামড়া ভেদ করতে পারবে?

সেটা একটা কথা বটে। তবে রাইফেলের গুলিতে যে ক্ষত হবে সেই ক্ষতর উৎস ধরে শকুন খেতে আরম্ভ করতে পারে এবং শকুনদের মিলিত চেষ্টায় গণ্ডারের চামড়াও হয়তো গণ্ডারের মাংসে পৌঁছোনোর বাধা হবে না।

তারপর তাগার দিকে ফিরে বলল, তোমার কী মনে হয়?

তাগা বলল ব্যাপারটা সম্বন্ধে ঠিক বলতে পারবে না সে কারণ তার কোনও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নেই। তা ছাড়া কাজিরাঙাতে শকুন সে দেখেওনি।

ঋজুদা বলল, টাটকা মারা গণ্ডারের মাংসতে পৌঁছোনো হয়তো শকুনের পক্ষেও সম্ভব নয় তবে গণ্ডারের মৃত্যুর দু’-চারদিন পরে গণ্ডারের চামড়াও তো গলতে শুরু করবে, তখন অবশ্যই শকুনের পক্ষে তাকে কবজা করা সম্ভব হবে। তবে এ ব্যাপারে আমি ঠিক জানি না, স্বীকার করতেই হবে। জানতে হবে ব্যাপারটা।

তা তোমার কী মনে হল?

 আমি জিজ্ঞেস করলাম।

আমার মনে হল পোচাররা সম্ভবত কোনও হগডিয়ার বা শুয়োর-টুয়োর শিকার করেছে নিজেদের খাওয়ার জন্যে। গণ্ডার মারলে পাখ-পাখালির ওপরে তার অভিঘাত অন্যরকম হত।

অভিঘাত তো রাইফেলের আওয়াজের। সে অভিঘাত তো কী জানোয়ার মারা হল তার ওপর নির্ভর করবে না। আওয়াজ হলেই পাখিরা চিৎকার করে ওড়াউড়ি করবে।

সেটাও ঠিক।

ঋজুদা বলল।

তারপর বলল, তাগা, তোমার কী মনে হয়?

তাগা বলল, আমার স্থির কিছু মনে হয় নাই স্যার।

ঋজুদা বলল, তাগার মনে হওয়াটাও অস্থির হলে আমাদের একটু ধৈর্য ধরাই শ্রেয়। আত্মহত্যাই যদি করবি তোরা তবে তো তোর বড়মামার এগারোতলার ফ্ল্যাট থেকে লাফিয়ে পড়লেই হত। এত কাঠখড় পুড়িয়ে হিরো বনবার জন্যে কাজিরাঙাতে আসা কেন? তাই আজকে আমরা কোথাওই যাব না। এখানেই থাকব। তাঁবুটা বরং খাঁটিয়ে ফেল। রাতেও যখন ঘুমোব তখন ভাল করে আরামে ঘুমোনোই ভাল, জিপ নিয়ে আমি এই কাঠোনি ছেড়ে রাতে বা দিনে বাইরে যেতে চাইনা। ওরা বাইনাকুলার দিয়ে দেখে ফেলবে আমাদের। যেতে যদি হয়ই তাহলে পায়ে হেঁটেই যেতে হবে। তবে সেটা এখুনি নয়। ওরা যে এ অঞ্চলে আছেই রাইফেলের গুলির শব্দই তো তার অকাট্য প্রমাণ। তাই হড়বড় করার দরকার নেই। মহম্মদ পর্বতের কাছে না গেলে পর্বতই না হয় যাবে মহম্মদের কাছে। ধৈর্য ধরে দেখাই যাক।

ভটকাই বলল, পার্কালাম!

 ইয়েস। পার্কালাম।

ঋজুদা বলল।

তারপর বলল, তাগা তুমি আমাদের একেবারে ডিটেইলসে বলল তো ফরেস্ট গার্ড মতিরাম যেবারে মারা গেলেন সে রাতে ঠিক কী হয়েছিল। সেটা জানলে ওদের modus-operandi-টা বোঝা সুবিধে হবে।

কাজিরাঙার অভয়ারণ্য এলাকার মধ্যে মধ্যে ফরেস্ট গার্ডদের, চোরাশিকার বন্ধ করার জন্যে এবং জানোয়ারদের খোঁজখবর রাখার জন্যে ক্যাম্পে থাকতে হয়। ভাগ ভাগ করে। সাধারণত এক-একটি ক্যাম্পে চারজন করে গার্ড থাকে। তাঁদের চারজনের মধ্যে দু’জনের কাছে হয় থ্রি-ফিফটিন রাইফেল, নয় দু’নলা বা একনলা টুয়েলভ বোর শটগান থাকে।

মতিরামের বয়স হয়েছিল বছর চল্লিশেক। কাজিরাঙা থেকে বনবিভাগেরই বানানো একটি পথ দিয়ে গেলে মাইল দশেক পরে পেলিক্যান কাঠোনি। এক সময়ে ওই কাঠোনিতে পেলিক্যানরা বাসা বেঁধে ডিম পাড়ত। এখন তারা বনের আরও অনেক গভীরে চলে গেছে যদিও, কিন্তু পেলিক্যান কাঠোনির নাম পেলিক্যান কাঠোনিই রয়ে গেছে। পেলিক্যান কাঠোনিতে বড় গাছের মধ্যে ছিল কোবরাই (আলবিনিয়া প্রোসেরা), জংলি আম, অটেঙ্গা (ডেলিয়ানা ইন্ডিকানা), দু’-একটি বড় অশ্বত্থ, শিমুল, সিধা ইত্যাদি।

ঘটনার দিন শ্রীগুণিন শইকিয়া, রেঞ্জার এবং শ্রীস্বপন শীলশৰ্মা (এখন অবশ্যই ডি. এফ. ও. হয়ে গেছেন) রেঞ্জ অফিসে বসে একজন চোরাশিকারিকে ভাল করে জেরা করছিলেন। অল্প ক’দিন আগেই একটি গণ্ডারকে গুলি করার অপরাধে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। জেরা যখন চলছে ঠিক সেই সময়েই মতিরামের দলের একজন ভগ্নদূতের মতো এসে খবর দিলেন যে, তাঁরা চোরাশিকারিদের গুলির শব্দ শুনছেন। যা জানা গেল তাঁদের কাছে তা হচ্ছে এই যে, গুলির শব্দ শুনেই মতিরাম আর অন্য তিনজন কোথা থেকে গুলিটা এল তার খোঁজ করতে করতে এগিয়েও ছিলেন।

গাছের মাথায় চড়ে ওঁরা দেখতে পেলেন যে, এক জায়গায় কতগুলো গোবক উড়ছে। যেখানে পাখি উড়ছে, তার কাছাকাছিই গুলিটা হয়েছে এমন অনুমান করেই ওঁরা ওইদিকে এগিয়েও যান। চার কিমি মতো পথ হবে সে জায়গাটা ওঁদের ক্যাম্প থেকে। মতিরামের দলের চারজনের মধ্যে মতিরামের কাছে একটা একনলা সিঙ্গল ব্যারেল বারোবোরের শটগান, অন্য একজনের হাতে একটি থ্রি-ফিফটিন রাইফেল। এই ফায়ারিং পাওয়ার নিয়ে জায়গাটার কাছাকাছি মতিরামেরা পৌঁছোতেই চোরাশিকারিরা দূর থেকেই দেখতে পেয়ে গুলি চালায় ওঁদের দিকে। যদিও সে গুলি ওঁদের কারও গায়েই লাগেনি তবু মতিরামেরা পালটা গুলি না-ছুঁড়ে উত্তেজিত হয়ে রেঞ্জ অফিসে এলেন রিপোর্ট করতে। গুণিন শইকিয়া আর স্বপন শীলশৰ্মা যখন সেই গেন্দা-গুলি-করা চোরাশিকারিকে জেরা করে তার কাছ থেকে খবর বার করার চেষ্টা করছিলেন, সেই সময়েই ভগ্নদূতের মতো এই খবর নিয়ে এসে হাজির হলেন মতিরামরা।

খবর শুনেই রেঞ্জ অফিসে হই-চই পড়ে গেল। তক্ষুনি আট-আটজনের দুটি দল তৈরি করে দু’দলকে পাঠিয়ে দেওয়া হবে এমনই স্থির হল জিপে করে। কিন্তু জিপ ছিল মাত্র একটাই।

দু’দলকে সবসুদ্ধ আটটি আগ্নেয়াস্ত্র দেওয়া হল, চারটি চারটি করে। আটটির মধ্যে ছটি থ্রি-ফিফটিন রাইফেল এবং দুটি শটগান।

প্রথমে দলটিকে পাঠানো হল লাউডুবির দিকে, অন্যদের পেলিক্যান কাঠোনির দিকে। দু’দলকেই ওয়াকিটকিও দিয়ে দেওয়া হল, যাতে রেঞ্জ অফিসের সঙ্গে প্রয়োজন হলেই তারা কথা বলতে পারে। কী হল বা না-হল, জানাতে পারে। জিপ রেঞ্জারসাহেবের একটাই ছিল। সেই জিপটাই দু’ট্রিপে ওই ষোলোজনকে ওই দু’জায়গায় পৌঁছে দিয়ে ওখানেই রয়ে গেল।

যে এলাকাতে গুলি হয়েছিল এবং গোবকদের উড়তে দেখেছিল, পেলিক্যান কাঠোনির কাছের সেই পুরো ঘাসী এলাকাটাতেই আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট থেকেই কিছুদিন আগে, যেমন প্রত্যেক বছরই গরমের শুরুতে দেওয়া হয়। বড় গাছেদের অবশ্য কোনও ক্ষতি হয় না তাতে, শুধু ঘাসই পুড়ে যায়।

ওই দুটি দল লাউডুবি আর পেলিক্যান কাঠোনির কাছে পৌঁছে আলাদা হয়ে গিয়ে ওই পোড়া ঘাসের বনের মধ্যে দিয়ে এক সাঁড়াশি-অভিযান শুরু করল পেলিক্যান কাঠোনির দিকে। ষোলোজন গার্ড এবং দশটি আগ্নেয়াস্ত্র, জিপ এবং ওয়াকিটকি, সেই তখনও অদৃশ্য এবং সম্ভবত একজনমাত্র চোরাশিকারির মোকাবিলার পক্ষে যথেষ্টই ছিল।

জিপের শেষ ট্রিপ চলে গেলে, রেঞ্জার শইকিয়াসাহেব একটি সিগারেট ধরিয়ে আবারও মোটকা গোগোইকে নিয়ে পড়লেন। যে চোরাশিকারি কদিন আগে একটি গেন্দাকে গুলি করেছিল, তার নামই মোটকা গোগোই। তবে লোকটি সত্যিই মোটকা ছিল কিনা আমার জানা নেই। অনেক শুটকো লোকের নামও মোটকা হয় দেখেছি।

জেরা যখন জোরকদমে এগোচ্ছে, ঠিক তখনই ওয়ারলেস সেটে কোড ওয়ার্ড ক্যাঁক্যাঁ করে উঠল: ‘রাইনো’! রাইনো’!

প্রথম দলটি, যাদের পেলিক্যান কাঠোনিতে পাঠানো হয়েছিল তাদের মধ্যে একজন উত্তেজিত গলায় খবর দিল যে, ওরা চোরাশিকারিদের সঠিক অবস্থান জানতে পেরেছে। শিকারি একজন নয়, চারজন। ব্যাপার খুবই ডেঞ্জারাস। তবে জবর খবর হচ্ছে এই যে, চোরাশিকারিদের মধ্যে তিনজনকে ওরা মেরেও ফেলেছে। চতুর্থজন একটা বড় বটগাছে উঠে লুকিয়ে আছে পাতার আড়ালে। তাকেই এখন কবজা করার চেষ্টা চলছে। কিন্তু বিপদ হয়েছে এই যে, গুলি সব ফুরিয়ে গেছে ওদের। গুলির দরকার আরও। এক্ষুনি।

রেঞ্জার গুণিন শইকিয়া এই খবরে স্বভাবতই খুশি এবং উত্তেজিতও হলেন। কিন্তু নাম গুণিন হলেও হাত গুনতে তো আর জানেন না তিনি! অতগুলো গুলি দিয়ে ষোলোজন গার্ড কী যুদ্ধ করলেন, তা ওঁরাই জানেন। প্রত্যেককে পাঁচ রাউন্ড করে গুলি দেওয়া হয়।

তার মানে চল্লিশ রাউন্ড গুলি।

আমি বললাম, তা দিয়ে তো কারগিলে পাকিস্তানকেই ঠাণ্ডা করে দেওয়া যেত।

ঋজুদা বলল, তা যেত যদি গুলি লক্ষ্যস্থানে পৌঁছোত। সবাই যদি জেঠুমনির বন্ধুদের মতো to aim at the genuine direction-এ aim করে তাহলে গুলির সঙ্গে টার্গেটের যোগাযোগ হওয়ার সম্ভাবনা তো না থাকারই কথা।

তারপর বলল, নার্ভাস হয়ে গেলে ওরকম হতেই পারে। জেঠুমনির বন্ধুরা কি হরিণ দেখেও নার্ভাস হয়েছিলেন নাকি?

না। নার্ভাস হননি কারণ হরিণের কাছ থেকে কোনও ভয় ছিল না কিন্তু উত্তেজিত তো হয়েছিলেন। যাঁরা শিকারি নন তাঁরা বক দেখেও উত্তেজিত হতে পারেন। আর ওভার একসাইটমেন্ট নার্ভাসনেসের চেয়েও খারাপ।

তারপর, সবই ফুরিয়ে ফেললেন গার্ডরা তিনজন ডাকাত মারতে? তা ছাড়া গুলি এখন পাঠাবেনই বা কী করে? একটিমাত্র জিপ, সেটি তো আগেই পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এও ঠিক যে, তক্ষুনিই কিছু করা দরকার।

তাগা বলল, তারপর শইকিয়াসাহেব তড়িঘড়ি পর্যটন বিভাগের একটি জিপ বন্দোবস্ত করে সঙ্গে যথেষ্ট গুলি এবং স্বপন শীলশৰ্মা সাহেবকে নিয়ে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই নিজেই অকুস্থলে গিয়ে পৌঁছোলেন খালি হাতেই। মানে শুধুই গুলি নিয়ে। আগ্নেয়াস্ত্র ছিল না কোনওই। গুলি ফুটোবার আগ্নেয়াস্ত্র তো ছিল না সঙ্গে। গুলি দিয়ে ঢিল মারলে তো গুলি ফুটবে না।

ভাগ্যিস সেই রাস্তাটা সে বছরই বানানো হয়েছিল। নইলে অত কম সময়ে পৌঁছোনো যেত না আদৌ। তবে ঠিক পৌঁছোনওনি তখনও, তাঁরা যখন পেলিক্যান কাঠোনি থেকে তিনশো মিটার মতো দূরে আছেন, তখনই একজন গার্ড পড়ি-কি মরি করে দৌড়ে আসতে আসতে হাত তুলে চেঁচাচ্ছিলেন, ‘পলাউক পলাউক!’ মানে পালিয়ে যান। পালিয়ে যান। সেই গার্ড নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েই গুণিনসাহেবদের সৎ পরামর্শ দিতে দিতে দৌড়ে আসছিলেন। বটগাছের ঝুপড়ি ডালপালায় প্রায়ান্ধকার থেকে যে কোনও সময়ে গুলি এসে ধরাশায়ী করতে পারত তাকে। সাংঘাতিক সাহসের কাজই করেছিলেন, সন্দেহ নেই।

সেই ‘পলাউক, পলাউক’ চিৎকারে রেঞ্জারের দল দাঁড়িয়ে পড়েন। কাছে এসে সেই গার্ড যে সংবাদ দিলেন তা শুনে তো চোখ কপালে উঠল শইকিয়াসাহেবদের। জানলেন যে আসল ঘটনার সঙ্গে প্রথম ওয়ারলেস মেসেজের কিছুমাত্র মিলই ছিল না।

ভটকাই তাগাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, তার মানে?

তাগা বলল, আসল ঘটনা যা ঘটেছিল তা হল একেবারেই অন্যরকম। মতিরাম এবং অন্য গার্ডরা জিপে করে রেঞ্জ অফিস থেকে ফিরে গিয়ে শিকারিদের খুঁজতে খুঁজতে বড় বটগাছটার ঠিক নীচে এসে পৌঁছেন। অনেকদূর হেঁটে আসায় ক্লান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে মতিরাম পকেট থেকে একটা সিগারেট বার করেন। সিগারেটে দেশলাই জ্বেলে যখন আগুন ধরাতে যাবেন ঠিক তখনই চোখ ওপরের দিকে তুলতেই তিনি দেখতে পান, বটগাছের ওপরে একজন নাগা-শিকারি রাইফেল হাতে বসে আছে।

মতিরামের সঙ্গে শিকারির চোখাচোখি হওয়ামাত্রই মতিরাম চিৎকার করে উঠে সঙ্গীদের জানান। কিন্তু মতিরাম তাঁর বন্দুকে হাত ছোঁয়াবার আগেই সেই নাগা চোরাশিকারি মতিরামকে গুলি করে। গুলি করতেই উনি মাটিতে পড়ে যান। সঙ্গীরা তখন গাছটিকে লক্ষ করে এবং ওই শিকারিকে লক্ষ করেও গুলি ছুঁড়তে থাকে। গাছের একাধিক জায়গা থেকেও যখন গুলি আসতে থাকে তখন বোঝা যায় যে, চোরাশিকারি একজন নয়, একাধিক।

যা ছিল সব গুলিই চোরাশিকারিদের প্রতি নৈবেদ্য দেন ওঁরা এবং মতিরাম অ্যান্ড কোম্পানির গুলি খেয়ে গাছে লুকোনো দলের তিনজন শিকারিই গুলিবিদ্ধ হয়ে নীচে পড়ে যায়। মতিরামের দলের আটজনের মধ্যে চারজনই নিরস্ত্র ছিলেন। নিরস্ত্রদের একজনের হাতে ছিল ওয়াকিটকি। গুলির বহর দেখে ওই নিরস্ত্র চারজনই পিঠটান দেন। নিরাপদ দূরত্বে পৌঁছে গিয়ে রেঞ্জ অফিসে খবর দেন যে, তিনজন শিকারি গাছ থেকে পাকা আমের মতো গুলিতে খসেনীচে পড়েছে। কিন্তু তাঁদের মতিরাম বড়ুয়াও যে গুলি খেয়ে সবচেয়ে আগেই পড়ে গেছেন তা উনি জানতেনও না পর্যন্ত। যা জানতেন সেইরকমই মেসেজ পাঠিয়েছিলেন রেঞ্জ অফিসে।

গুলিতে পেলিক্যান কাঠোনির চারপাশের অনেক গাছই চিরে গিয়েছিল। সশস্ত্র গার্ডদের হয়তো ব্যাপার বেগতিক দেখে সঠিক খবরটা যে কী জানার কোনও তাগিদ ছিল না।

পলাউক, পলাউক শুনে শইকিয়াসাহেবেরা শাসিয়েছিলেন কিনা জানা নেই, তবে শইকিয়াসাহেবের কাছে যতটুকু শোনা গেল, তাতে এই-ই জানা গেল যে, ‘পলাউক’ ওয়ার্নিং শুনেই দাঁড়িয়ে পড়ে ওঁরা ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করেন। ব্যাপার বেগতিক দেখেই ওঁরা সঙ্গে সঙ্গে জোরে জিপ চালিয়ে ফিরে যান কাজিরাঙা পুলিশ স্টেশনে। সেখান থেকে এক ব্যাটেলিয়ন আর্মড পুলিশ এবং পুলিশের গাড়ি নিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আবারও পেলিক্যান কাঠোনিতে ফিরে আসেন। সেখানে পৌঁছে বটগাছের এক ফার্লং দূর থেকেই তাঁরা হামাগুড়ি দিয়ে এগোতে থাকেন ওইদিকে। এবং পুলিশের ব্যাটেলিয়ন বটগাছটিকে ঘিরেও ফেলে। তবে মাত্র তিন দিক। অন্য দিকে এলিফ্যান্ট গ্রাস ছিল। সেদিকে ঘাস পোড়ানো হয়নি। তাই সেদিকটা অরক্ষিতই রয়ে গেছিল। শিকারিরা চাইলেই ওদিক দিয়ে পালাতে পারত।

বটগাছের নীচে পোঁছেই দেখা গেল মতিরাম বড়ুয়া বুকে ও পায়ে গুলি লাগা অবস্থায় পড়ে আছেন। রক্তে ভেসে যাচ্ছে সমস্ত জায়গাটা। গাছের নীচে আরও অনেক জায়গাতেও রক্ত পাওয়া গেল। কিন্তু বেমালুম গুলি হজম করা সেই নাগা চোরাশিকারিদের কাউকেই দেখা গেল না। তারা আহত হয়ে গাছ থেকে পড়ে যাওয়া সত্ত্বেও।

আচ্ছা গুলিখোর লোক তো সব!

ভটকাই স্বগতোক্তি করল।

 শোন। ইন্টারাপট করিস না।

ঋজুদা বলল, মতিরামকে সঙ্গে সঙ্গেই জিপে করে হাসপাতালে পাঠানো হল। কিন্তু হাসপাতালের পথেই তাঁর প্রাণ বেরিয়ে যায়। বেচারি! পানি, পানি! বাঁচাও, বাঁচাও’ করে অনেক চেঁচিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর পালিয়ে যাওয়া নিরস্ত্র সঙ্গীরা তাঁর আর্ত চিৎকারকেই আহত নাগা-শিকারিদের আর্ত চিৎকার বলে ভুল করেছিলেন। উত্তেজিত অবস্থাতে এরকম অনেক ভুলই হয়।

মতিরামকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েই রক্তের দাগ দেখে এগোলেন ওঁরা সকলে মিলে। রাইফেল, বন্দুক রেডি পজিশনে ধরে। কিছুদূর এগোতেই আহত জানোয়ারের রক্তের দাগ যেমন পাওয়া যায় ঘাসে, ঝোপঝাড়ে, তেমনই আলাদা আলাদা তিনটি ব্লাড ট্রেইল পাওয়া গেল। অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজি করেও নাকি আহত শিকারিদের টিকিও মিলল না।

সত্যিই কি খোঁজাখুঁজি করা হয়েছিল না তোর বাহাদুর জামাইবাবুর গুলি করা শেপার্ড খোঁজার মতো এইসব হয়েছিল তা কে বলতে পারে।

ভটকাই বলল।

 ঋজুদা রেগে বলল, তুই চুপ করবি ভটকাই।

তারপর এলিফ্যান্ট গ্রাসের বনের মধ্যে যেদিকটাতে ঘাস তখনও ছিল, সেদিকটাতেও আগুন ধরিয়ে দেওয়া হল। ওই ঘাসবনে আগুন ধরে যেতেই একজন লুকিয়ে থাকা শিকারি আগুনের হাত থেকে বাঁচার জন্যে কোনওরকমে হেঁচড়ে ছেচড়ে বেরিয়ে আসতেই পুলিশের হাতে পড়ল। তাকে জেরা করে জানা গেল যে, গুলি তিনজন চোরাশিকারির গায়েই লেগেছিল। এবং তারা তিনজনই আহত হয়েছে। তবে নেতা যে চতুর্থজন, তার কিছুই হয়নি এবং সে পালিয়েও গেছে। বিপদে, সঙ্গীদের ফাঁসিয়ে দিয়ে নিজে প্রাণ নিয়ে পালাতে না জানলে নেতা হওয়া যায় না বোধহয় আজকাল। বিশেষ করে আমাদের দেশে।

তবুও অন্যদের ধরার জন্যে সূর্যাস্ত অবধি তন্নতন্ন করে খোঁজাখুঁজি করেও কাউকেই পাওয়া গেল না। পরদিন সকালে আবারও নতুন করে খোঁজ আরম্ভ হল। কিন্তু লাভ হল না কিছু। তখন স্বাভবিকভাবেই ধরে নেওয়া হল যে, শিকারিদের আঘাত নিশ্চয়ই তেমন গুরুতর নয়। তাই তারা পালিয়েই গেছে।

দুর্ঘটনার চতুর্থ দিনে মিস্টার পি সি দাস, তখনকার চিফ কনজার্ভেটর, ওয়াইল্ড লাইফ (এখন তিনি আসামের চিফ কনজার্ভেটর জেনারেল) নিজেই এলেন সরেজমিনে তদন্ত করতে। কাজিরাঙা ন্যাশনাল পার্কের ডিরেক্টর মি. পরমা লাহোনও আসেন। মি. লাহোন কিন্তু ঘটনার দিনেই তাঁর নিজের ওয়ারলেস সেটে রেঞ্জ অফিস আর মতিরামের দলের মধ্যে ওয়াকিটকিতে যে কথা হয়, তা মনিটর করামাত্রই নিজের রাইফেল নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে একাই ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়েছিলেন।

খুবই প্রশংসনীয় এবং দুঃসাহসী কাজ বলতে হবে।

ঋজুদা বলল।

দ্বিতীয় এবং চতুর্থ দিনে আটটি হাতি দিয়ে ঘাসবন আঁতিপাতি করে খোঁজা হয়। মি. দাস যেদিন ছিলেন, মানে চতুর্থ দিনে, ওই এলিফ্যান্ট গ্রাসের বনের মধ্যে থেকেই একটি পচা, ফোলা, গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ খুঁজে পান ওঁরা।

শিকারিদের চারজনের মধ্যে প্রথমজন গুলিতে আহত অবস্থায় ধরা পড়েছিল প্রথম দিনেই। দ্বিতীয়জনের গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ, ফোলা, শক্ত অবস্থায় পাওয়া গেল চতুর্থ দিনে। নেতা পালিয়ে গিয়েছিল অক্ষত অবস্থায়। এবং অন্যজনের যে কী হল সেটাই রহস্য। সেও কি পালিয়েই গিয়েছিল? তা ছাড়া এতভাবে খুঁজেও দ্বিতীয়জনের মৃতদেহটি প্রথম এবং দ্বিতীয় দিনে পাওয়া গেল না কেন? যদি প্রথম দিনই ঘাসের মধ্যে তিনজন মানুষের ব্লাড ট্রেইল পাওয়া গিয়ে থাকে, তাহলে তো অনুমান করতে হয় যে, নেতা ছাড়া যে পালিয়ে গেল, সেও আহতই ছিল। আহত অবস্থায় সে পালাল কী করে? নদী দিয়ে পালাল? না অন্যভাবে?

মতিরাম বড়ুয়ার মৃত্যুকে ঘিরে এই চারজন নাগা শিকারির ব্যাপারটাতে একটু রহস্যের গন্ধ থেকেই যায়। অবশ্য দাসসাহেব এবং লাহোনসাহেব নিজেরা যখন এসেছিলেন এবং ব্যাপারটার তদারকি নিজেরাই করেছিলেন, তার ওপর পুলিশের এক ব্যাটেলিয়ন সশস্ত্র প্রহরীও যখন যুক্ত ছিল ওই খোঁজে, তখন রহস্য কোনও থাকার কথা নয়। তবু পুরো ঘটনাটাই গোয়েন্দা কাহিনীরই মতো মনে হয়। তাই রহস্যের গন্ধ নাকে লেগে থাকে।

মতিরামের পরিবারকে বনবিভাগ থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দেওয়া হয়। তা ছাড়া প্রত্যেক গার্ডের, যাঁরা চোরাশিকারিদের মোকাবিলা করার দায়িত্ব নিয়ে নির্জনে ক্যাম্প করে থাকেন তাঁদের জন্য কুড়ি হাজার টাকার জীবনবিমার প্রিমিয়ামও নাকি বনবিভাগই দেয়। সেই কুড়ি হাজারও পেয়েছিলেন মতিরামের পরিবার।

কুড়ি হাজার!

 ভটকাই বলল।

 হ্যাঁ। তাগা বলল।

 কুড়ি হাজার দিয়ে কী করবে? গোরু হবে কি একটা ভাল? এটা বাড়ানো উচিত।

ঋজুদা বলল, এটা আসাম সরকারের ব্যাপার। তুই কোন মাতব্বর এসেছিস? তা ছাড়া আমাদের পশ্চিমবঙ্গে আদৌ এটুকুও করা হয়েছে কিনা তার খোঁজ নে না ফিরে গিয়ে।

আমার কথা কে শুনবে? তুমি বলো না!

দেখব।

ঋজুদা বলল।

এই ঘটনার কথা পুত্থানুপুঙ্খরূপে জেনে আমার মনে হচ্ছে যে, ভারতের সমস্ত অভয়ারণ্যই, যেখানেই চোরাশিকারিদের পা পড়ে, সেখানকার ফরেস্ট গার্ডদের রাইফেল চালনা এবং প্যারা মিলিটারি না হলেও অন্তত ফিল্ড ট্রেনিংয়ের একটি করে কোর্স বাধ্যতামূলকভাবেই করাবার ব্যবস্থা করা উচিত, তাঁদের চোরাশিকারিদের ধরতে পাঠানোর আগে। নইলে আরও অনেক মতিরাম মারা যাবেন। হাতে রাইফেল থাকলেই সকলেই যে অভিজ্ঞ প্রতিপক্ষর মোকাবিলা করতে পারবেন এমন নয়। শটগানও তাঁদের একেবারেই দেওয়া উচিত নয়। শটগান দিয়ে আধুনিক চোরাশিকারিদের মোকাবিলা করাও যায় না। এই নাগা শিকারিরা থ্রি-ও-থ্রি প্রহিবিটেড বোরের রাইফেল, এমনকী সেলফ-লোডিং রাইফেলও (এস এল আর) যে ব্যবহার করেছিল, তারও প্রমাণ নাকি পাওয়া গিয়েছিল।

আজকাল তো এ কে ফর্টি-সেভেনও আকছার আসছে। চিন আর পাকিস্তান দু’জনেই তো আমাদের বন্ধু।

রাতে খাওয়ার স্পৃহা কারওরই ছিল না। যে কাজে আসা সেই কাজটাই যদি একটুও না এগোয় তো খিদে পাবেই বা কার। পাঁউরুটি ছিল, তাই মাখন লাগিয়ে চার পিস করে খেয়ে নিলাম আমরা রাত ন’টা নাগাদ। আলো জ্বালানো বা আগুন জ্বালানোও চলবে না রাতের বেলা। তবে আমরা কাঠোনির মধ্যে অন্ধকারে এবং জটাজুট সংবলিত এক প্রাগৈতিহাসিক অশ্বত্থ গাছের নীচে আছি বলেই এখানে ঝুপসি অন্ধকার আর বাইরে রূপসী জ্যোৎস্না কাজিরাঙার ভয়াবহ এবং রহস্যময় মঞ্চকে আলোকিত করে রেখেছে। বসন্তে যে ঝিঁঝি ডাকে এইরকম অঞ্চলে তারা সন্ধে থেকেই ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের মতো কোরাস শুরু করে দিয়েছে নিচু গ্রামে। নানা রাতপাখির মিশ্র স্বর ভেসে আসছে চাঁদভাসি ঘাসবন আর মাঝে মাঝের ঝুপড়ি অন্ধকার কাঠোনি থেকে। একজোড়া পেঁচা ছাড়া অন্যদের নাম আমি জানি না। প্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁ করে মার্সিডিজ ট্রাকের হর্নের মতো হাতির ডাক ভেসে এল দক্ষিণ দিক থেকে। গণ্ডারের ডাক কেমন তা আমি জানি না। আফ্রিকাতেও কখনও শুনিনি নিজকানে। ঋজুদা হয়তো বলতে পারবে।

রুটি মাখন খাওয়া সেরে যখন একেকজনকে তিন ঘন্টার জন্যে নাইট গার্ড রেখে আমরা চারজন তিন ঘণ্টা করে ঘুমিয়ে নেব ঠিক করে ভটকাইকে প্রথম গার্ড করে আমরা তিনজন শুতে যাব, ঠিক সেই সময়েই ভটকাই হঠাৎ খুবই বিরক্ত হয়ে দু’হাত ওপরে ছুঁড়ে দিয়ে ঋজুদার অথরিটিকে পুরোপুরি অমান্য করে টিপিকালি ভটকাইয়ের কায়দাতে বলল, দুসসসসস। কোনও মানে হয়! এমন করে চোরাশিকারিদের জন্যে অপেক্ষা করব? আমি চললাম একাই। তোমরা ঘুমোও।

জঙ্গলে বা পাহাড়ে বা সমুদ্রে বা ঘাসবনেও সে শিকারের জন্যেই যাওয়া হোক, কী অন্য যে কোনও কাজে, নেতা একজন অবশ্য থাকা দরকার। নেতা না থাকলে নানারকম বিপদ হতে পারে–যেমন বিপদ হতে পারে নেতা থাকলে, শহরে-বন্দরে। নেতাকে অমান্য করার শান্তি সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী বা বায়ুসেনা বাহিনীতেও কোর্ট-মার্শাল। তার মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে। ভটকাই যে এসব জানে না তাও নয়। সব জেনেশুনেও এমন বেয়াদবি অভাবনীয়। ঋজুদা এক মুহূর্ত ভটকাইয়ের মুখে চেয়ে থাকল। কাঠোনির গাছপালার ফাঁকফোকর দিয়ে বাইরের আলোর উদ্ভাস যেটুকু আসছিল ভিতরে, তাতে ভটকাই বা ঋজুদার মনের ভাব অবশ্য বোঝা গেল না। দীর্ঘ দু-তিন মিনিট নিস্তব্ধ হয়ে গেল আবহ।

নীরবতা ভেঙে ঋজুদা বলল, ঠিকই বলেছে ভটকাই। এরকম অনির্দিষ্টকাল অপেক্ষাতে না বসে থেকে আমাদেরই ইনিসিয়েটিভ নিয়ে কিছু করা দরকার। বিপদ যদি হয় তো হবে।

আমি বললাম, বিপদের ভয় করলে তো আমরা কেউই এখানে আসতাম না। কিন্তু সাহস আর হঠকারিতা তো এক কথা নয়।

ঋজুদা, ইংরেজিতে যাকে বলে, to put one’s foot down তাই করল। বলল, না, আমি veto দিলাম। ভটকাই যা বলছে তাই আমরা করব। যেদিকে গুলির শব্দ হয়েছিল শুধু সেদিকেই নয়, অন্য দিকেও আমরা বেরিয়ে পড়ব। গুলি করার পরে কেউ তো আর তাদের অ্যারালাইট দিয়ে সেঁটে রাখেনি সেখানে। তারা কোন দিকে চলে গেছে তা ঈশ্বরই জানেন।

তারপর বলল, সবচেয়ে আগে আমি যাচ্ছি। আমার কুড়ি মিনিট পরে যাবে রুদ্র, উলটো দিকে।

কোন দিকের উলটো দিকে?

তা তো দেখতেই পাবে। আমি তো আর কর্পূরের মতো উবে যাব না।

 ফেরার কোনও আউটার বাউন্ডস?

আমি জিজ্ঞেস করলাম ঋজুদাকে।

 যখন খুশি ফিরতে পারো, তবে নিদেনপক্ষে এক-একজন করে চোরাশিকারি এক-একজনকে ধরে আনতে হবে–তাতে কাল ফেরো পরশু ফেরো আমার কোনও আপত্তি নেই।

বললাম, উইশফুল থিঙ্কিংয়ের ব্যাপার হয়ে গেল না ঋজুদা?

হল হয়তো, কিন্তু উইশ ছাড়া তো বাঁচাও যায় না কিনা।

ঋজুদা গলা থেকে বাইনাকুলারটা খুলে আমাকে দিয়ে দিল। অন্যটা তো তাগার কাছেই ছিল। বলল, চললাম।

বেরোবার আগে ওয়াকিটকিটা অন করে একবার চেক করে নিল ঋজুদা। আমাদেরও বলল চেক করে নিতে। ওগুলো বনবিভাগ থেকেই আমাদের দেওয়া হয়েছিল। নওগাঁ থেকে আসার পর থেকে জিপে ওয়ারলেস থেকেই কাজিরাঙার কন্ট্রোলের সঙ্গে কথা বলেছি আমরা তিন ঘণ্টা অন্তর অন্তর। এই কন্ট্রোল কাজিরাঙা পার্কের কন্ট্রোল নয়। পোচারদের ধরার অপারেশনের জন্যে অন্য একটা ফ্রিকুয়েন্সি দেওয়া হয়েছে আমাদের। কাজিরাঙা অভয়ারণ্যের গার্ডদের কোড ওয়ার্ড হচ্ছে ‘রাইনো’। কিন্তু আমাদের কোড ওয়ার্ড হচ্ছে, ‘মোটকা। তবে আমরা নিজেদের মধ্যেও কথা বলতে পারব। buzzer বেজে উঠলেই সুইচ টিপে কথা বলতে পারব। অন্যদের ডাকলেও তাদের buzzer বাজবে। বেরোবার আগে ঋজুদামোটকা’ কোডে ওঁদের জানিয়ে দিল যে জিপের ওয়ারলেস সেট অ্যাটেন্ড করার মতো কেউ থাকবে না, তাই উত্তর না পেলে চিন্তা না করতে। তবে কোনও মেসেজ দেওয়ার থাকলে আমাদের ওয়াকিটকিতে ডাইরেক্ট দিতে পারেন। তবে যত কম কথা বলেন আমাদের সঙ্গে ততই মঙ্গল, কারণ চোরাশিকারিদের কাছেও যে ওয়াকিটকি নেই তা কে বলতে পারে। আজকাল ইলেকট্রনিক ইন্ডাস্ট্রির দৌলতে যাদের পকেটে পয়সা পৃথিবী তো তাদেরই পকেটে।

ঋজুদা এগিয়ে গেল।

ভটকাই বলল, গুড লাক।

আমি বললাম, গুড হান্টিং।

তাগা মেচ বলল, সাবধানে যাইয়েন স্যার।

 ঋজুদা সোজা যেদিক থেকে সকালে গুলির আওয়াজটা এসেছিল সেদিকে আস্তে আস্তে পা ফেলে এগিয়ে গেল। আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করলাম যে ঋজুদা টুপিটা রেখে গেল। কেন যে, তা বুঝলাম না। তবে কারণ নিশ্চয়ই আছে।

ঠিক পনেরো মিনিট পরে আমিও বেরোলাম। আমার বেরোনোর পনেরো মিনিট পরে ভটকাই আর তাগা মেচ। আমিও টুপিটা জিপের মধ্যে রেখে গেলাম।

এতক্ষণ কাঠোনির গভীর জঙ্গলের ঘেরাটোপের মধ্যে ছিলাম, কাজিরাঙার এই ব্যাপ্তি ও আদিমতা সেখান থেকে ঠিক বোধগম্য হয়নি। বাইরে বেরোতেই হঠাৎ আমার মনে হল যে এ পর্যন্ত অনেক মানুষখেকো বাঘ, গুণ্ডা হাতি ইত্যাদির মোকাবিলা করেছি। চোরাশিকারিদেরও করেছি, কিন্তু এতখানি একলা কখনও মনে হয়নি নিজেকে। আরও একটা কথা মনে হল, তা হল এই যে, মানুষের মতো সাংঘাতিক জানোয়ার আর দুটি নেই। যখন সে জানোয়ার হবে বলে মনস্থ করে। আমি বাইরে বেরিয়ে ডানদিকে যেতে লাগলাম। ঋজুদা তো সোজা গেছে। প্রতিটি পা ফেলছি আর দাঁড়াচ্ছি। তীক্ষ্ণ চোখে সামনে ও দু’পাশে, এবং মাঝে মাঝে পেছনেও তাকিয়ে দেখছি অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়ে কিনা। গন্তব্যও কিছু নেই, বিশেষ দ্রষ্টব্যও কিছু নেই অথচ সব জায়গাতেই গন্তব্য, সব কিছুই দ্রষ্টব্য। আমার হাতঘড়িতে এখন আটটা বেজেছে রাত। এখানে সূর্য খুব তাড়াতাড়ি ওঠে। কলকাতার থেকে অনেকই পুবে তো। তাই আলো ফোঁটার আগে আমার হাতে ঘণ্টা আট-সাড়ে আট সময় আছে। রাত থাকতে তত চিন্তা নেই, কিন্তু সকাল হয়ে গেলেই বিপদ বাড়বে। পাওয়ারফুল বাইনাকুলার দিয়ে ওই আড়ালহীন তৃণভূমিতে বহু দূর থেকে নজর চলবে।

আধঘণ্টাটাক চলার পরে সামনে হঠাৎই একটি মস্ত জলাভূমি চোখে পড়ল। জলের আলাদা গন্ধ থাকে, বাদারও। শিশুকাল থেকে বনেবাদাড়ে ঘোরাঘুরি করে নাকটা কুকুরের নাক হয়ে গেছে। চৈত্ররাতের মিশ্রগন্ধবাহী হাওয়া যেদিকে বইছিল আমি সম্ভবত সেইদিক দিয়েই এগোচ্ছি। তাই জলের গন্ধ পাইনি। হঠাৎই গতিপথ পরিবর্তিত হতেই নাকে বাদা-বিলের গন্ধ এল এবং চোখে পড়ল এক বিস্তীর্ণ জলজ উদ্ভাস। তার সঙ্গে কানও বঞ্চিত রইল না। জলের মধ্যে একদল জানোয়ারের লাফিয়ে লাফিয়ে যাওয়ার আওয়াজও কানে এল। হগ-ডিয়ারের দল এবং সঙ্গে সঙ্গে বড় বাঘের চাপা বিরক্তি প্রকাশের আওয়াজ। সম্ভবত বড় বাঘটি অনেকক্ষণ পরিশ্রমের পরে হরিণের দলটাও কাছে চলে এসেছিল তাদের stalk করে। ইতিমধ্যে নিঃশব্দ পায়ে আমি হঠাৎ অকুস্থলে হাজির হওয়াতে হরিণরা আমাকে দেখেই পালিয়ে গেল। মধ্যে দিয়ে বাঘ বেচারি পড়ল ফাঁকিতে। বাঘকে যখন হরিণেরা দেখেইনি তখন বাঘ নিজের অবস্থান আওয়াজ করে জানাল কেন সেইটাই রহস্য। সচরাচর ক্লাস ওয়ান গ্রেড ওয়ান শিকারি বলেই বাঘ নিজের অবস্থান জানান তো দেয়ই না, কোনওরকমের আওয়াজও করে না। এমন স্বল্পবাক সে যে মানুষদের মৌনী ঋষির সঙ্গে তুলনীয়।

ব্যাপারটা কী হল বোঝার চেষ্টা করছি, এমন সময়ে দেখি সেই জলার মধ্যে দাঁড়িয়ে এক বুরুন্টিকা। আমার চেহারা হয়তো তার পছন্দ হয়নি। আমারও তার চেহারা পছন্দ হয়নি। হঠাৎ সামনে মাটি খুঁড়ে পাহাড়ের মতো একদাঁতি গণেশ যদি আবির্ভূত হয় তবে পিলে তো চমকাবারই কথা। সবচেয়ে বিপদের কথা এই যে, কোনও কিছুকেই গুলি করার উপায় নেই আমাদের। সে বাঘে ঢুটি কামড়েই ধরুক আর গণেশ আমাকে নিয়ে ফুটবলই খেলুক। গণেশ তার বিরক্তি প্রকাশ করতেই প্যাঁ-অ্যা-অ্যা করে এমন চিৎকার করল যে আমার বুঝতে বাকি রইল না যে সেই ডাক শুনে তাগা মেচের বর্ণনা দেওয়া হুলালপথ নদীর মধ্যে পেল্লাই চিতলগুলোও ভয় পেয়ে জলে পেল্লাই পেল্লাই ঘাই মারল, ওলটাল-পালটাল।

আমি যে কত বড় পেটুক তা সেইক্ষণে বুঝলাম। বাঘেই খায় না হাতিতেই লাথি মারে সেই দুশ্চিন্তা ভুলে চিতল মাছের কথা নইলে মনে আসে কী করে। একটু কায়দা করে সরে গিয়ে আরও ডাইনে যেতেই এক অভাবনীয় দৃশ্য চোখে পড়ল। আমি যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম সে জায়গাটা একটু উঁচু এবং শুকনো, জোয়ার-ভাটা খেলা স্যাংগ্রোভ ফরেস্টস, সুন্দরবনের মাঝে মাঝে যেমন থাকে, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার শিকারি ও জেলে মৌলেরা যাকে বলে ‘ট্যাঁক’, সেইরকম আর কী! সেই ‘ট্যাঁকে দাঁড়িয়ে ডানদিকে চাইতেই চোখে পড়ল দিগন্তবিস্তৃত ব্রহ্মপুত্র নদ চৈত্রমাসের শুক্লপক্ষের জ্যোৎস্নায় ভাসছে। শুধু ভাসছেই নয়, ভাসাচ্ছেও কত কিছু নিশ্চয়ই। নদীর পাড়, আমি যেখানে ছিলাম, এখান থেকে প্রায় আধ মাইল হবে। ট্যাঁক থেকে ভাল করে দেখে নিয়ে আমি নদীর দিকে এগোলাম। মনে হল, আমার আর নদীর, থুড়ি, নদের মধ্যে আরেকটা ট্যাঁক আছে যেটা নদের বেশ কাছে। ভাবলাম, সেখানে পৌঁছোতে পারলে, জায়গাটা উঁচু বলেই সেখান থেকে চারধার আরও ভাল করে দেখা যাবে।

শিকারিরা যেমন সাবধানী নিঃশব্দ পায়ে বনে চলাফেরা করে, চোরাশিকারিদের খোঁজে এসে আমিও তেমন করেই এগোতে লাগলাম। সারা শরীরের কোনও অংশই যেন ত্রস্ত বা চকিত কোনও ভঙ্গি না করে, শরীরের ওপরে মাথাটা এদিক থেকে ওদিক ঘোরাতেও অনন্তকাল সময় নিয়ে ঘোরাতে হয়, সেই সমস্ত সাবধানতা অবলম্বন করেই আমি এগোচ্ছিলাম। ঋজুদা আসবার সময়ে প্লেনে বলেছিল এবং আমারও সে কথা খুবই যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়েছিল যে, সম্ভবত গণ্ডার-শিকারিরা কাজিরাঙাতে পৌঁছোয় নৌকো করে। ডাঙা দিয়ে এলে বনবিভাগ তো বটেই, পুলিশ এবং সাধারণ মানুষেরও চোখে পড়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। নদ ধরে এলে জায়গা বুঝে নৌকো লাগিয়ে নৌকো থেকে অপারেট করাটাই সবচেয়ে সুবিধাজনক। তাদের কোনও কাঠোনির মধ্যে বড় গাছের ওপরে মাচা বেঁধে থাকাটা যেমন খুবই সম্ভব, নৌকোতে থাকাটাও আরও বেশি সম্ভব। বেগতিক দেখলেই তারা নৌকো খুলে সমুদ্রের মতো নদীতে ভেসে পড়তে পারে।

আরও বেশ কয়েক পা যেতেই সামনের সেই কাঠোনিতে পৌঁছোবার আগেই ঘাসবনের মধ্যে সাদা একটা টিপি মতো দেখতে পেলাম চাঁদের আলোতে। আর একটু এগোতেই বুঝলাম যে সেটা টিপি নয়, একটা মস্ত গণ্ডার। এক পাশে কাত হয়ে শুয়ে আছে। আরও কাছে যেতেই দেখতে পেলাম যে তার খড়্গটা কাটা। চাঁদের আলোতে যতখানি ভাল করে নজর করা যায় তা করতে গিয়েই নাকে একটা পচা গন্ধ এল। শরীরের কোথায় গুলি করে মেরেছে গণ্ডারটা তা বোঝা গেল না, তবে তাকে মারা হয়েছে কম করে তিন-চারদিন আগে। তা যখন বোঝা গেল তখন এও প্রাঞ্জল হল যে সকালে আমরা যে গুলির আওয়াজ শুনেছিলাম তার সঙ্গে ওই গণ্ডারের মৃত্যুর কোনও সম্পর্ক নেই।

সাদা গণ্ডারের পটভূমিতে চাঁদের আলোতে আমাকে সহজেই দেখা যাবে তা মনে হতেই আমি গণ্ডারটার পাশে বসে পড়লাম। বসে পড়তেই মানুষের গলার স্বর কানে এল। তবে বেশ দূর থেকে। কারা যেন নিজেদের মধ্যে গল্প করছে। তারা কি সামনের কাঠোনির মধ্যে আছে নাকি নদীর দিকে আছে তা বোঝা গেল না। আমি স্থাণুর মতো বসে রইলাম, তবে তার আগে কাঁধে ঝোলানো রাইফেলটাকে কাঁধ থেকে নামিয়ে হাতে নিয়ে সেফটি ক্যাচ এবং ট্রিগার গার্ডে আঙুল ছুঁইয়ে স্মল অফ দ্য বাট ডান হাতের মুঠোতে শক্ত করে ধরে বসলাম যাতে মুহূর্তের মধ্যে গুলি করতে পারি। পিস্তলটা কোমরের হোলস্টারে ছিল। বেল্টের সঙ্গে বাঁধা। হোলস্টারের বোতামটা খুলে রাখলাম।

লোকগুলো ক’জন তা বোঝা যাচ্ছিল না তবে কমপক্ষে তিনজন হবেই। যে ভাষায় ওরা কথা বলছিল তা আমি বুঝতে পারছিলাম না। তবে মাঝে মাঝে লাহে লাহে’ শব্দ দুটি শুনতে পাচ্ছিলাম। অহমিয়াতে লাহে মানে যে আস্তে এটুকু জানতাম কারণ বাবার এক অহমিয়া বন্ধুকে তেজপুরে তাঁর গাড়ির ড্রাইভারকে প্রায়ই লাহে লাহে’ বলতে শুনতাম, একবার যখন দোলের সময়ে তেজপুরে গেছিলাম আমরা। লোকগুলোর কথাবার্তাতে কোনও উদ্বেগ ছিল না। তারা বেশ খোশমেজাজে আছে বলেই মনে হচ্ছিল।

এখন আমার কী করণীয় তাই হচ্ছে কথা! ওদের কথা আমি যখন শুনতে পাচ্ছি, ওয়াকিটকিতে আমি ঋজুদা ও ভটকাইদের সঙ্গে কথা বললেও ওরা শুনতে পাবে। তবে নাও হয়তো শুনতে পারে। এখন নদীর দিক থেকে হাওয়া বইছে এবং আমি সেইজন্যেই লোকগুলোর কথা শুনতে পাচ্ছি। হাওয়া তাদের কথা উড়িয়ে নিয়ে আসছে। আমি যেহেতু হাওয়ার ভাটিতে আছি, তাই আমার কথা হাওয়া উজানে থাকা ওরা শুনতে নাও পারে। কিন্তু বললেও আমি কী বলব ঋজুদাদের? ওদের কাউকেই এখানে আসতে বলে লাভ নেই। ওরা বিভিন্ন দিকে গেছে এবং কাঠোনি থেকে বেরিয়ে ডানদিকে আসতেও আমার প্রায় ঘণ্টাখানেক লেগে গেল। ওদের আসতে আরও বেশি সময় লাগবে। অথচ এও ঠিক যে ওরা তিন-চারজন থাকলে ওদের ফায়ারিং পাওয়ার আমার চেয়ে অনেক বেশি থাকবে। তা ছাড়া ফরেস্ট গার্ড মতিরামকে যেমন করে মেরেছিল তাতে বোঝা যায় যে গেন্দা মারতেও তাদের হাত যেমন কাঁপে না মানুষ মারতেও কাঁপে না। তবে আমার হালকা থার্টি-ও-সিক্স রাইফেলটা নিয়ে আমি অত্যন্তই দ্রুত গুলি করতে পারব এবং নির্ভুল নিশানাতে। ম্যাগাজিনে পাঁচটি এবং চেম্বারে একটি গুলি আছে– সক্ট নোজড বুলেট। ম্যাগাজিন খালি হবার আগে কম করে পাঁচজনকে পটকে দিতে পারব আমি একাই। তবে গুলি করার আগে টার্গেট ভাল করে দেখা চাই। মানুষ মারা মোটেই আনন্দের জিনিস নয়, তবে নিজের প্রাণ বাঁচাতে যদি মারতে হয় তাহলে না মেরেই বা উপায় কী?

একটুক্ষণ ভেবে নিয়ে আমি গণ্ডারের আড়াল ছেড়ে লেপার্ড-ক্রলিং করে এগোতে শুরু করলাম। তবে কাঠোনির দিকে সোজা নয়। নদীর দিকে এগোতে লাগলাম, যাতে সুযোগ ও সুবিধামতো দিক পরিবর্তন করে কাঠোনির দিকে এগোতে পারি। এলিফ্যান্ট গ্রাসের আড়াল তো ছিলই, কিন্ত সাবধান হতে হচ্ছিল, আমার শরীরের ধাক্কাতে নলবনের মাথাগুলো আন্দোলিত না হয় এবং কোনও শব্দও না হয়। এগোতে তাই খুবই সময় লাগছিল। প্রায় আধঘণ্টাতে যতটা এগোলাম তাও ব্রহ্মপুত্র থেকে বেশ খানিকটা দূরেই রইলাম। কিন্তু তাতেই আবার ঘটনা নতুন মোড়ে পৌঁছোল। এবারে নদীর দিক থেকেও দু’জন মানুষের কথা শোনা গেল। এই দু’জন কি কাঠোনি থেকে এল? না, এরা আলাদা!

এবারে খুবই সাবধানে এগোতে লাগলাম এবং নলবন ক্রমশ পাতলা হয়ে আসতে লাগল। নলবনের বদলে ঘাসবন শুরু হয়েছে। সেই ঘাসবন গিয়ে নদীর পাড়ে মিশেছে। নদীর কাছাকাছি পৌঁছে সটান শুয়ে পড়লাম কান খাড়া করে। সব ইন্দ্রিয়র প্রতিভূ হল তখন শুধুমাত্র শ্রবণেন্দ্রিয়ই। তখন শোনা ছাড়াও কান দিয়ে দেখা। নাকও অবশ্য সজাগ থাকে, বেশ বেশি সজাগ, যখন চোখ কাজ করে না। ঠিক সেই সময়ে নাকে খিচুড়ি রান্নার গন্ধ এল নদীর দিক থেকে হাওয়ায় ভেসে। ভাজা মুগের ডালের খিচুড়ি, তার মধ্যে উৎকৃষ্ট ঘি ঢালা হয়েছে। হয়তো ঘি দিয়েই রান্না হচ্ছে। খিচুড়িভক্ত আমি তখন গেন্দা-শিকারিদের সঙ্গে এনকাউন্টারের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে খিচুড়ির গন্ধে কুঁদ হয়ে গেলাম।

আরও একটু এগিয়ে গিয়ে একেবারে ফ্রিজ করে গেলাম। দেখি মস্ত বড় একটা গামারি গাছের নীচে বাঁধা একটি বড় নৌকো। ব্রহ্মপুত্রে ছোট নৌকোর পক্ষে সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। তা ছাড়া সময়টা শেষ চৈত্র। যখন-তখন হাওয়া উঠতে পারে এবং ওঠেও। সেই বড় নৌকোটার সঙ্গে একটা ছোট নৌকো বাঁধা, জলিবোট-এর মতো। তাতেই দেখি একটা জনতা স্টোভে খিচুড়ির হাঁড়ি আর অন্য একটা স্টোভে কী ভাজছে। নাক আবারও চেগে উঠল। এ তো চিতল মাছের গন্ধ। চিতল মাছের নদনদে তেলওয়ালা পেটি ভাজছে কেউ। চিতল মাছের পেটি সর্ষে দিয়ে, কাঁচালঙ্কা-ধনেপাতা দিয়ে, এমনকী দই দিয়েও খেয়েছি কিন্তু পেটি ভাজা কখনও খাইনি। এই বনবাসে এত তরিবৎ করে রান্না করার সময় ও সুবিধাও ছিল না রাঁধুনির। রাঁধুনির সঙ্গে একটা লোক পাড়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। রাঁধুনি তাকে যা বলল তাতে মনে হল সে অন্যদের ডেকে আনতে বলছে গরম গরম খাবার পরিবেশন করবে বলে।

একেই বলে কপাল! খিচুড়ি আর চিতল মাছের পেটি ভাজা যখন খাবে তারা তখন হয়তো একজন পাহারাতে থাকবে। অন্যরা তো খেতেই মশগুল থাকবে। দেখা যাক, ঘটনা কী ঘটে।

লোকটি কাঠোনির দিকে চলে গেল এবং আধখানি পথ গিয়েই গলা তুলে ডাক দিল ওদের। তার ডাকের মধ্যে মোটকা নামটা উচ্চারিত হল একবার। চমকে উঠলাম আমি। তবে তো তাগা মেচ ঠিকই আন্দাজ করেছিল।

যেখানে পড়ে ছিলাম সেখানেই ঘাপটি মেরে পড়ে রইলাম। আমার ভাগ্যেই যে শিকে ছিঁড়ল এটা ভেবেই আনন্দিত হলাম। এখন শিকেই ঘেঁড়ে না প্রাণটাই যায় সেটাই দেখবার। উত্তেজনাতে শরীরের সব স্নায়ু এবং মন টানটান হয়ে রইল। সেই লোকটা ওখানেই দাঁড়িয়ে রইল। অন্ধকার কাঠোনির দিক থেকে দু’জন লোক বাইরে বেরিয়ে এসে চাঁদের আলোর মধ্যে ঘাসবন পেরিয়ে এসে ওই লোকটার সঙ্গে মিলিত হয়ে তিনজনই নৌকোর দিকে যেতে লাগল। আমি পরিষ্কার দেখতে পেলাম যে সেই দু’জনের মধ্যে একজনের হাতে একটা রাইফেল। কী রাইফেল তা বোঝা সম্ভব ছিল না, তবে মনে হল সিঙ্গল ব্যারেল রাইফেল। হাতি মারার জন্যে হেভি বোরের রাইফেল আর মানুষ মারার জন্যে লাইট বোরের রাইফেল এনেছে কিনা জানা সম্ভব নয়। তবে এটা ঠিক যে গণ্ডার মারা রাইফেলের মার খেলে যে কোনও মানুষ কিমা হয়ে যাবে, কারণ তা চারশো বোরের বা তার চেয়েও হেভি বোরের রাইফেলই হবে। আর লাইট বোরের রাইফেল দিয়ে মারলে মানুষ মরবে অবশ্যই তবে ছেদড়ে-ভেদড়ে যাবে না।

ওরা তিনজন কথা বলতে বলতে নৌকোর দিকে এগোতে লাগল। তাদের দেখে মনে হচ্ছিল যে তারা খুব খুশি। কে জানে! হয়তো খিচুড়ি আর চিতল মাছের পেটি ভাজা খেয়ে ওরা আজ রাতেই নৌকো ভাসাবে। কোন দিকে যাবে কে জানে! উজানে না ভাটিতে। নাকি রাতে ভাল করে ঘুমিয়ে ভোররাতে অন্ধকার থাকতে থাকতে রওনা হবে। হয়তো তাও নয়, ওরা আরও কিছু দিন থাকবে হয়তো এখানেই। যে লোক তিনটে নৌকোর দিকে যাচ্ছিল তাদের দু’জনের পরনে লুঙ্গি আর আরেকজনের পরনে জিনসের প্যান্ট। সে বড় বড় টানে সিগারেট খাচ্ছিল। তার সিগারেটের আগুন মাঝে মাঝে টান দেওয়ার সময়ে জোর হচ্ছিল। এদের মধ্যেই একজন মোটকা গোগোই, কিন্তু তিনজনেই রোগা-সোগা। মোটা কেউই নয়। এ কী রসিকতা কে জানে।

ওরা ছোট নৌকোটার কাছে পৌঁছে নদীর জলে ভাল করে হাত ধুয়ে নিল। নদীর ওপর দিয়ে চৈতি হাওয়া বইছে জলের গন্ধ নিয়ে, তারপর হাওয়াটা ডাঙায় পৌঁছোতেই জলজ গন্ধের সঙ্গে বনজ গন্ধ মিশে যাচ্ছে। ওরা বড় নৌকোটার দিকে চেয়ে কী সব বলাবলি করছিল। বড় নৌকোর মধ্যে আরও কেউ নেই তো? কে জানে।

নাঃ। বড় নৌকো থেকে আর কেউ তো বাইরে বেরিয়ে এল না।

 ওই তিনজন লোক ছোট নৌকোর পাটাতনে বসল। ওদের স্টেনলেস স্টিলের থালাগুলো চাঁদের আলোয় চকচক করছিল। যে রান্না করছিল সে বোধহয় খিদমদগার। কারণ, সে নিজে না খেয়ে ওদের খাবার পরিবেশন করছিল। সম্ভবত পরে খাবে সে। যে লোকটার হাতে রাইফেল ছিল সে রাইফেলটাকে ছোট নৌকোর গলুইয়ের ওপরে হেলান দিয়ে রেখেছিল।

আমি এবারে আস্তে আস্তে উঠে বসলাম। ওরা, মনোযোগ দিয়ে খাচ্ছিল। খাওয়া যখন হয়ে গেছে তখন আমি ব্যাঙের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে একটু দম নিয়ে রাইফেল হাতে উঠে দাঁড়ালাম। আর দাঁড়ানোমাত্র রাঁধুনি, যে আমার দিকেই মুখ করে বসেছিল, উত্তেজিত হয়ে কী একটা বলেই আমার দিকে আঙুল দিয়ে দেখাল। আর দেখানোর সঙ্গে সঙ্গেই যে লোকটা রাইফেল নিয়ে এসেছিল সে খাওয়া ফেলে এঁটো হাতেই রাইফেলটার দিকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে হাত বাড়াল। আর দেরি করা যায় না। আমি সঙ্গে সঙ্গে গুলি করলাম লোকটাকে।

রাতের বেলা এবং চাঁদনি রাতে তো অবশ্যই বন্দুক দিয়ে মারাটা একটুও অসুবিধের নয়। কিন্তু রাইফেলের ব্যারেলের ব্যাক সাইট এবং ফ্রন্ট সাইটে আলো না পেলে রাইফেল দিয়ে মারতে রাতে খুবই অসুবিধা হয়। গুলি হয়তো লাগে, কিন্তু জায়গামতো লাগে না।

গুলি করতেই লোকটা পড়ে গেল। তার রাইফেলটা নেওয়ার জন্য অন্য একজন দৌড়ে যেতেই আমি তাকেও গুলি করলাম। তার পা লক্ষ করে। প্রথমজনের কোথায় গুলিটা ঠিক লেগেছিল জানি না। আরেকজন লোক আমি গুলি করার সঙ্গে সঙ্গে খাওয়া ফেলে এক ডিগবাজি দিয়ে ঝপাং করে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তাকে আর দেখা গেল না।

যে লোকটা পরিবেশন করছিল সে আমাকে উদ্দেশ করে যা বলল, তার মানে হল বড্ড খিদে লেগেছে। সে বলতে চাইছে যে খেয়েনি আগে, তারপরে মামলাটা কী হল বোঝা যাবে এখন।

আমি ততক্ষণে এগিয়ে যেতে যেতে ওদের বলেছি, হ্যান্ডস আপ। দু’জন গুলি খাওয়া লোকই দু’হাত ওপরে তুলল। বুঝলাম যে তাদের বুকে-পেটে লাগেনি সম্ভবত গুলি। কিন্তু যে খাবার খাচ্ছিল সে খেয়েই যেতে লাগল হাত না তুলে। আমি তার মাথার এক হাত ওপর দিয়ে একটা গুলি চালিয়ে দিতেই নোকটা আতঙ্কেই উলটে পড়ে গেল। তখন আমার দয়া হল। আফটার অল আমি এবং সে দু’জনেই খিচুড়ি আর চিতল মাছের ভক্ত–তা ছাড়া যে মানুষ মৃত্যুকে উপেক্ষা করেও খেতে পারে তার খিদেটা নিশ্চয়ই মারাত্মক বেশি। আমি বললাম, ঠিক আছে। তুমি খাইতে পারো। আর গুলি করুম না। তারপরে তুমি রাইফেলটারে ছুঁইড়্যা আমারে দ্যাও। সাবধানে। ট্রিগারে যদি হাত দিছ মুণ্ডুটারে কিমা বানাইয়া দিমু অনে।

লোকটা কী বুঝল জানি না, কিন্তু উঠে গিয়ে রাইফেলটার নল ধরে জোরে আমার দিকে ছুঁড়ে দিল। তার রাইফেল ধরার কায়দা দেখেই বুঝলাম যে জীবনে সে রাইফেলে হাত দেয়নি। রাইফেলটা আমার পায়ের কাছে পা দিয়ে ঠেলে সরিয়ে রেখে তাকে বললাম, খাও এখনে, খাইয়্যা লও পেট ভইর্যা। তারপর মনে পড়ে গেল, ‘পালিয়ে যান’ যদি অহমিয়াতে পলাউক হয় তবে ‘খান’ হতেও পারে খাউক। তাই আমি তাকে বললাম, খাউক। লোকটা হয়তো গুলি খেলেও অত অবাক হত না এমনভাবে আমার দিকে তাকাল। অন্য দু’জনকেও বললাম, তোমরাও খাইতে পারো। কিন্তু তারা খেল তো নাই, সেই রাঁধুনিকে যাতা গালাগালি করতে লাগল।

আমার রাইফেলের নলটা ওদের দিকে রেখে ডানহাতে রাইফেলটাকে হোন্ড করে পকেট থেকে ওয়াকিটকিটা বের করে সুইচ টিপে বললাম, মোটকা। মোটকা। হ্যালো মোটকা। তখুনি দেখি যে লোকটার হাতে রাইফেল ছিল সে নড়ে-চড়ে উঠল, প্রতিবাদ করার ভঙ্গিতে। বুঝলাম যে সে তাহলে মোটকা গোগোই নয়।

কন্ট্রোল থেকে সাড়া পেয়ে যা বলার বললাম। আমার হাতঘড়ির সঙ্গে যে। কম্পাস ছিল তা থেকেও জায়গাটার বিবরণ ও কাজিরাঙার রেঞ্জ অফিস থেকে কোন দিকে হবে তা বলে দিলাম। পুলিশকে খবর দিয়ে সঙ্গে নিয়ে আসতে বললাম। বললাম, ডাক্তারও যেন নিয়ে আসে ওষুধ, ইঞ্জেকশন ইত্যাদি সব সঙ্গে নিয়ে। তিনজন ইনজিওর্ড মানুষ এখানে। তারপর ঋজুদাকে ওয়াকিটকিতে বললাম যা বলার। ডিরেকশনও দিলাম।

ঋজুদা বলল, খুব সাবধান।

কেন?

যে লোকটা নদীতে ঝাঁপাল সে নিশ্চয় সাঁতরে ডাঙাতে উঠে যাবে। আমার মনে হচ্ছে ও-ই মোটকা গোগোই। নইলে অত হুশিয়ার হত না। মাত্র একটা রাইফেল যখন ওদের কাছে দেখেছিস অন্য অস্ত্র-শস্ত্র নিশ্চয়ই কাঠোনির মাচা-টাচাতে রাখা আছে। সেই অস্ত্র নিয়ে সে এসে তার সঙ্গীদের তো উদ্ধার করবেই, তোকেও অবশ্যই মারবে।

আমি ইংরেজিতে বললাম, তুমি ভেবো না। আমি কাঠোনির দিকে তাকিয়ে থাকছি।

ঋজুদা বলল, তুই একটা নম্বরী গাধা। ও যে ওই দিক দিয়েই আসবে তার কী মানে আছে! তোর ডানদিক-বাঁদিক দিয়েও আসতে পারে। রাইফেল উঁচু করে ধরে সাঁতরেও আসতে পারে তোর পেছন দিক দিয়ে।

বুঝেছি।

 আমি বললাম।

তারপর ভটকাইকেও ধরলাম ওয়াকিটকির বোতাম টিপে।

 ও বলল, কী রে খোকা, খবর কী?

 ভারিক্কি গলায় বললাম, বাঁদরামো না করে ডিরেকশনটা ভাল করে বুঝে নে, তারপর তাড়াতাড়ি চলে আয়। তোর জন্যে ভাজা মুগডালের গাওয়া ঘি জবজবে খিচুড়ি আর চিতল মাছের পেটি ভাজা অপেক্ষা করছে।

ভটকাই বলল, স্বপ্নেই যখন বিরিয়ানি রাঁধছিস তখন ঘি ঢালতে কঞ্জুষিই বা করবি কেন?

আমি বললাম, সত্যি বলছি। এসেই দ্যাখ।

 কামিং। বলে ভটকাই ডিসকানেক্ট করে দিল ওয়াকিটকি।

আমি ওদের তিনজনকে নৌকো থেকে নেমে এসে ফাঁকা জায়গাতে আমার দিকে পিছন ফিরে ঘাসবনের দিকে মুখ করে হাত ওপরে তুলে দাঁড়িয়ে থাকতে বললাম। যার উরুতে গুলি লেগেছিল তার পক্ষে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব ছিল না। তাকে বসার অনুমতি দিলাম। আর আমি রাইফেলের নল ওদের দিকে করে নৌকোর গলুইয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। ঘড়িতে দেখলাম রাত দশটা। প্রথম দিনই অপারেশন সাকসেসফুল হওয়াতে এবং আমিই হিরো বনে যাওয়াতে মনে মনে একটু খুশিই হলাম। এখন ঋজুদা, ফরেস্টের লোকেরা, পুলিশ সব কখন আসে সেই হচ্ছে কথা। যাদের ধন তাদের হাতে এদের সঁপে দিলেই আমাদের ছুটি। কাজিরাঙা লজে গিয়ে ঘুম লাগাব, একেবারে আগামীকাল দশটাতে উঠব সকালে।

রাঁধুনির কিন্তু শেষ পর্যন্ত খাওয়া হয়নি। তার সঙ্গীরা তাকে এমনই গালাগাল করেছিল যে বেচারির পক্ষে খাওয়া আর সম্ভবই হয়নি। মানুষটা বড় গরিব। চেহারা দেখলেই বোঝা যায়। এরা সকলেই গরিব। গুলি খাবে, জেল খাটবে, হাত-পা কাটা যাবে সার্জেনের ছুরিতে এদেরই, আর ওরা যাদের হয়ে এসব করছে দুটো পেটের ভাতের জন্যে, তাদের নাগাল পাবে না আইন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কমলাকান্তের দপ্তরে সেই লিখে গেছিলেন না যে আইন একটা তামাশামাত্র। বড়লোকেরাই পয়সা খরচ করিয়া সে তামাশা দেখিতে পারে’– সেই কথা এতদিন পরেও সত্যি আমাদের দেশে। এ বড় দুঃখের কথা।

অনেকক্ষণ হয়ে গেছে। ঘড়িও দেখিনি বহুক্ষণ। একটা জিপের আওয়াজ শোনা গেল যেন মনে হল। ঘড়িতে তখন বারোটা বেজে দশ। তার আগেই ঋজুদা যেন মাটি খুঁড়ে বেরোল লোকগুলোর বিস্ফারিত চোখের সামনে। তারপর আমার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল, কনগ্রাচুলেশনস রুদ্র। ফরেস্টের লোকজন এলেই খড়ঙ্গগুলো খুঁজে বের করবে। বামাল ধরতে না পারলে অসুবিধে হবে অনেক।

আমি বললাম, মরা গণ্ডারই তো যথেষ্ট প্রমাণ।

ঋজুদা ওই তিনজনকে পেরিয়ে যে নৌকোতে ভর দিয়ে আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম সেদিকে এগিয়ে এল এবং তারপরই কোথা থেকে কী হয়ে গেল এক ঝটকায় নিজের রাইফেলটা তুলে নিয়েই ঋজুদা আমাকে গুলি করল এবং সঙ্গে সঙ্গে আমার বাঁপাশে জলের ওপর থেকে একটা গুলির আওয়াজ। কী যেন একটা গরম ছ্যাঁকা দিল, কী যেন একটা বেঁধালো কে আমার বাঁ কাঁধে, ধাক্কা দিল জোর। আমি পড়ে গেলাম নৌকোর ওপরে। ঋজুদার গুলি আমার লাগেনি, জলের মধ্যে গিয়ে পড়েছিল এবং যেখানে পড়েছিল সেখান থেকে একজন লোক হ্যাঁচোর-প্যাঁচোর করতে করতে জল থেকে ডাঙায় উঠেই পড়ে গেল মাটিতে। তার মুখ দিয়ে ঝলক ঝলক রক্ত বেরোতে লাগল। একবার খুব জোরে নড়ে উঠেই লোকটা স্থির হয়ে গেল। ইতিমধ্যে সেই রাঁধুনি গোলমালে তালেগোলে দৌড় লাগাল কাঠোনির দিকে আর সঙ্গে সঙ্গে ঋজুদার রাইফেলের গুলি গিয়ে পড়ল তার পায়ের পেছনে, মাটিতে। ভয় পাওয়াবার জন্যেই গুলিটা করেছিল ঋজুদা। এবং ভয় সে অবশ্যই পেয়েছিল। ভয় পেয়ে এক লাফে অনেকটা ওপরে উঠেই সে আবার ফিরে এসে যেখানে ছিল সেখানেই দাঁড়াল দু’হাত ওপরে তুলে লক্ষ্মী ছেলের মতো।

আমি বললাম, ভাগ্যিস তুমি দেখেছিলে ঋজুদা।

সবই ভাগ্যিস। জোর বেঁচে গেছিস এযাত্রা। আর দু’ইঞ্চির জন্য তোর হার্টটা বেঁচে গেছে। কী রাইফেল ছিল মোটার হাতে কে জানে। মনে হয় থ্রি ফিফটিন। হেভি রাইফেল হলে তুই এতক্ষণে শেষ হয়ে যেতিস।

তার রাইফেল তো এখন ব্রহ্মপুত্রের তলায়। কী রাইফেল ছিল তা এখন জানার উপায় নেই।

ঋজুদা নিজেই বলল। তারপর ওয়াকিটকিতে রেঞ্জ অফিসের সঙ্গে কথা বলল। বলল, এখুনি একটা হেলিকপ্টার দরকার। ইনজিওর্ডদের হাসপাতালে নেওয়া দরকার। আর্মির হেলিকপ্টার আছে গুয়াহাটি এবং ডিমাপুরেও। কনজার্ভেটর জেনারেল এবং ফরেস্ট মিনিস্টারের সঙ্গে কথা বলতে বলল।

ঋজুদার কথা শেষ হতে না হতেই ভূটকাইচন্দ্র এবং তাগা মেচ এসে পৌঁছল। নৌকোর পাটাতনে শুয়ে শুয়ে দেখলাম আমি। তাদের পেছন পেছন রেঞ্জ অফিসের জিপও এল।

ঋজুদা বলল, ভটকাই, তুই আর তাগা এখানে থাক। আমি এই জিপে গিয়ে আমাদের বোলেরোটা নিয়ে আসি। এত লোকে নইলে যাওয়া হবে কী করে। তা ছাড়া ফাস্ট-এইড বক্সটাও আছে সেখানে। এখুনি দরকার।

জিপের ড্রাইভার জিপটা ঘোরাতেই ঋজুদা তাতে উঠে পড়ল। ভটকাই বলল, তোমাকে কী বলেছিলাম?

ঋজুদা বিরক্ত হয়ে বলল, কী?

নিজে না মরতে রাজি থাকলে কাউকেই মারা যায় না।

ঋজুদা একটু বিরক্তির সঙ্গেই বলল, ঠিক। গৌতম বুদ্ধের পরে তোর মতো জ্ঞানী আর কেউ হননি ভারতবর্ষে।

ঋজুদা চলে গেলে ভটকাই আমার কাছে এসে বলল, যা রক্ত বেরোচ্ছে তাতে তাড়াতাড়ি কিছু একটা করতে না পারলে…

বললাম, সব ঠিক হয়ে যাবে। চিন্তা করিস না। ঋজুদা লোকটাকে সময়মতো না মারলে গুলি আমার হার্টে লাগত। তোর সঙ্গে এ জন্মে আর কথা বলা যেত না। তখন যখন মরিনি, আর এ যাত্রায় মরছি না।

কী যে বলিস।

ভটকাই বলল।

ওর দু’চোখ জলে ভরে গেছিল আমার অবস্থা দেখে।

 তাগা মেচ মৃত লোকটাকে দেখে বলল, আরে এই তো মোটকা গোগোই। কী মোটা দেখলেন স্যার।

তুমি চিনলে কী করে?

 আমাগো অফিসে ফোটো আছে না। তাই দেখছি।

ভটকাই বলল, আশ্চর্য। এত মোটা মানুষ এত ফিট হয় কী করে।

আমার জ্ঞান আস্তে আস্তে চলে যাচ্ছিল। আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। মোটকা গোগোই আর তার দুজন গুলি-খাওয়া সঙ্গীর জন্যেও খুবই কষ্ট হচ্ছিল। রাঁধুনির সম্ভবত হবে না কিছু। অল্প-স্বল্পেই ছাড়া পাবে। কিন্তু বাড়ি ফিরে তো আর জবজবে করে ঘি-ঢালা মুগের ডালের খিচুড়ি আর চিতলের পেটি ভাজা খেতে পারবে না। শুধু দু’মুঠো পেটের ভাতের জন্যে মানুষ কত এবং কতরকম কষ্টই না করে। নানারকম অন্যায়ও করে। শুধু তাই নয়, প্রাণও দিয়ে দেয়। বাজে। বাজে। বাজে।

এবারে আমি ঘুমোব। আমার মুখের ওপরে ঝুঁকে পড়া ভটকাইয়ের উদ্বিগ্ন মুখটা ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসতে লাগল।

আমি…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *