নতুন জন্ম
গোমতী নদী এইখানে হঠাৎ মোচড় মেরে আবার সোজা এগিয়ে গেছে।
পাশে বন্যারোধী চওড়া বাঁধ, মনে হয়, যেন একখানা সুদীর্ঘ বাহু জলা-খাদ মাঠ-গোঠ বনানী—শীর্ষ সবুজ-নীল গ্রামের ভিতর দিয়ে সুদূরে মিশে গেছে। দিগন্তের সরু রেখা ঐ বাহু-প্রান্তে উপুড় করা কর-তালু-লগ্ন রাঙা আঙুলের সমষ্টি। সূর্য্যের আলোয় ঝলমল করছে তার-ই নীচে গোমতীর নেশা—ছলছল চোখ। দূরে দৃষ্টি মেলে চেয়ে আছে গোমতী কারো প্রতীক্ষায়। অনুভূতির ঝঞ্ঝা স্রোত-রূপে উদ্বেলিত বুকের সমতলে ফুঁসে উঠছে।
বর্ষার অবেলায় ঝিরিঝিরি বাতাসের পিঠে সওয়ার পাহাড়ী মেঘ আকাশ-বিজয়ে তাঁবু তুললো এই মাত্র।
নিচে গর্নার নৌকা, মাছ ধরা জেলে-ডিঙ্গি, সাদা গাং-চিল ছন্দের সমতা বজায় রাখছে।
—হালী আইজ ক্ষেপছে।
ডিঙি থেকে একজন মন্তব্য করল। হালী অর্থাৎ শালী।
গোমতীর এই মুহূর্তের ভগ্নিপতি ফরাজ আলি ছোট ডিঙির উপর হাল ধরে দাঁড়িয়েছিল। বাঁশের লগি ঠেলছে তারই বছর এগারো বয়সের পুত্র আক্কাস।
গোমতীর স্রোত ঘূর্ণী-তোড়ে চীৎকার করে উঠল।
—হালী আইজ ক্ষেপছে।
ফরাজ আলি গোমতীর সঙ্গে এই সম্বন্ধ পাতিয়াছে বহু-দিন।
চেহারা খানা কালো, আট-সার্ট গাট্টা-বাঁধন, খাটো কদ্। তার উপর সে যা’ পীচ-রং, দেখতে ঠিক নধর শিশুকের মত। নদীর সঙ্গে রিস্তা থাকবে না কেন?
ফরাজ আলির কালো ভুরুর উপর খোঁচা খোঁচা চুল এসে পড়ে। চোখে দয়া-মায়ার দাগ পর্যন্ত নেই। চোখ নয় ত, গোল কোটরের ভেতর দুটো কালো কাচ বসিয়ে মাঝখানে কেউ অতি ছোট্ট পিদিম জ্বালিয়ে দিয়েছে। কথা বলার সময় ফরাজ আলির দৃষ্টি যেন জ্বালা ছড়ায়। বেঁটে শরীর। আরো বেঁটে, মাংসল, পেশী-খাড়া হাত। থুত্নীর দু-পাশে রুক্ষ চোয়াল থেবড়ে বসে গেছে গৃহস্থের দাওয়ায় কাবুলী—ওয়ালার মত—দেনা শোধ অথবা সুদ ছাড়া উঠবে না।
দম্ভের প্রতিমূর্ত্তি ফরাজ আলির মুখাবয়ব।
এক হাতে পালের দড়ী ধরেছিল সে। কাফ্রি-সম্রাট যেন স্যাল্যুট নিচ্ছে তাঁবেদার ফৌজ মহলে।
কিন্তু ইতিমধ্যে বাতাস মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। আকাশের প্রাঙ্গণে ধুনুরী নেমেছে। মেঘ-মহল্লা গোষ্ঠী-সুখ চায় না আর।
ফরাজ আলি তাড়াতাড়ি পাল নামিয়ে ফেল; এত বাতাসে ছিঁড়ে যেতে পারে। গণ্ডা দশেক তালি বাদামের পাঁজরায়।
আকাশের দিকে চোখ ফিরিয়ে একবার দেখল ফরাজ আলি। ঝড়ের সম্ভাবনা আছে। কিন্তু পলকে অন্য চিন্তার ঢেউ ওঠে। ঝড়ের কথা আর মনে থাকে না। হাল বগলে দাবিয়ে গলুইয়ের মুখ থেকে সে বিড়ি বের করে, মাটীর হাঁড়ির জীয়ানো আগুনে ধরিয়ে নিল তাড়াতাড়ি।
গোমতীর বুক, মুখ কালো হোয়ে এলো। মেঘের ওপারে সূর্য্যের অস্তিত্ব এখন অনুমানের ব্যাপার।
বড় আরামে বিড়ি টানে ফরাজ আলি।
স্রোত একটু খর। দুই পাড়ে আছড়ে পড়া পানির গর্জ্জন-শব্দে অস্বাভাবিকতা। ফরাজ আলির কান এড়ায় না।
দাঁতে দাঁত চেপে বিড়বিড় শব্দে উচ্চারণ করল সে, “হালী…।”
আক্কাস লগী ঠেলছে। শীতার্ত বৃদ্ধের দাঁতের মত ডিঙির গায়ে লগীর ঠকঠক শব্দ হয়। উজানের তোড় ক্ষুদে কিশোরের কাছে সহজে হার মানতে চায় না!
ফরাজ আলি উৎসাহ দিতে থাকে, সাবাস বেটা!
আক্কাস দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে লগি ফেলে আর পা টিপে টিপে অগ্রসর হয়।
শেষে সে বলে, বা-জান।
কণ্ঠে অসহায়তার আবেদন। বা-জান, অর্থাৎ আমি হাল ধরি, তুমি লগি চালাও।
জবাব আসে একটু পরে। জবাব নয়, অনুরোধ।
—বা-জান, আস্তে লগী চলাইস।
—ক্যান? পুত্রের জবাব।
—আমাগো ভিটা ছিল এহানে। তোঁয়ার চাচার কবর আছে।
—চাচা?
–হ। তারে দেখস নাই। হে এক জোয়ান ছিল। ফরাজ আলি উৎসাহে অগ্রজের কাহিনী বয়ান করে। আকাশের দিকে খেয়াল থাকে না। ‘তুফানে ডুইব্যা মরছিল।’ কথা শেষ করে ফরাজ আলি পুত্রের মুখের দিকে তাকায়। ভয়ের ছায়া কচি মুখে।
—ডর করস, বা-জান? ডরের কি আছে? ‘এই হালী’…ফরাজ গোমতীর শ্রাদ্ধ-শেষে অন্য কাহিনী পাড়ে। বড় জোর স্রোত। হাল বাগ মানে না। রুক্ষ কণ্ঠে বিড়বিড় করেস, “হালী…”।
আবার অস্পষ্ট গলায় পুত্রের আবেদন : বা-জান।
আবেদনের দিকে লক্ষ্য নেই ফরাজ আলির। নিজের মনে আউড়ে চলে, “হালী, তরে দ্যাখমু একদিন। বা-জান?”
বা-জান তখন লগির সঙ্গে কুস্তি-রত। পলিমাটী ছিল নিচে, লগি পুঁতে গেছে। আক্কাস-ও শক্ত ছেলে। লগি তুলে ডিঙির কিনারে-কিনারে এগিয়ে যায়।
—বা-জান, ডর কির লেইগ্যা?
আবেদন-মাখা কণ্ঠে আক্কাস বলে, “বা-জান, আমানের দিকে চাইয়া দ্যাহেন।”
আকাশ কালো হোয়ে গেছে। বেলা বেশী নেই। ফরাজ আলি চেয়ে দেখল। তবু কোন বিকার নেই মুখে।
পুত্ৰ লগী ঠেলে নিঃশব্দে। পিতার মুখের দিকে আর তাকায় না।
গোমতী যেখানে বাইজীর মত কোমর বাঁকায় নৃত্য-ছন্দে, তার-ই কোলে কোলে ঘর আছে। জোর একখানা, দু-খানা। বন্যারোধী বাঁধ আর নদী-তট—মাঝখানে দশ-বারো হাত জায়গা কি আরো কম ফাঁক থাকে, সেখানেই ফরাজ আলির মত আরো যারা আলি আছে তারা আস্তানা বাঁধে। শণে ছাওয়া কুঁড়ে। বাঁধের উপর থেকে মনে হয় ঝড়ে উড়ে এসে কারো ঘর জমিনে মুখ থুবড়ে পড়েছে। কিন্তু বাঁধের গায়ে পায়ে-চলা সরু দাগ-পথে নেমে গেলে দেখা যায়, আর এক জগৎ। আস্ত ঘর। ঘরের মুখ আছে। কান নেই, চোখ নেই। সম্মুখে বালি-চিকচিকে উঠান। কলা গাছের ঝাড় আছে, বান-ভাসি কল্কে ফুলের গাছ আছে। কেউ কেউ চারা ফুলগাছ লাগিয়ে রাখে। ফরাজ আলির চালের সঙ্গে পাখীর খাঁচা ও পাখী ঝুলছে। বুনো লতা কঞ্চির দেওয়াল বয়ে চালে উঠে গেছে। শুচিতার স্পর্শ চৌদিকে। ঘর, ঐ ঘরের ভিতর রহস্য—পুরী। বাইরের মানুষের কাছে জানার কথা নয়, এখানে আছে বাঁশের তক্তপোষ। সোনার পাথর-বাটীর নবতম সংস্করণ। বাঁশের পায়া, উপরে বাখারী বিছানা—মাদুর পেতে শোয়ার কাজ চলে। কিন্তু আরো অভিনবত্ব আছে মায়া-পুরীর ভেতর। তক্তপোষ, ঐ তক্তপোষের নানা সাইজের পায়া জড়ো করা থাকে এক কোণে। বর্ষা ও কোটালের জোয়ারে গোমতী একটু গৃহ-সুখ চায়, তখন জলের পরিমাপ অনুযায়ী পায়া বদল চলে। মাঝে মাঝে তক্তপোষ আভিজাত্যে ফুলে মট্কায় গিয়ে ঠেকে, কারণ খুব লম্বা বংশ—পায়ার উপর আসীন থাকেন কিনা। পানির সঙ্গে সঙ্গে আবার পায়ার খাড়াই ছোট হোয়ে আসে।
ফরাজ আলীর ছোট উঠানের পাশে দু-ঝাড় কলা গাছ দু-দিকে। মাঝখানে বাঁশের পৈঠা। গ্রীষ্মের সময় নদীর পানি সরে যায়। তখন পৈঠা বয়ে নীচে নেমে থালা-বাসন ধোওয়া, গোসলের কাজ চলে। অঢেল ভাদ্রের সময় মাচাং-পোষ (মাচাং ও তক্তপোষ) থেকে আর নামতে হয় না কোন কাজের জন্য। কলাগাছ খুব বাড়ে পলিমাটীর উপরে। তলার দাঁড়িয়ে এইখান থেকে পাতার ফাঁক দিয়ে ফরাজ আলির স্ত্রী দেখত, দূরের আকাশ আর সূর্য্যোদয়। দু-বছর আগে সে মরে গেছে। এখন সেই জায়গায় মাঝে মাঝে আনমনা হোয়ে দাঁড়ায় আক্কাস।
বসুন্ধরা কত কৃপণা, এখানে এলে বোঝা যায়। দিগন্ত-বিস্তার কত ছোট হোয়ে গেছে! এক ফালি জায়গার বেশী ধরিত্রী তার শিশুদের আর কিছু ঋণ দিতে বিমুখ। ওভারসীয়ার সাহেব এসে বলেছিল, ‘ফরাজ আলি, বে—আইনী ঘর তুলেছো’। ‘হুজুর নদীর লগে হব গ্যাছে গ্যা। তার মুখের কথা কেড়ে নিয়েছিলেন ওভারসীয়ার সাহেব, “জমিন টুকু শুধু বাকী। তা ঠিক। কিন্তু কিছু দিতে হয় যে-” 1
—বে-আইনী করতাছি দিমুনা ক্যান?
—ঠিক বুঝেছো। ওভারসীয়ার সাহেব তখন পরিতৃপ্ত মুখে বিড়ি গুঁজে বলতেন, “জানো ফরাজ আলি, আমাদের আবার ইঞ্জিনীয়ার সাহেবকে দিতে হয়। এই দেয়া-নেয়ার খলা চলছে দুনিয়ায়। দিবে আর নিবে, মিলিবে মিলাবে…”। পাঠ্য-পুস্তকের ঢেকুর তুলছিলেন তারপর। সেদিকে ফরাজ আলির কোন কৌতূহল থাকার কথা নয়। দেওয়ার ব্যাপারেই উৎসাহ বেশী। নদীর কোল ছাড়া মন টেকে না। যাক, কিছু যাক।
ফরাজ আলির এক প্রতিবেশী প্রায় বলত, ‘চলেন মিয়া যাই, চইলা যাই এহান থেইক্যা”।
-–যামু কোথা? এই হালীর লগে বড় পীরিত, আর কোথাও মন লয় না। দ্যাহো, চুলের লাহান স্রোতের গেরো।
চুলের মত স্রোতের গ্রন্থী।
কণ্ঠস্বরে ফরাজ আলির অনুভূতি রূপ পায়। অবয়বে সে পাষাণের মত অনড়।
প্রতিবেশী হাস্ত “বড় জবর পীরিত, মিয়া বাই। শাদী করেন এবার। ভাবী-সাব ত বহুৎ জমানা এন্তাকাল করছেন।”
—না। আর শাদী করমু না। এই হালী লগ ছাড়ে কি। কিন্তু আমার লগে এত পীরিত ক্যা?
—পছন্দ অইছে।
—হালীরে কৈ, হালী—আঁর কি আছে। ক্ষেইপ্যা উঠস্, ক্ষেইপ্যা ওঠ। যা’ হালী বাঁধ ভাইঙা কুমিল্লা শহরৎ—ওহানে বড় বড় সাব আছে—পীরিত মজাসে করতা পারবি। সাব মটোর চড়াইবো, শরাব পিলাইবো। যা, হালী যা’—ওহানে ইমারত মিলবো—পাতার গরে আস্স ক্যা—হালী হুল কৈ—
অবিকৃত মুখে ফরাজ আলী শ্যালিকার উপর অভিসম্পাত ঝাড়ত।
আজও স্ত্রীর সহোদরা নির্ব্বিকার।
বাতাসের সঙ্গে সঙ্গে গোমতীর স্রোত দ্রুত শুরু হয়। বাঁশের লগীর গায়ে খলখল কল-হাস্যে আছড়ে পড়ে।
আকাশে হুঙ্কার-রত পুরু মেঘ ছিন্ন-ভিন্ন কালো গোপালের মত গুঁতোগুঁতি শুরু করে।
আক্কাস এবার দাবী-দৃঢ় কণ্ঠেই কথা চালায়, “বাজান। আঁই আর পারতাম না। লগী ধরেন আপনে।”
এতক্ষণে হুঁশ হয় ফরাজ আলির, আরো জোরে ঝড় উঠতে পারে।
সমস্ত আকাশ ঝুলে পড়েছে। গোমতীর দূর-বিস্তার বক্ষ মেঘের অন্ধকারে লুপ্ত। আশে-পাশে কোন নৌকা নেই। পিতা-পুত্র কালো পট-ভূমির গহ্বরে যেন সেঁধিয়ে যাচ্ছে।
—বা-জান, জলদি করেন।
আশঙ্কা-ক্লিষ্ট চীৎকারে পুত্র হুশিয়ারী ছাড়ে। শনশন বাতাসের আওয়াজ। মৃদু-ভাষের কোন দাম নেই আর। ফরাজ আলীর চীৎকারে জবাব দিতে হয় : আইতাছি।
পিতার জায়গায় পুত্রের সমাসীন হোতে কয়েক মুহূর্তের অপচয়। তারই ভেতর নৌকা চর্কির মত তিন পাক খেয়ে গেল।
জোরে চীৎকার করে ফরাজ আলি, ‘হাইল জুরসে কোলের দিকে টান্তা লাগ, বা-জান।’
—আঁরে কওয়া লাগব না।
এম্নি আক্কাস শান্ত ছেলে। এখন তেজী গলায় বিরক্তি ষোল আনা জানান দেয়।
নৌকা সায়েস্তা হোয়ে গেছে। লগি ফেলছে ঝঝপ ফরাজ আলি।
নিমেষে চারিদিক সীসার খাপে যেন ঢুকে গেল। ঝড় উঠল জোরে।
চীৎকারে এখন সাধারণ বাক্য বিনিময় হয়। ফরাজ আলি বলে, “ডর না করস, বা-জান। হাইল ঝিক্যা দে। ঝিক্যা দে।”
—দিতাছি। বালকের ক্ষীণ কণ্ঠস্বর বাতাসে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
—হালী ক্ষেপছিস, হালী। তরে ডরাই না। তরে ডরাই না। বাচ্চা লগে। হালী আর সময় পাইলি না মশকরার। তরে দ্যাহামু, ছিনাল—
আপন মনে চীৎকার করে আর লগি ঠেলে ফরাজ আলি। কুঁজো হোয়ে যাচ্ছে সে। লগি বেঁকে যাচ্ছে ধনুকের মত। দরদর ঘাম ছুটছে গা থেকে।
আক্কাস আন্দাজে হাল চালায়।
শনশন বাতাসের সঙ্গে এবার বৃষ্টি শুরু হোলো। শব্দে কান পাতা দায়। চতুৰ্দ্দিক মুছে গেছে। আঁকা-বাঁকা নানা কোনে বৃষ্টির ফোঁটা তীর বেগে ছুটে আছে।
ফরাজ আলির ডিঙি থামে না। আঁকছে, বাঁকছে—ঢেউয়ের দোলায় নেচে নেচে তলিয়ে যাচ্ছে, আবার মাথা ফুঁড়ে উঠছে। হাতের পেশীর কাছে প্রাকৃতিক আক্রোশ বৃথাই ফোঁস চালায় বিষ-শূন্য নাগিনীর মত।
টোকা মাথায় দিতে যায় ফরাজ আলি, উড়ে পড়ে গেল নদীর ভিতর।
—যা ‘হালী লিয়া যা, শরীফ খান্দানের মাইয়ার লাহান বুকে কাঁচলি বাঁধবি। বা-জান, তর টোকা ফেইলা দে—ফেইল্যা দে। একখান কাঁচলি তোয়ার খালা আম্মার বুকে বেঢপ দ্যাহাইবো—ফেইল্যা দে–।
বাতাসের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ফরাজ আলির চিৎকার দাপটের পথ পায়।
আক্কাস পিতার অনুরোধ রাখে না। চুপ-চাপ নিজের কাজে ব্যস্ত থাকে।
হেসে উঠল ফরাজ আলি। দাঁত বেরোয় না, ঠোঁট কাঁপে না, গালে টোল পড়ে না। তবু হাসে সে। আজব ধরন। বুক শুধু গুরগুর করে ওঠে, দোলা খায় বার-বার।
ফরাজ আলির মুখ বন্ধ হয় না : “দুলা বাইয়ের লগে মস্করা করতাছস? আঁই মরদ। বুছনি হালী? মহাজনের কেরায়া নাউ, নইলে দ্যাহাইতাম হালী নাউ চালান কারে কয়।”
ফরাজ আলি স্বগতোক্তি কেউ শোনে না। শোনে সে। হয়ত শোনে উন্মাদিনী গোমতী।
গাছ-পালার মেরুদণ্ড রবারের মত কুঁচকে আবার সটান হোচ্ছে। ঝাল্লা বৃষ্টি-শীকরে বোঝা যায় না, ওই গুলো গ্রামান্তের গাছ-পালা। পুঞ্জীভূত কালির পাহাড় যেন ভূমিকম্পে কাঁপছে। তারই আর্ত্তনাদ, ছলাৎছল পাগল ঢেউএর অট্টরবে, বাতাসের গলা-টেপা গোঙানির শব্দ-পটে।
হাজার লকলকে জিভ দিয়ে বিজলীর সাপ আকাশের আলকাত্রা-গা চেটে নিচ্ছে।
ফরাজ আলি এই চকিত ইশারার ফাঁকেই দেখতে পায় : নিকটে ঘর ও ঘাট। বাঁকের মুখে এসে পড়েছে তারা।
আর একবার ভেংচি দিল সে শ্যালিকার উদ্দেশ্যে।
বৃষ্টি থেমে এলো ইল্সে-ফোঁটায়। ঝড়ের আক্রোশ অবিরামগতি, তেমনই চলছে।
ঘাটে নৌকা বেঁধে ফরাজ আলি চুটিয়ে ঝাল নিংড়ে দিল, “আয় হালী, দেহি ত’র। বা-জান, টোকা ফেইলা দে–।”
শেষে সম্বোধন পুত্রের উদ্দেশ্যে।
আক্কাস কোন কথা না কানে তুলেই জাল কাঁধে ঘরের দিকে এগিয়ে গেল।
ঝড়ের জুলুমে মাছ ধরা মাটী। আক্কাসের বড় খারাপ লাগে।
পৈঠায় নৌকা বেঁধে পেছন পেছন এলো ফরাজ আলি।
আগেই ডিপা জেলে দিয়েছে আক্কাস।
ভিজে গাম্ছা খুলে ফালি লুঙ্গী পরছিল, ফরাজ আলি তখন জিজ্ঞেস করে, “সালন পাক করতা চাস্, বা-জান?”
মাথা দোলায় আক্কাস। নঅ।
—আব্বা। ছাড়ান দিন। দুফরের বা’তে অইব।
আর কথা বলতে পারে না সে। হি হি করে শীতে কাঁপতে থাকে। অনেক বৃষ্টি গেছে কচি মাথার উপর দিয়ে।
বাঁশের আলনা থেকে কাঁথা টেনে গায়ে দিল আক্কাস।
ফরাজ আলিরও খুব শীত পেয়েছে। এখন প্রয়োজন সামান্য তামাক। নৌকায় সব ভিজে গেছে। বাঁধের উপর, আরো দক্ষিণে রহম মুদীর দোকান আছে। যাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না এমন দুর্বিপাকে।
দুইজনে ক্লান্ত।
আক্কাস বেশী কথা বলে না। চুপ-চাপ থাকে। কিন্তু মনে মনে সংলাপ চলে। সে অবিকল পিতার সংস্করণ। খেলাধুলায় খুব পটু ছিল। আজ-কাল বাপ সঙ্গী হিসেবে তার মর্য্যাদা দিয়েছে। মৃত পত্নীর স্মৃতি অথবা জীবিকার জুটি-রূপে। তাই আরো চুপ করে থাকে আক্কাস। অনেক দিন ঘরে বসে বা ডিঙির লগি ঠেলার সময় নদীর পাড়ে ছেলেদের কোলাহলে তার মেজাজ তেতে, মুখের পেশী শক্ত হোয়ে উঠতো। কিন্তু মুখে সরব কিছু শোনা যেত না।
বাইরে অন্ধকার নদী আর ঝড়ের গর্জ্জন একাকার মিশে গেছে।
পিতা-পুত্র পাশাপাশি বসে আছে। দুইজনে নীরব। সামান্য নড়া-চড়ার ইচ্ছা-টুকু-ও অন্তর্হিত।
আক্কাস মাঝে মাঝে কান খাড়া করে।
পৈঠার উপর গোমতী মাথা কুটছে। পাড় ভেঙে পড়ছে ঝঝপ শব্দে।
কলা-গাছের জন্য আক্কাসের দুঃখ হয়। সব হয়ত নদীতে ভেঙে পড়বে কাঁদি-সহ।
—বা-জান, নদী যা’ গরজাইতাছে, কেলা গাছ হব পইড়া যাবো, চলেন কাঁচা কাইট্যা আনি।
—আইজ ঠিক থাইকব।
জনক অভয় দিল সংক্ষেপে।
আক্কাস তবু উসখুস করে। তার মন সরে না। সামান্য গড়িমসির ফলে এমন তৈরী জিনিষ নষ্ট হবে। এক সপ্তাহ থাকলে পাকা কলা বাজারে বিক্রি করে আসতে পারত।
ঘরের প্রবেশ-পথে সে মুখ বাড়িয়ে দেখার চেষ্টা করল। জোরে ঝড় দিচ্ছে। অন্ধকারে আন্দাজেই সে দেখতে পায় যেন, কলাগাছ জোরে নাড়া খাচ্ছে। শিকড়ে বেশী মাটী নেই। রাত্রি কাবার হোতে—হোতে গাছের আয়ুও কাবার হবে।
কিন্তু নিকটে কি যেন সাদা-সাদা দেখা যায়। দমকা বাতাসে ছলাৎ শব্দ হয় পৈঠার নিকট। পানি কি বাড়ছে তবে?
আশঙ্কিত ডাকে আক্কাস, অ বাজান। বা-জানের খোয়ারী লেগেছিল। আক্কাসের গলা অত-দূর পৌঁছায় না।
আরো জোরে ডাকল সে, অ বা-জান।
—কি ক’। সুপ্তোত্থিত কণ্ঠ
—দ্যাহেন। পানি বাড়তাছে। বান আইতা পারে।
গোমতীর রগ্ চেনে ফরাজ আলি। তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল সে। মাটীর বাসন আড়াল দিয়ে পিদিম হাতে এগিয়ে এলো। ফিকে আলো নদীর ধারে পৌঁছায়।
ফরাজ আলি চেয়ে দেখে, নূতন ফেনা পৈঠার গায়ে গায়ে। আক্কাসের আশঙ্কা মিথ্যা নয়।
আশঙ্কায় ফরাজ আলির বুক-ও হয়ত কাঁপল। সে বিড় বিড় শুরু করে “হালী, এহন-ই জ্বালাইতা লাগছস।”
গালি দেওয়ার বেশী অবসর নেই। ঘরে ফিরে এলো সে। এক কোণে স্তূপীকৃত বংশ-পায়া ঠিক আছে কিনা, পরীক্ষা করল। বান বাড়লে, মাচান-পোষই একমাত্র আশ্রয়।
বাইরে চড়চড়-ধ্বঅস-স শব্দ হোলো। আবার স্রোতের হুটপাট। যেন কুমীর কোন জংলা হাতী শীকার ধরেছে।
আক্কাস বলে, বা-জান। নদী গাছ নিতাছে, নদী। চলেন—
—না, আঁন্দারে যাওনের কাম নাই।
পিতার কণ্ঠ রুক্ষ। সমস্ত নদীর গায়ে কত ফাটল। এখন যাওয়া সমীচীন নয় মোটে। আক্কাস বোঝে না কেন?
বাঁশের পায়া ঠিক করে, দুইজনে প্রতীক্ষায় থাকে। হুড়হুড় শব্দ হচ্ছে। ষাঁড়ের পাল গাঁ-গাঁ রবে মাঠের সড়ক ধরে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে। ঝড়ের দাপট পূর্ব্ব-বৎ।
আধ ঘণ্টার ভেতর বন্যার জল হু হু বাড়তে থাকে। পৈঠা করে পার হোয়ে, এখন ঘরে ঢুকছে।
ও-সব দুর্বিপাক ফরাজ আলির গা-সওয়া। কিন্তু আরো কত বাড়ে বন্যা, সেখানেই সমস্যা।
সে আরো কয়েক ইঞ্চি লম্বা পায়া লাগালো মাচাং-পোষে।
আক্কাস চুপচাপ হাঁটুর ভেতর মাথা গুঁজে বসে থাকে। বাবা একবার খাওয়ার তাড়া দিল। কিন্তু ক্ষুধা তার মিটে গেছে। ক্রুর কালো অন্ধকার পটে দৃষ্টি মেলে সে এক-একবার তাকায়। তার কিশোর মনে হাজার রকমের প্রশ্ন অর্থ-হীন জিজ্ঞাসায় ভিড় করে।
দু-ঘণ্টায় বানের জল হু হু করে ঢুকে পড়ল চারিদিকের রন্ধ্র পথে। মাচাং এবার দ্বীপ। পিতা-পুত্র দ্বীপের অধীশ্বর। এখন-ও জ্বলছে টিম্ টিম্ প্রদীপ। ঝড়ের দমকে ঘর-খানা মচমচ্ শব্দে কাঁপছে। থুবড়ে পড়বে না তো সব নিয়ে? ফরাজ আলি একবার ভাবল।
নিচে হাঁটুর বেশী পানি। দড়ির শিকেয় হাঁড়ি-কুড়ি ঝুলছে। পাখীর খাঁচা ঘরে তোলা হোয়েছিল। ডানায় মুখ গুঁজে ঘুমিয়ে আছে পাখীটা এক পায়ে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ খাঁচা নড়ে উঠল। ডানার ঝটপটানি ওঠে। সান্ত্বনার স্বরে ফরাজ আলি বলে, “র’ র’।” বিষণ্ণ খেচর আবার মাথাগুঁজে ডানার ভেতর।
ঝড় সামান্য কমলো। কিন্তু বন্যার জল মেঝের উপর এক-বুক।
এমন বহু রাত্রি কাটিয়েছে ফরাজ আলি স্ত্রীর সঙ্গে। সে-ও আজ ভয় পায়। নূতন তৈরী ঘর। এই যা’ ভরসা।
নেশাগ্রস্ত প্রাণীর মত আক্কাস ঝিমোয়।
চোখে নিদ্ৰা। বুকে ভয়। দোটানায় ঝড়ের দমকে ঘর কেঁপে ওঠা-মাত্র হঠাৎ সে হাউ-মাউ করে উঠল।
—বা-জান’?
—চুপ র’! ডরাস ক্যা?
ধমক দিল ফরাজ আলি। কিন্তু পর মুহূর্তে সে-ও বিবেচনার লাঙল চালায় মনে মনে। বন্যা পড়েছে, বাড়ছে। এমন কাল-রাত্রি। এখন-ও সাঁতার দিয়ে বাঁধে ওঠা চলে।
কিন্তু ঝড়ের মুখে পড়া যুক্তি-যুক্ত নয়।
সৌভাগ্য তাদের। ঝড় থেমে গেল একটু পরে। কিন্তু আকাশ সাক্ষী, যে-কোন মুহূর্তে আসতে পারে আরো জোরে। দমকা বাতাস থামেনি এখনও।
এই সুযোগ
আক্কাস বাবার ধমক খেয়ে মাচাঙে শুয়ে পড়েছিল কাঁথা মুড়ি দিয়ে।
ফরাজ আলি তা-কে ঈষৎ ঠেলা-যোগে বলে “বা-জান, ওড়। এহানে আর না।”
—কুই যাবো?
—কি কস? এহানে আর না। বাঁধের উপর যামু।
আক্কাস যেন এমন-ই অনুরোধের প্রতীক্ষা করছিল। এক মুহূর্তে তৈরী সে।
ফরাজ আলির গলা-সই পানি। আক্কাসের সাঁতার ছাড়া উপায় নেই।
ফরাজ আলি ভাতের হাঁড়ি, মাদুর কাঁথা মাথার উপর চাপিয়ে দিল। শেষে চোখে পড়ে, খাঁচা আর পাখী। তা-ও মাথায় তুলে নিল সে। মনে মনে বলে, “ময়না, এই ঝড়ের রাইত। তোরে ছাড়মু না। জান্ যাবে তোগোর। কাল বিহানে ছাইড়া দিমু। হালী…”
ডিপা নিভে গেল একটু অসাবধানতার ফলে। অন্ধকারে উঠানে নাম্ল ফরাজ আলি।
“বা-জান”। পুত্রকে সম্বোধন করে বলে সে, “বা-জান আমার কান্ধার পর হাত রাইখ্যা সাঁতার দিতা র’। ঠিগ যামু বান্ধের লগে।”
আকাশের কোন-কোন ঠিকানায় মেঘ সরে গেছে। নিষ্প্রভ চাঁদ ছিল শুক্লা তিথির। এই-টুকু বিরাট সান্ত্বনা ফরাজ আলির কাছে। হোক ঝাপ্সা, বাকী-টুকু আন্দাজ পরিপূরক।
আক্কাস পিতার কাঁধ ধরে সাঁতার কাটে। এগিয়ে যায় ফরাজ আলি। খাড়া বাঁধ। সব জায়গা দিয়ে উপরে ওঠা চলে না। পায়ে পায়ে পথ-পড়া দাগ খোঁজা চাই। চাঁদের আলো আর একবার দুই মনুষ্য—সন্তানের উপকারে এগিয়ে এলো।
বাঁধের উপর পৌঁছল তারা।
আকাশ আরো পরিষ্কার হোয়ে আসে। মেঘ-মুক্তির আস্বাদে জ্যোৎস্না ফুটফুটে রোশনাই ছড়ায়।
কাঠের কয়েকটা মোটা গুঁড়ি পড়েছিল চওড়া কাঁধের এক পাশে। তারই উপর পুনর্বসতির মহড়া। সব গুছিয়ে রাখল ফরাজ আলি।
তার গাম্ছা, লুঙ্গী, পরিধেয় সম্বল দুই ভিজে গেছে। যা’ শীত, স্যাঁতসেঁতে কিছু পরে থাকা অসহ্য। ফরাজ আলির উপস্থিত বুদ্ধি সৰ্ব্বক্ষণ ঘটে জমা থাকে। সে চট করে ভিজে লুঙ্গি খুলে ফেলে উলঙ্গ হোয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে বসে পড়ল কাঠের গুঁড়ির উপর।
আক্কাস মাথায় গামছা বেঁধে সাঁতার দিয়েছিল। তার পরনে শুকনো কাপড়। তবু গা শিরশির করে
শীতে। সে দাঁড়িয়ে থাকে।
ফরাজ আলি বলে, বয়, বা-জান।
—আঁই বইতাম ন।’
—ক্যা?
আঁই আর এহানে থাকমু না।
—যাবি কুই?
—শহরে যামু।
—খাইবি কি ওহানে?
—চুরি করমু, ডাকাইতি করমু, কাম করমু—
—মরদের বাচ্চা, চুরি ডাকাইতি করতা চাস, সরম করে না—সরম করে না?
চিড়-ধরা গলায় জবাব দিল আক্কাস, “মাসে এ্যামনে থাহে? তুমি সুসুঙের বাচ্চা, না মাসের বাচ্চা? নদীর লগে-লগে থাকার চাও, তোয়ার সরম করে না? সুসুঙের বাচ্চার লাহান খালি…।” শিশুকের বাচ্চা! বিস্ময়ে তাকায় ফরাজ আলি পুত্রের মুখের দিকে।
তারপর জোর-করে রুষ্ট পুত্রকে পাশে বসিয়ে বলে, “বয়। ঠিক কইছস। বিয়ান আইতে দে। আমিও যামু তর লগে। মহাজনের নাউ দিয়া দিমু।”
ঠাণ্ডায় হি হি করে কাঁপে আক্কাস।
ফরাজ আলি সস্নেহে তা-কে কাঁথার ভিতর মুড়ি দিয়ে নিতে-নিতে অপরাধীর মত বলে “সরম না করস। আঁই তোয়ার পোলা ন, বা-জান?”
বিবস্ত্র পিতার পাশে গাম্ছা-পরিহিত পুত্র। দুই জনে ভোরের প্রতীক্ষা করে।