স্বর্গ যদি কোথাও থাকে

স্বর্গ যদি কোথাও থাকে

যে কবি এমন চমৎকার একটি জিজ্ঞাসা রচনা করেছিলেন, তিনি নিশ্চয় জানতেন যে স্বর্গ কোথায়।

অবশ্য অতি শিশুকালে পাঠশালায় পড়ার সময় অন্য এক ছাত্র-পাঠ্য কবিতা পাঠ করে আমরা জেনে গিয়েছিলাম, স্বর্গ বা নরক বহু দূরে নয়, এই পৃথিবীতেই স্বর্গ-নরক রয়েছে।

এখানে এসব কবিকথা নিয়ে বাড়াবাড়ি করা উচিত নয়, বরং আমরা আসল স্বর্গ নরকের গল্পে যাই।

সবাই জানেন স্বর্গ ও নরকে প্রবেশ পথের পাশে একটি অফিস ঘর আছে। অফিস ঘরটি বড়, এর একপাশে যমরাজা ও চিত্রগুপ্ত বসেন। আগে নথিপত্র, দলিল-দস্তাবেজ সব অবিন্যস্ত ছিল। অনেকটা সরকারি অফিসের মতো। প্রয়োজনে দরকারি রেকর্ড খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন ছিল। ফলে কখনও-সখনও ভুল হত, অবিচার হয়ে যেত।

আজকাল আর তা সম্ভব নয়। যমরাজের দপ্তর পুরোপুরি কম্পিউটার ব্যবস্থায় আনা হয়েছে। এক কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার অকালে ম্যালেরিয়ায় মারা গিয়ে কলকাতা থেকে পরলোকে এসেছিলেন। সুন্দরী যুবতী স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও তিনি অফিস-কলিগের সঙ্গে নিয়মিত ফস্টি-নস্টি ইত্যাদি করতেন। তাঁর তিন মাস নরকবাস প্রাপ্য ছিল। তাঁর নরকবাস মুকুব করে যমরাজা তাঁকে কম্পিউটারের দায়িত্ব দিয়েছেন।

চিত্রগুপ্ত পুরনো ঘুঘু। দেখে দেখে অনেকটাই শিখে গিয়েছেন। সব মানুষকে যন্ত্রের মধ্যে নম্বর দেওয়া আছে, প্রয়োজনানুসারে চিত্রগুপ্ত বোতাম টিপলেই নির্দিষ্ট লোকটির কাজকর্মের রেকর্ড বেরিয়ে আসে, তাই দেখে যমরাজা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

অন্যান্য দিনের মতো আজ সকালেও যমরাজা অফিস ঘরে বসে আছেন। তাঁর সামনে সারা পৃথিবীর হাজার-হাজার সংবাদপত্র। আলগোছে, দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিচ্ছেন তিনি। এখনকার মানুষের পাপকার্যাদির সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়ার এটাই শ্রেষ্ঠ পন্থা।

যমরাজার চোখে পড়ল কলকাতার কাগজগুলোয় বড় বড় হেডিং, ‘শিক্ষা সম্মেলনে বজ্রপাত’। কলকাতার কাছেই কোথায় এক খোলা মাঠে শিক্ষা সম্মেলন হচ্ছিল, শিশুরা অজ আম ইট শিখবে নাকি বি এল এ ব্লে, সি এল এ ক্লে শিখবে কিংবা দুটোই, তাই নিয়ে কুটতর্ক। সেই কুটতর্কের মধ্যখানে বিনা মেঘে বজ্রপাত হয়। ভয়াবহ ব্যাপার। কতজন হতাহত হয়েছে তার পূর্ণ বিবরণ এখনও সংবাদপত্র দিয়ে উঠতে পারেনি।

যমরাজা খোঁজ নিলেন। বজ্রপাত সভার মধ্যে হয়নি, মঞ্চে হয়েছিল। নিহতের সংখ্যা তিন-চারজনের বেশি নয়। তাঁদের মধ্যে দু’জন বলাইবাবু এবং কানাইবাবু যমালয়ে এসে গেছেন।

বলাইবাবু এবং কানাইবাবু দু’জনেই মরজীবনে মানে গতকাল পর্যন্ত কলকাতার শহরতলির দুটি কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন।

যমরাজা প্রথম বলাইবাবুকে ডেকে পাঠালেন। চিত্রগুপ্ত কম্পিউটারে রেকর্ড চেক করে বলল, ‘ভদ্রলোক অধ্যাপক ছিলেন, শেষ বয়েসে, দু’বছর আগে কলেজের অধ্যক্ষ হয়েছেন।’

যমরাজা সুবিবেচক, সব কিছু খোঁজখবর রাখেন, বললেন, ‘গত দু’বছর তা হলে ভদ্রলোকের খুব ভোগান্তি হয়েছে। খুব কষ্ট করেছেন। কলেজের প্রিন্সিপালের চাকরি দু’বছর করা, সে তো সাক্ষাৎ নরকবাস। বলাইবাবুর আর কোনও রেকর্ড দেখতে হবে না। ওঁর অক্ষয় স্বর্গবাস আমি মঞ্জুর করলাম।’

বলাইবাবুর পাশেই ছিলেন কানাইবাবু। তিনি কুড়ি বছর কলেজের অধ্যক্ষতা করেছেন, যমরাজার এই কথার পরে তিনিও বলাইবাবুর সঙ্গে স্বর্গের পথে রওনা হলেন।

চিত্রগুপ্ত তাঁকে থামালেন, ‘আপনি কোথায় যাচ্ছেন।’ কানাইবাবু বললেন, ‘বলাইদা মাত্র দু’বছর প্রিন্সিপালগিরি করেছেন তাই স্বর্গবাস। আমি ওঁর দশগুণ, কুড়ি বছর প্রিন্সিপাল ছিলাম, আমি তো স্বর্গেই যাব।’

চিত্রগুপ্ত যমরাজার দিকে তাকালেন। যম এতক্ষণ সব কথা মন দিয়ে শুনছিলেন। এবার ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘কানাইবাবু, আপনি কুড়ি বছর প্রিন্সিপালি করেছেন। আপনার নরকযন্ত্রণা অভ্যেস হয়ে গেছে। আপনাকে নরকেই যেতে হবে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *