হিটাইট ফলক রহস্য

হিটাইট ফলক রহস্য – কিশোর কর্নেল সমগ্র ৪ – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

ব্রোঞ্জের ফলক চুরি

মার্চ মাসের এক ভোরবেলায় টেলিফোনের বিরক্তিকর শব্দে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। যথারীতি খাপ্পা হয়ে রিসিভার তুলে বলেছিলুম,রং নাম্বার।

অমনই আমার কানে পরিচিত কণ্ঠস্বর ভেসে এল,–রাইট নাম্বার ডার্লিং! অপ্রস্তুত হয়ে উঠে বসে বলেছিলুম,–মর্নিং ওল্ড বস! আসলে

-জানি, জানি। তুমি আটটার আগে ওঠ না। তবে আমি জানি, নাইট ডিউটি থাকলে ভোরে ঘুমন্ত সাংবাদিকদের কানের কাছে কামান গর্জন হলেও তাদের ঘুম ভাঙে না। যাই হোক, বোঝ যাছে, তোমার নাইট ডিউটি ছিল না।

–কিন্তু ব্যাপারটা কী?

–ব্যাপার না থাকলে এই বৃদ্ধ তোমার কাঁচা ঘুম ভাঙায় না, তা তো তুমি জানো জয়ন্ত!

হাসতে-হাসতে বললুম,–অর্থাৎ আপনার বাড়িতে আমার আজ ব্রেকফাস্টের নেমন্তন্ন। তারপর!

কর্নেল কিছুটা চাপা স্বরে বললেন, তারপর আমরা জনৈক আলুওয়ালার কাছে যাব।

–কী সর্বনাশ! এবার আলুর গুদামে রহস্যের ইঁদুর ঢুকেছে নাকি?

–জয়ন্ত! হাতে সময় কম। এখনই চলে এসো।…

ঠিক এইভাবেই মার্চের সেই অদ্ভুত দিনটা শুরু হয়েছিল। অদ্ভুত বলছি, তার কারণ আমি কল্পনাও করিনি, জনৈক আলুওয়ালাসায়েবের পাল্লায় পড়ে একসময় আমাকে-হ্যাঁ, শুধু আমাকেই, কর্নেল নীলাদ্রি সরকারকে নয়, সুদূর কোনো দেশের মরুভূমির উত্তপ্ত বালিতে শুয়ে মৃত্যুর জন্য প্রতীক্ষা করতে হবে।

তবে না। সে-কথা যথাসময়ে হবে। সেদিনকার কথা দিয়েই এই রোমাঞ্চকর কাহিনি শুরু করা যাক।

কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে ব্রেকফাস্ট করে এবং কফি খেয়ে কর্নেলের সঙ্গে বেরিয়ে পড়েছিলুম। তারপর পৌঁছেছিলুম সত্যি সত্যি জনৈক আলুওয়ালাসায়েবের নিউ আলিপুরের ফ্ল্যাটে। অবশ্য তাঁকে আমি এই কাহিনিতে আলুওয়ালা বললেও তার প্রকৃত পদবি আলুওয়ালিয়া।

তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর কর্নেল এবং তার মধ্যে যে-সব কথাবার্তা হয়েছিল, এবার তা বলা যাক্। …

–মোহেনজোদাড়োতে ঘোড়া? অসম্ভব। ওখানে খোঁড়াখুঁড়ি করে এযাবৎ অনেক জন্তুর মূর্তি পাওয়া গেছে, ঘোড়ার কোনো চিহ্নই মেলেনি। এর একটাই মানে দাঁড়ায়। ওখানকার লোকেরা ঘোড়া নামে কোনো জন্তুর কথা জানত না। আর শুধু ওখানে কেন, হরাপ্পা, চানহুড়ো, কালিবঙ্গান থেকে শুরু করে, যেখানে-যেখানে সিন্ধু সভ্যতার চিহ্ন পাওয়া গেছে, কোথাও ঘোড়ার মূর্তি দেখা যায়নি।

–আচ্ছা ডঃ আলুওয়ালা, মোহেনজোদাড়োর ধ্বংসাবশেষ তত বাঙালি পুরাতাত্ত্বিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় আবিষ্কার করেছিলেন। তাই না?

-হ্যাঁ। ১৯২১ সালে তিনিই সিন্ধুপ্রদেশের লারকানা থেকে মাইল বিশেক দূরে একটা বৌদ্ধ স্কুপ দেখতে পান। সেখানে খোঁড়াখুঁড়ি করার সময় টের পান, একটা শহরের ধ্বংসাবশেষ মাটির তলায় লুকিয়ে আছে। এর প্রায় একশ বছর আগে ওখান থেকে চারশ মাইল দূরে হরাপ্পার ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছিল। তবে যাকে বলে বিজ্ঞানসম্মত খনন, তা শুরু হয় ১৯২১ সালে। তারপর …।

-একটা কথা জিজ্ঞেস করি ডঃ আলুওয়ালা। আপনার বাবা ওই সময় লারকানায় স্টেশন মাস্টার ছিলেন। তাই না?

-হ্যাঁ। কিন্তু আপনি কীভাবে জানলেন?

–আপনার লেখা একটা প্রবন্ধ পড়ে। চমৎকার প্রবন্ধ।

–বাঃ। আপনার দেখছি পুরাতত্ত্ব বিষয়ক পত্রিকা পড়ারও নেশা আছে।

-আমি সবই পড়ি, ডঃ আলুওয়ালা। সত্যি বলতে কী, আপনার ওই প্রবন্ধ পড়েই আপনার সঙ্গে যোগাযোগের লোভ সামলাতে পারিনি।

-হাঃ হাঃ হাঃ! এতক্ষণে বুঝলুম, কেন আমার কাছে এসেছেন। বাঁচালেন মশাই। এতক্ষণ আপনার সঙ্গে কথা বলছি বটে, কিন্তু মনের মধ্যে অস্বস্তি হচ্ছিল প্রচণ্ড রকমের।

–সে কী! কেন, কেন?

–আপনার কার্ডটা দেখে। ওতে লেখা আছে : কর্নেল নীলাদ্রি সরকার, প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটার। অর্থাৎ কিনা শখের গোয়েন্দা। দেখেই আমি চমকে উঠেছিলুম। আমার কাছে এই সাতসকালে গোয়েন্দা কেন রে বাবা? আমি নেহাত অধ্যাপক মানুষ। হাঃ হাঃ হাঃ! তার ওপর আপনার সঙ্গী ভদ্রলোক আবার খবরের কাগজের লোক। বলুন, অস্বস্তি হয় কি না!

এই সময় একটা লোক চা ও স্ন্যাকস্ নিয়ে এল ট্রে বোঝাই করে। ডঃ আলুওয়ালা তার থেকে ট্রে প্রায় কেড়ে নিলেন এবং টেবিলে রেখে সযত্নে কফি তৈরি করতে ব্যস্ত হলেন। আড়চোখে তাকিয়ে দেখি, কর্নেল ডঃ আলুওয়ালার বইঠাসা আলমারিগুলোর দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে আছেন। অপরাধতত্ত্ব থেকে প্রকৃতিতত্ত্বে এসে পৌঁছেছিলেন ইদানীং। এবার দেখছি পুরাতত্ত্বে ঝুঁকেছেন। হুঁ, এবার তত্ত্ববাগীশ না হয়ে ছাড়বেন না।

–চা নিন, কর্নেল।

কর্নেল হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপ নিয়ে বললেন,–আপনি মোহেনজোদাভোর একটা ফলকের হরফগুলো নাকি পড়তে পেরেছেন। দয়া করে সেটা যদি একবার দেখান, বাধিত হব।

ডঃ আলুওয়ালা একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, আপনাকে দেখাতে আপত্তি নেই। কিন্তু জয়ন্তবাবুকে একটা বিশেষ অনুরোধ করব।

বললুম,–নিশ্চয়, নিশ্চয়।

–দেখুন, জয়ন্তবাবু! সেই ১৯২২ থেকে এ পর্যন্ত দেশবিদেশের বড় বড় পণ্ডিত সিন্ধু সভ্যতার সময় নিয়ে বিস্তর মাথা ঘামাচ্ছেন। সীলমোহর এবং ফলকের লেখাগুলো পড়তে পারলে হয়তো সঠিক সময় নির্ণয় করা যেত। কেউ বলছেন, এ সভ্যতা খ্রিস্টপূর্ব তিন হাজার সালের, কেউ বলছেন, আরও পরবর্তী যুগের। আজ অব্দি সিন্ধুলিপির পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। যদিও মাঝে মাঝে কেউ কেউ দাবি করেন যে তিনি লেখাগুলো পড়তে পেরেছেন। আসলে সমস্যা কোথায় জানেন? সম্ভবত যে-ভাষার ওই লিপি, সেই ভাষাই হাজার হাজার বছর আগে লুপ্ত হয়েছে। যাই হোক, এই সমস্যার একটা সমাধানের পথ আমি খুঁজে পেয়েছিলুম। আপনারা চিত্রলিপির কথা নিশ্চয় জানেন? অতীত যুগে সূর্য বোঝাতে সূর্য আঁকা হত। পাখি বোঝাতে পাখি। মোহেনজোদাড়োর একটা ফলক নিয়ে আমি গবেষণা শুরু করেছিলুম। সেটাতে কয়েকটা চিহ্ন দেখে আমার মনে হয়েছিল, এ নিশ্চয় চিত্রলিপি। চিহ্নগুলোতে ফসলের শীষ, লাঙল, বলদ, শস্যগোলা ইত্যাদির আভাস আছে যেন। এই সূত্র ধরেই ফলকটা আমি অনুবাদ করে ফেলেছি। কিন্তু এখনই হুট করে সেটা প্রচার করতে চাইনে। যদি ভুল প্রমাণিত হয়, উপহাস্যাস্পদ হব। তাই জয়ন্তবাবু খবরের কাগজের লোক বলেই বলছি, ফলকের অনুবাদটা যেন কাগজে ছেপে দেবেন না। আমি পত্রিকার প্রবন্ধে শুধু বলেছি, একটা ফলকের পাঠোদ্ধার করেছি বলে মনে করি। তার বেশি কিছু লিখিনি।

আমি জোরে মাথা দুলিয়ে বললুম,–কক্ষনোও ছেপে দেব না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন

ডঃ আলুওয়ালা। তা ছাড়া আপনার সঙ্গে এই সাক্ষাৎকারের ব্যাপারটাই আমি দৈনিক সত্যসেবকে। প্রকাশ করব না। কারণ, আমার মাননীয় বন্ধু কর্নেল আমাকে আগেই সেটা নিষেধ করে দিয়েছেন।

কর্নেল দাড়ি ও টাক পর্যায়ক্রমে চুলকে বললেন,–ঠিক, ঠিক।

ডঃ আলুওয়ালা উঠে গিয়ে একটা স্টিলের আলমারি খুললেন। তারপর একটা ফাইল বের করে আনলেন।

কর্নেল ঝুঁকে পড়লেন কাগজপত্রের দিকে। আমি কি বুঝলাম না। একগাদা কাগজে নানা বিঘুঁটে আঁকজোক রয়েছে। তার পাশে নানান উদ্ভুটে শব্দ ইংরাজিতে লেখা।

ডঃ আলুওয়ালা একটা কাগজ তুলে নিয়ে বললেন,–ফলকটায় লেখা আছে কী শুনুন : ‘শস্যগোলার অধিকর্তাকে একটি সেরা জাতের বলদ পাঠানো হচ্ছে।‘

কর্নেল বললেন,–পাঠাচ্ছেন কে?

–সেকথা ফলকে নেই। মনে হচ্ছে, এটা একটা বাণিজ্য সংক্রান্ত সংবাদ। আজকাল যাকে বলে চালান বা ইনভয়েস।

-ফলকটা কিসের তৈরি? কোথায় আছে ওটা?

-ফলকটা ব্রোঞ্জের। মাপ হচ্ছে সাড়ে তিন ইঞ্চি চওড়া সাত ইঞ্চি লম্বা। ওটা এখন আছে লন্ডনের জাদুঘরে। মোহেনজোদাড়ো এবং হরাঙ্গা পাকিস্তানে। তাই পাকিস্তান সরকার ব্রিটিশ সরকারের কাছে ওটা দাবি করছেন। শুনেছি, ফলকটা শিগগির ফেরত দেওয়া হবে।

–আপনি কোত্থেকে ফলকের নকল সংগ্রহ করেছিলেন?

ডঃ আলুওয়ালা হাসলেন। আমার বরাত বলতে পারেন। বাবা ছিলেন লারকানার স্টেশন মাস্টার। এখন তো লারকানা বিরাট শহর। পাকিস্তানের পরলোকগত প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলি ভুট্টোর বাড়ি ওখানে। আমার ছেলেবেলায় লারকানা ছিল অখাদ্য জায়গা। যাই হোক, বাবার একটু-আধটু পুরাতত্ত্বের বাতিক ছিল। স্যার জন মার্শাল ভারতে ব্রিটিশ সরকারের পুরাতত্ত্ব দপ্তরের কর্তা ছিলেন তখন। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন তার অধীনে এক কর্মচারী। রাখালদাসের সঙ্গে বাবার খুব বন্ধুত্ব ছিল। সেই সুত্রে বাবা ওঁরই কাছ থেকে এই ব্রোঞ্জের ফলকের একটা অবিকল

নকল জোগাড় করেছিলেন। সেটা এখনও আমার কাছে আছে। দেখাচ্ছি।

বলে ডঃ আলুওয়ালা উঠলেন। ভেতরের ঘরে চলে গেলেন। এতক্ষণে আমি আবার কর্নেলকে প্রশ্ন করার সুযোগ পেলুম,–হ্যালো ওল্ড বস! ব্যাপারটা কী বলুন তো?

-চুপ, চুপ! আমাকে বস বলে ডেকো না।

–তাহলে কি টিকটিকি বলে ডাকব?

–কিছু না। স্রেফ কর্নেল বলে ডাকবে।

–বেশ। কর্নেল স্যার, এবার বলুন তো সাতসকালে আমাকে ঘুম থেকে তুলে কেন এই গোরস্থানে নিয়ে এলেন?

-–গোরস্থান! … কর্নেল চাপা হাসলেন : তুমি ঠিকই বলেছ জয়ন্ত। মোহেনজোদাড়ো কথাটার মানে মৃতদেহের স্তূপ।

–এবং এই ডঃ আলুওয়ালা দেখছি সেই গোরস্থানের এক মামদো ভূত!

–ছিঃ ছিঃ! মহাপণ্ডিত মানুষ উনি!

যাই বলুন, হাজার হাজার বছর আগের ব্যাপার নিয়ে যাঁরা মাথা ঘামান, তাঁরা মামদো ভূত নয়তো কী? বর্তমানেই আমাদের কত রকম সমস্যা! তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করলে কাজ হত। তা নয়, মোহেনজোদাড়ো!

–উঁহু, মোহেনজোদাড়োর ঘোড়া।

–সে ঘোড়াও তো কত হাজার বছর আগে মরে ভূত হয়ে গেছে। তা ছাড়া এখন ঘোড়ার মূল্য কী? এটা যন্ত্রযুগ। বড়জোর রেস খেলায় বাজি ধরে যারা, তারা ঘোড়া নিয়ে মাথা ঘামায় দেখেছি। আপনি কি ইদানীং রেসুড়ে হয়ে উঠেছেন? ছ্যা ছ্যা!

জয়ন্ত ডার্লিং! তোমার কথাগুলো কিন্তু ভিন্ন অর্থে সত্যি। আমি সম্প্রতি মোহেনজোদাড়োর ঘোড়া ভূতের পাল্লায় পড়েছি এবং রেসুড়েদের মতো পিছনে বাজিও ধরেছি।

এবার একটু চমকে উঠলুম। কর্নেলের কথার হেঁয়ালি আছে। কিন্তু আর প্রশ্ন করার সুযোগ পেলুম না। ডঃ আলুওয়ালা হন্তদন্ত হয়ে ফিরে এলেন। একেবারে অন্য রকম চেহারা। হাঁফাতে-হাঁফাতে বললেন,–তাজ্জব কাণ্ড কর্নেল! ফলকটা খুঁজে পেলুম না।

–সে কী!

–শুধু তাই নয়, শোবার ঘরের যে আলমারির লকারে ওটা রেখেছিলুম, তার তালা ভাঙা। আলমারির পাল্লার তালা কিন্তু ঠিক আছে।

–ভারি আশ্চর্য তো!

–অতি আশ্চর্য! গত রাতেও দেখেছি, লকারটা ঠিক আছে। এখন দেখি তালা ভাঙা। কে এমন সাংঘাতিক কাজ করল বুঝতে পারছি না!

–আর কোনো জিনিস চুরি গেছে কি?

–না। আমার স্ত্রীর গয়নাগাটি এবং কিছু নগদ টাকা ছিল। সব আছে।

–আপনার স্ত্রী কিছু বলতে পারছেন না?

–আমার স্ত্রী গতকাল সকালে বোম্বাই গেছেন মেয়েকে নিয়ে। বাড়িতে আমি একা।

–আপনার চাকর আছে দেখলুম!

–ও! হ্যাঁ! বৈজু আছে বটে। কিন্তু সে তো খুব বিশ্বাসী ছেলে। প্রায় মাস তিনেক হল, তাকে রেখেছি। বুঝতেই পারেন, আজকাল ভালো ঝি চাকর পাওয়া কত সমস্যা।

–বৈজুকে জিজ্ঞেস করলেন কিছু?

–নিশ্চয় করব। বোধ হয়, বাজার করতে গেছে। ফিরে আসুক।

–আপনি দয়া করে বসুন, ডঃ আলুওয়ালা!

কর্নেলের কথায় উনি ধুপ করে বসলেন। উত্তেজনায় তখনও ওঁকে অস্থির দেখাচ্ছে। আমি বললুম,–পুলিশে জানানো উচিত।

কর্নেল বললেন, অবশ্যই। আচ্ছা ডঃ আলুওয়ালা, ফলকের নকল চুরি করে কার কী লাভ হতে পারে?

ডঃ আলুওয়ালা জবাব দিলেন,–বুঝতে পারছি না। তবে একটা কথা, ওই ফলকটার ছবি কিন্তু এ যাবৎ কোনো বইয়ে দেখিনি। কোথাও কোনো উল্লেখও পাইনি। নেহাত বাবার খেয়াল ছিল, তাই সংগ্রহ করেছিলেন, এবং আমি দেখবার সুযোগ পেয়েছিলুম।

–লন্ডন মিউজিয়ামে যে আসল ফলকটা আছে, কী ভাবে জানলেন?

–খবরের কাগজে পড়ে। পাকিস্তান সরকার ব্রিটিশ সরকারের কাছে যেসব প্রত্নদ্রব্য দাবি করেছেন, তার মধ্যে ওই ফলকটার উল্লেখ ছিল।

–হুম। কষ্ট করে এবং প্রচুর অর্থ ব্যয়ে লন্ডন যাওয়ার চেয়ে আপনার আলমারি থেকে ওটার নকল বাগানো অনেক সোজা হয়েছে।

ডঃ আলুওয়ালার মনে ধরল কথাটা। সায় দিয়ে বললেন,–ঠিক, ঠিক। কিন্তু ওতে এমন কী আছে কে জানে? চোর ইচ্ছে করলে এই ফাইলটাও হাতাতে পারত। এতেও কাগজে আঁকা অবিকল স্কেচ রয়েছে।

কর্নেল হাসলেন। কাগজের স্কেচের চেয়ে ব্রোঞ্জের নকল ফলকটাই কাজে লাগবে মনে হয়েছে কারুর। আপনার এই স্কেচ তো নকলস্য নকল। আপনার ড্রইং ক্ষমতায় সম্ভবত আস্থা নেই ভদ্রলোকের।

–ভদ্রলোক! সে ব্যাটা ভদ্রলোক। নচ্ছার চোর কাহেকা। এখুনি থানায় জানাচ্ছি।

ডঃ আলুওয়ালা উত্তেজিতভাবে ফোনের কাছে গেলেন। ডায়াল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বিরক্ত হয়ে বললেন,–সব সময় এনগেজড়! কলকাতার টেলিফোনকে ভূতে ধরেছে। নাঃ! থানায় গিয়েই সব জানিয়ে আসি। বৈজু আসুক।

এই সময় আমি লক্ষ করলুম কর্নেল টেবিলে রাখা সেই ফাইল থেকে একটুকরো কাগজ তুলে নিয়ে কোটের পকেটে ঢোকালেন। ডঃ আলুওয়ালা টের পেলেন না। আবার ডায়াল করতে ব্যস্ত হয়েছেন। বোঝা যায় থানায় যেতে মন চাইছে না। নেহাত বেঘোরে না পড়লে আজকাল থানায় যেতে কারই বা ইচ্ছে করে!

কিন্তু কর্নেল যা করলেন, তাও যে চুরি! আমি কটমট করে তাকাতেই উনি চোখ টিপে একটু হাসলেন। আমার অস্বস্তি হল। বুড়ো বয়সে কেলেঙ্কারি করবেন যে!

ডঃ আলুওয়ালা আরও কয়েকবার চেষ্টা করার পর থানার লাইন না পেয়ে হাল ছেড়ে দিলেন। তারপর আমাদের কাছে এসে বিমর্ষভাবে বললেন,–দেখুন তো, কী সর্বনাশ হল।

কর্নেল বললেন,–থানায় গিয়ে জানিয়ে দিন এক্ষুনি। আজ আমরা তাহলে উঠি। অনেক মূল্যবান সময় নষ্ট করলুম আপনার।

–মোটই না! ভাগ্যিস আপনারা এসেছিলেন, তাই চুরিটা এত শিগগির ধরা পড়ল। নইলে আমি তো ওই আলমারি এখন খুলতুম না। কিছু টেরও পেতুম না।

কর্নেল ও আমি উঠে দাঁড়ালুম। ডঃ আলুওয়ালা এগিয়ে গিয়ে দরজার পর্দা তুলে ধরলেন। ভদ্রলোক অতি সজ্জন ও কেতাদুরস্ত মানুষ।

আমরা তিনতলা থেকে নেমে আসছি, দোতলার মুখে ডঃ আলুওয়ালার চাকর সেই বৈজুর সঙ্গে দেখা হল। তার হাতে বাজারের থলে। সসম্ভ্রমে একপাশে সরে সে আমাদের সেলাম দিল। কর্নেল তাকে কী যেন জিজ্ঞেস করতে ঠোঁট ফাঁক করলেন। করেই বুজিয়ে নিলেন। বৈজু জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে রইল। কর্নেল গট গট করে নেমে গেলেন, আমি বৈজুর দিকে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাতে তাকাতে তাকে অনুসরণ করলুম।

রাস্তায় আমার গাড়ি দাঁড় করানো ছিল। একটু পরে গাড়িতে যেতে যেতে বললুম,–আপনিও ওই চুরিতে জড়িয়ে পড়বেন নেই–তখন আপনার ওপরই সন্দেহ হবে।

কর্নেল চাপা হেসে বললেন,–চোরের ওপর বাটপাড়িতে দোষ নেই, জয়ন্ত।

–তার মানে?

–ডঃ আলুওয়ালার ব্রোঞ্জের ফলকটাও চুরি করা।

–সে কী! উনি যে বললেন, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ওঁর বাবাকে—

বাধা দিয়ে কর্নেল বললেন,–স্রেফ মিথ্যে। রাখালবাবু সত্যি এক ভদ্রলোককে আসল ফলকের একটা নকল দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই ভদ্রলোকের নাম ডঃ পরমেশ্বর ভট্টাচার্য। তিনি ছিলেন একজন নামকরা প্রত্নবিজ্ঞানী। রাখালবাবুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তার বাড়ি বর্ধমানের এক গ্রামে। অনেক দিন আগে তিনি মারা গেছেন। তার ছেলে শচীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য স্থানীয় স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। এখন রিটায়ার করেছেন। সম্প্রতি মাস দুই আগে তার গ্রামের বাড়ি থেকে রহস্যজনক চুরি হয়েছে। চোর আর কিছু নেয়নি–নিয়ে গেছে শুধু একটা ব্রোঞ্জের ফলক।

–কী কাণ্ড! তা হলে ডঃ আলুওয়ালাই কি এই চুরির পেছনে?

–তা আর বলতে! পুরাতাত্ত্বিক পত্রিকা ‘দা এনসেন্ট ওয়ার্ড’-এ একটা বিশেষ ফলক প্রসঙ্গে ওঁর লেখা প্রবন্ধ পড়েই আমার সন্দেহ জেগেছিল। তাই আজ ওঁর বাড়ি এসেছিলুম। ইচ্ছে করেই নিজের পরিচয় দিয়েছিলুম। ভদ্রলোক অসম্ভব ধূর্ত।

–কিন্তু ওঁর আলমারি ভেঙে ফলকটা চুরি গেছে! নিশ্চয় ব্যাপারটা বেশ ঘোরালো।

কর্নেল হো হো করে হাসলেন। চুরি যায়নি। এক মিথ্যে ঢাকতে আরেক মিথ্যে।

আমি হতভম্ব হয়ে গেলুম। সত্যি, এতক্ষণে একটা জটপাকানো রহস্য সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

.

রাজা হেহয়ের গুপ্তধন

ইলিয়ট রোডে কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে সেদিন দুপুর অব্দি কাটাতে হল আমাকে। কাপের পর কাপ কফি খেলুম এবং অসংখ্য প্রশ্ন করলুম। জবাবে যেটুকু জানলুম, তা আগেই যা জেনেছি তার একচুল বেশি নয়। অর্থাৎ বর্ধমানের এক গ্রামের জনৈক স্কুল শিক্ষক শচীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের বাড়ি থেকে ব্রোঞ্জের ফলক চুরি গেছে। শচীনবাবু কবে এসে কর্নেলকে ধরে ছিলেন। কর্নেল কথা দিয়েছিলেন, চেষ্টা করবেন ফলকের হদিস পেতে। মনে হচ্ছে, পেয়েও গেছেন। ব্যস, এটুকুই।

কর্নেল ডঃ আলুওয়ালার আঁকা সেই স্কেচটার দিকে তাকিয়ে ধ্যানমগ্ন। কয়েকবার প্রশ্ন করে যখন জবাব আর পেলুম না, তখন বললুম,–বেলা হয়ে গেছে। আমি উঠি তাহলে।

কর্নেলের ধ্যান ভাঙল একথায়। বললেন,–আচ্ছা, জয়ন্ত! ফলকের স্কেচে এই চিহ্নটা দেখে কী মনে হচ্ছে তোমার? বাঁদিক থেকে পঞ্চম চিহ্নটা।

তারপর স্কেচটা আমার সামনে এগিয়ে ধরলেন।

হিটাইট ফলক রহস্য ১

দেখে নিয়েই বললুম,–হনুমান ওটা। অবশ্য অনুমানের হনুমানও বলতে পারেন।

কর্নেল হেসে উঠলেন। বললেন, তা হলে ডঃ আলুওয়ালার পাঠোদ্ধারটা দাঁড়াচ্ছে : শস্য অধিকর্তাকে একটি সেরা জাতের হনুমান পাঠানো হল। এই তো? বৎস, হনুমান শস্যের যম। অতএব শস্য অধিকর্তার কাছে হনুমান পাঠিয়ে রসিকতা করেছিল কেউ!

–তা ছাড়া আর কী হতে পারে? ডঃ আলুওয়ালা ওটাকে কীভাবে বলদ ভাবলেন কে জানে! –আচ্ছা জয়ন্ত, ওটাকে ঘোড়া ভাবতে দোষ কী?

–কিন্তু ডঃ আলুওয়ালা তো বললেন, মোহেনজোদাড়োতে ঘোড়ার কোনো মূর্তি পাওয়া যায়নি। বুনো জন্তু-জানোয়ারের মূর্তি আছে। ঘোড়ার মতো উপকারি গৃহপালিত প্রাণীর মূর্তি কেন থাকবে না? তার মানে ঘোড়ার কথা কেউ জানত না। তাই ঘোড়ার চিহ্নই নেই।

–তা বটে। হরাপ্পাতে কুকুর আর মুরগির মূর্তি পর্যন্ত পাওয়া গেছে।

–তা হলে বুঝতেই পারছেন, ওটা ঘোড়া নয়, হনুমান!

–হুম! জয়ন্ত তুমি শুনলে খুশি হবে যে ওখানে হনুমানের ছবিও পাওয়া গেছে।

লাফিয়ে উঠে বললুম,–তবে তো আর কথাই নেই। ওটা হনুমান। বাঁদিক থেকে চতুর্থ চিহ্নটা লক্ষ করুন না! হনুমানটার তাড়া খেয়ে একটা লোক পালাচ্ছে। এই লোকটাই শস্যঅধিকর্তা।

কর্নেল হাসতে-হাসতে বললেন,–শাবাশ জয়ন্ত, শাবাশ! প্রত্নতত্ত্ব দফতর তোমাকে যাতে পুরস্কৃত করেন, তার ব্যবস্থা করা যাবে। কিন্তু মুশকিল কী হয়েছে জানো? ডঃ পরমেশ্বর ভট্টাচার্যও এই ফলকটার পাঠোদ্ধার করেছেন বলে দাবি করেছিলেন। তার অনুবাদ একেবারে আলাদা। তোমাকে দেখাচ্ছি।

বলে কর্নেল উঠে টেবিলের দেরাজ থেকে একটা কালো জীর্ণ নোট বই বের করে আনলেন। নোট বই খুলে বললেন,–ডঃ ভট্টাচার্যের মতে প্রাচীন যুগের ভারতে প্রচলিত খরোষ্ঠী লিপির মতো সিন্ধুলিপি ডানদিক থেকে পড়তে হবে। সেইভাবে পড়ে উনি কী অনুবাদ করেছেন শোনো :

‘… প্রথম চিহ্নের অর্থ : সৌর বৎসরের ষষ্ঠ মাস। সূর্যের চাকার মধ্যে ছটা রেখা থাকায় ওটা হবে ষষ্ঠ মাস। দ্বিতীয় চিহ্নের অর্থ : চন্দ্রের প্রতিপদ। চন্দ্রকলার মধ্যে একটা দাঁড়ি রয়েছে। তৃতীয় চিহ্নের অর্থ : সিন্ধুনদের বাঁকের মধ্যবর্তী ত্রিকোণ ভূমি। চতুর্থ চিহ্নের অর্থ : ঘোড়া। পঞ্চম চিহ্নের অর্থ : মানুষ। ষষ্ঠ চিহ্নের অর্থ : খণ্ডিকৃত কৃষিজমি। সপ্তম চিহ্নের অর্থ : শস্য। অষ্টম চিহ্নের অর্থ : বৃক্ষমূলে প্রোথিত সম্পদ।

কথাগুলি বাক্যের আকারে সাজালে দাঁড়ায় : বৎসরের ষষ্ঠ মাসে চাঁদের প্রথম তিথিতে এক ব্যক্তি ঘোড়া নিয়ে সিন্ধুনদের বাঁকে ত্রিকোণ শস্যক্ষেত্রের সীমানায় এক বিশাল গাছের তলায় ধনসম্পদ পুঁতে রেখেছিল। ..

আমি চমকে উঠে বললুম,–গুপ্তধন! গুপ্তধন!

কর্নেল হাত তুলে আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,–ডঃ ভট্টাচার্যের ডাইরি থেকে পড়ে শোনাচ্ছি। শুনে যাও।

‘… রাখালদাসবাবুর সঙ্গে আমার এ নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। উনি আমার অনুবাদ যথার্থ বলে স্বীকার করেছেন। সিন্ধুনদ এখন মোহেনজোদাড়ো থেকে সামান্য দুরে সরে গেলেও ধ্বংসাবশেষের দু’মাইল দুরে প্রাচীন খাতের চিহ্ন আমরা দুজনেই দেখে এসেছি। অবিকল ওই তৃতীয় চিহ্নের মতো বাঁক দেখেছি। তিনকোণা জমিটার আয়তন আন্দাজ বারো একর। পোড়ো রুক্ষ জমি। ক্ষয়াখবুটে গুল্মে ঢাকা। রাখালদাস বলেছেন, প্রত্নদফতরের কর্তা জন মার্শালকে কথাটা বলবেন এবং ওই জায়গায় মাটি খোঁড়ার কাজ শুরু করা হবে।‘ …

কর্নেল আবার কয়েকটা পাতা উল্টে গিয়ে পড়তে শুরু করলেন :

‘…আমাদের দুর্ভাগ্য। প্রবল বর্ষার জন্য খোঁড়ার কাজ একবছর পিছিয়ে গেল। তা ছাড়া জন মার্শালও বিশেষ উৎসাহ দেখাচ্ছেন না। রাখালদাস বলেছিলেন তাঁর শরীর ইদানীং ভালো যাচ্ছে না। শীঘ্র কলকাতায় ফিরতে চান। …

‘…রাখালদাস কাল চলে গেলেন দেশে। আমি স্টেশনে তাকে ট্রেনে তুলে দিয়ে এসেছি। স্টেশন মাস্টার রামচন্দ্র আলুওয়ালার সঙ্গে অনেকক্ষণ আড্ডা দিলাম। কথায় কথায় ঝোঁকের মুখে ওঁকে ব্রোঞ্জের ফলকটার কথা বলে ফেললাম। কাজটা ঠিক হল কিনা কে জানে! ভদ্রলোক কিন্তু পুরাতত্ত্বের ব্যাপারে খুব উৎসাহী। অনেক খোঁজখবর রাখেন। বললেন, সরকারি দফতরের ব্যাপার স্যাপারই এরকম। ওদের বিশ মাসে বছর। বরং আপনি যদি আমার সাহায্য চান, বলুন। মাটি কাটার লোক জোগাড় করে দেব। আমি বললুম ওখানে বেসরকারি লোককে মাটি কাটতে দেওয়া হবে না। আইনে বাধা আছে। তাই শুনে স্টেশনমাস্টার বললেন, তা হলে রাতে লুকিয়ে মাটি খোঁড়ার ব্যবস্থা করা যায়। আমার হাসি পেল। গুপ্তধনের কথা শুনেই ভদ্রলোক লোভে চঞ্চল হয়ে উঠেছেন। বললুম, তা কি সম্ভব? এক রাতের কাজ নয়। কাজেই ধরা পড়ে যাবার চান্স আছে। আমারও চাকরি যাবে মশাই? এতে মিঃ আলুওয়ালা খুব নিরাশ হলেন।

‘…স্যার জন মার্শালকে কলকাতার অফিসে সব জানিয়ে আবার চিঠি লিখেছিলাম। আজ জবাব এসেছে। উনি এবার স্পষ্ট করে বলেছেন যে আমার পাঠোদ্ধার ভুল। তা ছাড়া ওই বিশেষ চিহ্নটা ঘোড়া নয়। সিন্ধুসভ্যতায় ঘোড়ার কথা অবান্তর। তখন প্রাক-আর্য যুগে ওখানে ঘোড়ার কথা কেউই জানত না। ঘোড়াকে বশ মানানো হয়েছিল মধ্য এশিয়ায়। সে সিন্ধুসভ্যতার যুগের অন্তত দেড় দুই হাজার বছর পরের কথা।

‘…হায়! কীভাবে বোঝাব, আমার অনুবাদ যথার্থ। মার্শাল কেন বুঝতে পারছেন না, এমনও তো হতে পারে, তারও আগে তিব্বত বা চীনে ঘোড়াকে বশ মানানো হয়ে থাকবে এবং কোনো দেশত্যাগী অথবা পলাতক রাজপুরুষ ঘোড়ার পিঠে ধনরত্ন নিয়ে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। মোহেনজোদাড়ো শহরে! তিনিই ধনরত্ন ওইভাবে গুপ্তস্থানে পুঁতে রেখেছিলেন এবং সেই সংবাদ প্রাচীন প্রথামতো একটা ব্রোঞ্জের ফলকে খোদাই করেছিলেন–যাতে তার অবর্তমানে কেউ না কেউ ধনরত্নের সঙ্গতি করতে পারে।

‘… এই অনুমানের কারণ আছে। তিব্বতের মঠে এক পুরোনো পুঁথিতে লেখা আছে : মর্ম অর্থাৎ ব্রহ্মবংশোদ্ভূত রাজা হেহয় এক দুর্যোগের রাতে অশ্বসহ এই মঠে আশ্রয় নেন। তার সঙ্গে প্রচুর ধনরত্ন ছিল। বিবেকবান বৌদ্ধ ধর্মগুরুরা ধনরত্ন ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্বকে এড়িয়ে চলেন। তাই রাজা হেহয়কে পরামর্শ দেন, স্বরাজ্য ব্রহ্মাবর্তে ফিরে গিয়ে আপসে মিটমাট করুন। তা শুনে রাজা হেহয় ক্রুদ্ধ হয়ে মঠ ত্যাগ করেন।

‘…কোথায় গিয়েছিলেন হেহয়? নিশ্চয় মোহেনজোদাড়ো নামে দ্রাবিড় রাজ্যে। আমার ধারণা হেহয় থেকেই হয় কথাটির উদ্ভব। হয় মানে ঘোড়া। পুরাণে হয়গ্রীব অবতারের কথা আছে। সে কি ব্রহ্মবৰ্তরাজ হেহয়েরই উপাখ্যান? সম্ভবত রাজ্যে বিদ্রোহের ফলে হেহয়কে উত্তরে পালাতে হয়েছিল। আশ্রয় না পেয়ে সেখান থেকে তিনি কাশ্মীর ঘুরে দক্ষিণ-পশ্চিমে দ্রাবিড় রাজ্যের রাজধানীতে চলে আসেন। কাশ্মীরে একটি গিরিপথের নাম হোহো।…’

কর্নেল ডাইরিটি বন্ধ করে বললেন, তাহলে দেখা যাচ্ছে ডঃ আলুওয়ালার ফলকচুরির উদ্দেশ্য সম্ভবত নিছক পুরাতত্ত্ব নয়, গুপ্তধন। পৈতৃক নেশার ব্যাপার।

বললুম,–কিন্তু মোহেনজোদাড়ো তো এখন পাকিস্তানে। আর কি সুবিধে করতে পারবেন ডঃ আলুওয়ালা?

কর্নেল গম্ভীর হয়ে বললেন,–জানি না। তবে সম্প্রতি একটা সুযোগ ওঁর সামনে এসেছে। সিমলাচুক্তি অনুসারে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিদের জ্ঞান আদান-প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তারই ভিত্তিতে খুব শিগগিরি ভারত থেকে একদল পুরাতাত্ত্বিক পাকিস্তানে মোহেনজোদাড়ো এবং হরাপ্পা দেখতে যাচ্ছেন। খবরের কাগজের নোক হয়েও এ খবর রাখ না দেখে অবাক লাগছে বৎস!

বললুম,রোজ হাজার হাজার খবর বেরোয়। অত মনে থাকে না।

–তা স্বীকার করছি। … বলে কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। একটু পায়চারি করলেন। তারপর বললেন,–পুরাতাত্ত্বিকদের সঙ্গে একদল সাংবাদিকও যাচ্ছেন শুনেছি। জয়ন্ত, তোমাকে একটা দায়িত্ব দিচ্ছি। তুমি যেভাবে হোক, কর্তৃপক্ষকে রাজি করিয়ে দৈনিক সত্যসেবকের পক্ষ থেকে তোমার নামটা সেই দলে ঢোকাবার ব্যবস্থা করো। আর আমিও চেষ্টা করে দেখি, কোনো ফিকিরে নিজেকে ঢোকাতে পারি।

হাসতে-হাসতে বললুম-খুব সোজা রাস্তা আছে। আপনি তো ইদানীং ন্যাচারালিস্ট বা প্রকৃতিবিজ্ঞানী হয়ে উঠেছেন। দুর্লভ ও বিরলজাতের পাখি প্রজাপতি পোকামাকড় নিয়ে ধানাইপানাই করছেন বিস্তর। বিদেশি কাগজে অনেক প্রবন্ধও লিখে ফেলেছেন। মাকড়সা আর প্রজাপতি সম্পর্কে তো আপনার খুব মাথাব্যথা। কারণ নাকি, দুইয়ের মধ্যে খুনী ও জোচ্চোরদের প্রবৃত্তি আবিষ্কার করে ফেলেছেন। অতএব হে প্রাজ্ঞ ঘুঘু! আপনার অসুবিধেটা কোথায়? বিশেষ করে কেন্দ্রীয় দফতরে দিল্লিওয়ালারা অনেকেই তো আপনার বন্ধু। আপনি …

কর্নেল হাত তুলে থামিয়ে হাসতে বললেন,–যথেষ্ট, যথেষ্ট ডার্লিং। তোমার প্রদর্শিত পথেই আমি এগবো। ….

.

ডঃ আলুওয়ালার অন্তর্ধান

অনেক চেষ্টাচরিত্র করে পাকিস্তানগামী সাংবাদিকদের দলে ঠাই পেলুম। দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে যখন পৌঁছেছি, তখনও কিন্তু কর্নেলের পাত্তা নেই। বিমান ছাড়তে আর পনেরো মিনিট দেরি। উদ্বিগ্ন হয়ে ঘোরাঘুরি করছি, সেই সময় পুরাতাত্ত্বিক পণ্ডিতদের দলটি এসে পৌঁছলেন। পনেরো জন পণ্ডিত এক জায়গায় জুটলে যা হয়। প্রত্যেকের মুখ গম্ভীর হাবভাব দেখে ভয় করে আমার। দু-তিনজন বাদে সবার চুল পাকা। জ্ঞানের তাপেই হয়তো টাক পড়েছে অনেকের মাথায়। কিন্তু কোথায় আমার সেই সুপরিচিত টাক? শুধু টাক থাকলেই চলবে না, দাড়িও চাই।

রাশভারি দলটির মধ্যে দাড়িওয়ালা আছেন, টাকওলাও আছেন। কিন্তু একসঙ্গে দাড়ি ও টাক আছে, এমন কাকেও দেখতে পাচ্ছি না।

তা হলে কর্নেল কি দলে ভিড়তে পারেন নি? ভাবনায় পড়ে গেলুম। আমি খামোকা একা গিয়ে করবোটা কী? তা ছাড়া ওইসব গোরস্থান বা ভূতপেরেতের জায়গায় যাওয়া আমার একেবারে পছন্দসই নয়। নেহাত বুড়ো ঘুঘুমশায়ের টানে এত কাণ্ড করে এখানে হাজির হয়েছি।

মাইকে বিমানযাত্রীদের ডাকাডাকি শুরু হল। সেই সময় ঠাহর করে দেখি, ডঃ আলুওয়ালা ভিড় ঠেলে বেরিয়ে কাকে যেন খুঁজছেন। আমার চোখে চোখ পড়তেই থমকে দাঁড়ালেন। তারপর এগিয়ে এলেন হাসিমুখে,–আরে! জয়ন্তবাবু না? আপনিও কি যাচ্ছেন নাকি ডেলিগেশনের সঙ্গে?

–যাচ্ছি। আপনিও আছেন, তা লিস্টে দেখলুম।… বলে আমি খুব অন্তরঙ্গতা প্রকাশ করলুম।

ডঃ আলুওয়ালা মুখে খুশির ভাব ফুটিয়ে বললেন,–যাকগে মশাই। বাঁচা গেল। আমি গোলমাল ভিড় একদম পছন্দ করি নে। তাতে বুঝতেই পারছেন, আজকাল আমি অনেক জ্ঞানীগুণী লোকেরই ঈর্ষার কারণ হয়েছি। তাই একদম ইচ্ছে করছিল না যেতে। সরকারও ছাড়লেন না, আর শেষ অব্দি দেখলুম, যে বিষয়ে সারাজীবন গবেষণা করছি–সেই বিষয়েই তো এই ডেলিগেশন। তবে তার চাইতে বড় কথা বাল্যস্মৃতি। লারকানা এলাকায় আমার ছেলেবেলা কেটেছে। কাজেই মনের টানও বাজল।

আমি মন দিয়ে ওঁর কথা শুনছিলাম না। কারণ কর্নেল বুড়ো এখনও এসে পৌঁছলেন না। বিমানযাত্রীদের আবার ডাকা হচ্ছিল। ডঃ আলুওয়ালা আমার হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেলেন। সিকিউরিটি পুলিশ ও শুল্ক দপ্তরের লোকেরা পরীক্ষা করছেন। প্রত্যেক যাত্রীকে লাইনে দাঁড়াতে হবে।

পাসপোর্ট ভিসা এবং অন্যান্য আইন কানুনের ব্যাপার সামলে যখন পাকিস্তান এয়ারলাইনসের বিশাল বোয়িং বিমানের সিঁড়ির কাছে পৌঁছলুম, তখনও কর্নেলের পাত্তা নেই।

কোনো গণ্ডগোলে পড়েননি তো? ডেলিগেশনের লিস্টে নাম আছে দেখেছি। অথচ এখনও আসছেন না কেন?

দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করার সুযোগ নেই। ডঃ আলুওয়ালা ঠেলতে ঠেলতে বিমানে চড়িয়ে ছাড়লেন। সিট নম্বর মেলাতে গিয়ে দেখি আমার পাশে ডঃ অনিরুদ্ধ যোশী বলে এক পণ্ডিতের সিট পড়েছে। দুচ্ছাই! বরং কোনো সাংবাদিক পাশে থাকলে জমতো ভালো। মিঃ যোশী গাব্দাগোব্দা প্রকাণ্ড মানুষ। বেঁটে। দাড়িগোঁফ আছে মুখে। অবশ্য টাক নেই। কাঁচাপাকা কোঁচকানো একরাশ চুলে মাথাটা ভর্তি। আমার সঙ্গে তখুনি আলাপ করে নিলেন। ভারি অমায়িক লোক মনে হল। একটু পরেই বিমান ছাড়ার সময় হয়ে গেল। আমি তখন কর্নেলের আশা ছেড়ে দিয়ে ভাগ্যের হাতে নিজেকে সঁপে দিয়েছি।

বিমান ফ্লাই অন রানওয়ে দিয়ে চলতে চলতে ক্রমশ গতি বাড়াল। তারপর মাটি-ছাড়া হল। আজ আবহাওয়া ভারি চমৎকার। সকালের রোদ ঝলমল করছে।

কয়েক মিনিটের মধ্যে দেখি আকাশের এতদূরে পৌঁছেছি যে নীচে সব সমতল দেখাচ্ছে–যেন একখানা চমৎকার কার্পেট পাতা রয়েছে। যা গে! কর্নেল যখন এলেন না, তখন ফলকরহস্য তোলা রইল। অন্য সাংবাদিকরা যে উদ্দেশ্যে যাচ্ছেন, আমিও যখন সাংবাদিক তখন সেই উদ্দেশ্যে পাকিস্তান সফর করে আসি। উপায় কী আর?

লারকানা বিমানবন্দর তিন ঘণ্টার যাত্রা। একটু পরে বিমানে পরিচারিকা স্ন্যাকস্ ও কফি দিতে এলেন। স্ন্যাকসের প্যাকেটের সঙ্গে দেখি একটা চিরকুট। তাতে লেখা আছে : ডার্লিং! ইওর ওল্ড ডাভ ইজ হিয়ার।

ওল্ড ডাভ! বুড়ো ঘুঘু। আমি চঞ্চল চোখে তাকাতেই পরিচারিকা একটু হেসে পিছনে ইশারা করলেন। ঘুরেই ইচ্ছে হল চেঁচিয়ে উঠি–হ্যালো ওল্ড ডাভ।

কিন্তু চেঁচামেচি করা গেল না। দুজনে পরস্পরের দিকে হাসলুম শুধু। ধড়ে প্রাণ এল আমার।

ডঃ যোশী আমার সঙ্গে আলাপ জুড়ে দিলেন। কথায় কথায় জানলুম, ইনি পুণা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক। ছাত্রজীবনে কলকাতায় ছিলেন। বাঙালিদের প্রতি প্রচুর শ্রদ্ধা পোষণ করেন। এক ফাঁকে আমি জিজ্ঞেস করলুম, আচ্ছা, স্যার, সিন্ধুসভ্যতার যুগে কি ঘোড়া ছিল না?

ডঃ যোশী যেন চমকে উঠলেন। বললেন,–ঘোড়া? হঠাৎ ঘোড়ার কথা কেন? তারপর হাসতে থাকলেন। সাংবাদিকের পক্ষে ঘোড়া রোগ খুব সুবিধের নয়।

মনে মনে একটু রাগ হল। কিন্তু মুখে হাসি ফুটিয়ে ফুটিয়ে বললুম,–প্রশ্নটা কি অন্যায়, স্যার?

ডঃ যোশী আমার কাঁধে হাত রেখে সকৌতুক বললেন,–মোটেই না। তবে ইদানীং দেখছি কারুর-কারুর মাথায় সিন্ধুসভ্যতার কাল্পনিক ঘোড়া দৌড়াদৌড়ি করছে।

–তা হলে সিন্ধুঘোটক বলুন!

ডঃ যোশী আরও জোরে হেসে উঠলেন।যা বলেছেন। অবশ্য সিন্ধুঘোটক থাকে অন্য সিন্ধুতে। অর্থাৎ সমুদ্রে। এ সিন্ধু প্রদেশটা নেহাত মাটি দিয়ে তৈরি। তাই মাটির ঘোড়া দু-একটা থাকলেও থাকতে পারত সিন্ধুসভ্যতার যুগে।

–যেমন আমাদের বাঁকুড়ার ঘোড়া। কুটিরশিল্পের খাসা দৃষ্টান্ত।

ডঃ যোশী আমার পাল্টা রসিকতায় খুশি হলেন। বললেন,–রসকষ আছে বলেই আমি সাংবাদিকদের পছন্দ করি।

-স্যার, একটু আগে বললেন, ইদানীং নাকি কারুর কারুর মাথায় … বাধা দিয়ে ডঃ যোশী বললেন,–হা জয়ন্তবাবু। যেমন ধরুন আপনাদের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতত্ত্বের অধ্যাপক ডঃ আলুওয়ালার মাথায় ঘোড়া ঢুকেছে। এর আগে উনি মাথায় বলদ ঢুকিয়েছিলেন। এখন বলছেন, বলদটা আসলে ঘোড়াই হবে। বিশুদ্ধ সংস্কৃতে যাকে বলে কিনা হয়।

–শুনেছি হেহয় থেকে নাকি ‘হয়’।

–অ্যাঁ বলে ডঃ যোশী আমার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। তারপর বললেন,–কোথায় শুনলেন একথা?

বললুম,–এক ভাষাতত্ত্ববিদ পণ্ডিতের কাছে।

–কে তিনি? নাম কী? থাকেন কোথায়? এতক্ষণে মনে হল, ভুল করেছি। মুখ ফসকে গোপন একটা তথ্য বের করে দিয়েছি। অথচ কর্নেল পই পই করে বারণ করেছিলেন। অগত্যা বানিয়ে বললুম,–কলকাতায় ভাষাতত্ত্ববিদ পণ্ডিত ডঃ ভবার্ণব ভট্টাচার্যর কাছে।

–ডঃ ভবার্ণব ভট্টাচার্যর নাম তো শুনিনি!

আমার ভাগ্য ভালো এইসময় পরিচারিকা দ্বিতীয় দফা খাদ্য পরিবেশন করতে এলেন। এটা ব্রেকফাস্ট। ডঃ যোশীকে পেটুক মনে হল। তখুনি স্যান্ডউইচের প্যাকেট খুলে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কিন্তু আড়চোখে লক্ষ করলুম, উনি খেতে খেতে মাঝে মাঝে সন্দেহাকুল দৃষ্টিতে আমাকে দেখে নিচ্ছেন। ব্যাপারটা কেমন যেন লাগল …

কিন্তু আমার পক্ষে স্বস্তির কথা, ডঃ যোশী আর এ প্রসঙ্গে গেলেন না। দেশের রাজনীতি নিয়ে পড়লেন। দেখতে-দেখতে কখন সময় কেটে গেল। আমাদের বিমান লারকানা বিমান, বন্দরের ওপর চক্কর দিতে শুরু করল। নীচে সিন্ধুনদ দেখা যাচ্ছিল। লারকানার পূর্বে সামান্য দূরে সিন্ধুনদ বয়ে চলেছে।

বিমান যখন মাটিতে নামল, তখন সকাল সাড়ে দশটা। পাকিস্তান সরকারের প্রতিনিধি এবং সেখানকার পুরাতাত্ত্বিক পণ্ডিত ভারতীয় প্রতিনিধিদের স্বাগত জানতে অপেক্ষা করছিলেন। পরিচয় ও কোলাকুলি পর্ব সেরে গাড়ি করে শহরের দক্ষিণপ্রান্তে নিরিবিলি এলাকায় একটা স্টার হোটেলে আমাদের নিয়ে যাওয়া হল। দশতলা এই রাজকীয় হোটেলে বিদেশি পর্যটকদের বেশ ভিড় দেখলুম। শীতের শেষ বলে নাকি এখন ভিড়টা কমেছে। মোহেনজোদাড়ো এখান থেকে কিছু দূরে দক্ষিণে সিন্ধুনদের পশ্চিম তীরে রয়েছে। তাই এত পর্যটকদের ভিড়।

এলাকার ভূপ্রকৃতি কেমন যেন রুক্ষ। অবশ্য গাছপালা রয়েছে প্রচুর। তাদের রং কেমন ধূসর। ছোট ছোট পাহাড় আছে অসংখ্য। পাকিস্তান সরকার সিন্ধুনদের জল সেচের কাজে লাগিয়েছেন। ফলে ফসলের ক্ষেত ও গাছপালা অনেকটা শ্ৰী ফুটিয়ে তুলেছে।

কর্নেলের মুখোমুখি হয়েছিলুম হোটেলের লাউঞ্জে। তারপর আশ্বস্ত হয়ে দেখলুম, তাঁর ঘরেই আমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। অর্থাৎ উনিই তদ্বির করে এ ব্যবস্থাটা করে ফেলেছেন। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বাঁচলুম।

ঘরটা দক্ষিণ-পূর্ব কোণে, সাততলায়। কর্নেল দক্ষিণের জানালায় দাঁড়িয়ে ওঁর প্রখ্যাত বাইনোকুলারটি–যা বিরল জাতের পাখির খোঁজে ব্যবহার করেন, চোখে চোখ রেখে বললেন,–হুম! মোহেনজোদাড়ো অস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে।

বললুম,–আপনার মাথা খারাপ! এখান থেকে অনেক মাইল দূরে!

-–ঠিকই! তবে আমরা একটা টিলার মাথায় দশতলা হোটেলের সাততলায় দাঁড়িয়ে আছি। সামনে বরাবর ফঁকা। তুমিও দেখতে পার। তা ছাড়া এই দূরবিনটা খুব শক্তিশালী।

–কাছে গিয়েই দেখব’খন। বিকেল তিনটেয় যাওয়ার প্রোগ্রাম না?

–হুঁ। … বলে কর্নেল বাইনোকুলারে চোখ রেখে আবার যেন মোহেনজোদাড়ো দেখতে থাকলেন। কী বিদঘুঁটে স্বভাব!

বললুম,–এবার আমার প্রশ্নের জবাব দিন।

–বলো ডার্লিং!

–এয়ারপোর্ট পৌঁছতে আপনার দেরি হল কেন?

–পাকিস্তানের দূতাবাসে গিয়েছিলুম এক বন্ধুকে নিয়ে।

–কেন?

–মোহেনজোদাড়োর সরকারি অতিথিশালায় একটা ডাবল বেড ঘর জোগাড় করতে।

–সে কী! ডেলিগেশনের ব্যাপার। এঁদের সঙ্গেই তো থাকা উচিত।

–থাকব না। আমি আগাম ব্যবস্থা সেরে এসেছি।

–আমাদের প্রতিনিধিদের নেতা আপত্তি করবেন না তো?

–ডঃ তিড়কে? মোটেই না। কথা বলে নিয়েছি ওঁর সঙ্গে।

–ডঃ আলুওয়ালার সঙ্গে নিশ্চয় চোখাচোখি হয়েছে আপনার?

–হয়েছে। ভদ্রলোক খাপ্পা হয়ে গেছেন। বিশেষ কথাবার্তাই বললেন না।

–স্কেচ চুরির অভিযোগ করলেন না?

–নাঃ। তো জয়ন্ত, তোমার সঙ্গে ডঃ যোশীর খুব ভাব দেখলুম।

–ভাব জমাতে আমি ওস্তাদ।

–তোমাকে একটা ব্যাপারে সতর্ক করে দিই। ডঃ যোশীর সঙ্গে আর ভাব জমাতে যেও না। বিপদে পড়বে। আমাকেও বিপদে ফেলবে।

–কেন? কেন?

–আপাতত আর কিছু বলব না, ডার্লিং!

জানি, আর হাজার প্রশ্ন করলেও জবাব পাব না, তাই চুপ করে গেলুম। যতক্ষণ কথা বললেন, কর্নেলের চোখে বাইনোকুলার রয়ে গেল। কী দেখছেন অমন করে? আমার অস্বস্তি জাগল। তাই না বলে পারলুম না–এত কী দেখছেন বলুন তো?

কর্নেল বাইনোকুলার আমার হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন,–এবার তুমি দেখ। আমার দেখা শেষ। হয়েছে আপাতত।

–দেখবটা কী? মোহেনজোদাড়ো তো?

–না। এই হোটেলের নীচের রাস্তার যে টিলাটা আছে, সেখানে দেখবে একটা পার্ক। পার্কে একটা গাছের তলায় দাঁড়িয়ে আছেন দুই ভদ্রলোক।

তখনি বাইনোকুলারে চোখ রাখলুম। তারপর চমকে উঠলুম। দুই ভদ্রলোকের একজন হচ্ছেন ডঃ আলুওয়ালা। অন্যজনের গাঁট্টাগোট্টা চেহারা। পেল্লায় গোঁফ আছে মুখে। এই গুঁফো লোকটিকে আমাদের দলে দেখেছি, এতে কোনো ভুল নেই।

কিন্তু ডঃ আলুওয়ালা হোটেলে পৌঁছেই বেরিয়ে গেছেন এবং ওই লোকটির সঙ্গে এতক্ষণ ধরে কী কথা বলছেন? ভারি সন্দেহজনক ব্যাপার।

একটু দেখেই আমার ক্লান্তি লাগল। সরে এলুম। কর্নেল পোশাক বদলাতে ব্যস্ত হয়েছেন। আমি পোশাক বদলে নিলুম। দিল্লিতে ভোরবেলা স্নান করে নিয়েছি। এখানে দেখছি মার্চ মাসেও শীতটা কড়া। বাথরুম থেকে এসে দেখি, চা এসে গেছে। তার সঙ্গে প্রচুর ফল এবং মিষ্টান্নও। আমরা সরকারি অতিথি বলেই এত আদর নিশ্চয়।

কিন্তু কর্নেলের মুখটা গম্ভীর কেন? কাছে যেতেই একটা খাম এগিয়ে দিয়ে বললেন,–ওদের টনক নড়েছে। এই দেখো।

–কাদের?

-–খুলে চিঠিটা পড়ে নাও আগে।

খামের মধ্যে ভাজ করা একটা চিঠি আছে। খামের ওপরে ইংরেজিতে লেখা : ৬৩২ নম্বর স্যুটের অধিবাসীদ্বয়কে।

চিঠি নয়–চিরকুট বলাই উচিত। তাতে ডটপেনে লেখা আছে :’ঘোড়াটা মোগা। ওই নিয়ে রেস লড়তে যেও না। সর্বস্বান্ত হবে।

ইতি–রেসুড়েদের রাজা।‘

আমার হাত কাঁপছিল। কর্নেল চাপা হেসে বললেন, জয়ন্ত কি এতেই ভয় পেয়ে গেলে?

শুকনো হেসে বললুম,মোটেও না। আপনার কথা মতো আমি সঙ্গে আমার রিভলভারটা এনেছি। গুলিও এনেছি প্রচুর। না না–আইন ভেঙে আনিনি। সিকিউরিটির হাতে ধরা পড়তুম। ওদের মেটাল ডিটেক্টর যন্ত্রে ঠিক টের পেয়ে যেত। দিল্লির পাকিস্তানি দূতাবাসে আপনার যেমন বন্ধু আছেন, আমারও কি থাকতে নেই? তবে আমার প্রত্যক্ষ বন্ধু নয়। বন্ধুর বন্ধু আর কী! আর আপনি তো জানেন, সাংবাদিকরা কিছু বিশেষ সুবিধা সব দেশের সরকারের কাছেই পেয়ে থাকেন। অতএব কোনো ঝামেলা হয়নি অনুমতি পেতে।

কর্নেল বললেন,–আমিও সশস্ত্র, জয়ন্ত। আমারও অনুমতি পেতে ঝামেলা হয়নি। বরং আরও অস্ত্র সাহায্য চাইলে পেয়ে যাব।

-বলেন কী!

-এখনই সব বুঝতে পারবে। করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতত্ত্ব বিভাগের সিন্ধুসভ্যতা সংক্রান্ত শাখার প্রধান অধ্যাপক ডঃ আবদুল করিমের আসবার সময় হল। তার সঙ্গে আসছেন সরকারি গোয়েন্দা দফতরের স্থানীয় অধিকর্তা কর্নেল কামাল খাঁ। আমি সব আয়োজন করেই এসেছি।

সব দুর্ভাবনা মুহূর্তে চলে গেল। চা খেতে-খেতে এবার ডঃ যোশীর সঙ্গে আমার বাক্যলাপ প্রসঙ্গটি তুললুম। কর্নেল বিরক্ত হয়ে বললেন, তুমি এখনও বড় ছেলেমানুষ জয়ন্ত! কোন আক্কেলে ‘হেহয়’ কথাটা বললে ওঁকে?

–মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে। কিন্তু ডঃ যোশী আসলে কে?

–এই প্রশ্ন শুনে বুঝতে পারছি, তোমার বুদ্ধি খুলেছে। জয়ন্ত, ওই একই প্রশ্ন আমার মাথাতেও ঘুরছে। কারণ পুণা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা পত্রিকায় ডঃ যোশীর যে ছবি দেখেছিলুম, তাতে মুখে দাড়ি নেই।

–কী মুশকিল। এখন দাড়ি রেখেছেন উনি?

–সেই ছবির মুখে দাড়ি কল্পনা করেছি, কিন্তু মিলছে না।

–তা হলে কি ইনি জাল ডঃ যোশী?

এই সময় ফোন বাজল। কর্নেল ফোন তুলে সাড়া দিলেন এবং চাপা গলায় কী বললেন। তারপর ফোন রেখে হাসিমুখে ঘুরলেন,–জয়ন্ত, ডঃ করিম এবং কামাল খাঁ এসে গেছেন।

তিন মিনিট অপেক্ষার পর ঘণ্টা বাজল। দরজা খুলে দেখি একজন বেঁটে, অন্যজন দৈত্যের মতো বিশাল লোক ঘরে ঢুকে সম্ভাষণ জানালেন। কর্নেলের সঙ্গে কোলাকুলি শেষ হতেই চায় না। তারপর আমার দিকে দুজনে এগোতেই ভয় পেয়ে গেলুম। এই বেঁটে ও লম্বা পর্বতের সামনে আমি একেবারে নেংটি ইঁদুর যে!

কর্নেল বেঁটে ভদ্রলোককে দেখিয়ে বললেন, আমার একসময়কার ঘনিষ্ঠ বন্ধু কর্নেল কামাল খাঁ মিলিটারি জীবনে দুজনেই আফ্রিকা রণাঙ্গনে ছিলুম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়।

মনে হল ওঁরা ব্যস্ত। ঝটপট কাজের কথা শুরু করলেন। কর্নেল কামাল খাঁ ব্রিফকেস্ থেকে একটা ভাঁজ করা ম্যাপ বের করে বিছানায় খুলে ধরলেন। তিনজনে ম্যাপের ওপর ঝুঁকে পড়লেন। তারপর যা সব কথাবার্তা হল, আমি স্পষ্ট কিছু বুঝতে পারলুম না। শুধু টের পেলুম, এতদিনে মোহেনজোদাড়োর ঘোড়া রহস্যের একটা কিনারা হতে চলেছে।

. ওঁরা বিদায় নিয়ে যাওয়ার পর আমরা লাঞ্চ খেতে গেলুম। এই ফ্লোরেও ডাইনিং হল আছে। সেখানে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ভোজ দিচ্ছেন। বক্তৃতাও হল। তারপর অতিথিদের খানাপিনা শেষ হতে পাক্কা একঘণ্টা লেগে গেল।

ঘরে ফিরে কর্নেল বললেন,–জয়ন্ত, ভোজসভায় একটা বিশেষ ব্যাপার কি তোমার চোখে পড়ছে?

–বিশেষ ব্যাপার? না তো।

–ডঃ আলুওয়ালা কিন্তু ভোজসভায় অনুপস্থিত!

–তাই নাকি? লক্ষ করিনি।

–তুমি না সাংবাদিক! সব কিছুতে লক্ষ রাখা তোমার উচিত ডার্লিং!

–তাই বলে আলুওয়ালা পটলওয়ালাদের নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই।

কর্নেল হাসতে-হাসতে বললেন, কিন্তু প্রতিনিধিদলের নেতা ডঃ তিড়কের মাথাব্যথা শুরু হয়েছে। ডঃ আলুওয়ালা ছিলেন ডঃ যোশীর ঘরে। ডঃ যোশী বলেছেন, তাঁর সঙ্গে নাকি কী একটা ব্যাপারে তর্কাতর্কি হয়েছিল। ডঃ আলুওয়ালা রেগেমেগে দুপুর সাড়ে বারোটা নাগাদ জিনিসপত্র নিয়ে বেরিয়ে গেছেন। ডঃ তিড়কে এতে যেমন উদ্বিগ্ন, তেমনি খাপ্পা। ভারতীয় পণ্ডিতের এহেন আচরণ বিদেশে বাঞ্ছুনীয় নয়। যাই হোক, নীচে রিসেপশনের কেউ লক্ষ করেনি কখন উনি বেরিয়ে গেছেন। শুধু লিফটম্যান বলেছে, এক বেঁটে মোটা ভদ্রলোক ব্যাগেজ নিয়ে নেমেছেন। যাক গে, এবার নাটক জমে উঠল মনে হচ্ছে।

ক্লান্তি তো বটেই, বাদশাহী ধরনের একটা অসাধারণ খাওয়ার পর আমার চোখে ঘুম জড়িয়ে আসছিল। শুয়ে পড়লুম। সেই সময় লক্ষ করলুম, কর্নেল একটা ম্যাপ খুলে বসেছেন এবং কী সব চিহ্ন দিচ্ছেন ম্যাপে।

ঘুম ভাঙল কর্নেলেরই ডাকে। ওঠ জয়ন্ত! তিনটে বেজে গেল। আমরা এবার রওনা দেব। ডঃ তিড়কের কাছে বিদায় নেওয়া হয়ে গেছে। আর দেরি করা ঠিক নয়। এখনই কামাল সায়েবের জিপ এসে পড়বে।

দ্রুত জিনিসপত্র গুছিয়ে নিলুম। কিছুক্ষণ পরে ফোনে রিসেপশান থেকে জানাল–জিপ এসে গেছে। আমরা বেরিয়ে পড়লুম। ব্যাগেজ হোটেলের লোকেরা এসে নিয়ে গেল। করিডোরে লিফটের দিকে এগোচ্ছি, টাইমস অফ ইন্ডিয়ার সাংবাদিক মিঃ রঘুনন্দনের সঙ্গে দেখা। বললেন,–এ কী চৌধুরী! কোথায় যাচ্ছ তুমি?

–এত বাদশাহী আরামে থাকা পোষাবে না ভাই! এক চেনা ভদ্রলোকের ওখানে উঠব।

–সে কী!

মিঃ রঘুনন্দন হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইল। আমি দৌড়ে গিয়ে লিফটে ঢুলুম। কর্নেল বললেন,–কী বললে ওঁকে?

বললুম,–এক চেনা ভদ্রলোকের বাসায় যাচ্ছি …

নীচে নেমে গিয়ে জিপে উঠলুম। পাঠান ড্রাইভার জিপে স্টার্ট দিল। রাস্তায় যেতে-যেতে একটা অদ্ভুত বৈষম্য চোখে পড়ছিল। বিশাল চওড়া হাইওয়েতে অজস্র বিলিতি গাড়ি যাতায়াত করছে বটে, উট আর ঘোড়াগাড়ির সংখ্যাও কম নয়। মাথায় পাগড়ি ও পা অব্দি রঙবেরঙের আলখাল্লা পরা মানুষের ভিড়ে বিলিতি পোশাকের মানুষও রয়েছে। সেইসঙ্গে ভেড়ার পাল নিয়েও যাচ্ছে যারা–তারা কসাই না রাখাল বুঝতে পারলুম না।

অদ্ভুত এখানকার ভূপ্রকৃতিও। কখনও চড়াই, কখনও উত্রাই। এই রাস্তার দুধারে মাঝে-মাঝে টানা সবুজ শস্যের মাঠ, কখনও ধু ধু বালিয়াড়ি আদিগন্ত। ন্যাড়া টিলা, আবার কখনও রুক্ষ বাঁজা জমির ওপর বড় বড় পাথর পড়ে রয়েছে। তারপর রাস্তা ক্রমশ নীচের দিকে নেমে গেছে। গাছপালা খুবই কম। তারপর একটানা বাজার। বাজার পেরিয়ে গিয়ে একটা টিলার গায়ে সরকারি গেস্ট হাউস।

গেস্ট হাউসের পুবের বারান্দায় দাঁড়িয়ে কর্নেল বললেন,–ওই হের বৎস! সিন্ধুনদ ও তার তীরবর্তী হাজার-হাজার বছরের পুরোনো ভারতীয় সভ্যতার নিদর্শন সেই মোহেনজোদাড়ো।

কে জানে কেন, অস্বস্তিতে আমার বুক কেঁপে উঠল এতক্ষণে।…

.

মামদো ভূতের কবলে

গেস্ট হাউসটার পরিবেশ এই রুক্ষ মরুসদৃশ জায়গায় একেবারে বিপরীত। সবুজ গাছ ও ফুলে সাজানো। মোহেনজোদাড়ো রয়েছে পূর্বে অনেক নীচে। তার ওধারে সিন্ধুনদের চরগুলো দেখা যাচ্ছে। বারান্দায় চেয়ার পেতে বসে চা খেতে খেতে কর্নেল হঠাৎ বললেন,–ওই দেখো জয়ন্ত, ভারতীয় পণ্ডিত এবং সাংবাদিকদের বাস দুটো দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওঁরা মোহেনজোদাড়ো শহরের রাজপথে হেঁটে যাচ্ছেন।

দেখে নিয়ে বললুম,–আমরা কখন বেরুব?

–সন্ধ্যার একটু আগে। ওঁরা বিদায় নিক, তারপর।

–ওরে বাবা! শুনেছি ভূতের ভয়ে নাকি সন্ধ্যার দিকে ওখানে কেউ ঘেঁষে না।

–তা সত্যি। তবে সরকারি লোকেরাও পাঁচটার পর ওখানে কাউকে যেতে দেয় না।

–আমরা কীভাবে যাব তা হলে?

–আমরা আপাতত অন্য এলাকায় যাব।

এরপর কর্নেল মোহেনজোদাভোর কথা শুরু করলেন। বুঝলুম, বুড়ো ইতিমধ্যে প্রচুর কেতাব পড়ে ফেলেছেন। সিন্ধু সভ্যতার বৈশিষ্ট্য, ইরাকের ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিস নদীর তীরে সুমেরু সভ্যতার সঙ্গে তার সম্পর্ক থেকে শুরু করে আর্যদের ভারতে আগমন এবং দ্রাবিড় জাতির সঙ্গে সংঘর্ষ–সে এক পেল্লায় ইতিহাস শুনিয়ে ছাড়লেন। আমার কান ও মাথা ভো ভো করছিল। সেই সময় ডঃ করিম এবং কর্নেল কামাল খাঁ এসে গেলেন। বাঁচা গেল এবার।

আরেকবার চা খেয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লুম। তখন প্রায় সাড়ে পাঁচটা বাজে। কিন্তু যথেষ্ট রোদ আছে। কারণ এটা পশ্চিম ভারতের-থুড়ি, পশ্চিম পাকিস্তানের একটি অঞ্চল। কলকাতার সঙ্গে সময়ের তফাত আছে। কলকাতার সূর্যাস্ত যখন, তখনও এখানে সূর্য দিগন্তের অনেকটা উঁচুতে।

আমরা জিপে চেপে চলেছি। বুঝলুম, গন্তব্যস্থান আপাতত ওই ভূতের শহর নয়, সিন্ধুনদের সেই মজে-যাওয়া ত্রিকোণ জায়গা। বুকের মধ্যে কাঁপন শুরু হয়ে গেল।

দক্ষিণে মাইল দুই এগিয়ে ন্যাড়া এবং পাথরভর্তি জমি এবং টিলাগুলোর মধ্যে একস্থানে জিপ দাঁড়াল। সবাই নামলুম। আগে আগে চললেন ডঃ করিম। উনি পথপ্রদর্শক।

এবার আমরা পুবের দিকে চলেছি। রাস্তাঘাট নেই কোথাও। কাঁটাঝোঁপ আর পাথুরে জমি। কিছুটা এগিয়ে দুরে আবার সিন্ধুনদ চোখে পড়ল। আমরা যেখানে দাঁড়ালুম, তার নীচে গভীর এবং চওড়া খাদ উত্তর থেকে এসে বাঁক নিয়ে পুবে এগিয়ে গেছে। কর্নেল বলে উঠলেন,–এটাই কি সেই প্রাচীন সিন্ধুনদের গতিপথ?

ডঃ করিম বললেন,–হ্যাঁ। আমাদের এই খাদ পেরিয়ে ওপারে উঠতে হবে।

পাথরে পা রেখে সাবধানে চারজনে নামতে শুরু করলুম। তিনশ ফুট নীচে খাদে অন্ধকার জমে গেছে ইতিমধ্যে।

খাদ থেকে ওপারে ওঠাটা ভারি কষ্টকর। কিন্তু তিনজন বয়স্ক মানুষ–বিশেষ করে একজন তো পঁয়ষট্টি বছরের বুড়ো, অর্থাৎ কর্নেল নীলাদ্রি সরকার–ওঁরা যখন পারছেন, জোয়ান হয়ে আমার না পারার কারণ নেই।

ওপরে উঠে ঢালু সমতল ত্রিকোণ জমিটায় যখন পৌঁছলুম, তখন প্রচণ্ড হাঁফাচ্ছি।

ডঃ করিম বললেন,–আসুন, কিছুক্ষণ বিশ্রাম করা যাক। এখনও কিছুটা দেরি আছে।

সবাই শুকনো ঘাসে বসে পড়লুম। জানতে চাইলুম কীসের দেরি।

–চাঁদ ওঠার। জবাবটা কর্নেল দিলেন। জয়ন্ত, প্রথম চাঁদ কিন্তু! প্রতিপদে চাঁদ দেখা যায় না। আজ দ্বিতীয়া।

–তা চাঁদের সঙ্গে কী সম্পর্ক?

–ফলকের সংকেতের কথা কি ভুলে গেছ জয়ন্ত?

-–তাই বলুন। কিন্তু চাঁদ উঠলে হবেটা কী শুনি?

ডঃ করিম হাসতে হাসতে বললেন,–জয়ন্তবাবু সাংবাদিক মানুষ। কাজেই এত কৌতূহলী। তবে অপেক্ষা করুন। কিছুক্ষণ পরেই সব বুঝতে পারবেন।

দিনের আলো ক্রমশ কমে আসছিল। ওঁরা চাপা গলায় কীসব আলোচনা করছিলেন! কান দিলুম না। আমি একটু কল্পনাপ্রবণ হয়ে পড়েছিলুম। আজ থেকে অন্তত পাঁচ হাজার বছর আগে এখানে শস্যক্ষেত্র ছিল। ব্রহ্মাবর্তরাজ হেহয় রাজ্যচ্যুত হয়ে এদেশে সেদেশে ঘুরতে ঘুরতে ঘোড়ার পিঠে চেপে যখন এখানে পৌঁছলেন, তখন সবে চাঁদ উঠেছে। একফালি ক্ষীণ চাঁদ। ধনরত্ন লুকিয়ে রাখতে এসেছেন এই নির্জন শস্যক্ষেত্রে। কারণ কখন ওই ধনের লোভে তাকে দস্যুরা মেরে ফেলবে বলা যায় না।

কল্পনার চোখে দেখতে থাকলুম দৃশ্যটা। নির্জন নিঝুম, অন্ধকার ঘনিয়ে ওঠা এই মাঠে ওই যেন একটা ঘোড়ার লাগাম ধরে এগিয়ে আসছে একটা মানুষ! তারপর …

আচমকা আমার কল্পনা ছত্রখান হয়ে গেল। কোত্থেকে কে বা কারা গুলিবৃষ্টি শুরু করল মুহুর্মুহু। সঙ্গে-সঙ্গে আমরা উবুড় হয়ে শুয়ে পড়লুম। কর্নেল কামাল খাঁর চিৎকার শুনলুম।লুকিয়ে পড়ুন, লুকিয়ে পড়ুন! পাথরের আড়ালে চলে যান সবাই!

এখানে ওখানে পাথরের মস্ত চাই রয়েছে। তখন অন্ধকার কিছুটা ঘন হয়েছে। ঝোঁপঝাড় ও শুকনো ঘাসে প্রায় সাপের মতো বুকে হেঁটে যে-যেখানে পারলুম। আত্মরক্ষা করতে ব্যস্ত হলুম। একটা উঁচু পাথরের আড়ালে পৌঁছে মাথা তুললুম। আবার এক ঝাঁক গুলি এসে পড়ল। মুখ গুঁজে মড়ার মতো পড়ে রইলুম।

তারপর সব চুপচাপ।

তারপর জোরালো টর্চের আলো ছড়িয়ে এল। সঙ্গে সঙ্গে মনে হল আমাদের দলের কেউ আলো লক্ষ করে গুলি ছুঁড়লেন। আলো নিভে গেল।

এতক্ষণে আমার মনে পড়ল, আসার সময় রিভলভারটা নিতে ভুলে গেছি! নিজেকে অসহায় মনে হল। ঘটনার আকস্মিকতায় আমাদের দলটা ছত্রভঙ্গ হয়ে কে কোথায় ছিটকে পড়েছি বোঝা যাচ্ছে না। পাথরটা উঁচু এবং প্রকাণ্ড। এপাশ-ওপাশ সাবধানে ঘুরে আবছা অন্ধকারে কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছি।

একটু পরে সম্ভবত পিছনে খাদের দিক থেকে কর্নেল কামাল খাঁর ডাক শোনা গেল–জয়ন্তবাবু! জয়ন্তবাবু!

সাড়া দিয়ে বললুম,–আমি এখানে!

সঙ্গে সঙ্গে আমার সামনের পাথরে এক ঝাঁক গুলি এসে পড়ল। স্পিনটারের ফুলকি আর পাথরের টুকরো ছিটকে পড়তে থাকল। আবার ঘাড় গুঁজে মড়ার মতো পড়ে রইলুম।

গুলি ছোঁড়া বন্ধ করল ওরা। কতক্ষণ চুপচাপ থাকার পর মুখ তুলে দেখি, অন্ধকার ঘন হয়েছে। কারুর কোনো সাড়া নেই। চেঁচিয়ে কর্নেলকে ডাকব ভাবলুম। কিন্তু আবার যদি ওরা গুলি ছোঁড়ে, সেই ভয়ে চুপ করে গেলুম।

কিন্তু ওরা কারা? যারাই হোক, অন্তত এটুকু বুঝতে পারছি এখানে আমাদের এসে পড়াটা ওদের পছন্দ হয়নি।

ঘাড় ঘুরিয়ে এ সময় চোখে পড়ল, পিছনে দক্ষিণ-পশ্চিম আকাশের দিগন্তে একফালি ক্ষীণ চাঁদ জেগে আছে। এখনই ওই চাঁদ অস্ত যাবে। পাঁচ হাজার বছর আগে এখানে ঠিক এই সময়ে যে নাটক শুরু হয়েছিল, আজ এতকাল পরে কি তারই শেষ দৃশ্য অভিনীত হচ্ছে?

কিন্তু আর এভাবে থাকা যায় না। আস্তে আস্তে গিরগিটির মতো লম্বা হয়ে পিছিয়ে গেলুম। যে ভাবেই হোক, খাদে গিয়ে নামতে হবে। সম্ভবত দুই কর্নেল এবং ডঃ করিম খাদেই নেমে গেছেন এবং আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। একবার নীচে থেকে আবছা ডাকও যেন শুনলুম।

কতক্ষণ ওইভাবে পিছু হটে এগিয়েছি হিসাব নেই। এক সময় দেখি, উঁচু উঁচু পাথরের মধ্যে এসে পৌঁছেছি। মনে পড়ল, খাদের কিনারায় এমনি উঁচু পাথরের সারি ছিল বটে। এবার হামাগুড়ি দিয়ে সোজা এগোলুম। কিন্তু হঠাৎ পা পিছলে গেল এবং গড়াতে গড়াতে নীচের দিকে পড়তে থাকলুম।

ক্রমাগত পাথরে ধাক্কা খেতে-খেতে হাড়গোড় ভেঙে যাবার দাখিল। আঁকড়ে ধরার মতো কিছু পাচ্ছি না। শুধু মসৃণ পাথর। তারপর গিয়ে পড়লুম বালির গাদায়। আঘাতটা জোর হল না। বুঝলুম, খাদের তলায় বালির চড়ায় এসে পড়েছি।

চিত হয়ে কতক্ষণ আচ্ছন্নভাবে পড়ে থালুম।

হঠাৎ কী একটা খসখস শব্দ হল। তারপর বিশ্রী দুর্গন্ধ টের পেলুম। নিশ্চয় কোনো হিংস্র জন্তু-বাঘ কিংবা নেকড়ে। শুনেছি এদেশের পাহাড়ি এলাকায় নেকড়েরা দলে-দলে ঘুরে বেড়ায়। আতঙ্কে আবার কাঁপুনি শুরু হল।

একটু পরে মনে হল যে খসখস শব্দটা শুনেছিলুম, সেটা ক্রমশ কাছে এগিয়ে আসছে। দুর্গন্ধে বমি এসে যাচ্ছে। নাকে রুমাল চাপা দেব ভেবে যেই প্যান্টের পকেটে হাত ঢোকাতে গেছি, অমনি কী একটা প্রাণী আমার হাত ধরে ফেলল।

হাত ছাড়িয়ে নিতে গিয়ে বুঝলুম, প্রাণীটার গায়ে অসম্ভব শক্তি। সে এক হ্যাঁচকা টানে আমাকে বালির ওপর টানতে শুরু করল।

এবার টের পেলুম, প্রাণীটার মানুষের মতো হাত আছে। সেই হাত আমার কব্জি সাঁড়াশির মতো ধরেছে। পরক্ষণে সে আচমকা পিলে চমকানো হাসি হেসে উঠল–হিঁ-হিঁ হিঁ-হিঁ-হিঁ-হিঁ!

ওরে বাবা! এ যে ভূতুড়ে হাসি! তা হলে এ কার পাল্লায় আমি পড়েছি? চেঁচিয়ে ওঁদের ডাকব ভাবলুম, কিন্তু গলা দিয়ে শুধু গোঁ গোঁ আওয়াজ হল। তারপর দেখি, সেই ভূতুড়ে প্রাণীটা দুহাতে আমাকে শূন্যে তুলে নিয়েছে এবং দৌড়তে শুরু করেছে। বিকট গন্ধে নাড়িভুড়ি উগরে আসছে।

তারপর আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললুম।…

.

রাজা হেহয়ের শিলালিপি

যখন জ্ঞান হল, কয়েক মুহূর্ত কিছু বুঝতে পারলুম না কোথায় আছি এবং কী ঘটেছে। তারপর সব মনে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসলুম। সর্বাঙ্গে ব্যথা করছে।

সামনে একটা পিদিম জ্বলছে। সেই আলোয় যা দেখা গেল, বুঝলুম আমি একটা গুহার মধ্যে আছি। পিদিম জ্বলছে একটা পাথরের বেদির ওপর। মাটির পিদিম আর বেদির পাশে এক বুড়ো জটাজুটধারী লম্বাচওড়া দাড়িওয়ালা ফকির চোখ বুজে সম্ভবত ধ্যান করছেন। তার গলায় কয়েকটা রঙিন পাথরের মালা।

তখন মুহূর্তেই আতঙ্ক ঘুচে গেল। ডাকলুম,–ফকিরসায়েব!

ফকিরসায়েব! ফকির চোখ খুললেন এবং ঘুরে আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন। বললুম,–আমাকে এখানে কে আনল ফকিরসায়েব?

ফকির ইশারায় কাছে ডাকলেন। গুহার ছাদটা নিচু। দাঁড়ালে মাথা ঠেকে যাবে। প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে কাছে গেলুম। তখন ফকির আমাকে অবাক করে পরিষ্কার বাংলায় বলে উঠলেন, তুমি কে বাবা?

–এ কী! আপনি বাঙালি?

–হ্যাঁ বাবা, আমি বাঙালি। কিন্তু তুমি কি কোনো পর্যটক? মোহেনজোদাড়ো দেখতে এসেছিলে?

–হ্যাঁ ফকিরসায়েব। কিন্তু আপনি …।

ফকির একটু হেসে বললেন,–দেখতেই তো পাচ্ছ আমি সংসারত্যাগী ফকির। এই গুহায় সাধনভজন করি। এটাই আমার আস্তানা। কিন্তু তুমি কেমন করে ওই নচ্ছারটার পাল্লায় পড়লে? ভাগ্যিস, ওই সময় একবার বেরিয়েছিলুম। আমার সামনে পড়তেই ব্যাটা তোমাকে ফেলে দিয়ে পালিয়ে গেল। আমি তখন নিয়ে এলুম তোমাকে।

–কে ও? ভূত, না মানুষ?

ফকির আবার হেসে ফেললেন। –ও ব্যাটাকে ভূতও বলতে পার মানুষও বলতে পার। ও একটা ভূত-মানুষ।

–তার মানে কী ফকিরসায়েব?

–মানে? মানে কী আমিও জানি ছাই? এই গুহায় জুটেছি আজ প্রায় দুবছর। প্রথম প্রথম অমাকে খুব ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। তারপর আমিই ওকে ভয় পাইয়ে দিলুম। আমার এই ফকিরি চিমটে ঝনঝন করে বাজালেই ব্যাটা পড়ি-কী-মরি করে পালিয়ে যায়। তবে একথা ঠিক, ওকে দিনে একবারও দেখিনি! তা হলে ও আসলে কে, ঠিকই বুঝতে পারতুম। ব্যাটা সন্ধ্যার পর বেরিয়ে পড়ে। এই খাদেই ওর গতিবিধি। তবে একবার ফুটফুটে চাঁদের আলোয় সামনা-সামনি দেখেছিলুম। ও মানুষের মতো দু-পায়েও হাঁটে। অসম্ভব জোরে দৌড়াতে পারে। আর ওর একটা বিদঘুঁটে অভ্যাস। মাঝে মাঝে ঘোড়ার মতো চিহি করে ওঠে। মনে হবে, ওটা ওর হাসি। কিন্তু মোটেও তা নয়। ব্যাটা নিজেকে হয়তো ঘোড়া ভাবে।

ফকিরের এসব কথা শুনে আমি তো হতভম্ব। বললুম,–এবার আপনার কথা বলুন।

–আমার কথা কী বলব বাবা? বললুমই তো, আমি সংসারত্যাগী মানুষ।

–কিন্তু আপনি বাঙালি বলেই আমার সব কিছু জানতে ইচ্ছে করছে।

–জেনে কী হবে? তার চেয়ে এখন তোমার বিশ্রাম জরুরি। এ গরিবের আখড়ায় তোমার খুব কষ্ট হবে, জানি। কিন্তু উপায় কী? অল্প কিছু ফল আছে। খেয়ে নাও। কুঁজোয় জল আছে। খেয়েদের শুয়ে পড়ো। কম্বলও পাবে।

–জায়গাটা কোথায় বলুন! আমি বরং ট্যুরিস্ট লজে ফিরে যাব তা হলে।

–সর্বনাশ! সর্বনাশ। খবর্দার বাবা, এখন গুহা থেকে বেরুলেই বিপদে পড়বে।

–কেন বলুন তো?

ফকির গম্ভীর হয়ে বললেন, সম্প্রতি কিছুকাল থেকে গুণ্ডাপ্রকৃতির কিছু লোক ওপরের দিকে একটা গুহায় আস্তানা গেড়েছে। তাদের কাছে প্রচুর গুলিবারুদ অস্ত্রশস্ত্রও আছে। মাঝে-মাঝে দেখি, তারা এখানে-ওখানে মাটি খোঁড়াখুড়ি করছে। পাথরের আড়াল থেকে ওদের গতিবিধি লক্ষ করেছি। আমার ধারণা, ওরা গুপ্তধন খুঁজছে। যদি বৈদাৎ ওদের পাল্লায় পড়ে যাও, খুন হয়ে যাবে। কারণ ওদের খরব কেউ জানুক, এটা ওরা চায় না। একদিন আমি তো গুলিতে মরতে-মরতে বেঁচে গেছি। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, আমার এই আস্তানার খবর ওরা জানে না।

আজ সন্ধ্যায় যা ঘটেছে, ফকিরকে বলব ভাবলুম। পরে মনে হল, কী দরকার? ফকির হয়তো আরও ভয় পেয়ে যাবেন এবং আমাকে পাল্টা আরেকটা গুপ্তধন সন্ধানী দলের লোক ভেবে বসবেন।

বললুম,–অন্তত একটা কথার জবাব দিন। এই গুহাটা ট্যুরিস্ট লজ থেকে কত দূরে?

–তা মাইল পাঁচেকের বেশি তো হবেই। তবে গুহাটা খাদের ধারেই। একবার বেরিয়ে গেলে কিন্তু আর খুঁজে এখানে ঢোকা মুশকিল। এটাই এ গুহার মজা!

–কেন?

–সে স্বচক্ষে সকালে দেখবে’খন। এটা একটা গোলকধাঁধার মতো। খাদের পাশে দেওয়ালের মতো এবড়োখেবড়ো পাথরে অজস্র ফাটল আছে। কোন ফাটল দিয়ে ঢুকলে এ গুহায় পৌঁছানো যাবে, বোঝা মুশকিল। আমারও মাঝে-মাঝে গণ্ডগোল হয়ে যায়। বিশেষ করে রাতের বেলা। ভুল ফাটলের মধ্যে ঢুকে হয়রান হই। প্রত্যেকটা ফাটলই তলায়-তলায় সুড়ঙ্গের মতো গলিখুঁজি ঘরে গিয়ে শেষ হয়েছে। শুধু একটা ফাটলের পথ এ গুহায় পৌঁছেছে। সেই ফাটলে অবশ্য একটা চিহ্ন দিয়ে রেখেছি। অন্যের চোখে পড়া মুশকিল। ওটা শুধু আমিই চিনতে পারি।… বলে ফকির বেদির ওপর রাখা একটা ঝোলা থেকে দুটো আপেল বের করলেন। তারপর বললেন,–নাও। খেয়ে ফেলল। অনেক রাত হয়েছে। আমার এখন ধ্যানে বসার সময়। দয়া করে আর আমাকে ডাকাডাকি কোরো না। আর এই কম্বলটা রইল। গুহার মধ্যে শীত তত টের পাবে না। শুয়ে পড়বে চুপচাপ।

কী আর করি, একটা আপেলে কামড় বসালুম। খিদেয় পেট চোর্চো করছে। মাটির কুঁজো থেকে জলও খেলুম। তারপর নগ্ন পাথরের মেঝেয় শুয়ে পড়লুম। কম্বলটা দরকার হল না। ওই একটা মোটা কম্বল। ফকিরের কম্বলে আর ভাগ বসাই কেন? ফকির আবার চোখ বুজে ধ্যানস্থ হয়েছেন ততক্ষণে।

যাক গে, রাতের আশ্রয় পেয়েছি এবং মামদো ভূতের–উঁহু, ঘোড়াভূতের হাত থেকে বেঁচে গেছি, এই পরম সৌভাগ্য।

হঠাৎ মনে পড়ল, কর্নেল বলেছিলেন মোহেনজোদাড়োর ঘোড়াভূতের কথা। তা হলে তো এই সেই ঘোড়াভূত! ওর বিকট হাসির মতো হি হি করে ওঠাটা এখনও কানে ভাসছে।

কিন্তু কে ও? বেঁচেবর্তে ট্যুরিস্ট লজে ফিরতে পারলে কর্নেলকে সব জানাতে হবে। তারপর এই রহস্যের কিনারা করতেই হবে।

এইসব ভাবতে-ভাবতে আর ঘুমই এল না। তার ওপর সারা শরীরে ব্যথা। কেটে ছড়ে গেছে অনেক জায়গায়। জ্বরজ্বালা না এলে বাঁচি। একটু পরে পাশ ফিরে দেখলুম ফকির একইভাবে ধ্যানস্থ। পাশ দিয়ে বেদিটা দেখা যাচ্ছে।

বেদিটার কিছু অংশে আলো পড়েছে। হঠাৎ চমকে উঠে দেখলুম বেদির গায়ে অজস্র খোদাই করা চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। অবিকল সিন্ধুলিপির মতো।

মতোই বা বলছি কেন? এখানে সিন্ধুলিপিই তো স্বাভাবিক। তা হলে এই বেদিটা নিশ্চয় সিন্ধুসভ্যতার সমকালীন।

চঞ্চল হয়ে উঠলুম। তা হলে তো আমি এযাবৎ অনাবিষ্কৃত একটা প্রাচীন নিদর্শন আবিষ্কার করে ফেলেছি?

কিন্তু ওই বেদিটা কীসের? নিছক পুজো-আচ্চার বেদি-নাকি ওটা একটা কবর? সিন্ধুসভ্যতার কবরও পাওয়া গেছে অনেকগুলো। তখন যেমন মড়া পোড়ানো হত, তেমনি কবরও দেওয়া হত। হরপ্পাতে কয়েকটা কঙ্কালও পাওয়া গেছে। মাটির জালায় সেগুলো ঠেসে ভরা ছিল। কর্নেলের কাছেই তো শুনেছি এসব কথা।

সাবধানে মুখটা একটু বাড়িয়ে লিপিগুলো ভালো করে দেখার চেষ্টা করলুম। তারপর আবার চমকে উঠলুম।

এ কী দেখছি? ডঃ আলুওয়ালার যে ফলকের স্কেচ কর্নেল হাতিয়ে ছিলেন এবং ডঃ ভট্টাচার্য যে ফলকের পাঠোদ্ধার করেছিলেন, তার সঙ্গে বেদির গায়ের খোদাই করা লিপিগুলোর হুবহু মিল রয়েছে।

সেই ফলকের চিত্রলিপিগুলো আমার স্পষ্ট মনে আছে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলুম। না। অবিকল সেই বলদ অথবা হনুমান অথবা ঘোড়া এবং মানুষটাও রয়েছে যে!

তা হলে কি এই বেদির তলায় …

আর ভাবতে পারলুম না। আনন্দে উত্তেজনায় চঞ্চল হয়ে উঠলুম। যেভাবেই হোক, এই গুহায় ঢোকার পথটা সকালে যাবার সময় ফকিরের অজান্তে চিহ্নিত করে রাখব।

তারপর আর সময় কাটতেই চায় না। ফকির ধ্যানমগ্ন। নিস্তব্ধ গুহা ছমছম করছে।

তারপর কখন ঘুমিয়ে গেছি।

ফকিরের ডাকে ঘুম ভাঙলে তাকিয়ে দেখি মাথার ওপর একটা ফাটল দিয়ে সূর্যরশ্মি এসে গুহায় ঢুকেছে। গুহার ভেতর অন্ধকার নেই।

উঠতে গিয়ে টের পেলুম, এবার হেঁটে অতখানি পথ যাওয়া ভারি কষ্টকর হবে। কিন্তু উপায় নেই।

ফকির সস্নেহে জিজ্ঞেস করলেন,–শরীর কেমন বাবা? হেঁটে যেতে পারবে তো?

একটু হেসে বললুম,–দেখা যাক।

–যদি না পার, থেকে যাও। তোমার সেবাযত্নের ত্রুটি হবে না।

–না ফকিরসায়েব, আমাকে যেতেই হবে।

–তা হলে এসো।

ফকিরের সাহায্যে আস্তে-আস্তে উঠে বসলুম। নিচু খাদ। ফকির আগে, আমি পেছনে সাবধানে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে চলতে থাকলুম।

সত্যি এ একটা গোলকধাঁধা। ঘুরে-ঘুরে পথটা অন্ধকারে এগিয়েছে। আমি বাঁকগুলো গুনতে থাকলুম। নটা বাঁকের পর অন্ধকার ঘুচল। কিন্তু টের পেয়ে গেছি, এই সুড়ঙ্গ পথের আরও অনেক শাখাপথ আছে। তবে সেই পথগুলো আরও ঘুপটি। কাজেই ভুল হবার চান্স নেই।

আবছা আলোর মধ্যে চলার সময় হাত বাড়িয়ে ফকিরের অজান্তে একটুকরো পাথর কুড়িয়ে নিলুম। কিছুক্ষণ পরে ফাটলের মুখে পৌঁছনো গেল। ফকির বেরিয়ে গিয়ে ডাকলেন–এসো বাবা!

সেই সময় দ্রুত পাথরের টুকরোটা দিয়ে ফাটলের নীচে একটা বর্গমূল নির্ণয়ের চিহ্নের মতো চিহ্ন দিলুম।

ফাটলটা মোটে ফুট দেড়েক চওড়া, কিন্তু অনেকখানি লম্বা। অতিকষ্টে বেরিয়ে গিয়ে দেখি, সেই খাদে পৌঁছেছি। খাদটা বালি আর পাথরে ভর্তি। দুধারে খাড়া পাথরের দেওয়াল। ফকির ফের জিজ্ঞেস করলেন,–কষ্ট হচ্ছে কি হাঁটতে?

বললুম,–না।

–আমি কিন্তু বেশি দূর যেতে পারব না। তোমাকে মোহেনজোদাড়ের প্রটেক্টেড এরিয়ার কাছে পোঁছে দিয়ে আসব।

ফকিরের মুখে ইংরেজি শব্দটা শুনে চমকে উঠলাম। উচ্চারণও নিখুঁত। তা হলে কে এই ফকির? বললুম,–আপনি নিজের কোনো পরিচয়ই দিলেন না ফকিরসায়েব।

ফকির একটু হেসে বললেন,–কী হবে পরিচয় জেনে? পরিচয় বলতে আজ আর কি আছে আমার? ঈশ্বরের ধ্যানে কাটাচ্ছি। যেকটা দিন বাঁচব ঈশ্বরের ধ্যানেই কাটাব। বাবা, আমার মতো পাপী আর কে আছে? এ সেই পাপেরই প্রায়শ্চিত্ত!

–পাপী কেন বলছেন আপনি?

–হ্যাঁ বাবা, আমি মহাপাপী। একদিন আমিও মোহেনজোদাড়োর গুপ্তধনের লোভে পাগল হয়ে উঠেছিলুম। গুপ্তধনের লোভ বড় সাংঘাতিক বাবা! এই লোভেই আমার এক প্রাণের বন্ধুকে খুন করেছিলুম!

বলে ফকির দু-হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। আমি হতবাক।

পরক্ষণেই উনি সংযত হয়ে চোখ মুছলেন জোব্বায়। তারপর বললেন,–চলো বাবা! এখনও অনেকটা পথ যেতে হবে।

বাকি পথ আমরা দুজনেই চুপচাপ এলুম। মাইলখানেক চলার পর দেখা গেল, একখানে খাদের দুধারেই ঝোঁপঝাঁপ গাছপালা দেখা যাচ্ছে। পাথরও বিশেষ নেই। দুধারে পাড় অনেক ঢালু। ফকির বললেন,–বাঁ পাড়ে উঠে গেলেই আশা করি চিনতে পারবে।

আমি কৃতজ্ঞতায় ওঁর পা ছুঁয়ে প্রণাম করে এগিয়ে গেলুম। এক সময় পাড়ে উঠে পিছু ফিরে দেখি ফকির দ্রুত চলেছেন খাদের পথে। একবারও ওঁকে পিছু ফিরতে দেখলুম। না। কিন্তু কে এই ফকির? …

.

ঘোড়াভূত ও ডঃ আলুওয়ালা

টুরিস্ট ম্যানেজার ইকবাল খাঁ আমাকে দেখেই দৌড়ে এলেন। বললেন,–কী ব্যাপার মিঃ চৌধুরী? আপনার এ দশা কেন? কোথায় ছিলেন সারারাত? আমরা তো ভেবেই অস্থির। আপনার কর্নেল সাহেব আবার সকালে আপনাকে খুঁজতে বেরিয়েছেন। ডঃ করিম আর কর্নেল কামালও গেছেন একদল মিলিটারি নিয়ে।

–মিলিটারি নিয়ে? সে কী?

ইকবাল খাঁ হাসলেন। এ দেশে মিলিটারি ছাড়া দুশমনদের জব্দ করা যায় না মিঃ চৌধুরী। আমরা কথায় কথায় মিলিটারির সাহায্য নিই। যাকগে, ঝটপট পোশাক বদলান। আমি খবর পাঠাই ওঁদের।

আমাদের ঘরের ডুপ্লিকেট চাবি ওঁর কাছে রয়েছে। দরজা খুলে দিলেন। বেয়ারা হুকুমের অপেক্ষায় সেলাম দিয়ে দাঁড়ালে বললুম,–আপাতত এককাপ কড়া কফি ছাড়া আর কিছু দরকার হবে না।

–ব্রেকফাস্ট খাবেন না স্যার?

–ওঁরা ফিরে আসুন, তারপর।

বেয়ারা চলে গেল। একটা এনার্জি ট্যাবলেট বের করে খেয়ে ফেললুম। তারপর বাথরুমে পোশাক ছাড়লুম। স্নান করে এসে দেখি, কফি রেডি।

জানালার কাছে বসে কফি খেতে খেতে মোহেনজোদাড়ো শহরের দিকে তাকিয়ে রইলুম। কী বিচিত্র মানুষের অতীত ইতিহাস!

অনেকক্ষণ পরে বাইরে জিপের শব্দ হল। তারপর দুমদাম জুতোর শব্দ শোনা গেল বারান্দায়। প্রথমে ঢুকলেন কর্নেল কামাল খাঁ। দৈত্যাকৃতি পাঠান ভদ্রলোক এক লাফে এগিয়ে আমাকে প্রায় শুন্যে তুলে ফেললেন। মুখে শুধু-হ্যাল্লো, হ্যাল্লো!

ডঃ করিম বললেন,–তবিয়ত ঠিক আছে তো জয়ন্তবাবু?

বললুম,–হাঁ, ঠিক আছে।

আমার বৃদ্ধ বন্ধু টাকে হাত বুলোচ্ছেন এবং মিটমিট হাসছেন। টুপিটা বগলদাবা। গলায় বাইনোকুলার ও ক্যামেরা যথারীতি ঝুলছে। বললেন,আশা করি সুনিদ্রা হয়েছে ডার্লিং! হবারই কথা। ফকিরসাহেব অতি দয়ালু এবং স্নেহপ্রবণ মানুষ।

চমকে উঠে বললুম,ফকিরসাহেবের কথা আপনি কীভাবে জানলেন?

তিনজনেই অট্টহাস্য করে উঠলেন। তারপর কর্নেল বললেন, এটা কোনো অলৌকিক উপায়ে অবগত হইনি আমরা। কারণ আমরা ফকির নই। সাধারণ মানুষ মাত্র।

বিরক্ত হয়ে বললুম, হেঁয়ালি করার দরকার কী?

ডঃ করিম বললেন,–একটা হেঁয়ালি বোধহয় আছে জয়ন্তবাবু। আপনাকে রাতে বিশেষ খোঁজাখুঁজি করতে পারিনি, সেজন্য ক্ষমা করবেন। অন্ধকার ওই এলাকায় গেলে আবার দুশমনগুলোর সঙ্গে অকারণ গুলি ছোঁড়াছুড়ি করতে হত। তাই সকালে বেরিয়ে পড়েছিলুম। খাদ বরাবর সিন্ধুনদ পর্যন্ত এগিয়ে ব্যর্থ হয়ে যখন ফিরে আসছি, একস্থানে আপনার বন্ধু বালিতে আপনার জুতোর ছাপ আবিষ্কার করলেন। ছাপ ক্রমশ উত্তর-পশ্চিমে এগিয়েছে। তার মানে, বোঝ গেল আপনি ফিরে চলেছেন। একটা বাঁক পেরিয়ে দেখি একজন ফকির হন্তদন্ত হয়ে আসছেন। আমাদের তিনি দেখেই পাড়ের দেওয়ালের খাঁজে লুকিয়ে পড়লেন। কর্নেল কামাল খাঁ তার বাহিনী নিয়ে দৌড়ে গিয়ে জায়গাটা ঘিরে ফেললেন। গুলি ছোঁড়ার ভয় দেখালে ফকিরসাহেব বেরিয়ে এলেন। তার মুখেই আপনার খবর পাওয়া গেল।

কর্নেলের দিকে ঘুরে বললুম,–ওই ফকির কিন্তু বাঙালি এবং রীতিমতো শিক্ষিত লোক। কর্নেল বললেন,–জানি বৎস! তবে তুমি কি ওঁর আসল পরিচয় টের পেয়েছ?

-না তো। কে উনি?

-উনি এক প্রখ্যাত বাঙালি পুরাতত্ত্ববিদ পণ্ডিত ডঃ ফরিদ আমেদ! একসময় কলকাতার পুরাতত্ত্ব দফতরের অধিকর্তা ছিলেন। অজন্তা, ইলোরা এবং সিন্ধুসভ্যতার ওপর ওঁর মূল্যবান গবেষণা গ্রন্থগুলো দেশ-বিদেশে এখনও সমাদৃত হয়। দেশভাগের পর উনি চলে যান প্রাক্তন পূর্বপাকিস্তান অর্থাৎ বাংলাদেশে। সেখানে রিটায়ার করার পর দিব্যি ছিলেন। হঠাৎ লন্ডনে একটা সেমিনারে আমন্ত্রিত হন এবং সেখানে গিয়ে জাদুঘরে একটা ব্রোঞ্জের ফলক দেখতে পান।

-রাজা হেহয়ের আসল ফলকটা তো?

-ঠিক বলেছ। ওই হল ওঁর কাল। অভিশপ্ত ফলক বলতে পার। ফিরে এসে ফলকের পাঠোদ্ধারের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। সে এক দীর্ঘ কাহিনি। সংক্ষেপেই বলছি। বর্ধমানের গ্রামে ডঃ ভট্টাচার্যের ছেলে সেই শিক্ষক ভদ্রলোকের কাছেও উনি অনেকবার যাতায়াত করেছিলেন। কারণ ডঃ ভট্টাচার্যের বইয়ে ফলকটার উল্লেখ ছিল। শেষপর্যন্ত ওঁর ডায়েরিটা দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন ডঃ আমেদ। নিজের অনুবাদের সঙ্গে ডঃ ভট্টাচার্যের অনুবাদের মিল দেখে আর ধৈর্য ধরতে পারেন নি। নাম ভাঁড়িয়ে ভারতের নাগরিক সেজেই উনি পাসপোর্ট-ভিসা জোগাড় করেন।

আবার একপ্রস্থ কফি এল। আমার ব্রেকফাস্টও এসে গেল। খেতে-খেতে বললুম,–তারপর কী হল বলুন?

কর্নেল বললেন,–ডঃ আমেদ একটা ভুল করলেন। ডঃ ভট্টাচার্যের ডায়েরিতে লারকানার স্টেশন মাস্টার মিঃ আলুওয়ালার উল্লেখ ছিল। তাঁর ছেলে ডঃ আলুওয়ালার সঙ্গে ডঃ আমেদের অল্প চেনাজানা ছিল। একা মোহেনজোদাড়ো অভিযানে যেতে সাহস করেন নি। ডঃ আলুওয়ালাকে সঙ্গে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ডাঃ আলুওয়ালা পণ্ডিত মানুষ হলে কী হবে? ভীষণ পাজি লোক। যাবার আগে ষড়যন্ত্র করেন যে গুপ্তধন পেলে ডঃ আমেদকে মেরে ফেলা হবে। তাই এক আন্তজাতিক ডাকতদলের সর্দার কিষাণাদের সাহায্য নিলেন। কিষাণচাঁদ পণ্ডিত সাজলো। নাম নিল ডঃ ব্রীজেশ সিং। ডঃ আমেদ অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাকে সঙ্গে নিতে বাধ্য হলেন। যাইহোক, ডঃ আমেদ একটা কাজ কিন্তু করেছিলেন, ফলকের প্রকৃত অনুবাদের কথা সঙ্গীদের জানান নি। এখানে এসে বিস্তর খোঁজাখুঁজি করেন তিনজনে। তারপর একরাতে তিনজনে কী একটা কথায় নাকি তুমুল ঝগড়া বেধে যায়। রাগের চোটে ডঃ আমেদ খাদের ওপর থেকে ধাক্কা মেরে ডঃ আলুওয়ালাকে ফেলে দেন। কিষাণচাঁদ তাকে আক্রমণ করে। কিন্তু ভাগ্যক্রমে ওই সময় একদন মিলিটারি টহলদার দূর থেকে সার্চলাইট ফেলেছিল। নেহাত রুটিন মাফিক ঘোরাঘুরি করছিল ওরা। এর ফলে কিষাণচাঁদ পালিয়ে যায়। ডঃ আমেদ লুকিয়ে পড়েন। সকালে খাদে নেমে একজায়গায় রক্ত দেখে ওঁর অনুতাপ জাগে। ভাবেন, নির্ঘাত ডঃ আলুওয়ালা এখানে অচেতন হয়ে পড়েছিলেন এবং নেকড়েরা তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে খেয়ে ফেলেছে। ধর্মভীরু ডঃ আমেদের অনুশোচনা তীব্র হয়ে ওঠে ক্রমশ। দিনের পর দিন পাপবোধে অস্থির হয়ে ওঠেন। তারপর ফকিরী অবলম্বন করেন। তারপর থেকে ওইভাবে থেকে গেছেন।

–এসব কথা কি উনিই বলেছেন আপনাকে?

আমার প্রশ্নের জবাব দিলেন কর্নেল কামাল খাঁ। –মিঃ চৌধুরী, দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, ফকিরসাহেব ওরফে ডঃ আমেদকে আমি গ্রেফতার করতে বাধ্য হয়েছি। জেরার চোটে উনি সব কবুল করেছেন।

চমকে উঠলুম।–গ্রেফতার করেছেন? কেন?

–প্রথম কথা উনি নাম ভঁড়িয়ে ভিসা জোগাড় করেছিলেন। পরে আমার গোয়েন্দা দফতর সেটা টের পেয়ে ওঁকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল এটা দুবছর আগের ঘটনা। দ্বিতীয় কথা, উনি বে-আইনিভাবে গুপ্তধন খোঁজাখুঁজি করছেন। আমরা কিষাণ সিং এবং ডঃ আলুওয়ালাকেও গ্রেফতার করার জন্যে প্রস্তুত ছিলুম। কিন্তু ব্যাপারটা টের পেয়েই দুজনে গা ঢাকা দিয়েছে।

কর্নেল সরকার বললেন,–কিষাণ সিং কে জানো? তুমি প্লেনে যে ভদ্রলোকের পাশে বসে এসেছ–সেই জাল ডঃ অনিরুদ্ধ যোশী!

কর্নেল কামাল খাঁ বললেন,–গা ঢাকা দিয়ে দুজনে দলবল নিয়ে ওই এলাকায় লুকিয়ে আছে। ওদের অস্ত্রশস্ত্র আছে প্রচুর। কিষাণ সিং-এর লোকেরা তো ওখানে বরাবর রয়ে গেছে। কোনো গুহায় আস্তানা গেড়েছে। খুঁজে বের করতেই হবে।

বললুম,–ফকিরসাহেব কোথায় এখন?

–আপাতত লারকানায় হাজতে পাঠিয়ে দিয়েছি।

 শুনে খুব দুঃখ হল। কিন্তু এদেশে মিলিটারি আইন। কিছু করার নেই।

আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে কর্নেল কামাল খাঁ এবং ডঃ করিম চলে গেলেন। কর্নেলকে বললুম,–হ্যালো ওল্ড ম্যান। ফকিরসাহেবের কাছে কী শুনেছেন জানি না। আমার ব্যাপারটা এবার আপনার শোনা দরকার। আমি গুপ্তধনের খোঁজ পেয়েছি।

কর্নেল চমকে উঠলেন–সে কী? কোথায়? কীভাবে পেলে?

–বলব। একটা শর্ত।

–কী শর্ত?

–কথা দিন, পাকিস্তানি গোয়েন্দা দফতরের অধিকর্তা এবং আপনার বন্ধু ওই কর্নেল কামাল খাকে বলে ফরিকসাহেবের মুক্তির ব্যবস্থা করবেন।

কর্নেল একটু হেসে বললেন,–চেষ্টা করতে পারি।

–চেষ্টা নয়, করতেই হবে। কামাল খাঁর হাতে প্রচুর ক্ষমতা!

–ঠিক আছে। এবার বলো?

–ফকিরসাহেব যে গুহায় থাকেন এবং আমি যেখানে আশ্রয় পেয়েছিলুম, সেখানে একটা বেদি আছে। তার গায়ে অবিকল সেই ফলকের চিত্রলিপি খোদাই করা আছে।

কর্নেল অবাক হয়ে বললেন,–বলো কী জয়ন্ত!

–হ্যাঁ। গুহার পথ খুঁজে বের করা কঠিন। তাই গোপনে একটা চিহ্ন দিয়ে এসেছি। কর্নেল গম্ভীর মুখে কিছু ভাবলেন তারপর বললেন, তা হলে তো ফকিরসাহেব অর্থাৎ ডঃ আমেদ গুপ্তধনের সন্ধান পেয়েই গিয়েছিলেন! অথচ … আশ্চর্য তো!

–কী আশ্চর্য!

–তবু উনি গুপ্তধন উদ্ধার করেননি কেন?

–হয়তো সংসারত্যাগী ফকির হয়েছেন এবং ডঃ আলুওয়ালাকে মেরে ফেলায় পাপ হয়েছে। ভেবেই নির্লোভ থাকার সাধনা করেছেন। বলেছিলেন, প্রায়শ্চিত্ত করছি।

–হুম! তোমার এ কথায় যুক্তি আছে।

–সেই স্বাভাবিক। তাই বেদির সামনে ওঁকে ধ্যানমগ্ন দেখেছি।

–ঠিক, ঠিক … বলে কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। তারপর একটু পায়চারি করে বললেন,–জয়ন্ত, আমি আসছি।

বেরিয়ে গেলেন কর্নেল। আমার শরীরের ব্যথাটা যায়নি। একটা পেনকিলার ট্যাবলেট খেয়ে নিলুম এবং শুয়ে পড়লুম। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছিল।…

দুপুরে লাঞ্চের সময় কর্নেল এসে আমাকে জাগালেন। তখন শরীর অনেকটা হাল্কা হয়েছে আমার।

খাওয়া-দাওয়া সেরে কর্নেল বললেন,এখনই ডঃ করিম এবং কর্নেল কামাল খাঁ এসে পড়বেন। ফোনে যোগাযোগ করতে না পেরে সেই লারকানা যেতে হয়েছিল। তোমার কথামতো কর্নেল কামালকে অনুরোধ করেছি। সম্ভবত ফকিরসাহেব মুক্তি পাবেন। তুমি চিন্তা করো না। তৈরি হয়ে নাও।

পোশাক পরে ফেললুম ঝটপট। এবার গুলিভরা রিভলভারটা নিতে ভুল করলুম না। বললুম।–দিনের আলো থাকতে-থাকতে পৌঁছানো দরকার। নইলে ফাটলের চিহ্নটা খুঁজেই পাব না।

কর্নেল একটু হেসে বললেন,–বোধ করি, তোমার চিহ্নের আর দরকার হবে না। কারণ ফকিরসাহেবকে কর্নেল কামাল সঙ্গে আনার চেষ্টা করবেন। নিজের গোপন আস্তানা চিনতে ওঁর ভুল হবে না আশা করি।

আমার মনে যেটুকু গর্ব ছিল, মিইয়ে গেল। মনে মনে কামনা করলুম, ফকিরসাহেব যেন কিছুতেই না আসেন। তা হলে আমাকেই সাধাসাধি করিয়ে ছাড়বে। এতকাল কর্নেল সব রহস্যে চাবিকাঠিটি নিজের হাতে রেখেছেন। এবার চাবিকাঠি আমি ভাগক্রমে হাতিয়েছি। এমন মওকা ছাড়ব কেন?

কিছুক্ষণ পরে জিপের শব্দ হল বাইরে। আমরা বেরিয়ে গেলুম।..

জিপে যেতে-যেতে ওঁদের যে আলোচনা হল, তাতে বুঝলুম কর্নেল কামাল খায়ের বাহিনীটি বেশ বড়। একদল দুপুরে গিয়েই সেই শুকনো খাদের মাথায় ত্রিকোণ মাঠটা ঘিরে রেখেছে। পাথরের আড়ালে ওৎ পেতে সৈনিকেরা লক্ষও রেখেছে। সৈনিকগুলো নাকি একেবারে কসাই। কিষাণচাঁদের দলের লোকেদের পেলেই গলায় ছুরি চালিয়ে কোতল করবে। বেছে-বেছে কাঠখোট্টা ধরনের হিংস্র পাঠানদেরই মোতায়েন করা হয়েছে। কাজেই কিষাণচাঁদ আর সুবিধে করতে পারবে না আজ। একেই বলে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা। আগের দিন যেখানে জিপ রেখে আমরা খাদে নেমেছিলুম, সেইখানেই নামলুম। যেতে যেতে হঠাৎ চোখে পড়ল, খাদের ওপরে উঁচুতে পাথরের আড়ালে মিলিটারি পাঠান সাবমেশিনগান বাগিয়ে বসে আছে। এ যে প্রায় যুদ্ধের আয়োজন।

বুঝলুম, কর্নেল কামাল খাঁ কাল সন্ধ্যায় কিষাণচাঁদের দলের হাতে ইটটি খেয়ে ভারি রেগে গেছেন এবং তার শোধটা ভালোমতো তুলবেন।

বেচারি মিঃ আলুওয়ালার জন্যে আমার দুঃখ হচ্ছিল। অধ্যাপক এবং পণ্ডিত মানুষ। অথচ গুপ্তধনের নেশায় পড়ে এমন সর্বনাশের পথে ছুটে বেড়াচ্ছেন কতদিন থেকে!

ব্রহ্মবৰ্তরাজ হেহয়ের গুপ্তধন যে অভিশপ্ত তাতে কোনো ভুল নেই। সেই অভিশাপের জন্যেই মানুষ হয়ে পড়েছে ষড়যন্ত্রী শয়তান।

যাচ্ছি তো যাচ্ছি, খাদের যেন শেষ নেই। বাঁক ঘুরে পুবে এগিয়ে সেই গুহা। কিন্তু অবাক কাণ্ড, ঠিক সেই জায়গাটা আমি চিনতে পারছিনে কেন? কর্নেল বারবার জিজ্ঞেস করছেন। আমি বাঁদিকে খাড়া দেওয়ালের মতো পাড়ে ফাটল খুঁজছি। এখানে কোথাও ফাটল নেই। তা হলে কি বেশি এগিয়ে এসেছি?

মনে পড়ছে, বাঁকের পরই বাঁদিকে ফাটল শুরু হবার কথা। অজস্র ফাটল পাথুরে পাড়ে তখন লক্ষ করেছিলুম। কিন্তু কই সেগুলো?

এবার কর্নেল মুচকি হেসে বললেন,–জয়ন্ত সব গুলিয়ে ফেলেছে। তা হলে এবার আমরা নিজেদের বুদ্ধির ওপর ভরসা করে খুঁজি। কী বলেন ডঃ করিম?

ডঃ করিম বললেন,–অগত্যা তাই।

কর্নেল কামাল খাঁ আমাদের দেহরক্ষীর মতো দুহাতে দুটো রিভলভার বাড়িয়ে সাবধানে চারিদিকে দেখতে দেখতে পিছনে আসছিলেন। বললেন,–কী হল?

কর্নেল বললেন,–জয়ন্ত পথ হারিয়েছে।

একেই বলে পিলে চমকানো হাসি। এক কর্নেলের কথা শুনে আরেক কর্নেল যা একখানা হাসলেন, এই খাদের মধ্যে যেন মেঘ ডাকল।

কর্নেল নীলাদ্রি সরকার ও ডঃ করিম বালির দিকে ঝুঁকে বোধকরি আমারই সকালবেলার জুতোর ছাপগুলো খুঁজছেন। কিন্তু খাদের মধ্যে প্রবলবেগে বাতাস বইছে। শুকনো বালি উড়ছে। ছাপ ঢেকে গেছে সম্ভবত।

হঠাৎ আমার মনে পড়ে গেল, গুহার ফাটল দিয়ে বেরিয়ে খাদের ওপারে প্রথমেই চোখে পড়েছিল একটা বিরাট লাল পাথর। এখানে কোথাও অমন লাল পাথর না থাকায় ওটা চোখে না পড়ে পারে না। কথাটা বললুম ওঁদের। ওঁরা খুঁজতে ব্যস্ত হলেন।

আমি ডানদিকের পাড়ে পাথরগুলো ভালো করে দেখার জন্যে কর্নেলের কাছে বাইনোকুলার নিলুম। প্রথমে পিছনের দিকে অর্থাৎ যেদিক থেকে এসেছি,সেদিকে ডান পাড়টা খুঁটিয়ে দেখলুম। কোনো লাল পাথর নেই কোথাও। অন্তত মাইলখানেক দূর পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

তারপর সামনের দিকে ডান পাড় বরাবর লক্ষ করলুম। কিন্তু কোথায় গেল লাল পাথরটা? এ যে রীতিমতো রহস্যময় ব্যাপার! সামনে খাদ সোজা পুবে গিয়ে সিন্ধুনদে মিশেছে। পাথরের একটা প্রাকৃতিক বাঁধ দেখা যাচ্ছে শেষ সীমায়। তাই বর্ষায় এই নদের জল ঢোকার সুযোগ পায় না। তবে বৃষ্টির জল জমতে পারে। কিন্তু এই এলাকায় বৃষ্টি হয় না বললেই চলে। তাই জল জমলেও তার পরিমাণ সামান্য হওয়াই সম্ভব। বুঝতে পারলুম, এজন্যেই গুহাটা নিরাপদ রয়েছে। নইলে বর্ষায় জল ঢুকে যেত। ফকির সাহেবের পক্ষে ওখানে বাস করা সম্ভবই হত না।

বাইনোকুলারে চোখ রেখেই একথা ভাবছিলুম, আমাদের কাছেই ডান পাড়ে একটা পাথরের আড়ালে কালো রঙের কী একটা বসেছিল, সরে গেল। বললুম,–কর্নেল! নেকড়ে বাঘ নিশ্চয় কালো হয় না। অথচ একটা কালো জন্তু দেখলুম যেন। এখানে কি ভাল্লুক আছে?

কর্নেল কামাল খাঁ বললেন,–কোথায়, কোথায়?

–ওই যে ওখানে।

সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে গিয়ে উনি ওপর দিকটা তাক করে দুহাতের রিভলভার থেকে এক ঝক গুলি ছুঁড়ে বসলেন। প্রচণ্ড প্রতিধ্বনি ছড়িয়ে পড়ল। তারপর তুলকালাম ঘটে গেল।

আমাদের বাঁদিকের পাড়ে সেই ত্রিকোণ মাঠ অন্তত একশ ফুট উঁচুতে রয়েছে। সেখানে থেকে পাঠান মিলিটারিরা গুলিবর্ষণ শুরু করে দিল। আমরা উপুড় হয়ে শুয়ে প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত হলুম। কর্নেল কামাল খাঁ রেগে আগুন হয়ে গেলেন। দুর্বোধ্য ভাষায় গালাগালি দিতে দিতে যখন উঠলেন, তখন সাদা বালিতে মিলিটারি পোশাক ভূতের পোশাক হয়ে উঠেছে। তারপর বিকট চিৎকার করে মাতৃভাষায় কী বললেন।

মুখ তুলে দেখি, পাড়ের উঁচুতে এক মিলিটারি পোশাক পরা মূর্তি দাঁত বের করে স্যালুট দিচ্ছে। পশ্চিম থেকে রোদ্দুর সোজা তার দাঁতে গিয়ে পড়েছে। সে এক দেখার জিনিস বটে!

বাকি তিনজন বালি ঝাড়তে ঝাড়তে উঠলুম। হঠাৎ কর্নেল বলে উঠলেন, জয়ন্ত জয়ন্ত! ওই তোমার লাল পাথর।

ঘুরে দেখে আমি হতবাক। আশ্চর্য কাণ্ড, এতক্ষণ ধরে খুঁজছি–কোথাও ছিল না। হঠাৎ যেন আলাদিনের-পিদিমের দৈত্যের মতো ওটা আমাদের নাকের ডগায় এসে ঠিক জায়গায় বসেছে। এই রহস্যের অর্থ কী?

কর্নেল গুম হয়ে যেন একথাই ভাবছিলেন। তারপর ইউরেকা বলে চেঁচিয়ে ওঠার মতো বললেন,–বুঝেছি! বুঝেছি! ব্যাপারটা আর কিছু নয়–মোহেনজোদাড়োর কাক।

–কাক! তার মানে?

–ওই দেখ, কাকগুলো এখন তুমুল চাচাতে চাঁচাতে পালিয়ে যাচ্ছে। আসলে ওই কাকগুলো লাল পাথরটা জুড়ে বসেছিল। তাই এতক্ষণ লাল রং ঢেকে গিয়েছিল। গুলির শব্দে ভয় পেয়ে পালাতেই লাল পাথরটা বেরিয়ে পড়েছে। শুনেছিলুম বটে কাকের কথা। সিন্ধুপ্রদেশে নাকি অসংখ্য কাকের উপদ্রব আছে। বিশেষ করে নাকি মোহেজোদাড়োতে কাকের উপদ্রবটা বেশি। এবার স্বচক্ষে দেখলুম।

বললুম,–কিন্তু লাল পাথরের বিপরীত দিকের পাড়ে ফাটল থাকার কথা। কিন্তু ফাটল নেই যে!

কর্নেল বললেন,–হুম! ওই তো ফাটল। একটা কেন? সারি সারি কয়েক গজ অন্তর অজস্র ফাটল দেখতে পাচ্ছি।

এতক্ষণে গোলমালটা টের পেলুম। সকালে সূর্যের আলো পড়েছিল। পশ্চিমের পাড়ে। এই পুব পাড়টা ছিল ছায়ায় ঢাকা। তাকালে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল ফাটলগুলো। কিন্তু সূর্য এখন পশ্চিমে রয়েছে। তার উজ্জ্বল কিরণ এসে পড়েছে পুব পাড়ের দেওয়ালে। সোনালি রঙের পাথরে সেই আলো ঠিকরে গিয়ে বিভ্রম সৃষ্টি করেছে। দেওয়ালটা মসৃণ বলেই রোদের প্রতিফলন আরও তীব্র হয়ে উঠেছে।

এবার খুঁটিয়ে প্রতিটি ফাটলের তলার দিকে আমার এঁকে রাখা সেই বর্গমূল চিহ্ন খুঁজতে শুরু করলুম। সাতটা ফাটলের পর যে ফাটলটা দেখলুম, তার তলায় চিহ্নটা দেখা গেল এবং আনন্দে চেঁচিয়ে উঠলুম,–পাওয়া গেছে। পাওয়া গেছে।

প্রথমে ঢুকলুম আমি। তার পিছনে কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। তার পিছনে ডঃ করিম। শেষে কর্নেল কামাল খাঁ।

কর্নেল টর্চ জ্বেলে আমার কাঁধের ওপর ধরে রেখেছেন। গোলকধাঁধার পথ এটা। বাঁকে বাঁকে নটা সরু ফাটল দেখে গেছি। সেগুলো এড়িয়ে হামাগুড়ি দিতে দিতে গুহার মুখে পৌঁছনো গেল।

ভেতরে সকালের মতো আলো নেই। যদিও ফাটল দিয়ে ওপরের আলো টের পাওয়া যাচ্ছে। কারণ সকালে সূর্য ছিল ওদিকেই। সোজা আলো এসে ঢুকছিল। এখন সূর্য পশ্চিমে চলে গেছে।

বেদিতে পিদিম জ্বলছে না। দেখে কেমন খারাপ লাগল। ফকির সাহেবের কম্বলটা ভাজ করে রাখা আছে। ওঁর ঝোলাটাও আছে। কর্নেল কামাল খাও দুটো নিলেন। ডঃ করিম টর্চের আলোয় লিপিগুলো পরীক্ষা করে বললেন,–এই তা হলে সেই গুপ্তধন!

কর্নেল সরকার বললেন,–বেদিটা ভাঙা উচিত নয়। সেটা একটা জঘন্য অপরাধই হবে। বরং পরীক্ষা করে দেখা যাক আগে।

কর্নেল কামাল খাঁ বললেন, আমার কাছে ট্রেঞ্চ খোঁড়ার ছোট্ট গাইতি আছে। দরকার হবে বলে এনেছি।

–দেখছি। বলে কর্নেল সরকার বেদির চারদিক খুঁচিয়ে দেখতে থাকলেন। তারপর ওপাশে গিয়ে দুহাতে সিন্দুকের ডালা খোলার মতো হ্যাঁচকা টান দিলেন। বেদির ওপরটা নড়ে উঠল।

ডঃ করিম বললেন,–এ কী! এ যে দেখছি একটা পাথরের সিন্দুক!

সবাই মিলে হাত লাগিয়ে পাথরের ডালাটা সরানো হল। ভেতরে আলো ফেলতে দেখা গেল, কোণার দিকে দুটো বাঁকা ধূসর রঙের আট-ন-ইঞ্চি মাপের চ্যাপ্টা কী জিনিস ছাড়া আর কিছু নেই।

কর্নেল হাত বাড়িয়ে তুলতে গিয়ে বললেন,–ওঁড়ো হয়ে ভেঙে যাচ্ছে। ওঠানো যাবে না!

বললুম,–কী ও দুটো?

সম্ভবত ঘোড়ার চোয়াল। প্রিয় ঘোড়ার মৃত্যু হলে প্রাগৈতিহাসিক যুগে তার দুটো চোয়াল যত্ন করে রাখা হত।

ডঃ করিম বললেন, তা হলে রাজা হেহয়ের ঘোড়ার চোয়াল!

–তা ছাড়া আর কী। … বলে কর্নেল হাত বাড়িয়ে কী একটা তুলে নিলেন। চোখের সামনে নাড়াচাড়া করে দেখে বললেন,–একটা ব্রোঞ্জের চাকতি। পরিষ্কার করে দেখতে হবে এই সীলমোহরটা কার।

কর্নেল কামাল খাঁ বললেন, তা হলে গুপ্তধন নেই?

–সেই তো দেখছি। মনে হচ্ছে, কে কবে হাতিয়ে নিয়ে গেছে। কর্নেল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন। কতকাল আগে নিয়ে গেছে, কে বলতে পারে! হয়তো দুহাজার বছর আগে–কিংবা তারও আগে! ভাই কামাল সায়েব! সব গুপ্তধনই এখন তাই নিছক কিংবদন্তিতে পরিণত।

আমরা গুহার মধ্যে হতবাক হয়ে বসে রইলুম। একটু পরে স্তব্ধতা ভেঙে ডঃ করিম বললেন, –গুপ্তধন কী ছিল, জানি না। কিন্তু এ একটা বড় আবিষ্কার নয় কি কর্নেল সরকার? ব্রহ্মবৰ্তরাজ হেহয়ের বাকি ইতিহাসটুকু পেয়ে গেলুম। এই পাথরের সিন্দুকই বিশ্বের পুরাতত্ত্বের ইতিহাসে সেরা একটি সম্পদ। আসলে এটাই একটা গুপ্তধন। দেশবিদেশে হিড়িক পড়ে যাবে। বিশেষ করে আপনাদের ভারতীয় পণ্ডিতরা এসেছেন। এই বিস্ময়কর আবিষ্কার দেখতে তাদের আমন্ত্রণ জানাব। ইতিহাসের এক রহস্যময় অধ্যায় এবার আলোকিত হয়ে উঠবে। ….

হঠাৎ আমাদের পিছনে থেকে কে জোরালো টর্চের আলো ফেলল। চোখ ধাঁধিয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। সে চিৎকার করে বলল,–একটু নড়লেই গুলি করব। যে যেভাবে আছ চুপ করে বসে থাকো। আর টর্চ নেভাও।

ঘটনার আকস্মিকতায় আমরা হতচকিত। আমাদের টর্চগুলো নিভে গেল।

তারপর কর্নেল একটু হেসে বললেন,–ডঃ আলুওয়ালা! শুনে দুঃখিত হবেন যে গুপ্তধনের সিন্দুকটা একেবারে খালি। স্বচক্ষেই দেখুন। রাজা হেহয়ের ঘোড়ার চোয়াল দুটো ছাড়া আর কিছু নেই।

মিথ্যা কথা! তোমরা গুপ্তধন বাগিয়ে লুকিয়ে ফেলেছ!

–না ডঃ আলুওয়ালা! আমরা …

–চুপ! এখনও বলছি, গুপ্তধন বের করো। নয়তো গুলি করে মারব।

–গুপ্তধন যদি সত্যি আমরা বাগিয়ে থাকি এবং আপনাকে তা দিই, তাহলেও তো আপনি আমাদের খুন করবেন ডঃ আলুওয়ালা! কারণ, আমাদের বাঁচিয়ে রাখলে আপনিই বিপদে পড়বেন।

শুনে আমার আত্মা খাঁচাছাড়া হবার উপক্রম। অথচ কর্নেল কী ঠাণ্ডা গলায় নির্বিকার মুখে কথা বললেন।

ডঃ আলুওয়ালা জোরালো আলোর পিছনে রয়েছেন বলে ওঁকে দেখতে পাচ্ছি না। এবার হা হা করে হেসে বললেন,–ঠিকই বুঝেছ! তা হলে রেডি। …

হঠাৎ ওঁর পিছনে কাল রাতে শোনা সেই বিদঘুঁটে হাসি অথবা ঘোড়ার ডাক শোনা গেল–হিঁ-হিঁ-হিঁ-হিঁ-হিঁ-হিঁ!

তারপর কী একটা ঘটল। ডঃ আলুওয়ালার টর্চ ছিটকে পড়ল। হাতের রিভলভার থেকে গুহার। মধ্যে কান ফাটানো আওয়াজে গুলি বেরুল। কয়েক মুহূর্ত অন্ধকারে ধস্তাধস্তির শব্দ শোনা গেল। গুহার ভেতর ততক্ষণ উগ্র দুর্গন্ধে ভরে গেছে।

তারপর আমাদের টর্চগুলো জ্বলে উঠল। সেই আলোয় যা দেখলুম, গায়ের রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে গেল। একটা কালো চামচিকের মতো মানুষ জাতীয় প্রাণী ডঃ আলুওয়ালার বুকের ওপর বসে দুহাতে গলা টিপে ধরেছে। ডঃ আলুওয়ালার জিভ বেরিয়ে গেছে।

কর্নেল কামাল খাঁ দুহাতের দুটো রিভলভারেরই ঘোড়া টিপে দিলেন। প্রাণীটা একটা বিদঘুঁটে আর্তনাদ করে ছিটকে পড়ল। তারপর কাঁপতে কাঁপতে স্থির হয়ে গেল।

আমরা হামাগুড়ি দিয়ে গেলুম। ডঃ আলুওয়ালাকে পরীক্ষা করে কর্নেল হতাশভাবে বললেন,–বেচারি মারা পড়েছেন। অতি লোভের পরিণাম!

প্রাণীটাকে কর্নেল কামাল খাঁ ও ডঃ করিম পরীক্ষা করেছিলেন। কর্নেল সরকার একটু ঝুঁকে দেখে নিয়ে বললেন,–এ কী! এ যে মানুষ! …

.

বিদায় সম্বর্ধনায় তুলকালাম

লারকানা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতত্ত্ব বিভাগের একটি বিশাল সভাকক্ষে ভারতীয় পণ্ডিতদের সম্বর্ধনা দেওয়া হচ্ছিল পরদিন সকাল দশটায়। একের পর এক দু-দেশের পণ্ডিতরা বক্তৃতা দিয়ে উঠে মোহেনজোদাড়োতে নতুন এবং বিস্ময়কর প্রত্ন-আবিষ্কারের কথা বলছেন। প্রত্যেকেই কর্নেল বুড়ো এবং এই অধম সাংবাদিক জয়ন্ত চৌধুরীর প্রশংসা করছেন। ডঃ আলুওয়ালার জন্য দুঃখ প্রকাশও করছেন।

শুনে-শুনে কান ঝালাপালা হয়ে গেল। উসখুস করছি দেখে কর্নেল বললেন,–তোমাকেও বক্তৃতা দিতে হবে ডার্লিং। তৈরি হয়ে নাও।

–পাগল, না মাথাখারাপ! আমি ওতে নেই। এক্ষুনি কেটে পড়ছি।

উঠতে যাচ্ছি, ডঃ করিম ঘোষণা করলেন,–এবার ভারতীয় সাংবাদিক জয়ন্ত চৌধুরীর মুখে এই রোমহর্ষক আবিষ্কারের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা শুনবেন আপনারা। মিঃ চৌধুরী কলকাতার প্রখ্যাত পত্রিকা দৈনিক সত্যসেবকের স্পেশাল রিপোর্টার।

কী আর করি, অগত্যা মঞ্চে দাঁড়িয়ে সংক্ষেপে দায়সারা কাহিনি শোনালুম। তারপর আসনের উদ্দেশে এগোলুম। মুহুর্মুহু করতালি চারদিকে। আমি তো একেবারে ঘাবড়ে গেছি।

গিয়ে দেখি, কর্নেলের আসন শূন্য। এদিক-ওদিক তাকিয়ে ওঁকে খুঁজলুম। তারপর দেখি, দরজার পাশে উঁকি মেরে চোখের ইশারায় আমাকে ডাকছেন।

কাছে যেতে-যেতে শুনি, সভাপতি ডঃ করিম ঘোষণা করছেন–এবার আমি প্রখ্যাত প্রকৃতিবিদ কর্নেল নীলাদ্রি সরকারকে অনুরোধ করছি …

বাইরে গিয়ে কর্নেল বললেন,–এসো, কেটে পড়া যাক।

বললুম,–আপনি অদ্ভুত মানুষ তো! এটা অভদ্রতা হচ্ছে না? আপনাকে তারা বক্তৃতা দিতে ডাকছেন আর আপনি কেটে পড়ছেন?

কর্নেল জবাব না দিয়ে হনহন করে লন পেরিয়ে চললেন। আমার খুব রাগ হল। মাঝে-মাঝে বুড়োর মাথায় যেন ভূত চাপে। এমন একটা জ্ঞানীগুণীর সমাবেশ ছেড়ে এবং রীতিমতো অভদ্রতা দেখিয়ে চলে গেলেন! এতে ভারতেরই মাথা কি হেট হচ্ছে না? কারণ উনি একজন ভারতীয় প্রতিনিধি!

দেশের সম্মান বাঁচাতে আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এল। এখনই সভামঞ্চে গিয়ে জানিয়ে দেব, কর্নেল সরকার হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাই তিনি ভাষণ দিতে পারছেন না।

কিন্তু হলে ঢুকেই আমার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল।

মঞ্চে অবিকল কর্নেল মতোই দাড়ি ও টাকওয়ালা এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক সবে মাইকের সামনে দাঁড়িয়েছেন এবং সবিনয়ে ঘোষণা করছেন,–অধমের নাম কর্নেল নীলাদ্রি সরকার …

আমি কি স্বপ্ন দেখছি? আসল কর্নেল থাকতে নকল কর্নেল কেন রে বাবা?

ডঃ করিম এবং আরও অনেকে তো আসল কর্নেলকে চেনেন। এমনকি এই দু-তিনদিন ধরে ওঁর সঙ্গে ঘুরে বেড়ালেন। অথচ একজন উটকো লোক উঠে গিয়ে কর্নেল সেজে মঞ্চে ভাষণ দিচ্ছে।

আমি হতভম্ব হয়ে সামনের দিকে সাংবাদিকদের জায়গায় আমার নির্দিষ্ট আসনে বসতে গেছি, সেই সময় আচম্বিতে একটা তুলকালাম শুরু হয়ে গেল।

প্রথমে প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ হল। তারপর দেখলুম নকল কর্নেল মাইকের সামনে উঁচু ডেস্কটার তলায় ঢুকে পড়লেন।

তারপর চেঁচামেচি, হুড়োহুড়ি তাণ্ডব চলতে থাকল। মিলিটারি সেপাইদের মঞ্চ ঘিরে ফেলতে দেখলুম। ওরে বাবা! পাকিস্তানে কি আবার মিলিটারি বিপ্লব হচ্ছে তাহলে?

মঞ্চে কর্নেল কামাল খাঁকে দেখলুম। দুহাতে দুটো রিভলভার নিয়ে হেঁড়ে গলায় গর্জন করলেন,–যে-যেখানে আছেন, চুপচাপ বসে পড়ুন! আমরা আততায়ীকে পাকড়াও করেছি।

এই সময় আমার বাঁদিকের দরজার কাছে দেখতে পেলুম, সেপাইরা একটা লোককে টানতে-টানতে নিয়ে যাচ্ছে। লোকটাকে আমার চেনা মনে হল। ওঃ হো! একেই তো সেদিন পার্কে ডঃ আলুওয়ালার সঙ্গে কথা বলতে দেখেছিলুম। সভা এবার অনেকটা শান্ত হয়েছে। যারা হুড়মুড় করে বেরিয়ে গিয়েছিল, তারা অনেকে ফিরে এসে আসনে বসছে। বুঝলুম, এ দেশে এমন কাণ্ড যেন লোকের গা সওয়া।

কিন্তু ততক্ষণে আমি ব্যাপারটা ধরতে পেরেছি।

গোয়েন্দা দফতর আগেভাগে টের পেয়েছিল, কর্নেল মঞ্চে উঠলেই গুপ্তঘাতকের পাল্লায় পড়বেন। তাই নকল কর্নেল সাজিয়ে গোপনসূত্রে পাওয়া খবরের সত্যতা যাচাই করতে চেয়েছিল। বলাই বাহুল্য, সত্যিকার কর্নেলকে মঞ্চে হাজির করে ঝুঁকি নিতে চায়নি। কিন্তু বলিহারি সাহস ওই নকল কর্নেল ভদ্রলোকের! যদি গুলিটা লাগত!

আমি আর বসে থাকতে পারলুম না। তখুনি ভিড়ের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে পড়লুম। বাইরে কোথাও কর্নেলকে দেখতে পেলুম না।

তখন একটা ট্যাক্সি ডেকে সটান হোটেলে চলে গেলুম। ইন্টারলকিং সিস্টেমের দরজা লক করা আছে। চাবি দিয়ে খুললুম। হ্যাঁ, বুড়ো ঘরেই আছেন। তবে চুপচাপ বসে নেই। টেবিলে সেই গুহার সিন্দুকে পাওয়া চাকতিটা ঘষামাজা করছেন। দুটো ছোট শিশিতে সাদা ও রঙিন তরল পদার্থ রয়েছে। একটা ছোট্ট ব্রাশ দিয়ে ব্রোঞ্জের চাকতিটা পরিষ্কার করছেন কর্নেল।

.

হিটাইট সীলমোহর

ঘরে ঢুকেই রুদ্ধশ্বাসে যা ঘটেছে বললুম। শুনে কর্নেল একটু হাসলেন। বললেন,–কিষাণচাঁদ ওরফে ডঃ অনিরুদ্ধ যোশী সহজে ছাড়বে না। এবার মরিয়া হয়ে উঠেছে।

অবাক হয়ে বললুম,–কেন? গুপ্তধনের সিন্দুক তো খালি! মিছিমিছি আর কেন সে ঝামেলা করতে চাইছে?

কর্নেল চাকতিটা দেখিয়ে বললেন,–জয়ন্ত, ভেবেছিলুম রাজা হেহয়ের গুপ্তধন রহস্যের পর্দা এতদিন খুলতে পেরেছি। কিন্তু তার বদলে দেখছি, রহস্য আরও ঘনীভূত হয়ে উঠল।

-বলেন কী!

–এই চাকতিটা লক্ষ করো। একটা ফুটো দেখতে পাচ্ছ। তাই না? আমার ধারণা, ব্রোঞ্জের এই চাকতি বা সীলমোহরটা রাজা হেহয়ের ঘোড়ার কপালে ঝোলানো ছিল। চাকতির হরফগুলোর পাঠোদ্ধার করা পণ্ডিতদের কাজ। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, ব্রোঞ্জের ফলকটা বা পাথরের সিন্দুকের গায়ে যে-চিত্রলিপি আমরা দেখেছি, এগুলো সেই ঢঙের চিত্রলিপি নয়। তুমি এই আতস কাঁচের মধ্যে দিয়ে দেখতে পার এ কিছুতেই সিন্ধুসভ্যতার চিত্রলিপি নয়। সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাঁচের।

আতস কাঁচের সাহায্যে ব্রোঞ্জের চাকতিটা দেখতে থাকলুম। হ্যাঁ, কর্নেল যা বলছেন তাই বটে।

-এই চাকতির মধ্যে দণ্ডধারী পুরুষটি নিশ্চয় রাজা। ব্রহ্মাবর্তের রাজা হেহয়। কী বলেন কর্নেল?

কর্নেল হেসে বললেন,–ব্যস! তা হলে তুমি তো পাঠোদ্ধার করেই ফেলেছ দেখছি। তোমাকে পণ্ডিতরা এবার বিদ্যাদিগগজ বাচস্পতি উপাধি দেবেন, জয়ন্ত! নাকি বিদ্যার্ণব–বিদ্যাবাগীশ, গোছের কিছু চাই তোমার?

ক্ষুব্ধ হয়ে বললুম,–এটা একটা রামছাগলকে দেখান। বলবে, এই মূর্তিটা একজন রাজার। রাজার হাতে রাজদণ্ড থাকে না?

কে জানে।–বলে কর্নেল অন্যমনস্কভাবে ঘড়ি দেখলেন। তারপর হাই তুলে বললেন,– ডঃ করিম আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করব আমরা। তারপর বেরুব।

–কোথায় বেরুবেন? আবার ওই ঘোড়াভূতের আড্ডায় নাকি?

–হুম। কিন্তু তুমি ওকে এখনও ঘোড়াভূত বলছ কেন জয়ন্ত? বেচারী আসলে তো একজন মানুষ। রাজা হেহয়ের গুপ্তধনের লোভে এ পর্যন্ত কত মানুষ যে অমনি পাগল হয়ে গেছে, তার সংখ্যা নেই। এই হতভাগ্যের পরিচয় আর জানা সম্ভব নয়। শুধু এইটুকুই বলতে পারি, সে পাগল হয়ে যাবার পর ওই এলাকার কোনো একটা গুহায় আশ্রয় নিয়েছিল। অখাদ্য কুখাদ্য খেয়ে জীবনধারণ করছিল। আর শেষ পর্যন্ত নিজেকেই ভেবেছিল, রাজা হেহয়ের সেই ঘোড়া!

–কিন্তু ওর গায়ের রঙ এত কালো হল কীভাবে?

–যে গুহায় ও ছিল, সম্ভবত সেই গুহায় কালো ছাই ভর্তি রয়েছে। কীসের ছাই, তাও এখানে ফরেনসিক ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করা হয়েছে। শুনলে অবাক হবে, কারবন-১৪ নামে একরকম আধুনিক পরীক্ষা পদ্ধতি আছে। তাতে প্রায় নিখুঁত হিসেব করে বলা যায়, জিনিসটি কত বছরের পুরনো। জানা গেছে, লোকটার গায়ে যে ছাই লেগে আছে, তা আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগের কাঠ পোড়ানো ছাই।

–বলেন কী! তাহলে মোহেনজোদাড়োতে যখন মানুষ বাস করত, তখনকার ছাই!

–হ্যাঁ জয়ন্ত। তখনকারই।

–কিন্তু গুহার মধ্যে কাঠ পুড়িয়েছিল কেন?

–সম্ভবত ওটা ছিল মোহেনজোদাড়োবাসীদের শ্মশান।

–গুহার মধ্যে শ্মশান! কেন?

–জয়ন্ত, সব দেশেই প্রাগৈতিহাসিক কালে গোপনে মৃতদেহের সৎকার করার প্রথা ছিল। সর্বত্র এর প্রমাণ পাওয়া গেছে। লোকে বিশ্বাস করত, মৃতদের আত্মা শান্তিতে থাকতে চায়। তাই এমন নির্জন জায়গায় তাদের শেষকৃত্য করা হত–যাতে কোনো ক্রমেই জীবিত মানুষদের জীবনযাত্রার কোনো আওয়াজ তাদের কানে না পৌঁছয়। নইলে তাদের শান্তির ঘুম ভেঙে যাবে এবং বিরক্ত হয়ে জীবিতদের ক্ষতি করতে থাকবে। বুঝলে তো?

–বুঝলুম। কিন্তু এও বুঝলুম, আপনি সেই শ্মশান গুহা আবিষ্কার না করে ছাড়বেন না। কিন্তু একটু আগে সম্বর্ধনা সভায় যা ঘটল, তাতে কি আপনার একটুও ভয় হচ্ছে না?

কর্নেল মিটিমিটি হেসে শুধু মাথা দোলালেন।

–কিষাণচাঁদ ডাকুর হাতে নির্ঘাত এবার প্রাণটি খোয়াবেন দেখছি।

–তুমি কি খুব ভয় পেয়েছ, ডার্লিং?

–আলবাৎ পেয়েছি। সবসময় আমার বুকে ভূমিকম্প হচ্ছে!

কর্নেল হো হো করে হেসে উঠলেন। তত ভয়ের কারণ নেই জয়ন্ত! আমার বন্ধু কর্নেল কামাল খাঁ অতি ধুরন্ধর গোয়েন্দাসদার। কিষাণচাঁদের দলেও ওঁর এজেন্ট রয়েছে। কাজেই নিশ্চিন্তে গোঁফে তা দাও।

আমার গোঁফই নেই।

–গোঁফ রাখতে শুরু করো। .. বলে কর্নেল ফোনের দিকে হাত বাড়ালেন। ফোন বাজছিল। কাকে কী জবাব দিয়ে বললেন,–ডঃ করিম এবং আমাদের প্রতিনিধিদলের নেতা ডঃ তিড়কে এসে গেছেন।

একটু পরেই ওঁরা দুজনে ঘরে ঢুকলেন। ডঃ তিড়কে কর্নেলের বয়সি। মস্ত গোঁফ আছে। লম্বা ঢ্যাঙা রোগাটে গড়নের মানুষ। একটু কুঁজোও। তিনজনে টেবিলে ঘিরে বসে চাকতিটা দেখতে ব্যস্ত হলেন। আমি কর্নেলের নির্দেশমতো কফির অর্ডার দিলুম ফোনে। ঘড়িতে এখন বাজছে দুপুর বারোটা। লাঞ্চ সেই একটায়।

একটু পরে প্রথমে মুখ খুললেন ডঃ তিড়কে।–এটা হিটাইট চিত্রলিপি মনে হচ্ছে।

ডঃ করিম বললেন,–হ্যাঁ, আমারও তাই ধারণা।

কর্নেল বললেন,–হিটাইট? পশ্চিম এশিয়াবাসি আর্যদের একটা শাখা ছিল ওরা তাই না?

ডঃ তিড়কে বললেন, হ্যাঁ, কর্নেল সরকার। হিটাইটরাও আর্য জনগোষ্ঠীভুক্ত ছিল। প্রথমে ওরাও বর্বর পশুপালক ছিল। অনেক প্রাচীন কৃষিকেন্দ্রিক নগরসভ্যতা ওরা ধ্বংস করেছিল। পরে ওরা ক্রমশ সভ্য হয়ে ওঠে। বাইবেলেও ওদের কথা আছে। সিরিয়ায় ওদের অনেক ফলক ও সীলমোহর পাওয়া গেছে।

ডঃ করিম বললেন,–হিটাইটরা নিজেদের দেশকে বলত হাট্টি বা হত্তি।

কর্নেল বললেন,–কিন্তু হিটাইট ভাষায় লেখা এই চাকতি রাজা হেহয়ের ঘোড়ার মাথায় ঝোলানো ছিল কেন? হেহয়কে তো উত্তর ভারতের ব্রহ্মাবর্ত রাজ্যের লোক বলা হয়। কোথায় সিরিয়া, কোথায় উত্তর ভারত!

ডঃ তিড়কে একটু ভেবে নিয়ে বললেন,–বড্ড গোলমেলে ব্যাপার, তা সত্যি। এই চাকতিতে কী লেখা আছে না জানা পর্যন্ত রহস্যভেদ করা যাচ্ছে না ড: করিম, চলুন বরং আপনার স্টাডিতে গিয়ে দুজনে কিছুক্ষণ মাথা ঘামানো যাক্। হিটাইট লিপির পাঠোদ্ধার তো জার্মান পণ্ডিত হেলমুথ থিওডোর বোসার্ট ১৯৪৬ সালে করে ফেলেছেন। কাজেই সেই সূত্র ধরে এগোলে আমরাও নিশ্চয় চাকতির লেখাগুলো পড়ে ফেলতে পারব।

ডঃ করিম বললেন,–কর্নেল সরকারকেও আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।

কর্নেল সবিনয়ে হাসতে হাসতে বললেন,–ক্ষমা করবেন ডঃ করিম। আপনাদের কাজের সময় এই অপণ্ডিত মহামূখের উপস্থিতি অনেক বিঘ্ন ঘটাবে। আপনারা অনুগ্রহ করে সময়মতো জানাবেন, চাকতিতে কী লেখা আছে। ব্যস, তাহলেই যথেষ্ট।

চাকতি নিয়ে ওঁরা চলে গেলেন। দরজা লক করে এসে কর্নেল বললেন,–জয়ন্ত আশা করি, বুঝতে পেরেছ যে রাজা হেহয়ের গুপ্তধনরহস্য কেন ঘনীভূত হয়েছে?

মাথা দুলিয়ে বললুম,–কিচ্ছু বুঝিনি।

–যে সিন্দুকটা আমরা গুপ্তধনের আধার বলে ভেবেছি, ওটা আসলে মৃত ঘোড়ার চোয়াল সংরক্ষণের জন্য প্রাচীন প্রথা অনুসারে তৈরি একটা পাথরের সিন্দুক।… কর্নেল ছাত্রকে বোঝানোর ভঙ্গিতে বলতে থাকলেন। … একটা ব্যাপার গোড়াতেই আমাদের বুঝতে ভুল হয়েছিল। ব্রহ্মাবর্তরাজ হেহয়ের মাতৃভাষা কিছুতেই সিন্ধুভাষা ছিল না-হতেই পারে না। তিনি এখানে বিদেশি মাত্র। যদি গুপ্তধনের সঙ্কেত তিনি ফলকে লিপিবদ্ধ করেন, তাহলে মাতৃভাষাতেই করা স্বাভাবিক ছিল। কাজেই এটা মোটেই রাজা হেহয়ের লিপি নয়। নিশ্চয় অন্য কারুর। তিনি স্থানীয় লিপিকারকে দিয়ে মোহেনজোদাড়োর ভাষায় লিখিয়ে নিয়েছিলেন, তাও বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে । কারণ তাতে দ্বিতীয় একজন গুপ্তধনের হদিস পেয়ে যাবে। কোন বুদ্ধিমান মানুষ এটা করবেন না।

–তা হলে?

-এর একটাই ব্যাখ্যা হতে পারে। কোনো মোহেনজোদাড়োবাসী সন্দেহবশে রাজা হেহয়ের পিছু নিয়েছিল এবং সে যা দেখেছিল, তা একটা ব্রোঞ্জের ফলকে লিপিবদ্ধ করেছিল। এবার এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ডঃ ভট্টাচার্যের অনুবাদটা পড়া যাক। কী দাঁড়াচ্ছে শোনো :

‘আমি দেখেছি : সৌরবর্ষের ষষ্ঠ মাসে চাঁদের প্রথম তিথিতে একজন লোক একটা ঘোড়া নিয়ে সিন্ধুনদের তীরে ত্রিকোণ ভূমিতে উপস্থিত হল। ঘোড়ার পিঠে একটা বাক্স ছিল। সে বাক্সটা শস্যক্ষেত্রের সীমানায় একটি বৃক্ষের নীচে পুঁতে রাখল।‘

বললুম,–‘আমি দেখেছি’-টা কোথায় পাচ্ছেন?

কর্নেল হতাশভঙ্গিতে বললেন,–তা হলে সব প্রাচীন লিপির ইতিহাস তোমাকে শোনাতে হয়। আপাতত সে-সময় হাতে নেই। শুধু জেনে রাখ, সব প্রাগৈতিহাসিক ফলক বা শিলালিপি বা সীলমোহর যা কিছু লেখা আছে, সবের গোড়ার ধরে নিতে হবে, কেউ কিছু বলছেন কিংবা ঘোষণা করছেন। অর্থাৎ প্রত্যেকটি লেখা ব্যক্তিগত উক্তি। আজকালকার মতো নৈর্ব্যক্তিক নয়। কোনো পুরোহিত বা কোনো রাজা বা কেউ না কেউ কিছু স্থায়ীভাবে অন্যান্য মানুষকে জানাতেই ওগুলো লিখেছেন। নিজে না লিখুন, লিপিকারকে দিয়ে লিখিয়েছিলেন। কাজেই সব লেখার গোড়ায় ‘আমি দেখেছি’ বা ‘আমি বলছি এই কথাটা ধরে নিতেই হবে। এই ফলকে একটা ঘটনার কথা লেখা রয়েছে। কাজেই …।

বাধা দিয়ে বললুম,–বেশ, তাই। তা হলে পাথরের বাক্সেও অবিকল একই লেখা এল কী ভাবে?

–এর একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যায়। সে লোভ সামলাতে না পেরে রাজা হেহয় এবং তার ঘোড়াটিকেও হত্যা করেছিল। তারপর তখনকার প্রথা অনুসারে পালিত পশু হিসাবে ঘোড়ার চোয়াল একটা পাথরের সিন্দুকে ভরে ওই গুহায় সমাধিস্থ করেছিল। ঘোড়ার মাথায় ঝোলানো সীলমোহর বা চাকতিটাও সিন্দুকে রেখে দিয়েছিল। কারণ ওটা ঘোড়াটারই একটা সাজ।

–কিন্তু গুপ্তধন?

–বলছি। পাথরের সিন্দুকের গায়েও একই কথা লিখে রাখার কারণ : নিজের জীবনে যে অদ্ভুত ঘটনা ঘটল, তার একটা বিবরণ আরও স্থায়ীভাবে রেখে যেতে চেয়েছিল সে। এবার গুপ্তধনের প্রসঙ্গে আসি। আমরা দুটো লেখাতেই কিন্তু এমন কোনো আভাস পাচ্ছি না, যাতে নিশ্চয় করে বলা যায় ঘোড়ার পিঠে সোনাদানা হীরা-জহরত ছিল। একটা বাক্স-জাতীয় জিনিস চিত্রলিপির ঘোড়ার পিঠে দেখছি এবং তিনটে ডালওয়ালা গাছের তলাতেও শুধু সেই বাক্সই দেখছি। একই চৌকোণা জিনিস এবং মধ্যিখানে একটা বিন্দুচিহ্ন।

–তা হলে কী এমন অমূল্য জিনিস ছিল বাক্সে, যা রাজা হেহয় কাকেও জানতে দিতে চাননি?

-বোঝা যাচ্ছে না। শুধু এটুকু বুঝতে পারছি মোহেনজোদাড়োবাসী লোভী ও খুনে লোকটি বাক্সর মধ্যে হিরে-জহরত সোনাদানা না পেয়ে নিরাশ হয়ে কিংবা পাপবোধে অনুতপ্ত হয়েই ঘটনাটা লিখে রেখেছিল।

–ভ্যাট! আরও গোলমাল হয়ে গেল সব। তিব্বতি মঠের পুঁথিতে বলা হয়েছে নাকি, রাজা হেহয় ধনরত্ন নিয়েই আশ্রয় নিয়েছিলেন সেখানে।

–তিব্বতি মঠের সাধুরাও কি ওই লোকটির মতো ভুল করতে পারে না?

–হ্যাঁ! তা অবশ্য ঠিকই।

এই সময় ফের ফোন বাজল। কর্নেল ফোন তুলে কী শুনে নিয়ে বললেন,–অলরাইট। উই আর রেডি। তারপর ফোন রেখে বললেন,–জয়ন্ত, লাঞ্চের আয়োজন করা হয়েছে। তৈরি হয়ে নাও।…

.

ফকিরসাহেবের কেরামতি

বিকেলে আমরা আবার চলেছি মাহেনজোদাড়োর দিকে। এবার সঙ্গে রীতিমতো মিলিটারি কনভয়। চারটে ট্রাকভর্তি মিলিটারি সামনে ও পিছনে যেন আমাদের জিপটাকে গার্ড দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এ তো দেখছি ফ্রন্টে যুদ্ধ করতে যাওয়ার মতো। আমার অস্বস্তি বেড়ে যাচ্ছিল।

আমাদের জিপে আছেন আর পাঁচজন। কর্নেল, আমি এবং ডঃ তিড়কে বসেছি পেছনে। কর্নেল কামাল খাঁ জিপ চালাচ্ছেন। তাঁর পাশে বসেছেন ডঃ করিম। বুঝতে পারছি, ভারতীয় প্রতিনিধিদের নিরাপত্তার কড়া আয়োজন করা হয়েছে।

ভারতের অন্যান্য প্রতিনিধি ও সাংবাদিকরা আজ মোহেনজোদাভোর সাত মাইল দূরে একটা বৌদ্ধস্তূপ দেখতে গেছেন। সহকারী নেতা ডঃ দীনবন্ধু আচার্য তাদের নেতা হয়েছে। কারণ মূল নেতা ডঃ তিড়কে আমাদের সঙ্গে এসেছেন।

মোহেনজোদাভোর কাছাকাছি এসে আমাদের জিপ একটা এবড়োখেবড়ো বাজে রাস্তার দক্ষিণে এগোল। বাঁদিকে অজস্র ন্যাড়া টিলার আড়ালে সিন্ধু নদ দেখা যাচ্ছে মাঝে-মাঝে। ডানদিকে রুক্ষ ধু-ধু মরুভূমি বলাই চলে-বালি, পাথর আর কঠিন মাটির দেশ। ছোট-ছোট কাঁটাগাছ আর ক্কচিৎ ঝোঁপঝাড় আছে। সেইসব ক্ষয়াখবুটে ঝোঁপের পাতা মুড়িয়ে খাচ্ছে মস্ত-মস্ত ছাগল আর তাগড়াই গড়নের দুম্বা নামে এক জাতের ভেড়া। কোথাও উটের পিঠে জিনিসপত্র চাপিয়ে দড়ি ধরে ধীরে-সুস্থে চলেছে কোনো মানুষ। মাথায় প্রকাণ্ড পাগড়ি, হাতে একটা লম্বা বর্শা। একখানে জিপসিদের ছোটখাটো একটা দলকে দেখলুম তবু পেতে রান্নাবান্না করছে। ওখানে একটা কুয়ো আছে। একদল ছাগল ভেড়াকে লাইন দিয়ে চৌবাচ্চা থেকে জল খাওয়াচ্ছে রাখালরা। জিপসি মেয়েরা চাকা ঘুরিয়ে জল তুলছে আর অকারণে হাসাহাসি করছে। আমাদের মিলিটারি গাড়িগুলো দেখে কিছুক্ষণ যেন ওরা সবাই ভয় পেয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।

এবার সত্যি বলতে কী কোনো পথই নেই। অসমতল প্রান্তর ও বালিয়াড়ি পেরিয়ে কনভয় চলেছে। ধুলোর মেঘ চলেছে আমাদের সঙ্গে। দম আটকানো অবস্থা।

কর্নেল ও ডঃ তিড়কে চাপাগলায় কী সব আলোচনা করছেন। মাঝে মাঝে পিছু ফিরে সামনের সিট থেকে ডঃ করিমও তাতে যোগ দিচ্ছেন। কিছু বুঝতে পারছি না–শুধু ‘হিটাইট’ শব্দটা বাদে।

এদিকে ধুলোয় ধূসর হয়ে গেছি সবাই। বড্ড বিরক্তিকর লাগছিল যাত্রাটা। একসময় কর্নেলের উদ্দেশে না বলে পারলুম না, আর কতদূর?

সামনে থেকে ডঃ করিম জবাব দিলেন,–এসে পড়েছি।

সামনে বাঁদিকে সিন্ধুনদ দেখা যাচ্ছিল। ঘড়িতে তখন ছটা বাজে। সূর্য অস্ত যেতে এখনও ঘণ্টাখানেক দেরি আছে। কিন্তু এবার আর ধুলো নেই। মাটি শক্ত। হলদে ঘাসের চাবড়া গজিয়েছে। তারপর একটা দুটো করে গাছও নজরে পড়তে থাকল। আমরা সিন্ধুনদের প্রায় কিনারা ধরে চলেছি এখন।

কোথাও কোনো বসতি দেখতে পেলুম না। তবে আরও দূরে দক্ষিণে দিগন্তের কাছে সবুজ রং দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলুম,–ওটা কী?

ডঃ করিম বললেন,–ওটা সেচ এলাকা। ওখানে সরকারি কৃষিক্ষেত্র আছে।

বাঁয়ে অনেকগুলো টিলা সিন্ধুনদের ধারে সার বেঁধে চলে গেছে সবুজ কৃষিক্ষেত্রের দিকে। ডাইনেও তেমনি টিলার সারি আছে। এখানে অজস্র কাটাগুল্মের জঙ্গল গজিয়ে রয়েছে। আর তারমধ্যে একটা করে চ্যাপ্টা পাথর পোঁতা আছে দেখলুম। জিজ্ঞেস করে জানা গেল, ওগুলো কোন্ যুগের গোরস্থান। প্রাগৈতিহাসিক যুগের তো বটেই। ওই পাথরগুলো নাকি এই এলাকার এক আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কাছে খুব পবিত্র। তারা প্রতি বছর শীতের শুরুতে এসে ওখানে পুজো আচ্চা করে। ভেড়া বলি দেয়। মেলা বসে তখন। অনেক পর্যটক দেখতে আসে। শুনলুম, জায়গাটার নাম দুহালা। নামটা অদ্ভুত লাগল। কতকটা বাংলা-বাংলা নাম যেন!

এখানেই আমাদের কনভয় থামল। আমরা জিপ থেকে নামলুম। কর্নেল কামাল খাঁ মিলিটারি সেপাইদের দুর্বোধ্য ভাষায় কী সব আদেশ দিলেন। তারা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সিন্ধুনদের ধারে টিলাগুলোর দিকে চলে গেল। কয়েকজন সেপাই সাবমেসিনগান নিয়ে পাহারায় রইল গাড়িগুলোর কাছে।

ফ্লাস্কে আনা চা খাওয়া হল ঘাসে বসে। আলোচনা শুরু হল তার ফাঁকে-ফাঁকে। সামনে একটা ম্যাপও রাখা হল। ওঁরা ঝুঁকে পড়লেন ম্যাপটার দিকে। আমি মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারছি না।

একসময় অধৈর্য হয়ে উঠে দাঁড়ালুম। সেই প্রাগৈতিহাসিক গোরস্থানে গিয়ে চ্যাপ্টা পাথরগুলো দেখতে লাগলুম। প্রতিটি পাথর মাটির ওপর অন্তত ছ’সাতফুট লম্বা। তার গায়ে দুর্বোধ্য কী যেন লেখা আছে।

হঠাৎ মনে পড়ে গেল, পূর্বভারতে মেঘালয় এলাকায় এমন অনেক গোরস্থান দেখেছিলুম বটে। শিলং থেকে চেরাপুঞ্জি যাবার পথে একটা দেখেছি। আরও নানা জায়গায়। ওগুলো খাসি জাতির লোকদের কাছে খুব পবিত্র। ওরাও পুজো-আচ্চা করে সেখানে গিয়ে।

আমার পিছনে জুতোর শব্দ হচ্ছিল। ঘুরে দেখি, আমার বৃদ্ধ বন্ধুটি আসছেন। মুখে মিটিমিটি হাসি। –হ্যাল্লো খুদে পণ্ডিত! নতুন কিছু আবিষ্কার করলে নাকি?

–চেষ্টা করছি।

–কিন্তু সাবধান, এখানে বিস্তর ভূত আছে। ঘাড় মটকে দেবে।

বুড়োর কথায় না হেসে পারা যায় না। হাসতে-হাসতে বললুম,–আপনারা কি সেইসব ভূতের সঙ্গে লড়াই করতে সেপাইসাথ্রি গোলাগুলি নিয়ে এসেছেন?

–তুমি ঠিকই ধরেছ, জয়ন্ত।

–আর কিষাণচাঁদ ডাকু বুঝি ওদেরই সর্দার।

–বাঃ! তা হলে তোমার বুদ্ধি খুলে গেছে!

–কিন্তু কর্নেল, আগেভাগে বলে দিচ্ছি, ওসব গোলাগুলির মধ্যে আমি নেই।

আমার মুখের কথা বলার সঙ্গে-সঙ্গে সিন্ধুনদের ধারে টিলাগুলোর দিকে পৃথিবী কাঁপানো একটা আওয়াজ হল। তারপর দেখলুম, কিছুটা দূরে প্রচণ্ড ধোঁয়া এবং তার সঙ্গে বড় বড় পাথরের টুকরো আকাশে ছড়িয়ে গেল। পায়ের তলার মাটি কেঁপে উঠেছিল। কী সাংঘাতিক ওই বিস্ফোরণ!

কর্নেল চাপা গলায় বললেন,–ডিনামাইট দিয়ে টিলাটা উড়িয়ে দিল বুঝি!

উত্তেজিতভাবে বললুম,–কারা ডিনামাইট চার্জ করল কর্নেল?

–আবার কারা? কিষাণচাঁদরা।

–কেন বলুন তো?

–একটা গুহায় ঢোকার পথ খুঁজে পাচ্ছিল না, তাই পাহাড় উড়িয়ে দিয়ে সে গুহার পথ আবিষ্কার করতে চায়।

–কী আছে সে গুহায়?

-জানি না। শুধু এইটুকুই জানি, কিষাণচাঁদ মশাই ধুরন্ধর লোক এবং সে আমাদের টেক্কা দিতে পেরেছে। সম্ভবত সে অসাধারণ পুরাতাত্ত্বিক পণ্ডিতের সাহায্য নিয়েছে।

–ডাকুকে কোন পণ্ডিত সাহায্য করতে যাবেন?

কর্নেল জবাব না দিয়ে হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে উঠলেন।–চলে এসো জয়ন্ত। আমরা এবার রওনা দেব।

ওঁর সঙ্গে এগিয়ে গিয়ে দেখলুম, ডঃ তিড়কে এবং কর্নেল কামাল খাঁ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। এবার দলবেঁধে সবাই দ্রুত টিলাগুলোর উপর দিয়ে এগিয়ে চললুম।

একটা টিলার উপর পোঁছে বড় পাথরের আড়ালে সব বসে পড়লুম। উঁকি মেরে দেখে অবাক হয়ে গেলুম। নীচে সিন্ধুনদ দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ মনে হবে সমুদ্র যেন। কূল-কিনারাহীন। তবে জায়গায় জায়গায় অনেক বালিয়াড়ি দ্বীপের মতো ছড়িয়ে রয়েছে। সেই চাতালে জনাপাঁচেক সশস্ত্র লোক একজন আলখাল্লাধারী ফকিরকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে।

ফকির আর কেউ নন, আমার প্রাণদাতা সেই সাধকপুরুষ এবং বাঙালি পণ্ডিত ডঃ আমেদ!

কর্নেলের মুখে বিস্ময় ফুটে উঠল। ফিসফিস করে বললেন,–যা আশঙ্কা করেছিলুম, তাই ঘটেছে। ফরিসাহেব কিষাণাদের পাল্লায় পড়েছেন।

ডঃ করিম বললেন,–মুক্তি পেয়েই উনি গা ঢাকা দিয়েছিলেন। অনেক খুঁজে আর পাত্তা পেলুম না। কিন্তু ভাবিনি যে উনি বোকার মতো আবার এখানে এসে পড়বেন।

ওঁকে থামিয়ে দিলেন কর্নেল কামাল খাঁ। ঠোঁটে আঙুল রেখে চুপ করতে ইশারা করলেন। সেই সময় দেখলুম, মিলিটারি সেপাইরা বুকে হেঁটে চাতালটার দুদিক থেকে পাথরের আড়ালে এগুচ্ছে। আমার বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। নির্ঘাত প্রচণ্ড লড়াই বেধে যাবে। তার মধ্যে ফকিরসাহেব বিপন্ন হয়ে পড়বেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই কর্নেল কামাল খাঁ পাঠান বলেই বুঝি এত গোঁয়ারগোবিন্দ মানুষ।

কিন্তু তারপরই আশ্বস্ত হয়ে দেখলুম, সেপাইরা চাতালের তলায় গিয়ে ঢুকল। এবং ফকিরসাহেব দুহাতে বার কতক তালি বাজালেন। আকাশের দিকে মুখ।

তারপর সিন্ধুনদের দিকে ইশারা করে কিছু বললেন। সশস্ত্র লোকগুলো সেদিকে তাকিয়ে কী দেখতে থাকল। তখন সদ্য সূর্যাস্ত হয়েছে। সিন্ধুর জলে রক্তিম ছটা বিচ্ছুরিত হচ্ছে। দেখতে-দেখতে সেই সিঁদুর গোলা জলের রঙ বদলাতে থাকল। এমন বিচিত্র দৃশ্য আমি দেখিনি। সোনালি-রূপালী পাখনা মেলে যেন অসংখ্য পরী স্নান করতে নেমেছে।

ব্যাপারটা বিস্ময়কর এজন্যে যে শুধু একটা জায়গায় ওই রঙের খেলা দেখা যাচ্ছে। লোকগুলো নিশ্চয় তাজ্জব হয়ে দেখছে। ফকিরসাহেব এবার সোজা দাঁড়িয়ে দুহাত তুলে প্রার্থনা করছেন।

তারপর দেখলুম, ফকিরসাহেব প্রার্থনা শেষ করে কয়েকবার তালি দিলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে পাথরের চাতালটার কিনারা থেকে মিলিটারি সেপাইরা আচমকা লাফিয়ে উঠল এবং লোকগুলোকে ঘিরে ফেলল।

লোকগুলো চমকে উঠেছিল। ভ্যাবাচ্যাকা অবস্থায় প্রত্যেকে বন্দুক ফেলে দিয়ে দুহাত তুলে দাঁড়াল।

কর্নেল কামাল খাঁ দৌড়ে নেমে গেলেন। দুহাতে দুটো রিভলভার থেকে দুবার গুলি ছুঁড়তে ভুললেন না।

আমারও নীচে গিয়ে ব্যাপারটা মুখোমুখি দেখার ইচ্ছে করছিল। কিন্তু একটু নড়তেই কর্নেল চিমটি কেটে বসে থাকতে ইশারা করলেন।

কর্নেল কামাল খাঁ এবং তাঁর বাহিনী ডাকাতগুলোকে আগ্নেয়াস্ত্রের ডগায় রেখে চাতাল থেকে নামালেন। অপেক্ষাকৃত ঢালু পথটা দিয়ে ভেড়ার পালের মতো তাড়িয়ে নিয়ে চললেন। ফকিরসাহেব এবার আমাদের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন।

কর্নেল বললেন,–চলুন, এবার যাওয়া যেতে পারে।

আমরা চারজনে নীচে নেমে গেলুম। নামাটা সহজ হল না অবশ্য। পাথরে সাবধানে পা রেখে নামতে হল।

কাছে গিয়েই ডঃ করিম বুকে জড়িয়ে ধরেছেন ফকিরসাহেবকে। কর্নেল এবং ডঃ তিড়কে করমর্দন করলেন ওর সঙ্গে। আর আমি ওঁর পায়ের ধুলো নিয়ে মাথায় ঠেকালুম। এই মানুষটি আমার প্রাণদাতা!

ফকিরসাহেব হাসতে হাসতে বললেন,–কেরামতিটা কেমন দেখালুম বলুন? সিন্ধুনদের ওই জায়গাটায় অদ্ভুত আলোর খেলা দেখা যায় সন্ধ্যার আগে। ন্যাচারাল ফেনোমেনা। ব্যাটাদের বললুম, ওই দ্যাখ–ওখানেই রাজা হেহয়ের গুপ্তধন পোঁতা আছে। ওরা বিশ্বাস করল। …

.

শ্মশানগুহার বিভীষিকা

ফকিরসাহেব ওরফে ডঃ আমেদের কাছে জানা গেল : কাল বিকেলে কর্নেল খাঁ ওঁকে মুক্তি দিয়েছিলেন। উনি তাঁর গুহার আড্ডায় ফেরার পথে কিষাণচাঁদের হাতে বন্দি হন। বুদ্ধিমানের মতো তিনি ওদের সাহায্য করতে রাজি হয়েছিলেন। নইলে প্রচণ্ড নির্যাতন করে ওরা তাকে মেরে ফেলত। এখানে ওই খাড়িমতো জায়গায় উঁচু তিনশো ফুট যে পাথরের দেওয়াল দেখা যাচ্ছে, তার গায়ে দুশো ফুট উঁচুতে একটা গর্ত আছে। এই গর্তটা একটা গুহার পথ। কিন্তু নীচে সিন্ধুনদের জল ওখানে সমুদরের ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়েছে। তাই ওখানে কোনো নৌকা নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। গেলেও খাড়া পাথরের দেওয়াল বেয়ে উঠে গর্তে পৌঁছানো দুঃসাধ্য। তাই কিষাণচাঁদকে উনি পরামর্শ দিলেন, যদি দেওয়ালটার ওপর থেকে দড়ি ঝুলিয়ে সেই দড়ি বেয়ে কেউ নামতে পারে তাহলে একশো ফুট নীচে গর্তটায় পৌঁছতে পারবে। এ কাজ দক্ষ পর্বতারোহীর। ওদের দলে তেমন কেউ নেই। তাই সেই দুপুর থেকে গর্ত খুঁড়ে ডিনামাইট ভরে দিয়েছিল কিষাণাদ। কিছুক্ষণ আগে আমরা সেই ডিনামাইটের বিস্ফোরণ টের পেয়েছি। দেওয়ালটা উড়ে গেছে। গুহার ছাদে ফাটল ধরেছে। সেই ফাটল দিয়ে কিষাণচাঁদ নেমে গেছে একা। সঙ্গীদের বলে গেছে, এক ঘণ্টার মধ্যে আমি না ফিরলে এই ফকিরকে জবাই করবে।

এখনও কিষাণচাঁদ ফেরেনি। এদিকে চাতালে দাঁড়িয়ে থাকতে-থাকতে হঠাৎ ফকিরসাহেবের চোখে পড়েছিল, একদল মিলিটারি সেপাই পাথরের আড়ালে বসে আছে। তখন তিনি শয়তানগুলোকে কথায় কথায় ভুলিয়ে রাখেন এবং ওই কেরামতি দেখান। সেই সঙ্গে সেপাইদের এগিয়ে আসতেও ইশারা করেন।

কর্নেল কামাল খাঁ বন্দিদের ট্রাকে তুলে চালান করে ফিরে এলেন। এখন আলো আর নেই। ধূসরতা ঘনিয়ে উঠেছে। উনি এসেই বললেন,–কিষাণচাঁদ তো নেই ওদের দলে!

ফকিরসাহেব বললেন,–চলুন, আপনাদের কিষাণাদের কাছে নিয়ে যাই। কিন্তু তার আগে বলুন, আপনারা এভাবে এখানে হঠাৎ এসে পড়লেন কোন্ সূত্রে?

জবাব দিলেন ডঃ তিড়কে। সে ভারি অদ্ভুত যোগাযোগ বলতে পারেন। রাজা হেহয়ের ঘোড়ার কপালে যে ব্রোঞ্জের চাকতি ছিল, সেটা নিশ্চয় আপনি পাথরের সিন্দুকে দেখেছিলেন?

–হুঁ, দেখেছিলুম। কিন্তু আমি ও-নিয়ে আর মাথা ঘামাতে চাইনি। ঈশ্বরের দিকে যে মন ফিরিয়েছে, তার কাছে আর ওসব জিনিসের কতটুকু মূল্য ডঃ তিড়কে?

–তা ঠিক। এবার ব্যাপারটা শুনুন তা হলে। ওই চাকতিটা একটা হিটাইট সীলমোহর। হিটাইট লিপি আছে ওতে।

–বলেন কী! ব্রহ্মবৰ্তরাজের ঘোড়ার সাজে হিটাইট লিপি।

–হ্যাঁ। যাই হোক, হঠাৎ আমার মনে পড়ে গিয়েছিল, একটা হিটাইট ফলকে সিন্ধুনদ অঞ্চলের সূর্যপূজারী সম্প্রদায়ের উল্লেখ আছে। তারা মৃতদেহের কবর দেয় এবং প্রতিটি কবরে পাথর পুঁতে খাড়া করে রাখে। তারা ঘোড়া আমদানি করে হিটাইট দেশ হাট্টি (বর্তমান সিরিয়া) থেকে। মোহেনজোদাড়োবাসীরা অবশ্য ঘোড়া তাদের কাছে দেখে থাকবে। কিন্তু ঘোড়া তারা যে কারণেই হোক, পছন্দ করেনি। হয়তো ঘোড়ার পিঠে চাপা পাপ ভাবত। লাঙল বা গাড়ি টানতে তো বলদই যথেষ্ট। আমি তাই ডঃ করিমকে জিজ্ঞেস করলুম সিন্ধুনদের তীরে তেমন কোনো গোরস্থান আছে নাকি। উনি বললেন, হ্যাঁ, আছে। তখন ঠিক হল, আমরা সেখানে গিয়ে খোঁজাখুঁজি করব। সেই সময় কর্নেল কামাল খাঁ জানালেন, কিষাণদের দল দুহালায় রওনা হয়ে গেছে। ওর দলে সরকারি গোয়েন্দা আছে। সেই খবর দিয়েছে। তখন আমরা বুঝলুম, আমাদের অনুমান সঠিক। কিষাণচাঁদ কীভাবে এসব জানতে পেরেছিল, কে জানে।

কর্নেল কামাল খাঁ বললেন,–লারকানা জাদুঘরের সহকারি ডিরেক্টর আরশাদ হুসেন কিষাণচাঁদের পরামর্শদাতা। ফিরে গিয়েই ওকে আমি গ্রেফতার করব। এবার চলুন ফকিরসাহেব।

অন্ধকার হয়ে এল যে!

ফকিরসাহেব পা বাড়িয়ে বললেন,–চলুন। কিন্তু সাবধান। আলো জ্বালাবেন না। আমি গোপনে একটা পথে আপনাদের ওই গুহায় নিয়ে যাব। শুধু মনে রাখবেন কিষাণচাঁদ খুব ধূর্ত এবং ভীষণ হিংস্র।

ফকিরসাহেব আগে, তাঁর পিছনে কর্নেল কামাল খাঁ, তার পিছনে ডঃ করিম, তারপর একে-একে ডঃ তিড়কে, কর্নেল সরকার এবং আমি। আমি সবার পিছনে। অন্ধকার খুব একটা ঘন হয়নি। তাছাড়া আজ চতুর্থী, চাঁদের জ্যোৎস্না ফুটেছে। অসুবিধে হচ্ছিল না।

ওপরে উঠে সমতল একটা জায়গা পাওয়া গেল। ততক্ষণে চাঁদের আলো বেশ পরিষ্কার হয়েছে। এক ফাঁকে ফিসফিস করে কর্নেলকে জিজ্ঞেস করলুম,–ব্রোঞ্জের চাকতিতে কি সত্যি গুপ্তধনের খোঁজ আছে?

কর্নেল ফিসফিস করে বললেন,–ভাগ চাই নাকি তোমার? পাবে, কথা দিচ্ছি।

রাগে মুখ দিয়ে কথা বেরুল না। আমি কি গুপ্তধনের লোভে ঘুরে বেড়াচ্ছি এঁদের সঙ্গে? অদ্ভুত বললেন তো!

কাটাঝোঁপগুলো এড়িয়ে সাবধানে অনেকখানি যাওয়ার পর ফকিরসাহেব দাঁড়ালেন। সামনে আবার একটা প্রাগৈতিহাসিক কবরখানা মনে হল। সার সার চ্যাপ্টা উঁচু পাথরের চাঁই পোঁতা আছে! ফিকে জ্যোৎস্নায় ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে সেগুলো। আগে না দেখা থাকলে ভয়ে ভিরমি খেতুম।

ফকিরসাহেব ইশারায় সেই কবরখানায় ঢুকতে বলে এগিয়ে গেলেন। মাঝামাঝি গিয়ে একখানে একটা পাথরের সামনে দাঁড়ালেন। ফিসফিস করে বললেন, এখানেই। তারপর পাথরের চাঁইটা অক্লেশে দুহাতে উপড়ে ফেললেন। এ যে দৈত্যদানবের কীর্তি! আমরা সবাই হতভম্ব হয়ে গেছি। কেউ কেউ অস্ফুটস্বরে বিস্ময়সূচক শব্দও করেছেন। তাই ফকিরসাহেব বললেন,–এই পাথরগুলো কাঠের তক্তার মতো হাল্কা। এক বিশেষ ধরনের পাথর! অথচ ভারি মজবুত। দুহালা এলাকার লোকেরা বলে চাঁদের পাথর। সূর্যদের পুজোয় খুশি হয়ে নাকি ওদের পূর্বপুরুষদের এইসব পাথর চাঁদ থেকে পাঠিয়ে দিতেন। পরীরা বয়ে আনত। অবশ্য কেউ মারা গেলে, তবেই। যাকগে, নীচের এই বেদিটার তলায় সুড়ঙ্গপথ আছে।

বলে উনি বেদির মতো চারকোণা একটা হাল্কাপাথর একইভাবে তুলে পাশে রাখলেন। বেদির মধ্যে পাথরের চাঁই বসানোর গর্ত রয়েছে।

ফকিরসাহেব বললেন,–সাবধান, আলো জ্বালবেন না কেউ। ভেতরে কিষাণচাঁদ কোথায় আছে আমরা জানি না। সিঁড়ি বেয়ে নামবেন একে-একে। প্রত্যেকে প্রত্যেকের পিঠে হাত রাখবেন।

গর্তটা কোনোমতে একজন ঢোকার মতো। কর্নেল ফিসফিস করে বললেন, “জয়ন্ত, ইচ্ছে না করলে তুমি অপেক্ষা করতে পার এখানে।

বললুম,–পাগল! একা এই ভূতের রাজ্যে বসে থাকার চেয়ে পাতালে আপনাদের সঙ্গে গিয়ে মরা ঢের ভালো।

একে-একে সবাই অদৃশ্য হলেন। তারপর কর্নেলের পিছনে আমিও নেমে গেলুম। কেমন একটা বাসি ধূপ-ধুনোর গন্ধ যেন। কুয়োর মতো সুড়ঙ্গের সিঁড়ি বেয়ে নামছি তো নামছি। ঠাসা অন্ধকার। সংকীর্ণ জায়গা। দম আটকে যাচ্ছিল।

কতক্ষণ পরে টের পেলুম, মেঝের মতো মসৃণ চওড়া একটা জায়গায় আমরা দাঁড়িয়ে আছি।

হঠাৎ সামনে দূরে কোথাও একঝলক আলো জ্বলেই নিভে গেল। ফকিরসাহেব ফিসফিস করে বললেন,–আবার সবাই সবাইকে ছুঁয়ে পা বাড়ান। আমি আগে থাকছি।

এবার মেঝের মতো সমতল জায়গায় হেঁটে চলেছি পরস্পরকে ছুঁয়ে। কখনও ডাইনে, কখনও বাঁয়ে ঘুরে-ঘুরে অনেকখানি যাওয়ার পর সবাই দাঁড়ালাম। কোথায় খসখস শব্দ হচ্ছে। শব্দটা বাড়তে থাকল। তারপর উপর্যুপরি বন্দুকের আওয়াজে গুহার স্তব্ধতা চুরমার হয়ে গেল।

তারপর একটা অমানুষিক আর্তনাদ অথবা গর্জন শোনা গেল। আঁআঁ–আঁআঁ! ওটা যে মানুষের গলার নয়, তা ঠিকই। কিন্তু অমন কানে তালাধরানো ভয়ঙ্কর চিৎকার কোন প্রাণীর?

অমনি ফকিরসাহেব চাপা গলায় বলে উঠলেন–সর্বনাশ! শ্মশান-গুহার দানবটা জেগে গেছে। পালিয়ে আসুন পালিয়ে আসুন। যেপথে এসেছি, সেই পথে।

একটা হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। বেঁকের মাথায় কর্নেল কামাল খাঁ টর্চ জ্বাললেন। ফকিরসাহেব বললেন,–আলো নয়। আলো নয়! আমার পিছু পিছু সেইভাবে চলে আসুন সবাই।

আমি সবার পিছনে। হুড়োহুড়ি করে উঠতে গিয়ে পড়ে গেলুম। তারপর গড়াতে গড়াতে আবার মেঝেয়। কর্নেল কি টের পেলেন না? পায়ের শব্দ ওপরের দিকে মিলিয়ে গেল দ্রুত। সেদিনকার চোটখাওয়া জায়গাতেই আবার চোট পেয়েছি। গোড়ালি দুমড়ে গেছে। উঠতে দেরি হল।

তারপর আর কিছুতেই সিঁড়িটা খুঁজে পেলুম না। যেদিকে যাই দেয়ালে বাধা পাই। শেষে একজায়গায় ফাঁক পেয়ে পা বাড়ালুম, কিন্তু সেখানে সিঁড়ি নেই। এদিকে পিছনে আবার বন্দুকের প্রচণ্ড আওয়াজ আর সেই অমানুষিক গর্জন বা আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে–আঁ-আঁ-আঁ-আঁ।

পাগলের মতো খোঁড়াতে খোঁড়াতে এগিয়ে চললুম। কিছুটা যাওয়ার পর মনে হল ধূলোবালির মধ্যে হাঁটছি। গলা শুকিয়ে গেছে। আতঙ্কে থরথর করে কাঁপছি। শেষপর্যন্ত মরিয়া হয়ে রিভলভার বের করলুম। এবং দেশলাই বের করে জ্বালাতেই দেখি, আমি কালো ছাই গাদায় হাঁটু পর্যন্ত ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে আছি!

তা হলে এই সেই মামদো-ভূতের আড্ডা শ্মশানগুহা! এখান থেকে বেরুতে পারলে আমাকেও সবাই মামদোভূত ভেবে বসবে, তাতে কোনো ভুল নেই।

অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে আছি তো আছি। এই নিচ্ছিদ্র অন্ধকারে আবার কোথায় যেতে কোথায় গিয়ে পড়ব ভেবে পা বাড়াতে সাহস হচ্ছে না।

ওদিকে গুলির শব্দ ও গর্জন বা আর্তনাদটা আবার থেমেছে। মনে হচ্ছে, কিষাণচাঁদ কিংবা সেই অজ্ঞাত দানবের লড়াই শেষ হয়েছে এতক্ষণে। কে জিতেছে কে জানে! আমি মনে জোর আনার চেষ্টা করতে থাকলুম।

কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলুম জানি না, হঠাৎ পিছন থেকে আমার গায়ে টর্চের আলো পড়ল। ঘুরেই রিভলভার বাগিয়ে গর্জে বললুম,–কে তুমি?

আলোর পিছন থেকে চাপা অট্টহাসি হাসল কেউ।–কী? বুড়ো ঘুঘুর বাচ্চা! তুমি কেমন করে শ্মশান-গুহার ছাইগাদায় এসে জুটলে হে? তোমার বুড়ো ঘুঘুটি কোথায়? তার সাঙ্গপাঙ্গ টিয়া-বুলবুলি আর সেই হুতুম প্যাচাটাই কোথায়?

–আর একটা কথা বললে গুলি ছুঁড়ব।

–তার আগে তোমার মুণ্ডু উড়ে যাবে। দেখতে পাচ্ছ না, এটা একটা স্টেনগান?

এবার লক্ষ করলুম, আলোর সামনে কালো একটা নল আমার দিকে তাক করে আছে। বললুম, –তুমি কি কিষাণচাঁদ?

–রিভলভার ফেলে দাও আগে। তারপর কথাবার্তা হবে।

–যদি না ফেলি।

–মুণ্ডটি হারাবে। রেডি–ওয়ান … টু … থ্রি ..

রিভলভার ফেলে দিলুম। ছাইগাদায় ডুবে গেল। কিষাণচাঁদ এসে পায়ে ছাই সরিয়ে সেটা তুলে নিল। দেখলুম, ওর জামাপ্যান্টে রক্ত লেগে আছে। রক্তগুলো ওর নিশ্চয় নয়। কারণ ওকে আহত বলে মনে হচ্ছে না।

সে আমার জামার কলার খামচে ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে চলল। পায়ের ব্যথার কথা ভুলে গেলুম। নির্ঘাত শয়তানটা আমাকে জবাই করতে নিয়ে যাচ্ছে।

নিচু ছাদওয়ালা একটা করিডোরের মতো জায়গা পেরিয়ে একটা প্রশস্ত ঘরে পৌঁছলুম। সেখানে দেখি, অনেক মাটির জালা রয়েছে। গুপ্তধন নাকি?

পরক্ষণে বুঝলুম, সব ছাইভর্তি অস্থিভস্ম। কত হাজার-হাজার লোকের অস্থিভস্ম কে জানে! মনে হল, একটু আগে যে ঘরে ঢুকে পড়েছিলুম-সে ঘরের জালাগুলো কেউ ভেঙে ফেলেছে। বলে ছাই ঘরময় ছড়িয়ে রয়েছে।

কিষাণচাঁদ এবার পকেট থেকে একটা মোম জ্বালল। একটা জালার মুখে রেখে টর্চ নেভাল। তারপর বাঁকা হেসে বলল,–এবার খবর বলো হে ক্ষুদে ঘুঘু!

বললুম,–খবর সাংঘাতিক। তোমার দলবলকে মিলিটারিরা গ্রেফতার করে চালান দিয়েছে। এবার তোমার সেই দশা হবে। চারদিক মিলিটারিরা ঘিরে রেখেছে।

কিষাণচাঁদ একটু ভড়কে গেল যেন। ভুরু কুঁচকে বলল,–তাই নাকি?

-হ্যাঁ। আর তোমার পরামর্শদাতা মুরুব্বি লারকানা জাদুঘরের অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টরকেও এতক্ষণ গ্রেফতার করা হয়েছে।

কিষাণচাঁদ কী যেন ভাবল! তারপর বলল,–সেদিন প্লেনে আসতে-আসতে তোমার প্রতি আমার স্নেহ জন্মে গিয়েছিল। নয়তো এতক্ষণ তোমাকে বাঁচিয়ে রাখতুম না। তা ছাড়া তুমি সাংবাদিক। সাংবাদিক মারা আর ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করা একই কথা। যাকগে, আমার এই ব্যবহারের বিনিময়ে তোমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত।

–আলবাত করছি। আমি কৃতজ্ঞ ডঃ অনিরুদ্ধ যোশী! কিষাণচাঁদ বাঁকা হেসে বলল,–ডঃ অনিরুদ্ধ যোশীকে তোমার মনে ধরেছিল দেখছি। হুঁ, আমাকে কিন্তু অদ্ভুত মানিয়েছিল।

–দারুণ! আমি তো একটুও ধরতে পারিনি।

–কিষাণচাঁদ লাখে একটাই জন্মায় হে ছোকরা! যাকগে, এবার তোমাকে নিয়ে কী করব একটু ভাবা যাক। … বলে সে পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরাল। ভাবতে থাকল।

বললুম,–আমি আপনাকে ডঃ যোশী বললে কি রাগ হবে কিষাণভাই?

–তুমি আমাকে ভাই বলছ?

–কেন বলব না? আমাকে এতক্ষণ বাঁচিয়ে রেখেছেন। আমি কি অকৃতজ্ঞ?

–হুঁ, তুমি এবার পথে এসেছ দেখছি। তা আমাকে ডঃ যোশী বললে আপত্তি করব না। পুনার ডঃ যোশীর সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক জানো? আমরা দুজনে স্কুল-কলেজে সহপাঠী ছিলুম। সে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আমাদের দুজনের চেহারাতেও দারুণ মিল! যাকগে সেকথা। শোনো, তোমাকে আমি … হা মুক্তিই দেব। একটা শর্তে।

–বেশ, বলুন।

–হেহয়রাজার ঘোড়ার সেই ব্রোঞ্জের চাকতিটা আমার চাই।

–কিন্তু আমি কোথায় পাব? আমার কাছে তো ওটা নেই।

–তুমি এই কাগজে নিজের হাতে লেখ : ‘আমি বন্দি আছি। আমার মুক্তিপণ হিটাইট ব্রোঞ্জচাকতি। পত্রবাহকের হাতে না দিলে আগামীকাল ভোর ছটায় এরা আমাকে মেরে ফেলবে। নীচে নাম সই করে তারিখ দাও। আমার লোক এটা আজ রাতে তোমার কর্নেল সাহেবের কাছে পৌঁছে দেবে। চাকতি কোথায় কীভাবে পৌঁছে দিতে হবে সেসব আলাদা চিরকুটে লিখে দেব। বাকি যা করার, আমি করব। নাও, লেখ।

সে পকেট থেকে একটা নোটবই বের করে কাগজ ছিঁড়ল এবং একটা ডটপেন দিল। আমি কথাগুলো লিখে সই করে দিলুম, তারিখও দিলুম।

এবার কিষাণচাঁদ জালার ওপর রাখা একটা হ্যাঁভারস্যাক থেকে মোটা নাইলনের রশারশি বের করল। বুঝলুম, দেওয়াল বেয়ে এই গুহায় ঢোকার জন্য দরকার হবে বলে দড়ি এনেছিল সে।

দড়িতে আমার হাতদুটোকে পিঠমোড়া করে বাঁধল। তারপর বলল,–চলো, তোমাকে ভালো জায়গায় রেখে আসি। এখানে থাকলে তো তোমার স্যাঙাতরা এসে তোমাকে উদ্ধার করে ফেলবে।

একহাতে টর্চ আর আমার রিভলভার অন্য হাতে স্টেনগানের নল আমার পিঠে ঠেকিয়ে সে আমাকে ঠেলতে-ঠেলতে নিয়ে চলল। আবার একটা নিচু ছাদওয়ালা সংকীর্ণ করিডোরের মতো জায়গা পেরিয়ে গেলুম। এতক্ষণে মনে হল অজস্র ঘর ও করিডোেরওয়ালা গুহাটা প্রাকৃতিক গুহা নয়। প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষরা বানিয়েছিল। এখানেই তারা সম্মানিত লোকেদের অস্থিভস্ম এনে জালায় রেখে দিত।

এবার যে চওড়া ঘরে ঢুকলুম, সেই ঘরের মেঝের দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠতে হল। একটা অক্টোপাসের গড়নের মতো জানোয়ার রক্তাক্ত শরীরে পড়ে আছে। বললুম,–ওটা কী প্রাণী? ওটার সঙ্গেই কি আপনি লড়াই করছিলেন তখন?

কিষাণচাঁদ খুশি হয়ে বলল,–হ্যাঁ। দেখতে পাচ্ছ, ওটার কী দশা হয়েছে।

–প্রাণীটার নাম কী ডঃ যোশী।

কিষাণচাঁদ আরও খুশি হয়ে বলল,–ওটা অধুনালুপ্ত প্রাগৈতিহাসিক জীব হেক্টোপাস।…

.

জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে

হেক্টোপাস নামে এই প্রাগৈতিহাসিক জন্তুটির রক্তাক্ত শরীর থেকে বিশ্রী দুর্গন্ধ বেরুচ্ছিল। এই ঘরেই যদি আমাকে বন্দি করে রাখে, তা হলে বমি করতে করতে নির্ঘাত মারা পড়ব। কিন্তু কিষাণচাঁদ আমাকে সেই ঘর থেকে আরেকটা ঘরে নিয়ে গেল।

এ ঘরের ছাদের ফাটল দিয়ে আকাশ দেখা গেল। তখন বুঝলুম, এই ঘরেরই ওপরটা ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে ফেলেছে কিষাণচাঁদ। ফাটলটা অনেকটা চওড়া। মেঝেভর্তি পাথরের চাঁই পড়ে আছে। ভয় হল, এখনই ফাটলধরা ছাদটা ধসে পড়বে না তো?

কিষাণচাঁদ বলল,–এবার আমার কিছু হুকুম তামিল করো লক্ষ্মী ছেলের মতো।

–বলুন কী করতে হবে?

–এই টর্চটা ধরে থেকে আমাকে আলো দেখাবে।

–আমার হাত যে বাঁধা।

তাতে কোনো অসুবিধা হবে না সোনা! তোমার কব্জি দুটো পিছন থেকে বাঁধা আছে এই তো? আমি তোমার হাতে জ্বলন্ত টর্চ ধরিয়ে দিচ্ছি। তুমি এদিকে পিঠ রেখে দাঁড়াও। ব্যস! কিন্তু খুব সাবধান। আলো ওপরে ফেলার চেষ্টা করবে না। তা করলেই দেখতে পাচ্ছ, স্টেনগান রেডি আছে।

–কী করতে চান ডঃ যোশী?

কিষাণচাঁদ চোখ নাচিয়ে বলল,–বাহাদুর ছোকরা দেখছি হে! অ্যাঁ? ডঃ যোশী বলে আমাকে গলাবার চেষ্টা করছ যে! উঁহু, ও চালাকি বারবার খাটবে না। নাও, টর্চ ধরে থাক। সাবধান।

আমি ঘুরে দাঁড়ালাম। সে আমার হাতে জ্বলন্ত টর্চ ধরিয়ে দিল। টর্চের মুখ দেওয়ালের দিকে। তারপর চোখের কোণা দিয়ে দেখলুম, সে একটা বড় পাথর ঠেলে এনে এক জায়গায় রাখল। সেই পাথরে তাকে উঠতে দেখে টের পেলুম সে কী করতে চায়।

আমাকে বেঁধে রাখা দড়ির ডগা সে নিজের কোমড়ে জড়িয়ে ভালোভাবে বাঁধল। তারপর ছাদের ফাটল আঁকড়ে ওপরে উঠে গেল। দড়িটা বেশি বড় নয়। টানটান হয়ে রইল। ওপর থেকে সে স্টেনগানের নল বের করে রাখতে ভুলল না। তারপর হুকুম দিল চাপা গলায়,আঙুল বাঁকা করে টর্চের স্যুইচ অফ করে দাও।

চেষ্টা করে বললুম,–পারছি না যে!

–পারতেই হবে। স্যুইচ তোমার তর্জনীর কাছেই রেখেছি টিপে নীচের দিকে ঠেলে দাও।

অনেক কষ্টে টর্চ নেভাতে পারলুম। তখন সে বলল,–সাবধান! তোমার সঙ্গে আমিও বাঁধা আছি। কাজেই অন্ধকারে পালাবার চেষ্টা কোরো না। এবার যা বলছি, করো। ওই পাথরে উঠে দাঁড়াও।

দু-হাত পেছনে বাঁধা আছে। কিছুতেই উঠতে পারছি না। কোনোভাবেই ওঠা সম্ভব নয়। অথচ সে বারবার ফিসফিস করে বলছে, কী হল? দেরি হচ্ছে কেন?

বললুম,–অসম্ভব। হাত বাঁধা মানুষ পাথরে চাপবে কী ভাবে?

–লাফ দাও না।

–অন্ধকারে লাভ দিয়ে হাড়গোড় ভাঙবে না? তা ছাড়া পাথরটা যে আড়াই ফুটের বেশি উঁচু মনে হচ্ছে।

–অপদার্থ! মুরগির যেটুকু জোর আছে তোমার নেই। আবার ঘুঘুগিরি করতে এসেছ! ঠিক আছে, তোমাকে ওঠাচ্ছি। কিন্তু ব্যাপারটা ভারি কষ্টদায়ক হবে তোমার কাছে।

অসহ্য লাগছিল। পা-মচকানো ব্যথা, তার ওপর বেঁধে রাখার ফলে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে কব্জির ওখানটা ফুলে ঢোল হচ্ছে বুঝতে পারছি। খুব যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। তার ওপরে সেই অবস্থায় টর্চ ধরে আছি। দাঁতে দাঁত চেপে বললুম,–যা হয়, করুন। আর পারছি না।

আমাকে ওপর থেকে হ্যাঁচকা টানে শূন্যে ঝোলাল। আর্তনাদ করে উঠলুম। দুই বাহু ভেঙে গেল মনে হল। কিন্তু সে চাপা গর্জে বলল,–চুপ!

দ্বিতীয়বার হ্যাঁচকা টানে আমাকে শয়তানটা ফাটলের কাছে তুলে ফেলল। ওর গায়ে দানবের শক্তি যেন।

কিন্তু আর যন্ত্রণা সহ্য করতে পারলুম না! অজ্ঞান হয়ে গেলুম।

কতক্ষণ অজ্ঞান ছিলুম জানি না, যখন জ্ঞান হল দেখি মুখের ওপর বিশাল নক্ষত্রভরা আকাশ ঝলমল করছে। সারা শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। তারপর টের পেলুম, আমি বালির ওপর শুয়ে আছি। আমার বাঁধনটা আর নেই। কিন্তু উঠে বসার ক্ষমতাও নেই। এদিকে প্রচণ্ড কনকনে ঠাণ্ডা। যন্ত্রণা ও ঠাণ্ডার চোটে কাতর হয়ে রইলুম।

আমার মাথা, কাঁধ, মুখ ও জামার ওপরটা ভিজে মনে হচ্ছিল। আমি অতিকষ্টে বললুম-কে আছ এখানে?

সঙ্গে সঙ্গে মাথার কাছ থেকে কিষাণাদের সাড়া এল–এই যে সোনা! ঘুম ভেঙেছে দেখছি। অনেক কষ্ট দিলে হে। কিষাণচাঁদ জীবনে যা করেনি, তাকে দিয়ে তাই করালে। তোমার মতো একটা ক্ষুদে বিচ্ছুর সেবাও করতে হল।

-–আমি কৃতজ্ঞ ডঃ যোশী।

–চুপ। বাঁদরামি করলে মুখ ভেঙে দেব।

বুঝলুম, কিষাণচাঁদ খামখেয়ালি প্রকৃতির লোক। এখন একরকম, তখন একরকম হয়ে ওঠে। ওর রাগ হয়, এমন কিছু করা উচিত হবে না। বললুম,–দাদা বললে কি আপত্তি করবেন কিষাণচাঁদজি?

–আমি কারুর দাদা নই।

–আমার সেবা করেছেন যে! দাদা ছাড়া ছোটভায়ের সেবা কেউ করে?

–করেছি নিজের স্বার্থে। চাকতিটা না পাওয়া পর্যন্ত যেভাবেই হোক তোমাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।

–তারপর বুঝি মেরে ফেলবেন?

–চাকতি পেলে দেখা যাবে।

–আপনি কিন্তু কথা দিয়েছেন, চাকতি পেলে আমাকে ছেড়ে দেবেন। কিষাণচাঁদ কোনো কথা বলল না। মনে মনে শিউরে উঠলুম। তা হলে কি সে আমাকে মেরে ফেলবে চাকতি পেলেও?

জানি না, আমার চিঠি পেয়ে কর্নেল কী করবেন। আমাকে তিনি কত স্নেহ করেন, তা জানি। কিন্তু ওই চাকতিটা তো তার ব্যক্তিগত জিনিস নয়। যখনই পাকিস্তান সরকারের প্রতিনিধি ডঃ করিম এবং কর্নেল কামাল খাঁকে ওটা দেখিয়েছেন তখনই ওটা সরকারি সম্পত্তি হয়ে গেছে।

এই সময় কেউ এসে দাঁড়াল। কিষাণচাঁদ তাকে বলল,–দেখা হয়েছে?

-–হ্যাঁ, স্যার। এই নিন, উনি চিঠিও দিয়েছেন।

ডাকাত সর্দারকে স্যার বলা শুনে এখন হাসার অবস্থা নয়। নয়তো হো হো করে হেসে ফেলতুম। কিষাণচাঁদ মন দিয়ে চিঠি পড়ছে এখন। পড়া শেষ হলে সে টর্চ নিভিয়ে জিজ্ঞেস করল–আর কী বললেন?

–বললেন, খাঁটি জিনিসই বটে।

–কখন দেখা হবে ওঁর সঙ্গে?

–চিঠিতে তো সব লিখে দিয়েছেন?

–তোমার মুখেই শুনি।

–কাল দশটায় তিন নম্বর গেটে থাকবেন।

-–ঠিক আছে। চলো, রওনা হওয়া যাক।

–আপনার উট কী হল?

–পাঠিয়ে দিয়েছি। হারুনকে বলেছি, উট বেঁধে রেখে তাবারুর জিপ নিয়ে রুণ্ডিতে অপেক্ষা করবে আমার জন্যে। তুমি কোন পথে এলে?

–জুলং বাজার হয়ে।

–মিলিটারি আছে ওখানে?

–না। তবে শুনলুম, দুহালার দিকে একটা বড় কনভয় রাত বারোটায় রওনা দিয়েছে।

–ঠিক আছে। চলো রওনা হই।

–আসামির অবস্থা কী? কবর দিয়ে যেতে হবে নাকি?

কিষাণচাঁদ টর্চের আলো আমার মুখে ফেলল। ওর স্যাঙাত বলল,–তাজ্জব। এখনও তাজা হয়ে আছে যে স্যার!

কিষাণচাঁদ চাপা হেসে আমার উদ্দেশে বলল,–তা হলে ছোটঘুঘু। আসি আমরা। তুমি আরামে ঘুমোও। তোমাকে মুক্তি দেব বলেছিলুম, দিলুম। আমরা আসি।

ওঠার চেষ্টা করে বললুম,–আমি এখানে পড়ে থাকব? এ তো মরুভূমি!

-বাঙালি হয়ে জন্মেছ। মরুভূমি একবার দেখবে না কেমন বস্তু? রাগে দুঃখে বলে উঠলুম,–আপনি এত নিষ্ঠুর কিষাণচাঁদজি! আপনি জবাব দিয়েছিলেন, চাকতির বদলে কর্নেলের কাছে আমাকে পৌঁছে দেবেন।

–মোটেও না। তেমন কিছু বলি নি। যা বলেছি, তা করেছি। তোমার ঠিকানা আমার লোক তোমার বুড়ো ঘুঘুকে দিয়ে এসেছে। অতএব ভাবার কিছু নেই। ওরা এসে তোমাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে।

বলে কিষাণচাঁদ উটের পিঠে বসল। ওর স্যাঙাত উটের দড়ি ধরে নিয়ে চলল। আস্তে আস্তে দূরে উটের পায়ের শব্দ মিলিয়ে গেল। অন্ধকার রাতের মরুভূমিতে হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডায় আহত শরীরে পড়ে রইলুম। চোখ ফেটে জল এল এতক্ষণে।, একটু পরে হঠাৎ মাথায় এল, এই মরুভূমিতে কর্নেলরা আমাকে খুঁজে পাবেন কীভাবে? ওঁরা খুঁজতে-খুঁজতে যদি বেলা হয়ে যায়, রোদ তীব্র হতে থাকে, তা হলে তো আমি তেষ্টাতেই মারা পড়ব। তারপর প্রচণ্ড উত্তাপ তো আছেই।

অতএব প্রাণপণ চেষ্টায় কোনোরকমে যদি রাত থাকতে এগোবার চেষ্টা করি, তা হলে বাঁচার সুযোগ পেতেও পারি।

কিষাণচাঁদ যে দিকে গেল, সেই দিকে তাকিয়ে আবছা দূরে যেন সিগারেটের আগুন দেখলুম। মরিয়া হয়ে ওঠার চেষ্টা করলুম।

হামাগুড়ি দিয়ে কিছুটা চলার পর উঠে দাঁড়ালুম অতিকষ্টে। দুই কাঁধে ভীষণ যন্ত্রণা। আস্তে-আস্তে টলতে-টলতে পা বাড়ালুম। কখনও আছাড় খাচ্ছি, কখনও উঠে হামাগুড়ি দিচ্ছি। আবার কখনও কয়েক পা কুঁজো হয়ে হাঁটছি। এভাবে কিছুটা চলার পর মনে জোর এল।

যখনই দম আটকানোর মতো অবস্থা হল, তখনই থেমে চিত হয়ে শুয়ে পড়লুম। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলুম। তারপর হাঁফাতে-হাঁফাতে এইভাবে এগিয়ে গেলুম।

একটা উজ্জ্বল নক্ষত্র লক্ষ করে চলার ফলে কিষাণচাঁদরা পেথে গেছে, সেই পথেই যাচ্ছি মনে হল। সাদা বালির ওপর নক্ষত্রের আলো পড়ায় পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল উটের ও মানুষের পায়ের গভীর ছাপ।

একবার মনে হল কিষাণচাঁদের নাগাল পেয়ে গেছি। পরে দেখলুম, ভুল। বাতাসের শব্দ।

এইভাবে চলেছি তো চলেছি। কখনও হাঁটু ভর করে, কখনও বুকে হেঁটে। আবার কখনও উঠে দাঁড়িয়ে পা ফেলার চেষ্টা করছি। মাঝে মাঝে বিশ্রামও নিচ্ছি।

কিছুক্ষণ পরে উটের পায়ের দাগ হারিয়ে ফেললুম। সামনে উঁচু বালির পাহাড় আছে মনে হল। সেখানে গিয়ে অনেক চেষ্টা করেও ওটাতে উঠতে পারলুম না। প্রতিবার কিছুটা উঠে গড়িয়ে নীচে এসে পড়লুম।

বারবার চেষ্টার পর ক্লান্তিতে ভেঙে পড়লুম। শেষবার গড়াতে গড়াতে এত জোরে নীচে পড়লুম যে ঝাঁকুনির চোটে আবার অজ্ঞান হয়ে গেলুম।

যখন জ্ঞান হল, তখন দিনের আলো ফুটছে।

অনেক কষ্টে মুখ তুলে চারপাশটা দেখলুম। তারপর আমার গায়ের রক্ত হিম হয়ে গেল। যতদূর চোখ যায়, শুধু বালি আর বালি। দিগন্তে আকাশ নিচু হয়ে এসে মিলেছে। মরুভূমি কাকে বলে, এতক্ষণে টের পেলুম।

একটু পরে সূর্য উঠবে। তারপর কী ঘটবে, স্পষ্ট বুঝতে পারছি।

তবু মানুষের মনে কী যেন একটা শক্তি আছে। বেঁচে থাকার একটা সুতীব্র ইচ্ছা আছে। সেই শক্তি আর ইচ্ছা আমাকে সাহস জোগাল।

আবার ক্ষীণ একটা আশা জেগে উঠল, কর্নেলরা আমাকে খুঁজে বের করবেনই। বিশেষ করে কর্নেল কামাল খাঁ মিলিটারি কনভয় নিয়ে নিশ্চয় বেরিয়ে পড়েছেন ওর সঙ্গে। আমি চারদিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টি রেখে বসে রইলুম। এ আমার জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ। …

.

জিপসি মেয়ে রমিতা

কিছুক্ষণ পরে দিগন্তের আকাশ লালচে হয়ে উঠছে, দেখে জানলুম ওটাই তাহলে পূর্বদিক। আমি উত্তর দিকেই এগিয়েছি। আমার পায়ের ছাপ দেখে সেটা বোঝা গেল। কিন্তু এবার সূর্য ওঠার সময় হয়েছে। দেখতে-দেখতে মরুভূমির সূর্য উঁকি দিল। লাল প্রকাণ্ড একটা চাকার মতো সূর্য। বুক শুকিয়ে গেল আতঙ্কে।

চাকাটা ক্রমশ বড় হতে-হতে এক লাফে মাটি ছাড়া হল। এক ভয়ংকর একচক্ষু দানব যেন আমাকে দেখতে পেয়েই লাল জিভ বের করে ঠোঁট চাটছে।

ওদিকে তাকাতে ভয় করছিল। তাই ঘুরে দক্ষিণে দৃষ্টি রাখলুম। তারপর এক আজব দৃশ্য দেখলুম। শূন্যে কী একটা কালো জিনিস ভাসছে।

জিনিসটা কাঁপতে কাঁপতে রঙ বদলাল ক্রমশ। মনে হল কী একটা প্রকাণ্ড চারঠেঙে প্রাণী দিগন্তের আকাশে নড়বড় করে পাখির মতো সাঁতার কাটছে।

একটু পরে দেখি, প্রাণীটা যেন একটা উট।

তা হলে কি মরুভূমিতে দিনের প্রথম মরীচিকা দেখতে পাচ্ছি আমি? মনে-মনে ঠিক করলুম, মরীচিৎকার দিকে তাকাবো না। মরীচিৎকার নাকি মায়া আছে। মানুষ বা প্রাণীকে আকর্ষণ করে নিয়ে যায় এবং পরিণামে ওই মিথ্যার পিছনে ছোটাছুটি করে মারা পড়তে হয়।

কিন্তু আবার দেখবার ইচ্ছে হল ব্যাপারটা। তখন ঘুরে, স্পষ্ট দেখলুম সত্যি সত্যি একটি উট দৌড়ে আসছে। উটের পিঠে একটা ছাতার মতো কিংবা নৌকার ছইয়ের মতো জিনিস চাপানো রয়েছে এবং তাতে দু-জন মানুষ বসে আছে।

মরীচিৎকার পিছনে মানুষ ছোট। কিন্তু এ যে দেখছি মরীচিকাই আমার দিকে ছুটে আসছে। হতবাক এবং অসহায় হয়ে তাকিয়ে রইলুম।

ততক্ষণে সূর্যের রঙ সোনালি হয়ে উঠছে। দিগন্ত বিস্তৃত ধু ধু বালির সমুদ্রে তরল সোনার স্রোত বয়ে যাচ্ছে যেন। ক্রমশ উত্তাপ জেগে উঠছে শীতল বালিতে।

উটটা দেখতে দেখতে এসে পড়ল কাছাকাছি। তখন দেখলুম সামনের দিকে বসে আছে একটি কিশোরী মেয়ে। তার হাতে উটের দড়ি। পিছনে বসে আছে এক বৃদ্ধ। ওরা আমাকে দেখতে পেয়েছে কিনা বোঝা যাচ্ছিল না।

তাই অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়িয়ে দুহাত তুলে প্রাণপণে চেঁচিয়ে উঠলুম,–বাঁচাও! বাঁচাও!

সঙ্গে সঙ্গে কিশোরীটি উটের দড়ি টেনে ধরল এবং উটটা মুখ উঁচুতে তুলে দাঁড়িয়ে গেল।

আবার চিৎকার করে বললুম,–বাঁচাও! বাঁচাও!

উট দৌড়তে শুরু করছে আমার দিকে। এ কখনও মরীচিকা হতে পারে না। মরীচিৎকার কোনো ছায়া পড়ে না। কিন্তু এই উট এবং তার আরোহীদের লম্বাটে ছায়া পড়েছে।

উটটা এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে গেল। কিশোরীটি ড্যাবডেবে চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। বৃদ্ধ দুর্বোধ্য ভাষায় আমাকে কী বলল, বুঝতে পারলুম না। ইশারায় বোঝাবার চেষ্টা করলুম, পথ হারিয়ে বিপদে পড়েছি। আমাকে উদ্ধার করো।

উটকে ইশারা করতেই হাঁটু ভাজ করল। তখন বৃদ্ধ এবং কিশোরী নেমে দাঁড়াল। আমাকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টে দেখে নিয়ে বৃদ্ধ এবার উর্দু ভাষায় বলল, তুমি কে? এখান কেমন করে এলে?

উর্দু আর হিন্দিতে তফাত খুব কম। আমি হিন্দিতেই জবাব দিলুম,আমি হিন্দুস্থানী। খবরের কাগজের লোক। দোশান মরুভূমি দেখতে এসে দিগভ্রান্ত হয়ে পড়েছি। সারারাত ঘুরে মরছি।

বৃদ্ধ হাসল।–তাজ্জব কথা বটে। মরুভূমি দেখার শখ এত বেশি তোমার? ঠিক আছে। এসো আমাদের সঙ্গে। তবে আমার উটটা খুব ক্লান্ত। আগের রাতে আমরা গিয়েছিলুম এই মরুভূমির একটা তীর্থে। সেখানে এক পীরের দরগা আছে। সারাদিন কাটিয়ে সন্ধ্যায় রওনা দিয়েছিলুম। কিন্তু উটটা পাজি। পথ ভুল করে উল্টোদিকে চলে গিয়েছিল। তাই সকাল হয়ে গেল। আমরা ফিরে যাচ্ছি রুণ্ডির বাজারে।

বৃদ্ধের গায়ে একটা হাতকাটা ফতুয়া, পরনে ঢিলেঢালা পাতলুন, কোমরে একপ্রস্থ কাপড় জড়ানো। মাথায় পাগড়ি আছে। তার কাছে একটা বল্লম আর সেকেলে গাদা বন্দুকও দেখতে পাচ্ছিলুম।

মেয়েটির পরনে একটা ঘাগরা। কোমরবন্ধ আছে। ফুলহাতা জামার ওপর একটা হাতকাটা ক্ষুদের জহরকোটের মতো সবুজ ও নকশাদার আঙরাখা চাপানো। পরনে সালোয়ার ও পায়ে নাগরা জুতো। তার চুল বেণীবাঁধা। মাথায় একটা রুমালও সুন্দরভাবে জড়ানো আছে। সে ফ্যালফ্যাল করে আমাকে দেখছে আর দেখছে।

সাজ-পোশাক দেখে মনে হল এরা কি জিপসিদলের নোক? তাই জিজ্ঞেস করলুম,–আপনারা কি রোমানি?

জিপসিরা নিজেদের রোমানি বলে। বৃদ্ধ জবাব দিল,–হ্যাঁ, আমরা রোমানি। আমাদের লোকেরা রুণ্ডি বাজারের ওখানে একটা মাঠে তাবু পেতেছে। আমি ওদের সর্দার। দলের জন্যে মানত দিতে গিয়েছিলুম। তা, তোমার মুখ দেখে বুঝতে পারছি, খাওয়া জোটেনি। ঠিক আছে। রোদ বেড়ে যাচ্ছে। উটের পিঠে যেতে-যেতে খেয়ে নেবে।

উটের পিঠে সুন্দর গদির আসন। ছইয়ের মতো একটা কাঠামো চাপানো। তিন দিক তেরপলের মতো শক্ত কাপড়ে ঘেরা। ছাদও রয়েছে। আরামে বসব ভাবলুম। কিন্তু উট চলতে শুরু করলে বেজায় ঝাঁকুনি টের পেলাম। শরীরের ব্যথা বেড়ে গেল।

বৃদ্ধ খুব দয়ালু। সে একটা টিফিন কেরিয়ার বের করে একটুকরো মোটা রুটি, খানিকটা জেলির মতো জিনিস আর একমুঠো কিসমিস দিল। বলল,–খেয়ে নাও। আর এই রইল জল। সবটাই খেয়ে নিতে পার। আর আমাদের জলের দরকার হবে না। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে পৌঁছে যাব।

ক্ষুধাতৃষ্ণা মিটিয়ে নিয়ে ওদের সঙ্গে গল্প শুরু করলুম। কথায় কথায় জানা গেল, বৃদ্ধ সর্দারের নাম মেহেরু। ওর মেয়ের নাম রমিতা। ওরা রুণ্ডিবাজারে এসেছে দিন সাতেক আগে। তার আগে ওরা ছিল কাফরিস্তানে। সেটা বালুচিস্তান ও ইরানের মধ্যে একটা পাহাড়ি এলাকা। কাফরিস্তানে থাকার সময় ওদের তিনটে ভেড়া মারা পড়েছে অসুখে। রুণ্ডিতে এসে কয়েকটা মুরগি মারা পড়েছে। ওদের ধারণা, শয়তানের নজর পড়েছে ওদের দলের ওপর। তাই তিখারি মরূদ্যানের তীর্থে পুজো দিয়ে এল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই রমিতার সঙ্গেও আমার খুব ভাব হয়ে গেল। আমি কোন দেশের লোক সে-দেশটা কেমন–সব খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করল। তারপর অবাক হয়ে গেল যেন। সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা সবুজ বাংলার ছবি ওর কল্পনায় আসছিল না। তারপর কলকাতার কথা উঠল। কলকাতার কথা ওরা শুনেছে। বড় আজব শহর পুবের দেশে নাকি। বাবা ও মেয়ে অজস্র প্রশ্ন করে কলকাতা শহরের কথা জেনে নিল। তারপর বুড়ো বলল,–কলকাতা না দেখে ওর মৃত্যু হবে না। দেখা চাই। তবে সে তো বহুদিনের রাস্তা। সেই যা সমস্যা। …

ঘণ্টা দেড়েক চলার পর দিগন্তে রুণ্ডি বাজারের বাড়িগুলো ভেসে থাকতে দেখা গেল। একটু ভয় হল এবার। কিষাণচাঁদ রুণ্ডির কথা বলছিল। ওখানে নিশ্চয় ওর লোকজন আছে। আমাকে কি তারা চিনতে পারবে?

আরও আধঘণ্টা চলার পর আমরা রুণ্ডি পৌঁছে গেলুম। রুক্ষ অনুর্বর পাহাড়ি এলাকা। কিছু কল-কারখানা আছে দেখলুম। শহরের বাইরে একটা উপত্যকায় জিপসিদের গোটা পাঁচেক তাবু রয়েছে। ছাগল-ভেড়া-দুম্বা আর মুরগির পাল আছে। বেঁটে কয়েকটা ঘোড়া আর উটও আছে। কুকুর আছে একডজন। আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার উপক্রম করছিল কুকুরগুলো। দু-জন জোয়ান জিপসি তাদের তাড়া করে ভাগিয়ে দিল। তারপর তিরিশ-বত্রিশ জন ক্ষুদে ও বড় নানা বয়সের জিপসি নারী পুরুষ আমাকে ঘিরে ধরল। সর্দার মেহেরু তাদের অল্প কথায় ব্যাপারটা শুনিয়ে আমাকে তার তাবুতে নিয়ে গেল।

তাঁবুর মধ্যে একটা খাঁটিয়ায় সুন্দর বিছানা পাতা রয়েছে। আমাকে শুয়ে পড়তে বলল। একটু পরে রমিতা এল হাসতে-হাসতে। ভাঙা উর্দুতে বলল,–ভাইজি। আপনার স্নান করা দরকার। আমি জল এনেছি কুয়ো থেকে। স্নান করে নিন।

বেরিয়ে দেখি, তাঁবুর সামনে একটা টুল পেতে রেখেছে। দুটো প্লাস্টিক বালতিতে জল রয়েছে। রমিতার হাতে সাবানের কৌটো আর তোয়ালে। শুধু তাই নয়, একপ্রস্থ পোশাকও এনেছে।

টের পাচ্ছিলুম, জিপসিরা একালের শহরে মানুষের ব্যবহৃত সব জিনিসই ব্যবহার করে। স্নান করার পর শরীরের ব্যথা অনেকটা কমে গেল। রমিতা ছাগলের টাটকা দুধ এনে দিল এক গ্লাস। বলল,–ভাইজি, খেয়েদেয়ে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নাও। খাবার সময় হলে ডাকব।

চোখের পাতা জড়িয়ে আসছিল। আমার পরনে এখন জিপসি পোশাক। ঘুমিয়ে অদ্ভুত স্বপ্ন দেখছিলুম। মরুভূমির মধ্যে দুলতে দুলতে উটের পিঠে চলেছি তো চলেছি। রমিতা বলছে–ভাইজি! বাংলা মুল্লুক আর কতদূর।…

ঘুম ভেঙে দিল কার ভারী গলার ডাকাডাকিতে। তারপর চোখ খুলে কয়েক মুহূর্ত বুঝতে পারলুম না–কোথায় আছি।

–ডার্লিং! আশা করি সুনিদ্রা হয়েছে।

সঙ্গে-সঙ্গে হুড়মুড় করে উঠে বসলুম। এই কণ্ঠস্বর এবং এই বাক্যটি বহুকালের পরিচিত।

দেখি, আমার খাঁটিয়ার পাশে একটা টুলে বসে আছে আমার বৃদ্ধ বন্ধু কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।

নিশ্চয় আবার বিদঘুঁটে একটা স্বপ্ন দেখছি। চোখ কচলে বললুম,–আপনি কি সত্যিই কলকাতার ইলিয়ট রোডবাসী সেই বৃদ্ধ ঘুঘু?

–অবশ্যই সত্য, ডার্লিং!

–কিন্তু কি উদ্দেশ্যে এসেছেন? জয়ন্ত তো কিষাণচাঁদের হাতে মারা পড়েছে। আমি জয়ন্ত নই! . দেখছেন না আমি একজন জিপসি।

–তা তো দেখতেই পাচ্ছি।

–লজ্জা করেনি আপনার আমার কাছে আসতে? কাল সারারাত আমি মরুভূমিতে কী ভোগান

কর্নেল হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে বললেন,–সব শুনেছি। জয়ন্ত, আমাদের ক্ষমা করো। তোমাকে উদ্ধারের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। সারাটা রাত পুরো একটা মিলিটারি কনভয় নিয়ে কর্নেল কামাল খাঁ আর আমি দোশান মরুভূমি তন্নতন্ন করে খুঁজে বেড়িয়েছি। কিষাণচাঁদ যে । পথনির্দেশ দিয়েছিল, তা ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যে। ওর নিষ্ঠুরতার তুলনা নেই।

–আমি জিপসি তাবুতে আছি, কে বলল?

–তোমাকে সারারাত খোঁজাখুঁজি করে আমরা রুণ্ডির দিকে আসছিলুম। একস্থানে উটের পায়ের ছাপ দেখে সন্দেহ হল। পরীক্ষা করে দেখলুম, বালিতে কেউ শুয়েছিল। আশেপাশে কয়েকটা জুতোর ছাপও রয়েছে। তারপর উটের পায়ের ছাপ অনুসরণ করে আমাদের গাড়ি এগোল। ছাপ গেছে সোজা উত্তরে। তখন ভাবলুম, হয়তো কিষাণচাঁদ তোমাকে এখনও ছেড়ে দেয়নি। কোনো কারণে আরও কোনও তথ্য আদায় করতে চায়। যাই হোক, এইমাত্র রুণ্ডি পৌঁছে খবর নিতে শুরু করলুম।-দোশান থেকে কোনো উটওয়ালা এদিকে এসেছে নাকি। তারপর সেইসূত্রে এদের তাবুতে এসে দৈবাৎ তোমাকে পেয়ে গেলুম।

তাঁবুর সামনে ভিড় জমেছিল। দুজনে বেরিয়ে গিয়ে দেখি, কর্নেল কামাল খাঁ একদল সেপাই নিয়ে আসছেন। জিপসিদের মুখে আতঙ্কের ছাপ পড়েছে। ব্যাপারটা কর্নেলকে বললুম। তখন তিনি ওদের উদ্দেশে ছোটখাটো একটা ভাষণ শুরু করলেন। কর্নেল যে এত চমৎকার উর্দু জানেন, কে জানত।

কর্নেলের বক্তৃতা শুনে ওরা খুশি হল। জিপসিরা খুব আমুদে। কেউ কেউ অতি উৎসাহে নাচগান জুড়ে দিল আমাদের ঘিরে।

ভিড় ঠেলে রমিতা এতক্ষণে এসে আমার হাত ধরল।–ভাইজি, তুমি নাকি চলে যাচ্ছ?

–যাচ্ছি বোন!

–বা রে! তোমার জন্যে খানার জোগাড় হয়েছে না? তুম আমাদের মেহমান (অতিথি)।

কর্নেল ওর চিবুক সস্নেহে নাড়া দিয়ে বললেন,–বেটি! এ বুড়ো বুঝি মেহমান নয়?

রমিতা সলজ্জ হেসে মাথা দুলিয়ে বলল,–হ্যাঁ, তুমিও মেহমান।

কর্নেল কামাল খাঁ ভিড়ে উঁকি মেরে বললেন,–আর আমি?

রমিতা ভেংচি কেটে বলল, তুমি তো মিলিটারি আদমি। মানুষ মারো। তুমি দূর হও এখুনি।

সর্দার মেহেরু বলল,–ছি, ছি বেটি! সবাই মেহমান। আজ সবাই খাবে। আজ আমাদের জীবনে একটা খুশির দিন। তিখারির পীরবাবা আমাদের দয়া করেছেন। তাই এত সব বড়া আদমি আমাদের তাঁবুতে এসেছেন।

বলে সে জিপসি ভাষায় ভিড়ের উদ্দেশে কিছু বলল। অমনি ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেল। কাঠের খুঁটি পুঁততে শুরু করল জোয়ানরা! তার ওপর রঙিন নকশাকাটা শামিয়ানা চড়াল। বুঝলুম, রীতিমতো একটা পার্টির আয়োজন হচ্ছে। কী সুন্দর ঝালরওয়ালা শামিয়ানা!

একটু তফাতে তেরপলের ছাউনির তলায় উনুনে বড়-বড় পাত্রে রান্না চাপল। যাকে বলে কমিউনিটি ভোজ। একসঙ্গে ওরা খায়। এখন হঠাৎ মেহমান এসে পড়ায় বাড়তি খাদ্যের ব্যবস্থা হচ্ছে। দুজন জোয়ান একটা মস্ত দুম্বা নিয়ে গেল টানতে টানতে। নিশ্চয় ওই দুম্বার মাংসে অতিথিদের সেবা হবে।

গতিক দেখে কর্নেল কামাল খাঁ ওঁর দলবলকে ধমক-ধামক দিয়ে কোথায় যেন পাঠিয়ে দিলেন। পঞ্চাশজন সেপাইয়ের খাবার জোগানো এদের ওপর অত্যাচারের শামিল হত। জনা দুই মিলিটারি অফিসার এবং স্বয়ং কামাল খাঁ রয়ে গেলেন। একটা জিপ থাকল। জিপ ঘিরে জিপসি ছেলেমেয়েরা খেলা জুড়ে দিল। উজ্জ্বল রৌদ্রে বিশাল নীল আকাশের তলায় রঙিন পোশাকপরা ছেলেমেয়েদের মনে হচ্ছিল প্রজাপতির ঝক।

এদিকে তাবুর সামনে একদল যুবক-যুবতী। গিটারের বাজনার সঙ্গে নাচগান শুরু করেছে। দেখলুম, বিশালদেহী কর্নেল কামাল খাঁকে ওরা টানতে টানতে ভেতরে ঢোকাল। তারপর তাজ্জব হয়ে গেলুম। মাথার ওপরে একটা হাত ঘুরিয়ে এবং মাঝে মাঝে গোঁফে তা দিয়ে ভুড়ি দুলিয়ে ও কোমর ঘুরিয়ে গোয়েন্দা দফতরের মিলিটারি অধিকর্তা সে কী নাচ নাচছেন!

হঠাৎ রমিতা দৌড়ে এসে কর্নেল বুড়োকে হ্যাঁচকা টান দিল।

তারপর দেখলুম, বুড়ো আসরে ঢুকে গেছেন। এবং দিব্যি নাচ শুরু করেছেন। কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের নাচ দেখব, সে কি স্বপ্নেও ভেবেছিলুম?

ওদের নাচগান চলতে থাকল। সর্দার মেহেরু আমাকে নিয়ে গেল ওর সেই তাবুতে। তারপর বলল,–তুমি কমজোর হয়ে গেছ, বেটা। তুমি রোদে ঘুরো না। চুপচাপ শুয়ে থাকো। খেতে একটু দেরিই হবে। ততক্ষণ তুমি আংরেজি কেতাবটা পড়তে পার।

বইটা দেখে অবাক হলুম। জাঁ পল সাত্রের লেখা ফরাসি বইয়ের ইংরাজি অনুবাদ : দা জিপসিজ। বললুম, এই বই কোথায় পেলেন সর্দারজি?

মেহেরু বলল,–এক সাহেব দিয়েছিল। আমাদের খবরা-খবর জানতে এসেছিল। তখন আমরা কাফ্রিস্তানে ছিলুম। ওটা তুমি ইচ্ছে করলে নিতে পার। আমরা কী করব ও নিয়ে?

বইটা পড়তে শুরু করলুম। অনেক খবর জানা গেল। এরা আসলে ভারতেরই বাসিন্দা ছিল কোনো যুগে। এদের ভাষায় হিন্দুস্থানী শব্দ প্রচুর। রোমানি কথাটা এসেছে সংস্কৃত রম্যানি’ থেকে। তার মানে ভ্রমণকারী। ফার্সিতে রম্ মানেও ভ্রমণ। রতা’ মানে বেড়াচ্ছে।

তাহলে রমিতার মানে দাঁড়ায়-যে মেয়ে সারাজীবন বিশ্বজুড়ে ঘুরে বেড়াবে বলে জন্মেছে। হায়, আমি যদি একজন জিপসি হতুম, রমিতা হত আমার ছোটবোন!

.

আবার মোহেনজোদাড়ো

রওনা হতে পাঁচটা বেজে গেল। রমিতার জন্য রুণ্ডি বাজার থেকে কয়েকটা সুন্দর পাথরের মালা আর একজোড়া সোনার দুল কিনে এনেছিলুম। সেগুলো পেয়ে রমিতা কি খুশি!

কিন্তু যাবার সময় সে ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,–ভাইজি এমন করে চলে যাবে জানলে ওই মরুভূমিতেই ফেলে রেখে আসতুম।

ওকে আদর করে বললুম,–বোনটি আমার! রাগ করো না। আবার দেখা হবে।

সে বেণী দুলিয়ে জোরে মাথা নেড়ে বলল,হবে না। বাইরের লোকের সঙ্গে আমাদের দুবার দেখা হয় না।

–বেশ। তা হলে মরে গিয়ে আমি তোমাদের দলে জন্মাব।

রমিতা কী বুঝল কে জানে, হঠাৎ, ভেংচি কেটে দৌড়ে চলে গেল তাবুর দিকে। কিছুক্ষণ পরে পাহাড়ের চড়াইয়ে ওঠার সময় ঘুরে নীচের উপত্যকার জিপসি,তাঁবুগুলোর দিকে তাকালুম। হঠাৎ দেখতে পেলুম, উপত্যকার পুবদিকের টিলার চূড়ার একটা পাথরের ওপর রমিতা দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে রুমাল নাড়ছে।

আমি হাত নেড়ে মনে মনে বললুম–বিদায় রমিতা! বিদায়! মন খারাপ হয়ে গেল কিছুক্ষণের জন্যে। এই যাযাবর মানুষগুলোর সম্পর্কে কত ভুল ধারণা ছড়িয়ে আছে। ওরা নাকি চোর-ডাকাত, খুনে এবং জাদুকর।

মনে হল, সব মিথ্যা। ওদের চির-যাযাবর জীবনের আনন্দ, ওদের স্বাধীনতা আর বাধাবন্ধনহীন উদ্দাম জীবন দেখে ঈর্ষাবশত আমরা ওদের নামে বদনাম রটাই।

কিছুক্ষণ পরে আমাদের জিপ পৌঁছল একটা প্রশস্ত হাইওয়েতে। অজস্র যানবাহন যাতায়াত করছে। কর্নেল কামাল খাঁ জানালেন–এই হাইওয়ে লারকানায় পৌঁছেছে। উনি জিপ চালাচ্ছেন। কর্নেল ও আমি ওর ডানপাশে বসেছি। এতক্ষণে কর্নেলকে জিজ্ঞেস করার সময় পেলাম। শেষ পর্যন্ত কী হল গুপ্তধনের?

কর্নেল বললেন,–হিটাইট সীলমোহরের অবিকল একটা নকল ভাগ্যিস আগেভাগেই তৈরি করিয়ে রেখেছিলুম। সেটা দেওয়া হয়েছে কিষাণচাঁদকে। চিত্রলিপি অদলবদল করা হয়েছে ডঃ তিড়কের সাহায্যে। ওই সূত্র ধরে কিষাণচাঁদ ফাঁদে পড়বে। কামালসাহেব ফাঁদ পেতে রেখেছেন। মোহেনজোদাড়োর ধ্বংসাবশেষের মধ্যে লুকিয়ে আছে ওঁর বাহিনী।

–গতরাতে দুহালার সেই গুহায় কি আমার খোঁজ করেননি আপনারা?

–করেছিলাম। তোমাকে পাইনি। তারপর …

-–থাক ও কথা। এবার হিটাইট সীলমোহরটার কথা বলুন।

–ওটা হিটাইটরাজ বার্নার সীলমোহর। ওটা একটা আদেশপত্র! তাতে লেখা আছে : ‘এতদ্বারা হিটাইটারাজ তাবার্না তার পুত্র হেহয়কে আদেশ দিচ্ছেন, প্রিয় সখা ইন্দিলম্মার অস্থিভস্ম সিন্ধুতীরবর্তী সূর্য-উপাসক সম্প্রদায়ের কাছে পৌঁছে দিতে হবে।

বললুম,–কিন্তু হেহয় তো উত্তর ভারতের রাজা ছিলেন!

কর্নেল বললেন,–হ্যাঁ, ও ঘটনা আর্যদের আগমনের প্রথম যুগের। হিটাইটরাও আর্য। আর্যদের যে-গোষ্ঠীকে বলা হয় ইন্দো-ইরানীয়, তাদের উপাস্য দুই দেবতা অসুর ও দেবকে কেন্দ্র করে পরস্পর সংঘর্ষ বেধেছিল। দেব-ভক্ত আর্যগোষ্ঠী পালিয়ে এসে পশ্চিম ভারতে বসতি স্থাপন করে। অসুর-ভক্তরা ইরানে থেকে যায়। ওদিকে একদল হিটাইটও কাশ্মীর হয়ে ভারতে এসে বসতি করে। তাবার্নার পুত্র হেহয় ছিল এই গোষ্ঠীর নেতা। এ পর্যন্ত আমরা প্রমাণসিদ্ধ ইতিহাস পাচ্ছি। পরেরটুকু এই চাকতি থেকে অনুমান করে নিতে হয়েছে।

–বলুন, শুনি।

–সম্ভবত দেবভক্ত আর্যদের আর একটা দল সূর্য-উপাসক হয়ে ওঠে এবং দুহালায় গিয়ে বাস করতে থাকে। তাদেরই নেতার নাম ইন্দিলাম্মা। ইন্দি শব্দটাতে সিন্ধুর আভাস আছে। যাই হোক, ইন্দিলাম্মা হিটাইটরাজ তাবানার প্রিয় বন্ধু ছিলেন। হাট্টিদেশে বেড়াতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে মারা যান। তাই তাবার্না তার অস্থিভস্ম পাঠিয়ে দিয়েছিলেন পুত্র হেহয়ের কাছে উত্তর ভারতে। এর পর কী ঘটেছিল, তিব্বতি মঠের পুঁথিতে পাওয়া যাচ্ছে। এখানে একটা কথা বলা দরকার। গৌতম বুদ্ধ খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের। আর এ ঘটনা তার আড়াই হাজার বছর আগের। কিন্তু আধুনিক পণ্ডিতদের মতে, বৌদ্ধধর্ম আরও প্রাচীন। গৌতম বুদ্ধ ১৯তম বুদ্ধ ছিলেন। কাজেই আর্যযুগেও বৌদ্ধ ছিল। তিব্বত অঞ্চলে। হেহয় এই সময় রাজ্যচ্যুতি হন এবং পিতৃ আদেশ পালন করতে ঘঘাড়ার পিঠে একটা বাক্সে ইন্দিলাম্মার চিতাভস্ম নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। পশ্চিম-তিব্বত ঘুরে তিনি কাশ্মীর হয়ে পাঞ্জাব পেরিয়ে দুহালা পৌঁছানো নিরাপদ মনে করেছিলেন। তারপর যথাসময়ে তিনি পৌঁছান মোহেনজোদাড়ো শহরে। বাক্সে বিন্দুচিহ্ন মৃতের প্রতীক। শ্মশানগুহার জালার গায়ে এই চিহ্ন আমরা দেখেছি।

–কিন্তু তিনি অস্থিভস্মের বাক্স পুঁততে গেলেন কেন?

–ডঃ তিড়কে ব্রোঞ্জের সেই ফলকটা পরীক্ষা করে একটা কারণ খুঁজে পেয়েছেন। ঘোড়াটার যে চিত্রকল্প আঁকা হয়েছে, তা একটা রুগ্ন ঘোড়ারই। কারণ ঘোড়র পেটের দিকটায় টানা কয়েকটা রেখা আছে। ওগুলো পাঁজরের হাড় বেরিয়ে পড়া ঘোড়া। তা না হলে স্বাভাবিক নীতিতে অন্যান্য জীবজন্তুর ছবির মতোই পেটটা চৌকো করে আঁকা হত। কোন রেখার আঁকিবুকি থাকত না?

-খুব যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা। তারপর?

-ঘোড়াটা বাক্স বইতে পারছিল না। ওদিকে সম্ভবত দীর্ঘ পথশ্রমে ক্লান্ত হেহয় দুহালা পৌঁছতে পারেননি। বিশ্রাম করতে চেয়েছিলেন মোহেনজোদাড়োতে। কিন্তু পবিত্র অস্থিভস্মের বাক্স দেখে লোকেরা কানাকানি শুরু করেছিল। পাছে বাক্সটা কেউ কেড়ে নিয়ে ধনরত্নের বদলে ছাই দেখে তা নষ্ট করে ফেলে, তাই হেহয় ওটা সেবারের মতো নির্জন কোনো গুপ্তস্থানে পুঁতে রাখতে গিয়েছিলেন। ঘোড়াটাও আর ভার বইতে পারছিল না। তার পক্ষে বাক্স বয়ে নিয়ে সৌর উপাসক সম্প্রদায়ের জনপদ খুঁজে বের করা কঠিন কাজ। ফলে যা স্বাভাবিক, তাই করতে গেলেন এবং এক গুপ্ত অনুসরণকারীর পাল্লায় পড়লেন। আশা করি, আবার সব স্পষ্ট হয়েছে তোমার কাছে।

–হয়েছে। তা হলে অস্থিভস্মের জন্যেই এতকাল ধরে এত হাঙ্গামা আর খুনোখুনি? ভ্যাট! কোনো মানে হয়?

হ্যাঁ, জয়ন্ত। অলীক গুপ্তধনের নেশা। এ নেশা চিরকালের।

একটু পরে জিজ্ঞেস করলুম,–ফকিরসাহেব কোথায় আছেন?

কর্নেল একটু হেসে বললেন,–করাচি রওনা হয়ে গেছেন। সেখান থেকে মক্কাতীর্থে যাবেন। সেখানেই বাকি জীবন সন্ন্যাসব্রতে কাটাবেন।

–একটা প্রশ্নের জবাব বাকি আছে।

–কী?

–কাল সন্ধ্যায় সব জেনেও কেন দুহালা অভিযানে গিয়েছিলেন? খামোকা যত রাজ্যের বিপদ আমাকেই ভুগিয়ে ছাড়লেন।

কর্নেল জোরে হাসলেন,–গিয়েছিলুম, শ্মশানগুহায় হেহয়ের বাক্সটারই সন্ধানে। সেই সঙ্গে বন্ধুবর কামাল খায়ের প্ল্যান ছিল দুর্ধর্ষ ডাকু কিষাণচাঁদকে বন্দি করা।

কর্নেল কামাল খাঁ বললেন,–কাল হাত ফসকে পালিয়েছিল। উটের পিঠে যে জয়ন্তবাবুকে নিয়ে যাচ্ছে ব্যাটা, কীভাবে বুঝব? ব্যাটা ছদ্মবেশ ধরতে ওস্তাদ। দিব্যি উটওয়ালা সেজে নাকের ডগা দিয়ে চলে গেল। তখন রাত প্রায় সাড়ে নটা। তবে আজ আর নিস্তার নেই। ফাঁদে পড়বেই।

বললুম,–আচ্ছা কর্নেল, অস্থিভস্মের বাক্সটা কি পেয়েছেন?

কর্নেল বললেন,–পেয়েছি। শ্মশানগুহায় একটা জালার মধ্যে ছিল। পাথরের বাক্স। দু ফুট চওড়া আড়াই ফুট লম্বা। মজার ব্যাপার, হেহয়ের হত্যাকারী এটা পৌঁছে দিয়ে থাকবে। সেই বাক্সের গায়েও অবিকল একই কথা লিখে রেখেছে সে। ব্রোঞ্জের ফলকে এবং ঘোড়ার চোয়াল রাখা সিন্দুকের গায়ে লেখা ছিল, হুবহু তাই। বোঝা যায়, খুব অনুতপ্ত হয়েছিল লোকটা।…

বাকি পথ আমরা চুপচাপ ছিলুম। জিপের গতি ক্রমশ বাড়ছিল। সাতটার মধ্যে পৌঁছে গেলুম লারকানায়। সেই হোটেলের পরিচিত ঘরে আমাদের পোঁছে দিয়ে কর্নেল কামাল খাঁ চলে গেলেন। অনেক রাতে কর্নেলের ডাকে ঘুম ভাঙল। কর্নেল বললেন,–সুসংবাদ ডার্লিং! এইমাত্র বন্ধুবর কামালের ফোন পেলুম। মোহেনজোদাভোর শস্যগোলার ওখানে কিষাণচাঁদ এবং তার সঙ্গীরা ধরা পড়েছে। এবার নিশ্চিন্তে ঘুমোও। অনেক ভোগান্তি গেছে তোমার ওপর। তবু তোমার বাকি রাতের সুনিদ্রার কথা ভেবে তোমাকে এই খবর দেওয়া জরুরি ভেবেছিলুম। আর ডার্লিং জয়ন্ত, আগামীকাল সকালে আমরা সিন্ধুসভ্যতার ধ্বংসাবশেষ দেখতে যাব। শুভরাত্রি। সুনিদ্রা সুখের হোক! ….

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *