দুই চোখ কানা
চার বছর আগে যদি হেঁটে থাকেন এই গলি-পথে, আজ আর চিনতে পারবেন না কিছু-ই।
সব বদলে গেছে।
ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাষ্ট আর যুদ্ধ, নূতন চুণকাম ছড়িয়ে দিয়ে গেল। টাকার রং চুনের মতই সাদা, এ—ত আপনিও জানেন। গলি অন্তর্হিত। এখন চওড়া রাস্তা। দু-পাশে রং-বেরঙের বাসিন্দা, দোকান্দার, ষ্টোর, নূতন বাড়ী ও নাগরিক জীবনের বিবিধ উপাদান।
তিন নম্বর বাড়ীর উঠানে কলা গাছ দেখলে সন্দেহ হয়, কারো আঙ্গুল নয় ত?
আট নম্বর বাড়ীর পাশ দিয়ে বহুবার হেঁটেছেন। তখন নিশ্চয় আপনার চোখে পড়েছে, ছোট্ট একটা রুটীর কারখানা, খোলার ছাউনী চাল, মুখ থুবড়ে পড়ে-পড়ে। উপরে তুন্দুরের চিমনী। নীচে বাঁশ-বেড়ার দেওয়াল, গায়ে গায়ে কাদা ধরানো। সেগুন কাঠের লম্বা মেইজ দুটো মেঝের উপর। চার-পাঁচ জন কুঁচো ছেলে এইখানে ময়দা দন্ত, পাতা গুছাত, ঝগড়া করত, কখন কখন শীতের রাত্রে না-খেয়ে অথবা মিস্ত্রীর বকুনি খেয়ে কাঁদত—এ-সব আপনি দেখেছেন। আরো দেখেছেন, গলির মুখে দোকানের মুখ। কয়েকটা ক্যানেস্তারা টিনে বিস্কুট ভরা। পাশে দুটো প্যাটরার মত কাচ লাগানো সিন্দুক-ই বলা যাক, যার ভেতর রুটী থাকত। মাঝে মাঝে কাঁচও দেখতেন না। মাছি আর রুটী এক সঙ্গে বিক্রি হোতা। দোকানের নীচে ড্রেন, উপরে কাঠের তক্তা পাতা। তা-ও খুব চওড়া নয়। সাবধানে পার হোতেন, না?
আপাততঃ চুপ করা যাক। পুরাতন বমির বেগ আজ না-ও সামলাতে পারেন।
এখন দেখছেন গলির মুখে সুন্দর ফ্যাক্টরী। গেটে শাল কাঠের ব্লক অক্ষরে লেখা “সৰ্ব্বনেতা বেকারী।” নামে চমকে উঠবেন না। এদের রুটীর বিভিন্ন নাম, হরেক নেতার নামে। যদিও কয়েক বছর আগে আপনি এখানে বিভিন্ন রকম মশার কামড় খেয়েছেন। বিভিন্ন-বিশেষণ তখন শুধু মশকের আগেই যোজনা করা হোতো।
এখন চোখ কচ্লাতে হবে বার বার। গলির মুখে একি পরিবর্তন! পাকের পরিবর্তে রেইনফোসর্ড কংক্রীট!
তা হোলে পুরাতন কাহিনী আবার নূতন-করে বলা দরকার।
.
মুনশী আসছে।
কারখানার সকলে এতক্ষণ গল্প করছিল কাজের ফাঁকে-ফাঁকে। ফিসফিস্ শব্দ মুখে মুখে; মুনশী আছে! আদিম ভয়ের ঝড় বয়ে গেল এক নিমেষে। ময়দা দলতে শুরু করে হাফিজ। জোর চালু তার হাত। রজব পাতা-গোছানোর সময় ঘাড় পর্যন্ত নাড়ে না।
মুনশী।
সকলে ত্রস্ত।
সে-ই পুরাতন খোলার ঘর স্মরণীয়। পেছনে আস্তাকুঁড়। তারপর ছোট্ট মাঠ পড়ে আছে, তুন্দুরের জ্বালানী কাঠ স্তূপীকৃত থাকে। ইট-ও জড়ো করা কয়েক হাজার। পাঁচিল একটু দূরে। তার ভেতর এক জায়গায় মালিক কিছু আম-লিচু গাছ লাগিয়েছিল। সে-পাশে ঘন ছায়া। গরমের দিনে কারখানার ছেলে ও মিস্ত্রীরা পাঁচিল টপকে গিয়ে সেখানে ঘুমোয়। মাদুর পেতে চাঁদনী রাত্রে গল্প করে।
মুনশী নামধারী মহাপুরুষ যাঁর নাম সকলের ঠোঁটে এখন উচ্চারিত, এই কারবারে আছেন একদম সূত্রপাত থেকে। মালিক নন, মালিকের গোমস্তা। খাতা-পত্র লেখেন, মাল গস্ত করেন, বাজার-হাট যান। কিন্তু মালিকের চেয়ে তাঁর প্রতিপত্তি বেশী। হাজিরা খাতায় তাঁর কলমের রায় রদ হয় না। মাসের শেষে এই নিয়ে সবাই ক্ষুব্ধ অসন্তোষ ঝাড়ে। ঠিক মাস-কাবারী মাইনের রেওয়াজ থাকলেও মাঝে মাঝে অনেকে খরচা স্বরূপ কিছু নিয়ে থাকে। এইজন্য মিস্ত্রী ও ছেলেরা হিসাবের হের-ফেরে পড়ে। মুনশী সাহেবের মুখের উপর কারো কথা চলে না।
এই সাহেবের বয়স বর্তমানে পঞ্চান্নর কোঠায়। আসল বয়স যদিও চল্লিশ। কোমর বেঁকে গেছে। চশমা নিতে হোল বছর দুই আগে। একদিকে ডাঁট ভাঙা, সূতো বেঁধে কাজ চালান। পরনে লুঙ্গি, পাঞ্জাবী। কিস্তী-টুপি মাথা-ছাড়া হয় না। দাড়ির ও অধীশ্বর। সরু থুনীর উপর পাতলা জমীন। চোখ চশমার তলায় ঢুকে থাকে। আগে শরীর ছিল দোহরা, এখন এক-হারা। চেরাটা এই থেকে স্পষ্ট আন্দাজ করে নিতে পারেন।
এ-হেন ব্যক্তির ভয়ে সকলে চুপ থাকে। কোন টু শব্দের উপায় নেই। মালিক চৌধুরী সাহেব সব মুনশীর উপর ছেড়ে দিয়েছেন। মাঝে মাঝে তিনি আসেন, টাকা নিয়ে যান, হিসাব দেখেন। চৌধুরী সাহেবের আরো কারবার আছে। মুনশীকে তিনি বেশ খাতির করেন। কারবার জেঁকে উঠেছে তাঁরই পরামর্শে। জায়গাটা ‘লিজ’ নিয়ে চৌধুরী সাহেব ঘর তুলছিলেন। মুনশীর যুক্তিতে কিনে নিয়ে খুব জিতেছেন। ‘বড় কাজের লোক তুমি, মুনশীজী।’ মুনশী এইজন্য কারখানার আজরাইল। অনেকের পিলে কাঁপে কারখানায় তাঁর নামে। ফরমাস খাটা ছোট ছেলেরা ভয়ে কথা বলে না। মুনশীর সঙ্গে অনর্থ বাধাতে বুকে চওড়া পাটার দরকার হয়। মুখে গালাগাল খইয়ের মত ফুটতে থাকে দিন-রাত। এখানে হজম শক্তি ভাল না থাকলে কেউ চাকরী রাখতে পারে না। সেবার এক ছোকা এসেছিল, আলিম। বাখরগঞ্জ বাড়ী। বয়স বছর পনর। চেহরা ছিল অসুরের মত। মুনশীর গাল সে সহ্য করত না। একদিন দু-জনে হাতাহাতির উপক্রম। পাড়ার গুণ্ডাদের হাতে সে মার খেল, চাকরীও গেল। মুনশী সাহেবের দাপট কম নয়। ওকে খুশী না করলে কারো মাইনে বাড়ে না। লুকিয়ে ঘুষ দিতে হয়। এ-গুলো ওর উপরী পাওনা। পা-হাত টেপা, চুল টেনে-দেওয়া—হুকুমের সঙ্গে তামিল করতে হয়। দৈনিক বাজারের ভার মুনশীর উপর। ভাল খাওয়ার গোড়া ওর হাতে। মুনশী সাহেবের উপরি রোজগারের আর এক সুরাহা। বাজারের পচা মাছ আর শাক হাঁড়িতে ওঠে। তবু টু শব্দ চলবে না।
এ-হেন মুনশী সাহেব, কারখানায় প্রবেশ-মাত্র সকলের মুখে কথা নিভে গেল।
রহিমের বাড়ী আজমগড় জেলা। পশ্চিমা, খুব মেহনতে, মজবুত স্বাস্থ্য। সে পর্য্যন্ত চুপ করে থাকে। ‘কিয়া করেগা। পেট শালা এয়সা বুরী চিজ হ্যায়।” রহিম গালাগাল পরিপাক করে, ছাতুর জোস্ থ’ পায় না।
মুনশী সাহেব ডাকলেন, রহিম।
—জী।
—এই হারামীর পুত, ওকে কাজ বলে?
—কিয়া মুনশী সাব?
গালাগাল এই কারখানায় কথার মাত্রা মনে করে সকলে।
—আরে শালা, দেখছ না ময়দার বস্তার মুখ খোলা। ধুলো পড়বে।
পান থেকে চুণ খসলে রক্ষা নেই। রহিম নীরবে বস্তার মুখ বন্ধ করে দিল। অথচ এই রাজ্যে অপরিচ্ছন্নতার আরাধনা চলে। ইচ্ছা করেলই কয়েকটা বাড়তি ঘর বেঁধে নেওয়া যেত। পাশে জায়গা রয়েছে। এত নোংরা হোত না কারখানা। মালিকের ইচ্ছা ছিল তা-ই। মুনশী সাহেব বারণ করলেন। হুজুর, আরো কিছু জমিয়ে নিন, তার পর কাজে হাত দেবেন। অপ্রশস্ত ঘর। একই জায়গায় রান্না, খাওয়া। মুশি সাহেবের জন্য অবিশ্যি সংলগ্ন একটা ছোট কামরা বরাদ্দ ছিল। ছোট, তবে মন্দ নয়। বাতাস আসে। সকালে রোদ পাওয়া যায়।
—এই জমীর। মুনশী সাহেবের দরাজ গলা হেঁকে উঠে। জমীর কাজে ব্যস্ত ছিল।
—এই ছোট লোকের বাচ্চা, মাসে মাসে মাইনে নাও তবু কাজ নাগা। এ মাসে তিনদিন মাইনে কাটব।
মুনশী সাহেব, আমার ম্যালেরিয়া সারছে না।
—ছোট লোকের বাচ্চা। দেশে গিয়ে যা-তা খাবি। ম্যালেরিয়া হবে না?
জমীর মাস দুই আগে একবার খোদ চৌধুরী সাহেবের কাছে গিয়েছিল দু-টাকা মাইনে বাড়ানোর তাগিদে। মুশীও হাজির সেখানে। এমন ভেংচালো জমীর-কে, সেই মুখ-বিকার এখনও সে ভুলতে পারেনি। “দেখুন ত, হুজুর, এই ছোট লোকের ছেলেরা বলে মাইনে বাড়াও। দু-পয়সার ডাল-ভাতে ওদের পেট ভরে, ওরা বলে মাইনে বাড়াও। পোলাও কোর্ম্মা খেতে চায়। শালা ছোট লোকদের হোলো কী? বলুন ত চৌধুরী সাহেব, মান-ইজ্জৎ রাখা দায়!”
কৰ্ত্তা নীরব ছিলেন দুই ব্যাপারে। মাইনা ও মুশীর মন্তব্যে।
জমীর আজ কুঁচকে গেল ছেঁড়া স্প্রিঙের মত। মুর্শী সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে সে ছোখ নীচু করল।
তার মুখের তোড় কমে না : ম্যালেরিয়া, হারামীর পুত, মশারীর ভেতর শুতে পার না?
রহিম জবাব দিল, মশারী কা ভাউ জানতে হে?
তেড়ে গেলো তার দিকে মুনশী, যেন এঁড়ে গুরু গুঁতোতে যাচ্ছে।… আরে শালা কা বাচ্চা, তোম সে কোন বাত করতা হ্যায়?
রহিম মাথা নীচু করল।
কোমর-ভাঙ্গা দেহে হাঁপিয়ে উঠেছিলেন। এতক্ষণ খেয়াল ছিল না তাঁর। মুনশী আরো তেতে উঠেঃ না সব শালা ইতরের বাচ্চাদের ঝেঁটিয়ে তাড়া। চলবে না। এমন ভাবে কারখানা চলতে পারে না।
মুনশী সাহেব বেরিয়ে গেলেন। বোধ হয় হাতে ঝাঁটা ছিল না, তাই।
থমথমে স্তব্ধতা কিছুক্ষণ।
রহিম প্রথমে ফেটে পড়ল : নেহি, শালেকা নউকরী নেহি করেঙ্গে।
জমীর মুখ খোলে তারপর “খোদ কর্তা আমার মাইনে বাড়াতে রাজী ছিল। ওই মুনশী যত খারাপ করে দিল।”
রহিমের মেজাজ চড়ে গিয়েছিল, ধমক দিল সে “আরে মালিক চাহতা ত কিঁউ নেহি বাড়হায়া, ছোড় দো শালা মালিক টালিক কা বাত।”
জবু, কবুর অন্যান্য সকলে মন্তব্য ছড়ায়। ধূমায়িত মন আগুনের হল্কা নিক্ষেপ করে।
জমীর রাগে ক্ষোভে একটা পাতা ঝনঝন শব্দে মেঝের উপর আছড়ে ফেলল। সমস্ত অপরাধ নিষ্প্রাণ টীনের পাতার। মুর্শী সাহেবের দক্ষতা সবাই জানে, কেউ কথা গিয়ে লাগাতে পারে। যা কান—পাতলা মানুষ। রহিম এইজন্য ডাঁট নিয়ে বলে, ‘কুই শালা চুল্লী কাটেগা ও ঔস্কা গলা কাট দেঙ্গে।” সেইদিন রাত্রে জমীর আবার না-হক সামান্য কসুরে মার খেল, এক বদনা পানী দিতে দেরী হয়েছিল। মেজাজ বটে!
মুনশী সাহেব বলেন, চৌধুরী সাহেব ‘ছোট লোকদের পায়ের তলায় না রাখলে কাজ পাওয়া যায় না। আদরে মাথায় উঠে, বকের মত চোখ উপড়ে খাবে।’
ভয়ানক লাথি খেয়েছিল জমীর, বারেক পাঁজরে লাগেনি। সরু ঠ্যাঙ্গে এত জোর!
অন্যদিন জমীর কেঁদে ফেলত সকলের সম্মুখে। আজ সে এক ফোঁটা চোখের পানী ফেলল না। ভাতও স্পর্শ করল না।
বাইরে শীতের রাত্রি। কুয়াশার পুরু প্রলেপ গাছ-পালায়। জমীর জ্বালানী কাঠের স্তূপীকৃত গুঁড়ির উপর চুপচাপ এসে বসল। খালি গা। সেদিকে খেয়াল নেই। ঠাণ্ডা বাতাসে বরফ গলে রয়েছে।
অনেকক্ষণ চুপচাপ বসেছিল, হঠাৎ ডুকরে উঠল সে লিচু গাছের তলায় ফিকে অন্ধকারে। জমীর ফুলতে লাগল। জোর কান্নার বেগ সে অতি কষ্টে আয়ত্তে এনেছে।
এই জগতের জীবনে এ-সব সাধারণ ঘটনা। সহানুভূতির উৎস সহজে শুকিয়ে যায়।
জমীর হঠাৎ চমকে উঠল। আবার এসেছে নাকি মুনশী সাহেব!
—আরে! তোম রো রহা হ্যায়?
জমীর চেয়ে দেখল।
রহিম বসল তার পাশে।
—আরে চুপ করো, মরদ কা বাচ্চা? রোনা মৎ। ঠারের যাও। সব ঠিক হো জায়েগা।
জমীরের কান্না এবার আর থামে না। জোরে ডুকরে উঠল সে।
রহিম জোর করে টেনে নিয়ে গেল তা-কে, কারখানার ভেতর। “চলো। খানা খাও মরদ কা বাচ্চা, রোতা কেউ?”
দৈনন্দিনতার জগদ্দল এখানে অনড়। অপরিষ্কার নোংরা কারখানার অন্ধকার, গালাগালি মারপিট, লাঞ্ছনা।
কিন্তু যুদ্ধের শুরুতেই কারখানা-ঘরে নূতন হাওয়ার ঝলক লাগল। খোলা পতিত জায়গার উপর এলো টীন, সুরকী, বাঁশের বদলে শালের খুটী। প্রসারণের জোয়ার লেগেছে কলেবরে। বস্তু-জগতে ওই—টুকু। প্রাণ-জগতে আরো মিস্ত্রী ও ছোকরার সংখ্যা বাড়ল।
মুনশী সাহেবের ফুরসৎ নেই। নানা কাজ। কারখানা মেরামতের ঝঞ্ঝাট। তা ছাড়া আরো দৌড়াদৌড়ি। রাত্রির অন্ধকারে ময়দা আসে লরী বোঝাই। আবার অন্ধকারেই মিলিয়ে যায়।
দু-বছরে আরো বদলে গেল রং। মালিক চৌধুরী সাহেব খোদ এই কারবারে নজর দিলেন। আরো কারবার আছে। আগে এদিকে দৃষ্টি ছিল না। এখন বিন্দু, ফোঁটার মধ্যে তিনি সমুদ্র দেখেছেন।
আরো এক বছরে ইট দরকার হোলো গাড়ি-গাড়ি। পুরাতন কারখানায় আর চলে না। মালের চাহিদা বেশী। অল্প জায়গায় কুলান হয় না। অনুপাতে মিস্ত্রী, ছোকরা-ও খাটছে দিনরাত্রি। পূর্ব্বের চেয়ে এখন সংখ্যায় অনেক বেশী। প্রায় পঞ্চাশ জন। নরক রীতিমত জম-জমাট। মালের ডেলিভারী দিতে লরী ছাড়া চলে না। তিন-খানা ট্রাক কিনে ফেললেন চৌধুরী সাহেব।
মুনশী সাহেব আজকাল তম্বী ঝাড়ার সময় পান কম। সারাদিন ছুটাছুটি, নানা কাজে প্ৰাণান্ত। অবশ্য রোজগার কিছু বেড়েছে। ছোকরা মিস্ত্রীর সংখ্যা কম নয় ত।
চৌধুরী সাহেব খতিয়ে দেখেছেন, কারখানা তৈরীর এ-ই সময়! মালের চাহিদা আরো বাড়ছে। প্রস্তাবটা তিনি উত্থাপন করলেন মুনশীর কাছে।
—কি বলুন’ আরম্ভ করা যাক্ কারখানা?
—জী। আল্লার মেহেরবানী
তারপর দু-মাস মুনশীর ছুটী ছিল না। বাড়ী তৈরীর ঝঞ্ঝাট পোহানো, অল্প কথা নয়। মজুর, রাজমিস্ত্রী কামীন, চূণ, সুর্কিওয়ালা—কত জনের সঙ্গে জাগতিক পরিচয় দরকার হয়।
কারখানা তৈরী হোয়ে গেল। মেশিন এলো সঙ্গে সঙ্গে, বেলা-মেশিন, কাটার এবং বহু শত ডাইস। পূর্ব্বে ছেলেদের হাতে ছাঁচা খটখট শব্দ তুলতো। এখন কারখানার আওয়াজও বদলে গেছে।
কিন্তু মুশী সাহেবের আওয়াজ কমেনি। আরো তিরিক্ষি মেজাজ তার। এত লোক কর্তৃত্ব ফলাতে মগজ সুস্থ থাকে না।
গেঁছে যাওয়া মদের ফেনার মত চৌধুরী সাহেবের কারবার ফেঁপে উঠল। এই জন্য পরবর্তি সনে তিনি আধুনিক কায়দায় আফিস পর্য্যন্ত তৈরী করলেন। মিলিটারীদের মাল সাপ্লাই দিতে ভড়ং দরকার। এলো টাইপ-রাইটার, খাতা-পত্র। পনর দিনে তিনটে কামরা তৈরী হোলো গেটের সম্মুখে। কাজ চাই। চৌধুরী সাহেব পয়সা খরচে পেছ-পা হন না।
মুনশী একদিন রাশ-ভারী চৌধুরী সাহেবকে জিজ্ঞেস করেন, এই কাঠের ঘর গুলোতে কে থাকবে?
—ম্যানেজার।
—মা শা-আল্লাহ্।
মুনশী সাহেব সেদিন দুনিয়ায় ছিলেন না। তাঁর জন্য ঘর পর্য্যন্ত তৈরী হোয়ে গেল। সুন্দর প্যাটার্ন কোয়ার্টার। সেই পুরাতন কারখানার এককোনে দরমার বেড়ার পাশে এই প্রাসাদ! আল্লা, তুমি আলেমুল গায়েব।
মুনশী সাহেব এখনও কারখানার ভেতরে এক জায়গায় থাকেন। সম্মুখে অফিস, পেছনে কারখানা। মাঝখানে দেওয়ালে একটা জানালা। কর্মচারীদের হাঁক-ডাকের জন্যে এই ব্যবস্থা।
মুনশী সাহেব চর্কীর মত ঘোরেন। এলোপাতাড়ি গালাগাল দেন, ছোকরা আর মিস্ত্রীদের কাজে সামান্য গাফলতি দেখলে। জমীর আবার একদিন ভয়ানক মার খেল। হাতে ছড়ি ছিল না, মুনশী সাহেব সরু চেলা কাঠ সদ্ব্যহার করলেন।
পরদিন অপরাহ্ণ। সামান্য ফুরসৎ পেয়েছিল মিস্ত্রী আর ছেলেরা। ‘কাটার’ মেশিনের কলকব্জা বিগড়েছে। তাই কিছুক্ষণের জন্য কাজ বন্ধ। রহিম, শফী, কলিম ও অন্যান্য সকলে গল্পে মত্ত।
হঠাৎ তাদের কানে অদ্ভুত ফোঁপানির শব্দ গেল। শফী বলল চুপ।
সকলে উৎকর্ণ।
মুনশী সাহেবের নূতন শিকার হোলো নাকি কেউ?
কালু বল্ল, “আফিস ঘর থেকে ফোঁপানী কান্নার শব্দ আছে, আমি ওঁৎ পেতে দেখে আসি।” আস্তে আস্তে গেল সে দেওয়াল-লগ্ন জানালার কাছে।
স্তম্ভিত কালু!
আফিস ঘরে বসে আছেন চৌধুরী সাহেব। সম্মুখে দাঁড়িয়ে মুনশী ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
পাশবিক উল্লাসে কালু ছুটে এলো। “আরে, মুনশী কাঁছে!”
সংবাদটা দ্রুত ছড়াতে গিয়ে কালুর জিব জড়িয়ে গেল। আরে মুনশী-কারখানার মুনশী–।
মুনশী মুনশী ফিফিস উল্লাস-চিহ্নিত বিস্ময়-ধ্বনি।
প্রাথমিক উত্তেজনার পর সবাই এসে দাঁড়িয়েছে জানালার নীচে অতি সন্তর্পণে। একে অপরের পিঠের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। কোন শব্দ নেই দেওয়ালের ওপারে। চাপা হাসি আর কৌতুহলের পাহাড় ভেঙে পড়ছে। জমীর বেঁটে। সে তাড়াতাড়ি একটা বিস্কুটের টীন নিয়ে, চড়ে দাঁড়ায়। সকলে টিকেট-না-পাওয়া ফুটবল খেলার দর্শক।
ককিয়ে উঠল মুনশী সাহেব, “হুজুর!”
সহজে জবাব দিচ্ছেন চৌধুরী, “আমাকে কারবার দেখতে হবে। লোকসান ত দিতে পারিনে।”
-–হুজুর, এতদিন আপনার নিমক খেয়েছি। মুশীর গলা বুজে আছে বোঝা যায়।
—দেখুন, মুনশী সাহেব, এ-কারবার কি আপনি আর দেখতে পারেন? লাখ লাখ টাকার হিসেব। ও জাব্দা খাতায় কুলোয় না। আমি মাদ্রাজী এ্যাকাউন্ট্যান্ট ঠিক করেছি। আজ রাত্রের ট্রেণে আসবে। ওই তার কোয়ার্টার।
—অন্য কোন কাজে দিন।
—কি কাজে দেব, আপনি বিস্কুট কাটতে জানেন না। পারবেন?
মুনশী হতবাক চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। চোখ ধোঁয়া।
—টাইপের কাজ জানেন না। মিলিটারী সাহেবদের কাছে ত হাতে লিখে চিঠি কি দরখাস্ত দেওয়া চলে না।
ঢোক গিলছে যেন মুনশী “জী”।
টাইপের কাজ খুব ভাল করে ফিরিঙ্গী মেয়েরা। আমি বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম। আজ সব আসবে দেখা করতে। দেখুন, মুনশী সাহেব, আয়ের দিকে নজর না থাকলে কারবার চলে না।
দেওয়ালের ওপারে একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। জমীর প্রায় হেসে ফেলেছিল। তার মুখে হাত চাপা দিল সফী।
—হুজুর, কত বছর এখানে কাটিয়ে দিলাম, এই বুড়ো বয়সে ছেলে-পুলে নিয়ে কোথায় দাঁড়াব?
জমীর ওদিকে টিন থেকে নেমে দূরে সরে গেল। হাসি আর সে চেপে রাখতে পারছে না।
চৌধুরী সাহেব নম্রকণ্ঠে বলে যান, ও-কথা মুখে আনবেন না। আল্লা মুখ দিয়েছেন, আহারও দিয়েছেন। রুজীর মালিক ত আমি নই। আপনি কতবার বলেছেন, রাজাকাল্লাহ।
—হুজুর।
হাত-জোড় করে ভেঙে পড়লেন এ-বার মুনশী সাহেব। আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেন না।
দেওয়ালের ওপারে ফিফিস শব্দ ওঠে : মৃগী ব্যারাম ধরল নাকি রে।
রীতিমত হাঁপাতে থাকে মুনশী। চৌধুরী সাহেব সামান্য বিব্রত বোধ করেন।
—হুজুর এই বয়সে কোথা গিয়ে দাঁড়াব?
অক্ষমতার চরম পরিচয় চৌধুরীর মুখাবয়বে। সবিনয় জবাব দেন, “এ-কথা বলে গোনাগার হবেন না। আল্লার উপর আপনার ভরসা নেই। আল্লার দুনিয়ায় কি কারো দিন অচল আছে?”
ধুঁকতে লাগলেন মুনশী সাহেব।
চৌধুরী সাহেব হাঁকেন, দরওয়ান।
দরওয়ান ছুটে এলো।
—জী।
—দেখো মিসি বাবা-লোগ আয়েগা। ঠায়রনে বলো। ড্রাইভার কো খবর দো।
—জী’ আচ্ছা।
আপিস ঘর থেকে চৌধুরী সাহেব বেরিয়ে গেলেন।
সম্মুখে কারখানার ফটক।
মুনশী সাহেব সেই দিকে বার বার দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে লাগলেন।
দেওয়ালের ওপারে সবাই নেমে পড়েছে। খেলা যেন খতম হোয়ে গেল।
মন্তব্যের খই ফুটে।
রহিম স চীৎকার বলে, “ভাইয়ো, উধার চলো।”
রীতিমত ছুটতে আরম্ভ করেছে সে। একটা মেজের কিনারায় হাত দিয়ে লাফিয়ে উঠল তার উপর। পাশের ‘কাটার’ মেশিনের বেল্ট ঝুলছে। সুঠাম দেহ নিয়ে দাঁড়িয়েছে রহিম। হাতটা শুধু বেল্টের উপর।
ইশারা করে সে, “আউ, জলদি আউ।”
কয়েকজন তখনও জানালার কাছে। বান-বিদ্ধ শিকারের মত মুনশীর দিকে চেয়ে ওদের তৃপ্তি মিটছে না। “আউ, আউ।”
রহিম চীৎকার করে। শব্দ-ভেদী বানে সে সব চুরমার করে ফেলবে।
“আউ, খুশী মানাও।” জোর গলায় আবার সে বলে, “সব চলা জায়েগা। সব জায়েগা।” এতক্ষণ অন্যান্য সহকর্মী এসে জুটেছে মেঝের চারিদিকে।
রহিম চেঁচিয়ে বলে, ‘সব জায়েগা।”
জমির বলে, মুনশী?
“খুশী মানাও সব জায়েগা। সব জায়েগা। সব জায়েগা… সাব… সাব… মুনশী… উন্শী… সাব।”
কলিম বলে, “রহিম, আস্তে, চৌধুরী সাহেব আসছে নাকি?”
রহিম একদম জোশে উঠেছে।
—আরে ও ভি জায়েগা। চৌধুরী ফৌধুরী। সাব-সাব জায়েগা। এক ভি নেহি রহেগা।
হাতের পেশী ফুলিয়ে সদম্ভে সে চীৎকার করে, “দেখো, হামলোগ হ্যায় আওর রহেঙ্গে, আলবৎ আলবৎ… হামলোগ যো আপনা মেহনত সে খাতে পিতে…আওর কুই নেহি রহেগা।”