সহধর্মিণী – ২৫

পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ

অনেকক্ষণ পতিবক্ষে আনন্দাশ্রু বিসর্জ্জনে অনেক পরিমাণে সুস্থ হইয়া হেমাঙ্গিনী আবার পূর্ব্বের ন্যায় ব্যগ্রকণ্ঠে স্বামীকে বলিল, “কেন তুমি এ সব কথা আগে আমায় বল নাই? কেন রমেন্দ্র বাবুর অবস্থা দেখিয়া তখনই সকলকে জানাও নাই? কেন সব কথা সকলকে বল নাই? কেন এমন নিষ্ঠুর উদাসীনতা দেখাইতে? তাহা হইলে আমি—আমি এত কষ্ট পাইতাম না। নিজের হৃদপিণ্ড নিজে উপাড়িয়া ফেলিবার আয়াস যে কি কঠিন তাহা তোমরা বুঝিবে না।”

সতীশচন্দ্র বলিলেন, “কেন বলি নাই, তাহা ত তোমায় বলিলাম। আমায় লোক সন্দেহ করিবে বলিয়াই এ কথা প্রকাশ করিতে সাহস করি নাই। পথে মালী খুনের কথা বলায়, আমার মনে হইয়াছিল, সে নিশ্চয়ই রমেন্দ্রের খুনের কথাই বলিতেছে। তাই খানসামা মাড়োয়ারীর খুনের কথা বলায় আমার মনে হইয়াছিল যে সে ভুল শুনিয়াছে। মাড়োয়ারী খুন হয় নাই, রমেন্দ্রনাথ খুন হইয়াছেন।”

“কেন তুমি এ রকম করিলে—কেন—কেন, তাই আমরাও তোমাকে সন্দেহ করিয়াছিলাম। কি কষ্ট যে পাইয়াছি, তাহা তুমি জান না। তুমি আমার সর্ব্বস্ব—ইহকাল পরকালের আশ্রয়—ধৰ্ম্ম অর্থ কাম মোক্ষ—আমার সর্বস্ব—তোমাকে খুনী মনে করার আগে আমার সহস্রবার মৃত্যু শ্রেয়ঃ—কিন্তু এই খোকাখুকীদের জন্য সে প্রশস্ত পথও যে আমার রুদ্ধ—আমার যে অবস্থা হইয়াছিল তা আর কি বলিব! আমি জীবনৃতা—সজ্ঞানে লুপ্তসংজ্ঞা—যাহার উত্তমাঙ্গ দূষিত, বিষক্লিন্ন—তাঁহার জীবন কি ভীষণ তাহা বুঝিবে কি?” হেমাঙ্গিনী আবার কাঁদিয়া ফেলিল।

সতীশচন্দ্র কহিলেন, “সব জানি, কিন্তু উপায় ছিল না। প্রকৃত খুনী ধরা না পড়িলে অন্যের কথা কি—তোমরাও আমার কথা বিশ্বাস করিতে না, তাই আমাকে বাধ্য হইয়া নীরব থাকিতে হইয়াছিল। এখন ত সব শুনিলে—এখনও কি সন্দেহ কর?”

“না—না—আমি বাঁচিলাম! আমায় ক্ষমা কর, অবলা নিরক্ষরা তোমারই সহধর্মিণীকে ক্ষমা কর।”

সতীশচন্দ্র দুই হস্তে হেমাঙ্গিনীর অশ্রুসিক্ত মুখখানি তুলিয়া ধরিয়া সাদরে সপ্রেমে চুম্বন করিলেন। কিয়ৎক্ষণ উভয়েরই কথা কহিবার ক্ষমতা ছিল না। অবশেষে সতীশচন্দ্র বলিলেন, “আজই এখান থেকে যাইবে স্থির করিয়াছ?”

“হাঁ, রাত্রের গাড়ীতে যাওয়া স্থির করিয়াছি।”

“তোমার শরীর এখনও ভাল হয় নাই, আরও কয়েকদিন এখানে থাকিলে তোমার শরীর ভাল হইবে, তাহার পর কলিকাতায় ফিরিব—কি বল?”

“তুমি যা বল। এখন সব স্থান আমার স্বর্গ বলে বোধ হইতেছে, কেননা পূত-পতিবক্ষ আবার আমার আশ্রয় হইয়াছে। তুমি হয় ত শোন নাই, আমার জ্বর-বিকার হইয়াছিল।”

“আমি সব জানি। তুমি কেমন আছ, আমি রোজ খবর পাইতাম।”

“কে খবর দিত? পিসীমা বলিলেন, তিনি তোমায় পত্র লেখেন নাই?”

“ডাক্তার বাবু রোজ খবর দিতেন। তোমার পীড়া বাড়িলে আমি তখনই ছুটিয়া আসিতাম। কিন্তু ডাক্তর বাবু রোজ লিখিতেন, পীড়া গুরুতর বটে, তবে কোন ভয় নাই, আসিবার আবশ্যকতা নাই। তুমি কি মনে কর যে আমি তোমায় ভুলিয়াছিলাম?”

“না—না—তা আমি কখনও মনে করি নাই, কিন্তু আমার হৃদয়ের অবস্থা তুমি বুঝিতেছ না—যেখানে আমার প্রাণের দেবতার অধিষ্ঠান সেখানে এ রুধিরস্রাবী খুনীর অবস্থান হইবে—দেবতার মন্দিরে পিশাচ বসিবে! হৃদয়ের এ তুমুল ঝড় কি ভীষণ!—যা’ক, ওসব পাপের কথায় আর দরকার নাই, কৰ্ম্মফল সকলকেই ভুগিতে হয়, আমিও ভুগিয়াছি। তবে তুমিই আমায় অন্যায় সন্দেহ করিয়াছিলে?”

“স্বীকার করি। কিন্তু এখন সে সন্দেহ একেবারে গিয়াছে। আর কখনও এই সন্দেহ-রাক্ষস যে আমার হৃদয়ে প্রবেশ করিতে পারিবে, তাহার কোন সম্ভাবনা নাই। দেখ, স্বামী ও স্ত্রী এক, অভিন্ন হৃদয়। সুখে-দুঃখে—সম্পদে বিপদে, দম্পতী অদ্বৈত। স্বামী ও স্ত্রীর পৃথক্ ধৰ্ম্ম বা চিন্তা নাই। আমি তাহা হাড়ে হাড়ে, মজ্জায় মজ্জায় বুঝিয়াছি! পরস্পরে আত্মগোপনই সংসারে দাম্পত্যে দারুণ হলাহল প্রসব করে, আর তাতে সমগ্র বিশ্ব অচিরে বিনাশ পায়। তুমি আমার পত্নী—ইহকাল পরকালের অর্দ্ধাঙ্গিনী সহধর্ম্মিনী, তোমায় সন্দেহ করে আমাদের সর্বনাশ হইতেছিল—আমার বড় সাধের সাজান সোনার সংসার একেবারে ছারেকারে যাইতে বসিয়াছিল!

“ভগবান আছেন—”

“আর পাচ হাজার কেন, আমার সমস্ত সম্পত্তি দিলেও রমেন্দ্রবাবু যদি ফিরিয়া আইসেন, আমি তাহাও করিতে প্রস্তুত আছি।”

“সে রাত্রে যাহা দেখিয়াছিলে, তাহা কি সকলকে পুলিসকে বলিবে না?”

“না—হেম, এ সব কথা বলিয়া কোনই লাভ নাই। লোকটাকে আমি অন্ধকারে দেখিতে পাই নাই। যে লোক ধরা পড়িয়াছে সেই যে রমেন্দ্রকে খুন করিয়াছিল, তাহা আমি শপথ করিয়া বলিতে পারিব না। আমি কলিকাতায় পুলিশকে সব কথা বলিয়াছি, আর এখানে সেই কথা বলিয়া কথা বাড়াইয়া কোনই লাভ নাই। যাহা আমরা জানিলাম, ইহাই যথেষ্ট। আর কাহারও জানিবার আবশ্যকতা কি!”

এই সময়ে খোকা সেইখানে ছুটিয়া আসিয়া “বাবা বাবা” বলিয়া সতীশচন্দ্রকে জড়াইয়া ধরিল। সতীশচন্দ্র তাহাকে কোলে তুলিয়া লইয়া চুম্বন করিলেন।

খোকাবাবুর পশ্চাতে পুরাণ ঝি, বাবু যে ফিরিয়া আসিয়াছেন তাহা সে জানিত না, কাজেই বিস্মিত ভাবে চাহিয়া রহিল।

হেমাঙ্গিনী বলিল, “ঝি, বাবু বলিতেছেন-“

সতীশচন্দ্র বলিলেন, “হাঁ, এখনও হেমের শরীর ভাল হয় নাই, আরও দিনকতক এখানে তাহার থাকা দরকার। যাও—জিনিষ পত্র খুলিতে বল।”

উপসংহার

আজি সতীশবাবুর গৃহে মহা সমারোহ, হেমাঙ্গিনীর ব্যধিমুক্তির প্রীতিভোজন। সতীশবাবুর মধুপুরস্থ আলাপী ও বন্ধুগণ সকলেই সস্ত্রীক তাঁহার বাড়ীতে নিমন্ত্রিত। প্রদোষে প্রীতিভোজন হইবে। ষ্টেশন- ষ্টাফের সঙ্গে তিনি কলিকাতার সেই প্রসিদ্ধ গোয়েন্দা পুলিশ মহাশয়কেও উৎসবে যোগদানের নিমিত্ত মহা সমাদরে আহ্বান করিয়াছেন। হেমাঙ্গিনী এখনও সম্পূর্ণ সুস্থ হইতে পারে নাই, রোগমুক্ত হইলেও তাহার দুর্ব্বলতা বেশ আছে। তথাপি আনন্দোচ্ছ্বাসে হেম আর শয্যাগত নহে, পিসীমা ও শুধাংশুর সঙ্গে সেও সৰ্ব্বত্র সৰ্ব্ববিষয়ে নানাবিধ উপদেশ দিতেছে। আজ তাহার প্রাণ উৎসাহপূর্ণ, হৃদয় প্রফুল্ল, সুন্দর মুখখানি শারদ চন্দ্রমার ন্যায় হাসি-সুধাময়। মাঝে মাঝে শান্তি বা ক্লান্তি বোধ করিলে এক একবার হল-ঘরে সোফায় বসিয়া বিশ্রাম করিতেছে। ক্রমে সন্ধ্যা হইল, অমনি সতীশবাবুর পূৰ্ব্ব-কৃত বন্দোবস্তমত গৃহের সর্ব্বত্র আলোকমালায় সুরঞ্জিত হইল। বস্তুতঃ গৃহখানি সাজসজ্জা ও আলোতে যেন দিব্য বৈজয়ন্ত ধামের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল, কেননা আজিকার সব আয়োজন, সতীশবাবু ও গৃহস্থিত সকলেই, প্রাণের প্রীতি ও আনন্দের অনুরূপ করিবার জন্য পূর্ব্ব হইতেই প্রাণপণে চেষ্টিত। পরিবারস্থ সকলের হৃদয়ই আনন্দময়, মুখে প্রীতির উচ্ছ্বাস। কক্ষমধ্যে সতীশবাবু হেমাঙ্গিনীকে একাকিনী দেখিয়া তাহার পার্শ্বে আসিয়া উপবিষ্ট হইলেন। তাহাকে দেখিলেই বোধ হয় সতীশবাবুর হৃদয়খানি প্রীতি-প্রফুল্ল, নেত্রদ্বয় প্রেম-পূরিত ও মুখ হাসিময়-

“আজ বড় আনন্দের দিন হেম, আমাদের যেন আজ আবার ফুলশয্যা। কিন্তু—”

“কিন্তু কি! আর কিন্তু বলোনা, আমার প্রাণের ভিতর কেমন করে উঠে। একবার এই কিন্তুর জন্য তোমার কাছে এক কথা লুকায়ে কত ভীষণ দণ্ড ভোগ করতে হোল!”

“ঠিক কথা, হেম। তোমাতে আমাতে কিছু লুকাবার নাই। লুক-চুরিই সুধাময় দাম্পত্যে মহাবিষ ঢালিয়া দেয়। আমি তা বেশ বুঝিয়াছি, প্রাণে প্রাণে উপলব্ধি করিয়াছি। আমার “কিন্তু” তা’ বলিবার অভিপ্ৰায় নহে, আমি বলিতে যাইতেছিলাম—আমাদের এই প্রীতিউৎসবে ডাক্তার রমেন্দ্রনাথ যদি উপস্থিত থাকিতেন তাহা হইলে কি সুখের হইত! রমেন্দ্রবাবু আমাদের জন্য কত করিয়াছেন—রমেন্দ্রবাবু ওরূপ নিঃস্বার্থভাবে প্রাণ দিয়া চিকিৎসা না করিলে খোকাকে কি আর ফিরিয়া পাইতাম! আর আমি ঈর্ষায় অন্ধ হয়ে তাঁর সকল কার্য্যেই নিরর্থক কত দোষ বাহির করিয়াছি, তাঁর পবিত্র হৃদয়সম্বন্ধে কত অসাধু অভিমত পোষণ করিয়াছি। আমার এই গুরুতর পাপের সমুচিত দণ্ডই ভুগিয়াছি।”

সহসা বিস্মিতি ও ভীতি বিজড়িত কণ্ঠে হেমাঙ্গিনী আর্তরব করিয়া উঠিল—’কে কে—আপনি—র—!” হেমাঙ্গিনী সোফার উপরে মুচ্ছিত হইয়া পড়িল। সতীশচন্দ্র নিতান্ত ব্যস্ত-ত্রস্ত হইয়া তাহার চোখে ও মুখে অঞ্জলি পূর্ণ করিয়া সলিল নিক্ষেপ করিতে করিতে তালবৃত্ত বীজন করিতে লাগিলেন। বস্তুতঃ হেমাঙ্গিনীর হঠাৎ এইরূপ মূৰ্চ্ছা দেখিয়া সতীশবাবু বড়ই ভীত ও বিব্রত হইয়া পড়িয়াছিলেন, অন্য কোনও দিকে তাঁহার দৃষ্টি ছিল না।

কি আশ্চর্য্য! সত্যসত্যই রমেন্দ্রবাবু কক্ষমধ্যে প্রবিষ্ট হইলেন! তিনি ধীর পাদবিক্ষেপে অগ্রসর হইয়া নাড়ী পরীক্ষার জন্য হেমাঙ্গিনীর করধারণ করিলেন। সতীশ বাবুর দৃষ্টি সহসা তাঁহার উপরে নিপতিত হইল। যুগপৎ ভীতি, বিস্ময় ও আনন্দে তাঁহার বানিষ্পত্তি হইল না।

রমেন্দ্র বাবু বুঝিতে পারিয়া বলিলেন—”আমি মরি নাই, বাঁচিয়া আছি। আজ আপনাদের এই উৎসবে যোগদানের লোভ সংবরণ করিতে না পারিয়া বরাবর চলিয়া অসিয়াছি। ব্যস্ত বা ভীত হইবেন না সতীশবাবু, ইনি এখনই সুস্থ হইবেন।”

“আপনাকে কি বলিয়া সম্বোধন করিব বুঝিতে পারিতেছি না। আমি আপনার নিকটে বড়ই অপরাধী। নিতান্ত সৌভাগ্যবলে আবার আপনাকে দেখিতে পাইলাম। ধন্য ভগবান্।”

“কিছু না সতীশবাবু। সব কেবল ভুল—আপনি ভুল করিয়াছিলেন, আমি ভুল করিয়াছিলাম, আপনার পত্নীও ভুল করিয়াছিলেন। তাই আমরা সকলেই সমুচিত ভুগিয়াছি। এখন আমাদের ভ্রম ভাঙ্গিয়াছে, আশা করি সকলেই এবার সুখী হইব।”

“আমি বিষম ভ্রমে পতিত হইয়াছিলাম তাহা বেশ বুঝিয়াছি—অস্থিতে অস্থিতে মজ্জায় মজ্জায়, উহার উপলব্ধি করিয়াছি। হেমও ভুল করিয়াছিল, বটে! কিন্তু আপনি কি ভুল করিয়াছিলেন, ডাক্তারবাবু?”

আমি কি ভুল করিয়াছিলাম? আমার এই বিষম ভুলের জন্যই ত নিরর্থক আপনাদিগকে, মধুপুর শুদ্ধ লোককে, এত কষ্ট পাইতে হইয়াছে। পশ্চাদ্দিক্ হইতে হঠাৎ একটা লাঠীর আঘাতে আমি একেবারে নিঃসংজ্ঞ প্রায় হইয়া পড়িয়াছিলাম, তারপর একটু সংবিৎ প্রাপ্ত হইয়াই আপনাকে আমার সম্মুখে দেখিয়া আমি নিতান্ত অবাক্ ও ম্রিয়মাণ হইয়া পড়িলাম, মনে হইল আপনিই আমাকে আঘাত করিয়াছেন, নতুবা আমাকে তাদৃশ অবস্থায় ফেলিয়া আপনি তৎক্ষণাৎ পলাইবেন কেন? আপনি কেন হঠাৎ এরূপ নৃশংস আচরণ করিলেন তাহা তৎক্ষণাৎ বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না। কিন্তু আপনি চলিয়া গেলে আপনার বিবাহের পূর্ব্ববর্ত্তী বৃত্তান্ত সকলই আমার মনে আসিতে লাগিল এবং আমি বেশ বুঝিলাম যে গুরুতর ঈর্ষায় অন্ধ হইয়া আপনি আমাকে হত্যা করিবার মানসে এইরূপ দারুণ যষ্টির প্রহার করিয়াছিলেন। এই ভাব মনে উদিত হইবামাত্রই সংসারের উপর অত্যন্ত বিতৃষ্ণা জন্মিল, মাৰ্জ্জনা করিবেন সতীশবাবু, আপনার উপরেও আমার অত্যন্ত ঘৃণা হইল, কেননা আমি জানি আপনি আপনার স্ত্রীকে প্রাণাপেক্ষা ভালবাসেন। যে পত্নীকে প্রাণের চাইতে ভালবাসে সে কি তাহার উপরে পরপুরুষাসক্তির সন্দেহ করিতে পারে? কারণ, প্রকৃত প্রেম ও ভালবাসায় কামসক্তি নাই, সুতরাং তাহাতে ঈর্ষা বা সন্দেহেরও স্থান নাই। আমি আপনার সম্বন্ধে বড়ই সঙ্কীর্ণ অভিমত হৃদয়ে পোষণ করিলাম।”

সতীশচন্দ্ৰ বাধা দিয়া বলিলেন—”আপনি ঠিক ধারণাই করিয়াছিলেন, ডাক্তারবাবু। আমি হেমকে পূর্ব্বে ঠিক প্রকৃত ভালবাসি নাই, কেবল তাহার রূপজ মোহে আচ্ছন্ন ছিলাম মাত্র, তাই পদে পদে ঈর্ষা, সন্দেহ, দ্বেষ আসিয়া আমাকে সময় সময় পশুরও হেয় করিয়া তুলিত। বলিতে কি ডাক্তরবাবু, দাম্পত্য কি, সহধৰ্ম্মণী কি—কিছুই আগে বুঝি নাই। কেবল ভোগ ও বাসনা পরিপূর্ত্তি লইয়াই ব্যস্ত ছিলাম। এতদিনে চোখ ফুটিয়াছে—সহধৰ্ম্মিণীকে চিনিয়াছি। বলুন, রমেন্দ্রবাবু, তারপর?

রমেন্দ্র। তারপর মনে করিলাম, আমি এক্ষণে আপনাদের আবার দেখা দিলে, আপনার ঈর্ষা এখন শুধু ক্রোধে ও হিংসায় পরিণত হইবে, আর সাধ্বী হেমাঙ্গিনীর ক্লেশ ও অশান্তির পরিসীমা থাকিবে না। তৎপরিবর্তে আমি যদি, যতদিন আপনারা মধুপুরে থাকিবেন, ততদিন কোথায়ও অন্য আপনাদের অবিদিত হইয়া থাকি, তাহা হইলে আমি আর জীবিত নাই জানিয়া আপনি নিশ্চিন্ত থাকিবেন—আপনার পত্নীরও অশান্তির কোন কারণ থাকিবে না। কিন্তু আমি পলাইয়া গিয়াছি এরূপ হইলে এখানে অনেক কথা উঠিতে পারে, এমনকি সাধ্বী হেমাঙ্গিনীর সম্বন্ধেও নানা কথা প্রচার হইতে পারে, তাহাতে শুধু অশান্তি বাড়িবে বই কমিবে না। তাই আমি পকেট হইতে মাত্র দশখানি দশ টাকার নোট লইয়াই, (আমার সঙ্গে সেদিন অনেক গুলি টাকা ছিল) আমার সমুদয় পোষাক ইত্যাদি ফেলিয়া রাখিয়া সেইখানেই পতিত একখণ্ড জীর্ণবস্ত্র পরিধান করিয়া গিরিধীর পথে অদৃশ্য হইয়া যাই।

সতীশবাবু। সে কি রকম! আপনার মৃতদেহ মধুপুর বাসী সকলেই চাক্ষুষ দেখিয়াছে—পুলিশ পরীক্ষান্তে উহা রীতিমত শ্মশানে দগ্ধ হইয়াছে?

রমেন্দ্র। তাহা হইয়াছে বটে। আশ্চর্য্য হইবেন না সতীশবাবু—এখানে কাকতাল সংযোগ ঘটিয়াছে।

 সতীশবাবু। কিরূপ? ডাক্তারবাবু একি রহস্য-যবনিকা আপনি উত্তোলিত করিতেছেন?

ঠিক এই সময়ে কলিকাতার সুবিখ্যাত গোয়েন্দা মহাশয় নিমন্ত্রণারক্ষার জন্য সেখানে উপস্থিত হইলেন। তিনি রমেন্দ্রবাবুকে দেখিবামাত্র পকেট হইতে একখানি ফটো বাহির করিয়া কিয়ৎক্ষণ তৎপ্রতি দৃষ্টিপাত করিলেন, তারপর বলিলেন—”মাপ করিবেন সতীশ বাবু, হরেন্দ্র বিশ্বাস, আমি তোমাকে দণ্ডবিধি আইনের বিধি অনুসারে বাগবাজার নিবাসীনী শ্রীমতী বিলাসিনীর হত্যাপরাধে ধৃত করিতেছি।” এই বলিয়াই তিনি রমেন্দ্রবাবুর দক্ষিণ হস্ত দৃঢ়মুষ্টিতে ধারণ করিলেন। রমেন্দ্রবাবু কোনও কথা বলিলেন না।

সতীশবাবু বিস্ময়ে অবাক্ হইয়া রহিলেন। এই সময়ে হেমাঙ্গিনীর সম্পূর্ণ জ্ঞান সঞ্চার হইল এবং প্রফুল্লবাবু প্রভৃতি অন্যান্য নিমন্ত্রিত ব্যক্তিবর্গ আসিয়া পৌঁছিলেন। এদিকে অনেকক্ষণ যাবৎ হেমাঙ্গিনী ও সতীশবাবুকে না দেখিতে পাইয়া পিসীমা ও সুধাংশু তাঁহাদের খোঁজে হল ঘরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। সকলেই সম্মুখে রমেন্দ্রবাবুকে দেখিয়া যুগপৎ ভীতি, বিস্ময় ও আনন্দে নিৰ্ব্বাক্ হইয়া রহিলেন। আবার গোয়েন্দা পুলিশ মহাশয়ের হস্তে রমেন্দ্রনাথের দক্ষিণ হস্ত সুদৃঢ় ধৃত দেখিয়া তাঁহাদের বিস্ময়ের আর সীমা রহিল না। সকলেই ব্যাপার কি জানিবার জন্য রমেন্দ্রবাবুর মুখ প্রতি সোৎসুক কৌতুহলপূর্ণ নেত্রে চাহিলেন।

রমেন্দ্রবাবু। ডিটেকটিভ বাবু ব্যস্ত হইবেন না—আপনারা এ রহস্যের কিনারায়ও আসিতে পারেন নাই। আমি যখন দেখিলাম আমারই মৃতদেহ সকলে যথারীতি সৎকার করিয়া ঘরে ফিরিল, তখন তলাইয়া দেখিবার জন্য আমার বেশ একটু আগ্রহ হইল। ঘটনা পরম্পরা বেশ রহস্যময়ই বটে। আমি পশ্চাৎ সন্ধানে জানিয়াছি, ঠিক আমারই মত চেহারার আর কে ব্যক্তির মৃতদেহ আমার পরিত্যক্ত পরিচ্ছদে সজ্জিত ঠিক আমি যেখানে পড়িয়াছিলাম, সেই খানেই আমার ভৃত্য দেখিতে পাইয়াছিল। লাসের সমুদয় মুখখানি রক্তমাখা মাটীতে লিপ্ত ছিল বলিয়া আমি কি আমার ঠিক হুবহু একাকার অপর ব্যক্তি ইহা কেহই ঠিক করিতে পারেন নাই, আর কাহারও অন্য ব্যক্তি বলিয়া আদৌ সন্দেহও হয় নাই।

সতীশ। ডাক্তারবাবু, আপনি দেখিতেছি এক অপূর্ব কাহিনীর সূচনা করিয়া তুলিয়াছেন? এরূপ ব্যাপার ত অদ্ভুত গোয়েন্দা কাহনীতেও শুনি নাই?

রমেন্দ্র। এ ঘটনা প্রকৃত হইলেও গোয়েন্দার অদ্ভুত কল্পনাময় উপন্যাসকে ছাপাইয়া গিয়াছে বটে। আমি বিশেষ অনুসন্ধানে জানিলাম, হরেন্দ্র বিশ্বাস নামক ঠিক আমারই চেহারার এক ব্যক্তি কলিকাতার বাগবাজার হইতে একটি যুবতী বিধবা সালঙ্কারা ভদ্রমহিলাকে প্রলোভিত করিয়া যামতাড়ায় আনিয়া, কিছুদিন যাবৎ স্বামী-স্ত্রীভাবে উভয়ে তথায় বাস করিতেছিল। হঠাৎ কি কারণে কলহ হওয়ায় ঠিক আমাদের ঘটনার দিনই বিশ্বাসমহাশয় সন্ধ্যাবেলা প্রণয়িণীকে হত্যা করিয়া তাহার সমুদয় গহনা ও নগদ টাকা কড়ি লইয়া পদব্রজে মধুপুরে আসিতে আসিতে মধুপুরের মাঠে এই দোষাদদের হস্তেই নিহত হন। দেষাদেরা অকুস্থানে পুনরায় আসিয়া আমাকে দেখিতে না পাইয়া সেই হরেন্দ্র বিশ্বাসকে আমার পোষাকে সজ্জিত করিয়া সেখানে রাখিয়া দেয়।

সতীশবাবু। অদ্ভুত কাহিনী! এ যে আরব্যোপন্যাসকেও অতিক্রম করিতেছে? তবে দোষাদদের এরূপ করিবার উদ্দেশ্য কি?

রমেন্দ্র। দোষাদেরা ধড়ীবাজ দস্যু—পুলিশের চোক্ষে ধুলি দিবার উদ্দেশ্যেই এরূপ করিয়াছিল। তাহারা মনে করিল আমার লাশ কেহ সরাইয়া অন্যতর লইয়া গিয়াছে, আর এই নূতন লাশ ও ঠিক আমার চেহারার, অথচ বিদেশী, ইহার হত্যাকাণ্ড কেহই জানেনা, সুতরাং আমার পোষাকে সজ্জিত করিয়া রাখিয়া দিলে কেহই অন্য ব্যক্তি বলিয়া সহজে ধরিতে পারিবে না। সুতরাং একটা খুন চাপিয়া যাইবে, আর বস্তুতঃ তাহাই হইয়াছে।

তখন গোয়েন্দা পুলিশ মহাশয় নিতান্ত লজ্জিত হইয়া রমেন্দ্রবাবুর নিকটে পুনঃ পুনঃ ক্ষমা ভিক্ষা চাহিলেন। তিনি বলিলেন, তিনি অনেক জটিল খুনের অনুসন্ধান করিয়া হত্যাকারীকে ধৃত করিয়াছেন, কিন্তু তাঁহার জীবনে এরূপ অপ্রস্তুত আর কখনও হন নাই। তিনি সেইদিন হইতে গোয়েন্দার কৰ্ম্ম ছাড়িয়া দিবেন প্রতিজ্ঞা করিলেন।

বলা বাহুল্য রমেন্দ্রবাবুকে সেদিন প্রত্যেককে পৃথক্ ভাবে অনেকবার নিজের কাহিনী বলিতে হইয়াছিল। তিনি অবশেষে সতীশবাবু ও হেমাঙ্গিনীকে নিৰ্জ্জনে তাঁহাদের সমুদয় ভুল ভাঙ্গাইয়া দিয়াছিলেন—তিনি যে সুমুদায় জানিয়াই আজ প্রীতি-ভোজের দিন সেখানে আসিয়াছেন তাহা তাঁহাদের বেশ করিয়া বুঝাইয়া দিলেন, সুতরাং সেদিনকার প্রীতি-ভোজটি সম্পূর্ণরূপে সকলের পূর্ণপ্রীতিপদ হইয়াছিল।

হেমাঙ্গিনীর যত্নে ও উৎসাহে শীঘ্রই প্রফুল্লবাবুর কন্যার সঙ্গে রমেন্দ্রনাথের শুভবিবাহ হইয়া গেল। এই বিবাহে হেমাঙ্গিনী সুশীলাকে এক ছড়া হীরার পুষ্পহার উপহার দিয়াছিলেন, তাহার মটো ছিল—’পতি বিনা রমনীর কিছু নাহি আর’। সতীশচন্দ্রও রমেন্দ্রবাবুকে এক ছড়া চেইন হার উপহার দিয়াছিলেন, তাহার মটো ছিল—অৰ্দ্ধাং ভাৰ্য্যা মনুষ্যস্য ভাৰ্য্যা শ্রেষ্ঠতমঃ সখা’। রমেন্দ্রের মাতা নবদম্পতীকে আশীর্ব্বাদ করিতে করিতে আজি মন খুলিয়া হেমাঙ্গিনীকে আশীর্ব্বাদ করিলেন—”মা তুমি পতির সহধর্মিণী হও”।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *