গোলাপবাগান

গোলাপবাগান – মতি নন্দী – উপন্যাস

ভগবতীচরণ আর্য বিদ্যালয়ের একশো বছর আজ পূর্ণ হচ্ছে সকাল দশটায়। স্কুলের উঠোনের একদিকে শামিয়ানার নীচে মঞ্চ বাঁধা। জাতীয় পতাকার তিন রঙা কাপড়ে মঞ্চটি ঘেরা। তার উপরে সাদা কাপড়ে ঢাকা জোড়া দেওয়া তিনটি টেবল। টেবলের উপর দুটি ফুলদানিতে লাল গোলাপ গুচ্ছ। টেবলের পিছনে পাঁচটি চেয়ারে এখন বসে আছেন চারজন, পঞ্চমটি খালি রয়েছে। চারজনের একজন হলেন আজকের সভাপতি রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী, অপর তিনজন-স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ভগবতীচরণের নাতি, যিনি পরিচালন সমিতির প্রেসিডেন্ট; বর্তমান হেডমাস্টার এবং সবথেকে পুরোনো জীবিত ছাত্র যাঁর বয়স এখন নব্বুই। ইনি স্বাধীনতা সংগ্রামী। সরকারের দেওয়া তাম্রফলক পেয়েছেন; পঞ্চম চেয়ারে বসার কথা সবথেকে পুরোনো জীবিত শিক্ষকের, যিনি চল্লিশ বছর শিক্ষকতা করে কুড়ি বছর আগে অবসর নিয়েছেন।

মঞ্চের ডানদিকে সাদা চাদরে ঢাকা চেয়ারে হেলান দিয়ে রাখা তেলরঙে আঁকা শীর্ণ মুখ মাথায় শামলা মোটাগোঁফ আয়ত চোখ কৃষ্ণকায় ভগবতীচরণের প্রতিকৃতি। চেয়ারটির পাদদেশে জ্বলছে একগোছা ধূপ, প্রতিকৃতির দু-পাশে দাঁড় করানো রজনীগন্ধার ছড়। মঞ্চের বাঁদিকে একটি টেবলের উপর হারমোনিয়াম ও ডুগিতবলা। চারটি ছাত্র এইমাত্র ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ’ গানটি গেয়ে মঞ্চ থেকে নেমে গেল।

কাশীনাথ প্রতিদিন দশটায় স্কুল শুরুর ঘড়ি গত পঁয়ত্রিশ বছর ধরে নির্দিষ্ট একটা তালে যেভাবে বাজিয়ে আসছে আজও সেইভাবে বাজাল। মঞ্চে মাইক্রোফোনে এসে দাঁড়ালেন সহ-প্রধান শিক্ষক, হাতে অনুষ্ঠানসূচি লেখা কাগজ।

প্রাক্তন ছাত্র ব্রতীন রায়চৌধুরি স্কুলের শতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে হাজির হতে, ত্রিশবছর আগে যেসব পথ দিয়ে নিত্য স্কুলে যেত সেই পথগুলি দিয়ে এখন হাঁটছে। বাড়ি থেকে স্কুল প্রায় এক মাইল। আটটি লেন ও স্ট্রিট ধরে হেঁটে এবং একটি রাজপথ, চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনু পার হয়ে সে সাত বছর স্কুলে যাতায়াত করেছে, মাধ্যমিক পাশ করে বিজ্ঞানে, অঙ্কে ও ভূগোলে লেটার নিয়ে। মেধা তালিকায় তার স্থান হয়েছিল বারোজনের পরে। অতঃপর কলেজে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে জৈব রসায়নে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম এবং ওই বিষয়েই পিএইচ ডি অর্জন করার পর পুণেয় এক ঔষধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানে চার বছর থেকে গত চোদ্দো বছর মুম্বইয়ে রয়েছে এক জার্মান প্রতিষ্ঠানে চিফ অ্যানালিস্টের পদে।

বাড়ি থেকে এতদূরে স্কুলে পড়ার কারণ, এই ভগবতীচরণ স্কুল থেকেই তার পরলোকগত বাবা বগলাপ্রসাদ এবং কাকা ক্ষীরোদপ্রসাদ ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেছিলেন। ব্রতীনের শিক্ষাজীবন শুরু হয় মা অনসূয়ার কোলে এবং পাড়ার পাঠশালায়। অনসূয়া যখন বিধবা হন ব্রতীন তখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। সেই বছরই তার জন্য প্রথম গৃহশিক্ষক নিযুক্ত করেন তার কাকা।

পাড়ায় নবাগত ভাড়াটিয়া উমাপদ পালকে শিক্ষকরূপে সুপারিশ করেন ব্রতীনদের প্রতিবেশী ও উমাপদর বাড়িওলা সতীকান্ত মল্লিক। উমাপদ সতীকান্তর ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া মেয়ে বাসন্তীকে বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম স্থান পাওয়াতে যে সাহায্য করেন সতীকান্ত সবিস্তারে তা ক্ষীরোদকে গল্প করেন। পরের দিনই ক্ষীরোদ হাজির হন অবিবাহিত উমাপদর ঘরে।

উমাপদ প্রথমে রাজি হননি ব্রতীনের শিক্ষক হতে যেহেতু তিনি জীবনবিমা অফিসে চাকরি করেন এবং অফিস থেকে ফিরে একটি মেয়েকে পড়াবার পর বিশ্রাম নিতে ও কিছু পড়াশুনা করতে চান। ক্ষিরোদ কথা বলে বুঝতে পারেন বেশি মাইনের টোপ ফেলে উমাপদকে গাঁথতে পারবেন না। প্রস্তাব দেন বাসন্তী ও ব্রতীনকে একসঙ্গে পড়াবার, যদিও একজন সপ্তম ও অন্যজন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। এর সঙ্গে একটি মোক্ষম টোপ দেন, উমাপদ দু-বেলা তার গৃহে আহার করবেন।

মহামায়া পাইস হোটেলের দু-বেলায় খদ্দের উমাপদ এই দ্বিতীয় টোপটি উপেক্ষা করতে না পেরে গিলে ফেলেন। এতদ্দ্বারা প্রভূত উপকৃত হয় ব্রতীন। উমাপদর কঠোর শৃঙ্খলা ও সস্নেহ শাসনের বাতাবরণে তার পড়াশুনো এগিয়ে যায়। প্রায় সমবয়সি একটি ভালো ছাত্রীর সঙ্গে রেষারেষি করে পড়া এবং তার মতন বার্ষিক পরীক্ষার প্রথম স্থান পাওয়ার জন্য উত্তেজিত হয়ে সে বই ও পরিশ্রমে ডুবে যায়। বছরের শেষে দেখা গেল দুজনেই প্রথম স্থান পেয়েছে। ব্রতীন বুঝে গেল কম কথা বলা লাজুক বাসন্তী তার সঙ্গে পাঞ্জা কষার জন্য আড়ালে তৈরি হয়েছিল। স্কুল ফাইনাল পাস করার পরও ব্রতীন বি এসসি-তে ভরতি হওয়ার আগে পর্যন্ত তালিম নিয়েছে উমাপদর কাছে। ওরা দুজন চারবছর প্রতি সন্ধ্যায় উমাপদর দু-পাশে টেবলে দু-ঘণ্টা বসে পড়েছে ও শুনেছে কিন্তু নিজেদের মধ্যে কথা প্রয়োজন ছাড়া একবারও বলেনি। রাস্তায় বহুবার মুখোমুখি হয়েছে। স্মিত হেসে দুজনে পাশ কাটিয়ে চলে গেছে।

ব্যাপারটা ব্রতীনকে আজও ধাঁধায় রেখেছে। হতে পারে বাসন্তী মুখচোরা লাজুক তাই বলে চার চারটে বছর, একটাও বাড়তি কথা না বলে থাকতে পারলে কী করে! সে হিসেব করে দেখেছে বছরে মোটামুটি তিনশো দিন, চার বছরে বারোশো দিন, দিনে দু-ঘণ্টা করে হলে হয় চব্বিশশো ঘণ্টা। তার ধারণা ঘণ্টায় দুটো কি তিনটে ‘একস্ট্রা রিফিল আছে?’ বা ‘ইন্সট্রুমেন্ট বক্সটা দাও তো’ জাতীয় বাক্য তারা বিনিময় করেছে। দেওয়াল ঘড়িতে ন-টা বাজলেই উমাপদ বলতেন, ‘এবার বাড়ি যাও।’ বাসন্তী বইখাতা গুছিয়ে কাপড়ের থলিতে ভরে সেটা কাঁধে ঝুলিয়ে উঠে দাঁড়াত। তখন ব্রতীন আড়চোখে তাকাত উমাপদর মাথার উপর দিয়ে। পলকের জন্য চোখাচোখি হবে এবং এক সেকেন্ডও দেরি না করে বাসন্তী ঘর ছেড়ে যাবে।

ব্রতীন দুটো রাস্তা পেরিয়ে এল। এখান থেকে ইংরেজি ‘ওয়াই’-এর মতো দু-দিকে চলে গেছে আশু দেব লেন আর গোলাপবাগান স্ট্রিট। দুটো রাস্তা দিয়েই তার স্কুলে যাওয়া যায়। সে ইচ্ছামতো এক একদিন রাস্তা বেছে নিত। ব্রতীন কী ভেবে আজ আশু দেব লেন বেছে নিল। বেছে নেওয়ার কারণ একটা বারান্দা সে দেখবে বলে।

এই বাঁকটা ঘুরেই বাঁদিকে দোতলার সেই টানা বারান্দাটা। ঢালাই লোহার নকশাদার রেলিং। রোদ বৃষ্টির ছাঁট আটকাবার জন্য বারান্দাটা সিলিং থেকে আধখানা ঢাকা কাঠের খড়খড়ি দিয়ে। লোহার চেইনে ঝোলানো দাঁড়, তাতে বসা একটা চন্দনা। ফ্রকপরা এক কিশোরী, শ্যামবর্ণ, ঘাড় পর্যন্ত ছাঁটা ঝাঁকড়া চুল, চোখা নাক, চঞ্চল চোখ, এই সময়ই চন্দনার মুখের কাছে ছোলাভরা হাতটা এগিয়ে ধরে থাকত। চন্দনাটা একটা একটা ছোলা ঠোঁট দিয়ে তুলত।

ব্রতীন তখন ক্লাস টেন-এ পড়ে। লম্বা এবং বলিষ্ঠ, যুবকের মতো দেখতে। কয়েকদিন বারান্দায় চন্দনাটার দিকে সে তাকাল। অবশ্যই মেয়েটিও তার দৃষ্টিপথে এল। এরপর সে শুধু মেয়েটিকে দেখার জন্যই মুখ তুলত এবং লক্ষ করল মেয়েটি মুখ নামিয়ে চোখে হাসি মাখিয়ে তাকে দেখছে। বাড়িটার উলটোদিকে একটা লম্বা রক তাতে প্রায়ই এইসময় দুটি প্রৌঢ় বসে গল্প করে। ব্রতীন বারান্দার দিকে তাকাবার আগে দেখে নিত লোক দুটি তাকে দেখছে কি না। একদিন মাথায় একটা ছোলা পড়ল, ব্রতীন প্রথমেই তাকাল রকের দিকে। লোক দুটো পরস্পরের দিকে তাকিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে, দেখতে পায়নি মেয়েটির ছোলা ছোড়া। সে মাথায় হাত বুলিয়ে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে মুখ ঘুরিয়ে বারান্দার দিকে তাকিয়ে হেসেছিল। কেন যে সে এই কাজটি করে ফেলল তাই নিয়ে পরে নিজেকে ধিক্কার দিয়েছে।

পরপর কিছুদিন তার মাথায় কাঁধে কপালে ছোলা পড়ল। সে মাথায় হাত বুলিয়ে যদি দেখত লোক দুটি রকে বসে নেই তাহলে মুখ তুলে তাকিয়ে হাসত বা ভ্রূ কোঁচকাত। ব্যাপারটা একটা খেলার মতো হয়ে দাঁড়ায়। তখন আশু দেব লেনের ওই বাঁকটার কাছাকাছি এলেই উত্তেজনার হলকায় তার মুখ গরম হয়ে উঠত। ওকে দেখতে পাবে এই প্রত্যাশায় ঢিবঢিব করা বুকে বাঁকটা ঘুরেই সে বারান্দার দিকে তাকাত। দেখতে পেয়েই তার বুক হালকা লাগত, মাথার মধ্যে ফুরফুরে হাওয়া বয়ে যেত। তার মনে হয়েছিল তাকে দেখে ওর চোখে ঝিলিক দিয়ে উঠত খুশি। তার চলার সঙ্গে সঙ্গে বারান্দায় এক ধার থেকে অন্য ধারে সরে সরে যেত ও। রেলিংয়ের উপরের কাঠের বাতান ঠিক ওর বুকের নীচে। ব্রতীন আভাস পেত ওর ভেপে ফুলে ওঠা বুকের।

একসময় তার মনে হল ও তাকে কিছু জানাতে চায়। ও যখন বারান্দায় থাকে তখন দ্বিতীয় কোনো লোক থাকে না। বাড়িটায় কি ও একা? সাধারণত শুকোবার জন্য জামাকাপড় বারান্দায় ঝোলে কিন্তু সে একটি কাপড়ও কখনো ঝুলতে দেখেনি। স্কুল থেকে ফেরার সময় সে কোনোদিনই ওকে দেখতে পায়নি। এটা তাকে বিস্মিত ও হতাশ করেছিল।

সে তখন মনে মনে কতকগুলো কারণ খুঁজে বার করার চেষ্টা করে। চন্দনাটা আছে যখন বাড়িতে নিশ্চয় আরও মানুষ আছে তবে সংখ্যায় কম। একতলায় সদর দরজার উপর সাইনবোর্ড। তাতে লেখা, ‘দি ইউনিভার্সাল প্রিন্টার্স’। নামেই বোঝা যায় একতলায় আছে একটা ছাপাখানা, হয়তো সেটা ওদেরই। ওর বাবা সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ছাপাখানাতেই কাটায়। রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে সে চেয়ারে বসা দু-তিনটে মাথা দেখতে পায়, তাদেরই একজন হয়তো ওর বাবা। খুব কড়া লোক। মেয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াক সেটা একদমই পছন্দ করে না। এইরকম স্বভাবের লোক সে দেখেছে তাদের পাড়াতেই। বাড়ির বউ বা মেয়ে জানালায় কী বারান্দায় দাঁড়ালে রেগে যাচ্ছেতাই নোংরা কথা বলে এমনকী গায়ে হাতও তোলে। বাবা যখন ছাপাখানায় থাকে মেয়ে শুধু তখনই বারান্দায় আসার সুযোগ পায়। বাবা দুপুরে দোতলায় উঠে আসে। বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত হয়তো থাকে। সেই সময় ও বারান্দায় আসতে পারে না।

মনগড়া এই কারণটাকে একসময় তার যুক্তিগ্রাহ্য বলে মনে হয় না। যদি সত্যিসত্যিই তাকে ভালো লেগে থাকে তাহলে বাবা যত ভয়ংকরই হোক বিকেলেও বারান্দায় দাঁড়াতই, তাকে একবার চোখের দেখা দেখতে। এক ধরনের অধিকারবোধের থেকে জন্মানো দাবি তাকে তখন আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল, ভালো লাগা কথাটাকে সে ততদিনে ভালোবাসায় বদলে ফেলেছে। তখন সে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করত ভালোবাসলে পৃথিবীতে এমন কোনো বাধা নেই যা অগ্রাহ্য করা যায় না। তখন তার মনের আবেগের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শরীরের কিছু নতুন ব্যাপার ফলে মেয়েদের সম্পর্কে সে অন্যভাবে ভাবতে শুরু করেছে। এই ভাবনায় প্রথম যাকে জড়ালো সে বাসন্তী। কিন্তু সংকোচে, লজ্জায় বা ভয়ে সে কোনোদিনই নিজেকে উদঘাটন করতে সাহস পায়নি পাশের গলির, রোগা, কম কথা বলা পরিষ্কার মাথার মেয়েটির কাছে।

আশু দেব লেনের বাঁক ঘুরেই ব্রতীনের চোখ উঠে গেল বারান্দায়। শাড়ি, শায়া, শার্ট ও মোজা রেলিংয়ে শুকোচ্ছে। চন্দনা পাখিটা নেই। তার চোখ ঘুরে গেল সামনের সেই রকটায় যেখানে দুই প্রৌঢ় বসে গল্প করত। রকটায় এক ইস্ত্রিওলা লম্বা একটা কাঠের টেবলে কাপড় ইস্ত্রি করছে, পাশে একটা কয়লার উনুন। ইউনিভার্সাল প্রিন্টার্স সাইনবোর্ডটা নেই।

সে দাঁড়িয়ে এধার ওধার তাকাল যদি পুরনো কোনো মুখ চোখে পড়ে। রাস্তায় লোক বেড়ে গেছে। অনেকগুলো মুখ সে তিরিশ বছর কমিয়ে আন্দাজ করার চেষ্টা করল তার চেনা লাগে কি না। ইস্ত্রিওলার কাছে কাচা কাপড় বুকের কাছে জড়ো করে ধরে লুঙ্গিপরা মাঝবয়সি একটি লোক দাঁড়িয়ে। নিশ্চয় এই পাড়ারই লোক এবং পুরনো বাসিন্দা বলেই তার মনে হল।

‘আচ্ছা দাদা এই বাড়িতে একটা প্রেস ছিল না?’ ব্রতীন জিজ্ঞাসা করল নম্র স্বরে।

লোকটি অবাক হল, কপাল কুঁচকে বলল, ‘হ্যাঁ ছিল, সে তো বহুকাল আগের কথা।’

‘প্রেসটা কোথাও উঠে গেছে কিনা জানেন?’

‘না জানি না। তবে শুনেছি ভালো চলছিল না, প্রচুর দেনা হয়ে যায় তাই বাড়িসমেত প্রেসটা বিক্রি করে দিয়ে অনাদি সুর বেহালা না গড়িয়ায় চলে গেছে, তা আজ থেকে বছর পঁচিশ আগে হবে। আপনি এতদিন পর ওর খবর নিচ্ছেন!’ লোকটি নিশ্চয়ই অবাক হতে পারে এবং হলও।

লোকটি প্রশ্ন করেনি কৌতূহল প্রকাশ করেছে। ব্রতীন সামলাবার জন্য এবং নিজের কৌতূহল মেটাবার জন্য বলল, ‘ওর একটি মেয়ে ছিল, তার সঙ্গে আমার এক আত্মীয়ের বিয়ের সম্বন্ধ হয় কিন্তু মেয়েটি বিয়ে করবে না বলে বেঁকে বসে। বলতে পারেন মেয়েটির বিয়ে হয়েছে কিনা?’

‘বুড়ি! ওর ভালো নাম জানি না। সে তো এই পাশের গোলাপবাগান বস্তিরই একটা ছেলেকে বিয়ে করে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছে। ছেলেটা ইলেকট্রিক মিস্তিরি। আপনার আত্মীয় খুব বাঁচান বেঁচে গেছে ওই মেয়েকে বিয়ে না করে।’

ব্রতীন বিষণ্ণ বোধ করল। যৌবনের মাধুর্য মাদকতা উত্তেজনার দরজা প্রথম খুলে দিয়েছিল এই বুড়িই। মাথায় ছোলা ফেলতে ফেলতে একদিন ফেলল দলাপাকানো একটা কাগজ, চিঠি! সে ঝুঁকে কুড়িয়ে নিতে গিয়ে দেখে রকে বসা দুজনের একজন তার দিকে তাকিয়েই বারান্দার দিকে তাকাল, সে কাগজটা কুড়িয়ে নিতে গিয়েও নিল না লজ্জায় আর ভয়ে। এই রাস্তা দিয়ে দু-বেলা সে যাতায়াত করে, ওরা তাকে দেখে। এবার থেকে ওরা তার সম্পর্কে কী ধারণা করবে? ব্রতীন সোজা তাকিয়ে হেঁটে যায়, কাগজটা পড়ে থাকে রাস্তায়। সেই দিনের পর কখনো আর এই রাস্তা দিয়ে সে হাঁটেনি।

রাস্তার যে জায়গাটায় কাগজটা এসে পড়ে সেখানে সে তাকাল। শেষ পর্যন্ত কি ওখানেই পড়ে থেকে ছিল নাকি ওই দুটি লোকের একজন রক থেকে উঠে এসে কুড়িয়ে নেয়! ওটায় কী লেখা ছিল? তিরিশ বছর পর ব্রতীন হঠাৎই বুকের মধ্যে একটা ফাঁকা জায়গা খুঁজে পেল।

সে আর কথা না বাড়িয়ে হাঁটতে শুরু করল। মেয়েদের কর্পোরেশন স্কুলের পাশের বাড়ির একতলার জানলার নীচের দেয়ালে রং দিয়ে আঁকা কালীর ছবি তার পাশে বংশীধারী শ্রীকৃষ্ণ। এমন জায়গায় শিল্পচর্চার কারণ জানতে সে ক্ষণেকের জন্য দাঁড়াল। জানলা দিয়ে এক বুড়ি বলল, ‘পেচ্ছাপ করলেই দেবতার মুখে, করবে?’

এবার একটা শীতলা মন্দির। সামনে দিয়ে যাবার সময় চোখ বুজত। মন্দিরটা একইরকম রয়েছে। আজ সে চোখ বুজল না। পাশে ছিল একটা তেলেভাজার দোকান, এখন সেটা হয়েছে ইলেকট্রিক সরঞ্জামের দোকান। দোকানে বসা বুড়ো লোকটিকে দেখে মনে হল একেই যেন আলুর চপ ভাজতে দেখেছে।

একতলা বাড়িটা একতলাই রয়ে গেছে, এই বাড়ির একটা ছেলে একবছর তাদের সঙ্গে পড়ে ফেল করে ক্লাস এইটেই রয়ে যায়। শিবু, ভালো নাম ছিল শিবেন্দ্র। তার সঙ্গে খুবই ভাব হয়ে যায়। শিবুর কণ্ঠস্বর ছিল উদাত্ত সুরেলা, চমৎকার আবৃত্তি করত। নির্মলেন্দু লাহিড়িকে হুবহু নকল করে সে ‘দেবতার গ্রাস’ আবৃত্তি করেছিল টিচার্স রুমে কনকবাবুর বিদায় সংবর্ধনা সভায়। কনকবাবুই ওকে বাংলায় একশোয় সতেরো নম্বর দিয়েছিলেন অ্যানুয়াল পরীক্ষায়। শিবু একদিন তাকে আচমকা জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘হ্যাঁরে বতু আমাকে দেখে তুই আড়ষ্ট হয়ে যাস দেখি। কেন, ফেল করেছি বলে? আড়ষ্ট তো আমার হওয়ার কথা, লজ্জা তো আমিই পাব।’

সে থতমত হয়ে গেছল শিবুর এমন এক স্বীকারোক্তিতে। ওর ব্যর্থতা আর সারল্য, তাকে এক ধরনের লজ্জায় ফেলে দেয়। পড়াশুনোয় শিবু ভালো ছিল না। বলত, ‘আমার মাথায় ঢোকে না কিন্তু তোর মাথায় তো দিব্যি ঢোকে। দেখতে হবে কী আছে তোর মাথার মধ্যে।’ দেখা আর হয়নি, শিবু আবার ফেল করে। পরীক্ষার রিপোর্ট কার্ড হাতে নিয়ে স্কুল থেকে সে কোথায় চলে গেল কেউ জানে না। ওর বাড়ির লোক যথাসাধ্য খোঁজাখুজি করেছিল। ওর মা তার কাছে এসেছিল শিবু যদি কিছু বলে গিয়ে থাকে। শিবু তাকে কিছু বলে যায়নি। ব্রতীনের ইচ্ছে করল শিবুর মা-র সঙ্গে দেখা করে যায়। তারপরই মনে হল এখনও কি উনি বেঁচে আছেন? ত্রিশ-বত্রিশ বছর তো কেটে গেছে।

এরপর সে জয় ঘোষ লেন ধরে এগিয়ে পড়ল প্রফুল্ল মল্লিক স্ট্রিটে। রাস্তাটা গিয়ে পড়েছে বিধান সরণিতে। এখানে থাকত বা এখনও থাকে নীলেশ, নীলেশ অধিকারী, নীলু। স্কুলের কাছেই বাড়ি, টিফিনের সময় সে বাড়ি গিয়ে ভাত খেত। স্কুল থেকে বেরোতে হলে গেট পাশ লাগত, সেটা দেখতে ট্রেনের মান্থলি টিকিটের মতো, প্রতি মাসে একটাকা দিয়ে রিনিউ করাতে হত। নীলুকে শুধু এইজন্যই সে হিংসে করত, দুপুরে বাড়ি গিয়ে ও পেট ভরে ভাত খেয়ে আসে। স্কুলে আসার জন্য সকাল সাড়ে ন-টায় ভাত খেলে দুপুরে খিদে পাবেই। নীলুর পরিতৃপ্ত মুখটা দেখলে চুঁইচুঁই করা পেট মুচড়ে উঠত।

একদিন নীলু বলল, তুই বেশ আছিস, সকালে ভাত-টাত খেয়ে স্কুলে আসিস, আমাদের উনুনই ধরে সকাল দশটায়। বাবা সক্কালবেলা বেরিয়ে যায় দোকান খুলতে। বাজারেই মাখন পাঁউরুটি খেয়ে নেয়। বাসি রুটি-তরকারি খেয়ে স্কুলে আসি, খেতে ইচ্ছে করে না, বাবা গরম ভাত খেতে ভালোবাসে তাই দুপুরে ভাতের হাঁড়ি চড়ে, দোকান থেকে এসে বাবা খেয়ে আর একটু ঘুমিয়ে নিয়ে আবার দোকানে যায়।’ হাতিবাগান বাজারে নীলুদের মুদির দোকান।

নীলুর বাবার গরম ভাত খাওয়ার সাধ মেটানোর আর বাসি রুটি খেয়ে স্কুলে আসার কথা শুনে তার পেটের জ্বালা একটু কমে ছিল। নীলু পরে ভালো ওয়াটার পোলো প্লেয়ার হয়। ব্রতীনকে সে হেদোয় সেন্ট্রাল ক্লাবে ভরতি করিয়ে দেয়। এক মাসেই সে নভিস থেকে সুইমার হয়েছিল পরীক্ষা দিয়ে। পরীক্ষা নিয়েছিল নীলুর বড়োমামা সুধীরদা। ‘প্লাটফর্ম থেকে ডাইভ দাও….দু-হাত তোলো।’ ডুবজলে সে দু-হাত তোলে। ‘চিত সাঁতার কাটো’, সে তিরিশ মিটার সাঁতরে আসে। ‘একশো মিটার ফ্রিস্টাইল’, সে পঞ্চাশ মিটার এপার-ওপার করে। ওই একটা বছরই সে হেদোর জলে নেমেছিল। আর সাঁতার কাটেনি।

নীলেশের বাড়ির সামনে দিয়ে যাবার সময় দেখল ধুতি আর গেঞ্জি পরা পাকা চুলের এক শীর্ণকায় লোক বাড়িটায় ঢুকছে হাতে লাঠি আর পলিব্যাগ।

সে জিজ্ঞাসা করল, ‘নীলু কি এই বাড়িতেই থাকে?’

কয়েক সেকেন্ড মুখের দিকে তাকিয়ে বৃদ্ধ বললেন, ‘থাকে। আপনি কে?’

‘আমি ওর স্কুলের বন্ধু, একই ক্লাসে পড়েছি। আপনি কি ওর বাবা?’

‘হ্যাঁ। নীলু তো এখন দোকানে।’

তার জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা হল, এখনও কি গরম ভাত না খেলে আপনার খাওয়া হয় না? তার বদলে জিজ্ঞাসা করল, ‘কখন ওকে বাড়িতে পাব?’

‘দুপুরে ভাত খেতে আসবে তারপর একটু ঘুমোবে তখন দেখা করতে এসো।’

ব্রতীনের হাসি পেল। সেই ট্রাডিশন সমানে চলিতেছে।

‘ওকে বলবেন বতু এসেছিল, ব্রতীন।’

কয়েক পা এগোতেই উপর থেকে পানের পিক পড়ল তার তিনহাত সামনে। থমকে সে উপরে তাকাতেই ঘোমটা দেওয়া একটা মুখ জানলা থেকে চট করে সরে গেল। সামনে যে লোকটি আসছিল মন্তব্য করল, ‘কবে যে এদের সিভিক সেন্স হবে।’ তারপরই বলল, ‘আপনার নাম ব্রতীন না?’

‘হ্যাঁ, আপনাকে তো চিনলাম না।’

‘আমি আপনার এক ক্লাস নীচে পড়তুম। আপনাকে চিনি, স্কুলে ভালো ছাত্র ছিলেন, স্যাররা বলতেন ব্রিলিয়ান্ট। অনেক বছর পর দেখলুম।’

‘আমি তাহলে খুব বেশি বদলাইনি। তুমি এখন কী করছ?’ ব্রতীন নামটা আর জিজ্ঞাসা করল না। ওটা নিরর্থক। সে নিশ্চিত এর সঙ্গে জীবনে আর দেখা হবে না।

‘পি অ্যান্ড টিতে চাকরি করছি। বেলেঘাটা পোস্ট অফিসে আছি।’

‘অফিস যাওনি এখনও?’ ব্রতীন ঘড়ি দেখল, দশটা-কুড়ি।

‘এই যাব, আপনি এদিকে কোথায় চললেন?’

‘স্কুলে। সেন্টিনারি সভা হচ্ছে। তুমি যাবে না?’

‘অফিস রয়েছে। উইক ডেজে না করে ছুটির দিনে তো করতে পারত।’

ব্রতীন কথা না বাড়িয়ে এগোল। ট্রাম রাস্তা পেরিয়ে ডানদিকে একশো মিটার গেলে স্কুল। সে ট্রাম রাস্তা পার হল। পরপর পুরোনো বইয়ের দোকান, ঘড়ির দোকান, চশমার দোকান, কবিরাজখানা, রেস্তোরাঁ, ছবি বাঁধাইয়ের দোকান। সব একইরকম রয়েছে শুধু ভিতরের মানুষগুলো বদলেছে।

পুরোনো বইয়ের দোকানিটি এক যুবক। তখন বসত কালো, রোগা, জিরজিরে বুক, ফতুয়া পরা, পাতা কাটা কাঁচাপাকা চুল এক আধবুড়ো। স্কুল থেকে ফেরার সময় প্রতিদিন সে পেতে রাখা মলাট ওলটানো বইগুলোর নামের উপর চোখ বোলাত। একদিন ‘বাগদি ডাকাত’ নামটা দেখে সে থেমে যায়, বইটা তুলে পাতা ওলাটাতে থাকে। মিনিট তিনেক পর লোকটা বলে, ‘সঙ্গে পয়সা আছে? ভালো বই। পয়সা না থাকে তো রেখে দাও।’

পকেটে ছিল একটা আধুলি। সে কিন্তু কিন্তু করে বলেছিল, ‘আট আনা আছে।’ তারপর বইটার দাম দেখে, আড়াই টাকা। একটা লাইব্রেরির স্ট্যাম্প মারা, ‘পূর্বাচল ১৯৪৮।’ শুধু বাগদি ডাকাত নয় তার সঙ্গে রয়েছে ‘বিশেডাকাত’।

চকচক করে উঠেছিল তার চোখ। ভিক্ষে চাওয়ার মতো গলায় বলেছিল, ‘দেবেন?’

লোকটা চোখ বড়ো করে বলে, ‘আট আনায়, পাগল! বইয়ের কন্ডিশান দেখেছ? একেবারে নতুন। একটাকার কমে হবে না। লিখেছে কে দেখেছ, খগেন মিত্তির, ভীষণ নামকরা লেখক।’

সে মিনতি করে বলেছিল, ‘কাল টাকা নিয়ে আসব, বইটা রেখে দেবেন?’

লোকটা বলে, ‘বিক্রি না হয়ে গেলে থাকবে।’

বাড়ি যাবার জন্য পা বাড়িয়েছে, লোকটা ডাকল, ‘শোনো খোকা, ভগবতী ইস্কুলে পড়ো?’ সে ‘হ্যাঁ’ বলতেই জিজ্ঞাসা করে, ‘কোন কেলাসে?’

সে বলে, ‘ক্লাস নাইন।’

‘বিষ্টুহরিবাবুকে চেনো?’

‘আমাদের নতুন সায়ান্স টিচার।’

সদ্য এম এসসি পাশ করা যুবক বিষ্ণুহরি কাঞ্জিলাল চারমাস আগে তখন পড়াতে এসেছেন। মালকোঁচা দিয়ে ধুতি আর পাঞ্জাবি পরা কাঞ্জিস্যার ক্লাসে মুগ্ধ করে রাখতেন ছেলেদের তাঁর পড়ানোর গুণে। কঠিন বিষয়কে সরল করে বুঝিয়ে দেওয়ায় তাঁর মতো কাউকে ব্রতীন কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে পায়নি।

‘উনি আমার কাছ থেকে বই নেন। বাকি আট আনা কাল দিয়ে যেয়ো। না দিলে কিন্তু বিষ্টুহরিবাবুকে বলে দেব। নাম কী তোমার?’

ব্রতীন বইটা নিয়ে বাড়ি ফেরে। মাকে দেখাতেই হাত থেকে কেড়ে নিয়ে মা বলেন, ‘আগে আমি পড়ব, সেই কবে পড়েছিলুম।’ মা ছিল বইয়ের পোকা, এখনও তাই। পর দিন স্কুল যাবার সময় বইওলাকে সে আট আনা শোধ করে দেয়।

এই বইওলাকে দেখে তার মনে হল বোধহয় বত্রিশ বছর আগের লোকটির ছেলে। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি কতদিন দোকানে বসছেন?’

যুবক অবাক হয়ে গেল হঠাৎ এমন একটা প্রশ্ন শুনে।

‘কেন বলুন তো?’

‘কৌতূহলে জিজ্ঞাসা করছি। ত্রিশ বছর আগে দেখেছি বসতেন অন্য একজন।’

‘আমার মামা, মারা গেছেন।’

‘ওঁর ছেলেমেয়ে ছিল না?’

‘বিয়েই করেননি।’

ব্রতীনের মুখে ভাবান্তর ঘটল না। সে নিজেও তো বিয়ে করেনি। আগের মতোই মলাট খোলা বইগুলো চিত করে সাজানো। নতুন যা চোখে পড়ল কয়েকটা ইংরেজি ম্যাগাজিন, মলাটে প্রায় উলঙ্গ মেমসাহেবরা উত্তেজক ভঙ্গিতে। যুবকটি লক্ষ করছিল তার মুখভাব। প্রায় কৈফিয়ত দেবার মতো গলায় বলল, ”ওই ম্যাগাজিনগুলোই ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছে নয়তো দোকান লাটে উঠে যেত।’

আর কথা বলার কিছু নেই। ব্রতীন সরে গেল। পরপর দোকান। ছবি বাঁধানোর দোকানের সামনে থমকে দাঁড়াল। একচিলতে হাসিতে ঠোঁট বেঁকে গেল। মিলিটারি পোশাকে নেতাজি কোমরে তরোয়াল। ছবিটা তিরিশ বছর আগে সে দেখেছে, তবে এটা নিশ্চয় সেই ছবিটা নয়। তিরিশ বছরের মধ্যে কম করে শ-দুয়েক নেতাজি বিক্রি তো হয়েছেই। সেই মহাদেব, মাথার জটা থেকে গঙ্গা নামছে, সেই রামকৃষ্ণ-সারদা বসে আছেন মধ্যিখানে মা কালী, রাম-সীতা সিংহাসনে হনুমান বুক চিরে দেখাচ্ছে তার ভক্তি। এরই মাঝে অপ্রত্যাশিত একটা ছবি দেখে তার মজা লাগল:-ব্যাট হাতে সৌরভ গাঙ্গুলি! নিশ্চয় কেনার লোক আছে। ছেলের উৎসাহ বাড়াতে অনেক বাবা অথবা মা ক্রিকেটারকে দেয়ালে ঝোলাবে যদি ছেলে কোনোক্রমে সৌরভ হয়ে যেতে পারে!

পাশেই কবিরাজের দোকান, তারা বলত কোবরেজখানা। শতরঞ্জি ঢাকা তক্তাপোশে বিশালবপু কবিরাজ সত্যপ্রসন্ন গুপ্ত তাকিয়ায় হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে থাকতেন। পাশের কাচের আলমারিতে নানান শিশি, চিনেমাটির বোয়েম। একটা ছোটো টেবলে বসে থাকত কম্পাউন্ডার। ব্রতীন মাঝে মাঝে দেখেছে তক্তাপোশে বসে একটি বা দুটি লোক, বোধহয় রোগী। কম্পাউন্ডারের গলায় কণ্ঠি, সাদা হাফশার্ট পরা, খুব যত্ন করে ওষুধের মোড়ক বানিয়ে খামে ভরছে।

আজ সে দেখল কোবরেজখানার সেই চেহারাটা আর নেই। মাথার সাইনবোর্ডে লেখা-‘সত্যপ্রসন্ন হোমিও হল।’ তক্তাপোশটা নেই। একটা টেবলে তরুণবয়সি ডাক্তারবাবু বসে, রোগী নিয়ে খুবই ব্যস্ত। দুটো বেঞ্চে বসে জনাপাঁচেক পুরুষ ও বাচ্চচা-কোলে গৃহিণী। চেয়ারে একজন রোগী, যার নাড়ি ডাক্তারবাবু এখন দেখছেন হাতঘড়ির দিকে চোখ রেখে। ব্রতীনের মনে হল ডাক্তারের পসার জমে উঠেছে, রোগীরা টেনেটুনে সংসার চালায়, চেহারায় ও কাপড়চোপড়ে সেটাই প্রকট। কাঠের নতুন কাউন্টার, পিছনে সেই পুরোনো আলমারিটা তার মধ্যে ছোটো ছোটো শিশি সাজানো। কম্পাউন্ডারটি অল্পবয়সি, ওষুধের মোড়ক বানিয়ে খামে ভরতে ভরতে এক মহিলাকে বুঝিয়ে কিছু বলছে।

ব্রতীন প্রায় আধমিনিট দাঁড়িয়ে দেখল। বাইরের কাঠের ফলকটায় নতুন পালিশ আরশুলা রঙের । তাতে লেখা: ডাঃ অনুপম গুপ্ত। তারপর কতকগুলো ইংরিজি অক্ষর এবং প্রথম ব্র্যাকেটে ক্যাল। আবার তিনটে অক্ষর এবং ব্র্যাকেটে ইউ এস। বাইরে একটি লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অনুপম গুপ্ত একবার তাকাল। ব্রতীন ধরে নিল ডাক্তার কোবরেজ মশাইয়েরই ছেলে অথবা ভাইপো।

সে চেঁচিয়ে বলল, ‘কোবরেজমশাই বেঁচে আছেন?’

ডাক্তার চোখ মুদে মাথা কাত করল।

‘বয়স কত হল?’

ডাক্তার রোগীকে জিভ বার করতে বলল, জিভ বেরিয়ে এল। দেখতে দেখতে চেঁচিয়ে, ‘নব্বুই।’

এবার একটা রাস্তা, গুরুদাস স্ট্রিট, তারপরই স্কুলের পাঁচিল। মাইক্রোফোনে বক্তৃতা করছে কেউ: ‘এই ভগবতীচরণ বিদ্যালয় শুধু এই পল্লির নয়, শুধু এই কলকাতার নয়, শুধু এই পশ্চিমবঙ্গের নয়, সারা ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এক বিদ্যাশিক্ষা ভবন।’ ব্রতীন রাস্তা পার হবার জন্য পা বাড়াল, আর তখনই গাড়িটা ট্রাম রাস্তা থেকে বেশ জোরেই বাঁক নিয়ে ঢুকে ব্রতীনের একফুট দূরে ব্রেক কষে থামল।

চমকে উঠে সে একপা পিছিয়ে গাড়ির চালকের দিকে তাকাল। দেখল চালক কালোকাচের চশমা পরা, ঠোঁট ছড়িয়ে হাসছে। নিশ্চয় চেনা কেউ নয়তো এমন রসিকতা করতে পারত না। ভালো চালায়, গাড়ির ব্রেকটাও ভালো। চোখদুটো দেখা গেলে নিশ্চয় চিনতে পারত।

চালক চশমা খুলে নীচু হয়ে ঝুঁকে জানলার দিকে মুখ এগিয়ে এনে বলল, ‘কীরে শালা, চোখ বুজে হাঁটার ওভ্যেসটা এখনও গেল না।’

‘গুণো! তাই বল। নইলে এমন বদ রসিকতা আর কে করবে!’

‘দাঁড়া গাড়িটা রেখে আসছি, স্কুলে যাবি তো?’ উত্তরের অপেক্ষা না করে গুণেন্দ্রমোহন গাড়ি রাস্তার মধ্যে ঢুকিয়ে একটা চওড়া জায়গা পেয়ে দাঁড় করাল। গাড়ির চাবির রিং আঙুলে ঘোরাতে ঘোরাতে গুণেন্দ্র ফিরে এল।

‘কদ্দিন পরে দেখা হল বল তো।’

ব্রতীন বলল, ‘সিক্সটি সেভেনের পর, তিরিশ বছর হল। গাড়িটা তোর?’

‘তবে নাতো কার!’ গুণেন্দ্র বিস্মিত আহত চোখে তাকাল। ‘স্কুলে যাবি তো চল, বক্তৃতা তো শেষ হয়ে গেল বলে।’

ব্রতীন যে গুণোকে শেষবার দেখেছে সে ছিপছিপে, গাল চোপসানো, সরু সরু হাত। খয়েরি ইস্ত্রিবিহীন ট্রাউজার্স, ময়লা হলে বোঝা যেত দু-মাস পর, হাফহাতা ছাপছোপ মারা হাওয়াই শার্ট। গুণোর ওই চেহারাটাই তার চোখে রয়ে গেছে। কিন্তু এখানকার গুণো একদমই অন্যরকম। ওর মাথা থেকে পা পর্যন্ত যেসব জিনিস রয়েছে, সানগ্লাস, শার্ট, ট্রাউজার্স, ঘড়ি, জুতো, হালকা যে সৌগন্ধ জামা থেকে বেরোচ্ছে এ সবের মোট দাম অন্তত আট-ন হাজার টাকা তো হবেই।

‘বতু, তুই তো পুণে না বোম্বাই কোথায় যেন থাকিস, আজ যে এখানে হঠাৎ?’ গুণেন্দ্র ব্রতীনের কনুই ধরে এগোল স্কুলের গেটের দিকে। গেটের দু-ধারে দুটি ছেলের হাতে ট্রে তাতে গোলাপের কুঁড়ি। যে ঢুকছে তার হাতে একটা কুঁড়ি ধরিয়ে দিচ্ছে। ওরা দুজনও দুটি পেল। দু-ধারে চেয়ার পাতা মাঝে দু-মিটার চওড়া পথ সোজা গেছে মঞ্চ পর্যন্ত। মঞ্চের কাছাকাছি চেয়ারগুলো ভরতি, পিছন দিকের গুটিতিরিশ খালি।

‘কোথা থেকে ঠিকানা পেল জানি না, মুম্বইয়ে, নামটা এখন বোম্বাই নয় মনে রাখিস, অফিসের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিয়েছে একটা চিঠি, পেয়ে খুব ভালো লাগল, এতবছর পরও মনে করে রেখে দিয়েছে। তুই আজ এলি কেন?’

‘আমার ছেলে তো এখানেই পড়ে, সামনের বছর উচ্চচমাধ্যমিক দেবে। ওর হাত দিয়ে চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছিল। কত বছর দেখি না স্কুলের বন্ধুদের, ভাবলুম যাই যদি কারোর সঙ্গে দেখা হয়ে যায় চুটিয়ে আড্ডা দোব। গুরুর কি কৃপা দেখ প্রথমেই তোর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। হাতে সময় আছে তোর?’

‘এখনও ছ-দিন সময় আছে। সাত দিনের ছুটি নিয়ে এসেছি।’

ব্রতীন নিজেকে ফুরফুরে বোধ করল গুণোর সঙ্গে দেখা হয়ে। ওকে সে খুব পচ্ছন্দ করত খোলামেলা ব্যবহারের জন্য আর কথাবার্তায় কোনো রাখঢাক ছিল না বলে। মাঝে মাঝে বেপরোয়া কাণ্ড বাধিয়ে নিজেকে জাহির করার একটা উৎকট চেষ্টা ওর মধ্যে দেখা দিত।

ব্রতীন পরে বুঝেছিল কেন ওকে তার ভালো লাগে। যে কাজ করতে বা যে কথা বলতে তার নিজের শিক্ষায় রুচিতে বাধে বা সাহসে কুলোয় না সেটা ঘনিষ্ঠ কেউ অবলীলায় করে দিলে মনে হয় নিজেই করলুম। সে লক্ষ করেছে শচীন টেন্ডুলকর যখন ব্যাট করে তার সঙ্গে সে নিজেও ব্যাট করে, শচীন যখন সেঞ্চুরিতে পৌঁছয় তখন সেও সেঞ্চুরির অংশীদার হয়ে টগবগ করে ওঠে। গুণোর বহু অসংযত অশ্লীল কাজে সে আপত্তি জানিয়েও বাধা দেয়নি বরং উপভোগ করেছে।

‘বতু দেখ তো ওই সেকেন্ড রো লেফট কর্নারে গেরুয়া পাঞ্জাবি পরাটাকে। চেনা চেনা ঠেকছে যেন।’ গুণেন্দ্রর দৃষ্টি অনুসরণ করে ব্রতীন চোখ সরু করে তাকাল।

‘আরে ও তো বলদেব, বলা। ওকে ভোলা যায়! পরীক্ষায় টুকলিতে মাস্টার ছিল।’ ব্রতীন উৎসাহিত গলায় বলে উঠল। ‘যাক আর একটাকে পেলুম। খুঁজে দেখ তো আর কাকে পাওয়া যায়।’

গুণেন্দ্র চোখ বোলাতে লাগল মাথাগুলোয়। ব্রতীন কয়েকপা এগিয়ে গেল। তখনই সেলুলার ফোন বেজে ওঠার শব্দ শুনে ফিরে তাকিয়ে দেখল গুণেন্দ্র পকেট থেকে ফোন বার করে কানে ধরেছে।

‘হ্যাঁ বল।’ কিছুক্ষণ অপর দিকের কথা শুনে গুণেন্দ্রর মুখ বিরক্তি আর চিন্তায় কুঁচকে উঠল। ‘তোরা কী নাকে সর্ষের তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছিলি হতভাগা? সারাতে কতক্ষণ লাগবে বলেছে?’ উত্তেজনায় গলা চড়ে গেছে বুঝতে পেরে গুণেন্দ্র স্বর সংবরণ করে বলল, ‘ঠিক আছে তুই এক্ষুনি চেতনের সঙ্গে কথা বল, ওর তো দুটো বাস, একটা হয়তো পাওয়া যেতে পারে। পেলে এক্ষুনি নিয়ে নে, যত টাকা চায় রাজি হয়ে যাবি। ট্যুরিস্টরা হোটেলে ওয়েট করছে মনে থাকে যেন। গুণেন ব্যানার্জির কথার খেলাপ আজ পর্যন্ত হয়নি, শিগ্গির যা চেতনের কাছে। কোনো কথা শুনতে চাই না।’ ফোন বন্ধ করে সে পকেটে রেখে বিড়বিড় করল, ‘দু-হাজার মাইনে নিচ্ছে আর বুদ্ধি করে একটা ব্যবস্থা করে নিতে পারে না।’

‘কী ব্যাপার রে গুণো অত চটে গেলি কেন?’ ব্রতীন এগিয়ে এল।

‘চটব না? ফরেন ট্যুরিস্ট, যাবে বহরমপুর, আমার ওপর দায়িত্ব ঘুরিয়ে আনার, আমার বাসটা গ্যারেজে দিয়েছিলুম দু-দিন আগে, পেছনের বাঁদিকের সাসপেনসারটা একদম বসে গেছে, যাবে নাই বা কেন, আমাদের যা রাস্তা। দুটো ঝাঁকুনি খেলেই বাবারে মারে করে ফরেনাররা। গ্যারেজ বলছে একটার আগে দিতে পারবে না। এখন অন্য ট্রান্সপোর্টারের কাছ থেকে ভাড়া নিয়ে মুখরক্ষা করতে হবে।’

ব্রতীন বুঝে গেল গুণ্যের কাজটা কী। ট্যুরিস্টদের ঘোরার জন্য গাড়ি দেওয়া। কলকাতায় এখন প্রচুর বিদেশি বেড়াতে আসছে। ব্যবসাটা ভালো করে চালাতে পারলে মাসে দেড়-দু লাখ টাকা আয় হয়। মুম্বইয়ে তার অফিসের প্রোডাকশন বিভাগের সুপারভাইজার চিটনিসের শালা ট্যুর অপারেশনের ব্যবসা করে। তার কাছেই সে শুনেছে শ্যালকটি দিনরাত পরিশ্রম করে চার বছরেই এক লাখ টাকার ব্যবসাটা নিয়ে গেছে বছরে পঁচিশ লাখ টাকায়। চিটনিস বলেছিল, ‘চৌধুরীবাবু এত লেখাপড়া শিখে বছরে আড়াই লাখ টাকার চাকরি করে কী লাভ, তার থেকে এইরকম ব্যবসায় নেমে পড়ুন। আমার শালা অর্ডিনারি গ্র্যাজুয়েট দেখুন আপনার দশগুণ আয় করছে। দুনিয়ায় সবকিছুর শেষ কথা তো টাকা। টাকা থাকলে মানমর্যাদা সুখশান্তি সব পাবেন।’

শুনে হেসে ফেলে সে বলেছিল, ‘তা বটে। তবে সবাই যদি ট্যুর অপারেটরের কাজে নেমে পড়ে তাহলে ওষুধ তৈরির কাজটা করবে কে?’

সেলুলার ফোন পকেটে রেখে গুণেন্দ্র বক্তৃতা মঞ্চের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘হ্যাঁরে বতু কার্ডে গোটা পাঁচেক নাম দেখেছিলুম। ডায়াসে তো চারটে লোক একটা চেয়ার খালি পড়ে রয়েছে, ওটা কার জন্য? দাঁড়া ওই ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করি।’

গুণেন্দ্র কথা বলার জন্য একটি ছেলের দিকে এগিয়ে গেল। ব্রতীন দেখল বলদেব উঠল। সেই একইরকম বেঁটেই রয়ে গেছে। চেয়ারের দুটো সারির মধ্যে দিয়ে হাঁটুতে ধাক্কা দিতে দিতে বেরোচ্ছে। একবার থেমে সামনের চেয়ারে বসা একজনের কানের কাছে মুখ নিয়ে কী বলল। লোকটি মুখ ফিরিয়ে তাকিয়ে বলদেবকে জবাব দিল। ব্রতীনের মনে হল ওই লোকটা তপেন দত্ত। এই তো আরেকজনকে পাওয়া গেল। বলদেব বাৎসরিক স্টাফ ভার্সাস স্টুডেন্ট ক্রিকেট ম্যাচে স্কোরার হয়ে হেডমাস্টার মশায়ের তেরোটা রান বাড়িয়ে দিয়েছিল। আসলে উনি করেছিলেন দু রান। হেডমাস্টারমশাই এটা ধরে ফেলেন, পরে বলদেবকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘একাজ তুমি করতে গেলে কেন?’ সপ্রতিভভাবে সে উত্তর দিয়েছিল, ‘রানটা ডাবল ফিগারের না হলে হেডমাস্টারের সম্মান থাকে না।’ তিনি হাসবেন না ধমকাবেন ঠিক করতে না পেরে বলেছিলেন, ‘আর কোনোদিন স্কোর লিখবে না।’ বলদেবকে আর স্কোর লিখতে হয়নি। পরের বছরই সে কলেজে ভরতি হয়।

গুণেন্দ্র ফিরে এসে বলল, ‘যে লোকটা ভ্যাজ ভ্যাজ করছে ও হল স্কুল কমিটির প্রেসিডেন্ট, ওর ডানপাশে এখনকার হেডমাস্টার, বাঁপাশে আমাদের এমপি, তার পাশে কাঁধে চাদর স্কুলের ওল্ডেস্ট জীবিত ছাত্র অরবিন্দ দত্ত, বয়স নব্বুই, স্বদেশি করে মোট এগারো বছর জেল খেটেছে। তার পাশে খালি চেয়ারটা ওল্ডেস্ট জীবিত টিচার মনমোহন ভটচাযের জন্য, কাল ওকে আর জি কর হাসপাতালে ভরতি করা হয়েছে, বয়স পঁচাশি। বতু তুই তো ওই চেয়ারটায় বসতে পারিস।’ গুণেন্দ্রর চোখেমুখে মোটেই হালকামি নেই, গলার স্বরও যথেষ্ট গাঢ়।

ব্রতীন অবাক হয়ে গেল গুণেন্দ্রর এই আচমকা প্রস্তাবে। বলল, ‘আমি! আমি কেন?’

‘একশো বছরের বেস্ট স্টুডেন্ট বলে। তুই তো মাধ্যমিকে থার্টিন্থ হয়েছিলি, দেখ এখনও কেমন মনে করে রেখেছি। এই স্কুল থেকে এখনও কেউ কুড়ি-পঁচিশেও আসেনি। তোর তো হক আছে ওই চেয়ারটায় বসার।’

ব্রতীন হাত থেকে ধুলো ঝাড়ার মতো ভঙ্গিতে বলল, ‘তুই সেই আগেকার মতোই ছিটেল আছিস। মনে করে কার্ড পাঠিয়েছিল সেটাই যথেষ্ট, চেয়ার-ফেয়ার মাথায় থাক। ওই দেখ বলা আসছে। তপেনকে দেখলুম বলার সঙ্গে কথা বলল।’

লম্বায় পাঁচ ফুটের এক ইঞ্চি কম, ঘাড়ে গর্দানে হৃষ্টপুষ্ট, বলদেব ব্যস্তভাবে দ্রুতপায়ে গেটের দিকে যাচ্ছে। গুণেন্দ্র হাঁক দিল, ‘এই বলা।’

বলদেব থমকে দাঁড়াল।

গুণেন্দ্রকে দেখতে না পাওয়ার ভান করে ব্রতীনের দিকে তাকিয়ে কপালে আঙুল ঠেকিয়ে বলল, ‘বতু না? এখানে দাঁড়িয়ে কেন? সামনে গিয়ে বোস।’

‘বসছি, তুই হনহনিয়ে চললি কোথায়?’ ব্রতীন হাত রাখল বলদেবের কাঁধে, ‘কত বছর পর দেখা। তোদের দেখতে পাব এই আশা নিয়েই তো আজ এখানে এলুম।’

বলদেবের চোখ নরম হয়ে গেল স্মৃতিভারে। বলল, ‘একবার কী দু-বার দেখেছি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিস, তখন তুই কলেজে পড়িস। তারপর আর দেখা হয়নি। চেহারাটা তো দেখছি একই রকম রেখেছিস। আমিও আজ এসেছি কারুর না কারুর সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে ভেবে। একঘণ্টা বসে থেকে থেকে এই উঠলুম অফিস যেতে হবে। দুটো থেকে ডিউটি।’

‘দুটো থেকে ডিউটি? কারখানা নাকি!’ ব্রতীন ঠাট্টার সুরে বলল। ‘কারখানাই বটে, খবরের কারখানা, রোজ হাজার কয়েক শব্দ উৎপাদন করতে হয়। আমি চিফ সাব-এডিটর। বতু তোর দেখছি ভুঁড়ি হয়নি।’

ব্রতীনের বেশ আশ্চর্য লাগে কথাটা শুনে। কাকার মেয়ে দেবী গতকাল বলল, ‘বড়দা তোমার তো ভুঁড়ি হওয়ার কথা, হয়নি কেন বলো তো?’ ‘হয়নি কেন মানে?’ সে প্রশ্ন করেছিল কৌতূহলী হয়ে।

দেবী খুবই পরিশ্রমী ন্যাকামিবর্জিত স্বচ্ছ দৃষ্টির মেয়ে। বয়স তিরিশের কাছাকাছি। যথেষ্ট রকমের ভালো দেহগড়ন ও মুখশ্রী। চার বছর আগে ডিভোর্স করেছে আমেরিকাবাসী স্বামীকে, রায়চৌধুরি বংশে এমন কাজ প্রথম। দেবী হঠাৎ তার ভুঁড়ি না থাকার কারণ জানতে চাইবে এটা তার কাছে অদ্ভুত লেগেছিল।

‘আমাদের বংশের তো সবার, জ্যাঠামশাইয়ের ছিল বাবার তো আছেই, ছোড়দার নেয়াপাতি ধরনের গজিয়েছে, শিগ্গিরিই কুমড়োর শ্যেপ নেবে। এক তুমিই ট্র্যাডিশনের বাইরে রয়ে গেলে।’

‘ট্র্যাডিশনের বাইরে কী শুধু একা আমিই?’ ব্রতীন চোখ পিটপিট করে খুড়তুতো বোনের দিকে তাকিয়ে থেকেছিল। দেবী হেসে চোখ সরিয়ে নেয়।

মুখ নিরীহ, স্বর নরম করে গুণেন্দ্র বলল, ‘আচ্ছা বলা, দেখে আনন্দ পাবার মতো জিনিস পৃথিবীতে তো প্রচুর আছে, এই যেমন রবিঠাকুরের দাড়ি আছে, আশু মুখুজ্জের গোঁফ আছে, বিবেকানন্দের পাগড়ি আছে, এগুলো দেখ না। বতুর ভুঁড়ি দেখার জন্য তুই ব্যস্ত হচ্ছিস কেন?’

‘মোটেই ব্যস্ত হইনি বরং খুশিই হয়েছি। বন্ধুদের একজন এখনও ইয়াং রয়ে গেছে সেটা বললেই কী দোষের হয়ে যায়? গুণো, কাঠি দেওয়ার অভ্যেসটা তোর আজও গেল না।’ বলদেব উত্তেজিত হয়ে কড়া চোখে গুণেন্দ্রর দিকে তাকাল।

ব্রতীন বিব্রত বোধ করল। তার মনে হল বলদেবের এভাবে রেগে ওঠার মতো কথা গুণেন্দ্র বলেনি বরং রসিকতার চেষ্টাই করেছে তবু যখন রেগে উঠল বুঝতে হবে কোথাও কিছু একটা গোলমাল দুজনের মধ্যে ঘটে আছে এবং সেটা স্কুলে পড়ার সময় ঘটেনি, তাহলে ব্রতীন জানতে পারত। ওরা দুজন পাশাপাশি পাড়ায় থাকত আজও বোধহয় আছে।

‘বলা, তুই এখনও সেই বাড়িতেই আছিস?’ ব্রতীন জিজ্ঞাসা করল।

‘আছি। ওটা আমাদের পৈতৃক বাড়ি, একতলাটা আমি পেয়েছি। আয় না একদিন সকালের দিকে।’ বলদেব মানিব্যাগ থেকে একটা কার্ড বার করে ব্রতীনকে দিল। ‘ফোন নম্বর লেখা আছে। আসার আগে যদি একটা ফোন করিস তাহলে ভালো হয়।’

বলদেব স্কুলগেট দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে দেখে নিয়ে ব্রতীন বলল, ‘হঠাৎ কীরকম চটে উঠল তোর ওপর।’

গুণেন্দ্র শুকনো স্বরে বলল, ‘কারণ, একটা কী দুটো নিশ্চয় আছে।’

ব্রতীন কারণ জানার জন্য আগ্রহ দেখাল না। সেই সময় মাইকে ঘোষণা হল : ‘এবার দু-চার কথা বলবেন অরবিন্দ দত্ত। বিদ্যালয়ের যেসব ছাত্র আজও আমাদের মধ্যে আছেন ইনি তাঁদের মধ্যে সর্বজ্যেষ্ঠ। অরবিন্দবাবুর বয়স এখন নব্বুই।’

অরবিন্দ দত্ত চেয়ারে বসে রইলেন। মাইকটা তাঁর সামনে আনা হল। তিনি কোনো ভণিতা না করে সোজা শুরু করলেন ঘর্ঘরে শ্লেষ্মা জড়ানো স্বরে, ‘আজকালকার ছেলেপুলেরা শিক্ষক গুরুজনদের একদমই মান্য করে না, শ্রদ্ধা করে না। ইংরিজিতে একটা দরখাস্তও লিখতে পারে না। কালীকিঙ্করবাবু আমাদের পেটারসন সাহেবের গ্রামার পুরো মুখস্থ করিয়েছিলেন। সে গ্রামার বই এখন আর পড়ানো হয় না। পড়াবে কে? মাস্টাররা নিজেরাই তো গ্রামার জানে না।’

অরবিন্দ দত্ত দম নেবার জন্য থামলেন। শ্রোতাদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হল। গুঞ্জন অনুমোদনসূচক বলেই ব্রতীনের মনে হল। অরবিন্দ দত্ত পঁচাত্তর বছর আগে স্কুলে পড়েছেন হয়তো তখন পেটারসন নামের কোনো সাহেবের বই পড়ানো হত। ব্রতীন নামটা এই প্রথম শুনল তবে বাড়িতে সে নেসফিল্ড সাহেবের লেখা পেনসিলের দাগমারা মলাট ছেঁড়া একটা গ্রামার বই দেখেছে। বইটা তার বাবার।

‘আমাদের সময়ে স্কুলে বেত মারা হত একটু বেচাল দেখলেই। অমৃত পণ্ডিতমশায়ের ছিল মস্ত টিকি, সেটা আবার পাকিয়ে গিঁট দেওয়া। তখন আমি সেকেন্ড ক্লাসে পড়ি। প্রভাসরঞ্জন নামে একটি ছেলে হঠাৎ ক্লাসে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা পণ্ডিতমশাই, আকাশের বিদ্যুৎ নাকি টিকি টেনে নেয় আর সেজন্যই টিকিওলাদের ব্রেন খুব টনকো হয়, সত্যি? ওর কথা শুনে ক্লাসের ছেলেরা হেসে ওঠে। পণ্ডিতমশাই জিজ্ঞাসা করলেন, কার কাছ থেকে তুই এসব কথা শুনেছিস? প্রভাস তখন নাম করল সরোজের। পণ্ডিতমশাই সরোজকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন হেডমাস্টারমশাইয়ের কাছে। তিনি শুনলেন সরোজের বক্তব্য। সে বলল বাড়িতে বড়দার কাছে শুনেছে, তখন তিনি তাকে সাজানো তিনটে বেতের থেকে মোটা বেতটা নামিয়ে সরোজের দু-হাতের চেটোয় বারো ঘা মেরে বললেন, দাদাকে আমার সঙ্গে দেখা করতে বলবি। দাদা অবশ্য আসেনি, বেত খাওয়ার ভয়ে, সরোজ সাতদিন আঙুল দিয়ে পেনসিল ধরতে পারেনি। এই ছিল আমাদের সময়ের শাসন, এইরকম ছিল তখনকার হেডমাস্টার। আর এখন?’ অরবিন্দ দত্ত নাটকীয় চমক দিতে দশ সেকেন্ড নীরব রইলেন।

ব্রতীনের মনে হল, বুড়োর ব্রেন এখনও তো বেশ টনকোই রয়েছে। বাইরে থেকে জবুথবু মনে হয় বটে কিন্তু এতক্ষণ যেসব বক্তৃতা হল তাতে শুধুই স্তুতি আর বন্দনা, শুনতে শুনতে শ্রোতারা ফিসফাস কথা বলা শুরু করেছিল, বুড়ো বিদ্যুতের শক দিয়ে ঝাঁকিয়ে দিল একঘেয়েমিটাকে।

‘এখন তো শুনি ফিফথ ক্লাসের ছেলেরাও মাস্টারদের সঙ্গে মুখে মুখে তক্কো করে, রাস্তায় মাস্টারদের ধরে পেটায়ও। এসব যদি বন্ধ করতে চান তাহলে এই ভগবতী স্কুলের আমার সময়ের হেডমাস্টারের মতো তিরিশ টাকা মাইনের হেডমাস্টার চাই, আর চাই বেত। নমস্কার।’

দুম করে অরবিন্দ দত্ত বক্তৃতা শেষ করে মুখ ফিরিয়ে পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা এক তরুণ শিক্ষককে যা বললেন মাইকবাহিত হয়ে শ্রোতারা তা শুনতে পেলেন, ‘গাড়িতে বাড়ি পৌঁছে দেবে বলেছ, ঠিক দেবে তো বাবা?’

ব্রতীন লক্ষ করল মঞ্চে বসা লোকগুলির মুখ আরও গম্ভীর হয়ে গেল যখন হাততালি একটু বেশিক্ষণ ধরে চলল। গুণেন্দ্র উত্তেজিত স্বরে বলল, ‘হ্যান্ড্রেড পারসেন্ট কারেক্ট বলেছে, চাবকানো স্রেফ চাবকানো দরকার।’

ব্রতীন বলল, ‘চাবুক নয় রে বেতের কথা বললেন। দুটোর মধ্যে প্রচুর তফাত, বেতটা অল্পবয়সিদের জন্য চাবুকটা গুরুজনদের জন্য। তিরিশ টাকা মাইনের হেডমাস্টারের সময় টাকায় ক-মণ চাল পাওয়া যেত বল তো?’

‘কী জানি। বাবার কাছে শুনেছি যুদ্ধের শুরুর সময় খাদি প্রতিষ্ঠান থেকে চাল কিনেছে আড়াই টাকা মণ এখন সেই চাল এগারো টাকা কেজি। ষাট বছরে কী পরিবর্তন হয়ে গেছে বল? পঁচাত্তর বছর আগের মতো মাস্টার আর ছাত্তর এখন আশা করা যায় কী? ভাইকে কুশিক্ষা দিচ্ছে তাই সরোজের দাদাকে আসতে বলেছিল বেতাবে বলে, ভাবতে পারিস!’ গুণেন্দ্র মাথা নাড়ল আক্ষেপে অথবা আগের হেডমাস্টারদের বিলুপ্তি ঘটার জন্য কিনা ব্রতীন বুঝতে পারল না। গুণেন্দ্র আবার বলল, ‘পরিবর্তন যে কতটা ঘটেছে তার খানিকটা তো আমি বুঝতে পারি নিজেকে দিয়ে।’

সবাইকে চকিত করে মাইকে শোনা গেল, ‘একটি জরুরি ঘোষণা, এইমাত্র আমাদের কাছে খবর এল মনমোহন ভট্টাচার্য, যাঁকে আজ মঞ্চে আপনাদের সামনে উপস্থিত করাব বলে আমরা ভেবেছিলাম তিনি আজ সকালে আর জি কর হাসপাতালে মারা গেছেন। বয়স হয়েছিল পঁচাশি। আমরা এবার তাঁর পরলোকগত আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এক মিনিট নীরবতা পালন করব। ধন্যবাদ।’

ব্রতীন আর গুণেন্দ্র দাঁড়িয়েই ছিল, মাথাটা শুধু নীচু করল। একটু আগের শব্দমুখর জায়গাটা নিস্তব্ধ। ব্রতীনের চোখ কবজির ঘড়িতে সেকেন্ডের কাঁটায়। টিক টিক করে সরে যাচ্ছে এক একটা বছর। মনমোহন, ওকে দেখেছি কি? কুড়ি বছর আগে রিটায়ার করেছেন, নিশ্চয় দেখেছি। কিন্তু চেহারাটা মনে পড়ছে, ধুতি, খদ্দরের সাদা পাঞ্জাবি গলা পর্যন্ত বোতাম আঁটা। ছিপছিপে কাঁচাপাকা চুল, বুকপকেটে কলম। ব্রতীন নিজের স্মৃতি ক্ষমতাটিকে অটুট অবস্থায় উদ্ধারে ক্ষীণভাবে আত্মপ্রসাদ বোধ করল।

একমিনিট শেষ হতেই গুণেন্দ্র বলল, ‘কর্তব্য পালিত হল, মনমোহন ভটচায মুছে গেল স্কুলের স্মৃতি থেকে। এবার কী করবি?’

‘বাড়ি চলে যাব, খাব-দাব বই নিয়ে শোব।’

অবাক গুণেন্দ্র বলল, ‘বই নিয়ে! কেন বউ নেই?’

‘বিয়ে করিনি।’

গুণেন্দ্রকে এখন বজ্রাহত বলা যায়। বিয়ে ব্যাপারটাকে সে অতি তুচ্ছ এবং বহুবিধ ঝামেলা এড়াবার জন্য পালনীয় কাজ হিসাবে মনে করে। বতু তো ভালোই মাইনে পায় তাহলে একটা বিয়ে করে রাখলে ক্ষতি কী হত? খাওয়া-দাওয়ার মতো দুটো বড়ো সমস্যা যখন ওর নেই তাহলে-‘বতু খুব বেঁচে গেছিস। বিয়ে একবার করে ফেললে মেয়েমানুষ করতে ঝামেলা অনেক বেড়ে যায়। আইবুড়ো থাকলে গায়ে ফুঁ দিয়ে চলা যায়।’

‘তাহলে আইবুড়ো থাকিসনি কেন?’

গুণেন্দ্র উত্তর দিতে গিয়ে ব্রতীনের কানের পাশ দিয়ে দেখল তপেন দত্ত আসছে। ‘আরে এই যে তপা, আয় আয়, অনেক দিন পর, খবর কী তোর? এই দেখ বতুকে পেয়ে গেলুম আর তোকেও।’

তপেনেরও ধুতি পাঞ্জাবি, কাঁধে কাপড়ের একটা ঝোলা। ব্রতীনের থেকেও মাথার সামনের চুল বেশি ওঠা। রং ফরসা, মুখশ্রী ভালো, শরীর দোহারা। তপেন জড়িয়ে ধরল ব্রতীনের হাত।

‘সত্যি অনেকদিন পর। আমি জানতুম এখানে এলে কারোর না কারোর সঙ্গে দেখা হয়ে যাবেই। গুণোর সঙ্গে তো মাঝেমধ্যে দেখা হয়ই, ওর ছেলে আমার কোচিংয়ে পড়ে।’

‘তোর কোচিং আছে!’ ব্রতীনের কথার সুরে ‘আর একটা বিয়ে করেছিস?’ বা ‘আর একটা ফ্ল্যাট কিনেছিস!’ ধরনের বিস্ময়। তপেন একগাল হাসল জবাব না দিয়ে।

‘কোচিং আছে মানে?’ গুণেন্দ্র বলল চোখ দুটো বড়ো করার জন্য ভ্রূ টেনে তুলে। ‘দু দুটো। একটা ওর আর একটা ওর বউয়ের। আর একটা খুলবে বছর সাতেক পরে মেয়ে বি এ পাস করলেই।’

ব্রতীন বুঝে গেল তপেন গাধা পিটিয়ে টাকা রোজগারের কাজে নেমে গেছে। এম এসসি পড়ার সময় সে একটি ছেলেকে হায়ার সেকেন্ডারির বিজ্ঞানে নম্বর তোলাবার দায়িত্ব নিয়েছিল। ছেলেটির বাবা মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে ম্যানেজিং ডিরেক্টর, মা সমাজসেবা করেন, গ্রামের গরিব মহিলাদের দিয়ে লঙ্কা জিরে হলুদ ইত্যাদি গুঁড়ো করে প্যাকেটে ভরে নানান দোকানে বিক্রির ব্যবস্থা করা এক সমাজসেবী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থেকে। দুজনেই ভীষণ ব্যস্ত তাই ছেলেকে চারজন প্রাইভেট টিউটারের হাতে ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত। ব্রতীন সপ্তাহে দু-দিন পড়িয়ে মাসে চারশো টাকা পেত, চব্বিশ বছর আগে। ছেলেটি খাটিয়ে ছিল, উচ্চচমাধ্যমিকে চতুর্থ হয়। কী এক ফাউন্ডেশনের বৃত্তি পেয়ে ছেলেটি আমেরিকার কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করতে গেছে, ব্রতীন ওইটুকু খবর জানত, ছেলেটির নাম এখনও মনে আছে, অমলেন্দু লাহা।

‘বতু, তোর তো এখন হাতে কাজকম্মো নেই, আয় কাল ডাকাতি করি তপার বাড়িতে। দুপুরবেলা, কলিং বেল বাজাব, যে দরজা খুলবে ঠেলে ঢুকে যাব। তোকে একটা টয় পিস্তল দোব তুই সেটা ধরে গলায় কী পেটে ঠেকাবি। আমি সোজা শোবার ঘরে গিয়ে তোশকটা ওলটাব, তারপর কী দেখব জানিস?’ গুণেন্দ্র থেমে তপেনের মুখের দিকে তাকাল।

তপেন হেসে বলল, ‘কাগজের প্যাকেটে মোড়া থরে থরে হাজার টাকার নোট।’

গুণেন্দ্র সামান্য মিইয়ে গেল, ভেবেছিল কথাগুলো সে-ই বলবে তার আগেই তপেন বলে দিল।

ব্রতীন মজাটা উপভোগ করে বলল, ‘তুই এখন করছিস কী? দেখে তো মাস্টার মাস্টার লাগছে।’

তপেন বলল, ‘মাস্টার তবে কলেজের। হাওয়ায় মাধবতলা বলে একটা জায়গা আছে, বোধহয় নামটা এই প্রথম শুনলি সেখানে পল সায়ান্স পড়াই।’

গুণেন্দ্র বলল, ‘হ্যাঁরে তপা কলেজে পড়াতে যাস-টাস? এই কবে যেন কাগজে পড়লুম কলেজের মাস্টাররা হপ্তায় তিন-চারদিন তিন-চার ঘণ্টার জন্য কলেজে আসে, বছরে মোট চার-পাঁচ মাস পড়ায়, সত্যি, বুঝলি বতু এই এক সুখের চাকরি বছরে ষাট-সত্তর হাজার টাকা মাইনে আর বাড়িতে শিক্ষার দানছত্তর খুলে বিদ্যে বিলিয়ে রোজগার।’

কথাবার্তা বাঁকা পথে চলে যাচ্ছে দেখে ব্রতীন বলল, ‘তপা তোর ছেলেপুলে ক-টি? বউয়ের সঙ্গে আলাপ করব, কবে তোর বাড়ি যাব বল, ছ-দিন কলকাতায় আছি।’

‘আমার একটিই মেয়ে। রবিবার আয়, দুপুরে খাবি।’

‘আমাকে খেতে বললি না তো?’ গুণেন্দ্র কিছুটা আবদার কিছুটা অভিমান মিশিয়ে অভিযোগের সুরে বলল।

তপেন তাড়াতাড়ি বলল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ তুইও আয়।’

ব্রতীন হাত তুলে বলল, ‘দাঁড়া সল্টলেকে আমার খুড়তুতো ভাইয়ের বাড়িতে যাওয়ার কথা আছে, অন্য আর একদিন ব্যবস্থা কর।’

তপেন চিন্তিত মুখে বলল, ‘মুশকিলে ফেললি। আমার কলেজ, ইলার স্কুল, ওকে বরং একদিন কামাই করতে পারবে কি না জিজ্ঞেস করে নিয়ে তোকে জানাব। দুজনে চাকরি করলে এই হয় মুশকিল, ছুটির দিন ছাড়া কাউকে নেমন্তন্ন করা যায় না, কোথাও যাওয়াও যায় না।’

‘তপা তুই এখন যাবি কোথায়?’ ব্রতীন জানতে চাইল।

‘হাওড়া স্টেশনে। ওখান থেকে মাধবতলার বাস ধরব। তোরা এখন কী করবি?’

ব্রতীন কিছু বলার আগেই গুণেন্দ্র বলল, ‘আমরা এখন খেতে যাব চিনেপাড়ায়। বতুকে বাড়িতে নেমন্তন্ন করে খাওয়াবার আর চান্স পাব কি না জানি না, হাতে যখন সময় আছে তখন ওকে আজ আর ছাড়ছি না, বাইরেই খাওয়াব।’

তপেন বলল, ‘গুণোর এই একটা সুবিধে, কখনো অন্যের চাকরি করেনি তাই দায়দায়িত্ব পালন কী জিনিস সেটা আর জানল না।’ হাত তুলে ঘড়ি দেখে সে ‘উহহহ দেরি হয়ে গেল’ বলেই বাসস্টপের দিকে ছুট দিল। শতবর্ষপূর্তি সভা শেষ হয়েছে। লোকেরা বেরিয়ে যাচ্ছে। গুণেন্দ্র বলল, ‘মাস্টারমশাইদের সঙ্গে দেখা করে যাবি?’

ব্রতীন বিব্রত মুখে বলল, ‘কাউকেই তো চিনি না। কাঞ্জি স্যারকে দেখতে পেলে দেখা করতাম।’

‘উনি তো এখানে দু-বছর পড়িয়েই আই এ এস হয়ে চলে গেছেন, তুই জানিস না?’

ব্রতীন অবাক হয়ে বলল, ‘সে কী, টিচিং লাইনটা ছেড়ে দিলেন! অত ভালো টিচার তো দেখাই যায় না। জানি না কত ভালো অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হয়েছেন তবে নিঃসন্দেহে ক্ষতি হয়েছে শিক্ষাজগতের। এইসব ব্রিলিয়ান্ট লোকেদেরই তো টিচার হওয়া দরকার।’

গেট থেকে বেরিয়ে গাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে গুণেন্দ্র বলল, ‘এখন তো ভদ্রগোছের মাইনে পাচ্ছে। তখন সামান্য মাইনে, সমাজেও সম্মান নেই, কেন মাস্টারি করবে ভালো ছেলেরা? তপাকে তো দেখলি নিজের মাইনে আর বউয়ের মাইনে মিলিয়ে এখন মাসে হাজার দশেক আয় হয় তার সঙ্গে যোগ কর সকাল সন্ধে কোচিং চালিয়ে দুজনে আরও কুড়ি হাজার। আমার ছেলে হপ্তায় তিনদিন পড়ে চারশো টাকা নেয়। এরকম গোটা কুড়ি ছেলে শুধু সকালের শিফটেই পড়ে, সন্ধেয় আছে আর দুটো শিফট।’

গুণেন্দ্র চাবি দিয়ে সামনের দরজা খুলে গাড়িতে উঠল, ভিতর থেকে লক করা অন্য দরজাটা খুলে দিয়ে ব্রতীনকে ডাকল, ‘আয়’। ব্রতীন উঠে তার পাশে বসল।

‘বতু তোকে সঙ্গে নিয়ে খেতে যাব এ চিন্তা কিন্তু আমার মাথায় ছিল না। তপা যখন বলল বউ ছুটি নিতে পারবে কি না জেনে তোকে খেতে বলবে তখনই মাথায় স্ট্রাইক করল, আজ দুজনে একসঙ্গে খাব।’ গুণেন্দ্র মুখ ঘুরিয়ে পিছনের কাচ দিয়ে রাস্তা দেখতে দেখতে গাড়ি পিছনে হটিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় কথাগুলো বলল থেমে থেমে। ট্রামরাস্তায় গাড়ি বার করে এনে দক্ষিণমুখো চালাল।

‘কোথায় যাব বল। ট্যাংরা না পার্ক স্ট্রিট?’

ব্রতীনের কাছে দুটোই সমান। খাবার তো একই, পরিবেশটা শুধু আলাদা।

‘খাঁটি চিনে খাবার কোথায় পাওয়া যাবে বল তো?’ ব্রতীন জানতে চাইল।

‘কোথাও পাবি না। সর্বত্র ইন্ডিয়ান জিভের ভালো লাগার মতো করে চিনে খাবার তৈরি হয়, খাঁটি চিনে স্বাদ মুখে দিতে পারবি না। অনেকে নিজেদের ভোজনরসিক প্রমাণ করতে দারুণ বলে বটে, মনে হয় না তারা কোনোদিন ভালো রান্না মুখে দিয়েছে। শুনেছি পার্ক স্ট্রিটের পিপিং একসময় খুব নামকরা রেস্টুরেন্ট ছিল। বতু ট্যাংরাতেই চল। ইস্টার্ন বাইপাস দিয়ে গেছিস কখনো?’

‘বছর চারেক আগে নেমন্তন্ন খেয়ে বাইপাস দিয়ে রাত্তিরে ফিরেছিলুম বালিগঞ্জ থেকে, ওই একবারই।’

‘তাহলে চল বাইপাস দিয়ে ট্যাংরায় যাই।’ গুণেন্দ্র বাঁদিকে গাড়ি ঘোরাল বিবেকানন্দ রোড ধরে মানিকতলার দিকে। এরপর দশ মিনিট গুণেন্দ্র কথা বলার অবকাশ খুব কমই পেল, ক্লাচ-ব্রেক- গিয়ার-মোটরচালনার এই ত্রিবিধ পদ্ধতির প্রয়োগ দ্বারা দুর্ঘটনা এড়াবার কাজে ব্যস্ত থাকায়। মানিকতলার মোড় থেকে পূর্বদিকে সোজা কাঁকুরগাছি যাওয়ার পথে মাঝে একটা খাল।

সেতুর উপর দিয়ে গাড়ি যাওয়ার সময় ব্রতীন বলল, ‘গুণো এখনও তোরা যে বেঁচে আছিস এটাই পৃথিবীর নবম বিস্ময়। খালের অবস্থা দেখেছিস, দু-ধার থেকে ঝুপড়ি নেমে এসে খালটা বুজিয়ে দিয়েছে, এটা তো মশাদের স্বর্গ। পুত্রকন্যা উৎপাদনের জন্য এমন সুন্দর ব্যবস্থা মশারা আর কোথায় পাবে। হ্যাঁরে গুণো, শুনেছি সল্ট লেকে নাকি উচ্চচশিক্ষিত লোকেরা থাকে!’

‘বতু, মাঝে মাঝে দিল্লি, বোম্বে থেকে এসে লেকচার ঝেড়ে ব্যঙ্গ করে যায় অনেকেই, তারা কিন্তু কলকাতায় থাকে না, কলকাতা নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথাও নেই।’

ব্রতীন আড়চোখে গুণেন্দ্রর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কথাগুলো কী আমাকে উদ্দেশ করে?’

জবাব না দিয়ে গুণেন্দ্র গাড়ি থামাল একটা প্রাইভেট বাসের পিছনে। বাসটা রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে যাত্রী তুলছে। পিছনে শুরু হয়ে গেল অধৈর্য হর্নের শব্দ। শুনতে শুনতে গুণেন্দ্র মুখ বিকৃত করে বলল, ‘শুয়োরের বাচ্চচা।’

‘কাকে বললি?’ ব্রতীন সামনে তাকিয়ে বলল। গুণেন্দ্র জবাব দিল না।

লোক তোলা শেষ করে বাসটা ছাড়ল একরাশ কালো ধোঁয়া বমি করে। ব্রতীন জানলার কাচ তুলে দিল।

‘মুম্বইয়ে এয়ার পলুশন আছে কিন্তু এতটা শব্দ নেই। কলকাতায় দুটোই মারাত্মক। ইউরোপ আমেরিকায় হাজার হাজার মোটর রাস্তা দিয়ে যায়, একটু শব্দ শুনতে পাবি না। হর্ন বাজালে লোকে তাকিয়ে দেখবে হনুমান দেখার মতো চোখ করে।’

‘তোদের এই এক বদ অভ্যেস, বড়োলোক দেশের সঙ্গে আমাদের তুলনা করা।’ গুণেন্দ্রর গলায় ক্ষোভ। ‘দামি দামি গাড়ি, রেগুলার ওরা মেইন্টেনও করে, একটু পুরনো হলে বিক্রি করে নতুন গাড়ি কেনে। পয়সা থাকলে শিক্ষা থাকলে সভ্য হওয়া যায়। এটা গরিব দেশ ভুলে যাস কেন। ওই যে বাসটা সামনে কেমন ধোঁয়া ছাড়ল দেখলি তো। বাসের মালিক এটা জানে, এঞ্জিনটা ঠিক করে নেবে তো, তা করবে না। করতে গেলেই পয়সা খরচ হবে। দু-চার টাকা লাভ কমলে বাসটার যে আয়ু বাড়বে সেই সঙ্গে আয়ও, সেটা আর মাথায় আসে না।’ গুণেন্দ্র কাঁকুড়গাছির মোড়ে ট্রাফিকে আটকে গিয়ে এতগুলো কথা ব্রতীনকে শুনিয়ে দিল।

ব্রতীন দু-ধারে তাকিয়ে রাস্তা বাড়ি দোকান দেখতে দেখতে বিস্মিত চোখে বলল, ‘গুণো জায়গাটা যে আর চেনা যাচ্ছে না রে। চার বছর আগে এখান দিয়ে এয়ারপোর্ট গেছি তখন তো এত ভিড় আর দোকান দেখিনি। কত ব্যাঙ্ক রে! বললি গরিব দেশ কই গরিবিয়ানার চিহ্ন তো চোখে পড়ছে না। গাড়িগুলোও তো নতুন মডেলের।’

হুঁশিয়ার হয়ে মোড়টা পার হতে হতে গুণেন্দ্র বলল, ‘শুধু একটা জায়গা দেখেই দেশের অবস্থা সম্পর্কে ধারণা করে ফেললি? এই ভিড়ের মধ্যে কত বেকার রয়েছে তা তো আর জানিস না।’

‘ইন্ডাস্ট্রি বাড়লেই বেকারের সংখ্যা কমবে আর পলুশন বাড়লেই নানান রোগ বাড়বে। আমাদের ওষুধ তৈরির ইন্ডাস্ট্রিরও রমরম করে ব্যবসা বাড়বে। এখনই এদেশে এগারো হাজার কোটি টাকা ওষুধের ব্যবসায় খাটছে, এটা আরও বাড়বে। অনেক বেকার তখন চাকরি পাবে অতএব পলুশনের জয় হোক।’ ব্রতীন দু-হাত তুলল জয়ধ্বনি দেওয়ার ভঙ্গিতে।

ইস্টার্ন বাইপাসে পৌঁছে ডানদিকে গাড়ি ঘোরাল গুণেন্দ্র।

‘বতু, এই পলুশন নিয়ে কিন্তু বাড়াবাড়ি করা হচ্ছে। দেশে অনেক সমস্যা রয়েছে কই সেগুলো নিয়ে তো হইচই হয় না, কাগজে পড়লুম পৃথিবীতে বছরে দুশো কোটি মানুষ যক্ষ্মায় মারা যায়-এইডস রোগের ওপর গবেষণার জন্য টাকার অভাব হয় না অথচ পৃথিবীর সবথেকে বড়ো খুনি যক্ষ্মার গবেষণায় নাকি টাকা পাওয়া যায় না। ভাবলে অবাক লাগে রোগটার আবিষ্কার হয়েছে আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে, এখনও একে নির্মূল করা গেল না। তোদের মেডিক্যাল সায়ান্স কোনদিকে যে চলেছে বুঝি না, ব্রেনে নিউরো চিপস বসাবার কথা বলা হচ্ছে অথচ সাধারণ সর্দি সারাবার একটা ওষুধ বার করতে পারলি না এখনও। ম্যালেরিয়ায় মানুষ মারা যায় কেন বলতে পারিস? ওষুধ নেই বলে। মশার কাজ মশা করে, কামড়ায়; সায়ান্টিস্টের কাজ মানুষের প্রাণ বাঁচানো, সেটা কি তারা করছে?’

ব্রতীন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল গুণেন্দ্রর মুখের দিকে। এই কী সেই গুণো যাকে তারা ছ্যাবলা ছিটেল চ্যাংড়া বলত তিরিশ বছর আগে! লেখাপড়ায় ছিল অতি সাধারণ, কোনোক্রমে পরীক্ষায় পাস করত। অথচ কী গম্ভীরভাবে এখন বুঝিয়ে দিল জীবন আর জগৎ সম্পর্কে সে ভাবনাচিন্তা করে, খোঁজখবর রাখে। নিউরো চিপস শব্দদুটো কী স্বচ্ছন্দে মুখ থেকে বার করল। সবথেকে বড়ো কথা গুণো ভাবে, কিন্তু ভাবনাটা সেকেলে নয়, ব্যবসা করে কিন্তু খুবই আধুনিক ব্যবসা, লক্ষ লক্ষ টাকা বছরে আয়, বিদেশিদের সঙ্গে ঘোরাফেরা করে-ওর চিন্তাধারা বাস্তবমুখী তো হবেই।

ব্রতীনের কৌতূহল হল গুণেন্দ্রর ব্যক্তিগত জীবন জানতে, তবে এখন কোনো প্রশ্ন নয়, পরে সুযোগ বুঝে করবে।

‘গুণো তখন তুই দাঁত কিড়মিড় করে ‘শুয়োরের বাচ্চচা’ বললি, কেন বললি?’ গুণেন্দ্র চুপ করে রইল দেখে ব্রতীন বলল, ‘পিছনে হর্নের আওয়াজে উত্ত্যক্ত হয়ে উঠে বলেছিলি। এটাই হল হাইপারটেনশন, যা রক্তের শিরাগুলোকে চেপে ধরে হার্টের উপর আরও চাপ তৈরি করে, এর মানে হাই ব্লাডপ্রেশার, কার্ডিয়াক প্রবলেম। ভারতে সবথেকে বেশি পেসমেকার বিক্রি হয় কলকাতায়। এইরকম শব্দ শুনতে শুনতে মানুষ একসময় কালা হয়ে যায়, অনিদ্রা রোগ তৈরি হয় আর সেক্সুয়াল কাজকর্মেও দুর্বলতা দেখা দেয়। পলুশন নিয়ে মোটেই বাড়াবাড়ি হচ্ছে না।’

ভ্রূ কুঁচকে গুণেন্দ্র মুখ পাশে ফিরিয়ে বলল, ‘কী বললি! কী দুর্বল করে দেয়?’

‘সেক্সুয়াল পারফরম্যান্স।’

‘তুই ঠিক জানিস?’

‘আমি জেনেছি একটা রিসার্চ রিপোর্টে, সায়ান্টিস্টদের কথা, তা না হলে সেক্সের ব্যাপারে আমার জানার কথা নয়।’

‘তোর কোনো অভিজ্ঞতাই নেই?’ গুণেন্দ্রকে বিচলিত দেখাল।

‘না।’

‘তোর কখনো দরকার মনেও হয়নি?’

গুণেন্দ্র মুখ টিপে হাসল ব্রতীনকে ইতস্তত করতে দেখে। সে উত্তর পাওয়ার জন্য আবার প্রশ্নটা করল না। ব্রতীন জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলল, ‘এই হচ্ছে ধাপা। এখানকার ফুলকপির স্বাদের তুলনা হয় না।’

ব্রতীন যখন মুগ্ধ চোখে সবুজ ফসল দেখছে গুণেন্দ্র গাড়িটা তখন ডানদিকে একটা রাস্তায় ঢোকাল। সার দিয়ে গোলাপি রঙের উঁচু পাঁচিলের ছিরিছাঁদহীন চিনেদের বাড়ি, লোহার ফটকগুলো লাল রং করা লোহার চাদরে ঢাকা, ভিতরে দেখা যায় না। দেখে মনে হয় কোনো রহস্য যেন গোপন করার চেষ্টা চলছে। রাস্তা ভাঙাচোরা। গুণেন্দ্রর গাড়ি চালানো থেকে ব্রতীনের মনে হল পথটা ওর খুব পরিচিত। কয়েকটা বাঁক নেওয়ার পর চোখে পড়তে লাগল রেস্টুরেন্টের সাইনবোর্ড। গুণেন্দ্র রাস্তা থেকে একটা সরু গলিতে গাড়ি ঢুকিয়ে ‘কাফুলোক’ লেখা রেস্টুরেন্টের সামনে অপেক্ষমাণ দুটো মোটর ও একটা মোটরবাইকের পিছনে গাড়ি রাখল। রেস্টুরেন্টের গায়েই খোলা নর্দমা।

মাঝারি আকারের ঘর, সাত-আটটা টেবল, বাইরের দিকের দেয়ালে এয়ারকুলার বসানো। পুত্রকন্যা নিয়ে এক বাঙালি দম্পতি, ঝুলছে কাগজের চিনা লন্ঠন, দেয়ালে ছাপাই নিসর্গচিত্র আঁটা। কয়েকজন মহিলা সহ সাত-আটজন লোক আহারে ব্যস্ত তিনটি টেবিলে।

গুণেন্দ্র বলল, ‘এটা ফ্যামিলি এরিয়া, আমাকে চেনে তাই ভিড় না হলে বসতে দেয়। আগে দুটো বিয়ার আনাই, খাস তো?’

‘মাঝেমধ্যে।’

বাঁধানো আট পাতার খাদ্য তালিকা হাতে টেবলে হাজির হল একটি লোক। সেটি অগ্রাহ্য করে বিয়ার ও ভাজা চিংড়ি মাছের বরাদ্দ দিয়ে গুণেন্দ্র বলল, ‘তপেনের মুখটা দেখছিলি যখন বললুম বাড়িতে ডাকাতি করতে যাব, কীরকম বোকা বোকা হয়ে গেল।’

‘তুই ওকে আমার সামনে যেভাবে বললি তাতে আমার অস্বস্তি হচ্ছিল।’ ব্রতীন অভিযোগের সুরে বলল। ‘কত বছর পর দেখা হল, আমি তো ওর কাছে এখন বাইরের লোকের মতো। তুই এখনও সেই ঠোঁটকাটাই রয়ে গেলি। তোর কথা শুনে মনে হচ্ছিল কীসের যেন একটা ঝাল মেটাচ্ছিস।’

‘আমার এক বন্ধুর বোনের সঙ্গে ওর বিয়ের সম্বন্ধ করি। অপূর্ব সুন্দরী মেয়ে বাংলা অনার্সে বি-এ। যদি আমার বিয়ে না হয়ে যেত তাহলে আমিই বিয়ে করে নিতুম। তপাকে নিয়ে গিয়ে মেয়ে দেখালুম, ওর খুব পছন্দ হল, বলল বিয়ে করবে। কথাবার্তা অনেক দূর এগোল, তখন ও কলেজে পড়াচ্ছে আর বাড়িতেও শুরু করেছে কোচিং। এর পর হঠাৎ বলল বিয়ে করা সম্ভব নয়, কুষ্ঠিতে মিলছে না। আমি যে কী অপ্রস্তুতে পড়লুম কী বলব। তবে ভালোই হয়েছে মেয়েটির বিয়ে হয়েছে সল্টলেকে ভাবা অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টারের এক সায়েন্টিস্টের সঙ্গে।’ গুণেন্দ্র থামল বিয়ার এসে যাওয়ায়। বোতল থেকে গ্লাসে ঢেলে দিল বেয়ারা। গুণেন্দ্র একচুমুকে গ্লাস শেষ করে নিজেই বোতল থেকে আবার গ্লাসে ঢালল। ব্রতীন নিজের গ্লাস তুলে ছোট্ট করে চুমুক দিল।

‘ওকী রে! বিয়ার খাচ্ছিস না চা খাচ্ছিস, চোঁ চোঁ করে মেরে দে আমার মতন।’

‘অভ্যেস নেই।’ ব্রতীন একটা বড়ো ঢোঁকে অনেকটা গিলে নিয়ে চোখ বন্ধ করল।

‘যা বলেছিলুম, একদিন শুনলুম তপা বিয়ে করেছে। মেয়েটি বি এসসি, স্কুলে সায়ান্স আর বাড়িতে তিনটে মেয়েকে পড়ায়। তপা বলে প্রেম করে বিয়ে করেছে, বিশ্বাস হয় না। ব্যাটা কোচিংয়ের দোকান খুলবে বলে হিসেব কষে দেখেছে সায়ান্স আর অঙ্ক টিচারের চাহিদা খুব। বাংলা অনার্স দিয়ে মাল বেচা যাবে না।’ গুণেন্দ্র গ্লাস শেষ করে ব্রতীনের গ্লাসের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তাড়াতাড়ি কর আর দুটো আনাই।’

‘না না দুটো খেতে পারব না।’ ব্রতীন আঁতকে ওর ভাব দেখাল।

‘না পারিস আমি তো আছি ফেলা যাবে না, যতটা পারিস খা। এত বছর পর দেখা। অন্তত আমার জন্য আজ একটু নিয়মভঙ্গ কর। বতু তুই খুব হেলথ কনশাস, না? তোর ভুঁড়ি নেই সেজন্যই। তবে সেক্স লাইফ না থাকলে কিন্তু শরীর থাকবে না।’

গুণেন্দ্র বেয়ারাকে ডেকে দুটো বিয়ার ও এক প্লেট ভাজা চিংড়ি আনতে বলে ব্রতীনকে বলল, ‘যা খাবি এখনই বলে দে। চিনে রেস্টুরেন্টে অর্ডার দিলে কুড়ি মিনিট পর খাবার আসে। বল কী খাবি, সুপ বলি, কাঁকড়ার সুপ, ফ্রায়েড রাইস, নাকি চৌমিন?’

ব্রতীনের ইচ্ছে নেই সুপ খাওয়ার কিন্তু গুণেন্দ্রর মুখের আন্তরিকতাটা তার ভালো লাগল। এত বছর পর স্কুলের বন্ধুকে পেয়ে গুণো যেন কৈশোরে ফিরে যাবার জন্য তাকে আঁকড়ে ধরতে চাইছে। ব্রতীনের মনে হল সেও তো তাই চেয়েছে নয়তো মুম্বই থেকে সে আসতে যাবে কেন!

‘সুপ আর ফ্রায়েড রাইস বল, দুপুরে নুডলস খেতে ভালো লাগে না।’

শুনেই গুণেন্দ্র টেবলে চাপড় মেরে বলল, ‘আমারও ভালো লাগে না। বাঙালির ছেলে দুপুরে ভাত না পেলে মনে হয় খাওয়াটা ঠিকমতো হল না।’ এরপর দাঁড়িয়ে থাকা বেয়ারাটিকে বলল, ‘শুনলে তো কী কী আনতে হবে, কর্ন ক্র্যাব সুপ, মিক্সড ফ্রায়েড রাইস আর ওর সঙ্গে দু প্লেট চিলি চিকেন। বিয়ারটা তাড়াতাড়ি দাও।’ গ্লাসে সামান্যই বিয়ার পড়ে, সে ব্রতীনের বোতলের বাকিটুকু নিজের গ্লাসে ঢেলে নিল। দেখে মনে মনে ব্রতীন হাঁফ ছাড়ল।

‘বুঝলি বতু, আলি সাহেব যা বলে গেছে খাঁটি সত্যি কথা, সৈয়দ মুজতবা আলি, পড়েছিস?’ উত্তরের জন্য গুণেন্দ্র তাকিয়ে আছে দেখে ব্রতীন বলল, ‘পড়েছি। কী বলে গেছেন?’

‘পৃথিবীতে সেরা খাদ্য চারটে। চিনে, ফরাসি, মোগলাই আর বাকিটা কী বল তো?’

‘বাঙালি হিন্দু বিধবার নিরিমিষ রান্না।’

‘সাবাস। তোর দেখছি মনে আছে।’ গুণেন্দ্র খুশিতে চনমন করে উঠল।

বাঙালি পরিবারটি খাওয়া শেষ করে বিল চুকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। গুণেন্দ্র মুখ ফিরিয়ে তাকিয়ে দেখল। ওরা বেরিয়ে যাবার পর চাপা গলায় বলল, ‘পাছাটা দেখলি, আমার বউয়ের মতো।’

‘গুণো মনে হচ্ছে, তুই বদলাসনি।’

‘কোন শালা বদলাতে চায়, তুই চাস? ষোলো-সতেরো বছর বয়সে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে না?’

গুণেন্দ্র পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বার করে কয়েকটা নম্বর টিপে কানে চেপে ধরল। বেয়ারা দুটো বোতল আর ভাজা চিংড়ির প্লেট রেখে বোতলের ছিপি খুলে দিয়ে চলে গেল।

‘হ্যাঁ, কে উমেদ? আমি গুণোবাবু বলছি, ছোটকু আছে? দাও তো ওকে।’ গুণেন্দ্র অপেক্ষা করার ফাঁকে চোখ টিপল ব্রতীনকে। ‘হ্যালো ছোটকু, গুণোদা, কেউ আছে?…হ্যাঁ হ্যাঁ চিনেছি একবার তো এসেছিল। …ঘণ্টাখানেক পরে পাঠিয়ে দে, ট্যাংরায় খাচ্ছি, সঙ্গে বন্ধু, ছোটোবেলার বন্ধু, এখন তো দুটো, তিনটের সময় আসুক, ও তো ফ্ল্যাট চেনে…আচ্ছা আচ্ছা।’ গুণেন্দ্র ফোন বন্ধ করে পকেটে রাখল, মুখে রহস্য মাখানো হাসি। একটা বোতল তুলে ব্রতীনের খালি গ্লাসে ঢালতে লাগল। ফেনা উপচে টেবল ক্লথ ভিজিয়ে দিল। ব্রতীনের মনে হল গুণো যেন হুঁশের বাইরে চলে যাচ্ছে।

‘কাকে ফোন করলুম বুঝতে পারলি না। আচ্ছা বতু, তুই কী লক্ষ করেছিলি বলাটা আমাকে দেখেও না দেখার ভান করল!’

‘কেমন যেন তোর ওপর রেগে উঠল। তোর পাড়াতেই তো থাকে, দেখাসাক্ষাৎ হয়?’

‘খুব কম। আমাকে ও আর সহ্য করতে পারে না, কারণ একটা অবশ্য আছে, ভালোই কারণ। নে, খেয়ে ফেল।’ গুণেন্দ্র অধৈর্য স্বরে বলল। ব্রতীন গ্লাস তুলে নিল, এটা তার দ্বিতীয় গ্লাস। গুণেন্দ্র তার চতুর্থ গ্লাস ভরল।

‘বলার চেহারাটা তো দেখেছিস, আমরা ওকে বেঁটে বলি আসলে বামন বলাই উচিত। ওর বিয়ে হচ্ছিল না এইজন্যই। এম এ পাস, নিজেদের বাড়ি, বাপ-মা নেই, ভালো চাকরি ভালো বংশ, দুটো ভাই দুজনই ভালো চাকরি করে। এমন ছেলেকে তো পাত্রীপক্ষ লুফে নেবে। কিন্তু লুফতে এসেও পিছিয়ে যায় শুধু ওর হাইট দেখেই। রোগাকে মোটা করা যায় মোটাকে রোগা কিন্তু বেঁটেকে লম্বা করার কোনো উপায় এখনও বেরোয়নি, হ্যাঁ রে বেরিয়েছে কি?’

ব্রতীন মাথা নাড়ল।

‘শেষমেশ একটা মেয়ে আর আপত্তি না করে বিয়ে করতে রাজি হয়। বিয়েতে বলা আমাকে সপরিবারে নেমন্তন্নও করেছিল। দুজনে পাশাপাশি দাঁড়ালে বউটির কাঁধের কাছে ওর মাথা পৌঁছাত। গোলমালটা শুরু হল এখান থেকেই। বলার পাশের বাড়িতে আমার বউয়ের বন্ধু থাকে তার কাছ থেকেই শুনেছি। প্রায় ঝগড়াঝাটি হত ওদের। বলা সন্দেহ করত বউকে, প্রেম করছে। কার সঙ্গে করছে সেটাই খুঁজে মরত। কাউকে না পেয়ে ক্ষেপে উঠত, গায়ে হাত তুলত।’ গুণেন্দ্র গ্লাস শেষ করে আবার ভরে নিল। স্বাভাবিক কণ্ঠস্বর কিন্তু দুটো চোখ ঝকঝকে হয়ে উঠেছে। ঘরে ঢুকল একজোড়া তরুণ ছেলেমেয়ে। ছেলেটির হাতে হেলমেট। ঘরের লোকেদের মুখগুলো দেখে নিয়ে বেয়ারাকে চাপা গলায় কী বলল। ব্রতীন ওদের হাবভাব দেখে সম্পর্কটা বুঝে নিল।

‘যা বলছিলুম,’ গুণেন্দ্র খেই ধরে শুরু করল, ‘মেন্টাল টর্চার সহ্য করতে না পেরে ওর বউ কাউকে কিছু না বলে একদিন পালিয়ে গেল। বলা খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিল গোপনে, লজ্জায় কাউকে বলতে পারে না, এমনকী ভাইদেরও নয়। পাড়ার লোকেদের বলল, বউ এক বস্ত্রে বাপের বাড়ি গেছে হঠাৎই বাবার স্ট্রোক হবার খবর পেয়ে, ও নিজে গিয়ে পৌঁছে দিয়ে এসেছে। বলা শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে শুনল বউ সেখানে যায়নি। বউয়ের আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে খোঁজখবর করল, পেল না। দু-মাস কেটে গেছে, বলার তখন আধপাগলা অবস্থা, পুলিশে জানাবে কিনা ভাবছে। প্রচুর মিথ্যে কথা বলে যেতে হচ্ছে। শেষকালে রটাল বাবা-মায়ের সঙ্গে লছমনঝোলা যাবার পথে পাহাড় থেকে পা পিছলিয়ে খাদে পড়ে বউ মরে গেছে।’

ব্রতীন অবাক হয়ে বলল, ‘সে কী রে, বউকে মেরে ফেলল!’

‘ফেলল। তারপর শোন না, আমি ট্যুরিস্ট নিয়ে শান্তিনিকেতন গেছি বাসে। উত্তরায়ণে গাইড রবীন্দ্রনাথের বাড়ি ট্যুরিস্টদের দেখাচ্ছে। আমিও দেখছি। বাড়ির সামনের মাঠে তখন এক বুড়ির সঙ্গে দেখি একটি মেয়েকে। লাঠি হাতে পা পা করে বুড়ি হাঁটছে, আর মেয়েটি হাত ধরে সঙ্গে সঙ্গে হাঁটছে, মনে হল যেন বলার বউ। ওর পাশ দিয়ে হেঁটে গেলুম মুখটা ভালো করে দেখার জন্য। নাইনটি পারসেন্ট নিশ্চিত হলুম আরে ওই তো বলার বউ! নামটা ঠিক মনে ছিল না নইলে পিছন থেকে নাম ধরে ডেকে দেখতুম তাকায় কি না। পক্ষাঘাতে ডান দিকটা পড়ে গেলে ফিজিওথেরাপি করে সারিয়ে তোলার জন্য হাঁটানো হয়, বুড়িটার হাঁটা দেখে মনে হল তাই করানো হচ্ছে।’ গুণেন্দ্রকে থামতে হল, খাবার এসে গেছে। কথা বলতে বলতে সে একটা বোতল শেষ করে দিয়েছে। অন্য বোতলটা থেকে ব্রতীনের গ্লাসে ঢেলে বাকিটা নিজের গ্লাসে ঢালল।

‘না বলবি না, আজ আমি তোর হোস্ট। এক চুমুকে খেয়ে নে।’ গুণেন্দ্র এক চুমুকে নিজে খেতে গিয়ে পারল না, ঢেঁকুর তুলে গ্লাস রেখে দিল। ব্রতীন লক্ষ করল বেয়ারা দুটো গ্লাসে বিয়ার ঢালল। ছেলেটি গ্লাস তুলে কী যেন বলল। লাজুক মুখে দু-পাশে তাকিয়ে মেয়েটি গ্লাস তুলে ইতস্তত করে চুমুক দিয়েই মুখ বিকৃত করে শিউরে উঠল, ব্রতীন হাসল।

‘হাসলি যে!’ গুণেন্দ্র মুখ ঘুরিয়ে ব্রতীনের দৃষ্টি অনুসরণ করে পিছনে তাকাল। ‘তোর চেনা?’

‘না।’

‘বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে এরকম অনেক আসে, গেরস্ত ঘরের মেয়ে, এটাই এদের অ্যাডভেঞ্চার। আগে খেয়ে নে পরে বাকিটুকু বলব।’ গুণেন্দ্র উঠে দাঁড়াল। ‘টয়লেট থেকে ঘুরে আসি, বিয়ার খেলে এই এক ফ্যাকড়া বাধে।’

আধঘণ্টায় খাওয়া শেষ করে ওরা কাফুলোক থেকে বেরোল। মিনিট দশেকে পৌঁছল পার্কসার্কাস হয়ে বেগবাগান। একটা কম চওড়া রাস্তায় গাড়ি ঢুকল।

ব্রতীন বলল, ‘কোথায় যাচ্ছি?’

‘আমার একটা আস্তানা আছে এখানে। বন্ধুর ফ্ল্যাট। ইনকাম ট্যাক্সে আছে বদলি হয়ে গেছে কানপুরে, আমার জিম্মায় রেখে গেছে ফ্ল্যাটটা। মাঝেমধ্যে আসি জিরোতে।’ গুণেন্দ্র অনুত্তেজিত স্বরে কথাগুলো বলল একটু জড়ানো গলায়।

একটা আটতলা বাক্সর মতো চৌকো খাড়াই বাড়ির গেট দিয়ে গুণেন্দ্র মোটর ঢোকাল। একতলাটা উঠোন, দু-তিনটি মোটর রয়েছে। সে ফাঁকা একটা জায়গা দেখে মোটর রাখল। ‘কাচ তুলে লক করে দে।’

ব্রতীন তাই করল। গুণেন্দ্র এগোল লিফটের দিকে। ব্রতীন কৌতূহলী দৃষ্টিতে চারিদিকে তাকাল। গেটে তিনটি লোক বসে গল্প করছে, বোধহয় দরোয়ান। সারি দিয়ে লেটারবক্স আর ইলেকট্রিক মিটার। একটা ছোটো ঘর, সম্ভবত জলের পাম্পসেট ওখানেই রয়েছে। কাগজের টুকরো, পলিথিন ব্যাগ, পানপরাগ আর সিগারেটের খালি প্যাকেট উঠোনে ছড়িয়ে। ব্রতীনের মনে হল এখানকার বাসিন্দারা আত্মকেন্দ্রিক, বসবাসের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখার কথা ভাবে না। বাড়িতে ঢুকেই লিফটের দিকে এগিয়ে যায় দু-পাশে তাকায়ও না। মুখ তুলে বারো-চোদ্দোটা এয়ারকুলার তার চোখে পড়ল। নিশ্চয় আরও সব দামি দামি আরামের যন্ত্র ফ্ল্যাটগুলোয় আছে। নিশ্চয় এরা কেউ কারোর সঙ্গে আড্ডা দেয় না, ফ্ল্যাটে বসে শুধু টিভি দেখে।

লিফট উপরে রয়েছে। বোতাম টিপে গুণেন্দ্র দাঁড়িয়ে। ‘গুণো ক-টা ফ্ল্যাট এখানে?’

‘প্রতি তলায় তিনটে করে তবে দোতলায় পুরোটাই নার্সিংহোম বাড়ির মালিকের। ফ্ল্যাট একুশটা।’

‘মালিক এখানে থাকে?’

‘তিনতলায় থাকে দুটো ফ্ল্যাটে দুই ভাই। বড়োজন ডাক্তার আর ছোটোজন মাফিয়া সর্দার।’

এক প্রৌঢ় দম্পতি এসে দাঁড়াল তাদের পাশে, চেহারা ও পোশাকে অবাঙালিত্ব প্রকট। গুণেন্দ্র চুপ করে গেল। লিফট নেমে এল, বেরিয়ে এল দুটি বাচ্চচা মেয়ে, সালোয়ার কামিজ পরা মাঝবয়সি মহিলা আর স্যুট টাই পরা এক যুবক। ওরা চারজন লিফটে ঢুকল। গুণেন্দ্র পাঁচ নম্বর বোতাম টিপে লোকটির দিকে তাকাতে সে বলল, ‘ফোর।’ গুণেন্দ্র চার নম্বরটা টিপে দিল।

ছ-তলায় লিফট থেকে তারা বেরোল, দু-দিকে পাঁচ হাত চওড়া প্যাসেজ। আলো কম। দু-দিকে দুটি ও সামনে একটি ফ্ল্যাট। দরজাগুলো এক পাল্লার। গুণেন্দ্র ডানদিকে এগোল। পকেট থেকে চাবি বার করে দরজায় ঝোলানো বড়ো তালাটি খুলে ভিতরে ঢুকে আলো জ্বালল পাখা চালাল। ভিতরে ঢুকেই ভ্যাপসা বাসি গন্ধ পায় ব্রতীন। গুণেন্দ্র একটা একটা করে তিনটি জানালা খুলে দিল। সোফা আর সেন্টার টেবল দেখে ব্রতীন বুঝল এটা বসার ঘর। এর একধারে স্নানের আর রান্নার ঘর অন্য ধারে ছোটো দুটি শোবার ঘর পাশাপাশি, একটির বন্ধ দরজায় তালা ঝুলছে।

গুণেন্দ্র তালাবিহীন শোবার ঘরে ঢুকে জানলা দুটো খুলল। বাইরেই রাস্তা। ব্রতীন ওকে অনুসরণ করে ঘরে ঢুকল। একটা ডাবলবেড খাট। রঙিন ফুলকাটা চাদরে ঢাকা ফোমের গদি। দুটো বালিশ। একটা স্টিলের আলমারি তার মাথায় রাখা দেড়হাত লম্বা মাটির সরস্বতী। গলায় দড়ির মতো শুকনো মালা ঝুলছে। বোঝা যায় একটা পরিবার এই ফ্ল্যাটে থাকত কিন্তু আপাতত থাকে না। দুটো জানলার মাঝে একটা দরজা, গুণেন্দ্র সেটা খুলল। ছোট্ট বারান্দা, কোমর সমান দেয়ালে ঘেরা। প্রত্যেক দরজায় পরদা টাঙাবার রড লাগানো কিন্তু পরদা নেই।

‘বাথরুমটা কোথায় রে?’ ব্রতীন জিজ্ঞাসা করল। গুণেন্দ্র আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসার আগে সে মুখে চোখে জলের ঝাপটা দিয়ে তোয়ালে খুঁজল, পেল না। ঘরে এসে দেখল গুণেন্দ্রর গেঞ্জি জামা প্যান্ট খাটের গায়ে ঝুলছে, সে খালি গায়ে লুঙ্গি পরে চিত হয়ে চোখ বুজে শুয়ে, পাখা ঘুরছে। মাথার বালিশের পাশে চশমা আর মোবাইলটা।

‘লুঙ্গি পেলি কোথা থেকে?’

‘এখানেই রাখা ছিল।’ উঁচু গোলাকার পেটে হাত বুলোতে বুলোতে গুণেন্দ্র চোখ না খুলে বলল। ‘একটু বেশি খাওয়া হয়ে গেছে ফ্রায়েড রাইসটা।’

‘আমারও। একটা প্লেট দুজনে ভাগাভাগি করে খাওয়া যেত।’

ব্রতীন বালিশটা টেনে বগলের নীচে রেখে কাত হল গুণেন্দ্রর পাশে। ‘বলার গল্পটা এবার শেষ কর। দারুণ ইন্টারেস্টিং।’

‘ওখানে একজনকে জিজ্ঞাসা করে জানলুম ওই বুড়ি হচ্ছে বিশ্বভারতীর এক ইতিহাসের প্রোফেসারের মা, নাম বলল প্রদীপ না প্রণব দাশগুপ্ত, থাকে কী এক পল্লিতে, চোদ্দো-পনেরো বছর আগের কথা নাম-টাম অত আর মনেও নেই। আমার তখন দাঁড়িয়ে কথা বলার সময় নেই, পার্টি রওনা দিয়েছে বাসের দিকে। কলকাতায় ফিরে বলাকে বললুম তোর বউকে দেখলুম শান্তিনিকেতনে। শুনে ও চমকে উঠে বলল, সেকী ওতো লছমনঝোলায় মরে গেছে। তখন কী ইচ্ছে হল জানিস, মারি পেটে একটা লাথি, বললুম গাঁজা গুলগপ্পো আমার কাছে মারিসনি, শান্তিনিকেতনে গিয়ে খোঁজ নে। দিন তিনেক পরে শুনলুম বলার বউ ফিরে এসেছে। একদল সাধু নাকি পাহাড়ের গায়ে অজ্ঞান অবস্থায় বউকে কুড়িয়ে পায়, নিজেদের আশ্রমে নিয়ে গিয়ে শেকড়-বাকড় খাইয়ে বাঁচিয়ে তোলে কিন্তু স্মৃতি নষ্ট হয়ে যায়। দু-মাস পর হঠাৎ স্মৃতি ফিরে আসে তখন স্বামীর নাম ঠিকানা বলে। সাধুরা টেলিগ্রাম করে বলাকে-একেবারে হিন্দি ফিল্মের গপ্পো, আশ্চর্যের কী জানিস সবাই বিশ্বাস করে নিয়েছিল। বলা আমার পা ধরে বলে গুণো কাউকে ব্যাপারটা বলিসনি, তোর বউকেও নয়। বতু বিশ্বাস কর সত্যি সত্যি কাউকে ব্যাপারটা বলিনি, বউকেও নয়। হাজার হোক বলা ছেলেবেলার বন্ধু। মানুষটা ভালো। আর মানুষ তো ভালোয় মন্দয় মিশিয়েই হয়। ভগবান ওকে চেহারায় মেরে দিয়েছে ওর তো কিছু করার নেই। শুধু তোকেই আজ প্রথম বললুম তুই এখানে থাকিস না বলে।’

ব্রতীন আবার গুণেন্দ্রের চরিত্রের একটা দিক আবিষ্কার করে স্নিগ্ধ বোধ করল। সে বলল, ‘তুই নিশ্চিন্ত থাকিস কাউকে বলব না, অবশ্য কাকেই বা বলব। আমার চেনাজানাদের মধ্যে কেউ বলাকে চেনে না।’

‘বতু এখন কিন্তু একটা মেয়ে এখানে আসবে।’

ব্রতীন হতভম্ব হয়ে উঠে বসে গুণেন্দ্রর দিকে তাকিয়ে রইল। আচমকা মাথার উপর জোরে কিল মারলে যে অবস্থা হয় এখন তার সেইরকম মনে হচ্ছে। কথাগুলোর বিস্তৃত ব্যাখ্যা তার মস্তিষ্ক চাইল।

‘একজনই আসবে, ভেবেছিলুম দুজনের কথা বলব। তোর সঙ্গে এতক্ষণ কাটিয়ে মনে হল তুই এখনও আগের মতো ভালো ছেলেই রয়ে গেছিস তাই একজনকেই পাঠাতে বললুম।’

ব্রতীন ভালো করে গুণেন্দ্রর মুখ লক্ষ করল। ঠাট্টা করছে না তো! বদ রসিকতা গুণো করতে পারে বিশেষ করে স্কুল জীবনের বয়সে ফিরে যাবার জন্য যখন ওর শখ হয়েছে। তখন তারা ক্লাস টেন-এ পড়ে। একদিন স্কুল ছুটির পর গুণোর সঙ্গে সে হেঁটে ফিরছে। ট্রামস্টপে তিন-চারজন লোকের সঙ্গে একটি স্কার্ট পরা বইখাতা বুকে জড়িয়ে ধরা টকটকে ফরসা রঙের মেয়েও দাঁড়িয়ে ছিল। গুণো দেখে বলল, ‘গাল দুটো দেখেছিস, আপেল! টিপে দিতে ইচ্ছে করছে।’ গুণো দাঁড়িয়ে পড়ে স্টপ থেকে প্রায় পনেরো মিটার দূরে। ট্রাম আসতে লোকগুলি উঠল, মেয়েটিও। স্টপ ছেড়ে ট্রাম চলা শুরু করামাত্র গুণো হাতের বইগুলো তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে শুধু বলল, ‘টিপে দিয়ে আসি।’ ট্রাম তখন সবে গতি নিয়েছে সে শিউরে উঠে দেখল গুণো চলন্ত ট্রামের হাতল ধরে টুক করে উঠে পড়ল। তার বুকের মধ্যে তখন ধুকপুকুনি শুরু হয়। বিশাল একটা কেলেঙ্কারির জন্য নিজেকে তৈরি করে সে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। গুণোর যা পাগলাটে স্বভাব, গাল তো টিপবেই তারপর যা ঘটবে সে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে-ট্রামের লোক পেটাতে পেটাতে ওকে নামাচ্ছে। পাঁচ সেকেন্ড বড়োজোর কেটেছে, সে দেখল অদ্ভুত ভারসাম্য রেখে গুণো ট্রাম থেকে নেমে পড়ে হাত তুলে তাকে ডাকছে। সে দৌড়ে যেতেই ও বলল, ‘উঠেই দেখি সামনে সেজো পিসেমশাই, খুব বেঁচে গেছি।’

‘গুণো, তুই এই ধরনের রসিকতার অভ্যেসটা এখনও ছাড়তে পারলি না।’ ব্রতীন কথাগুলো বলেও ভরসা পেল না গুণো সত্যি না মিথ্যে রসিকতা করছে।

‘এই বয়সেই তো রসিকতা করব রে।’ হাত তুলে ঘড়ি দেখে গুণেন্দ্র বিরক্ত স্বরে বলল, ‘এখনও এল না, তিনটেয় বলেছিলুম। বতু বড়োজোর আধঘণ্টা। ততক্ষণে বাইরের সোফাটায় শুয়ে ঘুমিয়েও নিতে পারিস।’

ব্রতীন ওর বলার ভঙ্গি থেকে বুঝতে পারল রসিকতা নয়, সত্যিই একটা মেয়ে আসবে। তাকে ভালোছেলে বলে যে চিমটিটা কাটল সেটা যে তাকে নাড়া দেয়নি, সে যে এসব ব্যাপারে ভ্রূক্ষেপ করে না, যথেষ্ট আধুনিক খোলামনের এটা বোঝাতে সে হালকা চালে বলল, ‘মেয়েটা কে, কোত্থেকে জোগাড় করলি?’

‘আমার খুব ঘনিষ্ঠ একজনের বিউটি পার্লার আছে এই কাছেই সার্কুলার রোডে। ছ-টা মেয়ে কাজ করে তার মধ্যে তিনটে এন্টারটেইন করে সেজন্য ওখানেই ঘর আছে। কলকাতায় এখন ব্যবসাটা ভালো চলছে।’

‘তখন ফোনে কথা বললি ছোটকু নামে একজনের সঙ্গে, সেই কি মালিক?’

‘কারেক্ট। ওর দুটো অ্যাম্বাসাডার আমি ভাড়া নিই, পার্লারের ব্যাপারে পুলিশের সঙ্গে বন্দোবস্ত করে দিয়েছি তবে সেজন্য অন্যায় কোনো সুযোগ কখনো নিইনি। টাকা না দিয়ে কোনো মেয়েকে এখানে আনিনি। অবশ্য ইচ্ছে করলে ফ্রি সার্ভিস ডিমান্ড করতে পারি, ছোটকু সেটাই চায় তাহলে আমাকে হাতে রাখতে পারবে। দু-তিনশো টাকার জন্য এইসব নোংরা বাজে লোকের কাছ থেকে অনুগ্রহ নেবার প্রবৃত্তি হয় না।’

ব্রতীন দেখল গুণেন্দ্রর চোখের পাতা নেমে আসছে, কথা সামান্য জড়িয়ে যাচ্ছে। এখন সে নিশ্চিতভাবে বুঝে গেছে রসিকতা নয়। সত্যিই একটি মেয়ে আসছে, এখনই। কৌতূহল মেটাবার জন্য এবার সে তৈরি।

হালকাভাবে কলিং বেলে ‘টুংটাং’ বেজে উঠল একবার। আলতো করে বোতাম টিপেই ছেড়ে দেওয়া কুণ্ঠিত শব্দটা কারোর হাজিরা জানান দিল। ব্রতীন তাকাল গুণেন্দ্রর মুখের দিকে।

‘এসেছে। বতু আমাকে আর ওঠাসনি, খুলে দিয়ায়।’

ব্রতীন উঠে গিয়ে দরজা খুলল। প্রথমেই তাকাল মুখে এবং অবাক হয়ে গেল। এ তো তিরিশ বছর আগের, বারান্দায় চন্দনাকে ছোলা খাওয়াত সেই মেয়েটি! সেই গঙ্গা মাটির মতো রং, সেই উঁচু কপাল ভুরু নাক, সেই চোখ তবে সুর্মা দিত না, সেই চুল তবে এমন উড়ুক্ষে থাকত না। ব্রতীনের ঠোঁটে ফিকে হাসি দেখে মেয়েটিও হাসল। হালকা গোলাপি রং ঠোঁটে। উপরের পাটির ঝকঝকে দুটো দাঁতের আধখানা দেখা গেল। আশ্চর্য এত মিলও হয়। আজই সে জেনেছে ওর নাম ছিল বুড়ি। তাকে সে একরঙা খয়েরি রঙের এমন সালোয়ার কামিজ ওড়না গায়ে দেখেনি, এমন ছিপছিপে লম্বাও ছিল না। কিন্তু এর মুখখানি বুড়ির ছাঁচে বসানো, মুখের রংও। মুখটুকু ছাড়া আপাদমস্তক ঢাকা, ঢোলা কামিজের প্রান্ত হাঁটুর নীচে নেমে রয়েছে। কামিজের গলায় বগলে সোনালি সুতোর কাজ। কমদামি কাপড়ের পোশাক। এমন ঢাকা শরীর দেখে ব্রতীন বুঝতে পারল না মেয়েটি কতটা স্বাস্থ্যবতী, আন্দাজ করল বয়স কুড়ির কাছাকাছি।

‘গুণোবাবু আছেন?’ নীচু খসখসে গলায় জিজ্ঞাসা করল।

‘আছে, ভেতরে এসো।’ ব্রতীন সরে দাঁড়াল।

ভিতরে ঢুকেই মেয়েটি ডানদিকে শোবার ঘরের দিকে তাকাল।

ব্রতীন শুনেছে ও আগে এই ফ্ল্যাটে এসেছে সুতরাং ঘরটা চেনে এবং জানে ওই ঘরেই তাকে যেতে হবে।

‘কে রে মলি নাকি?’ ভিতর থেকে গুণেন্দ্রর গলা ভেসে এল।

‘হ্যাঁ, আমি।’

‘এ ঘরে আয়।’

মলি শোবার ঘরে গেল। ওর কাঁধ থেকে ঝুলছে বাস কন্ডাক্টরদের মতো খয়েরি রঙের নকল চামড়ার ব্যাগ। ব্রতীন লক্ষ করল ওর হাঁটা আর জুতো। চকচকে খয়েরি রঙের সিন্থেটিক চামড়ার পাম্প শু, প্রায় পাঁচ ইঞ্চি লম্বা সরু হিল। প্রথম পদক্ষেপেই বাঁ পা টলে গেল। ব্রতীন বুঝে গেল হাই হিলে মলি অভ্যস্ত নয়। কেন যে পরে এমন জুতো!

‘দরজাটা বন্ধ কর।’ গুণেন্দ্রর গলা শোনা গেল।

ব্রতীন দেখল দরজার পাল্লা ভেজানোর সময় মলি তার দিকে তাকিয়ে ছিল নির্বিকার দৃষ্টিতে। সোফায় বসে সে তিন দিকে তাকাল। দেখার মতো কিছু নেই। সারা বাড়ি শব্দহীন। শব্দ ঢোকার কোনো পথ থাকে না ফ্ল্যাটবাড়ির বাইরের দরজা বন্ধ থাকলে, শব্দ আসতে পারে শুধু জানলা দিয়ে। রাস্তায় মোটর চলার আর হর্নের শব্দ আবছাভাবে ঘরে ঢুকছে। মাথার পিছনে দুটো হাত জড়ো করে সোফায় হেলান দিয়ে সে যতটা সম্ভব পা দুটো সামনে ছড়িয়ে চোখ বন্ধ করল। কিছু একটা এখন তাকে ভাবতে হবে। কী ভাবা যায়? এখন ওরা ঘরে কী করছে? এটা তার কাছে কুৎসিত একটা ভাবনা বলে মনে হল। সে কোনোভাবেই এখন পারবে না ওদের দুজনকে নগ্ন অবস্থায় কল্পনা করতে। তার শিক্ষা রুচি ধমক দিয়ে তাকে কুঁকড়ে দিল। এমন একটা অবস্থার মধ্যে যে তাকে পড়তে হবে কিছুক্ষণ আগেও সে জানত না। গুণেন্দ্র যখন বলল, ‘এখন কিন্তু একটা মেয়ে এখানে আসবে,’ শোনামাত্র তখন যে ধাক্কাটা সে পেয়েছিল তার জের থেকে মস্তিষ্কের কোষগুলো এখনও উদ্ধার পায়নি।

হঠাৎ তার মনে হল শোবার ঘরের বন্ধ দরজার ওধার থেকে যেন ক্ষীণ শব্দ হল মোবাইল ফোন বেজে ওঠার। সে উৎকর্ণ হল। গুণেন্দ্রর গলা, বেশ উত্তেজিত। আধ মিনিট পর দড়াম করে দরজা খুলে বেরিয়ে এল গুণেন্দ্র। খালি গা শুধু জাঙ্গিয়া পরা, এক হাতে জামা আর ট্রাউজার্স অন্য হাতে ফোন। দৃষ্টি উদভ্রান্তের মতো।

‘কেলেঙ্কারি হয়েছে রে বতু, বাসটা অ্যাকসিডেন্ট করেছে!’ ট্রাউজার্সটা ডান পায়ে গলাতে গলাতে বলল, ‘রানাঘাটের কাছে, আমি যাচ্ছি এখন…….সামনে দিয়ে আসছিল একটা মিনিবাস……তুই থাক, মেয়েটা তোর কাছে রইল…..টাকা-ফাকা যা দেবার দিয়ে দোব।’……গুণেন্দ্র কুঁজো হয়ে বাঁ পায়ে ট্রাউজার্স গলাতে গিয়ে বেটাল হয়ে পড়ে যাচ্ছিল দরজার পাল্লায় হাত রেখে সামলাতে গেল, পাল্লাটা খুলে গেল আর গুণেন্দ্র মেঝেয় পড়ে গেল কাত হয়ে।

তখন ব্রতীন দেখতে পেল খাটে পা ঝুলিয়ে অবাক ভীত চোখে বসে মলি, কামিজটা কোমর পর্যন্ত নামানো, ব্রেসিয়ারটা ঘাড় থেকে পাখির ভাঙা ডানার মতো ঝুলে রয়েছে। গুণেন্দ্র মেঝে থেকে ওঠার আগেই মলি খাট থেকে লাফিয়ে নেমে গুণেন্দ্রকে হাত ধরে টেনে তুলল।

‘আমার বন্ধুকে দেখিস।’ কোমরে বেল্ট আঁটতে আঁটতে বলল গুণেন্দ্র। ‘সতেরো বছর ব্যবসা করছি এই প্রথম এমন ঘটল।’ গুণেন্দ্রর চোখে উদবেগ, কণ্ঠস্বর উত্তেজিত।

ব্রতীন কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। সে শোবার ঘরের দরজায় দাঁড়ানো মলির মুখের দিকে তাকাল। মুখটা বিমূঢ়।

‘গুণো এখন তুই কোথায় যাবি?’

‘রানাঘাট হাসপাতাল থেকে ফোন করেছিল কলকাতায় অপারেটারের অফিসে। ওরাই আমাকে ফোন করল, না মরে-টরেনি তবে সিরিয়াসলি ইঞ্জিওরড হয়েছে দুজন জাপানি।’ জুতোর ফিতে বেঁধে উঠে দাঁড়াল গুণেন্দ্র। জামাটা পরতে গিয়ে তার মনে পড়ল গেঞ্জি পরা হয়নি।

‘গেঞ্জিটা এনে দে।’

মলি দ্রুত গেঞ্জি দিল। মাথা দিয়ে গেঞ্জিটা গলিয়ে সে হাওয়াই শার্টটা পরে নিয়ে বলল, ‘এখন রানাঘাট যাব। তালাচাবি রইল, পরে চাবিটা তোর কাছ থেকে নিয়ে নেব।’ দু-হাত দিয়ে চাপড়ে চুল ঠিক করে সে মলির দিকে তাকাল, ‘ছোটকুকে বলে দিস যা শুনলি আর বতুকে তোর কাছে রেখে গেলুম, যত্ন করিস, চলি।’

সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নামার খটখট শব্দ ব্রতীন শুনল। লিফটের জন্য অপেক্ষা করার তর সয়নি। খোলা সদর দরজার দিকে তাকিয়ে সে বসে রইল। মলি এগিয়ে এসে দরজা বন্ধ করে দিল। শূন্য দৃষ্টিতে ব্রতীন তার দিকে তাকাল। গত পাঁচ মিনিটে একটা সাইক্লোন যেন তার সারাদিনে গড়ে ওটা বাস্তবকে অলীক করে দিল।

প্রায় ফিসফিসিয়ে মলি বলল, ‘ঘরে আসবেন?’

‘না। তুমি ওটা ঠিক করে পরে নাও।’ ব্রতীন আঙুল দিয়ে রুগণ স্তনদুটিতে দেখাল। মলি ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল। মিনিট দুয়েক পরে বেরিয়ে এল জুতো পরে, শরীর কামিজে ঢাকা। মুখ চোখ স্বাভাবিক। হাতে গুণেন্দ্রর ফেলে যাওয়া সানগ্লাসটা।

‘গুণোবাবু যত্ন করতে বলে গেছেন।’

ওর বলার সুরে ব্রতীন মজা পেল।

‘তুমি এখানে বসো।’ সোফায় চাপড় দিয়ে ব্রতীন বলল, ‘তোমার পদবি কী?’

মলি ব্রতীনের পাশে বসে বলল, ‘রায়’।

‘মলি ডাকনাম না ভালো নাম?’

‘দুই-ই।”

‘থাকো কোথায়?’

‘বিরাটি।’

‘কীভাবে আসো।’

‘ট্রেনে।’

‘বাড়িতে কে কে আছে?’

‘ভাই বোন, বাবা মা, দিদি। কথা না শুনলে গুণোবাবু রেগে যাবে।’

‘রেগে গেলে কী হবে?’

‘ছোটকুদাকে বলে দিলে আমাকে পার্লারে হয়তো আর রাখবে না। গুণোবাবুর কথা দেখেছি ছোটকুদা খুব মানে। ঘরে যাবেন না?’ মেয়েটির স্বরে অস্পষ্ট আবেদন। ব্রতীনের মায়া হল ওর মুখ দেখে। মলি অন্যমনস্কের মতো হাত রাখল ব্রতীনের আঙুলের উপর। ব্রতীন হাত সরিয়ে নিল না তবে অস্বস্তিতে রইল।

‘পার্লারের নাম কী?’

‘মুনলাইট।’

‘তুমি কতদূর পড়েছ?’

‘ক্লাস টেন পর্যন্ত, এ বছর মাধ্যমিক দেওয়ার কথা ছিল।’

‘দিলে না কেন?’

‘বাবার কারখানা বন্ধ হয়ে গেল। দিনের পর দিন না খেতে পেয়ে ছোটো ছোটো চারটে ভাইবোন যখন কান্না শুরু করে তখন পরীক্ষা-টরিক্ষা মাথায় উঠে যায়।’ মলির স্বরে আবেগ ফুটে উঠল। ব্রতীন মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থেকে মনে মনে বলল, মেয়েটা ভালো।

‘তোমাকে এই লাইনে আনল কে?’

‘আমাদের স্কুলেরই একটা মেয়ে। আমি জানি আমি দেখতে ভালো নই, তবু বয়স্ক লোকেরা আমাকে সবথেকে বেশি পছন্দ করে।’ মলির চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল।

‘বয়স্ক লোকেরা তোমাকে পছন্দ করে কিন্তু আমি কী খুব বয়স্ক লোক?’ ব্রতীনের স্বরে কৌতুক ফুটে উঠল। উত্তর দিতে মলি দ্বিধাগ্রস্ত। ব্রতীন তার হাত সরিয়ে দিয়ে ভ্রূ কুঁচকে তাকাল। ‘আমি বোম্বাইয়ে থাকি। আমার সঙ্গে তিনজন মেয়ের আলাপ আছে, একজন মারাঠি, একজন গুজরাতি, একজন গোয়ানিজ। কেউ আমাকে বয়স্ক বলেনি, তুমি আমাকে না জেনেই বয়স্ক ধরে নিলে। ব্যাড, ভেরি ব্যাড। আমার বয়স কত বলে মনে হয়?’

মলি সতর্কভাবে বলল, ‘তিরিশ।’

‘ঠিক করে আবার বলো।’

‘পঁয়ত্রিশ।’

‘আবার বলো।’

‘একটুও বাড়িয়ে বলব না আপনাকে চল্লিশের একটা দিনও বেশি মনে হয় না। আপনার একদমই ইচ্ছে হচ্ছে না ঘরে যেতে?’

‘না’। ব্রতীন কড়াভাবেই বলল এবং বলে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে রইল।

অপ্রতিভ হয়ে চোখ নামিয়ে হাতে ধরা চশমাটা নাড়াচাড়া করতে করতে মলি বলল, ‘এটা আপনার কাছে রেখে দিন, গুণোবাবুকে দিয়ে দেবেন।’

‘এখন তুমি কোথায় যাবে, পার্লারে?’

‘না। ছুটি দিয়ে দিয়েছে আজকের মতো।’

‘বাড়ি যাবে?’

মলি মাথা নেড়ে ব্যাগের ফিতেটা ঘাড়ের উপর ঠিক করে রেখে বলল, ‘ক-টা বাজে?’

ঘড়ি দেখে ব্রতীন বলল, ‘চারটে।’

‘অহহ।’ মলি যেন হতাশ হল। ‘এখনও দু-ঘণ্টা খোলা থাকবে।’

‘তাতে তোমার কি কোনো অসুবিধে হবে?’ ব্রতীন কথাটা বলেই বুঝল প্রশ্নটা ব্যক্তিগত হয়ে গেল, উচিত হয়নি।

‘অসুবিধে আর কী, এই সময়েই কাজ বেশি হয়। দুটো টাকা আসত।’

‘এখানে যে এলে সেজন্য টাকা পাবে? কিছুই তো হল না। গুণো তো সময়ই পেল না।’

‘সেজন্য আমি তো দায়ী নই, টাকা ঠিকই পাব।’

‘ওখানে আর কী করো, মেয়েরা আসে?’

‘বিউটি পার্লারে তো মেয়েরাই আসবে!’ মলি অবাক হল এমন বোকার মতো প্রশ্নে। ‘পুরুষরাও আসে। চুল কাটি, ফেসিয়াল করি, কলপ লাগাই, ভ্রূ প্লাক করি, ম্যাসেজ করে দি। এসবের জন্য অবিশ্যি আলাদা মাইনে পাই।’ মলি এবার উৎসাহিত হয়ে উঠল, ‘আপনি ম্যাসেজ করাবেন?’

‘না। এবার আমি যাব।’ ব্রতীন উঠে দাঁড়াল। গুণেন্দ্র চশমাটা বুক পকেটে রেখে তালা চাবিটা তুলে নিল। মলিও উঠে দাঁড়াল।

‘তাহলে আমি যাই।’

‘এসো।’

খটখট শব্দ তুলে মলি দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। ব্রতীন ওর জুতোর শব্দ শুনে বুঝল সাবধানে একটা একটা ধাপে পা রেখে নামছে।

হঠাৎ একটা কুকুরের ডাক আর মলির ভীত চীৎকার ভেসে এল। কোনো ফ্ল্যাট থেকে কুকুর বেরিয়ে পড়েছে। ডাকের গভীরতা থেকে ব্রতীনের মনে হল বড়ো কুকুর বোধহয় অ্যালশেসিয়ান। ভয় পেলে মলি সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নামছে। ব্রতীন ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে এসে সিঁড়ির মাথায় দাঁড়াল। লিফটে নামলে ওকে কুকুরের সামনে পড়তে হত না। খট খট শব্দ বেশ দ্রুত মিলিয়ে যাচ্ছে, বোধহয় ছুটে নামছে। কুকুরটাকে এক মহিলাকণ্ঠ ধমক দিতেই ওর ডাক আর দরজা বন্ধের শব্দ হল। সেই সঙ্গেই ব্রতীনের কানে এল হুড়মুড়িয়ে কারোর পড়ে যাওয়ার শব্দ।

মলি পড়ে গেল না কি! ব্রতীন সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নামতে শুরু করল। চারতলার ল্যান্ডিংয়ে মলি কাত হয়ে পড়ে রয়েছে। ব্রতীন দুটো কাঁধ ধরে ওকে বসাল। নির্জন সিঁড়ি, সব ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ। মলি ডান হাতটা উঁচু করে বলল, ‘তুলে দিন।’

ব্রতীন হাতটা ধরে হালকা শরীর একটা ছোট্ট টানেই উঠে এল। দাঁড়িয়েই মলি যন্ত্রণায় মুখ বিকৃতি করে বাঁ পা সামান্য তুলে দেওয়াল ধরে দাঁড়াল।

‘কী হল, চোট লেগেছে?’

‘ব্যথা করছে।’ বাঁ পা মেঝেয় রেখে দাঁড়িয়েই পা-টা তুলে নিল বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো। কান্নাধরা গলার মতো স্বরে বলে উঠল, ‘আমি হাঁটতে পারব না।’

‘তুমি দাঁড়াও, দরজায় তালাটা দিয়ে আসি।’

ব্রতীন দুটো করে সিঁড়ি লাফিয়ে লাফিয়ে উঠে গেল। ফ্ল্যাটে ঢুকে তালাটা হাতে নিয়ে চারধারে তাকাল। জানলাগুলো খোলা, বন্ধ করার সময় এখন নেই, থাক খোলা। সে আলো-পাখা বন্ধ করে দরজায় তালা লাগিয়ে নেমে এসে দেখল দেয়ালে দুটি হাত রেখে মাথা ঝুঁকিয়ে মলি দাঁড়িয়ে। অসহায় করুণ চোখে তাকিয়ে বলল, ‘আমাকে ফেলে যাবেন না তো?’

‘এই অবস্থায় কী ফেলে যাওয়া যায়। তোমাকে ডাক্তার দেখাতে হবে এখুনি। অ্যাঙ্কেলটা ভেঙেছে কি না দেখতে হবে। অমন একটা জুতো পরেছ কেন?’ ব্রতীন ধমকে উঠল। ‘যা পরে হাঁটতে পারো না, তা পরার দরকার কী?’

‘কুকুরটা যেভাবে দাঁত বের করে এগিয়ে এল তাতে আপনিও ভয় পেতেন। হাঁটতে পারব না আমায় একটু ধরে নামিয়ে দেবেন?’

‘বাড়ি যাবে কী করে? শেয়ালদা স্টেশন পর্যন্ত নয় ট্যাক্সিতে পৌঁছে দিতে পারি, তারপর?’

ব্রতীন দেখল মলির মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। দ্রুত কী কী যেন চিন্তা করে নিচ্ছে। সত্যিই বিপদে পড়েছে মেয়েটি। এই পা নিয়ে ট্রেনে উঠে একা বিরাটি যাওয়া সহজ কাজ নয়।

‘আগে চলো তো, পরে দেখা যাবে। হাঁটতে পারবে? জুতো খুলে হাতে নাও।’

বাঁ হাতে জুতো জোড়া, ডান হাত দিয়ে ব্রতীনের বাহু ধরে কোনোক্রমে মলি দুটো ধাপ নেমে দাঁড়িয়ে গেল। দু-চোখ ভিজে। ‘আমাকে হামাগুড়ি দিয়ে নামতে হবে, তাও বোধহয় পারব না।’

বাক্য ব্যয় না করে ব্রতীন মলিকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করল। বাসি সেন্টের একটা ক্ষীণ গন্ধ ওড়না থেকে পাওয়া ছাড়া অনুভবে ব্রতীন আর কিছু পেল না। দোতলায় পৌঁছে সে ‘সার্কাস নার্সিংহোম’ লেখা কাঠের বোর্ড দেখে খোলা দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল।

বড়ো ঘর। ডানদিকে একটা টেবলে বসে এক বয়স্কা মহিলা, টেবলে দু-তিনটে খাতা। ব্রতীনের মনে হল রিসেপশনিস্ট।

‘একে একবার দেখতে হবে, সিঁড়িতে নামতে গিয়ে পড়ে গেছে। ডক্টর আছে?’ মলিকে নামিয়ে দিল। একহাতে টেবলের কিনার ধরে সে দাঁড়াল, অন্য হাতে জুতো। একটা খালি চেয়ার দেখে ব্রতীন ওকে ধরে বসিয়ে দিল।

মহিলা কথা না বলে ভিতরের একটা ঘরে চলে গেলেন। একটু পরেই হাতকাটা গেঞ্জি আর ট্রাউজার্সপরা একটি লোক ঘুম-জড়ানো চোখে এসে বললেন, ‘কী হয়েছে, পা ভেঙেছে না মচকেছে?’ দেওয়ালের দিকে রোগীকে শুইয়ে পরীক্ষা করার টেবলটা দেখিয়ে বললেন, ‘যান শুয়ে পড়ুন। কোথায় পড়েছেন?’

ব্রতীন বলল, ‘চারতলার সিঁড়ি থেকে, কুকুরের তাড়া খেয়ে।’

‘লাম্বাদের কুকুর। ভীষণ পাজি ওটা। কেন যে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখে না।’

মলিকে তুলে ব্রতীন টেবলে শুইয়ে দিল। ডাক্তার তিন মিনিট ধরে বাঁ পায়ের গোছ ঘুরিয়ে বাঁকিয়ে টিপে পরীক্ষা করে একটা শ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘মনে হয় না ভেঙেছে, একটা এক্স-রে করিয়ে নিন, আপাতত ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছি, হাঁটাচলা একদম বন্ধ।’

ডাক্তার ব্যান্ডেজ করে দিলেন। প্যাডে লিখতে গিয়ে বললেন, ‘নাম কী?’

‘মলি রায়।’ মলি বলল।

‘বয়স?’

‘আঠারো।’

ডাক্তার চার-পাঁচটা বাক্য লিখে কাগজটা ব্রতীনের হাতে দিলেন। সে দিল মলির হাতে।

ব্রতীন নম্রস্বরে বলল, ‘আপনার ফি কত?’

মহিলা উত্তর দিলেন, ‘একশো টাকা আর ব্যান্ডেজের জন্য দশ টাকা।’

ব্যান্ডেজ বাঁধা পায়ে জুতো ঢুকল না, ডান পায়ে জুতো পরে মলি একপাটি হাতে নিয়ে ব্রতীনের মুখের দিকে তাকাল। ব্রতীন বুঝল, কোলে তুলে নিতে হবে।

মলিকে কোলে নিয়ে গেটের কাছে এসে ব্রতীন বিস্মিত দারোয়ানকে বলল, ‘ভাই একে একটু বসতে দেবে, আমি একটা ট্যাক্সি ডেকে আনি।’

পায়ের ব্যান্ডেজের দিকে তাকিয়ে দারোয়ান তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে মলিকে বলল, ‘জরুর! আপ বৈঠিয়ে।’

‘কোথায় যাবে, স্টেশনে?’

‘না। মাসির বাড়ি যাব, দর্জিপাড়ায় গোলাপবাগান স্ট্রিট।’

ব্রতীন প্রথমে বিশ্বাস করতে পারল না নিজের কানকে। গোলাপবাগান! ঠিক শুনেছে তো!

‘কী বললে, গোলাপবাগান?’

‘হ্যাঁ।’

ব্রতীনের চোখ থেকে মলির মুখ ধীরে ধীরে বদলে গিয়ে ফুটে উঠল সকালে শোনা নাম বুড়ির মুখটা। আশ্চর্য মিল দুটো মুখের, আশ্চর্য গোলাপবাগান নামটা। বুড়ি কাছেই থাকত আশু দেব লেনে। একটা বিরাট বস্তির পাশ দিয়ে গোলাপবাগান রাস্তাটা। যেদিন ইচ্ছা হত সে ওটা ধরে স্কুলে যেত। বস্তির বাইরের দিকে ছিল নানান ধরনের দোকান। ওখানেই কি না যেতে চাইল মলি? সে আবার জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি গোলাপবাগানে যাবে, ঠিক বলছ?’

‘হ্যাঁ, মাসি থাকে, পৌঁছে দেবেন?’ কাতর চোখে মলি মিনতি জানাল।

একটা ট্যাক্সি গেটের মুখে দাঁড়াল। ব্রতীন ছুটে গেল।

‘দর্জিপাড়া যাব, যাবেন?’

ট্যাক্সিওয়ালা সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘ভবানীপুর যাব।’

ব্রতীন এধার-ওধার তাকিয়ে খালি ট্যাক্সি দেখতে পেল না। বড়ো রাস্তায় এসে দাঁড়াল। হু হু করে গাড়ি চলেছে, খালি ট্যাক্সির দেখা নেই। গাড়ির স্রোতের মধ্য দিয়ে মিটার ফ্ল্যাগ তোলা একটি ট্যাক্সি দেখতে পেয়ে ‘ট্যাক্সি ট্যাক্সি’ চিৎকার করে হাত তুলে ডেকে দেখল ড্রাইভার তার দিকে একবার তাকাল মাত্র, দাঁড়াল না। মিনিট তিনেক পর তাকে অবাক করে তার পাশের রাস্তা থেকে একটা খালি ট্যাক্সি বেরিয়ে এল এবং দর্জিপাড়ায় যেতে রাজি হল।

ব্রতীনের বাহু ধরে এক পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে মলি ট্যাক্সিতে উঠল। পথে ব্রতীন একবারই কথা বলল, ‘কালকেই এক্স-রে-টা করিয়ে নিয়ো।’ গোলাপবাগান বস্তির সামনে ব্রতীনের হাত ধরে মলি নামল।

‘এবার যেতে পারবে তো?’ ব্রতীন ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে রেখে বলল। এই ট্যাক্সিতেই সে বাড়ি ফিরে যাবে ভেবে রেখেছে। বস্তির একটা মুদির দোকানে দুজন বাচ্চচা খদ্দের দাঁড়িয়ে। ট্যাক্সি থেকে মলিকে নামতে দেখে কৌতূহলী হয়ে তারা তাকিয়ে রয়েছে। পাশের চুলকাটার দোকানে একমাত্র নাপিতটি একজনকে দাড়ি কামিয়ে দিচ্ছে। পান সিগারেটের দোকানদার মাচায় বসে, তার নীচে মুড়ি ছোলার দোকান। মলি অসহায় চোখে তার উপর চোখ বুলিয়ে বুঝল কেউ তার সাহায্যে আসবে না। চেনা একজনকেও সে দেখতে না পেয়ে বলল, ‘আমাকে একটু ধরে পৌঁছে দেবেন?’

পঁয়ষট্টি টাকা ভাড়া চুকিয়ে ব্রতীন ট্যাক্সি ছেড়ে দিল। ইট-পাতা সরু পথ রাস্তা থেকে বস্তির ভিতর ঢুকে গেছে। ব্রতীন যতদূর মনে করতে পারল পথটা আগে মাটির ছিল একপাশে ছিল মাটির খোলা ড্রেন এখন সেটা সিমেন্ট বাঁধানো। ইলেকট্রিক পোস্ট। রাস্তার ধারে একতলা বাড়িগুলো একই রয়েছে, চুন-সুরকির দেওয়ালের ঘর, টিনের বা টালির ছাদ। তবে আগের থেকে পরিচ্ছন্ন বলে তার মনে হল।

এক হাতে তার বাহু ধরে হাঁটতে মলিকে জখম পা-টা জমিতে রাখতে হচ্ছে। যতবারই রাখছে যন্ত্রণায় মুখ বিকৃত করছে দাঁত চেপে।

‘আর কতটা?’

‘ওই বাড়িটার পাশের গলিতে।’ মলি জুতোধরা হাত তুলে দশ-বারো মিটার দূরের বাড়িটা দেখাল। ব্রতীন পাঁজাকোলা করে মলিকে তুলে নিয়ে গলির দিকে এগোল। একটা বাড়ির জানলা থেকে স্ত্রীলোক কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হল রে তোর নিমি?’

গলি দিয়ে ঢোকার জন্য ব্রতীনকে পাশ ফিরতে হল। মাত্র দু-হাত চওড়া গলিটা।

‘এই যে এই বাড়িটা।’

ব্রতীন দরজার সামনে দাঁড়াল। নীচু ছোটো দরজা। মলি হাত বাড়িয়ে আঙুল দিয়ে দরজার কড়া টানতেই ওধারে ‘খট’ শব্দ হল ছিটকিনি পড়ার।

আবার পাশ ফিরে ব্রতীনকে ঢুকতে হল। ছোটো ঘর, দুটি ছোটো জানলা, ঘরে আলো খুবই কম। তক্তাপোশে ময়লা সবুজ শাড়ি-পরা এক স্ত্রীলোক শুয়ে। মলিকে দু-হাতে কোলে নিয়ে একজন অপরিচিত পুরুষকে ঢুকতে দেখে স্ত্রীলোকটি অবাক হয়ে ধড়মড়িয়ে উঠে বসে গায়ের কাপড় ঠিকঠাক করতে করতে ভীত স্বরে বলে উঠল, ‘নিমি! কী হয়েছে?’

মলিকে তক্তাপোশের উপর বসিয়ে দিয়ে ব্রতীন বলল, ‘পা মচকেছে কিংবা হয়তো গোছের হাড় ভেঙেছে, এক্স-রে করলে সঠিক জানা যাবে।’

স্ত্রীলোকটি নেমে এসে আলোর সুইচ টিপল। কম পাওয়ারের খোলা বালব। মাথায় ঘোমটা তুলে দিয়ে ব্রতীনের দিকে ফিরে দাঁড়াল। সরু কাঁধ, রুগণ দেহ, কণ্ঠার হাড় উঁচু হয়ে, গালদুটি বসে গিয়ে হনুর হাড় প্রকট হয়ে রয়েছে, উচুঁ কপালটা শুধু চামড়ায় মোড়া, রগের উপর ফুলে রয়েছে শিরা দুটো। বাহুদুটি শীর্ণ। ব্রতীন পলকেই বুঝে গেল অপুষ্টিতে ভুগছে, নানান ব্যাধি শরীরটাকে জীর্ণ করে দিয়েছে।

কিন্তু মুখখানি!

ব্রতীন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। এই তো সেই বুড়ি। তিরিশ বছর আগে যাকে একটুখানির জন্য বারান্দায় দেখতে পাবে বলে আশু দেব লেনের মোড়টা ঘুরত শ্বাসবন্ধ করে। দেখতে পেলেই মনে হত এক হাজার গোলাপ বুকের মধ্যে ফুটে উঠল। শরীর যেমনই হোক মুখের সেই আদল চোখের সেই চাহনি এখনও রয়ে গেছে।

‘কোথায় পা ভাঙল? দেখো দিকি কী মুশকিলে ফেললি। এনাকে কোথায় পেলি?’

‘আমাদের পার্লারে। উনি সিঁড়ি দিয়ে উঠছেন আমি নামছি। সিঁড়িতে জল ছিল হড়কে পড়ে গেলুম। উনি তুলে ধরে ডাক্তারখানায় নিয়ে গেলেন, ডাক্তার ব্যান্ডেজ করে দিল। তারপর উনি ট্যাক্সি করে নিয়ে এলেন।’

ব্রতীন অবাক হয়ে নিমির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। কী নির্বিকার মুখে বানিয়ে বলল! এবার সে বুঝতে পারল মেয়েটা তাকে যা বলেছে, বাবা, ভাইবোন, দিদি, বিরাটিতে বাড়ি, গোলাপবাগানের মাসি, সবই মিথ্যে এমনকী নিজের নামটাও। মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়েছে কি না বিশ্বাস হচ্ছে না। ওকে নিমি বলে ডাকল দুজন, এটাই ওর আসল নাম। তবে পার্লারে কী কাজ করে সেটা ওর মা বোধহয় জানে না।

‘আপনি দাঁড়িয়ে কেন, বসুন।’ মলির মা তক্তাপোশে হাত বুলিয়ে বলল।

ময়লা নীল চাদরে ঢাকা পাতলা তোশকটার চিটচিটে কালো একটা কোণ বেরিয়ে। ব্রতীন ইতস্তত করে নিমির পাশে বসল। এই মানুষটাই তিরিশ বছর আগের সেই মেয়েটি কি না জানার কৌতূহল প্রবলভাবে তাকে পেয়ে বসেছে। যদি সঠিক হয় তা হলে আজও কি ওর মনে আছে মাথায় ছোলা ছুড়ত, একদিন একটা পাকানো কাগজও ছুড়েছিল।

‘একটা কথা জিজ্ঞাসা করব, আপনি কি কোনোদিন আশু দেব লেনে থাকতেন?’

কয়েক সেকেন্ড ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে নিমির মা বলল, ‘কেন বলুন তো? হ্যাঁ থাকতুম। আমার বাপের বাড়ি সতেরোর চার আশু দেব লেন।’

‘দোতলায় একটা বারান্দা ছিল, একটা চন্দনা পাখি ছিল।’

উজ্জ্বল হয়ে উঠল নিমির মা-র চোখ। গলার কণ্ঠা ওঠানামা করল। ‘আপনি কী ও-পাড়ায় থাকতেন?’

‘না, ও-পাড়া দিয়ে স্কুলে যেতাম। তখন দেখেছি পাখিটাকে ছোলা খাওয়াতেন।’

ব্রতীন দেখল তিরিশ বছরের ওপার থেকে ভেসে আসছে স্মৃতি নিমির মা-র দুটি চোখে। মনে করার চেষ্টা করছে। তিরিশ বছর এমন কিছু বেশি সময় নয়। হেসে ফেলল। এবার মনে পড়ে গেছে। ব্রতীনও হাসতে শুরু করল।

‘মনে পড়েছে? আপনার নাম তো বুড়ি, তাই না?’

‘হ্যাঁ।’

‘নামটা আজই জানলুম। সকালে ও-পাড়ায় গেছলুম, একটা লোককে জিজ্ঞেস করতেই বলল, বুড়ি? সে তো গোলাপবাগান বস্তির একটা ছেলেকে বিয়ে করেছে। নিমির মুখের সঙ্গে আপনার মুখের ভীষণ মিল, ওকে দেখেই আপনার কথা মনে পড়ে, তারপর ও যখন বলল গোলাপবাগান যাবে তখন কেন জানি মনে হল, আচ্ছা একবার গিয়ে দেখি তো সেই মেয়েটিই কি না। তা হলে আমাকে মনে পড়েছে?’

বুড়ি মাথাটা বাঁদিকে অনেকখানি হেলিয়ে দিল। নিমির চোখে বোকার মতো চাহনি। সে ওদের দুজনের মুখের দিকে পালটাপালটি তাকিয়ে কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করল। একটা ব্যাপার বুঝেছে এই লোকটা যখন স্কুলে পড়ত তখন মাকে চিনত।

‘তখন বয়স অনেক কম ছিল, বুঝতুম না অনেক কিছুই।’ বুড়ির স্বর নদীর ওপর দিয়ে ভেসে যাওয়া সান্ধ্য বাতাসের মতো। স্মৃতির কণাভরা, স্নিগ্ধ তাপজুড়ানো। ওর চোখ দেখে ব্রতীন অনুমান করল, একে একে ছবির মতো অতীত দিনগুলো আঁকা হয়ে যাচ্ছে মনের পটে।

‘কম বয়সটা তো সেই জন্যই, না বুঝে অনেক কিছু করে ফেলা যায়। আর যায় বলেই কম বয়সটা চিরদিন কমই থেকে যায়।’ ব্রতীন কথাগুলো বলে উঠে দাঁড়াল।

‘চললেন?’

বুড়ির গলার স্বরে কী যেন রয়েছে। ব্রতীন ‘হ্যাঁ’ বলতে গিয়েও পারল না। বুড়ির চাহনিতে চাপা হাসির ছটা, যেন জানত ব্রতীন যাবে না এবং গেল না বলেই চোখদুটি হেসে উঠল। তারা প্রায় সমবয়সি কিন্তু অভিজ্ঞতায় অসম স্তরে। তিরিশ বছর আগে তারা ছিল একই স্তরে। তারপর থেকে একজন উঠেছে অন্যজন পড়েছে। দুজনের আজ আর একই স্তরে ফিরে আসা সম্ভব নয় ব্রতীন তা জানে। শুধু স্মৃতি দিয়ে বয়স কমিয়ে কতটা আর সমান সমান হওয়া যায়। সে আবার তক্তাপোশে বসল।

‘নিমি চলফেরা করতে না পারলে আমি মুশকিলে পড়ে যাব। সংসারে একমাত্র রোজগেরে তো ও-ই। আমি আর ক-টা টাকাই বা রোজগার করি। চারদিন কাজে বসতে পারিনি, কত কাজ পড়ে রয়েছে, ওই দেখুন না।’ বুড়ি ক্লান্ত আঙুল তুলে ঘরের জানলার দিকটা দেখাল।

ব্রতীন দেখেছিল কিন্তু বিশেষভাবে নজর করেনি। একটা বেডকভারে ঢাকা সেলাই মেশিন। তার উপর পাট পাট স্তূপ করে রাখা সাদা-হলুদ-সবুজ রঙের কাপড়। বুড়ি বলল, ‘সায়ার কাপড়। মাপ করে কেটে দিয়ে যায় আমি সেলাই করে দি। এখনও চল্লিশটা পড়ে রয়েছে। পুজোর জন্য কাজ এখন থেকেই শুরু হয়ে গেছে, করে দিতে না পারলে অন্য লোককে দিয়ে দেবে।’

ব্রতীন বলল, ‘কাজ করার আর কেউ নেই?’ সে লক্ষ করেছে বুড়ির সিঁথি, সিঁদুর নেই সুতরাং তার প্রশ্নটা অবান্তর।

বুড়ি হাল ছেড়ে দেওয়া স্বরে বলল, ‘আর আমার কে থাকবে, নিমির বাবা তো দশ বছর আগে শক খেয়ে মই থেকে পড়ে মরে গেল। গরমেন্টের চাকরি করত। তারপর থেকেই তো আমরা দুজন টেনেটুনে চালাচ্ছি।’

ব্রতীন ভাবল জিজ্ঞাসা করবে, বাপের বাড়ির কেউ সাহায্য করে না? কিন্তু জিজ্ঞাসাটা ব্যক্তিগত পর্যায়ে নাক গলানোর মতো হয়ে যাবে। বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করা মেয়ের সঙ্গে বাপের বাড়ির সম্পর্ক তিক্ত হবে, এটা তো জানা কথাই। অনেক কথা জিজ্ঞাসা করার আছে যা ঠাট্টার ছলেও এই বয়সে জিজ্ঞাসা করা যায় না, বিশেষত বেশি মাত্রায় পাকা মেয়ের সামনে।

‘আপনি এখন কী করেন? ক-টি ছেলেমেয়ে?’

ব্রতীন এই প্রশ্নটার অপেক্ষাতেই ছিল। হাসি চেপে বলল, ‘বোম্বাইয়ে কুড়ি বছর আছি। ওখানে একটা ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করি। ছেলেমেয়ে নেই, বিয়েই করিনি। সংসারে শুধু মা।’

বুড়ি অবাক হয়ে বলল, ‘বিয়ে করেননি, কেন!’

প্রশ্ন নয় বিস্ময়। চাকরি করে অথচ বিয়ে করেনি এমন পুরুষ মানুষ পৃথিবীতে থাকতে পারে? বুড়ি যেন এই প্রথম এমন একটা লোককে দেখছে। নিমিও অবাক হয়ে তাকিয়ে। এতক্ষণ সে ওদের কথা শুনে যাচ্ছিল চুপ করে, এইবার বলল, ‘বললেন তিনটে মেয়ের সঙ্গে আলাপ আছে!’

‘আলাপ থাকলেই কি সেটা প্রেম? তিনজনেরই বিয়ে হয়ে গেছে। ওদের স্বামীরা আমার বন্ধু। আর বিয়ে করিনি কেন? করতেই হবে এমন কোনো মাথার দিব্যি আছে কি? আসলে আমি ঝাড়া হাতপায়ে থাকতে ভালোবাসি। বিয়ে মানেই তো নানান ঝামেলায় জড়িয়ে যাওয়া।’

বুড়ি বলল, ‘মা বলে না বিয়ে করার জন্য?’

‘বলত। বলে বলে হাল ছেড়ে দিয়েছে। যাই হোক নিমি কাল তুমি অবশ্যই এক্সরে করে এখানকার কোনো ডাক্তারকে দেখাবে। আর ওই জুতো জোড়া কখনো পরবে না।’ ব্রতীন উঠে দাঁড়াল।

‘চললেন?’

এই নিয়ে দ্বিতীয়বার বুড়ি বলল কথাটা। ব্রতীন ওর চোখে আর হাসি দেখতে পেল না। সে নিমির মাথায় চুল নাড়িয়ে এলোমেলো করে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল, এখানে থাকার আর কোনো আগ্রহ তার নেই, কৌতূহল মিটে গেছে। বস্তি থেকে রাস্তায় পা দিয়েই তার মনে হল বুড়ির ভালো নামটা তো জানা হল না! পর মুহূর্তেই সে নিজেকে বলল, জানার দরকার কী, জীবনে আর তো দেখা হবে না। সে হাতঘড়িতে সময় দেখল এখান থেকে বাড়ি যেতে কত মিনিট লাগবে? স্কুলে পড়ার সময় তার ঘড়ি ছিল না, কলেজে ভরতি হতে মা দিয়েছিল বাবার দামি রোলেক্স ঘড়িটা, সেটা এখন তোলা আছে।

জোরে হেঁটে ব্রতীনের বাড়ি পৌঁছতে ছ-মিনিট লাগল। দোতলাটা তাদের অংশের, তিনতলাটা কাকার। মেয়ে দেবীকে নিয়ে থাকেন বিপত্নীক ক্ষীরোদপ্রসাদ, বয়স উনসত্তর, মেয়ে দেবী ছাড়া আছে এক ছেলে শিবপ্রসাদ, সে থাকে শিলিগুড়িতে। রায়চৌধুরী পরিবারের তিনটি কয়লার খনি ছিল ঝরিয়ায়।

সেগুলো সরকারের হাতে চলে যাবার পর ক্ষীরোদপ্রসাদ যে টাকা খেসারত হিসাবে তাঁর ভাগে পেয়েছিলেন তাই দিয়ে শিলিগুড়িতে হোটেলের ব্যবসায়ে নামেন। বগলাপ্রসাদ তখন মৃত। অনসূয়া তার নাবালক ছেলে ব্রতীনকে লেখাপড়ার দিকে এগিয়ে দেবার জন্য বিষয়-সম্পত্তির বোঝা আর বাড়াতে চাননি, শ্বশুরবাড়ির দোতলায় বড়ো তিনটি ঘর আর বারান্দা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকেন।

ক্ষীরোদপ্রসাদের প্রগাঢ় ইচ্ছা ছিল সপ্রতিভ, সুদর্শন, বলিয়ে কইয়ে ইংরাজি নবিশ, ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেবার। জামাই যেন পাঁচজনকে বলার মতো জামাই হয়। সল্ট লেকে যে জমিটি কিনেছিলেন সেখানে একতলা একটি বাড়ি করে দিয়ে এবং শিলিগুড়ির হোটেলের স্বত্ব লিখে দিয়ে তিনি শিবপ্রসাদকে পরিবার থেকে আগেই আলাদা করে দিয়েছেন। আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে শিবপ্রসাদের পরিচয় ‘হোটেলওয়ালা শিবু’, সে কোনোক্রমে বি এ পাস কিন্তু ব্যবসায়ে সফল, দার্জিলিংয়ে একটি পুরনো হোটেল কেনার কথাবার্তা পাকা করতে এখন কলকাতায় এসেছে। ক্ষীরোদপ্রসাদের বাসনা তাঁর ছেলে পূরণ করতে পারেনি, শিবু ধুতি-পাঞ্জাবি থেকে জিনসে উত্তীর্ণ হওয়ায় চূড়ান্ত ব্যর্থ, ইংরেজিতে দ্রুত বাক্যালাপ একদমই পারে না ভগবতীচরণ আর্য বিদ্যালয়ের এই ছাত্রটি।

পৈতৃক বাড়ির নিজের অংশ ক্ষীরোদপ্রসাদ ইচ্ছাপত্র মারফত দেবীকে দান করে রেখেছেন এবং অন্যান্য অস্থাবর জিনিস ও নগদ কয়েক লক্ষ টাকা। দেবীকে সব কিছু দিয়ে যান তার বিবাহ বিচ্ছেদের পর এবং শিবপ্রসাদের অনুরোধে। শিবু কখনো উঁচু গলায় বাবার সঙ্গে কথা বলেনি, তর্ক করা তো দূরের কথা। একবারই শুধু রেগে উঠে বলেছিল, ‘শখ মিটেছে তো! উচ্চচশিক্ষিত ফরফর করে ইংরিজি বলিয়ে জামাই করার শখ মিটেছে তো! তোমার জন্যই দেবীর আজ এই অবস্থা। না দেখেশুনে শুধু মুখের কথা শুনেই বিয়েটা দিলে। একবার খোঁজখবরও নিলে না ছেলেটার চরিত্র কেমন। হাজার হাজার মাইল দূরে কোথায় ন্যাশভিল ফিস্ক ইউনিভার্সিটি আর কোথায় কলকাতা। ওর ভবিষ্যৎ কী হবে সেটাই এখন ভাবো। কোথায় থাকবে, কী খাবে!’

ক্ষীরোদপ্রসাদ মুখ নীচু করে শুনে যাচ্ছিলেন। শুকনো গলায় বলেছিলেন, ‘তুই দেখবি তোর বোনকে।’

শিবপ্রসাদ বলে, ‘তাই দেখব। নাগদ যা টাকাকড়ি আছে আর এই বাড়ি ওকে দিয়ে দাও, কালই উকিলের কাছে যাও, আমার কিছু চাই না। উইলের সাক্ষী আমি হব।’

অবাক হয়ে ক্ষীরোদপ্রসাদ বলেন, ‘তোর কিছুই চাই না!’

‘না চাই না। আমি যা পেয়েছি তাই দিয়ে আমার চলে যাবে। যদি পুরুষমানুষ হই তাহলে এই জীবনেই এর বিশ গুণ বাড়াব কিন্তু দেবী তো তা পারবে না। ও বহু বছর বাঁচবে, ওর কথা ভাবো।’

ব্রতীন এসব কথা পরে কাকার মুখে শুনেছিল। এরপর থেকে শিবুকে সে অন্য চোখে দেখতে শুরু করে। গতদিন সন্ধ্যায় শিবু এসেছিল বাবার সঙ্গে দেখা করতে বউকে নিয়ে। বহু বছর পর শিবুর সঙ্গে তার দেখা হল। শিবুর সল্ট লেকের একতলা বাড়ি এখন দোতলা। শিলিগুড়ি থেকে এলে তারা দোতলায় থাকে। একতলাটা ভাড়া দিয়েছে ব্রতীনের বন্ধুর ভাই সলিলকে। রবিবার শিবুর বউ দুপুরে সল্ট লেকের ফ্ল্যাটে খেতে বলেছে ননদ ও ভাসুরকে।

গোলাপবাগান থেকে ফিরে ব্রতীন তিনতলায় গেল তার ঘরের চাবি চাইতে। সকালে বেরোবার সময় ঘরে তালা দিয়ে চাবিটা রেখে গেছল দেবীর কাছে। দিনরাতের কাজের লোক কমলের মা তাকে চাবি দিয়ে বলল, ‘দিদিমণি এই মাত্তর বেরোল। পাশের মল্লিকদের বাড়িতে গেছে ওদের বড়ো মেয়ে এসেছে।’

বড়ো মেয়ে মানে বাসন্তী। কত বছর ওকে দেখেনি মনে করার চেষ্টা করল ব্রতীন স্নান করার সময়। সন্ধেবেলায় স্নান না করলে রাতে ঘুম আসে না। অঙ্কে ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে এম এ পাশ করে বাসন্তী বেলেঘাটায় একটা স্কুলে পড়াত, মাসকয়েক পরে ব্রতীন শোনে বাসু বর্ধমানে একটা কলেজে পড়াচ্ছে কলকাতা থেকে যাতায়াত করে। মুম্বইয়ে থাকার সময় শোনে বাসুর বিয়ে হয়েছে এক ডবলু বি সি এস-এর সঙ্গে। তারপর শোনে বাসু কলকাতার উইমেনস কলেজে পড়াচ্ছে। বছর পনেরো আগে ওকে শেষ দেখেছে বাসস্টপে তখন বাসুর বিয়ে হয়ে গেছে। ব্রতীন আগেই বাসস্টপে অপেক্ষা করছিল, ভিড় দেখে সে একটা বাস ছেড়ে দেয়। বাসু আসে তারপর। তাকে দেখে যথারীতি বাসু হাসে, একটু দূরে দাঁড়ায়। ব্রতীন এগিয়ে গিয়ে বলে, ‘কোথায়?’

‘শ্বশুরবাড়ি, সরকার হাটে।’

‘সেটা আবার কোথায়?’

বাসু হেসে ফেলে। ওর গজদাঁত আর বাঁ গালের টোল দেখতে ব্রতীনের বরাবরই ভালো লাগে। সেদিন আরও ভালো লাগল। বাসু আর আগের মতো রোগা নেই। ব্লাউজের চাপে ঘাড়ের মাংস ফুলে রয়েছে, কোমরে চর্বির ভাঁজ হালকাভাবে পড়েছে। গায়ের রং উজ্জ্বল হয়ে সোনার মতো, নিতম্ব ভারী হয়েছে। বাসুকে বেশ সুন্দর আর সুখী মনে হয়েছিল ব্রতীনের। বিবাহ সুখের হলে মেয়েদের রূপ খুলে যায় বলে সে শুনেছে, বাসু তার জ্যান্ত নির্দশন।

‘সবাই বলে সেটা আবার কোথায়। সবাইকে উত্তর দিতে দিতে মুখ ব্যথা হয়ে গেছে। সরকার হাট হল বেহালা ছাড়িয়ে ঠাকুরপুকুরেরও দক্ষিণে একটা জায়গা, নতুন বসত হচ্ছে।’

‘কর্তা শুনেছি সরকারি অফিসার, কোথায়?’

‘স্টেট ইলেকট্রিসিটি বোর্ডে।’

‘এখনও কলেজে পড়াচ্ছ?’

‘হ্যাঁ, তবে ছাড়ব। কলকাতা-বর্ধমান যাতায়াত আর পারছি না। ছেলেকে যে সময় দেব তারও সময় আর পাচ্ছি না।’

‘ছেলের বয়স কত?’

‘দু বছর।

‘এখান থেকে বেহালার দিকে টানা কোনো বাস যায় না, তোমাকে নিশ্চয় এসপ্ল্যানেডে বাস বদলাতে হবে।’ ব্রতীন হাত তুলে একটা খালি ট্যাক্সি থামাল। ‘আমি গোলপার্ক যাব, চলো তোমাকে নামিয়ে দেব।’

ব্রতীন যাবে বউবাজার ছোটোমাসির বাড়ি মাকে আনতে। কাল থেকে অনসূয়া ছোটোবোনের বাড়িতে রয়েছেন। ‘গোলপার্ক যাব’ এই মিথ্যা কথাটি কেন বলল, তাই নিয়ে ব্রতীনের তখন চিন্তা করার অবকাশ ছিল না। ব্রতীনের ডাক শুনে বাসন্তী দ্বিরুক্তি না করে ট্যাক্সিতে উঠে পড়ল।

‘এই পাতাল রেলের কাজ যে কবে শেষ হবে। সাত-আট বছর আগে দেখেছি খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হয়েছে আজও চলছে। রাস্তাঘাটের অবস্থা দেখো।’ জানলা দিয়ে ব্রতীন বাইরের দিকে তাকাল।

‘এটা হলে খুব সুবিধে হবে।’ ছোট্ট মন্তব্য করে বাসন্তী কী যেন ভাবতে শুরু করল। ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়ে ট্যাক্সিটা ঝাঁকুনি দিতে দিতে মন্থর গতিতে চলেছে। জানলা দিয়ে মুখ বার করে ব্রতীন দেখছে রাস্তার মাঝে গর্ত করে লোহার বিম দিয়ে খাঁচার মতো কাঠামো বানানো, তার উপর কংক্রিটের ছাদ হবে। কিছু পরেই রাস্তা খোঁড়ার কাজ চলছে। উটের মতো গলা নামিয়ে রাস্তা ঠোকরাচ্ছে যন্ত্রচালিত মোটা শাবল। লোকে ভিড় করে দাঁড়িয়ে দেখছে। রাস্তার ভাঙা টুকরো কুড়িয়ে যন্ত্রই ঢেলে দিচ্ছে লরিতে। লরি চলে যাচ্ছে ফেলে দিয়ে আসতে। কোথায় ফেলছে? ব্রতীন মনে মনে ফেলার জায়গাটা খুঁজতে লাগল।

‘তুমি এখনও বিয়ে করোনি? কবে আর করবে?’

অপ্রত্যাশিত প্রশ্ন! এটা প্রশ্ন না কৌতূহল? দরকার কী এমন কৌতূহলের। দুটো প্রশ্ন একসঙ্গে করেছে, ‘করোনি?’ আর ‘কবে করবে?’ প্রথমটার উত্তর জেনেই দ্বিতীয়টা করেছে। ব্রতীন হাসল।

‘না এখনও করিনি।’ এবার সে তৃতীয় প্রশ্নটা আশা করল, ‘কেন করোনি?’

‘করার মতো মেয়ে এখনও পেলে না?’

ব্রতীন চুপ করে রইল। বাসন্তী আড়চোখে তার মুখ লক্ষ করে নিল তা সে বুঝতে পারল।

‘ঠিকই বলেছ।’

‘মিশুকে হলে পেয়ে যেতে।’

‘আমি মিশুকে নই তোমায় কে বলল?’ ব্রতীন তাকাল ওর মুখের দিকে। বাসন্তী জানলার দিকে মুখ ফেরাল, ঠোঁটের কোণ টিপে থাকায় গালে টোল পড়েছে।

‘কেউ বলেনি। আমি জানি।’

‘কবে জানলে?’

‘অনেক দিন।’ বাসন্তী জানলার বাইরে মগ্ন হওয়ার চেষ্টা করল।

কতদিন? ব্রতীন বছরগুলো ঠেলেঠেলে পিছিয়ে গিয়ে আটকে গেল একতলার পড়ার ঘরে। দুজনের মাঝখানে উমাপদবাবু একাগ্রমনে টেবলে ঝুঁকে এগারোর উপপাদ্য তাকে বোঝাচ্ছেন। বাসন্তী উমাপদবাবুর পিঠের উপর দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে, মুহূর্তের জন্য চোখাচোখি, বাড়ি যাবার জন্য বই খাতা গুছিয়ে বাসন্তী চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল। সন্তর্পণে সে চোখ তুলল, পলকের জন্য চোখাচোখি। হ্যাঁ, অনেকদিন আগে তো বটেই। সে কোনোদিনই মিশুকে হতে পারেনি। পারলে কী হত?

‘তুমিও তো মিশুকে নও।’ কথাটা বলে ব্রতীনের মনে হল এটা কোনো মন্তব্য নয়, অভিযোগের মতো তার নিজের কানেই শোনাল।

‘জেঠিমাকে বলব তোমার জন্য মেয়ে দেখতে নইলে চিরকাল আইবুড়োই থেকে যাবে।’

‘থাকি না, মন্দ তো লাগছে না। তোমার কেমন লাগছে?’

‘মন্দ তো লাগছে না।’ বাসন্তী চোখ ফিরিয়ে এনে তাকাল এবং হাসল কানের উপর থেকে চুল সরিয়ে দিয়ে।

এরপর আর তাদের কথা হয়নি। চৌরঙ্গিতে সুরেন ব্যানার্জি রোডের মোড়ে বাসন্তী নেমে যাবার সময় বলল, ‘আবার কবে দেখা হবে কে জানে।’

ট্যাক্সি এগিয়ে গিয়ে ঘুরল বউবাজারে যাবার জন্য। ফেরার সময় ব্রতীন দেখল অপেক্ষমাণ যাত্রীদের জটলার মধ্যে বাসন্তী হাতব্যাগটা বুকের কাছে ধরে দাঁড়িয়ে পরনে সবুজ খোলে খয়েরি বরফিকাটা নকশার তাঁতের শাড়ি। বাসন্তীকে সেই তার শেষবারের মতো দেখে নেওয়া।

স্নান করে এসে ব্রতীন খাটে শুয়ে পড়ল, পরনে পাজামা পাঞ্জাবি। কমলের মা জানতে এসেছিল ভাত খাবে কি না, ঢাকা দেওয়া আছে খেলে গরম করে দেবে। সন্ধ্যাবেলায় ভাত খাওয়ার মতো খিদে তার হয়নি। গুণোর সঙ্গে যে খেতে যাবে তা ঠিক করা ছিল না। গুণেন্দ্রর কথা মনে পড়তে সে মুখ ফিরিয়ে টেবলে রাখা চশমাটা আর চাবিটাকে দেখে নিল। ও দুটো দেখে তার মলিকে অর্থাৎ নিমিকে মনে পড়ল সেই সঙ্গে বুড়িকেও। বুড়ি বেশিদিন বাঁচবে না। অভাব নিয়ে ওইরকম বস্তির ঘরে থেকে ওর রুগণ শরীর যক্ষ্মাকে ঠেকাতে পারবে না। তখন মেয়েটার কী হবে? তারও তো স্বাস্থ্য বলে কিছু নেই। যে ব্যবসা শুরু করেছে তাতে যে কোনোদিনই এইডস ওকে ধরতে পারে। মারা গেলে বেঁচে যাবে মা আর মেয়ে দুজনেই। জীবনকে দেওয়ার মতো কোনো পুঁজিই তো ওদের নেই।

চিন্তাটা বিষণ্ণতার দিকে চলে যাচ্ছে, ব্রতীন অস্বচ্ছন্দ বোধ করল। একটা বই পেলে ভালো হত। আলমারিতে কিছু পুরনো বাংলা বই এখনও সাজানো রয়েছে। ব্রতীন উঠে গিয়ে কাচের পাল্লা খুলে বইগুলো সাবধানে নাড়ল। মলাটগুলো ঢিলে, পাতাগুলো ভিজেভিজে, জোড়া লেগে কালো ছ্যাতলা পড়েছে, বিন্দু বিন্দু ফুটো পোকায় কাটার জন্য। একটা বই দেখে সে চমকে উঠল : ‘বাগদি ডাকাত!’ ক্যালেন্ডারের মোটা কাগজের মলাট। মা-র কাজ। মলাটে মোটা অক্ষরের লাল কালি দিয়ে বইয়ের নাম লেখা। এটা সেই পুরনো বইয়ের দোকান থেকে কেনা, মা ছোঁ মেরে বইটা নিয়ে বলেছিল, ‘আমি আগে পড়ব, সেই কবে পড়েছিলুম।’

সেই কবে পড়েছিলুম, ব্রতীন মনে মনে আওড়াল অনসূয়ার কথাগুলো। বইটা খুলেই চোখ পড়ল ছয়ের অধ্যায়ে। পড়তে শুরু করল দাঁড়িয়েই :

‘ঘোর বন। গাঢ় অন্ধকার। নাগিনী উচ্ছ্বাসে ফুলে উঠেছিল। এখন তার দেহ একটু একটু করে কমে আসছে। কিন্তু স্রোতের বেগ তখনও প্রখর, সেই স্রোতধারা ধরে একখান নৌকা দক্ষিণ দিকে ছুটে চলেছে।

‘তার আরোহীরা সকলেই নীরব, তীরের এক জায়গা থেকে হঠাৎ ঘোর ঘর্ঘর শব্দ হতে লাগল। মনে হল, রাত্রির সেই পাথরের মতো জমাট অন্ধকার ও নিস্তব্ধতাকে কে যেন খুব মোটা দাঁতওয়ালা বিষম ভারী করাত দিয়ে চিরছে। এক একবার প্রচণ্ড জোরে তার গায়ে আঘাত করছে; সেই সময় শব্দ হচ্ছে-‘হুম-হুম’। তবুও সেই অন্ধকারের একটি কণাও খসে পড়ছে না।’

তিরিশ-বত্রিশ বছর আগে পড়তে পড়তে যেমন শরীর ছমছম করেছিল, এখন আবার সেই অনুভূতি সে পেল। বই হাতে নিয়ে সে খাটে এসে বসল। একটা বালিশ টেনে নিয়ে বগলের নীচে রেখে কাত হয়ে পড়ল। এগারোটা পাতা পড়া হয়েছে তখন সিঁড়িতে পায়ের শব্দ আর দেবীর গলা শুনতে পেল, ‘কমলের মা, বড়দা ফিরেছে?’ উত্তরটা সে শুনল, ‘অনেকক্ষণ!’ দেবী এবার তার সঙ্গে কথা বলতে আসবে। ব্রতীন বইটা বন্ধ করে হাসিমুখে দরজার পরদার দিকে তাকিয়ে রইল। পরদা সরিয়ে ঢুকল দেবী। মুখ ঘুরিয়ে পিছনে তাকিয়ে বলল ‘এসো বাসুদি, আছে।’

বাসন্তী পরদা সরাল। বছর পনেরো আগে ট্যাক্সি থেকে শেষ দেখার পর বাসুকে সে আবার দেখছে। ব্রতীন উঠে দাঁড়িয়ে অস্ফুটে বলল, ‘আরে বাসু!’ তারা প্রায় অপরিচিতের মতো পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইল।

ভোরের প্রথম আলোয় ধীরে ধীরে চরাচর স্বচ্ছ হয়ে ওঠার মতো ব্রতীনের মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ল। কত বছর পর দেখা! গত দশবছরে চারবার সে কলকাতায় এসেছে, শেষ এসেছে তিনবছর আগে। একবারও বাসুর সঙ্গে তার দেখা হয়নি, হওয়ার কথাও নয়। কী বলবে ভেবে না পেয়ে ব্রতীন আচমকা বলে উঠল, ‘তোমার চুলে পাক ধরেছে বাসু, এর মধ্যেই!’

প্রশ্ন এবং বিস্ময় জড়ানো রয়েছে কথাটায়। বাসন্তী উত্তর দেবার দায় এড়িয়ে বলল, ‘আমি জানতুম প্রথমেই চুলের দিকে চোখ পড়বে, প্রত্যেকেই ওই এককথা বলে, এর মধ্যেই চুল পাকিয়ে ফেললে? যেন ইচ্ছে করে আমি পাকিয়েছি, বয়স হলে চুল তো পাকবেই।’

দেবী বলল, ‘কই বড়দার তো পাকেনি। তোমরা তো একবয়সি।’

‘পেকেছে কী পাকেনি তুই জানিস?’ বাসন্তী চোখ বড়ো করে তাকাল দেবীর দিকে। ‘কত রকমের কলপ এখন বাজারে কিনতে পাওয়া যায়, ছোড়দা হবার জন্য বড়দারা এখন চুলে লাগাচ্ছে।’

ব্রতীনের একটু অবাক লাগল বাসন্তীর কথায় এবং কথা বলার ঢঙে। কেমন যেন প্রগলভের মতো লাগছে। কখনো তো দুটোর বেশি তিনটে কথা বলত না আর সেজন্যই সে বাসুর সঙ্গে কথা বলতে উৎসাহ পেত না। কালো মাথায় কয়েকটা রুপোলি চুল বেশ ভালোই লাগছে ব্রতীনের। মেয়েদের থেকে ছেলেদের চুল আগেই পাকে। তার কাছাকাছি বয়সি কোনো মেয়ের মাথায় পাকাচুল সে এখনও অন্তত দেখেনি।

দেবী বলল, ‘আচ্ছা বাসুদি, বড়দার চেহারার কোনো পরিবর্তন লক্ষ করছ? অনেক বছর পর তো দেখছ।’

‘অনেক বছর পর, কত বছর হল বতু?’

ব্রতীন অন্তত তিরিশ বছর পর বাসন্তীর মুখে তার নামটা উচ্চচারিত হতে শুনল, কেমন যেন নতুন-নতুন শোনাল। আজও তো পুরনো বন্ধুদের মুখে ‘বতু’ শুনেছে, কই এমনটা তো লাগল না।

‘পনেরো বছর।’

বাসন্তী ভ্রূ তুলে বলল, ‘পনেরো, মনে আছে তোমার!’

ব্রতীন স্মিত হেসে মাথা হেলাল। ‘মনে আছে সেদিন সবুজ শাড়ি, খয়েরি ব্লাউজ, দু-গাছা সোনার চুড়ি, একটা খয়েরি টিপও ছিল।’

‘দেখেছিস দেবী কী স্মৃতিশক্তি! উপপাদ্যগুলো ওর মতো মুখস্থ করতে পারলে মাধ্যমিকে একশোয় একানব্বুই না পেয়ে একশোই পেতুম।’ মুখ দেবীর দিকে ফিরিয়ে রেখে বাসন্তী তির্যকদৃষ্টিতে ব্রতীনের দিকে তাকিয়ে বলল। ব্রতীন লক্ষ করল বাসুর শরীর একটু ভারী হয়েছে, ফরসা গলায় দুটো খয়েরি দাগ, চিবুকের নীচে চর্বির পুঁটলি, তলপেট একটু উঁচু লাগছে, কপালে টিপ নেই, ভ্রূ আর পঞ্চমীর চাঁদের মতো বাঁকা নয়, কানের লতি খালি তবে চুড়ি দু-গাছা হাতে রয়েছে। ব্যাপার কী? তার চোখ আপনা থেকেই বাসুর সিঁথিতে উঠে গেল। সিঁথি চুলে ঢেকে রয়েছে, বোঝা গেল না কিছু। সে বিভ্রান্ত বোধ করল নিজের চিন্তা নিয়ে। বাসু বিধবা, এমন একটা ধারণা তার মনে এল কেন?

দেবী বলল, ‘বড়দার স্মৃতিশক্তির একটা পরীক্ষা নিই তা হলে। আচ্ছা তুমি তো পাঠশালায় পড়েছ ছোটোবেলায়, তখনকার পড়া একটা পদ্যের দুটো লাইন বলতে পারবে?’

দেবীর কথা শেষ হওয়া মাত্র ব্রতীন বলল, ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে, কথায় না বড়ো হয়ে কাজে বড়ো হবে।’ দুটো লাইন হয়ে গেছে আরও বলব? ‘মুখে হাসি বুকে বল তেজে ভরা মন’-।’

‘থাক থাক, খুব হয়েছে।’ হাত তুলে বাসন্তী থামিয়ে দিল।

ব্রতীন বলল, ‘কার লেখা জানো, জীবনানন্দ দাশের মা কুসুমকুমারী দাশের। এটা অবশ্য পরে জেনেছি।’

হঠাৎ দেবী বলল, ‘চা খাবে বড়দা? বড়ো চা তেষ্টা পেয়েছে। বাসুদি?’

বাসন্তী বলল, ‘খাব।’

‘আমিও।’ ব্রতীন বলল।

দেবী ঘর থেকে বেরিয়ে চেঁচিয়ে দু-তিনবার কমলের মাকে ডেকে সাড়া না পেয়ে তিনতলায় উঠে গেল।

‘তোমাকে বেশ শুকনো দেখাচ্ছে, ‘ব্রতীন মৃদু স্বরে বলল, ঘরে পাশাপাশি শুধু দুজন খাটে বসে, পনেরো বছর পর দেখা, এখন আর কী বলা যায়! এমন একটা কথা সে বলল যার উত্তরে হাসা ছাড়া আর কিছু করার থাকে না। কিন্তু বাসন্তী হাসল না, বলল, ‘তোমাকে শেষ যেমনটি দেখেছি আজও তেমনটি রয়েছ।’

ব্রতীন হাসল, ‘বলেছিলে বর্ধমানে যাতায়াত করতে কষ্ট হয় কাজটা ছেড়ে দেবে, দিয়েছ?’

‘হ্যাঁ। তারপর বাগবাজারে উইমেনস কলেজে চার বছর কাজ করলাম, কলকাতাটাকে দক্ষিণ থেকে উত্তরে পুরো পার হয়ে বাসে যাতায়াত সে যে কী কষ্ট, ভাবতে পারো! তখনও মেট্রোরেল চালু হয়নি, হলে অর্ধেক কষ্ট কমত।’

বাসুর গলায় সেই সময়ের কষ্ট লেগে রয়েছে। ব্রতীন ভেবে পেল না, এত কষ্ট করে পড়াতে যাওয়া তো টাকার জন্য, কী এমন টাকার দরকার হল! ওর স্বামী তো সরকারি অফিসার, হাজার তেরো-চোদ্দো মাইনে এখন নিশ্চয় পায়। তাতে কি চলে যায় না!

‘একদিন ফেরার সময় মিনিবাসে অজ্ঞান হয়ে যাই অবশ্য মিনিটখানেক পরেই জ্ঞান ফিরে আসে, তারপরই চাকরিটা ছেড়ে দিই,’ বাসন্তী মুখটা নামিয়ে আবার তুলে জানালার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ছাড়ার আগে অনেক ভাবতে হয়েছিল।’

‘কেন?’

‘বাড়িটা করার জন্য ধার করতে হয়েছিল সেটা তখনও শোধ হয়নি। তখন ওঁর কিডনির অসুখটা শুরু হয়েছে, ননদের জন্য ভালো একটা সম্বন্ধ এসেছে কানপুর থেকে, তারা বিয়েটা তাড়াতাড়ি দিতে চান, সেও অনেক টাকার ধাক্কা। তার উপর আমার হার্টের প্রবলেম, কী করব ভেবে ভেবে রাতে ঘুম আসে না, শ্বশুর শাশুড়ি চাননি আমি চাকরি ছাড়ি।’

‘তোমার স্বামী?’

‘তিনিও চাননি, তারপর আবার একদিন অজ্ঞান হয়ে পড়লুম, তবে বাসে নয় বাড়িতেই।’ বাসন্তী মুখ টিপে হাসল এমনভাবে যেন খুব মজার একটা ঘটনার কথা বলছে। ‘ডাক্তার চার-পাঁচ রকম পরীক্ষা করল, শেষে বলল স্ট্রেস থেকে তৈরি হাইপার টেনশনে ভুগছি, এখুনি চাকরিটা ছাড়া দরকার। শুনে আমার কী আনন্দ যে হল, পরের সপ্তাহেই চাকরিতে ইস্তফা দিলুম। আমার চা খাওয়া কিন্তু উচিত নয়।’

‘তা হলে খেয়ো না।’

‘না না খাব, এক কাপ খেলে কিছু হবে না। দেবী বোধহয় চা নিজেই করে আনছে।’ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বাসন্তী চিন্তিত মুখে বলল, ‘ও কি এভাবেই জীবন কাটাবে? বয়স তো খুবই কম আটাশ-উনত্রিশ, ওর কিছু একটা ব্যবস্থা করো।’

‘আটাশ-উনত্রিশ খুব কম বয়েস নয়, ব্যবস্থা মানে তো বিয়ে। কাকা বিজ্ঞাপন দেখে কথাবার্তা বলে বিয়ে দিয়েছিলেন। এবার দেবী নিজেই দেখেশুনে বিয়ে করুক। দেখতে ভালো, লেখাপড়া জানে, বুদ্ধিমতী, পার্সোনালিটি আছে, সবথেকে বড়ো কথা মায়া-মমতা সেটা ওর অ্যাডিশনাল প্লাস পয়েন্ট। তুমিই তো দেবীকে বলতে পারো।’

‘ঠারেঠোরে বলেছি, খুব একটা গা করল না। তুমি ঘরের লোক, বলে দেখতে পারো। ভালো কথা, উমাপদবাবুকে মনে আছে?’

‘থাকবে না! ওঁর কৃপাতেই তো লেখাপড়ার বনেদটা তৈরি হয়েছে, আমার আর তোমারও।’

একশোবার। উমাপদবাবু পণ্ডিচেরিতে চলে যান, শুনলাম সেখানেই মারা গেছেন।’

শুনে ব্রতীন বিষণ্ণ হয়ে পড়ল। যে ক-জন মানুষকে সে শ্রদ্ধা করেছে তার মধ্যে সে রেখেছে এই গৃহশিক্ষককে। সাদাসিধে জীবন, সততা, ঠান্ডা স্বভাব। সে যতদূর সম্ভব অনুসরণ করার চেষ্টা করে উমাপদবাবুকে। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ব্রতীন বলল, ‘তোমার হার্ট এখন কেমন অবস্থায়?’

‘ভালো। আর কোনো গণ্ডগোল করেনি।’

‘বলেছিলে তোমার স্বামীর কিডনির অসুখ শুরু হয়েছিল, এখন কেমন আছেন?’

বাসন্তী ইতস্তত করে নিরুত্তর রইল। ব্রতীন উত্তরের আশায় তাকিয়ে আছে দেখে বলল, ‘ভালো আছেন তবে বিনা অসুখে মানুষ কতদিন আর থাকতে পারে। কিডনি থেকে অসুখটা এখন মনে।’

‘তার মানে!’

‘সব কিছুতেই ওর সন্দেহ, এমনকী আমাকেও সন্দেহ করেন।’

‘কী সন্দেহ?’ ব্রতীন কৌতূহল চাপতে পারল না। বলরামের কথা মনে পড়ল। বউকে মেন্টাল টর্চার করত আর সেটা তো স্বামীরা একই কায়দায় করে-চরিত্র নিয়ে সন্দেহ। বাসুকে আর কোনো প্রশ্ন করা ঠিক হবে কি না ব্রতীন বুঝে উঠতে পারছে না। বাসন্তী থমথমে মুখে মেঝের দিকে তাকিয়ে। অস্বস্তিকর অবস্থা। ব্রতীনের মনে হল বাসুর মধ্যে অনেক কথা জমে রয়েছে সেগুলো শোনাবার মতো এমন একটা লোক পেয়েছে যে তাকে চেনে জানে এবং যার সঙ্গে আর কবে দেখা হবে সে জানে না।

‘বাসু মনে হচ্ছে তুমি কিছু বলতে চাও।’ নরম স্বরে ব্রতীন এমনভাবে বলল যাতে ইঙ্গিত রয়েছে, ‘তুমি বলতে পারো আমি শুনব।’

‘চাই। কাউকে আমায় বলতে হবে নয়তো আমি পাগল হয়ে যাব বতু। এই বয়সে এমন সব কথা শুনতে হয় তাও ছেলের সামনে যে সামনের বছর হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা দেবে, মনে হয় তখন আত্মহত্যা করি।’

বাসন্তী উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। সেটা চাপার চেষ্টায় স্বর নামিয়ে কথা বলার জন্য গলা কর্কশ শোনাল। ব্রতীন ওর মুখের দিকে অপলকে তাকিয়ে। তার দৃষ্টিতে এমন কিছু ছিল যা দেখে বাসন্তী ‘আত্মহত্যা করি’ বলেই থমকে গেল।

‘কী দেখছ বতু?’

‘তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে।’

‘একথাটা তিরিশ বছর আগে বলনি কেন?’ বাসন্তীর স্বর কঠিন।

‘বললে কী হত?’ ব্রতীনের স্বরে চাপল্য।

‘তা হলে আজ আমাকে এই দুর্দশায় পড়তে হত না।’

‘তুমি কী নিশ্চিত দুর্দশায় পড়তে না?’

বাসন্তীকে থতমত দেখাল। কিছু না ভেবেই সে বলল, ‘না পড়তুম না, তুমি অন্য ধাতুতে গড়া।’

‘তিরিশ বছর আগে তোমাকে প্রণয় নিবেদন করলে তুমি তা গ্রহণ করতে, আজ আমরা তা হলে স্বামী-স্ত্রী হতুম, তোমার জীবন অন্যরকম হত। এই বোধটা এখন তোমার মধ্যে উদয় হল। আমি কিন্তু ইতিমধ্যে বিয়ে করে ছেলেমেয়ের সুখী বাবা হয়ে যেতে পারতুম, তখনও কী তুমি আমার সম্পর্কে এমনভাবে ভাবতে পারতে?’

‘হ্যাঁ পারতুম।’ জেদি গলায় ঘাড় বেঁকিয়ে বাসন্তী তাকিয়ে রইল ব্রতীনের মুখের দিকে।

এবার ব্রতীনকে থতমত দেখাল, বাসু কেমন যেন বেপরোয়া হয়ে গেছে তার মানে ভীষণভাবে প্রতিবাদ জানাচ্ছে স্বামীর বিরুদ্ধে, বিবাহিত জীবনকে ধিক্কার দিয়ে। রক্ত ছুটে এসেছে মুখে, উজ্জ্বল তপ্ত দেখাচ্ছে সারা মুখ, ব্রতীনের মনে হল বাসু যেন সেই পনেরো বছর বয়সের কিশোরী। বই খাতা গুছিয়ে হাতে নিয়ে ঘর থেকে বেরোবার আগে একবার আড়চোখে তাকানো মেয়েটি। ওকে আর একটু ঘাঁটিয়ে দেখা দরকার। দরকার এইজন্য, এখন রীতিমতো একটা টান বাসুর জন্য সে অনুভব করে চলেছে। ওর রুপালি চুলগুলো তার সারা দেহের রোমকূপের গোড়ায় বসে গেছে।

‘তোমার স্বামীর সন্দেহ করার রোগটা শুরু হল কবে থেকে?’

‘আট বছর আগে টাকাপয়সার গোলমাল করেছিলেন বলে সাসপেন্ড হন, এনকোয়ারি শুরু হয়। তখন বলতে শুরু করেন, আমাকে ফাঁসিয়েছে, বিশ্বাস করে স্যাংশন করেছিলুম, ঘুষ নিলে আজ এই চক্রান্তের শিকার হতুম না, অফিসের কয়েকজন আর দুজন কন্ট্রাক্টরের নাম করে মাঝরাতে বিছানায় বসে গালাগাল দিতেন। একটাই কথা বারবার বলতেন, এরপর লোকের কাছে মুখ দেখাব কেমন করে! এনকোয়ারিতে নির্দোষ প্রমাণ হন, কিন্তু বদলি করে ফুড ডিপার্টমেন্টে একটা তুচ্ছ চেয়ারে বসিয়ে দেওয়া হয়। এরপর থেকে ওর আচরণ কথাবার্তা অস্বাভাবিক হতে শুরু করে।’

‘তোমার উপর সন্দেহ শুরু হল কেন?’

‘সবার উপরই শুরু হয়, সব ব্যাপারেই উনি চক্রান্ত খোঁজেন আর সেটা দেখতে পান, বাড়ির সবাইকে উদব্যস্ত করে তুলতে থাকেন। ঝি-চাকরদের সঙ্গে ঝগড়া, ওরা নাকি চোর, মুদি ওজন মারছে, স্টেশনার দাম বেশি নিচ্ছে, ছেলে টাকা চুরি করছে, কী অশান্তিকর ব্যাপার যে। এর মধ্যে আমি একবার বলেছিলুম, ননদের বিয়েতে কুড়ি ভরি সোনা দিতে হয়েছিল, না দিলেই ভালো হত, এখন কেউ লাখটাকার সোনা গায়ে চাপিয়ে দেখায় না, লোকে হাসে। তা ছাড়া অত সোনা দেবার মতো অবস্থাও আমাদের নয়। শাশুড়ি তার ছেলেকে চাপ দিয়ে বাধ্য করে, বোনের জন্য এইটুকু স্যাক্রিফাইস করতে পারবে না? এতবড়ো ঘরে বোনের বিয়ে হবে! ঘর মানে চামড়ার ব্যবসা। কানপুরে জুতো চটি তৈরি করে। কুড়ি ভরি সোনা তার সঙ্গে আনুষঙ্গিক ফ্রিজ, টিভি, সোফা, খাট, বিছানা ইত্যাদি ইত্যাদি কেনার জন্য আরও পঞ্চাশ হাজার টাকা। এরপর লোক খাওয়াতে আরও হাজার পঞ্চাশ। অপরাধের মধ্যে আমি একদিন বলেছিলুম, এত টাকা তুমি ম্যানেজ করলে কোত্থেকে? ব্যস, তুলকালাম চিৎকার, আমি নাকি বলেছি বোনের বিয়ে দেবার জন্য ঘুষ নিয়েছি, বলেছি উনি করাপ্ট। এরপর উনি উঠেপড়ে প্রমাণ করার চেষ্টা শুরু করলেন আমি অন্য পুরুষের সঙ্গে মেন্টালি অ্যান্ড ফিজিক্যালি ইনভলভড। স্তম্ভিত হয়ে গেলুম, এত নীচে মানুষ নামতে পারে! বতু আমি তখনই আত্মহত্যার কথা ভেবেছিলুম।’

‘তুমি কি বিশ্বাস করো উনি ঘুষ নিয়েছেন?’

‘এখন বিশ্বাস করি। লোকটা সৎ ছিল, পরিবারের আর সামাজিক সম্মান রক্ষার চাপে পড়ে নিজেকে দাঁড় করিয়ে রাখতে পারেনি। বতু উনি ইকনমিক্সের এম এ, ভাবতে পারো!’

‘আত্মহত্যার চিন্তাটা কি এখনও তোমার আছে?’

‘না’।

পরদার ওধার থেকে দেবীর গলা শোনা গেল। ‘পরদাটা একটু সরাও না বাসুদি।’

বাসন্তী উঠে গিয়ে পরদা সরিয়ে ধরতে চায়ের ট্রে হাতে দেবী ঘরে ঢুকল। ‘কমলের মাকে বাবা ফিশফ্রাই কিনতে পাঠিয়েছে আমাকেই চা করতে হল, দাদার তো চিনি ছাড়া, এই কাপটা তোমার।’ দেবী সোনালি ঘের দেওয়া একটা কাপ থুতনি তুলে দেখাল, ব্রতীন তুলে নিল।

‘ডায়াবেটিসের ভয়? বতু বরাবরই স্বাস্থ্য সচেতন।’ বাসন্তী চায়ে চুমুক দিয়ে বলল।

‘বরাবর?’ ব্রতীন চোখ কুঁচকে তাকাল।

‘তখন সাধন নামে একজন চাকর ছিল। তুমি খাবার জল চাইলে, জলের গ্লাস হাতে দেবার সময় সাধন কথা বলেছিল, তুমি সেই জল না খেয়ে ফেলে দিয়েছিলে, মনে আছে?’

‘বাব্বা, বাসুদির স্মৃতিশক্তিও দেখছি কম নয়।’

বাসন্তী বলল, ‘দেবী, অনেক কথা অনেক ব্যাপার ভুলে যায় মানুষের কিন্তু খুব তুচ্ছ ছোটোখাটো ব্যাপার চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর পরও মনে থেকে যায়।’

‘ঠিক কথা, আজ স্কুলে যাবার সময় পথে অনেক কথা মনে পড়ছিল বিশেষ করে একটা মেয়ের কথা।’ ব্রতীন লক্ষ করল দেবী আর বাসন্তী উৎসুক চোখে তার দিকে তাকাল। সে হেসে ফেলল। ‘যা ভাবছ তা নয়। মেয়েটা হাতে করে একটা চন্দনা পাখিকে ছোলা খাওয়াত রোজ আমার স্কুলে যাবার সময়।’ তার বলতে ইচ্ছে হল আজ সেই মেয়েটার সঙ্গেই তার দেখা হয়ে গেল অদ্ভুত একটা পরিস্থিতিতে। কিন্তু সেকথা এদের বলল না। বললে অনেক কিছুই বলতে হবে, বুড়ি, নিমি, গুণো এরা এসে যাবে কথার মধ্যে।

সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ। দেবী বলল, ‘কমলের মা, ফিশফ্রাই এল। বাসুদি খাবে তো? মলয় কেবিনের!’

‘খাব। বতু, তুমি তো খুব চিংড়ির কাটলেট খেতে মলয় কেবিনে লুকিয়ে লুকিয়ে, মনে আছে? জানিস দেবী, তখন সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি, কলেজের এক বান্ধবীকে নিয়ে মলয় কেবিনে ঢুকেছি চা খেতে। দেখি কোণের টেবলে বাবু কাটলেট সাঁটাচ্ছেন দরজার দিকে পিছন ফিরে বসে। কাটলেটটা শেষ হতেই আর একটা কাটলেট এল। পরপর দুটো! চা খেয়ে বেরিয়ে এলুম তাই আর তৃতীয়টা খাওয়া দেখা হল না।’

‘খেলে সাধ মিটিয়ে খাওয়া উচিত, সত্যিই ওদের চিংড়ির কাটলেটের তুলনা হয় না কিন্তু বাসু লুকিয়ে লুকিয়ে বললে কেন?’

‘যেভাবে দেওয়ালের দিকে মুখ করে কোণে বসে খাচ্ছিলে তাই তো মনে হয়েছিল পাছে কেউ দেখে ফেলে!’

‘চোখ আর মন জগৎ থেকে সরিয়ে নিয়ে খাদ্যে গেঁথে না দিলে ভালো খাবারের স্বাদ ঠিকমতো পাওয়া যায় না, একই কথা মেয়েদের সৌন্দর্যের স্বাদ পাওয়ার ব্যাপারেও খাটে। তোমরা যে আমার পিছনের টেবলে বসে চা খাচ্ছিলে সেটা কিন্তু আমি তোমার গলার আওয়াজেই জেনে গেছলুম, চায়ের দামটা যে তোমার বান্ধবীই দিয়েছিল সেটা দেখেছি। তখন যদি একবার বলতে ‘আরে বতু নাকি! কী খাচ্ছ, কাটলেট?’ তাহলেই তোমাদের দুজনকে কাটলেট খাওয়াতুম।’

‘ইসস তোমার মনের ইচ্ছাটা তখন যদি জানতুম তাহলে কাটলেট মিস করতুম না। আসলে মানসিক জড়তা তখন আমার ভীষণভাবে ছিল এজন্য অনেক কিছু মিস করতে হয়েছে।’ কথাগুলো বলে বাসন্তী হাসল। ব্রতীন কথার এবং হাসির অর্থ যে ধরতে পেরেছে সেটা বোঝাতে চোখ বন্ধ করে মাথা নেড়ে বলল, ‘মিস আমিও করেছি, দুটি মেয়েকে খাওয়ানোর সুযোগ।’

পিঠ দিয়ে পরদা সরিয়ে ঘরে ঢুকল কমলের মা হাতে ট্রে। তিনটি প্লেটে ফিশফ্রাই। ব্রতীন বলল, ‘কাকাবাবুর জন্য আছে তো?’

‘আছে। পাঁচটা এনেছি, উনি দুটো খাবেন।’ কমলের মা হাসল। ‘দুটোর কম উনি খান না।’

শুনে আশ্বস্ত হল ব্রতীন। ক্ষীরোদপ্রসাদ কৈশোর থেকে হোটেল রেস্তোরাঁয় খাওয়ার ভক্ত। অনেকবার তিনি ন-কাকার গল্প করেছেন, তাকে ধরে পার্ক স্ট্রিটে চিনা রেস্তোরাঁ পিপিংয়ে যাওয়া, ছ আনায় বড়ো বড়ো দুটো চিংড়ির কাটলেট, আট আনায় ইয়া বড়ো শুয়োরের মাংসের পোর্ক চপ। সে সব স্বাধীনতার আগের আমলের কথা। তিনভাই মিলে রেস্তোরাঁটা চালাত। দু-ভাই ওয়েটার একভাই কাউন্টারে, তিনবউ রান্নাঘরে। ছেলেমেয়েরা বাসনকোসন ধোয় টেবল গোছায়। সবারই হাসিখুশি মুখ।

‘কাকাবাবুর ধাত আমি খানিকটা পেয়েছি। বাসু তো নিজের চোখেই দেখেছে মলয় কেবিনে। আজ স্কুলের পুরনো বন্ধু গুণোর সঙ্গে দেখা হল, ধরে নিয়ে গেল ট্যাংরায় চিনে রেস্তোরাঁয়। প্রচুর বাগদা চিংড়ি খেলুম।’

‘ভাগ্যবান তুমি।’ ফিশফ্রাইয়ের টুকরো মুখে ঢুকিয়ে বাসন্তী বলল, ‘বাগদা চিংড়ি কী জিনিস ভুলেই গেছি। বাজারে যেদিন আসে, তিনশো সাড়ে তিনশো টাকা কিলো তাও খুব বড়ো সাইজের নয়। ফিশটা মনে হচ্ছে ভেটকিই। শোল মাছ নয়।’

তিনতলা থেকে কমলের মা নেমে এসে বলল, ‘সল্ট লেক থেকে বউদি ফোন করেছে, আপনি রোববার যাচ্ছেন তো? জানতে চাইছে।’

‘বলে দাও তিনজন যাচ্ছি- আমি, দেবী আর বাসন্তীদিদি।’

যাবার কথা দুজনের, ব্রতীন যোগ করে দিল বাসন্তীকেও। চোখ বড়ো করে বাসন্তী বলল, ‘সে কী, আমি আবার কেন! আমি তো রোববার সকালেই সরকারহাট চলে যাব। না না আমাকে বাদ দাও, আমি তো ওদের কাছে একেবারেই অচেনা।’

ব্রতীন জবাব না দিয়ে উঠে গিয়ে টেবল থেকে খবরের কাগজের আধখানা পাতা ছিঁড়ে এনে বাসন্তীর হাতে খানিকটা, দেবীর হাতে খানিকটা দিয়ে বলল, ‘হাতের তেলটা মুছে নাও।’ কমলের মা তখনও দাঁড়িয়ে আছে দেখে বলল, ‘যাও, বলে দাও তিনজন যাব।’ কমলের মা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

‘এটা কিন্তু জবরদস্তি। বাড়িতে বলা আছে-‘

‘বলা আছে তো কী হয়েছে, বাড়িতে ফোন আছে তো। ওপরে গিয়ে ফোন করে বলে দাও রোববার রাত্রে ফিরবে।’ ব্রতীন স্থির দৃষ্টিতে বাসন্তীর অস্বস্তিভরা চোখে চোখ রাখল। ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে উজ্জ্বলতা ফিরে এল বাসন্তীর চোখে। দেবী তা লক্ষ করে মনে মনে হাসল।

‘ফোন করতে যাবে তো বাসুদি, চলো।’

ব্রতীনের দিকে ভ্রূকুটি করে কোপ দেখিয়ে বাসন্তী বলল, ‘চল। পড়েছি মোগলের হাতে রবিবার খানা তো খেতেই হবে।’

সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় দেবী বলল, ‘তোমাদের একসময় খুব ভাব ছিল মনে হল।’

‘ভাব!’ বাসন্তীর চোখ প্রায় কপালে উঠল। ‘তিন বছর প্রায় পাশাপাশি বসে উমাপদবাবুর কাছে পড়েছি, তিনটে সেন্টেন্স আমরা বলেছি কিনা মনে পড়ছে না।’

দাঁড়িয়ে পড়ল দেবী। অবাক হয়ে বলল, ‘কিন্তু দেখে মনে হচ্ছিল একটা সম্পর্ক যেন তৈরি হয়েছিল।’

‘বয়স হলে মেয়েরা একটু ফাজিল হয়ে যায়, আমার ছেলেকে দেখিসনি, লম্বায় বাপকে ছাড়িয়ে গেছে এর মধ্যেই। বয়স হলে হাসিঠাট্টার লাইসেন্স পেয়ে যায় মায়েরা। তোর বড়দাও তো আর খোকাটি নয়। চল ফোনটা সেরে ফেলি।’

বড়োঘরে ইজিচেয়ারে শুয়ে ক্ষীরোদপ্রসাদ টিভি দেখছিলেন, বাসন্তী প্রণাম করতে রিমোট কন্ট্রোলের বোতাম টিপে টিভি বন্ধ করে দিলেন।

‘আরে বাসু এসো। দেবী তখন বলল বটে তুমি এসেছ। কিন্তু চুল এর মধ্যেই-‘।

‘ওহহ জ্যাঠামশাই। পাকা চুলের জন্য জবাবদিহি কতবার কতজনকে যে করতে হল, আরও কতজনের কাছে যে করতে হবে! কেন কালো আকাশে ঝিকমিক করা রুপোলি তারা দেখতে খারাপ লাগে?’

‘খারাপ! বলছ কী? তোমার মুখটা আরও সুন্দর করে দিয়েছে। আছ কেমন? সতীকান্ত মারা যাবার পর আর তোমাদের খোঁজখবর রাখা হয় না। উমাপদবাবুও চলে গেলেন। এখন আমিই-‘।

‘বাবা বাসুদি একটা ফোন করবে।’ দেবী থামিয়ে দিল তার বাবার বিলাপ। একবার শুরু হলে চলবে ঘণ্টাখানেক।

টেলিফোন রয়েছে ঘরের আর একদিকে নীচু একটা টি-পয়-এর উপর। বাসন্তী ডায়াল করেই ওপ্রান্ত থেকে সাড়া পেল, নীচু গলায় সে বলল, ‘কে বাবলু, মা বলছি। শোন তোর বাবাকে বলিস রোববার সকালে যেতে পারব না। দুপুরে দিদা পিছলে পড়ে গিয়ে বোধহয় কোমরের হাড় ভেঙেছে, এক্সরে করাতে নিয়ে গেছলুম, প্লেট কাল সকালে পাব। রোববার রাতে নয়তো সোমবার সকালে যাব। ঠিক করে বুঝিয়ে বলে দিস, আমি পাশের বাড়ি থেকে ফোন করছি। রাখছি এখন।’

ফোন রেখে দেখল দেবী কৌতূহলী চোখে তার দিকে তাকিয়ে। বাসন্তী হেসে বলল, ‘দেখলি দিব্যি কেমন মায়ের কোমর ভেঙে দিলুম। তোর বড়দার জন্য এই পাষণ্ড কাজটা করতে হল!’

ব্রতীন ‘বাগদি ডাকাত’ আবার পড়তে শুরু করেছিল তখন দেবী আর বাসন্তী ফিরে এল।

‘বড়দা তোমার দুপুরের ভাত তোলা আছে ফ্রিজে, রাতে খাবে কি?’

‘দুপুরে বড্ড খাওয়া হয়ে গেছে এখনও খিদে পাচ্ছে না তার ওপর এতবড়ো একটা ফিশফ্রাই খেলুম, বেশ বানিয়েছে। আজ গুণোর কাছে আমাদের স্কুলের এক বন্ধু বলদেব ওরফে বলা সম্পর্কে মজার এক খবর পেলুম। বলা খবরের কাগজের চাকরি করে, বেঁটে, ফুট পাঁচেক লম্বা এ জন্যই বিয়ে হচ্ছিল না। অবশেষে বিয়ে হল, বউ ওর থেকে লম্বা আর এখানেই হল মুশকিল।’

দেবী বলে উঠল, ‘মুশকিল হত না বেঁটে মেয়ে বিয়ে করলে। পাঁচ ফুটের কম হাইটের মেয়ে তো হাজারে হাজারে পাওয়া যায়।’

‘তা যায়। হয়তো বলা তার পছন্দ অনুযায়ী মেয়েটি বেঁটেদের মধ্যে পায়নি কিংবা তেমনভাবে খোঁজখবর করেনি। যাই হোক, লম্বা বউ বাড়িতে আছে ঠিক আছে। বউকে নিয়ে বাড়ির বাইরে বেরোলে লোকেরা তাকিয়ে থাকে। এই প্রসঙ্গে একটা মজার কথা বলি, সুনীল গাওস্কর পাঁচ ফুট আড়াই ইঞ্চি এটা সবাই জানে। ইংল্যান্ডে সমারসেটে কাউন্টি ক্লাবের হয়ে একবছর খেলেছিল। ওকে রেখেছিল যে বাড়িতে সেই বাড়িতে ক্লাব রেখেছিল আরও একজন ক্রিকেটারকে, নামটা ভুলে গেছি তেমন নামি কেউ নয়। তবে তার হাইট ছিল ছ-ফুট পাঁচ ইঞ্চি। খেলার দিন দুজনকে মাঠে নিয়ে যাবার জন্য গাড়ি আসত। দুজনে একসঙ্গে বেরিয়ে গাড়িতে উঠত। গাওস্করকে একটা ম্যাগাজিন প্রশ্ন করেছিল তোমার জীবনের সবথেকে এমব্যারাসিং মুহূর্ত কোনটে? গাওস্কর উত্তরে বলেছিল ওই সময়টা, যখন আমরা দুজনে পাশাপাশি হেঁটে গিয়ে গাড়িতে উঠতাম আর আমাদের দেখার জন্য বারান্দার জানালায় সারি দিয়ে লোক দাঁড়িয়ে থাকত।’

বাসন্তী বলল, ‘গাওস্কর খ্যাতিতে এমন উচ্চচতায় উঠেছে বলেই নিজের শরীরের উচ্চচতা নিয়ে রসিকতা করতে পারে। তোমার বন্ধুটি মোটেই মুশকিলে পড়ত না যদি রসিক হত।’

ব্রতীন বলল, ‘হতে পারেনি বলেই মুশকিল হল। বলার বাইরেটা যেমন খাটো ভেতরটাও তেমনি খাটো। ফলে হীনম্মন্যতায় ভুগতে শুরু করল আর তাই থেকেই শুরু হল বউয়ের ওপর মানসিক অত্যাচার।’

বাসন্তী দ্রুত বলল, ‘নিশ্চয় চরিত্র নিয়ে সন্দেহ।’

ব্রতীন কয়েক সেকেন্ড বাসন্তীর চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। বাসু একথা কেন বলল, সেটা সে বুঝতে পেরেছে, দেবী পারেনি তাই সে হালকাসুরে বলল, ‘লম্বা হওয়ার কী জ্বালারে বাবা! পবিত্র ছ-ফুট তিন ইঞ্চি আমি পাঁচফুট দু ইঞ্চি, বাইরে ও সবসময় একটু তফাতে থাকার চেষ্টা করত দেখেছি।’ পবিত্র দেবীর প্রাক্তন স্বামী।

ব্রতীন বাসন্তীর প্রশ্নটা ধরে বলল, ‘হয়তো চরিত্র নিয়েই, কেননা বউকে ঘায়েল করতে স্বামীদের এটাই ব্রহ্মাস্ত্র তবে স্বামীদের মাথায় কলকবজা ঢিলে করে দিতে বউয়েরাও যথেষ্ট সাহায্য করে, অবশ্য সচেতনভাবে নয়। বলার বউ নাকি অনেক দিন সহ্য করে আর না পেরে একদিন হঠাৎ বাড়ি থেকে হাওয়া হয়ে গেল।’

‘তারপর বাপের বাড়ি গিয়ে উঠল, যা মেয়েরা করে।’ নিশ্চিত স্বরে দেবী বলল।

‘না।’

‘কোনো আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের বাড়িও যায়নি স্রেফ উবে গেল।’

‘তা হলে গেল কোথায়? কোনো ছেলের সঙ্গে-!’ দেবীর রুচিতে আটকে গেল বাকি অংশটা।

‘তা হলে গেল কোথায়? এটা বলারও প্রশ্ন ছিল আর ছিল বাড়ির লোক পাড়াপ্রতিবেশী আত্মীয়স্বজনের কাছে তার লজ্জা। বলা পুলিশেও যেতে পারছে না লোক জানাজানি হবার ভয়ে। শেষে গল্প বানাল বউ কেদারনাথ না বদরিনাথে যাবার পথে পাহাড় থেকে পিছলে খাদে পড়ে মারা গেছে।’ ব্রতীন এবার মিটিমিটি হাসতে লাগল। বাসন্তীর মুখে কোনো ভাবান্তর নেই তবে মন দিয়ে শুনছে এটা বোঝা যায় ওর মাথা কাত করে রাখা দেখে। খুব মজার একটা গল্প শুনেছ এমন ভাব দেবীর চোখে মুখে।

ব্রতীন আবার শুরু করল। ‘অনুমান করছি বউয়ের শ্রাদ্ধশান্তিও বলা করে লোক দেখিয়ে। এরপর একদিন গুণো শান্তিনিকেতনে দেখতে পেল বলার বউকে, পক্ষাঘাতে একদিকের অঙ্গ পড়ে যাওয়া বৃদ্ধাকে ধরে ধরে হাঁটছে। তার মানে নার্সই বলো আর আয়াই বলো সেবাশুশ্রূষা করার চাকরি করছে। ফিরে এসে গুণো বলাকে আড়ালে ডেকে যা দেখেছে বলল। বলা গিয়ে বউকে ফিরিয়ে আনল।’

দেবী সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, ‘কিন্তু বউ মরে গেছে বলে যে ইতিমধ্যে গল্প রটিয়েছে!’

ব্রতীন একচোট হেসে নিয়ে বলল, ‘বলাকে কী সহজে দমানো যায়। ভাওয়াল সন্ন্যাসীর কাহিনি পড়া আছে, তা ছাড়া হিন্দি ফিল্মও যথেষ্ট দেখেছে, বলা রটিয়ে দিল একজন সন্ন্যাসী বউকে অজ্ঞান অবস্থায় কুড়িয়ে পেয়ে তুলে নিয়ে যায় তাদের আশ্রমে, শেকড়বাকড় খাইয়ে সারিয়ে তোলে কিন্তু বউয়ের মেমারি লস হয়ে কিছুই সে আর মনে করতে পারে না, তারপর হঠাৎই একদিন অতীত জীবনকে তার মনে পড়ে যায়। তারপর আর কী, বলদেব খবর পেয়ে ছুটে গিয়ে জ্যান্ত বউ নিয়ে ফিরে এল। আশ্চর্যের কথা, সবাই ওর এই গল্পটাকে বিশ্বাস করে নিয়েছে।’

দেবী বলল, ‘কিন্তু তোমার বন্ধু গুণো তো আসল ব্যাপারটা জানে, সে যদি সবাইকে বলে দেয়!’

‘দেয়নি, দেবেও না। এবার কলকাতায় এসে গুণোই আমার একটা আবিষ্কার। গুণো ঠোঁটকাটা বরাবরই, বেশিরভাগ লোকই ওকে পছন্দ করে না, দুষ্টুবুদ্ধি ওর মাথায় সবসময় ঘোরে, কিন্তু বন্ধুকে বিপদে ফেলবে লজ্জায় ফেলবে এমন কাজ ও কখনো করবে না। বন্ধুত্বের মর্যাদা যেভাবেই হোক ও রাখবেই। বলার এই কাণ্ডটা গুণো নিজের বউয়ের কাছেও গল্প করে বলেনি পাছে ফাঁস হয়ে যায়।’ কথাগুলো বলে ব্রতীন আড়চোখে টেবলে রাখা চশমা আর চাবির দিকে তাকাল। চোখে পড়লে দেবী হয়তো কৌতূহলী হয়ে কী করে ওগুলো এল জিজ্ঞাসা করবে, তা হলেই মলি-প্রসঙ্গ এসে পড়বে।

বাসন্তী বলল, ‘বলদেব, গুণো এদের মনে হয় আমি এ পাড়ায় দেখেছি, তোমার কাছে আসত। বলদেবের বউকে অবশ্য দেখিনি, তুমি দেখেছ?’

‘না, তবে দেখতে ইচ্ছে করছে। ভাবছি কাল বলার বাড়ি যাব। কার্ড দিয়েছে, টেলিফোন করে যাব।’

‘এবার আমি যাই।’ বাসন্তী খাট থেকে উঠে দাঁড়াল। পাশে বসা দেবী তার সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়েই ‘আহহহ’ বলে উঠে কোমরের পিছন দিকে হাত চেপে আবার খাটে বসে পড়ল।

‘কী হল দেবী?’ বাসন্তী উৎকণ্ঠিত স্বরে বলল।

‘গত একমাস এখানে মাঝে মাঝে একটা ব্যথা হচ্ছে। হঠাৎ করে উঠতে গেলেই লাগে।’ মুখবিকৃত করে দেবী জায়গাটা আঙুল দিয়ে টিপেই আবার ‘আহহ’ করে উঠল।

‘তোর বসাটাই ছিল বিশ্রী ভঙ্গিতে। অমন কুঁজো হয়ে বসলে হাড়ে তো বাঁকাভাবে চাপ পড়বেই।’ ব্রতীন মৃদু ধমক দিল। ‘আস্তে উঠে সোজা হয়ে দাঁড়া।’

দেবী সাবধানে খাট থেকে নেমে দাঁড়াল। ধীরে ধীরে টান করাল দেহ। বাসন্তী বলল, ‘এখনও লাগছে?’

‘শিরদাঁড়ার এই জায়গাটা’ দেবী নিতম্বের মাঝামাঝি হাত রাখল।

‘চোট-টোট কখনো লেগেছিল?’ ব্রতীন জানতে চাইল।

‘না। চুপচাপ একভাবে শুয়ে থাকলে সেঁক দিলে আপনা থেকেই কমে যায়।’

‘রোববার শিবুর বাড়ি যাচ্ছি তো ওখানে সলিলকে দিয়ে দেখিয়ে দোব। ও হাড়ের ডাক্তার অর্থোপেডিক সার্জন। তুই এখন নড়াচড়া না করে খাটে লম্বা হয়ে শুয়ে থাক। চলো বাসু তোমাকে এগিয়ে দি।’ ব্রতীন দরজার দিকে এগোল। বাসন্তীর জন্য পরদাটা সরিয়ে অপেক্ষা করল। দেবী দেখল, বাসন্তী দরজা পার হচ্ছে যখন ব্রতীন তার কনুইয়ের কাছে হাতটা ধরল।

ব্রতীন হাতটা আলতো করে ধরে, বাসন্তীর কাছে এটা অপ্রত্যাশিত। এই মুহূর্তে বারান্দা আর সিঁড়িটা নির্জন। তার শরীর শিরশির করে উঠল। সিঁড়ি দিয়ে পাশাপাশি নামার সময় ব্রতীনের মনে হল তাদের শরীর যতটুকু ছোঁয়ার তার থেকে একটু বেশিই ছুঁয়ে যাচ্ছে। পরিবেশটা তৈরি, স্বামীর প্রতি বিতৃষ্ণ বাসু, খোলাখুলিই ঘৃণা দেখিয়েছে। এখন বাসু মানসিকভাবে দুর্বল। তিরিশ বছর আগে একবার যদি সে প্রণয়ার্থী হত তা হলে বাসু আজ সুখী জীবনযাপন করত একথা এতদিন পর বলতে গেল কেন? এই রহস্যটা রহস্যই হয়ে থাক।

সিঁড়িটা মাঝামাঝি জায়গায় বাঁক নিয়ে নীচে নেমেছে। ব্রতীন একবার থমকাল, বাসন্তীও দাঁড়িয়ে পড়ল। মুহূর্তের জন্য ব্রতীনের মনে হল বাসু, ঘনিষ্ঠতা চাইছে-চুমু! গাঢ় আলিঙ্গন! মলি বলেছিল, ঘরে যাবেন না? তিরিশ বছর পর তাদের প্রথম বন্ধুত্ব হল। চমৎকার এই অনুভূতি, স্থূলভাবে নষ্ট করলে এই স্বাভাবিক প্রসন্নতাটার চিরকালের মতো হারিয়ে যাবে। থাক।

বাসন্তীর বাহুধরা হাত ব্রতীন নামিয়ে নিল। বাসন্তীদের বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে ব্রতীন বলল, ‘রোববার তৈরি থেকো, দশটা নাগাদ বেরোব।’

‘বতু তোমাকে কেমন যেন ক্লান্ত দেখাচ্ছে, অনেকক্ষণ ধরে দেখছি তুমি ঘামছ।’ বাসন্তী আঁচল দিয়ে ব্রতীনের কপাল, গাল মুছে দিতে লাগল।

‘সারাদিনটাই নানান অবস্থার মধ্য দিয়ে কেটেছে, একটু জুড়োবার সময় পাইনি, চরকির মতো ঘুরেছি। কলকাতায় এলেই ঘোরাঘুরি করতে ইচ্ছে করে।’

‘করুক ইচ্ছে তুমি বয়সের কথাটা মনে রাখবে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হার্ট দুর্বল হতে থাকে, ব্লাডপ্রেশার আর একরকম থাকে না। এখুনি বাড়ি গিয়ে শুয়ে পড়ো।’ ব্রতীনের বুকে হাত রেখে বাসন্তী আলতো ঠেলা দিল। ঘরে ফিরে এসে ব্রতীন দেবীকে শুয়ে থাকতে দেখে বলল, ‘এখনও ব্যথা করছে?

দেবী ধীরে ধীরে উঠে বসল। ‘বেকায়দায় নড়াচড়া করলে চিড়িক দেয় নয়তো ঠিকই আছে। তুমি কি রাত্রে খাবে?’

‘ভাবছি উপোস দোব, খিদে নেই। আচ্ছা দেবী একটা পার্সোনাল কথা তোকে জিজ্ঞাসা করব, ঠিকঠিক জবাব দিবি।’ তীক্ষ্ন চোখে ব্রতীন খুড়তুতো বোনের দিকে তাকিয়ে রইল। দেবীর চোখে অস্বস্তি। ঢোঁক গিলে বলল, ‘কী জানতে চাও।’

ব্রতীন খাটের একধারে বসল পা ঝুলিয়ে। ‘বিয়ের তিন মাস পর আমেরিকায় পবিত্রর কাছে গেলি আর সাতদিনের মধ্যে চলে এলি। ব্যাপারটা কী?’

দেবীর মুখ থেকে উৎকণ্ঠা সরে গিয়ে হাসি ফুটল। ‘ওহ এই তোমার পার্সোনাল জিজ্ঞাসা! আমি ভাবলুম না জানি গুরুতর কিছু জানতে চাইবে।’

‘এটা গুরুতর নয়?’

‘আমার কাছে অবশ্যই কিন্তু এখন অতটা গুরুতর নয়। পবিত্র একবছর ধরে ন্যান্সি মিলার নামে একটা মেয়ের সঙ্গে রয়েছে। মেয়েটা ওর কলেজেই পড়ত, কলেজ ছেড়ে দিয়ে একটা কম্পুটার কোম্পানিতে ওয়েবসাইট ডিজাইনারের চাকরি নিয়েছে। ন্যান্সিকে দেখিনি তবে ওরা যে একসঙ্গে বসবাস করে সেটা গিয়েই বুঝেছিলাম। আমি আসব বলে ও কয়েকদিনের জন্য অন্য জায়গায় চলে যায়। পবিত্র আমাকে রিসিভ করে নিউ ইয়র্কে কেনেডি এয়ারপোর্টে। সেখান থেকে আবার দেড় ঘণ্টার ফ্লাইট। পথেই পবিত্র আমাকে খোলাখুলি ন্যান্সির সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা বলে।’

‘পবিত্রর পড়াবার বিষয় কী?’

‘ইকনমিক হিস্ট্রি। কথাবার্তা আচরণে অত্যন্ত ভদ্র, মার্জিত। বড়দা আমি যে রেগে উঠব সেটাও আর পারলুম না। ও জানত আমি কী প্রশ্ন করব। নিজে থেকেই বলল, পরিবারের চাপ থেকে মুক্তি পাবার জন্য বিয়েটা করেছে। মা আত্মহত্যা করতে গেছল বিষ খেয়ে ছেলের মেম বিয়ে করা আটকাবার জন্য। আমার বায়োডাটা দেখে পবিত্রর কেন জানি ধারণা হয়, আমি ওর অবস্থাটা বুঝব আর মাপ করে দোব তাই ঝামেলা এড়াতে বিয়েতে রাজি হয়ে যায়।’

‘মাপ মানে ডিভোর্স? তিলে খচ্চচর!’ ব্রতীন ঠোঁট বাঁকাল তাচ্ছিল্যে। ‘অন্তত দেড় লাখ টাকার গহনাই কাকাবাবু তোকে দিয়েছিলেন, সেগুলোর কী হল?’

‘সব ও ফেরত দিয়ে গেছে।’

ব্রতীন চমকে উঠল। ‘দিয়ে গেছে, মেরে দেয়নি?’

‘বিয়ের জন্য যত টাকা খরচ হয়েছে, ডিভোর্সের মামলার জন্য যত খরচ হবে, আন্দাজমতো ডলারে তিন লাখ টাকার একটা চেক আমার নামে পাঠিয়ে দেয়। প্রথমে ভেবেছিলুম নোব না পরে ভেবে দেখলুম, কেন নোব না। উনি মুক্তি পাবার জন্য বিয়ে-বিয়ে খেলা খেলবেন আর তার জন্য খেসারত দেবে আমার বাবা?’

‘কাকাবাবু যদি কলকাতার কোনো ডিটেকটিভ এজেন্সিকে দিয়ে বিয়ের আগে খোঁজ নিতেন, অনেক এজেন্সিরই বিদেশে অফিস আছে তা হলে সব খবরই পেয়ে যেতেন।’ ব্রতীন আফশোস করল। ‘উনি শুধু বাড়ির লোক, বাড়ির অবস্থা, বনেদি বংশ আর আমেরিকায় থাকে শুনেই নেচে উঠেছিলেন।’

দেবী করুণস্বরে বলল, ‘বড়দা বাবাকে তুমি কিছু বোলো না, বয়স হয়েছে, ছোড়দা একদিন যাচ্ছেতাই করে বাবাকে বলেছে সেই থেকে চুপচাপ রয়েছেন। দেখলে কষ্ট হয়।’

ব্রতীন মুখটা গোঁজ করে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর হেসে উঠল। ‘তোর হাতে এখন অনেক টাকা, কী করবি টাকাগুলো নিয়ে?’

‘কী করা যায় বলো তো? একবার ভেবেছিলুম শাড়ির ব্যবসা করব, তারপর ভাবলুম কোনো পারফিউম কোম্পানির এজেন্সি নোব নয়তো হ্যান্ডিক্র্যাফটসের দোকান দেব। শুধু ভেবেই গেছি কোনোটার সম্পর্কে ছিটেফোঁটা অভিজ্ঞতাও নেই।’

‘অভিজ্ঞতা যাতে নেই তাতে নামতে যাসনি। টাকাগুলো এখন থাক। পরে ভেবেচিন্তে কিছু একটা করিস। ভালো কথা তুই তো বিয়ে করতে পারিস, করছিস না কেন?’

ব্রতীন এতক্ষণ ভূমিকা ফেঁদে এবার আসল কথায় এল।

দেবী হঠাৎ বিয়ের কথার সামনে পড়ে গিয়ে অপ্রতিভ হয়ে ইতস্তত করে বলল, ‘বিয়ে? বাসুদি একবার বলল বটে, আমি এসব নিয়ে কখনো ভেবে দেখিনি, তেমন কারোর সঙ্গে তো আলাপ-পরিচয়ও হয়নি।’

‘বাড়িতে বসে থাকলে লোকের সঙ্গে পরিচয় হবে কী করে। তবে সম্বন্ধ করে আর বিয়ে নয়। নিজে দেখেশুনে বাজিয়ে নিয়ে বিয়ে করবি। মুম্বইয়ে দু-তিনটে ভালো ছেলে চিনি কিন্তু ওদের লাইফস্টাইল দেখে ভরসা হয় না ভগ্নীপতি করতে। কে জানে কতদিন বাঁচবে। এই সেদিন ক্লাবে হরিশ মানচান্দনি নামে বছর ত্রিশের একটা ছেলে টেবলটেনিস খেলতে খেলতে ধপ করে পড়ল, তিন মিনিটের মধ্যেই মরে গেল। হজেস অ্যান্ড টেম্পলটন একটা বিদেশি ফিনান্সিয়াল ফার্ম, তার এক্সিকিউটিভ হয়েছিল হরিশ এত অল্পবয়সেই। ওপরে ওঠার জন্য উদয়াস্ত খেটেছে। রাতে ক্লাবে এসে এন্তার মদ খেয়ে বাড়ি ফিরত। ভালো স্বাস্থ্য, রোগভোগ নেই, হার্টেরও কোনোরকম ট্রাবল ছিল না। শিক্ষিত ভদ্র, ওকে আমি খুব ভালোবাসতাম। এইসব অ্যাম্বিশাস ছেলেদের সামনে ওপরে ওঠার রাস্তাটা গত দশ বছরে খুলে গেছে, কে আগে উঠবে তাই নিয়ে গোঁতাগুতি, তার সঙ্গে চাকরি রক্ষার দুশ্চিন্তা সঙ্গে ইনসোমনিয়া আর মদ খাওয়া। এদের প্রত্যেকের ভুঁড়ি হবেই হবে। বলছিলিস না আমার ভুঁড়িই হয়নি শিবুর হয়েছে। শিবুটা টাকার পেছনে দৌড়চ্ছে, নির্ঘাত ও মদ খাচ্ছে।’

‘বউদির কাছে শুনেছি ছোড়দা ভীষণ খাচ্ছে।’

‘এদের বারণ করে লাভ নেই। উন্নতির পথ এরা দেখতে পেয়ে গেছে। এই এপিডেমিকের খপ্পরে বাসু পড়েছিল, চাকরি ছেড়ে দিয়ে বেঁচে গেছে। ওর মুখেই শুনে নিস। এখন আমি ঘুমোব, ওপরে যা। যেতে পারবি তো?’

দেবী খাট থেকে নামল একটু কুঁজো হয়ে। ধীরে ধীরে সোজা হল এবং কাঠের মতো খাড়া থেকে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

আলো নিভিয়ে শুয়ে ব্রতীন চোখ কচলাল। জ্বালা করছে চোখ। একটা দিন কাটল। তার জীবনে এমনদিন আগে কখনো আসেনি। সকাল থেকে কী কী ঘটেছে মনে করতে করতে সে গভীর ঘুমের মধ্যে ঢুকে গেল।

পরদিন বিকেলে ব্রতীন ফোন করল বলদেবের বাড়িতে। ওধার থেকে স্ত্রী কণ্ঠে উত্তর এল, ‘হ্যালো।’

‘বলদেব বাড়ি আছে?’

‘উনি তো এখন অফিসে। আপনি কে বলছেন?’

বলদেব এখন বাড়ি থাকবে না জেনেই ব্রতীন ফোনটা করল।

‘আমি ওর বন্ধু ব্রতীন। আমি কার সঙ্গে কথা বলছি জানতে পারি কি?’

‘আমি ওর স্ত্রী রঞ্জনা। আপনার কথা কাল রাতে উনি অফিস থেকে ফিরেই করলেন। আপনি নাকি খুব ভালো ছাত্র ছিলেন। এখন মুম্বইয়ে থাকেন, খুব বড়ো কোম্পানিতে চাকরি করেন। অনেকক্ষণ স্কুলের গল্প করেছিলেন। আপনি আসুন না আমাদের বাড়ি।’

মিষ্টি অথচ ভারী স্বর। স্বচ্ছন্দ ঝরঝরে ভঙ্গিতে অপরিচিত মহিলাটি যেভাবে কথাগুলো বললেন তাতে ব্রতীনের মনে হল স্বাধীনভাবে চলাফেরা ও চিন্তা ইনি পছন্দ করেন। চিন্তার সঙ্গে সঙ্গে কাজও সেইভাবে করতে পারেন অন্তত করে তো দেখিয়েছেন। একে তো একবার দেখতেই হয়।

‘যাব তো কিন্তু বলা তো বাড়ি নেই।’

‘তাতে কী হয়েছে আমি তো আছি। বন্ধুর সঙ্গে তো দেখা হয়েইছে আমাকে দেখেননি, আমিও আপনাকে দেখিনি। আলাপটা হয়ে যাক, স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে আসুন এখুনি। কাছেই তো থাকেন।’

‘কাছেই থাকি, আপনার সঙ্গে আলাপটাও সেরে নিতে চাই কিন্তু স্ত্রীকে তো সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে না।’

‘কেন!’ বিস্মিত হল রঞ্জনা।

‘উনি নেই।’

‘আহহ।’

শোকসূচক একটি ধ্বনি টেলিফোনের তার দিয়ে ব্রতীনের কানে পৌঁছতেই সে হেসে উঠল। ‘নেই মানে কোনো এক ভদ্রমহিলা আমার স্ত্রী হওয়ার যাতনা থেকে রক্ষা পেয়ে গেছেন। আমি বিয়েই করিনি।’

‘তিনি বেঁচে গেছেন না আপনি বেঁচে গেছেন।’ প্রশ্ন নয়, বিস্ময় নয়, সহজ বিবৃতি বেরিয়ে এল রঞ্জনার গলা দিয়ে।

কণ্ঠের প্রথম দিকের ঋজুতা এখন অনেক নমনীয় তরল হয়ে এসেছে। ব্রতীন বুঝল বলার বউ আলাপী এবং আলাপকে অনেক দূর ছড়িয়ে দিতে পারে।

‘কে বেঁচে গেছেন সেটা একটা ডিবেটের বিষয় হতে পারে তবে ফোনে নয়। আমি আধঘণ্টার মধ্যে পৌঁছোচ্ছি।’

ফোন নামিয়ে ব্রতীন পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দেবীর দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, ‘বলার উৎপাতে ইনি বাড়ি সংসার ছেড়ে চলে গেছলেন। ফিরে এসে ঠিক কাজ করেছেন কি না সেটা জেনে আসি। তোকে তো বেশ ফিট মনে হচ্ছে।’

‘জায়গাটা টিপলে চিড়িক করে ওঠে।’

‘কই দেখি।’ ব্রতীন আঙুল বাড়াল দেবীর শিরদাঁড়ার নীচের দিকে।

হাতটা সরিয়ে দিয়ে ‘থাক’ বলে দেবী পিছিয়ে গেল।

ব্রতীন অপ্রতিভ মুখে তাকিয়ে রইল। বয়সে অনেক বড়ো, সম্পর্কে দাদা হলেও কোনো তরুণীর অঙ্গের কিছু কিছু জায়গা যে স্পর্শ করার পক্ষে ‘নিষিদ্ধ এলাকা’ এটা তার মনে রাখা উচিত ছিল। অপ্রতিভতা কাটিয়ে উঠতে সে একটু বেশি সপ্রতিভ হল।

‘কাল বাসু বলল, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হার্ট দুর্বল হতে থাকে ব্লাডপ্রেশার আর একরকম থাকে না। কথাটার দু-রকম মানে হয়। বলতে পারিস মানে দুটো কি?’

দেবী চিন্তিত ও বিব্রত ভাব মুখে ফুটিয়ে বলল, ‘একটা তো পরিষ্কার ফিজিক্যাল মানে। বয়স হলে ভেতরের ভাইটাল অর্গ্যানগুলো ঢিলে হয়, শুকিয়ে যায়, কাজের ক্ষমতা হারায়। দ্বিতীয় মানে, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরে ক্ষয় মানে, আয়ুর ক্ষয় অর্থাৎ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া। মৃত্যুকে কোনো মানুষ সহজে মেনে নিতে চায় না যেহেতু বহু রকমের বাসনা মানুষের অপূর্ণ থেকে যাবেই আর তারই ফলে জীবনকে শেষবারের মতো ভোগ করে নেওয়ার একটা ইচ্ছা জাগে। বাসুদি হয়তো এই অপূর্ণতাকে পূরণ করার ইচ্ছার কথাটাই অন্যভাবে তোমায় মনে করিয়ে দিয়েছে।’

‘ওরে বাব্বা, তুই তো বেশ ভাবিস-টাবিস দেখছি। কিন্তু অপূর্ণতাটা কার, আমার না বাসুর?’

‘দুজনেরই। তোমার দিকটা তুমিই ভেবে দেখো, একবার পিছনে তাকিয়ে হিসেব নাও।’

‘নিয়ে কোনো লাভ নেই লোকসানও নেই। একসময় ভাবতুম গাওস্করের মতো ক্রিকেটার হব, হলুম না; সত্যেন বোস হব, পারলুম না;জীবনানন্দের মতো কবিতা লিখব, হল না। তার বদলে হলুম বায়োকেমিস্ট এটাই বা খারাপ কী?’

‘তুমি যে ক-জনের নাম করলে তারা কেউই আইবুড়ো থাকেননি। তুমি এদিক থেকে অন্তত ওঁদের সমান হতে পারতে।’

‘এভাবে সমান তো এ দেশে কম করে অন্তত পঞ্চাশ কোটি মেয়ে-পুরুষ, তাতে হলটা কী? বিয়ে করিনি বলে আমি অপূর্ণ রয়ে গেছি, কই কখনো তো আমার তা মনে হয়নি! তোর মনে হয়?’

‘এখনও মনে হয়নি তবে কখনো তো মনে হতেও পারে। ছেলে আর মেয়েদের মন একভাবে কাজ করে না।’ দেবী চূড়ান্ত রায় দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ব্রতীন হাতঘড়ি দেখে বলদেবের বাড়ি কখন পৌঁছোতে পারবে সেটা আন্দাজ করে নিল।

সদর দরজায় লোহার কড়ার আর কলিংবেলের বোতাম দুইই রয়েছে। অভ্যাসমতো ব্রতীন কড়া নাড়ল। দশ সেকেন্ডের মধ্যেই দরজা খুলল এক স্ত্রীলোক, বোধহয় খোলার জন্য তৈরিই ছিল। দেখতে সাধারণ, তাঁতের শাড়িটাও সাধারণ, সাদার ওপর কালো ডুরে; হাতে সোনার চুড়ি; সিঁদুর, শাঁখা ও লোহা; মাথায় আধঘোমটা। একটু আগেই স্নান করার জন্য মুখের চামড়া উজ্জ্বল। দেহ কিঞ্চিৎ স্থূল। চোখদুটিতে বালিকাসুলভ কৌতূহল এবং বুদ্ধির দীপ্তি প্রকাশ পাচ্ছে। ব্রতীনের মনে হল ইনিই রঞ্জনা।

‘আমি ব্রতীন। আপনি নিশ্চয় রঞ্জনা।’

‘হ্যাঁ। একেবারে কাঁটায় কাঁটায় আধঘণ্টার মাথায় এলেন। ভেতরে আসুন।’

বোধহয় দু-বার সে এই বাড়িতে এসেছে। ব্রতীনের মনে হল ডানদিকে একটা বৈঠকখানায় সে বসেছিল। আর বাঁদিকে উপরে যাবার খোলা সিঁড়ি ছিল, এখনকার মতো দরজা ফুটিয়ে শেকল তুলে দেওয়া ছিল না। দোতলায় বোধহয় সহদেব থাকে, বাড়ি যে ভাগ হয়ে গেছে সেটা বোঝা যায় উঠোনের মাঝে পাঁচিলটা দেখে।

‘কাঁটায় কাঁটায় পৌঁছোবার জন্য মিনিট চারেক রাস্তায় ঘোরাঘুরি করেছি চানা খেতে খেতে।’ ব্রতীন হাতের ঠোঙাটা দেখিয়ে বলল, ‘খাবেন নাকি?’

‘চানাভাজা আমার ভালো লাগে না।’ হেসে প্রত্যাখ্যান করল রঞ্জনা।

সেই বৈঠকখানা ঘরটা এখন শোবার ঘর। সেইখানেই ব্রতীন বসল একটা চেয়ারে। মুখোমুখি খাটে পা ঝুলিয়ে বসল রঞ্জনা। সালোয়ার কামিজ পরা এক কিশোরী ঘরে ছিল। রঞ্জনা তাকে বলল, ‘সুচিত্রা চায়ের জল বসা।’ মেয়েটি বেরিয়ে গেল। ‘কী প্রশংসা আপনার, চেহারা নাকি একটুও বদলায়নি!’

‘বলেনি, একটুও ভুঁড়ি হয়নি! আজ দু-বার কথাটা শুনতে হয়েছে।’

‘তৃতীয়বার শোনার সুযোগ নেই কারণ তিরিশ বছর আগে আপনাকে আমি দেখিনি।’ বলে হাসল। ব্রতীনের চোখে পড়ল পানের ছোপধরা দাঁত।

‘আপনাদের বিয়ে কতদিন হয়েছে? পুত্রকন্যা?’

‘তা বছর পনেরো। ছেলেমেয়ে নেই।’ রঞ্জনা হাসার চেষ্টা করল। হাসিটা বেদনা জড়ানো। ব্রতীন তা লক্ষ করল।

‘তা হলে নির্ঝঞ্ঝাটে আছেন!’

‘তা একরকম বলতে পারেন। ছেলেমেয়েকে ভালো স্কুলে ভরতি করাবার হ্যাপা পোয়াতে হয়নি, কেজি স্কুলে পৌঁছে দিয়ে দু-ঘণ্টা লোকের বাড়ির রকে বসে সময় কাটাতে হয়নি, হিন্দি সিনেমা দেখা আটকাতে টিভি পাহারা দিতে হয়নি, ছেলে নকশাল কিংবা মস্তান হবে কি না তাই নিয়ে ভয়ে ভয়ে দিন কাটাতে হয়নি। নির্ঝঞ্ঝাট বলতে তো এগুলোই বোঝায়। দোতলায় থাকে আমার দেওর আর জা, দুটি ছেলে, এখন তারা থ্রি আর ফোরে পড়ছে। ওদের দেখেই মনে হয় ভালোই হয়েছে ছেলেপুলে না হয়ে।’ রঞ্জনা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল একটু চেষ্টা করে।

‘তা হলে আমিও বেঁচে গেছি।’ ব্রতীন স্বস্তি পেল রঞ্জনার সঙ্গে একই স্তরে পৌঁছোতে পেরে। এখন সহজে কথা বলা যাবে। ‘ভালো কথা, আমি চিনি ছাড়া চা খাই কিন্তু।’

রঞ্জনা উঠে গেল ঘর থেকে। সুচিত্রাকে নির্দেশ দিয়ে ফিরে এসে বসল।

‘উনিও ডায়বিটিস হবার আতঙ্কে আছেন, বাবার ছিল। ইদানীং পাতে নুন খাওয়াটাও বন্ধ করেছেন। রেগুলার প্রেশার চেক করেন।’

‘বলা খুব খুঁতখুঁতে, সাসপিসাসও। ওর সন্দেহ হত, জানি না এখনও সেটা আছে কি না, সবাই ওর দিকে তাকাচ্ছে আর মনে মনে হাসছে।’ কথাগুলো বলেই ব্রতীনের মনে হল বউয়ের কানে এগুলো ভালো শোনাবে না।

‘কেন, ওর হাইটের জন্য?’

রঞ্জনার স্বর খুব স্বাভাবিক প্রায় কৌতুকের মতোই।

‘ঠিক ধরেছেন।’

একটা প্লাস্টিকের ট্রেতে সুচিত্রা দু-কাপ চা নিয়ে এল। ওর গায়ের রং, মুখের গড়ন এবং স্বাস্থ্য ব্রতীনকে মনে পড়াল মলিকে। মেয়েকে ডাক্তার দেখাতে গেছে কি না কে জানে! চায়ে চুমুক দিয়ে বুঝল দামি চা এবং সুচিত্রা নষ্ট করে ফেলেনি।

‘বাহঃ ভালো বানিয়েছে তো।’

দাঁড়িয়ে থাকা সুচিত্রা লাজুক হয়ে উঠল প্রশংসা শুনে।

‘এই একটি কাজই ও ভালো পারে আর সব ব্যাপারেই উলটোপালটা কাজ করে। যা ময়দাটা মেখে ফেল।’ রঞ্জনার স্বরে প্রশ্রয় চোখে স্নেহ।

‘আপনার বন্ধু হাইট নিয়ে এখন আর মাথা ঘামায় না।’

‘সে কী! কবে থেকে।’

‘দশ-বারো বছর। শুনলুম আপনি আঠারো-কুড়ি বছর কলকাতা ছাড়া। ওর সঙ্গে কালই আপনার প্রথম দেখা হল তাই জানেন না।’

‘এই সন্দেহ করার বাতিকটা তা হলে গেছে। বাঁচা গেল। কিন্তু গেল কী করে?’ ব্রতীন চোখ কুঁচকে রইল উত্তরের আশায়। মনে মনে হাসল, দেখি কী বলে।

‘একবার আমি কলকাতার বাইরে যাই চাকরি নিয়ে, ওকে কিছু না বলে। ব্যস চোখে অন্ধকার দেখতে লাগল।’ রঞ্জনা হাসি চাপল মুখ নামিয়ে। ব্রতীন অবাক হয়ে ভাবল, বেশ সুন্দরী তো!

‘কতদূরে গেছলেন?’

‘বেশিদূরে নয় শান্তিনিকেতনে। কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দেখেছিলুম, এক বৃদ্ধার দেখাশোনা করার জন্য ভদ্র গরিব ঘরের নির্ঝঞ্ঝাট বয়স্কা মহিলা চাই। থাকা খাওয়া বাদে দুশো টাকা মাইনে। তখন দুশো টাকার অনেক দাম। দিলুম এক চিঠি। বয়সটা একটু বাড়িয়েই লিখলুম, আমাকে তো বয়স্কাই দেখায়। আর লিখলুম বাপের বাড়ি থাকি, স্বামী পরিত্যক্তা। উত্তর খুব তাড়াতাড়িই এল। একটা পুঁটলি নিয়ে চলে গেলুম।’

ব্রতীন ওর বলার ধরনটা লক্ষ করে গেল। স্বামীকে ছেড়ে চলে যাওয়াটা যেন কোনো ব্যাপারই নয়। জীবনের এতবড়ো ঘটনাটা ঘটাল শুধু আত্মসম্মান বজায় রাখতে। এ কাজ বাসুও তো পারত বা এখনও পারে।

‘চলে গেলুম মানে নিঃশব্দে কাউকে কিছু না বলে?’

‘ঠিক তাই। ট্রেন কখন জেনে নিয়েছিলাম। দুপুরে ও অফিসে বেরোতে কিছুক্ষণ পর আমিও বেরিয়ে যাই। চিঠি-ফিঠি লিখে যাইনি।’

‘আপনি কি আর ফিরবেন না স্থির করেই বেরিয়েছিলেন?’

‘প্রথমে তাইই ভেবেছিলুম। মাত্র মাধ্যমিক পাশ খুব সাধারণ ছাত্রী ছিলাম। কী আর কাজ পাব। তবু ঠিক করলুম নিজের পায়ে দাঁড়াব। আপনার বন্ধুকে দেখিয়ে দোব।’

‘কী দেখিয়ে দেবেন?’

রঞ্জনার স্বর কঠিন হয়ে উঠছিল। চোখে বিদ্যুৎ চমকেছে বার দুয়েক। ব্রতীনের ব্যগ্র প্রশ্নটা শুনে চুপ করে রইল, কিছুক্ষণ পর মাথা নেড়ে রঞ্জনা বলল, ‘থাক ওসব কথা। অন্যের অসাক্ষাতে তাকে নিয়ে আলোচনা করাটা ঠিক হবে না।’

‘আপনি ফিরে এলেন কেন?’ যা দেখাতে চেয়েছেন তা দেখানো হয়েছে বলে?’

‘হ্যাঁ, ঠিক তাই। তা ছাড়া আমার মনে হয়েছিল বিয়ে যখন করেছি তখন আমারও একটা দায়িত্ব আছে স্বামী সম্পর্কে। আমি ওকে বুঝিয়েছি কেউ তোমাকে দেখে মনে মনে হাসে না, পৃথিবীতে কয়েক কোটি মানুষ আছে যারা তোমার থেকেও কম হাইটের। আমি তো জেনেশুনেই বিয়েতে রাজি হয়েছি। শান্তিনিকেতন থেকে ওই আমায় ফিরিয়ে আনে। আমি ওকে নিয়ে সিনেমায় গেছি, দোকান বাজার করেছি, বিয়েবাড়ি গেছি। ওকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছি কেউ হাসেনি। ও বলত সামনে হাসছে না কিন্তু মনে মনে তো হাসছে। কী বিপদ দেখুন, মনে মনে তো বহু ব্যাপারেই মানুষ হাসে। ঢ্যাঙা লোকের পাশে বেঁটে বউ আকছার দেখতে পাবেন। তাই নিয়ে হাসতে কার দায় পড়েছে?’

‘আপনার চলে যাওয়াটা বোধহয় ওকে প্রচণ্ড ধাক্কা দিয়েছিল।’

‘একদম ভেঙে পড়েছিল, দেখে মায়া হয়েছিল। যাই দেখি, সুচিত্রা কী তালগোল পাকাচ্ছে।’ রঞ্জনা উঠে দাঁড়াল হাসিমুখে। ‘লুচিতে আপত্তি নেই তো? বন্ধু নেই বলে আতিথেয়তার অযত্ন হল বলতে দেব না।’

‘না না লুচিতে বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই সঙ্গে যদি বেগুনভাজা পাই।’

‘পাবেন।’

ঘর থেকে রঞ্জনা বেরিয়ে গেল। ব্রতীন ভাবতে শুরু করল রঞ্জনার কথাগুলো। অনেক কথা জমেছিল বলার মতো লোক পাচ্ছিল না। চিন্তাটা সে নিজের দিকে ঘোরাল। কী এমন তার মধ্যে মেয়েরা দেখতে পায় যেজন্য গলগল করে মনের কথা বলে ফেলে। খুব ভালোমানুষ? হৃদয়বান? বন্ধুর মতো?

সুচিত্রা এসে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি আর এক কাপ চা খাবেন?’

‘খুব ভালো চা করেছিলে, শিখলে কোথায়?’

‘বউদির কাছে।’

‘থাকো কোথায়?’

‘গোলাপবাগানে। দিনের বেলায় এখানে থাকি।’

সোজা হয়ে বসল ব্রতীন। ‘ওখানে নিমি বলে একটা মেয়ে থাকে, তাকে চেনো?’

সুচিত্রা অবাক হয়ে রইল কয়েক সেকেন্ড। ইতস্তত করে বলল, ‘চিনি।’

‘ওর মা আছে, বুড়ি নাম।’

‘আপনি ওদের চিনলেন কী করে?’

‘তিরিশ বছর আগে বুড়িকে চিনতুম তখন ও তোমার বয়সি ছিল।’

‘নিমি তো খারাপ হয়ে গেছে।’

‘তুমি জানো?’

‘বস্তির সবাই জানে।’

ব্রতীন সিঁটিয়ে উঠল। একে আর কোনো প্রশ্ন নয়।

‘এবার চা নিয়ে এসো, চিনি ছাড়া।’

সুচিত্রা রান্নাঘরে গিয়ে নিশ্চয় রঞ্জনাকে বলবে, যে লোকটা এসেছে সে তাদের বস্তির একটা মেয়ের কথা তাকে জিজ্ঞাসা করেছে। কী অস্বস্তিতে পড়া গেল, না জিজ্ঞেস করলেই হত। ব্রতীন চলে যাবার জন্য মনে মনে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। বলার বউয়ের কথা তো শোনা হয়ে গেছে এবার যত তাড়াতাড়ি বেরোনো যায়।

চা নিয়ে এল রঞ্জনা। ব্রতীন নজর করল ওর মুখভাব। কোনো ভাবান্তর চোখে পড়ল না। সুচিত্রা বোধহয় এখনও কিছু বলেনি হয়তো পরে বলবে। রঞ্জনা তাকে জিজ্ঞাসা করল বাড়ির কথা, কাজের কথা, মুম্বইয়ের কথা। সে যথাসম্ভব উত্তর দিয়ে গেল সংক্ষেপে। তার মাথায় ঘুরছে, ‘নিমি তো খারাপ হয়ে গেছে; বস্তির সবাই জানে।’ কথাগুলো বলার সময় সুচিত্রার মুখে কিছু ফুটে উঠেছিল কি? কোনোরকম অবাক হওয়ার চিহ্ন? তন্নতন্ন করে সে ওর মুখটা মনে ফুটিয়ে তুলতে লাগল।

রঞ্জনা উঠে ভিতরে গেল। ফিরে এল রেকাবি ভরতি ফুলকো লুচি, বেগুনভাজা আর একটা প্লেটে সন্দেশ নিয়ে।

‘একে ডায়বিটিস সন্দেশ বলে, চিনি ছাড়া, স্যাকারিনে তৈরি। আমাদের পাড়ায় একটা দোকানই করে। খেয়ে দেখুন।’

‘তা খাচ্ছি কিন্তু লুচি অর্ধেক করুন।’

‘মাত্র ছ-টা, খুব পারবেন।’

গলার স্বরে ব্রতীন বুঝল সবকটা তাকে খেতেই হবে। সে আর অনুরোধে গেল না, খেতে শুরু করে দিল। দশ মিনিটেই শেষ করে দিল রেকাবি।

দুই গ্রাসে দুটো সন্দেশ শেষ করে, হাত ধুয়ে উঠে দাঁড়াল, ঘড়ি দেখল।

‘সাতটায় একজনের বাড়িতে আসার কথা আছে, আমি এবার যাব। খুব ভালো লাগল আলাপ হয়ে। বলাটা থাকলে ভালো হত। আপনার কথা অনেকদিন মনে টাটকা হয়ে থাকবে। আমি ভাবতেই পারিনি ও এমন ভাগ্য করে এসেছে, এত ভালো বউ পাবে।’

‘আমিও ভাবনি ওর এত ভালো খাইয়ে বন্ধু আছে। আবার কলকাতায় এলে অতি অবশ্য আসবেন কিন্তু।’

সামান্য একটা মিথ্যা বলতে হল, সাতটায় কারোরই আসার কথা নেই। সে যে নিমিকে পাঁজাকোলা করে গোলাপবাগানের ঘরে পৌঁছে দিয়েছে এ খবরটা কি সুচিত্রা জানতে পারবে! জানলে রঞ্জনাকে পরে বলবে। বাড়ি ফেরার সময় ব্রতীন শুধু এই কথাটা নিয়েই ভাবল, রঞ্জনা মনে মনে কী ধারণা করবে তার সম্পর্কে!

রবিবার সকালে ব্রতীন দেবীকে বলল, ‘কমলের মাকে একবার বাসুদের বাড়িতে পাঠা, ওকে মনে করিয়ে দিয়ে আসুক ঠিক দশটায় আমরা বেরোব।’

কমলের মা গেল এবং ফিরে এসে বলল, ‘বাসুদি যেতে পারবে না। বলল ওকে নিয়ে যেতে ওর সোয়ামি এসেছে। এখুনি সঙ্গে করে নিয়ে যাবে। দেখলুম টাকমাথা একটা লোক ঘরে বসে বাসুদির মায়ের সঙ্গে কথা বলছে।’

শুনেই দেবী মাথায় হাত দিয়ে বলল, ‘সর্বনাশ করেছে বড়দা। বাসুদি ফোনে সেদিন বলল, মা পড়ে গিয়ে কোমরে চোট পেয়েছে এক্স রে হয়েছে তাই সোমবারের আগে যেতে পারবে না। এখন জামাইবাবু নিজের চোখ দেখলেন পুরোটাই মিথ্যে। বাসুদি বোধহয় ভাবতে পারেনি জামাইবাবু এসে হাজির হবে শাশুড়িকে দেখতে।’

ব্রতীনের মুখ শুকিয়ে গেল। সন্দেহবাতিকগ্রস্ত লোক। বউকে বিশ্বাস করে না। সে যদি জোর করে রবিবার পর্যন্ত থাকতে না বলত তা হলে বাসুকে এই বিপদের সামনে পড়তে হত না। ভারাক্রান্ত গলায় সে বলল, ‘শাশুড়িকে দেখতে এসেছে কি না জানি না তবে বাসুর কপালে দুখ্যু আছে। এভাবে মিথ্যা কথা কেন যে বলতে গেল!’

‘আমিও তো তখন তাই ভাবলুম, বাপের বাড়িতে মেয়ে দুটোদিন বেশি তো থাকতেই পারে। সদ্য বিয়ে হওয়া হলে নয় কথা ছিল, তাতো নয়। শুনেছি লোকটা খিটখিটে মেজাজের। হয়তো এই নিয়ে অনেক কথা শোনাবে বাসুদিকে।’

‘যাক গে, তুই তৈরি হয়ে নে। রাত্রে টেলিফোন করে জেনে নিস, কী হল।’

দশটার সময় ওরা দুজন বাড়ি থেকে বেরোল। ট্যাক্সি ধরতে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ে গিয়ে দাঁড়াল। দেবীই ব্রতীনকে দেখাল, ‘ওই দেখো বড়দা, বাসুদিরাও দাঁড়িয়ে ট্যাক্সির জন্য।’

তাদের উলটোদিকে রাস্তার ওপারে বাসন্তীর পাশে শীর্ণকায়, ট্রাউজার্স হাওয়াই শার্ট পরা টাকমাথা একটি লোক দাঁড়িয়ে। লোকটি দূরে তাকিয়ে খালি ট্যাক্সি আসছে কি না দেখছে। দেবী হাত তুলে বাসন্তীর উদ্দেশে নাড়ল। না দেখার ভান করে বাসন্তী মুখ ঘুরিয়ে নিল। দেবী আবার হাত তুলল।

‘থাক দেবী। বাসু দেখেছে আমাদের।’

একটি ট্যাক্সি বাসুদেব সামনে থামল। লোকটি ঝুঁকে ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলে পিছনের দরজা খুলে বাসন্তীকে উঠতে বলল। ট্যাক্সি ছাড়ামাত্র বাসন্তী জানলা দিয়ে তাদের দিকে তাকাল। দু-তিন সেকেন্ডের জন্য বাসন্তীর চোখ দুটো তার চোখ ঘষে দিয়ে চলে গেল। ব্রতীন চোখে হাত রাখল, জ্বালা করছে। তখনই দেবী বলে উঠল, ‘বড়দা খালি ট্যাক্সি আসছে, ধরো ধরো।’

সল্টলেক উপনগরীতে ব্রতীন আগে দু-বার এসেছে। এক অধ্যাপকের আর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সহপাঠীর বাড়িতে। বাসে এসেছিল। কত নম্বর ট্যাক স্টপে যেন নেমেছিল আজ আর তা মনে নেই। শুধু মনে আছে বি ডি মার্কেট নামটা। আর একটা নাম মনে আছে লালকুঠি। আজ যা দেখছে তাতেই সে অবাক হচ্ছে। দশ-বারো বছরেই এত বাড়ি আর দোকান হয়ে গেছে! বহু বাড়িই দেখতে সুন্দর। একটা জায়গায় বড়ো বড়ো কয়েকটা বাড়ি দেখে সে দেবীকে জিজ্ঞাসা করল, ‘এগুলো কীসের বাড়ি রে?’

‘সরকারি অফিস। সেচ ভবন, বিদ্যুৎ ভবন, ময়ূখ ভবন, পূর্ত ভবন, বিকাশ ভবন নাম শুনেই বুঝতে পারছ কী কাজ হয় এইসব বাড়িতে।’ দেবী বহুবার এসেছে সল্টলেকে, এখানকার সোজা সোজা রাস্তার অনেকগুলোই তার চেনা।

‘আমাকে যদি ঠিকানা দিয়ে খোঁজার জন্য এখানে ছেড়ে দিস তা হলে আমি ঘুরপাক খেয়ে মরব। কিন্তু দর্জিপাড়া কি কুমোরটুলিতে ছেড়ে দিলে কাউকে জিজ্ঞেস না করে ঠিক বাড়ি বার করে নোব। কলকাতার রাস্তাগুলোর আলাদা আলাদা চরিত্র আছে এখানে সবই একরকম।’

দেবীর নির্দেশমতো ট্যাক্সি পৌঁছোল ডি এল ব্লকে একটা পাঁচিল ঘেরা দোতলা বাড়ির লোহার ফটকের সামনে। বাড়ির সামনে একটা নোংরা জলের খাল, ফটকের পাশে নেমপ্লেটে ইংরেজিতে লেখা : ডা. সলিল সরকার এফ আর সি এস (ইঙ্গ), এফ আর সি এস (এডিন)। ফটকটা খোলাই রয়েছে। ফটক দিয়ে ঢুকে সিমেন্ট বাঁধানো পথ ধরে সোজা গেলেই গ্যারাজ, একটা নীল মারুতি গ্যারাজের সামনে দোতলায় যাবার সিঁড়ির পাশে দাঁড়িয়ে। দোতলায় রয়েছে শিবপ্রসাদ আর প্রমিতা।

ফটকের ডানদিকে বড়ো একটা উঠোনের মাপের ফাঁকা জায়গা। কয়েকটি ফুলগাছ আর একটা দোতলার উচ্চচতার দেবদারু গাছ। ঢাকা একটা চাতাল সেটা দিয়ে সলিলের ফ্ল্যাটে যেতে হয়। চাতালের লাগোয়া দুটো দরজা। তার একটি দিয়ে ঢুকতে হয় রোগী দেখার চেম্বারে অন্যটি তার ব্যক্তিগত বসার ঘরের।

ফটক দিয়ে ঢুকতেই দেবীর চোখ পড়ল দেবদারু গাছের পাশে একটা বছর চারেকের বাচ্চচা ছেলের উপর। হাতে ছোট্ট ক্রিকেট ব্যাট।

তাকে রবারের বল ছুড়ে দিচ্ছে পাজামা আর শার্ট পরা তিরিশ-বত্রিশ বছর বয়সি একটি লোক। লোকটি জোরে বল ছুড়ল, ছেলেটি ব্যাট চালিয়ে ফসকাল। দেবী দাঁড়িয়ে পড়ল।

‘অত জোরে দেবে না, আস্তে তুলে উঁচু করে দাও।’ ছেলেটি বলল।

‘বড়দা ছেলেটা কে?’

‘সলিলের ছেলে, ওর মা মারাঠি মেয়ে, মোটর অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছে মুম্বইয়ে। তখন ওর একবছর বয়স। মাসি ওকে নিয়ে গিয়ে রাখে। সলিল মুম্বাইয়ে থাকত, বউ মারা যেতে কলকাতায় চলে আসে। আমিই শিবুকে বলে এখানে ওঁর থাকার ব্যবস্থা করে দিই।’

লোকটি এবার খুব উঁচু করে বল দিল, ছেলেটি মুখ উঁচু করে ব্যাট তুলল। বলটা তার মাথার পিছনে পড়ল ব্যাটটা চালাবার পর। ছেলেটি রেগে ব্যাট ছুড়ে ফেলে দিল। এর আগে বোধহয় অনেকবার বল ফসকেছে।

‘বল করার কী ছিরি। বাচ্চচাদের কী করে বল করতে হয় তাও জানে না।’ দেবী ক্ষোভের সঙ্গে মন্তব্য করল, ‘লোকটা কে?’

‘বোধহয় সলিলের চাকর। চল ভেতরে। তুই ওপরে যা আমি সলিলের সঙ্গে একটু কথা বলে নিই।’

চেম্বারে রোগী পরীক্ষার টেবলে একটি লোক শুয়ে, সলিল তার ব্লাডপ্রেশার মাপছে। ব্রতীনকে দেখে সে বলল, ‘বতুদা তুমি পাশের ঘরে বোসো আমি এখুনি আসছি।’

মিনিট পাঁচেক পর সলিল বসার ঘরে এল। ব্রতীন খবরের কাগজটা রেখে দিয়ে বলল, ‘তোর তো রুগি-টুগি দেখছি না, চলে কী করে? হাসপাতালেও চাকরি করিস না!’

সলিল একগাল হেসে বলল, ‘চলে যায়। দুটো নার্সিংহোমে অপারেশন, সন্ধ্যেয় দুটো জায়গায় বসি। বাড়িতে দু-চারটে রুগি আসে পথ ভুলে। অনেকে তো জায়গাটা চেনেই না, একদিক দিয়ে ভালো। সকালটা শান্তিতে কাটানো যায়।’

‘ছেলেকে দেখে কে?’

‘ভগবান, একটা নয় দুটো ভগবান, পার্বতী আর অমিত। একজন দেখে রান্নাবান্না ঘর সংসার অন্যজন বাইরের সবকিছু।’

‘বাইরে ছেলের সঙ্গে খেলছে কে, অমিত?’

‘হ্যাঁ।’

‘চাকর-বাকরের হাতে ছেলে মানুষ হচ্ছে এটা কিন্তু ভালো নয়।’

‘কী করব, যেমন ভাগ্য করে এসেছে বাবাই। আমি যতটা পারি ওর সঙ্গে সকালটা কাটাই। বাকি দিন ও কী করে আমি জানি না, রাতে যখন ফিরি তখন ও ঘুমোচ্ছে। এবার ওকে স্কুলে দেব। তুমি যে আজ আসবে সেটা শিবুবাবু কাল বললেন। ক-দিন থাকবে?’

‘আর তিন-চার দিন।’

‘যাক অনেকদিন পর দেখা হল। দেখে মনে হচ্ছে ভালোই আছ। মাসিমা কেমন আছেন?’

‘রোজ বাজার যান নিজের ঘর নিজে মোছেন সুতরাং কেমন আছেন বুঝে নে, এখন বয়স একাত্তর।’

‘ওঁকে আনলে না কেন?’

‘চার বছর পর শহরে গুরুদেব এসেছেন এখন ওঁকে মুম্বইয়ের বাইরে বার করা যাবে না। শোন এবার বিয়ে কর। ছেলেটার মুখ চেয়ে কাজটা করে ফেল।’

ঠিক তখনই দোতলার বারান্দা থেকে দেবীর তীক্ষ্ন গলা শোনা গেল। ‘ওকি তুমি ছেলেটাকে বল দিয়ে মারলে? অতবড়ো লোক ওইটুকু বাচ্চচার মুখে বলটা ছুড়ে দিলে!’

‘মারলাম কোথায় বলটা তো লেগে গেল।’

‘মারা আর লেগে যাওয়ার তফাতটা কি বুঝিনা? শিগগিরি ওর চোখে ঠান্ডা জল দাও।’

‘বতুদা কে কথা বলল? বেশ দাপট আছে মনে হচ্ছে। অমিত একদম চুপ।’

‘শিবুর বোন দেবী। ওর লাম্বার রিজিয়নে স্পাইনালকর্ডে একটা ব্যথা ক-দিন হল হয়েছে, বেকায়দায় নড়াচড়া হলেই চিড়িক দিয়ে উঠছে। তোকে দেখাব বলে এনেছি।’

জানলার বাইরে দেবীর গলা শোনা গেল, এবার স্বর একদম অন্যরকম, ‘না না কিছু লাগেনি। বড়ো বড়ো ব্যাটসম্যানদের অমন একটু-আধটু লাগে তাই বলে কি তারা কাঁদে? চলো বরফ জল চোখে দিয়ে দিচ্ছি।’ দেবীর গলার স্বর এবার কঠিন হয়ে উঠল। ‘ওহে তখন বললুম ওর চোখে ঠান্ডা জল লাগাতে, কথাটা গ্রাহ্যেই আনলে না। ঘরে ফ্রিজ আছে? বোতলে ঠান্ডা জল আছে?’

‘আছে।’

‘আছে তো দাঁড়িয়ে আছ কেন?’

ব্রতীন আর সলিল মুখ চাওয়াচাওয়ি করল, জানলার কাছে গিয়ে পরদা সরিয়ে সলিল উঁকি দিল। এই প্রথম সে দেবীকে দেখল। বাবাইয়ের মাথাটা পেটে চেপে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ঝুঁকে কী বলছে চাপা গলায়। প্রায় দৌড়ে এল অমিত, হাতে জলের বোতল। দেবী শাড়ির আঁচল জলে ভিজিয়ে বাবাইয়ের চোখে বুলিয়ে দিল।

‘এবার চোখ খুলে তাকাও তো আমার দিকে।’

বাবাই চোখ পিটপিট করে তাকাল দেবীর দিকে।

‘দারুণ! এই তো শচীন টেণ্ডুলকরের মতো তাকাচ্ছ। দেখি আর একবার বল মারো তো।’ দেবী বলটা হাতে নিয়ে পিছিয়ে গেল।

দোতলা থেকে নেমে এসেছে শিবু, তার সঙ্গে কথা শুরু করল ব্রতীন। ঘর থেকে বেরিয়ে সলিল চাতালে গিয়ে দাঁড়াল। সলিলের বয়স সবে চল্লিশ পেরিয়েছে। লম্বা ছিপছিপে টাউজার্স টিশার্ট পরা গৌরবর্ণ, পায়ে চটি। চারবার বল করার পর দেবীর ব্যথাটা চেগে উঠতেই সে খেলা বন্ধ করে বাবাইকে বলল, ‘আর নয়। পরে খেলব। আমার কোমরে ব্যথা।’

‘ঠান্ডা জল দাও না, সেরে যাবে।’ মাটিতে রাখা বোতলটা তুলে নিল।

‘আরে না না, জল দিয়ে এ ব্যথা সারানো যায় না।’

‘হ্যাঁ যায়।’ বোতলের ঢাকনা খুলে বাবাই, দেবী সরে যাওয়ার আগেই খানিকটা জল তার কোমরের কাছে ঢেলে দিল।

‘বাবাই।’

কঠিন স্বরে ধমক দিয়ে সলিল চাতাল থেকে ছুটে এল। ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেল বাবাইয়ের মুখ, সে দেবীর পিছনে সরে গিয়ে আঁকড়ে ধরল তার হাত। দেবী দু-হাত পিছনে বাড়িয়ে বাবাইয়ের কাঁধ ধরে রাখল।

‘এদিকে এসো, ছেড়ে দাও ওনাকে।’ সলিল চোখে আগুন ঝরাল।

দেবী অনুভব করল ছেলেটা কাঁপছে ভয়ে, সে ঘুরে সলিলের দিকে পিঠ ফিরিয়ে বাবাইকে জড়িয়ে ধরল।

‘মারবেন না ওকে, মারবেন না।’ দেবী মিনতি জানাল।

‘অসভ্য বাঁদর হচ্ছে দিনকে দিন।’ সলিল গর্জে উঠল।

অমিত ফুট কাটল, ‘এরকম রোজ করে আমার সঙ্গে।’

‘কেন করে সেটা তো আগে দেখতে হবে।’ দেবী বলল।

দোতলার বারান্দা থেকে প্রমিতা চেঁচিয়ে বলল, ‘ঠাকুরঝি ওপরে এসো, শাড়িটা পালটে নাও।’

দেবী রওনা হতে গিয়ে থমকে পড়ল। বাবাই তার হাত আঁকড়ে রয়েছে।

‘আমি যাব তোমার সঙ্গে।’ বাবার দিকে ভীত দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে।

‘নিশ্চয় যাবে।’ দেবী আশ্বস্ত করল।

বাবাইকে কোলে তুলে নিয়ে, সলিলের দিকে কড়াদৃষ্টি হেনে দেবী সিঁড়ির দরজার দিকে উদ্ধত পায়ে এগোল। বিস্মিত অপ্রতিভ চোখে সলিল তাকিয়ে রইল। জানলায় দাঁড়িয়ে শিবপ্রসাদ আর ব্রতীন।

শিবু বলল, ‘বড়দা দেবীটা আর বদলাল না।’

‘দরকার কী বদলাবার, ঠিকই তো আছে।’

‘ঠিক থাকলে ডিভোর্সটা আর করত না। অপেক্ষা করে থাকলে দেখত ঘরের ছেলে ঠিক ঘরে ফিরে এসেছে।’

‘তাতে দেবীর আত্মামর্যাদা কতটা থাকত?’

সলিল ঘরে ঢুকল। শিবুকে আর জবাব দেবার দায় নিতে হল না। ব্রতীন বলল, ‘ওই হল তোর পেশেন্ট, একবার দেখে দে। শিবু ডেকে আন তো দেবীকে।’

একতলা ফ্ল্যাট থেকে দোতলায় ওঠার সিঁড়িতে যাওয়া যায় একটা দরজা খুললেই। দরজাটা বেশিরভাগ সময় বন্ধই থাকে। আজ সেটা খোলা।

কয়েক মিনিট পর শিবু নেমে এল সঙ্গে দেবী, ময়ূরকণ্ঠী রঙের সিল্কের শাড়ি পরনে, ব্রতীন ও সলিল অবাক হল ওর কাঁখে গলা জড়িয়ে থাকা বাবাইকে দেখে।

‘তোর কোমরে ব্যথা না!’ ব্রতীন বলল।

‘কী করব ছাড়ল না। যা ভয় পেয়েছে।’ দেবী চোখ কুঁচকে সলিলকে দেখে নিয়ে বলল, ‘কোথায় দেখবেন, ওই ঘরে?’

‘হ্যাঁ চলুন।’ সলিলের গলা থমথমে।

সবাই এল চেম্বারে। দেবী ঘরে চোখ বুলিয়ে হতাশ স্বরে বলল, ‘যন্ত্রপাতি কই?’

‘যেখানে থাকার কথা যেখানে ঠিকই আছে। এখানে শুধু পরীক্ষা হয়,’ গম্ভীর স্বরে বলল সলিল।

‘পরীক্ষা করতে তো যন্ত্রপাতি লাগে।’ দেবী তর্ক করার জন্য তৈরি হচ্ছিল। শিবু বাধা দিয়ে বলল, ‘যন্ত্রের থেকেও বেশি এফিসিয়েন্ট ডাক্তার সরকারের হাত চোখ আর মাথা।’

‘টেবলে শুয়ে পড়ুন।’

পাতলা ছোবড়া আর তুলোর উপর রেক্সিন মোড়া টেবলটা। একটা রুগণ যৎসামান্য বালিশ। পা রেখে ওঠার জন্য একটা টুল। দেবী উঠে বসল।

‘শুয়ে পড়ুন, উপুড় হয়ে।’

দেবী চিত হয়ে শুয়ে গড়িয়ে উপুড় হল। সিল্কের শাড়ি নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলল তার নিতম্ব। ব্রতীন চট করে সলিলের মুখের দিকে তাকিয়ে নিল। মনে হল ওর চোখে পলকের জন্য তারিফের মতো একটা ভাব ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল। পেশাদার লোক, মুহূর্তে চোখের ভাবে ব্যস্ততা এনে ফেলল। ব্লাউজ আর কোমরের শাড়ির প্রান্ত, তার মাঝে অনাবৃত ইঞ্চি ছয়েক পিঠ। সলিল তার দুটো আঙুল শিরদাঁড়ার নীচের দিকে রেখে চাপ দিল।

‘লাগছে?’

‘না।’

আঙুল দুটো একটু নীচে নামল। ‘লাগছে?’

‘না।’

আঙুল দুটো আরও নীচে শাড়ির কিনারে এল। ‘লাগছে?’

অস্বস্তি ভরে ‘না।’

এবার আঙুল দুটো যেখানে পৌঁছোল তাতে ব্রতীন ‘থাক’ শব্দটা শোনার আশা করল। তেমন কিছু শোনা গেল না শুধু দেবীর কোমরের নীচের অংশ সামান্য নড়ে উঠল, মুখটা বালিশে চেপে ধরল লজ্জা লুকোতে। পাশে দুটো দাদা দাঁড়িয়ে দেখছে এটা ওর মাথায় রয়েছে।

‘লাগছে?’

‘হ্যাঁ।’

ব্রতীন বুঝল ‘না’ বললে আঙুল দুটো আরও নীচে নামবে তাই ‘হ্যাঁ’ বলে থামিয়ে দিল।

‘সলিল আমার মনে হয় দেবী ঠিক জায়গাটা বুঝতে পারছে না। তুমি আর একটু দেখো তো।’

‘না না ওখানেই।’ দেবী তাড়াতাড়ি কাত হয়ে উঠে বসতে গেল। সলিল দু-হাতে কোমর ধরে আবার উপুড় করে দিল।

‘যখন বলব তখন উঠবেন।’ সলিলের গলায় ডাক্তারি হুকুম।

‘ঠিক করে বলুন, এখানে লাগছে?’

‘হ্যাঁ।’

সলিল আঙুল বুলিয়ে কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করে বলল, ‘ঠিক আছে উঠে বসুন।’

দেবী উঠে পা ঝুলিয়ে বসল। সবাই সলিলের মুখের দিকে তাকিয়ে, জানতে চায় ডাক্তারের অনুসন্ধানের ফল।

‘কিচ্ছু হয়নি, শুধু কতকগুলো ব্যায়াম দরকার।’

শিবু বলল, ‘স্পন্ডালাইসিস? এক্স রে করতে হবে?’

‘না। তবে টাকা খরচ করতে চান যদি কলকাতায় অনেক বড়ো বড়ো ডাক্তার পাবেন। আমি অহেতুক টাকা খরচ করাই না, ট্রিটমেন্ট করি। জটিল হতে পারে যদি ব্যায়ামগুলো না করে।’

‘কী ব্যায়াম করব?’ দেবী জানতে চাইল।

‘দেখিয়ে দিচ্ছি। পা জোড়া করে সোজা সামনে তুলুন মাথার পিছনে দুটো হাত রেখে। শরীরটা হবে ইংরিজি ‘এল’-এর মতো। করুন করুন।’ নির্দেশমতো টেবলের কিনারে বসে সে জোড়া পা তুলল। ‘সোজা করে রাখুন।’ দেবী দুটো ঠোঁট কামড়ে ধরে সোজা রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। ‘পিঠ সোজা করুন।’ দেবী সোজা করল।

ব্রতীন দেখল দেবীর উরুর পেশি ফুলে উঠেছে। পা দুটো কাঁপছে সোজা করে ধরে রাখতে পারছে না। সলিল দু-হাত পায়ের নীচে রেখে উঁচু করে তুলে দিল। ‘একইভাবে থাকবে।’

ঝপাৎ করে পা নামিয়ে দেবী উঠে দাঁড়াল, ‘পারব না অতক্ষণ রাখতে।’ বলেই সবাইকে অবাক করে দপদপিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বাবাই তার পিছু নিল। বাচ্চচা ছেলে অনুভূতি দিয়ে জেনে গেছে আত্মরক্ষার দুর্গটি কোথায়।

ওরা বসার ঘরে আসার সঙ্গে সঙ্গে প্রমিতা দোতলা থেকে নেমে এল।

‘বড়দা, দেবী বলেছিল তিনজন আসবেন, এলেন তো দুজন। বাকি রান্নাটা খাবে কে?’

‘এটা কি খুব বড়ো একটা সমস্যা?’ ব্রতীন মুখ ঘুরিয়ে সলিলের দিকে তাকাল। ‘ডাক্তারের ফি বাবদ ওকে নেমন্তন্ন করো।’

‘আমি! না না আমার ভাত করা আছে।’

‘থাক না করা। ও বেলা খেয়ে নেবেন।’ প্রমিতা বলল।

‘সলিল মাঝে মাঝে স্বাদ বদল করে দেখিস, ভালো লাগবে। কী রেঁধেছ প্রমিতা?’ ব্রতীন জানতে চাইল।

‘অল্প রান্না। চালকুমড়োর পাতুরি সর্ষেবাটা দিয়ে, মুগের ডাল, বড়ি ভাজা আর কাঁকড়ার ঝাল, জলপাইয়ের চাটনি। দই মিষ্টি আর রাখিনি।’

ব্রতীন লাফিয়ে উঠে বলল, ‘প্রচণ্ড প্রচণ্ড। কাঁকড়া? পাতুরি? সলিল রাজি না হলে বুঝব তুই একটা গোরু।’

নিজেকে গোরু প্রমাণের বাসনা সলিলের মধ্যে ছিল না। দোতলায় খাবার টেবলে চারজনের সঙ্গে বাবাইকেও দেখা গেল দেবীর পাশে একটা চেয়ারে। পরিবেশনে ব্যস্ত প্রমিতা।

‘বউদি ওকে শুধু ভাত আর ডাল। সর্ষেবাটা লঙ্কাবাটার কোনো রান্না নয়।’ দেবী খেতে বসেই আগাম নির্দেশ দিল প্রমিতাকে।

‘না আ আ আমি কাঁকড়া খাব।’ বাবাই নাকিসুরে আবদার জুড়ল।

কড়া গলায় দেবী মৃদু ধমক দিল, ‘যা বলছি শোনো। ওসব বড়োদের খাবার। তুমি যখন বড়ো হবে তখন খাবে। এখন খেলে শচীনের মতো গায়ে জোর হবে না, ছয় মারতে পারবে না।’

বাবাইকে ডাল ভাত মেখে দিল দেবী।

‘তুমি খাইয়ে দাও।’

‘নিজের হাতে খাও। খেতে শেখো।’ দেবী নিজের পাত থেকে খেয়ে দেখিয়ে বলল, ‘এইভাবে ভাতের গরাস তৈরি করে গপ করে মুখে পুরে দাও। ভালো করে চিবোও।’

হইচই করে সবাই খাওয়া শেষ করল। সলিল নীচে নেমে যাবার আগে বাবাইকে ডাকল, ‘চলো এবার ঘুমোবে।’

‘না।’ বাবাই এখন যথেষ্ট সাহসী। ‘মাসিমণির কাছে ঘুমোব।’

‘মাসিমণি!’ সলিল অবাক হয়ে তাকাল দেবী তারপর ব্রতীনের দিকে।

‘থাক না এখনে।’ ব্রতীন বলল।

দেবী বলল, ‘আমার কোনো অসুবিধা হবে না।’

সলিল কিছু না বলে নীচে নেমে গেল। প্রমিতা খেতে বসেছে পরিবেশন করছে দেবী। শিবু খেয়ে উঠেই শুয়ে পড়েছে। ব্রতীন বারান্দায় এসে দাঁড়াল। রাস্তা দিয়ে দু-চারজন লোক যাচ্ছে। সামনের খালের নোংরা জলে স্নান করছে কতকগুলো বাচ্চচা ছেলে। একজন স্ত্রীলোক সাবান ঘষে চুল পরিষ্কার করছে। একটু দূরে বড়ো রাস্তা দিয়ে সরকারি বাস চলে গেল। বারান্দার রেলিং ধরে সে আকাশে তাকাল। ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন আকাশ। বেশিক্ষণ চোখ রাখা যায় না। আজ সকাল থেকে দিনটা উজ্জ্বল থাকত যদি বাসন্তীকে ওইভাবে চলে যেতে না হত। ট্যাক্সিতে উঠে চলে যাবার সময় ও তাকিয়েছিল। চোখের চাহনিতে কিছু একটা বলতে চেয়েছিল। কী চেয়েছিল সেটা আর জানা হয়নি। আর কোনোদিন জানা হবেও না।

ব্রতীনের মনে পড়ল, আর একটা না জানা কথা জানতে বাকি রয়ে গেছে। গোলাপবাগানের বুড়ি তিরিশ বছর আগে দলা পাকিয়ে যে চিঠিটা তার সামনে ফেলেছিল তাতে কী লিখেছিল? যে দুটো লোক রকে বসেছিল তাদের একজন চিঠিটা কুড়িয়ে নেয়। নিশ্চয় পড়েছে, পড়ে হাসাহাসি করেছে। তা মনে পড়লে সে বিব্রত হয় এখনও। ওটাই ছিল তার জীবনে প্রথম পাওয়া প্রেমপত্র আর ওটাই শেষ। চিঠিটা পেয়েও পাওয়া হয়নি, লজ্জায় সে কুড়োতে পারেনি। মলি বলেছিল ‘ঘরে যাবেন না?’ এভাবে ডাক পাওয়াও জীবনে প্রথম, বিতৃষ্ণায় কি প্রত্যাখ্যান করেছে না কি লজ্জায়!

ব্রতীন অনেকগুলো প্রশ্ন তুলে আকাশে চেয়ে রইল। তারপর এক সময় ঘরে এসে ঘুমন্ত শিবুর পাশে শুয়ে পড়ল।

নীল মারুতিটা সলিলের। সে নিজেই বলল পৌঁছে দেবে। পিছনের আসনে দেবী সঙ্গে নাছোড়বান্দা বাবাই। সেও সঙ্গে যাবে যতক্ষণ পারে মাসিমণির কাছে থাকতে চায়। সারা পথ অজস্র প্রশ্নে সে জেরবার করল দেবীকে।

‘মাসিমণি তুমি নিক্কোপার্ক দেখেছ?’

‘না, তুমি দেখেছ?’

‘না। ওখানে বাঘ আছে?’

‘না, ওখানে অনেক রকমের মজার খেলা আছে। বাঘ আছে চিড়িয়াখানায়।’

‘তুমি চিড়িয়াখানা দেখছ?’

‘দেখেছি। তুমি দেখেছ?’

‘না, তুমি আমাকে বাঘ দেখাবে?’

‘বাবাকে বলো, বাবা তোমাকে দেখিয়ে আনবে।’

বাবাই চুপ করে রইল। ব্রতীনের মনে হল বাবাই তার বাবা সম্পর্কে আড়ষ্ট, বোধহয় ভয়ও পায়। ছটফটে কৌতূহলী নিঃসঙ্গ ছেলেকে সামলাতে ধমকে চুপ করিয়ে দেওয়াকেই অস্ত্র করেছে সলিল, যেজন্য ছেলের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়নি। ব্রতীন বলল, ‘দেবী তুই তো ওকে বাঘ দেখিয়ে আনতে পারিস। সলিল ব্যস্ত মানুষ, সময় করে উঠতে পারে না।’

দেবী বলল, ‘ইচ্ছে থাকলে সময় ঠিকই করে উঠতে পারা যায়। ঠিক আছে আমিই বাবাইকে বাঘ দেখিয়ে আনব অবশ্য ওর বাবার যদি তাতে আপত্তি না থাকে। আমি প্রথম চিড়িয়াখানায় যাই এক বছর বয়সে বাবার কোলে চড়ে।’

ব্রতীন বলল, ‘কী রে সলিল তোর কি আপত্তি আছে দেবী যদি ওকে চিড়িয়াখানা দেখিয়ে আনে।’

‘না না আপত্তি হবে কেন, এ তো খুবই ভালো কথা। আমি অনেকদিনই ভেবেছি ওকে নিয়ে সপ্তায় একদিন বেরোব, সারাদিন ওর সঙ্গে কাটাব। বাবাই সারাদিনই একা একা কাটায় ওর কম্পানি দরকার। কিন্তু কী জানো, অপারেশন, চেম্বার রোগী দেখা এ সবের পর এত টায়ার্ড থাকি-।’ অরবিন্দ সেতুতে ওঠার মুখে সলিল ব্রেক কষে গাড়ির সামনে থতমত হয়ে থাকা এক প্রৌঢ়ের উদ্দেশ্যে জানলা দিয়ে মুখ বার করে বলে উঠল, ‘দু সেকেন্ড তর সয়না? এভাবে রাস্তা পার হয়?’

ফার্স্ট গিয়ার দিয়ে দলিল গাড়ি ছেড়ে বলল, ‘নিজে মরত আমাদেরও বিপদে ফেলত।’

দেবী বলল, ‘আস্তে চালান।’

‘তাই তো চালাচ্ছি। এর থেকে আস্তে চালালে গোরুর গাড়িতে যাওয়াই ভালো।’ গজগজে সুরে সলিল বলল।

সে ফার্স্ট গিয়ারে রেখেই গাড়ি চালাল। কিছুক্ষণ কেউ কথা বলল না। গাড়ি ঢুকছে উত্তর কলকাতায় সবথেকে ভিড় এলাকা হাতিবাগানে। সলিল সতর্ক এবং বিরক্ত চোখে সামনে তাকিয়ে। হাতিবাগান মোড় পার হবার আগে গাড়ি প্রায় চার মিনিট অপেক্ষা করে। এঞ্জিন বন্ধ করে তখন সলিল বলল, ‘বতুদা এক এক সময় মনে হয় গাড়ি রাস্তায় আর বার করব না, বেরোলেই টেনশনে পড়ে যাই তার ওপর এই ছেলে!’

‘কেন বাবাই আবার কী টেনশন বাড়াল আপনার?’ পিছন থেকে দেবী বলল অবাক সুরে।

সলিল মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘মাত্র কয়েক ঘণ্টা তো ওকে দেখেছেন, দিনের পর দিন যদি দেখতে হত তা হলে-‘

‘তা হলে পাগল হয়ে যেতুম, কেমন?’ দেবী বলল তীব্র এবং বাঁকা স্বরে।

‘হ্যাঁ হতেন।’ সলিল নিশ্চিত গলায় বলল।

দেবী এবার বাবাইকে বলল, ‘বাবাই তুমি আমাকে পাগল করে দেবে?’

‘হ্যাঁ আ আ,’ বাবাই ‘হ্যাঁ’টাকে টেনে লম্বা করল।

‘তা হলে বাঘ দেখাতে নিয়ে যাব না।’

‘পাগল না করলে নিয়ে যাবে?’

‘যাব।’

‘তা হলে পাগল করব না।’

সামনের গাড়ি এগোতেই সলিল এঞ্জিন চালু করে বলল, ‘বাবাইয়ের এই ‘করব না’র আয়ু দশ মিনিটের বেশি টিঁকবে না।’

‘বাবাই শুনলে তো বাবা কী বললেন। তুমি নাকি দশ মিনিট পরেই আমাকে পাগল করে দেবে।’

‘দশ নয় এগারো মিনিট পরে।’ বাবাই নিশ্চিত স্বরে বলল। দশ মিনিটের আগেই ওরা বাড়ির সামনে পৌঁছে গেল।’

গাড়ি রেখে ওদের সঙ্গে সলিল আর বাবাইও নামল। ব্রতীন বলল, ‘সলিল বাড়িটা চিনে যা, ওপরে আয়।’

কোনো আপত্তি তুলল না সলিল। দেবীর হাত ধরে বাবাই তার পিছনে ওরা দুজন। ‘দেবী সলিলকে ওপরে নিয়ে যা। কাকাকাবুর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দে। এ বাড়িতে ও আগে কখনো আসেনি, অনিল এসেছে। অনেকবার।’ সলিলের দাদা অনিল, ব্রতীনের বন্ধু।

‘বড়দা তুমিও এসো।’

‘আমি একটু বেরোব, কাজ আছে। সলিল কিছু মনে কোরো না, এখুনিই ফিরে আসব।’

দোতলা থেকে ব্রতীন দ্রুত নেমে এল। কাজ আছে। কলকাতায় আর তিন-চার দিন মাত্র সে থাকবে। তার মধ্যেই কাজটা মিটিয়ে ফেলতে হবে। মুম্বই থেকে রওনা হবার সময় এগুলো সে সঙ্গে করে আনেনি এমনকী তার চিন্তায়ও ছিল না। স্কুলের প্রতিদিনের রাস্তা দিয়ে তিরিশ বছর পর হাঁটার ইচ্ছাটা যদি হঠাৎ মাথায় চেপে না বসত তা হলে এত বছর ধরে যে একটা কৌতূহল তার মধ্যে ঘাপটি মেরে আছে সেটা সে জানতেই পারত না। যেমন জানতেই পারত না বাসুর চেহারা এত সুন্দর হয়ে উঠবে বয়স বাড়ার সঙ্গে, এত সহজভাবে ও বলবে ‘একথাটা তিরিশ বছর আগে বলোনি কেন?’

তালগোল পাকিয়ে মেয়েটি রাস্তায় তার সামনে ছুড়ে দিয়েছিল যে কাগজটা তাতে কী লেখা ছিল? অবশ্যই প্রেমপত্র। একটা সতেরো বছরের ছেলের প্রথম প্রেমপত্র পাওয়ার অনুভূতি তিরিশ বছর পর আবার যে ফিরে আসবে, ‘ওয়াই’ হয়ে যাওয়া দুটো রাস্তার মোড়ের কাছে পৌঁছোবার আগে পর্যন্ত এটা একদমই সে অনুমান করতে পারেনি।

আর কী অদ্ভুতভাবে সে পেয়ে গেল নিমিকে! ব্রতীন কোনোদিনই বিশ্বাস করেনি নিয়তিতে, বিজ্ঞানে বিশ্বাসী বরাবর এবং এখনও। তিরিশ বছর আগের মেয়েটিকে খুঁজে পাওয়াটাকে সে কাকতালীয় ধরে নিয়েছে। সেইভাবে বুড়িকে যখন আবিষ্কার করেই ফেলেছে তখন ছুড়ে দেওয়া চিঠিতে কী লিখেছিল সেটাও জেনে নেওয়া যেতে পারে। এখন তো তারা দুজনেই পরিণত এবং বয়স্ক। বুড়ি কিন্তু সত্যিই বুড়ি হয়ে গেছে! ওর সঙ্গে আগের দিন কথা বলে তার মনে হয়েছে কৈশোরের ছেলেমানুষি হঠকারিতা কবুল করতে এখন ওর লজ্জা করবে না। বাসু তো স্পষ্টই মেনে নিল, তিরিশ বছর আগে যদি সে জানত ব্রতীন তার প্রতি অনুরক্ত কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারছে না তা হলে আজ তাকে এই দুর্দশায় পড়তে হত না। বয়স বাড়লে, অভিজ্ঞতার চড়চাপড় খেতে খেতে মানুষ এক সময় বুঝে যায় সে কী জিনিস হারিয়েছে। বাসু এটা এখন বুঝতে পেরেছে কিন্তু সে নিজে কি বুঝতে পারছে। তিরিশ বছর আগের সেই মেয়েটি এখন গোলাপবাগানের বস্তিতে, সে কি ভাবছে তার রোগজীর্ণ শরীর আর দারিদ্র্য নিয়ে? সেদিনের স্কুলের ছেলেটা যদি চিঠিটা কুড়িয়ে নিত তা হলে আজ তাকে এইরকম দুর্দশায় পড়তে হত না!

জানতে হবে তাকে। হাঁটতে হাঁটতে ব্রতীন ভেবে চলেছে। মুম্বই ফিরে যাবার আগেই তাকে জেনে নিতে হবে সে বাসুকে হারিয়েছে না বুড়ি তাকে হারিয়েছে।

সেন্ট্রাল অ্যাভিনুর ওপারটা অন্ধকার। পাওয়ার কাট চলছে। রাস্তা পার হয়ে ব্রতীন দ্রুত পায়ে গোলাপবাগানের দিকে এগোল। দোকানগুলোয় মোমবাতি আর হারিকেন জ্বলছে। দু-তিনটে বাড়ি থেকে জেনারেটরের আলো রাস্তায় পড়ে বাকি অন্ধকারকে আরও গাঢ় করে তুলেছে। গোলাপবাগান বস্তিতে ঢোকার মুখে কিছু স্ত্রী-পুরুষ বসে গরম থেকে রেহাই পেতে। তারা মুখ তুলে ব্রতীনের দিকে তাকিয়ে লোকটা কে ঠাওর করার চেষ্টা করল।

ঘরের দরজা খোলা, ছোটো একটা হারিকেন জ্বলছে। পলতেটা নামানো তেল বাঁচানোর জন্য। ব্রতীন দাঁড়িয়ে ভিতরে তাকাল। তক্তাপোশে বুড়ি শুয়ে। ঘরে আর কেউ নেই।

‘কে?’

‘আমি।’

‘ওহঃ আপনি।’

বুড়ি উঠে বসল। গায়ে মাথায় কাপড় ঠিক করতে করতে বলল, ‘নিমি এই মাত্তর বেরোল। একজনদের ঘরে গেছে। ওর পায়ের ছবি দেখে ডাক্তার বলেছে ভাঙেনি তবে চিড় ধরেছে।’

‘চিড় ধরলে চলাফেরা বন্ধ রাখতে হয় নয়তো বেড়ে যাবে।’ ব্রতীন কথাটা বলে এধার-ওধার তাকাল বসার মতো কিছু একটা পাওয়ার খোঁজে। সেলাই মেশিনটার কাছে একটা টুল দেখতে পেয়ে টেনে এনে বসল বুড়ির মুখোমুখি।

‘আমিও তো ওকে তাই বললুম, হাঁটাহাঁটি করার দরকার কী ঘরে বসে থাক, কে আর শোনে আমার কথা। কথা না শুনলে এক সময় ওকে পিটিয়েছি, এখন আর গায়ে জোর নেই, তা ছাড়া নিমি তো এখন আর ছোটো নেই।’ ধীরে ধীরে শ্বাস টেনে বুড়ি কথাগুলো বলল।

‘নিমির বয়স কত হল?’

‘আঠারো চলছে সামনের অঘ্রানে উনিশে পড়বে।’

‘পড়াশুনো কদ্দূর করেছে?’

‘কর্পোরেশন ইস্কুলে ক্লাস ফোর পর্যন্ত, নিজেই পড়া ছেড়ে দিল ওর বাবা মরে যেতে।’

‘এখন যে কাজটা করে সেটা পেল কী করে?’

‘এখানকারই একটা বউ ওই পার্লারে কাজ করে, সে-ই কাজটা পাইয়ে দিয়েছে। নিমি তো ওর ঘরেই গেছে টিভি দেখতে তারপরই লোডশেডিং হল। আপনার কথা নিমি আজ সকালেও বলছিল।’

ব্রতীন কৌতূহলী হয়ে উঠল। কী বলেছে মেয়েটা? নিশ্চয় খারাপ কিছু তার সম্পর্কে বলেনি। তা বললে মায়ের কাছে নিজের সম্পর্কে কিছুই আর গোপন করে রাখতে পারবে না। তা ছাড়া তাকে খারাপ চরিত্রের লোক বলার মতো কিছুই তো ঘটেনি।

‘আপনার মতো মানুষ ও কখনো দেখেনি। যদি ওকে তুলে না আনতেন তা হলে ওর বাড়ি ফেরাই হত না। অনেক টাকা নাকি ওর জন্য খরচ করেছেন। নিজের মেয়ের মতো করে একজন অচেনা লোক যে এমন যত্ন করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে, ট্যাসকি করে ঘর পর্যন্ত পৌঁছে দেবে এটা ও ভাবতেই পারেনি।’ বুড়ির গলা ধরে এল আবেগে। ‘আমিও ভাবতে পারিনি। ভগবান আপনাকে ঠিক সময়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন। নিমির ভাগ্যি।’

ব্রতীন গলাখাঁকারি দিয়ে বলল, ‘একটা ব্যাপার জানার ছিল। সত্যি কথা বলবেন, লজ্জা করবেন না। আচ্ছা আমি একদিন স্কুল যাচ্ছি তখন আপনি একটা চিঠি ছুড়ে দিয়েছিলেন বারান্দা থেকে। মনে পড়ে?’

‘চিঠি? আমি!’ অন্ধকারে হঠাৎ মুখে জোরালো টর্চের আলো পড়লে খরগোশের যে অবস্থা হয় বুড়ির মুখ সেইরকম দেখাল।

‘কই আমার তো মনে পড়ছে না কখনো চিঠি ছুড়েছি।’

‘ঠিক আমার সামনে ফেললেন, দলা পাকিয়ে।’ ব্রতীন সামনে ঝুঁকে তীক্ষ্ন নজরে তাকাল।

বুড়ি চোখ বুজে রইল কয়েক সেকেন্ড। টাইমবোমার ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে চলার মতো শব্দ ব্রতীনের বুকের মধ্যে। বুড়ি চোখ খুলল, চোখে হাসি। মনে পড়েছে। ‘নটবর মানে চন্দনাটাকে ছোলা দিয়ে খালি ঠোঙাটা পাকিয়ে রাস্তায় ছুড়ে দিয়েছিলুম আর ঠিক সেই সময়ই আপনি আসছিলেন। আমি তো লজ্জায় জিভ কেটে ফেলেছিলুম, ভাগ্যিস গায়ে পড়েনি। মনে হল আপনি একটু ঝুঁকলেন তারপর হেঁটে চলে গেলেন। শম্ভু জ্যাঠা রক থেকে উঠে এসে ঠোঙাটা কুড়িয়ে নিয়ে খুলে দেখে ফেলে দিল। আপনি ওটাকে চিঠি ভেবেছেন! হায় পোড়া কপাল।’ বুড়ি শব্দ না করে হেসে উঠল।

ব্রতীনের প্রথমেই মনে হল, কেন বোকার মতো জিজ্ঞাসা করতে গেলুম। তা হলে বুড়ির এই হাসিটা দেখতে হত না। এবার তার মনে পড়ল ‘বাগদি ডাকাতে’র লাইনগুলো, ‘রাত্রির সেই পাথরের মতো জমাট অন্ধকার ও নিস্তব্ধতাকে কে যেন খুব মোটা দাঁতওয়ালা ভীষণ ভারী করাত দিয়ে চিরছে।’

সে টের পেতে লাগল তার মাথার মধ্যে একটা অন্ধকার পাথরের মতো জমাট বাঁধছে আর বুড়ির নিঃশব্দ হাসিটা ভারী দাঁতওয়ালা করাতের মতো সেটা চিরছে কিন্তু ‘সেই অন্ধকারের একটা কণাও খসে পড়ছে না।’ ব্রতীন নিজের মনে বলার মতো করে বলল, ‘আপনি ঠিক বলছেন চিঠি নয় ঠোঙা, ভুল করছেন না তো?’

‘ওরে বাবা চিঠি ফেলব শম্ভু জ্যাঠার সামনে! সারা পাড়ায় ঢি ঢি পড়ে যাবে না। বাবার কানে গেলে পিঠের চামড়া তুলে দেবে!’

ঠিক এই সময় ঘরের ইলেকট্রিক বালবটা জ্বলে উঠল। গোলাপবাগান জুড়ে স্বস্তির চাপা একটা ধ্বনি উঠল, ‘হা আ আ।’

‘আপনি চললেন?’

উঠে দাঁড়িয়েছে ব্রতীন। জমাট অন্ধকারের জায়গায় একটা অন্ধ ক্রোধ এখন তার মাথার মধ্যে দখল নিয়েছে। মূর্খ, মূর্খ, এভাবে বোকা বনে গেলুম! কী দরকার ছিল কৌতূহল মেটাতে এখানে আসার। দরজা দিয়ে গলিতে বেরিয়ে কয়েক পা এগিয়ে এসেই থমকে দাঁড়াল সে। নিমি আসছে দেয়ালে হাত রেখে অল্প খুঁড়িয়ে।

‘এই যে মলি।’ কঠিন গলায় ব্রতীন বলল। ‘বেড়াতে গেছলে? পা তা হলে ঠিক হয়ে গেছে?’

‘এই পাশের এক বউদির বাড়িতে গেছলুম। পায়ে বেশ ব্যথা রয়েছে।’

জায়গাটা অন্ধকার, নিমির মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছ না। তবে ওর গলার স্বরে ব্রতীন বুঝল অপ্রতিভ হয়ে পড়েছে কারণটা বোধহয় নিমির বদলে মলি সম্বোধন শুনে।

‘ব্যথা? দিব্বি তো হেঁটে বেড়াচ্ছ। ফ্ল্যাটের চাবিটা আমার কাছেই রয়েছে, কাল যাবে? ট্যাক্সি করে নিয়ে যাব ফিরিয়ে আনব।’

কর্কশ স্বরে ব্রতীন বলল। মাথার মধ্যে রাগটা দপদপ করছে। নিজেকে ভেঙেচুরে গুঁড়িয়ে ফেলা একটা ইচ্ছে তাকে ঠেলতে ঠেলতে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে সে জানে না। শুধু জানে শোধ নিতে হবে, নিজের উপর রাগটা সে নিমির দিকে ঘুরিয়ে নিজেকে ফেলে দিয়েছে গভীর গর্তে।

‘কী বলছেন আপনি?’ নিমি বিস্ময়ের ধাক্কা সামনে বলল, ‘আপনাকে তো আমি ভালো লোক বলে জানতুম, আর পাঁচটা লোকের মতো নন।’

‘আমি কেমন লোক তা দিয়ে তোমার দরকার কী? দরকার তো টাকার, আমি দেব। কত নেবে?’

‘পথ ছাড়ুন, লোক এসে পড়বে। যদি চেঁচাই তা হলে আপনার ইজ্জত থাকবে না।’

নিমি পাশ কাটিয়ে যেতে গেল। ব্রতীন খপ করে ওর বাঁ হাতের কবজিটা মুঠোয় ধরে নিয়ে বলল, ‘এখানকার লোকেরা জানে কি তুমি কী কাজ করো পার্লারে?’

‘জানলে তো ভারি বয়েই যাবে।’ নিমির স্বর রুক্ষ হয়ে একটু উচ্চচগ্রামে উঠল। ‘সেদিন তো বেশ ভদ্দর ছিলেন হঠাৎ আজ ছোটোলোক হলেন যে?’

ব্রতীন ছেড়ে দিল নিমির হাত। এগিয়ে গেল সে বাড়ির দিকে। ব্রতীন দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এল গোলাপবাগান বস্তি থেকে। তার মাথার মধ্যে রাগটা কুণ্ডলি পাকিয়ে চলেছে, গর্তের মধ্য থেকে উঠে আসার জন্য তার দরকার একটা শক্ত রশি। হাঁটতে হাঁটতে সে পৌঁছোল চিলড্রেনস পার্কে। চল্লিশ বছর আগে এই পার্কে সে দোলনায় দুলেছে, চারকোণে ছোটো ছোটো বাঁশের বেড়া ঘেরা বাগান ছিল পাতাবাহার আর ফুলগাছের। এখন আর গাছ নেই দোলনাও নেই। পার্কের মধ্যে ঢুকে দেখল দু-তিনটি মাত্র বেঞ্চ এবং তাতে লোক বসে রয়েছে। জমিতে ঘাস নেইই প্রায়। মেট্রোরেল তৈরির জন্য পার্কে গুদাম করা হয়েছিল। পার্কটা বিধ্বস্ত হয়ে যায়। এখনও আগের সবুজ ফিরে পায়নি। খুঁজে খুঁজে কোনোক্রমে বসার মতো ঘাস পেয়ে সে বসল।

মিনিট পাঁচেক পর ব্রতীন উঠে পড়ল। এভাবে একা বসে থাকলে তার মাথার আগুন নিভবে না। এখন তার কথা বলার জন্য লোক চাই নয়তো পড়ায় ডুবে যাবার মতো কোনো বই কিংবা টিভি-তে মিষ্টি প্রেমের সিনেমা। গোলাপবাগানকে স্মৃতি থেকে উপড়ে ফেলার জন্য চাই কোদাল বা শাবলের মতো একটা কিছু, নয়তো একটা নতুন গোলাপবাগান।

বাড়ির কাছাকাছি এসে দূর থেকে সে দেখতে পেল সলিল, দেবী আর বাবাই গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে, চাবি লাগিয়ে সলিল দরজা খুলল। একটু দূর থেকেই ব্রতীন চেঁচিয়ে বলল, ‘সলিল চললি নাকি রে!’

‘আরে বতুদা এতক্ষণ তোমার জন্য অপেক্ষা করে করে ফিশ ফ্রাইটা শেষকালে খেয়ে ফেললুম, অনবদ্য! নর্থ ক্যালকাটায় এমন যে দেবভোগ্য বস্তু মেলে আগে জানতুম না।’ সলিল দরজা বন্ধ করে একগাল হেসে দেবীর দিকে তাকাল।

‘এখন জানলি তো মাঝে মাঝে এসে খেয়ে যাস। দেবভোগ্য নয় ওটা দেবীভোগ্য। মলয় কেবিনের বড়ো পেট্রন হল দেবী আর আমার কাকা, তোর আলাপ হল কাকার সঙ্গে?’

‘হয়েছে, তবে আমার থেকে বাবাইয়ের সঙ্গেই ওনার বেশি আলাপ হল।’

‘তাহলে এতক্ষণ বসে বসে করলি কী। শুধু ফ্রাইই সাঁটিয়ে গেলি?’ ব্রতীনের গলায় ফুরফুরে মেজাজের ছাপ ফুটে উঠল। এটাই সে চেয়েছে নতুন করে।

বাবাইয়ের কাঁধে হাত রেখে দেবী দাঁড়িয়ে শুনছিল দুজনের কথা। এবার বলল, ‘ডাক্তারবাবুকে বলছিলাম আমার আমেরিকার অভিজ্ঞতার কথা। একা অদ্দূর ভেতো বাঙালি মেয়ে প্লেনে যাচ্ছে, ইংরিজি বলতে গেলে আগে মনে মনে বাংলা থেকে ট্র্যানস্লেট করে নিয়ে বলি,কাঁটা হয়ে থাকি এই বুঝি গ্রামার ভুল করলুম, সে যে কী আতঙ্ক! তবে পবিত্র নিউ ইয়র্কে আমার দায়িত্ব নেবার পর ইংরিজি বলা থেকে আমায় আড়াল করে রাখে। আমেরিকান উচ্চচারণে খুব সুন্দর ইংরিজি বলে পবিত্র।’

‘আমারও ঠিক একই ব্যাপার। বিলেতে প্রথম প্রথম ওদের ইংরিজি বুঝতে অসুবিধে হত, চারু ওদেশে বাচ্চচা বয়স থেকে রয়েছে ওর সঙ্গে ইংরিজিতে কথা বলে বলে সড়গড় হই।’

ব্রতীন একটু অবাক হল, একজন প্রাক্তন স্বামীর আর একজন মৃতা স্ত্রীর প্রশংসা পরস্পরকে শোনাতে যেন একটু ব্যস্তই। তার মনে হল, সম্ভব হলে সলিল এই রাস্তায় দাঁড়িয়েই আড্ডা দিয়ে রাতকাবার করে দেবে।

‘বড়দা কাল আমরা চিড়িয়াখানা যাচ্ছি। তুমি যাবে?’ দেবী বলল।

‘আমরা মানে কারা?’

উত্তর দিল সলিল, ‘দেবী আমি আর বাবাই, আপনিও চলুন না।’

‘চিড়িয়াখানায় বার চারেক গেছি স্কুলে পড়ার সময়। আমাদের দেশে পশুপাখিদের যেভাবে রাখা হয় দেখলে কষ্ট হয়, তোরা বরং দেখে আয়। সেই একই বাঘ একই ভাল্লুক একই বাঁদর। খাবার-দাবার নিয়ে যাস কিন্তু।’

‘অবশ্যই।’ সলিল একটা অবলম্বন যেন পেল আর কিছুক্ষণ কথা চালিয়ে যাওয়ার। ‘আমি বললুম যাওয়ার সময় স্যান্ডউইচ, পেস্ট্রি ফ্লুরিজ থেকে আর আপেল কলা নিউ মার্কেট থেকে কিনে নেব। কিন্তু উনি তো।’ দেবীর দিকে হাত নেড়ে সলিল বলে চলল, ‘এক কথায় নাকচ করে বললেন ওসব শুকনো অখাদ্য জিনিস গিলতে পারব না’

‘ঠিকই তো,’ দেবীর গলায় প্রায় গাছকোমর করার সুর, ‘আচ্ছা তুমিই বলো বড়দা, দুপুরবেলায় স্যান্ডউইচ খাব? আমাদের কি সাহেবদের পেট? লুচি-বেগুনভাজা কি ওর থেকে খারাপ লাগবে? পেস্ট্রির বদলে হরিমোদকের কাঁচাগোল্লা?’

বাবলু বায়নার সুরে বলে উঠল, ‘মাসিমণি আমি কাঁচাগোল্লা খাব।’

‘ওই শুনুন ছেলে কী বলছে।’

সলিল স্বরে নকল গাম্ভীর্য মাখিয়ে বলল, ‘উসকে দিলে তো বলবেই।’

ব্রতীনের মজাই লাগল দুজনের খুনসুটিতে। কে বলবে মাত্র আজ সকালেই ওদের মধ্যে প্রথম সাক্ষাৎ ঘটেছে অথচ দশঘণ্টার মধ্যেই বাবাইকে কেন্দ্র করে ওরা কাছে চলে এসেছে। দুজনের মনের গড়ন একই ধরনের বলে বোধহয় এটা হয়েছে। চার বছরে চব্বিশশো ঘণ্টা বাসুর সঙ্গে এক টেবলে বসেও তারা কাছাকাছি আসতে পারেনি, মনের গড়নে অনেক তফাত ছিল। সেই গড়নটা কি বদলানো যায় না?’

‘শুনুন মশাই যা কেনার তা আজ রাতেই সেরে ফেলুন। বাড়ি ফেরার পথে হাতিবাগান বাজার পড়বে, গোটা ছয়েক ডিম, ফুটপাথেই কলা আর আপেল পাবেন, আর মিনারেল ওয়াটারের তিনটে বোতল, এগুলো নিয়ে কাল সকালেই হাজির হবেন। আর যা কিছু তৈরি করার কমলের মা সকালেই করে ফেলবে। এগারোটার মধ্যে বেরোব। এবার কেটে পড়ুন, বাবাইয়ের খাওয়ার সময় হয়েছে, তাড়াতাড়ি ঘুমোতে হবে।’

দেবী টানা কথাগুলো বলে গেল হালকা দাপুটে গলায়। সলিল বোকার মতো হেসে আড়চোখে ব্রতীনের দিকে একবার তাকাল। ব্রতীনের মনে হল সলিল উপভোগ করছে দেবীর এই কর্ত্রীত্বপনা। ও যেন বুঝে নিয়েছে সলিলের মধ্যে সহজ নরম জীবনযাপনের জন্য একটা ইচ্ছা আশ্রয় খুঁজছে।

ব্যস্ত হয়ে সলিল বলে উঠল, ‘নাহ এবার কেটে পড়াই ভালো।’

গাড়ির দরজা খুলে সলিল স্টিয়ারিংয়ে বসল। ব্রতীন আশ্চর্য হল বাবাইকে দেবীর হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে।

‘চললাম বতুদা, কাল দেখা হবে।’ স্টার্ট দিয়ে সলিল রাস্তার দিকে সোজা তাকাল। দেবী মুখ নামিয়ে বাবাইয়ের মাথায় হাত বুলোচ্ছে। কেউ কাউকে যেন চেনে না এমন একটা ভাব দুজনের মধ্যে দেখে ব্রতীনের মজা লাগল। সলিল গাড়ি ছেড়ে দেবার পর ব্রতীন বলল, ‘হ্যাঁ রে দেবী, বাবাই গেল না যে?’

‘আমার কাছে আজ রাতে থাকবে বলে কান্না শুরু করল। থাকুক। কাল চিড়িয়াখানা দেখে একেবারে বাড়ি ফিরবে। মা-মরা ছেলেটা কী অযত্নে মানুষ হচ্ছে!’

‘সত্যিই ছেলেটা স্নেহ ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়ে আগাছার মতো বাড়ছে।’ ব্রতীন বলল সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময়।

‘মাসিমণি তুমি হাঙরের দাঁত দেখেছ?’

‘না দেখিনি।’

‘আমি দেখেছি টিভি-তে। দাদু বলল ওরা নাকি লোহা চিবিয়ে গুঁড়ো করে দেয়! বাঘ কী করে হরিণ ধরে টিভিতে দেখায়, দেখবে তো তাড়াতাড়ি চলো।’

বাবাই ওদের ফেলে দুড়দুড় করে তিনতলায় উঠে গেল তার নতুন পাওয়া দাদুর সঙ্গে টিভি দেখার জন্য।

দেবী বলল, ‘বাড়িতে বাবার ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে এখানে কত স্বচ্ছন্দ!’

‘এখানে ওর কয়েকঘণ্টার স্বাচ্ছন্দ্য ভোগের থেকে বরং তুই যদি ওখানে গিয়ে থাকিস তা হলে ও অনেক বেশি-।’

দেবী ঘুরে দাঁড়িয়ে কথার মানেটা বোঝার জন্য ভ্রু কুঁচকে রইল তিন-চার সেকেন্ড। ব্রতীনের ঠোঁট টিপে চোখ দিয়ে হাসা দেখে সে চোখ পাকিয়ে বলল, ‘বড়দা তুমি কিন্তু ভীষণ ফাজিল হয়ে গেছ।’

‘গেছি নাকি! তা হলে বয়সটা কমছে বল।’

‘হাঁ কমছে, প্রায় বিয়ের বয়সে পৌঁছে গেছ।’

তিনতলায় পৌঁছে ব্রতীনের নিজেকে হালকা ফুরফুরে মনে হল। গোলাপবাগান আর নিমির কথা মুছে গেছে মন থেকে এর মধ্যেই। এটাই সে চেয়েছে। অযথা মাথাটায় গিঁট দিয়ে দিয়ে জীবনটাকে জটিল করে ফেলার মানে হয় না। জট ছাড়িয়ে যতটা সম্ভব হাত-পা ছড়িয়ে না বাঁচতে পারলে তো বাঁচা যায় না! তিরিশ বছরের স্মৃতি একটা বোঝা এটাকে মাথা থেকে খানিকটা নামাতে পেরে তার ভালো লাগছে। দেবী বলল, ‘হ্যাঁ কমছে,’ বয়স কমছে! আশ্চর্য, কী করে ও জানল?

ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে ক্ষীরোদপ্রসাদ, চেয়ারের হাতলে বসে বাবাই টিভি-তে দেখছে তিনটে সিংহের বাচ্চচার শুয়ে থাকা মায়ের পিঠের উপর লাফালাফি করে নিজেদের মধ্যে হুটোপাটি। ব্রতীন ওদের পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। বাবাইয়ের পরের পর প্রশ্ন বাচ্চচাগুলোর মতো লাফালাফি করে মুখ থেকে বেরোচ্ছে।

‘দাদু সিংহের বাচ্চচারা কোথায় খেলা করছে?’

‘আফ্রিকায় সেরেঙ্গেটি নামে একটা জায়গা আছে সেখানে।’

‘চিড়িয়াখানায় সিংহ আছে?’

‘আছে, কাল তুমি দেখবে।’

‘বাচ্চচাদের দেখব?’

‘দেখবে।’

‘ওদের বাবা কোথায়?’

‘খাবার আনতে গেছে?’

‘কী খাবার খাবে?’

‘হরিণ খাবে।’

‘ওদের মা রেঁধে দিল তারপর খাবে, তাই না?’

‘হ্যাঁ।’

দেবী ঘরে এসে বলল, ‘বাবাই আর পাঁচ মিনিট, তারপর খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়বে।’

‘না এখন খাব না। সিংহ খাবার আনুক, বাচ্চচারা খাক তারপর।’

দেবী বলল, ‘সিংহের অনেক দেরি হবে খাবার আনতে ততক্ষণ তোমাকে বসে থাকতে হবে না।’

জেদি গলায় বাবাই বলল, ‘হবে। আমি এখন খাব না। সিংহের বাচ্চচারা আগে খাবে তারপর আমি খাব।’

দেবী হতাশ চোখে ব্রতীনের দিকে তাকাল। ব্রতীন বলল, ‘দেখছে, দেখুক না।’

‘তুমি জানো না বড়দা, টিভি বাচ্চচাদের কাছে প্রচণ্ড একটা নেশার জিনিস।’

টেলিফোন বেজে উঠল। রিসিভার তুলল দেবী। ‘হ্যাঁ আমি, দেবী। বলো বাসুদি।’

ব্রতীন মুখ ফিরিয়ে দেবীর দিকে একবার তাকাল। সে ধরে নিল সকালে সরকারহাটে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে বাসু কিছু বলার জন্য ফোন করেছে।

‘কমলের মা যেই বলল তোমাকে নিয়ে যেতে সোয়ামি এসেছে তখনই বুঝলুম চিত্তির হয়ে গেছে। বড়দা শুনেই বলল বাসুর কপালে দুখ্যু আছে। যাই হোক তোমার জন্য রান্নাটা ফেলা যায়নি কাজে লেগে গেছে, ওখানেই একজন খাবার লোক আমরা পেয়ে গেছি।… কে বড়দা? এই তো সামনেই দাঁড়িয়ে, কথা বলবে?’

দেবী রিসিভারটা বাড়িয়ে দিল ব্রতীনের দিকে। বাইরে থেকে কমলের মা-র গলা শোনা গেল, ‘দিদিমণি একবার এদিকে এসো তো, বেতের ঝুড়ির ডালাটা বন্ধ হচ্ছে না।’

দেবী ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই ব্রতীন ফোন কানে লাগিয়ে বলল,’তোমার কাছে কেউ রয়েছে?’

‘হ্যাঁ।’

‘তোমার স্বামী?’

‘হ্যাঁ।’

‘তা হলে তো আমাকেই কথা বলে যেতে হবে। একটু আগে দেবী বলল, আমার বয়স কমে গিয়ে বিয়ের বয়সে পৌঁছে গেছে। তোমার কী মনে হয়?’

‘দেবী তুই এবার বিয়ে কর।’

‘তোমার হাতে মেয়ে আছে?’

‘আমি কোথায় ছেলে পাব? বাবা কি বড়দাকে বল ওরা পাত্তর খুঁজে দেবে তবে আগেরবারের মতো ভুল যেন না করে।’

‘আমিও তো তাই চাই। সম্বন্ধ করে বিয়ে করার ফল তো হাতে হাতেই তুমি পেয়েছ, এখনও কিন্তু ভুল সংশোধনের সুযোগ আছে। চুল একটু-আধটু পেকেছে তো কী হয়েছে শরীরটাকে তো মনে হল তিরিশ বছরে ধরা রয়েছে। বাসু তোমার কাছ থেকে যতটুকু শুনেছি তাতে মনে হয়েছে স্বামী সম্পর্কে তুমি বীতশ্রদ্ধ, বলেছিলে একসময় আত্মহত্যা করার ইচ্ছে হয়েছিল। আমার ধারণা স্বামীও আর তোমায় ভালোবাসে না। এই প্রেমহীন সম্পর্কটাকে একটা খাটিয়ায় শুইয়ে সাদা চাদরে ঢেকে তোমরা দুজনে এখন কাঁধে বয়ে নিয়ে চলেছ লোক দেখিয়ে, কী দরকার এই ভণিতায়। এই নকল দাম্পত্য প্রেমের খোলস ভেঙে তুমি তো বেরিয়ে আসতে পার। শিক্ষিত তুমি, একটু চেষ্টা করলেই চাকরি জোগাড় করে নিতে পারবে। বেরিয়ে এসো অন্ধকূপ থেকে, ছেলে তো যথেষ্ট বড়ো হয়ে গেছে, সে তোমার অপমান দেখেছে, তোমার পক্ষেই সে থাকবে, সমর্থনও করবে। লোকে কী বলবে, লোকে ভাববে এইসব চিন্তায় কুঁকড়ে থেকো না-।’

‘কীসব আজেবাজে কথা বলছিস দেবী? তোকে কেউ বিয়ে করবে না এমন ধারণা হল কী করে? আমি যদি ছেলে হতুম এখুনি তোকে বিয়ে করতুম।’

‘সত্যি বলছ বাসু?’ ব্রতীন ঠাট্টার স্বর বদল করে গাঢ় করল। একটা পুরুষ গলা সে শুনতে পেল বোধহয় বাসুর স্বামীর। বাসু খুক খুক কেশে গলা পরিষ্কার করল।

‘এই শোন তোর জামাইবাবু আমাকে বলল বিয়ে যদি করে তা হলে টাক পড়ে গেছে এমন লোককে যেন করে। আসলে নিজের মাথায় টাক তো। আমার মতো চুল পাকার কোনো চান্স নেই।’

‘বাসু তোমার বোধহয় কথা বলতে অসুবিধে হচ্ছে।’

‘তা তো হচ্ছেই, চুল পাকলে মন খারাপ সবার হয়।’

‘কাল তোমার সময় হবে, দুপুরে? তা হলে কোথাও বসে কথা বলতুম।’

এবার ব্রতীন স্বস্তি পেল বাসন্তীর কথায়। ‘বতু লোকটা ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে যা বলার তাড়াতাড়ি বলো।’

‘তোমাকে ট্যাক্সি থেকে যেখানে নামিয়ে দিয়েছিলুম পনেরো বছর আগে মনে আছে?’

‘আছে।’

‘কাল ঠিক বারোটায় সেখানে দাঁড়িয়ে থেকো। আমি তোমায় তুলে নেব।’

‘নিয়ে কোথায় যাবে?’

‘জাহান্নামে।’

দেবী ঘরে ফিরে এসেছে, রিসিভার রেখে দিল ব্রতীন।

‘কাল কখন বেরোবি তোরা?’

‘আমি ন-টার মধ্যে রেডি হয়ে যাব, দেখি উনি কখন আসেন। বউদি পাতুরিটা দারুণ করেছিল তাই না বড়দা! ভাবছি শিখে নেব, বউদিরা আর তিন-চার দিন মাত্র তো থাকবে।’

‘তার মধ্যেই যদি শিখে নিতে চাস তো কাল চিড়িয়াখানা দেখার পর বাবাইকে পৌঁছে দিতে ওকে সঙ্গে নিয়ে তুই যাবি তো। রাতে তাহলে শিবুদের কাছেই থেকে যাবি, সকালে রান্নাটা প্রমিতার কাছে শিখে নিবি। দুপুরে নেমতন্ন করে আমাকে আর সলিলকে খাওয়াবি, সন্ধেবেলায় সলিল আজকের মতো গাড়ি করে পৌঁছে দিয়ে যাবে সঙ্গে অবশ্যই বাবাই থাকবে। রাতটা বাবাই মাসিমণির কাছে থাকার জন্য বায়না করবে, থাকবে। পরদিন ওকে নিতে সলিল-।’

‘বড়দা!’ চাপা গলায় দেবী ধমকে উঠল। ক্ষীরোদপ্রসাদ মুখ ঘুরিয়ে একবার তাকিয়ে নিয়ে টিভিতে চোখ রাখলেন। ব্রতীন দু-হাত তুলল আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে।

‘আমার বয়স কমে গেছে দেবী, ফাজিল হওয়ার জন্য মাপ চাইছি।’

পরদিন সকাল দশটায় সলিল হাজির হয়ে আধঘণ্টার মধ্যেই বাবাই আর দেবীকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। কিছু রসিকতা ব্রতীনের মাথায় জমা হয়েছিল কিন্তু তার মনে হয় দেবী আর সলিলের ঘনিষ্ঠতা স্বাভাবিকভাবে গড়ে ওঠাটাই ভালো, তাকে রসিকতার কিল মেরে দ্রুত পাকিয়ে দিলে ফলটা সুস্বাদু হবে না। সে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে বয়স্ক দুই নরনারী এই মুহূর্তে এখন কৈশোরে, যেখানে সে নিজে পৌঁছোতে চেয়েছিল। চব্বিশ ঘণ্টাটাও হয়নি ওদের দুজনের প্রথম সাক্ষাতের, প্রেমে যারা পড়ে তারা এইভাবেই পড়ে, অগ্রপশ্চাৎ না ভেবে হুড়মুড় করে। এইভাবে সেও তো পড়তে পারত, বাসুও পড়তে পারত কিন্তু দুজনের কেউই পারল না! নিউটনের থার্ড ল, বাসু আর সে অপোজিট পোল হলে পরস্পরের দিকে আকর্ষিত হত।

ওরা মোটরে ওঠার সময় বারান্দায় এসে দাঁড়ায় ব্রতীন আর ক্ষীরোদপ্রসাদ, সলিল ড্রাইভারের আসনে বসার আগে মুখ তুলে ওদের দিকে তাকিয়ে হাসল। দেবী পিছনে দরজা খুলে বাবাইকে নিয়ে উঠে বসল। ব্রতীন নিশ্চিত পাড়া থেকে বেরিয়ে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ে পড়ামাত্র সলিল গাড়ি থামিয়ে বলবে ‘বাবাই সামনে বসবি?’ বাবাই বলবে ‘হ্যাঁ অ্যা অ্যা। মাসিমণির কোলে বসে যাব।’ সলিল বলবে ‘তা হলে মাসিমণি সামনে আসুন।’ গাড়ি থেকে নামতে নামতে দেবী বলবে, ‘বাবারে বাবা, কী যে জেদি ছেলে।’

ব্রতীনের কল্পনার ঘোড়া এতক্ষণ চমৎকার ছুটছিল খোশমেজাজে, ট্যাক্সি ধর্মতলার মোড় পেরোতেই সে রাশ টানল। সামনেই সুরেন ব্যানার্জি রোড, বাসু দাঁড়িয়ে থাকবে মোড়টা পেরিয়ে একটা মিষ্টির দোকানের সামনে। সে জানলা দিয়ে মুখটা বার করল নিজেকে দেখাবার জন্য।

ওই তো বাসু! ব্রতীন হাত নেড়ে ডাকল। এখানে গাড়ি দাঁড় করানো বারণ, কাছাকাছি সার্জেন্ট রয়েছে। ট্যাক্সিওয়ালা বলল, ‘ওনাকে এগিয়ে আসতে বলুন।’ ব্রতীন হাত নেড়ে বাসুকে এগিয়ে যেতে ইশারা করে বলল, ‘সামনে এসো এখানে থামা বারণ।’ প্রায় পঞ্চাশ মিটার এগিয়ে ট্যাক্সি থামতে সে দরজা খুলে অপেক্ষায় রইল।

বাসু উঠে বসতেই ব্রতীন বলল, ‘কতক্ষণ অপেক্ষা করেছ?’

হাতের ঘড়ি দেখে বাসন্তী বলল, ‘মিনিট কুড়ি।’

‘এত আগে!’

‘বাসস্টপে দাঁড়িয়েছিলুম, চেনা এক ভদ্রলোক গাড়ি নিয়ে সামনে থামলেন যাচ্ছেন শ্যামবাজার, উঠে পড়লুম। এই কাছেই নামিয়ে দিলেন তাইতেই সময়টা বেঁচে গেল। তবে বেঁচে আর গেল কই সেই তো দাঁড়িয়ে থাকতেই হল। আমরা যাচ্ছি কোথায়?’

ট্যাক্সিওয়ালাকে বলে রেখেছিল ব্রতীন কোথায় যেতে হবে। সেইমতোই ট্যাক্সি দক্ষিণ দিকে চলছে। ব্রতীন জবাব না দিয়ে বাসন্তীর দিকে তাকিয়ে রইল। চুল পিছন দিকে টান করে ঘাড়ের কাছে ক্লিপ দিয়ে গোছা করা। হাত ব্যাগটা কোল দু-হাতে আঁকড়ে ধরা, চিবুকের নীচে নরম ভাঁজ, বগলের নীচে ব্রেসিয়ারের চাপে ফুলে রয়েছে চর্বি। মুখের তামাটে চামড়া তেলতেলা, কিছু একটা মেখেছে। খাটো হাতা ব্লাউজ থেকে নেমে যাওয়া বাহু দুটির ডৌলে চোখ বুলিয়ে সে প্রায় ফিসফিস করে বলল, ‘কাল তো বলেছি, জাহান্নামে।’

বাসন্তী চোখ সরু করে ত্যারছা তাকিয়ে বলল, ‘ওখানে যাওয়ার কোনো ইচ্ছে আমার নেই।’ কথাটা বলে সে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল। ওদের মধ্যে আর কথা হল না।

ট্যাক্সি বাঁদিকে ঘুরল। জগদীশ চন্দ্র বোস রোড ধরে কয়েক মিনিট যাওয়ার পরেই বেগবাগান। আটতলা বাড়িটার ফটকের সামনে ব্রতীন ট্যাক্সি দাঁড় করাল। বাসন্তী বিস্মিত হয়ে বলল, ‘এখানে!’

‘এখানেই জাহান্নাম, নামো।’

সেদিনের মতোই বাড়ির গেটে টুলে বসে দুটি লোক। উঠোনটা অবশ্য খুব অপরিচ্ছন্ন নয়। মোটর রয়েছে তিনটি আর একটি মোটরবাইক। ব্রতীন লিফটের জন্য বোতাম টিপে অবাক বাসন্তীকে বলল, ‘ছ-তলায় আমার বন্ধুর ফ্ল্যাট, ইনকাম ট্যাক্সের অফিসার কানপুরে বদলি হয়ে সপরিবারে গেছে। ফ্ল্যাটটা খালি, চাবি আমার কাছে।’

ব্রতীন হাসল, বাসন্তীর মুখ দেখে বুঝল ওর মন কুটিল হয়ে যাচ্ছে, সন্দেহ করছে বদমতলবে বোধহয় বতু তাকে এখানে এনেছে।

‘ভয়ের কিছু নেই, তোমাকে রেপ করা খুব সহজ ব্যাপার হবে না।’

বাসন্তী কী একটা বলতে যাচ্ছিল লিফট নেমে আসায় বলা হল না। বেরিয়ে এল থলি হাতে এক বৃদ্ধ। লিফটে ঢুকে বাসন্তী বলল, ‘ও কাজটা করতে হলে কলজের জোর চাই সুতরাং ভয় আমি পাচ্ছি না, তবে কাল যেসব কথা বললে তাতে ভয় পেয়েছি।’

ব্রতীন জবাব দিল না। ছ-তলায় লিফট থেকে বেরিয়ে ফ্ল্যাটটার দরজার দিকে এগোল। ফ্ল্যাটের তালাটা খুলে মুখ ফিরিয়ে দেখল বাসন্তী তখনও লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে।

‘কী ব্যাপার, এসো!’

‘কীরকম অন্ধকার-অন্ধকার, নির্জন, শব্দ-টব্দও নেই, ফিল্মে মার্ডার করার আইডিয়াল লোকেশান ঠিক এইরকমই হয়।’

‘রেপ করার মতো কলজের জোর নেই বলে ভেবো না ছুরি মারার মতো হাতের জোর নেই।’

দরজার পাল্লা খুলে ব্রতীন ভিতরে ঢুকে আলো জ্বেলে দিল। বাসন্তী দরজা পার হয়েই ভ্রু কুঁচকে ঘরটাকে তন্নতন্ন দেখতে লাগল।

‘আচ্ছা বতু, তুমি থাকো বোম্বে তোমার বন্ধু কানপুরে, এই ফ্ল্যাটের চাবি তোমার কাছে এল কী করে?’

ব্রতীন কয়েক সেকেন্ড সময় নিল উত্তর দেবার আগে। সে জানে বাসুর মাথাটা খুব পরিষ্কার কথাবার্তায় সামান্য বেচাল দেখলেই ধরে ফেলবে মিথ্যা বলছি। দরকার নেই, সত্যি বলাই ভালো। গুণোকে আনা যাবে কিন্তু মলির অংশটা একদম নয়।

‘গুণোকে তো তুমি দেখেছ?’

‘দেখব না আবার, অতি বদ, কিছুদিন আমার পেছনে লেগেছিল।’

ব্রতীন সাবধান হয়ে গেল। গুণোর গুণকীর্তন এখন একদমই চলবে না। ওকে বরং ভিলেন করে রাখাই ভালো। ব্রতীন বলল, ‘তুমি আগে বোসো। তুমি সন্দেহ করছ কোনো খারাপ মতলব নিয়ে তোমাকে এখানে এনেছি। এই ফ্ল্যাটটা গুণোর বন্ধুর, আমার নয়। চাবি ওর কাছ থেকেই চেয়ে এনেছি তোমার সঙ্গে দুটো কথা বলব বলে।’

বাসন্তী সোফায় বসল ঠিক যেখানে নিমি বসেছিল। একটু দূরত্ব রেখে ব্রতীনও বসল।

‘কলকাতায় নিরিবিলিতে বসে কথা বলার জায়গা নেই তাই তোমাকে এখানে এনেছি তবে এটা একটু বেশি নিরিবিলি। এমন জায়গায় অনাত্মীয় পুরুষের বিশেষ করে যে পুরুষ সম্পর্কে একসময় দুর্বল ছিলে, অন্তত তেমন কথাই সেদিন বললে। এই বলা থেকেই মনে হল এখনও তুমি মনে মনে দুর্বল রয়েছ।’

ব্রতীন চোখ সরায়নি বাসন্তীর চোখ থেকে। সে দেখল বাসুর চোখ স্তিমিত হয়ে এল, মুছে গেছে সন্দেহের কুটিলতা। তার কথার সমর্থন এবং অনুমোদন ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। সে হাত রাখল বাসন্তীর হাতের উপর যেভাবে নিমি হাত রেখেছিল তার আঙুলে।

‘বাসু আমি তিরিশ বছর আগে ফিরে গিয়ে জীবন শুরু করতে চাই তুমিও কি চাওনা?’ ব্রতীন উদগ্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে মুঠোয় আঁকড়ে ধরল বাসন্তীর আঙুল।

‘আমিও চাই বতু। তোমাকে লেকচার দিয়ে আমাকে কিছু বোঝাতে হবে না। তোমার থেকে আমার মাথা কোনো অংশে ইনফিরিয়ার ছিল না, উমাপদবাবু সেটা রোজ তোমাকে বুঝিয়ে দিতেন। তুমি প্রচণ্ড খাটতে, তোমার আদ্ধেক খাটুনি খাটলে আমি পি আর এস, পি এইচ ডি পেতে পারতুম। একটা মালটি ন্যাশনাল কোম্পানিতে তুমি বিশাল টাকার, গরিব এই দেশের তুলনায় বিশাল টাকা মাইনের চাকরি করো, বয়স পঞ্চাশও হয়নি, দেখতে শুনতে ভালো এবং আইবুড়ো। আমি এখন স্রেফ বেকার, হার্টের রুগি, একটা জঘন্য স্বামী আছে যাকে আমি ভালোবাসি না। ব্রতীন রায়চৌধুরি এবার বলো আমার কাছ থেকে তুমি কী আশা করো?’

ব্রতীন আশা করেনি বাসন্তী নিরাসক্ত স্বরে ঠান্ডা মাথায় তাকে জমিতে নামিয়ে আনবে। তবু মরিয়া হয়ে সে চেষ্টা করল আর একবার আকাশে ওড়বার। ‘বাসু আমার কাছে গিয়ে তুমি থাকবে?’

বাসন্তীর ভ্রূ কুঁচকে উঠল। ক্ষীণ একটা হাসিতে মুচড়ে গেল ঠোঁট দুটি। ‘কীভাবে? আমি তো একজনের বৈধ পত্নী, তোমার বন্ধু বলার বউয়ের মতো একদিন চুপিসাড়ে পালিয়ে গিয়ে?’ বলতে বলতে বাসন্তী হেসে উঠল, হাতের উপর রাখা হাতটা ব্রতীন তুলে নিল। ‘তারপর একদিন বোম্বাইয়ের পুলিশ গিয়ে হাজির হবে কোর্টের পরোয়ানা নিয়ে, ভাঙা দাম্পত্য সম্পর্ক জোড়া লাগাবার জন্য সরকারহাটে ফিরে চলো। না বতু, হুট করে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না।’

বাসন্তী হাত রাখল ব্রতীনের হাঁটুর উপর। ওর মুখে শান্ত মৃদু হাসি। সে হাসিতে প্রশ্রয় না বিষাদ ব্রতীন বুঝে উঠতে পারল না।

‘বাসু তুমি তো ডিভোর্স করতে পার।’

‘তা পারি।’

‘তা হলে করো। মানসিক অত্যাচারের গ্রাউন্ডে তুমি মামলা করো, খরচ আমি দেব।’ বাসন্তী মুখ নামিয়ে রেখেছে, চোখে আনমনা চাহনি। ব্রতীন দু-হাতে ওর কাঁধ ধরে নাড়া দিল।

‘ভাবছ কী? জীবনের অর্ধেকেরও বেশি আমরা পার করে এসেছি বাসু, নিষ্ফলা অসুখী অর্ধেক। যে ক-টা বছর হাতে রয়েছে সেগুলো অন্তত ভরে উঠুক।’

‘আমাকে মুশকিলে ফেললে বতু। তোমার সঙ্গে এত বছর পর দেখা না হলেই ভালো হত। আসলে এমন একটা মানসিক বিপর্যয়ে এলোমেলো ছিলুম আর ঠিক সেই সময়েই তোমাকে সামনে পেয়ে গেলুম, মনের পুরনো আবেগ সেদিন তোমার ঘরে ভেসে উঠেছিল। পরে ভাবতে গিয়ে দেখলুম পুরনো হলেও কিন্তু মনের মধ্যে তুমি তাজা হয়েই রয়েছ।’

বাসন্তী মুখ তুলে তাকাল। তার দু-চোখে ব্রতীন কী যেন দেখতে পেল। হঠাৎ সে বাসন্তীকে দু-হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বুকে টেনে নিয়ে ঠোঁটের উপর ঠোঁট চেপে ধরল। বাসন্তী বাধা দিল না। ব্রতীন অনুভব করল বাসুর শ্বাস ভারী হয়ে উঠছে, ঠোঁট দুটি সাড়া দিচ্ছে, শরীর শিথিল হয়ে পড়ছে। তার মনে পড়ে গেল নিমির ফিসফিস করে বলা ‘ঘরে আসবেন?’

বাসন্তীর কানে মুখ ঠেকিয়ে ব্রতীন বলল, ‘ঘরে চলো।’

‘না।’ বাসন্তীর শরীর কঠিন হয়ে গেল।

অপ্রতিভ ব্রতীন ছেড়ে দিল বাসন্তীকে। সোজা হয়ে বসে বাসন্তী বলল, ‘এই পর্যন্তই থাক। আমাকে ভাবতে দাও, পরে তোমাকে জানাব। জীবনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটা এত চট করে, না ভেবেচিন্তে নেওয়া যায় না। আমাকে কিছুদিন সময় দাও বতু।’

ব্রতীন যেন ভিড় রাস্তায় কলার খোসায় পা দিয়ে আছাড় খেয়েছে এমনভাবে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘তার মানে তুমি আমার কথায় রাজি নও, যেভাবে আছ সেইভাবেই থাকতে চাও?’

‘না চাই না। শুধু কয়েকটা দিন সময় চাই, ছেলের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তোমার মুম্বাইয়ের ঠিকানাটা দাও।’

ব্রতীন পার্স থেকে কার্ড বার করে বাসন্তীর হাতে দিয়ে বলল, ‘ফোন নাম্বারও রয়েছে, এসটিডি করতে পারো সন্ধের পর।’

‘আমি এবার যাব, তুমি কি বেরোবে?’ বাসন্তী উঠে দাঁড়াল।

ব্রতীন অবসাদ বোধ করল। উত্তেজনা আর প্রত্যাশা এতক্ষণ তাকে টানটান করে রেখেছিল এখন মিলিয়ে গেছে। সে মাথা নাড়ল, ‘আমি একটু ঘুমোব।’

ঘর থেকে বেরোবার জন্য দরজার দিকে এগিয়ে বাসন্তী থামল, ফিরে এসে ঝুঁকে ব্রতীনের ঠোঁটে ছোট্ট চুমু খেয়ে বলল, ‘মানুষের মতো বাঁচতে পারব এমন একটা জীবন চাই আমি।’

ব্রতীন খোলা দরজার দিকে তাকিয়ে বসে বাসন্তীর চটির শব্দ শোনার চেষ্টা করল। নিমির উঁচু হিলের শব্দ অনেকক্ষণ পেয়েছিল। বাসু বোধহয় লিফটে নামছে। ব্রতীন দ্রুত ঘরে ঢুকে ছোটো বারান্দাটায় গিয়ে দাঁড়াল। একটু পরেই দেখল বাসন্তী ফটক দিয়ে বেরিয়ে বড়ো রাস্তার দিকে গেল। হাত তুলে ট্যাক্সি থামিয়ে ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলে দরজা খুলে ভিতরে উঠে বসল। ট্যাক্সিটা চলে গেল।

ঘরের মধ্যে এসে ব্রতীনের খেয়াল হল পাখাটা ঘুরছে। কী আশ্চর্য, পাঁচদিন ধরে এটা ঘুরে যাচ্ছে, সেদিন ভুলেই গেছলুম বন্ধ করতে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *