উপসংহার
[শ্রেণীহীন (জাতিবর্ণহীন) সমাজ গঠনের পক্ষে পদবীকে একটি অন্তরায় মনে করে পদবী বাদ দেওয়ার কয়েকটি প্রতিবেদন]
(ক) আনন্দবাজার পত্রিকা (ইং ২২।৮।৭৭) :– আনিজের নাম থেকে জাতি-বর্ণসূচক পদবীর লেজুরটি ছেঁটে ফেলুন। জনতা ওয়ারকিং কমিটির প্রস্তাবে নেতাদের প্রতি এই অনুরোধ করা হয়েছে। জাতিবর্ণভেদ প্রথা উচ্ছেদের ডাক দিয়েছেন কমিটি।
(খ) আনন্দবাজার পত্রিকা (ইং ২৩।৮।৭৭) :– জনতা দলের কার্যকরী কমিটির বৈঠকে যে প্রস্তাব গৃহীত হইয়াছে তাহাতে দলের নেতা এবং কর্মীদের আহ্বান জানানো হইয়াছে : আপনারা সকলে নামের আগে-পরে পদবী ত্যাগ করুন। কেননা এই সব পদবী জাতিবর্ণের পরিচয় বহন করে। একবার তাহা লোপ করিয়া দিলে কে কোন সম্প্রদায়ের বা বর্ণের তাহা আর ঠাহর করা যাইবে না। তাহাতে বর্ণভেদ প্রথার মলে কুঠারাঘাত করা হইবে।
(গ) আনন্দবাজার পত্রিকা (ইং ৭।৮।৭৮) :- শান্তিভুষণ (কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী) সাংবাদিকদের জানান “তাঁর পিতামহ আর্য সমাজের সংস্কার আন্দোলনের একজন নেতা ছিলেন। আমাদের দেশে পদবী দিয়ে জাত ও কুল-কৌলিন্যের বিচার হয় বলে তিনি সেই যুগে তাঁর “গর্গ” পদবী মুছে ফেলেন। তাঁর পিতাও পদবী ব্যবহার করতেন না। তাঁর নাম ছিল বিশ্বামিত্র। বোধ হয় “মিত্র” কথাটি থেকেই তাঁরা বাঙালী এই কাহিনীর উৎপত্তি।
(ঘ) The Stateman, New Delhi, March 21st, 1979. The Prime Minister to-day inaugurated the Backward Classes Commission. The Prime Minister said all men were equal although their condition of work might differ. But the feeling of superiority or inferiority among sections of the population must be removed. Real success could be achieved only when the caste and communal feelings were removed. It was the duty of those who were in a position of advantage in society to see that they gave the benefit of their advan—tage to others. Deputy Prime Minister Mr. Jagjiban Ram said, caste was the main factor determining the status and station of the individual in Indian society. It was suggested by many that economic criteria should be the basis for determining backwardness. But that cannot happen in Indian society. If the Commission could suggest a way of doing away with caste system, that would be a day of rejoicing for human society. As a first step in this direction, he said, the use of prefix or suffix to the names to denote the class a person belonged to should be done away with. [ষ্টেটসম্যান, নয়াদিল্লী, ২১শে মার্চ ‘৭১ ] :—অদ্য প্রধানমন্ত্রী অনুন্নত শ্ৰেণী কমিশনের উদবোধন করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন “কর্মাবস্থানের তারতম্য থাকা সত্ত্বেও সকল মানুষই সমান। কিন্তু জনতার কোন কোন অংশের মন থেকে উচ্চম্মন্যতা বা হীনম্মন্যতা বোধ অবশ্যই দূর করতে হবে। সত্যিকারের সাফল্য কেবল তখনই সম্ভব যখন জাতপাত ও সাম্প্রদায়িকতার মনোভাব বিদারিত হবে। সমাজে যাঁরা সুবিধা ভোগ করছেন তাঁদের কর্তব্য হল সমাজের আর সকলকে তাঁদের সেই সুবিধা ভোগের সুযোগ করে দেওয়া।” উপ-প্রধানমন্ত্রী শ্রীজগজীবন রাম বলেন, “ভারতীয় সমাজে ব্যক্তিবিশেষের মর্যাদা ও স্থান প্রধানত তার জাত দ্বারা নির্ণীত হয়। অনেকে বলেন, অর্থনৈতিক অবস্থাই অনগ্রসরতা নির্ণয়ের মাপকাঠি হওয়া উচিত। কিন্তু ভারতীয় সমাজে তা সম্ভব নয়। যদি এই কমিশন জাতিপ্রথার বিলুপ্তি সাধনের উপায় নির্ধারণ করতে পারে তবে সেই দিনটি হবে মানব সমাজের পক্ষে আনন্দের দিন। তিনি আরও বলেন—এই কাজের প্রথম ধাপ হিসাবে নামের আগে বা পরে ব্যক্তির শ্রেণীগত পরিচয়সূচক পদ ব্যবহারের প্রথা উচ্ছেদ করতে হবে”।
(ঙ) আনন্দবাজার পত্রিকা (ইং ১০।৯।৭৯) :—সকলেই জানেন ভারতের অনেক বিশিষ্ট রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক ব্যক্তি তাঁহাদের প্রচলিত নাম পরিচয়ের মধ্যে কৌলিক পরিচয়ের সূচক কথাটি বাদ দিবার একটি নৈতিক আদর্শ গ্রহণ করিয়াছেন। যথা শ্রীমন নারায়ণ (কিংবা শ্রীমান নারায়ণ) আগরওয়াল নিজেকে শুধু শ্রীমন নারায়ণ বলিয়া পরিচিত করিবার প্রথা গ্রহণ করিয়াছিলেন। শ্রীকামরাজ নাদারও তাই শুধু শ্রীকামরাজ হইয়াছিলেন। একটা যুক্তির কথা শোনা যায়, কৌলিক পরিচয়ের সূচক কথাগুলি যথা আগরওয়াল ও নাদার, বস্তুত “জাত” বাচক নাম। তাই জাতপাতের কোন গুরুত্ব ও সার্থকতা যাঁহারা আদর্শিক কারণে স্বীকার করেন না, তাঁহাদের পক্ষে নামের মধ্যে কৌলিক পরিচয়ের কোন প্রকাশ না রাখিবার ইচ্ছাই স্বাভাবিক।
(চ) মাহিষ্য সমাজ (মাসিক পত্রিকা – ৬৮ বর্ষ, ভাদ্র – ১৩৮৬— “আপন হাতে শক্তি ধর”— চক্রপানি) : —পদবীর দ্বারা উচ্চবর্ণ হিন্দুরা (মাহিষ্য ব্যতীত) বল নিরুপণের ব্যবস্থা রেখেছে। চক্রবর্তী, চট্টোপাধ্যায়, উপাধ্যায়, মুখোপাধ্যায়, ভট্টাচার্য প্রভৃতি পদবীধারিগণ নিশ্চিতভাবে ব্রাহ্মণ; বসু, মিত্র, দত্ত, ঘোষ পদবীর ব্যক্তি যে কায়স্থ তাহা নিরূপণ করতে কোন অসুবিধা নাই। কিন্তু, মাহিষ্যদের পদবী কর্মানুসারে অর্জিত। কোন কোনটি আবার পরিচ্ছন্ন অর্থবহ নয়। উদ্দেশ্য সিদ্ধির পথে পদবী যথেষ্ট সহায়ক। সে কারণ পদবী ত্যাগের আন্দোলনে বর্ণ হিন্দুগণের সমর্থন বা উৎসাহ আদৌ উল্লেখযোগ্য নয়।
(ছ) আঁধার হতে আলো (‘ধর্ম ও সমাজ’ আলোচিত গ্রন্থ—শ্রীনারায়ণ মজুমদার) :—যে বর্ণভেদ হইতে জাতিভেদের উদ্ভব হইয়াছে সেই বর্ণভেদের (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র) বিলোপ সাধন করে হিন্দু সমাজকে বর্ণ বিভাগহীন (CASTELESS) একটা ঐক্যবদ্ধ সমাজ বা গোষ্ঠীতে পরিণত করতে হবে। ইহার প্রথম পদক্ষেপ হবে—সমাজে সকলের পদবী (TITLE) বিলোপ করা—পুরাকালে যেমন ছিলেন ব্যাস, বশিষ্ঠ, বাল্মীকি, বিশ্বামিত্র, রামচন্দ্র প্রমুখ মনীষিগণ। শুধু নাম দিয়ে হবে মানুষের পরিচয়,—যেমন রাম, শ্যাম, যদু, মধু, ইত্যাদি। পরে পরিচিতি লাভ করবে বাঙালীরূপে, হিন্দু রূপে এবং ভারতবাসীরূপে। এই পদবী বিলোপে মানুষের উচ্চ-নীচ গরিমা বিদারিত হয়ে প্রত্যেকে সম মর্য্যাদার অধিকারী হবে। ইহাতে মানসিক ও সামাজিক একতা দৃঢ় হবে।
(জ) ভারতবাণী (শারদীয়া, ১৩৮৬ “পিছিয়ে থাকা সমাজে লেখক হওয়ার সমস্যা”—নিরঞ্জন হালদার) :— তপশীল সম্প্রদায়ের শিক্ষিত মহল থেকে এই জাতীয় অভিযোগ শোনা যাচ্ছে, তপশীলী সম্প্রদায়ের লেখকদের লেখা এই রাজ্যের উচ্চ বর্ণের হিন্দু পরিচালিত ও সম্পাদিত পত্রপত্রিকায় ছাপা হয় না, বই দিলেও তা সমালোচনার যোগ্য বলে গণ্য হয় না। বালা, গাইন, মণ্ডল, বিশ্বাস, কয়াল, সিকদার প্রভৃতি উপাধি দেখলেই নাকি ওই সব লেখকের লেখা পড়া হয় না। রাধানাথ মণ্ডল আনন্দবাজার পত্রিকায় চাকরি না করলে ওই পত্রিকার রবিবাসরীয় সাময়িকীতে তাঁর লেখা ছাপা হত কিনা সে বিষয়েও সন্দেহ প্রকাশ করা হয়। এই সব অভিযোগ আংশিক সত্য হলেও এই অভিযোগের কারণগুলি নিয়ে কোন আলোচনা এখনও আমার চোখে পড়েনি।
(ঝ) আনন্দবাজার পত্রিকা (ইং ২৪।১।৮০— “উপাধি বিষম ব্যাধি”—অমিতাভ, কলিকাতা-১৩) :—আপনার বহুল প্রচারিত সংবাদপত্রের মাধ্যমে একটা বলিষ্ঠ প্রস্তাব জনসাধারণের সামনে তুলে ধরতে চাই। যা ভারত থেকে সাম্প্রদায়িকতা ও জাতপাত নির্মাণ করতে সাহায্য করবে বলে আমার মনে হয়। সেটা হল উপাধি বা টাইটেল বর্জন করা। যদিও মানসিকতার আমূল পরিবর্তনই কেবলমাত্র সাম্প্রদায়িক অভিশাপ থেকে দেশকে মুক্তি দিতে পারে, তবুও সংস্কারমুক্ত সাম্য-সমাজ গঠন করতে চাইলে সে সমাজে টাইটেলের কোন স্থান নেই। টাইটেলই সাম্প্রদায়িকতা ও জাতপাতের সবচেয়ে প্রত্যক্ষ নিদর্শন।
(ঞ) প্রজাতান্ত্রিক ভারত (জুন, ১৯৮০– ভারতের পশ্চাদপদ শ্রেণীর মুখপত্র, পরিচালনা—ভারত সেবক সমিতি)
উক্ত পত্রিকায় ‘বাঙালীর জাতীয় চরিত্রে দুর্বলতা কোথায়?’ শীর্ষক প্রবন্ধে শ্রীবুদ্ধ লিখেছেন : জন্মগত জাত-ব্যবস্থার বিলোপ ঘটাতে হলে মাত্র দুইটি পন্থা আছে। (১) প্রত্যেক বাঙ্গালীর নামের শেষ অংশে উপাধি যথা—চাটার্জী, বসু, বিশ্বাস, মণ্ডল, রাখা চলবে না। (২) ছেলে ও মেয়ের বিয়ের সময় জাত দেখালে চলবে না! উপযুক্ত বাঙালী ছেলের সহিত উপযুক্ত বাঙ্গালী মেয়ের বিয়ে দিতে হবে। এই দুইটি পন্থা যতদিন বাঙ্গালীরা গ্রহণ না করছে ততদিন বাঙ্গালীত্ব গড়ে উঠতে পারে না—এক শতাব্দী চলে যাবে কিন্তু জাত ব্যবস্থা উঠবে না। [ প্রসংগত উল্লেখযোগ্য, “ভারত সেবক সমিতি”র পরিচালকমণ্ডলী শ্রীকৃষ্ণপদ, শ্রীমদনকুমার, শ্রীরণজিতকুমার, শ্রীহীরালাল ও শ্রীননীগোপাল—এইরূপে তাঁদের পদবীহীন নাম লেখা সুরুও করেছেন]।
(ট) নিদ্রিত শূদ্রের নিদ্রাভঙ্গ (‘সামাজিক গ্রন্থ’—ডাঃ সুধীর কুমার বাগচি) :—পণ্ডিত দিগিন্দ্র নারায়ণ ভট্টাচার্য্য লিখিত “জাতিভেদ উচ্ছেদ” গ্রন্থখানি আমি পাঠকগণকে পাঠ করিবার জন্য অনুরোধ করিতেছি। সমস্ত হিন্দুগণ একজাতি বা শ্রেণীতে কোনদিন পরিণত হইতে পারিবে কিনা জানিনা তবে লেখক মনে প্রাণে আশা করিয়াছেন এবং শাস্ত্রীয় প্রমাণ দ্বারা দেখাইয়াছেন যে পূর্বে সমস্ত হিন্দুই এক বিরাট শ্রেণীহীন হিন্দু, বা ব্রাহ্মণ নামে অভিহিত হইত এবং পুনরায় সেইরূপে একশ্রেণীবদ্ধ হওয়া সম্ভব এবং সঙ্গত। তিনি ইহার জন্য উপাধি বা পদবী বর্জনের নির্দেশ দিয়াছেন। যদি একান্ত তাহা সম্ভব না হয় তবে সকল হিন্দুকে এক “রায়” পদবী গ্রহণ করিতে নির্দেশ দিয়াছেন। আমিও ইহা সর্বান্তঃকরণে সমর্থন করি এবং তপসিল সম্প্রদায়ের মধ্যে আজও যাহারা দাস, নমঃদাস, নমঃশূদ্র, ঢালী, বাদ্যকর, জালিয়া, মালো ইত্যাদি পদবী ব্যবহার করেন তাহাদের অবিলম্বে “রায়” পদবী গ্রহণ করিতে অনুরোধ করিতেছি।
(ঠ) রূপান্তর—[ ১৯৭৬, বিশেষ সংকলন; ভ্যানিটি সাহিত্যচক্র, কোলাঘাট (মেদিনীপুর) ‘পাঁশকুড়া থানার সমাজ ও সংস্কৃতি’—ডঃ হরিসাধন গোম্বামী ] :—
পাঁশকুড়া থানার অধিবাসীদের নামের পদবীও লক্ষণীয়। হাওড়া জেলার অনেক অঞ্চলে অন্য যেসব পদবী আছে তা’ এখানে অনুপস্থিত। তবে উপাধি হিসাবে পড়্যা, কর, করণ, পাত্র, মাইতি, জানা, গুড়্যা, ঘড়া, বাগ, হাতী, কাঁঠাল, পাখিরা ইত্যাদি হরেক রকম বাস্তু-প্রতীকী উপাধি বা নামবাচক বা গুণবাচক উপাধি লক্ষ্য করা যায়। আধুনিক যুগে আমরা এইসব সেকেলে উপাধি থেকে বেরিয়ে আসতে চাই একটি কারণে—জাতের গণ্ডি আমাদের অপছন্দ। তাই ভাবি হরিসাধন গোস্বামীর পাত্রের নাম রবিশঙ্কর হরিসাধন হোক; কন্যার নাম সুতপা হরিসাধন – বিয়ে হ’লে সুতপা দীপঙ্কর হয়ে যাক্। ইচ্ছে থাকলেও তা’ যে হ’তে পারছে না তার কারণ সামাজিক আন্দোলনের অভাব। আমি যদি ভাগ্যবিধাতা হ’তাম তা’হলে এক নাগাড়ে সকলের নামের উপাধি আর জায়গার পুরানো নাম বদলে দিয়ে সব নতুন করে দিতাম। বড়জোর ঐতিহ্যকে বাঁচাবার জন্যে একটা এলাকার নাম ঐতিহ্য অনুসারে ভাগ করে দিতাম। আর জাত এবং পদবীর বিচার অবশ্য অদূর ভবিষ্যতে একদম মুছে যাবে—শিক্ষার চেতনা যতই বাড়বে। কিন্তু যত শিগগীর ওই জাত, খাদ্যাখাদ্যের বিচার (অবিচার), পোষাক-আশাকে সেকেলে মনোভাব আমরা দূর করতে না পারি ততদিন আমরা আদিম বলেই গণ্য হবো।
(ড) আনন্দবাজার পত্রিকা (ইং ৯.১১.৮০ – ‘আমাদের পদবীর ইতিহাস’— লোকেশ্বর বসু) :—আপনার নামের শেষে একটি পদবীনামক পুচ্ছ যুক্ত হয়ে আছে। স্বর্গত ধনগোপাল মুখোপাধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি ডিপ্লোমা ইত্যাদিকে বানরের লেজ বলে অভিহিত করেছিলেন, একযুগ আগেকার সেই শ্লেষ হয়তো অধুনা সুপ্রযুক্ত বলে বিবেচিত হতেও পারে, কিন্তু আমাদের পদবী মাহাত্ম্যকে কেউই বোধহয় বিদ্রূপ করেন নি। বরং উত্তর ও পশ্চিম ভারতে অর্ধশতাব্দী আগেও মিঃ রমেশ বা মিঃ রামলাল জাতীয় পদবী বিযুক্ত নামের প্রচলন ছিল বলে তাঁরা অনেকেই উপহাস কুড়িয়েছেন। স্বাধীনতা আন্দোলনের কালে সমস্ত ভারতবাসীকে এক জাতিত্বে গড়ে তোলার প্রয়োজনে একদিকে যেমন অস্পৃশ্যতা দূর করার চেষ্টা হয়েছিল, তেমনই জাতিভেদও শিথিল হয়ে এসেছিল। বিবাহের ক্ষেত্রে না হলেও, সামাজিক অন্যান্য ক্ষেত্রে। কিন্তু পদবীর গুরুত্ব কমে নি। শনিবারের চিঠিতে সজনীকান্ত একদা দুঃসাহসিকভাবে লেখকদের পদবী বিলপ্ত করেছিলেন, যদিও বলা বাহুল্য সে-কালীন পাঠকেরা এই প্রচেষ্টাকে উপভোগ্য কৌতুক হিসেবেই গ্রহণ করেন, সম্ভবত পত্রিকাটির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্য। স্বাধীনতার পর বেশ কিছুকাল প্রতিক্রিয়াশীল ভাবনা-ধারণা অদৃশ্য থাকলেও ইদানীং সেই শক্তিগুলি ক্রমশই মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। তার একটি হল পদবীর কৌলীন্য, যার আড়ালে লুকিয়ে আছে জাতিভেদ। সমস্যা আয়ত্তের বাইরে চলে যাওয়ার পর যথারীতি বিদেশী রাষ্ট্রের কলকাঠি অনুমান করেই তখন আমরা নির্বিকার থাকবো। এই সেদিন একটি বেসরকারী অফিসে উচ্চপদে জনৈক করুণাময় গুড় তাঁর নানাবিধ যোগ্যতা নিয়ে নিযুক্ত হওয়া সত্ত্বেও সেই অফিসের অধস্তনদের মধ্যে বিক্ষোভের কারণ হয়ে পড়লেন। কারণ, তপশীলী তো দরের কথা, “গুড়” যে ব্রাহ্মণদের একটি আদি পদবী এই ধারণাটিও অনেকের নেই।… গড়াই যদি সমযোগ্যতাসম্পন্ন হন, তা হলেও ইনটারভিউ বোর্ডের সদস্যরা পদবী-কৌলীন্যের দিকেই স্বাভাবিক পক্ষপাতিত্ব দেখাবেন সে-বিষয়ে কোন সন্দেহ আছে কি? গুড় ও গড়াইয়ের মধ্যে ধ্বনিগত বা সাংস্কৃতিক পার্থক্যই বা কোথায়? শৈশব থেকে পদবীর সঙ্গে আমাদের আত্মীয়তা গড়ে ওঠে বলেই আমাদের ধারণা জন্মায় যে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া এই পদবী অত্যন্ত প্রাচীন। মাত্র একশো বছরের পুরোনো কোন প্রথাকে হাজার বছরের ঐতিহ্য মনে করার অসাধারণ এক পটুতা আছে আমাদের। পদবীর ব্যাপারেও সে কারণেই সে কারণেই আমাদের বিভ্রান্তি কম নয়। সংবাদপত্রে কখনো কখনো বিজ্ঞপ্তি ছাপিয়ে আদালতে এফিডেবিট করে পদবী পরিবর্তন করার দৃষ্টান্ত চোখে পড়লে আমরা অনেকেই কৌতুক বোধ করি। জাতিবিদ্বেষবশত কেউ কেউ অনুদার মন্তব্যও করে বসি। অথচ এই একই অপরাধে আমরা সকলেই অপরাধী, অন্তত আমাদের পূর্বপুরুষেরা। কারণ এই অপরাধ (?) তাঁরা প্রায় সকলেই করে গেছেন। তাঁরা কেউ ইচ্ছেমত পদবী গ্রহণ করেছেন, কেউ আদি পদবীর গায়ে সংস্কৃত ভাষার পালিশ চড়িয়েছেন, কেউ বা পদবীটি আমূলে বদলে নিয়েছেন। আমরা পরবর্তী সন্তান সন্ততিরা সেই পদবীকেই আদি ও অকৃত্রিম মনে করে নামের শেষে যুক্ত রেখে আত্মগর্বে আপ্লুত হয়ে আছি।
(ঢ) ধর্মীয় শীতলী সংঘ, শ্রোত্রিয় সবিতৃ ব্রাহ্মণ মহাসম্মিলনী ও সমন্বয় পত্রিকা সংসদ কর্তৃক ১৩৮৭ সন, ১৩ই চৈত্র তারিখের (অর্ধ শতাব্দপর্তি) ৺রীশ্রীশ্রীশীতলা পূজোৎসবের স্মারক পত্র–শ্রোত্রিয় সবিতৃ ব্রাহ্মণ : নবসত্যযুগ—শ্রীঅনিলচন্দ্ৰ মজুমদার :—সত্যযুগে নাহি ছিল জাতিভেদ/ছিল এক বর্ণ, এক ধৰ্ম্ম / পদবী কাহারো ছিল না কখনো/করিত সবে সবার কর্ম্ম/পদবী কাহারো নাহি রবে তাই/কেবলমাত্র থাকিবে নাম/তবেই বিভেদ ঘুচিবে সমূলে/সবে সুখে রবে অবিরাম।
উক্ত প্রতিবেদনগুলির পরিপ্রেক্ষিতে উল্লেখিত “সমাজ-বিবর্তন” ও “পদবী—বিবর্তন” পর্যালোচনা অপরিহার্য। তবে এখানে উক্ত দুটি বিষয়ের বিশদ ব্যাখ্যা ব্যতিরেকেই সংক্ষেপে বলা যায় যে, গুণগত কর্মানুসারে সৃষ্ট ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও ক্ষুদ্র এই চারবর্ণের একমাত্র ব্রাহ্মণগণই জন্মগত অধিকারে ব্রাহ্মণবর্ণের দাবিদার হয়ে রয়েছেন; অন্য বর্ণগুলির বর্ণাধিকারের পরিচয় সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন নামের জাতগুলির মধ্যে হারিয়ে গেছে। জাতগুলির উৎপত্তি প্রাথমিক পর্যায়ে কর্মভিত্তিক পথে হওয়ায় কর্মের উচ্চ-নীচ স্তর অনুসারে জাতগুলির উচ্চ-নিম্ন স্থান সমাজে নির্দিষ্ট রয়েছে। অর্থাৎ, জাতগত পেশার দ্বারাই সমাজগত মর্যাদার তারতম্য হয়ে আসছে। বর্ণ স্তরে কর্মের উৎকর্ষে উচ্চবর্ণে উন্নীত হওয়ার মত সুযোগ জাতিস্তরে ব্রাহ্মণেতর জাতিগুলির নাই। জন্মসসূত্রেই তাদের জাতির পরিচয় হয় আর জাতিগত কর্মের দ্বারাই জীবিকার ব্যবস্থা করতে হয়। কিন্তু ব্রিটিশ ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তন ও তার প্রভাব এবং জাতিবর্ণ নির্বিশেষে গুণে বা যোগ্যতার ভিত্তিতে কর্ম-প্রাপ্তির প্রথার প্রবর্তন হওয়ায় অর্থনৈতিক অবস্থার নিরিখে কর্মের কৌলীন্যে বর্ণ বা জাতের কৌলীন্য প্রকাশের সুযোগ না-থাকলেও জন্মগত অধিকারে ব্রাহ্মণবর্ণের ন্যায় তথাকথিত উন্নত পর্যায়ের জাতগুলির সমাজে উচ্চ মর্যাদার দাবি নস্যাৎ হয় নি এবং নিম্নমানের জাতগালির প্রতি অবহেলার পথও রয়েছে খোলা। আর, ঐ উচ্চ-নীচ তারতম্য বোধ জিইয়ে রাখতে প্রচ্ছন্নভাবে সহায়তা করে আসছে কতকগুলি পদবী। যেহেতু বর্ণ, জাত বা সম্প্রদায়, কুল বা গোষ্ঠীর বংশপরম্পরায় ব্যবহৃত পদবীর দ্বারাই সামাজিক স্থান নির্ধারিত হয়ে থাকে।
বাঙ্গালী হিন্দুজাতির বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভিন্ন পদবী প্রচলিত। পদবীর দ্বারা সম্প্রদায়কে চিহ্নিত করার একটি ঐতিহ্য দীর্ঘকাল হিন্দু সমাজেও প্রচলিত। কিন্তু পদবী পালটানোর সুবিধা থাকায় যেরূপভাবে পদবী পালটানো হয়েছে বা হচ্ছে, এতে যদিও আর পদবীর দ্বারা জাতিবর্ণ নির্দিষ্ট করার পথ খোলা নেই, তবুও শ্রেণীহীন (জাতিবর্ণহীন) সমাজ গঠনের পথে পদবী একটি বিশেষ অন্তরায় হয়ে সমাজে উন্নত পর্যায়ের জাতগুলির মধ্যে ব্যবহৃত পদবীগুলিও জাতবর্ণের ন্যায় কৌলীন্যের মর্যাদা পাওয়াতে এবং পিছিয়ে-পড়া জাতগুলির মধ্যে ব্যবহৃত পদবীগুলির মান নিচু বলে চিহ্নিত হওয়ায় অর্থাৎ, পদবীর পরিচয়ে ব্যক্তির সামাজিক স্থান প্রকাশ পাওয়ায় দৃশ্যত পদবীকেই সমাজে বিভেদনীতির বাহক মনে করা হয়। এবং এই ধারণা থেকেই জাতপাতের ধ্বজাবাহী পদবীর লেজুড়টি নিজেদের নাম থেকে ছেঁটে ফেলতে কেউ কেউ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অনেকে এর অনুকূলে বক্তব্যও রাখছেন।
সমাজে উন্নত পর্যায়ের জাতিবর্ণগুলির মধ্যে ব্যবহৃত পদবীগুলিরও জাতিবর্ণের ন্যায়ই কৌলীন্যের মর্যাদা থাকায় সাধারণত অনগ্রসর শ্রেণীর লোকেরা তাদের অপাংক্তেয় অকুলীন পদবীগুলি পালটে মর্যাদাপূর্ণ পদবীগুলি ধারণ করছেন। যার ফলে পদবীর কৌলীন্য ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে। পদবীযোগে বর্ণ, জাত বা সম্প্রদায়ের কৌলীন্য প্রকাশের চিন্তিত প্রথাটি যে বিনষ্ট হয়ে পড়েছে তা এই সংকলনে বিশেষ-ভাবে পরিলক্ষিত হবে। পদবীর কৌলীন্যে জাতিবর্ণের কৌলীন্য প্রকাশের ধারণা আজকার দিনে কত যে অবাস্তব তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ রয়েছে এই সংকলনের “ঘ” বিভাগে। নিম্নমানের জাতগুলির মধ্যে তথাকথিত কুলীন পদবী ব্যবহারের ছড়াছড়ি দেখে সমাজের উন্নত-অনুন্নত জাতিবর্ণ নির্বিশেষে কুলীন পদবী ব্যবহারের মোহ যেদিন কাটবে সেদিন হয়ত অপাংক্তেয় পদবীগুলি পালটানোর মতোই পদবী ছেঁটে ফেলে পৌরাণিক যুগের ন্যায় পদবীহীন নাম লেখা সুরু হতেও পারে।
প্রসংগক্রমে এ কথাও বলা যায় যে, কর্ম ভিত্তিক বর্ণ বিভাগের বিকৃতিতে জন্মসূত্রে বর্ণের অধিকার এবং বর্ণের অধিকারে কর্মের অধিকার কালক্রমে অন্ধ সংস্কারে পরিণত হয়ে বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে যে চরম স্পৃশ্যাস্পৃশ্য বিভেদের সৃষ্টি করেছিল পরবর্তীকালে তা-ই হিন্দু সমাজকে শতধা বিভক্ত করে তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক এমনকি ধর্মগত ঐক্যও বিনষ্ট করেছে। তথাকথিত উচ্চবর্ণের লোক নিজেদের স্বার্থে অনগ্রসর কোন কোন শ্রেণীর লোকদের অপাংক্তেয়, অস্পৃশ্য বা অচ্ছুৎ বলে চিহ্নিত করে সকল প্রকার সামাজিক ও ধর্মীয় অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে। সমাজ তথা জাতির জীবনে এক নিদারুণ কলংক এই বঞ্চনা ও ছুতমার্গ। জাতপাতের বিচারে জাতির সামগ্রিক জীবন বিভেদ-বিষে জীর্ণ। বিষক্রিয়ায় হিন্দু জাতি ক্ষয়িষ্ণু। এ ক্ষয়িষ্ণুতা রোধে, বিভেদ-বিদ্বেষের ও মনুষ্যত্বের এই অবমাননার বিরুদ্ধে যুগে যুগে মহাপুরুষদের সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে। “অপমানে হতে হবে তাঁহাদের সবার সমান” কবিগুরুর উচ্চারিত এ সূত্র ধরেই বুঝি অপমানিত জাতকুলের মানষেরা জাগরিত চেতনায় কৌলীন্যের ধ্বজাবাহী অসামান্য পদবীকে ধূলুবলুণ্ঠিত সমান করে দিচ্ছে, নিজেদের কুলজাত পদবীর বদলে ঐ পদবীগুলি গ্রহণ করে। পদবী পরিবর্তনের এ প্রক্রিয়াকে সমাজের পিছিয়ে-থাকা অংশের সামাজিক আন্দোলন বললেও অত্যুক্তি হয় না। কারণ সাধারণভাবে অনগ্রসর তথাকথিত অনভিজাত সমাজের জন্য চিহ্নিত পদবীর পরিবর্তে অগ্রসর অভিজাত সমাজে ব্যবহৃত পদবী গ্রহণ প্রাথমিক বিচারে অবহেলিত অকৌলীন্যের চিহ্নটুকু বিলুপ্ত করে দেওয়ার প্রয়াস বলেই মনে হয়। এ আন্দোলন সমাজ জীবনে ফল্গুধারার ন্যায় প্রবাহিত। কোথাও সংগঠিত, কোথাও অসংগঠিত পথে। এ আন্দোলনের প্রেক্ষিতেই বিভিন্ন মহল থেকে প্রস্তাব আসছে কৌলীন্য-অকৌলীন্যের নিশান এই পদবীটি একেবারে ছেঁটে ফেলে পদবীহীন নাম ব্যবহারের। দিনে দিনে এ আন্দোলন দানা বেঁধে হয়ত সর্বজনীন রূপ পরিগ্রহ করবে। আর, মানষের পদবীহীন নাম-পরিচয় হবে শ্রেণীহীন (জাতবর্ণহীন) সমাজ গঠনের পথে একটি সার্থক পদক্ষেপ।