নীলপুরের নীলারহস্য – কিশোর কর্নেল সমগ্র ৪ – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
বৃষ্টিসন্ধ্যার চিঠি
শ্রাবণ মাসের সন্ধ্যা। টিপটিপিয়ে বৃষ্টি পড়ছিল। কর্নেলের ড্রয়িংরুমে বসে কফি খেতে খেতে প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে. কে. হালদার–আমাদের প্রিয় হালদার মশাইয়ের পুলিশ জীবনের গল্প শুনছিলুম। রোমাঞ্চকর সব গল্প। হালদারমশাই বলছিলেন,–বৃষ্টিবাদলার রাত্তিরে চোরগো চুরি করনের খুব সুবিধা। ক্যান? না–ঠাণ্ডা ওয়েদারে লোকেরা হেভি ঘুম ঘুমায়।… তো তখন আমি রাজশাহি জেলার চণ্ডীপুরে থানার অফিসার-ইন-চার্জ। লোকে তখন কইত বড়বাবু। এক বর্ষার রাত্তিরে—
কর্নেল ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে বসে চোখ বুজে চুরুট টানছিলেন। হঠাৎ বললেন,–হালদারমশাই! ঠাণ্ডা ওয়েদারে বড়বাবুদের ঘুম আরও হেভি হওয়ার কথা!
হালদারমশাই মাথা নেড়ে বললেন,–কী যে কন কর্নেলস্যার! তখন ব্রিটিশ আমল।
গল্পে বাধা পড়ায় বিরক্ত হয়ে বললুম,–এক বর্ষার রাতে কী হয়েছিল, তা-ই বলুন শুনি।
ঠিক এইসময় আরও রসভঙ্গ করে ডোরবেল বাজল এবং কর্নেল হাঁকলেন,–ষষ্ঠী!
একটু পরে একজন ধুতিপাঞ্জাবিপরা নাদুস-নুদুস গড়নের প্রৌঢ় ভদ্রলোক ঘরে ঢুকে কর্নেলকে নমস্কার করে বললেন,–চিনতে পারছেন তো স্যার? আমি নীলপুরের অঘোর অধিকারী। তা মনে করুন, চারপাঁচ বছর আগের কথা। সেই যে রায়মশাইয়ের বাড়িতে আমাকে দেখেছেন। তারপর মনে করুন হঠাই এসে পড়তে হল।
কর্নেল একটু হেসে বললেন,–বলুন অঘোরবাবু।
অঘোরবাবু সোফায় বসে বললেন,–তা মনে করুন, তিনটে পঁচিশের ট্রেনে চেপেছি। দমদমে একটা ঘণ্টা দাঁড়িয়ে রইল। শেয়ালদা পৌঁছুতে মনে করুন সাড়ে ছটা।
বুঝলুম, ‘মনে করুন’ বলাটা ভদ্রলোকের মুদ্রাদোষ। উনি ব্যস্তভাবে কাঁধের ব্যাগটা কোলে টেনে হাত ভরলেন। তারপর একটা চশমার খাপ বের করলেন। ভাবলুম চশমা পরবেন। কিন্তু আমাকে অবাক করে চশমার তলা থেকে একটা ভাঁজকরা কাগজ বের করে উনি কর্নেলকে দিলেন।
কর্নেল কাগজটার ভাঁজ খুলতে খুলতে বললেন, রায়মশাইয়ের চিঠি?
অঘোর অধিকারী বললেন,–তা মনে করুন রায়মশাই নিজেই আসতেন। কিন্তু বাড়ি ছেড়ে আসবেন কী করে? যা অবস্থা! তাই চিঠি লিখে মনে করুন আমাকেই পাঠালেন। এদিকে ফেরার ট্রেন রাত আটটা পাঁচে। সব ট্রেন তো নীলপুর স্টেশনে দাঁড়ায় না। তারপর মনে করুন আমি রাতবিরেতে রায়মশাইয়ের কাছে না থাকলেও চলে না।
কর্নেল চিঠিটা ততক্ষণে পড়ে ফেলেছেন। বললেন,–চিঠিটা আপনি চশমার খাপে ঢুকিয়ে রেখেছিলেন কেন অঘোরবাবু?
অঘোরবাবু বিষণ্ণ মুখে বললেন,–আজকাল মনে করুন কী যেন হয়েছে। কিছু মনে থাকে না। চশমার খাপের ভেতর চিঠিটা রাখলে মনে থাকবে। কেন জানেন স্যার? সঙ্গে একটা বই এনেছি। ট্রেনজার্নিতে সময় কাটাতে বইয়ের মতো জিনিস নেই। এদিকে মনে করুন, সারাক্ষণ চোখে চশমা পরে থাকতে পারি না। নতুন চশমা নিয়েছি তো! তাই মনে করুন–
কর্নেল তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,–ছাতি আনেননি দেখছি! আসবার সময় ট্যাক্সি পেয়েছিলেন। এখন না পেতেও পারেন।
–ঠিক বলেছেন স্যার। কিন্তু মনে করুন ছাতি এনেছিলাম। ওই যে বললুম কিছু মনে থাকে । ট্রেনে ফেলে নেমে এসেছি। তারপর মনে করুন ট্যাক্সির লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার সময় মনে পড়ল। এখনই উঠছি স্যার! শেয়ালদার কাছাকাছি ছাতার দোকান আছে। একটা কিনে নেব’খন।
বলে পা বাড়িয়ে অঘোরবাবু হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ালেন,–ওই যাঃ! বলতে ভুলে গেছি। আমি যে মনে করুন আপনাকে রায়মশাইয়ের চিঠি দিলুম, তার প্রমাণ আনতে বলেছেন উনি। আমারও ভুলো মন। আর রায়মশাইও মনে করুন কাকেও আজকাল বিশ্বাস করেন না। আমাকেও না। তাই মনে করুন চিঠি যে পেলেন, তা একটুখানি প্রমাণ
কর্নেল তাকে আশ্বস্ত করে বললেন,–দিচ্ছি। তারপর টেবিলের ড্রয়ার থেকে তার একটা নেমকার্ড বের করে উল্টোপিঠে কিছু লিখে দিলেন।
কার্ডটা অঘোরবাবু যথারীতি চশমার খাপে ভরে নমস্কার করে বেরিয়ে গেলেন।
হালদারমশাই হাসলেন,–খালি কয় মনে করুন। কী কাণ্ড!
বললুম;-তা মনে করুন, ভুলো মনের মানুষ। তাই মনে করুন অর্থাৎ স্মরণ করুন বলেন।
হালদারমশাই আরও হেসে অস্থির হলেন। কর্নেল চুরুটের ধোঁয়া ছেড়ে বললেন,–জয়ন্ত ঠিকই ধরেছে। তবে মনে করুন বলেও সবকিছু ঠিকঠাক মনে পড়ে না। নীলপুর কৃষ্ণনগরের কাছে। ওখানকার সরপুরিয়া বিখ্যাত। রায়মশাই আমার জন্য একপ্যাকেট সরপুরিয়া পাঠিয়েছিলেন। অঘোরবাবুর ব্যাগে সেটা থেকে গেছে।
হালদারমশাই তড়াক করে উঠে দাঁড়ালেন,–ওনারে রাস্তায় গিয়ে ধরব নাকি? সরপুরিয়া কত খাইছি! বলে জিভে জল টানার ভঙ্গি করলেন তিনি। তারপর দরজার দিকে পা বাড়ালেন।
অমনি আবার ডোরবেল বাজল। কর্নেল হাঁক দিলেন,–ষষ্ঠী!
একটু পরেই আবার অঘোর অধিকারীর আবির্ভাব ঘটল। কাঁচুমাচু মুখে তিনি ব্যাগ থেকে একটা প্যাকেট বের করে বললেন,–ভুলো মনের এই এক জ্বালা! রায়মশাই মনে করুন স্যারের জন্য সরপুরিয়া পাঠিয়েছেন। দিতে ভুলে গেছি।
মিষ্টান্নের প্যাকেটটা হলদে পলিব্যাগে মোড়া ছিল। দুহাতে কর্নেলকে এগিয়ে দিয়ে অঘোরবাবু চলে যাচ্ছিলেন। হালদারমশাই সকৌতুকে বললেন,–মনে করুন আর কিছু আছে নাকি?
আজ্ঞে না।–অমায়িক হাসলেন অঘোরবাবু : এবার মনে করুন বিদায় নিই। ট্রেন ফেল হবে।
কর্নেল স্মরণ করিয়ে দিলেন,–অঘোরবাবু! ছাতা! রাস্তার ছাতা কিনতে ভুলবেন না।
–তা মনে করুন বৌবাজারের মোড়ে কিনে ফেলব। বৃষ্টি পড়ছে। এবার আর ভুল হবে না। বলে নমস্কার করে অঘোরবাবু সবেগে বেরিয়ে গেলেন।
কর্নেল বললেন,–বৃষ্টির সন্ধ্যায় সরপুরিয়া খেতে মন্দ লাগবে না। আরেক দফা কফিও খাওয়া যাবে।
বলে তিনি ষষ্ঠীচরণকে ডেকে তিনটে প্লেট আর তিনটে চামচ আনতে বললেন। ষষ্ঠী তক্ষুনি প্লেট আর চামচ এনে দিল। কর্নেল শ্যাকেট খুলে সরপুরিয়া চামচে তুলে একটা প্লেটে নিজের জন্য একটুখানি রাখলেন। তারপর হালদারমশাই এবং আমার প্লেটে অনেকখানি তুলে দিলেন। বাকিটা ষষ্ঠীর জন্য রাখলেন। ষষ্ঠী ততক্ষণে কফির জল গরম করতে গেছে।
হঠাৎ দেখি, কর্নেল প্যাকেটটার তলার কাগজ সরিয়ে একটা মুখআঁটা খাম বের করছেন। হালদারমশাই খাওয়া বন্ধ করে গুলিগুলি চোখে তাকিয়ে রইলেন। আমি বললুম,–এ কী! অদ্ভুত
কর্নেল একটু হেসে বললেন,–হ্যাঁ। অদ্ভুত! নীলপুরের শিবশদ্ভু রায়ের এই চিঠিটাই আসল চিঠি। অঘোরবাবু বললেন : আজকাল রায়মশাই তাঁকেও বিশ্বাস করেন না। তাই খোলাচিঠিতে আমাকে শুধু ওঁর বাড়িতে শিগগির একবার যেতে বলেছেন। কোথায় নাকি আশ্চর্য প্রজাতির পরগাছা দেখেছেন ইত্যাদি। তারপর একপ্যাকেট সরপুরিয়া পাঠানোর কথা লিখে আন্ডারলাইন করে দিয়েছেন। কিন্তু আমি অঘোরবাবুকে ইচ্ছে করেই সরপুরিয়ার প্যাকেটের কথা মনে করিয়ে দিইনি।
গোয়ন্দাপ্রবর অবাক হয়ে শুনছিলেন। বললেন,–দ্যাননি ক্যান?
পরীক্ষা করতে চেয়েছিলুম সত্যি উনি ভুলো মনের মানুষ কি না। বলে কর্নেল খামটা টেবিলে পেপারওয়েট চাপা দিয়ে রাখলেন। তারপর সরপুরিয়াটুকু তারিয়ে তারিয়ে খেলেন।
হালদারমশাই বললেন,–বহু বৎসর সরপুরিয়া খাই নাই। জয়ন্তবাবুরে কই, মিষ্টান্ন খাইয়া জল খাইবেন না য্যান। অ্যাসিডিটি হইতে পারে।
কর্নেল সায় দিলেন,–ঠিক বলেছেন। জলের বদলে কফি নিরাপদ।
খামের ভেতর গোপন চিঠিতে নীলপুরের রায়মশাই কী লিখেছেন, তা জানার জন্য খুব আগ্রহ হচ্ছিল। কিন্তু কর্নেলের কোনো তাড়া লক্ষ্য করছি না। ষষ্ঠীচরণ ট্রেতে কফি আনল। কর্নেল তাকে বাকি সরপুরিয়াভর্তি প্যাকেটটা দিলে সে খুশি হয়ে নিল এবং একগাল হেসে বলল,–বাবামশাই একবার ঠিক এইরকম সন্দেশ এনেছিলেন।
কর্নেল চোখ কটমটিয়ে বললেন,–সরপুরিয়া।
আজ্ঞে। মনে পড়েছে বটে!–বলে ষষ্ঠী চলে গেল।
কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন,–নীলপুর নামের ইতিহাস আছে। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে ওখানে নীলের চাষ হত। একটা নীলকুঠি ছিল। তা ভেঙেচুরে কবে জঙ্গল গজিয়েছিল। নদীর ধারে সেই জঙ্গলে একসময় বাঘ থাকত। চারবছর আগে সেই জঙ্গলে নির্ভয়ে ঘোরাঘুরি করেছিলুম। ওখানে একটা শ্মশান আছে। কিন্তু স্থানীয় লোকেরা রাতবিরেতে সেই শ্মশানে মড়া পোড়াতে গেলে ধুন্ধুমার বাধায়।
হালদারমশাই বললেন,–ধুন্ধুমার? তার মানে?
–কয়েকটা ডেলাইট জ্বেলে লাঠিসড়কিবন্দুক নিয়ে ঢাকঢোল বাজাতে বাজাতে শ্মশানে যায়।
–ক্যান?
–নীলকুঠির জঙ্গলে নাকি একটা মড়াখেকো পিশাচ আছে।
–পিচাশ? কন কী!
হালদারমশাই পিশাচকে ‘পিচাশ’ বলে তা জানি। কিন্তু আমি রায়মশাইয়ের গোপন চিঠির জন্য। উসখুস করছিলুম। বললুম,–কর্নেল! চিঠিতে পিশাচের খবর আছে নিশ্চয়ই!
কর্নেল এবার খামের মুখ ছিঁড়ে বললেন,–থাকতেও পারে। সেবার ওখানে গিয়ে রায়মশাইয়ের বাড়ির দোতলা থেকে দুপুর রাতে একটা অমানুষিক গর্জন শুনতে পেয়েছিলুম। গর্জনটা ভেসে এসেছিল জঙ্গলের দিক থেকে। কিন্তু আগেই বলেছি, দিনের বেলায় জঙ্গলে ঘোরাঘুরি করে কোনো পিশাচ দেখিনি।
গোয়ন্দাপ্রবর বলে উঠলেন,–গর্জন শুনছিলেন! কিসের গর্জন?
জানি না–বলে কর্নেল চিঠিটা পড়তে থাকলেন। পড়ার পর তিনি চিঠিটা হালদারমশাইকে দিয়ে বললেন : দেখুন। রায়মশাইয়ের হারানিধি উদ্ধার করতে পারেন নাকি।
প্রাইভেট ডিটেকটিভ চিঠিটা পড়ছিলেন। তার গোঁফটা উত্তেজনায় তিরতির করে কাঁপছিল। উঁকি মেরে দেখলুম, চিঠিতে শুধু লেখা আছে :
আমার মহা সর্বনাশ হয়েছে। পূর্বপুরুষের সযত্নে রক্ষিত
রত্ন নীলা হারিয়ে গেছে। এ বাজারে দশ লক্ষ টাকা দাম।
দয়া করে শীঘ্র এসে উদ্ধারের ব্যবস্থা করুন।
কর্নেল বললেন,–নীলাটা আমাকে দেখিয়েছিলেন রায়মশাই। প্রায় মুরগির ডিমের সাইজ। রত্নটার নীল রঙে আলো পড়লে চোখ ঝলসে যায়। কিন্তু ওটা হারাল কী করে, তা লেখেন নি।
প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে.কে. হালদার উত্তেজিতভাবে বললেন,–নীলপুরে যাওয়া দরকার। কর্নেলস্যার কখন যাইবেন, কন। আমি আপনার লগে লগে যামু। নাকি আমি একা যামু? যামু কিসে?
কর্নেল বললেন,–তাই যান। ভোরে এসপ্ল্যানেড থেকে বাস ছাড়ে। ট্রেনের চেয়ে বাসই ভালো। তবে একটু হাঁটতে হবে এই যা। ….
.
রাতের উপদ্রব এবং বন্দুক
নীলপুরকে নেহাত পাড়াগাঁ ভেবেছিলুম। পরদিন দুপুরে সেখানে পৌঁছে দেখলুম, জমজমাট বাজার আর একতলা-দোতলা প্রচুর বাড়ি আছে। বিদ্যুৎ আছে। শিবশম্ভু রায়ের বাড়ি নীলপুরের শেষপ্রান্তে নদীর ধারে। উঁচু পাঁচিলঘেরা সেকেলে গড়নের দোতলা বাড়ি। তবে পাঁচিল এবং বাড়ির অবস্থা জরাজীর্ণ। এদিকটায় আমবাগান আর এখানে-ওখানে ঝোঁপ-জঙ্গল গজিয়ে আছে। বাড়ির গেটের অবস্থাও শোচনীয়।
কর্নেল বললেন,–চার বছর আগে রায় ভবনের অবস্থা এমন ছিল না। বোঝা যাচ্ছে, রায়মশাই আর বাড়ি মেরামতে মন দেননি। দিয়েই বা কী করবেন? এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলে থাকে আমেরিকায়। মেয়ে বাঙ্গালোরে।
গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই অঘোরবাবু বেরিয়ে এলেন। একগাল হেসে বললেন,–এসে গেছেন স্যার? তা এলেন কিসে? মনে করুন বাসে বেজায় ভিড়। তারপর মনে করুন রাস্তা একেবারে খানাখন্দে ভরা।
কর্নেল বললেন,–আমরা বাসে এসেছি অঘোরবাবু!
অঘোরবাবু জিভ কেটে বললেন, কী সর্বনাশ! ট্রেনে এলে মনে করুন আরামে আসতেন। বলে বাড়ির দিকটা দেখে নিয়ে চাপা স্বরে ফের বললেন,–একটা অনুরোধ স্যার। রায়মশাইকে যেন দয়া করে বলবেন না আমি কাল সন্ধ্যাবেলা আপনার কাছে গেছি। আজ্ঞে মনে করুন, আমি দুপুরেই গেছি।
-কেন বলুন তো?
অঘোরবাবু কাঁচুমাচু মুখে বললেন,–রায়মশাই মনে করুন আমাকে সক্কালেই পাঠিয়েছিলেন। স্টেশনে যাবার সময় শুনলুম, ফরেস্ট অফিস থেকে নানারকম গাছের চারা বিলি হচ্ছে। আমার মনে করুন বাগান করার খুব সখ। ওপাশে রায়মশাইয়ের পোড়ো জমিতে মনে করুন গাছের চারাগুলো পুঁতব। রায়মশাই বাড়ির ভেতর মনে করুন
কর্নেল হাসলেন,–বুঝেছি। সাপের ভয়ে বাড়ির ভেতরে গাছপালা ঝোঁপঝাড় গজাতে দেন না। তা আপনাদের কাছে কাল সন্ধ্যায় তো গাছের চারা দেখিনি?
–স্টেশনে ওগুলো হরির কাছে রেখে গিয়েছিলুম। আজ্ঞে হরির মনে করুন চায়ের দোকান আছে। খুব ভালো লোক স্যার। তারপর মনে করুন কাল রাত্রে ফেরার সময় চারাগুলো নিয়ে এসেছি।
–রায়মশাই আপনার এত দেরি করার কারণ জিজ্ঞেস করেন নি?
–তা আবার করবেন না? মনে করুন ওঁকে বলেছি, রেল অবরোধ হয়েছিল।
এই সময় দোতলার জানলা থেকে কারও ডাক ভেসে এল,–অঘোর! ও অঘোর!
অঘোরবাবু চেঁচিয়ে বললেন,–রায়মশাই! মনে করুন কর্নেলসায়েব এসে গিয়েছেন! তারপর গেটের দিকে ঘুরে হন্তদন্ত পা বাড়ালেন। একবার ঘুরে আমরা ওঁকে অনুসরণ করছি কি না দেখেও নিলেন।
বাড়ির ভেতর ঢুকে দেখলুম, লম্বাচওড়া চৌকো সেকেলে লাইম কংক্রিটের উঠোন। ডানদিকের পাঁচিলের একপাশে সমান্তরাল কিছু দেশি ফুলের গাছ আছে। কিন্তু গাছগুলোর তলা পরিষ্কার। একটা টিউবয়েল আছে। ফ্ৰকপরা এক কিশোরী বালতিতে জল ভরছিল। বাঁদিকের পাঁচিল ঘেঁষে একটা চালাঘর। টালির চাল। সেখানে গরু থাকে, তা বুঝতে পারলুম।
নীচের বারান্দায় রায়মশাইকে দেখা গেল। লম্বা শীর্ণ এক বৃদ্ধ মানুষ। গায়ে ফতুয়া। এবং হাঁটুঅব্দি তোলা ধুতি। তার হাতে একটা ছড়ি। মুখে পাকা গোঁফ। মাথার চুল কিন্তু কাঁচাপাকা এবং মধ্যিখানে সিঁথি। চেহারায় আভিজাত্য। কর্নেলকে নমস্কার করে বললেন,–আসুন কর্নেলসায়েব। আপনি না এসে পারবেন না এই বিশ্বাস অবশ্য ছিল। কারণ ইংরিজতে ও. কে. লিখে কার্ড পাঠিয়েছেন। অঘোর যে কার্ডখানা এনেছে, এই যথেষ্ট। ওর আজকাল কিছুই নাকি মনে থাকে না।
কর্নেল আমার সঙ্গে রায়মশাইয়ের পরিচয় করিয়ে দিলেন। রায়মশাই বললেন,–বাবাজীবন, আমার ছেলের বয়সী। কাজেই তুমি বলব।
বললুম,–নিশ্চয়ই বলবেন।
অঘোরবাবু নীচের তলায় একটা ঘরের তালা খুলছিলেন। রায়মশাই বললেন,–এখন ওঘরে নয়। কর্নেলসায়ের আগে আমার ঘরে যাবেন। অঘোর! কিনুঠাকুরকে বলে এখনই কর্নেলসায়েবের জন্য কফির ব্যবস্থা করো। দেরি কোরো না।
দোতলায় উঠে চওড়া বারান্দা দিয়ে হেঁটে শিবশঙ্কু রায় মাঝখানের একটা ঘরে তালা খুললেন। চাবি তাঁর পৈতেয় বাঁধা ছিল। ঘরের জানালাগুলো বড়ো এবং ভোলা। পর্দা একপাশে গুটানো আছে। পর্দার অবস্থা দেখে বুঝলুম, বাড়িটার মতোই জীর্ণ এবং বিবর্ণ।
উঁচু মেহগিনি পালঙ্ক একপাশে এবং অন্যপাশে গদিআঁটা কয়েকটা চেয়ার। একটা প্রকাণ্ড টেবিল। টেবিলে কীসব কাগজপত্র, ফাইল, একটা অ্যালার্মর্ঘড়ি এবং একটা ছোট্ট বাক্স। হোমিওপ্যাথি ওষুধের বাক্স মনে হল। তার পাশে দুটো মোটা অভিধানের মতো বই। নিশ্চয়ই হোমিও মেটিরিয়া মেডিকা।
ফ্যান চালিয়ে দিয়ে রায়মশাই বললেন,–বসুন আপনারা। আমি আসছি।
চেয়ারে বসে টুপি খুলে কর্নেল তার পিঠে আটকানো কিটব্যাগটা নীচে রাখলেন। বাইনোকুলার আর ক্যামেরা তাঁর কোলে বসল। আমার কাঁধের ব্যাগটা আমিও নামিয়ে রাখলুম। রায়মশাই পাশের ঘরে ঢুকেছেন ততক্ষণে।
পালঙ্কের কাছাকাছি ঘরের এককোণে পাশাপাশি দুটো কাঠের বদ্ধ আলমারি চোখে পড়ল। তার পাশে দেওয়ালে বসানো একটা আয়রন চেস্ট। বলতে যাচ্ছিলুম,–দশ লক্ষ টাকা দামের নীলা কি আয়রন চেস্টে ছিল? বলা হল না। রায়মশাই ফিরে এলেন দোনলা বন্দুক নিয়ে।
কর্নেল বললেন,–বন্দুক কেন রায়মশাই?
রায়মশাই চাপা স্বরে বললেন, আপনারা আসার একটু আগে ও-ঘরের জানালায় বন্দুকহাতে বসেছিলুম। একটা লোক আমবাগানের কাছে ঝোঁপের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিল। দুবার লোকটাকে সন্দেহজনকভাবে উঁকিঝুঁকি দিতে দেখেছি। বন্দুকের নল দেখামাত্র লুকিয়ে পড়েছে। তাই অঘোরকে ডাকছিলুম।
-কেমন চেহারা নোকটার?
–শুধু মাথাটা দেখেছি। মাথায় ছাইরঙা টুপি। মুখটা স্পষ্ট দেখতে পাইনি। অঘোর আসুক। ওকে ওদিকে লক্ষ্য রাখতে বলব।
কর্নেলের দিকে তাকালুম। চোখের ইশারায় ওঁকে বলতে চেয়েছিলুম, লোকটা নিশ্চয়ই আমাদের প্রিয় হালদারমশাই। কিন্তু কর্নেল আমার দিকে তাকালেন না। বললেন, আপনাকে সেবার বলেছিলুম জিনিসটা সাবধানে রাখবেন।
শিবশম্ভ রায় চাপাস্বরে বললেন,–সাবধানেই তো রেখেছিলুম। আগে কফি খেয়ে নিন।
অঘোরবাবু নিজেই কফি আনলেন ট্রেতে। বললেন, রায়মশাই! কিনুদাকে সায়েবদের জন্য মনে করুন স্পেশাল রান্না করতে বলেছি। ওবেলা বরং বাজার থেকে স্পেশাল মাছ-মাংস আনব। ততক্ষণে মনে করুন আমি গিয়ে দেখি, ভুলু কতটা জায়গা পরিষ্কার করল। বিকেলে মনে করুন গাছের চারাগুলো পুঁততেই হবে।
রায়মশাই বাঁকা হেসে বললেন, বাবুর বাগান করার সখ হয়েছে। বুঝলেন কর্নেলসায়েব? একগুচ্ছের কীসব গাছের চারা এনে রেখেছে।
কর্নেল হাসলেন, ভালো তো! এখন তো বৃক্ষরোপণ উৎসব চলেছে সবখানে। অঘোরবাবু সেই উৎসব পালন করবেন।
রায়মশাই বললেন,–মনমেজাজ ভালো থাকলে বলতুম, আপনি ওর বৃক্ষরোপণ উৎসব উদ্বোধন করবেন।
অঘোরবাবু কাঁচুমাচু মুখে বললেন,–আজ্ঞে মনে করুন গোটা দশবারো চারা! কিসের গাছ তা-ও জানি না। বিনিপয়সায় বিলি করছিল। তাই মনে করুন আমিও গিয়ে লাইন দিয়েছিলুম।
রায়মশাই তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,–অঘোর! ওসব কথা ছাড়ো! সকাল থেকে দেখছি, আমবাগানের পাশে ঝোঁপের ভেতর থেকে একটা লোক উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। তোমাকে ডেকে সাড়া পাইনি। আমি বন্দুক বাগিয়ে বসে ছিলাম। এবার দেখলেই গুলি ছুড়তুম।
অঘোরবাবু আঁতকে উঠে বললেন,–সর্বনাশ! তাহলে মনে করুন রাতবিরেতে কি ওই লোকটাই বাড়িতে ঢিল ছুঁড়ে আমাদের ভয় দেখাত? দিন তো আমাকে বন্দুকটা। ব্যাটাচ্ছেলেকে মনে করুন তাড়া করে গুলি ছুঁড়ে মনে করুন
রায়মশাই ওঁর হাতে সত্যিই বন্দুকটা দিলেন। বন্দুক কাঁধে নিয়ে অঘোরবাবু সবেগে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। রায়মশাই বললেন,–অঘোর! সাবধান! লোকটাকে সত্যি সত্যি গুলি করবি নে। তার মাথার ওপর গুলি ছুঁড়ে ভয় দেখাবি। দেখেছিস্ তো? সে-রাতে যেই গুলি ছুঁড়লুম, ঢিল পড়া বন্ধ হয়ে গেল।
অঘোরবাবু ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন। মুচকি হেসে বললেন, আমার মাথা খারাপ? সত্যি সত্যি কারও ঠ্যাংয়ে গুলি ছুঁড়লে মনে করুন উল্টে খুনের দায়ে ফেঁসে যাব না?
কর্নেল বললেন,–রাতবিরেতে বাড়িতে ঢিল পড়ত বুঝি?
রায়মশাই বললেন, হ্যাঁ। কফি খান। বলছি সে-সব কথা।
আমি বললুম,–অঘোরবাবুকে বন্দুক দিলেন। উনি বন্দুক চালাতে জানেন তো?
–সরকার আইন করে শিকার নিষিদ্ধ করেছেন। কিন্তু একসময় আমি অঘোরকে সঙ্গে নিয়ে নীলকুঠির জঙ্গলে হরিয়াল মারতে যেতুম। আমার সঙ্গী ছিল অঘোর। মাঝেমাঝে তাকেও গুলি ছোঁড়ার ট্রেনিং দিতুম। আসলে অঘোর আমার ঠাকুর্দার নায়েবের নাতি। ঠাকুর্দা ছিলেন জমিদার। জমিদারি উঠে যাওয়ার পর তাঁর নায়েব সদানন্দবাবু বৃদ্ধ বয়সে এবাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তার ছেলে রমাকান্ত-মানে অঘোরের বাবা কেষ্টনগরে স্কুলমাস্টারি করতেন। রমাকান্তকাকা হঠাৎ মারা গেলে। অঘোরকে নিয়ে তার বিধবা স্ত্রী সুধাময়ী আমাদের বাড়িতে এসে আশ্রয় নেন। সুধাকাকিমা বাড়ির কাজকর্ম করতেন। সে অনেক বছর আগের কথা। সুধাকাকিমা মারা গেলেন। অঘোর এবাড়িতেই থেকে গেল। বিয়ে করেনি। মাঝেমাঝে কোথায় উধাও হয়ে যেত। আবার ফিরে আসত। এখন বয়স হয়েছে। এদিকে আমিও একা মানুষ। অল্প কিছু জমিজমা আছে। অঘোেরই দেখাশুনা করে। বলে রায়মশাই করুণ হাসলেন : কর্নেলসায়েব এসব কথা জানেন।
কর্নেল বললেন,–রাত্রে বাড়িতে ঢিল পড়ার ব্যাপারটা বলুন।
গত সপ্তাহে একদিন মাঝরাত্রে নীচে অঘোরের চ্যাঁচামেচি শুনে ঘুম ভেঙে গেল। বারান্দায় বন্দুক হাতে গিয়ে টর্চের আলো জ্বেলে জিজ্ঞেস করলুম, কী হয়েছে? অঘোর বলল, বাড়ির ভেতর কোনো বদমাস ঢিল ছুঁড়ছিল।
–তখন বাড়িতে কি বিদ্যুৎ ছিল না?
–না। লোডশেডিং ছিল। নীলপুরের বিদ্যুতের হাল শোচনীয়। তো তারপর যে-রাতে লোডশেডিং হয়েছে, সেই রাতে ঢিল। সকালে দেখেছি, উঠোনে ইটপাটকেল ভর্তি। তারপর খেয়াল হল, হাতে বন্দুক থাকতে চুপ করে থাকা উচিত হচ্ছে না। পরশু রাতে তৈরি হয়েই ছিলুম। অঘোরের চ্যাঁচানি শুনে বারান্দা থেকে পরপর দুটো ফায়ার করলুম। ঢিলপড়া বন্ধ হল। তারপর সকালে আবিষ্কার করলুম নীলা চুরি গেছে।
–কোথায় রেখেছিলেন?
ঠিক এই সময় বাইরে কোথাও বন্দুকের গুলির শব্দ হল এবং অঘোরবাবুর চিৎকার শোনা গেল,–ধর! ধর! ভুলু! ভুলু! …
.
বটতলায় একটা নৌকোড়
রায়মশাই সেই পাশের ঘরে ঢুকে জানালা থেকে চিৎকার করছিলেন,–অঘোর! অঘোর!
কর্নেল ফফি শেষ করে চুরুট ধরালেন। তার কোনো চাঞ্চল্য দেখলুম না। বললুম,–নীচে গিয়ে ব্যাপারটা দেখা উচিত ছিল। হালদারমশাই উঁকি দিতে এসে বিপদে পড়লেন নাকি?
কর্নেল চোখ বুজে চুরুট টানতে থাকলেন। একটু পরে রায়মশাই এ ঘরে এসে বললেন, –অঘোর খামোকা একটা কার্তুজ নষ্ট করল। ওদিকটায় বনবাদাড়। আর ভুলু লোকটা ভীতুর শিরোমণি! দিনদুপুরে ভূত দেখতে পায়।
জিজ্ঞেস করলুম,ভুলুই কি আপনার বাড়িতে থাকে?
-না। ভুলু একজন দিনমজুর। অঘোরের বাগানের সাধ হয়েছে। তাই ওকে দুপুর পর্যন্ত কাজে লাগিয়েছে। জঙ্গল কেটে মাটিতে গর্ত করে রাখবে। ব্যস্।
কর্নেল চোখ খুলে বললেন,–অঘোরবাবুকে কোথায় দেখে এলেন?
–ও এক আস্ত গবেট। ঝোঁপের মধ্যে দাঁড়িয়ে ভুলুকে আঙুল তুলে দেখাচ্ছে, লোকটা কোনদিকে পালিয়েছে।
–এবার বলুন নীলা কোথায় রেখেছিলেন? রায়মশাই কপালে থাপ্পড় মেরে বললেন,–আমারই দুর্বুদ্ধি! আপনাকে দেখিয়ে ছিলুম, রত্নটা আয়রন চেস্টে থাকত। ঠাকুর্দার বাবার আমলের আয়রন চেস্ট। গতবছর চাবি ঢুকিয়ে ঘোরাতেই চাবি ভেঙে গেল। অঘোরকে দিয়ে কামার ডেকে এনে কোনোক্রমে খোলা তো হল। কিন্তু চাবির ভাঙা অংশটা কামার অনেক চেষ্টাতেও বের করতে পারল না। সে বলল,–কলকাতা থেকে মিস্তিরি আনতে হবে। অঘোর কলকাতা থেকে মিস্তিরি এনেছিল। বললে,–দেওয়াল ভেঙে আয়রন চেস্ট বের করে তার সঙ্গে কলকাতা পাঠাতে হবে। তা না হলে চাবি বের করা যাবে না। নতুন লক তৈরি করে লাগাতে হবে। সে এক হাঙ্গামা! তাই মিস্তিরিকে যাতায়াতের ভাড়া আর কিঞ্চিৎ বকশিস দিয়ে বিদেয় করলুম।
–তা হলে এখন আয়রন চেস্টের অবস্থা কী?
–কপাট ঠেলে আটকে রেখেছি। ভেতরকার জিনিস অন্যত্র সরিয়েছি।
–রত্নটা?
শিবশদ্ভু রায় চাপা স্বরে বললেন,–ওটা কিছুদিন কাঠের আলমারিতে লুকিয়ে রেখেছিলুম। তারপর ভাবলুম, নিরিবিলি জায়গায় বাড়ি। ডাকাত পড়লে আলমারি ভাঙবে সোনাদানার লোভে। তাই মাঝেমাঝে ঠাঁইবদল করে রাখতুম। কখনও পাশের ঘরের কুলুঙ্গিতে গণেশের তলায়। কাগজে মুড়েই রাখতুম। কখনও ওই পালঙ্কে গদির তলায়। আমার দুর্মতি। গত সপ্তাহে ওটা এই হোমিওপ্যাথির বাক্সের ভেতর একটা খোপে ঢুকিয়ে রাখলুম। ভাবলুম, এর ভেতর এমন দামি রত্ন আছে কেউ ভাবতেও পারবে না।
–ওটা হোমিওপ্যাথির বাক্স থেকেই চুরি গেছে?
রায়মশাই করুণ মুখে বললেন, হ্যাঁ।
–আপনি হঠাৎ হোমিওপ্যাথির দিকে মন দিয়েছিলেন কেন?
–ও! আপনি তো জানেন সে কথা। মধ্যে বছর দুয়েক পা আর কোমের বাত হয়েছিল। অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসায় সারেনি। তারপর নীলপুরের হোমিওপ্যাথির ডাক্তার অমর মুখুজ্যের চিকিৎসায় সেরে গেল। তখন নিজেই বইপত্তর পড়েটড়ে হোমিওপ্যাথির নেশায় পড়ে গেলুম। অঘোর, কিনু ঠাকুর, তার বউ মানদা, কিনুর মেয়ে কাকলি সব্বাই অসুখবিসুখে আমার ওষুধ খায়। বললে বিশ্বাস করবেন না, ম্যাজিক!
কর্নেল একটু হেসে বললেন,–ঠিক বলেছেন। ম্যাজিক। কিন্তু এই বাক্সটা কি এখানেই থাকে? নাকি মাঝেমাঝে নীচে নিয়ে গিয়ে অন্য রোগীদের চিকিৎসা করেন?
রায়মশাই বিমর্ষ ভাবে বললেন,–তা করি-মানে, কখনও-সখনও করেছি।
–গত একসপ্তাহের মধ্যে বাক্সটা নীচে নিয়ে গিয়ে কাকেও ওষুধ দিয়েছেন কি?
না!–রায়মশাই জোরে মাথা নাড়লেন,–তবে একদিন ভুলুর বউ তার বাচ্চার জন্য ওষুধ নিতে এসেছিল। তখন আমি শুধু ওষুধ নিয়ে নীচে গিয়েছিলুম। ওই সময় :দি কেউ এ ঘরে ঢুকে থাকে–বলেই তিনি আবার মাথা নাড়লেন,–বাইরের লোকের ঢোকার এশ্নই ওঠে না। বাড়ির কেউ ঢুকতে অবশ্য পারে। কিন্তু যে-ই ঢুকুক, সে কেমন করে জানবে এই বাক্সতে দামি রত্ন লুকোনো আছে?
–রত্নটার কথা বাড়ির কেউ কি জানে?
শিবশঙ্কু রায় জোরে মাথা নেড়ে বললেন,–নাহ! আমি কাকেও বলিনি। জানবার মধ্যে জানে শুধু আমার ছেলে অমলকান্তি। সে থাকে আমেরিকার ডালাসে। মেয়ে নন্দিতা থাকে বাঙ্গালোরে। আমার জামাই ওখানে টাউন প্ল্যানিংয়ের হর্তাকর্তা। বছরে মেয়ে-জামাই একবার আসে পুজোর সময়।
–তাহলে আপনার জামাইও জানেন?
–সুপ্রকাশের না জানার কারণ নেই।
এই সময় অঘোরবাবু বন্দুক কাঁধে নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ঘরে ঢুকলেন,– তা মনে করুন মানুষ না ভূত বোঝা গেল না। দেখলুম, ঝোঁপঝাড়ের ফাঁক দিয়ে মনে করুন একটা টুপি ভাসতে ভাসতে ভ্যানিশ হয়ে গেল। তন্নতন্ন খুঁজে পেলুম না। এদিকে ভুলুও মনে করুন–
রায়মশাই উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। বাধা দিয়ে বললেন,–বন্দুক দাও। খামোক একটা কার্তুজ খরচ করে এলে।
–তা মনে করুন, আপনিই গুলি ছুঁড়তে বলেছিলেন।
–খুব হয়েছে। কর্নেলসায়েবদের নিয়ে যাও। চান-টানের ব্যবস্থা করে যাইয়ে দাও। আমি যাচ্ছি।
একটু পরে নীচের একটা সাজানো-গোছানো ঘরে আমাদের ঢুকিয়ে দিয়ে অঘোরবাবু বললেন,–কাকলিকে স্নানের জল ভর্তি করতে বলি। স্নান করলে মনে করুন শরীর ফ্রেশ হয়ে যাবে।
কর্নেল বললেন,–আমি স্নান করব না অঘোরবাবু!
অঘোরবাবু বললেন, তাহলে মনে করুন আমি ভুলুর কাছে গিয়ে কতগুলো গর্ত করেছে দেখে আসি। তলায় মনে করুন গোবর-সার ফেলে জল ঢালতে হবে। বলে বারান্দায় গিয়ে তিনি ডাকলেন : কিনুদা! আমি এখনই আসছি। সায়েবদের খাওয়া রেডি করো …
খাওয়া-দাওয়া করে কর্নেল জানালার কাছে বসে চুরুট টানছিলেন। আমি বিছানায় অভ্যাসবশে গড়িয়ে নিচ্ছিলুম। একটু পরে কর্নেল বললেন,–জয়ন্ত! উঠে পড়ো। বেরুব।
–কোথায় বেরুবেন? হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলে কেলেঙ্কারি!
–বৃষ্টির লক্ষণ দেখছি না। জোরে বাতাস বইছে। ওঠো! নীলকুঠির জলে যদি দৈবাৎ পিশাচটার দেখা পাই!
কর্নেলের তাগিদে বেরুতে হল। গেট ভেজানো ছিল। বাইরে গিয়ে নেল বললেন, অঘোরবাবুর বাগান দেখে আসি।
বললুম,–বাগান তো এখনও হয়নি!
ভবিষ্যতে হবে।–বলে কর্নেল বাড়ির পূর্বদিকে গেলেন। তারপর বললেন : বাঃ! অনেকটা জায়গা পরিষ্কার করা হয়েছে। গাছের চারা বসানোর গর্তও হয়ে গেছে।
কর্নেল এগিয়ে গিয়ে গর্তগুলো গুনলেন। তারপর ওপাশে একটা ঘাসে ঢাকা জমিতে গিয়ে বাইনোকুলারে সম্ভবত পাখি খুঁজতে থাকলেন।
একটু পরেই তিনি হন্তদন্ত এগিয়ে গেলেন। অনুসরণ করতে হল। এখানে একা দাঁড়িয়ে থাকার মানে হয় না। একটা ছোট্ট নালা ডিঙিয়ে ঝোঁপজঙ্গলের ভেতর পায়েচলা পথ পাওয়া গেল। সেই পথ ধরে কিছুদূর যাওয়ার পর একটা প্রকাণ্ড বটগাছ এবং নীচে নদী দেখতে পেলুম।
বটতলায় গিয়ে কর্নেল একটু কাশলেন। অমনি অবাক হয়ে দেখলুম, গাছটার অন্য পাশে ঝুরির আড়াল থেকে আবির্ভূত হলেন প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে. কে. হালদার। আমাদের দেখে তিনি ফিক করে হাসলেন। তারপর বললেন,–ইরিগেশন বাংলার চৌকিদারের ম্যানেজ করছি। অসুবিধা হয় নাই। আপনারা আইলেন কি না খরব লইবার জন্য রায়মশায়ের বাড়ির পিছনে গিছলাম। কী কাণ্ড!
অঘোরবাবু সাংঘাতিক লোক। বন্দুক লইয়া তাড়া করছিল। একখান গুলিও ছুঁড়ছিল। কর্নেল বললেন, আপনি তাড়া খেয়ে কি সেচবাংলোয় চলে গিয়েছিলেন?
-হঃ। লাঞ্চ খাইয়া এখানে ওয়েট করছিলাম।
–আমাদের জন্য?
নাহ। আমি ক্যামনে জানব আপনারা এখানে আইবেন? –হালদারমশাই চারদিক দেখে নিয়ে চুপিচুপি বললেন : রায়মশায়ের বাড়ির কাছে অঘোরবাবুর তাড়া খাইয়া এখানে আইয়া পড়ছি, হঠাৎ দেখি একখান নাও ওখানে বান্ধা আছে। আমারে অরা দেখে নাই। মাঝি বিড়ি টানছিল। আর একজন প্যান্টশার্টপরা লোক নাওয়ের থিকা নাইম্যা মাঝিরে কইল, তুমি এখন যাও! চাইর-সাড়ে চাইর বাজলে এখানে আইয়া ওয়েট করবা।
কনের্ল দ্রুত বাইনোকুলারে যেদিক থেকে এসেছি, সেই দিকটা খুঁটিয়ে দেখে বললেন,–বাঃ! তাহলে অন্তত একজন সন্দেহজনক লোককে আবিষ্কার করেছেন।
গোয়েন্দাপ্রবর মিটিমিটি হেসে বললেন,–নাওখান যদি আগেই আইয়া পড়ে, মাঝির লগে আলাপ করুম। কী কন?
–কিন্তু জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বাংলোয় ফিরতে তো আপনার সন্ধ্যা হয়ে যাবে।
–সঙ্গে টর্চ আছে। ফায়ার আর্মস আছে।
–পিশাচের পাল্লায় পড়লে রিভলভার দিয়ে আত্মরক্ষা করা যাবে না হালদারমশাই।
হালদারমশাই একচোট হেসে বললেন,–পিচাশ? বাংলো চৌকিদারও কইছিল, নীলকুঠির জঙ্গলে পিচাশ আছে। কর্নেলস্যার! চৌতিরিশ বৎসর পুলিশে চাকরি করছি। কত রাত্রে বনেজঙ্গলে ঘুরছি। পিচাশ দেখি নাই। তবে আপনার লগে যাইয়া দুইবার নকল পিচাশ দেখছিলাম!
এখানকার পিশাচ নকল না হতেও পারে।-বলে কর্নেল বাইনোকুলারে নদী দেখতে থাকলেন। একটু পরে বললেন : একটা ছইঢাকা নৌকো আসছে।
হালদারমশাই বললেন,–যন্তরখান একবার দ্যান কর্নেলস্যার!
কর্নেল ওঁকে বাইনোকুলার দিলেন। গোয়েন্দাপ্রবর কিছুক্ষণ দেখার পর বললেন, হ্যাঁ।
নৌকোটা কিছুক্ষণের মধ্যে এসে পড়ল। হালদারমশাইয়ের ইচ্ছে ছিল একা গিয়ে আলাপ জমাবেন। কিন্তু কর্নেল এগিয়ে গিয়ে বললেন,–এই যে মাঝিভাই! আমাদের একটু বেড়াতে নিয়ে যাবে? ভাড়ার অসুবিধে হবে না। কত চাও?
মাঝি নৌকো বেঁধে বলল,–না স্যার। হরিপুরের বিশুবাবুর ভাড়া করা নৌকো। বাবু নীলপুরে শ্বশুরবাড়িতে আছেন। বাবু আর বাবুর বউ পাঁচটা নাগাদ এসে পড়বেন। কটা বাজছে স্যার?
হালদারমশাইয়ের মুখ দেখে মনে হল, কথাটা তিনি বিশ্বাস করেননি। …
.
একটুখানি ছাই এবং বিশুবাবু
হালদারমশাই মাঝির সঙ্গে আলাপ করলেন। বোঝা গেল, তিনি আমাদের সঙ্গী হতে চান না। বরাবর দেখে আসছি, ওঁর মনে কোনো খটকা বাধলে, উনি তার হেস্তনেস্ত না করে ছাড়বেন না। কোন্ হরিপুরের জনৈক বিশুবাবু সম্পর্কে ওঁর কেন খটকা বেধেছে, তা আপাতত জানা যাবে না।
ততক্ষণে কর্নেল হাঁটতে শুরু করেছেন। তাকে অনুসরণ করে বললুম, এদিকে কোথায় যাচ্ছেন?
নীলকুঠির জঙ্গলে।
কর্নেল বাইনোকুলারে পূর্বদিকে জঙ্গলের শীর্ষে সম্ভবত পাখি-টাখি দেখে নিলেন। তারপর ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে হন্তদন্ত হাঁটতে শুরু করলেন। মধ্যে মধ্যে ফাঁকা ঘাসজমি। তারপর জমাট ঝোঁপের মধ্যে উঁচু-নিচু গাছগুলো এলোমেলো বাতাসে দুলছে। চারদিকে অদ্ভুত শোঁ শোঁ শনশন শব্দ।
এদিকে আমি প্রতিমুহূর্তে সাপের ছোবল খাওয়ার আশঙ্কায় বিপন্ন বোধ করছি। তবে কর্নেল আমার আগে আছেন। সাপ ফোঁস করে উঠলে প্রথমে তিনিই টের পাবেন। কিছুক্ষণ পরে ইটের চাবড়া দেখতে পেলুম। তা হলে এটাই নীলকুঠির ধ্বংসাবশেষ। এখানে গাছের তলা মোটামুটি ফাঁকা এবং এখানে ওখানে ছড়িয়ে আছে প্রকাণ্ড সব লাইম-কংক্রিটের স্তূপ।
কর্নেল আরও কিছুটা এগিয়ে থমকে দাঁড়ালেন। তারপর আমাকে ইশারায় দাঁড়াতে বলে একটা উঁচু প্রকাণ্ড স্তূপের দিকে পা টিপে টিপে এগিয়ে গেলেন। তিনি জঙ্গলে ঢাকা পটার কাছাকাছি গেছেন, অমনি ধুপধুপ শব্দে কেউ যেন দৌড়ে পালিয়ে গেল। কর্নেল ততক্ষণে তূপের ওপাশে চলে গেছেন।
আচমকা এরকম ধুপধুপ দৌড়ে যাওয়ার শব্দ শুনে হকচকিয়ে গিয়েছিলুম। কর্নেল স্তূপের আড়ালে অদৃশ্য হতেই ডাকলুম,–কর্নেল। কর্নেল!
কর্নেলের সাড়া এল,–এখানে এসো জয়ন্ত!
স্কুপের ওপাশে গিয়ে দেখি, কর্নেল খানিকটা ছাইয়ের কাছে হাঁটু মুড়ে বসে আছেন। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলুম-কী দেখছেন?
কর্নেল হাসলেন,–যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তা-ই, পাইলে পাইতে পারো অমূল্য রতন। এই পদ্যটা তুমি নিশ্চয় পড়েছ। লক্ষ্য করো, ছাইটুকু থেকে এখনও ধোঁয়া উঠছে।
-কেউ এখানে সবে আগুন জ্বেলেছিল মনে হচ্ছে। পালিয়ে গেল কেন?
কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,–ইস্স্। আর দু-তিন মিনিট আগে আসতে পারলে লোকটাকে হাতে-নাতে ধরে ফেলতুম। বাইনোকুলারে ওকে জঙ্গলে ঢুকতে দেখে সন্দেহ হয়েছিল বটে, কিন্তু অনুমান করতে পারিনি ওর উদ্দেশ্য কী। এখন বোঝা গেল।
-ওটা কীসের ছাই?
তুমিই পরীক্ষা করে বলল এটুকু ছাই কিসের হতে পারে!-কর্নেল কয়েক পা এগিয়ে ঘাসের ভেতর থেকে একটা দেশলাই কুড়িয়ে নিলেন। বললেন : লোকটা দেশলাই ফেলে পালিয়েছে দেখছি! তার মানে সে যা পোড়াচ্ছিল, তা গোপন কিছু!
ছাইটুকু লক্ষ্য করে বললুম,–কাগজপোড়া মনে হচ্ছে।
–ঠিক ধরেছ।
–কিন্তু লোকটাকে পালানোর সময় দেখতে পাননি?
–কাছেই এই ঝোঁপটা দেখছো, এর ভেতর ঢুকে গিয়ে সামনে স্তূপের আড়াল হওয়া সোজা।
–তার পালিয়ে যাওয়ার শব্দ শুনতে পেয়েছি।
কর্নেল আতসকাঁচ বের করে ছাইটুকু পরীক্ষা করে বললেন,–মনে হচ্ছে একটা চিঠি।
অবাক হয়ে বললুম,–একটা চিঠি পুড়িয়ে ফেলার জন্যে এই জঙ্গলে ঢোকার কী দরকার ছিল?
কর্নেল হাসলেন,–লোকটা যে-ই হোক, বেশি সাবধানী। রায়মশাইয়ের বাড়ির দোতলা বা ওঁর ঘরের জানালা থেকে চারপাশটা দেখা যায়। খোলামেলা জায়গা। কাজেই চিঠিটা নীলকুঠির জঙ্গলে পোড়ানো নিরাপদ। চলো! ফেরা যাক।
জঙ্গল পেরিয়ে পোড় ঘাসে ঢাকা মাঠ এবং সেই নালা পেরিয়ে গিয়ে বললুম,–চিঠি পোড়ানোর ব্যাপরাটা মাথায় ঢুকছে না। কেউ কোনো গোপনীয় চিঠি পোড়াতে চাইলে আমরা এখানে আসবার আগেই পুড়িয়ে ফেলতে পারত। হঠাৎ আজ বিকেলে কেন পোড়াল?
কর্নেল বললেন,–যত ভাববে, মাথার ঘিলু বিগড়ে যাবে। ছেড়ে দাও।
রায়মশাইয়ের বাড়ির কাছাকাছি গিয়ে দেখলুম, অঘোরবাবু গাছের চারাগুলো গর্তে বসিয়ে ঝারি থেকে জল ঢালছেন। আমাদের দেখতে পেয়ে একগাল হেসে বললেন,–তা মনে করুন, চারাগুলো তাজা। একবছরেই আঁকড়া হয়ে বেড়ে উঠবে।
কর্নেল চোখ বুলিয়ে চারাগুলো দেখে বললেন,–কিন্তু বেড়া না দিলে গরুছাগলে মুড়িয়ে ফেলবে অঘোরবাবু!
–তা কি দেব না ভাবছেন স্যার? ওই দেখুন রায়মশাইয়ের বাঁশঝাড়। পারমিশন নিয়ে নিয়েছি। কাল ভোরে ভুলু কাটারি নিয়ে আসবে। আমি বাজার থেকে দড়ি কিনে আনব।
–বাঃ! কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, চারাগুলো একজাতের গাছের হলে ভালো হত। এটা মনে হচ্ছে আকাশমণি। পরেরটা শিরিষ। কী আশ্চর্য! এটা মনে হচ্ছে অর্জুন গাছ। আর ওটা সম্ভবত ইউক্যালিপ্টাস!
অঘোর অধিকারী বললেন,–হো না! বিনিপয়সায় পেয়েছি।
–কিন্তু এত ঘন করে লাগানো ঠিক হয়নি। গাছগুলো বেড়ে উঠলে ঠাসাঠাসি হয়ে যাবে।
–আজ্ঞে স্যার! মনে করুন গাছ দেখতে ভালোবাসি। তারপর মনে করুন এগুলো হবে আমার নিজের গাছ। বুড়ো বয়সে এখানে কুটির তৈরি করে মনে করুন মুনিঋষির মতো বসে থাকব। রায়মশাই মনে করুন যখন স্বর্গধামে, তখন তো আমার ও বাড়িতে ঠাই হবে না। ওঁর ছেলে বা মেয়েজামাই বাড়ি বেচে দেবেন। সেইসব ভেবেই মনে করুন এই প্ল্যান মাথায় এসেছিল।
–চমৎকার প্ল্যান! আপনার বুদ্ধির প্রশংসা করি অঘোরবাবু।
অঘোরবাবু হাসতে হাসতে বললেন,–আজ্ঞে স্যার। আমার যে বড্ড ভুলো মন। তাই আগেভাগেই মনে করুন নিজের আশ্রম পত্তন করে রাখলুম।
অঘোরবাবু দাঁড়িয়ে রইলেন। আমরা রায়বাড়িতে গিয়ে ঢুকলুম। রায়মশাই উঠোনের শেষপ্রান্তে গরুর চালাঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমাদের দেখে এগিয়ে এলেন। বললেন,–নীলকুঠির জঙ্গলে ঢুকেছিলেন নাকি?
কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। জয়ন্তকে নীলকুঠির ধ্বংসাবশেষ দেখিয়ে আনলুম।
বর্ষার সময় জঙ্গলে ঢোকা উচিত হয় নি। সাপ থাকতে পারে। বলে রায়মশাই হাঁক দিলেন : কিনু! সায়েবদের কফি তৈরি করে আনো। অঘোর বোধ করি গাছের চারা পুঁতছে। পাগল একটা!
আমাদের থাকার ঘরের তালা আঁটা ছিল। খাপ্পা হয়ে রায়মশাই বললেন,–চাবি অঘোরের কাছে। কাকলি! এ ঘরের চাবি নিয়ে আয়। অঘোরের কাছে আছে।
কিনু ঠাকুরের মেয়ে কাকলি দৌড়ে বেরিয়ে গেল।
কর্নেল আস্তে বললেন,–আচ্ছা রায়মশাই! আপনি হরিপুরের বিশুবাবু নামে কাউকে চেনেন–নীলপুরে তার শ্বশুরবাড়ি?
রায়মশাই ভুরু কুঁচকে বললেন,–তাকে চেনেন নাকি?
–না। নদীর ঘাটে নৌকো রেখে বিশুবাবু নাকি শ্বশুরবাড়ি বউকে আনতে গেছেন। নৌকোর মাঝি বলল। ওটা নাকি ছোট ঘাট। নতুন তৈরি হয়েছে।
রায়মশাই চাপা স্বরে বললেন,–ঠক! জোচ্চোর। চিটিংবাজ। আগে তো নীলপুরেই থাকত। ঘরজামাই ছিল। হরেন দত্তর আড়ত আছে। একটিমাত্র মেয়ে। তাই বিশুকে আড়তে বসিয়েছিল। বদমাস বিশু এরিয়ার চোরডাকাতদের চোরাই মাল কিনত আর কলকাতায় বেচে আসত। শেষে পুলিশ ওকে ধরেছিল। হনের টাকাকড়ি খরচ করে জামাইকে ছাড়িয়ে এনেছিল। কিন্তু বিশু কোন মুখে আর শ্বশুরবাড়িতে থাকবে? কদিন আগে হরেন বলছিল, তার মেয়ে রাগ করে চলে এসেছে। তাই বুঝি বিশু শ্বশুরবাড়ি এল। কিন্তু অমন চোরাপথে কেন? মাঝি বুঝি আপনাদের বলল ছোট ঘাট? নতুন ঘাট? বোগাস! ওখানে ঘাট নেই।
–বিশুবাবু কি আপনার বাড়িতে কখনও এসেছেন?
–নাহ। আমার কাছে ওর কী কাজ থাকতে পারে? এলে বাড়ি ঢুকতেই কেন দেব?
অঘোরবাবু দৌড়ে এলেন,–ইস্! কর্নেলসায়েবদের দেখেও মনে করুন চাবির কথা মনে পড়েনি। আমার ভুলো মন! ছ্যা ছ্যা ছ্যা!
বলে তিনি তালা খুলে দিলেন। রায়মশাই বললেন,–চাবিটা আমাকে দাও অঘোর। তোমার ভুলো মন নিয়ে আমার সব সময় প্রব্লেম। দাও!
চাবিটা রায়মশাইকে দিয়ে অঘোরবাবু টিউবয়েলে হাত-পা ধুতে গেলেন। দেখলুম, কাকলি হাতল টিপে দিচ্ছে।
ঘরে বসে কফি খেতে খেতে শাঁখ বাজল। সম্ভবত কিনু ঠাকুরের স্ত্রী মানদা শাঁখে ফুঁ দিচ্ছেন। রায়মশাই বললেন,–সন্ধ্যা-আহ্নিক সেরে আসি। আপনারা রেস্ট নিন। বলে তিনি সুইচ টিপে আলো জ্বেলে দিলেন। ফ্যানের স্পিড বাড়িয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
কফি খাওয়ার পর কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন,–বিশুবাবুর যা পরিচয় পেলুম, হালদারমশাই বিপদে পড়েন।
বললুম,–হালদারমশাইয়ের কাছে রিভলভার আছে।
কর্নেল কী বলতে যাচ্ছিলেন, অঘোরবাবু চায়ের কাপ হাতে ঘরে কে একটা চেয়ারে বসলেন। বললেন,–তা মনে করুন আজ শান্তিতে ঘুমুতে পারব।
কর্নেল বললেন,–হ্যাঁ। নিজের আশ্রমের শিলান্যাস করলেন!
–আজ্ঞে না, না! সে কথা বলছি না। আপনি এসেছেন তাই মনে করুন বাড়িতে আর টিল পড়বে না রাতবিরেতে।
ঢিলপড়া নাকি গতরাত থেকে বন্ধ হয়েছে?
অঘোরবাবু চাপা স্বরে বললেন,–গতরাতেও মনে করুন ঢিল পড়েছিল। রায়মশাইকে কিছু জানতে দিইনি আমরা। কিনুদাকে জিজ্ঞেস করুন। জানলে গুলি খরচ করতেন। কার্তুজের যা দাম মনে করুন!
–আচ্ছা অঘোরবাবু, আপনি নীলপুরের হরেন দত্তর জামাই বিশুবাবুকে চেনেন? অঘোরবাবু নড়ে বসলেন,খুব চিনি। তাকে মনে করুন কোথায় দেখলেন?
–নদীর ঘাটে নৌকো থেকে নেমে গ্রামে ঢুকেছেন।
ব্যাটাচ্ছেলের কাছে মনে করুন আমি পনেরো টাকা পাব। ধার করেছিল। শোধ দেয়নি। রাতের আঁধার মনে করুন কখন কেটে পড়বে। এক্ষুনি গিয়ে ওকে মনে করুন ধরে ফেলতেই হবে।–বলে অঘোরবাবু দ্রুত বেরিয়ে গেলেন। ..
.
স্বপ্নের বাগান
একটু পরে কর্নেল জানালায় উঁকি মেরে বললেন,–অঘোরবাবু টর্চ জ্বেলে টাটুঘোড়ার মতো দৌড়ে গেলেন।
বললুম,–কিন্তু হরিপুরের বিশুবাবুকে কি আর উনি শ্বশুরবাড়িতে পাবেন? নৌকোর মাঝি বলছিল বিকেল পাঁচটা নাগাদ উনি সস্ত্রীক নৌকোয় উঠবেন। আপনি অঘোরবাবুকে কথাটা বললেই পারতেন।
কর্নেল বললেন,–তাই তো! আমারও দেখছি বড্ড ভুলো মন। বেচারা অকারণ হয়রান হয়ে ফিরে আসবেন। কিংবা বলা যায় না, নদীর দিকে দৌড়বেন। কিন্তু তোমারও কি ভুলো মন জয়ন্ত? তুমি ওঁকে বললে না কেন?
একটু হেসে বললুম,–তা মনে করুন একটু ভুলো মন হয়ে পড়েছি। হালদারমশাই আমাকে অন্যমনস্ক করেছেন।
সাবধান জয়ন্ত! অঘোরবাবুর কথা নকল করতে গিয়ে তুমিও মুদ্রাদোষের কবলে পড়বে।–বলে কর্নেল দরজার কাছে গেলেন : হালদারমশাইয়ের জন্য আমিও উদ্বিগ্ন। আমার এখনই নদীর ধারে যাওয়া উচিত।
–আমিও যাব আপনার সঙ্গে।
কর্নেল বললেন,–থা। আর তোমাকে সন্ধ্যাবেলায় বনবাদাড়ে হাঁটতে হবে না। আমার পায়ে হান্টিং বুট আছে। সাপের দাঁত বিবে না। তুমি অপেক্ষা করো। আমি বেরুচ্ছি। পথে বরং গাছের ডাল কেটে একটা লাঠি বানিয়ে নেব।
কর্নেল তাঁর কিটব্যাগটা পিঠে এঁটে বেরিয়ে গেলেন। বাইনোকুলার এবং ক্যামেরা নিলেন না। কিটব্যাগে জঙ্গলকাটা কাটারি আছে, তা আমি জানি।
কিছুক্ষণ পরে রায়মশাইয়ের সাড়া পাওয়া গেল। ডাকলেন,–অঘোর। অঘোর!
বারান্দায় কাকলি দাঁড়িয়ে ছিল। সে বলল,–ছোটবাবু টর্চ নিয়ে কোথায় বেরিয়েছেন।
রায়মশাই বললেন,–টর্চ নিয়ে? তার মানে বাজারে আড্ডা দিতে গেছে। আবার আড্ডাবাজ হয়েছে অঘোর। কাল অত রাতে ফিরল। বলল ট্রেন লেট। মিথ্যা কথা। পরশু রাতেও ফিরল দশটার পর। আসুক! মজা দেখাচ্ছি।
বলে উনি আমাদের ঘরে ঢুকলেন। জিজ্ঞেস করলেন,–কর্নেলসায়েবকে অঘোর সঙ্গে নিয়ে গেছে বুঝি?
বললুম,–না। কর্নেল সেচবাংলোয় ওঁর একজন বন্ধুর কাছে গেছেন।
রায়মশাই একটা চেয়ার টেনে বসে চাপা স্বরে বললেন, আপনি তো কর্নেলসায়েবের কাছের মানুষ। আমার জিনিসটার ব্যাপারে তদন্ত-টদন্ত কতদূর করলেন জানেন?
বললুম, মনে হচ্ছে, তদন্ত করতেই বেরিয়েছেন। কারণ সেচবাংলোয় ওঁর সেই বন্ধু একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ। আগেই ওই ভদ্রলোককে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন কর্নেল।
রায়মশাই খুশি হয়ে বললেন,–কর্নেলসায়েবের ওপর আমার ভরসা আছে। আপনি নিশ্চয়ই জানেন, আগেরবার এখানে উনি এসে নীলকুঠির জঙ্গলের পিশাচ রহস্য ফর্দাফাই করেছিলেন।
-বলেন কী? আমি জানি না তো! কর্নেল শুধু বলেছেন, ওই জঙ্গলে রাতদুপুরে অমানুষিক গর্জন শুনেছিলেন।
রায়মশাই হাসলেন,–ওটা ছিল চোরাচালানিদের ঘাঁটি। শ্মশানে রাতবিরেতে শবযাত্রীরা গেলে ওদের নৌকো চোখে পড়ে সন্দেহ হতেই পারে। তা পিশাচের গপ্পো রটিয়েছিল ব্যাটাচ্ছেলেরা। আর ওই অমানুষিক গর্জন ব্যাপারটা মাইক্রোফোনে বিকট চিৎকার। কর্নেল দলটাকে পুলিশ দিয়ে পাকড়াও করিয়েছিলেন। তবে এই গোপন ব্যাপার বাইরের লোকেরা তো জানে না। তাই এখনও রাতবিরেতে শ্মশানযাত্রীরা ডেলাইট জ্বেলে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঢাকঢোল বাজায়।
রায়মশাই এবার ঘটনাটা বিস্তারিত শুনিয়ে ছাড়লেন। তার কিছুক্ষণ পরে কর্নেল এসে গেলেন। বারান্দার নীচে থেকে বললেন,–জঙ্গলে জলকাদায় আছাড় খেয়েছি রায়মশাই। শর্টকাটে আসতে গিয়ে এই বিপদ। এক বালতি জল চাই।
রায়মশাই উঠে গেলেন,–কাকলি! এখানেই জল এনে দে। ইহ : হাতে আর জুতোয় কত কাদা লেগে গেছে!
কাদা ধুয়ে কর্নেল ঘরে ঢুকলেন। জিজ্ঞেস করলুম, হালদারমশাইয়ের খবর কী?
কর্নেল আমার কথায় কান দিলেন না। তোয়ালেতে হাত মুছে জুতো খুলে চটি পরলেন। তারপর বললেন,–রায়মশাই! কফি খাব।
নিশ্চয়ই খাবেন। কিনু! সায়েবকে কফি দাও-বলে চাপা স্বরে জিজ্ঞেস করলেন : খবর আছে। কিছু?
–আছে। কফি খেয়ে আপনার ঘরে গিয়ে বলব।
রায়মশাই অস্থির হয়ে বললেন, তাহলে বরং আমার ঘরেই চলুন। সেখানেই কফি পাঠাতে বলছি।
কর্নেল একটু হেসে বললেন, ঠিক আছে। তাই চলুন। জয়ন্ত! তুমিও এসো।…
দোতলায় রায়মশাইয়ের ঘরে গিয়ে বসার পর কিছুক্ষণের মধ্যে কিনুঠাকুর কফি আর পাঁপরভাজা দিয়ে গেলেন। কর্নেল বনে,রায়মশাই! সিঁড়ির দরজাটা ভেতর থেকে আটকে দিয়ে আসুন।
রায়মশাই এ কাজে দেরি করলেন না। খবর শোনার জন্য আমিও উদগ্রীব। কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে চাপা স্বরে বললেন,–সুখবর। কিন্তু আগে বলুন, জিনিসটা কিসের ভেতর রেখেছিলেন?
-ওটা ছিল একটা রুপোর কৌটোর মধ্যে। আমি রুপোর কৌটো ওই আলমারিতে রেখে হোমিওপ্যাথি ওষুধ যে সাদা কাগজে দিই, তার মধ্যে মুড়ে রেখেছিলুম–যাতে চোরডাকাতের সন্দেহ না হয়।
কর্নেল প্যান্টের পকেট থেকে একটা ছোট্ট কৌটো বের করলেন। সেটা অ্যালুমিনিয়ামের। এ ধরনের কোটোয় লোকেরা দোক্তা খায় দেখেছি। কর্নেল বললেন,–এই কৌটোটা কার চিনতে পারছেন কি?
-না তো!
কৌটোটা নতুন কেনা।–বলে কৌটোর মুখ খুলে কর্নেল প্রায় মুর্গির ডিমের গড়ন একটা নীল পাথর টেবিলে রাখলেন। পাথরটাতে আলোর ছটা পড়ে ঝলমল করছিল।
রায়মশাই দুহাতে নীলাটা নিয়ে কপালে ঠেকিয়ে বললেন,–ভগবান আপনার মঙ্গল করুন।
রায়মশাইয়ের চোখ জলে ভিজে গেল।
অবাক হয়ে বললুম,–এটা কার কাছে কোথায় হঠাৎ উদ্ধার করলেন?
কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন,–ওই কথাটা আমার বলা বারণ। রায়মশাই, রত্নটা এবার যত্ন করে ভালো জায়গায় রাখুন। কাঠের আলমারি নিরাপদ নয়। আপনার ঘরে গতবারে একটা ছোট সিন্দুক দেখেছিলুম। সেটা কোথায়?
রায়মশাই বললেন,–খাটের তলায় পড়ে আছে। বহুদিন ব্যবহার হয় না।
–ওটা ঐ সিন্দুকের মধ্যে রাখুন। কিন্তু সাবধান। ওঘরে আপনার অগোচরে কেউ যেন না ঢুকতে পারে। …
সে রাতে কর্নেলকে অনেক প্রশ্ন করেও জানতে পারলুম না, এত সহজে কী করে তিনি দশ লক্ষ টাকা দামের নীলা উদ্ধার করলেন।
সকালে উঠে দেখি, কর্নেল যথারীতি প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছেন। আজও আকাশে বৃষ্টিমেঘ ছিল না। মনে হচ্ছিল যেন শরঙ্কাল। আমি ঘুম থেকে উঠে কফির বদলে চা খাই। চা খাওয়ার পর বেরিয়ে গেলুম। অঘোরবাবুর হাঁকডাক শোনা যাচ্ছিল। বাড়ির পূর্বদিকে গিয়ে দেখলুম, সেই ভুলু বাঁশ কেটে এনেছে এবং বেড়ার আয়োজন চলেছে। আমাকে দেখে অঘোরবাবু হাসলেন,–এতক্ষণে উঠলেন বুঝি? কর্নেলসায়েবকে মনে করুন একবার নীলকুঠির জঙ্গলে দেখলুম।
বললুম,–অঘোরবাবু! কাল সন্ধ্যায় বিশুবাবুর দেখা পেয়েছিলেন?
অঘোরবাবু বেজার মুখে বললেন,–না। মনে করুন সে বিকেলেই কেটে পড়েছিল।
চারাগুলো একরাত্রেই সতেজ হয়ে উঠেছে। দেখতে দেখতে বললুম,–চারাগুলোর ডালে দড়ি বাঁধা আছে। কেটে ফেলা উচিত।
-হ্যাঁ। কেটে ফেলব। আর মনে করুন দুতিনটে দিন যাক্।
একটা চারার দুটো ডালে সাদা সুতো বাঁধা এবং একটা চিরকুট আটকানো দেখে বললুম,–এটা আবার কী?
–তা মনে করুন ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের স্লিপ। গাছের নাম লেখা আছে। কিছুক্ষণ বেড়াবাঁধার কাজ দেখার পর বাড়ির ভেতর গেলুম। দেখলমু, কখন কর্নেল বাড়ির পশ্চিমদিক ঘুরে বাড়ি ঢুকেছেন। বললুম,–হালদারমশাই কেমন আছেন? যাননি সেচবাংলোয়?
কর্নেল ঘরে ঢুকে বললেন,–হালদারমশাই এতক্ষণ নীলপুর বাসস্টপে। সেচবাংলোয় গিয়ে দেখা করেছি। এ যাত্রা উনি অক্ষত শরীরে আছেন। তবে হরিপুরের বিশু যেতে দেরি করেছিল। রাত নটায় নৌকোয় হালদারমশাইকে দেখে সে খাপ্পা হয়েছিল। হালদারমশাই কিছু বলার আগে বিশু তাকে ধাক্কা মেরে জলে ফেলে দিয়েছিল। ওখানে অবশ্য হাঁটু পর্যন্ত জল। হালদারমশাই পাড়ের ঝোঁপ আঁকড়ে না ধরলে কী ঘটত বলা যায় না। যাই হোক, ব্রেকফাস্ট করে আমরাও বাসস্টপে যাব। উনি অপেক্ষা করবেন আমাদের জন্য।…
ব্রেকফাস্ট করে রায়মশাইয়ের কাছে বিদায় নিয়ে বেরুচ্ছিলুম। অঘোরবাবু এসে বললেন,–তা মনে করুন কোথায় চললেন স্যার?
কর্নেল বললেন,–কলকাতা ফিরতে হচ্ছে। চলি অঘোরবাবু! পরে আপনার বাগান দেখতে আসব।
অঘোরবাবু বললেন,–আজ্ঞে আসবেন বৈকি। তা মনে করুন বাগান আমার স্বপ্ন।…
শর্টকাটে বাসস্টপ যাবার পথে বললুম,–কর্নেল! নীলা উদ্ধারের রহস্যটা এবার না বললে মনে করুন
সাবধান জয়ন্ত!–কর্নেল অট্টহাসি হাসলেন : ওই মনে করুন বড় সাংঘাতিক জিনিস। বাইনোকুলারে দূর থেকে দেখছিলুম, তুমি অঘোর অধিকারীর স্বপ্নের বাগানে দাঁড়িয়ে ছিলে। চারাগুলোর মধ্যে কোনো বৈশিষ্ট্য তোমার চোখে পড়েনি?
একটু ভেবে বললুম,–চারাগুলোর ডালে দড়ি বাঁধা ছিল। আর একটা চারার ডালে সাদা সুতোয় বাঁধা ছিল বনবিভাগের চিরকুট।
কর্নেল বললেন,–দোক্তার কৌটোয় নীলা ভরে অঘোর অধিকারী ওই চারাটার তলায় পুঁতে রেখেছিল। বিশুর সঙ্গে নিশ্চয়ই কথা হয়েছে। অঘোর এখনও জানে না তার চোরাইমালে বাটপাড়ি হয়েছে। তাই আহ্লাদে আছে। আসলে এটা আমার অঙ্ক, জয়ন্ত! এতকাল পরে হঠাৎ অঘোর অধিকারীর বাগান করার সখ হয়েছে! কতকগুলো চারা জোগাড় করেছে। কাল সন্ধ্যায় বেরিয়ে চিরকুটবাঁধা চারাটা ওপড়াতেই কৌটোটো টর্চের আলোয় চকচক করে উঠেছিল। ডার্লিং! এটা নিছক অঙ্ক। আজ জঙ্গলে অঘোরবাবু ভুলুকে একটা চিঠি পোড়াতে পাঠিয়েছিল। চিঠিটা রায়মশাই মেয়েকে লিখেছিলেন। অঘোর অধিকারী নিশ্চয়ই সব চিঠি খুলে পড়ে ফের আঠা এঁটে ডাকবাক্সে ফেলত। এভাবেই সে নীলাটার কথা জেনেছিল। যে চিঠিটা ভুলুকে দিয়ে সে গোপনে পোড়াতে পাঠিয়েছিল, ওতে রায়মশাই লিখেছিলেন, নীলাটা তিনি বুদ্ধি করে হোমিওপ্যাথির বাক্সে লুকিয়ে রেখেছেন। বয়স হয়েছে। হঠাৎ স্ট্রোকে মারা পড়লে তাঁর মেয়ে যেন এসে নীলাটা খুঁজে পায়। অঘোর এই চিঠি পড়েই স্বর্গ হাতে পেয়েছিল।
–এ-ও কি আপনার অঙ্ক?
–আজ ভোরে বেরুনো সময় কৌশলে রায়মশাইকে জিজ্ঞেস করেছিলুম, সম্প্রতি কোনো চিঠি তিনি ছেলে বা মেয়েকে লিখেছিলেন কি না এবং তাতে কী লিখেছিলেন? রায়মশাই জানিয়ে দিলেন। অঘোর অধিকারীকে দিয়েই সব চিঠি ডাকঘরে পাঠান উনি। কাজেই অঙ্কটা মিলে গেল।
–ঢিল পড়ত কেন?
–ওটাই অঘোরের বদমায়েসি। ভূতুড়ে আবহাওয়া তৈরি করতে চেয়েছিল বাড়িতে। রায়মশাই মুখে যা-ই বলুন, আমি খুব ভালো জানি, উনি ভূতপ্রেতে বিশ্বাসী। যদি নীলা চুরি ভূতের ঘাড়ে চাপানো যায়!
বলে কর্নেল বাইনোকুলারে সম্ভবত পাখি দেখে নিয়ে আবার হাঁটতে থাকলেন।…
***
একটু পরিশিষ্ট আছে। তা বলা দরকার। আমরা কলকাতা ফিরে যাওয়ার কিছুদিন পরে কর্নেল রায়মশাইয়ের একটা চিঠি পেয়েছিলেন। তাতে উনি লিখেছিলেন :
সম্প্রতি অঘোর বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। একটা চিঠি লিখে রেখে গেছে। সংসারে তার আর মন নেই। সদগুরুর কাছে দীক্ষা নিয়ে সন্ন্যাসী হয়ে হিমালয়ে যাবে। হতভাগা কেন সন্ন্যাসী হবে, এটা আমার কাছে রহস্য। তবে এ রহস্য নিয়ে আমার মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। আপনাকেও এ বিষয়ে মাথা ঘামাতে বলছি না। আর একটা কথা। যাবার আগে সে তার বাগানের চারাগাছগুলো উপড়ে ফেলে দিয়ে গেছে। …