হযরত ইসমাঈল (আ)
জন্ম ও বংশপরিচয়
হযরত ইসমাঈল (আ) আনু, খৃ. পূ. ২০৭৪ সালে (তাফসীরে মাজেদী, ১খ, ২৩১, টীকা ৪৫২) পবিত্র ভূমি জেরুসালেমে জন্মগ্রহণ করেন। হযরত ইসহাক (আ)-এর জন্মের পূর্ব পর্যন্ত তিনি ছিলেন হযরত ইবরাহীম (আ)-এর একমাত্র পুত্র সন্তান। মাতা হাজার (রা) ছিলেন মিসরের কিবতী রাজ-বংশীয় মহিলা এবং তিনি হযরত ইবরাহীম (আ)-এর দ্বিতীয় স্ত্রী (বাইবেলে হাগার; ইবন সাদ ‘আজারও লিখিয়াছেন, ১খ, পৃ. ৪৯ : উপমহাদেশের জনগোষ্ঠীর উচ্চারণ হাজেরা)। হাদীছ শরীফ হইতেও তাঁহার মিসরীয় (কিবতী বংশীয়) হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়।
“কাব ইবন মালিক আল-আনসারী (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলিয়াছেনঃ তোমরা যখন মিসর জয় করিবে তখন তথাকার অধিবাসীদের সহিত উত্তম ব্যবহার করিবে। কারণ তাহাদের জন্য রহিয়াছে একটি নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি ও রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়তার বন্ধন। ইবন ইসহাক বলেন, আমি ইমাম যুহরী (র)-কে জিজ্ঞাসা করিলাম, রাসূলুল্লাহ (সা) যে রক্তের বন্ধনের উল্লেখ করিয়াছেন তাহা কি? তিনি বলেন, ইসমাঈল (আ)-এর মাতা হাজার (রা) ছিলেন মিসরীয়” (আরাইস, পৃ. ৮৫)।
সামান্য শাব্দিক পরিবর্তনসহ হাদীছটি সহীহ মুসলিম ও ইব্ন সাদ-এর আত-তাবাকাতুল কুবরা গ্রন্থেও (১খ, পৃ. ৫০) উদ্ধৃত হইয়াছে। হাজার (রা) সম্পর্কে বিস্তারিত দ্র. “ইবরাহীম (আ) শীর্ষক নিবন্ধ।
হযরত ইবরাহীম (আ)-এর ৮৬ বৎসর বয়সে (বাইবেলের আদিপুস্তক, ১৬ ও ১৬) ইসমাঈল (আ) ছিলেন তাঁহার একমাত্র সন্তান। তিনি বৃদ্ধ বয়সে আল্লাহ তাআলার নিকট দুআ করিলে আল্লাহ তাঁহাকে উক্ত পুত্র দান করেন। কুরআন মজীদে উল্লেখ আছে, হযরত ইবরাহীম (আ) বলিয়াছিলেন; “হে আমার প্রতিপালক! আমাকে এক সকর্মপরায়ণ সন্তান দান করুন” (৩৮ ও ১০০)। জবাবে আল্লাহ তাআলা বলেন : ৯, “অতএব আমি তাহাকে পরম সহিষ্ণু এক পুত্রের সুসংবাদ দিলাম” (৩৮ : ১০১)।
ইসমাঈল (আ)-এর জন্মের চৌদ্দ বৎসর পর অর্থাৎ ১০০ বৎসর বয়সে হযরত ইবরাহীম (আ)-এর ইরাকী স্ত্রী সারার গর্ভে ইসহাক (আ) জন্মগ্রহণ করেন। তিনিও ছিলেন তাঁহার দুআর ফল। দুই স্ত্রীর গর্ভে দুই সন্তান লাভের পর তিনি আল্লাহর নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন :
“সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি আমাকে আমার বার্ধক্যে ইসমাঈল ও ইসহাককে দান করিয়াছেন। আমার প্রতিপালক অবশ্যই প্রার্থনা শুনিয়া থাকেন” (১৪ ও ৩৯)।
বাইবেলেও কুরআনের মত অনুরূপ দুআ ও তাহা কবুলের প্রতিশ্রুতি বিদ্যমান আছে : “ইবরাহীম কহিলেন, হে প্রভু, সদাপ্রভু! তুমি আমাকে কি দিবে? আমি তো নিঃসন্তান অবস্থায় প্রয়াণ করিতেছি…… তাহার কাছে সদাপ্রভুর বাক্য উপস্থিত হইল …… যে তোমার ঔরসে জন্মিবে, সেই তোমার উত্তরাধিকারী হইবে” (আদিপুস্তক, ১৫ : ১-৪)। “আর ইসমাঈলের বিষয়েও তোমার প্রার্থনা শুনিলাম। দেখ আমি তাহাকে আশীর্বাদ করিলাম এবং তাহাকে ফলবান করিয়া তাহার অতিশয় বংশবৃদ্ধি করিব” (ঐ, ১৭ ও ২০)। পরে ইবরাহীম সদাপ্রভুকে কহিলেন, ইসমাঈলই তোমার গোচরে বাঁচিয়া থাকুক” (ঐ, ১৭ ও ১৮)।
অতএব বাইবলে যেমন আল্লাহ তাআলা ইসহাক (আ) হইতে পুত্র ইয়াকূব (আ)-এর মাধ্যমে দ্বাদশ গোত্রীয় মহাজাতি উৎপন্ন করার প্রতিশ্রুতি দিলেন, তদ্রূপ ইসমাঈল (আ- হইতেও দ্বাদশ গোত্রীয় মহাজাতি উৎপন্ন করার প্রতিশ্রুতি দিলেন (আদিপুস্তক, ১৭ ও ২০; ২১ : ১৩)। ইয়াহুদী-খৃস্টান জাতি সব সময় হযরত ইসমাঈল (আ)-এর অবদানকে খাটো করিয়া দেখিয়াছে। তাহারা বাইবেল হইতে এবং তাহাদের অন্যান্য গ্রন্থ হইতে কাবা ঘর নির্মাণের ইতিহাস এবং তাহা মানবজাতির তাওয়াফ ও ইবাদত স্থান এবং কিবলা হওয়ার প্রসঙ্গটি উদ্দেশ্যমূলকভাবে বাদ দিয়াছে। আধুনিক কালে পাশ্চাত্য ভাষায় যেসব বিশ্বকোষ রচিত হইয়াছে, তাহাতে ইবরাহীম (আ), ইসহাক (আ) ও ইয়াকূব (আ) সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা থাকিলেও ইসমাঈল (আ) সম্পর্ক আলোচনা তেমন গুরুত্ব পায় নাই। ইসমাঈল বংশীয় মহানবী (স) ও মুসলিম উম্মাহ্র প্রতি বিদ্বেষের বশবর্তী
হযরত ইসমাঈল (আ)-এর জন্মের পর ইবরাহীম (আ)-এর প্রথমা স্ত্রী সারার মনে সতীন ও সতীন-পুত্রের প্রতি স্বভাবসুলভ ঈর্ষার উদ্রেক হয়। তিনি তাহাদেরকে পরিবার হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া দেওয়ার জন্য ইবরাহীম (আ)-কে অনুরোধ করেন। পারিবারিক শান্তি-শৃংখলা বজায় রাখার স্বার্থে আল্লাহ তাআলার নির্দেশ অনুযায়ী হযরত ইবরাহীম (আ) তাহাদেরকে সঙ্গে লইয়া মক্কার পথে রওয়ানা হন। এই প্রসঙ্গে সহীহ আল-বুখারীতে একটি সুদীর্ঘ হাদীছ বর্ণিত আছে। মূল পাঠসহ তাহা
এখানে উদ্ধৃত হইল :
“আবদুল্লাহ ইব্ন আব্বাস (রা) হইতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নারীরা ইসমাঈল (আ)-এর মাতার নিকট হইতে সর্বপ্রথম কোমরবন্ধের ব্যবহার রপ্ত করে। তিনি তাঁহার (সতীন) সারা (রা) হইতে স্বীয় চিহ্নাদি লুকাইবার জন্য একটি কোমরবন্ধ ধারণ করেন। অতঃপর ইবরাহীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ইসমাঈলের মাতা ও তাহার দুগ্ধপোষ্য শিশুকে (ইসমাঈল) লইয়া আসিলেন। তাহাদেরকে তিনি একটি প্রকাণ্ড বৃক্ষের নিচে, মসজিদের উচ্চ ভূমিতে যমযমের স্থানে রাখিলেন। সে সময় মক্কায় কোন জনবসতি কিংবা পানির ব্যবস্থা ছিল না। তিনি তাহাদেরকে সেখানে রাখিলেন। আর তাহাদের পাশে এক ঝুড়ি খেজুর ও এক মশক (চামড়ার তৈরি পানির পাত্র) পানি রাখিলেন। অতঃপর ইবরাহীম (আ) তথা হইতে রওয়ানা হইলেন। ইসমাঈলের মাতা তাঁহার পিছনে পিছনে যাইতেছিলেন এবং বলিতেছিলেন, হে ইবরাহীম! আপনি আমাদেরকে এই জনপ্ৰাণীহীন উপত্যকায় রাখিয়া কোথায় যাইতেছেন? এখানে তো বন্ধু-বান্ধব ও পরিচিত পরিবেশ কিছুই নাই। তিনি তাঁহাকে এই কথা বারবার বলিতে থাকিলেন। কিন্তু ইবরাহীম (আ) তাহার কথায় ভ্রূক্ষেপ করিলেন না। তিনি পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন, আল্লাহ কি আপনাকে ইহার নির্দেশ দিয়াছেন? ইবরাহীম (আ) বলিলেন : হাঁ। তখন ইসমাঈলের মাতা বলিলেন, তবে আল্লাহ আমাদেরকে ধ্বংস করিবেন না। অতঃপর তিনি স্বস্থানে ফিরিয়া আসিলেন। ইবরাহীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বিদায় হইলেন। তিনি তাহাদের দৃষ্টিসীমার বাহিরে ‘সানিয়াহু নামক স্থানে পৌঁছিয়া কাবা ঘরের দিকে মুখ ফিরাইলেন এবং দুই হাত তুলিয়া দুআ করিলেনঃ “হে আমাদের প্রতিপালক! আমি পানি ও তরুলতাশূন্য উষর এক প্রান্তরে আমার সন্তানদের একটি অংশ তোমার মহাসম্মানিত ঘরের কাছে আনিয়া বসবাসের জন্য রাখিয়া গেলাম। …. অতএব তুমি লোকদের অন্তরকে তাহাদের প্রতি অনুরক্ত করিয়া দাও, ফলমূল হইতে তাহাদেরকে খাবার দান কর, যেন তাহারা কৃতজ্ঞ ও শোকরকারী বান্দাহ হইতে পারে” (১৪ : ৩৭)।
ইসমাঈলের মাতা ইসমাঈলকে বুকের দুধ পান করাইয়া লালন-পালন করিতে লাগিলেন। তিনি নিজে মশকের পানি পান করিতে থাকিলেন। পরিশেষে পাত্রের পানি শেষ হইয়া গেল, তিনি নিজে এবং তাঁহার সন্তান পিপাসাকাতর হইয়া পড়িলেন। তিনি দেখিলেন যে, তাঁহার দুগ্ধপোষ্য শিশু পিপাসায় ছটফট করিতেছে। তিনি তাহা সহ্য করিতে না পারিয়া উঠিয়া চলিয়া গেলেন। সেখানে সাফা পাহাড়কে তিনি তাঁহার সর্বাধিক নিকটে দেখিতে পাইলেন। তিনি সাফা পাহাড়ে উঠিয়া চারিদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করিলেন। উপত্যকার দিকে এই আশায় তাকাইলেন যে, কাহারো দেখা পাওয়া যায় কি না, কিন্তু কাহারো দেখা পাইলেন না। অতএব তিনি সাফা পাহাড় হইতে নামিয়া আসিলেন এবং উপত্যকা পার হইয়া মারওয়া পাহাড়ের পাদদেশে পৌঁছিয়া তাহাতে আরোহণ করিলেন। পাহাড়ের উপর দাঁড়াইয়া তিনি এদিক-সেদিক তাকাইয়া দেখিলেন কাহাকেও দেখা যায় কি না, কিন্তু কোন লোকজন দেখিতে পাইলেন না। এমনিভাবে তিনি দুই পাহাড়ের মাঝখানে সাতবার দৌড়াইলেন। আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা) বর্ণনা করিয়াছেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলিয়াছেন : এই কারণেই লোকেরা (হজ্জের সময়) উভয় পাহাড়ের মধ্যে দৌড়াইয়া (সাঈ করিয়া) থাকে। ইসমাঈলের মা (শেষবারের মত) দৌড়াইয়া মারওয়া পাহড়ে উঠিলে একটি শব্দ শুনিতে পাইলেন। তিনি নিজেকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, কি ব্যাপার! আওয়াজ শুনিতে পাইলাম যেন। অতঃপর তিনি শব্দের প্রতি কান খাড়া করিলেন। তিনি আবার শব্দ শুনিতে পাইলেন এবং মনে মনে বলিলেন, তুমি আমাকে আওয়াজ শুনাইলে, হয়তো তোমার কাছে আমার বিপদের কোন প্রতিকার আছে। হঠাৎ তিনি (বর্তমান) যমযমের কাছে একজন ফেরেশতাকে দেখিতে পাইলেন। তিনি তাহার পায়ের গোড়ালি দিয়া মাটি খুঁড়িতেছিলেন এবং এইভাবে পানি ফুটিয়া বাহির হইল। তিনি ইহার চারিপাশে বাঁধ দিলেন এবং অঞ্জলি ভরিয়া মশকে পানি ভরিতে লাগিলেন। তিনি মশকে পানি ভরিতে ছিলেন, এদিকে পানি উথলিয়া পড়িতে থাকিল। অন্য বর্ণনায় আছে, তিনি মশক ভরিয়া পানি রাখিলেন। ইবন আব্বাস (রা) বর্ণনা করিয়াছেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলিয়াছেন । ইসমাঈলের মায়ের উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হউক। যদি তিনি যমযমকে ঐ অবস্থায় রাখিয়া দিতেন, অথবা বলিয়াছেন : তাহা হইতে যদি মশক ভরিয়া তিনি পানি না রাখিতেন, তবে যমযম একটি প্রবহমান ঝর্ণায় পরিণত হইত। নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলিয়াছেন । তিনি পানি পান করিলেন এবং তাঁহার সন্তানকে দুধ পান করাইলেন। ফেরেশতা তাঁহাকে বলিলেন, আপনি ধ্বংস হইয়া যাওয়ার ভয় করিবেন না। কেননা এখানে আল্লাহর ঘরের স্থান নির্দিষ্ট আছে, যাহা এই ছেলে ও তাহার পিতা নির্মাণ করিবেন। আল্লাহ এখানকার বাসিন্দাদেরকে ধ্বংস করেন না। ঘটনাক্রমে বনী জ্বরহুমের কাফেলা অথবা বনী জ্বরহুম গোত্রের লোক এই পথ ধরিয়া কাদাআ নামক স্থান দিয়া আসিতেছিল। তাহারা মক্কার নিম্নভূমিতে পৌঁছিলে সেখানে কিছু পাখি বৃত্তাকারে উড়িতে দেখিয়া বলিল, এসব পাখি নিশ্চয়ই পানির উপর চক্কর খাইতেছে । আমরা তো এই মরুভূমিতে আসিয়াছি অনেক দিন হইল, কিন্তু কোথাও পানি দেখি নাই। তাহারা একজন অথবা দুইজন অনুসন্ধানকারীকে খোঁজ নেওয়ার জন্য পাঠাইল । তাহারা গিয়া! পানি দেখিতে পাইল এবং ফিরিয়া গিয়া তাহাদেরকে জানাইল। কাফেলার লোকেরা অনতিবিলম্বে পানির দিকে চলিয়া আসিল। ইসমাঈলের মাতা তখন পানির কাছে বসা ছিলেন। তাহারা আসিয়া তাহাকে বলিল, আপনি কি আমাদেরকে এখানে আসিয়া অবস্থান করার অনুমতি দিবেন? তিনি বলিলেন, হ্যাঁ, কিন্তু পানির উপর তোমাদের কোন মালিকানা স্বত্ব প্রতিষ্ঠিত হইবে না। তাহারা বলিল, হাঁ, তাহাই হইবে। আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা) বর্ণনা করিয়াছেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলিয়াছেন : ইসমাঈলের মায়ের উদ্দেশ্য ছিল তাহাদের সহিত পরিচিত হইয়া একটা অন্তরংগ ও সহানুভূতিসম্পন্ন পরিবেশ গড়িয়া তোলা। ঐ সকল লোক অসিয়া এখানে বসতি স্থাপন করিল এবং কাফেলার অন্যান্য লোকও তাহাদের পরিবার-পরিজনদেরকে ডাকিয়া আনিল। অবশেষে সেখানে বেশ কয়েক ঘর বসতি গড়িয়া উঠিল। ইসমাঈল যৌবনে পদার্পণ করিলেন এবং তাহাদের নিকট হইতে আরবী ভাষা শিখিলেন । তাঁহার স্বাস্থ্য-চেহারা ও সুরুচিপূর্ণ জীবন তাহারা খুবই পছন্দ করিল। তিনি বড় হইলে ঐ লোকেরা তাহাদের এক কন্যার সহিত তাহার বিবাহ দিল।
ইতিমধ্যে ইসমাঈলের মা ইন্তিকাল করিলেন। ইসমাঈলের বিবাহের পর ইবরাহীম (আ) মক্কায় আসিলেন নিজের রাখিয়া যাওয়া পরিজনের খোঁজে। তিনি ইসমাঈলকে বাড়িতে পাইলেন না। তিনি পুত্রবধূর কাছে জিজ্ঞাসা করিলেন, ইসমাঈল কোথায় গিয়াছে? সে বলিল, খাদ্যের সংস্থান করার জন্য তিনি বাহিরে গিয়াছেন। অন্য বর্ণনায় আছে : তিনি শিকারে বাহির হইয়াছেন। ইবরাহীম (আ) তাহাদের জীবনযাত্রা ও সাংসারিক বিষয়াদির খোঁজ নিলেন। পুত্রবধূ বলিল, আমরা খুব খারাপ অবস্থায় আছি। কঠোরতা ও সংকীর্ণতা আমাদেরকে গ্রাস করিয়াছে। এসব কথা বলিয়া সে অভিযোগ করিল। তিনি বলিলেন, তোমার স্বামী আসিলে তাহাকে আমার সালাম জানাইয়া বলিবে, সে যেন তাহার ঘরের দরজার চৌকাঠ পরিবর্তন করে।
বাড়ী ফিরিয়া ইসমাঈল (আ) যেন কিছু অনুভব করিতে পারিলেন। তিনি স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, কেহ আসিয়াছিলেন নাকি? স্ত্রী বলিল, হাঁ, এরূপ একজন বৃদ্ধ লোক আসিয়াছিলেন। তিনি আপনার সম্পর্কে আমাকে জিজ্ঞাসা করিলে আমি তাহাকে অবহিত করিলাম। আমাদের সংসারযাত্রা কিভাবে চলিতেছে তিনি তাহাও জিজ্ঞাসা করিলেন। আমি তাহাকে জানাইলাম যে, আমরা খুব কষ্ট-ক্লেশের মধ্যে দিনাতিপাত করিতেছি। ইসমাঈল (আ) জিজ্ঞাসা করিলেন, তিনি কি তোমাকে কোন কথা বলিয়া গিয়াছেন? স্ত্রী বলিল, হাঁ! তিনি আমাকে আপনাকে সালাম পৌঁছাইতে বলিয়াছেন এবং আপনাকে আপনার ঘরের চৌকাঠ পরিবর্তন করিতে বলিয়াছেন। ইসমাঈল (আ) বলিলেন, তিনি আমার পিতা। তিনি তোমাকে পরিত্যাগ করিতে আদেশ দিয়াছেন। সুতরাং তুমি তোমার পরিবার-পরিজনের কাছে চলিয়া যাও। পরে তিনি তাহাকে তালাক দিলেন এবং ঐ গোত্রেরই অন্য এক মেয়েকে বিবাহ করিলেন।
আল্লাহর ইচ্ছামত ইবরাহীম (আ) বেশ কিছু দিন আর এদিকে আসেন নাই। পরে তিনি যখন আবার আসিলেন তখনও ইসমাঈলের সাথে তাঁহার দেখা হইল না। পুত্রবধূর কাছে গিয়া। ইসমাঈলের কথা জিজ্ঞাসা করিলে সে বলিল, তিনি আমাদের খাদ্যের সন্ধানে গিয়াছেন। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, তোমরা কেমন আছ? তিনি তাহাদের সাংসারিক জীবন ও অন্যান্য বিষয়েও জানিতে চাহিলেন। ইসমাঈলের স্ত্রী বলিল, আমরা খুব ভাল এবং স্বচ্ছল অবস্থায় দিন যাপন করিতেছি। এই কথা বলিয়া সে মহান আল্লাহর প্রশংসা করিল। ইবরাহীম (আ) জিজ্ঞাসা করিলেন, তোমরা কি খাও? পুত্রবধূ বলিল, গোশত। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, কি পান কর? সে বলিল, পানি । তখন ইবরাহীম (আ) দুআ করিলেন : হে আল্লাহ! ইহাদের গোশত ও পানিতে বরকত দান করুন। নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলিয়াছেন । সেই সময় তাহাদের কাছে কোন খাদ্যশস্য ছিল না, যদি থাকিত তাহা হইলে ইবরাহীম (আ) তাহাদের খাদ্যশস্যেও বরকতের দুআ করিতেন। এইজনই মক্কা ছাড়া অন্য কোথায়ও শুধু গোশত ও পানির উপর নির্ভর করিলে তাহা স্বাস্থ্যের জন্য অনুকূল হয় না। ইবরাহীম (আ) বলিলেন, তোমার স্বামী ফিরিয়া আসিলে তাহাকে আমার সালাম জানাইয়া বলিবে, সে যেন তাহার ঘরের চৌকাঠ হিফাজত করিয়া রাখে।
ইসমাঈল (আ) ফিরিয়া আসিয়া স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, তোমার কাছে কেহ কি আসিয়াছিল? স্ত্রী বলিল, হাঁ! আমার কাছে একজন সুন্দর সুঠাম বৃদ্ধ লোক আসিয়াছিলেন। স্ত্রী বৃদ্ধের কিছু প্রশংসাও করিল। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, কিভাবে আমাদের জীবিকা ও ভরণপোষণ চলিতেছে? আমি বলিলাম, আমরা বেশ ভাল আছি। ইসমাঈল (আ) জিজ্ঞাসা করিলেন, তিনি কি তোমাকে কোন উপদেশ দিয়াছেন? স্ত্রী বলিল, হাঁ! তিনি আপনাকে সালাম জানাইয়াছেন এবং ঘরের চৌকাঠ হিফাজত করার হুকুম দিয়া গিয়াছেন। সব কথা শুনিয়া ইসমাঈল (আ) বলিলেন, তিনি আমার পিতা এবং তুমি ঘরের চৌকাঠ। তিনি আমাকে তোমার সহিত বৈবাহিক সম্পর্ক সুদৃঢ় রাখার নির্দেশ দিয়া গিয়াছেন।
ইবরাহীম (আ) আল্লাহর ইচ্ছায় বেশ কিছু দিন পর্যন্ত আর এখানে আসেন নাই। একদিন ইসমাঈল (আ) যমযম কূপের পাশে একটি প্রকাণ্ড বৃক্ষের নিচে বসিয়া তাহার তীর ঠিক করিতেছিলেন। এমন সময় ইবরাহীম (আ) আসিলেন। ইসমাঈল (আ) পিতাকে দেখিয়া উঠিয়া আগাইয়া গেলেন। অতঃপর যেভাবে পিতা পুত্রের সঙ্গে এবং পুত্র পিতার সঙ্গে সৌজন্য বিনিময় করিয়া থাকে, তাঁহারাও তাহাই করিলেন। তিনি বলিলেন, হে ইসমাঈল! আল্লাহ্ আমাকে একটি কাজের নির্দেশ দিয়াছেন। ইসমাঈল (আ) বলিলেন, আপনার প্রভু আপনাকে যে কাজের নির্দেশ দিয়াছেন তাহা আঞ্জাম দিন। তিনি বলিলেন, তুমি এই কাজে আমাকে সাহায্য কর। পুত্র বলিলেন, আমি আপনাকে অবশ্যই সাহায্য করিব। ইবরাহীম (আ) বলিলেন, আল্লাহ আমাকে এখানে একখানা ঘর নির্মাণ করার নির্দেশ দিয়াছেন। এই কথা বলিয়া তিনি একটি উঁচু টিলার দিকে ইশারা করিয়া বলিলেন, ইহার চারিদিকে ঘর নির্মাণ করিতে হইবে। অতঃপর তাঁহারা এই ঘরের ভিত্তি স্থাপন করিলেন। ইসমাঈল (আ) পাথর বহিয়া আনিতেন, আর ইবরাহীম (আ) তাহা দ্বারা ভিত গাঁথিতেন। চতুর্দিকের দেয়াল অনেকটা উঁচু হইয়া গেলে ইবরাহীম (আ) এই পাথরটি আনিয়া (মাকামে ইবরাহীম) উহার উপর দাঁড়াইয়া ভিত গাঁথিতে থাকিলেন এবং ইসমাঈল (আ) পাথর আনিয়া যোগান দিতে থাকিলেন। পিতা-পুত্র উভয়ে ঘর নির্মাণকালে প্রার্থনা করিতে থাকিলেন : “হে আমাদের প্রভু! আমাদের এই প্রচেষ্টা ও পরিশ্রম কবুল করুন। আপনি সব কিছু শুনেন এবং জানেন” (২ : ১২৭)। রাবী বলেন, তাঁহারা নির্মাণ কাজ করিতে থাকিলেন। তাঁহারা উভয়ে কাবা ঘরের চারিদিকে প্রদক্ষিণ করিতেছিলেন এবং বলিতেছিলেনঃ “হে আমাদের প্রভু! আমাদের এই প্রচেষ্টা ও পরিশ্রম কবুল করুন; নিশ্চয় আপনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞাতা” (বুখারী, কিতাবুল আম্বিয়া, ১খ, পৃ. ৪৭৪-৬)। বুখারীর অপর বর্ণনায়ও প্রায় অনুরূপ বর্ণিত হইয়াছে। হযরত ইব্ন আব্বাস (রা) বলেন :
“ যখন ইবরাহীম (আ) ও তাঁহার পরিবারের (স্ত্রী সারার) মধ্যে যাহা ঘটিবার তাহা (পারিবারিক কলহ) ঘটিয়া গেল, তখন ইবরাহীম (আ) ইসমাঈল ও তাহার মাকে সঙ্গে লইয়া বাহির হইয়া পড়িলেন। তাহাদের সঙ্গে একটি পানির মশক ছিল। ইসমাঈলের মা মশকের পানি পান করিতেন এবং সন্তানকে দুধ পান করাইতেন। এভাবে তাঁহারা মক্কায় পৌঁছিলেন। ইবরাহীম (আ) স্ত্রীকে একটা প্রকাণ্ড গাছের নিচে রাখিয়া পরিবার-পরিজনদের কাছে রওয়ানা হইলেন। ইসমাঈলের মাতা তাঁহার পিছনে পিছনে যাইতে থাকিলেন। অবশেষে কাদাআ নামক স্থানে পৌঁছিয়া তিনি পিছন হইতে স্বামীকে ডাকিয়া বলিলেন, হে ইবরাহীম! আপনি আমাদেরকে কাহার নিকট রাখিয়া যাইতেছেন? তিনি বলিলেন, আল্লাহর নিকট রাখিয়া যাইতেছি। ইসমাঈলের মাতা বলিলেন, আমি আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। এই কথা বলিয়া তিনি ফিরিয়া আসিলেন। তিনি মশকের পানি পান করিতে এবং বাচ্চাকে দুধ পান করাইতে থাকিলেন। এক সময় পানি ফুরাইয়া গেল। তিনি বলিলেন, আমাকে কোথাও যাইয়া খোঁজ করা উচিৎ কোন লোক দেখা যায় কি না। নবী (সা) বলিয়াছেন : এই বলিয়া তিনি রওয়ানা হইলেন এবং সাফা পাহাড়ে গিয়া উঠিলেন। তিনি বারবার এদিক-ওদিক তাকাইলেন, কোন লোক দেখা যায় কি না, কিন্তু দেখা মিলিল না। তিনি ঐ পাহাড় হইতে নামিয়া মারওয়া পাহাড়ের দিকে রওয়ানা হইলেন। উপত্যকার মাঝখানে পৌঁছিয়া তিনি দৌড়াইলেন এবং মারওয়া পাহাড়ে আসিয়া পৌঁছিলেন। এইভাবে তিনি দুই পাহাড়ের মাঝে কয়েকবার চক্কর দিলেন। অতঃপর ভাবিলেন, গিয়া দেখিয়া আসা দরকার আমার শিশু পুত্রের কি অবস্থা! তাই তিনি চলিয়া গেলেন এবং দেখিতে পাইলেন বাচ্চা যেন মৃত্যুর জন্য তড়পাইতেছে। এই দৃশ্য তিনি সহ্য করিতে পারিলেন না। তিনি ভাবিলেন, আবার গিয়া খোঁজ করা দরকার কাহাকেও পাওয়া যায় কি না। তাই তিনি সাফা পাহাড়ে গিয়া উঠিলেন এবং বারবার এদিকে ওদিক তাকাইলেন, কিন্তু কাহারো দেখা পাইলেন না। এইভাবে সাতবার পূর্ণ হইলে তিনি ভাবিলেন, গিয়া দেখা দরকার বাচ্চটি কি করিতেছে।
ইতিমধ্যে তিনি একটা শব্দ শুনিতে পাইয়া বলিয়া উঠিলেন, যদি কোন উপকার করিতে পার তাহা হইলে সাহায্যের জন্য আগাইয়া আস। দেখা গেল হযরত জিবরাঈল (আ) সেখানে উপস্থিত। তিনি তাঁহার পায়ের গোড়ালি দিয়া মাটির উপরে আঘাত করার ইংগিত করিয়া আঘাত করিলেন। ইহাতে সহসা পানি ফুটিয়া বাহির হইলে ইসমাঈলের মাতা হতভম্ব হইয়া গেলেন এবং গর্ত খুঁড়িতে লাগিলেন। আবুল কাসেম (সা) বলেন ৪ হাজার (রা) যদি ইহাকে স্ব-অবস্থায় ত্যাগ করিতেন তাহা হইলে পানি ছড়াইয়া পড়িত। ইব্ন আব্বাস (রা) বলেন, অতঃপর হাজার (রা) পানি পান করিতে থাকেন এবং তাঁহার শিশু সন্তানকে নিজের বুকের দুধ পান করাইতে থাকেন।
জ্বরহুম কবীলার একদল লোক উপত্যকা অতিক্রম করিতে করিতে এক ঝাঁক পাখি দেখিতে পাইল এবং ইহা তাহাদের নিকট অবিশ্বাস্য মনে হইল। তাহারা বলিল, পাখি তো পানির নিকটেই থাকে। তাহারা তাহাদের একজন লোক পাঠাইল এবং সে তথায় পৌঁছিয়া পানি দেখিতে পাইল। সে ফিরিয়া আসিয়া তাহাদেরকে বিষয়টি অবহিত করিল। অতঃপর তাহারা হাজার (রা)-এর নিকট উপস্থিত হইয়া তাঁহাকে বলিল, হে ইসমাঈলের মা! আপনি কি আমাদেরকে আপনার এখানে বসবাস করার অনুমতি দিবেন? অতঃপর হাজার (রা)-এর পুত্র বয়ঃপ্রাপ্ত ইহলে জ্বরহুম গোত্রের এক মেয়েকে বিবাহ করিলেন।
ইবন আব্বাস (রা) বলেন, হযরত ইবরাহীম (আ)-এর নির্বাসিত পরিজনের কথা তাঁহার স্মৃতিপটে উদয় হইলে তিনি তাঁহার স্ত্রী (সা)কে বলিলেন, আমি আমার নির্বাসিত পরিজন সম্পর্কে ওয়াকিফহাল হইতে চাই । অতঃপর তিনি (মক্কায়) পৌঁছিয়া পুত্রবধূকে সালাম দিলেন এবং জিজ্ঞাসা করিলেন, ইসমাঈল কোথায়? ইসমাঈলের স্ত্রী বলিল, তিনি শিকারে গিয়াছেন। ইবরাহীম (আ) বলিলেন, সে ফিরিয়া আসিলে তাহাকে বলিবে, “তোমার গৃহের চৌকাঠ পরিবর্তন কর”। তিনি ফিরিয়া আসিলে স্ত্রী তাহাকে বিষয়টি অবহিত করিল। তিনি বলিলেন, তুমিই সেই চৌকাঠ, তুমি তোমার বংশে ফিরিয়া যাও।
ইব্ন আব্বাস (রা) বলেন, পুনরায় নির্বাসিত পরিজনের কথা ইবরাহীম (আ)-এর মনে পড়িলে তিনি তাঁহার স্ত্রীকে বলিলেন, আমি আমার নির্বাসিত পরিজনের খবর জানিতে ইচ্ছুক। অতঃপর (মক্কায়) পৌঁছিয়া (পুত্রবধূকে) জিজ্জাসা করিলেন, ইসমাঈল কোথায়? তাঁহার স্ত্রী বলিল, তিনি শিকারে গিয়াছেন। আপনি কি (কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিবেন না, কিছু পানাহার করিবেন না? ইবরাহীম (আ) জিজ্ঞাসা করিলেন, তোমাদের খাদ্য ও পানীয় কি? পুত্রবধূ জবাব দিল, গোশত আমাদের খাদ্য এবং পানি আমাদের পানীয়। তিনি বলিলেন, হে আল্লাহ! ইহাদের খাদ্যে ও পানীয়ে বরকত দান করুন।” আবুল কাসেম (সা) বলেন : ইবরাহীম (আ)-এর দোআর ফলেই (এখানকার খাদ্য ও পানীয়) বরকত হইতেছে।
ইবন আব্বাস (রা) বলেন, নির্বাসিত পরিজনের কথা পুনরায় মনে পড়িলে হযরত ইবরাহীম (আ) তাঁহার স্ত্রীকে বলিলেন, আমি আমার নির্বাসিত পরিজনের খবর লইতে ইচ্ছুক। এবার তিনি (মক্কায়) পৌঁছিয়া ইসমাঈল (আ)-এর সাক্ষাত পাইলেন। তখন তিনি যমযম কূপের পিছনে বসিয়া তাঁহার তীর-ধনুক মেরামত করিতেছিলেন। তিনি বলিলেন, হে ইসমাঈল! তোমার প্রতিপালক আমাকে আদেশ করিয়াছেন যে, আমি যেন তাঁহার জন্য একখানা গৃহ নির্মাণ করি। ইসমাঈল (আ) বলিলেন, আপনার প্রতিপালকের নির্দেশ পালন করুন। ইবরাহীম (আ) বলিলেন, তিনি এই ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করার জন্য তোমাকেও আদেশ করিয়াছেন। ইসমাঈল (আ) বলিলেন, তথাস্ত, আমি সহযোগিতা করিব। অতঃপর তাঁহারা উদ্যোগী হইলেন এবং ইবরাহীম (আ) গৃহ নির্মাণ করিতে লাগিলেন, আর ইসমাঈল (আ) তাঁহাকে পাথর আনিয়া দিতে থাকিলেন এবং উভয়ে বলিতে থাকিলেন : “হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের এই কাজ গ্রহণ কর। নিশ্চয় তুমি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞাতা” (২: ১২৭)। রাবী বলেন, ইতিমধ্যে দেওয়ালের ভিত উঁচু হইয়া গেলে ইবরাহীম (আ) পাথর উপরে উত্তোলন করিতে অক্ষম হইয়া পড়িলেন, তাই তিনি মাকামে ইবরাহীমের পাথরের উপর দাঁড়াইয়া দেয়াল গাথিতে লাগিলেন এবং পিতা-পুত্র বলিতে থাকিলেন : “হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের এই কাজ কবুল কর। নিশ্চয় তুমি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞাতা” (বুখারী, কিতাবুল আম্বিয়া, ১খ, পৃ. ৪৭৬-৪৭৭)।
আল্লামা ইব্ন কাছীর তাঁহার তাফসীর গ্রন্থে হাদীছখানি বেশ কয়েকটি সনদে বর্ণনা করিয়াছেন। বিস্তারিত আকারে। তাহাতে তথ্যের কিছুটা হাস-বৃদ্ধি আছে। ইব্ন কাছীর বলেন যে, ইব্ন আব্বাস (রা)-এর বর্ণনায় ইসরাঈলী কথাও প্রক্ষিপ্ত হইয়াছে (বিদায়া, ১খ, পৃ. ১৫৬)।
হযরত আলী (রা)-র হাদীছের বক্তব্যের সূচনা হইয়াছে এভাবে : “আল্লাহ তাআলা হযরত ইবরাহীম (আ)-কে কাবা ঘর নির্মাণের আদেশ প্রদান করিলে তিনি হাজার ও ইসমাঈল (আ)-কে সঙ্গে লইয়া মক্কায় আগমন করিলেন। কাবার নির্মাণকার্য সমাপ্ত হইলে তিনি দেশে ফিরিয়া যাইতে উদ্যত হইলেন। স্ত্রী হাজার (রা) তাঁহাকে বলিলেন, হে ইবরাহীম! আমাদেরকে কাহার আশ্রয়ে রাখিয়া যাইতেছেন? তিনি বলিলেন : তোমাদেরকে আল্লাহর আশ্রয়ে রাখিয়া যাইতেছি। হাজার (রা) বলিলেন, তাহা হইলে আপনি চলিয়া যান, আল্লাহ আমাদেরকে ধ্বংস করিবেন না….” (তাফসীরে ইব্ন কাছীর, বাংলা অনু., ১খ, পৃ. ৫৫২)। সম্ভবত আলী (রা)-র বর্ণনাটিতে ইবরাহীম (আ)-এর প্রথম বারের আগমনেই কাবা ঘর নির্মাণের যে কথা বলা হইয়াছে তাহা ছিল শুধু কাবার চারদিকের ঘেরাও নির্মাণ এবং অতঃপর ছিল পিতা-পুত্র কর্তৃক উহার পূর্ণাঙ্গ নির্মাণ (তাফসীর ইব্ন কাছীর, ১খ, পৃ. ৫৫৩)। তাফসীরকার ও ঐতিহাসিকগণ উক্ত হাদীছদ্বয়কে তাহাদের তথ্যের উৎস হিসাবে গ্রহণ করিয়াছেন।
ইব্ন আব্বাস (রা) ও আলী (রা)-র বর্ণনার সহিত বাইবেলের বর্ণনার অসামঞ্জস্য লক্ষ্য করা যায়। উভয় সাহাবীর বর্ণনায় যেখানে বলা হইয়াছে, হযরত ইবরাহীম (আ) নিজেই তাঁহার স্ত্রী-পুত্রকে সঙ্গে লইয়া মক্কায় আসেন, সেখানে বাইবেলে বলা হইয়াছে :পরে ইবরাহীম প্রত্যুষে উঠিয়া রুটি ও পানিপূর্ণ কূপা লইয়া হাজারের স্কন্ধে দিয়া বালকটিকে সমর্পণ করিয়া তাহাকে বিদায় করিলেন (আদিপুস্তক, ২১ : ১৪)। যেখানে নবী-রাসূলগণ মানবজাতির প্রতি সর্বাধিক সদয়, সহমর্মী, সহযোগী ও সাহায্যকারী হইয়া থাকেন, সেখানে হযরত ইবরাহীম (আ)-এর মত একজন মহান নবী তাঁহার বৃদ্ধ বয়সের একমাত্র দুগ্ধপোষ্য সন্তানকে তাহার মাতার সহিত অসহায় অবস্থায় বাড়ি হইতে বিদায় করিয়া দিবেন, ইহাও কি কল্পনা করা যায়। এখানেও বাইবেল রচয়িতাদের হীন মানসিকতা প্রকাশ পাইয়াছে এবং প্রকৃত তথ্য বিকৃত করা হইয়াছে। বাইবেলের পরের বর্ণনা নিম্নরূপ ও সে (হাজার) প্রস্থান করিয়া বির সাবআ প্রান্তরে ঘুরিয়া বেড়াইল! কুপার পানি শেষ হইয়া গেলে সে বালকটিকে একটি ঝোঁপের নীচে ফেলিয়া রাখিল আর আপনি তাহার সম্মুখ অনেকটা দূরে অনুমান এক তীর দূরে তাহার নিকট হইতে সরিয়া গিয়া বসিল। কারণ সে কহিল, বালকটির মৃত্যু আমি দেখিব না। আর সে তাহার সম্মুখ হইতে দূরে বসিয়া উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিতে লাগিল । তখন সদাপ্রভু বালকটির বর শুনিলেন। তাঁহার দূত আকাশ হইতে ডাকিয়া হাজারকে বলিলেন, হাজার! তোমার কি হইল :ভয় করিও না, বালকটি যেখানে আছে সদাপ্রভু তথা হইতে তাহার বর শুনিলেন। তুমি উঠিয়া বালকটিকে তুলিয়া তোমার হাতে ধর। কারণ তাহাকে আমি এক মহাজাতি করিব। তখন সদাপ্রভু তাহার চক্ষু খুলিয়া দিলেন। তাহাতে সে পানি ভর্তি এক কূপ দেখিতে পাইল। তিনি তথায় গিয়া কুপাতে পানি ভরিয়া বালকটিকে পান করাইল । পরে সদাপ্রভু বালকটির সহবর্তী হইলেন, আর সে বড় হইয়া উঠিল এবং প্রান্তরে থাকিয়া ধনুর্দ্ধর হইল। সে পরান (ফারান পর্বত) প্রান্তরে বসতি করিল (আদিপুস্তক, ২১ : ১৪-২১)। তাফসীরকার ও ঐতিহাসিকগণ উক্ত বর্ণনা এবং ইসমাঈল (আ)-এর বার পুত্র ও এক কন্যা সংক্রান্ত বর্ণনা গ্রহণ করিয়াছেন ।
নবী-রাসূলগণ কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আল্লাহর নির্দেশ ব্যতীত স্ব-উদ্যোগে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন না। ইহা তাঁহাদের নবুওয়াতী পদমর্যাদার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। হযরত ইবরাহীম (আ)-ও তাঁহার পরিবারবর্গের একাংশকে আল্লাহ তাআলার নির্দেশেই যে মক্কার জনমানবহীন এলাকায় বসতি স্থাপন করান স্বামী-স্ত্রীর বাক্য বিনিময় হইতেও ইহার প্রমাণ পাওয়া যায়। হযরত ইবরাহীম (আ) যখন দুগ্ধপোষ্য ইসমাঈলসহ হাজার (রা)-কে রাখিয়া ফিরিয়া যাইতে লাগিলেন, তখন হাজার (রা) জিজ্ঞাসা করিলেন, আপনি কি আল্লাহর হুকুমে ইহা করিলেন : ইবরাহীম (রা) উত্তর দিলেন, হাঁ, আল্লাহর হুকুমে। তখন হাজার (রা) এই বলিয়া ফিরিয়া আসিলেন, তাহা হইলে আল্লাহ আমাদের ধ্বংস করিবেন না।
নবী-রাসূলগণ সর্বাবস্থায় আল্লাহ তাআলার উপর নির্ভরশীল থাকেন, আল্লাহর হুকুমের সামনে বিনা বাক্যব্যয়ে মাথা নত করিয়া দেন। স্ত্রী-পুত্রকে নির্জন প্রান্তরে রাখিয়া ইবরাহীম (আ) আল্লাহর কাছে দুআ করিয়াছিলেন :
“হে আমাদের প্রতিপালক! আমি আমার বংশধরদের কতককে অনুর্বর উপত্যকায় তোমার পবিত্র ঘরের নিকট বসতি করাইলাম । হে আমাদের প্রতিপালক! তাহা এইজন্য যে, তাহারা যেন সালাত কায়েম করে। অতএব তুমি কতক লোকের অন্তর তাহাদের প্রতি অনুরাগী করিয়া দাও এবং ফলাদি দ্বারা তাহাদের রিযিকের ব্যবস্থা করিও, যাহাতে তাহারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিতে পারে” (১৪ : ৩৫-৮)।
অনন্তর তিনি স্ত্রী-পুত্রকে নিঃসঙ্গ ফেলিয়া রাখিয়া নিশ্চিন্ত হইয়া থাকেন নাই, মাঝে-মধ্যে সেখানে আসিয়া তাহাদের খোঁজ-খবর লইতেন। আল্লাহ তাআলা তাঁহার প্রিয় নবীর প্রতি সন্তুষ্ট হইয়া তাঁহার জন্য মুজিযাস্বরূপ দুই পবিত্র ভূমির মধ্যকার দূরত্বকে গুটাইয়া সংকুচিত করিয়া দিতেন। ফলে তিনি অতি অল্প সময়ে ও অল্প আয়াশে এখানে আসা-যাওয়া করিতেন (বিদায়া, ১খ, পৃ. ১৫৭; আরোহণ, পৃ. ৮৭; তারীখুল কাবীম, ৩খ)। অন্তত তাঁহার দুইবারের আগমন তো কুরআন মজীদের বক্তব্য দ্বারাই প্রমাণিত হয়। একবার ইসমাঈল (আ)-কে আল্লাহর নির্দেশে কুরবানী করার জন্য (দ্র. ৩৭ ১০০ ও তৎপরবর্তী আয়াত) এবং দ্বিতীয় বার কাবা ঘরের পূর্ণাঙ্গ নির্মাণের জন্য (দ্র. ২৪ ১২৫-২৯; আরও দ্র. ২২ : ২৬-২৭)।
মহানবী (সা)-এর হাদীছ দ্বারা হযরতর ইবরাহীম (আ)-এর দুই পবিত্র ভূমির মধ্যে যাতায়াত প্রমাণিত।
“নবী (সা) হাসান ও হুসায়ন (রা)-এর জন্য আশ্রয় প্রার্থনা করিতেন এবং বলিতেন, তোমাদের দুই জনের পূর্বপুরুষ (ইবরাহীম) ইহা দ্বারা ইসমাঈল ও ইসহাক (আ)-এর জন্য (আল্লাহর নিকট) আশ্রয় প্রার্থনা করিতেন? আমি আল্লাহর পূর্ণ বাক্যসমূহের উসীলায় প্রতিটি শয়তান, প্রাণনাশী বিষাক্ত প্রাণী ও বদনজরের অনিষ্ট হইতে (আল্লাহর) আশ্রয় প্রার্থনা করিতেছি” (বুখারী, বাংলা অনু., আম্বিয়া, বাব ১১, নং ৩১২১, ৩, পৃ. ৩৬৬, তিরমিযী, তিব্ব, বাব হাসান-হুঁসায়নকে ঝাড়ফুক; ইব্ন মাজা, তিব্ব, বাব মা আওয়্যাযান নাবিয়ু (সা) ওয়ামা উব্বি বিহি)।
ইব্ন আব্বাস (রা)-এর দীর্ঘ হাদীছেও (ইতিপূর্বে উদ্ধৃত) তাঁহার কয়েকবার মক্কায় আগমনের কথা উল্লেখ হইয়াছে। বাইবেল হইতেও তাহার মক্কা ভূমিতে একবার আগমনের প্রমাণ পাওয়া যায়। হযরত ইবরাহীম (আ)-এর প্রতি খতনার (লিঙ্গাগ্রের ত্বকছেদন) আদেশ নাযিল হইলে তিনি নিজেও খতনা করেন এবং ইসমাঈল ও ইসহাক (আ)-সহ তাঁহার পরিবারের সহিত সংশ্লিষ্ট সকল পুরুষ লোকেরও খতনা করান (আদিপুস্তক, ১৭ : ১০-১৪)।
মাতা-পুত্রের নির্বাসনের কারণ সম্পর্কিত ভিন্ন একটি ঘটনা এইভাবে বর্ণিত হইয়াছে : শিশুরা যেমন পরস্পর মারামারি করে, একদিন দুই শিশু ভ্রাতা ইসমাঈল ও ইসহাক তাহাই করেন। ইহাতে সারা (রা) হাজার (রা)-এর উপর অসন্তুষ্ট হন এবং ইবরাহীম (আ)-এর নিকট তাঁহাকে অন্যত্র পৃথক করিয়া দেওয়ার দাবি করেন। সেই পরিপ্রেক্ষিতে মাতা-পুত্রকে মক্কায় নির্বাসন দেওয়া হয় (আরাইস, পৃ. ৮৬; আল-কামিল, ১খ, পৃ. ৭৯)। ইহা হাদীছ ও ইতিহাসের বর্ণনার বিপরীত। তাই ইবনুল আছীর এই ঘটনাকে অনির্ভরযোগ্য বলিয়াছেন (আল-কামিল, ১ খ, পৃ./৭৯)।
ইসমাঈল (আ) কর্তৃক পবিত্র ভূমিতে আল্লাহর ঘর কাবার রক্ষণাবেক্ষণ, হজ্জের অনুষ্ঠান পরিচালনা এবং অত্র এলাকায় একটি মানব বসতি গড়িয়া উঠা সবই ছিল আল্লাহর হিকমতের অন্তর্ভুক্ত।
খতনার সুন্নাত প্রবর্তন
হযরত ইবরাহীম (আ) আল্লাহ তাআলার নির্দেশে আশি, অন্য বর্ণনায় নিরানব্বই ও এক শত বিশ বৎসর বয়সে নিজের খতনা করেন এবং তাঁহার পরিবারের সকল পুরুষ লোকেরও খতনা করান। ইসমাইল (আ)-এর তের বৎসর বয়সে তিনি তাঁহার খতনা করান (বিদায়া, ১খ, পৃ. ১৫৬)। তখন হইতে তাওহীদবাদী উম্মতের জন্য খতনা সুন্নাত-ই ইবরাহীমরূপে একটি সুন্নাতে পরিণত হয়। মহানবী (সা) বলেন :
“নবী ইবরাহীম (আ) আশি বৎসর বয়সে বাইস দ্বারা (মতান্তরে কাদূম নামক স্থানে) নিজের খতনা করেন” (বুখারী, আম্বিয়া, বাব ১০, নং ৩১০৮, ৩খ, পৃ. ৩৫০; বিদায়া, ১খ, পৃ. ১৫৬)। মহানবী (সা) আরও বলেন :
“চারটি বিষয় নবী-রাসূলগণের আদর্শ ও লজ্জাশীলতা, অপর বর্ণনায় খতনা, সুগন্ধি ব্যবহার ও বিবাহ” (তিরমিযীর বরাতে মিশকাতুল মাসাবীহ, বাংলা অনু., ২খ, পৃ. ৯৯, নং ৩৫২, কিতাবুত তাহারাত, দ্বিতীয় ফাসূল; আরও দ্র. বুখারী, লিবাস, বাবঃ গোঁফ কাটা, নং ৫৪৬১ ও ৫৪৬৩, ৫খ, পৃ. ৪০৪-৫; মুসলিম, তাহারাত, বাব ১৬, নং ৪৮৮-৯, ২খ, পৃ. ৩০-১; আবু দাউদ, তারাজুল, বাব ফী আখযিশ শারিব; তিরমিযী, আদাব, বাব ১৪, নং ২৬৯৩; ইবন মাজা, তাহারাত, বাব ৮, নং ২৯২, ২৯৪; নাসাঈ, তাহারাত, বাব ও ফিতরাত, তাকলীমুল আযফার, নাতফুল ইবিত; যীনাত, বাবও ফিতরাত)।
মুসলমানদের ন্যায় ইয়াহূদীরাও এই সুন্নাত পালন করে। কিন্তু খৃস্টানরা ইবরাহীম-ইসমাঈল ইসহাক-ইয়াকূব (আ)-এর এই রীতিকে কিসের ভিত্তিতে বর্জন করিয়াছে তাহা অজ্ঞাত। অথচ বাইবেলে খতনা করাইবার প্রতি অত্যন্ত জোর দেওয়া হইয়াছে। আল্লাহ তাআলা ইবরাহীম (আ)-কে বলেন : “তোমার সহিত ও তোমার ভাবী বংশের সহিত কৃত আমার যে নিয়ম তোমরা পালন করিবে তাহা এই যে, তোমাদের প্রত্যেক পুরুষের ত্বকছেদ হইবে। তোমরা আপন আপন লিঙ্গাচর্ম ছেদন করিবে, তাহাই তোমাদের সহিত আমার নিয়মের চিহ্ন হইবে। পুরুষানুক্রমে তোমাদের প্রত্যেক পুত্র সন্তানের আট দিন বয়সে ত্বকছেদ হইবে…. ত্বকছেদ অবশ্য কর্তব্য” (আদিপুস্তক, ১৭ : ১০-১৪)।
বালক ইসমাঈল ও তাহার ভাষার পরিবর্তন
শৈশবকাল হইতে ইসমাঈল (আ) জ্বরহুম গোত্রের লোকদের নিকট আরবী ভাষা শিক্ষা করেন। এই প্রসঙ্গে মহানবী (সা) বলেন :
“সর্বপ্রথম স্পষ্ট আরবী ভাষা ইসমাঈল (আ)-এর মুখে ফুটিয়া উঠে; তখন তিনি ছিলেন চৌদ্দ বৎসরের বালক” (শীরাযীর আলকাব গ্রন্থের বরাতে কানযুল উম্মাল, ১১ খ, পৃ. ৪৯০, নং
“ইসমাঈল (আ)-এর অন্তরে আরবী ভাষা শিক্ষার অনুপ্রেরণা সঞ্চারিত হইয়াছিল” (ঐ গ্রন্থ, ১১খ, নং ৩২৩১১; হাকেম ও ইবন হিব্বানের আস-সাহীহ গ্রন্থের বরাতে)।
বালক ইসমাঈল (আ) তীরন্দাজী, অশ্বারোহণ, শিকার ও কুন্তি শিক্ষা করেন। বংশবিশারদ ও জীবনীকারগণ বলেন যে, ইসমাঈল (আ)-ই সর্বপ্রথম ঘোড়াকে পোষ মানাইয়া উহাকে বাহন হিসাবে কাজে লাগান । ইহার পূর্বে অশ্ব ছিল বন্য প্রাণী। মহানবী (সা) বলেন :
“তোমরা ঘোড়া পোষো এবং উহার প্রতি যত্নবান হও। কেননা উহা তোমাদের পূর্বপুরুষ ইসমাঈল (আ)-এর পরিত্যক্ত সম্পদ” (সাঈদ ইব্ন ইয়াহইয়া আল-উমাবীর আল-মাগাযী গ্রন্থের বরাতে বিদায়া, ২খ, পৃ. ১৯২)।
ইসমাঈল (আ) যৌবনে একজন পারদর্শী তীরন্দাষ ছিলেন, বাইবেল এবং মহানবী (সা)-এর হাদীছে যাহার স্বীকৃতি বিদ্যমান। তিনি শিকারকার্য করিয়া জীবিকা নির্বাহ করিতেন (বরাতের জন্য দ্র. ইতিপূর্বে উদ্ধৃত দীর্ঘ হাদীছ)।
কুরআন মজীদে হযরত ইসমাঈল (আ)
কুরআন মজীদের মোট নয়টি সূরায় হযরত ইসমাইল (আ) সম্পর্কে উল্লেখ আছে। তন্মধ্যে বারো স্থানে তাঁহার নামোল্লেখসহ আলোচনা রহিয়াছে। (দ্র. ২ : ১২৫, ১২৭, ১৩৩, ১৩৬, ১৪০; ৩ : ৮৪; ৪ : ১৬৩; ৬ : ৮৬; ১৪ ও ৩৯; ১৯ ও ৫৪; ২১ ও ৮৫ ও ৩৮ : ৪৮)। ২ : ১২৪-১৪১ আয়াতে পিতা-পুত্রের কাবা ঘর নির্মাণ, তৎসংক্রান্ত দুআ এবং ইবরাহীম পরিবারের তৌহীদী আদর্শের আলোচনা, ১৪ ও ৩৯-৪১ আয়াতে মাতা-পুত্রকে মক্কায় স্থানান্তর ও ইবরাহীম (আ)-এর আবেগাপ্লুত দুআ এবং ৩৭ ও ১০০-১১৩ আয়াতে কুরবানী সংক্রান্ত ঘটনা আলোচিত হইয়াছে। অবশিষ্ট সূরাসমূহে তাঁহার সম্পর্কে খুবই সংক্ষিপ্ত উল্লেখ আছে।
যমযম কূপের পূর্বকথা
ইবন আব্বাস (রা) কর্তৃক বর্ণিত দীর্ঘ হাদীছে বলা হইয়াছে যে, ইবরাহীম (আ) স্ত্রী ও পুত্রের জন্য যে যৎসামান্য পানি রাখিয়া গিয়াছিলেন তাহা ফুরাইয়া যাওয়ার পর হযরত হাজার (রা) পানি সংগ্রহের আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও তাহার কোন ব্যবস্থা করিতে না পারিয়া নিরাশ হইয়া পড়িলেন। তিনি সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে ছুটাছুটির সময়ে মারওয়া পাহাড়ে উঠার পর একটি অদৃশ্য আহবান শুনিতে পান এবং বর্তমানে যেখানে যমযম কূপ অবস্থিত সেখানে একজন ফেরেশতাকে দেখিতে পান। ফেরেশতার পদাঘাতে বা ডানার আঘাতে মাটির অভ্যন্তর হইতে পানির উৎস নির্গত হইল। হযরত হাজার (রা) ইহার চারিপাশে আইল বাঁধিয়া উহাকে কূপের রূপ দান করিলেন (বুখারী, বাংলা অনু., ৩খ, পৃ. ৩৫৭-৮, নং ৩১১৪)। এই কূপই “যমযম কূপ” নামে ইতিহাস খ্যাত। ইহাই যমযম কূপের আদি উৎস। যমযম শব্দের আভিধানিক অর্থ নির্ণয়ে মতভেদ আছে। ইবন হিশামের মতে আরবদের নিকট; শব্দের অর্থ প্রাচুর্য, সঞ্চিত হইয়া জমা হওয়া। যেহেতু সূচনা হইতেই ইহাতে পানির প্রাচুর্য লক্ষ্য করা গিয়াছে এবং ব্যবহারের ফলে পানি হ্রাস প্রাপ্ত না হইয়া সঙ্গে সঙ্গে পরিপূর্ণ হইয়া গিয়াছে, তাই ইহার এই নামকরণ। ভিন্ন মতে শব্দটির অর্থ গর্জন, নাদ, শব্দধ্বনি; হযরত হাজার (রা) অদৃশ্য শব্দধ্বনি শ্রবণ করিয়া কূপের সন্ধান লাভ করিয়াছিলেন। ভিন্নমতে; শব্দ হইতে উক্ত নামকরণ হইয়াছে। শব্দটির অর্থ অবরুদ্ধ হওয়া, শক্ত করিয়া বাঁধা। হাজার (রা) কূপের চারিদিকে বাঁধ নির্মাণ করিয়া পানি অবরুদ্ধ করিয়াছেন। বাঁধ দিয়া আটক করা না হইলে কূপের পানি মাটির উপর দিয়া গড়াইয়া যাইত। ইবন আব্বাস (রা)-এর এই মত। হারাবীর মতে । ১৯; শব্দের অর্থ ‘পানির শব্দ এবং এজন্য কূপটির উক্ত নামকরণ। ইয়াকূব আল-হামাবী লিখিয়াছেন যে, পানির প্রাচুর্যের কারণেই কূপটির যমযম নামকরণ করা হইয়াছে। মুহাম্মাদ ইব্ন ইসহাক আল-ফাঁকিহী তাঁহার “আখবার মাক্কাতা ফী কাদীমিদ-দারি ওয়া হাদীছিহি” গ্রন্থে যমযম কূপের চৌত্রিশটি অর্থবোধক নাম উল্লেখ করিয়াছেন (মক্কা শরীফের ইতিকথা, পৃ. ৫৮-৬১; তারীখুল-কাবীম, ৩থ, পৃ. ৯৫; মুজামুল-বুলদান, ৩খ, পৃ. ১৪৭-৮)।
যেহেতু কাবা শরীফ হযরত আদম (আ)-এর যুগ হইতেই বর্তমান স্থানে বিদ্যমান ছিল, হয়ত কালের প্রবাহে কখনও কখনও গৃহকাঠামো অবলুপ্ত হইয়াছে, তাই নিশ্চয়ই তখন হইতেই এখানে পানির ব্যবস্থাও বিদ্যমান থাকার কথা। আল্লাহর ইবাদতে লিপ্ত হওয়ার উদ্দেশে পানি হইল পবিত্রতা অর্জনের অন্যতম উপাদান। তাই এই মহাসম্মানিত গৃহের সংলগ্ন পানি ব্যবস্থাও নিশ্চয়ই ছিল।
সকল ঐতিহাসিকের জন্য ইব্ন আব্বাস (রা)-র হাদীছই যমযমের আদি ইতিহাসের উৎস। আল্লাহ তাআলা হযরত ইবরাহীম ও ইসমাঈল (আ)-এর দুআ (দ্র. ২ : ১২৬-২৯ এবং ১৪ : ৩৫-৮) এবং স্বামী-স্ত্রী ও পুত্রের আল্লাহর জন্য নিবেদিতপ্রাণ হওয়ার উসীলায় এমন বরকত দান করিলেন যে, এই যমযম কূপকে কেন্দ্র করিয়া স্বল্প কালের মধ্যে মক্কার বিজন প্রান্তর মানুষের কোলাহলে মুখরিত হইয়া উঠিল । প্রাথমিক পর্যায়ে আরবের একটি আদি গোত্র ‘জুরহুম হযরত হাজার (রা)-এর অনুমতিপ্রাপ্ত হইয়া এখানে বসতি স্থাপন করে এবং হযরত ইসমাঈল (আ) যৌবনে পদার্পণ করিয়া এই গোত্রে বিবাহ করেন।
হাদীছ শরীফে যমযম কূপ সম্পর্কে বহু স্থানে আলোচনা বিদ্যমান থাকিলেও কুরআন মজীদে এই কূপ সম্পর্কে সরাসরি কোন বক্তব্য নাই। হজ্জ সংক্রান্ত আলোচনায় পরোক্ষভাবে ইহার উল্লেখ আছেঃ
“যাহাতে তাহারা তাহাদের কল্যাণময় স্থানসমূহে উপস্থিত হইতে পারে” (২২ : ২৮)
অতএব যমযম কূপ কাবার চত্বরে অবস্থিত হওয়ায় ইহা একটি কল্যাণময়, মর্যাদাপূর্ণ ও বরকতময় স্থান এবং ইহার পানি মানুষের জন্য বরকতপূর্ণ। দুগ্ধপোষ্য নবীর জীবন তো এই পানি দ্বারা সঞ্জীবিত হইয়াছিল। অর্থাৎ একজন মহান নবীই সর্বপ্রথম এই কূপের পানি পান করিয়াছিলেন। তাঁহারই উত্তর পুরুষ বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা)-কে মিরাজ উপলক্ষে ঊধ্বজগতে আরোহণ করানোর প্রস্তুতিকালে তাঁহার হূদয় মুবারক যমযমের পানি দ্বারাই ধৌত করা হয়। এই সম্পর্কে মহানবী (সা) বলেন : “আমি মক্কায় অবস্থানকালে একদিন রাত্রিবেলা আমার গৃহের ছাদ খুলিয়া গেল এবং জিবরাঈল (আ) অবতরণ করিয়া আমার বক্ষ বিদারণ করেন এবং যমযমের পানি দ্বারা তাহা ধৌত করেন, অতঃপর একখানা স্বর্ণের থালায় ঈমান ও হিকমত পরিপূর্ণ করিয়া আনিয়া আমার বক্ষমধ্যে ঢালিয়া দিয়া তাহা জোড়া লাগাইয়া দেন ……” (বুখারী, কিতাবুল হজ্জ, বাব ৭৫ : যমযম সম্পর্কে যাহা কিছু উল্লিখিত ইহয়াছে, ২খ, পৃ. ১১৪)।
হাফিজ যয়নুদ্দীন ইরাকী বলেন, যমযমের পানি দ্বারা তাঁহার বক্ষ ধৌত করার উদ্দেশ্য যাহাতে তিনি বেহেশত-দোযখসহ ঊর্ধ্ব জগত অবলোকন করিবার শক্তি অর্জন করিতে পারেন। কারণ যমযমের পানি দ্বারা অন্তরাত্মা শক্তিশালী হয় এবং ভয়ভীতি দূর হয়। বালক বয়সের বক্ষ বিদারণ কালেও যমযমের পানি দ্বারা তাঁহার বক্ষ ধৌত করার কথা উল্লিখিত হইয়াছে (আযরাকীর আখবার মাক্কা গ্রন্থের বরাতে মক্কা শরীফের ইতিকথা, পৃ. ৬৫)। ইবন আব্বাস (রা) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে যমযমের পানি পান করাইয়াছি। তিনি দাঁড়ানো অবস্থায় তাহা পান করেন” (বুখারী, পূ. স্থা, নং ১৫২৭; তিরমিযী, আশরিবা, বাব ১২, নং ১৮৩০, ৩খ, পৃ. ৩৫৪-৫; মুসলিম, আশরিবা, বাব ২০৮, নং ৫১০৮-১১, ৭খ, পৃ. ৪৭; নাসাঈ, মানসিক, বাব : আশ-শুরবি যামযাম কাইমান)।
জাবির ইবন আবদিল্লাহ (রা) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে বলতে শুনিয়াছি ও “যমযমের পানি যে উদ্দেশ্যে পান করা হইবে তাহা পূর্ণ হইবে” (ইবন মাজা, মানসিক, বাব ৭৮, নং ৩০৬২, ২খ, পৃ. ১০১৮; আও দ্র. মুসতাদরাক হাকেম)। ইবন আব্বাস (রা)-এর নিকট এক ব্যক্তি আসিয়া উপস্থিত হইলে তিনি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি কোথা হইতে আগমন করিয়াছ? সে বলিল, যমযম হইতে। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, ইহার পানি যেইভাবে পান করিতে হয় সেইভাবে তুমি কি তাহা পান করিয়াছ? আগন্তুক বলিল, তাহা কিভাবে :তিনি বলিলেন, তুমি ইহার পানি পান করার সময় কিবলামুখী হইবে, বিসমিল্লাহ বলিবে, তিন নিঃশ্বাসে পান করিবে, উদর পূর্তি করিয়া পান করিবে এবং পানশেষে আলহামদু লিল্লাহ বলিবে। কেননা রাসূলুল্লাহ (সা) বলিয়াছেন :
“আমাদের ও মুনাফিকদের মধ্যে পার্থক্য এই যে, তাহারা উদর পূর্তি করিয়া যমযমের পানি পান করে না” (ইব্ন মাজা, মানাসিক, বাব ৭৮, নং ৩০৬১)।
আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলিয়াছেন :
“পৃথিবীর বুকে সর্বোত্তম পানি হইল যমযমের পানি” (সহীহ ইবন হিব্বানের বরাতে মক্কা শরীফের ইতিকথা; পৃ. ৬৫)।
ইবন আব্বাস (রা) মহানবী (সা)-এর বাণী হিসাবে বলেন, যমযমের পানি যে উদ্দেশে পান করা হইবে তাহা পূর্ণ হইবে। তুমি উহার পানি রোগমুক্তির জন্য পান করিলে আল্লাহ তোমাকে আরোগ্য দান করিবেন এবং পিপাসা নিবারণের জন্য পান করিলে আল্লাহ তোমার পিপাসা মিটাইবেন। ইহা জিবরীল (আ)-এর পদাঘাতে ইসমাঈল (আ)-এর পানীয় হিসাবে সৃষ্টি হইয়াছে (আযরাকীর আখবার মাক্কা গ্রন্থের বরাতে মক্কা শরীফের ইতিকথা, পৃ. ৬৩; একই কথা মুজাহিদ (র)-এর নিজস্ব বক্তব্য হিসাবেও উদ্ধৃত হইয়াছে। তবে তাহাতে আরও আছে : তুমি উহা ক্ষুন্নিবৃত্তির উদ্দেশে পান করিলে আল্লাহ তোমার ক্ষুণিবৃত্তি করিবেন, পৃ. ৬২; তারীখুল কাবীম, ৩খ, পৃ. ৬৭)। আষরাকীর গ্রন্থে আরও আছে যে, মহানবী (সা) সুহায়ল ইব্ন আমর (রা)-কে যমযমের পানি উপহারস্বরূপ পাঠাইয়াছিলেন (মক্কা শরীফের ইতিকথা, পৃ. ৬২; তারীখুল কাবীম, ৩খ, পৃ. ৬৮)। ইবন আব্বাস (রা) বলিলেন, তোমরা পুণ্যবান লোকদের সালাতের স্থানে সালাত আদায় কর এবং দীনদার লোকদের পানীয় পান কর। তাঁহাকে পূন্যবানদের সালাতের স্থান এবং দীনদারগণের পানীয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হইলে তিনি বলেন, পুণ্যবানদের সালাতের স্থান হইল মীযাবের নিচে এবং দীনদারগণের পানীয় হইল যমযমের পানি (আযরাকীর বরাতে মক্কা শরীফের ইতিকথা, পৃ. ৬৪;
স্বেচ্ছায় দারিদ্র্য বরণকারী প্রবীণ সাহাবী হযরত আবু যার আল-গিফারী (রা) মহানবী (সা)-এর নবুওয়াত লাভের সংবাদ জানিতে পারিয়া তাঁহার সহিত সাক্ষাত করিতে মক্কায় আগমন করেন। তিনি তাঁহার সহিত সাক্ষাতের ইচ্ছা প্রকাশ করিলে মক্কার কুরায়শ মুশরিকরা তাঁহাকে প্রস্তর নিক্ষেপে জর্জরিত করিয়া বেশ করিয়া ফেলে এবং তাঁহার সমস্ত শরীর রক্তাক্ত হইয়া যায়। হুঁশ ফিরিয়া পাইলে তিনি যমযমের নিকট গিয়া দেহের রক্ত ধুইয়া ফেলেন এবং যমযমের পানি পান করেন। তিনি মহানবী (সা)-এর সহিত সাক্ষাতের আশায় কাবার চত্বরে তিরিশ দিন (বর্ণনান্তরে পনর দিন) অতিবাহিত করেন। এই সময় যমযমের পানি ব্যতীত তাঁহার অন্য কোন খাদ্য বা পানীয় ছিল না। তিনি উহা পান করিয়া সুস্বাস্থ্য লাভ করেন এবং এই দীর্ঘ সময়ে কখনও ক্ষুধা অনুভব করেন নাই। তাঁহার সহিত সাক্ষাত হইলে পর রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁহার এই কয়দিনের খাদ্য-পানীয়ের খবর লইলে তিনি বলেন যে, যমযমের পানি ছাড়া আর কিছুই তাহার উদরে প্রবেশ করান নাই এবং ইহাতেই তিনি সুস্বাস্থ্য লাভ করিয়াছেন। রাসূলুল্লাহ (সা) বলিলেন : এই পানি ক্ষুধার সময় খাদ্যের অভাব পূর্ণ করে (দ্র. বুখারী, মানাকিবুল আনসার, বাব ইসলাম আবী যার, ১খ,, পৃ. ৫৪৪-৫; ইসাবা, ৭খ, পৃ. ৬–৬২, নং ৩৮২। সহীদ মুসলিম কিতাবুল ফাদাইলু মিন ফাদাইল আবী যার (রা), ২খ, পৃ. ২৯৫-৬; বাংলা অনু. ৮খ, পৃ. ৫-৯)।
আব্বাস (রা) বলেন, জাহিলী যুগে লোকেরা একবার ভীষণ দুর্ভিক্ষের শিকার হইল। বাদ্য সংগ্রহ তাহাদের জন্য কষ্টসাধ্য হইয়া পড়িল। এই সময় তাহারা যমযমের পানি পান করিয়া এবং তাহাদের দুগ্ধপোষ্য শিশুদেরকেও পান করাইয়া নিশ্চিত মৃত্যুর করাল গ্রাস হইতে মুক্তি পায়। ইবন আব্বাস (রা) বলেন, এইজন্যই যমযম কূপের অপর নাম হয় শাব্বাআহ (c) ক্ষুধা নিবারণকারী; (তারীখুল কাবীম, ৩থ, পৃ. ৬৮)। যমযমের পানি দাঁড়ানো অবস্থায় পান করা সুন্নাত। কারণ রাসূলুল্লাহ (সা) দাঁড়ানো অবস্থায় ইহার পানি পান করেন। ইবন আব্বাস (রা) যমযমের পানি পানকালে নিম্নোক্ত দুআ পড়িতেন :
“হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট প্রার্থনা করি উপকারী বিদ্যার, পর্যাপ্ত রিযিকের এবং যাবতীয় রোগব্যাধি হইতে আরোগ্য লাভের” (মক্কা শরীফের ইতিকথা, পৃ. ৭৩)। পৃথিবীর সর্বত্রই এই বরকতময় পানি সরবরাহের ব্যবস্থা রহিয়াছে।
হাকেম তিরমিযী (র) বলেন, যমযম কূপের পানি দ্বারা উপকার লাভ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির খাঁটি নিয়তের উপর নির্ভরশীল। খালেছ নিয়তে উহা পান করিলে উপকার লাভ অবশ্যম্ভাবী। আল্লামা মুনাবী আত-তায়সীর বিশারহি আল-জামে আস-সাগীর গ্রন্থে বলিয়াছেন যে, যমযমের উৎপত্তি হইয়াছিল হযরত ইবরাহীম (আ)-এর পুত্র ইসমাঈল (আ)-এর সাহায্যার্থে। আজও কেহ নিষ্ঠার সহিত এই পানি ব্যবহার করিলে সেও আল্লাহর সাহায্য প্রাপ্ত হইবে (আখবার মাক্কা গ্রন্থের বরাতে মক্কা শরীফের ইতিকথা, পৃ. ৬৬)।
কালের পরিক্রমায় মানুষ সত্য দীন হইতে বিচ্যুত হইয়া পথভ্রষ্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর কুদরতে সৃষ্ট এই বরকতময় কূপেরও বিলুপ্তি ঘটে। ইসমাঈল (আ)-এর বংশধরগণকে পরাভূত করিয়া জ্বরহুম গোত্র কাবার কর্তৃত্ব দখল করিয়া নেওয়ার পর তাহারা ক্রমান্বয়ে পথভ্রষ্ট হইতে থাকে। তাহারা পবিত্র হারাম শরীফের অসম্মান করে, হারাম শরীফে প্রদত্ত উপহার-সামগ্রী প্রকাশ্যে ও সন্তর্পণে চুরি ও আত্মসাৎ করিতে থাকে। তাহাদের গোত্রের প্রবীণ ব্যক্তি আমর ইবন হারিছ ইব্ন মাদাদ তাহাদেরকে এইসব অপকর্ম হইতে বিরত থাকিবার উপদেশ দেন, কিন্তু তাহারা উহাতে কর্ণপাত করে নাই। তাই তিনি কাবার ধনভাণ্ডারে রক্ষিত দুইটি স্বর্ণের হরিণের প্রতিকৃতি এবং স্বর্ণের তরবারি রাতের অন্ধকারে গোপনে কূপের মধ্যে দাফন করিয়া কূপটিকে ভরাট করিয়া ফেলেন (মুহাম্মদ তাহির আল-কুরদী, তারীখুল কাবীম, ৩খ, পৃ. ৫৬)। কোন কোন ঐতিহাসিক বলেন যে, মাদাদ ইব্ন আমর আল-জুরহুমী খুযাআ গোত্রের নিকট পরাজিত হইলে তিনি তাহাদেরকে পানি হইতে বঞ্চিত করার উদ্দেশে নিজের মূল্যবান দ্রব্যাদি ও স্বর্ণ দ্বারা কূপটিকে ভরাট করিয়া ফেলেন,অতঃপর মরুভূমির ধুলা-বালিতে কূপের চিহ্নও বিলুপ্ত হইয়া যায়। ইয়াকূত আল-হামারী বলিয়াছেন যে, বৃষ্টিপাতের অভাবে কূপটি শুষ্ক হইয়া যায় এবং অবশেষে ইহার কোন চিহ্নই অবশিষ্ট থাকে নাই (মুজামুল বুলদান, ৩খ, পৃ. ১৪৯)। কোন কোন ঐতিহাসিক বলিয়াছেন যে, বৃষ্টিপাতের অভাবের কারণে নয়, জ্বরহুম গোত্রের অবাধ্যাচারের কারণে কূপটি শুকাইয়া যায় এবং পরবর্তী কালে বন্যার কারণে ইহার শেষ চিহ্নও বিলুপ্ত হইয়া যায় (মক্কা শরীফের ইতিকথা, পৃ. ২৩-২৪)।
জুরহুম গোত্রের পর কাবাসহ মক্কার ক্ষমতা খুযাআ গোত্রের হস্তগত হওয়ার ইতিহাস কিছুটা জানা গেলেও মহানবী (সা)-এর দাদা আবদুল মুত্তালিব কর্তৃক যমযম কূপের পুনরাবিষ্কারের পূর্বে পর্যন্ত উক্ত কূপের ইতিহাস সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না। মক্কা শরীফে যেহেতু কোন নদীনালা ছিল না, তাই লোকেরা সম্ভবত বিকল্প কূপ খনন করিয়া নিজেদের পানির প্রয়োজন মিটাইত। কুরায়শ বংশের প্রতিষ্ঠাতা কুসায়্যি ইব্ন কিলাব চামড়ার মশকে করিয়া মক্কার বাহির হইতে পানি আনিয়া হাজ্জীদেরকে পান করাইতেন। পরে তিনি উম্মু হানী (রা)-র গৃহের স্থানে আব্দুল নামক কূপ খনন করিয়া পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করেন। যমযম ছাড়া ইহাই মক্কার ভিতরের প্রথম কূপ (মক্কা শরীফের ইতিকথা, পৃ. ৪৬)। তখনও যমযম কূপ অনাবিষ্কৃত থাকে।
আবদুল মুত্তালিব একটি স্বপ্নের ভিত্তিতে যমযম কূপের সন্ধান লাভ করেন। তিনি হিজরে ইসমাঈলে (বর্তমান হাতীম) ঘুমন্ত অবস্থায় স্বপ্নে তিনবার কূপ খননের নির্দেশ লাভ করেন। স্বপ্নে কেহ তাঁহাকে নির্দেশ প্রদান করেন যে, কাবার সম্মুখে অবস্থিত, যুগল মূর্তি বরাবর পিপড়ার ঢিবিতে ময়লা ও রক্তের মাঝে কাকের ঠোঁকরে সৃষ্ট ছিদ্রের মধ্যে খননকার্য চালাইয়া যমযম কূপ আবিষ্কার করা যাইবে । অতএব তিনি মসজিদুল হারামে পৌঁছিয়া স্বপ্নের লক্ষণসমূহ অবলোকন করার অপেক্ষায় ছিলেন। এই সময় হারাম শরীফ এলাকার বাইরে একটি গরু যবেহ করা হইলে উহা শেষনিঃশ্বাস ত্যাগের পূর্বে অলৌকিকভাবে ছুটিয়া আসিয়া কাবার চত্বরে পতিত হইয়া সেখানে মারা যায়। এক পর্যায়ে কাক আসিয়া পিপড়ার ঢিবি বরাবর খুঁড়িতে থাকে। আবদুল মুত্তালিব তাঁহার স্বপ্নের লক্ষণ বুঝিতে পারিয়া একমাত্র পুত্র হারিছকে লইয়া কূপ খনন শুরু করেন। কূপ খননের প্রাক্কালে তিনি যে বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হন তাহা অপসারিত করার জন্য আল্লাহর দরবারে দুআ করেন এবং বলেন যে, তিনি দশটি পুত্র সন্তান লাভ করিলে তাহাদের একজনকে আল্লাহর নামে কুরবানী করিবেন (ইবন হিশাম, ১খ, পৃ. ১৫৭)। আল্লাহ তাঁহার অভিযান সফল করেন এবং তিনি কূপের সন্ধান লাভ করেন। তিনি ইহাতে দাফনকৃত দুইটি সোনার হরিণের প্রতিকৃতি, একটি স্বর্ণের তরবারি ও অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র লাভ করেন এবং এইগুলিকে কাবার ধনভাণ্ডারে জমা করেন (তারীখুল । কাবীম, ৩খ, পৃ. ৬-৬২, মুজামুল বুলদান, ৩খ, ১৪৯; তারীখ মাক্কা-এর বরাতে মক্কা শরীফের ইতিকথা, পৃ. ৪৮-৫১)। পরবর্তী কালে আবদুল মুত্তালিব দশজন পুত্র সন্তান লাভ করেন এবং পরিণত বয়সে তাহারা কুরায়শদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেন। তিনি তাঁহার মানত অনুযায়ী সন্তানদের মধ্যে লটারী করেন এবং ইহাতে তাঁহার সর্বাধিক প্রিয় ও সর্বকনিষ্ঠ সন্তান এবং মহানবী (স)-এর পিতা আবদুল্লাহর নাম উঠে । তিনি তাঁহাকে যবেহ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। অতঃপর তাঁহার ভ্রাতাগণের পরামর্শে তিনি একশত উষ্ট্র অথবা তাঁহার কনিষ্ঠ পুত্রের মধ্যে লটারী করেন। তৃতীয়বারে এক শত উষ্ট্রের নামে লটারী উঠে। অতএব তিনি পুত্রের পরিবর্তে এক শত উষ্ট্র যবেহ করেন (তারীখুল কাবীম, ৩খ, পৃ. ৬২)। এজন্য রাসূলুল্লাহ (সা)-এর একটি উপাধি হইল ইবনুয-যাবীহায়ন (দুই যবেহকৃতের পুত্র)। পরবর্তীকালে নরহত্যার দিয়াতস্বরূপ এক শত উট প্রদান ইসলামী শরীআতে বিধিবদ্ধ হয় (তারীখুল কাবীম, ৩থ, পৃ. ৬২)।
ইব্ন ইসহাকের বর্ণনামতে, আবদুল মুত্তালিব যমযম কূপ খননে কুরায়শদের বাধার সম্মুখীন হইয়া মানত করিয়াছিলেন যে, তিনি দশটি পুত্র সন্তান লাভ করিলে এবং তাহারা বয়ঃপ্রাপ্ত হইলে তাহাদের একজনকে আল্লাহর নামে কুরবানী করিবেন। তিনি দশটি সন্তান লাভ করার পর নিজ প্রতিশ্রুতি মুতাবিক তাহাদের একজনকে কুরবানী করিতে উদ্যোগী হইলেন। লটারীতে কনিষ্ঠ পুত্র মিহানবী (সা)-এর পিতা ] আবদুল্লাহর নাম উঠে। কুরায়শ নেতৃবৃন্দ তাঁহাকে সাজাহ নাম্নী এক মহিলা গণকের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দিল এবং তদনুযায়ী তিনি তাহার শরণাপন্ন হইলেন। সে তাহাকে দশটি উট কুরবানী করার পর তাহার সন্তান ও উটের মধ্যে ভাগ্য নির্ণায়ক শর টানিবার নির্দেশ দেয়। যতক্ষণ না উট কুরবানীর পক্ষে শর নির্গত হয় ততক্ষণ প্রতিবার দশটি করিয়া উট কুরবানী করিতে হইবে। নিয়মানুযায়ী দশবারে আবদুল্লাহর পরিবর্তে উট কুরবানী করার পক্ষে শর নির্গত হয় এবং তিনি এক শত উট কুরবানী করিলেন। ইহার পর হইতে মানুষ হত্যার দিয়াতরূপে এক শত উট ধার্য হয়, ইতিপূর্বে নরহত্যার দিয়াত ছিল দশটি উট (ইবন হিশাম, ১খ, পৃ. ১৫৯-১৬১)। এখানে উল্লেখ্য যে, মহানবী (সা)-এর পিতা আবদুল্লাহ আবদুল মুত্তালিবের সর্বকনিষ্ঠ পুত্র ছিলেন না, বরং তিনি তাঁহার মাতার সর্বকনিষ্ঠ সন্তান ছিলেন। কারণ আবদুল্লাহ্র কনিষ্ঠ হামযা এবং হামযার কনিষ্ঠ ছিলেন আব্বাস (রা)। অর্থাৎ আব্বাস (রা)-ই ছিলেন আবদুল মুত্তালিবের সর্বকনিষ্ঠ সন্তান এবং মহানবী (সা)-এর জন্মের সময় তাঁহার বয়স ছিল প্রায় তিন বৎসর (সীরাতে ইবন হিশামের ১নং টীকা, ১খ, পৃ. ১৫৯; আর-রাওদুল উনুফ-এর বরাতে; আর-রাওদুল উনুফ, ১খ, পৃ. ১৭৬)।
ইহার পর হইতে বিভিন্ন শাসকের আমলে যমযমের সংস্কারকর্ম অব্যাহত থাকে এবং বর্তমান কাল পর্যন্ত তাহা অব্যাহত আছে (বিস্তারিত আধুনিক তথ্যের জন্য দ্র. মক্কা শরীফের ইতিকথা গ্রন্থখানি)। যমযমের তলদেশে তিনটি উৎস হইতে পানি আসিয়া উক্ত কূপকে সর্বদা পানিপূর্ণ করিয়া রাখে। হাজারুল আসওয়াদ, সাফা ও আবু কুবায়স পর্বতদ্বয় এবং মাওয়া পর্বত ইহার তিনটি উৎস। এইগুলির মধ্যে হাজারুল আসওয়াদ ঝর্ণা হইতে সর্বাধিক পরিমাণ পানি নির্গত হয় এবং ঝর্ণাটি জান্নাত হইতে প্রবাহিত বলিয়া কথিত (তারীখুল কাবীম, ৩খ, পৃ. ৬৫; মুজামুল বুলদান, ৩খ, পৃ. ১৪৮)।
যমযম কূপের বিশেষত্ব
আল্লাহ তাআলার নির্দেশে এবং শিশু নবী হযরত ইসমাঈল (আ) ও তাঁহার পুণ্যময়ী মাতা হাজার (রা)-এর প্রতি তাঁহার অসীম অনুগ্রহস্বরূপ সর্বাধিক সম্মানিত ফেরেশতা হযরত জিবরাঈল (আ) এই কূপ প্রবাহিত করেন। একজন নবী ও তাঁহার পুণ্যবতী মাতা সর্বপ্রথম এই কূপের পানি পান করায় ইতিহাসে ইহার মর্যাদা বৃদ্ধি পাইয়াছে (তারীখুল কাবীম, ৩খ, পৃ. ৬৭)। কথিত আছে যে, এই পানি পান করার সঙ্গে সঙ্গে হযরত হাজার (রা)-এর স্তনদ্বয় তাঁহার সন্তানের জন্য দুগ্ধে পূর্ণ হইয়া যায় (তারীখুল কাবীম, ৩খ, পৃ. ৫৯)। এই কূপের বরকতেই ধূসর মরুতে মানববসতি গড়িয়া উঠে। হযরত আলী (রা) বলেন, পৃথিবীর বুকে সর্বোত্তম কূপ হইল যমযম (তারীখুল কাবীম, ৩খ, পৃ. ৬৭)।
এই কূপটি কাবা ঘরের পাদদেশ এবং আল্লাহর দুই নিদর্শন সাফা-মারওয়া পর্বতদ্বয়ের সহিত সংযুক্ত। হাজারুল আসওয়াদমুখী নালাটি জান্নাত হইতে প্রবাহিত হওয়ায় জান্নাতের কূপের সঙ্গে এই কূপের যোগসূত্র স্থাপিত হইয়াছে এবং স্বয়ং কূপটিও আল্লাহর এক নিদর্শন।
সুদূর অতীত হইতে আম্বিয়ায়ে কিরাম, আল্লাহর অনুগ্রহপ্রাপ্ত মহান বান্দাগণ, সিদ্দীকীন, সালিহীন প্রমুখ এই কূপের পানি পান করিয়াছেন এবং এখনও পান করা হইতেছে। ইবন আব্বাস (রা)-এর মতে সত্তরজন এবং মুজাহিদ (র)-এর মত পঁচাত্তরজন নবী-রাসূল (আ) কাবা ঘরের চত্বরে আসেন এবং হযরত মূসা (আ) ও তাঁহাদের অন্তর্ভুক্ত। এই উপলক্ষে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নবী উক্ত কূপের পানি পান করিয়া ইহার মর্যাদা বর্ধিত করিয়া থাকিবেন (তারীখুল কাবীম, ৩খ, পৃ. ১১৫)।
মহানবী (সা)-এর যতবার শাকুস-সদর (বক্ষস্থল বিদীর্ণকরণ) হইয়াছে ততবার তাঁহার কলব এই কূপের পানি দ্বারা ধৌত করা হইয়াছে। তিনি এই কূপের পানি পান করিয়াছেন এবং অন্যদেরকে তাহা পান করিতে উৎসাহিত করিয়াছেন (বিস্তারিত দ্র. তারীখুল কাবীম, ৩থ, পৃ. ৬৬-৭১)।
এই বরকতময় কূপ আল্লাহর রহমতে কিয়ামত পর্যন্ত অটুক থাকিবে। দাহহাক (র) বলেন, কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার পূর্বে ইহার পানির উৎস বন্ধ হইয়া যাইবে এবং এইভাবে কূপটি বিলীন হইয়া যাইবে (অরাকীর তারীখ মাক্কা-এর বরাতে তারীখুল কাবীম, ৩থ, পৃ.৭৫)।
যমযম কূপ সম্পর্কিত হুকুম ও ইহার পানির বহুমুখী ব্যবহার
এই কূপের চত্বর মসজিদের অন্তর্ভুক্ত বিধায় এখানে সালাত আদায় করা, ইতিকাফ করা ইত্যাদি জাইয। এখানে নাপাক অবস্থায় প্রবেশ করা বা বসা, থুথু বা আবর্জনা ইত্যাদি নিক্ষেপ করা নিষিদ্ধ। ইহা হানাফী মাযহাবের অভিমত এবং অন্যান্য মাযহাবের অধিকাংশ আলিমের অভিমতও ইহাই। আবদুল মুত্তালিব যখন কূপ খনন শুরু করেন তখন কুরায়শরা তাহাকে বলিল, আমরা আপনাকে মূর্খ মনে করি না, কিন্তু আপনি আমাদের মসজিদে খননকার্য করিয়া কেন তাহা নষ্ট করিতেছেন? এই কথার দ্বারা পূর্বোক্ত মতের সমর্থন পাওয়া যায় (বিস্তারিত দ্র. তারীখুল কাবীম, ৩খ, পৃ. ১০১-১০৫)।
অনুরূপভাবে যমযমের পানিও যাবতীয় প্রয়োজনে ব্যবহার করার ব্যাপারে বিধিনিষেধ আছে। ইব্ন আব্বাস (রা) বলেন, আমি যমযমের পানি দ্বারা গোসল বৈধ মনে করি না। এই পানি পান করা এবং ইহা দ্বারা উষ্য করা যাইবে। আল-ফাসী লিখিয়াছেন যে, যমযমের পানি দ্বারা পবিত্রতা অর্জন করা যাইবে। ইমাম নববী এবং মাওয়ারদীও একই কথা বলিয়াছেন। ভিন্ন পানির ব্যবস্থা থাকিলে যমযমের পানি দ্বারা শৌচকার্য করা জাইয নয়। এই পানি দ্বারা শৌচকার্য সমাধা করিলে অর্শ রোগ হয় বলিয়া কথিত আছে। মাওয়ারদীর এক বর্ণনা হইতে জানা যায় যে, যমযমের পানি দ্বারা শৌচ করা এবং মুদাকে গোসল করানো জাইয নয়। মালিকী মাযহাবে ইহার পানি দ্বারা উযূ করা মুস্তাহাব বলা হইয়াছে। শাফিঈ মাযহাবমতে ইহার পানি দ্বারা উযূ ও গোসল উভয়ই জাইয। ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল (র)-এর এক মত অনুযায়ী যমযমের পানি দ্বারা উযূ করা মাকরূহ। ফাঁকিহী উল্লেখ করিয়াছেন যে, মক্কার লোকেরা মুর্দাকে গোসল করানোর পর বরকত লাভের উদ্দেশে যমযমের পানি দ্বারা মুর্দাকে আরেকবার গোসল করাইয়া থাকে। আবু বা আস-সিদ্দীক (রা)-এর কন্যা আসমা (রা) তাঁহার পুত্র এবং হিজরতের পর প্রথম জন্মগ্রহণকারী আবদুল্লাহ ইবনুয যুবায়র (রা)-এর লাশ যমযমের পানি দ্বারা গোসল করান। শায়খ জামালুদ্দীন মুহাম্মাদ জারুল্লাহ আল-কুরায়শী তাঁহার গ্রন্থে লিখিয়াছেন, যমযম কূপের পানি পবিত্র। তবে ইহার অর্থ এই নহে, উহা শৌচকার্যে ব্যবহার করা যাইবে না। অপরদিকে মুহিব্বদীন আত-তাবারী জোর দিয়া বলিয়াছেন যে, যমযমের পানি দ্বারা পবিত্রতা অর্জন বৈধ হইলেও ইহা দ্বারা শরীরের নাপাক দূর করা জাইয নয়।
আল ফাসী বলেন, চারি মাযহাবের সর্বসম্মত রায় অনুযায়ী যমযম কূপের পানি অন্য স্থানে বা দেশান্তরে লইয়া যাওয়া বৈধ, বরং শাফিঈ ও মালিকী মাযহাবমতে উহা মুস্তাহাব। উম্মুল মুমিনীন হযরত আইশা (রা) তাঁহার সঙ্গে করিয়া যমযমের পানি আনিতেন এবং তিনি অবহিত করিয়াছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা)-ও উহা বহন করিয়া আনিতেন (তিরমিযী, হজ্জ, বাব ১১২, নং ৯০৫, ২খ, পৃ. ২০০)। রাসূলুল্লাহ (সা) কলসী ও চামড়ার মশকে করিয়া যমযমের পানি সঙ্গে নিয়াছেন, রুগ্ন ব্যক্তিদেরকে তাহা পান করাইয়াছেন এবং তাহাদের দেহে উহা ছিটাইয়া দিয়াছেন। ইবন আব্বাস (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) সুহায়ল ইবন বায়দাকে যমযমের পানি উপহার দিয়াছিলেন এবং বিনিময়ে তিনি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে দুইটি ভারবাহী উট উপহার দিয়াছিলেন (সম্পূর্ণ আলোচনাটি আযরাকীর আখবার মাক্কাহ গ্রন্থের বরাতে মক্কা শরীফের ইতিকথা, পৃ. ৭৪-৭৫ হইতে পত্রস্থ)।
ইসমাঈল (আ)-কে কুরবানীর নির্দেশ
আল্লাহ তাআলা হযরত ইবরাহীম (আ)-এর যে কয়টি কঠিন পরীক্ষা গ্রহণ করেন, একমাত্র পুত্র ইসমাঈল (আ)-কে কুরবানীর নির্দেশ সম্বলিত পরীক্ষা তার অন্যতম। নবী-রাসূলগণ নিজ নিজ মর্যাদা ও স্থান অনুযায়ী পরীক্ষার সম্মুখীন হইয়া থাকেন (কাসাসুল কুরআন, ১খ, পৃ. ২৩৫)। তিনি স্বপ্নযোগে নিজ পুত্রকে কুরবানী করার নির্দেশ প্রাপ্ত হন এবং “নবী-রাসূলগণের স্বপ্ন জাগ্রত অবস্থায় প্রাপ্ত ওহীর সমতুল্য” (তাফসীরে ইবন কাছীর, ৩থ, পৃ. ১৮৬; তাফসীরে রূহুল মাআনী, ২৩খ, পৃ. ১২৮ ইত্যাদি)। তিনি পরপর তিন রাত্র স্বপ্ন দর্শন করেন যে, আল্লাহ তাআলা তাঁহাকে তাঁহার একমাত্র পুত্রকে কুরবানী করার নির্দেশ দিতেছেন (মাআরিফুল কোরআন, বাংলা, অনু, ৭খ, পৃ. ১৪৫; কাসাসুল কুরআন, ১খ, পৃ. ২৩৬)। কতক মুফাসসিরের মতে ইবরাহীম (আ) সরাসরি নিজ পুত্রকে কুরবানী করিতেছেন এইরূপ স্বপ্ন দেখিয়াছিলেন (নাজ্জার, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ১০১)। হযরত ইবরাহীম (আ) সর্বপ্রথম যিলহজ্জ মাসের সাত তারিখ দিবাগত আট তারিখের রাত্রে এই স্বপ্ন দর্শন করেন। সারাটি দিন তাহার উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও দুশ্চিন্তার মধ্যে অতিবাহিত হয় যে, স্বপ্নটি কি আল্লাহর পক্ষ হইতে, না ইহা শয়তানের চক্রান্ত? তাই এই দিনটি ইয়াওমুত তারবিয়াহ (উৎকণ্ঠার দিন) নামে অভিহিত হয়। আট তারিখ দিবাগত রাত্রে তিনি পুনরায় একই স্বপ্ন দর্শন করেন এবং অনুধাবন করেন যে, ইহা আল্লাহর একটি নির্দেশ। তাই এই দিনটির নামকরণ করা হয় ইয়াওমুন নাহ্র বা কুরবানীর দিন (তাফসীরে কবীর, ২৬খ, পৃ. ১৫৩; তাফসীরে রূহুল মাআনী, ২৩খ, পৃ. ১২৮; কুরতুবীর আহকামুল কুরআনের বরাতে মাআরিফুল কোরআন, বাংলা অনু, ৭খ, পৃ. ৪৪৫; কাসাসুল কুরআন, ১খ পৃ. ২৩৬)। স্বপ্নের ভিন্নতর ব্যাখ্যা করার অবকাশ থাকা সত্ত্বেও হযরত ইবরাহীম (আ) আল্লাহর নির্দেশের সামনে মাথা নত করিয়া দেন (তাফসীরে কবীরের বরাতে মাআরিফুল কোরআন, ৭খ, পৃ. ৪৪৫)।
কুরআন মজীদে মাত্র এক স্থানে সংক্ষেপে কুরবানী সংক্রান্ত বিষয়ের আলোচনা আছে। বাইবেলেও সংক্ষিপ্তাকারে ঘটনাটির উল্লেখ আছে। তবে সেখানে ইসহাক (আ)-কে যবেহ করার কথা বলা হইয়াছে। বাইবেলের বর্ণনা নিম্নরূপ : “এই সকল ঘটনার পরে সদাপ্রভু ইবরাহীমের পরীক্ষা করিলেন। তিনি তাঁহাকে বলিলেন, হে ইবরাহীম! তুমি আপন পুত্রকে, তোমার অদ্বিতীয় পুত্রকে, যাহাকে তুমি ভালোবাস, সেই ইসহাককে লইয়া মোরিয়া দেশে যাও এবং তথাকার যে এক পর্বতের কথা আমি তোমাকে বলিব, তাহার উপর তাহাকে হোমাৰ্থে যবেহ কর। পরে ইবরাহীম প্রত্যুষে উঠিয়া গর্দভ সাজাইয়া দুইজন দাস ও আপন পুত্র ইসহাককে সঙ্গে লইলেন, হোমের নিমিত্ত কাষ্ঠ কাটিলেন, আর উঠিয়া সদাপ্রভুর নির্দিষ্ট স্থানের দিকে গমন করিলেন। তৃতীয় দিবসে ইবরাহীম চক্ষু তুলিয়া দূর হইতে সেই স্থান দেখিলেন। তখন ইবরাহীম আপন দাসদিগকে কহিলেন, তোমরা এই স্থানে গর্দভের সহিত থাক; আমি ও যুবক আমরা ঐ স্থানে গিয়া প্রণিপাত করি, পরে তোমাদের কাছে ফিরিয়া আসিব। তখন ইবরাহীম হোমের কাষ্ঠ লইয়া আপন পুত্র ইসহাকের স্কন্ধে দিলেন এবং নিজ হস্তে অগ্নি ও খড়গ লইলেন; পরে উভয়ে একত্রে চলিয়া গেলেন। আর ইসহাক আপন পিতা ইবরাহীমকে বলিলেন, হে আমার পিতা! তিনি কহিলেন, হে বৎস! দেখ, এই আমি। তখন তিনি বলিলেন, এই দেখুন অগ্নি ও কাষ্ঠ, কিন্তু হোমের নিমত্ত মেষশাবক কোথায়? ইবরাহীম কহিলেন, বৎস! সদাপ্রভু আপনি হোমের জন্য মেষশাবক যোগাইবেন। পরে উভয়ে একসঙ্গে চলিয়া গেলেন। সদাপ্রভুর নির্দিষ্ট স্থানে উপস্থিত হইলে ইবরাহীম সেখানে যবেহ করার মঞ্চ নির্মাণ করিয়া কাষ্ঠ সাজাইলেন, পরে আপন পুত্র ইসহাককে বাঁধিয়া মঞ্চে কাষ্ঠের উপর রাখিলেন। অতঃপর ইবরাহীম হস্ত বিস্তার করিয়া আপন পুত্রকে যবেহ করিতে খড়গ গ্রহণ করিলেন। এমন সময় আকাশ হইতে সদাপ্রভুর দূত তাহাকে ডাকিলেন এবং বলিলেন, ইবরাহীম! তিনি বলিলেন, দেখুন এই আমি। তখন তিনি বলিলেন, যুবকের প্রতি তোমার হস্ত বিস্তার করিও না, তুমি সদাপ্রভুকে ভয় কর, আমাকে আপনার অদ্বিতীয় পুত্র দিতেও অসম্মত নও। তখন ইবরাহীম চক্ষু তুলিয়া চাহিলেন, আর দেখ, তাঁহার পশ্চাৎ দিকে একটি মেষ, তাহার শিং ঝোপে বদ্ধ। পরে ইবরাহীম গিয়া সেই মেষটি লইয়া আপন পুত্রের পরিবর্তে হোমাৰ্থে যবেহ করিলেন।….. পরে সদাপ্রভু কহিলেন….. আমি অবশ্যই তোমাকে আশীর্বাদ করিব এবং আকাশের তারকারাজি ও সমুদ্র তীরস্থ বালুকার ন্যায় তোমার অতিশয় বংশ বৃদ্ধি করিব…” (বাইবেলের যাত্রাপুস্তক, ২২ : ১-১৯)। যীহুল্লাহ সম্পর্কে বাইবেলের বর্ণনায় স্ববিরোধিতা রহিয়াছে। কুরআন মজীদে এই ঘটনার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা নিম্নরূপঃ
“অতঃপর সে যখন তাহার পিতার সহিত কাজ করিবার বয়সে উপনীত হইল তখন ইবরাহীম বলিল, বৎস! আমি স্বপ্নে দেখি যে, আমি তোমাকে যবেহ করিতেছি। অতএব তোমার অভিমত কি বল। সে বলিল, হে আমার পিতা! আপনি যাহা আদিষ্ট হইয়াছেন তাহাই করুন। আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাইবেন। যখন তাহারা উভয়ে আনুগত্য প্রকাশ করিল এবং ইবরাহীম তাহার পুত্রকে কাৎ করিয়া শোয়াইল তখন আমি তাহাকে ডাকিয়া বলিলাম, হে ইবরাহীম! তুমি তো স্বপ্নাদেশ সত্যিই পালন করিলে। আমি এইভাবেই সৎকর্মপরায়ণদেরকে পুরস্কৃত করিয়া থাকি। নিশ্চয় ইহা ছিল এক স্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তাহাকে মুক্ত করিলাম এক কুরবানীর বিনিময়ে। আমি ইহা পরবর্তীদের স্মরণে রাখিয়াছি। ইবরাহীমের উপর শান্তি বর্ষিত হউক। এইভাবে আমি সৎকর্মপরায়ণদেরকে পুরস্কৃত করিয়া থাকি। সে ছিল আমার মুমিন বান্দাদের অন্যতম” (৩৭ ১০২-১১১)।
ইতিহাস ও তাফসীর ভিত্তিক বিবরণ হইতে জানা যায় যে, হযরত ইসমাঈল (আ) তখন তের বৎসর বয়সে পদার্পণ করেন (মাআরিফ, ৭/৪৪৬) (মাযহারী)। কুরআন হইতে তের বৎসর বয়স সংক্রান্ত মতের সমর্থন পাওয়া যায়। যেমন বলা হইয়াছে “সে যখন তাহার সহিত কাজ করিবার মত বয়সে উপনীত হইল।” অতএব তের বৎসর বা তাহার কাছাকাছি বয়সই সমর্থনযোগ্য। এই বয়সের বালকের মধ্যে পূর্ণ বুদ্ধির উন্মেষ না ঘটিলেও ভালো-মন্দ, লাভ-ক্ষতি এবং উপকারী ও ক্ষতিকারক বিষয়ের মধ্যে পার্থক্যবোধের উন্মেষ ঘটিয়া থাকে। ইসলামী শরীআতে এই বয়সের শিশুদেরকে “সাগীর মুমায়্যিয” বলা হয় (দ্র. মুজাম লুগাতিল ফুকাহা, পৃ. ২৭৪, শিরো, সাগীর; কাওয়াইদুল ফিকহ, পৃ.৩৪৯, শিরো, ঐ)। হযরত ইবরাহীম (আ) সুযোগ্য পুত্রের সামনে পরামর্শ লাভের ভঙ্গিতে স্বপ্নের বিষয় পেশ করেন : “আমি স্বপ্নে দেখিলাম যে, আমি তোমাকে যবেহ করিতেছি”। যেমন পিতা তেমন সন্তান এবং ভাবী নবী। পিতার বক্তব্য শোনামাত্র তিনি জবাব দিলেন, “আপনি যাহা আদিষ্ট হইয়াছেন তাহাই করুন। আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাইবেন” (নাজ্জার, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ১০১)। এই কথার মধ্য দিয়া কিশোর ইসমাঈল (আ)-এর অতুলনীয় বিনয় ও আত্মনিবেদনের পরিচয় পাওয়া যায় এবং সঙ্গে সঙ্গে ইহাও উপলব্ধি করা যায় যে, আল্লাহ্ তাআলা তাহাকে এই কচি বয়সে কি পরিমাণ মেধা ও জ্ঞান দান করিয়াছিলেন (বিদায়া, ১খ, পৃ. ১৫৮)। কোন কোন বর্ণনা হইতে অনুমিত হয় যে, হযরত ইবরাহীম (আ) কুরবানী করার নির্দেশ প্রাপ্তির পর পুত্রকে বলিলেন, বৎস! দড়ি ও ছুরি লও, আমরা পরিবারের জ্বালানী কাষ্ঠ সংগ্রহের নিমিত্ত ঐ উপত্যকায় যাই। তিনি উপকার নির্জন স্থানে পৌঁছিয়া পুত্রকে কুরবানীর বিষয়টি অবহিত করেন (আল-কামিল, ১খ, পৃ. ৮৬; আরাইস, পৃ. ৯৯-১০০)। তাফসীর ও ইতিহাসের বর্ণনা হইতে আরও জানা যায় যে, শয়তান হাজার (রা), ইবরাহীম (আ) ও ইসমাঈল (আ)-কে প্রতারিত করার পেপ্রয়াস চালায়। প্রতিবারই তিনি শয়তানের প্রতি সাতটি করিয়া পাথর নিক্ষেপ করিয়া অভিশপ্তকে বিতাড়িত করেন। এই প্রশংসনীয় কাজের স্মৃতিস্বরূপ মিনায় কঙ্কর নিক্ষেপ মহান হজ্জের অনুষ্ঠানসমূহের অন্তর্ভুক্ত করা হইয়াছে (মাআরিফুল কোরআন, ৭খ, পৃ. ৪৪৮; আল-কামিল, ১খ, পৃ. ৮৬)। ইবন আব্বাস (রা) হইতে আবুত তুফায় বর্ণনা করেন যে, ইবরাহীম (আ) নিজ পুত্রকে কুরবানী করার নির্দেশপ্রাপ্ত হইলে পর শয়তান মাশআরুল হারাম নামক স্থানে ইবরাহীম (আ)-এর মুখামুখি হয় এবং তিনি তাহাকে পরাস্ত করেন। অতঃপর জামরাতুল আকাবায় পৌঁছিয়া শয়তান তাহাকে প্রতারিত করিতে চাহিলে তিনি তাহার প্রতি পরপর সাতটি কঙ্কর নিক্ষেপ করিয়া উহাকে বিতাড়িত করেন। একইভাবে জামরাতুল উসতায় এবং অবশেষে জামরাতুল কুবরায় পৌঁছিয়া শয়তান তাহার প্রতিবন্ধক হইলে তিনি উভয় স্থানে ইহার প্রতি পরপর সাতটি করিয়া প্রস্তর নিক্ষেপ করিয়া ইহাকে তাড়াইয়া দেন এবং অতঃপর আল্লাহর নির্দেশ কার্যকর করিতে উদ্যোগী হন (আরাইস, পৃ. ১০১)।
আবু হুরায়রা (রা) কাব আল-আহ্বারের সূত্রে এবং ইব্ন ইসহাক কতিপয় সূত্রে শয়তানের ধোকা প্রদানের ঘটনা এইভাবে বর্ণনা করিয়াছেনঃ হযরত ইবরাহীম (আ) তাঁহার পুত্রকে কুরবানী করার স্বপ্ন দর্শনের পর শয়তান ইবরাহীম (আ) পরিবারকে ধোকা দিতে বদ্ধপরিকর হইল। সে মানুষের বেশে হযরত হাজার (রা)-এর নিকট উপস্থিত হইয়া বলিল, তুমি কি জান ইবরাহীম তোমায় পুত্রকে কোথায় লইয়া গিয়াছে। তিনি বলেন, কাষ্ঠ সংগ্রহের জন্য এই উপত্যকায় গিয়াছেন। শয়তান শপথ করিয়া বলিল, সে তাহাকে যবেহ করিতে লইয়া গিয়াছে। তিনি বলিলেন, কখনও নহে, তিনি তাহার প্রতি আমা হইতে অধিক স্নেহশীল ও মমতাময়। শয়তান বলিল, ইবরাহীমের ধারণা যে, তাহাকে তাহার প্রভু ইহা করিবার নির্দেশ দিয়াছেন। তখন হাজার (রা) বলিলেন, আল্লাহ যদি তাঁহাকে এই হুকুম দিয়া থাকেন তাহা হইলে তিনি আল্লাহর আনুগত্য করিতে এবং তাঁহার নির্দেশের কাছে আত্মসমর্পণ করিতে উত্তম কাজই করিয়াছেন। এই উত্তরে নিরাশ হইয়া শয়তান ইসমাঈল (আ)-এর নিকট উপস্থিত হইল এবং তাঁহাকে বলিল, হে বালক! তুমি কি জান তোমার পিতা তোমাকে কোথায় লইয়া যাইতেছে? তিনি বলিলেন, ঐ উপত্যকায় কাষ্ঠ সংগ্রহের জন্য। সে শপথ করিয়া বলিল, তিনি তোমাকে যবেহ করিতে এখানে আনিয়াছেন। কারণ তিনি ধারণা করেন যে, আল্লাহ তাঁহাকে ইহা করিবার নির্দেশ দিয়াছেন। ইসমাঈল (আ) বলিলেন, যদি তাহাই হইয়া থাকে তবে তিনি আল্লাহর নির্দেশ পালন করুন। এই উত্তরে শয়তান নিরাশ হইয়া হযরত ইবরাহীম (আ)-এর নিকট উপস্থিত হইয়া বলিল, হে বৃদ্ধ! কোথায় যাইতেছেন? তিনি বলিলেন, একটি প্রয়োজনে এই উপত্যকায়। সে বলিল, আমি অবশ্যই মনে করি যে, শয়তান আপনাকে পুত্র কুরবানীর স্বপ্ন দেখাইয়াছে। ইবরাহীম (আ) শয়তানকে চিনিয়া ফেলিলেন এবং বলিলেন, হে অভিশপ্ত! আমার নিকট হইতে দূর হও । আল্লাহর শপথ! আমি আমার প্রভুর নির্দেশ অবশ্যই পালন করিব (দ্র. কুরতুবীর আহকামুল কুরআন, ১৫, পৃ. ১০৫-৬; রূহুল মাআনী, ২৩ খ, পৃ. ১৩২; তাফসীর ইবন কাছীর, ৩খ, পৃ. ১৮৭; তাফসীরে কবীর, ২৬খ, পৃ. ১৫৩; মাআরেফুল কোরআন, ৭খ, পৃ. ৪৪৮)। হযরত ইবরাহীম (আ) পুত্রের পরামর্শ অনুযায়ী তাঁহার হাত-পা শক্ত করিয়া বাঁধিয়া উপুড় করিয়া শোয়াইলেন, অতঃপর তাহার গলায় নিজ হস্তে দ্রুত ছুরি চালাইলেন কিন্তু শত চেষ্টা সত্ত্বেও এক গাছি পশমও কাটিতে পারেন নাই । পিতা-পুত্রের এইরূপ কঠিন পরীক্ষা চলা অবস্থায় আল্লাহ তাআলা ডাক দিলেন : “হে ইবরাহীম! তুমি তো স্বপ্নকে সত্য প্রমাণিত করিয়া দেখাইলে”। ইমাম সুদ্দী (র) বলেন যে, আল্লাহ তাআলা পিতার ছুরি ও পুত্রের কণ্ঠনালীর মাঝখানে একটি তাম্রপাত রাখিয়া দিয়াছিলেন। ফলে ছুরি কণ্ঠনালী স্পর্শ করিতে পারে নাই (আরাইস, পৃ. ১০০)। মহান আল্লাহ বলেন : “আমি এইভাবেই সকর্মপরায়ণদেরকে পুরস্কৃত করিয়া থাকি”। হে ইবরাহীম। এই তোমার পুত্রের পরিবর্তে তোমার যবেহ করার প্রাণী। ইহাকে তুমি যবেহ কর। ইবরাহীম (আ) দৃষ্টি ফিরাইয়া একটি হৃষ্টপুষ্ট দুম্বাসহ হযরত জিবরাঈল (আ)-কে উপস্থিত দেখিতে পান। ইবন আব্বাস (রা) হইতে বর্ণিত যে, ইহা ছিল জান্নাতের একটি দুম্বা যাহা চল্লিশ বৎসর ধরিয়া জান্নাতে বিচরণ করিয়াছে। অপর বর্ণনায় আছে, ইবন আব্বাস (রা) বলেন যে, ইবরাহীম (আ) যে দুম্বা যবেহ করেন তাহা ছিল আদম (আ)-এর পুত্র হাবীল কর্তৃক কুরবানীকৃত দুম্বা, যাহা আল্লাহ কবুল করিয়াছিলেন (তাফসীরে কবীর, ২৬খ, পৃ. ১৫৮; তাফসীরে রূহুল মাআনী, ২৩ খ, পৃ. ১৩২)।
ইবরাহীম (আ) পুত্রকে ছাড়িয়া দিলেন এবং দুটি মিনার কুরবানীর স্থানে যবেহ করিলেন (আরাইস, পৃ. ১০০; মাআরেফুল কোরআন, ৭খ, পৃ. ৪৪৯)। তখন হইতে কিয়ামতকাল পর্যন্ত তৌহীদবাদী মানবজাতির জন্য প্রতি বৎসর দশ যুলহিজ্জা পশু কুরবানী করার ঐতিহ্য চালু হইয়াছে। এইভাবে অবিস্মরণীয় করিয়া রাখা হইয়াছে পিতা-পুত্রের এক কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার দৃষ্টান্তকে। “নিশ্চয় ইহা ছিল এক স্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তাহাকে মুক্ত করিলাম এক কুরবানীর বিনিময়ে। আমি ইহা পরবর্তীদের জন্য স্মরণে রাখিয়াছি” (৩৭ : ১০৬-৭)।
এখানে একটি প্রশ্ন জাগিতে পারে যে, হযরত ইবরাহীম (আ) তো পুত্রকে কুরবানী করার স্বপ্ন দেখিয়াছেন, অথচ তিনি তাহাকে কুরবানী করেন নাই। তাহা হইলে নবীর স্বপ্ন সত্য হইল কিভাবে :বস্তুত ইবরাহীম (আ) স্বপ্নে পুত্রকে যবেহ করিতে দেখিয়াছেন, যবেহ করিয়া তাহাকে শেষ করিয়া ফেলিয়াছেন তাহা দেখেন নাই। অতএব তিনি তাঁহার স্বপ্ন বাস্তবায়িত করিয়াছেন অর্থাৎ স্বপ্নে যবেহ করিতে দেখিয়াছিলেন এবং বাস্তবেও তিনি ছুরি হাতে লইয়া পুত্রের গলায় তাহা সজোরে চালাইয়াছেন কিন্তু যেহেতু তিনি যবেহকর্ম সমাপ্ত করিয়াছেন এইরূপ স্বপ্ন দেখেন নাই, তাই বাস্তবেও যবেহ সমাপ্ত করিতে পারেন নাই। আল্লাহ তাঁহাকে যতদূর স্বপ্ন দেখাইয়াছেন, তিনি ততটাই বাস্তবায়িত করিয়াছেন (দ্র. তাফসীরে কবীর, ২৬খ, পৃ. ১৫৫; তাফহীমুল কুরআন, ৩৭ ও ১০২ ও ১০৫ আয়াত সংশ্লিষ্ট ৫৮ ও ৬৩ নং টীকা)।
ইয়াহুদী-খৃস্টানগণ হযরত ইসমাঈল (আ)-এর প্রতি বিদ্বেষবশত এই কুরবানীর ঐতিহ্যকে ত্যাগ করিয়াছে । আরবদের মধ্যে ইহা চালু থাকিলেও কালক্রমে তাওহীদের বিশ্বাস হইতে তাহাদের বিচ্যুতির সঙ্গে সঙ্গে এই প্রথাও বিকৃত হইয়া যায়। তাহারা আল্লাহর উদ্দেশ্যে কুরবানী করার পরিবর্তে তাহাদের মনগড়া দেব-দেবীর নামে পশু উৎসর্গ করিত। যেমন কুরআন মজীদে উক্ত হইয়াছে :
“এবং যাহা মূর্তিপূজার বেদীর উপর বলি দেওয়া হয় (তাহাও তোমাদের জন্য হারাম)” (৫ : ৩)।
জাহিলী যুগে আরব মুশরিকরা কাবা ঘরে স্থাপিত মূর্তির নামে পশু যবেহ করিত এবং উহার রক্ত সেগুলির দেহে মর্দন করিত। অন্যান্য স্থানেও তাহারা অনুরূপ কুরবানগাহ স্থাপন করিয়াছিল (ফী জিলালিল কুরআন, ২খ, পৃ. ৮৪০)। ইবন কাছীর (র) বলেন, অর্থাৎ মূর্তিপূজার বেদীতে যাহা যবেহ করা হয়। মুজাহিদ ও ইবন জুরায়জ বলেন, কাবা গৃহের পার্শ্বে অবস্থিত একটি পাথরকে নুসুব বলা হয়। ইবন জুরায়জ আরও বলেন, জাহিলী যুগে সেখানে ৩৬০টি পূজার বেদী ছিল। সেইগুলির উপর তাহারা পশু বলি দিত এবং তাহারা কাবাগৃহের নিকটবর্তী বেদীগুলিতে বলিকৃত পশুর রক্ত কাবাগৃহে ছিটাইয়া দিত এবং ঐগুলির গোশত বেদীমূলে রাখিয়া দিত (তাফসীরে ইব্ন কাছীর, সংক্ষিপ্ত সং, ১খ, পৃ. ৪৮১; বৃহৎ সং, ২খ, পৃ. ৪৮৬)।
“যাহাতে আল্লাহর নাম লওয়া হয় নাই তাহার কিছুই তোমরা আহার করিও না” (৬ : ১২১)।
উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় আতা (র) বলেন, এখানে সেইসব জন্তুর গোশত ভক্ষণ করিতে নিষেধ করা হইয়াছে, যাহা কুরায়শ সম্প্রদায় তাহাদের দেব-দেবীর নামে যবেহ করিত (তাফসীরে ইবন কাছীর, উক্ত আয়াতাধীন; ফী জিলালিল কুরআন, ৩খ, পৃ. ১১৯৭)।
মহানবী (স) নবুওয়াত প্রাপ্তির পর এই মহান কুরবানীকে পুনর্জীবিত করেন এবং ইহা আবহমান কাল পর্যন্ত ইসলামী শরীআতে একটি অবশ্য পালনীয় প্রথারূপে বিধিবদ্ধ হয়। মহান আল্লাহ বলেন :
“সুতরাং তুমি তোমার প্রভুর উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর এবং কুরবানী কর” (১০৮: ২)।
“যাহাতে তাহারা তাহাদের কল্যাণময় স্থানগুলিতে উপস্থিত হইতে পারে এবং তিনি তাহাদেরকে চতুস্পদ জন্তু হইতে যাহা রিযিক হিসাবে দান করিয়াছেন উহার উপর নির্দিষ্ট দিনগুলিতে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করিতে পারে। অতঃপর তোমরা উহা হইতে আহার কর এবং দুঃস্থ-অভাবগ্রস্তকে আহার করাও” (২২৪২৮)।
“আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য কুরবানীর নিয়ম করিয়া দিয়াছি। তিনি তাহাদেরকে রিযিকরূপে যে সকল চতুস্পদ জন্তু দান করিয়াছেন, সেগুলির উপর যেন তাহারা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে” (২২ ও ৩৪)।
“এবং উষ্ট্রকে করিয়াছি আল্লাহর নিদর্শনগুলির অন্যতম, তোমাদের জন্য উহাতে রহিয়াছে কল্যাণ। সুতরাং সারিবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান অবস্থায় উহাদের উপর তোমরা আল্লাহর নাম উচ্চারণ কর । যখন এইগুলি কাত হইয়া পড়িয়া যায় তখন তোমরা উহা হইতে আহার কর এবং ধৈর্যশীল অভাবগ্রস্তকে ও যাজ্ঞাকারী অভাবগ্রস্তকেও আহার করাও” (২২ : ৩৬)।
সাহাবায়ে কিরাম (রা) মহানবী (স)-কে জিজ্ঞাসা করেন, “হে আল্লাহর রাসূল! এই কুরবানী কি?” তিনি বলেন : “তোমাদের পিতা ইবরাহীম (আ)-এর সুন্নাত” (সুনান ইব্ন মাজা, আদাহী, বাব ছাওয়াবিল উদহিয়্যা)।
কুরবানী করা হইয়াছিল ইসমাঈলকে, ইসহাককে নয়
কুরআন মজীদে কুরবানীর যে ঘটনা বিবৃত হইয়াছে তাহাতে নামোল্লেখ করিয়া বলা হয় নাই যে, হযরত ইবরাহীম (আ) তাঁহার পুত্রদ্বয়ের মধ্যে ইসমাঈল (আ)-কে কুরবানী করিয়াছেন, না ইসহাক (আ)-কে। এই বিষয়ে হাদীছের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থাবলীতেও সহীহ সনদসূত্রে রাসূলুল্লাহ (স)-এর কোন বক্তব্যও বিদ্যমান নাই। ইয়াহুদী-খৃস্টান সম্প্রদায় দাবি করে যে, হযরত ইসহাক (আ)-কে কুরবানী করা হইয়াছিল, ইসমাঈল (আ)-কে নয়। এই বিষয়ে বাইবেলের বক্তব্য নিম্নরূপঃ “তুমি আপন পুত্রকে, তোমার অদ্বিতীয় পুত্রকে, যাহাকে তুমি ভালবাস, সেই ইসহাককে লইয়া মোরিয়া দেশে যাও এবং তথাকার যে এক পর্বতের কথা আমি তোমাকে বলিব, তাহার উপর তাহাকে হোমার্থে কুরবানী কর” (আদিপুস্তক, ২২ ও ২ এবং উক্ত অধ্যায়ে কুরবানীর ঘটনাও বিধৃত হইয়াছে)। উপরিউক্ত বক্তব্যে লক্ষ্য করা যায় যে, হযরত ইবরাহীম (আ)-কে তাঁহার অদ্বিতীয় অর্থাৎ একমাত্র পুত্রকে কুরবানী করার নির্দেশ প্রদান করা হইয়াছিল। অথচ হযরত ইসহাক (আ) কোনও কালেও তাঁহার একমাত্র বা অদ্বিতীয় পুত্র ছিলেন না। স্বয়ং বাইবেল হইতেই প্রমাণিত যে, হযরত ইসমাঈল (আ)-ই ছিলেন দীর্ঘ চৌদ্দ বৎসর পর্যন্ত হযরত ইবরাহীম (আ)-এর একমাত্র ও অদ্বিতীয় পুত্র। বাইবেল বলে, “ইবরাহীমের ছিয়াশি বৎসর বয়সে হাগার ইবরাহীমের নিমিত্তে ইসমাঈলকে প্রসব করিল” (আদিপুস্তক, ১৬ ও ১৬)। “ইবরাহীমের এক শত বৎসর বয়সে তাঁহার পুত্র ইসহাকের জন্ম হয়” (আদিপুস্তক, ২১ : ৫)। “ইবরাহীমের লিঙ্গাগ্রের ত্বক ছেদনকালে তাঁহার বয়স নিরানব্বই বৎসর, আর তাঁহার পুত্র ইসমাঈলের লিঙ্গাগ্রের ত্বক ছেদনকালে তাঁহার বয়স তের বৎসর” (আদিপুস্তক, ১৭ : ২৪-২৫)। অতএব এখানেও লক্ষ্য করা যায় যে, ইবরাহীম (আ) নিরানব্বই বৎসর বয়সে যখন খতনা করার নির্দেশ প্রাপ্ত হন তখনও তাঁহার পরিবারে একমাত্র পুত্র সন্তান ছিলেন হযরত ইসমাঈল (আ) এবং তাহার বয়স তখন তের বৎসর। অতএব ইহাই যুক্তিসঙ্গত যে, আল্লাহ তাআলা ইবরাহীম (আ)-কে তাঁহার সর্বাপেক্ষা প্রিয়পাত্র ও অদ্বিতীয় পুত্র ইসমাঈল (আ)-কেই কুরবানী করিতে নির্দেশ প্রদান করিয়াছিলেন।
একদল খৃস্টান পাদ্রী উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার জন্য বলিয়া থাকে যে, ইসমাঈল (আ) দাসীপুত্র হওয়ায় তাহার মাংসে রক্ত-মাংসের (কামনা-বাসনা) আধিক্য ছিল এবং ইসহাক (আ) স্বাধীনা মহিলার সন্তান হওয়াতে তিনিই আল্লাহর প্রতিশ্রুত পবিত্র সন্তান (দ্র. বাইবেলের লূতন নিয়ম, গালাতীয় পুস্তক, ৪ : ২২-২৬)। এই কথা মোটেই সত্য নহে যে, ইসমাঈল (আ)-এর মাতা হাজার (রা) দাসী ছিলেন, বরং তিনি ছিলেন রাজবংশীয়া (এই বিষয়ে তথ্যনির্ভর আলোচনার জন্য দ্র. “ইবরাহীম” শীর্ষক নিবন্ধ)। বাইবেলে বহুবার হযরত ইসমাঈল (আ)-কে হযরত ইবরাহীম (আ)-এর পুত্র বলা হইয়াছে, যেভাবে হযরত ইসহাক (আ)-কে বলা হইয়াছে। “পরে ইবরাহীম আপন পুত্র ইসমাঈলকে…” (আদিপুস্তক, ১৭ : ২৩); “ইব্রাহীম ও তাহার পুত্র ইসমাঈল…” (ঐ, ১৭৪ ২৬); “আর তাঁহার পুত্র ইসমাঈলের…” (ঐ, ১৭ : ২৫)। উপরন্তু ইসহাক (আ)-এর জন্য বাইবেলে যেরূপ ‘বিরাট ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি বিদ্যমান, ইসমাঈল (আ)-এর জন্যও দ্রুপ বিরাট ভবিষ্যতের প্রতিশ্রতি বিদ্যমান রহিয়াছে।
“সদাপ্রভুর দূত তাহাকে (হাজারকে) আরও বলিলেন, আমি তোমার বংশের এমন বৃদ্ধি করিব যে, বাহুল্য প্রযুক্ত অগণ্য হইবে…” (আদিপুস্তক, ১৬ : ১০)।
“আর ইসমাঈলের বিষয়েও তোমার (ইবরাহীমের) প্রার্থনা শুনিলাম। দেখ, আমি তাহাকে আশীর্বাদ করিলাম এবং তাহাকে ফলবান করিয়া তাহার অতিশয় বংশবৃদ্ধি করিব, তাহা হইতে দ্বাদশ রাজা উৎপন্ন হইবে এবং আমি তাহাকে বড় জাতি করিব” (আদিপুস্তক, ১৭ ও ২০)।
অনুরূপভাবে হযরত ইসমাঈল (আ)-ও ইসহাক (আ)-এর মতই ইবরাহীম (আ)-এর প্রতিশ্রুত সন্তান। ইবরাহীম (আ) নিঃসন্তান হওয়ার অভিযোগ করিলে “সদাপ্রভুর বাক্য তাঁহার নিকট উপস্থিত হইল… যে তোমার ঔরসে জন্মিবে সে তোমার উত্তরাধিকারী হইবে” (আদিপুস্তক, ১৫ ও ৪)। এই ভবিষ্যদ্বাণীর পরপরই হযরত ইসমাঈল (আ)-এর জন্মবৃত্তান্ত বিবৃত হইয়াছে এবং তথায় হযরত হাজার (রা)-কে পুত্র সন্তান প্রসবের সুসংবাদ প্রদান করা হইয়াছে (দ্র. আদিপুস্তক, ১৬ ও ১-১৬)।
ইবরাহীম (আ) ও ইসমাঈল (আ) কর্তৃক আল্লাহর মহান ঘর কাবা শরীফ নির্মাণ ও ইহাকে কেন্দ্র করিয়া আল্লাহ তাআলা তৌহীদের পতাকাবাহী মানবগোষ্ঠীর হজ্জ অনুষ্ঠানের যে মহান ইবাদতের ব্যবস্থা করিয়াছিলেন, সেই ধারাবাহিক ইতিহাসকে বাইবেলে যেভাবে বিলুপ্ত করা হইয়াছে, দ্রুপ কুরবানী সংক্রান্ত ইতিহাসকেও বিলোপ না করিলেও উহার ব্যাপক তথ্যগত বিকৃতি সাধন করা হইয়াছে। বাইবেলে উদ্দেশ্যমূলকভাবেই হাজার (রা)-কে দাসী আখ্যায়িত করা হইয়াছে, কুরবানীর এলাকা মারওয়া পাহাড়কে মোরিয়া বলা হইয়াছে এবং ইসমাঈল-এর স্থলে ইসহাক শব্দ প্রবিষ্ট করা হইয়াছে। বাস্তবিকই ইসহাক (আ) যবীহুল্লাহ হইয়া থাকিলে ইয়াহুদী-খৃস্টানদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে কোন না কোনভাবে এত বড় মাহাত্ম্যপূর্ণ ঘটনার স্মৃতি জাগরুক থাকিত, কিন্তু তাহা নাই। এই মহান মর্যাদাপূর্ণ ঘটনার ইতিহাস কেবল মুসলমানগণই জাগরুক রাখিয়াছে (দ্র. তাফসীরে উছমানী, পৃ. ৫৯৯, টীকা ৬; তাফহীমূল কুরআন, পূ. স্থা.। অবশ্য ইসহাক (আ)-ই যদি যবীহুল্লাহ হইতেন, তাহাতেও মুসলমানদের কোন আপত্তি থাকিত না। কারণ মুসলমানগণ সকল নবীর প্রতিই সমানভাবে শ্রদ্ধাশীল এবং তাহাদের অবদানকে গৌরবের সহিত স্মরণ করিয়া থাকে, তিনি ইসরাঈলী বংশোদ্ভূতই হউন অথবা অ-ইসরাঈলী ।
“আমরা তাঁহার রাসূলগণের মধ্যে কোনও তারতম্য করি না” (২ : ২৮৫; আরও দ্র. ২ : ১৩৬; ৩ : ৮৪)।
হযরত ইসমাঈল (আ)-ই যবীহুল্লাহ ছিলেন বলিয়া মুসলিম উম্মাহর প্রায় সকলেই একমত। সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে হযরত আবু বকর সিদ্দীক, আলী, ইবন উমার, ইবন আব্বাস, আবু হুরায়রা ও মুআবিয়া (রা) এবং তাবিঈগণের মধ্যে ইকরিমা, মুজাহিদ, ইউসুফ ইব্ন মিহরান, হাসান বাসরী, মুহাম্মাদ ইবন কাব আল-কুরাজী, শাবী, সাঈদ ইবনুল মুসায়্যাব, দাহ্হাক, মুহাম্মাদ ইবন আলী ইবনুল হুসায়ন, রাবী ইবন আনাস, আহমাদ ইবন হামবাল (র) প্রমুখ এই মত পোষণ করেন (তাফহীমুল কুরআন, ৪খ, পৃ. ২৯৮, টীকা ৬৭)। কুরআন মজীদে এবং সহীহ হাদীছে যবীহুল্লাহ কে ছিলেন তাহা স্পষ্টভাবে উল্লিখিত না হইলেও ঘটনা-পরম্পরা যেভাবে আলোচিত হইয়াছে তাহাতে স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় যে, ইসমাঈল (আ)-ই ছিলেন যীহুল্লাহ (নাজ্জার, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ১০১)।
(১) আল্লাহ তাআলা হযরত ইবরাহীম (আ)-এর উক্তি এইভাবে উল্লেখ করিয়াছেন।
“আমি আমার প্রতিপালকের দিকে চলিলাম। তিনি অবশ্যই আমাকে সৎপথে পরিচালিত করিবেন” (৩৭ : ৯৯)।
ইহার পর তিনি আল্লাহ তাআলার নিকট সন্তান কামনা করেন :
“হে আমার প্রতিপালক! আমাকে একটি সৎকর্মপরায়ণ সন্তান দান করুন” (৩৭ :১০০)।
অর্থাৎ হযরত ইবরাহীম (আ) সিরিয়ার প্রবাস জীবনের একাকীত্ব দূরীভূত করার জন্য আল্লাহ তাআলার নিকট একটি পুত্রসন্তান প্রার্থনা করেন। এই প্রার্থনাকালে তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। আর এই বিষয়ে ইয়াহুদী, খৃস্টান ও মুসলিম নির্বিশেষে সকলেই একমত যে, ইসমাঈল (আ) ছিলেন ইসহাক (আ)-এর বয়জ্যেষ্ঠ (তাফসীর ইবন কাছীর, ৩খ, পৃ. ১৮৬; তাফসীরে কবীর, ২৬খ, পৃ. ১৫৪)। কুরআন মজীদেও দুই ভ্রাতার উল্লেখের ক্রম নিম্নরূপঃ
“সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আমাকে আমার বার্ধক্যে ইসমাঈল ও ইসহাককে দান করিয়াছেন” (১৪ : ৩৯)।
অতএব প্রমাণিত হয় যে, উক্ত দুআর ফসল হইলেন ইসমাঈল (আ)। অতঃপর যবেহ সংক্রান্ত ঘটনার উল্লেখ করা হইয়াছে। ইহাতে প্রমাণিত হয় যে, যবীহুল্লাহ ছিলেন হযরত ইসমাঈল (আ)।
(২) আবদুল ওয়াহহাব আন-নাজ্জার ৩৭ : ১১৩ আয়াতের ভিত্তিতে অত্যন্ত শক্তিশালী একটি যুক্তি পেশ করিয়াছেন। উক্ত আয়াতে বলা হইয়াছে :
“আমি তাহাকে বরকত দান করিয়াছিলাম এবং ইসহাককেও” (৩৭ : ১১৩)।
উক্ত আয়াতে Al-এর সর্বনাম (দামীর)-এর ৬০ (প্রত্যাবর্তন স্থল) হইল “যবীহ পুত্র” এবং ইহার পর ইসহাক-এর উল্লেখ দ্বারা এই দাবি আরো জোরালো হয় যে, যবীহ ও ইসহাক স্বতন্ত্র দুই ব্যক্তি (কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ১০২)। সংশ্লিষ্ট আয়াতের পরবর্তী অংশ হইতেও তাঁহার ঐ যুক্তির সমর্থন পাওয়া যায়?
“তাহাদের উভয়ের বংশধরদের মধ্যে কতক সৎকর্মপরায়ণ এবং কতক নিজেদের প্রতি স্পষ্ট অত্যাচারী” (৩৭ : ১১৩)।
“তাহাদের উভয়ের বংশধর” বলিতে হযরত ইসমাঈল ও ইসহাক (আ)-এর বংশধরগণকে বুঝানো হইয়াছে (তাফসীরে উছমানী, পৃ. ৬০০, টীকা ২; তাফহীমুল কুরআন, ৪খ, পৃ. ৩০১, টীকা ৬৮)। যদিও কতক তাফসীরবিদ হযরত ইবরাহীম ও ইসহাক (আ)-এর বংশধর বলিয়াছেন, কিন্তু এই প্রসঙ্গে তাহা তাৎপর্যহীন। কারণ ইসহাকের বংশধরগণ ইবরাহীম (আ)-এরই বংশধর (তাফসীরে উছমানী, পূ. স্থা.)।
(৩) কুরআন মজীদে আরও একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, যেসব স্থানে হযরত ইসহাক (আ) সম্পর্কে সুসংবাদ আসিয়াছে সেইসব স্থানে তাহার সহিত ইলম (জ্ঞান)-এর বৈশিষ্ট্যও যুক্ত হইয়াছে :
“তুমি ভয় করিও না, আমরা তোমাকে এক জ্ঞানী পুত্রের সুসংবাদ দিতেছি” (১৫ : ৫৩)।
“তাহাদের মনে উহাদের সম্পর্কে ভীতির সঞ্চার হইল। উহারা বলিল, ভীত হইও না। অতঃপর উহারা তাহাকে এক জ্ঞানী পুত্রের সুসংবাদ দিল” (১ : ২৮)।
কিন্তু কুরবানীর ঘটনার পূর্বাভাষ পর্যায়ে হযরত ইবরাহীম (আ)-কে যে পুত্রসন্তানের সুসংবাদ প্রদান করা হইয়াছিল তাহার সহিত ধৈর্য বা সহিষ্ণুতার গুণ যুক্ত করা হইয়াছে :
“অতঃপর আমি তাহাকে এক ধৈর্যশীল পুত্রের সুসংবাদ দিলাম” (৩৭ : ১০১)।
ইহা হইতে প্রমাণিত হয় যে, ইবরাহীম (আ)-এর দুই পুত্র সন্তানের সহিত স্বতন্ত্র দুইটি গুণের সমাহার ঘটানো হইয়াছে। আর যবেহ করার নির্দেশ জ্ঞানী পুত্রের বেলায় ছিল না, ছিল ধৈর্যশীল পুত্রের ক্ষেত্রে। উপরন্তু কুরআন মজীদের অন্য এক স্থানেও ধৈর্যের গুণ হযরত ইসমাঈল (আ)-এর সহিত যুক্ত করা হইয়াছে :
“এবং স্মরণ কর ইসমাঈল, ইদরীস ও যুল-কিফল-এর কথা, তাহাদের প্রত্যেকেই ছিল ধৈর্যশীল” (২১ : ৮৫)।
পিতা তাঁহার এই ধৈর্যশীল পুত্রকে কাৎ করিয়া যবেহ করিতে উদ্যত হইলে তখন তিনি চরম ধৈর্যের পরিচয় দিয়াছেন এবং এই বিষয়ে পিতাকে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি, “হে পিতা! আপনি যাহার জন্য আদিষ্ট হইয়াছেন তাহাই করুন” (৩৭ : ১০২) রক্ষা করিয়াছেন (দ্র. তাফসীরে কবীর, ২৬খ, পৃ. ১৫৩-৫৪)। তাই কুরআন মজীদের এক স্থানে তাঁহাকে “প্রতিশ্রুতি পালনে সত্যাশ্রয়ী” ছিলেন বলিয়া আখ্যায়িত করা হইয়াছে :
“স্মরণ কর এই কিতাবে ইসমাঈলের কথা, নিশ্চয় সে ছিল প্রতিশ্রুতি পালনে সত্যাশ্রয়ী” (১৯ ৫৪)।
(৪) কুরআন মজীদে হযরত ইসহাক (আ)-এর জন্মগ্রহণের সুসংবাদ প্রদানের সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার ঔরসে হযরত ইয়াকূব (আ)-এর জন্মগ্রহণের সুসংবাদও প্রদান করা হইয়াছে :
“অতএব আমি তাহাকে ইসহাকের এবং ইসহাকের পরবর্তী ইয়াকূবের সুসংবাদ দিলাম” (১১ : ৭১)।
যে পুত্রের জন্মগ্রহণের সুসংবাদ প্রদানের সঙ্গে সঙ্গে তাহার ঔরসে এক যোগ্য সন্তানের জন্মগ্রহণের সুসংবাদও দেওয়া হইয়াছিল, তাহার সম্পর্কে ইবরাহীম (আ)-এর প্রতি যবেহ করার নির্দেশদান যুক্তিসঙ্গত হইতে পারে না। কারণ তাঁহাকে তো স্পষ্ট বাক্যেই জানানো হইয়াছে যে, তাহার পুত্রের ঔরসে আরও একজন নবীর আবির্ভাব হইবে। অতএব ইহা হইতেও প্রমাণিত হয় যে, হযরত ইসমাঈল (আ)-ই ছিলেন যীহুল্লাহ (তাফসীরে কবীর, ২৬খ, পৃ. ১৫৪; মাআরেফুল কোরআন, বাংলা সংস্করণ, ৭খ, পৃ. ৪৫০; তাফহীমুল কুরআন, ৪খ, পৃ. ২৯৯, ৬৭ নং টীকার ৩য় প্যারা; তাফসীরে উছমানী, পৃ. ৫৯৯, টীকা ৬; নাজ্জার, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ১০১ ও ১০৩; বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ, পৃ. ১৫৯)। ইসহাক (আ) যবীহুল্লাহ হইলে সুসংবাদ ও কুরবানীর নির্দেশের মধ্যে একটি বৈপরিত্য দেখা দেয়। একদিকে সুসংবাদ দেওয়া হইয়াছে যে, উক্ত পুত্রের ঔরসে ইয়াকূব নামে একজন নবী জন্মগ্রহণ করিবেন, অপরদিকে পুত্রসন্তান জন্মের পূর্বেই তাঁহাকে কুরবানী করার নির্দেশ প্রদান করা হইতেছে। কিন্তু ইসমাঈল (আ) যবীহুল্লাহ হইলে এই বৈপরিত্যের প্রশ্ন থাকে না (বিদায়া, ১খ, পৃ. ১৫৯; কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ১০৩)।
(৫) কুরবানীর সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করার পর মহান আল্লাহ বলেন :
“আমি তাহাকে সুসংবাদ দিয়াছি ইসহাকের, সে ছিল সৎকর্মপরায়ণদের অন্তর্ভুক্ত” (৩৭ ১১২)।
এই আয়াত হইতে প্রমাণিত হয় যে, ৩৭ : ১০১ আয়াতে যে পুত্র-সন্তানের সুসংবাদ দেওয়া হইয়াছিল তিনি এই শেষোক্ত আয়াতে সুসংবাদ দেওয়া পুত্র হইতে স্বতন্ত্র । হযরত ইবরাহীম (আ) প্রথমোক্ত পুত্রকে কুরবানী করার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইলে আল্লাহ তাআলা তাঁহাকে আরেকজন মহান পুত্রসন্তান দানের সুসংবাদ প্রদান করেন। এই পুত্র যে হযরত ইসহাক (আ) ছিলেন এবং যীহুল্লাহ যে হযরত ইসমাঈল (আ) ছিলেন তাহা অধিক যুক্তিসঙ্গত (তাফহীমুল কুরআন, ৪খ, পৃ. ৩০০, টীকা ৬৭/৪; মাআরেফুল কোরআন, বাংলা অনু, ৭, পৃ. ৪৫০; তাফসীরে উছমানী, পৃ. ৬০০, টীকা ১)।
(৬) পিতা-পুত্র কর্তৃক কাবা ঘর নির্মাণকালে যে দুআ করেন তাহাতে তাঁহারা বলেন, “তুমি আমাদের দুইজনকে তোমার একান্ত অনুগত বানাও” (২ : ১২৮)। আর কুরবানী সংক্রান্ত ঘটনায় বলা হইয়াছে, “যখন তাহারা দুইজনে আনুগত্য প্রকাশ করিল” (৩৭ : ১০৩)। উভয় স্থানে একই শব্দের দ্বিবচন (তাছনিয়া)-এর ব্যবহার হইতেও ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, হযরত ইসমাঈল (আ)-ই ছিলেন যীহুল্লাহ (তাফসীরে উছমানী, পৃ. ৬০০, টীকা ৬)। একইভাবে ‘হালীম’ ( = পরম ধৈর্যশীল, সহিষ্ণু) শব্দটির ব্যবহারও লক্ষ্যণীয়। কুরআন মজীদে নবীদের ক্ষেত্রে কেবল হযরত ইবরাহীম (আ) ও ইসমাঈল (আ)-এর সহিত শব্দটি যুক্ত করা হইয়াছে, অন্য কোন নবীর প্রতি প্রযুক্ত হয় নাই (দ্র. ৯ : ১১৪ এবং ১১ : ৭৫, ইবরাহীম (আ)-এর প্রতি প্রযুক্ত)। আবার কুরবানীর ঘটনা বিবৃত হইবার পূর্বে প্রতিশ্রুত পুত্রের সহিতও উক্ত শব্দ প্রযুক্ত হইয়াছে। ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হইয়াছে যে, ইসহাক (আ)-এর সহিত জ্ঞানবান হওয়ার বিশেষণ যুক্ত করা হইয়াছে। অতএব ইহা হইতেও ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, যীহুল্লাহ ছিলেন হযরত ইসমাঈল (আ)।
(৭) বহু নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক বর্ণনা হইতে জানা যায় যে, হযরত ইসমাঈল (আ)-এর রক্তের বিনিময়ে যে দুম্বা যবেহ করা হইয়াছিল তাহার শিং হযরত আবদুল্লাহ ইবনুষ যুবায়র (রা)-র কাল পর্যন্ত কাবা ঘরে সুরক্ষিত ছিল, কোন কোন বর্ণনামতে কাবা ঘরের মীযাবের সহিত লটকানো ছিল। অতঃপর হাজ্জাজ ইব্ন ইউসুফ আবদুল্লাহ ইবনুয যুবায়র (রা)-কে অবরোধ করিবার কালে কাবা ঘর অগ্নিদগ্ধ হইলে তখন ঐ শিংও নষ্ট হইয়া যায়। ইবন আব্বাস (রা) ও আমের আশ-শাব (র) সাক্ষ্য দেন যে, তাঁহারা স্বচক্ষে কাবা ঘরে ঐ শিং দেখিতে পাইয়াছেন (ইব্ন কাছীর-এর বরাতে তাফহীমুল কুরআন, পূ. স্থা; আরও দ্র. আল-কামিল, ১ খ, পৃ. ৮৫; তাফসীরে কবীর, ২৬ খ, পৃ. ১৫৪; আরাইস, পৃ. ১০০; বিদায়া, ১ খ, পৃ. ১৫৮; তাফসীরে তাবারী, ২৩ খ, পৃ. ৫৬; তাফসীরে ইবন কাছীর, ৩ খ, পৃ. ১৮৮)।
(৮) শত শত বৎসর ধরিয়া আরবদেশে কুরবানীর এই ঘটনা একটি সুরক্ষিত বর্ণনা হিসাবে চলিয়া আসিয়াছে। সেই সুদূর অতীত হইতে মহানবী (স)-এর আবির্ভাবকাল পর্যন্ত লোকেরা হজ্জের সহিত কুরবানীর অনুষ্ঠানও পালন করিত। ইবরাহীম (আ) যেখানে কুরবানী করিয়াছিলেন, লোকেরাও তথায় পশু যবেহ করিত। রাসূলুল্লাহ (স)-ও নবুওয়াত প্রাপ্তির পর এই সুন্নাত বহাল রাখেন এবং বর্তমান কাল পর্যন্ত তাহা অব্যাহত আছে। সাড়ে চার হাজার বৎসর ধরিয়া অব্যাহত এই সুন্নাত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, পিতা-পুত্রের কুরবানীর উত্তরাধিকারী ইসমাঈল (আ)-এর বংশধরগণ, ইসহাক (আ)-এর বংশধরগণ নয়। ইসহাক বংশীয়গণের মধ্যে কোন কালেই কুরবানীর স্মৃতিস্বরূপ এই প্রথা কখনও উদযাপিত হয় নাই (তাফহীমুল কুরআন, পূস্থা)।
আল-আসমাঈ বলেন, আমি আবু আমর ইবনুল ‘আলাকে জিজ্ঞাসা করিলাম যে, যবীহুল্লাহ কে ছিলেন? ইসমাঈল (আ)-ই তো মক্কায় বসবাস করিতেন, তিনি স্বীয় পিতার সঙ্গে একত্রে কাবা ঘর নির্মাণ করেন এবং কুরবানীর স্থান (মানহার) ও তো মক্কায় অবস্থিত (তাফসীরে কবীর, ২৬ খ, পৃ. ১৫৩)।
অতএব সার্বিক প্রেক্ষাপট, ঐতিহাসিক সাক্ষ্য-প্রমাণ এবং আদিকাল হইতে মক্কায় কুরবানীর অনুষ্ঠান উদযাপন (পৃথিবীর অন্য কোথাও নহে) ইত্যাদি বিবেচনা করিলে সহজেই বুঝা যায় যে, যবীহুল্লাহ ছিলেন হযরত ইসমাঈল (আ)।
অবশ্য কতক তাফসীরকারের মতে হযরত ইসহাক (আ) ছিলেন যবীহুল্লাহ। সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে হযরত উমার, আলী, ইবন মাসউদ, আব্বাস ইবন আবদুল মুত্তালিব, ইবন আব্বাস ও আবু হুরায়রা (রা) এবং তাবিঈগণের মধ্যে কাতাদা, ইকরিমা, হাসান বসরী, সাঈদ ইবন জুবায়র, মুজাহিদ, শাবী, মাসরূক, মাকহুল, যুহরী আতা, মুকাতিল, সুদ্দী, কাব আল-আহবার ও যায়দ ইব্ন আসলাম (র) প্রমুখের মতে যবীহুল্লাহ ছিলেন হযরত ইসহাক (আ) (তাফহীমুল কুরআন, ৪খ, পৃ. ২৯৮, টীকা ৬৭)। আল্লামা ইব্ন জারীর তাবারী (র) এই মতের প্রবক্তা (তাফসীরে তাবারী, ২৩ খ, পৃ. ৪৮-৫৩ দ্র.)। ইসহাক (আ) কুরবানীর পাত্র ছিলেন, ইহার পক্ষে যেসব যুক্তিপ্রমাণ পেশ করা হইয়াছে তাহা কেবল ধারণাপ্রলূত, দৃঢ় বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত নহে (কাসাসুল কুরআন, ১খ)। ইবন জারীর তাবারী (র) বলেন, ৩৭ : ১০১ আয়াতে প্রথমে হযরত ইসহাক (আ)-এর জন্মের সুসংবাদ প্রদান করা হইয়াছে, অতঃপর তিনি আল্লাহর সন্তোষ লাভের অভিপ্রায়ে কুরবানী হইবার জন্য প্রস্তুত হইয়া গেলে ইহার পুরস্কারস্বরূপ ৩৭ :১১২ আয়াতে তাহার নবী হওয়ার সুসংবাদ প্রদান করা হয় (তাফসীরে তাবারী, ২৩খ, পৃ. ৫৫; তাফসীরে কবীর, ২৬খ, পৃ. ১৫৪)। তাবারী আরও বলেন, ইসহাক (আ)-এর ঔরসে ইয়াকূব (আ) জন্মগ্রহণ করার পর ইবরাহীম (আ) যবেহ সংক্রান্ত স্বপ্ন দেখিয়াছিলেন (তাফসীরে তাবারী, ২৩ খ, পৃ. ৫৫)। ইমাম তাবারীর এই যুক্তি গ্রহণযোগ্য নহে। কারণ ও
(১) কুরআন মজীদে বলা হইয়াছে, “অতঃপর সে (বালক) যখন পিতার সহিত শ্ৰম করিবার বয়সে উপনীত হইল” (৩৭ ও ১০২), সেই সময় যবেহ করার স্বপ্ন দেখানো হইয়াছিল। উক্ত আয়াতের প্রতি গভীর দৃষ্টিতে তাকাইলে এক বালকের ছবিই অন্তরলোকে ভাসিয়া উঠে; পূর্ণ বয়স্ক, বিবাহিত ও সন্তানের অধিকারী ব্যক্তির ছবি নহে (তাফহীমুল কুরআন, ৪খ, পৃ. ২৯৯-৩০০, টীকা ৬৭/৩)। উপরন্তু যেই সন্তানকে যবেহ করার নির্দেশ প্রদান করা হইয়াছিল তাহার অল্পবয়স্ক ও অবিবাহিত হওয়ার ব্যাপারে প্রায় সকল তাফসীরকারের মধ্যে মতৈক্য বিদ্যমান (বিভিন্ন তাফসীর গ্রন্থে : Jaal ti আয়াতের ব্যাখ্যা দ্র.)।
(২) তাবারীর এই বক্তব্যও অপ্রাসঙ্গিক যে, প্রথমে ইসহাক (আ)-এর জন্মের সুসংবাদ প্রদান করা হইয়াছে, পরে তিনি কুরবানী হইবার জন্য রাজি হইলে তাহাকে নবুওয়াত প্রদানের সুসংবাদ দেওয়া হইয়াছে। কারণ সংশ্লিষ্ট আয়াতে (৩৭৪ ১১২) প্রথমেই সুসংবাদ প্রদান করা হইয়াছে পুত্র ইসহাকের, অতঃপর বলা হইয়াছে যে, তিনিও নবী হইবেন। শুধু নবী হওয়ার সুসংবাদ প্রদান করা হইলে হয়তো এইভাবে বলা হইত, “তোমার এই পুত্র নবী হইবে”। অতএব হযরত ইবরাহীম (আ) তাঁহার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইলে পর তাঁহাকে আরও এক পুত্র সন্তান দানের সুসংবাদ প্রদান করা হয় এবং এই শেষোক্ত পুত্র হইলেন ইসহাক (আ) (তাফহীমুল কুরআন, ৪খ, পৃ. ৩০০, টীকা ৬৭/৪)।
এখানে উল্লেখ্য যে, কতক সাহাবী ও তাবিঈর নাম দুই মতের অনুসারীদের অন্তর্ভুক্ত লক্ষ্য করা যায়। হইতে পারে তাহারা পূর্বে যে মত পোষণ করিতেন পরে তাহা ত্যাগ করিয়া অন্য মত গ্রহণ করিয়াছেন। উদাহরণস্বরূপ ইবন আব্বাস (রা)-র সূত্রে তাঁহার শাগরিদ ইকরিমা (র) বর্ণনা করিয়াছেন যে, হযরত ইবরাহীম (আ)-এর সেই পুত্র হইলেন ইসহাক (আ)। তাঁহার তাফসীর গ্রন্থেও তাঁহার এই মত দৃষ্ট হয় (তাফসীরে ইবন আব্বাস, দ্র.)। অপরদিকে আতা ই আবু রিবাহ (র) ইবন আব্বাস (রা)-র নিম্নোক্ত মত উদ্ধৃত করিয়াছেন :
“ইয়াহুদীরা ধারণা করে যে, তিনি ছিলেন ইসহাক (আ)। ইয়াহূদীরা মিথ্যা ধারণা করে” (তাফহীমুল কুরআন, পূ, স্থা.)।
প্রশ্ন হইল, এতসব সাক্ষ্য-প্রমাণ বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও মুসলিম উম্মাহর মধ্যে হযরত ইসহাক (আ) যবীহুল্লাহ হওয়ার ধারণা কিভাবে অনুপ্রবেশ করিল? এই প্রসঙ্গে আল্লামা ইবন কাছীর তাঁহার তাফসীর গ্রন্থে বলেন, প্রকৃত বিষয় আল্লাহ তাআলাই অবগত, তবে আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় যে, যেসব দলীল-প্রমাণের ভিত্তিতে ইসহাক (আ)-কে যাবীহুল্লাহ সাব্যস্ত করা হয় তাহার সবই কাব আল-আহ্বার (র) হইতে বর্ণিত ও উদ্ধৃত। তিনি হযরত উমার (রা)-র খিলাফতকালে (১৭ হি.) ইসলাম গ্রহণ করেন এবং তিনি ছিলেন ইয়াহূদী পণ্ডিত। তিনি ইয়াহূদী প্রাচীন কিতাবাদির কথা কখনও কখনও লোকদের নিকট বর্ণনা করিতেন। উমার (রা)-ও তাহা শুনিতেন। এই কারণে জনগণও তাহার কথায় কর্ণপাত করিত এবং তিনি ভালো-মন্দ যাহা বর্ণনা করিতেন লোকেরও তাহা বর্ণনা করিত। তাঁহার এইসব বিবৃতির কিছুই মুসলিম উম্মাহর জন্য প্রয়োজনীয় ছিল না (ইব্ন কাছীরের বরাতে তাফহীমুল কুরআন, পৃ. স্থা.; ই.বি., ৬খ, পূ. ৬১৯-২০, কাব সম্পর্কে)।
মুহাম্মাদ ইব্ন কাব আল-কুরাযী (র) বলেন, একদা আমার উপস্থিতিতে উমর ইব্ন আবদুল আযীয (র)-কে জিজ্ঞাসা করা হইল যে, কাহাকে যবেহ করিতে চাওয়া হইয়াছিল, ইসহাক (আ)-কে ইসমাঈল (আ)-কে? ঐ মজলিসে এমন এক ব্যক্তিও উপস্থিত ছিলেন যিনি পূর্বে ইয়াহূদী আলিম ছিলেন এবং পরে ইসলাম গ্রহণ করিয়া খাঁটি মুসলমান হন। সেই ব্যক্তি বলিলেন, হে আমীরুল মুমিনীন! আল্লাহর শপথ! ইসমাঈল (আ)-ই ছিলেন যীহুল্লাহ। ইয়াহুদীরা এই কথা ভালো করিয়াই জানে। কিন্তু আরবদের প্রতি বিদ্বেষবশত তাহারা ইসহাক (আ)-কে যবীহুল্লাহ বলিয়া দাবি করে (তাফসীর ইব্ন জারীর তাবারী, ২৩খ, পৃ. ৫৪; বিদায়া, ১খ, পৃ. ১৬০; আরাইস, পৃ. ৯৭-৮; তাফসীরে ইবন কাছীর, ৩খ, পৃ. ১৮৮; তাফহীমুল কুরআন, পূ, স্থা.)। অনন্তর রাসূলুল্লাহ (স) নিজের সম্পর্কে বলিয়াছেন, “আনা ইবনুয-যাবীহায়ন (আমি যবেহকৃত দুই ব্যক্তির পুত্র)। এক বেদুঈন রাসূলুল্গাহ (স)-কে ইয়া ইবনায-যাবীহায়ন (হে দুই যবেহকৃতের পুত্র) বলিয়া সম্বোধন করিলে তিনি মুচকি হাসি দেন। এই বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হইলে তিনি বলেন, আবদুল মুত্তালিব যমযম কূপ খননকালে আল্লাহর উদ্দেশ্যে মানত করেন যে, আল্লাহ তাহার জন্য কাজটি সহজসাধ্য করিয়া দিলে তিনি তাহার এক পুত্রকে যবেহ করিবেন। যবেহর জন্য লটারীতে মহানবী (স)-এর পিতা আবদুল্লাহর নাম উঠে। কিন্তু তাঁহার ভাইগণ তাহাকে ইহা করিতে নিষেধ করেন এবং পুত্রের পরিবর্তে এক শত উট যবেহ করার পরামর্শ দেন। অতএব তিনি তাহার পরিবর্তে এক শত উট যবেহ করেন এবং অপর যবেহকৃত হইলেন হযরত ইসমাঈল আলায়হিস সালাম (উভয় উদ্ধৃতির রাতের জন্য দ্র. তাফসীরে কবীর, ২৬ খ, পৃ. ১৫৩; তাফসীরে তাবারী, ২৩ খ, পৃ. ৫৪)। অতএব হযরত ইসমাঈল (আ)-ই যে ছিলেন যাবীহুল্লাহ তাহাতে সন্দেহের অবকাশ নাই।
বৈবাহিক জীবন ও সন্তান-সন্তুতি
হযরত ইসমাঈল (আ) যৌবনে পদার্পণ করিয়া দাম্পত্য বন্ধনে আবদ্ধ হন। ইব্ন আব্বাস (রা)-র দীর্ঘ হাদীছে বলা হইয়াছে, ইসমাঈলও (ক্রমান্বয়ে) বড় হইলেন এবং জ্বরহুমীদের নিকট হইতে আরবী ভাষা শিখিলেন। যৌবনে পদার্পণ করিলে তিনি তাহাদের অধিক আগ্রহের পাত্র হইলেন এবং তাহাদের এক কন্যাকে বিবাহ করিলেন। অতঃপর ইসমাঈলের মাতা ইনতিকাল করেন। একদা ইবরাহীম (আ) তাহার পরিজনকে দেখিতে আসিয়া ইসমাঈল (আ)-কে বাড়িতে পাইলেন না। এদিকে তিনি তাঁহার পুত্রবধূর কথাবার্তা ও আচরণে সন্তুষ্ট হইতে না পারিয়া তাহার নিকট ইঙ্গিতে পুত্রকে জানাইয়া যান যে, তিনি যেন এই স্ত্রীকে বিদায় করিয়া দেন। পিতার নির্দেশমত তিনি প্রথম স্ত্রীকে ত্যাগ করিয়া একই গোত্রের আরেক কন্যাকে বিবাহ করেন। এক সময় ইবরাহীম (আ) পুনরায় পুত্রের সহিত সাক্ষাত করিতে আসিয়া শেষোক্ত পুত্রবধূর কথাবার্তা ও আচরণে সন্তুষ্ট হন এবং তাহার প্রতি যত্নবান হওয়ার জন্য পুত্রকে নির্দেশ দিয়া যান (বুখারী, আম্বিয়া, বাব ১১, নং ৩১১৪, ৩য় খণ্ড)। ইব্ন কাছীর লিখিয়াছেন যে, ইসমাঈল (আ) যৌবনে পদার্পণ করিয়া প্রথমে আমালিক গোত্রের উমারাহ নামী এক কন্যাকে বিবাহ করেন এবং পরে পিতার নির্দেশে তাহাকে ত্যাগ করেন। সে ছিল সাদ ইব্ন উসামা ইবন আকীল আল-আমালিকীর কন্যা। অতঃপর তিনি মাদাদ ইব্ন আমর আল-জুরহুমীর কন্যা সায়্যিদা (মতান্তরে ছালিছা)-কে বিবাহ করেন। ইবন সাদ ও ইবনুল আছীরের মতে তাহার উভয় স্ত্রীই ছিল জরহুম গোত্রীয়। ইবন ইসহাকের মতে শেষোক্ত স্ত্রীর নাম রিলা বিন্ত মাদাদ ইবন আমর এবং আল-কালবীর মতে রিলা বিনৃত ইয়াশজাব ইবন ইয়াব (তাবাকাত, ১খ, পৃ. ৫১)। তাঁহার গর্ভে ইসমাঈল (আ)-এর ১২ জন পুত্র জন্মগ্রহণ করেন (বিদায়া, ২খ, পৃ. ১৯২-৯৩; আরাইস, পৃ. ১০৭; আল-কামিল, ১খ, পৃ. ৯৫)। তাঁহাদের নাম ও নবায়ত কেদর অদবেল মিবসাম মিশ্ম দূমা মসা হদদ তেমা যিটুর নাফীশ ও কেদমা (বাইবেলের পৃ. ১৮৪; আরাইস, পৃ. ১০৭; আল-কামিল, ১খ, পৃ. ৯৫; তাবাকাতুল কুবরা, ১খ, পৃ. ৫১; কোন কোন নামের উচ্চারণে যৎকিঞ্চিৎ পার্থক্য আছে)।
নাসামা নামী তাহার এক কন্যা সন্তানও ছিল। মৃত্যুর সময় ইসমাঈল (আ) হযরত ইসহাক (আ)-কে ওসিয়ত করিয়া যান যে, তাঁহার পুত্র এষৌ-এর সহিত তাহার কন্যাকে (বাইবেলে নাম বাসম, আদি, ৩৬ ও ৩) যেন বিবাহ দেন। তাঁহার ওসিয়ত কার্যকর হয় (আদিপুস্তক, ৩৬ :৩; আরাইস, পৃ. ১০৭; বিদায়া, ১খ, পৃ. ১৯৩; আরও দ্র. পৃ. ১৮৫; আনওয়ারে আম্বিয়া, পৃ. ৬৬)। এই কন্যার গর্ভে রূম, ইউনানা ও ইশবাস (মতান্তরে ফারিস) নামে তিন পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করে (বিদায়া, ১৩, পৃ. ১৯৩; আরও দ্র. ২খ, পৃ. ১৮৫)।
কথিত আছে যে, সমস্ত আরবজাতি ইসমাঈল (আ)-এর দুই পুত্র নাবিত (নবায়ত) ও কায়যার (কেদর)-এর বংশধর (বিদায়া, ২খ, পৃ. ১৮৪; আরও দ্র. ১৩, পৃ. ১৯৩; আরাইস, পৃ.১০৭)।
“সকল আরব ইসমাঈল ইব্ন ইবরাহীম (আ)-এর বংশধর” (তাবাকাত ইবন সাদ-এর বরাতে কানযুল উম্মাল, ১১খ, পৃ. ৪৯০, নং ২২৩১০, আলী ইবন আবূ রাবাহ-এর সূত্রে মুরসালরূপে বর্ণিত)। কিন্তু বিশুদ্ধ ও প্রসিদ্ধ মত এই যে, মূল আরবজাতি (আল-আরাবুল আরিবাহ) হযরত ইসমাঈল (আ)-এর আগমনের পূর্বেই আরবে বসবাসরত ছিল। আদ, ছামূদ, তাম, জাদীস, আমীম, জ্বরহুম, আমালীকসহ নাম না জানা অনেক গোত্র-গোষ্ঠী ইবরাহীম (আ)-এর পূর্বে এবং তাঁহার যুগেও আরবে বসবাসরত ছিল। কিন্তু আরবী ভাষাভাষীতে রূপান্তরিত জাতি (আল-আরাবুল মুসতারিবা) অর্থাৎ হিজাবাসী আরবগণ হযরত ইসমাঈল (আ)-এর বংশধর (বিদায়া, ২খ, পৃ. ১৫৬)। অবশ্য ইয়ামনবাসী আসলাম গোত্র হযরত ইসমাঈল (আ)-এর বংশধর বলিয়া হাদীছ হইতে ইঙ্গিত পাওয়া যায়। আওস ও খাযরাজ গোত্রদ্বয় উক্ত গোত্রের অন্তর্ভুক্ত।
“সালামা ইবনুল আকওয়া (রা) হইতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী (স) আসলাম গোত্রের একদল লোককে অতিক্রম করিয়া যাইতেছিলেন এবং তাহারা তখন তীরন্দাজির প্রতিযোগিতা করিতেছিল। নবী (স) বলিলেনঃ হে ইসমাঈল (আ)-এর সন্তানগণ! তোমরা তীরন্দাজি কর। কেননা তোমাদের পিতাও তীরন্দা ছিলেন। অবশ্য আমি অমুক গোত্রের সঙ্গে আছি। রাবী বলেন, ইহাতে একদল তীরন্দাযি বন্ধ করিয়া দিল। রাসূলুল্লাহ (স) জিজ্ঞাসা করিলেন : তোমাদের কি হইল যে, তোমরা তীরন্দাযি করিতেছ না? তাহারা বলিল, আমরা কিভাবে তীরন্দাজি করিতে পারি যখন আপনি তাহাদের সঙ্গে আছেন! নবী (স) বলিলেন : তোমরা তীরন্দাযি কর, আমি তোমাদের সকলের সঙ্গে আছি” (বুখারী, জিহাদ, ৩খ, পৃ. ১২৮, বাব ৭৭, নং ২৬৮৫; আম্বিয়া, ৩খ, পৃ. ৩৬৮, বাব ১৩, নং ৩১২৩; মানাকিব, ৩, পৃ. ৪৪৩, বাব ৬, নং ৩২৪৪)।
হযরত ইসমাঈল (আ) যে তীরন্দাষ ছিলেন তাহার প্রমাণ বাইবেলেও বিদ্যমান আছে (দ্র. আদিপুস্তক, ২১ ও ২০)।
বাইবেলে বর্ণিত হইয়াছে যে, ইসমাঈল (আ)-এর সন্তানগণ নামানুসারে গ্রাম ও তাঁবুপল্লী অনুসারে তাহাদের এই জাম তাহারা আপন আপন জাতি অনুসারে দ্বাদশজন অধ্যক্ষ ছিলেন…। তাহার সন্তানগণ হবীলা অবধি আশূরিয়ার দিকে মিসরের সম্মুখস্থ শূর পর্যন্ত বসতি করিল (আদিপুস্তক, ২৫ ও ১৬-১৮)। আনওয়ারে আম্বিয়ার গ্রন্থকার লিখিয়াছেন যে, ইসমাঈল (আ)-এর বারজন সন্তান নিজ নিজ বংশের প্রধান ছিলেন। হযরত মূসা (আ)-এর যুগে (১৫০০ খৃ. পূ.) ইসমাঈল বংশীয়গণ হিজায, সিরিয়া, ইরাক, ফিলিস্তীন ও মিসর পর্যন্ত বিস্তৃত হইয়াছিল। ভারত মহাসাগর ও লোহিত সাগরের তৎকালীন বাণিজ্যিক গুরুত্ত্বপূর্ণ বন্দরসমূহ ইসমাঈল বংশীয়দের নিয়ন্ত্রণে ছিল। আরবের মূল ভূখণ্ডও তাহাদের অধিকারে ছিল। ইসমাঈল (আ)-এর পুত্র কায়যার (কেদর) খুবই প্রসিদ্ধ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। প্রাচীন আসিরীয় ও গ্রীক ভূগোলে তাঁহার উল্লেখ দেখা যায়। কায়রের বংশধর মক্কাতে বসবাস করিত এবং তাহার শাখাগোত্র আদনান হইতে শেষ যমানার নবী হযরত মুহাম্মাদ (স) আবির্ভূত হন (পৃ. ৬৫-৬৬)। ইবন কাছীর (র) বলেন, উম্মতে মুহাম্মাদীর মধ্যেও বারজন মহান নেতার আবির্ভাবের সুসংবাদ রহিয়াছে। মহানবী (স) বলেন : “বারজন শাসকের আবির্ভাব হইবে, তাহারা সকলেই কুরায়শ বংশীয়” (ইয়াকূনু ইছনা আশারা আমীরান কুলুহুম মিন কুরায়শ-বুখারী ও মুসলিম)। তাঁহাদের পাঁচজন হইলেন যথাক্রমে চার খুলাফায়ে রাশিদীন এবং উমার ইবন আবদুল আযীয (র)। অবশিষ্টদের মধ্যে কয়েকজন বনু আব্বাসের অন্তর্ভুক্ত। শীআ সম্প্রদায় এই বারজন ইমাম তাহাদের মধ্য হইতে আবির্ভূত হওয়ার যে দাবি করে তাহা ভিত্তিহীন। কারণ তাহারা যাহাদেরকে তাহাদের বারো ইমাম বলিয়া দাবি করে, উম্মতের উপর তাহাদের কোন সার্বিক (রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ইত্যাদি) কর্তৃত্ব কখনও ছিল না (বিদায়া, ১খ, পৃ. ১৫৩-৪)।
কাবা শরীফ নির্মাণে ইসমাঈল (আ)-এর অংশগ্রহণ
হযরত ইবরাহীম (আ) তাঁহার জ্যেষ্ঠ পুত্র হযরত ইসমাঈল (আ)-কে সঙ্গে লইয়া আল্লাহ তাআলার মহিমান্বিত ঘর কাবা শরীফ স্থায়ীভাবে নির্মাণ করেন। তিনি সর্বপ্রথম কাবা ঘর নির্মাণ করেন নাই, বরং পুনর্নির্মাণ করিয়াছেন, যাহা ১৪ : ৩৭ আয়াত হইতে পরিষ্কার বুঝা যায়। এই ঘরের সম্পূর্ণরূপে লূতন নির্মাণে হযরত ইসমাঈল (আ) পিতার সহযোগিতা করেন। কুরআন মজীদে তাহা এইভাবে উল্লেখ করা হইয়াছে :
“এবং আমি ইবরাহীম ও ইসমাঈলকে আদেশ করিলাম যে, তোমরা দুইজনে আমার ঘরকে তাওয়াফকারী, ইতিকাফকারী এবং রুকূ ও সিজদাকারীদের জন্য পবিত্র রাখ” (২ : ১২৫)।
“যখন ইবরাহীম ও ইসমাঈল কাবা ঘরের প্রাচীর তুলিতেছিল তখন তাহারা বলিয়াছিল, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের এই কাজ কবুল কর, নিশ্চয় তুমি সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞাতা” (২ : ১২৭)।
তাফসীর ও ইতিহাসের বর্ণনা হইতে জানা যায় যে, হযরত ইসমাঈল (আ) কাবা ঘর নির্মাণে প্রয়োজনীয় পাথর ও আনুষঙ্গিক দ্রব্যাদির যোগান দিতেন। কাবা ঘর আগে নির্মিত হইয়াছে না কুরবানীর ঘটনা আগে ঘটিয়াছে তাহা নিশ্চিত করিয়া বলা যায় না। তবে কাবা ঘর নির্মাণকালেও ইসমাঈল (আ) যে তরুণ যুবক ছিলেন তাহার ইঙ্গিত পাওয়া যায় কাবা ঘর নির্মাণে তাঁহার সহযোগী ভূমিকা হইতে। ইবন সাদ লিখিয়াছেন যে, হযরত ইবরাহীম (আ) এক শত বৎসর বয়সে কাবা ঘর নির্মাণের নির্দেশ প্রাপ্ত হন এবং তখন ইসমাঈল (আ)-এর বয়স ত্রিশ বৎসর হইয়াছিল (আত-তাবাকাতুল-কুবরা, ১খ, পৃ. ৫২)। তবে কাবা শরীফ নির্মাণকালে ইবরাহীম (আ.)-এর বয়স সংক্রান্ত এই বর্ণনাটি সন্দেহমুক্ত নহে। কাবা ঘর নির্মাণ সংক্রান্ত বিস্তারিত বিবরণ হ্যরত ইবরাহীম (আ) শীর্ষক নিবন্ধে দ্র.।
১১. নবুওয়াত প্রাপ্তি ও হযরত ইসমাঈল (আ) আল্লাহ তাআলার একজন মহান নবী ও রাসূল ছিলেন। তাহার দাওয়াতের কর্মক্ষেত্র ছিল হিজায, ইয়ামান, হাদারামাতসহ সমগ্র আরব উপদ্বীপ । তিনি কত বৎসর বয়সে নবুওয়াতপ্রাপ্ত হন তাহা নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায় না। তাহার নবুওয়াত ও রিসালাতের সাক্ষ্য প্রদান করিয়া মহান আল্লাহ বলেন :
“আর স্মরণ কর এই কিতাবে ইসমাঈলের কথা। সে ছিল প্রতিশ্রুতি পালনে সত্যাশ্রয়ী এবং সে ছিল রাসূল ও নবী। সে তাহার পরিবারবর্গকে নামায ও যাকাত আদায়ের নির্দেশ দিত এবং সে ছিল তাহার প্রতিপালকের সন্তোষজন” (১৯ : ৫৪-৫৫)।
“বল, আমরা আল্লাহতে এবং আমাদের প্রতি যাহা নাযিল হইয়াছে তাহাতে এবং ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব ও তাহার বংশধরগণের প্রতি যাহা নাযিল হইয়াছে তাহাতে ঈমান আনিয়াছি” (৩ : ৮৪)।
“তোমরা বল, আমরা ঈমান আনিয়াছি আল্লাহতে এবং যাহা আমাদের উপর নাযিল হইয়াছে এবং যাহা ইবরাহীম ও ইসমাঈলের উপর নাযিল হইয়াছে…..” (২: ১৩৬)।
“আমি তোমার নিকট ওহী প্রেরণ করিয়াছি যেমন নূহ ও তাহার পরবর্তী নবীগণের নিকট ওহী প্রেরণ করিয়াছিলাম, ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব…. নিকট ওহী প্রেরণ করিয়াছিলাম” (৪ : ১৬৩)।
অনুরূপভাবে ৬ ও ৭৪-৯০ আয়াত অবধি হযরত ইবরাহীম (আ) প্রসঙ্গে আলোচনার সূত্রপাত হইয়া ধারাবাহিকভাবে অন্যান্য নবীগণের প্রসঙ্গও উল্লিখিত হইয়াছে এবং সেখানে হযরত ইসমাঈল (আ)-ও অন্তর্ভুক্ত আছেন। অতএব তাহার নবুওয়াত প্রাপ্তিও সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হইয়াছে। পিতা-পুত্র কর্তৃক নির্মিত তাওহীদবাদী মানবজাতির কিবলা ও পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম ঘর কাবা শরীফকে কেন্দ্র বানাইয়া হযরত ইসমাঈল (আ) গোটা আরবভূমিতে দীন ইসলামের দাওয়াত সম্প্রসারিত করেন (আরাইস, পৃ. ১০৭; বিদায়া, ২খ, পৃ. ১৯৩)। বুখারীর কিতাবুল আম্বিয়ায় সন্নিবিষ্ট ৩১১৪ নম্বর হাদীছ হইতে জ্ঞাত হওয়া যায় যে, হযরত ইবরাহীম (আ) ইসমাঈল (আ) ও তাঁহার মাতাকে দেখিবার জন্য দুইবার মক্কায় আসিয়াছিলেন এবং পুত্রকে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দান করিয়া যান। হযরত ইসমাঈল (আ) তাহার মায়ের ভাষা কিবতী (কপটিক) এবং পিতার ভাষা হিব্রুও জানিতেন এবং আরবে আসিয়া আল্লাহর অনুগ্রহে আরবী ভাষাও শিক্ষা করেন। ফলে ঐ তিন ভাষাভাষী জাতির মধ্যে আল্লাহর দীন প্রচার তাহার জন্য সহজসাধ্য হয়, অন্তত ভাষাগত দিকের বিবেচনায় (আনওয়ারে আম্বিয়া, পৃ. ৬৫)। তাঁহার তত্ত্বাবধানে বাৎসরিক হজ্জের অনুষ্ঠানও উদযাপিত হইতে থাকে। এখানে উল্লেখ্য যে, পিতা-পুত্র-ভ্রাতুস্পুত্ৰ সকলের ধর্মীয় নীতিমালা ছিল একই এবং বলা যায়, ইবরাহীম (আ) ছিলেন তিনজন নবীর ইমাম। সেই কালেও হজ্জ করা ফরয ছিল। যেমন কুরআন মজীদ হইতে জানা যায় যে, আল্লাহ তাআলা হযরত ইবরাহীম (আ)-কে নির্দেশ প্রদান করিয়া বলেন :
“এবং তুমি মানুষের মধ্যে হজ্জের ঘোষণা করিয়া দাও, তাহারা তোমার নিকট আসিবে পজে ও সর্বপ্রকার ক্ষীণকায় উষ্ট্রের পিঠে, তাহারা আসিবে দূর-দূরান্তের পথ অতিক্রম করিয়া” (২২ : ২৭)।
কিন্তু ইয়াহুদীরা হযরত ইসমাঈল (আ) ও তাঁহার মাতার প্রতি অনর্থক বিদ্বেষভাবাপন্ন হইয়া বাইবেল হইতে কাবা ঘরের নির্মাণ, হজ্জের মহাসমাবেশ ও কুরবানীর উৎসবকে সম্পূর্ণরূপে গায়েব করিয়া দিয়াছে। শুধু তাহাই নহে, তাহারা নিজদিগকে ইবরাহীম (আ)-এর বংশধর ও তাঁহার আদর্শের উত্তরাধিকারী বলিয়া দাবি করিলেও তাহারা এই নবীগণের নিকট অবতীর্ণ সহীফাসমূহ অবলুপ্তির হাত হইতে রক্ষা করিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হইয়াছে।
কালের পরিক্রমায় জ্বরহুম গোত্র ইসমাঈল (আ)-এর বংশধর হইতে কাবা শরীফসহ মক্কার কর্তৃত্ব ছিনাইয়া লয়। এখানে উল্লেখ্য যে, জ্বরহুম গোত্র হযরত ইবরাহীম (আ)-এর দীন গ্রহণ করিয়াছিল। জ্বরহুমীরা ছিল কাতান গোত্রীয় এবং সেই সূত্রে হযরত নূহ (আ)-এর পুত্র সাম-এর বংশধর। তাহারা মক্কায় পৌঁছিয়া হযরত হাজার (রা)-এর অনুমতিপ্রাপ্ত হইয়া কুআয়কি আন পর্বতের পাদদেশে বসতি স্থাপন করিয়াছিল। জ্বরহুমীরা ক্রমান্বয়ে আল্লাহর অবাধ্যচারী, অত্যাচারী, নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী ও ধর্মদ্রোহী হইয়া উঠে। কথিত আছে যে, এক পর্যায়ে তাহাদের বংশীয় আসাফ ও নাইলা নামক একজোড়া নারী-পুরুষ বায়তুল হারামের অভ্যন্তরে ব্যভিচারে লিপ্ত হয় এবং আল্লাহর গযবে নিপতিত হইয়া অভিশপ্ত পাথর মূর্তিতে পরিণত হয়। এই ঘটনা হইতে অনুমান করা যায় যে, জ্বরহুমীদের নৈতিক অবস্থা কত ঘৃণ্য পর্যায়ে পৌঁছিয়াছিল। তাহারা উহা কাবার চত্বরে স্থাপন করে এবং কালক্রমে একটি তাওহীদবাদী সম্প্রদায় মূর্তিপূজায় লিপ্ত হইয়া পড়ে। সাবা রাজ্যের অধিবাসী ইয়ামানী খুযাআ গোত্র বন্যা কবলিত হইয়া (সায়লু ‘আরিম, দ্র. ৩৪ ও ১৬) মক্কায় আসে এবং যুদ্ধ করিয়া জ্বরহুমীদেরকে পরাজিত করিয়া তাহাদেরকে মক্কা হইতে উৎখাত করে এবং নিজেরা হারাম শরীফের চারিদিকে বসতি স্থাপন করে। এই খুযাআ গোষ্ঠী ইসমাঈল (আ)-এর বংশধর বলিয়া একটি মত আছে (বিদায়া, ২২, পৃ. ১৮৫; এই সম্পর্কিত একটি হাদীছ নিবন্ধের ৯ম অনুচ্ছেদে দ্র.)। কালের পরিক্রমায় খুযাআ গোত্রও পথভ্রষ্ট হইতে থাকে এবং এই গোত্রের প্রভাবশালী ধনাঢ্য নেতা আমর ইবন আমের ইব্ন লুহায়্যি সর্বপ্রথম জনগণকে মূর্তিপূজার দিকে আহ্বান করে (বিদায়া, ২খ, পৃ. ১৮৭)। সে কোন কার্য উপলক্ষে সিরিয়ায় গমন করে এবং বালকা অঞ্চলের মাআব নামক স্থানে পৌঁছিয়া আমালীক গোষ্ঠীকে মূর্তিপূজায় লিপ্ত দেখিতে পায়। তাহাদের মূর্তিপূজার আচার-অনুষ্ঠানে মুগ্ধ হইয়া সে তাহাদের নিকট হইতে হুবাল নামক একটি মূর্তি চাহিয়া আনে এবং উহাকে মক্কায় স্থাপন করিয়া জনগণকে উহার পূজা করিতে ও উহার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের নির্দেশ দেয় (বিদায়া, ২খ, পৃ. ১৮৭-৮)। আরবজাতি এইভাবে ইবরাহীম ও ইসমাঈল (আ)-এর তাওহীদভিত্তিক দীন হইতে বিচ্যুত হইয়া পৌত্তলিকতায় লিপ্ত হইয়া পড়ে। সুহায়লী প্রমুখের মতে আমর ইবন আমের সর্বপ্রথম হজ্জের তালবিয়ার শেষাংশে এই কথা যোগ করে?
অভিশপ্ত শয়তান তাহাকে ইহা শিখাইয়া দেয় (বিদায়া, ২খ, পৃ. ১৮৮)। তাহার সম্পর্কে মহানবী (স) বলেন।
“আমি খুযাআ গোত্রের আর ইব্ন আমের ইবন লুহায়্যিকে দোযখের মধ্যে তাহার (পেট হইতে বাহির হইয়া আসা) নাড়িভুড়ি হেঁচড়াইয়া ফিরিতে দেখিয়াছি। এই ব্যক্তিই সর্বপ্রথম দেব-দেীর উদ্দেশে উষ্ট্রী ছাড়িয়া দেওয়ার প্রথা চালু করে” (বুখারী, মানাকিব, বাব ১১, নং ৩২৫৮; মুসলিম, সালাতুল-কুসূফ, নং ১৯৬১; সিফাতিল জান্নাত, বাব ৫৩১, নং ৬৯২৯; আরও দ্র. নং ৬৯২৮; বিদায়া, ২খ, পৃ. ১৮৮)। ৮ম হিজরীতে মহানবী (স) পিতা-পুত্র ইবরাহীম-ইসমাঈল (আ)-এর তাওহীদের কেন্দ্র যখন দখল করিলেন তখন কাবা ঘরের মধ্যে ইবরাহীম (আ), ইসমাঈল (আ) ও মারয়াম (আ)-এর প্রতিকৃতি দেখিতে পান এবং সেই প্রতিকৃতিতে পিতা-পুত্রের হাতে ছিল ভাগ্য নির্ণায়ক তীর। এইসব প্রতিকৃতি মুছিয়া না ফেলা পর্যন্ত মহানবী (স) কাবা ঘরে প্রবেশ করেন নাই (দ্র. বুখারী, আম্বিয়া, বাব ১০, নং ৩১০৩ ও ৩১০৪, ৩খ, পৃ. ৩৪৯)। পিতা-পুত্রের সম্মিলিত দুআর (দ্র. ২ : ১২৯) বরকতে হযরত মুহাম্মাদ (স) কর্তৃক তাঁহার পিতৃপুরুষের তাওহীদের কেন্দ্র কিয়ামত কালের জন্য প্রতিমামুক্ত হইয়া আবার মিল্লাতে ইবরাহীমীর কেন্দ্রে পরিণত হইল।
১২. হযরত ইসমাঈল (আ)-এর চারিত্রিক গুণাবলী ও মর্যাদা ও কুরআন মজীদে হযরত ইসমাঈল (আ)-এর নবুওয়াত ও রিসালাত সম্পর্কে উল্লেখ বিদ্যমান (দ্র, ১৯ ও ৫৪; ৩ ও ৮৪; ২ : ১৩৬ এবং ৪ :১৬৩)। তিনি ছিলেন ধৈর্যশীল, পরম সহিষ্ণু ও আত্মত্যাগী বান্দা এবং পিতা-মাতার একান্ত অনুগত। পিতার পরামর্শে তিনি তাহার প্রথম স্ত্রীকে ত্যাগ করিতেও কুণ্ঠাবোধ করেন নাই। তাঁহার জীবনযাত্রা ছিল অত্যন্ত সাদাসিধা। কাষ্ঠ সংগ্রহ ও শিকার করিয়া তিনি পারিবারিক ভরণপোষণের ব্যবস্থা করিতেন। তিনি প্রতিশ্রুতি পালনে ছিলেন অতীব নিষ্ঠাবান। নিজে যেমন ইবাদত-বন্দেগীতে অভ্যস্ত ছিলেন, তদ্রপ পরিবারের সদস্যগণকেও বিশেষভাবে সালাত ও যাকাত আদায়ে বিশেষ তাগিদ দিতেন এবং তাহার নির্মল চরিত্র ও কর্তব্য নিষ্ঠার জন্য তিনি ছিলেন আল্লাহর সন্তোষজন।
“স্মরণ কর এই কিতাবে ইসমাঈলের কথা। সে ছিল প্রতিশ্রুতি পালনে সত্যাশ্রয়ী এবং সে ছিল রাসূল, নবী। সে তাহার পরিবারবর্গকে সালাত ও যাকাত আদায়ের নির্দেশ দিত এবং সে ছিল তাহার প্রতিপালকের সন্তোষজন” (১৯ ও ৫৪-৫৫)।
সূরা আম্বিয়ায় অপরাপর নবী-রাসূলগণের সহিত ইসমাঈল (আ)-এর বিশেষ দুইটি গুণ উল্লিখিত হইয়াছে :
“এবং স্মরণ কর ইসমাঈল, ইদরীস ও যুল-কিফুল-এর কথা। তাহাদের প্রত্যেকেই ছিল ধৈর্যশীল। আর আমি তাহাদেরকে আমার অনুগ্রহভাজন করিয়াছিলাম। তাহারা ছিল সৎকর্মপরায়ণ” (২১ : ৮৫-৮৬)।
অর্থাৎ ইসমাঈল (আ) ছিলেন একান্ত ধৈর্যশীল বান্দা এবং ইহার পুরস্কারস্বরূপ আল্লাহ তাআলা তাঁহাকে তাঁহার নেককার বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করিয়া নেন। তাঁহার সৎকর্মপরায়ণতা, ধৈর্যশীলতা ও পরম সহিষ্ণুতার গুণাবলী পরোক্ষভাবে অন্য এক জায়গায় উল্লিখিত হইয়াছে (দ্র. ৩৭ : ১০০-১০১)। অন্যত্র তাঁহাকে সৌন্দর্যময় ব্যক্তিত্ব ও গুণীজনদের মধ্যে উল্লেখ করা হইয়াছে :
“এবং স্মরণ কর ইসমাঈল, আল-ইয়াসাআ ও যুল-কিফুলের কথা। তাহাদের প্রত্যেকেই ছিল সজ্জন; ইহা এক স্মরণীয় বর্ণনা। মুত্তাকীদের জন্য রহিয়াছে উত্তম আবাস” (৩৮ ও ৪৮-৪৯)।
সবশেষে আল্লাহ তাআলা তাহাকে বিশ্ববাসীর উপর শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা দান করিয়াছেন :
“আরও সৎপথে পরিচালিত করিয়াছিলাম ইসমাঈল, আল-ইয়াসাআ, ইউনুস ও লূতকে; তাহাদের প্রত্যেককে বিশ্ববাসীর উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করিয়াছিলাম এবং তাহাদের পূর্বপুরুষ, বংশধর ও ভ্রাতৃবৃন্দকেও। আমি তাহাদেরকে মনোনীত করিয়াছিলাম এবং সরল পথে পরিচালিত করিয়াছিলাম” (৬ : ৮৬-৮৭)।
উপরিউক্ত আয়াতদ্বয় হইতে জানা যায় যে, আল্লাহ তাআলা উল্লিখিত নবীগণকে সৎপথে পরিচালিত করিয়াছেন, তাই তাঁহারা সৎকর্মপরায়ণ বান্দাদের শামিল হইতে পারিয়াছেন এবং তাহাদেরকে মানবজাতির উপর এক বিশেষ মর্যাদা দান করিয়াছেন, তাঁহাদের বংশধর ও তাহাদের ভ্রাতৃগোষ্ঠীকেও হেদায়াতের পথে পরিচালিত করিয়াছেন ও বিশেষ মর্যাদা দান করিয়াছেন। বিশ্ববাসীর নিকট, বিশেষত তৌহীদবাদী মানবগোষ্ঠীর নিকট তাঁহারা শ্রেষ্ঠ মানবরূপে মর্যাদাপ্রাপ্ত হইয়াছেন। হযরত ইসমাঈল (আ)-এর শ্রেষ্ঠ মর্যাদার নিদর্শন এই যে, তাঁহার বংশেই আল্লাহ তাআলা সায়্যিদুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালীন ওয়া খাতামান নাবিয়ীন হযরত মুহাম্মাদ (স)-এর আবির্ভাব ঘটাইয়াছেন, যাঁহার উম্মত এককভাবে ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক ও ইয়াকূব (আ)-এর “একমাত্র ইলাহ” (২: ১৩৩)-এর ধারক ও বাহক হইয়া পৃথিবীতে বিচরণ করিতেছে। উপরন্তু পৃথিবীর এক বিরাট মানবগোষ্ঠী তাঁহাকে নিজেদের আদিপুরুষ বলিয়া গৌরব বোধ করে। ইহা এক অতুলনীয় মহান মর্যাদা।
হযরত ইসমাঈল (আ)-এর ইনতিকাল
বাইবেলের বর্ণনামতে হযরত ইসমাঈল (আ) ১৩৭ বৎসর বয়সে ইনতিকাল করেন (দ্র. আদিপুস্তক, ২৫ :১৭)। মুসলিম ঐতিহাসিকগণও উক্ত তারিখ উদ্ধৃত করিয়াছেন (দ্র. বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ, পৃ. ১৯৩; তাবারী, তারীখুল উমাম, ১খ, পৃ. ১৬২-এর বরাতে আওয়ারে আম্বিয়া, পৃ. ৬৬; আল-কামিল, ১খ, পৃ. ১৯৫; আরাইস, পৃ. ১০৭)। ইনতিকালের সময় তিনি ভ্রাতুস্পুত্র ইসূর সহিত নিজ কন্যার বিবাহের ওসিয়ত করিয়া যান এবং তাহা প্রতিপালিত হয় (আরাইস, পৃ. ১০৯; আল-কামিল, ১খ, পৃ. ৯৫; বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ, পৃ. ১৯৩)। মুসলিম ঐতিহাসিকগণের মতে ইসমাঈল (আ) মক্কা শরীফেই ইনতিকাল করেন এবং তাঁহাকে তাহার মাতার কবরের পাশে রুকন ও কাবার মাঝখানে হিজরে মীযাবের নিচে দাফন করা হয় (আত-তাবাকাতুল কুবরা, ১খ, পৃ. ৫২; আল-কামিল, ১খ, পৃ. ৯৫; বিদায়া, ১খ, পৃ. ১৯৩; আরাইস, পৃ. ১০৭; তারীখ তাবারী, ১খ-এর বরাতে কাসাসুল কুরআন, ১খ, পৃ. ২৪৭)। আল্লামা হিফজুর রহমান লিখিয়াছেন, তাওরাতে ইঙ্গিত রহিয়াছে যে, হযরত ইসমাঈল (আ)-এর কবর ফিলিস্তীনেই অবস্থিত এবং তিনি এখানেই ইনতিকাল করেন (কাসাসুল কুরআন, ১খ, পৃ. ২৪৭)। তিনি সম্ভবত নাজ্জারের কাসাসুল আম্বিয়ার বক্তব্য উদ্ধৃত করিয়াছেন। কারণ উহাতে এইরূপ একটি বক্তব্য বিদ্যমান (পৃ. ১০১)। কিন্তু বাইবেলের আদিপুস্তকের ২৫শ অধ্যায়সহ উক্ত পুস্তকের কোথায়ও অনুরূপ স্পষ্ট ইঙ্গিত নাই (নিবন্ধকার)।
উমার ইবন আবদুল আযীয (র)-এর সূত্রে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন, ইসমাঈল (আ) আল্লাহর নিকট মক্কাভূমির উষ্ণ আবহাওয়ার অভিযোগ করিলে তাহার মহান প্রতিপালক ওহী মারফত বলেন, তোমাকে যেখানে দাফন করা হইবে, আমি সেখান হইতে তোমার জন্য জান্নাতের দিকে একটি দরজা খুলিয়া দিব এবং কিয়ামত পর্যন্ত তোমার আত্মার প্রতি উহার শান্তিধারা প্রবাহিত হইতে থাকিবে (বিদায়া, ১খ, পৃ. ১৯৩; আরাইস, পৃ. ১০৭)। ইবন সাদ বলেন, তিনজন নবীর কবরের স্থান সম্পর্কেই জানা যায় : ইসমাঈল (আ)-এর কবর কাবার চত্বরে, হূদ (আ)-এর কবর ইয়ামানের কোন এক পর্বতোপরি, যেখানে মাটি সিক্ত করার উপযোগী একটি বৃক্ষ আছে, যে স্থানের উষ্ণতা পৃথিবীর মধ্যে সর্বাধিক এবং মহানবী (স)-এর রওযা মুবারক (তাবাকাত, ১খ, পৃ. ৫২)।
ইসমাঈল (আ) ও তাঁহার মাতার দাফন স্থান ‘হিজর ইসমাঈল নামে পরিচিত। বর্তমান কাবা সংলগ্ন উত্তর পার্শ্বের অর্ধ-বৃত্তাকার দেওয়ালের মধ্যকার গোলাকার স্থানটিকে “হিজর ইসমাঈল” বলা হয়। হযরত ইবরাহীম (আ) বিশ্রাম গ্রহণের জন্য যে চালা নির্মাণ করিয়াছিলেন তাহাই হিজর ইসমাঈল। ইহা পরে ইসমাঈল (আ)-র ভেড়া-বকরীর খোয়াড় হিসাবে ব্যবহৃত হয়। ইহার বর্তমান নাম ‘হাতীম (ভগ্নাংশ)। উম্মুল মুমিনীন হযরত আইশা (রা) বলেন, আমি বায়তুল্লাহর অভ্যন্তরে সালাত আদায় করিতে চাহিলে রাসূলুল্লাহ (স) আমার হাত ধরিয়া আমাকে ‘হিজর ইসমাঈল-এ প্রবেশ করান এবং বলেন, যদি তুমি কাবার অভ্যন্তরে সালাত আদায় করিতে চাও তাহা হইলে এখানেই সালাত আদায় কর। কারণ ইহা কাবার-ই অংশ (নাসাঈ, কিতাবুল হজ্জ)। ইসমাঈল (আ)-এর কন্যাগণকেও হিজরে দাফন করা হয় এবং হযরত নূহ, হ্রদ, সালিহ ও শুআয়ব (আ)-এর কবরও হিজর ও যমযমের মধ্যস্থলে অবস্থিত বলিয়া কথিত । অপর বর্ণনায় আছে যে, নিরানব্বই জন নবী হজ্জ করিতে আসিয়া এখানে ইনতিকাল করেন এবং তাঁহাদের কবরও এখানেই অবস্থিত (তারীখুল কাবীম, ৩থ, পৃ. ১১৫; বিস্তারিত দ্র. পৃ. ১১৬-৭)।
গ্রন্থপঞ্জী : (১) আল-কুরআনুল করীম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১৯শ মুদ্রণ, ১৪১৭/ ১৯৯৭, আয়াতসমূহের তরজমার জন্য; (২) তাফসীর ইব্ন কাছীর, বাংলা অনু., ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা ১৪১৩/১৯৯২ (দ্বিতীয় সংস্করণ); (৩) মুখতাসার তাফসীর ইবন কাছীর, মুহাম্মাদ আলী আস-সানী সম্পা., ৫ম সং, বৈরূত ১৪০০ হি., ৩খ, পৃ. ১৮৬-৯; ঐ, বৃহৎ সংস্করণ, দারুল আন্দালুস, বৈরূত ১৪০২/১৯৮৪, ২খ, পৃ. ৪৮৬; (৪) আল্লামা ফখরুদ্দীন রাষী, তাফসীরে কবীর, বৈরূত তা.বি., ২৬খ, পৃ. ১৫৩ প; (৫) কুরতুবী, আল-জামে লিআহকামিল কুরআন, বৈরূত তা.বি., ১৫খ, পৃ. ১০৫-৬; (৬) সায়্যিদ মাহমূদ আল-আসী, রূহুল মাআনী, দেওবন্দ, (ভারত), তা.বি., ২৩খ, পৃ. ১২৮-৩২; (৭) ইব্ন জারীর আত-তাবারী, তাফসীর, ৩য় সং, বৈরূত ১৩৯৮/১৯৭৮, ২৩ খ, ৩৭ ও ৯৯-১১৩ আয়াতের অধীন বিস্তারিত আলোচনা; (৮) সায়্যিদ আবুল আলা মওদূদী, তাফহীমুল কুরআন (উর্দু), ১১শ সং, লাহোর ১৯৮১, ৪খ, ৩৭ : ৯৯-১১৩ আয়াতের অধীন বিস্তারিত আলোচনা; (৯) মুফতী মুহাম্মাদ শফী, মাআরিফুল কোরআন (বাংলা সংস্করণ), ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ৪র্থ সং, ঢাকা ১৪১৫/১৯৯৪, ৭খ, পৃ. ৪৪৪-৪৫৪; (১০) তাফসীরে উছমানী (উর্দু), সৌদী আরব সরকার কর্তৃক প্রকাশিত সংস্করণ, ৩৭ ও ৯৯-১১৩ আয়াতের অধীন টীকাসমূহ; (১১) আবদুল মাজেদ দরিয়াবাদী, তাফসীরে মাজেদী, বাংলা অনু, ই.ফা.বা., ঢাকা, ১খ, পৃ. ২৩১, টীকা ৪৫২।
হাদীছের গ্রন্থাবলী : (১) সহীহ আল-বুখারী, আধুনিক প্রকাশনী সং, ৬ খণ্ডে সমাপ্ত; (২) সহীহ মুসলিম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ সংস্করণ, ৮ খণ্ডে সমাপ্ত; (৩) জামে আত-তিরমিযী, ইসলামিক সেন্টার সংস্করণ, ৬ খণ্ডে সমাপ্ত; (৪) সুনান আবী দাউদ, মূল আরবী সংস্করণ; (৫) সুনান নাসাঈ, মূল আরবী সংস্করণ; (৬) সুনান ইবন মাজা, মুহাম্মাদ ফুআদ আবদুল বাকী সম্পাদিত, বৈরূত তা.বি.; (৭) আলী মুত্তাকী আল-হিন্দী, কানযুল উম্মাল, ১ম সং, আলেপ্পো ১৩৯৪/১৯৭৪, ১১খ, পৃ. ৪৯০-৯১।
ইসলামী ইতিহাস ও অন্যান্য : (১) ইবন কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, দারুল ফিকার আল-আরাবী, বৈরূত তা.বি., ১খ, পৃ. ১৫৩-৬৩, ১৯১-৩; ২খ, পৃ. ১৫৬ প; ১৮৪-৮; (২) ইবনুল আছীর, আল-কামিল, ১ম সংস্করণ, বৈরূত ১৪০৭/১৯৮৭, ১খ, পৃ. ৭৮-৯৫; (৩) ইবন সাদ, আত-তাবাকাতুল কুবরা, দারু সাদির, বৈরূত তা.বি., ১খ, পৃ. ৪৮-৫২; (৪) ছাআলাবী, কাসাসুল আম্বিয়া (আল-মুসাম্মা বি-আরাইস); তা.বি., পৃ. ৮৩-১০৯; (৫) আনওয়ারে আম্বিয়া (লেখকের নাম অজ্ঞাত), ৫ম সং, লাহোর ১৯৮৫, পৃ. ৬০-৬৬; (৬) আল্লামা হিফজুর রহমান, কাসাসুল কুরআন, লাহোর তা.বি., ১খ, পৃ. ২২৪-২৪৭; (৭) আবদুল ওয়াহহাব নাজ্জার, কাসাসুল আম্বিয়া, বৈরূত তা.বি., পৃ. ৯২-৯৪, ১০১-১০৯; (৮) ইয়াকূত আল-হামাবী, মুজামুল বুলদান, দারু সাদির, বৈরূত, তা.বি., ৩, পৃ. ১৪৭-৪৯; (৯) মুহাম্মদ তাহির আল-কুর্দী, আত-তারীখুল-কাবীম লি-মাক্কাতা ওয়া বায়তিরাহিল কারীম, ১ম সংস্করণ, মক্কা ১৩৮৫ হি, ৩.; (১০) এ.এন.এম. সিরাজুল ইসলাম, মক্কা শরীফের ইতিকথা, ৩য় প্রকাশ, বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, ঢাকা ১৯৯৮ খৃ.; (১১) ড. মুহাম্মাদ রাওয়াস ও ড. হামিদ সাদিক কানীবী, মুজাম লুগাতিল ফুকাহা, করাচী তা.বি., পৃ. ২৭৪; (১২) মুফতী সায়্যিদ মুহাম্মদ আমীমুল ইহসান, কাওয়াইদুল ফিক্হ, ১ম সং, উত্তর প্রদেশ (ইন্ডিয়া) ১৩৮১/১৯৯১, পৃ. ৩৪৯।
অমুসলিম উৎস : (১) বাইবেল, বাংলা সংস্করণ, বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটি, ঢাকা; (২) বুতরুস আল-বুস্তানী, দাইরাতুল মাআরিফ, বৈরূত তা.বি., ২৪, ৩২, পৃ. ৬১২-১৫।