মনিরার মুক্তি

মনিরার মুক্তি –১২৪

ডুবু জাহাজের বৈদ্যুতিক আলোতে বনহুরের দেহের জমকালো পোশাকটা চক চক করছিলো। আজ তার মাথায় পাগড়ি নয়, অদ্ভুত ধরনের ক্যাপ। শরীরে ডুবুরীর ড্রেস। টেলিভিশন পর্দার সম্মুখে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে সে পর্দার দিকে।

আংগুলের ফাঁকে ধূমায়িত সিগারেট।

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ করছে বনহুর টেলিভিশন পর্দা এবং মাঝে মাঝে সে দেখে নিচ্ছিলো দিকদর্শন যন্ত্রটা। পাশে দন্ডায়মান তার বিশ্বস্ত অনুচর জুনলং। যদিও সে বিদেশী তবুও বনহুরের আস্তানায় সে বিশ্বাসী একজন অনুচর। সাগর তলে ডুবু জাহাজ চালনায় সে দক্ষ বলা যায়। কান্দাই সাগর এসে যেখানে প্রশান্ত মহাসাগরে মিশেছে ঠিক সেই স্থানে বনহুরের ডুবু জাহাজ এখন পৌঁছেছে। বনহুর দিক দর্শন যন্ত্রটার দিকে তাকিয়ে বললোডন আমরা প্রশান্ত মহাসাগরে পৌঁছে গেছি।

হা-সর্দার আমাদের ডুবু জাহাজখানা এখন কান্দাই সাগর অতিক্রম করে চলে এসেছে। এখন আর একটা নতুন বিপদের সম্ভাবনা আছে।

কি রকম? বললো বনহুর।

ডন বললো—প্রশান্ত মহাসাগরের তলদেশে অনেক ডুবু পর্বতমালা মাথা উঁচু করে আছে।

ঠিক বলেছো ডন। সাবধানে আমাদের জাহাজখানা চালনা করবে। তুমি যাও, ইঞ্জিন ক্যাবিনে যাও। এততটুকু অসাবধানতার জন্য আমাদের জাহাজখানা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে। তাছাড়া আছে নানাধরণের হিংস্র জলজীব। বিরাট আকার তিমি, এবং হাঙ্গর যা আমাদের জাহাজের ক্ষতিসাধন করতে পারে।

সর্দার আপনার নির্দেশ পালনে আমরা সর্বদা প্রস্তুত আছি। কথাটা বলে চলে গেলো ডন ডুবু জাহাজের ইঞ্জিন ক্যাবিনের দিকে।

রহমান আর মাহবুব এসে দাঁড়ালো, তারা কুর্ণিশ জানালো বনহুরকে।

 বললো বনহুর—মাহবুব এখন কেমন বোধ করছো?

বললো মাহবুব–অনেকটা সুস্থ বোধ করছি সর্দার।

রহমান বললো—সর্দার, ব্যাগটার মধ্যে যে কাগজপত্র রয়েছে তা অত্যন্ত মূল্যবান এবং সে কারণেই তারা ঐ ব্যাগটা নিয়ে আতুরক্ষার চেষ্টা করেছিলো।

হাঁ ঠিক বলেছো রহমান। ব্যাগের কাগজপত্রগুলোর মধ্যে লুকিয়ে আছে অনেক রহস্য। মাহবুব এখন অনেকটা সুস্থ। কাজেই আমি কিছুটা নিশ্চিন্ত তার ব্যাপারে।

রহমান বললো—সর্দার মাহবুবের আঘাতটা সাংঘাতিক ছিলো। তবুও তাড়াতাড়ি সে আরোগ্য লাভ করতে সক্ষম হলো আপনার চেষ্টায়।

হেসে বললো বনহুর—আমি তো ডাক্তার বা কবিরাজ নই, সামান্য কিছু ঔষধ-পত্র আমার জানা আছে, যা আমি জাহাজে রেখেছি। যাক ওসব কথা, শোন রহমান—আমাদের লক্ষ্য ছিলো শত্রু জাহাজের তলদেশে যে বাক্স অথবা জলযান ঝুলন্ত অবস্থায় ছিলো তা উদ্ধার করা। কিন্তু সম্ভব হলো না। তার একমাত্র কারণ কান্দাই সাগর এগিয়ে গেছে প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে এবং এমন এক স্থানে শত্রু জাহাজ তাদের জাহাজের তলদেশ হতে ঝুলন্ত বাক্সটি খুলে দিলো বা বিচ্ছিন্ন করলো সে স্থানের জলরাশি প্রবল বেগে প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এ কারণেই সেই অদ্ভুত বাক্সটা আমরা খুঁজে পেলাম না। বাক্সটা যতদূর সম্ভব প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে চলে গেছে ভাসমান অবস্থায়।

রহমান বললো–হা সর্দার আপনার অনুমান মিথ্যা নয়। ঐ বাক্সটার রহস্য আমরা কোনদিন উদ্ধার করতে আর সক্ষম হবো না।

তোমার অনুমান সত্য রহমান।

সর্দার ব্যাগটার মধ্যে যে কাগজপত্র আছে ওগুলো পরীক্ষা করে দেখা দরকার, যদি কোন রহস্যের সন্ধান পাওয়া যায়।

হাঁ তাই দেখবো। মাহবুব সেই ব্যাগটা নিয়ে এসো।

মাহবুব চলে গেল।

বনহুর বললো–জবরু আর মতি লাল কোথায়?

ওরা সাবমেরিনগুলো ঠিকভাবে জাহাজের খোলসের মধ্যে উঠিয়ে রাখছে।

সাবমেরিনগুলো ঠিক আছে কিনা ভালভাবে পরীক্ষা করা হয়েছে?

হাঁ সর্দার।

যে কোন মুহূর্তে ওগুলো দরকার হতে পারে। আমাদের জাহাজ এখন প্রশান্ত মহাসাগরে উপনীত হয়েছে। অনেক ডুবু পর্বতমালা আছে যার সঙ্গে আমাদের ডুবু জাহাজের সংঘর্ষ হতে পারে এবং আমাদের জাহাজখানা বিধ্বস্ত হতে পারে। এ কারণে সর্বক্ষণ সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে জাহাজের সামনের ভাগে।

এমন সময় মাহবুব সেই অদ্ভুত ধরণের ব্যাগটা নিয়ে হাজির হলো এবং বনহুরের সামনে টেবিলটার উপরে রাখলো।

বনহুর ব্যাগটা খুলে ফেললো।

একটা ভাজ করা কাগজ এবং আরও কিছু চিঠিপত্র।

বনহুর প্রথমে চিঠিগুলো এক একটি করে মেলে ধরলো চোখের সামনে। চোখেমুখে তার ভাবের পরিবর্তন হচ্ছিলো। কয়েকখানা চিঠি পড়ার পর বনহুর তাকালো রহমানের মুখের দিকে।

এতক্ষণ রহমান এবং মাহবুব বিস্ময়ভরা দৃষ্টি নিয়ে দেখছিলো। অবশ্য চিঠির লেখাগুলো ছিলো খুব সংক্ষিপ্ত। সর্দারের মুখোভাব তারা লক্ষ করে বুঝতে পারছিলো, চিঠিগুলো সাধারণ নয়।

বনহুর একটা শব্দ করলো–হু……

রহমান বললো–সর্দার কিছু অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছেন কি? চিঠির লেখাগুলো সাংকেতিক শব্দ বলে মনে হচ্ছে?

বনহুর ভ্রুকুঞ্চিত করে বললো—অত্যন্ত সুচতুর ওরা। সাংকেতিক শব্দগুলো জটিল। পুনরায় আর একটি চিঠি মেলে ধরলো বনহুর। একটি ইংরেজি চিঠি। বনহুর দ্রুত চিঠিখানার উপরে দৃষ্টি বুলিয়ে গেলো, গম্ভীর হয়ে পড়েছে তার মুখমন্ডল।

বনহুর সর্দারের মুখোভাব লক্ষ করে বিচলিত হলো, চিঠি খানাতে এমন কি লিখা আছে যা সর্দারের মনে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। চিঠিখানা বার দুই পড়লো বনহুর তারপর বললো—রহমান এ চিঠি অত্যন্ত রহস্যপূর্ণ। কথাটা বলে সোজা হয়ে দাঁড়ালো সে।

প্রশ্ন ভরা দৃষ্টি নিয়ে সর্দারের মুখে তাকালো রহমান এবং মাহবুব। তাদের মনে একটা প্রবল দুঃশ্চিন্তার ছায়াপাত ঘটলো। হঠাৎ করে কিছু জিজ্ঞাসা করার সাহস হলো না। রহমান জানে ভীষণ কোন ঘটনার সম্মুখীন হলে তখন সর্দারের মুখোভাব কঠিন হয়ে উঠে। নিশ্চয়ই এমন কোন কথা চিঠিতে পেয়েছে সর্দার যা অত্যন্ত ভয়ংকর এবং আশংকাজনক।

বনহুর বললো–রহমান দুঃসংবাদ। এ চিঠিখানা মাত্র কয়েকদিন পূর্বে লেখা। বি, কে চৌধুরী স্বয়ং এ চিঠি লিখে ছিলেন তার প্রধান সহকারী রবিন হামবার্ডের কাছে। মনিরাকে ওরা চুরি করে এনেছে এবং কোন গোপন স্থানে বন্দী করে রেখেছে……

সর্দার বলেন কি!

হাঁ রহমান এ চিঠিতে তাই জানতে পারলাম। অগণিত নর হত্যাকারী বি, কে চৌধুরী মিঃ জাফরীকেও হরণ করেছিলো এবং তারই ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে মনিরা।

সর্দার তার উদ্দেশ্য? প্রশ্ন করলো মাহবুব।

উদ্দেশ্য তার নরহত্যা, যে উদ্দেশ্যে মিঃ জাফরীকে অপহরণ সেই উদ্দেশ্যেই মনিরাকে ওরা চুরি করে এনেছে।

এতো বড় দুঃসংবাদ……না না আমরা ভাবতেও পারছি না মনিরাকে বি, কে চৌধুরী অপহরণ করে এনে বন্দী করে রেখেছে। অসম্ভব!

অসম্ভব নয় রহমান বি, কে চৌধুরীর অসাধ্য কিছু নেই কারণ তার প্রচুর অর্থ আছে এবং সে একজন নেতৃস্থানীয় লোক। তা ছাড়া বিড়াল তপস্বী সেজে প্রতিপত্তিশালী হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। যত অপরাধ করুক সব চাপা পড়ে যায়, কেউ তার ভয়ে প্রকাশ করতে চায়না। বি, কে চৌধুরী আসলে একটি নর পশু। এ সব জেনেও লোকে তার বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারেনা বা চায়না।

সর্দার তার সম্বন্ধে সব কথা আমরা আপনার নিকটে শুনেছি কিন্তু এই লোকটা সবার চোখে ধুলো দিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করে তোক সমাজের ক্ষতি সাধন করে যাচ্ছে, এ কেমন কথা? সর্দার আপনি বলেছিলেন এক বিস্ময়কর নারীমূর্তি আপনাকে বি, কে চৌধুরীর দুর্গম বন্দীশালা থেকে বের করে আনে এবং বি, কে চৌধুরীকে সেই বন্দী শালায় আবদ্ধ করে, কিন্তু সেই দুর্গম বন্দীশালা থেকে কি ভাবে উদ্ধার লাভ করলো……।

বনহুর হেসে উঠে বললো–রহমান তুমি এ প্রশ্ন করবে ভাবতে পারিনি। কারণ বি, কে চৌধুরী তার নিজের বন্দী শালায় আবদ্ধ ছিলো। যত দুর্গম হোক মুক্তির পথ সে তৈরি করে নিতে সক্ষম হয়েছিলো। যদিও আমি নিজে অনেক খোঁজ করেও গোপন কোনো পথ আবিস্কার করতে সক্ষম হইনি সেদিন। অত্যন্ত ধূর্ত আর ভয়ঙ্কর লোক এই বি, কে চৌধুরী তার আসল নাম বারীকুর চৌধুরী। অবশ্য তার আরও একটি নাম আছে যে নাম অনেকেই জানেনা তার ছদ্ম নাম…..রেড টাইগার–মানে লাল ব্যাঘ্র। এ নামে সে তার দলবলের কাছে পরিচিত। একটু থামলো বনহুর তারপর অধর দংশন করে বললো—মনিরাকে চুরি করে এনে সে আমাকে কাবু করতে চেয়েছে…….এবার আমি বারীকুর চৌধুরীকে দেখে নেবো রহমান। তার চামড়া ছাড়িয়ে লবন মাখিয়ে দেবো। যেমন করে সে শত শত অসহায় মানুষকে মৃত্যু যন্ত্রণা দিয়েছে। পুনরায় চিঠিখানা পড়লো বনহুর।

এবার সে ভাঁজ করা কাগজটা তুলে নিলো হাতে। মেলে ধরলো বনহুর টেবিলটার উপরে। কাগজখানা একটি নক্সা। বনহুর ঝুঁকে পড়ে মনোযোগ সহকারে দেখতে লাগলো।

রহমান, মাহবুব তারাও দেখছে।

জাহাজখানা এখন প্রশান্ত মহাসাগর এর তলদেশ দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সামনে এবং দু’পাশে নানা ধরনের জলজীব এবং উদ্ভিদ পরিলক্ষিত হচ্ছে। চালক উন ও তার সহকারীগণ অত্যন্ত সজাগ, হঠাৎ কোনো বিপদের সম্মুখীন না হয়। অনেক ডুবু পাহাড় পর্বত নজরে পড়ছে। একটু অসাবধান হলেই প্রচন্ড ধাক্কা লাগতে পারে এবং জাহাজখানা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যেতে পারে। ডন এ কারণে নিজে জাহাজখানা চালনা করছিলো।

বনহুর আরও বলেছিলো তোমাদের দৃষ্টি যেন সাগরের উপরিভাগে থাকে। কারণ আমরা সেই অজানা ভাসমান বাক্সটার সন্ধান চালিয়ে চলেছি। বাক্সটার মধ্যে এমন কিছু ছিলো বা আছে যা আমাদের অজ্ঞাত। যখনই শত্রু পক্ষের জাহাজখানা জানতে পেরেছিলো, তাদের জাহাজখানাকে কেউ ফলো করছে তখনই তারা তাদের জাহাজের তলদেশ হতে ঝুলন্ত বাক্সটার শিকল বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিলো। কাজেই আমাদের খুঁজে বের করতেই হবে সেই হারিয়ে যাওয়া বাক্সটা।

ডন এ কারণে সজাগ দৃষ্টি রেখে জাহাজ চালনা করে চলেছে।

বনহুর ম্যাপ বা নক্সা খানায় ভালভাবে নজর দিয়েই বলে উঠলো–রহমান এ নক্সা সেই ঝুলন্ত বাক্সটার। এই দেখো–

রহমান এবং মাহবুবুও দেখছিলো। তারা বলে উঠলো, হাঁ সর্দার এই নক্সাখানা সেই জাহাজে ঝুলন্ত বাক্সটির, তাই মনে হচ্ছে।

হাঁ এবং এই দেখো নিচে সাংকেতিক চিহ্ন। এ চিহ্নতে বোঝা যাচ্ছে সেই বাক্সটার মধ্যে দুটি লোককে ওরা বন্দী করে রেখেছে।

সর্দার অত্যন্ত জটিল এবং বিস্ময়কর ব্যাপার।

তা সত্য এবং এ কাজ সেই নরাধম বি, কে চৌধুরী ছাড়া কারো নয়। এ মুহূর্তে দেশব্যাপী মানুষ অপহরণের যে অরাজকতা চলেছে তা চরম পর্যায়ে উপনীত হয়েছে।

হাঁ সর্দার দেশব্যাপী ভীষণ এবং ভয়ংকর অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। ছেলেমেয়ে চুরি, যুবক যুবতী তারপর বয়স্ক ব্যক্তিরাও বাদ যাচ্ছে না। এর কারণ কি সর্দার? কথাটা বললো মাহবুব।

বনহুর বললো—কারণ গভীরভাবে একটু চিন্তা করলে বুঝতে পারবে।

রহমান বললো—সর্দার সেবার সুন্দরবন অভিযান চালিয়ে আপনি ব্যর্থ হননি। বহু অসহায় বালক বালিকা উদ্ধার পেয়েছিলো, কত তরুণ তরুণী পেয়েছিলো পরিত্রাণ। সে সময় বহু নর শয়তান দলকে আপনি উপুক্ত সাজাও দিয়েছিলেন।

বনহুর ভাঁজ করা কাগজখানার উপরে পুনরায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো–আবার সমাজে সাধুতার মুখোশ পরে বহু নেতৃস্থানীয় লোক আজকাল মানুষ অপহরণ ব্যবসায় অবতীর্ণ হয়েছেন এবং তারা লোক চক্ষুর অন্তরালে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যাচ্ছেন। এই দলের একজন বি, কে চৌধুরী।

রহমান বললো—সর্দার ঐ কাগজ পত্রগুলো কিছু উপকারে আসবে বলে কি মনে করেন?

হাঁ রহমান এই ব্যাগে যে কাগজপত্রগুলো তোমরা উদ্ধার করে এনেছে তা আমাদের পরম উপকারে আসবে। মনিরাকে ওরা বন্দী করে কোথায় রেখেছে তাও জানতে পেরেছি। পথ দেখাবে ঐ চিঠিখানা।

তা হলে এবার আমাদের ফিরতে হবে? বললো মাহবুব।

বনহুর অন্যমনস্কভাবে কিছু ভেবেছিলো তারপর বললো–হা আর বিলম্ব করা ঠিক হবে না। কিন্তু প্রশান্ত মহাসাগর আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। জানিনা কেন এ আহ্বান……

বনহুরের চোখ দুটো চক চক করে উঠলো, একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার বুক চিরে, কাগজ এবং চিঠিখানা ভাজ করে পকেটে রাখলো বনহুর।

এমন সময় সাউন্ডবক্সে ভেসে এলো ড এর কণ্ঠস্বর, সর্দার দূরে একটা কালো কিছু নজরে পড়ছে।……বস্তুটা ভাসমান কিছু বলে মনে হচ্ছে …..

বনহুর বললো আমি দেখছি……তুমি আমাদের ডুবু জাহাজের মুখ ঐ বস্তুটির দিকে ফিরিয়ে নাও…

হাঁ সর্দার আমি সেই ভাবেই জাহাজখানাকে চালনা করছি। বস্তুটি অত্যন্ত ক্ষুদ্রাকার আমাদের নজরে আসছে…

রহমান দ্রুত সুইচ টিপলো, সঙ্গে সঙ্গে টেলিভিশন পর্দায় সাগরের ছবি ভেসে উঠলো। ব্যাগের কাগজ পত্র পরীক্ষা করে দেখার সময় বনহুর স্বহস্তে সুইচ অফ করে দিয়েছিলো। এবার বনহুর তাকালো টেলিভিশন পর্দাটার দিকে। তরঙ্গায়িত জলরাশির বিশালতা সীমাহীন, দূরে কিছু একটা ক্ষুদ্রাকৃতি ভাসমান বস্তু নজরে পড়ছে।

মাহবুব এবং রহমানও ভাল ভাবে দেখছিলো।

রহমান বললো–সর্দার আমাদের টেলিভিশন ক্যামেরাটারও কিছু উপরিভাগে বাড়িয়ে দিলে হয়তো ধরা পড়বে বস্তুটার আসল রহস্য।

হাঁ ঠিক বলেছো রহমান। মাহবুব তুমি হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে টেলিভিশন ক্যামেরাটা আরও কিছু পানির উপরে তুলে ধরো।

আচ্ছা সর্দার। মাহবুব বনহুরের নির্দেশ মতো টেলিভিশন ক্যামেরার হ্যান্ডেল ঘোরাতে লাগলো।

বনহুর আর রহমান তীক্ষ্ণ নজরে দেখছে।

দেখা গেলো জিনিসটা কালো এবং ভাসমান কিছু। রহমান বললো, সর্দার আমার মনে হয় এই সেই বাক্স যার সন্ধানে আমরা এতোদূর এসেছি।

তোমার অনুমান সত্য রহমান। আমার যত দূর মনে হয় ঐটি আমাদের সেই লক্ষ বস্তু। ওর মধ্যে বন্দী করে রাখা হয়েছে দুটি মানুষকে। জানিনা তারা জীবিত আছে কিনা।

ডন বার বার নাবিকগণকে নির্দেশ দিচ্ছিলো। তারা সঠিকভাবে যেন তাকে সাহায্য করে। একজন দিকদর্শন যন্ত্রের দিকে লক্ষ রেখে পথের নির্দেশ দিচ্ছে। অপর একজন নাবিক লক্ষ রাখছে পথ পরিস্কার আছে কিনা। কোন দিকে ছোট খাটো প্রবাল পাহাড়, কোনো দিকে উদ্ভিদ আর আগাছার ছাপ বেশি। দ্রুত অথচ সাবধানে ডন জাহাজখানা চালিয়ে যাচ্ছে।

ক্রমে ভাসমান কালো বস্তুটির নিকটবর্তী হচ্ছে তারা।

প্রায় কাছাকাছি এসে গেছে।

হ্যান্ডেল ধরেছিলো মাহবুব।

বনহুর কোন সময় টেলিভিশন ক্যামেরা সাগরবক্ষে একফুট পানির উপরে কোন সময় আধফুট বা তারও কম উপরিভাগে তুলে ধরার ইংগিত করছিলো। এবার বনহুর স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, ভাসমান বস্তুটি তাদের সেই আকাংখিত বাক্সটি ছাড়া আর কিছু নয়। তবে সেটার বেশির ভাগ অর্ধডুবন্ত অবস্থায় রয়েছে।

প্রশান্ত মহাসাগর আজ শান্ত তাই ঢেউগুলো স্বাভাবিক ছিলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই বনহুরের ডুবু জাহাজ পানির উপরিভাগে ভেসে উঠলো। তখন ভাসমান বাক্সটাকে কৌশলে জাহাজে উঠিয়ে নিলো তারা। কিন্তু বাক্সটা উঠিয়ে নেওয়ার পর বনহুরও অন্যান্য সবাই অবাক হলো। দেখা গেলো বাক্সটার মধ্যে ফাঁকা, কিছু নেই।

রহমান বললো–সর্দার এই বাক্সটিই যে আমাদের লক্ষ বস্তু, সে বাক্সটি নাও হতে পারে?

বনহুর উবু হয়ে ভালভাবে ভিতরটা পরীক্ষা করে দেখছিলো রহমানের কথায় সোজা হয়ে দাঁড়ালো তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বললো রহমান এই সেই বাক্স, যেটাকে আমরা শত্রু জাহাজের তলদেশে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখেছিলাম।

মাহবুব বললো—আমরা কান্দাই সাগরে সেই শত্রু জাহাজটিকে ঘায়েল করে তলিয়ে দিয়েছি। বাক্সটি তারও অনেক পূর্বে সেই জাহাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছিলো। সে বাক্সটি প্রশান্ত মহাসাগরে এলো কি করে ঠিক বুঝতে পারছি না সর্দার।

তুমি নির্বোধের মত কথা বললে মাহবুব। কারণ তুমি জানো আমাদের জাহাজখানা দুদিন পূর্বেও কান্দাই সাগরের তলদেশে ছিলো। তারপর আমরা এখন প্রশান্ত মহাসাগরে উপনীত হয়েছি। কান্দাই সাগর এসে মিলিত হয়েছে প্রশান্ত মহাসাগরের সঙ্গে, তাই এ ব্যাপারে অবাক হওয়ার কিছু নেই। তবে আমাদের ভাগ্যে যে আমরা অত্যন্ত সহজ উপায়ে বাক্সটার খোঁজ পেলাম। সীমাহীন সাগরের বুকে ক্ষুদ্রতম একটা বাক্স খুঁজে বের করা সহজ ছিলোনা……কিন্তু বাক্সটা পেয়েও আমাদের কোন ফল হলোনা। বাক্সের আসল বস্তুই উধাও হয়েছে……এই দেখে বাক্সটার মধ্য লৌহ শিকল দিয়ে তাদের বেঁধে রাখা হয়েছিলো তার কিছু অংশ এখনও বাক্সের ভিতরে আটকে রয়েছে।

অবাক দৃষ্টি মেলে দেখছিলো রহমান মাহবুব ও আরও কয়েকজন বনহুরের অনুচর। সবাই ভাবছে বাক্সটার মধ্যে যে দুজন মানুষ ছিলো তারা কারা এবং তারা কি ভাবে বাক্সটা খুলে বেরিয়ে গেলো।

বনহুর বাক্সটাকে জাহাজের খোলের মধ্যে রেখে দেওয়ার জন্য নির্দেশ দিলো। একটা গভীর চিন্তার ছাপ পরিলক্ষিত হলো বনহুরের চোখে মুখে।

জাহাজখানা আবার নেমে চললো গভীর জঙ্গলের তলদেশে।

বনহুর ফিরে এলো তার বিশ্রাম কামরায়। এ ক্যাবিনে বা কামরায় কোনো অনুচরদের প্রবেশ নিষেধ ছিলো। বনহুর অর্ধশায়িত অবস্থায় শয্যায় শুয়ে পড়লো। তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো অদ্ভুত পোষাক পরিহিতা একটি নারী মূর্তি। যার পরিচয় এখনও সে জানতে পারিনি। একটা হাসির ক্ষীণ রেখো ফুটে উঠলো বনহুরের ঠোঁটের কোণে। কে এই সুচতুরা নারী যে তার চোখকেও ফাঁকি দিতে পেরেছে।

*

দাও ওর মুখের বাঁধন খুলে দাও। গম্ভীর একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো মনিরার কানে। চোখ মেলে তাকাতেই নজরে পড়লো কালো চশমা পরিহিত একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে তার শিয়রে।

দু’জন লোক তার দু’পাশে দন্ডায়মান।

মনিরা উঠে বসতে চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না তার মুখই শুধু বাধা নয়, তার হাত পা সব কিছু বাধা রয়েছে শক্ত দড়ি বা রশি দিয়ে। মনিরা ভালভাবে লোকটার দিকে লক্ষ করলো, তাকে চিনবার চেষ্টা করলো কিন্তু কোথাও তাকে দেখেছে বলে মনে হলো না।

ততক্ষণে দু’জন লোক খুলে দিলো মনিরার মুখের এবং হাত পায়ের বন্ধন। বললো মনিরা–আমাকে তোমরা কেনো ধরে এনেছো? বলো আমাকে তোমরা কেন ধরে আনলে?

সব পরে জানতে পারবেন মিসেস মনিরা।

 আমি তো কোনো অপরাধ করিনি?

 অপরাধ আপনি করেননি, করেছে আপনার দেব সমতুল্য স্বামী।

জবাব দিচ্ছে গম্ভীর কণ্ঠ ব্যক্তিটি। সেই ব্যক্তিই যে দলপতি তাতে কোনো সন্দেহ নাই। মনিরা উঠে বসলো, শয্যা নয় একটি কাঠের শক্ত বিছানায়। সমস্ত শরীরে ব্যথা অনুভব করলো। হাতের বন্ধন মুক্ত করে দেবার পর, হাতের কজায় কালো দাগ পরিলক্ষিত হলো, ব্যথায় টন্ টন্ করছে হাত দুখানা।

ভেবে পায়না মনিরা কেন এখানে তাকে আনা হয়েছে। তাকে নিয়ে আসার পিছনে নিশ্চয়ই কোনো উদ্দেশ্য আছে এবং উদ্দেশ্য আছে বলেই তাকে এভাবে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় আনা হয়েছে। এরা কারা। লোকটা দলপতি এবং এদের নেতা হবে, ওর কথাতেই চলছে তাদের দলের লোকগুলো।

মনিরাকে ভাবতে দেখে লোকটা বললো—কি ভাবছেন? আপনার হাতে অনেক ক্ষমতা আছে, আপনার স্বামীকে আমাদের হাতে তুলে দিলে সব পাবেন। যত টাকা আপনি চান তাই দেবো আমরা। তাছাড়া আপনার সন্তান নূরকেও আমরা বন্দী করবো তারপর তাকে হত্যা করবো যদি আপনি আমাদের কথামত কাজ না করেন।

কে আপনি নরপশু? স্ত্রীর কাছে স্বামীর বিনিময়ে টাকা। থু আপনাদের টাকায়। আমি টাকাকে ঘৃণা করি।

আপনার সন্তান। সন্তানের জীবনের বিনিময়েও আপনি আপনার স্বামী বনহুরকে আমাদের হাতে তুলে দিতে রাজি নন।

কোন জবাব দেয়না মনিরা।

লোকটি পুনরায় কঠিন কণ্ঠে বলে এমন স্থানে আপনাকে আনা হয়েছে যেখান থেকে আপনার ফিরে যাবার কোন উপায় নাই। আপনার একমাত্র সন্তান নূরকে বন্দী করে এনে আপনার সামনে হত্যা করা হবে। আমার কথার একটুও এদিক ওদিক হবে না।

না না আমাকে আপনি হত্যা করুন, আমার সন্তানকে আপনারা কিছু বলবেননা, তার শরীরে আপনারা স্পর্শ করবেন না। আমি হাসিমুখে মৃত্যুবরণ করবো তাতে আমার একটুও দুঃখ হবেনা। ব্যথা করুন স্বরে বললো মনিরা।

সেই গম্ভীর কণ্ঠস্বর-জানেন মিসেস মনিরা, আমরা আপনাকে একটি উদ্দেশ্য নিয়েই বন্দী করে এনেছি! উদ্দেশ্য আপনার স্বামী বনহুরকে আমরা চাই।

মনিরার কানের কাছে স্বামীর কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বনি হলো, মিঃ জাফরীকে যারা বন্দী করে নিয়ে গেছে তাদের কোন উদ্দেশ্য আছে—তবে কি মিঃ জাফরীকে হরণ করার পিছনেও এই সেই লোক, মিঃ জাফরীকে আটক রেখেও বনহুরকে পাওয়ার উদ্দেশ্য…যেমন তাকে চুরি করে আনা হয়েছে বনহুরকে পাবার জন্য-কি ভয়ংকর নর শয়তান এরা–এদের দলে আছে যারা স্থানে স্থানে আস্তানা গেড়ে কুকর্মে লিপ্ত

কি ভাবছেন মিসেস মনিরা বললো লোকটা।

 এমন সময় একটি লোক এসে বললো স্যার জরুরি কথা আছে এদিকে আসুন।

জরুরি কথা!

 হা স্যার।

 চলো।

 লোকটা তার সঙ্গীর সঙ্গে পাশের কক্ষে চলে গেলো।

মনিরা কান পেতে শুনলো পাশের ঘরে ওরা কথা বলছে। কি বলছে সোনার জন্য চেষ্টা করলো মনিরা কিন্তু স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে না। স্থান ত্যাগ করে উঠে এলো সে দেয়ালের পাশে। এবার মনিরা শুনতে পেলো দ্বিতীয় ব্যক্তিটি প্রথম ব্যক্তিকে বলছে, সর্বনাশ হয়েছে স্যার। কান্দাই সাগর অতিক্রম করার সময় আমাদের জাহাজখানাকে বনহুরের ডুবু জাহাজ ধ্বংস করে দিয়েছে,…..

তারপর? প্রথম ব্যক্তির কণ্ঠস্বর।

জাহাজখানা ধ্বংস হবার পূর্বেই আমাদের জাহাজ থেকে ঝুলন্ত বাক্সটা বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছিলো।

কারণ?

স্যার বাক্সটাই ছিলো বনহুরের লক্ষ্য। তাই মালেক মসায়ুর……

সর্বনাশ করেছে ময়ুর। বাক্সটার মধ্যে আমাদের মূল্যবান বস্তু ছিলো। জাভেদ আর ফুল্লরা। ওদের দুজনকে আটক করতে আমাদের কত বেগ পেতে হয়েছিলো তা তোমরা জানো।

স্যার মসায়ুরও জানতো।

তা হলে সে অমন করে ওটা জাহাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতোনা।

জাহাজখানাকে যখন বনহুরের ডুবু জাহাজ ফলো করছিলো তখন আমাদের জাহাজ খানাকে রক্ষার জন্য এ কাজ করেছিলো। ময়ুর ভেবেছিলো ওটা জাহাজ থেকে সরিয়ে ফেললে হয়তো বনহুরের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবে।

অপদার্থ। তারপর? ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বর প্রথম ব্যক্তির।

দ্বিতীয় ব্যক্তি বললোস্যার আমাদের জাহাজ থেকে অগ্নিগোলক নিক্ষেপ করেও কোন ফল হয়নি। বনহুরের ডুবু জাহাজখানা এতো বেশি দ্রুতগামী ছিলো যার জন্য আমাদের জাহাজখানা কোন রকমেই রক্ষা পেলোনা।

 মালেক মসায়ুর ডুবু জাহাজ লক্ষ্য করে কামান চালাতে পারতো।

তাও করে ছিলো কিন্তু কোন ফল হয়নি। জাহাজখানা আমাদের জাহাজ থেকে বেশ দূরে সাগর তলে ডুবু অবস্থায় ছিলো এবং জাহাজ থেকে বনহুর ডুবুরীর বেশে সাগর তল দিয়ে আমাদের জাহাজের কাছাকাছি এসেছিলো—

মনিরা কথাগুলো মনোযোগ সহকারে শুনছিলো। তার মনে প্রচন্ড একটা আলোড়ন সৃষ্টি হচ্ছিলো কারণ তার স্বামী সাগর তলে ডুবু জাহাজ নিয়ে অপর একটি জাহাজকে ফলো করে চলছিলো, তারপর ডুবুৰীর ড্রেসে সাঁতার কেটে শত্রু জাহাজের নিকটবর্তী হয়েছে–কানে ভেসে এলো—আমরা যখন বনহুরকে লক্ষ্য করে অগ্নিগোলক নিক্ষেপ করছিলাম তখন একটি অদ্ভুত ধরনের ডুবু জল যান এসে তাকে তুলে নিলো যানটার মধ্যে।

বলো কি?

হাঁ স্যার, আমরা লৌহ জাল দ্বারা বনহুরকে বেষ্টন করে ফেলেছিলাম ঐ সময় সেই বিস্ময়কর জলযান কোথা হতে সাগর তলে এসে হাজির।

নিশ্চয়ই বনহুরের দলের লোক ছিলো সেই জলযানে?

না স্যার আমরা ঠিক জেনেছি জলযান বনহুরের নয়।

তবে?

জানিনা কে এগিয়ে এসেছিলো বনহুরকে উদ্ধার করতে–

সাধে বলি তোমরা অপদার্থ। শোন জাহাজখানা যখন কান্দাই সাগরে বিধ্বস্ত হয় তখন আমি ভূগর্ভ গুহায় ছিলাম।

স্যার আপনি তা হলে টেলিভিশন ক্যামেরায় সব লক্ষ করেছেন?

হাঁ করেছিলাম। সব আমি নিজে লক্ষ করেছি আমাদের ভূগর্ভ গুহায় টেলিভিশন ক্যামেরায়। বনহুরকে তোমরা যখন লৌহ জালে আবদ্ধ করো তখন বনহুরের ডুবু জাহাজ থেকে সাবমেরিন নিয়ে কেউ বেরিয়ে এসে আমাদের জাহাজের তলদেশে আঘাত হেনেছিলো। যে আঘাতে আমাদের জাহাজ খানার তলদেশ ফেঁসে গিয়ে সলিল সমাধি লাভ করে।

স্যার আপনি তা হলে

সব না জানলেও অনেক কিছু জানি। বনহুরের ডুবু জাহাজ এখন কান্দাই সাগর অতিক্রম করে প্রশান্ত মহাসাগরের তলদেশে গিয়ে পৌঁছেছে। আমি ইচ্ছা করলে তার ডুবু জাহাজসহ তাকে ডিনামাইট দিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের তলায় চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিতে পারি কিন্তু তা করবোনা। আমি বনহুরকে জীবন্ত অবস্থায় আটক করতে চাই। একটু থেমে বললো, প্রথম ব্যক্তিটি—আমার জাহাজ খানা বিধ্বস্ত করে দিয়েছে তাতে আমার এতোটুকু আফসোস নাই। বনহুরকে জীবন্ত পাকড়াও করাই আমার মূল উদ্দেশ্য।

স্যার তা হলে…

হা আমি বনহুরের স্ত্রী মনিরাকে বন্দী করে এনেছি। এবার সে যাবে কোথায়।

স্যার ইতিপূর্বে মিঃ জাফরীকেও আটক করা হয়েছিলো ঐ একই উদ্দেশ্যে।

সফলকাম হতে পারিনি, আমার বেশ কিছু লোককে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছিলো।

এ ভাবে যদি একটির পর একটি ধ্বংসলীলা চলতে থাকে তা হলে আমাদের শুধু লোক ক্ষয়ই হবে না, বহুমূল্যবান সম্পদও হারাতে হচ্ছে।

কোন আফসোস নেই। জানোনা মোরী বনহুরের মূল্য কত? এ সব সম্পদ তার তুলনায় কিছু নয়। এবার আমি জয়ী হবো মোরী শত শত মানুষকে আমি হত্যা করেছি শুধু একই উদ্দেশ্যে!

হাঁ স্যার বহু অসহায় মানুষকে হত্যা করেছি তারপর ঝুলিয়ে দিয়েছি কান্দাই জঙ্গলে। তবুও বনহুরকে আমরা পাকড়াও করতে পারিনি। আচ্ছা স্যার নীলাঞ্জনাকে যার নির্দেশে আপনি…

তার কথা জানতে চেওনা মোরী তুমিও মারা পড়বে। যাও মসায়রুকে পাঠাও তার মুখে সব শুনবো। এতোবড় ভয়ংকর ধ্বংস লীলার মধ্যেও সে কি করে জীবনে বেঁচে আছে?

স্যার আমি তাহলে চললাম মসায়রুকে ডেকে আনতে।

 যাও বিলম্ব করোনা। যেমন করে থোক মিসেস মনিরার দ্বারা বনহুরকে করায়ত্ত করতে হবে। একবার সে পালিয়েছে আর তাকে সে সুযোগ দেওয়া হবে না। একটু থেমে বললো—- বনহুরের সাধ্য ছিলো না সে আমার দুর্গম কারাকক্ষ থেকে পালায়। এক বিস্ময়কর নারী মূর্তি ছায়ার মত আবির্ভূত হয়……কৌশলে আমাকে বন্দী করে বনহুরকে নিয়ে যায়। ওরা জানত না আমার দুর্গম কারাকক্ষে আমাকে আটক করে রাখা একটা হাস্যকর ব্যাপার। কথাটা বলে হেসে উঠলো গম্ভীর কণ্ঠস্বর লোকটি।

মনিরা তখনও কান পেতে শুনছিলো।

এবারও সে শুনতে পেলো দেয়ালের ওপাশে, কারো প্রস্থানের শব্দ।

মনিরা দ্রুত ফিরে এলো শষ্যায়। তার মনে নানা প্রশ্নের উদ্ভব হচ্ছে। গম্ভীর কণ্ঠস্বর লোকটির মুখে অনেক কথাই সে শুনতে পেলো যা সে কোনোদিন শোনেনি বা জানেনা। বনহুরকে গ্রেপ্তার করার জন্য এরা তাহলে ভীষণ একটা ষড়যন্ত্রের ফাঁদ পেতেছে। নানা ধরনের কৌশল অবলম্বন করেছে, তবুও এরা সফলকাম হতে পারেনি। কিন্তু কে সে নারী মূর্তি যার অসাধ্য সাধন ক্ষমতা আছে। দুর্গম কারাকক্ষ হতে বনহুরকে সে উদ্ধার করে নিয়ে গেছে–কে সে আর কিইবা তার উদ্দেশ্য-বনহুরের সঙ্গে কিইবা তার সম্পর্ক অনেকগুলো প্রশ্ন তার মনকে নাড়া দিচ্ছে, এরা কারা?

মনিরা চমকে উঠলো, একটা অদ্ভুত শব্দ কানে এলো তার।

 এবার এক সঙ্গে তিনটি লোক প্রবেশ করলো মনিরার কক্ষে।

যদিও কক্ষটির কোনো দরজা জানালা নাই তবু বিস্ময়কর ভাবে প্রবেশ করলো লোক তিনজন। দেয়াল সরে গেলো এক পাশে, বের হলো একটি দরজা সেই পথে লোকগুলো প্রবেশ করলো।

মনিরা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।

একজন পূর্বের সেই ব্যক্তি যার কণ্ঠস্বর কঠিন আর গম্ভীর।

লোকটা মনিরার ঠিক পাশে এসে দাঁড়ালো।

তার পিছনে আরও দুজন।

পিছনের লোক দু’জনের চেহারা হিংস্র ব্যাঘের মত। আধো অন্ধকার কক্ষমধ্যে শার্দুলের চোখের মত জ্বলছে ওদের চোখগুলো।

শিউরে উঠলো মনিরা।

প্রথম ব্যক্তি তার সঙ্গী দু’জনকে লক্ষ্য করে বললো–তোমরা এর প্রহরায় থাকবে। এর জন্য আমাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। বনহুর যদি আত্নসমর্পণ করে তাহলে আমি একে মুক্তি দেবে নইলে আজীবন এই ভূগর্ভ গুহায় বন্দী করে রাখবো। শুধু তাই নয় বনহুরের সন্তান নরকে ধরে আনবো এবং তাকে ওর সাক্ষাতে হত্যা করবো।

অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলো মনিরা। অন্তর দিয়ে করুণাময়ের সাহায্য প্রার্থনা করতে লাগলো। এ ছাড়া আর কোন উপায় নাই তার।

প্রথম ব্যক্তির কথায় লোক দু’জন জবাব দিলো-আচ্ছা স্যার আপনার নির্দেশ মত কাজ করবো।

এবার প্রথম ব্যক্তি দেয়ালের কাছে এগুতেই দরজা বেরিয়ে এলো।

 লোক তিনজন সেই পথে বেরিয়ে গেলো।

দেয়াল পুনরায় যেমন ছিলো তেমনি আকার ধারণ করলো।

মনিরা ছুটে এলো দেয়ালের পাশে। হাত দিয়ে অনেক চেষ্টা করলো কিন্তু এক চুলও নড়লোনা দেয়ালখানা।

মাটিতে বসে পড়লো মনিরা।

দু’হাতে মাথার চুল টেনে ছিঁড়তে ইচ্ছে হলো তার, চোখের সামনে সব যেন অন্ধকার লাগছে। বার বার মনে পড়ছে মামীমার মুখখানা, তিনি হয়তো কেঁদে কেটে অস্থির হয়ে পড়েছেন। তাছাড়া বৃদ্ধ সরকার সাহেব এবং বাড়ির সবাই তাকে সকাল বেলা শয্যায় না দেখে কি ভাবছেন কে জানে। নূরও জেনে ফেলেছে, হয়তো বা সে তার সন্ধানে ছুটোছুটি করে ফিরছে। তার অসাবধানতা মুহূর্তে যদি শয়তান দল তাকে বন্দী করে ফেলে তখন কি

ভাববার অন্ত নাই মনিরার।

এরপর থেকে শুরু হলো মনিরার উপর নির্মম অত্যাচার।

প্রতিদিন তাকে দশটা করে বেত্রাঘাত করা হয়, তারপর হাত পা মুখ বেঁধে ফেলে রাখা হয় মেঝেতে।

ঠান্ডা হিম শীতল মেঝেতে হাত পা জমে যাবার উপক্রম হয়।

 নীরবে আল্লাহকে ডাকা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই মনিরার।

*

নূর অস্থিরভাবে কক্ষমধ্যে পায়চারী করছে।

যা সে কোন দিন ভাবতে পারেনি তাই ঘটে গেল। কে বা কারা তার মাকে ঘুমন্ত অবস্থায় বিছানা হতে তুলে নিয়ে গেলো। পুলিশ মহলে এ ব্যাপারে নূর কিছু না জানালেও পুলিশ সুপার মিঃ কিবরিয়া জোর তদন্ত শুরু করেছেন।

নূর কিছুতেই শক্ত হতে পারছিলো না।

বারবার মায়ের মুখখানা ভেসে উঠছিলো তার মনের পর্দায়। না জানি মা এখন কোথায় কেমন আছে। কারা তাকে এভাবে সবার অজ্ঞাতে হরণ করে নিয়ে গেল। কিছুতেই নিজের মনকে সান্তনা দিতে পারছিলো না নূর।

পুলিশ সুপার মিঃ কিবরিয়া কিছুদিন হল কান্দাই এসেছেন। তরুণ পুলিশ সুপারের বেশ হৃদয় জমে উঠেছে নুরুজ্জামানের সঙ্গে। যখন কিবরিয়া শুনলো নুরুজ্জামানের মাকে কে বা কারা শয্যা হতে ঘুমন্ত অবস্থায় তুলে নিয়ে গেছে। বাড়ির সবাইকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় দেখা গেছে। ঘটনাটা তার কানে যাবার সঙ্গে সঙ্গে ব্যস্ত সমস্ত হয়ে ছুটে গেলো নূরুজ্জামানের বাংলোয়। সব কিছু শুনলো সে নূরের মুখে, তারপর নিজে এর তদন্ত ভার গ্রহণ করলো।

সমস্ত পুলিশ মহল ব্যস্তভাবে কাজে নেমে পড়লো।

কোথাও কোন ক্লু সংগ্রহ করতে পারলো না তারা।

প্রতিদিন নূরের বাংলোয় আসে মিঃ কিবরিয়া। পরামর্শ করে তারা এই ব্যাপার নিয়ে। বেশ কয়েকজন সরকারি ডিটেকটিভ গোপনে সন্ধান চালিয়ে চলেছেন।

সপ্তাহকাল চলে গেল কিন্তু কোন হদিস খুঁজে পেলো না কান্দাই পুলিশ মহল। পুলিশ মহলের সবার মনে দুঃচিন্তার ছাপ, সবাই উৎকণ্ঠার সঙ্গে প্রতিক্ষা করছে এবং গোপনে ও প্রকাশ্যে সন্ধান চালিয়ে চলছে।

নূর নিজেও এ ব্যাপারে হন্যে হয়ে ছুটোছুটি করছে। মায়ের কণ্ঠস্বর তার কানের কাছে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, বাবা নূর, আমি ভাল নেই…আমি ভীষণ কষ্টের মধ্যে আছি…আয় বাবা আমাকে মুক্ত করে নিয়ে যা-আমাকে মুক্ত করে নিয়ে যা….

নূর কক্ষমধ্যে পায়চারী করছিলো আর ভাবছিলো মায়ের কথা।

এমন সময় গাড়ি বারান্দায় গাড়ি থামার শব্দ শোনা গেলো।

একটু পর বয় এসে জানালোস্যার পুলিশ সুপার এসেছেন।

নূর বললো—আসতে বল।

বয় চলে গেলো।

একটু পরে সিঁড়িতে জুতোর শব্দ শোনা গেলো।

নূর একটি সোফায় বসে পড়লো।

কক্ষমধ্যে প্রবেশ করলো পুলিশ সুপার কিবরিয়া। নূর উঠে দাঁড়িয়ে করমর্দন করে বললো–বসুন!

পুলিশ সুপার ক্যাপটা খুলে টেবিলে রেখে বসে পড়লো, তারপর বললো–নুরুজ্জামান, আমরা একটা ক্লু পেয়েছি আপনার সহযোগিতা প্রয়োজন।

নূর উদ্বিগ্ন দৃষ্টি নিয়ে তাকালো মিঃ কিবরিয়ার মুখের দিকে।

 মিঃ কিবরিয়া বললো—গতরাতে আমার বাসায় একটি চিঠি পাওয়া গেছে।

চিঠি! আপনার বাসায়।

 হাঁ চিঠি। আশ্চর্য, চিঠিখানা আমার টেবিলে এলো কি করে ভেবে পাচ্ছি না।

কি লিখা আছে চিঠিতে? বললো নূর।

মিঃ কিবরিয়া বললো—চিঠিখানা আমার পকেটে আছে। পকেট থেকে চিঠিখানা বের করে মেলে ধরলো নূরের সামনে।

নূর চিঠিখানা হাতে নিয়ে পড়লো,

মিঃ কিবরিয়া, আপনাকে সাবধান করে দিচ্ছি-মিসেস মনিরার সন্ধানে আপনি কোন রকম উৎসাহ দেখাবেন না। আপ নার জীবন বিপন্ন হতে পারে। এ ছাড়া প্রখ্যাত তরুণ গোয়েন্দা মিঃ নুরুজ্জামান কেও ক্ষান্ত হতে বলুন। তার মাকেই শুধু হরণ করে আমরা স্থির হবো না, আমরা তাকেও বন্দী করবো যদি আমা দের উদ্দেশ্য সফল না হয়।
–নীলাঞ্জনা

দু’তিন বার চিঠিখানা পড়ে নিয়ে বললো নূর–নীলাঞ্জনা, কে এই নীলাঞ্জনা? যে আমার মাকে হরণ করেছে। মিঃ কিবরিয়া আপনার ঠিক মনে হয় কোন নারী এ কাজ করেছে।

পুলিশ সুপার মিঃ কিবরিয়া এতক্ষণ নূরের মুখোভাব লক্ষ করছিলো। এতো অল্প বয়সে এতো বড় একটি পোষ্টের অধিকারী হয়েও তার এতোটুকু গর্ব ছিলো না। অত্যন্ত অমায়িক এবং সুন্দর স্বভাবের অধিকারী ছিলো মিঃ কিবরিয়া। নূরের কথায় জবাব দিলো সে নীলাঞ্জনা নারী কিংবা পুরুষ তা ঠিক অনুমান করা কঠিন। তবে যতদূর সম্ভব ঐ নাম কোন ষড়যন্ত্রকারীর ছদ্মনাম। একটু থেমে বললো কিবরিয়া সাহেব–অত্যন্ত সাবধানে আমাদের অগ্রসর হতে হবে। নীলাঞ্জনার দলবল সুচতুর তাতে কোন সন্দেহ নাই। আমাদের বেডরুমের ড্রেসিং টেবিলে এ চিঠি এলো কি করে তাই ভেবে আশ্চর্য হচ্ছি।

নূর হেসে বললো—মিঃ কিবরিয়া আপনি মনে করেন বাইরের কোন ব্যক্তি এই চিঠিখানা রেখে গেছে?

না, মিঃ নূর আমি তা মনে করিনা। আমি আমার বয় বাবুর্চির মধ্যে কেউ এ চিঠি টেবিলে রেখেছে বলে মনে করি এবং সে কারণেই আমি আপনাকে বলেছি এই রহস্যজনক ঘটনার ক্লু পেয়ে গেছি। আপনি যা সন্দেহ করছেন আমিও সেই রূপ ধারণা করছি।

নূর চিঠিখানা ভাজ করে এগিয়ে দিলো মিঃ কিবরিয়ার দিকে রাখুন।

মিঃ কিবরিয়া চিঠিখানা পকেটে রেখে উঠে দাঁড়ালো, বললো, সে আপনি বাসায় অপেক্ষা করুন আমি পুনরায় আপনার নিকটে আসবো।

ঠিক আছে মিঃ কিবরিয়া আপনার কথা মত আমি বাসায় থাকবো।

 কিবরিয়া নূরের সঙ্গে করমর্দন করে বিদায় গ্রহণ করলো।

নূর পুনরায় পায়চারী করতে লাগলো, তার মনের পর্দার চিঠিখানা ভেসে উঠলো, তার মাকেই শুধু হরণ করে আমরা স্থির হবোনা, আমরা তাকেও বন্দী করবো যদি আমাদের উদ্দেশ্য সফল না হয়।

ভ্রু ভ্রুকুঞ্চিত হয়ে উঠলো নূরের, এমন দুঃসাহস কাদের যারা তার মাকে হরণ করে নিয়ে গেছে।

*

স্বনামধন্য ব্যক্তি মিঃ আহসান হাবীব, তিনি দীর্ঘ দিন ধরে ব্যবসা বাণিজ্য করে আসছেন। তার প্রচুর অর্থ ও ধন-সম্পদ আছে। অনেকগুলো কল-কারখানার মালিক তিনি। কালাইয়ের হীরাঝিলে তার বাসভবন। হাবীব সাহেবের ব্যবসায় কোটি-কোটি টাকা আসে।

শত শত শ্রমিক তার কল-কারখানায় কাজ করে।

মাঝে-মধ্যে হাবীব সাহেব নিজে আসেন ইন্ডাষ্ট্রিগুলো পরিদর্শনে। তার দৃষ্টি সতর্ক খুব কেউ ফাঁকি দিতে পারে না কোনো কাজে।

প্রায়ই তিনি বিদেশ যান নানা কারণে। কেন যান তা কেউ বলতে পারে না। এমন কি তার স্ত্রী মিসেস হাবীবও জানেন না স্বামীর মনের কথা।

হাবীব সাহেব নিজের ইন্ডাষ্ট্রি দেখাশোনা ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত আছেন। বিভিন্ন সমিতি এবং সংস্থার প্রেসিডেন্ট তিনি। এ সব সমিতি-সংস্থায় তাঁর দান অপরিসীম। হাজার হাজার টাকা তিনি এ সব প্রতিষ্ঠানে দান করে দাতা হিসেবে সুনাম কুড়িয়েছেন। সমিতি-সংস্থার সদস্যগণ সকলেই তার দলের লোক, তার পক্ষে যারা নেই তারা কখনও সদস্য পদে বহাল হওয়ার সুযোগ লাভ করে না। কৌশলে অর্থের বিনিময়ে তিনি সদস্যদের নিজের হাতের মুঠায় ভরে রাখেন। বাইরের সাধারণ লোক এখানে কোনো সুযোগ পায় না কোনো সময়।

মাঝে মাঝে শ্রমিকদের মধ্যে বিদ্রোহ ভাব জেগে উঠলে হাবীব সাহেব নিজে খোঁজ নেন কে এই ব্যক্তি যে শ্রমিকদের মধ্যে বিদ্রোহী মনোভাব সৃষ্টি করে তুলছে। সংবাদ সংগ্রহ করতে বেশি সময় লাগে না তার।

পরদিন সেই ব্যক্তিকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না।

গোপনে তাকে সরিয়ে ফেলা হয়।

ইন্ডাষ্ট্রির পেছন অংশে একটি গুপ্ত কক্ষ আছে, সেখানে হাত পা-মুখ বেঁধে তার বুকে অস্ত্রোপচার করা হয়। বের করে নেওয়া হয় হৃৎপিন্ড, তারপর অন্ধকূপে নিক্ষেপ করা হয় তাকে।

কেউ জানে না কোথায় হারিয়ে গেলে সেই ব্যক্তিটি।

এমনি করে বহু শ্রমিককে গুম করে দেওয়া হয়েছে যারা আহসান হাবীবের বিরুদ্ধাচরণ করেছে।

দিনের পর দিন এক একজন শ্রমিক হারিয়ে যায়, কেউ তার সন্ধান পায় না। শ্রমিকদের মধ্যে এ নিয়ে কেউ যদি আলোচনা করে তার মুখও বন্ধ করে দেওয়া হয় বিভিন্ন কৌশলে।

সরকারের প্রশাসন বিভাগ জানে মিঃ আহসান হাবীব একজন মহৎ ব্যক্তি। তার দান প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে সজীব করে তুলেছে। প্রায়ই তার বাসভবনে গণ্যমান্য ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ হয়ে থাকে, হাস্যোজ্জ্বল হাবীব সাহেব অর্থব্যয়ে কোনোরূপ কার্পণ্য করেন না। শুধু দেশেই তার সুনাম ছড়িয়ে পড়েনি, বিদেশেও তার নামডাক আছে।

হাবীব সাহেবের পাঁচটি সন্তান।

সকলেই বিদেশে পড়াশোনা করে, মাঝে মাঝে আসে তারা কান্দাইয়ে বড় ছেলে বিদেশী ভাবধারায় গড়ে উঠেছে। নেশা করা তার স্বভাব। পিতার অলক্ষ্যে যথেচ্ছাচরণে লিপ্ত হয় সে। শহরে সবাই আহসান হাবীবের সন্তান বলে কিছু বলে না, সম্ভবতঃ বলার সাহস হয়না কারাও।

সেদিন আহসান হাবীবের বাসভবনে জলসা আছে।

 বহু গণ্যমান্য ব্যক্তির সমাগম হয়েছে।

আমন্ত্রিত ব্যক্তিরা সবাই আসছেন। আহসান হাবীবের বাসভবন আলোয় আলোময়।

বাসভবনের সম্মুখে অগণিত গাড়ির ভীড় জমে উঠেছে।

আহসান হাবীব পুলিশ সুপার মিঃ কিবরিয়া এবং তার সহকারীকেও দাওয়াত করেছেন। এ ছাড়া পুলিশ মহলের আরও গণ্যমান্য অনেককেই আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তিনি।

এলেন তরুণ পুলিশ সুপার মিঃ কিবরিয়া এবং তার সহকারী মিঃ বাশার।

আহসান হাবীব নিজে অভ্যর্থনা জানিয়ে সবাইকে বসাচ্ছেন।

আহসান হাবীবের পরম বন্ধু বি, কে চৌধুরীও আমন্ত্রিত।

তিনি আসার সঙ্গে সঙ্গে জলসা শুরু হলো।

আহসান হাবীব জলসা জমে ওঠার পর সবার অলক্ষ্যে মিঃ বি, কে চৌধুরী সহ জলসার আসর ত্যাগ করে অন্তঃপুরে গেলেন।

জলসা বেশ জমে উঠেছে।

মাদান বাঈজী এসেছে সুদুর রোহিনা থেকে।

রোহিনা কান্দাই থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরে অবস্থিত। আহসান হাবীব অনেক দিন চেষ্টা চালিয়ে মাদান বাঈজীকে এনেছেন তার বাসভবনের জলসায়। একদিনের জন্য তার পারিশ্রমিক বিশ লক্ষ টাকা।

জলসায় কাওয়ালী শুরু হয়েছে।

 নানা ধরনের আলোর ঝলকানি চোখে ধাঁধা লাগাচ্ছে।

মঞ্চের সম্মুখে বসেছেন আহসান হাবীবের পরম বন্ধু বি, কে চৌধুরী এবং অন্যান্য নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। পুলিশ সুপার এবং পুলিশ মহলের গণ্যমান্য ব্যক্তিগণও বসেছেন তাদের সারিতে।

পুলিশ প্রধানের সহকারী মিঃ বাশারও বসেছেন জলসার সম্মুখভাগে।

একটানা কাওয়ালী চললো, তারপর মাদান বাঈজীর চান।

জলসায় উপস্থিত ব্যক্তিগণ সবাই বিপুল আগ্রহ নিয়ে প্রতীক্ষা করছেন মাদান বাঈজীর নাচ দেখার জন্য।

ঠিক ঐ মুহূর্তে আলো নিভে গেলো।

সমস্ত জলসাকক্ষ জমাট অন্ধকারে ভরে গেলো, সঙ্গে সঙ্গে একটা গোঙানির শব্দ। মাত্র কয়েক সেকেন্ড, আলো জ্বলে উঠলো। দেখা গেলো মিঃ আহসান হাবীব মেঝেতে মুখ থুবড়ে পড়ে আছেন।

রক্তে লালে লাল হয়ে উঠেছে মেঝের কার্পেটের কিছু অংশ।

আলো জ্বলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সবার মুখে গভীর আতঙ্কের ছাপ ফুটে উঠলো। সবাই আসন ত্যাগ করে ঘিরে ধরলো আহসান হাবীবকে। দেখা গেলো একটি সূতীক্ষ্ণধার ছোরা বিদ্ধ হয়ে আছে তার বুকে।

কে তার বুকে ছোরা বিদ্ধ করলো এ নিয়ে ভীষণ একটা আলোড়ন সৃষ্টি হলো। পুলিশ সুপার মিঃ কিবরিয়া নিজে উপস্থিত আছেন, তিনি অনুমান করলেন হত্যাকারী এই আসরেই আছে। তাই কিবরিয়া জলসা কক্ষের প্রবেশদ্বার বন্ধ করে দিলেন। একটি প্রাণীও যেন এ কক্ষ হতে বেরিয়ে যেতে না পারে।

বন্ধুর নিহত ব্যাপার নিয়ে বি, কে চৌধুরী সব চেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন এবং উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। তার চোখেমুখে গভীর চিন্তার ছাপ ফুটে উঠেছে।

সন্ধান চালানো হলো নানাভাবে।

কিন্তু কে খুনী বোঝা গেলো না বা কাউকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হলেন না পুলিশ প্রধান কিবরিয়া। তার সহকারী মিঃ বাশার বললেন-খুনীকে এ মুহূর্তে খুঁজে পাওয়া না গেলেও তাকে পাকড়াও করা কঠিন হবে না, কারণ হত্যাকারী আমাদের মধ্যেই রয়েছে।

মিঃ বি, কে চৌধুরী বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন–হত্যাকারীকে যিনি খুঁজে বের করতে পারবেন আমি নিজে তাকে পুরস্কৃত করবো। আমার পরম বন্ধু আহসান হাবীব আজ নিহত হলো। এ আমি কিছুতেই বরদাস্ত করব না। কারণ তাকে ছাড়া আমি সম্পূর্ণ একা, অক্ষম

পুলিশ প্রধান কিবরিয়া বললেন–মিঃ আহসান হাবীব এ অঞ্চলেই শুধু নন সমস্ত কান্দাইয়ের স্বনামধন্য ব্যক্তি। আজকের জলসা তার জীবনের অবসান বয়ে আনবে আমরা কেউ তা ভাবতেও পারিনি।

লাশ তদন্ত করার পর মর্গে পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন মিঃ কিবরিয়া।

মিঃ বাশার তাকে সহযোগিতা করলেন।

সেদিন আর জলসা জমলোনা।

বাঈজী মাদানের নাচ দেখার সৌভাগ্য কারও হলো না।

সবাই যে যার বাসভবনের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন। গাড়ির মিছিল ধীরে ধীরে কমে এলো।

কিছু সময় পূর্বের আলো ঝলমল রাজা-অট্টালিকার আনন্দমুখর পরিবেশ কোথায় উবে গেলো। একটা গভীর শোকের ছায়া নেমে এলো গোটা বাড়িতে।

সবাই বিদায় হলেও, রয়ে গেলেন বি, কে চৌধুরী ও তার কয়েকজন সঙ্গীসাথী।

মিঃ কিবরিয়া লাশ মর্গে পাঠানোর পর বিদায় হবেন ভাবছেন। এমন সময় মিঃ বাশার বললেন–স্যার, আপনি চলে গেলেও আমাকে থাকতে হবে। পুলিশ প্রহরিগণ সতর্কভাবে পাহারা দিচ্ছে কিনা জানার জন্য আমার থাকা উচিত বলে মনে করি।

ঠিক বলেছেন মিঃ বাশার কথাটা আমিই বলব আপনাকে, তার পূর্বে আপনি বললেন–অত্যন্ত খুশি হলাম। লাশ মর্গে পাঠালেও এখনও অনেক কিছুর তদন্তু বাকি আছে।

হাঁ স্যার, আর সেই কারণেই আমি থাকতে চাই।

মিঃ বি, কে চৌধুরী বললেন-আমিও সেই কারণেই বিদায় গ্রহণ না করে থেকে গেলাম। আমার বন্ধুবরের হত্যার সঠিক তদন্ত হওয়া চাই এবং হত্যাকারীর উপযুক্ত শাস্তি চাই।

পুলিশ প্রধান কিবরিয়া মিঃ বি, কে চৌধুরীর সঙ্গে করমর্দন করে বললেন–আপনার সহযোগিতা দরকার হবে মিঃ চৌধুরী।

বি, কে চৌধুরী বললেন–সর্বপ্রকার সহযোগিতা পাবেন মিঃ কিবরিয়া। তবে আপনি বয়সে অত্যন্ত তরুণ এ কারণে কিছুটা বেগ পেতে হবে আপনার।

কারণ? ঐ ভ্রুকুঞ্চিত করে বললেন কিবরিয়া।

দক্ষতা। কাজে দক্ষতা আপনার আছে তবে পাকা নয়।

আপনার হেঁয়ালিপূর্ণ কথা আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না

আপনি বিদায় হবার পূর্বে একবার মাদার বাঈজীর সঙ্গে দেখা করা উচিত বলে মনে করি। কারণ তার আগমনেই আজকের এই জলসার আয়োজন করা হয়েছিলো।

মন্দ কথা বলেননি মিঃ বি, কে চৌধুরী। মিঃ বাশার?

বলুন স্যার?

আপনি সংবাদ দিন আমি মাদান বাঈজীর সঙ্গে দেখা করতে চাই এবং তার সঙ্গে কিছু আলাপ আলোচনা করতে চাই। কথাটা বলে হাতঘড়িটার দিকে তাকালেন কিবরিয়া।

মিঃ বাশার দু’জন সঙ্গীসহ চলে গেলেন।

মিঃ আহসান হাবীবের বাড়িটা কয়েক ভাগে বিভক্ত ছিলো। অন্দরমহল, বাইরের মহল ছাড়াও ছিলো খাসমহল।

বাঈজী মাদানকে খাসমহলে স্থান দেওয়া হয়েছিলো।

 মিঃ বাশার সঙ্গীদ্বয়সহ এই খাসমহলে পৌঁছলেন।

মস্তবড় টানা বারান্দা তারপর বিরাট কক্ষ। আশেপাশে আরও অনেকগুলো কক্ষ আছে।– সব কক্ষে নীরবতা বিরাজ করছে, শুধু বাঈজী মাদানের কক্ষে আলো জ্বলছে এবং কিছু কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে।

অন্দরমহল থেকে নারীকণ্ঠের চাপা কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। অনেক সান্ত্বনার সুরও শোনা যাচ্ছে। বেশ অনুমান করা যাচ্ছে মিঃ আহসান হাবীবের স্ত্রী শোকে মূহ্যমান হয়ে পড়েছেন এবং তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন ঘনিষ্ঠ আত্নীয়-স্বজন। মিঃ বাশার তার দু’জন সঙ্গীসহ এসে উপস্থিত হলেন মাদার বাইজীর কক্ষের বাইরে। চমকে উঠলেন মিঃ বাশার, কক্ষের ভিতর থেকে হাসির আওয়াজ ভেসে আসছে। নারীকণ্ঠের হাসি।

বিস্ময়ে হলেন মিঃ বাশার ও তার সঙ্গীদ্বয়।

শোকার্ত পরিবেশে সুমিষ্ট হাসির ধ্বনি, এর কারণ কি!

মাদান বাইজীর কানেও পৌঁছেছে মিঃ আহসান হাবীর-এর মর্মান্তিক মৃত্যু সংবাদ এবং সেই কারণেই জলসা বন্ধ হয়ে গেছে। রোহিনা থেকে তার আসা বৃথা হলে বলা যায়। যদিও অর্থ সে পাবেই যা তার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন আহসান হাবীব। তবুও একটা বিস্ময়কর মৃত্যু এটা কান্দাইয়ের জন্য দুঃসংবাদ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এমন পরিবেশে মাদান বাঈজীর কক্ষে সুমিষ্ট হাস্যধ্বনি।

মিঃ বাশার ভীষণ অবাক হলো এবং সঙ্গী দু’জনকে সেখান থেকে সরে যাওয়ার জন্য ইংগিত করলেন।

বাশারের সঙ্গী দু’জন সরে গেলো আড়ালে।

 মিঃ বাশার দরজার পাশে আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ালেন।

তার কানে ভেসে এলো নারীকণ্ঠে কেউ বলছে-শেষ পর্যন্ত বাঈজীর ভূমিকা গ্রহণ করলে?

 অপর নারীকণ্ঠ–এই বুঝি তোর হাসির কারণ?

হা। তুমি যাই বলল নাচতে কিন্তু পারতে না……।

 তোকে দিয়েই চালিয়ে নিতাম।

কিন্তু…

থাক সব কথা বলা উচিত হবে না। দেয়ালেরও কান আছে।

মিঃ বাশার আর মুহূর্ত বিলম্ব না করে সরে এলেন সেখান থেকে। মিঃ কিবরিয়াও চলে গেলেন মাদার বাইজীর সাথে দেখা না করে।

*

মিঃ কিবরিয়া আপনি যা ভাবছেন তা নয়। এ হত্যাকান্ডের পেছনে বিরাট রহস্য লুকিয়ে আছে! বললো নূর।

মিঃ কিবরিয়ার ভ্রু ভ্রুকুঞ্চিত হলো, বললো—মিঃ নূর, আপনি কি বলতে চান মিঃ আহসানের হত্যাকারী জলসায় ছিলো না? বাইরে থেকে এসে সে হত্যা করে ভেগেছে?

হাঁ ঠিক তাই, কারণ হত্যাকারী জলসায় উপস্থিত হবার পূর্বেই প্রস্তুত ছিলো এবং আলো নিভে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মিঃ আহসান হাবীবের বুকে ছোরা বিদ্ধ করে সরে পড়েছে।

তাহলে আপনি কি বলতে চান-হত্যাকারী বাইরের কেউ?

ঠিক তাই, তবে আহসান হাবীবের হত্যাকারী সম্পূর্ণ বাইরের নয়, তার বাসভবনেই আছে। মিঃ কিবরিয়া, আপনি প্রস্তুত হয়ে চলুন, মাদান বাঈজীকে গ্রেপ্তার করুন।

এ আপনি কি বলছেন মিঃ নূর!

হাঁ, আপনি মোটেই বিলম্ব করবেন না, চলুন।

পুলিশ সুপার তখনই পুলিশ অফিসারকে ডাকলেন এবং কয়েকজন পুলিশসহ প্রস্তুত হতে নির্দেশ দিলেন।

বিস্ময় কাটলো না মিঃ কিবরিয়ার। পুনরায় নূরকে লক্ষ্য করে প্রশ্ন করলেন মিঃ নূর, আমরা যে কাজ করতে যাচ্ছি তা মারাত্নক ভুলও হতে পারে, কারণ মাদান বাঈজী সাধারণ মহিলা নয় এবং এ হত্যাকান্ডের সঙ্গে সে কিভাবে জড়িত থাকতে পারে এটা এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।

প্রথমেই তাকে আমরা এরেষ্ট করবে না, তবে নজরবন্দী করে কিছু জেরা করবো। মিঃ কিবরিয়া, আমার সন্দেহের কারণ আপনি পরে জানতে পারবেন।

বেশ, আপনার কথামতই কাজ হবে। বলল কিবরিয়া।

 গভীরভাবে ভাবতে লাগলেন পুলিশ প্রধান, তার বয়স মিঃ নূরুজ্জামানের চেয়ে কম হবে না বরং দু’চার বছর বেশি হবে। কান্দাইয়ের পুলিশ প্রধানের দায়িত্বভার তার উপর অর্পণ করা হয়েছে, সরকার চিন্তা ভাবনা করেই তাকে এ গুরুদায়িত্ব দিয়েছেন। কিন্তু নূরও কম নয়, সে বিদেশ থেকে পাকা ডিটেকটিভ বনে এসেছে। তার সূতীক্ষ্ণ বুদ্ধিবলে বহু দুস্কৃতিকারীকে শাস্তি পেতে হয়েছে।

মিঃ কিবরিয়া তাই নূরুজ্জামানের কথা অবহেলা করতে পারলেন না। কয়েকজন পুলিশ অফিসারসহ কিবরিয়া হাজির হলেন আহসান হাবীবের বাসভবনে।

কিন্তু ব্যর্থ হলেন পুলিশ প্রধান।

আহসান হাবীবের বাসভবনে পৌঁছে জানতে পারলেন, মাদান বাঈজী কোনোরকম পারিশ্রমিক গ্রহণ না করেই বিদায় গ্রহণ করেছে। তার সঙ্গী অপর একজন মহিলা সেও মাদানের সঙ্গে চলে গেছে।

বি, কে চৌধুরী ছিলেন, তিনি মিঃ কিবরিয়াকে যথাসাধ্য সাহায্য করলেন। বি, কে চৌধুরী বন্ধুর মৃত্যুর পর রয়েই গেছেন কারণ আহসান হাবীবের পত্নী একেবারে ভেঙে পড়েছেন। তাকে সান্ত্বনা দেওয়া একান্ত কর্তব্য তার। আহসান হাবীবের অন্যান্য সন্তান সবাই বিদেশে থেকে পড়াশোনা করে। বড় ছেলে বিদেশ থেকে ফিরে এসেছে সবে কিছুদিন হলো।

পিতার মৃত্যুর সংবাদ পেয়েও পুত্র আরমান হাবীব ছুটে আসেনি, জলসার রাত্রে সে কান্দাইয়ে নামকরা এক হোটেলে রাত্রি যাপন করেছিলো তার বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে। পিতার মৃত্যু-সংবাদ শোনার পর তার মুখোভাবে কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি, বরং সে বলেছিলো, আমি জানতাম তার মৃত্যু এভাবেই হবে।

পুলিশ মহল যখন তাকে জেরা করছিলো তখন সে বলেছিলো, আব্বা মরেছেন তাতে আমাকে এত কথা ব্যয় করতে হবে কেন? যার যা প্রাপ্য তা সে পাবেই। আব্বার সম্বন্ধে আমি কিছুই প্রকাশ করতে পারবো না।

আরমান হাবীবের মুখ থেকে এর বেশি কিছু বের করা সম্ভব হয়নি। হোটেলের কক্ষ ছেড়ে এসেছিলো সে মাকে সান্তনা দেবার জন্য, কয়েক ঘন্টা সময় কাটিয়েছিলো সে মায়ের পাশে।

মাকে কাঁদতে দেখে বলেছিলো আরমান-অমন লোকের জন্য চোখের পানি ফেলাও পাপ বুঝলে আম্মি! মানুষ বেঁচে থাকে পরের উপকারের জন্য, কিন্তু আব্বু, তিনি শুধু মানুষের সর্বনাশ করে গেছেন। গরিব শ্রমিকদের রক্ত শোষণ করে রাজপ্রাসাদ গড়েছেন। কত অসহায় মানুষকে তিনি পথের ফকির বানিয়ে ঐশ্বর্যের ইমারত গড়ে তুলেছেন। নিজের স্বার্থের সন্ধানে তিনি অমানুষ বনে গিয়েছিলেন কিন্তু তিনি নিজের চোখে নিজের রূপ দেখতে পাননি। তিনি কিছু অর্থ দান ধ্যান করে নিজেকে স্বনামধন্য ব্যক্তি করে রেখেছিলেন।

মিসেস আহসান বলেছিলেন, চুপ কর আরমান চুপ কর। অমন করে বলিস না।

আম্মি বলতে দাও! আমাকে বলতে দাও! আব্বু  ভেবেছিলেন কৌশলে অপরের ধন সম্পদ লুটে নিয়ে নিজে রাজাধিরাজ বনে যাবেন। ছেলেদের বিদেশে রেখে লেখাপড়া শিখিয়ে মস্তবড় নামী-দামী মানুষ করবেন। কিন্তু তা হয় না আম্মি, তা হয় না। পরের সম্পদ লুটে নিয়ে অন্যায়ভাবে অর্থ উপার্জন করে কেউ চিরস্থায়ী হতে পারে না। যেমন আব্বুও হতে পারলেন না। বিদেশে রেখে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করলেও সন্তান সন্ততি মানুষ হয় না। দেখছোনা আমার দিকে তাকিয়ে কত বড় সুনামধারী মানুষ হয়েছি…এই দেহটা দেখছো আমি! এই দেহের শিরায় শিরায় প্রতিবিন্দু রক্তে মিশে আছে পাপ…..যে অর্থ যে খাদ্য গ্রহণ করে এতোবড় হয়েছি তা দূষিত, অপবিত্র……না, না, আমি মানুষ হইনি, হয়েছি লম্পট শয়তান। পাপী পিতার সন্তান কি করে সৎ মহৎ হবে বলো?…….

মিসেস আহসানের চোখের পানি জমাট বেঁধে গিয়েছিলো তার চোখের পাতায়, বলে কি আরমান! তার সন্তানগণ মানুষ হয়নি কেউ, সবাই অমানুষ হয়েছে। এত সুন্দর পরিবেশে, ঐশ্বর্য আর প্রাচুর্যে গড়ে তুলেছেন তিনি সন্তানদের, তারা কিনা মানুষ হয়নি……

যা ভাবছো আম্মি তা সত্য। আব্বুর সমস্ত অর্থ ঐশ্বর্য সব বৃথা, কারণ বংশধরগণ যদি অমানুষ হয় সে ধন-সম্পদের কি দাম আছে বলো? অন্যের সম্পদ লুটে নিয়ে কেউ কোনদিন স্থায়ী হতে পারে না। যেমন আমার আব্বু। নিজে নৃশংসভাবে প্রাণ হারালেন। তোমাকে বরণ করতে হলো বৈধব্যের অসহ্য জ্বালা। সন্তানরা সবাই বিদেশে বসে পিতার অগাধ অর্থের অপচয় ঘটাচ্ছে। যেমন- আমি, তার জীবন্ত প্রমাণ। আম্মি, একটি সন্তান যদি তোমাদের সৎ মহৎ চরিত্রবান হয়ে গড়ে উঠতো তাহলেও তোমরা সান্ত্বনা পেতে কিন্তু তা হয়নি। আব্বু যা সঞ্চয় করে গেছেন তা যে পথে এসেছে সেই পথেই যাবে। আমার প্রতিদিন কত খরচ জানো আম্মি? মাত্র দশ হাজার টাকা আর তোমার অন্যান্য গুণধর সন্তান যারা বিদেশে আছেন তাদের খরচ প্রতিদিন আমার খরচের অংকের চারগুণ। দুঃখ হচ্ছে আব্বু  অকালে জীবন হারালেন। আমাদের টাকার অংক তো কমানো সম্ভব হবে না, কিন্তু এই কল-কারখানা ইন্ডাষ্ট্রি সব নিঃশেষ হলে কার কাছে আমরা হাত পাতবো–আন্মি, তোমার সোনার গয়নাগুলো যত্ন করে রেখো। ওগুলো আমাকে ছাড়া আর কাউকে দিও না–তাহলে তোমার অবস্থাও আব্বুর মত হবে। আমি কাউকে খাতির করবো না।

কথাগুলো বলে বেরিয়ে গিয়েছিলো আরমান। টলতে টলতে গাড়িতে গিয়ে বসেছিলো সে।

মিসেস আহসান তখন চোখে সর্ষে ফুল দেখছিলেন।

স্বামী মৃত্যুবরণ করার সঙ্গে সঙ্গে এমন কথা শুনতে হলো তাকে। সত্যিই কি তার স্বামী ছেলেদের মানুষ না করে অমানুষ বানিয়েছেন। অমানুষই হয়েছে ওরা, ওদের মধ্যে নেই কোনো মানবতাবোধ। পিতা মাতার প্রতি সন্তানের কর্তব্য কি তাও তারা জানে না। জানলে আরমান শোকাতুরা মাকে রেখে অমন করে চলে যেতো না।

পুলিশ সুপার মিঃ কিবরিয়া যখন দল বল সহ গিয়ে পৌঁছলেন তখন এগিয়ে এলেন মিঃ। বি, কে চৌধুরী এবং জানালেন, মাদান বাঈজী চলে গেছে তার পারিশ্রমিক গ্রহণ না করেই।

মিঃ বাশার কিবরিয়াকে লক্ষ্য করে বললেন স্যার, মাদান বাঈজীর মধ্যে গভীর রহস্য লুকিয়ে ছিলো এবং সে কারণেই বাঈজী তার পারিশ্রমিক না নিয়েই চলে গেছে। আমরা তার কক্ষটি তদন্ত করে দেখতে চাই।

মিঃ বি, কে চৌধুরী বললেন—চলুন মিঃ কিবরিয়া, মাদান বাঈজী ও তার সঙ্গিনী যে কক্ষে ছিলো আমি সেই কক্ষ আপনাদের দেখাচ্ছি।

মিঃ কিবরিয়া এবং মিঃ বাশার মিঃ বি, কে চৌধুরীর সঙ্গে মাদান বাঈজীর পরিত্যক্ত কক্ষে প্রবেশ করলেন। আশ্চর্য হলেন মিঃ কিবরিয়া এবং মিঃ বাশার। কক্ষে একটা অদ্ভুত গন্ধ সুবাসিত কোন বস্তুর গন্ধ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এটা কিসের গন্ধ ঠিক ঠাওর করতে পারলেন না তারা।

মিঃ কিবরিয়া হঠাৎ বলে উঠলেন–মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে।

মিঃ বাশার বললেন-স্যার, এ কক্ষে আর এক মুহূর্ত বিলম্ব করা উচিত হবে না। শিগগির বেরিয়ে আসুন, কক্ষে কোনো ঔষধ মেশানো গ্যাস ছাড়া হয়েছিলো। দরজার দিকে পা বাড়াতেই মিঃ কিবরিয়া ঢলে পড়লেন।

মিঃ বাশার দ্রুত বেরিয়ে আসার জন্য পা বাড়াতেই মিঃ বি, কে চৌধুরী তার হাত ধরে টেন নিলেন কক্ষের মধ্যে। সে মুহূর্তে তার চোখ দুটো শার্দুলের মত জ্বলছিলো। মিঃ বাশার ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেন তাকে।

মুহূর্তে কক্ষ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে গেলো।

 মিঃ বাশার আর মিঃ বি, কে চৌধুরীর মধ্যে শুরু হলো ধস্তাধস্তি।

কিন্তু মিঃ বাশার মিঃ বি, কে চৌধুরীকে কাবু করে বেরিয়ে এলেন বাইরে। অন্ধকারে দরজা লক্ষ করে বেরিয়ে এলেন বলেই রক্ষা, নইলে তারও অবস্থা মিঃ কিবরিয়ার মত হত তাতে কোনো ভুল নেই।

মিঃ বাশার বাইরে বেরিয়ে এসেই বাঁশীতে ফুঁ দিলেন।

সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন পুলিশ সেইখানে এসে দাঁড়ালো, তারা সবাই প্রস্তুত ছিলো এই। বাঁশীর শব্দের জন্য।

পলিশ বাহিনী পৌঁছতেই মিঃ বাশার বললেন–ঐ কক্ষে বিষাক্ত গ্যাস ছাড়া হয়েছে। সেই কক্ষে মিঃ কিবরিয়া সংজ্ঞাহীন অবস্থায় মেঝেতে পড়ে আছেন। আমি ঐ কক্ষে প্রবেশ করছি আপনারা আমাকে অনুসরণ করুন। কিন্তু কক্ষে প্রবেশ করবার পূর্বে অক্সিজেনপূর্ণ। মুখোশ পরে নেবেন।

মিঃ বাশারের কথা শেষ হবার পর মুহূর্তে পুলিশবাহিনী অক্সিজেনপূর্ণ মুখোশ পরে নিলো তাদের নিজ নিজ মুখে এবং প্রবেশ করলো সেই কক্ষে।

কিন্তু আশ্চর্য তখন কক্ষে কোনো গ্যাস বা সুমিষ্ট গন্ধ নাকে প্রবেশ করলো না। মেঝেতে মিঃ কিবরিয়া কিংবা মিঃ বি, কে চৌধুরী কাউকে দেখা গেলো না। কক্ষ সম্পূর্ণ ফাঁকা, এমন কি মেঝের কার্পেটখানাও উধাও হয়েছে।

মিঃ বাশার লক্ষ করেছিলেন সেই কক্ষের মেঝেতে গাঢ় সবুজ রঙের কার্পেট বিছানো ছিলো। এখন কোনো কার্পেট মেঝেতে নেই। মেঝে সাদা মার্বেল পাথরে তৈরি। মেঝের স্থানে স্থানে কালো রেখা দ্বারা বিভিন্নভাবে কারুকার্য করা হয়েছে।

মিঃ বাশার শুধু একটা শব্দ উচ্চারণ করলেন–হু।

পুলিশ অফিসার ও পুলিশবাহিনী অবাক হলো। মিঃ বাশার তাদের মুখের অক্সিজেনভরা মুখোস খুলে ফেলার নির্দেশ দিলেন।

পুলিশের লোক সবাই নিজ নিজ মুখের অক্সিজেনভরা মুখোস খুলে ফেললো। তারা হতবাক বিস্মিত হলো। মিঃ বাশার সবার অজ্ঞাতে মিঃ কিবরিয়াকে বলেছিলেন–স্যার, কিছু পুলিশ বাহিনী সঙ্গে থাকা দরকার বলে মনে করি।

মিঃ কিবরিয়া তখন বলেছিলেন-মিঃ বাশার, আপনার কথা ঠিক অনুধাবন করতে সক্ষম হলাম না। কারণ আমরা যাচ্ছি এমন ব্যক্তির সন্ধানে যেখানে পুলিশ বাহিনীর কোনো প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না।

বাশার বলেছিলেন- স্যার, আমরা মাদান বাঈজীর সন্ধানে যাচ্ছি। যদিও তাকে সন্দেহ করতে চাই না তবুও সন্দেহ আসে, কারণ মিঃ আহসান হাবীব ঐ দিন নিহত হন যেদিন তারই বাসভবনে এক উৎসবে মাদান বাঈজীর নাচার কথা ছিলো।

বলেছিলেন মিঃ কিবরিয়া হাঁ, সে কথা অবশ্য সত্য। মিঃ বাশার, আপনার যুক্তি মন্দ নয়।

মিঃ বাশারের দাড়ি-গোঁফে ভরা মুখমন্ডলের আড়ালে একটা স্মিত হাসির রেখা ফুটে উঠেছিলো। বলছিলেন মিঃ বাশার–পুলিশ বাহিনী সবার দৃষ্টির আড়ালে থাকবে। যতক্ষণ আমরা তাদের প্রয়োজন বোধ না করবে ততক্ষণ তারা সাদা পোশাকে সবার চোখের আড়ালেই থাকবে। প্রয়োজনবোধে বাঁশী বাজাবো, তখন তারা আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে।

মিঃ কিবরিয়া বলেছিলেন তাই হোক। দুজন পুলিশ অফিসার সহ কয়েকজন পুলিশকে তিনি প্রস্তুত হয়ে নিতে বলেছিলেন এবং নির্দেশ দিয়েছিলেন তারা অন্যান্যের দৃষ্টি এড়িয়ে স্বাভাবিক পরিচ্ছদে মিঃ আহসান হাবীবের বাড়ির আশেপাশে থাকবে।

পুলিশ প্রধানের নির্দেশ পালন করেছিলেন পুলিশ অফিসার ও পুলিশগণ।

এই মুহূর্তে যখন কক্ষে পুলিশ অফিসার সহ পুলিশ বাহিনী প্রবেশ করে কাউকে দেখতে পেলো না তখন অবাক হলো। ব্যাপারটা বড়ই রহস্যজনক তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মিঃ বাশারের মুখমণ্ডল গম্ভীর। চোখ দুটো তার জ্বলছে মনে হলো। আপন মনে বললেন তিনি। রহস্য অত্যন্ত জটিল।

অনেক সন্ধান করেও মিঃ বি, কে, চৌধুরী এবং মিঃ কিবরিয়াকে পাওয়া গেলো না।

 পুলিশ অফিসার দু’জন এবং পুলিশ বাহিনী সহ মিঃ বাশার ফিরে এলেন পুলিশ অফিসে।

 এমন একটা অবস্থার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না মিঃ বাশার।

মিঃ কিবরিয়াকে তিনি উৎসাহিত করেছিলেন আজ মিঃ আহসানের বাসভবনে যাওয়ার জন্য এবং মাদান বাঈজীর কক্ষ তদন্তের জন্য কিন্তু নিজেকে কেমন যেন অপরাধী মনে হচ্ছিলো মিঃ বাশারের।

*

অট্টহাসির শব্দে চোখ মেলে তাকালেন মিঃ কিবরিয়া। এ অট্টহাসি কোনো নরপশুর তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মিঃ কিবরিয়ার কানে এ হাসির শব্দ বিষাক্ত প্রতিধ্বনির মত শোনালো। মুখ ফিরে তাকাতেই তার দৃষ্টি যার মুখে পতিত হলো তিনি হলেন বিশেষ পরিচিত ব্যক্তি মিঃ বি, কে চৌধুরী।

একটা কুৎসিত মুখভঙ্গী করে হাসছেন তিনি মিঃ কিবরিয়ার দিকে তাকিয়ে।

জায়গাটা কোথায় ঠিক ঠাওর করতে পারলেন না মিঃ কিবরিয়া।

মিঃ বি, কে, চৌধুরীকে অদ্ভুত এক অবস্থায় দেখলেন এবং ভীষণ একটা দুশ্চিন্তা তাকে গ্রাস করে ফেললো। সব যেন কেমন এলোমেলো আর ঘোলাটে লাগছে তার কাছে। মিঃ বাশার কোথায়? বি, কে, চৌধুরী একজন সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোক, তিনিই বা এখানে এমন এক পরিবেশে কেন এলেন। তবে কি মিঃ আহসান হাবীবের হত্যারহস্যের সঙ্গে জড়িত আছেন মিঃ বি, কে চৌধুরী?……

মিঃ কিবরিয়ার মনের কথা যেন বুঝতে পারলেন মিঃ বি, কে চৌধুরী, তিনি কুৎসিত মুখভঙ্গি করে বললেন–পুলিশ প্রধান, আপনি এ মুহূর্তে যা ভাবছেন তা সত্য নয়। মিঃ আহসান হাবীব আমার শুধু বন্ধুই ছিলো না, সে আমার ব্যবসার একজন প্রধান সহায়ক। একটু থামলো মিঃ বি, কে চৌধুরী, তারপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন–মিঃ কিবরিয়া, আর কোনোদিন আপনি আমার এই গুপ্ত বন্দীশালা থেকে ফিরে যেতে পারবেন না, কাজেই আপনার কাছে আমার সব কথা বলতে কোনো বাধা নেই……

মিঃ কিবরিয়া বিস্মিত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছেন সাধুতার মুখোসধারী সমাজসেবক স্বনামধন্য মিঃ বি, কে, চৌধুরীর মুখের দিকে। মানুষ কত হীন, জঘণ্য, নরাধম হতে পারে। মানুষের রূপধারী পাপী শয়তান বি, কে চৌধুরী তার প্রমাণ।

বলেই চললেন বি, কে চৌধুরী–পুলিশ প্রধান, আপনি জানেন না আপনার সঙ্গী মিঃ বাশার কে? আমার উদ্দেশ্য ছিলো তাকেই বন্দী করা কিন্তু ভাগ্যচক্রে তার পরিবর্তে আপনিই আমাদের শিকার হলেন।

মিঃ কিবরিয়ার চোখে বিস্ময়, তার সহকারী মিঃ বাশারের আর একটি পরিচয় আছে…কি সেই পরিচয় কে সে আর তাকে বন্দী করার জন্যই বি, কে চৌধুরীর ছিলো প্রচেষ্টা কিন্তু তাকে বন্দী করা সম্ভব হয়নি…বি, কে চৌধুরী তাহলে মিঃ বাশারকেই বন্দী করতে চেয়েছিলো কিন্তু কেন…।

মিঃ কিবরিয়ার দৃষ্টি বি, কে, চৌধুরীর মুখে স্থির হলো।

বি, কে, চৌধুরী বললেন—-পুলিশ প্রধান হলেও আপনি নেহাত ছেলেমানুষ। জানেন তো অভিজ্ঞতার দাম আছে। আরও বহুদিন লাগবে আপনার দিব্যদৃষ্টি লাভ করতে। জানেন মিঃ কিবরিয়া, মিঃ বাশারকে আমি প্রথম দিনই চিনতে পেরেছি তবে তার ছদ্মবেশ নিখুঁত ছিলো! চিনতে পেরেছিলাম তার কণ্ঠস্বরে। আর আপনি তার সঙ্গে রয়েছেন, তবু তাকে চিনতে পারেননি। হাঁ, আমি তার পরিচয় আপনাকে দিতে চাই, কারণ তাতে কোনো লাভ বা লোকসান হবে না আমার। তবে একটা কথা জেনে রাখুন মিঃ কিবরিয়া, আহসান হাবীবকে কে বা কারা খুন করেছে তা ঠিক আমিও জানি না। আহসান হাবীবের মৃত্যু আমার চরম ক্ষতি সাধন করেছে।

মিঃ কিবরিয়া এতক্ষণে বললেন-কে বা কারা আহসান হাবীবকে হত্যা করেছে তা আপনার জানার যেমন প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন আমাদের। কারণ একটা হত্যাকান্ড সংঘটিত হলে পুলিশমহলের দায়িত্ব সবার চেয়ে বেশি এবং সেই কারণেই আমরা আহসান হাবীবের হত্যার ব্যাপার নিয়ে…।

সে কথা আমি জানি, তাই বললাম–আপনি পুলিশপ্রধান হলেও অনেক অনভিজ্ঞ আর আপনার সহকারীর পরিচয় দিয়ে যে আপনার পাশে পাশে সর্বক্ষণ আছে সে ভীষণ চালাক। পুলিশ মহলের সহায়তা ছাড়া তার এগুনো সম্ভব হচ্ছে না, তাই আপনার সহকারী হিসেবে নিজেকে গুরুদায়িত্বে রেখে কাজ করছে সে। সুচতুর মিঃ বাশার শুধু আহসান হাবীবের হত্যাকারীকে খুঁজে বের করতে সচেষ্ট নয়, আরও কিছু রহস্য উদঘাটনেও সে তৎপর হয়ে উঠেছে। যার জন্য আমরা তাকে বন্দী করতে চাই…শুধু বন্দীই নয়–তার দুটি চোখ উপড়ে নেবো এবং তাকে অন্ধ করে দেবো যেন সে আর কোনোদিন আমাদের ক্ষতি সাধনের চিন্তা করতে না পারে।

মিঃ কিবরিয়া অবাক হয়ে তাকিয়েছিলেন মিঃ বি, কে চৌধুরীর দিকে। গুপ্তকক্ষের আবছা অন্ধকার আলোছায়ায় তার মুখ খানাকে ভয়াবহ মনে হচ্ছিলো। একটা জানোয়ার বলে মনে হচ্ছিলো তাকে! মিঃ কিবরিয়া যখন কান্দাই এলেন তখন কোনো এক সুধী সমাবেশে পরিচিত হয়েছিলেন তিনি বি, কে চৌধুরীর সাথে। ঐ দিনের কথাটা আজ মিঃ কিবরিয়ার মনে উদয় হলো ধ্রুবতারার মত জ্বলজ্বল করে। একটা অবিশ্বাসের কালোছায়া তার মনটাকে আচ্ছন্ন করে ফেললো। সুধী সমাবেশে যারা এসেছিলেন তারা সবাই জ্ঞানী-গুণী মহৎ-মহান। তাই তাদের সমাবেশকে বলতে হয় সুধী সমাবেশ–কিন্তু সুধী নামধারী যারা তারা কি সত্যি এমনি নরাধম? মুখোসের অন্তরালে তাহলে এমনি ভন্ডামির লীলাখেলা চলে! সেদিন যে মুখে সাধুতার প্রতিচ্ছবি দেখেছিলেন মিঃ কিবরিয়া, আর সেই মুখে হিংস্র জানোয়ারের রূপ দেখছেন, তবে কি পৃথিবীর স্বনামধন্য ব্যক্তিদের আরও একটি রূপ লুকানো থাকে মুখোসের অন্তরালে।……

কি ভাবছেন মিঃ কিবরিয়া?

না, কিছু না।

জানি আপনি ভাবছেন আমিই কি সত্যি সেদিনের মিঃ বি, কে, চৌধুরী? হ, সত্যি আমি সেই বি, কে, চৌধুরী……শুধু কান্দাই নয়, আমার মত বি, কে চৌধুরী পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে আছে সব জায়গায়।

হাঁ আমি তা বুঝতে পারছি।

কিছুই বুঝতে পারেননি কারণ আমরা বহুরূপী–এক এক সময় আমাদের এক এক রূপে দেখবেন। জনসমাজে একরূপ, অফিসে একরূপ, বাসায় আর এক রূপ–আর এক রূপ ধারণ করি আমরা যা লোকচক্ষুর অন্তরালে……

সত্য আপনি সত্যবাদী লোক। বললেন মিঃ কিবরিয়া।

 তার মানে?

আপনার মত এমন সহজভাবে কেউ কোনোদিন নিজেদের গোপন কথা ব্যক্ত করে না।

অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন বি, কে, চৌধুরী।

মিঃ কিবরিয়া বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে রইলেন তার মুখের দিকে। লোকটা এত কুৎসিতভাবে হাসতে পারে! ঘৃণায় মনটা বিষিয়ে ওঠে তার।

হাসি থামিয়ে বললেন বি, কে চৌধুরী–আপনি যা ভাবছেন তা সত্য নয়। যত গোপন কথাই ব্যক্ত করি না কেন আপনি এখন আমাদের হাতের মুঠায়……আপনাকে আটক করার একমাত্র উদ্দেশ্য আপনার সহকারী মিঃ বাশারকে গ্রেপ্তার করা এবং তাকে সমুচিত শাস্তি দেওয়া।

ঠিক সেই মুহূর্তে সেখানে একজন লোক এসে ব্যস্তকণ্ঠে বি, কে, চৌধুরীকে লক্ষ্য করে বললো–স্যার গাড়ি এসেছে।

বি, কে, চৌধুরীর চোখেমুখে একটা উত্তেজনার ছাপ ফুটে উঠলো। বললেন তিনি–ওর চোখ দুটো কালো কাপড়ে বেঁধে দাও, তারপর নিয়ে চলল।

লোকটা ওপাশ থেকে একটা কালো রুমাল তুলে নিয়ে মিঃ কিবরিয়ার চোখ দুটো ভাল করে বেঁধে দিলো, তারপর টেনে নিয়ে চললো।

কোন কিছু দেখতে না পেলেও অনুভব করছেন কিবরিয়া তাকে কোনো সুড়ঙ্গপথে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কোনো ঠান্ডা বাতাস তাদের স্পর্শ করছে না। কেমন একটা চাপা গুমোট ভাব।

টেনেহিঁচড়ে তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

মাঝে মাঝে দেহের সঙ্গে দেয়ালের ঘর্ষণ অনুভব করছিলেন মিঃ কিবরিয়া। চামড়া কেটে রক্ত বেরিয়ে পড়ছিলো তার দেহ থেকে। চোখ বাঁধা থাকায় কিছু দেখতে পাচ্ছিলেন না মিঃ কিবরিয়া। কিন্তু বুঝতে পারছিলেন তাকে কোথাও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তার সঙ্গে বি, কে চৌধুরীও চলেছেন, মিঃ কিবরিয়া তা ঠিক অনুধাবন করছিলেন।

এক সময় শরীরে ঠান্ডা হাওয়া স্পর্শ করলো মিঃ কিবরিয়ার। বেশ বুঝতে পারলেন তাকে এবার সুড়ঙ্গপথের বাইরে নিয়ে আসা হলো।

শুনতে পেলেন মিঃ কিবরিয়া বি, কে চৌধুরীর কণ্ঠস্বর–রবার্টহাং মিঃ কিবরিয়ার হাত দুখানা বেঁধে গাড়ির পেছন আসনে বসিয়ে দাও। তারপর ড্রাইভারকে লক্ষ্য করে বললেন বি, কে, চৌধুরী-সাবধানে গাড়ি নিয়ে যাবে। কোনো জনবহুল রাস্তায় যাবে না। আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে যাবো, তারপর যা করতে হয় করব। রবার্ট হাং, তুমি ওর পাশে সতর্কভাবে বসে থাকো।

ড্রাইভারের কোনো উত্তর শোনা গেলো না।

রবার্টহাং মিঃ কিবরিয়ার হাত দুখানা পিছমোড়া করে বেঁধে গাড়ির পেছন আসনে বসিয়ে দিলো এবং সে নিজেও উঠে বসলো।

গাড়ি চলতে শুরু করলো।

মিঃ কিবরিয়া প্রাণের মায়া ছেড়ে দিয়েছেন। বুঝতে পেরেছেন তাকে এবার এমন কোনো জায়গায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে যেখানে তাকে হত্যা করা হবে। পাশে বসে আছে রবার্ট হাং, তার হাতে আছে আগ্নেয়অ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তরুণ পুলিশ প্রধান কিবরিয়া ভাবতেও পারেননি এমন এক অবস্থা আসবে তার জীবনে। এমন মুহূর্তে বার বার মনে পড়ছে নুরুজ্জামানের কথা। তরুণ ডিটেকটিভ নর বলেছিলো, মিঃ কিবরিয়া, আপনি যাই বলন মিঃ বি, কে চৌধুরীর ভেতর কোনো গভীর রহস্য লুকিয়ে আছে। আহসান হাবীবের মৃত্যু রহস্যের পেছনে বি, কে চৌধুরীর অদৃশ্য হাত আছে। কথাটা মিঃ কিবরিয়া কানে নেননি সেদিন, বলেছিলেন বি, কে চৌধুরী একজন স্বনামধন্য ব্যক্তি। তার সুনাম আছে সমাজে। সবাই তাকে শ্রদ্ধা করে, এমন কোনো সন্দেহজনক কিছু তার মধ্যে দেখা যায়নি……কিন্তু নুরুজ্জামানের কথাই ঠিক হলো, সম্মানিত ব্যক্তি বলে তিনি যে মিঃ বি, কে চৌধুরীকে জানতেন, সেই ব্যক্তির চরিত্র এত হীন, জঘন্য……

হঠাৎ গাড়ি ব্রেক কষে থেমে পড়লো।

চমকে উঠলেন মিঃ কিবরিয়া।

তার হাত দু’খানা পিছমোড়া করে বাধা থাকায় কোনো রকমে নিজেকে সামলে নিতে পারলেন না, হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন সামনের আসনের দিকে।

ঐ মুহূর্তে তার কানে ভেসে এলো নতুন একটা কণ্ঠস্বর-রবার্ট হাং, একচুল নড়বে না। তোমার যমদূত তোমার সামনে হাজির……

গাড়ির দরজা খোলার শব্দ হলো।

 তারপর সেই কণ্ঠস্বরনেমে আসুন মিঃ কিবরিয়া।

আন্দাজে কিবরিয়া গাড়ি থেকে নেমে এলেন চোখ ও হাত বাঁধা অবস্থায়। সঙ্গে সঙ্গে গুলীর আওয়াজ এবং গাড়ির ভেতরে তীব্র আর্তনাদ কানে ভেসে এলো তার। মিঃ কিবরিয়ার হাত দু’খানা পিছমোড়া বাধা থাকায় চোখের বাধন স্বহস্তে খুলে ফেলতে পারছেন না কিন্তু বেশ বুঝতে পারলেন ড্রাইভার রবার্টহাংকে গুলি করেছে। আর্তনাদটি রবার্টহাং-এর তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

আর্তনাদের শব্দ এক মুহূর্তে থেমে গেলো।

এবার কিবরিয়া অনুভব করলেন তার চোখের বাঁধন এবং পরে হাতের বাঁধন খুলে দিলো ড্রাইভার। অন্ধকারেও তিনি বেশ অনুধাবন করলেন ড্রাইভার অন্য কেউ নয়, তারই সহকারী!

মিঃ কিবরিয়া জড়িয়ে ধরে বলে উঠলেন–মিঃ বাশার আপনি!

 হাঁ স্যার।

আপনি কি করে…

সব কথা পরে শুনবেন। লাশটা নামিয়ে ফেলি তারপর…….

কথা শেষ না করেই মিঃ বাশার রবার্টহাং-এর গুলীবিদ্ধ প্রাণহীন দেহটা টেনে নামিয়ে ফেললেন এবং পথের একধারে শুইয়ে দিয়ে ড্রাইভ আসনের দরজা খুলে ধরে বললেন স্যার, আপনি ড্রাইভিং আসনের পাশে বসুন। কথাটা শেষ করেই ড্রাইভ আসনে উঠে বসলেন ড্রাইভারবেশী মিঃ বাশার।

গাড়িতে স্টার্ট দিলেন।

 মিঃ কিবরিয়া বললেন-মিঃ বাশার, আপনি একজনকে খুন করলেন?

 বললেন মিঃ বাশার–এ ছাড়া কোনো উপায় ছিলো না।

 গাড়ি ছুটে চলেছে।

মিঃ কিবরিয়ার মনে নানা প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। মিঃ বাশার…তার আরও একটা পরিচয় আছে। কি সে পরিচয়, কে সে। বিনা দ্বিধায় খুন করলেন মিঃ বাশার একজনকে……

ড্রাইভ আসন থেকে বললেন মিঃ বাশার-কি ভাবছেন স্যার?

মিঃ কিবরিয়া বললেন—আপনি কি করে জানলেন আমাকে ওখানে আটক করে রাখা হয়েছে।

সেইদিন, যেদিন আহসান হাবীবের বাড়ি থেকে আপনাকে উধাও করা হলো…তারপর আমি গোপনে নানাভাবে সন্ধান ও চেষ্টা করতে লাগলাম এবং জানতে পারলাম মিঃ বি, কে চৌধুরীর গোপন আস্তানা কোথায়। আমি একজন মজুরের বেশে বি, কে চৌধুরীর গোপন আস্তানায় পৌঁছতে সক্ষম হলাম বটে কিন্তু সন্ধান নিয়ে জানলাম আপনি সেখানে নেই। আপনাকে অন্য এক স্থানে আটক করে রাখা হয়েছে। আরও জানলাম আপনাকে সেই গোপন স্থান হতে নিয়ে আসা হবে সেখানে, এবং আপনার চোখ দুটো উপড়ে ফেলে আপনাকে চির তরে অন্ধ করে দেয়া হবে।

বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে মিঃ কিবরিয়া শুনতে লাগলেন মিঃ বাশারের কথা।

গাড়িখানা স্পীডে ছুটে চলেছে শহর অভিমুখে।

 নির্জন পথ।

 বেশ দূরে দূরে লাইটপোষ্টগুলো প্রহরীর মত দাঁড়িয়ে আছে।

লাইট পোষ্টের স্বল্প আলোতে মিঃ বাশারের দাড়ি-গোঁফে ঢাকা মুখখানা স্পষ্ট নজরে না পড়লেও কিছু কিছু পরিলক্ষিত হচ্ছিলো। বড় রহস্যময় মনে হচ্ছিলো তাকে। মিঃ কিবরিয়া চমকে উঠলেন, তার চোখ দুটো উপড়ে ফেলে তাকে চিরতরে অন্ধ করে দেবার মতলব এঁটেছিলো তাহলে বি, কে, চৌধুরী।

মিঃ বাশার গাড়ি ড্রাইভ করে চলেন, দৃষ্টি তার সামনে।

এ পথে বড় একটা যানবাহন চলে না।

যদিও ক্কচিৎ গাড়ি ঘোড়া চলে তাও দিনের বেলা, রাত্রির অন্ধকারে কোনো যানবাহন এ পথে আসে না।

মিঃ বাশারকে নিয়ে এত ভাবার কথা ছিলো না বি, কে চৌধুরী বলেছে মিঃ বাশারকে আপনি জানেন না, তার আসল পরিচয় গোপন রেখে সে আপনার সহকারী হিসেবে কাজ করছে কারণ পুলিশের সহায়তা ছাড়া তার এগুনো সম্ভব নয়……

এলোমেলো চিন্তাধারা বয়ে চলেছে মিঃ কিবরিয়ার মাথার মধ্যে। বি, কে চৌধুরীর কথাটা যে মিথ্যা নয় তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ মিঃ বাশারের কার্যকলাপে একটা রহস্যের ছাপ আছে। মিঃ বাশার তার সঙ্গে কাজ করেন বটে কিন্তু মাঝে মাঝে তাকে খুঁজে পান না মিঃ কিবরিয়া। এ জন্য প্রায়ই মিঃ কিবরিয়া মিঃ বাশারকে কঠিনভাবে নানা প্রশ্ন করে থাকেন। মিঃ বাশার তার কথায় কোনোদিন রাগ করেন না, বরং নিশ্চুপ থেকে ব্যাপারটা হাল্কা করে নিতে চেষ্টা করেন। আজ অনেক কথাই মনে পড়ছে মিঃ কিবরিয়ার।

মিঃ বাশার দক্ষ ড্রাইভারের মত গাড়ি চালিয়ে কান্দাই পৌঁছে গেলেন।

একটি বিরাট গাছের নিচে এসে গাড়িখানাকে থামিয়ে ফেললেন। এবার গাড়ি থেকে নেমে ড্রাইভ আসনের ওপাশের দরজা খুলে ধরলেন মিঃ বাশার, বললেন–নেমে আসুন স্যার।

মিঃ কিবরিয়ার বুকটা ধক করে উঠলো, কারণ বাশারের আরও একটা পরিচয় আছে, যা তিনি জানেন না। তবে কি মিঃ বাশার তাকে কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে এনেছেন। দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নিয়ে নেমে দাঁড়ালেন মিঃ কিবরিয়া।

মিঃ বাশার বললেন–স্যার গাড়ি এখানে থাক। এবার আমাদের অন্য উপায়ে ফিরে যেতে হবে। হাঁটতে পারবেন স্যার?

অন্ধকারে ভালভাবে মিঃ বাশারের মুখখানা লক্ষ করবার চেষ্টা করলেন মিঃ কিবরিয়া কিন্তু বাশারের কণ্ঠস্বর ছাড়া আর কিছু নজরে পড়লো না, বললেন তিনি—পারবো।

মিঃ বাশার বললেন–আপনাকে কিছুটা হাঁটতে হবে, তারপর আপনার জন্য গাড়ি আসবে, আপনাকে পৌঁছে দেবে আপনার বাংলোয়!

আর আপনি?

আমি ঠিক সময়মত আপনার পাশে গিয়ে হাজির হবো।

গাড়িখানা রেখে হাঁটতে শুরু করলেন মিঃ বাশার এবং মিঃ কিবরিয়া। মিঃ বাশারের শরীরে ড্রাইভারের ড্রেস।

মিঃ কিবরিয়া বললেন–মিঃ বাশার, আপনি কি করে আমার খোঁজ পেলেন জানার জন্য মনটা ভীষণ অস্থির হয়ে পড়েছে।

বলেছি তো। সব পরে জানাবো স্যার। এখন গাড়ি এলে আপনাকে গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দেওয়া হবে। ঐ যে স্যার, আপনার জন্য গাড়ি অপেক্ষা করছে আর বেশি হাঁটতে হলো না। চলুন স্যার গাড়িতে উঠিয়ে দেই……।

মিঃ কিবরিয়া বললেন-মিঃ বাশার আবার কোন্ নতুন বিপদ–

না স্যার ওটা আমাদের গাড়ি। আপনি নিরাপদে বাংলোয় পৌঁছে যাবেন।

থেমে থাকা গাড়িখানার নিকটে পৌঁছতেই গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো ড্রাইভার। দরজা খুলে ধরলো পেছন আসনের।

মিঃ বাশার বললেন—উঠে পড়ুন স্যার।

মিঃ কিবরিয়ার কাছে সব যেন কেমন রহস্যময় মনে হচ্ছে। জীবনে এমন একটা ঘটনা ঘটবে ভাবতেও পারেননি তিনি। দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নিয়ে গাড়িতে বসলেন কিবরিয়া।

ড্রাইভার ড্রাইভ আসনে বসে গাড়িতে স্টার্ট দিলো।

জমাট অন্ধকারে গাড়িখানা দ্রুত এগিয়ে চললো, শুধু গাড়ির লাইট থেকে সামনের রাস্তায় আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে।

মিঃ কিবরিয়া ভাবছেন তার কাছে কোনো অস্ত্র নেই যদি কোনো বিপদ আসে তাহলে আত্নরক্ষার কোনো উপায় থাকবে না। তাছাড়া ড্রাইভার কেমন লোক তাও জানেন না তিনি। নানা রকম চিন্তা-ভাবনার উদ্ভব হতে লাগলো মিঃ কিবরিয়ার মনে।

*

স্যার, পুলিশ প্রধান এসেছেন। আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান তিনি। বললো বাবুর্চি হাসমত আলী।

নূর সবেমাত্র শয্যা ত্যাগ করে উঠে দাঁড়িয়েছে।

বললো নূর—আসতে বল।

বেরিয়ে গেলো হাসমত আলী।

 একটু পরে দরজার ভারী পর্দা ঠেলে কক্ষে প্রবেশ করলেন মিঃ কিবরিয়া।

নূর তাকে লক্ষ্য করে স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো–বসুন।

 নিজেও অপর একটা সোফায় বসে পড়লো নূর।

মিঃ কিবরিয়া বেশ অবাক হলেন, কারণ আজ কদিন হলো কিবরিয়া নিখোঁজ হয়েছিলেন। পুলিশমহল এবং সি আই ডি বিভাগ হন্যে হয়ে খুঁজে ফিরছিলো তাকে। নানাজনের মুখে বিভিন্ন কথাবার্তা ছড়িয়ে পড়েছিলো। পত্র-পত্রিকায় এ ব্যাপারে বিভিন্ন ধরনের মতামত প্রকাশ পেয়েছিলো। মিঃ কিবরিয়া অবাক হলেন, কারণ তাকে দেখেও নূরের মধ্যে কোনো পরিবর্তন পরিলক্ষিত হলো না।

নূর সিগারেট কেসটা বের করে এগিয়ে ধরলো মিঃ কিবরিয়ার দিকে।

মিঃ কিবরিয়া একটা সিগারেট হাতে তুলে নিলেন বটে কিন্তু তাতে অগ্নিসংযোগ করার চেষ্টা না করেই বললেন–মিঃ নূর, আমার সম্বন্ধে আপনি সব কিছু অবগত ছিলেন?

সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে বললো নূর—ছিলাম।

কিন্তু….

আমি এতটা স্বাভাবিক আছি কি করে তাই না?

 হাঁ, আপনাকে দেখে আমার মনে হচ্ছে আমি যেন আপনার পাশেই ছিলাম বা আছি।

কতকটা তাই।

মিঃ নূর, জানেন আমার জীবন বিপন্ন হতে যাচ্ছিলো। মিঃ বাশার যদি আমাকে কৌশলে উদ্ধার করে না আনতেন তাহলে…

আপনার চোখ দুটো উপড়ে নেওয়া হতো এবং আপনাকে চিরতরে অন্ধ বানিয়ে রাখা

আপনি এ সব জানলেন কি করে! মিঃ কিবরিয়ার কণ্ঠে বিস্ময়।

গম্ভীর কণ্ঠে বললো নূর—আপনার উধাও ব্যাপারটা একেবারে অবহেলা করার মত ছিলো না। সমস্ত কান্দাইয়ে যখন এই ঘটনা নিয়ে তোলপাড় চলছে তখন আমিও নিশ্চুপ ছিলাম না। তবে আমাকে ভীষণভাবে মাথা ঘামাতে হয়েছে।

মিঃ নূর, কিছু বলবার জন্য আমি এসেছি, কারণ আপনার জানা দরকার। আমার সহকারী মিঃ বাশার আমার রক্ষাকারী বলা যায় কারণ তার জন্য আমি এ যাত্রা বেঁচে গেলাম।

নূর একটা শব্দ করলো।

মিঃ কিবরিয়া বলে চলেছেন-আমি মিঃ বাশারসহ আহসান হাবীবের বাসভবনে গেলাম। কয়েকজন পুলিশ বাহিনীর লোক সঙ্গে নিলাম। তবে তারা আড়ালে থাকবে, প্রয়োজনবোধে তাদের ডাকা হবে।

হাঁ, এসব কথা আপনি আমার সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন। বললো নুর।

মিঃ কিবরিয়া বললেন–আহসান হাবীবের বাসভবনে বাঈজী ও তার সঙ্গিনীর পরিত্যক্ত কক্ষ পরিদর্শনে যাওয়ার সময় আপনাকেও আমি আমাদের সঙ্গে যাওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়েছিলাম কিন্তু আপনি যেতে পারেননি।

হাঁ, আমি সেদিন কোনো কাজে ব্যস্ত ছিলাম।

আমি আমার সহকারী মিঃ বাশার সহ আহসান হাবীবের বাসভবনে গেলাম। আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন মিঃ বি, কে, চৌধুরী এবং আহসান হাবীবের একজন আত্নীয়। আমরা প্রথমে বৈঠকখানায় বসলাম তারপর বাঈজীর পরিত্যক্ত কক্ষ পরিদর্শনে গেলাম। আমার সঙ্গে ছিলেন মিঃ বাশার এবং বি, কে চৌধুরী। আমরা কক্ষে প্রবেশ করে সবকিছু লক্ষ্য করছিলাম এমন সময় একটা সুমিষ্ট গন্ধ আমার নাকে প্রবেশ করলো। মিঃ বাশার সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে গেলো কিন্তু আমি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেললাম।

বললো নূর—তারপর?

তারপর যখন আমার সংজ্ঞা ফিরে এলো, আমি চোখ মেলতেই দেখতে পেলাম আমার শিয়রে দাঁড়িয়ে মিঃ বি, কে, চৌধুরী। তার চোখেমুখে একটা ভয়ংকর হিংসাত্মকমূলক ভাব পূর্বের বি, কে, চৌধুরী রূপে এক নর শয়তান। মিঃ নূর আমি ভাবতেও পারিনি মিঃ বি, কে, চৌধুরীকে এমন এক অবস্থায় দেখবো। তাকে ভীষণ আর ভয়ংকর রূপে দেখলাম–কি যেন ভাবলেন মিঃ কিবরিয়া তারপর পুনরায় বলতে শুরু কলেন তাকে নর শয়তান বলে মনে হলো। আমি যখন তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি তখন তিনি এমনভাবে হাসলেন সে হাসির কথা কোনদিন ভুলবো না। সে এক পৈশাচিক হাসি, বললেন বি, কে, চৌধুরী, ভাবছেন আমিই ঠিক সেদিনের বি, কে চৌধুরী কিনা। হ সত্যি আমিই সেই বি, কে, চৌধুরী…শুধু কান্দাই নয়, আমার মত বি, কে, চৌধুরী পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে আছে সব জায়গায়। কারণ আমরা বহুরূপী-এক এক সময় আমাদেরকে এক এক রূপে দেখবেন। জনসমাজে এক রূপ, অফিসে একরূপ, বাসায় আর একরূপ এবং আর এক রূপ ধারণ করি আমরা লোক চক্ষুর অন্তরালে……জানেন মিঃ নূর তার কথায় আমি বলেছিলাম; আপনি বেশ স্পষ্টবাদী লোক, সহজ ভাবে সত্য কথা ব্যক্ত করলেন। আমার কথায় অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন মিঃ বি, কে, চৌধুরী, বললেন তিনি, আপনি এখন আমাদের হাতের মুঠায়……আর কখনও আপনি এখান থেকে বেরুতে পারবেন না, তাই আপনার কাছে গোপন কথা বলতে দ্বিধা নেই। আপনাকে আটক করার মূল উদ্দেশ্য ছিলো আপনার সহকারী মিঃ বাশারকে গ্রেপ্তার করা এবং তাকে সমুচিত শাস্তি দেওয়া।

ক্রমান্বয়ে আগ্রহ বেড়ে উঠেছিলো নূরের যদিও প্রথম দিকে তেমন কোনো আগ্রহ দেখা যায়নি তার মধ্যে। বললো—তারপর কি বললেন–স্বনামধন্য ব্যক্তিটি?

কিছু বলতে যাচ্ছিলেন বি, কে চৌধুরী ঠিক সেই মুহূর্তে একজন লোক এসে তাকে জানালো, স্যার গাড়ি এসেছে। কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে মিঃ বি, কে চৌধুরীর মুখমন্ডলে একটা উত্তেজনার ছাপ ফুটে উঠলো। আমার চোখ দুটোকে কালো কাপড়ে বেঁধে গাড়িতে উঠানোর জন্য নির্দেশ দিলেন বি, কে, চৌধুরী। কিন্তু দেখতে না পেলেও বুঝতে পারলাম আমাকে কোনো গোপন সুড়ঙ্গপথে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বার বার আমার শরীরে দেয়ালের ঘর্ষণ লাগছিলো। কয়েক জায়গায় চামড়া কেটে গেলো। কারণ যন্ত্রণা অনুভব করছিলাম শরীরে। এতটুকুও হাওয়া ছিলো না সেই সুড়ঙ্গ পথে। তাই নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছিলো। আমার সঙ্গে মিঃ বি, কে, চৌধুরীও চলেছে বুঝতে পারছিলাম। এক সময় আমার শরীর ঠান্ডা হাওয়া স্পর্শ করলো। বুঝতে পারলাম আমরা এখন গোপন সুড়ঙ্গপথ অতিক্রম করে বাইরে এসেছি। একটু থেমে বললেন মিঃ কিবরিয়া-এ সব কথা আপনাকে জানানো দরকার বলে মনে করছি এবং এ ব্যাপারে আপনার সহায়তা আমার কাম্য…

নূর মৃদু হেসে বললো—আপনি বলুন মিঃ কিবরিয়া, আমি সব মনোযোগ সহকারে শুনছি। তারপর?

আমার চোখ কালো কাপড়ে বাধা থাকায় আমি কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। তা ছাড়াও আমার হাত দু’খানাও গাড়িতে বসার পূর্বে পিছমোড়া করে বেঁধে দেওয়া হলো। কোনো অস্ত্র আমার হাতে না থাকায় নিজকে সম্পূর্ণ অসহায় মনে হচ্ছিলো। তাছাড়া আমাকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো তাই কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছিলাম না। মিঃ বি, কে, চৌধুরীর কণ্ঠ শুনতে পেলাম, নরপশুটা তার সঙ্গীর নাম ধরে ডেকে বললো, রবার্টহাং, ওকে সাবধানে গন্তব্যস্থানে নিয়ে যাও। তারপর আমি এসে যা ব্যবস্থা করবার করবো। মিঃ নূর, তখনও আমি জানতাম না আমাদের গাড়ির ড্রাইভার আসনে ছিলেন আমারই সহকারী বাশার।

কথাটা শুনে নূর সামনের জানালা দিয়ে বাইরের নীল আকাশে অন্যমনস্কভাবে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। কিছু যেন গভীরভাবে চিন্তা করছে সে।

মিঃ কিবরিয়া বলে চলেছেন–গাড়িখানা চলতে শুরু করলো, দু’পাশে লাইটপোষ্টগুলো কুয়াশায় ঝাপসা আলো ছড়াচ্ছিলো। হঠাৎ গাড়িখানা থেমে গেলো এক স্থানে। তাকিয়ে দেখলাম একটি বিরাট গাছের তলায় গাড়িখানা থেমে পড়েছে। ড্রাইভার বেশী বাশার নেমে দাঁড়ালেন, তারপর বিশ্বাস করুন মিঃ নূর এমন ঘটনা ঘটে গেলো যা অত্যন্ত ভয়ংকর……। চারিদিকে তাকালেন মিঃ কিবরিয়া কেউ তাদের কথাবার্তা শুনছে না তো এমনি মনোভাব পরিলক্ষিত হলো তাদের চোখেমুখে।

নূর ভ্রুকুঞ্চিত করে বললো–থাক ওসব না বলাই ভাল। হাঁ, বাশার ঠিকই করেছেন, কারণ তিনি জানতে পেরেছিলেন মিঃ চৌধুরীই মিঃ কিবরিয়াকে উধাও করেছে এবং সেইজন্য মিঃ বাশার গোপনে সন্ধান করে ফিরছিলেন। তারপর গোপন সূত্রেই জানতে পারেন মিঃ চৌধুরীর কোনো রহস্যময় গোপন স্থানে আপনাকে আটক করে রাখা হয়েছে। মিঃ বাশার তাই ড্রাইভারের ছদ্মবেশে মিঃ চৌধুরীর সেই গোপন স্থানে গিয়ে হাজির হন এবং তারপরের ঘটনা তো আপনি জানেন…….

মিঃ নূর, আপনি কি তাহলে……

হাঁ মিঃ কিবরিয়া, আমি মিঃ বাশারের মুখে সব জেনেছি। আরও জানি মিঃ বি, কে চৌধুরী মিঃ বাশারকে বন্দী করার জন্যই ষড়যন্ত্র এঁটেছিলেন সেই জালে আটকে পড়েছিলেন আপনি।

সবই দেখছি জানেন আপনি মিঃ নূর!

 নূর কোনো জবাব না দিয়ে একটু হাসলো শুধু।

 বয় দু’কাপ গরম চা রেখে গেলো নূর এবং কিবরিয়ার সামনে।

বললো নূর—তারপর একদিন আপনার উপরে যা অত্যাচার হয়েছে……যাক, রাতে ঠিকমত বাংলোয় পৌঁছে গিয়েছিলেন তো?

হাঁ, কিন্তু আপনি কি করে জানলেন আমি রাতে বাংলোয় ফিরেছি?

আপনার কথা থেকেই আমি সবকিছু আন্দাজ করে নিয়েছি মিঃ কিবরিয়া।

মিঃ নূর, আপনার তীক্ষ্ণ বুদ্ধির পরিচয় পেয়ে আমি মুগ্ধ, এবার বলুন কি ভাবে আমাকে সাহায্য করতে পারেন?

যেভাবে আপনি চান। বললো নূর।

মিঃ বি, কে চৌধুরীর আসল রূপ আমার কাছে প্রকাশ হয়ে পড়েছে। আর সে মুখোসের অন্তরালে নিজকে লুকিয়ে রাখতে পারবে না। আমি তাকে গ্রেপ্তার করবো।

নূর বললো—আপনি যত সহজ মনে করছেন তত সহজ নয় ব্যাপারটা মিঃ কিবরিয়া। বি, কে চৌধুরী আপনার আমার চেয়ে অনেক ধূর্ত। একটু থেমে বললো নূরমিঃ বাশার বি, কে চৌধুরীর আস্তানার সন্ধান পেয়েছেন কাজেই তার সহায়তা নিলে আপনি জয়যুক্ত হবেন বলে আশা করা যায়। তবে হাঁ, আমি নিজেও আপনাকে সাহায্য করবো তবে প্রকাশ্যে নয়।

মিঃ নূর আমি আশ্চর্য হয়েছি সাধুতার মুখোস পরে একশ্রেণীর ধনকুবের দেশ ও দশের সরল সহজ জনগণের বুকের রক্ত শোষণ করে চলেছে, যাদের আমরা সমাজের উচ্চ শিখরে স্থান দিয়েছি…

হাসলো নূর, কিছুটা অন্যমনস্ক হলো সে। হয়তো তার স্মরণ হলো একটি পৌরুষদীপ্ত বলিষ্ঠ মুখ। যে নিজের জীবন বিপন্ন করে দেশ ও দশের জনগণের জন্য সংগ্রাম করে চলেছে,–স্বয়ং দস্যু বনহুর……

কি ভাবছেন মিঃ নূর?

একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে নিয়ে বললো নূর–ভাবছি সেই সব মানুষের কথা যারা দেশের রক্ষক সেজে ভক্ষক হয়ে মুখোসের অন্তরালে নিজেদের আসল রূপ গোপন করে রাখে। মিঃ। কিবরিয়া, আপনি বিশ্বাস করেছিলেন মিঃ চৌধুরী এবং আহসান হাবীবকে। কারণ এরা এমন এক ধরনের ধূর্ত যাদের চেনা বড় দায়। মিঃ বি, কে চৌধুরী এবং আহসান হাবীব যৌথভাবে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। উভয়েই উভয়ের অন্তরঙ্গ বন্ধু এবং সঙ্গী। শুধু কান্দাই নয়, সমগ্র বিশ্বে এদের ব্যবসা চলছে এবং সে ব্যবসা সৎ উপায়ে নয়…মানুষের রক্ত শুষে নিয়ে এরা ফেঁপে উঠছে। ধনকুবের হচ্ছে। দেশের স্বনামধন্য ব্যক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করছে— সুধী মহলে এদের পরিচয় আছে এবং থাকবে চিরকাল।

মিঃ নূর, এদের খুঁজে বের করে শাস্তি দেওয়া দরকার।

হাঁ, দরকার বটে কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাধবে কে? অর্থের কাছে মানুষ পরাহত। অর্থ দ্বারা এরা অসাধ্য সাধন করে। সবাই মান্য করে, সম্মান দেয় এবং নেতা হিসেবেও আসন পায় কিন্তু……যাক সে কথা, এবার বলুন কি ভাবে আপনি অগ্রসর হবেন?

মিঃ কিবরিয়া বললেন-আমার চক্ষু দুটি কালো কাপড়ে বাঁধা থাকায় আমি ঠিক বুঝতে পারিনি মিঃ বি, কে চৌধুরীর আসল আস্তানার ঠিকানা, আমি তাই চিনতে সক্ষম হবে না। মিঃ নূর, আমি ভাবছি সেই বড় গাছটার নিচে সেই গাড়িখানার কথা। আরও ভাবছি ঐ রবার্টহাংয়ের কথা, যাকে মিঃ বাশার গুলী করে হত্যা করেছেন।

হাঁ, ভাববার কথাই বটে। নূর তার হাতের সিগারেটটা সম্মুখস্থ এ্যাসট্রের ভেতরে খুঁজে রাখলো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তুলে ধরলো সে মিঃ কিবরিয়ার মুখের দিকে, তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বললো—মিঃ কিবরিয়া, মিঃ বি, কে চৌধুরী শুধু আপনাকেই বন্দী করেছিলেন তা নয়। আমার মাকেও নরপশু আটক করে রেখেছে, উদ্দেশ্য আমার মাকে বন্দী করে আমাকে সায়েস্তা করা। যে কোনো মুহূর্তে আমাকেও সে হত্যা করতে পারে। কারণ এখন আমি তার প্রধান শত্রু তার পথের কাঁটা। মিঃ কিবরিয়া, আপনার সাহায্য আমার একান্ত দরকার। নিজের পরিচয় গোপন রেখে ছদ্মবেশে আমি আপনার সঙ্গে ছিলাম। মিঃ বি, কে চৌধুরী জেনে নিয়েছে কে আপনার সহকারী মিঃ বাশার! কাজেই আর গোপন রাখার কোনো প্রয়োজন বোধ করছি না, মিঃ বাশারই মিঃ নূর……

বিস্ময়ভরা চোখ তুলে তাকালেন কিবরিয়া নূরের মুখের দিকে। অবাক কণ্ঠে বললো আপনি আমার সহকারী……মিঃ বাশার।

হাঁ মিঃ কিবরিয়া।

আশ্চর্য আপনার ছদ্মবেশ ধারণ!

ব্যর্থ হলাম ছদ্মবেশ ধারণে, কারণ ধূর্ত বি, কে চৌধুরী আমাকে চিনে ফেলেছে, কাজেই এবার আমি প্রকাশ্যভাবে আপনার সাহায্য কামনা করছি। একটু থেমে বললো নূর–বি, কে চৌধুরীর আস্তানা ও তার গোপন ব্যবসার কেন্দ্রস্থলগুলির সন্ধান আমি পেয়েছি।

সত্যি বলছেন মিঃ নূর?

হাঁ মিঃ কিবরিয়া। এবার আপনার সাহায্য প্রয়োজন হবে। কারণ পুলিশ বাহিনীর দরকার।

যথাসাধ্য সাহায্য পাবেন মিঃ নূর এবং এটা আমাদের কর্তব্যও বটে।

নূর উঠে দাঁড়ালো, বললো সে–এখন আর বেশি কথা নয় মিঃ কিবরিয়া। আমি আপনার ওখানে আসছি এবং সব কথা আপনার অফিসেই হবে।

মিঃ কিবরিয়াও উঠে দাঁড়িয়েছেন, নূরের সঙ্গে করমর্দন করে বললেন–ঠিক আছে, আপনি চলে আসুন মিঃ নূর। কাল আপনি মিঃ বি, কে চৌধুরীর সহচর রবার্টহাংকে যে ভাবে……

যাক ওসব কথা, দেয়ালেও কান আছে। মিঃ কিবরিয়া, আপনি জানেন না আমি এখন কতখানি ভয়ঙ্কর হয়েছি। আমার মাকে যারা ধরে নিয়ে গিয়ে আটক করে রেখেছে তাদের আমি ক্ষমা করবো না……কথাগুলো দূর দাঁতে দাঁত পিষে বললো।

মিঃ কিবরিয়া অবাক হয়ে চাইলেন নূরের দিকে। নূরের মধ্যে আজ নতুন এক রূপ দেখতে পেলেন তিনি।

করমর্দন করে বেরিয়ে গেলেন মিঃ কিবরিয়া ঘর থেকে।

মিঃ কিবরিয়া চলে যাবার পর নূর আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালো। তার ছদ্মবেশ ধারণ নিখুঁত হয়েছে তবু মিঃ চৌধুরী তাকে চিনতে পেরেছে, ঠিক আছে আমিও দেখে নেবো তোমাকে…আপন মনে কথাগুলো বললো নূর।

সেই মুহূর্তে ফোন বেজে উঠলো ক্রিং ক্রিং করে।

নূর এসে রিসিভার তুলে নিলো হাতে–হ্যালো, স্পিকিং নুরুজ্জামান….

ওপাশ থেকে ভেসে এলো কর্কশ কঠিন কণ্ঠস্বর,…..বাছাধন, তুমি ঘুঘু দেখেছো ফাঁদ দেখোনি….আমার লোককে তুমি গুলি করে হত্যা করেছে–রবার্টহাংকে হত্যা করে তুমি মিঃ কিবরিয়াকে নিয়ে ভেগেছো।

নূর অট্টহাসি হেসে উঠলো, তারপর বললো—বলুন মিঃ বি, কে চৌধুরী, থামলেন কেন, বলুন?…

বাপের মত হাসতে শিখেছে, জানোনা আমার হাতের মুঠায় এখন তোমার স্নেহময়ী জননী…

-জানি মিঃ বি, কে চৌধুরী আর জানি বলেই আমি আপনার মত নরপশুর পেছনে ধাওয়া করেছি রবার্টহাং আমার প্রথম শিকার কথাটা বলে নূর রিসিভার রেখে দিলো, তারপর সে তার ড্রেসিংরুমে প্রবেশ করলো।

*

গভীর মনোযোগ সহকারে একটি ম্যাপের দিকে তাকিয়ে কিছু লক্ষ করছে বনহুর। বাম হাতের আংগুলের ফাঁকে অর্ধদগ্ধ সিগারেট থেকে ধুম্ররাশি উঠে যাচ্ছে উপরের দিকে। ম্যাপখানা সামনের টেবিলে মেলে ধরে তীক্ষ্ণভাবে কিছু লক্ষ্য করছিলো সে।

এমন সময় ক্যাবিনে প্রবেশ করলো রহমান ও মাহবুব।

কুর্ণিশ জানিয়ে দাঁড়ালো ওরা দুজন।

রহমান বললো—সর্দার, আমাদের ডুবুজাহাজখানা আপনার নির্দেশমত সঠিক জায়গায় পৌঁছে গেছে।

বনহুর ম্যাপ থেকে চোখ তুলে তাকালো রহমানের দিকে, তারপর বললো—আমাদের জাহাজখানা ঠিক জায়গায় পৌঁছে গেছে।

হাঁ সর্দার।

যাক, পথে কোনো বাধা আসেনি তাই এত তাড়াতাড়ি পৌঁছে গেলাম। আমাদের জাহাজখানা কত ফুট পানির তলায় অবস্থান করছে।

প্রায় হাজার ফুট নিচে।

আরও নিচে নামিয়ে নাও, কারণ কোনো জাহাজ বা জলযান যেন আমাদের জাহাজের সন্ধান জানতে না পারে।

আচ্ছা সর্দার তাই হবে। বললো রহমান।

রহমান এবং মাহবুব চলে যাচ্ছিলো, বনহুর বললো—মাহবুব, তুমি ডন কে সংবাদটা জানিয়ে দাও। রহমান, তুমি থাকো, তোমার সঙ্গে কথা আছে।

ঠিক আছে সর্দার। রহমান দাঁড়িয়ে পড়লো।

মাহবুব চলে গেলো। ডুবুজাহাজের চালক ডনকে সর্দারের নির্দেশ জানাতে।

বনহুর ম্যাপখানার এক স্থানে আংগুল দিয়ে দেখিয়ে বললো–রহমান, আমাদের ডুবুজাহাজখানা এখন এই স্থানে এসে পৌঁছেছে। দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে এই যে রেখাটা দেখছো এটা সাংকেতিক চিহ্ন। এই রেখা ধরে আমাদের এগুতে হবে। প্রশান্ত মহাসাগর অতিক্রম করে আমাদের জাহাজখানা এখন কান্দাই সাগরের মোহনায় প্রবেশ করেছে।

হাঁ সর্দার, আমি বুঝতে পেরেছি। এখন আমরা এখান হতে কোন পথে কান্দাই সাগরের দিকে অগ্রসর হবে?

ঐ কথাটাই বলবো তোমাকে রহমান, এই যে গোলাকার চিহ্ন দেখছো—

হাঁ সর্দার দেখছি, মনে হয় সাগরতীরে কোনো পর্বতগহ্বরের গুহামুখ ও গুলো।

তুমি ঠিকই বলেছ রহমান। এগুলো পর্বতের গুহামুখ। ঐ গুহামুখ দিয়েই প্রবেশ করতে হবে। আর এই যে লাল তীর চিহ্ন, এখানেই আছে কোন গুহা যার মধ্যে বন্দী করে রাখা হয়েছে মনিরাকে।

উঃ! কি সাংঘাতিক ব্যাপার! বৌরাণীকে নরশয়তান এত দূর দেশে নিয়ে এসেছে?

হাঁ রহমান, কারণ তাদের উদ্দেশ্য সফল করা। মনিরাকে আটকে রেখে আমাকে হাতের মুঠায় নেওয়াই হলো সেই দলের উদ্দেশ্য।

আমরা তা হতে দেবো না সর্দার।

পারবে ওখানে যেতে?

আপনি নির্দেশ দিলে আমরা জান দিতেও প্রস্তুত। কোনো কাজ করতে আমাদের অসুবিধা হবে না সর্দার। আমাদের ডুবুজাহাজ খানা আরও কিছুটা এগিয়ে নিলে হয়না?

কিন্তু শত্রুপক্ষ যদি টের পায় তাহলে মনিরাকে সরিয়ে ফেলতে পারে এবং আমাদের জাহাজের ক্ষতি সাধন করার চেষ্টা করবে, কাজেই তোমরা ডুবুজাহাজখানা নিয়ে গভীর জলের তলায় অপেক্ষা করো আর আমি আমাদের ক্ষুদে জলযান নিয়ে

সর্দার, আপনি যাবেন……

কিছু ভেবো না রহমান, আল্লাহ ভরসা। তুমি যাও ক্ষুদে জলযানটাকে প্রস্তুত করে নাও।

আচ্ছা সর্দার।

রহমান চলে গেলো সেখান হতে।

বনহুর আবার ম্যাপখানায় মনোনিবেশ করল। এই ম্যাপটাই তাকে পথের নির্দেশ দিচ্ছে। আর চিঠিখানাতে জানতে পেরেছে মনিরাকে শত্রুগণ কান্দাই হতে বন্দী করে এনে কোনো গুপ্ত গুহায় আটক করে রেখেছে। উদ্দেশ্য বনহুরকে আটক করা। অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো বনহুর আপনা-আপনি। কারণ বনহুরকে গ্রেপ্তার করার জন্য একটি সরল অবলা নারীকে তারা বন্দী করে বাহাদুর সেজেছে…

মাহবুব ফিরে এলো, ক্যাবিনে প্রবেশ করবার পূর্বে ক্যাবিনের মধ্য হতে সর্দারের হাসির শব্দ শুনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো।

বনহুর পদশব্দ শুনতে পেয়েছিলো, বললো—–এসো।

 মাহবুব এসে কুর্ণিশ জানিয়ে বললো—ক্ষুদে জলযান প্রস্তুত আছে সর্দার।

জ্বালানি ঠিক আছে তো?

হাঁ সর্দার, জ্বালানি ঠিকমতই ভরা আছে।

যাও, আমি আসছি।

মাহবুব চলে গেলো।

বনহুর প্রবেশ করলো পাশের ক্যাবিনে। যে ক্যাবিনের দেয়ালে লটকানো আছে বিভিন্ন। ধরনের ডুবুরী পোশাক এবং জলযান চালনার নানা ধরনের সরঞ্জাম ও অক্সিজেনভরা মুখোশ।

বনহুর সজ্জিত হয়ে নিলো অদ্ভুত ধরনের পোশাকে।

পোশাকের ভেতরে ক্ষুদে পিস্তল এবং সূতীক্ষ্ণধার ছোরা নিয়ে নিলো। ড্রেসিং আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালো বনহুর–হাতে তার অক্সিজেনভরা মুখোশ। মুখোশটা মুখে পরবার পূর্বে তাকে জলযানের নিকটে যেতে হবে।

ড্রেসিং আয়নায় নিজের চেহারাটা দেখছে বনহুর, তার মনের পর্দায় ভেসে উঠলো মনিরার মুখ। আজ তারই জন্য মনিরা কঠিন শান্তি ভোগ করছে, একটা অসহায় মহিলাকে তারা কষ্ট দিচ্ছে অন্যায়ভাবে, কাপুরুষরা।

রহমান এসে দাঁড়ালো তার পেছনে সর্দার!

 বলো রহমান ফিরে দাঁড়ালো বনহুর।

রহমান বললো—সর্দার আপনি একা যাবেন, যদি কোনো বিপদ আসে?

বিপদের সঙ্গেই তো মোকাবেলা করতে যাচ্ছি রহমান। তোমরা প্রস্তুত থাকবে এবং জাহাজখানাকে ক্রমান্বয়ে গভীর তলদেশে নিয়ে যাবে।

আচ্ছা সর্দার।

বনহুর আর রহমান ডুবুজাহাজের খোলের মধ্য দিয়ে আরও নিচে নেমে চললো। বিদায় নিয়ে বনহুর প্রবেশ করলো ক্ষুদে জলযানের মধ্যে। জলযানে প্রবেশের পূর্বে মুখে অক্সিজেনভরা মুখোশ পরে নিলো।

এবার একটি মেশিনে চাপ দিতেই জাহাজের তলদেশে একটি লম্বা ছিদ্রপথ বেরিয়ে এলো। বনহুর সেই পথে ক্ষুদে জলযান নিয়ে বেরিয়ে গেলো।

বনহুর পুনরায় সেই মেশিন ঘোরালো, এবার ডুবুজাহাজের ছিদ্রপথ বন্ধ হয়ে গেলো।

বনহুরের জলযান তখন প্রশান্ত মহাসাগরের মোহনা অতিক্রম করে কান্দাই সাগরসীমার দিকে উল্কাবেগে এগিয়ে যাচ্ছে। জলযানটি ক্ষুদ্র হলেও তার গতি ছিলো ঘণ্টায় শত শত মাইল। বনহুর জলযানটির মধ্যে বসে সামনে দৃষ্টি রেখে সুইচ টিপছিলো।

অগণিত জলজীব তার জলযানটির দু’পাশে সরে যাচ্ছে। সব কিছু দেখতে পাচ্ছে বনহুর সামনের পুরু গ্লাসের ভেতর দিয়ে। বিরাটকায় একটি তিমির পাশ কেটে চলে যাবার সময় আক্রমণ করতে যাচ্ছিলো বনহুরের জলযানটিকে কিন্তু ততক্ষণে জলযানটি তিমি মাছটার আওতার বাইরে চলে গেলো।

বনহুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে প্রশান্ত মহাসাগরের মোহনা অতিক্রম করে কান্দাই সাগরের ভেতরে প্রবেশ করলো। তার পাশ কেটে চলে যাচ্ছে বৃহৎ আকার হাঙ্গর এবং আরও ভয়ংকর নাম না জানা কত জলজীব। কিছু সময় পর বনহুরের জলযান এমন একস্থানে এসে পৌঁছলো যেখানে মস্ত বড় একটি প্রবাল পাহাড়।

বনহুর তার জলযানের গতি কিছুটা কমিয়ে নিলো।

 প্রবাল পাহাড়টি অতিক্রম করার সময় পুনরায় ম্যাপখানা মেলে দেখে নিলো বনহুর।

 হাঁ, ঠিক পথেই চলেছে সে।

*

মিসেস মনিরা, এবার তোর শেষ পরীক্ষা। তোমাকে বন্দী করে রাখলেও এতদিন তোমার কোনো ক্ষতি করিনি। তোমাকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করে আমরা তোমার স্বামী বনহুরকে আটক করতে চাই। একথা তোমার স্বামীকে নানাভাবে জানিয়ে দিয়েছি। তার বিনিময়ে আমরা অনেক কিছু ক্ষতি সাধন করেও পারিনি তাকে বন্দী করতে। অনেক জীবন নাশ করেছি আমরা, বনহুর যাদের ভালবাসে তাদের অনেককে হত্যা করে কান্দাই জঙ্গলে ঝুলিয়ে রেখে দিয়েছি তবুও……একটু থামলো বি, কে চৌধুরী।

মনিরার হাত দুখানা রশি দিয়ে দু’পাশে বাঁধা। সামনে দু’হাতে দুটি সূতীক্ষ্ণধার ছোরা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি ভয়ংকর চেহারার লোক। মিঃ বি, কে চৌধুরীর নির্দেশের অপেক্ষা মাত্র। করুণ চোখে তাকিয়ে আছে মনিরা মিঃ বি, কে চৌধুরীর দিকে। একটি কথাও তার মুখ দিয়ে বের হচ্ছে না। বার বার তার দৃষ্টি চলে যাচ্ছে সূতীক্ষ্ণধার ছোরা দুটির দিকে।

মিঃ বি, কে চৌধুরী বললো—সে আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেনি। সন্তান এবং স্ত্রীর প্রতি তার কোনো মায়া নেই। নূরকে আমরা বন্দী করে আনবো এবং তোমার সামনে তাকে হত্যা করবো। কিন্তু তোমার দেখবার সৌভাগ্য হবে না মিসেস মনিরা, কারণ তখন তোমার চোখ দুটোকে অন্ধ করে দেওয়া হবে।

শিউরে উঠলো মনিরা।

বিশেষ করে সন্তান নূরের কথা স্মরণ হতেই তার মাতৃহৃদয় বিগলিত হলো। নরাধম যা বলছে সত্যি যদি তাই হয়, তার সামনে নূরকে যদি হত্যা করা হয় তাহলে সে কি সহ্য করতে পারবে। তার চেয়ে তাকেই ওরা হত্যা করুক।

কি ভাবছো? তুমি বলে সম্বোধন করছি তাই খুব চটে যাচ্ছে বোধ হয়? তোমার স্বামী যদি স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ না করে তাহলে তার পরিণতি হবে ভীষণ আর ভয়ংকর।

মনিরা এতক্ষণ রুদ্ধ নিঃশ্বাসে শুনছিলো পাপীষ্ঠ বি, কে চৌধুরীর কথাগুলো। এবার বলে উঠলো–আমাকে হত্যা করে তাতে দুঃখ নেই। কিন্তু আমার সন্তানের কোনো ক্ষতি তুমি করো না। আমার নূর তোমার কোন ক্ষতি করেনি……

দাঁত পিষে বললো মিঃ বি, কে চৌধুরী তোমার সন্তান ক্ষতি করেনি বলছো? সে আমাদের একজন বিশ্বস্ত কর্মীকে হত্যা করেছে। বাপের মতই সে চতুর……কিন্তু যত চতুরই হোক নিস্তার পাবে না আমাদের হাত থেকে।

মনিরা আড়ষ্ট হয়ে শুনছিলো।

তার সমস্ত ব্যথা-বেদনা ভুলে গেলো ঐ মুহূর্তে। নূর তাহলে এই নরপশুদের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। এদের কাছাকাছি এসেছিলো সে। না এলে তাদের একজন কর্মীকে সে হত্যাই বা করবে কি করে। নূর তাহলে মানুষ হত্যা করেছে। না না, তা বিশ্বাস হয় না, নূর মানুষ হত্যা করতে পারে না……।

জংজিং, এবার তোমার কাজ শেষ করো! মিঃ বি, কে চৌধুরী কঠিন কণ্ঠে তার অনুচর ভয়ংকর চেহারার লোকটাকে নির্দেশ দিলো। ইংগিত করলো ছোরা দিয়ে মনিরার চোখ দুটো তুলে নেওয়ার জন্য।

নরপও হিংস্র জংজিং তার ছোরা দুটো নিয়ে যেমনি মনিরার দিকে অগ্রসর হলো অমনি জমকালো পোশাক পরিহিত এক ব্যক্তি এসে লাফিয়ে পড়লো জংজিং-এর ঘাড়ে।

হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলো জংজিং। তার দক্ষিণ হাতের ছোরাখানা আমূলে বিদ্ধ হলো তার বুকে। একটা তীব্র আর্তনাদ করে উঠলো জংজিং।

জমকালো পোশাক পরিহিত ব্যক্তি ফিরে দাঁড়াতেই অবাক হলো–মিঃ বি, কে, চৌধুরী উধাও হয়েছে।

জমকালো মূর্তি দ্রুতহস্তে নিজের হাতের ছোরাখানা দিয়ে মনিরার হাতের রশি কেটে দিয়ে বললো—মনিরা, তাড়াতাড়ি নেমে এসো……

তুমি! মনিরার কণ্ঠে বিস্ময় ঝরে পড়ছে। স্বামীকে সে এমনভাবে এখানে পাবে কল্পনাও করতে পারেনি। আনন্দে আত্মহারা মনিরা স্বামীর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো।

বনহুর বলে–আর এক মুহূর্ত বিলম্ব করা চলবে না মনিরা। কারণ শয়তানটা ভেগেছে!

 তুমি আসবে ভাবতেও পারিনি।

পরে কথা হবে মনিরা। চলো এবার।

বনহুর মনিরার হাত ধরে গুহামুখের দিকে অগ্রসর হলো দ্রুত গতিতে।

গুহামুখ বন্ধ হয়ে গেছে। বনহুর অবাক হলো, কারণ কিছু পূর্বেই গুহামুখ ভোলা ছিলো। বনহুর অপর একটি গুহামুখ দেখতে পেলো। মনিরাসহ সেই গুহামুখ দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। জমাট অন্ধকার, বনহুর জানে না এ পথ কোন্ দিকে কতদূর চলে গেছে।

বনহুর আর মনিরা অন্ধকারে দ্রুত এগুচ্ছে, হোঁচট খাচ্ছে বার বার।

তবু বনহুর আর মনিরা এগুচ্ছে দ্রুত গতিতে। হঠাৎ সামনে লৌহশিকের বেষ্টনী পথ রোধ করে ফেললো তাদের।

বনহুর আর মনিরা এগুতে পারলো না।

এবার পেছনে পিছিয়ে যাবে তাও পারছে না, যে পথে সুড়ঙ্গে প্রবেশ করেছিলো সে পথও বন্ধ হলো একটা লোহার পাত নেমে এলো উপর হতে নিচে।

ছোট্ট জায়গার মধ্যে বন্দী হলো বনহুর আর মনিরা।

ভীতভাবে মনিরা স্বামীর বুকের মধ্যে মুখ লুকালো।

বনহুর মনিরার পিঠে হাত বুলিয়ে বললো–ভয় পেও না মনিরা, বিপদে আল্লাহকে স্মরণ করো।

মনিরা বললো–মরতে আমি ভয় পাই না, ভাবনা তোমার জন্য। তুমি কেন এসেছিলো এখানে? জানো ওরা তোমাকে বন্দী করবে বলেই আমাকে ধরে এনে আটক করে রেখেছিলো।

মনিরা, ঠিক সময় আমি যদি এসে না পড়তাম তাহলে এতক্ষণ তোমার চোখ দুটো ওরা অন্ধ করে দিতো।

তাও ভাল ছিলো। আমি অন্ধ হয়েও যদি তোমাকে জীবিত পেতাম…

একটা অট্টহাসির শব্দ ভেসে এলো বনহুর আর মনিরার কানে। এ হাসি মিঃ বি, কে চৌধুরীর তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

বনহুর তাকিয়ে দেখলো এবং শুনতে চেষ্টা করলো কোন্ দিক থেকে শব্দটা আসছে।

ঠিক সেই মুহূর্তে পায়ের নিচের অংশ নেমে যাচ্ছে বলে মনে হলো তাদের। ভালভাবে লক্ষ করে বুঝতে পারলো নিচে নামছে তারা।

হাসির শব্দ থেমে গেছে।

বনহুর আর মনিরাসহ সুড়ঙ্গ পথের নিচের অংশটা একটা আবছা অন্ধকার গুহায় এসে থেমে পড়লো। চারধারে পাথরের প্রাচীর, একটা ছিদ্রপথে সামান্য আলো আসছে সেই গুহার মধ্যে। ছিদ্রপথের পাশেই একটা সাউন্ড বক্স ধরনের মেশিন।

বনহুর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে দেখছে ঠিক ঐ সময় পুনরায় সেই হাসির শব্দ, তারপর ভেসে এলো কঠিন গম্ভীর কণ্ঠস্বর……বনহুর, এবার তোমার সব শক্তির সমাধি হয়েছে…মিসেস মনিরাকে যে কারণে বন্দী করে এনেছিলাম সে কাজটি সমাধা হলো…আমাদের উদ্দেশ্য ছিলো। তোমাকে বন্দী করা…উদ্দেশ্য আমাদের সফল হয়েছে..আর কোনদিন এখান থেকে তুমি বেরিয়ে যেতে পারবে না বনহুর, মিসেস মনিরাকে আমরা মুক্তি দেবো কারণ তার কোনো অপরাধ নেই…তবে তার সামনে তোমাকে হত্যা করার পর তার মুক্তি, যেন সে ফিরে গিয়ে তোমার সন্তান নূরকে জানাতে পারে যে, বনহুর চির বিদায় নিয়েছে।

মনিরা বনহুরের জামার কিছু অংশ হাতের মুঠায় চেপে ধরে বলে উঠলোনা না তা হতে দেবো না। তোমাকে ওরা হত্যা করবে তা আমি হতে দেবো না। ওরা আমাকেই হত্যা করুক…

মনিরা, বিচলিত হলে চলবে না। তুমি যদি এত উতলা হও তাহলে আমি…

না না, আমি উতলা হবো না। তুমি কি করবে বলো?

ভেসে এলো পুনরায় সেই কণ্ঠস্বর…বনহুর, তোমাকে হত্যা করার পর আমাদের দ্বিতীয় কাজ হবে নূরকে পৃথিবী থেকে সরানো……সে আমাদের আসল রূপ জানতে পেরেছে।…শুধু তাই নয়, আমাদের একজন বিশিষ্ট কর্মীকে সে হত্যা করেছে,..বনহুর মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়ে নাও…জানি তোমাকে বন্দী করা কারও সাধ্য ছিলো না। কিন্তু আমরা পেরেছি…অনেক চেষ্টার পর অসাধ্য সাধন করতে সক্ষম হয়েছি…।

বনহুর আর মনিরা সাউন্ড বক্সটার দিকে তাকিয়ে আছে। নিশ্চয়ই বি, কে চৌধুরী এমন কোনো জায়গায় অবস্থান করছে যেখানে কেউ প্রবেশে সক্ষম নয়। সেখান থেকে কথা বলছে বি, কে, চৌধুরী….

মনিরার মুখমন্ডল ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে। তার যত আতঙ্ক ভয় সব বনহুরকে নিয়ে। তারই চোখের সামনে হত্যা করবে ওকে, তা কি করে সে সহ্য করবে। অসহায় করুণ চোখে স্বামীর মুখের দিকে তাকাচ্ছে মনিরা।

বুঝতে পারে বনহুর সুড়ঙ্গপথের মেঝেটা সম্পূর্ণ একটা ঝুলন্ত বস্তু ছিলো, যা কতকটা লিফটের মত। মেঝেটা তাদের দুজনকে এমন এক জায়গায় নিয়ে এসেছে যা অত্যন্ত দুর্গম স্থান। বনহুরের চোখের সামনে ভেসে উঠলো সেই ম্যাপখানা। যে ম্যাপখানা এখনও তার পকেটেই আছে। ম্যাপখানা সম্বন্ধে জানে না মিঃ বি, কে চৌধুরী। কারণ বনহুর যে উপায়ে ম্যাপখানা পেয়েছে তা অত্যন্ত জটিল এবং রহস্যময়। বি, কে চৌধুরী ভাবতেও পারেনি ম্যাপসহ সেই চিঠিখানা বনহুরের হাতের মুঠায় গিয়ে পড়েছে। ম্যাপের মধ্যে সাংকেতিক চিহ্ন দেওয়া ছিলো, প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে কোন এক পর্বতের গুহায় মনিরাকে বন্দী করে রাখা হয়েছে। কোন পথে গেলে সেই পর্বতমালায় পৌঁছানো যাবে তার স্পষ্ট চিহ্ন আঁকা আছে ম্যাপখানায়। বনহুর তাই অতি সহজেই পৌঁছতে সক্ষম হয়েছে, যদিও জীবনের অনেক ঝুঁকি পোহাতে হয়েছে বনহুরকে।

বনহুর একবার গভীরভাবে ভেবে ছিলেন এখন কোনো স্থান সম্বন্ধে কোনো সংকেত চিহ্ন আছে কিনা ম্যাপখানার মধ্যে। কিন্তু কিছুই ঠিক স্মরণে আসছে না। আবার ভেসে এলো সাউন্ডবক্সে সেই গলার স্বর…বনহুর সেই অজ্ঞাতনারী তোমাকে উদ্ধার করেছিলো তাই তুমি রক্ষা পেয়েছিলে সেদিন নইলে আমার সেই দুর্গম কারাকক্ষ থেকে তুমি কোনোদিনই বের হতে পারতে না। জানি না কে সেই নারী…আমার লোক তার সন্ধান করে ফিরছে…আশা করি তাকে খুঁজে বের করবোই একদিন…এবং তাকে শুধু আমরা হত্যাই করবো না, এমনভাবে হত্যা করবো যা ভাবলে আমি নিজেও শিউরে উঠি……বনহুর তোমাকেও আমরা সহজে হত্যা করবে না, কারণ তোমার মূল্য অনেক……তোমার বিনিময়ে পাবো আমরা কোটি কোটি টাকা……হত্যা যদি করতেই হয় তাহলে জীবন্ত অবস্থায় তোমার দেহের চামড়া ছাড়িয়ে তারপর মাংসগুলো টুকরো টুকরো করে কেটে নেবো…তবুও তোমাকে জীবিত রাখবো, কারণ তোমাকে আটক করতে আমাদের চরম বেগ পেতে হয়েছে…এমন এক জায়গায় তোমরা এখন বন্দী আছে যা কারও চিন্তা-শক্তির মধ্যে নেই…

বনহুর তাকালো মনিরার মুখের দিকে, সে ভীষণ ঘাবড়ে গেছে, তার চোখেমুখে ফুটে উঠেছে একটা ভীতিভাব।

বনহুর যখন মিঃ বি, কে চৌধুরীর দুর্গম বন্দীশালায় বন্দী, তখন রহমান, মাহবুব ও অন্যান্য অনুচর ডুবুজাহাজে সাগর তলে গভীর জলের নিচে অবস্থান করছে। নানা ধরনের চিন্তার উদ্ভব হচ্ছে তাদের মাথার মধ্যে। একদিন দু’দিন করে তিনদিন তিন রাত্রি কেটে গেলো। সর্দার ফিরে আসছে না, উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো বনহুরের অনুচরগণ।

ডুবুজাহাজখানাকে সর্দারের নির্দেশমত আরও নিচে নামিয়ে নেওয়া হয়েছে। রহমান জাহাজের তলদেশে খোলের মধ্যে বসে সাগরতলের জলজীবের বিচরণ লক্ষ করছিলো। নানা ধরনের জলজীব। বিশালকায় দেহবিশিষ্ট তিমির সঙ্গে হাঙ্গরের লড়াই। অনেক সময় তাদের ডুবু জাহাজখানাকেও তিমি এবং হাঙ্গর আক্রমণ করছিলো। কিন্তু ওরা বনহুরের ডুবুজাহাজখানার কোন ক্ষতি সাধন করতে সক্ষম হচ্ছিলো না। কারণ তা ছিল অত্যন্ত মজবুত।

রহমান ভাবছিলো সর্দার নিশ্চয়ই কোনো বিপদে পড়েছে নইলে সে ফিরে আসতো। ম্যাপখানাতে সঠিক নির্দেশ দেওয়া আছে কিনা তাই বা কে জানে।

পাশে এসে দাঁড়ালো মাহবুব। তার মুখমন্ডলেও চিন্তার ছাপ ফুটে উঠেছে। ক্ষুদ্র জলযানটি ছিলো অত্যন্ত দ্রুতগামী, কাজেই তার ফিরে আসতে বিলম্ব হবে এমন কোনো সন্দেহ ছিলো না, অবশ্য যদি সঠিকভাবে ফিরে আসতে সক্ষম হয়।

রহমান বললো—মাহবুব, সর্দারের কথামত আমরা এখানেই অপেক্ষা করবো না জাহাজটা এগিয়ে নেবো?

আমিও তাই ভাবছি রহমান ভাই, নিশ্চয়ই সর্দার কোনো বিপদে পড়েছেন নইলে এত বিলম্ব তার হতো না।

আমারও সেইরকম মনে হচ্ছে। চিন্তিত কণ্ঠে বললো রহমান।

 এমন সময় একটি বিরাটকায় তিমি তাদের জাহাজখানার কাছাকাছি এসে ভীষণভাবে ধাক্কা দিলো। সঙ্গে সঙ্গে জাহাজখানা দুলে উঠলো। একবার দু’বার তিনবার আঘাত করতেই জাহাজটির কিছু অংশ ঘায়েল হলো।

রহমান বললো—মাহবুব আর এক মুহূর্ত এখানে জাহাজ রাখা আমাদের উচিত হবে না, কারণ তিমি মাছটি ভীষণ ক্ষেপেছে। আর সে কেন ক্ষেপেছে তাও আন্দাজ করে নিতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।

মাহবুব অবাক চোখে তাকিয়ে আছে রহমানের মুখের দিকে। রহমান বললো তিমিটির বাসস্থান এই জাহাজের তলদেশে চাপা পড়েছে এবং সেই বাসস্থানের গর্তের মধ্যে রয়েছে ওর বাচ্চা…

মাহবুব বলে উঠলো—ঐ দেখো রহমান ভাই, তিমিটা কি ভীষণ বেগে আবার তেড়ে আসছে।

মাহবুব, শীঘ্র চালককে বলে দাও জাহাজখানাকে এখান হতে সরিয়ে নিতে, নইলে এক্ষুণি জাহাজখানাকে ধ্বংশ করে দেবে।কি ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছে তিমিটা।

মাহবুব সাউন্ড বক্সে মুখ রেখে ইঞ্জিন ক্যাবিনে চালক ডনকে লক্ষ্য করে বললো—এক মুহূর্ত বিলম্ব করোনা, জাহাজখানাকে সরিয়ে নাও। আমাদের জাহাজের তলদেশে তিমিটার গর্ত আছে। তার মধ্যে তিমির বাচ্চা আটকা পড়েছে, শীঘ্র জাহাজখানাকে সরিয়ে না নিলে তিমি আমাদের জাহাজখানাকে ধ্বংস করে ফেলবে–

চালক ডন বললো—কোনদিকে জাহাজ সরিয়ে নেবো, বাঁয়ে না ডানে?

মাহবুব রহমানকে জিজ্ঞাসা করলো–রহমান ভাই, আমাদের জাহাজখানা বাঁ দিকে না ডান দিকে সরিয়ে নেবে, ডন জিজ্ঞাসা করছে।

রহমান দিকদর্শন যন্ত্রটির দিকে তাকিয়ে বললো—-ডান দিকে সরিয়ে নিতে বলো মাহবুব।

[পরবর্তী বই দুর্ধর্ষ জাভেদ]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *