হীরা ঝিলের গহ্বরে

হীরা ঝিলের গহ্বরে –১৩৬

রহমান হন্তদন্ত দরবার কক্ষে প্রবেশ করলো। গুহার চার পাশে চারটি মশাল দপ দপ করে জ্বলছে। মশালের আলোতে গোটা গুহা লালে লাল মনে হচ্ছে। বনহুরের মুখমন্ডল রক্তাভ লাগছে। মাথার পাগড়ী পাশের আসনের উপর রক্ষিত। পাগড়ীর পাশে রিভলভার।

রহমান কুর্নিশ জানিয়ে বললোসর্দার, হিরোইন চোরাচালান-কারী সেকেন্দার শাহ ধরা পড়েছে। মালামালসহ সে বিমান বন্দরে যাওয়ার সময় আমাদের লোক তাকে গাড়িসহ আটক করেছে।

কোথায় সে? বললো বনহুর, তার চোখ দুটো যেন জ্বলে উঠলো।

এখানে আনা হয়েছে। তার সঙ্গীদ্বয়কে আস্তানার বন্দীশালায় বন্দী করে রাখা হয়েছে।

নিয়ে এসো। বললো বনহুর।

রহমান বেরিয়ে গেলো এবং একটু পরেই চোখ বাঁধা অবস্থায় সেকেন্দার শাহকে নিয়ে এলো দরবার কক্ষে। তার হাতে হাত কড়া, মাজায় দড়ি! বনহুরের চারজন অনুচর তার দুই পাশে, তাদের হাতেও রাইফেল। হিরোইনের বাক্সটাও উপস্থিত করা হলো।

বনহুর বললো—-মুক্ত করে দাও ওর চোখ দুটো।

 সর্দারের আদেশ পেয়ে রহমান মুক্ত করে দিলো সেকেন্দার শাহর চোখের বন্ধন।

চোখ দুটো মুক্ত হতেই সেকেন্দার শাহ বিস্ময় নিয়ে তাকালো। বহু জায়গা সে দেখেছে, কিন্তু এমন জায়গা সে কখনও দেখেনি। দেখেনি এমন পোষাক পরা এমন লোক। সমস্ত গুহা লালচে আলোতে আলোকিত। জমকালো পোষাক পরিহিত বনহুরের পোষাক সেই আলোতে অতীব আশ্চর্য অদ্ভুত লাগছিলো। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তাকাচ্ছে সেকেন্দার শাহ। ভীত ফ্যাকাশে তার মুখমন্ডল।

বনহুর তাকে লক্ষ্য করে বললো–কতদিন হলো আপনি এ ব্যবসায় নিয়োজিত আছেন? সত্যি কথা বলবেন, একচুল মিথ্যা বললে……বনহুর পাশের আসন থেকে রিভলভারখানা তুলে নিলো হাতে, তারপর আবার বললো সে এবং কোন কোন দেশে আপনি এ ব্যবসার শাখা খুলেছেন?

বললো সেকেন্দার শাহ—অনেক দিন হলো। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আমার এ ব্যবসার শাখা আছে। আমার এ ব্যবসায় তোমার কি ক্ষতি যার জন্য আমাকে এ ভাবে নাজেহাল করছে……

দাতে দাঁত পিষে বললো বনহুর। ক্ষতি আমার কিছু নয়, ক্ষতি করতেও পারবে না। তুমি করছো দেশ ও দেশের জনগণের সর্বনাশ। পৃথিবীময় ছড়িয়ে দিচ্ছো অভিশাপ। তুমি এ ব্যবসা করে লুটে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা।

বললো সেকেন্দার শাহ–হাঁ, তুমিও আমার পার্টনার হিসাবে থাকতে পারো।

ভাল যুক্তি তুমি আমাকে দিচ্ছে মিঃ শাহ। আর সেই কারণেই আমি তোমাকে এনেছি এখানে। বলল তোমার পার্টনার হতে গেলে আমাকে কি করতে হবে?

ফরমে চুক্তিপত্র হবে। এ ফরম আমার কোম্পানীর কাজেই……পাকা দলিল হবে তোমার সঙ্গে।

বেশ তো, আমি রাজি। বললো বনহুর।

বললো সেকেন্দার শাহ–তবে নিয়ে চল আমাকে। আমিই এ ব্যবস্থা করবো।

কিন্তু তোমার সহকারীগণ তাতে রাজি হবে?

আমি, আমি মত করলে সবাই একমত হবে।

কত টাকা শেয়ার দিতে হবে।

 বেশি নয়, পঞ্চাশ লক্ষ টাকা।

হাঁ, রাজি। বললো বনহুর।

এতক্ষণে সেকেন্দার শাহর মুখ কিছুটা প্রসন্ন হলো।

বনহুর বললো–সেকেন্দার শাহ! তুমি এখানে থাকবে, যতক্ষণ না আমি তোমার অফিস থেকে ফিরে আসবো ততক্ষণ……

তা কি করে সম্ভব।

হাঁ, সম্ভব হবে, তুমি তোমার অফিসের ঠিকানা বলে দাও এবং তোমার হেড ম্যানেজারের কাছে চিঠি লিখে দাও। আমাকে যেন সে ফরম দিয়ে দেয়।

সেকেন্দার শাহ বললো—সে স্থান বড় দুর্গম। আমি এবং আমার লোক ছাড়া কেউ সে পথের সন্ধান পাবে না।

তবে কি করে তুমি আমাকে তোমাদের পার্টনার করে নিতে চাও?

আমার কোন পার্টনার আজও জানে না কোথায় আমার অফিস।

তুমি বড় বুদ্ধিমান সেকেন্দার শাহ!

না হলে এ দুনিয়ায় স্বনামধন্য ব্যক্তি হওয়া যায় না। আমার পার্টনারগণ সবাই ধনকুবেরু, শুধু ঐশ্বর্যবানই নয়, তারা দেশের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। তারা অর্থের বিনিময়ে সুনাম যশ হাতের মুঠায় করেছে। আমি তোমাকেও তেমনি বানাবো। যদি তুমি আমাকে মুক্তি দাও এবং আমার সঙ্গে হাত মিলাও।

হাঁ, সব হবে। যদি তুমি তোমার গোপন অফিসের সঠিক ঠিকানা দাও।

না, তা হবে না।

সত্যি বলছো?

আমি এবং আমার লোকেরা জীবন দেবে, তবুও আমার অফিসের সন্ধান কেউ দেবে না বা পাবে না!

তোমাকে দিতে হবে সেই ঠিকানা।

না, তা হবে না। বললো সেকেন্দার শাহ।

বনহুর বললো–রহমান!

সর্দার! রহমান সোজা হয়ে ফিরে দাঁড়ালো।

 বললো বনহুর–এর সঙ্গীদের হাজির করো।

আচ্ছা সর্দার। চলে গেলো রহমান।

কিছুক্ষণের মধ্যেই সেকেন্দার শাহর সহচরদ্বয়কে হাজির করা হলো। তাদের চোখেও কালো পট্টি আঁটা।

বনহুর বললো—-খুলে দাও এদের চোখের আবরণ।

সর্দারের আদেশ পালন করলো দু’জন অনুচর।

ভীত কম্পিত-দৃষ্টি নিয়ে তাকালো ওরা বনহুরের দিকে। তার জমকালো পোশাক এবং গুহামধ্যে লালচে আলো গুহাটাকে আরও ভয়াবহ করে তুলেছে, ওদের মুখমন্ডল বিবর্ণ রক্ত শূন্য হয়ে পড়লো। তাকিয়ে তাকিয়ে বেতস পত্রের মত কাঁপতে লাগলো সেকেন্দার শাহের সঙ্গীদ্বয়।

বনহুর কঠিন কণ্ঠে বললো—তোমরা হিরোইন গুদামের এবং সেকেন্দার শাহর অফিসের পথ বলো! যেখানে কোটি কোটি টাকার হিরোইন মজুত আছে।

না, আমরা চিনি না। বললো একজন।

 দাঁত পিষে বললো বনহুর চেনো না।

উভয়েই তাকালো মালিক সেকেন্দার শাহর মুখের দিকে।

সেকেন্দার শাহই জবাব দিলো–ওরা জানে না সে পথ, ঠিকানাও ওরা জানে না।

সত্যি কথা জানো না তোমরা তবে…রিভলভার উদ্যত করে একটি লোককে গুলীবিদ্ধ করলো বনহুর।

সঙ্গে সঙ্গে তীব্র আর্তনাদ করে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো লোকটা। গুহার পাথুরে মেঝে তাজা রক্তে রাঙা হয়ে উঠলো। কিছুক্ষণ ছট ফট করে স্থির হয়ে গেলো লোকটা।

অপর জনের দিকে রিভলভার ফিরিয়ে নিতেই লোকটা ভীত স্বরে বলে উঠলো—মেরো না, আমি বলছি। হীরা ঝিলের অভ্যন্তরে দক্ষিণ পাশে একটি সুড়ঙ্গ পথ…কথা শেষ হয় না লোকটার, সেকেন্দার শাহ প্রচন্ড একটি লাথি মারলো লোকটার দেহে। লোকটা হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলো। সেকেন্দার শাহ একখানা পা লোকটার গলার উপরে তুলে দিয়ে ভীষণ জোরে চাপ দিলো।

সঙ্গে সঙ্গে বনহুরের গুলী এসে বিদ্ধ হলো সেকেন্দার শাহর পায়ে।

 পড়ে গেলো সেকেন্দার শাহ, পা দিয়ে রক্ত ঝরতে লাগলো তার।

লোকটার মুখ থেকে জিভটা বেরিয়ে এসেছিলো সেকেন্দার শাহর পায়ের চাপে। জিভটার সঙ্গে ফেনাযুক্ত রক্তও গড়িয়ে পড়ছিলো।

বনহুর রহমানকে বললো—দেখো ওর অবস্থা……

রহমান লোকটাকে তুলে উঁচু করে বসাতে গেলো, কিন্তু পারলো না, ঢলে পড়লো লোকটা রহমানের হাতের উপর। বললো রহমান–সর্দার সেকেন্দার শাহ ওকে যখম করে দিয়েছে।

বনহুর এবার সেকেন্দার শাহর বুক লক্ষ্য করে রিভলভার উদ্যত করতেই বলে উঠলো সেকেন্দার শাহ-আমাকে মেরো না, ঠিকানা যখন পেয়েই গেছো, তখন আমিই তোমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবো।…

*

হিং হিং ছট হিং হিং ছট……অদ্ভুত একটা শব্দ ভেসে আসছে বনহুরের কানে।

অশ্বপৃষ্ঠ থেকে নেমে দাঁড়ালো বনহুর।

চারদিকে জমাট অন্ধকার।

তাজের দেহটা যেন মিশে গেছে রাত্রির অন্ধকারে একাকার হয়ে। বনহুরের শরীরেও জমকালো ড্রেস, কাজেই তার চেহারাও দেখা যাচ্ছে না। ছায়ার মত অথচ দ্রুত এগুচ্ছে বনহুর সেই অদ্ভুত শব্দ লক্ষ্য করে। কিছুটা এগুতেই বনহুর দেখলো, একটা লোক হীরাঝিলের পথের ধারে বসে অদ্ভুত ধরনের শব্দ করছে। বনহুর বুঝতে পারলো, লোকটা হিরোইন ব্যবহারী এবং নেশাগ্রস্থ হয়ে সে এমনভাবে উৎকট শব্দ করছে।

পাশে এসে তার কাঁধে হাত রাখলো।

লোকটা অন্ধকারে ফিরে তাকালো, তার নেশাগ্রস্থ চোখে হয়তো সে তার কোন বন্ধুকে মনে করলো। বললো সে, হারুনাথ এসেছিস? বড় দেরী করে ফেলেছিস রে? সদর গেট বন্ধ হয়ে গেছে, মাল আর বেরুবে না। কিরে। চুপ করে আছিস কেনো? বস, দেখি কাউকে পাই কিনা। আমার চেনা আছে কোন্ পথে প্রবেশ করতে হয়……

বনহুর তবুও নীরব, বসলো ওর পাশে, কিন্তু বেশ দূরত্ব রেখেই বসলো সে, যেন লোকটা তাকে চিনতে না পারে।

পাশে বসতেই লোকটা উঠে দাঁড়ালো, বললো—আমি যাচ্ছি, হারুনাথ তুই চুপ করে বসে থাকবি। আমি কিছু মাল নিয়েই চলে আসবো। চলে গেলো লোকটা।

বনহুর কিন্তু চুপ চাপ বসে রইল না, সে উঠে এগিয়ে এলো। তাজের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললো–অপেক্ষা করবি। তারপর লোকটাকে অনুসরণ করলো বনহুর।

লোকটা টলতে টলতে এগুচ্ছে।

 পিছনে জমাট অন্ধকারে বনহুর তাকে লক্ষ করে চলেছে।

হীরা ঝিলের পিছন দিকে অগ্রসর হয়ে একটি ছোট্ট দরজার পাশে এসে দাঁড়ালো। টোকা দিলো বার কয়েক, সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে গেলো। লোকটা ভিতরে প্রবেশ করলো।

বনহুর আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখলো।

লোকটা ভিতরে চলে যেতেই বনহুর এসে দাঁড়ালো, সেও মৃদু আঘাত করলে পর পর! দরজা খুলে গেলো, সম্মুখে দাঁড়ালো ব্যক্তিটির কণ্ঠ দিয়ে কোন শব্দ বের হবার সঙ্গে সঙ্গে বনহুর তার মুখ চেপে ধরে একটি মুষ্ঠিঘাত করলো তার মাথায়। লোকটার সংজ্ঞা তৎক্ষণাৎ লুপ্ত হলো। ঢলে পড়লো সে দরজার পাশে।

বনহুর লোকটাকে দরজার এক পাশে আড়ালে সরিয়ে রেখে এগুলো। হীরাঝিলের সম্মুখ ভাগে গভীর মাটির তলায় ছিলো আহসান হাবীবের গোপন আড্ডাখানা। যেখানে কান্দাই অসৎ ব্যবসায়ীদের ঘাঁটি ছিলো। সেটা আজ সমূলে ধ্বংস প্রাপ্ত। বনহুর ভাবতেও পারেনি হীরাঝিলের তলদেশের পিছন অংশে এমন একটি গোপন স্থান আছে–যেখানে অতি স্বচ্ছন্দে হিরোইন ব্যবসায়ী সেকেন্দার শাহ তার হিরোইন রক্ষণাবেক্ষণের গুপ্ত স্থান করে নিয়েছে।

কিছুটা এগুনোর পর তার কানে এলো একটি কর্কশ কণ্ঠস্বর। জামশেদ, কি করে সেকেন্দার শাহ নিজে ধরা পড়লো? তাকে ভেবেছিলাম সে বুদ্ধিমান। তোমরা প্রস্তুত থেকো, আমি বনহুরকে শায়েস্তা করবো এবং সেকেন্দার শাহকে উদ্ধার করে আনবো। জানে না বনহুর আমার দল সর্বত্র ছড়িয়ে আছে।

বনহুর আরও এগুলো।

ছোট্ট একটি পর্বতমালা যেন মাটির নিচে। কোথা থেকে কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। ছোট ছোট টিপি আর পাথরের স্তর, স্থানে স্থানে বড় বড় ছিদ্রপথ! জায়গাটা বহুপূর্বের তা বেশ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। বনহুর এ পথ সে পথ করে পাথরের টিলা গুলির আড়ালে আত্মগোপন করে এগুতে লাগলো। আবার সেই কণ্ঠস্বর বনহুর এবার রেহাই পাবে না। সেকেন্দার শাহকে আমি উদ্ধার করে আনবোই।

বনহুর কাছাকাছি এসে পড়েছে।

সে স্পষ্ট দেখতে পেলো একটা সাহেবী পোষাক পরিহিত লোক আরও কয়েকজন গুন্ডা প্রকৃতির লোকের সঙ্গে বসে কথা বার্তা বলছিলো। বনহুর আড়াল থেকে আরও দেখলো তাদের আশে পাশে বেশ কিছু হিরোইনপূর্ণ বাক্স। ঐ বাক্সগুলোতে কম পক্ষে গোটা পৃথিবীর জন্য হিরোইন মজুত রাখা হয়েছে। ওসবের মূল্য কয়েক লক্ষ কোটি হবে।

বনহুর কান পেতে শুনলো এবং তাদের কথা বার্তায় বুঝতে পারলো, যে লোকটা নেতৃত্বের আসনে বসে আছে, সে বিদেশী এবং ব্যবসায়ী। সেকেন্দার শাহর আটক সংবাদ পেয়ে বিমান যোগে এসেছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। লোকটা নিশ্চয়ই কান্দাইবাসী ছিলো এককালে। হিরোইন ব্যবসায় ফেঁপে উঠেছে এবং সে কারণেই বিদেশে ঘাটি করে নিয়েছে। বনহুর বেশ অনুধাবন করে, ওকে খতম করতে পারলেই বিদেশী হিরোইন ব্যবসায় ভাটা পড়বে। যেমন করে হোক, লোকটাকে খতম করা চাই। ওদের পাশে অস্ত্র রয়েছে।

বনহুর আড়ালে আত্নগোপন করে ঠিক ওদের পিছনে এসে দাঁড়ালো। এবার সে স্পষ্ট দেখতে পেলো, যে লোকটা তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছে তাকে হাত পা বেঁধে মাটিতে শুইয়ে রাখা হয়েছে। বনহুর বুঝতে পারলো ঐ লোকটা তাদেরই অনুচর ছিলো, কোন কারণে তাকে বহিস্কার করা হয়েছে। যদিও সে বনহুরকে স্বইচ্ছায় পথ দেখিয়ে আনেনি। বনহুর তাকে অনুসরণ করেই এতদূর পৌঁছেছে। তবুও মায়া হলো তার। বিনা পারমিশনে প্রবেশে ওর অপরাধ হয়েছে এবং সেই কারণেই তাকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে।

বিদেশী লোকটা ইংগিত করলো তার পাশের জনকে।

অমনি পাশের ব্যক্তিটি একটি রিভলভার তুলে নিলো হাতে এবং ভূতল শায়ী ঐ ব্যক্তিটিকে লক্ষ্য করে গুলী ছুঁড়লো।

একটা তীব্র আর্তনাদ করে নীরব হয়ে গেলোলোকটা।

বনহুর ঐ মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়লো তাদের সামনে।

 রিভলভার উদ্যত করে বললো বনহুর–খবরদার নড়বে না।

কে তুমি! বললো সেই বিদেশী লোকটা।

বনহুর বললো—যার নাম তুমি কিছুক্ষণ পূর্বে উচ্চারণ করেছিলে?

 তুমি, তুমি বনহুর! দস্যু বনহুর? বললো সেই লোকটা।

হাঁ, আমিই তোমার আকাংখিত জন।

এখানে কি ভাবে এলে?

যাকে কয়েক সেকেন্ড আগে হত্যা করলে তোমরা।

উঃ! কি নরশয়তান ভাগুয়া নাথ। ওকে হত্যা করে তাহলে ভালই করেছি। এবার তা হলে তোমার পালা।

নরশয়তান সে একা নয়, তোমরাও। বললো বনহুর। একটু থেমে বললোতোমরা রেহাই পাবে না এবার ভাগুয়া নাথের মতই অবস্থা হবে তোমাদের।

বললো আর একজন, আমাদের মালিক সেকেন্দার শাহকে তুমি আটক করেছে। এবার তুমি আমাদের হাতে বন্দী। আমরা জানতে পেরেছি তুমি সেকেন্দার শাহর কাছে আমাদের ঠিকানা জানার জন্য তাকে হত্যার হুমকি দিয়েছে।

হঠাৎ অট্টহাসি হেসে উঠলো বনহুর। তার হাসির শব্দ হীরাঝিলের তলদেশ প্রকম্পিত হলো।

বিস্ময় ঝরে পড়ছে ওদের চোখে মুখে। এমন হাসি তারা শোনেনি কোনদিন। বনহুরের হাতে উদ্যত রিভলভারটার দিকে তাদের সবার দৃষ্টি। কোন রকমে একবার ওর হাতখানা অন্যদিকে ফেরাতে পারলেই তারা আক্রমণ করবে তাকে।

এমন সময় পিছন থেকে একজন বনহুরের উপর লাফিয়ে পড়লো।

 বনহুরকে সে একটুও নড়াতে পারলো না।

বরং বনহুর ঝাপটে ধরে ফেললো একজনকে। এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে গুলী ছুঁড়লো তার মাথায়। সঙ্গে সঙ্গে ধাক্কা দিয়ে তাকে ফেলে দিয়ে অপর জনকে লক্ষ্য করে গুলী ছুঁড়লো।

যার মাথায় গুলী বিদ্ধ হয়েছিলো সে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো এবং নীরব হয়ে গেলো তার দেহটা।

অপর জনের বুকে গুলী বিদ্ধ হওয়ায় সে তীব্র আর্তনাদ করে চীৎ হয়ে পড়ে গেলো।

বনহুর বললোনর শয়তান দল, তোমাদের একটিকেও আমি জীবিত রাখবো না। তোমাদের হিরোইন ব্যবসা নিধন করে দেবো। তোমরা শুধু কান্দাই জনগণের সর্বনাশ করছো না, করছো সারা দুনিয়ার সর্বনাশ।

দু’জন নিহত হবার সঙ্গে সঙ্গে অপর ব্যক্তি গুলো বেশ ঘাবড়ে গেছে বলে মনে হলো, কিন্তু সেই বিদেশী লোকটা চোখে মুখে ফুটে উঠেছে একটা তীব্র হিংস্র ভাব। সে ভীষণভাবে আক্রমণ করলো বনহুরকে। বনহুর বামহস্তে ওর গলার কলার চেপে ধরে রিভলভার ধরলো বুক লক্ষ্য করে।

ঐ মুহূর্তে আলখেল্লা পরা একটি লোক ঝাঁপিয়ে পড়লো তাদের সম্মুখে। তার হাতেও রিভলভার, বনহুর কিছু ভাবার পূর্বেই আলখেল্লা পরিহিত ব্যক্তি রিভলভার উদ্যত করে বললো—সাবধান, কেউ একচুল নড়বে না। সঙ্গে সঙ্গে গুলী ছুঁড়বো।

বনহুর কিছুটা অবাক হলো, মুখে মুখোস থাকার জন্য ঠিক বুঝতে পারে না এ কণ্ঠস্বর কার।

বনহুর রিভলভার নামিয়ে নেয়।

 বিদেশী শয়তান লোকটা ঐ সময় সুযোগ নেয়।

আলখেল্লাধারীর রিভলভার সহ হাতখানা চেপে ধরে ঝটকা মারে। কিন্তু রিভলভার ছাড়িয়ে নিতে পারে না, আলখেল্লাধারী তার রিভলভার খানা উঁচু করে গুলী ছোড়ে।

অদূরে দেয়ালে একটি তারকা চিহ্ন ছিলো।

আলখেল্লাধারীর রিভলভারের গুলী গিয়ে বিদ্ধ হলো সেই তারকা চিহ্ন মধ্যে। সঙ্গে সঙ্গে একটি গোলাকার সুড়ঙ্গ মুখ বেরিয়ে এলো ঐ দেয়ালের নিচের অংশে।

এবার ভীষণ ধস্তাধস্তি শুরু হলো আলখেল্লাধারী আর বিদেশী লোকটার সঙ্গে। অন্যান্য লোক যারা বিদেশীর সঙ্গে কিছুপূর্বে আলাপ আলোচনায় রত ছিলো তারা আক্রমণ করলো জমকালো পোষাক পরিহিত বনহুরকে! বনহুর বিদেশী ব্যক্তির বুক লক্ষ্য করে গুলী ছুঁড়লো– তাকে হত্যা না করলে সে পালাবে তাতে কোন ভুল নেই।

কিন্তু বনহুর আশ্চর্য হলো, বিদেশী বেশধারী ব্যক্তির বুক থেকে রক্ত ঝরলো না। ঐ সময় একটা ধূম্ররাশি ছড়িয়ে পড়লো। সমস্ত কক্ষ মধ্যে ধূমরাশি ছড়িয়ে পড়ায় আর কিছু নজরে পড়লো না।

বনহুর বুঝতে পারলো এই ধূমরাশি সৃষ্টি করার পিছনে এদের একটি কৌশল আছে এবং শয়তান দল নিশ্চয়ই তাদের দৃষ্টির আড়ালে চলে গেছে।

কিছুক্ষণের মধ্যে ধূমরাশি কমে এলো।

বনহুর অবাক হয়ে দেখলো বিদেশী পোষাকধারী এবং তার দলবল উধাও হয়েছে। বনহুর আরও লক্ষ্য করলো আলখেল্লা পরিহিতও নেই সেখানে।

সম্মুখে তাকিয়ে দেখলো সেই বিস্ময়কর সুড়ঙ্গ মুখ। মেঝেতে পড়ে আছে কয়েকটি রক্তাক্ত লাশ। বনহুর রিভলভার উদ্যত করে দেয়ালে তারকা চিহ্ন নিচের সেই সুড়ঙ্গ মধ্যে প্রবেশ করলো।

অদ্ভুত সে সুড়ঙ্গ পথ।

ধাপে ধাপে করে সিঁড়ি নেমে গেছে আরও গভীরে। বনহুর সেই প্রশস্ত সিঁড়ি পথ বেয়ে নিচে নামতে লাগলো। দু’পাশে পাথুরে দেয়াল। দেয়ালের গায়ে মাঝে মাঝে ছিদ্র পথ পরিলক্ষিত হলো। ঐ পথে বাইরের হাওয়া প্রবেশ করে ভূগর্ভ সুড়ঙ্গ পথটাকে স্বচ্ছ রেখেছে। দেয়াল উঁচু নীচু এবড়ো থেবড়ো, মোটেই মসৃণ নয়। হীরা ঝিলের তলদেশে এ ধরনের সুড়ঙ্গ থাকতে পারে কেউ তা ভাবতে পারবে না। আরও কিছু নিচে নেমে আসার পর হঠাৎ বনহুরের কানে গেলো ভীষণ ধস্তাধস্তির আওয়াজ। মুষ্টি আর মুষ্টিঘাতের শব্দ ছাড়াও গোঁ গোঁ আওয়াজ

বনহুর সাবধানে সিঁড়ির ধাপগুলো অতিক্রম করছে। হাতে তার রিভলভার। রিভলভারটিকে বনহুর সজাগ রেখেছে। লক্ষ তার নিচের দিকে। আরও কয়েক ধাপ নেমে আসার পর বনহুর দেখতে পেলো একটি বৃহদাকার কক্ষ। কক্ষমধ্যে বৈদ্যুতিক আলো জ্বলছে। সবকিছু স্পষ্ট নজরে পড়ছে, কক্ষের চারপাশে নানাধরনের বাক্স সাজানো আছে।

বুঝতে পারলো বনহুর এসব কক্ষে মাদকদ্রব্য বোঝাই রয়েছে। প্রচুর মাদকদ্রব্য গোপনে এখানে আনা হয় এবং এখান থেকে চোরাভাবে দেশ বিদেশে চালান হয়। বনহুর আরও দেখলো বৃহৎ কক্ষটির মেঝেতে আকা বাঁকা হয়ে চলে গেছে কয়েকটি রেল লাইন। ঐ লাইনগুলো কক্ষের দেয়ালের ভিতর পথে প্রবেশ করে বাইরে সুড়ঙ্গ পথের মধ্য দিয়ে চলে গেছে। ঐ স্থানেই চলেছে কয়েকজনের মারামারি এবং ধস্তাধস্তি।

আড়ালে আত্নগোপন করে ভালভাবে লক্ষ্য করতে লাগলো বনহুর। আলখেল্লাধারীর সঙ্গেই চলেছে ধস্তাধস্তি, তাকে প্রায় সাত আটজন লোক আক্রমণ করছে। কিন্তু আশ্চর্য সুকৌশলে আলখেল্লাধারী পরাজিত করে যাচ্ছে। চেয়ার আর টুল-টেবিল তুলে নিয়ে ছুঁড়ে মারছে ওরা ওকে লক্ষ্য করে। বনহুর বুঝতে পারলো যে মুহূর্তে সেই কক্ষে ধূম্ররাশি ছড়িয়ে পড়েছিলো তখন ঐ নর শয়তানের দল আলখেল্লাধারীকে জোরপূর্বক ধরে নিয়ে এসেছে তার উপর চালিয়েছে আক্রমণ।

বনহুর কিছুক্ষণ লক্ষ করলো তারপর সেও ঝাঁপিয়ে পড়লো নরশয়তানদের উপর। এবার সবাই কাহিল হয়ে পড়লো বনহুর আর আলখেল্লাধারীর কাছে। তারা বাধ্য হলো বনহুরের রিভলভারের মুখে হাত উঁচু করে দাঁড়াতে।

আলখেল্লাধারী বাঁশি বের করে তাতে ফুঁ দিলো।

আশ্চর্য হলো বনহুর, সঙ্গে সঙ্গে একদল পুলিশ ফোর্স রাইফেল উদ্যত করে ঐ সুড়ঙ্গ পথে নেমে এলো নিচে। তারা ঘেরাও করে দাঁড়ালো চারপাশে।

এক চুলও যেন কেউ নড়তে না পারে।

পুলিশ ফোর্স ভিতরে প্রবেশ করার পর আলখেল্লাধারী মুখের আবরণ উন্মোচন করে ফেললো এবং পুলিশ প্রধানকে লক্ষ্য করে বললো, এদের সবাইকে গ্রেপ্তার করে ফেলুন।

পুলিশ ফোর্সগণ অস্ত্রের মুখে শয়তান দলবলকে গ্রেপ্তার করে ফেললো। একজনও পালানোর সুযোগ পেলো না। এবার আলখেল্লাধারী ফিরে তাকালে যেখানে দাঁড়িয়েছিলো বনহুর! কিন্তু আশ্চর্য হলো সেখানে কেউ নেই।

পুলিশ প্রধান আলখেল্লাধারীর করমর্দন করে বললেন–মিঃ নূর। আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। হিরোইন ব্যবসায়ীদের ঘাঁটির সন্ধানে পুলিশমহল বেশ কিছুদিন ধরে হয়রানী হচ্ছে, কিন্তু আজ পর্যন্তও কোন হদিস খুঁজে পাওয়া যায় নাই। আপনিই তার সমাধান খুঁজে বের করলেন……।

আমাকে ধন্যবাদ দেবার পূর্বে আর একজন ধন্যবাদ পাবেন, কিন্তু তিনি আমাদের ধন্যবাদ গ্রহণের পূর্বেই চলে গেছেন। তিনি না হলে আমি একা সফলতা লাভে সক্ষম হতাম না কথাগুলো বললো, কে তিনি? কোথeনি এখানে ছিলেন

পুলিশ প্রধান বললেন–কে তিনি? কোথায় গেলেন?

জানি না কোথায় গেলেন, তবে একটু পূর্বেও তিনি এখানে ছিলেন।

তাকে চিনতে পারলেন না?

 জানি না কে সে! নূর গম্ভীর কণ্ঠে কথাটা বললো।

পুলিশ প্রধানের কাছে নূর কথাটা চেপে গেলেও সে চিনতে ভুল করেনি বনহুরকে। আলখেল্লার অন্তরালে নূর নিজকে গোপন রাখলেও সে পিতাকে চিনতে ভুল করেনি। ঐ মুহূর্তে পরিচয় দেওয়া বা নেওয়ার মত সময় অথবা সুযোগ ছিলো না। নূর ভালভাবেই বুঝতে পেরেছে তার পিতা যদি ঐ মুহূর্তে না এসে পড়তো, তাহলে হয়তো তার পক্ষে সম্ভব হতো না হিরোইন ব্যবসায়ীদের আসল ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা। কিন্তু এখন আশ্চর্য হচ্ছে-নূর হঠাৎ কোন ফাঁকে বেরিয়ে গেছে তার আব্বু। অবশ্য না গেলে একটু অসুবিধা হতে পুলিশ প্রধানের কাছে। বিশেষ করে পরিচয় দেওয়ার বেলায় অত্যন্ত সজাগ হয়ে কথা বলতে হতো।

পুলিশ প্রধান বললেন মিঃ নূর। আপনাকে বেশ ভাবাপন্ন মনে হচ্ছে। কে তিনি যার সাহায্য আপনাকে সফল করেছে এই জঘন্য ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তারে?

হাঁ, তারই কথা ভাবছিলাম। চলুন এবার এই দূর্গম স্থান থেকে বেরিয়ে যাই।

পুলিশ ফোর্স ততক্ষণে হিরোইন ব্যবসায়ী শয়তানদের হাতে হাত কড়া এবং মাজায় দড়ি বেঁধে রাইফেল উদ্যত করে ধরে সুড়ঙ্গ পথে হীরা ঝিলের বাইরে অপেক্ষায় গাড়িগুলোর পাশে নিয়ে এসেছে। শুধু হিরোইন ব্যবসায়ীদের নিয়েই তারা এলো না, তাদের সঙ্গের অন্যান্য পুলিশ বাহিনী তারা হিরোইন ভর্তি বাক্সগুলোও বের করে এনে একটি ট্রাক ভর্তি করলো।

হিরোইন ছাড়া আরও মাদকদ্রব্য ছিলো মজুতদারদের গুদামে, সেগুলোও এনে ট্রাকে ভর্তি করা হলো। তারপর গাড়িগুলো ছাড়ার নির্দেশ দিলেন পুলিশ সুপার।

একসঙ্গে তিনখানা পুলিশ ভ্যান এবং মাদকদ্রব্য বোঝাই ট্রাকখানা এগিয়ে চললো।

 পথ অন্ধকার।

বহুদূর এক একটি লাইট পোষ্ট।

আলো তেমন প্রখর নয়, তাই গাড়ির সার্চ লাইটের আলো পথ আলোকিত করে এগুচ্ছিলো।

গাড়িতে বসে কথা হচ্ছিলো পুলিশ প্রধান এবং নূরের মধ্যে। পুলিশ প্রধান বললেন–হীরা ঝিলের তলদেশে এমন একটি রাজত্ব ছিলো তা ভাবা যায়নি। মিঃ নূর, গোয়েন্দা বিভাগে আপনি যে এমন দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন সত্যি প্রশংসার যোগ্য। আমরা পুলিশ মহল সুদীর্ঘসময় সন্ধান চালিয়েও কৃতকার্য হতে পারিনি। এই হিরোইন এবং বিভিন্ন বিদেশী মাদকদ্রব্য যার মূল্য কোটি কোটি টাকা, তার আসল ঘাটি কোথায় এবং সমস্ত দেশব্যাপী কারা সরবরাহ করে থাকে। একেবারে আসল মূলঘাটি আপনি আবিষ্কার করেছেন। আজও তা শোনা হয়নি কি ভাবে এই ঘাটির সন্ধান পেলেন?

নুর একটু হেসে বললো—-পুলিশ বাহিনী বা আপনাদের অগোচরে আমি এই বিষময় হিরোইন ব্যবসায়ীদের সন্ধান চালাতে থাকি। আজ কাল প্রায়ই দেখা যায় দেশের প্রায় তরুণ দল হিরোইন অথবা যে কোন মাদকদ্রব্যের নেশায় নেশাগ্রস্থ হয়ে তারা নিজেদের জীবন এবং জনজীবনকে সর্বনাশের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। জাতীর ভবিষ্যৎ এই যুব সমাজ তারাই যদি হিরোইনের নেশায় নেশাগ্রস্থ হয়ে দেশ ও দশের মস্তকে বজ্রাঘাত করে, তা হলে যে কোন জাতি ভয়ংকর এক অভিশাপের অগ্নিতে জ্বলে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাবে। আর আমি সেই কারণেই উনখ আগ্রহে ঝাঁপিয়ে পড়লাম হিরোইন ব্যবসায়ীদের সন্ধানে।

যখন পুলিশ প্রধান এবং ডিটেকটিভ নূর মিলে কথা হচ্ছিলো তখন পুলিশ ভ্যানগুলি এবং মাদকদ্রব্য বোঝাই ট্রাকটি হীরা ঝিল ব্রিজের উপর দিয়ে এগুচ্ছিলো। নিচে গভীর পানি আর উপরে ব্রিজ।

গাড়িগুলোর সার্চ লাইটের আলোতে ব্রিজখানা স্পষ্ট নজরে পড়ছিলো।

হঠাৎ চমকে উঠলো সবাই, ব্রিজের উপর থেকে নিচে মাদকদ্রব্য বোঝাই গাড়িখানা গড়িয়ে অথৈ পানিতে পড়ে গেলো। অন্যান্য গাড়ি গুলোকে পুলিশ প্রধান থামতে বারণ করে ওয়ারলেসে জানালেন–তোমরা গাড়িগুলো সাবধানে সতর্কতার সঙ্গে হাঙ্গেরী কারাগারে নিয়ে যাও। আমরা দেখছি কি ঘটলো।

ওয়ারলেসে অন্যান্য গাড়ির চালকগণ পুলিশ প্রধানের সতর্কবাণী অনুযায়ী এগিয়ে চললো। প্রতিটি গাড়িতে রাইফেলধারী পুলিশ ফোর্স রয়েছে। আর আছে এক একজন পুলিশ ইনসপেক্টর।

পুলিশ প্রধান ও নূরের গাড়িখানা থেমে পড়লো।

পাওয়ারফুল টর্চ ফেলে এগুলো পুলিশ প্রধান ও নূর তাদের সঙ্গে কয়েকজন অস্ত্রধারী পুলিশ ফোর্স। তারা বিস্ময় নিয়ে দেখলো ব্রিজের কিছু অংশ ভেঙে মাল বোঝাই ট্রাকটি হীরা ঝিলের গভীর পানির বুকে পড়ে গেছে। ট্রাকের ড্রাইভার নিখোঁজ। পুলিশ প্রধান বললেন নিশ্চয়ই ড্রাইভারের অসতর্কতার দরুণ কোটি কোটি টাকার মাদকদ্রব্য সহ ট্রাকখানা এ ভাবে গভীর পানিতে পড়ে গেছে-তাতে কোন ভুল নাই। বেটা ড্রাইভারটিও খতম হয়েছে……

নূর বললো–আমারও তাই মনে হচ্ছে। নিশ্চয়ই ড্রাইভার ঘুমিয়ে পড়েছিলো অথবা…….।

এতো টাকার মালামাল বিনষ্ট হলো এটা বড়ই দুঃখজনক।

নূর হেসে উঠলো, যেমনটি করে বনহুর হাসে।

সেই হাসির শব্দ নিস্তব্ধ হীরা সেতুর বুক প্রতিধ্বনিত হলো। বিস্ময় নিয়ে বললেন পুলিশ প্রধান মিঃ নূর আপনার হাসির কারণ?

হিরোইন ও মাদকদ্রব্যগুলির জন্য আপনার দুঃখজনক উক্তিই আমার হাসির কারণ। স্যার ওগুলি এ মুহূর্তে যদি পানিতে নিক্ষিপ্ত না হয়ে পুলিশ হেড গুদামে পৌঁছাতো, তাতে কি লাভ ছিলো? বরং ঝিলের পানিতে ডুবে যাওয়াটাই শ্রেয়। নইলে পুলিশমহলের দৃষ্টি এড়িয়ে ওগুলো পুনঃ স্বস্থানে পৌঁছাতে পারতো শুধু হস্ত বদল হতো এই মাত্র……

মিঃ নূর আপনিই তা হলে……

মোটেই না, এক্ষেত্রে আমার কোন ইংগিত ছিলো না স্যার। তবে এক্ষণে যা ঘটে গেলো। তা মঙ্গলজনক। তারপর একটু মৌন থেকে বললো নূর মাদকদ্রগুলির সদ্বব্যবহার হয়েছে। ওগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ভাবতে হবে না আর! কিন্তু ভাবনা ঐ ড্রাইভারটির জন্য। বেচারী প্রাণ বিসর্জন দিলো অকালে। ওর জন্য দুঃখ হচ্ছে……

পুলিশ প্রধান পাওয়ারফুল টর্চলাইটের আলো ফেলে ব্রিজের নিচে পানির মধ্যে লক্ষ করছিলেন। গাড়িখানা যেখানে নিমজ্জিত হয়েছে সেই স্থানে শুধু অথৈ পানি ছাড়া আর কিছুই নজরে পড়লো না।

নূর বললো—এখানে পুলিশ প্রহরী রেখে চলুন যাওয়া যাক। তবে গাড়িখানা আর ড্রাইভারের সন্ধান চালাতে হবে। ঐ হিরোইন এবং অন্যান্য নেশাযুক্ত মালামালগুলি এততক্ষণে ঝিলের পানিতে ডুবে গভীর অতলে তলিয়ে গেছে।

এরপর আর বিলম্ব না করে ফিরে চললেন পুলিশ প্রধান এবং নুরুজ্জামান।

পুলিশ অফিসে পৌঁছে হাঙ্গেরী কারাগারে টেলিফোন করলেন পুলিশ সুপার। সঙ্গে ছিলো নূর। তারা জানতে পারলেন কড়া প্রহরায় সঠিকভাবে হিরোইন ব্যবসায়ীদের হাঙ্গেরী কারাগারে নিতে পেরেছে। লৌহসেলে ভালভাবে আটকানো হয়েছে তাদের সবাইকে।

পুলিশ সুপার এবং নূর আশ্বস্ত হলো।

 নূর ফিরে এলো তার বাংলোয়।

*

গাড়ি থেকে নামতেই ড্রাইভার বললো–রিভলভারখানা রেখেই চলে যাচ্ছেন স্যার।

নূর হাত বাড়ালো ড্রাইভারের দিকে, চমকে উঠলো নূর। গাড়ি বারান্দার উজ্জল আলোতে দেখলো ড্রাইভারের আসনে যে ব্যক্তি বসে রিভলভারখানা তার দিকে বাড়িয়ে ধরেছে সে অন্য কেহ নয়, তারই পিতা বনহুর। যদিও বনহুরের শরীরে তখন ড্রাইভারের ড্রেস পরিহিত ছিলো তবুও চিনতে ভুল হলো না। তার দ্বীপ্তময় দুটি চোখ অতি পরিচিত।

নূরকে বিস্ময়ভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললো বনহুর—নূর ট্রাকটিকে আমিই হীরা ঝিলে নিক্ষেপ করে দেশের এক বৃহদাংশকে নেশামুক্ত করতে পেরেছি। নূর, আসল ব্যবসায়ী আমার আস্তানায় বন্দী আছে। যদি হীরা ঝিলের অভ্যন্তরের পথ খুঁজে না পাওয়া যায়, তাহলে প্রয়োজন ছিলো সেকেন্দার শাহর।

নূর তীক্ষ্ণদৃষ্টি মেলে তাকিয়ে ছিলো এবার সে বললো—-সেই ধূর্ত হিরোইন ব্যবসায়ী তোমার আস্তানায় বন্দী?

হাঁ।

তুমি তাকে এবার কি করতে চাও?

তার গোপন আড়ডাখানার মালামাল ধ্বংস করেছি আর তাকে এই পৃথিবীতে জীবিত রাখা যায় না নূর। কথাটা বলে গাড়িতে স্টার্ট দিলো বনহুর।

নূর বললো—তোমার সঙ্গে অনেক কথা আছে যা আমার জানা দরকার।

আজ ভোর হয়ে এলো আবার কাল রাতে দেখা হবে।

কিন্তু সেকেন্দার শাহর সঙ্গে দেখা হওয়া আমার একান্ত দরকার ছিলো।

বেশ তাই হবে। হীরা ঝিলের অদূরে একটি টিলা আছে, ওখানে তাকে আনা হবে। সেখানেই দেখা হবে তোমার সঙ্গে।

কথাটা শেষ করেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলো বনহুর।

 নুর কিছুক্ষণ স্তব্দ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো, তারপর সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলো উপরে।

 জামা কাপড় পালটে সোফায় গা এলিয়ে দিলো নূর।

 বয় এসে তার সম্মুখে এক কাপ কপি রেখে গেলো।

নূর কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকালো বয় হোসেনের দিকে। ওকে লক্ষ্য করে বললো নূর–হোসেন! তুই এতো রাত জেগেছিলি?

হোসেন কফির বাটিটা রেখে চলে যাচ্ছিলো, বললো–হাঁ স্যার, আপনি বেরিয়ে যাবার পর থেকেই জেগেছিলাম, কারণ হঠাৎ আপনি ওভাবে চলে গেলেন তাই…….

নূর কফির কাপে চুমুক দিয়ে বললো—সত্যি তোকে ধন্যবাদ জানাতে হয়। আম্মু ছাড়া আমার জন্য এমন করে কেউ ভাববার নেই। রাত দুপুরে গরম কপি আমার প্রাণটাকে চাঙ্গা করে দিলো।

একটু হেসে হোসেন চলে গেলো, তার চোখ দুটোতে আনন্দের দ্যুতি খেলে গেলো।

নূর কফির কাপটা সম্মুখের টি-টেবিলে নামিয়ে রেখে শোবার ঘরে এলো, হাত-পা ছড়িয়ে এবার সে বিশ্রাম করবে। যা পরিশ্রম গেছে তার, বড় ক্লান্ত সে।

বিছানায় বসতেই দেখলো একটি ভাজ করা কাগজ বালিশের পাশে। তাড়াতাড়ি ভাজ করা কাগজখানা হাতে তুলে নিয়ে মেলে ধরলো চোখের সামনে, লিখা আছে তাতে–

প্রিয় বন্ধু নূর,
জানি তুমি যুব সমাজের পরম বন্ধু হিসাবে হিরোইন সেবি যুবকদের মুক্তি কামনা করো। কিন্তু জানো না বন্ধু। তুমি আমার কতখানি ক্ষতি সাধন করেছে। কোটি কোটি টাকার সামগ্রী তোমার জন্য আমি হারালাম। সেকেন্দার শাহকে বনহুর বন্দী করে রাখলেও আমার তাতে কিছু যায় আসে না। কিন্তু মনে রেখো আমিও তোমার এই কর্মের প্রতিশোধ নেবো।
–তোমার প্রিয় বন্ধু।

নূর চিঠিখানা বার দুই পড়লো তারপর আপন মনে হাসলো সে। কিন্তু চোখে তার ঘুম আসছে না, কিছু সময় পূর্বেই যে ঘটনার সমাধান করে এসেছে তার প্রতিক্রিয়া এখনও সমস্ত মন জুড়ে বিরাজ করছে আরও একটা ব্যাপার তাকে বিস্মিত করেছে তা হলো তারই পিতা বনহুর স্বয়ং ড্রাইভারের বেশে হিরোইন বোঝাই ট্রাক হীরা ঝিলের পানিতে নিক্ষেপ করে সব কিছুর সমাধান করে দিয়েছে। কিন্তু সব কিছু সমাধান করা সম্ভব হয়নি এই চিঠির লেখক প্রিয় বন্ধু কে সে, যার নেতৃত্বে হিরোইন ব্যবসা চলছিলো। তবে কি সেকেন্দার শাহ ছাড়া আরও ব্যক্তি আছে হিরোইন ব্যবসার মূল কর্তা হিসাবে…….

হঠাৎ একটি কণ্ঠস্বর, হাঁ আমিই তোমার সেই প্রিয় বন্ধু যাকে নিয়ে তুমি ভাবছে।

নূর চমকে ফিরে তাকালো একটি মুখোস পরিহিত ছায়ামূর্তি আলগোছে বেরিয়ে গেলো পাশের দরজা দিয়ে।

নুর তাড়াতাড়ি শয্যা ত্যাগ করে মেঝেতে নেমে দাঁড়ালো। দ্রুত এগিয়ে গেলো সে পাশের দরজা দিয়ে পিছনের বেলকুনির দিকে। কিন্তু কোথাও কিছুই দৃষ্টিগোচর হলো না। নূরের দু’চোখে বিস্ময় ফুটে উঠে তার শয়নকক্ষে ছায়ামূর্তি কি করে প্রবেশ করলো আর কেই না সে?

ফিরে এলো নূর নিজ শয্যায়।

*

হিরাঝিলের অদূরে একটি টিলার পাশে এসে গাড়ি থামলো। নূর স্বয়ং গাড়ি ড্রাইভ করে এসেছে। জমাট অন্ধকারে গাড়ি থেকে নেমে পড়লো নূর। অন্ধকারেই তীক্ষ্ণদৃষ্টি মেলে তাকালো সে চারিদিক। ও পাশেই পাইন গাছের ঝোঁপ, এক একটি পাইন গাছ ঠিক এক একটি প্রহরীর মত দাঁড়িয়ে আছে মাথা উঁচু করে। নূরের দক্ষিণ হস্তে গুলি ভরা রিভলভার, বাম হস্তে টর্চ লাইট।

আলো ফেলে তাকালো নূর এ পাশে ও পাশে। হঠাৎ তার দৃষ্টি গোচর হলো জমকালো একটি ছায়ামূর্তি। প্রথম মনে করলো নূর তারই পিতা বনহুর। কিন্তু সে ভুল ভেঙে গেলো মুহূর্তে, চাপা কণ্ঠস্বর সাবধান নূর ফিরে যাও। সেকেন্দার শাহকে আমি হত্যা করতে দেবো না……

বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে নূর, এ সেই ছায়ামূর্তি যে তার শয়ন কক্ষে প্রবেশ করেছিলো। এ সেই কণ্ঠস্বর, যে কণ্ঠস্বর সে শুনেছিলো শয্যায় শুয়ে। মুখে মুখোস থাকায় কণ্ঠস্বর ঠিক বোঝ যায় না।

নূর কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল, তারপর বললো তুমি আমাকে বন্ধু বলে ভালই করেছো নইলে এতোক্ষণ এই রিভলভারের গুলীতে তোমার দেহ ঝাঁঝরা করে দিতাম।

হাঃ হাঃ হাঃ তুমি আমার দেহ ঝাঁঝরা করে দেবে? দাও বন্ধু আমি প্রস্তুত, কিন্তু মনে। রেখো, তোমার রিভলভারের একটি গুলিও আমার দেহ ভেদ করতে পারবে না।

মুহূর্ত বিলম্ব না করে নুর গুলী ছুঁড়লো ছায়ামূর্তির বুক লক্ষ্য করে।

কিন্তু আশ্চর্য। গুলী তার দেহ ভেদ না করে ছিটকে পড়লো দূরে। পরপর কয়েকটা গুলী ছুড়লো নূর, সবগুলো গুলীই ছিটকে পড়লো আশে পাশে। নূর তাকিয়ে দেখলো ছায়ামূর্তি উধাও হয়েছে।

নূরের কাঁধে কেউ হাত রাখলো।

ফিরে তাকালো নূর।

গম্ভীর কণ্ঠে বললো–নূর, তোমার জন্য আমি অপেক্ষা করছি। এসো আমার সঙ্গে।

নূর চিনতে পারলো যার সঙ্গে সে এখন যাচ্ছে সে তার পিতা বনহুর। অন্ধকারে পিতা আর পুত্র এগুচ্ছে, তাদের পায়ে ভারী জুতোর শব্দ অন্ধকার রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে অদ্ভুত একটা শব্দ সৃষ্টি করছে।

বেশ কিছুটা এগুনোর পর ওরা দুজন একটি টিলার পাশে এসে দাঁড়ালো পাশেই একটা পাথর খন্ড। বনহুর পাথর খন্ডটার নিচের অংশে চাপ দিতেই পাথর খন্ডটা সরে গেলো। দেখা গেলো একটি সুড়ঙ্গ পথ। বনহুর তার প্যান্টের পকেট থেকে একটি টর্চ বের করে আলো ফেললো।

আশ্চর্য হয়ে দেখলো নূর একটি লৌহ কপাট।

নূরকে লক্ষ্য করে বললো বনহুরনূর সাবধান এই লৌহ কপাটে হাত বা তোমার দেহের কোন অংশ স্পর্শ করলেই তোমার মৃত্যু ঘটবে। আমি দরজা খুলে দিচ্ছি তুমি আলগোছে প্রবেশ করে।

নূর অন্ধকারেই তাকালো বনহুরের মুখের দিকে। অন্য কেউ তাকে এ ভাবে প্রবেশ করতে বললে সে কিছুতেই তা করতো না। বনহুর তার পিতা, সে যদি কোন অভিসন্ধি নিয়েই তাকে এখানে এনে থাকে বা তাকে বন্ধী করে রাখতে চায় তাতে তার একটুও কিছু ভাববার নেই। পিতার কাছে সন্তানের পরাজয় তাও শ্রেয়।

হেসে বললো বনহুর এসো নূর আমার সঙ্গে এসো। তোমাকে এমন এক দৃশ্য দেখাবো–যা তোমার জীবনে এ প্রথম দেখবে। এসো…বনহুর অতি সাবধানে প্রবেশ করে টর্চলাইট এর আলো ধরলো।

বনহুর যে ভাবে লৌহ দরজা পার হয়ে গেলো ঠিক ঐ ভাবেই নূরও লৌহ দরজাটি পার হয়ে এ পারে এলো। বনহুর এবার একটি সুইচ টিপলো, সঙ্গে সঙ্গে দরজাটি বন্ধ হয়ে গেলো।

বনহুর বললো—নূর যেখানে এসেছে এ স্থান অত্যন্ত বিপদ সংকুল। এখানে এলে তার বেরুনোর কোন উপায় নেই। এসো আমার সঙ্গে।

তুমি বলেছিলে সেকেন্দার শাহর……।

হাঁ, তাকেও দেখবে। আমি জানি তাকে হত্যা করলে এখনও অনেক রহস্য চাপা থাকবে তাই আমি তাকে হত্যা না করে জীবিত রেখেছি। এই সুড়ঙ্গপথ হীরা ঝিলের অভ্যন্তরেই গিয়ে শেষ হয়নি, হীরা ঝিলের তলদেশে এক নতুন জগতে চলে গেছে। যেখানে কেউ যেতে পারেনি, শুধু হীরা ঝিল যে তৈরি করেছিলো সে ছাড়া।

কে সে?

বলবো! আমিও জানতাম না, জেনেছি অনেক পরে। এই হীরাঝিল এক বিস্ময়কর স্থান। আগ্রার তাজমহল তৈরি করেছিলেন বাদশা শাহজাহান এবং যাদের দ্বারা তৈরি করেছিলেন, তারাই সেই সুদক্ষ মিস্ত্রী বা কারিগর তৈরি করেছিলো এই হীরা ঝিল এবং তাজমহল তৈরি করতে যে অর্থ ব্যয় হয়েছিলো তার দেড়গুণ বেশি অর্থ ব্যয় হয়েছে এই হীরাঝিল তৈরি করতে।

সুড়ঙ্গ পথে চলতে চলতে নূরের মনে জাগে নানা প্রশ্ন। হীরা ঝিল কান্দাইনগরীর এক রহস্যময় ইতিহাস। হীরাঝিল নিয়ে নানা জনের মনে নানা প্রশ্ন নানা কথার মালা। হীরাঝিল ছিলো কান্দাইনগরীর ঐতিহ্যময় পুরি। খানবাহাদুর রায়হানের কোন এক পূর্ব পুরুষ তৈরি করেছিলেন এই হীরাঝিল। একদিন হীরাঝিল নিয়ে নানা রকম আলাপ আলোচনা চলতো। এখানে নানা ধরনের ফাংশন, উত্সব হতো। দেশ বিদেশ থেকে আসতে বাদ্যকর এবং নাচনে ওয়ালী সেরা সেরা বাঈজী, যাদের নূপুরের ঝংকারে মুখর হয়ে থাকতে হীরাঝিলের অভ্যন্তর। শোনা গেছে রায়হান বংশের পূর্ব পুরুষ, বহু নারীকে ধরে নিয়ে গিয়ে তাদের ইজ্জৎ নষ্ট করার পর তাদের হত্যা করে হীরাঝিলের কোন এক কক্ষে নিক্ষেপ করা হতো। সেই অসহায় নারীদেহ গুলি একদিন পচে-গলে কংকালে পরিণত হতো। কেউ আর তাদের সন্ধান পেতো না।

কান্দাইনগরীর পূর্ব পুরুষ মুখে আরও শোনা যায় এখনও গভীর রাতে হীরাঝিল থেকে ভেসে আসে করুন কান্নার আওয়াজ। আজও সেই আওয়াজ শুনে শিউরে উঠে কান্দাইবাসীগণ। কান্দাই সরকার হীরাঝিল সংস্কারে উদ্যোগ নিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। মজুর মিস্ত্রী যারাই হীরাঝিল সংস্কারে আগ্রহী হয়ে গেছে তারাই মৃত্যুবরণ করেছেন। হয়তো নিঃশ্বাস রুদ্ধ হয়ে, নয়তো সর্প দংশন অথবা ছোরা বিদ্ধ হয়ে। তবুও প্রচেষ্টার শেষ নেই।

শেষ অবধি সরকারের চেষ্টায় একটি নতুন ভবন তৈরি হয়েছে হীরাঝিলের পাশে। মাঝে মাঝে এখানে বিদেশী রাষ্ট্রদূত এবং শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ এখানে আসেন এবং দিন কয়েক থাকার পর যে যার স্থানে ফিরে যান কান্দাই এর কাজ শেষ করে। এই ভবনটি রক্ষণা বেক্ষণ এবং পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য কয়েকজন কর্মচারী নিযুক্ত রয়েছেন। তাদের মুখে শোনা যায় হীরাঝিল সম্বন্ধে নানা কথা। গভীর রাতে শোনা যায় নারীকণ্ঠের করুণ আর্তনাদ, কখনও শোনা যায় হাসির শব্দ আর কখনও শোনা যায় গুলীর শব্দ তার সঙ্গে মৃত্যু যন্ত্রণার গোঙ্গানী। ভীত আতঙ্ক নিয়ে হীরাঝিলের নতুন ভবনের কর্মচারীবৃন্দ কাল যাপন করে। দিনে ঘুমায় আর রাত্রিকালে তারা আগ্নেয় অস্ত্র নিয়ে জেগে থাকে।

নানা কথা ভাবছিলো নূর।

বললো বনহুর হীরাঝিলের রহস্য উদঘাটনে অনেক দিন ধরে চেষ্টা চালিয়ে চলেছিলাম নূর। বিভিন্ন কাজে নিজেকে হারিয়ে ফেলার জন্য এই বিলম্ব। একটু থেমে বললো সে, আজ আমি হীরাঝিলের সমস্ত রহস্য উন্মোচন করেছি। আর সেই কারণেই আজ আমি তোমাকে এখানে এনেছি। কারণ তুমি যেন হীরাঝিলের গহ্বরের গোপন রহস্য জানো এবং কোন দিন যেন তুমি হীরাঝিলের গোপন রহস্য নিয়ে রহস্য জালে জড়িয়ে না পড়ো।

আব্বা আমিও হীরাঝিলের রহস্য নিয়ে অনেক ভেবেছি। অনেক অনুসন্ধান চালিয়েছি এবং সেই গোপন রহস্য উদঘাটনে এসে হিরোইন পাচারকারীদের সন্ধান পেয়েছি। সেদিন তা তুমিও জানো।

কিন্তু নূর তার চেয়ে আরও বেশি রহস্য লুকিয়ে আছে-যা তোমাকে বিস্মিত করবে।

কথাটা বলে বনহুর সামনে একটি অদ্ভুত মেশিন দেখালো, বললো সে, এই মেশিনে কয়েকটি সুইচ আছে, একটি চাপ দিলে নতুন একটি সুড়ঙ্গ মুখ বের হবে আর অপরটিতে চাপ দিলে ওর মধ্যে আলো জ্বলবে। তখন ঐ সুড়ঙ্গ মধ্যে প্রবেশ করতে পারবে। যদি ভুল হয় সুইচ টিপতে তাহলে সঙ্গে সঙ্গে একটি ধারালো লৌহ ফলক এসে বিদ্ধ হবে তোমার বুকে এবং সঙ্গে সঙ্গে তোমার মৃত্যু ঘটবে।

এ পথ কি পূর্ব হতেই ছিলো? প্রশ্ন করলো নূর।

বললো বনহুর, না, এই গোপন পথে প্রবেশ করার বিস্ময়কর কৌশল আমি করেছি।

আব্বা!

হাঁ নূর, এ পথ তৈরি করতে আমাকে পাঁচ বছর সময় নষ্ট করতে হয়েছে। বহু অর্থ ব্যয়ে এ পথ হয়েছে, কিন্তু এ পথ যার তার জন্য নয়। আমার কোন অনুচরও এ পথের সন্ধান জানে না। যে বৈজ্ঞানিক এ পথ তৈরি করেছে তাকে আমি এখানেই বন্দী করে রেখেছি।

কারণ?

তাকে মুক্তি দিলেও সে বাঁচবে না কারণ আমি জানি, সে জীবন দেবে তবু এ পথের সন্ধান কাউকে দেবে না, আর সেই কারণেই তাকে জীবন হারাতে হবে। আমি চাই না এমন একজন মহান ব্যক্তি প্রাণ হারাক।

তাহলে তুমি তাকে অন্যায় ভাবে……।

হাঁ, যদিও এটা আমার অন্যায়, তবুও আমি বাধ্য হয়েছি যখন জানতে পারলাম বৈজ্ঞানিক মার্সালকে কোন এক ব্যক্তি সন্ধান করে ফিরছে তখনই আমার কাছে সব পরিস্কার হয়ে গেলো, কেন তার সন্ধান করা হচ্ছে। আমি তার মত একজন বিস্ময়কর বৈজ্ঞানিককে হারাতে চাই না। তার মূল্যবান জীবনের মূল্য আমার জীবনের চেয়েও মূল্যবান–তাই আমি তাকে এই হীরা ঝিলের অভ্যন্তরে বন্দী করে রেখেছি লোক চক্ষুর অন্তরালে। এসো আমি তাকে দেখবো আজ।

নূরের দু’চোখ বিস্ফারিত হলো বিশ্ববিখ্যাত বৈজ্ঞানিক মিঃ মার্সাল রাশিয়ার কোন এক স্থানে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্রাগারের একজন কারিগর। রাশিয়ার শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক হিসাবে তিনি খ্যাতি লাভ করেছেন। রাশিয়া পত্রিকায় নূর-এর নাম। দেখেছে তাই স্মরণ হলো ঐ নামটি। রাশিয়া পারমাণবিক অস্ত্র শক্তির মূল উৎস বৈজ্ঞানিক মার্সাল। বনহুর তার প্রয়োজনে সেই দেশ থেকে তাকে তুলে এনেছিলো কৌশলে। বৈজ্ঞানিক মিঃ মার্শাল লর্ডকে দেখার প্রবল ইচ্ছা নূরকে আকর্ষণ করলো।

তবুও প্রশ্ন করলো নূর—প্রখ্যাত হিরোইন ব্যবসায়ী সেই সেকেন্দার শাহ……

হাঁ তুমি সব কিছুর সন্ধান পাবে নূর। অনেক কিছু তুমি জানতে পারবে–যা তোমার ডিটেকটিভ জীবনে জানা দরকার। জানি অর্থের কোন প্রয়োজন তোমার নেই। কারণ আমার আব্বার যে সম্পত্তি আছে তা তোমার জন্য যথেষ্ট কাজেই আমি চাই অর্থ বা ঐশ্বর্যের মোহ কোন দিন তোমাকে আচ্ছন্ন করবে না। তুমি শুধু অপরের মঙ্গল সাধনে জীবন মন সমর্পণ করবে।

আব্বা তোমার আদেশ আমি চির জীবন স্মরণ রাখবো।

বনহুর নূরের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললো—জানি তুমি আমার কথা গুলি মেনে চলবে।

এবার বনহুর সেই বিস্ময়কর মেশিনের একটি সুইচ টিপলো, সঙ্গে সঙ্গে একটি দরজা বেরিয়ে এলো সেই পথে বনহুর আর নূর প্রবেশ করলো। কিন্তু আশ্চর্য এক পাও আর এগুতে হলো না, একটি চক্রাকারে সিঁড়ি তাদের দুজনকে নামিয়ে আনলো হীরা ঝিলের তলদেশে। উজ্জল আলোতে উদ্ভাসিত সেই স্থান। চারিদিকে মনোরম দৃশ্য, নানা ধরনের আলোর ঝাড় ঝুলছে। মাঝখানে একটি বিস্ময়কর আলো, আলোটি ধীরে ধীরে ঘুরছে। সেই বিস্ময়কর আলোর ছটায় অন্যান্য আলোর ঝাড়গুলির বিচ্ছুরিত আলো কখনও লাল, কখনও নীল বর্ণ কখনও গোলাপী এবং কখনও গাঢ় হলুদ বর্ণ রূপ ধারণ করছে। সেই আলোর দ্যুতির সঙ্গে ভেসে আসছে মিষ্টি মধুর মিউজিকের সুর।

নূর আশ্চর্য হলো এই সবই তার আবার কীর্তি। সত্যি সে বিমুগ্ধ অভিভূত হলো। এই দৃশ্য তার চোখে সম্পূর্ণ নতুন লাগছে। বনহুর তাকে লক্ষ্য করে বললো—এসো নূর।

নূর বললো–হীরা ঝিলের অভ্যন্তরে হিরোইন ব্যবসায়ীদের আস্তানা ছিলো, যেখান থেকে আমরা সেদিন কোটি কোটি টাকার হিরোইন উদ্ধার করেছিলাম এবং হিরোইন ব্যবসায়ী বিদেশী ও তার কয়েকজনকে আমরা নিহত করতে সক্ষম হয়েছিলাম……।

হাঁ, তুমি বলতে চাচ্ছো এই হীরা ঝিলের অভ্যন্তরেই তো সেই গোপন আস্তানা ছিলো বা আছে। হাঁ শুধু তাই নয়, হীরা ঝিলের অভ্যন্তরে আছে বিভিন্ন স্তর, এক একটি স্তরে আস্তানা গেড়েছে নানা ধরনের ব্যক্তিত্ব। এক একজনের এক একধরনের ব্যবসা। তবে বেশির ভাগ ব্যক্তিই তাদের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে গোপন আস্তানা গেড়েছে অসৎ কর্মকান্ড নিয়ে। নূর এদের অসৎ উদ্দেশ্যকে নস্যাৎ করতে হবে এরা হীরা ঝিলের অভ্যন্তরে আত্নগোপন করে কান্দাইবাসীদের সর্বনাশ সাধন করে চলেছে। এই সর্বনাশের হাত থেকে জনগণকে বাঁচাতে হবে এবং বাঁচাতে গেলে তোমাকে জানতে হবে সবকিছু। নূর তোমার কাজে আমি সহায়তা করবো সেদিন যেমন করেছিলাম। শুধু কোটি কোটি টাকার হিরোইন হীরাঝিলে নিক্ষেপ করিনি, এই হিরোইন তৈরির ঘাঁটিও আবিষ্কার করেছি। বিদেশ থেকে যারা হিরোইন এবং নানা ধরনের মাদক দ্রব্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাচার করে থাকে তাদের মূল স্তম্ভ যে অধিনায়ক তাকে খুঁজে বের করবো এবং সমূলে ধ্বংস করবো সেই সব ঘাটিগুলি। আর সেই কারণেই আমার এ প্রচেষ্টা। একটু থেমে বললো বনহুর—বিশ্বের পুলিশ অধিনায়কগণ শত চেষ্টা করেও এদের সন্ধান পাবে না।

বনহুর যে কথাগুলো বলছিলো তা অধীর আগ্রহে শুনছিলো নূর। বিশ্ববাসী জানে বনহুর দস্যু হৃদয়হীন পাষন্ড। কিন্তু তারা জানে না তার পিতা বনহুর কত বড় মহৎ, কত হৃদয়বান কত মহৎ।

নির্বাক দৃষ্টি মেলে নূর তাকিয়ে থাকে পিতার সুন্দর দ্বীপ্ত মুখ মন্ডলের দিকে। একদিন সেও তার পিতাকে ভুল বুঝেছিলো। দস্যু বনহুর নাম শুনতেই ঘৃণায় নাসিকা ভ্রুকুঞ্চিত হতো তার। বনহুরকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা সেও করেছিলো প্রাণপণে। তারপর যখন নূর জানতে পেরেছিলো তারই পিতা ফেরেস্তা সমতুল্য ব্যক্তিটিই স্বয়ং দস্যু বনহুর, তখন তার মন বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিলো, পিতা হলেও তাকে সে ক্ষমা করতে পারছিলো না। এমন একটি দর সন্তান সে ভাবতেই মন তার ক্ষুব্দ হয়ে উঠেছিলো। সেদিন মায়ের প্রতিও এসেছিলো অবিশ্বাস। এমন এক ব্যক্তিকে তার শিক্ষিতা মাতা কি করে স্বামী বলে গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু সে ভুল ভেঙে গেছে, নূরের মন প্রাণ আজো পবিত্রতায় ভরে উঠেছে। তার পিতা মানুষের মত একজন মানুষ যার সঙ্গে তুলনা হয় না এখনকার মানুষ নামি জানোয়ারগুলোর। সমস্ত দেশ আজ ভরে উঠেছে অসৎ ব্যক্তিদের দৌরাত্মে। অন্যায় অনাচার, নির্যাতন নিষ্পেষণ শোষণ শাসন ছাড়া আর কোন পথ যেন ওদের নেই। কি করে অসহায় গরীবদের রক্ত শোষণ করবে, কি করে তাদের উপর চালাবে নিজেদের কর্তৃত্ব। কি করে নিজেরা ধনদৌলত আর ঐশ্বর্যের ইমার গড়ে তুলবে এই তাদের চেষ্টা। তার পিতা এই সব ব্যক্তিদের দমনকারী আর সেই কারণেই তারা তার প্রধান শত্রু। নূর পিতার সৌম্য সুন্দর বলিষ্ঠ মুখের দিকে তাকিয়ে সে কথায় ভাবছিলো, ভাবছিলো সমস্ত দেশ আজ আচ্ছন্ন মাদকদ্রব্য জাতীয় বিষে, যার প্রতিক্রিয়া আজ বিশ্বের যুব সমাজকে পঙ্গু করে দিচ্ছে। এক ধরনের ব্যক্তি যারা চায় সমস্ত দেশ ও দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিক সমূলে ধ্বংস হয়ে থাক। যারা দেশের মহাশক্তি যুবক শ্রেণী তারা যদি বিকল পঙ্গুতে অচেতন হয়ে পড়ে, তাহলে তাদের চলার পথ হবে মুক্ত কণ্টকহীন। যা খুশি তাই করবে, নিজেদের ইচ্ছা মত অসৎ ব্যবসা চালিয়ে যাবে কেউ তাদের বাধা স্বরূপ হয়ে দাঁড়াবে না, তার পিতা বনহুর এই শ্রেণীর লোকদের নিধন করতে চায়। দেশকে বাঁচাতে হলে জীবন উৎসর্গ করেও তাই করতে হবে……

বনহুর বুঝতে পারে নূর অনেক কিছু ভাবছে, কারণ তার মনে নানা প্রশ্নের উদ্ভব হয়েছে। তার মনকে প্রশ্ন করার জন্য বললো বনহুর এসো নূর।

নূরের মনে পড়লো সেই ছায়ামূর্তির কথা, যাকে গুলীবিদ্ধ করা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি কে সেই ছায়ামূর্তি। বললো নূর—আব্বা একটি কথা তোমাকে বলা উচিৎ ছিলো–যা তোমাকে এখনও বলা হয়নি। তোমার কথামত আমি নিজে ড্রাইভ করে এই নির্জন হীরাঝিলের অদুরে সেই স্থানটিকে উপস্থিত হয়ে ছিলাম। এসে তোমার সন্ধানে চারদিকে তাকাতেই একটি ছায়ামূর্তি আমার সম্মুখে হাজির হলো। আমি তাকে পূর্বেও আমার বাংলোয় আমার শয়ন কক্ষে আচম্বিতে দেখেছিলাম এবং আমাকে জানিয়েছিলো সে নাকি আমার বন্ধু…..

অবশ্য এ কথা সত্য, সে তোমার বন্ধুর প্রেত আত্না।

 আব্বু সে যদি আমাদের অনুসরণ করে থাকে?

তাতে কিছু যায় আসে না। এখানে প্রবেশ করে কেউ ফিরে যেতে পারবে না নূর। এ বিষয়ে তুমি নিশ্চিন্ত থাকো?

বনহুর নূর সেই মনোরম কক্ষের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হলো। অদ্ভুত সে পথ, লাল কার্পেটে ঢাকা পথ বেয়ে কিছুটা এগুতেই আরও একটি কক্ষ, কক্ষ নয় যেন হলঘর। এই কক্ষটিও মনোরম সাজে সজ্জিত। আলোয় আলোকিত চারিদিক। সেই কক্ষের দেয়ালে একটি বৃহদাকার পদ্মফুল। যদিও ফুলটি ধাতু দিয়ে তৈরি তবুও কেউ বুঝতে পারবে না সেটা নকল ফুল। বনহুর সেই ফুলটির পাশে গিয়ে একটি বোতাম টিপলো, সঙ্গে সঙ্গে সুদৃশ্য একটি রাজমহল ধরনের কক্ষের ফটক খুলে গেলো।

বনহুর বললো–এসো নূর।

নূর বিস্ময় নিয়ে প্রবেশ করলো সেই সুদৃশ্য মহলটির মধ্যে।

চারদিকে মার্বেল পাথরের গাঁথুনি। ছাদ নজরে আসে, তবে মাথা ছেড়ে অনেক দূরে। ছাদে অসংখ্য তারার মালার মত লাল নীল হলুদ আলোর বাল্ব জ্বলছে। সুন্দর স্নিগ্ধ শীতল আলো। কতকটা নীলাভ জ্যোতির্ময় সে আলো। একপাশে একটি খাবার টেবিল, টেবিলে নানাবিধ খাদ্য সম্ভার থরে থরে সাজানো। ফলমূল আর সুস্বাদু খাদ্যদ্রব্য, পাশে রেকাবিতে পাখীর মাংসের রোষ্ট, গরম চাপ দুম্বার মাংসের কোরমা। অপর একটি রেকাবিতে পরোটা।

টেবিলের পাশে কয়েকটি গদিযুক্ত চেয়ার।

কক্ষের একপাশে দুগ্ধফেনিল নরম গদিযুক্ত শয্যা। সম্মুখে পাশে লাইট জ্বলছে। নূর কক্ষমধ্যে প্রবেশ করেই প্রথম দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। শয্যায় অর্ধশায়িত একটি ব্যক্তি সংবাদপত্র পাঠ করছেন। বুঝতে পারে নূর এই সেই বৈজ্ঞানিক, কিছু পূর্বে তার আব্বু তাকে যার সম্বন্ধে বলেছিলো। বৈজ্ঞানিক মার্শাল লর্ড। দীর্ঘাকৃতি চেহারা, একমুখে মেহেদী রাঙা দাড়িগোফ, চোখে হাল্কা নীলাভ কাঁচের চশমা।

বনহুর কক্ষমধ্যে প্রবেশ করেই বললো—গুড মনিং মিঃ মার্সাল।

হস্তস্থিত পত্রিকাখানা পাশে রেখে হাত ঘড়ির দিকে তাকালেন বৈজ্ঞানিক তাপস মিঃ মার্শাল লর্ড, ধীর শান্তকণ্ঠে বললেন গুড মর্নিং। সোজা হয়ে বসলেন তিনি।

বনহুর বিনয়ের সঙ্গে ইংরেজিতে নূরের পরিচয় দিলো আমার সন্তান নূর যার কথা আপনাকে বলেছিলাম।

বৈজ্ঞানিক লর্ড মৃদু হেসে ইংরেজিতেই বললেন ব্যস, তোমার পিতার মুখে তোমার ডিটেকটিভ জীবনের পরিচয় পেয়েছি। তোমার সুদর্শন চেহারা আমাকে মুগ্ধ করলো। ঐ চেয়ার দুখানায় তোমরা পিতা পুত্র বসতে পারো।

বনহুর বললো—আপনার খাবার সময় উত্তীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। সকালের নাস্তা ঠিক সময় মত খাওয়া মঙ্গল।

হাঁ সে কথা সত্য। আমি ঠিক সময় মত আমার খাবার খাই। একটা নতুন সংবাদ পাঠ করছিলাম।

বললো বনহুর—নতুন সংবাদ।

হীরাঝিলের অভ্যন্তর থেকে কোটি কোটি টাকার হিরোইন উদ্ধার এবং সেই মালামাল এবং ট্রাক চালকসহ ট্রাকটি হীরা ঝিলের পানিতে নিমজ্জিত।

বনহুর বললো–হাঁ মিঃ লর্ড এ কথা সত্য।

হেসে বললো মিঃ লর্ড—আমি খুশি হয়েছি হিরোইন সেবিদের এবার কিছুটা দুর্ভোগ হবে, কিন্তু আফসোস ট্রাক ড্রাইভারটি এই মাদকদ্রব্যের সঙ্গে আত্মাহুতি দিলো বলে।

বললো বনহুর—দুঃখ করার কিছুই নেই, কারণ সেই ট্রাক চালক ছিলাম আমি। আর আমি ইচ্ছা করেই হীরা ঝিল ব্রিজের উপর থেকে সুকৌশলে সেই কোটি কোটি টাকার হিরোইন গভীর জলে ফেলে দিয়েছি।

মিঃ লর্ড শয্যা ত্যাগ করে ছোট্ট শিশুর মত জড়িয়ে ধরলো বনহুরকে, বললো—সাবাস বন্ধু তোমাকে আমি আরও একটি সুরম্য মহল তৈরি করে দেবো যার মধ্যে বসে তুমি বিশ্বের সব সংবাদ পাবে। অদ্ভুত একটি মেশিন সেটা, আমি সেই মেশিন তৈরি ব্যাপারে গবেষণা চালাচ্ছি।

আমি জানি আপনি এখানে  নিশ্চুপ  বসে নাই।

হাঁ, বরং আমি এখানে সবার অলক্ষ্যে আমার সাধনা চালিয়ে যেতে সক্ষম হচ্ছি। যদি তোমার সহায়তা পাই……

বললো বনহুর–নিশ্চয়ই পাবেন আপনি আমার আন্তরিক সাহায্য আর সহযোগিতা।

শুধু একটি দুঃখ, আমার কন্যা মেরী কেমন আছে জানি না। মেরী তার মাকে হারিয়ে শুধু আমাকেই তার একমাত্র সম্বল মনে করতো। আমার স্নেহ ভালবাসা দিয়ে আমি তাকে মানুষ করেছিলাম। যদিও আমি সব সময় তার দিকে ভালভাবে নজর দিতে পারিনি, কিন্তু মেরী সর্বক্ষণ আমাকে দেখতে, আমার বৈজ্ঞানিক জীবনে তার সহায়তা আমাকে উৎসাহিত করেছিলো। জানি না সে কেমন আছে, কোথায় আছে। কোন শত্রু তার পিছু লেগেছে কিনা তাই বা কে জানে। একটু থেমে বললেন মিঃ লর্ড-এখন সে যদি আমার পাশে থাকতো তাহলে আমি খুব আনন্দ পেতাম।

নূর বললো—আব্বু তুমিও দুঃখ বুঝতে পারছো তবে কেন নিশ্চুপ আছে এতোদিন।

বনহুর মিঃ লর্ডের দক্ষিণ হাতখানা মুঠায় চেপে ধরে বললো—-এর পূর্বে আপনি আমাকে কোন সময় আপনার মেরীকে পাশে পাবার বাসনা জানাননি। বেশ আমি এবার এ ব্যাপারে সচেষ্ট হবো, কথা দিলাম আপনাকে। আসুন এবার খাবার টেবিলে এসে বসুন।

চলো বনহুর তোমার সন্তানসহ চলো।

বৈজ্ঞানিক মিঃ মার্শাল লর্ড, বনহুর আর নূর এসে খাবার টেবিলে বসলো। একজন অদ্ভুত পোষাক পরা লোক কয়েক কাপ ধূমায়িত চা এনে রাখলো। বনহুর আর নুর সম্মুখে প্লেট টেনে নিতেই মিঃ লর্ড দীপ্ত মুখে গরম এবং মরচে অথচ নরম পরোটা তুলে দিলো তাদের প্লেটে। হেসে বললেন মিঃ লর্ড লজ্জা করো না, যা পারবে খাবে। যা ভাল লাগবে বেশি করে উঠিয়ে নেবে।

বনহুর তাকালো নূরের মুখের দিকে।

নুর মিঃ লর্ডের কথাবার্তা এবং চালচলনে বিস্মিত হয়েছে। তার আচরণে মনে হচ্ছে তিনি পরম সুখী এবং এই বৃহদাকার রাজমহল সম ঐশ্বর্যের একচ্ছত্র অধিপতি। বনহুর ও নূর যেন তারই মেহমান।

মিঃ লর্ড নাস্তা খাচ্ছিলেন এবং পরিবেশন করছিলেন। তারই ফাঁকে ফাঁকে গল্প করছিলেন তাদের মধ্যে কথাবার্তা সব ইংরেজীতেই হচ্ছিলো। মিঃ লর্ড এক সময় বললেন–আমার গবেষণা চলছে আমার ইচ্ছা মত। নূর তোমাকে আমি আমার গবেষণাগার দেখাবো। বনহুর আমার গবেষণা প্রয়োজনে যা দরকার সব পূরণ করে দিয়েছে। কিন্তু সব সময় একটা অভাব আমাকে বিদগ্ধ করছে তাহলে মেরীর অভাব…..গলাটা ধরে আসে তার। চোখ দুটো অশ্রুসজল হয়, একটু থেমে বললেন-মেরী কেমন আছে জানি না……ওকে পেলে আমার সব আশা পূর্ণ হবে।

বনহুর বললো—ঠিক আছে, আশা আপনার পূর্ণ হবে। আমি কথা দিলাম।

হাসি ফুটলো মিঃ লর্ডের মুখে।

খাবার খাওয়া শেষ করে উঠে পড়ে বনহুর আর নূর।

করমর্দন করেন বৈজ্ঞানিক মিঃ লর্ড উভয়ের সঙ্গে। তারপর সেখান থেকে বেরিয়ে আসে বনহুর আর নূর।

*

কিছুটা এনোর পর বনহুর একটি গুহাজাতীয় কক্ষের দরজায় এসে দাঁড়ালো। সেখানে অদ্ভুত ধরনের কালো পোশাক পরা চারজন লোক আগ্নেয় অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে আছে। বনহুরকে দেখা মাত্র তারা সেলুট করে সরে দাঁড়ালো।

বনহুর কিছু ইংগিত করতেই একজন ওপাশের দেয়ালে চক্রাকার একটি হ্যান্ডেল ঘোরাতে লাগলো। নূর অবাক হয়ে দেখলো সম্মুখস্থ দরজা ফাঁক হয়ে গেলো।

এবার নূরসহ বনহুর সেই মুক্ত দরজা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো। আরও অবাক হলো নূর, হাত-পা শৃংখলাবদ্ধ অবস্থায় একজন বসে আসে মেঝেতে। কক্ষটি আধো অন্ধকার, বনহুর প্রবেশ করতেই একজন মার্সাল হস্তে প্রবেশ করলো এবং সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল একপাশে।

বনহুর বললো–নূর এই সেই প্রখ্যাত হিরোইন ব্যবসায়ী সেকেন্দার শাহ। তোমার কোন প্রশ্ন থাকলে করতে পারো।

নূর বিস্ময় নিয়ে দেখছিলো। পিতার মুখে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো–সব প্রশ্নের সমাধান পেয়েছি! সেকেন্দার শাহ এখন তোমার করায়ত্ব। যতদিন তুমি হিরোইন উৎপন্নের মূল ঘাঁটি আবিষ্কার করতে না পারবে, ততদিন সেকেন্দার শাহর এই বন্দী জীবনের অবসান নেই আমি জানি। তুমি হিরোইন উৎপাদন ঘাঁটি আবিষ্কার করতে সক্ষম হবে এবং তা এই সেকেন্দার শাহর দ্বারাই সম্ভব করবে। আমার যদি প্রয়োজন মনে করো, তবে আমি তোমাকে প্রাণ দিয়ে সহায়তা করবো।

তোমার কথাগুলো ঠিক, আমি এই অসৎ ব্যক্তির জীবনাবসানের পূর্বেই তার দ্বারা হিরোইন প্রস্তাবের মূলকেন্দ্র আবিষ্কার করবো এবং বিধ্বস্ত করবে, তবেই আমার স্বস্তি এবং বনহুর সেকেন্দার শাহর দিকে লক্ষ্য করে বললো বনহুর—তুমি আমাদের আলাপ আলোচনায় সবকিছু বুঝতে পারছে। বুঝতে পারছো হিরোইন উৎপন্নকারী ঘাটির মূল কেন্দ্রস্থল কোথায়, তোমাকেই তার সন্ধান জানাতে হবে। যেমন করে জানিয়েছিলে কান্দাই নগরীর হিরোইন ঘাঁটি কোথায়। হাঁ, তোমার কথা মতই আমি হীরা ঝিলের অভ্যন্তরে খুঁজে পেয়েছিলাম কান্দাই নগরীর মূল শাখা এবং সমূলে কান্দাই নগরীর হিরোইন মূল ঘাটি বিধ্বস্ত করা সম্ভব হয়েছে।

বললো সেকেন্দার শাহ—আমার জীবন নিতে পারো তবুও সেই মূল ঘাঁটির সন্ধান তুমি আমার কাছে জানতে পারবে না…….

বনহুর গর্জন করে উঠলো–এই কি তোমার শেষ কথা সেকেন্দার শাহ?

হাঁ

সত্য বলছো?

সেকেন্দার শাহকে যত সহজ মনে করেছে বনহুর তত সহজ সে নয়। তবে কান্দাই নগরীর ঘাটির সন্ধান বা পথের নির্দেশ তোমাকে জানিয়েছিলাম জীবন রক্ষার্থে কিন্তু আমি এখন বুঝতে পারছি আমি মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে আছি। হিরোইন তৈরির মূলঘাটির সন্ধান আমি জানতে রাজি নই……দৃঢ়ভাবে কথাগুলো বললো বন্দী সেকেন্দার শাহ।

বনহুরের মুখমন্ডল কঠিন হয়ে উঠলো, দাঁতে দাঁত পিষে বললো—এটাই তোমার শেষ কথা?

হাঁ, আমি কিছুতেই বলব না।

মুহূর্তে বনহুরের হস্তস্থিত রিভলভার গর্জে উঠলো।

শুধু মাত্র একটি তীব্র আর্তনাদ।

সেকেন্দার শাহর দেহটা মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো।

বনহুর বললো—এসো নূর।

নূরের দু’চোখে বিস্ময় ঝরে পড়ছে সে পিতাকে নানা বেশে এবং বিভিন্ন পরিবেশে দেখেছে কিন্তু আজ তার পিতার নতুন এক রূপ সে দেখলো। একটি জীবন্ত কুকুর হত্যার মতই তার পিতা সেকেন্দার শাহকে বিনা দ্বিধায় হত্যা করলো। নূর কোন কথা না বলে বেরিয়ে এলো।

বললো বনহুর–দেখলে নূর নরশয়তান সেকেন্দার শাহর দুঃসাহস। মৃত্যুকে সে সানন্দে গ্রহণ করলো তবুও সে তাদের মূল ঘাটির সন্ধান জানাতে রাজি নয়। ওর উপযুক্ত শাস্তি দিলাম। তুমি বৈজ্ঞানিক মিঃ মার্শাল লর্ডকে দেখলে তার প্রতি আমি প্রসন্ন। দেশ ও জনগণের মঙ্গলই তার কামনা আর সেই কারণেই তার শত্রু অনেক, যারা অসৎ এবং অন্যায়কারী তারা তার মৃত্যু কামনা করে। তাকে হত্যার জন্য বিভিন্ন দেশের প্রখ্যাত ব্যক্তিগণ যারা কু’অভিসন্ধি নিয়ে ভাবছে তারা তাকে জীবিত রাখতে চান না। তাকে হরণ করার অভিপ্রায় নিয়ে যখন বিভিন্ন রাষ্ট্র গোপন ষড়যন্ত্র শুরু করে ছিলো আমি তখন তাকে সতর্কতার সঙ্গে সরিয়ে এসেছিলাম।

তুমি ঠিক কাজের মত কাজ করেছে। বৈজ্ঞানিক মিঃ মার্শাল লর্ডের প্রয়োজন আছে এবং তাকে রক্ষার জন্য তুমি যে রুচিশীল ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, তা সত্যি প্রশংসনীয়।

নূর খুশি হয়েছে তাহলে। হীরাঝিলের গহ্বরে যে মনোরম সুদৃশ্য গুহা বা কক্ষ গুলি দেখলে তা ঐ মিঃ মার্শাল লর্ডের চিন্তাধারার ফসল। তিনি এখন যে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন তা অতি বিস্ময়কর। হীরা ঝিলের অভ্যন্তরে বসে তিনি পৃথিবীর সর্বত্র সংবাদ জানতে পারেন এমন কি অনেক গোপনীয় বিষয় অবগত হতে পারেন। একটু থেমে বললো বনহুর সেকেন্দার শাহ কিছুতেই মুখ খুলতো না। তার দ্বারা হিরোইন প্রস্তুত ঘাটির কোন সন্ধান পাওয়া যেতো না, তাই তার অস্তিত্ব মুছে দিলাম। সে যেন আমার কোন সংবাদ বাইরে পরিবেশন করতে না পারে।

বনহুর এবার নূরসহ একটি গুহার মত কক্ষে প্রবেশ করলো এবং একটি লিফটে চেপে দাঁড়ালো। সুইচ টিপলো বনহুর, সঙ্গে সঙ্গে লিটখানা আরও গভীরে নেমে চললো। চারিদিক জমাট অন্ধকারে আচ্ছন্ন-দু’চোখে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। নূর নির্ভীক চিত্তে দাঁড়িয়ে আছে, পাশে তার পিতা স্বয়ং বনহুর। নূর ভাবছে, আজ যদি অপর কারো পাশে এমনিভাবে জমাট অন্ধকারে একটি অজানা জায়গায় থাকতো তা হলে নিশ্চয়ই সে ঘাবড়ে যেতো, তাতে কোন সন্দেহ নেই। নূর আজ এমন একজনের পাশে দাঁড়িয়ে আছে যে তার পরম আপনজন। কিন্তু একটু পূর্বেই যে রূপ তার দেখেছে তা যে কোন ব্যক্তির ভীতির কারণ।

বললো বনহুর–নূর সেকেন্দার শাহর প্রতি আমি এতোখানি নির্দয় হতাম না, যদি সে আমার বশ্যতা স্বীকার করতো। হিরোইন প্রস্তুত ঘাঁটির সন্ধানে আমাকে সহায়তা করত, তাহলে তার জীবন রক্ষার্থে আমি সহযোগিতা করতাম। সেকেন্দার শাহ কোথায় হারিয়ে গেলে কেউ জানবে না। সেকেন্ডার শাহ ছিলো কান্দাই নগরীর হিরোইন ব্যবসায়ীদের অধিনায়ক। তারই কু-পরামর্শে এবং চেষ্টায় গড়ে উঠেছে কান্দাই নগরীর বিভিন্ন জায়গায় হিরোইন ব্যবসায়ীদের গোপন আস্তানা। জানো নূর আমাদের দেশের মহাশক্তি হলো যুব সমাজ, দেশের মেরুদন্ড বলা যায়। সেই মহাশক্তিকে বিধ্বস্ত করার জন্য কোন কোন রাষ্ট্র সুকৌশলে এইসব মাদকদ্রব্য বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দিচ্ছে এবং যুবশক্তিকে বিনষ্ট করে তাদের উদ্দেশ্য পরিকল্পিতভাবে হাসিল করে নিচ্ছে এবং নেবার চেষ্টা করছে। নূর! তোমাকে আমি আমার আস্তানায় নিয়ে যাচ্ছি। সেখানে আমি বৈজ্ঞানিক মার্শালের দ্বারা এমন একটি যান তৈরি করে নিয়েছি যে, যানটি জলে স্থলে এবং আকাশে উড়তে পারে। আমি তোমাকে কয়েকদিন আমার আস্তানায় রাখতে চাই, কারণ তোমাকে যানটি চালানো শিখতে হবে। তুমি রাজি আছো?

হাঁ! হাঁ আব্বু  আমি রাজি।

কিন্তু তোমার মা–তিনি তোমাকে না দেখলে নিশ্চয়ই ভীষণ চিন্তিত হবেন। কাজেই আমি তোমার মায়ের পারমিশন ছাড়া……তবে তাকে সত্য কথা বললে তিনি আসতে দেবেন না। এ কারণে তোমাকে প্রতিদিন আমি আমার গাড়িতেই নিয়ে আসবো। হাঁ তাই ভাল হবে।

বেশ তাই হবে। বললো নূর।

*

মনিরার কোলে মাথা রেখে ছোট্ট শিশুর মতই বললো নূর—আম্মু! কিছুদিনের জন্য আমাকে বাইরে যেতে হচ্ছে। তুমি আমার জন্য অহেতুক চিন্তা-ভাবনা করো না। বলল আম্মু তোমার মত আছে?

নূর! সদা-সর্বদা তোর পিছনে বিপদ ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোথায় যাবি আবার নতুন কোন বিপদ তোকে গ্রাস করবে তাই তোর কোথাও যাওয়ার কথা শুনলে……

বড্ড ভীত হয়ে পড়ো তাই না?

হাঁ। হাঁ-রে তুই যে আমার নয়নের মণি।

তোমার নয়নের মণি বলেই তো তোমার কাছাকাছি থাকি আম্মু। লক্ষ্মী মা! তুমি অমত করো না।

জানি না কোথায় যাবি, কেমন থাকবি……

তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে আমি যেন কোন অতলে তলিয়ে যাচ্ছি। তুমি কিছু ভেবো না।

কবে যাবি? কার সঙ্গে যাবি, বলবি না?

 ফিরে এসে সব বলবো। প্রফুল্ল মুখে কথাগুলো বললো নূর।

মনিরা সন্তানের চুলে হাত বুলিয়ে বললো—কোন দিন কাউকে বিশ্বাস করিসনে বাবা। বন্ধু সেজে…….

মায়ের মুখে হাত চাপা দেয় নূর-না-না এমন জনের পাশে আমি থাকব, যাকে তুমিও অবিশ্বাস করতে পারো না।

বেশ, যা তুই ভাল বুঝিস কর, তবে আল্লাহর উপর বিশ্বাস রেখে সব কাজে পা বাড়াবি।

 নিশ্চয়ই তাই হবে।

নূর মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে ললাটে চুমু দিয়ে বললো—তুমি বড় বুদ্ধিমতী জননী আমার। এই তো সুন্দর কথা……আসি আম্মু।

নূর আলনা থেকে কোটটা নিয়ে গায়ে পরলো তারপর মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বেরিয়ে গেলো।

রাত তখন গভীর।

মনিরা ছুটে গেলো জানালার পাশে, জোছনার আলোতে সে স্পষ্ট দেখতে পেলো একটা মোটরকার দাঁড়িয়ে ছিলো বারান্দায়। নূর গাড়িতে চেপে বসতেই গাড়িখানা তাকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। শব্দ বিহীন, একটুও আওয়াজ হলো না। মনিরা বুঝতে পারলো এ গাড়ি নূরের নয়। গাড়িখানা সম্পূর্ণ অপরিচিত।

মনিরার মন অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠলো। না জানি কে বা কারা তার নূরকে এভাবে নিয়ে গেলো। মায়ের হৃদয় ডুকরে কেঁদে উঠলো, এমন কেউ নেই যার কাছে সব খুলে বলবো। বৃদ্ধা মামিমা শ্বাশুড়ীও বটে–তিনি ছিলেন একমাত্র অসময়ের সাথী। একটু ব্যথা বা দুঃখ পেলে মনিরা ছুটে যেতো তার পাশে। মনের সব কথা ব্যক্ত করতো তার কাছে! আজ তিনিও নেই, চির বিদায় নিয়ে চলে গেছে পরপারে। একমাত্র বৃদ্ধ সরকার সাহেব কালের ইতিহাস হয়ে বেঁচে আছেন, কিন্তু তিনি পূর্বের মত শক্তি সাহস যোগাতে পারেন না। বার্ধক্যের তাড়নায় তিনি নিজেই অচল পয়সার মত অবস্থা। মনিরা গভীর রাতে কার পাশে যাবে নূরের ব্যাপারে কিছু আলাপ আলোচনা করতে।

মনিরা নিজেও কেমন যেন ঝিমিয়ে পড়েছে। নানা চিন্তা তাকে দুর্বিসহ যন্ত্রণা দিচ্ছে। যখন মনিরা একা একা বিছানায় শুয়ে থাকে তখন নানা কথা মনে পড়ে, কত স্মৃতি মনের পর্দায় ভেসে উঠে। গ্রাম্য জীবন, বাবা-মার বড় আদরের ধন ছিলো মনিরা। শহরে এসেছিলো মামা-মামীর কাছে বেড়াতে, মামা-মামীর সঙ্গে তাদের কাছে থেকে লেখা-পড়া করবে। কিন্তু সে আসাই তার জীবনে শেষ আসা হলো। নৌকা ডুবিতে মামা-মামী হারালেন তাদের জীবনের প্রদীপ নয়নের মণি একমাত্র সন্তান মনিরকে। কোথায় হারিয়ে গেলো সে, তাকে আর তারা খুঁজে পেলেন না। সুদীর্ঘ সময় কেটে গেলো আর ফিরে এলো না মনির। মামা মামী তাকে আর গ্রামে পাঠালেন না, নিজ কন্যার স্নেহে প্রতিপালন করলেন, লেখা-পড়া শিখিয়ে তাকে মানুষ করলেন। মামা-মামীর যথেষ্ট আদর যত্নের ত্রুটি ছিলো না, যখন যা প্রয়োজন তার বেশিই সে পেয়েছে তাদের কাছে।

একদিন বয়স বাড়লো মনিরার। লেখাপড়াও শেষ হলো, উচ্চ ডিগ্রী লাভ করলো মনিরা। সেদিন মামা-মামীর কি আনন্দ! আজও সব স্পষ্ট মনে আছে মনিরার। নিজের অজান্তে মনিরার ভাল লেগেছিলো মামার ছেলে মনিরকে। তখন যে বয়স ছিলো মনিরার যে বয়সে প্রেম-ভালবাসা জন্ম নেবার কথা নয়, তবে ভাল লাগতো মনিরকে তার।

মনির নৌকা ডুবিতে হারিয়ে যাবার পর মামা-মামী উম্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন। মনিরা বালিকা মাত্র, তবুও তার মনেও বড় ব্যথা জেগেছিলো। সত্যি মনির ভাইয়াটা কোথায় হারিয়ে গেলো। মাঝে মাঝে একা বসে থাকতো সে। একটি সুন্দর মুখ সুন্দর হাসি, সুন্দর করে কথা বলার ভঙ্গি, বালক হলেও মনির ছিলো শিশুকাল থেকেই গম্ভীর প্রকৃতির। শুধু বাবা-মাই নন সবাই মনিরকে ভালবাসতো, স্নেহ করতো, তাই হয়তো বালিকা মনিরারও ভাল লাগতো ওকে। মনিরা যখন স্কুল ত্যাগ করে কলেজে জীবন শুরু করলো, তখনও মনির সে ভুলতে পারেনি। প্রায়ই তার মনের গহনে একটি মুখ ভেসে উঠতো, তখন তন্ময় হয়ে ভাবতে মনিরা, ছোট বেলার অনেক কথাই মনে হয় মনিরার। তারপর বিস্ময়কর ভাবে পুনঃ সাক্ষাৎ ঘটলো তার প্রিয়জন হারিয়ে যাওয়া সেই মনিরের। তখন সে পূর্বের সেই ছোট্ট বালকটি নেই, অদ্ভুত সুন্দর সুপুরুষ বলিষ্ঠ এক যুবক মনির। পৌরুষ দ্বীপ্ত কণ্ঠস্বর, চোখ দুটি তার বড় আকর্ষণীয়। প্রথম চিনতেই পারেনি মনিরা এই সেই মুনির, যার কথা সর্বক্ষণ তার মানস পটে ভাসছে। পরিচয় ঘটলো বিস্ময়কর ভাবেই, অপহরণ করতে এসেছিলো সে তার অংগুলির হীরক আংটি জন্মদিনে মামা-মামীর মহামূল্য উপহার। দস্যু বনহুর তার শয়ন ঘরে প্রবেশ করেছিলো, কিন্তু নিতে পারেনি তার অংগুরাটি-পরিচয় ঘটেছিলো সেদিন…..

হঠাৎ একটি পরিচিত কণ্ঠস্বর-কি ভাবছো মনিরা?।

চমকে ফিরে তাকালো মনিরা—মুহূর্তে তার চিন্তা-ধারা বিচ্ছিন্ন হলো। বিস্ময় ভরা কণ্ঠে বললো—তুমি!

হাঁ! কেমন আছো মনিরা?

যেমন রেখেছো তেমনি। এমন করে হারিয়ে যাও, বেঁচে আছে কিনা তাও জানি না। জানি না তুমি কেন আমাকে তোমার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে এভাবে জীবন্ত করে রেখেছো?

লক্ষীটি সব জেনে শুনে তবুও রাগ করো আমার উপরে শোন মনিরা সত্যি আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না তবুও আমার অজান্তে তুমি ব্যথা পাও। জানি না মনিরা! আমি তোমাকে কোনদিন খুশি করতে পারবো কিনা। হয়তো সত্যি সত্যি একদিন হারিয়ে যাবো আর ফিরে আসবো না কোনদিন।

মনিরা স্বামীর মুখে হাত চাপা দেয়।

বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলে মনিরা–এমন কথা বলো না। তোমাকে হারিয়ে আমি বেঁচে থাকবো। চাই না এমন জীবন……একটু থেমে বললো–মনিরা জানো নূর এখন কোথায়? ওর জন্য সদা-সর্বদা উদ্বিগ্ন রয়েছি। কখন কোন বিপদ আসে কেহ জানে না। মামী-মা ছিলেন, তার কাছে বসে সান্তনা পেতাম। সরকার সাহেব ভীষণ অসুস্থ, তিনি আর বোধ হয়। বাঁচবেন না।

হাঁ তার জন্য আমি ডাঃ মোর্শেদকে বলেছি তিনি আসবেন।

তাহলে তুমি জানো সরকার সাহেব অসুস্থ?

জানতাম। মনিরা যেখানেই থাকি সব সংবাদ রাখি। সরকার সাহেবের জন্য আমি কিছু ফল এনেছি চলো তাকে দেখে আসি।

সরকার সাহেবকে দেখতে যাবার পূর্বে তোমার সঙ্গে কথা আছে মনিরা।

 বলো?

নূর হঠাৎ কোথায় যায়, কেন যায় কিছু জানি না। ওকে নিয়ে আমার ভীষণ ভয় হয়……

হেসে বললো বনহুর—তুমি অহেতুক ভাবো মনিরা। নূর এখন বেশ বড় হয়েছে, জ্ঞান বুদ্ধিও কম নয়। তাছাড়া……

শোন, মনির ও আজ একটু পূর্বে কোথায় চলে গেলো। আমি এই জানালায় দাঁড়িয়ে দেখলাম, আমাদের বাড়ির সামনে একটি গাড়ি অপেক্ষা করছে, গাড়িখানা যে নূরের নয় তা বেশ স্পষ্ট বুঝতে পারলাম।

মনিরা, ওকে যারা নিয়ে গেছে, তারা আমার পরিচিত। তুমি ওর জন্য ভেবো না। প্রায়ই ও যাবে তারপর যখন নূর তার সাধনা শেষ করবে তখন তার নতুন এক জীবন লাভ হবে।

এ তুমি কি বলছ? আমার নূরকে নিয়ে তুমি আবার খেলা শুরু করলে……..মনিরা স্বামীর জামার কলার চেপে ধরলো, রাগত কণ্ঠে বললো—নিজেই তুমি আমার ধরা ছোঁয়ার বাইরে, আবার নূরকে কেড়ে নিতে চাও আমার কাছ থেকে? বলল ওকে তুমি আর…

মনিরা, ওর প্রতি আমার কি মায়া নেই যেখানেই যাক, সে তোমার পাশে ঠিকই ফিরে আসবে। একটু থেমে বললো—সে অন্যান্যদের মত নয়, তার চিন্তাধারা অনেক বড়।

তাই বলে সে তোমার মত……

 আবার হেসে বললো বনহুর—আমার মত হবে না মনিরা। তুমি নিশ্চিন্ত থেকো।

মনিরা স্বামীর বুকে মুখ লুকিয়ে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললো—ওগো সব হারিয়ে আমি নিঃস্ব, তবুও কি তোমার একটু করুণা হয় না? তুমি পুরুষ, তাই আমার ব্যথা বুঝবে না।

আবার তুমি অবুঝের মত কথা বলছো মনিরা। আমি সব জানি আর বুঝি, তবুও নিজের স্বভাব পারি না পালটাতে।

এবার তোমাকে স্বভাব পাল্টাতে হবে। আমি তোমাকে যদি পুলিশে ধরিয়ে দিই।

খুব ভাল। পাঁচ লাখ ডলার আসবে তোমার হাতের মুঠায় তোমাকে আর ভাবতে হবে না কিছু।

ঠাট্টা করছে। তোমাকে ধরিয়ে দিবো, কিন্তু একটি পয়সাও আমি নেবো না।

 বেশ তো, এটা আরও ভাল। কান্দাই সরকার তোমাকে যথেষ্ট সম্মান দেবেন এবং…..

চাই না আর শুনতে।

বেশ এবার চলোসরকার চাচাকে দেখে আসি।

চলো–বললো মনিরা।

সরকার সাহেব হল ঘরের পাশের কক্ষে থাকতেন। কক্ষে প্রবেশ করে বনহুর সরকার সাহেবের বিছানায় গিয়ে বসলো, ডাকলো-সরকার চাচা! সরকার চাচা……।

মনিরা পাশে দাঁড়িয়ে রইল, তার চোখ দুটি অশ্রুসজল হয়ে উঠেছে। যারা সরকার সাহেবের সেবায় নিযুক্ত ছিলো তারা এক পাশে দাঁড়ালো, প্রায় তিন-চারজন সব সময় বৃদ্ধ সরকার সাহেবের সেবা-যত্নে নিযুক্ত ছিলো বা থাকে।

বনহুরের ডাকে চোখ মেললেন সরকার সাহেব, একটা আনন্দদূতি খেলে গেলো তার চোখে, ক্ষীণজড়িত কণ্ঠে বললেন–মনি-এসেছো বাবা! আঃ! কি আনন্দ হচ্ছে আমার। অনেক দিন থেকে তোমার দেখা নাই, ভীষণ চিন্তায় ছিলাম। এসেছো ভালই হলো বাবা……

বনহুরের চোখ দুটো অশ্রুসজল হলো, মৃত্যু পথের যাত্রী হয়েও সরকার সাহেব তার জন্য ভাবছেন, কত ভাল বাসতেন তিনি। যদিও বনহুরের তেমন করে মনে নাই, তবুও স্মরণ হলো বহুদিন পূর্বের কথা। বনহুর তখন বালক মাত্র, সরকার সাহেব সব সময় তাকে কাছে কাছে নিয়ে রাখতেন। পাশে বসে পড়াতেন, সবে তখন বনহুর দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়াশোনা করতো। দুষ্টোমি করতো সে, সরকার সাহেব কাঁধে নিয়ে ঘোরাতেন, কখনও বা পিঠে চাপিয়ে নিজে ঘোড়ার মত হামাগুড়ি দিতেন। নিজের বিছানায় শুইয়ে ঘুম পাড়াতেন, সব ঝাপসা মনে পড়ে তার। আজ সেই সরকার সাহেব মৃত্যু শয্যায় শুয়েও ভাবছেন তার কথা। বনহুর সরকার সাহেবের হাত দুখানা চেপে ধরে বললো–সরকার চাচা আপনার কি কষ্ট হচ্ছে।

না না বাবা, কোন কষ্ট হচ্ছে না, তবে বয়স হয়েছে বুকে বড় যন্ত্রণা হয়। মাঝে মাঝে দম বন্ধ হয়ে আসে, কেমন যেন সব এলো মেলো হয়ে যায়।

আমি বড় ডাক্তার আনবে সরকার চাচা। অনেক দিন দূর দেশে ছিলাম তাই আপনাদের খোঁজ খবর ঠিক মত নেওয়া হয়নি।

তুমি ভাল আছো, এবার আমি সেরে উঠবো। সব সময় তোমার কথা ভেবে ভেবে আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। এবার ঠিক সেরে উঠবো।

বৃদ্ধ সরকার সাহেবের গন্ড বেয়ে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। বনহুর নিজের হাতে মুছিয়ে দিলো তার চোখের পানি।

*

 বনহুর নূরের পিঠ চাপড়ে দিলো—আমি জানতাম তুমি পারবে। আর সে জন্যই আমি তোমাকেই বেছে নিয়েছি নূর।

যানটি চালনা বনহুর স্বয়ং বৈজ্ঞানিক মার্শাল লর্ড এর কাছ থেকে জেনে নিয়েছিলো। বনহুরই নূরকে নিজে শিখিয়ে নিলো অত্যন্ত কৌশলে। এতো সহজে নূর এমন একটি বিস্ময়কর যান চালানো শিখবে বা শিখতে পারবে ভাবতে পারেনি।

মাত্র কয়েক দিন তারই মধ্যে নূর বিস্ময়কর যানটি দক্ষ চালকের মত শিখে নিতে সক্ষম হলো। আনন্দ ধরে না বনহুরের। বৈজ্ঞানিক মার্শাল লর্ডও খুশি হলেন। সুদীর্ঘ সময়ে যে যানটি তিনি তৈরি করতে পেরেছেন–তা নূরের মত কম বয়সী একটি তরুণ এতো সহজে জলে স্থলে এবং আকাশে চালনা করতে পারবে তিনি যেন ভাবতেই পারেননি।

বনহুর আর বৈজ্ঞানিক মার্শাল কান্দাই পর্বতমালার নিভৃত এক সমতল স্থানে দন্ডায়মান ছিলো, সম্মুখে সেই অদ্ভুত যানটির নাম কোয়িংগো যান। নূর যানটির অভ্যন্তরে গিয়ে বসলো, তার শরীরে জমকালো বিস্ময়কর পোষাক। মাথায় ক্যাপ, মুখে অক্সিজেন ভরা পাইপ বক্স।

যানটি আজ আকাশে ভাসবে, উড়বার পূর্বে নূর বিস্ময়কর পোষাকে সজ্জিত হয়ে নিয়েছিলো। যে যানটির সুইচ টিপবার পূর্বে বনহুর এবং বৈজ্ঞানিক মার্শালকে লক্ষ্য করে হাত নাড়লো।

বনহুর আর বৈজ্ঞানিক মার্শাল এর মুখে হাসির আভাস। তারাও হাত নেড়ে তাকে অভিনন্দন জানালো।

যানটি উড়ে উঠলো আকাশে এবং মুহূর্তে উধাও হয়ে গেলো। মেঘের অন্তরালে অদৃশ্য হবার সঙ্গে সঙ্গে বনহুর আর বৈজ্ঞানিক মার্শাল লর্ড হেসে উঠলো হো হো করে। আনন্দে আপুত ভরা দুজন।

ঘন্টা দুই কাটার পর পুনরায় শব্দবিহীন সেই বিস্ময়কর যানটিসহ ফিরে এলো নূর।

বনহুর আর মার্শাল লর্ড দাঁড়িয়ে ছিলো, তারা প্রতীক্ষা করছিলো নূরের। নূর যান থেকে অবতরণ করতেই বনহুর তাকে জড়িয়ে ধরলো–সাবাস নূর। সাবাস

নূর তৃপ্তির হাসি হাসলো।

বৈজ্ঞানিক মার্শাল লর্ড প্যান্টের পকেট থেকে একটা ম্যাপ বের করে নূরের হাতে দিলো এবং বললোবৎস! তোমাকে এই ম্যাপ ধরে কাজ করতে হবে। এসো আমার সঙ্গে।

বনহুর আর নূরকে নিয়ে কান্দাই পর্বতের একটি গুহায় প্রবেশ করলো বৈজ্ঞানিক মার্শাল লর্ড। একটি পাথরের উপরে ম্যাপটি মেলে ধরে বললো—এই শহর ইথোল মাংলুতে। এখানে যেতে মাত্র আধ ঘণ্টা লাগবে। মাংলু আমেরিকার একটি পল্লী অঞ্চল। এখানেই জন্ম, তবে বেশি দিন আমি সেখানে বসবাস করতে পারিনি, বাবার সঙ্গে চলে গিয়েছিলাম হ্যারিসনে। সেখানে বাবা একটা কোম্পানীতে শ্রমিকের কাজ করতো। যখন লেখাপড়া শেষ করলাম, তখন বাবার মৃত্যু ঘটলো, সে মৃত্যু মর্মান্তিক। মাকে হারিয়েছিলাম শিশুকালে, বাবা মার্শাল ড্র আমাকে মা ও বাবার স্নেহ দিয়ে লালন-পালন করেছিলেন তাই বাবার মর্মান্তিক মৃত্যু আমাকে ভীষণ ব্যথিত করে তুলে ছিলো। এরপর নিজকে বড় অসহায় মনে করলাম, এমন সময় বৈজ্ঞানিক মিঃ আয়রুব-এর সঙ্গে পরিচয় ঘটলো এবং সেই থেকে আমি তার সঙ্গেই রয়ে গেলাম। আয়রুব আমাকে তার কাজের সাহায্যকারী হিসাবে গ্রহণ করবেন। মিঃ আয়রুবের আরও কয়েকজন সাহায্যকারী ছিলো, তবুও তিনি আমাকেই বেশি স্নেহ করতেন। কারণ আমার মধ্যে তিনি নাকি একটি ঘুমন্ত প্রতিভার সন্ধান পেয়েছিলেন। ইতিমধ্যে আমি বিয়ে করেছি, আর একটি কন্যা সন্তানও জন্ম গ্রহণ করলো, তবুও আমার কাজে কোন শিথীলতা এলো না। সমস্ত দিন আমি বৈজ্ঞানিক আয়রুর সঙ্গে কাজ করতাম, রাতে ফিরে আসতাম বাসায়। স্ত্রী মাঝে মাঝে রাগ করতেন। কারণ আমি বড় বেখেয়ালী হয়ে পড়েছিলাম তাদের ব্যাপারে। আমার স্ত্রী ক্যাথেলোও চাকরী করতো একটি ফার্মে। ভালো টাকা বেতন পেতো, সংসারে কোন অভাব ছিলো না। আমার স্ত্রী ক্যাথেলো চালিয়ে নিতো সবকিছু। তার রাগ অভিমান স্বামীকে সে কাছে পেতো না বলে এবং একমাত্র কন্যা মেরীর দিকে আমার তেমন লক্ষ্য ছিলো না বলে। একটু থামলো মিঃ লর্ডমেরীর যখন বয়স সাত কিংবা আট হবে, সেই সময় গাড়ি এ্যাক্সিডেন্টে প্রাণ হারালেন আমার স্ত্রী ক্যাথোলা। ভাবলাম, ভালই হলো, রাত করে বাড়ি ফিরলে আর কেউ বকা-ঝকা করবে না। কিন্তু যন্ত্রণা হলো মেরীকে নিয়ে বেচারী বড় একা…..একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো মিঃ লর্ডের বুক চিরে, বাম হাতে চোখ রগড়ে বললো মিঃ লর্ড–অনেক কষ্টে মেরী বড় হলো। লেখাপড়াও শিখলো, বড় আদরের ধন আমার, কিন্তু তাকে রাখতে পারলাম না। আমার শত্রু যারা তারা তাকে বিভ্রান্ত করলো। জানি না এখন সে কোথায়, কেমন আছে…..

তারপর বললো—-হয়তো মেরী হ্যারিশনেই আছে। আমার মন বলছে তাকে হ্যারিশনেই পাওয়া যাবে।

বনহুর বললো ঠিক আছে, আমি নূরকে সহায়তা করবো মেরীকে যেন আপনার পাশে সে এনে দিতে পারে। আপনি তার একখানা ছবি ওকে দেবেন। কারণ আপনার মেরীকে চিনবার জন্য ওটা প্রয়োজন হবে।

বৈজ্ঞানিক মিঃ মার্শাল লর্ড-এর চোখ দুটো দীপ্ত উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। একটা আশার আলো তার মনের আকাশে জ্বলন্ত তারার মত জ্বলে উঠলো যেন।

বনহুর ম্যাপখানায় মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলো।

মাঝে মাঝে নূরকে কিছু বুঝতে দিচ্ছিলো এবং মার্শাল লর্ডের সঙ্গেও আলোচনা করছিলো।

নূর শুনছিলো মনোযোগ সহকারে।

*

নতুন এক জীবন ফিরে পেলো নূর। বিস্ময়কর যানের বিস্ময়কর চালক সে। যানটি তাকে শুধু অভিভূতই করেনি, দিয়েছে নতুন স্বাদ। সব সময় ঐ একই চিন্তা, তাকে ঐ বিস্ময়কর যান নিয়ে যেতে হবে নতুন এক দেশে এবং তাকে খুঁজে বের করতে হবে বৈজ্ঞানিক মিঃ মার্শালের কন্যা মিস মেরীকে। নূর বালিশে হেলান দিয়ে ভাবছিলো মিস মেরীর কথা। ছবিখানা এখনও তার পকেটে। নূর বের করলো পকেট থেকে মেরীর ছবিটা। চোখের সামনে ধরে ভালভাবে লক্ষ্য করতে লাগলো। সে জানে না মেরী এখন কোথায়, সে জীবিত আছে। কিনা, তাও জানেন না মিঃ মার্শাল লর্ড।

নূর যখন মিস মেরীর ছবি নিয়ে ভাবছিলো তখন হঠাৎ পরিচিত কণ্ঠস্বর তাকে চমকে দিলো।

-নূর কি ভাবছো একা একা?

–কে? আরমান! আরে তুমি? এতোদিন কোথায় ছিলে?

আরমান হাস্য উজ্জল দীপ্ত মুখে নুরের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো—-তোমার খবর কি বলল? তারপর আমার কথা। কথাটা বলে বসে পড়লো আরমান নূরের শয্যার পাশের চেয়ারটায়।

নূর আরমানের অলক্ষ্যে হাতের মুঠায় মেরীর ছবিখানা গোপন করে পুনরায় রেখেছিলো বালিশের তলায়।

বললো নূর—অনেক দিন ডুব দিয়েছিলে হঠাৎ আবির্ভাব, ব্যাপার কি বলো তো?

কোন কারণ থাকে যেমন ধরো তুমি নতুন কিছু আবিষ্কারে মেতে আছ আমিও তেমনি কিছু কাজে আত্মনিয়োগ করেছি।

তা বটে।

 তবে তোমার আবিষ্কার আর আমার আত্ননিয়োগে কিছু পার্থক্য আছে।

তা তো থাকবেই বন্ধু। আমি আর তুমি যখন একত্রে বিদেশ গেলাম উচ্চ ডিগ্রি লাভের জন্য তখনও আমাদের দুজনার শিক্ষার পথ ছিলো আলাদা। আমি আত্ননিয়োগ করেছিলাম গোয়েন্দা বিভাগে আর তুমি ব্যবসা ক্ষেত্রে। তারপর ফিরে এসে যে যার কাজে……

হা, কিন্তু তুমি সহজেই নিজকে ডুবিয়ে দিলে আর আমি ব্যবসার কোন হদিস খুঁজে পেলাম না। আমার প্রয়োজন অর্থের…চাই অনেক পয়সা…তাই ব্যবসা আমার নাগালের বাইরে চলে গেলো। আমি যেই হারিয়ে গেলাম…তুমি তা জানো। একটু থেমে বললো আরমান—সে অভাব আমার দূরে সরে গেছে এখন আমি বাবসায়…থাক ওসব কথা আজ কি কারণে তোমার সাক্ষাৎ লাভ করতে এলাম শোন নূর।

বলো? নূর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে তাকালো আরমানের মুখের দিকে। আজ আরমানকে এক নূতন রূপে দেখছে যেন নূর।

আরমান একটি সিগারেট ধরালো অপর একটি সিগারেট বাড়িয়ে ধরলো নূরের দিকে। নূর সিগারেটটি নিয়ে আংগুলের ফাঁকে চেপে ধরে বললো—আরমান আমি নতুন একটি ম্যাচ কিনেছি ম্যাচটি কিছু বিস্ময়কর। বসো ম্যাচ বাক্সটি নিয়ে আসি..নুর সিগারেটটি আংগুলে রেখে ম্যাচ বাক্সটি নিয়ে এলো এবং ম্যাচ জ্বেলে সিগারেটটি ধরালো।

আরমান তীব্র কটাক্ষে চেয়ে ছিলো নূরের মুখের দিকে।

নূর হেসে বললো—দেখলে বন্ধু এ ম্যাচ বাক্সটি কেমন, সিগারেটের পাশে ধরলে এমনিতেই জ্বলে উঠে এবং ম্যাচের আগুন মোটেই নজরে পড়েনা।

আরমান বললো–হাঁ তোমার ম্যাচ বাক্সটি সত্যি আশ্চর্য বটে। নইলে..

বলো থামলে কেনো? বললো নূর! আচ্ছা আরমান তোমার কি যেন আলাপ ছিলো আমার সঙ্গে? যে কারণে তুমি হঠাৎ করে আমার সান্নিধ্যে এসে পড়েছো?

হাঁ ছিলো কিন্তু আজ নয় আবার এক সময় আসবো তখন তুমি প্রস্তুত থেকো আমার কথাগুলো শোনার জন্য।

আরমান আমি সব সময় প্রস্তুত আছি বা থাকবো।

তা হলে আজ উঠি কেমন?

যেতে পার।

আরমান উঠলো এবং যেমন দ্রুত এসেছিলো তেমনি বেরিয়ে গেলো।

আরমান বিদায় হবার সঙ্গে সঙ্গে নূরও উঠে পড়লো এবং পাশের ঘরে টেবিলে ম্যাচ বাক্সটা রেখে তার নিজ সিগারেট কেসটা তুলে নিলো হাতে। বের করলো আরমানের দেওয়া সিগারেটটা। হাতে নিয়ে আপন মনে হাসলো নূর। সিগারেটটি যে মারাত্নক একটি অস্ত্র তাতে কোন সন্দেহ নাই। সিগারেটটিতে অগ্নিসংযোগ করার সঙ্গে সঙ্গে একটি সূতীক্ষ ক্ষুদে বোম তার মুখ গহবর ভেদ করে বেরিয়ে যেত তার ঘাড়ের পিছন অংশ দিয়ে। এতোক্ষণে নূরের প্রাণহীন দেহ শয্যায় তার বালিশের উপর পড়ে থাকতো। উঃ! কি সাংঘাতিক রূপ ধারণ করেছে আরমান। তাকে হত্যার কারণেই সে এসেছিলো তাতে কোন সন্দেহ নেই। আরমান তা হলে বন্ধু বেশে নরশয়তান শত্ৰু……

যতই ভাবে নূর ততই সব ঘোঘালাটে হয়ে আসে। আর একদিনের কথা মনে পড়ে, তার শয়ন কক্ষে কে যেন প্রবেশ করে তাকে আচম্বিতে সাবধান করে দিয়েছিলো, তবে কি সেও আরমানের ইংগিত। সে এমন কোন ব্যবসায় আত্মনিয়োগ করেছে যা থেকে সে পাচ্ছে কোটি কোটি টাকা। তাকে মানুষ থেকে পশুতে পরিণত করেছে।

নূর জানত আরমানের পয়সার অভাব আছে। তবে একেবারে গরিব শ্রেণীর সারিতে নয়। আর তার স্বভাবও ছিলো সৎ মহৎ চরিত্রবান আর সেই কারণেই নূর তাকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করেছিলো কিন্তু সেই আরমান তাকে এসেছিলো কৌশলে হত্যা করতে। ভেবেছিলো। সামান্য একটা সিগারেটে ক্ষুদে আগ্নেয় অস্ত্র সংযোগ করে তাকে নিভৃতে খুন করে নির্বিঘ্নে বেরিয়ে যাবে।

সব কৌশল তার ব্যর্থ হলো। আরমান মনে করেছে আমি কিছু বুঝতে পারিনি। তার অস্ত্রটা কাজ করেনি। কাজ করেনি বলেই বিফল হৃদয় নিয়ে ফিরে গেলো আরমান কিন্তু সে আবার আসবে এবং বন্ধু সেজেই আসবে। হাঁ ওকে পরীক্ষা করার জন্যই নূর কিছুই জানেনা বা বুঝতে পারেনি তেমন ভান করতে হবে।

নূর বেশ কিছু সময় ধরে মেঝেতে পায়চারী করতে করতে অনেক কিছু ভাবলো।

পরদিন নূর সকালে চা নাস্তা করেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। ড্রাইভার গাড়িতে বসতেই বললে নূর তোমাকে যেতে হবেনা। আমিই গাড়ি নিয়ে যাবো।

ড্রাইভার বিনা বাক্যে নেমে পড়লো।

 নূর গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। সোজা সে আরমানদের বাসায় এসে হাজির হলো।

আরমান নুরকে পেয়ে খুশিতে উচ্ছল হয়ে উঠলো। করমর্দন করে বললো সে–বন্ধু কি ব্যাপার? হঠাৎ যে আগমন?

অনেকদিন পর সেদিন গেলো তাই বারবার তোমার কথা মনে হচ্ছিলো। এ জন্যই এলাম কেমন ভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে……

আরে বসো বসো, সব দেখবো, বলবো, তাছাড়া কথা আছে তোমার সঙ্গে। কথাগুলো বললো আরমান।

নূর আসন গ্রহণ করে বললো—তা হলে এসে ভালই করেছি কি বলো?

তা তো নিশ্চয়ই। বন্ধু আজ কাল টাকা ছাড়া মানুষের কোন মূল্যই নাই। মানুষ টাকা ছাড়া শুকনো নারকেল ছোবড়া বুঝলে?

হাঁ তা অবশ্য ঠিক আর টেরও পাচ্ছি হাড়ে হাড়ে। প্রতিটি কাজে চাই টাকা। মনের খেয়ালে বেছে নিলাম মস্ত বড় ডিটেকটিভ হবো কিন্তু এখন দেখছি কাজটা খুব সুবিধার নয়। জীবনে জয়ী হতে পারবো কিনা সন্দেহ আছে। যেখানেই যাই, যে কাজেই অগ্রসর হই শুধু কষ্ট আর যন্ত্রণা। এ বয়সে কম নির্যাতন পোয়াতে হয়েছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলো নূর। অবশ্য ইচ্ছা করেই সে এ কথাগুলো বললো।

আরমান বললো—-এততদিনে তোমার হুস হয়েছে কি বল?

হাঁ বন্ধু এ কথা মিথ্যা নয়। ললাটে চিন্তা রেখা ফুটে উঠলো নুরের।

 আরমান বললো—বলো বন্ধু তুমিই বলো অর্থ ছাড়া কেউ চলতে পারে?

মোটেই না।

 তুমি হাত মিলাও আমার সঙ্গে……হাতখানা বাড়িয়ে দিলো আরমান, নূরের দিকে।

নূর মৃদু হেসে নিজের হাতখানা বাড়িয়ে আরমানের হাতে হাত মিলালো।

এবার বললো—–যাক যা হবার হয়ে যেতো সবই ভাল। বন্ধু তোমার মত দক্ষ একজন সহায়ক হলে আমাদের ব্যবসা চলবে ভাল। বলল এবার কি খাবে?

যা তোমার খুশি।

আরমান সুইচ টিপলো সঙ্গে সঙ্গে সম্মুখস্থ টেবিলের কভার সরে গেলো। অবাক হয়ে দেখলো নূর টেবিলে নানা ধরনের খাদ্য সম্ভার থরে থরে সাজানো রয়েছে। এমন কি টি পটে গরম কফি থেকে ধূম্র নির্গত হচ্ছে। নূর একটি আপেল তুলে নিলো হাতে।

নূর আপেলটা দাঁত দিয়ে কামড়ে খেতে খেতে বললো—ভারী মিষ্টি কিন্তু!

 বললো আরমান–ফলগুলো কান্দাই এর বাইরে থেকে আনা।

ফল খেতে খেতে নানা রকম গল্প চললো দু’বন্ধুর মধ্যে। নূর মাঝে মাঝে অন্যমনস্কা হয়ে পড়ছিলো। ভাবছিলো অনেক কথা, আরমান তার ব্যবসায় তাকে পার্টনার করে নিতে চায়। হাঁ তাকে আপাততঃ ওর পার্টনার হিসাবেই কাজ করতে হবে। কিন্তু জীবন নাশের ভয়ও আছে, আরমানকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করা যাবেনা কারণ তার সেই রাত্রির কথা মনে হচ্ছে, অদ্ভুত সেই সিগারেটটি যদি সেদিন নূর পান করতে যেতে তা হলে কি মর্মান্তিক মৃত্যুইনা ঘটতো তার।

আনমনা হয়ে পড়েছিলো নূর হঠাৎ আরমানের কথায় সম্বিৎ ফিরে পায় সে। বলে আরমান–আমার এ সব দেখে ভাবছিস কেমন করে হলো তাই না?

নূর বললো–অবাক হওয়ার কথাই বটে। জিন্দেগী ভর উপার্জন করে তোমার মত ধনকুবেরু হওয়া সম্ভব হবে না।

তা সত্যি ক’দিন পূর্বেই কি ছিলাম আর এখন কি হয়েছি।

সত্যি বলছো আরমান আমায় তুমি তোমার ব্যবসায় পার্টনার করে নেবে?

 আরমান যা বলে সত্যি।

বেশ আজ তাহলে উঠি সময় করে আবার আসবো।

 অবশ্য এসো কিন্তু বন্ধু…..

 নূর মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানিয়ে বেরিয়ে গেলো।

আরমান আপন মনে হেসে উঠলোহাঃ হাঃ হাঃ নুর তোমাকে হাতের মুঠায় আনাই আমার মূল উদ্দেশ্য। তুমি জানোনা তোমার বন্ধু আরমান পূর্বের সেই আরমান নেই, সে এখন অনারূপ ধারণ করেছে… তোমাকে করায়ত্ব করাই আমার ব্রত……কলিংবেল টিপলো আরমান।

পাশের দেয়াল সরে গেলে বেরিয়ে এলো একটি জোয়ান ভদ্র বেশী লোক। লোকটার চোখ যেন শার্দুলের চোখের মত হিংস্র। কর্কশ কণ্ঠে বললো—আমি ওকে দেখে রেখেছি। স্যার। যে কোন অবস্থায় ওকে আমার চিনতে ভুল হবে না। সুদর্শন বটে।

হাঁ বন্ধুর যেমন রূপ তেমনি গুণ। ডিটেকটিভ নুরুজ্জামান চৌধুরী। বিদেশ থেকে গোয়েন্দা বিভাগে উচ্চ ডিগ্রিলাভ করে এসেছে। দক্ষ গোয়েন্দা সে।

ওসব কিছু চলবে না, কোন বাহাদুরীই আমার নাগপাশ থেকে বেরিয়ে যেতে পারবে না। বললে যে কোন মুহূর্তে খতম করে দেবো নেংটি ইঁদুরের মত।

না সেদিন এমনও আসেনি। প্রথম যাত্রা যখন রক্ষাই পেলো তবে ওকে নিয়ে আমি কিছু খেল খেলতে চাই। ওরে সম্মুখে রেখে কাজ করতে চাই। গ্লেলিস তুমি সাবধানে ওকে ফলো করবে।

বুকে হাত রেখে বললো গ্লেলিস-স্যার, আপনার নির্দেশ ঠিক ভাবেই পালন করবো।

আরমান একটা সুইচ টিপলো, সঙ্গে সঙ্গে ওপাশের দেয়ালে একটা ছোট্ট আলো জ্বলে উঠলো–তাতে কয়েকটি অক্ষর ফুটে উঠলো। এবার আরমান বললো—ঐ দেখো আমার বন্ধু গাড়ির নম্বর। মনে রেখো গ্লেলিস মনে থাকবে তো?

ঠিক থাকবে। এর পূর্বে যারাই আপনার এখানে এসেছে তাদের প্রায় সবার গাড়ির নাম্বার আমার চোখের পর্দায় লিখা হয়ে গেছে।

হাঁ, এ মেশিন কান্দাই দেশের কোথাও নেই। যে গাড়িই আমার সীমানায় এসে পড়বে তারই নম্বর এ পর্দায় দেখতে পাবো। আমার নোট বুকে এ সব নম্বর লিখে রেখেছি। শোন গ্লেলিস আমি সামনে কোন এক তারিখে পু কাউঁহুড়ে রওয়ানা দিবো-তুমি থাকবে আমার সঙ্গে।

স্যার, হঠাৎ প্লু কাউহুন্ডে……।

বহু মাল সেখানে গুদামজাত হয়ে আছে। ওগুলি আনতে না পারলে মাল দেবো কি করে। কোটি কোটি টাকার ব্যবসা আমার অচল হয়ে যাবে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললোক’দিন পূর্বে আমাদের যে ক্ষতি সাধন হয়েছে তা পূর্ণ করতে সময় লাগবে এবং সে ক্ষতির পিছনে বন্ধু নুরুজ্জামান চৌধুরীর……যাক, এ পর্যন্ত শুনে রাখো, আমিও কম নই। যাও গ্লেলিস তোমার কাজে যাও।

*

দুদিন পর আবার এলো নূর আরমানের বাসায়।

আরমান জানতো আবার আসবে নূর—কারণ, টাকার প্রয়োজন কার না আছে। নূরকে দেখতে পেয়ে হাস্যোজ্জ্বল দ্বীপ্ত মুখে এগিয়ে এলো আরমান। হলঘরে এনে বসালো নূরকে, যে ঘরে প্রথম দিন বসেছিলো নুর আর আরমান।

হেসে বললো নূর—সত্যি অবস্থা দেখে আমার লোভ হচ্ছে। চির দিন গোয়েন্দাগিরি করে কি-ই বা করতে পারব। এ ভাবেই কাটিয়ে দিতে হবে জিন্দেগী। তুমি আমাকে তোমার পার্টনার করে নাও বন্ধু।

নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই, তোমার মত বুদ্ধিমান সহযোগী পেলে ধন্য হবো। বলল আজ কি খাবে?

যা ইচ্ছা। তবে ফল-মূল হলে ভাল হয়, কারণ আমি ফল খেতেই বেশি ভালবাসি।

বেশ, তাই খাও। সুইচ টিপলে আরমান আর ধীরে ধীরে টেবিলের ঢাকনা সরে গেলো।

যখন আরমান টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে সুইচ টিপছিলো সেই ফাঁকে সোফার নিচে আরমানের সেদিন রেখে যাওয়া ক্ষুদে টেপ রেকর্ড বক্সটা তুলে নিয়ে দ্রুত হস্তে পকেটে রাখলো।

ততক্ষণে আরমান টেবিলের পাশে চেয়ারে বসে বললো—এস নূর যা ইচ্ছা খাও।

নূর কাজ হাসিল করে বন্ধু আরমানের পাশে এসে বসলো এবং সম্মুখস্থ টেবিল থেকে আংগুরের একটি ঝোঁপ তুলে নিলো হাতে। তারপর খেতে শুরু করলো। খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে আরমানের ব্যবসায় কি ভাবে সে পার্টনার হতে পারে এ ব্যাপারে কথা বলছিলো। অত্যন্ত আগ্রহ সহকারেই নূর প্রশ্ন করছিলো।

আরমানও বিশেষ সতর্কতার সঙ্গে জবাব দিচ্ছিলো। অনেকটা সংযত ভাবে কথাবার্তা বলছিলো। মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিলো আরমান কারণ চট করে তার গোপন ব্যবসা ফাঁস করে দেওয়া ঠিক হবে কি-না সেটাই ভাবছিলো সে।

কিছুক্ষণ আলাপ আলোচনার পর নূর বন্ধুর কাছে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেলো, যাবার সময় বললো নূর—-আবার আসবো। তোমার ধন-সম্পদ আমাকে আকৃষ্ট করেছে বন্ধু।

বললো আরমান–আমি তোমাকে সঙ্গী হিসাবে পেলে সামর্থ হবো।

আরমানের বাসায় আসার সময় নূর তার ড্রাইভারকে আনে না, সে নিজেই গাড়ি চালিয়ে চলে আসে। নূর চায় না তার আসল উদ্দেশ্য কেউ যেন জানতে না পারে, তা হলে হয় তো তার সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে।

*

বনহুরের আস্তানার একটি নিভৃত গুহায় জমকালো ড্রেস পরিহিত অবস্থায় বসে আছে বনহুর স্বয়ং সম্মুখে অপর একটি আসনে বসে নূর। মধ্যস্থ টেবিলে রক্ষিত ক্যাসেটটি থেকে কিছু শুনছিলো তারা। অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে শুনছে তাতে কোন সন্দেহ নাই।

একবার দু’বার তিনবার চালু করে দিলো নূর, ক্যাসেটে আরমানের গলা…..অবশ্যই এসো কিন্তু বন্ধু…(পদশব্দ-নূর বেরিয়ে গেলো কক্ষ থেকে)……হাঃ হাঃ হাঃ নূর……তোমাকে হাতের মুঠায় আনাই আমার মূল উদ্দেশ্য……তুমি জানোনা তোমার বন্ধু আরমান পূর্বের সেই আরমান নেই…….সে এখন অন্যরূপ ধারণ করেছে……তোমাকে করায়ত্ব করাই আমার ব্রত……(কলিং বেলের শব্দ হলো)……(কর্কশ কণ্ঠ এবার) আমি ওকে দেখে রেখেছি স্যার……যে কোন অবস্থায় ওকে আমার চিনতে ভুল হবেনা…..সুদর্শন বটে……হাঁ বন্ধুর যেমন রূপ তেমনি গুণ……ডিটেকটিভ নূরুজ্জামান চৌধুরী বিদেশ থেকে গোয়েন্দা বিভাগে উচ্চ ডিগ্রি লাভ করে এসেছে……দক্ষ গোয়েন্দা সে……(সেই কর্কশ কণ্ঠস্বর) ও সব কিছু চলবে না…কোন বাহাদুরীই আমার নাগপাশ থেকে বেরিয়ে যেতে পারবে না……বললে যে কোন মুহূর্তে…খতম করে দেবো নেংটি ইঁদুরের মত……(আরমানের গলা) না সেদিন এখনও আসেনি……প্রথম মাত্র যখন রক্ষাই পেলো তবে ওকে নিয়ে আমি কিছু খেল খেলতে চাই…ওকে সম্মুখে রেখে কাজ করতে চাই…….গ্লেলিস তুমি সাবধানে ওকে ফলো করবে…(সেই কণ্ঠস্বর)……স্যার আপনার নির্দেশ ঠিক ভাবেই পালন করবো…(আরমানের কণ্ঠ) ঐ দেখো আমার বন্ধুর গাড়ির নম্বর…মনে রেখে গ্লেলিস……মনে থাকবে তো…(সেই কর্কশ কণ্ঠস্বর)……ঠিক থাকবে…এর পূর্বে যারাই আপনার এখানে এসেছে তাদের প্রায় সবার গাড়ির নম্বর আমার চোখের পর্দায় লিখা হয়ে গেছে…(আরমানের গলা)…হা এ মেসিন কান্দাই কেন কোন দেশের কোথাও নাই…যে গাড়ির…যে গাড়িই আমার সীমানায় এসে পড়বে তারই নম্বর এ পর্যায় দেখতে পাবো……আমার নোট বুকে এ সব নম্বর লিখে রেখেছি…শোন গ্লেলিস আমি সামনে কোন এক সরিখে ক্লু কাউঁহুন্ডে রওয়ানা দিবো তুমি থাকবে আমার সঙ্গে……(গ্লেলিস এর কণ্ঠ)……স্যার হঠাৎ ক্লু কাউছন্ডে……(আরমানের কথা) বহুমাল সেখানে গুদামজাত হয়ে আছে……ওগুলি আনতে না পারলে মাল দিব কি করে……কোটি কোটি টাকার ব্যবসা আমার অচল হয়ে যাবে……(একটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ) ক’দিন পূর্বে আমাদের যে ক্ষতি সাধন হয়েছে তা পূর্ণ করতে সময় লাগবে এবং সে ক্ষতির পিছনে বন্ধু নূরুজ্জামান চৌধুরীর……থাক এ পর্যন্ত শুনে রাখো আমিও কখনই……যাও গ্লেলিস তোমার কাজে যাও……।

সুইচটা অফ হয়ে গেলো, বনহুর আর নূর বুঝতে পারলে তার রেখে আসা টেপটি আপনা আপনি বন্ধ হলো।

এবার নূর তাদের সম্মুখস্থ টেপৃটিও অফ করে দিলো।

বনহুর নূরের পিঠ চাপড়ে বললো–সাবাস নূর, তুমি বুদ্ধিমানের মতো কাজ করেছে। আরমান তোমার বন্ধু জানতাম কিন্তু সেও হিরোইন ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছে। হাঁ অর্থের মোহ তাকে উন্মাদ করে তুলেছে তাতে কোন সন্দেহ নাই। কোটি কোটি টাকার ব্যবসা তার অচল হয়ে যাবে। কদিন পূর্বে তাদের মস্তবড় একটা লোকসান হয়েছে, হীরাঝিলের অভ্যন্তরে হিরোইন ব্যবসার মূল ঘাঁটি ছিলো তাদের। তা ধ্বংস স্তূপে পরিণত হয়েছে। লক্ষ লক্ষ টাকার মালামাল হীরাঝিল নবীবক্ষে অতল গহ্বরে হারিয়ে গেছে। গোটা কান্দাই এখন মাদকদ্রব্যবিহীন অচল। যারা নেশায় মাতোয়ারা হয়ে নিজেদের সর্বনাশ করে মনে মনে আত্নতৃপ্তি লাভ করতে তারা এখন যন্ত্রণায় ছটফট করছে। নুর এমন রাষ্ট্র আছে যারা পৃথিবীর মেরুদন্ড ভেঙে দিচ্ছে। যুব সমাজ দেশ ও জাতীর শক্তি সাহস এবং ভবিষ্যৎ। এই মহা শক্তিকে অচল করে দেবার জন্যই এই ব্যবসার সূত্রপাত। আমাদের দেশের কিছু কিছু অর্থশালী বিত্তবান মহল আরও বিত্তশালী হওয়ার বাসনা নিয়ে এই মাদকদ্রব্য যা দেশকে অন্তঃসার শূন্য করে ফেলছে সেই ব্যবসায় মেতে উঠেছে। একটু থেমে বললো বনহুর—–এরা ভদ্রবেশী শয়তান-নরাধম। নিজেদের ঐশ্বর্য বাড়ানোর জন্য নিজেরা নিজেদের চরম সর্বনাশ সাধন করছে। ইতর-কুকুর এরা, নিজেদের মনে করে তারা শিক্ষিত বুদ্ধিমান জ্ঞান গরিমায় অন্যদের চেয়ে আলাদা, ঐশ্বর্যের ইমারং গড়ে, কাঁচের চাকচিক্যে আত্নহারা। হাঃ হাঃ হাঃ এরা জানেনা নিজেরা কত অধঃপতনে নেমে গেছে। দেশের পুঁচকে চোর বদমাইশদের চেয়েও এরা হেয়……শোন নূর একটা গল্প তোমাকে বলবো এই সব ইতর বদমাইশদের কাহিনী।

বলো শুনবো। বললো নূর।

বনহুর বললো—তোমাকে গল্পটা শোনানোর পর আমরা আবার কাজের কথায় ফিরে আসবো।

হাঁ তাই হবে। বললো নূর।

বনহুর উঠে গিয়ে পাশের টেবিল থেকে তার নিজস্ব সিগারেট কেস থেকে সিগারেট বের করে তাতে অগ্নিসংযোগ করলে তারপর আসন গ্রহণ করে বললো—কান্দাইনগরীর এক ধনাঢ্য ব্যক্তি রাসেল আহম্মদ মিঃ আহম্মদ নামে সবার কাছে পরিচিত সে। সবার কাছে সে সাধুতার মুখোস পরে একজন সৎ ব্যক্তি সেজে বিচরণ করে বেড়াতো। স্বনাম ধন্য ব্যক্তিদের নিয়ে তার উঠা বসা। প্রচুর ধন-দৌলতের মালিক সে কিন্তু প্রথম জীবনে তেমন কোন ইন্ডাষ্ট্রির মালিক ছিলো না সে। অর্থের লালসায় উন্মাদ হয়ে উঠলো মিঃ আহম্মদ। গোপনে সে অসৎ ব্যবসা চালাতো যাকে বলা হয় চোরাকারবারী। শুধু অর্থের লালসাই তার ছিলো তা নয়, সে বিভিন্ন ধরনের নেশা পান করতো। এক মাত্র সন্তান মামুন আহম্মদও বালক অবস্থায় হিরোইন সেবনে অভ্যস্ত হলো, শুধু হিরোইন নয় আরও অন্যান্য নেশায় চুর হয়ে থাকতো। পিতা-মাতার সেদিকে খেয়াল ছিলো না, তারা কি করে আরও ধনকুবেরু হবে এটাই তাদের অন্ধ করে রেখেছিলো। মামুন শিশুকালে সুন্দর ফুটফুটে ছিলো, লেখাপড়াতেও ভালছিলো কিন্তু যতই সে বড় হতে লাগলো ততই সে ভীষণ ভাবে মাদকদ্রব্য সেবনে মাত হয়ে পড়লো। দিনরাত পিতা তার অসৎ ব্যবসা নিয়ে এমনি ব্যস্ত যে সে অন্যদিকে চাইবার সময় পেতো না। কিন্তু নর পশু ভাবতো না যে সম্পদ সে অসৎ ভাবে সংগ্রহ করছে তা ঐ একমাত্র সন্তানের জন্যই…একটু থেমে বললো বনহুর—-কিশোর বয়সে মামুন প্রচুর হিরোইন গ্রহণে এবং বিভিন্ন নেশা সেবনে মৃত্যুবরণ করলো। একমাত্র সন্তানের মৃত্যুর পর মিঃ আহম্মদ উম্মাদ প্রায় হয়ে পড়লো। স্ত্রী এ শোক সহ্য করতে পারলো না, সে সন্তানের মৃত্যু সংবাদ পাবার পর সেই যে জ্ঞান হারালো তার জ্ঞান ফিরে এলো না। সন্তানের মৃত্যুর তিনদিন পর সেও মৃত্যুবরণ করলো। মিঃ আহম্মদ পাগল হয়ে ঘরের মূল্যবান আসবাবপত্র ভাংচুর শুরু করে দিলো। তার হাতে দড়ি বেঁধে রাখলো তার কর্মচারীবৃন্দ এবং পায়ে বেড়ী পরানো হলো। সমস্ত ব্যবসা বাণিজ্য কোটি কোটি টাকার সম্পদ সব লুটপাট করে ভাগাভাগি হয়ে গেলো বা নিলো মিঃ আহম্মদের কর্মচারীমহল। নূর তুমি হয়তো দেখে থাকবে কান্দাই শহরের রাস্তায় চট পরিহিত মুখে দাড়ি গোঁফ ভরা মাথায় জটা একটি বৃদ্ধ পাগল ঘুরে বেড়ায়, এখনও হাতে পায়ে তার বেড়ী। পায়ের এবং হাতে কেড়ীপরা স্থানে যা মাছি তার পিছনে বনবন করে ঘুরছে। শুধু একটি মাত্র পয়সার জন্য মাঝে মাঝে পথচারীদের পাশে গিয়ে হাত পেতে দাঁড়ায়, কখনও হোটেলের পাশে ক্ষুধার্ত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে। লোকে তার দেহের গন্ধে নাকে রুমাল চাপা দিয়ে তাকে সরে যেতে বলে। পথচারীগণ জানে না কে সে কি তার পরিচয়–কি ভয়ংকর বেদনাদায়ক পরিণতি এদের।

নূর এতোক্ষণ স্তব্ধ হয়ে শুনছিলো বনহুরের কথাগুলো এবার সে নড়ে বললো, বললো— তবুও তো এই অসাধু ব্যক্তিদের সংজ্ঞা ফিরে এলোনা আব্বু?

হবে না, এরা কুকুরের চেয়েও অধম, এদের জ্ঞান বা বিবেক বলে কিছু নেই এরা এক শ্রেণীর অন্ধ শার্দুল।

হাঁ ঠিক বলছো আব্বু। এদের এমনটিই হয় বা হওয়া উচিত। আরমানের কি ছিলোনা গাড়ি বাড়ি ঐশ্বর্য সব ছিলো বা আছে তবুও তার আরও লোভ-লালসা আরও অর্থ সম্পদ তার চাই আর সেই কারণেই সে বেছে নিয়েছে এমন একটি পথ তা ঐ মিঃ আহম্মদের মত। আজ আরমান অমানুষ শুধু নয় সে নরপশুতে পরিণত হয়েছে। আব্বু আমি ইচ্ছা করলে ওকে তোমার হাতে তুলে দিতে পারি কিন্তু তা হবে আরও পরে।

নূর, আমার চিন্তাধারা অত্যন্ত বুদ্ধিযুক্ত। ওর দলে যোগ দিয়ে তোমাকে তার মূল উদ্দেশ্য জানতে হবে। আরও জানতে হবে তাদের মালামাল প্রস্তুত এবং রক্ষণাবেক্ষণের ঘাঁটি কোথায়। কিন্তু তার মনের কথা টেপ রেকর্ড তোমাকে জানিয়ে দিলো। তার সঙ্গে মোটেই নিরাপদ নয় সে তোমাকে যে কোন মুহূর্তে হত্যা করতে পারে এ কারণে তোমার নিজকে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অত্যন্ত সতর্ক এবং সজাগ থাকতে হবে।

এ জন্য ভেবো না আব্বু–তুমি আজীবন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা কষে এলে। সর্বত্র তুমি যেমন জয়ী হয়ে এসেছো আমিও যেন তোমার মত জয়ী হতে পারি।

. সাব্বাস নূর, তোমার সাহস আমাকে মুগ্ধ করেছে। কিন্তু তোমার মা চিরদিন অশান্তিতে ভুগছে। আমার মা-ও বড় ব্যথা বেদনা নিয়ে এই নশ্বর পৃথিবী থেকে চিরতরে বিদায় নিয়েছে। সে শুধু আমার কারণে। তিনি চেয়েছিলেন স্বামী সন্তান নিয়ে একটি সুখের নীড় বাঁধতে কিন্তু সে আশা তার পূর্ণ হয়নি। নুর মায়ের সেই অশান্তি ব্যথা বেদনা দুঃখের জন্য দায়ী শুধু আমি…..বাষ্পরুদ্ধ হয়ে এলো বনহুরের কণ্ঠ। তার চোখ দুটি অশ্রু ছল ছল হয়ে এসেছে।

নূর তাকালো বনহুরের মুখের দিকে, হৃদয় দিয়ে অনুভব করলো সে পিতার অন্তরের বেদনা। দাদীমাকে নূর শিশুকাল থেকেই দেখে এসেছে, কোন দিন তিনি প্রাণ খুলে হাসেননি, তার বুক ভরা দারুণ একটা ব্যথা–যা তার মুখের হাসি প্রাণের আনন্দ কেড়ে নিয়েছিলো চিরতরে। শিশুকালে তেমন করে অনুধাবন না করলেও নূর বড় হয়ে বেশ বুঝতে পারতো সব সময় দাদীমাকে নূর বিষণ্ণ দেখেছে। কেন যে তিনি এমন, তাও পরে জানতে বা বুঝতে পেরেছিলো, যখন নূর বিদেশ থেকে ফিরে এলো, ডিটেকটিভ নূরুজ্জামান হিসাবে। তার প্রথম কর্তব্য ছিলো দস্যু বনহুরকে সে গ্রেপ্তার করে সুনাম নয় স্বনামধন্য ডিটেকটিভ হবে। কিন্তু তার আশা পূর্ণ হলো বটে, তখন নূর জানতে পারলো বিশ্ববিধাতা দস্যু বনহুর স্বয়ং তার পিতা তখন সব পরিস্কার হয়ে গেলো, অনুধাবন করলো কেন তার দাদীমার মুখে হাসি ছিলো না, কেন তার মাকে নীরবে অশ্রু সংবরণ করতে দেখতো, কেন মা মন খুলে কথা বলতে পারতেন না। সবই মুহূর্তে মনে পড়ে গেলা নূরের।

বনহুর হাতের পিঠে চোখ রগড়ে নিয়ে বললো—-আমি জানি তোমার মা-র মনেও ব্যথা কম নয় তাও আমারই কারণে। নূর তুমিও যদি এভাবে নিজকে বিলিয়ে দাও তাহলে তোমার মায়ের কথা একবার ভেবেছো? তুমিই যে এখন তার একমাত্র ভরসা।

আব্বু!

হা নূর, তোমার হাসি মুখ তাকে বাঁচিয়ে রাখবে নইলে বেচারী মারা পড়বে অকালে। আমার বুক ভরা দুঃখ তাকে আমি শান্তি দিতে পারলাম না……বনহুর নিজের মনের ব্যথাকে গোপন করার জন্য ওদিকের মুক্ত জানালার পাশে গিয়ে বাইরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।

একটু পরে নিজের দূর্বলতাকে চেপে ফিরে দাঁড়ালো বনহুর।

 নূর পিতার মনোভাব বুঝতে পেরে সেও অপর দিকে দৃষ্টি রেখে চুপচাপ বসেছিলো।

বনহুর বললো—মূর আর বিলম্ব নয়, জু কাউঁহুন্ডের সেই গোপন ঘাটি খুঁজে বের করতে হবে। যেখানে কোটি কোটি টাকার মালামাল তোমার বন্ধু আরমান গুদামজাত করে রেখেছে। তুমি হয়তো জানো না, ক্লু কাউঁহু কোন জায়গায় বা কোন দেশে অবস্থিত।

নূর প্রশ্নভরা দৃষ্টি তুলে ধরলো বনহুরের মুখের দিকে।

বনহুর আসন গ্রহণ করলো-তারপর শান্ত গলায় বললো—রাশিয়ার দক্ষিণে সুদানে ক্লু কাউঁহুন্ড! ক্লু কাউহুন্ডে পৌঁছতে পারলে খুঁজে নিতে বিলম্ব হবে না। তবে ক্লু কাউহুন্ডে যাবার পূর্বে তোমাকে নিপুণতার সঙ্গে আরমানের পার্টনার হিসাবে কাজ করতে হবে এবং এ কারণে তোমার চাই বহু অর্থ। কান্দাই মোইং ব্যাংকে তোমার নামে একটি একাউন্ট খুলবে এবং তা করতে হবে আগামী কালই। সেখানে তোমার একাউন্টে আমি পাঁচ কোটি টাকা জমা দেবো। ঐ টাকা তুমি চেকের মাধ্যমে যা প্রয়োজন তা উঠিয়ে নেবে। আরমান যেনো তোমার উপর বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে। একটু থেমে বললো বনহুর—-আরমান যেন বিশ্বাস করতে পারে তোমাকে পার্টনার হিসাবে গ্রহণ করে ভালই করেছে।

কিন্তু……।

কোন কিন্তু নয় নূর, যে পথে তুমি পা বাড়িয়েছে সে পথ তোমাকে অতিক্রম করতেই হবে।

আব্বু দোয়া করো যেন সাধনায় জয়যুক্ত হতে পারি। নূর দুটি বাহু দিয়ে বনহুরের কন্ঠ বেষ্টন করে ধরলো।

তোমার প্রচেষ্টা সার্থক হবে। হিরোইন প্রস্তুতকারী কারখানা বা ব্যবসার মূল ঘাঁটি ধ্বংস করতে পারলে বিশ্বের যুবকদল এই মৃত্যু ছোবল থেকে রক্ষা পেতে পারে। বিশ্বের বৃহত্তম শক্তি যুবদল, এদের পঙ্গুত্ব থেকে রক্ষা করাই হবে তোমার জীবনের সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য। পারবে নূর? এই কাজ তুমি পারবে?

পারবো! দৃঢ় কণ্ঠস্বর নূরের।

এবার তোমার একান্ত প্রয়োজন তোমার বিস্ময়কর নতুন যানটি। ঐ যানটির নাম রাখা হলো ক্যাথোলা বৈজ্ঞানিক মার্শাল লর্ডের প্রিয়তমা ছিলেন মিসেস ক্যাথোলা তারই নামে নামকরণ হলো নতুন যানটির। এতে বৈজ্ঞানিক মার্শাল লর্ড খুশি হবেন বলে মনে করি।

নূর একটু হেসে বললো–হাঁ, আব্বু  আমিও তাই ভাবছিলাম। বৃদ্ধ মিঃ লর্ডের সৃষ্টি এই যানটির নামকরণ তারই প্রিয়জনের নামেই হওয়া উচিৎ হবে।

বেশ, তাই হলো! কবে তাহলে তুমি রওয়ানা দিচ্ছে ক্লু কাউঁহুন্ডের উদ্দেশ্যে নূর?

অচিরেই রওয়ানা দেবো, কিন্তু তার পূর্বে বন্ধু আরমানের সঙ্গে গভীরভাবে আমাকে মিশতে হচ্ছে।

হা ঠিক বলেছো। তোমাকে যে ভাবে নির্দেশ দিয়েছি ঐ ভাবেই তুমি কাজ করবে। আরমানের গোপন রহস্যময় টেপৃটি আমার কাছে থাক। কারণ এটা নিতান্ত প্রয়োজন আছে। বনহুর উঠে দাঁড়ালো তারপর বললো—হিরোইন ঘাটি সম্পূর্ণ নির্মূল করতে হবে। চলো নূর তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।

বনহুর আর নূর গুহার বাইরে বেরিয়ে এলো।

 দুটি অশ্ব তাদের জন্য অপেক্ষা করছিলো। একটি তাজ অপরটি দুলকী।

বনহুর আর নূর দু’জন দুটি অশ্বে চেপে বসলো।

*

মিঃ রবার্ড মেরিন এসেছেন কান্দাই। প্রখ্যাত হিরোইন ব্যবসায়ী এবং প্রস্তুত কারক।

বিমান বন্দরে তাকে অভ্যর্থনা জানাতে আরমান ও তার দলবল গেছে। চারটি গাড়ি বিমান বন্দরের বাইরে প্রতীক্ষা করছে।

নূরও আছে এই অভ্যর্থনাকারীদের মধ্যে। আরমান স্বয়ং গিয়ে তাকে নিয়ে এসেছে তার বাংলো থেকে। ইতিপূর্বে মোটা অংক টাকা নূর প্রদান করেছে আরমানের হাতে। এ কারণে নূর এখন আরমানের নেতৃস্থানীয় পার্টনার। কাজেই তাকে আজ আমন্ত্রণ না জানালেই নয়।

আরমান বেশ উপলব্ধি করেছে সেদিন তাকে হত্যা করলে চরমভাবে ঠকে যেতে আরমান নিজে। কারণ নূর এতো সহজেই তার বশ্যতা মেনে নেবে এটা সে সেদিন ভাবতে পারেনি। সুচতুর আরমান মনে মনে ভীষণ খুশি হয়েছিলো এবং তাকে পার্টনার হিসাবে গ্রহণ করেছিলো মনেপ্রাণে। আজ তাদের অধিনায়ক আসছেন সুদূর সুদান থেকে। তার সঙ্গে নূরের পরিচয় হওয়া দরকার।

বিমান থেকে অবতরণের পর মিঃ রবার্ড এলেন কান্দাই এর প্রখ্যাত হিরোইন ব্যবসায়ীদের অভ্যর্থনা গ্রহণ করতে। হাতে হাত মিলিয়ে পরিচিত হলেন তিনি সবার সঙ্গে। তারপর আরমানের রক্ষিত গাড়ি গুলিতে উঠে বসলেন। যে গাড়িখানা আরমানের নিজস্ব ঐ গাড়িতে উঠে বসলেন মিঃ রবার্ড আরমান ও নূর।

নূর সবার অলক্ষ্যে তার কোটের পকেটে ক্ষুদে টেপ রেকর্ডটি চালু করে দিলো।

মিঃ রবার্ড একটি সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে একমুখ ধোয়া নিক্ষেপ করে বললেন মিঃ আরমান এতো সুন্দর কান্দাই নগরীর মানুষগুলোর মধ্যে বিষকীট লুকিয়ে আছে। এত টাকার মালামাল হীরা ঝিলে ডুবে গেলো এই বিষকীটগুলোই এত বড় সর্বনাশ করেছে। তারা কি করে তোমার গোপন ঘাটির সন্ধান পেলো?

বললো আরমান—সেকেন্দার শাহর ভুলের খেসারত দিতে গিয়ে এমন হলো। বাংলাদেশে মাল পারাপারের সময় সেকেন্দার শাহ তার কয়েকজন সঙ্গীসহ ধরা পড়ে গেলো দস্যু বনহুরের কাছে……

ক্রুদ্ধকণ্ঠে বললেন মিঃ রবার্ট লক্ষ লক্ষ টাকার মালামাল নিয়ে সে বনহুরের কবলে পড়লো। নিশ্চয়ই তার সাবধানতায় ত্রুটি ছিলো। তোমাদের সবার মুখে শুধু বনহুর আর বনহুর। একটা সাধারণ মানুষ তোমাদের উপর টেক্কা মেরে যাচ্ছে আর তোমরা তা নীরবে সহ্য করে যাচ্ছে।

আরমান বললো–স্যার, দস্যু বনহুর আমাদের মত সাধারণ মানুষ নয়।

তবে কি সে কলের মানুষ। সে কি যান্ত্রিক, সে সব কিছু শক্তিকে সে পরাহত করে যাচ্ছে। শুনেছি কান্দাই পুলিশ মহল তাকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম নয়। হাঙ্গেরী কারাগার তাকে আটকে রাখতে পারেনি। এমন মহা শক্তি যার অস্বাভাবিকই বটে। আমি কান্দাই এসেছি শুধু তোমাদের ব্যবসা দেখতে নয়। আমি এসেছি সেই অসাধারণ ব্যক্তি দস্যু বনহুরকে দেখতে……

তার সাক্ষাৎ লাভ আমাদেরই ঘটেনি স্যার। ধূমকেতুর মতই তার আবির্ভাব আবার তেমনি তার কাজ। তার হৃদয়ে দয়া-মায়া-মমতার লেশ নেই। কান্দাইবাসীই শুধু নয় সমস্ত পৃথিবীর মানুষ তার নামে ভীত।

মিঃ রবার্ট হাসলেন—আরে ছোঃ আমার কাছে সে তুচ্ছ একটি মানুষ ছাড়া কিছু নয়। আমি এমন একটি……

কথাটা অসমাপ্ত রেখে বললো মিঃ রবার্ট–তোমার পার্টনারটিকে তুমি বিশ্বাস করো তো?

হাঁ, সে আমার একান্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তার কোটি কোটি টাকা আমাদের ব্যবসায় চলছে।

সে কথা তোমার সংক্ষিপ্ত চিঠিতে আমি জেনেছি। এ জন্য আমি তাকে ধন্যবাদ দেই। মনে রেখো সবাইকে বিশ্বাস করা যায় না। তবে তোমার বন্ধুটি আমাদেরই লোক, এটা আমি অনুধাবন করেছি।

স্যার!

হাঁ, কারণ তার চোখে মুখে প্রফুল্লতার ছাপ আমাকে মুগ্ধ করেছে। তা ছাড়া এতো টাকা যে বিনা দ্বিধায় ব্যবসায় পার্টনার হিসাবে দিতে পারে, নিশ্চয়ই সে তোমার এবং তার ব্যবসায় মঙ্গল চায়। ঘাড় ফিরিয়ে মিঃ রবার্ট একবার নূরকে দেখে নিলো।

নূর তখন অন্যমনস্কভাবে গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়েছিলো।

মিঃ রবার্ট বলে চলেছেন-যেমন করে হোক আমি বনহুরের সাক্ষাৎ লাভ করবোই……হাঃ হাঃ হাঃ, বনহুর দস্যু বনহুর—আমার কাছে তাকে পরাজয় বরণ করতেই

স্যার, পুলিশমহল তাকে গ্রেপ্তার ব্যাপারে কোটি টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছেন। তা ছাড়া গোয়েন্দা বিভাগ বহু সন্ধান চালিয়েও তার সন্ধান পায়নি। এ ছাড়াও আমাদের লোক সদাসর্বদা তার অনুসন্ধান করে ফিরছে, কিন্তু…….

আমি কিছুদিন কান্দাই অবস্থান করবো। সঙ্গে রয়েছে কিছু গোপন অস্ত্র–যা তার জীবন লীলার অবসান ঘটাতে সক্ষম হবে। অস্ত্রগুলি আমার ব্রিফকেসে আছে। অতি সাবধানে ঐগুলি এনেছি।

স্যার, ওগুলি বিমানে আনায় চেকিং ব্যাপারে……

 সে পথ পরিস্কার করেই আমি রওয়ানা দিয়েছিলাম।

ধন্যবাদ স্যার।

তুমি কি আজ বুঝতে পারোনি আরমান এতো টাকার মারামাল আমার ইন্ডাষ্ট্রি থেকে দেশ বিদেশে চালান হয়ে যাচ্ছে তা কেমন করে সম্ভব হচ্ছে? তোমাকে আরও জানতে হবে…আরমান সব কথা পরে হবে, আর কত পথ যেতে হবে আরমান।

আর কয়েক মিনিট। আমরা প্রায়ই এসে গেছি। বললো আরমান।

কিছুক্ষণ নীরবে ধূম্র উদগিরণ করলেন মিঃ রবার্ট।

গাড়ি বাসায় পৌঁছতেই ড্রাইভার গাড়ি থেকে নেমে গাড়ির দরজা খুলে ধরলো।

 মিঃ রবার্ট ধন্যবাদ বলে নেমে গেলেন।

আরমান সবার অলক্ষ্যে পকেটে হাত পুরে ক্ষুদে টেপটির সুইচটি অফ করে দিলো।

 পূর্ব হতেই খানাপিনার বিরাট আয়োজন হয়েছিলো।

আর সেই কারণেই মিঃ রবার্ট সাহেবকে আরমান তার বাসায় এনেছে। অন্যান্য যারা। মিঃ রবার্টকে অভ্যর্থনা জানাতে এসেছিলো তারাও উপস্থিত হলো।

বিরাট হল ঘরে নানাবিধ সাজ-গোজ করা হয়েছিলো। মাঝে মাঝে ডিম্বাকৃতি সুস্বাদু খাদ্য সম্ভারে ভরপুর।

এইসব খাদ্য সম্ভারের পাশে মূল্যবান সরাবের পাত্র রক্ষিতা ছিলো।

আরমান তাদের সম্মানিত প্রখ্যাত হিরোইন ব্যবসায়ী মিঃ রবার্ট এবং অন্যান্য অতিথি বৰ্গদের নিয়ে উপস্থিত হলো। গাঢ় লাল রং এর ভেলভেট মোড়া সোফাসেট সুন্দরভাবে থরে থরে সাজানো। এই সোফায় উপবেশন করলেন মিঃ রবার্ট ও তার সঙ্গীগণ।

একপাশে সুমিষ্ট মিউজিক সুরের মূর্ছনা ছড়াচ্ছে।

শুরু হলো খানাপিনা।

কাঁটা চামচের শব্দ তার সঙ্গে হাসি গল্পের প্রতিধ্বনি।

 আরমান নিজে পরিবেশন এবং তদারক করে চলেছে। এক সময় নূরের পাশে এসে বললো কেমন লাগছে বন্ধু?

সংক্ষেপে জবাব দিলো নূর—খুব ভাল লাগছে।

 হা, এরপর আরও আছে সে সব ফাংশান তোমার আরও ভাল লাগবে।

 হঠাৎ আলো নিভে গেলো।

চমকে উঠলো নূর গোটা হল ঘর জমাট অন্ধকারে ভরে উঠলো। নূর মুহূর্তে চেয়ার বদলে নিয়ে বসলো, না জানি এর পিছনে আরমানের কোন উদ্দেশ্য নেই তো? আর সেই কারণেই দ্রুত চেয়ার বদল করে নিলো। ভাগ্যিস তার পাশের চেয়ারখানা খালি ছিলো।

একটি গম্ভীর কণ্ঠস্বর মিঃ রবার্ট আপনি আমার সাক্ষাৎ লাভে উন্মুখ, সেই কারণে এসেছি। হাত বাড়ান আমার দিকে। পরিচয় হয়ে ভালই হলো কেমন?

হয়তো অন্ধকারেই মিঃ রবার্টের সম্মুখে একটি হাত প্রশস্ত হলো।

 মিঃ রবার্টের কণ্ঠ, কে তুমি?

সেই কণ্ঠ—যার সাক্ষাৎ লাভের আশায় আপনি কান্দাই এসেছেন।

 তুমি…তুমি দস্যু বনহুর! মিঃ রবার্টের গলা।

সমস্ত কক্ষ নীরব।

মিউজিকের মোহময় সুর থেমে গেছে আলো নিভে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে।

দস্যু বনহুরের হাসির শব্দ—-হাঃ হাঃ হাঃ, হাঃ হাঃ হাঃ অট্টহাসির শব্দে গোটা হলঘর কেঁপে উঠলো তারপর গম্ভীর কণ্ঠ—আবার সাক্ষাৎ লাভ ঘটবে মিঃ রবার্ট, আজ চলি তা হলে কেমন?

কক্ষ মধ্যে কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বনি হলো।

 তারপর আলো জ্বলে উঠলো।

বৈদ্যুতিক আলোর উজ্জ্বল আলোতে সবাই যেন নিশ্বাস ফেলে বাঁচলো। এতক্ষণ কারো মুখে টু শব্দটি ছিলো না। এবার সবার মুখে তাকিয়ে দেখলো প্রত্যেকের মুখে চোখে একটা ভীষণ ভীতভাব ফুটে উঠেছে। কারো মুখে হাসি খুশি ভাব নেই। কেমন যেন বিমর্ষ মলিন সবার মুখমন্ডল। কিছু পূর্বে যে উচ্ছল আনন্দে তারা মেতে উঠেছিলো সে আনন্দ উচ্ছ্বাস উঠে গেছে সবার মুখ থেকে।

নূর  নিশ্চুপ । তার চোখে মুখেও বিস্ময়। তার আব্বু তাহলে এখানেও এসেছে শুনেছিলো গাড়িতে বসে তাদের মধ্যে কি আলাপ হয়েছিলো। নূর লক্ষ্য করলো মিঃ রবার্টের মুখ সবার চেয়ে বেশি অন্ধকার এবং কালো হয়ে উঠেছে। বনহুরকে তিনি যত সহজ ব্যক্তি হিসাবে মনে করেছিলেন তা নয়। বনহুর তাহলে শুধু সাংঘাতিকই নয় ভয়ংকরও বটে।

সেদিন আর তেমন করে কেউ কোন আনন্দ ফুর্তি করতে পারলোনা। কারণ যারা সেখানে উপস্থিত ছিলো তারা সবাই মাদকদ্রব্য ব্যবসায়ী, হিরোইন ব্যবসায় তারা চূড়ান্তভাবে কেঁপে উঠেছে। এক একজন বনে গেছে ধনকুবেরু। হঠাৎ বনহুরের অতর্কিত আগমনে সকলেরই হৃদকম্প শুরু হয়েছে। বনহুরকে তারা দেখে নাই, তবে তার সম্বন্ধে তারা ভালভাবেই অবগত আছে। অন্যায় অনাচার কু-কর্ম যারা করে তাদের কাউকে ক্ষমা করে না বনহুর, যেমন তার প্রমাণ সেকেন্দার শাহ এবং তার ক’জন সঙ্গীর ভয়ংকর মৃত্যু বনহুর এদের হত্যা করে কান্দাই রাজপথে রেখে দিয়ে প্রমাণ করেছিলো, অসৎ ব্যক্তিদের পরিণাম এই রকমই হয়। যারা আরমানের আমন্ত্রণে মিঃ রবার্টের সঙ্গে মিলিত হবার জন্য এসেছিলো, জানো তারা কেমন কতখানি আত্নবিশ্বাস আছে তাদের নিজেদের উপর। তারা এক একজন শুধু স্মাগলারই নয়, তারা জাতির ধ্বংস দূত। কাজেই ভীত হবার কথাই বটে, এতক্ষণ যে সুস্বাদু খাদ্য তারা ভক্ষণ করছিলো এক্ষণে তা বিস্বাদ লাগছে। কেউ আর তেমন করে ভূরি ভোজনে উৎসাহী হলোনা। কিছুক্ষণের মধ্যেই আরমানের সুরম্য হলঘর শূন্য মরুপ্রান্তরের মত হয়ে পড়লো।

মিঃ রবার্ট সব লক্ষ করছিলেন।

কিছু পূর্বে যে উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে মিঃ রবার্ট কথাবার্তা এবং খানা-পিনা করছিলেন একদন্ডের মধ্যে সব যেন নিঃশেষ হয়ে গেলো, কিন্তু নরপশু যারা হয় তাদের হৃদয়ে ভয়ের লেশ বেশীক্ষণ স্থায়ী হয় না। মিঃ রবার্ট বললেন–বনহুর তোমাকে সায়েস্তা করার ঔষধ আমি বহন করে এনেছি। মরতে তোমাকে হবেই।

সবাই বিদায় গ্রহণ করলেও নূর বিদায় নেয়নি, তখনও সে নির্বাক বসেছিলো। তার আব্বু তাহলে তার সঙ্গেই ছিলো বা আছে।

আরমান নূরকে উদ্দেশ্য করে বললো আজ আমাদের ফাংশান এখানেই শেষ হলো। চলো নুর মিঃ রবার্টকে হোটেল ফাংহায় রেখে আসি। সেখানেই আমরা স্যারের থাকার ব্যবস্থা করেছি।

নূর বললো—-সেই ভাল। হোটেল ফাংহায় কেউ তাকে বিরক্ত করতে পারবে না।

*

গভীর রাত।

একটি গাড়ি এসে থামলো হোটেল ফাংহার সম্মুখে। ধূসর রং এর গাড়িখানা রাত্রির অন্ধকারে সহজে কারো নজরে পড়বে না। যে লোকটি গাড়ি থেকে নামলো তার দেহের পোষাকও ধূসর রং এর। লোকটি সতর্কতার সঙ্গে তাকিয়ে দেখেছিলো চারিদিক। পকেটেও হাত পুরলো, কারণ সেখানে রক্ষিত বস্তুটি আছে কিনা দেখে নিলো একবার।

হাঁ, পকেটে পিস্তলটা ঠিকই আছে।

লোকটা আরও কিছুটা অগ্রসর হতেই দারোয়ান রাইফেল চেপে ধরলো তার বুকে!

লোকটা মোটেই চমকে উঠলো না।

সে অতি সহজেই দারোয়ানটির হাত থেকে মোচড় দিয়ে রাইফেল কেড়ে নিলো। গুলী ছুড়বার সুযোগ তার হলো না। পকেট থেকে পিস্তল বের করে গুলী বিদ্ধ করলো দারোওয়ানটিকে শব্দ বিহীন পিস্তলের একটি গুলী খেয়ে দারোয়ান মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো নিচে। লোকটি তার প্রাণহীন দেহটা সরিয়ে রাখলো তারপর নিঃশব্দে প্রবেশ করলো হোটেলে।

অপর একটি গাড়ি এসে থামলো পূর্বের গাড়িখানার অদূরে। সমস্ত দেহ তার আলখেল্লায় ঢাকা। তার হাতেও রিভলভার। লোকটা অতি সতর্কতার সঙ্গে হোটেলে প্রবেশ করলো।

প্রথম ব্যক্তি ততক্ষণে হোটেলে প্রবেশ করে এগুলো লিফটের দিকে।

যদিও লিফট বন্ধ ছিলো তবুও খুলে ফেলতে বিলম্ব হলো না। লিফটে পৌঁছে গেলো উপরে পাঁচ তলায়।

দ্বিতীয় ব্যক্তিও অপর দিকের লিফটে পঞ্চম তলায় পৌঁছে গেলো তার পৌঁছার পর পরই। যে কক্ষে মিঃ রবার্ট ঘুমিয়ে ছিলেন ঐ কক্ষের দরজার পাশে আত্মগোপন করে দাঁড়ালো।

প্রথম ব্যক্তি কক্ষমধ্যে প্রবেশ করলো অতি সন্তর্পনে। কক্ষে প্রবেশ করবার পূর্বে একবার চারদিকে তাকিয়ে দেখে নিলো সে।

দ্বিতীয় ব্যক্তি একটি পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করছিলো প্রথম ব্যক্তির কার্যকলাপ, হাতে তার রিভলভার উদ্যত রয়েছে।

প্রথম ব্যক্তি মিঃ রবার্টের শয্যার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। পকেট থেকে বের করলো সে তার শব্দবিহীন পিস্তলখানা। এবার সে মিঃ রবার্টকে লক্ষ্য করে পিস্তল উঁচু করে ধরলো। আর এক মুহূর্ত, তাহলেই মিঃ রবার্ট তার শয্যায় নিহত হতেন। কিন্তু পিছন থেকে দ্বিতীয় ব্যক্তি তার হাতের পিস্তল কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলো বাইরে।

প্রথম ব্যক্তি মুহূর্ত বিলম্ব না করে বেরিয়ে গেলো যে পথে এসেছিলো ঐ পথে।

দ্বিতীয় ব্যক্তির মুখ ঢাকা ছিলো, তাই প্রথম ব্যক্তি বুঝতেই পারলোনা কে সে। এবার দ্বিতীয় ব্যক্তি নিজের রিভলভারখানা পকেটে রেখে মিঃ রবার্টের জামা ধরে ঝাঁকুনি দিলো।

আচমকা ঘুম ভেঙে যাওয়ায় মিঃ রবার্ট ব্যস্ত সমস্ত হয়ে উঠে বসলেন এবং বিস্ময়ভরা দৃষ্টি নিয়ে রাগত্ব কণ্ঠে বললেন, কে তুমি! এখানে এলে কি করে?

দ্বিতীয় ব্যক্তি বললো—আমার পরিচয় পরে বলছি। আমি এসেছি একজনকে ফলো করে। যে আপনাকে এই মুহূর্তে হত্যা করতো। আমি তার হাত থেকে আপনার জীবন রক্ষা করেছি। সে আপনাকে শব্দবিহীন পিস্তল দিয়ে হত্যা করতে প্রস্তুত হয়েছিলো। আমি তার হাত থেকে পিস্তলটি কেড়ে নিয়ে বাইরে ফেলে দিয়েছি।

আশ্চর্য হয়ে বললেন মিঃ রবার্ট–কে আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিলো। তবে নিশ্চয়ই সে ঐ দস্যু বনহুর।

এবার হাসলো দ্বিতীয় ব্যক্তি তারপর বললো—এমন সাধ্য কারো নেই যে, বনহুরের হাত থেকে অস্ত্র কেড়ে নেয়।

তুমি তা হলে কেন তাকে ফলো করেছিলে?

 জানতাম আপনাকে হত্যার ষড়যন্ত্র চলছে।

 তাতে তার লাভ?

 আছে বা ছিলো। আপনাকে হত্যা করে তারা আপনার মূলধন আত্মসাৎ করতে চায়।

আমাকে রক্ষা করে তোমার লাভ?

প্রয়োজন আছে তোমাকে তাই……

কে তুমি! কি তোমার পরিচয়?

 যার সঙ্গে দেখা করার জন্য আপনি উন্মুখ ছিলেন বা আছেন।

তুমিই তা হলে মিঃ আরমানের বাসায়..

হাঁ, আমিই গিয়েছিলাম বিনা আমন্ত্রণে।

 বনহুর! তুমি দস্যু বনহুর?

হাঁ বন্ধু, জীবন রক্ষাকারী। সাবধানে থাকবেন। কথাটা বলে বেরিয়ে গেলো দ্বিতীয় ব্যক্তি বনহুর।

*

বনহুর তার দরবার কক্ষে বসে আলাপ করছে তার অনুচরদের সঙ্গে। রহমান এবং অন্যান্য অনুচর সবাই উপস্থিত আছে।

রহমান বললো–সর্দার রুপাই নামে একটি বাঈজী ছিলো। আজ রাতে কে বা কারা তাকে হত্যা করে তার মাথাটা নিয়ে গেছে। এ হত্যাকান্ড ভয়ংকর এবং রহস্যজনক।

 হাঁ, তাতে কোন সন্দেহ নাই। বললো বনহুর।

এ হত্যা রহস্য নিয়ে পুলিশ মহল ভীষণভাবে তদন্ত শুরু করেছে, কিন্তু হত্যাকারী কোন কুই রেখে যায়নি বা পুলিশ মহলকে হত্যা রহস্য উদঘাটনে সাহায্য করবে।

 শোন রহমান, আমি এখন এমন একটা মহা সমস্যার মোকাবেলায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছি যা দেশ ও দেশবাসীর সর্বনাশই শুধু করছে না, প্রতিটি দেশের মেরুদন্ড ভেঙে দিচ্ছে। আমি এই সর্বনাশকারীদের মূল শিকড় উপড়ে ফেলতে চাই।

সর্দার, আমরা তা জানি। সেকেন্দার শাহর মালামাল আমাদের কাছে আটক হবার পর…….পরই সবাই আমরা অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছি নতুন এক সমস্যায় জড়িয়ে পড়লেন আপনি।

হাঁ রহমান, এ কথা সত্য। তবে যতদূর এগিয়েছি তাতে এর সমাধান করতে বেশি দিন লাগবে না। রহমান বিরাট এক চক্রের বেড়ী জালে আজ সমগ্র পৃথিবী তলিয়ে যেতে বসেছে অতল গহ্বরে। এই ষড়যন্ত্রকারী দলের অধিনায়ক অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছে। আমি এদের চক্রান্ত নস্যাৎ করে দেবার চেষ্টা চালাচ্ছি। এ কারণে তারা সাধুতার মুখোশ পরে আমার সাক্ষাৎ লাভের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।

সর্দার!

হাঁ, আমি তাকে সাক্ষাত্নান করেছি। তাকে পরিচয়ও দান করেছি।

সর্দার, কে সে-যার সান্নিধ্যে গিয়ে আপনি তাকে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখলেন। আপনার রিভলভারের গুলী তাকে রেহাই দিলো।

এতো শীঘ্র আমি তাকে দুনিয়া থেকে বিদায় করতে চাই না। বরং তাকে জীবিত রেখে সমস্যার সমাধান করতে চাই। তাকে হত্যা করার চেয়ে বাঁচিয়ে রাখার নিতান্ত দরকার আছে।

আপনি তাকে চিনতে পেরেছেন? বললো কায়েস।

বনহুর বললো–চিনতে বা তার সাক্ষাৎ লাভে আমার তেমন কষ্ট হয়নি। এ ব্যাপারে নূরের সহায়তা আমাকে অনেকটা সফল করেছে। অবশ্য নূরও জানে না। আমি নূরকে ফলো করেই অগ্রসর হয়েছি। রহমান আমার উদ্দেশ্য সফল হবে বলে মনে করি, তবে আমাকে ভীষণ এক সংগ্রামের মুখোমুখি হতে হবে, তাতে কোন ভুল নেই। যারা দেশ ও দশের মেরুদন্ড ভেঙে দিয়ে সমগ্র পৃথিবীটাকে পঙ্গুত্বে পরিণত করতে চাচ্ছে, তারা শুধু পৃথিবীর অস্তিত্ব বিনষ্ট করতে চাচ্ছে না, তারা যা চায় তা কল্পনার অতীত। ভাবলে শিউরে উঠে সমস্ত শরীর, ঘৃণায় মাথাটা যেন খারাপ হওয়ার যোগাড় হয়। রহমান, আমি চাই এদের নির্মূল করতে……দাতে দাঁত পিষে কথাটা বললো বনহুর।

দরবার কক্ষের দেয়ালে গুঁজে রাখা মশালগুলো দপ দপ্ করে জ্বলছে। মশালের লাল আলোর শিখায় বনহুরের চোখ দুটো জ্বলে উঠলো যেন। বললো আবার সেমিঃ রবার্ট মেরিনকে আজ রাতে হত্যার উদ্দেশ্যে একজন গিয়েছিলো, হত্যাও করে ফেলতো, কিন্তু মিঃ রবার্টকে হত্যা করা চলবে না। আমি তোমাদের বলেছি, আবারও বলছি, তাকে জীবিত রেখে আমার উদ্দেশ্য সফল করতে হবে। রহমান, মিঃ রবার্ট আমাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছে এবং সুদান থেকে মারাত্নক অস্ত্রসস্ত্র গোপনে সে নিয়ে এসেছে। ঐ অস্ত্রগুলি সে ব্যবহার করবে আমাকে নিহত করার জন্য। হাঃ হাঃ হাঃ, রবার্ট, ঐ অস্ত্রে তাকে মৃত্যুবরণ করতে হবে। হোটেল ফাংহায় সে রয়েছে। আরমান তাকে সেখানে রেখেই হত্যা করতে গিয়েছিলো…

রহমান বললো—সর্দার, আরমান নূরের পরম বন্ধু ছিলো এটাই জানতাম কিন্তু সে……

হাঁ, অর্থ আর ঐশ্বর্যের মোহ তাকে গ্রাস করেছে, তার জীবন এখন একটি পশুর চেয়েও ঘূণ্য। সে নূরকেও হত্যা করতে গিয়েছিলো। নূর সজাগ ভাবে নিজকে পরিচালিত করছে। ওকে পেলেই আমার চলবে।

বনহুর এবার তার আসনের অদূরস্থ একটি মেশিনের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। বললো বনহুর—এই যে নতুন একটি মেশিন তোমরা দেখতে পাচ্ছো, এটা নতুন আবিষ্কার বৈজ্ঞানিক মার্শাল লর্ডের। আজ তোমাদের এখানে ডেকেছি এই নতুন আবিষ্কৃত মেশিনটা দেখাব বলে। এর কাজ বড় বিস্ময়কর। মার্শাল লর্ড শুধু একজন বৈজ্ঞানিক নন, আমার সবচেয়ে বড় বন্ধু…একটু থেমে পুনরায় বললো–এখন আমার চোখে গোটা বিশ্বটা আরও পরিস্কার হয়ে গেছে। রহমান তোমাদের দেখাবো হীরা ঝিলের অতল গহ্বরে আমার নিক্ষিপ্ত হিরোইনগুলির অবস্থা এবং এর বিষক্রিয়ায় গভীর পানির তলার জীবগুলির অবস্থা কেমন রয়েছে।

কথাগুলো বলে বনহুর একটি সুইচ টিপলো, সঙ্গে সঙ্গে সম্মুখস্থ পর্দায় ভেসে উঠলো হীরা ঝিলের তলদেশের ছবি। একটি বৃহদাকার ট্রাক কাৎ হয়ে পড়ে আছে, গভীর জলের মধ্যে এলোমেলো ভাবে পাকার কিছু মালামাল। জলোচ্ছাসে সব ছিন্নভিন্ন একাকার। ওগুলো সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে পড়েছে। হাঃ হাঃ করে অট্টহাসি হাসলো বনহুর তারপর বললো–এবার ধ্বংস করেছি শাখা-প্রশাখার মূল উৎস, এরপর সমূলে উপড়ে ফেলবো হিরোইন তৈরির মূল ঘাঁটি। এখন যিনি কান্দাই অবস্থান করছেন সেই মহামানব মিঃ রবার্ট মেরিন। সেকেন্দার শাহর মৃত্যু তাকে বিচলিত করে তুলেছে। আর সেই কারণেই তিনি সুদান ক্লু কাউঁহুড ছেড়ে এসেছেন, সঙ্গে এনেছেন মারাত্মক অস্ত্র। যে অস্ত্র দ্বারা তিনি আমাকে নিহত করে পৃথিবীতে তার দৌরাত্ম পুরাপুরি স্থাপন করবেন।

সর্দার আপনি সব সংবাদ পেয়ে গেছেন?

হাঁ, রহমান আমি নিজে তার কথাগুলো শুনেছি। সে গাড়িতে মিঃ রবার্টমেরিন আসছিলেন ঐ গাড়ির ড্রাইভারবেশে ছিলাম আমি এবং নূর ছিলো ঐ গাড়িতে।

মিঃ রবার্টের মতলব তাহলে বানচাল হয়ে গেছে সর্দার?

মিঃ রবার্টের মৃত্যু গতরাতে অনিবার্য ছিলো যদি আমি ঠিক সময় মত গিয়ে হাজির না হতাম। ওর মৃত্যু আমার উদ্দেশ্যকে বিফল করে দিতো কারণ মিঃ রবার্টের দ্বারা আমি তার হিরোইন তৈরির ঘাটি বিধ্বস্ত করবে এবং তার সহকারী বা সহপাঠিদের খুঁজে বের করে, সমুচিত শাস্তি দিবো। আরমান স্বয়ং ছদ্মবেশে তাকে হত্যা করার চেষ্টা চালিয়ে ছিলো…….

সর্দার, তার কারণ?

কারণ আরমান চায় না মিঃ রবার্ট হিরোইন ব্যবসায় সমস্ত পৃথিবী জয় করুক। সে মিঃ রবার্টের স্থান অধিকার করে নিয়ে বিশ্বজয়ী হিরোইন ব্যবসায়ী হতে এবং মিঃ রবার্টের স্থান দখল করে নিতে। একটু থেমে বললো বনহুর—আমি তা হতে দেবো না কারণ হিরোইন প্রস্তুত ঘাঁটিগুলো সমূলে ধ্বংস করতে হলে চাই মিঃ রবার্টকে। আমার মনে হয় তাকে তাড়াতাড়ি স্বদেশে ফিরিয়ে নেওয়াই বাঞ্চনীয়। হীরা ঝিলে মালমালগুলো নষ্ট হলেও দমে যায়নি মিঃ রবার্ট। ফিরে গিয়েই নতুন মালামাল পাঠানোর ব্যবস্থা তিনি করবেন।

সে কথা অবশ্য মিথ্যা নয় সর্দার। কোটি কোটি টাকা যার আর সে কি সময় নষ্ট করতে পারে রহমানের কথা শেষ হতে না হতে ফিরোজ খাঁ নামক অনুচরটি এসে পড়লো সেখানে।

বনহুর বললো—কি সংবাদ ফিরোজ খাঁ?

ফিরোজ খাঁ পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখের ঘাম মুছে ফেলে বললো–সর্দার আপনি মিঃ রবার্টের উপর ভালভাবে নজর রাখতে বলেছিলেন আমি এবং মংলু আপনার নির্দেশ মতই কাজ করেছিলাম। হঠাৎ কাউকে কিছু না জানিয়ে মিঃ রবার্ট তার নিজস্ব বিমান নিয়ে……

বলো, ফিরোজ থামলে কেনো? বলো? বললো বনহুর।

ফিরোজ খাঁ বললো—-এবার বিমান নিয়ে আকাশে উঠার কয়েক মিনিট পরই মিঃ রবার্ট ও তার দু’জন পাইলটসহ বিমানটি বিধ্বস্ত হয়।

বলো কি ফিরোজ খাঁ?

হা সর্দার। আমিও মংলু বিমান বন্দর পর্যন্ত তাকে ফলো করেছিলাম। বিমানটি বিধ্বস্ত হবার পরপরই আমি চলে এসেছি। আর মংলু কান্দাই বিমান বন্দরে অপেক্ষা করছে।

বনহুর কপালে হাত রেখে বললো—আমার উদ্দেশ্য সফলে বিঘ্ন ঘটলো। নিশ্চয়ই কোন ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন মিঃ রবার্ট।

এমন সময় সাউন্ড বক্সে ভেসে এলো বৈজ্ঞানিক মিঃ মাসাল লর্ডের কণ্ঠস্বর–মিঃ রবার্ট মেরিন এর বিমান বিধ্বস্ত এটা একটা ছলনা মাত্র–সে নিজে বিমানে আরোহণ করেনি…তারই পোষাক পরিহিত এক ব্যক্তি বিমানে আরোহণ করেছিলো এবং সে নিজের জীবন বিনাশ করে মিঃ রবার্টের কার্য ও উদ্দেশ্যকে সফল করার উদ্যোগ নিলো…

বনহুর এবং তার অনুচরবর্গের চোখে মুখে বিস্ময় ফুটে উঠলো।

ফিরোজ খাঁ ও মংলুর দু’চোখ বিস্ময়ে বিস্ফারিত হলো, তাদের দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে তাহলে মিঃ রবার্ট নিজেকে মৃত বলে ঘোষণা করলো।

বনহুর তার নিজস্ব ওয়ারলেস মেসিনের সুইচ্ টিপলো তারপর গম্ভীর গলায় বললো— মিঃ মার্শাল লর্ড আমি ভীষণভাবে দুঃখ পেয়েছিলাম রাশিয়ান হিরোইন প্রস্তুতকারী এবং ঐ কোম্পানির মালিক মিঃ রবার্ট মেরিন-এর মৃত্যু সংবাদ পেয়ে। মিঃ লর্ড আপনার অনুমান যদি সত্য হয় তাহলে আমি তাকে খুঁজে বের করবোই এবং তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবো তার দেশে…..

ভেসে আসে মিঃ লর্ডের কণ্ঠ-আমার কম্পিউটার আমাকে মিথ্যা জানাতে পারেনা বনহুর—-সত্যই সে উদগিরণ করেছে সত্য কথা। যদি তাকে দেখতে চাও তাহলে তোমার বিশ নম্বর টেলিভিশন পর্দার সুইচ টিপে দাও…এখন সে কোথায় কি করছে…….

ধন্যবাদ মিঃ লর্ড আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। কথাটা বলে উপকৃত করলেন। বনহুর এবার তার বিশ নম্বর টেলিভিশন এর সুইচ টিপলো। হীরাঝিলের তলদেশে বৈজ্ঞানিক মিঃ মার্শাল লর্ড তার কম্পিউটার মেসিন চালু করে দিলো।

সংগে সংগে বনহুরের বিশ নম্বর টেলিভিশন পর্দায় স্পষ্ট দেখা গেলো একটি লোক কালো কোট পরা এবং চোখে কালো চশমা পরা মাথায় ক্যাপ, মুখে দাড়ি, একটি ট্যাক্সিতে উঠে বসলো এবং গাড়ি ড্রাইভ করে এগিয়ে চললল।

বনহুর তার কালার ক্যামেরায় তুলে নিলো লোকটির ছবি এবং গাড়িখানার ছবি। তারপর সুইচ অফ করে দিলো সে।

বনহুর এবার বললো–রহমান ফিরোজ খাঁ এবং মংলুর সংবাদ সঠিক কিন্তু তাদের চোখে ধূলো দিয়ে শয়তানটা ভেগেছে, নিজে স্বশরীরে জীবনে বেঁচে আছে। আত্মগোপন করে সে কার্যসিদ্ধ করবে বনহুর হঠাৎ হেসে উঠলো আপন মনে।

*

নূর তার হলঘরে পায়চারী করছিলো আর ভাবছিলো, হিরোইন প্রস্তুতকারী প্রখ্যাত ব্যবসায়ী পালানোর চেষ্টা করেছিলো কিন্তু সে পালাতে পারেনি বিমান বিধ্বস্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলো। কেন সে সকলের অজ্ঞাতে পালাতে চেষ্টা করেছিলো তা সবার অজ্ঞাতে রয়ে গেলো। তার উদ্দেশ্য সফল হলো না…….

এমন সময় দারোয়ান এসে সালাম দিয়ে বললো–স্যার, একজন লোক আপনার সংগে দেখা করতে চায়।

নূর দারোয়ানকে লক্ষ্য করে বললো—নিয়ে এসো।

দারোয়ান বেরিয়ে গেলো একটু পরে একজন প্রৌঢ় লোকসহ ফিরে এলো।

নুর দাঁড়িয়ে ছিলো প্রৌঢ় লোকটি কর মর্দন করে বললো—-আমি জর্জ মিট। আপনার সংগে কিছু কথা আছে।

বললো নূর—বসুন। নিজেও একটি চেয়ারে বসলো।

ভদ্র লোকটি আসন গ্রহণ করে বললো—-আমি একটা বিপদে পড়েছি, আমাকে পুলিশ খুঁজে বেড়াচ্ছে। আমার আসল নাম গোপন রেখে মিথ্যা নামে আমাকে নিজের পরিচয় দিতে হচ্ছে। আমাকে আপনার বাঁচাতে হবে।

কিন্তু আসল নাম গোপন রেখে কথা বললে তো আমি আপনার কোন উপকার করতে পারবো বলে মনে হয় না। কথা বলার আগে আপনার আসল নামটা আমার জানা দরকার।

হা বললো, আর আপনার কথা দিতে হবে যেমন করে থোক আমাকে বাঁচাবেন। বললো প্রৌঢ় লোকটা, তার চোখে মুখে একটা করুণ ভাব ফুটে উঠেছে।

নূর ভালভাবে লক্ষ করছিলো ভদ্রলোকটিকে। তার কথাবার্তা গুলোও মনোযোগ সহকারে শুনছিলো। ভদ্রলোক তাকে কোন থোকা বাজিতে ফেলতে চায় না সত্যিই সে বিপদগ্রস্ত এটাই ছিলো তার লক্ষ্য।

প্রৌঢ় ভদ্রলোক পকেট থেকে রুমাল বের করে বার বার মুখমন্ডল মুছে নিচ্ছিলো। তার ললাটে বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে উঠলো।

নূর একটু হেসে বললো—-আমি উকিল নই তবুও আপনার সত্য কথা শুনলে হয়তো চেষ্টা করবো আপনাকে বিপদ মুক্ত করতে।

লোকটা দূরের কথায় যেন ভরসা পেলো, এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে নিলো বললো— রাজা ধর্মেন্দ্র বর্মনকে আমিই হত্যা করেছি……

নূরের দু’চোখে বিস্ময় ফুটে উঠলো, অবাক হয়ে কণ্ঠে বিস্ময় নিয়ে বললো—আপনি রাজা ধর্মেন্দ্র বর্মনকে হত্যা করেছেন? আপনি রামানন্দ লাল?

হাঁ হাঁ, আমিই রামানন্দলাল আমার আসল পরিচয় এইটাই।

 রাজা ধর্মেন্দ্র বর্মন ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি ছিলেন আপনি তাকে…

আমিই তাকে হত্যা করেছি। কেন করেছি সব বলবো আপনাকে।

পুলিশ আপনাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে এবং আমি নিজেও এ ব্যাপারে উৎসাহী। আর আপনি এসেছেন আমার কাছে উপকার নিতে?

হাঁ নূর, আমি জানি আপনি এ ব্যাপারে পুলিশের পাশে থেকে গোপনে আমার সন্ধান করে ফিরছেন।

এতো জেনেও আপনি এসেছেন আমার কাছে।

এসেছি আর কতদিন এমনিভাবে পালিয়ে আত্মগোপন করে বেড়াবো, ছদ্ম নামেই বা আর কতদিন এ ভাবে চলবে……

সীতানাথ বাবু আপনি কেন তাকে হত্যা করেছিলেন? সত্য জবাব দিবেন এবং সত্য বলবেন।

শুনুন, আমি বলতেই এসেছি।

 বলুন?

সীতানাথ বাবু বলতে শুরু করলেন–আমার বাল্যবন্ধু ছিলো রাজা ধর্মেন্দ্র বর্মণ।

হাঁ, এ কথা ডায়রীতে লিখা আছে তা ছাড়াও আপনার কন্যা সীমা রাণীর বিয়েও দিয়েছিলেন রাজা ধর্মেন্দ্র বর্মণের পুত্র শ্যামাবর্মণের সঙ্গে কিন্তু……

কিন্তু কেন আমি এ কাজ করেছি।

তাই আমার প্রশ্ন–শুধু আমার নয় পুলিশ মহলের সবার মনেই এ প্রশ্ন। মিঃ বর্মণ শুধু। আপনার বাল্যবন্ধুই ছিলেন না তিনি আপনার পরম আত্নীয়।

হাঁ, সত্য এ সব কথা। তবু আমি কেমন করে এ কাজ করলাম।

আপনি তাকে এমন ভাবে হ্যাঁ করেছেন যা শুধু নিশংসই নয় এক ভয়াবহ হত্যা। প্রকাশ্য তাকে সূতীক্ষ্ণ ধারালো অস্ত্রদ্বারা হত্যা করেছেন।

করেছি…..একবার মুখমন্ডল রুমাল দ্বারা মুছে নিয়ে বললো ভদ্রলোক সীতানাথ শুনেছি আপনি হিরোইন ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ক্ষেপে আছেন, তাদের নির্মূল করার জন্য আপনার প্রচেষ্টা…….

হাঁ, আপনাকে যে ব্যাপারে আমি প্রশ্ন করলাম সেই ব্যাপারে বলুন?

আমার একমাত্র কন্যাকে হত্যা করেছিলো রাজা ধর্মেন্দ্র বর্মণ আর আমি সেই কারণেই তাকে হত্যা করেছি। প্রতিহিংসা আমাকে উন্মাদ করে তুলেছিলো। সবাই জানে আমার সীমা রাণী সন্তান প্রসবকালে মৃত্যুবরণ করেছে।

হাঁ, আমরা সেই রকম রিপোর্ট পেয়েছি। আপনি বিনা কারণে রাজা ধর্মেন্দ্র বর্মণকে শ্মশানে আপনার কন্যার শবদেহর সৎ কাজের সময় প্রকাশ্য হত্যা করেছিলেন?

এ কথা সত্য, কিন্তু আমার কন্যা সীতারাণী সন্তান সম্ভবা ছিলো না। তাকে হত্যা করা হয়েছিলো বিনা দোষে। ধর্মেন্দ্র বর্মণের পুত্র শ্যামা বর্মনের অগোচরে। শুনুন সে কাহিনী……আমার বন্ধু ধর্মেন্দ্র রাজ পরিবারের সন্তান বটে কিন্তু সে ছিলো একজন অসৎ ব্যক্তি। গোপনে সে হিরোইনের ব্যবসা করতো। বিদেশ থেকে কোটি কোটি টাকার মাল আসতো এবং পাচার করতো সে সমস্ত দেশে। আমি বা কোন আত্নীয়-স্বজন জানতাম না তার এই অবৈধ মাদকদ্রব্য ব্যবসার কথা। তার অর্থ-লালসা বেশি ছিলো তাই বলে সে এতো বড় সর্বনাশী ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলো এটা জানলে ঐ পরিবারে আমার একমাত্র কন্যাকে সমর্পণ করতাম না।

তারপর?

আমার জামাতা শ্যামা বর্মন হিরোইন ব্যবহার করতে একথাও আমি বা আমার মেয়ে জানতো না। যখন সীমা জানতে পারলো তখন সে ঘৃণায় দুঃখে শয্যাশায়ী হলো। একদিন গোপনে সন্ধান নিয়ে দেখতে পেলো তারই শ্রদ্ধেয় শ্বশুর রাজা ধর্মেন্দ্র বর্মন হিরোইন ব্যবসা করেন এবং তার আসল ব্যবসার ঘাটি তারই বাড়ির তলদেশে ভূগর্ভে। সীমা স্বয়ং উপস্থিত হয় সেই ভূগর্ভস্থ কক্ষে। সবকিছু উদ্ঘাটন হয়ে পড়ে তার কাছে। ধর্মেন্দ্র সীমাকে দেখে বিস্ময়ে থ’ হয়ে যায়। কারণ সে কোন দিন তার গোপন ব্যবসার কথা পরিবারের কাউকে জানাতে রাজি ছিলো না। সীমার রাগ, দুঃখ প্রকাশ পায়, সীমা কঠিন মেয়ে, সে ধর্মেন্দ্রর মুখের উপর বলেছিলো–আপনি এতো অসৎ জানতাম না। অসৎ ব্যক্তির সন্তান অসই হয়। আপনার ব্যবসার শিকার আপনার সন্তান শ্যাম। আমি আপনাকে পুলিশে ধরিয়ে দিবো……হাঁ, আমার মেয়ে সীমা আর সেই ভূগর্ভ থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। তাকে পাষন্ড রাজা ধর্মেন্দ্র বর্মন গলা টিপে হত্যা করে তার মুখ বন্ধ করে দেয়, কিন্তু সে ভাবতে পারেনি তারই এক কর্মচারী এ দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে এবং রাত্রির অন্ধকারে আমার বাড়ি এসে সবকিছু অবগত করে।

আমি সংবাদ শুনে উম্মাদের মত ছুটলাম ততক্ষণে আমার সীমাকে ধর্মেন্দ্র রাত্রির অন্ধকারে শ্মশানে নিয়ে গিয়ে দাহ করে। আমি নিজকে সামলাতে পারিনি সূতীক্ষ্ণ ধার ছোরা কাপড়ের নিচে লুকিয়ে নিয়ে শ্মশানে ছুটে যাই এবং সকলের সম্মুখে ধর্মেন্দ্র বর্মনের বুকে বসিয়ে দেই। এবার থামলো সীতানাথ বাবু, চোখে মুখে তার কঠিন ক্রুদ্ধতার ছাপ ফুটে উঠে। তারপর ছোট্ট বালকের মত হু-হুঁ করে কান্নায় ভেঙে পড়লো।

নূর উঠে দাঁড়ালো, তারপর গম্ভীর গলায় বললো—আপনি তারপর আত্নগোপন করেছিলেন?

হাঁ, কিন্তু আমার প্রতিহিংসা তবুও নিবৃত্ত হয়নি। যতদিন না রাজা ধর্মেন্দ্র বর্মনের বাড়ির সেই হিরোইন বোঝাই কক্ষটিকে সমূলে ধ্বংস করতে না পেরেছি ততদিন আমি স্বস্তি পাবো না। জানি, পুলিশ মহলের লোকেরা আমাকে খুঁজে ফিরছে, হয়তো বিচারে আমার ফাঁসি হবে, তাতে আমার দুঃখ নেই। আমি ধর্মেন্দ্র বর্মনের সাধের হিরোইন গুলোকে সমূলে বিনষ্ট করতে পারলে স্বস্তি পাবো এবং তখন আমি নিজে গিয়ে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করবো……

নূর হাত বাড়িয়ে সীতানাথ বাবুর দক্ষিণ হাতখানা চেপে ধরলো–আমি আপনাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করবো সীতানাথ বাবু!

বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললো সীতানাথ-সেই ভরসা নিয়েই আমি এসেছি আপনার কাছে। জানতে পেরেছি হিরোইন এবং মাদকদ্রব্য নির্মূল করার ব্যাপারে আপনি আগ্রহী……

হা, সীতানাথ বাবু, আপনার কথা সত্য। কোন কোন রাষ্ট্র বা দেশ পৃথিবীর যুব শক্তিকে ধ্বংসকল্পে বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করেছে। মাদকদ্রব্য ব্যবহার মারাত্মক তাই তারা মাদকদ্রব্যের দ্বারা দেশকে পঙ্গু করে দিচ্ছে। আপনার ঘটনাটা জানতে আমি উপকৃত হলাম। আপনার জীবন যাতে বিপন্ন না হয় এ জন্য আমার খেয়াল থাকবে।

তা হলে সীমাকে হারানোর ব্যথা কিছুটা লাঘব হবে। আমি নিজের জীবনের জন্য মোটেই ভয় পাই না। তবে আমার বাসনা যে কারণে আমার সীমা জীবন দিয়েছে তা যেন ব্যর্থ না হয়। সীতানাথ বাবু উঠে পড়লেন এবং বিদায় গ্রহণ করলেন।

নূর কিছুক্ষণ আপন মনে পায়চারী করে নিলো তারপর ড্রয়ার খুলে বের করলো তার ছোট্ট নোট বইখানা। কিছু লিখলো তারপর পুলিশ অফিসে ফোন করলো সে।

পুলিশ ইন্সপেক্টর আহসান আলী তখন অফিসে কর্মরত ছিলেন। নূরের ফোন পেয়ে খুশি হলেন কারণ নূরকে পুলিশমহল যেমন ভাল বাসেন তেমনি তার উপর আস্থা আছে সকলের।

নূর ইন্সপেক্টর আহসান আলীর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বললো এবং কিছু সময়ের মধ্যেই পুলিশ অফিসে যাবে বলে জানালোকারণ কিছু গোপনীয় এবং জরুরি কথা আছে।

বয় এসে কফি দিয়ে গেলো।

নূর কফির কাফে চুমুক দিতে দিতে গভীরভাবে ভাবতে লাগলো। একটু পূর্বে সীতানাথ বাবুর কথাগুলোই ভাবছিলো সে। মাদকদ্রব্যে দেশ ছেয়ে গেছে, বিশেষ করে হিরোইন ব্যবসা জেকে বসেছে। দেশে বহু ধনাঢ্য ব্যক্তিগণ এ ব্যবসায় আরও ধনাঢ্য হয়ে বসেছে। বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীগণ এ সুযোগ নিয়ে এই সব ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে দেশ ও দশের সর্বনাশ করে যাচ্ছে। বিভিন্ন দেশের সরকার মহল এ ব্যাপারে সজাগ পদক্ষেপ গ্রহণ করেও কিছু করতে পারছেন না। তবে সবাই হতাশ হলে চলবে না। এই সব অসৎ ব্যবসায়ীদের খুঁজে বের করতে হবে এবং এ ব্যবসার মূল উৎস বিনষ্ট করতে হবে। সীতানাথ বাবু আইনের চোখে দোষী হলেও রাজা ধর্মেন্দ্র বর্মণকে হত্যা করে সে ভাল করেছে। রাজপরিবারের একজন ধন কুবেরু অর্থ লোতে দেশের ভবিষ্যৎ বিনষ্ট করে দিচ্ছিলো এবং ব্যক্তির উচিৎ সাজা মৃত্যুদন্ড।

নূর কফি পান শেষ করে উঠে পড়লো।

তারপর ড্রাইভারকে তার গাড়ি বের করার নির্দেশ দিলো সে।

*

পুলিশফোর্স নিয়ে ঐ দিনই রাজা ধর্মেন্দ্র বর্মণ এর বাড়িতে হানা দিয়ে সেই গোপন ব্যবসাকেন্দ্র আবিষ্কার করলো নূর তারপর কোটি কোটি টাকা মূল্যের হিরোইন বের করে আনলো। সেই গোপন কক্ষের একটি গোপন কুঠরীর মধ্যে পাওয়া গেলো শ্যামা বর্মণের প্রাণহীন দেহ। অতিরিক্ত হিরোইন গ্রহণ করায় তার মৃত্যু ঘটেছে। শ্যামাবর্মনের শবদেহ মর্গে পাঠিয়ে নূর এবং পুলিশ সুপার মিঃ হাসনাত ও ইনসপেক্টর আহসান আলীসহ মাদকদ্রব্য সব পুলিশ অফিসে ফিরে আসে।

মাদকদ্রব্যগুলি পুলিশ অফিসের অদূরে একটি খোলা মাঠে আগুনে ভস্মিভূত করা হয়। কান্দাইবাসীগণ জানতে পেরে পুলিশ অফিসের অদূরে ভীড় জমিয়ে এ দৃশ্য দেখে। সবার মুখেই কথা, রাজা ধর্মেন্দ্র বর্মণ নিজেও মরলেন একমাত্র সন্তান তাকেও হারালেন এবং দেশব্যাপী কুখ্যাত রাজা বলে প্রমাণিত হলো।

শুধু কান্দাই নয় সমস্ত বিশ্বে এ কথা ছড়িয়ে পড়লো বেতারে।

এরপর নূর পুলিশবাহিনীসহ খুঁজে ফিরতে লাগলো কোথায় কে মাদকদ্রব্য গোপনে রক্ষণাবেক্ষণ করে ব্যবসার ফাঁদ পেতে বসেছে।

নূর যখন এ সব নিয়ে মেতে উঠেছে তখন আরমান বন্ধুর প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো, সে তার সঙ্গীদের নিয়ে আলাপ আলোচনা করলো। নূর তার পার্টনার হবার ছলনা করে গোপন ব্যবসা রহস্য জেনে নিয়েছে। এবার সে যে কোন মুহূর্তে তাকে নাকানিচোবানি খাওয়াবে। কাজেই নূরকে পৃথিবী থেকে সরাতে হবে।

একদিন নূর বাসায় ফিরছিলো।

 রাত তখন বারোটা হবে।

পথ প্রায় নির্জন।

দু’একটা যানবাহন চলাচল করছে।

নূর একাই গাড়ি ড্রাইভ করে চলেছে। নূর গিয়েছিলো মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। হঠাৎ করে কখন কোন মুহূর্তে তার আব্বু তাকে সুদানে যাবার জন্য নির্দেশ দেবে তা কে জানে। নূর ক’দিন পূর্বে পিতার সঙ্গে ওয়্যারলেসে কথা বলে সেই রকম আন্দাজ করে নিয়েছিলো। অচিরেই হয়তো ডাক আসবে তার।

মায়ের শরীর ভাল নয় তাই নূর ভীষণ চিন্তিত। তাই আজকাল নূর প্রায়ই মায়ের কাছে যায়। সন্তানকে কাছে পেয়ে মায়ের মনে শান্তি আসে, নানারকম আলাপ-আলোচনা হয় মায়ের সঙ্গে।

আজ নূরের মনটা বেশ স্বচ্ছল ছিলো।

 মা বলেছে, তুই আমার নয়নের মনি, দূরে থাকলে কি চলে বাবা।

বলেছিলো নূর–দূরে কই আম্মু। এই তো সামান্য কয়েক মাইল হবে, তর এসে পড়ি, এই তো আমি তোমার পাশে।

মনিরা তখন ভাবছিলো এমনি করেই কথা বলতে বনহুর। ঠিক নূর যেন তারই প্রতিচ্ছবি। আনমনা হয়ে যায় মনিরা।

নূর বলে–কি ভাবছো আম্মু?

না, কিছু না।

 নূর গাড়ি ড্রাইভ করছিলো আর ভাবছিলো মায়ের কথা। মাকে নূর তেমন করে হাসতে দেখেনি কোনদিন। সব সময় মাকে সে আনমনা বিষণ্ণ দেখেছে। আজ তাকে কাছে পেয়ে মা প্রাণ খুলে হেসেছিলো। সত্যি মাকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছিলো……।

হঠাৎ একটা গাড়ি এসে পথরোধ করে ফেললো নূরের গাড়ির। নেমে এলো চার পাঁচজন অস্ত্রধারী লোক। সবার মুখে মুখোশ, হাতে চক্চকে রিভলভার।

নূর গাড়ি থামিয়ে ফেলতে বাধ্য হলো।

[পরবর্তী বই শত্রু কবলে নূর]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *