সুফল
শেষের কথা বলে শেষ করে চলে যাই। দিন চলচে, বছরের পর বছরও ঘুরলো। মানব-সমাজের তীরে-তীরে একাকী আনাগোনা করচি। সে-পথ এখনো পার হতে পারিনি; তার শেষ নেই, বিচ্ছেদ নেই। যাদের ধরে রাখতে চাই তাদের ধরাছোঁয়া পাইনে-মাঝখানে বিপুল ব্যবধান। যাদের দূরে ফেলে গিয়েছিলাম তারা দূরে সরে গেচে। মন বচে, তীর্থ করেচ, ‘সুফল কী পেলে?— পাইনি কিছুই, কিন্তু গেচে অনেক। সেই অফুরন্ত পথের ধারে-ধরে জীবনের বহু পাথেয় ফেলে এসেছি, বন্ধুত্ব, প্রেম, বাৎসল্য, মায়া ও মোহ। পুণ্যসঞ্চয় করতে গিয়ে আর সকল সঞ্চয়কে উৎসর্গ করে এসেছি। লোভ, লালসা, কামনা-এদের হাত বাড়িয়ে ধরতে যাই কিন্তু নাগাল পাইনে। বিদ্বেষ বুদ্ধি, বিষয়লিপ্সা, আত্মপরতা ও দম্ভ এরাও যদি একে-একে বিদায় নেয় মানুষ বাঁচে কী নিয়ে?
কোথাও যাবার জন্য পা বাড়ালেই পথ অবরোধ করে সেই মহাপ্রস্থানের পথ। সেই দুর্গম ও দুস্তর, সেই আদিঅন্তহীন অবিচ্ছিন্ন পথরেখা আমার জাগরণে, স্বপ্নে, আহারে-বিহারে, কল্পনায় ও রচনায়, আমার সকল কর্মে ও অবকাশে সাপের মতো হিলহিল করে ওঠে, নিয়তির মতো নিরন্তর সে আমাকে আকর্ষণ করে পথ ভুলিয়ে তার কি নিয়ে যায়। সেই পথরেখা আমাকে রিক্ত ও নিঃস্ব করেছে, তবু তৃষ্ণার্ত জিহ্বা মেলে ব্যাকুল বাহু বাড়িয়ে বলে জানো দাও, ক্ষুধা আমার মেটেনি। চলে এসো, ছুটে এসো, ছিঁড়ে এসে তোমার সকল বন্ধন!
আজ তারা কোথায় গেল যারা আমার সকলের চেয়ে নিকটের? চিনতে পারিনে আজ অতি নিকট-আত্মীয়দের; মাঝখানে অপরিচয়ে বিরাট সেতু। যাদের পাশে বসি, কাছে থাকি, দুই হাতের মধ্যে যাদের জড়িয়ে ধরি, তারাও যেন অনেক দূরে, ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে ছুটতেও তাদের যেন ধরতে পারিনে, তারা যেন স্মরণের সীমানার বাইরে চলে গেচে। ঘর থেকে বারান্দা, বারান্দা থেকে কলতলা, কলতলা থেকে রান্নাঘর মনে হয় একটা থেকে আর একটা যেন শত- শত ক্রোশ দূরে, যেন আর চলতে পাচ্চিনে, নাগালে আসচে না। আজ দেয়ালঘেরা ক্ষুদ্র কক্ষের স্তিমিত দীপালোকে বসে ভাবচি, সেদিন যারা সঙ্গের সাথী ছিল তারাও কি আমার মতো এমনি অভিশপ্ত ‘সুফল’ সঞ্চয় করেছে, তারাও কি আমার মতো পারচে না সংসারের অকিঞ্চিৎকর সুখ-দুঃখের মধ্যে ফিরে আসতে? তারও কি পথে-পথে প্রেতের মতো ঘুরে বেড়ায়?
অতীত-স্মৃতির পিছনে থাকে একটি সকরুণ বেদনা, ছেড়ে চলে আসার একটি গভীর দীর্ঘশ্বাস। আজ তাদের সবাইকে ভাল লাগছে, যারা ছিল দুর্গমের সঙ্গী। ঐশ্বর্য ও সৌভাগ্যের নানা আড়ম্বর, সেখানে প্রতিযোগিতার তাল ঠোকাঠুকি, আমরা সবাই সেখানে পরস্পর বিচ্ছিন্ন,-কিন্তু দুঃখের দুস্তর তীর্থে আমাদের মধ্যে আর ব্যবধান থাকে না,-সেখানে হয় রাজার সঙ্গে রাখালের বন্ধুত্ব, সেই দুঃখের পূত সলিলে অস্পৃশ্য ও অভিজাতের ভেদাভেদ নেই।
বহুদিন পরে শা-নগরের এক পথের ধারে গোপালদার সঙ্গে দেখা। –
‘কেমন আছেন গোপালদা? ভালো ত সব?’
’ভালো! তুমি?’
আর উত্তর দিতে পারিনে।
‘এই আমার মণিহারি-দোকান, এসো ভাই, একটু তামাক ধরাই!’
কিন্তু ওই পর্যন্তই, তারপরে আর আলাপ জমে না। সেদিন কথা ফুরোত না, আজ তার কী বিপরীত, মাঝখানে আজ অনতিক্রম্য বিচ্ছেদ, পরস্পরের আর নাগাল পাইনে। তামাক পুড়তে থাকে, তিনি তার কুণ্ডলীকৃত ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে এক সময় বলে ওঠেন, ‘ভাবচি এ বছর আবার যাবো-আবার পালিয়ে যাই সেখানে!
মৌখিক সৌজন্যের পর দোকান থেকে উঠে চলে আসি। দিনের পর দিন চলে যায়।
শ্যামবাজারের পথে যেতে একদা পিছন থেকে কানে এল, ‘দাদাঠাকুর, কেমন আছেন?’
মুখ ফিরিয়ে নিঃশব্দে একটি নারীর দিকে তাকিয়ে রইলাম।
‘চিনতে পারলেন না, আমি যে সেই ভুবন দাসী।’ সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত করে পুনরায় সে বললে, ‘আপনার দয়া কি ভুলবো কোনোদিন, আপনার জন্যেই ত মা-গোঁসায়ের হাড় ক’খানা দেশে ফিরেচে। শেঠের বাগানে একদিন পায়ের ধুলো দেবেন, ‘দাদাঠাকুর। এই যে কাছেই, উল্টোডিঙিতে।’
নানা কথার পর সে এক সময় বিদায় নেয়। এরা সেদিন আমার চোখে ছিল অতি বিচিত্র, রহস্যময় মানুষ, অপার্থিব ও অলৌকিক যুগ যুগান্তকালের জন্ম-মৃত্যু পার হয়ে যাওয়া তীর্থযাত্রী, দূর আকাশের কোননা অনাবিষ্কৃত গ্রহলোকের জীব,-শহর-সভ্যতার কোলাহলের ভিতর দাঁড়িয়ে এদের চিনতে পারার কথা নয়। আবার সেই হিমালয়ের পর্বতচূড়ায়, তুষার নদীর তীরে, অরণ্যের নিস্তব্ধতায়, প্রাণান্তকর পথের পীড়নের মধ্যে দেখা না হলে এদের আর পরিপূর্ণরূপে গ্রহণ করা যাবে না।
মহানগরের রাজপথ দিয়ে ছুটে চলে যাই। পথে লোকজন জড়ো করে বলতে ইচ্ছা করে, আমাকে তোমরা চিনতে পারছো না, আমি যে সেই। কী পরিবর্তন আমার ঘটেছে? কেন সর্বান্তঃকরণে সবাইকে গ্রহণ করতে পারিনে? কেন এই হৃদয় হলো নির্দয়?
গল্প লিখি, উপন্যাস রচনা করি, কিন্তু তার ভিতরে অতি সংগোপনে মানব- জীবনের এই প্রশ্ন থেকে যায়-জীবন কি সাহিত্যের চেয়ে বড় নয়? মানব-যাত্রী কি একদিন স্বর্গরাজ্য প্রতিষ্ঠার কল্পনায় তীর্থযাত্রা করবে? পরম আশার বাণী কি তাদের কানে ধ্বনিত হবে না? মহত্তর জীবন, নিষ্পাপ প্রেম, অকলঙ্ক মনুষ্যত্ব, দাক্ষিণ্যময় জীবপ্রীতি-এরা কি সেই অপরূপ তীর্থ-পথের পাথেয় হয়ে উঠবে না?
গেরুয়া গেচে কিন্তু বৈরাগ্য যেতে চায় না। মহাপ্রস্থানের পথের ধূলিতে ধূসর সে-বৈরাগ্য। সে বৈরাগ্য উঠেচে ইহকাল, পরকাল, পুনর্জন্ম, সকল প্রশ্নেরও ঊর্ধ্বে। তার চারিদিকে ঈশ্বর নেই, সৃষ্টি নেই, জন্ম-জরামৃত্যু নেই; তার পথ চিররাত্রি-চিরদিন উত্তীর্ণ হয়ে লোক লোকান্তরের দিকে চলে গেচে। পার হবে সে মর্ত্যলোক, পার হয়ে যাবে গ্রহ-নক্ষত্রসৌরজগৎ, মহাব্যোমের অকূল আলোক- সমুদ্র সন্তরণ করে একদা সে পৌঁছবে জীব-কল্পনার অতীত কোন এক স্বৰ্গলোকে।
‘যা কিছু পেয়েছি, যাহা কিছু গেল চুকে,
চলিতে চলিতে পিছে যা রহিল প’ড়ে;
যে-মণি দুলিল যে ব্যথা বিধিল বুকে,
ছায়া হয়ে যাহা মিলায় দিগন্তরে;
জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা,
ধূলায় তাদের যত হোক্ অবহলা,
পূর্ণের পদ-পরশ তাদের পরে ॥’
সমাপ্ত