সিভিলিয়ন ও উঁচুতলার সায়েবদের নৈতিক চরিত্র

সিভিলিয়ান ও উঁচুতলার সায়েবদের নৈতিক চরিত্র

একটা বহুল প্রচলিত ধারণা আছে যে, ক্লাইভ এবং তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরা, যেমন, ড্রেক, হলওয়েল, ওয়াটস প্রমুখ অনৈতিকতার বিষবৃক্ষ রোপণ করে গিয়েছিলেন বাংলা তথা কলকাতার মাটিতে। ধারণাটা একেবারে মিথ্যে নয়। এর পেছনে বিশ্বাসযোগ্য তথ্য আছে প্রচুর। ১৭৫৭ থেকে ওয়ারেন হেস্টিংসের দায়িত্ব গ্রহণের মাঝের সময়টায় বাংলায় ছিল রাজনৈতিক নৈরাজ্য। সে সময় বাংলা বহিঃশত্রুর আক্রমণের আশঙ্কা থেকে মুক্ত থাকায় কোম্পানির কর্মচারীরা দুর্নীতির রাজ্যে বিচরণ করত অবাধে। কিন্তু এর একশো বছর আগেও এদেশে আগত সায়েবদের নৈতিক চরিত্রের মলিন ছবি এঁকে গেছেন স্যার থোমাস রো (১৬৬৫)-এর সঙ্গে আসা তাঁর এক সঙ্গী। তিনি খ্রিস্টানদের উচ্ছৃঙ্খলতার পাশে ভারতীয়দের উজ্জ্বল চরিত্রে মুগ্ধ। কোম্পানির আমলের প্রথমদিকে আসা পর্যটকরাও ভারতীয়দের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ফর্‌ব্‌স (Forbes) কিন্তু ভিন্ন কথা বলছেন। তাঁর মন্তব্য, ভারতে ইংরেজদের চরিত্র তাদের দেশের অহংকার। ‘In private life they are generous, kind, and hospitable; as husbands, fathers, masters, they cannot be easily excelled.’২ক বলা বাহুল্য, ইংরেজ চরিত্রের এই বিশেষণগুলো আঠারো শতকের উঁচুতলার সায়েবদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল না।

এখানে একটা প্রশ্ন উঠে আসে স্বাভাবিক ভাবে। বিলেতের এইসব মানুষ এদেশে এসেই নীতিবোধ হারিয়েছিল, না তারা প্রথম থেকেই নীতিজ্ঞানশূন্য ছিল। এ প্রশ্নের উত্তর নিয়ে বিতর্ক আছে। অনেকের ধারণা, নীতিভ্রষ্টতার জীবাণু ছিল তাদের রক্তে। এদেশের পরিবেশ পরিস্থিতি তার প্রকাশে সুযোগ করে দেয় মাত্র। ১৮৪৪-এ The Calcutta Review মন্তব্য করেছিল, তারাই প্রাচ্যের বসতিতে আমদানি করেছিল শুধুমাত্র কুমতি, একটাও খ্রিস্টধর্মের সুনীতি নয়। বস্তুত, কর্নওয়ালিশের আসার আগে শ্বেতাঙ্গদের চরিত্রে দুর্নীতির কালো দাগ এত গাঢ় হয়ে লেগেছিল যে, মুছে ফেলতে সময় লাগে।

আঠারো শতকে যে-সব ইংরেজ বাংলায় আসত, তারা কোম্পানির কর্মচারী হোক বা না হোক, নিজেদের মার্চেন্ট বলে মনে করত। তখন গোটা ব্রিটিশ জাতটাই হয়ে উঠেছিল বানিয়ার জাত। তাদের ভারতে আসার একমাত্র লক্ষ্য ছিল বাণিজ্য করে অর্থোপার্জন। কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যে বাধা না দিয়ে বাণিজ্য করতে পারলে সাফল্য ছিল নিশ্চিত। সমসাময়িক বিলেতের প্রভাবশালী ব্যক্তিরাও তাদের সাফল্যকে বাহাবা দিতে সর্বদা প্রস্তুত থাকত। এডমন্ড বার্কের মতো মানুষও দেখতে চাইতেন, ব্রিটিশ তরুণরা ভারতে গিয়ে ধনী হয়ে ফিরে আসুক, তবে সৎভাবে। তখন বিলেতের ধনী-গরিব, উচ্চজাত-নিম্নজাত নির্বিশেষে সমস্ত পরিবারের অভিভাবক ছেলেদের ভারতে পাঠানোর চেষ্টায় অকাতর। উইলিয়ম হিকি লিখেছেন, ভারত ছিল বিলেতের মস্তান, বেয়াদপ ছোকরাদের কিছু করে খাওয়ার শেষ আশ্রয়। তাদের অভিভাবকরা বয়ে যাওয়া ছেলেদের ভারতে পাঠিয়ে দিয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচতে চাইত। বিলেতের এক ব্যারনের কুড়ি বছরের ভাই সম্ভ্রান্তবংশে জন্মগ্রহণ করেও এত বেয়াড়া ও অবাধ্য হয়ে উঠেছিল যে, তাকে বাংলায় পাঠিয়ে দিয়ে রেহাই পায় তার আত্মীয়স্বজনরা। হিকির বক্তব্য ছিল, তাঁর সময়ে বিলেতের উঁচুশ্রেণিও এমন দাবি করতে পারত না যে, তারা ভারতীয়দের থেকে শ্রেষ্ঠ। বিলেতে এবং ভারতে তারা উদ্দাম, উত্তেজনাপূর্ণ জীবনের পেছনে ছুটত। তিনি সমসায়মিক লন্ডনের ধনীদের লাম্পট্য ও নীতিজ্ঞানহীনতার কথা উল্লেখ করেছেন, যার প্রভাব পড়েছিল নিচু শ্রেণির ওপর। এটা ছিল নীতিভ্রষ্টতার সুবর্ণযুগ। উঁচুতলার ব্রিটিশ মহিলারা যদিও অবাধ যৌনাচারে লিপ্ত থাকত না, বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক ছিল অতিসক্রিয়। আঠারো শতকে অভাব ছিল না অবৈধ সন্তানের।৭ক Sketches of India-র অজ্ঞাতনামা লেখক অবশ্য তাদের উন্নত নৈতিক চরিত্রের শংসাপত্র দিয়েছেন দরাজ মনে। তারা নাকি এমনই স্বচ্ছ চরিত্রের ছিল যে, এদেশে এসে জীবনসঙ্গী নির্বাচনে যথেষ্ট বিবেক ও বিবেচনার পরিচয় দিত।

ক্লাইভ ও তাঁর সমসাময়িক তরুণরা এদেশে আসার সময় কেউ উচ্চনীতিবোধ নিয়ে আসেনি। ফলে নীতিভ্রষ্ট হওয়ার পরিবেশ ও পরিস্থিতি যখন তাদের সামনে হাজির হয়, তারা তার সুযোগ নিয়ে কসুর করেনি। পলাশি যুদ্ধের ফলাফল তাদের উপহার দিয়েছিল সেই পরিবেশ ও পরিস্থিতি। দুর্নীতিই হয়ে উঠেছিল তাদের নীতি। ক্লাইভ থেকে ওয়ারেন হেস্টিংস, এই সময়ের মধ্যে অনেক ইংরেজ স্বদেশে ফিরে যায় ‘নবাব’ তকমা অঙ্গে ধারণ করে। বিলেতের মানুষ তাদের ঐশ্বর্য দেখে বিস্ময়ে বোবা হয়ে গিয়েছিল। পলাশি ও বক্সারের পরের কয়েকটা বছর ছিল লুণ্ঠন ও দুর্নীতির পৌষমাস। রিচার্ড বারওয়েল তাঁর বাবাকে লিখেছিলেন, ‘নিশ্চিত স্বাচ্ছন্দ্য লাভের পথ হল ভারতে আসা। একটু সচেতন থাকলে, একেবারে নির্বোধ হলেও… ধনী হওয়ার যথেষ্ট ইতিবাচক উপায় আছে।’ পলাশির পনেরো বছর পরে ক্লাইভ পার্লামেন্টে সদম্ভে অতীতের স্মৃতিচারণ করে বলেছিলেন, ‘এক বিশাল পরিমাণ অর্থ আমার ইচ্ছের মধ্যে ছিল, একটা সমৃদ্ধশালী শহর ছিল আমার করুণার আশ্রয়ে, এর ধনী মহারাজরা আমার এক টুকরো হাসি দেখার জন্য পরস্পর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হত। আমার একার জন্য খুলে দেওয়া হত কোষাগার, মুঠো ভর্তি সোনা-জহরত। মি. চেয়ারম্যান, এই মুহূর্তে আমার নীতিবোধে আমি বিস্ময়বোধ করছি।’১০ এই নীতিবোধের দম্ভকে ইতিহাস সমর্থন করে না। ইতিহাস অন্য কথা বলে।

কোম্পানির কর্মচারীদের নীতিজ্ঞানহীনতার প্রবল স্রোতে প্রথম বাঁধ দেওয়ার চেষ্টা করেন লর্ড কর্নওয়ালিশ। এই উদ্যোগ নেওয়ার পেছনে দুটো কারণ ছিল। প্রথম, তিনি ছিলেন ইংল্যান্ডের অতি উচ্চবংশজাত সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারের সন্তান। সে দিক থেকে তাঁর সঙ্গে ক্লাইভ বা হেস্টিংসের তুলনাই চলে না। দ্বিতীয়, কর্নওয়ালিশ ক্লাইভ ও হেস্টিংসের তুলনায় অনেক পরিণত বয়সে এদেশে এসেছিলেন। তিনি তাঁর প্রবাসী স্বদেশবাসীর কাছে এসেছিলেন সম্মান ও নৈতিকতার ব্রিটিশ ধারণা নিয়ে।

তবে সিভিলিয়ানদের চারিত্রিক ত্রুটি-বিচ্যুতি দূর করে তাদের নৈতিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ করার প্রথম ইতিবাচক পদক্ষেপ নেন লর্ড ওয়েলেসলি। এমনিতে তাঁর চরিত্র খুব একটা উন্নতমানের ছিল না। কিন্তু যতদিন গভর্নর-জেনারেল পদে ছিলেন, কোনও চারিত্রিক কলঙ্ক যেমন গায়ে মাখেননি, কোনওরকম দুর্নীতিও তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ প্রতিষ্ঠার পিছনে তাঁর অন্যতম উদ্দেশ্য কেবল সিভিলিয়ানদের প্রশাসনিক কাজে দক্ষ করে তোলাই ছিল না, তাদের স্বচ্ছ ভাবমূর্তি গড়ে তোলার পরিকল্পনাও ছিল। সমসাময়িক সিভিলিয়ানদের অসংস্কৃত আচরণের নিন্দা করে ১৮০০ সালে যে বিবৃতি দেন তা ‘Notes on the necessity of a special collegiate training of Civil Servants’ নামে পরিচিত।১০ক ১৮০৪ সালে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের একদল ছাত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেন কোম্পানির প্রবীণ সিভিলিয়নদের অনৈতিকতা ও চারিত্রিক দূষণের বিরুদ্ধে।১০খ কিন্তু এটা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। সাধারণভাবে এই কলেজের ছাত্রদের আচরণ এবং কার্যকলাপ কলেজ কর্তৃপক্ষের যথেষ্ট মাথা ব্যথার কারণ ছিল। তাদের উচ্ছৃঙ্খলতা এবং কলেজের নিয়ম ভাঙার প্রবণতার প্রতিষেধক হিসেবে প্রয়োগ করতে হয় জরিমানা চাপিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা।১০গ

বিলেতের কর্মকর্তারা কোম্পানির কর্মচারীদের নীতিভ্রষ্টতার আঁচ পেয়েছিলেন অনেক আগে, ১৭৭০-এর মন্বন্তরের সময়। ওই বছর কোম্পানি দেখে তার দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। ব্রিটিশ সরকারের কাছে আর্জি পেশ করতে হয় সরকারের প্রাপ্য চার লক্ষ পাউন্ড দেওয়ার দায়বদ্ধতা থেকে রেহাই পেতে।১১ পরিচালক সমিতি লক্ষ করেছিল, একজন সামান্য রাইটারও মন্বন্তরের বছরে ষাট হাজার স্টার্লিং পাঠিয়েছিল বিলেতে, আগের বছরেও যার দু’ হাজার টাকা পাঠানোর সংগতি ছিল না।১২ অথচ পরিচালক সমিতি যখন মুনাফাবাজদের শাস্তি দেওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করে অপরাধীদের নাম জানতে চায়, কলকাতা কাউন্সিল নিপাট মিথ্যে কথা লেখে, ‘আমরা আপনাদের এটুকু অন্তত নিশ্চিত করার সাহস রাখি যে, দুর্ভিক্ষের সময় একজন ইউরোপীয়ও মানুষের প্রয়োজনীয় বস্তু নিয়ে ব্যাবসা করার সুযোগ গ্রহণ করেনি।’১৩ এই ঘটনার পরই স্বদেশে ফিরে আসা কর্মচারীদের নবাবি চাল দেখে বিলেতের কর্মকর্তাদের বিন্দুমাত্র সন্দেহ রইল না তাদের নৈতিক অধঃপতন সম্পর্কে।১৪ স্বয়ং ক্লাইভও কলকাতা সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘One of the most wicked places in this Universe’, যেখানে সিভিলিয়ানদের ন্যায়-নীতির বালাই নেই।১৫

সম্ভবত এই কারণে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ১৭৭৯ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাজকর্ম ও ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনার জন্য একটা আইন পাশ করার উদ্যোগ নেয়। এই আইনে সুপ্রিম কোর্টকে কতকগুলো ক্ষমতা দানের প্রস্তাব দেওয়ায় আতঙ্কিত হয়ে ওঠে বাংলা প্রেসিডেন্সির কোম্পানির শ্বেতাঙ্গ কর্মচারীরা। তারা প্রতিবাদলিপি পাঠায় বিলেতে, যা সম্ভবত রচনা করেছিলেন জন শোর। তাদের বক্তব্য ছিল, ভারতে কোম্পানির কর্মচারীদের আচরণ সম্পর্কে ভুল বার্তা গেছে পার্লামেন্টে। এই আইনে সুপ্রিম কোর্টকে যে ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে, তাতে আখেরে ক্ষতি হতে পারে কোম্পানির। কিন্তু সমসাময়িক ভারতে শ্বেতাঙ্গ সমাজের সঙ্গে যাদের সামান্য পরিচয় ছিল, তারাও অস্বীকার করতে পারত না যে, ইংরেজদের নীতিবোধ তলানিতে ঠেকে গিয়েছিল।১৬

প্রশ্ন হল, ভারতে এসে অধিকাংশ ব্রিটিশ সন্তান এভাবে কেন অনৈতিক কাজকর্মে জড়িয়ে পড়ত? সম্ভাব্য কারণ ছিল তাদের অপরিণত চিন্তা-ভাবনা। রাইটাররা যখন কলকাতায় আসত, খুব বেশি হলে তাদের বয়স তখন পনেরো কি ষোলো, সবেমাত্র ইস্কুলের গণ্ডি পেরিয়েছে। যারা কখনও নিজেদের পরিচিত এলাকার বাইরে যাওয়ার সুয়োগ পায়নি, মা-বাবা, ভাই-বোনকে ছেড়ে থাকেনি, তারা ছ’ মাস একঘেঁয়ে সমুদ্র দেখতে দেখতে একদিন প্রাচ্যের এই শহরে এসে পৌঁছত। জীবনে তারা প্রথম বাঁধনহারা, তা-ও ওই কচি বয়সে। তখন ভাল-মন্দ বিচার করার ক্ষমতা থাকে না মানুষের, গড়ে ওঠে না আত্মসম্মান এবং সুস্থনীতিবোধ। স্বদেশ থেকে হাজার হাজার যোজন দূরে, মাথার ওপর নজরদারি করার কেউ নেই। স্বদেশের সমাজ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। এই অবস্থায় সমস্ত রকম নীতিহীনতার দরজা খুলে যেত তাদের সামনে। নানা ধরনের আকর্ষণ তাদের ডাকত হাতছানি দিয়ে। বড় কঠিন ছিল সেসব এড়ানো। জমজমাট পার্টির উল্লাস, রেসের ঘোড়া, প্রবীণ সিভিলিয়নদের অনন্ত অমিতাচার— সবকিছু তাদের টানত চুম্বকের মতো। বয়ঃসন্ধিকালে ইন্দ্রিয় সুখের তাড়নায় ভেসে যেত নিজেদের অজ্ঞাতে। এই বিদেশ বিভুঁইয়ে এমন কেউ থাকত না, যার পরামর্শকে তারা গুরুত্ব দিতে পারে শ্রদ্ধার সঙ্গে বিবেচনা করে। নিঃসঙ্গতা কাটাতে সিভিলিয়ানরা ‘জেনানা’ গড়ত, কিংবা আশ্রয় নিত মদের বোতলে। সমস্ত রকম অনৈতিক কাজকর্মে ডুবতে থাকত যতক্ষণ না পর্যন্ত সম্পূর্ণভাবে একটা অপদার্থ মানুষে পরিণত হয়। কলকাতায় সে সময় সায়েব সমাজ তেমন সুগঠিত হয়নি। তাই সমাজের ভ্রুকুটির ভয়ও ছিল না প্রথম দিকে।১৭

একজন সুবিবেচক রাইটার ১৭৭১ সালে ‘Observations on the Present State of the East India Company’ প্রবন্ধে মন্তব্য করেন, তরুণ রাইটারদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। দোষ তো তাদের, যারা আচরণবিধি সম্পর্কে সচেতন না করে, নীতিশিক্ষা না গিয়ে তাদের ছেলেদের বিদেশে পাঠায়। তারা ভুলে যায় কী উদ্দেশ্যে ভারতে পাড়ি দিতে চলেছে। তাই ডুবে যায় লাম্পট্যে, ফুরিয়ে যায় অহেতুক অপব্যয়ে।১৮

উনিশ শতকে কলকাতায় শ্বেতাঙ্গদের নীতিজ্ঞানহীনতার জন্য দায়ী ছিল আত্মসংযমের অভাব, যা দূর করা সম্ভব ছিল তাদের কঠোরভাবে নীতি শিক্ষা দিয়ে। কিন্তু কলকাতায় দীর্ঘদিন ধরে মিশনারী কাজকর্ম নিষিদ্ধ থাকায় খ্রিস্টধর্মের সুনীতিগুলো প্রচার করা সম্ভব হয়নি তাদের মধ্যে। এই শতকের প্রথম কয়েক দশক কোম্পানির কর্তৃপক্ষ এবং ধনী সায়েবরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কলকাতায় খ্রিস্টধর্মের সুসমাচার প্রচারে বাধা সৃষ্টি করেছিল। তাদের আশঙ্কা ছিল, এতে নেটিভদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে, সংকটে ফেলবে কলকাতায় শ্বেতাঙ্গদের অস্তিত্বকে।

রেভারেন্ড ম্যালকম (Malcolm) মনে করেন, খুব কম সংখ্যক সিভিলিয়ন নিষ্কলুষ ছিল।১৯ কলকাতার মুষ্টিমেয় শ্বেতাঙ্গ ছিল গির্জামুখী। মেমদের মধ্যেও ছিল ধর্ম সম্পর্কে সমান উদাসীনতা। তাদের বক্তব্য ছিল, এই পৌত্তলিক দেশে রবিবারে চার্চে যাওয়া অর্থহীন। মেমরা অবান্তর অজুহাতে চার্চে যাওয়া এড়িয়ে যেত। এমিলি এডেন চার্চে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন প্রচণ্ড গরমের দোহাই দিয়ে।২০

একথা সত্যি যে, যেসব তরুণ এদেশে আসত তারা সকলেই বিলেতের সমাজ-পরিত্যক্ত নয়। বার্ক তাদের মধ্যে অন্যায় কিছু দেখেননি। তাঁর মন্তব্য, “There is nothing worse in the boys we send to India, than in the boys whom we are whipping at school….”২১ অ্যাডাম স্মিথও তরুণ সিভিলিয়নদের প্রতি সহানুভূতিশীল। তাঁর বক্তব্য, ‘তারা যা করত, পরিস্থিতির চাপে। যারা তাদের আচরণ নিয়ে বেশি কলরব করে, অমন পরিস্থিতিতে পড়লে তারাও ওর চেয়ে ভালভাবে কিছু করতে পারত না।’২২ বার্ক এবং স্মিথ পদস্থ সিভিলিয়নদের নৈতিকতাকে ইঙ্গিত করলেও, যারা সামাজিক নৈতিকতা সম্পর্কে সরব ছিল, তারা এমন কিছু উন্নত নীতিবোধের নজির রাখতে পারেনি। শ্বেতাঙ্গ সমাজের সার্বিক নৈতিকতার অভাবের মূলে ছিল যথেষ্ট পরিমাণ রাজনৈতিক ও সামাজিক বাঁধনের ঘাটতি।২৩

বিলেতের কর্তৃপক্ষ তাদের কর্মচারীদের অনৈতিক কাজকর্ম সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিল। তারা কলকাতার কর্মচারীদের ভোগ-বিলাসে রাশ টানার জন্য নানা রকম রেগুলেশন পাঠাত। কিন্তু তাতে কোনও লাভ হয়নি। ১৭৩৫ পর্যন্ত একটা অজুহাতই দেখান হত, ওপর থেকে তলা পর্যন্ত কোম্পানির কোনও কর্মচারী তার বেতনের ওপর নির্ভর করে কলকাতায় একটু স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে থাকতে পারে না।২৪ হয়তো এজন্যই কলকাতার কর্তৃপক্ষ চোখ বুজে থাকত ছোটখাটো ব্যাপারে কেউ পরিচালক সমিতির নির্দেশ অমান্য করলে। প্রবীণ সিভিলিয়নদের মধ্যে কেউ কেউ নীতিবোধের নজির রাখলেও তার প্রভাব বুদবুদের মতো মিলিয়ে যেত উঁচুতলার অধিকাংশ সিভিলিয়নের অনৈতিক আচরণে। সুস্থ নীতিবোধ অনুসরণযোগ্য দৃষ্টান্ত হয়ে উঠতে পারত না। রবার্ট ক্লাইভ ‘লর্ড’ হয়ে দ্বিতীয়বার কলকাতায় আসার কিছুদিন পরে জনৈক সিভিলিয়ন তাঁকে বলেন, ‘বিদেশে ভ্যান্সিটার্টের উপচিকীর্ষা স্বদেশে তাঁর অতিথিপরায়ণতার মতোই। তাঁর শাসনকালে তিনি কম করে চার হাজার টাকা দান করতেন প্রতি মাসে। অনেক বিধবা এবং গরিব সঙ্গীহীন তরুণী তাঁর কাছ থেকে সাহায্য পেত। তাদের সুখের বিয়ে হত অথবা যে কোনও ধরনের সমস্যা ও অসুবিধে থেকে মুক্তি পেত।’

ভ্যান্সিটার্টের এই বদান্যতার বর্ণনা কিন্তু ক্লাইভের মনে বিন্দুমাত্র আঁচড় কাটতে পারেনি। প্রত্যুত্তরে তিনি সেই সিভিলিয়নকে বলেন, ‘ভ্যান্সিটার্ট যা করেছেন তা আমার কাছে কোনও দৃষ্টান্ত নয়। আমি সে পথে যেতে চাই না।’২৫

১৭৮০ সালে হিকি সায়েবের গেজেটে একটা ব্যঙ্গাত্মক কাল্পনিক প্রশ্নোত্তর প্রকাশিত হয়েছিল, যা পড়ে সমকালীন কলকাতার সায়েবদের নৈতিক চরিত্রের কিছুটা হদিস মেলে।

‘প্রশ্ন: বাণিজ্য কী?

উত্তর: জুয়া খেলা।

প্রশ্ন: সর্বোৎকৃষ্ট গুণ কী?

উত্তর: ধন।

প্রশ্ন: স্বদেশ প্রেম কী?

উত্তর: আত্মপ্রেম।

প্রশ্ন: সময় সম্বন্ধীয় নিয়ম পালন কী?

উত্তর: ডুয়েল বা অভিসারে অঙ্গীকার যথা সময়ে পালন করা।

প্রশ্ন: ভদ্রতা কী?

উত্তর: অমিতব্যয়িতা।’২৬

ব্যক্তিগত বাণিজ্য নিষিদ্ধ হওয়ার আগে পর্যন্ত বেশির ভাগ সিভিলিয়নের হাতে অর্থের জোগান ছিল অঢেল। এই অর্থই ছিল অনর্থের মূলে। অনেক ক্ষেত্রেই অর্থ হয়ে ওঠে অনৈতিক কাজকর্মের উৎস। সিভিলিয়নদের ব্যক্তিগত আচরণ এবং তারা তাদের যে সামাজিক ভাবমূর্তি দর্শাতে চাইত, দুটোর মধ্যে ছিল দুস্তর ফারাক। মদ্যপানের প্রতিযোগিতা এবং অন্যান্য অনৈতিক আচরণ সামাজিক চৌহদ্দি থেকে সরে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল ব্যক্তিগত জীবনে।২৭ অনেকের বক্তব্য, সায়েবদের ইন্দ্রিয়পরায়ণতার জন্য দায়ী ছিল এদেশের উষ্ণ-আর্দ্র জলবায়ু।২৮ এ ব্যাখ্যা সঠিক বলে মনে হয় না। যারা সে সময় বিলেত থেকে আসত, তাদের অনেকের রক্তে ছিল কামবাসনার বীজ। সেই বীজ থেকে অঙ্কুরোদ্গম হত এখানকার শ্বেতাঙ্গদের সামাজিক পরিবেশ ও তাদের রাজনৈতিক অহমিকার স্পর্শে। উইলিয়ম হিকি নিজেই কবুল করেছিলেন, অবৈধ সম্পর্কের প্রতি তাঁর বিশেষ আসক্তি ছিল। সুন্দরী মহিলা দেখলেই তিনি নিজেকে ঠিক রাখতে পারতেন না। শহরে কোনও সুন্দরী মেম এলেই তার সঙ্গ কামনা করতেন, যখন তাঁর বয়স মাত্র উনিশ। অন্যদিকে পছন্দ করতেন সাধারণ পতিতাদের, যাদের সম্পর্কে লিখতে গিয়ে অন্তরের উষ্ণতা ও আন্তরিক সহানুভূতি প্রকাশ করেন। লন্ডনের ট্যাভার্ন, বেশ্যালয়, এমনকী পকেটমারদের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন ঘনিষ্ঠভাবে।২৯

ওয়েলেসলি তাঁর ফরাসি পত্নী হ্যায়সিনথ-কে (Hyacinthe) বলেন, তিনি লন্ডন থেকে কলকাতায় না এলে গভর্নর জেনারেল তাঁর প্রতি বিশ্বস্ত নাও থাকতে পারেন। এদেশের জলবায়ু তাঁর যৌনাবেগকে ভীষণভাবে উত্তেজিত করে। এটা অজুহাত মাত্র। গভর্নর জেনারেলের পদে যোগ দেওয়ার আগে এবং লন্ডনে ফিরে গিয়ে পত্নীর সঙ্গে বিবাহ-বিচ্ছেদের পরে তিনি ভীষণভাবে অবৈধ যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হয়ে পড়েন। এর ফলে অকাল মৃত্যু ঘটে তাঁর রাজনৈতির জীবনের উজ্জ্বল সম্ভাবনার।২৯ক

উনিশ শতকে সিভিলিয়নরা আর আগের মতো সৌভাগ্য গড়ে তুলতে না পারলেও স্বদেশে তারা যে সামাজিক স্তরে অবস্থান করত, তার থেকে অনেক উঁচু এবং সম্মানজনক স্তরে স্থান পেত কলকাতার শ্বেতাঙ্গ সমাজে। সেই সঙ্গে বিলাস ও আরাম, যা স্বদেশে ছিল দুর্লভ। কিন্তু বিনিময়ে ঝুঁকি নিতে হত ভয়ংকর ক্রান্তীয় অসুখ-বিসুখ এবং অকাল মৃত্যুর হাতছানির। শহরে ‘নবাব’ হতে গিয়ে মূল্য চোকাতে হত আপত্তিজনক শারীরিক ব্যভিচারের।৩০

আঠারো ও উনিশ শতকের প্রথম দিকে কোম্পানির পদস্থ সিভিলিয়ন, ফ্যাক্টর এবং অন্যান্য ধনী সায়েবরা ‘জেনানা’ অথবা উপপত্নী রাখত। অনুমান করা যেতে পারে, কলকাতার সমসাময়িক ধনী অভিজাতদের রক্ষিতা রাখার রেওয়াজটা প্রভাবিত করেছিল সায়েবদের, যারা প্রায়শই আমন্ত্রিত হয়ে যেতেন তাদের মহলে। উনিশ শতকে কলকাতার ধনীদের সামাজিক মর্যাদা প্রকাশ পেত রক্ষিতা রক্ষণে। শিবনাথ শাস্ত্রী লিখেছেন, পদস্থ ব্যক্তিরা কোনও নতুন ব্যক্তির সঙ্গে কারওর পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় বলতেন, ‘ইনি ইঁহার রক্ষিতা স্ত্রীলোকের পাকা বাড়ি করিয়া দিয়াছেন।’৩১ পার্সিভ্যাল স্পিয়ারও মনে করেন, এটা খুব অস্বাভাবিক নয় যে, সায়েবদের ‘জেনানা’ প্রথা সমসাময়িক ভারতীয় আদব-কায়দার প্রভাবে গড়ে উঠেছিল।৩২ এক সময় যে রেওয়াজ প্রয়োজনের তাগিদে শুরু হয়েছিল, ক্রমশ তা ধনী সায়েবদের দৃষ্টিভঙ্গিতে হয়ে দাঁড়ায় সামাজিক সম্মানের মাপকাঠি।৩৩ যে সায়েবের বিবির সংখ্যা যত বেশি, তার সামাজিক মর্যাদাও তত উঁচু মাপের।

আঠারো শতকে সায়েবদের উপপত্নী রাখার পেছনে কারণ ছিল। এই শতকে যে সব তরুণ ইংরেজ কলকাতায় আসত, তারা ধরেই নিত, এই শহরে বা ভারতে দীর্ঘ সময় কাটাতে হবে। এদেশেই ঘর-সংসার করতে হবে বিয়ে করে। কিন্তু তখন কলকাতায় তরুণী মেমের আকাল। রাইটার বা সিভিলিয়নরা যে বেতন পেত এবং কলকাতার বাজারে জিনিসপত্রের মূল্য যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছিল, তাতে স্বদেশে গিয়ে বিয়ে করে এখানে বউ নিয়ে সংসার করা ছিল সাধ্যাতীত। খুব সাধারণভাবে জীবনযাপন করলেও একজন সিভিলিয়নের বছরে অন্তত ৬০০ পাউন্ড প্রয়োজন হত। ওদিকে কলকাতার সায়েব সমাজে তখন উনিশ শতকে কলকাতার দিশি ধনী পরিবারের মতো বিলাস-ব্যসন ও বেপরোয়া টাকা ওড়াবার তীব্র প্রতিযোগিতা, বিশেষ করে মেমদের মধ্যে। তাদের বায়না, সখ-আহ্লাদ পূরণ করতে গিয়ে স্বামী বেচারার করুণ অবস্থা। সুতরাং সাধারণ সিভিলিয়নদের পক্ষে একজন শ্বেতাঙ্গিনীকে বিয়ে করা ছিল সামর্থ্যের বাইরে। যারা বিবাহিত, তারা অনেকে পত্নীকে কলকাতায় আনতে পারত না। তাদের অজুহাত, দীর্ঘ সময় ধরে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ভারতে আসার ধকল তারা সইতে পারবে না। জন শোর ১৭৮৫ সালে বিলেতে গিয়ে বিয়ে করেন। কিন্তু তাঁর পত্নী ভারতে আসতে রাজি হননি। তিনি একাই ফিরে এসে একাকিত্ব ঘুচিয়েছিলেন উপপত্নী রেখে।

পরিচালক সমিতি কর্মচারীদের ভারতীয় উপপত্নী রাখাকে স্বীকৃতি দিয়েছিল একটা বিশেষ কারণে। যে বয়সে তরুণ রাইটাররা কলকাতায় নিকট আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধব, মা-বাবার নজরের বাইরে থাকত, তাতে বেপরোয়া এবং উচ্ছৃঙ্খল হওয়া বিচিত্র ছিল না। পরিচালকরা ভেবেছিলেন, তাদের এই আচরণে রাশ টানা যেতে পারে নেটিভ বিবি রাখার অধিকারকে মেনে নিয়ে।৩৪

ক্যাপ্টেন উইলিমসন আঠারো শতকে কলকাতায় শ্বেতাঙ্গিনীর অভাবের দোহাই দিয়ে সায়েবদের ‘জেনানা’ বা বিবি রাখাকে সমর্থন করেছেন।৩৫ কিন্তু ওয়ারেন হেস্টিংসের সময় তো কলকাতায় মোটামুটি একটা শ্বেতাঙ্গ সমাজ গড়ে ওঠে। বিবাহিত দম্পতির সংখ্যাও ছিল যথেষ্ট। অনেক দিন ধরে বসবাসকারী ইংরেজদের বৈধ কন্যার সংখ্যাও কম ছিল না। তথাপি কেন তখনও ধনী সায়েবদের ‘জেনানা’ লালনের আকর্ষণ কমেনি? ১৮০৪ সালে লর্ড ভ্যালেনসিয়া লিখেছিলেন, ইউরোপীয়দের মধ্যে ‘জেনানা’-র সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়াটা স্বাভাবিক ব্যাপার।৩৬

তবে রাইটারদের মধ্যে ‘বিবি’ রাখার প্রধান কারণ আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যের অভাব। ১৬৭৪ সালে পরিচালক সমিতি সিভিলিয়নদের জন্য যে বেতন কাঠামো তৈরি করে দিয়েছিল, তা অপরিবর্তিত থাকে ১৭৫৮ পর্যন্ত, দীর্ঘ চুরাশি বছর। ১৭৫৯ সালে রাইটারদের বেতন বছরে পাঁচ পাউন্ড থেকে বেড়ে হয় ২৭ পাউন্ড। ১৭৬৮-তে ওপর তলার কর্মচারীদের বেতন ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেলেও রাইটারদের বেতন পঞ্চাশ পাউন্ডের ওপরে উঠতে পারেনি।৩৭ সুতরাং তাদের এদিশি বিবি রাখা ছাড়া উপায় ছিল না, যে রীতি সে সময় আর্থ-সামাজিক বিচারে মেনে নেওয়া হয়েছিল খোলাখুলিভাবে। তবে একটা মন্তব্য সমীচীন বলে মনে হয়। পদস্থ সিভিলিয়ন যারা ‘জেনানা’ লালন করত, আর রাইটারদের মতো ছোট ইংরেজ যারা দিশি ঘরনি বা মিসট্রেস রাখত, নৈতিকতার বিচারে উভয়কে এক গোত্রে ফেলা যায় না। ‘জেনানা’ বা ‘হারেম’ রাখাটা ছিল ব্যভিচার, ‘বিবি’র ক্ষেত্রে সেটা প্রয়োজনের তাগিদ।

এসব কারণ ছাড়া আর একটা কারণ ‘জেনানা’ বা ‘বিবি’ রাখার রেওয়াজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তা হল, প্রাচ্যের সুন্দরীদের প্রতি সায়েবদের টনটনে টান। হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের নারীর সৌন্দর্যে ফিদা হয়ে গিয়েছিল শ্বেতাঙ্গ পুরুষরা। এ প্রসঙ্গে উইলিয়ম হিকির জেমদানী নামে এক অনিন্দ্যসুন্দরী বিবির কথা উল্লেখ করা যায়, যার আকর্ষণ হিকি সায়েবের কাছে ছিল অপ্রতিরোধ্য।

ওয়ারেন হেস্টিংসের আমলে কলকাতার সায়েব সমাজের ওপরতলার ইংরেজদের নৈতিক চরিত্রের মান নেমে এসেছিল একেবারে তলানিতে। ব্যভিচার, মদ্যাসক্তি, ডুয়েল, পারস্পরিক কলহ, ষড়যন্ত্র— সব মিলে এই সময়কার সায়েব সমাজ কলঙ্কিত হয়ে ওঠে নানাভাবে। এ সবের নাটের গুরু ছিলেন স্বয়ং ওয়ারেন হেস্টিংস। কীভাবে বন্ধুপত্নীকে ফুসলে নিজের বাগে আনা যায়, যা সে সময় কলকাতার প্রভাবশালী ও ক্ষমতাশালী সায়েবদের আচরণের বড় কলঙ্ক ছিল, তার পথ দেখিয়েছিলেন হেস্টিংস।

ভারতে আসার সময় জাহাজে হেস্টিংসের সঙ্গে আলাপ হয় খ্রিসটোফ অ্যাডাম কার্ল ভন ইমহোপ এবং তাঁর পত্নী ম্যারিয়ান ইমহোপ নামে এক জার্মান দম্পতির। হেস্টিংস তখন বিপত্নীক। শ্রীমতী ইমহোপকে দেখে তিনি পাগল হয়ে উঠলেন। মাদ্রাজে তাঁর অতিথি হন জার্মান দম্পতি। সেখানেই সেই দম্পতির সঙ্গে হেস্টিংসের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। ১৭৭০-এর সেপ্টেম্বরে ইমহোপ কলকাতায় আসেন পত্নীকে বন্ধুর কাছে রেখে দিয়ে। ইমহোপ মাদ্রাজ ছেড়ে যাওয়ার আগে হেস্টিংস কলকাতায় তাঁর থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। পরের মাসে শ্রীমতী ইমহোপ কলকাতায় চলে আসেন স্বামীর কাছে। ইমহোপের অবর্তমানে সম্ভবত হেস্টিংস ও ইমহোপ পত্নী পরস্পরের একটু কাছাকাছি চলে আসেন। হয়তো নেহাতই বন্ধুত্ব। কিছুদিন পরে হেস্টিংসও কলকাতায় এলেন মাদ্রাজ ছেড়ে। শ্রীমতী ইমহোপ এবং হেস্টিংসের বন্ধুত্ব নিয়ে কোনও রকম গুজব রটেনি। কারওর ধারণা ছিল না, তাদের সম্পর্ক নিছক বন্ধুত্বের নয়। তলে তলে তা কিন্তু গভীর প্রেমে পরিণত হয়েছিল। ১৭৭২-এ ইমহোপ পরিবারের সঙ্গে হেস্টিংসের সম্পর্কে চিড় ধরল। আর ঠিক সেই সময় বিলেত থেকে নির্দেশ এল, ইমহোপকে অবিলম্বে ভারত ছাড়তে হবে।

ইমহোপ কলকাতা ছাড়ার জন্য প্রস্তুত হলেন। কিন্তু রাজি হলেন না তাঁর পত্নী। তিনি স্বামীকে জানালেন, হেস্টিংসকে বিয়ে করতে চান। রাজি হয়ে গেলেন ইমহোপ। পত্নীকে কলকাতায় রেখে একাই রওনা দিলেন ইউরোপে। শোনা যায়, হেস্টিংস দশ হাজার পাউন্ড ঘুষ দিয়ে ইমহোপকে পত্নীর সঙ্গে বিবাহ-বিচ্ছেদে রাজি করান। ঠিক হয়েছিল, ফিরে গিয়ে ইমহোপ বিবাহ-বিচ্ছেদ প্রার্থনা করবেন জার্মানির আদালতে। বিবাহ-বিচ্ছেদের পর অবশ্য হেস্টিংস ইমহোপকে তাঁর পত্নীর ভরণপোষণের দায় থেকে মুক্তি দেন। বিবাহ-বিচ্ছেদের পর হেস্টিংস বিয়ে করেন শ্রীমতী ইমহোপকে। হেস্টিংস তখন পয়তাল্লিশ, শ্রীমতী তিরিশ। সেন্ট জনস্‌ চার্চের রেজিস্টারে লেখা রয়েছে, ১৭৭৭-এর আগস্ট গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস ও ম্যারিয়ান বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।৩৮

এ হেন গভর্নর জেনারেলের কাউন্সিলররা যে হেস্টিংসের মতোই নীতিজ্ঞানবর্জিত পুরুষ হবেন, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। হেস্টিংসের কাউন্সিলে তাঁর সবচেয়ে বড় বিরোধী এবং শত্রু ছিলেন ফিলিপ ফ্রান্সিস। তাঁর কাণ্ডকারখানা কলকাতার সায়েব সমাজে রীতিমতো হই-চই ফেলে দিয়েছিল। মাথা হেঁট হয়ে গিয়েছিল কলকাতার সজ্জন সায়েবদের।

তেত্রিশ বছরের এক সামান্য কেরানি ফ্রান্সিসকে (১৭৪০-১৮১৮) প্রধানমন্ত্রী লর্ড নর্থ যেদিন গভর্নর জেনারেলের কাউন্সিলের সদস্য করে পাঠান, সেদিন অনেকে অবাক হয়েছিলেন। কাউন্সিলের অন্য সদস্য ক্লেভারিং ও মনসনের মতো তাঁর বংশমর্যাদা ছিল না। বলা হয়, বিলেতে থাকাকালীন তিনি তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গলেখক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। লিখতেন ‘জুনিয়াস’ ছদ্মনামে। তাঁর কলমকে যথেষ্ট ভয় করতেন ইংল্যান্ডের সমসাময়িক রাজনীতিবিদরা। লর্ড নর্থ হয়তো তাঁকে জব্দ করার জন্য ভারতে পাঠান কাউন্সিলর করে। ঠিক জানা যায় না। তবে ফ্রান্সিস কলকাতায় এসেছিলেন অর্থ উপার্জনের থেকে বেশি করে ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি লাভের টানে।৩৯

একুশ বছর বয়সে ফ্রান্সিস বিয়ে করেন শ্রীমতী ম্যাকবেরিকে, ভালবেসে। বিয়ের আট বছর পরে তিনি লেখেন, ‘আমার মনে হয়, প্রধানমন্ত্রীর চেয়েও আমার জীবন সুখের।’ এরকম পত্নীপ্রেমিক ফ্রান্সিস কলকাতায় এসে পালটে গেলেন একেবারে। ভারতে আসার সময় পত্নীকে আনতে চেয়েছিলেন সঙ্গে করে। শ্রীমতী ফ্রান্সিস আসেননি। ভরসা হয়নি পাঁচ কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের জননীর। ১৭৮০ সালে তিনি যখন শুনলেন, তাঁর স্বামী হয়তো আরও এক বছর কলকাতায় থেকে যেতে পারেন, তাঁর মন ভেঙে গেল। সাত বছর ধরে স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ-যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছিলেন না। মনে জেগে উঠেছিল একটা আশঙ্কা। ফ্রান্সিসের মন কি পালটে গেছে? তাঁর ভালবাসায় কি ভাটা পড়েছে? তাঁর আশঙ্কা সত্যি ছিল। সে সময় ফ্রান্সিস শ্রীমতী গ্রান্ডকে নিয়ে মত্ত। মহিলার আসল নাম নোয়েল ক্যাথরিন ওয়েরলি। ১৭৬১ সালে জন্ম। কলকাতায় তখন ক্যাথরিনের রূপের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে, কলকাতার সবচেয়ে সুন্দীর মেম। ক্যাথরিন ছিলেন চন্দননগরের এক দিনেমার ভদ্রলোকের মেয়ে। সেখানে ফরাসি শাসনকর্তার বাড়িতে জর্জ ফ্রান্সিস গ্রান্ডের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটে। দু’জনে প্রেমে পড়েন। ক্যাথরিন তখনও কিশোরী, পনেরো বছর অতিক্রম করেননি। গ্রান্ডের থেকে অনেক ছোট। সম্ভবত, বয়সের এই ফারাকটার মধ্যে বাসা বেঁধেছিল ভবিষ্যতের অশুভ পরিণতি।

গ্রান্ড কলকাতায় এসে একটা চাকরির জন্য ধরে বসলেন বারওয়েলকে, হেস্টিংসের আর একজন কাউন্সিলর। তিনি গভর্নর জেনারেলের কাছের মানুষ। তাঁর সুপারিশে গ্রান্ড পেলেন নিমক মহলের সচিবের পদ। বেতন, মাসে ১৩০০ টাকা। ১৭৭৭-এর ১০ জুলাই গ্রান্ডের সঙ্গে বিয়ে হল ক্যাথরিনের। গ্রান্ড লিখেছেন, তাঁর বিবাহিত জীবন সুখের ছিল। কিন্তু সব ওলোট-পালোট হয়ে গেল ১৭৭৮-এর ৮ ডিসেম্বর। ওই রাতে বারওয়েলের বাড়ি ডিনারে গ্রান্ডের নেমতন্ন ছিল। গ্রান্ড বারওয়েলের বাড়ির পথে রওনা দিলেন রাত ন’টা নাগাদ। তিনি লিখেছেন, ‘ওই রাতে যখন বাড়ি থেকে বেরোই, আমার চেয়ে সুখী ব্যক্তি পৃথিবীতে আর কেউ ছিল না। রাত এগারোটায় যখন ফিরি, আমার মতো হতভাগ্য আর কেউ নেই।’৪০

গ্রান্ডের অনুপস্থিতিতে ফ্রান্সিস নাকি মই ঘাড়ে করে গ্রান্ডের বাড়ি যান অভিসারে, ক্যাথরিনের কাছে। পরনে ছিল কালো পোশাক। কিন্তু ধরা পড়ে যান গ্রান্ডের ভৃত্যদের হাতে। বারওয়েলের বাড়িতে তখন গ্রান্ডের খানাপিনা চলছে। এমন সময় তাঁর এক ভৃত্য এসে খবর দিল, ফ্রান্সিস লুকিয়ে গ্রান্ডের বাড়িতে ক্যাথরিনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে ধরা পড়েছেন জমাদারের হাতে। গ্রান্ড ছুটলেন, হাতে তলোয়ার। বাড়ি পৌঁছতেই ভৃত্যরা জানাল ফ্রান্সিস পালিয়ে গেছেন।

সে সময় কলকাতায় সায়েবদের মধ্যে কোনও কারণে মনান্তর, ঝগড়া-ঝাটি হলে একে অপরকে ডুয়েল লড়তে চ্যালেঞ্জ জানাত। গ্রান্ডও ফ্রান্সিসকে ডুয়েলের চ্যালেঞ্জ ছুড়লেন। ফ্রান্সিস তাতে সাড়া দিলেন না। তিনি জানালেন, যেহেতু তিনি মনে করেন, গ্রান্ডের কোনও ক্ষতি করেননি, তাই ডুয়েল লড়বেন না। গ্রান্ড তখন ফ্রান্সিসের বিরুদ্ধে মামলা করলেন পনেরো লক্ষ সিক্কা টাকা দাবি করে। গ্রান্ড অ্যাটর্নি উইলিয়ম হিকিকে অনুরোধ করলেন তাঁর পক্ষে সওয়াল করতে। হিকি রাজি হলেন না। কারণ ফ্রান্সিস বার্কের বন্ধু, আবার হিকির অন্তরঙ্গ। গ্রান্ড অন্য অ্যাটর্নি নিয়োগ করলেন।

প্রধান বিচারপতি এলিজা ইম্পে তাঁর রায়ে বললেন, ‘অভিযুক্তের অপরাধ নিঃসন্দেহে প্রমাণিত।’ তাঁর জরিমানা হল, পঞ্চাশ হাজার সিক্কা টাকা।৪১ তবে এই ঘটনার পেছনে ক্যাথরিনের প্রশ্রয় ছিল কি না, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। সাক্ষীদের জবানবন্দি থেকে জানা যায়, রাত দশটা নাগাদ ক্যাথরিন দাইকে একটা মোমবাতি আনতে বলেন। দাই মোমবাতি এনে দেখে মালকিনের ঘরের দরজা বন্ধ। ডাকাডাকি করে সাড়া না পেয়ে ভৃত্যদের খবর দেয়। সেই সময় তার নজরে পড়ে দেয়ালে ঠেস দেওয়া রয়েছে একাট মই। আর ফ্রান্সিস নেমে আসছেন। তাঁকে সকলে চিনত। সে সময় নাকি ক্যাথরিন বেরিয়ে এসে ভৃত্যদের অনুরোধ করেন, ফ্রান্সিসকে ছেড়ে দিতে।

ক্যাথরিন ও গ্রান্ড প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন। এমনও হতে পারে, দু’জনের বয়সের ব্যবধানের জন্য ক্যাথরিন মেনে নিতে পারছিলেন না গ্রান্ডকে। কিন্তু ফ্রান্সিসও তো তখন যুবক ছিলেন না। তখন তাঁর বয়স আটত্রিশ। ক্যাথরিন সতেরো। ফ্রান্সিস ভাল ফরাসি জানতেন, বলতে পারতেন। ক্যাথরিনও ফরাসি মেয়ে। এজন্য ক্যাথরিন ফ্রান্সিসের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন, একথা বলা শক্ত। ঘটনাটা রীতিমতো রহস্যজনক ছিল।

গ্রান্ডের সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর ফ্রান্সিস নাকি ক্যাথরিনকে হুগলিতে তাঁর বাগান বাড়িতে নিয়ে আসেন। কলকাতা থেকে ঘন ঘন ছুটে যেতেন সেখানে। কিন্তু ক্যাথরিনের ছিল উচ্চাশা। তাঁর মতো রমণী ফ্রান্সিসের রক্ষিতা হয়ে জীবন কাটানোর কথা ভাবে না। তিনি এরপর মাদ্রাজ সিভিল সার্ভিসের এক তরুণ সিভিলিয়ন, টমাস লিউন-এর সঙ্গে কিছুদিন লন্ডনে কাটিয়ে চলে যান প্যারিসে। সেখানে ১৮০২ সালে বিয়ে করেন নেপোলিয়ন বোনাপার্টের পররাষ্ট্র সচিব মঁসিয়ে ট্যালিরাঁকে। ক্যাথরিন তখন ছত্রিশ। ফ্রান্সিস পরবর্তীকালে তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর কাছে সাফাই গেয়েছিলেন, ক্যাথরিনের ব্যাপারে তাঁর বিশেষ দোষ ছিল না। তাঁর প্রতি দুর্বলতা ছিল, কিন্তু কোনও অপরাধ করেননি।৪২

আঠারো শতকে সায়েবদের সম্পর্কে লিখতে গিয়ে এক অজ্ঞাত লেখক মন্তব্য করেছিলেন, ‘The people of these settlements live in astonishing luxury, but notwithstanding have very little politeness among them… Every man’s fortune seems to depend on death, ruin or removal of another.’৪৩ ওয়ারেন হেস্টিংসের অন্যতম কাউন্সিলর রিচার্ড বারওয়েল কলকাতায় থাকাকালীন যেসব কেলেঙ্কারি ঘটিয়েছিলেন, তা মনে করলে ওপরের মন্তব্যটি যথার্থ বলে মনে হয়। থোমাস নামে জনৈক মিশনারি তাঁর সম্পর্কে বলেন, ‘তিনি (বারওয়েল) এমন একজন ব্যক্তির মনের শান্তি নষ্ট করেছিলেন, যিনি কখনও তাঁর কোনও ক্ষতি করেননি।৪৪

বারওয়েলরা ছিল কলকাতার সুপ্রতিষ্ঠিত ইংরেজ পরিবার। রিচার্ড বারওয়েলের বাবা উইলিয়ম বারওয়েল ১৭৪৮ সালে প্রেসিডেন্ট ও গভর্নর হন মাত্র চোদ্দো মাসের জন্য। বরখাস্ত হয়েছিলেন পরিচালক সমিতির নির্দেশে। তাঁর ছেলে রিচার্ড বারওয়েল কখনও ওই পদে না বসলেও হেস্টিংসের অন্যতম কাউন্সিলর হিসেবে যথেষ্ট প্রভাব-প্রতিপত্তি ভোগ করতেন গভর্নর জেনারেলের ঘনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক হওয়ার সুবাদে। অথচ গভর্নর জেনারেল তাঁকে ঘৃণা করতেন। বারওয়েল ছিলেন রমণীমোহন। হেস্টিংস এক ব্যক্তিগত বার্তায় মন্তব্য করেন, ‘আমার মনে হয়, এদেশের জলবায়ুর প্রভাবে যেসব খারাপ গুণগুলো এদেশের মানুষের মধ্যে দেখা যায়, তা সবই আছে তাঁর মধ্যে।… তিনি অর্থলোভী, কিন্তু অলস। উচ্চাকাঙ্ক্ষী, কিন্তু নিজের দক্ষতা প্রয়োগে অক্ষম। তাঁর একমাত্র পুঁজি হল, ঘুষ ও ষড়যন্ত্র, যা দিয়ে তিনি সব কিছু করতে চান।৪৫

রিচার্ড বারওয়েল ফিলিপ ফ্রান্সিসের মতো বোকামি করেননি সত্যি। কিন্তু যা করেছিলেন, তা সমস্ত বিবেকহীনতা ও নির্লজ্জতার সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। হেনরি ফ্রেড থমসন ছিলেন কোম্পানির নৌবিভাগের একজন কর্মচারী। তিনি মজে ছিলেন সারা বোনার (Sarah Bonner) নামে এক তরুণীর প্রেমে। সারার বাবা ছিলেন একটা নৌযানের মালিক। তিনি যখন মারা যান, সারা খুব ছোট। তার মা আবার বিয়ে করেন একজন দরজিকে, নাম ডাওনিং। পরিবারের অসচ্ছলতার কারণে তার মা তাকে পরিচারিকার কাজে পাঠান, সারা তখন মাত্র পনেরো। ক্রমশ সে পরম রূপসী হয়ে ওঠে। তার রূপ লাবণ্যে ছিল আবেশ সৃষ্টি করার ক্ষমতা। সে আবেশে নিস্তেজ হয়ে পড়ত বিবেক, বোধবুদ্ধি। বারওয়েলের মতো মানুষের পক্ষে সে রূপ উপেক্ষা করা সহজ ছিল না। তিনি সারাকে পাওয়ার জন্য প্রায় পাগল হয়ে উঠলেন।

থমসন কলকাতায় আসার পর শহরের সায়েবরা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসতেন সে সময়কার শ্বেতাঙ্গ সমাজের রীতি অনুসারে। সকল পরিবারের দরজা সকলের জন্য খোলা থাকত। একদিন সন্ধেবেলা একজন অতিথি এলেন থমসনের সঙ্গে দেখা করতে। ভদ্রলোককে তিনি কখনও দেখেননি। তাঁর মার্জিত কথাবার্তা, তাঁর চেহারা, বেশভূষা সব মিলিয়ে মনে হয়েছিল, তিনি একজন নিপাট ভদ্রলোক। তাঁর পরিচয় জানতে চাইলে থমসন জানতে পারলেন তাঁর অতিথি আর কেউ নন, রিচার্ড বারওয়েল। অতিথির সামাজিক অবস্থান ও প্রভাব সেই মুহূর্তে থমসনের মনে হয়েছিল, তাঁর কাছে ভীষণ মূল্যবান। কিন্তু অচিরে আবিষ্কার করলেন বারওয়েল সম্পর্কে তাঁর মূল্যায়ন একেবারেই ভুল। তিনি এসেছেন তাঁর সুখ-আনন্দকে বিনষ্ট করতে। অনেকের সামনে তাঁর হবু স্ত্রীর রূপ ও গুণের তারিফ করে বারওয়েল বোঝাতে চাইলেন তিনি সারার অযোগ্য।

এতে অবশ্য থমসন ও সারার বিয়ে আটকানো গেল না। কিন্তু তাদের বিয়ের পরও বারওয়েল হাল ছাড়লেন না। সারাকে চিঠি লিখতে থাকলেন গোপনে। এমনই একটা চিঠি হুবহু তুলে দেওয়া যাক।

“আমার প্রিয়তমা শ্রীমতী,

আমি প্রতি মুহূর্তে কল্পনা করি, তুমি তোমার স্বামীর আলিঙ্গনে বদ্ধ। যে চুম্বনগুলি তার ওপর বর্ষিত হচ্ছে, সেগুলির স্বাদ আমি একলা পেতে চাই। কিন্তু আমার কপালে নেই। কেন অনুতাপ করব। যদি তার চুম্বন এবং আলিঙ্গন তোমার বিস্বাদ ঠেকে, গ্রহণ করো না। আর যদি সেগুলি তোমাকে আনন্দ দেয়, তাতে আমার কেন অভিযোগ থাকবে? সেগুলি থেকে তোমাকে কেন বঞ্চিত করব? আদরের মেয়ে, তোমাকে দোষ দিচ্ছি না… আমাকে দোষ দিও না এজন্য যে, আমি তোমার স্বামীর সুখে কিঞ্চিৎ ঈর্ষাকাতর। তোমাকে আমি ভালবাসি, আমি চাই তুমি আমার কাছে থাকো। তোমার স্বামী দূরে থাকুক।

তোমার সবচেয়ে আদরের

রিচ বারওয়েল

মার্চ ৩, ১৭৭১।”৪৬

১৭৭১-এর মার্চ থেকে নভেম্বরের মধ্যে বারওয়েল এমন বারোখানা চিঠি লিখেছিলেন সারাকে। সারার দুটো সন্তান হয়েছিল। কিন্তু থমসনের কথায়, ‘সন্তান দুটো কার, সেটা শুধু সারাই বলতে পারে, আমার না বারওয়েলের।’৪৭ ক্লাইভ বলেছিলেন, ‘বন্ধুপত্নীদের শয্যাসঙ্গী হওয়া ছাড়া বারওয়েলের কোনও গুণ আছে বলে জানি না।’৪৮

এইসব ঘটনার প্রেক্ষিতে একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে যায়। আঠারো শতকের শেষ দিকে শুধু কলকাতার সায়েবরাই ব্যভিচারে পটু ছিল না, সমান পটীয়সী ছিল মেমরাও। শুধু উঁচুতলার সম্ভ্রান্ত মেমরাই নয়, নিচুতলার গোরা সেনাদের মেমদেরও যথেষ্ট কুখ্যাতি ছিল। সেনা শিবিরে নানা অনৈতিক কাজকর্মে অভ্যস্ত ছিল তারা। মনে করা হত, মেমরা সায়েবদের থেকেও বড় মাতাল। তারা মাঝে মাঝে এমন দৃশ্য সৃষ্টি করত, যেটা নেটিভদের কাছে ছিল দৃষ্টিকটু। মেমরা এমন মাতলামি করতে পারে, তা তাদের ধারণার বাইরে ছিল।৪৯

থমসন ১৭৭৩ সালে ইংল্যান্ডে ফিরে যান। সারা থেকে যান কলকাতায়। কিছুদিন পরে থমসন বারওয়েলের একটা চিঠি পেলেন। তাঁকে অনুরোধ করা হয়েছে, তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের জন্য কলকাতায় ফিরে আসতে। থমসন ফিরে এলেন কলকাতায়। কিন্তু সারার সাক্ষাৎ পেলেন না। জানতে পারলেন, সে ইতিমধ্যে ১৭৭৫-এর সেপ্টেম্বরে পাড়ি দিয়েছে বিলেতের উদ্দেশে। কলকাতার সায়েব সমাজ ও সরকারের ওপর বারওয়েলের তখন অখণ্ড প্রভাব। থমসন সরকারি নির্দেশ পেলেন, বারওয়েলের কেলেঙ্কারির কথা যেন চাউর না হয়। এর সঙ্গে কোম্পানির মান-সম্মানের প্রশ্ন জড়িয়ে ছিল। তাই এই নিষেধাজ্ঞা। আসলে, কাউন্সিল বিব্রত ছিল বারওয়েলের বেপরোয়া আচার-আচরণে। তাঁকে বাধ্য করা হয় সারাকে লন্ডনগামী জাহাজে তুলে দিতে।

বারওয়েলের পরের কেচ্ছা কুমারী মারিয়া মার্গারেট ক্লেভারিংকে নিয়ে। সে তথ্য সরবরাহ করেছেন ফিলিপ ফ্রান্সিস। এই দুই কাউন্সিলরের মধ্যে সম্পর্ক ছিল সাপে-নেউলে। ফ্রান্সিসের আগের থেকেই ক্ষোভ ছিল বারওয়েলের ওপর। কারণ, তাঁর প্রণয়িনী ক্যাথরিনের স্বামী গ্রান্ডের সঙ্গে বারওয়েলের বন্ধুত্ব ছিল। ফ্রান্সিস জানিয়েছেন, বারওয়েল বিয়ের প্রস্তাব দেন কুমারী ক্লেভারিংকে। এ বিয়ে সুখের হবে না বলে ফ্রান্সিসের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল। তিনি মনে করতেন, বারওয়েল যে ধরনের ‘চতুর, নিষ্ঠুর, লোভাতুর, স্বেচ্ছাচারী এবং দুশ্চরিত্র’ তাতে শুধু অসম্মানই হবে ক্লেভারিং পরিবারের।

জেনারেল ক্লেভারিং ছিলেন ফৌজি অফিসার। তিনি এই প্রস্তাবিত বিয়ের কট্টর বিরোধী ছিলেন। তিনি চাননি, তাঁর প্রিয় কন্যার সঙ্গে বারওয়েলের মতো একজন হীনচরিত্রের মানুষের বিয়ে হোক। তবে ব্যাপারটা বানচাল হয়ে গেল অন্য এক ঘটনার অভিঘাতে। জানাজানি হয়ে গেল, বারওয়েল কয়েকজন আর্মেনিয়ান ব্যবসায়ীর সঙ্গে প্রতারণা করেছেন জমি বেচা-কেনা নিয়ে। তাই নিয়ে বচসা শুরু হল বারওয়েল ও ক্লেভারিং-এর মধ্যে। বারওয়েল পরে অপরাধ কবুল করলেও সেই মুহূর্তে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলে দু’জনে ডুয়েলে মুখোমুখি হলেন। ক্লেভারিং-এর গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। কিন্তু বারওয়েল আদৌ গুলি ছুড়লেন না। অনেকের অনুমান, তিনি নিষ্ক্রিয় ছিলেন জেনারেলের মেয়ের প্রতি ভালবাসার টানে। এতে হতাশ হয়েছিলেন ফ্রান্সিস। তিনি আশা করেছিলেন, ক্লেভারিং ব্যর্থ হবেন না। তাঁর গুলি ফুটো করে দেবে বারওয়েলের কপাল। এত কাণ্ড হওয়ার পর বারওয়েল শেষ পর্যন্ত বিয়ে করেন এলিজাবেথ জেন স্যান্ডারসনকে। সেই মহিলারও অনেক অনুরাগী ছিল। তবে বিয়েটা সুখের হয়নি। অন্য কোনও কারণে নয়, বিয়ের দু’ বছর পরে ১৭৭৮ সালে শ্রীমতী বারওয়েল গতায়ু হন।৫০

এই ডুয়েল লড়া ছিল আঠারো শতকে কলকাতার সায়েব সমাজে এক অবাঞ্ছিত এবং দুঃখজনক রেওয়াজ। ডুয়েল হয়েছিল ওয়ারেন হেস্টিংস ও ফ্রান্সিসের মধ্যে। আলিপুর সেতুর প্রায় বিপরীতে দুটো বড় গাছ ছিল সে সময়। এই গাছের নীচে সেই লড়াই হয়েছিল বলে তাদের নাম হয় ‘The Tree of Destruction’.৫১ ডুয়েলে হেস্টিংসের গুলিতে আহত হয়েছিলেন ফ্রান্সিস। হেস্টিংস অক্ষত ছিলেন। শুধুমাত্র বড় ইংরেজরাই ডুয়েল লড়ত না। এই রেওয়াজ ছড়িয়ে গিয়েছিল সর্বস্তরে, সামরিক অসামরিক উভয়ক্ষেত্রেই। সায়েবদের সম্মানবোধ ছিল প্রখর। কোনও কারণে, তা যত সামান্যই হোক না কেন, সেই সম্মানে কেউ আঘাত করলেই হত ডুয়েল। কেল্লায় হয়তো কোনও সৈনিক গান গেয়ে হই-হল্লা করে কারওর রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে, অমনি শুরু হত দু’জনের ডুয়েল। বেটিং-এ কেউ হেরে গিয়ে টাকা দিতে না পারলে ফয়শলা হত ডুয়েলে। এমনকী, ১৮৩০-এর দশকে কলকাতায় বিখ্যাত প্রাচ্য পাশ্চাত্যবাদীদের বিতর্ক দুই পক্ষের মধ্যে এমন তিক্ত সম্পর্ক সৃষ্টি করেছিল যে, ডুয়েল হয়েছিল কয়েকজন পরস্পরবিরোধীদের মধ্যে। উইলিয়ম টেলর (William Tayler) তাঁর Thirty Eight years in India গ্রন্থে কলকাতার আইনজীবী লিঙ্গুভিল ক্লার্ক (Lingue ville Clark) এবং রেভা. আলেকজান্ডারের মধ্যে ডুয়েলের উল্লেখ করেছেন। প্রথমজন প্রাচ্যবাদী, অপরজন পাশ্চাত্যবাদী। অথচ ১৮২৭ সালে ডুয়েল নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল এক আইনে।৫২

মহিলারাও ডুয়েলের জন্য বিশেষভাবে দায়ী ছিল। সুন্দরী শ্বেতাঙ্গিনীর অধিকার নিয়ে অনেক সময় ডুয়েল হত দুই শ্বেতাঙ্গের মধ্যে। Hartly House-এর লেখিকা লিখেছেন, কলকাতার বিবাহিতা নারীকে বীরত্ব দেখাবার যে অভ্যেস পুরুষের ছিল, তা ফ্রান্সের সেই বীরত্বের সঙ্গে বিশেষ মিল দেখা যায়— ‘I trust you with my wife— you trust me with yours’, এটাই ছিল আঠারো শতকে কলকাতার সায়েব ভদ্রলোকের মধ্যে চলতি মনোভাব।৫৩

কলকাতার সায়েব সমাজে উঁচুতলার সায়েবদের অনৈতিক আচরণের জন্য সুপ্রিম কোর্ট কম দায়ী ছিল না। প্রধান বিচারপতি এলিজা ইম্পে তো লোলুপতা এবং অন্যায় বিচারের মূর্ত প্রতীক ছিলেন। যেমন তিনি ছিলেন দুর্নীতিগ্রস্ত, তেমনি তাঁর নীচের স্তরের ব্যক্তিরাও অপযশে ছিলেন প্রায় তাঁরই সমান। গোটা ছবিটা ছিল হতাশাজনক। ১৭৮০ সালে হিকির গেজেট কলকাতার বড় ইংরেজদের কীর্তিকলাপ ফলাও করে বর্ণনা করলে, তা সহ্য করা সম্ভব হয়নি শ্বেতাঙ্গ সমাজের। হিকিকে বাধ্য করা হয় সংবাদপত্র গুটিয়ে নিতে। তবে বিলেতের মানুষের মধ্যে তীব্র বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যেত সিভিলিয়নদের অনৈতিক কাজকর্মের বিরুদ্ধে। অবৈধভাবে পাওয়া সৌভাগ্যের সুবাদে হঠাৎ-নবাবদের স্পর্ধা ক্ষুব্ধ করেছিল বিলেতের সমাজকে। মাইকেল এডওয়ার্ডস (Michael Edwards) তাঁর The Nabobs at Home গ্রন্থে লিখেছেন, বিলেতের সামাজিক বিন্যাসকে এলোমেলো করে দেওয়ার এ এক অশুভ ইঙ্গিত। ব্রিটেনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনে প্রাচ্যের দুর্নীতি ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্য তাদের অভিযুক্ত করা হয়।৫৪ এখানে একটা প্রশ্ন উঠে আসে। প্রাচ্যের দুর্নীতির সঙ্গে পরিচয় কি তাদের ব্যক্তিগত দুর্নীতি এবং অনৈতিক কাজকর্মের উৎস? প্রাচ্য দুর্নীতিমুক্ত ছিল না, একথা যেমন সত্যি, তেমনি একথাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, তাদের সীমাহীন লোভ টেনে নিয়ে গিয়েছিল দুর্নীতি ও নীতিজ্ঞানহীনতার পাঁকে। The Nabob at Home-এর নাট্যকার স্যামুয়েল ফুট (Samuel Foote) যে সব নীতিহীন চরিত্রের পরিচয় দিয়েছেন, তাদের অনৈতিক কাজকর্মে হাতখড়ি কি প্রাচ্যের পরিমণ্ডলে হয়েছিল?৫৫

কলকাতার ইংরেজরা ওলন্দাজদের মতো সৌজন্যবোধেরও পরিচয় দিতে পারেনি। তাদের আপ্যায়ন করার সময় ইংরেজরা তাদের সঙ্গে আচরণ করত একটা অপরিচিত জাতি হিসেবে। বিপরীতটা হলে ওলন্দাজরা অপরিসীম সৌজন্যবোধ দেখাত, কখনও বদমেজাজ প্রকাশ করত না। ওলন্দাজরা না হয় অন্য দেশের মানুষ, কোম্পানির কিছু কর্মচারী দ্বিধা করত না নিজের দেশের স্বাধীন বণিকদের সঙ্গে উদ্ধত আচরণ করতে। উইলিয়ম বোল্টস্‌-এর সব কথা হয়তো ধ্রুব সত্যি নয়। কিন্তু কোম্পানির কর্মচারীদের আচরণ সম্পর্কে তিনি যা বলেছেন, তা ঠেলে দেওয়ার মতো নয়। তিনি বলেছেন, তারা স্বাধীন ইংরেজ বণিকদের সঙ্গে আচরণে নিজেদের ক্ষমতার অপব্যবহার করত।৫৬ পদস্থ কর্মচারীদের অভব্য আচরণে সংক্রমিত হয়েছিল রাইটার্স বিল্ডিং-এর রাইটাররাও। তাদের উচ্ছৃঙ্খল আচরণ সম্পর্কে সরকারি তথ্য আছে। তারা নিশানা অভ্যেস করত পথচারীর দিকে শক্ত গুটলি ছুড়ে। কখনও মুসলমানদের ধর্মীয় মিছিলে এমনভাবেই তাক করত।৫৭ যারা চুরি, ছিনতাই, ডাকাতির মতো কাজ করতে সাহস করত না, তারা অর্থ উপার্জনের জন্য ধরত বাঁকা পথ। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল টাকা জাল করা। ১৮২৩ সালে জেমস ট্রিজার (James Treaser) নামে এক সায়েবের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় ব্যাংক নোট ও কোম্পানির কাগজ জাল করার প্রচুর যন্ত্রপাতি।৫৮

১৮০৭ সালে বিলেত আর কলকাতার কর্মকর্তাদের মধ্যে রীতিমতো মতান্তর ঘটে সাধারণ শ্বেতাঙ্গদের নৈতিক মান উন্নত করার উপায়কে কেন্দ্র করে। তার আগে ১৭৯২-এ কমন্স সভায় আলোচনার সময় উইলবারফোর্স ভারতে কোম্পানির এলাকায় মিশনারিদের কাজকর্ম করার পক্ষে সওয়াল করেন, যাতে ইংরেজদের ধর্মীয় ও নৈতিক মানের উন্নতি হয়। রাজি হয়নি পরিচালক সমিতি ও মালিক সভা। প্রস্তাবটা বাতিল হয়ে যায়।

অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে থাকে উনিশ শতকের মধ্য ভাগ থেকে। ‘জেনানা’ বা ‘বিবি’ রাখার প্রবণতা হ্রাস পেতে থাকে সময় এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। প্রথম কারণ হল, যেসব নতুন সিভিলিয়ন হেইলিবেরি থেকে আসত প্রশিক্ষণ নিয়ে, তাদের অনুপযুক্ত ছিল দিশি বিবি। দ্বিতীয়, এইসব বিবিদের টাকা দিয়ে কিনে আনা হত তাদের পরিবার থেকে। ইভানজেলিকালদের দৃষ্টিতে তারা ছিল ক্রীতদাসী। বিলেতে ক্রীতদাস প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন ক্রমশ জোরদার হওয়ায় তার ঢেউ এসে পৌঁছয় ভারতে। ফলে ‘বিবি’ রাখার প্রথায় আঘাত পড়ে। তৃতীয়, কলকাতার নগরায়ণে যত উন্নয়ন ঘটতে থাকল, অসুখ-বিসুখের প্রকোপ হ্রাস পেল, বিলেতের সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়েরাও আর আগের মতো ভারত সম্পর্কে ভীতি বোধ করল না। কলকাতায় তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকল। মনোমত শ্বেতাঙ্গিনী পাত্রী পাওয়ায় হ্রাস পেল ‘বিবি’র চাহিদা।৫৯

উনিশ শতকে কলকাতায় শ্বেতাঙ্গ সমাজের কলেবর বৃদ্ধি পেলেও অসামরিক সমাজ লন্ডনের মতো বিশাল ছিল না। তাই কিছু পরিমাণ সামাজিক নিয়ন্ত্রণ কার্যকর করা সম্ভব হয়, যেহেতু সমাজের সকলে পরস্পরের পরিচিত ছিল। সকলেই জানতে পারত তাদের চারপাশে যারা নিত্য ঘোরাঘুরি করে, তাদের মধ্যে কে ভাল, কে মন্দ, কে সংযত, কে উদ্ধত, সৎ না অসৎ, ধার্মিক না অধার্মিক।৬০ তাই অনৈতিক কাজ করার আগে সম্ভবত একবার ভাবত, সম্মতি চাইত বিবেকের কাছে।

সূত্রনির্দেশ

১. Percival Spear, The Nabobs, London (1980), p. 25.

২. The Calcutta Review, May-August, 1844,pP. 294.

২ক. Kathleen Blechynden, Calcutta: Past and Present, New Delhi (2003), p. 108.

৩. The Calcutta Review, তদেব, p. 292.

৪. P. J. Marshall, East Indian Fortunes, London (1976), p. 3.

৫. Ketaki Kushari Dyson. A Various Universe, New Delhi (2006), p. 155.

৬. The Calcutta Review, প্রাগুক্ত, p. 295.

৭. Ketaki Kushari Dyson, প্রাগুক্ত, pp. 155-56.

৭ক. William Dalrymple, White-Mughals, Gurgaon (2004). p. 62.

৮. P. T. Nair (ed.), Calcutta in the 19th Century, Calcutta (1989), p. 195.

৯. Begal Past and Present, Vol. 8, 1914, p. 203.

১০. Percival Spear, Master of Bengal, Clive and His India, London (1975), p. 189.

১০ক. George Smith, The Life of William Carey: Shoe maker and Missionary, London (No date) p. 161.

১০খ. F. Deaville Walker, William Carey: Missionary Pioneer and Statesman, London (1926), p. 239.

১০গ. Bengal Past and Present, vol. XXI, 1920, p. 166.

১১. Ramsay Muir, The Making of British India, London (1917), p. 81.

১২. Gautam Bhadra, Famine of 1770 and Town of Murshidabad (Marxist Muscellany, No 7, p. 36).

১৩. নিখিল সুর, ছিয়াত্তরের মম্বন্তর ও সন্ন্যাসী ফকির বিদ্রোহ, কলকাতা, ২০১৩ (প্রথম প্রকাশ ১৯৮২) পৃ. ২০.

১৪. Harlald Fischer, Tine, Low and Licentious Europeans—Race, class and ‘White- Subalternity’ in Colonial India, New Delhi (2009), P. 28.

১৫. তদেব, p. 29.

১৬. The Calcutta Review, প্রাগুক্ত, p. 293.

১৭. তদেব, p. 298.

১৮. তদেব, p. 303.

১৯. Abhijit Dutta, European Social Life in 19th Century Calcutta, Calcutta (1994), p. 24.

২০. Emily Eden, Letters from India, vol. II, London (1872), pp. 135-36.

২১. The Calcutta Review, প্রাগুক্ত, p. 299.

২২. তদেব।

২৩. তদেব।

২৪. P. J. Marshall, East Indian Fortunes, p. 14.

২৫. The Calcutta Review, প্রাগুক্ত, p. 302.

২৬. রাজা বিনয়কৃষ্ণ দেব, কলিকাতার ইতিহাস, কলকাতা (১৯৮৯), পৃ. ২১৭।

২৭. Harald Fischer- Time, Britain’s other civilising mission: Class prejudice, European, ‘loaferism’ and the work house—system in Colonial India. (The Indian Economic and Social History Review, 2005, vol. 42, p. 301, F.N. 30)

২৮. Anonymous: Sketches of India (P.T. Nair (ed.), Calcutta in the 19th Century, p. 195.

২৯. Ketaki Kushari Dyson, প্রাগুক্ত, p. 153.

২৯ক. William Dalrymiple, প্রাগুক্ত, pp. 323-24.

৩০. E.M. Collingham, Imperial Bodies, Malden, USA, (2001), p. 36.

৩১. শিবনাথ রচনা সংগ্রহ, কলকাতা (১৯৭৬), পৃ. ২৫৮।

৩২. Percival Spear, The Nabobs, p. 36.

৩৩. Michael Edwards, The Sahibs and the Lotus, London (1988), p. 47.

৩৪. Suresh Chandra Ghosh, The Social Condition of the British Community in Bengal, Leiden (1970), p. 73.

৩৫. The Calcutta Review, প্রাগুক্ত, p. 322.

৩৬. তদেব, p. 320.

৩৭. Suresh Chandra Ghosh, প্রাগুক্ত, p. 66.

৩৮. A. Mervyn Davies, Life and Times of Warren Hastings, Delhi, (1988), pp. 232-33.

৩৯. সুবীর রায়চৌধুরী, সে যুগের কেচ্ছা একালের ইতিহাস, কলকাতা (১৯৭০), পৃ. ৭২।

৪০. তদেব, পৃ. ৭৭।

৪১. শ্রীপান্থ, কলকাতা, কলকাতা (২০১৬), পৃ. ১১৯।

৪২. সুবীর রায়চৌধুরী, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৪।

৪৩. T. R. Barret, Calcutta— Strange Memoirs— Foreign Perceptions, Kolkata (2014) p. 85.

৪৪. তদেব,

৪৫. তদেব, p. 88.

৪৬. তদেব, p. 96.

৪৭. তদেব, p. 106.

৪৮. সুবীর রায়চৌধুরী, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭২।

৪৯. Harald Fischer- Tine, প্রাগুক্ত, p. 301.

৫০. T. R. Barret, প্রাগুক্ত, p. 118.

৫১. H. E. Busteed, Echoes from Old Calcutta, New Delhi, (তারিখ নেই), p. 152.

৫২. Abhijit Dutta, প্রাগুক্ত, p. 9.

৫৩. Abhijit Dutta, Glimpses of European Life in 19th Century Bengal, Calcutta (1995), p. 12.

৫৪. E. M. Collingham, The Imperial Bodies, Maldan (USA), 2001, p. 35.

৫৫. তদেব, p. 36.

৫৬. The Calcutta Review, প্রাগুক্ত, p. 304.

৫৭. Sarmistha De, Marginal Europeans in Colonial India: 1860-1920, Kolkata (2008), p. 31.

৫৮. Judicial (Criminal) Proceedings, 18 December 1823, No 33.

৫৯. E.M. Collingham, প্রাগুক্ত, p. 74.

৬০. The Calcutta Review, প্রাগুক্ত, p. 335.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *