সাদা ইমারত
গাঁয়ের এইদিকে হাসিনা কোন দিন আসে নাই। এত বড় মাঠ আছে তাদের গাঁয়ে? বিস্ময়ে সে চারিদিকে চাহিয়া থাকে!
সঙ্গিনী তার আরো তিন চার জন। কৃষক-পল্লীর গরীব ছেলে-মেয়েরা মেটে-শাক তুলিতে আসিয়াছে।
কি রে হাসি, তুই যে হাঁ করে চেয়ে আছিস। শাক তুবি নে। চেয়ে থাকলে পেট ভরবে?
হাসিনা সচেতন হয়। আবার তার হাত চলে। উবু হইয়া বসিয়া শাক তোলা বেশীক্ষণ ভাল লাগে না। তবু কৰ্ত্তব্য অবকাশ দেয় না এতটুকু।
বাড়িতে আজ তরকারীর কোন বন্দোবস্ত নাই। মুঠি কয়েক ডাল আছে মাত্র। তাও পোকা—খাওয়া। দু-টী ছোট ভাই-বোনের পক্ষে তা যথেষ্ট নয়। তার নিজের জঠরের দিকে সে তাকায় নাই।
হাসিনা শাক তুলিতে মাঠে আসে। কিন্তু আজ আসিয়াছিল নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বে। মন তার ভাল নয়। দুপুর-বেলা তার আব্বা মুনিশ খাটিয়া ফিরিলে ব্যঞ্জনের অভাব হইবে। ছোট ভাই-বোন কম কান্নাকাটি করিবে না, খাওয়ার সময় তরকারী কম হইলে। তাই হাসিনা মাঠে আসিয়াছিল। পাড়ার চাষীদের আরো কয়েকটি গরীব মেয়ে সঙ্গিনী জুটিয়াছিল। এইটুকুই যথেষ্ট।
কিন্তু মাঠে আসিয়া তার বুক ভরিয়া গেল। মাঠের এই দিকে সে কোন দিন পা বাড়ায় নাই।
সঙ্গিনীরা কচি-কচি মাটে শাকের ডগ তুলিয়া কোঁচড় ভর্ত্তি করিতেছে। আজ তার হাতে জোরে চলে না। কাজে সে অবশ্য খুব পটু নয়। বাবা তার জন্য কম গালি-গালাজ করে না।
—চট্পট নে, হাসি। মাঠে এসে আজ তোর ভাব লেগেছে নাকি?
হাসিনা ব্যথিত হয়। সে স্বামী-পরিত্যক্তা। যৌবন তার আসিয়াছিল, বোধ হয় কয়েক মুহূর্ত্তের জন্য। তারপর সে আর বাড়ে নাই। শরীরে কোথায় যে ব্যাধির কীটেরা বাসা বাঁধিয়াছিল, সে জানে না। এই অপরাধে স্বামী তাকে পরিত্যাগ করিয়াছে। যদি তালাক দিত, কোন দুঃখ ছিল না। স্বামী আর তার কাছে আসে না। শ্বশুর-বাড়ী সে নিজেই যাচিয়া গিয়াছিল একবার। স্বামী ও সঙ্গে-সঙ্গে বাড়ী ছাড়িয়াছিল। শ্বশুর-বাড়ীর লোকদের জ্বালাতন সে স্বচ্ছন্দে সহ্য করিত। এক দেবর তা-কে আবার এই গাঁয়ে পৌঁছাইয়া দিয়া যায়। চরম লাঞ্ছনার আর কী বাকী থাকে।
হাসিনা-কে দেখিলে মনে হয়, বয়স হইয়াছে বাইশের বেশী। কিন্তু সে যুবতী এমন লক্ষ্মণ-ই তার মধ্যে নাই। অথচ একদিন বাড়ীর লোকেরা—বাবা আরো অনেকে নিশ্চিন্ত হইয়াছিল তার বিবাহে।
হাসিনার মা নাই। মা-কে সহজে মনেও পড়ে না। যেদিন হাসিনার চোখে পানী আসে, সেদিন সে ডুকরে কাঁদা বুকে মার স্মৃতি আঁকিবার চেষ্টা করে। সে চেষ্টাও নিষ্ফল।
সঙ্গিনীর কথায় হাসিনা ব্যথিত হয়। ধীরে ধীরে মেটে শাকের সবুজ ডগ একটী নখের আগায় খুঁটিতে থাকে। তার হাল্কা বুকে যেন আবার জগদ্দল পাথর চাপিয়া বসিল।
খাগড়া-গাছ ভরা মাঠ। আরো বুনো ঘাসের রাজগী এখানে। মাঝে মাঝে ফাঁকা জায়গায় মেটে শাক জন্মায়। দরিদ্র কৃষক-পল্লীর ছেলেমেয়েদের আশীর্ব্বাদ স্বরূপ প্রকৃতি শুধু এই একটী মাত্র উপহার দান করে। ব্যঞ্জন-হীন ক্লিষ্ট দিনের ব্যথা মুছিয়া যায়। পৃথিবীর আদিমতার পরিবেশে মানুষের সন্তানেরা দাঁতে কুন্দ-ফুল ফোটায়। তারাও হাসে, আনন্দে যাদের কোন অধিকার নাই।
আনমনা হাসিনা দূরে দৃষ্টি মেলিয়া অবাক হয়। মাঠের প্রান্তে বাঁধ দেখা যায়। উঁচু খাগড়ার বন বাতাসের দাপে ভূমি-শায়ী হইয়া আবার মাথা উঁচু করে। হাসিনা দেখিতে পায় দূরে বাঁধের কোলে একটা সাদা পাকা-বাড়ী। উপরে লাল টালি-ছাওয়া। নিচের দেওয়াল সাদা নয়, লাল।
চোখের পাতা মুছিয়া হাসিনা দাঁড়ায়। মরিয়ম বলে, কি লো ভাবের লোক দেখা গেল নাকি?
মাঠের আল-পথ বাহিয়া কতগুলি লোক হাঁটিতেছিল। বোধ হয় গঞ্জে যাইতেছে।
হাসিনা লজ্জিত হয় না। কারণ লজ্জিত হইবার কোন বোধ, সঙ্গিনীর কথায় জাগে না।
মরিয়ম দাঁড়াইয়া সাদা বাড়ীটা নিরীক্ষণ করিতে লাগিল। ভারী সুন্দর দেখায় বাড়ীটা। নিচের দেওয়াল-গুলো লাল ইটে গাঁথা; বাড়ীর অধিকারী চুণকামের বদলে বোধ হয় মাজা ইট লাগাইয়াছে।
হাসিনার পরনে ময়লা তাঁতের কাপড়। আঁচল দিয়া সে কোঁচড় তৈরী করিয়াছিল। মেটে শাকের ভাণ্ডার ত সে-টাই। হাসিনা অবশ্য কম মেটে শাক তোলে নাই। কোঁচড় তার প্রায় পূর্ণ।
বাতাসে রুক্ষ চুল ওড়ে। গালে একটা বন পোকা হঠাৎ বসিয়াছিল। হাসিনা তার কৃশ আঙ্গুল বুলায় গালের উপর।
সঙ্গিনী মরিয়ম ভারী মুখরা। সে এই বাড়ীর বৌ। দিন-মজুরের স্ত্রী। অবরোধ ভাঙিয়া মাঠেও আসিতে হয়; নচেৎ জঠর চলে না।
মরিয়ম উঠিয়া দাঁড়ায়। বলে, কি দেখছিস লো। ভাবের লোক কোথা গেল?
তারপর সে মরিয়মের শাক-ভরা কোঁচড়ে আঙ্গুলের টোকা দিয়া বলে, ও বাবা, এরি মধ্যে পেট উঁচু।
অন্যান্য মেয়েরা খিখিল করিয়া হাসে। মরিয়ম হাসিনার মুখের দিকে তাকায় না। সে নিস্তব্ধ, নীরব। রসিকতা তাকে কোনদিন স্পর্শ করে না। অন্ততঃ এই রসিকতা।
হাসিনা সাদা ইমারতের দিকে আবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। অচেনা অজানা অন্য কোন মানুষের নীড় তার বুকে আঁকা হইয়া যায়। হাসিনা যেন রহস্য-পুরীর দিকে চাহিয়া আছে।
গ্রামে দু-একজন বনেদী একদা-ধনবান লোকের পাকা ইমারত আছে। তা নিতান্ত ইটের উপর ইট সাজানো মাত্র। এমন সুন্দর ঘর কোনদিন তার চোখে পড়ে নাই।
হাসিনা স্পষ্ট মনের কাছে কিছু খুঁজিয়া পায় না। এখনও তার কর্তব্য সমাপ্ত হয় নাই, তাই আবার সে বসিয়া পড়ে উবু হইয়া। তার সম্মুখে মেটে শাকের বন। হাসিনা শাক তুলিতে থাকে। মাঝে মাঝে দম-ফেলার জন্য বাঁধের কোলে দৃষ্টি বিবাগী করে। দূরে সাদা প্রতীক্ষমাণ ইমারত, থম্থমে স্তব্ধ রাত্রির প্রাঙ্গণে অভিসারিকা যেন তরুলতার ফাঁক দিয়া হাতছানি দিতেছে।
হাসিনার মন ভারাক্রান্ত। শ্রাবণের মেদুর আকাশের মত তার মুখে কালো ছায়া।
অন্যান্য মেয়েরা কর্ম-ব্যস্ত। হাসিনার দিকে দৃষ্টিপাত করিবার সময় তাহাদের নাই। মেটে শাক বেশী তোলা লাভেরই ব্যাপার। প্রতিবেশীদের নিকট হইতে অন্ততঃ এক পলা তেল, দুটো লঙ্কা কি সামান্য নুন পাওয়ার প্রত্যাশা থাকে।
হাসিনা আজ জীবনে প্রথম কর্তব্য অবহেলা করিতেছে।
দূরে শ্বেত-মর্ম্মরের দৈত্য-পুরী। কারা বিচরণ করে তার প্রাঙ্গণে? তাল-পাতা-ছাওয়া মাটীর ঘরে যারা মাস, বর্ষ মন্বন্তর কাটায়, তাদের চোখে প্রাসাদের অঞ্জন কেমন করিয়া প্রতিভাত হয়! মনের অতল গহনে কোন আরশীর ফলক আছে বোধ হয়, যার সমতলে মাঝে মাঝে বিচিত্র ছবির আশ্বাস ভাসিয়া উঠে।
হাসিনা আবার উঠিয়া দাঁড়ায়। লোভ হয় তার—একদিন বাঁধের কোলে সে নিশ্চয় পাড়ি দিবে। এই সামান্য এক ক্রোশ পথ।
তার তন্দ্রা হঠাৎ ভাঙিয়া যায় মরিয়মের ডাকে। সে বলে, চলো। আর দরকার নেই।
দুপুরের কাছাকাছি বেলা।
মরিয়ম জবাব দিতে হোঁচট খায় যেন, “একটু দাঁড়াও, ভাবী। আর কয়েকটা তাজা ডগ তুলে নি।”
—বেশী দেরী করিস নে। তোর ত আজ কাজে গা নেই।
বিষণ্ন মন লইয়া মাঝে মাঝে খেলা করিতে ভাল লাগে। হাসিনার সে অবকাশ কোথায়? তাড়াতাড়ি হাত চালায়। ভাল শাক আর সে বাছে না। পোকা-ধরা ডগ-ই হয়ত কোঁচড়ে তুলিয়া রাখে। তার জন্য আবার মেহনত করিতে হইবে। হাসিনা সে-দিকে খেয়াল করে না।
মরিয়ম ও অন্যান্য মেয়েরা সবাই এবার উঠিয়া দাঁড়ায়। হাসিনা-কে তারা ডাকে, কই উঠে পড়। তোর বাবা এলে যদি ভাত না পায়, ছুঁড়ী-কে চেলা-কাঠ দিয়ে না পেটে—যে রাগী লোক।
হাসিনা ত্রস্ত উঠিয়া পড়ে। মরিয়ম আবার হাসে। বলে, অত ভাব করলে কি আর শাক তোলা হয়?
—খামখা আমাকে দোষো, ভাবী।
মরিয়ম খুব প্রাণবন্ত। তাই দারিদ্র্যের পরিবেশেও সে কেবল মনের জোরে আনন্দ আহরণ করে। হৃদয়ের সাড়া নাই, তবু সে হাসে।
কিষাণ-পল্লীর বৌ-ঝিরা গাঁয়ের দিকে মুখ ফেরায়।
হাসিনা সকলের পিছনে। সে গাঁয়ের সড়কের মুখে আসিয়া আবার পশ্চাতে তাকায়। চোখের পাতা তার পড়ে না। দূর-দিগন্তের কোল ঘেঁষা বাঁধের সর্পিল রেখা ভিনগাঁয়ের দিকে চলিয়া গিয়াছে। তারই এক-টেরে ইমারতখানা সূর্য্যের আলোয় ঝলমল করে।
মরিয়ম হঠাৎ পেছনে ফিরে বলে, কি লো এখনও ওদিকেই চেয়ে আছিস। তোর হোল কী?
—এই যে চলো, ভাবী। এই মাঠে কোনদিন আসিনি কিনা, তাই চেয়ে দেখছি।
—সব বুঝেছি লো। তারপর সে মিষ্টি সুরে হাসিনার গলা ধরিয়া বলে—
ভাবের লোকের দেখা যদি পাই,
বোলো তারে,
তোমার মত নিদয় হেন নাই!
.
২.
হাসিনার বাবার জমি-জায়গা দু-এক বিঘা বহুদিন আগে ছিল। নানা বিপর্যয়ে এখন সে খোয়ার। পাৎলা চেহরায় এক-রাশ দাড়ী মুখে। চোখ দুটো খুব ছোট—যেন শঙ্খচূড় সাপের চোখ। অদ্ভুত হিংস্রতা তার অবয়বে ফুটে উঠে। কিন্তু কারো সঙ্গে বিবাদ সে করে না। শ্রম-ক্লান্ত অবেলায় সে গালি-গালাজ করে কেবল হাসিনা-কে। অথবা হাসিনার অনেক ছোট, ছেলে আর মেয়েটাকে ধমকায়। মাজুর বয়স ছয়, সে হাসিনার বোন। ভাইয়ের বয়স পাঁচ। নাম শাহাদ। প্রসবের সময় মা মারা যায়। শাহাদ আজও জীবিত। মাটিতে পড়ার পর সে হাসিনার কোলে উঠিয়াছে। এই দায়িত্ব হইতে তার কোন রেহাই নাই। বিবাহে কয়েকদিন সে কাছ-ছাড়া হইয়াছিল। কিন্তু স্বপ্নের মত সে-বিবাহের রেশ ছিল মাত্র কয়েক মুহূর্ত, কয়েকদিন। শাহাদ আবার হাসিনার কোলে হারানো মা-কে খুঁজিয়া পায়।
বাবার দিকে চাহিয়া হাসিনার মুখ শুকাইয়া যায়। ছোট একটা ঘরে বাবা ভাঙা তক্তপোষে মাজু—কে লইয়া ঘুমায়। নিচে উনুনের এক পাশ রান্নার পর পরিষ্কার করিয়া ঘুমায় হাসিনা, সঙ্গে থাকে শাহাদ। শাহাদও ভারী ম্রিয়মান। হাসিনার নিস্তেজ প্রাণের আবেদন যেন ওইটুকু কচি ছেলের বুকও অধিকার করিয়াছে। রূপ-কথা শোনার আবদার তার মনে জাগে না, শিশুদের পক্ষে যা’ স্বাভাবিক। শাহাদ মাঝে মাঝে বিছানায় মুতে ফেলে। মাদুর ভিজিয়া যায়। হাসিনার সে-রাত্রে ঘুম হয় না। পাছে কাপড় বদলানোর সময় বাবার ঘুম ভাঙে, তখন জবাব দিহি হইবার সাহস তার নাই। ব্যাপারটা শুনিলে হয়ত ঘুমন্ত শাহাদের হাত ধরিয়া ধুলার উপর ফেলিয়া দিবে। একবার এই কাণ্ড করিয়াছিল তার বাবা। তাই হাসিনা পক্ষী-জননীর মত সব সময় শাবকের উপর ডানা মেলিয়া রাখে; ঝড়ের আক্রোশ আসুক তার উপর, রাত্রির ক্রুরতা প্রাণরোধী নিঃশ্বাস ফেলিয়া যাক; সে তার কর্তব্য-ভূমিতে অনড়, স্থির।
কোন-কোন রাত্রে হাসিনার বাবা বিছানায় থাকে না। সেদিন হাসিনার আরো কষ্ট হয়। অতন্দ্র চোখের পাতা টনটন করে, তবু ঘুম আসে না। হাসিনা জানে, তার বাবা কোথায় যায়। তার বাবা চোর। অবশ্য ছেঁড়া চোর। গেরস্থর কলা-মূলা চুরি করে।
হাসিনা বাবার নৈশ অভিযানের প্রক্রিয়া ভালরূপে বোঝে। প্রথমে সে ডাকে, হাসি জেগে আছিস?
হাসিনা জাগিয়া থাকিলেও জবাব দেয় না। আগে সে উত্তর দিত তখনই। কিন্তু বাবা চট ঝাঁঝালো স্বরে খেঁকাইত : হারামজাদী, ঘুমো না। সকালে কত কাজ মনে আছে?
তাই ইদানীং হাসিনা নীরবতা বজায় রাখে। তখন তার বাবা ধীরে ধীরে সন্তর্পণে তক্তপোষ থেকে নামে, তারপর ঘরের টাঁটি খোলে খুব সাবধানে। তারপর একলাফে এক-দম উঠানে I
হাসিনার বাবা কালু ফিরিয়া আসে ভোরে রাত্রে। এতক্ষণ হাসিনার বুক দুরুদুরু করে। ছোট ভাইটা—কে আরো বুকের কাছে টানিয়া সে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে। তার দুই কান সদা সর্বদা জাগ্ৰত। চৌকিদার প্রহর হাঁকিয়া গেল, তার ডাক নৈশ আকাশ-প্রান্তরে মিলাইয়া যাইতেছে; হাসিনার অঙ্গ থরথর করিয়া কাঁপে। কোনদিন বাবা জেলে চলিয়া যাইবে। কিন্তু এমন দুর্ঘটনা কোনদিন ঘটে নাই। কলা, মূলা পেঁপে,
বনজ শাক-সব্জী লইয়া কালু বাড়ী ফেরে। হাসিনা সব জানে। দিনে সে এই সব রান্না করে না, বাবার হুকুম। রাত্রে সন্ধ্যা-প্রহরের পর সে ভাত চড়ায়। ছোট ভাই-বোনদের অনেক রাত্রি-ই খাওয়া হয় না। তারা ঘুমাইয়া পড়ে। হাসিনা হাজার ক্ষুধায়ও আহার সহজে গ্রহণ করিতে পারে না। কালু মিয়ার জন্য অবশ্য কোন জিনিষ ফেলা যায় না। সকালে পান্তা আহারের পর সে জন খাঁটিতে যায়।
হাসিনা নির্বিকার। তার মনের অনুভূতি কোন অর্থ তার কাছে যেন বহন করে না। প্রকৃতির আশীর্বাদে যে শিরা রক্ত-ধমনী পার্থিব ঐশ্বর্য ও নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যের বাণী বহন করিয়া আনে, তার সহজ সরল বিকাশ রুদ্ধ হইয়া গেলে, তা দুমড়ানো গোলাপের পাপড়ির মত সৌগন্ধ-শূন্য হইয়া পড়ে, সজীবতা হারাইয়া ফেলে। বাতাসের কাছে তা সৌরভের বার্তা আর পৌঁছাইয়া দিতে পারে না। হাসিনা এই অভিশপ্ত মানবীদের সহযাত্রিণী। রাত্রে বিছানার উপর বসিয়া অন্ধকারে সে চুলের অরণ্যে উকুন বাছে। একটু পরে বিছানায় কাত্ হইবার সময় তার মনে পড়ে, এতক্ষণ তার হাত মাথায় ছিল।
পৃথিবীর বুকে এত ঘটনার মিছিল। এত রকমের প্রবাহ দৈনন্দিনতায়। হাসিনার কাছে তারা খরস্রোতের মত বহিয়া যায় মাত্র। মনে কোন আঁচড় লাগে না। তার বোধ-শক্তি এখানে পরাজিত। অহেতুকতার ধাঁধার ভেতর জীবনের চাকা অর্থহীন আবর্তন ঘোরে।
বাঁধের কোলে সাদা ইমারত তার চোখের সামনে বারবার হাতছানি টানিয়া যায়। ওই রহস্যপুরীর তোরণ-দেশে কারা প্রহরী, কা’দের আভাস-ভূমি ওই দেশ। সেখানে কী মানুষ থাকে, যাদের জীবনের দুঃখের ছায়া পড়ে না। মনের গতি সেখানে হয়ত অব্যাহত। নিস্তেজ, ম্রিয়মান এক রকমের অস্পষ্ট অনুভূতির সাহায্যে হাসিনার মনের কল-কব্জা চালু হয়। তার ব্যক্তিত্ব এখানে গৌণ। সামগ্রিক একটা পরিবেশে সে শুধু যন্ত্রের ব্যষ্টি মাত্র।
গ্রামের সৌধ-বিলাসিনীদের সে দেখিয়াছে। তাদের চুল, পরিধেয়, অবয়ব জীবন-যাপনের ধারাই স্বতন্ত্র। তবু রহস্যের আবেশ সে কোনদিন খুঁজিতে চেষ্টা করে নাই। আজকের দেখা সাদা বাড়ী-টার অনুষঙ্গ এমন দুয়ে ধাঁধার কৌতূহল মনে ডাকিয়া আনে কেন?
হাসিনার কাছে এ-সব প্রশ্ন জাগে না। কোনদিন জাগিলেও সে আরো নিস্তেজ হইয়া পড়িত।
তার বাবা কালু সেদিন মাঝ-রাত্রে বিছানা পরিত্যাগ করিয়াছে। হাসিনা তার গতিবিধি দেখিয়াছে, কিন্তু সাড়া দেয় নাই।
কালু চলিয়া যাওয়ার পর তার-ও মনে দুর্বার দুঃসাহস জাগে। এই বাড়ী, ঘর-দোর ফেলিয়া চলিয়া যাওয়ার দুঃসাহস।
তক্তপোষে মাজু উস করিতেছিল, বোধ হয়, মশা কামড়াইতেছে। হাসিনা তাড়াতাড়ি উঠিয়া পড়িল। ছেঁড়া গাম্ছা দিয়া সে ঝট্কা দিল কয়েকবার। বর্ষার জমা পানিতে এবার মশা খুব বাড়িয়াছে। হাসিনা মাজুর কাছে শুইয়া পড়িল। একটা ছোট জানালা সম্মুখে। কালু এই মাত্র গেল। কোন দিকে গেল? হাসিনা তাই দুই চোখের জাগ্রত দৃষ্টি অন্ধকারের বুকে নিক্ষেপ করে। পা-তালি বা পথিক আনাগোনার কোন শব্দ শোনা যায় না।
হাসিনার ভয় হয় আবার। বাবা যদি এখনি ফিরিয়া আসে! মাজুর মুখে একটা চুমু খাইয়া সে শাহাদের কাছে ফিরিয়া আসিল; ছোট ভাইটী নির্বিবাদে ঘুমাইতেছে।
অনুতাপীদের মনে বিগত কার্যাবলীর ছবি বারবার ভাসিয়া উঠে। তারা এত অসোয়াস্তি পায় না, হাসিনা যত সাদা বাড়ীর স্বপ্ন দেখে। চোখ বুজিয়াও নিস্তার নাই। মন তার কোথায় যে হারাইয়া যায়। ছোট ভাইটা ঘুমের ঘোরে তার কোল ঘেঁষে বিড়বিড় শব্দ করে। হাসিনা তার গায়ে থুক-কুঁড়ি দেয়। বদনজর লাগিয়াছে বোধ হয় শাহাদের।
একটু পরে হাসিনার ঘুম আসে।
কিন্তু জীবনে সোয়াস্তি নাই তার। বাবার ডাক কানে যায়। হাসি, উঠ শিল্পীর।
ধড়মড়িয়ে উঠিয়া বসে হাসি।
কি আব্বা?
—একটা হাঁড়ি বের করে, আর একটু পানী।
—কেন?
কালু ভেংচি কাটে, “আবার কথার উপর কথা।” তন্দ্রাক্লিষ্ট হাসিনা যন্ত্রের মত পিতার আদেশ পালন করে।
কালু গাম্ছার খোঁটে বাঁধা দুটো বড়ো মাগুর মাছ বাহির করিল। মেঝের উপর পড়িয়া জ্যান্ত মাছ দুটো সাঁতারের চেষ্টা পায়। এক রকম খখস শব্দ হয়।
—তাড়াতাড়ি মাছ হাঁড়িতে তোল, জিইয়ে রাখ্।
হাসিনা দ্বিরুক্তি করে না। পরে অজানিতেই সে আবার জিজ্ঞসা করে, কোথা পেলে আব্বা?
—ফের কথার উপর কথা? বিলে ধরেছি।
কালু মিয়া আরো কুঁচো চুনো মৌরলা মাছ এক গাদা মেঝের উপর ঢালিয়া দিল।
হাসিনার সন্দেহ অমূলক নয়। সে জানে, বাবা কোন চাষীর মাছ ধরা মুগ্রী পাং ঝাড়িয়া আনিয়াছে।
—সকাল না হোতে হোতে বেছে ফ্যাল মাছগুলো।
তখনও সামান্য অন্ধকার আছে। হাসিনা ডিপা জ্বালাইয়া মাছ কুটিতে বসিল। অন্ধকারেই ঘাট হইতে বাছা-মাছ ধুইয়া আনিল। হাঙামা ত কম নয়। ঝাল না হয় পরে দেওয়া চলে, আবার নুন মাখানো বাকী। বাড়ীতে নুন আছে কি না, কে জানে। নচেৎ পচা গন্ধে ঘর মাৎ হইয়া উঠিবে।
যা হোক ঘরে নুন ছিল। একটা অসোয়াস্তি হইতে হাসিনা পরিত্রাণ পাইল।
মোরগের ডাক শুরু হইয়াছে। ভোর হইতে আর বিলম্ব নাই। এখন শোয়া বৃথা। তবু হাসিনা শুইয়া পড়িল। কালু নাক ডাকাইয়া ঘুমাইতেছে।
বাবার তক্তপোষের দিকে ভয়ে ভয়ে দৃষ্টি ফিরাইয়া হাসিনা চক্ষু বন্ধ করিল।
দুপুরের পর হাসিনার সামান্য অবসর থাকে। বাবার মুনিশ খাটিয়া ফিরিতে অবেলা হয়। ছোট ভাই-বোন দুটী খাওয়া-দাওয়ার পর খেলা করিতে যায়। কখনো তক্তপোষে তার কাছে শুইয়া নানা রকম প্রশ্ন করে।
হাসিনার কিন্তু অসোয়াস্তি যায় না। চারিদিকে নির্ম্মমতার বেড়ি। কড়া-পড়া হাতের মত তার হাড়ে কোন জোর নাই। সব চুরমার করিয়া ফেলিবার কোন অদম্য ইচ্ছা ও তার জাগে না। যৌবন-দেবতা তা-কে পথের প্রান্তে বাসি মালার মত ফেলিয়া গিয়াছে। মনও তার কুমীরের উদগীর্ণ শীকার
একটা সাদা বাড়ীর ছবি সে শুধু আঁকে। মজ্জমান ব্যক্তি তৃণ-খণ্ডে আলো-বাতাসে বাইরের পৃথিবী খোঁজে। দুরাশার হাত-ছানি বাঁচিয়া থাকার প্রেরণার কাছেই হার মানে। হাসিনা একটী সাদা বাড়ী দেখিয়া আসিয়াছে। মনের সুড়ঙ্গে সুড়ঙ্গে ভিত গাঁথা হয় তার। অসোয়াস্তি আর আকুলতার বন্যা চোখের পলক শুষ্ক রাখিয়া যায় না।
হাসিনাদের বাড়ীর পর কয়েকটা ঘেঁষা-ঘেঁষি পাড়া। উত্তর দিকের মাঠ, এখানে কোন আভাস ছড়ায় না। দক্ষিণে বাঁধের সর্পিল আকার দেখা যায়। এই বাঁধ-ই উত্তর মাঠ বেষ্টন করিয়া ভিন গাঁয়ের দিকে চলিয়া গিয়াছে। দাওয়ায় বসিয়া বসিয়া হাসিনা বাঁধের অংশ, কোণটুকু দেখে। পাড়ার অন্যান্য মেয়েরা আসে। চাষীদের বৌ-ঝিরা অনটনের মুখেও হাসিতে জানে। হাসিনা শুধু মূক।
আনমনা সে বসিয়া থাকে। ছোট বোন কোলে উপবেশন করিয়া বলে, “বুবু, তুমি কি দেখছ?”
—কিছু না। তোর ক্ষিধে লেগেছে? কথা সমাপ্ত করিয়াই হাসিনা আবার ভয় পায়। ঘরে বাড়তি খাওয়ার কিছু নাই। বর্ষার জন্য মুড়ির চাল তৈরী করা কষ্টকর। ভাই-বোন দুটী সহজে শান্ত হয় না। তবে তারা বড় লক্ষ্মী। বুবুর কথা শোনে। অবশ্য সব-সময় নয়। শাহাদের জিদ্ আর ঝোঁক একটু বেশী।
অবলার দিকে কালু ফিরিয়া আসে। হাসিনার কাজ তখন খুব বাড়ে। পান হইতে চুন খসিলে সে গালি-গালাজ খায়। এইজন্য হাসিনার যত্নের ত্রুটী নাই। কিন্তু আশঙ্কার মধ্যেই সে কাজে অনেক ভুল করিয়া ফেলে।
কয়েকদিন পর হাসিনার মন আরো খারাপ হইয়া যায়। বাবা আজকাল রাত্রে বাহির হয় না, দিনেও সময়ে থাকে না। অভাব-অনটন রুক্ষ মূর্ত্তি প্রকাশ করে।
হাসিনা ভাবে, বাঁধের কোলে সাদা বাড়ীর কথা। জীবনে এমন দিন কী তার আসিবে—এমন কপাল হইবে তার; ওই সৌধের কক্ষে যদি সে জীবন-যাপন করিতে পাইত। আনন্দিত হয় হাসিনা, যেন তার নূতন জীবন আরম্ভ হইয়াছে। বাস্তবের কঠিন আঘাত তার চেতনা-কে অন্য স্রোতমুখী করে।
হাসিনা মরিয়মের বাড়ী যায়।
—কি গো ভাবী, কি করছো?
মরিয়ম খেজুর পাতার একটা চেটাই বুনিতেছিল।
—বসো। দেখছো হাতে কাজ।
হাসিনা বসে না। বলে, আজ উত্তর মাঠে যাবে, আমাদের ঘরে সব বাড়ন্ত।
—না, আজ সময় নেই। ঐ মাঠে কী তোর ‘জান্’ পড়ে আছে না কি?
হাসিনা ম্লান-মুখে বলে, না গো, ভাবি, একবার চলো না। একা অত বড় মাঠে যেতে ভয় লাগে।
—আজ যেতে পারব না।
হাসিনা ম্লান মুখে ফিরিয়া আসে। সত্যই ঘরে আজ ব্যঞ্জন বাড়ন্ত। বাবা রাত্রে কোথাও যায় নাই।
মাজু আর শাহাদ উঠানে খেলা করিতেছিল। হাসিনা তাদের ডাকে। দুজনেই ছুটিয়া যায়।
—কি বড়, বুবু?
—আমার সঙ্গে মাঠে শাক তুলতে যাবি?
দু-জনেই খুব খুশী। কিন্তু মাঠের দূরত্ব তারা জানে না। হাসিনা এই কচি দুটো ছেলের সঙ্গে মাঠে যাওয়ার দুঃসাহস রাখে।
—তবে, তিন্ জনে যাই চল্। এসে রান্না হবে। তিন ভাইবোন উঠান হইতে নীচে নামিল। তাদের বাড়ীর পর মাইতিদের পাড়া। এই পল্লী ছাড়াইয়া তারা আরো কিয়দ্দূর আসিয়াছে, ছাগল আর বাছুর গোরুর হাম্বা-রব আসে চারিদিক হইতে। হাসিনা আকাশের দিকে তাকায়। মাঠের উত্তর কোণে বৃষ্টি নামিয়াছে। বাতাসে বৃষ্টি ছুটিয়া আসিতেছে। এক নিমেষে আকাশ অন্ধকার হইয়া গেল।
হাসিনা শাহাদকে কোলে করিয়া বলে, “মাজু, জলদি বাড়ী চল—দৌড়, না হোলে ভিজে যাব।”
বাড়ী পৌঁছিবার আগেই জোরে বৃষ্টি নামিল। তিন ভাই-বোন ভিজিয়া গেল। হাসিনা ভাইবোনের গা মুছিয়া দিল। তাদের বয়স কম, তারা উলঙ্গ থাকিতে পারে। হাসিনার অন্য একটি ছেঁড়া শাড়ী সকালে থালা বাসন মাজার সময় ভিজিয়া যায়। সে ভিজা কাপড়ে রহিল। মাজু বলে, “বুবু, তুমি ভিজা কাপড়ে থাকলে তোমার যে অসুখ করবে। জ্বর হবে।”
—না, আমার অসুখ করে না। শাহাদ বলে, ও কথা মুখে আনতে নেই, মাজু।
এখনই হাতে কোন কাজ নাই। ভিজা কাপড় নিংড়াইয়া হাসিনা একটা পিঁড়ির উপর বসিল। দুটী কচি ভাইবোন তার দু-পাশে দাঁড়াইয়া।
ঝমঝম বৃষ্টি নামিয়াছে। দাওয়ার ওপারে সড়কের পর মাঠ আরম্ভ হইয়াছে। ঝর্ঝর নিনাদে ব্যাঙের ডাক দূরাগত মনে হয়। পালা কুয়াশার পর্দ্দা শুধু তাদের চোখের সম্মুখে। উঠানে একটা জীর্ণ পেঁপে গাছ দোলা খাইতেছে। ওপারে আর কিছু দেখা যায় না।
শাহাদ দাপাদাপি করে দাওয়ার উপর। মাজুও তার সঙ্গে চীৎকার করে—
এই বৃষ্টি ছেড়ে যা,
লেবু পাতায় করমচা।
হাসিনা ফ্যাকাশে মুখে বাহিরে দৃষ্টি মেলে শুধু। শূন্যতার ওপারে বাঁধের কোলে বিধাতার-গড়া নিকেতন তার জন্য অপেক্ষা করিতেছে। রাজ-হংসের মত অগ্নির অভিষেকে মৃত্যু-সঙ্গীত শোনায় অবেলার বর্ষণমুখর প্রহর। দহন-ক্লান্ত বনের উপর তুষার-ধবল মেরু-প্রান্তর রচিত হইতেছে। বৃষ্টির ছায়ায় কেবল কিছু-ই দেখা চলে না।
.
৩.
কয়েকদিন পর গভীর রাত্রি। কালু ঘরে ঢুকিয়া বলিল, মা হাসিনা ঘুমোচ্ছ?
হাসিনা জাগিয়াছিল। বাবার ডাকে সে সাড়া দিল না। সত্যই কী তার বাবা ডাকিতেছে? এমন আদর-বিগলিত কণ্ঠ! মা হাসিনা!
কালুমিয়া আবার ডাকিল, মা হাসিনা। হাসিনা সাড়া দিল, কি আব্বা?
—একবার উঠে পড়, মা। কাজ আছে। হাসিনা তাড়াতাড়ি বাবার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল।-আমার সঙ্গে একটু বাইরে যাবি, মা?
হাসিনা ইতস্ততঃ করিতেছিল।
—কোথা এত রাত্রে, বাবা?
—ভয় পানে, মা। আমার সঙ্গে আয়।
হাসিনার ভয় হয় বৈকি। বাবার স্বভাব সে জানে। চোরের সঙ্গে রাত-বিরেত ভয়-লাগা স্বাভাবিক, চোর জন্মাদাতা হইলেও।
হাসিনার বিশ্বাস হয় না, তার বাবার কণ্ঠ এত মোলায়েম।
সে পিতার অনুসরণ করিতে লাগিল। পৈঠা বাহিয়া তারা দুই জনে ভিটার উপর হইতে নামিয়া গেল।
বর্ষাকাল। পায়ে সব সময় কাদা লাগে। হাসিনার গা ছমছম করে। দু-দিন আগে মরিয়মের সঙ্গেই সে উত্তর মাঠে গিয়াছিল। বুক ভরিয়া সে একটী মাত্র কামনা পোষণ করিয়াছে, একদিন ঐ শ্বেত—সৌধের নিকট যদি সে যাইতে পারিত!
অন্ধকার চারিদিকে। মাঠের স্বপ্নে তার গা আরো রোমাঞ্চিত হয়।
চারিদিকে রোয়া ধান। বৃষ্টির পানি জমিয়া রহিয়াছে। পা দেওয়া মাত্র চবাং শব্দ হইল? কালু ফিফিস করিয়া বলে, হাসিনা মা, আস্তে পা ফেলো, কেউ না শোনে।
হাসিনা আরো ত্রস্ত। সে কী বাবার চৌর্য্য-সহকারিণী আজ! এমন চুন্নির কাজ শেষ পর্য্যন্ত সে গ্রহণ করিল।
ধান-জমির পথ কয়েক মিনিটে শেষ হইয়া গেল। তবে এবার পথ ভয়ানক পিচ্ছিল।
আকাশে তারকারা মিটমিট করে। কালু হাসিনাকে বলে, মা’ আমাকে তোদের ভারী ভয় আর ঘেন্না, না?
—না, আব্বা।
—বুঝেছি। আমি চুরি করি। আব্বা বলতে লজ্জা হয়।
কালু মিয়া থামে। তারপর হাসিনার সন্নিকট হইয়া বলে, অনেক খেটেছি। সারা জীবনে দুনিয়ার কোন বদ্কাজে ছিলাম না। কিন্তু খেতে-পরতে পেলাম কই? তোদের নিয়ে সারা জীবন-ই এই টানাটানি। তার চেয়ে—
কালু মিয়া হঠাৎ চুপ করে। কথা তার মিথ্যা নয়। সাধুতা যদি জীবনে অনিশ্চয়তা ডাকিয়া আনে, আর চৌর্য-বৃত্তি অনিশ্চয়তা ডাকিয়া আনিলেও তার মাত্রা কম, তা হইলে সাধু সাজিয়া লাভ কী
কালু মিয়া বলে, “মা আর বেশী দিন নয়।”
হাসিনা ভয় পায়। বাবা কী তবে জেলে যাইবে!
—ঘাত আর দাঁও পেয়েছি। আর দু-মাস পরে তওবা তওবাস্তফের করে ছাড়ব। কালু মিয়া কথা শেষ করে চাপা-গলায় বলে, খুব সাবধানে। আর বেশী দেরী নেই।
হাসিনা ভ্যাবাচ্যাকা খায়। ভয়ে তার সর্বাঙ্গ কাঁপে। শুধু পিতার আদেশের জন্য সব-কিছু সে পালন করিয়া যাইতেছে। কেউ হঠাৎ ডাক দিলে, সে বোধ হয় মূৰ্চ্ছা যাইত।
জলা-জাঙালের পথ ভাঙিয়া একটি সরু খালের মুখে তারা দুইজনে দাঁড়াইল। বাবলা গাছের ডালে বাতাসের শন শন রব শোনা যায়। খালে একটা ছিপ-ডিঙি। কালু মিয়া বলিল, আর হাঁটতে হবে না, নৌকোর কাছে চলো।
হাসিনা নৌকার নিকট আসিলে, কালুমিয়া নৌকার খোল হইতে এক কাঁদি কলা বাহির করিয়া বলিল, তুই এটা নে, মা। তাই তোকে আনা।
কালু মিয়া নিজে একটা বাক্স খালের কিনারায় নামাইল।
—হাসিনা, একটু দাঁড়া, মা।
হাসিনা ভারী কলার কাঁদি লইয়া পিতার গতিবিধি লক্ষ্য করিতেছিল।
হঠাৎ নৌকা-ডোবার ভড়ভড় শব্দ শোনা গেল। কি করছ বাবা?
—চুপ কর। নৌকাটা ডুবিয়ে দিচ্ছি এখন। কাল রাত্রে আবার ঝেড়ে তুলতে হবে।
হাসিনা ভয়ে জড়সড় হয়।
বাক্স মাথায় কালু-মিয়া বলে, এবার চট্পট নে, মা। দুই জনে আবার চলা শুরু করে।
অন্ধকার পথ চেনা যায় না। হাসিনা এই অঞ্চল চেনে। কিন্তু এই গভীর রাত্রে সে দিশাহারা। বাবার অনুসরণ ছাড়া তার উপায় নাই।
বাড়ীর নিকটে আসিয়া আবার বৃষ্টির জল-ভরা ধান জমি পার হওয়ার সময় হাসিনা ‘উঃ” শব্দ করিয়া উঠিল। ঝপাস্ শব্দ হইল পানীর উপর। কলার কাঁদি তার হাত হইতে পড়িয়া গিয়াছে।
—কি হোলো, হাসিনা?
চাপা গলায় হাসিনা ডাকে, আব্বা, আমার পায়ে খেজুর কাঁটা ফুটেছে।
আবার ‘উঃ’ শব্দ করে সে।
কালুমিয়া ডাকে, চলে আয়, ডাঙায় উঠে দেখব।
হাসিনার সমস্ত কাপড় ভিজিয়া গিয়াছিল। ডাঙায় উঠিয়া সে পায়ের তলায় হাত বুলাইতে লাগিল। দু-তিনটি শাল কাঁটা। আল নষ্ট হয় বলিয়া চাষীরা এমন কাঁটা দিয়া থাকে।
কালুমিয়া রাগান্বিত হয়। এইজন্য মেয়ে-ছেলে নিয়ে বেরুতে নেই। কৈ আমার পায়ে ত কিছু ফুল না।
মেয়ের পা’র দিকে হাত বাড়ানো মাত্র হাসিনা বলিল : আব্বা, মাফ করবেন; আমি তুলে ফেলেছি, একটা ভেঙে গেল। একটু পায়ের ভিতর থেকে গেছে।
—থাক, তাড়াতাড়ি বাড়ী চল। গিয়ে আলোয় দেখা যাবে।
ভারী কলার কাঁদি। হাসিনার কষ্ট হয়। এতদূর পথ যে সে নিজ-কে বহন করিয়া আনিয়াছে, তা—ই সৌভাগ্য।
কত রাত্রি কে জানে। পেঁচকের দল তালগাছের মাথায় বোধ হয় প্রহর ডাকিতেছে। প্রহরের কোন ঠিকানা নাই হাসিনার কাছে।
সেইদিন রাত্রে হাসিনার পা টনটন করিতেছিল। সকালে ব্যথা আরো বাড়িয়াছে। পায়ের পাতার উপরেও সামান্য ফুলিয়াছে।
কালু মিয়া বলিল, একটু সেঁক দে, মা। কাঁটা সামান্য ছিল। বাহির করিবার সময় কিছুই দেখা গেল না। কালু মিয়া তাই নিশ্চিন্ত। কিন্তু সে জানে খেজুর কাঁটা কখন এক জায়গায় থাকে না।
হাসিনা পিতার আদেশ পালন করিয়াছিল। কিন্তু কোন সুফল দেখা গেল না।
পরদিন তার পা ক্রমশঃ ফুলিতে লাগিল। যন্ত্রণা-ও সেই রূপ। পায়ের তলায় একটা ক্ষত-মুখ দেখা গেল।
কালু-মিয়া আজকাল সকলের উপর সদয়। চাল, ডাল, মাছ, তরকারী বাজার হইতে নিয়মিত আসে। কিন্তু হাসিনার জন্য সকলে বিব্রত। মাজুরও মনে সুখ নাই। শাহাদ বাহিরে গেলেও আবার বুবুর কাছে ফিরিয়া আসে।
আরো দু-দিন পর হাসিনার পা ঊরু পর্য্যন্ত ফুলিয়া উঠিল, যেন বেরিবেরি রোগী। পায়ের যন্ত্রণা সে দাঁতে দাঁত চাপিয়া সহ্য করে।
রাত্রে বেশী আহ-উহ্ শব্দ করে না। পাছে বাবার ঘুম ভাঙে।
কিন্তু পর-দিন হইতে ভয়ানক বিপাক দেখা গেল। হাসিনার মত শক্ত মেয়েও চীৎকার করিতে আরম্ভ করিল।
কবিরাজ ও পাড়ার বর্ষীয়ানদের উপদেশ মত ওষুধ লাগানোর কোন ত্রুটী ছিল না। গ্রাম্য ঔষধ অবশ্য। কালু-মিয়ার জীবনে নূতন বিপত্তির সংগ্রাম। অসুখ-বিসুখ তার বরদাস্তের বাইরে। তবু এই কচি শিশুদের জন্য তার মায়া হয়। হাসি-না-ই ত তাদের জীবন-দাত্রী। পুরুষেরা কী ছেলে মানুষ করিতে পারে।
হাসিনা অবশ্য তার দায়িত্ব এড়ায় নাই। তার যন্ত্রণা একটু শেঁক-তাপে উপশম হইলে, সে রান্না করিতে বসে। মাজু শাহাদের মুখে তা না হইলে অন্ন উঠিবে না। উত্তাপের মুখে হাসিনা ঘামিয়া উঠে খোঁড়া পা একদিকে লম্বা করিয়া কোন রকমে রান্না সারে। ছোট ভাই আর বোন সাহায্য করে। হাঁড়ি নামাইবার সময় শাহাদ আসে।
হাসিনা বলে, সোনা, দেখো যেন ভেঙে ফেলো না।
—না, বড় বুবু।
হাসিনা বিপদের মুখেও ম্লান হাসি হাসে।
কিন্তু বিপদের মেঘ আর কাটে না। তার পা আরো ফুলিয়া উঠিল। ঘাও সেই পরিমাণ বাড়িয়াছে। কালু মিয়ার আর কোথাও বাহির হইবার পথ নাই। রান্না করিবার জন্য তার সাহায্যের প্রয়োজন হয়। হাসিনা ক্রমশঃ অকেজো হইয়া পড়িতেছে।
কবিরাজ ও পাড়ার অন্যান্য লোকেরা প্রমাদ গণিল।
হাসিনা তবু কাজ করিতে পশ্চাৎপদ হয় না। বেদনা উপশম হইলেই সে রান্নার সাহায্য করে। শুইয়া শুইয়া আলু-ছেলা ইত্যাদি কাজে রত হয়।
সেদিন সন্ধ্যায় হাসিনা চুলার কাছে দুই পা মেলিয়া বসিয়া আড়-ভাবে রান্না করিতেছিল। বড় ব্যথা পায়ে। যন্ত্রণার অকস্মাৎ ঝিলিক, সে দাঁত চাপিয়া সহ্য করে।
শাহাদ-কে সে বলিল, একটু পানী আনো তো সোনা-ভাই, কলসী থেকে।
শাহাদ পানী আনিতে গিয়া কলসী ভাঙিয়া ফেলিল।
হাসিনা চীৎকার করিয়া ডাকে, এদিকে আয়, শুয়ার। এদিকে আয়।
শাহাদ বুবুর কথা অমান্য করে না। বড় বিরক্তি আজ হাসিনার মনে। সে চুলায় জ্বাল দেওয়ার একটা কঞ্চি লইয়া সপাং সপাং শব্দে শাহাদের পিঠে চাবুক মারিতে লাগিল।
ওগো মা গো গেলাম গো। শাহাদ কাঁদে। হাসিনার কঞ্চি ভাঙিয়া গেলে সে থামিল। এমন নিষ্ঠুরতা, নির্মমতা কোথা হইতে আসিল হাসিনার বুকে।
শাহাদ রাগে উঠানের অন্ধকারে নামিয়া পড়িল।
—তোমার কাছে আর থাকব না, বুবু। মা মাগো। হাসিনার কানে ‘মা’ শব্দ তীরের মত বিদ্ধ হয়। সমস্ত শরীর তার থরথর করিয়া কাঁপে।
বুবুর মূর্ত্তি দেখিয়া মাজু জড়সড় হইয়া দাঁড়াইয়াছিল।
হাসিনা তাকে বলে, “যা ডেকে আন ওকে। আঁধারে কোথায় গেল। উঠলে আমি রক্ষে রাখব না।”
শাহাদ একটু ভীতু। সে উঠানেই অন্ধকারে বসিয়া ফুঁপাইতেছিল। মাজু আসিয়া টানা মাত্র সে সুড়সুড় তার অনুসরণ করিল।
ঘরে ঢুকিয়া সে বুবুর দিকে তাকায় না।
হাসিনা ডাকে, আয় শাদু। তারপর সে নিজেই হাউমাউ করিয়া কাঁদিতে আরম্ভ করে। মা-গো-মা-আমাকে কোন সাগরে ফেলে গেলে।
শাহাদ বুবুর কাছে গিয়া বসে। হাসিনা দুই হাতে তা-কে জড়াইয়া কাঁদিতে থাকে। অশ্রুতে-চুম্বনে সে ছোট ভাইটার মুখ ছাইয়া ফেলে।
—আমার উপর রাগ করবি না, বল? হাসিনা জিজ্ঞাসা করে।
পিঠের উপর কয়েক জয়গা ফুলিয়া গিয়াছিল, হাসিনা হাত বুলায়। তার পর অশ্রু রুদ্ধ কণ্ঠে বলে, মাজু তেলের শিশিটা আত।
মাজু তেল আনিয়া দিল। হাসিনা তেল মাখাইতে থাকে। অশ্রু আর রোধ মানে না। শাহাদ হঠাৎ ফুঁপায়, কথা বলে না।
হাসিনা অজস্র চুমু খায় তাকে। নিজের পায়ের যন্ত্রণা সে যেন বিস্মৃত হইয়াছে। মাজুও হঠাৎ ফুঁপাইয়া কাঁদিতে থাকে। হাসিনা তা-কে দুই হাতে টানিয়া নিজের কাছে বসায়, তারপর বলে, মাজু আমি মরে গেলে কখনও কাঁদিনি। তোদের এত মারধোর করি!
থমথম করে রাত্রির স্তব্ধতা। বিশ্বে সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন ঘটে, ইতিহাসের পাতা তার আঁচড় ধরিয়া রাখে। মানুষের দুঃখ-বেদনার ইতিহাস বায়ু-তরঙ্গে ভাসিয়া বেড়ায়। হৃদয়ের ঐতিহাসিক হয়ত আজও পৃথিবীতে আবির্ভূত হন নাই।
পাড়া-গাঁর একটী খড়ো-ঘরে নাটক অভিনীত হইতে থাকে। এত দ্রুত তার দৃশ্যের পরিবর্তন, চোখ সে-ঝলক সহ্য করিতে পারে না।
একটু পরে আসিল শাহাদের বাবা। হাসিনা যন্ত্রণায় ছটফট করিতেছিল। মাজু বাবার কাছে ছুটিয়া গেল।
—আব্বা, দাদা-কে খুব মেরেছে, বুবু।
—কেন?
—কলসী ভেঙেছে যে।
কালুমিয়া হাসিনার কাছে তীরবেগে গিয়া দাঁড়ায়! “হারামজাদী মরতে বসে এতদূর। তোর জন্য আমার সব নষ্ট হোলো ক’দিনে। আরও কতদিন তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে—কে জানে। তোর এত বাড়াবাড়ি!”
একি বাবার কণ্ঠস্বর! সেদিনের রাত্রির কথা মনে পড়ে। কি সুযোগ বাবা হারাইয়াছেন? হাসিনা কোন জবাব দেয় না। উবুড় হইয়া মাটীর উপর অব্যক্ত বেদনায় সে মুখ ঘসিতেছিল। চোখে অশ্রু কোন বাধা মানে না।
—এত বাড়াবাড়ি, হারামজাদী। বাবার কণ্ঠ হৃদয় দীর্ণ করিয়া চারিদিকে প্রতিধ্বনিত হয়। মূৰ্চ্ছিত উন্মাদের মত হাসিনা কাঁদে। কান্নার জমাট বাষ্পের দল আজি নিঃশেষে মুক্তি চায়।
সেই রাত্রি কালু মিয়া, শাহাদ-মাজু আহার করিল এক সঙ্গে। হাসিনার সঙ্গে কেহ কথা বলিল না, তার কোন প্রয়োজন আছে কেহ জিজ্ঞাসা করিল না।
বাবার কাছে প্রহৃত শাহাদ সহজেই ঘুমিয়া পড়িল।
.
৪.
পরদিন হাসিনার অবস্থা দেখিয়া কালু মিয়া শঙ্কিত হইল। পাড়ার কয়েকজন লোক-সহ একজন ডাক্তার আসিয়াছিল। সকলেই বলিল, এ-কে এখনই ডিষ্ট্রিক্ট বোর্ডের হাসপাতালে পাঠানো উচিত। অপারেশন ছাড়া কোন উপায় নেই।
হাসিনার চীৎকার করিবার ক্ষমতা লোপ পাইয়াছে। মাঝে মাঝে কাত্রায় মাত্র। তা-ও নিস্তেজ কারানি।
দু-মাইল পথ, পাল্কী ছাড়া হাসিনাকে বহন করিয়া লইয়া যাওয়া অসম্ভব।
কালু মিয়ার আজ হাতে কানা-কড়ি পৰ্য্যন্ত নাই।
কালু পাড়ার কয়েকজন লোকের শরণাপন্ন হইল। সকলের এক মত : সময় বেশী নেই। পাল্কী ডাকতে সময় লাগবে। বেহারা পাওয়া যাবে কিনা, কে জানে। তার চেয়ে বাঁশের একটা খাট করে তক্তা বিছিয়ে আমরা পৌঁছে দিয়ে আসি।
মফিজ, রেয়াজ এবং আরো কয়েকজন কালু মিয়ার জ্ঞাতি এই বিপদে সাহায্য করিতে রাজী হইল।
তখনই বাঁশের খাট তৈরী সম্পন্ন হইল। সাত আট জন জোয়ান কিষাণ পল্লীর ছোকরা এই সঙ্গে আসিয়া জুটিল।
হাসিনা প্রায় অচেতন। শুধু দৃষ্টি তার সজাগ। মাজু-শাহাদ কিছু বুঝিতে পারে না, কোথায় কী যেন ঘটিতেছে।
খাট কাঁধে সবাই যখন ভিটা হইতে নামিতে লাগিল, তারা দুইজনে ধুলার উপর গড়াগড়ি দিতে আরম্ভ করিল—“বুবু-কে রেখে যাও বুবু—বুবু—”
শিশু-বুকে আল্লা এত অগাধ আকুলতা দিয়াছিলেন। হাসিনার কানে এই ডাক পৌঁছিয়াছিল কি না, কে জানে।
.
অপারেশানের তিনদিন পর হাসিনার চেতনা-সঞ্চার হইল। কোথায় আসিয়াছে সে। তার পাশে আরো দু-তিন জন রোগী।
দো-তালা একটা ঘরে হাসিনা শুইয়া আছে।
দূরে মাঠ দেখা যায়। শুধু মাঠ নয়। তাদের গ্রাম। একটা বড় অশত্থ গাছ গাঁয়ে প্রসিদ্ধ। তারই প্রতিচ্ছবি তো দূরে আজ?
হাসিনার পা’র ফুলা কমিয়াছে, কিন্তু যন্ত্রণার উপশম হইয়াছে সামান্য।
কোথায় এসেছি, মা? পাশের খাটে শোয়া একটা মেয়েকে সে জিজ্ঞাসা করে।
—এই তো বালিপুরের হাসপাতাল। মেয়েটা জবাব দেওয়ার পর সান্ত্বনার সুরে বলে, কেমন আছো
হাসিনা জবাব দেয় : ভাল। ঐ গাঁয়ের নাম কী?
—হরিরামপুর। মেয়েটি জবাব দিল। তাদেরই গ্রাম। তবে সে সাদা বাড়ীতে আসিয়াছ! তার আরাধ্য আবাসে! কিন্তু এটা হাসপাতাল। চারিদিকে সদা-চুণ-কাম-করা দেওয়াল আনন্দের আভাস বহিয়া আনে।
দুঃখের পাথারে আনন্দের বার্তা মনের চতুর্দ্দিকে শক্তির বিদ্যুৎ সঞ্চার করে। হাসিনার মনে হয়, তার ব্যথা যেন ক্রমশঃ কমিয়া আসিতেছে।
সাদা বাড়ীর অধিবাসিনী সে। মানুষ এই রাজ্যে বাস করে! তার মত রক্ত-মাংসের মানুষ। একটু পরে ডাক্তার আসিল। বয়সে বৃদ্ধ।
—কেমন আছো, মা?
—ভাল আছি, ডাক্তার-বাবু।
—তাড়াতাড়ি সেরে ওঠো। আগে হাসপাতালে আসতে হয়। তোমাদের গাঁ থেকে ত এই সাদা বাড়ী দেখা যায়। প্রথম দিন যখন পায়ে কাঁটা ফুটে, তখন যদি আসতে।
পাঁচটা মাত্র বেড দো-তলায়। নিচে দশটী। মোট পনরটী বেডের হাসপাতাল।
ডাক্তারবাবু অন্য রোগী দেখিতে অগ্রসর হইলেন। হাসিনা ভাবে, এমন ঘরে মানুষ বাস করে। তার মত মানুষ। দুই চোখ তার পানীতে চক্চক করে।
দুপুর বেলা কালু মিয়া হাসিনাকে দেখিতে আসিল। সঙ্গে মাজু। মাজু হাসিনার জন্য বাড়ীতে ভারী কান্নাকাটি করে। তাই সে সঙ্গে আসিয়াছে। যন্ত্রণা এখন অনেকটা কমিয়াছে বলিয়া মাজুর সঙ্গে হাসিনা নানা আলাপ করে। তার কালো চুলে হাত বুলায়।
বিদায়ের সময় সে আবার কান্নাকাটি আরম্ভ করিল। মাতৃহীন ছোট বোনটিকে দেখিয়া হাসিনা আনন্দিত হইয়াছিল। ছোট ভাইটির কচি মুখ স্মরণে আঁচলে মুখ ঢাকিয়া সে নিঃশব্দে কাঁদিতে লাগিল। সেদিনের রাত্রির নির্মম ঘটনা তার বুকে দুর্দম প্লাবন সূচনা করে।
অনেক দূর অব্দি মাঠ দেখা যায়। রাত্রি আর দিনের মিছিল ভারী ভাল লাগে এই জায়গায়।
মাজুর কথা ভাবিয়া হাসিনার মন আবার খারাপ হইয়া যায়।
.
কয়েকদিন পর কালু মিয়াকে আবার হাসপাতাল প্রাঙ্গণে আসিয়া দাঁড়াইতে হইল। সঙ্গে তার মফিজ, রেয়াজ আরো কয়েকজন জওয়ান। হাসিনাকে পাটায় তুলিয়া গাঁয়ে লইয়া যাইতে হইবে। দু’দিন আগে তার খুব জ্বর দেখা দেয়। এখন গাঁয়ে বসন্ত দেখা দিয়াছে। হাসপাতালের পিওন খবর দিয়াছিল, বসন্ত রোগী হাসপাতালে রাখা চলে না।
হাসিনা পাটাতনে শুইয়া পড়িল। জ্বর এখনও সামান্য আছে। গায়ে বসন্তের গুটি উঠিয়াছে। কিন্তু বেশীর ভাগ গুটি ঠিক মত উঠিতেছে না। ডাক্তার তাই খুব সাবধান হইতে বলিয়াছেন।
বাঁধের উপর উঠিয়া কালু মিয়া আকাশের দিকে দুই হাত তুলিয়া বিড়বিড় করিয়া কি যেন বলিল। সে ফরিয়াদ করিতেছে। সঙ্গীরা কেহ তা-কে খাট বহিতে দেয় নাই।
পাটাতনের উপর হাসিনা গঁ গঁ শব্দ করিতেছিল। চেতনা তার সম্পূর্ণ নাই।
পাটাতনে শুইয়া অবোধ দৃষ্টি দিয়া হাসিনা সম্মুখে দেখিতে লাগিল। সাদা বাড়ীটা ঝলমল করে দূরে। সে গ্রামে ফিরিতেছে, এ-চেতনা সে বিস্মৃত হয় নাই।
বিরাট মাঠের মধ্য দিয়া কয়েকটি লোক খাট বহিয়া ধীর-পদে চলিতেছে। কাতর বেদনায় হাসিনা প্রাণ-দীর্ণ শব্দ করে। মাথার উপরে তার অবেলার আকাশ শুধু।
বাহকেরা কেহ কোন কথা বলে না। মানুষের উপর বিপদ এমন করিয়া আসে না। এই বিস্ময়ে
তারা হয়ত চুপ করিয়া থাকে।
আধ মাইল চলার পর, রেয়াজ বলে, একবার নামাও খাটটা। মেয়েটা গোঙাচ্ছে।
মফিজ দ্বিরুক্তি করিল না।-আল্লার ইন্সাফ দেখ। মা-মরা অনাথ মেয়ে, তার উপর—
রেয়াজ কালু মিয়ার দূরাত্মীয়। ভাই সম্পর্কীয়। চাষীদের মধ্যে তার সুনাম আছে, বিপদে সে কাউকে হতাশ করে না। কিন্তু সেও দীনাতিদীন।
রেয়াজ খাট নামাইয়া হাসিনার কাছে গিয়া ডাকিল, ওমা, দ্যাখ দেকিন, কোথা এসেছি।
রেয়াজ হাসিনার গায়ে হাত দিল। ঠাণ্ডা নিঃসাড়।
চোখের পাতার দিকে সে চাহিয়া দেখিল, দৃষ্টি ঘোলাটে।
আরো নিরীক্ষণ করিল সে। আঁখি-তারা নিস্পন্দ।
উন্মুক্ত-দৃষ্টি, প্রসারিত-পদ্ম হাসিনা চাহিয়া আছে নীল আকাশের দিকে। আল্লার নীল-নীল দিগন্ত-বিস্তৃত আকাশ।
চক্ষু মুছিতে মুছিতে রেয়াজ রুদ্ধকণ্ঠে বলিল : কালু ভাই, ওর চোখের পাতাটা বন্ধ করে দাও।