যাত্রা

যাত্রা

বৈশাখ ১৯, ১৩৩৯। সেদিন প্রথম আমাদের পদব্রজে যাত্রা শুরু হ’লো। কাঁধে বোঝা আর হাতে লাঠি নিয়ে দুই বন্ধুতে পথে নেমে এলাম। পাথর ও কাঁকরের পথ, বাঁ দিকে দূর পর্বতের চূড়ায় টিহরীর রাজপ্রাসাদ তাজমহলে ছবির মতো, তারই নিচে দেরাদুনের গভীর অরণ্য। দক্ষিণে প্রভাত-সূর্যের নিঃশব্দ সমারোহ আকাশে-আকাশে প্রসারিত হয়ে চলেচে। প্রস্তরসঙ্কুল শুষ্কপ্রায় চন্দ্রভাগা নদী পেরিয়ে কিছুদূর যেতে এলো মৌনী বন। বনের গায়ে সামান্য একখানি গ্রাম, ভরত-শত্রুঘ্নজীর মন্দির। মন্দির পার হয়ে ধীরে ধীরে চললাম। পাহাড়ের চড়াই শুরু হ’লো, আমাদের গতি হ’লো মন্থর। পাহাড়ের পথে যেতে যেতে গল্প করা চলে না। মুখ যখন বন্ধ থাকে, মন তখন আপন কাজ করে যায়। মাইল দুই পথ পার হতেই আমাদের যথেষ্ট পরিশ্রম হ’লো, নতুন জুতো পায় লাগচে, ব্রহ্মচারী চলচে বকের মতো টপ্‌কে টপকে, বহুকাল পরে তার পায়ে উঠেচে জুতো, জুতা পরার উল্লাসে তার পা দুখানা কথা কইতে কইতে চল্‌চে। অনেক উঁচুতে উঠে পথ আবার নিচের দিকে নামলো। পার্বত্যপথ আপন ইচ্ছায় যাত্রীদের টেনে নিয়ে যায়। সমতল ভূমিতে যেমন আমাদের অবাধ স্বাধীনতা, যেদিকে খুশি এঁকে বেঁকে চলতে পারি, এখানে তার উপায় নেই, এখানে তুমি পথের অধীন, পথের নির্দেশেই তোমাকে যেতে হবে। ক্রমে জলের শব্দ প্রখর হয়ে উঠলো, বুঝলাম নিচে নেমেচি। কারো কিছুদূর এসে লছমনঝুলা পেলাম, গঙ্গার নীলধারার পরে পুল, দু’দিকে লোহার কাছি দিয়ে বাঁধা টানা সাঁকো! বদরীনারায়ণের পথের প্রায় সমস্ত পুলই লছমনঝুলার আদর্শে তৈরি, পার হতে গেলে সমস্তটা দোলে, পুল ছিঁড়ে পড়ে যাবার ভয় হয়, আমোদও লাগে। পুল পার হয়ে কয়েকজন বাঙালী পুরুষ ও মহিলার সঙ্গে সাক্ষাৎ হ’লো। আমরা বদরীনাথের পথে পা বাড়িয়েচি শুনে তাঁরা বিস্মিত হলেন, শুভেচ্ছা জানালেন, নমস্কার করে বিদায় দিলেন।

সম্মুখে গগনস্পর্শী নীলকণ্ঠ পর্বত, তারই নিচে দক্ষিণে স্বর্গাশ্রমের শ্বেত মন্দির, হাঁসের পালকের মতো শাদা, পদতলে গঙ্গার নীল স্রোতপ্রবাহ। বিদায় স্বদেশ, বিদায সভ্যতা, বিদায় জনসমাজ! আত্মীয়, বন্ধু, পরিচিত, মনে মনে সকলের নিকট বিদায় নিলাম। চোখে আমাদের সুদূরের পিপাসা, অন্তরে উদ্দীপনা ও উৎসাহ, বুকে দুঃসাহসিক পথযাত্রার দুর্জয় আনন্দ। আমরা গৃহবিরাগী, কিন্তু তবু মন ভারাক্রান্ত হয় কেন? কেন এমন করে পা কাঁপে, কেনই বা গলার ভিতরে কী যেন ঠেলে ওঠে? হয়ত এমনিই হয়! মানুষের এই ছেড়ে চলে যাওয়ার পিছনে আছে একটি অনন্ত বেদনার সুর। এত মায়া, এত মমতা, এত হৃদয়াবেগের খেলা, তথাপি ঠিক সময়ে চলে যেতে হয়, বিদায় নিতে হয়। একদিন হয়ত সকালের এই নির্মল আলো উজ্জ্বল রোদ চোখ থেকে মুছে যাবে; হয়ত এই আকাশ, এই গঙ্গা, এই পর্বতমালা, ধরিত্রীর চারিদিকের এই মনোরম ঐশ্বর্যসম্ভার হারিয়ে আমি বিদায় নেবো, সেদিনের হয়ত আর দেরিও নেই, সেদিনও এই মরজগতে এমনি করেই চলবে আনন্দ। কলরব, কিন্তু যে-ক্ষুধা, যে-আশা, যে-স্বপ্ন যাবার বেলায় পথের প্রান্তে ফেলে যাবে তার দিকে কেউ ফিরেও চাইবে না!

কষ্টদায়ক বন্ধুর পথ, প্রস্তরসঙ্কুল, মাঝে মাঝে পাহাড়ের গায়ে পত্রপল্লবের ভিতর এক একটা ঝরনার শব্দ শুনতে পাচ্ছি, শেষ বসন্তের ঝরাপাতায় পথ আচ্ছন্ন, মানুষের সমাগম প্রায় নিঃশেষ হয়ে এলো, আর সাড়াশব্দ নেই। নতুন জুতো পায়ে লাগচে! পিঠে বাঁধা কম্বল ও ঝোলার দড়িতে কাঁধ কন্ কন্ করচে, শরীর ক্লান্ত হয়ে এলো। নানা জনের নানা উপদেশ পেয়েছিলাম, কিন্তু সে উপদেশ মাত্র, পথে এসে তার সার্থকতা খুঁজে পেলাম না, খেই হারিয়ে গেল। ঘণ্টা দুই চলবার পর ব্রহ্মচারী শুষ্ককণ্ঠে বললে, ‘আসুন দাদা, একটু বসে যাই, জল তেষ্টা পেয়েচে।’

ছায়াশীতল পথের প্রান্তে দুজনে বসলাম। নিচে নদীর কলধ্বনি, বনময় পাহাড়, কাছেই একটি অতি ক্ষুদ্র মন্দির, নিভৃত ও প্রশান্ত,-পূজারী আমাদের পানীয় জল দিলেন। জল খেয়ে ব্রহ্মচারী বিড়ি টানতে লাগলো। গল্প করার আর কিছু নেই, কী গল্পই বা করবো?-আস্তে আস্তে পা ছড়িয়ে সেইখানে শুয়ে পড়লাম।

সংসারে হৃদয়াবেগের মূল্য নেই জানি, তবু এই পথের ধারে শুয়ে কোথায় যেন অভিমান ভরে উঠতে লাগলো। শখের বশে দেশভ্রমণ করে বেড়ানো আমার পেশা নয়, যারা হৈ চৈ করে দলবদ্ধ হয়ে হাওয়া বদলাতে বেরোয় তাদের কথা ধরিনে, প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে যাদের ভাবালুতা আসে সেই স্বল্পপ্রাণ উচ্ছ্বাসসর্বস্ব লোকগুলোকেও জানি, অথচ নিজেকেও ত এদের থেকে আলাদা করে দেখতে পারিনে। আজ যে সবাইকেই ভালো লাগচে! যারা বন্ধু যারা বিরূপ, যাদের ফেলে এসেচি, যে জন্মভূমি আমার পরমায়ুকে সঞ্জীবিত করেছে, সমাজ ও লোকালয়, অখ্যাত ও অনাদৃত, কেউ ত আমার পর নয়! আজ আমার সন্ন্যাসীর বেশ, কিন্তু সে যে শুধু পরিচ্ছদ, শুধু বহিরাবরণ, দেশের কথা মনে হলেই যে এখনো দেহের লক্ষ লক্ষ স্নায়ু ঝন্ ঝন্ করে বেজে ওঠে। অবলীলাক্রমে সেদিন যে-মমতার আশ্রয় ছেড়ে এসেছি, উদাসীন হয়ে যাদের কাছে বিদায় নিয়েচি, আজ এই সন্ন্যাসের কৃত্রিম আবরণের নিচে বিচ্ছেদ-কাতর মন বলচে, তোমরা আমায় ভুলে যেয়ো না, আমি আছি, বেঁচে আছি।’

একদিন সবাই মরবে, কিন্তু নিশ্চিহ্ন হয়ে মুছে যাওয়ার মতো। সান্ত্বনাহীন মৃত্যু আর কিছু নেই। আমরা নিরুপায়, দুর্বল, ভাগ্যের ক্রীড়নক, তবু যে আমরা নিরন্তর বেঁচে থাকতেই চাই! এই বাঁচার চেষ্টা অবিশ্রান্ত চলেচে সমস্ত পৃথিবীময়। কেউ বাঁচে নবজীবন সৃষ্টির মধ্যে, কেউ শিল্প ও সাহিত্যে আত্মপ্রকাশ করে বাঁচে, কেউ খ্যাতি ও যশ আহরণ করে বাঁচতে চায়,–এই যে সমাজ, সভ্যতা, বিজ্ঞান, সাম্রাজ্য-প্রতিষ্ঠা, এদের মূলে রয়েচে মানুষের বাঁচার অনন্ত পিপাসা। যার জীবনকে অসার জেনে মোক্ষ প্রাপ্তির ক্ষুধায় তীর্থভ্রমণে পা বাড়িয়েচে তারাও চায় বাঁচতে, তাদের দেখেছি পথের ধর্মশালায় নিজ নিজ নাম। লিখে রাখার কি অপরিসীম আগ্রহ ও অধ্যবসায়!

ব্রহ্মচারী গা-ঝাড়া দিয়ে উঠলো। বললে, ‘চলুন দাদা, বেলা হয়ত বারোটা হয়ে গেচে, ক্ষিধে পেয়েচে আপনার নিশ্চয়ই।’

নিশ্বাস ফেলে ঝোলা ও কম্বল বাগিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। বললাম, ‘ক মাইল হাঁটা হলো ব্রহ্মচারী?’

পথে মাইল-পোস্ট আছে। ব্রহ্মচারী মনে মনে হিসেব করে বললে, ‘মাইল পাঁচেক।’

আরো কিছুদূর এসে গরুড় চটি পাওয়া গেল। একখানা বড় ধর্মশালা। নিচে একটি দোকান, দোকানে বেশি দামে সব আহার্যই পাওয়া যায়। ধর্মশালার পাশে সুন্দর একখানি বাগান ও জলাশয়। নিকটে পাহাড়ের গায়ে একটি খরস্রোতা ঝরনা, তারই জল এই জলাশয়টিতে যাত্রীদের জন্য সংরক্ষিত হয়। চটিতে রান্নার জন্য পিতলের বাসন পাওয়া যায় এই সত্যে যে, চটিওয়ালার নিকট ডাল আটা ঘি চাল ইত্যাদি কিনতে হবে। যারা কিছু কিনবে না, তাদের পক্ষে চটিতে স্থান পাওয়া কঠিন। অনেক চটিতে মাথা পিছু দু’পয়সা দিলেও আশ্রয় পাওয়া যায়। সকল চটিতেই প্রায় একই নিয়ম। এবেলার মতো এখানেই বিশ্রাম, ওবেলায় আবার যাত্রা। চটির দোতলায় তখন বহু যাত্রীর সমাবেশ হয়েচে। বিশ্রান্তে দুই বন্ধুতে রান্নার আয়োজনে ব্যস্ত হলাম।

এমনি করেই আমাদের যাত্রা। দু’বেলা রান্না, দু’বেলা বাসন মাজা, দু’বেলা পথ হাঁটা। দুপুরবেলা আহারাদি পর অগাধ নিদ্রা, মাছির তাড়নায় মরা মানুষের মতো আপাদমস্তক মুড়ি দেওয়া, বিকালবেলা অবার পথ হাঁটতে শুরু করা, সন্ধ্যায় কোনো এক চটিতে আশ্রয় নেওয়া, আহরান্তে জানোয়ারের মতো ঘুম, সন্ধ্যারাতেই ঘুমে অচেতন। চটিগুলো আস্তাবলের মতো তিন দিক বন্ধ, এক দিক খোল, গাছের গুঁড়ি ও ডাল-পাতা দিয়ে তৈরি, কাঁকর-পাথর মিশানো মাটি দিয়ে লেপা, নিতান্ত দরিদ্র ও সামান্য। আমরা যাত্রীর দল গিয়ে সাজপোশাক ছেড়ে গা এলিয়ে দিতাম। ক্লান্তি আর অবসাদে মুখে কথা ফুটতো না।

যাত্রীরা এসেছে নানা দেশ থেকে, কেউ দক্ষিণী, কেউ সিন্ধি, কোনো দল পাঞ্জাবী, খোট্টা, মাড়েয়ারী, উড়িয়া, গুজরাটি, মারহাট্টি, বাঙালীর দল এদের মধ্যে ছড়ানো। সাধারণ ভাষা উর্দু এবং হিন্দির সংমিশ্রণ। দু’চারজন ছাড়া সকলেরই পায়ে জুতো, বেশির ভাগ জুতোই ক্যাম্বিসের, তলায় নবাবের সোল, এই জুতোই সুবিধা। হাতে একগাছা লাঠি নিতেই হবে, নৈলে শেষ পর্যন্ত পথ চলা অসম্ভব। লাঠিই পথের একমাত্র উপকারী ও নিঃস্বার্থ বন্ধু। অনেক যাত্রী যায় গাড়োয়ালী কুলীর পিঠে, কুলীদের অসীম শক্তি। কাণ্ডিওয়ালা তাদের নাম। কাণ্ডিটা একটা ঝুড়ির মতো, পিঠের দিকে বাঁধা থাকে, তাতে মালও যায়, মানুষও যায়। কাণ্ডির উপরে স্ত্রী যাত্রীই বেশি সংখ্যা ওঠে। ডাণ্ডিগুলো ইজি চেয়ারের ধরন, তলা ডাণ্ডা লাগিয়ে চারজন কুলী কাঁধে তুলে নিয়ে পাল্কীর বেহারার মতো চলে। সম্ভ্রান্ত যাত্রীরা ডাণ্ডি করেই যায়, এইটিই সকলের চেয়ে আরামদায়ক। ঝাঁপানও আছে, মড়ার খাটের মতে তার চেহারা, আসনপিঁড়ি হয়ে বসে যেতে হয়, পথশ্রম বাঁচে বটে কিন্তু আরামটুকু নেই। প্রথম-প্রথম যাত্রীরা দলে দলে উৎসাহের সঙ্গে হাঁটতে থাকে, দু’চারদিন ছ’দিনের পর দেখা যায় তাদের গতি হয়েচে মন্থর, কেউ চলচে খুঁড়িয়ে, কেউ হাঁটচে লেংচে, কেউ পড়েচে পেছিয়ে, কেউ রোগাক্রান্ত, কারু এসেচে বিতৃষ্ণ, কেউ গেল ফিরে। প্রথম দিকে যাদের দেখেছিলাম সুস্থ, সরল, প্রফুল্ল ও মিষ্টভাষী, কয়েকদিন পরে দেখা গেল দেহ তাদের শীর্ণ, ধুলোয় ও রোদে মলিন, করুণকাতব দৃষ্টি, পায়ের হাঁটুতে হয়ত ধরেচে ব্যথা, চোখে মুখে অস্বাভাবিক বিতৃষ্ণা, অত্যন্ত রুক্ষ মেজাজ। কাছে এসে দাঁড়ালে ভয় করে। যাত্রীদের এই অবস্থা কুলীরা বোঝে। তাই যারা বেকার কুলী, বা পিঠে খালি কাণ্ডি ঝুলিয়ে দিনের পর দিন ধৈর্যসহকারে দলবদ্ধ যাত্রীদের পিছনে পিছনে হাঁটতে থাকে। ক্রমে ক্রমে দেখা যায় একটি একটি করে তাদের খরিদ্দার মিলচে, তখন তারা গরজ বুঝে বেশি দর হাঁকে, এবং তা দিতেই হয়; গরজ বড় বালাই। এ পথে সভ্যসমাজের মতো চুরি-ডাকাতি রাহাজানি এসব কিছু নেই, যাত্রীরা এদিক দিয়ে যথেষ্ট নিরাপদ। কুলীরা বিশ্বাসী, ভদ্র ও সরল। অর্থের প্রতি তাদের মোহ আছে কিন্তু তার জন্য দুষ্প্রবৃত্তি নেই। তারা বিবাদ করবে কিন্তু প্রবঞ্চনা করবে না। তারা দরিদ্র বটে, কিন্তু দারিদ্র্য তাদের হৃদয়কে কলুষিত করেনি। বিত্তহীন, কিন্তু চিত্তহীন নয়।

উত্তরাখণ্ডের গঙ্গার তীরে তীরে আমাদের পথ। এপারে বৃটিশ গাড়োয়াল, বাঁ-দিকে নদী, ওপারে টিহরী-গাড়োয়াল। করদরাজ্য, নামেমাত্র স্বাধীন। গঙ্গা, অলকানন্দা ও মন্দাকিনীই সাধারণত সেই রাজ্যের নির্দিষ্ট সীমানা। গাড়োয়ালীদের গ্রাম কোথাও কোথাও দু’মাইল পর্যন্ত উঁচুতে অবস্থিত। গ্রামবাসীরা সকলেই অবস্থাপন্ন বলতে হবে। সকলেই চাষী। পাহাড়ী ঢালু জমিতে খাঁজ কেটে কেটে তার এক আশ্চর্য উপায়ে শস্য উৎপাদন করে-গম, আলু, অড়হর, কপি, সরষে, ইত্যাদি। বয়সে যারা যুবক, কিংবা বোঝা বহনে সমর্থ বৃদ্ধ ও প্রৌঢ়, তারা চৈত্রের শেষে পথে নেমে আসে, হরিদ্বারে গিয়ে যাত্রীদের ধরে বোঝা পিঠে নিয়ে পাহাড়ে ওঠে। হরিদ্বার থেকে মেহলচৌরী পর্যন্ত তাদের গতিবিধি সীমাবদ্ধ, এর বাইরে যাবার হুকুম তাদের নেই। মেহলচৌরী গাড়োয়াল জেলার শেষ সীমানা। পৃথিবীতে কোথাও যে সমতল ভূমি আছে, শহর আছে, রঙ্গালয় আছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে, এ তারা ভাবতেই পারে না। রেলপথে যে ট্রেন দৌড়, জলে যে জাহাজ ভাসে, মাঠে যে ফুটবল খেলা হয় এ তাদের কাছে স্বপ্ন। শীতের দিনে এরা কেমন করে বাঁচে জানিনে, কিন্তু গ্রীষ্মকালে কম্বল মুড়ি দিয়ে রাত কাটাতে হয়। কুলীরা জাতিতে প্রায়ই ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়, যাত্রীদের সঙ্গে তারা শোয়, বসে, গল্প করে, ভুরা তামাক টানে, কিন্তু তাদের ছোঁয়া খায় না। আহার সম্বন্ধে তাদের বিস্ময়কর শুচিতা। আমিষ ভক্ষণ তারা পাপ মনে করে। জীবহিংসা তাদের একেবারেই নেই। তাদের মেয়েরা ঘরের কাজ নিয়েই কেবল বসে থাকে না, তারাও চাষ করে, গৃহপালিত পশুর তদ্বির করে, কম্বল বনে, জামা কাটে, তেল-ঘি তৈরি করে, পাহাড়ের বন থেকে কাঠ কেটে আনে, ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে পিঠের উপর বেঁধে নিযে ভ্রমণে বেরোয়। পথে যেতে যদি কোনো গ্রাম পড়ে, অমনি বয়স্থা মেয়েরা ও বালক- বালিকারা বেরিয়ে এসে যাত্রীদের কাছে হাত পাতে। বলে, “এ শেঠজি, এ রাণা, সুঁই-সুতা দেও, পাই-প্যায়সা দেও, এ রাণা, দে রাণা?-ছুঁচ-সুতো এবং সিকি পয়সা ছাড়া তাদের ভিক্ষা করবার আর কিছু নেই। যদি পুরো একটি পয়সা পায় ত মহাখুশি, যেন অপ্রত্যাশিত ঐশ্বর্য হাতে এল। ছুঁচ-সুতায় তাদের অদ্ভুত আসক্তি। এ বস্তুটি গাড়োয়াল জেলায় নাকি মেলে না।

চতুর্থ দিন তো উত্রাই পথে আমরা ব্যাসঘাটের দিকে চললাম। পর্বত চূড়া থেকে জলধারার মতো যাত্রীরা নেমে চলচে। যখন কোনো নদী পার হতে হয় কিম্বা এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে চড়তে হয় তখনকার পথ উত্তাই। উত্রাই পথে নামার সময় বিপদ আছে। হোঁচট খাওয়া এবং পা পিছলোনোর ভয়। অতি সন্তর্পণে এবং সতর্কতার সহিত ঘণ্টার পর ঘণ্টা নামতে নামতে বিরক্তি ধরে। পায়ের হাঁটুতে জোর লাগে, ব্যথা জমে, শেষ পর্যন্ত পা খারাপ হয়ে যায়। চড়াই পথে উঠতে উঠতে কোমর-পিঠ-ঘাড় কন্ কন্ করে, বুকের মধ্যে ব্যথা ধরে, দাঁতে দাঁতে চেপে মুখের যন্ত্রণা হয়-দূরে চড়াই পথ আছে সংবাদ পেলে আমরা ভীত হয়ে পরস্পরের মুখের দিকে তাকাই। যেন আসন্ন বিপদ পথে আমাদের জন্য প্রতীক্ষা করে রয়েচে।

আকাশ সেদিন প্রাতে মেঘে মেঘে মলিন। নয়ার নদী ও গঙ্গার সঙ্গমে হু হু শব্দে হাওয়া উঠেছে। নতুন এক রাজ্যে উত্তীর্ণ হয়ে এসেচি। আজ সকাল পর্যন্ত বত্রিশ মাইল পথ হাঁটা হলো। সমতল ভূমিতে এইটুকু পথ অতিক্রম করতে আমাদের পরিশ্রম সামান্যই হয়, কিন্তু এ যে পাহাড়,-দুর্গম, দুরারোহ, প্রস্তরসঙ্কুল। এ পথের শেষ নেই, বিচ্ছেদ নেই, একঘেয়ে, যন্ত্রণাদায়ক পথ। নয়ার নদীর পুল পার হয়ে ব্যাসগঙ্গার তীরে এক চটিতে এসে উঠলাম। গতদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত কয়েকটা চটি পার হয়ে এসেছি,-নাইমুহানা, বিজনী, বান্দর, শেমালু, কান্দি ইত্যাদি। বান্দর চটিতে সেদিন রাত্রে এক কাণ্ড! নিদ্রিত অবস্থায় আমাদের দুই বন্ধুকে প্রকাণ্ড এক পাহাড়ী সাপ সস্নেহে আলিঙ্গন করেছিল, কিন্তু কী সৌভাগ্য, চুম্বন করেনি! লাঠির ঘায়ে সাপ মরলো কিন্তু সেই সূত্রে এক পণ্ডিতজির সঙ্গে জলে বন্ধুত্ব। পণ্ডিতজির বাড়ি মধ্যভারতের বুরহানপুর জেলায়। একা মানুষ, পাকা তীর্থযাত্রী। বছরখানেক থেকে তিনি পরিব্রাজক হয়ে সকল তীর্থ ঘুরচেন। সন্ন্যাসী-যোগীর বেশ তাই রেলওয়ে কোম্পানী তার কাছে কখনো ভাড়া আদায় করতে পারেনি। না পারার কারণও ছিল, তার চতুর ও মধুর আলাপে বনের পশুও বশীভূত হয়। লোকটির বয়স পঁয়তাল্লিশ থেকে পঁয়ষটির মধ্যে, রোগা ও দীর্ঘ দেহ, কয়েকটা দাঁত নেই, চাতুর্য ও ভগবভক্তির সংমিশ্রিত দীপ্তিতে দুটো চোখ উজ্জ্বল, গলায় ছড়া চার পাঁচ রুদ্রাক্ষের মালা, জপে বসে থলিটি খুলে ফোঁটা-চন্দন তিলক পরত, মুখে বোল ছিল, ‘সীতারাম’। ইতিমধ্যে আমরা দলে একটু পুরু হয়েছি, সেই কালীঘাটের যাত্রীরা এসে মিলেচে। দীর্ঘ চুল, গঞ্জিকাসেবী বৃদ্ধ দাদাটি এসে পৌঁছেচেন, তার পিছনে আছে এক পাল বুড়ী। বুড়ীদের উৎসাহ, ধৈর্য ও সহনশীলতা দেখে বিস্মিত হতে হয়।

চারুর-মা’র কোমর ভাঙা, কুঁজো হয়ে চলে, আখের ছিবড়ের মতো শীর্ণকঙ্কাল দেহ, কালীঘাটে দুধ বিক্রি করে খায়; অনেকগুলি গোরুর মালিক সে। সংসারে মেয়ে ছাড়া তার আর কেউ নেই। মেয়ের নাম চারু

‘শুনচ, অ বা’ঠাউর, ভাদুর যেদিন ছেলে হ’লো…কী বিষ্টি, তেমনি অন্ধকার, আমি বলি, আর বুঝি বিউতে পারে না…কিন্তু কানি, জুনি, পাগলি, ওদের বেলা…’

‘কি বকিস্ লা চারুর-মা, গজর গজর করে?’-বামুন-বুড়ী ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে— “এই জন্যে তোকে আনতে চাইনি। গোরুর আদিখ্যেতা শুনতে শুনতে… যদি এতই কুটকুটুনি তবে এলি কি জন্যে? আমি মরি শীতের জ্বালায়, আর তুই…দে তোর কম্বলখানা আমার গায়ে চাপিয়ে।’

‘আহা, শোনো না গল্পটা বামুন-মা? তা’ পর, বুঝলে বা’ ঠাউর?’

“থাম্ থাম্‌, আ মর্, অবাধ্য মাগি…চুঁনি আমাকে, ওইখানে সরে বোস্, ইত্যিজাত ছুঁয়ে ছুঁয়ে আমার জাতধর্ম আর কিছু রইল না। দেশে গিয়ে প্রাচিত্তির না করলে আর- ’

অস্পৃশ্যা চারুর মা অপ্রস্তুত হয়ে সরে যায়।

দাদার সঙ্গে আছে অম্রা সিং। যুবকটি পাণ্ডার লোক, পথ-নির্দেশক হয়ে যাত্রীদের বদরীনাথ পর্যন্ত পৌঁছে দেবার ভার নিয়ে এসেচে। শুদ্ধাচারী ব্রাহ্মণ- সন্তান। কিছু লেখাপড়াও জানে, দেব-প্রয়াগ থেকে কিছুদূরে পাহাড়ের কোন্ এক গ্রামে তার বাড়ি। বৎসরান্তে অর্থ উপার্জনের জন্য হরিদ্বারে নেমে যায়। যাত্রীদের সুখ-সুবিধার দিকে তার প্রখর দৃষ্টি, সামান্য বিশ তিরিশ টাকার জন্য প্রায় সাড়ে তিনশো মাইল তাকে হেঁটে যেতে হয়। লোকটি ভদ্রবেশী বর্বর নয়, ভদ্রই।

ব্যাসঘাটে প্রকৃতির অপূর্ব প্রকাশ। উদার পর্বতশ্রেণী, মেঘকজ্জ্বল আকাশের ছায়া নেমেচে নদীতে, নদীর প্রস্তর-আবর্তে ঘুরে ঘুরে লক্ষ লক্ষ সাপের মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে চলেছে স্রোতের কলকল্লোল,-দূরবিস্তার বালির চড়ায় কোথাও কোথাও এক-আধজন সন্ন্যাসী জপে বসেচে। ঘনশ্যান বনরেখা, তার ভিতর দিয়ে ঝরনার শব্দ, একটি অনির্বচনীয় অবকাশ। কিন্তু বিশ্রামের সময় আমাদের নেই। এই স্বপ্নরাজ্যের শোভা যেমন এক চোখে দেখেচি, তেমনি অন্য চোখে ছিল পথের জ্বালা, অপরিমিত দুঃখ, অসহ্য কষ্ট। এখনো ভাবচি, কেমন করে ফিরে যাই, দু’চারজনকে ফিরে যেতে দেখচি, আমার যাওয়াই বা এমন কী অপরাধ? এখনো সময় আছে, এখনো তিনদিন হাঁটলে জন্মভূমিকে স্পর্শ করতে পারি, পথ এখনো গভীরে ডুবে যায়নি, এরপরে অনুশোচনার আর অন্ত থাকবে না! ফিরে গেলে লোকলজ্জা একটা আছে জানি, কিন্তু সেই সামান্য লোকলজ্জার কাছে এমন জীবনকে বলি দেবো? না, মরতে আমি পারব না; মৃত্যুতে আমার বড় ভয়!

‘তুমি কেন এলে বাবা তীর্থ করতে? এই অল্পবয়সে-’

বললাম, ‘তীর্থ করতে আমি ত আসিনি।!

‘তবে? তবে এলে কেন এই দুর্গমে বাবা? হ্যাঁ গা, অ ছেলে?’

‘এমনি বেড়াতে এসেচি বুড়ী-মা।’

‘বেড়াতে এসেচ! ও মা কি হবে গো, বেড়াবার কি আর জায়গা পেলে না? বিয়ে হয়নি বুঝি?’

হেসে বললাম, ‘বিয়ে হলে কি কেউ আসে না এ পথে?”

একজন বললে, ‘আহা, সে বাবার দয়া! যাকে টানেন সেই—’

বললাম, ‘বাবার দয়া যে চায় না সে কেন আসে বুড়ী-মা? ‘

বুড়ী চোখ কপালে তুলে বললে, ‘বাবার দয়া চায় না, এমন মানুষ…সে যে নাস্তিক বাবা!’

মাইল কয়েক রাস্তা গিয়ে কানাঘুষোয় শুনলাম, আমার মতো নাস্তিক আর ভূ-ভারতে নেই! নিন্দা এলো, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ আসতে লাগলো, আমার প্রতি বুড়ীদের শ্রদ্ধা ও স্নেহ বিলুপ্ত হলো, পথে আমার মতো অহঙ্কারী, আত্মম্ভরী, নাস্তিক যাত্রীর দেখা পাওয়া মহাপাপ। নতমস্তকে তাদের মন্তব্য মেনে নেওয়া ছাড়া অন্য গতি ছিল না!

‘ও কিছু না, বুঝলে দাদা, ওসব মেয়েমানুষের কথা। পাগলে কী না বলে আর ছাগলে~’ ব্রহ্মচারী বলে।

‘কী বল্‌চে, আমি ত শুনতে পাইনি!’

‘শুনতে না পাওয়াই ভালো! বলে কানে দিয়েচি তুলো আর পিঠে বেঁধেচি কুলো! ওসব মেয়েমানুষের কথায় কান দিতে নেই-ওরা ভারি পুণ্যি করতে এসেছে!

সেদিন বহুপথ অতিক্রম করে সন্ধ্যায় দেবপ্রয়াগে এসে পৌঁছলাম। পথের ধারে বসে আছেন এক উলঙ্গ সন্ন্যাসী, নির্বিকার, নির্লিপ্ত, পাশে এক ভক্ত শিষ্য দুই হাঁটুর মধ্যে মাথা গুঁজে বসে আছে। নবাগত যাত্রী দেখে সে মুখ তুলল না, বোধ হয় ঘুমোচ্ছিল। পাশে ধুনি জ্বলচে। একখানা পাথরের উপর খানিকটা কাঁচা ভাঙা তৈরি করা রয়েচে। ভক্তিভরে তাঁর পায়ের কাছে মিনিট কয়েক নিমীলিত নেত্রে বসে একসময় উঠে সরে পড়লাম। বাস্তবিক, সন্ন্যাসীর মতো সন্ন্যাসী বটে!

দেবপ্রয়াগ ছোট একখানি পাহাড়ি শহর। অলকানন্দা এসে এখানে গঙ্গার সঙ্গে মিলেচে। যেন নীলাম্বরী পরা দুটি যমজ বোন বহুকাল পরে পরস্পরের দেখা পেয়ে গলাগলি করচেন। এখানে আছে রামচন্দ্রের মন্দির। শোনা গেল, দেবপ্রয়াগে উত্তর-পুরুষদিগকে আগমন করতে দেখে পূর্বপুরুষরা পিতৃলোকে আনন্দে নৃত্য করেন। ইচ্ছেটা, বংশধরগণের হাতে, গ্রহণ করেন পিণ্ড; পিতৃলোকে বোধ করি নিত্য দুর্ভিক্ষ। শহরের প্রয়োজনীয় সামান্য কিছু কিছু এখানে আছে। গুটিকয়েক ধর্মশালা, কম্বলীবাবার আশ্রম ও দাতব্য ঔষধালয়, ছোট্ট একটি বাজার, একটি বিদ্যালয় ও ডাকঘর।

আজকের মতো যাত্রা শেষ হ’লো। ক্লান্ত মন ও ভগ্ন দেহ নিয়ে আমরা সিংহের নির্দেশক্রমে আমরা সবাই এসে একটি ধর্মশালায় উঠলাম। বাঁচলাম, শহর দেখে বাঁচলাম, মানুষের সমাগম এবং লোকালয় দেখে বাঁচলাম। এই হিমালয়ের রাজ্য এবং মহাপ্রস্থানে পথ, যার আদি আছে কিন্তু অন্ত নেই, মনুষ্যজাতি এর মধ্যে কোথাও যে বাসা বেঁধেছে, সমাজ গঠন করেছে, এখানেও যে আছে জীবন-সংগ্রাম, সুখ-দুঃখ, আশাআনন্দ, এ আমরা আগে বুঝতেই পারিনি। আমরা সবাই উদাসীন সমাজচ্যুত তীর্থযাত্রীর দল, বায়ুতাড়িত শুষ্ক ও ম্লান ছিন্নপত্র; নিতান্ত বৈরাগ্যে আমরা শহরের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমাদের অন্তরের সঙ্গে আজ এর কোথাও যোগ নেই।

সামান্য জলযোগান্তে কম্বলশয্যা গ্রহণ করা গেল। পাশে ব্রহ্মচারী, মাথার কাছে বৃদ্ধ দাদা, ওদিকে বুড়ীদের মধ্যে বিড়ালের মতো কোলাহল বেধেছে। কা’র গায়ে কা’র পা ঠেকে গেচে, কা’র মিল্‌চে না পয়সাকড়ির হিসাব, দেশে কে কে লিখবে চিঠি, কা’র জামাই আসতে মানা করেছিল, মাছির কামড়ে আর চুলকানিতে কারু পায়ে ঘা ফুটেছে, তারই যন্ত্রণা ও কাতরোক্তি-এমনিতর নানা জটলা। বামুন-মার গলার আওয়াজ মাঝে মাঝে সেই জটলাকে তীরের ফলার মতো বিদীর্ণ করে ছুটোছুটি করছিল।

পরম যত্নে ও সাগ্রহে ছোট কল্‌কেটি সেজে দাদা অন্ধকারে দেশালাইটি এগিয়ে দিয়ে বললেন, “জ্বালো দাদা, তুমি না ধরিয়ে দিলে টেনে সুখ নেই। সাঁপিটা দেখচি শুকিয়ে গেছে।’

ময়লা একখানা জলে ন্যাকড়া ভিজিয়ে তিনি কলকের তলায় জড়িয়ে নিলেন।

ব্রহ্মচারী অনুগত ভক্তের মতো প্রসাদ পাবার ইচ্ছায় গুটি গুটি উঠে বস্‌ল। ঘুমের আগে দু’ টান না টালে তার ঘুম আসে না।

ধূমপান করতে করতে দাদা বললেন, ‘গোপা ঘোষ মানুষ চেনে, যা তা লোকের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব নেই। তোমাকে পথে কুড়িয়ে পেলাম দাদা, তোমার মতন মানুষ হ্যাঁ, কেউটের বাচ্চা বটে-বলে কল্‌কেটা ছেড়ে দিয়ে তিনি মাথা গুঁজে শুয়ে পড়লেন।

ব্রহ্মচারী তাঁর কথা লুফে নিয়ে বলে উঠলো, ‘এত বড় ধার্মিক, বুঝলেন গোপালদা, সমস্ত পথ আমাকে খাওয়াতে খাওয়াতে…দাদা, আপনার ঋণ আমি এ জীবনে—’

অর্থাৎ, গুরু ও শিষ্য দুজনেই তখন নিবিড় নেশায় মশগুল।

বললাম, ‘ব্রহ্মচারী, নিন্দা আর প্রশংসা এখন আমার কাছে একই বস্তু। কিন্তু আপনার পক্ষে এসব যে বেমানান।’

‘কী দাদা?’

‘এই আপনার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করাটা। সন্ন্যাসীর সবচেয়ে বড় লক্ষণ নির্বিকার হওয়া।’

অনেক রাত পর্যন্ত জেগে ব্রহ্মচারীর সঙ্গে আলাপ হতে লাগল। কত তার মনের কথা, কত জল্পনা-কল্পনা। বললে, ‘পূর্ণ বিশ্বাস ভগবানে না থাকলে…মঠ যেদিন তুলবো সেদিন আপনি ভার নেবেন, দাদা। মঠ আমি করবই। এখন কিছুদিন চলবে আমার ভিক্ষাবৃত্তি, দরকারের জন্যেই টাকা যেমন করেই হোক ছলে-বলে-কৌশলে …‘

বললাম, ‘ভিক্ষায় পেট চলে, সম্পত্তি করা চলে না।’

ব্রহ্মচারী কিয়ৎক্ষণ কী যেন ভাবতে লাগল। তারপর বললে, ‘নেশার মুখে তবে খুলেই বলি আপনাকে, ক’দিন ধরে আপনার কাছে পরামর্শ নেবার জন্যে…বলেই ফেলি আপনাকে, গোপালদা কি ঘুমোলেন?’

গোপালদার সাড়া না পেয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে চুপি চুপি সে বললে, ‘কিছু টাকা জমিয়েছি দাদা, এই ধরুন হাজার খানেক, এখনো হাজার দুই টাকা লাগবে অন্তত। ভেবেচি কি জানেন? বাংলা দেশেই যাবো, জল-হাওয়া ভালো এমন এক গ্রামে। দিন তিনেক আগে রাতের বেলা লুকিয়ে এসে গ্রামের শেষে মাঠে, এক গাছতলায়…’

মুখ তুলে তার দিকে তাকালাম।

‘লজ্জা আর আপনাকে করবো না, বলেই ফেলি’, ব্রহ্মচারী লজ্জিত চোখ দুটো নামিয়ে বললে, সেই গাছতলায় মাটি খুঁড়ে এক শিবলিঙ্গ পুঁতে সরে পড়বে। তিনদিন পরে সন্ন্যাসীর বেশে যাবো সেই গ্রামে, বলবো এসেচি কৈলাস থেকে আদেশ নিয়ে, বৃক্ষমূলে হবে বাবার আবির্ভাব, স্বয়ম্ভু মহাদেব, মন্দির প্রতিষ্ঠা করতে এসেচি।’

উৎসাহিত হয়ে বললাম, ‘তবে আমাকেও একটু ঠাঁই দিয়ো ব্রহ্মচারী, আমি তোমার বিজ্ঞাপন প্রচার করবো,-দেখো যেন গাছটা বেশ প্রাচীন হয়! প্রাচীনের ভক্ত আমরা ভয়ানক।’

ব্রহ্মচারী খুশি হয়ে বললে, ‘ব্যাটারা দেশটাকে বোঝে না, দেব-দেবতার ব্যবসাই এদেশে সবচেয়ে জমাটি কারবার।’

বললাম, ‘তুমি আর-একটা কাজ ক’রো ব্রহ্মচারী, ওই সঙ্গে অমনি তুক- তাক ওষুধের ব্যবসাটাও খুলে দিয়ে। যে-মেয়ের ছেলে হয় না, স্বামীর সঙ্গে যার বনিবনা নেই, হিস্টিরিয়ার মাদুলি, যার অম্বলের ব্যারাম তার জন্যে-

উৎসাহ ও আনন্দে হেসে উঠে ব্রহ্মচারী বলে, “আর এক কল্‌কে সুপা সাজি, দাদা?”

এদিকে চরসের প্রাদেশিক নাম সুপা। ব্রহ্মচারীর বড় প্রিয়

সকালবেলা ঘুম ভাঙলো। ক্লান্তি ও অবসাদে আচ্ছন্ন শরীর। মাথা তুলতে ইচ্ছা হচ্ছিল না! ঘাড়ে ব্যথা, কাঁধে পিঠে কোমরে ব্যথা, ক্ষতবিক্ষত পা দুটোর করুণ চেহারা দেখলে চোখে জল আসে; কত যন্ত্রণাই তাদের দিচ্ছি, প্রভুভক্ত পা দুখানা পীড়ন সয় অথচ প্রতিবাদ করে না।

উঠে বসলাম। আড়ষ্ট শরীর, দেহের উপরে যেন লাঠালাঠি হয়ে গেচে। আজ সকলের চেয়ে বড় আনন্দ, পথ হাঁটতে হবে না। এইখানে যদি নিয়মিত অন্নবস্ত্র জুটে যায় তবে আর স্বর্গেও যেতে চাইনে। পৃথিবীতে যে মানুষ সকলের চেয়ে সুখী বলে আমাদের ধারণা, তার যখন মৃত্যু ঘটে তখন আমরা সবাই তার আত্মার শান্তি কামনা করি। মানুষ আসলে যে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে দুঃখ পায়, এখানে যে তার শাস্তি নেই, একথা মানুষ আপন অন্তরেই অনুভব করে। করে বলেই দেবদেবতার সৃষ্টি, স্বর্গের সৃষ্টি, পরলোকের সান্ত্বনার সৃষ্টি। শিল্প, সাহিত্য, কৃষ্টি,[১] সভ্যতা, সমস্ত ছাড়িয়েও মানুষের দৃষ্টি ঊর্ধ্বদিকে, গভীরের মধ্যে সে খুঁজেচে একটি পরম সান্ত্বনার বাণী, আশার আশ্রয়, জীবনের চরম পরিণামের মধ্যে একটি সুদূর বেদনাকে সে নিরন্তর অনুভব করে।

[১. আমার ব্যবহৃত এই ‘কৃষ্টি’ কথাটা নিয়ে কিছুকাল পূর্বে সাহিত্য-সমাজে একটা বাদানুবাদ উপস্থিত হয়। রবীন্দ্রনাথ সর্বপ্রথমে (নবেম্বর, ১৯৩৩) আমাকে লেখেন, ‘কৃষ্টি’ শব্দটা ভাষায় কুশ্রী অপজনন। অন্যত্র ‘সংস্কৃতি’ শব্দটাই প্রচলিত—এটা ভদ্র সমাজের যোগ্য।’ বলাবাহুল্য, তৎকালের বহু সাময়িক পত্রে নানা বাগ্‌বিতণ্ডার পর রবীন্দ্রনাথের ‘সংস্কৃতি’ই ভোটাধিক্যে জয়লাভ করেছিল। -গ্রন্থকার।]

নির্মল রৌদ্রে চারিদিক ভেসে গেচে, স্নিগ্ধ হাওয়া বইছে। আকাশ কোমল নীল, কোথাও কোথাও শাদা পালকের মতো টুকরো মেঘ পদচারণা করে বেড়াচ্চে। তাদেরই মাঝে মাঝে স্পশ করচে পর্বত চূড়াগুলি, সেই চূড়ার গায়ে ঘন সবুজ অরণ্যের উত্তরীয়, বাতাসে থেকে থেকে সে উত্তরীয় আকুল হয়ে উঠচে।

গঙ্গা ও অলকানন্দার সঙ্গমস্থলে যাত্রীর দল বসে গেল শ্রাদ্ধ ও তর্পণে, গোপালদা ও ব্রহ্মচারী প্রমুখ বুড়ো-বুড়ীর দল মস্তক মুণ্ডন করলো। পাণ্ডা পড়ালেন মন্ত্র, পিতৃপুরুষ এসে ভক্ত উত্তর-পুরুষগণের হাত থেকে আটার গোলা খেয়ে বোধকরি পরিতৃপ্ত অন্তরেই অদৃশ্য হলেন। সকল প্রয়াগেই শ্রাদ্ধ ও পিণ্ডদান করতে হয়, শাস্ত্রের আদেশ। শাস্ত্রের দেশ!

দিনটি বেশ লাগচে। এত কষ্ট, এত পরিশ্রম, তবু এই সুন্দর সকালটিকে রেখে রেখে উপভোগ করচি। নিকটে নদীর ওপারে কাঠমল্লিকার গাছগুলি হাওয়ায় দুলচে, নদী অনেক নিচে, গায়ে বাতাস লাগিয়ে অলকানন্দার পুলের উপর ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। মনে মনে বলছিলাম, ‘শুধু অকারণ পুলকে, ক্ষণিকের গান গা’রে আজি প্রাণ ক্ষণিক দিনের আলোকে।’ কবিতাটুকুর মধ্যে যে ব্যঞ্জনা, তারই চেহারা যেন দেখছিলাম দিকে দিকে। সকালের এই ছবিখানি যেন এক শিল্পীর সমস্ত জীবনের সাধনায় আঁকা। সমস্ত মন এই চিত্রপটখানিতে নিবিড় তৃপ্তিতে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে রইল।

অনেক বেলায় রান্নাবান্নার আয়োজন সেরে অলকানন্দায় স্নান করে এলাম। ব্রহ্মচারী এবেলা রামচন্দ্রজীর প্রসাদ পাবে আমার কাছে তার আহার নেই, সে গেচে মন্দিরে। জোগাড় করে নিয়ে বসেছি, এমন সময় গোপালদা বললেন, ‘টাকার ভাঙানি পেলুম না, আনা হরেক পয়সা দাও ত দাদা, দোকানের হিসেবটা মিটিয়ে ফেলি। আবার দেবো’খন।’

কাঠের উনুনে ফুঁ দিতে দিতে চোখে জ্বালা ধরেছিল, জল পড়ছিল, বললাম, ‘দিই, একটু দাঁড়ান।’

রুমালে বাঁধা টাকা-পয়সা ট্যাকেই থাকে, দিনরাত সঙ্গে সঙ্গে ফেরে। পয়সা বা’র করতে গিয়ে দেখি ট্যাক খালি, রুমালের চিহ্নও নেই। তার মানে? তার মানে কী? চারিদিকে একবার তাকালাম, মনে হলো নিজেরই মুখের চেহারাটা এক নিমেষের মধ্যে বিকৃত হয়ে এলো। উঠে ঝোলাঝুলি হাঁটুকে দেখলাম, কম্বলখানা ঝাড়লাম, জামার পকেটগুলো তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম। গলার ভিতরে কি যেন ঠেলে উঠে আসতে লাগলো, বুকের মধ্যে ঢেঁকির পাট-পড়ার মতো এক রকম শব্দ শুরু হ’লো। চীৎকার করে ওঠবার চেষ্টা করলাম, আওয়াজ বেরুল না। ছুটে পালাবার ইচ্ছা হ’লো, কিন্তু কোথা যাবে? সর্বনাশ, এ কী হ’লো ভগবান?

কুকুরের মাথায় হঠাৎ লাঠি মারলে সে যেমন ওলট-পালট খেয়ে পাগলের মতো অল্প একটুখানি জায়গার মধ্যে ঘুরতে থাকে, তেমনি কিয়ৎক্ষণ হতচেতন হয়ে ধর্মশালার মধ্যে ঘুরলাম। সবই আছে, কম্বল আছে, ঝোলা আছে, লাঠি- ঘটি আছে, নেই শুধু সেই সব চেয়ে প্রয়োজনীয় বস্তুটি, সর্বশ্রেষ্ঠ ধন। আমার সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, পথশ্রম ও তীর্থযাত্রা, স্বপ্ন ও সৌন্দর্যবোধ, সহানুভূতি ও অনুপ্রেরণা, সকলের মূলে যে রয়েচে সেই ময়লা রুমালে বাঁধা টাকা- পয়সাগুলি, একথা প্রথমেই আমার মনে এলো। আমার প্রাণের রস একটি নিমেষে কে যেন নিংড়ে নিল, দেহে বিন্দুমাত্র রক্ত নেই, সর্বাঙ্গ বরফের মতো শীতল, চেতনাহীন, আমার ঘটেচে অপমৃত্যু। নিজের ভয়াবহ পরিণামের কথা মনে করে নিশ্বাস রুদ্ধ হয়ে এলো। এ-পথে কারো সহানুভূতি নেই, মমত্ববোধ নেই, যেটুকু আছে তা নিতান্ত মৌখিক, স্নেহহীন পুণ্যলোভী যাত্রীর দল উদাসীন হয়ে ফেলে চলে যাবে, আজ থেকে যে চিরদিনের জন্য এই দুর্গমে নির্বাসন! সমস্ত পাহাড়গুলো রাক্ষসের মতো তেড়ে এসে সুমুখে বিকটভাবে নৃত্য করতে লাগলো!

‘কই দাদা, দিন্ ভাই একটু তাড়াতাড়ি।’

বললাম, ‘আমারো ভাঙানো পয়সা নেই গোপালদা, টাকা ভাঙাতে হবে।’

‘তবে বাজারেই যাই, ভাঙিয়ে আনিগে। এদেশে টাকা ভাঙানো পাওয়া দেখচি ভারি কঠিন।’ বলে গোপালদা বেরিয়ে গেলেন।

বুড়ীগুলো ওদিকে খেতে বসেচে। আমার উনুনে আগুন নিবে ধোঁয়া হতে লাগলো, সহস্র সহস্র মাছিতে চারিদিক ছেয়ে গেচে, খাবারের জিনিসগুলো আর হয়ত নেওয়া যাবে না। তাদের দিকে তাকিয়ে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। নদী মরে গেল, স্রোত গেল শুকিয়ে, চারিদিক ধুধু করচে, ছায়া নেই, চোখে আর আলো নেই, আনন্দ নেই, আকাশ হয়েছে বিষাক্ত, সমস্ত প্রকৃতির চেহারা দেখতে দেখতে মলিন হয়ে উঠলো। আমি সন্ন্যাসী নই, পূর্ণ বিশ্বাস ভগবানে আমার হয়নি, বাবা বদরীনাথের দয়ার আশা করে পথে আমি পা বাড়াইনি, দেবতার উপরে ভরসা আমি করিনে; আমার ক্ষুধা আছে, তৃষ্ণা আছে, নিজের জীবন সকলের চেয়ে আমার প্রিয়। দারিদ্র্যে, দুঃখে, হতাশায় আমি বেদনা পাই, সৰ্বস্ব লুণ্ঠিত হলে বিপদগ্রস্ত হই, গৃহবৈগুণ্যে বিধাতার অভিশাপ মাথায় নেমে এলে চোখে এখনো জল আসে! আমার ভিতরে বৈষয়িক মন আছে, স্বার্থ ও সুবিধার জন্য লোলুপতা আছে। আমি দেশে ফিরে যেতে চাই; সমাজের মধ্যে, মানুষের মধ্যে, স্নেহ-মমতা, দয়া-দাক্ষিণ্য, লোভ-মোহ, কলহ-কলঙ্ক, গ্লানি ও মালিন্য- এদের সকলের মধ্যে থেকে গৃহীর মতো জীবন ধারণ করতে যে আমি ভালোবাসি! সর্বশরীর আমার ভয়ে ও হতাশায় ঠক্ ঠক্ করে কাঁপতে লাগলো। সাহায্য প্রার্থনা করতে গেলে সবাই করবে বিদ্রুপ, সকলের মৌখিক প্রীতির মুখোশ খুলে পড়ে সত্যকারের চেহারা প্রকাশ পাবে, সবাই অবজ্ঞা করবে, আমার দুর্ভাগ্যের দিকে ইঙ্গিত করে মুখ ফিরিয়ে চলে যাবে। তাছাড়া যাত্রীরা সঙ্গে আনে জীবনধারণের উপযোগী খরচ, তীর্থপূজার খরচ; দরিদ্র পুণ্যকামীর দল, দুঃস্থকে সাহায্য করবার মতো সম্বল ত তাদের নেই! শহরের যারা মানুষ, পূজারী, পাণ্ডা, দোকানদার,-তারা আসে বছরের এই সময়টায় যাত্রীদের শোষণ করতে, সংগ্রহ ও সঞ্চয়ের অনন্ত ক্ষুধা তাদের, দান করবার মানুষ তাদের মধ্যে বিরল।

হঠাৎ মনে হ’লো, ব্রহ্মচারী আমার টাকা-পয়সা নেয়নি ত? উত্তেজনায় চোখ দুটো আমার দেখতে দেখতে জ্বলে উঠলো। এইবার ঠিক ছুঁয়েচি! গতকাল আমার রুমাল সম্বন্ধে সে কী যেন একটা ইঙ্গিত করে থেমে গিয়েছিল। সে ছাড়া আর কেউ নয়! এই তারকপশা, এই তার রীতি, কাল রাত্রে তার ভিতরের ভয়াবহ রূপ দেখেছি, ভণ্ড সাধুর বেশে মানুষকে চিরদিন সে বঞ্চনা করেছে। সাপের মতে তার চরিত্র, শৃগালের মতো তার চক্ষু, শ্যেনপক্ষীর মতো সে সুবিধাবাদী! যে তাকে আশ্রয় দেয় তার ঘরে লাগায় আগুন; বিশ্বাসঘাতক, কাপুরুষ, তার টুটি টিপে-

‘দাদা, কী ভাবচেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে? বলতে বলতেই ব্রহ্মচারী পাশে এসে দাঁড়ালো, কাঁধে হাত রেখে ঢেকুর তুলে বললে, ‘অনেকদিন পরে একটা পান খেতে পেলাম, রুটি আর আলু চিবিয়ে মুখখানা খারাপ হয়ে গেচে।

তার মুখের দিকে তাকালাম। সে পুনরায় বলতে লাগলো এই যে আপনার জন্যে পান একটা এনেছি-একি, এখনো খাওয়া হয়নি আপনার? চান্ করেননি?

‘চান্? ওঃ-এই যে যাচ্ছি।’

‘হ্যাঁ, বেশ লাগবে অলকানন্দায় চান্ করতে, চকচকে জল…ভারি আরাম।’ ততক্ষণে আমি নদীর দিকে ছুটে চলেচি। পড়ি ত মরি। কিছুদূর এসে বাঁ- হাতি বেঁকতে হয়, তারপর পাথরের খারি-করা সিঁড়ি, নদী অনেক নিচে, – উন্মত্তের মতো সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলাম। সুমুখে দীর্ঘ বালির চড়া, দ্রুত চলা যায় না, চারিদিকে ছোট-বড় অসংখ্য পাথরের খণ্ড ছড়ানো, পায়ে হোঁচট লেগে রক্তারক্তি হ’লো-এমনি করে এলাম জলের ধারে।

বিশেষ একখানা পাথর চিহ্ন করা ছিল, দ্রুত কাছে গিয়ে হেঁট হয়ে তার তলায় বালির মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দিলাম। আহ, এই যে আমার সোনামণি, আমার সাত রাজার ধন মানিক, আমার স্বর্গ, আমার বদরীনাথ! আঃ বাঁচলাম, বাঁচলাম! স্নান করবার সময় রুমালসুদ্ধ এর তলায় যে লুকিয়ে রেখেছিলাম, তাই কি ছাই মনে ছিল? ধন্যবাদ তোমায় ব্রহ্মচারী, হে খরস্রোতা অলকানন্দা, তোমাকে ধন্যবাদ! আনন্দে আর জ্ঞান রইলো না, আহ্লাদে আর সংযম রইলো না, স্নেহে ভালোবাসায় আবেগে উত্তেজনায় সাশ্রুনেত্রে রুমালখানি মুখে চেপে আদরে- আদরে ভরিয়ে দিলাম।

বদরীবিশালা কী জয়! জয় বাবা কেদারনাথ! পায়ে রেখো বাবারা!

যাকে ছিল আমাদের পরম প্রয়োজন, ঠিক সময়টিতে নিতান্ত অবহেলায় তাকে ত্যাগ করে যেতে হলো। সেদিন অপরাহ্ণ বেলায় দেবপ্রয়াগের দেনা- পাওনা চুকিয়ে মুসাফিরের দল আবার নেমে এলো সেই পরিচিত বন্ধুর পথে। এ-পথের দিকে তাকালে ভয় করে, এ যেন সবাইকে দূরান্তের দুর্গমের দিকে টেনে নিয়ে যাবার জন্য হানা দিয়ে পড়ে রয়েচে। সাপের মতো শীর্ণকঠিন তার দেহ, সম্মুখ ও পিছনের দুরারোহ পর্বতমালাকে বেষ্টন করে অজগরের মতো সে চিরনিদ্রায় নিদ্রিত; গ্রীষ্ম, বর্ষা ও বরফে তার চাঞ্চল্য নেই। পথে নেমে ধর্মশালার দিকে একবার ফিরে দেখলাম, সে যেন দেউলে হয়ে গেল। যে দিল আশ্রয়, স্নেহক্রোড়ে যে আমার দু’দিন লালন করলো, দৌরাত্ম্য সইলো, কিন্তু আপত্তি জানালো না, আজ তার দিকে মুখ ফিরেও চাইবার প্রয়োজন নেই, সে ফুরিয়ে গেচে। এমনিই হয়। আবার হয়ত কতদিন ওখানে আলো জ্বলবে না, ভয়ের বাসা হয়ে থাকবে; হয়ত কোনো বন্যজন্তু এসে ওখানে আশ্রয় নেবে; রাত্রির অন্ধকারে এক রকম এলোমেলো বাতাস এসে ওর কোণে কোণে বিচ্ছেদের নিশ্বাস ফেলে যাবে অথচ তখন আমাদের এই প্রিয় ধর্মশালাটি থাকবে এমনিই নির্বিকার, নির্লিপ্ত, অকৃপণ, দাক্ষিণ্যময়, স্থাণু সন্ন্যাসীর মতো।

সমস্ত অগ্রগতির পিছনে থাকে একটি উৎসাহ, প্রাণের বেগ, একটি অনির্বাণ নেশা; কিন্তু এ যাদের নেই তাদের অপেক্ষা করা চলবে না, টেনে টেনে এসেচে, ঠেলে ঠেলে যেতে হবেই, যাহা বাহান্ন তাহা তিপ্পান্ন। ভিতর থেকে প্রতি মুহূর্তেই একটা প্রতিজ্ঞা ঠেলে উঠচে-কেনই বা যাবে? চল, চল,-থাক্ পিছনে জীবন, থাক মৃত্যু, থাক্ আমার সকল চাওয়া-পাওয়া,—চল! গৌরীশঙ্কর সীতারাম! জয় বদরী- বিশাল-লাল কী জয়!

‘মহারাজ জি?’

মুখ ফিরিয়ে তাকালাম। কৌপীনধারী চি-েহাতে এক সাধু হেসে বললে, ‘সীতারাম মৎ বলল, রাধেশ্যেয়ামকে। নাম লেও। সীতারাম কহোগে, চিটি বাজায়কে চলোগে; আওর রাধেশ্যেয়াম কহোগে, ঘমে বৈঠকে রহোগে-হাঃ হাঃ হাঃ, চলো ভাই চকাচক্।’

রিক্ত ও নিঃস্ব সাধুজি পরম স্ফূর্তি এবং আনন্দে গদগদ হেসে ওলোট-পালট খেয়ে আগে আগে চলতে লাগলো। নিজেকে সে জয় করেচে।

তপোলোকে এ-ক’দিন ভ্রমণ করেচি, এবার পদার্পণ করলাম দেবলোকে। বাঁ-দিকে নিচে এবার নতুন নদী, দক্ষিণবাহিনী অলকানন্দা, গঙ্গার মতোই তার স্রোতের শব্দ, নীল নির্মল প্রবাহ; জলের অবিশ্রান্ত আওয়াজে নীরবতা আরো গভীর হয়ে উঠেচে,-চড়াই- পথে আমরা চলেচি উত্তরদিকে। ক্রমাগত উত্তরদিকেই আমাদের গতি, মহাযোগীর জটাকে স্পর্শ করবার জন্য নিরন্তর তার দেহ বেয়ে উঠচি যত পিপীলিকার দল। তীর্থের এই দীর্ঘ পথটিই আমাদের তপস্যা, পথ শেষ হলেই সকলের ছুটি। জীবনেও এমনি, অবিচ্ছিন্ন অগ্রগতিই আমাদের বাঁচা, আমাদের সাধনা; চরম পরিণামকে স্পর্শ করতে আমরা এগিয়ে চলেচি, কোথায় গিয়ে পৌঁছবো জানিনে। শীতের শেষে প্রথম বসন্তকালের মতো আবহাওয়া; বন্য ওষধিলতা ও অরণ্যপুষ্পের একরূপ বিচিত্র মিশ্র গন্ধে কোথাও কোথাও পথ আচ্ছন্ন, বাতাস মাঝে মাঝে সে-গন্ধকে দূরে প্রসারিত করে যাত্রীদের অভিবাদন জানাচ্চে; পর্বতচূড়ার শ্যামশ্রীর উপরে ক্রমবিলীয়মান রক্তিম সূর্যলেখা, নিচে নদীর নির্জনে সন্ধ্যার ছায়া চুপি চুপি নাচে। এ-বেলায় আমরা সামান্য পথই হাঁটবো; একটি দিন বিশ্রাম নিয়ে আরামের লোভ আমাদের জেগে উঠেচে, প্রথম সুবিধা পেলেই আমরা আশ্রয় নেবো। সামান্য মাইল তিনেক পথ, বেশ ধীরে-সুস্থে হাঁটচি, তাড়াতাড়ি নেই, সময়ের আন্দাজ আছে, বিদ্যাকুটি চটিতে পৌঁছতে দেরি লাগবে না।

কিন্তু গৃহবৈগুণ্য। আজ সকাল থেকে হাঁটুর মধ্যে কেমন একটা ব্যথা খচ্ খচ্ করছিল, এ-বেলা সেটা বেড়ে উঠলো। উঁচু নীচুতে যাদের হাঁটা অভ্যাস নেই, শুনলাম, এ-ব্যথাটা তাদের সহজে আশ্রয় করে। পায়ে হেঁটে বদরীনাথ যাবার পক্ষে ব্যথাটাই এই সকলের চেয়ে বড় বাধা, এর কথা অনেকেই জানে। চড়াই পথে ওঠবার সময় এ ব্যথাটা জন্মায়, উত্রাই পথে নামবার সময় হয় এর প্রতিক্রিয়া। ভয় পেয়ে গেলাম, এবং সে যে কী ভয় তা আজ আর লিখতে বসে বোঝাতে পারবো না। আস্তে আস্তে সন্তর্পণে পা মচকে চলেচি, আর সবাই গেল এগিয়ে, গোপালদা ও ব্রহ্মচারী চোখের আড়াল হয়ে গেচে। কেনই বা যাবে না? যে রুগ্ন ও অশক্ত, সুস্থ মানুষ তার সঙ্গে সহযোগিতা করে আপনাকে পঙ্গু করবে কোন্ যুক্তিতে? আমার সঙ্গে কীসের বন্ধন তাদের? কীসেরই বা ঋণ? খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলেচি, শুনেচি আত্মবিস্মৃতিতে ব্যাধির খানিকটা উপশম হয়। নানা অবস্থায় আত্মহারা হওয়া অভ্যাস আছে, কিন্তু আত্মবিস্মৃত হবো কেমন করে? যাকে ভুলে যাওয়ার দরকার তাকেই যে মনে পড়ে সকলের আগে! অথচ আয়না থাকলে দেখতাম কী দুরবস্থাই শরীরের হয়েছে! ধুলোয় ও রোদে মাথার চুলগুলো খড়ের মতো রংচটা, চামড়া বিবর্ণ ও রক্তহীন, কোটরগত ক্ষীণ দৃষ্টি, হাতপা’গুলো কুৎসিত ও কাঙাল, কাঠের আগুনের আঁচ লেগে দুই হাতের লোমগুলো পরিষ্কার হয়ে গেচে, জামা-কাপড়ে ও মাথার চুলের মধ্যে উইপোকার মতো একরকম যন্ত্রণাদায়ক পোকা ভিড় করেছে। তাদের অশ্রান্ত উৎপীড়নে রাতে ও দুপুরে নিদ্রা নেই, একবার তাড়ালে আবার কেমন করে এসে দেহকে আশ্রয় করে। এদের সঙ্গে রয়েচে মাছির প্রচণ্ড উপদ্রব, লক্ষ লক্ষ মাছি, কোটি কোটি মাছি, সব মাছিময়, মাছির সমুদ্র। মাছির কামড়ে হাতে পায়ে ঘা ফোটেনি, এমন যাত্রীই ছিল না। জলের উপরেও যে মাছি পড়তে পারে, এ দৃশ্য এই প্রথম দেখলাম।

লাঠির উপরে ভর দিয়ে ধীরে ধীরে বিদ্যাকুঠিতে এসে পৌঁছলাম। তখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়েছে। পাশেই একটা কদলীবন, শুক্লা পঞ্চমীর জ্যোৎস্না কলাগাছের চওড়া পাতাগুলির উপরে নেমে এসেছে, রূপোর পাতের মতো ঝলমল করচে, অন্ধকারে অলক্ষ্য অলকানন্দার ঝর ঝর শব্দ কানে আসছে, – চারিদিকে প্রকৃতির একটি রোমাঞ্চকর বসন্ত-শোভা। কিয়ৎক্ষণ বিশ্রামের পর ব্রহ্মচারী রুটি সেকার আয়োজন করতে লাগলো। আগে কোনোক্রমে জল গরম হলো, তাতে নুন মিশিয়ে পায়ে মালিশ করতে বসে গেলাম। যে-দেশে যে- আচার, নুন আর গরম জলের মতো পায়ের ব্যথার ওষুধ নাকি আর ভূ-ভারতে নেই! ব্রহ্মচারী বললে, ‘আপনার ব্যথা আমি ভাল করে দেবোই, এ ওষুধে যদি না পারে ত আর একটা আমার জানা আছে!’

রন্ধন, ভোজন ও শয়নে সে-রাত কাটলো। ভোর রাত্রেই আবার যাত্রা! বুড়ীরা নাস্তিক ও ধর্মত্যাগী বলে সম্পর্ক ছিন্ন করেচে, আমার প্রতি আর তাদের সহানুভূতি নেই। কোমর-ভাঙা চারুর-মা শুধু সবাইকে লুকিয়ে চুপি চুপি বলে গেচে, তা বলে আমি তোমাকে ছাড়চিনে বা ঠাউর, আমি আছি তোমার পাছে পাছে। কালীঘাটের চকোত্তির ঘরে আমি তিন পো করে দুধ দিই, টাকাকড়ি অবিশ্যি চারুই রাখেঢাকে, তাদের ঘরে তোমার মতন একটি ছেলে আছে’… আহা, যেদিন আমার নিবারণ সরে গেল, ওই একটি ভাইপোই ছিল-সেই বছরই দুধ দুইতে বসে হালির পা ছুড়ে আমার হাঁটু ভেঙে দ্যায়, হাবলির পায়ে দড়ি বাঁধা ছিল না। ওমা, যাই, আবার ওরা ধমক দেবে পায়ে ব্যথাটা কমেনি একটু বা’ ঠাউর?’—এই বলেই চারুর-মা লাঠি ধরে কুঁজো হয়ে লম্বা লম্বা পায়ে এগিয়ে গিয়েছিল। বুড়ির বয়স সত্তর পার হয়ে গেচে।

আস্তে আস্তে চলেচি, আজ অনেকদূর পথ যেতে হবে, আজ আর ক্ষমা নেই। আমিই সাধারণত যেতাম সকলের আগে এগিয়ে, এবার থেকে আর তা হবে না, এবারে থাকতে হবে পিছিয়ে। গোপালদা গেচেন বুড়ীদের নিয়ে, ব্রহ্মচারীও কিছুদুর সঙ্গে সঙ্গে এসে তারপর এগিয়ে গেচে, পিছনে যে পাঞ্জাবী ও বিহারী হিন্দুস্থানীর দলটা আসচিলো, তারাও সস্নেহে আমার পায়ের দিকে একবার তাকিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেল, পিছনে আর কেউ যে আছে তা মনে হচ্ছে না। সকলেরই মনের কথা, আগে চল আগে চল ভাই! আজকে পথ বড় দুস্তর ও দুর্গম, কোথাও কোথাও নদীর কিনারায় পথ ধসে গেচে, কোথাও কোথাও পাথরের চাঁই বিপজ্জনক অবস্থায় পাহাড়ের গায়ে সামান্য ভিত্তির উপরে আটকে রয়েচে, একবার পিছলে পড়লে অসাবধানে অন্তত জন দশেক যাত্রীর মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। ঝোলাঝুলি আর এই কম্বলের বোঝা বইতে পারচিনে, কাঁধ কনকন করচে। নিজেকে টেনে নিয়ে চলতেই কষ্ট হচ্ছে, বোঝা বইব কেমন করে? সামান্য এক সের ওজনের জিনিস এই দুর্গম পথে বহন করা কঠিন, বিরক্তিকর ও শ্রমসাধ্য, আমার কাছে অন্তত সাত সের ওজনের ঝুলি ও কম্বল। যাত্রার আনন্দ নেই, শরীর অচল, পা পঙ্গু, আহারের কৃচ্ছ্রসাধন, জুতোর কামড়ে পায়ে বড় বড় ফোস্কা, সর্বাঙ্গে অহরহ পোকা কামড়াচ্ছে, নিরুৎসাহ মন, পুণ্যসঞ্চয়ের স্পৃহা নেই-এদের ভিতর দিয়ে কেনই বা যাওয়া? অথচ প্রায় আশী মাইল পাহাড় এমনি করেই ত পার হয়ে এলাম!

অস্ফুট একটা আর্তনাদে ফিরে চাইলাম। পথের প্রান্তে একখানা পাথরে হেলান দিয়ে দুইজন পুরুষ-যাত্রী বসে বসে হাঁপাচ্চে। বুঝলাম পীড়িত, চলতে পারচে না। ব্যস ওই পর্যন্তই। লাঠি ঠুক্ ঠুক্ করে এগিয়েই যাচ্ছিলাম, একজন হাত নেড়ে ডাকলো। ডাকলেই কিছু আর কাছে যাওয়া যায় না, বিরক্ত হয়ে বললাম, কহে, কেয়া বোতা? কী যেন সে বিড় বিড় করে বলে, ঠিক বোঝা গেল না কোন জাতি। অবশেষে একজন উঠে এসে আমার লোলাটা ছুঁয়ে, ইঙ্গিতে জিজ্ঞাসা করলে, জল আছে কিনা। জল অল্পই ছিল, রোগীর মুখে একটু ঢেলে দিয়ে আবার চললাম। বোধহয় পিছন থেকে একটু আশীর্বাদ করলে কিন্তু ভাষাটা বোধগম্য হলো না! তার আশীর্বাদের মূল্য আমার কাছে এক কানাকড়িও নয়, পায়ের ব্যথা না সারলে বিশ্বসংসারকে আর আমি সুদৃষ্টিতে দেখতে পারব না।

হাঁ, সংসারের নিয়মই এই। নিজের মনের রঙ দিয়েই আমরা সবকিছুকে বিচার করে যাই। সৃষ্টিকে কেউ দেখে সুন্দর, কেউবা দেখে কুৎসিত! পায়ে ব্যথা ছিল বলেই সেদিনের তীর্থপথ, পথের প্রকৃতির সৌন্দর্য, হিমালয়ের বিপুল ঐশ্বর্য- সম্ভার আমার চোখে বিষাক্ত হয়ে গেল, আমি হারালাম সুস্থ মন, সহজ উপলব্ধি, সরল দৃষ্টি। অবজ্ঞা ও বিরক্তিতে আকাশ আর পৃথিবী ছেয়ে গেল। হয়ত এমনিই হয়। আর্ট ও সাহিত্যের সমালোচনায় দেখি একই বস্তুর সম্বন্ধে সমালোচকগণের বিভিন্ন মত। বিভিন্ন মতের মূল্য আছে জানি, কিন্তু সাহিত্য যেখানে আর্টের পর্যায়ে উঠেচে, যেখানে প্রকাশ পেয়েছে গভীর অনুভূতির নির্মল আনন্দ, সেখানে মতের বিভিন্নতা মন মেনে নেয় না। বিচারের অন্যায়ে সুসাহিত্যকে মলিন করবার চেষ্টায় যারা ব্যর্থ, বুঝতে হবে সেই সমালোচকরা আজ আমারই মতো খুঁড়িয়ে হাঁটে। খোঁড়া পায়ের গ্লানি তারা ছড়ায় আর্ট ও সাহিত্যের তথাকথিত সমালোচনায়।

‘কি দাদা, বড় কষ্ট হচ্ছে? অনেক পিছিয়ে পড়েছিলেন, এখানে একটু বসেছিলাম আপনার অপেক্ষায়। এই-আর একজন সঙ্গী পাওয়া গেচে।’

মুখ তুললাম। দেখি, একটি লম্বা-চওড়া কৃষ্ণকায় বাঙালী ভদ্রলোক একখানা পাথরের উপরে বসে বিড়ি ফুঁক্‌চেন। নমস্কার বিনিময় করে’ তখনই সামান্য আলাপ হলো। কথায় কথায় জানা গেল তিনি একা নন, স্ত্রী এবং শাশুড়ী আছেন সঙ্গে, তারা কয়েক পা এগিয়ে গেচেন, দশ মাইলের বেশি রোজ তাদের পক্ষে হাঁটা কঠিন। লোকটির নাম অঘোরবাবু। তিনি বললেন, ‘এত করে’ মশাই বললুম কাণ্ডি কিংবা ডাণ্ডিতে ওঠো, কতই আর খরচ, কিন্তু কিছুতেই না, মেয়েমানুষের গোঁ বড় ভয়ানক, রাস্তার মাঝখানে অবাধ্য হওয়া আমি ভালোবাসিনে। হবেই ত, পায়ে ব্যথা ত ধরবেই।’

বললাম, ‘ডাণ্ডিতে উঠবেন না কেন?’

‘পুণ্যি হবে না, তাই জন্যে! হেঁটে গেলে বাবার দয়া বেশি করে পাওয়া যায়!’

ব্রহ্মচারী বললে, ‘আহা তা সত্যি, ওঁ নমো নারায়ণায়! ভগবানে পূৰ্ণ বিশ্বাস না নিয়ে চলে, আসুন আপনারা, আমি ততক্ষণ এগোই।’-বলে, সে ঝোলাঝুলি নিয়ে লাঠি ঠুকে চলতে লাগলো।

অঘোরবাবুর বাড়ি কলকাতায়। কাজ-কারবার আছে, এখন ব্যবসার বাজার মন্দা। স্ত্রীকে নিয়ে প্রায়ই তিনি তীর্থভ্রমণে বেরোন্। কি ভাগ্যি ছেলেপুলে নেই। বলেন, ‘আপনারা ত সন্ন্যাসী মানুষ, সংসারের জ্বালা নেই! আচ্ছা, বলতে পারেন, ব্রহ্মচারীটি কেমন লোক? শুনলুম আপনি ত ওকে খাওয়াতে খাওয়াতে আচেন। ও লোকটা কী? ভণ্ড-টণ্ড নয় ত?’

বললাম, ‘ভণ্ড হলেই বা ক্ষতি কি আমাদের বলুন সবাই সাধু হলে বিপদও আছে!’

‘তাই বলচি, তাই আপনাকে জিজ্ঞেস করছি। আমার কাছে অনেক দুঃখ জানাচ্ছিল, কিছু সাহায্যও চাইলো পয়সা কড়ি ত আর দিতে পারবো না, না-হয় এ-ক’টা দিন খেতে দিতে পারি।’

‘ও, বেশ ত!’ বললাম, ‘পথে খেতে দেওয়াটাও ত কম নয়!’

‘হ্যাঁ, তাই বল্‌চি, মানুষকে চেনা দুষ্কর কিনা! একবার একটা খোট্টা চাকর রেখেছিলুম। ব্যাটা বিনা-মাইনেয় চাকরি করতে এল,-বেশ থাকে মশাই, হঠাৎ একদিন পালালো, বাক্স খুলে দেখি গয়নাপত্রগুলোও তার সঙ্গে পালিয়েচে | পরের গয়না বন্ধক রেখে টাকা ধার দিতুম, কী ভয়ানক বিপদ বলুন ত?’

হেসে বললাম, ‘মাইনে না দেওয়ার বিপদ!’

কথাটা শুনে ভদ্রলোক বোধহয় খুশি হলেন না, কিন্তু আত্মসংবরণ করে বললেন, ‘তাই বটে, লাভের গুড় পিঁপড়েয় খেয়ে গেল!”

আলাপ করতে করতে রামপুর চটিতে এসে পৌঁছলাম, এর আগে ছেড়ে এসেচি রাণীবাগ। সুমুখে একটা বড় ঝরনা নেমে এসেছে, আশপাশে খানকয়েক চটি। পথের ধারে বড় চটির কাছাকাছি অঘোরবাবুর স্ত্রী ও শাশুড়ীকে দেখা গেল। পথশ্রমে দুজনেই ক্লান্ত ও মলিন কিন্তু ভস্মাচ্ছাদিত বহ্নির মতো মেয়েটির দেহলাবণ্য সকলেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মুখে কেমন যেন কমনীয় শান্ত-শ্ৰী। ব্রহ্মচারী পাশেই ছিল দাঁড়িয়ে, সোৎসাহে বলে উঠলো, ‘দাদা, এই দেখুন, এই আমার মা, অন্নপূর্ণা মা, আর ইনি আমার দিদিমা।’ বলে, সে পাশের বৃদ্ধাটিকে দেখিয়ে দিল!

স্মিতমুখে তাঁদের দিকে তাকালাম বটে কিন্তু আলাপ করার বিশেষ প্রয়োজন ছিল না। পথে যত নারী-যাত্রী দেখা গেচে এ পর্যন্ত, এই বউটি তাদের মধ্যে একমাত্র অল্পবয়স্কা ও রূপবতী। বললাম, আমাদের জন্যে কোন্ চটি ব্যবস্থা হয়েছে ব্রহ্মচারী?’

‘এই চটি এইটেই ভাল দাদা,—ওই যে গোপালদাও এসে উঠেছেন।’

‘বেশ বেশ, আগে একটু বসে পড়ি, পায়ে বড় লাগচে।’-সমস্ত শরীরে তখন যন্ত্রণা হচ্চে।

আমার ঔদাসীন্য দেখে অঘোরবাবু বোধ করি একটু ক্ষুণ্ণ হলেন, অথচ বলবারই বা কী ছিল? হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে বললেন, ‘এখানে দুধ পাওয়া যায় না? আমার কাছে চা-চিনি আছে, একটু চা খেতুম।’

চায়ের সন্ধানে তিনি চলে গেলে বউটি স্নিগ্ধ হেসে সবিনয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনারো কি পায়ে ব্যথা ধরেচে?’

বললাম, ‘হ্যাঁ, ভারি জব্দ হয়েচি।’

বৃদ্ধা বললেন, ‘যাক্, রাধারাণীর ব্যথার সঙ্গী জুটলো। আমার মেয়েরো ডান পা-টা খারাপ হয়েচে বাবা।’

শ্রান্ত হাস্যে চুপ করে গেলাম। পরে বললাম, ‘ব্রহ্মচারী, তুমি আমার দিকে এবেলা খাবে না ত?’

ব্রহ্মচারী সরে এসে মাথা চুলকে বললে, ‘এই কথাই বলছিলাম আপনাকে, মা অন্নপূর্ণার প্রসাদ পেলেই আমার চলবে দাদা, আপনি ত যথেষ্টই খরচপত্র করেছেন আমার জন্যে। এবার থেকে এঁরাই—’

‘বেশ বেশ—’

‘আমি আপনার রেঁধে দিই দাদা!”

‘না, রাঁধতে আমার কষ্ট নেই।

এতক্ষণে গোপালদার দেখা পেলাম। তিনি একপাশে বসে অতি আনন্দে তামাক সাজছিলেন। চুপি চুপি বললেন, ‘বড় ঘরের মেয়ে, কি বলেন? আহা, কেনই যে কষ্ট করে এলেন! সুখ বুঝি সইলো না। নিন্ ধরুন কলকেটা, দেশালাইটে জ্বালি।’

পাশাপাশি সবাই রান্না করতে বসলাম। অঘোরবাবু ছুরি দিয়ে আলু কুট্‌চেন, ব্রহ্মচারী কোথা থেকে মসলা সংগ্রহ করে’ পাথরে পিষতে বসেচে। তবু, উৎসাহ যে আর কিছুতেই নেই তা বেশ বোঝা গেল। শাশুড়ী-বৌ আধমরা হয়ে বসে পড়েচেন, মনে হচ্ছে আর তাদের উত্থানশক্তি নেই, সর্বাঙ্গ তাদের ধূলা-ধূসর, লজ্জাকর মলিন বসন, মাথার চুলে এরই মধ্যে প্রায় জটা ধরেছে, যেন মৃতের সৎকার করে শ্মশান থেকে ফিরলেন। অথচ কেই বা কা’র দিকে তাকায়? যে দিকেই চোখ ফেরানো যায়, কেবল ক্লান্তি, পথের পীড়ন, অপারগ দেহ, অবসন্ন মন। এরই মধ্যে জনকয়েক স্ত্রী-পুরুষ হাঁটতে না পেরে চড়া দাম আর নাকে-খৎ দিয়ে কুলির পিঠে কাণ্ডিতে উঠেচে! খিদিরপুরের মাসির পা উঠেচে পেকে, কাণ্ডিতে উঠতে-নামতে তার কাতরোক্তি শুনলে ভয় করে। মনসাতলার নির্মলা ত অনাহারে প্রায় মরতে বসেচে। পথ হেঁটে রান্নার উৎসাহ তার আর থাকে না, জল আর চিনি দিয়ে আটা গুলে খায়, কিন্তু পেটে তা সইবে কেন, অতএব ফল ফতে শুরু করেচে। এছাড়া মাছির কামড়ের চুলকানি, চুলকে চুলকে কেউ-কেউ পাগল হয়ে ছুটোছুটি করচে। মনে হয় ঝরনার জলেও দোষ আছে। পাহাড়ের নানাজাতীয় লতাপাতা ধুয়ে যে-ঝরনা নেমে আসে, তার জল ব্যবহার করাও নিরাপদ নয়।

কিন্তু আশ্চর্য জল-বাতাসের গুণ। অর্ধ ঘণ্টা বিশ্রামের পর মৃতদেহগুলি আবার গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে বসে রান্না-বান্না, জটলা, গালগল্প, পরচর্চা, আবার আসে উৎসাহের জোয়ার। আহারাদির পর সবাই বাসন ধুয়ে চটিওয়ালার সঙ্গে হিসাব করতে বসে যায়। এক বেলায় মোটামুটি একজনের আনা চারেক খাই- খরচ পড়ে। কিন্তু যেখানে জিনিসপত্র মূল্য সেখানে ছ’ আনার কম উদরপূর্তি হয় না। ঘৃত ও দুগ্ধ সম্বন্ধে যারা ব্যয়সঙ্কোচ করে, তাদের শেষ পর্যন্ত শয্যাগত হবার সম্ভাবনা। স্বহস্তে প্রস্তুত ছাড়া আর কিছু আহার করা এ পথে নিতান্তই বিপজ্জনক। প্রতি বৎসর আহারাদির অত্যাচারে কত যাত্রী যে অকর্মণ্য ও অচল হয়ে মৃত্যু-কবলিত হয় তার আর ইয়ত্তা নেই।

‘কী যে কষ্ট এদের, দেখলে আমার কান্না পায়। বেঘোরে জীবন দিতে এরা কেন যে আসে!’

বউটির গলার আওয়াজ শুনে মুখ ফিরিয়ে তাকালাম। কণ্ঠের কারুণ্য ও আন্তরিকতায় প্রথমে কেউ উত্তর দিল না, কিন্তু তারপরেই অঘোরবাবু উত্ত্যক্ত হয়ে বললেন, ‘তুমিই বা এলে কেন? ঘরে বসে পুজো করলে পুণ্যি হতো না?’

হাসিমুখে রাধারাণী বললেন, ‘মরবার একটা জায়গা চাই ত।’

‘তবে চুপ করে’ থাকো, বাজে বক্ বক্ করো না।’

শাশুড়ী বললেন, ‘বদ্যিনারাণ আমাদের পথ ভুলিয়ে আলো বাবা, ব্যাটা শঠ, আমাদের দোষ নেই। ‘

অত ক্লান্তিতেও বউটির মুখে হাসি এল। কিয়ৎক্ষণ পরে বললেন, “আচ্ছা, পায়ের ওষুধের কোনো খোঁজ পেয়েছেন ভারি যে বিপদ হ’লো!’

বললাম, ‘শ্রীনগরে শুনলাম হাসপাতাল আছে, দেখা যাক্।’

‘আপনার ত দেখচি ডান পা-টা খারাপ হয়েচে, আমার কিন্তু বাঁ-পা। ওঠবার সময় তবু সহ্য হয়, কিন্তু উৎরাইয়ে…ওরে বাবা, হাঁটু ভেঙে পড়ে, চোখে জল আসে! লাঠির ওপর জোর দিয়ে ডান হাতটা আজ আর নাড়তে পারচিনে,-আচ্ছা, একটা কথা বলবেন?’

মুখ তুললাম। তিনি অনেক দ্বিধা ও সংকোচ কাটিয়ে হঠাৎ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তখন থেকেই ভাবচি, আপনি কি স্বামী বিবেকানন্দের কোনো আত্মীয়?’

‘আজ্ঞে না।’

আবার কিছুক্ষণ নানা গোলমালে কালো। আহারের উদ্যোগ করচি, এমন সময় বউটি চুপি চুপি কী যেন অঘোরবাবুকে অনুরোধ করলেন। স্বামী বললেন, ‘কি আশ্চর্য, তুমি বলতে পারো না, এ ত তোমারই বলবার কথা!

তিনি পুনরায় সরে এসে দাঁড়ালেন।

মুখ তোলবার আগেই এই স্নিগ্ধ, দীপ্ত ও সম্ভ্রান্ত মহিলাটি তার স্বাভাবিক কোমল লজ্জাজড়িত কণ্ঠে সবিনয়ে বললেন, ‘পথে আমগাছ দেখে কাঁচা আম পেড়ে এনেছিলুম, চাটনি তৈরি করেচি, একটু খাবেন?’

ভুলেই গেচি পৃথিবীতে কোথাও আছে স্নেহের বন্ধন, কোথাও আছে অযাচিত আত্মীয়তা, ভুলেই গেচি কোথাও আছে মানুষের জন্য মানুষের উদ্বেগ ও হিতকামনা। মনে হলো ইনি এসেছেন দূর বাংলার শ্যামশ্রীর কমনীয়তা নিয়ে, মৃত্তিকার মমতা নিয়ে। তবু বিনীত কণ্ঠে বললাম, ‘শাস্ত্রে বলে, তীর্থের পথে প্রতিগ্রহ করা উচিত নয়।’

‘ও, তবে থাক, সে কথা আমার মনে ছিল না!’ বলতে বলতে তিনি নতমস্তকে চলে গেলেন।

আজ শ্রীনগরে পৌঁছানো চাই। তাড়াতাড়ি বেলা আড়াইটে আন্দাজ সবাই পথে নেমে এলাম। পায়ের জন্য সোজা হয়ে চলতে পারচিনে, বউটিও নিতান্তই লাঠি ধরে ধরে খুঁড়িয়ে হাঁটচেন, ভালো মালিশের ব্যবস্থা করলেই আর চলচে না। মাত্র দিন ছয়েক আমরা হাঁটচি, এখনো অন্তত একমাস পথ হাঁটতে হবে, পাগুলিকে সুস্থ রাখা চাই-ই চাই। এক জায়গায় দু’ চারদিন বিশ্রাম নিয়ে আমরা পায়ের ব্যথা সারিয়ে নিতে পারতাম, কিন্তু তাতে আমাদের চলার ছন্দ ভেঙে যায়, পিছিয়ে পড়তে হয়, সময়ের সঙ্গে তাল রাখা যায় না; পথের যারা সুখ- দুঃখের অস্থায়ী সঙ্গী-সকালে বিকালে দুঃখে-দুর্গমে যাদের ব্যথিত ও করুণ মুখগুলি আমরা নিয়মিত দেখে-দেখে যাই, তাদের একেবারে হারাতে হবে। আমরা সবাই সবাইয়ের পরমাত্মীয় হয়ে উঠেচি-পণ্ডিতজী, পাগড়ীপরা রামায়ার, একটি পুণা-আগতা মারহাট্টী বৃদ্ধা, গোপালদা, অম্রা সিং, কুলী কালীচরণ ও তুলসীরাম, ব্রহ্মচারী, রুইদাস সুক্কুল-এদের কাউকে ছাড়তে গেলে বুকে বড় বাজবে। জাতিবিচার নেই, স্পৃশ্যতা ও অস্পৃশ্যতার প্রশ্ন নেই, সকলে একত্রে বৈঠকে বসে তামাক খাওয়া চলে। হোক কালীচরণ কুলী, সে কলকে টেনে গোপালদার হাতে দেয়, গোপালদা দেন অম্ররা সিংকে, অম্রা সিং দেয় ব্রহ্মচারীর হাতে, ব্রহ্মচারীর প্রসাদ পায় রুইদাস সুক্কুল। সন্ধ্যাবেলা মৌজে না থাকলে কারো চলে না, সর্বত্যাগী পরিব্রাজকের দল ভুরা ও সুপার নেশায় অর্ধচেতন হয়ে চটির ধারে গা এলিয়ে দেয়। বাইরের পৃথিবীর কোনো সংবাদ নেই তাদের কাছে মানুষের কল্পকামনায় ঘেরা এ যেন কোন্ এক অলোকসামান্য রূপকথার স্বপ্নরাজ্য, তাদের মাথার উপরে আসে প্রথম সূর্যরশ্মিলেখা, তারা জানে উদাসিনী সন্ধ্যার রহস্যময় পথ। তারা সবাই গৃহত্যাগী সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনী, তাদের মুখে শুধু তীর্থ ও দেবমন্দিরের গল্প; নদী, সাগর ও তুষার-দেশের গল্প, বন্যজন্তুর গল্প; বিপদের কাহিনী।

এবেলা প্রায় আট মাইল পথ। ভারি পায়ে লাগচে হাঁটুতে। ভীলকেদার পর্যন্ত চার মাইল পথটা অতিরিক্ত কষ্টদায়ক। এখানকার আর-এক নাম ঢুণ্ডপ্রয়াগ ভীলগঙ্গা ও অলকানন্দা এখানে পরস্পর আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়েচেন। খান পাঁচ ছয় পাশাপাশি জীর্ণ চটি রয়েচে। প্রথমে প্রস্তাব হলো, আজকের মতো ভীলকেদারেই আস্তানা নেওয়া যাক, কিন্তু কারো মনঃপূত হলো না। বেলাও অনেকটা এখনো বাকি, অনায়াসেই এখনো তিন চার মাইল হাঁটা চলে। পায়ের ব্যথার নাম করে আমরা দু’একজন আপত্তি তুললাম কিন্তু জনমতেরই জয় হ’লো। শোনা গেল, পথে চড়াই আর উৎরাই তেমন কিছু নেই, বেশ পা ছড়িয়ে হাঁটা চলবে, শ্রীনগরে আজ পৌঁছানো উচিত।

মল্লিকা আর মালতীলতায় এবেলার পথ ছাওয়া। বুনো গোলাপের জঙ্গল থেকে মুখচোরা গন্ধ ভেসে আসচে। এতদিন পরে আজ একটু সমতল পথ পেলাম। অলকানন্দার তীর থেকে ঢালু পাহাড়ের গা পর্যন্ত চাষ-আবাদ চলছে। নদীর কোলে কোলে ক্ষুদ্র এক একখানি গ্রাম চিত্রপটের মতো আঁকা। পথে কাঁচা সিদ্ধি ও ফণীমনসার গভীর জঙ্গল, তার ভিতর দিয়ে যাত্রীরা চলেচে। এদের মধ্যে মূলের চেয়ে বিস্ময়কর হচ্ছে আম ও সজিনা গাছ। আশপাশে কোথাও কোথাও চুন ও বালির পাহাড়, শুকনো ঝরনার গভীর দাগ। নদীর ওপারে মনোরম প্রাকৃতিক শোভা, পর্বত-চীরে আমাদের ক্লান্ত দৃষ্টি আর প্রতিহত হচ্ছে না, চোখগুলি প্রকৃতির অখণ্ড অবকাশের মধ্যে ছাড়া পেয়েচে। স্নায়ুর গ্রন্থিগুলি আলগা হয়ে এই কমনীয়তার মধ্যে এলিয়ে পড়তে চাইচে। প্রায় আমরা নদীর সমতলে এসেচি।

পিছনেই পড়েছিলাম। চলতে চলতে দেখি মা ও মেয়ে পথের ধারে কা‍ হয়ে বসে পড়েচেন। এগিয়েই যাই আর পিছনেই পড়ি, সকলেরই সাক্ষাৎ একবার করে পাওয়া যায়, চন্তে চলতে দু’একবার সকলকে বিশ্রাম নিতেই হয়—জল খায়, গায়ে হাওয়া লাগায়, আবার আড়ষ্ট শরীর সোজা করে চলতে থাকে। নদীর কাছে নামলে গ্রীষ্মকাল, চড়াই পথে উঠলে শীতল আবহাওয়া। গরমের চেয়ে ঠাণ্ডাতেই যাত্রীদের সুবিধা। মা ডেকে বললেন, ‘তোমাদের শ্রীনগর আর কতদূর বাবা? মেয়ে যে আর চলতে পারে না।’

দাঁড়িয়ে কথা কইতে গেলে সর্বশরীর কন্কন করে, ঝুলি-কম্বল নামিয়ে পথের এপারে মুখ বিকৃত করে বসে পড়লাম। বললাম, ‘আর বেশি দূর নেই।’

মা ও মেয়ে শ্বাস টানছিলেন। মেয়ের পায়ের উপর হাত বুলিয়ে মা বললেন, তোমার ঘটিতে জল আছে বাবা? একটু দাও ত।’

এমনই আমরা পরিশ্রান্ত যে, তিনিই উঠে এসে জল নেবে কিংবা আমিই উঠে গিয়ে দেবে, এই সমস্যায় কয়েক মুহূর্ত কাটলো তিনিই উঠে এসে জল নিয়ে গেলেন। নিজে খেলেন ও নিমীলিতচক্ষু মেয়ের মুখে ঢেলে দিলেন। পায়ের ব্যথায় মেয়ের আর চেতনা ছিল না, প্রায় চলৎশক্তিহীন, এবার একটু সুস্থ হয়ে মুখ তুলে চাইলেন। কৃতজ্ঞতা প্রকাশের আর প্রয়োজন নেই, ওটা পুরোনো হয়ে গেচে। কেবল বললেন, ‘আপনারা পুরুষ মানুষ, ব্যথা নিয়েও গড়িয়ে গড়িয়ে চলতে পারেন, আমরা কিন্তু ভেঙে পড়ি।’

ধুলোয়, বালিতে, তেল-জলের দাগে, অযত্ন ও অসাধ্য পরিশ্রমে অমন লক্ষ্মীর মতো রূপ তার শুকিয়ে কালো হয়ে উঠেচে-এই কথাটিই তার মা বলতে লাগলেন। তাই মনে হ’লো। সুখের শরীর, ঐশ্বর্য ও ভোগের মধ্যে লালিত, কিন্তু মেয়ের কী নেশা ঘাড়ে চাপলো, এলেন এই দূরতিক্রম্য তীর্থপথে, মাকেও সঙ্গে আসতে হলো। এখনকার ছেলেমেয়েরা মনে মনে সবাই ভবঘুরে! শুধুই কি তীর্থ- দর্শন ও পুণ্য কামনা? কই মেয়ে ত তার ঠাকুর-দেবতা নিয়ে কোনোদিন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেনি? অথচ কয়েক বছর ধরে তীর্থে তীর্থে না ঘুরতে পারলে মেয়ের যেন আর শান্তি নেই। বয়স আর কত, তিরিশ বছরও হতে এখনো দেরি!—ধৈর্য ধরে মায়ের কথা শুনে গেলাম।

বিশ্রামান্তে আবার সবাইকে উঠে দাঁড়াতে হলো। ঝোলাঝুলির মৃত্যু- যন্ত্রণাদায়ক বোঝ আবার পিঠে তুলে নিলাম। মা ও মেয়ে লাঠি ঠুকতে ঠুকতে এগিয়ে চললেন। একবার বললেন, ‘অঘোরকে বলি বাবা, এতখানি করে পথ ত আমরা হাঁটুতে পারবো না, না-হয় দশদিন দেরিই হবে, প্রাণ যে যায়! দশ মাইলের বেশি মেয়েমানুষের পক্ষে রোজ হাঁটা সে হবে না বাবা।’

পথের উপর জুতো ঘষতে ঘষতে তারা চলেচিলেন। বাস্তবিক, তাঁদের অবস্থা দেখে যে-কোনো লোকেরই মনে হবে এখনি হয়ত কোথাও তারা অকর্মণ্য হয়ে পথের ধারে শুয়ে পড়বেন-কিছুই বিচিত্ৰ নয়!

অবশেষে এক সময় শ্রীনগরের চিহ্ন দৃষ্টিগোচর হলো। পথের ধারেই কালিকম্বলীওয়ালার একটি জলসত্র, বাঁ দিকে ফণীমনসার জঙ্গলের ভিতর দিয়ে একটি সঙ্কীর্ণ পথ কমলেশ্বর মহাদেবের মন্দিরের দিকে চলে গেচে। পথের মোড়ে অঘোরবাবু ও ব্রহ্মচারী প্রতীক্ষা করছিলেন। মা ও মেয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে ক্ষীণকণ্ঠে বললেন, ‘এমন করে আমরা কিন্তু হাঁটতে পারিনে, সকলের শরীর ত আর সমান নয়! পায়ের এই শোচনীয় অবস্থা—’

ব্রহ্মচারী বললে, ‘ধর্মশালায় গিয়ে আপনার পায়ের জন্যে আমি ভালো ওষুধ করে দেবো মা।’

‘আচ্ছা বাবা।’ বলে বউটি মায়ের সঙ্গে অগ্রসর হতেই অঘোরবাবু বললেন, ‘কমলেশ্বর দর্শন করা হবে না?’

‘মাথায় থাকুন।’-একটু বিরক্ত হয়েই তারা কথার জবাব দিয়ে গেলেন।

সকলে একে একে এগিয়ে যাবার পর আমি ও ব্রহ্মচারী গেলাম মন্দিরদর্শনে। কিন্তু এমন কিছুই নয়। পুরাতন শুষ্ক মন্দির, ভিতরে প্রকাণ্ড এক শিবলিঙ্গ। পূজা-অর্চনার কোথাও আয়োজন নেই। নিকটে বোধহয় কোথাও গ্রাম ছিল, ছেলেমেয়েরা ও মন্দিরের রক্ষকের দল ছুটে এসে পাই-পয়সার জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগলো। ভারতের প্রায় সকল তীর্থেই ঠাকুরকে কেন্দ্র করে যাত্রীদের ‘পরে এমনি জুলুমই চলে। চাতুরী ও ফন্দির দ্বারা যাত্রীদের শোষণ করা এদেশের তীর্থগুরুদের একটি প্রধান কাজ। উত্ত্যক্ত হয়ে ফিরে এলাম। পথ আর বেশিদূর ছিল না, খানিকটা রাস্তা এসেই ডানহাতি একটা পাকা গাঁথুনির বড় হাসপাতাল পাওয়া গেল। খুশী হয়ে ভিতরে ঢুকলাম যে ক’জন রোগী রয়েচে তারা সবাই প্রায় অকর্মণ্য যাত্রী। আমাদের আরজি পেশ করলাম। পায়ের জন্য একটি মলম, নাকের ঘায়ের জন্য খানিকটা ভেসেলিন পমেড, এবং ব্রহ্মচারীর দাতের জন্য একটু আইডিন-এই নিয়ে আমরা চারিদিক দেখে শুনে আবার বেরিয়ে এলাম। শ্রীনগর রীতিমত একটি সুসজ্জিত ক্ষুদ্র শহর। অবশ্য এখানকার হেডকোয়ার্টার্স পৌড়ীতে-এখান থেকে নয় মাইল দূরে; সেখানে আদালত, পুলিশ, জেল ও হাকিম সায়েবের বাসা। পৌড়ীর খুব নাম। পথে জন দুই বাঙালী ভদ্রলোককে দেখে বিস্ময়বোধ করলাম। তাঁরা এই সুদূর হিমালয়ের গহন-রাজ্যে এখানে কোন কলেজে শিক্ষকতার কাজে এসেচেন। বাঙালী যে দিগ্বিজয়ী তাতে আর সন্দেহ নেই। আলাপান্তে আবার অগ্রসর হলাম। শহরের একটি মাত্ৰ পাকা রাজপথ, কি ভাগ্যি পথটা সমতল। দোকানপাট অনেকগুলি, বিলাতী ও জার্মানী মাল মন্দ চল্‌চে না। সেটা আইন অমান্যতার যুগ, শুনলাম কয়েকদিন আগে এখানে পিকেটিং ও সভা-সমিতি হয়ে গেচে। পথে এক জায়গায় এখনো ১৪৪ ধারার নোটিশ টাঙানো, সভাসমিতি বন্ধ। খুঁজে খুঁজে এসে ধর্মশালার ভিতরে ঢুকলাম। ভিতরে দু’মহল। প্রকাণ্ড প্রাঙ্গণ। সুমুখে একটি মন্দির, সন্ধ্যারতির আয়োজন চলচে। বিরাট দোতলা ব্যারাক। ভারি স্ফূর্তি হলো। লাঠিটা অবলম্বন করে বেশ খানিকটা বেড়িয়ে নিলাম। রাস্তার উপরেই দুটো বড় বড় খাবারের দোকান, অতএব আর রান্নাবান্না করতে হবে না, রাত্রির ভোজন সমারোহের সঙ্গেই আজ সাঙ্গ হবে! খোঁজ নিয়ে জানা গেল, দোকানে চায়ের বন্দোবস্তও হতে পারে! তবে আর কী, কেল্লা মার দিয়া, আর পায়ে ব্যথা নেই, বদরীবিশাললাল কী জয়! ওঁ নমো নারায়ণায়’!-আনন্দে ব্রহ্মচারী লাট্টুর মতো ঘুরে বেড়াতে লাগলো।

কী অনির্বচনীয় আরামদায়ক রাত্রিই না নেমে এল! দুগ্ধ, দধি, জিলিপি, চা, উৎকৃষ্ট ঘৃতপক্ব পুরি, আলুর তরকারি, অম্ল-সবগুলিই প্রায় একত্রে ভোজন করা গেল। আহারের কার্যটি যতক্ষণ চললো, ব্রহ্মচারী চোখ খুললো না। বললে, ‘দাদা, মুখব্যাদান করে থাকি, যত খুশি লাগে, ভেতরে ঢুকিয়ে দিন।’

‘কলেরা হবে যে ব্রহ্মচারী?’

উচ্চকণ্ঠে এই ক্ষুদ্র মানুষটি চক্ষু বুজেই হেসে উঠলো। বললে, ‘দাদা, ভয় পাচ্ছেন রথে উঠে? বিশ্বরূপ দেখিয়ে দেবো? এই পেটে আজ সব গ্রাস করে ফেলতে পারি। আমি দাদা উপোসী ছারপোকা!”

আহারান্তে ব্রহ্মচারী গান গাইতে গাইতে উপরে উঠে এল! পাশাপাশি দু’জনে কম্বল ছড়িয়ে জমি নিলাম। আজ ব্রহ্মচারী ঘন ঘন ‘ওঁ নমো নারায়ণায়’ ছাড়তে শুরু করেছে। মনে হলো আজকের আহারে তার দন্ত, ওষ্ঠাধর, জিহ্বা ও তালু-সবগুলি পরিতৃপ্ত হয়েছে। কত গল্পই সে করলে। ওধারে গোপালদা সদলবলে এসে বুড়ীদের গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খাচ্চেন। সন্ধ্যায় একমাত্র অহিফেন ও এক ছিলি গঞ্জিকার পর গোপালদা এক নূতন মূর্তি ধারণ করেন, দেবলোকের পারিজাত-কাননে দার্শনিকের মতো তিনি ভ্রমণ করে বেড়ান, যে সময় কেউ উত্ত্যক্ত করলে তাকে হত্যা করা উচিত। বিড়ালস্বভাব বুড়ীগুলোর জ্বালায় বেচারার আর শান্তি নেই! মাথার দিকের ছোট্ট ঘরটিতে অঘোরবাবু সপরিবারে এসে উঠেচেন, এইমাত্র তাদের আহারাদি শেষ হয়েছে। তাঁরা অর্থাৎ মা ও মেয়ে এসে একবার আমাদের ভোজন ও শয়ন সম্বন্ধে তদ্বির করে গেলেন।

পায়ের বেদনা কিন্তু কারোই কমলো না, নানা টোটকা, মুষ্টিযোগ, হাসপাতালের মালিশ,-কিছুতেই না। অতএব সাব্যস্ত হলো, অল্প অল্প পাঁচ সাত মাইল রোজ হাঁটতে হবে। কষ্টের সময় আমরা সাধারণত যে কল্পনা করি, কার্যক্ষেত্রে তার ঘটে পরিবর্তন। পথে নেমে মনে হয়, পথ ফুরোলেই বাঁচি। শ্রীনগর থেকে প্রাতে বেরিয়ে বেলা আন্দাজ এগারোটার সময় আমরা ভট্টিসেরায় এসে পৌঁছলাম। পথে সুতা নামক ক্ষুদ্র নদী ও একটি চটি পার হয়ে এলাম। ভট্টিসেরায় পথ একটু সমতল, তাই আট মাইল এক বেলায় পার হয়ে আসতে পারলাম। পাশেই নদী, নাম হর্ষবর্তী, অলকানন্দারই একটি শাখা। চটির পাশে একটা ঝরনা, তারই প্রবাহকে বুদ্ধির দ্বারা মানুষ কেমন আপন প্রয়োজনে লাগিয়েছে, সেই দৃশ্যই এখানে দেখা গেল। এর নাম পানচাকী, অর্থাৎ পানি ও চাকা। কাঠের একখানা চাকার উপরে জলস্রোত এসে ধাক্কা দিয়ে তাকে ঘুরিয়ে দিচ্চে, উপরে লাগানো আছে পাথরের জাঁতা এবং তার মধ্যে গম। বিনা পরিশ্রমে আটা তৈরি হচ্ছে। তারিফ না করে উপায় নেই। যতদূর স্মরণ আছে, এই ভট্টিসেরায় গোপালদার দলের বামুন-মার সঙ্গে অঘোরবাবুর কলহ হয়। উপলক্ষ-জাতিবিচার ও শুচিবাতিক। অত্যন্ত সামান্য কারণে বামুন-মার প্রচণ্ডতা দেখে অঘোরবাবুর স্ত্রী স্তম্ভিত হাসি হেসে মুখের দিকে তাকালেন। বামুন-মা আমাদের সনাতন ধর্মের মূর্তিমতী প্রতিমা, জাতিবিচার ও অস্পৃশ্যতা ছাড়া তিনি বাঁচবেন কেমন করে? তিনি সাকি ভাঙার মতো খান্ খান্ করে উঠলেন, ‘কি পাপেই তোমাদের সঙ্গে দেখা হয়েছে মা, শুকনো কাপড়খানি আমার কোন আক্কেলে ছুঁয়ে দিলে? শূদ্দুরের বাড়াবাড়ি আজকাল বড্ড বেড়ে গেচে বাছা!’

অঘোরবার ধৈর্যচ্যুতি ঘটছিল, স্ত্রী এসে তাকে সামলে বললেন, “ছি, যতই হোক ব্রাহ্মণের মেয়ে, ওঁর সম্মান রেখে চলতে হয়।’

ব্রহ্মচারী রাগে গোঁ গোঁ করে বললে, ‘ওকি বামুনের মেয়ে মা, ও ত’ চণ্ডাল।’

‘ছি বাবা, ও-কথা বলতে নেই! যে অন্ধ তার দৃষ্টি নেই বলে গাল দেওয়া বড় পাপ!’

গোপালদা নীরবে বসে রইলেন, বোবার শত্রু নেই। কিন্তু সেইদিন বিকাল বেলায় আমরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হলাম। ছান্তিখালের উত্তুঙ্গ এবং মর্মান্তিক দু’মাইল চড়াই অতিক্রম করে খাঙ্করা চটির দিকে নেমে এলাম-তখনো সন্ধ্যার কিছু বিলম্ব আছে। অপেক্ষাকৃত সমতল স্থান, নিকটে অলকানন্দারই আর একটি শাখানদী, নাম পটুবতী, অদূরে মনোরম একটি পার্বত্য উপত্যকা, তিনদিকে গগনস্পর্শী পর্বতচূড়া, স্নিগ্ধমধুর বাতাস, ঝরনার ঝঙ্কার, বনফুলের লজ্জাজড়িত গন্ধ,-অঘোরবাবুর স্ত্রী বললেন, ‘আজকে আর এগিয়ে কাজ নেই, এখানেই থাকুন না?

পথের দিকে একবার ফিরে তাকালাম। প্রায় এক মাইল দূরে নদীর বাঁকে সদলবলে গোপালদার সুস্পষ্ট ক্ষুদ্র শরীরটি দেখা গেল, মন্থর পদে পিপীলিকাশ্রেণীর মতো তারা চলেচেন, অন্যান্য সঙ্গীরাও যাচ্চেন। বললাম, ‘ওদের কি ছেড়ে দিতে বলেন?’

তাঁর হয়ে অঘোরবাবু বললেন, ‘মাইল দুই হয়ত, পিছনে থাকবো, তারপর ধরে নিলেই চলবে।’ শাশুড়ী বললেন, ‘তাই থাকো বাবা, তোমার শরীর আমাদের চেয়েও খারাপ হয়েছে, আমাদের কুলীর কাছে বিছানা আছে, তারা আসুক, তোমার জন্যে বিছানা পেতে দিই। এবেলা তোমার আর আলাদা রেঁধে কাজ নেই, আমাদের সঙ্গেই ব্যবস্থা হোক।’ ব্রহ্মচারী বললে, ‘আজকের মতো ওদের মায়া-মমতা কাটান দাদা!’

স্বামী-স্ত্রী তখন এদিকে তাকিয়ে জয়ের হাসি হাসচেন। আমাকে তারা যেন জয় করেছেন। বললাম, ‘আজ না-হয় রইলাম এখানে, কিন্তু এত অল্প পথ হাঁটলে অন্য দিন আমার ত চলবে না! যাত্রাটা আমার তাড়াতাড়ি শেষ করা চাই।’

‘বেশ, আজকের মতনই না-হয় থাকুন, মায়ের অনুরোধও ত রাখতে হয়!”

সন্ধ্যা হলো, পাহাড়ের চূড়ার পাশে শীর্ণ চন্দ্র দেখা দিল, তারায় তারায় ছেয়ে গেল আকাশ-সমস্তটার চেহারাই যেন কেমন করে বদলে গেল। হয়ত এমনি করেই বদ্‌লায়! দিনে প্রখর আলো, স্থূল বাস্তবিকতা, মানুষের দৈন্য ও স্বার্থের অতি স্থূল ঘাত-প্রতিঘাত; কিন্তু কি আশ্চর্য, রাত্রে সব বদলায়, এই বিশ্বপ্রকৃতিকে প্রসাধন-পারিপাট্যে অলংকৃত ক’রে কে যেন মনোহর ক’রে তোলে, রাত্রির স্নিগ্ধ জ্যোৎস্নায় দিনের আলোকে যেন আর মনে পড়ে না মা ও মেয়ের আন্তরিক যত্ন ও পরিচর্যায় সেরাত্রে আমরা সবাই যথেষ্ট আনন্দ পেলাম। উচ্চশিক্ষার এমন একটি দীপ্তি ও গাম্ভীর্য বৌটির মুখে চোখে দেখলাম যে, আমরা দু’জন সন্ন্যাসী পর্যন্ত তাঁর প্রশংসা না করে থাকতে পারলাম না। ব্রহ্মচারী ত মা মা বলে একরূপ উন্মত্ত হয়ে উঠলো। আমি বাইরে বসে আকাশের তারা গুণতে শুরু করে দিলাম। সে-রাত্রি কাটলো। সকাল বেলা ব্রহ্মচারীকে নিয়ে আগেই বেরিয়ে পড়লাম। প্রথম তিন চার মাইল পথ আমরা নিঃশব্দে হনহন করে চলে যাই। পথে কোথাও সকালের দিকে প্রায়ই দুধ মেলে, চার আনা ছ’ আনা সের, গরম দুধ খেয়ে আবার চলি। আজকে সঙ্গে আর যাত্রী নেই, যে দু একজন পাওয়া গেল তারা অপরিচিত, সহযাত্রী দেখে ‘জয় বদরীবিশাল’ বলে চলতে লাগলো। চলতে চলতে আমরা চিড়বনের বায়ুপ্রবাহের মতো পরস্পরের নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাই-বিশেষ করে চড়াই পথে ওঠবার সময়। আজকের পথ কোথাও অতি সংকীর্ণ, যথেষ্ট তর্ক হয়ে এবং সাবধানে হাঁটতে হচ্ছে, নিচের দিকে অতি সাহসী ব্যক্তিরও তাকাবার দুঃসাহস নেই, মাথা ঘুরে পড়ে যাবার সম্ভাবনা, অতল পাথার যেন যাত্রীদের নিরন্তর আকর্ষণ করে নেবার চেষ্টা করছে। পায়ের ব্যথাটা সহ্য করে চলা অভ্যাস হয়ে গেচে, যন্ত্রণা ও দুঃখ শরীবের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হয়েচে, সোজা হয়ে সুস্থ দেহে হাঁটতে ভুলে গেচি। সমস্ত দুঃখই মানুষকে এমনি করে সহনশীলতা দেয়, আপন প্রয়োজন সিদ্ধ করতে মানুষকে সে উপযুক্ত করে, খাঁটি করে নেয়, দুর্গমকে সুস্থ করে দেবার জন্য তাকে সে কঠিন করে তোলে। নির্মল প্রচ্ছন্ন হয়ে আমাদের চলার উপায় নেই, সমস্ত পথটির দাগ। আমাদের সর্বাঙ্গে ফুটে উঠেছে। লোকের চক্ষে আমরা আগেকার সেই সামাজিক মানুষ আর নেই, আমাদের সর্বশরীরে হিমালয়ের ছাপ একদিকে জ্বালা-যন্ত্রণা অন্যদিকে দুঃসহ ক্লান্তি, ছিন্ন-মলিন বসন, ধূলি-ধূসর কালিবর্ণ দেহ, কোটরপ্রবিষ্ট ক্ষীণ ও শূন্য দৃষ্টি, রক্তহীন শীর্ণ রূপ-আমরা পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে নিশ্বাস ফেলি। আমরা যেন খরচ হয়ে গেছি, দেউলে হয়ে গেচি।

সেদিন মধ্যাহ্ন রৌদ্রে হাঁপাতে হাঁপাতে আমরা কয়েকজন প্রায় মুমূর্ষু অবস্থায় অলকানন্দার পুল পার হয়ে রুদ্রপ্রয়াগে এসে পৌঁছলাম। বিশ্রাম, কোথাও একটু বিশ্রাম নিতে চাই। লাঠির উপরে ভর দিয়ে দিয়ে একটা ধর্মশালার দোতলায় উঠে থুবড়ে বসে পড়লাম। আর সঙ্গতি নেই, রুচি নেই-আর পেরে উঠিনে একবার চীৎকার করে পথের এই দুঃখের প্রতিবাদ করতে গেলাম-কিন্তু থাক, আগে একটু শুয়ে পড়ি। সব চুলোয় যাক্, সমস্ত ধ্বংস হোক্,-এর কী প্রয়োজন ছিল কেউ আজ বলতে পারে? কী আমবা চাই? এই দুঃখের অবসান যেদিন হবে, কী আমাদের মিলবে সেদিন? কাঙালের মত দৈন্য ও মালিন্য নিয়ে কী ভিক্ষা করতে আমরা এসেচি?’

চোখের পাতা বন্ধ কবে শুয়ে আছি। আঃ, এই ভালো! আর চোখ মেলে তাকাবো না। আর যেন কেউ দেখতে না পায়! সবাই ফেলে যাক্, দূর হয়ে যাক্, এই পুণ্যলোভী তীর্থকীটগুলোর প্রতি আর কোনো শ্রদ্ধা নেই, মাযা নেই। আর কোথাও যাব না, অনেক শিক্ষা হয়েছে, এবাব মাটি কামড়ে এইখানে পড়ে থাকবো!

কিন্তু হায় রে, নির্লজ্জ দেহ আবার স্নিগ্ধ মধুর বাতাসের স্পর্শে একটু একটু করে সজীব ও সচল হয়ে ওঠে। ধর্মশালার নীচই যে ঘন নীল অলকানার কলকল্লোল, কেমন করে চোখ খুঁজে পড়ে থাকি। বনরাজিশ্যাম পর্বত-চূড়ার ছায়া নেমে এসেছে যে রৌদ্রোজ্জ্বল জলধারার উপরে-ওরে মন, চেয়ে দেখ! চেয়ে দেখি দেহ আর কাতর নয়, দৃষ্টি আর ক্ষীণ নয়, ব্যথা নেই, বিক্ষোভ নেই, এমনটি আর কোথায় কবে দেখেচি? এ ত’ কেবল রূপ নয়, এ যে রূপাতীত; কেবল সৌন্দর্য নয়, লোকোত্তর ব্যঞ্জনা; কেবল কাব্য নয়, সুদূর অনির্বচনীয়তা। জল, মাটি, গাছ, আলো আর আকাশ-এদের ছন্দের মধ্যে এনে ভাবরূপ দেওয়া, ব্যঞ্জনার দিকে ইঙ্গিত করা-এ যে সকলের চেয়ে বড় শিল্পী, সর্বোত্তম স্রষ্টার কারুকার্য। ওরে মন, চেয়ে দেখ্‌।

ধীরে ধীরে উঠে বসলাম, যেন হাড়গোড় ভেঙে পঙ্গু হয়ে গেচি, পায়ে আর হাত দিতে পারচিনে, যেন বড় বড় ফোড়া উঠেচে। এই রুদ্রপ্রয়াগ! সামান্য একটুখানি শহর, ওপারে পাহাড়ের কোলে ছোট ছোট দুটি সরকারি বাঙলা, দক্ষিণে অলকানন্দা ও মন্দাকিনীর সঙ্গম তীর্থ। একটি নদী দেবলোকের, অপরটি ব্রহ্মলোকের। এই নদীর সঙ্গমে একদিন গয়রাজার যজ্ঞে অসন্তুষ্ট পরশুরামের শাপে ব্রহ্ম-রাক্ষসযোনিপ্রাপ্ত দু’লক্ষ ব্রাহ্মণ মুক্তিলাভ করেছিলেন। এখানে আছে রুদ্রেশ্বর শিবমন্দির, ধর্মশালা, সদাব্রত, ডাকঘর ও একটি ক্ষুদ্র বাজার। রুদ্রপ্রয়াগে রাস্তা দু’ভাগ হয়ে গেচে। একটি পথ কর্ণপ্রয়াগ হয়ে অলকানন্দার তীরে তীরে সোজা চলে গেচে বদরীকাশ্রমের দিকে, আর একটি পথ মন্দাকিনীর তীরে-তীরে কেদারনাথের দিকে উঠে গেচে। আমরা প্রায় একশো মাইল অতিক্রম কবে এসেচি। ভিতবে চারিদিকে চেয়ে দেখি, যেন মৃত্যুপুরী। জ্বরাক্রান্ত, আমাশয় গ্রস্ত, অকর্মণ্য কোনো কোনো যাত্রী, মুখে চোখে মাছি বসছে, কিন্তু সাড়া নেই, মৃত্যু ঘটলে শববহনের লোক নেই! অথচ এমনি করেই এরা চলেছে, খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে, হামাগুড়ি দিয়ে, টিক্‌টিকির মতো পাহাড় বেয়ে ওঠে, মাঝে-মাঝে রোগে ও যন্ত্রণায় জর্জরিত হয়ে অনেককেই থামতে হয়। সহযাত্রীরা একবার মুখ ফিরিয়ে উদাসীন হয়ে ‘আহ’ বলে চলে যায়! বাবার বুঝি দয়া হ’লো না!

দিন গড়ালো অপরাহ্ণের দিকে। যারা কেদারনাথের দিকে উজিয়ে যেতে ভয় পেল, তারা যাত্রা করলো সোজা বদরীনাথের দিকে। কেদারনাথের পথ ভয়াবহ। কেদার দর্শন করতে গেলে আরো প্রায় আশী মাইল পথ হাঁটতে হয়। রুদ্রপ্রয়াগের সঙ্গমে তাই যাত্রীদের হয় পুণ্যকামনার অগ্নিপরীক্ষা। যারা দেহের ভয়ে ভীত, শক্ত ও দুর্বল, যাত্রার উৎসাহ যারা হারিয়েচে, রোগ-মদীটালা কালী তনু যাদের, তারা আর কেদারের পথের দিকে ফিরেও তাকায় না, সোজা চলে যায় কর্ণপ্রয়াগের দিকে। তাদের পক্ষে শুধু বদরী, কেদার-বদরী নয়! আমিও কেদার পরিত্যাগ করবার সাব্যস্ত করলাম। কিন্তু ঘটনার প্রতিঘাত হলে অন্য রকম। অপরাহ্ণের দিকে একজন নিম্নশ্রেণীর বাঙালী স্ত্রীলোক হঠাৎ খুঁজে খুঁজে পায়ের কাছে এসে কেঁদে পড়লো,-’ও বাবা, রক্ষে করো বাবা, আমার মা- গোঁসায়ের আর কোনো উপায় নেই, তোমার কথা সারা পথ শুনতে শুনতে এসেচি বাবা, আমাদের আর কেউ নেই ধন!

প্রথমটা সে হাউ-মাউ করে কাঁদতে লাগলো, কান্না থামলে যে ঘটনাটা সে ভেঙে-ভেঙে জানালো তা হচ্চে, গুরুমা ও জনকয়েক শিষ্য এসেছিল কল্কাতার উল্টোডিঙি বোষ্টমের আখড়া থেকে, শেঠের বাগানে তাদের আড়া। বেশ আসচিল সবাই, পরশু রাতে কোন এক চটিতে অন্ধকারে গুরুমা চটির দরজা থেকে কি-একটা প্রয়োজনে নেমে এসেছিল, হঠাৎ পা ফসকে পাহাড় থেকে পড়ে যায়, ওলোট-পালট খেয়ে গড়িয়ে কোথায় যেন আটকায়, চটির লোক নেমে গিয়ে তুলে আনে; দেখে, গুরুমার সর্বশরীরের অস্থি চূর্ণ-বিচূর্ণ, রক্তাক্ত ও অচেতন। পয়সাকড়ি যা ছিল তাই দিয়ে অতি কষ্টে এক কাণ্ডি যোগাড় করে বুড়ীকে শ্রীনগরের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা হয় বটে কিন্তু স্থানাভাবে রোগীকে কর্তারা রাখতে চায়নি, ঔষধপত্র কিছু সঙ্গে দিয়ে রুদ্রপ্রয়াগে দিয়েচে পাঠিয়ে। এসো বাবা, তোমার দুটি পায়ে পড়ি, একটা ব্যবস্থা করে দাও। হাউহাউ করে সে আবার কান্না জুড়লো।

ঘটনাটা অবশ্য সবই সত্য। নিচে এসে দেখি, বুড়ী যন্ত্রণায় মর্মান্তিক চীৎকার করচে। সমস্ত জীবন ধরে ধর্মাচরণ করে ও শিষ্যার কানে মন্ত্র দিয়ে এই সর্বশ্রেষ্ঠ তীর্থের পথে এসে একটি নারীর এমনি শোচনীয় পরিণাম। কিন্তু জীবনে এমনিই ত হয়। অপরাধ নেই অথচ শাস্তি আছে, পাপ নেই অথচ আছে একটা যুক্তিহীন প্রতিফল, কারণ নেই অথচ রয়েচে দুঃখ ও ব্যথার একটানা দুর্ভোগ। কিন্তু চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকার সময় নেই, সময় বয়ে যায়, অতএব লাঠির উপরে অবলম্বন করে লোকজন ডেকে এনে বুড়ীর অবস্থার কথা নিবেদন করলাম। একটি স্থানীয় যুবক ও অঘোরবাবু সেদিন যথেষ্ট সাহায্য করেছিলেন। বাজারে, পথে, ঘাটে ও যাত্রীদের কাছে ঘুরে ঘুরে মানুষের জীবনের আকস্মিক বিপদ সম্বন্ধে ওজস্বিনী ভাষায় বক্তৃতা দিয়ে পরিশেষে তাদের দুর্বল মুহূর্তে চাতুর্যের সঙ্গে ভিক্ষাপাত্র বাড়ালাম। আমরা ভিখারীর জাত, অতএব অসম্ভ্রম বোধ করলাম না, বরং পরোপকারের আবরণে ঢেকে ওটাকে বেশ একটা মহত্ত্বের মুখোশ পরানো গেল। আধলা, জয়সা, আনি, দু’আনি, আধুলি,-কিন্তু পুরো একটা টাকা কেউ দিল না। দোষ বোধ করি আমারই, একটাকা দামের মধ্যে বক্তৃতা হয়ত দিতে পারিনি, মােল আনা মূল্য একসঙ্গে পাওয়া গেল না। জীবনে বোধ করি এই প্রথম নিঃস্বার্থ পরোপকার করবার সুযোগ পেয়েচি, অতএব একে সহজে ছাড়চিনে, কচলে কচলে যাত্রীর কাছে অর্থ শোষণ করছিলাম। যে রকম অন্ধ আবেগে ও ক্লাসিক্ হিন্দি ভাষায় সেদিন মানুষের নীতিবোধ, ধর্মানুভূতি ও পরোপকারের প্রেরণা সম্বন্ধে উত্তেজনামূলক বক্তৃতা দিলাম, তাতে বিষয়টা রাজনীতির দিকে ঘোরালে হয়ত এই পঁয়ত্রিশ কোটি দেশবাসী ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ক্ষেপে উঠতো

কিন্তু এত করেও পনেরো টাকার প্রয়োজনে সাড়ে বারোটি টাকার বেশি চাঁদা ওঠানো গেল না। বাকি নিজেদেরই ভাগাভাগি করে দিতে হলো। অঘোরবাবুর স্ত্রী হেসে বললেন, ‘আপনি কী! লোকে মাতৃদায়েও যে এত কষ্ট করে না! হাঁ, আজ আমার দিকে আপনার খাবার করেচি, খাবেন ত? আজ কিন্তু কিছুতেই আর শুনবো না।’

‘যথাযোগ্য মূল্য ধরে নেবেন, বলুন?’

‘যদি পারেন ত দেবেন! যা দেবেন তাতে শুধু খাবারের দামটাই উঠবে, মনে রাখবেন!

অঘোরবাবু তাঁর স্ত্রীর দিকে একবার তাকিয়ে আমাকে বললেন, ‘আপনি বড় নির্দয় মশাই।’

টাকাগুলি একটি শিষ্যার হাতে গুণে দিয়ে বুড়িকে আগামী কাল প্রাতে উখীমঠ হাসপাতালে ডাণ্ডিযোগে পাঠাবার ব্যবস্থা করে যখন হাঁপাতে হাঁপাতে উপরে উঠে এলাম, সুজন নিশ্চয় রাত দশটা বাজে। প্রায় সব যাত্রীই তখন গভীর ঘুমে অকাতর। এতক্ষণে ব্রহ্মচারীর দেখা পাওয়া গেল। ঝড়-ঝাপ্টার সময় কোথায় যে সে অদৃশ্য হয় বোঝা যায় না। তাড়াতাড়ি আহারাদি শেষ করে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে সে বললে, ‘দাদা, গান শুনবেন?’

গান! এই মৃত্যু দিয়ে ঘেরা মহা দুর্গমে কেউ আবার গান গায়? পীড়িতের নিশ্বাস শুনেচি, জর্জরিতের বিলাপ শুনেচি, গান ত শুনিনি। বিস্মিত হয়ে বললাম, ‘গান কোথায় ব্রহ্মচারী?’

‘আসুন আমার সঙ্গে।’ বলে সে হাত ধরে নিয়ে চললো।

পথ নিস্তব্ধ। কোথাও আলোর চিহ্নমাত্র নেই। চোখে তখন ঘুম জড়িয়ে এসেছে, শরীর বড় ক্লান্ত, তবু যেতে হলো। পথ ঘুরে সোজা সে নদীর সঙ্গমের ধারে এসে বললে, ‘নেমে আসুন, এই যে বাঁধানো সিঁড়ি!’

‘কোথায় যাবো, এ যে নদী? নদীর গান নাকি?’ –

‘নামুন না সিঁড়ি দিয়ে, বলি।’

লাঠির উপরে শরীরের ভার দিয়ে পায়ের ব্যথা নিয়ে কয়েকটা সিঁড়ি নামলাম। এতক্ষণ পরে দেখলাম, সুন্দর জ্যোৎস্নাময়ী রাত্রি। পরিচ্ছন্ন সুস্মিত নীল আকাশে নক্ষত্রগুলি জ্বল জ্বল করচে। দুইটি নদীর ঘাতপ্রতিঘাতে জলের প্রবল গর্জন, কান পাতা যায় না। তবু সেই শব্দ অতিক্রম করেও মনে হ’লো, আজ বড় সুন্দর প্রশান্ত রাত্রি। আজ আর ঘুমোবার কথা নয়, নদী-পর্বত ও জ্যোৎস্নার দিকে একান্তমনে তাকিয়ে আজকের রাত এমনি করেই কাটানো উচিত। সেই স্বপ্নময় রাত্রে নদীর গর্ভের দিকে ইঙ্গিত করে ব্রহ্মচারী বললে, ‘আসুন আমার সঙ্গে, এই যে বাঁ-হাতি —’

সিঁড়ির পাশেই পাহাড়ের ঢালুর গায়ে একখানি কাঁচাপাকা কুটীর। ব্রহ্মচারীর পিছনে পিছনে তার ভিতরে এসে ঢুকলাম। টিপ, টিপ, করে এক কোণে একটি আলো জ্বলচে। ব্যাঘ্র ও ভল্লুক-চর্মের খান-তিনেক আসন পাতা, তারই একটির উপরে এক স্থূলকায় প্রৌঢ়া সন্ন্যাসিনী বসে রয়েচেন, নবাগতকে দেখে হেসে সস্নেহে ডাকলেন, ‘আও বেটা।’

তাঁর পদপ্রান্তে গিয়ে বসে প্রণাম করলাম। বুঝলাম আসবার আগেই ব্রহ্মচারী আমার সম্বন্ধে এর কাছে আলোচনা করে রেখেছে। এতক্ষণ লক্ষ্য করিনি, একপাশে একটি শীর্ণকায় বৃদ্ধ হাতে একটি একতারা নিয়ে বসে রয়েচেন, সম্ভবত তিনিই গায়ক। আদর-অভ্যর্থনার ত্রুটি হলো না, অনেক তীর্থ সম্বন্ধে আলোচনা চলতে লাগলো, সন্ন্যাসিনী নারায়ণ গিরি মারি কৈলাস যাবার জন্য পরামর্শ দিলেন, আষাঢ় মাসেই কৈলাস যাওয়ার উপযুক্ত সময়, এবারের সুযোগ যেন ত্যাগ না করি। বিনয় ও ভক্তি সহকারে তাঁর বাণী শুনে যাচ্ছিলাম। ঘরের ভিতর আসবাবপত্র বলতে কয়েক ছড়া রুদ্রাক্ষের মালা, গোটা দুই শখ, কাঠের কয়েকটা কৌটা, খান চারেক কম্বল, পাথরের কয়েকটা বাসন, কতকগুলি তাম্রপাত্র ও ফুল, মোটা মোটা খান তিনেক বই, আগুন রাখার একটা খাপরা। অনেক গল্পই মায়িজীর সঙ্গে চলতে লাগলো, সবাই যোগ দিলাম, মায়ের কাছে সবাই বেটা ও বেটি,-বড় ভাল লাগলো। আলোটা টিপ, টিপ, করচে, দরজার কাছে আকাশ থেকে এক ঝলক জ্যোৎস্না এসে পড়েছে, মায়িজী তার মনোরম হিন্দি ও উর্দু, ভাষার লালিত্য দিয়ে তার বহু তীর্থপথের অভিজ্ঞতা কথা বলে যেতে লাগলেন। কোথায় কোন্ নদীর তীরে হিংস্র শ্বাপদের আনাগোনা, কোন্ মরুভূমি পার হয়ে কোথায় গেচে অপরিচিত দুর্লভের পথ, অজানা কোন পৰ্বত চূড়ার তুষারাচ্ছন্ন পথে কবে ঝব্বু, ও ঘোড়ার পিঠে উঠে তাকে কৈলাস যেতে হয়েছিল তারই রহস্যময় ও চমকপ্রদ কাহিনী। কথা বলতে বলতে একসময় তিনি ভিতরের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ছিলম্ বনাও দেও রপি, এ সোনি?”

ভিতর থেকে আওয়াজ এল, ‘দেথৈ মায়ি!’ এবং তারই মিনিট দুই পরে দু’টি তরুণী সন্ন্যাসিনী লঘু পদক্ষেপে বেরিয়ে এলেন। প্রথমটি মায়ের কাছে এসে বসলেন এবং দ্বিতীয়টি একটি পিতল-বাঁধানো বড় সরু কলকে মায়িজীর হাতে দিয়ে অন্য পাশে গিয়ে বসলেন! ভিতরের আবহাওয়াটা মুহূর্তের জন্য যেন কেমন করে বদলে গেল। প্রথমেই মনে হলো এ দুটি ফুল একই বৃন্তের। মাথায় জটাময় রুক্ষ আলম্বিত বেণী, মুখে সংযমের একটি মিশ্র দীপ্তি ও কাঠিন্য, বলিষ্ঠ ও দীর্ঘাকার দেহ, গৈরিক বসন, চারিটি চক্ষে নির্বিকার ও নিস্পৃহ ‘শূন্য দৃষ্টি। তাঁদের দিকে একবারটি তাকিয়ে ব্রহ্মচারী দেশলাইট জালালো, মায়িজী কলকে টান দিলেন। হাঁ, টান্ বটে। যখন ধোঁয়া ছাড়লেন, কুটীরের ভিতরটা তখন অন্ধকার হয়ে গেল। সকলের হাতে কলটো একবার করে ঘুরে সোনি ও রপ্‌পির হাতে গিয়ে পৌঁছলো। তাদের অকুণ্ঠ ধূমপান দেখে চমৎকৃত হয়ে গেলাম। এবারে বৃদ্ধের গান গাইবার পালা। একতারাটি বাগিয়ে তিনি ধীরে ধীরে কণ্ঠের আওয়াজ তুললেন, গান তিনি চমৎকার গাইলেন মুগ্ধ শ্রোতার দল নিঃশব্দে কান পেতে বসে রইলো, কেবল ছিলটা মাঝে মাঝে এক হাত থেকে অন্য হাতে ঘুরে বেড়াতে লাগলো। কিন্তু সমস্তটার মধ্যে একটি বিস্ময় নিহিত ছিল। এ যেন একটি অবাস্তব রূপকথা। আমরা নবাগত বিদেশী, বৃদ্ধ গায়কটিও সম্ভবত নতুন পরিচিত, সম্মুখে এই মমতাময়ী আশ্রয়দাত্রী, তার দুই দিকে লক্ষ্মী ও সরস্বতী,- এই তিনটি নারীর ঘর-দুয়ার, জীবন-যাত্রা, আচার ব্যবহার, কোথা থেকে এদের আগমন, এরা কে, এরা কী, কী এদের জীবনের চরম লক্ষ্য, এমনিতর নানা সমস্যায় আমি স্তব্ধ হয়ে রইলাম। অথচ আজ তাদের কথা লিখতে বসে একান্ত আন্তরিকতায় স্বীকার করে যাবো যে, সেই জ্যোৎস্নাময়ী সুন্দর রজনীতে, সেই রহস্যময় ক্ষুদ্র কুটীরের স্বপ্নালোকিত পরিবেষ্টনের মধ্যে সন্ন্যাস জীবনের একটি অপূর্ব সংযম ও শ্রী সকলের মুখগুলিকে নির্মল ও উদাসীন করে রেখেছিল; অত্যন্ত সহজসরল সৌজন্য ও উদাসীনতা নিয়ে আমরা সবাই দুখানি ব্যাঘ্রচর্মের উপরে নিতান্ত কাছাকাছি বসেছিলাম। সেদিনও পরিচয় নিইনি, আজো আমার অজ্ঞাতকে সেই দুটি তরুণী, মায়িজিই বা তাদের কে, কোথায় তাদের পথ; এই কুটীর, এর আশ্রয়ও ত তারা পরিত্যাগ করে শীঘ্রই চলে যাবে-কিন্তু কোথায়? জীবন কি তাদের শুধুই শূন্য? শুধুই একান্ত লক্ষ্যহীন? তাদের সমস্ত পরমায়ুব্যাপী পথযাত্রার পরম সার্থকতা কি?

গান থামলে মায়িজিকে প্রণাম করে ভারাক্রান্ত মনে বিদায় নিলাম। হাঁ, স্বীকার করতে লজ্জা নেই, ক্ষুদ্র মন আমার কৌতূহলে ভরে উঠেছে। শুধু কি কৌতূহলই? এই চন্দ্রকরোজ্জ্বল নিভৃত রজনীর পদপ্রান্তে দাঁড়িয়ে পরিশ্রান্ত ও পঙ্গু পথিক আমি-আমি কি শপথ করে বলতে পারি, শুধু কি কৌতূহল, বেদনা কি বিন্দুমাত্রও নেই? মূঢ় বিপথগামী সন্ন্যাসী আমি, আমিও যে জানি জীবনের ব্যর্থতার চেহারাটা কেমন! সুখ, ঐশ্বর্য, আনন্দ, সম্ভোগ, পিপাসা-জীবনের অনিত্যতা আছে বলেই ত এদের এত প্রয়োজন, এত প্রলোভন! সমস্ত পরমায়ু দিয়ে কঠিন বৈরাগ্য ও ভয়াবহ শূন্যতাকে প্রকাশ করে, তোমরা নারী, তোমরা করেচ এই বিশ্বসৃষ্টির অনন্ত স্রোতকে প্রতিহত, অপমান করে প্রকৃতির নিয়মকে, ধ্বংসের নিষ্ঠুরতা এনেচ সংসারে, রূপ ও সৌন্দর্যকে চুঁটি টিপে হত্যা করেচ!

এক হাতে লাঠি, অন্য হাতে ব্রহ্মচারীর কাঁধে ভর দিয়ে পা টেনে টেনে উপরে উঠলাম। ব্রহ্মচারী মুখের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো, ‘আপনার যে কী হ’লো দাদা, আপনাকে না আনলেই হতো, অতটা ভাবিনি।’

.

পরদিন আবার পথ হাঁচি। ব্রহ্মচারী চলচে, অঘোরবাবু এগিয়ে যাচ্ছেন, শাশুড়ী-বৌ হাঁটচেন। বন্ধুত্ব এবং আত্মীয়তা একটু ঘনিষ্ঠ হয়েছে, অঘোরবাবু আনন্দ পেয়েছেন, বউটি বড় বোনের মতো ব্যবহার করতে শুরু করেছেন। তাঁর চোখে ও মুখে সস্নেহ হাসি, আলাপে আন্তরিকতা, দুই করতলে সহোদর সেবা ও যত্ন, তাকে কাছে পেয়ে যে কোনো পথচারী সৌভাগ্য জ্ঞান করবে। ছতোলী ও মঠচটি পার হয়ে মধ্যাহ্নের রৌদ্রে ক্লান্তপদে আমরা সেদিন রামপুর চটিতে এসে পৌঁছলাম।

কিন্তু হঠাৎ বিপত্তি ঘটলো। শাশুড়ীর পায়ে উঠেচে মস্ত বড় একটা ফোস্কা, হাঁটতে তার ভারি কষ্ট হচ্ছে। সবাই অত্মস্থ বিপন্ন হলেন। এদিকে ঘটলো আর এক কাণ্ড। ব্রহ্মচারী ও অঘোরবাবু নিচে দাঁড়িয়ে কথা বলতে বলতে হঠাৎ যেন গরম হয়ে উঠলেন। তর্ক করতে করতে অঘোরবাবু ব্রহ্মচারীর প্রতি ব্যক্তিগত কটাক্ষ করে বসলেন। ব্রহ্মচারী নাকি অলস ও আরামপ্রিয়, আহারাদির সময় ছাড়া আর তার দেখা পাওয়া যায় না। ব্রহ্মচারীর আত্মসম্মানে বোধহয় আঘাত লাগলো, ক্ষুব্ধ হয়ে বললে, ‘আমি কারো পরোয়া করিনে মশাই, খেতেই না হয় দিচ্ছেন, তা বলে অপমান করতে পারেন না।‘

অঘোরবাবু বলে বসলেন, ‘আপনার মতন লোককে আমার জানা আছে।’

অতএব ব্রহ্মচারী চলে যাবার জন্য প্রস্তুত হলো। পূর্ণ বিশ্বাস ভগবানে থাকলে দিন তার চলেই যাবে—এই কথা বলে সে বাঁধা-ছাঁদা শুরু করে দিল। আমাকেও চলে যেতে হবে, প্রথমত এতটুকু করে রোজ পথ হাঁটলে আমার চলবে না, দ্বিতীয়ত ব্রহ্মচারীকে ছেড়ে থাকাও কঠিন। রান্নাবাড়া প্রায় শেষ করেছিলাম, কিন্তু ব্রহ্মচারী আজ খেতে রাজি হলো না, নিচের দোকানওলার কাছে আটা নিয়ে জলে গুলে খেয়ে বললে, ‘আমি এখানে অপেক্ষা করি, আপনি সেরে নিন। না-হয়ত এগোই দাদা, কি বলেন?’

বুঝলাম এখানে একদণ্ডও সে আর থাকতে চাইছে না, রাগে সে কঁপছিল। বললাম, ‘যা সুবিধে হয় করো।’

সেই রৌদ্রদগ্ধ রুক্ষ দিনটি আজো আমার চোখে জ্বলজ্বল-করচে। আহারাদির পর নিরুপায় হয়ে বিদায় নিতে গেলাম। অঘোরবাবু দুঃখিত হয়ে বললেন, ‘আপনি কিন্তু সঙ্গে থাকলে আমরা খুশি হতাম, ও যাচ্চে যাক্, অবশ্য আপনার তাড়াতাড়ি যাওয়া দরকার কি করব বলুন, এদের জন্যেই আমাকে এমন আস্তে আস্তে-’

মা ও মেয়ের কাছে বিদায় নিতে গেলাম। একটু ভিতরে গিয়ে দেখি মা ও মেয়ে কোলের কাছে ভাত নিয়ে বসেছেন মাত্র, কিন্তু ছেনি। মেয়ে বললেন, ‘আপনি চলে যাচ্ছেন, মায়ের চোখ দিয়ে যে জল পড়চে।’

‘কেন!’

‘কেন!’ বলে তিনিও মুখ তুলে তাকালেন, এবং তার চক্ষুর দিকে তাকাবারো আর উপায় ছিল না! বললাম, ‘কি করবো বলুন, যেতে আমাকে তাড়াতাড়ি হবেই, আবার কখনো দেখা হয়ত হবে আপনাদের সঙ্গে—’

বউটির চক্ষু আর বোধ করি বাধা মানলো না, ভারাক্রান্ত হয়ে উঠলো। রুদ্ধকণ্ঠে বললেন, ‘একটিমাত্র ছোট ভাই আমার ছিল, সে আপনারই মতন…সে আর নেই! মা, ছেলের সঙ্গে তুমি কথা বলো।

মা তাকালেন মুখ তুলে। বললাম, ঠিকানাটা না-হয় দিন, দেশে যদি ফিরি কোনোদিন তাহলে- ‘

‘ঠিকানা ত দেবার উপায় নেই ভাই?’

পুনরায় বিস্মিত হয়ে বললাম, ‘কেন?’

অস্ফুটস্বরে মা বললেন, ‘তা হোক, ঠিকানাটা তুই দে রাধারাণী, যত অযোগ্যই হই, আমরা মা-বোন!

নাটক সৃষ্টির সময় আমার ছিলো না। ‘আচ্ছা, তবে থাক্।’ বলে হেঁট হয়ে নমস্কার করবার চেষ্টা করতেই অঘোরবাবুর স্ত্রী হাত ধরে ফেললেন। বললেন, বলতে পারছিনে ভাই, মুখ ফুটচে না মেয়েমানুষের অপমানের কথা বলতে; তবুও তোমার কাছে লুকোবো না, বদরীনাথ যাওয়া তা হলে আমার মিথ্যে হবে।’

সবাই আমরা পরস্পরের মুখের দিকে একবার করে তাকালাম। মেয়ে ও মা মাথা হেঁট করলেন, এবং তেমনি নতমস্তকেই অঘোরবাবুর স্ত্রী সজলকণ্ঠে বললেন, ‘আমি তোমার বড় বোন, কিন্তু আমি নরকের কীট! আমি…আমি বেশ্যা!’

কান দুটো ঝাঁ ঝাঁ করে উঠলো। বললাম, ‘কী বললেন?’

উত্তর নেই; এবং উত্তর শোনবার আগেই উঠে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পাথরের ধাপ বেয়ে নেমে কেমন করে ছুটতে শুরু করেছিলাম তা আজও বেশ মনে করতে পারি। নীতিবিদ্ আমি নই; বেশ্যাকে বেশ্যা জানবামাত্র আমি পালাচ্চিনে, সাহিত্যিকের উপযোগী উদারতায় আমিও কারো চেয়ে কম নই; কিন্তু এত বড় আকস্মিক আঘাত,-আমার সমস্ত জীবনের উপর কে যেন সপাৎ করে এক ঘা চাবুক মারলো! খোঁড়া পা, ভগ্নদেহ, পিঠে বোঝা, মাথার উপরে সূর্যের অগ্নিবৃষ্টি, প্রস্তর-কঙ্করময় উঁচু-নীচু পথ, গলার ভিতরে মরুভূমি, তবু মাইলের পর মাইল ছুটে চলেচি। কোথায় ব্রহ্মচারী, কোথাও তার চিহ্নও নেই! কেন সেদিন ছুটেছিলাম, কেন নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসচিল তা আজো আমার কাছে বিস্ময়! প্রাণপণে পালাবার চেষ্টা করেছিলাম। মনে হয়েছিল, পৃথিবীর আলেবায়ুহীন কারাগারে আমি বন্দী!

ঝোলাঝুলি নামিয়ে এক জায়গায় বসে পড়লাম। কিন্তু ধরার শক্তিও আর ছিল না, দেহ বিস্তার করে শুয়ে পড়লাম। আঃ আর যেন উঠতে না হয়, সকল জ্বালার অবসানে আসুক প্রশান্ত মৃত্যু। ছায়া নেই, মুখের উপরে সূর্য জ্বলতে লাগলো; জল নেই, ভিতরটা হা হা করচে! কিন্তু এ কী অশান্তি, এ কী চঞ্চলতা? দুর্বল চিত্ত আজকের ঘটনাকে মেনে নিতে চায় না কেন? এ কি সত্যি শ্রদ্ধায় ও সম্মানে যার পূজা করেচি, সে-প্রতিমা আমার চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে ধূলায় গড়াগড়ি যাচ্ছে? হে সত্যনারায়ণ সূর্য, তুমি ত জানো, তার কোনো মালিন্য নেই! যত্নে স্নেহে দাক্ষিণ্যে ও ব্যবহারে সে ত’ কোনো সম্ভ্রান্ত ভদ্রমহিলার চেয়ে কম নয়, তবু সে পতিতা কেন? তার ত ছলনা নেই, মোহজাল নেই, লালসার কোনো অভদ্র ইঙ্গিত নেই, সে ত সংসারে কারো চেয়ে হীন নয়, অনুপযুক্ত নয়! হে সূর্যদেব, তুমি বলে দাও! তুমি আজ বলে দাও, রাধারাণী কি বেশ্যা?

অপরাহ্ণের রৌদ্র ম্লান হয়ে এল। শুয়ে শুয়ে অসহ্য অস্থিরতায় গড়াগড়ি দিয়ে একবার বমি করলাম। তবু এক সময় ধুলায় বালিতে বমিতে চোখের জলে কিম্ভূতকিমাকার চেহারা নিয়ে উঠে চলতে শুরু করলাম। অগস্ত্যমুনির মন্দির ও সৌরী চটি পার হয়ে গেলাম। একটু একটু করে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল, পথে আর কোনো সঙ্গীর দেখা মিলছে না। আকাশে চন্দ্র দেখা দেবার কথা কিন্তু দেখতে দেখতে মেঘ করে এল, জলে হাওয়া বইতে লাগলো। মনে মনে আশা আছে চন্দ্রাপুরী চটিতে গিয়ে আজ ঠিক পৌঁছতে পারব। শরীর দুর্বল, বাতাসের সঙ্গে দুচে।

অন্ধকার ঘনিয়ে এল চারিধারে, ঘুমের ঘোরে যেন পথ চলেচি। পথের রেখা কিছুদূর পর্যন্ত দেখা যাচ্চে, তার পরে সমস্তটা অদৃশ্য হয়ে গেচে। কোথায় ব্রহ্মচারী? আর সাহসে কুলোচ্চে না, উপরে মেঘাচ্ছন্ন আকাশে চন্দ্রালোক নিবে গেচে, এত অন্ধকারে কোনদিন পথ হাঁটিনি, বাঁ দিকে নিচে বনবেষ্টিত নদী কুলু কুলু বইচে, দক্ষিণে ও মাথার উপরে পাহাড়ের পর পাহাড় অরণ্যের আঁধারে আবৃত-গা এর ছম্ ছম্ করে উঠলো। নিজের পায়ের শব্দেই এক একবার এই নির্জনে চকিত হয়ে উঠচি। লাঠির উপরে জোর দিয়ে সাহস পাচ্চিনে। ভয়ে কানের ভিতরটা ঝাঁ ঝাঁ করতে লাগলো। পা কাঁপচে।

এ কি, এ কোথায়? নদীর ভাঙনে পথ যে হারিয়ে গেল! মন্দাকিনী ও চন্দ্রা নদীর সঙ্গম, কিন্তু যাবে কোন্ দিকে? ভয়ার্ত গর্জনে হু হু করে অতল পাথার নদী বয়ে যাচ্ছে দেখতে দেখতে পথের চিহ্ন অদৃশ্য হলো। মনে আছে মুখ থেকে একটা শব্দ বেরিয়ে গেল। মুখখানা যেন অন্যের। গা কাঁপছে, দেহের রক্ত ভয়ে ক্ষণে ক্ষণে কোলাহল করে উঠচে, গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেচে, হাঁটু দুটো নিজের বলে আর মনে হচ্ছে না, নিতান্ত দশ বছরের বালকের মতো নিরুপায় হয়ে এই পথের তীরে দাঁড়িয়ে চোখের জলে আমার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এল। এমনি করে শ্বাপদসঙ্কুল অরণ্য ও নদীর গর্ভে অসহায় মরণ মরতে আমার কোনোদিন ইচ্ছা ছিল না। বিপদে পড়ে ভগবানকে ডাকার কথাও যেন ভুলে গেলাম, তেমনি ভুললাম জীবনের তুচ্ছতার কথা। সত্যিকারের মৃত্যু যেদিন আসে সেদিন চেয়ে দেখি জীবনকে আমরা কতদিক থেকে গভীর আলিঙ্গনে বেঁধে রেখেচি। হায় রে সন্ন্যাস, হায় রে নিষ্ফল বৈরাগ্য!

‘কৌন্ হ্যায়?’

হঠাৎ ভয়ে আঁকে থর থর করে কেঁপে উঠলাম। আকস্মিক কণ্ঠস্বরে বুকের ভিতরটা ধক্ ধক্ করতে লাগলো। একটা ছায়ামূর্তি কখন নিঃশব্দে পাশে এসে দাঁড়িয়েচে। লাঠিটা জোরে বাগাতে গেলাম, হাতের মুঠি শিথিল হয়ে এল। ঘন ঘন নিশ্বাসের শব্দ শুনে মনুষ্যমূর্তি বলে ধারণা হলো। কম্পিতকণ্ঠে বললাম, ‘তুম্ কোন্ হ্যায়?’

‘ম্যায় জেনানা!’

স্ত্রীলোক! অন্ধকারে তার মুখের কাছাকাছি গিয়ে তাকে লক্ষ্য করলাম। ধীরে ধীরে লাঠির উপরে জোর এল, সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। কে বলে আমি নার্ভাস! যতদূর বোঝা গেল, মেয়েটি পাহাড়ী, বয়স বেশি নয়, গলায় তার কয়েক ছড়া রুদ্রাক্ষের মালা, মাথার চুলের চূড়ায় বড় একটা পালক, সম্ভবত পরনে গেরুয়া, দুই হাতে ফুল ও রুদ্রাক্ষের গহনা, ডান হাতে কমণ্ডলু এবং বাঁ-হাতে একটা শিঙা। নগ্ন পদ। চকিত ও চঞ্চল মেয়ে!

‘কেয়া দেখতা হ্যায়, সাধুজি?’

‘তুম্ জেনানা হ্যায়?’

‘জি। হিঁয়া কেঁও তুম্ খাড়া হুয়া হ্যায়? কাঁহা যাওগে?’ ‘চন্দ্রপুরী যানা, রাস্তা ছুট্‌ গিয়া।’

‘আচ্ছা, পরদেশী! আও মেরি সাথ, বাৎলাতে হেঁ। বলেই ভৈরবীটি এগিয়ে চললো। কিন্তু তারও পথ ছিল না, দেখলাম এক লীলায়িত ভঙ্গীতে নদীর ভাঙন বেয়ে জলের দিকে সে নামতে লাগলো। আশ্চর্য, তার যেন বাধা-বিপত্তি নেই; যেন তার গৃহাঙ্গনের মতোই পরিচিত পথ, এঁকে-বেঁকে হেলে-দুলে হেসে-নেচে সানন্দে সে নামতে লাগলো। অতি কষ্টে বসে গড়িয়ে অতি সন্তর্পণে তার অনুসরণ করে নামতে লাগলাম। অনেকখানি নেমে গিয়ে বাকিটুকু থাকতেই সে হঠাৎ সবসুদ্ধ নদীর চড়ায় ঝাঁপিয়ে পড়লো,…তার ভিতরে যেন দুরন্ত রক্তধারা প্রাণবন্যা, নদীর অবলীলা! তার লাগলো তিন মিনিট, আমি নিলাম দশ মিনিটে। নদীতে নেমে সন্তর্পণে দু’জনে হেঁটে জল পিরয়ে এপারে এলাম, সে আগে আগে, আমি পিছনে পিছনে। কাছেই আর একটা ঝরনা নেমে এসেচে, তার উপরে আমাকে তুলে দিয়ে সে অদূরে চন্দ্রপুরীর পথটা দেখিয়ে বিদায় চাইলো। বিদায় ত তাকে দেবোই, কিন্তু এতক্ষণে হঠাৎ যেন চমক ভেঙে গেল। ঝরনার ধারে দাঁড়িয়ে এই অকস্মাৎ আবির্ভূতা কপালকুণ্ডলার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘তুমারা ঘর কাঁহা?’

‘বহুৎ দূর হিঁয়াসে! চল্‌তেঁ হেঁ,-যাও তুম্, আরাম করো।’ বলতে বলতেই সে নদীর প্রস্তব-পথে দ্রুতপদে চলতে লাগলো। চারিদিকে অন্ধকাব কালিবৰ্ণ পর্বতরাজি, তারই গভীর গহ্বর থেকে উন্মাদিনী চার প্রবাহ অন্ধবেগে ছুটে আসচে, সেই নদীর উপর দিয়ে রহস্যময়ী মেয়েটি কিছুদূর গিয়ে নিশীথিনীর অঞ্চলের তলায় অদৃশ্য হয়ে গেল। কোথায় তার বাসা, কতদূরে, কোন্ গহন- গভীরে, কে জানে! নির্বাক স্তম্ভিত দৃষ্টিতে শুধু সেইদিকে তাকিয়ে রইলাম। সেই বিচিত্র ঘটনাটি আজ নিজের কাছেও আমার স্বপ্ন বলে মনে হয়।

চন্দ্রাপুরীতে পৌঁছে গোপালদা ও ব্রহ্মচারীকে আবার পেলাম। দীর্ঘ বিরহের পর মিলন। বাঁচলাম। আমার সব যাক্, গোপালদা ও ব্রহ্মচারীকে আর ছাড়তে পারবো না। আহারাদির পর গঞ্জিকার আসরে বসে শেষের এই ঘটনাটা বললাম। কিন্তু তাতে আবার একটি ক্ষুদ্র নাটক সৃষ্টি হ’লো। এ ক’দিন আমি নাস্তিক ও অধার্মিক বলে উপেক্ষিত ও পরিত্যক্ত হয়েছিলাম। গল্পটা শুনে হঠাৎ বুড়ীর দল এগিয়ে এসে আছড়ে পড়ে বলতে লাগলো, ‘কে বাবা, মানুষের ছদ্মবেশে কে বাবা তুমি? আমরা পাপী, অধম, তুমিই বাবা দর্শন পেয়েচ সেই মা ভগবতীর! কোন্ দিকে বাবা সে গেল, কোন পথে, তুমি জড়িয়ে ধরলে কেন বাবা, পায়ের ধুলো কেন নিলে না? আহা, তুমি ব্রাহ্মণ, ধার্মিক, তোমার মতন মহাপুরুষ আমাদের অপরাধ নিয়ো না বাবা, তুমি যে কে আমরা এতদিনে- ‘

হাসি চেপে চোখ বুজে বসেছিলাম, এবারে দুই হাত বাড়িয়ে বরাভয় দিয়ে দেবজুনোচিত কণ্ঠে বললাম, ‘সম্ভবামি যুগে যুগে!

চারুর মা চুপি চুপি এসে পায়ের ধুলো মাথায় তুলে নিল।

.

সমতল পথ ও জঙ্গলের ভিতর দিয়ে ভীরীচটি পার হয়েছি। রুদ্রপ্রয়াগ থেকে অলকানন্দাকে বিদায় দিয়ে মন্দাকিনীকে ধরেচি। মন্দাকিনীর ওপারে ভীমসেন ও বলরামের মন্দির পড়ে রইলো। তার পর এল কুণ্ডচটি। এখান থেকে কেদারনাথের বরফ দৃষ্টিগোচর হলে। তুষার-কিরীট হিমালয়, সূর্যকিরণ স্নাত দুগ্ধশুভ্র পর্বতমালা, বর্ণের উজ্জ্বলতায় রোমাঞ্চকর, নয়নাভিরাম রূপ। তারপরেই আবার পথ চড়াই, সেই প্রাণান্তিক পথ অতিক্রমণ, পিপীলিকার মতো মন্থরগতি। কয়েক পা এগোই, একটু দাঁড়াই, কোনো অর্ধচেতন যাত্রীর মুখে একটু জল দিই, নিজে হয়ত একটু খাই, আবার কিছুদূর এগোই। এমনি করে এসে পৌঁছলাম গুপ্তকাশীর ধর্মশালায়। ছোট্ট একটি শহর। খান পনেরো কুড়ি ধর্মশালা, কয়েকটি দোকান, বিশ্বেশ্বরের প্রাচীন মন্দির, দূরে একটি ডাকঘর, সম্মুখে তুষারাচ্ছন্ন পর্বত। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন, কোথাও কোথাও অল্প অল্প কুয়াশা, নিচে পর্বতের সানুদেশে চিত্রপটের মধ্যে ক্ষুদ্র এক একখানি পাহাড়ী গাঁও, কোথাও কোথাও সামান্য আবাদ। ধর্মশালাগুলি বেশ সুসজ্জিত ও কারুকার্যময়। এতদিনে আমাদের শীতের কাঁপুনি লাগলো। এবার শীতের দরজায় এসেছি, বসন্তকাল ফুরিয়ে গেচে, বরফ সন্নিকট। এখানে গোমুখীধারা, মণিকর্ণিকা কুণ্ডে স্নান এবং গুপ্তদানের মাহাত্ম্য! পথের উপর থেকে গুপ্তকাশীর রূপটি সুন্দর! দূর ওপরে উখীমঠ শহরটি ছবির মতো দেখা যায়। শীতের সময় এ সকল পথ ও শহর বরফে আচ্ছন্ন থাকে, মানুষ ও জানোয়ার সব নিচের দিকে পালিয়ে যায়।

কেদারনাথে পৌঁছবার জন্য আমরা সবাই ব্যগ্র। পরম্পরায় শোনা যাচ্চে, যাত্রীদের ধৈর্য ও শক্তির অগ্নিপরীক্ষা সন্নিকট, এখন থেকে সকলের প্রস্তুত হওয়া দরকার। যারা কেদারনাথ দর্শন করতে চায় না, তারা এখনো মন্দাকিনী পার হয়ে উখীমঠ দিয়ে বদরীনারায়ণের দিকে চলে যেতে পারে, এর পরে মাথা খুঁড়লেও আর উপায় নেই। সম্মুখে ভীষণ চড়াই, প্রাণঘাতী বিপদসঙ্কুল পথ, দুর্মূল্য খাদ্য বস্তু, তুষারের ঝটিকা, প্রকৃতির ভয়াবহ রূপ,-”অতএব যারা দুর্বল, যারা ভীত, যাদের ধৈর্য কম, প্রাণের মমতায় এখনো যারা সংকোচ জড়িত-তারা এইবেল উখীমঠের দিকে চলে যাক্। কয়েকজনকে চলে যেতেও দেখলাম। আর একটা অসুবিধে, গুপ্তকাশী থেকে প্রায় তিরিশ মাইল পথ কেদারনাথ পর্যন্ত গিয়ে আবার প্রায় সাতাশ মাইল একই পথে ফিরে আসতে হয়, অর্থাৎ উখীমঠ দিয়ে না গেলে বদরীনাথ যাওয়া যায় না। মিছামিছি এই সাতাশ মাইল পথ হাঁটাটা বড় গায়ে লাগে। আজ পর্যন্ত আমরা প্রায় একশো কুড়ি মাইল হেঁটেচি, হাঁটুতে আমাদের কষ্ট নেই, কিন্তু চড়াই-উত্রাই পাহাড়ের পথে হাঁটায় সামান্য এক মাইল পথ শতগুণ হয়ে ওঠে। যাইহোক, বেলা থাকতেই আমরা গুপ্তকাশী থেকে যাত্রা করলাম, কিছুদূর গিয়ে ডাকঘর দেখে মনটা একবার দুলে উঠলো, কিন্তু কাকে চিঠি লিখবো? মনের ভিতরে সবাই অতল তলে তলিয়ে গেচে। যাক্-জয় কেদারনাথ কী জয়! মাইল খানেক এসে নলাশ্রম চটিতে পৌঁছলাম। এখানে চটিওলার কাছে গুরুভার মালপত্র রসিদ নিয়ে জমা রেখে কোরনাথের দিকে যাব ব্যবস্থা আছে, ফেরবার মুখে আবাব জিনিসপত্র ফেরৎ নিয়ে যাত্রীবা উখীমঠের দিকে যায়। ঝোলাটা রেখে যাবার সুযোগ পেয়ে বাঁচলাম, সমস্ত পথ ঐ ঝোলা আর কম্বল আমাকে শাস্তি দিয়েচে।

রসিদ নিলাম বটে কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে চটিগুলা যদি ফেরৎ না দেয় ত বাঁচি, আর আমি ওর মুখদর্শন করতে চাইনে! নলাশ্রম থেকে এক মাইল দূরে ভেতাদেবী চটি, এখানে একটি কুণ্ড ও প্রাচীন মন্দির দণ্ডায়মান। তারপরেই আবার পথ চড়াই। চড়াই দেখলেই কান্না পায়, বুকের রক্ত শুকোয়। পুরো দু’মাইল চড়াই পার হয়ে পেলাম বুঙ্গমলা চটি। শোনা গেল এখানে ভগবতীর মন্দিরে অনেক মহাত্মার দেখা পাওয়া যায়। থাক, মহাত্মায় আর রুচি নেই। এখানে কাঠের বাসন সস্তায় বিক্রি হয়। বুঙ্গমলার পর আবার উত্রাই, চড়াই আর উত্রাই মানে একটি করে পাহাড় পার হওয়া। জনশ্রুতি, সবসুদ্ধ এক লক্ষ পাহাড় অতিক্রম না করলে বদবিনারায়ণ পৌঁছানো যায় না। মাইল দুই পথ এসে পেলাম মৈখণ্ডা। এখানে আছে মহিষমর্দিনী দেবীর মন্দির এবং নদীর উপরে ঝোলা দড়ির পুল। উত্তর দিকে পথ ঘুরলেই দূরে তুষাররাজ্য চোখে পড়চে। রৌদ্রের সময় অপূর্ব্ব রূপ। উপরে উজ্জ্বল নীল আকাশ, তা নিচে ধরল তুষার রেখা, আবার তার নিচেই সবুজ অবণ্যময় পর্বতরাজি-পিছনের পটভূমিকায় তিনটি বর্ণের বিস্ময়কর সমাবেশ। ভিতর থেকে কেমন যেন অনুভূত অনল গুঞ্জন করে ওঠে। আবার এক মাইল এসে ফাটা চটি পাওয়া গেল। এখানে একটি সরকারি ধর্মশালা ও পানচাক্কী আছে। দেখতে দেখতে সন্ধ্যার অন্ধকার আসন্ন হয়ে এল। আজকের মতো এইখানেই বিশ্রাম। কিন্তু আশ্চর্য, ব্রহ্মচারী গেচে এগিয়ে, কাল থেকেই সে আমাদের এড়িয়ে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করছে, কোনো তাৎপর্য বুঝলাম না, এখান থেকে বদলপুর চটি সাড়ে তিন মাইলের কাছাকাছি, রাত্রি সন্নিকট, বদলপুরে সে পৌঁছতে পারবে কিনা কে জানে। চিন্তিত মনে গোপালদা ও বুড়ীর দল নিয়ে চটিতে উঠে এলাম। ব্রহ্মচারীর মনে কোথায় যে ভাঙন ধরেচে কিছুই বুঝলাম না। গোপালদার সঙ্গেও তার অবশ্য বিশেষ বনিবনা হয় না। ভগবানের প্রতি তার পূর্ণ বিশ্বাস গোপালদাকে মুগ্ধ করেনি, কিন্তু আমি যে তাকে অন্তরঙ্গ বলে মেনে নিয়েচি!

পরদিন ভোরে অন্ধকার থাকতেই যাত্রা। শীত পেয়ে পথ হাঁটার সুবিধা হলো, সহজে ক্লান্তি আসে না। প্রথমটা ঠাণ্ডায় একটু কষ্ট হয় তারপরে শরীর ঈষৎ গরম হয়ে উঠলে ভালোই লাগে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগিয়ে চলেচি। শূন্যমন, ব্রহ্মচারীর অভাব বোধটা মনে মনে এক একবার পদচারণা করে যাচ্ছে, পথে সমবয়সের সঙ্গীকে ছেড়ে দেওয়া বড়ই কষ্টকর। দুঃখ ও আনন্দবোধটা সমবয়সের ক্ষেত্রে একই জায়গায় এসে মেলে, সহজেই আমরা পরস্পরকে বুঝতে পারি। মনের মধ্যে এ ক’দিনে অনেক জায়গায় ভেঙেচে, অনেক জায়গায় জোড়া লেগেচে। খানিকটা গলে প্রবাহ ব’য়ে গেচে, খানিকটা জমাট বেঁধে পাথর হয়েচে। আবেগ শুকিয়ে গেচে, ভাবালুতা চাপা পড়েছে, দুঃখে আনন্দের চেহারা এখন প্রায় একই রকম। একটু একটু করে সকালের আলো ফুটলো, আকাশে আকাশে প্রসারিত হলো প্রভাতের নিঃশব্দ সমারোহ, পর্বতচূড়াগুলি লোহিত রৌদ্রে ঝলমল করে উঠলো,-আমরা চলেচি মন্থরগতিতে। বদলপুর চটিতে এসে মিনিট কয়েক বিশ্রাম নিলাম। বিশ্রাম নিয়ে আবার অগ্রসর হলাম। পথটা একটু সমতল মনে হচ্ছে, পাষে আর তত লাগচে না। মাথা নীচু করে চলেচি, কিছুই ভাবচিনে, কেবল হাঁচি, হাঁটা ছাড়া আর আমাদের কোনো কাজ নেই। পথের পাশে কুল ও কুরুবকের ঝাড়,-তা হোক, চল হাঁটি। গৌরীফল, ডালিম ও আখরোটের বন,-বেশত, চল হাঁটি। কোথাও জলপ্রপাত হচ্চে হু হু শব্দে, কোথাও পাহাড়ের গা বেয়ে নাম্‌চে ঝরনা, নামুক, আমাদের হাঁটতে হবে ত! চটি থেকে একটা পাহাড়ী কুকুর সঙ্গে সঙ্গে আসচে, প্রায়ই যেমন আসে, যুধিষ্ঠিরর পাশে ছদ্মবেশী ধর্মের মতো, কত দূব যাবে কে জানে! সেদিন হিসাব করে দেখেছিলাম একটা কুকুর প্রায় বিশ মাইল পথ আহারের লোভে অনুসরণ করে এসেছিল। পথে বহু যাত্রীর সঙ্গেই একটা করে কুকুর দেখা যায়। এ পথ যে মহাপ্রস্থানেরই তাতে আর বিন্দুমাত্রও সন্দেহ নেই। চলতে চলতে পাহাড়ের একটা খোলা জায়গায় এসে দাঁড়ালাম। গোপালদা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘোড়ার মতো হাঁপাচ্ছিলেন, পথশ্রমে চোখের দৃষ্টি তার ঝাপসা হয়ে এসেছি। সেই বিপুল অবকাশের মধ্যে আত্মস্থ হয়ে দাঁড়ালে উত্তর দিকে দূরদূরান্তর পর্যন্ত দৃষ্টি ছুটে যায়। পথটা অর্ধচন্দ্রাকৃতি হয়ে ঘুরে গেচে অনেক দূর গিয়ে পথ দ্বিখণ্ডিত হয়ে একটি পাকদণ্ডী আকারে উপর উঠেচে, আর একটি গেচে নিচে মন্দাকিনীর দিকে। মনে হ’লো পথের সেই সংযোগ স্থলে ক্ষুদ্র একটি বিন্দুর মতো ব্রহ্মচারীকে নড়তে দেখা যাচ্চে। পিঠে ঝুলানো সবুজ কম্বল ও আরক্তিম গৈরিক বসন-ব্রহ্মচারী ছাড়া আর কেউ নয়! বার দুই চিৎকার করে উঠলাম, হাত তুলে নাড়লাম, কিন্তু নিষ্ফল, তার কানে পৌঁছলো না, তেমনি করেই সে নিচেব পথে হাঁটতে লাগলো। ছুটে গিয়ে ধরবার উপায় থাকলে তাকে ধবে ফেলতাম, এমন করে তাকে নিষ্ঠুর হতে দিতাম না। আমি ছাড়া তার চরিত্রেরের ভিতর থেকে কেউ আনন্দ পায় না, আমি তাকে ভালোবেসেচি।’

বেলা আন্দাজ ন’টার সময় আমরা ত্রিযুগীনাথের পাকদণ্ডী-পথ স্পর্শ করলাম। পথের আর একটি শাখা নিচে মন্দাকিনী তটে নেমে গেচে। প্রথমটা বিশেষ বুঝতে পাবিনি, কিন্তু শ’দুই গজ আন্দাজ চড়াই উঠে আমি ও গোপালদা পরস্পর মুখের দিকে তাকালাম। পথ যেমন বন্ধুর, তেমনি দুরারোহ। দুই পাশে ঘনজঙ্গল, কোথাও কোথাও পত্রপল্লবের ভিতব ঝরনার ঝকঝবানি, গিরগিটির অবিশ্রান্ত ডাক, ছায়াময় নিঃশব্দতায়। দেয়াল বেয়ে যেমন টিকটিকি ওঠে, তেমনি করে উঠচি, খাড়াই পথ প্রায় বুকের কাছে ঠেকচে। থাম্‌চি আর হামাগুড়ি দিচ্ছি। এ ত’ তীর্থযাত্রা নয়, পূর্বজন্মার্জিত পাপের শাস্তি। মানুষের উপরে এ হচ্ছে নিয়তি অন্যায় অত্যাচার। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে হঠাৎ চটে উঠে বললাম, ‘ত্রিযুগীনাথ না এলে কী হতো, কে আসতে বলেছিল?’ গোপালদা ছাড়া আর কেউ কাছে ছিল না, জন চারেক স্ত্রীলোক পিছনে পড়ে আছে। তিনি বললেন, হেসেই বললেন, ‘মাথা খারাপ হয়েছিল, জের পাবিনে। আবার চলচি। পা টানতে পারচিনে, কোমরে ব্যথা ধরেচে, বুক কন্ কন্ করচে, ইচ্ছা হচ্ছে এদের সবাইকে খুন করে ফেলি এই পুণ্যলোভী, এই অন্ধ, এই নির্বোধ যাত্ৰীদেব। আঃ, আগুনের মতে গরম নিশ্বাস, নাক টাক গলা সব কাঠ, দাঁতের উপর চেপে মুখটা কন্কন্ করচে, মাথার চুলের ভিতর ও গায়ে এঁটুলি পোকা কামড়াচ্ছে, নোংরা শরীর, মলিন বসন, লাঠি ধরে ধরে হাতে উঠেচে ফোস্কা, আর পারিনে, কণ্ঠনালী সাঁ সাঁ করচে, মৃত্যু আর কতদূরে?

পীড়ন যখন মানুষের অনুভূতির সীমানা ছাড়িয়ে যায় তখন তার অবস্থা কী? কী তা বলতে পারিনে। সিঁড়ি বেয়ে উঠচি আকাশে। আকাশ ছোঁবার আর দেরি নেই। ভাবচি এর চেয়েও ত যন্ত্রণার কথা। জানি মুখের ভিতরে আলপিন্ ঢুকিয়ে দিলে মানুষ কী যন্ত্রণা পায়। আধখানা শরীর মাটির গর্তে, বাকি আধখানায় ডালকুত্তা খোবলাচ্চে তখন অপরাধ কেমন কয়ে কঁদে? গায়ের চামড়া টেনে ছিঁড়ে নিলে মানুষ কেমন আওয়াজ করে? রণক্ষেত্রে শেলএর ঘায়ে। আহত সৈন্য যখন কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলতে ঝুলতে চেঁচায় তখন তার কী হয়? ব্যস, আর যন্ত্রণা হচ্ছে না! চীৎকার করে একবার হেসে উঠলাম। গোপালদা তখন মুখ থুবড়ে বসে পড়েচেন।

চারমাইল বিশাল চড়াই এমনি কবে পার হয়ে ত্রিযুগীনারায়ণে এসে পৌঁছলাম। গাঁয়ের নাম রায়না। গঙ্গোত্তরী হয়ে আর একটি পথ এখানে এসে মিলেচে। মন্দিরটিকে কেন্দ্র করেই গ্রাম। শীতে হাওয়ায় জবু-থবু হয়ে গেলাম। ভীষণ মাছির উৎপাত। মায়া করবার আর শারীরিক সঙ্গতি ছিল না। মন্দির দর্শন করতে গিয়ে দেখি ভিতরটা ঝুপ্‌সি অন্ধকার, নাটমন্দিরে একটা বড় পাথরের খাপ্পার মধ্যে ধুনি জ্বল্‌চে। জ্বল্‌চে ত্রেতা যুগ থেকে-কোনো মুহূর্তেই নিৰ্বাপিত হয় না। শীতের দিনে আগুনে কাঠ জুগিয়ে পান্ডারা নিচে নেমে যায়, গ্রীষ্মকালে এসে মন্দিরের গাজা খুলে দেখে ছাই চাপা আগুন–অন্তত এই কথাই প্রকাশ। কোনো তথ্যেরই সত্য নির্ণয় করার রুচিও নেই, উৎসাহও নেই। বোঝা গেল, সমগ্র মহাভারত ও রামায়ণ গ্রন্থ দু’খানি চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে আছে। ভারতবর্ষে সভ্যতা ও শিল্পকলা, ধর্ম ও আচার, শাস্ত্র ও দর্শন, সাহিত্য ও বিজ্ঞান এই দুখানি মহাকাব্যকে কেন্দ্র করে যে গড়ে উঠেছে তাতে আর সন্দেহ নেই। মন্দির দর্শন করে দোকানদারের কাছে পুরি ও তরকারি কিনে চটিতে এসে উঠলাম। বেলা আন্দাজ তিনটে। তা হক, আজকে আর পাদমেকং ন গচ্ছামি।

পরদিন প্রভাতে শীতে কুণ্ডলী পাকিয়ে ত্রিযুগীনাথ থেকে দ্রুতগতি অবতরণ। উত্রাইয়ে পায়ের ব্যথাটা বাড়তে লাগলো, তা হোক, ক্ষিপ্রগতিতে নেমে চলেচি। সবাই জলস্রোতের মতো পাহাড়ের গা বেয়ে হু হু ক’রে নামচে। উৎরাইয়ে সকলেরই একটু আরাম, কেবল আমারই দুঃখ। আজ দুঃখের কথা বললে গোপালদা আর শুনবেন না। বোঝা গেল লোকটির পথ-চলার অভ্যাস আমার চেয়ে অনেক বেশি। আজ ব্যবস্থা হয়েচে, গৌরীকুণ্ডে পৌঁছে মধ্যাহ্নভোজন করা হবে। পথ হাঁটাই যেন মুখ্য, ভোজন ও শয়নটা গৌণ। মাইল দুই পথ নেমে এসে ছোট্ট একটি মন্দির, তারই ধার দিয়ে পথ নেমেচে মন্দাকিনীর দিকে। সর্পাবৃতি অত্যন্ত সংকীর্ণ পথরেখা, দু’ধারে পাহাড়ী বন। গ্রামের কোনো কোনো ছেলে-মেয়ে পাই-পয়সা ভিক্ষা চাইতে ছুটে এল, বড় বড় মেয়েরা তাদের শিখিয়ে দিচ্চে পিছন থেকে, ভিক্ষাবৃত্তি এদের পেশা নয়, বিলাস। প্ৰায় মাইলখানেক পাকদণ্ডী পথে গড়িয়ে নেমে মন্দাকিনীর পুল পেলাম। রুদ্রপ্রয়াগের পর এই প্রথম নদী, নদী পার হয়ে আবার পাহাড়ে উঠতে শুরু করলাম। মাইল- পোস্টে দেখা গেল, এখান থেকে কেদারনাথ আর মাত্র মাইল নয়েক। পাহাড়ে উঠতে উঠতে দেখি, পিছন দিক থেকে আর একটি ছোট খরস্রোতা নদী, নাম দুধগঙ্গা, মন্দাকিনীরই শাখা,–মন্দাকিনীতে এসে মিলেচে। আমরা দুধগঙ্গার ধারে সুউচ্চ পর্বতের গা বেয়ে চললাম। বেলা আন্দাজ দশটা, শীতের হাওয়া; রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশ, আমরা পর্বতের গভীর অরণ্যের ভিতর দিয়ে পথ হাঁটচি। এবার আমার এগোবার পালা, চড়াইতে পায়ে ব্যথা কম লাগে, এক একজন অগ্রগতিশীল যাত্রীকে দম্ভভরে অতিক্রম করে এগিয়ে চলেচি। বন-জঙ্গলের বাঁকে বাঁকে ছায়ায়-ছায়ায় সবাই তটস্থ হয়ে দল পাকিয়ে হাঁচে। শোনা গেল এদিকে জানোয়ারের ভয় আছে।

প্রায় দ্বিপ্রহর বেলায় এসে পৌঁছলাম গৌরীকুণ্ডের গ্রামে। গ্রামের কোলের উপর দিয়েই বইচে মন্দাকিনী। ক্ষুদ্র নদী, কিন্তু প্রচণ্ড বেগবতী। জল বরফের চেয়েও ঠাণ্ডা, সদ্যতুষার বিগলিত, স্নান করবার উপায় নেই। রুদ্রপ্রয়াগ থেকেই আমাদের বন্ধ হয়েচে। গৌরীকুণ্ডে গৌরীর মন্দিরের পাশেই একটি চটিতে এসে উঠলাম। সমস্তই প্রাচীনের সাক্ষ্য দিচ্ছে। কেদারখণ্ডে লিখিত আছে, দেবী পার্বতী মন্দাকিনীতটে ঋতুস্নান করায় স্থানের নাম গৌরীতীর্থ হয়েছে। যে বস্তুটির নাম গৌরীকুণ্ড তার দর্শন মিললো এতক্ষণে। প্রকাণ্ড একটা উষ্ণ জলাধার কোন্ অলক্ষ্য পর্বতচূড়া থেকে একটি উষ্ণ প্রস্রবণ উদ্ভূত হয়ে এখানে নেমে এসেচে। যাত্রীরা সেই গরম জলের ধারে বসে তর্পণ জুড়ে দিল। বাস্তবিক, এই শীতপ্রধান দেশে ফুটন্ত জল থেকে ধুম-নিঃসরণ দেখে মনটা উল্লসিত হয়ে উঠলো। জল এত গরম যে, তার ভিতরে হাত-পা রাখা যায় না। অথচ কোনো কোনো যাত্রী পুণ্যের লোভে বাহাদুরী দেখিয়ে উত্তপ্ত জলের ভিতর নেমে মিনিটের পর মিনিট দাঁড়িয়ে রইলো। পুণ্যসঞ্চয় তারা করবেই।

এবেলায় আর বিশ্রাম নয়, সকলের শরীরেই উৎসাহ রয়েচে, বেলাবেলি রামওয়াড়ায় পৌঁছে রাত্রির মতো বিশ্রাম নেওয়া যাবে। আগামী কাল প্রাতে চিরতুষারাচ্ছন্ন, বহু আশা ও আকাঙ্ক্ষার, বহু স্বপ্ন ও তপস্যার কেদারনাথ-মন্দিরে পৌঁছতে হবে। আজ সমস্ত রাত শক্তির সাধনা করবে। বরফ স্পর্শ করতে আর আমাদের দেরি নেই। দোকানে অর্ডার দিয়ে পুরি আনিয়ে খেয়ে রামওয়াড়ার দিকে যাত্রা করবো, এমন সময় একদল বেয়াড়া বেখাপ্পা ভ্রমণকারী কোথা থেকে উড়ে এসে সকলকে ভয়চকিত করে খটাখট দুমদাম্ শব্দে হাজির হ’লো। কী দুঃশীল এবং শৃঙ্খলাহীন, কোনোদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই, যেন যুদ্ধের ঘোড়া কিম্বা শিকারীর দল! অনুকম্পাভরে দরিদ্র ও পীড়িত যাত্রীদের পানে একবার তাকালো, মানুষ বলে আমাদের যেন কেয়ারই করে না। সমস্ত মন তাদের দিকে তাকিয়ে বিতৃষ্ণায় ভরে উঠলো। নদী, পর্বত, তুষার ও অরণ্যের পরিবেষ্টনে তাদের আধুনিক সভ্যতাসুলভ আচার-ব্যবহার ও পোশাক-পরিচ্ছদ খাপ খাচ্ছে না, হট কোট প্যান্ট ও বুটএর ঔদ্ধত্য, ভ্রমণের বৈজ্ঞানিক সাজ-সরঞ্জাম, সুসজ্জিত ঘোড়া ও সহিস, সস্তটা মিলে এই ধবলজটাধারী নিমীলিতচক্ষু মহাতপস্বী হিমাদ্রি-দেবতার প্রতি যেন বিদ্রুপ করচে।

এমনি ধারণা নিয়েই চলে যাচ্ছিলাম, কিন্তু হঠাৎ তাদের মধ্যে এক ব্যক্তির সঙ্গে আলাপ হলো। ক্যামেরা দাঁড় করিয়ে তিনি আমার ছবি তুলে বসলেন। আমি নাকি টিপিক্যাল তীর্থযাত্রী। লোকটি একটি বাঙালী উৎসাহী যুবক, চোখে চশমা, ভদ্র ও সম্ভ্রান্ত ঘরের ছেলে। নাম শ্রীধীরেন্দ্রনাথ সাহা। লক্ষ্ণৌ ‘রেডক্রশ সোসায়েটি’র ইনি প্রধান সিনেমাটোগ্রাফার। সরকারি স্বাস্থ্যবিভাগের খরচে সদলবলে হিমালয়ভ্রমণে বেরিয়েচেন। ইনিই দলপতি। আলাপ করে যে পরিমাণে আনন্দ পেলাম, ঠিক সেই পরিমাণে ভুলও ভাঙলো। জনহিতকর কাজে এঁরা শরীর বিপন্ন করে এতদূরে এসেচেন। আপাতত ইনি কেদার ও বদরীনাথ যাত্রাপথের ফি তুলচেন। ভারতবর্ষে এই জাতীয় চলচ্চিত্র এই সর্বপ্রথম। এতে হিমালয়ের মনোরম দৃশ্যাদি এবং পৌরাণিক তীর্থমাহাত্ম্য ছাড়াও স্বাস্থ্য সম্বন্ধীয় বহু আলোচনা ও উপদেশ গ্রথিত থাকবে। যাত্রীদের সুখ-সুবিধা, রোগ-ভোগ, দুঃখ ও পীড়ন, অকাল ও অপঘাত মৃত্যু-কীই বা তার প্রতিকার, ইত্যাদি। এই চলচ্চিত্র কেদার-বদরী যাত্রার প্রারম্ভে হরিদ্বারে প্রতি বছর দেখানো হবে। জনহিত সম্বন্ধে লক্ষ্ণৌ রেডক্রসের এই বিপুল উৎসাহ ও উদ্যম বাস্তবিক প্রশংসারযোগ্য। ধীরেন্দ্রনাথের সঙ্গে আলাপ করে সুখী হলাম। মিষ্টভাষী, সদালাপী ও চরিত্রবান যুবক। তারই উদ্যোগে এবং লক্ষ্যে রেড ক্রশের সৌজন্যে উত্তরকালে আমি কেদার-বদরীর আলোকচিত্রগুলি সংগ্রহ করতে পেরেছিলাম। পরে জানবার সুযোগ হয়েছিল ধীরেন্দ্রনাথই একমাত্র দেশীয় চিত্রসংগ্রাহক যিনি ১৪০০০ ফুট উঁচুতে উঠে চিরতুষারময় নদী অলকানন্দার জন্মস্থলের চিত্র আপন জীবনকে বিপন্ন করেও অবলীলাক্রমে তুলতে সমর্থ হয়েছিলেন!

গৌরীকুণ্ড ছেড়ে অগ্রসর হলাম। শীত ধরেচে। সমস্ত পথটাই চড়াই। খুঁড়িয়ে হাঁটতেও আর কষ্ট নেই, সব সয়ে গেচে। আকাশ কোথাও কোথাও মেঘময়। একটু আগে অল্প অল্প বৃষ্টি হয়েচে। শীতের বাতাস নিয়ে বইতে শুরু করেচে। মাঝে মাঝে দলে দলে কেদার প্রত্যাগত শীতার্ত যাত্রীর দেখা মিল্‌চে। পরস্পর দেখা হলেই ‘জয় কেদারনাথ’ বিনিময় হচ্ছে। সকলেই যথাসাধ্য শীতবস্ত্রে আচ্ছাদিত। সবাই একবার করে বলে যাচ্ছে, ‘সামাকে চললো ভাই, বহুৎ বরফ, জান্ চায় কে।’ যতই এগোই ততই ভয়, একটা আসন্ন বিপদ যেন দূরে আমাদের প্রতীক্ষায় রয়েচে। নানা শঙ্কা ও দুশ্চিন্তা, কিন্তু গতি আমাদের মন্থর নয়, যথেষ্টই দ্রুত এবং সতর্ক, কোথাও কোথাও পথ অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ, দলে দলে ছাগলের পিঠে খাদ্যবস্তু ও জ্বালানি কাঠের আঁটি বোঝাই নিয়ে এক একজন পাহাড়ি যাতায়াত করছে, সঙ্গে চলেচে গৃহপালিত এক একটা বড় কুকুর। পথে জানোয়ারের কবল থেকে ছাগলগুলিকে রক্ষার জন্য একটি প্রকাণ্ড শিকারী কুকুরই যথেষ্ট।

আমরা চলেচি বনময় পার্বত্য পথ দিয়ে। স্থানটির নাম চীরবাসা ভৈরব। চেষ্টা করলে আজই আমরা কেদারনাথে পৌঁছাতে পারি, কিন্তু সন্ধ্যার প্রাক্কালে কেদারের পথ একেবারেই নিরাপদ নয়, আকাশও ঘন মেঘে এরই মধ্যে প্রায় অন্ধকার হয়ে আসচে, সম্ভবত বৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে তুষারপাত কিংবা শিলাবৃষ্টি হতে পারে, অতএব রামওয়াড়াতেই আজ আমাদের রাত্রিবাস। আমাদের পরম প্রিয় ছোড়িদার অম্রা সিং এ সম্বন্ধে যথেষ্ট সদ্বিবেচনার পরিচয় দিতে লাগলো। বেলা আন্দাজ সাড়ে চারটের সময় আমরা রামওয়াড়ার চটিতে এসে উঠলাম, তখন সপ্ সপ্ করে বৃষ্টি নেমেছে। এত হাওয়া ও শীত যে খোলা জায়গায় এক মিনিটও দাঁড়াবার উপায় নেই। বুকের ভিতরটা শীতে এক একবার গুর্ গুর্ করে উঠচে, গায়ে কাঁটা দিচ্ছে, তাড়াতাড়ি পুরু কম্বলখানি আশ্রয় করে বসে পড়লাম। দাঁতে দাঁতে জড়িয়ে যাচ্চে।

বৃষ্টি থামলো বটে কিন্তু আকাশ পরিষ্কার হ’লো না। চটির দেয়াল ও ছাউনি কাঁপিয়ে বরফের প্রচণ্ড বাতাস থেকে থেকে হু হু শব্দে বয়ে চলেচে। গোপালদা কলকে ধরিয়ে ভয়ে ভয়ে বাইরের দিকে চেয়ে কি যেন ভাবছিলেন। এমন সময় কোথা থেকে ঝড়ের মতো ব্রহ্মচারী এসে হাজির। হঠাৎ উল্লাসে আমি প্রায় চেঁচিয়ে উঠেছিলাম। হাসতে হাসতে সে বললে, ‘ঘুরে এলাম কেদারনাথ থেকে। ওরে বাপ রে, কী ভয়ানক ব্যাপার। বরফ, বরফ আর বরফ। খুব সাবধান, যেন ঝড়ের মুখে পড়বেন না দাদা! এদিক থেকে এখন পালাতে পারলে বাঁচি।’

‘তুমি আমাদের ছেড়ে গেলে কেন ব্রহ্মচারী?’

‘এই ত সঙ্গেই আছি দাদা, এগিয়েই রইলাম, এরপর বদরীনাথে আবার দেখা হবে। আমার একটু তাড়াতাড়ি আছে কিনা, ফিরে গিয়ে বৃন্দাবনে যাবো। বলে সে ধূমপান করতে লাগলো। চোখে তা নূতন চাঞ্চল্য, বুকে আশা, কোথায় সে যেন সাহস পেয়ে এসেচে। একথা আজ তাকে জিজ্ঞাসা করতে লজ্জা হ’লো, কে তার আহার যোগাচ্চে, নূতন বন্ধু তার কে, আমার চেয়েও আজ কে তোর আপন,-কিন্তু নিঃশব্দে তার দিকে চেয়ে চুপ করে রইলাম। মাত্র হয়ত দিন পনেরো হলো তার সঙ্গে পরিচয়, কিন্তু সময়ের পরিমাণটাই ত বড় নয়, সে জড়িয়ে গেচে আমার নাড়িতে নাড়িতে; পথে-পথে, দুঃখে-সুখে, আপদে-বিপদে আমাদের পরিচয় হয়েছিল নিবিড়, বন্ধুত্বের গোড়ায় পড়েছিল গ্রন্থির পর গ্রন্থি। ধূমপান শেষ করে ঝোলা-কম্বল, লাঠি ও ঘটি নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে সে হেসে গোপালদার কাছে বিদায় নিয়ে বললে, “চলি দাদা, বেলা থাকতে থাকতে গৌরীকুণ্ডে গিয়ে পৌঁছতে হবে। ওঁ নমো নারায়ণায়!”

চোখ আর তার দিকে তুলতে পারলাম না, তাহলে সে হয়ত দেখতে পেতে, প্রিয়জনকে ছেড়ে দেবার সময় কী আমার হয়, আমার চেয়ে দুর্বল ও ক্ষণভঙ্গুর সংসারে আর কেউ নেই। শুধু একটিবার মাত্র বলতে গেলাম, ‘কী আমার অপরাধ ব্রহ্মচারী, বলে গেলে না?’ কিন্তু মুখের আওয়াজ আমার ফুটলো না।

অথচ সে এমনিই, এমনি করেই সে চিরদিন পরম অবজ্ঞায় ও অবহেলায় সবাইকে ত্যাগ করে এসেছে। কোথাও কারণ আছে, কোথাও নিতান্ত অকারণ। সে ভিক্ষা করে, কাঙালপনা করে, অত্যন্ত বিসদৃশ তোষামোদ করতেও তাকে দেখেচি, তবু তার মধ্যে কোথায় যেন কঠিন ইস্পাতের দৃঢ়তা ছিল। মানব- সমাজের প্রতি তার ছিল একটা ভয়ানক আকুতি, নিগূঢ় অভিমান। এই তার চরিত্র, এই তার সন্ন্যাস! সে চলে যাবার পরেও তেমনি করে বসে রইলাম,— বসেই রইলাম। ভিতরে এক-একজন শীতকাতর যাত্রী থেকে থেকে মুখের শব্দ করে উঠচে, কেউ কেউ আগুন জ্বেলে ঘিরে বসেচে, কেউবা কম্পিত কণ্ঠে শুরু করেচে মহাভারতের কথা,-আমি নির্বাক হয়ে গৌরীকুণ্ডের পথের দিকে তাকিয়ে বসে রইলাম। সম্মুখে শীতজর্জর আঁধার-রাত্রি নাচে, এক্ষুনি হয়ত মেঘ ও বৃষ্টির ভিতর দিয়ে তুষারপাত হবে, কোথায় সেই নিষ্ঠুর অদৃশ্য হয়ে গেল কে জানে। জীবনে কোনোদিন তার দেখা আর পাবো না তাও জানি, তবু কাঙালের মতো ছুটচে আমার মন তার পিছনে পিছনে। সে দরিদ্র ও ভিক্ষাজীবী বলে আমি বরাবর তাকে আহার ও আশ্রয় দিয়ে এসেচি, এ অহংকার আর আমার নেই, মনে হ’লো এতদিন আমিই তার আয়ত্তের মধ্যে ছিলাম। আমি তার কাছে পরাজিত, আমি তার অধীন!

.

রাত্রে চটিওয়ালার কাছে চার আনা দিয়ে একখানি লেপ ভাড়া করতে পেরেছিলাম, সুতরাং প্রভাতকালে আর ঘুম ভাঙলো না। না ভাঙবারই কথা, লেপের গরম। চেয়ে দেখি বুড়ো ইঁদুরের মতো গোপালদা আমার লেপের মধ্যে ঢুকে ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে নাক ডাকাচ্ছেন। অম্রা সিং ও কালীচরণের ধমকের চোটে তাড়াতাড়ি সবাই উঠে পড়লাম। লেপ ছাড়তেই বাইরের ঠাণ্ডাটা যেন চাবুক মারতে লাগলো। তড়িৎগতিতে বাঁধা-ছাঁদা করে যখন হি হি করতে করতে পথে নেমে এলাম তখন বেশ বেলা বেড়ে উঠেচে।

আকাশ ঘন মেঘ ও কুয়াশায় প্রায় অন্ধকার। শোনা গেল বৎসরে কোনো কোনোদিন মাত্র এ-রাজ্যে সূর্যকিরণ দেখা যায়। সম্মুখ, শাদা তুষারময় পর্বতের কোলে-কালে মেঘ ভেসে চলেচে। ঠাণ্ডায় পা ঠিক পড়চে না, মাতালের মতো ছন্দহীন হয়ে চলেচি। দাঁতের উপর দাঁত চেপে জমাট বেঁধে যাচ্ছে। ইচ্ছা করচে ছুটোছুটি করি। মুখে চোখে ছুঁচের মতো তুষারের হাওয়া বিধচে, লাঠিটা বাগিয়ে ধরতে পারচিনে। পাকদণ্ডী পাহাড়ের পথ, দীর্ঘ লম্বা চড়াই নয়, গোলকধাঁধার মতো ঘুরে ঘুরে উপরে উঠচি। বুকের মধ্যে দম্ আছে প্রচুর, কিন্তু পা ক্লান্ত হচ্চে। একটু দাঁড়িয়ে আবার উঠতে থাকি। আজ আমি আগে-আগে। ব্যথা নেই, ক্লান্তি নেই, উৎসাহহীন নই, পিছনের পথ কুয়াশায় অবলুপ্ত, সমুখে হিমালয়ের অনন্ত কুহেলিকা, পথের ধারে ধারে বরফের স্তূপ জমাট বেঁধে রয়েচে, ঝরনাগুলি সাবানের ফেনার মতো গলে পড়চে, আজ আমি আগে-আগে। আজ আমার শরীরে ফিরে এসেচে পুরাতন শক্তি, বলিষ্ঠতা, দুরন্ত উদ্দীপনা, অপরিমেয় প্রাণলীলা। কোথায় হারিয়ে গেচে পিছনের পৃথিবী, কোথায় বিলীন হয়েছে পশ্চাৎ জীবনের সমাজ সংসার ও আত্মীয়-বন্ধুর দল,-আজ আমি আর বিশ্রাম নেবো না, তুচ্ছ দেহের অভাব-অভিযোগের প্রতি দৃষ্টি দেবো না, আজ বন্যার মতো অপ্রতিহত গতিতে ছুটে যাবে। সমস্ত জীবন থেকে এবার পেয়েচি মুক্তি, সকল বাঁধন গেচে খুলে, লোভ মোহ স্বার্থ লোকালয়ের পথে ফেলে এসেচি, পাপ-পুণ্য দুঃখ ও আনন্দের কোনো প্রশ্ন নেই। এবার নদী ছুটেচে মহাসাগরের দিকে, ‘অন্ধকার ছুটেচে আলোয়, জীবন ও মৃত্যু ছুটেচে মহানির্বাণের পথে, মানুষ ছুটেচে স্বর্গে! বাধা আর মানবো না, চলেচি স্বর্গরাজ্য প্রতিষ্ঠার কল্পনায়, দেহ থেকে এসেচি দেহান্তরে, আত্মাকে করেচি আবিষ্কার। আজ আমি আগে-আগে, আগে-আগে, ছুটে-ছুটে…

একবার দাঁড়ালাম। ছুটতে-ছুটতে সকলকে পিছনে ফেলে এসেচি I চারিদিকে অকূল কুয়াশার মধ্যে সঙ্গীরা কে কোথায় হারিয়ে গেচে, কেবল দেখা যাচ্ছে দুইদিকের সামান্য পথরেখা। কোথাও বৃক্ষলতা নেই, বন-অরণ্য নেই, জীব-জানোয়ারের চিহ্নমাত্র নেই, শুধু তুষারময় পর্বতমালা, অসংখ্য ঝরনা চীৎকার করতে করতে পথের ধারে নেমে আসচে। বামে দক্ষিণে সম্মুখে পিছনে মেঘের ঘনঘটা, বিলুপ্ত আকাশ, নিশ্চিহ্ন পৃথিবী। এবার চলচি হাতড়ে হাতড়ে, গর্জনমত্ত বায়ুবেগে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারচিনে। ক্রমে-ক্ৰমে আলো প্রখর হয়ে উঠলো। সে-আলো আকাশের নয়, রৌদ্রের উজ্জ্বলতা নয়, বিদ্যুৎ- বহ্নির নয়, সে এক নতুন অলৌকিক আলো-তুষার শুভ্রতার তীব্র, তীক্ষ্ণ আলো। আলোর স্রোত, আলোর সমুদ্র, আলোক-ধাঁধা। চোখের দৃষ্টি উগ্র যন্ত্রণায় বুজে এল, চোখ জুড়ে বন্ধ হয়ে গেল। চোখে হাত চাপা দিয়ে অন্ধের মতো সংকীর্ণ পথরেখার উপরে পা বুলিয়ে-বুলিয়ে হাঁটচি। সে কী ভয়ানক সর্বনাশা আলোকের উগ্রতা, তীরের মতো চোখে এসে লাগে, যাত্রীরা পথভ্রষ্ট হয়ে হোঁচট খেয়ে ছিটকে পড়ে যায়। দেখতে-দেখতে আর একটা নূতন উপসর্গ দেখা দিল। উঠলো ঝড়, ঝড়ের সঙ্গে সঙ্গে শিউলি ফুলের মতো তুষার বৃষ্টি, তার সঙ্গে দানা- দানা জল। কী কঠিন ঠাণ্ডা! আঃ আর বুঝি আত্মরক্ষা হলো না, আর কতদূর আছে কে জানে, মন্দির আর কতদূরে? মাথার উপরে পড়চে বরফ, কাঁধে পড়চে বরফ, কম্বলটা বরফে শাদা হয়ে গেল, চোখে হাত চাপা দিয়েও চোখ খুলতে পাচ্চিনে! পাগলের মতো ছোটবার চেষ্টা করলাম।

‘আঁক্’!

পড়লাম পা পিছলে বরফের উপরে, পথ তুষারে ডুবে গেচে। একি, সত্যিই কি আমার শরীরে আর শক্তি নেই? শরীর পাথরের মতো অসাড় হয়ে আসচে কেন? এ কোথায় ছিটকে পড়েচি? হাত বুলিয়ে বুলিয়ে কম্বলটা খুঁজে পেলাম। আহা বেচারি, কী দুঃখই সইলো আমার জন্য! কত নিচে পড়েচি বোঝা গেল না, অনেক করে চোখের পল্লব একটু খুলে দেখি, পাশেই একটা ছোট্ট জলাশয় ঠাণ্ডায় জমে আয়নার কাচের মতো কঠিন হয়ে গেচে। গা-ঝাড়া দিয়ে আবার উঠলাম, মিছরির ঢিবির মত বরফের স্তূপে পা পুঁতে গেচে। লাঠিটা আছে খাড়া দাঁড়িয়ে বরফের মধ্যে। যাক্, এ যাত্রা বেঁচে গেলাম। কোমর পর্যন্ত ঠাণ্ডা উঠে পক্ষাঘাত হয়েছে, ওর দেহটা কেবল বাকি। নিজেকে টানতে টানতে এগোচ্চি, চোখ খুলতে পারলে দেখতাম আর কতদূরে! চোখে মুখে পড়চে তুষার ও জলের বিন্দু, মাথার চুল ভারি হয়ে উঠেচে, পরনের গৈরিক-সজ্জা মোলায়েম তুষারে আচ্ছন্ন হলো। মিটমিট করে একবার তাকাবার চেষ্টা করলাম। সম্মুখে তুষারের পুষ্পবৃষ্টি রূপার ঝালরেব মত ঝলমল করচে, মাথার উপরে তুষারের চন্দ্রাতপ। কী অনির্বচনীয় রূপগৌরব! এ যেন কোন্ বিরাটের পদতল ছোঁবার জন্য উঠচি, যেন এক বিপুল বিশ্বের তোরণদ্বারে করাঘাত করবার জন্য পাগলের মতো, অন্ধের মতো হাতড়ে চলচি—যেন স্বর্গের সঙ্গে মর্ত্যের আজ আলিঙ্গন হবে।

শঙ্খধ্বনি শুচি। কাঁসর-ঘণ্টার বুঝি আওয়াজ আসচে! কোন্ দিকে? উত্তরে, না দক্ষিণে? আবার কান পেতে শুনলাম। কিন্তু আর যে চলতে পারচিনে, একটিবার শুয়ে পড়ে বিশ্রাম নেবে। কিন্তু শুলেই যে থামতে হবে, অন্তিমমুহূর্তের থামা। প্রাণের মধ্যে-ধীরে-ধীরে তলিয়ে যাচ্ছি, সব ডুব দিচ্ছে,-রূপ, আলো, শব্দ, চেতনা, নিশ্বাস,-সব। হাত-পাগুলো আর কথা শুনতে চাইচে না! একবার চীৎকার করে কাঁদতে পারিনে? একবার পারিনে ঝড়ের মতো হেসে উঠতে?

‘মহারাজ-জি, কেঁও খাড়া হুয়া হ্যায়?’-হাতের উপরে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি খেয়ে সজাগ হয়ে উঠলাম। হাতটা ধরে হিড়-হিড় করে কয়েক পা টেনে নিয়ে গিয়ে সে বললে, ‘এ্যায়সা হোতা হ্যায় ঠণ্ডেমে, জলদি-জলদি আনা-’

‘কোন্ হ্যায় তুম ছাড়ো ছাড়ো-’

‘আও জী, আঁখ্ খুলো, ম্যায় অম্রা সিং হ্যায়। আও, পুল্ আ গৈ।’—অম্রা সিং আমাকে টেনে নিয়ে চললো।

শরীরের সমস্ত শক্তি সঞ্চয় করে চোখের পাতা মেলে একবার তাকালাম। তখন মন্দাকিনী-দুধগঙ্গার পুলের কাছাকাছি এসে গেচি। কাঁসর-ঘণ্টার শব্দ অদূরে আবার শোনা গেল। দু’চারজন যাত্রী দূরে ছায়ার মতো নড়ে-চড়ে বেড়াচ্ছে। পুল পার হয়েই সামান্য লোকালয় ও কয়েকটা পাথরের ঘর, দুএকটি দোকান, পথগুলি পাথর-বাঁধানো। ঘর-দুয়ার, দোকান-পাট, পথ-ঘাট সমস্তই কঠিন বরফের স্তূপে ঢাকা। তার উপর দিয়েই আনাগোনা চল্‌চে। খবর নিয়ে জানলাম গোপালাদার দল এখনো অনেক পিছনে।

পথ ঘুরেই সম্মুখে তুষারময় হিমালয়ের পটভূমিকায় কেদারনাথের মন্দির দেখা গেল। সম্মুখে প্রস্তরময় বেদিকার উপরে পথের দিকে পিছন ফিরে এক বিরাট পাথরের ষাঁড় উপবিষ্ট। চোখে বরফের আলো এতক্ষণে একটু সয়ে গেচে, এবারে আর কষ্ট হচ্চে না। এবারে হাতের দিকে তাকিয়ে দেখি, আঙুলের ডগাগুলো ঠাণ্ডায় ফেটে গিয়ে রক্ত ঝরচে, পায়ের চামড়া ফেটে গেচে। তা যাক, বাইরে পাদুকা ত্যাগ করে এই পরম রূপবান মনিবের ঘনান্ধকার অন্দরে তাড়াতাড়ি প্রবেশ করলাম। ভিতরে তখন জনকয়েক অর্ধ-উন্মত্ত স্ত্রীপুরুষ যাত্রী কেদারনাথের ‘বিপুল দেহের উপর ওলোটপালট খাচ্ছে।’ কেদারনাথ মূর্তিমান স কর্কশ অসমতল বড় একখানা পাথরের খণ্ড, হোক, তাকেই আলিঙ্গন করে কেউ হাসছে, কেউ কাঁদচে, কেউ চীৎকার করচে, কেউ ধরেচে গান, কেউ করচে আর্তনাদ ও করুণ মিনতি, কেউবা শীতবিদীর্ণ রক্তাক্ত মুখে তাকে পাগলের মতো চুম্বন করচে! আবেগ, উত্তেজনা, উল্লাস, আর্তস্বর, পূজাপাঠ, স্তব-মন্ত্র, স্নেহ- ভালোবাসা, ভক্তি ও আনন্দ,-কিন্তু স্থাণু ও বধির প্রস্তরস্তূপ অচঞ্চল নীরবতায় তেমনি করেই পড়ে রইলো। ভিতরটায় কালীবর্ণ অন্ধকার ও কঠিন অসহ্য প্রাণান্তিক ঠাণ্ডা, পা পেতে দাঁড়াবার উপায় নেই, সম্মুখে এই পথশ্রান্ত পাগলের দল আত্মহারা হয়ে কোলাহল করচে। কী যেন ভেবে অন্ধকারে একবার নিঃশব্দে দাঁড়ালাম।

কিন্তু ভিতরের হিমগর্ভ অন্ধকারের মধ্যে স্থির হয়ে দাঁড়াবার উপায় নেই, ঠাণ্ডায় মুহূর্তে-মুহূর্তে সর্বশরীর অসাড় হয়ে আসে, গায়ের রক্ত জমাট বেঁধে যায়, গলার ভিতর থেকে একরকম ভগ্ন, আর্ত আওয়াজ বিদীর্ণ হয়ে ছোটে। এদিকে ক্ষিপ্ত ও উন্মত্ত যাত্রীদের প্রলাপ, কারো মুখের কস্ বেয়ে গড়াচ্চে রক্ত, কারো ফেনা, হাতে-পায়ে হিমক্ষত, রক্তের দাগ, সর্বাঙ্গে তুষারের চূর্ণ, কারো কারো কণ্ঠস্বর বসে গেচে,-কিন্তু কেন? দুর্গমের এই বীভৎস পীড়নের ভিতর দিয়ে কোন্ দুর্লভকে তারা বরণ করতে এসেছিল? মন্দিরের অন্দরে প্রেতের মতো একাকী কিয়ৎক্ষণ টহল দিয়ে বেড়ালাম; ভিতরটা চির-অন্ধকার, ভয়ের বাসা রহস্যের পাথার, সূচ্যগ্র পরিমাণ আলোক প্রবেশের পথ কোথাও নেই। কী বলব, কী প্রার্থনা জানাবো? এই নির্বোধ প্রস্তর স্তূপের সুমুখে দাঁড়িয়ে কাঙালপনা প্রকাশ করবে-সে যে ভয়ানক ছেলেমানুষী! অথচ, একজন পথশ্রান্ত সামান্য তীর্থযাত্রী, সেইটুকুই ত আমার শেষ পরিচয় নয়; আমি যে ক্ষুদ্র, আমি যে নগণ্য-এই কথাই বা অনুভব করি কোন্ সংকীর্ণতায়? আবেগ দিয়ে, আনন্দ দিয়ে, বিশ্বাস ও প্রেম দিয়ে যারা মাটি ও পাথর, এর প্রাণ-প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে, তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে নিজেকে যে ছোট করে ভাবতে পারে না সে কি তার নিতান্তই অহমিকা? দেবতার কাছে এসে দাঁড়ালেই যে আমি আপন দেবত্বকে অনুভব করি!

অন্ধকারের ভিতর থেকে পা বুলিয়ে বুলিয়ে দরজা দিয়ে বা’র হয়ে এলাম। হাত, পা, মুখ ঠাণ্ডায় বেঁকে যাচ্ছে, নেমে এসে কোনোক্রমে জুতো জোড়া পায়ে ঢুকিয়ে ছুটতে-ছুটতে চললাম। হাতে লাঠি, তাকে চালনা করার আর শক্তি নেই, পায়ের তলায় বরফের চাপড়াগুলিতে মচ মচ করে শব্দ হচ্ছে, অন্ধকার থেকে তুষারের আলোয় নেমে আবার চোখ বুজে আসচে-মুখে এক রকম শব্দ করতে- করতে এসে ধর্মশালায় উঠলাম।

ছোট্ট পাথরের ঘরখানি বরফের গর্ভে সমাধিস্থ হয়ে রয়েচে। ভিতরে আমরা কয়েকজন যাত্রী। গোপালদা ও বুড়ীরা কম্বল জড়িয়ে কুকুরকুণ্ডলী হয়ে বসে ঠক্‌ঠক্ করে কাঁপছে, কারো মুখে আর কথা নেই, চোখে ও মুখে সকলেরই প্রাণভয়ের চিহ্ন। বাইরে মেঘলা আকাশ, প্রতিনিয়ত নিঃশব্দে তুষার ঝরে পড়চে,-যতদূর পর্যন্ত কুয়াশার ভিতর দিয়ে দেখা যায়, পাথরের ঘরগুলির মাথায়, জানালায়, দরজায়, পথে-ঘাটে, দোকানগুলির চালায় পাকার বরফের কঠিন আবরণ। কোনা-কোনো স্থানীয় লোক লোহার অস্ত্র নিয়ে বরফ কেটে আপন চলাচলের পথ সুগম করচে। প্রত্যেক দিন দুবার-চারবার করে তাদের অস্ত্র ধরতে হয়। সবাই যদি এদেশে নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থাকে তবে একদিন বরফে তাদের গ্রাস করবে। ঠাণ্ডায় শরীরে শক্তি জমে, গরমে শক্তি গলে।

এমন সময় অম্রা সিং কতকগুলি কম্বল আর কাঠ এনে হাজির করলো। পাণ্ডারা এদেশে বিনামূল্যে কম্বল ধার দিয়ে যাত্রীদের সাহায্য করেন, কাঠও তারা কিছু এমনিই আনিয়ে দেন। কম্বল দিল বটে কিন্তু সহজে সেগুলি স্পর্শ করা গেল না, তারাও বরফ হয়ে গেচে, ছুঁলেই হাত কক করে ওঠে, গায়ে চাপালে শীতে হাড়ে-হাড়ে ঠোকাঠুকি লাগে। অম্রা সিং একটা লোহার প্রায় কাঠের আগুন জ্বালো। আগুন দেখে আমাদের কী আনন্দ! ও যেন মৃতসঞ্জীবনী, ও যেন আমাদের সকলের লুপ্ত পরমায়ু! কাঠ এত ঠাণ্ডা যে ভাল করে জ্বলতে চায় না, তবু সেইটুকু আগুনের চারিদিকে যাত্রীরা গিয়ে ঘিরে বসলো, কেউ তার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দেয়, কেউ দেয় পা। হাত-পা পুড়ে যাক্, ছ্যাঁকা লাগুক, গ্রাহ্য নেই,– আগুন নিয়ে কাড়াকাড়ি, ঝটপট, আগুন নিয়ে মনোমালিন্য। একজনের শরীর একটু বেশি গরম হয়ে উঠলে আর একজন ঈর্ষান্বিত হয়ে ওঠে। বামুন- বুড়ীর সম্বন্ধে এমনো সন্দেহ হলো, সে হয়ত-বা এইবার কাঠের আড্ডাগুলি সকলের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে নিজের গায়ের উপরেই ছড়িয়ে দেবে। ইতিমধ্যে যাত্রীদের ভিতরে বামুন-বুড়ীর পর-পীড়ন ও আত্মপরতা সর্বজনবিদিত হয়ে উঠেচে। কোমরভাঙা চারুর-মা এতক্ষণ ঠাণ্ডার জ্বালায় কম্বলরাশির তলায় আত্মগোপন করে ছিল, এইবার হঠাৎ একখানা কম্বল হাতে নিয়ে উঠে পাগলের মতো আগুনের দিকে এগিয়ে গেল, দিল কম্বলখানা আাগুলির মধ্যে ঢুকিয়ে, একটি রেঞ্জাও তার পুড়লো না, বামুন-বুড়ী হাঁ-হাঁ করে উঠতেই সে আবার সেখানা তুলে নিয়ে উঁচুতে ধরে কিয়ৎক্ষণ তাতালো, তারপর আবার এল এগিয়ে। কাঠের মতো কঠিন ও নিশ্চল হয়ে এতক্ষণ একপাশে বসেছিলাম, চারু-মা হঠাৎ সেই কম্বলখানা খুলে আমার গায়ে জড়িয়ে দিল। বললে, ‘সব আগুনটুকু ওরা চেটে খাচ্ছে, তুমিও যে একটা মানুষ তা আর ওদের…কম্বলখানা একটুও গরম হয়নি, না বা’ঠাউর?’ বলেই সে আবার সেই কম্বলরাশির তলায় গিয়ে ঢুকলো।

কৃতজ্ঞতা জানাবার ভাষা হয়ত ছিল কিন্তু শক্তি ছিল না। শুধু কেবল শীত- কাতর মুখখানা ফিরিয়ে এই স্নেহময়ী বৃদ্ধার দিকে তাকালাম। এই মেরুদণ্ড ভাঙা চারুর-মা কঙ্কাল-দেহখানিকে নিয়ে বরাবর হেঁটে চলেচে, অথচ আশ্চর্য, মুখে তার নিরন্তর হাসি ও রসালাপ। এই বুড়ীকে সবাই করে তাচ্ছিল্য ও অনাদর করে, সামান্য কারণে ধমকায় ও শাসন করে, কথায় কথায় সরস মন্তব্য করে বলে অনেকের কাছেই সে পাগল, পয়সা-কড়ি খরচ করে হিসাব রাখেন বলে বামুন-মার কাছে সে লক্ষ্মীছড়ি, অথচ চটিতে চটিতে দেখি অনেকের উচ্ছিষ্ট বাসন সে মেজে দেয়, কারো ধরিয়ে দেয় উনুন, মাঝে-মাঝে দেয় মসলা পিষে, অপ্রার্থিত সেবায় সে সকলকে সুস্থ রাখবার চেষ্টা করে। এগুলি নিতান্তই সামান্য পরিশ্রম কিন্তু পথশ্রান্ত অনড় যাত্রীদের পক্ষে এগুলি মহৎ উপকার হয়ে দেখা দেয়।

ঘরখানির চারিদিক বন্ধ, পাথরের মজবুদ ঘর, কোথাও একটি ছিদ্র নেই, বাইরের বাতাসকে সবাই বাঘের মতো ভয় করে-সেই বায়ুলেশহীন ঘরের ভিতর আগুন জ্বালিয়ে সবাই বসে রইলাম। ধোঁয়ায় ও আগুনের আভায় ভিতরটা যখন একটু গরম হলো তখন ফুলো কারো কারো মুখে কথা। বেলা তখন অনেক, হয়ত বারোটা হবে। একরাত্রি কেদারনাথে বাস করে যাওয়া রীতি। অম্রা সিংয়ের সাহায্যে সেদিন পুরি ও আলুর তরকারির ব্যবস্থা করা গেল। আকাশের দুর্যোগ কমল না, সূর্য নাকি এদেশে নেই, মেঘ ও কুয়াশায় চিরদিন এদেশ অন্ধকারে আচ্ছন্ন থাকে; কখনো তুষারের বদলে পড়ে বৃষ্টি, কখনো-বা বৃষ্টির বদলে তুষার, সেই তুষার দেখতে-দেখতে জমাট বরফে পরিণত হয়। বর্ষাকালের শেষ পর্যন্ত কেদারনাথে মানুষের সমাগম থাকে, শরৎকাল পড়লেই সবাই নিচে নেমে যায়, পশু, পক্ষী ও মানুষের চিহ্ন পর্যন্ত দেখা যায় না। ঘরবাড়িগুলি বরফের তলায় কয়েক মাসের জন্য অদৃশ্য হয়ে থাকে। এই বাড়িগুলি ও পথঘাট নাকি বহু শতাব্দী পূর্বে নির্মিত, কিন্তু আজো যেমনি আনকোরা তেমনি পরিচ্ছন্ন, কোথাও বিনাশের চিহ্ন নেই, খুব সম্ভবত একই ঋতুর আবহাওয়ায় থেকে তাদের পরমায়ু এত দীর্ঘ হয়ে উঠেচে।

সমস্ত দিন আগুন জ্বালিয়ে কম্বল জড়িয়ে ঘরের ভিতর অকর্মণ্য হয়ে বসে রইলাম। কখন্ বিকাল গড়ালো সন্ধ্যার দিকে, কখন সন্ধ্যা রাত্রিতে পরিণত হলো, কিছুই বোঝা গেল না। চোখে ঘুম জড়িয়ে এল বটে কিন্তু ঠাণ্ডায় নিশ্চল হয়ে রইলাম, হাত-পা ছড়াবার শক্তি লুপ্ত হয়ে গেচে। শীতের অসহ্য ক্লেশ ও পীড়নের ভিতর দিয়ে সেই ভয়-ভীষণ রাত্রি অতিবাহিত করা গেল।

***

তার পর আর বলবো না। সেদিন প্রভাতে সেই আকাশের অবারিত দুর্যোগ, তুষারপাত, শিলাবৃষ্টি, মেঘান্ধকার তাদের ভিতর দিয়ে কেমন করে পালিয়েছিলাম, কেমন করে উত্রাই পথে রামওয়াড়া পার হয়ে সোজা গৌরীকুণ্ডে এসে পুনরায় থামলাম, তার কথা বলে আর কাজ নেই। আগেকার পথ ধরেই আমাদের প্রত্যাগমন। দুদিনের পথ পার হয়ে একদা মধ্যাহ্নে আমরা সেই নলাশ্রম চটিতে এসে উঠলাম। এখানেই আমরা কিছু-কিছু পোঁটলা-পুঁটলি ফেলে গিয়েছিলাম। এবারে আর শীত নেই, আকাশ নীলকান্তমণির মতো ঝলমল করে উঠেচে, সুন্দর আরামদায়ক রৌদ্র, আবার দেখা দিল অরণ্যের সুস্নিগ্ধ শ্যামলতা- বসন্তকালকে বরণ করে নিলাম। এবারের পথ আবার নতুন। দক্ষিণের পথ গুপ্তকাশীর, সম্মুখের পথ গভীর নিচের দিকে মন্দাকিনীর তটে নেমে গেচে। আবার সেই প্রচণ্ড মাছির উৎপাত শুরু হলো, সেই আপাদমস্তক পোকা, গায়ের চুলকানি, পায়ের হাঁটুতে সেই ব্যথা। নলাশ্রম চটিতে আহারাদি শেষ করে সেই পুরাতন ঝোলাঝুলি ঘাড়ে নিয়ে এই উত্রাই পথটি ধরে পুনরায় যাত্রা করলাম। শোনা গেল, মন্দাকিনী পার হয়ে এখান থেকে উখীমঠ মাত্র তিন মাইল। আজ আমাদের উখীমঠ পৌঁছতেই হবে। কেদারনাথ শেষ করা হয়েছে, এবার একটু নতুন উৎসাহ, এবার সোজা বদরীকাশ্রম, আর অন্য কথা নয়, এক লক্ষ্য!

কিন্তু হায় রে তিন মাইল! গড়গড়িয়ে যাত্রীর দল নামচে ত নামচেই, তিন মাইল আর শেষ হয় না। যাত্রীদের উৎসাহকে সজীব করে রাখার জন্য কোন্ মিথ্যাবাদী প্রচার করেছে যে, এই দীর্ঘ পথটা মাত্র তিন মাইল? পাকদণ্ডীর পথ ঘুরে-ঘুরে যখন মন্দাকিনীর পুলের কাছে নেমে এল তখন আমরা যথেষ্ট ক্লান্ত হয়ে উঠেচি। পুল পার হয়েই পথের চেহারা সম্পূর্ণ বদলে গেল। একেবারে খাড়াই পর্বত, বুক-বুক চড়াই, এবং সে-চড়াই যে কী ভীষণ তা অনুমান করাও কঠিন। এক হাতে লাঠি, অন্য হাতে পথের উপর রীতিমতো ভর দিয়ে চলচি। সে ত’ চলা নয়, হামাগুড়ি দেওয়া। এমন ভীষণ চড়াই গত দিন দুই আমরা অতিক্রম করিনি। নিঃশব্দে হামাগুড়ি দিচ্ছি, মাঝে মাঝে কোনো-কোনো আর্ত যাত্রী মুখে একরকম শব্দ করে উঠচে, ফাঁসির দড়িতে টান পড়বার মুহূর্তে অপরাধীর মুখের ভিতর থেকে কী রকম আওয়াজ বেরিয়ে আসে? চলতে চলতে দেখি, পথের ধারে সেই খিদিরপুরের নির্মল কাঁদতে বসেচে। একেই ত সে পরিশ্রমের ভয়ে রান্না করে খায় না, তার উপর এই চড়াই,—আহা বেচারা!- বেচারা? বেশ হয়েছে হতভাগীর, খুব হয়েছে। এসেছিলি কেন মরতে? মর্ তুই, মরে যা, চুলোয় যা!

আবার এক-পা এক-পা করে চলেচি। কমণ্ডলুর জল ফুরিয়ে গেচে, গলাটা কাঠ হয়ে এসেছে, চোখ দুটো জ্বালা করচে তা করুক, চল এগোই! গোপালদা কই? সেই জংলী ভালুকের মতো কুৎসিত লোকটা? লোকটার চেহারা যেন আধপোড় রোঁয়া-ওঠা একখানা কম্বল! পাপ, এরা সবাই পাপ! দুই দিকে আমার পাপের শোভাযাত্রা, কলুষ-কালিমার প্রদর্শনী, অসুন্দর ও অশ্লীলতার মেলা। এরা কেউ আনন্দ দেয় না, দুঃখ দেয়, এদের চেহারায় সমস্ত জীবনের পাপের ছাপ, দুষ্কৃতির দাগ, লিপ্সা লোভ ও বাসনার শ্মশান,-সংসার এদের ঘৃণা করে তাড়িয়ে দিয়েছে, তাই এরা সেই পাপের ভার নামিয়ে চলেচে তীর্থে তীর্থে। এদের উপরে দেবতার দয়া ও করুণা হবে? দয়া ও করুণা কি এতই সুলভ? সেদিন কোথায় ছিলে তোমরা দুর্ভাগ্য-যেদিন তোমাদের পরমায়ুতে ছিল বর্ণের ঔজ্জ্বল্য, মনের ঐশ্বর্য; যেদিন ছিল তোমাদের যৌবন? কী করেছিলে যৌবনে?

একটু দাঁড়াই, তৃষ্ণায় বুকের ছাতি ফেটে যেতে চায়, তা যাক—আবার শামুকের মতো এগোই। ওপারে দূর পর্বতের চূড়ায় গুপ্তকাশীর ক্ষুদ্র শহরটি দেখা যাচ্চে। কতদিন কতকাল আগে যেন ওই শহরটিকে পিছনে ফেলে এসেচি, অতীত জীবনের পৃষ্ঠায় ওটি যেন সামান্য একটুখানি স্মৃতির মতো জড়িয়ে রইলো। প্রতিদিন আমরা ভুলে যাই পূর্ব দিনটিকে, প্রতি প্রভাতে আমাদের হয় নবজন্ম। আমরা যেন চিরদিবসের তীর্থযাত্রী, চির-তীর্থপথিক, জন্ম-জন্মান্তর পার হয়ে চলেচি চির-সুন্দরের পদপ্রান্তে; যেন চলেচিলেন একদিন শ্রীমতী শতবর্ষ বিরহ পার হয়ে শ্রীকৃষ্ণের চরণে আত্মাঞ্জলি দিতে। প্রেমের তপস্যাই এই, বেদনার মধ্যে তার রূপ, অন্তরে তার দুঃখলোক। যে চিরদুর্লভ, যার জন্য এই দুর্গম পথ বা এই দুর্গম পথযাত্রা, এই পীড়ন, যার জন্য এই যন্ত্রণাজর্জর পথের প্রাণান্তকর তপস্যা, সেই রূপাতীত রূপকে আমার চাই, সে আমার আশার পরিতৃপ্তি, সকল পাওয়ার শেষ পাওয়া! আজকের এই যাত্রাপথের দিকে তাকিয়ে অকস্মাৎ জীবনের রহস্যময় গতিতত্ত্বটি যেন চক্ষের সম্মুখে উদ্‌ঘাটিত হয়ে গেল। নারীর গতি মিলনের পথে, পুরুষের গতি বিরহলোকে। নারী চলেছে পরম পুরুষের পায়ে আত্মদান করতে, পুরুষ চলেচে পরম জ্যোতির্ময়ীকে আবিষ্কার করতে। মিলনের আনন্দে নারী অতিক্রম করে নিজেকে, আবিষ্কারের আনন্দে পুরুষ অতিক্রম করে জীবনকে। নারী সৃজন করেচে প্রেমের সুকোমল মৰ্ত্যলোক, পুরুষ সৃষ্টি করেচে বিরহের সুদূর স্বর্গলোক! নারীর তপস্যা আনন্দময় বন্ধন, পুরুষের দুঃখময় মুক্তি।

থাক্ আপাতত স্ত্রী-পুরুষের গতিতত্ত্ব! বুকের রক্ত শুকিয়ে দুস্তর পথ পার হয়ে যখন উখীমঠের ধর্মশালায় এসে পৌঁছলাম, দিন তখন শেষ হতে আর দেরি নেই। খুব ছোট শহর নয়। কতকগুলি বিশৃঙ্খল নাগরিক সাজ-সরঞ্জাম এখানে- ওখানে ছড়ানো। যথা, একটি বাজার, থানা, ছাপাখানা, হাসপাতাল ও কম্বলীবাবার সদাব্রত। উখীমঠের সংস্কৃত নাম ঊষামঠ। পুরাকালে এখানে বাণাসুরের রাজধানী ছিল। তার কন্যা ঊষাকে নাকি শ্রীকৃষ্ণের নাতি অনিরুদ্ধ অপহরণ করেন। শ্রীকৃষ্ণের উপযুক্ত নাতি বটে! আমাদের ধর্মশালার গায়েই প্রকাণ্ড মন্দির। এই মন্দিরে কেদারনাথের পূজারী রাওল মহাশয়ের বাসস্থান, শীতকালে কেদারনাথের উদ্দেশে এখান থেকেই পূজা নিবেদন করা হয়। আজ পর্যন্ত আমরা সর্বসমেত আঠারো দিন পথ হাঁচি। আঠারো দিন পূর্বে আমাদের মৃত্যু ঘটেছে, আমরা সবাই প্রেতাত্মার দল, আপন-জন যদি আজ কেউ আমাদের দেখে, চিনতে না পেরে মুখ ফিরিয়ে চলে যাবে। আমরাও তাদের চিনবো না, চেনালে তারা ভয় পেয়ে পালাবে, পূর্বজন্মের পরিচয়কে প্রেতজন্মে টেনে কেনই বা আনবে? মন্দিরের মধ্যে কিয়ৎক্ষণ টহল দিয়ে ঘুরে বাইরে চত্বরে এসে বসলাম। পাশেই একটা দোকান, দোকানটা বেশ মান্যগণ্য, তারই নিচে একখানা কাঠের চৌকী আশ্রয় করা গেল। মন্দিরের পাশেই পুলিশের থানা, তারই জমাদার ও দারোগা বেরিয়ে এসে চৌকীর আর এক পাশে বসে গল্প জুড়ে দিল। বোঝা গেল, থানার ব্যয় আছে কিন্তু আয় নেই, মাইনে দিয়ে সবাইকে পুষে রাখা আর চলচে না। থানার দারিদ্র্য শুনে এখানকার জনসমাজের সম্বন্ধে ভালো ধারণাই হয়। চুরি, ডাকাতি এবং অন্যান্য সামাজিক অপরাধ কম, এমন দেশ এই গাড়োয়াল। দারোগাবাবুর হাতে একখানি পুরাতন ইংরেজি সংবাদপত্র দেখে চমকে উঠলাম। তবে কি আমরা সত্যিই মরজগতে জীবিত অবস্থায় আছি!

আশ্চর্য, আজ এই প্রথম এতকাল পরে কাগজের টুকরো দেখলাম; হিমালয়ে কোথাও কাগজ নেই। কাগজখানি যেন বাইরের পৃথিবীর প্রতিনিধি হয়ে চোখের সুমুখে এসে দাঁড়ালো। কাঙালের মতো হাত পেতে একবার সংবাদপত্রখানি চেয়ে নিলাম। কী যত্ন, কী আগ্রই! কাগজখানি লাহোরের ট্রিবিয়ুন। পাঞ্জাব,-বাংলা দেশ,-বিলাত,-আমেরিকা, সবাই যেন পরস্পর আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে রয়েচে। মহাত্মাজী কারাগারে বন্দী। পঞ্চম জর্জের স্বাস্থ্য ভাল আছে। একটি মেয়ে উড়েচে উড়োজাহাজে বিলেত থেকে অস্ট্রেলিয়া। মদিনীপুরে ম্যাজিস্ট্রেট হত্যার জের। মুসোলিনীর মুখে দেখা গেচে ঐতিহাসিক হাসি। রাউণ্ড টেবলের পরিশিষ্ট। চীনা সহরে জাপানী বোম। ডি ভ্যালেরা। সুভাষ বোসের পীড়া!- সংবাদগুলির দিকে তাকিয়ে আমার প্রিয় পৃথিবীর দেহস্পর্শটিকে নিবিড় আনন্দে অনুভব করতে পেলাম। চোখে আমার অশ্রু এলো।

কাগজখানি ফিরিয়ে দিয়ে নীরবে বসে রইলাম। শরীরটা ঝিম্ ঝিম্ করচে। আজ এই সামান্য পথটুকু আসতে অতিরিক্ত পীড়া অনুভব করেচি। যতই দিন যাচ্ছে ততই সহজে ক্লান্ত হয়ে উঠচি। কষ্ট সহ্য করবার শক্তিও কমে আসচে। শরীরে এসেচে অকাল বার্ধক্য ও জীর্ণতা। এমনি করেই এক জায়গায় এসে পৌঁছবে কৌতূহল ও আকাঙ্ক্ষা নিয়ে এবং ঠিক এমনি করেই যাবার সময় অবহেলায় ফেলে চলে যাবে—মনে এতটুকু দাগ থাকবে না। আমরা সকল জায়গায় দুষ্প্রাপ্য একটা কিছু খুঁজে বেড়াই, কোথাও তাকে লাভ করিনে,-এক চোখে আমাদের আশা, অন্য চোখে আশা-ভঙ্গের মনস্তাপ। এই খোঁজাখুজি এবং ব্যর্থতাই জীবনের আসল চেহারা। যে-পথটা আমাদের জীবন থেকে মৃত্যুর দিকে প্রসারিত সেই পথের দুধারে কত আনাগোনা, কত জানশোনা; কত আশা ও আশাভঙ্গ; কত আনন্দ ও বেদনা; কত সন্ন্যাস ও কত ভোগ। আমরা ওদের ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাই; কোথাও বাধা নেই, তারা আমাদের অগ্রগতির সহায়, পূজার উপকরণ মাত্র। জীবনের যে স্রোতটা চলে উৎপত্তি থেকে নিবৃত্তির দিকে, সেই স্রোতের দুই তীরে কত হাসিকান্না, কত সুখ-দুঃখ, কত মানুষের ছোট-বড় অসংখ্য বিচিত্র ইতিহাস? কোথাও ভালবেসেছি, কোথাও সৃষ্টি করেচি স্নেহ ও মমতার বন্ধন, কোথাও সয়েচি প্রতারণা ও পীড়ন, কোথাও দৈন্য ও অপমান। তবু জীবন কোথাও ব্যাহত হয় না, রুদ্ধ হয় না, পরিপূর্ণ আত্মবিকাশের প্রেরণায় আপন বেগে ছুটে চলে।

সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হলো, তার সঙ্গে নেমে এল অপরূপ জ্যোৎস্না। সম্ভবত আগামীকাল পূর্ণিমা। জানি এটা বৈশাখী পূর্ণিমা। সেই শুক্লা চতুর্দশীর দিকে তাকিয়ে চোখে এল ঘুম। কোথাও একটু চুপ করে বসলেই ঘাড় ভেঙে তন্দ্ৰা আসে। ঘুমোত পারলেই আমরা বাঁচি; প্রেরণা আমাদের নিস্তেজ, উৎসাহ আমাদের স্তিমিত। আমরা ক্লান্ত, বড়ই ক্লান্ত। সর্বনাশিনী পথমায়া আমাদের গলায় দড়ি বেঁধে টেনে নিয়ে চলেছে,-ধুলোয়, কাঁকরে, পাথরে কাঁটায় আমরা ক্ষতবিক্ষত, তবু না গেলে উপায় নেই, এই আমাদের নিয়তি। পিছনের পথ যেমন অতলে তলিয়ে গেচে, সম্মুখের পথ তেমনি অনন্ত রহস্যে অবলুপ্ত। নিজেদের উপরে আর আমাদের কোনো হাত নেই, নিয়তির কাছে আমরা আত্মসমর্পণ করেছি, আমাদের জীবন ও মরণ তারি কাছে বাঁধা। আমরা নিয়তির খেয়ালে খেলায় সাজানো পুতুল, তার ইচ্ছার ইঙ্গিতে নড়ে-চড়ে বেড়াই, হাসি আর কাঁদি, বাঁচি আর মরি। আমাদের সকল কাজকর্মের পিছনে সে আছে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে, তার অঙ্গুলি-নির্দেশ মেনে নিতে হবে, আমাদের স্বতন্ত্র সত্তা কিছু নেই।

ঘুমোতে পারলেই বাঁচি, তন্দ্ৰায় চোখ জড়িয়ে এসেচে। পথ হাঁটতে হাঁটতে আজকাল আমাদের চোখে তা নেমে আসে। কখনো কখনো বহুদূর পথ হেঁটে গিয়ে হঠাৎ চমক ভাঙে, তাই ত, চলতে চলতে সত্যিই যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, কিছু ত মনে নেই! হাঁটতে হাঁটতে নিজেদের নাক ডাকার শব্দে নিজেই বিস্মিত হয়ে পরস্পরের মুখের দিকে তাকাই। ঘুমের ঘোরে পাছে কোনোদিন পাহাড়ের গা থেকে পা পিছলে যায়, সেই আতঙ্কে সতর্ক হয়ে থাকি। না বাঁধানো লাঠি শক্ত হাতে ধরে ঠুকে ঠুকে চলি। পথের একদিকটা পাহাড়ের গা, অন্য দিকটা একেবারে আগা, সুতরাং পাহাড়ের গা ঘেঁষেই চলি। এই ক্ষণ ভঙ্গু জীবন সম্বন্ধে আমরা নিরন্তর সন্ত্রস্ত, কেবলই আমাদের সতর্কতা; অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর দিকে আমরা ক্ষণে ক্ষণে তাকাই, প্রতিদিন প্রভাত থেকে রাত্রি পর্যন্ত মৃত্যুর কবল থেকে আত্মরক্ষা করতে করতে সবাই আমরা ক্লান্ত হয়ে উঠি। অথচ জানি একদিন আর পালাতে পারবো না, ধরা একদিন দিতেই হবে। এত সাজসজ্জা, এত বিলাস, এত ভোগ ও তিতিক্ষা, এত দুঃখ ও প্রেম-সমস্ত আয়োজন মৃত্যুর দিকেই, সকল উপকরণ দিয়ে একদিন আত্মবলি দিতেই হবে মৃত্যুর পদতলেও অজ্ঞান মানুষের স্থায়িত্বের প্রতি তাই এত প্রলোভন। কেউ গড়ে তাজমহল, কেউ পিরামিড, কেউবা মহাপ্রাচীর। মৃত্যুর কোনো সান্ত্বনা নেই, সে অকরুণ তার ষোলো আনা প্রাপ্য এক সময় চুকিয়ে নেবেই। আশী লক্ষ জীবের সঙ্গে মানুষও তার চোখে সমান। মানুষ বলে কোনো বিশেষ সম্মান অথবা পক্ষপাতিত্ব তার কাছে নেই, তার ধ্বংসের সম্মার্জনী ঝেঁটিয়ে সবাইকে এক-একবার সাফ করে দিচ্চে। আজ যারা নবীন, যাদের চোখে নতুন আলো, নব উদ্যম ও অনুপ্রেরণা, কাল তারা পক্বকেশ ও প্রবীণ, সংসার থেকে তাদের প্রয়োজন নিঃশেষে ফুরিয়ে গেল, তারা আবার ছুটলো মৃত্যুর গর্ভে। দুরন্ত উল্লাসে বারে বারে তারা ছুটে আসে, দুর্দান্ত তাড়নায় বারে বারে তারা ছুটে পালায়। এর নাম জীবন।

আকাশ ও পৃথিবী প্লাবিত করে শুক্লা চতুর্দশীর চন্দ্রালোক ঝিম্ ঝিম্ করতে লাগলো, পর্বতের চূড়ায়-চূড়ায় উজ্জ্বল নক্ষত্রগুলি রইলো জেগে, বসন্তের বাতাস আপন উত্তরীয় উড়িয়ে ভ্রমণ করে ফিরতে লাগলো-মন্দির-চত্বরের একান্তে শুয়ে আমার চোখে এল ঘুম।

পরদিন ভোর রাত্রে আবার তল্পি-তপা কাঁধে নিয়ে সেই একটানা যাত্রা। যে-উখীমঠে পৌছবার জন্য এত আয়োজন ও আকর্ষণ আজ তার প্রতি যাত্রীদের নির্দয় অবহেলা। আমাদের জীবন থেকে তার প্রয়োজন একেবারে শেষ হয়ে গেচে, সে পিছন থেকে সকরুণ দৃষ্টিতে আমাদের পথের দিকে তাকিয়ে রইলো। আমাদের ডাক এসেচে প্রভাতের দিকে, ডাক দিল শুক্রতারকা, আহ্বান এল দূর- দূরান্তরের। রাত্রির আঁধার রইলো পিছনে, আলো পাঠিয়েছে তার নতুন সংবাদ, আমাদের যাত্রা শুরু হলো। ভোরের মুখচোরা বাতাস চলাচল করচে, পাখীর কলকাকলি জানাচ্চে আনন্দ-অভিনন্দন, পথের পাশে-পাশে বসন্ত-পুষ্পের সমারোহ, আকাশের দেবতা সুরঞ্জিত বরণডালায় উষাকে বন্দনা করছেন, তারই নিচে-নিচে তীর্থযাত্রীদের পথ। পথ কেবল চড়াই, কেবল উঠচে উপর দিকে, আমরা চলচি গুটিগুটি। কারো এগিয়ে যাবার উপায় নেই, ছন্দটি ঠিক বজায় রেখে চলতেই হবে; যে দু’পা পিছনে থাকবে তাকে বরাবর পিছনেই থাকতে হবে, যদি সে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করে তবে দম্ ফুরিয়ে এক সময় তাকে বসে পড়তেই হবে; কেউ যদি বাহাদুরী প্রকাশ করে, পথ তার কাছে কড়ায়-গণ্ডায় মূল্য আদায় করে নেবে। শক্তিমান এবং দ্রুতগামীর প্রতি বাবা বদরীনাথের বিশেষ পক্ষপাতিত্ব একটুও নেই, দুর্বল এবং বলবানকে তিনি সমশ্রেণীভুক্ত করে কাছে টেনে নেন্।

কাঁথা চটি এবং গোলিয়া বগড় পার হয়ে আরো এক মাইল চড়াই অতিক্রম করে আমরা সেদিন মধ্যাহ্ন-রৌদ্রে অর্ধমৃত অবস্থায় দোয়েড়া চটিতে এসে পৌঁছলাম। এই চটিগুলো যে কবে শেষ হবে জানিনে, এরা যেন পথের ধারে বসে থাকে যাত্রীদের ধরে গিলতে এবং ঠিক সময়ে উদ্‌গিরণ করে দিতে। অথচ, উপমাটা উলটে দাও, এই চটির মতো বন্ধু পথে আর কেউ নেই। যে-পথ অবারিত এবং বাধাহীন, যে-পথে মুক্তির অনাবৃত অবকাশ, সে-পথে চলা যায় না, পথিকের পায়ে সে-পথ ভয়ানক বাধা, তার নাম মরুভূমি,-তাই পরিশ্রান্ত পথচারীকে সাদরে আহ্বান করে নেয় এই ডালপালায় বাঁধা, লতাপাতায় ঘেরা চটি। দরিদ্রা দুঃখিনী মাতা যেন পথের ধারে দাঁড়িয়ে পথক্লান্ত সন্তানের আশায় চেয়ে থাকেন—এক হাতে তাঁর ঝরনার সুশীতল জল, অন্য হাতে যৎসামান্য বিদুরের খুদ্।

ভোজন ও নিদ্রার পরে বেলা তিনটে নাগাত আবার পথে নেমে এলাম। রৌদ্র তখনো প্রচণ্ড, মেঘের চিহ্ন কোথাও নেই, দিন তিনেক আগে যে আমরা বরফের গর্ভে ঠাণ্ডায় সমাধিস্থ হতে চলেচিলাম আজ ঘর্মাক্ত কলেবরে যেতে- যেতে সে-কথা ভুলেই গেচি। এবেলার পথটিতে শীতকাল, ওবেলার পথে নেমেছে চারিদিক আবৃত করে বর্ষাঋতু। গ্রীষ্মের পরেই হয়ত এক সময় দেখা দিল সুন্দর বসন্তকাল। দুপুরবেলায় শীতে হয়ত সর্বশরীর ঠক্‌ঠক্ করে কাঁপচে, রাত্রে হয়ত বা গ্রীষ্মাধিক্যে অনাবৃত দেহে চটির দরজার কাছে ঘুমিয়ে রইলাম। একটি দিনের মধ্যেই কখনো পাই শরৎকালের নীলোজ্জ্বল আকাশ, মল্লিকা ও শেফালির সমারোহ; কখনো পাই শ্রাবণের মতো সকরুণ জলধারা, কদম্ব- চম্পকের শোভা; কখনো পাই ঋতুরাজের বসন্ত বিলাস,-পূর্ণিমার মধুযামিনী; কখনো বা পাই শীতের শীর্ণতা;-প্রকৃতির রুক্ষ বৈধব্য বেশ। প্রতিদিন আমাদের চোখে বৈচিত্র্যময় ঋতু-উৎসব। উৎপীড়িত আমরা জীবন-বৈরাগ্যের দল অর্ধ নিমীলিত দৃষ্টিতে তাদের দেখে দেখে উদাসীন হয়ে চলে যাই। আমরা আর কিছুতেই যেন মোহগ্রস্ত হইনে।

আগের দিন মন্দাকিনী পার হয়ে উখীমঠের পথে সেই যে চড়াই শুরু হয়েছিল, সেই-চড়াই আজ এখনো চল্‌চে, এর আর শেষ নেই, বিরাম নেই। আমাদের নিঃশক্তি করা ও রক্তশোষণ করাই এ পথের উদ্দেশ্য। আজ সকালে রুইদাস সুক্কুর ও পণ্ডিতজীকে সুকর্মণ্য হয়ে পিছনের চটিতে পড়ে থাকতে দেখে এসেচি। সেই বৃদ্ধা ও স্থূলকায়া মারহাট্টি স্ত্রীলোকটিকে পথে বসে আর্তনাদ করতে দেখেচি। মনসাতলার মাসি চড়া দামে একটা কাণ্ডি ভাড়া করে কুলির পিঠে উঠেচে। মাছির কামড়ের ঘায়ে ও পোকার তাড়নায় একেই ত সবাই যন্ত্রণাজর্জর, তারপরে এই চড়াই, জীবনের আশা আর কেউ তারা করে না। নির্মলা চলতে চলতে একবার করে দাঁড়ায়, বোধহয় কতবার চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না, জিহ্বার সঙ্গে টাগরা স্পর্শ করতে না পেরে কেমন একরকম ভঙ্গীতে মুখের শব্দ করে, অনেকটা মৃত্যুপথযাত্রীর খাবি খাওয়ার মতো; চলতে চলতে কেউ হয়ত যন্ত্রচালিতের মতো তার মুখে একটু জল দিয়ে যায়, সে তখন ঢোক গিলতে চেষ্টা করে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিরুপায় হয়ে তাকায়। মুখে কথা এদের কারো নেই, দাঁতের সঙ্গে জিহ্বা ও তালু জুড়ে এঁটে গেচে, বাক্যব্যয়ের শক্তি নেই; তাদের একটিমাত্র কথা-পথ আর কতদূর? পথ আর কত দূর তা কেমন করে জানবো? একই অজানা পথের যাত্রী আমরা সবাই, কী করে বলবো সেই চির-ঈপ্সিত দুর্লভের মন্দির আর কতদূরে! ইচ্ছা হয় বলি, তোমরা আর এগিয়ো না, এইখানে থেমে যাও, এইটুকুই তোমাদের সীমা ও শেষ; কিন্তু কেমন করে বলি? থামবার জায়গা ত এ নয়, এ সমস্তই যে অতিক্রম করে যেতে হবে, না গেলেই চলবে না, পিছনে হিমালয়ের অনন্ত পর্বতমালার গর্ভে আমরা হারিয়ে গেচি, থামলেই যে চিরদিনের মতো থামতে হবে, অগ্রগতি ছাড়া আর আমাদের গতি নেই। এপথে ক্ষমাও যেমন নেই, সুবিধারও তেমনি অভাব। পদব্ৰজে যে চলেচে তার অবস্থা যতই সচ্ছল হোক, বিশেষ সুযোগ পাবার কোনো উপায়ই তার নেই। এইটি সকলের চেয়ে বড় পরীক্ষা। ছোট বড়র প্রশ্ন এখানে ওঠবার এতটুকু অবকাশ নেই, দরিদ্র ও ধনীর বিভিন্ন হয়ে চলবার কোনো পথ নেই, অহমিকা আত্মম্ভরিতা, বিদ্বেষ চিত্তমালিন্য, স্বার্থ ও সংকীর্ণতা—এগুলিকে প্রকাশ করবার কোনো সুবিধাই নেই। জাতিবর্ণনির্বিশেষে আমরা সবাই সমান। আহার- বিহার, বিশ্রাম শয়ন ও পরিশ্রম-সকলেরই এক ধরনের। একজন যে কোথাও আর একজনের চেয়ে ভালো খেয়েচে, ভাল থেকেচে, এ-কথা বলবার উপায় নেই, যদি কেউ বলে তবে সে মিথ্যাবাদী।

পৌথীবাসা ও বানিয়া কুণ্ড ছেড়ে সন্ধ্যার প্রাক্কালে আমরা চোপতা এসে পৌঁছলাম। সম্মুখে একটি বড় ধর্মশালা, তারই প্রায় কোল ঘেঁষে খানিকটা খোলা জায়গা এতক্ষণে দেখতে পেয়ে আমরা যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। সমতল স্থানের কাঙাল হয়ে উঠেচি, যেদিকেই তাকাতে যাই পাহাড়ে পাহাড়ে দৃষ্টি প্রতিহত হয়ে ফিরে আসে, কোথাও আমাদের মুক্তি নেই, কেবলই মনে হয়েছে কোথাও ছুটে পালাই, কোনো উন্মুক্ত সমতল প্রান্তরে, কোনো দূর সমুদ্রের তীরে I কোথায় আঁকাবাঁকা বনপথ, গ্রাম থেকে বেরিয়ে যে-পথ গেচে ধানক্ষেতে, সেখান থেকে নদীর কিনারায়, গ্রাম-বধূর দল যে-পথ দিয়ে কলস নিয়ে ফেরে, বাউল যে-পথে গান গেচে যায়—’মনের মানুষ মনের মাঝে কর অন্বেষণ।’ সে-পথ কোথায়? আমরা এ হিমালয় আর চাইনে, পাথরের পর পাথরের পুঁজি আর চাইনে, আর চাইনে পার্বতীয় নীল নদী, উন্মাদিনী অন্ধ ঝরনা।

মানুষের জীবন যেখানে সঙ্গীহীন একাকী, যেখানে সে নিজের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছে, যেখানে সে সম্পূর্ণ স্বাধীন হয়ে নিজের কর্তৃত্ব নিজে করে, সেখানে সে অতিরিক্ত অসহায়। সকলের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজের দিন নিজেই ঠেলে চলা, সে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা নয়, তার নাম উচ্ছল আত্মপরতা। যারা দোকানে বসে খায়, ধর্মশালায় গিয়ে ঘুমোয়, প্রমোদাগারে গিয়ে লীলা- বিলাস করে, যথেচ্ছ ভ্রমণে বেরোয়, রুগ্ন অবস্থায় হাসপাতালে গিয়ে ভর্তি হয়, তারা স্বাধীন হতে পারে, কিন্তু তারা দুর্ভাগা। প্রত্যেক মানুষের সঙ্গেই পৃথিবীর একটা দেনা-পাওনা আছে। দু’টি বন্ধন আমাদের স্বীকার করে নিতেই হবে, স্নেহের ও সেবার। সকল মহাপুরুষের জীবনেতিহাসে দেখতে পাই এই স্নেহ ও সেবার খেলা। মানুষকে ভালোবাসতে হবে এবং ভালোবাসা পেতে হবে, সেবা করতে হবে এবং সেবা নিতে হবে। মানুষের সেবাকে যে অস্বীকার করলো, যে মানলো না স্নেহের বন্ধন, সে হতভাগা বিষাক্ত করে গেল মানব-সমাজকে। তাকে আমরা বোহেমিয়ান্ বলবো, কিন্তু মানুষ বলবো না। আজ যদি সবাই ব্যক্তিগত স্বাধীনতা পেয়ে ক্ষেপে ওঠে, যদি সমাজের কোনো একটা আকারকে প্রত্যেকে না মেনে নেয়, তবে সমগ্র জগৎ মরুভূমিতে পরিণত হবে; পৃথিবীতে স্নেহ ও সেবা নেই, প্রেম ও মোহ নেই, ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সংসর্গ নেই—তবে তার কেমন চেহারা দাঁড়ায়? যে-সভ্যতা আজ দিকে দিকে প্রসারিত, তার মর্মমূলেই যে এই স্নেহ ও সেবার রসসিঞ্চিত হয়েছে, এদের ছেড়ে মানব-সমাজ চলবে কোন্ দিকে? এই যে তীর্থযাত্রীর দল চলেচে, এদের চেয়ে স্বাধীন আর কে? এরা স্নেহ করে শুধু নিজেকে, সেবা করে শুধু নিজের। এদের পিছনেও যেমন আজ বন্ধন নেই, সম্মুখেও নেই তেমনি বাধা। এরা সবাই নিজের পুঁটলি সামলায়, নিজেরাই কাঠকুটো সংগ্রহ করে আনে, নিজের বিপদ ও কুশল নিয়েই ব্যস্ত, আপন-আপন স্বাতন্ত্র্যই তাদের মূলমন্ত্র। সুখের বিষয় এইটিই এদের আসল চেহারা নয়। এদের দিকে তাকিয়ে ভয় পাই, এরা মানবজীবনের স্নেহহীন কঙ্কালের দল, এদের তীর্থ যেদিন ফুরিয়ে যাবে সেদিন এরা ছুটবে মমতা ও দাক্ষিণ্যের স্নিগ্ধ ছায়ায়, এরা সেদিন পালাবে গৃহ ও সমাজের পথে-এদের আমি জানি। এদের জীবনের সকল ক্ষুধা নিবৃত্তি হয়নি; ক্ষুধার পথরোধ করে, অস্বাভাবিক সংযমের রূপ পরিগ্রহ করে, মোহ ও ভালোবাসার কারবার স্থগিত রেখে এরা এসেচে এই মহাতীর্থের পথে আত্মশুদ্ধির আকাঙ্ক্ষায়। মন্দিরের কোণে কোণে যদি জঞ্জালের স্তূপ জমা থাকে তবে সেখানে দেবতার আসন পাতা চলে না। যারা তীর্থের পর তীর্থ পর্যটন করে বেড়ায়, তাদের মধ্যে কেবল আছে আত্ম-তাড়না, তারা দেবতার পিছনে পিছনে ছোটে, দেবত্বের স্পৰ্শ পায় না।

ধর্মশালার রক্ষী একজন পাঞ্জাবী ব্রাহ্মণ। শীতের হাওয়ায় আমাদের জর্জরিত ও আড়ষ্ট দেখে তিনি কয়েকখানা কম্বল কোথা থেকে আনিয়ে দিলেন। বিনয়ী ও সদালাপী পা-জামা-পরা মানুষটি। যাত্রীদের কাছে সামান্য দু’চারটি পয়সা যা পান্ তাইতেই তার চলে। দুধ ও তামাক খেয়ে গোপালদা একটু সুস্থ হয়ে বসলে তিনি কিয়ৎক্ষণ ধর্মালোচনা ও কিছু প্রণামী নিয়ে চলে গেলেন। সমস্ত দিন গ্রীষ্মের পর অকস্মাৎ সন্ধ্যায় এই হিমাচ্ছন্ন বাতাস পেয়ে সবাই কতকটা সজীব ও উৎসাহিত হয়ে উঠলাম। গোপালদা প্রতি পনেরো মিনিটে একবার করে ছিলিম্ ধরাতে লাগলেন। বন্ধ ধর্মশালার বাইরে বৈশাখী পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায় চারিদিক প্লাবিত হতে লাগলো,-তুহিন-শীতল নিভৃত রাত্রি।

পরদিন ভোরে শীতে কাঁপতে কাঁপতে আমরা ভুলোকনা চটির ধারে এলাম। আকাশে মেঘ করেচে, মাঝে মাঝে এক-এক ফোঁটা বৃষ্টির জল আমাদের এ ছুঁয়ে ছুঁয়ে চলে যাচ্চে। কখনো-কখনো বিদীর্ণ মেঘের ফাঁকে-ফাঁকে রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশ হেসে উঠচে। পথে আজ হয়ত ঘোরালো হয়ে বৃষ্টি নামবে। ভুলোকনা পার হয়ে কিছুদূর অগ্রসর হয়েই পাওয়া গেল বাঁ-হাতি তুঙ্গনাথের পথ। দক্ষিণের পথ সোজা উঠে গেচে লালসাঙ্গা অথবা চামেলির দিকে। পথের ধারে জনকয়েক কান্ডিওয়ালাকে দেখা গেল। তুঙ্গনাথের পথ ভয়ানক চড়াই, অনেকটা ত্রিযুগীনারায়ণের মতো, যদি কেহ উঠে গিয়ে দর্শন করে আসতে চায় তবে সে এখানে খুচরো কাণ্ডি ভাড়া করতে পারে। অনেকেই গেল, কেউ গেল পদব্রজে, কেউবা কাণ্ডিতে। হিমালয়ে সবসুদ্ধ চার ধাম। বদরীনাথ, কেদারনাথ, ত্রিযুগীনাথ ও তুঙ্গনাথ। তুঙ্গনাথ থেকে চব্বিশ মাইল উত্তরে মান্ধাতার ক্ষেত্র আছে। যাত্রীরা এখানে আকাশগঙ্গায় স্নান করেন, পুরাতন মন্দিরটিতে একটিমাত্র পূজারী, অতিরিক্ত নীরব ও জনবিরল পর্বতচূড়া, আশপাশে কোথাও গ্রাম ও চটির চিহ্নমাত্র নেই, সামান্য একখানি মাত্র দোকান এক পাশে টিম্ টিম্ করচে। তুঙ্গনাথের উপরে দাঁড়ালে দূর উত্তরে ধবল তুষারময় হিমালয়ের নয়নাভিরাম রূপ দৃষ্টিগোচর হয়। এমন অপরূপ রূপের বৈচিত্র্য তুঙ্গনাথ ছাড়া আর কোনো জায়গা থেকেই এমন করে দেখা যায় না। যেন মহাযোগী কেদার ও বদরীনাথের শ্বেতপুষ্পশয্যা, পদতলে এই একাত্ম হরিহরের সেবায় বসে রয়েচেন শ্যামল শোভাময়ী মহাসতী।

দক্ষিণের পথ তুঙ্গনাথের কটিদেশ বেষ্টন করে পূর্বদিক থেকে ঘুরে পশ্চিমদিকে চলে গেচে, তুঙ্গনাথ দর্শন করে এই পথে নেমে আসতে হয়। পথ এখানে অরণ্যময় ও নিস্তব্ধ, সামান্য চড়াই ও সামান্য উত্রাই, সমুদ্র-তরঙ্গের মতো আমরা কখনো উঠছি, কখনো বা নামচি, অনেকটা সমতল বলা যেতে পারে। পথটি ধরে যতই এগোই, অরণ্য ততই নিবিড় ও অন্ধকার হয়ে আসে। এখন এখানে বসন্তকাল, শুকনো ঝরা পাতায় পথ আচ্ছন্ন। একা একাই বনপথ দিয়ে চলেচি, উত্রাইটুকু পেয়ে হাঁপ ছেড়েচি বটে, কিন্তু পায়ের সেই ব্যথাটা আবার খচ্ খচ্ করে উঠেচে। শরীরের কোথাও এক স্থানে ব্যথাটি যেন থাবা পেতে লুকিয়ে বসে থাকে, সুযোগ পেলেই আত্মপ্রকাশ করে। পত্রপল্লবের ভিতর দিয়ে সর-সর শব্দে বসন্ত-বাতাস থেকে-থেকে বয়ে চলেছে। এবারে বামে ও দক্ষিণে আবার বহুদূর পর্যন্ত দৃষ্টি ছুটে গেল। আকাশের দিলয় যখন সুবিস্তৃত হয়ে ওঠে তখনই বুঝতে হবে আমরা অনেক উঁচুতে উঠেচি। সকল দিকের দৃষ্টির বাধা যেন খুলে গেচে। জীবনেও এমনি। যখন সংকীর্ণ চেতনার মধ্যে আমরা বাস করি তখন আমাদের মনের আকাশ অল্পপরিসর, স্বল্প-আয়তন; মানুষ যখন উদারতা ও মহত্ত্বের শীর্ষে উঠে দাঁড়ায় তখন দেখতে পাই তার হৃদয় ও দৃষ্টির প্রসারতা, পরিব্যাপ্তি। যারা নিতান্ত আপন ঘর নিয়ে ব্যস্ত তারা সমাজবদ্ধ জীব, তাদের ছাড়িয়ে আর একটু উঁচু স্তরে যারা ওঠেন তাদের বলি দেশমান্য, তারা রাষ্ট্রপতি। সমাজ ও রাষ্ট্রের নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করে যারা আরো ঊর্ধ্বলোকে উঠেচেন আমরা তাদের বলি বিশ্বের কল্যাণকামী, মহামানব, মহাত্মা। কাব্য ও সাহিত্যেও এই সুবিস্তৃত কল্পনা, অনন্ত সৌন্দর্যলোক। কথাকে অতিক্রম করে সুর, ছন্দকে অতিক্রম করে ব্যঞ্জনা। যখন গল্প লিখি তখন কতকগুলি চরিত্র সুমুখে এসে নড়ে-চড়ে বেড়ায়, তাদের স্বাধীন ইচ্ছা, সহজ গতি, তারা নিজেরাই ঘটনার সৃষ্টি করে, নিজেদের চরিত্রের ইঙ্গিত করে। কিন্তু শুধুই ত’ চরিত্র নয়, কেবলই ত’ ঘটনা নয়—তাদের সাহিত্যে টেনে আনার প্রকৃত প্রয়োজন কী? বাস্তব জীবনেও ত আমরা কত বিচিত্র চরিত্র ও ঘটনার সংস্পর্শে আসি, কিন্তু প্রত্যেকের স্থান ত সাহিত্যে নেই! যিনি বড় আর্টিস্ট তার আছে এই নির্বাচন-শক্তি, চরিত্র ও ঘটনাকে পর্যবেক্ষণ করার বিশিষ্ট ভঙ্গী। যিনি চরিত্র সৃষ্টি করেন তিনি দ্রষ্টা, যিনি রসসৃষ্টি করেন তিনি স্রষ্টা। শিল্পী হচ্চেন একাধারে দ্রষ্টা ও স্রষ্টা। তার স্পর্শে সামান্য বস্তু হয়ে ওঠে অসামান্য, তিনি নিয়ে যান লোক থেকে লোকান্তরে, সংকীর্ণতা থেকে পরিব্যাপ্তিতে, জীবন থেকে মহাজীবনে।

পাঙ্গরবাস চটিতে এসে উঠলাম। সূর্যের উত্তাপ এবেলায় অল্প, আকাশ আজ সকাল থেকেই মেঘ-মলিন। উপরে ও নিচে অরণ্যময় পর্বত, সেই অরণ্যের গভীর গহ্বর থেকে ছোট-ছোট এক-একটি ঝরনা এখানে-ওখানে নেমে এসেচে। কাছাকাছি কোথাও ঝরনা থাকলেই আমরা টের পাই,-এবেলায় গিরগিটির ডাক অত্যন্ত প্রখর হয়ে উঠেচে। শীত তেমন আর নেই, প্রভাতের শীত মধ্যাহ্নে বসন্তে রূপান্তরিত হয়েছে। এতক্ষণ লক্ষ্য করিনি, এবারে দেখলাম সর্বাঙ্গে মাছির দল বিড়বিড় করচে, মৌচাকের গায়ে যেমন লেগে থাকে মধুমক্ষিকা ফুঁ দিলে মাছি নড়তে চায় না, হাত দিয়ে সরিয়ে দিতে হয়। মাঝে মাঝে কোনো কোনো চটিতে লক্ষ লক্ষ মাছির এমন একটা গভীর গুঞ্জন ওঠে যে কান পেতে শুনতে ভালই লাগে। একটি মধুর একঘেয়ে উদাসীন সুর। রাত্রির অন্ধকারে অর্ধজাগ্রত তন্দ্রায় কানের কাছে যারা মশার গান শুনেচে, তারা জানে কেমন একটি সকরুণ অবসাদে মন উদাসীন হয়ে ওঠে।

ভোজন ও শয়নের পর আবার ঝোলাঝুলি কাঁধে নিয়ে পথে নামা। জুতোটা একটু ছিঁড়ে গেচে, রাঁধতে-রাঁধতে হাত দুখানায় আঁচ লেগে কালো হয়ে উঠেছে, হাতে আর লোম নেই, বাসন মেজে-মেজে আঙুলগুলো বিবর্ণ ও কদাকার, আহারে কৃচ্ছ্রসাধনা করে শরীর হয়ে এসেচে রক্তহীন;-যখন বসি তখন আর উঠতে পারিনে, যখন হাঁটি তখন আর বসতে পারিনে। পথে নেমে যন্ত্রের মতো চলি, পথ পেলেই ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় পা দুখানা আপনি চলতে থাকে। নিজেদের দিকে তাকিয়ে আমরা অশ্রু ভারাতুর নিশ্বাস ফেলি, ঘুমের ঘোরে মুখের ভিতর থেকে একরকম আর্তস্বর বেরুতে থাকে, তার শব্দে নিজেরাই চমকে উঠি, তখন বুঝতে পারি মানুষের নিপীড়িত আত্মা কী কষ্টে মানুষের মধ্যে কেঁদে বেড়ায়।

উপর থেকে নিচে অরণ্যের ভিতরে নেমে চলেচি। এখনো সন্ধ্যার অনেক বিলম্ব তবু ধীরে-ধীরে অন্ধকার হয়ে আসছে। শোনা গেল, এ অঞ্চলে হিংস জানোয়ারের উৎপাত মাঝে মাঝে প্রবল হয়ে ওঠে, সাপ এখানে পায়ের শব্দে পালায় না, মানুষ দেখলে ঘাড় উঁচু করে তাকায়, গাছ-পালায় তারা ভ্রমণ করে, পথের ধারে-ধারে হাঁটে। কবে নাকি এ-অঞ্চলে দাবানল জ্বলে উঠেছিল, তারই পোড়া দাগ গাছে গাছে এখনো লেগে রয়েচে। সন্ত্রস্ত ভয়ে আমরা সদলবলে চলেচি। কেউ যদি এগিয়ে যায় তবে দু’পাশে জঙ্গলের চেহারা দেখে শঙ্কিত হয়ে থমকে দাঁড়ায়, অকারণ গোলমালে পথটা সরগরম করে তোলে। পিছিয়ে পড়তে কেউ চায় না। কোথাও-কোথাও পথ পিছল, শ্যাওলা-পড়া, কোথাও কোথাও পথের উপর দিয়েই কোনো কোনো ঝরনার আবিল স্রোত বয়ে চলেচে। আকাশ দেখতে-দেখতে ঘন-ঘটাচ্ছন্ন হয়ে এল, মেঘ ডেকে উঠলো, বিদ্যুৎ খেলতে লাগলো,-বজ্রপাতের শব্দে এদিকে পাথরে ফাটল ধরে, পাথরখণ্ড স্থানচ্যুত হয়ে গড়িয়ে নেমে আসে, সে এক ভয়াবহ বিভীষিকা। দেখতে-দেখতে অন্ধকার ঘন হয়ে এল, সপ-সপ করে বৃষ্টি নামলো। তখন আর উপায় নেই, বর্ষণ শেষ হবার অপেক্ষায় কোথাও দাঁড়ানো যায় না, এ গভীর অরণ্যে একটি মুহূর্তও কোথাও আশ্রয় নেওয়া চলে না। বৃষ্টিতে ভিজি ক্ষতি নেই, কিন্তু এই অরণ্যের কবল থেকে পালাতে পারলে আজকের মতো বেঁচে যাই। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে এক-একবার বৃক্ষলতার ফাঁক দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে চলেচি, গা ছম্‌ছম্ করচে, শরীর ক্ষণে-ক্ষণে রোমাঞ্চিত হয়ে উঠছে। আঁকাবাঁকা পথ, একজন মোড় ঘুরলেই অন্য জনকে আর দেখা যায় না, সবাই কাছাকাছি আছি বটে কিন্তু প্রত্যেকেই হারিয়ে গেচি। এতক্ষণ কথাবার্তা বলছিলাম কিন্তু পথের ঠিক পাশেই কি-একটা জানোয়ারের একখানা শুকনো কঙ্কাল দেখে অবধি আর আমাদের মুখে কথা নেই। কখনো-কখনো অন্ধকারে পাখীর ডানার ঝটাপট শব্দ শুনতে পাচ্চি, এবার হয়ত সত্যিই সন্ধ্যা হয়েচে। বায়ু ও বৃষ্টির বেগে আমার সেই অন্ধকারে প্রায় দিশাহারা হয়ে গেলাম।

চারুর-মা কুঁজো হয়ে চলতে-চলতে হঠাৎ সোজা হয়ে দাঁড়ালো, বামুনবুড়ী কুলীর পিঠে কাণ্ডিতে চলচে, তার দিকে তাকিয়ে চারুর-মা ভয়ার্ত কণ্ঠে বললে, ‘তুমি পাচ্চ না মা?’

বামুন-বুড়ী চুপি-চুপি বললে, ‘কি লা?’

চারুর-মা চলতে-চলতে এদিক-ওদিক তাকিয়ে বললে, ‘কেমন যেন বোটকা গন্ধ! এই কাছেই কোথাও আছে মা।’

‘দুগ্‌গা দুগ্‌গা-ও তুলসীরাম, চল্ বাবা এগিয়ে।’ বলেই বামুন-বুড়ী হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো, ‘পঞ্চাননের কিছু করে আসতে পারলুম না…মধুসূদন, নারায়ণ!’

তুলসীরাম তাকে নিয়ে এগিয়ে যেতেই সেই কঙ্কাল-শরীর জরাজীর্ণ চারুর- মা আমার কাছাকাছি এসে একগাল হেসে বললে, ‘দিলাম বামুনমাকে ভয় খাইয়ে বা’ঠাউর…মরবার নামে এত ভয়!’—বলতে বলতেই সেই অশীতিপর মৃত্যু, ভয়হীনা বৃদ্ধা গল্ গল্ করে হাসতে লাগলো। ‘-আমি যদি মরি তবে চারু রইলো, ও আমি চুকিয়েই এসেচি…সরস্বতী, ভাদু, হাবলি, আর বাকি ক’টা গরু- বাছুর…তিরিশ সের দুধ রোজ হবেই, চারুর একটা পেট, সেই এগারো বছর বয়স থেকে বিধবা…চলবে না বা’ঠাকুর?’

‘চলবে বৈকি।’

কত গল্পই চারুর-মা সেই দুর্যোগময় পথে যেতে-যেতে করে গেল। তার দুধের ব্যবসার ইতিহাস, তার ভাইপোর কাহিনী, তার সেতুবন্ধ রামেশ্বর ও নেপাল-পশুপতিনাথের রোমাঞ্চকর অ্যাডভেঞ্চার। কিছুই কানে ঢুকছিল না, মাঝে মাঝে শুধু ‘হু’ দিয়ে তাকে উৎসাহ দিচ্ছিলাম। চারুর-মা কোনো বিপদ বা দুঃখকে এতটুকু ভয় করে না।

যাক্, বৃষ্টি ধরে গেল এবং তার সঙ্গে সঙ্গে অনন্ত সমুদ্রে পথহারা নাবিক যেমন অকস্মাৎ একটি ক্ষুদ্র দ্বীপ আবিষ্কার করে বসে, তেমনি দূর অন্ধকারে আলোকবর্তিকা দেখে আমরা উল্লসিত হলাম। আজকের মতো মৃত্যুকে আমরা তবে এড়াতে পেরেচি! অরণ্যের পথ তখন শেষ হয়েচে। আঃ-বাঁচলাম!

অন্ধকারে খুঁজে-খুঁজে চটি পাওয়া গেল। নিকটে বালখিল্য নদীর শীর্ণধারা দৃষ্টিগোচর হ’লো না, শুধু নদীর রেখাটি দেখা গেল। একটি ক্ষুদ্র মন্দির আছে কিন্তু তা দর্শন করার আর শক্তি নেই। ধর্মশালায় জায়গার অনটন হলো, আমরা ডালপালায় বাঁধা চটিতেই আশ্রয় নিলাম। এর নাম মণ্ডল চটি, অনেকে জঙ্গল চটি বলেও একে অভিহিত করে। আজকের মতো এখানেই যাত্রা শেষ। গোপালদা মহাসমারোহে গঞ্জিকার ছিলিম্ প্রস্তুত করলেন।

খানিক রাতে, আমরা তখন শয়নের আয়োজন করচি,-এমন সময় দু’টি হিন্দুস্থানী স্ত্রীলোক ও একটি পুরুষ কাঁদতে কাঁদতে এসে চটির ধারে দাঁড়ালো। কী কান্না, কী আকুলি-বিকুলি! বললে, ‘মহারাজজী, তুমারা গোড় লাগি, এক লণ্ঠন হাকো দেও, এক আমি হামারা জঙ্গলমে রহে গৈ, দেও বাবা, দেও।’

এই ঘনঘটাচ্ছন্ন রাত্রে কোথায় কোন্ জঙ্গলে তাদের লোক পড়ে রইলো? সে কি এখনো বেঁচে আছে? জানা গেল, সে স্ত্রীলোক। সঙ্গে আসতে আসতে পিছনে পড়েছে, এতক্ষণ অপেক্ষা করেও সে এসে পৌঁছলো না। আলো হাতে নিয়ে তাকে সেই দুর্গম ও প্রাণঘাতী পথে খুঁজতে যেতে হবে, কিন্তু হারিকেন্ লণ্ঠন তাদের কাছে নেই। নির্মলা আর থাকতে পারলো না, দিল তার লণ্ঠনটা তাদের হাতে তুলে, তারা উন্মাদের মতো সেই রাত্রে আবার সেই পথ ধরে চললো,-কথা রইলো, লালসাঙ্গায় তারা লণ্ঠনটা গিয়ে ফেরৎ দেবে।

তারা গেল কিন্তু সঙ্গে নিয়ে গেল আমার এই নিভৃত রাত্রির নিদ্রা। আমারো ব্যাকুল মন ও সজাগ দৃষ্টি তাদের সঙ্গে-সঙ্গে সেই নিরুদ্দিষ্টার সন্ধান করে ফিরতে লাগলো। হয়ত, কে জানে, তাদের মানুষ তারা এক সময় খুঁজে পাবে, কিন্তু আমি পাবো না খুঁজে, আমার লক্ষ্যহারা কল্পনায় সে-মানুষ চিরনিরুদ্দেশ, চিরপথহারা; সে আর কোনোদিন ফিরবে না।

সবাই ঘুমুলো, কিন্তু আমায় দিল বিধাতা কঠিন শাস্তি। গায়ে কম্বল ফুটচে, সর্বশরীরে যন্ত্রণা, বিশ্রী অস্বস্তি, সমস্ত রাত নদীর দিকে নিঃশব্দে দৃষ্টি প্রসারিত করে জেগে রইলাম, ঘুম আর এল না।

.

গতদিনকার কথা ভুলে গেচি। যত দিন যায়, স্মৃতি শিথিল হয়ে আসে। গত রাত্রের দুর্যোগ?—সে ত’ স্বপ্ন, সে ত’ মায়া! আজকের এই সকালবেলাটিই সত্য;- এই নীল আকাশ, এই নির্মল রৌদ্রবসন্তদিবসের এই অপরূপ ঐশ্বর্যসম্ভার। গত দিনের প্রকৃতির আলোড়ন, প্রলয়ান্ধকার, ঝটিকা ও বজ্রপাত-সে অতীত কালের, গত জন্মে। আমাদের সর্বশরীরে তার ছাপ আছে, কিন্তু মনে তার একটুও দাগ নেই। স্মরণ-শক্তির পরিসর আমাদের অতি সংকীর্ণ হয়ে এসেচে বলার ইতিহাস ওবেলায় হয়ে ওঠে উপন্যাস। আমারই ঘটনা অন্যের মুখ থেকে যখন শুনি, অবাক হয়ে চেয়ে থাকি। আবার হাঁটছি! সকাল থেকে লেগেছে চড়াই, দেয়াল বেয়ে যাত্রীর দল উঠচে পোকার মতো। পোকার মতো অক্লান্ত, পোকার মতো নির্বাক।

সুটানা চটি ধীরে ধীরে পার হলাম। আর চলতে পাচ্চিনে। শরীর অতিরিক্ত যন্ত্রণায় থর-থর করে কাঁপচে। চোখ জ্বালা করচে, হাতের লাঠি আর শক্ত করে ধরে থাকা যাচ্ছে না। ঝোলা ও কম্বল কাঁধের উপরে প্রবল শত্রুর মত চেপে ধরেচে, এদের গুরুভার ও পীড়ন আর সইতে পারিনে। এমনি করে এলাম আরো মাইল দেড়েক পথ। রৌদ্র অত্যন্ত তীব্র হয়ে উঠেচে, এত তীব্র যে গা পুড়ে যায়। কাছেই পাওয়া গেল গোপেশ্বর, সম্মুখে গোপেশ্বরের প্রকাণ্ড প্রস্তরময় মন্দির। অতি নগণ্য একটি শহরের অনুকরণ, দু’একখানি দোকান, নিকটেই ক্ষুদ্র একখানি গ্রাম, গ্রামের ছেলেমেয়েরা পাই-পয়সা ভিক্ষা করতে যাত্রীদের কাছে ছুটে এল। শিবমন্দিরটির সম্মুখে বিরাট এক ত্রিশূল দণ্ডায়মান, তারই লৌহবক্ষে দ্বাদশ শতাব্দীর মহারাজা অনেকমল্লের বিজয়বার্তা এক দুর্বোধ্য ভাষায় লিখিত। যাত্রীরা এখানে বৈতরণীকুণ্ডে স্নান করে। তা করুক, একখানা দোকানের ধারে পাথরের গায়ে হেলান দিয়ে বসে পড়লাম। মাথা ঘুরচে, শরীর ঝিম্ ঝিম্ করচে। হঠাৎ বুকের ভিতরটা মুচড়ে উঠে সেই পথের ধারেই বমি করলাম। ভগবান এ কী হলো? দম নেবার আগে আর একবার বমি। লোকজন পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে, মুখ ফিরিয়ে তাকাবার প্রয়োজন তাদের নেই, এমন অবিশ্রান্তই ঘচে।

কে একজন পার হয়ে যাচ্ছিল, বলে গেল, ‘এক কাণ্ডে করিলেও ইয়ার, জয় বদরীবিশাল লাল কি!’

না, না, সময় নেই, সবাই গেল এগিয়ে। ওঠের শ্রান্ত, ওরে ভ্রান্ত, ওরে ভগ্ন, আর একবার উঠে দাঁড়া, কাধে তুলে নে ঝোলাঝুলি, ধর বাগিয়ে লাঠি ও ঘটি, অতীত শক্তি ফিরিয়ে আন্, বিদীর্ণ কণ্ঠে চীৎকার ক’রে ওঠ-

‘ব্যাঘাত আসুক নব নব-
আঘাত খেয়ে অচল র’ব
বক্সে আমার দুঃখে তব
বাজবে জয়ডঙ্ক,
দেবো সকল শক্তি, ল’ব
অভয় তব শঙ্খ।’

টতে-টতে চললাম, ছুটতে ছুটতে। মরণ আসচে এগিয়ে, সে যেন তাড়া করেছে পিছন থেকে। উজ্জ্বল দিবালোক মুছে গেচে শুধু নীল অন্ধকার, আকাশটা দুচে, অর্ধমুদ্রিত কোটরগত চক্ষু দিয়ে নাচে উষ্ণ জলধারা। আমি কি পাগল হয়ে গেচি? আমি কি মাতাল? কেন এমন করে পা কাঁপে? কেন সমস্ত মন প্ৰচণ্ড প্রতিবাদে এমন ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে? জানিনে কী আশা নিয়ে চলেচি, কী পাবে। সেখানে গিয়ে! সেখানে কি আমার সকল আশার পরিসমাপ্তি, সকল চাওয়ার শেষ? আমার পরম পাওনা বুঝে পড়ে নেবো তার কাছে যার আশায় এই অকাল- মরণের হাত এড়িয়ে চলেচি, যে রয়েচে আমারই প্রতীক্ষায়। আমার কণ্ঠে দেবে পরম বাণী, কানে দেবে আত্মপ্রকাশে মূলমন্ত্র, সৌন্দর্যসৃষ্টির উৎসমুখ দেবে খুলে, শক্তি ও সাহস-বিস্তৃদয়, অফুরন্ত প্রেম ও অকৃপণ দাক্ষিণ্য, চোখে দেবে অনির্বাণ স্বপ্নলোক, বুকে অনন্ত বহ্নিক্ষুধা!

বালি-পাথরের পাহাড়, সূর্যকিরণ প্রতিমূর্তি হয়ে নানাবর্ণে ঝলমল করে উঠচে, পাশে বনগোলাপের জঙ্গল, ডালিম আর আখরোটের বন। তারপরেই বাঁ- দিকে পথ ঘুরলো। ঘুরতেই দেখলাম বহু নিচে চামোলি শহর, লালসাঙ্গা। তারই নিচে অলকানন্দা নদীর ওপারে শাদা সুতোর মতো শীর্ণ সেই মহাপ্রস্থানের পুরাতন পথটি কর্ণপ্রয়াগ হয়ে লালসাঙ্গায় এসে মিলেচে, ওই পথটি ধরে যাত্রীরা ফিরে যায়। ঘণ্টাখানেক হাঁটার পর অলকানন্দার পুল পার হয়ে লালসাঙ্গার ধর্মশালায় এসে উঠলাম। বেলা তখন টা-টা করচে।

কেদার, বদরী ও কর্ণপ্রয়াগের কেন্দ্রস্থল এই চামোলি। ছোট্ট শহর, কিন্তু সমৃদ্ধ। এখানে গাড়োয়াল জেলার একটি আদালত, বনবিভাগের দপ্তর, কালেক্টরী, পুলিশ, কুলি-এজেন্সি, হাসপাতাল, বিদ্যালয়, বাজার, সদাব্রত ও ডাকঘর প্রভৃতি শহরের নিত্যপ্রয়োজনীয় বস্তুগুলির সাক্ষাৎ পাওয়া গেল। অকর্মণ্য যাত্রীরা এখান থেকে বদরীনাথ পর্যন্ত মূল্য দিয়ে ঘোড়া সংগ্রহ করতে পারে।

ধর্মশালায় গোপালদা ও বুড়ীদের দেখা পেলাম কিন্তু বাক্যালাপের রুচি হলো না। তিনি কেবল একবার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ও কি, কী হ’লো দাদা তোমার?’

কথা বলতে পারছিলাম না, কেবল কম্বলটা কোনোরকমে ছড়িয়ে শুয়ে পড়লাম। চোখ বুজে নিঃশব্দে পড়ে রইলাম। মাটির ভিতরে যেন তলিয়ে যাচ্ছি। গোপালদা সরে এলেন, গায়ে ও কপালে কিয়ৎক্ষণ ত্রস্তভাবে হাত বুলিয়ে বলে উঠলেন, ‘যা, যা ভেবেচি কুঠি এ ত’ রোদের গরম নয়, গা যে তোমার জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে! কী হবে?’

কী হবে তা সবাই জানে, গোপালদারও অবিদিত নয়। তার সস্নেহ উক্তিটি বিদ্রুপের মতো কানের ভিতরে বাজলো। কিন্তু তখন উত্তর দেবার আর সামর্থ্য ছিল না, জ্বরে আমি অচেতন। আর আমার মাথা তুলে দাঁড়াবার শক্তি নেই। যে প্রকাণ্ড আমাদের দল একদিন হৃষীকেশ থেকে যাত্রা করে দেবপ্রয়াগ পৌঁচেছিল, সেই দল আমাদের ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গেচে। কেউ গেচে ফিরে, কেউ থেমে গেচে, কেউ অকর্মণ্য হয়ে কোথায় পিছনে নিরুদ্দেশ হয়ে গেচে, কেউ পড়েচে মৃত্যুমুখে! আমাদের দলের তিনজন নেই, আজ আমাকেও থেমে যেতে হলো। বাইশটি দিনে সমস্ত পথ শেষ করেছিলাম, আর মাত্র সামান্য পথ বাকি, অতি সামান্য পথ, কেবলমাত্র আটচল্লিশ মাইল, এক ছুটেই হয়ত এই আটচল্লিশ মাইল শেষ করে দিতাম, কিন্তু তা আর হলো না। জ্বরাক্রান্ত, পঙ্গু হয়ে এই পথের ধারে অনির্দিষ্টকালের জন্য পড়ে রইলাম। গোপালদা কেবল হাসপাতালের দিকটা দেখিয়ে দিলেন।

কোনোক্রমে সামান্য আহারাদি শেষ করে আমার এই পরম প্রিয় দলটি যাত্রার আয়োজন করলো। আমার সাড়া ছিল না, বা শক্তি ছিল না, তাদের বিদায় দেবার মতো উৎসাহও নেই, কেবল নিঃশব্দে পড়ে রইলাম। যাবার সময় চারুর- মা দিল একটু জল, গোপালদা দিয়ে গেলেন সহানুভূতি ও শুভকামনা। বলে গেলেন, ‘দুঃখ করবার কিছু নেই, সবই বাবার ইচ্ছে। ফেরবার সময় এই পথেই আসতে হবে’ এসে দেখি যেন তুমি সেরে উঠেচ ভাই। আর একটু কমলে কিছু খাবার চেষ্টা করো।’

এটুকুও পাবার আশা করিনি, এই সামান্য মমত্ববোধের স্পর্শটুকু পেয়ে বুকের ভিতরটা উদ্বেল হয়ে উঠলো। এ লোকটাকে কোনোদিন পছন্দ করিনি, আজ সন্দেহ হ’লো এ বোধহয় আমার কল্যাণকামী। কম্বলের ভিতর থেকে মুখ বার করে শুয়েই রইলাম, তিনি ধীরে ধীরে বিদায় নিলেন, এবং যাবার সময় আর একবার বলে গেলেন, ‘তিন চারদিন ধরে তোমার মেজাজ যে রকম রুক্ষ হয়েছিল, তাতেই বুঝেছিলাম তোমার শরীর ভালো নেই।

.

নির্জন ধর্মশালা, মাথার দিকে নিচে অলকানন্দার কলকল শব্দ শুনতে পাচ্চি। কাছেই কোথা থেকে একটু-আধটু মানুষের গলার আওয়াজ কানে আসচে। মাথার কাছে দেখতে দেখতে অপরাহ্ণের রৌদ্র এসে পড়লো, হু হু করে বসন্তের হাওয়া বয়ে যাচ্চে। সম্মুখে লাল ও শ্বেতপাথরের দুটো পাহাড় সূর্যকিরণে এক আশ্চর্য রূপ পরিগ্রহ করেচে। নদীর ওপারে যে-পথটা দিয়ে আমরা এসেচি সেই পথ-রেখাটি স্বপ্নলোকের মতো দেখা যাচ্ছে। ধীরে ধীরে আমার রক্তরাঙা রুগ্ন ও স্তিমিত দৃষ্টি আবার বুজে এল। সর্বশরীরে জ্বরের অসহ্য যন্ত্রণা ও জল ধরেচে, আর আমার কোনো আশা নেই। মনে-মনে সকলের নিকট সজ্ঞানে বিদায় নিলাম। জন্মভূমির দিকে তাকিয়ে অভিবাদন জানালাম।

কতক্ষণ পড়েছিলাম মনে নেই, এক সময় উঠে পাগলের মতো ছুটে ধর্মশালার পিছন দিকের পথে নেমে এলাম। তখন অপরাহ্ণ চলেচে সন্ধ্যার দিকে, বেলা আর বাকি নেই। বালি ও পাথরের দুস্তর পথ দিয়ে সোজা নেমে নদীর তীরে এলাম। দু’চার জন সাধু-সন্ন্যাসী এখানে ওখানে জটলা করে বসে রয়েচে। হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে সবসুদ্ধ জলের মধ্যে নামলাম, স্রোত অত্যন্ত প্রবল, কিছুদূর জলের মধ্যে গিয়ে একখানা বড় পাথর আঁকড়ে ধরে ডুব দিলাম।

প্রায় আধঘণ্টা বেপরোয়া স্নান করে যখন ধর্মশালায় এসে উঠলাম, তখন শরীর একটু সুস্থ হয়েছে। বিষে বিষক্ষয় হ’লো। কোনদিকে আর না তাকিয়ে ঝোলাঝুলি আর লাঠি নিয়ে একাকী পথে এলাম। সন্ধ্যা তখন সমাগত। তা হক, খানিকটা পথ এখনো হাঁটা যাবে। আমি সেদিন মরীয়া।

কেমন করে কয়েকটা চটি পার হয়েছিলাম আজ আর স্পষ্ট মনে নেই। রাত্রে এক জায়গায় আশ্রয় নিলাম। পরদিন প্রভাতে পার হলাম পিপলকুঠি। পথের ধারে কয়েকটি রক্তকবরীর গাছ পাওয়া গেল। লাল ফুলের সমারোহের উপরে এসে পড়েছে নবীন সূর্যের কিরণচ্ছটা। এখানে বাঘ ভালুকের চামড়া খুব সস্তা হবে বিক্রি হয়। পিপলকুঠিতে গাড়োয়ালী মেয়েরা কম্বলের ব্যবসা করতে আসে। মধ্যাহ্নে এসে পৌঁছলাম গরুড়গঙ্গার চটিতে। এখানে গরুড়গঙ্গা ও অলকানন্দার সঙ্গম। গরুড় মন্দির ও সামান্য শহর পাওয়া গেল। প্রকাশ, ফেরবার পথে গরুড়গঙ্গায় এক ডুবে একটি পাথরের নুড়ি তুলে বাড়ি নিয়ে গিয়ে পূজা করলে সাপের ভয় থাকে না। গরুগঙ্গা থেকে পাতালগঙ্গা চার মাইল চড়াই পথ। পথটি চিড় ও পাইনে জঙ্গলে সমাকীর্ণ, ছায়াবিথীর মতো। সন্ধ্যার সময় পাতালগঙ্গার চটিতে এসে আশ্রয় নেওয়া গেল। পাশেই গণেশের মন্দির, পাতালগঙ্গা গিয়ে মিশেচে অলকানন্দায়।

.

পরদিন সকাল থেকেই পথ হাঁটতে শুরু। সঙ্গে সঙ্গে জনকয়েক অপরিচিত যাত্রী চলেচে। গোপালকুঠি পার হয়ে মধ্যাহ্নে এসে পৌঁছলাম কুমারচটিতে। সমতল পথ, প্রাকৃতিক শোভায় চটিটি সমৃদ্ধ। নিকটে কমনাশা নদী। আহারান্তে কিয়ৎক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম, কোথাও অকারণে বেশিক্ষণ থাকতে আর ভালো লাগছে না। বরং পথে পথে বসে বিশ্রাম নেওয়া যাবে, পথেই আমাদের যা-কিছু।

ঝড়কুলা ও সিংহদ্বার পার হয়ে সন্ধ্যার কিছু পূর্বে যেখানে এসে পৌঁছলাম সে আমার আবাল্যের স্বপ্ন যোশীমঠ। অল্প-অল্প বৃষ্টি পড়চে। আবার বেশ শীত লেগেচে। যোশীমঠ নামে এই ক্ষুদ্র শহরটির খ্যাতি, এর সংস্কৃত নাম জ্যোতির্মঠ। এখান থেকেই শঙ্করাচার্যের উত্তরধাম শুরু হলো। বদরীনাথের পূজারী রাওল মহাশয়ের এখানে বাসা, শীতকালে এখান থেকেই তিনি বদরীনাথের পূজা করেন। নৃসিংহদেব প্রমুখ অনেকগুলি দেবতার মন্দির এখানে রয়েচে, সবগুলি মন্দিরই একটি চত্বরের চারিপাশে অবস্থিত। এখানে নভোগঙ্গা স্নান অপেক্ষা দণ্ডধারায় স্নান প্রশস্ত। আসলে দুটিই অব্যবহার্য, তালপুকুরে ঘটি ডোবে না। যোশীমঠ ক্ষুদ্র শহর বটে কিন্তু উখীমঠের চেয়ে বড়। বাজার, ডাকঘর, ছাপাখানা, সদাব্রত, বসতবাটী-কি নেই? কাছেই তিব্বত ও মানসসরোবর যাবার পথ। অনেকেই এখান দিয়ে যায় কৈলাস ও মানস সরোবর। মাইল তিনেক গেলেই ভবিষ্যবদরী দর্শন হয়। ধর্মশালায় উঠে কিয়ৎক্ষণ বিশ্রাম নিয়েই শীতের কাঁপুনি ধরলো, নিকটে পাহাড়ের চূড়ায় একটু-একটু শাদা তুষার দেখা গেল। তুষার সম্বন্ধে একটা ভীতি জন্মে গেচে। যোশীমঠের প্রাকৃতিক দৃশ্য অতি সুন্দর।

রাত্রি শেষে শীতার্ত দেহে একাকী যোশীমঠের নিকট বিদায় নিয়ে উত্রাই পথে নামতে লাগলাম। তিন মাইল পথ নামতে হয়, পায়ের ব্যথাটা জেগে উঠলো। তিন মাইল পথ এসে নদীর পুল পার হয়ে যখন বিষ্ণুপ্রয়াগে পৌঁছলাম তখন সকাল হয়েছে। এখানে বিষ্ণুগঙ্গা বা অলকানন্দা ও ধবলীগঙ্গার সঙ্গম। পুরাকালে বিষ্ণু-আরাধনা করে নারদমুনি এখানে সর্বজ্ঞ হবার বর লাভ করেছিলেন। নীলবসনা অলকানন্দার কোলে গৈরিকবসনা গঙ্গার আত্মসমর্পণ এস্থলে এক রোমাঞ্চকর নয়নাভিরাম দৃশ্য। এখান থেকে বদরীনাথ আর মাত্র ষোলো সতেরো মাইল পথ।  

ধবলা গঙ্গার তীরে তীরে অত্যন্ত সংকীর্ণ, বিপজ্জনক পথ; খানিকটা সমতল, খানিকটা বা চড়াই। খাড়া দেয়ালের মতো চড়াই নয়, ধীরে ধীরে উঠছে 1 কোথাও কোথাও পথ সম্পূর্ণ ভেঙে গিয়ে নদীর মধ্যে অদৃশ্য হয়েচে। কোথাও পড়েচে পাথর, তাকে অতিক্রম করা এক দুঃসাধ্য ব্যাপার। কোথাও পথ নেই, ঝরনার জলের উপর দিয়েই চলতে হচ্ছে। কোথাও স্তূপাকার বালি ও নুড়ি, অত্যন্ত সাবধানে পা ফেলে যেতে হয়। কাল থেকে মার্বেল পাথরের পাহাড় দেখতে পাচ্ছি, কোনোটা হাঁসের পালকের মতো শাদা, কোনোটা গোলাপী, কোনোটায় নীল ও হরিদ্রার সমাবেশ। দুই দিকে শ্বেত পাথর, মাঝখানে কুলুকুলু গঙ্গার প্রবাহ। অল্প-অল্প চড়াই পথ ধরে কেবলই আমরা উপর দিকে উঠে চলেচি, আজকের চড়াইতে বুকে ব্যথা ধরছে না বটে কিন্তু ক্লান্তি আসচে-পা কনকন করচে। জ্বর ছেড়ে গেচে, কিন্তু শরীর সুস্থ হয়নি। অর্ধাশন ও উপবাসে দেহ বেতসলতার মতো দুলচে। ঘাটচটি পার হয়ে দু’মাইল চড়াই উঠে অনেক বেলায় অবসন্ন শরীরে পাণ্ডুকেশ্বর গ্রামে এসে পৌঁছলাম।

গ্রামখানি মন্দ নয়, নদীর উপরেই। পাথরের খারি করা গ্রামের উঁচুনীচু পথ, ডালপালা ও গাছের গুঁড়ির তৈরি অনেকগুলি চটি, ক্ষুদ্র একটি ধর্মশালা, নিকটে যোগবদরী মন্দির। একটি ঔষধালয় পাওয়া গেল, সেখানে মুষ্টিযোগ ও টোকা তুকতাকের কারবার। সম্মুখের পর্বতচূড়ায় পাণ্ডুরাজা বাস করতেন, মন্দিরে তাম্রশাসন পত্র আছে। স্থানীয় লোকেরা বোঝাতে চাইলো, এই পথ দিয়ে একদিন পঞ্চপাণ্ডব ও দ্রৌপদী স্বর্গারোহণ করেছিলেন, কতকগুলি প্রমাণোপযোগী চিহ্ন পর্যন্ত তারা দেখিয়ে দিল। আমরা স্বর্গদ্বার অবধি যাবে কিনা অনেকে প্রশ্ন করলো। শীতপ্রধান মূলুক, তাই এদিকের সাধারণ অধিবাসীরা সুশ্রী ও সুন্দর। আজকের পথের আশেপাশে বহু ভূজপত্রের গাছ, মঝে মাঝে কোনো-কোনো চটির চালাগুলি মোটা-মোটা ভূজপত্রের তৈরি। কোথাও-কোথাও রক্তরাঙা জবাফুলের মতো পাহাড়, কোনো পাহাড় উজ্জ্বল কালো রঙের, কোনোটা নীলাভ্রের মতে, আবার কোনো পাড় বা দুগ্ধশুভ্র,-নির্বাক বিস্ময়ে দেখে-দেখে চলে যাই। আহারাদির পর আবার পথ ধরেচি। বর্ষণোন্মুখ মেঘ মাঝে-মাঝে সূর্যালোককে আবৃত করে ভেসে চলেচে, নদীর তীর ধরে হাঁটচি। গঙ্গার ধারা আর নীল নয়, কোমল মৃত্তিকাবর্ণের। নদী এখন আমাদের দক্ষিণে। পথের নির্দেশে একই নদী বহুবার এপার-ওপার হতে হয়, যতদূর দৃষ্টি চলে কেবল ঋজু-কুটিল অনন্ত উপলখণ্ডময় গঙ্গা সগর্জনে ছুটে আসচেন। পথ থেকে নেমে পাথরের জটলা পার হয়ে নদীর জল স্পর্শ করা অসাধ্য ব্যাপার, সে সম্ভব নয়। আবার রক্তাদীর সমতল ছেড়ে উপর দিকে পথ উঠচে, অল্প-অল্প ঘিনঘিনে চড়াই পায়ের হাঁটু ককন করে। কখনো-কখনো দুচারজন বদরী প্রত্যাগত প্রসন্নমুখ যাত্রীর দেখা মিলচে। সকলের মুখেই খুশি, আনন্দ ও বদরীনাথকীৰ্ত্তন। কাঙালের মতো তাদের দিকে মুখ তুলে আবার এগিয়ে যাই।

লামরগড় চটি পার হলাম। পথ অস্তে-আস্তে উপরে উঠচে, কেবলই উঠচে। এবার নদীও উঠে এসেচে, মুখর তার প্রবাহ, ভীমগর্জনে নিচের দিকে ছুটচে। পাথরের সঙ্গে নদীর খেলা দেখলে আর চোখ ফেরানো যায় না। কতবার যেতে- যেতে থামি, চোখ ভরে দেখে দেখে মনে ছবি এঁকে রাখি, নিশ্বাস ফেলে আবার চলতে থাকি। নদীর অবিশ্রান্ত গতির দিকে তাকিয়ে মানুষের মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে কেন তা বলতে পারিনে, কিন্তু দুরন্ত জলস্রোত শিরার রক্তে যে দোলা দিয়ে যায় জানি। এক জায়গায় এসে থামতে হ’লো, এমন সংকীর্ণ ও গড়ানে পথ যে, বসে-বসে নামা ছাড়া উপায় নেই। বসে বসেই নিচের দিকে লাঠি গেঁথে নদীর ধারে নেমে এলাম! এপার থেকে ওপারে যেতে হবে, মাঝখানে দড়ির পুল। এই দড়ির পুল অত্যন্ত স্বদেশী, আদি ও অকৃত্রিম। এপারের পাহাড়ের সঙ্গে ওপারের পাহাড়ের পাথরে বাধা মোটা দু’জোড়া কাছি, সেই কাছির সঙ্গে বাঁধা কয়েকখানা তক্তা, তার উপর দিয়ে ভয়ার্ত মহাপ্রাণী হাতে নিয়ে পার হয়ে যেতে হবে। উপায় নেই, মরেচি না মরতে আছি, চোখ বুজে কম্পিত কলেবরে, ভয়ে ও সাবধানে পুলটা পার হয়ে গেলাম। পার হয়ে যে পথটি স্পর্শ করলাম তার চেহারা দেখেই ত চক্ষুস্থির। একখানি খাড়া মনুমেন্ট, অথচ ওঠবার সিঁড়ি নেই। আর কত বাধা ও বিঘ্ন সৃষ্টি করবে বাবা বদরীনাথ? কিন্তু বাবা আছেন এখনো আট ন’ মাইল দূরে, তার বাবারও সাধ্য নেই, এই পথটা সুগম করে দেন! কী আর হবে, পাথর আর মাটির দেয়াল আঁচড়ে আঁচড়ে, নাক দিতে দিতে, কাৎ হয়ে, চিৎ হয়ে, বদরীনাথের ঊর্ধ্বতন চতুর্দশ পুরুষের শ্রাদ্ধ করতে করতে, লাঠিটা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে, ডন দিয়ে দিয়ে অবশেষে এক সময় উপরে উঠলাম। ধন্য তীৰ্থ! অথচ এইটিই বাবাজির মন্দিরে যাবার রাজপথ, নাঃ পন্থাঃ। এত ধৈর্য ধরে ও এতখানি কষ্ট করে যাচ্ছি, গিয়ে দেখবো হয়ত একখানা পাথরের স্তূপ, কিংবা কিম্ভূতকিমাকার একটা কিছু ফাঁকি। তীর্থকামীর অভিসম্পাতভরা কাতরতায় বদরীনাথ চিরগৌরবান্বিত। রোগ-জরাহীন, আনন্দোজ্জ্বল, পরিচ্ছন্ন দেহ ও বলিষ্ঠ যাত্রীদের উপরে বদরীনাথের দৃষ্টি নেই; মুমূর্ষু, অকালবার্ধক্যক্লিষ্ট দুঃখপীড়িত দেহ, চলৎশক্তিহীন—এদের নৈলে তার চলে না। এদের নিয়েই তার যত মহিমা ও গৌরব। যে-পথ দিয়ে তার ভক্তরা আসবে সে-পথে তিনি ছড়িয়ে রেখেচেন দুর্ভিক্ষ, মারীভয়, মহাসংকট, অকালমৃত্যু ও দুরারোগ্য ব্যাধি। আর্তের আর্তনাদই তাঁর পূজার মন্ত্র, মানুষের বাহ্য কলুষ আর মলিন্য নিয়ে তার আনন্দ-আয়োজন। দুঃখ, দুর্যোগ ও পীড়নের মধ্যে এসে তীর্থযাত্রী আপন আন্তরিকতার পরীক্ষা দেয়, তাই বোধ হয় তাদের শারীরিক অপরিচ্ছন্নতায় বদরীনাথের পথ ও মন্দির অপবিত্র হয় না।

হনুমান চটিতে পৌঁছে সেদিনের মতো যাত্রা শেষ করলাম। প্রচণ্ড শীতের হাওয়ায় সর্বশরীর ঠক্ ঠক্ করে কাঁপচে, আবার বরফের তীরে এসে পৌঁছেচি। আকাশ মেঘলা, টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে, চারিদিক অন্ধকার করে এসেছে। কাল সকালে বদরীনাথে গিয়ে পৌঁছবো, যাত্রা শেষ হবে। পাশেই হনুমানজীর প্রাচীন মন্দির, কিন্তু ভিতরে ঢুকে দর্শন করবার আর সামর্থ্য নেই। বাঁ-হাতি পাকা ধর্মশালাটার দোতলায় এসে উঠলাম। ভিতরে-বাইরে তখন বহু যাত্রীর সমাগম হয়েচে।

‘ওমা, বা’ঠাউর যে! এলে?’

ফিরে দেখি, চারুর-মা। বললাম, ‘এই যে, ভালো ত সব? গোপালদা কই?’

ভিতর থেকে শীতার্ত কণ্ঠে সানন্দে উত্তর এল, ‘এসো দাদাভাই, তামাক ধরাচ্ছি। সমস্ত পথটা তোমার কথা ভাবতে-ভাবতে…ভাগ্যি এ বেলায় বেরিয়ে পড়িনি!’

আর সবাই বললে, ‘তুমি বাবা সন্নিসি নও, সন্নিসি হ’লে মানুষের ওপর এতটা টান হ’তো না!’

‘তথাস্তু।’ বলে গোপালদার পাশে গিয়ে কম্বল বিছেলাম। ভয়ানক ঠাণ্ডায় তখন হাত-পা জড়িয়ে যাচ্চে। চারিদিকে শীতজর্জর সন্ধ্যা নেমে এসেচে।

* * *

“যাত্রা কর, যাত্রা কর যাত্রীদল”,
উঠেছে আদেশ,
“বন্দরের কাল হ’ল শেষ।”

প্রত্যুষের তরল অন্ধকারে কাঁপতে কাঁপতে সবাই নামলো পথে। মেঘে মেঘে দিগ্‌দিগন্ত ঘনতমসাবৃত, বৃষ্টির ফোঁটাগুলি চাবুকের মতো সপাসপ, গায়ে এসে আঘাত করচে। বাঁ-দিকে নদীর ভাঙন ঘুরে অধচন্দ্রাকৃতি পথ উত্তরদিকে চলে গেচে। হিমকণাযুক্ত তীক্ষ্ণ বাতাসে বুকের রক্ত পর্যন্ত ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্চে, দাঁতের সঙ্গে দাঁত ঘষে একরকম শব্দ হচ্ছে। আবার সেই কেদারনাথের মতো ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ? বন-বালিকার মতো লতা-পুষ্পালঙ্কার শোভিত ঝরনাগুলি যাত্রীদের সাদর অভিনন্দন জানাতে পথের উপরেই নেমে এসেচে। কোথাও অরণ্যের আর দেখা মিলছে না, এদিকে তাদের আর আশ্রয় নেই, এদিকে তুষারের দেশ, কোথাও কোথাও দরিদ্রবেশধারী কয়েকটি গাছপালা স্বদেশী নেতার মতো জটলা করে তুষারের অত্যাচার সম্বন্ধে ভীরু প্রতিবাদ জানাচ্চে। তাদের উপর দিয়ে চলচে দুর্যোগের ঝটিকা। নদীর প্রবাহ কোথাও লুপ্ত হয়েছে, উপরে আস্তৃত হয়েচে জমাট বরফের শয্যা। দুই তীরের কৃষ্ণকায় পর্বতের গা বেয়ে শাদা তুষারের ধারা নেমে এসেচে, যেন ঘনশ্যাম বনমালীর গলায় দুলচে মল্লিকার মালা।

প্রভাত হয়েচে, সূর্যালোকহীন প্রভাত। প্রভাত কিংবা গোধূলি ঠিক বোঝা যায় না। সৃষ্টির আদিযুগে যেন উত্তীর্ণ হয়ে এসেচি, তখন সূর্য-চন্দ্র, গ্রহ-নক্ষত্র ছিল না, এমনি একটা অনৈসর্গিক অনুজ্জ্বল আলোয় বসে বিধাতা আপন কাজ করে গিয়েচেন। এ আলো যেন জীবনের শেষ প্রহরগুলির মতো স্তিমিত ও ক্লান্ত, অন্তিমদিনের মতো ঝাপসা এবং নিরানন্দ। স্থবিরত্বের চেহারা বোধ করি এমনিই। আজ আমাদের শেষ যাত্রা, শেষ খেয়া, শেষ পথের হিসাব। যে প্রকাণ্ড দল নিয়ে একদিন বেরিয়েছিলাম তাদের কথা ভাবছি, তাদের অনেকেই নেই। অনেকে গেচে থেমে, একজন বাচ্চা ঘোড়ায় যেতে যেতে পা পিছলে এক মাইল নিচে নদীর গর্ভে চিরদিনের মতো অদৃশ্য হয়ে গেচে। যার আজো সঙ্গে আছে তাদের দিকে তাকালে কান্না পায়। কেউ আমাশয়-ব্যাধিগ্রস্ত, কারো জ্বর, কারো কানে লেগেচে তালা, চোখ গেচে খারাপ হয়ে, কেউ আর কথা বলে না, কারো মস্তিষ্ক বিকৃতির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, কেউ পরনের কাপড় ছিঁড়ে পায়ের তলায় ফালি বেঁধে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটচে। কিছুদূর যাই, খানিকক্ষণ বসি, পিছনের পথের দিকে বারেবারে তাকাই। কিন্তু কিছু ভাবতে গেলে মাথার যন্ত্রণা হয়, মস্তিষ্ক বিকৃতির ভয়ে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াই, আবার এগিয়ে চলি। ঘাড় আর সোজা হয় না, মাথা উঁচু হয় না, আপন পদক্ষেপের দিকে তাকাই আর হাঁটি।

‘মেরি লাল?’

উদাসীন দৃষ্টিতে মুখ ফিরাই, কতবার শুনেছি এমনি অনড় যাত্রীর কাতর কণ্ঠ, নিরুত্তরে আবার মুখ ফিরিয়ে চলে গেচি।

‘আওর কেনা রাস্তা বা, নেরি লাল?’-একটি স্ত্রীলোক ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। মুখ দিয়ে তার ফেনা নির্গত হচ্চে, সঙ্গে ছিটা-ছিটা রক্ত। হাতে রিভলবার থাকলে ওর যন্ত্রণা শেষ করে দিতাম!

‘থোড়াই হ্যায় মাহি। বলে আবার এগোই। পথের ঠিক পরিমাণটা বলিনে, শুনলে হয়ত ওর হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া এখনি বন্ধ হয়ে যাবে। পথের দূরত্ব সম্বন্ধে কোনো শ্রান্ত যাত্রীকে ইঙ্গিত করতে নেই, তার উৎসাহ ও শক্তি নষ্ট হয়ে যায়।’

কয়েকজন মা সারবন্দী হয়ে চলেচি। পথ আজ অত্যন্ত সঙ্কটাপন্ন, কোথাও- কোথাও বালুময় কিনা, পথ নদীর মধ্যে ধসে গেচে অগাধ নিচে নদী। ভয়ে পা কাঁপছে। কোথাও কয়েক ইঞ্চি মাত্র কিনারা, কাত হয়ে পাহাড়ের গায়ে পিঠ ঘেঁষে চোখ বুজে পার হচ্ছি, কেউ পিছন থেকে এক-একবার প্রাণ ভয়ে আৰ্তনাদ করে উঠচে একটিবার মাত্র পা কে গেলেই-ব্যাস, আর টাল সামলানো যাবে না, তুষারময় নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে যেতে হবে।

কিছুক্ষণ এমনি করে হাড়ে হাড়ে আবার একটু ভালো জায়গায় এসে পৌঁছলাম। কাছেই যৎসামান্য একটি পাহাড়ী বসতি। মেয়েরা পিঠে কাঠের বোঝা নিয়ে বদরীনাথের দিকে রওনা হচ্ছে। কেদারের মতো বদরীনাথেও জ্বালানি কাঠ মেলে না, দক্ষিণের বন থেকে কাঠ সংগ্রহ করে স্ত্রী-পুরুষ পিঠে বেঁধে নিয়ে যায়, এক আনায় ছোট এক আটি বিক্রি করে। তাদের গতিবিধির দিকে তাকিয়ে মনে হলো, পথ ফুরিয়ে এসেচে।

ভূত যখন ছাড়ে শেষ দৌরাত্ম্য দেখিয়ে যায়। আবার লাগলো প্রাণঘাতী চড়াই। চড়াই, চড়াই আর চড়াই। চলতে-চলতে একবার দাঁড়াই বুকের মধ্যে কেমন একটা বিশ্রী শব্দ হতে থাকে, কানের মধ্যে বাজে জলতরঙ্গের মতো একটা অস্বাভাবিক কোলাহল।

.

তারপর?

তারপর স্বপ্ন দেখচি। অনিদ্রার আবেশে জেগে উঠলো একটি রূপলোক, মায়াময় বিচিত্র অমরাবতী,-সম্মুখে দূরে একটি বিপুল বিস্তৃত তুষারময় প্রান্তর, তারই একান্তে কুয়াশায় ঢাকা একখানি গ্রামের অস্পষ্ট চিত্র, মধ্যস্থলে মন্দিরের একটি স্বর্ণচূড়া, পদ-প্রান্তে স্রোতস্বিনী জহ্নু বালা!

নিশ্চয়, নিশ্চয় বেঁচে আছি। বুকে এখনো আছে প্রাণচিহ্ন, এখনো শিরায় আছে শেষ রক্তবিন্দু, চক্ষু এখনো নিঃশেষে অন্ধ হয়নি; এই পক্ষাঘাতগ্রস্ত হাত, এই পীড়ন-জর্জর চরণ এই শুষ্ক নীরস দেহ, এই ভগ্ন অবসন্ন হৃদয়-এ আমার, এ আমিই!

“দুর্জয়ের জয়মালা
পূর্ণ করে মোর ডালা”

জয় বদরী-বিশাল-কী জয়!

১২ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩৩৯।

মহাকালের জপের মালায় আজকের দিনটি নেই, আজকের এই হিমকণাময় কুয়াশাভরা প্রভাতটি আমাদের পরমায়ু থেকে বিচ্ছিন্ন, মৃত্যুর অন্ধকার ঠেলতে ঠেলতে আমরা একটি নূতন লোকে উত্তীর্ণ হয়ে এসেচি। তাই প্রথমেই মনে হলো, আমরা বুঝি বেঁচে নেই, এ বুঝি বা একটা নির্দয় প্রলোভন, অমর্ত্য মরীচিকা।

দূর থেকে বদরীনাথের ক্ষুদ্র গ্রামখানি যখন প্রথম দৃষ্টিগোচর হলো তখন এই কথাটিই ভেবে নির্বাক হয়েছিলাম। আনন্দ ও উল্লাস করবার শারীরিক এবং মানসিক সঙ্গতি নেই। কেমন করেই বা থাকবে? আমরা ফুরিয়ে ফতুর হয়ে গেচি নিঃশেষিত তৈল-প্রদীপের মতো। দীর্ঘ পঁচিশ দিনের যে দুঃখময় ইতিহাসটা আমাদের পিছনে পড়ে রইলো, তাকে আমরা ভুলেই গেচি, আজ আমাদের যাত্রার শেষ, দুঃখ-দহনের নিবৃত্তি। যে পদচিহ্নময় পথ একদিন গ্রামের সীমা অতিক্রম করেছিল, পার হয়েছিল নদী ও অরণ্য, উত্তীর্ণ হয়েছিল দেশ-মহাদেশ, আজ সেই পথ প্রসারিত হয়েচে বিশ্বের দিকে; আমাদের সেদিনের সামান্য তীর্থযাত্রা আজ বিরাটের পদতল স্পর্শ করেচে। মন বললে, তুমি এই? এই তোমার রূপ?-যার জন্যে এলাম সে ত’ মন্দিরে নেই, সে যে আমার আছে পথে- পথেই! সামান্য মন্দিরে তুমি ত বন্দী নও!

গঙ্গার পুল পার হয়ে ঢুকলাম গ্রামে। গ্রামের নামও বদরীকাম; কেউ বলে বদরী-বিশালা, কেউবা নারায়ণাশ্রম। প্রথমেই বাঁ-হাতি ছোট ডাকঘর। তারপরেই পথের দু’ধারে ছোট ছোট দোকান। আকাশ মেঘলা, ঝুপ্-ঝুপ্ করে বৃষ্টি পড়চে, বাতাসের বেগে ও অসহ্য ঠাণ্ডায় কোনোদিকে আর মুখ ফিরাবার উপায় নেই। তাড়াতাড়ি নির্দিষ্ট বাসায় এসে উঠলাম।

বাসাটির আভিজাত্য অল্প নয়, বেশ পাকা পাথরের দোতলা বাড়ি। দরজা, জানলা, উপরে উঠবার সিঁড়ি, সম্মুখে পাথরের খাদরি-করা প্রকাণ্ড চত্বর। এটি আমাদের পাণ্ডার বাসা-বাটী। যে-পাণ্ডাকে আমরা আশ্রয় করেচি তিনি এখানে বেশ বর্ধিষ্ণু, নাম-ডাক আছে। তাঁরা পাঁচ ভাই। সূর্যপ্রসাদ, রামপ্রসাদ প্রভৃতি। পুত্রের নাম পিয়ারীলাল। দেবপ্রয়াগেও এদের প্রতিনিধি আমাদের তত্ত্বাবধান করেছিলেন। প্রথমেই এদের অতিথি-সৎকারে আমরা কৃতজ্ঞ বোধ করলাম। নিচের ঘরে কতকগুলি কম্বল এনে এরা আমাদের জন্য বিছিয়ে দিলেন, কাঠ এনে আগুন জ্বালালেন। এই আগুন আর কম্বল সেই দুর্যোগে আমাদের জীবন দান করলো। সূর্যপ্রসাদ এবং রামপ্রসাদের মতো এমন ভাদ্র সদালাপী পাণ্ডা তীর্থস্থানে অতি বিরল। প্রত্যেক বাঙালী এবং হিন্দুস্থানী যাত্রীই এদের বাসাবাটীতে এসে ওঠেন

দুর্যোগে ও ঠাণ্ডায় অকর্মণ্য হয়ে সমস্ত দিন ঘরের ভিতরে অতি অস্বস্তিতে কাটতে লাগলো। মাছি নেই, কিন্তু কাপড় চোপড় ও কম্বলে পোকার ভয়ানক উৎপাত। আহারাদি তথৈবচ। রান্নাবান্নার জায়গাও নেই, সুবিধাও নেই, শক্তিও নেই—অতএব অমৃত সিংয়ের মারফৎ পুরি আনাতে হলো। ধন্য পুরি! পুরিই সর্বদেশে অগতির গতি।

কোথা দিয়ে কালো অপরাহ্ণ, কোন্ পথ দিয়ে এল সন্ধ্যা। বাইরে টিপটিপ করে তখন বৃষ্টি পড়ছে, বাতাস মাঝে-মাঝে দরজা-জালা কাঁপিয়ে ছুটচে, বন্ধ ঘরের ভিতর আগুনের চারিদিকে আমরা কয়েকজন ঘিরে বসে গল্প করচি, গোপালদা গুটি গুটি উঠে তামাক টান্‌চেন। বামুনবুড়ী পথ থেকে রোগ কুড়িয়ে এনে একপাশে কুণ্ডলী পাকিয়ে নির্জীব হয়ে রয়েচে এবং সেই সুবিধা নিয়ে দুর্দম- শক্তি কঙ্কাল-দেহ চারুর-মা শুরু করেচে তার গৃহপালিত গোরুর গল্প। ধীরে ধীরে রাত্রি নিশুতি হয়ে এল।

পরদিন প্রভাতে উঠে আকাশের দিকে তাকিয়ে আমরা সকলেই বিস্মিত হলাম। রাঙা রোদে চারিদিক হাসচে। আকাশ পরিচ্ছন্ন নীল। আশপাশের পাহাড়গুলির মাথায় স্তূপীকৃত বরফ রৌদ্রালোকে ঝলমল করচে। নদীর ওপারে সমতল জায়গাটুকুতে চাষের কাজ চলছে, কোথাও কোথাও সামান্য বৃক্ষলতা বাতাসে মাঝে-মাঝে আন্দোলিত হয়ে উঠচে, আমরা পরম তৃপ্তিতে চারিদিক চেয়ে-চেয়ে দেখলাম। এই রৌদ্রময় অলস দিনটি রেখে-রেখে উপভোগ করার মত সৌভাগ্য হবে, এ আমরা স্বপ্নেও ভাবিনি। মানুষের ভাগ্য-বিপর্যয়ের পর যেমন সুদিন আসে, আজকের এই সুনির্মল আলোকোদ্ভাসিত দিনটি তেমনি আমাদের উপরে বিধাতার আশীর্বাদের মতো নেমে এসেচে। আজ সকালবেলা উঠে হাঁটতে হয়নি, সমস্ত শরীর বিশ্রাম পেয়েচে। কোমল উষ্ণরোদে চক্ষু বুজে বসে রইলাম।

মন্দির ও ঠাকুর দর্শনের আগ্রহ আমার নেই শুনে অনেকেই চোখ কপালে তুলে নানা মন্তব্য করে বসলো এবং যখন শুনলো দেবমূর্তির সম্বন্ধে আমার কোনো মোহ অথবা কৌতূহল বিন্দুমাত্রও নেই, পূজাও দেবো, মুক্তিও চাইবো না, তখন তাদের সমস্ত চেহারাই গেল বলে।

‘কিছু না হোক, পেন্নামও ত একটা করবে বাছা?’

‘কাকে?’

‘কাকে? গা জ্বলে যায় বাছা তোমার কথা শুনলে। তা হলে বলে বাপ- পিতামো’র মুখে একটু জলও দিয়ে যাবে না?’

এখানে ব্রহ্মকপালীতে পিতৃপুরুষের উদ্দেশে পিণ্ডদান করা বিধি। জনশ্রুতি, স্বর্গীয় পিতৃপুরুষগণ স্বর্গদ্বার থেকে অঞ্জলী প্রসারিত করে উত্তরপুরুষের নিকট এইস্থলে পিণ্ড গ্রহণ করেন। গৌরীকুণ্ডের মতো এখানেও একটি উষ্ণ জলধারা আছে, যাত্রীরা অতি আরামে সেই জলে স্নান করে। পথের ধারে আর একস্থলে আছে একটি ঈষদুষ্ণ ঝরনা, এই জলে স্নান করলে শরীর সতেজ হয়ে ওঠে, সুতরাং এর প্রতিই যাত্রীদের আগ্রহ সকলের চেয়ে বেশি। গঙ্গায় একটি লোককেও স্নান করতে কিংবা জল ব্যবহার করতে দেখা গেল না। তুষারাচ্ছন্ন গৈরিকবেশা গঙ্গাকে স্পর্শ করার মতো দুঃসাহস কারো নেই।

স্খলিত দেহ, নগ্নপদ, মলিন পরিচ্ছদ, বীতস্পৃহ, উদাসী মন,-এক সময় ধীরে-ধীরে মন্দিরের সিঁড়ি বেয়ে ভিতরে প্রবেশ করলাম। জাতি-নির্বিশেষে যাত্রীর দল ভিতরে কোলাহল জুড়ে দিয়েছে। আজ সবাই এসে পৌঁছেচে তাদের পরম লক্ষ্যে, মুখে ফুটেছে তৃপ্তির হাসি। কারো শরীর রুগ্ন, কেউ ক্ষত-বিক্ষত, কেউ হাঁচে খুঁড়িয়ে, কেউবা ভগ্ন-কণ্ঠ, তা হোক, আপন-আপন ললাটে তারা জয়টিকা পরেচে। মন্দিরের ভিতরে অন্ধকার, নানা অলঙ্কার ও আভরণে আবৃত বদরীনাথকে স্পষ্ট করে দর্শন করা এক দুরূহ ব্যাপার। শঙ্খচক্রগদাপদ্মধারী বিষ্ণু মূর্তি, আশপাশে ছোট ছোট দেবদেবী। মূর্তিটি ছোট। সম্মুখে অন্ধকারে প্রদীপ জ্বলচে, নিকটেই অম্লভোগ থরে-থবে সাজানো। শ্রীক্ষেত্রের মতো এখানেও অন্ন সম্বন্ধে স্পষ্ট ও অস্পৃশ্যের ভেদাভেদ নেই।

এতদিনের পথশ্রম এত সামান্যতেই আজ শেষ হয়ে গেল। দুঃখ, পীড়ন, কাতরতা, উপবাস ও পথশ্রম, এত কৌতূহল, ব্যথা বেদনা ও আয়োজন-সমস্ত এসে থামলো এক প্রস্তর মূর্তির পদপ্রান্তে। কত মৃত্যু মহামারী, কত ক্লেশ ও উৎপীড়ন, কত পথে কত ঘটনা ও সংঘাত-আজ কি তার কোনো মূল্য নেই?

কে বলেচে মূল্য নেই! কত যুগ যুগান্তর, কত কাল-কালান্তরব্যাপী লোকপ্রবাহ অবিশ্রান্ত ব’য়ে এসেচে এই বিরাটের তীরে, কোটি কোটি পিপাসার্ত হৃদয় মুক্তি বাসনায় বিগলিত অশ্রুতে ভেঙে পড়েচে এব চরণপ্রান্তে, আজ আমার মতো নগণ্য মানুষের শিথিল সন্দেহ আব অবিশ্বাস বাদে তার মূল্য কি যাবে কমে? এতবড় অহংকার ত আমার নেই!

চারিদিকে একবার তাকালাম। সমস্ত স্নায়ুতন্ত্রীগুলির ভিতরে আমার কেমন একটা অদ্ভুত আন্দোলন জেগে উঠেচে এই নাম কি নাস্তিকের আত্মগ্লানি? একেই কি বলব অবিশ্বাসবাদীর অবচেতন প্রতিক্রিয়া? কিন্তু, ঘুচে যাক আমার প্রকৃতিগত অহংকার, মুছে যাক্ আমার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের নিস্ফল দম্ভ,-আমি এদেরই একজন, এদেরই মতো ভক্তিরসের প্লাবন-বন্যায় আমিও ভেসে যেতে চাই। তাদেব সকলের সম্মিলিত প্রার্থনার ভিতরে নিজের কণ্ঠ মিলিয়ে আমাকে বলতে ইচ্ছা হলো, হে দেবাদিদেব, আমার সন্দেহ আর অবিশ্বাস দূর করে, দূর করে দাও যত কিছু জঞ্জাল! হে পরশরতন, যত মালি, যত কুরূপ, যত বিরূপতা, যত কিছু আবরণ,- তোমার স্পর্শে যেন সব সুন্দর হয়ে ওঠে। সুদূর প্রাচীনকাল থেকে যারা তোমার দর্শন-কামনায় ওই দুর্যোগ-দুর্গম পথের ভিতর দিয়ে দলে দলে এসেচে, মহাকালের স্রোত-তাড়নায় দলে দলে যারা অদৃশ্য হয়ে গেচে, হে ঠাকুর, যুগ-যুগান্তের সেই কোটি-কোটি অগণ্য নরনারীর মোক্ষলাভের অতৃপ্ত বাসনা আমার এই তৃষাতুর হৃদয়ে আশ্রয় করেচে, তুমি একে মুক্তি দাও! অবিশ্বাস নয়, সন্দেহ নয়, মোহ নয়,-আমি সেই আবহমানকালের হিন্দু, সেই চিরন্তন হিন্দুকুলে আমার জন্ম, আমার শিরার রক্তে সেই আদিম শুচিতাবোধ, তোমার চরণের তলায় আমি যেন দলিত হই, ধন্য হই, কৃতার্থ হই।

.

ভারাক্রান্ত মনে আবার পথ পার হয়ে এসে বাসার ধারে বসলাম। নীল আকাশে রৌদ্র ঝলমল করচে, দুই ধারের ফেনশুভ্র তুষারময় পর্বতচূড়াগুলিতে সূর্যকিরণ প্রতিফলিত হয়ে অপরূপ শোভা বিকীর্ণ করছে, মহাযোগীর আলম্বিত জটার মতো বরফের ধারাগুলি ঝরনার আকারে নিচে নেমে এসেচে। দূরে মাঝে– মাঝে বেজে উঠচে মন্দিরের কাঁসর-ঘণ্টা। ওপারের পাহাড়ের নিচে একখানি সরকারি বাংলা, তারই পাশে কোমল সবুজ চাষের জমি। তিন চার মাসের মধ্যে যেটুকু ফসল উৎপন্ন করা যায়, তারপরেই শরৎকাল থেকে আবার এ-রাজ্য ধীরে-ধীরে বরফের গর্ভে সমাধিস্থ হয়ে যাবে। গ্রামবাসীদের নেমে যেতে হবে নিচে। বদরীনাথের মন্দির অদৃশ্য হবে, পূজারী রাওল মহাশয় গিয়ে বাস করবেন যোশীমঠে, সেখান থেকেই শীতকালে তিনি বদরীনাথের উদ্দেশে পূজা নিবেদন করবেন।

‘দাদা?’-করুণ কণ্ঠ কেঁপে উঠলো আমার কানের পাশে।

মুখ ফিরিয়ে তাকালাম। সে-কণ্ঠস্বর আমি আজো ভুলিনি।

‘এসেছেন আপনি? ভালো আছেন ত?’

ব্রহ্মচারীকে সহসা চিনতে পারলাম না। চেনবার উপায়ও নেই। রুক্ষ শীর্ণ দেহ, শীতশুষ্ক আদফাটা মুখ, দুই পায়ে বীভৎস গলিতক্ষত, হাত-পা ভয়ানক ফুলো,-হাঁ করে নিশ্বাস টানতে টানতে পাশে এসে বসলো। বললে, ‘ক’দিন জ্বরে ভুচি। আর এই পা—কী যে যন্ত্রণায় দিন কাটচে!’—চোখে তার জল এল।

‘পায়ে অমন হ’লো কি করে?”

‘মাছির কামড়ের ঘা…দাদা, আপনার কাছে আমার শত অপরাধ, আপনাকে ত্যাগ করেই আমার এই শাস্তি। ক্ষমা করুন আমাকে।’

ডান পায়ে তার একগোছা ছেঁড়া চুল আর কড়ি বাঁধা, সেইদিকে একবার তাকিয়ে বললাম, ‘ক্ষমা করবার ত কিছু নেই। তুমি যে একদিন আমাকে ছেড়ে এসেছিলে সে-কথা ভুলেই গেচি।’

এ-কথা আমার মিথ্যা নয়। যে-ব্রহ্মচারীর প্রতি সেদিন মমতায় ও স্নেহে অন্ধ হয়েছিলাম, যাকে ছাড়তে গিয়ে বুক ভেঙে গিয়েছিল, আজ তার সম্বন্ধে আমার কোনো চেতনাই নেই; মনের দেউল আমার ধুয়ে মুছে পরিষ্কার হয়ে গেচে। ব্রহ্মচারীর সম্বন্ধে আমার হৃদয় আজ নিতান্তই উদাসীন।

‘ভাবচি এই পা নিয়ে কেমন করে আবার এই হিমালয় পার হয়ে যাই-আর বোধহয় বাঁচবো না!

বললাম, ‘মরবে ত সবাই একদিন, ব্রহ্মচারী!’

ব্রহ্মচারী কিয়ৎক্ষণ চুপ করে রইলো, তারপর বললে, ‘আপনার আশাতেই আমি এখানে রয়েচি আজ চার দিন, রোজ দু’একবার আপনাকে খুঁজতে বেরোই, আপনি এসে পৌছলেন কি না। জানি আমার সব দাবিই আপনি পূরণ করবেন।’

আবার সে বললে, ‘উপবাস করতে-করতে এসেচি, উপবাস করতে করতেই যাবো, কিন্তু রামনগর থেকে বৃন্দাবন পর্যন্ত ট্রেন-ভাড়াটা না হলে চলবে না-আমি শুধু আপনার ভরসাতেই—’

মুখ তুলে তাকাতেই সে পুনরায় বললে, ‘যদি কিছু ভিক্ষা দেন।’

একদিন নিজের আগ্রহেই ব্রহ্মচারীর ব্যয়ভার বহন করেছিলাম কিন্তু সে- হৃদয় আজ আমার বেঁচে নেই। তার করুণ প্রার্থনায় হঠাৎ নির্দয় হয়ে উঠলাম, বললাম, ‘সঙ্গে আমি জমিদারি ত বেঁধে আনিনি!’

মুখখানা তার দেখতে-দেখতে অপমানে, ভয়ে ও নিরুপায়ে শাদা হয়ে গেল। দুর্বল ও রুগ্ন দেহ তার এ আঘাত সইতে পারলো না, পাথরে সে হেলান দিল। বললাম, ‘আমি দান করতেও আসিনি, পুণ্য করতেও না, ভিক্ষে আমার কাছে মিলবে না।’

‘সামান্য কিছু—অন্তত আনা আষ্টেক পয়সা–’

কঠিন কণ্ঠে বললাম, ‘না।’

ব্রহ্মচারী আর কিছু বললে না, শুধু নিঃশব্দে তার অকর্মণ্য পা দুটো সাবধান করে হেঁট হয়ে নমস্কার করলো, তারপর অতি কষ্টে উঠে আস্তে আস্তে চলে গেল। ব্রহ্মচারীর কাহিনীর এইটুকুই পরিশিষ্ট।

এও ত জীবনের আর একটা চেহারা। যার কাছে আঘাত পাই, যে করে তাচ্ছিল্য ও অনাদর, তাকে জয় করে করতলগত করবার জন্য মন যায় ছুটে, আবার যেখানে আমারই কাছে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ, আমাকে অবলম্বন করে যে বাঁচতে চায় তার প্রতি আমার নির্দয় অবহেলা, নিষ্ঠুর ঔদাসীন্য। জীবনের গতি সোজা দিকে নয়। ঈশ্বর উদাসীন বলেই তাকে পাবার জন্য আমাদের এত আগ্রহ, এত ব্যাকুলতা। দেবতা কথায়-কথায় আমাদের করতলগত হলেই তার মূল্য যেত কমে, আমাদের কামনা ও কৌতূহল যেত থেমে। প্রেমের দুই দিক একদিকে একজনকে অবলম্বন করে হৃদয় রঙে ও রসে সিক্ত হয়ে ওঠে, প্রেমকে কেন্দ্র করে মানুষের হয় আত্মবিকাশ; অন্যদিকে আমরা ছুটি তার পশ্চাতে যাকে পাইনে, যাকে পাওয়া যায় না। বহু মানুষের মধ্যে আমরা চির-ঈপ্সিত মনের মানুষকে খুঁজে-খুঁজে চলে যাই, বহু জীবনের ঘাটে-ঘাটে তাকে হাতড়াই, নিষ্ফল হয়ে ঘুরি-ফিরি।

গ্রামের চেয়ে বদরীনাথকে ক্ষুদ্র শহরও বলা যেতে পারে। ওইটুকু একটিমাত্র পাথর-বাঁধানো দু’শো গজ আন্দাজ লম্বা পথ, কিন্তু তার উপরেই দু’ধারি দোকানের সারি। কাপড়-চোপড়, বেনে-মসলা, চাল-ডাল, মণিহারি, পুরি- কচুরি-অনেকগুলি দোকান। বিস্মিত হলাম এক জায়গায় একখানি ছবি ও বইয়ের দোকান দেখে কি ভাগ্যি নাটক-নভেল নয়,-ধর্মগ্রন্থ! তার চেয়েও বিস্মিত হলাম যখন অকস্মাৎ আবিষ্কৃত হ’লো চা ও পানের দু’খানি ছোট দোকান। খুশি হয়ে চা খাওয়া গেল।

শীতের হাওয়ায় গায়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে পিতৃমাতৃহীন বালকের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম, সন্ধ্যার তখনো কিছু বিলম্ব ছিল। পথের দক্ষিণ দিকে কয়েকখানি ‘শিলাজিৎ’ ও চামরের দোকান দেখে দেখে যাচ্ছিলাম। এ দুটি বস্তু অতি দুষ্প্রাপ্য। শিলাজতু হচ্চে পাহাড়ের ঘাম। কোনো-কোনো বিশেষ পাহাড়ের এক অলক্ষ্য চূড়ায় আকাত্রার ন্যায় এই বস্তুটি মধুর মতো এক জায়গায় প্রকৃতির খেয়ালে জমা হতে থাকে। মানুষ একদা এই বস্তুটি জিহ্বার দ্বারা আস্বাদন করে ভাবলে, খেতে মন্দ না। চাখতে গিয়ে উদরসাৎ করলে। দেখা গেল, শরীরের পক্ষে পুষ্টিকারক ও বলবর্ধক একরূপ স্বদেশী সানাটোজেন্। অমনি ছুটলো পাহাড়ে-পাহাড়ে, হিমালয়ের ঘাম শোষণ করে এনে ভরি দরে বিক্রি করতে লাগলো। ভালো এক ভরি শিলাজিতের দাম আট আনা। তার পর চামর হিমালয়ের তুষারদেশে ‘সুরা’ গাই দেখা যায়, কেউ বলে ‘চামরী’ গাই। কঠিন বরফের ভিতরে তারা বিচরণ করে। তুষারের মতো শাদা দেহ, ল্যাজগুলি সুন্দর। ব্যস্ আর কি, আন্ সেই গরুর ল্যাজ কেটে। হিন্দুর ছেলে কালো গরু, পশুর ল্যাজের সঙ্গে হাতল বেঁধে গৃহপালিত পশুপতিকে ব্যজন করতে শুরু করলে।

বড় একখানা দোকানে উঠে চামর আর শিলাজিৎ (শিলাজতু) পরীক্ষা করছিলাম। গোপালদা আছেন পাশে, এ দুটি বস্তুর প্রতি তার ভয়ানক মোহ। দর-দস্তুর করবার জন্য তিনি আমাকেই সুমুখে ঠেলে দিলেন, আমি একেবারে অন্ধের মতো অনর্গল উর্দু মিশ্রিত হিন্দী ভাষা ছুটিয়ে দিলাম। দোকানে প্রচুর জটলা, স্ত্রী-পুরুষের ভিড়ে দোকানদার একেবারে হকচকিয়ে গেচে। তার জিনিস ওলোটপালট করে মনের মতো ছোট চামরটি খুঁজছিলাম। হাত বাড়িয়ে একটি চামর ধরতেই অন্যদিক থেকে আর একখানা হাত এসে তার উপর চেপে বসলো। যে-হিন্দুস্থানী মেয়েটি এতক্ষণ ঝাঁ-ঝাঁ করে সমস্ত দোকানখানাকে কথায়-বার্তায় হাসিতে তর্কে ও দরকষাকষিতে আলোড়িত করে তুলেছিল এ হাতখানি তারই। স্ত্রীলোক বলে বেশি সুবিধা দিতে আমি রাজি নই, চামরখানি হাতের মধ্যে টেনে নিলাম।

‘ওইটি কিন্তু আমার পছন্দ, দিন আমাকে।

বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে চামরটি তার কাছে এগিয়ে দিলাম। ভিড়ের ভিতরে গলা নামিয়ে বললাম, ‘আপনি বাঙালী।’

ভদ্রমহিলা হেসে বললেন, ‘কী দেখে সন্দেহ হচ্চে? হিন্দী শুনে?-কই, দিদিমা গেলেন কোথায়? আমাদের চৌধুরী মশাই? ও হরি, ওঁরা দেখচি ওদিকে দোকানসুদ্ধ তুলে নিয়ে যাবেন। এ চামরটা আপনার কেমন লাগে?’

বললাম, ‘বেশ জিনিসটি, ছোট-খাটো, দামও কম, দশ আনা মাত্র।’

তিনি বললেন, ‘দাম বেশিও দিতে পারি যদি মনের মতন হয় বেশ, এইটিই আমি নিলাম, কিছু মনে করবেন না। আমার ঘরে আছেন নারায়ণ, তার জন্যেই এই বলে তিনি আবার দোকানদারের সঙ্গে শিলাজিৎ সম্বন্ধে আলাপ জুড়ে দিলেন।

নিজের হিন্দী বুলিকে সংযত করলাম, এর সঙ্গে পেরে উঠবো না, হয় ত এখুনি কি বলতে কী বলে বসবো, দরকার নেই।

‘আপনি এখানে কী করতে এসেছেন?’-আপাদমস্তক তিনি একবার তাকালেন আমার দিকে।

‘এসেচি তীর্থে—সবাই আসে যে জন্যে!’

‘তীর্থে?’ ঠোঁট উলটে তিনি হঠাৎ এমন অবজ্ঞার হাসি হাসলেন যে অত্যন্ত কুণ্ঠিত হয়ে গেলাম, একটি মুহূর্তে আমার এই ছাব্বিশ দিনের সমস্ত তীর্থযাত্রাটাই যেন মিথ্যে হয়ে গেল। বললেন, ‘তীর্থ করবার বুঝি এই বয়স আপনার? ও হরি, আপনার সাজসজ্জাও যে আধা-সন্নিসির!’

কানে তার কথাগুলি তিরস্কারের মতো বাজলো। একটুখানি খতিয়ে গোপালদার কাছে ঘেঁষে বসলাম। তাঁর দীপ্ত চক্ষুর সম্মুখে আমি মুহূর্তেই সংকুচিত হয়ে উঠেচি। দেখতে-দেখতে দিদিমা আর চৌধুরী মশাই এসে দাঁড়ালেন। সহজেই আলাপ হয়ে গেল। জিনিসপত্র কিনে সবাই উঠে পড়লাম। সঙ্গে-সঙ্গে ছিলেন পাণ্ডা সূর্যপ্রসাদ। স্বর্ণদ্বার সম্বন্ধে আলোচনা উঠলো। স্বর্গদ্বার যেতে গেলে বরফের ভিতর দিয়ে দু’দিন হাঁটতে হয়,-মানুষের অগম্য পথ। স্বর্গদ্বারের পথ গিয়ে মিলেছে ‘শতপন্থে’-এই পথের প্রথম প্রান্তে পাণ্ডবপত্নী দেবী দ্রৌপদী ভূতলশায়িনী হয়েছিলেন,-মহাপুরুষ এবং প্রকৃত সন্ন্যাসী ছাড়া সাধারণ মানুষ সেখানে যেতে অপারগ। এখান থেকে মাইল ছয়েক পথ বরফের ভিতর দিয়ে অতিক্রম করলে বসুধারার দৃশ্য দেখা যায়। বসুধারা একটি তুষারের প্রপাত। বরফের উচ্চ চূড়া থেকে একটি বায়ুতাড়িত, জলধারা অসংখ্য বিন্দুতে চারিদিকে বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে, অনেকটা নিম্নগামী ফোয়ারার মতো,-তারই নাম বসুধারা। পথে দাঁড়িয়েই চলছিল, এমন সময় জ্ঞানানন্দ স্বামী-যার সঙ্গে প্রথম হরিদ্বারে আলাপ, তিনিও সদলবলে এসে পৌঁছেচেন,—আমাদের আলাপে তিনিও যোগ দিলেন। এখান থেকে ফিরবার পথে যোশীমঠ দিয়ে কৈলাসযাত্রার একটা বাসনা আমার মনে-মনে ছিল, অতএব উঠলো কৈলাসের কথা। সকল আলাপে, সকল তর্কে ও আলোচনায়, সকল সমস্যায় যিনি অনর্গল নিজের মতামত ব্যক্ত করে যাচ্ছিলেন তিনি হচ্চেন দিদিমার নাতনী,-মার্জিত রুচি, বুদ্ধিদীপ্ত কথা, অসঙ্কোচ ব্যবহার,-সকলকে অবলীলায় অতিক্রম করে তাঁর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য আমাদের সকলের কাছেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল। চৌধুরী মশায় জানালেন, তারা গড়ে দু’বেলায় প্রতিদিন দশ মাইলের বেশি হাঁটেন না, অল্প-অল্প হাঁটাই ভালো। আজ তিন দিন হলো তারা এখানে এসেচেন, কাল প্রভাতে দুর্গা বলে দেশের দিকে রওনা হবেন।

বললাম, ‘আমরা রোজ বারো-চোদ্দ মাইল পর্যন্ত হাঁটি।’

নাত্নী বললেন, তাহলে ত পথে আমাদের ধরতেও পারেন,-চলো দিদিমা, তোমার জন্যে কিছু নিয়ে বাসায় ফিরি, চৌধুরী মশাই শীতে কষ্ট পাচ্ছেন। আমাদের চৌধুরী মশাইটি কেমন মানুষ জানেন?-শান্ত, শিষ্ট, গোবেচারী, রোগ- ভাঙ ছড়া মানুষটি, পুজো-অর্চনা করে চালান, শিষ্য-সেবক আছে-আর কি বলব চৌধুরী মশাই?

চৌধুরী মশাই স্নেহের হাসি হেসে বললেন, ‘অনি তোমার রাঙা-দিদির কথাটাও বলে দাও? আমার অবর্তমানে-

সবাই হেসে উঠলাম। বললাম, ‘কিন্তু যাই বলুন একটি জিনিস দেখে হিংসে হচ্ছে, সে আপনাদের ধবধবে কাপড়-চোপড়।’

নানী চট করে একবার সকলের দিকে তাকালেন, তারপর বললেন, ‘আমরা বিবাগী হয়ে ত’ আসিনি, সাজসজ্জা নিয়ে এসেচি।’

কথা ত নয়, যেন চাবুক। তা বেশ, পায়ে তার মোজা, সাদা জুতো, গায়ে জড়ানো পশমের একখানা বেগুনী চাদর, ঐশ্বর্যের ঘরেই তিনি লালিত। তার কথালাপের ভিতর দিয়ে একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারকে অতি সহজেই চেনা যায়।

গোপালদাকে নিয়ে চলেই যাচ্ছিলাম, নাত্নী পাশ থেকে আর একটি অলক্ষ্য উক্তি করলেন, আপনারা সবাই এসেছেন তীর্থে, ‘আমি এসেচি বেড়াতে।’

তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে বললাম, ‘বেড়াবার দেশই বটে। আসুন গোপালদা, আর এক পেয়ালা চা খাওয়া যাক্।’

.

চা পানের পর গরম পুরি সংগ্রহ করে শীতের হাওয়ায় কাঁপতে-কাঁপতে বাসায় এসে উঠলাম। তখন পাহাড়ে পাহাড়ে সন্ধ্যার অন্ধকার নাচে। রৌদ্রের উত্তাপটুকু রৌদ্রের সঙ্গেই চলে গেচে, আবার উঠেচে বরফের বাতাস। ভিতরে আগুন জ্বলচে; তারই চারিপাশে বুড়ীর পাল নিতান্ত গ্রাম্য আলাপে মত্ত। যে উচ্চাঙ্গের রুচি এবং সুর একটু আগে পথের উপরে দাঁড়িয়ে মনে মনে সঞ্চয় করেচি, তার সঙ্গে এদের তুলনা করে হঠাৎ বিতৃষ্ণায় ভিতরটা ভরে উঠলো। জানি এ আমার অন্যায় পক্ষপাতিত্ব, কিন্তু একি নিতান্তই অস্বাভাবিক? মনে হ’লো, এই কুৎসিত কুরুচিপূর্ণ গ্রাম্য সংসর্গ ছেড়ে কোথাও ছুটে পালাই, এদের বোঝা আর বইতে পারিনে।

দলাদলি করিনে বটে কিন্তু দলের বৈচিত্র্যে দিকে মন টাচে। বৈচিত্র্যের ক্ষুধা মানুষের সহজাত। বৈচিত্র্যের ভিতর দিয়েই সে আন্তরিক আনন্দ পায়। প্রতি মুহূর্তেই সে কামনা করে নূতনতর জীবন, অভিনব চরিত্র, বিস্ময়কর ঘটনার ঘাতপ্রতিঘাত। শিল্পীর মন এমনি। কোথাও সে বন্ধন স্বীকার করে না। মোহের কাছে নয়, প্রেমের কাছে নয়, অবস্থার কাছে নয়। সবকিছুকেই সে স্পর্শ করে এবং সমস্তই সে অতিক্রম করে চলে। সামাজিক বিধিনিষেধ, নীতি ও ধর্মের বাধাবিপত্তি, মনুষ্যত্বের মাপকাঠি,-এ সমস্ত তার জন্য নয়। শিল্পী বাস করে এক বিচিত্র জগতে, মানবসমাজে সে এক অমর্ত্য দেবদূত।

দেখতে দেখতে বুড়ীদের কথাবার্তা থেমে এল, এক একজন করে ঘুমিয়ে পড়েচে। ঘরের কোণে হারিকেন লণ্ঠনটা কমানো, একপাশে কাঠের আগুন গন গন করচে, ভিতরটি বেশ গরম হয়ে উঠেচে। পাশে গোপালদা কম্বলের তলায় কোথায় হারিয়ে গেচেন, তাঁর আর সাড়াশব্দ নেই। তার ধারণা, এই বন্ধ ঘরের মধ্যেও কম্বলের ভিতর থেকে মুখ বার করলেই তিনি ডবল নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হবেন। আমারো চোখে তন্দ্রা এসেছিল।

বাইরে একটা সোরগোল শোনা গেল এবং সে কোলাহল যে একদল বাঙালীর তা সহজেই বুঝলাম।

‘কে আছ গো, একটু আলো দেখাও না বাবা, পথটা দেখে নিই? দয়া করে একটু আলো দেখাও না বাছা, ভারি অন্ধকার।

‘কোনদিকে কিছুই বুঝতে পাচ্ছিনে, সেই সিঁড়িটা কোথায় গেল?”

‘পিসি আবার রাতকানা, এইদিকে গো, এইদিকে, বকের মতন ঠ্যাং বাড়িয়ো না পিসি, মরবে এখুনি,−খুব জব্দ হয়েচি হোক। আমরা সবাই ঠিক আছি, হারাধনের দশটি ছেলে না হারিয়ে গেল কেউ?’

‘কানা ছিলুম, আলো বিনে এবার খোঁড়া হলুম। ওগো, বলি ও ভালো মানুষের দল, কে কোথায় আছে বাবা, আলো নিয়ে একটু বেরোও, আমরা ত আর বাঘের পেটে যেতে পারিনে!’

কম্বল ছেড়ে উঠে আলোটা বাড়িয়ে হাতে নিয়ে বাইরে এলাম। ‘আহা এস বাবা এস, অল্প বয়েসের গুণ কত!

একজন বললেন, ‘বোঝা গেল তোমার গায়ে মানুষের চামড়া আছে, এত ডাকাডাকি করচি, এই শীতে—’

‘এইদিকে একটু ধরুন ত আলোটা,-ইয়া, ঠিক হয়েচে, থ্যাঙ্ক, ইউ।’

‘ওমা এই যে বাবা তুমিই উঠে এসেচ দেখচি, আহা বেঁচে থাকো।’

‘দিদিমা বুঝি এতক্ষণে ওকে চিনতে পারলে?-খুব সাবধানে চৌধুরী মশাই, সিঁড়িতে হোঁচট খাবেন না; ওদিকে বিজয়াদিদিরা ভাবচে আমরা। বুঝি হারিয়েই গেলাম,-সত্যি বাপু, বই কিনতে গিয়ে আমাদের অনেক দেরি হয়ে গেল, ধর্ম- ধর্ম করেই তোমরা সব অস্থির।’

একজন বললেন, ‘হ্যাঁ বাবা, তোমার কি কৈলাস যাওয়া ঠিক?’

দিদিমা সিঁড়ি দিয়ে উঠছিলেন, আলোটা তুলে ধরে বললাম, ‘ঠিক এখনো বলতে পারিনে। ওটা খেয়াল।’

নানী লাঠি নিয়ে উঠছিলেন সকলের শেষে। মুখ ফিরিয়ে একটু গলা নামিয়ে বললেন, ‘খেয়াল নয়, বখেয়াল! কী হবে কৈলাসে গিয়ে, দেশের ছেলে দেশে চলে যান।’

অনেক দূর পর্যন্ত উঠে গিয়ে তিনি পুনরায় বললেন, ‘এইবার বাসা চিনতে পেরেচি, আপনি যেতে পারেন,—উঃ কী শত বাবারে বাবা!”

ভিতরে এসে দরজা বন্ধ করে আবার কম্বলের মধ্যে ঢুকলাম। গোপালদা চুপি-চুপি বললেন, ‘সেই বাচাল মেয়েটার দল বুঝি? ও-মেয়ে সুবিধে নয়, বসে- বসে পা নাচায়-রক্তের তেজ!’

কিয়ৎক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, ‘কাল চলে যাচ্চি গোপালদা।’

গোপালদা ফস্ করে হাতটা ধরে বললেন, ‘এই অসুখ শরীরে? তিন রাত্রি যে এখানে বাস করে যেতে হয় ভাই!’

মনের মধ্যে কেমন যেন একটা রুদ্ধ রোষ ও অভিমান স্ফীত হয়ে উঠেছিল। বললাম, ‘কৈলাসের দিকেই যাবো এখন, আপনি দেশে গিয়ে বাড়িতে একটা খবর পাঠাবেন, ঠিকানা দিয়ে যাবো।’

‘দাঁড়াও, এক হাত তামাক সাজি।’ বলে গোপালদা উঠে বসলেন।

.

রাত্রে যে-ঝড় উঠেছিল, পরদিন সকালের রৌদ্রে উঠে দেখি সমস্ত শান্ত হয়ে গেচে। আকাশে আর কোনো মালিন্য নেই, দিক্-দিগন্ত পরিচ্ছন্ন নীলাভায় ঝলমল করছে। যাত্রীর দল আজ ভাবতে শুরু করেচে দেশের কথা, আত্মীয়- পরিজনের কুশল। গভীর নিদ্রা থেকে আজ সবাই জেগে উঠেচে। এবারের পালা সঞ্চয়ের। কেউ নিচ্চে তীর্থের ‘সুফল’, কেউ ঠাকুরের প্রসাদ, কেউ ছবি ও বই। অনেকে পথ থেকে কাঁচা সিদ্ধির গাছ ছিঁড়ে এনে রোদে শুকাতে দিয়েচে। যাদের আর ধৈর্য নেই, তারা বসে গেচে চিঠি লেখাতে, এখানকার ডাকঘরের ছাপ দিয়ে দেশে চিঠি পাঠাবে। আজ আর কোনো তাড়া নেই, সবাই নিচে বিশ্রাম, গাল-গল্প চলচে, কেউ ঔষধপত্র সংগ্রহ করছে, কেউ খুঁজচে কাণ্ডি-তার আর হেঁটে ফিরবার সঙ্গতি নেই। মাঝে মাঝে সূর্যপ্রসাদ ও রামপ্রসাদ মধুর আলাপে ও ব্যবহারে যাত্রীদের আপ্যায়িত করে যাচ্ছেন। এমন হৃদয়বান ও ভদ্র পাণ্ডা ভারতবর্ষের যে- কোনো তীর্থেই বিরল।

পূর্ণযাত্রা

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *