সহদেবের তাজমহল – মতি নন্দী – উপন্যাস
এক
এখনও পর্যন্ত সহদেব তাজমহল দেখেনি।
কিন্তু বছর বাইশ আগে সে একটা বড়ো গল্প লিখেছিল, যাতে তার নায়ক নায়িকার মধ্যে প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল তাজমহলের চত্বরে। তখন তার বয়স প্রায় কুড়ি। প্রি. ইউ. থেকে বিএ ক্লাসে বসছে।
কলেজের ম্যাগাজিনে দেবার জন্য গল্পটা লিখেছিল। যথেষ্ট বড়ো হয়ে যাওয়ায় ওরা নিতে রাজি হয়নি। ছাত্র সম্পাদক বলেছিল, একটা লেখাই যদি অর্ধেক ম্যাগাজিন খেয়ে নেয় তাহলে অনেকের লেখা বাতিল করতে হবে। তারা তখন তাকেই খেয়ে ফেলবে।
সহদেব অতঃপর গল্পটি মাসিক ‘সাহিত্য ভারতী’ পত্রিকায় দিয়ে এসে প্রতি দুই সপ্তাহ অন্তর খবর নিতে শুরু করে। তিনমাস পর প্রবীণ সম্পাদক তাকে নিজের কামরায় বসিয়ে কোনো ভণিতা না করে জিজ্ঞাসা করেন, ‘আপনি তাজমহল দেখেছেন?’
‘না।’
‘ছবিতে দেখেছেন।’
‘হ্যাঁ।’
‘কেমন ছবি সেটা?’
‘ক্যালেন্ডারে, স্কুলের ইতিহাস বইয়ে আর-‘ সহদেবের গল্প ছাপবার বাসনা তখন মিইয়ে আসছে।
‘রবীন্দ্রনাথের ‘শাজাহান’ পড়েছেন।’
‘হ্যাঁ।’
‘আর?’
‘শচীনদেব বর্মনের গানটা, প্রেমের সমাধি তীরে, নেমে এল ওই-‘
সম্পাদক হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে বলেন, ‘আগে তাজমহলটা দেখে আসুন। যমুনা নদীতে কতটা জল, তাজমহল থেকে তাতে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে ডুবে মরা যায় কিনা…লিখেছেন, আগ্রা ফোর্ট থেকে শাজাহান যে স্ফটিকের মধ্যে তাজমহল দেখত সেটা দিয়ে আপনার নায়ক তাজমহল দেখল…এগুলো স্বচক্ষে একবার দেখে আসুন।’
পাণ্ডুলিপিটি এগিয়ে দিয়ে অবশেষে তিনি ভয়ংকর বাক্যটি উচ্চচারণ করেন: ‘আপনার লেখার হাত ভালো, লেখা ছাড়বেন না।’
সহদেব তখনই প্রায় প্রতিজ্ঞা করেছিল, অচিরেই সে তাজমহল দেখে আসবে, লেখাটা আবার লিখে এই সম্পাদককেই দেবে এবং দেখবে, অবশ্যই সম্পাদকের সাহিত্য বোধ যদি থাকে, তাহলে না ছাপিয়ে আবার ফেরত দিতে পারে কি না!
পাণ্ডুলিপিটি একটা ফ্ল্যাট ফাইলে ভরে সে তাকে তুলে রেখে দিয়েছিল। বছর দুয়েক পরই পত্রিকাটি পাততাড়ি গুটিয়ে ফেলে এবং বাইশ বছর পর সে তাজমহল প্রথমবার দেখতে যাওয়ার জন্য টুরিস্ট বাসের টিকিট কাটল দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্কের বাজারে সাইনবোর্ড, টেলিফোন আর টেবল নিয়ে বসা একটা লোকের কাছ থেকে।
তবে একটা ব্যাপারে সে নিজেকে কিছুটা এগিয়ে রেখেছিল, যদিও সাহিত্য সৃষ্টির কাজে তার কোনো দরকার হবে বলে সে মনে করে না। এম এ পড়ার সময় বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরিতে আর্কেওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার এক সাহেবের লেখা একটা পুরোনো বই পেয়ে সেটা উলটে পালটে দেখেছিল। আগ্রা ফোর্ট, তাজমহল, ফতেপুর সিক্রি ইত্যাদি মুঘল আমলে তৈরি অট্টালিকাগুলোর গড়ন ও সৌন্দর্য সম্পর্কে স্থাপত্যের দৃষ্টিকোণ থেকে বইটি লেখা। বইয়ের ছবি আর স্কেচগুলো দেখে, সম্পাদকের উপদেশ, ‘স্বচক্ষে একবার দেখে আসুন,’ তার মনে পড়ে এবং কানদুটি গরম হয়ে ওঠে।
সে তখন আবার প্রতিজ্ঞা করে, তাজমহল দেখতে আগ্রায় যেতে হবেই। এর দু-বছর পরই দুর্গাপূজায় নাটক করার জন্য ‘রঙ্গ ভারতী’ দলের সঙ্গে সে দিল্লি যায়। সহদেব অভিনেতা নয়। সার্ত্রের যে নাটকটি রঙ্গ ভারতীয় প্রযোজনায় মঞ্চস্থ হয়ে থাকে, সেটিকে ইংরেজি থেকে বাংলায়, হুবহু অনুবাদ নয়, বঙ্গীয়করণ তারই করা। সহদেব ফরাসি ভাষাটা জানে না। নাটকটি জনপ্রিয় হয়।
দলের পরিচালক ও প্রধান অভিনেতা দীনেন ভটাচাযের অনুরোধেই সে ওদের সঙ্গে দিল্লিতে যায়। অনেকের মতো সেও ঠিক করে তাজমহলটা দেখে আসবে। কিন্তু সেই সময়ই আগ্রায় দাঙ্গা বাধার জন্য যাওয়া হল না। সহদেব অবশ্য তাতে দমল না, দিল্লিতে আবার সে আসবেই, এই রকম একটা প্রত্যয় নিয়ে সে কলকাতায় ফিরে এসেছিল।
দ্বিতীয়বার সে দিল্লি গিয়েছিল মাকে প্লেনে তুলে দিতে। সহদেবের দাদা বলরাম ম্যাঞ্চেস্টারে চোখের ডাক্তারি করে। বউদির দ্বিতীয় বাচ্চচা হবে। তাই মাকে পাঠিয়ে দেওয়া। দাদাদের পরিচিত মিসেস বসাক লন্ডনে ফিরছেন তার সঙ্গেই মা যাবেন। হিথরো এয়ারপোর্ট থেকেই মাকে তুলে নিয়ে দাদা ম্যাঞ্চেস্টার চলে যাবে।
ট্রেনে দিল্লি। স্টেশন থেকে গ্রেটার কৈলাসে মিসেস বসাকের বাড়ি। খুবই যত্ন করলেন তারা। বারো ঘণ্টা পরই, মাঝরাতে দিল্লি থেকে মা উড়ে গেলেন বড়োছেলের সংসার সামলাতে। পরদিন সহদেব ট্রেনে উঠল কলকাতায় ফেরার জন্য। তাজমহল দেখতে যাওয়ার চিন্তাটা মাথায় আনার কোনো সুযোগই সে পায়নি।
তখন বাড়িতে দিনরাতের কাজের এবং রান্নার জন্য প্রৌঢ়া কেশবের মা, ভাই বাসুদেব আর ছোটো বোন শমিতাকে নিয়ে তারা চারজন মাত্র লোক। সহদেবের থেকে দু-বছরের ছোটো অনিতার তখন দুটি মেয়ে, শ্বশুরবাড়ি বেলগাছিয়ায়। শমিতা তখন সদ্য কলেজে ভরতি হয়েছে। বাড়িতে একা অভিভাবকহীন অবস্থায় বোন থাকুক অনিতার সেটা মনঃপূত নয়। ছুটির দিনগুলোয় অসিত গাড়ি নিয়ে আসত শালিকে নিয়ে যেতে।
এই সময়েই সহদেব কেন্দ্রীয় সরকারি অফিসে আপার ডিভিশন ক্লার্কের চাকরি পায়। আমদানি-রপ্তানির লাইসেন্স পাওয়া ব্যবসায়ী সংস্থাগুলি বিধি-নিয়মমাফিক কাজ করছে কি না তাই দেখার এবং না করলে পাকড়াও করার কাজ তার অফিস করে। চাকরি পাওয়ার চার-পাঁচ মাসের মধ্যে, ‘বড়ো ঢিলে ঢালা’ এবং এক বছরের মধ্যেই ‘কোনো কম্মের নয়’ রূপে প্রতিষ্ঠিত হলেও মধ্যবয়সি নাট্যরসিক মালয়লি উপরওলা তাকে খাতির করে। ইংরেজি খবরের কাগজে নাটক বিষয়ে তখন তার প্রবন্ধ বেরিয়েছে, বাংলার লোকনাট্য সম্পর্কে পড়াশুনায় ব্যস্ত। ব্রিটিশ কাউন্সিলে, আমেরিকান সেন্টারে, নাট্য সম্পর্কিত সেমিনারে তাকে বলার জন্য আমন্ত্রণ করা হয়। তা ছাড়া তার চিরকুট নিয়ে গেলে কলকাতার প্রতিষ্ঠিত নাট্যদলগুলি ‘পাস’ দিতে অসম্মত হয় না। সুতরাং তার টেবলে কিছু লোকের আনাগোনা থাকেই। সহদেবের টেবলের মতো ঢিলেঢালা কাজের টেবল সব সরকারি অফিসেই আছে। হাজিরা এগারোটা বা বারোটায় দিলেও চলে, তিনটা বা চারটায় অফিস থেকে বেরিয়ে গেলে কেউ তা লক্ষ করে না।
এই সময়েই শমিতার বন্ধু কেয়ার সঙ্গে তার পরিচয়। ওরা সমবয়সি, কলেজে একই সেকশনে। মিনিট দুই হেঁটে পাশের পাড়া, ধর লেনে কেয়াদের বাড়ি। ওর দাদা রঞ্জনের সঙ্গে সহদেব স্কুলে পড়েছে, তখন কয়েকবার ওদের বাড়িতে সে গেছেও।
কেয়ার মুখটি সুন্দর। বড়োবড়ো দুটি চোখের চাহনি শান্ত। গৌরবর্ণা, মাঝারি উচ্চচতা। শরীরের ঝোঁকটা স্থূলত্বের দিকে। চিবুকের নীচে একটা হালকা ভাঁজ, ঘাড়ে খোঁপার নীচে চর্বির একটা থাক। স্তনভারে ঊর্ধ্বাঙ্গ ঈষৎ ঝোঁকানো, গুরু নিতম্ব। কথা বলে লাজুক স্বরে, গলাটি মিষ্টি। সে ক্ল্যাসিকাল সংগীত চর্চা করছে কোনো এক গুরুর অধীনে। শমিতা আলাপ করিয়ে দেয়, দু-চারদিন কথা বলার পর তার আড়ষ্টতা ভাঙে এবং সহদেবের মার্জিত আচরণ, উচ্চচারণ সরস কথাবার্তায় সে মুগ্ধ হয়, যুবকটিকে তার ভালো লাগতে শুরু করে।
তখন সহদেবের আঠাশ বছর বয়স। সৌম্যদর্শন এবং স্বাস্থ্যবান। একটি সদ্য যৌবনা, কমনীয়া, লাবণ্যময়ী মেয়ে তার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে, এটা তার হৃদয়ে অবশ্যই দোলা দেয়। নানানভাবেই কেয়ার জন্য তার অনুরাগ প্রকাশ হতে থাকে। সে নাটক লিখেছে, হোক না বিদেশি নাটক থেকে, সেটা জনপ্রিয় হয়েছিল, সে সেমিনারে ইংরেজিতে আলোচনা করে, খবরের কাগজে ইংরেজিতে লেখে, থিয়েটারের নট-নটীদের সঙ্গে তার আলাপ আছে- এইসব ব্যাপারগুলি কেয়ার কাছে তাকে খুবই শ্রদ্ধার পাত্র করে তোলে। তার সব কিছুই-চীনা দোকানে ওয়েটারকে খাবারের বরাদ্দ দেওয়ার সময় কথা বলার বা চেঁচিয়ে ‘ট্যাক্সি’ ডাকার এবং দাঁড় করাবার জন্য। হাত তোলার বা থিয়েটারহলে চেনা লোকেদের দিকে তাকিয়ে মাথাটা ঈষৎ হেলিয়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে কেয়া মুগ্ধ হয়ে পড়ে। এগুলো সে সহদেবকে বলতও। একবার সে বলেছিল, ‘তোমায় অটোগ্রাফ দিতে হয় না?’ ওর সারল্যে সহদেব মাঝে মাঝে বিব্রত হয়ে পড়ত।
ফ্যামিলি প্ল্যানিং নিয়ে একদিন কথা হতে হতে বারবার সন্তান হলে মেয়েদের শরীরের কী ক্ষতি হয়, সেটা বোঝাতে গিয়ে সহদেব বলেছিল, ‘দোষটা আসলে পুরুষদেরই শুধু নয় মেয়েদেরও। ছেলেপুলে তো আর অমনি অমনি হয় না! মেয়েরা তখন আর রিফিউজ করতে পারে না।’ কেয়া মুখ লাল করে চোখ নামিয়ে নিয়েছিল। শমিতার সামনেই কথা হচ্ছিল। ছোটোবোনের সঙ্গে সে বন্ধুর মতো আচরণ করে। শমিতা ফাজিল প্রকৃতির, সে জানে দাদার সঙ্গে তার বন্ধুর হৃদয় নিয়ে বিনিময়ের একটা খেলা চলছে। উচ্ছ্বাসের প্রথম ধাক্কায় কেয়াই তাকে খবরটা জানিয়ে দিয়েছিল।
শমিতা সেই সময় বলে ওঠে, ‘মমতাজ মহলের কটা সন্তান? উনিশ বছরের বিয়েতে চোদ্দোটা! বাচ্চচা হয়ে বেচারা অ্যানিমিয়ায় মারা গেল আর অমনি, ভুলি নাই, ভুলি নাই প্রিয়া, বলে শাজাহান একটা তাজমহল বানিয়ে দিল। প্রেমের কী ছিরি!’
তখন ‘তাজমহল’ শব্দটা সহদেবকে মনে পড়িয়ে দেয়, একদা সে একটা গল্প লিখেছিল যেটা এখনও ফাইলের মধ্যে রয়েছে। তারপরেই মনে পড়ল, এখনও তার তাজমহল দেখা হয়নি।
গল্পের কথাটা সে কেয়াকে বলেছিল। খাতা, বই, বড়ো বড়ো খাম আর ফাইল ভরা লোহার র্যাকটা দেখিয়ে সে ঠাট্টার সুরে বলে, ‘এর মধ্যে আমার প্রথম সাহিত্যপ্রেমের তাজমহলটি লুকিয়ে আছে।’
চারদিন পর ফাইলটা হাতে নিয়ে কেয়া গভীর স্বরে তাকে বলেছিল, ‘গল্পটাকে বাজে বলেছেন কেন?’
সহদেব অবাক হয়ে বলে, ‘এটা তুমি পেলে কী করে, খোঁজাখুঁজি করে নিশ্চয় বার করে নিয়ে গেছ!’ তার গলায় অনুযোগ ছিল না।
‘হ্যাঁ নিয়ে গেছি, কেন অন্যায় করেছি নাকি?’
‘তা নয়, তবে এত কাঁচা গল্প…’
‘জানেন, পড়তে পড়তে আমার কান্না আসছিল জয়দীপের জন্য।’
কে জয়দীপ! তারপর মনে পড়ে নামটা গল্পের সেই নায়কের যে তাজমহল থেকে যমুনায় ঝাঁপ দিয়ে ব্যর্থ প্রেমের জ্বালা জুড়োয়। কেয়ার আন্তরিক মুখ, গভীর করুণ কণ্ঠস্বরের জন্যই হেসে উঠতে গিয়ে সহদেব হাসতে পারেনি। তার মনে তখন প্রশ্ন উঠেছিল, এই রকম একটা আবেগে ভ্যাদভ্যাদে, হাস্যকর, অবাস্তব প্রেমের কাহিনি যাকে কাঁদাতে পারে, তার মাথার মধ্যে কী রয়েছে?
কেয়া সম্পর্কে এই প্রশ্নটা সহদেবের মনে মাঝে মাঝে উঠলেও উত্তর খোঁজার চেষ্টা কখনো করেনি কেননা, ইতিমধ্যে বহু চুমু খেয়ে এবং শরীরটাকে ধামসে সে কেয়ার প্রতি নৈতিক দায়বদ্ধতায় আটকে গেছে। এবং এখনও তার তাজমহল দেখা হয়ে ওঠেনি।
দুই
অবশেষে সুযোগটা এল।
ফেব্রুয়ারির শেষে দিল্লিতে ‘ভারতীয় পরম্পরায় মৌখিক সাহিত্য’ বিষয়ে সেমিনার। উদ্যোক্তা, সাহিত্য আকাদেমি। সহদেব প্রবন্ধ পড়ার আমন্ত্রণ পেল। প্লেনে বা ট্রেনের প্রথম শ্রেণিতে যাতায়াত ভাড়া এবং ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারে দু-দিন থাকা ও খাওয়ার ব্যয় আকাদেমি বহন করবে।
সহদেব ঠিক করল এবার সে তাজমহল দেখবেই। দিল্লি পৌঁছবে মঙ্গলবার সকালে রাজধানী এক্সপ্রেসে, বুধবার সকাল সাড়ে নটায় তার সেমিনার। চারজন প্রবন্ধ পড়বে। ঘণ্টা তিনেক লাগবে পড়ায় ও আলোচনায়। পরের দিন দুপুরে খাওয়া সেরে তাকে সেন্টার ত্যাগ করতে হবে।
সে চিঠি দিল শ্যামলকে। রঙ্গ ভারতীতে কিছুদিন শিক্ষানবিশি করেছিল। দীনেনই ওকে সুপরামর্শ দেয়, ‘সময় আর বয়স নষ্ট না করে, অন্য কিছু দেখ।’ শ্যামল তাই দেখেছে। রাজস্থান থেকে পাথর আনিয়ে, সাইজ মতো কেটে বিক্রি করা। ভারতের নানান জায়গায় খদ্দের। পাথর কাটার কারখানাটা দিল্লির কিনারে। ব্যবসাটার মালিক সে একা নয়, আরও দুজন আছে।
এগারো বছর সে চিত্তরঞ্জন পার্কে ভাড়া বাড়িতে বাস করছে। বিয়ে করেনি। একাই থাকে এবং রেঁধে খায়। শ্যামল কলকাতায় গেলেই সহদেবের সঙ্গে দেখা করে। সহদেবের চিঠি পেয়ে সে উত্তরে জানাল আগ্রায় যাওয়ার জন্য এত আগে থেকে বাসে সিট বুকিং করতে হয় না, যাওয়ার আগের দিনও করা যায়। অনেকগুলো ট্রাভেল এজেন্সির বাস রোজ আগ্রা যায়। ‘সেমিনার শেষ হলে আমি গিয়ে সেন্টার থেকে আপনাকে আনব। দু-চার দিন আমার কাছে থাকবেন।’
মাকে নিয়ে দিল্লি আসার পর এই আবার আসা। কয়েকটা বছর পর রাজধানীকে দেখে কোনো পরিবর্তন সে বুঝতে পারল না। তার কাছে প্রথমবারের মতোই ভালো লাগল। রাস্তাগুলো চওড়া, পরিচ্ছন্ন, মসৃণ, কলকাতার মানুষের কাছে ভালো না লেগে উপায় নেই। চমৎকার বাড়িগুলোও। ভালো মেজাজেই সে ম্যাক্সমূলার মার্গে ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারে পৌঁছল। দুপুরে খেয়ে, ঘুমিয়ে, কিছুক্ষণ রাস্তায় হেঁটে ঘরে ফেরামাত্রই শ্যামলের ফোন পেল।
‘সহদেবদা পরশু দুপুরে যাচ্ছি। রেডি থাকবেন।’
‘থাকব। শুধু তো একটা সুটকেস।’
‘খাওয়াদাওয়ার অসুবিধে হচ্ছে না তো?’
‘আরে দারুণ দারুণ খাদ্যদ্রব্য, আমিষ নিরামিষ নানান রকমের ডিশ। মেনু কার্ডে নাম দেখে তো কিছুই বুঝলাম না। এধার-ওধার যারা খাচ্ছিল তাদের প্লেট দেখে একটা পছন্দ করে বললাম, ‘ওইটে এক প্লেট’। লোকটা আমার কথা শুনে কিন্তু মুচকে হাসল না, ওয়েল ট্রেইন্ড!…প্রচুর কাবাব খেয়ে ফেলেছি। পরের পয়সায় খেলে এই হয় মুশকিল।’
‘আমি কিন্তু আপনাকে পাবদামাছের ঝোল খাওয়াব। কলকাতার থেকে এখানে মাছটা ভালো পাওয়া যায়। আর শুনুন, কয়েকটা দিন থাকছেন তো?’
‘ট্রেনের টিকিট কাটা আছে ভাই। শনিবার উঠব, রবিবার হাওড়ায় নামব।’
‘সে কী! দিল্লিটা একটু ঘুরে দেখবেন না!’
‘পরে যদি আসি তখন দেখব…বাড়িতে ভীষণ ঝামেলা চলছে, তাড়াতাড়ি ফেরা দরকার। তাজমহলটা দেখব বলেই একদিন বেশি থাকছি নয় তো শুক্কুরবারই রওনা দিতাম।’
‘আপনার আবার ঝামেলা কী? আমার মতোই তো ব্যাচেলার রয়ে গেছেন।’
‘বিয়ে না করলে বুঝি ঝামেলা থাকে না? ভাই, বোন, প্রতিবেশী, আত্মীয়, বন্ধু, অফিসের কলিগ, এরা তো আছে। মা থাকলে আরও ঝামেলা হত। ব্যাচেলারদের বোঝা তো বিধবা মা! আমার বোন শমিতাকে দেখেছ তো, একতলায় থাকে স্বামী আর একটা পঙ্গু মেয়ে নিয়ে…ঝামেলাটা ওকে নিয়েই। সে সব কথা তোমায় বলা যাবে না, এদিকে দাদারা আসছে ম্যাঞ্চেস্টার থেকে, তবু রক্ষে শ্বশুরবাড়িতে উঠবে। বাড়িতে থাকার মতো ঘর আর কোথায়!’
‘আপনি তাহলে এবার বিশ্রাম করুন, কাল তো পেপার পড়তে হবে… যদি পেট ভার থাকে তা হলে রাতে আর কিছু খাবেন না।’
‘না না, স্রেফ উপোস।’
বিছানায় শুয়ে সকালে স্টেশনে কেনা খবরের কাগজটা চোখের সামনে তুলে পড়তে শুরু করল। কয়েক মিনিট পর সে কাগজটা নামিয়ে দুটো হাত আড়াআড়ি কপালের উপর রাখল।
ঝামেলা। শব্দটা মুখ থেকে বেরোনো মাত্র একটা গুমোট অনুভব তার মাথাটাকে ভারী করে দিয়েছে। কী যেন একটা খারাপ ঘটনা ঘটবে, এমন একটা সন্দেহ তার কাজকর্মের, পড়া ও লেখার, এমনকী যৌন আবেগের উপরও প্রভাব বিছিয়ে রেখেছে সেই ব্যাপারটা থেকে। পনেরো বছর ধরে সে দমচাপা অস্বস্তিকর একটা অবস্থার মধ্য দিয়ে চলেছে যাতে তার পরিবারের লোকেদের অবদানটাই বেশি। তার মধ্যে শমিতার ভূমিকাটাই মুখ্য।
বছর পনেরো আগে কেয়ার কাছ থেকে সে খবরটা শোনে। মা তখন এক বছর ধরে দাদার কাছে। বাসুদেব ড্রাফটসম্যানশিপ পড়ছে যাদবপুরে। কেরিয়ার তৈরি করার জন্য খুব খাটছে। সকালে বেরিয়ে সন্ধ্যায় ফেরে। শমিতা ছুটির দিনে থাকে বেলগাছিয়ায় অনিতার কাছে। রাতে অসিত পৌঁছে দিয়ে যায় গাড়িতে। সহদেব নিজেও বাড়ি ফেরে, কোনো কোনো দিন রাত এগারোটায়। সারাদিন বাড়ি থাকে শুধু কেশবের মা।
শনিবার সহদেবের অফিসে ছুটি। শমিতা কলেজ থেকে বেলগাছিয়ায় চলে যাবে, বাসুদেব সন্ধ্যায় ফিরবে, কেশবের মা দরকার না পড়লে দোতলায় ওঠে না। সহদেব দুপুর থেকে তার নিজের ছোট্ট ঘরটায় একাই। কেয়া আসবে।
সে তখন বিছানায় শুয়ে বই পড়ছিল। কেয়া ঘরে ঢুকে দরজার একটা পাল্লা ভেজিয়ে তার পাশে খাটে বসল। কিছুক্ষণ কথা বলার পর সে হাত ধরে অল্প টান দিতেই কেয়া তার বুকের উপর ঝুঁকে এল। এই সময় কেয়া কথাটা বলবে, ‘বড্ড সাহস তোমার, দরজা খোলা রয়েছে না?’ তখন সহদেব বলে থাকে : ‘বন্ধ করে দিয়ে এসো।’ কেয়া বলবে, ‘তুমি দাও, আমার লজ্জা করে’। তখন সহদেব উঠে গিয়ে খিল দেবে।
সেদিন, সেই শনিবারে, যথারীতি কেয়া বুকের উপর ঝুঁকে পড়ল। ব্লাউজের গলার ফাঁক দিয়ে সে ভিতরে তাকাবার ভান করল। তারপর ওর গলা জড়িয়ে ধরে আকর্ষণ। এবার কেয়া বললেব-‘বড্ড বাড়াবাড়ি করছি আমরা…ভয় করে।’
‘কীসের ভয়!’ সহদেব ধড়াস করা হৃৎপিণ্ডটা সামলে নিয়ে বলেছিল।
‘যদি’…
‘যদি কী?’
‘…কিছু হয়ে যায়?’ বুকে মাথা রেখে কেয়া ফিসফিস করে বলেছিল, প্রায় মাফ চাওয়ার মতো গলায়।
‘হবে না, কিছু হবে না। তুমি তো লেখাপড়া জানা, আমিও…ব্যবস্থা নিয়েই তো…’। সহদেব বিরক্তি চাপল না।
তার মুখের খুব কাছে কেয়ার মুখ। সে দেখল চোখ দুটোয় যন্ত্রণা আর ভয় মিশে ওকে অসহায় করে দিচ্ছে।
‘জান, শমিতার পেটে বাচ্চচা।’ দু-হাতে তার কাঁধ আঁকড়ে বুকে মুখ গুঁজে কেয়া ফুঁপিয়ে উঠল।
কথাটা মাথার মধ্যে বসতে কয়েক সেকেন্ড লেগেছিল। তারপর সে বলে, ‘কী বললে?…য়্যা?’
‘হ্যাঁ, আজই কলেজে ও আমায় বলল। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলুম না…কিন্তু এই রকম কথা কী মিথ্যে মিথ্যে কেউ বলতে পারে?’
কেয়া ফুঁপিয়ে চলেছে। নির্ভেজাল ওর চোখের জল। সহদেবের মনে হল তাকে শ্মশানে নিয়ে যাবার জন্য খাটে শোয়ানো হয়েছে। ‘বল হরি’ বলে খাটটা তোলার আগে বুকের উপর শেষবারের মতো কেউ কেঁদে নিচ্ছে।
শুকনো গলায় প্রথম কথাটা সে বলল কিছুক্ষণ পর, ‘আর কেউ জানে?’
‘দিদি জানে।’
‘আর কেউ?’
‘বোধহয় না। কাউকে বলতে বারণ করেছে, শুধু তোমায় বললুম।…কেন, বলব না তোমায়?’
কিছুক্ষণ পর সে আসল প্রশ্নটা করে, ‘কাজটা কার,…বলেছে?’
‘হ্যাঁ।’ তারপর কণ্ঠস্বর সহদেবের বুকে মিশিয়ে সে বলেছিল, ‘জামাইবাবু।’
প্রায় পনেরো বছর আগে একদলা ধোঁয়া তার বুকের মধ্যে ঢুকে গেল, এখনও যা তাকে কাশতে কাশতে প্রায়ই দম বন্ধ করায়।
‘চারমাস হয়ে গেছে।…নার্সিং হোমে অপারেশন করাবার ব্যবস্থা হয়েছে, ভয়ের কিছু নেই বলেছে।’
‘কাউকে আর বলবে না, কেউ যেন জানতে না পারে।’ কঠিন, ভয় দেখানো স্বরে সহদেব বলেছিল।
সিধে হয়ে বসে মাথা নাড়তে নাড়তে কেয়া খুব আন্তরিকভাবে বলে, ‘কাউকে না,মরে গেলেও না। এই রকম লজ্জার কথা কি বলা যায়! আমার নিজের বোনের এমন অবস্থা হলে কি কাউকে…’
‘চুপ করো।’ কর্কশ চাপা ধমকে ওকে থামিয়ে দিয়ে সহদেব উঠে বসে। যদি জানাজানি হয় তাহলে বুঝব তোমারই কাজ, তা হলে কিন্তু-‘
কেয়া ঝাঁপিয়ে তার দুটো পা বুকে চেপে ধরে হাউ হাউ করে উঠেছিল।
‘আমাকে তুমি বিশ্বাস করো, তোমাকে ছুঁয়ে দিব্যি করছি, আমার মুখ দিয়ে যদি একটা কথাও বেরোয় তাহলে তুমি আমাকে-‘ কেয়া আর কিছু বলার মতো কথা খুঁজে না পেয়ে অসহায়ের মতো সহদেবের পায়ে মাথা ঘষতে থাকে।
পা টেনে নিয়ে সে ধীর গলায় বলেছিল, ‘তোমাকেও তাহলে জ্বলেপুড়ে মরতে হবে।’
কথাগুলো এতবছরেও সে ভোলেনি। সহদেব খাট ছেড়ে উঠে, সিলিং থেকে মেঝে পর্যন্ত ঝোলানো ভারী পর্দাটা সরাল। কাচের দরজার পরে ছোটো বারান্দা, বিস্তৃত বাগান আর চওড়া বাঁধানো রাস্তা। এয়ারকুলারের জন্য ঘরটা ঠান্ডা। তার মনে হল বাইরে এখন চমৎকার বাতাস বইছে। কাগজে দেখেছে গতকাল এখানকার তাপ ছিল উনত্রিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
কাচের দরজাটার দুটো ছিটকিনি খুলে ঠেলাঠেলি করল। কোথায় যেন আটকে যাচ্ছে। আর চেষ্টা করতে গিয়ে কাচ যদি ভেঙে যায়! সে দাঁড়িয়ে বাইরের বাগানের দিকে তাকিয়ে রইল। বিকেলে ফুলের ছোটো ছোটো সাজানো বাগিচায় যেসব ফুল দেখেছে শুধু গোলাপ ছাড়া, তাদের কোনোটাই সে চেনে না।
বুদ্ধিমান, সুশিক্ষিত, রুচিমান লোকেদের সামনে তার বিদ্যার, মেধার পরিচয় দেবার জন্য তাকে আমন্ত্রণ করে আনা হয়েছে। অথচ তার মুখ দিয়েই কিনা ইতরের মতো, ‘তোমাকেও তাহলে জ্বলেপুড়ে মরতে হবে’, এই ধরনের মানসিক হীনতাও তার মধ্যে থিতিয়ে আছে যা বাইরের জগৎ জানে না।
লজ্জাটা শমিতার আর অসিতের এবং তা পাওয়া উচিত কিনা সেটা অন্য কথা। কিন্তু সে তা পাবার ভয়ে কাতর হয়ে পড়েছিল। পড়ার কি কোনো দরকার আছে? সামাজিক নিন্দার ভয় না থাকলে সে অবিবাহিত বোনের পেট হওয়া নিয়ে কোনো চিন্তায়ই পড়ত না। এমন অবস্থা তো কেয়ারও হতে পারত, সৌভাগ্যবশত আজও হয়নি। বেচারা অসিত, তারই সমবয়সি ভগ্নিপতি, ফেঁসে গেল। ওকে পাপী বললে তার নিজেকেও বলা উচিত। মনে মনে বলতে চেষ্টা করে স্বচ্ছন্দেই বলতে পেরেছে।
অথচ সে অসিতকে বলেছিল, ‘দুশ্চরিত্র, লম্পট। একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করে দিলে! অনিতার উচিত তোমাকে ডিভোর্স করা। শমিতা তোমাকে কোর্টে নিয়ে যেতে পারে তা জানো?’
কিন্তু না অনিতা, না শমিতা, না সে নিজে অসিতের বিরুদ্ধে কিছুই করেনি, সম্ভ্রম খোয়াবার ভয়ে।
উচিত ছিল। তার একটা কিছু করা উচিত ছিল। কিন্তু অসিতের গালে একটা চড়ও সে মারতে পারেনি। বরং চিন্তায় পড়েছিল, নার্সিং হোমের খরচটা তার ঘাড়ে যদি চাপিয়ে দেয়। যদি অসিত বলে বসে: একা আমাকে দায়ী করছেন কেন, শমিতারও তো সায় ছিল। অর্ধেক খরচ শমিতার হয়ে আপনি দিন? নয়তো রইল ওর পেটের বাচ্চচা।
এতটা পর্যন্তও সে ভেবেছিল, অসিত যদি এই ধরনের কথা বলেই তাহলে সে বলবে, ঠিক আছে, শমিতার বাচ্চচা হোক আমিই তাকে মানুষ করব।
কিন্তু-কোথায় মনের মধ্যে সামাজিক মানমর্যাদা বোধের খুব পুরোনো একটা বাগান আছে। সেখানকার ফুলগুলো শৈশব থেকেই চেনা…মুচকি হাসি, বাঁকানো ঠোঁট, কথা বলতে বলতে থেমে গিয়ে আড়চোখে চাওয়া, ভ্রু তুলে মুখ ফিরিয়ে রাখা, গা টেপাটেপি।
তবুও বাগানটা রয়েই গেছে। বিদ্যাবুদ্ধি, অনুভূতি দিয়ে সব মেনে কাজের মধ্য দিয়ে তার ধারণা বা বিশ্বাসগুলোকে সে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে না। এই রকম কাচের দরজা সবসময়ই তার সামনে। ঠেলাঠেলি করে খুলতে গিয়ে ভেঙে যাবার ভয়ে সে থমকে যায়। অথচ ওপরেই একটা বাগান সে দেখতে পাচ্ছে যার ফুলগুলো অজানা, স্বচ্ছন্দ বাতাসও বইছে।
কেয়াকে সে বিয়ে করেনি। দশ বছর অপেক্ষা করে বাড়ির পছন্দ করা পাত্রর গলায় সে মালা দিয়েছে। বোধহয় তারা দুজনেই বেঁচে গেছে। শমিতার বিয়ে অনিতার সংগ্রহ করা পাত্র বিদ্যুতের সঙ্গে হয়েছে। শমিতা শান্তিতে নেই।
সহদেব সুটকেস থেকে টাইপ করা কাগজগুলো বার করে, ঝালিয়ে নেবার জন্য, মৃদুস্বরে পড়তে শুরু করল। মাঝে মাঝে থেমে সামনের শ্রোতাদের দিকে যেভাবে তাকাবে, তার মহড়া দিল। তখন সে কেয়া, শমিতা, অসিত, বিদ্যুৎ এদেরই মুখগুলো দেখতে পায়।
কণ্ঠস্বর ভালো, ইংরেজি উচ্চচারণ ভালো, ভঙ্গিটা আকর্ষণীয়, তার প্রবন্ধ পাঠ তারিফ পেল। সহদেব মঞ্চ থেকে নেমে চেয়ারে ফিরে আসতেই পাশের চেয়ারের মহিলা ডানদিকে মাথা হেলিয়ে তাকে ইংরেজিতে বললেন, ‘সিক্সটিনথ সেঞ্চুরিতে রাজস্থানের পশ্চিমে কয়েকটা গ্রামে মেয়েরা নাটক করত বৈশাখী পূর্ণিমার রাতে। ওদিকে ঘুরতে গিয়ে আমি এটা জেনেছি। এখন অবশ্য আর হয় না। কাহিনিগুলো ট্র্যাডিশনাল, পৌরাণিক রাধাকৃষ্ণ নিয়ে। কিন্তু সংলাপ আর গান তক্ষুনি ওরা বানিয়ে নিত। অনেকটা বাংলার কবিগানের মতো। এখন তো এই ফর্মে রাস্তায় স্ট্রিট ড্রামা হচ্ছে!’
মহিলা মুচকে হাসলেন। মুখে টোল পড়ল। পুরুষদের মতো ঘাড় পর্যন্ত ছাঁটা কালো চুলে বাম রগের কাছ থেকে কানের উপর দিয়ে পিছন পর্যন্ত এক ইঞ্চি চওড়া সাদা চুলের পটি। সহদেব হাসিটা ফিরিয়ে দিয়ে মাথাটা পাশে কাত করে বলল, ‘আমরা আধুনিক হচ্ছি তো, তাই সিক্সটিনথ সেঞ্চুরি থেকে নাটকের ফর্ম খুঁজে আনছি।’
কথাটা বলে সহদেব মহিলার মাথায় আড়চোখে নজর ফেলল। কী একটা কেমিক্যাল দিয়ে যেন সাদা করা যায়। মন্দ দেখায় না। অনেক মেয়ে, পুরুষই এটা করে, বহুজনের মধ্যে এদের চোখে পড়ে যায়। আর পাঁচটা লোকের থেকে যে এরা রুচিতে, বিত্তে, শিক্ষায় ও মর্যাদায় আলাদা, তারই বিজ্ঞাপন যেন ওই সাদা চুলের দাগ। তার ক্ষীণ একটা ইচ্ছা হল, চুলে এই রকম একটা সাদা ব্যাপার করতে পারলে কেমন হয়। কিন্তু একটা ইউ ডি ক্লার্ককে কি মানাবে? ইউনিভার্সিটির মাস্টার হলেও নয় চলে যেত।
আর একজনের প্রবন্ধ পাঠ হচ্ছে। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈক ডক্টর অরোরা পার্বত্য উপজাতিদের মধ্যে মৌখিক সাহিত্যের উৎসের হদিশ ঘরের জন্য ত্রিশ মানুষকে দিচ্ছেন। সহদেব আবার আড়চোখে পাশের মাথার দিকে তাকাল কাঠ হয়ে সামনে মুখ করে। ইনি কে হতে পারেন? এঁর স্বামী বা বন্ধু কী আজকের কোনো বক্তা? কিংবা রিসার্চ ফেলো? কাগজের লোক? অথবা নাটকের পরিচালক? অভিনয় করেন?…হতেও পারে কিংবা বুটিকের মালিক। বয়স চল্লিশের এধার-ওধারে, চমৎকার একটা মিষ্টি গন্ধ ঘাড় বা চুল থেকে আসছে। ইন্টিমেট বোধহয়, আর তো কোনো সেন্টের নাম সে জানে না, তবে গন্ধটা তাকে মাতিয়ে তুলছে।
‘ছেলেমানুষের মতো!…সবাই যা জানে তাই বলছে।’ মহিলা আবার মাথা কাত করে ফিসফিস করলেন।
‘এরাও ইনভাইটেড হয়!’ সহদেবও ফিসফিস করল এবং মনে হল গলা থেকে ওর বুকের দিকে ঢালটা অনেকটা কেয়ার মতোই। কবজির গড়নও অনেকটা। ব্রেসিয়ারের ফিতের সঙ্গে গায়ের মাজা রঙের মিল রয়েছে। তবে কেয়া ছিল আরও মোটা, এখন নিশ্চয় আরও হয়েছে। বিয়ের পর আর সে ওকে দেখেনি। পাঁচ বছর তো হয়ে গেল। মহিলার মধ্যে কেয়ার শরীরের কিছু কিছু আদল সে খুঁজে পাচ্ছে। পাছাটা তো এখন আঁচ করা সম্ভব নয়, পরে দেখে নেবে।
মহিলাটি বক্তৃতার মাঝেই উঠে চলে গেলেন সহদেবের দিকে বিনীতভাবে মাথা ঝুঁকিয়ে। মুখ ঘুরিয়ে ওর চলে যাওয়াটা অর্থাৎ পিছন থেকে দেখাটা আর সহদেবের হল না। কে কী ভাববে!
শ্যামল এল পাঁচটা নাগাদ।
‘ভাবলুম একা রয়েছেন যাই দেখা করে আসি। কাল কিন্তু এসে নিয়ে যাব এই সময়।’
ওকে পেয়ে সহদেব যেন বেঁচে গেল।
‘বোস বোস, চা আনাই। টেলিফোনে বলে দাও তো, প্যান্ট্রির নম্বরটা কার্ড থেকে দেখে নাও।’
টেবলে রাখা কার্ডে নানান নম্বর লেখা। ডায়াল করে ঘরের নম্বর বলে এক পট চা দিয়ে যাবার কথা বলে শ্যামল জিজ্ঞাসা করল, ‘সহদেবদা আর কিছু বলব?’
‘না না, অবেলায় খাওয়া এখনও পেটটা ভার রয়েছে। তুমি কিছু খাও তো বলে দাও।’
ফোন রেখে শ্যামল বলল, ‘আমিও খাব না। নেমন্তন্ন ছিল এক বন্ধুর বাড়ি, অচিন্ত্য নিয়োগি। বলল আপনাকে চেনে।’
‘আমাকে চেনে! নিয়োগি? …কই মনে তো পড়ছে না। করে কী?’
‘এল আই সি-র অফিসার বছর পনেরো আগে আপনার সঙ্গে একদিন মাত্র আলাপ হয়েছিল, আইল্যান্ডস নার্সিং হোমে। অচিন্ত্যর বাবার প্রস্টেট অপারেশন হয় ওখানেই। আপনারও কার যেন অপারেশন ছিল।’
‘ওহ হো, এতদিন পর কী আর মনে থাকে! শমির…অ্যাপেন্ডিক্স অপারেশন ছিল।’ কথাটা বলার সময় বুকটা একটু খচ করে উঠল। ‘অদ্ভুত মেমারি তো!’
‘অচিন্ত্যর! ওর মেমারি হাতির মতো, খুঁটিনাটি সব মনে থাকে। ও বলে দিল, আপনার পাজামা খদ্দরের হলুদ হাঁটু পর্যন্ত পাঞ্জাবি, কাঁধের ঝোলা, সঙ্গে ছিলেন আপনার বোন আর ভগ্নিপতি। অচিন্ত্যকে নার্ভাস হয়ে বসে থাকতে দেখে আপনি নিজেই ওর পিঠে হাত রেখে বলেছিলেন, ‘এত চিন্তার কী আছে, প্রস্টেট অপারেশন খুব জটিল কিছু নয়, হরদম করে করে সার্জনদের হাত পেকে গেছে।’ মনে করে রেখেছে এই জন্যই, সেদিন ওই একটা সামান্য কথাই ওই সময়ে ওকে খুব ভরসা জুগিয়েছিল।’
‘ওর বাবার মৃত্যু ঘটেনি তো?’
‘আরে না না, বুড়ো এখানেই ছেলের কাছে থাকেন। রোজ দোকান-বাজার করেন।’
‘কিন্তু যদ্দুর মনে পড়ছে, আমার নাম তো ওকে বলিনি।’
‘হয়তো আপনার সঙ্গের ওদের কারুর কাছ থেকে শুনেছে।’
চা আসতে কথা অন্যদিকে ঘুরে গেল। সহদেব এতক্ষণ অস্বস্তিবোধ করছিল নার্সিং হোম প্রসঙ্গে। সুদূর দিল্লিতে এমন একজন রয়েছে যে শমিতার অপারেশনের দিন নার্সিং হোমে ছিল। কেয়া ছাড়া পঞ্চম একজনও যে আছে, যদিও সে জানে অ্যাপেন্ডিক্স অপারেশন তবু এত বছর পরও ঘটনাটার স্মৃতি অস্বস্তিকর। অনিতাদের বাড়ি থেকেই শমিতা নার্সিং হোম যায় এবং তিনদিন পর ওই বাড়িতেই ফেরে। বাসুদেব আর কেশবের মা জেনেছিল দিদিদের সঙ্গে শমি দিঘায় বেড়াতে গেছে। হয়তো কেয়া জানত যাওয়াটা দিঘায় নয়- কিন্তু একবারও সে এটা নিয়ে কোনোরকম উচ্চচবাচ্য সহদেবের কাছে করেনি। এমনকী কেয়ার কোনো প্রশ্নের সম্মুখীনও শমিকে হতে হয়নি।
অদ্ভুত চরিত্র! সহদেব অবাক হয় কেয়ার কথা ভাবলে। সহদেব বিয়ে করবে এই আশায় দশটা বছর শবরীর মতোই প্রতীক্ষা করে গেছে। বি এ পাশ করেছে প্রচুর মুখস্থ করে, সাধারণভাবে। কিন্তু ক্ল্যাসিকাল সংগীতটি স্বতঃস্ফূর্ত আগ্রহে যত্ন করে শিখেছে। সে জানে এই জায়গায় কেয়া সূক্ষ্ম শিল্পবোধের দ্বারা মহান সুকুমার অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে। কিছু একটা তবু সৃজন করে কেয়া, সহদেব যেটা পারে না। ও’ নিল-এর একটা নাটকের ছায়া ধরার চেষ্টাতেই তার নাট্যকার কেরিয়ার শেষ। হয়তো, এ জন্যই যাচ্ছেতাই ভাবে কেয়ার সঙ্গে কথা বলেছে, অপমান করেছে। ওর নিবেদিত ভালোবাসাকে তার ন্যাকামো মনে হয়েছে। অথচ সে জানত, এখনও বিশ্বাস করে, কেয়ার মধ্যে কৃত্রিমতা নেই। ওর প্রকৃতিটাই গভীর। একবার যা বিশ্বাস করে বা আঁকড়ে ধরে সেটা ও ছাড়বে না।
বিয়ের জন্য বাড়ি থেকে অসহনীয় চাপ ওর উপর দেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু সহদেবের প্রতি অটল ছিল কেয়া। তখন বয়স উনত্রিশ। ওর দাদা রঞ্জন এসে সহদেবের হাত ধরে বলেছিল, ‘তুমি অনুমতি না দিলে কেয়া বিয়ে করবে না।’
‘ও সহদেবদা, চা-টা শেষ করুন।’ শ্যামল অবাক স্বরে বলল, ‘পেপার ঠিকমতো পড়েছেন তো? রিঅ্যাকশানস কী?’
‘এক মহিলা পাশে বসেছিলেন, তাকেই মনে পড়ছিল। অবাঙালি, হয়তো পাঞ্জাবি, একটা রাগেড প্রিমিটিভ, প্যাসন মুখে মাখানো যেটা সেক্সুয়ালি আমাকে অ্যারাউজ করেছিল।’ সহদেব একটু ভেবে চোখ কুঁচকে আবার বলল, ‘আচ্ছা শ্যামল, আমি ইংরেজিতে এটা বললুম কেন?…সেক্সুয়ালি অ্যারাউজ কী বাংলায় বলা যায় না?’
‘যায় তো নিশ্চয়ই তবে আমার বয়সি, ছোটো ভাই-স্থানীয়র কাছে বলতে গেলে যে বাংলাটা বলতে হবে, সেটা আপনি বলতে পারবেন না। বললে এবং শুনলে আমাদের দুজনের কানই লাল হয়ে যাবে।’
‘অথচ এটা কান লাল হওয়ার মতো একটা ব্যাপার নয়…আদি অনুভব, মানবিক, স্বাভাবিক। অথচ একে প্রকাশ করার মতো চলতি শব্দ বাংলা ভাষার নেই! আমরা, শিক্ষিতরা নিজেদের মধ্যে যখন বলি তখন সেক্স অর্গানগুলোর নাম আর বাংলায় জিভে আসে না, অন্য ভাষার সাহায্য নিয়ে বলতে হয়….পেনিস, ভ্যাজাইনা!…এসব কী, য়্যাঁ? অথচ অশিক্ষিত অমার্জিতদের মুখ থেকে পথেঘাটে বাংলায় যা বেরোয় আর না শোনার ভান করে ভদ্রলোক ভদ্রমহিলাদের যা শুনতে হয়, বাংলা নাটকের কোনো চরিত্র যদি…ধরো আমি যদি এখন তোমায়-এ কী যাচ্ছ নাকি!’
‘সহদেবদা, এবার আমি উঠব। কাজ আছে।’ বলার সঙ্গে শ্যামল উঠেই দাঁড়াল।
‘আরে বোস বোস, আমিও একটা শিক্ষিত বাঙালি, সুতরাং মাতৃভাষায় সেক্স অর্গানের, এটাও ইংরেজিতে বললুম, একটা নামও জিভ থেকে বেরোবে না।…ছোটো ভাইয়ের বয়সি তো কী হয়েছে, দুজনেই অ্যাডাল্ট পুরুষ এবং কুমার। ঠিক বললুম? কুমার তো?’ সহদেব চোখ মারার চেষ্টা করল শ্যামলকে বন্ধুর পর্যায়ে আনার জন্য।
শ্যামল সেটা লক্ষ করে বলল, ‘নাহ, কাল দেখছি আপনার জন্য রাম বা হুইস্কি রাখতেই হবে। কোনটা রাখব?’
‘তুমি খাও নাকি?’
‘খাই, নিয়মিতই।’ শ্যামলের গলা স্বাভাবিক।
‘আমি মাঝেমধ্যে, তবে কাল খাব, তোমার সঙ্গে। যে-কোনো একটা হলেই হবে। মদের পার্থক্য আমি বুঝি না, যেমন বয়সটয়সের পার্থক্যটা কোনো ফ্যাক্টরই নয়। কলকাতা থেকে হাজার মাইল দূরেও যদি প্রাণ আর মুখ না খুলতে পারি তা হলে কবে কোথায়, কার কাছে খুলব? বাংলায় তো লেখাই যায় না! ইংরেজিটা শিখে বেঁচে গেছি, ইংরেজি কাগজে সবই লেখা যায়, অন্তত সৎ থাকা যায়।’
‘ওরে বাবা, আপনি তাহলে সৎ?’ শিউরে ওঠার ভান করল শ্যামল।
‘আলবাত।’
‘তাহলে কাল দুপুরে আপনি চেক-আউট করছেন। আমি একটায় রিসেপশন থেকে আপনাকে তুলে নিয়ে যাব। তাজমহল দেখার জন্য বাস-এ সিট পেয়ে যাবেন আর পাবদা মাছের ঝোল কেমন রাঁধি সেটাও জেনে যাবেন।’
শ্যামল চলে যাবার পর সহদেব কিছুটা আচ্ছন্ন হয়ে থাকল। এখন তার মনে হচ্ছে, কেয়াকে বিয়ে করে ফেললে এমন কী সর্বনাশ তার হত? কেয়ার তো এখন যথেষ্ট নাম, দেখতেও সুন্দর, সহ্য করা যেত না কী? টাকাও তো ভালো রোজগার করে।
একলা এই ঘরে এখন কাচের দরজায় দাঁড়িয়ে ওপাশের বাগানের দিকে তাকিয়ে থাকার শাস্তি নিজেই তো ডেকে এনেছি। এটা ভেবেও সহদেব নিজের জন্য দুঃখ বোধ করল না কারণ এবার সে তাজমহল দেখবেই।
তিন
সুটকেসটা ঘরের একধারে নামিয়ে রেখে শ্যামল বলল, ‘বেশ গরম, চান করবেন?’
খাটে বসে ঘরের জিনিস ও আসবাব দেখতে দেখতে সহদেব বলল, ‘নাহ, আর একটু পরে।’
‘চা না কফি, কী দেব?’
‘চা।…গ্যাসের উনুন?’
‘হ্যাঁ।’
‘আমরা মাসদুয়েক হল কয়লার পাট তুলে দিয়েছি।’
‘আমরা মানে? আপনি তো একা।’
‘হ্যা, কিন্তু তাই বলে তো আর হোটেলে খাওয়া চলে না। শমিরা একতলায় থাকে, ওর বর বিদ্যুৎ আর একটা মেয়ে।’
‘বাড়িতে আর কেউ নেই, আপনার ভাই?’
‘বাসু তো দুর্গাপুরে কোয়ার্টারে থাকে। তোমারই বয়সি। ভালো মাইনে পায়, দুটো ছেলে, ওর ঘরটা তালা দেওয়া। মায়ের ঘরটায়, মা মারা যাওয়ার পর থেকে আমিই থাকি। আর যে ছোটো ঘরটায় আগে আমি থাকতাম সেটা কে নেবে তাই নিয়ে মন কষাকষি শুরু হল বাসুর সঙ্গে, তার জের আজও চলছে।’
‘চায়ের জলটা চড়িয়ে আসি, আপনি লুঙ্গি না পাজামা পরবেন।’
‘আমার সঙ্গেই আছে, লুঙ্গি আমি পরি না।’
সহদেব সুটকেস থেকে পাজামা বার করে পরল। সিঙ্গল বেড খাট, টেবলে কয়েকটা ইংরেজি-বাংলা বই, দেয়ালে একটিই ছবি, রামকৃষ্ণের, সাদা-কালো পোর্টেবল টিভি সেট, একটা রেফ্রিজারেটর। ঘরটা তিনতলায়। বেরোলেই ছোটো একটা ছাদ।
ছাদে এসে দাঁড়াল সহদেব। কোনোক্রমে শেষ করা, পুরোনো একতলা দুটি বাড়ি ছাদের নীচেই। দূরে দূরে উঁছু বাড়িগুলো বুঝিয়ে দিল ধনবান লোকেরাও এখানে বাস করে। রাস্তা দিয়ে বহু লোক হেঁটে যাচ্ছে। সহদেব পাঁচিলে হাত রেখে পথিকদের দিকে তাকিয়ে রইল। শ্যামল দুটো চেয়ার টেনে আনল তারপর চা।
‘চা খেয়ে, চান করে চলুন বাসের টিকিটটা নিয়ে আসি। নব্বুই টাকা, আমি বলে রেখেছি ট্রাভেল এজেন্টকে।’
চায়ে চুমুক দিয়ে দূরের বাড়িগুলোয় চোখ বুলিয়ে সহদেব বলল, ‘একা থাকতে অসুবিধে হয় না?’
‘কীসের অসুবিধে? ঠিকে কাজের লোক সব করে দিয়ে যায়, রান্নাটা শুধু নিজে করি। সহজ রান্না, ডাল, ভাত, মাছ একবেলা রাঁধি।’
‘তা বলছি না। নিঃসঙ্গ বোধ কর না?’ সহদেব একটু তীক্ষ্ন করল নজরটা। শ্যামলের মুখে কোনো ভাবান্তর ঘটল না দেখে দমে গেল।
‘আপনি বলছেন বিয়ে করার ইচ্ছে হয় কি না?…না।’
ছোট্ট একটা শব্দ, ‘না’। কেন হয় না, সেটা জানতে চাইবার উৎসাহ সহদেবের এল না। তবে স্বগতোক্তির মতো সে বলল, ‘আমার মাঝে মাঝে হয়। ভয় থেকে হয়। একদিন তো বুড়ো হব, অশক্ত হয়ে পড়ব, চাকরি থাকবে না, লেখালেখির সামান্য টাকায় তো আর চালানো যাবে না…ধর বড়ো কোনো অসুখে পড়লুম, কে তখন দেখবে?’
‘তাহলে বিয়ে করে ফেলুন, এখনই না করলে দেরি হয়ে যাবে। চাকুরে মেয়েকেই করুন, এই পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ…অনেক পেয়ে যাবেন। আপনার অফিসে কেউ নেই?’
সহদেব একচোট হেসে নিয়ে মাথা নাড়ল। ‘আছে তবে বিয়ে করা যায় না।’
‘কাগজে বিজ্ঞাপন দিন কিংবা পাত্রপাত্রীর বিজ্ঞাপন পড়ুন।’
‘বিজ্ঞাপন দিলে কী লিখব বল তো? বিজ্ঞাপন চার্জ কমাবার জন্য তো সাংকেতিক পদ্ধতিতে লিখতে হবে, দঃ রাঢ়ি, বসু, পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি, সুশ্রী, উঃ শ্যাম, চুয়াল্লিশ, এমএ কেঃ সঃ চাকুরে, স-অসঃ চাকুরে, পঁয়ত্রিশ মধ্যে, দাবি নাই, বিধবাও চলিবে।…এইভাবে লিখব তো?’ সহদেব কথাগুলো বলে মজা পেল।
‘উঁহু, একটু বেশিই ইনফর্মেশন দিয়ে ফেলেছেন। খরচ কমান।’ শ্যামলের গলাতেও মজা।
‘কোনটে আবার বেশি?’
‘আসল কথাটাই তো বললেন না, কলকাতায় নিজের বাড়ি…কলিঃ নিজ বাড়ি, এটা বলতেই হবে। মেয়েরা বা তাদের বাপ-মা ওইটে আগে দেখে। ওরা ভাবে বাড়ি থাকলে মেয়ের পথে বসার ভয় আর থাকবে না।’
‘বেশ, কলিঃ নিজ বাড়ি…আর?’
‘সুশ্রী, উজ্জ্বল শ্যাম আর হাইটটা ফালতু। আসল খবরটা হল কেন্দ্রীয় সরকারের চাকুরে। তারপর গুরুত্ব পাবে বয়সটা, তারপর বিদ্যের বহরটা। এই তিনটেই সাফিসিয়েন্ট। আপনার ডিমান্ডগুলো ঠিকই দিয়েছেন, তবে সুশ্রী বা স্লিম বা ফরসা, এসব বায়নাক্কা কী জুড়বেন? কিংবা বুদ্ধিমতী কী উচ্চচশিক্ষিতা?’
‘না, না, বায়নাক্কা থাকবে কেন এই বয়সে? তাছাড়া বাত, অম্বল, ডিসপেপসিয়া, ফিটের বা মাথা ধরার ব্যামো, এর যে-কোনো দুটো-একটা থাকলে, যেটা বিয়ের পর জানতে পারব, তখন ফরসা আর সুশ্রী দিয়ে আমার কী হবে! আর বুদ্ধিমতী জিনিসটা একটু গোলমেলে ধরনের। ধরো আমার বোন শমি সাংসারিক ব্যাপারে খুবই বুদ্ধি ধরে, যেটা প্রায়শই স্বার্থপরতার পর্যায়ে চলে যায় অথচ এমন বোকামিও করেছে যা তাকে কানাগলির দিকে ঠেলে দিল।’
সহদেব খালি চায়ের কাপ শ্যামলের হাতে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। হালকা চালের কথাবার্তা ভারী দিকে চলে গেল এই ‘কানাগলি’ শব্দটায়। এটা ব্যাখ্যা করতে গেলেই গলার স্বর গম্ভীর করে ফেলতে হবে যেটা সে এখন চায় না। কিন্তু শব্দটা কীভাবে যেন মুখে এসে গেল।
শ্যামলের একটা বড়ো গুণ যেচে সে কৌতূহল দেখায় না। কেন বা কী ধরনের ‘কানাগলি’ এটা নিয়ে প্রশ্ন করল না। করলে সে কী সত্যি কথাটা বলত?
‘আপনি তাহলে সৎ!’
‘আলবাত।’
‘চানটা করে নিন।’
বাঙালি বাজারে চেয়ার টেবল পেতে টেলিফোন নিয়ে বসা যুবকটি শ্যামলকে বলল, ‘একটা সিট রেখেছি। টাকাটা পেলে কনফার্ম করে জানিয়ে দেব।’
‘কোথায় কোথায় বাস থামবে?’ শ্যামল জানতে চাইল। টেবলের পাশে জমিতে দাঁড় করানো লম্বা বোর্ডে কয়েকটা রুটের ও দ্রষ্টব্য জায়গাগুলোর নাম লেখা।
‘যাবার সময় আগ্রা ফোর্ট, তাজ, ফেরার সময় সেকেন্দ্রা মথুরা আর বৃন্দাবন। ফিরতে ফিরতে রাত আটটা-নটা হয়ে যাবে।’
টাকা দিয়ে সহদেব বিল পেল। যুবকটি টেলিফোনে কার সঙ্গে যেন হিন্দিতে কথা বলে সহদেবকে জানাল, ‘পিছনে জানালার ধারে আপনার সিট। আটটায় নেহরু প্লেসের সামনে থেকে বাস ছাড়বে।’
‘এয়ারকন্ডিশনড?’
‘না। যা হাওয়া দেবে তাতে গরম লাগবে না। লাক্সারি কোচ, কম্ফর্টেবলিই থাকবেন। পথে খাওয়ার জন্য ধাবায় বাস দাঁড়াবে, আগ্রায় হোটেল পাবেন। অসুবিধের কিছু নেই।’
না থাকলেও শ্যামলের পরামর্শমতো সহদেব পাউরুটি, মাখন আর কলা কিনে নিল।
‘চিনিটা বাড়ি থেকে দিয়ে দেব। বুঝলেন বারো ঘণ্টার ধকল, শরীরটা হালকা, ঝরঝরে রাখা দরকার। এইসব হোটেল আর ধাবার মশলা দেওয়া রিচ খাবার না খাওয়াই ভালো। আর দামও নেবে অসম্ভব। আমার ওয়াটারবটল আছে, জল ফুরিয়ে গেলে পথে ভরে নিতে পারবেন।
বাজারটার মধ্যে ঘুরে দেখার ইচ্ছা হল সহদেবের। কলেজে পড়ার সময় রোজই সে বাজার করত। তারপর দায়িত্ব নেয় বাসুদেব। কিন্তু চাকরি নিয়ে সে দুর্গাপুরে চলে যাবার পর থেকে এখন পর্যন্ত বিদ্যুৎই করে যাচ্ছে। তবে মাঝে মাঝে সহদেবকে বাজার যেতে হয় যখন বিদ্যুতের মদ খাওয়াটা বেশি হয়ে যায়।
‘সহদেবদা, একটু তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে, রান্নাবান্না আছে। আজ তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ুন। আপনার তো দেরিতে ওঠা অভ্যেস, কাল কিন্তু সকাল সকাল উঠতে হবে।’
বাজার থেকে বেরিয়ে আসার আগে সহদেব মাছের দিকটায় একবার চোখ বুলিয়ে মুগ্ধ স্বরে বলল, ‘শ্যামল, এ তো চাঁদের হাট! পার্শে, ট্যাংরা, পাবদা, বাগদা, পুঁটি, মৌরলা। ঝকঝকে টাটকা আর কী সব সাইজ! কাতলা-রুই এক একটা তিন-সাড়ে তিন কেজি তো হবেই। ইচ্ছে করছে কিনে কলকাতায় নিয়ে যাই।’
‘আপনার ট্রেন পরশু, কলকাতায় পৌঁছবেন তরশু। ততক্ষণে পচে যাবে।’
‘শুধু মাছ কেন, সব কিছুই বেশি সময় দিলে পচে যায়।’ সহদেব কথাটা বলেই নিজের ওপর বিরক্ত হল। এই রকম খেলো দার্শনিক কথাই তো বুঝিয়ে দেয় সে একটা কেরানি। কিন্তু শ্যামলকে তো আর তা বলা যায় না।
‘ফিরে এসে সহদেব বলল, ‘এবার একটু মদ খাব, কোনটে এনেছ?
‘রাম, হুইস্কি দুটোই আছে। আমি প্রেফার করি রাম।’
‘ওটাই খাব।’
রান্নাঘর থেকে রাম আর জল মিশিয়ে গ্লাসটা সহদেবের হাতে দিয়ে শ্যামল বলল, ‘দেখুন তো আর জল দেব কি না।”
চুমুক দিয়েই মুখ কুঁচেকে সে চোখ বুজে ঢোঁকটা গিলে নিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে।’
‘একটু বেশিই জল দিয়েছি।’
‘না না ঠিক আছে। তোমার কই?’
‘রান্নাঘরে রয়েছে, রাঁধতে রাঁধতে খাব। ডালটা করাই আছে, ভাত, বেগুন ভাজা আর কালোজিরে দিয়ে ঝোল। একঘণ্টার মধ্যেই হয়ে যাবে।..টিভি দেখবেন?’
‘না, না।’ সহদেব প্রায় আঁতকে উঠল। ‘আমার এখনও নেশা হয়নি, পারব না দেখেতে। একতলায় শমির ঘরে একটা আছে, সাদা-কালো, সব সময়ই চলছে। ওর একটিই মেয়ে সেবা, তার জন্যই টিভি খুলে রাখে। বেচারার একটা পা পোলিওয় গেছে। ক্রাচ নিয়ে চলে, দেখে বড়ো কষ্ট হয়। ক্লাস ফাইভে পড়ে, আঁকার হাতটা খুব ভালো। টিভি-তে বিজ্ঞাপন দেখতে সেবা খুব ভালোবাসে’। এই কটি কথা বলার মধ্যেই সে দুটো চুমুকে গ্লাসের অর্ধেকটা শেষ করেছে।
‘আপনি একা, খাওয়া-দাওয়া কী বোনের কাছেই?’ শ্যামল রান্নাঘরে ঢুকে সেখান থেকেই সামান্য গলা চড়িয়ে বলল।
‘তাছাড়া উপায় কী! পাঁচশো টাকা মাসে দিই। খানিকটা অবশ্য ওদের হেল্প করাও হয়।’ সহদেবও একটু গলা তুলল। ‘বুঝলে শ্যামল, এই এজমালি বাড়ির অংশীদার হওয়াটা একটা ঝঞ্ঝাটে ব্যাপার। এর থেকে ভাড়াটে হয়ে কোথাও থাকা অনেক নিশ্চিন্তের।…তিন ভাই, দু-বোন, পাঁচ ভাগ করলে কী সেকেলে প্ল্যানে তৈরি পুরোনো বাড়িতে বাস করা যায়? তাও আমি বিয়ে করিনি, দাদা বিলেতে থাকে, প্রচুর কামাচ্ছে। সে এ বাড়িতে পেচ্ছাপ করতেও আসবে না। সল্ট লেকে জমি কিনেছে।’
শ্যামল ঘরে এসে খালি গ্লাসটা তুলে নিয়ে যাবার সময় বলল, ‘বেশি জল দিয়েছিলাম, এবার কী একটু কম দেব?’
সহদেব সম্মতি জানিয়ে মাথা হেলাল। শ্যামল ব্যস্তভাবে রান্নাঘরে ফিরে গেল।
‘বাসুটা একেবারেই অন্যরকমের, এক ইঞ্চিও ছাড়তে রাজি নয়। দোতলায় একটা ঘর তালা মেরে রেখে দিয়েছে। একতলায় শমি দেড়খানা ঘর নিয়ে কেন থাকবে তাই নিয়ে বাসুর সঙ্গে ঝগড়া, আমার সঙ্গেও ঝগড়া। নীচের পুরোনো রান্নাঘরেই শমি রান্না করে। অধিকার ফলালে আমাদের তিনজনেরই তো তিনটে রান্নাঘর, দরকার, কল-পায়খানাও। বল তো-।’ হাত বাড়িয়ে গ্লাসটা নিয়ে সেটা চোখের সামনে তুলে, সহদেব রঙের গাঢ়ত্ব পরীক্ষা করল।
শ্যামল যাবার সময় বলল, ‘এবার একটু আস্তে খান।’ সহদেব জবাব দিল না। তার মধ্যে একটা রাগ ফেঁপে উঠতে চাইছে, এটা বুঝতে পেরে সে সাংসারিক কথাবার্তার বাইরে নিজেকে রাখবে ঠিক করল।
‘তুমি তো রাজধানীতেই যাওয়া আসা কর শ্যামল। লক্ষ করেছে, সময়টা বড়ো বেশি লাগছে?’
নিজের গ্লাস হাতে নিয়ে শ্যামল ঘরে এল। খাটে আধশোয়া সহদেবের পাশে টুলটা টেনে এনে বসল।
‘ভাত বসিয়েছি। বলছিলেন, সুপারফাস্ট রাজধানী এক্সপ্রেসের কথা? দেখুন, ঘণ্টায় একশো কি একশো দশ কিলোমিটার স্পিডে ট্রেন চালাতে গেলে রেলওয়ে ট্র্যাক, সিগন্যাল, আর কোচগুলোর যে মেইনটেনান্স দরকার সেটা একদমই করতে পারেনি। ফলে অ্যাকসিডেন্ট বেড়েছে, বেশি স্টেশনে থামতে শুরু করল পলিটিক্যাল প্রেসারে, ফলে স্পিড কমল। অথচ বাহাত্তর সাল থেকে টিকিটের দাম বাড়িয়ে চলেছে, টাকার লোভে কোচ-এর সংখ্যা বাড়িয়ে স্পিড আরও কমিয়েছে। এতে রেলের লাভ বেড়েছে। জানেন এখন ভারতে বাহাত্তরটা সুপার ফাস্ট ট্রেন আর তাদের অ্যাভারেজ স্পিড, শুনলে হাসবেন… পঁয়তাল্লিশ থেকে পঁয়ষট্টির মধ্যে! সুপারফাস্ট নাম দিয়ে টিকিটের উপর লেভি বসিয়ে রেল টাকা কামাচ্ছে, বছরে দশ কোটি টাকা! দেশের সবথেকে বড়ো মোনোপলি কীভাবে লোক ঠকাচ্ছে ভাবতে পারেন? না আছে স্পিড, না পাওয়া যায় সুখস্বাচ্ছন্দ্য।’
‘ক্যালাস, ক্যালাস, দেশের মানুষ ক্যালাস।’ সহদেব উত্তেজিত হয়ে গ্লাসে বড়ো চুমুক দিল। ‘পৃথিবীতে বহু দেশে এখন সুপার ফাস্ট ট্রেন চলে ঘণ্টায় তিনশো-চারশো কিলোমিটার স্পিডে আর ভারতে আশি কিলোমিটারের নীচে চললেই সেটা সুপারফাস্ট। এ দেশের কী কিছু হবে?’ সহদেব চোখ বিস্ফারিত করে উত্তরটা পাবার জন্য তাকিয়ে রইল।
শ্যামল ধীরে দুবার মাথা নাড়ল।
‘সুপারফাস্ট চালাবে বলে তুমি লেভি বসিয়েছ, তাহলে ঠিক সময়ে আমায় পৌঁছে দিতে হবে, এ জন্যই বাড়তি টাকা আমি দিচ্ছি। লেট করে পৌঁছে দিলে টাকাটা তাহলে ফেরত দাও! কেউ চায় না বলেই লেটে চালায়।’ সহদেব উঠে বসল, কথাটা বলে সে স্ফূর্তি বোধ করল। এই মেজাজটা তাকে ধরে রাখতে হবে। গ্লাস খালি করে শ্যামলের দিকে বাড়িয়ে ধরল।
শ্যামল উঠে রান্নাঘরে গেল। ছাদের খোলা দরজা দিয়ে সহদেব বাইরে তাকিয়ে ভাবল, রাজধানী যদি লেটে হাওড়ায় পৌঁছয় তাহলে কী সে রিফান্ডের জন্য দাবি জানাবে? ফেরত নিশ্চয়ই দেবে না, কিন্তু হইচই তোলা যাবে কি? যাবে না। এ দেশে এ সব নিয়ে কেউ মাথাই ঘামাবে না। আমিও কী ঘামাব? আবার কবে সুপারফাস্ট ট্রেনে চড়ব তার ঠিক নেই! ঘোরাঘুরি অবশ্য তার ভালো লাগে না। তাজমহল দেখার ইচ্ছেটা বহু বছরের তাই যাচ্ছে। সাহিত্য ভারতীর সম্পাদকের কথাটা, ‘স্বচক্ষে একবার দেখে আসুন’ প্রায়ই মনে না পড়লে তার কোনো আগ্রহই থাকত না।
গল্পটা এখনও কী র্যাকে ফাইলের মধ্যে আছে? পুরোনো জিনিস সাধারণত সে ফেলে দেয় না। কেয়া ওটা কী আবার নিয়ে গেছে? নিয়ে গিয়ে নিজের কাছে রেখেও দিতে পারে। সুভেনির! কাগজে বিজ্ঞাপন দেখেছিল। কেয়ার রাগপ্রধান গানের ক্যাসেট বেরিয়েছে।
‘কী হল শ্যামল?’ সহদেব তাগিদ দিয়ে উঠে গেল আয়নার সামনে।
‘ভাতটা নামিয়েই যাচ্ছি।’
চুলে একটা সাদা পটি, ঠিক সিঁথির উপর দিয়ে গেলে কী ভালো দেখাবে! কানের উপরে কয়েকটা মাত্র পেকেছে, কলপ দিলেই চুঁকে যাবে। সহদেব চুলচেরা বিচার করার জন্য মুখটাকে আয়নার আরও কাছে নিয়ে গেল। এবং তখনই তার চোখে ধরা পড়ল।
সে ক্লান্ত।
প্রতিদিন অফিসের বাঁধাধরা কাজ, কাগজের অফিসে সিনেমা-মঞ্চ বিভাগের বা পাবলিশারের ঘরে গিয়ে বসা, নাটক দেখা, বইয়ের দোকানে নতুন বই ওলটানো, লাইব্রেরিতে যাওয়া, থিয়েটারের কারুর বাড়িতে গিয়ে আড্ডা, রাত করে বাড়ি ফিরে পড়তে শুরু করা বা লেখার জন্য বসা আর দেরিতে বিছানা থেকে ওঠা। মোটামুটি এই গণ্ডিটার মধ্যেই তার যা কিছু সফর, যা কিছু দেখা, যা কিছু শোনা। খুবই ছোটো গণ্ডি তাই বহু বিষয়ে সে অল্প জ্ঞানসম্পন্ন লোকের সঙ্গেও কথা বলতে পারে না। এই যে শ্যামল সুপারফাস্ট ট্রেন নিয়ে এত বলল, এ সব তো সে জানতই না!
চোখের নীচে, চোয়ালে, গলার কণ্ঠায়, ঠোঁটের কোণে সে যা দেখছে সেগুলো একঘেয়ে জীবন থেকে থিতিয়ে থিতিয়ে জমে যাওয়া ক্লান্তি। চোখের সাদা অংশটা অনুজ্জ্বল, চাহনি নিষ্প্রভ। এইরকম চোখ শমি বা বিদ্যুতেরও নাকের দুপাশে সে দেখতে পায়। ওরা নিজেদের মধ্যে হাতহাতিও করে, চিৎকার তো নিয়মিতই।
বাড়িতে থাকতে ইচ্ছে করে না বলেই সে যতটা পারে বাইরে থাকে। এজন্য পড়ার বা লেখার সময়টা অনেক কমে যায়। এজন্য তার খেদ আছে। সেই খেদ জমে জমে হয়তো এখন মুখের কোথায় একটা ভাঁজ তৈরি করার কাজে ব্যস্ত।
‘বুঝলেন সহদেবদা,’ গ্লাস হাতে শ্যামল ঘরে এল, সহদেবের হাতে সেটা ধরিয়ে বলল, ‘অ্যাকসিডেন্ট হবে না কেন, বাইশ হাজার কোটি টাকা দরকার সারা ভারতবর্ষের রেলের ট্র্যাক বদলাতে। এরকম অবস্থা হল কেন?’
সহদেব ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে বুঝিয়ে দিল উত্তর সে জানে না।
‘খুব সোজা…কবেকার সেই পুরোনো লাইন, পুরোনো সিগন্যালিং, কিছুই মেইনটেন্ড হয়নি, বদলানোও হয়নি। চলছে, চলুক, কাজ তো চলে যাচ্ছে! এই মেন্টালিটির ফল এখন ফলছে।…দেখুন না, বৃষ্টি হলেই কলকাতার রাস্তা খালবিল হয়ে যাচ্ছে। আদ্যিকালের ড্রেনেজ ব্যবস্থা, যুগ যুগ ধরে পরিষ্কার করা হয়নি। ওই, চলে তো যাচ্ছে মেন্টালিটি! ভবিষ্যতে জনসংখ্যা বাড়বে তার ফলে চাপও বাড়বে আর সেই মত বদলাতে হবে বাড়াতে হবে, সেটা আর আমাদের মাথায় আসে না। যা চলে আসছে সেটাই চলুক, বদল করতে গেলে একবার থমকে দাঁড়াতেই হবে, আমরা ওটাকেই ভারি সর্বনাশ হয়ে গেল বুঝি।….এই গ্লাসটা শেষ হলেই কিন্তু খেতে বসব।’
সহদেব, ‘হ্যাঁ, খেতে বসব’ বলে বিছানায় এসে বসল। ‘এই মেন্টালিটিটা এল কোথা থেকে?’
শ্যামলকে একটু বিব্রত দেখাল। এই রকম বিষয়ের প্রশ্নে একশো উত্তর হয়। কিন্তু প্রশ্নকারীর নিজস্ব একটা উত্তর থাকবে যেটা অবশ্যই উদ্ভট ধরনের হবে। সহদেব অবশ্য দশ সেকেন্ডের বেশি শ্যামলকে অস্বস্তির মধ্যে রাখল না।
‘আমি যখন পারিবারিক জীবনকে দেখি তখন বুঝতে পারি অনেক কিছু সামাজিক বোধ, চেতনা বা এখনকার দিনে অচল, হাস্যকর, ক্ষতিকরও, সেগুলো বদলানো দরকার। কিন্তু বুঝেও আমি বদলাবার জন্য চেষ্টা করি না। চলছে চলুক, আমার আর কী? এই মেন্টালিটি আমার মধ্যেও রয়েছে।’
‘রাম খেয়ে দেখছি আপনি আত্মসমালোচক হয়ে পড়ছেন।’
‘মাঝে মাঝে যারা খায় তাদের এইরকমই হয়। মেয়ের পোলিও সারাবার জন্য শমি মানত, পুজো, কোথায় গিয়ে যেন গাছে ইটও বেঁধে এল। মেয়ের কোমরে একদিন একটা মাদুলি দেখে রেগে গিয়ে আমি সুতোটা কেটে দিলুম। অবৈজ্ঞানিক জিনিস সহ্য করা মানে নিজের শিক্ষাদীক্ষাকে অপমান করা। কিন্তু শমি এসে চেঁচিয়ে যাচ্ছেতাই করে আমাকে বলল, তার মেয়ের ভালোমন্দ সে বুঝবে। মেয়ের কল্যাণ কীসে হয় ভালো করেই সে তা জানে। বিদ্যুৎও আমাকে দুকথা শোনাল।’
‘আর আপনি টাকা দিয়ে এদের কাছে দুবেলা খান!’
‘ওইটের জন্যই ওদের সব চিৎকার, অপমান আমি মেনে নিলুম। তাহলে বাইরে হোটেলে খেতে হয়, তা আমি পারব না। অথচ এই শমির মুখ বন্ধ করার ওষুধ আমার কাছে আছে।’ সহদেব গলা নামাল, ঠোঁটদুটো চওড়া হল নিঃশব্দ হাসিতে। ‘কিন্তু সে ওষুধ আমি প্রয়োগ করতে পারব না। হাজার হোক বোন তো, বংশেরই মেয়ে।’
ওষুধটা কী, শ্যামল তা জানার জন্য আগ্রহ দেখাল না। দেখাবে না, সহদেব তা জানে। কিন্তু রক্ত চলাচলের এবং হৃৎপিণ্ডের বেগ বেড়ে গেছে। সে এখন অনেক কথা বলতে চায়। কাচের দরজার এধারে দাঁড়িয়ে থেকে থেকে সে বিরক্ত। একটা স্থায়ী ছায়া কাচে লেগে রয়েছে, সেটাকেই সে মুছে দিতে চায়।
‘জানো শ্যামল, বিদ্যুৎ ওর বউকে রাতে পেটাচ্ছিল, গালাগাল দিচ্ছিল, ‘খানকি মাগি’ বলে। আমারই বোন, তাই সহ্য করতে না পেরে নীচে নেমে গেলুম। এবাড়ি ওবাড়ি থেকে মুখ উঁকি দিচ্ছে। বাইরে আমার একটা মানসম্মান আছে। গিয়ে বিদ্যুৎকে একটা চড় মারলুম। ও কী বলল জান?…বলল, ‘আপনারা সব করাপ্ট। এই করাপ্টেড মেয়েটার সঙ্গে আমার বিয়ে দিয়েছেন অথচ বড়ো ভগ্নিপতির সঙ্গে ওর ইল্লিসিট রিলেশন ছিল, এখনও আছে। লোকটা মাঝে মাঝে দুপুরে আসে তা কী আপনি জানেন?’ দুপুরে বাড়ি থাকি না তাই এ সব কিছু জানিও না। কিন্তু আমায় কী বলল জানো? একটা কুমারী মেয়েকে বিয়ে করব প্রমিস করে তাকে আমি ভোগ করেছি তারপর ভাগিয়ে দিয়েছি। আশপাশের বাড়ির লোকেরা কথাগুলো শুনল!’
সহদেব পরপর দুটো চুমুক দিল। শ্যামল তাকে বাহু ধরে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বলল, ‘বসুন। আস্তে খান। অ্যাতো এক্সাইটেড হচ্ছেন কেন? বলেছে তো বলেছে। এ কান দিয়ে শুনে ও কান দিয়ে বার করে দেবেন।’
‘আমার বিদ্যেবুদ্ধি রুচির সঙ্গে মেলাতে পারি না। এদের মনে হয় সিক্সটিন্থ সেঞ্চুরির লোক। ইচ্ছে করে-‘সহদেব কথা খোঁজার জন্য থেমে গেল। কয়েক সেকেন্ড পর মন্থর স্বরে বলল, ‘ওই ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারে ঘর থেকে বারান্দায় বেরোবার দরজাটা ঠেলাঠেলি করেও খুলতে পারিনি। খুব ইচ্ছে করেছিল একবার বারান্দাটায় গিয়ে দাঁড়াতে। …ইচ্ছেই শুধু হয়। খুব ইচ্ছে করেছিল আমার পাশে বসা সেই মহিলাটির নিতম্ব দেখতে, যিনি তার অজান্তেই সেক্সুয়ালি আমাকে খুঁচিয়েছিলেন।’ সহদেব হাসিতে মুখ ভরিয়ে তুলল।
‘খোঁচা খাওয়ার কথা জানিয়ে, আমি যে অ্যাডাল্ট, এটা আপনি স্বীকার করলেন।’
‘কেন, অস্বীকার করব কেন? চল্লিশের কাছাকাছি হয়েছ তো?’
‘বেশিই। তবে সহদেবদা, বাড়িটা আপনি ছাড়ুন। আর বিয়েও করুন। ভালো থাকবেন।’
‘কথাটা আগেও ভেবেছি তবে এবার সিরিয়াসলি ভাবব।’
শ্যামল রান্নাঘরে ফিরে গেল। নীচু হয়ে আধখাওয়া গ্লাসটা খাটের নীচে মেঝেয় রেখে সহদেব টানটান হয়ে বিছানায় শুল। বেশি বকা হয়ে গেছে, অবশ্যই অ্যালকোহলের প্রভাবে। কিন্তু আর নয়। তাজমহলের মতো একটা জিনিস কাল দেখতে যেতে হবে। সে জন্য মনটাকে পরিচ্ছন্ন অন্যরকম করে রাখা দরকার।
কিছুক্ষণ পর শ্যামল তাকে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে বলল, ‘খেতে চলুন।’
চার
সহদেবকে নিয়ে অটোরিকশায় মিনিট চারেকেই নেহরু প্লেসে পৌঁছে শ্যামল বলল, ‘ফেরার সময় এইখানেই নামবেন, অটোরিকশা ধরে আমার ওখানে চলে আসবেন। রাতে একসঙ্গে খাব।’ আর এই সানগ্লাসটা রাখুন। এখনকার রোদ বড়ো চড়া, বাইরে তাকালে চোখ জ্বালা করে।’ ঠিকানাসহ ‘গ্লোব ট্র্যাভেলার্স’ লেখা রয়েছে সাদা বাসের গায়ে এবং লম্বা একটা বোর্ডে ছাদেও।
বাসের নম্বরটা রসিদে লিখে দিয়েছিল, সুতরাং পেট্রল পাম্পে অপেক্ষমাণ বাসটিকে সহজেই চিহ্নিত করা গেল। লাক্সারি বলতে পুরু গদির সিট। যার পিঠটা পিছন দিকে ইচ্ছা করলে কিছুটা হেলিয়ে দেওয়া যায়। বাসটা প্রায় নতুনই।
কখন ছাড়বে জানার জন্য শ্যামল ড্রাইভারের সহকারীকে জিজ্ঞাসা করে এসে বলল, ‘দিল্লির দু-তিনটে পয়েন্ট থেকে প্যাসেঞ্জার তুলে একটা পিক-আপ বাস আসবে। তারপর ছাড়বে। আপনি কী এখুনি উঠে বসে থাকবেন নাকি একটু চা খেয়ে নেবেন?’
‘সিটটা জেনে নিলে ভালো হয়।’
শ্যামল পিছনের কাচের পাল্লাটা দেখিয়ে বলল, ‘জেনে নিয়েছি, একদম শেষে জানালার ধারে। থলেটা আর ওয়াটার বটলটা বরং রেখে দিয়ে আসি।’
জিনিস দুটো রেখে দিয়ে শ্যামল বাস থেকে নেমে বলল, ‘সব সিটই প্রায় ভরা, আপনার পাশেরটা খালি রয়েছে, বোধহয় পিক-আপে আসবে।’
সহদেব গোটা বাসটার উপর চোখ বোলাল। ত্যাবড়াতোবড়া, রং-চটা, খোঁচা বার করা কলকাতার প্রতিদিনের বাসের মতো নয়। এটা তাকে খুশি করল। সুশ্রী, নিটোল, মসৃণ এবং উজ্জ্বল এমন চেহারার বাসে চড়ে যেতে আরামই লাগবে এমন একটা ধারণা তৈরি হওয়ায় সে স্ফূর্তি পেল।
জানালার কাচের পাল্লাগুলো সরিয়ে দিয়ে যাত্রীরা অপেক্ষা করছে। মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে অবশ্য তার স্ফূর্তিটা বাড়ল না। বয়স্ক গেরস্ত, ভারিক্কি, সংসার সামলাতে ব্যতিব্যস্ত, এইসব লোকেরাই যেন বেশি। তার ঠিক সামনের সিট দুটোয় এক তরুণ দম্পতি। মেয়েটি গম্ভীরমুখে একটা কিছু পড়ছে, পুরুষটি কলা খাচ্ছে। দুজনের মুখ ভালোভাবে দেখা না গেলেও তারুণ্যের সান্নিধ্যে থাকবে জেনে সে প্রসন্নতা ফিরে গেল।
রাস্তার ধারে চৌকিতে চায়ের দোকান। ভাঁড়ে চা খেতে খেতে সহদেব লাজুক স্বরে বলল, ‘জান শ্যামল, আমার বাইশ বছরের ইচ্ছেটা আজ পূর্ণ হতে চলেছে। এতকাল শুধু ছবিতে আর সিনেমার পর্দায় দেখেছি।’
‘এর পরের বার যখন আসবেন বাহাইদের লোটাস টেম্পলটা দেখে নেবেন। এই তো, পাশের এই রাস্তাটা দিয়ে মিনিট দশেক হেঁটে গেলেই …খুব ভালো লাগবে। দেখতে শ্বেতপদ্মের মতো, তাকে ঘিরে বিশাল ফুলের বাগান। শান্ত, নির্জন। যেকোনো ধর্মের, জাতের লোক গিয়ে চুপচাপ বসে নিজের ভগবানকে স্মরণ করতে পারে। …ওখানে গেলে ধ্যান করতে ইচ্ছেও হবে।’
‘আমি তো একেবারেই নাস্তিক, তবে তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে মন্দিরটা দেখা উচিত। সুন্দর আর্কিটেকচারাল ওয়ার্ক দেখতে তো ভালোই লাগবে। দেখি আবার কবে-।’
একটা বাস এসে থামল। জনা চারেক লোক নেমে অপেক্ষমাণ বাসটার দিকে এগোলর্।
‘সহদেবদা এবার আপনার বাস ছাড়বে, বাকি প্যাসেঞ্জাররা এসে গেছে।’
কী যেন তার মনে হওয়ায়, সহদেব সানগ্লাসটা পরে নিল। একটা হালকা স্নিগ্ধতা চোখে নিয়ে সে বাসে উঠল। দরজা দিয়ে উঠে বাঁ দিকে লম্বা সিট, যাতে চারজন বসতে পারে। ডানদিকে দুটো সারির মাঝ দিয়ে যাবার সময় যাত্রীদের মুখগুলো দেখে নিতে নিতে চোখটা এক সেকেন্ড বেশি রইল তার সামনের সিটে জানালার ধারে বসা মেয়েটির মুখে।
‘এক্সকিউজ মি।’
প্রৌঢ় লোকটি মুখ তুলে সহদেবের দিকে তাকিয়ে সিট থেকে উঠে বেরিয়ে এল। নিজের সিটে বসার জন্য দেহটাকে বাঁকিয়ে ঢোকার সময় সহদেব দুজনের মাথার উপর দিয়ে নজর বুলিয়ে নিল। পুরুষটি ফর্সা, টিকোলো নাক, চওড়া শক্ত চোয়াল, চওড়া কবজি, সোনালি ধাতুর ব্যান্ডে ভারী ঘড়ি, নীল টি-শার্ট, খয়েরি ট্রাউজার্স। চাঁদিতে টাকের ক্ষীণ আভাস। পেটের কাছটা ফুলে রয়েছে! এই বয়সেই ভুঁড়ি! বয়সটা পঁয়ত্রিশের কাছাকাছি। পুরুষটির তুলনায় মেয়েটির জৌলুস অনেক কম। উজ্জ্বল শ্যাম টেনেটুনে বলা যায়। সরু গলা, লম্বাটে মুখ, মোটা ভুরু। সামগ্রিক গড়নটাই রোগাটে। কবজিতে পুরুষ ঘড়িটা কালো চামড়ার ব্যান্ডে। লাল সবুজ ফুলের এমব্রয়ডারি কামিজে। কপালটা একটু উঁচু এবং সর্ষেদানার মতো হিরের নাকছবি যে নাকটিতে সেটি মাঝখানে চাপা কিন্তু ডগাটি তোলা। চুল আলগা খোঁপায় বাঁধা। সহদেবের মনে হল মেয়েটি বেশ লম্বা, সাড়ে পাঁচ ফুটেরও বেশি হতে পারে। বয়স পঁচিশ-ত্রিশের মধ্যে।
‘থ্যাঙ্ক-ইউ।’ নিজের সিটে বসে সহদেব পাশের প্রৌঢ়কে বলল।
লোকটি দুদিকে মাথা নেড়ে, ‘অলরাইট, অলরাইট, নিড নট মেনশন।’ বলে হাসল। ভালো দাঁত, একদিনের কাঁচাপাকা দাড়ি, মোটা কালো ফ্রেমের চশমা, সাদা হাফ শার্ট, ধুতির লুঙ্গি। অবশ্যই দক্ষিণ ভারতীয়। তবে কেরলের না তামিলনাড়ুর কথা বললেও সে বুঝতে অক্ষম। দেখে মনে হচ্ছে শিক্ষক বা হোমিওপ্যাথ। একাই।
বাস ছাড়ার সময় সে হাত নাড়ল শ্যামলের উদ্দেশ্যে। একমাত্র তাকেই বিদায় জানাতে একজন হাজির। সহদেবের মনে হল তাজমহল দর্শনার্থীদের সবাই দিল্লির বাইরের লোক। এদের মধ্যে বাংলায় কথা বলে কজন? পাশের জন্য বাঙালি নয়। চোখের সামনে দেওয়ালের মতো দুটো চেয়ারের পিছন, যার উচ্চচতা উপবিষ্টদের মাথা ছাড়িয়ে উঠে আছে। তার অবস্থানটা একটু কোণঠাসাই। একমাত্র বাঁদিকের জানলাটা ছাড়া আর কোনোদিকে চোখ রাখা যাচ্ছে না। ইংরেজি খবরের কাগজটা সে মুখের সামনে খুলে ধরল।
কিছুক্ষণ পরেই সে দেখতে পেল চোখ রাখার আরও একটা জায়গা আছে!
কাগজটা সে নামিয়ে নিল সামনের সিটে দুজনের কথা কানে আসায়।
‘দশটাতেই শুরু করে দিলে?’
‘হ্যাঙ্গওভার কাটাতে…কাল বড্ড খাওয়া হয়ে গেছে। …তুমি একটু?’
‘না।’
একটু কঠিনই শোনাল মেয়েটির ‘না’। স্বরটি গভীর ও চাপা। তাহলে বাঙালি। দুটো সিটের মাঝে ইঞ্চি তিনেক ফাঁক। দুজনের কাঁধ, গলা এবং মুখের পাশ সহদেব দেখতে পাচ্ছে। পুরুষটির এক হাতে ফ্লাস্ক অন্য হাতে প্লাস্টিকের সাদা গ্লাস। মুখ উপরদিকে তুলে চোখ বন্ধ করে। মেয়েটি জানালার দিকে মাথা হেলিয়ে। সম্ভবত জিন খাচ্ছে। স্বামী-স্ত্রী। বিয়ে সদ্য নয়, হনিমুন নয়, প্রেম করেই বোধহয়।
সে কাগজটা আবার তুলে ধরার আগে দেখল স্বামী অর্থাৎ পুরুষটি এক ঢোকে গ্লাসটা শেষ করে চোখ খুলল।
‘বাইরে কিছু কি দেখার আছে?’
‘আছে।’ আবার কঠিন স্বর।
সহদেব বাইরে তাকাল। একতলা বাড়িই বেশি। কংক্রিট আর ইটের কিন্তু এত নোংরা আর কদাকার। প্রায় বস্তির মতোই। দোকান আর দোকান, ট্রাক আর লরি। সাইনবোর্ড থেকে জানল এখন তারা ফরিদাবাদে।
বোধহয় মান-অভিমানের মতো কিছু একটা চলছে। মেয়েটি যথেষ্টই রেগে রয়েছে। কাল বেশি খেয়ে হয়তো কিছু একটা কেলেঙ্কারি করেছে…..বমি! বউকেই পরিষ্কার করতে হয়েছে। কিংবা একঘর লোকের মাঝে দড়াম করে পড়ে, বেহুঁশ হয়ে থাকে। বউকেই ধরাধরি করে বাড়িতে নিয়ে যেতে হয়েছে।
‘কাল ফ্লাইট কটায়?’ মেয়েটির গলা।
‘কেন, বাড়ির জন্য মন কেমন করছে?…ভোরে উঠতে হবে তো? ঠিক উঠে পড়ব।’
একটু পরে।
‘কী খাবার এনেছ? আমি কিন্তু কিছু খাব না।’
‘কিছু আনিনি।’
‘সারাদিন উপোস!’
উত্তর হল না। সহদেবের পাশের যাত্রীটির মাথা বুকের দিকে ঈষৎ ঝোঁকানো। এরও বোধহয় রাতে ঘুম হয়নি। সহদেব কাগজ মুড়ে চোখ বন্ধ করল। অত ভোরে ওঠা তার অভ্যাস নেই। চোখ ভারভার লাগছে। বাস ঘণ্টা আড়াই মাত্র চলেছে, এর মধ্যেই ঝিমুনি আসছে।
চটকা ভাঙল বাস দাঁড়িয়ে পড়ায়। একটা ধাবা। বাইরে সাইনবোর্ড। একটা প্রাঙ্গণ তাতে গোটা দশেক ছোটো টেবল আর প্রতি টেবলে চারটে করে চেয়ার, একটি প্লাস্টিক জলপাত্র, কয়েকটি প্লাস্টিক গ্লাস। বাস থেকে সব যাত্রীই প্রায় নামল। সুশ্রী এক যুবক তাদের হাত নেড়ে নেড়ে ভিতরের একটা ঘরে যাবার পথ দেখিয়ে দিচ্ছে যেখানে তারা বসতে পারে। অবশ্যই সেটা খাবার ঘর।
সহদেব জানালা দিয়ে দেখতে পেয়েছে যা সে খুঁজছিল। ‘জেন্টস’ আর ‘লেডিজ’ লেখা দেওয়ালটা ধাবা থেকে দশ-বারো মিটার পাশে। দেওয়াল ঘেরা, চালবিহীন একটা জায়গা। বাইরের দেওয়ালে একটা বেসিন আর কল।
সহদেবের পাশের যাত্রী বাস থেকে নেমে গেছে। একমাত্র তার সামনের দুজন ছাড়া বাসটা ফাঁকা। সহদেব ওদের পাশ দিয়ে দরজার দিকে যেতে গিয়ে চকিতে আড়চোখে তাকল। মেয়েটি উৎসুক চোখে ধাবার দিকে তাকিয়ে, পুরুষটির চোখও বাইরে তবে ব্যাজার দৃষ্টিতে।
‘জেন্টস’ লেখা জায়গাটা থেকে বেরিয়ে আসার পর সে খাদ্যদ্রব্যের তালিকায় দামগুলো পড়ল।
টেবলগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখল অনেকেই শুধু চা বা কফি খাচ্ছে। ওমলেট এবং পনির মটর নিয়ে একটা টেবলে পাঁচজনের একটা দল। দশ-এর মধ্যে বয়স তিনটে ছেলেমেয়ে, এক বৃদ্ধা আর স্কার্ট পরা, ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, মুখে নানান রঙের প্রসাধনীমাখা এক স্ত্রীলোক। যার কাঠির মতো হাত-পা।
সহদেব দু টাকা দিয়ে ছোটো একটা নোংরা চিনেমাটির কাপ নিল যাতে প্রচুর চিনি দেওয়া গরম জলের সঙ্গে কফির মতো একটা কিছু মেশানো রয়েছে। কাপটা নিয়ে একটা চেয়ারে বসে সে ওই পরিবারটায় নজর দিল। চোখে পড়ার মতো লাল কালো নীল হলুদ রঙের ঝলমলে সিন্থেটিক পোশাক। স্ত্রীলোকটির চুল ঘাড় পর্যন্ত। তাতে নাইলনের ফুল কানের উপরে। দুটি টকটকে লাল কানপাশা, কীসের তৈরি কে জানে। গলায় সরু সোনার চেন থেকে একটা ক্রস ঝুলছে। তার মনে হল পরিবারটি কেরল থেকে এসেছে। অনেক টাকা স্ত্রীলোকটির হাতে। নিশ্চয় কোনো আরব দেশে ওর স্বামী চাকর বা মজুরের কাজ করে আর দেশে টাকা পাঠায়। বাচ্চচা তিনটি ওরই, বৃদ্ধাটি বোধহয় মা অথবা শাশুড়ি। উত্তর ভারত ভ্রমণে বেরিয়েছে।
সহদেবের অনুমানচর্চায় ছেদ পড়ল। গেরুয়া সালোয়ার-কামিজে এখন বুকের উপর সবুজ দোপাট্টা। কাঁধ থেকে ঝুলছে বাস কন্ডাক্টরদের মতো একটা চামড়ার ব্যাগ। তবে আকারে একটু বড়ো। সটান হয়ে হাঁটার ধরনে নিজের উপর প্রত্যয়টাই ঘোষিত হচ্ছে। মেয়েটি সোজা ‘লেডিজ’ লেখা দেওয়ালের দিকে এগিয়ে গেল। ওখানে টিনের দরজার বাইরে দুজন অপেক্ষা করছে। শ্যামলের সানগ্লাসটা যে খুবই কাজের সহদেব এখন তা বুঝতে পারল। আড়চোখেও আর তাকাবার দরকার হচ্ছে না। দেহের সঙ্গে এঁটে থাকা কামিজটা অবশ্যই দর্জি দিয়ে বানানো। লম্বা ছিপছিপে। চওড়া কাঁধ থেকে নেমে আসা পিঠ ঈষৎ সরু হয়ে কোমরের কাছে ধাক্কা খেয়ে চমকে উঠেই হুমড়ি দিয়ে গড়িয়ে গেছে। সহদেবের দৃষ্টি শুধু একটি কোনো জায়গায় নয়, মেয়েটির দেহকে সামগ্রিকভাবে ধরল। দেখতে দেখতে তার ইচ্ছা করল মেয়েটির সঙ্গে পরিচিত হতে।
মেয়েটির টিনের দরজা বন্ধ করা পর্যন্ত সে ওকে লক্ষ করল। পরিচয় করে নেওয়াটা খুব শক্ত কাজ নয়। কিন্তু নিছক সৌজন্যতার স্তর থেকে যদি কথাবার্তা স্বচ্ছন্দভাবে না নামে অর্থাৎ গায়েপড়া হয়ে তাকে যদি কথা বলে যেতে হয় তাহলে আলাপ না করাই ভালো। এরপরও একটা খিঁচ আছে, মেয়েটির স্বামী। লোকটা তাকে অপছন্দ করে উপেক্ষা দেখাতে পারে। এই সকালবেলাতেই মদ খাওয়াটা যে বউ পছন্দ করেনি তা তো কথা থেকেই বোঝা গেছে। বউকে ভালোবাসলে নিশ্চয় এটা করত না। মেয়েটি বাস থেকে নেমে এল, লোকটা সঙ্গ দিতেও নামেনি। উচিত ছিল। বউ-এর আলাপীর সঙ্গে ভালোভাবে নাও কথা বলতে পারে।
সহদেব বাসের দিকে তাকিয়ে দেখল লোকটি এখন জানালার ধারের সিটে উঠে এসেছে। হাতে প্লাস্টিকের গ্লাস। আবার খাচ্ছে! যেন সকালবেলা মদ খাবার জন্যই বাস-এ চড়ে আজ তাজ দেখার প্রোগ্রামটা নিয়েছে। বউকে অফার করেছিল, তার মানে মেয়েটিও খায় কিন্তু শোভনতা বজায় রেখে। লোকটা আজ অন্তত না খেলেও পারত। সকাল থেকে রাত, মদ না খেয়ে কী থাকা যায় না, নিজের সম্মানের কথা ভেবেও?
সহদেবের মনে হল, এই একটা ব্যাপারের মধ্যে দিয়েই ওই লোকটার হালকা, বেপরোয়া, মোটা অনুভূতির চরিত্রটা ধরা পড়েছে। এক লোকের মধ্যে এতগুলো ঘণ্টা এই ছোট্ট জায়গার মধ্যে ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকলে কেউ না কেউ জেনে যাবেই, ফ্লাস্ক থেকে বিশুদ্ধ জল খাওয়ার ভান যতই হোক না কেন। গা টেপাটেপি, হাসাহাসি অথবা গজগজ আপত্তি হতে থাকলে বউ যে একটা অসম্মানকর অবস্থায় পড়বে, সেই বোধটাই কী নেই? অথবা আছে কিন্তু গ্রাহ্য করে না।
এটার মধ্য দিয়েই ওদের সম্পর্কটা এখন কোথায় অবস্থান করছে সেটা আন্দাজ করা যায়। বেশিরভাগ স্বামী-স্ত্রী বিয়ের বছর পাঁচেকের মধ্যেই তো এইরকম জায়গায় পৌঁছে যায়। তারপর দুজনেই আবিষ্কার করে তারা ভুল করেছে। এটাও কী সেইরকম ভুল আবিষ্কার করার মতো ব্যাপার?
মেয়েটি বেরিয়ে এল। মুখে জল দিয়েছে, অর্থাৎ মেক-আপ করেনি। ব্যাগ থেকে একটা রুমাল বার করে মুখ মুছতে মুছতে এগোল কফি কাউন্টারের দিকে। সহদেব মুখ ফিরিয়ে রাস্তার দিকে তাকাল। তিনতলা উঁচু আখ বোঝাই দুটো ট্রাক যাচ্ছে। পিছনেও একটা ট্র্যাক্টর তার ট্রেলারেও বোঝাই আখ। কিছু লোক বাসে ফিরে গেছে। লোকটা সিটে মাথা রেখে মুখটা ছাদের দিকে তুলে। হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে।
মেয়েটি কাপ হাতে সামনের ফাঁকা টেবলটায় বসল। পায়ের উপর পা তুলে। দুটো স্ট্র্যাপের পাতালা বাদামি রঙের চটি। পায়ের নখে রং এবং দুই আঙুলে লাল-সবুজ মিনে করা রুপোর আঙট। সহদেব সোজা তাকালেই ওকে দেখতে পাবে পাঁচ-ছয় ফুট দূরে। সানগ্লাসটা সে চোখ থেকে খুলে ফেলল। এত কাছে চোখে এটা পরে বসে থাকলে মেয়েটি বদস্বভাবের লোক বলে মনে করতে পারে।
এধার ওধার তাকাতে তাকাতে ও একবার সহদেবের মুখের দিকেও তাকাল। তারপর ঘাড়টা নীচু করে কাপে চুমুক দিয়েই মুখ কোঁচকাল। কাপটা টেবলে রেখে দিল। সহদেব হাসল।
বাঁ হাতটা টেবলে রেখে একদৃষ্টে ও কাপটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। দুটো টাকা জলে যাওয়ার দুঃখে নিশ্চয় কাতর হয়ে পড়েনি। কিছু একটা ভাবছে। সহদেব অনুমান করার চেষ্টা করল। কিছু একটা খচখচ করছে মনের মধ্যে, নয়তো সামান্যক্ষণের জন্য একা হয়েই চিন্তায় ডুবে যাবে কেন? খুব নিকট অতীত বা নিকট ভবিষ্যৎ নিয়ে মানুষ এভাবে অন্যমনস্ক হয়, বর্তমান নিয়ে নয়। নিজেকে নিয়ে বা অন্যের জন্য দুর্ভাবনা? কোনো বিপদ হতে পারে বা ঘটে গেছে? ওর চোখে সুখ বোধ করার আভা নেই।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ও কাপটা মুখের কাছে তুলল আর সেই সময়ই বাসের হর্ন বেজে উঠল। দুবার। মেয়েটি প্রায় চমকে উঠে কাপটা টেবলে রেখে উঠে দাঁড়াল। ভালোভাবে একটা চুমুকও দেয়নি। দ্রুত বাসের দিকে ও এগোতেই সহদেব উঠে দাঁড়াল। সে তার কাপ শেষ করেছে।
মেয়েটির পিছনেই ও বাসে উঠল। কোনো সেন্টের গন্ধ পেল না। জানালায় সিটে লোকটি চোখ বন্ধ করে ছিল, মেয়েটি তাকে সিট বদল করতে না বলে খালিটায় বসে পড়ল। সহদেবের প্রতিবেশী অনুরোধ করার আগেই উঠে পড়ল। একগাল হেসে। অস্ফুটে ‘থ্যাঙ্কস’ বলে সে নিজের জায়গা নিল।
বাসের গতি এবার আরও বেড়েছে এবং সেটা রক্ষিতও হচ্ছে। রাস্তা ফাঁকা, ঝাঁকুনি নেই, এঞ্জিনের একটানা একঘেয়ে শব্দে যাত্রীদের তন্দ্রা লাগছে। বিশেষ করে জানালার ধারে বসার জন্য চোখে বাতাসের চাপ পড়ায় প্রায়ই চোখ বুজিয়ে ফেলার দায় এড়াতে সহদেব ছোট্ট একটা ঘুম আদায়ের চেষ্টা করল। ঘুম এলো না। মাঝে মাঝে চোখ খুলে সে বাইরে তাকাচ্ছে।
একসময় দেখল আকাশে ধোঁয়ার কুণ্ডলি পাকিয়ে উঠছে। মনে হল কোনো দাহ্য পদার্থের গুদামে আগুন লেগেছে। সে অবাক হয়ে জানলা দিয়ে মুখ বার করে দেখল লম্বা একটা সরু চিমনি দিয়ে আগুন উঠছে। দিনের বেলাতেও আকাশটা গোলাপি আর পাক দিয়ে দিয়ে ধোঁয়া উঠে ছড়িয়ে যাচ্ছে।
‘মথুরা অয়েল রিফাইনারিজ, দেখবে তো উঠে জানালা দিয়ে মুখ বাড়াও।’ সামনের পুরুষটি বলল।
‘এ আর দেখার কী আছে।’ নিস্পৃহ স্বরে প্রত্যাখ্যান।
সিটের ফাঁক দিয়ে সহদেব দেখল মেয়েটি মুখ নামিয়ে একটা কী যেন পড়ছে।
‘রেগে আছ?’
‘না’।
‘কলকাতায় গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।’
পুরুষের হাতটা এসে পড়ল মেয়েটির কবজিতে। চেপে ধরল।
‘বছরে একবার অন্তত বেড়াতে বেরোনো দরকার, টেনশন কাটে।’
‘কারুর কারুর তাতে বাড়েও।’
পুরুষের হাতটা সরে গেল। আঙুলে দুটো আংটি, একটা পলার অন্যটা গোমেদের। লোকটা ভাগ্যবিশ্বাসী। ব্যবসায়ী? ঘুষের চাকরি করে?
আর কোনো কথা ওদের মধ্যে হল না। সহদেব চোখ বন্ধ করল।
পাঁচ
অমর সিং গেট দিয়ে আগ্রা ফোর্টে ঢোকার সময় ভিড় দেখে শ্যামলের কথাটা তার মনে পড়ল, ‘শুক্রবার টিকিট থাকে না, ফ্রি।’ আরও চারটে লাক্সারি ট্যুরিস্ট বাস দাঁড়িয়ে। ঠেলা গাড়িতে জল বিক্রি হচ্ছে। ফিরিওলা পসরা বিছিয়ে বসে। কাঠের চালাঘরে দোকান। সহদেব বাস থেকে নেমেছে সবার শেষে।
দুপাশে খাড়া উঁচু দেওয়াল। চারটে হাতি পাশাপাশি যেতে পারে, পাথর বাঁধানো এমন একটা প্রায় তিনশো মিটার রাস্তা চড়াই-এর মতো উঠেছে। সহদেব ধীরে হাঁটছে, তার কিছুটা আগে চলেছে সামনের সিটের দম্পতি। রাস্তার শেষে পৌঁছে সে ঠিক করে উঠতে পারছিল না, ডানদিকের বাড়িটায় ঢুকবে না সামনের বাড়িটায়। বাড়ি না বলে প্রাসাদ বলাই উচিত। চারশো বছর আগে আগ্রাকে রাজধানী করে যমুনার দক্ষিণ তীরে দেড় মাইল বেড়ের এই দুর্গেই তো আকবর বসবাস করেছেন। তারপর রাজধানী হয় আরও পশ্চিমে ফতেপুর সিক্রি-তে।
দম্পতি ডানদিকের বাড়ির দিকে যাচ্ছে। পুরুষটি মন্থর, পদক্ষেপ সামান্য এলোমেলো, মেয়েটিকে মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে পড়তে হচ্ছে পাশাপাশি হবার জন্য।
বিরাট ফটক দিয়ে ঢুকে বেলে পাথরের বড়ো একটা চত্বর। ডানদিকে সার দেওয়া ঘর। ঘরগুলোর তিনদিকে দেওয়াল, সামনেটাই শুধু খোলা। সবই বেলে পাথরের। সহদেবের মনে পড়ল, ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরিতে পড়া সাহেবের লেখা বইটার একজায়গায় সে পেয়েছিল, বলিষ্ঠ পৌরুষের ছাপ মুঘল আমলের প্রথম দিকের স্থাপত্যে ধরা পড়ে। সাম্রাজ্য বাড়াবার ও রক্ষার জন্য ব্যস্ত কঠিন নির্মম রুক্ষ চরিত্রটা এই দুর্গের মেঝেয়, দেওয়ালে, গড়নে ছড়িয়ে আছে। প্রায় ষাট-সত্তর বছর পর আকবরের নাতি শাজাহানের সময় বেলেপাথরের জায়গায় এল শ্বেত মর্মরের যুগ। রুচি সৌন্দর্য, সামঞ্জস্য আর কমনীয় সুষমায় ভরা স্থাপত্য উপচে পড়ল। রাজনৈতিক নিশ্চয়তা পাওয়ায় আর সম্পদের বিশাল ভাণ্ডারের মালিক হওয়ায় শাজাহানের পক্ষে তাই সম্ভব হয়েছিল শিল্প নির্মাণে উৎসাহী হতে। বহু জায়গায় তিনি বেলেপাথর সরিয়ে সেখানে শ্বেতপাথর বসিয়েছেন দেখতে সুন্দর লাগবে বলে।
সহদেব উঁচু প্রাকারে দাঁড়িয়ে যমুনার ওপারে তাজমহল প্রথমবার দেখল। যমুনার মাঝখানে চড়া, একটা চওড়া খালের মতো তার জলধারা। চড়ায় চাষবাস হচ্ছে বোধহয়! প্রাকারের নীচে ঘন ঝোপজঙ্গল, সে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে অবশেষে হেসে ফেলল। এতদূর থেকে তাজমহলটার বিশালত্ব কিছুই প্রায় ধরা যাচ্ছে না। প্রায় অন্ধ শাহজাহান যেখান থেকে তাজমহল দেখতেন, সেই শ্বেতপাথরের একটা আটকোনা মণ্ডপ, আকারে শোবার ঘরের মতো, তারই দেওয়ালের একটা জায়গায় ভিড়। সেখানেই সহদেব দেখতে পেল দম্পতিটিকে।
পায়ে পায়ে সে ভিড়টার কাছে এল। গাইড বক্তৃতা দিচ্ছে। দেওয়ালে চিঠির খামের আকারের একটা অংশে পাথর নেই। ওখানে না স্ফটিক বসানো ছিল। শাজাহান এই স্ফটিকে প্রতিবিম্বিত তাজমহল দেখতেন। গেরুয়া চাদর গায়ে তিব্বতী বৌদ্ধ ভিক্ষুক ভিডিও ক্যামেরায় ছবি তুলছে।
‘উর্মি ওদিকে দ্যাখো।’
পুরুষটি স্ত্রীর কনুইয়ে টান দিল। মেয়েটি মুখ ঘুরিয়ে দেখল। খোলা কার্নিসের ধারে মাঝবয়সি স্বামী-স্ত্রী বসে। স্ত্রীর কাঁধে বেড় দিয়ে স্বামীর বাহু ঘোমটা দেওয়া স্ত্রীর মাথা স্বামীর কাঁধের দিকে ঝোঁকানো। দুজনের মুখ তাজমহলের দিকে। চোখ আধবোজা। এতলোক যে তাদের দিকে তাকাচ্ছে সেটা অগ্রাহ্য করেই ওরা বসে, মনে হচ্ছে যেন মানত করেছিল শাজাহানের ভূমিকা নিয়ে দুজনে এই জায়গাটিতেই একদিন বসবে।
সহদেবও ওদের দেখল এবং হেসে ফেলল। তারপরই মেয়েটির দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল এক ফালি হাসি ওর মুখেও। এই প্রথম সে ওর চোখে ঔজ্জ্বল্য দেখতে পেল। ঠোঁটে কৌতুকের ভাঁজ। হঠাৎই তার সঙ্গে মেয়েটির চোখাচোখি হয়ে গেল। একই হাসি তাদের মুখে, দুজনেই অপ্রতিভ হয়ে চোখ সরিয়ে নিল। তাহলে ওর নাম ঊর্মি, নিশ্চয়ই ঊর্মিলা।
‘এই বয়সেও কত রোমান্টিক!’ স্বামী বলল।
ঊর্মি আঙুল তুলে বাইরের দেওয়াল দেখাল। রোমান্টিক দম্পতির হাত কুড়ি দূরে কার্নিস থেকে ঝুলছে তিনটি ছোটো-বড়ো মৌচাক। ভনভনিয়ে উড়ছে মৌমাছি।
‘কামড়াবে না, ওরাও প্রেমিক। চলো ওদিকে মোতি মসজিদ, দিওয়ান ই আম, দিওয়ান ই খাস, শীশমহল আরও কী কী যেন রয়েছে।’ স্বামী যাবার জন্য পা বাড়াল।
‘আর একটু।’ তাজমহলের দিকে মুখ ফেরাল ঊর্মি। সহদেব কয়েক মুহূর্তের জন্য ওর চোখে বিষণ্ণতা দেখতে পেল বৃষ্টিভেজা বিকেলের আলোর মতো। একবার চোখের পাতা মুদল। হয়তো কিছু একটা মনে পড়েছে। বিয়ের আগেকার দিনগুলোকে কিংবা প্রাক্তন প্রেমিককে।
‘কী হল? আরে ড্রাইভার বলে দিয়েছে একঘণ্টা, খেয়াল আছে সেটা?’
সহদেব তাকিয়ে রয়েছে তাজমহলের দিকে। চোখের কোণ দিয়ে দেখল ঊর্মি চলে যাচ্ছে স্বামীর সঙ্গে। তার মনে হল ওদের সঙ্গ নেওয়ার কোনো মানে হয় না। ওরা নিশ্চয়ই লক্ষ করবে পিছনের সিটের লোকটা তাদের পিছনে লেগে রয়েছে, কিন্তু কেন? এটা নিয়ে হয়তো নিজেদের মধ্যে কথা বলবে, হাসাহাসিও হতে পারে। সে ঘড়ি দেখল, সানগ্লাসটা চোখে পরল এবং আবার পকেটে রেখে বাসের উদ্দেশে দ্রুত ফিরে চলল। তার খিদে পেয়েছে।
চিনি সহযোগে পাউরুটি, মাখন এবং কলা যে এত ভালো খাবার সহদেব সেটা তার তৃপ্তির বহর থেকে বুঝে নিল। কাগজে হাত মুছে সেটা বাসের জানলা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলার সময় দেখল অনেকেই ফিরে আসছে তার মধ্যে ঊর্মি এবং তার স্বামীও। জল খেয়ে ওয়াটার বটলটা ঝোলায় ভরে সেটা পায়ের কাছে রেখে মুখ তুলতেই ঊর্মির চোখে চোখ পড়ল। ওর ভ্রূ দুটো একটু শুধু নড়ে উঠল।
মিনিট কুড়ি পর বাস যেখানে পৌঁছল, সেখান থেকে তাজমহলের প্রধান ফটক পর্যন্ত হেঁটে প্রায় আধ কিলোমিটার যেতে হল। প্রেমের ভুবন খ্যাত সৌধ দেখতে যাবার পথের দুধারের অপরিচ্ছন্নতা আর দীন পরিবেশে সহদেবকে একটু দমিয়ে দিল। এখানেও নোংরা চায়ের দোকান, ফুটপাতে অল্প পয়সার খাবার। তার মনে হল , যেহেতু আজ দু টাকার টিকিট কেটে ঢুকতে হবে না তাই আগ্রার কাছাকাছি অঞ্চলের গরিবরা এর সুযোগ নিতে এসেছে। বাইরের ফটক দিয়ে ঢুকেই দুধারে বিভিন্ন রাজ্যের কাপড়, জুতো আর কারুশিল্পের দোকান। ঊর্মির স্বামী রাজস্থান সরকারের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে চপ্পল দেখছে। নিস্পৃহ ভঙ্গিতে অপেক্ষারত ঊর্মির পাশ দিয়ে এগিয়ে যাবার সময় আবার তাদের চোখাচোখি হল। ক্ষীণ একটা স্বতঃস্ফূর্ত হাসি সহদেবের মুখে ফুটল। ভদ্রতা দেখিয়ে ঊর্মিও তাই করল।
বাক্যকাল থেকে দেখে আসা তাজমহলের সবথেকে পরিচিত ছবিটাই সহদেবের চোখে ধরা দিল যখন সে বিশাল ফটকটার সামনে দাঁড়াল। লম্বা হয়ে চলে গেছে সিমেন্ট বাঁধান অগভীর সরু খাল, যার জলে তাজের ছায়া। তার দুপাশে পাথর বাঁধানো সরু পথ, তার ধারে সারি দিয়ে সমান মাপে কেয়ারি করা গাছ, তার পাশে সবুজ তৃণভূমি। সবার শেষে জমি থেকে হাত পনেরো উঁচু, আধখানা ফুটবল মাঠের থেকেও বড়ো সরল সাদামাটা চৌকো গড়নের মর্মর বেদি যার ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে-সহদেব বিড়বিড় করে বলল, ‘শুভ্র মেঘের দল।’
ফটকের সিঁড়ি থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে সে এগোল বাঁধানো পথ ধরে। এবার সে দেখতে পেল সরু খালে নোংরা জল, তাতে তাজের ছায়া প্রতিবিম্বিত হচ্ছে না। ফুল গাছগুলোয় যত্নের ছাপ নেই, পথের পাথরগুলো ভাঙা, দুধারের ঘাসের জমিতে হাঁটাচলা বা সেখানে নেমে ফোটোতোলা নিষেধ করে ফলক পোঁতা। বহু লোক তা মানছে না। গোটা পরিবেশটাই হইচই-এ ভরা।
সহদেব এগুলো নিয়ে নিজেকে বিরক্তিতে ভরিয়ে দিল না। আসুক, সবাই দেখুক, তাজমহল তো প্রেমের প্রতি আনুগত্য আর সৌন্দর্য সম্পর্কে একটা ধারণা। কিন্তু তার বাইরেও তো আবাক হয়ে যাওয়ার মতো একটা স্থাপত্য কর্ম। সেটা দেখলেও তো সূক্ষ্ম অনুভবগুলো সজাগ হয়ে উঠতে পারে।
পনেরো হাত উঁচু শ্বেত পাথরের বিশাল চত্বরে ওঠার আগেই সহদেব অপ্রত্যাশিত একটা মুশকিলে পড়ল। জুতো পড়ে ওঠা নিষিদ্ধ, তাজের ভিতরে যাওয়াও। এটা তো সে জানত না। সেমিনারে গণ্যমান্য বিদগ্ধজনেরা উপস্থিত থাকবে ভেবে সে দিল্লি আসার চারদিন আগে একশো সত্তর টাকা খরচ করেছে চটি কেনার জন্য। সেটা খুলে রেখে যাওয়া কোনোমতেই সম্ভব নয়। আশপাশের লোকেদের মধ্যে অনেকেরই স্বভাব সম্পর্কে সে নিশ্চিন্ত হতে পারছে না। যারা খুলে রেখে যাচ্ছে তাদের সঙ্গের কেউ না কেউ পাহারায় থাকছে।
পয়সার বিনিময়ে জুতো জমা রাখে এমন কাউকেও সে দেখতে পেল না। বিদেশি টুরিস্টদের কেউ কেউ অবশ্য জুতো অরক্ষিত রেখেই ভিতরে যাচ্ছে। সে লক্ষ করল ওদের জুতোগুলো নোংরা বটে কিন্তু দামি! জুতো চুরি গেলে ওদের গায়ে লাগবে না, অনেক টাকা হাতে নিয়ে ওরা আসে, দু-ঘণ্টার মধ্যেই আবার কিনে নেবে। কিন্তু আমার পক্ষে তো সেটা সম্ভব নয়।
সহদেব ইতিউতি তাকিয়ে যখন ভাগ্যের হাতে নতুন চটিজোড়াকে ছেড়ে দেবে মনস্থ করেছে তখনই দেখল ঊর্মির স্বামী নীচু পাঁচিলের উপর বসে তার দিকেই তাকিয়ে। ওর পায়ের কাছে বউয়ের চটিজোড়া। কপাল ঠুকে সহদেব এগিয়ে গেল।
‘আপনি ভেতরে যাননি?’
লোকটি প্রখর রোদের জন্য চোখ কুঁচকে মুখ তুলল, মাথা নাড়ল। ‘চটি পাহারা দিচ্ছি। …তাছাড়া আমার দেখা আছে। তাজমহল বাইরে থেকেই দেখতে ভালো। আপনার কি এই প্রথমবার?’
‘হ্যাঁ।’
‘ভেতরে যাবেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘চটি রেখে যেতে পারেন। তবে ও এসে গেলে আমরা কিন্তু চলে যাব।’
নেই মামার চেয়ে কানামামা, এই মুহূর্তে সহদেবের কাছে প্রার্থিত বলেই ঠেকল। চটি খুলেই সে সময় অপচয় করল না। সিঁড়ি দিয়ে তরতরিয়ে উঠে গেল।
বিশাল খিলেন। সেটা দিয়ে ঢুকেই নীচে যাবর জন্য মেঝেটা চৌকো ভাবে কাটা, কোনো রেলিং নেই। সেই কাটা মেঝে দিয়ে সিঁড়ি নেমে গেছে। সহদেব জানে শাজাহান আর মমতাজের দুটো সমাধি। একটা উপরে, সেটা নকল। আর আসলটা নীচে, সিঁড়ি দিয়ে নেমে দেখতে হবে। সে ঠিক করল আগে উপরেরটাই দেখবে।
কাটা মেঝের পাশ দিয়ে গিয়ে জালকাটা নকশাদার শ্বেত পাথরের পার্টিশনের মুখোমুখি হল। মেঝে থেকে ছ-সাত ফুট উঁচু, তিন-চার ইঞ্চি পুরু আসাধারণ মর্মর। বাইরে থেকে সমাধি দুটো যাতে না দেখা যায় সেজন্য পর্দার কাজ করছে। কী ধৈর্যে আর দক্ষতায় পাথরে নকশা তুলে ফাঁকগুলো তৈরি করা হয়েছে! সহদেব হাত বুলোতে বুলোতে ফাঁক দিয়ে ঊর্মিকে দেখতে পেল। মুখটা তুলে প্রায়ান্ধকার এই আটকোণা বিরাট ঘরটার ছাদের দিকে তাকিয়ে।
ইতস্তত ভাবটা ঝেড়ে ফেলেই সহদেব পাথরের পার্টিশানটাকে ঘুরে গিয়ে ঊর্মির সামনে দাঁড়াল। ওর মুখে বিস্ময় ফুটল।
‘আমার চটিজোড়া আপনার কর্তার জিম্মেয় রেখে এসেছি। উনি নিজেই বললেন রেখে যান তবে আপনি ফিরে গেলেই আর অপেক্ষা করবেন না, চলে যাবেন। কাজেই আমি এখন আপনাকে কী অনুরোধ করব সেটার অনুমান নিশ্চয়ই করতে পারছেন।’
‘পারছি।’ ঊর্মি হাসল। দাঁড়াবার ধরনে স্বাচ্ছল্য আনল এবং কণ্ঠস্বরে সহযোগিতার রেশ। ‘আমাকে একটু বেশিক্ষণ থাকতে হবে।’
‘যদি বিরক্ত না হন।’
‘তাজমহলে ঢুকে বিরক্ত?’ ভ্রূ দুটো চিমটি কাটার মতো উঠে গেল।
‘না না, বিরক্ত বলতে…’ সহদেব জানে কথা অসম্পূর্ণ রাখার মানে হেরে যাওয়া, সেটা মেয়েরা পছন্দ করে।
‘আমার এখনও নীচেটা দেখা হয়নি।’ ঊর্মি তাকে আশ্বস্ত করল। ‘এই দুটো নকল। নীচেরই রেপ্লিকা।’
‘সেই রকমই শুনেছি।’ সহদেব বলল না যে এই তথ্যটা সে জানে। কথা যা বলার ওই বলুক। ওর ভারি গম্ভীর স্বর তার ভালো লাগছে। তার মনের গভীরে কোনো একটা জায়গায় কম্পন তুলছে।
ওরা সমাধি দুটি ঘুরল। দেওয়ালে ফুল লতাপাতার নকশা আরও ভালোভাবে দেখার জন্য এক সাহেব সিগারেট লাইটার জ্বালিয়ে ঝুঁকে দেখছে। ঊর্মি বলল, ‘এ রকম পিওর টেক্সচার আর ডেলিকেট গ্রেইন খুব কম মার্বেলেই দেখা যায়, সকরানা থেকে আনা।’
‘আপনি তো দেখছি অনেক জানেন!’ সহদেবের বিস্ময়ে খাদের মিশেল নেইই প্রায়।
‘বাবার কাছে শোনা। প্রচণ্ড বই পড়ার নেশা, সবরকম বই, যখন যা হাতের কাছে পান পড়ে ফেলেন। উনি তাজমহল দেখেননি কিন্তু আমাকে এই মার্বল স্ক্রিনটার কথা বলেছিলেন। …দেখার মতো, না?’
ঊর্মি সরল দৃষ্টি সহদেবের মুখে রেখেছে উত্তরের প্রত্যাশায়।
‘হ্যাঁ। এখন আর এ জিনিস তৈরি হবে না।’
‘তাজমহলের মতোই?’
‘হ্যাঁ। সেজন্য শাজহান চাই, মমতাজ মহল চাই, কোটি কোটি টাকাও চাই।’
‘এসব ছাড়াও কি তাজমহল গড়া যায় না?’
সহদেব বুঝে উঠতে পারল না, কথাবার্তা কোন দিকে সে নিয়ে যাবে! সিরিয়াস দিকে নিয়ে যেতে চাইলে সে বলবে, তাজমহল তো মানুষের মনে। গরিব চাষি মজুরও তার ভাঙা ঘরে এটা বানাতে পারে যদি গভীরভাবে কোনো নারীকে ভালোবাসতে পারে, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এই মুহূর্তে একজন অপরিচিতার সঙ্গে এই স্তরে আলাপ চালানো যায় না।
‘গড়া যাবে না কেন? সহদেব ব্যাপারটা লঘু করার জন্য বলল, ‘দোকানে দোকানে তাজমহল বিক্রি হচ্ছে দুশো-আড়াইশো টাকায়, মার্বেলেরই!’
‘এবার নীচেটা দেখে আসি।’ ঊর্মি ঘড়ি দেখল। ‘কুড়ি মিনিটের মধ্যে ফেরার কথা।’ সহদেব বুঝে গেল শস্তা রসিকতা ওর পছন্দ নয়।
সরু সিঁড়ি, প্রচুর লোক ওঠানামা করছে এবং সিঁড়ির খোলা দিকটায় কোনো বেড়া নেই। ওরা হুঁশিয়ার হয়েই নামছিল তবু পিছন থেকে পিঠে ছোটো একটা ধাক্কা খেয়ে সহদেব পরের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে যাওয়া ঊর্মির কাঁধে হাত রাখতে বাধ্য হল।
কিছু কি মনে করল? সহদেব ও মুখ দেখার চেষ্টা করে ক্ষমাপ্রার্থীর স্বরে বলল, ‘পড়ে যাচ্ছিলুম, যা একটা ঠেলা মারল!’
‘আমিও সামনের লোকটাকে ধাক্কা দিয়েছি।’ মুখ ঘুরিয়ে চাপা গলায় ঊর্মি জানাল। শুনেই আড়ষ্টতা আলগা হয়ে সে ঝরঝরে হালকা বোধ করল।
উপরের থেকে নীচের ঘরটা খুবই ছোটো এবং আরও অন্ধকার। ঘরে টিমটিমে একটা ইলেকট্রিক বালব জ্বলছে। ভ্যাপসা গন্ধ। শ’য়ে শ’য়ে মানুষ আসছে, তাদের শ্বাসপ্রশ্বাস জমে রয়েছে, বার করে দেবার কোনো ব্যবস্থা নেই। খোলা সিঁড়ি দিয়ে যতটুকু হাওয়া চলাচল করে তাতে গুমোট গন্ধটা কমে না। উপরের নকল থেকে এখানকার সমাধি দুটো ছোটো কিন্তু হুবহু একই রকমের নকশা, লাল সবুজ নীল পাথরের লতাপাতায় যেন মিনে করা।
হাঁটু সমান উঁচু চাতালের মতো দুটো সমাধি। মমতাজেরটি আকারে ছোটো, দুটির মাঝে আধহাত ফাঁকা। বড়ো দুটি মোমবাতি আর ধূপ সমাধির একধারে জ্বলছে। মৌলবির মতো একটা লোক দর্শকদের দেওয়া প্রণামীর নোটগুলো ভালো করে বিছিয়ে রাখায় ব্যস্ত।
সহদেব ফিসফিস করে বলল ‘টাকাগুলো গুনুন। …একশো, পঞ্চাশ, কুড়ি টাকার নোটই দেখছি পড়েছে।’
মনে মনে গুনে ঊর্মি বলল, ‘শ ছয়েক হবে।’
‘ভাগে বেশিটা কার, শাজাহানের না মমতাজের?’
ঊর্মি আবার গুনে বলল, ‘শাজাহনেরই বেশি, সাড়ে চারশোর মতন। …চলুন বেরোই, দমবন্ধ হয়ে আসছে আর এখানে থাকা যাচ্ছে না।’
উপরে উঠে বেরিয়ে আসার সময় খিলেনের তলায় দাঁড়িয়ে থাকা, রংচটা নীল বুশশার্ট আর পাতলুন পরা একটা লোককে চেঁচিয়ে বলতে শুনল, ‘বি ওয়্যার অফ পিকককেট, জেব সামহালকে…।’
হাফ প্যান্ট পরা, লম্বা চুলের এক ছোকরা সাহেবকে বেল্টের মতো পেটে জড়ানো কালো গেঁজেটা হাত দিয়ে চেপে ধরতে দেখে সহদেব বলল, ‘আপনার ব্যাগটা কিন্তু খেয়ালে রাখবেন।’
‘আমার ব্যাগে! …কিচ্ছু পাবে না। দেখলেন তো, মমতাজের বরাতে কটা টাকা! মমতাজ ভালোবেসেছিল বলেই যে শাজাহান তাজমহল তৈরিতে ইন্সপায়ার্ড হয়েছিল এটা কেউ আর বোঝে না!’
‘মমতাজের রেটিং যে এত পুওর, ভাবতেই পারি না! আমার মনে হচ্ছে লোকটা নোটগুলো সাজিয়ে রেখেছে, ওগুলো দেখে যাতে ওই মাপে টাকা দান করে, সেই উসকানি দেবার জন্যই… দেখেননি ভিখিরিরা কুড়ি পয়সা, পঁচিশ পয়সা সামনে ছড়িয়ে রাখে যাতে দশ পয়সা দিতে লোকে ইতস্তত করে।’
কথা বলতে বলতে তারা ডানদিকে ঘুরে চলতে শুরু করল। চত্বরে লোক কম, বোধহয় ঝাঁ ঝাঁ রোদের জন্য। তাজমহলের পিছন দিকে গেলে যমুনা দেখা যাবে। তারা আবার ডানদিকে ঘুরল।
কী রকম একটা পুজো-পুজো, ধর্ম-ধর্ম ভাব যেটা তাজমহলের সঙ্গে মোটেই মেলে না। এখানে টাকাপয়সা দান কেন করবে, এটা তো গভর্নমেন্টের টাকায়, তাদেরই অধীনে চলে!’ ঊর্মি বলল।
‘কেউ হয়তো ব্যবসা করছে। গরিব দেশে অত বড়ো নোট কজন দিতে পারে? তাছাড়া শাজাহান-মমতাজকে বা কেন দেবে? এটা রামমন্দির কি বাবরি মসজিদ তো নয়! আমার মনে হয় বিদেশি টুরিস্টরাই এদের টার্গেট।’
‘হতে পারে।’ ঊর্মি নীচু পাঁচিলে হাত রেখে যমুনার দিকে তাকাল। নদীটা বাঁ দিকে এগিয়ে। হাঁসুলির মতো যেখানে বাঁক নিয়েছে আগ্রা ফোর্ট অনেকটা উঁচুতে সেখানেই। ঝোপ আর গাছপালায় পরিখা প্রাচীরের তলাটা ঢাকা। ফোর্টের অনেকটাই দেখা যাচ্ছে না। শাজাহান যেখান থেকে তাজমহল দেখত সহদেব সেই খোলা মণ্ডপটা খুঁজে বার করার চেষ্টায় পাঁচিলে ঝুঁকল। আগ্রা ফোর্ট এখান থেকে এক মাইলেই মতো মনে হল। এই পাঁচিল থেকে যমুনার জল অন্তত আড়াইশো-তিনশো মিটার দূরে। আর তার গল্পের নায়ক কিনা তাজ থেকে ঝাঁপ দিয়ে ডুবে মরেছিল!
‘বাঁ দিকের ওটা দেখুন’ ঊর্মি আঙুল তুলে নদীর ধারে একটা মসজিদ দেখাল। সহদেব মুখ ফিরিয়ে তাকাল। ‘এবার ডানদিকে দেখুন, ওদিকে ঠিক একইরকম দেখতে একটু ছোটো আর একটা সমজিদ রয়েছে ওটা মিহমানখানা, গেস্ট হাউস। বাবার কাছে শুনেছি, বাঁ দিকের মসজিদটার সঙ্গে আর্কিটেকচারাল ব্যালান্স বজায় রাখতেই ওই ডানদিকেরটা তৈরি করা হয়েছে।’
‘এত সব তখন ভাবা হয়েছিল!’ সহদেব তার গলায় বিস্ময়টা রেখেই এবার প্রশ্ন করল, ‘আপনার বাবা কি আর্কিটেক্ট?’
‘একদম নন। খুবই সাধারণ একজন কেরানি। রাইটার্সে হেড অ্যাসিস্টেন্ট ছিলেন রিটায়ার করার সময়।’ ঊর্মির মুখে বড়ো একটা হাসি। বোধহয় বাবাকে আর্কিটেক্ট ভেবে নেওয়ায় খুশি হয়েছে। সহদেব স্বস্তি বোধ করল একটি কারণে, সেও কেরানি এবং ঊর্মির কাছে হীনমন্যতা বোধ করার দরকার নেই। কেরানির মেয়ে, আশা করা যায় কেরানিকে নীচু শ্রেণিতে ফেলবে না।
‘কুড়ি মিনিট অনেকক্ষণ হয়ে গেছে।’ ঊর্মি ঘড়ি না দেখেই বলল।
‘চলুন।’
ওরা সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতেই ঊর্মির স্বামী তেতো গেলার মতো মুখ করে বিরক্ত গলায় বলল, ‘এই তোমার কুড়ি মিনিট?’
‘কুড়ি মিনিটে কি তাজমহল ঘুরে দেখা যায়?’
সহদেব অপ্রতিভ বোধ করলেও, সায় দিয়ে বলল, ‘সত্যিই, কুড়ি মিনিটে দেখা হয় না। অনুভব করার ব্যাপার তো, সেজন্য একটু সময় তো দিতেই হবে।’
‘অনুভব! সেটা আবার কি জিনিস? …পেয়েছেন তো, নাকি পাবার জন্য আপনি আরও কিছুক্ষণ এখানে থাকবেন?’ স্বামীর চোখে ব্যঙ্গের মতো একটা চাহনি সহদেবকে বুঝিয়ে দিল আর বেশি কথা বলা ঠিক হবে না।
মুখ নীচু করে চটি পরতে পরতে ঊর্মির মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। চাপা স্বরে বলল, ‘চলো।’
সহদেব অপেক্ষা করল ওদের চলে যাওয়ার জন্য সময় দিতে। ড্রাইভার একঘণ্টা সময় দিয়েছে। এখান থেকে বাস পর্যন্ত হেঁটে যেতেই তো পনেরো মিনিট লাগবে। সে মন্থর গতিতে বাগানের মধ্য দিয়ে হেঁটে বিশাল খিলানওয়ালা দরওয়াজার বাইরে এল। ঘুরে দাঁড়িয়ে তাজমহলকে দেখল। আর হয়তো তার আসা হবে না।
বাসে উঠে আড়ষ্টভাবে ওদের পাশ দিয়ে গিয়ে সে পিছনের সিটে বসল। ওরা কেউ তার দিকে তাকাল না। সিটের ফাঁক দিয়ে সে একবার মাত্র তাকিয়ে, স্বামীটির হাতে আবার ফ্লাস্ক দেখতে পায়। বাস ছাড়ার সময় লোকটির কী যে কথার জবাবে, ঊর্মি শুধু ‘হ্যাঁ’ বলল। একটা জিনিস সহদেবের মনে পড়ল, তারা কেউ কারোর নাম বলেনি। ঊর্মি বা ঊর্মিলা নামটা সে হঠাৎই জেনে গেছে কিন্তু স্বামীর নাম বা কোথায় নিবাস এসব সে জিজ্ঞাসা করেনি, ওরাও নয়। ভালোই হয়েছে। পথের সামান্য আলাপ পথেই শেষ হোক। একটা অসুখী দম্পতি।
ঊর্মি যে শিক্ষিত সেটা ওর বলার ভঙ্গি আর উচ্চচারণেই বোঝা যায়। ব্যক্তিত্ব আছে। হয়তো চাকরিও করে। এই রকম একটা মেয়ে এমন একটা স্বামীকে কতদিন সহ্য করবে? যদি বছর চার-পাঁচ বিয়ে হয়ে থাকে তাহলে অন্তত বাড়তি তিনটি বছর একসঙ্গে বসবাস করছে। ডিভোর্স করে আবার বিয়ে করার সময় ঊর্মির এসে গেছে।
সহদেবের কান সজাগ হল সামনের সিটের কথাবার্তায়।
‘আজই শেষ রাত। ব্যস …আমি কথা রাখব। বিশ্বাস করো, আর ঝামেলা…।’
‘হাত ছাড়ো।’
‘না।’
‘অসভ্যতা কোরো না, ছাড়ো।’
‘হাত ধরলে অসভ্যতা হয়? আমি তো তোমার অন্য কিছু-।’
‘চুপ করবে কি না?’
কিছুক্ষণ পর আবার শুরু হল।
‘অ্যাতো মেজাজ কীসের? য়্যাঁ, আমার সঙ্গে এই রকম ব্যবহার করার সাহস আসে কোত্থেকে?’
‘সাহস আমার বরাবরই ছিল এখনও আছে। নেহাত…।’
‘নেহাত কী?’
‘তুমি সেটা ভালো করেই জান। সাহস না থাকলে কি এইভাবে আসি?’
‘অ …গ্লাসটা কোথায়? …দ্যাখ তো তোমার সিটের পাশেটাসে… একি, এর ওপর বসেছিলে, এতো ফেটে গেছে!’
‘ফ্লাস্কে চুমুক দিয়েই তো খেতে পার।’
‘তাই খাব।’
সহদেব বাইরে তাকিয়ে রইল। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা, তারপর রাতও নেমে এল। বাসটা মথুরা, বৃন্দাবনে থেমে ছিল। যাত্রীরা প্রায় সবাই নেমেছিল। সামনের দম্পতি এবং সহদেব নামেনি। জানলা দিয়ে সে মফস্সল শহরের দোকানগুলোর দিকে তাকিয়ে বসে থেকেছে। সবাই যখন ফিরে এসে সিটে বসে সে তখন জানলার দিকে মুখ ফিরিয়ে, তার ভাবনা এখন কলকাতায় চলে গেছে।
ভাই, বোন, ভগ্নিপতি এবং ঝরঝরে পুরোনো বাড়ি প্রত্যেকেই এক একটা সমস্যা আর দুর্ভাবনা। অবিরত তৈরি হয় একটা না একটা ঝামেলা আর কুরে কুরে তার শান্তি, একাগ্রতা, উদ্যম ঝাঁঝরা করে দেয়। মাথাটাকে ক্লান্ত করে। পড়া আর চিন্তায় মন বসাতে পারে না। তবু রক্ষে সে বিয়ে করেনি, ছেলেপুলে নেই।
কেয়া। বিয়ে করলে তো ওকেই করার কথা। বিদ্যুৎ বলেছে একটা কুমারী মেয়েকে বিয়ে করব প্রমিস করে তাকে ভোগ করেছি তারপর ভাগিয়ে দিয়েছি। একদম বাজে কথা, প্রমিস টমিস কখনোই করিনি। কেয়া ওটা ধরে নিয়েছিল। আর নিয়েছিল বলেই সে কুমারীত্ব সমর্পণে রাজি হয়েছিল। কিন্তু কেন সে ধরে নেবে? শুরু শরীর দিয়েই কি একটা বিরাট গাছের মতো ভালোবাসার শিকড় নামিয়ে দেওয়া যায়? আজীবনের ভালোবাসা নানান জিনিসে ছড়িয়ে যায়। শরীরটাকে মেয়েরা যে কেন এত বড়ো করে দেখে! শুধু মুগ্ধতা আর আনুগত্য জীবনের একটা পর্যায় পর্যন্ত ভালো লাগে, বোধ বুদ্ধিকে টানে। কেয়ার অবশ্য গলাটা ভালো। পরিশ্রম করেছে গানের জন্য। কিন্তু তাই দিয়েই তো আর দিনের পর দিন বছরের পর বছর পাশাপাশি বাস করা যায় না! কেয়া এত উন্মুক্ত এত বৈচিত্র্যহীন।
এখন বিবাহিত জীবনযাপনে ওর কোনো অসুবিধে হচ্ছে কি? অবশ্য বছরপাঁচেক দেখাসাক্ষাৎ নেই কিন্তু কেয়ার নাম কাগজে সে দেখেছে। ভালো গাইছে, ক্যাসেট বেরিয়েছে। বাংলা সাপ্তাহিকে ছবিও ছাপা হয়। ওর স্বামী লোকটি কেমন? একসময় ইচ্ছে করেছিল লোকটিকে দেখতে, দু-চারটে কথা বলে বুঝে নিতে। কিন্তু সে আর এগোয়নি। কেয়ার পক্ষে মর্মান্তিক হবে স্বামীর সঙ্গে প্রাক্তন প্রণয়ীকে আলাপ করিয়ে দিতে। নার্ভাস বোধ তো করবেই তাছাড়া ভয়ও পাবে। স্বামীটি হয়তো খুবই সৎ, ভালোমানুষ, ঠান্ডা প্রকৃতির। গুণী স্ত্রী পেয়ে মনে মনে নিজেকে ধন্য বোধ করে। স্ত্রীর আঁচল ধরে থাকতে চায়।
কিন্তু যদি উলটোটি হয়, এই সামনের সিটের স্বামীটির মতো! ঊর্মি, মনে হয়, এর সঙ্গে বেশিদিন থাকবে না। নির্ঘাৎ এদের ছাড়াছাড়ি হবে। কিন্তু কেয়া এমন কাজ পারবে না। ওর মনের মধ্যে আদর্শ নারীর একটা ফরমুলা ঝোলানো আছে, তাতে ডিভোর্স বিষয়ে কোনো উল্লেখ নেই।
অনিতাকে সে বলেছিল অসিতকে ডিভোর্স করতে। তাইতে অনিতা বলে, ‘কী কারণ দেখাব? বলব আমার স্বামী লম্পট, সে তার শালিকে প্রেগনান্ট করেছে? এ কথা জানাজানি হয়ে যাবেই, মেয়ে দুটো এখন নয় শিশু কিন্তু একদিন বড়ো তো হবে, জানতেও পারবে। দাদা তুই শমির কথাটাও ভাব। …ওর জীবন তো একদমই নষ্ট হয়ে যাবে, যাবে না?’
এই ‘যাবে না?’-অনিতা সেভাবে চোখ বিস্ফারিত করে আন্তরিক স্বরে বলেছিল তাতে তখন তার হাসি পেয়ে যায়, এখন আবার পেল। বেচারা অনিতা! সহজ সরল এবং রূপসী।
একদা মেদিনীপুরে প্রভূত জমিজমার এবং এখনও কলকাতায় সাত-আটটি বাড়ির, দুটি বস্তির ও একটি কোল্ড স্টোরেজের মালিক, অমৃত বসুমল্লিক শুধুমাত্র রূপ দেখেই মধ্যবিত্ত বাড়ির প্রি. ইউ. পাশ মেয়ে অনিতাকে পুত্রবধূ করেন। অনিতাকে কখনো কেউ অসুখী দেখেনি। দুঃখ বেদনা যন্ত্রণা শুষে নেওয়ার অদ্ভুত একটা ক্ষমতা জন্ম থেকেই ও পেয়েছে। ছোটো বোনের জীবন নষ্ট হয়ে কি ‘যাবে না?’ এই ‘যাবে না’ই ওর জীবনের মূলমন্ত্র। কেয়ার সঙ্গে বহু ব্যাপারে ওর মিল আছে। অনিতা দিন দশেক আগে এসেছিল, ওর বড়ো মেয়ে উনিশ বছরের কাবলি নাকি একটা বাছে ছেলের সঙ্গে মেলামেশা করছে। ‘দাদা তুই ওকে একটু বুঝিয়ে বল। যদি ড্রাগট্রাগ ধরে তা হলে তো মরে যাবে, যাবে না?’ কলকাতায় ফিরলেই অনিতা আবার আসবে বলেছে।
ম্যাঞ্চেস্টার থেকে বড়দারও এসে যাওয়ার কথা। সল্ট লেকে জমি কেনা আছে, সেখানে বাড়ি তোলার ব্যবস্থা পাকা করার জন্য আসছে। উঠবে শ্বশুরবাড়িতে। একবার নিশ্চয় এ বানিতে আসবে। দুর্গাপুর থেকে বাসু চিঠি লিখেছে, বড়দা এলেই বাড়ির ভবিষ্যৎ নিয়ে মেজদা ওর সঙ্গে কথাটা যেন বলে নেয়। বাড়িতে তার যে অংশ, বলদেব ইঙ্গিত দিয়েছিল, ছেড়ে দেবে। সেটা যেন এবার লেখাপড়া করে পাকা করে দেয় এই অনুরোধ সহদেবকে করতে হবে। একটা বিশ্রী কাজ!
বিদ্যুৎ বলেছে শমির সঙ্গে অসিতের সম্পর্ক এখনও রয়েছে। অসিত দুপুরে মাঝে মাঝে আসে। কিন্তু ওর একটা অভিযোগ: ‘এই করাপ্টেড মেয়েটার সঙ্গে আমার বিয়ে দিয়েছেন’, এটাই তাকে বিছুটির চাবুক মেরেছে। বরং সে আপত্তিই করেছিল। বলেছিল শমিকে কয়েকবছর সময় দাও, নিজেই কাউকে পছন্দ করে বিয়ে করুক। কিন্তু ব্যস্ত হয়ে অনিতা কোথায় কাকে দিয়ে খোঁজ খবর করিয়ে, তারকেশ্বরের কাছে একটা গ্রাম থেকে বিদ্যুৎকে আবিষ্কার করে। অসিতই খেসারত হিসেবে দিয়েছিল বিয়ের সব খরচ, আট ভরি সোনা, পোস্তায় এক ট্রান্সপোর্ট কোম্পানিতে চাকরি। কলকাতায় বসবাসের জন্য বিনা খরচে দুটো ঘর এবং বউয়ের দৌলতে বাড়ির কিছু অংশে মালিক হওয়া, এটাও নিশ্চয় বিদ্যুৎকে টোপ গিলিয়েছে। এত সব যখন সে পাচ্ছে তখন কি একবারও ওর মনে খটকা লাগেনি, তার মতো দরিদ্র, গ্রাম্য, মফসসল কলেজের গ্র্যাজুয়েটকে কেন এত সব দেওয়া হচ্ছে। বজ্জাত, ধড়িবাজ টাইপের তো বটেই, ওকে দেখলেই কেমন একটা অস্বস্তি সে বোধ করে। লোকের ক্ষতি করার জন্য সবসবয়ই যেন ছোঁকছোঁক করছে।
সহদেব ক্লান্ত রোধ করতে লাগল। সারাক্ষণ সে কিছু লোক আর তাদের সঙ্গে নিজের জড়িয়ে থাকা নিয়ে ভেবে চলেছে যার মধ্যে ইতিমূলক কোনো ভবিষ্যৎ নেই। শুধুই বিরক্তি, দুর্ভাবনা, পারিবারিক গোলমালে জড়িয়ে পড়ার ভয়। যে প্রবন্ধটা পড়ে এল সেটা এখন সে একদমই ভুলে গেছে। দু-তিনজন যে মন্তব্য করেছিল তাও মনে নেই। তার মনে হয়েছে এই সব সেমিনারে শুধুই ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করা হয়। যে সব পেপার পড়া হল তার বিষয়গুলোর সঙ্গে দৈনন্দিন কালচারাল জীবনের কোনো সম্পর্ক নেই, বা থাকলেও তাতে কোনো কাজ হয় না।
ঝিমুনি এল তারপর চোখ বুজল এবং হালকা তন্দ্রায় সহদেব ডুবে গেল। রাত নটায় বাস থামল নেহরু প্লেসের পেট্রল পাম্পে। পাশের সিটের দক্ষিণ ভারতীয়টি নেমে যাবার আগে তাকে মৃদু ঠেলা দিয়ে উৎকণ্ঠিত ভাবেই ইংরেজিতে বলল, ‘আপনি তো এখানেই নামবেন?’
বাস অর্ধেক খালি করে যাত্রী নামল, তাদের সঙ্গে সহদেবও। একটা অটো রিকশা থামাবার জন্য হাতটা তুলে ক্ষণিকের জন্য বাসের দিকে তাকাল। জানলায় ঊর্মির মুখ। মনে হল যেন তার দিকেই ফেরানো। স্বামীর ব্যবহারে মরমে মরে থাকার মতো চাহনি। সহদেব তোলা হাতটা একটু ঘুরিয়ে জানলার উদ্দেশে পাঞ্জাটা নাড়ল। ঊর্মি দেখতে পেল কি না বুঝল না। ওর বোঝা না বোঝায় তার আর কিছু এসে যায় না। আর তো ওর সঙ্গে জীবনে দেখা হবে না!
ছয়
নির্ধারিত সময় থেকে পনেরো মিনিট দেরিতে রাজধানী এক্সপ্রেস হাওড়ায় প্ল্যাটফর্মে যাত্রা শেষ করল। হাওড়া ব্রিজ পর্যন্ত হেঁটে গিয়ে একটা ট্যাক্সি ধরে সহদেব দুপুর সাড়ে বারোটায় বাড়ি পৌঁছল। সদরের কড়া নাড়তে দরজা খুলল বিদ্যুৎ।
‘ট্রেন কি লেট করেছিল?’ বিদ্যুৎ সামাজিক ও প্রাথমিক সম্ভাষণ জানাল।
‘মিনিট পনেরো।’ সহদেব গা ছাড়া উত্তর দিয়ে সিঁড়ির দিকে এগোল।
‘আপনার ভাত করা আছে। চানটা করে নিন।’
সহদেব না থেমে বলল, ‘ভালোই করেছ, খুব খিদে পেয়েছে।’
‘জানি তো ট্রেন কখন পৌঁছবে, শমিকে তাই বলে রেখেছিলুম, দাদা এসেই ভাত চাইবে।’
সহদেব ‘ভাত চাইবে’টা শুনল দোতলায় বারান্দায় পৌঁছে। বাঁ দিকে তালা দেওয়া বাসুর ঘর। ডানদিকে বারান্দার শেষ প্রান্তে মায়ের ঘর, যেটায় এখন সে থাকে। তালা খুলে ঘরে ঢুকেই সে ভ্যাপসা গন্ধ পেল। তাজমহলের নীচের সমাধি ঘরের মতো ঠিক নয়। এটা স্যাঁতসেঁতে পুরোনো কাপড়চোপড়, বিছানা আর কাঠ থেকে তৈরি হওয়া গন্ধ। জানলা দুটো খুলে পাখার সুইচ টিপল। পাখা ঘুরল না। তা হলে পাওয়ার কাট!
বিরক্ত, অবসন্ন সহদেব খাটে শুয়ে চোখ বুজল। মিনিট দশেক পর ঘরের দরজায় শমিতার গলা শুনতে পেল। ‘মেজদা শুয়ে পড়লে নাকি। আগে চান খাওয়া করে নাও। এখন ঘুমিয়ে পড়লে আর উঠতে পারবে না। আমি ভাত নিয়াসছি।’
সহদেব উঠে বসল। খোলা জানলা দিয়ে সামনের বাড়ির ঘর দেখা যায়। শমিতা তার দৃষ্টি অনুসরণ করে জানলা দিয়ে তাকিয়ে বলল, ‘ওদের খুব বিপদ হয়েছে। অরুণকাকা মিনিবাস থেকে পড়ে গেছল মঙ্গলবার, বাসের চাকা ডান পায়ের ওপর দিয়ে চলে গেছে। পাটা কেটে বাদ দিতে হয়েছে। …আর দেরি কোরো না, দেড়টা বাজে।’
শমিতা চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে সহদেবও খাট থেকে নামল। অরুণকাকা ইউনিভার্সিটিতে চাকরি করেন, অত্যন্ত ডিসিপ্লিনড জীবন, সাতটি ছেলেমেয়ে। তিরিশ থেকে ষোলোর মধ্যে তাদের বয়স। প্রত্যেকে পড়াশুনোয় ভালো। বড়ো ছেলে ডবলু বি সি এস, বাঁকুড়ার কোথায় যেন বিডিও। খবরটা শুনে তার মনে হল একবার ও বাড়িতে গিয়ে কাকিমার সঙ্গে দেখা করা উচিত। ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় অরুণকাকার বিয়েতে সে কদমতলায় বরযাত্রী হয়ে গেছল।
স্নান সেরে শোবার ঘরে এসে দেখল দেয়াল ঘেঁষা ছোটো টেবলটায় শমি ভাতের থালা এবং দুটো বাটি রেখে খাটে বসে। হাতে একটা লম্বা সাদা খাম। কোনোদিনই তো এই রকমটা হয় না অর্থাৎ কাছে বসে যত্ন আত্তি দেখানো! হঠাৎ আজ… ব্যাপার কী? বিদ্যুৎকেও যথেষ্ট বিগলিত দেখাল! খামটা খুলে দেখল আমেরিকান সেন্টারে ফিল্ম দেখার জন্য আমন্ত্রণ চিঠি। সাতদিন পর টিকিট বিলি হবে। খামে চিঠি ভরে রেখে সে শমিতার দিকে তাকাল।
‘মাংসের কী দাম, আটান্ন টাকা!’
‘আজ হয়েছে বুঝি? সহদেব চুল আঁচড়ে ফোল্ডিং স্টিলের চেয়ারটা পেতে বসল।
‘আধ কেজি এনেছে। ও বেলার জন্য আর রাখলুম না।’
কাল দুপুরে শ্যামল মাংস রেঁধেছিল। চমৎকার ওর রান্নার হাত। শমিও ভালো রাঁধে। কিন্তু পরপর দুদিন চড়া মশলা আর তেল, আর মাঝখানে ট্রেনে রাতের জঘন্য খাদ্য, এত ধকল পাকস্থলী নিতে পারবে না। সে বলল, ‘আমি কম খাব, তুই মাংসের অর্ধেক তুলে নে, পেটটা ভালো নেই।’
‘ওই কটা তো টুকরো, ওর থেকে আবার তুলব কী! খেয়ে নাও।’
সহদেব অবাক হয়ে যাচ্ছে। হল কি শমির! ডাল শেষ করে মাংসের বাটিটায় হাত দিয়েছে তখন শমি বলল, ‘বড়দা এসেছিল, তুমি যে দিন গেলে তার পরের দিন, মঙ্গলবারে।’
‘তাই নাকি! উঠেছে কোথায়, শ্বশুরবাড়িতে?’
‘নিউ আলিপুরে এক বন্ধুর বাড়িতে। আধঘণ্টার মতো ছিল।’
‘কী বলল?’ সহদেব মামুলি গলায় জানতে চাইল। তার কোনো মাথাব্যাথা নেই সচ্ছল, প্রবাসী বড়ো ভাই সম্পর্কে। তিনবছর আগে বড়দা কলকাতায় এসেও এই বাড়িতে আসেনি।
‘বাড়ি করবে সল্ট লেকে। আরও বছর পাঁচেক থাকবে ওখানে। মেয়ে কেমব্রিজে পড়ছে, ছেলে পড়ছে ডাক্তারি। দাদা এখানে নাকি চোখের ডায়গোনেস্টিক সেন্টার না কি যেন করবে।’
‘কোথায় করবে, সল্ট লেকে?’
‘কোথায় করবে বলেনি। বড়দা কিন্তু স্বাস্থ্যটা খুব ভালো রেখেছে। বিরাট দু বাক্স সন্দেশ, একশো টাকার তো হবেই, দুটো সিল্ক শাড়ি আমার আর দিদির জন্য, দুটো অন্তত দু হাজার টাকার, হাতে করে এনেছে। সেবাকে দুশো টাকা দিয়ে গেছে ফ্রক কেনার জন্য।’
সহদেব মুখ নীচু করে খেয়ে যাচ্ছে। শমির চাপা উচ্ছ্বাসের মধ্যে কাঙালেপনার বুড়বুড়িটা তাকে বিরক্ত করল। একটুকরো মাংস পাতে তুলে বাটিটা সরিয়ে রাখল।
‘তোমার কথা জিজ্ঞাসা করল। দিল্লিতে পেপার পড়তে গেছ শুনে বলল, ভাইদের মধ্যে ওরই মাথাটা সব থেকে ভালো ছিল। বিয়ে করল না কেন? দিদির, ছোড়দারও খোঁজ খবর নিল।’
‘আর কী বলল?’
‘এই বাড়ির কথা বলল। কেউ সারাচ্ছে না, মেরামত করছে না, দুদিন পর তো ভেঙে পড়বে। সবাই টাকা দিয়ে সারাক।’
‘সবাইটা কারা?’
শমিতা থমকে গেল। সহদেব এটাই আশা করেছিল। বাড়ির যা অবস্থা তাতে নমো নমো করে সারালেও অন্তত আট থেকে দশ হাজার টাকার দরকার। ফাটা ছাদ থেকে এই ঘরে জল পড়ে। প্রতি বছর বর্ষায় ছাদে সিমেন্ট-বালি লাগাতে হয়। যেহেতু শমিরা একতলায় থাকে তাই ছাদ নিয়ে ওরা ভাবে না। কিন্তু দোতলা বারান্দা যার উপর ভর রেখেছে সেই লোহার থামগুলো উঠেছে একতলা থেকে জরাজীর্ণ তাদের অবস্থা। লোহার দুটো বর্গা গত বছর খসে পড়েছে। বারান্দাটা যে এখনও ধসে পড়েড়ি কেন, সহদেব সেটা ভেবে প্রায়ই অবাক হয়। ভেঙে পড়লে শমিদের কারুর মাথার উপর পড়তে পারে। ওরা ভয়ের মধ্যেই থাকে। সদর দরজার পাল্লা দুটোর বাতান বহুদিন আগে খসে গেছে। পাল্লার তক্তার জোড়গুলো এত আলগা যে ধাক্কা দিতে ভয় হয়। পাইখানার প্যানটা ফাটা। ইলেকট্রিক তার জয়েন্ট বক্সগুলো খোলা এবং জট পাকানো। সারা বাড়ির তার অবিলম্বে বদলাতে হবে।
‘কি রে চুপ করে রইলি কেন? দাদা তো বলেই খালাস… সবাই টাকা দিয়ে সারাক!’
‘আমিও তাই বললুম, সারাবার মতো টাকা আমার নেই, মেজদারও নেই। ছোড়দা থাকে না তাই বলে দিয়েছে দেবে না। তারপর আমি বড়দাকে বললুম, তুমিই মেরামত করে দাও না। এটা তো তোমার পৈতৃক ভিটেই, এই বাড়িতেই তো তুমি জন্মেছ, বাবা-মা মারা গেছেন এই বাড়িতে, তোমার বিয়েও হয়েছে এই বাড়িতে, আট-দশ হাজার টাকা তোমার কাছে তো হাতের ময়লা।’
সহদেব তাকাল শমিতার দিকে। কত সহজে ভিক্ষার মতো টাকা চাইল প্রায় অপরিচিত হয়ে যাওয়া একটা লোকের কাছে। মেজদার টাকা নেই, এই কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে সে মেজদাকেও দরিদ্র পর্যায়ে নামিয়ে দিল। ভাবতেই সহদেবের মেজাজ তপ্ত হতে শুরু করল।
‘কী বলল?’
‘বলল, আমি তো বলে দিয়েছি এই বাড়িতে আমার অংশটা ছেড়ে দোব। তিনজন অংশীদারকে না দিয়ে একজনকেই দোব। এইটুকু অংশ ভাগাভাগি হলে, এক একজনের ভাগে সামান্যই পড়বে তাতে কারুর কোনো লাভ হবে না, তার থেকে একজনই বেশি পাক, ভালোভাবে থাকুক। কাকে দোব সেটা অবস্থা বুঝে সহদেবই ঠিক করে দেবে।’
শমির কথায় আর আচরণে আকস্মিক বদল কেন ঘটেছে এতক্ষণে সহদেবের কাছে সেটা স্বচ্ছ হয়ে গেল। মুখভাবে পরিবর্তন না ঘটিয়ে সে বলল, ‘আমি! আমি ঠিক করে দেব বড়দার অংশ কে পাবে? কেন?’
‘তুমি এত বয়সেও বিয়ে করলে না যখন আর তখন করবেও না, তাই বড়দা ধরে নিয়েছে বিষয় সম্পত্তিতে তোমার লোভ নেই, যেহেতু দরকার নেই। বললও তাই, সহদেবই হচ্ছে একমাত্র লোক নিরপেক্ষ ভাবে বিচার করার মতো বোধ যার মধ্যে পাওয়া যাবে।’
‘আমি কি এখনও বিয়ে করতে পারি না? কত বয়স আমার জানিস?’
শমিতা থতমত হয়ে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি বিয়ে করবে! এই বয়সে!’
‘তেতাল্লিশ-চুয়াল্লিশ কি বিয়ে করার বয়স নয়? পুরুষমানুষ এখনই তো ম্যাচুওরড হয়!’
শমিতার অপ্রতিভ মুখ এবার গম্ভীর হয়ে উঠল। দুশ্চিন্তায় সে ডুবে যাচ্ছে বুঝতে পেরে সহদেব অদ্ভুত একটা সুখ সংগ্রহ করে ভাবল, এদের এই ভাবেই জব্দ করতে হয়। ‘কেয়ার খোঁজ খবর কিছু রাখিস?’
‘না, কেন?’ শমিতা উৎকণ্ঠিত হয়ে তাকাল।
‘কে যেন বলছিল স্বামীর সঙ্গে ওর নাকি বনিবনা হচ্ছে না। অনেকদিনই তো ওর সঙ্গে দেখা হয়নি, ভাবছি এবার দেখা করব… যাকগে ওসব কথা। অনির শাড়িটা দিয়ে অসিস মনে করে। …মাংসটা খুব ভালো হয়েছে।’ সহদেব উঠে পড়ল হাত ধোবার জন্য। বারান্দায় বালতিতে জল তোলা থাকে। হাত ধুয়ে ফিরে এসে দেখল শমিতা খাটে পা ঝুলিয়ে একইভাবে বসে রয়েছে, চাহনি জানলার বাইরে। অপলক।
‘ভাবছিস কী, থালাবাটি নিয়ে নীচে যা, এখন আমি একটু ঘুমোব।’
‘যাচ্ছি।’ শমিতা উঠে দাঁড়াল। থালার উপর বাটি দুটো রেখে টেবলে পড়া ভাতগুলো খুঁটে তুলতে তুলতে বলল, ‘কেয়া কি আবার বিয়ে করবে। এখন যথেষ্ট রোজগার করে, এই ভাঙা বাড়ির একখানা ঘরে থাকতে আসবে না।’
সহদেব নখ দিয়ে দাঁতের ফাঁক থেকে মাংসের কুচি বার করায় ব্যস্ত। শমিতার কথা না শোনার ভান করল। স্বামীর সঙ্গে কেয়ার বনিবনা হচ্ছে না বা হচ্ছে জানার জন্য শমি যে এবার উঠে পড়ে লাগবে, তাতে কোনো সন্দেহ তার নেই। মেজদা যদি বিয়ে করে ফেলে, এই ভয়ের মধ্যে ওরা এবার থাকুক। খোশমেজাজেই সহদেব বিছানায় গড়িয়ে পড়ল।
শেষ বিকেলে সে বাড়ি থেকে বেরোল অনিতার সঙ্গে দেখা করার জন্য। তার আগে শমিতাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘অনির কাছে যাচ্ছি, দাদার দেওয়া ওর শাড়িটা যদি দিস তো দিয়ে আসব।’
শমিতা ইতস্তত করে বলল, ‘ভেবেছিলুম আমিই দিয়ে আসব…আচ্ছা, যখন যাচ্ছই তো নিয়ে যাও।’
ঝোলার মধ্যে শাড়ির বাক্সটা নিয়ে সহদেব একটু দোনামনা করে সামনের বাড়ির কড়া নাড়ল। দরজা খুলে দাঁড়াল অরুণকাকার ছোটো ছেলে অনির্বাণ। ইলেভেন ক্লাসে পড়ে।
‘বাবা কেমন আছেন? …মা কোথায়?’
‘মা তো এইমাত্র হাসপাতালে গেল, বাবা এখন বিপদ কাটিয়ে উঠেছে।’
‘আমি আজ দুপুরে দিল্লি থেকে ফিরে শুনলুম। কি যে হল শুনে… মাথাটা ঘুরে গেল। কত ছোটো থেকে ওকে দেখছি, কত হুঁশিয়ার, সজাগ, সাবধানী আর তারই কি না এমন অ্যাকসিডেন্ট!…ডান পা?’
‘হ্যাঁ, ডান পা। বাসটা ছেড়ে দিয়েছে আর বাবা হ্যান্ডেলটা ধরে চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে ছুটছে, ভীষণ ভিড় ছিল… ‘পা-টা রাখার একটু জায়গা দিন, একটু পা সরান’, কেউ কি আর পা সরায়! তারপর লাফিয়ে পা রাখতেই পা-টা পিছলে যায়। …মাথার ওপর দিয়ে চাকাটা চলে যেত, বাবা রাস্তায় পড়া মাত্রই বুদ্ধি করে গড়িয়ে গেছল, নইলে…।’
সহদেব শিউরে উঠল। অনির্বাণ তা লক্ষ করে বলল, ‘বাবা যদি আর বিঘতখানেক গড়াতে পারত পাটা বেঁচে যেত। …হাঁটুর নীচেটা একদমই গুঁড়িয়ে গেছে।’
‘যাক তবু রক্ষে, একটা পায়ের ওপর দিয়েই গেল। …অপারেশন ঠিকঠাক হয়েছে তো? গ্যাংগ্রিন ধরলে আবার আরও বাদ দিতে হতে পারে!’
‘সেরকম সম্ভাবনা তো থাকতেই পারে। তবে ডাক্তার মৈত্র নিজে অপারেশন করেছেন, মনে তো হয় না ও সব হবে।’
‘অরুণকাকা ফিরে আসুন, তারপর দেখা করব। মাকে বোলো আমি এসেছিলুম।’
সহদেব সন্ত্রস্ত হয়ে বাস স্টপে এল। তাকেও রোজ ভিড় বাসে উঠে অফিস যেতে হয়। পা রাখার জায়গা অবশ্য পায় এমনকী মিনিট পাঁচেকের মধ্যে বাসের মাঝমাঝি জায়গায় পৌঁছেও যায়। কিন্তু যদি কোনোদিন ওঠার সময় পা পিছলোয়!
প্রথম বাসটা সে ছেড়ে দিল। কেন জানি তার মনে হল, এটার পাদানিটা খুবই সরু, সে ভালোভাবে পা রেখে উঠতে পারবে না। পরক্ষণেই সে ভাবল, সব প্রাইভেট বাসের পাদানি তো এই রকমই আর সে রোজই দু বেলা তা ব্যবহার করে বাসে ওঠে এবং তাই থেকে নামে। দ্বিতীয় বাসটা আসামাত্র সে উঠে পড়ল এবং ওঠার সময় অসুবিধে বোধ করল না। একটা কারণেই-‘যদি আর বিঘতখানেক’, এই কথাটা তার মাথায় খেলে গেছল।
মরে যাব, মরে যাচ্ছি, ক্যানসার হতে পারে, এইডস হতে পারে এই সব চিন্তার একঝলক তাকে নাড়িয়ে দিল বাসের ভিড়ের মধ্যে। যে-কোনো মুহূর্তে সে মরে যতে পারে! আর একটা বাসের সঙ্গে মুখোমুখি ধাক্কা বা স্টিয়ারিং-এর টাই রড ভেঙে ফুটপাথে উঠে একটা দেয়ালে ধাক্কা, তিনজন বা চারজন নিহতের মধ্যে আমিও একজন হতে পারি! কিংবা বুকে ব্যথা, ডাক্তার নানান পরীক্ষা করে বলল বাইপাস সার্জারি করতে হবে বা কিডনিটা বদল না করলেই নয়, মৃত্যু অবধারিত-এ জন্য কম করে লাখ খানেক টাকা তো চাইই। পাব কোথায়?
টাকা বলতে তো প্রভিডেন্ট ফান্ড। পেনশন তো পরের কথা। ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়েছে। লেখাবাবদ পাওয়া চেকগুলো ভাঙাবার জন্য। মাসে মাসে কিছু টাকা জমাবে ভাবে, মাঝে মাঝে জমা দিয়েছেও, এখন এগারো-বারো হাজার বোধহয় জমেছে। তার বড়ো খরচ বই কেনা। বছরে গড়ে তিন-চার হাজার টাকা বেরিয়ে যায়। শমি খাইখরচের টাকা বাড়াতে বলেছে। অন্তত দিনে পঁচিশ টাকা করে ধরে মাসে সাড়ে সাতশো দিতে হবে। এ ছাড়া বাড়ির ট্যাক্সের তিনভাগের এক ভাগ আর যেহেতু বাসু থাকে না তাই ইলেকট্রিক বিলের অর্ধেক ধাঙড়, ঠিকে ঝি, এদের মাইনেরও অর্ধেক সে দেয়। তাছাড়া লেপ তোশক, বালিশ, পর্দা, বেড কভার, দামি বইয়ের জন্য কাচের আলমারি, সিলিং ফ্যান, দেয়াল জানলা রং করা-কিছু না কিছুতে খরচ লেগেই আছে। …ক্যানসার হলে বা হরেক নামের বদখত একটা রোগ চিকিৎসা করার জন্য টাকা কোথায়?
বড়দা কি টাকা দেবে? ‘মাথাটা সব থেকে ভালো ছিল’ যে ভাইয়ের তার শরীরের কোনো যন্ত্রাপাতি মেরামত বা বদলের জন্য দিলেও দিতে পারে। বহু লক্ষ টাকা না কামালে কি আর বাড়ি করার, ডায়গোনেস্টিক সেন্টার খোলার প্ল্যান করে? কিন্তু নিজের জন্য, ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ দাঁড় করাবার জন্য করা আর ভাইয়ের ভালো মাথাটাকে অ্যাপ্রিশিয়েট করার জন্য কিছু খসানো, এক জিনিস নয়।
যদি বড়দা না দেয় তা হলে বাসু? অকল্পনীয়, অবাস্তব! প্রথমেই বলবে, ‘এই দ্যাখো না ছেলে দুটোকে ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে পড়ানো, তাদের জন্য টিউটর রাখা, স্কুলবাস ভাড়া এতেই ছ-সাতশো মাসে মাসে বেরিয়ে যায়, তার ওপর সুলেখার মাথায় একটা যন্ত্রণা রোজ রাতে হচ্ছে, ডাক্তার বলেছে থরো চেক আপ করাতে, …গুচ্ছের টাকা বেরিয়ে যাবে। আমি এখন এমন টাইট অবস্থায় …মাইনে কত আর পাই।’ এ সব শুনলেই মনে হবে, বরং এইডসেই মরা ভালো তবু টাকা নিয়ে বাঁচার চেষ্টা কিছুতেই নয়।
বিদ্যুৎ আর শমির কাছ থেকে টাকা আশা করলে সেটা নিজেকে নির্বোধ বা পাগল প্রমাণ করা হবে। হয়তো বা বিদুৎ বলবে, আপনার পোর্সানটা বাঁধা রাখেন যদি তা হলে ধারধোর করে টাকা জোগাড়ের চেষ্টা করতে পারি।’
আর রইল অনি। ওর কাছে বরং আশা করা যায়। অত্যন্ত কোমল, স্নেহে ভরা, দরদি…অভিধানে যত ভালো ভালো বিশেষণ আছে সব ওর মন-এর আগে জুড়ে দেওয়া যায়। আর এইটারই সুযোগ নিয়ে অসিত গত কুড়ি-একুশ বছর ধরে বউকে ঠকিয়ে চলেছে। হারামজাদার বউ ভাগ্যটা ভালো। টাকার পাহাড়ের উপর অসিত বসে আছে, চাইলে কয়েকটা নুড়ি কি একটা চাঙড় ফেলে দেবে হয়তো। কিন্তু তার বদলে কিছু একটা আদায় করে নেবে। অসিত দুপুরে শমির কাছে আসে বলে বিদ্যুৎ চেঁচিয়ে ছিল। কিন্তু চেঁচানোই সার, বউ আর শালাকে গালাগাল দিয়ে ঝিমিয়ে চুপ করে গেছে। কারণ, পাঞ্জাবি বন্ধুর ট্রান্সপোর্ট কোম্পানিতে বিদ্যুতের চাকরিটা অসিতেরই দান। এটা অসিত ফিরিয়ে নিতে পারে যদি সে বিরক্ত বোধ করে।
বেচারা বিদ্যুৎ! এখন, এই বয়সে অন্য কোথাও চাকরি জোগাড় করে যথার্থ স্বামী হয়ে ওঠা ওর পক্ষে আর সম্ভব নয়। সে কোনোভাবেই অসিতের বিরক্তির কারণ হতে সাহস দেখাবে না। শমি নিশ্চয় এটা জানে। দাদার সামনে বিদ্যুৎ যেসব কথা চিৎকার করে তার সম্পর্কে বলেছে শমি তা শুনেছে। সহদেব ভেবেছিল বোন এরপর লজ্জায় কিছুদিন তার সামনে আসবে না।
কিন্তু শমি আধঘণ্টা পরই একটা নেমন্তন্নর কার্ড হাতে নিয়ে এসে বলেছিল, পাড়ার সুবল চাটুজ্জের মেয়ের বিয়ে। কাল রাতে সুবলবাবু কার্ডটা দিয়ে সবাইকে যেতে বলে গেছে।
এই সব চিন্তার মধ্যেই সহদেব ভিড়ের মধ্যেই নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে জানলার দিকে মুখ করে দাঁড়াতে পেরেছে। কন্ডাক্টরকে ভাড়া দিয়েছে, গোড়ালিতে জুতোর ধাক্কা খেয়ে ‘একটু দেখে যান ভাই,’ বলেছে, বসে থাকাদের মধ্যে কেউ উঠবে কিনা তা বোঝার জন্য মুখগুলোয় নজর রেখেছে। তার মধ্যে একজনকে বলেও দিয়েছে দত্তবাগান মোড় থেকে কোনদিকে গেলে মিল্ক কলোনি পাবে।
বাস থেকে নেমে তিন মিনিটেই সহদেব পৌঁছে গেল। প্রতিভাদি তাকে জানাল, অনিতা কাছেই তার সম্পর্কিত এক ননদের বাড়ি গেছে। দুই মেয়েই, কাবলি আর টাবলি টিভিতে সিনেমা দেখছে। দোতলায় চওড়া মার্বেল মেঝের দালানে কয়েকটা সোফা। এটাই বন্ধু ও নিকটজনদের সঙ্গে বসার জায়গা। সহদেব সেখানেই বসেছে। ধবধবে থান পরা, মধ্যবয়সি, সুশ্রী প্রতিভা পঁচিশ বছর এই বাড়িতে। অনির কাছেই সে শুনেছে মৃত শাশুড়ির শূন্যস্থান পূরণের জন্য তাঁর শ্বশুর সদ্য বিধবা, প্রতিভাকে দেশ থেকে আনিয়েছিল। মিষ্টভাষী এবং শিষ্টাচারে পারদর্শিনী প্রতিভা এই বাড়ির বেসরকারী কর্ত্রী। সহদেবের থেকে বয়সে বছর দুয়েকের বড়ো কিন্তু তাকে ‘মেজদা’ বলে। আসলে সে এই বাড়ির কাজের লোক কিন্তু সবার মতো সহদেবও তাকে ‘প্রতিভাদি’ বলে।
‘মেজদা কেমন আছেন? বাড়ির সব খবর ভালো? দিল্লি যাবেন শুনেছিলাম।’
কপাল পর্যন্ত ঘোমটা নামানো। ফিনফনে দামি কাপড়ের থান, আদ্দির ব্লাউজ। আঁচল দিয়ে ঊর্ধ্বাঙ্গ সযত্নে ঢাকা। সহদেব অস্বস্তি বোধ করে সরাসরি তাকিয়ে কথা বলতে। ওর মুখ থেকে দৃষ্টিটা সরিয়ে নিয়ে গোটা শরীরটা দেখার ইচ্ছা যেন না হয়, সেই চেষ্টাই সে করে।
তার ধারণা প্রতিভা খুবই বুদ্ধিমতী এবং পুরুষ চরিত্রটা ভালো বোঝে। ওর সঙ্গে যতবারই সে কথা বলেছে, লক্ষ করেছে প্রতিভা তার চোখের দিকে গোয়েন্দার নজরে তাকিয়ে থাকে। মনে হয় যেন অপেক্ষা করে কখন এই পুরুষটার চোখ তার মুখ থেকে নীচে শরীর বেয়ে বেয়ে নামবে। বদ ইচ্ছায় ভরে যাওয়া পাজি ধরনের পুরুষদের ধরে ফেলায় হয়তো ও আমোদ পায়। সহদেব সিঁটিয়ে থাকে, কোনোমতেই এই বাড়িতে অনিতার মেজদা পাজি চরিত্রের লোক বলে যেন গণ্য না হয়।
‘আজই দিল্লি থেকে ফিরলুম… বাড়ির সবাই ভালো আছে।’ কথা বলতে বলতে শাড়ির বাক্সটা বার করে সে নীচু টেবলটায় রাখল। ‘অনির জন্য একটা শাড়ি।’
‘দিল্লি থেকে আনলেন?’ প্রতিভা এগিয়ে এল না বাক্স খুলে শাড়িটা দেখার জন্য।
‘আমি না, বিলেত থেকে বড়দা এসেছে। সেই দুবোনের জন্য দুটো শাড়ি কিনেছে। আমি এখানে আসছি, তাই সঙ্গে নিয়ে এলুম।’ সহদেব বাক্সের ঢাকনাটা খুলে বাড়িয়ে ধরল। ‘দেখুন…. দাম আছে শাড়িটার।’
প্রতিভা হাত বাড়িয়ে বাক্সটা নিল। সহদেবের চোখে পড়ল ওর বাঁ-হাতের আঙুলে তামার আংটি যেটা চামড়ার সঙ্গে মিশে রয়েছে। মাথা নীচু করে মনোযোগ দিয়ে প্রতিভা শাড়িটায় আঙুল বোলাচ্ছে। সহদেব সুযোগটাকে কাজে লাগাতে প্রতিভার গলা থেকে কাঁধের উপর দিয়ে দৃষ্টিটা সবেমাত্র কাপড় সরে যাওয়া বগলে…. ঠিক তখনই হাজির হল কাবলি, তার বড়ো ভাগনি।
‘হ্যাললো, এম এম এম! কখন এলে গো…. শাড়ি! পিসি কার শাড়ি, দেখি দেখি।’ কাবলি বাক্সটা ছোঁ মেরে প্রতিভার হাত থেকে তুলে নিল।
‘কার শাড়ি গো পিসি?’
‘আমার।’
‘কে দিল তোমায়?’
‘মেজদা।’
‘এম এম এম, তুমি দেবার আর লোক পেলে না!’
সহদেব হাসছে। এম এম এম হল মিডল মাদার মাদার অর্থাৎ মেজো মামার সংক্ষেপিত চেহারা। ছটফটে, প্রাণবন্ত এবং মায়ের মতোই দেখতে। একে নিয়েই অনির জ্বালা। ওকে বুঝিয়ে বলতে হবে ড্রাগ যেন না ধরে।
‘হ্যাঁ, আমিই তো প্রতিভাদির হাতে দিলুম।’
‘আমি তাহলে এটা নেব।… পিসি নেব?’
কাবলি তারপরই এগিয়ে এসে ঝুঁকে, ‘কার জন্য এনেছ বলতো?’ বলেই পাশের সোফাটায় ধপাস করে বসে পড়ল। শাড়িটা খুলে ফেলে নিজের গায়ের উপর বিছিয়ে বলল, ‘কেমন দেখাচ্ছে?’
‘খুব ভালো দেখাচ্ছে। এবার পাট করে রাখ, ওটা তোর মায়ের জন্য বড়োমামা দিয়েছে।’ প্রতিভা শাড়িটা কাবলির দেহ থেকে তুলে নিয়ে ভাঁজ করতে লাগল।
‘দ্যাট বিলিতি মামা! আমি কিন্তু একবারও ওকে দেখিনি।’
‘তিন বছর আমিও দেখিনি। এবারও দেখা হল না। আমি যখন দিল্লিতে তখন এসেছিল।’
‘তুমি দিল্লি থেকে কী আনলে?’
‘একটা ঘোড়ার ডিম।’
‘কিছু আননি? তা হলে তো তোমাকে পানিশমেন্ট পেতে হবে,… তোমাকে বিয়ে করতে হবে। এই রকম একটা হ্যান্ডসাম ইন্টেলেকচুয়াল, এলিজিবল ব্যাচিলার কিনা আজীবন আইবুড়ো থেকে যাবে, হয় কখনো? দেশে কি মেয়ে নেই?’
‘তাহলে মেয়ে দ্যাখ।’
‘ঠিক?’
‘হ্যাঁ, ঠিক। তবে খুব তাড়াতাড়ি, নয়তো আমার মত বদলে যেতে পারে।’
সঙ্গে সঙ্গে কাবলি গভীর চিন্তায় ডুবে গেল। সহদেব এখন ফুরফুরে একটা মেজাজ পাচ্ছে যা বহুদিন সে পায়নি। ছেলেমানুষদের সঙ্গে ছেলেমানুষি, অর্থহীন কথাবার্তা, এরও যে দরকার আছে এটা সে জানত। একমাত্র উনিশ বছরের এই ভাগনিটি ছাড়া আর কেউ এই দরকারটা মেটাতে পারে না। ওর কথাবার্তায় পাগলামির লক্ষণ আছে, রসিকতা বোঝে ও করতে পারে, হাতের কাছে যা পায় গোগ্রাসে পড়ে, যা যা বললে বা করলে বয়স্কদের ভ্রূ কুঁচকে যায় স্বচ্ছন্দে তা বলে বা করে। সব থেকে বড়ো কথা, সহদেব ওকে হৃদয় আর বুদ্ধির মিশেলে গড়া চমৎকার একজন বন্ধু রূপে ভাবতে পারে।
‘মেজদা চা খাবেন তো?’
‘খাব।’
প্রতিভা চলে যাবার পর কাবলি বলল, ‘দাদুর পছন্দটা খারাপ ছিল না, কি বলো?’
‘নো কমেন্ট। … তোর ফাইনাল পরীক্ষা কবে?’
‘আর তিনমাস। … খবরদার এখন মায়ের রোল নিও না। দিনরাত বই মুখে দিয়ে বসে থাকলেই মা খুশি। তোমার বোন যে-।’ কাবলি দুহাত বাড়িয়ে শিউরে ওঠার ভান করল।
‘আমার বোন আবার কী দোষ করল!’ সহদেব আতঙ্কিত চোখে তাকাল। ‘গুরুজনদের সম্পর্কে তুই বড্ড আজেবাজে কথা বলিস।’
‘যেমন?’ কাবলি জিনসটা একটু টেনে তুলে সোফায় বাবু হয়ে বসে আবার বলল, ‘যেমন?’
‘যেমন, এই মাত্র নিজের দাদু সম্পর্কে যে ইঙ্গিতটা দিলি। ভদ্রলোকের চরিত্রদোষ ছিল কিন্তু-‘
‘ওয়েট, এম এম এম, ওয়েট। চরিত্রদোষ বললে না? আমি একে কোনো দোষ তো নয়ই বরং গুণ বলেই মনে করি। হোয়াট আ জেস্ট ফর লাইফ! কি কি ভিগারাসলি বেঁচে থাকার ইচ্ছে! নিংড়ে রস বার করে জীবনকে চুমুক দিয়ে দিয়ে খাওয়া, ঢাক ঢাক গুড়গুড় নেই, যেটা বজ্জাতদের থাকে… এই লোকটাকে অ্যাপ্রিশিয়েট না করে উপায় আছে!’ কাবলিকে রীতিমতো উত্তেজিত দেখাচ্ছে। আর মনে মনে অবাক হয়ে যাচ্ছে সহদেব। জীবনকে এই ভাবে দেখার দৃষ্টি এইটুকু মেয়ে পেল কোত্থেকে? এই রক্ষণশীল, আধুনিক চিন্তার ছোঁয়া থেকে সযত্নে দূরে থাকা পরিবারে তো মেয়েটা একটা প্রহ্লাদ!
‘যেসব দেশ শিক্ষা, রুচি, কালচার, সায়েন্স আর ইকনমিতে এগিয়ে, সেইসব দেশের মানুষদের মধ্যে একটা জিনিস কি লক্ষ করেছ?… জীবনকে তারা ভীষণ ভালোবাসে আর বাসে বলেই খুব যত্ন নেয়, তাকে কষ্ট দেয় না, তাকে অতৃপ্ত রাখে না। জীবনের চারদিকে ওরা কুশিক্ষা, কুসংস্কার, অচল ঐতিহ্য, লোকনিন্দা, অপবাদ, সামাজিক প্রথা, রীতি…এই যেসব বেড়া, এই যেসব আবর্জনা, জীবনকে যা কোণঠাসা করে রাখে, …আমাদের এদেশের জীবনকে তো রেখেছেই, সেগুলো কিন্তু ওরা সাফসোফ করে, পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে তার ফলে। ওদের জীবন মুক্তি পেয়েছে, ওদের চিন্তা করার ক্ষমতা বেড়েছে, অবাধ, স্বাধীন স্বচ্ছ মনের মালিক হয়েছে। দ্যাখো এম এম এম, যা কিছু ক্রিয়েটিভ এক্সপেরিমেন্ট সব কিছু ওদের দ্বারাই হচেছ… আর্ট, মিউজিক, ডান্স, লিটারেচার, ফিল্ম, এমনকী মানুষমারার মিসাইল আবার মানুষ বাঁচাবার মেডিক্যাল ইকুইপমেন্টস সব কিন্তু ওরাই করছে। আমরা স্রেফ চুরি নয়তো নকল করি আর তারপর ওদের ভোগবাদী, জড়বাদী বলে গালাগাল দিই।… কি শুনতে বিরক্ত লাগছে?’
‘লাগছে। বাচ্চচাদের মুখ থেকে বক্তৃতা আমার ভালো লাগে না, বিশেষ করে ধমকানিটা। মনে হচ্ছে তুই কারুর উপর রেগে তাকে হাতের কাছে না পেয়ে ঝালটা আমার ওপর ঝাড়ছিস।’
সহদেবের রীতিমতো ভালো লাগছে লাল হয়ে ওঠা কাবলির মুখটা দেখতে। আরও ভালো লাগছে চাঁচাছোলা কথাগুলো। এদের জেনারেশনে ন্যাকামি আর দুমুখো ব্যাপারটা অনেক কমে যাবে বলে তার মনে হচ্ছে।
‘আমি রেগেছি দাদুকে তুমি নোংরা চরিত্র বলতে চাওয়ায়। নো, সার্টেনলি হি ওয়াজ নট আ লউলি ক্যারেক্টার।’
‘নোংরা আবার কখন বললুম! শুধু বলেছি চরিত্রদোষ ছিল, তাতেই-‘
‘চরিত্র বলতে তুমি কী বোঝ?’ কাবলি চ্যালেঞ্জের মতো তালু ঠুকে ঊরুতে চড় মারল। ‘চারিদিকে যত লোক দেখছ সবাই বুঝি খুব চরিত্রবান? এই আমার বাবা, এই আমার মা, এই আমিই-‘
‘এর মধ্যে আবার বাবা-মাকে টানছিস কেন?’ সহদেব আপত্তি এবং বিরক্তি জানানোর সঙ্গে-সঙ্গেই দু-হাতে ট্রে ধরে চায়ের কাপ, জলের গ্লাস আর প্লেটে শিঙাড়া-সন্দেশ নিয়ে প্রতিভা হাজির হল।
‘হাতটা ধোব।’ সহদেব উঠে পড়ল। বৈঠকখানার লাগোয়াই একটা স্নানের ঘর, বাইরের লোকেদের জন্য। সাবান মাখিয়ে হাত কচলাবার সময় তার মনে পড়ল ঊর্মিকে। কথা বলার সময় কাবলির চোখে একটা রাগ ঝেঁঝে উঠছিল। ভুরুর, ঠোঁটের দ্রুত নড়ার, বেঁকে ওঠার, মাথাটা হেলানোর মধ্যেও দুজনের মিল রয়েছে। ঊর্মিকে ভাবতে ভাবতে সে হাত ধুয়ে ফিরে এল।
‘শিঙাড়া ঠান্ডা করবেন না মেজদা, আগে খেয়ে নিন।’
‘তোমাদের ব্রহ্মময়ীর শিঙাড়া? দারুণ করে।’
সহদেব একটা তুলে নিয়ে কাবলির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘খাবি তো তুলে নে, চারটে খেতে পারব না।’
কাবলি হাত বাড়াতেই প্রতিভা ধমকে উঠল, ‘এ কী হচ্ছে? মাত্র চারটে তাই থেকে তুই ভাগ বসাচ্ছিস। খাস তো ভেতরে আরও আছে, গিয়ে নিয়ায়।’
‘চারটে খাবে কি, দুটোই যথেষ্ট, তাই না?’ কাবলি অনুমোদনের জন্য সহদেবের দিকে তাকাল।
‘প্রতিভাদি, এই সাইজের চারটে সত্যিই খাওয়া যায় না। টাবলি কোথায়, টিভি দেখছে নাকি?’
‘উত্তমকুমারের ফিল্ম হচ্ছে, শেষ না হলে ও টিভি-র সামনে থেকে নড়বে না।’
‘এখনকার মেয়েরাও উত্তম পাগল! তোর মা-ও উত্তম ফ্যান ছিল।’
‘এখনও রয়েছে। জন্মে থেকে যেমনটি দেখেছি মা এখনও তাইই রয়েছে। … এক ধরনের মানুষ আছে যারা কিছুতেই বদলায় না।’
‘ঠিক।’ সহদেব আধখানা শিঙাড়া মুখে ঢুকিয়ে মাথা হেলিয়ে ভাগনিকে সমর্থন জানাল। ‘বদলায় না। বদলাবার জন্য সাহায্যগুলো জীবন থেকে তারা পায় না। বাড়ির বাইরে যাওয়া, বইপত্তর খবরের কাগজ পড়া, বুদ্ধিমান লোকেদের সঙ্গে মেলামেশা, কথা-বার্তা বলা। সেসব ব্যাপারে মন কৌতূহলী হয়ে ওঠে সেই সব ব্যাপার যদি না পায়, পৃথিবীটা বদলাচ্ছে সেই খবর যদি না পায় তাহলে সে নিজের ধ্যানধারণা বদলাবে কী করে?’
‘মা খবরের কাগজ পড়লে বাবা বিরক্ত হয়, তাই পড়ে না, আড়ালেও পড়ে না। এর কী ব্যাখ্যা দেবে?’
ভিতর থেকে একজন ঝি এসে প্রতিভাকে নীচু স্বরে কী বলল। ‘যাচ্ছি, চল।’ প্রতিভা যাবার আগে সহদেবকে বলল, ‘মেজদা সব কিন্তু খাবেন, ওই হ্যাংলাটাকে একটা সন্দেশও দেবেন না।’
‘পিসি জানোই তো মিষ্টি আমি খাই না।’ কাবলি দ্বিতীয় শিঙাড়া তুলে নিল।
‘মিষ্টি খাস না কেন, মোটা হয়ে যাবি বলে?’ সহদেব হালকা স্বরে, হালকা নজরে ভাগনিকে মৃদু চিমটি কাটল।
‘চিনি শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর।’ কাবলি একটি বাক্যে উত্তর দিয়েই প্রশ্ন করল, ‘ফিগার কনসাস হওয়াটা কি অপরাধের?’
‘এই দ্যাখো, অপরাধ-টপরাধ আবার এল কোত্থেকে? ভালো ফিগার, ছেলেই হোক আর মেয়েই হোক, দেখতে কত ভালো লাগে। … তোর কীরকম একটা অ্যাগ্রেসিভ স্বভাব তৈরি হয়েছে দেখছি। আগে তো এরকম ছিলিস না। নিশ্চয় ছেলেদের সঙ্গে মেলামেশা করছিস।’ সহদেব শেষের বাক্যটি বলে হাঁফ ছাড়ল। এতক্ষণে আসল প্রসঙ্গটার খুব কাছাকাছি এবার সে আসতে পেরেছে। অনিতা বলেছিল কাবলি আজেবাজে ছেলের সঙ্গে মিশছে। যদি ড্রাগট্রাগ ধরে। ‘দাদা ওকে একটু বুঝিয়ে বল।’
কাবলি চোখ বড়ো করে সহদেবের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে, হঠাৎ এমন একটা কথা মামা বলল কেন? চোখটা ধীরে ধীরে ছোটো স্বাভাবিক হয়ে এল। কৌতুক ঝিলিক দিয়ে উঠল।
‘মার সঙ্গে বোধহয় রিসেন্টলি তোমার দেখা হয়েছে?’
‘হয়েছিল, দিল্লি যাবার আগে।’
‘নিশ্চয় বলেছে একটা ছেলে আমার কাছে আসে।’
‘না, অত কিছু বলেনি। শুধু বলেছে তুই ড্রাগ ধরতে পারিস এই ভয় করছে।’
‘কী বলেছে? … ড্রাগ?’
তারপরই হো হো হেসে উঠল কাবলি। ‘আমি … আমি … ড্রাগ … ওরে বাবা।’ পেট চেপে ধরে হাঁফাতে লাগল। চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে এসেছে।
‘বিশ্বাস করে বসলে? এম এম এম তুমিও দেখছি মায়ের যথার্থ একটি দাদাই। ড্রাগ খেতে যাব কী দুখ্যে! য়্যাঁ, আমি কি বেকার না ফ্রাস্ট্রেটেড, অশিক্ষিত না হাঘরে?’
কাবলির দমফাটা হাসি দেখে সহদেবও হাসছিল তবে একটু অপ্রতিভ হয়ে। সে বলল, ‘বিশ্বাস করেছি, এমন ধারণা করলি কী করে? হেরোইন টেরোইন এখন তো স্কুলের ছেলেমেয়েরাও খাচ্ছে। তোর কাছে কে আসে?’
‘তরুণ। লেক টাউনে থাকে, সেন্ট জেভিয়ার্সে ইকনমিকস নিয়ে পড়ছে। খুব রোগা, কালো, চটি ট্যাঙস ট্যাঙস করে আসে, চুল আলুথালু। মা বোধহয় চেহারা দেখে ওকে ড্রাগ অ্যাডিক্ট…’
কাবলি আবার হেসে উঠে সোফা থেকে প্রায় গড়িয়ে পড়ার উপক্রম হল। ‘ও হো হো … বাবারে … আমি যে কী করব … ।’ বুকে হাত রেখে হাঁফাতে থাকল।
‘আস্তে হাস।’
‘আস্তে হাসব কি গো! এই জন্যই বোধহয় মা আমার বর খুঁজতে বেরিয়েছে। ভুনু পিসির সঙ্গে আজই সকালে ফোনে ফিসফিস হচ্ছিল। টাবু আমাকে বলেছে এই লাইনেই নাকি কথাবার্তা চলছিল। তুমি মাকে বলে দিও, কাবলি বলেছে বিয়ের নামগন্ধ একবার যদি পায় তাহলেই হেরোইন খেতে শুরু করবে। … বলবে তো?’
‘বলব।’
সহদেব এতক্ষণে টের পেল কথার মধ্যেই সে চারটে বৃহদাকার কড়াপাক সন্দেশ শেষ করে ফেলেছে এবং চা-ও। আর এক কাপ চা পানের ইচ্ছাও ইতিমধ্যে জন্ম নিয়েছে।
‘এক কাপ চা বল তো। আর যদি একস্ট্রা কড়াপাক থাকে তো দিতে বলিস।’
‘তুমি একটা টিপিক্যাল নর্থ ক্যালকাটান … স্যামবাজারের সসি বাবু।’
কাবলি উঠে যাবার আধ মিনিটের মধ্যে এসে পড়ল টাবলি। বাবার মতো চৌকো মুখ আর মাজা গায়ের রং। দিদির মতো লম্বা দেহ ও ছোটো চুল। মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসবে একমাস পর।
‘তুমি যে এসেছ যে খবর আমি পেয়েছি। কিন্তু এত ভালো দেখাচ্ছিল উত্তমকুমারকে যে-‘
‘তাই টিভি ছেড়ে আর ওঠা গেল না। কী বই হচ্ছিল?’
‘বিকেলে ভোরের ফুল।’
‘কথাটার কোনো মানে হয় না।’
‘কেন হয় না?’
‘গপ্পোটা কী?’
‘একজন অবিবাহিত মাঝবয়সি জনপ্রিয় লেখক, এই তোমার বয়সিই দিঘায় গেল। সেখানে অল্পবয়সি একটা মেয়ে যে তার মা, ভাই বোনের থেকে অন্য রকমের, সিরিয়াস ধরনের। তার ওই লেখককে ভালো লাগল আর সেই মাঝবয়সি লেখকেরও ওর সম্পর্কে, কী বলব, প্রেম, উঁহু বয়সের অনেক তফাত… দুর্বলতা জন্মাল।’
কাবলি সন্দেশের প্লেট হাতে ঢুকল।
‘চা আসছে ততক্ষণ এই কটা ধ্বংস করা। ছ-টা রয়েছে। দরকার হলে পিসি আরও আনাবে। টাবু শেষ পর্যন্ত কী হল রে?’
‘হবে আবার কী, উত্তম গাড়ি চালিয়ে কলকাতায় চলে গেল, সুমিত্রাও ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কেঁদে, বাংলা বইয়ে যা আর কি হয়ে থাকে … চুল পাকলেই প্রেম করা, বিয়ে করা এদেশে অচল, মানে ফিল্ম ফ্লপ করবে, উত্তম থাকলেও!’
‘সেই জন্যই বলেছি এম এম এম তোমার চুল এখনও থ্রি-ফোর্থ কালো রয়েছে, দেরি না করে বিয়েটা করে ফেল, আমি কি পাত্রী দেখে দেব?’
‘আমি তো তখনই তোকে বললুম, তাড়াতাড়ি দ্যাখ।’ সহদেব ভীষণ উপভোগ করছে এই দুটি মেয়ের সঙ্গে মজা করে কথা বলার সুযোগ পেয়ে। ‘আমি একটা ইউ ডি ক্লার্ক এটা মনে রেখে কিন্তু পাত্রী খুঁজিস। ঝরঝরে বাড়ি, ছাদ থেকে ঘরে জল পড়ে, একখানাই ঘর, নীচে মারাত্মক এক বোন আর তার পতি বাস করে। খবর প্রথমেই কিন্তু জানিয়ে দিবি।’
‘দোব।’ কাবলি এই বলেই মাথাটা সহদেবের মুখের কাছে এনে চাপা গলায় বলল, ‘তুমি একজনের সঙ্গে সিরিয়াস ধরনের প্রেম নাকি করেছিলে, সেটা কি সত্যি?’
‘সত্যি মানে! তোর ধারণা আমি কি পারি না? আমাকে এতই অপদার্থ ভাবিস? কিন্তু খবরটা তোকে দিল কে?’
‘বাবা আর মায়ের একটা ছোট্ট ঝগড়ার মধ্যে দিয়ে এটা যখন বেরিয়ে এল তখন হঠাৎ হাজির ছিলাম। সেই মহিলা এখন নাকি একজন বিখ্যাত গায়িকা, তোমার সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল, সত্যি?’ কাবলি সরল অল্পবয়সি কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে রইল।
সহদেব যে ধরনের কথা প্রকাশ্যে বলার চিন্তা কখনো করতে পারে না, অন্তত কিশোরী ভাগনিদের কাছে তো নয়ই, সেই রকম কথাই বলে ফেলল, ঈষৎ তাচ্ছিল্যভরে। এজন্য সে পরে আপশোস করে ভেবেছে, অল্পবয়সি দুটো মেয়ের কাছে বেপরোয়া আধুনিক ছোকরা সাজার ইচ্ছেটা হল কেন?
‘খুবই ঘনিষ্ঠতা! মানে সেকসুয়াল সম্পর্ক?’ সহদেব নিরাসক্ত স্বরে বলেই আড়চোখে দুজনের মুখের ভাব লক্ষ করে বলল, ‘হ্যাঁ তাও ছিল … তাতে হয়েছেটা কী?’
মেয়ে দুটির মুখে থতমত অপ্রতিভতা দেখে তার হুঁশ হল, এতটা না বললেও তো চলত।
‘না, হবে আবার কী।’ কাবলি গম্ভীর মুখে ছোটো বোনের দিকে এক পলক তাকিয়ে নিয়ে বলল, ‘বিয়ে না করার নিশ্চয় কোনো কারণ ছিল। কিন্তু তোমাকে রিফিউজ করল কেন?’
সহদেব প্রায় চমকে উঠে উত্তেজিত স্বরে বলল, ‘আমাকে রিফিউজ! কে বলল? আমিই তো ওকে বলেছি বিয়ে করা সম্ভব নয়, তোমাকে টানা তিনমাসের বেশি সহ্য করতে পারব না, মানে একসঙ্গে বসবাস করতে পারব না। ওর সঙ্গে তোর মা-র নানান দিক থেকে খুব মিল আছে।’
সহদেবের মনে হল, সে আবার ভুল করল এই শেষ বাক্যটিতে। অনিতাকে নিয়ে মেয়েরা যতই হাসুক না কেন, তাদের মা সম্পর্কে কেউ নীচু ধারণা প্রকাশ করলে তাকে ওরা সুনজরে দেখবে না।
‘সে তোমাকে এনজয় করতে দিয়েছিল নিশ্চয় এই ভেবে যে তাকে তুমি ভালোবাসো … তাকে চিট করবে না।’ কাবলির স্থির চোখে সহদেব সুনজর দেখতে পেল না। মা-কে তাচ্ছিল্য হেয়জ্ঞান করাটায় মেয়ে রেগে গেছে। পালটা ঝাপটা দিল ‘চিট’ শব্দটা জুড়ে দিয়ে।
‘এই যে একটু আগেই তুই কোন সব দেশের কথা বললি, যারা নাকি জীবনকে মুক্তি দিয়েছে। পুরোনো সংস্কার, সামাজিক প্রথা রীতি ভেঙে অবাধ, স্বাধীন, স্বচ্ছ মনের মালিক হয়েছে, ওগুলো কি তাহলে বাজে কথা?’ সহদেব ব্যঙ্গের মোচড় দিয়ে তার কথা শেষ করল।
‘না, বাজে কথা নয়।’ কাবলি একগুঁয়ের মতো মাথাটা কাত করে চোখ ছোটো করল। ‘আলাদা দেশ, আলাদা সোশিও-ইকনমিক সিস্টেম থেকে ভ্যালুজ তৈরি হয়েছে। আমাদের পুরোনো গরিব দেশে এখনও ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট ঘটেনি, এখানে সাবেকি ভ্যালুজ নিয়েই আমরা চলি, আরও বহুকাল চলতে হবে। তোমার কাজটা … কি বলব, বিশ্বাসঘাতকতারই সামিল।’
দপ করে আগুন জ্বলে উঠল সহদেবের মাথার মধ্যে। এইটুকু পুঁচকে মেয়ে হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষায় বসতে যাচ্ছে, কোথা থেকে শোনা চটকদার বুলি তোতাপাখির মতো আউড়ে তার চরিত্রকে চ্যালেঞ্জ জানাবার স্পর্ধা দেখাল! চোখ বন্ধ করে রাগটা নিবিয়ে আনার জন্য সময় নিল।
‘জীবনটা আমার আর সেই মেয়েটির, সমাজের নয়। সমাজের নিয়মনীতি সেখানে খাটে না। তোর ঠাকুরদার ক্ষেত্রে কি কেউ খাটাতে পেরেছে? বিয়ে না করে আমরা দুজনেই বেঁচে গেছি। নইলে-।’ সহদেব এবার যথাসময়ে নিজেকে থামিয়ে দিল। সে বলতে যাচ্ছিল, ‘নইলে তোর বাবা-মায়ের মতো দুঃখজনক সম্পর্ক নিয়ে জীবন টানতে হত।’
দুই বোন অসমাপ্ত কথাটা শোনার জন্য তার মুখের দিকে তাকিয়ে। সহদেব ঝুলিটা কাঁধে তুলে ওঠার উদ্যোগ করল। এরা চমৎকার মেয়ে, তার স্নেহের পাত্রী, আবেগপ্রবণ, ছেলেমানুষ। তার খুব ভালো লাগে এদের সঙ্গে কথা বলতে। মিষ্টি সম্পর্কটাকে তেতো করতে সে চায় না। বয়সের গণ্ডি ভেঙে কিছু কথা সে বলে ফেলেছে, আর এই ভুলটা সে করবে না।
‘অনি তো এখনও এল না। চলি এখন, গিয়ে ঘুমোতে হবে। ট্রেনে চেয়ারে বসে আসার যা ধকল! … শাড়িটা মাকে দিয়ে বলিস বড়োমামা কলকাতায় এসেছে। আমাদের বাড়িতে এসে বোনের জন্য শাড়িটা রেখে গেছে। বন্ধুর বাড়িতে উঠেছে, কদিন থাকবে তা জানি না। চলি।’ বন্ধুর বাড়িতে উঠেছে, কদিন থাকবে তা জানি না। চলি।’ সহদেব টাবলির চুল নেড়ে দিয়ে, কাবলির গালে আলতো করে চড় মেরে সিঁড়ির দিকে এগোল।
‘মা খুব ভালো।’
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে সহদেবের কানে কথাটা পৌঁছল। টাবলির গলা।
রাস্তায় বেরিয়ে অভ্যাসমতো ঝুলিতে একবার হাত ঢোকাতেই একটা কাগজ হাতে ঠেকল। বার করে দেখল আমেরিকান সেন্টারের সেই খামটা। এটা দিলে সিনেমার দুটো টিকিট পাওয়া যাবে। অফিস থেকে তিন সপ্তাহের ছুটি নিয়েছে। ফুরোতে এখনও দু-সপ্তাহ বাকি। সহদেব ভাবল, কাকে দিয়ে টিকিট আনাই! প্রতিবার অফিসের বেয়ারা পরেশ এনে দিয়েছে। এবার নিজেই যেতে হবে।
বাসে ফেরার সময় বার বার তার মাথায় পাক দিল ‘বিশ্বাসঘাতক’ শব্দটি। ‘আমরা দুজনেই বেঁচে গেছি’ এই কথাটা কি সে যথার্থ বলেছে? কেয়া কি ভেবে নিয়েছিল, সে চিটেড হয়েছে? ‘চিট’ কথাটাই কি বিশ্রী। বিদ্যুৎ বলেছিল ‘করাপ্ট’। আরও খারাপ কথাটা, শুনলেই নিজের উপর ভরসা কমে যায়, দুর্বল লাগে। কিন্তু বিশ্বাসভঙ্গের মতো কোনো অভিযোগ কেয়া তার কাছে বা অন্য কারুর কাছে তো তোলেনি! তাহলে কাবলি কেন এটা বলল? সে তার ঠাকুরদাকে তারিফ করে মামাকে নিন্দে করছে!
এটাও সেই কাচের দরজার এধার থেকে বাইরের বাগানের দিকে তাকিয়ে থাকা। কাবলিও ঠেলাঠেলি করল দরজাটা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে আসার জন্য। কোথায় যেন দরজাটা আটকে গিয়ে আর খুলছে না। ঠেলাঠেলিতে কাচ ভেঙে যাওয়ার ভয়। এধার থেকেই বরং বাগানটাকে দেখার জন্য কাচটাকে পরিষ্কার রাখতে মাঝে মাঝে ঝাড়পোছ আর কি!
কেয়া কি বেঁচে গেছে? এটা তাহলে জানা দরকার। ওর সঙ্গে একবার দেখা করতে হবে।
সাত
যা অনুমান করেছিল সেটাই শমি করেছে। দু-দিনের মধ্যেই সে খবর জোগাড় করে আনল কেয়ার সাংসারিক অবস্থা আর দাম্পত্য জীবন সম্পর্কে।
বহু বই, খাতা, ফাইল ইত্যাদিতে ড্যাম্প লেগে ছাতা পড়েছে। র্যাক থেকে সেগুলো নামাতেই পিছনের দেয়ালে বিঘতখানেক লম্বা উইয়ের উপনিবেশ দেখতে পেয়ে সহদেব সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল। একটা উইও যদি বইয়ের মধ্যে ঢোকে তাহলে সর্বনাশ করে ছাড়বে। সারা ঘরে ছড়ানো বইয়ের মধ্যে বসে সে এক একটি করে খুলে ছেঁড়া গেঞ্জি দিয়ে মুছে রাখছে। এর পর ছাদে নিয়ে গিয়ে রোদে বিছিয়ে দেবে।
শমিতা ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল এক কাপ চা নিয়ে।
‘খাব বলে করে, ভাবলুম তোমাকেও এক কাপ দিয়ে আসি।’
‘ভালো।’
‘ইসস, কী হয়েছে বই খাতার অবস্থা! দাও দাও আমায় দাও মুছে দিচ্ছি।’
‘হাত দিসনি, সাজিয়ে রাখা আছে, ওলটপালট হয়ে যাবে।’ সহদেব বইয়ের ব্যাপারে অত্যন্ত স্পর্শকাতর। কেউ হাত দিলে, বা নাড়াচাড়া করলে তার অস্বস্তি হয়। ফাইলের মধ্যে রাখা ‘তাজমহল’ গল্পটা একসময় তার অজান্তে কেয়া বার করে নিয়ে পড়েছিল। সে প্রচণ্ড চেষ্টায় রাগ চেপে বরং বলেছিল কেয়া অন্যায় করেনি। তখন এত দামি বইগুলোও ছিল না আর প্রথম প্রেমের আবেগটাও ছিল উথলে ওঠার পর্যায়ে।
‘কাল কেয়াদের বাড়িতে গেছলুম।’
মুখ তুলে সহদেব তাকাল। শমিতা চৌকাঠে উবু হয়ে বসল।
‘ওদের তিন ভাইয়ের হাঁড়ি আলাদা হয়েছে তবে ঝগড়াঝাঁটি নেই। ঠাকুরের নিত্য সেবা, ভোগ, বামুনের দক্ষিণার টাকা তিন ভাই-ই পিসিমার হাতে মাসে মাসে সমান ভাগে জমা দেয়। তিন ঘরে তিনটে সাদা-কালো টিভি। রঞ্জনদার ঘরে ফোন আছে, অন্যদের কল এলে ডেকে দেয়। ওদের ভাইয়ে-ভাইয়ে খুব মিলমিশ আছে।’
‘আমাদেরই শুধু নেই।’ সহদেব মুচকি হাসল।
‘তা সত্যি, আমাদের মধ্যে ওটা নেই। থাকলে কি আর বাড়িটার এই দশা হয়। যাক গে যা হবার তা হবে।’
‘তুই শুধু এইটুকুই দেখে এলি? আর কী দেখলি শুনলি?’
‘আর দেখাশোনার কী আছে! সব ভাইয়েরাই ভালো রোজগার করছে, ছেলেমেয়েরা পড়াশুনো করছে। আত্মীয়স্বজনরা আসে ওরাও যায়। কেয়া তো কদিন আগে এসেছিল, ঘণ্টাখানেক ছিল।’
‘মাত্র একঘণ্টা! বাপের বাড়ি এলে তো মেয়েরা কয়েকটা দিন থাকে।’
‘যা ব্যস্ত, থাকবে কী! ছোটো ভাইয়ের মেয়ের অন্নপ্রাশন ছিল বলেই এসেছিল, চার আনা সোনার বালা দিয়েছে।’
‘সে তো অনেক টাকা, এখন ভরি কত?’ সহদেব অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল শমিতার মুখের দিকে। প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল শমিতা।
‘কেয়া এখন অনেক টাকা রোজগার করছে। ফাংশানের কল তো লেগেই আছে। শিলিগুড়ি, আসানসোল, বহরমপুর কত জায়গায় ওকে যেতে হয়। দিল্লি, বোম্বাইও গেছে। দু-হাতে রোজগার করছে। বেহালায় পর্ণশ্রীর কাছে ফ্ল্যাট কিনেছে, চোদ্দোশো স্কোয়্যার ফুট। বিয়ে না করে তুমি কিন্তু ঠকেছই।’
সহদেবের কানদুটো গরম হয়ে উঠল। একটা বই খুলে সে তন্ময় হয়ে যাওয়ার ভান করল।
‘ওর বর তো গান লেখে, সুরও দেয়। মোটামুটি নাম আছে। দেখতেও নাকি খারাপ নয়। মেজোবউদি বলল, এখনও যখন ছেলেপুলে হয়নি তখন আর বোধহয় হবে না।’ শমিতার এবার খেয়াল হল সহদেব তার কথা না শুনে বইয়ের মধ্যে ডুবে রয়েছে।
সহদেব আড়চোখে বোনের দিকে তাকাল। সে বুঝতে পেরেছে শমি আসলে কী বলার জন্য চা হাতে নিয়ে উপরে উঠে এসেছে। এতক্ষণ যা বলল সেটা ভূমিকা মাত্র।
‘তুমি যে বললে স্বামীর সঙ্গে ওর বনিবনা হচ্ছে না, কই সে রকম কিছু আভাস তো মেজোবৌদির কথায় পেলুম না?
শমিতা প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য খুঁটিয়ে লক্ষ করবে, সহদেব তা অনুমান করেই একগাল হেসে বলল, ‘আমাকে বলেছিল অফিসের একটা ছেলে। ও কেচ্ছা কেলেঙ্কারির খবর খুব রাখে। আমি অবশ্য এই ধরনের গুজবে কান দিই না। শুনেছিলুম বলেই তোকে বলেছি। তবে বাচ্চচাটাচ্চচা না হলে কি মেয়েরা সুখী হয়?’
শমিতা জবাব না দিয়ে কী যেন ভাবতে লাগল। সহদেব কিছু বই স্তূপ করে দুহাতে তুলে একধারে সরিয়ে রাখল। উইয়ের বাসাটা এখনই ভেঙে দেবে কি না সেটা ঠিক করার জন্য সে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে ভাবছে।
‘বাচ্চচা না হওয়ার জন্য কোনো মেয়ে ডিভোর্স করে না।’ আচমকা শমিতা বলল।
‘হঠাৎ একথা?’
‘তুমি বিয়ে করবে বললে না?’
‘কাকে করব!’
‘কেয়াকেই তো। নয়তো স্বামীর সঙ্গে বনিবনা হচ্ছে না বললে কেন? ও ডিভোর্স করলে তুমি ওকে বিয়ে করবে, তাই তো?’
সহদেবের মনে হল তার উচিত এখন একটা অট্টহাস্য করে শমিকে চুরমার করে দেওয়া। তার বদলে সে গলার স্বর ঘন করে বলল, ‘আমার মনে হচ্ছে এবার বিয়ে করা দরকার। কত রকমের আপদ বিপদ মানুষের জীবনে আসতে পারে। সাহায্যের জন্য তখন খুব কাছের মানুষ দরকার হয়।’
‘কেন আমি কি কাছের মানুষ নই?’ শমিতা অভিমানীর মতো ঠোঁট ফোলাবার চেষ্টা করল।
‘একটা বউ যতটা কাছের হবে, বোন কি তা হতে পারবে? … কেয়ার মতো মেয়েই এখন আমার দরকার। ধর একটা কিডনি নষ্ট হয়ে গেল, না বদলালে তো মৃত্যু অবধারিত! কিডনি বদলাতে গেলে লাখখানেক টাকার ধাক্কা। তুই কি দিতে পারবি?’
শমিতা ফ্যালফ্যাল চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মাথা নাড়ল। ‘আমার সে সামর্থ্য কোথায়?’
‘যদি ক্যানসার হয়, বহু তাগড়াই লোকেরই হচ্ছে, তাহলে কত খরচ হবে বল তো? শুনেছি কেমোথেরাপির জন্য যে ইঞ্জেকশন, স্যালাইনের সঙ্গে নাকি হয়, তার একটার দামই নাকি আড়াই হাজার টাকা! দু-তিনটে নাকি দরকার হয়। এত টাকা আমার তো নেই।’
‘এসব অলুক্ষণে কথা বলছ কেন মেজদা?’
‘যদি একটা চাকুরে বউ থাকে, যদি শ্বশুরবাড়ির অবস্থা ভালো হয় তাহলে বাঁচার একটা চান্স তো নিতে পারব!’
‘কেয়ার এখন অনেক টাকা।’
‘আহা কেয়ার কথা আসছে কেন, কেয়া কি আমার বউ? এখন যদি ওর কাছে গিয়ে বলি পঞ্চাশ হাজার টাকা দাও প্রাণ বাঁচাবার জন্য চিকিৎসা করব, কেয়া কি আমায় দেবে? স্বামী হলে দিত।’
সহদেব বইগুলো দু-হাতে তুলে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে শমিতার পাশ দিয়ে ঘর থেকে বেরোল। সে ছাদে যাবে।
‘একবার চেয়েই দ্যাখো না, বোধহয় দেবে।’
থমকে দাঁড়াল সহদেব। তীক্ষ্ন স্বরে বলল, ‘কেন দেবে।’
অগোছালভাবে হেসে শমিতা বলল, ‘মেয়েরা অনেক জিনিস ভোলে না, চিরকাল মনে রাখে।’
কথাটা সহদেবের মাথায় গেঁথে গেল। তার মনে হল, ভোলে কি ভোলে না সেটা একবার যাচাই করলে কেমন হয়!
সকালে আমেরিকান সেন্টার থেকে সিনেমার টিকিট আনতে যাবার আগে সে কেয়ার দাদা, তার স্কুলের সহপাঠী রঞ্জনের সঙ্গে দেখা করল।
তাকে দেখে রঞ্জন সংগত কারণেই অবাক হল। পাশের পাড়া হলেও দুজনের মধ্যে বহু বছর সাক্ষাৎ ঘটেনি। কেয়ার সঙ্গে সহদেবের যে একটা সম্পর্ক ছিল এটা রঞ্জন জানে। বাড়ির সদরে দাঁড়িয়ে যখন সে আন্তরিকভাবে ‘আরে কী মব্যাপার, এসো এসো ভেতরে এসে বসো’ বলল, সহদেব তখন অযথাই স্বস্তি বোধ করল। সে ধরে রেখেছিল নৈর্ব্যক্তিক ধরনের ব্যবহার পাবে।
‘না ভাই বসার একটুও সময় নেই। এসেছি একটা দরকারে, ঠিক বললে আমাদের অফিসের একটি ছেলের দরকারে। ওদের ক্লাবের ফাংশান,ওরা কেয়াকে নিয়ে যেতে চায় কিন্তু ঠিকানাটা জানে না।’
‘ও তো এই সবে বাড়ি বদলেছে। নতুন ফ্ল্যাটের ঠিকানাটা তো,… দাঁড়াও আমার বউয়ের কাছে লেখা আছে, এনে দিচ্ছি।’
রঞ্জন মিনিট তিনেক পর ফিরে এল একটুকরো কাগজ হাতে। ‘ওর ফ্ল্যাটের ঠিকানা আর স্কুলের ঠিকানাটাও এতে আছে। নিউ আলিপুরে শনি-রবি, বিকেল চারটেয় গেলেই ওকে স্কুলে পাবে।’
‘কেয়া এখন তো খুবই ব্যস্ত আর্টিস্ট।’
‘হ্যাঁ, খুবই বিজি। একবার নাম হয়ে গেলে… ‘ রঞ্জনের মুখ তৃপ্ত হাসিতে ভরে গেল।
নাম হওয়ার এই এক জ্বালা, অবিরত কল আসবে, কোথায় কোথায় না যেতে হয়!’
‘হ্যাঁ নানান জায়গায়। তার ওপর আবার ওকে শুরুতেই তো বসায় না, মাঝরাত পার করে স্টেজে আনে। বাড়ি ফিরতে ফিরতে শেষ রাত হয়ে যায়। সঙ্গে অবশ্য ওর হাজব্যান্ড থাকে। তাহলেও খুব রিসকি জব। রাস্তায় গুন্ডা-বদমায়েশদের কীর্তিকলাপের খবর রোজই তো কাগজে পড়ছি। আমি তো ওকে বলি, রাতের এই সব ফাংশানে প্রোগ্রাম করার কী দরকার? টাকাটা বেশি পাওয়া যায়, এই তো? না হয় কয়েক হাজার কমই রোজগার হল, প্রাণটা আগে না টাকাটা আগে?’
‘নিশ্চয়, প্রাণটাই তো আগে। আচ্ছা রঞ্জন, আমার ভাই খুব তাড়া আছে, দেখা হয়ে বেশ ভালো লাগল।’
এরপর সহদেব বাসে এসপ্ল্যানেডে এল। এক মিনিট হেঁটেই আমেরিকান সেন্টারের ফটক। ভিতরে পা দিয়েই সে বারো-চোদ্দো জনের একটা সারি দেখে শেষ লোকটির পিছনে দাঁড়াল।
ঘণ্টাখানেক আগে যে ভাবে সে রঞ্জনকে অবাক করে দিয়েছিল সেইভাবেই সহদেব অবাক হল পঙ্কজকে দেখে। টিকিট দুটো নিয়ে পাঞ্জাবির বুক পকেটে রাখতে রাখতে ফটকের দিকে যাচ্ছিল তখনই সারিতে দাঁড়ানো সহদেবকে দেখে সে থমকে দাঁড়ায়।
‘সহদেবদা না!’
‘পঙ্কজ, তুমি! কতদিন পর!’
‘কত দিন কী, কত বছর বলুন। পাঁচ, ছয়, সাত…’
‘সাত বছরই হবে। লাস্ট দেখা কেশবের বাড়িতে। প্যারিস যাওয়ার চার দিন আগে। তোমাকে হুইস্কি দেওয়া হয়েছিল, তুমি ‘খাই না’ বলেছিলে…এখন খাও?’
পঙ্কজ জবাব না দিয়ে যেভাবে হাসল তাতেই সে বুঝে নিল, খায়। তার খুবই ভালো লাগছে, এতদিন পর একজন চেনা লোকের সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে সে উত্তেজনা অনুভব করল। পঙ্কজ মাইতিকে এক সময় ভারতের তরুণ উদীয়মান চিত্রশিল্পী হিসাবে গণ্য করা হত। সহদেবের সঙ্গে কে যেন আলাপ করিয়ে দিয়েছিল অ্যাকাডেমিতে একটা প্রদর্শনীতে। প্রদর্শনীটা ছিল অন্য আর এক শিল্পীর। কথায় কথায় পঙ্কজকে সে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘কেমন লাগছে ছবিগুলো’, সেদিনও পঙ্কজ এই রকম ভাবে হেসেছিল। শুধু মন্তব্য করেছিল, ‘ভালো নকল।’
সারিটা এগোচ্ছে। সহদেব অনুরোধের সুরে বলল, ‘এক মিনিট, টিকিটটা নিয়ে নিই।’
পঙ্কজ মাথা হেলিয়ে বলল, ‘দাঁড়াচ্ছি।’
সন্ধ্যা ছটার শো-এর দুটো টিকিট হাতে নিয়ে সহদেব ভাবল, বাড়তিটা কী করব? অফিসের জয়দেবকেই সে বাড়তি টিকিটগুলো দেয়। মাস দু-ই আগে ও’ নিল-এর চারটে নাটকের ফিল্মের বাড়তি টিকিটগুলো জয়দেবই চেয়ে নিয়েছিল। কিন্তু শুধু একটা টিকিট দেবার জন্য ছুটির মধ্যে অফিসে যেতে তার আর ইচ্ছে করল না।
আমেরিকান সেন্টারের বিপরীতেই একটা খাবারের দোকান। সহদেব বলল, ‘চলো চা খাই।’
‘আমার এক জায়গায় দশটার মধ্যে পৌঁছবার কথা। আজ থাক।’ পঙ্কজের স্বরে দৃঢ় অথচ বিনীত প্রত্যাখ্যান। সহদেব চা-এর জন্য চাপাচাপি করল না।
‘কবে ফিরেছ? এখন করছ কী?’
‘বাইরে এক বছর ছিলাম। ফিরে চণ্ডীগড়ে তারপর বোম্বাই-এ চাকরি, ছ-মাস আগে ছেড়ে দিয়ে এখন বেলেঘাটার সেই বাড়িতে আঁকছি। একটা কাজ করছি পারাদ্বীপে, কাল ফিরেছি আবার চলে যাব।’
‘তুমি কটার শো-এর নিয়েছ?’
‘ছটার। ফিরতে সুবিধে হয়।’
‘আমারও ছটার। …একটা টিকিট বাড়তি হচ্ছে, তুমি নেবে?’
‘কী করব নিয়ে, দুটোর বেশি তো আমার দরকার নেই।’
দুটো দরকার! পঞ্চজ কি তাহলে বিয়ে করেছে? সাত বছর আগে সেই ঘরোয়া পার্টিতে ওর সঙ্গে একটি মেয়ে এসেছিল। মিষ্টি মুখশ্রী, শান্ত চাহনি, নম্র কণ্ঠস্বর। একধারে চুপ করে বসেছিল ঘরে আর যে দু-তিনজন মেয়ে ছিল তাদের সঙ্গে সামান্য কিছু কথা বলেই মেয়েটি একা হয়ে যায়। ওকে দেখে সহদেবের মনে হয়েছিল, পাঁচ-ছটি বাচ্চচার মা হওয়ার জন্য মেয়েটি যেন প্রস্তুত। পঞ্চজ কি তাকেই বিয়ে করেছে?
‘তুমি বিয়ে করেছ?’
‘হ্যাঁ এবং আপনি এখনও করেননি। ঠিক বলেছি?’
পঙ্কজের হাসি থেকে শব্দ ছিটকে সুরেন ব্যানার্জি রোডের পেভমেন্টের কয়েকজন ব্যস্ত পথচারীকে আঘাত করল। চলতে চলতে তারা ফিরে তাকাল। পঙ্কজের সামনের দাঁত দুটো একটু উঁচু তাই দুই ঠোঁটের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসে। চৌকো কঠিন চোয়াল। গালে ব্রণর ক্ষতগুলো বেশ গভীর। উঁচু কপালে, চুলের তটরেখা অনেক পিছিয়ে রয়েছে। পঞ্চজ সুদর্শন নয়। উৎকট রকমের সবুজ ট্রাউজার্সের সঙ্গে হাঁটু পর্যন্ত নামা ঝামারঙের খদ্দরের পাঞ্জাবিতে ওকে হাস্যকর লাগছে।
‘কেন করেননি?’ পঙ্কজ কৈফিয়ত চাওয়ার ভঙ্গিতে বলল।
‘করার মতো কাউকে পাইনি বলে।’ এবার সহদেবও হাসির সঙ্গে শব্দ মেশাল। কিন্তু নিজের কানেই সেটা কৃত্রিম ঠেকল। তার মনে হল, এটা হাসির মতো কথা নয়, অক্ষমতার একটা আড়াল।
‘কাউকে পাননি! এটা কী একটা কথা হল? আসলে আপনি খুব কুঁড়ে, উদ্যোগী নন।’
‘এজন্য উদ্যোগ করতে হবে?’
‘নিশ্চয়। চমৎকার মহিলাদের তো আবিষ্কার করতে হয়, সেজন্য অবিরাম চেষ্টা আর প্রচুর ভাগ্যও থাকা চাই। আপনার এই যে কানের উপর অল্প পাকা চুল, এই যে স্বাস্থ্য, সৌম্যদর্শন চেহারা, পাণ্ডিত্য, উইজডম, কাগজে নাম, …এসবকে কাজে লাগাবার কোনো উদ্যোগই আপনি নিলেন না?’ পঙ্কজ দু-হাত ছড়িয়ে বিস্ফারিত চোখে মাথা নাড়তে লাগল।
‘তুমি তাহলে উদ্যোগী হয়ে আবিষ্কার করেছ?’ সহদেব মুচকি হাসিটা ঢাল-এর মতো এমনভাবে ধরে রাখল যেন পঙ্কজের কথাগুলো তাতে ধাক্কা খেয়ে ঠিকরে যায়। কিন্তু শুনতে তার ভালো লাগল। পঙ্কজের কোনো প্রয়োজন নেই স্তাবক হবার। সে ভালোই জানে সহদেব আর্ট ক্রিটিক নয় যে তাতে মাতিস বা দেগ্যাঁর সঙ্গে তুলনা করে প্রবন্ধ লিখবে। কিন্তু মনের গভীরে সহদেব চাঞ্চল্য বোধ করছে। কাবলির সঙ্গে কথা বলার সময় যে ধরনের বয়স কমে যাওয়ার টান লাগে এখন তা লাগছে। পঙ্কজ অনেকগুলো ভালো বিশেষণে তাকে আরাম দিয়েছে।
‘অবশ্যই।’ পঙ্কজ দুই ঠোঁট চেপে দাঁত দুটোকে ঢেকে পিটপিটিয়ে তাকাল। ‘অবশ্যই আবিষ্কার করেছি, …ওহহ, সহদেবদা আমার দেরি হয়ে গেছে, চলি, শুক্কুরবার দেখা হচ্ছে।’
পঙ্কজ প্রায় ছুটতে শুরু করল। দুটো লোককে ধাক্কা মেরে মেট্রোপলিটান বিল্ডিংটা ঘুরে ডানদিকে তার অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার ভঙ্গিটা সহদেব দেখল। ইউরোপ ঘুরে এসে প্রভূত বদলে গেছে। চটপটে হয়েছে, মুখচোরা ভাবটা ঘুচে গেছে। নিশ্চয় নিজের উপর আস্থা বেড়েছে, দাঁড়বার মতো জমি খুঁজে পেয়েছে।
সহদেব চৌরঙ্গির মোড়ে দাঁড়িয়ে ভাবল কী করা যায় এখন। লাইট হাউসের সামনে বইয়ের দোকানগুলোয় কি চোখ বোলাবে? স্কুলে পড়ার সময় অনেক সিনেমা হলে বারোটায় একটা শো হত। কিন্তু কখনও সে স্কুল পালিয়ে সিনেমা দেখেনি। এখন যদি কোথাও নুন-শো হয়, নিশ্চয়ই হয়, তাহলে টিকিট কেটে ঢুকে পড়া যায়। টাইগার, নিউ এম্পায়ার, লাইট হাউস বা …সহদেবের চোখ আটকে গেল কালো অক্ষরে মিনি বাসের গায়ে লেখা একটি শব্দে: পর্ণশ্রী।
ঝোলার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে কাগজটা স্পর্শ করেই সহদেব ছুটে গেল রানি রাসমণি রোড থেকে বেঁকে এসে দাঁড়ালো বাসটার দিকে। পর্ণশ্রী কলেজের কাছে একটা চারতলা বাড়ির তিনতলার ফ্ল্যাটে কী রকম চমক উঠবে সেটা অনুমান করার জন্য, বাসে উঠেই তার মাথাটা তোলপাড় শুরু করল।
আট
‘দিদি এখন চান কচ্ছেন, আপনার কি এখন আসার কথা ছিল?’ এক পাল্লার দরজাটা সামান্য খুলে কাজের মেয়েটি জানতে চাইল।
ইতস্তত না করে সহদেব বলল, ‘হ্যাঁ।’
‘বসুন।’ দরজাটা আর একটু খুলে ধরে মেয়েটি সরে দাঁড়াল।
তৃতীয় ব্র্যাকেটের মতো সাজান তিনটি বৃহদাকার সোফা। সহদেব ইতস্তত করল, কোন দিকের সোফায় বসবে ঠিক করার জন্য। ভিতর থেকে কেউ এলে প্রথমেই তার মুখটা যাতে দেখতে না পায়, এই রকম একটা সোফা সে বেছে নিল।
এখন তার সামনে কাচের পাল্লা দেওয়া বাঁ দিকে দুটি জানলা। জানলাগুলোর মাথায় পেলমেট। সোনালি জমিতে হাকলা হলুদ নকশা আঁকা সবকটা ভারী পর্দাই সরিয়ে রাখা। খোলা জানলা দিয়ে বহুদূর পর্যন্ত আকাশ দেখা যাচ্ছে। ঘরটা অলোয় ভরপুর। মাঝখানে নীচু একটা কাচ বসানো টেবল। পিতলের ফুলদানিতে রজনিগন্ধার গোছা। দুটো পিতলের অ্যাশট্রে, কয়েকটা রাবার ম্যাট। টেবলের নীচে একটা তাক। ম্যাগাজিনের মতো কয়েকটা বই, খবরের কাগজ। একটা পুরু গালিচা তিন দিকের সোফাকে স্পর্শ করে বিছানো।
সোফায় বসা মাত্রই সহদেব প্রায় এক ফুট ডুবে গেল। হাঁটু থেকে গলা পর্যন্ত শরীরটা সেজন্য এমন এক ভঙ্গি ধারণ করল যেটা তাকে অস্বাচ্ছন্দ্যে ফেলে রাখল। একবার তার মনে হল, উঠে গিয়ে অন্য সোফায় বসবে কিনা! কিন্তু আসন বদলাল না। তবে ঘরের একধারে দেয়াল ঘেঁষে একটা টেবল, সেখানে হাতলহীন একটা কাঠের চেয়ার আছে। ওটায় গিয়ে বসলে নিজেকে বোধ হয় লঘু করে ফেলা হবে। টেবলটায় রয়েছে টেলিফোন আর ডিরেক্টরি বইটা। প্যাড আর পেনসিল, টেবল ল্যাম্প, আর হাতির দাঁতের তৈরি বীণা কোলে নিয়ে ছোট্ট একটা সরস্বতী মূর্তি। দেয়ালে প্রায় দু-ফুট একটা সাদা-কালো ছবি, শীর্ণ মুখের এক বৃদ্ধ লাজুক হাসছেন। সহদেবের চেনা লাগল। কেয়া ক্ল্যাসিকাল শিখত এঁর কাছেই।
মসৃণ দেয়াল পাতি লেবু রঙের, ইলেকট্রিক তার দেখা যাচ্ছে না। ফ্লুরোসেন্ট টিউবও ঢাকা, চারদিকের দেয়ালেই ঝুলছে জাপানি ফানুসের আদলে চারটে ল্যাম্পশেড। সিলিংয়ে দুটো পাখা। এতবড়ো ঘরে দুটো ছাড়া চলে না। তার মাথায় উপরেরটা চালিয়ে দিয়ে মেয়েটি ভিতরে যাবার আগে প্রশ্ন করল, ‘আপনার নাম?’
‘সহদেব মিত্র।’
দেখার জন্য প্রথম চমকটা আর রইল না। বাথরুমের দরজার বাইরে থেকে মেয়েটি চেঁচিয়ে নামটা বলবে। শাওয়ারের দিকে মুখ তুলে জলের ধারার নীচে দাঁড়িয়ে, নিশ্চয় এখন শরীরে বসন নেই, কেয়ার কানে নামটা পৌঁছানো মাত্র বুকের মধ্যে একটা ধড়াস কি হবে না? চোখ বন্ধ করে নিশ্চল হয়ে থাকবে কিছুক্ষণ। ঝাঁ ঝাঁ করে রক্ত ছুটবে সারা শরীরে। এখন অনেক কথা ওর মনে পড়বে। ফিল্মের ফ্ল্যাশব্যাকের মতো মনের মধ্যে অনেক ছবি আসবে, অনেক কথা শুনতে পাবে, অনেক চিঠির লেখা…ওহহ ওর চিঠিগুলো যে একদিন ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছি সেটা ও জানে না, কিন্তু আমার দেওয়াগুলো …এতদিনে নিশ্চয় ফেলে দিয়েছে। দিক, কিন্তু সশরীরে হাজির হওয়াটা, বলা কওয়া নেই…এর ধাক্কাটা মাথা ঠান্ডা রেখে নিতে পারবে তো!
সহদেবের ভাবনা চঞ্চল হয়ে পড়ল। এই কুঁজো হয়ে বসা তার উপর সামনের খোলা জানলা দিয়ে আকাশে এত রোদ যে চোখ তোলা যাচ্ছে না। পর্দাটা টেনে দেবার জন্য সে উঠল।
‘আপনি কি সিউড়ি থেকে আসছেন?’
সহদেব চমকে ঘুরে দাঁড়াল। ধুতিটা লুঙ্গির মতো করে পরা, সাদা পাঞ্জাবি গায়ে এক মাঝবয়সি লোক। একটু স্থূলকায়, মুখ গোলাকৃতি, উচ্চচতা যা তাতে বেঁটেই বলা যায়। মাথায় প্রচুর চুল, শ্যামবর্ণ, চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা।
‘না, আমি আসছি কালিমোহন বোস স্ট্রিট থেকে, কেয়াদের পাশের পাড়া।’
রাস্তার নামটা শুনেছে কিংবা হয়তো শোনেনি, সেটা লোকটির মুখভাব থেকে স্পষ্ট হল না। সহদেব সেটা স্পষ্ট করে তোলার জন্য বলল এবং সেটা এখানে আসার কৈফিয়তের মতোই তার নিজের কানে ঠেকল, ‘কেয়াকে আমি ছোটোবেলা থেকেই চিনি।’
‘আপনি বসুন। ওঁকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।’ লোকটি ভিতরে চলে গেল। মুখে কোনো ভাবান্তর ঘটেনি।
কোমল, ধীর কণ্ঠস্বর। প্রেমিকের মতো গলা। ‘পাঠিয়ে দিচ্ছি’ বলল মানে কেয়াকে ইনি পাঠাতে পারেন কিংবা নাও পারেন। কেয়ার স্বামী!
‘পর্দাটা অর্ধেক টেনে দিয়ে এল সহদেব। আর তখনই কেয়া ঢুকল। ভিজে চুলের গোড়ায় তোয়ালে ঘষতে ঘষতে, মাথাটা একদিকে কাত করে।’
‘তাই বলি, সহদেব মিত্র আবার কে!… এতদিন পর যে, পথ ভুলে নাকি?’
সহদেব বুঝে উঠতে পারছে না, কেয়ার স্বরে ঘরোয়া স্বাগত না বিদ্রূপ? প্রাথমিক কাজটা সারতে সে অবশ্য সময় খরচ করল না। কেয়া যথেষ্ট চর্বি ঝরিয়েছে, গায়ের রং উজ্জ্বল কাঁসার মতো হয়েছে, চশমা মুখটাকে বদলে দিয়ে ব্যক্তিত্ব এনেছে, ঝরঝরে স্বরক্ষেপে সাবলীল জীবনের ঘোষণা।
‘পথ ভুলে আর যেখানেই যাই, এখানে এসে পৌঁছব না, একেবারে পথ চিনেই এসেছি। ঠিকানাটা রঞ্জনের দেওয়া।’
‘তাহলে দাঁড়িয়ে কেন, বোসো।’ কেয়া চুলের ডগা তোয়ালে চেপে রগড়াবার জন্য চুল আয়ত্তে আনার চেষ্টার মধ্যেই নির্দেশ দিল।
সহদেব প্রীত। কেয়া বদলে গেছে। বুদ্ধিমতী হয়েছে, না হলে এতক্ষণে প্রাক্তন প্রণয়ীকে দেখার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়াটা জানিয়ে ফেলত। থতমত, জড়তা, দ্বিধা, কুপিত বা কোমল চাহনি, এর কিছু একটা অন্তত ফুটে উঠত। যেন কিছুই হয়নি, সিউড়ি কি খড়দা থেকে ফাংশানে গান গাইবার প্রস্তাব নিয়ে আসা একটা লোকের সঙ্গে কথা বলার মতো এই ভাবটা, না বদলালে দেখাতে পারত না।
সোফায় অস্বস্তিকর ভঙ্গিতে আবার বসে সহদেব বলল, ‘কদিন আগে তাজমহল দেখতে যাই।’ কিঞ্চিৎ নিরুৎসুক স্বরে অতঃপর যোগ করল, ‘দিল্লিতে গত সপ্তাহে একটা সেমিনার ছিল, ট্র্যাডিশনাল ওরাল লিটারেচার সম্পর্কে, পেপার পড়তে গেছলাম। ওখানেই মনে হল, তাজমহল না দেখেই ওটার পটভূমিতে একটা প্রেমের গল্প লিখেছিলুম। তুমি সেটা পড়ে বলেছিলে, পড়তে পড়তে তোমার কান্না আসছিল নায়কের জন্য।’
‘সে তো অনেক বছর আগের কথা, তোমার এখনও মনে আছে দেখছি!’ কেয়া বাঁ দিকের সোফায় বসে পড়ল।
ওর বসাটা সহদেবকে আশ্বস্ত করল। তার মনে রাখাকে কেয়া কীভাবে নেবে সেটা এবার বুঝে নেওয়া দরকার।
ওর বসাটা সহদেবকে আশ্বস্ত করল। তার মনে রাখাতে কেয়া কীভাবে নেবে সেটা এবার বুঝে নেওয়া দরকার।
‘দিল্লিতে ভীষণ ভাবে মনে পড়ল…’ সহদেব মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে বলল, ‘তোমার ওই কান্নার কথাটা। কী এমন ছিল ওই গল্পটায়? তাই ভাবতে ভাবতেই আগ্রা যাবার বাসের একটা টিকিট কেটে ফেললুম। আমার শুধু মনে হয়েছিল প্রেম, বিরহ, একনিষ্ঠতা, বিচ্ছেদ, মরণ, আত্মাহুতি, এই সব ব্যাপার মেয়েরা খুব পছন্দ করে। তাই তোমাকে নাড়া দিয়েছিল গল্পটা, ঠিক কিনা।’
‘হতে পারে, তখন বয়সটা তো কম ছিল।’
‘ওটা বেড়েছে নাকি! কই শরীরের বয়স তো বাড়েনি বরং আগের থেকে কমই দেখাচ্ছে। বছর খনেক আগে তোমার একটা ছবি দেখেছিলুম, কুড়ি-বাইশ মনে হচ্ছিল। পুরোনো ছবি নাকি?’
সহদেব তুষ্ট করার প্রথম অস্ত্রটি নিক্ষেপ করে ধাঁধায় পড়ে গেল। কেয়ার মুখে রক্ত ছুটে গেল না। চোখের পাতা পলকের জন্যও বেতালা হল না। বস্তুত মোনালিসা ধরনের একটা হাসি ছাড়া আর কোনো ভাবান্তরই নেই! কেয়া বোধ হয় আগের মতো নেই!
‘যাই হোক, তাজমহল দেখলুম। যমুনা নদীর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে পড়ল, আমার গল্পের নায়ক দুর্ঘটনায় মারা পড়া তার প্রেয়সীর শোকের ভার আর বইতে না পেরে, যমুনায় ঝাঁপ দিল। ওইখানে তখন দাঁড়িয়ে, কি জানি কেন ব্যাপারটা আমার কিন্তু হাস্যকর বা অবাস্তব বলে মনে হল না। মনে হল প্রেম মানুষকে দিয়ে কত কাজই না করিয়ে নেয়। কেউ আত্মহত্যা করে কেউ তাজমহল গড়ে চিরবিরহীর বীণা যুগাযুগান্তরের জন্য রেখে যায়। … আর তখনই তোমাকে ভীষণ ভাবে মনে পড়ল। মনে পড়ল, রবীন্দ্রনাথের ‘শাজাহান’ কবিতাটাও। পঁচাত্তর বছর হয়ে গেছে কবিতাটার বয়স, কিন্তু কী তরুণ আজও।’
‘বিরাট কবিতা। সবটাই কি মনে পড়ল নাকি দু-চারটে লাইন?’
সহদেব অপ্রতিভ হয়ে গেল। কেয়া তাকে সিরিয়াসলি বোধ হয় নিচ্ছে না। কিন্তু সে যে এত বছর পর আচমকা হাজির হল, সেটা তো যৌক্তিক করা দরকার।
‘সবটা কি মনে পড়া সম্ভব? কবিতাটার মূল সুর, বক্তব্য, এটা তো অদৃশ্য ভাবে মনের মধ্যে থেকে যায়ই। হয়তো দু-চারটে লাইনও মনে পড়বে।’
‘পড়বে? আচ্ছা বলতো…’ কেয়া চোখ পিট পিট করে, ধাঁধা বলার মতো স্বরে প্রশ্ন করল, ‘যে প্রেম সম্মুখ-পানে চলিতে চালাতে নাহি জানে, যে প্রেম পথের মধ্যে পেতেছিল নিজ সিংহাসন, তার বিলাসের সম্ভাষণ… তার পরের লাইনে কী আছে বল?’
সহদেব ফাঁপরে পড়ে গেল। সাহিত্য ভারতীয় সম্পাদক বাইশ বছর আগে জিজ্ঞাসা করায় সে বলেছিল, হ্যাঁ শাজাহান পড়েছি। সত্যিই তখন পড়েছিল, কিন্তু মুখস্থ করেনি। একটা লাইন অবশ্য এখনও মনে আছে।
‘দ্যাখো তোমার ওই লাইনের পরে কী আছে বলতে পারব না, তবে এটা মনে আছে… যুগ যুগান্তরে কহিতেছে একস্বরে ভুলি নাই, ভুলি নাই, ভুলি নাই প্রিয়া।’ সহদেবের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ‘প্রিয়া’ শব্দটা আলতো কোমলভাবে টেনে রেখে সে কেয়ার দিকে ঠিকভাবেই তাকিয়েছে।
‘একটা লাইন ড্রপ করেছ, ‘যুগ’ নয় হবে ‘যুগে’ … যুগে যুগান্তরে কহিতেছে একস্বরে, তার পরের লাইন, চিরবিরহীর বাণী নিয়া-ভুলি নাই… যাক গে ভুলি নাই ভুলি নাই অনেক হয়েছে, বাড়ির খবর কী? শমির তো একটা মেয়ে, হয়েছে?’
সহদেব ধরেই রেখছিল অবধারিত প্রশ্ন হবে ‘বিয়ে করেছ?’ কিন্তু তার ধার কাছ দিয়েও কেয়া গেল না।
‘হ্যাঁ একটাই, বেচারার পোলিও। তোমার কটি?’
‘একটিও নয়।’ কেয়ার মুখে পাতলা হাসি। ‘আপাতত নয়।’
কেন নয়? আপাতত নয় মানে পরে হতে পারে! সহদেব ভ্রূ তুলে তাকাল। কাজের মেয়েটি তখনই তার পিছনে এসে দাঁড়াল। ইশারায় সে কিছু একটা বলতেই ‘ওহ, হ্যাঁ’ বলে কেয়া উঠে পড়ল। ভালো করে গা না মুছেই শায়া-শাড়ি পরার এবং বসার জন্য কাপড় ভিজে গিয়ে এঁটে রয়েছে দুই নিতম্বে। সহদেব লক্ষ করল খিলেনের মতো প্যান্টির বক্র রেখা। আগে তো এসব পরত না।
‘একটু বোসো, আসছি।’
সহদেব ঘাড় ঘুরিয়ে আর একবার দেখল। মিনিট দুয়েকের মধ্যেই ফিরে এল কেয়া।
‘নতুন একটা গান লিখছেন… মিল দিতে পারছিলেন না।’
‘কী রকম?’
‘তুমি যা বলতে পারলে না সেটাই বলে এলাম। ‘বিলাসের সম্ভাষণের’ পর আছে… ‘পথের ধুলার মতো জড়ায়ে ধরেছে তব পায়ে-দিয়েছ তা ধূলিরে ফিরায়ে।’ গোধূলির সঙ্গে মিল দেবার মতো শব্দ খুঁজছিলেন, বললুম এর থেকে বার করে মিল খুঁজে নাও। এরকম বহুবার হয় আর তখনই আমার ডাক পড়ে, এই ‘ডাক পড়া’ যে অতীব সুখের কেয়ার চোখমুখ তা গোপন করছে না।
‘তুমি শুধু ওনার লেখা গানই গাও?’
‘তা কেন, অন্যদের লেখা গানও অনেক গেয়েছি।’
‘শাজাহান মুখস্থ তোমার! কবে করলে?’
‘সেই তখন, যখন বলেছিলে আমার মাথার মধ্যে আছে, সম্ভবত গোবর।’
সহদেব সিঁটিয়ে গেল। মনে করে রেখেছে এখনও। মুখে হাসি টেনে এনে বলল, ‘মুখে বলেছিলুম না চিঠিতে?’
‘মুখেই। আমাকে যা খুশি বলা তো তোমার মুখে আটকাত না।’ কেয়া উদারভাবে হেসে উঠল। যেন একটা মজার কথা বলল।
সহদেব মজা পাচ্ছে না। চিঠির কথাটা ইচ্ছে করেই সে যোগ করেছে। ‘পরশু বইগুলো রোদে দিতে গিয়ে তোমার কটা চিঠি পেলুম। পড়লুম। বেশ লাগল।’
‘রেখে দিয়েছ! এত বছর ধরে!’ কেয়াকে অবিশ্বাসীর মতো দেখাচ্ছে।
‘আসলে তাড়াহুড়োয় বইয়ের মধ্যে গুঁজে রেখেছিলুম, তাই ওইভাবেই রয়ে গেছে। ভাগ্যিস রেখেছিলুম! নয়তো এখন আবার পড়ার সুযোগ হত না। ভীষণ ইমোশন্যাল ছিলে, অভিমানীও।’
‘দেখাবে চিঠিগুলো, কটা আছে? … অবশ্য আমি ফেরত দিয়ে দোব।’
‘না না, দেখানো যাবে না, ওগুলো আমার, একান্তই আমার সম্পত্তি। তাছাড়া তোমার এখানে ওসব জিনিস রাখার বিপদ আছে। কখন তোমার স্বামীর হাতে পড়ে যাবে।’
কেয়া একদৃষ্টে তাকিয়ে। চোখের মণি দুটো নড়ছে না কিন্তু ভ্রূ দুটো জোড়া লাগানো। সহদেব হাসল। হাসির মধ্যে পুরোনো প্রণয় যতটা ভরে দেওয়া সম্ভব তাই দিল।
খুব ধীরে কেয়ার ঠোঁটে একটা হাসি জেগে উঠল। কি একটা বলতে গিয়েও বলল না।
‘তুমি খুব সুখে আছ কেয়া। নাম, যশ, অর্থ, জীবনে যা যা কাঙ্ক্ষিত, পেয়েছ। একটা সুন্দর সংসারও। জানি না স্বামীটি কেমন। যে ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বললুম উনিই তো?’
‘হ্যাঁ।’
‘তুমি ওকে ভালোবাসো?’ সহদেব ঝুঁকে মৃদু স্বরে বলল। একটা উদবেগ তার মুখে ছড়ানো।
‘ওকে আমি প্রায় জোর করেই বিয়ে করেছি, উনি রাজি হচ্ছিলেন না। দেখতে খারাপ, বয়সেরও অনেক ডিফারেন্স, একটা গানের স্কুলে মাস্টার, এইসব বলে এড়িয়ে যেতে চেয়েছিলেন।’
‘তাহলে কেন…।’ অকৃত্রিম বিস্ময়ে সহদেব তাকিয়ে রইল। এমন একটা লোককে কেন?
কেয়ার মুখে এমন একটা হাসি ফুটে উঠল যার বারো রকম অর্থ করা যায়। সহদেব তেরো-তম তথ্যটি করল, ঘৃণা।
‘কেন, তা তো বলতে পারব না।’
‘আমাকে তুমি মন থেকে একদমই নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছ। তাই না?’
কেয়া যেন ভাবনায় পড়ল। জানলা দিয়ে কিছুক্ষণ বাইরে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘এত ব্যস্ত আমি।’
‘আমার কিন্তু মনে পড়ে।’
‘পড়ে নাকি? কেন।’ কেয়ার কোনো কৌতূহল বা বিস্ময় নেই। ‘কেন’ শব্দটা যেন একটা চিন্তার চেহারা নিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়েছে। উত্তর দেওয়ার দায় যেন তারই।
‘পড়ার কোনো তো কারণ নেই। বোধহয় তুমি ব্যস্ত নও। বই পড়া আর লেখা নিয়েই আছ নিশ্চয়, লোকজনের মধ্যে থাকাটা তো পছন্দ কর না। ভুল করেছ। পৃথিবীতে নানান রকম লোকের সঙ্গে মেলামেশা না করলে জানার বোঝার কাজটা হবে কী করে? শুধু বই পড়ে কি হয়? গাইবার সময় আমি একদম পিছনে বসা লোকেদের কথাও ভাবি।’
‘বাড়িতে অনেক ঝামেলা কেয়া, ব্যতিব্যস্ত করে মারে। আমার ব্যস্ততাটা অন্য রকমের, একদমই আনপ্রোডাক্টিভ। তারই মধ্যে যখন একা হতে পারি তখন বহু কথা, স্মৃতি, মনে পড়ে, আমাদের সেই সময়টাকেও।’
‘তুমিও ইমোশ্যানকে প্রশ্রয় দিচ্ছ!’
‘এটা কি খারাপ জিনিস? বই পড়তে পড়তে, গল্প শুনতে শুনতে বা সিনেমা দেখতে দেখতে বহু ঘটনা, কথা, দৃশ্য চোখে জল এনে দেয়। ইমোশ্যনাল হই বলেই তো আমরা মানুষ।’
‘আর আমার বেলায় চোখে জল এসে যাওয়াটা দোষের হয়েছিল।’ কেয়ার স্বরে অনুযোগ নেই। ঠান্ডা, কঠিন, নৈর্ব্যক্তিক স্বরে কথাটা বলল।
ছটফটিয়ে উঠল সহদেব। কী কথা দিয়ে আত্মপক্ষ সমর্থন করবে সেটা চট করে তার মুখে আসছে না। অগোছালোভাবে সে বলে উঠল, ‘তুমি বুঝতে পারছ না, কুড়ি-বাইশ বছর আগে আমি এক রকম ছিলুম, এখন বয়স বেড়েছে… তুমি কি ঠিক বুঝতে পারবে মানে আমি কি বোঝাতে পারব বয়স কীভাবে মানুষকে বদলে দেয়? বয়স দুর্বল করে দেয়, ঝাঁঝ কমিয়ে আনে, নানান রকমের ভয় এগিয়ে আসে। এই ধরো আজ যদি আমার ক্যানসার হয়, এইডস, কিডনি, বাইপাস হার্ট সার্জারি, কোথায় টাকা, কে দেবে টাকা? … আশ্চর্য তোমার কথাটা প্রথমেই মনে এল।’
‘আমার কথা কেন? এখন আমার কিছু টাকা হয়েছে বলে? … ওই সব অসুখগুলো তো আমার বা আমার স্বামীরও তো হতে পারে, পারে না? তখন আমারও টাকার দরকার হবে…কার কাছে চাইব, কে আমাকে দেবে?’ একটা স্থির উত্তেজনাকে, গান গাইবার সময় স্বরকে কঠিন নিয়ন্ত্রণে রাখার মতো, কেয়া তার কণ্ঠে বশীভূত করে রেখেছে।
সহদেব জেনে গেছে এখানে আসাটা ব্যর্থ হয়েছে। মিথ্যা ভান আর ছল দিয়ে শুরু করে সে আন্তরিক উঠেছিল। কিন্তু কেয়ার কাছে তার কোনো অস্তিত্বই নেই। কুড়ি-বাইশ বছর আগে কেয়াও অন্যরকম ছিল। দুজনের বদলটা দু-রকমভাবে হয়েছে, ঠিকভাবে বললে, কেয়াই শুধু বদলেছে। জীবনধারায় পরিবর্তন ওরই ঘটেছে। নিজেকে বাড়িয়েছে, ছড়িয়েছে সঙ্গে সঙ্গে কঠিন হয়েছে।
দু-হাতে চায়ের কাপ আর সন্দেশের রেকাব নিয়ে কাজের মেয়েটি এল। সোফার পাশে ছোটো একটা তেপায়ায় সে দুটো রাখতেই সহদেব বলল, ‘মিষ্টি আমি খাই না, খেতুম, ছেড়ে দিয়েছি। চিনি দেওয়া চাও নয়।’
খাব না বা খেতে ইচ্ছে করছে না বলার থেকে এই ধরনের মিথ্যা বললে চাপাচাপির ঝঞ্ঝাট এড়ানো যায়। অবশ্য অনুরোধ-উপরোধ কেয়া করবে, সহদেবের তা মনে হল না।
‘ডায়াবেটিস নাকি?’
‘সামান্যই, তবে যাতে না বাড়ে সেজন্য বন্ধ করেছি।’
‘উনিও চিনি খান না, বরাবরের অভ্যেস, ডায়াবেটিসের জন্য নয়… তাহলে আর কী দেওয়া যায়… ওমলেট খাও।’ কেয়াকে ব্যস্ত না হলেও কিছুটা বিব্রত দেখাল। ‘একেবারেই কিছু মুখে না দিয়ে … এই প্রথম এলে।’ কেয়া জিজ্ঞাসু চোখে এমন ভাবে তাকাল যেন সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায় সহদেবেরই।
‘কিচ্ছু দরকার নেই, স্রেফ এক গ্লাস ঠান্ডা জল। দুপুরে খাওয়ার কথা এই কাছেই গভমেন্ট হাউসিংয়ে, অফিসের এক কলিগের ছেলের পৈতে।’ সহদেব জানিয়ে দিল, পুরোনো প্রেম কবর থেকে তোলার জন্য এখানে আসিনি।
‘এগুলো নিয়ে যা আর ফ্রিজের থেকে এক গ্লাস জল দে।’ মেয়েটিকে নির্দেশ দিয়ে কেয়া টেবল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অস্ফুটে ‘ও ও ওহ’ বলেই ছুটে গিয়ে ফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল করতে শুরু করল।
জল খেয়েই চলে যাবে, এমন একটা প্রস্তুতি সহদেব ইতিমধ্যে নিল। একটা খুব ছেলেমানুষি কাজ আজ সে করে ফেলেছে এখানে এসে, এমন এক আত্মগ্লানি তাকে এখন চেপে ধরেছে। এটা বুঝতে পারার সঙ্গে সঙ্গে একটা রাগও ঘনিয়ে উঠছে তার মধ্যে। কেয়া কী ভাবল বা ভাববে সেটা নয়, নিজেকে সে কোন যুক্তি দিয়ে বোঝাবে, আজ এখানে, এতবছর পর প্রাক্তন প্রেমিকার কাছে, যে এখন বিবাহিতা, তার কাছে, যে এখন জনপ্রিয়তার একটা উঁচু জায়গায়, রোজগারও ভালো, তার কাছে আসার কোনো দরকার ছিল কি? কেয়া এখন খুব নামি, এটাই কি তাকে লুব্ধ করেছে? কেয়ার শারীরিক আকর্ষণ, অবশ্যই যৌন আকর্ষণ, কতটা তীব্র বা আরও ভোঁতা হয়েছে কি হয়নি, এসব মাথায় না রেখেই তো সে এসেছে। তাহলে সে কেন এল?
তার মধ্যে কোনো হতাশা, চেতনার অত্যন্ত গভীরে মনোবাসনা পূরণ না হওয়ার কোনো অতৃপ্তি কি তাকে এখানে ঠেলে নিয়ে এল! সহদেব বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে রইল টেলিফোন কানে লাগানো একটু ঝুঁকে নীচু স্বরে কথা বলায় ব্যস্ত কেয়ার দিকে। ওর শতগুণে বেশি বোধবুদ্ধি শিক্ষা আমার অথচ ওই নারী আমার থেকে শতগুণে বেশি পরিচিতা। কাদের কাছে? এটা কোনো প্রশ্ন নয়, এটা ঈর্ষার ব্যাপারও নয়। নিজের ক্ষেত্রে কেয়া গুণী, পরিশ্রম করে খ্যাতি অর্জন করেছে, এটা তো মানতেই হবে।
আসলে ওই মেয়েমানুষটা,-সহদেব হাত বাড়িয়ে জলের গ্লাসটা প্লেট থেকে তুলে নিয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে হাসল-কেয়া তাকে অপ্রতিভ করেছে। আমাকে ছাড়াই ও সুখী এটাই বোধ হয় অসহ্য ঠেকছে। সহদেব স্বস্তি পেল কারণটা আবিষ্কার করে।
‘গুরুজির সত্তর বছর বয়স পূর্ণ হল, একটা সংবর্ধনার ব্যবস্থা করতে হচ্ছে।’ কেয়া রিসিভার রেখে বলল।
সহদেব ছবিটার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সেই সময় থেকেই ওঁর কাছে শিখছ?’
‘সেই সময়’ বলতে সে কী বোঝাতে চায়, কেয়াকে সেটা হৃদয়ঙ্গম করাবার জন্য সহদেব চোখ, ভ্রূ, ঠোঁট মিলিয়ে একটা ছেলেমানুষি ভাব আনার চেষ্টা করল।
‘হ্যাঁ সেই সময় থেকেই। … অসাধারণ জ্ঞানী, উজাড় করে দিয়ে তেমনি শেখানও। অন্য কারুর কাছে নাড়া বাঁধার কথা আর ভাবতেও পারিনি। ওঁকে যে পেয়েছি, এটা আমার ভাগ্য!’
‘তোমার আর একটা সৌভাগ্যের কথা বোধ হয় ভদ্রতাবশতই আর বললে না… আমাকে স্বামীরূপে না পাওয়া।’ সহদেব উঁচু গলায় হেসে উঠল। এতটা জোরে হাসার মধ্যেই যেন সে তার মনের জ্বালাটা বার করে দিল। সে উঠে দাঁড়াল।
কেয়া প্রথম বিব্রত হয়ে সঙ্গে সঙ্গে সামলে নিয়ে বলল, ‘পরে আমারও তাই মনে হয়েছে, স্বার্থপর মানুষের বউ হওয়ার মতো দুঃখের আর কিছু হতে পারে না। নিজেকে নিয়েই তুমি মশগুল, চারপাশের মানুষ আর জগৎ সংসারকে তুমি গ্রাহ্য কর না। নিজেকে একা রেখে রেখে এখন তুমি নিঃসঙ্গ। বললে বয়স বেড়েছে তাই ভয় পাচ্ছ, দুর্বল হয়ে গেছ,… এসব কথা উঠছে কেন?’
সহদেব উত্তর দেবার চেষ্টা না করে তাকিয়ে রইল। কেয়ার স্বরে ঝাঁঝ ফুটে উঠেছে। ঘরের মাঝের টেবলটার কাছে এগিয়ে এসে সহদেবের মুখোমুখি হল।
‘পারো তো একটা মেয়ে খুঁজে নিয়ে এবার বিয়ে করো, বাবা হও…নইলে স্বাভাবিক থাকতে পারবে না। … একটা নর্মাল লাইফ থাকা দরকার।’ কেয়া নিজেকে থামিয়ে দিল সহদেবের মুখে ক্ষীণ, করুণ হাসিটা দেখে।
‘তুমি এবার যাও।’ প্রায় ফিসফিসিয়ে কেয়া অনুরোধ জানাল।
সহদেব দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে চোখটা একবার বুজিয়ে ফেলায়, হাঁটুতে টেবলের কানাটা লাগল। কেয়ার ‘আহহ’ শোনার পর দরজার নব ঘোরাল। সিঁড়ি দিয়ে যখন নামছে তখন শুনতে পেল।
‘আমি কিন্তু শমির কথাটা কাউকে আজও বলিনি।’
নয়
পাওয়ার কাট। সারা অঞ্চল অন্ধকার। বাড়িগুলোর খোলা জানলা দিয়ে মোমবাতির বা হারিকেনের আলো রাস্তা পর্যন্ত আর এসে পৌঁছয় না। ঘুটঘুটে অন্ধকারে রাস্তায় যদি কেউ টর্চ জ্বেলে চলে তা হলে জানা যায় গর্ত বা ঢিপি কোথায়। মুখে বিড়ি বা সিগারেট থাকলে ধাক্কা লাগাটা এড়ানো যায়। একটি বাড়ির তিনতলার ঘরে আলো জ্বলছে ইনভার্টার থেকে। এই পাড়ায় ওরাই সম্পন্ন।
রাস্তাটা সহদেবের মুখস্থ। চল্লিশ বছর সে এই পথ ধরে হাঁটছে, অন্ধকারে তার অসুবিধে হয় না। এই সময় তার ভয় শুধু একটাই, কুকুর না মাড়িয়ে ফেলে। দু-তিনজন কামড় খেয়েছে বলে সে শুনেছে। তবে কুকুরগুলো পাগলা নয়। তা না হলেও একটা ভয় তো মনের মধ্যে ঢুকে যায়! কবে জলাতঙ্ক রোগ ধরবে এবং মরে যাবে, এই ভয় নিয়ে বছরের পর বছর কিছু লোক কলকাতায় জীবন কাটাচ্ছে। তাদের অন্যতম হতে সহদেব একদমই রাজি নয়।
সদর দরজা খোলা রয়েছে দেখে সে বিস্মিত হল। পাওয়ার কাট-এর সময় ছিঁচকে চোরের উপদ্রব শুরু হয়, কেউ সদর খুলে রাখে না। নিশ্চয় কোনো কিছু একটা ঘটেছে। সহদেব ইতস্তত করল, কড়া নাড়বে কি নাড়বে না।
‘মেজোমামা আমি এখানে।’
পাশের বাড়ির রক থেকে সেবার গলা শোনা গেল। সহদেবের বিস্ময় আরও বাড়ল। অন্ধকারে, বাড়ির বাইরে, এই সময়ে!
‘তুই এখানে কেন?’
রক থেকে নেমে, ক্রাচে ভর দিয়ে বারো বছর বয়সি মেয়েটি তার কাছে এল। চলাফেরার সময় সেবার ক্রাচ শব্দ করে না। খটখট শব্দে কেউ বিরক্ত হোক বা তার পায়ের দিকে তাকাক এটা বোধহয় সে চায় না।
‘বাড়িতে কেউ নেই।’
‘কেন! তোর মা?’
‘মা বেরিয়ে গেছে, বাবাও।’
‘আশ্চর্য, কখন বেরিয়েছে?’
‘অনেকক্ষণ, তখন আলো ছিল সন্ধে থেকেই লোডশেডিং।’
‘একসঙ্গে বেরিয়েছে? গ্যাছে কোথায়? ঝগড়া হচ্ছিল?’
‘মাসিমার বাড়িতে গ্যাছে। প্রথমে বাবা বেরিয়ে গেল, তার একটু পরেই মা।’ সেবা একটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার দরকার বোধ করল না।
‘কী নিয়ে ঝগড়া হয়েছে?’ সহদেব যে অস্বস্তিটা পেতে ঘৃণা করে, এখন সেটা পাওয়াই শুরু হল। নিশ্চয় ওই দুটো চিৎকার শুরু করে, হয়তো হাতাহাতিও এবং অসিতকে কেন্দ্র করেই, নয়তো অনির বাড়িতে দৌড়বে কেন বিদ্যুৎ!
সেবা চুপ করে রইল। সব কিছু বোঝার বয়স না হলেও, বাবা-মায়ের মধ্যেকার সম্পর্কটা সে জেনে গেছে। সহদেবের কাছে এটা যন্ত্রণার মতো। এক একসময় তার মনে হয়েছে, ক্যানসার বা এইডস বোধহয় এর থেকে আরামদায়ক। মেয়েটার ভবিষ্যৎ বলে কিছু আর রইল না।
‘মেজোমামা ভেতরে যাবে?’ সেবা শান্ত ক্ষীণস্বরে অনুরোধ জানাল।
‘চল।’
ঘোর অন্ধকারে বাড়িটাকে পোড়ো মনে হচ্ছে। সেবার কাঁধ ধরে সহদেব তাকে সিঁড়ির কাছে এনে বলল, ‘ওপরে চল, আমার আগে ওঠ।’
দোতলায় ঘরের তালা খুলে সহদেব টেবল হাতড়ে টর্চটা খুঁজে নিল। তারপর কেরোসিনের ল্যাম্পটা জ্বালল।
‘আয়, ভেতরে এসে বোস।’
জানলা দুটো খুলে দিয়ে সহদেব আন্দাজেই বলল, ‘কিছু খাওয়া হয়নি তো?’
সেবা চুপ। ঝুলির মধ্যে হাত ঢুকিয়ে কাগজে মোড়া সাবানের মতো একটা কেক সে বার করল। কেয়ার বাড়ি থেকে বেরিয়ে ধর্মতলায় এসে এক চিনে দোকানে খেয়ে সে বইয়ের দোকানগুলোয় খানিকটা সময় কাটায়। তারপর সেন্ট্রাল অ্যাভেনিয়ুয়ের কফি হাউসে ঘণ্টা তিনেক। মিনিবাস-এ আধঘণ্টা ভিড়ের চাপে দাঁড়িয়ে থেকে সে খুবই ক্লান্ত বোধ করছিল। বাস থেকে অন্ধকারের মধ্যে নেমে দুটো কেক আর বিস্কুটের একটা প্যাকেট কিনেছে। সকালে চা-এর সঙ্গে শমি যা খেতে দেয় প্রায়শই তাতে তার মন ভরে না। সকালে মিষ্টি জিনিস খেতে তার ভালো লাগে।
‘এটা এখন খেয়ে নে। রান্নাবান্না আজ আর বোধহয় হবে না। আমরা দুজনে কালীমাতায় গিয়ে তাহলে কচুরি খাব। ওরা ছোলার ডাল দেয়, খেতে দারুণ।’
সহদেব লক্ষ করল কেকের মোড়কটা কত যত্নে সেবা ছিঁড়ল। কামড় দেওয়া এবং চিবোনোর মধ্যে ব্যস্ততা নেই। মুখটা নামিয়ে রেখেছে। ওর সংযত ভাবের মধ্যে এমন এক আভিজাত্য প্রকাশ পাচ্ছে যা এই বাড়ির কারুর নেই। সহদেব নিজেকেও তার অন্তর্ভুক্ত করল।
‘বাইরে গিয়ে বসেছিলিস। তোর ভয় কচ্ছিল, না?’
সেবা লাজুক হাসল।
‘নীচে তোর পড়ার অসুবিধে হয়, আমি জানি। এক কাজ কর, আমি যখন থাকব তুই বই নিয়ে ওপরে চলে আসবি।’
‘তুমি তো অনেক রাত করে ফেরো।’
‘রোজ তো রাত হয় না। আচ্ছা এবার চেষ্টা করব খুব তাড়াতাড়ি ফিরতে। একটা ইনভার্টারও কিনব ভাবছি, হাজার পাঁচেক টাকা লাগবে।’ পাঞ্জাবিটা খুলতে খুলতে সে কথাগুলো বলল।
এরপর সহদেব কুঁজো থেকে জল গড়িয়ে গ্লাসটা সেবার হাতে দিল। জল খেয়ে গ্লাসটা ফিরিয়ে দেবার সময় সেবা যেভাবে তাকাল, সহদেবের তাতে মনে হল ওর তেষ্টা মেটেনি। কিন্তু আর এক গ্লাস চাইতে যেন ও কুণ্ঠিত।
দ্বিতীয় গ্লাস জল খেয়ে দেবা তৃপ্ত ও কৃতজ্ঞ চোখে যখন তাকাল সহদেবের মনে হল, সারাদিনে জমে ওঠা মনের গ্লানি ও দেহের নিরুৎসাহ বোধ থেকে সে ছাড়া পাচ্ছে। একটা তীব্র আবেগ এখন তার দিকে ধেয়ে আসছে। আর তখনই বাইরে থেকে একটা ‘হা আ আ আ’ রব সে শুনতে পেল।
‘আলো এসেছে মেজোমামা।’ সেবা ব্যস্ত স্বরে বলল।
সুইচ টিপতেই আলোয় ভরে গেল ঘর। দুজনেই উজ্জ্বল চোখে দুজনের দিকে তাকিয়ে। তখনই সদরে কড়া নাড়ার আওয়াজ তারা শুনল। ব্যস্ত, অধৈর্য আওয়াজটা। সেবার মুখ ম্লান হয়ে এল।
‘তুই বোস।’ সহদেব দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে নীচে নেমে এল। দরজা খুলেই সে চমকে উঠল।
‘অনি তুই।’
‘মেজদা, শমিটা শুরু করেছে কী? আমার সব্বোনাশ না করে কি ও ছাড়বে না? আমাকে কি শান্তিতে থাকতে দেবে না?’
‘চুপ, চুপ,…আস্তে বল। ভেতরে আয়।’ হাত ধরে অনিতাকে ভিতরে এনে সহদেব দরজা বন্ধ করল।
‘হয়েছে কী?’
‘আর হয়েছে!’ ফুঁপিয়ে উঠল অনিতা, ‘বিদ্যুৎ গিয়ে যা নয় তাই বলে কী সব নোংরা নোংরা কথা শোনাল, ওর আর শমির নামে। বলল, ওকে খুন করে ফাঁসিতে যাবে।’
সহদেব ভেবে উঠতে পারছে না, এখন তার কী বলা বা করা উচিত। এই রকম একটা পরিস্থিতি যে ঘনিয়ে আসছে সে আঁচ করেছিল। এতকাল জেনেও না জানার ভান করে সবাই চলেছে শুধু বিদ্যুৎই মাঝেমধ্যে ফেটে পড়ত। অনির মধ্যে কোনোরকম প্রতিক্রিয়া না দেকে সে অবাক হত।
‘তুই একা এসেছিস না সঙ্গে কেউ আছে?’
‘ট্যাক্সিতে এসেছি, একাই।’
‘বাড়িতে কেউ নেই, সেবা ছাড়া। ওপরে চল।’ সহদেব কথাটা বলেই দোতলার দিকে তাকাল। সেবা বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে।
‘না যাব না।’ উঠোনের ধারে রকের উপর অনিতা বসে পড়ল।
‘কী করতে এসেছিস এত রাতে?’
‘হেস্তনেস্ত করতে । অসুক শমি… ওর একদিন কী আমারই একদিন। অনেক সয়েছি মেজদা, আর নয়।’ অনিতা দুই হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে কাঁদতে শুরু করল।
‘এত রাতে হেস্তনেস্ত করে আর লোক হাসাতে হবে না। বাড়ি চল। যা করার, বলার আমিই করব। চল তোকে পৌঁছে দিয়ে আসি।’
সহদেব হাত রাখল অনিতার মাথায়। ধীরে-ধীরে হাতটা বোলাতে থাকল। মিনিট তিনেক দুজনের কেউই কথা বলল না।
‘আমি একাই যেতে পারব।’ অনিতা উঠে দাঁড়াল। তার সুন্দর মুখে বিষাদ আর শ্রান্তি। সহদেব কষ্ট বোধ করল।
‘দাঁড়া, পাঞ্জাবিটা পরে আসি। একা যেতে হবে না।’
ছুটেই সে দোতলায় গেল। পাঞ্জাবিটা মাথা দিয়ে গলাবার সময় সেবার সঙ্গে চোখাচোখি হল। বিবর্ণ মুখে অপরাধীর মতো তাকিয়ে রয়েছে।
‘সদর দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে নীচেই থাক। আমি এখুনি আসছি।’
ট্যাক্সিতে যেতে যেতে একসময় অনিতা আলতোভাবে বলল, ‘বিদ্যুৎ একটা কথা বলেছে, সেবার বাবা নাকি ও নয়, অসিত বসুমল্লিক।’
সহদেব শুনে অবাক হয়নি, রাগেওনি, শুধু কষ্ট পায় বাচ্চচা মেয়েটার জন্য।
অনিতাকে তার বাড়িতে দোতলার শেবার ঘর পর্যন্ত সহদেব পৌঁছে দিল। ‘এখন একটু শুয়ে থাক।’
খাটে শুয়ে অনিতা পাশ ফিরে বালিশে মুখ চেপে ধরল। ওদের সঙ্গেই ঘরে ঢুকেছে প্রতিভা। সে নীচু গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘বউমণি কি আপনাদের বাড়িতে গেছিল?’
‘হ্যাঁ।’
সহদেবের মনে হল প্রতিভা সব কিছু জানে, অনি কী কারণে গেছে তাও।
‘আমি যেতে বারণ করেছিলুম, শুনল না’। প্রতিভা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে গিয়ে ফিরে দাঁড়াল।
‘চা খাবেন?’
‘হ্যাঁ’।
দেয়ালের ধারে দুটি চেয়ার, সহদেব একটিতে বসল। অনিতা একই ভাবে পাশ ফিরে শুয়ে। এখন ওর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা একদমই করা উচিত নয়। ও একা থাকুক। এই ভেবে সহদেব ঘর থেকে বেরিয়ে বসার দালানে এল। ভাগনি দুজনের সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। বোধহয় তিনতলায় পড়ার ঘরে। অনিকে নিয়ে একতলা থেকে নিঃসাড়েই সে শোবার ঘর পর্যন্ত গেছে। তার খবর ওরা এখনও পায়নি।
রাস্তার দিকে লাল-সবুজ-হলুদ শার্সি লাগানো পুরোনো চারটে জানলা। সন্ধ্যায় একটা দমকা ঝড় উঠেছিল, পাল্লাগুলো এখনও বন্ধ। একটা জানলার পাল্লা ধরে টানতে গিয়ে খুলল না। সহদেব দ্বিতীয় চেষ্টা করতে গিয়ে থমকাল। ধাক্কাধাক্কি করল যদি শার্সি ভেঙে পড়ে! ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারে বারান্দার কাচের দরজা তার মনে পড়ল। শার্সিতে নাক ঠেকিয়ে সে ওধারে কী দেখা যায় ঠাওর করতে চাইল। কিছুক্ষণ পর সে মুখ সরিয়ে নিল। সবই কালো।
‘মেজদা চা।’
পাখাটা ঘুরছে, প্রতিভা কাপ হাতে। সোফায় বসে চা-এ চুমুক দিয়ে সহদেব ওর মুখের দিকে তাকাল। প্রতিভা দৃষ্টি নামিয়ে কিছু একটা বলার জন্য উসখুস করছে বুঝে সে বলল, ‘কিছু কি বলবেন।’
‘হ্যাঁ।’ প্রতিভা দু-পা এগিয়ে সামনের সোফার পিঠে হাত রেখে দাঁড়াল। ‘এদের এই ব্যাপারটা … আগাগোড়াই আমি জানি। আমিই ঘটক ঠিক করে দিয়েছিলুম আপনার ছোটো বোনের বিয়ের জন্য।’
সহদেব বুঝতে পারল না, প্রতিভা কী বলতে চায়। তবে ওর স্বরে লাগানো অনুশোচনা আর বিমর্ষ ভাবটা তার কানে লেগেছে।
‘আপনার আর কী দোষ, তখন যা করার ছিল তাই করেছেন। কিন্তু ব্যাপারটা যে ওরা এভাবে টেনে চলবে তা তো আপনি, আমি তখন আর বুঝিনি।’
সহদেব ধীরে-ধীরে বলার সময় মুখটা লক্ষ্য করল। কী যেন ভাবছে আর সেটা গুছিয়ে প্রকাশ করার চেষ্টা চলছে। আর চোখে পড়ল নাকে সোনার ফুলটাকে। নাকটা একটু চাপা আর ছাড়ানো। নাকছাবিটা বোধহয় কাবলির দাদুর দেওয়া, পুরোনো ধরনের নকশা কিন্তু মন্দ দেখাচ্ছে না। ওকে নাকছাবি পরতে সে আগের দিনও দেখেনি। হঠাৎ এই বয়সে আবার পরার শখ হল কেন!
‘আচ্ছা বিদ্যুৎকে যদি,’ প্রতিভা সামনের সোফাটায় কোণ ঘেঁষে আড়ষ্টভাবে বসল। ‘কিছু টাকা দিয়ে বিদেয় করা যায়!’
‘ডিভোর্স!’
‘হ্যাঁ।’ প্রতিভা উৎসুক হয়ে ঝুঁকল। সহদেব খালি কাপ টেবিলে রাখার জন্য ঝুঁকল। প্রতিভা সেটা হাত বাড়িয়ে নেবার সময় বলল, ‘করা যায় না?’
সহদেব সিলিংয়ের দিকে মুখ তুলে চোখ বন্ধ করে ভাবল। ঠোঁট কামড়াল। তার সামনে এই প্রথম সে প্রতিভাকে বসতে দেখছে। এই মুহূর্তে ও নিজেকে আর কাজের লোক মনে করছে না। সংসারটাকে নিজের বলেই ভাবে, মায়ামমতা না থাকলে অনির ব্যক্তিগত বিপর্যয় নিয়ে এভাবে মাথা ঘামাত না। … প্র্যাকটিকাল বুদ্ধিটা রাখে, শৌখিনও।
‘করা যায়। অত্যন্ত লোভী, অর্থ পিশাচ … টাকা দেখালে রাজি হয়েও যেতে পারে, তবে ভালো টাকাই চাইবে।’
‘কত চাইবে? আপনি কি ওর সঙ্গে একবার কথা বলবেন?’
‘বলতে পারি।’ এরপরই সে যোগ করল, ‘কিন্তু এভাবে কি আসল সমস্যাটা মিটছে?’
‘একটা যন্ত্রণার হাত থেকে বউমণি তো রেহাই পাবে। তারপর দেখা যাবে অন্যটা।’
‘অন্যটা মানে অসিত?’
‘হ্যাঁ।’
‘কী করবেন?’
‘কী আবার করব, সামলেসুমলে চলতে বলব… বউমণি যেন মনোকষ্ট না পায় সেদিকে নজর রাখতে বলব। বড়োঘরের জোয়ান পুরুষ মানুষ, তার বেশি আর কিছু তো বলা যায় না।’
প্রতিভা উঠে দাঁড়াল, দূরত্ব ও সম্ভ্রম বজায় রাখার কথা মনে পড়ায়।
‘বিদ্যুৎ রাজি হলে টাকাটা কে দেবে, অসিত?’
‘তবে না তো কে! ফুর্তি করবে আর দাম দেবে না?’
সহদেব আশ্বস্ত বোধ করল। বিদ্যুৎকে বিদায় করতে পারলে সেও বাঁচে। অন্যের টাকায় যদি সেটা করা যায় তো ভালোই।
‘আমি তাহলে আসি। ওর সঙ্গে কথা বলেই আপনাকে জানাব।’ সহদেব এই প্রথম স্বচ্ছন্দ বোধ করছে প্রতিভার সামনে। তাই নয়, কিঞ্চিৎ চপল হবার মতো সাহসও সে ইতিমধ্যে সংগ্রহ করে ফেলেছে। সিঁড়ির দিকে দু-পা গিয়েই দাঁড়িয়ে পড়ল।
‘নাকছাবিটা তো বয়স অন্তত তিরিশ বছর কমিয়ে দিয়েছে। রোজ পরেন না কেন?’
প্রতিভা হকচকিয়ে দিশাহারার মতো তাকাল। বাঁ-হাতটা নাকে ঠেকাল। রং ফরসা হলে লাল অবশ্যই হয়ে উঠত মুখটা।
‘আজ সকালেই বাসকোটা ঘাঁটতে ঘাঁটতে পেলুম। সাবান জল দিয়ে পরিষ্কার করে ভাবলুম কাবুলকে এটা দিয়ে দিই। ওকে পরাতে গেলুম … জোর করে ও আমায় পরিয়ে দিল। … আপনার সবদিকে নজর।’
অত্যন্ত সুখদায়ক এই লাজুক ধমক সহদেবকে কেন জানি কৈশোর বয়সের অনুভব এনে দিল। তার থেকেও বয়সে বছর পাঁচেকের বড়ো, তাতে কি আসে যায়। প্রতিভা এখনও যৌবন ধরে রেখেছে।
‘ওটা খুলবেন না।’ বলেই প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য সহদেব আর দাঁড়াল না।
কালীমাতা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে এত রাতে কচুরি পাওয়া যায় না। সহদেব দই আর বোঁদে কিনল। ওরা পাতলা একটা পলিথিন থলিতে ভাঁড় আর বাক্সটা ভরে দিল। আজকাল এই থলির খুব চল হওয়ায় সুবিধেই হয়েছে। সহদেব রাস্তা থেকে একবার আপেল কিনেছিল শুধু এই থলিতে বওয়ার সুবিধা দেখেই। কালীমাতার পাশেই রুটি-তরকারির একটা দোকান। কুলি, মজুর, ঠেলা আর রিকশাওয়ালারাই এর প্রধান খদ্দের। সহদেবের মনে হল, এ বেলায় বোধহয় শমি রান্না করবে না। এই রকম আগেও তিন-চারবার হয়েছে। দোকানের রুটি, আলুর দম বা ঘুগনি সবাইকে খেতে হয়। আজও হয়তো তাই হবে। তবু সাবধানের মার নেই ভেবে সে চারটে মোটা রুটি আর তরকারি কিনল।
বোধহয় তার ফেরার কথা ভেবেই সদর দরজায় খিল দেওয়া নেই। ছিটকিনিটা সোজা করে তোলা থাকে। কড়া ধরে পাল্লাটা টানলেই সেটা খট করে নীচে পড়ে। সহদেব টান দিল, শব্দও হল।
শমিদের শোবার ঘরের দরজা খোলা, আলো জ্বলছে, টিভি থেকে বাজনা আর গানের শব্দ আসছে। খাটে শোয়া শমির খোঁপা, পিঠ এবং একধারে বসা সেবাকে ঘরের অন্যদিক থেকে কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করল। সেবা তাকে বলল, ‘মেজোমামা।’
মেয়েটার কি খাওয়া হয়েছে? জানার জন্য সহদেব ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়াল।
‘সেবা খেয়েছিস?’
‘হ্যাঁ।’
দরজার পাশ থেকে চেয়ারে বসা বিদ্যুৎ মাথা বাড়িয়ে বলল, ‘মেজদা আপনার খাবার আমি দিয়ে আসছি।’
সহদেব টিভি-র দিকে তাকাল। ভরত নাট্যম বা কুচিপুড়ি, তফাতটা সে বোঝে না, একজন নাচছে। শমিতা পাশ ফিরে ঘুমোচ্ছে বা ঘুমের ভান করে আছে। গম্ভীর চাপা গলায় সে বলল, ‘বিদ্যুৎ, কথা আছে তোমার সঙ্গে।’
‘আপনি ওপরে যান, আমি যাচ্ছি।’
দশ মিনিটের মধ্যেই বিদ্যুৎ ভাতের থালায় দুটি বাটি নিয়ে উঠে এল।
‘দুপুরে খাননি। গরম করে নিয়ে এলুম।’
‘এ বেলা রান্না হয়নি?’
‘না। আলুর দম, পাউরুটি দিয়েই চালিয়ে দিয়েছি।’
‘কেন হয়নি?’
বিদ্যুৎ চুপ করে রইল।
‘বোসো, কিছু কথা আছে, মন দিয়ে শুনে উত্তর দেবে।’
ইতস্তত করে বিদ্যুৎ চেয়ারে বসল, সহদেব খাটে।
‘আমি জানি আপনি কী বলবেন।’ বিদ্যুৎই শুরুটা করল।
‘কী বলব?’
‘এই আমাদের ঝগড়াঝাঁটির কথা। কিন্তু কতদিন এ সব সহ্য করা যায় বলুন তো?’
‘আস্তে, আস্তে কথা বলো, রাত্তির বেলায় অনেকদূর পর্যন্ত শোনা যায়।… হ্যাঁ এটাই আমি বলতে চাই, কতদিন আর সহ্য করবে।’ সহদেবের শান্ত, সহৃদয় স্বর। একটা পুরুষ মানুষ, আর একটা পুরুষ মানুষের জীবনের দুঃখে বেদনা, নৈরাশ্য, যাবতীয় মর্মান্তিক অবস্থাটা বুঝেছে, এমন একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে সহদেব কথা বলতে চায়, যেখানে বিদ্যুৎ তাকে বন্ধু ভাবতে পারে, শমির দাদা নয়।
‘তোমাদের বিয়ে সফল নয়। না হবার কারণ অবশ্যই শমি। ওকে তো আমি তোমার থেকে বেশি জানি। তোমাদের বনিবনা হয়নি, প্রেম ভালোবাসা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা, বিশ্বাস, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যেগুলো প্রধান বন্ধন সেটা তোমাদের নেই, তোমরা বন্ধু হতে পারনি। ঠিক কিনা?’
সহদেব উত্তরের জন্য অপেক্ষায় রইল। বিদ্যুৎ মেঝের দিকে তাকিয়ে চিন্তায় নিমগ্ন, উত্তর দিল না।
‘এভাবেই কি সারাজীবন চলবে? তোমরা এখনও ইয়াং। এভাবে কি চলতে পারে, চলা উচিত?’ সহদেব প্রশ্নটা রাখল স্বর আরও নরম করে।
‘লেখাপড়া করেছি, কিছু বোধবুদ্ধি হয়েছে, নিজেদের ভালোমন্দ বুঝতে শিখেছি…’
‘আমাদের মধ্যে মিল হওয়ার নয় মেজদা, হবে না।’ বিদ্যুতের ভাঙা স্বর থেকে সহদেব বুঝল ও মথিত হচ্ছে।
‘আমারও তাই মনে হয়। এ ক্ষেত্রে পরস্পরকে ছেড়ে দিয়ে সরে যাওয়া, একেবারে সরে যাওয়াটাই তো বুদ্ধিমানের, তাতে দুজনেরই লাভ।’
‘বিবাহ বিচ্ছেদ বলছেন?’
তাকিয়ে থাকা বিদ্যুতের চোখে চোখ রেখে সহদেব মাথাটা এক ইঞ্চি সামনে ঝোঁকাল।
‘মাঝে মাঝে আমি এটা ভেবেছি। দূর ছাই, কী হবে এই রকম একটা সংসার করে আর স্বামী সেজে থেকে… তার থেকে বরং দেশের বাড়িতেই চলে যাই! কিন্তু কী জানেন মেজদা, অনেক সমস্যাও এতে রয়েছে।’
‘কী সমস্যা… সেবা?’
‘ওটা তো আছেই … লোকে কী বলবে?’
‘এখানে তোমরা দুজনে যা করছ তাতেও তো লোকে হাসে, অনেক কথা আড়ালে বলে। আজ তুমি যা করেছ…’ আপনা থেকেই সহদেবের গলা কঠিন হয়ে উঠল।’ অনিকে তুমি কী সব কথা বলে এসেছ? অসিতকে খুন করবে? ভালো কথা, কিন্তু সেবা সম্পর্কে… ছি ছি ছি।’
বিদ্যুতের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে এল। মাথা নামিয়ে বলল, ‘রাগের মাথায় বলে ফেলেছি।’
‘রাগ! এইরকম নোংরা কথা রাগের মাথায়ও কোনো বাবা বলতে পারে না। আসলে তুমি ভয়ংকর একটা মানসিক ঘূর্ণির মধ্যে পড়ে গেছ বিদ্যুৎ, তুমি ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছ। এর থেকে বেরিয়ে আসতে হলে… বাঁচতে হলে একটাই পথ খোলা আছে।’
সহদেব পথটার নাম আর করল না। বিদ্যুৎ আনমনার মতো দরজার বাইরে তাকিয়ে। ক্রমশ তার মুখ কঠোর হতে হতে হতাশায় নরম হয়ে এল।
‘কিন্তু আমি একা কেন বদনামের বোঝা বইব? ওকে যা খুশি করার পাসপোর্ট দিয়ে আমি সরে যাব… কেন? বাড়ির লোকের কাছে মুখ দেখাব কী করে? বউ খেদিয়ে দিয়েছে, ব্যাটা হিজড়ে, এই ধরনের কথাই তো শুনতে হবে! তাছাড়া এ চাকরিটাও আর আমি করতে পারব না, ছেড়ে দেব। আমি তো একেবারে পথে বসে যাব!’
সহদেব যেদিকে কথাবার্তাটা আনতে চাইছিল বিদ্যুৎ নিজেই সেই দিকে তা টেনে নিল।
‘পথে বসবে কেন! চাকরি নাই করলে, ব্যবসাট্যাবসা কিছু একটা করো। আবার বিয়ে করো, সেটেল্ড হও, নতুন করে জীবন শুরু করো।’ সহদেব দ্রুত বলে গেল। তার ভয় হয়েছিল, কথাগুলো বলার সুযোগ বোধহয় আর পাবে না।
‘ব্যবসা… আবার বিয়ে!’ হতভম্বের মতো বিদ্যুৎ তাকিয়ে রইল। ‘বলছেন কী?’
‘ঠিকই বলছি। ডিভোর্স কি পৃথিবীতে কেউ করেনি না এ দেশে ওটা হয় না? যারা ডিভোর্স করেছ তারা কি সব পথে বসে গেছে?… না না এসব কোনো কথা নয়, এটা কোনো যুক্তি? তুমি লেখাপড়া শিখেছো, ম্যাচিওরড লোক… কিছু একটা ব্যবসা ধরে নিতে পারবে। চাও তো টাকার ব্যবস্থা আমি করে দেব।’ তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে সহদেব তাকাল।
বিদ্যুতের ঢিলেঢালা ধসেপড়া ভাবটা মুহূর্তে বদলে গেল। সহদেব মনে মনে হাসল। যে দেবতা যে পুজোয় সন্তুষ্ট হয়! টাকার গন্ধ পেয়েই ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়টি সজাগ হয়ে উঠেছে। সহদেব প্রস্তুত হল দরাদরির জন্য।
‘টাকা দেবেন? কত?’
‘তুমিই বল। একটা ছোটোখাটো ব্যবসা, তুমি খাটিয়ে লোক, অনেস্টলি কাজ করলে নিশ্চয় বড়ো হয়ে উঠতে পারবে। খুব বেশি তো আমি জোগাড় করতে পারব না।… হাজার দশেক হয়তো পারব।’
‘আপনি তো এখন বেলগাছিয়া থেকে আসছেন, দিদিকে পৌঁছে দিতে গেছলেন, না?’
সহদেব সতর্ক হল। কী বলতে চায় ও? টাকা দেবার আইডিয়াটা কোথা থেকে মাথায় ঢুকল? সেটা বুঝতে পেরেছে বোধহয়।
‘হ্যাঁ গেছলুম। হঠাৎ এ কথা?’
‘এমনিই। দশ হাজার টাকায় কী ব্যবসা শুরু করব?’ বিদ্যুৎ ভালোমানুষি গলায়, সরল মুখে জানতে চাইল।
বিব্রত হল সহদেব। তার কোনো ধারণা নেই এই ব্যাপারে। চোখ কুঁচকে বিদ্যুৎ অপেক্ষা করছে উত্তরের জন্য বা মজা দেখছে। মানুষের প্রয়োজনে যা কিছু লাগে তাই নিয়েই ব্যবসা করা যায় কিন্তু দশ হাজার টাকা দিয়ে তার কোনটার শুরু সম্ভব, সহদেব তা আন্দাজ করতে পারছে না। হঠাৎ চোখ পড়ল দই আর বোঁদের পলিথিন থলিটায়।
‘তুমি খাবারের দোকান দিতে পার। মিষ্টির দোকান।’
‘একটা শো-কেস, দুটো টেবিল আর আটটা চেয়ার করতেই দশ হাজার বেরিয়ে যাবে। তারপর?’ বিদ্যুৎ মিটমিট করে হাসতে লাগল। ‘এরপর বলবেন দর্জির দোকান বা লন্ড্রি বা চুলকাটার সেলুন!’ বিদ্রূপটা ঢাকা দেবার কোনো ইচ্ছা তার স্বরে নেই।
‘তাহলে কুড়ি হাজারে হয় এমন ব্যবসার কথা ভাব।’ সহদেব নিলামে দর দেবার মতো অঙ্কটা বাড়াল।
‘না ভাবব না। আজকের দিনে কুড়ি-পঁচিশ হাজারে কোনো ব্যবসা হয় না, অন্তত একলাখ হাতে নিয়ে ছোটোখাটো ব্যবসায় নামার কথা ভাবা যায়।’
‘এক লাখ!’ সহদেব আবার বলল, ‘বলছ কী! একলাখ?’
‘হ্যাঁ একলাখ। নগদে পেলেই কোর্টে দাঁড়িয়ে বলে আসব, মদ খাই, মাগিবাড়ি যাই,বউকে পেটাই, অত্যাচার করি। যা শিখিয়ে দেবেন তাই বলব, যে কাগজে বলবেন তাতেই সই করে দোব। নিঃশব্দে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাব, কাকপক্ষিতেও টের পাবে না। জীবনে আর আমার মুখ আপনারা দেখতে পাবেন না, এ কথা স্ট্যাম্প কাগজে রেজেস্ট্রি করে লিখে দিয়ে যাব।… একলাখ চাই।’
সহদেব ঢোঁক গিলল, হাসার চেষ্টা করল। বিদ্যুৎ উঠে দাঁড়িয়ে ধীর স্বরে বলল, ‘টাকা কোথা থেকে, কে দেবে তা আমি জানি। ফুর্তির পথ থেকে কাঁটা সরাতে গেলে একটু তো কাঁটা ফুটবেই মেজদা। আপনি জানিয়ে দেবেন, এক লাখ খসালেই পথটা ফুলে ঢেকে যাবে। শালিকে নিয়ে যা খুশি করতে পারবেন।… আমি যাচ্ছি।’
বিদ্যুৎ ঘর থেকে বেরিয়ে যখন সিঁড়ির কাছে সহদেব তাকে ডেকে আনল। পলিথিনের থলিটা তার হাতে তুলে দিয়ে বলল, ‘দই বোঁদে আর রুটি আছে সেবার জন্য, কাল সকালে ওকে দিও, আর টাকার ব্যাপারটা পরে তোমায় জানাব।’
বিনীত বাধ্য ছেলের মতো বিদ্যুৎ মাথাটা হেলাল।
রাতে বিছানায় শুয়ে সহদেব সকাল থেকে এখন পর্যন্ত, একটা দিনে তার যা কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে সেগুলোর একটা তালিকা গড়ার চেষ্টা করল। তারপর সে তালিকা থেকে কেয়ার নামটা বাদ দিল। অল্প বয়সে তাজমহল গল্প লেখার থেকেও বোকামি হয়েছে আজ তার কেয়ার কাছে যাওয়াটা। তার আসাটাকে নিয়ে কেয়াও নিশ্চয় ভাববে এবং নিশ্চিতই হাসবে। কিংবা তার অধঃপতন দেখে কিছুক্ষণের জন্য বিষণ্ণবোধ করবে। চমৎকারভাবে শোধ নিল : ‘পার তো একটা মেয়ে খুঁজে নিয়ে এবার বিয়ে করো, বাবা হও, নইলে স্বাভাবিক থাকতে পারবে না। একটা নর্মাল লাইফ থাকা দরকার।’
কোথায় আমি অস্বাভাবিক? সহদেব খুঁজে দেখার চেষ্টা করল, কোথায় আমি অ্যাবনর্মাল? যাকে প্রত্যাখ্যান করেছি, যখন তখন অপমান করেছি তাকে আবার দেখার ইচ্ছা হতেই পারে। স্বাভাবিক ইচ্ছা! একবারই শুধু দুর্বলতা দেখিয়েছে : ‘বয়স কীভাবে মানুষকে বদলে দেয়’ কথাটা বলে। ক্ষমা চাওয়ার মতো শোনাচ্ছে। আজ অনেকগুলো মিথ্যা কথা কেয়াকে বলেছে কিন্তু এটাও সত্যি, মনের গভীর থেকেই সে জানতে চায় : ‘আমাকে তুমি মন থেকে একদমই নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছ, তাই না?’
মাথার মধ্যে একটা তপ্ত সিক ঢুকে যাবার মতো যন্ত্রণা সহদেব বোধ করল। এ কী দীনতা, এ কী কাঙ্গালেপনা! কেয়া যদি তাকে মনে না রাখে তাতে কিই বা আসে যায়? তাতে তার প্রতিদিনের জীবনে এক সেন্টিমিটার হেরফেরও ঘটবে না। তবুও প্রশ্নটা কেন সে করল? কেয়ার হৃদয়ে বসবাসের জন্য একটা নিগূঢ় বাসনা কি তার মধ্যে রয়ে গেছে? এই বাসনা কি সবারই হয়? হলেই কি সে অ্যাবনর্মাল?
ঘুমিয়ে পড়ার আগে সেবার মুখটা সে দেখতে পেল। অসহায় ভীত চাহনি।
অনিকে দুই হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে বসে থাকতে দেখল। ‘অনেক সয়েছি মেজদা, আর নয়।’ বেচারা, ওকে যে আজীবনই দুঃখে কাটাতে হবে এটা ও জানে না।
শমিকে পাশ ফিরে খাটে শুয়ে থাকতে দেখল। কি অদ্ভুত স্বার্থপর! মানবিক ছোঁয়া থেকে নিজেকে দূরে রাখার কৃতিত্ব ও দেখিয়েছে। বড়ো কষ্টে ওর শেষ জীবনটা কাটবে।
পঙ্কজও একবার ভেসে উঠল তার চোখের সামনে। গালে ব্রণর গর্ত, সবুজ ট্রাউজার্স, লম্বা ঢোলা পাঞ্জাবি : ‘আসলে আপনি খুব কুঁড়ে, উদ্যোগী নন…. চমৎকার মহিলাদের তো আবিষ্কার করতে হয়।’
সহদেবের ঠোঁট নড়ে উঠল হাসির টানে। ‘তুমি উদ্যোগী হয়ে তাহলে আবিষ্কার করেছ? …’অবশ্যই’।
পাকাপাকি ঘুমিয়ে পড়ার আগে সে একটা নাকছাবি দেখতে পেল : ‘আপনার সবদিকে নজর।’
দশ
সহদেব আমেরিকান সেন্টারে পৌঁছল চার মিনিট দেরিতে। দেরির কারণ ট্রাফিক জ্যাম আর একটা কারণ বেলগাছিয়ায় যাওয়া।
বিদ্যুতের এক লাখ টাকা দাবির কথাটা প্রতিভাকে জানাতেই তার বেলগাছিয়া যাওয়া। সদরে ধনঞ্জয়কে দেখে সে নীচু গলায় তাকে বলে, ‘প্রতিভাদিকে একবার নীচে আসতে বলো। বলবে আমি অপেক্ষা করছি একটা কথা বলার জন্য। আলাদা ডেকে বলবে, কেউ যেন না জানতে পারে।’
সহদেব সিঁড়ির গোড়ায় অপেক্ষা করে, তিন মিনিটেই প্রতিভা নেমে আসে।
‘এখানে কেন, ওপরে গিয় বসবেন চলুন।’
‘না না, আমার তাড়া আছে, এক জায়গায় সিনেমা দেখতে যেতে হবে।’
‘একা!’
‘য়্যাঁ?’ সহদেব প্রশ্নটার মর্মার্থ বুঝতে পারল না।’
‘বলছি, একাই সিনেমা দেখতে যাচ্ছেন?’ প্রতিভা মুচকি হাসিটা যোগ করায় সহদেবের কাছে কথাটা পরিষ্কার হল।
‘যাবেন নাকি, একটা একস্ট্রা টিকিট আছে।’ সহদেব ভরসা করে রঙ্গ করার মতো মুখভাব করল।
‘আমি!’ প্রতিভা চোখ কপালে তোলার চেষ্টা করল। সহদেব তখন দেখল নাকছাবিটা নেই। সে একটু দমে গেল।
‘আপনার পাশে বসে সিনেমা দেখব আমি! হায় পোড়া কপাল, কোনো রকম যোগ্যতাই তো আমার নেই!’ প্রতিভা মাথার ঘোমটা আধ-ইঞ্চি টেনে দিল। ওর অনামিকায় একটা লাল পাথর বসানো আংটি দেখল, এটা আগে সে কখনো দেখেনি।
‘কী বলবেন বলে এলেছেন যেন?’ প্রতিভা হালকা প্রসঙ্গটাকে এক কথায় ভারী করে দিল।
‘ওহ, যা বলতে এসেছি।’ স্বরটা নামিয়ে সহদেব বলল, ‘এক লাখ চেয়েছে।’
‘এক লাখ, বলছেন কী!’
ঠিক এই ভাষায় এই ভঙ্গিতে সহদেবও বলেছিল বিদ্যুৎকে। তবে তখন সে ঢোঁক গিলে হাসার চেষ্টা করেছিল, প্রতিভা তা করল না।
‘সেয়ানা, বজ্জাত। আপনি কি বলেছিলেন কে টাকা দেবে?’
‘না। তবে ও ঠিক ধরে নিয়েছে এই বাড়ি থেকেই টাকাটা আসবে তাই অ্যামাউন্টটা এক লাখ করেছে।’
‘এ কি কম টাকা!… অসিদাদাকে বলে দেখি। দেশের বাড়িতে গেছে গাড়ি নিয়ে, সন্ধেবেলাতেই ফিরবে। … আপনি কি রাতে ফোন করতে পারবেন?’
‘চেষ্টা করব, নয়তো কাল সকালে।’ সহদেব যাবার জন্য পা বাড়াল।
‘আপনি কি ওকে সব ব্যাপার ভালো করে বুঝিয়ে বলেছিলেন?’
‘বেশি আর বোঝাতে হয়নি, ও নিজেই বোঝে। আশ্চর্যের কথা, বিদ্যুৎ ঠিক আপনার মতোই বলল, তবে অন্য ভাষায়, ফুর্তি করতে গেলে টাকা তো খসাতে হবেই।’
সহদেব লক্ষ করল প্রতিভার মুখটা একটু অন্যরকম হয়ে গেল। দোনামনা করে প্রতিভা বলল, ‘আপনি আর একবার বলে দেখুন না যদি কমসম করে, আমি অসিদাদাকে রাজি করাচ্ছি।’
‘বেশ।’
সেখান থেকে সহদেব এল শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ে। কী একটা ব্যাপার নিয়ে রাস্তা অবরোধ হয়েছিল। পাঁচটা রাজপথে সার দিয়ে গাড়ি দাঁড়িয়ে যায়। অবরোধ উঠে গেছে কিন্তু গাড়ির জট এখনও ছাড়ায়নি। সহদেব সেন্ট্রাল অ্যাভেনিয়ু দিয়ে ধর্মতলা যাওয়ার একটা বাসে উঠল। ঘড়ি দেখে হিসাব করল যদি স্বাভাবিক ভাবে যায় তাহলে সে সিনেমা শুরুর পাঁচ মিনিট আগে পৌঁছবে।
কিন্তু বউবাজারে মোড় থেকে আবার ট্রাফিক জ্যাম, তবে বড়ো রকমের নয়। থেমে থেমে বাসটা মেট্রো সিনেমার সামনে আসতেই সে নেমে পড়ে প্রায় ছুটেই আমেরিকান সেন্টারের ফটকে পৌঁছাল।
বাঁ দিকে একটা মানুষ ঢোকার মতো দরজা। একটি লোক দাঁড়িয়ে। টিকিটটা তার হাতে দিতেই দরজা খুলে তাকে যেতে দিল। আলো থেকে অন্ধকার ঘরে ঢুকে প্রথমেই যা হয় সহদেব সহদেব সামনের স্ক্রিনে ছবি ছাড়া কিছুই দেখতে পেল না। তবে এই ছোট্ট ঘরটা তার প্রায় মুখস্থ, বহুবার এসেছে সিনেমা দেখতে। তার প্রিয় বসার জায়গা একদম পিছনে দেয়াল ঘেঁষে।
কিন্তু এখন আর সেখানে খালি সিট আশা করা যায় না। টর্চ জ্বালিয়ে একটি লোক তাকে বাঁ দিকে মাঝামাঝি সারির ধারের আসনে বসিয়ে দিল। মিনিট কয়েকের মধ্যেই সে গল্পটা আঁচ করে ধীরে ধীরে সেঁধিয়ে গেল বিষয়ের মধ্যে।
নিগ্রো মহিলা মিসেস প্যাটারসনের সারা জীবনের কথা। এখন তাঁর বয়স শতাধিক। আমেরিকান গৃহযুদ্ধের সময়, এক প্ল্যান্টেশনে তিনি তখন ক্রীতদাসী বালিকা। সবার সঙ্গে তিনিও মুক্তি পেলেন। এরপর তার যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব আর বার্ধক্য নিয়ে পৌঁছলেন আমেরিকান সিভিল রাইটস আন্দোলনে, গৃহযুদ্ধ শুরুর ঠিক একশো বছর পর উনিশশো বাষট্টিতে। লোল চর্ম, বলি রেখাঙ্কিত মুখ, শত বছর ধরে কালোদের উপর সাদাদের অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার দেখেছেন, সয়েছেনও।
অথচ ক্রোধ, দ্বেষ থেকে মুক্ত, যুক্তিবাদী, উদার, সহৃদয় মিসেস প্যাটারসন আইন অমান্য করতে এগিয়ে এলেন। লাঠি হাতে শতাধিক বছরের বৃদ্ধা, ঠুকঠুক করে এগোচ্ছেন আদালত বাড়ির দিকে। বিরাট পুলিশ বাহিনী দরজার সামনে ব্যাটন আর আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে। বিশাল জনতা উদগ্রীব হয়ে দূর থেকে দেখছে, বৃদ্ধা লাঠিতে ভর রেখে পা পা করে এগিয়ে যাচ্ছেন। একা। পুলিশ বাহিনী বিব্রত, বিভ্রান্ত। তারা বুঝতে পারছে না বৃদ্ধা কী করতে চায়? ভেবে পাচ্ছে না বৃদ্ধাকে তারা কীভাবে বলপ্রয়োগ করে আটকাবে। দরজার বাইরে খাবার জলের কল। কালো মানুষদের সেই কল থেকে জল খাওয়া বারণ। নিষেধাজ্ঞা লেখাও রয়েছে। বৃদ্ধা কল খুললেন। যেন মানবতার উৎসমুখ খুলে গেল সারা বিশ্বের জন্য। প্রাণদায়িনী জল উছলে উঠল। তিনি মুখ নামিয়ে জল পান করলেন। সারা জীবনের অন্যায় বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে তার মুখ তৃপ্তিতে ভরে উঠল।
ছবি শেষ হয়ে গেছে। সহদেবের চোখের কোল বেয়ে জল গড়িয়ে নেমেছিল। সে মোছার চেষ্টা করেনি। চোখ বন্ধ করে বসে রইল কিছুক্ষণ। দর্শকরা বেরিয়ে যাচ্ছে। সরু ছোটো দরজা, সময় লাগছে বেরোতে। সহদেব উঠে দাঁড়িয়ে চোখ বোলাতেই দেখল সার দিয়ে পা পা করে দরজার দিকে এগোচ্ছে যারা তাদের মধ্যে পঙ্কজ। কিন্তু সামনে যার কাঁধে হাত রেখেছে পঙ্কজ তাকে দেখে সহদেব চমকে উঠল। ঊর্মি! পঙ্কজের সঙ্গে!
দরজা থেকে বেরিয়েই পঙ্কজ সিগারেট ধরাচ্ছিল। সহদেব আলতো করে তার পিঠে হাত রাখতেই সে লাইটারটা নামিয়ে মুখ ফেরাল।
‘আরে সহদেবদা। কেমন দেখলেন বলুন, দারুণ না? খুব ভালো লাগল… পরিচয় করিয়ে দিই, আমার বউ ঊর্মি আর ইনি হলেন সহদেব মিত্র, আমাদের সহদেবদা, একসঙ্গে আমরা কতদিন…’
সহদেব আর কিছু শুনতে পাচ্ছে না। দুটো এক্সপ্রেস ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ হলে যা হয় এখন তার ভিতরে সেটাই ঘটল। কয়েক মিনিট আগে সে আবগে মথিত হয়ে চোখ থেকে জল বার করেছে আর এখন তার জীবনের সেরা চমক! দুটোর ধাক্কা প্রকৃতিস্থ থাকার লাইন থেকে ছিটকে তাকে অবাস্তব অবিশ্বাস্য জমিতে আছড়ে ফেলে দিল। সে ফ্যালফ্যাল চোখে ঊর্মির দিকে তাকিয়ে রইল।
বোধহয় একই ব্যাপার ঘটেছে ঊর্মিরও। সেও একই ভাবে তাকিয়ে। মুখ থেকে রক্ত সরে গেছে। দু-হাত তুলে নমস্কার করার সময় স্পষ্টভাবেই আঙুলগুলো কাঁপল। হাসার একটা চেষ্টা করল।
তাহলে ওই লোকটা কে? কার সঙ্গে ঊর্মি তাজমহল দেখতে গেছল!
‘চলুন সহদেবদা একটু বসি কোথাও। শিঙাড়া খাবেন?’
‘না ভাই।’
‘কচুরি? আলুর চপ?’
‘আজ থাক।’
‘কেন অম্বলটম্বল হচ্ছে নাকি? আগে তো খুব খেতেন। আপনার বাড়ির কাছে বাসস্টপে একটা দোকান, কী যেন নামটা?’
‘কালীমাতা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার।’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ কালীমাতা। এখনও কি আগের মতো শিঙাড়ার টেস্ট আছে।’ পঙ্কজ রাস্তা পার হবার জন্য দুদিকে তাকাল। ‘কুইক ঊর্মি… সুরেন ব্যানার্জি রোড খালি পাওয়া একটা দুর্লভ ব্যাপার।’
তারা তিনজন ছুটেই ওপারের ফুটপাথে উঠল।
‘চলুন ওদিকের দোকানটায় ভালো মালাই করে। …কালীমাতার শিঙাড়া একদিন ঊর্মিকে নিয়ে গিয়ে খাইয়ে আসব।’
‘খাইয়ে আসবে কী, আমিই তো খাওয়াব। বিয়েতে তো নেমন্তন্ন করনি… কদ্দিন হল বিয়ে করেছ?’
এই সময় চৌরঙ্গি অঞ্চলে বেশ ভিড় থাকে। ওরা পদে পদে বাধা পাচ্ছে। পাশাপাশি তিনজনের হাঁটা কিছুতেই সম্ভব হচ্ছে না। সহদেবের পাশেই পঙ্কজ তার পাশে একহাত পিছনে ঊর্মি। সহদেব দেখার চেষ্টা করল ঊর্মির মুখটা। কানে মুক্তো, ঠোঁটে খুবই হালকা গোলাপি রং, সুতির ছাপা শাডি, বাহু উন্মুক্ত। কাঁধ থেকে ঝুলছে চামড়ার সেই ব্যাগটাই। ঊর্মিকে অন্যরকম লাগছে। মোলায়েম, অনুগ্র। শুধু মুখের উপর ভয় পাওয়ার একটা ছোপ। পঙ্কজ সেদিনের মতো পোশাকেই, সবুজ ট্রাউজার্স তবে হাফ হাতা গেরুয়া পাঞ্জাবিটা হাঁটুর নীচে ঝুলে থাকায় আলখাল্লার মতো দেখাচ্ছে।
‘দেড় মাসই তো?’ পঙ্কজ মুখ ফিরিয়ে ঊর্মিকে প্রশ্নটা করল। ঊর্মি শুধু হাসল।
তাহলে সেই লোকটা ওর স্বামী নয়!
‘এইটেতেই ঢুকি।’ পঙ্কজ হাত ধরে সহদেবকে টানল। দোকানের নীচের টেবলগুলো ভরা। সরু কাঠের সিঁড়ি দিয়ে দেড়তলায় উঠে তারা টেবল পেল। সহদেবের মুখোমুখি হয়ে বসল ওরা দুজন।
‘নেমন্তন্ন করব কী, বিয়েটা তো কালীঘাটে মন্দিরে গিয়ে করেছি। ইচ্ছে ছিল রেজিস্ট্রি করে করব। একমাসের নোটিস দিতে হয়, দেব দেব করছি তখন ঊর্মি আসানসোল থেকে ছুটে এসে বলল কালকেই বিয়ে করতে হবে, যেভাবেই হোক।… আসানসোল থাকে ওখানেই একটা স্কুলে আর্টের টিচার।’ কথা বলা থামিয়ে পঙ্কজ তিনটে মালাই দিতে বলল অপেক্ষমাণ লোকটিকে।
‘আমরা তো শুনেছি ‘ওঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ে’, আর এটা হল, ওঠ ছোঁড়া তোর বিয়ে। কী ব্যাপার না ওখানকার এক মাস্তানটাইপের লোক ঊর্মিকে বিয়ে করার জন্য খেপে উঠেছে, জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে, বলেছে ওকে না পেলে খুন করে নিজেও গলায় দড়ি দেবে। সুতরাং একজোড়া মৃত্যু রোধ করতে হলে এখুনি বিয়ে করে ফেলা ছাড়া আর পথ নেই। কী আর করি… ‘ পঙ্কজ তাকাল ঊর্মির দিকে, চোখে মিটমিটে হাসি। মুখ নামিয়ে ঊর্মি হাসল।
‘বেশ ব্যাপার তো!’ সহদেবের হঠাৎই শমিকে মনে পড়ল। ঊর্মিও কি ওই রকম একটা অসুস্থ অসুখী জীবনের দিকে এগোচ্ছে?
‘বেশ তো বটেই, তবে আমি বলে দিয়েছি চাকরিটা এবার ছাড়ো। প্রতি হপ্তায় দুদিনের জন্য কলকাতায় আসা আর ফিরে যাওয়া, আর নয়। পারাদ্বীপের কাজটা তো শেষ হয়েই এল, এবার পাকাপাকি এখানে এসে জমিয়ে সংসার করবে।’ পঙ্কজ আবার ঊর্মির দিকে তাকাল। ‘না না, কোনো ওজর আপত্তি নয়। জানলেন সহদেবদা, কালিকাপুরে একটা জমি কিনেছি, স্টুডিও করব। কাল সকালেই আর্কিটেক্টকে নিয়ে ওটা দেখাতে যাব। টাকাপয়সার টানাটানি ছিল তা সেটার অনেকটাই মিটেছে পারাদ্বীপের কাজটা পেয়ে। একটা নতুন ইলেকট্রনিকস কোম্পানির বাড়িতে চারটে তলায় মুরালের কাজ, আশি হাজার টাকার।’
তিনটে স্টিলের রেকাবিতে মালাই দিয়ে গেল। সহদেব চামচ দিয়ে একটা কোণ ভাঙার চেষ্টা করতে করতে বলল, ‘বিয়ে হয়ে গেছে দেখে মাস্তান কিছু করেনি। মানে গলায় দড়িটড়ি দিয়ে ফেলেনি তো?’
প্রশ্নটা সে ঊর্মির দিকে তাকিয়ে করেছে। ঊর্মি এতক্ষণে পূর্ণ দৃষ্টিতে এই প্রথম তার দিকে তাকাল। বুঝতে পেরেছে সহদেব তাকে খেলাবার জন্যই কথাটা বলল।
‘না, সেসব কিছু হয়নি।’ সংক্ষিপ্ত, দ্রুত উত্তর দিল ঊর্মি। ওর চাহনিতে কী যেন একটা বলার চেষ্টা, যেটাকে সহদেবের মনে হল মিনতি। একটা জ্বালা সে বোধ করল। এই রকম একটা চহনি সে কেয়ার কাছে প্রত্যাশা করেছিল। পায়নি।
মালাইয়ের একটা টুকরো মুখে ঢুকিয়ে পঙ্কজ বলল, ‘দারুণ। লোকে কেন যে আইসক্রিম খায়! মালাই করাটা শিখে ফেল ঊর্মি, এখন তো প্লাস্টিকের কুলপি পাওয়া যায়, ফ্রিজও আছে।’
‘তৈরি শুরু হলেই আমি যেন চেখে দেখার নেমন্তন্নটা পাই।’ সহদেব খোশমেজাজি ভাব গলায় আনল। ‘পঙ্কজ তোমার ফোন আছে তো, তাহলে মাঝেমাঝে খবর নোব।’
‘আছে। কলমটা আর একটুকরো কাগজ দাওতো।’ পঙ্কজ উর্মির সামনে হাত বাড়িয়ে ধরল।
‘নেই আমার কাছে।’
সহদেবের মনে হল, বলার আগে ঊর্মি চট করে কী যেন ভেবে নিল। ঝুলির মধ্য থেকে জটার পেন আর নোটবইটা বার করে সে পঙ্কজের সামনে ধরল। ফোন নম্বর আর ঠিকানাটাও সে লিখে দিল।
‘আপনার ঠিকানাটা বলুন লিখে নি… এর থেকে একটা পাতা ছিঁড়ব?’
‘দাও, আমি লিখে দিচ্ছি। আমার কিন্তু ফোন নেই।’
পাতাটা ছিঁড়ে পঙ্কজকে দিতেই সে কাগজটা ঊর্মিকে দিয়ে বলল, ‘তোমার কাছে রেখে দাও।’
সহদেব দেখল, ব্যাগের মধ্যে কাগজটা রেখেই ঊর্মির মুখ পাথরের মতো হয়ে গেল। রেকাবিতে মালাই গলে যাচ্ছে, খাচ্ছে না।
‘জান ঊর্মি, সহদেবদা ব্যাচিলার। বিয়ে করার মতো কাউকে এখনও পাননি। …একি খাচ্ছ না কেন! আমি তো আরও তিনটে আনাব।’
‘ভালো লাগছে না, মাথাটা বড্ড ধরেছে।’
ভিতর থেকে ঊর্মির ভাঙন শুরু হয়েছে। সহদেবের মনে হল ও যেন তাকেই জানিয়ে দিতে চাইল, অসহ্য লাগছে। কিন্তু এই দেখা হয়ে যাওয়াটা তো তার তৈরি করা জিনিস নয়! আগ্রা যাবার পথে তার সামনের সিটে একজোড়া স্বামী-স্ত্রী ছিল। এখন একেবারেই কাকতালীয় ভাবে সে জানল ওরা স্বামী-স্ত্রী নয়।
মেয়েটি এমন একজনের স্ত্রী যে তার খুবই পরিচিত এবং সেই পরিচিত লোকটি জানে না যে তার স্ত্রী দিল্লি, আগ্রা ঘুরে এসেছে অন্যের স্ত্রী সেজে। অবশ্য দুজনের মধ্যে সম্পর্কটা সে দেখেছে, খুবই তিক্ত ধরনের ছিল। কিন্তু আসল কথা, আজ তাদের দেখা হয়ে যাওয়াটা একদমই একটা দুর্ঘটনা। ঠিকমতো বললে, পঙ্কজ যদি ওর সঙ্গে না থাকত বা অন্য কোনো পুরুষও যদি থাকত তাহলে আজ এই দেখা হওয়াটা এমন বিপর্যয়কর হয়ে উঠত না। যতটুকু আলাপ হয়েছিল তাতে পাঁচ সেকেন্ড হাসি বিনিময় ছাড়া আর কী করার থাকত! আমরা অডিটোরিয়াম থেকে বেরিয়ে যে যার নিজের রাস্তা ধরতুম।
সুতরাং তোমার যদি অসহ্য লাগে, তার জন্য আমার কিছু করার নেই। এটা একেবারেই দৈব কাণ্ড। সহদেব মনে মনে ঊর্মির সঙ্গে কথা বলা শুরু করল। এর থেকেও অবাক হবার মতো ঘটনা পৃথিবীতে বহু ঘটেছে। কিন্তু আগ্রায় যার সঙ্গে গেছলে সে কে? কেনই বা যাওয়া?
‘পঙ্কজ আমিও কিন্তু আর খাব না। কিছুদিন আগে দারুণ সর্দি জ্বরে ভুগেছি।… তাছাড়া আমার একটু তাড়া আছে।’
‘সে কী, দুজনেই খাবে না!’ পঙ্কজকে হতাশ দেখাল। ‘তাহলে আর কী করা যায়। উঠি।’
‘তোমার কাছ থেকে অনেক কিছু শোনার আছে। তুমি নিজের কাজ সম্পর্কে কী ভাবছ, বিদেশে কী ভাবনা হচ্ছে, এদেশেই বা কে কী কাজ করছে, আমার কৌতূহল বিরাট।’ সহদেব ‘কৌতূহল’ শব্দটায় জোর দিল। ঊর্মি মুখ তুলে তার দিকে তাকাল।
‘তাহলে একদিন সকালে আসুন অনেকক্ষণ জমিয়ে আড্ডা দেওয়া যাবে, অবশ্য পারাদ্বীপ থেকে ফিরে আসার পর। কাল রাতেই চলে যাচ্ছি।’
নীচে নেমে দাম চুকিয়ে পঙ্কজ বলল, ‘এক মিনিট, ল্যাভাটরিটা একবার ঘুরে আসি।’
তারা দুজনে মুখোমুখি। অতন্ত অস্বস্তিকর পরিস্থিতি। দুবার চোখাচোখি হল। স্বাভাবিক করে তোলার জন্য কেউ একটা কিছু বলুক, দুজনে সেটাই চাইছে। অবশেষে ঊর্মিই কথা বলে উঠল।
‘আপনাকে দু-একটা কথা বলতে চাই। ‘
‘বেশ তো।’
‘কাল বা পরশু যদি…।’
পঙ্কজ ফিরে এসেছে। ঊর্মি কথা শেষ করল না। খাবারের দোকান থেকেই তারা আলাদা হয়ে নিজেদের পথ ধরল। সহদেব দু-পা এগিয়েই থেমে ফিরে তাকায়। সে যা অনুমান করেছিল তাই হল। ঊর্মি পিছন ফিরে একবারও তাকাল না। পিছন থেকে দেখলে শমির সঙ্গে ওর গড়নের এমনকী চলার ধরনেও এ একটা মিল আছে। এটা মনে হওয়ায় সঙ্গে সঙ্গে সহদেব ব্যস্ত হয়ে উঠল। প্রতিভাদিকে ফোন করে জেনে নিতে হবে।
পাড়ায় ঢোকার মুখে ওষুধের দোকান বিনোদ মেডিক্যাল হল। সহদেবের সঙ্গে মালিকের ভালোই পরিচয়। দরকার হলে সে ওদের ফোন ব্যবহার করে, অবশ্যই পয়সা দিয়ে। ডায়াল করার আগে সহদেব ঘড়ি দেখল, প্রায় পৌনে দশটা।
ফোন ধরল কাবলি।
‘কে? এম এম এম! এত রাতে? … য়্যা, কী বললে, পিসিকে, আমাকে নয়, মাকেও নয়, প্রতিভাদিকে!… ধরো ডেকে দিচ্ছি…. ওহ মেঘ না চাইতেই জল! এসে গেছে।’
‘হ্যালো, কে মেজদা?’
‘অসিত ফিরেছে?’
‘হ্যাঁ। আমি ওকে বললুম…’ প্রতিভা থেমে রইল।
‘হ্যালো, অসিত কী বলল?’ সহদেবের মনে হল, আশাপ্রদ খবর নয় বলেই প্রতিভাদি কথা খুঁজে পাচ্ছে না।
‘মেজদা আপনি বরং ওর সঙ্গেই একবার কথা বলুন, নীচে অপিস ঘরে আছে। ফোনটা ওখানে দিচ্ছি।’
সহদেবের বুকের মধ্যে ঢিবঢিব করে উঠল। প্রতিভাদির দৌত্য যে ব্যর্থ হয়েছে সেটা বোঝা যাচ্ছে, কিন্তু সে এখন কী বলবে? প্রস্তাবটা তার মাথা থেকে বেরোয়নি তবে এতে তার সায় আছে। অসিতকে না জানিয়েই এতটা সে এগিয়েছে। লাখ টাকাটা তো কম নয়!
‘কে মেজদা? আমি অসিত।’ গম্ভীর ভরাট স্বর। ওর লম্বা চওড়া শরীরটার সঙ্গে খুবই মানানসই।
‘হ্যাঁ, প্রতিভাদির কাছে নিশ্চয় শুনেছ?’
‘শুনেছি। কিন্তু আপনারা এসব কী করছেন আমাকে না জানিয়ে? এতে আমার মত আছে কি না, সেটাও একবার জিজ্ঞোসা করে নিলেন না?’ সহদেবের গলায় স্পষ্ট বিরক্তি এবং অস্পষ্ট ধমক। সহদেব কুঁচকে গেল।
‘ঠিক, তোমাকে জিজ্ঞাসা করা উচিত ছিল। তবে বাপারটা এখন এমন জায়গায় এসে গেছে যে কিছু একটা করা দরকার, খুবই দরকার। এত অশান্তি -।’
‘এমন জায়গা মানে? কী জায়গায়, কোন জায়গায়?… কোনো জায়গাতেই কিছু পৌঁছায়নি।’
‘কী বলছ তুমি, বুঝতে পারছি না!’
‘পরিষ্কার বাংলা ভাষাতেই বলছি। শুনুন মন দিয়ে মেজদা, কোনো ব্যাপারস্যাপার আমার আর শমির মধ্যে নেই। হ্যাঁ নেই, একটা সময় পর্যন্ত ছিল কিন্তু আর নেই। সুতরাং টাকা দেওয়ারও কোনো প্রশ্ন ওঠে না, তাও কিনা লাখ টাকা। টাকা কি খোলামকুচি! একটা বদমাস, হারামজাদা, বলে কিনা আমায় খুন করবে?’ রাগে থরথর করছে অসিতের গলা। ‘ওটাকে পিঁপড়ের মতো টিপে মারতে পারি, কালই ওর লাশ ফেলে দিতে পারি। এটা ব্ল্যাকমেল, পরিষ্কার ব্ল্যাকমেল আর আপনিই ওকে ওসকানিটা দিয়ে লোভ জাগিয়ে দিয়েছেন…ছি ছি ছি, এত লেখাপড়া শিখে শেষকালে কিনা একটা অশিক্ষিত গ্রাম্য মেয়েমানুষের কথায় নেচে উঠলেন? আপনার কাছ থেকে এটা আশা করিনি।’
শুনতে শুনতে অবশ হয়ে এল সহদেবের শরীর, তার মাথার মধ্যের স্নায়ুকোষগুলো। তাকে এইসব কথা শুনতে হল! অসিত কিনা তাকে ছি ছি করল!
‘যে অশান্তি আমাদের বাড়িতে চলছে, তার মূলে কিন্তু তুমিই। এটা তো অস্বীকার করতে পার না?’ সহদেব আড়চোখে দোকানের কর্মচারীকে লক্ষ করল। কানটা নিশ্চয় এইদিকেই!
‘কতরকমের অশান্তিই তো কত পরিবারে রয়েছে আবার মিটেও যায়। তাই বলে লাখ টাকা দিতে হবে?’
‘শমির মুখ চেয়েও তো তোমার দেওয়া উচিত। তার জীবনটার কথা তুমি ভাববে না? আর সম্পর্ক নেই বলে দিলেই কি দায় চুকে যায়? তার দাদা হিসেবে বলছি না, একটা মানুষ হিসেবেই বলছি, এভাবে কি সম্পর্ক মিটে যায়? আমরা কি জানোয়ার?… ও একটা মেয়ে।’
ওধারে ফোন রেখে দিল অসিত। কর্মচারীটি এবং একজন খদ্দের তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে দেখে সহদেব বুঝল সে গলাটা খুব বেশিই চড়িয়ে ফেলেছিল। হাতের আঙুলগুলো এখনও থরথরাচ্ছে। টাকাটা দিয়েই সে ছুটে ওষুধের দোকান থেকে বেরোলো।
কড়া নাড়তে দরজা খুলল শমি। টিভি চলছে।
‘এখন খেতে দোব।’
‘দে।’
সহদেব উপরে উঠে গেল। মিনিট দশেক পর শোবার ঘরের দরজা থেকে শমি ডাকল, ‘মেজদা।’
‘রেখে যা।’
ঘর অন্ধকার। শমি আলো জ্বালল। খালি গায়ে চিৎ হয়ে সহদেব কপালে দুটো হাত আড়াআড়ি রেখে শুয়ে। আলো জ্বালতেই হাত নামাল। থালা আর বাটি টেবলে নামিয়ে রেখে শমি বলল, ‘শরীর খারাপ?’
‘না।’
‘বড়দার সঙ্গে দেখা করেছ?’
‘কেন, দেখা করতে হবে কেন? তাছাড়া কোথায় বন্ধুর বাড়িতে উঠেছে তাও জানি না। বউদিরা এলে শ্বশুরবাড়িতে ওঠে, তারা তো আসেনি।’
এরপর শমির চলে যাওয়ার কথা কিন্তু দাঁড়িয়ে রয়েছে।
‘কিছু বলবি?’
এগিয়ে এসে শমি খাটের পাশে দাঁড়াল। ‘একটা কথা জিজ্ঞাসা করার ছিল।’
আঁচলের খোঁটা ধরে নখ দিয়ে টানছে। বলতে দ্বিধা হচ্ছে। সহদেব বুঝে উঠতে পারল না কী জিজ্ঞাস্য থাকতে পারে।
‘শুনলুম অসিতদা নাকি ওকে একলাখ টাকা দেবে।’
সহদেব হতভম্ব চোখে তাকিয়ে থাকল। শমির মুখে ভেসে উঠেছে সুখী হাসি।
‘তাই নাকি! কে বলল তোকে?’
‘ও বলল, তুমিই নাকি ব্যবস্থা করে দিচ্ছ।’
‘এত টাকা অসিত কী জন্য দেবে সেটা কি বিদ্যুৎ তোকে বলেছে?’
‘হ্যাঁ, ডিভোর্স করলে দেবে। … সত্যি মেজদা, আমি আর পারছি না, আমি তাহলে বেঁচে যাব যদি ও জীবন থেকে সরে যায়।’
‘তারপর কী করবি, তোর চলবে কী করে? সেবাও রয়েছে।’
‘সে যাহোক করে, দুমুঠো ভাত আর ছেঁড়া ন্যাকড়া পরেও চালিয়ে নোব কিন্তু এ জীবন আর আমার সহ্য হচ্ছে না।’
সহদেব কয়েক সেকেন্ড শমির জ্বলজ্বল করা চোখ দুটো দেখল। ভীষণভাবে আশা করে আছে। কিন্তু এটাকে আর বাড়তে দেওয়া উচিত নয়। ওকে বাস্তবে দাঁড় করিয়ে দেওয়া ভালো।
‘কিন্তু অসিত টাকা দেবে না। লাখ টাকা কেন, এক টাকাও নয়।’
‘দেবে না! কেন?’ শমিতা বুঝে উঠতে না পারার মতো তাকাল, তার মাথায় যেন কিছু ঢুকছে না।
‘দেওয়ার কোনো দরকার আছে বলে সে মনে করে না তাই দেবে না। ও আমাকে একটু আগে ফোনে বলল কোনো ব্যাপার তোর সঙ্গে ওর নেই, একটা সময় পর্যন্ত ছিল কিন্তু এখন আর নেই।’ শমির মুখ এখন দেখবে না বলেই সহদেব দুটো হাত আড়াআড়ি চোখের উপর রাখল।
অস্ফুট একটা আর্তনাদের মতো শব্দ হল। ‘তোমাকে একথা বলল? ঠিক বলছ?’
‘হ্যাঁ, এই কথাই বলল।’
‘ঠিক বলছ? ঠিক শুনেছ মেজদা?’
সহদেব উত্তর দিল না। কিছুক্ষণ পর হাত সরিয়ে দেখল ঘরে কেউ নেই। সে খাবার জন্য উঠল না। ইচ্ছাটাই নেই। আলোটা চোখে ধাক্কা দিচ্ছে, নেভাবার জন্য উঠল আর তখনই দেখল বিদ্যুৎ সিঁড়ির শেষ ধাপে।
‘দেবে না বলল? আমি তো জানতুমই দেবে না।’ বিদ্যুৎ ঘরে ঢুকেই মুখটা খুশিতে ভরিয়ে ফেলল অনুমান মিলে যাওয়ায়।
‘তুমি জানতে? তাহলে জেনে শুনেই লাখ টাকা দর হেঁকেছিলে!’
বিদ্যুতের মুখে টানা দু-তিনবার হাসি খেলে গেল। ‘জানাজানির আর কী আছে। একটা মেয়েমানুষের জন্য লাখ টাকা দিয়ে দেবে! তাও বয়স হয়ে গেছে, শরীর ধসে গেছে এমন একজনের জন্য। আপনি হলে দেবেন… কি দেবেন?’ যাত্রার ভিলেনের মতো ত্যারচা চোখে তাকিয়ে খিকখিক করে হেসে উঠল বিদ্যুৎ।
‘তাহলে তুমি জানতে… তাহলে তুমি এই জীবনের মধ্যেই থাকতে চাও, এতগুলো লোকের জীবনকে নরক করতে চাও… জীবন বদলাতে চাও না… ইউ ব্যাস্টার্ড।’
তরকারির বাটিটা ছুঁড়ে মারল সহদেব। বিদ্যুৎ বোধহয় এই রকম কিছু হবে আঁচ করেছিল, হাতটা মুখের সামনে যথাসময়ে তোলায় বাটিটা মুখে আঘাত করল না। তরকারি ছিটিয়ে পড়ল মেঝেয়, বিছানায়।
বিদ্যুৎ ছুটেই প্রায় পালিয়ে গেল।
এগারো
খবরের কাগজ পড়া শেষ করে, দাড়ি কামিয়ে সহদেব ভাবল অরুণকাকার খবর নেবে। হাসপাতাল থেকে আজও ফেরেননি। একটা পা বাদ গেলেও মানুষ অথর্ব হয়ে যায় না। সেবাও তো এক পা নিয়ে চলাফেরা করছে। এইরকম ভেবে সে গড়িমসি করছিল, পাঞ্জাবিটা চড়িয়ে সামনের বাড়ি থেকে একবার ঘুরে আসবে কি না।
তখনই নীচের থেকে সেবার ডাক সে শুনল, ‘মেজোমামা, মেজোমামা।’
ঘর থেকে বেরিয়ে সে বারান্দায় এল। খোলা সদরে সেবা দাঁড়িয়ে। মুখ তুলে সে বলল, ‘তোমাকে একজন খুঁজছেন।’
দরজার কাছে এসে সেবার পাশে দাঁড়িয়ে যে এবার উপরদিকে তাকাল, তাকে দেখে সহদেব হেসে বলল, ‘ওপরে চলে আসুন।’
ঊর্মি দোতলায় উঠে আসার আগেই সে ছুটে ঘরে গিয়ে পাঞ্জাবিটা পরে নিল। ছোটো ঘরটা খুলে বলল, ‘জায়গা কম, বসতে একটু অসুবিধে হবে।’
‘কিছু অসুবিধে হবে না। এইরকম ছোটো ঘরেই আমার বাবা-মা এখনও থাকেন, আমিও থেকেছি।’
ঊর্মি সারা ঘরে একবার চোখ বোলাল। বইগুলোর নাম পড়ার চেষ্টা করল।
‘বসুন।’
সহদেব তার নিজস্ব চেয়ারটাকে দেখিয়ে বলল। ওটায় হলুদ কাপড়ে ওয়াড় দেওয়া, চার ইঞ্চি পুরু ফোম রাবার পাতা আর হাতল আছে।
‘না না আমি এটায় বসছি।’ দরজার পাশে দেওয়াল ঘেঁষা চেয়ারটায়, যাতে হাতল নেই, ঊর্মি বসল।
‘চিনে এলেন কী করে?’
‘কেন অসুবিধের কী! ঠিকানাটা তো আছে আর পঙ্কজের কাছ থেকে জেনে নিয়েছি বাস থেকে কোথায় নামতে হবে। শুধু দুবার বাস বদলাতে হয়েছে।’
‘পঙ্কজের তো কালিকাপুর যাওয়ার কথা, গেছে?’
‘সকালেই বেরিয়ে গেছে।’
‘ও বোধহয় জানে না আপনি এখানে আসবেন।’
‘জানে না। বলতে অবশ্য পারতাম কিন্তু অযথা ওকে কিউরিয়াস করে তোলার দরকার কী। ও ফিরে আসার আগেই তো আমি বাড়ি পৌঁছে যাব।’ ঊর্মি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ভ্রূ কুঁচকে সময়ের একটা হিসাব কষে নিল।
ঠিক এই ভাবেই তো তুমি দিল্লি, আগ্রা ঘুরে এসেছ, পারাদ্বীপ থেকে পঙ্কজ এসে পড়ার আগেই। সহদেব মনে মনে ঊর্মির সঙ্গে কথোপকথন শুরু করল।
‘পঙ্কজের কাছে লুকিয়ে রাখার কি দরকার আছে, মানে দিল্লি সফরটা?’
‘হ্যাঁ আছে। আপনার কাছে আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ, পঙ্কজের সামনে আমাকে না চেনার ভান করেছিলেন বলে।’
‘ব্যাপারটা কী? লোকটাই বা কে?’ সহদেব তার নিজস্ব চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে বসল।
ঊর্মি ইতস্তত করল না। কোনোরকম অপরাধবোধ বা লজ্জা তার মুখে দেখা গেল না। হাঁটুর উপর শাড়িটা দুই আঙুলে ধরে ছড়িয়ে দিতে দিতে বলল, ‘ব্যাপার হল, লোকটা আমাদের প্রতিবেশী। লোকটাই বলছি, নাম আর বলার দরকার নেই, ওটা কোনো ফ্যাক্টর নয়। কেমিক্যালসের আর ফার্টিলাইজারের এজেন্সি নিয়ে প্রচুর টাকা করেছে। ও আমার মায়ের অসুখের সময়,… ব্লাড ক্যানসার… প্রায় চল্লিশ হাজার টাকা খরচ করে। আমি তখন সবে কলেজে ঢুকেছি। বাবার এমন সামর্থ্য ছিল না যে এত টাকা খরচ করে চিকিৎসা করাতে পারেন। ওর জেনরসিটি আমাকে মুগ্ধ করে। ওকে তখন দেবতা বলে মনে হয়েছিল… আমার বয়স তখন উনিশ। বুঝতেই পারছেন বুদ্ধি আর মন দুটোই তখন কাঁচা। কৃতজ্ঞতাবশতই বলতে পারেন, আমি নিজেকে ওর কাছে সাবমিট করি।’
এই পর্যন্ত বলে, থেমে ঊর্মি লক্ষ করল সহদেবের প্রতিক্রিয়া। সহদেব নড়ে বসে বলল, ‘মার কী হল?’
‘ব্লাড ক্যানসার, ন্যাচারালি মারা গেলেন। আমরা দু-তিনবার এইভাবে বাইরে গেছি পুরী, পণ্ডিচেরি, গোয়া, স্বামী-স্ত্রী হয়ে, বলা বাহুল্য কৌমার্য বহু আগেই হারিয়েছি। বাবা এসবের কিছুই কিন্তু জানেন না। অতি সরল, পড়াশুনো পাগল, আদর্শ মেনে চলা এক সামান্য কেরানি। এখনও আমার এই একটাই ভয় বাবা যেন না জানতে পারেন। কিছুতেই নয়, কোনোভাবেই যেন এসব কথা ওঁর কানে না পৌঁছয়।
‘প্রত্যেক মানুষেরই একটা নোঙর থাকে, নইলে সে ভেসে চলে যায় জীবনের বাইরে। বাবাই আমার নোঙর। সহদেবদা, আমি কিন্তু জীবনকে খারাপ, ভালো সবরকম ভাবেই গ্রহণ করতে চাই। কিন্তু তা করার জন্য যে মনের জোর দরকার, সেটাই আমার নেই।
‘আমি একটা বোকা, কী ভয়ংকর বোকামি যে করেছি এখন তা বুঝতে পারছি। আমার কিছু ফোটো ওর কাছে আছে, কিছু চিঠিও। লোকটাকে দেখতে কেমন তা তো আপনি নিজেই জানেন। খারাপ নয়। কিন্তু ওর শিক্ষা, রুচি, ব্যবহার, ওর অনুভূতি ওর বোধ বুদ্ধি, ওর হৃদয় কিছুই আর আমার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছিল না। আমি ওর থেকে দূরে সরে যাবার চেষ্টা করছিলাম। আসানসোল থেকে পাঁচ মাইল ভিতরে স্কুলের চাকরিটা পেয়েই কলকাতা ছাড়ি। আসলে ওর কাছ থেকে পালাবার জন্যই। কিন্তু সমানে আমাকে তাড়া করে যাচ্ছিল।’
দু-হাত তুলে বাস থামাবার মতো সহদেব ওকে থামাল। ‘আর কিছু বলার দরকার নেই, শোনার কোনো আগ্রহও বোধ করছি না। খুবই সেকেলে গল্প। অবোধ সরল বালিকা আর কুটিল, খল নায়ক। অতঃপর মঞ্চে গুণবান, সহৃদয়, খ্যাতিমান পঙ্কজ মাইতির প্রবেশ এবং বালিকার হুঁশ ফিরে আসা, তাই তো?’
ঊর্মি নিষ্পলক সহদেবের মুখের দিকে তাকিয়ে, তার চোয়ালের পেশি দপদপাল। মুখ কঠিন হয়ে উঠেছে।
‘এখন মনে হচ্ছে এখানে না এলেই হত।’
‘এ কথা মনে হওয়ার কারণ?’
‘আপনি বিদ্রূপ করলেন, অতি সাধারণ একটা মন এর মধ্য থেকে বেরিয়ে এল। আমি যে দুঃসহ, অপমানকর অবস্থার মধ্য দিয়ে গেছি আর তার থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছি সেটাই আপনি ধরতে পারলেন না। …ইয়েস আই লাভ পঙ্কজ, সত্যিকারের ভালোবাসা।…লোকটা আমাকে ভয় দেখিয়েছে, বাবার কাছে ধরিয়ে দেবে বলেছে। কিন্তু আমি বাবাকে আঘাত দিতে চাইনি, সেজন্য আমি নিজেকে বিক্রি করেছি, আমার চরিত্র মাপার একটা কি মাপকাঠি?… পঙ্কজকে মিথ্যে বলেছি, মাস্তানের গল্প সাজিয়েছি। কিন্তু আর নয়।’
সহদেব গালে হাত দিয়ে টেবলে কনুইয়ের ভর রেখে শুনে যাচ্ছিল। ঊর্মিকে দাঁড়িয়ে উঠতে দেখে, বসার জন্য হাত নেড়ে বলল, ‘আর নয়-এর মানেটা কী? পঙ্কজের কাছে কনফেস করবেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘সেটা আগেই করেননি কেন? … ইউ আর স্টিল অ্যান ইডিয়ট … এতদিনেও ওকে সব খুলে বলেননি কেন? এ সব ব্যাপার চেপে যাওয়ার ফল কী হতে পারে জানেন?’
‘মেজোমামা, মেজোমামা শিগ্গিরি এসো… মা পুড়ে যাচ্ছে।’ নীচের থেকে সেবার আকুল চিৎকার ভেসে এল।
‘কী ব্যাপার! কে পুড়ে যাচ্ছে?’ ঊর্মি সচকিত হয়ে সহদেবের দিকে তাকাল।
‘ও মেজোমামা শিগ্গিরি এসো, মা মরে গেল।’
সহদেব চেয়ার ছেড়ে ওঠার আগেই ঊর্মি ছুটে ঘর থেকে বেরোলো। বারান্দা থেকে নীচে তাকিয়েই সে সিঁড়ি দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে নীচে নেমে গেল।
সহদেবও বারান্দায় এসে উঠোনে তাকাল। তখনই শমিকে জাপটে ধরে উঠোনে ফেলে ঊর্মি গড়াগড়ি দিল। ধোঁয়া বেরোচ্ছে শমির দেহ থেকে। কেরোসিনের গন্ধ সহদেবের নাকে লাগল। উঠোনের একধারে ক্রাচ বগলে সেবা বিস্ফারিত চোখে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে। পাশের বাড়ির জানলা থেকে একজন চিৎকার করল, ‘অ্যাম্বুলেন্স ডাকুন, এক্ষুনি হাসপাতালে নিয়ে যান।’
বারান্দার রেলিং ধরে সহদেব করুণ স্বরে জানলার লোকটিকে বলল, ‘অ্যাম্বুলেন্সে একটা খবর দেবেন।’
‘এম এম এম এটা কিন্তু ধাঁধা নয়, স্রেফ অঙ্ক। কত তাড়াতাড়ি উত্তর দিতে পার দেখি। পাঁচ বছরে টাকা ডাবল হয় ইন্দিরা বিকাশ পত্রে, জান তো? একশো টাকা পাঁচ বছরে দুশো, রিনিউ করো, দুশো টাকা পাঁচ বছর পর চারশো। এইভাবে কতবার রিনিউ করলে একশো টাকার পত্রটি এক কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে?… কাগজ কলম দেব?
সহদেব চোখ কুঁচকে কাবলির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘একশো টাকার কাগজ এক কোটিতে যখন পৌঁছবে তখন আমার নাতির নাতি হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করছে।’
‘এটা কোন অ্যানসার হল না।’ টাবলি বলল।
সহদেব অনিতাকে লক্ষ করে বলল, ‘অনি, তোর এখানে আসা আমায় বন্ধ করতে হবে। … শিঙাড়া টিঙাড়াও আসছে না। ব্রেন কাজ করবে কী করে?’
‘আসবে, আসবে। পিসি এখানে অনুপস্থিত, তার মানে অর্গানাইজ করছে। কিন্তু আমার অঙ্কটা?’
‘পারব না বাপু, তুই বরং বলে দে কতবারে কোটি ছাড়াবে।’
‘সতেরোবারে। সতেরো ইনটু পাঁচ পঁচাশি বছরে একশো টাকার পত্রটা হবে এক কোটি একত্রিশ লক্ষ সাত হাজার দুশো টাকা। … তুমি কালই একটা কিনে ফ্যালো।’
‘কোটি টাকা নেবে কে, বংশধর কই! আমি তো বিয়েই করিনি।’
‘ইয়েস ইয়েস, বিয়ের ব্যবস্থা তো… মা, তোমার দাদার বিয়ের ব্যবস্থা এখনও করোনি কেন? তুমি ক্রমশই কুঁড়ে হয়ে যাচ্ছ।’
সহদেব অনাবিল আনন্দে সবার মুখের দিকে তাকাল। তার বোন, বড়ো ভালো মেয়ে। তার ভাগনিরা,ওরাও বড়ো ভালো, তার বন্ধুর মতো। কাবলি ফার্স্ট ডিভিসন পেয়েছে হায়ার সেকেন্ডারিতে। সে জানে, এ মেয়ে ড্রাগ ধরবে না, অনি মিথ্যেই ভেবে মরে। এইবার শিঙাড়া, সন্দেশ, চা নিয়ে আসবে প্রতিভাদি। পঞ্চাশের কাছাকাছি, ধবধবে পাতলা থান, মলমল-এর ব্লাউজ, ব্রেসিয়ার। ঠাসা মজবুত গড়ন। রসিকা এবং উইট বোঝে। অসিত বলেছিল, ‘গ্রাম্য অশিক্ষিত মেয়েমানুষ।’ তাতে কী বোঝায়? মেয়েমানুষ ইজ মেয়েমানুষ। একটা নিরাপদ জায়গা।
‘মেজোমামা জান,’ টাবলি বলল, ‘রাতে আমি তিনখানা রুটি খাই। মা একটা রুটি থেকে একটু ছিঁড়ে, চারখানা করে দেবে।…কী সুপারস্টিশাস! তিনটে দিলে তিন শত্তুর হয় বলে ওই পদ্ধতিতে চারখানা?’
‘আচ্ছা মেজদা, তিনখানা দিলে তিন শত্তুরই তো হয়, হয় না?’
সহদেব হেসে মাথা নাড়ল। এই অনি ছ মাস আগে আলুথালু হয়ে ছুটে গেছল। ‘ওর একদিন কি আমারই একদিন। অনেক সয়েছি মেজদা।’ সেই অনিই আধপোড়া বোনকে নার্সিং হোমে রেখে জলের মতো টাকা খরচ করল, বাঁচিয়ে তোলার জন্য।
এইভাবেই জীবন বয়ে চলেছে। সহদেব জানে এই সব সস্তার দার্শনিক কথাবার্তা শুনতে ও শোনাতে ভালোই লাগে। এর মধ্যে কোনো জটিলতা নেই, চাষাভুষোরাও বুঝতে পারে। কিন্তু জীবন কি এতই সরলভাবে বয়ে যাচ্ছে?
শিঙাড়া, সন্দেশ, চা এল। নাকছাবিটা আবার পরেছে প্রতিভাদি। কাবলি আবার একটা অঙ্ক ফেঁদেছে। ‘এম এম এম, এক কিলোটনের একটা বোমা মানে হাজার টন টি এন টি। হিরোশিমায় যে অ্যাটম বোমাটা ফেটেছিল সেটা কুড়ি কিলোটনের, মানে কুড়ি হাজার টন টি এন টি এন টির, তাতে মারা গেছল এক লাখ একচল্লিশ হাজার মানুষ। মনে রাখ এটা। এবার, এক মেগাটন মানে দশ লক্ষ টন টি এন টি, পৃথিবীতে এখন বারো হাজার মেগাটন ক্ষমতার বোমা জমা করে রাখা আছে। সবগুলো একসঙ্গে যদি ফাটে তা হলে বারো হাজার ইনটু দশ লক্ষ টন টি এন টি, তা হলে কটা হিরোশিমার লোক মারা যাবে?’
‘লিখে দে, বাড়ি গিয়ে উত্তরটা বার করব। তবে অঙ্ক না কষেই বলতে পারি পৃথিবী থেকে মানুষ সাফ হয়ে যাবে?’
‘তা হলে বোমা বানিয়ে লাভ কী হল?’
এর উত্তর আমি জানি না কাবলি। অনেক প্রশ্নেরই উত্তর অজানা থেকে গেছে। তোর বাবা যে টাকা শমিকে বাঁচাবার জন্য দিল সেটা বিদ্যুৎকে দিলে ঘটনাটা একদমই ঘটত না। ঊর্মি যদি ছুটে গিয়ে শমিকে জড়িয়ে উঠোনে ফেলে, আগুন না নেভাত তাহলে ও বাঁচতে পারত না। কিন্তু ঊর্মির মতো সাহস আমি দেখাতে পারলুম না কেন? অতই যদি সাহসী তা হলে একটা বদমাসের হাতের পুতুল হয়ে ঊর্মি ছিল কেন?
বাড়ি ফেরার সময় সহদেব বাসে দাঁড়িয়ে এই সব ভাবল। একবার তার মনে হল, যদি সে কেয়াকে প্রত্যাখ্যান না করত তা হলে কেয়া কি বড়ো হয়ে ওঠার জন্য সাধনা করত? কে জানে! অনেক প্রশ্নেরই উত্তর অঙ্কর নিয়মে পাওয়া যায় না।
কড়া নাড়তে দরজা খুলল বিদ্যুৎ। এখন ওর গলার আওয়াজ একদমই পাওয়া যায় না। বোঝাই যায় না ও বাড়িতে আছে। সহদেব দোতলায় ওঠার আগে ওদের ঘরের দিকে তাকাল। টিভি চলছে। সেবা খাটে বসে।
‘মেজদা খাবার দেব?’
‘দে।’
সহদেব দোতলায় উঠে এল। শমি থালা হাতে একটু পরেই এল। পরনে গলা থেকে পা পর্যন্ত ঢাকা ম্যাকসি। আধখানা মুখে পোড়া দাগ এখনও মেলায়নি। মেলাবেও না। একটা কান গলে গেছে। শমি আর বাড়ি থেকে বেরোয় না।
কাবলির দেওয়া কাগজের টুকরোটা ফেলে দিতে গিয়েও সহদেব ফেলতে পারল না। অঙ্কটা কষে ওদের তাক লাগিয়ে দিলে কেমন হয়! কলমের খোঁজে সে ছোটো ঘরটায় এল। চেয়ারে বসে একটা সাদা কাগজের জন্য র্যাকের দিকে তাকাতেই সার সার পুরোনো ফাইলগুলোয় তার চোখ পড়ল।
ওর কোনো একটার মধ্যে ‘তাজমহল’ গল্পটা আছে। কোনটায়? একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সহদেবের মনে পড়ল, তাজমহল তো সে দেখে এসেছে!