হযরত নূহ (আ)
নামকরণ
একজন বিশিষ্ট নবী ও রাসূল। আল্লাহ্ তাআলা তাঁহাকে “পরম কৃতজ্ঞ বান্দা” বলিয়া আখ্যায়িত করিয়াছেন। ইরশাদ হইয়াছে, “সে তো ছিল পরম কৃতজ্ঞ বান্দা” (১৭ : ৩)। হাদীছে তাহাকে প্রথম রাসূল বলিয়া আখ্যায়িত করা হইয়াছে (দ্র. আল-বুখারী, আস-সাহীহ, ১খ., ৪৭০; মুসলিম, আস-সাহীহ, ১খ., ১০৮; তিরমিযী, সুনান, ২খ., ৬৬; ইবন মাজা, ৩২৯-৩০)।
আল-কুরআনুল করীমে [ ]-রূপে এবং বাইবেলে Noah–রূপে লিখিত হইয়াছে। এতদ্ব্যতীত Noe-রূপেও ইহা লিখিত হইয়া থাকে [দ্র. Encyclopaedia Britannica (Index), vol. vii, 366]। শব্দটি হিব্রু, যাহার অর্থ হইল বিশ্রাম, আরাম। এই নামকরণের কারণ এইভাবে উল্লেখ করা হইয়াছে যে, পিতা লেমক (লামিক) তাহার নাম রাখেন নোহ। কেননা তিনি (নূহ-এর পিতা লামিক) কহিলেন, সদাপ্রভু কর্তৃক অভিশপ্ত ভূমি হইতে আমাদের যে শ্রম ও হস্তের ক্লেশ হয় তদ্বিষয়ে এ আমাদিগকে সান্ত্বনা করিবে (Genesis, 5 : 29; বাংলা অনু. পবিত্র বাইবেল, বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটি, ঢাকা, পৃ. ৭)।
নূহ নামকরণ সম্পর্কে আল্লামা আলুসী ইকরিমা ও মুকাতিল প্রমুখ মুফাসসিরের কয়েকটি অভিমত উল্লেখ করেন। তাহারা ইহাকে আরবী [ ] (ক্রন্দন করা) ধাতু হইতে উদ্ভূত বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। এমতাবস্থায় [ ]-এর অর্থ হইল অধিক ক্রন্দনকারী। তাঁহারা নূহ (আ)-এর অধিক ক্রন্দনের কয়েকটি কারণ বর্ণনা করিয়াছেন : (১) উম্মতের ধ্বংসের জন্য দুআ করায় পরবর্তী জীবনে তিনি অধিক ক্রন্দন করিতেন; (২) স্বীয় পুত্রের জন্য আল্লাহর নিকট সুপারিশ করার অপরাধ স্বরণ করিয়া (যাহার বিস্তারিত বিবরণ পরে আসিতেছে); (৩) একবার কুষ্ঠ রোগগ্রস্ত একটি কুকুরের নিকট দিয়া যাওয়ার সময় কুকুরটিকে লক্ষ্য করিয়া তিনি বলিলেন, “দূর হ হে কুশ্রী”! ইহাতে আল্লাহ্ তাহাকে বলেন, “তুমি কি আমাকে মন্দ বলিলে, না কুকুরটিকে?” এই অনুশোচনায় তিনি অধিক ক্রন্দন করিতেন; (৪) কওমের কুফরীতে বাড়াবাড়ি করায়। যখনই তিনি তাহাদিগকে দাওয়াত দিতেন আর তাহারা তাহা প্রত্যাখ্যান করিত তখনই তিনি ক্রন্দন করিতেন। এক বর্ণনামতে ইহার পূর্বে তাহার নাম ছিল “আস-সাকান”, মতান্তরে আবদুল জব্বার। এই সকল রিওয়ায়াত বর্ণনা করার পর আল্লামা আলুসী (র) নিজেই মন্তব্য করিয়াছেন যে, এই সকল রিওয়ায়াত গ্রহণযোগ্য নহে; বরং নূহ তাঁহার জন্মের সময়কারই নাম। আর ইহা [ ] ধাতু হইতে উদ্ভূত নহে (রূহুল-মাআলী, ৮খ., ১৪৯)। কারণ শব্দটি আদৌ আরবী নহে।
.
জন্ম ও বংশ পরিচয়
ঐতিহাসিক ও সীরাতবিদগণের মতে তাঁহার বংশ-৫৪লতিকা হইল : নূহ ইব্ন লামিক ইব্ন মাতৃশালিহ ইবন খানূখ বা আখনূখ (ইদরীস আ) ইবন য়ারুদ ইবন মাহলাঈল ইব্ন কীনান ইব্ন আনুশ ইব্ন শীছ (আ) ইব্ন আদম (আ) (ইবন কাছীর, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৫৯; ঐ লেখক, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া; আবদুল ওয়াহহাব আন-নাজ্জার, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৩০)। তিনি হযরত আদম (আ)-এর দশম পুরুষে স্বীয় পিতা লামিক-এর ১৮২ বৎসর বয়সকালে জন্মগ্রহণ করেন (Bible, Genesis 5 : 29; Encyclopaedia of Religion, Vol. 10, P. 460; Encyclopaedia Americana, Vol. 20, P. 392)। তবে আদম (আ) হইতে ঠিক কত বৎসর পর তাঁহার জন্ম হয় এই ব্যাপারে বহু মতামত পাওয়া যায়। ইব্ন জারীর তাবারীর বর্ণনামতে হযরত আদম (আ)-এর ইনতিকালের ১২৬ বৎসর পর হযরত নূহ (আ) জন্মগ্রহণ করেন। পূর্ববর্তী আহলে কিতাবদের ইতিহাসের বর্ণনামতে ১৪৬ বৎসর (ইবন কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ., ১০০-১০১; ঐ লেখক, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৫৯)। হাফিজ ইব্ন হিব্বান তাঁহার আস-সাহীহ গ্রন্থে আবু উমামা (রা) হইতে যে হাদীছ বর্ণনা করিয়াছেন তদনুযায়ী উভয়ের ব্যবধান হইল দশ শতাব্দী। কারণ তিনি বর্ণনা করেন যে, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (স)-কে জিজ্ঞাসা করিল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আদম কি নবী ছিলেন? রাসূলুল্লাহ (স) উত্তর দিলেন, হাঁ। লোকটি জিজ্ঞাসা করিল, তাঁহার মধ্যে এবং নূহ (আ)-এর মধ্যে ব্যবধান কত? দশ শতাব্দী [ ] (প্রাগুক্ত)। সাহীহ আল-বুখারীতে ইব্ন আব্বাস (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে যে, ইব্ন আব্বাস (রা) বলেন, আদম ও নূহ (আ)-এর মধ্যে দশ কারন [ ] ব্যবধান। ইহার মধ্যবর্তী সকলেই ইসলামের উপর ছিল (প্রাগুক্তঃ আল-বিদায়া, ওয়ান-নিহায়া, ১খ., ১০১)। এখন কারন শব্দ দ্বারা যদি ১০০ বৎসর বুঝানো হইয়া থাকে, যাহা সচরাচর ব্যবহৃত হয়, তবে উভয়ের মধ্যে ব্যবধান দাঁড়ায় এক হাজার বৎসর; আর উহা দ্বারা যদি জাতি তথা মানব সম্প্রদায় বুঝানো হইয়া থাকে, যেমন কুরআন করীমের বহু স্থানে ব্যবহৃত হইয়াছে, যথা [১৭ : ১৭] “নূহের পর আমি কত মানব গোষ্ঠী ধ্বংস করিয়াছি” [২৩ : ৩১] “অতঃপর তাহাদের পরে অন্য এক সম্প্রদায় সৃষ্টি করিয়াছিলাম” [১৯ : ৯৮] “তাহাদের পূর্বে আমি কত মানবগোষ্ঠীকে বিনাশ করিয়াছি” (২৫ : ৩৮[ ] “এবং উহাদের অন্তর্বর্তীকালীন বহু সম্প্রদায়কেও”। অনুরূপভাবে হাদীছেও ব্যবহৃত হইয়াছে ।
“সর্বোত্তম জাতি হইল আমার সহিত যাহারা আছে; অতঃপর তাহাদের পরপরই যাহারা আসিবে; অতঃপর তাহাদের পরপরই যাহারা আসিবে”।
তবে উভয়ের মধ্যে কয়েক হাজারের ব্যবধান হইবে। কারণ তখন অর্থ দাঁড়াইবে নূহ (আ)-এর পূর্বে দীর্ঘকাল যাবৎ কয়েক পুরুষ পৃথিবী আবাদ করিয়াছে (ইব্ন কাছীর, আল-বিদায়া, ১খ., ১০১; ঐ লেখক, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৫৯-৬০)। হাফিজ ইব্ন কাছীরের এই শেষোক্ত ব্যাখ্যাটি গ্রহণ না করিয়া 1 শব্দ দ্বারা যদি জাতি তথা পুরুষ বা বংশপরম্পরা বুঝানো হইয়াছে বলিয়া ধরা হয় তাহা ইলে ১৪১৫–এর অর্থ দাঁড়াইবে দশ পুরুষ যাহা ইতিহাস ও কুলজি শাস্ত্রের সহিতও খাপ খায়। সুতরাং এই অর্থ গ্রহণই যুক্তিযুক্ত বলিয়া মনে হয়। বাইবেলের হিব্রু, সামী ও গ্রীক ভাষার কপিসমূহে বহু মতভেদ পরিলক্ষিত হয়, যাহার সবই অনুমান নির্ভর বলিয়া মনে হয়। বাইবেলে বর্ণিত নূহ (আ)-এর পূর্বপুরুষদের সময়কালের একটি ছক নিম্নে প্রদত্ত হইল।
পুত্র শীছ (আ)-এর জন্মের সময় আদম (আ)-এর বয়স ১৩০ বৎসর
” আনুশ (আ) ” ” ” শীছ (আ) ” ” ১০৫ ”
” কীনান (আ) ” ” ” আনুশ (আ) ” ” ৯০ ”
” মাহলাঈল (আ) ” ” ” কীনান (আ) ” ” ৭০ ”
” য়ারুদ (আ) ” ” ” মাহলাঈল (আ) ” ” ১৬২ ”
” আখনূখ (আ) ” ” ” য়ারুদ (আ) ” ” ৬৫ ”
” মাতুশালিহ (আ) ” ” ” আখনূখ (আ) ” ” ১৮৭ ”
” লামিক (আ) ” ” ” মাতুশালিহ (আ) ” ” ১৮২ ”
” ১৮৭ নূহ (আ) ” ” ” লামিক (আ) ” ” ১৮২ ”
হযরত আদম (আ)-এর সৃষ্টি হইতে নূহ (আ)-এর জন্ম পর্যন্ত সময়কাল ১০৫৬ বৎসর, হযরত আদম (আ)-এর ইনতিকালের সময় তাঁহার বয়স ৯৩০ বৎসর। হযরত আদম (আ)-এর ইনতিকাল হইতে নূহ (আ)-এর জন্ম পর্যন্ত সময়কাল ১০২৬ বৎসর (Bible, Genesis, 5:1-32; আবদুল ওয়াহহাব আন-নাজজার, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৩০; হিফজর রাহমান সিউহারবী, কাসাসুল-কুরআন, ১খ., ৬৪)।
কুরআন করীমে হযরত নূহ (আ)
আল-কুরআনুল করীমের বিরাট একটি অংশ হযরত নূহ (আ)-এর আলোচনায় পূর্ণ। তাঁহার দাওয়াত ও তাবলীগ, কওমের নাফরমানী, নৌযান তৈরী, মহাপ্লাবন, কাফিরদের ধ্বংস এবং নূহ (আ) ও তাহার অনুসারীদের রক্ষা পাওয়া প্রভৃতি বিষয়ে বহু স্থানে আলোচনা করা হইয়াছে। একটি পূর্ণ সূরাতেই তাহার আলোচনা করা হইয়াছে যাহার নামকরণ করা হইয়াছে নূহ (আ)-এর নামে (দ্র. ২৯ পারা ৭১ নং সূরা)। কুরআন করীমের ৪৩ স্থানে তাহার নাম উল্লেখ করা হইয়াছে। তন্মধ্যে সূরা আরাফ, সূরা হূদ, সূরা আল-মুমিনূন, সূরা আশ-শুআরা, সূরা আল-কামার ও সূরা নূহ-এ বিস্তারিত আলোচনা করা হইয়াছে। কুরআন করীমের যেসকল সূরা ও আয়াতে তাহার বর্ণনা আসিয়াছে উহার একটি ছক নিম্নরূপঃ
সূরা নং – সূরার নাম – আয়াত নং
৩ আল-ইমরান ৩৩-৩৪
৪ আন-নিসা ১৬৩
৬ আল-আনআম ৮৪
৭ আল-আরাফ ৫৯-৬৪, ৬৯
৯ আত-তাওবা ৭০
১০ ইউনুস ৭১
১১ হূদ ২৫-৩৪, ৩৬-৪৮, ৮৯
১৪ ইবরাহীম ৯
১৭ বনী ইসরাঈল ৩, ১৭
১৯ মারয়াম ৫৮
২১ আল-আম্বিয়া ৭৬-৭৭
২২ আল-হাজ্জ ৪২
২৩ আল-মুমিনূন ২৩-২৪
২৫ আল-ফুরকান ৩৭
২৬ আশ-শুআরা ১০৫, ১০৬, ১১৬
২৯ আল-আনকাবূত ১৪-১৫
৩৩ আল-আহযাব ৭
৩৭ আস-সাফফাত ৭৫-৮৩
৩৮ সাদ ১২
৪০ আল-মুমিন ৫, ৩১
৪২ আশ-শূরা ১৩
৫০ কাফ ১২-১৪
৫১ আয-যারিয়াত
৫২ আন-নাজম
৫৪ আল-কামার ৯-১৬
৫৭ আল-হাদীদ ২৬
৬৬ আত-তাহরীম ১০
৭১ নূহ ১-২৮
(সংশোধনীসহ হিফজুর রহমান সিউহারবী, করাচী, ১৯৬৫, ১খ., ৩১)। তবে সূরা আরাফ, হ্রদ, মুমিনূন, শুআরা, কামার ও নূহ এই ৬টি সূরাতে নূহ (আ) সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হইয়াছে। সূরার ধারাবাহিকতানুযায়ী তাঁহার আলোচনা নিম্নরূপ :
“নিশ্চয় আল্লাহ আদমকে, নূহকে ও ইবরাহীমের বংশধর এবং ইমরানের বংশধরকে বিশ্বজগতে মনোনীত করিয়াছেন। ইহারা একে অপরের বংশধর। আল্লাহ সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞ” (৩ : ৩৩-৩৪)।
“আমি তো তোমার নিকট ওহী প্রেরণ করিয়াছি যেমন নূহ ও তাহার পরবর্তী নবীগণের নিকট ওহী প্রেরণ করিয়াছিলাম” (৪ : ১৬৩)।
“পূর্বে নূহকেও সৎপথে পরিচালিত করিয়াছিলাম এবং তাহার বংশধর দাউদ, সুলায়মান, আয়ুব, ইউসুফ, মূসা ও হারূনকেও। আর এভাবেই আমি সৎকর্মপরায়ণদিগকে পুরস্কৃত করি” (৬ : ৮৪)।
আমি তো নূহকে পাঠাইয়াছিলাম তাহার সম্প্রদায়ের নিকট এবং সে বলিয়াছিল, হে আমার সম্প্রদায়! আল্লাহর ইবাদত কর, তিনি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোন ইলাহ নাই। আমি তোমাদের জন্য মহাদিনের শাস্তির আশংকা করিতেছি। তাহার সম্প্রদায়ের প্রধানগণ বলিয়াছিল, আমরা তো তোমাকে স্পষ্ট ভ্রান্তিতে দেখিতেছি। সে বলিয়াছিল, হে আমার সম্প্রদায়! আমাতে কোন ভ্রান্তি নাই, বরং আমি তো জগতসমূহের প্রতিপালকের রাসূল। আমার প্রতিপালকের বাণী আমি তোমাদের নিকট পৌঁছাইতেছি ও তোমাদিগকে হিতোপদেশ দিতেছি এবং তোমরা যাহা জান না আমি তাহা আল্লাহর নিকট হইতে জানি। তোমরা কি বিস্মিত হইতেছ যে, তোমাদেরই একজনের মাধ্যমে তোমাদের প্রতিপালকের নিকট হইতে তোমাদের নিকট উপদেশ আসিয়াছে যাহাতে সে তোমাদিগকে সতর্ক করে? তোমরা সাবধান হও এবং তোমরা অনুকম্পা লাভ কর। অতঃপর তাহারা তাহাকে মিথ্যাবাদী বলে। তাহাকে ও তাহার সঙ্গে যাহারা তরণীতে ছিল আমি তাহাদিগকে উদ্ধার করি এবং যাহারা আমার নিদর্শন অস্বীকার করিয়াছিল তাহাদিগকে নিমজ্জিত করি। তাহারা তো ছিল এক অন্ধ সম্প্রদায়” (৭ : ৫৯-৬৪)।
“এবং স্মরণ কর, আল্লাহ তোমাদিগকে নূহের সম্প্রদায়ের পরে তাহাদের স্থলাভিষিক্ত করিয়াছেন এবং তোমাদের দৈহিক গঠনে অধিকতর হৃষ্টপুষ্ট বলিষ্ঠ করিয়াছেন” (৭ : ৬৯)।
“উহাদের পূর্ববর্তী নূহ, আদ ও ছামূদের সম্প্রদায়, ইবরাহীমের সম্প্রদায় এবং মাদয়ান ও বিধ্বস্ত নগরের অধিবাসিগণের সংবাদ কি উহাদের নিকট আসে নাই? উহাদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শনসহ উহাদের রাসূলগণ আসিয়াছিল। আল্লাহ এমন নহেন যে, তাহাদের উপর জুলুম করেন, কিন্তু উহারা
“উহাদিগকে নূহ-এর বৃত্তান্ত শোনাও। সে তাহার সম্প্রদায়কে বলিয়াছিল, হে আমার সম্প্রদায়! আমার অবস্থিতি ও আল্লাহর নিদর্শন দ্বারা আমার উপদেশ দান তোমাদের নিকট যদি দুঃসহ হয় তবে আমি তো আল্লাহর উপর নির্ভর করি। তোমরা যাহাদিগকে শরীক করিয়াছ তৎসহ তোমাদের কর্তব্য স্থির করিয়া লও, পরে যেন কর্তব্য বিষয়ে তোমাদের কোন সংশয় না থাকে। আমার সম্বন্ধে তোমাদের কর্ম নিষ্পন্ন করিয়া ফেল এবং আমাকে অবকাশ দিও না” (১০ : ৭১)।
“অতঃপর তোমরা মুখ ফিরাইয়া লইলে লইতে পার, তোমাদের নিকট আমি তো কোন পারিশ্রমিক চাহি নাই, আমার পারিশ্রমিক আছে আল্লাহর নিকট। আমি তো আত্মসমর্পণকারীদের অন্তর্ভুক্ত হইতে আদিষ্ট হইয়াছি। আর উহারা তাহাকে মিথ্যাবাদী বলে; অতঃপর তাহাকে স্থলাভিষিক্ত করি আর যাহারা আর নিদর্শন প্রত্যাখ্যান করিয়াছিল তাহাদিগকে নিমজ্জিত করি। সুতরাং দেখ,
“আমি তো নূহকে তাহার সম্প্রদায়ের নিকট পাঠাইয়াছিলাম। সে বলিয়াছিল, আমি অবশ্যই তোমাদের জন্য প্রকাশ্য সতর্ককারী, যেন তোমরা আল্লাহ ব্যতীত অপর কিছুর ইবাদত না কর; আমি তো তোমাদের জন্য মর্মন্তুদ দিবসের শাস্তির আশংকা করি। তাহার সম্প্রদায়ের প্রধানেরা, যাহারা ছিল কাফির, তাহারা বলিল, আমরা তোমাকে তো আমাদের মত মানুষ ব্যতীত কিছু দেখিতেছি না; আমরা তো দেখিতেছি তোমার অনুসরণ করিতেছে তাহারাই, যাহারা আমাদের মধ্যে বাহ্য দৃষ্টিতেই অধম এবং আমরা আমাদের উপর তোমাদের কোন শ্রেষ্ঠত্ব দেখিতেছি না, বরং আমরা তোমাদিগকে মিথ্যাবাদী মনে করি। সে বলিল, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আমাকে বল, আমি যদি আমার প্রতিপালক প্রেরিত স্পষ্ট নিদর্শনে প্রতিষ্ঠিত থাকি এবং তিনি যদি আমাকে তাঁহার নিজ অনুগ্রহ হইতে দান করিয়া থাকেন, আর ইহা তোমাদের নিকট গোপন রাখা হইয়াছে, আমি কি এই বিষয়ে তোমাদিগকে বাধ্য করিতে পারি, যখন তোমরা ইহা অপসন্দ কর? হে আমার সম্প্রদায়! ইহার পরিবর্তে আমি তোমাদের নিকট ধন-সম্পদ যাজ্ঞা করি না। আমার পারিশ্রমিক তো আল্লাহর নিকট এবং মুমিনদিগকে তাড়াইয়া দেওয়া আমার কাজ নয়। তাহারা নিশ্চিতভাবে তাহাদের প্রতিপালকের সাক্ষাত লাভ করিবে। কিন্তু আমি তো দেখিতেছি তোমরা এক অজ্ঞ সম্প্রদায়। হে আমার সম্প্রদায়! আমি যদি তাহাদিগকে তাড়াইয়া দেই, তবে আল্লাহ হইতে আমাকে কে রক্ষা করিবে? তবুও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করিবে না? আমি তোমাদিগকে বলি না, আমার নিকট আল্লাহর ধন-ভাণ্ডার আছে আর না অদৃশ্য সম্বন্ধে আমি অবগত এবং আমি ইহাও বলি না যে, আমি ফেরেশতা। তোমাদের দৃষ্টিতে যাহারা হেয় তাহাদের সম্বন্ধে আমি বলি না যে, আল্লাহ তাহাদিগকে কখনই মঙ্গল দান করিবেন না; তাহাদের অন্তরে যাহা আছে তাহা আল্লাহ সম্যক অবগত। তাহা হইলে আমি অবশ্যই জালিমদের অন্তর্ভুক্ত হইব। তাহারা বলিল, হে নূহ! তুমি তো আমাদের সহিত বিতণ্ডা করিয়াছ, তুমি বিতণ্ডা করিয়াছ আমাদের সহিত অতিমাত্রায়; সুতরাং তুমি সত্যবাদী হইলে আমাদিগকে যাহার ভয় দেখাইতেছ তাহা আনয়ন কর। সে বলিল, ইচ্ছা করিলে আল্লাহই উহা তোমাদের নিকট উপস্থিত করিবেন এবং তোমরা উহা ব্যর্থ করিতে পারিবে না। আমি তোমাদিগকে উপদেশ দিতে চাহিলেও আমার উপদেশ তোমাদের উপকারে আসিবে না, যদি আল্লাহ তোমাদিগকে বিভ্রান্ত করিতে চাহেন। তিনিই তোমাদের প্রতিপালক এবং তাঁহারই নিকট তোমাদের প্রত্যাবর্তন। তাহারা কি বলে যে, সে ইহা রচনা করিয়াছে? বল, আমি যদি ইহা রচনা করিয়া থাকি, তবে আমি আমার অপরাধের জন্য দায়ী হইব। তোমরা যে অপরাধ করিতেছ তাহা হইতে আমি দায়মুক্ত। নূহের প্রতি প্রত্যাদেশ হইয়াছিল, যাহারা ঈমান আনিয়াছে তাহারা ব্যতীত তোমার সম্প্রদায়ের অন্য কেহ কখনও ঈমান আনিবে না, সুতরাং তাহারা যাহা করে তজ্জন্য তুমি দুঃখিত হইও না। তুমি আমার তত্ত্বাবধানে ও আমার প্রত্যাদেশ অনুযায়ী নৌকা নির্মাণ কর এবং যাহারা সীমালংঘন করিয়াছে। তাহাদের সম্পর্কে তুমি আমাকে কিছু বলিও না; তাহারা তো নিমজ্জিত হইবে। সে নৌকা নির্মাণ করিতে লাগিল এবং যখনই তাহার সম্প্রদায়ের প্রধানেরা তাহার নিকট দিয়া যাইত, তাহাকে উপহাস করিত। সে বলিত, তোমরা যদি আমাকে উপহাস কর তবে আমরাও তোমাদিগকে উপহাস করিব। যেমন তোমরা উপহাস করিতেছ এবং তোমরা অচিরে জানিতে পারিবে, কাহার উপর আসিবে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি আর কাহার উপর আপতিত হইবে স্থায়ী শাস্তি। অবশেষে যখন আমার আদেশ আসিল এবং উনান উথলিয়া উঠিল; আমি বলিলাম, ইহাতে উঠাইয়া লও প্রত্যেক শ্রেণীর যুগলের দুইটি, যাহাদের বিরুদ্ধে পূর্ব সিদ্ধান্ত হইয়াছে তাহারা ব্যতীত তোমার পরিবার-পরিজনকে এবং যাহারা ঈমান আনিয়াছে তাহাদিগকে। তাহার সংগে ঈমান আনিয়াছিল অল্প কয়েকজন। সে বলিল, ইহাতে আরোহণ কর, “আল্লাহর নামে ইহার গতি ও স্থিতি, আমার প্রতিপালক অবশ্যই ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু”। পর্বত প্রমাণ তরঙ্গের মধ্যে ইহা তাহাদিগকে লইয়া বহিয়া চলিল। নূহ তাহার পুত্রকে, যে পৃথক ছিল, আহবান করিয়া বলিল, হে আমার পুত্র! আমাদের সঙ্গে আরোহণ কর এবং কাফিরদের সঙ্গী হইও না। সে বলিল, আমি এমন এক পর্বতে আশ্রয় লইব যাহা আমাকে প্লাবন হইতে রক্ষা করিবে। সে বলিল, আজ আল্লাহর হুকুম হইতে রক্ষা করিবার কেহ নাই, তবে যাহাকে আল্লাহ দয়া করিবেন সে ব্যতীত। ইহার পর তরঙ্গ উহাদিগকে বিচ্ছিন্ন করিয়া দিল এবং সে নিমজ্জিতদের অন্তর্ভুক্ত হইল। ইহার পর বলা হইল, হে পৃথিবী! তুমি তোমার পানি গ্রাস করিয়া লও এবং হে আকাশ! ক্ষান্ত হও। ইহার পর বন্যা প্রশমিত হইল এবং কার্য সমাপ্ত হইল, নৌকা জুদী পর্বতের উপর স্থির হইল এবং বলা হইল, জালিম সম্প্রদায় ধ্বংস হউক। নূহ তাহার প্রতিপালককে সম্বোধন করিয়া বলিল, হে আমার প্রতিপালক! আমার পুত্র আমার পরিবারভুক্ত এবং আপনার প্রতিশ্রুতি সত্য, আর আপনি তো বিচারকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বিচারক। তিনি বলিলেন, হে নূহ! সে তো তোমার পরিবারভুক্ত নহে। সে অবশ্যই অসৎকর্মপরায়ণ। সুতরাং যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নাই সে বিষয়ে আমাকে অনুরোধ করিও না। আমি তোমাকে উপদেশ দিতেছি, তুমি যেন অজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত না হও। সে বলিল, হে আমার প্রতিপালক! যে বিষয়ে আমার জ্ঞান নাই, সে বিষয়ে যাহাতে আপনাকে অনুরোধ না করি, এইজন্য আমি আপনার শরণ লইতেছি। আপনি যদি আমাকে ক্ষমা না করেন এবং আমাকে দয়া না করেন, তবে আমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হইব। বলা হইল, হে নূহ! অবতরণ কর আমার পক্ষ হইতে শান্তি ও কল্যাণসহ এবং তোমার প্রতি ও যে সমস্ত সম্প্রদায় তোমার সঙ্গে আছে তাহাদের প্রতি; অপর সম্প্রদায়সমূহকে আমি জীবন উপভোগ করিতে দিব, পরে আমা হইতে মর্মন্তুদ শাস্তি উহাদিগকে স্পর্শ করিবে” (১১ : ২৫-৪৮)।
“হে আমার সম্প্রদায়! আমার সহিত বিরোধ যেন কিছুতেই তোমাদিগকে এমন অপরাধ না করায় যাহাতে তোমাদের উপর তাহার অনুরূপ বিপদ আপতিত হইবে, যাহা আপতিত হইয়াছিল নূহের সম্প্রদায়ের উপর” (১১ : ৮৯)।
“তোমাদের নিকট কি সংবাদ আসে নাই তোমাদের পূর্ববর্তীদের, নূহের সম্প্রদায়ের, আদের ও ছামূদের এবং তাহাদের পূর্ববর্তীদের? উহাদের বিষয় আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেহ জানে না, উহাদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শনসহ উহাদের রাসূল আসিয়াছিল, উহারা উহাদের হাত উহাদের মুখে স্থাপন করিত এবং বলিত, যাহাসহ তোমরা প্রেরিত হইয়াছ তাহা আমরা অবশ্যই অস্বীকার করি এবং আমরা অবশ্যই বিভ্রান্তিকর সন্দেহে রহিয়াছি সে বিষয়ে, যাহার প্রতি তোমরা আমাদিগকে আহবান করিতেছ” (১৪ : ৯)।
“হে তাহাদের বংশধর! যাহাদিগকে আমি নূহের সহিত আরোহণ করাইয়াছিলাম; সে তো ছিল পরম কৃতজ্ঞ বান্দা” (১৭ : ৩)।
“নূহের পর আমি কত মানবগোষ্ঠী ধ্বংস করিয়াছি! তোমার প্রতিপালকই তাঁহার বান্দাদের
“ইহারাই তাহারা, নবীদের মধ্যে যাহাদিগকে আল্লাহ অনুগ্রহ করিয়াছেন, আদমের বংশ হইতে ও যাহাদিগকে আমি নূহের সহিত নৌকায় আরোহণ করাইয়াছিলাম এবং ইবরাহীম ও ইসমাঈলের বংশোদ্ভূত ও যাহাদিগকে আমি পথনির্দেশ করিয়াছিলাম ও মনোনীত করিয়াছিলাম; তাহাদের নিকট দয়াময়ের আয়াত আবৃত্তি করা হইলে তাহারা সিজদায় লুটাইয়া পড়িত ক্রন্দন করিতে করিতে” (১৯:৫৮)।
“স্মরণ কর নূহকে; পূর্বে সে যখন আহ্বান করিয়াছিল তখন আমি সাড়া দিয়াছিলাম তাহার আহ্বানে এবং তাহাকে ও তাহার পরিবারবর্গকে মহাসংকট হইতে উদ্ধার করিয়াছিলাম এবং আমি তাহাকে সাহায্য করিয়াছিলাম সেই সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে যাহারা আমার নিদর্শনাবলী অস্বীকার করিয়াছিল; নিশ্চয়ই উহারা ছিল এক মন্দ সম্প্রদায়। এইজন্য উহাদের সকলকেই আমি নিমজ্জিত করিয়াছিলাম” (২১:৭৬-৭৭)।
“এবং লোকেরা যদি তোমাকে অস্বীকার করে তবে উহাদের পূর্বে অস্বীকার করিয়াছিল তো নূহ, আদ ও ছামূদের সম্প্রদায়” (২২:৪২)।
“আমি নূহকে পাঠাইয়াছিলাম তাহার সম্প্রদায়ের নিকট। সে বলিয়াছিল, হে আমার সম্প্রদায়! আল্লাহর ইবাদত কর, তিনি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোন ইলাহ নাই । তবুও কি তোমরা সাবধান হইবে না? তাহার সম্প্রদায়ের প্রধানগণ, যাহারা কুফরী করিয়াছিল, তাহারা বলিল, এতো তোমাদের মত একজন মানুষই, তোমাদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করিতে চাহিতেছে, আল্লাহ ইচ্ছা করিলে ফেরেশতাই পাঠাইতেন। আমরা তো আমাদের পূর্বপুরুষগণের কালে এইরূপ ঘটিয়াছে, একথা শুনি নাই। এতো এমন লোক যাহাকে উন্মত্ততা পাইয়া বসিয়াছে; সুতরাং তোমরা ইহার সম্পর্কে কিছুকাল অপেক্ষা কর। নূহ বলিয়াছিল, হে আমার প্রতিপালক! আমাকে সাহায্য কর, কারণ উহারা আমাকে মিথ্যাবাদী বলিতেছে। অতঃপর আমি তাহার নিকট ওহী পাঠাইলাম, তুমি আমার তত্ত্বাবধানে ও আমার ওহী অনুযায়ী নৌযান নির্মাণ কর, অতঃপর যখন আমার আদেশ আসিবে ও উনুন উথলিয়া উঠিবে তখন উঠাইয়া লইও প্রত্যেক জীবের এক এক জোড়া এবং তোমার পরিবার-পরিজনকে, তাহাদিগকে ছাড়া যাহাদের বিরুদ্ধে পূর্বে সিদ্ধান্ত হইয়াছে। আর তাহাদের সম্পর্কে তুমি আমাকে কিছু বলিও না যাহারা জুলুম করিয়াছে। তাহারা তো নিমজ্জিত হইবে। যখন তুমি ও তোমার সঙ্গীরা নৌযানে আসন গ্রহণ করিবে তখন বলিও, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই যিনি আমাদিগকে উদ্ধার করিয়াছেন জালিম সম্প্রদায় হইতে। আরও বলিও, হে আমার প্রতিপালক! আমাকে এমনভাবে অবতরণ করাও যাহা হইবে কল্যাণকর; আর তুমিই শ্রেষ্ঠ অবতরণকারী” (২৩ : ২৩-২৯)।
“এবং নূহের সম্প্রদায়কেও সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত করিয়াছিলাম, যখন তাহারা রাসূলগণের প্রতি মিথ্যা আরোপ করিল তখন আমি উহাদিগকে নিমজ্জিত করিলাম এবং উহাদিগকে মানবজাতির জন্য নিদর্শনস্বরূপ করিয়া রাখিলাম। জালিমদের জন্য আমি মমর্তুদ শাস্তি প্রস্তুত করিয়া রাখিয়াছি” (২৫ : ৩৭)।
“নূহের সম্প্রদায় রাসূলগণের প্রতি মিথ্যারোপ করিয়াছিল। যখন উহাদের ভ্রাতা নূহ উহাদিগকে বলিল, তোমরা কি সাবধান হইবে না? আমি তো তোমাদের জন্য এক বিশ্বস্ত রাসূল। অতএব তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য কর। আমি তোমাদের নিকট ইহার জন্য কোন প্রতিদান চাহি না। আমার পুরস্কার তো জগতসমূহের প্রতিপালকের নিকট আছে। সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য কর। উহারা বলিল, আমরা কি তোমার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করিব অথচ ইতরজনেরা তোমার অনুসরণ করিতেছে? নূহ বলিল, উহারা কী করিত তাহা আমার জানা নাই। উহাদের হিসাব গ্রহণ তো আমার প্রতিপালকেরই কাজ; যদি তোমরা বুঝিতে! মুমিনদিগকে তাড়াইয়া দেওয়া আমার কাজ নহে। আমি তো কেবল একজন স্পষ্ট সতর্ককারী। উহারা বলিল, হে নূহ! তুমি যদি নিবৃত্ত না হও তবে তুমি অবশ্যই প্রস্তরাঘাতে নিহতদের শামিল হইবে। নূহ বলিল, হে আমার প্রতিপালক! আমার সম্প্রদায় তো আমাকে অস্বীকার করিতেছে। সুতরাং তুমি আমার ও উহাদের মধ্যে স্পষ্ট মীমাংসা করিয়া দাও এবং আমাকে ও আমার সহিত যে সব মুমিন আছে, তাহাদিগকে রক্ষা কর। অতঃপর আমি তাহাকে ও তাহার সঙ্গে যাহারা ছিল, তাহাদিগকে রক্ষা করিলাম বোঝাই নৌযানে; তৎপর অবশিষ্ট সকলকে নিমজ্জিত করিলাম” (২৬ : ১০৫-১২০)।
“আমি নূহকে তাহার সম্প্রদায়ের নিকট প্রেরণ করিয়াছিলাম। সে উহাদের মধ্যে অবস্থান করিয়াছিল পঞ্চাশ কম হাজার বৎসর। অতঃপর প্লাবন উহাদিগকে গ্রাস করে, কারণ উহারা ছিল সীমালংঘনকারী। অতঃপর আমি তাহাকে এবং যাহারা নৌযানে আরোহণ করিয়াছিল তাহাদিগকে রক্ষা করিলাম এবং বিশ্বজগতের জন্য ইহাকে করিলাম একটি নিদর্শন” (২৯ : ১৪-১৫)।
“স্মরণ কর, যখন আমি নবীদের নিকট হইতে অঙ্গীকার গ্রহণ করিয়াছিলাম এবং তোমার নিকট হইতেও এবং নূহ, ইবরাহীম, মূসা ও মারয়াম-তনয় ঈসার নিকট হইতেও-তাহাদের নিকট হইতে গ্রহণ করিয়াছিলাম দৃঢ় অঙ্গীকার” (৩৩ : ৭)।
“নূহ আমাকে আহ্বান করিয়াছিল, আর আমি কত উত্তম সাড়া দানকারী। তাহাকে এবং তাহার পরিবারবর্গকে আমি উদ্ধার করিয়াছিলাম মহাসংকট হইতে। তাহার বংশধরদিগকেই আমি বিদ্যমান রাখিয়াছি বংশপরম্পরায়, আমি ইহা পরবর্তীদের স্মরণে রাখিয়াছি। সমগ্র বিশ্বের মধ্যে নূহের প্রতি শান্তি বর্ষিত হউক। এভাবেই আমি সৎকর্মপরায়ণদিগকে পুরস্কৃত করিয়া থাকি, সে ছিল আমার মুমিন বান্দাদের অন্যতম। অন্য সকলকে আমি নিমজ্জিত করিয়াছিলাম” (৩৭ : ৭৫-৮২)।
“ইহাদের পূর্বেও রাসূলদিগকে অস্বীকার করিয়াছিল নূহের সম্প্রদায়” (৩৮ : ১২)।
“ইহাদের পূর্বে নূহের সম্প্রদায় এবং তাহাদের পরে অন্যান্য দলও অস্বীকার করিয়াছিল। প্রত্যেক সম্প্রদায় নিজ নিজ রাসূলকে আবদ্ধ করিবার অভিসন্ধি করিয়াছিল এবং উহারা অসার তর্কে লিপ্ত হইয়াছিল, উহা দ্বারা সত্যকে ব্যর্থ করিয়া দিবার জন্য। ফলে আমি উহাদিগকে পাকড়াও করিলাম এবং কত কঠোর ছিল আমার শান্তি” (৪:৫)।
“তিনি তোমাদের জন্য বিধিবদ্ধ করিয়াছেন দীন যাহার নির্দেশ দিয়াছিলেন নূহকে” (৪২: ১৩)।
“উহাদের পূর্বেও সত্য প্রত্যাখ্যান করিয়াছিল নূহের সম্প্রদায়, রাস ও ছামূদ সম্প্রদায়, আদ, ফিরআন ও লূত সম্প্রদায় এবং আয়কার অধিবাসী ও তুব্বা সম্প্রদায়; উহারা সকলেই রাসূলদিগকে মিথ্যাবাদী বলিয়াছিল, ফলে উহাদের উপর আমার শাস্তি আপতিত হইয়াছে” (৫০ : ১২-১৪)।
“আমি ধ্বংস করিয়াছিলাম ইহাদের পূর্বে নূহের সম্প্রদায়কে, উহারা তো ছিল সত্যত্যাগী সম্প্রদায়” (৫১ : ৪৬)।
“আর ইহাদের পূর্বে নূহের সম্প্রদায়কেও (তিনি ধ্বংস করিয়াছিলেন), উহারা ছিল অতিশয় জালিম ও অবাধ্য” (৫৩ : ৫২)।
“ইহাদের পূর্বে নূহের সম্প্রদায়ও অস্বীকার করিয়াছিল- অস্বীকার করিয়াছিল আমার বান্দাকে আর বলিয়াছিল, এতো এক পাগল। আর তাহাকে ভীতি প্রদর্শন করা হইয়াছিল। তখন সে তাহার প্রতিপালককে আহ্বান করিয়া বলিয়াছিল, আমি তো অসহায়, অতএব তুমি প্রতিবিধান কর। ফলে আমি উন্মুক্ত করিয়া দিলাম আকাশের দ্বার প্রবল বারি বর্ষণে এবং মৃত্তিকা হইতে উৎসারিত করিলাম প্রস্রবণ; অতঃপর সকল পানি মিলিত হইল এক পরিকল্পনা অনুসারে। তখন নৃহকে আরোহণ করাইলাম কাষ্ঠ ও কীলক নির্মিত এক নৌযানে, যাহা চলিত আমার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে; ইহা পুরস্কার তাহার জন্য যে প্রত্যাখ্যাত হইয়াছিল। আমি ইহাকে রাখিয়া দিয়াছি এক নিদর্শনরূপে; অতএব উপদেশ গ্রহণকারী কেহ আছে কি? কী কঠোর ছিল আমার শাস্তি ও সতর্কবাণী” (৫৪ : ৯-১৬)।
“আমি নূহ এবং ইবরাহীমকে রসূলরূপে প্রেরণ করিয়াছিলাম এবং আমি তাহাদের বংশধরগণের জন্য স্থির করিয়াছিলাম নুবুওয়াত ও কিতাব, কিন্তু উহাদের অল্পই সৎপথ অবলম্বন করিয়াছিল এবং
“আল্লাহ কাফিরদের জন্য নূহের স্ত্রী ও দূতের স্ত্রীর দৃষ্টান্ত দিতেছেন, উহারা ছিল আমার বান্দাদের মধ্যে দুই সৎকর্মপরায়ণ বান্দার অধীন। কিন্তু উহারা তাহাদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করিয়াছিল। ফলে নূহ ও লূত উহাদিগকে আল্লাহর শাস্তি হইতে রক্ষা করিতে পারিল না এবং উহাদিগকে বলা হইল, তোমরা উভয়ে প্রবেশকারীদের সহিত জাহান্নামে প্রবেশ কর” (৬৬ : ১০)।
“আমি নূহকে প্রেরণ করিয়াছিলাম তাহার সম্প্রদায়ের প্রতি এই নির্দেশসহ, তুমি তোমার সম্প্রদায়কে সতর্ক কর তাহাদের প্রতি মর্মন্তুদ শাস্তি আসিবার পূর্বে। সে বলিয়াছিল, হে আমার সম্প্রদায়! আমি তো তোমাদের জন্য স্পষ্ট সতর্ককারী, এই বিষয়ে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর ও তাহাকে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য কর; তিনি তোমাদের পাপ ক্ষমা করিবেন এবং তিনি তোমাদিগকে অবকাশ দিবেন এক নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত। নিশ্চয় আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত কাল উপস্থিত হইলে উহা বিলম্বিত হয় না; যদি তোমরা ইহা জানিতে। সে বলিয়াছিল, হে আমার প্রতিপালক! আমি তো আমার সম্প্রদায়কে দিবারাত্রি আহ্বান করিয়াছি, কিন্তু আমার আহ্বান উহাদের পলায়ন প্রবণতাই বৃদ্ধি করিয়াছে। আমি যখনই উহাদিগকে আহ্বান করি যাহাতে তুমি উহাদিগকে ক্ষমা কর, উহারা কানে আঙ্গুলী দেয়, বস্ত্রাবৃত করে নিজদিগকে ও জিদ করিতে থাকে এবং অতিশয় ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে। অতঃপর আমি উহাদিগকে আহ্বান করিয়াছি প্রকাশ্যে। পরে আমি উচ্চস্বরে প্রচার করিয়াছি ও উপদেশ দিয়াছি গোপনে। বলিয়াছি, তোমাদের প্রতিপালকের ক্ষমা প্রার্থনা কর, তিনি তো মহাক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের জন্য প্রচুর বৃষ্টিপাত করিবেন, তিনি তোমাদিগকে সমৃদ্ধ করিবেন ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতিতে এবং তোমাদের জন্য স্থাপন করিবেন উদ্যান ও প্রবাহিত করিবেন নদী-নালা। তোমাদের কী হইয়াছে যে, তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করিতে চাহিতেছ না! অথচ তিনিই তোমাদিগকে সৃষ্টি করিয়াছেন পর্যায়ক্রমে। তোমরা কি লক্ষ্য কর নাই? আল্লাহ কিভাবে সৃষ্টি করিয়াছেন সপ্ত স্তরে বিন্যস্ত আকাশমণ্ডলী? এবং সেথায় চন্দ্রকে স্থাপন করিয়াছেন আলোরূপে আর সূর্যকে স্থাপন করিয়াছেন প্রদীপরূপে; তিনি তোমাদিগকে উদ্ভূত করিয়াছেন মৃত্তিকা হইতে। অতপর উহাতে তিনি তোমাদিগকে প্রত্যাবৃত্ত করিবেন এবং পরে পুনরুত্থিত করিবেন। আর আল্লাহ্ তোমাদের জন্য ভূমিকে করিয়াছেন বিস্তৃত, যাহাতে তোমরা চলাফেরা করিতে পার প্রশস্ত পথে। নূহ বলিয়াছিল, হে আমার প্রতিপালক! আমার সম্প্রদায় তো আমাকে অমান্য করিয়াছে এবং অনুসরণ করিয়াছে এমন লোকের যাহার ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি তাহার ক্ষতি ব্যতীত আর কিছুই বৃদ্ধি করে নাই। আর উহারা ভয়ানক ষড়যন্ত্র করিয়াছিল এবং বলিয়াছিল, তোমরা কখনও পরিত্যাগ করিও না তোমাদের দেব-দেবীকে; পরিত্যাগ করিও না ওয়াদ্দ, সুওয়াআ, ইয়াগৃছ, ইয়াউক ও নাসরকে। উহারা অনেককে বিভ্রান্ত করিয়াছে। সুতরাং তুমি জালিমদের বিভ্রান্তি ব্যতীত আর কিছুই বৃদ্ধি করিও না। উহাদের অপরাধের জন্য উহাদিগকে নিমজ্জিত করা হইয়াছিল এবং পরে উহাদিগকে দাখিল করা হইয়াছিল অগ্নিতে, অতঃপর উহারা কাহাকেও আল্লাহর মুকাবিলায় পায় নাই সাহায্যকারী। নূহ আরও বলিয়াছিল, হে আমার প্রতিপালক! পৃথিবীতে কাফিরগণের মধ্য হইতে কোন গৃহবাসীকে অব্যাহতি দিও না। তুমি উহাদিগকে অব্যাহতি দিলে উহারা তোমার বান্দাদিগকে বিভ্রান্ত করিবে এবং জন্ম দিতে থাকিবে কেবল দৃষ্কৃতিকারী ও কাফির। হে আমার প্রতিপালক! তুমি ক্ষমা কর আমাকে, আমার পিতা-মাতাকে এবং যাহারা মুমিন হইয়া আমার গৃহে প্রবেশ করে তাহাদিগকে এবং মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদিগকে; আর জালিমদের শুধু ধ্বংসই বৃদ্ধি কর” (৭১ : ১-২৮)।
হাদীছে হযরত নূহ (আ)
হযরত নূহ (আ) সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (স)-এর হাদীছে খুব বেশি বর্ণনা পাওয়া যায় না। তাঁহার সম্পর্কে হাদীছে নিম্নলিখিত বর্ণনা পাওয়া যায় :
আবু হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত। তিনি বলেন, “একদা আমরা নবী (স)-এর সঙ্গে ছিলাম। [তিনি কিয়ামতের দিনের বর্ণনা দেন যে, সেই দিনের ভয়াবহতা হইতে রক্ষা পাইবার জন্য লোকজন আল্লাহর নিকট সুপারিশ করিবার জন্য বিভিন্ন নবীর দ্বারস্থ হইবে। এই পর্যায়ে তাহারা আদম (আ)-এর নিকট গিয়া আল্লাহর নিকট সুপারিশ করার অনুরোধ করিলে আদম (আ) বলিবেন তোমরা নূহ (আ)-এর নিকট যাও। তখন তাহারা নূহের নিকট গিয়া বলিবে, হে নূহ! বিশ্ববাসীর নিকট আপনি প্রথম রাসূল। আর আল্লাহ আপনার নাম রাখিয়াছেন “কৃতজ্ঞ বান্দা” আপনি দেখিতেছেন না, আমরা কি অবস্থায় নিপতিত! আপনি দেখিতেছেন না আমাদের কি কষ্ট হইতেছে! আমাদের জন্য আপনার প্রতিপালকের নিকট সুপারিশ করুন। তিনি বলিলেন, আমার প্রতিপালক আজ এমন ক্রোধান্বিত হইয়াছেন যে, এইরূপ ক্রোধান্বিত তিনি ইতোপূর্বে কোন দিন হন নাই, পরেও কোন দিন হইবেন না। নাফসী! নাফসী! তোমরা আমার বংশধরের কাছে যাও। মুসলিম ও ইব্ন মাজা গ্রন্থে এই স্থলে ইবরাহীম (আ)-এর নাম উল্লেখ রহিয়াছে যে, তোমরা ইবরাহীমের কাছে যাও, আল্লাহ্ যাহাকে খলীল (বন্ধু)-রূপে গ্রহণ করিয়াছিলেন (আল-বুখারী, আস-সাহীহ, ১খ., ৪৭০; মুসলিম, আস-সাহীহ, ১খ., ১০৮; ইবন মাজা, আস-সুনান, পৃ. ৩২৯-৩৩০; তিরমিযী, আল-জামি, ২খ, ৬৬)।
আবু সাঈদ খুদরী (রা) হইতে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ (স) বলেন, (কিয়ামতের দিন) নূহ (আ)-ও তাঁহার উম্মত (ময়দানে) আসিবে। তখন আল্লাহ তাআলা বলিবেন, তুমি কি (হিদায়াতের বাণী ও আমার দীনের দাওয়াত পৌঁছাইয়াছ? তিনি বলিবেন, হাঁ, হে আমার প্রতিপালক! অতঃপর তিনি (আল্লাহ) তাঁহার উম্মতকে বলিবেন, সে কি তোমাদের নিকট পৌঁছাইয়াছে তাহারা বলিবে, না, আমাদের কাছে কোন নবী আসে নাই। তখন তিনি নূহকে বলিবেন, তোমার সাক্ষী কে? তিনি বলিবেন, মুহাম্মাদ (স)-ও তাঁহার উম্মত। তখন আমরা সাক্ষী দিব যে, তিনি (হিদায়াতের বাণী) পৌঁছাইয়াছেন। ইহাই আয়াতে বর্ণিত হইয়াছে : “এইভাবে আমি তোমাদিগকে এক মধ্যপন্থী জাতিরূপে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি, যাহাতে তোমরা মানবজাতির জন্য সাক্ষীস্বরূপ এবং রাসূল তোমাদের জন্য সাক্ষীস্বরূপ হইবে” (আয়াত দ্র. ২ : ১৪৩; হাদীছ দ্র. আল-বুখারী, আস-সাহীহ, ১খ., ৪৭০)।
ইব্ন উমার (রা) হইতে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ (স) একবার লোক সমাবেশে দাঁড়াইলেন, অতঃপর আল্লাহর যথাযথ প্রশংসা করিলেন। অতঃপর দাজ্জালের প্রসংগ উল্লেখ করিয়া বলিলেন, ‘আমি তোমাদিগকে তাহার সম্পর্কে সতর্ক করিব। প্রত্যেক নবীই (তাহার সম্পর্কে) আপন সম্প্রদায়কে সতর্ক করিয়াছেন। নূহ (আ)-ও তাঁহার সম্প্রদায়কে সতর্ক করিয়াছিলেন” (আল-বুখারী আস-সাহীহ, ১খ., ৪৭০)।
আবদুল্লাহ্ ইবন আমর (রা) হইতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (স)-কে বলিতে শুনিয়াছি, নূহ (আ) ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার দিবস ব্যতীত সারা বৎসর সাওম পালন করিতেন (ইবন মাজা, আস-সুনান, ১খ., ১২৪)।
একটি হাদীছে হ্যরত নূহ (আ)-এর নাম উল্লেখ না থাকিলেও হাদীস বিশারদ ও ভাষ্যকারগণের মতে উক্ত হাদীছে নূহ (আ)-এর কথাই বর্ণনা করা হইয়াছে। হাদীসটি হইল :
আবদুল্লাহ (রা) বলেন, আমি যেন নবী (স)-কে দেখিতেছি যে, তিনি বর্ণনা করিতেছেন? নবীদিগের মধ্য হইতে একজন নবীকে তাঁহার সম্প্রদায় প্রহারে রক্তাক্ত করিয়া ফেলিয়াছে আর তিনি স্বীয় মুখমণ্ডল হইতে রক্ত মুছিয়া কলিতেছিলেন, হে আল্লাহ! আমার সম্প্রদায়কে ক্ষমা কর। কেননা তাহারা অজ্ঞ (আল-বুখারী, আস-সাহীহ, ১খ., ৪৯৫)।
বাইবেলে হযরত নূহ (আ)
বাইবেলের পুরাতন নিয়ম (Old Testament)-এর ৬-১০ অনুচ্ছেদ ব্যাপী হযরত নূহ (আ) সম্পর্কে আলোচনা করা হইয়াছে। সেখানে বেশির ভাগ বর্ণনাই পাবন সম্পর্কিত। এতদ্ব্যতীত তাহার পরবর্তী বংশের তালিকা ও বিবরণ প্রদান করা হইয়াছে। বাইবেলের বর্ণনা নিম্নরূপঃ
লেমক এক শত বিরাশী বৎসর বয়সে উপনীত হইলে তাহার এক পুত্র জন্মগ্রহণ করে যাহার নাম তিনি নোহ (বিশ্রাম] রাখিলেন। কেননা তিনি কহিলেন, সদাপ্রভু কর্তৃক অভিশপ্ত ভূমি হইতে আমাদের যে শ্রম ও হস্তের ক্লেশ হয়, তদ্বিষয়ে আমাদিগকে সান্ত্বনা করিবে; নোহের জন্ম দিলে পর লেমক পাঁচ শত পঁচানব্বই বৎসর জীবিত থাকিয়া আরও পুত্র-কন্যার জন্ম দিলেন; সবশুদ্ধ লেমকের সাত শত সাতাত্তর বৎসর বয়স হইলে তাহার মৃত্যু হইল। পরে নোহ পাঁচ শত বৎসর বয়সে শেম, হাম ও যেফতের জন্ম দিলেন (Genesis, 5 : 28-32; বাংলা অনুপবিত্র বাইবেলে, আদিপুস্তক, পৃ. ৭)।
নোহ ও জল প্লাবনের বৃত্তান্ত
এইরূপে যখন ভূমণ্ডলে মনুষ্যদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। আর সদাপ্রভু কহিলেন, আমি যে মনুষ্যকে সৃষ্টি করিয়াছি, তাহাকে ভূমণ্ডল হইতে উচ্ছিন্ন করিব; মনুষ্যের সহিত পশু, সরীসৃপ, জীব ও আকাশের পক্ষীদিগকেও উচ্ছিন্ন করিব। কেননা তাহাদের নির্মাণ প্রযুক্ত আমার অনুশোচনা হইতেছে। (কিন্তু) নোহ সদাপ্রভুর দৃষ্টিতে অনুগ্রহপ্রাপ্ত হইলেন। নোহের বংশ-বৃত্তান্ত এই : নোহ তাল্কালীন লোকদের মধ্যে ধার্মিক ও সিদ্ধলোক ছিলেন, নোহ, শেম, হাম ও যেফৎ নামে তিন পুত্রের জন্ম দেন। তৎকালে পৃথিবী ঈশ্বরের দৃষ্টিতে ভ্রষ্ট, পৃথিবী দৌরাত্মে পরিপূর্ণ ছিল। আর ঈশ্বর পৃথিবীতে দৃষ্টিপাত করিলেন, আর দেখ ইহা ভ্রষ্ট হইয়াছে, কেননা পৃথিবীস্থ সমুদয় প্রাণী ভ্ৰষ্টাচারী হইয়াছিল । তখন ঈশ্বর নোহকে কহিলেন, আমি সকল প্রাণীকে ধ্বংস করিবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছি, কেননা তাহাদের দ্বারা পৃথিবী দৌরাত্ম্যে পরিপূর্ণ হইয়াছে; আর দেখ আমি পৃথিবীর সহিত তাহাদিগকে বিনষ্ট করিব। তুমি গোদর কাষ্ঠ দ্বারা এক জাহাজ নির্মাণ করিবে ও তাহার ভিতরে ও বাহিরে ধুনা দিয়া লেপন করিবে। এই প্রকারে তাহা নির্মাণ করিবে। জাহাজ দৈর্ঘ্যে তিন শত হাত, প্রস্থে পাঁচ শত হাত ও উচ্চতায় ত্রিশ হাত হইবে। আর তাহার ছাদের এক হাত নীচে বাতায়ন প্রস্তুত করিয়া রাখিবে ও জাহাজের পার্শ্বে দ্বার রাখিবে; তাহার প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলা নির্মাণ করিবে। আর দেখ আকাশের নীচে প্রাণবায়ু বিশিষ্ট যত জীব-জন্তু আছে সকলকে বিনষ্ট করণার্থে আমি পৃথিবীর উপরে জল প্লাবন আনিব, পৃথিবীস্থ সকলে প্রাণ ত্যাগ করিবে। কিন্তু তোমার সহিত আমি নিজস্ব নিয়ম স্থির করিব; তুমি আপন পুত্রগণ, স্ত্রী ও পুত্রবধূদিগকে সংগে লইয়া সেই জাহাজে প্রবেশ করিবে। আর বংশবিশিষ্ট সমস্ত জীব-জন্তুর স্ত্রী-পুরুষ জোড়া জোড়া লইয়া তাহাদের প্রাণ রক্ষার্থে নিজের সহিত সেই জাহাজে প্রবেশ করাইবে। সর্ব জাতীয় পক্ষী ও সর্বজাতীয় পশু ও সর্ব জাতীয় ভূচর সরীসৃপ জোড়া জোড়া প্রাণ রক্ষার্থে তোমার নিকটে প্রবেশ করিবে। আর তোমার ও তাহাদের আহারার্থে তুমি সর্বপ্রকার খাদ্য সামগ্রী আনিয়া আপনার নিকটে সঞ্চয় করিবে। তাহাতে নোহ সেইরূপ করিলেন, ঈশ্বরের আজ্ঞানুসারেই সকল কর্ম করিলেন (Genesis 6:1-22; বাংলা অনু. পবিত্র বাইবেল, আদিপুস্তক, পৃ. ৭-৮; ঈষৎ পরিবর্তনসহ)।
আর সদাপ্রভু নোহকে কহিলেন, তুমি সপরিবারে জাহাজে প্রবেশ কর, কেননা এই কালের লোকদের মধ্যে আমার সাক্ষাতে তোমাকেই ধার্মিক দেখিয়াছি। তুমি শুচি পশুর স্ত্রী-পুরুষ লইয়া প্রত্যেক জাতির সাত সাত জোড়া এবং অশুচি পশুর স্ত্রী-পুরুষ লইয়া প্রত্যেক জাতির এক এক জোড়া এবং আকাশের পক্ষীদিগেরও স্ত্রী-পুরুষ লইয়া প্রত্যেক জাতির সাত সাত জোড়া সমস্ত ভূমণ্ডলে তাহাদের বংশ রক্ষার্থে নিজের সঙ্গে রাখ। কেননা সাত দিনের পর আমি পৃথিবীতে চল্লিশ দিবা-রাত্র বৃষ্টি বর্ষাইয়া আমার সৃষ্টি যাবতীয় প্রাণীকে ভূমণ্ডল হইতে উচ্ছিন্ন করিব। তখন নোহ সদাপ্রভুর আজ্ঞানুসারেই সকল কর্ম করিলেন। নোহের ছয় শত বৎসর বয়সে পৃথিবীতে জল প্লাবন হইল, জল প্লাবন হইতে রক্ষা পাওয়ার জন্য নোহ ও তাহার পুত্রগণ এবং তাহার স্ত্রী ও পুত্রবধূগণ জাহাজে প্রবেশ করিলেন। নোহের প্রতি ঈশ্বরের আজ্ঞানুসারে শুচি অশুচি পশুর এবং পক্ষীর ও ভূমিতে গমনশীল যাবতীয় জীবের স্ত্রী-পুরুষ জোড়া জোড়া জাহাজে নোহের নিকট প্রবেশ করিল। পরে সেই সাত দিন গত হইলে পৃথিবীতে জল প্লাবন হইল। নোহের বয়সের ছয় শত বৎসরের দ্বিতীয় মাসের সপ্তদশ দিনে মহা জলধির সমস্ত স্রোতধারা উথলিয়া উঠিল এবং আকাশের বাতায়ন সকল মুক্ত; তাহাতে পৃথিবীতে চল্লিশ দিবারাত্র মহাবৃষ্টি হইল। সেই দিন নোহ এবং শেম, হাম ও যেফৎ নামে নোহের পুত্রগণ এবং তাহাদের সহিত নোহের স্ত্রী ও তিন পুত্রবধূ জাহাজে প্রবেশ করিলেন। আর তাহাদের সহিত সর্ব জাতীয় বন্য পশু, সর্ব জাতীয় গ্রাম্য পশু, সর্ব জাতীয় ভূচর সরীসৃপ জীব ও সর্ব জাতীয় পক্ষী, সর্ব জাতীয় খেচর, প্রাণবায়ুবিশিষ্ট সর্ব প্রকার জীব-জন্তু জোড়া জোড়া জাহাজে নোহের নিকট প্রবেশ করিল। ফলত তাহার প্রতি ঈশ্বরের আজ্ঞানুসারে সমস্ত প্রাণীর স্ত্রী-পুরুষ প্রবেশ করিল। পরে সদাপ্রভু তাহার পশ্চাৎদ্বার বন্ধ করিলেন। আর চল্লিশ দিন পর্যন্ত পৃথিবীতে জল প্লাবন হইল, তাহাতে পানি বৃদ্ধি পাইয়া জাহাজ ভাসাইলে তাহা মৃত্তিকা ছাড়িয়া উঠিল। পরে পানি প্রবল হইয়া পৃথিবীতে অতিশয় বৃদ্ধি পাইল এবং জাহাজ পানির উপর ভাসিতে থাকিল। আর পৃথিবীতে পানি অত্যন্ত প্রবল হইল, আকাশ মণ্ডলের অধঃস্থিত সকল মহাপর্বত নিমগ্ন হইল। তাহার উপরে পনের হাত পানি উঠিয়া প্রবল হইল, পর্বত সকল নিমগ্ন হইল। তাহাতে ভূচর যাবতীয় প্রাণী-পক্ষী, গ্রাম্য ও বন্য পশু, ভূচর সরীসৃপ সকল এবং মনুষ্য সকল মরিল । এইরূপে ভূমণ্ডল নিবাসী সমস্ত প্রাণী-মনুষ্য, পশু সরীসৃপ জীব ও আকাশীয় পক্ষী সকল উচ্ছিন্ন হইল, কেবল নোহ ও তাহার সঙ্গী জাহাজস্থ প্রাণীরা বাঁচিলেন। আর পানি পৃথিবীর উপরে এক শত পঞ্চাশ দিন পর্যন্ত প্রবল থাকিল (Genesis, 7: 1-24; বাংলা অনু. পবিত্র বাইবেল, আদিপুস্তক পৃ. ৯)।
আর ঈশ্বর ননাহকে ও জাহাজে স্থিত তাহার সঙ্গী পশ্যাদি যাবতীয় প্রাণীকে স্মরণ করিলেন, ঈশ্বর পৃথিবীতে বায়ু বহাইলেন, তাহাতে পানি থামিল। আর জলধির স্রোতধারা ও আকাশের বাতায়ন সকল বন্ধ এবং আকাশের মহাবৃষ্টি নিবৃত্ত হইল। আর পানি ক্রমশ ভূমির উপর হইতে সরিয়া গিয়া এক শত পঞ্চাশ দিনের শেষে হ্রাস পাইল । তাহাতে সপ্তম মাসে, সপ্তদশ দিনে অরারর্যের পর্বতের উপরে জাহাজ লাগিয়া রহিল। পরে দশম মাস পর্যন্ত পানি ক্রমশ সরিয়া হ্রাস পাইল। ঐ দশম মাসের প্রথম দিনে পর্বতগুলোর শৃঙ্গ দেখা গেল।
আর চল্লিশ দিন গত হইলে নোহ আপনার নির্মিত জাহাজের বাতায়ন খুলিয়া একটি দাঁড় কাক ছাড়িয়া দিলেন; তাহাতে সে উড়িয়া ভূমির উপরস্থ পানি শুষ্ক না হওয়া পর্যন্ত ইতস্ততঃ গতায়াত করিল। আর ভূমির উপরে পানি হ্রাস পাইয়াছে কি না তাহা জানিবার জন্য তিনি নিজের নিকট হইতে এক কপোত ছাড়িয়া দিলেন। তাহাতে সমস্ত পৃথিবী পানিতে আচ্ছাদিত থাকায় কপোত পদার্পণের স্থান পাইল না, তাই জাহাজে তাহার নিকটে ফিরিয়া আসিল। তখন তিনি হাত বাড়াইয়া উহাকে ধরিলেন এবং জাহাজের ভিতরে আপনার নিকট রাখিলেন। পরে তিনি আর সাত দিন বিলম্ব করিয়া জাহাজ হইতে সেই কপোত পুনর্বার ছাড়িয়া দিলেন এবং কপোতটি সন্ধ্যাকালে তাহার নিকট ফিরিয়া আসিল; তাহার চঞ্চুতে জিত বৃক্ষের একটি নবীন পত্র ছিল; উহাতে নোহ বুঝিলেন, ভূমির উপরে পানি হ্রাস পাইয়াছে। পরে তিনি আর সাত দিন বিলম্ব করিয়া সেই কপোত ছাড়িয়া দিলেন। তখন সে তাহার নিকটে আর ফিরিয়া আসিল না । (নোহের বয়সের ছয় শত এক বৎসরের প্রথম মাসের প্রথম দিনে পৃথিবীর উপরে পানি শুষ্ক হইল; তাহাতে জাহাজের ছাদ খুলিয়া দৃষ্টিপাত করিলেন, ভূতল নির্জল। পরে দ্বিতীয় মাসের সাতাইশতম দিনে ভূমি শুষ্ক হইল (প্রাগুক্ত, ৪ ও ১-১৪, বাংলা আদিপুস্তক, পৃ. ৯-১০)।
নোহের সহিত কৃত ঈশ্বরের নিয়ম
পরে ঈশ্বর নোহকে কহিলেন, তুমি নিজ স্ত্রী, পুত্রগণ ও পুত্রবধূগণকে সঙ্গে লইয়া জাহাজ হইতে বাহিরে যাও। আর তোমার সঙ্গী পশু, পক্ষী ও ভূচর সরীসৃপ প্রভৃতি মাংসময় যত জীব-জন্তু আছে, সেই সকলকে তোমার সঙ্গে বাহিরে আন, তাহারা পৃথিবীকে প্রাণীময় করুক এবং পৃথিবী প্রজাবন্ত ও বহু বংশ হউক। তখন নোহ নিজ পুত্রগণ এবং নিজ স্ত্রী ও পুত্র বধূগণকে সঙ্গে লইয়া বাহির হইলেন। আর স্ব-স্ব জাতি অনুসারে প্রত্যেক পশু, সরীসৃপ জীব ও পক্ষী, সমস্ত ভূচর প্রাণী জাহাজ হইতে বাহির হইল। পরে নোহ সদাপ্রভুর উদ্দেশ্যে যজ্ঞবেদি নির্মাণ করিলেন এবং সর্ব প্রকার শুচি পশুর ও সর্বপ্রকার শুচি পক্ষীর মধ্যে কতকগুলো লইয়া বেদির উপরে হোম করিলেন (Genesis, 8: 15-22; বাংলা অনু. পবিত্র বাইবেল, আদিপুস্তক, পৃ. ১০-১১)।
পরে ঈশ্বর নোহকে ও তাহার পুত্রগণকে এই আশীর্বাদ করিলেন, তোমরা প্রজাবন্ত ও বহু বংশ হও, পৃথিবী পরিপূর্ণ কর। পৃথিবীর যাবতীয় প্রাণী ও আকাশের যাবতীয় পক্ষী তোমাদের হইতে ভীত ও ত্রাসযুক্ত হইবে; সমস্ত ভূচর জীব ও সমুদ্রের সমস্ত মৎস্য শুদ্ধ, সে সকল তোমাদেরই হস্তে সমর্পিত। প্রত্যেক গমনশীল প্রাণী তোমাদের খাদ্য হইবে; আমি হরিৎ, ঔষধির ন্যায় সে সকল তোমাদিগকে দিলাম কিন্তু স্বপ্রাণ অর্থাৎ সরক্তমাংস ভোজন করিও না। আর তোমাদের রক্তপাত হইলে আমি তোমাদের প্রাণের পক্ষে তাহার পরিশোধ অবশ্যই লইব; সকল পশুর নিকটে তাহার পরিশোধ লইব এবং মনুষ্যের ভ্রাতা মনুষ্যের নিকটে আমি মনুষ্যের প্রাণের পরিশোধ লইব; যে কেহ মনুষ্যের রক্তপাত করিবে, মনুষ্য কর্তৃক তাহার রক্তপাত করা যাইবে; কেননা ঈশ্বর নিজ প্রতিমূর্তিতে মনুষ্যকে নির্মাণ করিয়াছেন। তোমরা প্রজাবন্ত হও ও বহু বংশ হও, পৃথিবীকে প্রাণীময় কর ও তন্মধ্যে বর্ধিষ্ণু হও।
পরে ঈশ্বর নোহকে ও তাহার সঙ্গী পুত্রগণকে কহিলেন, দেখ তোমাদের সহিত তোমাদের ভাবী বংশের সহিত ও তোমাদের সঙ্গী যাবতীয় প্রাণীর সহিত, পক্ষী এবং গ্রাম্য ও বন্য পশু, পৃথিবীস্থ যত প্রাণী জাহাজ হইতে বাহির হইয়াছে, তাহাদের সহিত আমি আমার নিয়ম স্থির করি। আমি তোমাদের সহিত আমার নিয়ম স্থির করি; জল পাবন দ্বারা সমস্ত প্রাণী আর উচ্ছিন্ন হইবে না এবং পৃথিবীর বিনাশার্থে জল প্লাবন আর হইবে না। ঈশ্বর আরও কহিলেন, আমি তোমাদের সহিত ও তোমাদের সঙ্গী যাবতীয় প্রাণীর সহিত চিরস্থায়ী পুরুষ-পরম্পরার জন্য যে নিয়ম স্থির করিলাম, তাহার চিহ্ন এই। আমি মেঘে আপন ধনু স্থাপন করি তাহাই পৃথিবীর সহিত আমার নিয়মের চিহ্ন হইবে। যখন আমি পৃথিবীর উর্দ্ধে মেঘের সঞ্চার করিব, তখন সেই ধনু মেঘে দৃষ্ট হইবে। তাহাতে তোমাদের সহিত ও মাংসময় সমস্ত প্রাণীর সহিত আমার যে নিয়ম আছে তাহারা আমার স্মরণ হইবে এবং সকল প্রাণীর বিনাশার্থ জল প্লাবন আর হইবে না। আর মেঘ ধনুক হইলে আমি তাহার প্রতি দৃষ্টিপাত করিব; তাহাতে মাংসময় যত প্রাণী পৃথিবীতে আছে, তাহাদের সহিত ঈশ্বরের যে চিরস্থায়ী নিয়ম তাহা আমি স্মরণ করিব। ঈশ্বর নোহকে কহিলেন, পৃথিবীস্থ সমস্ত প্রাণীর সহিত আমার স্থাপিত নিয়মের এই চিহ্ন হইবে।
নোহের তিন পুত্রের বিবরণ
নোহের যে পুত্রেরা জাহাজ হইতে বাহির হইলেন, তাহাদের নাম শেম, হাম ও যেফৎ; সেই হাম কনানের পিতা। এই তিনজন নোহের পুত্র; ইহাদেরই বংশ সমস্ত পৃথিবীতে ব্যাপ্ত হইল।
জল প্লাবনের পরে নোহ তিন শত পঞ্চাশ বৎসর জীবিত থাকিলেন। সবশুদ্ধ নোহের নয় শত পঞ্চাশ বৎসর বয়স হইলে তাহার মৃত্যু হইল (Genesis, 9 : 1-29; বাংলা অনু, পবিত্র বাইবেল, আদিপুস্তক, পৃ. ১১-১২)।
হযরত নূহ (আ)-এর সম্প্রদায়
ইব্ন জুবায়র (মৃ. ১২১৭ খৃ.) প্রমুখের বর্ণনামতে নূহ (আ)-এর সম্প্রদায়কে বানূ রাসিব বলা হইত (ইব্ন কাছীর, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ. ৬০; আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ., ১০১)। প্রবীণ ঐতিহাসিক ইমাম আছ-ছাআলাবী (মৃ. ৪২৭/১০৩৫ সন) তাহার আরাইসুল-মাজালিস গ্রন্থে ইহাদের পূর্বপুরুষের বিস্তারিত পরিচয় তুলিয়া ধরিয়াছেন। তবে উহা গারীব (বিরল বর্ণনা)-এর পর্যায়ভুক্ত বলিয়া মনে হয়। কারণ নির্ভরযোগ্য ইতিহাস গ্রন্থসমূহে উক্ত বিবরণ পাওয়া যায় না। তিনি বলেন, নূহ (আ)-এর সম্প্রদায় ছিল কাবীল-এর বংশধর এবং শীছ (আ)-এর বংশধরের মধ্যে যাহারা উহাদের আনুগত্য করিয়াছিল তাহারা। প্রকৃতপক্ষে শীছ (আ)-এর বংশের লোকের সহিত কাবীলের বংশের রক্ত মিলিত হইয়া যে সম্প্রদায়ের জন্ম হয় তাহারাই ছিল নূহ (আ)-এর সম্প্রদায়। ইবন আব্বাস (রা) এই ইতিহাস বর্ণনা করিতে গিয়া বলেন, হযরত আদম (আ)-এর বংশের দুইটি ধারা ছিল, যাহার একটি সমতল ভূমিতে বসবাস করিত এবং অপরটি পর্বতে। পর্বতের পুরুষগণ ছিল সুশ্রী ও সুদর্শন আর মহিলাগণ কুৎসিত। অপরপক্ষে সমতল ভূমির মহিলাগণ ছিল সুন্দরী ও রূপসী আর পুরুষগণ কুশ্রী। ইবলীস একদিন এক গোলামের আকৃতি ধারণ করিয়া সমতল ভূমির এক ব্যক্তির নিকট আসিল, অতঃপর তাহার নিকট মজুরী খাঁটিবার বন্দোবস্ত করিল। সে তাহার সেবা করিত। ইবলীস একদিন রাখালদের বাঁশির ন্যায় একটি বাঁশি বানাইল। উহা হইতে এমন এক আওয়াজ বাহির হইতে লাগিল যাহা লোকে ইতোপূর্বে আর কখনও শোনে নাই। উক্ত আওয়াজ পার্শ্ববর্তী লোকজনের কানে পৌঁছিলে তাহারা উহা শুনিবার জন্য তাহার নিকট আসিল, অতঃপর তাহারা উহাকে উৎসবরূপে গ্রহণ করিল। সেখানে বৎসরে একবার তাহারা জড়ো হইত এবং নারী-পুরুষ খোলামেলাভাবে মিলিত হইত। পর্বতে বসবাসকারী এক ব্যক্তি অকস্মাৎ তাহাদের উৎসবের দিনে তাহাদের নিকট আসিয়া পড়িল এবং মহিলা ও তাহাদের সৌন্দর্য দর্শন করিল, অতঃপর ফিরিয়া আসিয়া সাথি-সঙ্গীদিগকে অবহিত করিল। অতঃপর তাহারা ইহাদের নিকট চলিয়া আসিল এবং ইহাদের সহিত একত্রে অবস্থান করিতে লাগিল। এইভাবে তাহাদের মধ্যে অশ্লীলতা ও অপকর্ম ছড়াইয়া পড়িল। ইহাই আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করিয়াছেন :
(৩৩ : ৩৩) “এবং প্রাচীন যুগের মত নিজদিগকে প্রদর্শন করিয়া বেড়াইবে না।”
ইবন আব্বাস (রা) বলেন, আদম (আ) ওসীয়ত করিয়াছিলেন যে, শীছ-এর বংশধর কাবীল-এর বংশধরকে যেন বিবাহ না করে। শীছ (আ)-এর বংশধর ইহা খুবই গুরুত্বের সহিত পালন করিত, এমনকি তাহারা নিজদের বাসস্থানে পাহারাদার নিযুক্ত করিয়াছিল যাহাতে কাবীলের বংশধরদের কেহ তাহাদের নিকটেও না আসিতে পারে। একদা শীছ (আ)-এর বংশধরের এক শত লোক বলিল, দেখি না আমাদের চাচার বংশধরেরা কি করিতেছে। এই বলিয়া সেই এক শত পুরুষ সমতল ভূমির সুন্দরী মহিলাদের নিকট নামিয়া আসিল। অতঃপর সেখানকার মহিলারা তাহাদিগকে বরণ করিয়া লইল। বেশ কিছু দিন এইভাবে অতিবাহিত হইয়া গেল। অতঃপর আর এক শতজন বলিল, দেখি না আমাদের ভ্রাতাগণ সেখানে কী করিতেছে। এই বলিয়া তাহারা পর্বত হইতে তাহাদের নিকট নামিয়া আসিল। তাহাদিগকেও মহিলারা বরণ করিয়া লইল। অতঃপর শীছ-এর বংশধর সকলেই নামিয়া আসিল। এইভাবে তাহারা পাপাচারে লিপ্ত হইল এবং পরস্পরে বিবাহ-শাদী করিল। পরস্পরে মিলিয়া-মিশিয়া তাহারা একাকার হইয়া গেল। এইরূপে কাবীলের বংশধর বৃদ্ধি পাইয়া পৃথিবী ভরিয়া তুলিল এবং তাহারা নানারূপ পাপাচার শুরু করিয়া পৃথিবী ভরিয়া দিল (আছ-ছালাবী, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৫৬)। কোনও কোনও ঐতিহাসিকের বর্ণনামতে কাবীলের বংশধর এতদূর পাপাচারী হইয়াছিল যে, তাহারা অগ্নিপূজা করিত। কিন্তু ইবন আব্বাস (রা) হইতে বর্ণিত বুখারীর হাদীস দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, হযরত আদম (আ) হইতে নূহ (আ) পর্যন্ত সময়কালের সকলেই ইসলাম ও হক-এর উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। তাই কাবীলের বংশধর মুশরিক হওয়ার বর্ণনা সঠিক বলিয়া মানিয়া লওয়া যায় না (ইব্ন কাছীর, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ. ৬০; আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ., ১০১)। হইতে পারে তাহারা শিরক ব্যতীত অন্যান্য পাপাচার করিত এবং নূহ (আ)-এর সময়ে আসিয়া তাহারা ওয়াদ্দ, সুওয়া, আগুছ, যাউক ও নাসর নামীয় মূর্তিসমূহের পূজা করিত। তাহার সম্প্রদায় শিরক তথা মূর্তিপূজা শুরু করিয়া দেয়। পৃথিবীর বুকে ইহাই ছিল সর্বপ্রথম মূর্তিপূজা। ইহার সূচনা সম্পর্কে ইমাম বুখারী (র) ইবন আব্বাস (রা) হইতে হাদীছ রিওয়ায়াত করিয়াছেন যে, ওয়াদ, সুওয়া, আগুছ, যাউক ও নাসর ছিল নূহ সম্প্রদায়ের সকর্মপরায়ণ ব্যক্তিবর্গের নাম। তাহারা ইনতিকাল করিলে শয়তান তাহাদের পরামর্শ দিল যে, তাহারা যে সকল স্থানে উপবেশন করিত সেখানে তাহাদের প্রতিকৃতি স্থাপন কর এবং সেগুলোকে উহাদের নামেই নামকরণ কর। তাহারা এইরূপ করিল। কিন্তু তখন উহাদের উপাসনা করা হইত না। অতঃপর এই সকল লোক যখন ইনতিকাল করিল এবং এই প্রতিকৃতি স্থাপনের আসল উদ্দেশ্য সম্পর্কে জ্ঞাত লোক পৃথিবী হইতে বিদায় লইয়া গেল তখন তাহাদের উপাসনা করা শুরু হইয়া গেল। ইবন আব্বাস (রা) বলেন, নূহ সম্প্রদায়ের এই মূর্তিপূজা পরবর্তীতে সমগ্র আরব জাহানে বিস্তার লাভ করে (আল-বুখারী, আস-সাহীহ, ২৩ খ., ৭৩২)। ইকরিমা, দাহহাক, কাতাদা, ইবন ইসহাক প্রমুখও এইরূপ বর্ণনা করিয়াছেন (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ১খ., ১০৫)। এই বিষয়টিই মুসলিম ঐতিহাসিকগণ আরও বিস্তারিত ও বিশদভাবে বর্ণনা করিয়াছেন যে, ইহাদের মধ্যে ওয়াদ্দ ছিলেন বয়ঃজ্যেষ্ঠ এবং বেশি নেককার ও জনপ্রিয়। তিনি ছিলেন বাবিল নিবাসী। তাহার ইনতিকালে লোকজন খুবই মর্মাহত ও শোকাভিভূত হইয়া পড়িল। তাহারা তাহার কবরের পাশে ঘুরিয়া ঘুরিয়া হা-হুঁতাশ করিতে লাগিল। ইবলীস তাহাদের এই মাতম ও হা-হুঁতাশ দেখিয়া একজন মানুষের আকৃতিতে আসিয়া বলিল, এই ব্যক্তির প্রতি আমি তোমাদের আক্ষেপ ও হা-হুঁতাশ দেখিতেছি। আমি কি তোমাদিগকে এই ব্যক্তির একটি প্রতিকৃতি বানাইয়া দিব, যাহা তোমরা তোমাদের মজলিসে রাখিয়া উহার মাধ্যমে তাহাকে স্মরণ করিবে? তাহারা বলিল, হাঁ। অতঃপর ইবলীস তাহাদের জন্য তাহার অনুরূপ একটি প্রতিকৃতি বানাইয়া দিল। তাহারা উহা তাহাদের মজলিসে রাখিয়া দিল এবং উহার মাধ্যমে তাহাকে স্মরণ করিতে লাগিল। উহার প্রতি তাহাদের স্মরণের এইরূপ অবস্থা দেখিয়া ইবলীস বলিল, আরও ভালমত স্মরণ করিবার সুবিধার্থে তোমাদের প্রত্যেকের ঘরে রাখিবার জন্য আমি কি ইহার অনুরূপ একটি করিয়া মূর্তি তৈয়ার করিয়া দিব? তাহারা বলিল, হাঁ। অতঃপর সে প্রত্যেকের ঘরে অনুরূপ একটি করিয়া মূর্তি বানাইয়া দিল এবং তাহারাও যথারীতি উহার মাধ্যমে তাহাকে স্মরণ করিতে লাগিল। তাহাদের সন্তানগণ তাহাদের এইরূপ কর্ম দেখিতে লাগিল। এমনিভাবে তাহাদের লূতন লূতন বংশধর আসিতে লাগিল এবং উহাকে স্মরণের উক্ত পদ্ধতিও পরিবর্তিত হইতে লাগিল। এক সময় ইবলীস তাহাদিগকে বুঝাইল যে, পূর্ববর্তিগণ তো ইহারই উপাসনা করিত এবং ইহারই নিকট বৃষ্টি প্রার্থনা করিত। ইহা শুনিয়া তাহারা ইহাকেই উপাস্য বানাইয়া ফেলিল এবং আল্লাহকে ছাড়িয়া ইহারই ইবাদত করিতে লাগিল। তাই আল্লাহ ব্যতীত সর্বপ্রথম যাহার ইবাদত করা হয় তাহা হইল এই ওয়াদূদ-এর মূর্তি, যাহাকে তাহারা ওয়াদ্দ নামেই আখ্যায়িত করিয়াছিল (ইব্ন কাছীর, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৬৬; আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ., ১০৫-১০৬; আল-আসী, রূহুল-মাআনী, ২৯ খ., ৭৭)। উল্লিখিত অন্যান্য মূর্তিগুলোরও তাহারা একই পন্থায় ইবাদত করিতে শুরু করে। এই কথাই একটি হাদীছে বর্ণিত হইয়াছে যে, উম্মুল মুমিনীন উম্মু সালামা ও উম্মু হাবীবা (রা) যখন তাঁহাদের হাবশায় দেখা মারিয়া নামক গির্জার সৌন্দর্য ও উহার অভ্যন্তরে রক্ষিত মূর্তিসমূহের কথা রাসূলুল্লাহ (স)-এর নিকট উল্লেখ করিলেন তখন রাসূলুল্লাহ (স) বলিলেন, ঐ সকল জাতির মধ্যকার কোনও নেককার লোক ইনতিকাল করিলে তাহারা তাহার কবরের উপর মসজিদ নির্মাণ করিত, অতঃপর উহাতে এই সকল মূর্তি স্থাপন করিত। আল্লাহর নিকট উহারাই হইল সর্বনিকৃষ্ট সৃষ্টি (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ., ১০৬; আল-বুখারী, ১খ., ১৭৯; মুসলিম, আস-সাহীহ, ১খ., ২০১)।
মোটকথা, নূহ (আ)-এর সময়ে আসিয়া তাহার সম্প্রদায় সর্বপ্রকারের পাপাচার শুরু করিয়া দেয়। তাই কেহ কেহ বলিয়াছেন, নূহ সম্প্রদায় আল্লাহর অপছন্দনীয় ও অসন্তুষ্টিমূলক কাজ, যথা অশ্লীল কাজে লিপ্ত হওয়া, মদ্য পান করা, আল্লাহর ইবাদত পরিত্যাগ করিয়া খেল-তামাশায় মত্ত হওয়া প্রভৃতিতে সকলেই ঐক্যবদ্ধ ছিল (ইবনুল-আছীর, আল-কামিল, ১খ., ৫৪)।
নবুওয়াত প্রাপ্তি
উক্ত সম্প্রদায় যখন এইরূপে বিভিন্ন ধরনের পাপাচারে লিপ্ত হইল, বিভিন্ন মূর্তির পূজা করিতে শুরু করিল এবং তাহাদের মধ্যে গোমরাহী ও কুফরী ব্যাপকভাবে ছড়াইয়া পড়িল, তখন আল্লাহ তাআলা স্বীয় বান্দাদের প্রতি দয়াপরবশ হইয়া তাহাদের হিদায়াতের জন্য হযরত নূহ (আ)-কে নবী ও রাসূলরূপে প্রেরণ করেন। তিনি হযরত ইদরীস (আ)-এর পরবর্তী নবী এবং পৃথিবীর প্রথম রাসূল । যেমন বুখারী ও মুসলিম-এর হাদীস গ্রন্থে বর্ণিত শাফায়াতের হাদীছে উল্লেখ করা হইয়াছে (দ্র. মুসলিম, আস-সাহীহ, ১খ., ১০৮; আল-বুখারী, আস-সাহীহ, ১খ., ৪৭০)।
নবুওয়াত প্রাপ্তির সময় নূহ (আ)-এর বয়স কত ছিল এই ব্যাপারে মতভেদ রহিয়াছে। আল্লামা আলুসী তাঁহার তাফসীর গ্রন্থ রূহুল মাআনীতে ইব্ন আব্বাস (রা)-এর একটি মত উদ্ধৃত করিয়াছেন যে, তখন নূহ (আ)-এর বয়স ছিল ৪০ বৎসর (দ্র. রূহুল মাআনী, ১২খ., ৩৫)। ইমাম ইব্ন জারীর তাবারী ইবন আব্বাস (রা)-এর মতে ৪৮০ বৎসর বয়সে নূহ (আ) নবুওয়াত প্রাপ্ত হন বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন (আত-তাবারী, তারীখ, ১খ., ৯০)। মুকাতিল-এর বর্ণনামতে ১০০ বৎসর, এতদ্ব্যতীত ৫০, ২৫০, ৩৫০ বৎসর বলিয়াও মতামত পাওয়া যায় (দ্র. আছ-ছালাবী, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ. ৫৬; ইবন কাছীর, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ. ৬০; আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ., ১০১; ইবন সাদ, তাবাকাত, ১খ., ৪০; আল-আলুসী, রূহুল মাআনী, ৮খ., ১৪৯, ১২খ., ৩৫-৩৬)।
দাওয়াত ও তাবলীগ
নবূওয়াত প্রাপ্ত হইয়া হযরত নূহ (আ) তাঁহার কওমকে জানাইলেন যে, তিনি আল্লাহর পক্ষ হইতে একজন সুস্পষ্ট সতর্ককারী (৭১ ও ২), তাহাদের জন্য এক বিশ্বস্ত রাসূল (৬ : ১০৭)। বিভিন্নভাবে তিনি তাহাদিগকে বুঝাইতে লাগিলেন। তাহাদিগকে অন্য সব উপাস্য পরিত্যাগ করিয়া এক আল্লাহর ইবাদত করিতে বলিলেন। ইহা অমান্য করিলে তাহাদের উপর আযাব অবতীর্ণ হইবে, সেই ব্যাপারে সতর্কও করিলেন, “হে আমার সম্প্রদায়! আল্লাহর ইবাদত কর। তিনি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোনও ইলাহ নাই। আমি তোমাদের জন্য মহাদিনের শাস্তির আশঙ্কা করিতেছি” (৭ : ৫৯)। তিনি শুধু তাহাদিগকে শাস্তির ভয়ই দেখাইলেন না, বরং আল্লাহর ইবাদত করিলে এবং তাঁহার (নূহ-এর) আনুগত্য করিলে তাহাদের কৃত অপরাধসমূহ ক্ষমা করিয়া দেওয়ার এবং নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অবকাশ দেওয়ার ঘোষণাও দিলেন (৭১ : ৩-৪)। তিনি তাহাদিগকে পার্থিব পুরস্কার ও সুখ-শান্তি প্রাপ্তির আশ্বাস দিলেন এবং তাহাদের প্রতি প্রদত্ত আল্লাহ্ তাআলার নিমাতসমূহের বিস্তারিত বর্ণনা দিলেন। তিনি বলিলেন, “তাহার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করিলে তিনি তোমাদের জন্য প্রচুর বৃষ্টিপাত করিবেন, তোমাদিগকে ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতিতে সমৃদ্ধ করিবেন, তোমাদের জন্য উদ্যান স্থাপন করিবেন এবং নদী-নালা প্রবাহিত করিবেন” (৭১ : ১০-১২)। অতঃপর তাহাদের প্রতি আল্লাহর বিশেষ দান ও অনুগ্রহের কথা উল্লেখ করিয়া তাহাদিগকে মৃদু ভর্ৎসনা করিলেন, “তো তোমাদের কি হইয়াছে যে, তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করিতে চাহিতেছ না। অথচ তিনিই তো তোমাদিগকে সৃষ্টি করিয়াছেন পর্যায়ক্রমে। তোমরা কি লক্ষ্য কর নাই, আল্লাহ কিভাবে সৃষ্টি করিয়াছেন সপ্ত স্তরে বিন্যস্ত আকাশমণ্ডলী এবং সেথায় চন্দ্রকে স্থাপন করিয়াছেন আলোবুপে ও সূর্যকে স্থাপন করিয়াছেন প্রদীপরূপে? তিনি তোমাদিগকে উদ্ধৃত করিয়াছেন মৃত্তিকা হইতে, অতঃপর উহাতে তিনি তোমাদিগকে প্রত্যাবৃত্ত করিবেন ও পরে পুনরুথিত করিবেন এবং আল্লাহ তোমাদের জন্য ভূমিকে করিয়াছেন বিস্তৃত যাহাতে তোমরা চলাফেরা করিতে পার প্রশস্ত পথে” (৭১ ১৩-২০)।
তাহারা তাহাদের নিজেদের মধ্যে হইতেই একজন লোক এই দায়িত্ব পাইয়াছে জানিয়া বিস্ময় প্রকাশ করিল (৭ ও ৬৩) এবং বলিল, আমরা তোমাকে তো আমাদের মত মানুষ ব্যতীত কিছু দেখিতেছি না; আমরা তো দেখিতেছি তোমার অনুসরণ করিতেছে তাহারাই যাহারা আমাদের মধ্যে বাহ্য দৃষ্টিতেই অধম এবং আমরা আমাদের উপর তোমাদের কোন শ্রেষ্ঠত্ব দেখিতেছি না; বরং আমরা তোমাদিগকে মিথ্যাবাদী মনে করি (১১ ২৭) । অতঃপর সকলে মিলিয়া তাহাকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করিল (২ : ৬৪)।
দাওয়াত ও তাবলীগের কাজে হযরত নূহ (আ) নিরলস পরিশ্রম করেন। তাঁহার সাধ্যমত সমস্ত উপায়-উপকরণ তিনি অবলম্বন করেন। তিনি দিবা-রাত্র, প্রকাশ্যে ও গোপনে উচ্চস্বরে (৭১ : ৫-৯) সর্ববিধ পন্থায় কওমকে দাওয়াত দেন, কিন্তু স্বল্প সংখ্যক দরিদ্র ও নিম্ন শ্রেণীর লোক ছাড়া কেহই তাহার দাওয়াতে কর্ণপাত করিল না; বরং তাহাদের সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ এবং ধনী শ্রেণীর লোকেরা তাহাকে স্পষ্ট গোমরাহীতে লিপ্ত (৭ : ৫৯) বলিয়া আখ্যায়িত করিল, তাঁহাকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করিল। তাঁহাকে একজন সামান্য মানুষ এবং তাহার অনুসারীদিগকে নিম্ন শ্রেণীর লোক বলিয়া তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করিল। তাহারা তাহাকে উন্মত্ত বলিয়া অপবাদ দিল, আবার কখনও তাঁহাকে শ্রেষ্ঠত্ব লাভের আকাঙ্খী বলিয়া দোষারোপ করিল এবং তাহার ব্যাপারে কিছুকাল অপেক্ষা করার জন্য নিজেরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়া বলিল, আল্লাহ ইচ্ছা করিলে তো একজন ফেরেশতাই পাঠাইতেন (২৩ ও ২৪-২৫; ৫৪৯)।
অবশেষে তাহারা নূহ (আ)-এর একনিষ্ঠ অনুসারী দরিদ্র ও নিম্নশ্রেণীর লোকদিগকে দূরে সরাইয়া দেওয়ার প্রস্তাব করিল। কিন্তু নূহ (আ) দৃঢ়তার সহিত এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করিয়া বলিলেন, মুমিনদিগকে তাড়াইয়া দেওয়া আমার কাজ নহে (২৬ ও ১১৪)। তাহারা নিশ্চিতভাবে তাহাদের প্রতিপালকের সাক্ষাত লাভ করিবে (১১ : ২৯)। তাহাদিগকে তাড়াইয়া দিলে আল্লাহ তাআলা অসন্তুষ্ট হইবেন। পরোক্ষভাবে ইহাও বলিলেন, আমি যদি তাহাদেরকে তাড়াইয়া দেই তবে আল্লাহর শাস্তি হইতে আমাকে কে রক্ষা করিবে? তবুও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করিবে না (১১ : ৩০)। তিনি আরো বলিলেন, “উহারা কি করিত তাহা আমার জানা নাই। উহাদের হিসাব গ্রহণ তো আমার প্রতিপালকেরই কাজ; যদি তোমরা বুঝিতে” (২৬ : ১১২-১১৩)। তিনি বলিলেন, এই সকল দুর্বল ও নিম্নশ্রেণীর লোক যাহারা মনে-প্রাণে আল্লাহর উপর ঈমান আনিয়াছে তাহারা তাহাদের (সম্প্রদায়ের) নিকট এইজন্য তুচ্ছ ও হেয় যে, উহারা তাহাদের ন্যায় সম্পদ ও বিত্তশালী নহে। আর এজন্যই তাহাদের (কাফিরদের) ধারণায় তাহারা (দরিদ্র মুমিনগণ) কল্যাণ বা সৌভাগ্য লাভ করিতে পারিবে না। কারণ তাহাদের ধারণামতে সৌভাগ্য ও কল্যাণ সম্পদের মধ্যে নিহিত; দরিদ্রতার মধ্যে নহে। প্রকৃতপক্ষে ইহাদের বিষয়টি আল্লাহর উপর ন্যস্ত, যিনি তাহাদের অন্তর সম্পর্কে জ্ঞাত। কারণ আল্লাহ প্রদত্ত সৌভাগ্য ও হিদায়াত বাহ্যিক ধন-সম্পদের উপর নির্ভরশীল নহে; বরং অন্তরের নির্মলতা, নিয়তের ইখলাস ও আল্লাহর সন্তুষ্টির উপর নির্ভরশীল।
নূহ (আ) বিভিন্নভাবে তাহাদিগকে বুঝাইলেন যে, তিনি পার্থিব কোন স্বার্থে (দাওয়াত ও তাবলীগের) কাজ করিতেছেন না। তিনি তাহাদের নিকট কোন সম্পদ বা কোন পদ ও পদবী চাহিতেছেন না। এই মহতী কাজের বিনিময় তো আল্লাহই তাহাকে প্রদান করিবেন (১১ : ২৯)। তিনি তাহাদিগকে বুঝাইলেন যে, তাহার কাছে না আল্লাহর ধন-ভাণ্ডার আছে, আর না তিনি অদৃশ্য সম্বন্ধে অবগত; আর না তিনি কোন ফেরেশতা (১১ : ৩১)। তিনি একজন মানুষ মাত্র, আল্লাহ তাআলা তাঁহাকে আল্লাহর বিধান ও নির্দেশের প্রতি তাহাদিগকে দাওয়াত ও তাবলীগের জন্যই মনোনীত করিয়াছেন।
কিন্তু কোন যুক্তিই তাহারা গ্রহণ করিল না, কোনভাবেই তাহারা দাওয়াত কবুল করিল না; বরং উক্ত দাওয়াতকে ঝগড়া ও বিতণ্ডারূপে আখ্যায়িত করিয়া বলিল, হে নূহ! তুমি আমাদের সহিত অতিরিক্ত বিতণ্ডা করিয়াছ। তাই নিতান্ত তাচ্ছিল্য ও অবিশ্বাসভরে তাহারা বলিল, তুমি যদি সত্যবাদী হও, তবে যাহার ভয় দেখাইতেছ তাহা আনয়ন কর (১১ : ৩২)। নূহ (আ) ইহার উত্তরে বলিলেন, “ইচ্ছা করিলে আল্লাহই তোমাদের নিকট উপস্থিত করিবেন এবং তোমরা উহা ব্যর্থ করিতে পারিবে না“ (১১ : ৩৩)। অবশেষে অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছিল যে, নূহ (আ) যখনই তাহাদিগকে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দিতেন তখনই তাহারা তাহার কোন কথাই যাহাতে কর্ণকুহরে না পৌঁছে সেইজন্য কানে আঙ্গুলি প্রবেশ করাইত। আর তাঁহাকে যাহাতে দেখিতে না হয় সেইজন্য নিজদিগকে কাপড়ে আবৃত করিয়া ফেলিত এবং জিদ ও ঔদ্ধত্য প্রকাশ করিতে লাগিল (৭১ : ৭)। এক পর্যায়ে তাহাকে পাগল বলিয়া ভীতি প্রদর্শন করিল (৫৪ : ৯) এবং এই কাজ হইতে বিরত না থাকিলে তাহাকে প্রস্তরাঘাতে হত্যা করিবার হুমকিও দিল (২৬ ও ১১৬)।
নূহ (আ)-এর নৈরাশ্য এবং আল্লাহ কর্তৃক সান্ত্বনা দান
এইভাবে সাড়ে নয় শত বৎসর তিনি অসীম ধৈর্যের সহিত তাহাদিগকে দাওয়াত দিলেন (২৯ ও ১৪)। কিন্তু তাহাদের স্বভাব-চরিত্রের কোনই পরিবর্তন হইল না। নূহ (আ)-এর যুক্তিপূর্ণ ও আন্তরিক দাওয়াত তাহাদের হূদয়ে একটুও দাগ কাটিল না। তাহারা নিজেরা তো গ্রহণ করিলই না, সন্তানদিগকেও তাহারা ওসিয়াত করিয়া যাইত যেন তাহারা নূহ (আ)-এর দাওয়াত গ্রহণ না করে (আল-বিদায়া, ১খ., ১০৯)। ইবন ইসহাক প্রমুখ নূহ (আ)-এর প্রতি তাঁহার সম্প্রদায়ের রূঢ় আচরণের কথা বিস্তারিতভাবে তুলিয়া ধরিয়াছেন। দাহহাক সূত্রে ইবন আব্বাস (রা) হইতে বর্ণিত যে, নূহ (আ)-এর সম্প্রদায় তাঁহাকে আটক করিয়া প্রহার করিত, গলায় ফাঁস দিত। ফলে তিনি বেহুশ হইয়া পড়িয়া যাইতেন। অতঃপর হুঁশ ফিরিয়া আসিলে বলিতেন, হে আল্লাহ! আমাকে ক্ষমা কর এবং আমার কওমকেও। কারণ তাহারা অজ্ঞ। অতঃপর তিনি গোসল করিতেন এবং কওমের নিকট গিয়া আবার তাহাদিগকে দাওয়াত দিতেন। এমনিভাবে তাহারা স্বীয় পাপে প্রতিনিয়ত ডুবিয়া রহিল। তাহাদের অপরাধ গুরুতর হইতে লাগিল। নূহ (আ) ও তাহাদের মধ্যকার এই আচরণ দীর্ঘায়িত হইতে লাগিল। এই মুসীবত তাঁহার জন্য কঠিন আকার ধারণ করিল। প্রজন্মের পর প্রজন্ম পর্যন্ত তিনি প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন; কিন্তু পরবর্তী প্রজন্ম পূর্বের তুলনায় আরও বেশী অপরাধী ও দুষ্কৃতকারী হইতে লাগিল, এমনকি পরবর্তী প্রজন্ম বলিতে লাগিল, এই লোকটি আমাদের বাপ-দাদাদের সময়ে এইরূপ পাগল ছিল। তাহারা ইহার কোন কথাই গ্রহণ করিত না।
তাঁহার কওম যে উত্তরোত্তর কেবল খারাপই হইতেছিল ইহার স্বপক্ষে ঐতিহাসিক ও মুফাসসিরগণ একটি ঘটনার অবতারণা করিয়াছেন। একবার এক লোক তাহার পুত্রকে কোলে লইয়া লাঠিতে ভর করিয়া নূহ (আ)–এর নিকট আগমন করিল এবং লোকটি তাহার পুত্রকে বলিল, বৎস! এই বৃদ্ধকে ভালমত দেখিয়া নাও। সে যেন তোমাকে কখনও ধোকা দিতে না পারে । ছেলেটি বলিল, পিতা! লাঠিখানি আমাকে দাও। লোকটি লাঠিখানি তাহার হাতে দিল। ছেলেটি আবার বলিল, আমাকে মাটিতে নামাইয়া দাও। লোকটি তাহাকে মাটিতে নামাইয়া দিল। সে হাঁটিয়া নূহ (আ)-এর কাছে গেল এবং লাঠি দিয়া তাঁহাকে প্রহার করিল। মনের দুঃখে নূহ (আ) তখন বলিলেন, হে আমার প্রতিপালক! তোমার বান্দারা আমার সহিত কীরূপ আচরণ করিতেছে তাহা তুমি দেখিতেছ। তাহাদিগকে যদি তুমি রাখিতে চাও তবে তাহাদিগকে হেদায়াত দান কর। আর যদি তাহা না হয় তবে তাহাদের ব্যাপারে তোমার ফয়সালা করা পর্যন্ত আমাকে ধৈর্য ধারণের তাওফীক দাও। তুমি তো উত্তম ফয়সালাকারী। তখন আল্লাহ তাআলা তাঁহাকে সান্ত্বনা দিয়া এবং কওমের শেষ অবস্থা জানাইয়া দিয়া তাঁহার নিকট ওহী পাঠাইলেন, যাহারা ঈমান আনিয়াছে তাহারা ব্যতীত তোমার সম্প্রদায়ের অন্য কেহ কখনো ঈমান আনিবে না। সুতরাং তাহারা যাহা করে তজ্জন্য তুমি দুঃখিত হইও না (১১ ও ৩৭; আছ-ছালাবী, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৫৬-৫৭; আত-তাবারী, জামিউল বায়ান ফী তাফসীরিল কুরআন, ১২ খ, ২২; ঐ লেখক, তারীখুল-উমাম ওয়াল মুল্ক, ১খ, ৯২; ইবনুল আছীর, আল-কামিল, ১খ, ৫৫; আল-আসী, রূহুল-মাআনী, ১২খ, ৪৮)। তিনি আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করিলেন, “হে আমার প্রতিপালক! আমাকে সাহায্য কর। কারণ উহারা আমাকে মিথ্যাবাদী বলিতেছে” (২৩ ও ২৬)।” আমি তো অসহায়, অতএব তুমি প্রতিবিধান কর” (৫৪ : ১০)।
কওমের বিরুদ্ধে নূহ (আ)-এর বদদোআ
নূহ (আ) তাহাদের ঈমান আনয়নের ব্যাপারে নিরাশ হইয়া গেলেন এবং আল্লাহর নিকট হইতে জানিতে পারিলেন যে, তাহাদের দাওয়াত কবুল না করা তাহার দাওয়াত পৌঁছানোর কোন ক্রটির কারণে নহে, বরং অমান্যকারীদের অহংকার ও অবাধ্যতার ফল এবং তাহারা কেহই আর কখনও ঈমান আনিবে না। তাহারা পৃথিবীতে থাকিলে কোন ফলোদয় হইবে না, বরং ধনেজনে বর্ধিত হইয়া পাপাচার আরও বৃদ্ধি করিবে। তাই তাহাদিগকে আর অবকাশ না দেওয়ার জন্য আল্লাহর নিকট দোআ করিলেন, হে আমার প্রতিপালক! পৃথিবীতে কাফিরগণের মধ্য হইতে কোন গৃহবাসীকে অব্যাহতি দিও না। তুমি উহাদিগকে অব্যাহতি দিলে উহারা তোমার বান্দাদিগকে বিভ্রান্ত করিবে এবং জন্ম দিতে থাকিবে কেবল দুষ্কৃতকারী ও কাফির (৭১ : ২৬-২৭)। কিন্তু সাথে সাথে স্বীয় পিতামাতা এবং তাহার অনুসারী মুমিনদের ক্ষমার জন্য দোআ করিলেন, হে আমার প্রতিপালক! তুমি ক্ষমা কর আমাকে, আমার পিতামাতাকে এবং যাহারা মুমিন হইয়া আমার গৃহে প্রবেশ করে তাহাদিগকে এবং মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদিগকে (৭১ : ২৮)। উল্লেখ্য যে, তাঁহার প্রতি ঈমান আনয়নকারীদের সংখ্যা ছিল অতি নগণ্য। কাহারও মতে নারী-পুরুষ মিলিয়া ৪০ জন, কাহারও মতে ৬০ জন, আবার কাহারও মতে ৮০ জন (আবদুল ওয়াহহাব আন-নাজ্জার, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৩৫; আল-আসী, রূহুল-মাআনী, ১২ খ, ৫৫)।
আল্লাহর নির্দেশে জাহাজ নির্মাণ
স্বীয় কাওম সম্পর্কিত নূহ (আ)-এর এই দোআ আল্লাহ তাআলা কবুল করিলেন (৩৭৪৭৫) এবং তাহাকে জানাইয়া দিলেন যে, তিনি কাফির মুশরিকদিগকে এক মহাপ্লাবনে নিমজ্জিত করিয়া ধ্বংস করিবেন। আর তাঁহাকে ও তাহার অনুসারী মুমিনদিগকে জাহাজে আরোহণ করাইয়া রক্ষা করিবেন। অতঃপর আল্লাহ তাআলা সরাসরি নিজের তত্ত্বাবধানে জাহাজ তৈরীর নির্দেশ দিলেন (১১ : ৩৭)।
ইমাম ছালাবী জাহাজ তৈরীর বিবরণ এইভাবে দিয়াছেনঃ তখনও পর্যন্ত যেহেতু নৌযান ব্যবহার শুরু হয় নাই, তাই নূহ (আ) কৌতূহলী হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, হে আমার প্রতিপালক! নৌযান কি? আল্লাহ তাআলা বলিলেন, একটি কাষ্ঠ নির্মিত গৃহ যাহা পানির উপর চলে । নূহ (আ) বলিলেন, হে প্রতিপালক! কাষ্ঠ কোথায় পাইব? আল্লাহ তাআলা বলিলেন, হে নূহ! আমি যাহা চাই তাহা করিতে সক্ষম। নূহ (আ) বলিলেন, হে আমার প্রতিপালক! বৃক্ষ কোথায় পাইব? আল্লাহ তাআলা বলিলেন, একটি বৃক্ষ তুমি রোপণ কর। অতঃপর তিনি একটি সেগুন, মতান্তরে দেবদারু (আল-বিদায়া, ১খ, ১১০) আর বাইবেলে বর্ণিত হইয়াছে গোফর বৃক্ষ (Genesis; 6:14) রোপণ করিলেন, অতঃপর চল্লিশ বৎসর মতান্তরে এক শত বৎসর (আল-বিদায়া, প্রাগুক্ত) কাটিয়া গেল। এই সময়কালে তিনি কওমের উপর বদদোআ করা হইতে বিরত রহিলেন। কোন কোন ঐতিহাসিক ও মুফাসসিরের বর্ণনামতে এই সময়কাল পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা তাহাদের মহিলাদিগকে বন্ধ্যা করিয়া রাখিলেন। ফলে তাহাদের আর কোন সন্তান পয়দা হইল না (ইবনুল আছীর, আল-কামিল, ১খ, ৫৬; আছ-ছালাবী, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৫৭)। প্রকৃতপক্ষে ইহা একটি ইসরাঈলী রিওয়ায়াত। কোনও বিশুদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য সূত্রে ইহার উল্লেখ নাই। ঐতিহাসিক ও মুফাসসিরগণ সম্ভবত এই ধারণার বশবর্তী হইয়া উহা বর্ণনা করিয়াছেন যে, জন্মের ধারা চালু থাকিলে অনেক নিষ্পাপ শিশুই পিতামাতার সহিত প্লাবনে মৃত্যুবরণ করিবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নিষ্পাপ শিশুকে শাস্তি হইতে রক্ষা করিবার জন্য এই জাতীয় বর্ণনার প্রয়োজন নাই। কারণ আল্লাহর নিয়ম হইল, কোনও অঞ্চলে আযাব আসিলে সেখানকার ছোট-বড়, ধনী-গরীব, যুবা-বৃদ্ধ, পাপী-নিষ্পাপ নির্বিশেষে সকলে উহাতে ধ্বংস হয়। অতঃপর পাপিষ্ঠদের দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জগতই বরবাদ হইয়া যায়। আর নিষ্পাপদের জন্য ইহা হয় সৌভাগ্যের ব্যাপার। কারণ তাহারা দুঃখ-কষ্টের জগত হইতে চিরস্থায়ী শান্তির জগতে উপনীত হয় । তাই নূহ (আ)-এর সম্প্রদায়ের যুবা-বৃদ্ধ-শিশু সকলেই প্লাবনে নিশ্চিহ্ন হইয়া যায় (হিফজুর রহমান সিউহারবী, কাসাসুল কুরআন, ১খ, ৮৪-৮৫)।
অতঃপর বৃক্ষটি যখন পূর্ণতা প্রাপ্ত হইল, সালমান (রা)-এর বর্ণনামতে ৪ বৎসর হইল (আত-তাবারী, তারীখ, ১খ, ৯১), তখন আল্লাহ তাআলা তাঁহাকে উহা কাটিবার নির্দেশ দিলেন। তিনি উহা কাটিয়া রৌদ্রে শুকাইলেন এবং বলিলেন, হে আমার প্রতিপালক! ইহা দ্বারা কিভাবে আমি উক্ত গৃহ নির্মাণ করিব? আল্লাহ তাআলা বলিলেন, উহাকে তিনটি অকৃতিতে বিন্যস্ত কর, উহার মাথা মোরগের ন্যায়, পেট পাখির পেটের ন্যায় এবং লেজ অনেকটা মোরগের লেজের মত বানাও। উহা বদ্ধ আকৃতির বানাও। দরজাগুলি বানাও উহার দুই পার্শ্বে। উহাকে ত্রিতলবিশিষ্ট বানাও। ৮০ হাত দৈর্ঘ্য, ৫০ হাত প্রস্থ এবং উচ্চতায় ৩০ হাত বানাও। ইহা আহলে কিতাবদের বর্ণনা বলিয়া ইমাম ছালাবী উল্লেখ করিয়াছেন (পৃ. ৫৭)। কিন্তু বাইবেলে ৩০০ হাত দৈর্ঘ্য, ৫০ হাত প্রস্থ এবং ৩০ হাত উচ্চতার কথা উল্লেখ রহিয়াছে (দ্র. Genesis, 6:15)। এই ব্যাপারে আরও বিস্তারিত বর্ণনা পরে আসিতেছে। অতঃপর আল্লাহ তাআলা নূহ (আ)-কে জাহাজ তৈয়ার করা শিক্ষাদান করিতে জিবরীল (আ)-কে প্রেরণ করিলেন। নূহ (আ) কাঠ কাটিয়া উহাতে পেরেক ঢুকাইয়া জাহাজের আকৃতি বানাইতে লাগিলেন (আছ-ছালাবী, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৫৭; ছানাউল্লাহ পানীপতি, আত-তাফসীরুল মাজহারী, ৫খ, ৮৪)। আর তাহার কওমের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ যখনই তাঁহার নিকট দিয়া গমন করিত তখনই ঠাট্টা-বিদ্রূপ করিত (১১৪ ৩৮)। তাহারা বলিত, নূহ! তুমি নবুওয়াতের দাবি করিয়া এখন কাঠমিস্ত্রি হইয়া গিয়াছ! তাহারা আরও বলিত, এই পাগলের কাণ্ড দেখ, কাষ্ঠ দিয়া ঘর বানাইতেছে যাহা নাকি পানির উপর দিয়া চলিবে! এই মরুভূমিতে পানি কোথা হইতে আসিবে! এই বলিয়া তাহারা পরস্পর হাসাহাসি করিত (আছ-ছালাবী, কাসাসুল আম্বিয়া, প্রাগুক্ত; আত-তাবারী, তারীখ, ১৩, ৬১)। নূহ (আ) ও তাহাদের পরিণতি সম্পর্কে উদাসীনতা এবং আল্লাহর নাফরমানীতে অটল থাকার ধৃষ্টতা দেখিয়া তাহাদের পন্থায় উত্তর দিতেন, তোমরা যদি আমাদিগকে উপহাস কর তবে আমরাও তোমাদিগকে উপহাস করিব, যেমন তোমরা উপহাস করিতেছ এবং তোমরা অচিরে জানিতে পারিবে কাহার উপর আসিবে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি (১১ : ৩৮-৩৯)। অতঃপর তিনি নিজ কাজে মনোনিবেশ করিতেন। আল্লাহ তাআলা পূর্বেই তাহাকে ইহাদের বিষয় জানাইয়া দিয়া বলিয়াছিলেন, “তুমি আমার তত্ত্বাবধানে ও আমার প্রত্যাদেশ অনুযায়ী নৌকা নির্মাণ কর। আর যাহারা সীমা লঙ্ঘন করিয়াছে তাহাদের সম্পর্কে আমাকে কিছু বলিও না; তাহারা তো নিমজ্জিত হইবে” (১১ ও ৩৭)। তাহাদের ব্যাপারে নূহ (আ)-এর দোআ কবুল হইয়াছিল এবং আল্লাহর সিদ্ধান্ত স্থির হইয়াছিল। অতঃপর আল্লাহ তাআলা নূহ (আ)-কে নৌকা নির্মাণ কর্ম তাড়াতাড়ি সমাপ্ত করিবার জন্য প্রত্যাদেশ পাঠাইলেন এবং বলিলেন, পাপিষ্ঠদের প্রতি আমার ক্রোধ বৃদ্ধি পাইতেছে। সুতরাং নৌকা নির্মাণ কর্ম তাড়াতাড়ি সম্পাদন কর। তখন নূহ (আ) দুইজন কাঠমিস্ত্রি ভাড়া করিলেন এবং তাঁহার পুত্র সাম, হাম ও আফিছও নৌকা বানাইতে লাগিয়া গেলেন। অতঃপর তিনি উহার নির্মাণ কর্ম সমাপ্ত করেন। কত বৎসরে উহা সমাপ্ত হয় সে ব্যাপারে অনেক মতভেদ রহিয়াছে। যায়দ ইবন আসলাম (রা)-এর বর্ণনামতে রোপণ ও কর্তনে ১০০ (এক শত) বৎসর অতিবাহিত হয় এবং নৌকা নির্মাণে আরও এক শত বৎসর ব্যয় হয়। অন্য এক বর্ণনামতে বৃক্ষ লাগানোর পর ৪০ বৎসর ব্যয় হয়। কাব আল-আহবারের এক বর্ণনাতে নূহ (আ) ৩০ বৎসরে নৌকা নির্মাণ করেন (ছানাউল্লাহ পানীপতি, তাফসীরুল-মাজহারী, ৫, ৮৫)। কিন্তু কাব হইতে অপর একটি বর্ণনা পাওয়া যায় ৪০ বৎসরের (আল-আলুসী, রূহুল-মাআনী, ১২খ, ৫০)। মুজাহিদের বর্ণনামতে ৩ বৎসরে নির্মাণকর্ম সমাপ্ত হয়। এতদ্ব্যতীত ৬০ ও ৪০০ বৎসরের বর্ণনাও পাওয়া যায় (প্রাগুক্ত)। আর ইবন আব্বাস (রা) হইতে একটি রিওয়ায়াত পাওয়া যায় যে, দুই বৎসরে তিনি নির্মাণ কর্ম সমাপ্ত করেন (আত-তাফসীরুল মাজহারী, ৫খ, ৮৪)। এই মতটিই অধিকতর যুক্তিযুক্ত বলিয়া মনে হয়। উক্ত নৌকার পার্শ্বে আল্লাহ তাআলা আলকাতরার একটি প্রস্রবণ প্রবাহিত করিয়া ছিলেন যাহা টগবগ করিতেছিল। অতঃপর নৌকার ভিতর ও বাহিরের দিকে উক্ত আলকাতরা দ্বারা প্রলেপ দেওয়া হইল এবং লৌহ কীলক দ্বারা মজবুত করা হইল (আছ-ছালাবী, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ. ৫৮)। ইহাই কুরআন করীমে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করিয়াছেন, “আর আমি তাহাকে আরোহণ করাইলাম কাষ্ঠ ও কীলক নির্মিত এক নৌযানে” (৫৪ : ১৩)।
নৌযানের আকৃতি
পূর্বেই বর্ণিত হইয়াছে যে, উক্ত নৌকার অগ্র ও পশ্চাৎ ভাগ ছিল মোরগের মাথা ও লেজের আকৃতিসম্পন্ন এবং মধ্যভাগ ছিল পাখির পেটের ন্যায়। ইমাম ছাওরীর বর্ণনামতে উহার বুক ছিল সরু, যাহাতে পানি ভেদ করিয়া চলিতে পারে (ইব্ন কাছীর, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ. ৭৩)। উক্ত নৌকার দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা কতটুকু ছিল সে সম্পর্কে মতভেদ রহিয়াছে : বাইবেলের বর্ণনা অনুযায়ী উহার দৈর্ঘ্য ছিল ৩০০ হাত, প্রস্থ ৫০ হাত এবং উচ্চতা ৩০ হাত (Genesis, 6:15)। অধিকাংশ মুফাসসির ও মুহাদ্দিছ এই মতটিই গ্রহণ করিয়াছেন। ইবন্ মারদূয়া সামুরা ইবন জুনদূব (রা) সূত্রে এবং আবদ ইবন হুমায়দ, ইবনুল-মুনযির ও আবুশ-শায়খ কাতাদা হইতে অনুরূপ বর্ণনা করিয়াছেন। ইমাম বাগাবী ইবন আব্বাস (রা) সূত্র হইতেও অনুরূপ একটি বর্ণনা পাওয়া যায়। কাযী ছানাউল্লাহ পানিপতি তাঁহার আত-তাফসীরুল মাজহারী গ্রন্থে ইহাকেই প্রসিদ্ধ মত বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন (দ্র. ছানাউল্লাহ পানিপতী, আত-তাফসীরুল মাজহারী, ৫, ৮৪-৮৫)। দাহহাক সূত্রে বর্ণিত ইবন আব্বাস (রা)-এর অপর এক মতে দৈর্ঘ্য ৬০০ হাত, প্রস্থ ৩৩০ হাত এবং উচ্চতা ৩৩ হাত (ছালাবী, কাসাস, পৃ. ৫৮)। ইবন আব্বাস (রা)-এর আরও একটি রিওয়ায়াত রহিয়াছে, সেই মতে দৈর্ঘ্য ১২০০ হাত, প্রস্থ ৬০০ হাত (ইবন কাছীর, কাসাস, পৃ. ৭৩)। ইমাম বাগাবী ও ইবন জারীর তাবারী প্রমুখ হাসান বসরী (র) হইতে অনুরূপ মত বৰ্ণনা করিয়াছেন (আল-আসী, রূহুল মাআনী, ১২খ, ৫০; পানিপতী, আত-তাফসীরুল-মাজহারী, ৫খ, ৮৫; ইবনুল-আছীর, আল-কামিল, ১খ, ৫৬)। শামীর বর্ণনামতে নৌকার দৈর্ঘ্য ৮০ হাত, প্রস্থ ৫০ হাত এবং উচ্চতা ছিল ৩০ হাত (প্রাগুক্ত)। ইবন আব্বাস (রা)-এর একটিমাত্র রিওয়ায়াত ছাড়া আর সকলেই এই ব্যাপারে একমত যে, উক্ত নৌকার উচ্চতা ছিল ৩০ হাত। ইহার তিনটি তলা ছিল। প্রত্যেক তলার উচ্চতা ছিল ১০ হাত। ইহার দরজা ছিল প্রস্থের দিকে যাহার উপর পর্দা ছিল (ইবন কাছীর, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৭৩; ঐ লেখক, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১ খ., ১১০)। ছাদের এক হাত নিচে ছিল বাতায়ন (বাইবেল, আদিপুস্তক ৬ : ১৬; বাংলা অনু, বংলাদেশ বাইবেল সোসাইটি, ঢাকা, পৃ. ৮)। এখানে উল্লেখ্য যে, হাত বলিতে ইবন সাদের মতে নূহ (আ)-এর পিতার দাদার হাত বুঝানো হইয়াছে (দ্র. তাবাকাত, ১খ, ৪১)। ছানাউল্লাহ পানিপতী বলেন, হাতের সীমানা হইল কাঁধের সীমানা জোড়া পর্যন্ত (তাফসীরুল মাজহারী, ৫খ, ৮৫)। হাফিজ ইবন কাছীর উল্লেখ করিয়াছেন যে, এমন বিশাল এক নৌকা তৈরী হইল, যাহার দৃষ্টান্ত পূর্বেও কখনও ছিল না, পরবর্তীতেও হইবে না (কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৭১; আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ, ১০৯)।
নৌকায় আরোহণ
নৌযান তৈরীর কাজ সমাপ্ত হইলে আল্লাহ তাআলা ওহী পাঠাইলেন যে, উহাতে উঠাইয়া লও প্রত্যেক শ্রেণীর যুগলের দুইটি, যাহাদের বিরুদ্ধে পূর্ব সিদ্ধান্ত হইয়াছে তাহারা ব্যতীত তোমার পরিবার-পরিজনকে এবং যাহারা ঈমান আনিয়াছে তাহাদিগকে (১১ ও ৪০)। প্রাণীকুলের প্রত্যেক জাতের একজোড়া করিয়া তোলার নির্দেশ এজন্য দিয়াছিলেন যাহাতে উহাদের বংশ বিলুপ্ত হইয়া না যায়। বাইবেলে বলা হইয়াছে যে, শুচি পশুর সাত জোড়া এবং অশুচি পশুর এক জোড়া নৌকায় উঠাও (Genesis, 7: 2-3); ইহা যুক্তিসঙ্গত বলিয়া মনে হয় না। কারণ বংশ সংরক্ষণের জন্য এক জোড়াই যথেষ্ট। অতঃপর স্থলভাগ ও জলভাগ এবং পর্বত ও সমভূমির সকল জীব-জন্তুকে আল্লাহ তাআলা তাঁহার নিকট একত্র করিয়া দিলেন। এক বর্ণনামতে ৪০ দিবা-রাত্র অবিরল ধারায় বৃষ্টি হয়। ফলে হিংস্র প্রাণী, জীবজন্তু ও পক্ষীকুল নূহ (আ)-এর নিকট আসিয়া জড়ো হয়। অতঃপর তিনি উহাদের জোড়ায় জোড়ায় নৌকায় তোলেন এবং আদম (আ)-এর লাশও তোলেন। অতঃপর নারী-পুরুষের মধ্যখানে পর্দা হিসাবে উহা রাখিয়া দেন (ইবন সাদ, তাবাকাত, ১খ, ৪১)। ইবন জারীর আত-তাবারী ও ইবনুল আছীর প্রমুখ ইবন আব্বাস (রা) হইতেও অনুরূপ একটি রিওয়ায়াত উদ্ধৃত করিয়াছেন (আত-তাবারী, তারীখ, ১৩, ৯৪; ইনুল আছীর, আল-কামিল, ১খ, ৫৭-৫৮)। কোন তলায় কোন জীব আরোহণ করে সেই ব্যাপারেও মতভেদ রহিয়াছে। এক বর্ণনামতে নীচ তলায় জীবজন্তু, দ্বিতীয় তলায় মানুষ ও রসদপত্র এবং তৃতীয় তলায় পক্ষীকুলকে আরোহণ করান হয় (ইবন কাছীর, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৭৩; আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১৩, ১১০; পানিপতী, আত-তাফসীরুল মাজহারী, ৫খ, ৮৫)। অপর এক বর্ণনামতে জীবজন্তু দ্বিতীয় তলায় এবং মানুষ উপরের তলায় আরোহণ করে । তাহাদের সহিত স্নেহভরে তোতা পাখীকেও লওয়া হয় যাহাতে অন্য কোন প্রাণী তাহাকে হত্যা না করে (আছ-ছালাবী, কাসাস, পৃ. ৫৯)। অন্য এক বর্ণনামতে নূহ (আ) পক্ষীকুলকে নীচের তলায় এবং হিংস্র প্রাণী ও অন্যান্য জীবজন্তুকে মধ্যের তলায় আরোহণ করান। আর নিজে ও তাহার সঙ্গীরা উপরের তলায় আরোহণ করেন (ইবনুল আছীর, আল-কামিল, ১খ., ৫৭)। কাযী ছানাউল্লাহ পানিপতী স্বীয় তাফসীর গ্রন্থে শারহু খুলাসাতিল মাসীর গ্রন্থের বরাতে উল্লেখ করিয়াছেন যে, নীচ তলায় আরোহণ করে পক্ষীকুল, হিংস্র প্রাণী ও অন্যান্য সকল জীবজন্তু, মধ্যের তলায় ছিল খাদ্য, পানীয় ও কাপড়-চোপড়। আর উপরের তলায় আরোহণ করে মানবমণ্ডলী (আত-তাফসীরুল-মাজহারী, ৫, ৮৫)। তবে সর্বপ্রথম বর্ণিত মতটি যুক্তিযুক্ত ও সঠিক বলিয়া মনে হয়। কারণ চতুষ্পদ জন্তুর জন্য নিচের তলায় আরোহণ সুবিধাজনক, আর পক্ষীকুলের জন্য উপরের তলাই সুবিধাজনক আর মানুষ তো যে কোন তলাতেই আরোহণ করিতে পারে।
ইবন আব্বাস (রা)-এর একটি রিওয়ায়াত অনুসারে সর্বপ্রথম নৌযানে আরোহণ করে পক্ষীকুলের মধ্যে তোতা পাখি এবং সর্বশেষ আরোহণ করে প্রাণীকুলের মধ্যে গাধা। ইবলীস উহার লেজ ধরিয়া আরোহণ করে। গাধা যখন নৌকায় প্রবেশ করিতেছিল তখন ইবলীস উহার লেজ ধরিলে গাধা তাহার পা তুলিতে পারিতেছিল না। তখন নূহ (আ) ধমক দিয়া বলিলেন, ধিক তোমার! প্রবেশ কর যদিও শয়তান তোমার সঙ্গে থাকে। নূহ (আ)-এর মুখ দিয়া অকস্মাৎ ইহা বাহির হইয়া পড়িয়াছিল। শয়তান এই সুযোগে গাধার সহিত নৌকায় প্রবেশ করিল। নূহ (আ) তাহাকে নৌকায় দেখিয়া বলিলেন, তুই কেন আসিলি, হে আল্লাহর দুশমন! শয়তান বলিল, কেন! আপনি বলেন নাই, প্রবেশ কর, যদিও শয়তান তোমার সঙ্গে থাকে? অনেকের ধারণামতে শয়তান নৌকার উপরিভাগে ছিল (আছ-ছালাবী, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ. ৫৯; আত-তাবারী, তারীখ, ১খ, ৯৩; ঐ লেখক, তাফসীর, ১২৩, ২৩; ইবনুল আছীর, আল-কামিল, ১খ, ৫৬-৫৭; পানিপতী, আত-তাফসীরুল-মাজহারী, ৫, ৮৭)।
মালিক ইব্ন সুলায়মান আন-নাহবারী বলেন, নৌকায় যখন সকল জীবজন্তু আরোহণ করিতেছিল তখন সৰ্প ও বিহ্ নূহ (আ)-এর নিকট আসিয়া বলিল, আমাদিগকেও আরোহণ করান। তিনি বলিলেন, তোমরা তো ক্ষতি, কষ্ট ও বিপদের কারণ । তাই আমি তোমাদিগকে আরোহণ করাইব না। তাহারা বলিল, আমাদিগকে আরোহণ করিতে দিন, আমরা আপনাকে এই প্রতিশ্রুতি দিতেছি যে, যাহারা আপনার স্মরণ করিবে তাহাদের কাহাকেও আমরা কোনরূপ ক্ষতি করিব না। এইজন্যই যে উহাদের ক্ষতির ভয় পায় সে যদি এই আয়াত তেলাওয়াত করে (৩৭ :৭৯)
তবে উহারা তাহার কোন ক্ষতি করে না (আছ-ছালাবী, প্রাগুক্ত; পানিপতী, আত-তাফসীরুল মাজহারী, ৫, ৮৭-৮৮)।
ওয়াহব ইবন মুনাব্বিহ (র) বলেন, আল্লাহ যখন নূহ (আ)-কে প্রত্যেক প্রাণীর একজোড়া করিয়া নৌকায় আরোহণ করার নির্দেশ দিলেন তখন নূহ (আ) বলিলেন, সিংহ ও গাভী কিভাবে একত্র করিব? আল্লাহ তাআলা তাহাকে বলিলেন, কে তাহাদের মধ্যে শত্রুতা পয়দা করিয়া দিয়াছে? নূহ (আ) বলিলেন, ওগো আমার প্রতিপালক! তুমিই । আল্লাহ বলিলেন, আমি তাহাদের মধ্যে ভালবাসা ও সমঝোতা পয়দা করিয়া দিব, ফলে একে অন্যের ক্ষতি করিবে না। অতঃপর আল্লাহ তাআলা সিংহকে জ্বরগ্রস্ত করিয়া দিলেন। তখন সে নিজকে লইয়াই ব্যস্ত রহিল (প্রাগুক্ত, আল-আসী, রূহুল-মাআনী, ১২খ, ৫৪)।
ইবন আবী হাতিম সূত্রে যায়দ ইবন আসলাম (রা) তাঁহার পিতা হইতে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (স) বলেন, নূহ (আ) যখন নৌকায় প্রত্যেক প্রাণীর একজোড়া করিয়া তুলিলেন, তখন তাহার সঙ্গীগণ রলিল, আমরা কিভাবে নিশ্চিত ও প্রশান্তিতে থাকিব অথচ আমাদের সহিত সিংহ রহিয়াছে! অতঃপর আল্লাহ তাআলা সিংহকে জ্বরে আক্রান্ত করিয়া দিলেন। পৃথিবীর বুকে ইহাই ছিল প্রথম জ্বর। অতঃপর তাহারা ইঁদুর সম্পর্কে অভিযোগ করিয়া বলিল যে, উহা তো আমাদের খাদ্য দ্রব্য ও মালপত্র বিনষ্ট করিয়া ফেলিবে। তখন আল্লাহ তাআলা সিংহের প্রতি প্রত্যাদেশ করিলে উহা হাঁচি দিল । ইহা হইতে বিড়াল বাহির হইল। বিড়ালের ভয়ে ইঁদুর আত্মগোপন করিয়া রহিল। এই বর্ণনার সনদটি মুরসাল (ইবন কাছীর, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৭৪; ঐ লেখক, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ১খ, ১১১; ইবনুল আছীর, আল-কামিল, ১খ, ৫৭; আল-আলুসী, রূহুল-মাআনী, ১২খ, ৫৩)।
হযরত নূহ (আ)-এর সহিত কতজন মুমিন নৌকায় আরোহণ করিয়াছিল সেই ব্যাপারে বিভিন্ন ধরনের বর্ণনা পাওয়া যায়। (১) ইবন আব্বাস (রা)-এর বর্ণনামতে তাহারা ছিল স্ত্রী-পুরুষ মিলিয়া ৮০ জন, যাহাদের একজনের নাম ছিল জ্বরহুম এবং তাহাদের সঙ্গে তাহাদের মহিলারাও ছিল। তাহার অপর এক বর্ণনায় সর্বমোট ৮০ জনের কথা বলা হইয়াছে যাহার ব্যাখ্যা হইল : শাম, হাম, আফিছ ও তাহাদের স্ত্রীগণ, নূহ (আ)-এর পত্নী এবং শীছ (আ) বংশের অন্য ৭৩ জন। (২) মুকাতিল-এর বর্ণনামতে ৭২ জন পুরুষ ও নারী। নূহ (আ)-এর তিন পুত্র ও তাহাদের স্ত্রীগণ এই মোট ৭৮ জন, যাহাদের অর্ধেক পুরুষ ও অর্ধেক ছিল নারী । (৩) কাব আল-আহবার-এর বর্ণনামতে ৭২ জন। (৪) ইবন ইসহাকের বর্ণনামতে মহিলা ছাড়া ছিল দশজন ও নূহ (আ), তাঁহার তিন পুত্র সাম, হাম, আফিছ এবং তাহার উপর ঈমান আনয়নকারী ছয়জন এবং ইহাদের স্ত্রীগণ অর্থাৎ দশজন পুরুষ ও দশজন মহিলা মোট ২০ জন। (৫) কাতাদা, ইবন জুরায়জ ও মুহাম্মাদ ইবন কাব আল-কুরাজীর বর্ণনামতে নৌকায় নূহ (আ), তাঁহার স্ত্রী, তাঁহার তিন পুত্র সাম, হাম, আফিছ এবং তাহাদের তিন পত্নী এই মোট ৮ জন ছাড়া আর কেহ ছিল না। (৬) আমাশ-এর বর্ণনামতে ৭ জন। নূহ (আ), তাঁহার তিন পুত্র ও তাহাদের তিন পত্নী। তিনি তাহাদের মধ্যে নূহ (আ)-এর স্ত্রীর কথা উল্লেখ করেন নাই (আত-তাবারী, তারীখ, ১৩, ৯৫; ইবন কাছীর, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ. ৭৫; ঐ লেখক, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ, ১১১; আছ-ছালাবী, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৫৯; ইবনুল আছীর, আল-কামিল, ১২, ৫৬; ছানাউল্লাহ পানিপতী, আত-তাফসীরুল-মাজহারী, ৫, ৮৭)। তবে শেষোক্ত মত দুইটি সঠিক নহে এবং তাহা গ্রহণযোগ্যও হইতে পারে না। কারণ ইহা স্পষ্টতই কুরআন করীমের পরিপন্থী। আয়াতে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রহিয়াছে যে, তাহার পরিবার-পরিজন ছাড়াও তাহার উপর ঈমান আনয়নকারীদের একটি দলও ছিল। ইরশাদ হইয়াছে :
“আমি বলিলাম, ইহাতে উঠাইয়া লও প্রত্যেক শ্রেণীর যুগলের দুইটি, যাহাদের বিরুদ্ধে পূর্ব সিদ্ধান্ত হইয়াছে তাহারা ব্যতীত তোমার পরিবার-পরিজনকে এবং যাহারা ঈমান আনিয়াছে তাহাদিগকে” (১১ : ৪০)।
অপর বণর্ণাগুলির মধ্যে ৮০ জনের বর্ণনাটিই সঠিক বলিয়া মনে হয়। কারণ নৌযান হইতে অবতরণ করিয়া তিনি যে লোকালয়ের পত্তন করেন উহার নাম রাখেন ছামানীন যাহা লূক হামানীন (৮০ জনের বাজার) নামে খ্যাত। ইহাতে বুঝা যায়, নূহ (আ)-এর সাথী-সঙ্গিগণ সংখ্যায় ৮০ জন ছিল। ইহাই অধিকাংশ আলিমের মত।
প্লবনের সূচনা ও তাননূর (উনান) উথলিয়া উঠার মর্ম
প্লাবনের সূচনার কথা আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীমে এইভাবে বর্ণনা করিয়াছেন :
“অবশেষে যখন আমার আদেশ আসিল এবং উনান উথলিয়া উঠিল আমি বলিলাম, ইহাতে উঠাইয়া লও প্রত্যেক শ্রেণীর যুগলের দুইটি, যাহাদের বিরুদ্ধে পূর্ব সিদ্ধান্ত হইয়াছে তাহারা ব্যতীত তোমার পরিবার-পরিজনকে এবং যাহারা ঈমান আনিয়াছে তাহাদিগকে” (১১ : ৪০)।
এখানে উনান উথলিয়া উঠার মর্ম কি সে ব্যাপারে আলিমগণের মধ্যে মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। (১) হযরত আলী ইবন আবী তালিব (রা) বলেন, ইহার অর্থ হইল ভোর হওয়া এবং চতুর্দিক, আলোকিত হইয়া যাওয়া। অর্থাৎ ভোরের আলো ছড়াইয়া পড়িলে সকলকে লইয়া নৌকায় আরোহন করিতে আল্লাহ তাআলা নির্দেশ দিলেন। তবে এই মতটি বিরল। অন্য কেহ এই ব্যাখ্যা গ্রহণ করেন নাই। (২) ইবন আব্বাস (রা) বলেন, ইহার অর্থ হইল যমীনের উপরিভাগ তথা যমীনের উপর দিয়া পানি প্রবাহিত হওয়া। আরবগণ যমীনের উপরিভাগকে তাননূর বলিয়া অভিহিত করিয়া থাকে। সুতরাং আয়াতের অর্থ হইল, যমীনের সকল স্থান হইতে পানি উথলিয়া উঠিল, এমনকি অগ্নি প্রজ্জলিত হইবার স্থান উনান হইতেও। ইহাই অধিকাংশ আলিমের অভিমত (ইবন কাছীর, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৭৪; আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ, ১১১; পানিপতী, আত-তাফসীরুল মাজহারী, ৫খ, ৮৫-৮৬)। (৩) কাতাদা (র) বলেন, তাননূর হইল যমীনের সবচেয়ে উন্নত ও মর্যাদাসম্পন্ন স্থান; (৪) হাসান, মুজাহিদ ও শাবী (র) বলেন, তাননূর অর্থ হইল যেখানে রুটি তৈরী করা হয় । ইহাই অধিকাংশ মুফাঁসিরের মত। আর উহা ছিল একটি পাথরের উনান পূর্বে যাহা হাওয়া (আ)-এর ছিল (আল-কামিল, ১খ, ৫৬), পরে হাত বদল হইতে হইতে নূহ (আ)-এর নিকট আসিয়া পৌঁছে (আত-তাবারী, তারীখ, ১৯, ৯৪; পানিপতী, আত-তাফসীরুল মাজহারী, ৫, ৮৬)। তাই ইহার অর্থ হইল, নূহ (আ)-কে বলা হইল যখন দেখিবে উক্ত উনান হইতে পানি উথলিয়া উঠিতেছে তখন তুমি ও তোমার সাথী-সঙ্গীবৃন্দ নৌকায় আরোহণ করিবে। অতঃপর তাঁহার স্ত্রী একদিন উনানে কাজ করিতেছিলেন। হঠাৎ উনান হইতে পানি উথলিয়া উঠিতে দেখিয়া তিনি নূহ (আ)-কে এই সংবাদ দিলেন (আছ-ছালাবী, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ. ৫৮)।
এই উনানটি কোথায় অবস্থিত ছিল সেই ব্যাপারে মতভেদ রহিয়াছে : (১) মুজাহিদ (র) বলেন, উহা ছিল কূফার প্রান্ত সীমায়। এই ব্যাপারে সুদ্দী (র) শাবী (র) হইতে বর্ণনা করেন যে, তিনি আল্লাহর কসম করিয়া বলিতেন যে, উনান কূফার প্রান্তেই উথলিয়া উঠিয়াছিল। তিনি আরও বলেন, নূহ (আ) কূফার মসজিদের অভ্যন্তরেই নৌকা তৈরী করেন। আর উনান ছিল মসজিদের প্রবেশ পথের ডাইন দিকে যাহা কিনদা গোত্রের দরজার সহিত মিলিত ছিল। উনান উথলিয়া উঠা ছিল নূহ (আ)-এর জন্য তাঁহার কওম ধ্বংস হওয়ার একটি আলামত ও দলীল। (২) আলী ইবন আবী তালিব (রা) বলেন, কুফার মসজিদের কিনদা গোত্রের দরজার দিক হইতেই উনান উথলিয়া উঠিয়াছিল। (৩) মুকাতিল (র) বলেন, ইহা ছিল আদম (আ)-এর উনান। ইহা শাম (বর্তমান সিরিয়া)-এর আয়ন বির নামক স্থানে অবস্থিত ছিল। (৪) ইবন আব্বাস (রা) বলেন, উনানটি ছিল ভারতবর্ষে। ইব্ন জারীর, ইবনুল মুনযির, ইবন আবী হাতিম, আবুশ-শায়খ ও আল-হাকিম ইহা বর্ণনা করত ইহাকে সহীহ বলিয়া মত প্রকাশ করিয়াছেন। কাতাদার বর্ণনামতে ইহা জাযীরাতুল আরবে ছিল (আছ-ছালাবী, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ. ৫৮; আত-তাবারী, তারীখ, ১খ, ৯৪-৯৫; পানিপতী, আত-তাফসীরুল-মাজহারী, ৫খ, ৮৬; ইবন কাছীর, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ. ৭৪; ঐ লেখক, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১২, ১১১; ইবনুল-আছীর, আল-কামিল, ১খ, ৫৬)।
প্লাবনের মুহূর্তে নূহ (আ)-এর দুআ
অতঃপর সকলকে লইয়া নূহ (আ) যখন নৌযানে আরোহণ করিলেন তখন আল্লাহর নির্দেশে এই দুআ পাঠ করিলেন ।
“আল্লাহর নামে ইহার গতি ও স্থিতি। আমার প্রতিপালক অবশ্যই ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু (১১ ও ৪১)।
আল্লাহর নির্দেশে তিনি আরও বলিলেন :
“সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই, যিনি আমাদিগকে উদ্ধার করিয়াছেন জালিম সম্প্রদায় হইতে” (২৩ ও ২৮)। তিনি আল্লাহর নির্দেশে তাঁহার নিকট দুআ করিলেন :
“হে আমার প্রতিপালক! আমাকে এমনভাবে অবতরণ করাও যাহা হইবে কল্যাণকর; আর তুমিই শ্রেষ্ঠ অবতরণকারী” (২৩ ও ২৯)।
মহাপ্লাবন
অতঃপর সকলের নৌযানে আরোহণ সমাপ্ত হইলে আল্লাহর নির্দেশে প্লাবন শুরু হইল। ইবন জারীর প্রমুখের বর্ণনামতে, গ্রীক হিসাব অনুযায়ী ‘আব মাসের ১৩ তারিখে উক্ত প্লাবন শুরু হয়। আরবী রজব মাসের দশ তারিখে (আছ-ছালাবী, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ. ৬০; ইবন কাছীর, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৭৬; আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ, পৃ. ১১২)। তখন পৃথিবীর সকল প্রস্রবণ, কূপ ও জলাশয় এবং বড় বড় নদী-নালা ফুসিয়া উঠিল। আকাশ হইতে ৪০ দিন ৪০ রাত্র অবিরল ধারায় বৃষ্টিপাত হইতে থাকিল। অতঃপর প্রবল বেগে পানি বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। ইহাই আল্লাহ তাআলা কুরআন করীমে ইরশাদ করিয়াছেনঃ “আমি উন্মুক্ত করিয়া দিলাম আকাশের দ্বার প্রবল বারি বর্ষণে এবং মৃত্তিকা হইতে উৎসারিত করিলাম প্রস্রবণ; অতঃপর সকল পানি মিলিত হইল এক পরিকল্পনা অনুসারে” (৫৪ : ১১-১২)। এইভাবে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নৌকা ভাসিল (আছ-ছালাবী, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ. ৬০; ইবনুল-আছীর, আল-কামিল, ১খ., ৫৬-৫৭; আত-তাবারী, তারীখ, ১খ, ৯৪)। এইভাবে পানি কেবল বৃদ্ধিই পাইতে লাগিল, এমনকি সকল পাহাড়-পর্বত ডুবিয়া গেল। ইবন আব্বাস (রা)-এর বর্ণনামতে, এই প্লাবনে পৃথিবীর পানি সর্বোচ্চ পাহাড় হইতে ১৫ হাত উপরে উঠিয়া যায়। বাইবেলে এই কথাই বলা হইয়াছে। মতান্তরে পাহাড় হইতে ৮০ হাত উপরে পানি উঠিয়া যায় (Genesis, 6:20)। পর্বত-প্রমাণ তরঙ্গ প্রবাহিত হইতে লাগিল। উহার মধ্য দিয়া নূহ (আ)-এর নৌযান উক্ত পানিতে ভাসিতে লাগিল (১১ : ৪২)। নৌযানখানি পানির উপর ৬ হাত ভাসিয়া ছিল (ইব্ন সাদ, ১খ, ৪১), অবশিষ্ট ২৪ হাত পানির নীচে নিমজ্জিত ছিল। এইভাবে ভাসমান অবস্থায় নৌকা চলিতে লাগিল। কোথায়ও উহা স্থির থাকিল না। ৬ মাস এইভাবে নৌকা ভাসিতে থাকিল। অতঃপর উহা হারামের নিকট আসিল, কিন্তু উহাতে প্রবেশ করিল না, বরং এক সপ্তাহ যাবৎ উহার চতুর্পার্শ্বে ঘুরিতে লাগিল। ইহা ছিল সেই ঘর যাহার কেন্দ্র রক্ষা করিবার জন্য আল্লাহ তাআলা উহাকে ৪র্থ আসমানে উঠাইয়া লইয়াছিলেন। ইহা ছিল জান্নাতের ইয়াকৃত দ্বারা তৈরী। জিবরীল (আ) হাজরে আসওয়াদকে আবু কুবায়স পর্বতে উঠাইয়া রাখিয়াছিলেন। ইবরাহীম (আ)-এর বায়তুল্লাহ নির্মাণ পর্যন্ত উহা সেখানেই ছিল। অতঃপর তিনি উহা স্বস্থানে স্থাপন করেন (আছ-ছালাবী, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ. ৬০; ইবন সাদ, তাবাকাত, ১খ, ৪১; ইবনুল-আছীর, আল-কামিল, ১খ, ৫৬)। এইভাবে ভাসিতে ভাসিতে উহা জুদী পর্বতে গিয়া স্থির হইল (জুদী পর্বতের অবস্থান সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ পরে আসিতেছে)। অবশেষে আল্লাহর সিদ্ধান্ত কার্যকর হইবার পর পৃথিবীকে পানি গ্রাস করিয়া লইতে এবং আকাশকে বারি বর্ষণ হইতে ক্ষান্ত হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। প্লাবন শুরু হইতে পানি গ্রাস করা পর্যন্ত সময় ছিল ছয় মাস (ইবনুল-আছীর, আল-কামিল, ১খ, ৫৭)। ইবন আব্বাস (রা) বলেন, নূহ (আ)-এর নৌকা জুদী পর্বতে স্থির হয়, আর পৃথিবীতে যাহা কিছু ছিল, কাফির-মুশরিক, প্রাণীকুল ও গাছপালা সবই ধ্বংস হইয়া যায় । তাই নূহ (আ) ও তাঁহার সঙ্গে নৌকায় যাহারা ছিল তাহারা ব্যতীত পৃথিবীতে আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না (আছ-ছালাবী, কাসাস, পৃ. ৬০)। ইহাই কুরআন করীমে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করিয়াছেন :
“ইহার পর বলা হইল, হে পৃথিবী! তুমি তোমার পানি গ্রাস করিয়া লও এবং হে আকাশ! ক্ষান্ত হও। ইহার পর বন্যা প্রশমিত হইল এবং কার্য সমাপ্ত হইল। নৌকা জুদী পর্বতের উপর স্থির হইল এবং বলা হইল, জালিম সম্প্রদায় ধ্বংস হউক” (১১ : ৪৪)।
উল্লেখ্য যে, কাতাদা প্রমুখের বর্ণনামতে নৌকা জুদী পর্বতে স্থির ছিল এক মাস (ইবন কাছীর, কাসাস, পৃ. ৮৩; আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ, ১১৬)।
ইবন জারীর তাবারী, ছালাবী ও ইবন কাছীর প্রমুখ নৌযান ও প্লাবন সম্পর্কে নূহ (আ)-এর তনয় হাম-এর যবানীতে একটি রিওয়ায়াত উদ্ধৃত করিয়াছেন। তাহা হইল, আলী ইবন যায়দ ইব্ন জুদআন সূত্রে ইব্ন আব্বাস (রা) হইতে বর্ণিত যে, হাওয়ারীগণ একবার ঈসা ইব্ন মারয়াম (আ)-কে বলিল, আপনি যদি এমন এক ব্যক্তিকে আমাদের সম্মুখে জীবিত করিতেন যিনি নূহ (আ)-এর নৌকা স্বচক্ষে দেখিয়াছিলেন, অতঃপর সেই সম্পর্কে আমাদিগকে অবহিত করিতেন। ঈসা (আ) তাহাদিগকে লইয়া চলিতে চলিতে একটি মাটির স্তূপের নিকট আসিলেন। অতঃপর উহা হইতে একমুষ্টি মাটি লইয়া বলিলেন, au। ১L 3 (আল্লাহর হুকুমে দাঁড়াইয়া যাও)। ইহা বলিতেই তিনি মস্তক হইতে মাটি ঝাড়িতে ঝাড়িতে দাঁড়াইয়া গেলেন। তিনি তখন বৃদ্ধ হইয়া গিয়াছিলেন। ঈসা (আ) তাহাকে বলিলেন, তুমি কি এই অবস্থায়ই ইনতিকাল করিয়াছিলে? তিনি বলিলেন, না, আমি যুবা অবস্থায়ই মারা যাই। কিন্তু আমি মনে করিলাম বুঝি কিয়ামত হইয়া গিয়াছে। সেই আতঙ্কেই আমি বৃদ্ধ হইয়া গিয়াছি। ঈসা (আ) তাহাকে বলিলেন, “নূহ (আ)-এর নৌকার বিবরণ দাও।” তিনি বলিলেন, “উহার দৈর্ঘ্য ছিল ১২০০ হাত এবং প্রস্থ ছিল ৬০০ হাত। উহা ছিল তিন তলাবিশিষ্ট। এক তলায় ছিল চতুষ্পদ জন্তু ও হিংস্র প্রাণী, আর এক তলায় ছিল মানুষ, অপর এক তলায় ছিল পক্ষীকুল। চতুষ্পদ জন্তুর বিষ্টা যখন বাড়িয়া গেল তখন আল্লাহ তাআলা নূহ (আ)-কে ওহী পাঠাইলেন যে, হাতীর লেজে আঘাত কর। তিনি আঘাত করিলেন, তখন উহা হইতে একটি নর শূকর ও একটি মাদি শূকর বাহির হইল। ইহারা সকল বিষ্টা খাইয়া ফেলিল। অতঃপর যখন ইঁদুরের উপদ্রব বৃদ্ধি পাইল এবং উহারা নৌকার রশিসমূহ কাটিয়া ফেলিতে লাগিল তখন আল্লাহ তাআলা নূহ (আ)-এর নিকট ওহী পাঠাইলেন যে, সিংহের চক্ষুদয়ের মধ্যখানে আঘাত কর। অতঃপর তিনি সেখানে আঘাত করিলে উহার নাক দিয়া একটি নর ও একটি মাদি বিড়াল বাহির হইল এবং ইঁদুরের উপর ঝাঁপাইয়া পড়িয়া উহাদিগকে খাইয়া ফেলিল। ঈসা (আ) তাহাকে বলিলেন যে, নূহ (আ) কিভাবে জানিলেন যে, জনপদ ও শহর শুকাইয়া গিয়াছে? তিনি বলিলেন, “তিনি খবর আনিবার জন্য প্রথমে কাক প্রেরণ করেন। অতঃপর উহা মরা লাশ পাইয়া উহাতে বসিয়া পড়ে এবং ফিরিয়া আসার পরিবর্তে সেখানেই মশগুল হইয়া পড়ে। তখন নূহ (আ) উহার প্রতি বদদোআ করেন যেন তাহার অন্তরে ভীতির সৃষ্টি হয়। এইজন্য উহা মানুষের পোষ মানে না এবং ঘরে আসিতে পারে না। অতপর তিনি কবুতর প্রেরণ করিলেন। উহা ঠোঁটে করিয়া যয়তুনের পাতা এবং পায়ে করিয়া কাদা মাটি লইয়া আসিল। তখন তিনি বুঝিতে পারিলেন যে, শহর ও জনপদ শুকাইয়া গিয়াছে। তখন তিনি কবুতরের গলায় সবুজের মালা পরাইয়া দিলেন যাহা এখনও পরিদৃষ্ট হয় এবং উহার জন্য দোআ করিলেন যেন সে ভালবাসা ও নিরাপত্তা লাভ করে। এইজন্য উহা মানুষের পোষ মানে এবং ঘরের সহিত সম্পৃক্ত থাকে।” তাহারা বলিল, “হে আল্লাহর রাসূল! আমরা ইহাকে আমাদের পরিবারের নিকট লইয়া যাই না কেন? সে আমাদের সহিত,উঠা বসা করিবে এবং আমাদের সহিত কথাবার্তা বলিবে।” তিনি বলিলেন, যাহার রিযিক নাই সে কিভাবে তোমাদের সঙ্গে যাইবে? অতঃপর তাহাকে বলিলেন, “UT 330 “আল্লাহর নির্দেশে পূর্বের রূপে ফিরিয়া যাও।” তখন সে আবার মাটি হইয়া গেল (ইবন কাছীর, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ. ৮২-৮৩; ঐ লেখক, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ., ১১৬; আত-তাবারী, ১খ., ৯১-৯২; ঐ লেখক, তাফসীর, ১২খ., ২২; আছ-ছালাবী, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ. ৬১; পানিপতী, আত-তাফসীরুল-মাজহারী, ৫খ., ৯০)। হাফিজ ইব্ন কাছীর এই রিওয়ায়াত বর্ণনার পর এই সম্পর্কে মন্তব্য করিয়াছেন যে, ইহা চূড়ান্ত পর্যায়ের বিরল [ ] (দ্র. তাহার রচিত কাসাসুল-আম্বিয়া ও আল-বিদায়া ও নিহায়া, প্রাগুক্ত)।
নূহ (আ)-তনয় কিনআনের অবস্থা
আল্লাহ্ তাআলা নূহ (আ)-কে প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলেন যে, তিনি তাঁহার পরিবার-পরিজন ও মুমিনদিগকে রক্ষা করিবেন। নূহ (আ)-এর এক পুত্রের নাম ছিল য়াম, যাহাকে কিনআন বলা হইয়াছে। সে ছিল কাফির, ঈমান আনে নাই। ফলে সে নৌকায়ও আরোহণ করে নাই। প্লাবনে ডুবিয়া তাহার মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী দেখিয়া নূহ (আ)-এর পিতৃ-হৃদয় স্নেহ বিগলিত হইয়া উঠিল। তিনি নিতান্ত স্নেহভরে পুত্রকে ডাকিলেন এবং আরোহণ করিতে বলিলেন। কাফিরদের সঙ্গী হইতে নিষেধ করিলেন। কিন্তু সে উহা প্রত্যাখ্যান করিয়া বলিল যে, সে পাহাড়ে গিয়া আশ্রয় লইবে। নূহ (আ) বলিলেন, আল্লাহর আযাব হইতে আজ কেহই রক্ষা করিতে পারিবে না। তিনি যাহার প্রতি রহম করিবেন কেবল সেই রক্ষা পাইবে। অতঃপর বিশাল এক তরঙ্গ আসিয়া দুইজনের মধ্যে অন্তরায় সৃষ্টি করিল। অতঃপর সে নিমজ্জিতদের অন্তর্ভুক্ত হইল (১১ : ৪২-৪৩)। তখন নূহ (আ) তাহার ব্যাপারে আল্লাহর নিকট অনুযোগ [কোন কোন মুফাসসিরের মতে কিনআন নিমজ্জিত হইবার পূর্বে নূহ (আ) আল্লাহকে সম্বোধন করিয়া ইহা বলেন। সেক্ষেত্রে ইহা অনুযোগ না হইয়া বরং স্বীয় পুত্রের জন্য সুপারিশ হইবে] করিলেন এবং তাহাকে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করাইয়া দিয়া বলিলেন, হে আমার প্রতিপালক! আমার পুত্র আমার পরিবারভুক্ত এবং আপনার প্রতিশ্রুতি সত্য। আর আপনি তো বিচারকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বিচারক (১১ : ৪৫)। উল্লেখ্য যে, “পরিবারভুক্ত” লোকের দ্বারা আল্লাহ তাআলা সকর্মপরায়ণ ও তাহার অনুসারীবৃন্দকে বুঝাইয়াছিলেন । কিন্তু নূহ (আ) আপন বৈবাহিক সূত্রে সৃষ্ট পরিবার বুঝিয়াছিলেন, সেইজন্য ঐরূপ অনুযোগ বা সুপারিশ করিয়াছিলেন, তাই আল্লাহ তাআলা ইহাতে অসন্তোষ প্রকাশ করিয়া তাহাকে বলিলেন, হে নূহ! সে তো তোমার পরিবারভুক্ত নহে। সে তো অসৎকর্মপরায়ণ। সুতরাং যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নাই সে বিষয়ে আমাকে অনুরোধ করিও না। আমি তোমাকে উপদেশ দিতেছি। তুমি যেন অজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত না হও (১১ : ৪৬)। অতঃপর নূহ (আ) নিজের ভুল বুঝিতে পারিয়া লজ্জিত ও অনুতপ্ত হইলেন এবং আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করিলেন। বলিলেন, হে আমার প্রতিপালক! যে বিষয়ে আমার জ্ঞান নাই সে বিষয়ে যাহাতে আপনাকে অনুরোধ না করি, এইজন্য আপনার শরণ লইতেছি। আপনি যদি আমাকে ক্ষমা না করেন এবং আমাকে দয়া না করেন তবে আমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হইব (১১ : ৪৭)।
উক্ত সর্বগ্রাসী প্লাবন হইতে কোন কাফিরই প্রাণে রক্ষা পায় নাই, সকলেই পানিতে নিমজ্জিত হইয়া প্রাণ হারাইয়াছিল। কোন কাফির মুশরিকের প্রতি সেই সময় আল্লাহ তাআলা দয়া প্রদর্শন করেন নাই। ইব্ন জারীর তাবারী ও ইবন আবী হাতিম প্রমুখ ইয়াকূব ইব্ন মুহাম্মাদ আয-যুহরী সূত্রে আইশা (রা) হইতে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (স) বলেন : আল্লাহ তাআলা যদি নূহ (আ) সম্প্রদায়ের কাহারও প্রতি দয়া প্রদর্শন করিতেন তবে অবশ্যই সেই শিশুটির মায়ের প্রতি দয়া করিতেন। তাহার ঘটনা এই ছিল যে, প্লাবনের পানি যখন রাস্তাঘাট পর্যন্ত বিস্তৃত হইয়া গেল তখন এক শিশুর মাতা ভয় পাইয়া গেল। সে শিশুটিকে ভীষণ ভালবাসিত। অতঃপর সে শিশুটিকে লইয়া পাহাড়ে আশ্রয় নিতে গেল এবং পাহাড়ের এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত আরোহণ করিল। সে পর্যন্ত পানি পৌঁছিলে সে শিশুটিকে লইয়া পাহাড়ের চূড়ায় আরোহণ করিল। পানি যখন তাহার পা পর্যন্ত পৌঁছিল তখন সে শিশুটিকে দুই হাত উঁচু করিয়া ধরিল। কিন্তু শেষ রক্ষা হইল না, মা ও শিশু উভয়েই নিমজ্জিত হইল (ইবন জারীর আত-তাবারী, তারীখ, ১খ., ৯১; ঐ লেখক, তাফসীর, ১২খ., ২১-২২; ইবন কাছীর, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ. ৭৮-৭৯; ঐ লেখক, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ., ১১৩-১১৪; আছ-ছালাবী, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ. ৬০)।
কোন কোন ইতিহাসবেত্তা ও মুফাসসির এই বিষয়ে এক অলীক ঘটনা বর্ণনা করিয়াছেন যে, উজ ইব্ন ইনাক নামক এক অসম্ভব দীর্ঘাকৃতির লোক উক্ত প্লাবন হইতে নৌকায় আরোহণ না করিয়াও রক্ষা পাইয়াছিল। তাহাদের বর্ণনামতে, ঊজ ইবন ‘ইনাক নূহ (আ)-এর পূর্বকাল হইতে মূসা (আ)-এর সময়কাল পর্যন্ত জীবিত ছিল। সে ছিল কাফির, অহঙ্কারী ও উদ্ধত বিরুদ্ধাচারী। সে ৩,৩৩৩ হাত লম্বা ছিল। এত দীর্ঘ হওয়ার কারণে সে সমুদ্রের তলদেশ হইতে মাছ ধরিয়া তাহা সরাসরি সূর্যের কাছে ধরিয়া উহার তাপে ভুনা করিয়া খাইত। সে নূহ (আ)-কে নৌকায় তুলিবার অনুরোধ করে, কিন্তু সে কাফির থাকায় নূহ (আ) তাহার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন। অতঃপর প্লাবন শুরু হইলে প্লাবনের পানি তাহার হাঁটুর উপর উঠিতে পারে নাই। ফলে সে নিমজ্জিত হওয়া হইতে রক্ষা পায় (আছ-ছালাবী, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ. ৬০-৬১; ইবন কাছীর, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ. ৭৯; ঐ লেখক, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ., ১১৪; আল-আসী, রূহুল-মাআনী, ১২খ., ৬২; আত-তাফসীরুল মাজহারী, ৫খ., ৯০)। এক বর্ণনামতে তাহার রক্ষা পাওয়ার কারণ ছিল, নূহ (আ) নৌকা তৈরীর জন্য সেগুন কাঠের প্রয়োজন অনুভব করেন। কিন্তু তিনি কোথাও উহা পাইতেছিলেন না। উজ তাহাকে শাম হইতে উহা বহন করিয়া আনিয়া দেয়। এইজন্য আল্লাহ তাআলা তাহাকে নিমজ্জিত হওয়া হইতে রক্ষা করেন (আত-তাফসীরুল মাজহারী, প্রাগুক্ত)। কিন্তু এই ঘটনা একদিকে যেমন যুক্তিগ্রাহ্য নহে, অপরদিকে তেমনি সুস্পষ্ট কুরআন-হাদীছের পরিপন্থী। যুক্তিগ্রাহ্য এইজন্য নহে যে, স্বয়ং নূহ (আ)-এর ঔরসজাত পুত্র কিনআন তাহার কুফরীর কারণে রক্ষা পায় নাই, নূহ (আ)-এর সুপারিশ সত্ত্বেও। অথচ তাহার পিতা একজন সম্মানিত নবী ও আল্লাহর প্রিয় বান্দা, আর ঊজ তো এক অহংকারী কাফির। অপরদিকে একজন অসহায় নারী ও নিষ্পাপ শিশুর প্রতি আল্লাহ তাআলা দয়া প্রদর্শন করেন নাই, আর এহেন একজন কাফির, মুশরিককে আল্লাহ্ দয়া প্রদর্শন করিয়া রক্ষা করিবেন, ইহা কোনও সুস্থ বিবেক গ্রহণ করিতে পারে না। আর কাষ্ঠ বহন করিয়া আনার বিষয়টিও স্বীকৃত নহে। কারণ অধিকাংশ বর্ণনামতে নূহ (আ) নিজেই বৃক্ষ রোপণ করিয়াছিলেন এবং উক্ত বৃক্ষের কাঠ দ্বারাই নৌকা তৈরী করা হয়। আর উহা কুরআন হাদীছের পরিপন্থী এইজন্য যে, নূহ (আ)-এর প্রার্থনা ছিল?
পৃথিবীতে বসবাসকারী কোন কাফির যেন নিস্তার না পায় (৭১ : ২৬)। আর এই দুআই ককূল হইয়াছিল আল্লাহর দরবারে। তাই ঊজ ইবন ইনাক কাফির হওয়া সত্ত্বেও কীভাবে নিস্তার পাইতে পারে? অপরদিকে আল্লাহ্ তাআলা ইরশাদ করিয়াছেন যে, মুমিন বান্দা ছাড়া অন্য সকলকে আমি নিমজ্জিত করিয়াছিলাম (৩৭ : ৮১-৮২)। সুতরাং উজ ইব্ন ইনাক-এর প্লাবন হইতে রক্ষা পাইয়া মূসা (আ)-এর যুগ পর্যন্ত জীবিত থাকার বিষয়টি কোন ক্রমেই সমর্থনযোগ্য নহে।
অপরদিকে তাহার যে অসম্ভব রকমের দীর্ঘাকৃতির কথা বর্ণনা করা হইয়াছে তাহা সহীহ হাদীছের পরিপন্থী। কারণ রাসূলুল্লাহ (স) বলেন :
“আল্লাহ্ তাআলা আদম (আ)-কে ষাট হাত লম্বা করিয়া সৃষ্টি করিয়াছিলেন। অতঃপর বর্তমান পর্যন্ত মানুষের দৈর্ঘ্য কেবল হ্রাস পাইতেছে” (আস-সাহীহ, ১খ., ৪৬৮)।
ইহাতে মিথ্যার লেশমাত্র নাই। সুতরাং ইহার ব্যত্যয় হইবার নহে (ইব্ন কাছীর; কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৭৯-৮০; ঐ লেখক, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ., ১১৪; পানিপতী, আত-তাফসীরুল মাজহারী, ৫, ৯০-৯১)। তাই বলা যায় যে, এই ঘটনা ইয়াহূদ-নাসারাদের মনগড়া কল্প-কাহিনী বৈ আর কিছুই নহে।
প্লাবনের সমাপ্তি এবং নূহ (আ)-এর ভূমিতে অবতরণ
অবশেষে আল্লাহর নির্দেশে প্লাবন থামিয়া গেল, ভূপৃষ্ঠ হইতে পানি সরিয়া গেল ও পৃথিবী চলা-ফেরার যোগ্য হইয়া গেল। মুহাম্মাদ ইব্ন ইসহাক-এর বর্ণনামতে আল্লাহ যখন প্লাবন বন্ধ করিতে চাহিলেন তখন পৃথিবীতে বাতাস প্রেরণ করিলেন। ফলে পানি স্থির হইয়া গেল এবং ঝর্ণাগুলির পানির প্রবাহ বন্ধ হইয়া গেল। অতঃপর ধীরে ধীরে পানিও শুকাইয়া গেল (ইব্ন কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ., ১১৭; ঐ লেখক, কাসাসুল আম্বিয়া পৃ. ৮৪)। বাইবেলেও ইহারই উল্লেখ রহিয়াছে (দ্র. Genesis :৪: 1-3)। বাইবেলের বর্ণনামতে পানি ক্রমশ সরিয়া গিয়া এক শত পঞ্চাশ দিবসের শেষে হ্রাস পাইল। তাহাতে সপ্তম মাসের সপ্তদশ রাত্রি অতিবাহিত হওয়ার পর নৌকা আশরাত (জুদী) পর্বতে আসিয়া স্থির হয়। আর দশম মাসের প্রথম দিন হইতে পাহাড়ের চূড়া দেখা যায়। অতঃপর চল্লিশ দিন অতিবাহিত হইবার পর নূহ (আ) তাঁহার নৌকার বাতায়ন খুলিয়া দিলেন। অতঃপর তিনি পানির অবস্থা জানিবার জন্য একটি দাঁড়কাক ছাড়িয়া দিলেন। সে আর ফিরিয়া আসিল না, বরং সে ইতস্তত গতায়াত করিল। অতঃপর তিনি কবুতর প্রেরণ করিলেন। সে ফিরিয়া আসিল, তাহার পা রাখার মত জায়গা পাইল না। অতঃপর তিনি হাত বাড়াইয়া উহাকে নৌকার মধ্যে প্রবেশ করাইলেন, ইহার পর সাত দিন অতিক্রান্ত হইল। অতঃপর তিনি পানির অবস্থা জানিবার জন্য আবার সেই কবুতর ছাড়িয়া দিলেন। উহা সন্ধ্যা বেলায় চঞ্চুতে করিয়া একটি যয়তুনের নবীন পাতা লইয়া ফিরিয়া আসিল। তখন নূহ (আ) বুঝিলেন যে, ভূপৃষ্ঠ হইতে পানি কমিয়া গিয়াছে। ইহার পর আর সাত দিন অপেক্ষা করিয়া আবার সেই কবুতর প্রেরণ করিলেন। অতঃপর সে আর ফিরিয়া আসিল না। তখন নূহ বুঝিলেন যে, মাটি জাগিয়া গিয়াছে। অতঃপর প্লাবন শুরুর দিন হইতে নূহের কবুতর প্রেরণ পর্যন্ত যখন এক বৎসর পূর্ণ হইল এবং দ্বিতীয় বৎসরের প্রথম মাসের প্রথম দিন আসিল তখন ভূপৃষ্ঠ দেখা গেল এবং মাটি পূর্ণরূপে জাগিয়া উঠিল। নূহ (আ)-ও নৌকার ছাদ খুলিয়া দিলেন (Genesis 8:3-14)।
মুসলিম ঐতিহাসিকগণও সামান্য পরিবর্তনসহ অনুরূপ বর্ণনা করিয়াছেন। তাহাদের বর্ণনা হইল : ইবন আব্বাস (রা) হইতে বর্ণিত, নূহ (আ)-এর সহিত নৌকায় ৮০ জন পুরুষ ছিল। তাহাদের সহিত তাহাদের স্ত্রীগণও ছিল। তাহারা ১৫০ দিন নৌকায় ছিলেন। আল্লাহ্ তাআলা এক পর্যায়ে নৌকা মক্কার দিকে ফিরাইয়া দেন। অতঃপর ৪০ দিন যাবত উহা বায়তুল্লাহকে কেন্দ্র করিয়া ঘুরিতে থাকে। অতঃপর আল্লাহ তাআলা উহাকে জুদী পর্বতের দিকে ফিরাইয়া দেন। সেখানে আসিয়া নৌকা স্থির হইয়া যায়। অতঃপর নূহ (আ) ভূপৃষ্ঠের খবর আনিবার জন্য কাক প্রেরণ করেন। সে গিয়া মরা লাশের উপর পতিত হয়, তাই আসিতে বিলম্ব করে। তখন তিনি কবুতর প্রেরণ করেন। সে তাহার নিকট যয়তুন বৃক্ষের পাতা লইয়া আসে এবং তাহার পায়ে কাদা মাটি লাগিয়াছিল। তখন নূহ (আ) বুঝিতে পারেন যে, পানি নামিয়া গিয়াছে। তখন আল্লাহ তাআলা নূহ (আ)-কে তাঁহার সঙ্গীগণসহ অবতরণের নির্দেশ দিয়া বলিলেন :
“হে নূহ! অবতরণ কর আমার পক্ষ হইতে শান্তি ও কল্যাণসহ এবং তোমার প্রতি ও যে সমস্ত সম্প্রদায় তোমার সঙ্গে আছে তাহাদের প্রতি; অপর সম্প্রদায়সমূহকে আমি জীবন উপভোগ করিতে দিব, পরে আমা হইত মর্মন্তুদ শাস্তি উহাদিগকে স্পর্শ করিবে।”
ইবন ইসহাকের বর্ণনামতে প্লাবনের ২য় বৎসরের ২য় মাসের ২৬তম রজনীতে এই নির্দেশ দেওয়া হয় (ইবন কাছীর, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ. ৮৪)। অতঃপর নূহ (আ) ১০ মুহাররাম তারিখে পুনরায় লূতন করিয়া আল্লাহর পৃথিবীতে জুদী পর্বতের পাদদেশে নামিয়া আসিলেন। বিশ্বের বুকে এইবার হইলেন তিনিই প্রথম মানব। এই হিসাবে তাহার উপাধি “আবুল বাশার ছানী” বা “আদম ছানী” (মানুষের দ্বিতীয় আদিপিতা)-রূপে প্রসিদ্ধ হয় এবং সম্ভবত এইজন্যই হাদীছে তাঁহাকে প্রথম রাসূল (দ্র.. আল-বুখারী, ১খ., ৪৭০; মুসলিম, ১খ., ১০৮) বলা হইয়াছে (হিফজুর রহমান সিউহারবী, কাসাসুল কুরআন, ১খ., ৭৬)।
কাতাদা প্রমুখের বর্ণনামতে তাহারা রজব মাসের দশম দিনে নৌকায় আরোহণ করেন। অতঃপর ১৫০ দিন তাহারা নৌকায় অতিবাহিত করেন। জুদী পর্বতে তাহাদিগকে লইয়া নৌকা স্থির ছিল এক মাস। আর তাহারা নৌকা হইতে অবতরণ করেন মুহাররামের দশ তারিখ । এইজন্য উক্ত দিবসের নামকরণ করা হয় ‘আশূরা। পৃথিবীতে অবতরণ করিয়াই তিনি তাঁহার সঙ্গী সকল মানুষ এমনকি জীব-জন্তুকেও ঐদিন আল্লাহর শুকরিয়া আদায়ম্বরূপ সাওম পালন করিবার নির্দেশ দেন (আছ-ছালাবী, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৬১-৬২; ইবন কাছীর, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ. ৮৩; ঐ লেখক, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ., ১১৬; আত-তাবারী, তারীখ, ১খ., ৯৬)। (উল্লেখ্য যে, নূহ (আ) ও তাঁহার সঙ্গীগণ নৌকায় আরোহণ করিয়াও সাওম পালন করিয়াছিলেন (তাবারী, প্রাগুক্ত)। এইখান হইতেই আশূরার সাওম চালু হয়। ইমাম ইবন জারীর তাবারী ইহার সমর্থনে একটি মার হাদীছ বর্ণনা করিয়াছেন যে, আবু হুরায়রা (রা) বলেন : একদা রাসূলুল্লাহ (স) ইয়াহূদীদের কিছু লোকের নিকট দিয়া যাইতেছিলেন, তাহারা সেই দিন সাওম পালন করিতেছিল। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “ইহা কোন্ সাওম”? তাহারা বলিল, ইহা সেইদিন যেদিন আল্লাহ মূসা (আ) ও বান্ ইসরাঈলকে নিমজ্জিত হওয়া হইতে রক্ষা করেন এবং ফিরআন নিমজ্জিত হয়, এই দিনে নৌকা জুদী পর্বতে স্থির হয়। অতঃপর নূহ ও মূসা (আ) এইদিনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করিবার জন্য সাওম পালন করেন। তখন রাসূলুল্লাহ (স) বলেন, আমি মূসার প্রতি বেশী হকদার এবং এই দিনের সাওম পালন করার বেশী হকদার। অতঃপর তাঁহার সাহাবীদিগকে ঐদিনে সাওম পালন করিবার নির্দেশ দেন (ইবন কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ., ১১৭; ঐ লেখক, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৮৩)।
অতঃপর নূহ (আ) সেখানে অবতরণ করিয়া জাযীরার কারদায় অঞ্চলের পার্শ্বে একটি জায়গা মনোনীত করিলেন এবং সেখানে একটি জনপদের পত্তন করিলেন, যাহার নাম রাখিলেন ছামানীন (অর্থাৎ ৮০)। কারণ সেখানে তিনি যাহারা তাহার উপর ঈমান আনয়ন করিয়াছিল তাহাদের প্রত্যেকের জন্য একখানি করিয়া গৃহ নির্মাণ করিলেন। আর তাহারা সংখ্যায় ছিল ৮০ জন। উক্ত জনপদ বর্তমানে লূক ছামানীন নামে খ্যাত (আত-তাবারী, তারীখ, ১খ., ৯৬; ইবনুল-আছীর, আল-কামিল, ১খ., ৫৮; আছ-ছালাবী, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ. ৬২)। ভূমিতে অবতরণ করিবার পর নূহ (আ) হযরত আদম (আ)-এর লাশ বায়তুল মাকদিসে দাফন করেন (ইব্ন সাদ, তাবাকাত, ১খ., ৪২)। অতঃপর তিনি তাহাদের মধ্যে আবার দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ শুরু করেন। নূহ (আ) ইহার পর ৩৫০ বৎসর জীবিত ছিলেন (আছ-ছালাবী, প্রাগুক্ত)। বাইবেলেও বলা হইয়াছে যে, জল প্লবনের পর নোহ তিন শত পঞ্চাশ বৎসর জীবৎ থাকিলেন (Genesis, 9: 28; বাংলা অনু, পবিত্র বাইবেল, পৃ. ১২)। কালক্রমে এক দিন তাহাদের ভাষা ৮০টি ভাষায় রূপান্তরিত হইল, যাহার একটি হইল আরবী। তাহারা একে অন্যের কথা বুঝিত না। নূহ (আ) তাহাদিগকে বুঝাইয়া দিতেন (ইবন কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ., ১১৬; ঐ লেখক, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৮৩)। এই প্লাবন-এর সময়কাল ৩২৩২ খৃ. পূ. বলিয়া অনুমান করা হয় (আবদুল মাজিদ দারয়াবাদী, মাসাইল ওয়া কিসাস, পৃ. ১০৭)।
প্লাবন বিশ্বের সর্বত্র না বিশেষ স্থানে হইয়াছিল
হযরত নূহ (আ)-এর সময়কার পাবন সমগ্র বিশ্বব্যাপী হইয়াছিল, না শুধু তাঁহার কওম যে অঞ্চলে বাস করিত সেই অঞ্চলে, এই ব্যাপারে দুইটি মত পাওয়া যায় : (১) ইসলামী চিন্তাবিদগণের একটি দল, ইয়াহুদ ও খৃস্টানদের ধর্মযাজকগণ এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানী, ভূতত্ত্ববিদ ও নৃতত্ত্ববিদদের একটি অংশ এই মত পোষণ করিয়াছেন যে, এই প্লাবন সমগ্র বিশ্বব্যাপী ছিল না; বরং নূহ (আ) ও তাঁহার সম্প্রদায় যে অঞ্চলে বসবাস করিত সেখানেই সীমাবদ্ধ ছিল। উক্ত অঞ্চলের আয়তন ছিল ১,৪০,০০০ (এক লক্ষ চল্লিশ হাজার) বর্গকিলোমিটার। তাহাদের মতে সীমাবদ্ধ অঞ্চলে হওয়ার কারণ হইল, তখনকার সময়ে জনবসতি ছিল একটি অঞ্চলে সীমাবদ্ধ। আর তাহা ছিল শুধুমাত্র নূহ (আ) ও তাঁহার সম্প্রদায় যে অঞ্চলে বাস করিত সেই অঞ্চলেই। কারণ তখনও হযরত আদম (আ)-এর বংশধর উক্ত অঞ্চল ব্যতীত অন্য কোথাও বিস্তার লাভ করে নাই। তাই তাহারাই শাস্তির উপযুক্ত ছিল এবং তাহাদের উপরই প্লাবনেয় শাস্তি প্রেরণ করা হয়। বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে যেহেতু কোনও বাসিন্দা ছিল না, তাই সেই সকল এলাকার সহিত প্লাবনের কোন সম্পর্ক নাই।
(২) আর কিছু সংখ্যক ইসলামী চিন্তাবিদ, ভূতত্ত্ববিদ, প্রকৃতি বিজ্ঞানী ও নৃতত্ত্ববিদের মতে এই প্লাবন ছিল বিশ্বব্যাপী। আর শুধু এই একটি প্লাবনই নহে, বরং তাহাদের মতে বিশ্বে আরও কয়েকটি বড় ধরনের প্লাবন হইয়াছে। তন্মধ্যে নূহ (আ)-এর প্লাবন অন্যতম। কারণ ‘জাযীরা ও ইরাকের ভূখণ্ড ছাড়াও বিশ্বের অন্যান্য উঁচু পর্বতের চূড়ায় এমন সব প্রাণীর কঙ্কাল ও হাড় পাওয়া গিয়াছে যাহার সম্পর্কে নৃতত্ত্ববিদ ও ভূবিজ্ঞানীদের অভিমত হইল, ইহারা জলজ প্রাণী। পানিতেই কেবল বসবাস করিতে পারে। পানি ছাড়া এক মুহূর্তও বাঁচিয়া থাকা তাহাদের জন্য দুষ্কর। তাই বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের উঁচু পর্বত শিখরে উক্ত নিদর্শন পাওয়ায় প্রমাণিত হয় যে, কোনও কালে এমন এক সর্বগ্রাসী প্লাবন হইয়াছিল যাহার আওতা হইতে পর্বত শৃঙ্গও রেহাই পায় নাই (আবদুল-ওয়াহহাব আন-নাজ্জার, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ. ৩৬; হিফজুর রহমান সিউহারবী, কাসাসুল-কুরআন, ১খ., ৭৬-৭৭)। আবদুল ওয়াহহাব নাজ্জার স্বীয় গ্রন্থে প্রথম অভিমতটিকে প্রাধান্য দিয়াছেন।
অগ্নি উপাসকগণ এই প্লাবন স্বীকার করে না। তাহারা বলে, ‘জিউমিরত (৩২) অর্থাৎ আদম-এর সময়কাল হইতে আমাদের রাজত্ব চলিয়া আসিতেছে। পুরুষানুক্রমে একের পর এক উহা লাভ করিয়া আসিতেছে ফীয ইব্ন য়াযদাজিদ ইব্ন শাহরিয়ার পর্যন্ত। প্লাবন সংঘটিত হইলে কওমের বংশলতিকা বিচ্ছিন্ন হইয়া যাইত। আর কওমের রাজত্বও বিলুপ্ত হইয়া যাইত। তাহাদের কিছু সংখ্যক লোক প্লাবন স্বীকার করে এবং বলে, উহা শুধু বাবিল ও তৎপার্শ্ববর্তী অঞ্চলে সংঘটিত হইয়াছিল। আর জিউমিরত-এর বংশধরদের নিবাস ছিল পূর্বাঞ্চলে। তাই তাহাদের পর্যন্ত উহা পৌঁছে নাই। আবু জাফর তাবারী বলেন, আল্লাহ তাআলা বনের যেই বিবরণ প্রদান করিয়াছেন এই ধারণা উহার পরিপন্থী। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন :
“তাহাকে এবং তাহার পরিবারবর্গকে আমি উদ্ধার করিয়াছিলাম মহা সংকট হইতে। তাহার বংশধরদিগকেই আমি বিদ্যমান রাখিয়াছি বংশ-পরম্পরায়”।
এখানে সুস্পষ্টভাবে উল্লিখিত হইয়াছে যে, নূহ (আ)-এর বংশধরই কেবল অবশিষ্ট রহিয়াছে; অন্য কেহ নহে। সবাই নিমজ্জিত হইয়া মারা গিয়াছে (আত-তাবারী, তারীখ, ১খ., ৯৭)।
ইবাদাত ও আখলাক
হযরত নূহ (আ) ছিলেন অতিশয় ইবাদতগু্যার বান্দা। স্বয়ং আল্লাহ তাআলা তাহাকে “পরম কৃতজ্ঞ বান্দা” বলিয়া আখ্যায়িত করিয়াছেন। ইরশাদ হইয়াছে :
“সে তো ছিল পরম কৃতজ্ঞ বান্দা” (১৭:৩)।
তিনি পানাহার, উঠা-বসা, পোশাক-পরিচ্ছদ তথা তাঁহার সকল কাজ-কর্মে আল্লাহর হামদ ও শোকর আদায় করিতেন (ইব্ন কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ., ১১৮; ঐ লেখক, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ. ৮৬)। ইমাম আহমাদ (র) আবু উসামা সূত্রে আনাস ইবন মালিক (রা) হইতে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (স) বলেন, আল্লাহ সেই বান্দার উপর সন্তুষ্ট হন যে আহার করিয়া উহার জন্য তাঁহার প্রশংসা করে; পানি পান করিয়া উহার জন্য তাঁহার প্রশংসা করে (মুসলিম, আস-সাহীহ, ২., ৩৫২)। আর শোকরপ্তার ও প্রশংসাকারী সেই হইতে পারে যে অন্তর দ্বারা, কথা-বার্তা এবং কাজকর্মে আল্লাহর আনুগত্য করিয়া থাকে (প্রাগুক্ত)।
হযরত নূহ (আ) সালাত কিভাবে আদায় করিতেন তাহা জানা যায় না। তবে তাঁহার সাওম পালন করা সম্পর্কিত হাদীছের দ্বারা পরোক্ষভাবে অনুমান করা যায় যে, তিনি দুই ঈদের সালাত আদায় করিতেন। তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠার সহিত সাওম ও হজ্জ পালন করিতেন, হাদীছের দ্বারা ইহা সুস্পষ্টরূপে জানা যায়। সাহল ইবন আবী সাহল সূত্রে আবদুল্লাহ ইবন আমর (রা) হইতে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ (স) বলেন, নূহ (আ) ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা দিবস ছাড়া সারা বৎসরই সাওম পালন করিতেন (ইবন মাজা, ১খ., ১২৪)! তাবারানী রাওহ ইব্ন ফারাজ সূত্রে আবদুল্লাহ্ ইব্ন আমর (রা) হইতে অনুরূপ রিওয়ায়াত করিয়াছেন (ইবন কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ১খ., ১১৮)। ইহাতে অনুমিত হয় যে, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার বিধান তাহার সময়েই ছিল এবং তাহার হজ্জ পালন সম্পর্কেও হাদীছে সুস্পষ্ট বিবরণ রহিয়াছে। ইব্ন আব্বাস (রা) হইতে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ (স) যখন হজ্জ করিতেছিলেন তখন উসফান উপত্যকায় আসিয়া আবু বাকর (রা)-কে বলিলেন, আবূ বাকর! ইহা কোন উপত্যকা? আবূ বাকর (রা) বলিলেন, ইহা উসফান উপত্যকা। রাসূলুল্লাহ (স) বলিলেন, নূহ, হূদ ও ইবরাহীম মধ্য বয়স্ক শক্তিশালী উষ্ট্রের উপর আরোহণ করিয়া এই উপত্যকা অতিক্রম করিয়াছেন। তাহাদের সঙ্গে ছিল কিছু গাধা, যেগুলোর নাকের রশি (নাকীল) ছিল খেজুর বৃক্ষের আঁশ দ্বারা তৈরী। আর তাহাদের পরনে ছিল আবা (জুব্বা) এবং তাহাদের চাদর ছিল পশমের সাদা-কালো ডোরাকাটা। তাহারা বায়তুল আতীক-এ হজ্জ করেন (ইবন কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ১খ., ১১৯; ঐ লেখক, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৮৮)। হাফিজ ইব্ন কাছীর এই হাদীছ উল্লেখ করিয়া ইহাকে গরীব বলিয়া মন্তব্য করিয়াছেন (প্রাগুক্ত)। ইবনুল জাওযী উরওয়া ইবনুয যুবায়র (রা) হইতে বর্ণনা করিয়াছেন যে, নূহ (আ)-এর এই হজ্জ ছিল প্লাবনের পূর্বে (দ্র. হাফিজ ইবন কাছীর কৃত কাসাসুল আম্বিয়া গ্রন্থের টীকা)।
হযরত নূহ (আ)-এর ধর্মের ইবাদত-বন্দেগী এবং বিধি-নিষেধসমূহ প্রায় সবই হযরত মুহাম্মাদ (স)-এর আনীত শরীআতের অনুরূপ ছিল। কুরআন করীমের ৪২ ও ১৩ নং আয়াতের দ্বারাও ইহার প্রমাণ পাওয়া যায়। তাহার সাওম, হজ্জ ও দুই ঈদের সালাতের কথা পূর্বেই উল্লিখিত হইয়াছে, যাহা রাসূলুল্লাহ্ (স) আনীত শরীআতেও রহিয়াছে। এতদ্ব্যতীত তাহার শরীআতের সাতটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা ও বিধি-নিষেধের কথা জানা যায়, যাহা রাসূলুল্লাহ (স)-এর শরীআতেও রহিয়াছে। সেইগুলো হইল : (১) হুকুম দেওয়ার অধিকারী কর্তৃপক্ষকে মান্য করা; (২) আল্লাহ কর্তৃক মনোনীত মহামানব তথা নবী-রাসূলদের নামের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা; (৩) শিরক তথা পৌত্তলিকতা পরিত্যাগ করা; (৪) ব্যভিচার না করা; (৫) মানুষ হত্যা না করা; (৬) দস্যুবৃত্তি না করা এবং (৭) জীবন্ত প্রাণীর গোশত ভক্ষণ না করা। এই ধরনের বিধি-নিষেধের সংখ্যা আরও ছিল। তৃতীয় শতাব্দীতেও কেহ কেই এই সকল বিধি-নিষেধ মানিয়া চলিত, লোকসমাজে তাহারা ধার্মিক হিসাবে পরিগণিত হইত, (Encyclopaedia of Religion and Ethics, vol. 9, P. 379-380) 1
নূহ (আ) অন্তিমকালে তাহার জ্যেষ্ঠ পুত্র সামকে যে ওসিয়াত করিয়াছিলেন তাহা রাসূলুল্লাহ (স)-এর দীনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় [উহার বিস্তারিত বিবরণ দ্র. “ইনতিকালের পূর্বে নূহ (আ)-এর ওসিয়াত” শিরো.]। স্বীয় পুত্রকে তিনি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ-এর যিকির করিতে নির্দেশ দেন। মূলত ইহাকেই রাসূলুল্লাহ (স) ঈমানের কলেমা বলিয়া আখ্যায়িত করিয়াছেন এবং এই কলেমা পাঠ করিয়া কেহ ইনতিকাল করিলে সে জান্নাতে প্রবেশ করিবে বলিয়া ঘোষণা করিয়াছেন। হাদীছে বর্ণিত হইয়াছে :
“আনাস (রা) হইতে বর্ণিত। নবী (স) একটি বাহনে আরোহী ছিলেন, আর মুআয (রা) তাঁহার পেছনে ছিলেন। তিনি ডাকিলেন : মুআয! তিনি উত্তর দিলেন, লাব্বায়ক ইয়া রাসূলুল্লাহ্! আমি প্রস্তুত। রাসূলুল্লাহ (স) এইভাবে তিনবার ডাকিলেন এবং মুআয (রা) তিনবার এরূপ উত্তর দিলেন। অতঃপর তিনি বলিলেন, যে ব্যক্তিই সত্যভাবে অন্তর হইতে লাইলাহা ইল্লাল্লাহু-এর সাক্ষ্য দিবে এবং মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্-এর সাক্ষ্য দিবে, আল্লাহ তাহার জন্য জাহান্নাম হারাম করিয়া দিবেন। মুআয (রা) বলিলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমি কি ইহার সংবাদ লোকজনকে জানাইয়া দিব না যাহাতে তাহারা সুসংবাদ লাভ করে? রাসূলাল্লাহ্ (স) বলিলেন, তাহা হইলে তাহারা ইহার উপর আস্থা করিয়া বসিয়া থাকিবে। অতঃপর মুআয (রা) ইহার সংবাদ তাহার মৃত্যুর সময় (হাদীছ না পৌঁছানোর) গুনাহের ভয়ে জানাইয়া যান।”
অন্য হাদীছে বর্ণিত হইয়াছে :
“আবু যার (রা) হইতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী (স)-এর নিকট আগমন করিলাম। তাঁহার শরীরে ছিল সাদা কাপড়, তিনি ঘুমন্ত অবস্থায় ছিলেন। আবার আসিলাম তখন তিনি জাগ্রত হইয়াছেন। তিনি বলিলেন : যে ব্যক্তি [ ] বলিবে, অতঃপর ইহার উপরই ইনতিকাল করিবে সে অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করিবে। আমি বলিলাম, যদিও সে ব্যভিচার করে ও চুরি করে? তিনি বলেন, যদিও সে ব্যভিচার করে ও চুরি করে। আমি বলিলাম, যদিও সে ব্যভিচার করে ও চুরি করে? তিনি বলিলেন, যদিও সে ব্যভিচার করে ও চুরি করে। আমি আবারও বলিলাম, যদিও সে ব্যভিচার করে ও চুরি করে? তিনি বলিলেন, যদিও সে ব্যভিচার করে ও চুরি করে, আবু যার-এর নাক ধূলায় ধূসরিত হওয়া সত্ত্বেও” (মিশকাতুল-মাসাবীহ, ১খ., ১৪; বুখারী ও মুসলিম-এর বরাতে)।
তিনি [ ]-এর যিকির করিবার জন্য স্বীয় পুত্রকে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিলেন। রাসূলুল্লাহ (স)-ও এই কলেমার বড়ই ফযীলত বর্ণনা করিয়াছেন :
[ ]
আবু হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত। নবী (স) বলেন : দুইটি কলেমা রাহমান (আল্লাহ্)-এর নিকট প্রিয়, মুখে উচ্চারণ করা সহজ, আর মীযানে (দাড়িপাল্লায়) তাহা হইবে ভারী। কলেমা দুইটি হইল :
[ ]
(আল-বুখারী, আস-সাহীহ, ২খ., ১১২৯)।
নূহ (আ) তাঁহার ওসিয়াতে আল্লাহর সহিত কাহাকেও শরীক করিতে নিষেধ করিয়াছেন। রাসূলুল্লাহ (স)-এর নিকট প্রেরিত মহাগ্রন্থ আল-কুরআনুল করীমে বহু স্থানে, বহুভাবে শিরক করিতে নিষেধ করা হইয়াছে। বলা হইয়াছে, শিরক মস্তবড় জুলুম (৩১ : ১৩) ke it dj । “নিশ্চয়ই শিরক চরম জুলুম”। আল্লাহ্ তাআলা শিরক ব্যতীত সকল গুনাহ ক্ষমা করিবেন, কিন্তু শিরক-এর অপরাধ ক্ষমা করিবেন না। ইরশাদ হইয়াছে :
“নিশ্চয় আল্লাহ তাঁহার সহিত শরীক করা ক্ষমা করেন না। ইহা ব্যতীত অন্যান্য অপরাধ যাহাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন; এবং যে কেহ আল্লাহর শরীক করে সে এক মহাপাপ করে।”
শিরক করিলে অন্যান্য ভাল আমলও নষ্ট হইয়া যায়। ইরশাদ হইয়াছে :
“তুমি আল্লাহর শরীক স্থির করিলে তোমার কর্মই তো নিষ্ফল হইবে এবং অবশ্যই তুমি হইবে ক্ষতিগ্রস্ত।”
শিরককারীর পরিণতি হইবে জাহান্নাম, জান্নাত তাহার জন্য হারাম হইয়া যাইবে। ইরশাদ হইয়াছে (৫ : ৭২) :
“কেহ আল্লাহর শরীক করিলে আল্লাহ তাহার জন্য জান্নাত অবশ্যই নিষিদ্ধ করিবেন এবং তাহার আবাস জাহান্নাম।”
নূহ (আ) স্বীয় পুত্রকে অহঙ্কার করিতে নিষেধ করেন। আর রাসূলুল্লাহ (স) অহঙ্কারকে জান্নাত পাওয়ার অন্তরায় বলিয়া ঘোষণা করিয়াছেন। তিনি ইরাশদ করিয়াছেন ।
“আবদুল্লাহ (রা) হইতে বর্ণিত। নবী (স) বলেন : সে ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করিতে পারিবে না, যাহার অন্তরে বিন্দু পরিমাণ অহঙ্কার রহিয়াছে। আর জাহান্নামে প্রবেশ করিবে না সে ব্যক্তি যাহার অন্তরে বিন্দু পরিমাণ ঈমান রহিয়াছে। আবদুল্লাহ (রা) বলেন, এক ব্যক্তি বলিল, আমার তো ইহা ভালো লাগে যে, আমার পোশাক সুন্দর হউক, আমার জুতা সুন্দর হউক (ইহা কি অহঙ্কারের অন্তর্ভুক্ত)! রাসূলুল্লাহ (স) বলিলেন, (না, ইহা তো ভাল কারণ) আল্লাহ্ সৌন্দর্য পছন্দ করেন; বরং অহঙ্কারী সেই ব্যক্তি যে সত্য প্রত্যাখ্যান করে এবং মানুষকে হেয় জ্ঞান করে।”
হযরত নূহ (আ) ছিলেন ধৈর্যের মূর্ত প্রতীক। তাই আপন কওমকে দিবারাত্র সারাক্ষণই দাওয়াত দিয়াছেন। তাঁহার কওম কাপড় মুড়ি দিয়া, কানে অঙ্গুলি প্রবেশ করাইয়া তাঁহার সে দাওয়াতের প্রতি তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করিয়াছে। এতদসত্ত্বেও তিনি ধৈর্যহারা হন নাই। সাড়ে নয় শত বৎসর তিনি এইভাবে সর্বদাই রোদন করিতেন, কখনও বা কওমের করুণ পরিণতির কথা স্মরণ করিয়া, কখনও নিজের অপরাধের কথা স্মরণ করিয়া। তিনি ছিলেন অতিশয় দয়ালু ও স্নেহবৎসল। তাই স্বীয় পুত্র কিনআন কাফির হওয়া সত্ত্বেও তাহার নিশ্চিত মৃত্যু দেখিয়া তাঁহার স্নেহবাৎসল্য উথলিয়া উঠিয়াছে। তাহাকে নৌকায় আরোহণ করিয়া প্রাণ রক্ষার আহ্বান জানাইয়াছেন। কওম তাঁহাকে প্রহারে প্রহারে রক্তাক্ত করিয়া ফেলিয়াছে, বেহুঁশ হইয়া তিনি মাটিতে পড়িয়া গিয়াছেন, কিন্তু হুঁশ ফিরিতেই শরীরের ধূলি ঝাড়িয়া আবার তাহাদের নিকট গমন করিয়াছেন এবং দাওয়াত দিয়াছেন। কারণ তাহাদের মর্মন্তুদ শাস্তির কথা স্মরণ করিয়া তাহার হূদয় বিগলিত হইয়াছে, তিনি স্থির থাকিতে পারেন নাই।
নূহ (আ)-এর বৈশিষ্ট্যাবলী
নবী হিসাবে নূহ (আ) বহু বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন, যাহা অন্য কোনও নবীর মধ্যে ছিল না। তাঁহার বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নরূপঃ (১) তিনিই প্রথম শরীআতের অধিকারী নবী ছিলেন; (২) তিনিই আল্লাহর দিকে প্রথম আহ্বানকারী; (৩) শিরক হইতে প্রথম সতর্ককারী; (৪) প্রথম দাঈ, যাহার উম্মাতকে তাঁহার আনীত হিদায়াত প্রত্যাখ্যানের কারণে শাস্তি দেওয়া হয়; (৫) তাঁহার দুআর ফলে বিশ্বের সকলকে ধ্বংস করা হয়; (৬) তিনি নবী-রাসূলদের মধ্যে সর্বাধিক দীর্ঘ জীবন লাভ করিয়াছিলেন। তাই তাঁহাকে [ ] বলা হয়; (৭) তাহার নিজের মধ্যেই ছিল তাঁহার মুজিযা। কারণ তিনি হাজার বৎসরাধিক বয়স পাইয়াছিলেন, কিন্তু বয়সের ভারে ন্যুজ হইয়া পড়েন নাই। আর তাঁহার শারীরিক শক্তি কিছুমাত্র কম হয় নাই; (৮) দাওয়াতের কাজে তিনি প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালাইয়াছিলেন এবং তিনি দিবা-রাত্রে, প্রকাশ্যে ও গোপনে দাওয়াত দিয়াছেন; (৯) তিনি তাঁহার উম্মতের পক্ষ হইতে দীর্ঘদিন যাবত প্রহার, গালিগালাজ, তিরস্কার, ভর্ৎসনা, ঠাট্টা ও উপহাস প্রভৃতি কষ্ট ও নির্যাতন সহ্য করিয়াছিলেন। এইজন্য আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন :
“আমি ধ্বংস করিয়াছিলাম ইহাদের পূর্বে নূহের সম্প্রদায়কে; উহারা তো ছিল সত্যত্যাগী সম্প্রদায়” (৫১ ও ৪৬);
(১০) আল্লাহ তাআলা তাঁহাকে অঙ্গীকার ও ওহীর ক্ষেত্রে দ্বিতীয় মুসতফা হিসাবে উল্লেখ করিয়াছেন। যেমন ইরশাদ হইয়াছে :
“স্মরণ কর যখন আমি নবীদের নিকট হইতে অঙ্গীকার গ্রহণ করিয়াছিলাম এবং তোমার নিকট হইতেও এবং নূহ, ইবরাহীম, মূসা ও মারয়াম-তনয় ঈসার নিকট হইতেও” (৩৩৭)। অন্যত্র ইরশাদ হইয়াছে :
“আমি তো তোমার নিকট ওহী প্রেরণ করিয়াছি, যেমন নূহ ও তাহার পরবর্তী নবীগণের নিকট ওহী প্রেরণ করিয়াছিলাম” (৪ : ১৬৩)।
(১১) যেদিন কিয়ামত কায়েম হইবে সেইদিন হযরত মুহাম্মাদ (স)-এর পরে তিনি কর হইতে উঠিবেন; (১২) তাহাকে আল্লাহ “কৃতজ্ঞ বান্দা”-রূপে আখ্যায়িত করেন। যা-ইরশাদ হইয়াছে :.1, 3৫ । “সেতো ছিল পরম কৃতজ্ঞ বান্দা” (১৭ : ৩); (১৩) তাহাকে নৌকা প্রদান করা হইয়াছিল এবং উহার নির্মাণ জ্ঞানও শিক্ষা দেওয়া হইয়াছিল; তাঁহাকে উহাতে করিয়া হেফাজত করা হয় এবং পানির উপর দিয়া উহা চালনা করা হয়; (১৪) তাহাকে শান্তি ও কল্যাণ দ্বারা সম্মানিত করা হয়। যথা আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন :
“হে নূহ! অবতরণ কর আমার পক্ষ হইতে শান্তি ও কল্যাণসহ তোমার প্রতি ও যে সমস্ত সম্প্রদায় তোমার সঙ্গে আছে তাহাদের প্রতি” (১১ : ৪৮)। মুহাম্মদ ইব্ন কাব আল-কুরাজী বলেন, কিয়ামত পর্যন্ত সকল মুমিন-মুমিনা এই শান্তি ও কল্যাণের অন্তর্ভুক্ত; (১৫) তাঁহার বংশধরদিগকেই
আল্লাহ তাআলা বংশ-পরম্পরায় পৃথিবীতে বিদ্যমান রাখিয়াছেন। যেমন ইরশাদ হইয়াছে :
“তাহার বংশধরদিগকেই আমি বিদ্যমান রাখিয়াছি বংশপরম্পরায়” (৩৭ : ৭৭)। এইজন্য তাহাকে আদম ছানী বলা হয় এবং বর্তমান মানবগোষ্ঠীর মূল ও আদি। কারণ তাঁহার তিন পুত্র, সাম, হাম ও আফিছ হইতেই বর্তমান মানবগোষ্ঠী বিস্তার লাভ করিয়াছে (আছ-ছালাবী, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৬৩)।
দৈহিক অবয়ব
হযরত নূহ (আ) ছিলেন গৌর বর্ণের, পাতলা চেহারা, লম্বা মস্তক, বড় চোখ, শক্ত ও মোটা বাহু, হাল্কা পায়ের গোছা, ভারী ও অধিক গোশতধারী উরু, মোটা নাভি, লম্বা দাড়ি ও লম্বা চওড়া ভারী শরীরবিশিষ্ট (ইবন কুতায়বা, আল-মাআরিফ, পৃ. ১৩; আল-আসী, রূহুল মাআনী, ২৯., ৬৮)।
ইনতিকালের পূর্বে নূহ (আ)-এর ওসিয়াত
ইমাম আহমাদ (র) সুলায়মান ইবন হারব সূত্রে রাসূলুল্লাহ (স) হইতে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, আল্লাহর নবী নূহ (আ)-এর মৃত্যু নিকটবর্তী হইলে তিনি স্বীয় পুত্র সামকে ডাকিয়া বলিলেন, বৎস! আমি তোমাকে দুই কাজ করিবার জন্য উপদেশ দিতেছি এবং দুই কাজ করিতে নিষেধ করিতেছি। যে দুইটি করিবার জন্য উপদেশ দিতেছি উহার একটি হইল : (১) [ ]-এর যিকির করিবে। কারণ সাত আসমান, সাত যমীন ও উহার মধ্যবর্তী সকল কিছু যদি এক পাল্লায় রাখা হয় আর [ ] অপর পাল্লায়, তবে [ ]-এর পাল্লা ভারী হইবে; যদি সাত আসমান ও সাত যমীন একত্র করা হয় তবুও উহা ভেদ করিয়া আল্লাহর নিকট পৌঁছিয়া যাইবে। অপর এক বর্ণনায় রহিয়াছে যে, সাত আসমান ও সাত যমীন যদি আলাদা আলাদা গোলাকার বৃত্ত হয়, তবে [ ] উহাদিগকে মিলাইয়া দিবে; আর অপরটি হইল (২) [ ]–এর যিকির করিবে। কারণ ইহা সকল সৃষ্টির দোআ (L) এবং ইহার দ্বারাই তাহাদিগকে রিযিক প্রদান করা হয়। আর যে দুইটি বিষয়ে নিষেধ করিতেছি উহা হইল : (১) শিরক ও (২) কিবর অর্থাৎ আল্লাহর সহিত অন্য কাহাকেও শরীক করা এবং অহঙ্কার করা। যাহার অন্তরে বিন্দুমাত্র শিরক বা কিবর আছে সে জান্নাতে প্রবেশ করিবে না (ইবন কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ., ১১৯; ঐ লেখক, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ. ৮৯; আছ-ছালাবী, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ. ৬২)।
নূহ (আ)-এর বয়স
হযরত নূহ (আ) পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা দীর্ঘজীবি রাসূল ও সর্বাপেক্ষা দীর্ঘজীবী মানব ছিলেন। এই ব্যাপারে কাহারও দ্বিমত নাই। তবে তিনি সর্বমোট কত বৎসর জীবিত ছিলেন এই ব্যাপারে বেশ কিছু মতামত পাওয়া যায়? আহলে কিতাব ও কিছু সংখ্যক আলিমের মতে নৌকায় আরোহণের সময় তাহার বয়স ছিল ৬০০ বৎসর, প্লাবনের পর তিনি আরও ৩৫০ বৎসর জীবিত ছিলেন। তাই তাঁহার মোট বয়স হইয়াছিল ৯৫০ বৎসর (Bible, Genesis, 7:6; 9: 28-29; আত-তাবারী, তারীখ, ১খ., ৯৬)।
ইব্ন আব্বাস (রা) হইতেও এই ধরনের একটি মত বর্ণিত আছে (ইব্ন কাছীর, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ. ৯০; আছ-ছালাবী, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ. ১২)। কিন্তু ইহা সঠিক নহে। আওন ইবন আবী শাদ্দাদের এক বর্ণনামতে নূহ (আ) প্লাবনের পর ৯৫০ বৎসর জীবিত ছিলেন এবং প্লাবনের পূর্বে তাহার বয়স ছিল ৩৫০ বৎসর। তদনুসারে নূহ (আ)-এর মোট বয়স ১৩০০ বৎসর (আছ-ছালাবী, প্রাগুক্ত)। এই মতটিও সঠিক নহে। উপরিউক্ত মতদ্বয় সঠিক না হওয়ার কারণ হইল ইহা কুরআন করীমের সুস্পষ্ট আয়াতের পরিপন্থী। কুরআন করীমের বর্ণনায় ইহা জানা যায় যে, নবুওয়াত প্রাপ্তির পর হইতে প্লাবন পর্যন্ত ৯৫০ বৎসর তিনি কওমের মধ্যে অবস্থান করত দাওয়াতী কাজ করেন। ইহার পর প্লাবন শুরু হয়। যেমন ইরশাদ হইয়াছে :
“আমি তো নূহকে তাহার সম্প্রদায়ের নিকট প্রেরণ করিয়াছিলাম। সে উহাদের মধ্যে অবস্থান করিয়াছিল পঞ্চাশ কম হাজার বৎসর। অতঃপর প্লাবন উহাদিগকে গ্রাস করে; কারণ উহারা ছিল সীমালংঘনকারী” (২৯ ও ১৪)। ইবন আব্বাস (রা)-এর অপর এক রিওয়ায়াতমতে নূহ (আ) ৪০ বৎসরে নবুওয়াত প্রাপ্ত হন; ৯৫০ বৎসর তিনি দাওয়াতী কাজ করেন এবং প্রাবনের পর আর ৬০ বৎসর জীবিত ছিলেন। ফলে তাঁহার মোট বয়স ৪০+৯৫০+৬০=১০৫০ বৎসর (আল-আসী; রূহুল-মাআনী, ১২খ., ৩৫)। মুকাতিল বলেন, নূহ (আ) ২৫০ বৎসরে নবুওয়াত প্রাপ্ত হন (মতান্তরে ১০০ ও ৫০ বৎসরে); ৯৫০ বৎসর তিনি দাওয়াতী কাজ করেন এবং প্লাবনের পর জীবিত ছিলেন ২৫০ বৎসর। সুতরাং তাঁহার মোট বয়স ছিল ১৪৫০ বৎসর (প্রাগুক্ত, ১২, ৩৫-৩৬; ৮খ., ১৪৯)। তবে দুই-একটি রিওয়ায়াত ব্যতীত অধিকাংশ বর্ণনামতে প্লাবনের পর তিনি ৩৫০ বৎসর জীবিত ছিলেন। ইতোপূর্বে নবুওয়াত প্রাপ্তির সময় তাঁহার বয়স সম্পর্কিত তিনটি মত উল্লেখ করা হইয়াছে। কুরআন করীমের উপরিউক্ত আয়াত-এর পরিপ্রেক্ষিতে এবং প্লাবিনের পর তিনি ৩৫০ বৎসর জীবিত ছিলেন, ইহা মানিয়া লইলে (যেমন অধিকাংশ মত) বর্ণিত তিনটি মতানুযায়ী তাহার বয়স দাঁড়ায় নিম্নরূপঃ (১) নবুওয়াত প্রাপ্তি ৫০ বৎসর+ দাওয়াতী কাজ ৯৫০+প্লাবনের পর ৩৫০ বৎসর মোট বয়স = ১৩৫০ বৎসর; (২) নবুওয়াত প্রাপ্তি ৩৫০ বৎসর + দাওয়াতী কাজ ৯৫০+ প্লাবনের পর ৩৫০ বৎসর = মোট ১৬৫০ বৎসর। এক বর্ণনামতে ইহা আওন ইবন আবী শাদ্দাদের মত বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে (ইবনুল-আছীর, আল-কামিল, ১খ., ৫৫; আত-তাবারী, তারীখ, ১খ., ৯০)। (৩) নবুওয়াত প্রাপ্তি ৪৮০ বৎসর দাওয়াতী কাজ ৯৫০ বৎসর+প্লাবনের পর ৩৫০ বৎসর; মোট বয়স=১৭৮০ বৎসর। ইহাই ইবন আব্বাস (রা)-এর মত বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে (ইবন কাছীর, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ. ৯০)। ইমাম আবু জাফর তাবারী অবশ্য এই মতটির মধ্যে দাওয়াতী সময়কাল ১২০ বৎসর বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন, যাহার ফলে তাহার বয়স হয় সর্বপ্রথম উল্লিখিত মতটির অনুরূপ (আত-তাবারী, তারীখ, ১খ., ৯০)। পূর্বেই উল্লেখ করা হইয়াছে যে, এই মত সঠিক নহে।
এত দীর্ঘ বয়স পাওয়া সত্ত্বেও মৃত্যু উপস্থিত হইলে হযরত নূহ (আ)-কে যখন জিজ্ঞাসা করা হইল, দুনিয়াকে আপনি কিরূপ পাইয়াছেন? তখন ইহার উত্তরে তিনি বলিলেন, উহা এমন একটি গৃহের ন্যায় যাহার দুইটি দরজা রহিয়াছে। উহার একটি দিয়া আমি প্রবেশ করিলাম এবং অপরটি দিয়া বাহির হইলাম। এই সামান্য সময়মাত্র (ইবনুল আছীর, আল-কামিল, ১খ, ৫৮; আছ-ছালাবী, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৮২)।
নূহ (আ)-এর কবর
হযরত নূহ (আ)-এর কবর কোথায় অবস্থিত এই ব্যাপারে বিভিন্ন মত পাওয়া যায়। এক বর্ণনামতে তাহার কবর কূফার মসজিদে অবস্থিত, অপর এক বর্ণনামতে জাবাল-ই আহমারে। আধুনিক কালের কোন কোন আলিমের মতে নূহ (আ)-এর কবর বর্তমানে লেবাননের একটি পর্বতের পাদদেশে অবস্থিত “কারাক” শহরে, যাহা বর্তমানে কারাক নূহ” নামে পরিচিত। এই কারণে সেখানে একটি মসজিদ নির্মিত হইয়াছে। ইব্ন জারীর ও আল-আযরাকী আবদুর রহমান ইবন ছাবিত প্রমুখ তাবিঈ হইতে মুরসাল হাদীছ বর্ণনা করিয়াছেন যে, নূহ (আ)-এর কবর আল-মাসজিদুল-হারাম-এ অবস্থিত। হাফিজ ইব্ন কাছীর এই মতটিকে অধিকতর সঠিক ও নির্ভরযোগ্য বলিয়া মন্তব্য করিয়াছেন (দ্র. আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ., ১২০; কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ. ৯০)।
পরিবার-পরিজন ও সন্তান-সন্ততি
হযরত নূহ (আ)-এর কয়জন স্ত্রী ছিলেন সে ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোনও বিবরণ পাওয়া না গেলেও আল-কুরআন ও ইতিহাসের বিবরণ পর্যালোচনা করিলে বুঝা যায় যে, প্লাবনের পূর্ব পর্যন্ত তাঁহার দুইজন স্ত্রী ছিলেন। একজন ছিলেন তাঁহার প্রতি ঈমান আনয়নকারিনী যিনি তাঁহার সহিত নৌকায় আরোহণ করিয়া মুক্তি পাইয়াছিলেন (আছ-ছালাবী, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৫৯)। আর অপরজন ছিল কাফির; সে প্লাবনে নিমজ্জিত হইয়াছিল এবং পরিণামে তাহার জন্য জাহান্নামের ফায়সালা হইয়াছে। আল-কুরআনে সুস্পষ্টভাবে এই স্ত্রীর কথাই উক্ত হইয়াছে :
“আল্লাহ কাফিরদের জন্য নূহের স্ত্রী ও দূতের স্ত্রীর দৃষ্টান্ত দিতেছেন, উহারা ছিল আমার বান্দাদের মধ্যে দুই সৎকর্মপরায়ণ বান্দার অধীন। কিন্তু উহারা তাহাদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করিয়াছিল। ফলে নূহ ও লূত উহাদিগকে আল্লাহর শাস্তি হইতে রক্ষা করিতে পারিল না এবং উহাদিগকে বলা হইল, তোমরা উভয়ে প্রবেশকারীদের সহিত জাহান্নামে প্রবেশ কর” (৬৬ : ১০)।
তবে বাইবেলে এই স্ত্রীর উল্লেখ নাই। শুধুমাত্র যে নৌকায় আরোহণ করিয়াছিল তাহার উল্লেখ রহিয়াছে। ইবন আব্বাস (রা) হইতে বর্ণিত যে, প্লাবনের পর নূহ (আ) কাবীলের বংশের এক মহিলাকে বিবাহ করেন। তাহার গর্ভে য়ুনান (৬) নামক এক পুত্র জন্মগ্রহণ করে (ইব্ন সাদ, আত-তাবাকাতুল-কুবরা, ১খ., ৪২)।
হাদীছ ও অন্যান্য বর্ণনায় হযরত নূহ (আ)-এর চারজন পুত্রের কথা জানা যায়। তন্মধ্যে তিন পুত্র, সাম, হাম ও আফিছ মুমিন ছিলেন বলিয়া নূহ (আ)-এর সহিত নৌকায় আরোহণ করিয়া রক্ষা পান। নৌকায় আরোহণের সময় সাম-এর বয়স ছিল ৭৮ বৎসর (আছ-ছালাবী, কাসাস, পৃ. ৬২), মতান্তরে ৯৮ বৎসর (আত-তাবারী, তারীখ, ১খ., ৯৭)। পরবর্তীতে ইহাদের দ্বারাই সমগ্র বিশ্বে নূহ (আ)-এর বংশ বিস্তৃত হয়। বর্তমান কালে বিশ্বে যত লোক আছে সবাই নূহ (আ)-এর উক্ত তিন পুত্রের বংশধর। এই কথাই আল্লাহ্ তাআলা ঘোষণা করিয়াছেন :
“তাহার বংশধরদিগকেই আমি বিদ্যমান রাখিয়াছি বংশ-পরম্পরায়” (৩৭ : ৭৭)।
নূহ (আ)-এর অপর পুর য়াম, যাহাকে আহলে কিতাবগণ কিনআন বলিয়া থাকে এবং সাধারণত এই নামেই সে পরিচিত, কাফির হওয়ার কারণে প্লাবনে নিমজ্জিত হইয়া মারা যায়। আবির নামে তাঁহার আর এক পুত্রের কথা জানা যায় যে প্রাবনের পূর্বেই মারা গিয়াছিল (আত-তাবারী, তারীখ, ১খ., ৯৭; ইব্ন কাছীর, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৮২)। এক বর্ণনামতে তাহার উপরিউক্ত তিন পুত্র (সাম, হাম ও আফিছ) প্লাবনের পর জন্মগ্রহণ করেন। প্লাবনের পূর্বে শুধু কিনআন জন্মগ্রহণ করে। সে প্লাবনে নিমজ্জিত হইয়া প্রাণ হারায়। কিন্তু এই বর্ণনা সঠিক নহে; বরং সঠিক হইল, উক্ত তিন পুত্রও প্রাবনের পূর্বে জন্মগ্রহণ করেন এবং মুমিন হওয়ার কারণে প্লাবনের সময় নৌকায় আরোহণ করে তাহাদের স্ত্রীগণসহ (ইবন কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ., ১১৫-১১৬)। য়ুনান নামে তাঁহার আরও এক পুত্রের কথা জানা যায় যাহার বিবরণ উপরে উল্লিখিত হইয়াছে।
ইমাম আহমাদ (র) আবদুল ওয়াহহাব সূত্রে সামুরা (রা) হইতে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (স) বলেন, সাম হইলেন আরবের পিতা; হাম হইলেন হাবশের পিতা; আর আফিছ হইলেন রূম-এর পিতা (ইব্ন কাছীর, কাসাস, পৃ. ৮১; ঐ লেখক, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ., ১১৫)। ইমাম তিরমিযীও বিশর ইব্ন মুআয় আল-আকাদী সূত্রে সামুরা (রা) হইতে অনুরূপ মার একটি হাদীছ বর্ণনা করিয়াছেন (ইব্ন কাছীর, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৮১)। ইসমাঈল ইবন আয়্যাশ সূত্রে সাঈদ ইবনুল মুসায়্যাব হইতে মুরসাল হাদীছ বর্ণিত যে, নূহ (আ)-এর তিন পুত্র জন্মগ্রহণ করেন : সাম, আফিছ ও হাম। এই তিনজনের প্রত্যেকেরই আবার তিন পুত্র ও সাম-এর পুত্র হইল আরব, ফারিস ও রূম; আছি–এর পুত্র তুর, সাকালিবা ওইয়াজুজ-মাজুজ; আর হাম-এর পুত্র হইল কিবত, সুদান ও বারবার (ইবনুল-আছীর, আল-কামিল, ১খ., ৬১; ইবন কাছীর, কাসাস, পৃ. ৮১; ঐ লেখক, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ১খ., ১১৫; ইবন সাদ, তাবাকাত, ১খ., ৪০-৪১)।
হাফিজ আবূ বা আল-বাযযার তাহার মুসনাদ গ্রন্থে আবু হুরায়রা (রা) হইতে একটি মারফু হাদীছ বর্ণনা করিয়াছেন যে, রাসূলুল্লাহ (স) বলেন : নূহ-এর সন্তানগণ হইলেন সাম, হাম ও রাফিছ। সামের বংশধর হইল আরব, ফারিস ও রূম। কল্যাণ ইহাদের মধ্যেই রহিয়াছে। ফিছের বংশধর হইল, য়াজুজ-মাজুজ, তুর ও সাকালিবা; ইহাদের মধ্যে কল্যাণ নাই। আর হাম-এর বংশধর হইল কিবৃত, বারবার ও সুদান। ইহা রিওয়ায়াত করিয়া তিনি মন্তব্য করিয়াছেন যে, এই একটিমাত্র সূত্রই কেবল মারফুরূপে বর্ণিত হইয়াছে। অন্যরা ইহাকে মুরসালরূপে বর্ণনা করিয়াছেন (ইবন কাছীর, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ.৮১)।
এক বর্ণনামতে নূহ (আ) নিষেধ করিয়াছিলেন যে, নৌকায় থাকাকালে কেহ যেন নিজ স্ত্রীর সহিত সঙ্গত না হয়। কিন্তু হাম উহা অমান্য করত স্ত্রীর সহিত মিলিত হইলে নূহ (আ) বদদুআ করিলেন যে, তাহার এই বীর্যের সৃষ্টি যেন কালো বর্ণের হয় এবং তাহার সন্তানগণ যেন স্বীয় ভ্রাতৃদ্বয়ের সন্তানগণের গুলাম হয়। অতঃপর তাহার কালো বর্ণের এক পুত্র সন্তান হয়, যাহার নাম কিনআন ইবন হাম। তিনি ছিলেন সুদানের দাদা (আছ-ছালাবী, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ.৫৯; ইবন কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১৩, ১১৬; ঐ লেখক, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৮২)।
সন্তানদের মধ্যে ভূমি বন্টন
নৌযান হইতে অবতরণের পর নূহ (আ) পৃথিবীকে তাঁহার সন্তানদের মধ্যে তিন ভাগে ভাগ করেন ও সাম-এর জন্য তিনি পৃথিবীর মধ্য ভাগ বরাদ্দ করেন। উহার অন্তর্ভুক্ত ছিল বায়তুল মাকদিস, নীল, ফুরাত ও দিজলা, সায়ন (সির দরিয়া) জায়ন (আম্মু দরিয়া) ও ফায়শূন। আর উহা ফায়শূন হইতে নীল নদের পূর্ব দুই প্রান্ত পর্যন্ত এবং উত্তরের বায়ু চলাচলের স্থান হইতে দক্ষিণের চলাচলের স্থান পর্যন্ত। আর হামের জন্য বরাদ্দ করা হয় নীল নদের পশ্চিম দুই তীর এবং পশ্চিম–এর বায়ু যতদূর যায় ততদূর পর্যন্ত ও ইহার অপর প্রান্ত হইতে সায়ন পর্যন্ত, পশ্চাতের বায়ু চলাচলের স্থান পর্যন্ত; আর আছি-এর জন্য বরাদ্দ করা হয় কায়ন ও ইহার পরবর্তী স্থান হইতে পূর্বের বায়ু যতদূর যায় ততদূর পর্যন্ত (আত-তাবারী, তারীখ, ১খ., ৯৮; আছ-ছালাবী, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ. ৬৩)। কুরআন কারীমে ইহার প্রতি ইঙ্গিত রহিয়াছে :
“তাহার বংশধরদিগকেই আমি বিদ্যমান রাখিয়াছি বংশ-পরম্পরায়; আমি ইহা পরবর্তীদের স্মরণে রাখিয়াছি। সমগ্র বিশ্বের মধ্যে নূহ-এর প্রতি শান্তি বর্ষিত হউক। এইভাবেই আমি সৎকর্মপরায়ণদিগকে পুরস্কৃত করিয়া থাকি। সে ছিল আমার মুমিন বান্দাদের অন্যতম” (৩৭ : ৭৭-৮১)।
(ক) নূহ (আ)-এর এলাকা
কুরআন কারীমের ইঙ্গিত ও বাইবেলের বর্ণনা হইতে প্রতীয়মান হয় যে, নূহ (আ)-এর কওম বর্তমান ইরাকের বাবিল নগরীতে বসবাস করিত। বাবিল–এর প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনে বাইবেল হইতে এবং প্রাচীন যে শিলালিপি পাওয়া গিয়াছে উহা হইতেও ইহার সত্যতার প্রমাণ পাওয়া যায়। উহাতে কুরআন ও বাইবেলে উল্লিখিত ঘটনার অনুরূপ বর্ণনা রহিয়াছে। ইহার ঘটনার স্থল মাওসিল-এর পার্শ্ববর্তী কোন স্থান বলিয়া বর্ণনা করা হইয়াছে (মাওলানা মাওদূদী-তাফহীমুল কুরআন, ২খ., ৪০-৪১)। আবুল হাসান-এর বর্ণনামতে নূহ (আ)-এর এলাকা ছিল ইরাকের কুফা নগরী। বলা হয় যে, নূহ (আ)-ই সর্বপ্রথম এখানে বসবাস করেন। এক বর্ণনামতে প্লাবনের পর তিনি ও তাঁহার সাথী-সঙ্গীবর্গ খাদ্য-পানীয়ের সন্ধানে এখানে আসিয়া বসতি স্থাপন করেন। এখানেই তাহাদের বংশ বৃদ্ধি হয়। এখানেই তাহারা নগর পত্তন করেন। তাহাদের বসতি ছিল দিজলা ও ফুরাত সংলগ্ন এলাকায় (ইয়াকূত আল-হামারী, মুজামুল-বুলদান, ১খ., ৩০৯)। ইবন সাদ-এর একটি বর্ণনা হইতেও ইহার সমর্থন পাওয়া যায়। তিনি লিখিয়াছেন, নূিহ (আ) প্লাবন শেষে জুদী পর্বতের পাদদেশে অবতরণ করেন এবং সেখানে “লূক ছামানীন” নামে একটি নগরীর পত্তন করেন, অতঃপর লূক ছামানীন-এ যখন স্থান সংকুলান হইতেছিল না তখন তাহারা বাবিল গমন করত বসতি স্থাপন করেন। ইহা ফুরাত ও সুরাত (৩)-এর মধ্যবর্তী স্থান যাহার আয়তন ১৪৪ বর্গ ফারসাখ, সেইখানে তাহার বংশ বৃদ্ধি হয়, এবং সংখ্যায় তাহারা এক লাখে পৌঁছায়, এবং তাহারা সকলেই মুসলিম ছিলেন (ইবন সাদ, তাবাকাত, ১খ., ৪২)।
যে সকল রিওয়ায়াত (জনশ্রুতি) কুরদিস্তান ও আর্মেনিয়ায় প্রাচীন কাল হইতে বংশপরম্পরায় চলিয়া আসিতেছে উহা হইতেও জানা যায় যে, প্লাবনের পর হযরত নূহ (আ)-এর নৌকা উক্ত অঞ্চলের কোনও এক স্থানে স্থির হইয়াছিল। মাওসিল-এর উত্তরে জাযীরা ইবন উমার-এর আশেপাশে আর্মেনিয়া সীমান্তে আরারাত পর্বতের পার্শ্ববর্তী এলাকায় এখনও নূহ (আ)-এর বিভিন্ন নিদর্শন চিহ্নিত করা হয়। নাখচিওয়ান শহরের বাসিন্দাদের মধ্যে এখনও প্রসিদ্ধ আছে যে, উক্ত শহর নূহ (আ) পত্তন করেন (মাওলানা মাওদূদী, তাফহীমুল কুরআন, ২খ, ৪০-৪১)। সুতরাং অনুমিত হয় যে, প্লাবনের পর নূহ (আ) উক্ত অঞ্চলে অবতরণ করেন এবং খাদ্য-পানীয়ের সন্ধানে দিজলা ও ফুরাত মধ্যবর্তী কূফায় গিয়া স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
(খ) জুদী পর্বতের অবস্থান
বাইবেলে উক্ত পবর্তকে “আরারাত” পর্বত বলা হইয়াছে। দিজলা ও ফুরাত নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলই ছিল নূহ (আ)-এর দাওয়াত ও তাবলীগের কেন্দ্রস্থল এবং পৃথক পৃথকভাবে প্রবাহিত হইয়া ইরাকে আসিয়া মিলিত হইয়াছে। অতঃপর ইহা পারস্য উপসাগরে গিয়া পতিত হইয়াছে। আর্মেনিয়ার পর্বতশ্রেণী “আরারাত” অঞ্চলে অবস্থিত। এইজন্য বাইবেলে উহাকে আরারাত পর্বত বলা হইয়াছে। কিন্তু কুরআন কারীমে শুধুমাত্র নৌকা যে স্থানে গিয়া স্থির হইয়াছিল অর্থাৎ জুদী, উহার উল্লেখ করা হইয়াছে। উহা দিজলা নদীর পূর্ব দিকে মাওসি-এর অন্তর্গত দিয়ার বাকর-এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে অবস্থিত (ইয়াকূত আল-হামাবী, মুজামুল বুলদান, ২খ., ১৭৯)। উহা আর্মেনিয়া পর্বতমালার সহিত মিলিত হইয়াছে। কামূসুল মুহীতে বলা হইয়াছে, জুদী জাযীরার একটি পর্বতের নাম যেখানে নূহ (আ)-এর নৌকা স্থির হইয়াছিল। তাওরাতে উহাকে আরারাত বলা হইয়াছে (আবদুল ওয়াহহাব আন-নাজ্জার, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ. ৩৭)। তাওরাতের ভাষ্য কারগণের ধারণা হইল : জুদী সেই পর্বতশ্রেণীর নাম যাহা আরারাত ও জর্জিয়ার পর্বতশ্রেণীকে পরস্পরের সহিত একত্র করিয়া দিয়াছে। তাহারা আরও বলেন, আলেকজাণ্ডার-এর সময়কালে গ্রীক লেখনীও ইহার সমর্থন করে। তদুপরি খৃস্টীয় অষ্টম শতক পর্যন্ত এখানে একটি মসজিদ ছিল যাহাকে মা বাদুস-সাফীনা বলা হইত (হিফজুর রাহমান সিউহারবী, কাসাসুল কুরআন, ১খ., ৮৫)।
গ্রন্থপঞ্জী : (১) আল-কুরআনুল কারীম, বহু, স্থা; (২) আল-বুখারী, আস-সাহীহ, কুতুবখানা-ই রাহীমিয়া, দিল্লী তা. বি., ১খ., ১৭৯, ৪৬৮, ৪৭০, ৪৯৫, ৫১৫; (৩) মুসলিম, আস-সাহীহ, কুতুবখানা, রাহীমিয়া, দিল্লী, তা. বি., ১খ., ১০৮, ২০১; ২খ., ৩৫২; (৪) আত-তিরমিযী, আল-জামি আস-সাহীহ, কুতুবখানা-ই রাশীদিয়া, দিল্লী, তা, বি., ২., ২১, ৬৬; (৫) ইবন মাজা, আস-সুনান, এম বাশীর হাসান এন্ড সন্স, কলিকাতা তা বি., ১খ., ১২৪; ২খ., ৩২৯-৩৩০; (৬) হাফিজ ইব্ন কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, দারুল ফিকর আল-আরাবী, মিসর তা, বি., বি., ১খ., ১০০-১২০; (৭)ঐ লেখক, কাসাসুল আম্বিয়া, আল-মারকাযুল-আরাবী আল-হাদীছ, কায়রো তা. বি., পৃ. ৫৯-৯০; (৮) ঐ লেখক, তাফসীরুল-কুরআনিল-আজীম, মাকতাবা দারুত-তুরাছ, কায়রো তা. বি., ২খ., ৪৪২-৪৪৯; ৪খ., ৪২৪-৪২৮; (৯) ইব্ন জারীর আত-তাবারী, তারীখুল উমাম ওয়াল-মুলুক, দারুল-কালাম, বৈরূত তা. বি., ১খ., ৮৯-৯৮; (১০) ঐ লেখক, জামিউল বায়ান ফী তাফসীরিল কুরআন, দারুল মারিফা, বৈরূত ১৩৯৮/১৯৭৮, ১২খ., ১৭-৩৫; ২৯থ., ৫৭-৬৪; (১১) আছ-ছালাবী, আরাইসুল মাজালিস বা কাসাসুল আম্বিয়া, আল-মাতবা আল-কাসতুল্লিয়্যা : ১২৮২ হি., পৃ. ৫৬-৬৩; (১২) ইবনুল-আছীর, আল-কামিল ফিত-তারীখ, বৈরূত, ১ম সং ১৪০৭/১৯৮৭ সন, ১খ., ৫৪-৬৩; (১৩) য়াকূত আল-হামাবী, মুজামুল-বুলদান, দারুল-কিতাব আল-আরাবী, বৈরূত তা, বি, ১খ., ৩০৯-৩১০;২খ., ১৩৪; (১৪) ইবন কুতায়বা, আল-মাআরিফ, দারুল কুতুব আল- ইলমিয়া, বৈরূত ১ম সং ১৪০৭/১৯৮৭ সন, পৃ. ১৩-১৭; (১৫) আবদুল ওয়াহহাব আন-নাজ্জার, কাসাসুল-আম্বিয়া, দারুল-ফিকর, বৈরূত তা, বি, পৃ. ৩০-৪৮; (১৬) ইবন সাদ, আত-তাবাকাতুল-কুবরা, দার সাদির, বৈরূত তা. বি. ১খ, ৪০-৪৫; (১৭) আল-আলুসী,রূহুল মাআনী, দার ইহয়াইত-তুরাছ আল-আরাবী, বৈরূত তা. বি. ৮খ, ১৪৯; ১২খ., ৩৫-৭৫; ২৯খ, ৬৮-৮১; (১৮) আল-কুরতুবী,আল-জামি লিআহকামিল-কুরআন, দারু ইহয়াইত-তুরাছ আল-আরাবী, বৈরূত তা. বি., ৯খ., ২২-৪৯; ১৮খ,, ২৯৮-৩১৪; (১৯) ফাখরুদ্দীন আর-রাযী, আত-তাফসীরুল-কাবীর, দারু ইহয়াইত-তুরাছ আল-আরাবী, বৈরূত তা. বি., ১৭খ., ২১০-২৩৫; ১৮, ২-৭; ৩০থ., ১৩৪-১৪৭; (২০) আস-সুয়ূতী,আদ-দুররূল মানছুর; তেহরান তা. বি., ৩খ., ৩২৬-৩৩৭; (২১) আশ-শাওকানী, ফাতহুল কাদীর, মিসর ২য় সং ১৩৮৩/১৯৬৪ সন ২খ., ৪৯২-৫০৩; ৫খ., ২৯৬-৩০২; (২২) ইমাম রাগিব আল-ইসফাহানী, আল-মুফরাদাত, দারুল-মারিফা, বৈরূত তা. বি., পৃ. ১০২-১০৩, শিরো ‘জুদ; (২৩) কাযী ছানাউল্লাহ পানিপতী, আত-তাফসীরুল-মাজহারী, মাকতাবা রাশীদিয়া, কোয়েটা, পাকিস্তান, তা, বি., ৫খ., ৮০-৯৩; ১০., ৭১-৭৮; (২৪) হিফজুর-রাহমান সিউহারবী, কাসাসুল কুরআন, মুশতাক বুক কর্ণার, লাহোর তা. বি., ১খ., ৬৩-১০১; (২৫) দাই-ই মাআরিফ-ই ইসলামিয়া, দানিশ গাহ-ই পাঞ্জাব, লাহোর ১ম সং ১৪০৯/১৯৮৯ সন, ২২খ., ৪৭৪-৪৮০, নূহ শিরো; (২৬) ইসলামী ইনসাইক্লোপিডিয়া, সম্পা, সায়্যিদ কাসিম মাহমূদ, শাহকার বুক ফাউন্ডেশন, করাচী, তা. বি., পৃ. ১৪১৬; (২৭) কাযী যয়নুল আবিদীন সাজ্জাদ মীরাঠী, কাসাসুল-কুরআন, মারকাযুল মাআরিফ, হোজাঈ, আসাম, দেওবান্দ শাখা, ১ম সং ১৯৯৪ খৃ., পৃ. ৫৩-৭৪; (২৮) The Holy Bible, Cambridge University Press, Genesis, Chapter 6-11, Page 6-13; (38) Encyclopaedia Britannia (Index). Helen Heminway Benton, Publisher 1973-1974, vol. vii, P. 366-7; (৩০) Encyclopaedia Americana, Canada 1979, Vol. 20, P, 392; (99) Encyclopaedia of Religion and Ethics, New York, vol. ix, P. 379-80, Noachian Precepts; (02) The Encyclopaedia of Religion, New York 1986, vol. 10, P. 460-61; (0) Encyclopaedia of Islam, New edition, Leiden 1995, vol. viii., 108-109, (৩৪) শাহ ওয়ালিয়ুল্লাহ দিহলবী, তারীখুল-আহাদীছ ফী রুমূযি কাসাসিল-আম্বিয়া, দিল্লী তা. বি., পৃ. ১৪-১৬।
আবদুল জলীল