দশম পরিচ্ছেদ
সতীশচন্দ্র গৃহমধ্যে আসিয়াই ভিতর হইতে দ্বার রুদ্ধ করিলেন। হেমাঙ্গিনী বিস্মিত হইয়া বলিল, “দরজা বন্ধ করিলে কেন?”
সতীশচন্দ্র বজ্র-গম্ভীর স্বরে বলিলেন, “সখ্! আমার কথা শেষ হইবার পূর্ব্বে ঘর হইতে বাহির হইয়া যাইতে পারিবে না বলিয়া দরজা বন্ধ করিয়াছি। তোমার সঙ্গে আমার বিশেষ কথা আছে। বলি, আজ এই জ্যোস্না-রাত্রে প্রণয়ীর সঙ্গে ভ্রমণ বৃত্তান্তটা কিরূপ আমি শুনিতে চাহি।”
হেমাঙ্গিনী দরজার দিকে চাহিল। স্বামীর এ ভাব দেখিলে সে কোন কথা না বলিয়া অন্যান্যবার তাহার সম্মুখ হইতে সরিয়া যাইত। আজ সহসা এরূপ পিঞ্জরাবদ্ধ হইয়া আর তাহার সহ্য হইল না, সে কাঁদিয়া ফেলিল, বলিল, “কেন তুমি এ রকম করিতেছ? আমি কি কখনও তোমার কাছে কোন দোষ করিয়াছি? বিনা কারণে কেন তুমি এই সব কথা বল? কখনও কি আমার কোন দোষ পাইয়াছ?”
সতীশচন্দ্র অত্যন্ত কঠিনকণ্ঠে বলিলেন, “না, এ পর্য্যন্ত পাই নাই, তাহা স্বীকার করি। এখানে আসিবার পূর্ব্বে আমি কখনও তোমাকে সন্দেহ করি নাই। কিন্তু তুমি এখানে আসিয়া আর নিজেকে সামলাইতে পারিতেছ না দেখিতেছি। এ সব কি ব্যাপার!”
“তুমি অন্যায় বলিতেছ, আমি অন্য কাহাকেও ভালবাসি না।”
“যদি সেই প্রেমের বিদায় দৃশ্য স্বচক্ষে না দেখিতাম।”
“কোন বিদায়?”
“কোন বিদায়!—বর্ণনা করিব কি? তুমি তাহা কি জান না? চোখের জলে ভাসিতে ভাসিতে যখন তোমার সাধের প্রণয়ীকে বলিয়াছিলে যে, তুমি আমায় ভালবাস না, তাহাকেই ভালবাস, যখন সে তোমার হাত তাহার বুকে তুলিয়া লইয়াছিল, আমি কি তাহা স্বচক্ষে দেখি নাই?”
হেমাঙ্গিনীর নিশ্বাস প্রায় রুদ্ধ হইয়া গিয়াছিল, সে কোন কথা বলিতে পারিল না।
সতীশচন্দ্র বলিলেন, “এ সব স্বচক্ষে দেখিয়াও আমি তোমায় কখনও কিছু বলি নাই, কারণ আমি তোমায় সর্ব্বাপেক্ষা, নিজের প্রাণ অপেক্ষাও ভালবাসি। আমি সমস্তই প্রায় ভুলিয়া গিয়াছিলাম—আর—তুমি, হেমাঙ্গিনী—হা হতভাগিনী তুমি—”
হেমাঙ্গিনী কাতরকণ্ঠে বলিল, “ভগবানের নামে শপথ করিয়া বলিতেছি, আমি ইহা সম্পূর্ণ ভুলিয়া গিয়াছি—আমি এখন আমার ছেলেমেয়ে ও তোমায় ভিন্ন কাহাকেও জানি না। কেন তুমি এই সকল আগেকার কথা তুলিয়া আমাকে কষ্ট দাও, তোমার প্রাণে কি একটুও দয়া নাই?”
“যে দিন আমরা এখানে আসিয়াছি, সেই দিন হ’তেই সে তোমার কাছে আসিতেছে। দিনের মধ্যে একবার নয় সাতবার!”
“তোমার ছেলেকে দেখিতে। তুমি কি বিনা চিকিৎসায় বাছাকে মারিয়া ফেলিতে চাও? তিনি এখানে সৰ্ব্বদাই ডাক্তারের মত আইসেন, অন্য কোন ভাবে কখনও আইসেন নাই। তুমি কি নিজে তাহা দেখ নাই?”
“আর আজ! তোমরা দু’জনে আধ ক্রোশ পথ নিৰ্জ্জনে এক সঙ্গে আসিয়াছ! তোমাদের এ ভাব দেখিয়া আমি যে পাগলের মত হইয়াছিলাম, তাহা কি তুমি বুঝ না? তাহার পরম সৌভাগ্য যে তখন আমার সঙ্গে তাহার দেখা হয় নাই, নতুবা কি যে ঘটিত বলিতে পারি না।”
“তুমি জ্ঞানী, বিবেচক। ছিঃ, তোমার কি এরূপ কথা ভাল? তিনি এখানে কখনও কোন অসম্মানের কথা বলেন নাই। তিনিও শিক্ষিত। তিনি কি জানেন না যে, আমি এখন অপরের স্ত্রী, ছেলেমেয়ের মা!”
সতীশচন্দ্র কি উন্মত্ত হইয়াছেন? সম্পূর্ণ না হইলেও কতকটা উন্মত্তই বটে। তিনি কাঁদিয়া ফেলিলেন, একেবারে বালকের মত হেমাঙ্গিনীকে উভয় বাহুবেষ্টনে বুকে চাপিয়া ধরিয়া তিনি ব্যাকুল হইয়া কাঁদিতে লাগিলেন।
হেমাঙ্গিনী তাঁহার ভাব দেখিয়া ভীতা হইল। সে তাহার স্বামীর এ ভাব আর কখনও দেখে নাই। সে প্রথমতঃ এতই রুষ্ট হইয়াছিল যে, স্বামীর নিকট হইতে চলিয়া যাইবার উপক্রম করিতেছিল কিন্তু এক্ষণে তাঁহার এ ভাব দেখিয়া সে তাহাকে ছাড়িয়া যাইতে পারিল না, তাহাকে শান্ত করিবার জন্য চেষ্টা পাইতে লাগিল। সান্ত্বনা দিবে কি, স্বামীকে কাঁদিতে দেখিয়া হেমাঙ্গিনী নিজেও কাঁদিয়া ফেলিল।
তখন সতীশচন্দ্র স্ত্রীর প্রতি যে সন্দেহ করিয়াছিলেন, তাহার জন্য মনে মনে অত্যন্ত লজ্জিত হইলেন। তাঁহার স্ত্রীর কথায় তাঁহার বিশ্বাস জন্মিল, তিনি প্রকৃতিস্থ হইলেন, চক্ষের জল মুছিয়া একটি প্রগাঢ় দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া শয্যার উপর হেলিয়া পড়িলেন।
পরদিবস রমেন্দ্রনাথ খোকাকে দেখিতে আসিলে সতীশচন্দ্র তাঁহার হস্ত-বিলোড়ন করিলেন, তাঁহাকে সমাদরে বসিতে বলিলেন। তিনি ইতিপূর্ব্বে এ কাজ আদৌ করেন নাই।
একাদশ পরিচ্ছেদ
ঈর্ষা ভীষণা কাল-সৰ্পী। সে কোনক্রমে একবার হৃদয়-গহ্বরে স্থান পাইলে, কে তাহাকে আর দল করিতে, এমন কি, সম্পূর্ণ দমন করিতে সক্ষম হয়? একটু সুবিধা পাইলেই সে মাথা তুলিয়া দং করিতে চেষ্টা করে। সতীশচন্দ্রেরও তাহাই হইল। তিনি ঈর্ষাকে হৃদয় হইতে তাড়াইতে পারেন নাই, তবে দমন করিয়াছিলেন বটে, কিন্তু উহা সাময়িক মাত্র, সমান্য সুযোগ পাইবামাত্র সে আবার তাঁহার ভীষণ ফণা উত্তোলিত করিল।
রমেন্দ্র ও তাঁহার স্ত্রীর সকল কার্য্যেই তিনি এখন বিনা কারণে সন্দেহ করিতে লাগিলেন। তিনি তাঁহার স্ত্রীকে আর কোন কথা বলিলেন না বটে, কিন্তু রমেন্দ্র তাঁহার স্ত্রীর সহিত, এমন কি, তাঁহার ছেলের সম্বন্ধে কথা কহিলেও তিনি মনে মনে ঈর্ষায় উন্মত্ত-প্রায় হইতেন। ক্রমেই তাঁহার মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মিতে লাগিল যে তাঁহার স্ত্রী তাঁহার চোখে ধূলি নিক্ষেপ করিয়া রমেন্দ্রের সহিত নিভৃতে মিশিতেছে। যে কখনও ঈর্ষার বিষম জ্বালা সহ্য না করিয়াছে, সে কোনক্রমে সতীশচন্দ্রের হৃদয়ের এই নরক-যন্ত্রণা উপলব্ধি করিতে পারিবে না। ফলতঃ সতীশচন্দ্র কেমন এক রকম হইয়া গেলেন—না উন্মাদ, না প্রকৃতিস্থ।
এদিকে খোকা দিন দিন ভাল হইয়া উঠিতে লাগিল, কাজেই রমেন্দ্রবাবুও এখন খুব কদাচ সতীশচন্দ্রের বাড়ীতে আসিতেন, কেননা ছেলে প্রায় ভাল হইয়াছে, এখন আর তাহাকে প্রত্যহ দেখিবার আবশ্যকতা ছিল না।
অবশেষে খোকা সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করিলে রমেন্দ্রনাথ একদিন হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “এখন আর আমার এখানে কোন কাজ নাই, এখন আমি বিদায় লইতে পারি।”
রমেন্দ্র চলিয়া গেলে সতীশন্দ্র অন্যমনস্ক ভাবে বলিলেন, “এত দিনে তবে বিদায় হইল।”
হেমাঙ্গিনী বলিল “হাঁ, বিল পাঠাইতে বলিয়া দিয়াছি।”
সে দিন সোমবার। মঙ্গলবার সতীশচন্দ্র আহারাদির পর বলিলেন, “এ পর্যন্ত ছেলের অসুখের জন্য এখানকার কিছুই দেখি নাই, আজ একবার দেখিয়া আসি।”
ছেলের জন্য যত না হউক, নিজের জন্য বটে, তিনি বাটীর বাহিরে অধিকক্ষণ থাকিতে পারিতেন না, কারণ স্ত্রীর উপর ঘোরতর সন্দেহ। আজ রমেন্দ্র বিদায় হইয়া গিয়াছে জানিয়া তিনি কতকটা নিশ্চিন্ত হইয়াছিলেন, সেই সাহসে আহারাদির পরেই বেড়াইতে বাহির হইলেন।
তিনি কেন অধিকক্ষণ বাড়ী ছাড়িয়া থাকেন না, তাহা হেমাঙ্গিনী বেশ বুঝিতে পারিত, কিন্তু সে তাহার মনের কথা মনেই রাখিত, কখনও প্রকাশ করিত না।
পরদিনও সতীশচন্দ্র আহারাদির পরেই বাহির হইয়া গেলেন।
আজ বৈকালের গাড়ীতে সতীশচন্দ্রের পিসীমা তাঁহার পুত্র সুধাংশুকে সঙ্গে করিয়া তাঁহাদের বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তিনি যে আসিবেন তাহা পূর্ব্বে লিখেন নাই, কাজেই সতীশচন্দ্ৰ তাঁহার আগমন বার্তা জানিতেন না।
সন্ধ্যা হইয়া গেল, তবুও সতীশচন্দ্র ফিরিলেন না। এই সময়ে হেমাঙ্গিনী বাহিরে কাহার পদশব্দে চমকিত হইয়া উঠিল, মনে মনে বলিল, “এই তিনি আসিয়াছেন। পিসীমা আসিয়াছেন শুনিয়া নিশ্চয়ই ভারি আশ্চৰ্য্য হইবেন।”
কিন্তু সতীশচন্দ্র আসিলেন না, আসিলেন রমেন্দ্রনাথ।”
আবার রমেন্দ্র। হেমাঙ্গিনীর প্রাণ কাঁপিয়া উঠিল। সতীশচন্দ্রের অনুপস্থিতিতে রমেন্দ্র! রমেন্দ্র আর আসিবেন না বলিয়া গেলেন, আবার আসিয়াছেন! এখন সতীশচন্দ্র ফিরিয়া আসিয়া তাহাকে রমেন্দ্রের সঙ্গে দেখিলে কি মনে করিবেন! হেমাঙ্গিনীর নয়নে সন্ধ্যার তরল অন্ধকার অমাবস্যার নিশীথের নিবিড় অন্ধকারে পরিণত হইল। তাহার বক্ষঃস্থল অত্যন্ত কাঁপিতে লাগিল, সে অতি কষ্টে আত্মসংযম করিয়া রহিল।
রমেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিলেন, “খোকা কেমন আছে?”
হেমাঙ্গিনী বলিল, “বেশ আছে। আপনি সেদিন বলিয়াছিলেন, আপনার আর আসিবার আবশ্যক হইবে না?”
রমেন্দ্র কহিল, “হাঁ, আর তাহাকে দেখিবার আবশ্যক নাই। এই পথে যাইতেছিলাম, তাই একবার মনে করিলাম, তাহার খবরটা লইয়া যাই। আজ কি কুয়াসাই হইয়াছে! এখানে মধ্যে মধ্যে শীতকালে এমনই কুয়াসা হয়, রাত্রে এখন একহাত দূরের লোক দেখিবার উপায় নাই।”
তিনি একখানা চেয়ার টানিয়া লইয়া হেমাঙ্গিনীর নিকট বসিলেন। এক্ষণে তাঁহার মনে পূর্ব্বের কোন ভাবই আর ছিল না, তিনি সতীশচন্দ্রের মনের ভাবও জানিতেন না, কাজেই তাঁহার মনে কোন সন্দেহও ছিল না। যেমন দশ জনের সহিত ব্যবহার করিতেন, রমেন্দ্রনাথ হেমাঙ্গিনীর সহিতও সেইরূপ ব্যবহার করিতেন। তিনি এখন তাহাকে পূর্ব্বপরিচিতা বন্ধুর ন্যায় বিবেচনা করিতেছিলেন। কিন্তু তিনি এইরূপ ভাবে উপবিষ্ট হইলে হেমাঙ্গিনীর বক্ষঃ আরও কাঁপিতে লাগিল। যদি এই সময়ে সতীশচন্দ্র ফিরিয়া আসেন, তাহা হইলে তিনি কি বলিবেন, তিনি কি ভাবিবেন!
সে রুদ্ধ কণ্ঠে বলিল, “খোকাকে একবার দেখিবেন না?”
হেমাঙ্গিনীর ইচ্ছা রমেন্দ্রনাথ যত শীঘ্র সম্ভব বিদায় হয়েন, কিন্তু রমেন্দ্র আজ এত শীঘ্র বিদায় হইবার ইচ্ছা করেন নাই। তিনি বলিলেন, “পরে দেখিব।”
হেমাঙ্গিনী উঠিয়া দাঁড়াইয়াছিল। রমেন্দ্রনাথ হেমাঙ্গিনীকে বলিলেন, “বসুন, আপনার সঙ্গে একটা কথা আছে।”
হেমাঙ্গিনীর মাথা ঘুরিতে লাগিল, সে কোন কথা কহিতে পারিল না, নীরবে তাহার সম্মুখে বসিল। এক নিমেষে তাহার আপাদ-মস্তক স্বেদাক্ত হইয়া গেল।
রমেন্দ্রনাথ বলিলেন, “আমি একটী গোপনীয় বিষয়ে কাহারও পরামর্শ লইতে চাহি। আমি জানি আপনি অতি বুদ্ধিমতী, আপনার পরামর্শ আমি অন্য সকলের চাইতে অ িকতর মূল্যবান্ মনে করি, তাই আমার নিজের একটি গুরুতর বিষয়ে আপনার পরামর্শ জিজ্ঞাসা করিতে চাই।”
হেমাঙ্গিনীর কণ্ঠ হইতে কোন কথা বাহির হইল না, সে প্রাণহীন পাষাণের মত বসিয়া রহিল।
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
কথা কহিবার চেষ্টা পাইয়াও হেমাঙ্গিনী কোন কথা কহিতে পারিল না, তাহার সমস্ত শরীর এতই কাঁপিতেছিল যে তাহার বুক যেন ফাটিয়া যায়। রমেন্দ্রনাথ কি বলিতে চাহে—তাহার সহিত কি পরামর্শ? এই সময়ে যদি স্বামী আসিয়া পড়েন!
সে কোন কথা কহিল না দেখিয়া রমেন্দ্রনাথ বলিলেন, “আপনি তো প্রফুল্ল বাবুর মেয়েকে দেখিয়াছেন?”
“হাঁ, দেখিয়াছি, বেশ মেয়ে।”
“বেশ ভাল মেয়ে?”
“হাঁ, খুব শান্ত প্রকৃতি, বেশ দেখিতে, লেখাপড়াও বেশ শিখিয়াছে। কেন, তাহার কথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন কেন?”
“তাহার বিবাহের জন্য।”
“কেন, আপনি কি তাহার সম্বন্ধ করিতেছেন?”
“সম্বন্ধ করিতেছি ঠিক নহে, নিজেই তাহাকে বিবাহ করিব স্থির করিতেছি।”
হেমাঙ্গিনী বিস্মিতভাবে তাঁহার মুখের দিকে চাহিল। ক্ষণপরে বলিল, “সুশীলা বেশ ভাল মেয়ে।”
রমেন্দ্রনাথ মৃদুহাস্যে কহিল, “তবে তাহাকে বিবাহ করা যায়? প্রফুল্ল বাবু এ প্রস্তাব করিয়াছেন।”
হেমাঙ্গিনী কহিল, “আমি শুনিয়া যথার্থই সুখী হইলাম।”
এ কথা হেমাঙ্গিনী মিথ্যা বলে নাই, কেননা রমেন্দ্রনাথ বিবাহ করিয়া সুখী হইলে, হেমাঙ্গিনী সত্যই অতিশয় সুখী হয়।
এই সময়ে জানালায় অন্ধকারে কাহার মুখ বাহির হইল! সে মুখের ভাব অত্যন্ত ভায়াবহ—তাহার বিস্ফারিত চক্ষু হইতে অগ্নি ছুটিতেছে, মাথার চুলগুলাও অত্যন্ত অপরিষ্কার, ওষ্ঠাধর অত্যন্ত বক্র, কি ভীষণ চেহারা! এ কে—একি মানুষের মুখ না কোন প্ৰেত!
হেমাঙ্গিনী বা রমেন্দ্রনাথ এ বিভিীষিকা দেখিতে পাইলেন না, তবে এই মূর্ত্তির কণ্ঠ হইতে তখন যে এক অৰ্দ্ধস্ফুট শব্দ নির্গত হইল, তাহারা উভয়ে তাহা শুনিয়া চমকিত হইয়া জানালার দিকে চাহিলেন। কেহ কিছু তথায় দেখিতে পাইলেন না।
হেমাঙ্গিনী জিজ্ঞাসিল, “এ কিসের শব্দ?”
রমেন্দ্রনাথ বলিলেন, “যে কুয়াসা আর অন্ধকার, কেহ বোধ হয় পথে হোঁচট খাইয়া পড়িয়া গিয়াছে। চলুন, খোকাকে একবার দেখিয়া যাই।”
উভয়ে খোকাকে গিয়া দেখিলেন।
রমেন্দ্রনাথ বাহিরে আসিয়া সেই সূচিভেদ্য অন্ধকার ও কুয়াসা দেখিয়া হাসিয়া বলিলেন, “আশা করি বিপদ আপদ ঘটিবে না, নিরাপদে বাড়ী পৌঁছিতে পারিব।”
রমেন্দ্রনাথ প্রস্থান করিলেন। কিন্তু তখনও সতীশচন্দ্র ফিরিলেন না।
এই ভীষণ অঞ্জন-প্রগাঢ় অন্ধকারে পথে তাহার কোন বিপদ আপদ ঘটিল না তো? যতই সতীশচন্দ্রের ফিরিতে দেরী হইতে লাগিল, ততই হেমাঙ্গিনী আরও অধীর ও উৎকণ্ঠিত হইয়া উঠিতে লাগিল।
ক্রমে এইরূপে প্রায় দুইঘণ্টা অতীত হইল, তখন সে আর নিশ্চিন্ত থাকিতে পারিল না। চাকরদিগকে লণ্ঠন লইয়া বাবুর সন্ধানে যাইবার জন্য আজ্ঞা করিল। কিন্তু এই সময়ে দ্রুতপদে বাটীর পশ্চাৎদিক্কার দরজা দিয়া সতীশচন্দ্র বাটীর ভিতর প্রবেশ করিলেন। তিনি কাহাকেও কিছু না বলিয়া অন্ধকারে নিজ শয়নকক্ষে প্রবেশ করিয়া দরজা বন্ধ করিয়া দিলেন।
তাঁহার এই কার্য্যে হেমাঙ্গিনী অত্যন্ত বিস্মিত হইল, তিনি তো কখনও এরূপ করেন না। সমস্ত দিনের পর এই ভীষণ কুয়াসা মধ্যে এতরাত্রে বাড়ী ফিরিয়া কাহারও সহিত কোন কথা না কহিয়া একেবারে ঘরে গিয়া দরজা বন্ধ করিলেন কেন? হয় ত আবার তাঁহার মনে সেই ভাব আসিয়াছে। সৌভাগ্যের বিষয় তিনি রমেন্দ্রকে এখানে দেখেন নাই, নতুবা হয় ত একটা বিষম অনর্থ ঘটিত।
হেমাঙ্গিনীর হৃদয়মধ্যে এক অজ্ঞাত প্রচণ্ড দুশ্চিন্তা-ঝটিকা বহিতে লাগিল, তাহার চিন্তাশক্তিতে নিদারুণ বিশৃঙ্খলা ঘটিল, সে ফিরিয়া আসিয়া শূন্যদৃষ্টিতে অন্য গৃহে বসিল। তাহার মুখখানি কলামাত্রাবশিষ্ট চন্দ্রের ন্যায় একান্ত ম্লান ও বিষণ্ণ হইয়া পড়িল।
কিয়ৎক্ষণ পরে সতীশচন্দ্র বাহির হইয়া আসিলেন। হেমাঙ্গিনী দেখিল, তিনি কাপড় ছাড়িয়া অন্য কাপড় পরিয়াছেন। ঘর হইতে বাহির হইয়াও তিনি কোন কথা কহিলেন না। বেশ রাত্রি হইয়াছিল, হেমাঙ্গিনী আহারের কথা কহিল, তাহাতেও তিনি কথা কহিলেন না। তাঁহার ভাব দেখিয়া হেমাঙ্গিনীর ভয় হইল। সে আবার জিজ্ঞাসা করিল, “এই কুয়াসার মধ্যে এত রাত্রি পর্য্যন্ত কোথায় ছিলে?”
এবার জড়িতকণ্ঠে সতীশচন্দ্র উত্তর করিলেন, “অন্ধকারে পথ ভুলিয়া অন্য দিকে গিয়া পড়িয়াছিলাম।”
“খাইবে না?”
“না—খাইয়াছি।”
“কোথায় খাইলে?”
“প্রফুল্ল বাবুর বাড়ীতে।”
সতীশচন্দ্র বাড়ীতে ফিরিয়াছেন শুনিয়া পিসীমা এই সময়ে ছুটিয়া আসিলেন। বাধ্য হইয়া সতীশচন্দ্ৰ তাঁহার সহিত নানা বাজে কথা কহিতে লাগিলেন। পিতার কণ্ঠস্বর শুনিয়া খোকাও তথায় ছুটিয়া অসিল, সতীশচন্দ্রের কণ্ঠস্বরে তাহার ঘুম ভাঙ্গিয়া গিয়াছিল।
পিসীমা বলিলেন, “এ জায়গা খুব ভাল, অন্য জায়গায় খোকার এত বড় ব্যারামটা হ’লে না জানি কত রোগা হয়ে যেতো।”
খোকা বলিয়া উঠিল, “আমি রোগা হ’ব কেন? ডাক্তার বাবু বলিলেন, আমি যে ভাল ছেলের মত তার ওষুধ খেয়েছি, একবারও কাঁদিনি।”
সতীশচন্দ্র ক্ষিপ্রবেগে মস্তক তুলিলেন, বলিলেন, “কখন ডাক্তার বাবু এ কথা বলিলেন?”
খোকা বলিল, “এই যে আজ সন্ধ্যার সময়। মা তাঁকে সঙ্গে করে আমায় দেখাতে নিয়ে এসেছিলেন।”
ক্ষিপ্ত ব্যাঘ্রের ন্যায় সতীশচন্দ্র নিজ স্ত্রীর দিকে ফিরিলেন এবং তাহার তীক্ষ্ণদৃষ্টি দ্বারা যেন হেমাঙ্গিনীকে বিদ্ধ করিয়াই বলিলেন, “আজ রমেন্দ্র আবার আসিয়াছিল?”
হেমাঙ্গিনী সহস্ৰ চেষ্টায়ও স্বর সংযত করিতে পারিল না, তাহার স্বর কম্পিত হইল; সে বলিল, “হাঁ, আজ সন্ধ্যার পর আসিয়াছিলেন।”
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
সতীশচন্দ্র আরাম কেদারায় গিয়া হেলান দিয়া বসিলেন, কোন কথা কহিলেন না। ক্ষণকালপরে হেমাঙ্গিনীকে বলিলেন, “তুমি বলিয়াছিলে, সে আর আসিবে না?”
হেমাঙ্গিনী ব্যথিত হৃদয়ে বলিল, “তিনি তাহাই বলিয়াছিলেন। তিনি আসিলে আমিও সে কথা বলিয়াছিলাম। তিনি বলিলেন, এই পথে যাইতেছিলাম, তাই খোকার খবর লইয়া যাইব ভাবিলাম, তাহার পর একটা খবর দেওয়ারও ছিল, শুনিবে কি?”
এই সময়ে সতীশচন্দ্রের খানসামা সেই গৃহমধ্যে হাঁপাইতে হাঁপাইতে প্রবেশ করিল। সতীশচন্দ্র বিরক্তভাবে বলিলেন, “বেটা, কাঁপিতেছিস কেন? কোথায় গিয়াছিলি, দূর করিয়া দেব জাননা?”
ভৃত্য ব্যাকুল হইয়া বলিল, “বাবু—বাবু—ভয়ানক—ভয়ানক—“
সতীশচন্দ্র উঠিয়া বসিয়া ধম্কাইয়া বলিলেন, “বেটা পাজী, ভয়ানক কী?”
“খুন—হুজুর—খুন।“
পিসীমা ও হেমাঙ্গিনী এই কথায় ভীত হইয়া উঠিলেন। দাস-দাসীরাও ভয়ে কাঁপিতে লাগিল। কিন্তু সতীশচন্দ্র বড় বিচলিত হইলেন না। তিনি আরাম কেদারায় ঠেসান দিয়া গম্ভীর মুখে প্রশ্ন করিলেন, “খুন! কোথায় খুন হইয়াছে?”
“হুজুর—রেলের মাঠে।”
“কিরকম?”
“একজন মাড়োয়ারী দোকানদার অনেক টাকা লইয়া গরুর গাড়ী করিয়া আসিতেছিল, কে তাহাকে খুন করিয়া সব টাকা কড়ি লইয়া পালিয়েছে। সমস্ত মধুপুরে হৈ চৈ পড়িয়া গিয়াছে।”
“দূর হ বেটা—গাঁজাখোর কোথাকার!”
খানসামা প্রভুর ধমক খাইয়া পালাইল। সতীশচন্দ্রর অর্দ্ধশায়িত অবস্থায় চক্ষু মুদ্রিত করিয়া বলিলেন, “লোকে দুই এক ঘণ্টার মধ্যে একটা বিষয় কি রকম বাড়াইয়া ফেলে দেখ। খুনের ব্যাপার সত্য বটে, কিন্তু ইহাত মাড়োয়ারী নেই, গরুর গাড়ী নেই, টাকা চুরি নেই, অথচ ইহার মধ্যে লোকে এই সব রটাইয়া তুলিয়াছে।”
পিসীমা বলিয়া উঠিলেন, “তাহা হইলে তুমি এ কথা আগেই শুনিয়াছিলে?”
“হাঁ, বাড়ীতে ফিরিবার আগেই শুনিয়াছিলাম।”
হেমাঙ্গিনী বলিল, “কই! তুমি তো এতক্ষণ কিছু বল নাই?”
সতীশ কহিল, “খুনের কথা আর কি বলিব।”
হেমাঙ্গিনী সভয়ে জিজ্ঞাসিল, “কে খুন হইয়াছে, শুনিয়াছ কি?”
“হাঁ, শুনিয়াছি।”
“আমাদের চেনা কেউ?”
“হাঁ, ডাক্তার রমেন্দ্র! তাঁহার বাড়ীর সম্মুখে দরজার পাশেই কে তাহাকে খুন করিয়া গিয়াছে।”
এই দারুণ ভয়াবহ সংবাদে হেমাঙ্গিনীর মনের যে অবস্থা হইল তাহা বর্ণনাতীত তাহার মুখমণ্ডল একেবারে নীরক্ত, বিবর্ণ হইয়া গেল, নিশ্বাস-বায়ুও নিরুদ্ধ হইয়া আসিল। কি ভয়ানক! এই সন্ধ্যার সময়েই রমেন্দ্র তাহার নিকটে বসিয়াছিলেন, এই কিছু কাল পূর্ব্বে তিনি তাঁহার বিবাহের কথা বলিতেছিলেন, আর সেই রমেন্দ্র আর নাই—ইহ জগতে নাই, খুন হইয়াছেন!
এক পলকে হেমাঙ্গিনীর মস্তিষ্কের মধ্যে শত চিন্তা, শত বিভীষিকা ঝটিকাবিক্ষিপ্ত উত্তাল তরঙ্গ- ভঙ্গের ন্যায় উদ্বেলিত হইয়া উঠিল, তাহার স্থির চিন্তা করিবার ক্ষমতা সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হইয়া গেল।
পিসীমা বলিলেন, “এ’ ডাক্তার কে?”
হেমাঙ্গিনীর কথা কহিবার ক্ষমতা ছিল না। সতীশচন্দ্র বলিলেন, “এখানকার ডাক্তার, খোকাকে তিনিই দেখিয়াছিলেন। আমি জানিতাম, তিনি আর আমার বাড়ীতে আসেন না। বোধ হয়, এখান হইতে বাড়ীতে ফিরিবার সময়ে কেহ তাঁহাকে খুন করিয়াছে। বেশ লোক ছিলেন।”
পিসীমা আশ্চৰ্য্য হইয়া বলিলেন, “এমন লোককে এমন করে কে খুন করিল?”
সংক্ষেপে সতীশচন্দ্র উত্তর করিলেন, “কেমন করিয়া বলিব, পিসীমা?”
পিসীমা জিজ্ঞাসিলেন—”তুমি কা’র কাছে শুনিলে?”
সতীশচন্দ্র কহিল, “এ সব খবর শীঘ্র চারিদিকে ছড়াইয়া পড়ে। যখন বাড়ীতে আসিতেছিলাম, সেই সময় দেখি পথে দু’টো লোক ভারি ব্যস্ত সমস্ত হইয়া কি বলাবলি করিতে করিতে ছুটিতেছে, তাই তাহাদের জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, তাহারাই ডাক্তারের কথা বলিল।”“
পিসীমা কহিলেন, “কিন্তু আমাদের খানসামা শুনিয়াছে যে একজন মাড়োয়ারী খুন হইয়াছে? হয় ত ডাক্তারের কথা মিথ্যা।”
সতীশচন্দ্র সংক্ষেপে “তাই হবে,” বলিয়া সেই আরাম কেদারায়ই নিষ্ক্রিত হইয়া পড়িলেন, পিসীমার সঙ্গে কে আসিয়াছে, তাহা পৰ্য্যন্ত তিনি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিতে ভুলিয়া গেলেন।
ক্রমে দাসদাসীগণ সকলে ঘুমাইয়া পড়িল। সতীশচন্দ্র চেয়ারেই ঘুমাইতেছেন দেখিয়া হেমাঙ্গিনী তাঁহাকে সেইখানে রাখিয়া শয়ন করিতে যাইতে পারিল না। সে সেই ঘরে বসিয়া পিসীমার সঙ্গে কথা কহিতে লাগিল।
রাত্রি প্রায় বারটার সময় কে সবলে সম্মুখ দরজায় ঘা দিল। উভয়েই চমকিত হইয়া উঠিলেন—এত রাত্রে কে? বিশেষতঃ তাহারা আজ হত্যাকাণ্ডের কথা শুনিয়াছিলেন, সামান্য কারণেই অতিশয় ভীত হইয়া উঠিতেছিলেন।
সুধাংশু পিসীমাকে সতীশচন্দ্রের বাড়ীতে রাখিয়া তখনই কাকার সহিত দেখা করিবার জন্য গিরিধী চলিয়া গিয়াছিল। কাকার নিকটে তাহার দুই একদিন থাকিবার কথা সুতরাং সে ত ফিরিবে না। তবে এত রাত্রে দরজায় এত জোরে ধাক্কা মারিতেছে কে! সেই শব্দে সতীশচন্দ্ৰ নিদ্রাত্যাগ করিয়া উঠিয়া বসিলেন।
চতুৰ্দ্দশ পরিচ্ছেদ
বহির্দ্বারে বারংবার আঘাতের ভয়ানক শব্দ উত্থিত হওয়ায় ভৃত্যদিগেরও ঘুম ভাঙিয়া গেল। তখন একজন গিয়া দরজা খুলিয়া দিল, তৎক্ষণাৎ সুধাংশু আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহাকে দেখিয়া তাহার জননী বলিয়া উঠিলেন, “তুই! এর মধ্যে ফিরিলি যে?”
সুধাংশু বলিল, “কাকাবাবু গিরিধীতে নাই, মফস্বলে চলিয়া গিয়াছেন, সাত-আট দিন ফিরিবে ন না, তাই আমি পরের গাড়ীতেই ফিরিয়া আসিলাম। সেখানে কাহার কাছে থাকিব?”
সতীশচন্দ্র এখন বুঝিলেন যে পিসীমা একা আসেন নাই—আসাও অসম্ভব, নিশ্চয়ই তাঁহার সঙ্গে সুধাংশু আসিয়াছে; কিন্তু তাঁহার মন অন্য বিষয়ে এতই অভিভূত ছিল যে তিনি এ সকল কথা ভাবিবারও বিন্দুমাত্র সময় পান নাই। এক্ষণে একটা কিছু কথা তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করা উচিত বিবেচনা করিয়া বলিলেন, “তুই এই অন্ধকারে কেমন করে পথ দেখিয়া আসিলি?”
সুধাংশু বলিল, “গিরিধী হইতে যখন বাহির হই, তখন এখানে যে এমন কুয়াসার অন্ধকার হইবে, তাহা কেমন করিয়া জানিব? তবে এখানে ষ্টেশনে নেমে বড় কষ্ট পাইতে হয় নাই।
সতীশচন্দ্র জিজ্ঞাসিলেন, “কেন, কি হইয়াছিল?”
“অনেক লোক লণ্ঠন হাতে পথে ছুটাছুটি করছে, তাহাদের লণ্ঠনের আলোয় আমার বেশ সুবিধা হইয়া গেল।”
পিসীমা বলিলেন, “তুই এত রাত্রে দরজা এমন করে ঠেছিলি যে আমরা ভয়ে মরি!”
“কেন, এত ভয় কিসের?”
“খুন!”
“কোথায়?”
“এই মধুপুরের কোথায়।”
“ওঃ—তাই বুঝি লোকগুল লণ্ঠন নিয়ে চারিদিকে ছুটিতেছিল! বটে—তা ভাবি নি। সতীশ দা, কে খুন হয়েছে?”
সতীশচন্দ্র বলিলেন, “একজন ডাক্তার!”
বিস্ফারিত করিয়া শুধাংশু বলিল, “কি ভায়ানক!”
পিসীমা বলিলেন, “তিনি খোকাকে দেখিতেছিলেন,—আজ সন্ধ্যার সময়ও এখানে আসিয়াছিলেন।”
সুধাংশু। তিনি খুন হইয়াছেন?
পিসীমা। হাঁ, আজ সন্ধ্যার সময় তিনি এখানে আসিয়াছিলেন। হেম, রমেন্দ্র বাবু এখান থেকে কটার সময় গিয়েছিলেন?
সু। রমেন্দ্র বাবু—ডাক্তার রমেন্দ্র বাবু—আমাদের রমেন্দ্র বাবু নয় তো?
সুধাংশু হেমাঙ্গিনীর দিকে চাহিল। পিসীমা বলিলেন “আমাদের রমেন্দ্র বাবু, সে কি!”
সু।বউ দিদি তা জানে। কলকাতায় বউ দিদির সঙ্গে তার আলাপ ছিল—আমাকে তিনি ভারি যত্ন করিতেন—তিনিই কি?
সতীশচন্দ্র গম্ভীর ভাবে বলিলেন, “হাঁ, সেই রমেন্দ্রবাবু!”
সু। সেই রমেন্দ্র বাবু! যিনি কলিকাতায় আমায় এত যত্ন করিতেন! কি ভয়ানক!
স। হাঁ, তিনিই। তিনি এখানে ডাক্তারি করিতেন।
সুধাংশুর মুখ নিতান্ত বিষণ্ণ হইল, সে যথার্থই এক সময়ে রমেন্দ্রনাথকে বড়ই ভালবাসিত। সে বলিল, “বউ দিদি, রমেন্দ্র বাবু এখানে আছেন, তুমি আমাকে লেখ নাই কেন? তাহা হইলে তিনি খুন হইবার আগেই আমি এখানে আসিয়া পৌঁছিতাম।”
পিসীমা বলিলেন, “তিনি খুন হবেন, তা কে আগে জানতো!”
সু। তিনি বড় ভাল লোক ছিলেন, আমায় ভারি যত্ন করিতেন।
পি। খুব ভাল লোক ছিলেন?
সু। বউ দিদিকে জিজ্ঞাসা কর। দাদার সঙ্গে বউ দিদির বে’হলো, না হলে রমেন্দ্রবাবুর সঙ্গেই হতো; আমি তখন ছেলে মানুষ ছিলাম—কিন্তু সব বুঝিতাম, বউ দিদি, রাগ কর না।
পিসীমা পুত্রের মুখ হইতে এই কথা শুনিবামাত্র তাঁহার মনে পূর্ব্বকথা উদিত হইল। তিনি রমেন্দ্র ও হেমাঙ্গিনীর ভালবাসার কথা শুনিয়াছিলেন। তিনি শুনিয়াছিলেন যে রমেন্দ্র হেমাঙ্গিনীকে ভালবাসিতেন, আর হেমাঙ্গিনীও তাঁহাকে ভালবাসিত। কেবল রমেন্দ্র গরীব বলিয়া হেমাঙ্গিনী তাঁহাকে বিবাহ করেন নাই। তবে সেই রমেন্দ্র আর এখানকার এই রমেন্দ্র দুই এক লোক! পিসীমার মনে যে কথা উদিত হইল, তাহা ভাবিতেও তিনি ভীতা হইলেন। অনেক রাত্রি হইয়াছিল। তাঁহারা সে দিনের মত সকলে শয়ন করিতে গেলেন।