কলকাতার সায়েবমেমদের জীবনচর্যা

কলকাতার সায়েবমেমদের জীবনচর্যা

জোব চার্নকের আমলে অর্থাৎ সতেরো শতকের শেষ দিকে কলকাতায় সায়েবদের সংখ্যা আঙুলে গোনা যেত। তখনও তারা কেল্লা গড়ে তুলতে পারেনি। সকলেই কোম্পানির বাণিজ্যকুঠির চার দেয়ালের মধ্যে থাকত। সকলের মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল খড়ের চালের মাটির ঘর। চার্নক কেবল কুঠিতে থাকতেন না। তিনি বাস করতেন হুগলির তীরে কোনও এক জায়গায় তাঁর পরিবার নিয়ে। এই ব্যবস্থা চলেছিল ১৬৯৬ সাল পর্যন্ত। খাওয়া-দাওয়া হত সরকারি টেবিলে একসঙ্গে, প্রেসিডেন্ট, সিনিয়র মার্চেন্ট, ফ্যাক্টর, রাইটার, চ্যাপলেন, সার্জেন সকলে মিলে। সে সময় না ছিল গির্জা, না ট্যাভার্ন, না কোনও বিনোদনের ব্যবস্থা। কলকাতা তখন বাংলার আর দশটা গ্রামের মতো একটা গ্রাম।

আঠারো শতকে পা দিতেই কলকাতার চেহারা পালটাতে থাকল একটু একটু করে। সায়েবদের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পেল। কলকাতার যে এলাকায় তারা বাস করত তার নাম ছিল ‘হোয়াইট টাউন’, শ্বেতাঙ্গদের শহর। কর্নওয়ালিশ ও স্যার জন শোর-এর আমলে ফরাসি বাহিনীর একজন অফিসার, L De Grandpre উত্তর কলকাতা বা নেটিভ টাউনকে আলাদা করে দিয়ে একটা বিভাজন রেখা টেনে দেন। ‘হোয়াইট টাউন’ ও ‘ব্ল্যাক টাউন’ নামকরণ তিনিই করেন।

এই শতকের প্রথমদিকে কলকাতায় কোম্পানির কর্মচারীদের ছিল অফুরন্ত অবসর। তখন সবে বাণিজ্যকুঠির পত্তন হয়েছে। তাই কাজকর্মের খুব একটা চাপ ছিল না। বিলেত থেকে জাহাজ এলে কর্মতৎপরতা দেখা দিত। তা-ও সেটা বিশেষ করে শীতকালে। বছরের বাকি সময়টা একঘেয়ে জীবন। এদেশে মেমসায়েবদের আসার ব্যাপারে কোম্পানির বিলেতের কর্মকর্তারা তেমন দরাজ ছিলেন না। তাই শহরের মেমদের সংখ্যা ছিল খুবই কম। যে ক’জন ছিল, তারা যে একটু গান-বাজনা করবে, সে সুযোগও ছিল না। কলকাতার গরম পিয়ানোর সহ্য হত না, ফেটে যেত। সেটাকে ভাল করে কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হত, না হলে ১৭৫১ সালে কলকাতার গির্জার জন্য পাঠানো অরগ্যানের দশা হত। অরগ্যানটা এখানে টেকেনি, খুলতেই মাটিতে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যায়।

উনিশ শতকেও হোয়াইট টাউনের বাড়ির সংখ্যা ছিল কম। চাহিদা বেশি, তাই বাড়ি ভাড়া আগুন। ১৭৭৯ সালে এলিজা ফে (Eliza Fay) যখন কলকাতায় আসেন, তখনই তাঁকে মাসে দুশো টাকা দিয়ে বাড়ি ভাড়া করতে হয়েছিল। তা-ও তেমন খানদানি এলাকায় নয়। না হলে সেই বাড়ির ভাড়া হত মাসে তিন থেকে চারশো টাকা। ফ্যানি পার্কস (Fanny Parks) উনিশ শতকের বিশের দশকে কলকাতায় এসে চৌরঙ্গি এলাকায় ৩২৫ টাকা দিয়ে একটা বাড়ি ভাড়া করেন। আসবাবপত্র ছাড়াই। পরে আসবাবপত্র আনা হয়। তবে ঘরের মেঝে মাদুর দিয়ে ঢাকা ছিল, কিছুটা কার্পেট দিয়ে। কার্পেটগুলো খুব উৎকৃষ্ট এবং মহার্ঘ, পারস্যের কিংবা মির্জাপুরের। ঘরের লাগোয়া বাথরুম। দুটো ঘরের মধ্যে ঠেলা দরজা। বেশ শৌখিন আসবাবপত্র। সে সময় চিনে বাজারে অনেক সায়েবের আসবাবপত্রের দোকান ছিল। ফরাসি আসবাবপত্র আমদানি করত M. de Bast। তার দোকানে মার্বেলের টেবিল ছাড়াও পাওয়া যেত সুন্দর আয়না এবং বিলাসবহুল কোচ। সায়েব ছুতোর মিস্তিরির তত্ত্বাবধানে দিশি ছুতোররাও খুব ভাল আসবাব তৈরি করতে দক্ষ ছিল। তবে Hartly House-এর লেখিকা, যিনি আঠারো শতকের শেষের দিকে কলকাতায় এসেছিলেন, লিখেছেন, সায়েবদের ঘরের বেশির ভাগ আসবাবপত্র ছিল চাইনিজ। চিনেদের তৈরি সোফা, ডিনার টেবিল, দুধ-সাদা কাপড়ের টেবিল ক্লথ— সবই ছিল খুব উঁচুমানের। তবে আঠারো শতকের মধ্যভাগেও কলকাতায় আসবাবপত্রের দুষ্প্রাপ্যতার কথা উল্লেখ করেছেন শ্রীমতী কিন্ডারসলি। ১৭৬৭ সালে তিনি লিখেছিলেন, আসবাবপত্র কেবল মহার্ঘই নয়, সংগ্রহ করাও ছিল কঠিন।৪ক

বাড়িগুলো ছিল বিলিতি কায়দায় তৈরি। একটা আর একটার লাগোয়া নয়। উঁচু স্তম্ভ দেওয়া বাড়ি সব, স্তম্ভের উচ্চতা প্রায় তিন তলার সমান। (টাউন হল তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, যার অস্তিত্ব এই একবিংশ শতকেই চোখে পড়ে) বাড়ির সামনে পোর্টিকো। সায়েবরা বাগান-বিলাসী ছিল। বাড়ির সামনে অনেকটা জায়গা জুড়ে থাকত বাগান। ঘরে অনেক দরজা-জানলা থাকত। জানলা উঠত ঘরের মেঝে থেকে, ফরাসি কায়দায়। একটা অদ্ভূত ব্যাপার চোখে পড়ত সায়েবদের ঘরে ঢুকলেই। সোফা, চেয়ার, টেবিল সবকিছু দেয়াল থেকে অন্তত এক ফুট ব্যবধানে থাকত। এর কারণ, সরীসৃপ জাতীয় প্রাণী থেকে সতর্ক থাকা। এমা রবার্টস লিখেছেন, কলকাতায় বাড়িতে আসবাবপত্রের বহর তেমন না থাকলেও, যা থাকত তা সবই রুচিসম্মত। দেয়ালে সাজানো থাকত মোমবাতিদান। তার চারপাশে থাকত কাচের শেড। কোনওটায় দুটো, কোনওটায় তিনটে মোমবাতি জ্বালানো যেত। নারকেল তেল ছিল সস্তা। নারকেল তেলের বাতিও ঘর আলোকিত করত।

কিন্তু শ্রীমতী ফেনটন ১৮২৭-এ কলকাতায় সায়েব পাড়ার ঘর-বাড়ি সম্পর্কে তাঁর এক ভিন্ন অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, বিশাল ঘরের চারটে দরজা খোলা রেখে রাতে শোয়ার ব্যবস্থা তাঁর অস্বস্তির কারণ হত, কারণ, বিলেতে এরকম ভাবাই যেত না। যে মহিলার বাড়িতে তিনি অতিথি হয়েছিলেন, সেখানে শোওয়ার ব্যাপারে লিখেছেন, ‘আমার বিছানা ছিল মেঝের ঠিক মাঝখানে। পরদা ছিল না ঘরে। বালিশ ছিল কাঠের টেবিলের মতো শক্ত, বিশাল। ঘরে শুধু একটা চেয়ার ছিল। জামা-কাপড় কোথায় রাখব বুঝতে পারছিলাম না। মুখ ধোওয়ার জন্য একটা বেসিনও ছিল না।’ বেশ বোঝা যায়, তিনি যে বাড়িতে অতিথি হয়েছিলেন, সে বাড়ির মালিক ছিলেন বেশ গরিব।

কলকাতায় সে সময় মাথা গোঁজার জন্য সায়েবমেমদের মোটা রকম দক্ষিণা দিতে হলেও খাবার-দাবার ছিল বেশ সস্তা। ১৭২০ নাগাদ ক্যাপ্টেন হ্যামিলটন লিখেছিলেন, কলকাতার বাসিন্দারা নানান ধরনের ফল ও প্রচুর পরিমাণে মাছ খেতে পায়। ষাট বছর পরে ১৭৮০ সালে শ্রীমতী এলিজা ফে খাবার-দাবার এবং সেগুলোর মূল্যের যে তালিকা দিয়েছেন তা আজকের দিনে কল্পনা করা যায় না। শেষে কৌতুক করে লিখেছেন, ‘ইংল্যান্ডে থাকতে শুনেছিলাম, বাংলার গরম খিদে নষ্ট করে দেয়। কিন্তু আমি এখনও পর্যন্ত সেরকম কিছু বুঝিনি। বরং ব্যাপারটা উলটো। আমি এখানে যে পরিমাণ খাবার-দাবার হজম করছি, তা আগে কখনও করিনি।’

পানীয়ের মধ্যে সায়েবমেমদের প্রথম পছন্দ ছিল ক্লারেট। মদ যেমনই হোক, ঠান্ডা হওয়া বাঞ্ছনীয়। ১৮৩৩-এর আগে পর্যন্ত আবদারের কাজ ছিল সোরার সাহায্যে পানীয় ঠান্ডা করা। কখনও কখনও দিশি জটিল পদ্ধতিতে স্বল্প পরিমাণে বরফ তৈরি হত। তবে তা ছিল বিলাসের সামগ্রী, প্রয়োজন মেটাতে পারত না। ১৮৩৩-এর সেপ্টেম্বরে কলকাতায় প্রথম বরফ আসে। ফ্রেডারিক টিউডর হলেন প্রথম মার্চেন্ট যিনি ভারতে তথা কলকাতায় বরফ রপ্তানি করেন। কলকাতার সায়েবদের যখন জানানো হয় যে, চল্লিশ টন বরফ নিয়ে একটা জাহাজ হুগলি দিয়ে কলকাতার দিকে এগিয়ে আসছে, শহরের সায়েব-মেমরা ভেসে গিয়েছিল উত্তাল উত্তেজনায়। তাদের কাছে এটা ছিল এক অভিনব আনন্দ সংবাদ। উষ্ণ-আর্দ্র জলবায়ুতে সে সময় বরফের আবির্ভাব ছিল আশীর্বাদ। বরফ যখন সত্যি সত্যি কলকাতায় এসে পৌঁছায় ইন্ডিয়া গেজেট লিখেছিল: ‘We are happy to state that the Board of Customs, salt and opium have authorised the landing of the cargo of ice… free of duty.’১০ তবে বরফটা বিলিতি ছিল না। মার্কিন মুলুক থেকে আনা হয়। ‘টাসকানি’ জাহাজে আমেরিকার বোস্টন বন্দর থেকে বরফ আনার জন্য জাহাজের ক্যাপ্টেন Roger-কে গভর্নর জেনারেল বেন্টিঙ্ক সম্মানিত করেছিলেন একটা অপূর্ব সুন্দর ফুলদানি উপহার দিয়ে।১১ কলকাতার সায়েব-মেমদের জানানো হয়, প্রতিদিন সূর্যোদয়ের পর চার আনা সের দরে বরফ বিক্রি করা হবে। আমেরিকানরা কলকাতায় বরফ চালান করে বেশ ফলাও করে ব্যাবসা করেছিল। সমস্যা দেখা দিয়েছিল বরফ সংরক্ষণে। সমস্যার সমাধান করে মেমসায়েবরা। দু’দিনের মধ্যে তিন হাজার টাকা চাঁদা তুলে হেয়ার স্ট্রিটে গড়ে তোলে বরফ-ঘর। শুধু সায়েবমেমদের পানীয়র জন্যই নয়, হাসপাতালের রুগিদের জন্যও প্রয়োজন ছিল বরফের। জাহাজ আসতে দেরি হলে বরফ রেশনিং করা হত। জাহাজ সাগর দ্বীপের কাছে এলে শহরে খবর পৌঁছতে দেরি হত না।

সুরা ছাড়া সায়েবদের পছন্দের পানীয় ছিল চা। ১৬৫০-এর আগে পর্যন্ত চা বিলেতে অপরিচিত ছিল পানীয় হিসেবে। ওই বছর চা এসে পৌঁছায় বিলেতে। এর কয়েক বছর পরে ব্রিটিশরাজ দ্বিতীয় চার্লস দু’ পাউন্ড চা পেয়েছিলেন উপহার হিসেবে। তারপর থেকে বিলেতের সমাজে চা ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে পানীয় হিসেবে। কলকাতার সায়েবমেমদেরও সকালে প্রাতরাশের সঙ্গে পছন্দ ছিল চা-পান।

আঠারো-উনিশ শতকে কলকাতার সায়েবমেমদের কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিনোদন ছিল পার্টি। সে সময় কোম্পানির কর্মকর্তা এবং পদস্থ সিভিলিয়নরা ছাড়াও পার্টির ব্যবস্থা করা হত সরকার পক্ষ থেকে। এর পেছনে একটাই উদ্দেশ্য ছিল, এই বিদেশ-বিভুঁইয়ে কর্মচারীদের একটু ফুর্তিতে রাখা। কলকাতায় সে সময় আজকের মতো বিনোদনের ঢালাও উপকরণ ছিল না। পার্টিতে তারা অন্তত ঘণ্টাখানেকের জন্য হলেও তাদের মন ক্লান্তি আর স্বজনের দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত থাকত। তবে খেয়াল রাখতে হবে, ওই পার্টি ছিল কেবলমাত্র উঁচুমানের ফ্যাশনদুরস্ত মার্জিত রুচিসম্পন্ন সায়েবমেমদের জন্য।১২ বিশেষ পার্টির ব্যবস্থা করা হত বিলেত থেকে আসা কোনও বিশিষ্ট ব্যক্তি কিংবা কলকাতায় কোম্পানির উঁচুপদে সদ্য নিযুক্ত ব্যক্তিদের সম্মাননায়। পার্টি দেওয়ার ব্যাপারে কর্নওয়ালিশের উৎসাহ ছিল প্রবল। প্রায় প্রতিদিনই কুড়ি-পঁচিশজনকে নিয়ে পার্টি দিতেন।১৩

মদ্যপান ও বলনাচ ছিল পার্টির অভিন্ন অংশ। তবে, মদ্যপান ও বলনাচ ছাড়াও বেসরকারি পার্টিতে এমন কিছু ঘটত, যা অসভ্যতার নামান্তর। টেবিলে খেতে বসে অনেক সময় সায়েবরা রুটি ইত্যাদি দলা পাকিয়ে বলের মতো করে পরস্পরের গায়ে ছুড়ে মারত। মেয়েরাও যোগ দিত এই অশালীন আমোদে। অনেকে এমন জোরে ছুড়ত যে, সোজা মুখের ওপর আঘাত করলে তা যথেষ্ট যন্ত্রণার কারণ হত। এই কুৎসিত কৌতুক কিন্তু মোটেই মার্জিত সমাজের উপযুক্ত ছিল না। অনেক সময় ঘটে যেত কলহ-বিবাদ। এমনকী, ব্যাপারটা কখনও কখনও ডুয়েলে পরিণত হত। তার পরিণাম সুখের হত না। পার্টিতে যদি বয়স্করা অনুপস্থিত থাকত, তা হলে পরিস্থিতি হয়ে উঠত আরও মারাত্মক। বিষয়টা বিলেতে ডিরেক্টরদের গোচরে এলে তাঁরা রীতিমতো ক্ষোভ প্রকাশ করে ১৭৭০-এ এক চিঠিতে মন্তব্য করেন, ‘We are sorry to hear that of late there has not been sufficient decorum kept up among our people, and particularly among the young writers and factors, and that there has been Files of Musqueteers sent for to keep peace at dinner times.’১৪ ভাবা যায় অসভ্য ছোকরা সায়েবদের ডিনার পার্টিতে শান্তি বজায় রাখার জন্য সান্ত্রি পাঠানো হত। ক্যাপ্টেন মরিসন বার বার এই রুটি নিয়ে ছোড়াছুড়ির ব্যাপারে তাঁর উষ্মা ও ঘৃণা প্রকাশ করেছিলেন। তিনি মনে করতেন এই খাবারের বল দিয়ে কাউকে আঘাত করা তাকে অপমান করার সামিল। তিনি নিজেই এমন আঘাত পেয়েছিলেন।১৫

কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক হলেও এখানে একটা কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। সরকারি পার্টিতে কেবলমাত্র কোম্পানির পদস্থ কর্মচারীরাই আমন্ত্রিত হত না, অন্যান্য গণ্যমান্য ইউরোপীয় সায়েবরাও নিমন্ত্রণ পেতেন। আঠারো শতকের শেষ দিকেও ইংরেজ-ফরাসিদের মধ্যে সুসম্পর্ক ছিল না। তথাপি কলকাতার সরকারি ডিনারে আমন্ত্রিত হতেন ফরাসি কোম্পানির পদস্থ ব্যক্তিরা। একবার চন্দননগরের গভর্নর মঁসিয়ে লা কমটে ডি মনটিগ্‌নি (Monsieur Le Comte de Motigny), চারজন ফরাসি অফিসার এবং কয়েকজন সিভিলিয়নসহ মোট আঠাশজন ফরাসি এক ডিনারে আমন্ত্রিত হন।

সায়েবদের জীবনচর্যার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল, সকাল-বিকেল খোলা মাঠে ঘোড়ায় চেপে হাওয়া খাওয়া। ইউরোপীয় শহরগুলির পরিকল্পনায় এজন্য প্রথম থেকেই একটা বিশাল খোলা মাঠের ব্যবস্থা রাখা হত। কলকাতা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় শহর হিসেবে মান্যতা পাওয়ায় সে ব্যবস্থা এখানেও হয়। গড়ের মাঠের পরিকল্পনার পেছনে সেটা ছিল অন্যতম ভাবনা, সামরিক প্রযোজন ছাড়াও। উনিশ শতকের প্রথমদিকে গড়ের মাঠ বর্তমান গড়ের মাঠের আয়তনের থেকেও বড় ছিল। নদীর পাড় থেকে কেল্লার দরজা পর্যন্ত রাস্তায় নিষিদ্ধ ছিল ঘোড়া ও ঘোড়া-গাড়ির চলাফেরা। সে রাস্তা সংরক্ষিত ছিল একমাত্র সায়েবমেম ও তাদের ছেলেমেয়েদের পায়ে হেঁটে ভ্রমণের জন্য।১৬ ১৮০৫ সাল নাগাদ ভ্যালেনসিয়া লিখেছিলেন, কলকাতায় সায়েবদের সাধারণত ভোরবেলায় ওঠা অভ্যেস ছিল। উদ্দেশ্য ছিল তাজা বায়ু সেবন করা।১৬ক প্রতিকূল জল-হাওয়ায় শরীর-স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে গেলে এ ছাড়া উপায় ছিল না। ওয়ারেন হেস্টিংস, জন শোর, কর্নওয়ালিশ সকলেই ভোরবেলায় সূর্য ওঠার আগেই ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে কয়েক মাইল পাক খেয়ে আসতেন।

সায়েবমেমরা দুপুরে কখন খেত, সেটাকে ডিনার না টিফিন বলত, তা নিয়ে বিভিন্নজনের কাছ থেকে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। ভ্যালেনসিয়া লিখেছেন, বেলা বারোটায় তারা গরম গরম খাবার খেত। তাকে বলা হত টিফিন। ডিনার খেত সন্ধে সাতটা থেকে আটটার মধ্যে। আবার শ্রীমতী এলিজা ফে-এর বর্ণনায় দেখি তারা ডিনার খেত বেলা দুটোর সময়।

ওপরতলার দায়িত্বশীল বড়ো সায়েবদের দিনের রুটিন প্রায় একরকম ছিল, ঈষৎ পার্থক্য ছাড়া। অনেকেই চেষ্টা করতেন তাঁদের জীবনযাত্রার মুখে লাগাম পরিয়ে টেনে রাখতে। জন শোর সকাল আটটায় প্রাতরাশ খেয়ে ঘণ্টা তিনেক কাজকর্ম করে ডিনার খেতেন। কর্নওয়ালিশও তাই করতেন, তবে ডিনার খেতেন বেলা দুটোয়। এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে, আঠারো বা উনিশ শতকের প্রথম দিকেও কলকাতায় সায়েব সমাজে লাঞ্চ কথাটার প্রচলন ছিল না বলে মনে হয়। নথিপত্রে ‘লাঞ্চ’ শব্দটির উল্লেখ পাওয়া যায় না। ওয়েলেসলি আট থেকে ন’টার মধ্যে প্রাতরাশ সেরে ঘণ্টা চারেক কাজ করতেন। তবে হেস্টিংস-কর্নওয়ালিশের মতো সকালে নয়, বিকেলে সওয়ার হতেন ঘোড়ার পিঠে। কলকাতার গরমের জন্য সায়েবরা সাধারণত দুপুরের পরে কাজকর্ম করতেন না। ১৭৫৪ সালে এক নির্দেশে বলা হয়েছিল, সিভিলিয়ানরা সকাল ন’টা থেকে বারোটা পর্যন্ত দপ্তরে উপস্থিত থাকবে। প্রয়োজন হলে দুপুরের পর চলে যাবে।১৭ পরবর্তীকালে কাজের চাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় এ নিয়ম বাতিল হয়ে যায়। যারা খুব সকালে বিছানা ছাড়ত, তারা দুপুরে ঘণ্টা দুয়েক দিবানিদ্রা দিয়ে চাঙ্গা করে নিত শরীরটাকে। দুপুরে আকণ্ঠ পানাহার করে দরজা-জানলা খোলা রেখে প্রায় উলঙ্গ হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ত গরমের ঠেলায়।১৮ বিছানা বলতে ঘোড়ার চুলের গদি আর পালকের বিছানা। উনিশ শতকের প্রথম দিকেও কলকাতায় সায়েবদের কাছে বালিশ অজানা ছিল।১৯ তবে সায়েবরা খসখসের ব্যবহার করতে শিখেছিল। সুগন্ধি ঘাসের শিকড় দিয়ে তৈরি এই পরদা ভিজিয়ে দিলে একদিকে যেমন ঘর ঠান্ডা থাকত, তেমনি বাইরের বাতাস খসখসের ভেতর দিয়ে এসে খুশবুতে ভরিয়ে দিত সমস্ত ঘর। ১৭৮৯ সালের ১০ মে, ডা. ক্যাম্পবেল এক চিঠিতে হর্ষ প্রকাশ করে লিখেছিলেন, কলকাতায় খসখসের প্রবর্তন এক অতীব আনন্দদায়ক পরিকল্পনা।২০

কলকাতায় সায়েবমেমদের কাহিল করত এখানকার গনগনে গরম ও মশা। ১৮২২-এ কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত লিখেছিলেন, ‘রেতে মশা দিনে মাছি/এই তাড়য়ে কলকেতায় আছি।’ একজন সিভিলিয়ন লিখেছিলেন, এক একটা মশার আকার প্রায় ডাঁশ মাছির মতো। মশাগুলো নবাগতদের বেশি কামড়াত, কলকাতায় যারা অনেকদিন ধরে আছে, তাদের ততটা নয়।২১ গ্রীষ্মের দহন থেকে কিছুটা নিস্তার পেতে সায়েবরা বাধ্য হয়েছিল তাদের বিলিতি পোশাকে কিছু পরিবর্তন আনতে। তারা সুতোর তৈরি কাপড়ের লম্বা ইজের পরত বাড়িতে। একে বলা হত, ‘মশার ইজের’ (Mosquito drawers)। অনেকে সন্ধে হলে হাঁটু পর্যন্ত ঢেকে রাখত পিজবোর্ড দিয়ে, মশার কামড় থেকে রেহাই পেতে। অনেক সায়েব কোটের নীচে মসলিনের বেনিয়ান পরত, যা ঘাম শুষে নিত। সাদা কোট পরা অনিবার্য হয়ে উঠেছিল রোদের তাপকে নিস্তেজ করার জন্য। তবে ওয়েলেসলি সাদা কোট পরা নিষিদ্ধ করেন।২২ বেন্টিঙ্কের আমল পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা বজায় ছিল।

কিন্তু উনিশ শতকের প্রথম দিকেও সন্ধেবেলায় কেউ কারওর বাড়িতে গেলে ঢিলেঢালা পোশাকেই যেত। কোট নয়, গায়ে থাকত সাদা লিনেনের ওয়েস্ট কোট। এটা খুব চালু না হলেও নবাগতরা ওই পোশাক অনুকরণ করত। রাজকীয় বাহিনীর অফিসারদের একটু বেশি দেমাক ছিল। তারা বিলিতি কায়দায় প্রথম প্রথম গরম জলে স্নান করত। কোট পরত। কালক্রমে তারাও বাধ্য হয় কলকাতার রেওয়াজকে রেয়াত করতে।২৩ মেমসায়েবরা গরমকালে বনেট খুলে রাখত। চুলের বিন্যাস করত সাদামাটা ভাবে। সবই গরম থেকে স্বস্তি পাওয়ার জন্য।

কলকাতার গরমে সায়েবমেমদের কিছুটা আরাম দিত টানা পাখা। কলকাতার ধনী বা অভিজাত জমিদার মহলে সাবেকি বড় বড় তালপাতার পাখা দাস-দাসীদের দিয়ে বাতাস করানোর রেওয়াজ থাকলেও সায়েবরা এই উপকরণটি গ্রহণ করেনি। টানা পাখার আবিষ্কার কিন্তু এদেশে নয়। এটা বিদেশি বস্তু। শোনা যায়, এর আবিষ্কারক ছিলেন খলিফা মনসুর (৭৫৩-৭৭৪ খ্রি.)। তাঁর আদি নাম ছিল মিরওয়াহ্‌-চাল-খইস (Mirwaha-tal-Khaish)২৪ ইসলামি সংস্কৃতি ভারতে প্রবেশ করলেও, মোগল ভারতে কিন্তু এর উল্লেখ পাওয়া যায় না। সে সময় হাত পাখার চলন ছিল। মোগলরা কাপড় বা ওই জাতীয় বস্তু দিয়ে তৈরি বড় বড় পাখার বাতাস করাত দাসদের দিয়ে।

বাংলা বা কলকাতায় টানা পাখার আবির্ভাব কবে হয়, বলা কঠিন। অনেকে মনে করেন, আঠারো শতকের শেষ দিকে চুঁচুড়ার ওলন্দাজ ডিরেক্টর বাংলায় প্রথম টানা পাখার ব্যবহার চালু করেন।২৫ ১৭৮০ সালের আগে কলকাতায় টানা পাখার ব্যবহার হত না বলে মনে হয়। ১৭৮৫-তে কলকাতায় এর ব্যবহারের উল্লেখ নজরে পড়ে। মহারাজ নন্দকুমারের ফাঁসির বিচারকালেও এই পাখার দর্শন মেলেনি।২৬ টানা পাখা কতটা আরাম দিতে পারে সে বিষয়ে ওয়ারেন হেস্টিংস ও ফিলিপ ফ্রান্সিসের সম্ভবত যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। সেইজন্য তাঁরা মোগল আমলের হাতপাখাই দাস ছোকরাদের হাতে গুঁজে দিতেন বাতাস করার জন্য।২৭ মাদ্রাজ থেকে কলকাতায় এসে লর্ড ম্যাকারটনে (Lord Macartney) কলকাতায় টানা পাখার ব্যবহার দেখেন। যখন খেতে বসতেন টানা পাখার বাতাস করা হত। ব্যাপারটা তাঁর কাছে রীতিমতো বিলাসিতা বলে মনে হয়েছিল।২৮

টানা পাখার একটা সমস্যা ছিল, বিশেষ করে রাতের বেলায়। পাখার ঝাপটায় ঝপ্‌ করে নিভে যেত মোমবাতি বা তেলের বাতি। সেজন্য বাতিগুলোকে কাচের দেয়াল দিয়ে আড়াল করার ব্যবস্থা করা হয়। সায়েব-মেমরা দিনে-রাতে যখনই খাওয়ার টেবিলে বসত, মাথার ওপর দুলতে থাকত টানা পাখা। দড়ি হাতে সেটাকে টানত একজন ভৃত্য, যে বসে থাকত এক কোণে অথবা ঘরের বাইরে। বিংশ শতকের পঞ্চাশ বা ষাটের দশকে মফস্‌সলে যখন সর্বত্র বিদ্যুৎ যায়নি, তখনও সেখানকার সরকারি দপ্তরে দর্শন মিলত এই ঐতিহাসিক বস্তুটির।

আঠারো শতকে কলকাতায় সায়েব সমাজ ছিল ছোট। খাদ্য-পানীয় ছিল সস্তা। সায়েবদের উপার্জনও মন্দ ছিল না। প্রাচুর্য ছিল অনেক সায়েবের জীবনে। ফলে কলকাতার শ্বেতাঙ্গ সমাজ হয়ে ওঠে আতিথেয়তার আধার। সৌভাগ্যসন্ধানী তরুণ কলকাতায় এসেই পেয়ে যেত কোনও গৃহকর্তার আশ্রয়। টাকা-পয়সা, চাকর-বাকর কোনও কিছুর জন্য তাকে চিন্তা করতে হত না। সবকিছুর ব্যবস্থা করে দিত তার আশ্রয়দাতা। আর সরকারি প্রাতরাশ তো বাঁধাই ছিল। তা দেওয়া হত গভর্নর জেনারেলের সৌজন্যে। বস্তুত, আঠারো শতকে কলকাতার সায়েব মহলে সামাজিকতা ছিল সমস্ত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে এক অনন্য অপরিচিত ছবি। লর্ড ভালেনসিয়া (Lord Valentia) কলকাতায় এসেছিলেন ১৮০৩ সালে। সে সময়ে কলকাতার ইংরেজদের আতিথেয়তার প্রশংসা করতে গিয়ে লেখেন, ‘আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, এদেশে আমার স্বদেশবাসীর আতিথেয়তা উঁচুমাপের এবং তাদের বদান্যতা সত্যিই সীমাহীন।’২৮ক

উনিশ শতকে এই আতিথেয়তার বহর আর বহাল ছিল না। ক্রমশ মিলিয়ে যেতে থাকে সায়েব সমাজ থেকে। তখন কোনও সায়েব পরিবারে ডিনারের সময় আগের মতো চল্লিশ থেকে আশিজন অতিথিকে খাওয়ার টেবিলে দেখা যেত না। দেখা যেত আট থেকে ষোলোজন। পার্টি হলে বড়জোর কুড়িজন। ১৮৪৪-এর এক তথ্য থেকে জানা যায়, বিলেত থেকে কোনও তরুণ সায়েব এলে, আশা করা হত, সে প্রয়োজনীয় সব কিছু সঙ্গে করে আনবে। কলকাতায় এসে হয়তো খাদ্য-পানীয় পেত, কিন্তু আগেকার আন্তরিক আতিথেয়তার স্পর্শ পেত না। বিছানা হয়তো একটা পেত, কিন্তু বালিশ, চাদর, বালিশের ওয়াড়, তোয়ালে এসব কিছু জোগাড় করতে হত নিজেকেই। অন্যের ভৃত্য তার কুটোটা নড়াত না।২৯

এই পরিবর্তনের কারণ ছিল, বাড়ি ভাড়া থেকে শুরু করে নিত্য প্রয়োজনীয় সব কিছুর মূল্যবৃদ্ধি এবং সায়েব সমাজের কলেবর স্ফীত হয়ে ওঠা। তথাপি শ্বেতাঙ্গ সমাজে সহমর্মিতা ও সহযোগিতার মনোভাব অক্ষুণ্ণ ছিল। ওয়াল্টার হ্যামিলটন ১৮২০ সালে লিখেছিলেন, ‘কোনও ইউরোপীয় অফিসারের মৃত্যু হলে তার বিধবা পত্নী ও সন্তানদের জন্য তৎক্ষণাৎ চাঁদা আদায় শুরু হয়ে যেত।’৩০ কলকাতার ইংরেজ চরিত্রের এই উজ্জ্বলতার তারিফ করেছেন অনেকেই। Forbes তাঁর Oriental Memoirs-এ লিখেছেন, ‘আমি জোর দিয়ে বলতে পারি, ভারতে ইংরেজদের চরিত্র তাদের দেশের গর্ব।’ আর লর্ড ভ্যালেনসিয়া মন্তব্য করেন, ‘… my eastern countrymen are hospitable in the highest degree and that their generosity is unbounded.’৩১

কলকাতার সায়েবদের জীবনে একঘেয়েমি ঘোচাবার জন্য যে সব বিনোদনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল থিয়েটার। সায়েবরাই বিলেত থেকে কলকাতায় নিয়ে এসেছিল থিয়েটারের মতো বিনোদনের উপকরণ। কলকাতায় প্রথম নাট্যশালার নাম ছিল Playhouse। স্থাপিত হয় ১৭৫৩ সালে, বর্তমান মহাকরণের পূর্ব দিকে সেন্ট অ্যান্ড্রুজ গির্জার বিপরীতে। সে জায়গায় পরে মার্টিন-বার্ন কোম্পানির ভবন তৈরি হয়।৩২ বলা হয়, লন্ডনে সেই সময়কার প্রখ্যাত শেক্‌সপিরীয় অভিনেতা ডেভিড গ্যারিক-এর (David Garrick) প্রেরণায় গড়ে উঠেছিল এই নাট্যশালা। মাত্র চার বছর টিকে ছিল এই থিয়েটার। ১৭৫৬ সালে নবাব সিরাজ-উদ্‌-দৌলার কলকাতা আক্রমণের সময় নবাবি ফৌজ একে গুঁড়িয়ে দেয়।

পলাশি যুদ্ধের পর ১৭৬০ সালে ট্যাঙ্ক স্কোয়ার বা বর্তমান বি-বা-দি বাগে আর একটা থিয়েটার স্থাপন করা হয় এক লক্ষ টাকা খরচ করে। কিন্তু বক্সের টিকিটের মূল্য একটা সোনার মোহর আর অন্য টিকিট আট টাকা করা হলেও এই থিয়েটার ডুবে যায় দেনার দায়ে।৩৩ সকলেই দ্বিতীয় থিয়েটার প্রতিষ্ঠার সময় নির্দেশ করেছেন ১৭৭৫ সালকে। এর নাম ছিল New Playhouse, আবার Calcutta Theatre-ও বলা হত। প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন জর্জ উইলিয়ামসন।৩৪ এর অবস্থান ছিল রাইটারস্ বিল্ডিংস্‌-এর পেছনে। তখন জায়গাটার নাম ছিল, নতুন চিনা বাজার। এই থিয়েটারের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস, রিচার্ড বারওয়েল, এলিজা ইম্‌পে প্রমুখ গণ্যমান্য সায়েব। কুশীলবরা ছিল সব অপেশাদার। স্ত্রী চরিত্রে অভিনয় করত সায়েবরাই, কারণ মেমসায়েবদের তখন মঞ্চে ওঠার অনুমতি মিলত না। অবশ্য কয়েক বছর পরে বিধি-নিষেধ বাতিল হয়ে যায়। এরপর থেকে সায়েবদের যে ক’টা নাট্যশালা স্থাপিত হয়েছিল, তা প্রায় সবই ছিল চৌরঙ্গি এলাকায় বা তার আশেপাশে। ১৭৮৯ সালে চৌরঙ্গিতে শ্রীমতী এমা ব্রিসটো-র (Emma Bristow) বাস ভবনে স্থাপিত হয় আর একটা নাট্যশালা। শ্রীমতী ব্রিসটো ছিলেন অসাধারণ রূপবতী। ১৭৮৯-এর ৭ মে ক্যালকাটা গেজেট লিখেছিল, ‘Mrs. John Bristow (Emma Bristow) with her reputation as the most handsome and attractive young English lady of her times in Calcutta, was verily the talk of the town.’ শ্রীমতী ব্রিসটো শহরের এলিটদের তাঁর থিয়েটারে টানতে পেরেছিলেন, যেখানে মেয়েরাও পুরুষের ভূমিকায় অভিনয় করত। কিন্তু বড় ক্ষণস্থায়ী হয়েছিল এই থিয়েটার, মাত্র আট মাস। ১৭৯০-এর জানুয়ারিতে শ্রীমতী ব্রিসটো লন্ডনে পাড়ি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই নাট্যশালার মঞ্চে পরদার পতন হয় চিরকালের মতো।

১৭৯৭ সালে আর একটা থিয়েটার গড়ে ওঠে বর্তমান এজরা স্ট্রিটে। নাম ছিল, ‘হোয়েলার প্লেস থিয়েটার’ (Wheler Place Theatre)। এডওয়ার্ড হোয়েলার এক সময় ওরারেন হেস্টিংসের কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন। তবে এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন জনৈক রুশ ভদ্রলোক। এই থিয়েটারের উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল, এখানে আবির্ভাব ঘটে কয়েকজন বাঙালি অভিনেতার।৩৫ এই থিয়েটারের আয়ুও খুব সংক্ষিপ্ত ছিল। সূচনা ১৭৯৭-এর ২১ ফেব্রুয়ারি, বিলুপ্তি ১৭৯৮-এ। আঠারো শতকের শেষ দিকে এরকম আরও দু’একটা থিয়েটারের আত্মপ্রকাশ ঘটলেও, সেগুলোর অকাল মৃত্যু ঘটে নানা কারণে।

উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে অবস্থার একটু পরিবর্তন ঘটে। ১৮১২ সালে ১৮ নং সার্কুলার রোডে স্থাপিত হয় অ্যাথেনিয়ন থিয়েটার। কিন্তু যথেষ্ট সংখ্যক দর্শকের অভাবে এটা বন্ধ হয়ে যায় দু’ বছর চলার পর। তবে সবচেয়ে বিখ্যাত ও আলোচিত থিয়েটার ওই সময়ে, ১৮১৩ সালে স্থাপিত হয় থিয়েটার রোড ও চৌরঙ্গির সংযোগস্থলে। নাম ছিল চৌরঙ্গি থিয়েটার। এই থিয়েটার স্থাপনার পেছনে উদ্যোগ ছিল কলকাতার কয়েকজন বিশিষ্ট জনের। তাঁরা হলেন, হোরেস হেম্যান উইলসন, অধ্যাপক ডি এল রিচার্ডস। দ্বারকানাথ ঠাকুর ছিলেন একমাত্র ভারতীয় যিনি এই উদ্যোগে অংশ নেন। এই নাট্যমঞ্চে অভিনয় করতেন Palmer, Curry, Playfair, Wilson প্রমুখ অভিনেতা। মেমসায়েবরাও অভিনয় করতেন মাসিক বেতনের ভিত্তিতে। বিশিষ্ট অভিনেত্রী ছিলেন শ্রীমতী এসথার লিচ (Esthar Leach)। চৌরঙ্গি থিয়েটার বন্ধ হয়ে যায় ১৮৩৫-এর ১৫ আগস্ট। দ্বারকানাথ ঠাকুর কিনে নেন ৩০,১০০ টাকায়।৩৬

চৌরঙ্গি থিয়েটারের উত্তরসূরি ছিল সনস্‌ সুসি (Sons Souci) থিয়েটার। পার্ক স্ট্রিটে যেখানে বর্তমান সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ, সেখানেই ছিল এর অবস্থান। অবশ্য এর সূচনা হয়েছিল ১৮৩৯-এর ২১ আগস্ট ওয়াটার লু এবং গভর্নমেন্ট প্লেসের সংযোগস্থলে। পরে চলে যায় পার্ক স্ট্রিটে। এই থিয়েটারে নতুন অভিনেতা আমদানি করা হয় বিলেত থেকে। দুটো বিশেষ ঘটনা এই থিয়েটারকে স্মরণীয় করে রেখেছে, মঞ্চে আগুন লেগে (১৮৪৩-এর ২ নভেম্বর) বিশিষ্ট অভিনেত্রী শ্রীমতা লিচ-এর মৃত্যু ও এক বাঙালির ওথেলোর ভূমিকায় অভিনয়। এখানে একটা বিতর্ক রয়েছে। Englishman-এর মতে এই দুর্ঘটনার পরিণামে সন্‌স সুসি থিয়েটার উঠে যায়।৩৭ কিন্তু অন্য এক তথ্যানুসারে এই রঙ্গমঞ্চে শেষবারের মতো অভিনয় হয়েছিল ১৮৪৯-এর ২১ মে।৩৮ ১৮৪৮-এর ১৭ আগস্ট তারিখেও ‘ওথেলো’ অভিনীত হয়েছিল, যাতে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন এক বাঙালি যুবক, বৈষ্ণবচরণ আঢ্য। ডেসডোমিনা হয়েছিলেন অভিনেত্রী শ্রীমতী লিচ-এর সুন্দরী মেয়ে শ্রীমতী অ্যান্ডারসন।

আঠারো ও উনিশ শতকের প্রথমার্ধে কলকাতার সায়েবমেমদের বিনোদনের উপকরণ হিসেবে থিয়েটার খুব একটা জনপ্রিয় হয়নি। অনেকগুলো রঙ্গমঞ্চ গড়ে উঠলেও টিকে থাকতে পারেনি বেশি দিন। বিশেষ করে আঠারো শতকের থিয়েটারগুলোর আয়ু ছিল খুবই সংক্ষিপ্ত। এর পেছনে একটা সম্ভাব্য কারণ ছিল, টিকিটের অতিরিক্ত চড়া মূল্য। একটা সোনার মোহর বা আট টাকা দিয়ে টিকিট কেনার ক্ষমতা সে সময় কলকাতার সায়েব মহলে ছিল সীমিত। দ্বিতীয় কারণ, কলকাতার সায়েব সমাজের অধিকাংশ সদস্য ছিল বিলেতের মধ্য ও নিম্নবিত্ত পরিবারের। তাদের পড়াশুনার দৌড় তেমন ছিল না। শেক্‌সপিয়রের নাটকের রসাস্বাদন করার মতো রস ও রুচি তাদের মধ্যে ছিল না বলেই মনে হয়। অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও তাদের অভিনয়ে অভিভূত না করতে পেরে হতাশ করেছিল দর্শকদের।

প্রায় একই অবস্থা হয়েছিল সায়েবদের বিনোদনের উপকরণ হিসেবে ক্রিকেট খেলা। কোম্পানির আমলে বিনোদন হিসেবে ক্রিকেট যে খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, তেমন তথ্য পাওয়া যায় না, যদিও তারা ক্রিকেট চালু করে উনিশ শতকের প্রথম দশকেই। ১৮০৪-এর ১৮ ও ১৯ জানুয়ারি কলকাতায় সায়েবরা প্রথম ক্রিকেট খেলে বর্তমান রাজভবনের সামনে সবুজ মাঠে। ক্যালকাটা গেজেট খবরটা ফলাও করে ছাপিয়েছিল ২৬ জানুয়ারি। যে দুটো দল এই খেলায় অংশ গ্রহণ করেছিল তারা হল সিভিলিয়ানদের এটোনিয়ান (Etonian) দল ও কলকাতার সিভিলিয়ানদের নিয়ে গড়া দল। এটনদের হাতে বড় বাজে হার হেরেছিল কলকাতার দল। এটনরা করেছিল ২৩২, আর কলকাতা দুই ইনিংস মিলিয়ে মাত্র আশি।৩৮ক

কলকাতার সায়েবরা কিন্তু ঘোড়-দৌড়ের (Race) মজায় মজেছিল বেশ ভালভাবেই। স্বয়ং গভর্নর জেনারেল থেকে শুরু করে বড় সায়েব, ছোট সায়েব সকলেই জড়ো হত রেসের মাঠে। সে সময় রেস শুরু হত খুব সকালে, সূর্য ওঠার পরই। চলত বেলা দশটা পর্যন্ত। ১৮০৩ সালে বেঙ্গল জকি ক্লাবের প্রতিষ্ঠা হয়।৩৯ তখন দুটো ঘোড়-দৌড়ের মাঠ ছিল, একটা গার্ডেনরিচের কাছে আক্রায়, আর একটা ময়দানে। আধুনিক রেস শুরু হয় ১৮১৯ সালে।৪০ ঘোড়া আনা হত আরব থেকে। বোম্বাই ও মাদ্রাজ হয়ে কলকাতায় এসে পৌঁছত। রেসের মাঠ সমস্ত গভর্নর জেনারেলের মনোহরণ করতে পারেনি। ওয়েলেসলি তো এটা জুয়া খেলা মনে করে বন্ধ করে দিয়েছিলেন। সে নিষেধাজ্ঞা খারিজ করেন লর্ড হেস্টিংস, ১৮১৬ সালে। অকল্যান্ডেরও রেসের মাঠের নেশা ছিল। একেবারে সপরিবারে হাজির থাকতেন রেসের মাঠে। তবে ১৮৪২-এর পর রেস সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা হারাতে শুরু করে। এর অন্যতম কারণ ছিল, গোয়ালিয়র, পঞ্জাব ও ব্রহ্মদেশের সঙ্গে কোম্পানির যুদ্ধ।৪১

বিনোদনের জন্য রেসের মাঠে যাওয়া ছাড়াও সায়েবদের নেশা ছিল জুয়া খেলা আর শিকার করা। গল্‌ফ্‌ খেলাও তারা উপভোগ করত। ১৮৩৯ সালে গল্‌ফ্‌ ক্লাবের প্রতিষ্ঠা হয়। সেলবির ক্লাব (Selby’s Club) ছিল জুয়াড়িদের আড্ডা। মেমসায়েবরা পর্যন্ত ডুবে গিয়েছিল জুয়ার নেশায়। ব্যাপারটা এমন পর্যায় পৌঁছে যায় যে, টনক নড়ে ওঠে পরিচালকদের। ১৭২৮ সালে তাঁরা কলকাতার কর্মকর্তাদের সতর্ক করে দিতে বাধ্য হন। ফলে লন্ডনের মতো কলকাতায়ও দশ পাউন্ডের বেশি জুয়া খেলা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। ধরা পড়লে শুধু চাকরি থেকে বরখাস্ত নয়, তুলে দেওয়া হত লন্ডনমুখী জাহাজে।৪২ সায়েবরা বনশূকর শিকার করতে যেত কলকাতার পনেরো মাইল দক্ষিণে, বাখরাহাটে। আর কলকাতার বাইরে একটু এদিক-ওদিক গেলেই মিলত চিতাবাঘ। কলকাতায় তখনও ফুটবল আসেনি। ছোটদের বিনোদনের জন্য আয়োজন করা হত পুতুল নাচের।৪৩

উনিশ শতকে কলকাতার বুকে প্রতিদিন বিকেলে গঙ্গার পাড়ে দেখা যেত এক অসাধারণ দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য। গভর্নমেন্ট হাউস থেকে কেল্লার কপাট পর্যন্ত পথের ওপর সায়েব-মেমরা তাদের ছোট ছেলে-মেয়েদের নিয়ে বেড়াতে আসত। এই পথে গাড়ি-ঘোড়ার চলাচল নিষিদ্ধ ছিল বলে ফুলের মতো শিশুরা ছুটোছুটি করত, হাসত, খেলত মহানন্দে। আর সেই নির্মল দৃশ্য উপভোগ করত বড়রা।৪৪

সায়েবদের দিশি নর্তকীর নৃত্য উপভোগ

১৮১৩ সালে প্রকাশিত দি ইউরোপিয়ান ইন ইন্ডিয়া, ক্যাপ্টেন থোমাস উইলিয়ামসন গ্রন্থ থেকে গৃহীত

সায়েবমেমদের জীবনচর্যায় দিশি প্রভাব:

‘ইতিমদ-অল-দৌলাহ্‌ আমির অল-মামালিক’ এই জবরজং নামের বোঝা বহন করতেন খুবই পরিচিত একজন ইংরেজ। ওয়ারেন হেস্টিংস। জোনাথান ডানকান পরিচিত ছিলেন ‘মুমতাজ অল-দৌলাহ্‌ আমিন অল-মুল্‌ক্‌ ঘাজানফার জঙ্গ’ নামে। আর একজন বিখ্যাত সায়েব, মেজর উইলিয়ম পামার নাম নিয়েছিলেন, ‘ইতিজাদ-অল-দৌলাহ্‌ নাসির অল-মুল্‌ক্ সৌকিত জঙ্গ।৪৫ এমন আরও অনেকে ছিলেন যাঁরা এইরকম মোগল খানদানি নামে নবরূপ নিয়েছিলেন। আঠারো শতকের সায়েবরা এমন সব জব্বর নামের জামা পরতে গেলেন কেন? আসলে, তাঁরা যে সময় এদেশে আসেন, সে সময় মোগল সাম্রাজ্য ভেঙে পড়লেও, মোগলীয় রীতিনীতি, ঠাটবাট, পারসিক সংস্কৃতির দাপট অটুট ছিল। সায়েবরা এসে দেখল, এদেশের মানুষ তাদের বিদেশি নামের বদলে এইসব নাম উদ্ভট হলেও বেশি পছন্দ করে। এমনও হতে পারে, এই বিদেশের মাটিতে ‘আমরা বিদেশি শাসক হলেও তোমাদেরই লোক’, এমন একটা ভান করার প্রয়োজন হয়েছিল তখন। ইংরেজরা ভারত শাসন করেছিল প্রায় দুশো বছর ধরে। সে ইতিহাস বহুচর্চিত। কিন্তু ভারত যে সায়েবদের ভাবনার রাজ্যকে জয় করে তাদের জীবনচর্যায় স্বচ্ছন্দে বিচরণ করেছিল অর্ধশতকের বেশি সময় (১৭৭০-১৮৩০) ধরে, সে ইতিহাস অনেকটাই অনালোচিত। বস্তুত, উল্লিখিত সময়ে শ্বেতাঙ্গ সমাজে এক ব্যাপক কৃষ্টিগত আত্মীকরণ ও সংকরীকরণ ঘটে গিয়েছিল বিস্ময়কর ভাবে।৪৬ কম-বেশি ভারতীয়করণ হয়েছিল প্রায় সমস্ত ইংরেজের। ফিলিপ ফ্রান্সিস লিখেছিলেন, ‘Europeans, by long residence in Bengal, contract the character of the country… There are no such men in Europe, for example, as Hasting, George Vansittart and Barwell.’৪৬ক

তবে অনেকের বক্তব্য, এই ভারতীয়করণ ব্যাপারটা ছিল একেবারেই অগভীর, ভাসা-ভাসা। আঠারো ও উনিশ শতকের অনেকটা সময় জুড়ে সায়েবদের মধ্যে এদেশীয় আচরণ, রীতিনীতির প্রতি কোনও ঘৃণা বা বিরূপ মনোভাব ছিল না। এদেশীয় কেতা-কায়দা যা জীবনধারণের পক্ষে আরামদায়ক ও বিলাসের ব্যাপার, খুব নির্দ্বিধায় গ্রহণ করেছিল তারা। কিন্তু সেটাকে তারা কখনও জীবনের সারবস্তু বলে মনে করেনি। পারসিভ্যাল স্পিয়ার মনে করেন, তারা মুসলমানের ‘জেনানা’ প্রথা গ্রহণ করেছিল, মুসলমান হয়নি। হিন্দুদের প্রচলিত সংস্কার অনুকরণ করেছিল, হিন্দুদর্শনকে মেনে নেয়নি।৪৬খ বক্তব্যটা কিন্তু অর্ধসত্য। কলকাতায় না হলেও ভারতের অন্যত্র ইসলামের প্রভাব এড়াতে পারেনি সায়েবরা। অনেক সায়েব মুসলমান হতে দ্বিধা করেনি রূপসী খানদানি মুসলমানিকে বিয়ে করার জন্য। এমন তথ্যের অভাব নেই। উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত, হায়দ্রাবাদে নিজামের দরবারে ব্রিটিশ রেসিডেন্ট জে এ কার্কপ্যাট্রিক এবং নিজামের বাহিনীতে ভাড়াটে সেনা ডবলিউ এল গার্ডনার। মহাবিদ্রোহের সময় দিল্লিতে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত শ্বেতাঙ্গদের কেশস্পর্শ করেনি বিদ্রোহীরা। মুসলমান সায়েবরা প্রাণে বেঁচেছিল।৪৭ ইংরেজদের হিন্দু অপেক্ষা মুসলমান হওয়ার ঘটনা বেশি সম্ভবত এই কারণে যে, হিন্দুদের পৌত্তলিকতা থেকে ইসলামের একেশ্বরবাদ তত্ত্ব তাদের বেশি করে মনে ধরেছিল, যেহেতু খ্রিস্টানরাও বিশ্বাসী ছিল সেই তত্ত্বে। ডেভিড অক্টোরলনি পুনার এক হিন্দু ব্রাহ্মণ নর্তকীকে উপপত্নী হিসেবে গ্রহণ করার আগে তাকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেন। নাম দিয়েছিলেন, মুবারক উল-নিসা বেগম। সকলের কাছে পরিচিত ছিলেন ‘বেগম আক্টোরলনি’ নামে। সায়েব তার সন্তানদেরও মুসলমানরূপেই মানুষ করেন।৪৮

কলকাতার সায়েবরা বাড়িতে আটপৌরে বেনিয়ান পরত, পান-সুপুরি চিবোত, হুঁকো টানত। কিন্তু সায়েবই থেকে গিয়েছিল চিন্তা-ভাবনায়। পি জে মার্শাল মনে করেন, কিছু ইংরেজ কোম্পানির বাহিনীতে যোগ দিত এদেশে জীবন কাটাবার উদ্দেশ্য নিয়ে। অনেকে ইউরেশীয় কিংবা ভারতীয় খ্রিস্টান মেয়ে বিয়ে করে সংসার পাতত। তাঁর বক্তব্য, ‘Such people became almost native in their habit.’ তবে তারা ছিল ব্যতিক্রম। ইংরেজরা এদেশের মানুষের থেকে নিজেদের ভিন্ন মনে করত সব সময়।৪৯

১৮৩০-এর দশক পর্যন্ত শ্বেতাঙ্গদের ওপর মোগলাই আদব-কায়দার প্রভাব অক্ষুণ্ণ ছিল। মোগলাইয়ানা আর সায়েবিয়ানার মধ্যে ভাব-সাব শুরু হয়েছিল একেবারে ষোড়শ শতকের গোড়া থেকেই যখন ১৫১০ সালে পর্তুগিজ সেনাপতি আলফানসো আলবুকার্ক গোয়া দখল করেন। গোয়ার যুদ্ধে হত হয়েছিল অনেক মুসলমান। তাদের বিধবাদের সংখ্যা অগুনতি। এদিকে গোয়ার পর্তুগিজ সমাজ নারীশূন্য। তাই সুন্দরী মুসলমানিদের খ্রিস্টান করে তাদের বিয়ে করার হুকুম দেন পর্তুগিজ সেনাপতি। কিন্তু জোর করে পর্তুগিজ সংস্কৃতি চাপিয়ে দিলেও তা বেশিদিন টেকেনি। পরের পঞ্চাশ বছরের মধ্যে ভারতীয় নারী, পরিবেশ ও ইউরোপের সঙ্গে গোয়ার সুদীর্ঘ সমুদ্র পথের দূরত্ব পর্তুগিজদের ওপর ভিন্ন প্রভাব ফেলে। ক্রমশ প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে পর্তুগিজরা স্বদেশী জীবনযাত্রার পথ ফেলে ভারতীয় জীবনচর্যায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠে।

ইংরেজ সায়েবরা কিন্তু এদিশি মেয়েদের ওপর জোর খাটায়নি পর্তুগিজদের মতো। ইংরেজ সায়েব ও এদিশি মেয়ের মধ্যে প্রেমের প্রথম উপাখ্যানের কথা জানা যায় ১৬২৬ সালে ২০ ফেব্রুয়ারি লিখিত একটা চিঠির উৎস থেকে। জন লিচল্যান্ড (John Leachland) নামে এক সায়েব গোপনে এদিশি একটা মেয়েকে নিজের কাছে রেখেছিলেন। সায়েব ছিলেন কোম্পানির কর্মচারী। ঘটনাটা জানাজানি হয়ে গেলে তাকে বলা হল মেয়েটাকে ত্যাগ করতে। রাজি হল না সে কিছুতেই। ফলে তাকে চাকরি থেকে জবাব দেওয়ার কথা ভাবা হল। কিন্তু প্রশ্ন দেখা দিল এই চূড়ান্ত পদক্ষেপের পরিণতি নিয়ে। তা করলে সায়েব হয়তো মেয়েটিকে বিয়েই করে নিতে পারে কোনও কিছু ভাবনা-চিন্তা না করে। তাতে কোম্পানি একজন দক্ষ কর্মচারী হারাবে। তাই ধরে নেওয়া হল, সময় তাকে ঠিক পথে ফিরিয়ে আনবে।৫০

সতেরো শতকে কলকাতায় জোব চার্নকের এক হিন্দু মেয়েকে ঘরনি করার গল্প তো সকলেরই জানা। চার্নক নাকি তাকে সতীর চিতা থেকে উদ্ধার করেছিলেন। বহু বছর তাঁরা একসঙ্গে ঘর করেছিলেন। তাঁদের কয়েকটা সন্তানও হয়। দিশি মেয়েদের সায়েবদের নজরে পড়ার আরও অনেক দৃষ্টান্ত আছে। ওয়ারেন হেস্টিংসের আমলে উইলিয়ম হিকি এসেছিলেন আইন ব্যাবসা করতে। সে সময় সায়েবদের কাছে কলকাতা মেমের অভাবে মরুভূমি। সায়েবদের জীবনে দুঃসহ একাকিত্ব। অভিভাবকহীন ছোকরা সায়েবরা নিঃসঙ্গ থাকায় কলকাতা শহরে উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনে ডুবে যেত। ব্যাপারটা পরিচালক সমিতির নজর এড়ায়নি। তারা সমস্যার সমাধানের জন্য কোম্পানির সেনা ও অসামরিক কর্মচারীদের উৎসাহ দেয় অখ্রিস্টান ভারতীয় মহিলা নিয়ে ঘর বাঁধতে।৫১ হিকি সায়েব তাঁর বন্ধু কার্টারের সঙ্গে এক বাড়িতে বাস করতেন। সে সময় জেমাদানি নামে এক হিন্দু মেয়ে মাঝে-মধ্যে কার্টারের সঙ্গে দেখা করতে আসত। খুব প্রাণবন্ত, চালাক-চতুর মেয়ে। হিকি তার প্রেমে পড়লেন। কার্টার বাংলা মুলুক ছেড়ে চলে গেলে হিকি তাকে তাঁর সঙ্গে থাকার প্রস্তাব দিলে সে রাজি হয়ে গেল। হিকি তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এদিশি হিন্দু মেয়েদের মতো সে নিজেকে অন্দরমহলে অবরুদ্ধ করে রাখত না। হিকির বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে পার্টিতে অংশ নিত অসঙ্কোচে। রসময়ীর বুদ্ধিদীপ্ত রসিকতাবোধ ছিল তারিফ করার মতো। তবে পার্টিতে যোগ দিলেও কখনও সুরা স্পর্শ করত না।৫২ জেমাদানি আমৃত্যু হিকিকে সঙ্গ দিয়েছিল নিখাদ নিষ্ঠায়। যমজ সন্তান প্রসবকালে তার মৃত্যু হয় অকালে। হিকি বড় আঘাত পেয়েছিলেন তাঁর মৃত্যুতে। গভীর শোকে ভেঙে পড়ে লিখেছিলেন, ‘Thus did I lose as gentle and affectionately attached a girl as ever a man was blessed with.’৫২ক

শুধু শ্বেতাঙ্গিনীর অভাব আর অর্থনৈতিক কারণে কলকাতার সায়েবরা এদিশি মেয়েদের প্রতি ঝুঁকেছিল, তা নয়। তারা এদিশি ললনাদের লালিত্যে লোভনীয় বৈশিষ্ট্যের সন্ধান পেয়েছিল, যা তারা স্বদেশের শ্বেতাঙ্গিনীদের মধ্যে পেত না। ১৭৭৪-এর সেপ্টেম্বরে ফিলিপ ডোমার স্ট্যানহোপ (Philip Domar Stanhpoe) কলকাতায় এসেছিলেন বেড়াতে। কলকাতায় দিশি মেয়েদের সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, সায়েবরা যে এখানে এসে ‘জেনানা’ রাখতে গিয়ে অকাতরে অর্থ ওড়াত, ‘সেই অমিতব্যয়িতা একটু ক্ষমা করতে পারতে, যদি এশিয়াটিক সৌন্দর্যের আকর্ষণে মুগ্ধ হওয়ার অভিজ্ঞতা তোমার হয়ে থাকে। আমি এখানে হিন্দু মহিলাদের দেখেছি। অপূর্ব তাদের গড়ন, অতীব চমৎকার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ভঙ্গিমা, চোখের ভাষাও তেমনি। যদি তাদের গায়ের রঙের সঙ্গে সমঝোতা করতে পার, তা হলে তোমাকে স্বীকার করতেই হবে, ইউরোপের নামকরা রূপসির তুলনায় তারা কিছু কম নয়’।৫৩

আঠারো শতকের দ্বিতীয়ার্ধেও কোম্পানির বেশির ভাগ কর্মচারী দিশি বিবি বা ঘরনিতে আসক্ত ছিল। ১৭৮০ থেকে ১৭৮৫-র সময়কালের মধ্যে রচিত অনেক উইল লন্ডনে ইন্ডিয়া অফিসে সংরক্ষিত আছে। দেখা যায়, সেগুলোর তিনটের মধ্যে অন্তত একটায় দিশি বিবি ও তার সন্তান সায়েবের উত্তরাধিকার হিসেবে ঘোষিত হয়েছে।৫৪ নিশ্চিন্তে একথাও অনুমান করা যায় যে, অনেক সায়েব তাদের ঘরনিদের ইচ্ছে করেই তাদের উত্তরাধিকারিণী করার কোনও বিধিসম্মত নথিপত্র রেখে যায়নি। উইলগুলো থেকে জানা যায়, অনেক বিবি বিস্ময়কর পরিমাণ স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি পেয়েছিল সায়েবের মৃত্যুর পর। ১৭৮২ সালে মেজর থোমাস নেলর মৃত্যুকালে তাঁর বিবিকে দিয়ে গিয়েছিলেন নগদ চল্লিশ হাজার টাকা, বহরমপুরে একটা বাগানসমেত বাংলো, সোনাদানা, অগুনতি পোশাক এবং ক্রীতদাসদাসী।৫৫

দিশি বিবি বা ঘরনির প্রতি এই বদান্যতা অবশ্য প্রমাণ করে না যে, এটা ছিল ভারত বা ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি সায়েবদের স্বতঃস্ফূর্ত অনুরাগের প্রকাশ। কিন্তু এটা স্বীকার করতেই হবে যে, সে সময় দিশি বিবির সঙ্গে বসবাসের ফলে কলকাতার সায়েবদের ওপর এদেশীয় সংস্কৃতির প্রভাব পড়েছিল নিশ্চিত ভাবে।৫৬ সায়েবরা তাদের আচরণ ও অভ্যাসে গ্রহণ করেছিল এদিশি আদব-কায়দা, পছন্দ-অপছন্দ, রুচি-রীতিনীতি।

বউবাজারে এক গাছ তলায় বসে জোব চার্নক গড়গড়া টানতেন। এমন কথা লিখে গেছেন অনেকেই। কোম্পানির আমলে সায়েবরা নেটিভদের যেসব অভ্যেসের বশ হয়েছিল, তার মধ্যে অন্যতম হল, এই হুঁকো টানা। তবে সেটা দিশি থেলো হুঁকো নয়, যা গ্রামের মানুষ টানে। নানান ধরনের হুঁকো ছিল। তাদের নামও ছিল হরেক রকম— কালিয়ান, গুড়গুড়ি, বাইজোউ, গড়গড়া, আলবোলা ইত্যাদি। গুড়গুড়ি ছিল আকারে ছোট, পালকির মধ্যেও নিয়ে যাওয়া যেত। বাইজোউ ছিল মেমসায়েবদের জন্য।

ভারতে হুঁকোয় ধূমপানের রেওয়াজ শুরু হয় মোগল আমলে। আকবর ধূমপান করতেন বলে জানা যায় না, কিন্তু তাঁর অভিজাতরা এই নেশায় অভ্যস্ত ছিল। রেওয়াজটা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে। জাহাঙ্গিরের আমলে ধূমপানের ধুম দেখা যায় আপামর মানুষের মধ্যে— অভিজাত থেকে ভিখিরি, ধর্মাত্মা থেকে শয়তান, কবি, ইতিহাসবিদ, চিকিৎসক, ধনী-গরিব সকলেই ধূমপানের নেশায় ডুবে যায়, যদিও জাহাঙ্গির ধূমপান নিষিদ্ধ করেছিলেন।৫৭ একজন ফারসি লেখক লিখেছিলেন, ‘Without doubt hooka is a most pleasing companion… . The music of its sound puts the warbling of the nightingale to shame and the fragrance of its perfume brings a blush to the cheek of the rose.’৫৮ হুঁকোর গুড়গুড় শব্দের সংগীত লজ্জা দেয় নাইটইংগেলের মিষ্টি সুরকে, তার সুবাস গোলাপের গালে ফুটিয়ে তোলে লজ্জার আভা। কী অসাধারণ উপমা!

তবে হুঁকোয় ধূমপান করা সায়েবদের ফ্যাশন হয়ে ওঠে তারা এদেশে আসার অন্তত দেড়শো বছর পরে। সেটা ঘটেছিল ১৭৫০ থেকে ১৭৬৮-র মধ্যে। ১৭০০-এ কলকাতার সায়েবরা এই খাঁটি প্রাচ্য বস্তুটির দর্শন লাভ করে যখন চুঁচুড়ার ওলন্দাজ গভর্নরকে ডিনারে আমন্ত্রণ জানানো হয়।৫৯ এরপরই হুঁকো ক্রমশ সায়েবদের মন জুড়ে বসে। ক্যাপ্টেন উইলিয়মসন হুঁকো টানার নেশা সম্পর্কে লিখেছেন, ‘আমি জানি না, আর কোন রেওয়াজ এমন মজ্জাগত হয়েছিল কি না। ঠিক সময়ে হাতের কাছে হুঁকো না পেলে যে এমন কষ্ট হয়, তা প্রায় অবিশ্বাস্য।’৬০ একজন সায়েব, যার বেতন ছিল বছরে মাত্র ২০০ পাউন্ড, তারও হুঁকোবরদার না হলে চলত না। ১৭৭৯ সালে হেস্টিংস দম্পতি এক কনসার্টে অতিথিদের আমন্ত্রণ জানাবার সময় খেয়াল করিয়ে দেন, হুঁকোবরদার ছাড়া আর কোনও ভৃত্যকে আনা চলবে না।৬১

উইলিয়ম হিকি লিখেছেন, ‘এখানে (কলকাতায়) সকলেই হুঁকো টানে, হুঁকো ছাড়া চলা অসম্ভব ব্যাপার। আমি এমন কথাও অনেককে বলতে শুনেছি, তারা বরং ডিনার না খেয়ে থাকবেন, কিন্তু হুঁকো বাদ নয়।’৬২ দীর্ঘ নলযুক্ত আলবোলা বা গড়গড়া অভিজাত ও সম্ভ্রান্ত পরিবারে খাবার ঘরের শুধু কেতা নয়, অপরিহার্য বস্তু বলে মনে করা হত। হুঁকো রাখার জন্য বিশেষ ধরনের কার্পেট পাতা হত, যাতে হুঁকোর নলে ধুলো-ময়লা না লাগে। এই কার্পেট তৈরি করা ছিল সে সময়ের মেমসায়েবদের অন্যতম শখ। সেগুলো তারা উপহার দিত বন্ধু-বান্ধব বা আত্মীয়স্বজনকে। নলের মুখটা রুপো, কখনও সোনা দিয়ে মোড়া হত। এক একটা নলের দাম ছিল আট থেকে দশ টাকা। তা-ও তিন মাসের বেশি চলত না। বাতিল করতে হত। ছিলিম তৈরি করতে হত অনেক সময় ও যথেষ্ট ধৈর্য নিয়ে।

১৮০০ সাল থেকে হুঁকো টানার রেওয়াজ হ্রাস পেতে থাকে। হ্রাসের কারণ সম্পর্কে ১৮০২ সালে মেজর ব্ল্যাকিস্টোন (Major Blakiston) লিখেছিলেন, এই নেশা ধরে রাখা ছিল ব্যয়সাপেক্ষ। হুঁকো, তামাক ইত্যাদি মহার্ঘ তো ছিলই, তার ওপর একজন হুঁকোবরদার রাখা ছিল জরুরি। ১৮১২ সালে গভর্নমেন্ট হাউসে হুঁকোর প্রবেশে হুড়কো তুলে দেওয়া হয়। সে সিদ্ধান্তে বেজায় অখুশি হয় অতিথিরা।৬৩ গভর্নমেন্ট হাউসে হুঁকো নিষিদ্ধ হলেও কলকাতার সায়েবরা ব্যক্তিগত জীবনে আলবোলার আকর্ষণ ছাড়তে পারেনি দীর্ঘকাল। ১৮৪০ পর্যন্ত হুঁকো টানার রেওয়াজ রাজত্ব করেছিল কলকাতার শ্বেতাঙ্গ সমাজে।৬৪

আঠারো শতকের প্রথমার্ধে কলকাতার সায়েবরা বাংলার নবাবের দর্শন পেত কালে-ভদ্রে। সকলে নয়। পদস্থ কর্মচারীদের মধ্যে যারা কাজে-কর্মে নবাবের দরবারে উপস্থিত থাকার সুযোগ পেত, তারা প্রত্যক্ষ করত নবাবি হালচাল। সায়েবরা তখনও কেউ পার্সিভ্যাল স্পিয়ারের ভাষায় ‘Nabob’ হয়ে ওঠেনি। মার্চেন্টরা বাণিজ্য করে বিত্তশালী হয়ে যদি স্বদেশে ফিরে যাওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করত, তাহলে সেখানে গিয়ে নিজেকে জাহির করত একজন দিশি ভদ্রলোক হিসেবে। কিন্তু পলাশি পর্বে কোম্পানির সায়েবদের চিন্তা-ভাবনা পালটে যায় রাজনীতি ও নবাবের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে ওঠার ফলে। নবাবি কেতা-কায়দা প্রভাব ফেলল তাদের ওপর। তারা নবাব হয়ে উঠল। নবাবি করতে গেলে অর্থের প্রয়োজন। অঢেল অর্থ না হলে নবাবি করা যায় না। পলাশির সাফল্য সায়েবদের কাছে এনে দিল সেই সুযোগ। বাংলার বাণিজ্যে তখন তারাই চালকের আসনে। অনবরত অফুরন্ত মুদ্রাস্রোত এসে ভরিয়ে তুলল তাদের তহবিল। আঠারো শতকের পঞ্চাশের দশকে যারা ছিল মামুলি মার্চেন্ট, ষাটের দশকে তারা রাজনীতিবিদ। বাণিজ্য করে যা পায়নি, তা পেল রাজনীতি করে। ১৭৭৫-এ জন শোর লিখেছিলেন, ‘The demon of party and politics has now broken loose among us.’৬৫

বেঁচে থাকলে সায়েব-নবাবকে একদিন স্বদেশে ফিরতে হত। কিন্তু ফিরে যাওয়াটা অনেক সময় সুখকর মনে হত না। নিজের সমাজকে মনে হত অপরিচিত। সেখানে সে বড় বেমানান। বিদেশে সে যে সম্মান পেত, স্বদেশে তা দেওয়ার মতো কেউ নেই। পরিবেশের সঙ্গে মানাতে না পেরে সে হয়তো নিজেকে গুটিয়ে নিত শামুকের মতো। রিচার্ড বারওয়েল বিশাল সম্পদের মালিক হয়ে বিলেতে ফিরে যান ১৭৮০ সালে। নবাবের মতোই বাস করতে থাকেন স্বদেশে। তথাপি মেজর স্কট তাঁকে অসুখী দেখেছিলেন। স্কট লিখেছেন, বারওয়েল এক হাজার পাউন্ড দিয়ে লর্ড হেলিফ্যাক্‌সের বাড়ি ও জমিদারি কিনে নিয়েছিলেন। অবসর জীবন কাটাচ্ছিলেন প্রাচুর্যের মধ্যে। কিন্তু সকলে উদ্বিগ্ন ছিল তাঁকে নিয়ে কারণ, তিনি সব সময় ভীষণ বিষাদগ্রস্ত হয়ে থাকতেন। স্কট লিখেছেন, ‘আমি একবার তাঁর আহারে সঙ্গী হয়েছিলাম। সে সময় আমার মনে হয়েছিল তিনি ভীষণ অতৃপ্ত ও অসুখী। তিনি চমৎকার সুন্দর বাড়িতে থাকতেন, বিলাসে জীবন কাটাতেন। বিশাল জমিদারি তাঁর। তবুও তিনি বলেন, তিনি দেশ ও দেশের মানুষকে পছন্দ করতে পারছেন না।’৬৬

আঠারো-উনিশ শতকে কলকাতার ধনী সম্ভ্রান্ত বাবুদের বাড়িতে দুর্গাপুজোর মতো উৎসবে কিংবা অন্য কোনও আনন্দ উপলক্ষে বাঈজি নাচ ছিল বাবুয়ানার অপরিহার্য অঙ্গ। ১৮১৬ সালে হাওড়া নিবাসী ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর প্রথম পুত্র সন্তান লাভের আনন্দে সালকিয়া ও হাওড়ার সমস্ত সায়েবদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন অনুষ্ঠানে বাঈজি নাচের আয়োজন করে।৬৭ রামমোহন রায়, দ্বারকানাথ ঠাকুরের মতো বিশিষ্ট ধনীদের বাড়িতে নাচের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হতেন কলকাতার গণ্যমান্য সায়েবরা। ১৮২২ সালে ফ্যানি পার্কস কলকাতায় এসে পরের বছর রামমোহনের বাড়িতে আমন্ত্রিত হন নাচের আসরে। অন্য এক ধনী গৃহস্থের বাড়িতে দুর্গোৎসবে আমন্ত্রিত হয়ে তিনি যা দেখেছিলেন, তার বিশদ বিবরণ দিয়েছেন তাঁর Wanderings of a Pilgrim in Search of Picturesque গ্রন্থে। লিখেছেন, ‘পাশের ঘরগুলোতে উপাদেয় খাদ্যসম্ভার সাজানো ছিল। সবই ইউরোপীয় খানা। বিদেশি অতিথিদের জন্য সেসব সরবরাহ করেছিল ‘মেসার্স গানটার অ্যান্ড হুপার’ সংস্থা। খাদ্য তালিকায় বরফ এবং ফরাসি সুরা ছিল। একটা চৌকো উঠোনে একদল বাঈজি নাচ করছিল গান গাইতে গাইতে। ইউরোপীয় এবং দিশি ভদ্রলোকেরা বসেছিল সোফা অথবা চেয়ারে।’৬৮ বাঈজি নাচ সায়েবদের মধ্যে এত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে তারা নিজেদের উদ্যোগেই বাঈজি নাচের আসর বসাত।৬৯ মেমসায়েবরাও উপভোগ করত এই নাচ। তাদের মধ্যে কেউ কেউ এই নাচের তেমন তারিফ না করলেও অস্বীকার করা যায় না যে, এদিশি মেয়েদের রূপের মোহে মজেছিল কলকাতার সায়েব সমাজ। ১৮১৪ সালে অজ্ঞাতনামা লেখক তাঁর Sketches of India গ্রন্থে লিখেছেন, ‘সাধারণভাবে হিন্দুস্তানি মেয়েদের (হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই) চমৎকার গড়ন। তাদের মুখমণ্ডল যত না সুন্দর, তার থেকে বেশি আনন্দদায়ক। তাদের টানা টানা কালো চোখে আছে নরম আগুন, যা এত কিছু প্রকাশ করে যে তা ভাষাতীত। দীর্ঘ উজ্জ্বল কেশরাশি তাদের অহংকার। তাতে একটা গিঁট দিয়ে ফেলে রাখে পেছনে। তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সুষম বিন্যাস প্রশংসা না করে পারা যায় না। গ্রীবার অপূর্ব গড়ন, ক্রমক্ষীণ কটি, নিখুঁত গোড়ালি এবং শিশুসুলভ পা দুটো দেখে লোকে যে ভীষণ আকৃষ্ট হত, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই।’ তারপরই লিখেছেন, যখন কেউ তাদের একজনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ত, সেই দিশি মেয়েটি তার অনুপম আচরণে অল্প সময়ের মধ্যে এক অবাক করা মোহে মুগ্ধ করত। মনে হত, তার সঙ্গে বিচ্ছেদ অসম্ভব।৭০

বিলেত থেকে মেমসায়েবদের আসা শুরু হলে এবং শহরে পশ্চিমি নৃত্য চালু হলে সায়েবরা ক্রমশ সেই দিকে ঝুঁকে পড়ে। কিন্তু বাঈজি নাচের প্রতি আকর্ষণও সেইসঙ্গে অটল ছিল। বাঈজি নাচ দেখা ছিল অনেকটা ইউরোপীয় ব্যালে নৃত্য উপভোগ করার মতো। কলকাতায় যখন থিয়েটার আসেনি, বাঈজি নাচ তার বিকল্প হয়ে ওঠে। কলকাতার ধনীবাবুরা তাঁদের ইংরেজ অতিথির বিনোদনের জন্য বেছে নিতেন বাঈজি নাচকে। এই রেওয়াজ ১৮২৬ সালেও টিকে ছিল, যখন শ্রীমতী ফেনটন কলকাতায় আসেন। এমনকী, আরও অনেক পরে, ১৮৭৫ সালে প্রিন্স এডওয়ার্ডের মতো সম্ভ্রান্ত সায়েব বিলেত থেকে এলে তাঁর মনোরঞ্জনের জন্য নাচের ব্যবস্থা করা হয়।৭১

হিন্দুস্তানি মেয়েদের মাধুরীতে মুগ্ধতা ছিল সম্ভবত মুসলমানি রীতিতে সায়েবদের ‘জেনানা’ বা ‘হারেম’ লালনের অন্যতম কারণ। সেটা অবশ্য মুষ্টিমেয় ধনী সায়েবের পক্ষে সম্ভব হত। বাকিরা জোগাড় করে নিত উপপত্নী বা রক্ষিতা, যে রীতি ছিল একান্তভাবে ভারতীয়। পশ্চিমি সভ্যতা এর অনুমোদন করে না। উইলিয়মসন ও ডি’ ওয়লে (Williamson and D’ Oyley) আঠারো শতকের শেষ কুড়িটা বছর এদেশে কাটিয়েছিলেন। তাঁরা মনে করেন, ‘জেনানা’ এদেশের সায়েব সমাজের সাধারণ প্রথা। সায়েবদের সম্পদ বৃদ্ধির ফলে এই ভারতীয় প্রথা ম্লান হওয়ার পরিবর্তে আরও প্রকট হয়ে উঠেছিল।

বাংলা তথা কলকাতার জলবায়ুতে উষ্ণতা ও আর্দ্রতার মেলবন্ধনে আজকের মতো তখনও স্বস্তি মিলত না বছরের বেশিরভাগ সময়। বিলেতের মতো শীত প্রধান দেশের মানুষ, সায়েবরা এদেশে এসেই হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিল, তাদের সায়েবি ধড়াচূড়ো এখানে অচ্ছ্যুৎ, অচল। অনেক সায়েব নিজেরাই কবুল করতেন, সায়েবি পোশাক এদেশের উপযুক্ত নয়। একবার জনৈক ভদ্রলোক ধুতি-চাদর পরে ছোটলাট বিডনের সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি ভীষণ বিরক্তি প্রকাশ করেন। পরে কোনও এক গ্রীষ্মের দিনে তিনি আবার সায়েবের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে অবাক হন। দেখেন, সায়েব ঢিলে পায়জামা ও পাতলা কামিজ পরে বসে আছেন। বিডন সায়েব তাঁকে বললেন, ‘তোমাকে দেখিয়া আমার হিংসা হচ্চে, ইচ্ছা করে, তোমাদিগের ন্যায় পরিচ্ছদ পরিয়া থাকি।’ ভদ্রলোক বললেন, ‘তাই করুন না কেন? সায়েব বললেন, ‘ওরূপ পরিচ্ছদ পরিধান করা আমাদিগের দেশাচারবিরুদ্ধ, সুতরাং কেমন ক’রে করি।’ গল্পটা শুনিয়েছেন রাজনারায়ণ বসু।৭২

মেজর জেমস অ্যাচিলস কার্কপ্যাট্রিক (Major James Achilles Kirkpatrick) (১৭৬৪-১৮০৫) কলকাতায় থাকার সময় একমাত্র কোনও সামাজিক অনুষ্ঠান ছাড়া বিলিতি পোশাক বর্জন করেছিলেন। জনৈক সাক্ষাৎপ্রার্থী তাঁকে মূল্যবান মুসলমানি পোশাক পরা দেখে অবাক না হয়ে পারেনি।৭৩ সায়েবরা কলকাতায় শোয়ার আরাম প্রথম অনুভব করে পায়জামা পরে। দিনেরবেলায় যা-ই পরুক, রাতে শোয়ার পোশাক অবশ্যই পায়জামা। তারা মসলিনের তৈরি বেনিয়ান পরা শিখেছিল এদেশে এসেই। এছাড়া উপায় ছিল না। থোমাস উইলিয়মসন সতর্ক করে দেন, শরীর টিকিয়ে রাখতে হলে, একটু আরাম পেতে গেলে নেটিভদের অভ্যেসের সঙ্গে আপস না করে পারা যাবে না। তিনি অনুকরণের কথা বলতে চাননি। তাঁর বক্তব্য, সাধারণভাবে এদিশি আচরণকে পথপ্রদর্শক হিসেবে গ্রহণ করা দরকার কোনও রকম বাছ-বিচার না করে। যারা প্রথম বিলেত থেকে ভারতে আসত, তাদের উদ্দেশে তাঁর পরামর্শ ছিল, এখানে এসেই সব কিছুকে বিলাসিতা মনে করে বিদ্রুপ করা অসংগত।৭৪ কোম্পানির ডাক্তার James Johnson মনে করতেন, এদেশের ক্রান্তীয় জলবায়ুতে বেঁচে থাকতে হলে ভারতীয়দের বাবুগিরির আদব-কায়দাগুলো একটু রপ্ত করা দরকার। শরীর-স্বাস্থ্যের স্বার্থে তিনি সায়েবদের পালকি ব্যবহার এবং দেহের দলাই-মলাই সমর্থন করেন। এক ভিন্নতর জলবায়ুতে নবাবদের দিশি আভিজাত্যকে আদাব জানানো তাঁর প্রয়োজন মনে হয়েছিল।৭৫ সমসাময়িক ইউরোপের চোখে যেটা ছিল বিলাসিতা, অবৈধ, ক্রান্তীয় জলবায়ুতে ভারতীয় ঢঙে শাসন পরিচালনা এবং নেটিভদের কাছে সেই শাসনের বৈধতাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যও তা ছিল নিতান্ত আবশ্যক।৭৬

বিলেত থেকে যারা প্রথম এদেশে আসত, তারা তাদের দেশওয়ালি ভাইদের পোশাক-আসাক, আদব-কায়দা দেখে শুধু অবাক হত না, বিদ্রুপ করতেও দ্বিধা করত না। বিশেষ করে যে সব সায়েব দাড়ি রাখত, পাগড়ি পরত তারা বেশি করে বিদ্রুপের শিকার হত। ভারতীয় পোশাক, হুঁকো আর বাঈজিদের প্রতি ডেভিড অক্টোরলনির অনুরাগ বিস্মিত করেছিল কলকাতার আর্চবিশপ রেজিনাল্ড হেবারকে। তিনি দেখেছিলেন, অক্টোরলনি চোগা আর পাগড়ি পরে ডিভানে বসে আছেন। ভৃত্যরা ময়ূরের পালকের পাখা দিয়ে তাকে বাতাস করছে। ব্রিটিশ ভারতের প্রধান সেনাপতির পত্নী শ্রীমতী মারিয়া নুগেন্ট (Lady Maria Nugent) তাঁকে দেখে আঁতকে উঠেছিলেন। ভদ্রলোক একেবারে নেটিভ হয়ে গেছেন। আর তাঁর সহকারীরা, উইলিয়ম ফ্রেজার এবং এডওয়ার্ড গার্ডনার তো আরও সাংঘাতিক। দু’জনের মুখে এক গোছা দাড়ি। তারা না খায় গোরু না শুয়োর। খ্রিস্টানের থেকে বেশি হিন্দু হয়ে গেছে। নেটিভদের মতো সংস্কার ও ধ্যান-ধারণার ধারক।৭৭

কৃষ্ণনগরে থাকার সময় স্যার উইলিয়ম জোন্স সুতির ঢিলে পোশাক পরতেন, বাঙালিরা যেমন পরে। একটা বাংলোয় থাকতেন। সেটাও খড়-কাঠ দিয়ে তৈরি। কৃষ্ণনগরের ব্রাহ্মণরাই তাঁকে সংস্কৃত শিখতে সাহায্য করেছিল। সংস্কৃত শেখার পর তাঁর মনে হয়েছিল, এটা এমন একটা ভাষা যা গ্রিক ভাষার চেয়ে অনবদ্য, ল্যাটিনের থেকেও ঐশ্বর্যশালী। সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য তাঁর মনে এমন গভীরভাবে দাগ কেটেছিল যে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমি গোপীদের প্রেমে পড়েছি, কৃষ্ণে মুগ্ধ, রামের উৎসাহী অনুরাগী।’৭৮

সায়েবরা এদেশের বেশকিছু দেশাচার গ্রহণ তো করেই ছিল, সেগুলির মধ্যে বেশ কিছু সংখ্যক বিলেতের মাটিতেও শিকড় চালিয়ে পুষ্টিলাভ করে, বিশেষ করে পরিচ্ছন্নতার ধারণা। এদেশের ঘরনিরা সায়েবদের প্রতিদিন স্নানের আনন্দ ও তৃপ্তির স্বাদ নিতে শেখায়। আঠারো শতকে যে সব সায়েব-মেম পর্যটক এদেশে আসেন, তারা কলকাতার সায়েবদের হিন্দুদের মতো ঘটিতে জল নিয়ে মাথায় ঢেলে স্নান করতে দেখে অবাক হয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, সায়েবরা কিছু কিছু ব্যাপারে হিন্দুদের মতো কুসংস্কারকে প্রশ্রয় দিত। হনোরিয়া লরেন্স ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল স্যার হেনরি মন্টগোমারি লরেন্সের (১৮০৬-৫৭) পত্নী। তিনি সায়েবদের মধ্যে জাত-পাত প্রথার প্রভাব দেখে অবাক হয়েছিলেন। নিচু জাতের নেটিভদের তারা হিন্দুদের মতো দূরে রাখত।৭৯

একই ভাবে সায়েবদের খানা-পিনাতেও ছোঁয়া লেগেছিল এদিশি খাদ্যাভ্যাসের। কোম্পানির বেশ কিছু শ্বেতাঙ্গ কর্মচারী নিরামিশাষী হয়ে যায়। এ সময়ে লিখিত এক উপন্যাস কলকাতা থেকে ফেরা এক সায়েবের অদ্ভুত পরিবর্তনের কথা শুনিয়েছে বিলেতের মানুষকে। হিন্দুপত্নীর অকাল মৃত্যুতে ভীষণ শোকাহত হয়ে এক সায়েব স্বদেশে ফিরে গিয়ে বিষণ্ণতায় ডুবে যান। তিনি এমন একজন মানুষে পরিণত হন, যিনি না ইংরেজ, না ভারতীয়; না খ্রিস্টান, না হিন্দু। খাদ্যাভ্যাসে তিনি প্রায় একজন হিন্দু ব্রাহ্মণ হয়ে যান। খেতেন শুধুমাত্র ভাত, তরকারি, আলু ও ফলমূল। গো-হত্যা দেখলে তাঁর মনে হত, তিনি নরহত্যা প্রত্যক্ষ করছেন।৮০

ইংরেজরা চিরকালই রক্ষণশীল। এহেন দেশের অনেক মানুষই ‘হিদেন’ বা পৌত্তলিক সংস্কৃতির প্রভাবে ভেসে গিয়েছিল। এর সম্ভাব্য কারণ ছিল, প্রথমদিকে সৌভাগ্যের সন্ধানে যে সায়েবরা এদেশে এসেছিল, বিলেতের মতো এখানে তাদের কোনও পুরনো, মজবুত এবং স্থিতিশীল সমাজ ছিল না। তাদের মধ্যে না ছিল প্রথাগত সংয়ম, না রুচিবোধ।৮১ এমনও হতে পারে এর ফলে অনেক সায়েবের খ্রিস্টধর্মের প্রতি বিশ্বাসের ভিত নড়ে গিয়েছিল। The Asiatic Journal লিখেছে, নেটিভ সমাজের সঙ্গে সায়েবদের অন্তরঙ্গতায় অশনিপাতের সম্ভাবনা ছিল। যারা দুর্বল চিত্তের, তারা এড়াতে পারত না হিন্দু-মুসলমানের রীতি-রেওয়াজ। অনেকে তো গো-শূকরের মাংস খাওয়াই ত্যাগ করত, যা হিন্দু-মুসলমানের অস্পৃশ্য। গঙ্গায় নিয়মিত স্নান করত। কয়েকজন বিখ্যাত সায়েবও ছিলেন তাদের মধ্যে।৮২

তবে অনেকে সম্ভবত প্রভাবিত হয়েছিল কোম্পানির ডাক্তারদের পরামর্শে। ডাক্তার জনসন এবং অন্যান্য ডাক্তাররা ব্রাহ্মণদের খাদ্যাভ্যাসকে আদর্শ বলে মনে করতেন। তাঁরা লক্ষ করেছিলেন, গরিব হিন্দুরা ধর্মের দোহাই বা দারিদ্র্যের কারণে যে নিরামিষ আহার গ্রহণ করে সেটা রোগ-ব্যাধি এড়িয়ে যাওয়ার পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ। তবে অনেক ইঙ্গ-ভারতীয় সায়েব ডাক্তারদের এই উপদেশকে উপহাস করত, আমল দিত না। অনেকে বিরোধিতা করত এই ধারণার। শ্রীমতী ফেনটন কড়া সমালোচনা করেছিলেন জুলিয়নের, যিনি বিলেতে ফিরে গিয়ে ব্রাহ্মণের মতো জীবন কাটাতেন। ডেভিড ম্যাকফারলান (উনিশ শতকে ত্রিশের দশকে কলকাতার চিফ ম্যাজিস্ট্রেট) তীব্র ঘেন্নায় তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন, যখন তাঁর ভাই তাঁকে স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য হিন্দুদের খাদ্যাভ্যাসের পরামর্শ দিয়েছিলেন।৮৩

রাজনারায়ণ বসু লিখেছেন, ‘সেকালে সাহেবরা অর্ধেক হিন্দু ছিলেন। তাঁহারা অনেক পরিমাণে দেশীয়দের আচার ব্যবহার পালন করিতেন।… বাল্যকালে শুনিতাম, কালীঘাটের কালীর মন্দিরে প্রথম কোম্পানির পূজা হইয়া, তৎপরে অন্যান্য লোকের পূজা হইত। ইহা সত্য না হইতে পারে… কিন্তু সাহেবরা বাঙ্গালীর ধর্মের অনুমোদন করিতেন। একালেও গভর্নর জেনারেল লর্ড এলেনবরা সাহেব আফগানিস্তানের যুদ্ধে জয়ী হইয়া ফিরিয়া আসিবার সময় বৃন্দাবন, মথুরা প্রভৃতি স্থানের দেবালয়ে দান করিয়াছিলেন।’৮৪ রোমান ক্যাথলিক পর্তুগিজ এবং অন্যান্য নিচুতলার সায়েবরা চড়ক, রথযাত্রা প্রভৃতি উৎসবের সময় নিজেদের বাড়ি ফুল দিয়ে সাজাত। স্টাথাম লিখেছেন, পর্তুগিজরা মহরমের মিছিলে অংশ গ্রহণ করত, বুক চাপড়াত মুসলমানদের মতো।৮৫ তিনি আরও লিখেছেন, বৈঠকখানার জনৈক পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেট প্রকাশ্যে হিন্দুদের চড়ক পুজোয় দারুণ উৎসাহ দিতেন। শ্রীপান্থ লিখেছেন, ‘আঠারো শতকের মাঝামাঝি থেকে ১৮৪০ পর্যন্ত দুর্গোৎসব ছিল রাজা-প্রজা নির্বিশেষে শ্রেষ্ঠ সামাজিক উৎসব।’৮৬ অনেক সায়েব হিন্দু দেব-দেবীর পুজো করত। ভয় পেত ব্রাহ্মণের ক্ষমতাকে। ব্রিটিশ সেনারাও সম্মান করত দেবদেবীকে।৮৭ অনেক রাজপুরুষ বিপদে পড়লে পুজো দিত। ওয়ার্ড লিখেছেন, ‘আমি এমন বিবরণ পেয়েছি যে ইউরোপীয়ানরা নিয়মিতভাবে কালীঘাটে গিয়ে থাকেন এবং দশ হাজার টাকা অবধি পুজো-অর্চনায় খরচ করেন। কোম্পানির একজন কর্মচারী, মোকদ্দমা জিতে কালীঘাটে তিন হাজার টাকা পুজো দিয়ে এসেছেন।’৮৮ কালীঘাটে পুজো দেওয়ার ব্যাপারে সংস্কার ছিল কলকাতায় কোম্পানির খোদ কর্মকর্তাদের মনেও। ওয়ার্ডের লেখাতেই সে তথ্য পাই। ১৮০২ সালে তিনি লেখেন, সরকার পক্ষ থেকে একটা ডেপুটেশন মিছিল করে কালীঘাটে গিয়ে ৫০০০ টাকা বিগ্রহকে দান করেছিল কোম্পানির নামে, যাতে কোম্পানি যুদ্ধে জিততে পারে।৮৮ক

তবে, যে সায়েব একেবারে নিখাদ হিন্দু হয়ে যাওয়ার এক বিরল ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটিয়েছিলেন, তিনি হলেন আইরিশ মেজর জেনারেল স্টুয়ার্ট। কলকাতার উড স্ট্রিট ও থিয়েটার রোডের সংযোগস্থলে, এক কোণে বাস করতেন। ১৮২৮-এর ৩১ মার্চ সত্তর বছর বয়সে মারা যান। হিন্দু ধ্যানধারণার প্রতি তাঁর আন্তরিক আনুগত্য ও অটল বিশ্বাসের জন্য ‘হিন্দু স্টুয়ার্ট’ নামে পরিচিত ছিলেন কলকাতার সায়েব সমাজে। ইভান কটন লিখেছেন, হিন্দুধর্মের প্রতি স্টুয়ার্টের অনুরাগ কলকাতার সায়েব সমাজে আলোচনার বিশেষ বিষয় ছিল।৮৯

স্টুয়ার্টের জন্ম হয় ১৭৫৮ সালে। মা-বাবার কথা তেমন কিছু জানা যায় না। ১৭৭৭ সালে মাত্র কুড়ি বছর বয়সে ভারতে আসেন। কলকাতায় আসার এক বছরের মধ্যে তিনি হিন্দুধর্মের টান অনুভব করেন। শুরু করেন হিন্দুর জীবনচর্যা, যা আমৃত্যু বজায় রেখেছিলেন নিখুঁত নিষ্ঠায়। প্রতিদিন সকালে গঙ্গাস্নান সেরে গঙ্গাপুজো করতেন হিন্দুরীতি মেনে। তাঁর মৃত্যুর বছরে The Asiatic Journal লিখেছিল, ‘General Stuart had studied the language, manners and customs of the natives of this country with so much enthusiasm that his intimacy with them, and his toleration of, or rather apparent conformity to their ideas and prejudices, obtained for him the name Hindoo Sturat.’৯০ তিনি অকপট অসঙ্কোচে নিজেকে ‘ধর্মান্তরিত হিন্দু’ বলে উল্লেখ করেছেন। নিয়মিত পুজো-পাঠ করতেন। গো-মাংস খেতেন না। সাগরে একটা মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। যখন বিলেতে যেতেন, সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন শালগ্রামশিলা।৯১

স্টুয়ার্ট কেবল হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন না, তিনি ছিলেন হিন্দুনারীর পরম অনুরাগী। হিন্দু মেয়েদের পোশাক তাঁকে খুব আকর্ষণ করত। ‘ক্যালকাটা টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর রচনাগুলিতে তিনি কলকাতার মেমসায়েবদের পরামর্শ দেন শাড়ি পরার। তাঁর মনে হত, সমসাময়িক ইউরোপীয় মহিলাদের ফ্যাশন অপেক্ষা শাড়ি অনেক বেশি আকর্ষণীয়। ওই শাড়ি না পরলে মেমসায়েবরা সৌন্দর্যে ভারতীয় মেয়েদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে না। তাঁর চোখে হিন্দু মেয়েরা তুলনায় ছোটখাটো, কিন্তু রূপবতী।৯২

স্টুয়ার্টের এই হিন্দুপ্রীতি, হিন্দু ধর্মানুরাগ কলকাতার সায়েব সমাজ তো বটেই, বিলেতের পরিচালক সমিতি পর্যন্ত বরদাস্ত করতে পারেনি। তাঁর সবচেয়ে বড় সমালোচক ছিলেন পরিচালক সমিতির অন্যতম সদস্য চার্লস গ্রান্ট। এক অজ্ঞাতনামা ‘বেঙ্গল অফিসার’ স্টুয়ার্টকে ‘বিধর্মী’ এবং ‘প্যাগান’ বলে ঘোষণা করে। স্টুয়ার্টের সহকর্মীরাও তাকে তুলোধোনা করতে ছাড়েনি। এলিজাবেথ ফেনটন তাঁর পত্রিকায় তীব্র আক্রমণ শানান স্টুয়ার্টের বিরুদ্ধে। ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে এক অফিসার লেখেন ‘কোম্পানির চাকরিতে এমন একজন ব্রিটিশ জেনারেল আছেন, যিনি হিন্দুদের প্রথা মেনে চলেন, মন্দিরে পুজো দেন, সঙ্গে বিগ্রহ নিয়ে ঘোরেন, ফকিরদের সঙ্গ দেন।’৯৩

স্টুয়ার্ট তো হিন্দু বলয়ে একেবারে বিলীন হয়ে গিয়েছিলেন। কলকাতার সমসাময়িক শ্বেতাঙ্গরা ডেভিড হেয়ারকেও রেয়াত করেনি, যিনি শুধুমাত্র হিন্দুদের শিক্ষা ও সামাজিক কাজকর্মে সহযোগিতা করেছিলেন শাসক-শাসিতের বৈষম্যকে আমল না দিয়ে। হঠাৎ কলেরায় মৃত্যু হলে খ্রিস্টানদের গোরস্থানে তাঁকে গোর দিতে গেলে বাধা আসে কট্টর শ্বেতাঙ্গ খ্রিস্টানদের থেকে। তাদের অভিযোগ ছিল, হেয়ার সায়েব খ্রিস্টানের থেকে বেশি রকম হিন্দু হয়ে গিয়েছিলেন।৯৪

কিছু সায়েব অবশ্য বড় ভালবেসে ফেলেছিল কলকাতাকে, এদেশকে। বিশেষ করে যাদের জীবনের একটা দীর্ঘ সময় কেটেছিল এই শহরে। J H Stocqueler লিখেছেন, দীর্ঘ দিন এদেশে বসবাস করার ফলে এদেশের সব কিছুই তারা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বলে মনে করত। যদি কখনও স্বদেশে যেত, বিলেতের সত্যিকারের উৎকৃষ্ট কিছুর কদর করতে পারত না। Stocqueler অবশ্য ব্যাপারটাকে একটু বাঁকা চোখেই দেখেছেন। কলকাতার প্রতি তাদের নিভাঁজ ভালবাসা তাঁর ভাবনায় আসেনি। তাঁর মনে হয়েছে, এদেশের সব কিছুর উৎকর্ষের মান এত নিচু এবং যা দেখে তারা এত অভ্যস্ত যে, তার ফলে ভারতে তৈরি মামুলি বস্তুকেও তারা বিলেতের উৎকৃষ্টতম বস্তুর থেকেও উৎকৃষ্টতর বলে মনে করত। হয়তো তিনি বলতে চেয়েছেন, মামুলি মাপকাঠি দিয়ে উৎকর্ষের সঠিক মূল্যায়ন করা যায় না। তার অভাব ছিল তাদের মধ্যে। তাঁর বক্তব্য, বিলেতের ভাল সামাজিক আচরণগুলো চর্চার অভাবে হারিয়ে গিয়েছিল তাদের চরিত্র থেকে। এজন্য তারা অন্ধবিশ্বাসী হয়ে উঠেছিল ভারত সম্পর্কে।৯৫

কলকাতার শ্বেতাঙ্গ-নেটিভ সম্পর্ক:

আঠারো শতকের অন্তিম লগ্ন থেকে সায়েবদের মনোভাব পালটাতে থাকে। পরিবর্তন আরও দৃশ্যমান এবং উপলব্ধ হতে থাকে ১৮৩০-এর দশক থেকে। ১৮৩০-এর দশকে বাষ্পীয় পোত আবিষ্কৃত হওয়ার পর সময়ের নিরিখে বিলেত ও এদেশের সামুদ্রিক দূরত্ব যত কমে গেল, বেড়ে গেল তত মানসিক দূরত্ব। অনেকটা নিউটনের তত্ত্বের মতো, প্রতিটি ক্রিয়ার বিপরীত এবং সমান প্রতিক্রিয়া আছে। পরিবর্তিত মনোভাবে ইন্ধন জোগান লর্ড কর্নওয়ালিশ। কোম্পানির প্রশাসন ব্যবস্থায় ভারতীয়দের অস্তিত্ব মুছে দিয়ে তিনি সমস্ত উঁচু পদে বসান ইংরেজ সিভিলিয়ানদের। ওই সব পদস্থ শ্বেতাঙ্গদের মনে জেগে ওঠে উচ্চমন্যতা। কর্নওয়ালিশ কলকাতায় এসেই মনস্থির করেন, উপনিবেশের শাসক শ্রেণির ভারতীয়করণে কখনওই প্রশ্রয় দেওয়া হবে না।

অনেক লেখকই দিশি দাস-দাসীর আনুগত্য ও সেবার প্রশংসা করেছেন। তাদের হেপাজতে থাকা শ্বেতাঙ্গ শিশুদের তারা যে আন্তরিকতা দিয়ে দেখভাল করত, তা অনেককেই অবাক না করে পারেনি। কিন্তু সকলেই শ্রীমতী এলউড কিংবা কুমারী এডেন ছিলেন না। প্রথম জন তাঁর আয়া জায়েসিনা এবং দ্বিতীয় জন তাঁর আয়া রোজিনার কাছে যেরকম স্নেহময়ী ছিলেন, সেটা কিন্তু মেমসায়েবদের সাধারণ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নয়, খুবই বিরল। বিশেষ করে ১৮৩০-এর পর যে সব সম্ভ্রান্ত ও অভিজাত মেমরা কলকাতায় আসত, তারা তাদের স্বামীদের থেকেও বেশি জাতি ও বর্ণবিদ্বেষী ছিল।৯৬এমনকী, রুচিসম্পন্না অভিজাত ভারতীয় মহিলাকেও তারা নিচু চোখে দেখত। মূল কারণ, তাদের গায়ের কালো রং। শ্রীমতী ফেনটন তাঁর আয়াকে সহ্য করতে পারতেন না এজন্য। কুমারী স্টিল (Miss Steele) তো ভয়ে আঁতকে উঠতেন কালো রঙের মানুষ দেখলে।৯৭ একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল খ্রিস্টান মিশনারী মেমরা, যারা কলকাতার ধনী পরিবারের মেয়েদের লেখাপড়া শেখাতে তাদের অন্দরমহলে প্রবেশ করত নিঃসঙ্কোচে।

আঠারো শতকে কলকাতার সায়েবরা স্বদেশে যেত কালে-ভদ্রে। আর্থিক অসচ্ছলতা, সুদীর্ঘ সমুদ্র পথ পাড়ি দিয়ে যাওয়া-আসার ধকল এবং কোম্পানির চাকরির কড়া নিয়ম-কানুনের নিগড়ে বাঁধা পড়ে অনেকেরই চাকরি জীবনে একবারও স্বদেশে যাওয়া ও পরিবারের সঙ্গে মিলিত হওয়ার সুযোগ হয়ে উঠত না। যদি বা কখনও-সখনও যেত, স্বদেশকেই মনে হত বিদেশ। উনিশ শতকে বিলেতে যাতায়াত অনেকটা সুগম হলে সায়েবরা ঘন ঘন স্বদেশে গিয়ে এদেশে অর্জিত অভ্যেস সেখানে বর্জন করার সুযোগ পায়। এদিকে বিলেত থেকে মেমসায়েবরা যত বেশি সংখ্যায় কলকাতায় আসতে থাকে, তত বেশি সংকীর্ণতা ও সংস্কার বাসা বাঁধে তাদের মনে। ভারতীয় জীবন ও সংস্কৃতি থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন রাখতে তারা তৎপর হয়ে ওঠে। তারা তাদের নিজেদের জীবনচর্যার মান চালু করার ফলে ক্ষয়ে যায় আগেকার রীতি, রেওয়াজ এবং অভ্যেস।৯৮ বিলিতি মেমের সাহচর্য সুলভ হওয়ায় সায়েবদের ‘জেনানা’ বা রক্ষিতা রাখার ঝোঁক মিলিয়ে যায় ক্রমশ। কলকাতার সায়েব সমাজে শ্বেতাঙ্গিনীরাই শাসক-শাসিতের ফারাকটা ফুটিয়ে তোলে বেশি করে, কারণ তারা দিশি বিবিদের অস্তিত্ব মুছে দিয়েছিল।৯৯ যেসব সায়েবের বউ রাখার ক্ষমতা ছিল, বিয়ে করত। তখন সেই নবদম্পতি হয়ে উঠত এক রাশ ব্রিটিশ রক্ষণশীলতা এবং এদেশের মানুষসহ সবকিছু ঘেন্না করার প্রতিমূর্তি। ঘটনাক্রমে সায়েব যদিও বা প্রাচ্য দর্শন বা চিন্তাকে তার চিত্তে স্থান দিত, মেমসায়েব সেসব থেকে শত হস্ত দূরে থাকত চরম অবজ্ঞায়। তারা স্বামীর দিশি কর্মচারীর জন্য যেসব বিশেষণ ব্যবহার করত, সেগুলো হল, ‘জঘন্য কালো’, ‘নোংরা হিদেন’, ‘কালো জানোয়ার’, ‘নরকের কীট’ প্রভৃতি। একটা পাঁচ বছরের সায়েব-বাচ্চাও তার ভৃত্যকে ‘কালো জানোয়ার’ বলা শিখে যেত।১০০

জোব চার্নক তাঁর দিশি ভৃত্যদের নিষ্ঠুরভাবে শাস্তি দিতেন। আলেকজান্ডার হ্যামিলটনের সেই বর্ণনাকে অতিরঞ্জিত বলে মনে করেন স্যার হেনরি ইউল (Sir Henry Yule)।১০১ কিন্তু আঠারো শতকে কলকাতার নেটিভদের ওপর শ্বেতাঙ্গদের নিষ্ঠুর আচরণের যেসব তথ্য মেলে, তাতে মনে হয়, আলেকজান্ডার হ্যামিলটনের বিবৃতি খুব একটা ভ্রান্ত নয়। রেভারেন্ড লঙ ১৭৬৯ সালের এমন একটা ঘটনার উল্লেখ করেছেন।১০২ বারটন নামে একজন সায়েব কাউন্সিলের দরজার একেবারে উলটো দিকে বাঁটুরাম চ্যাটার্জির হাত-পা বেঁধে বাঁশে ঝুলিয়ে নিয়ে গিয়েছিল, যে ভাবে শুয়োর মেরে নিয়ে যাওয়া হয়। শুধু তাই নয়, নিষ্ঠুরভাবে চাবুক মেরে তাকে গো-মাংস খাওয়ানোর চেষ্টা করেছিল তার ধর্ম নষ্ট করার জন্য। কোম্পানির বিলেতের কর্তৃপক্ষ কিন্তু এসব ঘটনা অনুমোদন করত না। ১৭৫৫ সালের ৩১ জানুয়ারি তারা কলকাতার কাউন্সিলকে জানায়, ‘আমরা চাই কলকাতার মানুষ যেন নিরপেক্ষভাবে অনুগ্রহ লাভ করে।’১০৩ মাঝে-মধ্যে যে এই নীতির প্রতিফলন ঘটত না, তা নয়। ভৃত্যকে প্রহার করে বেতন না দেওয়ার অপরাধে জনৈক জনসনকে কয়েদ করা হয়। তাকে তিন মাস কাটাতে হয় গারদের ভেতর। জনসন ভ্যান্সিটার্টের কাছে আর্জি পেশ করেও খালাস পায়নি। মকুব হয়নি তার শাস্তি।১০৪

এরকম ঘটনা কিন্তু বিচ্ছিন্ন ও বিরল। বিলেতের নীতিকে নস্যাৎ করে কলকাতার সুপ্রিম কোর্টের সায়েব জুরিরা বিচার কার্যে রীতিমতো জাতি-বিদ্বেষের পরিচয় দিত। আসলে, শ্বেতাঙ্গ ও ভারতীয়দের জন্য পৃথক বিচার ব্যবস্থা ছিল। ভারতীয় অপরাধী ছিল বিচার বিভাগের কাছে বিপজ্জনক, আর শ্বেতাঙ্গ অপরাধীরা অবাঞ্ছিত। কোম্পানির ফৌজদারি ও দেওয়ানি আদালতে শ্বেতাঙ্গ অপরাধীরা হামেশাই খালাস পেয়ে যেত। ভারতীয় দণ্ডবিধির প্রণেতা মেকলে, যিনি আইনের সমতার সমর্থক ছিলেন, তিনিও এই বৈষম্যের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন তাঁর দণ্ডবিধিতে।১০৫ ১৮৪০-এর ১৩ জুন একজন এদিশি মহিলাকে চুরির অপরাধে প্রিন্স অব ওয়েলেস দ্বীপে নির্বাসন দেওয়া হয় সাত বছরের জন্য। অথচ ১৮০৪-এর ৪ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্ট জন ম্যাকলাউচ্‌লিনকে (John Maclaucnlin) এক টাকা জরিমানা ও এক মাসের হাজতবাসের শাস্তি দেয় একটা খুন করার অপরাধে।১০৬ ১৮০২ সালের ১০ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি জনৈক মরগ্যানকে জালিয়াতের অপরাধে বেকসুর খালাস করে দেন। তাঁর যুক্তি ছিল, তার অপরাধ বিলেতে শাস্তিযোগ্য হলেও সেই আইন তখনও কোম্পানির এলাকায় চালু হয়নি।১০৭ অথচ এই ঘটনার অনেক আগে হেস্টিংসের আমলে নন্দকুমারকে ফাঁসি দেওয়া হয় একই অপরাধে। সম্পদশালী এবং সম্মাননীয় সায়েবরা কোনও কুকর্ম করলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বেমালুম রেহাই পেয়ে যেত, যেহেতু তাদের দহরম-মহরম থাকত পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে।১০৮ স্বাধীনোত্তর ভারতেও সেই ট্রাডিশন, কিছু ব্যতিক্রম সাপেক্ষে, আজও অব্যাহত। কলকাতার কর্মকর্তারাও এড়িয়ে যেতেন ওপর মহলের কোনও সায়েবের অপরাধকে। আসলে, সম্ভ্রান্ত প্রভাবশালীদের কয়েদ করার ক্ষমতা ছিল কেবলমাত্র গভর্নর জেনারেলের হাতে। আর সেই ক্ষমতার প্রয়োগ ছিল বিরল ঘটনা। উনিশ শতকের প্রথম তিরিশ বছরে মাত্র দুটো কি তিনটে ক্ষেত্রে কোনও বড় মাপের সায়েবকে গ্রেপ্তার করা হয় অপরাধ করার অভিযোগে। কোম্পানির এই একচোখামিকে আশকারা দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট।

এমিলি এডেন তাঁর Letters from India গ্রন্থে এর নজির তুলে ধরেছেন একটা ঘটনা উল্লেখ করে। ১০৯ জনৈক পদস্থ ইংরেজ, সুপারিনটেনডেন্ট অব রোড, তাঁর বাড়িতে ডাকাতির অপরাধে ষোলোজন নেটিভকে নিষ্ঠুর শাস্তি দিয়েছিলেন নিজের হাতে, নিছক সন্দেহবশে। একটা বাঁশে হাতগুলো বেঁধে শূন্যে ঝুলিয়ে প্রথমে তাদের চাবুক কশানো হয়। তারপর তাদের পায়ের নীচে আগুন জ্বালিয়ে লোহা গরম করে তিনি তাদের পায়ে ছ্যাঁকা দেন নির্মমভাবে। ওই ভাবেই অসহায় মানুষগুলোকে ঝুলিয়ে রাখেন চোদ্দো থেকে আঠারো ঘণ্টা। তাদের ওই অবস্থায় রেখে তিনি নাকি ডিনার উপভোগ করেছিলেন ছ’গজ দূরত্বে বসে। ঘটনাটা ক্যাপ্টেন হ্যামিলটনের লেখা জোব চার্নকের নিষ্ঠুরতার কথা মনে করিয়ে দেয়। তিনি লিখেছেন, কোনও নেটিভ অপরাধ করলে চার্নক তাকে চাবুক খাওয়ার শাস্তি দিতেন। আর চাবুক মারার সময় তিনি ডিনার করতেন সেই নেটিভের আর্তস্বর শুনতে শুনতে। সেটা নাকি তাঁর কানে সংগীতের মতো শোনাত।১১০ ষোলোজন অপরাধীর মধ্যে একজন মারা যায়, বাকিরা জ্ঞান হারায়। এমন ভয়ংকর অপরাধ করা সত্ত্বেও শ্বেতাঙ্গ জুরি তাঁকে মুক্তি দেন নির্দোষের শিরোপা দিয়ে।

১৮১২ সালের ১০ জুন ‘হান্টার’ জাহাজের মালিক ম্যাকডোনাল্ড তার এক কর্মীকে শীতকালে সারারাত খোলা আকাশের নীচে বেঁধে রেখেছিল। কর্মীটির মৃত্যু হয়। মালিকের বিচার হয় সুপ্রিম কোর্টে। সাক্ষ্য-প্রমাণের যেমন অভাব ছিল না, সেগুলো তেমনি ছিল স্পষ্ট। তবু জুরি রায় দেন, ‘Not guilty’. প্রধান বিচারপতির কিছু করার ছিল না। তবে রায় ঘোষণা করার সময় তিনি বলতে বাধ্য হন, ‘জুরি ভদ্রলোকেরা নিশ্চয়ই সাক্ষ্য-প্রমাণগুলো সন্দেহ করার কোনও কারণ দেখেছিলেন। সেজন্য আপনি মানুষ খুন করেও শাস্তি থেকে রেহাই পেয়ে গেলেন, যা আপনার প্রাপ্য ছিল বলে আদালত মনে করে। আমি আশা করি আপনার এই বেকসুর খালাস পাওয়াটা আপনাকে ভবিষ্যৎ আচরণে শিক্ষা দেবে। এমনও হতে পারে, আপনি আর কখনও এমন সদয় জুরি পাবেন না।’১১১

জেনারেল পামার ওয়ারেন হেস্টিংসকে লিখিত এক চিঠিতে ওয়েলেসলির সংকীর্ণ মনোভাব সম্পর্কে অভিযোগ করেন। আদালতে দিশি ভকিলদের প্রতি ওয়েলেসলির তাচ্ছিল্যবোধ এতটাই ছিল যে, বছরে দুই থেকে তিনবারের বেশি তিনি তাঁর সঙ্গে তাদের সাক্ষাৎ করার অনুমতি দিতেন না। পামারের মনে হয়েছিল, রাজনীতির দিক থেকে এটা একটা বিপজ্জনক আচরণ। একেবারে ওপরওয়ালার এই অবাঞ্ছিত আচরণের ছায়া পড়েছিল নীচের তলার সায়েবদের ওপর। অথচ ম্যাজিস্ট্রেট ও বিচারপতিদের ওই দিশি ভকিল ছাড়া চলত না, কারণ সায়েবদের ছিল ভাষাজ্ঞানের অভাব এবং আইনের অন্ধিসন্ধি সম্পর্কে অজ্ঞতা।১১২ প্রত্যেক আদালতে একজন প্রধান মৌলভী থাকত, যার মাসিক বেতন ছিল মাত্র পঞ্চাশ টাকা। এটাই ছিল নেটিভদের জন্য উচ্চতম এবং সর্বাধিক বেতনের পদ। অথচ তার দেওয়া তথ্য ও ব্যাখ্যার ওপর নির্ভর করেই বিচারপতিরা তাঁদের রায় দিতেন।

উনিশ শতকের সূচনা থেকেই সায়েব-নেটিভ সম্পর্ক শীতল হতে শুরু করে। ১৮১০-এ উইলিয়মসন লিখেছিলেন, হিন্দু বা মুসলমানের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হলেও সায়েবরা খুব কম ক্ষেত্রেই উপস্থিত থেকে আপ্যায়নে আপ্লুত হতে চাইতেন। আগের মতো বাঈজি নাচের আসরেও তাদের আর তেমন দেখা যেত না।১১৩ ওই বছরেই শ্রীমতী গ্রাহাম এসেছিলেন কলকাতায়। তিনি খেদ প্রকাশ করেন সায়েব আর নেটিভদের মধ্যে দূরত্ব লক্ষ করে। তিনি লেখেন, ‘আমি বোম্বাইয়ে এদেশীয় পরিবারের সঙ্গে যেমন পরিচিত হতে পেরেছিলাম, এখানে (কলকাতায়) পারিনি। ইংরেজদের মধ্যে এই বোধ খুব গভীর যে, ভারতীয়রা তাদের অধীন।’১১৪ একজন সামান্য রাইটারও আশা করত যে, প্রতিটি দিশি মানুষ তাকে সেলাম ঠুকবে। কলকাতার সমগ্র সায়েব সমাজের এই বদ বিবেক বিনষ্ট করেছিল আগেকার সায়েব-নেটিভ সুসম্পর্ককে। বেন্টিঙ্ক এসে কিছুটা সামাল দেন ভারতীয়দের ঘোড়ার গাড়ি চেপে গভর্নর জেনারেলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার অনুমতি দিয়ে।

বস্তুত, সায়েবদের বিচ্ছিন্নতাবোধের সূচনা হয়েছিল খুব মৃদুভাবে ১৭৬০-এর পর থেকে, যখন তারা বেশি সংখ্যায় আসতে শুরু করে। তাদের মধ্যে সেনার সংখ্যাই বেশি, কিছু ছিল কোম্পানির অসামরিক কর্মচারী, কিছু বাণিজ্য জগতের মানুষ। গোরা বাহিনীর একটা বড় অংশ ছিল রাজকীয় সেনা, যারা অল্প কিছুদিন এদেশে থেকে বিদায় নিত। তাদের মধ্যে ছিল জগদ্দল জাত্যভিমান। রাজকীয় বাহিনীর অফিসার-পত্নীরা ছিল এ ব্যাপারে আরও পরিপক্ব। যেমন, শ্রীমতী শেরউড, শ্রীমতী ফেনটন তাদের সামরিক পরিমণ্ডলের বাইরে যেতেন না, মিশতেন না এদেশের সমাজের সঙ্গে।১১৫ যে দেশে ইংরেজরা ব্রিটিশ উপনিবেশ গড়তে চলেছে সে দেশ সম্পর্কে একটা চরম অবজ্ঞা এবং উদাসীনতা পুষে রেখেছিল মনের মধ্যে। প্রতিটি উপনিবেশকে তারা বিলিতি মডেলের রূপ দিয়ে চেয়েছিল। ফলে এমন কোনও প্রভাবের অস্তিত্ব রইল না যা তাদের মজ্জাগত সংকীর্ণতা, জাতি হিসেবে অতি সচেতনতাকে ডিঙিয়ে যেতে পারে। ১৮৩১ সালে কলকাতার কর্তৃপক্ষ সিভিলিয়ানদের ‘নেটিভ’ স্টাইলে পোশাক পরা নিষিদ্ধ করলে সেই হুকুমনামায় সিলমোহর দিল বিলেতের কর্মকর্তারা।১১৫ক কলকাতার সায়েবদের সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছে এদেশ ক্রমশ অপরিচিত হয়ে থাকতে লাগল। ১৮২৭ সাল থেকে দেখা গেল, এদেশে তৈরি কোনও কিছুই, না মসলিন, না রেশম, ফুল, এমনকী, অলংকার তা যতই মনোহারী হোক না কেন, সায়েবমেমেদের মন গলাতে পারছে না।১১৬ সায়েবদের বিবি রাখার নেশাও কমতে থাকল ক্রমশ। ১৭৮০-৮৫ সালের মধ্যে রচিত তিনটে উইলের মধ্যে একজন বিবি চোখে পড়ে। ১৮০৫-১৮১০-এর মধ্যে চারটে উইলে একটা, ১৮৩০-এর মধ্যে ছ’টায় একটা, আর এই শতকের মধ্যভাগের উইলে বিবিরা অদৃশ্য।১১৭ সায়েবদের মনোভাব গড়ে উঠল এমন ভাবনায়, ‘How nice India would be if it wasn’t for Indians.’ কলকাতা থেকে চোখ সরে গিয়ে তাদের দৃষ্টি আটকে গিয়েছিল ভক্‌সল এবং ব্রিংটোনের জাঁকজমকে।১১৮

অনেকে মনে করেন, আসলে, অনেক জটিল উপাদান একসঙ্গে মিশে গিয়েছিল সায়েব ও দিশি সমাজের সম্পর্কে। একদিকে কৃষ্ণাঙ্গদের সম্পর্কে ইংরেজদের প্রাক্‌-ঔপনিবেশিক অভিজ্ঞতা তেমন ভাল ছিল না। আফ্রিকা এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের কালো মানুষের মধ্যে তারা যে অ-সভ্যতা দেখেছিল, সেটা গেঁথে গিয়েছিল তাদের মনের মধ্যে। ভারতে মুসলমানদের সম্পর্কে তাদের মনোভাবে প্রভাব ফেলেছিল পূর্বের ইতিহাস। আরব-তুর্কিদের সঙ্গে তাদের বৈরীভাব ছিল সেই ক্রুসেডের সময় থেকে। অন্য দিকে, হিন্দুরা তাদের গোঁড়া বর্ণপ্রথা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি কঠোর সামাজিক অনুশাসনকে অবজ্ঞা করে। তা ছাড়া, তারা এই শ্বেতাঙ্গ মানুষগুলোকে বিশ্বাস করতে পারেনি ষোলো শতকে পর্তুগিজদের নিষ্ঠুর অত্যাচার স্মরণ করে।

কিন্তু এসব কিছু গুরুত্বহীন। আসল কারণ রাজনৈতিক প্রভুত্বের প্রভাব। আঠারো শতকের প্রথম দিকে সায়েবদের মধ্যে জাতিবিদ্বেষ তেমন চোখে পড়ে না। সে সময় কলকাতায় কুঠি স্থাপন করলেও, লোকবল ও ধনবলের অভাব ছাড়াও তারা ত্রস্ত থাকত নবাবের ভয়ে। পলাশি যুদ্ধের পর থেকে এই ভীতি যত কেটে যেতে থাকল, তাদের অন্তর্লীন জাতিবিদ্বেষ প্রকাশ পেল ধাপে ধাপে। ক্ষমতার ভারসাম্য মুছে যেতেই শাসক জাতি হিসেবে ইংরেজদের অহমিকা ফাটল সৃষ্টি করতে থাকল শ্বেতাঙ্গ ও ভারতীয় সমাজের মধ্যে।

১৮৩৪ সালে The Asiatic Journal লিখেছিল, কলকাতার বাইরে মফস্‌সলে এদিশি কেউ বিচারপতি বা কালেকটরের বাড়িতে জুতো পরে ঢোকার সাহস করত না। ‘জনাব হুজুর’, ‘খোদাবন্দ’, ‘জাপুনা’ ইত্যাদি সম্মানজনক সম্বোধন করে তাদের সামনে দাঁড়াতে হত হাত জোড় করে। কোনও কালো মানুষ গোরা সায়েবের চোখে চোখ রেখে কথা বলবে এমন দস্তুর ছিল না। পালকিতে চেপে সায়েবের বাড়ির চত্বরে প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। সায়েবের সামনে বসা ছিল রীতিমতো কসুর। অবশ্য আদালতে পেশকর, মুনশিরা চেয়ারে বসত সায়েবের সামনে সকাল ন’টা থেকে সন্ধে সাতটা পর্যন্ত। কিন্তু সোজা হয়ে, একটু ঝুঁকে পড়া ছিল ঔদ্ধত্যের সামিল।১১৯

তবে কলকাতায় এতটা বাধা-নিষেধ ছিল না বলে মনে হয়। Victor Jacquemont লিখেছেন, কলকাতায় একজন অতি সাধারণ বাঙালিও গভর্নর জেনারেলের উপস্থিতিতে জুতো বা চটি পরে থাকতে পারত। দোষের ছিল না। কিন্তু দিল্লিতে ছিল কড়া নিয়ম-কানুন। সেখানে একজন অভিজাত মোগলও একেবারে নিচু স্তরের সায়েবের কাছে যাওয়ার সময় জুতো খুলে নিত।১২০ আসলে সায়েবরা এই দেশীয় রীতি নকল করেছিল এদিশি শাসককুলের কাছ থেকে। এক সময় বাংলার নবাবরা ইংরেজ রেসিডেন্টকেও তাঁর দরবারে প্রবেশকালে বাধ্য করত একই রকমভাবে তসলিম জানাতে। ১৭৭৬ সালে জনৈক ব্রিটিশ অফিসার এক চিঠিতে লিখেছেন, বাংলায় মসনদচ্যুত নবাব মিরকাশিম তখন মৃত্যুশয্যায়। চরম দারিদ্র্য তাঁকে গ্রাস করেছে। তিনি নিরাশ্রয়, নির্বান্ধব। একদিন তাঁর সন্তানদের পাশ দিয়ে ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে যেতে যেতে আগের একটা ঘটনার কথা অফিসারের মনে পড়ে যায়। পাটনায় মিরকাশিম তাঁকে ঘোড়া থেকে নেমে রাস্তার পাশে এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য করেছিলেন যতক্ষণ না নবাবের অনুচরেরা তাঁকে অতিক্রম করে যায়। তিনি লিখেছেন, ‘তাঁর সন্তানদের প্রতি ঠিক এমনই আচরণ আমি করতে পারতাম। কিন্তু আমি হিংসাপরায়ণ হয়ে উঠতে পারিনি।’১২১ বলা বাহুল্য, এটা ছিল ব্যতিক্রমী ঘটনা।

সূত্রনির্দেশ

১. Oneil Biswas, Calcutta and Calcattans: From Dihi to Megalopolis, Calcutta (1992), p. 111.

২. P.T. Nair, (ed.), British Social Life in Ancient Calcutta, 1750-1850, Calcutta (1983). p. 13

৩. Eliza Fay, Original Letters from India, 1779-1815. London (1986-র সংস্করণ) p.18.

৪. Hartly House Calcutta, ১৭৮৯-এর সংস্করণের পুনর্মুদ্রণ কলকাতা ১৯০৮। p. 34.

৪ক. W.H. Carey, The Good Old Days of Honourable John Company, Calcutta, (1980), p. 108.

৫. P.T. Nair, (ed.), Calcutta in the 19th Century, প্রাগুক্ত, p. 577.

৬. তদেব p. 446.

৭. Kathleen Blechynden, Calcutta: Past and Present. New Delhi (2003) p. 109.

৮. The Asiatic Journal, November 1816, p. 506.

৯. T.R. Barret, Calcutta, Strange Memoirs- Foreign Perceptions, Kolkata (2014), p. 437.

১০. তদেব, p. 438.

১১. The Asiatic Journal, New Series, vol. 14, No. 53, 1834; p. 2.

১২. William Huggins, Sketches in India, London (1824), p. 106.

১৩. Alfred Spencer, (ed.), Memoirs of William Hickey, vol. III, London (1923), p. 294.

১৪. Percival Spear, The Nabols, London (1980), p. 12.

১৫. Peter Quennell. (ed.), Memoirs of William Hickey, London (1975), p. 233.

১৬. Judicial (Criminal) Proceedings, 21 October, 1808, No. 4.

১৬ক. W.H. Carey, প্রাগুক্ত, p. 107.

১৭. J. Long. Selection from Unpublished Records of Government, Calcutta (1973), No. 140.

১৮. W.H. Carey, প্রাগুক্ত, p. 107.

১৯. Thomas Williamson, The European in India, London (1813) preface.

২০. W. H. Carey, প্রাগুক্ত, p. 107.

২১. Bengal Past and Present, vol. XXIX, 1925, p. 115.

২২. P.T. Nair, (ed.), British Social Life in Ancient Calcutta, 1750-1850, Calcutta (1983), p. 15.

২৩. Thomas Williamson, The East India Vade-Mecum, vol. 2, London (1810), p. 115.

২৪. P. Spear, The Nabob, p. 96.

২৫. Bengal Past and Present, vol. XXVIII, 1924, p. 135.

২৬. P. Spear, The Nabob, p. 97.

২৭. তদেব।

২৮. তদেব।

২৮ক. Kathleen Blechynden, প্রাগুক্ত, p. 108.

২৯. Laura Sykes, (ed.), Calcutta: Through British Eyes, 1690-1910, New Delhi (1992) p. 32.

৩০. Abhijit Dutta, European Social Life in the 19th Century Calcutta, Calcutta (1994), p. 55.

৩১. The Calcutta Review, May-August, 1844, pp. 23-24.

৩২. Sushil Mukherjee, The Story of Calcutta Theatres, 1753-1980, Calcutta (1982) p. 2.

৩৩. Phebe Gibbes and Michael Franklin (ed.), Hartly House, Calcutta. Calcutta (1908) pp. 58-59.

৩৪. Sushil Kumar Mukherjee, প্রাগুক্ত, p. 2.

৩৫. P.T. Nair, British Social Life in Ancient Calcutta, p. 63.

৩৬. Sushil Kumar Mukherjee, প্রাগুক্ত, p.4

৩৭. Bengal Past and Present, vol. XXVIII, 1924, p. 133.

৩৮. Sushil Kumar Mukherjee, p. 5.

৩৮ক. W.S. Seton Karr, Selections from Calcutta Gazettes, vol. 5. Calcutta (1984) pp. 121-22.

৩৯. H. E. A. Cotton, Calcutta Old and New, Calcutta, (1907), p. 150.

৪০. P.T. Nair, প্রাগুক্ত, p. 65.

৪১. তদেব, p. 176.

৪২. P. Spear, The Nabob, p. 17.

৪৩. The Asiatic Journal, New Series, vol. 13, 1834, p. 68.

৪৪. তদেব।

৪৫. Calendar of Persian Correspondence, vol. XI, p. XXXVI.

৪৬. William Dalrymple, White Mughals, Gurgaon, (2004) p. 10.

৪৬ক. T. R. Barret, প্রাগুক্ত, p. 13.

৪৬খ. Percival Spear, প্রাগুক্ত, p. 22.

৪৭. William Dalrymple, The Last Mughal, Haryana, (2007), p. 153.

৪৮. তদেব, p. 66.

৪৯. P. J. Marshall, British Society in India under the East India Company, (Modern Asian Studies, 31.1. 1997), p. 93, 101.

৫০. Dalrymple, White Mughals, p. 22.

৫১. Suresh Chandra Ghosh, The Social Condition of the British Community in Bengal, 1757-1800, Leiden, (1970), p. 76.

৫২. Alfred Spencer, (ed.), Memoirs of William Hickey, vol. III, London (1923), p. 327.

৫২ক. William Dalrymple, White Mughals, p. 235.

৫৩. T. R. Barret, Calcutta, Kolkata, (2004), p. 232.

৫৪. William Dalrymple, White Mughals, p. 34.

৫৫. তদেব, p. 35.

৫৬. P. Spear, প্রাগুক্ত, p. 36.

৫৭. Douglas Dewar, In the days of the Company. London (1920), p. 53.

৫৮. তদেব, p. 54.

৫৯. তদেব, p. 55.

৬০. তদেব, p. 56.

৬১. তদেব, p. 55.

৬২. Dalrymple, White Mughals, p. 33.

৬৩. The Asiatic Journal, New Series, vol. 15, 1834, p. 53.

৬৪. P. Spear, The Nabobs, p.99.

৬৫. তদেব, p. 38.

৬৬. James M. Holzman, The Nabobs in England, A Study of the returned Anglo-Indian, 1760-1785, Calcutta (1987), p. 23.

৬৭. The Asiatic Journal, November 1816, p. 519.

৬৮. P.T. Nair, (ed.), Cakcutta in the 19th Century, Calcutta (1989), pp. 258-59.

৬৯. Rudrangshu Mukherjee, Forever England, (Sukanta Choudhuri (ed.), Calcutta, the Living City, vol. I, Calcutta (1990), p. 50.

৭০. P. T. Nair, প্রাগুক্ত, p. 195.

৭১. Michael Edward, The Sahibs and the Lotus, London (1988), p. 41.

৭২. রাজনারায়ণ বসু, সেকাল আর একাল (সম্পা. ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সজনীকান্ত দাস), কলকাতা (১৪১১), পৃ. ৫৪।

৭৩. William Dalrymple, White Mughals, p. 4.

৭৪. Thomas Williamson, The East India Vade-Mecum, vol. II, p. 2.

৭৫. E. M. Collingham, Imperial Bodies, Malden, USA (2001),pP. 24.

৭৬. তদেব।

৭৭. William Dalrymple, প্রাগুক্ত, p. 53.

৭৮. তদেব, p. 41.

৭৯. P.T. Nair, প্রাগুক্ত, p. 609.

৮০. Thomas Medwin, The Angler in Wales, London (1834), pp. 4-8.

৮১. P. Spear, প্রাগুক্ত, p. 148.

৮২. The Asiatic Journal, New Series, Vol. 18, (1835), p. 122.

৮৩. E. M. Collingham, প্রাগুক্ত, p. 27.

৮৪. রাজনারায়ণ বসু, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩-৪।

৮৫. J. Statham, Indian Recollections, London (1832), pp. 203-4.

৮৬. শ্রীপান্থ, কলকাতা, কলকাতা (২০১৬), পৃ. ৩৪৯-৫০।

৮৭. Ashis Nandy, The Intimate Enemy: Loss and Recovery of Self Under Colonialism, Delhi (1995), p. 5.

৮৮. শ্রীপান্থ, প্রাগুক্ত।

৮৮ক. L. S. S. O’ Malley, Indian Civil Service 1601-1930, London (1931), p. 179.

৮৯. Bengal Past and Present, vol. XLVI, 1933, pp. 31-32.

৯০. The Asiatic Journal, vol. 26, 1828, p. 606-7.

৯১. Bengal Past and Present, vol. XXIV, 1923, p. 50.

৯২. William Dalrymple, White Mughals, p. 44.

৯৩. তদেব, p. 48-49.

৯৪. তদেব, p. 49.

৯৫. Abhijit Dutta, European Social Life in 19th Century Calcutta, pp. 62-63.

৯৬. Abhijit Dutta, European Women and Children in the 19th Century Bengal, Calcutta (1992), p. 4.

৯৭. The Asictic Journal, New Series, vol. 14, No. 54 (1834), p. 97.

৯৮. P. Spear, প্রাগুক্ত, p. 140.

৯৯. Kenneth Ballthatchet, Race, Sex and class under the Raj, London (1980), p. 5.

১০০. P. Spear, p. 141.

১০১. Thankappan Nair, Job Charnock, Calcutta (1977), pp. 31-32.

১০২. J. Long. Selections, No. 463.

১০৩. তদেব, No. 175.

১০৪. H. E. Busteed, Echoes from Old Calcutta, (Reminiscences of the Days of Warren Hastings, Francies and Impey) New Delhi, তারিখ নেই, p. 185.

১০৫. Sarmistha De, Marginal Europeans in Colonial India, 1866-1920, Kolkata (2008) p. 9.

১০৬. W.H. Carey, প্রাগুক্ত, p. 266.

১০৭. তদেব, p. 265.

১০৮. William Huggins, Sketches in India, London (1824) p. 114.

১০৯. Emily Eden, Letters from India, vol. II, London (1872), p. 149.

১১০. Captain Alexander Hamilton, A New Account of the East Indies, vol. I, London (তারিখ নেই) p. 6.

১১১. W. H. Carey, প্রাগুক্ত, p. 271.

১১২. P. Spear, p. 139.

১১৩. তদেব।

১১৪. তদেব।

১১৫. Ketaki Kushari Dyson, A Various Universe, New Delhi, (2006) p. 31.

১১৫ক. Letters from the Court of Directors, (Judicial), 2 February, 1831.

১১৬. Journal of Mrs. Fenton (P. Spear, p. 142).

১১৭. W. Dalrymple, White Mughals, p. 52.

১১৮. P. Spear, p. 142.

১১৯. The Asiatic Journal, New Series, vol. 14. 1834, p. 10.

১২০. P.T. Nair, Calcutta in the 19th Century, p. 515.

১২১. The Asiatic Journal, New Series, vol. 15, 1834, p. 61.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *