সূচনা (হিমালয় থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত)

সূচনা

হিমালয় থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ বিশাল ভূখণ্ড আমাদের দেশ ভারতবর্ষ। আর্যদের ভারত আগমনের পর থেকে বিভিন্ন সময়ে নানা জাতির আগমন ও সংমিশ্রণ হয়েছে আমাদের এই দেশে। বহু ভাষাভাষী ভারতজনের দেশে বিচিত্র আচার ব্যবহার ও নানা ধর্মে বিশ্বাস নিঃসন্দেহে বিভিন্ন জাতির বিভিন্ন। বৈশিষ্ট্যের পরিচয় বহন করে। খ্রীস্টান, মুসলমান প্রভৃতি ধর্মাবলম্বী জাতিগুলি ছাড়া হিন্দু জাতির প্রধান চারটি বর্ণের অসংখ্য বিভাগ ও উপজাতিগুলির বিভিন্ন গোষ্ঠী বর্তমান। ভারত-ইতিহাসের প্রাচীনত্বের নিরিখে হিন্দু জাতির প্রত্যেক ব্যক্তির বর্ণ ও গোষ্ঠী অনুযায়ী নিজস্ব পদবী ধারণের প্রথা অবশ্য নিতান্তই অর্বাচীন। কালক্রমে বিচিত্র পরিস্থিতিতে নূতন নূতন পদবীর উদ্ভব হয়। সেই পদবীগুলির সংকলন ও পদবী বিষয়ক তথ্যগুলির আলোচনাই এখানে মূখ্য উদ্দেশ্য।

মনের ভাব সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করতে যেমন কয়েকটি শব্দের প্রয়োজন তেমনি প্রত্যেক ব্যক্তির প্রাথমিক পরিচয়ে অন্তত দুটি শব্দের একান্তই দরকার। সেই শব্দ দটির প্রথমটি ‘নাম’ (NAME) এবং অপর শব্দটিকে ‘উপনাম’ বলা হয়। এই উপনাম শব্দটিই সাধারণ অর্থে প্রচলিত ‘পদবী’ (SURNAME) | কেবলমাত্র নাম দ্বারা কোন ব্যক্তির পরিচয় সম্পূর্ণ হয় না; সম্যক পরিচয়ের জন্য পদবীটি অত্যাবশ্যক। কোন ব্যক্তি তার নামের দ্বারা কোন বিশেষ মহলে পরিচিত হলে তার পরিচয়ে আর পদবীর প্রয়োজন হয় না; পক্ষান্তরে, কোন ব্যক্তি তার পদবীর বারা কোন বিশেষ মহলে পরিচিত থাকলে তার পরিচিতিতেও নাম নিষ্প্রয়োজন হতে পারে। তবে নাম ও পদবী একসংগে যুক্ত না-হলে কোন ব্যক্তিরই পরিচয় সম্পূর্ণ হয় না। নাম ও পদবীর মাঝে চন্দ্র, কুমার, লাল, নাথ, বরণ, রঞ্জন, ভূষণ, রাণী, বালা প্রভৃতি যে-পদগুলি ব্যবহৃত হতে দেখা যায় ঐগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রে লিংগবোধক; কদাচিৎ কোন স্থলে নিছক অলংকার মাত্র। নাম ও পদবীর মাঝে ঐরূপ যে-কোন একটি পদের ব্যবহার নিতান্তই ব্যক্তির ইচ্ছাধীন। মধ্যপদটি ব্যবহার না করলেও পরিচয়ের কোন হেরফের হয় না।

এখন যেমন ব্যক্তির নামের শেষে পদবী থাকে, প্রাচীনকালে অনূরূপ পদবী কেউ ব্যবহার করতেন না। গুণকর্ম অনুসারে আর্য চতুর্বর্ণের পদবী ধারণের প্রথম ধর্মীয় নির্দেশ পাওয়া যায় যথাক্রমে মনু-সংহিতা ও বৃহদ্ধর্মপুরাণ থেকে।

“শর্ম্মবদ্‌ ব্রাহ্মণস্য স্যাদ্‌ রাজ্ঞো রক্ষা সমন্বিতম।
বৈশ্যস্য পুষ্টি সংযক্তং শূদ্রস্য প্রেষ্য সংযুতমঃ”।।

(মনু-সংহিতা)

“ব্রাহ্মণে দেবশর্ম্মানৌ রায়বর্ম্মা চ ক্ষত্রিয়ে।
ধনোবৈশ্যে তথা শূদ্রে দাস শব্দঃ প্রযুজ্যতে”।।

(বৃহদ্ধর্মপুরাণ)

—এই দুটি শ্লোক থেকে স্পষ্টই প্রতিপন্ন হয় যে, ব্রাহ্মণের “শৰ্ম্মা” ও “দেবশর্ম্মা”, ক্ষত্রিয়ের “বৰ্ম্মা” ও “রায়বর্ম্মা” বা অনুরূপ কোন রক্ষাকর্মবাচক উপাধি, বৈশ্যের “ভূতি” বা অনুরূপ কোন পুষ্টিক্রিয়াবোধক উপাধি এবং শূদ্রের “দাস” বা অনরূপ কোন সেবকার্থক উপাধির দ্বারা বর্ণের পরিচয় হবে। কিন্তু বৈদিক যুগ থেকে যে-সব বিশেষ বিশেষ নামের সংগে আমরা পরিচিত সেই সব নামের শেষে পদবী দেখা যায় না; যেমন—বলি, অম্বরীশ, বিপ্রশ্চিৎ, হরিশ্চন্দ্র, (রাজা) দশরথ, (রাজর্ষি) জনক, যুধিষ্ঠির, দুর্যোধন প্রভৃতি। পুরাণ, রামায়ণ ও মহাভারত প্রভৃতি গ্রন্থে কাহারও নামের শেষে পদবীর উল্লেখ নাই। রাজন্যবর্গ ছাড়া বহু মহামনি ও ঋষির নামও শাস্ত্রগ্রন্থগুলিতে উল্লেখিত আছে, যাঁদের নাম এখনও গোত্রে ও প্রবরে বিদ্যমান। তাঁদের নামের শেষেও বর্ণজ্ঞাপক কোন পদবী দেখা যায় না। একাধিক পুরাণে বৈশ্যদের উপাখ্যান আছে, কিন্তু তাঁদের নামের শেষে বর্ণ জ্ঞাপক “ভূতি” অথবা “ধন” শব্দের উল্লেখ নাই। সুতরাং এরূপ সিদ্ধান্তে আসতে পারা যায় যে, শাস্ত্রীয় দ্বাদশ সংস্কার ও ক্রিয়াকাণ্ড ব্যতীত ধর্মীয় নির্দেশ অনুযায়ী নামের সংগে বর্ণের পরিচায়ক শর্ম্মা, বর্ম্মা, ভূতি ও দাস ব্যবহৃত হত না। বৈদিক ও পৌরাণিক যুগের যে-সব রাজর্ষি ও রাজন্যবর্গের নাম পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে সে-সব নাম থেকে পরিষ্কার প্রমাণিত হয় যে, ব্যক্তির নাম দ্বারাই তাঁর পরিচয় প্রকাশ ও পরবর্তীকালে তাঁর বংশের পরিচিতি হত; যেমন— “কুরু বংশ”, “রঘুবংশ” ইত্যাদি। তখন পদবীর দ্বারা বংশ পরিচিতি হত না। পৌরাণিক যুগের দীর্ঘদিন পরে হিন্দু সমাজে ধীরে ধীরে নামের সাথে সমাসবদ্ধ পদরূপে পদবীর সংযুক্তি দেখা দিতে থাকে; উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায়— ভবভূতি, দেবদাস, দেবদত্ত, বিষ্ণু শর্মা, ধর্মগুপ্ত, অগ্নিমিত্র ইত্যাদি। বংশানুক্রমিকভাবে যদিও কয়েক শতাব্দী এইভাবে নামের সংগে পদবীর ব্যবহার চলছিল কিন্তু পদবীর দ্বারা বংশের পরিচয় হত না। কালক্রমে দেবদত্ত স্থলে দেবরূপ দত্ত, বিজয় সেন স্থলে বিজয়কুমার সেন এবং বিষ্ণু শর্মা স্থলে বিষ্ণু সেবক শর্মা ইত্যাদি ব্যবহৃত হতে আরম্ভ হল এবং পদবী বংশানুক্রমিক হয়ে পড়ায় পদবীর দ্বারা বংশ পরিচিতি সুরু হল। আবার এও দেখা যায় যে, অতীতে ব্যক্তিগত নামগুলি ছিল একটিমাত্র শব্দ; যেমন, দুর্লভ, গরুড়, কলশখ ইত্যাদি। কোন কোন ক্ষেত্রে বন্ধুমিত্র, ধৃতিপাল, চিরাতদত্ত। এ প্রসংগে এও উল্লেখযোগ্য যে, আজকের বঙ্গদেশের পদবী চট্ট, বর্মন, পাল, মিত্র, দত্ত, নন্দন, দাস, ভদ্র, দেব, সেনা, ঘোষ ও কুণ্ডু, অতীতের নামের শেষাংশ কিনা তা নিয়েও পণ্ডিত সমাজে মতভেদ রয়েছে।

ভারতের বিভিন্ন অংশে বংশ-পরিচিতির ধারক “পদবী” বা “পারিবারিক নাম” ব্যবহারের বিভিন্ন রীতি পরিলক্ষিত হয়। বাঙ্গালী ও মহারাষ্ট্রবাসী ছাড়া অন্যেরা ততটা পদবী ব্যবহার করেন না। ভারতের দক্ষিণ অংশে অঞ্চলের নামই পারিবারিক নাম বা পদবী, যা ব্যক্তিগত নামের পূর্বে বসানো হয়। আবার কারো কারো নামের পর্বে তাঁর পিতার নাম যোগ করা হয়; যেমন, সর্বপল্লী রামস্বামী ভেঙ্কটরমন— ক্রমানুসারে প্রথম-পারিবারিক নাম বা পদবী যা অঞ্চলেরও নাম; দ্বিতীয়—পিতার নাম; এবং সর্বশেষে ব্যক্তিগত নাম। তামিলনাড়ুর লোকেরা সাধারণত পদবী ছাড়াই তাঁদের নাম লেখেন।

তবে তাঁদের পরিচয়ে যে-চারটি শব্দ ব্যবহার করেন তার প্রথম শব্দটি তাঁদের আদি বাসস্থানের নাম, দ্বিতীয় শব্দটি পিতার নাম, তৃতীয় শব্দটি নিজের নাম ও শেষের শব্দটি পদবী। কুম্ভকোলম্ রঙ্গস্বামী পদ্মনাভ আয়েঙ্গার— এই শব্দ কয়টির দ্বারা উক্ত পদ্ধতিতে একজনের পূর্ণ পরিচয় রয়েছে। তবে আয়েঙ্গার পদবী ব্যবহার না-করলে তার নাম হত পদ্মনাভন্‌। পশ্চিমাঞ্চলের পদ্ধতিতে দেবদত্ত রামকৃষ্ণ ভাণ্ডারকার—ক্রমানুসারে প্রথমটা ব্যক্তিগত নাম, দ্বিতীয়টা পিতার নাম এবং শেষটি অঞ্চলের নাম বুঝায়।

নিজ বা ব্যক্তিগত নামের মতোই পদবী বা পারিবারিক নাম দ্বারা অনেককেই কে কোন স্থানের অধিবাসী তা সহজেই নির্ণয় করা যায়; যেমন, দক্ষিণভারতে সুব্রহ্মণ্য, মহালিঙ্গ প্রভৃতি ব্যক্তিগত নাম আর আইয়ার ও আয়েঙ্গার ইত্যাদি পারিবারিক নাম বা পদবী। পূর্বভারতে ব্যক্তিগত নাম রাসবিহারী, হরেকৃষ্ণ ইত্যাদি আর মুখোপাধ্যায়, বাসু, প্রভৃতি পারিবারিক নাম বা পদবী। ভারতের পশ্চিমে ও দক্ষিণাংশে প্রায়ই অঞ্চলের নামেই পারিবারিক নাম বা পদবী রচিত হয়ে থাকে। বিশেষ করে পশ্চিম অঞ্চলে প্রায়ই পারিবারিক নামগুলি তাদের আদি বাসস্থানের নামের শেষে “কার” শব্দ যোগ করে গঠন করা হয়; যেমন, বিজয় পারকার—যার পরিবার বিজাপুরের আদি বাসিন্দা।

পদবী গ্রহণে হিন্দুর প্রতি শাস্ত্রের নির্দেশ থাকায় ও পদবীর দ্বারা মানুষের সামাজিক মর্যাদা তথা সমাজজীবনে তার স্থান নির্দিষ্ট হওয়ার প্রাথমিক রীতি প্রচলিত থাকায় হিন্দুরে ধর্ম তথা সমাজজীবনের প্রাসংগিক তথ্যগুলি আলোচনা এখানে অপরিহার্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *