পরোপকার
অনেকের মনে বদ্ধমূল ধারণা হয়েছে আমার মাথা সম্পূর্ণ খারাপ হয়ে গেছে। সম্পূর্ণ খারাপ।
আমার শুভানুধ্যায়ীরা অনেকে দুপুরের দিকে, অর্থাৎ আমি যখন বাড়িতে থাকি না, আমার অনুপস্থিতির সুযোগে আমার স্ত্রী-পুত্রের সঙ্গে দেখা করে খোঁজ নিতে আসেন। আমি কেমন আছি, আমার পরিবারবর্গের কোনও অসুবিধা হচ্ছে কিনা, কাচের গেলাস, আয়না, চশমা ইত্যাদি ভঙ্গুর দ্রব্য ছুড়ে ফেলার প্রবণতা আমার কীরকম—এই জাতীয় বহুবিধ প্রাসঙ্গিক, অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন, পরামর্শ ও উপদেশে আমার পারিবারিক জীবন বিপর্যস্ত হতে চলেছে।
একজন সুহৃদ নিজের পকেটের এক টাকা একত্রিশ পয়সা ব্যয় করে একগাছা তিরুলির বিখ্যাত পাগলের বালা আমার স্ত্রীকে পৌঁছে দিয়ে গেছেন, নিকটবর্তী কৃষ্ণপক্ষ মঙ্গলবার শেষ রাত্রিতে আমাকে গঙ্গাস্নান করিয়ে সেটা পরাতে হবে, তা হলে আর ভয় অথবা চিন্তার কোনও কারণ থাকবে না। পাগলের স্বাভাবিক প্রবৃত্তিবশত শেষ রাত্রে গঙ্গাস্নান করতে কিংবা এবং বালা পরতে আমি বাধা দিতে পারি; আমার স্ত্রী যদি প্রয়োজন বোধ করেন তা হলে সেই বিশিষ্ট দিনে যথাসময়ে কয়েকজন বলশালী লোক নিয়ে আমার সেই সুহৃদ আমার স্ত্রীকে সাহায্য করতে আসবেন বলে জানিয়ে গেছেন।
আরেকজন একটি দাতব্য মানসিক চিকিৎসালয়ের দরখাস্ত ফর্ম রেখে গেছেন। সেই ফর্মে কিছুই করতে হবে না, শুধু আমার স্ত্রী ও ভাই এবং দু’জন প্রতিবেশী মাননীয় পুলিশ কমিশনার বাহাদুরেব কাছে দরখাস্ত করবেন যে সামাজিক এবং পারিবারিক নিরাপত্তার প্রয়োজনে অবিলম্বে আমাকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে কোনও মানসিক ওয়ার্ডে প্রেরণ করা প্রয়োজন। এর জন্যে বিশেষ তদন্তের প্রয়োজন হবে না। যে-কোনও দুই বা তিন কিস্তি ‘কথায় কথায়’ আবেদনের সঙ্গে জুড়ে দিলেই কমিশনার সাহেব আবেদনের যৌক্তিকতা এবং গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারবেন।
এই দ্বিতীয় ভদ্রলোক নিতান্ত বেপরোয়া। যেদিন দরখাস্ত ফর্ম এনেছিলেন, তার পরদিনই খোঁজ নিতে এলেন কতদূর কী হল। যখন আমার স্ত্রীর কাছে শুনলেন যে, আমি সেই দরখাস্ত ফর্ম দেখে রেগে গিয়ে কুটিকুটি করে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছি, তিনি কপাল চাপড়িয়ে ‘হায়-হায়’ করে উঠলেন। এবং ‘আর দেরি নয়, আর দেরি নয়’ এই বলে দ্বিতীয় ফর্ম সংগ্রহের জন্য আমাদের বাড়ি থেকে দ্রুত নিষ্ক্রান্ত হলেন। বোধহয় ইচ্ছা ছিল সেদিনই আরেকটি ফর্ম নিয়ে আসবেন।
দুঃখের বিষয়, সেদিন উলটো রথের জন্য আমাদের অফিস কয়েক ঘন্টা আগে ছুটি গিয়েছিল। উনি আমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে গলির মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছেন, আমিও ট্রাম থেকে নেমে ফিরছি। একেবারে মুখোমুখি দেখা। তিনি আমাকে দেখে একেবারে ভুত দেখার মতো চমকিয়ে উঠলেন। আমি ঠিক করে ফেললাম এঁকে উচিত শিক্ষা দিতে হবে।
সোজাসুজি বন্ধুবরকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এদিকে কোথায় এসেছিলেন?’ ভদ্রলোক আমতা আমতা করে বললেন, ‘এই তোমার বাড়িতে।’ আমি বললাম, ‘আমিও আপনার বাড়ি হয়েই আসছি।’
ভদ্রলোক কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেলেন, ‘আমার বাড়িতে, এই ভরদুপুরে আমার বাড়িতে কী জন্যে?’ তাঁর গলা কেমন যেন শুকিয়ে এল। আমি বললাম, ‘আপনার গলা কেমন শুকিয়ে গেছে, একটু জল খেয়ে নিন।’ বলে তাঁকে পাশেই মোড়ের মুখে টিউবওয়েলের কাছে প্রায় ঠেলে নিয়ে গেলাম। বহুদিন অভ্যাস নেই মনে হল, ঘাড় গুঁজে মুখে মুখ লাগিয়ে জল খেতে তাঁর খুবই কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু আমি ছাড়লাম না, কর্কশ গলায় ‘আরও খান, আরও খান’ হুকুম করে প্রায় এক গ্যালন জল খাওয়ালাম। যখন সোজা হয়ে দাঁড়ালেন, তখন টইটম্বুর জল খেয়ে ঢকঢক করে টলছেন, সাদা জল খেয়ে কাউকে এর আগে এত বেসামাল হতে দেখিনি।
অবশ্য একটু পরে সামলিয়ে নিলেন এবং ঠিক তখনই আবার হুঁশ হল তাঁর ‘আমার বাড়িতে কেন গিয়েছিলে?’
আমি তাঁর চোখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। গল্পে-উপন্যাসে পড়েছি পাগলেরা মারাত্মক কিছু করার আগে এইভাবেই দৃষ্টিনিক্ষেপ করে। তিনি বেশিক্ষণ আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে সমর্থ হলেন না, ভয়ে ভয়ে মাথা নামিয়ে নিলেন। এইবার আমি তাঁর একটু আগের প্রশ্নের জবাব দিলাম। হিমশীতল কণ্ঠে বললাম, ‘আপনার বাড়িতে গিয়েছিলাম পেটানোর জন্যে।’
‘পেটানোর জন্যে’, সদাশয় পরোপকারী বন্ধু, হার্টফেল করেন আর কী, ‘কাকে পেটানোর জন্যে?’
ভদ্রলোকের উৎকণ্ঠা দেখে বড় আনন্দ হল, মৃদু হেসে বললাম, ‘কাকে আর? আপনিও বাড়ির বাইরে, আপনার স্ত্রীও অফিসে। প্রথমে ঠেঙালাম আপনার চাকরকে, সে দরজা খুলে দিতেই তাতে ল্যাং মেরে ফেলে দিলাম, কিন্তু সে ব্যাটা মহা ধড়িবাজ। সে উঠে দাঁড়াতেই টেবিলের উপর থেকে যেই তাকে আপনার টাইমপিসটা ছুড়ে মারলাম, ব্যাটা ছুটে গিয়ে রান্নাঘরে দরজা আটকিয়ে চেঁচাতে লাগল। তারপরে পেটালাম আপনার ছোট ছেলেটিকে। কিন্তু যাই বলুন আপনার বড় ছেলেটি বড় তুখোড়, রেডিয়োটা ছুড়ে মারতেই সে ছোকরা সামনের চারতলা বাড়িটার কার্নিশে উঠে বসে রইল, কিছুতেই ধরতে পারলাম না।’
আর অধিক বর্ণনার প্রয়োজন হল না, ভদ্রলোক বাড়ির দিকে ছুটতে লাগলেন।